চতুর্থ অধ্যায় – আসামে ভাষা আন্দোলন:বাংলা-অসমিয়া বিতর্ক (১৯৬০-১৯৬১)
প্রথম ভাগ
আমরা একটি সম্পাদকীয় নিবন্ধ দিয়ে শুরু করব:
… বঙ্গভাষাভাষী কাছাড় জেলার অধিবাসীদের মাতৃভাষা ত্যাগ করাইয়া অসমিয়া ভাষা গ্রহণ করাইবার ‘পবিত্র ব্রত’ সুসম্পন্ন করিবার উদ্দেশ্যে অসম সাহিত্যসভার রথী মহারথীরা যেভাবে রঙ্গমঞ্চে অবতীর্ণ হইয়াছেন— তাহার বিরুদ্ধে করিমগঞ্জের যুগশক্তি পত্রিকা গত ১ জানুয়ারি তারিখে একটি বলিষ্ঠ সম্পাদকীয় প্রবন্ধ প্রকাশ করিয়া কাছাড়বাসীগণের মনোভাব সুস্পষ্টরূপেই প্রকাশ করিয়াছেন।
অসমিয়া বন্ধুগণ এই সমস্ত সতর্কবাণীতে সংযত হইবেন তাহার কোনো লক্ষণ নাই। গত ডিসেম্বর মাসের শেষদিকে অসম সাহিত্যসভার পক্ষ হইতে কাছাড়বাসীগণকে অসমিয়া ভাষা গ্রহণে প্রবুদ্ধ করিবার জন্য অসম-সাহিত্যসভার সহ-সম্পাদক অধ্যাপক শ্রীহরিপ্রসাদ নিয়োগ (?) এবং সৈয়দ আবদুল মালেক শিলচর, হাইলাকান্দি, বদরপুর, তারাপুর, গুমরা, কালাইন, বিহারা প্রভৃতি অঞ্চলে জনসভায় বক্তৃতা প্রদান করিয়াছিলেন। সৈয়দ আবদুল মালেক গত ২৪ জানুয়ারি তারিখের আসাম ট্রিবিউন পত্রিকায় এই কাছাড় ভ্রমণ সম্পর্কে এক দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখিয়া কাছাড়ের লোক অসমিয়া ভাষা গ্রহণের জন্য কীরূপ উদগ্রীব হইয়া উঠিয়াছে তাহার এক বিবরণ প্রদান করিয়াছেন! বলাবাহুল্য, সকল ব্যাপারেই যেরূপ হইয়া থাকে— এই ভাষার ব্যাপারেও কতিপয় স্বার্থান্বেষী মেরুদন্ডহীন তথাকথিত কাছাড়বাসী অসমিয়া ভাষা প্রসারের এই অপপ্রয়াসকে সাহায্য করিতে কুন্ঠিত হয় নাই। অসম-সাহিত্যসভার নামে এখানে-সেখানে দুই-চারিটি সভার অভিনয় করিয়া তাহাতে গৃহীত প্রস্তাবকেই কাছাড়ের জনমত বলিয়া প্রচার করিবার ধৃষ্টতার সমুচিত প্রত্যুত্তর দেওয়ার প্রয়োজন হইলে কাছাড়ের গ্রামে গ্রামে জনসভার অনুষ্ঠান করিয়া তাহা করা হইবে।…
কাছাড় হইতে বাংলা ভাষাকে উচ্ছেদ করিবার ষড়যন্ত্র আসাম গবর্নমেন্ট দীর্ঘকাল যাবতই নানাভাবে করিয়া আসিতেছেন।… সংখ্যালঘু ভাষাভাষীগণের নিজ নিজ ভাষা রক্ষা করিবার জন্য যে-সমস্ত অধিকার দেশের সংবিধানে দেওয়া আছে, তাহাকে কার্যত ব্যর্থ করিয়া দিয়া কাছাড়ের উপর অসমিয়া ভাষার সাম্রাজ্য বিস্তারের এই অপপ্রয়াসকে রোধ করিবার জন্য প্রয়োজন হইলে কাছাড়ের অধিবাসীগণ চূড়ান্ত ব্যবস্থাই গ্রহণ করিবেন। …কাছাড়ের নিজের মাতৃভাষাকে রক্ষা করিবার জন্য কাছাড়ের লোক সর্বস্ব পণ করিয়া ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে দাঁড়াইতে একটুও কুন্ঠিত হইবে না…।১
বর্ণিত নিবন্ধ থেকে আমরা বেশ কয়েকটি বিষয় সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা লাভ করতে পারি। এক. অসম সাহিত্যসভা সদস্যগণ অসমিয়া ভাষা প্রচারের লক্ষ্যে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা পেরিয়ে বাংলাভাষী অঞ্চল কাছাড় জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়া এবং সেই সফরের চমকপদ বিবরণ ইংরেজি দৈনিক The Assam Tribune পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়া; দুই. অসম সাহিত্যসভা সৈয়দ আবদুল মালেকের মতো লোককে খুঁজে বের করে তাঁকে ব্যবহার করা; সম্পাদকীয় নিবন্ধে ভবিষ্যৎদ্রষ্টার ন্যায় ভবিষ্যৎবাণী উচ্চারণ এবং তিন. কাছাড়ের মানুষদের নিজ মাতৃভাষা রক্ষাকল্পে মরণপণ প্রতিজ্ঞা। আমরা প্রত্যক্ষ করব, কাছাড় জেলার মানুষের রক্তে রাজপথ, জনপদ রঞ্জিত হয়েছে, নিজ মাতৃভাষা রক্ষায় জীবন দিয়েছেন নারী-পুরুষ-নাবালক। এক নয়, দুই নয়, অনেক অনেক। পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন অসংখ্য মানুষ।
আমরা জানি, অসম সাহিত্যসভা ইতিমধ্যে আসাম সরকারকে ১৯৬০ সালের মধ্যেই অসমিয়া ভাষাকে রাজ্যের সরকারি ভাষা করার চূড়ান্ত সময়সীমা বেঁধে দিয়েছেন। অসমিয়াগণ সুচিন্তিত পরিকল্পনা করেই ধাপে ধাপে অগ্রসর হয়েছেন। তাঁরা একদিকে যেমন বাংলা ভাষা, বাঙালি বিরোধী প্রচারমাত্রা তীব্র থেকে তীব্রতর করেছেন, অন্যদিকে বাঙালি জাতির ওপর সর্বাত্মক হামলা চালিয়ে তাঁদের ঘরছাড়া, পঙ্গুত্বে পরিণত করতে প্রয়াস পেয়েছেন। আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সরকারকে চাপে ফেলে একমাত্র অসমিয়া ভাষাকে আসামের রাজ্যভাষা করার ষড়যন্ত্র পাকাপোক্ত করেছেন তাঁরা। এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল বাঙালি সমাজ শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ জানিয়েছেন দিনের পর দিন, মাসের পর মাস।
‘কাছাড় সাহিত্য পরিষদ’-এর উদ্যোগে ১২ মার্চ, শনিবার ১৯৬০, বিকালে শিলচর মিউনিসিপ্যাল হলে এমএলএ শ্রীমতী জ্যোৎস্না চন্দের সভানেত্রীত্বে স্থানীয় শিল্পী-সাহিত্যিক-সাংবাদিকদের এক প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় অসমিয়াকে সরকারি ভাষা হিসেবে গ্রহণের বিরোধিতা করা হয়। মুখ্যমন্ত্রী বিমলাপ্রসাদ চালিহা অসমিয়া ভাষাকে সরকারি ভাষা হিসেবে গ্রহণ বিষয়ে আসাম বিধানসভায় বলেন: ‘অসমিয়া ভাষা যাঁদের মাতৃভাষা নয়— সেইসব সম্প্রদায়ের মত না নিয়ে অসমিয়া ভাষাকে সরকারি ভাষা হিসেবে গ্রহণ করা সংগত হবে না। এই সভা চালিহার মতকে পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে জানায় যে, এভাবে জোর করে কোনো ভাষা সকলের ওপর চাপাবার চেষ্টা করলে আসামে ইতিমধ্যে বিভিন্ন ভাষাভাষী সম্প্রদায়ের মধ্যে যে সম্প্রীতি, একাত্মবোধ গড়ে উঠছিল— তা বিনষ্ট হবে এবং দেশের পক্ষে খুবই ক্ষতিকারক হবে। আইনজীবী নগেন্দ্রচন্দ্র শ্যাম প্রস্তাব সমর্থন করেন।’২
সরকারি ভাষা হিসেবে অসমিয়া ভাষার দাবি শেষপর্যন্ত আসাম বিধানসভায় উত্থাপিত হল। মুখ্যমন্ত্রী বি পি চালিহা জানালেন, অন্যান্য ভাষাভাষীদের মতামত নিয়েই এ বিষয়ে অগ্রসর হওয়া বাঞ্ছনীয়। চেরাপুঞ্জি থেকে নির্বাচিত কংগ্রেস বিধায়ক সভায় জানালেন, পার্বত্যবাসীরা অসমিয়া ভাষার দাবি কোনোভাবেই মেনে নেবেন না।
মুখ্যমন্ত্রীর অভিমতকে কেন্দ্র করে আসাম উপত্যকাজুড়ে অসমিয়াগণ চালিহার বিরুদ্ধে প্রায় বিদ্রোহ করে বসেন। অসম সাহিত্যসভার উদ্যোগে বিভিন্ন স্থানে একের পর এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়— যেখানে অসমিয়া ভাষাকে রাজ্যের একমাত্র সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণার দাবি জানানো হয়। এ সব সভায় চালিহার তীব্র সমালোচনা করা হয়। ‘এ সকল জনসভার কোনো কোনোটিতে— যাদের মাতৃভাষা অসমিয়া নয়, তাঁদের পক্ষ থেকে অসমিয়া ভাষার সমর্থন করে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য ভাড়াটিয়া বক্তাও আমদানি করা হয়।’৩ এর ফলে আসামে ভাষার বিষয়টি জটিল থেকে জটিলতর হয়।
১৮ মার্চ শুক্রবার দুপুর একটায় শিলচর জেলা কংগ্রেসের এক জরুরি সভায় অসমিয়া ভাষাকে আসামের সরকারি ভাষা হিসেবে গ্রহণের তীব্র বিরোধিতা করা হয়। জেলা কংগ্রেস সভাপতি নন্দকিশোর সিংহের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় বিশেষভাবে আমন্ত্রিত সতীন্দ্রমোহন দেব, নীরেন্দ্রনাথ দেব প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। সভায় মো. হুরমত আলি বড়লস্কর, সুখরঞ্জন চন্দ, অবনীকুমার বিশ্বাস, প্রণয়কুমার চন্দ প্রমুখও বক্তব্য রাখেন। নন্দকিশোর সিংহ তাঁর উদবোধনী ভাষণে বলেন: ‘অসমিয়া ভাষাকে আসামের সরকারি ভাষা হিসেবে গ্রহণের জন্য আসাম উপত্যকায় যে আন্দোলন আরম্ভ হয়েছে এবং এ সম্পর্কে আসাম প্রাদেশিক কংগ্রেসের কার্যকরী সমিতি এবং বিধানসভার কংগ্রেস দলের যুক্ত বৈঠকে যে আলোচনা হয়েছে তার বর্ণনা দিয়ে বলেন যে, আগামী ২৪ মার্চ শিলংয়ে উক্ত বৈঠক পুনরায় অনুষ্ঠিত হবে।’৪
সেদিনের সভায় নন্দকিশোর সিংহের ভাষণ থেকে জানা যায় যে, ‘প্রায় সকল সদস্যই এই অভিমত ব্যক্ত করেন যে, অসমিয়াকে একমাত্র সরকারি ভাষা হিসেবে গ্রহণ করা সংগতই হবে। কিন্তু যতদিন পর্যন্ত পার্বত্য অঞ্চলে এবং অসমিয়া ভাষাভাষী অঞ্চলে অসমিয়া ভাষা প্রসার লাভ না করে— ততদিন পর্যন্ত এ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ স্থগিত রাখা ঠিক হবে। তাড়াহুড়ো করে অসমিয়া ভাষা সকলের ওপর চাপাতে গেলে মূল উদ্দেশ্য ব্যহত হবে এবং বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হবে।’
মুখ্যমন্ত্রী শ্রীচালিহা যুক্ত বৈঠকে এই অভিমত প্রকাশ করেন যে, পার্বত্য অঞ্চলে এবং অনসমিয়া ভাষাভাষী অঞ্চলে অসমিয়া ভাষা প্রসারের ব্যবস্থা করতে হবে এবং আসামের জন্য অসমিয়া ভাষাকেই সরকারি ভাষা হিসেবে গ্রহণ করার যৌক্তিকতা যাতে সকলে অনুধাবন করতে পারেন—তার ব্যবস্থা করতে হবে।’৫
মুখ্যমন্ত্রী শ্রীচালিহা একদম একশো নব্বই ডিগ্রি ঘুরে গেলেন, মত পালটে ফেললেন; অসমিয়া ভাষার পক্ষে জোর সওয়াল করলেন। এই প্রশ্নে সেকাল আর একালের রাজনীতিকদের মধ্যে অদ্ভুত সাযুজ্য বর্তমান।
১৯৬০ সালের ২৪ মার্চ শিলং-এ পূর্বঘোষিত আসাম প্রদেশ কংগ্রেস কমিটি এবং আসাম বিধানসভা কংগ্রেস দলের যুক্ত বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সভায় অসমিয়া ভাষাকে সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণার প্রস্তাব বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসাম প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির এক বিশেষ অধিবেশনে গৃহীত হবে বলে সংবাদে উল্লেখ করা হয়। যুক্ত বৈঠকে যেসব সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়—তা ছিল নিম্নরূপ:
১. ‘সাধারণভাবে সদস্যগণ পর্যায়ক্রমে অসমিয়া ভাষা সরকারি ভাষা হিসেবে প্রবর্তনের অনুকূলে অভিমত প্রকাশ করেন; অন্য ভাষাভাষী জনগণের সম্মতি নিয়ে অসমিয়া ভাষাকেই সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণার প্রস্তাব করা হয়। স্বায়ত্তশাসনশীল পার্বত্য জেলাগুলির এবং কাছাড়ের অধিবাসীগণের পক্ষে অসুবিধাজনক অবস্থার সৃষ্টি না করে ক্রমে ক্রমে অসমিয়া ভাষা প্রবর্তনের উদ্দেশ্যে আইন প্রণয়নের প্রস্তাব রাখা হয়।
২. অপর প্রস্তাবে বলা হয় যে, অবিলম্বে অসমিয়া ভাষাকে সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণা করা হোক এবং অনসমিয়া ভাষাভাষী অঞ্চলে সুবিধামতো সময়ে পর্যায়ক্রমে প্রবর্তন করা হোক। এ বিষয়ে পরামর্শদানের জন্য একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি নিয়োগের প্রস্তাব করা হয়;
৩. এর পরের প্রস্তাবে স্বায়ত্তশাসনশীল পার্বত্য জেলাগুলি এবং কাছাড়ের বর্তমান ব্যবস্থার কোনো পরিবর্তন না ঘটিয়ে অসমিয়া ভাষাকে সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণা করাই সরকারের কর্তব্য হবে;
৪. চতুর্থ প্রস্তাবে বলা হয় যে, ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার জেলাগুলির জন্যে অবিলম্বে অসমিয়া ভাষাকে সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণা করা হোক। অন্য ভাষাভাষীগণের যাতে কোনো অসুবিধা না হয়— তজ্জন্য তাঁদের নিজ নিজ ভাষার পুষ্টিসাধনের ব্যবস্থা করা হউক।
৫. পঞ্চম প্রস্তাবে একটি কমিটি নিয়োগ করে অনসমিয়া ভাষাভাষীগণের যথাসম্ভব সম্মতি নিয়ে পর্যায়ক্রমে অসমিয়া ভাষা প্রবর্তনের প্রস্তাবটির কার্যকারিতা অনুসন্ধানের পরামর্শদান করা হয়।’৬
এদিকে শিলচর মোক্তার অ্যাসোসিয়েশনের উদ্যোগে ১৮ মার্চ অনুষ্ঠিত সভায় গৃহীত প্রস্তাবে বলা হল, ‘বহু ভাষাভাষী আসাম প্রদেশে, অসমিয়া ভাষার ন্যায় বহুলোকের ব্যবহৃত এবং সাহিত্যিক মর্যাদায় অধিকতর সুপ্রতিষ্ঠিত অন্য ভাষাভাষীও রয়েছেন। এমতাবস্থায় অসমিয়াকে সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণার কোনোই সংগত কারণ নেই।… এই প্রচেষ্টা অত্যন্ত কূটবুদ্ধি প্রণোদিত এবং আসামকে বিভিন্ন ভাষাভাষী কয়েকটি প্রদেশে পরিণত করার প্রেরণাই জোগাবে। এর ফলে সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি এবং অনৈক্যই বৃদ্ধি পাবে। প্রস্তাবে আরও বলা হয়, যতদিন পর্যন্ত ইংরেজি ভাষা চালু আছে— ততদিন তাই-ই থাকবে এবং যখন ইংরেজির পরিবর্তে হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চালু করা হবে— সে-সময় থেকে হিন্দিই আসামের সরকারি ভাষা হতে পারে।’৭
২৩ মার্চ তারিখে শিলচর জেলা বার অ্যাসোসিয়েশন অসমিয়া ভাষাকে সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণার প্রস্তাবকে অগ্রহণীয়, অযৌক্তিক বলে উল্লেখ করে প্রস্তাবে বলা হয়, ‘এই প্রদেশে বিভিন্ন ভাষাভাষী লোক রয়েছেন এবং তাঁদের মধ্যে সাংস্কৃতিক পার্থক্য বর্তমান। এই অবস্থায় সামান্যসংখ্যক লোকের একটি ভাষাকে প্রাধান্য দিলে প্রদেশের লোকের মধ্যে যে সংহতি ও ঐক্য রয়েছে তা বিনষ্ট হবে এবং এর ফলে অন্যান্য ভাষাভাষীগণও সাম্প্রদায়িক অনৈক্য বৃদ্ধির প্রেরণাই গ্রহণ করবেন। শুধু যে রাজনৈতিক দিক থেকে এই প্রয়াস অবিজ্ঞজনোচিত হবে কেবল তাই-ই নয়— জাতীয় স্বার্থের দিক থেকেও অশুভকর হবে।
এই প্রদেশের ওপর অসমিয়া ভাষা চাপাবার জন্য যে প্রয়াস মাঝে মাঝে করা হচ্ছে— তা রোধ করার জন্য এই প্রদেশের নাম পরিবর্তন করে ‘ইর্স্টান স্টেট’ বা ‘পূর্ব প্রদেশ’ রাখার জন্য জেলা বার দাবি জানাচ্ছে।’৮
করিমগঞ্জ বার অ্যাসোসিয়েশন এপ্রিল মাসের গোড়ার দিকে অনুকুলচন্দ্র সেন-এর সভাপতিত্বে এক সভায় মিলিত হয়ে বেশ কয়েকটি প্রস্তাব অনুমোদন করেন। প্রস্তাবে বলা হয় যে, ‘বহু ভাষাভাষী এই প্রদেশে অসমিয়া, বাংলা এবং পাহাড়িয়া ভাষার প্রভাব রয়েছে। অনসমিয়া ভাষাভাষীগণের ওপর সরকারি ভাষা অসমিয়া জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হলে প্রদেশের বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে বিদ্বেষভাবের জন্ম দেবে এবং অনৈক্যের সৃষ্টি হবে। ভারতীয় সংবিধানের মূলনীতি বিরোধী এই প্রচেষ্টা বন্ধ করার জন্য সরকারকে অনুরোধ জানানো হয়।’৯
অপরদিকে করিমগঞ্জ মোক্তার অ্যাসোসিয়েশন এক সভায় মিলিত হয়ে ‘অসমিয়া’-কে ‘আসামের সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণার প্রয়াসকে নিন্দা জানান। এই ব্যবস্থা গৃহীত হলে প্রদেশের বিভিন্ন ভাষাভাষী জনগণের মধ্যে যে সংহতি রয়েছে—তা বিঘ্নিত হবে। প্রস্তাবে বলা হয়, যতদিন পর্যন্ত রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ইংরেজি প্রচলিত থাকবে— ততদিন ইংরেজির সঙ্গে প্রদেশের বিভিন্ন অংশের আঞ্চলিক ভাষাগুলিকেও পূর্ণমর্যাদা দান করতে হবে। মোক্তার অ্যাসোসিয়েশন অসমিয়া ভাষা প্রবর্তনের কোনো প্রয়াসকে সমর্থন না জানাবার জন্য সরকারকে অনুরোধ জানানো হয়।’১০
প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ১৫ এবং ১৬ এপ্রিল আসাম ভ্রমণে ব্যস্ত সময় অতিবাহিত করেন। ১৬ এপ্রিল গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সংবর্ধনার উত্তরে শ্রীনেহরু বলেন, ‘আসাম বিভিন্ন ভাষাভাষী বহুজাতি অধ্যুষিত রাজ্য হওয়ায় অসমিয়া ভাষাভাষী নন, এরূপ অধিবাসীদের, বিশেষত পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসকারী খন্ডজাতীয়দের যাতে ধারণা হয় না যে, তাঁদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাঁদের ওপর অসমিয়ারা নিজেদের ভাষা চাপিয়ে দেবার চেষ্টা করছেন এবং সে-কারণেই সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। শ্রীনেহরু স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেন যে, ‘অসমিয়াকে আসামের সরকারি ভাষা বলে ঘোষণা করার জন্য বর্তমানে যে আন্দোলন চলছে, তিনি তা অনুমোদন করেন না। অনিচ্ছুক জনগণের ওপর জোর করে হিন্দি ভাষা চাপাবার চেষ্টার বিরুদ্ধেও তিনি অভিমত প্রকাশ করেন।’ তিনি আরও বলেন যে, ‘কোনো ভাষাকে রাতারাতি সমৃদ্ধিশালী করবার চেষ্টা সফল হতে পারে না।’১১
শিলং-এও প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হল। শিলং অপেরা হলে এপ্রিল মাসে সেখানকার প্রতিনিধিস্থানীয় নাগরিকবৃন্দের এক সভায় আসামের সরকারি ভাষা সমস্যা নিয়ে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়।… অধ্যাপক রাধন লিংডো আলোচনা সভায় বলেন, ‘পার্বত্য অঞ্চলের অধিবাসী এবং বঙ্গভাষাভাষী জনগণের ওপর অসমিয়া ভাষা চাপিয়ে দিলে তা বিরোধ ও অনৈক্যের সৃষ্টি করবে। স্থিতাবস্থা বজায় রেখে সমগ্র ভারতের, বিশেষ করে আসামের সাধারণ ভাষা হিসেবে এখনও ইংরেজি ভাষা ব্যবহৃত হওয়া উচিত। শ্রী এল এল ডি বাসন, অধ্যাপক কপিল চ্যাটার্জি, কেদারনাথ পুরকায়স্থ এবং অন্যান্য বক্তাও এই প্রচেষ্টার বিরোধিতা করেন।’১২
ধুবড়িতে সেখানকার নাগরিক সমিতি কার্যনির্বাহক পরিষদের এক সভায় গৃহীত প্রস্তাবে বলা হয় যে: ‘১৭ লক্ষাধিক বাঙালি আসামে বসবাস করেন। এ ছাড়া স্বায়ত্তশাসনশীল পার্বত্য জেলাগুলিতে নানা ভাষাভাষী খন্ডজাতীয় অধিবাসীর সংখ্যা প্রায় ১০ লক্ষ এবং সমতল অঞ্চলেও খন্ডজাতীয়দের সংখ্যা ১২ লক্ষ হবে। এমতাবস্থায় একাধিক ভাষাকেই আসামের সরকারি ভাষা বলে ঘোষণা করা উচিত। বর্তমান সময়ে কোনো বিশেষ ভাষাকে আসামের সরকারি ভাষা বলে ঘোষণা করা উচিত নয়।’১৩
এদিকে অসমিয়াভাষী সংগঠন ‘স্টেট ল্যাঙ্গুয়েজ কর্মপরিষদ’-এর উদ্যোগে ১৯ এপ্রিল গৌহাটির উজানবাজারে আসাম রাজ্য ভাষা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। দি আসাম ট্রিবিউন পত্রিকায় এ বিষয়ে বলা হল:
The Assam State Language Convention held here today asked the Government of Assam to adopt Assamese as the official language in the State and to make a declaration to that effect. The Convention, which was sponsored by the ‘State Language Karma Parishad’, in course of a resolution on the subject while congratulating the people including the tribals for their full support to the call of the ‘Asam Sahitya Sabha’ for demanding that Assamese be adopted as the State language in Assam deplored the attitude of the Assam Government in this matter and urged it not to delay any more the announcement in accordance with the wishes of the people. The Convention was held at Uzanbazar Bihutoli with Sri Dibakar Goswami, a former Director of Public Instruction and an educationist of the State.১৪
এখানে বলা প্রয়োজন যে, এই রাজ্যভাষা সম্মেলন আসলে আসাম প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির অনুষ্ঠিতব্য সভার ওপর চাপ প্রয়োগের অপকৌশল সে-বিষয়ে আমরা নি:সন্দেহ।
আসাম প্রদেশ কংগ্রেস কমিটি সভা প্রত্যাশানুযায়ীই অনুষ্ঠিত হল। কমিটির সভায় ‘২১ এবং ২২ এপ্রিল দু-দিনে বারো ঘণ্টার ওপরে আলোচনার পর আসাম সরকারের কাছে সুপারিশ জানানো হয় যে, আসাম রাজ্যের জন্য অসমিয়াকে সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণা করা হোক। কী কী উদ্দেশ্যে সেই ভাষা ব্যবহৃত হবে সরকারই তা স্থির করবেন। প্রস্তাবে একথাও বলা হয় যে, কাছাড় এবং স্বয়ংশাসিত খাসি ও জয়ন্তিয়া পাহাড়, গারো পাহাড়, মিজো পাহাড় এবং উত্তর কাছাড় পাহাড়ের অধিবাসীগণ যখন অসমিয়া ভাষা গ্রহণের জন্য প্রস্তুত হবেন— কেবল তখনই ওই সকল অঞ্চলে তা চালু করা হবে।’
প্রস্তাবে আরও বলা হয়: ‘সংখ্যালঘুদের নিজস্ব ভাষা সংরক্ষণ এবং পুষ্টির অধিকার বজায় রাখা হবে। অসমিয়াকে সরকারি ভাষা হিসেবে প্রবর্তনের সময়ে সরকারি চাকরিতে প্রবেশ এবং অন্যান্য ব্যাপারে অনসমিয়া ভাষাভাষীদের ন্যায়সংগত দাবি এবং অধিকারসমূহ সম্পূর্ণভাবে রক্ষিত হবে। প্রদেশের লোকের মধ্যে ঐক্যবৃদ্ধির পথে ভাষার বাধা দূরীকরণে সরকারের কাছে এ সুপারিশও করা হয় যে, যতশীঘ্র সম্ভব অসমিয়া এবং প্রদেশের অন্যান্য ভাষা শিক্ষাদানের জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক।’১৫
কমিটির আলোচনায় কাছাড় প্রতিনিধিদের মধ্যে মইনুল হক চৌধুরী, নন্দকিশোর সিংহ, রামপ্রসাদ চৌবে, বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায়, হেমচন্দ্র চক্রবর্তী, মুনীন্দ্রকুমার দাস এবং অরুণলাল রায় অংশগ্রহণ করেন। কাছাড়ের দশজন প্রতিনিধি একযোগে প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। কিন্তু যা হওয়ার তাই হল, কংগ্রেস কমিটি সভায় প্রস্তাবটি ৫৭-১০ ভোটে গৃহীত হয়।
কংগ্রেস কমিটি সভায় দেবেশ্বর শর্মা প্রস্তাবের ‘কাছাড় এবং স্বয়ংশাসিত পাহাড়ি অঞ্চলের অধিবাসীগণ যখন অসমিয়া ভাষা গ্রহণ করতে প্রস্তুত হবেন—তখনই ওইসব অঞ্চলে তা চালু করা হবে’— অংশের বিরোধিতা করে বলেন, ‘এর ফলে আসামকে বহু ভাষাভাষী রাজ্যে পরিণত করারই ব্যবস্থা করা হবে।’ প্রস্তাবটি ভোটে দিলে শ্রীশর্মা পরাজিত হন।১৬
আসাম প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির সভা সম্পর্কে দি আসাম ট্রিবিউন পত্রিকা যা জানাল সে-বিষয়টিও আমাদের নথিভুক্ত করা প্রয়োজন।
The Assam Pradesh Congress committee today (April 22, 1960) recommended to the Government of Assam that ‘Assamese be declared by law as the official language of the State and be adopted for such purpose as may be decided by the Government.’
The emergent meeting of the A P C C which was held to discuss the language tangle debated this subject for over 12 hours at two sittings on April 21 and 22. The 270 word resolution adopted by the A P C C on the language issue recognized that “the question of official language has been agitating the mind of the people of Assam for a long time” and that “a decision and guidance to the people can no longer be defferred.”
The resolution stated that:
Assamese be declared by law as the official language in all the districts but held that in the district of Cachar, the autonomous districts of Khasi and Jaintia Hills, Garo Hills, Mizo Hills and the North Cachar Hills Assamese may be introduced ‘as and when they are prepared for it.
The following is the text of the Resolution adopted by the A P C C:
The Assam Pradesh Congress Committee have noted that the question of official language has been agitating the mind of people of Assam for a long time. This question is indeed a delicate one of our state. Nevetheless, a decision and guidance to the people can nolonger be deferred. The Committee has taken into consideration the views expressed in the joint meeting of the Executive Committee of the Assam Pradesh Congress Committee and Assam Congress Parliamentary Party recently held at Shillong, the views expressed by the people and the different organizations throughout the State and the constitutional limitation. Having given careful consideration to all aspects of the matter, it is resolved:
a. That Assamese be declared by law as the official language of the state and be adopted for such purposes as may be decided by the Government;
b. That Assamese be introduced as official language in all the districts except the district of Cachar, the autonomous districts of K and J Hills, Garo Hills, Mizo Hills and North Cachar Hills in which areas it may be introduced as and when they are prepared for it;
c. That the right of the minorities for protection and development of their languages will be fully safeguarded;
d. That in the process of introduction and extension of Assamese as official language just claims and interest of non-Assamese speaking people in the matter public services and such other matter will be adequately safeguarded;
e. That the government be requested to take steps accordingly and to provide as early as possible all facilities for learning Assamese and other languages spokes in the State with a view to bringing the people closer and to break the language barrier.
It is understood that as many as 14 amendments were tabled to the draft resolution prepared by the Executive Committee of the A P C C of the amendments two were ultimately moved, other beings withdrawn. The two amendments were lost. ….. It is understood that among those who participated in the discussions were : Sri Bimala Prosad Chaliha, Sri Fakhruddin Ali Ahmed, Sri Debeswar Sarma, Sri Mahikanta Das, Sri Radhika Ram Das, Sri Lakshmidhar Borah, Sri Ramnath Sarma, Sri Naranarayan Gosswami, Sri Sarbeswar Bardoloi, Sri Kank Ch. Sarma, Sri Ratneswar Sarma, Sri Debendranath Sarma, Sri Thanuram Gogi, Sri Narayan Kakoti, Sriman Prafulla Gosswami, Sri Sarat Chandra Sinha, Sri Rupnath Brahma, Sri Ataur Rahman, Md Idris, Srimati Induprabha Barua. Sri Maham Singh (K & J Hills), Prof. G S Swell (K & J Hills), Sri Moinul Haque Choudhury (Cachar), Sri Ramprosad Choubey (Cachar), Sri Nanda Kishore Singh (Cachar), Sri Baidyanath Mukherjee (Cachar), Sri Hem Chakravarty (Cachar), Sri Munindra Kumar Das (Cachar), Sri Arunlal Roy (Cachar), Sri Sonaram Thousen (N C Hills), Sri Akramzaman (Garo Hills).১৭
এদিকে তুরা জেলা কাউন্সিল হলে ‘Eastern India Tribal Union’-এর সম্মেলন অনুষ্ঠিত হল ২৮ এবং ২৯ এপ্রিল। সম্মেলনে গৃহীত এক প্রস্তাবে ‘…. resolution opposed Assamese being the State language in Assam.’১৮
শিলচর ‘সাহিত্য চক্র’-ও অসমিয়া ভাষাকে রাজ্যের একমাত্র সরকারি ভাষা করার উদ্যোগের প্রতিবাদ জানায়। ১৬ এপ্রিল সন্ধ্যা সাড়ে ছ-টায় অরুণ চন্দ গ্রন্থাগারে সাহিত্য চক্রে-র কার্যকরী কমিটি ও সাধারণ সদস্যদের এক বিশেষ সভা ডা. রেবতীরমন চক্রবর্তীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। সভায় নিম্নলিখিত প্রস্তাব গৃহীত হয়:
১. ‘শিলচর সাহিত্য চক্রের’ এই বিশেষ সভা অসমিয়া ভাষাকে আসামের সরকারি ভাষারূপে চালু করার জন্য যে প্রচেষ্টা চলছে, তাতে গভীর উদবেগ বোধ করছে এবং এই অপচেষ্টার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জ্ঞাপন করছে।
২. আসাম বহু ভাষাভাষী লোকের আবাসভূমি এবং কোনো বিশেষ ভাষাকে জোর করে সর্বশ্রেণির বাসিন্দাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা স্বার্থবুদ্ধি প্রণোদিত এবং রাজ্যের সুসংহতির পক্ষে জটিলতা সৃষ্টির সহায়ক মাত্র।
অসমিয়া ভাষা অপেক্ষা সম্পদশালী ভাষা সমগ্র রাজ্যে চালু থাকা সত্ত্বেও সর্বসাধারণের কোনো মতামত গ্রহণ না করে, পার্বত্য ভাষাগুলিকেও উপেক্ষা করে একমাত্র অসমিয়া ভাষাকেই রাজ্যের সরকারি ভাষারূপে গ্রহণ করা অবিবেচনাপ্রসূত এবং প্রদেশের সর্বাঙ্গীণ উন্নতির পথে বিঘ্নস্বরূপ। এই সভা মনে করে যে, অসমিয়া বন্ধুদের এই অপপ্রচেষ্টার ফলে বিভিন্ন ভাষাভাষী লোকের মধ্যে অসন্তোষ এবং অশান্তির দানা বেঁধে উঠবার যথেষ্ট এবং সুসংগত কারণ রয়েছে। সুতরাং, এই সভা আসামে অসমিয়া ভাষা রাজ্য ভাষারূপে গৃহীত হওয়ার অথবা রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় পর্যায়ক্রমে অসমিয়াকে রাজ্য ভাষারূপে চালু করবার অপপ্রয়াসের ঘোর প্রতিবাদ জানাচ্ছে।
৩. আসাম প্রদেশের ওপর অসমিয়া ভাষাকে রাজ্য ভাষারূপে চালাবার চেষ্টাকে রোধ করবার জন্য আসাম প্রদেশের নাম পরিবর্তন করে ‘পূর্ব প্রদেশ’ অথবা ‘ইস্টার্ন স্টেট’ নাম দেওয়ার জন্য যে প্রস্তাব শিলচরের জেলা বার অ্যাসোসিয়েশন ইতিমধ্যে গ্রহণ করেছেন, সাহিত্যচক্রের এই সভা তার প্রতি পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপন করছে।’১৯
এদিকে শিলচর টাউন কংগ্রেস কমিটির উদ্যোগে ১ মে রবিবার, রাত আটটা থেকে সাড়ে দশটা পর্যন্ত কাছাড় জেলার বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে শিলচর কংগ্রেস কর্মীদের সঙ্গে রাজ্যের অর্থমন্ত্রী ফকরুদ্দীন আলি আহমদ-এর এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সভায় জ্যোৎস্না চন্দ, নন্দকিশোর সিংহ, আলতাফ হোসেন মজুমদার, প্রণয়কুমার চন্দ, সুরেশচন্দ্র বিশ্বাস, প্রভাসচন্দ্র সেন মজুমদার প্রমুখ আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন। এই সভাতেই ‘অসমিয়াকে সরকারি ভাষা হিসেবে গ্রহণে আসাম প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির সভায় গৃহীত প্রস্তাবকে সমর্থন করে অর্থমন্ত্রী বলেন:
‘‘অবস্থাধীন উহাই সর্বোত্তম ব্যবস্থা।’’ তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে ভাবোচ্ছ্বাসের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত না হয়ে নেতৃগণের পক্ষে যুক্তি অনুধাবন করাই সংগত।’ কিন্তু আলোচনায় অংশগ্রহণকারী সকলেই অসমিয়া ভাষা প্রবর্তনের বিরুদ্ধে কাছাড়ের জনমত দৃঢ়ভাবে সমর্থন করেন। ধুবড়ি এবং গোয়ালপাড়ায় যেভাবে জোর করে অসমিয়া ভাষা চাপানো হয়েছে— কাছাড়ের বেলায়ও তাই-ই করা হবে বলে উপস্থিত সদস্যগণ সন্দেহ প্রকাশ করেন।২০
শিলচর টাউন কংগ্রেস কার্যনির্বাহক কমিটির এক সভা জ্যোৎস্না চন্দের সভানেত্রীত্বে ২৯ এপ্রিল অনুষ্ঠিত হয়। অসমিয়া ভাষাকে রাজ্যভাষা হিসেবে গ্রহণের জন্য যে প্রস্তাব প্রদেশ কংগ্রেস কমিটি সভায় করা হয়েছে, এই সভায় তার তীব্র বিরোধিতা করা হয়। টাউন কংগ্রেস সম্পাদক প্রণয়কুমার চন্দ প্রমুখ সভায় বক্তব্য রাখেন।২১
লামডিং-এ ‘কৃষ্টি সংঘে’-র উদ্যোগে মে মাসে অনুষ্ঠিত হয় বঙ্গসাহিত্য সম্মেলন। সম্মেলনে গৌহাটির প্রবীণ সাহিত্যিক ও সাংবাদিক শ্রীসত্যভূষণ সেন সভাপতিত্ব করেন। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন গৌহাটি কটন কলেজের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রধান অধ্যাপক শ্রীযতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য। ‘মোদের গরব, মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা’ গানটি পরিবেশনের মধ্যদিয়ে সম্মেলনের উদবোধন করা হয়।
সম্মেলনে রাজ্যভাষা প্রশ্নে ‘… এই অভিমত ব্যক্ত করা হয় যে, অন্তত তিনটি ভাষা— বাংলা, ইংরেজি এবং অসমিয়াকে আসামে রাজ্যভাষা হিসেবে গ্রহণ করা উচিত।’২২
শিলচরের স্কুল ও কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা ২২ জুন কাছাড়ে অসমিয়া ভাষাকে সরকারি ভাষা হিসেবে চাপিয়ে না দেওয়ার দাবিতে পূর্ণ হরতাল পালন করেন। তারা দাবি করেন যে, এই জেলায় সরকারি ভাষা হিসেবে বাংলাকে মেনে নিতে হবে। প্রায় আট হাজার ছাত্র-ছাত্রী শিলচর শহরের বিভিন্ন রাস্তা প্রদক্ষিণকালে বিভিন্ন ধ্বনি প্রদান করায় পথ চলতি ও আশপাশের মানুষের দৃষ্টি গিয়ে পড়ে মিছিলের ওপর। পরে এক সভায় মিলিত হয়ে তারা ভাষাকে কেন্দ্র করে ‘আসাম উপত্যকায় যে গুণ্ডামি’ চলছে তার নিন্দা জানায়।২৩
কংগ্রেস এম পি দ্বারিকানাথ তেওয়ারির সভাপতিত্বে শিলচরে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় শ্রী তেওয়ারি কেবল অসমিয়া ভাষাকে সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন, ‘… রাজ্যে যখন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অতি জরুরি, সেই সময় এক শ্রেণির মানুষ আইন প্রণয়ন করে অসমিয়া ভাষাকে সরকারি ভাষা হিসেবে মান্যতা দিয়ে তাকে আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা করছে। এই প্রয়াস এ রাজ্যে বিভিন্ন ভাষাভাষীর মধ্যে বিভেদের বীজ-ই রোপিত করবে।২৪
এদিকে মুখ্যমন্ত্রী বি পি চালিহার এক বিবৃতি শিলং থেকে ২৩ জুন প্রচার করা হয়। বিবৃতির মুখ্য বিষয় ছিল— আসাম বিধানসভার আগামী অধিবেশনে অসমিয়াকে আসামের সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণা করার জন্য একটি বিল উত্থাপন করা হবে। সংবাদে বলা হয়:
I have noticed with regret some amount of unpleasant behaviour in certain areas of Assam on the question of the official language. The demand for introduction of Assamese as the official language of the State is a natural one and it has been there since our attainment of Independence.
Recently the subject has been discussed threadbare both in the Press and on the platform and also on the floor of the Assam Assembly and various suggestions from different quarters have been made. The ultimate objective which has given rise to such enthusiasm among the people is beyond question. But misdeeds cannot be the means to attain the objective, we have inview. Unruly behaviour only defeats our case.
I agree that the approach to this question of introducing Assamese as the official language will be different among different sections of people living in this State. The outlook of the non-Assamese speaking people may not in every case be the same as that of the Assamese-speaking people. Let us respect each others point of view even though we may not agree with them. It is only in a spirit of mutual tolerance and understanding that urgent and difficult problems should be faced and solved. Passion and tension only complicate our problems. If we fail to adjust our differences in a peaceful atomosphere and in an amicable manner, the cause which we wish to advance will suffer.
On the issue of the official language meetings, processions and demonstrations have been held. Such meetings and demonstrations, etc. so long as they are peaceful, cannot be banned. It is, however, regrettable to learn some incidents like besmearing and felling of signboards, stoppage of traffic, shouting of acrimonious slogans, etc. to give vent to feelings of the people.
I am convinced like others that Assam’s future is bright and we should create a healthy climate conducive of the growth and prosperity of our State. The duties and responsibilities that have devolved on its, particularly on the younger generation, are great and we should be able to play our part ably and well.
Never before had the need of unity among various sections of people living in our State been so great as it is today. We need this amity among our people in ample measure for the security and progressive development of Assam. We should not do anything which might help to destroy the unity among the people.
I feel that the recommendations of the Assam Pradesh Congress Committee effect a harmonious balance between the different viewpoints on this all important questions. It may be recalled that the A P C C’s recommendations advised the Government to introduce Assamese as the official language for the State purposes as would be decided by the State from time to time. Its application in districts of Cachar, Khasi and Jaintia Hills, Garo Hills, Mizo Hills and North Cachar Hills would be made as and when they are prepared for it.”২৫
মুখ্যমন্ত্রীর বিবৃতির পর সর্বপ্রথম আসাম বিধানসভার বিরোধীদলীয় নেতা হরেশ্বর গোস্বামী মুখ্যমন্ত্রী বি পি চালিহাকে অভিনন্দন এবং ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন:
আমার নিশ্চিত বিশ্বাস যে, কয়েক মাস পূর্বে যদি মুখ্যমন্ত্রীর এই জ্ঞান জন্মিত, তবে বিভিন্ন ভাষাভাষীদের মধ্যে এই আন্দোলনের আবশ্যকতাই হইত না এবং বিভিন্ন ভাষাভাষীদের মধ্যে এইরূপ বিদ্বেষও জন্মিতে পারিত না। শ্রীগোস্বামী বলেন যে, মুখ্যমন্ত্রী তাঁহার পূর্বতন মনোভাব ত্যাগ করিয়াছেন, ইহা আনন্দের কথা এবং আসামে যে আন্দোলন শুরু হইয়াছিল— মুখ্যমন্ত্রীর এই বিবৃতির পর তাহার অবসান হইবে বলিয়াই এখন আশা করা যায়। বিরোধী দলপতি ভাষাগত বিদ্বেষ ও বৈষম্যের নিন্দা করেন এবং বলেন যে, খুবই দুঃখের বিষয়, এই ব্যাপার লইয়া আসামের কোনো কোনো স্থানে বিশৃঙ্খলতার সৃষ্টি হয় বলিয়া খবর পাওয়া গিয়াছে।২৬
করিমগঞ্জের স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরাও অসমিয়া ভাষাকে রাজ্যভাষা করার ঘোষণার প্রতিবাদে ২৪ জুন ধর্মঘট পালন করে। জানা যায়, এ দিন করিমগঞ্জ ‘কলেজ ও নিম্নপ্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহের প্রায় ছ-হাজার ছাত্র-ছাত্রী অসমিয়াকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রতিবাদে ধর্মঘট করে। বস্তুত, কাছাড়ের সকল সম্প্রদায়ের ১১ লক্ষ অধিবাসী চালিহা মন্ত্রীসভা কতৃক অসমিয়াকে আসামের সরকারি ভাষা করার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে উঠেছেন।’
এ দিন করিমগঞ্জ ‘শহর ব্যাঙ্ক ময়দানে এক সর্বদলীয় সভায় কেবল অসমিয়া ভাষাকে সরকারি ভাষা করার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয়। জেলা কংগ্রেস সভাপতি বিধায়ক রণেন্দ্রমোহন দাস সভায় সভাপতিত্ব করেন। বিশাল এই জনসমাবেশে নলিনীকান্ত দাস ও অন্যান্য বক্তাগণ ভাষা বিষয়ে সরকারি মনোভাবের তীব্র সমালোচনা করেন।’
করিমগঞ্জে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী রেবা দেব-এর সভানেত্রীত্বেও ছাত্র-ছাত্রীদের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সুব্রত সেন, রণজিৎ চৌধুরী, ললিত শুক্লা, সতু রায়, ব্যোমকেশ বিশ্বাস, কামাখ্যা চৌধুরী, চন্দ বর্ধন প্রমুখ আসামে সরকারি ভাষা হিসেবে একমাত্র অসমিয়া ভাষা প্রবর্তনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে তাঁদের বক্তব্য পেশ করেন। মুখ্যমন্ত্রীর নির্বাচনকেন্দ্র কাছাড় জেলার কাটাখালেও ভাষা বিষয়ে তাঁর বিবৃতি প্রদানের বিরুদ্ধে পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। এখানকার সভায় মুখ্যমন্ত্রীর বিবৃতি প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়।২৭
শিলচর শহরের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীরা অসমিয়া ভাষাকে রাজ্যের একমাত্র ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রতিবাদে ২২ জুন হরতাল পালন করেন। কয়েক হাজার ছাত্র-ছাত্রীর এক বিশাল শোভাযাত্রা ‘অসমিয়া ভাষা চাপিয়ে দেওয়া চলবে না,’ ‘অনসমিয়া ভাষাভাষীদের ওপর জঘন্য অত্যাচার বন্ধ করতে হবে’ ইত্যাদি স্লোগানসহ শহরের বিভিন্ন রাস্তা প্রদক্ষিণ করে গান্ধীবাগে পৌঁছোয় এবং সেখানে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। শোভাযাত্রায় বহুসংখ্যক মণিপুরী এবং কাবুই-নাগা সম্প্রদায়ের ছাত্ররা নিজস্ব জাতীয় পোশাক পরিধান করে যোগদান করেন। বর্ণাঢ্য এই শোভাযাত্রা ছিল চোখে পড়ার মতো।
গান্ধীবাগে গুরুচরণ কলেজের ছাত্র কল্যাণব্রত ভট্টাচার্যের সভাপতিত্বে ছাত্র-ছাত্রীদের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বক্তাগণ অনসমিয়া ভাষাভাষীদের ওপর তাঁদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করে অসমিয়া ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয়।
সভায় গৃহীত প্রস্তাবে ‘রাজ্যের এক শ্রেণির লোকের মাতৃভাষা অসমিয়াকে সমগ্র রাজ্যের জন্য সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণা করার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জ্ঞাপন করে বলা হয় যে, আসামকে বহু ভাষাভাষী রাজ্য বলে ঘোষণা করা হোক। অপর আর এক প্রস্তাবে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় অনসমিয়া ভাষাভাষীদের ওপর যে অত্যাচার চালানো হচ্ছে, তীব্র ভাষায় তার নিন্দা এবং এই অরাজকতা অবিলম্বে বন্ধ করার জন্য সরকারের কাছে আবেদন জানানো হয়।’২৮
হাইলাকান্দি থেকে আঠারো মাইল দূরে রামকৃষ্ণনগরে অসমিয়াকে রাজ্যের একমাত্র সরকারি ভাষা হিসেবে গ্রহণের ষড়যন্ত্র এবং ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় ভাষার নামে বাঙালিদের ওপর যে নির্যাতন চালানো হচ্ছে— তার প্রতিবাদে ২৫ জুন রামকৃষ্ণনগর শহরে পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। ‘এ দিন দোকান, বাজার-হাট, স্কুল সম্পূর্ণ বন্ধ থাকে। বিকাল সাড়ে চারটায় এক বিশাল শোভাযাত্রা নানা স্লোগান সহকারে শহর প্রদক্ষিণ শেষে নেতাজিবাগে এক সভায় মিলিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন নলিনীকুমার গুপ্ত। সভায় বক্তব্য রাখেন—মতিলাল দত্ত, স্বরাজকান্তি দাস, রামরঞ্জন ভট্টাচার্য, দেবব্রত চক্রবর্তী প্রমুখ। বক্তাগণ অসমিয়া ভাষাকে রাজ্যের একমাত্র সরকারি ভাষা হিসেবে গ্রহণ করার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে বাংলাকে অন্যতম রাজ্য ভাষা করার দাবি জানান।’২৯
বহু ভাষাভাষী অধ্যুষিত আসামে অসমিয়াকে একমাত্র সরকারি ভাষা হিসেবে গ্রহণের প্রস্তাব সংবলিত সরকারি বিল বিধানসভায় পেশ করার যে ঘোষণা মুখ্যমন্ত্রী করেছেন এবং ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাঙালিদের ওপর নারকীয় নির্যাতনের প্রতিবাদে ২৮ জুন হাইলাকান্দি শহরে ছাত্র ধর্মঘট ও সাধারণ হরতাল পালিত হয়। ‘প্রায় আট হাজার ছাত্র-ছাত্রী ও জনসাধারণের এক বিশাল শোভাযাত্রা যা প্রায় এক মাইল দীর্ঘ বিভিন্ন স্লোগান সহকারে নগর প্রদক্ষিণ শেষে টাউন হল প্রাঙ্গণে সমবেত হয়। বিশাল এই সমাবেশে আইনজীবী কেশবচন্দ্র সেন সভাপতিত্ব করেন। জনসভায় সর্বশ্রী— সন্তোষকুমার রায়, মহিমচন্দ্র দাস, ডা. অমূল্য সেনগুপ্ত, শক্তি চৌধুরী, আবদুল খালেক লস্কর, নবেন্দু দত্ত, রবীন্দ্রনাথ সেন, দীনেশচন্দ্র সিংহ, ব্যোমকেশ বিশ্বাস প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।’৩০
শিলচর শহর ও মহকুমার সর্বত্র ছাত্র সমিতি ও স্থানীয় ব্যবসায়ীদের আহ্বানে ২৯ জুন সকাল সাতটা থেকে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত সর্বাত্মক স্বতঃস্ফূর্ত শান্তিপূর্ণ হরতাল প্রতিপালিত হয়। সংবাদপত্রে বলা হয়: ‘… আসামে একমাত্র অসমিয়া ভাষাকে রাজ্যের বঙ্গভাষাভাষী ও পার্বত্য জাতিসমূহের ওপর জোর করে চাপিয়ে সরকারি ভাষা হিসেবে গ্রহণ এবং ভাষা-বিল বিধানসভায় উপস্থাপনের ঘোষণা করার ফলে এই বিপুল জনসমষ্টি অঞ্চলে গভীর ক্ষোভ ও মনস্তাত্ত্বিক আলোড়ন জাগায়। এ দিন শিলচরে দোকানপাট, সাইকেল, রিকশা ও অন্যান্য যানবাহন, বাজার এবং নানা স্টল থেকে শুরু করে পথি-পার্শ্বস্থ অস্থায়ী ও ভ্রাম্যমাণ দোকান, ছোটো ছোটো পান-বিড়ি ও সিগারেটের দোকান, দ্রুত পচনশীল ফল—আম, আনারস, পেঁপে প্রভৃতির দোকান, মাছ-বাজার, সবজি-বাজার বন্ধ ছিল। স্টেট বাসে যাত্রী ছিল না, ট্রেনেও যাত্রীর সংখ্যা ছিল নগণ্য।’৩১
শিলচর থেকে ২০ মাইল দূরের পথ কাবুগঞ্জ, নরসিংপুর এবং সোনাই থেকে দলে দলে ছাত্ররা শিলচরের সভায় যোগদান করে। তাঁদের দাবি—বাংলা ভাষার সরকারি স্বীকৃতি এবং অসমিয়া ভাষার সমমর্যাদা। এদিকে ‘নরসিংটোলা মাঠে ছাত্রনেতা কল্যাণব্রত ভট্টাচার্যের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত প্রতিবাদ সভায় তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। সুকেশ বিশ্বাস, হেমবাবু সিং, কুমারী তারামণি দত্ত, বীরেন্দ্রচন্দ্র দাস, দীনেশ পাল, কুতুব উদ্দীন, প্রিয়তোষ চন্দ, গোপাল গোস্বামী, হীরেন্দ্র শর্মা, নিবারণনাথ চৌধুরী প্রমুখ ছাত্র-ছাত্রী অসমিয়াকে একমাত্র সরকারি ভাষা করার বিরুদ্ধে এবং আসামের সর্বত্র অনসমিয়া তথা বাঙালি নিরীহ যাত্রী ও পল্লিবাসী নর-নারীর ওপর একশ্রেণির অসমিয়াদের গুণ্ডামি, অপমান, লাঞ্ছনা ও আক্রমণের বিরুদ্ধে তীব্র ভাষায় নিন্দা জানিয়ে বক্তৃতা দেন।
সভায় দু-টি প্রস্তাব গৃহীত হয়। বিধানসভায় মুখ্যমন্ত্রীর আনা ভাষাবিলের তীব্র বিরোধিতা এবং আসাম উপত্যকায় অরাজকতা ও বাঙালিদের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ গুণ্ডামি দমনে অপারগ হলে পদত্যাগের দাবি এবং দ্বিতীয় প্রস্তাবে আসামকে বহুভাষী রাজ্য হিসেবে ঘোষণার দাবি জানানো হয়।’৩২
এ দিন শিলচর মহকুমার বাঁশকান্দি, লক্ষ্মীপুর, ধলাই, কাবুগঞ্জ, নরসিংপুর, পালংঘাট, সোনাই, উদারবন্দ প্রভৃতি স্থানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সর্বত্র হরতাল পালিত হয়।
জুন মাসেই শিলং থেকে পাওয়া সংবাদে জানা যায় যে, দু-জন কংগ্রেস সদস্য পৃথক পৃথক ভাবে আসাম রাজ্যভাষা বিল বিধানসভায় উত্থাপনে স্পিকারের অনুমতি প্রার্থনা করলে তিনি তার অনুমোদন দেন। কংগ্রেস বিধায়কদ্বয় ছিলেন—মহাদেব দাস এবং কমলপ্রসাদ আগরওয়ালা। আসাম গেজেট অনুযায়ী দু-টি বিলেরই লক্ষ্য এক— অসমিয়াকে আসাম রাজ্যের সরকারি ভাষা করা এবং উভয় বিলেরই শিরোনাম এক অর্থাৎ ‘১৯৬০ সালের আসাম সরকারি ভাষা বিল।’
বিধায়ক আগরওয়ালার প্রস্তাবিত বিলে বলা হল, ‘অসমিয়া ভাষাকে আসাম রাজ্যের সরকারি ভাষা সাব্যস্ত করিবার দাবিতে ব্যাপক জনমত প্রকাশিত হইয়াছে এবং বর্তমান গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ইংরেজির স্থানে অসমিয়াকে রাজ্যভাষা করা হইলে অধিকতর প্রশাসনিক সুবিধাও হইবে।’ বিধায়ক মহাদেব দাস-এর প্রস্তাবিত বিলে বলা হয় যে, ‘কাছাড় জেলা, সংযুক্ত খাসি-জয়ন্তিয়া জেলা, গারো পাহাড়, মিজো পাহাড় এবং উত্তর কাছাড় মহকুমাতে সেই অঞ্চলের অধিবাসীগণ যখন সম্মত হইবেন তখন অসমিয়াকে রাজ্যভাষারূপে প্রবর্তন করা হইবে।’ তবে দু-টি বিলেই বলা হয় যে, অতঃপর আইনসভায় গৃহীত সকল আইন, রাজ্য সরকার প্রবর্তিত সকল অর্ডিন্যান্স, সকল সরকারি নির্দেশ, নিয়ম ও বিধিসমূহ উপবিধিসমূহ অসমিয়া ভাষাতে রচনা করিতে হইবে।’৩৩
আসাম সরকার যুদ্ধকালীন তৎপরতায় পরিকল্পনামাফিক অসমিয়াকে রাজ্যভাষা করার লক্ষ্যে দৃঢ়পায়ে অগ্রসর হলেন। আসাম প্রদেশ কংগ্রেস কমিটি অতিসহজেই অসমিয়া ভাষাকে বিরাট ব্যবধানে অনুমোদন করিয়ে নিলেন। তারপরই ভাষা বিল প্রণয়ন এবং দু-জন কংগ্রেস বিধায়কের দু-টি বিল প্রস্তুতকরণ এবং স্পিকারের অনুমোদন লাভ— এই সমস্ত প্রক্রিয়াটিই অসম্ভব দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন হয়— যা সত্যিই বিস্ময়কর! মুখ্যমন্ত্রী বার বার জনমতের দোহাই দিয়েছেন, তাঁর অনুগামীরাও একই সুরে কথা বলেছেন। কিন্তু তাঁরা মুদ্রার কেবল একপিঠই দেখলেন, অপর পিঠে জনতার লিখন পড়লেন না। অবশ্য তার জন্য ইতিহাস থেমে থাকেনি। অসমিয়া তথা আসামের ইতিহাসে যে কলঙ্কময় অধ্যায় সেদিন রচিত হল, তা কেবল আসাম নয়— সমগ্র ভারতেরই লজ্জা। এ লজ্জা তাঁরা ঢাকবেন কী দিয়ে! বাঙালির প্রতিবাদ কিন্তু থেমে থাকেনি, হাজারো প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও তাঁরা মাতৃভাষার মান বাঁচাতে জীবনদানে কুন্ঠিত হননি।
নিখিল আসাম বঙ্গভাষা সম্মেলন: ২, ৩ জুলাই ১৯৬০
ভাষার নামে আসাম উপত্যকায় বাঙালি জাতির ওপর যখন নির্মম নির্যাতন সর্বাত্মক রূপ নিয়েছে, দিশাহারা, ভীতসন্ত্রস্ত, বাঙালি যখন বাঁচার পথ খুঁজছে, স্বভূমিতে যখন পরবাসী— তখন বঙ্গভাষা সম্মেলন সংবাদ বাঙালির প্রাণে আশার সঞ্চার ঘটায়। সমুদ্রে খড়কুটো ধরে বাঁচার প্রয়াস।
শিলচরে নিখিল আসাম বঙ্গভাষা সম্মেলন আহ্বানের উদ্যোগ নেওয়া হল ১৯৬০ সালের এপ্রিল মাসে। শিলচর মিউনিসিপ্যাল হলে ১৭ এপ্রিল বিকাল পাঁচটায় সেখানকার নাগরিকদের এক সভায় শিলচরে আসামে বসবাসকারী বঙ্গভাষাভাষীদের এক সম্মেলন অবিলম্বে আহ্বানের প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়।
ভাষা সমস্যা নিয়ে আসামে যে পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে— সে-সম্পর্কে সভায় বিস্তারিত আলোচনা হয় এবং একমাত্র অসমিয়াকে আসামের সরকারি ভাষা করার বিরোধিতা করা হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন প্রাক্তন মন্ত্রী আবদুল মতলিব মজুমদার।
ভাষাকে কেন্দ্র করে উদ্ভূত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে আসামের বঙ্গভাষাভাষীদের একটি সম্মেলন আহ্বান যে অতিজরুরি— সে-বিষয়ে উপস্থিত সকল বক্তাই একমত পোষণ করেন। এ দিন একটি প্রস্তুতি কমিটি গঠন করা হয় এবং প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক নিযুক্ত করা হয় অধ্যাপক শরৎচন্দ্র নাথকে। সভায় অবিলম্বে শিলচর শহরের নাগরিকদের নিয়ে একটি অভ্যর্থনা কমিটি গঠনেরও সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন— শ্রীমতী জ্যোৎস্না চন্দ, এম. এল. এ, সর্বশ্রী-আশুতোষ দত্ত, সুখময় সিংহ, নীরেন্দ্রনাথ দেব, বীরেশরঞ্জন আচার্য, বিনয়েন্দ্রকুমার চৌধুরী, প্রণয়কুমার চন্দ এবং ভূদেব ভট্টাচার্য। সভাপতি তাঁর ভাষণে কেন এই সম্মেলন সে-বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন।৩৪
বঙ্গভাষাভাষীদের এই সম্মেলন সংবাদকে কেন্দ্র করে এ সময় যে সম্পাদকীয় নিবন্ধ প্রকাশিত হয়— তা ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যবহ। সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হল:
সমগ্র আসামের বঙ্গভাষাভাষীদের একটি সম্মেলন আহ্বানের জন্য শিলচরে যে উদ্যোগ আরম্ভ হইয়াছে, আমরা তাহাকে সর্বান্তঃকরণে অভিনন্দিত করিতেছি। আসামে বঙ্গভাষীদের সংখ্যা প্রদেশের সমগ্র জনসমষ্টির এক তৃতীয়াংশের কম নহে। …. অনসমীয়া ভাষাভাষীদের উপর জোর করিয়া অসমিয়া ভাষা চাপাইবার চেষ্টা হইতে বিরত থাকিবার জন্য শ্রীজওহরলাল নেহরু যে সতর্কবাণী উচ্চারণ করিয়াছেন—তাহাতে অসমীয়া বন্ধুগণ কর্ণপাত করিবেন কিনা বলা শক্ত। প্রয়োজন হইলে শুধু আসাম উপত্যকার ছয়টি জেলার মধ্যে সীমাবদ্ধ শাসনব্যবস্থাও তাঁহারা মানিয়া লইবেন—তথাপি অসমীয়া ভাষাকেই রাজ্যভাষা বলিয়া ঘোষণা করিতে হইবে; ইহাই তাঁহাদের মনোভাব। যে গোয়ালপাড়াকে লইয়া অসমীয়াগণ ছয় জেলার হিসেব করিতেছেন— সেই গোয়ালপাড়ার পক্ষ হইতে অসমীয়া ভাষা প্রবর্তনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ উত্থিত হইয়াছে। গোয়ালপাড়ার অধিকাংশ লোকের মাতৃভাষা বাংলা ….। আসাম উপত্যকার অপর পাঁচটি জেলার অধিকাংশ লোক অসমীয়া ভাষায় কথা বলেন— একথা তর্কের খাতিরে স্বীকার করিলেও এই পাঁচটি জিলায় বঙ্গ ভাষাভাষীর সংখ্যা নিতান্ত নগণ্য নহে এবং মাতৃভাষার প্রতি তাঁহাদের আগ্রহ কাহারও অপেক্ষা কম নহে। ভারতীয় সংবিধানের মর্ম অনুযায়ী এই সকল বাঙালিদেরও নিজ মাতৃভাষার পূর্ণ মর্যাদা রক্ষা করিয়া চলিবার অধিকার রহিয়াছে এবং আসাম যদি কোনোকালে শুধু কামরূপ, দরং, নওগাঁ, শিবসাগর এবং লক্ষ্মীমপুর— এই পাঁচটি জেলার মধ্যেও সীমাবদ্ধ হইয়া পড়ে তথাপি রাজ্যভাষার ব্যাপারে শুধু একক ‘অসমীয়া’ ভাষার দাবিই তথায় গৃহীত হইবে না। সেই আসামেও একাধিক রাজ্যভাষা থাকিবে এবং তাহার একটি বাংলা-ই হইবে এই সম্ভাবনার কথা বিবেচনা করিয়াও আসামের এই পাঁচটি জিলার বঙ্গভাষাভাষীদের স্বার্থরক্ষার জন্য এখনই সংঘবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন।
শিলচরে নিখিল আসাম বঙ্গভাষাভাষী সম্মেলন আহ্বান করিয়া উদ্যোক্তাগণ সমগ্র আসামের বাঙালি সমাজের নিকট সংঘবদ্ধ হইবার যে সুযোগ উপস্থিত করিতেছেন, আমরা আশা করিতেছি আসামের সকল বাঙালি তাহার পূর্ণ সদব্যবহার করিবেন। … সংবিধানের বিধান অনুযায়ী যে অধিকার বঙ্গভাষার রহিয়াছে তাহা হইতে তাহাকে বঞ্চিত করিবার কোনো অপচেষ্টা কোনো বাঙালি সহ্য করিবেন না— মাতৃভাষা আমাদের নিকট আজ ইহাই দাবি করিতেছেন। শিলচর সম্মেলনে যোগদান করিয়া মাতৃভাষার এই দাবি পূরণ করিবেন আমরা তাহা বিশ্বাস করি।৩৫
এদিকে নিখিল আসাম বাংলা ভাষা সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক শরৎচন্দ্র নাথ জুন মাসে সংবাদপত্রে প্রকাশের জন্য এক বিবৃতি প্রেরণ করেন। বিবৃতিতে বলা হয়: ‘আগামী ২ ও ৩ জুলাই তারিখে শিলচরে নিখিল আসাম বাংলা ভাষা সম্মেলনের প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হবে। লোকসভার সদস্য, বিশিষ্ট সাংবাদিক ও সাহিত্যিক শ্রীচপলাকান্ত ভট্টাচার্য সম্মেলনে সভাপতিত্ব করবেন। সরদার কে এম পানিক্কর, শ্রী ইন্দুলাল যাজ্ঞিক, এম পি, শ্রী অতুল্য ঘোষ, এম পি, ডা. পি সি ঘোষ, এম এল এ, অধ্যাপক রেজাউল করিম, শ্রী বিমলাপ্রসাদ চালিহা, মুখ্যমন্ত্রী, আসাম, শ্রী হেমন্তপ্রসাদ ঘোষ, শ্রী শীলভদ্র যাজী, এম পি, সিদ্ধিনাথ শর্মা, এম এল এ, উইলিয়ামসন সাঙ্গমা, মন্ত্রী, আসাম এবং পার্বত্য অঞ্চলের অপর নেতাসহ আসামের অন্যান্য নেতৃবৃন্দ সম্মেলনে যোগদান করবেন বলে আশা করা যায়।
এই সম্মেলন আসাম, ত্রিপুরা ও মণিপুর সমন্বয়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। আসামের পার্বত্য অঞ্চল এবং কেন্দ্রশাসিত ত্রিপুরা ও মণিপুর থেকে সৌভ্রাত্র প্রতিনিধিদল এই সম্মেলনে যোগদান করবেন। সম্মেলনের সাফল্য ও আমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দের অভ্যর্থনার জন্য প্রস্ততি পূর্ণোদ্যমে চলছে। এই সম্মেলনের অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে আসামের রাজ্যভাষা নিয়ে আলোচনা হবে। সম্মেলনের প্রস্ততি কমিটি অসমিয়া ভাষাকে রাজ্যভাষারূপে অন্যান্য ভাষার ওপর চাপিয়ে দেওয়ার প্রতিবাদ পূর্বেই করেছেন।
আসাম, ত্রিপুরা ও মণিপুরের সৌভ্রাত্র প্রতিনিধি এবং অন্যান্য অতিথিবৃন্দ ছাড়াও ভারতের বিভিন্ন স্থানের— যাঁরা এই সম্মেলনের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন তাঁদেরকে এই সম্মেলনে যোগদানের জন্য বিশেষ আমন্ত্রণ জানানো যাচ্ছে। আমাদের লক্ষ্য সম্মেলনকে সাফল্যমন্ডিত করে তোলা।
সম্মেলনে প্রতিনিধি প্রেরণ নিম্নলিখিত উপায়ে করবার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে। শহরাঞ্চলের প্রতি পাড়ায় ২ জন, গ্রামাঞ্চলের প্রতি সার্কেলে ২ জন এবং চা-বাগানের ও শিল্পের প্রতি ইউনিটে ২ জন করে প্রতিনিধি প্রেরণ করা চলবে।
প্রতিনিধি চাঁদা ১ টাকা, অভ্যর্থনা সমিতির চাঁদা ২ টাকা।’৩৬
১৯৬০ সালের ২১ জুন শিলচর নরসিংটোলা ময়দানে এক বিশাল জনসমাবেশ আয়োজিত হয়। সভায় আসাম উপত্যকায় গুণ্ডারাজের নিন্দা, একমাত্র অসমিয়াকেই আসামের সরকারি ভাষা এবং নিখিল আসাম বাংলা ভাষা সম্মেলন আয়োজনের যৌক্তিকতা, প্রস্তুতি ও সভার দিন তারিখ বিষয়ে বিস্তৃত আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়।
এ দিনের সভায় সভাপতিত্ব করেন দ্বারিকানাথ তেওয়ারি, এম.পি.। নিখিল আসাম বাংলা ভাষা সম্মেলনকে সফল করে তুলতে প্রাক্তন মন্ত্রী শ্রী বৈদ্যনাথ মুখার্জিকে সভাপতি, অধ্যাপক শরৎচন্দ্র নাথকে সাধারণ সম্পাদক এবং প্রস্তুতি কমিটির সকল সদস্য ও অন্যান্য কর্মকর্তাকে পদাধিকার অনুযায়ী অভ্যর্থনা কমিটির সদস্য নিযুক্ত করে এই কমিটি গঠিত হয়। সভায় নিখিল আসাম বাংলা ভাষা সম্মেলন ২ ও ৩ জুলাই শিলচর শহরে অনুষ্ঠিত হবে বলে ঘোষণা করে অধ্যাপক শরৎচন্দ্র নাথ সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি এ পর্যন্ত যা করেছেন সভায় তার বিবরণ তুলে ধরেন।
সভায় ‘জেলা বারের উকিল আলতাফ হোসেন মজুমদার সংখ্যাধিক্যের জোরে অসমিয়া ভাষাকে সংখ্যালঘু ভাষাভাষীদের ওপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার যে অপচেষ্টা চলছে তার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জ্ঞাপন করে বলেন যে, আসামে অসমিয়া ভাষার সঙ্গে অন্যান্য মুখ্য ভাষাগুলিরও মর্যাদাপ্রাপ্তি এবং বাঁচবার অধিকার আছে, সেটা ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার আন্দোলনকারীদের বুঝতে হবে।
শিলচর জেলা কংগ্রেস কমিটির সভাপতি শ্রীনন্দকিশোর সিংহ বলেন যে, রাজ্য কংগ্রেস কমিটির সভায় সংখ্যালঘু প্রতিনিধিগণ প্রতিবাদ জানিয়ে ব্যর্থকাম হয়েছেন। কাছাড় কংগ্রেসের পক্ষ থেকে নিখিল ভারত রাষ্ট্রীয় সমিতির কাছে প্রতিবাদ জানাবার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
গোলাম ছবির খান বলেন, আসামের স্বাধীনতা কেবল অসমিয়াদের জন্যই এসেছে এবং আসামে একমাত্র তাঁরাই ‘রাজা বনেছে’, তাঁদের এই ভুল শীঘ্রই ভাঙবে। বাংলা ভাষা পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষা, এই ভাষাকে জোর করে দাবিয়ে রাখা যাবে না। বাংলা ভাষার সঙ্গে অন্যান্য পার্বত্য জাতিদের ভাষাগুলিকেও অসমিয়া ভাষার সমান মর্যাদা দিতে হবে।
যুবনেতা রথীন্দ্রনাথ সেন আবেগময়ী ভাষায় ঐতিহ্যের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে ছাত্র ও যুব সমাজকে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য বদ্ধপরিকর হওয়ার আহ্বান জানান। … তিনি বলেন, ‘শতকরা মাত্র পঁচিশজনের মাতৃভাষা অসমিয়াকে সমগ্র প্রদেশের লোকের ওপর জোর করে চাপানো চলবে না। শ্রীসেন আরও বলেন, ‘অসম’ শব্দ থেকে আসাম শব্দের উৎপত্তি। যারা একদা অসম অর্থাৎ পাহাড় অঞ্চলেই বাস করতেন— আজ তাঁরা সমগ্র প্রদেশের ওপর ভাষার সাম্রাজ্য বিস্তার করতে চাচ্ছেন। … অম্বিকাগিরি রায়চৌধুরী সংখ্যালঘু ভাষাভাষীগণের দাবিকে রাষ্ট্রদ্রোহীতা বলে যে অভিমত প্রকাশ করেছেন— তার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে শ্রী সেন বলেন,ভারতের সংবিধান শ্রীরায়চৌধুরীর পকেট বই নয়। লোকসভা সদস্য শ্রী নিবারণচন্দ্র লস্করও সভায় বক্তৃতা করেন। সভাপতি শ্রী দ্বারিকানাথ তেওয়ারি বলেন, অসমিয়াদের অবাঞ্ছিত কাজের ফলে আসাম আজ টুকরো টুকরো হওয়ার পথে। সীমান্ত এলাকায় যখন বহি:শত্রু উপদ্রব আরম্ভ করেছে—ঠিক সে-সময় অসমিয়াগণ এই আত্মঘাতী আন্দোলন আরম্ভ করেছেন। শ্রী তেওয়ারি বলেন, আসামের ভিতরে ও বাইরে নানা বিপর্যয় ঘনিয়ে উঠেছে, এসময় বহুভাষাভাষী অধ্যুষিত জনগণের জন্য একাংশের মাতৃভাষা অসমিয়াকে রাজ্যের একমাত্র সরকারি ভাষারূপে গ্রহণ করানোর চেষ্টা রাজ্যের ঐক্য ও সংহতির মূলে কুঠারাঘাত করবে। সময় থাকতে নেতৃবৃন্দ সাবধান হউন।’৩৭
নিখিল আসাম বাংলা ভাষা সম্মেলন আয়োজকদের পক্ষ থেকে জনগণের উদ্দেশ্যে এক প্রচারপত্র প্রকাশ করা হয়। কালের সাক্ষী সেই প্রচারপত্র তথা আবেদনে জনগণের উদ্দেশে বলা হয়:
বহুভাষাভাষী ও বহুজাতি অধ্যুষিত আসাম রাজ্যে একমাত্র অসমিয়া ভাষাকেই রাজ্যভাষা করার দাবিতে একশ্রেণীর অসমিয়াভাষী যে আন্দোলন ও অবাঞ্ছিত প্রচেষ্টা আরম্ভ করিয়া বিপর্যয়ের সৃষ্টি করিয়াছেন তাহা আসাম রাজ্যের ঐক্য ও সামগ্রিক কল্যাণের পরিপন্থী। উহার ফলে আজ আসাম রাজ্যে বাঙ্গালী ও অন্যান্য খন্ড জাতীর ভাষা ও সংস্কৃতি সংকটের সম্মুখীন। যদিও অসমীয়া ভাষা আন্দোলনের কোনো কোনো উদ্যোক্তা ও নেতৃবৃন্দ অন্য ভাষাভাষীর ভাষা ও সংস্কৃতির নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দান করিতেছেন। তথাপি স্বাধীনতা লাভের পর সুদীর্ঘ ১৩ বৎসরের তিক্ত অভিজ্ঞতা ও বর্তমান আন্দোলনের পদ্ধতি সংগতকারণেই আসামের অন্য ভাষাভাষীদের শঙ্কিত করিয়া তুলিয়াছে। ইহা সুপরিজ্ঞাত যে সমদৃষ্টির অভাবে বঙ্গভাষী অধ্যুষিত কাছাড় জেলা ও অনসমিয়া ভাষাভাষী পার্বত্যজেলাসমূহ স্বাধীনতার পরবর্তী উন্নতিমূলক পরিকল্পনাসমূহে সর্বদিকে অবজ্ঞাত ও উপেক্ষিত হইয়া আছে। ন্যায়নীতির মর্যাদা ও ভারতের সংবিধানের বিধি লঙ্ঘনক্রমে রাজ্যের সমগ্র লোকসংখ্যার মাত্র এক তৃতীয়াংশের ভাষা, অন্যান্য ভাষাভাষীদের ন্যায়সংগত অধিকার ও স্বার্থ দাবাইয়া রাখিয়া স্বীয় প্রাধান্য দাবি করিতে পারে না— এই অপচেষ্টা, স্বার্থবুদ্ধি ও সঙ্কীর্ণতার পরিচায়ক। আসামের ভৌগোলিক অবস্থান ও সাম্প্রতিক সীমান্ত সমস্যার পরিস্থিতিতে এবং বিশ্বরাজনৈতিক পটভূমিকায় এই অপরিণামদর্শী আন্দোলন, কোনো চিন্তাশীল ও ভারতের কল্যাণকামীর পক্ষে সমর্থনযোগ্য নহে। কিন্তু প্রকাশ যে, আসাম সরকার ও রাজ্যভাষা সম্পর্কিত প্রস্তাবে আগামী শরৎকালীন রাজ্য বিধানসভার অধিবেশনে উপস্থিত করার জন্য বিল প্রস্তুত করিতেছেন।
উপরিউক্ত সমস্যাজড়িত ও সংকটপূর্ণ পরিস্থিতিতে শিলচরে আয়োজিত নিখিল আসাম বাংলা ভাষা সম্মেলনের এই অধিবেশন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই সম্মেলনের সুচিন্তিত সিদ্ধান্তের উপরই রাজ্যের ও আসামের বঙ্গভাষী ও অন্যান্য খন্ডজাতীয় ভারতীয় নাগরিকগণের কল্যাণ ও ন্যায়সংগত স্বার্থ নির্ভর করিতেছে।
এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গভাষী ও অন্যান্য ভাষাভাষী নাগরিকগণকে অনুরোধ করা যাইতেছে যে, বিষয়ের গুরুত্ব উপলব্ধি করত: সকলে যেন দলমত ও জাতিধর্মনির্বিশেষে সম্মেলনে যোগদান করিয়া অসমীয়াকে একমাত্র রাজ্যভাষা করার প্রচেষ্টার তীব্র প্রতিবাদক্রমে আসাম রাজ্যে সকল নাগরিকের নিজ নিজ ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষার সুব্যবস্থা সম্পর্কে সুচিন্তিত ও কল্যাণকর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সম্মেলনকে সাফল্যমন্ডিত করিতে সকলের সক্রিয় সাহায্য ও সহযোগিতা প্রার্থনা করি।
অভ্যর্থনা সমিতির সদস্য চাঁদা-২ টাকা, প্রতিনিধি চাঁদা—১ টাকা।
বিনীত
করিমগঞ্জ, শিলচর এবং হাইলাকান্দির অসংখ্য অধিবাসীর নাম প্রচারপত্রে রয়েছে— যাঁদের নাম স্থানাভাবে উল্লেখ করা সম্ভব হল না বলে আমরা দুঃখিত।
এই সম্মেলনকে কেন্দ্র করে কেবল শিলচর নয়— সমগ্র কাছাড় জেলাতেই বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনা লক্ষ করা যায়, রীতিমতো সাজ সাজ রব। সম্মেলনের সভাপতিসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দ শিলচর আসা শুরু করেন। সেকালের সংবাদপত্র এ খবর দিয়ে জানাল:
করিমগঞ্জের জননেতাদের নেতৃত্বে প্রায় এক হাজার নর-নারী আজ (১ জুলাই) সকালে সম্মেলনে যোগদানের জন্য পদব্রজে যাত্রা করিয়াছে। পথে চরখোলা, ভাঙ্গা, রূপসিবাড়ি, বদরপুর, পঞ্চগ্রাম এবং কাটাখাল হইতে আরও বহুলোক তাঁহাদের সাথে যোগদান করেন। আগামীকল্য তাঁহারা একটি শোভাযাত্রা সহকারে শিলচর রওনা হইবে। রামকৃষ্ণনগর হইতেও পাঁচশত লোকের অপর একটি দল পদব্রজে শিলচর যাত্রা করিয়াছে। আগামীকল্য প্রাতে তাঁহারা শিলচরে পৌঁছিবে। প্রায় পাঁচ হাজার লোক এইভাবে শিলচর নিখিল আসাম বাংলা ভাষা সম্মেলনে যোগদান করিবে বলিয়া আশা করা যায়। আসামের কৃষিমন্ত্রী মঈনুল হক চৌধুরী গতকল্য সন্ধ্যায় শিলচর পৌঁছিয়াছেন।৩৮
অন্যদিকে এ সম্পর্কে করিমগঞ্জ থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক যুগশক্তি জানাল:
অদ্য শুক্রবার ভোরে করিমগঞ্জ টাউন ব্যাঙ্ক প্রাঙ্গণ হইতে প্রায় এক হাজার ছাত্র-যুবা-প্রৌঢ়ের পদযাত্রা শুরু হয়। পদযাত্রীরা দীর্ঘ ৩৫ মাইল রাস্তা পায়ে হাঁটিয়া আগামীকাল ২রা জুলাই শনিবার সকাল দশটায় শিলচর পৌঁছবেন। রাস্তায় বিভিন্ন স্থানে আরও পদযাত্রী আসিয়া যোগদান করিবেন এবং শেষ-পর্যন্ত পদযাত্রীদের সংখ্যা কমপক্ষেও দু-হাজার হইবে বলিয়া মনে হইতেছে।
অদ্য ভোর হইতে না হইতেই শহরের বিভিন্ন অংশ হইতে পদযাত্রীরা টাউন ব্যাঙ্ক প্রাঙ্গণে সমবেত হইতে থাকেন। মফসসল হইতেও বহু ছাত্র ও যুবক পূর্বদিন করিমগঞ্জ আসিয়া উপস্থিত হন। ভোর ঠিক পাঁচটায় যাত্রা আরম্ভ হয়। পদযাত্রীদিগকে বিদায় সংবর্ধনা জ্ঞাপন করার উদ্দেশ্যে বহু নর-নারী টাউন ব্যাঙ্ক প্রাঙ্গণে সমবেত হন। তন্মধ্যে শ্রী মুনীন্দ্রকুমার দাস, শ্রী রণেন্দ্রমোহন দাস, এমএলএ, শ্রী বিধুভূষণ চৌধুরী, শ্রী সুরেন্দ্রকুমার চৌধুরী, শ্রী সুরঞ্জন নন্দী, শ্রী বিনোদবিহারী সোম, শ্রী রমেশচন্দ্র দাস, ডা. আই বি দে, শ্রী তুলারাম ভুরা, শ্রী নেপালচন্দ্র সাহা প্রভৃতির নাম উল্লেখযোগ্য, বহুসংখ্যক সম্ভ্রান্ত মহিলাও উপস্থিত হইয়াছিলেন।
পদযাত্রীদের পরিচালনা করেন শ্রী বিশ্বনাথ উপাধ্যায় এম এল এ, স্কুল বোর্ডের চেয়ারম্যান শ্রী অরবিন্দ চৌধুরী, প্রজা সমাজতন্ত্রীনেতা শ্রী রথীন্দ্রনাথ সেন, প্রাক্তন লোকাল বোর্ড চেয়ারম্যান, শ্রী ননীগোপাল স্বামী, শ্রী বিমানবিহারী দাস প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ।
পদযাত্রা আরম্ভ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মহিলারা উলু ও শঙ্খধ্বনি করিয়া তাঁহাদের সাফল্য কামনা করেন। বন্দেমাতরম ধ্বনি সহকারে তাঁহারা যাত্রা আরম্ভ করেন। নেতাজি সুভাষ, বিপিনচন্দ্র পাল ও ড. শ্যামাপ্রসাদের প্রতিকৃতিশোভিত একখানা মোটরবাসে করিয়া একদল বালিকা ‘মোদের গরব মোদের আশা আ মরি বাংলা ভাষা’ গান গাহিতে গাহিতে পদযাত্রীদের সঙ্গে চলিয়াছে। পদযাত্রীরা আজ ভাঙ্গায় প্রাতরাশ, বদরপুরে মধ্যাহ্ন ভোজন ও কাটাখালে নৈশ ভোজন ও রাত্রি অতিবাহিত করিয়া আগামী কাল সকালে শিলচর পৌঁছবেন।৩৯
১ জুলাই নিখিল আসাম বাংলা ভাষা সম্মেলন সভাপতি বিশিষ্ট সাংবাদিক সাহিত্যিক শ্রী চপলাকান্ত ভট্টাচার্য, এম পি বেলা প্রায় একটার দিকে শিলচর সদরঘাট খেয়াঘাটে পৌঁছোলে বিপুলভাবে তাঁকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। এ সময় খেয়াঘাটে প্রায় দু-হাজার মানুষ উপস্থিত ছিলেন।
‘অভ্যর্থনা কমিটির চেয়ারম্যান শ্রী বৈদ্যনাথ মুখার্জি এবং শিলচর পৌরসভার অস্থায়ী সভাপতি শ্রী আশুতোষ দত্ত সম্মেলন সভাপতিকে মাল্যভূষিত করেন। শিলচর বার অ্যাসোসিয়েশন সদস্যগণ, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবর্গ ও বিপুলসংখ্যক সাধারণ মানুষ খেয়াঘাটে উপস্থিত ছিলেন।
সম্মেলন সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক শরৎচন্দ্র নাথ, কাছাড় জেলা সাংবাদিক সমিতি সম্পাদক অমিতকুমার নাগ, গৌহাটির একমাত্র বাংলা সাপ্তাহিক দেশবাণী সম্পাদক বিশ্বপ্রসাদ বসু প্রমুখ সম্মেলন সভাপতিকে কুম্ভীরগ্রাম বিমানবন্দরে মাল্যভূষিত করেন।’৪০
শিলচরের পথে শ্রী ভট্টাচার্য দু-টি স্থানে গ্রামবাসীদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা করেন। তিনি পথসভায় বলেন, আসামে বাংলা ভাষা তার প্রাপ্য মর্যাদা লাভ করুক—এটাই তাঁর ইচ্ছা। রাজ্যবাসী সকলের স্বার্থের জন্যই এমনটা হওয়া বাঞ্ছনীয়।
২ জুলাই ১৯৬০, শনিবার, বিকাল তিনটায় গান্ধীবাগে নির্মিত সুসজ্জিত প্যাণ্ডেলে প্রায় বিশ হাজার মানুষের উপস্থিতিতে কাজী নজরুল ইসলামের ‘দুর্গমগিরি কান্তার মরু’ গানটি পরিবেশনের পর শ্রী বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায় মনোনীত সভাপতি শ্রী চপলাকান্ত ভট্টাচার্যকে সভাপতির আসন গ্রহণের অনুরোধ জানান। আসামের সরবরাহ ও কৃষিমন্ত্রী মঈনুল হক চৌধুরী, খাসিয়া নেতা হুভার হাই নিউতা, এম পি, শ্রী সুরেশচন্দ্র দেব, এম পি, শ্রীনন্দকিশোর সিংহ, এমএলএ, শ্রী বিশ্বনাথ উপাধ্যায়, এমএলএ, ইকরিমগঞ্জ, হাইলাকান্দি ও শিলচরের বিশিষ্ট নেতৃবর্গ এবং আসাম উপত্যকার বিভিন্ন জেলা থেকে আগত বিশেষ প্রতিনিধিবর্গ এ সময়ে মঞ্চে উপবিষ্ট ছিলেন।
সভাপতির আহ্বানে সম্মেলনের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক শরৎচন্দ্র নাথ সম্মেলনে উপস্থিত থাকতে না পারার জন্য দুঃখপ্রকাশ করে যে চিঠি পাঠান সেই চিঠি এবং সম্মেলনের সাফল্য কামনা করে মাদ্রাজের রাজ্যপাল শ্রী বিষ্ণুরাম মেধী, পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল শ্রী যুক্তা পদ্মজা নাইডু, শ্রী হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ, শ্রী তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, মো: রেজাউল করিম, শ্রী বিমলাপ্রসাদ চালিহা, শ্রী অরুণচন্দ্র গুহ, শ্রী প্রফুল্লচন্দ্র সেন, ড. ত্রিগুণা সেন, শ্রী অতুল্য ঘোষ, শ্রী অজয় মুখার্জী, ডা. আর আহমেদ, শ্রী অনাথবন্ধু রায়, শ্রী হরেশ্বর দাস, শ্রী হেমচন্দ্র চক্রবর্তী প্রমুখ যেসব চিঠি, টেলিগ্রাম প্রেরণ করেছিলেন— তা পাঠ করা হয়। এরপরই অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি শ্রী বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায় তাঁর লিখিত অভিভাষণ পাঠ করেন।
সম্মেলনে উপস্থিত সকলকে স্বাগত জানিয়ে শ্রী মুখোপাধ্যায় ‘ভারতের বিরুদ্ধে সাম্যবাদী চীনের শত্রুতা, পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের মনের মিল না হওয়া এবং নাগা উপদ্রবের কথা উল্লেখ করে বলেন’:
ভিতরের এবং বাহিরের শত্রুদের কার্যের ফলে যখন আমাদের সমস্যাগুলির জটিলতা বাড়িয়া চলিতেছে ঠিক সেই সময়ে নিজেদের অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলির সহজ সমাধানের পথ না খুঁজিয়া তাঁহাদের জটিলতা বাড়াইয়া দেওয়ার ব্যবস্থা করা সুবুদ্ধির পরিচায়ক নয়।
‘মণীষী বিপিনচন্দ্র পাল, ডা. সুন্দরীমোহন দাস, মৌলবী আবদুল করিম, কামিনীকুমার চন্দ, শচীন্দ্র সিংহ, ভুবনমোহন বিদ্যার্ণব প্রমুখ সুরমা উপত্যকার মুখ উজ্জ্বলকারী শ্রেষ্ঠ সন্তানগণের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করে স্বাধীনতা আন্দোলনে শ্রীহট্ট ও কাছাড়ের গৌরবোজ্জ্বল অবদানের কথা উল্লেখ করেন। ১৯২১ সালে সুরমা উপত্যকার চা-শ্রমিক ধর্মঘট সারা ভারতবর্ষে শ্রমিক জাগরণের পথপ্রদর্শন করেছিল। সেই পথ ধরেই আসে পূর্ববঙ্গ রেলওয়ে ধর্মঘট— যা স্বাধীনতা সংগ্রামের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।’
শ্রী মুখোপাধ্যায় বলেন:
যেহেতু এই প্রদেশের নাম আসাম, অনসমিয়া ভাষাভাষীগণ সেই কারণেই কাহারও কাহারও নিকট বহিরাগতরূপেই প্রতীয়মান হইতেছেন। এঁরা যেন এই রাজ্যের পক্ষে বোঝা স্বরূপ। শ্রীহট্ট ও পূর্ববঙ্গ হইতে লক্ষ লক্ষ হিন্দু দেশনায়কগণের প্রদত্ত প্রতিশ্রুতির উপর নির্ভর করিয়া অসমিয়া ভাষাভাষীদিগকে আত্মীয় জ্ঞান করিয়াই এই রাজ্যে আশ্রয়গ্রহণ করিয়াছিলেন। কিন্তু আজ তাঁহারা চরম উপেক্ষার পাত্র—অবাঞ্ছিত অতিথি।
‘অনসমিয়া ভাষাভাষীগণের সর্বপ্রকার নাগরিক অধিকারকে ক্রমে সঙ্কুচিত করা হচ্ছে। ইংরেজ আমলে গোয়ালপাড়া জেলায় ২৫০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বাংলা ভাষার মাধ্যমেই শিক্ষাদানের ব্যবস্থা ছিল। স্বাধীনতালাভের পর তিন বৎসরের মধ্যেই ২৪৭টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বাংলা ভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা রহিত করা হয়।
রাজ্যের লোকসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ বাংলাভাষী। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার স্কুলসমূহে যথেষ্ট সংখ্যক বাংলা ভাষাভাষী ছাত্র-ছাত্রী থাকা সত্ত্বেও সেখানে বাংলা ভাষা শিক্ষার উপযুক্ত ব্যবস্থা করা সম্পর্কে গভর্নমেন্ট উদাসীন। গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের এম. এ. পরীক্ষায় বাংলা ভাষার কোনো স্থান আজও হয়নি। এই রাজ্যের তেল কোম্পানি, চা-বাগান প্রভৃতি শিল্প বাণিজ্য সংস্থায় এবং রেলওয়ে কিংবা পোস্ট বা টেলিগ্রাফের মতো কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন বিভাগগুলিতেও আসামের অধিবাসী অনসমিয়া ভাষাভাষীর নিয়োগ দিন দিনই সঙ্কুচিত হয়ে আসছে এবং এর অবশ্যম্ভাবী ফলস্বরূপ অনসমিয়া ভাষাভাষীদের মধ্যে বেকারের সংখ্যা দিন দিনই বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইদানীং আসামেও শিল্প উন্নয়নের ব্যবস্থা আরম্ভ হয়েছে। কিন্তু এ ব্যাপারেও অনসমিয়া ভাষাভাষী কাছাড় এবং পার্বত্য অঞ্চলগুলির প্রতি একটা বিমাতৃসুলভ ব্যবহার ক্রমেই উৎকটরূপে দেখা দিচ্ছে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বৈষম্যপূর্ণ ব্যবহারের প্রতিকারের জন্যই অতিসম্প্রতি দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্ত অঞ্চল কনভেনশনেগুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবসমূহ গৃহীত হয়েছে।
রাজ্যভাষা সম্পর্কিত প্রশ্নে আসামের বহুস্থানে নতুন করে বাংলা ও অন্যান্য অনসমিয়া ভাষাভাষীদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চলছে। এ সমস্ত ঘটনা শুধু লাঞ্ছিতের পক্ষেই অপমানজনক নয়, জনসাধারণ ও বিশেষ করে যাঁরা শাসনের দায়িত্ব গ্রহণ করে আসেন— তাঁদের পক্ষেও লজ্জাজনক। ‘ভাষা সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান না হইলে আসাম ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হইবে। ভাষার মোহে অন্ধ হইয়া যাঁহারা দেশের নিরাপত্তাকে বিঘ্নিত করিতেছেন—তাঁহাদের দেশপ্রীতি সন্দেহাতীত নয়।’
‘গায়ের জোরে এক শ্রেণীর লোক যে আজ অসমিয়া ভাষাকে আমাদের উপর চাপাইয়া দিতে চাহিতেছেন— তাঁহারা ভুলিয়া যাইতেছেন যে, গায়ের জোর দেখানোর অর্থই হইতেছে তাঁহাদের দাবির পিছনে কোনো যুক্তি নাই—এই কথাটাই প্রকারান্তরে স্বীকার করিয়া লওয়া। অসমিয়া ভাষার প্রতি মমতা অপেক্ষা বাংলা ও অন্যান্য ভাষার প্রতি বিদ্বেষের কথাটাই বড়ো হইয়া উঠিতেছে।’
‘কাছাড়কে আসামের মানচিত্র থেকে অপসারিত করেই যাঁরা ভাষা সমস্যার সমাধান করতে চান— তাঁরা ভুলে যাচ্ছেন যে, তদবস্থায় আরও বহু অঞ্চলকেই আসামের মানচিত্র থেকে অপসারিত করতে হবে।’
আমাদের ন্যায়সংগত অধিকারকে আমরা সর্বপ্রযত্নে রক্ষা করিব। প্রতিপক্ষের আক্রমণে জর্জরিত হইয়া আমাদের যেন ধৈর্যচ্যুতি না ঘটে। আমরা যেন আমাদের লক্ষ্যভ্রষ্ট না হই এবং কোনো কোনো সময়ে কোনো কারণে যেন হিংসা ও অন্যায়ের প্রতিকারে হিংসা ও অন্যায়ের আশ্রয় গ্রহণ না করি, আমরা সততা ও পবিত্রতা যেন সর্বদা সর্বাবস্থাতেই অক্ষুণ্ণ থাকে। কোনো ভাষা কোনো সংস্কৃতির প্রতি আমরা অশ্রদ্ধা পোষণ করিব না। নিজের মাতৃভাষা ও সংস্কৃতিকে রক্ষা করিতে গিয়া আমরা যেন কান্ডজ্ঞান না হারাই এবং কোনোরূপ লোকনিন্দিত পন্থার অনুসরণ না করি—জগদীশ্বরের নিকট ইহাই প্রার্থনা।
শ্রী মুখোপাধ্যায় বলেন, বিভিন্ন ভাষা, বিভিন্ন ধর্ম, বিভিন্ন সামাজিক স্তর—এগুলিকে যথাযোগ্য স্থান দিয়েই সমগ্র ভারতবর্ষকে ঐক্যের সূত্রে গ্রথিত করে তুলবার সুমহান আদর্শ ভারতবর্ষ গ্রহণ করেছে। এই আদর্শকে আসাম প্রদেশে বাস্তবে রূপায়িত করা অলীক কল্পনা নয়।
শ্রী মুখোপাধ্যায় প্রশ্ন রাখেন, ‘যদি পৃথক হইয়াই ঘর করিতে হয় তাহা হইলে তাহাও আমরা ভদ্রভাবে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই করিতে পারিব না কেন? লাঠালাঠি করিয়া সমস্ত প্রশ্নের মীমাংসা করিতে হইবে মহাত্মা গান্ধীর নিকট হইতে কি আমরা সেই শিক্ষাই লাভ করিয়াছিলাম? অসমিয়া ভাষাভাষী আদর্শবাদী প্রবীণ ও নবীনের কাছে ইতিহাসের দাবি ইহাই যে, এই সংকট মুহূর্তে সমস্ত ক্ষুদ্রতার ঊর্ধ্বে উঠিয়া ভারতবর্ষের সমন্বয়ের আদর্শের পতাকাকে উচ্চে তুলিয়া ধরিতে হইবে।’
তিনি বলেন, ‘রবীন্দ্র সাহিত্যের প্রতি, রবীন্দ্রনাথের ভাষার প্রতি একদিকে সম্মান দেখানো হইবে আর তারই সঙ্গে সঙ্গে সেই ভাষার ও সেই সাহিত্যের অনুরাগীদের পিঠে লাঠি চালানো হইবে— এর সামঞ্জস্য কোথায়?’
‘দেশে-বিদেশে বাংলাভাষার চর্চা হচ্ছে। কেরলের বিশ্ববিদ্যালয়েও বাংলা ভাষা পড়াবার ব্যবস্থা হচ্ছে। কিন্তু আসামে বাংলা ভাষাকে কোনো প্রকার মর্যাদাদান করলেই অসমিয়া ভাষা খাটো হয়ে যাবে— এই আতঙ্কে তাঁরা সর্বদা সন্ত্রস্ত।’ শ্রী মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘শ্রী শ্রী শঙ্কর দেবের বাণী বহন করিয়া অসমিয়া ভাষা নিজেকে সংস্কৃতির বাহনরূপে পরিচয় দিবার গৌরব অর্জন করিয়াছে। শ্রী শঙ্কর দেবের বা রবীন্দ্রনাথের ভাষা কেহ কখনো নষ্ট করিতে পারিবে না।’
বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায় তাঁর ভাষণের উপসংহারে বলেন:
মাতৃভাষার সৌষ্ঠব বৃদ্ধি, তার পুষ্টি এবং প্রসারের জন্য স্থায়ী সমিতি গঠন করিয়া প্রদেশের অপরাপর ভাষাভাষীদের ভাষা ও সংস্কৃতি হইতে নতুন কিছু আহরণ করিয়া যাতে আমরা স্ব স্ব মাতৃভাষাকে আরও সমৃদ্ধ করিয়া তুলিতে পারি— তার জন্য সচেষ্ট হইব।
আসাম প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটি রাজ্যভাষা সম্পর্কে যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়াছেন তাহার ফলে সংখ্যালঘু জনগণের ভাষা ও সংস্কৃতির উপর যে অন্যায় আক্রমণের ব্যবস্থা করা হইয়াছে— সেই সম্পর্কে ঊর্ধ্বতন কংগ্রেস কতৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়া তাঁহাদের সাহায্যে এই সিদ্ধান্তের পরিবর্তন ঘটাইতে হইবে। কেন্দ্রীয় সরকারের নিকট এই সম্পর্কে অবিলম্বে সমস্ত অবস্থা বিবৃত করিয়া স্মারকলিপি দাখিল করিতে হইবে। ভারতের রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর সহিত সাক্ষাৎ করিয়া আমাদের সমস্ত অভিযোগের প্রতিকার প্রার্থনা করিতে হইবে।৪১
এরপর বাংলা ভাষা সম্মেলনের উদবোধন করেন বিশিষ্ট সাহিত্যিক, চিন্তাবিদ কাজী আবদুল ওদুদ। কাজী ওদুদ সম্মেলনে বলেন:
ইংরাজের হাত হইতে স্বাধীনতা কাড়িয়া আনিবার জন্য আমরা এক উদ্দেশ্যে এক যোগে কাজ করিয়াছিলাম, কিন্তু স্বাধীনতা লাভের পর আমাদের সামনে সমস্যা ভিন্ন আকারে দেখা দিয়াছে। দেশের সামনে আজ সব চাইতে বড় সমস্যা দাঁড়াইয়াছে বৈচিত্র্যের মধ্যে একত্বকে কী করিয়া রক্ষা করা যায়। অসমিয়াগণ যখন অসমিয়া ভাষাকে রাজ্যভাষা করিতে চান তখন আপাতদৃষ্টিতে তাহাকে ন্যায়সংগত দাবি বলিয়াই মনে হয়। কিন্তু এই প্রশ্নের মীমাংসায় আসামের বিশেষ অবস্থার কথাও চিন্তা করিতে হইবে। আসাম বহু ভাষাভাষী রাজ্য। এখানে কোনো একটি ভাষাকে অপর সব ভাষার উপর প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত করিতে দেওয়া যায় না। কোনো একটি ভাষাকে সরকারি ভাষা করিয়া দিলেই কী তাহা বাস্তবিকপক্ষে বড় হইয়া যাইতে পারে? পৃথিবীতে অনেক রাজ্যে অনেক ভাষাকেই সরকারি ভাষা করা হইয়াছে— কিন্তু তাহাদের সবগুলিই ভাষা হিসেবে বড় নয়। কোনো ভাষাকে বড় করিতে হইলে মহৎ লোকের সৃষ্টি করিতে হয়। ডাণ্ডাবাজির দ্বারা সাহিত্যের উৎকর্ষসাধন হয় না। মহৎ সাহিত্যের সৃষ্টির জন্য মহৎ মানুষ সৃষ্টির প্রয়োজন। মনুষ্যত্বের বিকাশ ছাড়া সাহিত্য সৃষ্টি হয় না। সরকারি অর্থ সাহায্য লাভ করিয়াও কোনো সাহিত্য বড় হইতে পারে না। সরকারি অর্থের সাহায্যে অভিধান প্রস্তুত করা যাইতে পারে, অনুবাদ করা যাইতে পারে—কিন্তু সাহিত্য সৃষ্টি পৃথক জিনিস।
বাঙ্গালী যাঁহারা আসামে আছেন— তাঁহাদের বিশেষ দায়িত্ব বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ সম্পদ অসমিয়াদের নিকট তুলিয়া ধরা আর অসমিয়া এবং আসামের অন্যান্য ভাষার মধ্যে শ্রেষ্ঠ বস্তু যাহা আছে তাহা বাংলা সাহিত্যের জন্য আহরণ করিয়া বাংলা ভাষাকে আরও সমৃদ্ধ করা। বাঙ্গালীরাও কর্তব্যবুদ্ধি প্রণোদিত হইয়া আসামের উন্নতির জন্য সচেষ্ট হইবেন। প্রেমের দ্বারা সকলের মন জয় করিতে হইবে।
প্রদেশ বড় হইবে—এই ইচ্ছা ভালো, কিন্তু ভারত বড় না হইলে প্রদেশ রক্ষা পাইবে না—এই বুদ্ধিও থাকা উচিত। অসমিয়াদের অন্যায় আচরণের বিরুদ্ধে দৃঢ় প্রতিবাদ জানাইতে হইবে। অহিংসার পথেই এই অন্যায়ের প্রতিকার করিতে হইবে। আপনারা সত্যের পথে থাকুন, জয় অবশ্যম্ভাবী।৪২
কাজী আবদুল ওদুদের ভাষণের পর নিখিল আসাম বাংলা ভাষা সম্মেলনের সভাপতি শ্রী চপলাকান্ত ভট্টাচার্য, এমপি তাঁর ভাষণ দেওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালে গান্ধীবাগের বিশাল প্যাণ্ডেল জনতার করতালিতে মুখরিত হয়ে ওঠে। শ্রী ভট্টাচার্য সকলকে শুভেচ্ছা জানিয়ে আসামে রাজ্যভাষা নিয়ে যে অবাঞ্ছিত পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে তার উল্লেখ করে বলেন যে:
আসামে শতকরা ৩৩ জন বাংলাভাষী। বিশ্বসংস্কৃতির ক্ষেত্রে ভারতবর্ষকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করিতে বাংলা ভাষার ধারক ও বাহকেরা যে অগ্রদূতের কাজ করিয়া গিয়াছেন তাহা স্মরণ করিয়া ভারতের সর্বত্র এই ভাষাকে গৌরবের স্থান দেওয়া উচিত। তিনি বলেন যে, রবীন্দ্রনাথের যে ভাষায় ভারতের জাতীয় সংগীত মূর্ত হইয়া উঠিয়াছে, সেই ভাষার অমর্যাদা করিয়া একটা ঐতিহাসিক ট্র্যাজেডি ঘটিতে দেওয়া উচিত নহে।
শ্রী ভট্টাচার্য বলেন:
এমন একটা পরিস্থিতি দেখা দিয়াছে যাহাতে একথা প্রামাণিকভাবে নির্ধারণ ও ঘোষণা করা প্রয়োজন, আসাম রাজ্যে বাংলাভাষী সমাজের ভাষা কি অধিকারে ও মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত থাকিবে। সম্মেলনকে সেই কাজই করিতে হইবে। অসমিয়া ভাষাকে আসামের একমাত্র সরকারি ভাষা ঘোষণা করিবার উদ্যম হইতেছে। তাহারই সঙ্গে সঙ্গে এবং তাহাতেই উৎসাহিত হইয়া অসমিয়া সমাজের একাংশ এমন আচরণে লিপ্ত হইয়াছেন যাহাতে মনে হয়, এক আঘাতে বাংলা ভাষা ও বাংলাভাষী সমাজকে আসাম হইতে উচ্ছেদ করিতে তাঁহারা সংঘবদ্ধ। এই সংকটের সম্মুখে বাংলাভাষী সমাজের করণীয় কি সম্মেলনকে তাহা নির্দেশ করিতে হইবে।
তিনি বলেন:
আসাম রাজ্যের সরকারি ভাষা কি হইবে ইহাই মূলপ্রশ্ন। এই প্রশ্নে সমগ্র আসামে আজ অশান্তির আগুন জ্বলিয়া উঠিয়াছে। যাঁহারা অসমিয়া সমাজভুক্ত নহেন— তাঁহাদের জীবনযাত্রা বিঘ্নিত হইতেছে কেন? তাঁহাদের ধারণা অসমিয়া সমাজই আসামের প্রধান। ইহাই যদি সত্য হয়, তাহা হইলে অসমিয়া ভাষাকে সরকারি ভাষারূপে স্থাপনের সংকল্প কার্যে পরিণত করিতে তাঁহারা অন্য ভাষাভাষীদের মাথার উপরে দন্ড উত্তোলন করিয়াছেন কেন? তাঁহাদের এই স্নায়বিক অস্থিরতা কি ইহাই প্রমাণ করে না যে, সমগ্রভাবে আসাম রাজ্যে যে প্রাধান্য তাঁহারা দাবী করেন, সে প্রাধান্য তাঁহাদের নাই!
শ্রী ভট্টাচার্য বলেন:
এইখানে তাঁহাদিগকে সতর্ক করিতে চাহি এবং একটু স্থির হইয়া চিন্তা করিতে বলি। লাঠি উঁচাইয়া আর যাহাই করা যাক, লোককে তাহার নিজের ভাষা বর্জন করিতে অথবা অন্য ভাষা গ্রহণ করিতে বাধ্য করা যায় না। মানুষের ভাষা স্বাভাবিকভাবে গড়িয়া ওঠে, উপর হইতে জোর করিয়া চাপানো যায় না। ভারতের সংবিধানের দ্বারা সুরক্ষিত, ভারত সরকারের প্রভূত সাহায্য ও সমর্থনে পরিপুষ্ট এবং ভারতের বিশাল হিন্দীভাষী সমাজের দ্বারা একযোগে সমর্থিত হওয়া সত্ত্বেও হিন্দী ভাষা ভারতের সর্ব অঞ্চলে সরকারি ভাষারূপে প্রতিষ্ঠিত ও গৃহীত হইতে পারিতেছে না। নিখিল ভারতীয় ক্ষেত্রে হিন্দীর পক্ষে যাহা সম্ভব হয় নাই, আসামের সীমাবদ্ধ ক্ষেত্রে অসমিয়া ভাষার পক্ষে তাহা সম্ভব হইবে না। জনমতের অপেক্ষা করিতে হইবে, জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হইতে হইবে, লোকের স্বেচ্ছা প্রবৃত্ত আকর্ষণ যে ভাষাকে সমর্থন করে তাহাকেই স্বীকৃতি দিতে হইবে।
আসামের মুখ্যমন্ত্রী শ্রী বিমলাপ্রসাদ চালিহা মহাশয় ঘোষণা করিয়াছেন, অসমিয়া ভাষাকে সরকারি ভাষারূপে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য তিনি বিধানসভায় প্রস্তাব উত্থাপন করিবেন। এই প্রস্তাব উত্থাপনের ভূমিকাটি খুব সুখজনক নহে। ঘটনা পরম্পরার প্রতি লক্ষ করিয়া দেখিতেছি, ইহার পূর্বেই অসমিয়া ভাষাকে সরকারি ভাষারূপে প্রবর্তনের দাবীর সমর্থনে উপদ্রবমূলক অনুষ্ঠান আরম্ভ হইয়া গিয়াছে।
আসাম রাজ্যের সরকারি ভাষা কি হইবে এবং সেই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলা ভাষার স্থান কোথায় এই প্রশ্নটি আলোচনায় তিনদিক হইতে অগ্রসর হইব— ভারতবাসী হিসেবে কংগ্রেস-সেবক হিসেবে এবং বাঙালী হিসেবে। ভারতের সংবিধান একদিকে রাজ্যসমূহকে সরকারি ভাষা নির্ণয়ের অধিকার দিয়াছে, অপরদিকে সতর্কতা অবলম্বন করিয়াছে, যেন কোনো ভাষার উপরে জবরদস্তি না হয়। বিশেষ লক্ষ্য করিবার বিষয়, যে অনুচ্ছেদে রাজ্যসমূহকে আপন আপন প্রয়োজন অনুযায়ী সরকারি ভাষা নির্ধারণ করিবার অধিকার দেওয়া হইয়াছে, সেই অনুচ্ছেদে পরিষ্কার বলা হইয়াছে যে, এক বা একাধিক ভাষাকে সরকারি ভাষারূপে গ্রহণ করা চলিবে। ইহারই বলে পার্লামেন্ট দ্বিভাষী বোম্বাই রাজ্য গঠন অনুমোদন করিয়াছিলেন। এখনও পাঞ্জাব রাজ্যে হিন্দী ও পাঞ্জাবী— এই দুইটিকেই সরকারি ভাষারূপে গ্রহণের প্রস্তাব চলিতেছে।
সমগ্রভাবে আসাম রাজ্যের অধিবাসীদিগকে ভাষা ও সমাজের ভিত্তিতে শ্রেণীবিভাগ করিলে দেখা যায়, জনসমাজ তিনভাগে বিভক্ত— অসমিয়াভাষী সমাজ, বাংলাভাষী সমাজ এবং পার্বত্য উপজাতিসমূহ। এই পার্বত্য উপজাতিসমূহ বহু গোষ্ঠীতে বিভক্ত এবং ইহারা বহুভাষী। এই সামাজিক অবস্থার প্রতি লক্ষ্য করিলে বলিতে হয়, আসাম রাজ্যের সমাজকে তিন শ্রেণীতে বিভক্ত ধরিয়াই সরকারি ভাষার কথা বিবেচনা করিতে হইবে। জনসমাজের এই তিন অংশ প্রায় পরস্পর সমান অনুপাতে সন্নিবদ্ধ ইহার মধ্যে বাংলাভাষী সমাজের অংশ যে অন্তত শতকরা ৩৩, তাহা নি:সংশয়ে প্রমাণ করা যায়। বিশেষভাবে হিসেবে করিলে এই অনুপাত বরং আরও কিছু বাড়িবে, কিন্তু কমিবে না। জনসমাজের এই বৃহৎ অংশের যে ভাষা, সরকারি ভাষা নির্ণয়ে তাহার নিশ্চয়ই একটা স্থান আছে। আমার বক্তব্য এই—আসাম রাজ্যের সরকারি ভাষা নির্ধারণে বাংলা ভাষাকে অগ্রাহ্য করিবার কোনো উপায় নাই। এখানে মেজরিটি ভাষা বা মাইনরিটি ভাষা বলিয়া কোনো কথা উঠিতে পারে না। আসাম রাজ্যের সামাজিক অবস্থা বিবেচনা করিয়া অসমিয়া ও বাংলা— দুইটিকেই রাজ্যের প্রধান ভাষা বলিয়া স্বীকৃতি দিতে হইবে। সে-স্বীকৃতি প্রাপ্য হইলে বাংলা ভাষা স্বভাবতই সরকারি পর্যায়ে আসিয়া পড়ে।
শ্রী ভট্টাচার্য বলেন:
কংগ্রেসের গঠনতন্ত্রে যে-সকল অঞ্চলকে মূলত বাংলভাষী বলিয়া স্বীকার করা হইয়াছে, সেই সকল অঞ্চল যতদিন আসামের অন্তর্ভুক্ত থাকিবে, ততদিন বাংলাভাষী সমাজ আসামে বহিরাগত নহে, বাংলা ভাষাও বহিরাগতদের ভাষা নহে।
তিনি বলেন যে:
বর্তমান ভারতে বাঙালি হিসেবেও আমাদের কিছু বলিবার অধিকার আছে বৈকি। ভাষা হিসেবে বাংলার মর্যাদা আসামে স্বীকৃত হইলে তাহাতে আসাম রাজ্যের গৌরব বাড়িবে বৈ কমিবে না। বিশেষত বাংলা ভাষা ও অসমিয়া ভাষা উভয়ের মধ্যে বাহিরের সাদৃশ্য এবং অন্তর্নিহিত যোগ অত্যন্ত গভীর এবং দুই ভাষাই এক লিপিতে লিখিত হইয়া থাকে। এক্ষেত্রে এক ভাষাভাষীর পক্ষে অপর ভাষাভাষীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করিবার কোনো কারণ দেখিতে পাই না। বিশ্বসংস্কৃতির ক্ষেত্রে ভারতবর্ষকে মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করিতে বাংলা ভাষার ধারক ও বাহকেরা অগ্রদূতের যে কার্য করিয়া গিয়াছেন, তাহা স্মরণ করিয়া অত্যন্ত কৃতজ্ঞচিত্তে এই ভাষাকে ভারতের সর্বত্র গৌরবের স্থান দেওয়া উচিত। রবীন্দ্রনাথকে রাষ্ট্রীয় কবিরূপে মর্যাদা দেওয়া হইবে, রবীন্দ্রনাথের রচিত সংগীত রাষ্ট্রীয় সংগীতের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হইবে অথচ যে ভাষায় কবি আপনার মর্মবাণী গ্রথিত করিয়াছেন, সেই ভাষা মর্যাদা পাইবে না—এমনতর একটা ঐতিহাসিক ট্র্যাজেডি ঘটিতে দেওয়া উচিত নহে। অত্যন্ত সম্প্রতি কেরল সরকার বাংলা ভাষাকে তাঁহাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে সুপ্রতিষ্ঠিত করিয়াছেন। দূরে থাকিয়া কেরল সরকার যাহা পারিলেন, বাংলার পাশে থাকিয়া এবং বাংলার সহিত দীর্ঘকাল ধরিয়া একাত্ম হইয়া আসাম যদি তাহা না পারে, আমাদের জাতীয় জীবনের পক্ষে তাহা গভীর পরিতাপের বিষয় হইবে।
শ্রী ভট্টাচার্য বলেন:
… আসাম সীমান্তবর্তী রাজ্য। যে সীমান্তে ইহা অবস্থিত, সে-সীমান্ত এখন বাহিরের ও ভিতরের বিরুদ্ধ শক্তির উপদ্রবে নানাদিক দিয়া বিপর্যস্ত। এই সময়ে অন্তত রাজ্যের অভ্যন্তরীণ শান্তি ও সামাজিক সম্প্রীতি বিঘ্নিত না হয়—ইহা সকলেরই বিশেষ কর্তব্য এবং তাঁহাদেরও। আমাদের সৌভাগ্যের কথা এই, আসামের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী বাংলাভাষী কাছাড় হইতে নির্বাচিত এবং কাছাড়ের প্রতিনিধি। তাঁহার নিকট হইতে আমরা আশা করি, সরকারি ভাষা নির্ধারণের সময়ে বাংলা ভাষাও যাহাতে সে-তালিকায় স্থান পায়, সে-ব্যবস্থা তিনি করিবেন। আসামের মুখ্যমন্ত্রী কেবল অসমিয়াভাষী সমাজের মুখপাত্র নহেন, বাংলাভাষী সমাজেরও মুখপাত্র। আসামে ভাষাগত অশান্তি দূর করিবার একমাত্র উপায় বাংলা ভাষাকে স্বীয় মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করা। এই উদ্যোগে অগ্রণী হইতে এবং নেতৃত্ব গ্রহণ করিতে তাঁহার প্রতি অনুরোধ জানাইতেছি।৪৩
সভাপতি চপলাকান্ত ভট্টাচার্যের ভাষণের পর শিলচর পৌরসভার অস্থায়ী চেয়ারম্যান শ্রী আশুতোষ দত্ত অনুষ্ঠানে উপস্থিত সকলকে ধন্যবাদ জানান। এরপর ডি এল রায়ের ‘ধন ধান্যে পুষ্পে ভরা’ গানটি গাওয়ার পর বিকাল পাঁচটায় পরদিন পর্যন্ত অধিবেশন মুলতুবি রাখা হয়।
২ জুলাই ১৯৬০। এদিন সন্ধ্যা সাতটায় শিলচর সংস্কৃতি ভবনে খাসিয়া নেতা শ্রী হুভার হইনি উতা-র (?) সভাপতিত্বে আসামের পার্বত্য অঞ্চলের প্রতিনিধিগণসহ অনসমিয়া ভাষাভাষীদের এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সংস্কৃতি ভবনে তিল ধারণের স্থান ছিল না। ‘বন্দে মাতরম’ সংগীতের পর শিলচর পৌরসভার পক্ষ থেকে সমাগত অতিথিবৃন্দকে স্বাগত জানিয়ে শ্রী আশুতোষ দত্ত শ্রীহুভারকে সভাপতি পদে বৃত করেন। শরৎচন্দ্র নাথের সংক্ষিপ্ত ভাষণের পর বিশ্বনাথ উপাধ্যায় এমএলএ বক্তৃতা করেন। কাছাড়ের কাছাড়ি জাতির প্রতিনিধি অনিল বর্মণ বাংলায় বক্তৃতা কালে বলেন: ‘একসময়ে কাছাড়ি জাতি সমগ্র আসামে রাজত্ব করতেন। কাছাড়ি এবং নাগাগণই আসামের আদিম অধিবাসী। অসমিয়ারা পরে এসেছেন। শ্রী অম্বিকাগিরি রায়চৌধুরী কোন অধিকারে কাছাড়কে আসাম থেকে বের করে দিতে চান? তাঁরাই বের হয়ে যান। যে আগুন আসাম উপত্যকায় প্রজ্জ্বলিত হয়েছে— তার ফল তাঁদেরকেই ভোগ করতে হবে। উত্তর কাছাড়ের লোক বাংলা বলে এবং বাংলা ভাষায় শিক্ষালাভ করে। বাংলা ভাষা না জানা অসমিয়া শিক্ষক উত্তর কাছাড়ের পাঠশালাগুলির জন্য প্রেরণ করার অর্থ কী? রাজ্যভাষা হওয়ার পূর্বেই তাঁরা অসমিয়া ভাষা চাপাতে চাচ্ছেন। মিশনারিদের চেষ্টায়ই পাহাড়িয়াদের ভাষার উন্নতি হচ্ছে, অসমিয়াগণ এ বিষয়ে কোনো সাহায্য করেননি।
কাবুই নাগা প্রতিনিধি আবং কাবুই অসমিয়া ভাষা সারারাজ্যে চালু করার প্রতিবাদ জানান। শিলংয়ের অম্বিকা রায় বলেন, কাছাড়ের কাটলিছড়ার স্কুলসমূহে বাধ্যতামূলকভাবে অসমিয়া ভাষা শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। সকলের সমবেত চেষ্টায় এ সবের প্রতিরোধ করতে হবে।’
খাসিয়া-জয়ন্তিয়া জেলাপরিষদের চিফ এগজিকিউটিভ মেম্বার টি কাজী বলেন, ‘অসমিয়া ভাষা প্রবর্তনের বিরুদ্ধে পার্বত্য অঞ্চলের সকল জাতি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। ২৫ বছর পূর্বে আসামে বাংলা ভাষাই সম্মানের আসনে সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল। অসমিয়া ভাষা বাংলারই অপভ্রংশ। আসাম উপত্যকার লোকের ষড়যন্ত্রের ফলেই শ্রীহট্ট পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এর ফলে খাসিয়া পর্বতের লোকের আর্থিক দুর্গতি বেড়েছে। ১৯৫১ সালে লোকগণনা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। ১৯৩১ সালে যে অসমিয়াগণ সংখ্যালঘু ছিলেন, ১৯৫১ সালে তাঁরাই শতকরা ৫৫ জন হয়ে গেলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাঙালি পুরুষ সিংহ আশুতোষ মুখোপাধ্যায় পার্বত্য অঞ্চলের ভাষাগুলিকে মর্যাদাদান করেছিলেন। কিন্তু গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আজও তাঁদের কোনো স্থান নেই। রবীন্দ্রনাথ-বিপিনচন্দ্র পালের ভাষাকে কেউ দাবিয়ে রাখতে পারবে না। অসমিয়া ভাষায় কলেজের পাঠ্যপুস্তকের উপযোগী বই আজও পাওয়া যায় না।
পূর্ব ভারতের উপজাতীয় ইউনিয়ন-এর সহকারী সম্পাদক এবং মিজো জেলা প্রতিনিধি শ্রীথাংরি ডেমা বলেন, ‘ভাষা সমস্যা সম্পর্কে আমরা আসাম প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির গৃহীত প্রস্তাবের সম্পূর্ণ বিরোধিতা করি। অসমিয়াগণ আমাদের দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করেছেন— এই আহ্বান আমাদের গ্রহণ করতেই হবে। আসামের কোনো কোনো অংশকে তাঁরা আসামের মানচিত্র থেকে অপসারণের কথা তুলেছেন— তাঁরা আসামের বৃহত্তর অংশকেই বাদ দিতে চান।’
কাছাড় পার্বত্য জাতি সমিতির সম্পাদক শ্রীথেংটুয়ামা ‘অসমিয়া ভাষা প্রবর্তনের বিরোধিতা করেন।’ শিলচরের আইনজীবী নুরুল হুসেন মজুমদার বলেন, ‘গত বারো বছরে কাছাড়ের উন্নতি কিছুই করা হয়নি। এখন আবার আমাদের ভাষাকেও লোপ করবার চেষ্টা চলছে।’
কাছাড়ের মণিপুরী প্রতিনিধি শ্রী বি সিং বাংলা ভাষায় তাঁর বক্তব্য পেশ করেন। তিনি বলেন,
‘মণিপুরী সমাজ কোনো অবস্থায়ই অসমিয়া ভাষাকে মেনে নেবে না।’ কাছাড়ের খন্ডজাতিসমূহের প্রতিনিধি শ্রী বি এস বর্মণ বলেন, ‘অসমিয়া ভাষা উন্নত হোক— তখন সকলেই তাকে সম্মান দেখাবে।’ জৈন্তা পাহাড়-প্রতিনিধি শ্রী পর্শনা তাঁর ভাষণে বলেন, ‘মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন সংখ্যালঘু ভাষাভাষীরা চাইলে পরই অসমিয়া ভাষাকে রাজ্যভাষা করা হবে; কিন্তু তিন মাস না যেতেই তিনি মত বদলেছেন। আমরা কোনো অবস্থায়ই অসমিয়া ভাষাকে মেনে নেব না।’
সভাপতি শ্রী হুভার হানিউতা সভায় নিজেই প্রস্তাব উত্থাপন করেন এবং সর্বসম্মতিক্রমে তা গৃহীত হয়। তিনি ‘অসমিয়াকে রাজ্যভাষা করার তীব্র বিরোধিতা এবং বহুভাষাভাষী আসামের বৈচিত্র্যময় তাকে রক্ষা করে বর্তমান অবস্থায়ই চালু রাখার পক্ষে মত প্রকাশ করেন। শ্রী হুভার বলেন, ‘মাতৃভাষা মায়ের মতনই পবিত্র। ভাষার মন্দিরেই মানুষের আত্মার অবস্থিতি। অসমিয়া ভাষা মোটেই উন্নত হয়নি। এই ভাষাকে আমাদের ওপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে এই প্রচেষ্টার বিরোধিতা করব। ভাষার বন্ধন রক্তের বন্ধন অপেক্ষাও অধিক কার্যকর। আমরা অহিংস থেকেই প্রতিবাদ জানাব— কিন্তু সহ্যের একটা সীমা আছে। আমরা কারও দাসত্ব বন্ধনে আবদ্ধ হতে প্রস্তত নই।’৪৪
রাত দশটায় জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মধ্যদিয়ে অনসমিয়া ভাষাভাষী সম্মেলনের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়।
নিখিল আসাম বাংলা ভাষা সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন বা সমাপ্তি দিন ছিল ৩ জুলাই, ১৯৬০, রবিবার। এ দিন বিকাল তিনটায় শিলচরের গান্ধীবাগে নির্মিত বিশাল মঞ্চে সাংসদ চপলাকান্ত ভট্টাচার্যের সভাপতিত্বে সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ দিনও পার্বত্য অঞ্চল, ধুবড়ি, গোয়ালপাড়া, গৌহাটি, যোরহাট, উত্তর আসামের বিভিন্ন এলাকা এবং কাছাড় ও তৎসংলগ্ন এলাকা থেকে প্রায় ২৫ হাজার নর-নারী সভায় উপস্থিত ছিলেন। বর্ষাকাল, প্রবল বৃষ্টিপাতের মধ্যেও হাজার হাজার যুবক-যুবতী, ছাত্র-ছাত্রী ও মহিলা টানা চার ঘণ্টাব্যাপী অনুষ্ঠান নীরবে উপভোগ করেন। অতুলপ্রসাদ সেন-এর ‘মোদের গরব, মোদের আশা, আ মরি বাংল ভাষা’ এবং কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে’ সংগীত দু-টি পরিবেশনের মধ্যদিয়ে অধিবেশন শুরু হয়। এ দিন পূর্বাহ্ণে সংস্কৃতি ভবনে বিষয় নির্বাচনি কমিটি সভায় বিশদ আলোচনার পর যে ন-টি প্রস্তাব প্রণীত হয়— প্রকাশ্য অধিবেশনে সে-সবই সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়।
অধিবেশন উদবোধনের পর সম্মেলনের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক শরৎচন্দ্র নাথ সভায় তাঁর সংক্ষিপ্ত রিপোর্ট উপস্থাপন করেন। শ্রীনাথ তাঁর লিখিত ভাষণে ‘গভীর বেদনা ও ক্ষোভের সঙ্গে উত্তর আসাম ও ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার অনেকস্থানে অনসমিয়া ভাষীদের উপর রাজ্যভাষার দাবির নামে অকথ্য অত্যাচার ও উৎপীড়নের উল্লেখ করেন।’ তিনি বলেন, ‘আমি সাহিত্যসভা ও কোনো কোনো অসমিয়া দৈনিক এবং সাপ্তাহিক পত্রিকা অসমিয়াকে রাজ্যভাষা করার দাবীকে সমর্থন করতে গিয়ে বিভেদের উগ্র বিষ ছড়াতে থাকেন— যা এই রাজ্যের বিভিন্ন ভাষাভাষীর মধ্যে ঐক্য ও সংহতির পরিপন্থী।’
সভায় শিলচর জেলা কংগ্রেস সভাপতি নন্দকিশোর সিংহ কাছাড়ের বিভিন্ন স্থান থেকে যে-সকল পদযাত্রীদল সম্মেলন উপলক্ষে শিলচর এসেছেন— তাঁদের সকলের প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা জানিয়ে নানা কারণে তাঁদের যথাযথ আপ্যায়ন করা সম্ভব হয়নি বলে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। কাছাড়ের বিধান পরিষদ সদস্যগণ জবরদস্তিমূলকভাবে অসমিয়া ভাষা প্রবর্তনের বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত যা করেছেন— তার বর্ণনা দিয়ে শ্রী সিংহ বলেন, ১৯৫৫ সালে ভাষা প্রশ্ন মাথা চাড়া দেয়। কিন্তু পার্বত্য অঞ্চল ও কাছাড়ের ঘোর বিরোধিতায় তা পরিত্যক্ত হয়। কিন্তু গত মার্চ মাসে কংগ্রেস সংস্থা থেকে পুনরায় এ প্রশ্ন তোলা হয়। আমরা আবারও একযোগে বিরোধিতা করি। এর ফলে মুখ্যমন্ত্রী চালিহা প্রথম ঘোষণায় অপেক্ষা করার পক্ষে মত প্রকাশ করলেও অভ্যন্তরীণ ঘটনাপ্রবাহের অল্প কিছুদিনের ব্যবধানে তিনি আসাম রাজ্য পরিষদে ভাষাবিল আনছেন বলে ঘোষণা করেন। আসাম প্রদেশ কংগ্রেস কমিটি সভায় আমরা একযোগে প্রস্তাবের বিরোধিতা করি। কিন্তু ব্যর্থ হয়েছি আমরা। কিন্তু আমরা দমিনি। আমরা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ভাষাবিলের বিরোধিতা করতে বদ্ধপরিকর।
কাছাড়ের জনসভার ইতিহাসে বৃহত্তম জনসমাবেশের আত্মার রূপ উপলব্ধি করে শ্রীসিংহ বলেন, ‘আমি আপনাদের কংগ্রেসের পক্ষে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি যে, কাছাড় তথা আসামের বাঙালিদের মতের মর্যাদা রক্ষায় একযোগে কাজ করে যাব। আজ আমাদের এক কঠোর অগ্নিপরীক্ষার দিন। আমরা এ বিষয়টি কংগ্রেস হাইকম্যাণ্ডের কাছে তুলে ধরব। আমরা প্রতিকার প্রার্থী হব।’ শ্রী সিংহ বলেন, ‘আমি মণিপুরী, কিন্তু নিজেকে বাঙালি বলে মনে করি। মণিপুরীদের সংস্কৃতি বাঙালি সংস্কৃতি থেকে উদ্ভূত। তিনি দৃঢ় কন্ঠে ঘোষণা করেন আমাদের ভাষাগত দাবী একান্ত ন্যায্য এবং এ থেকে আমাদের কেউ বঞ্চিত করতে পারবে না’।
সভাপতির বিশেষ আমন্ত্রণে সভায় সর্বশ্রী দিলীপ চক্রবর্তী, সন্তোষ রায়, সুরেশচন্দ্র দেব, এমপি রণেন্দ্রমোহন দাস, এম এল এ, সতীন্দ্রমোহন দেব, রমণীমোহন বসু, মুনীন্দ্রকুমার দাস প্রমুখ বক্তৃতা করেন। নৃপতিরঞ্জন চৌধুরী পদযাত্রীদলের পক্ষ থেকে অভ্যর্থনা কমিটির সদস্যবৃন্দকে ধন্যবাদ জানিয়ে আবেগময় ভাষায় বর্তমান পদযাত্রার উদ্দেশ্য বর্ণনা করেন।
করিমগঞ্জের বর্ষীয়ান জননায়ক স্বাধীনতা সংগ্রামী শ্রীশচন্দ্র দত্ত রোগশয্যা থেকে সম্মেলনের শুভ কামনা করে যে পত্র প্রেরণ করেন— সভাপতি শ্রী ভট্টাচার্য সেটি পাঠ করেন।
এ দিনের সভায় মোট ন-টি প্রস্তাব গৃহীত হয়। সভার পক্ষ থেকে শ্রী ভট্টাচার্য শোক প্রস্তাব উত্থাপন করলে সমবেত জনতা, প্রতিনিধিমন্ডলী দাঁড়িয়ে উক্ত প্রস্তাব সমর্থন করেন। সৈয়দ ফজল আলি, রেভারেণ্ড নিকলস রায়, ক্ষিতিমোহন সেনশাস্ত্রী, রাজশেখর বসু, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, হেমন্তকুমার দত্ত, ডা. ললিতমোহন বড়ুয়া প্রমুখের মৃত্যুতে শোকপ্রকাশ এবং তাঁদের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করা হয়।
এরপর ‘মূল প্রস্তাবে ভাষা সমস্যা সম্পর্কে, আসামের বিশেষ অবস্থা বিবেচনা এবং এ সম্পর্কে পূর্বে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতির কথা স্মরণ করিয়ে একমাত্র অসমিয়া ভাষাকে রাজ্যভাষা করার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জ্ঞাপন করা হয় ও যেপর্যন্ত সর্ববাদীসম্মত কোনো নীতি গৃহীত না হয়— ততদিন পর্যন্ত বর্তমান অবস্থা চালু রাখার পক্ষে অভিমত প্রকাশ করা হয়। লোকসভা সদস্য শ্রী নিবারণচন্দ্র লস্কর আনীত এই প্রস্তাবকে সমর্থন করে লোকসভা সদস্য শ্রী দ্বারিকানাথ তেওয়ারি বলেন:
এই সঙ্কটকালে আমাদের প্রয়োজন দৃঢ় প্রতিজ্ঞা এবং ঐক্য। আমাদের শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রেখে চলতে হবে। নিজেদের উৎকর্ষ দেখিয়েই জয় লাভ করতে হবে। আমরা সংগ্রামের পথ বেছে নিয়েছি— যতদিন জয় লাভ না হয়, ততদিন ক্ষান্ত হব না। বিপুল হর্ষধ্বনির মধ্যে মূল প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়।
তৃতীয় প্রস্তাব উত্থাপন করেন বিশিষ্ট কংগ্রেস নেতা শ্রীসুরেশ চক্রবর্তী। তিনি বলেন যে, ‘শীতকালীন আসাম বিধানসভা অধিবেশনে ভাষা বিলটি যুক্তভাবে এই জেলার সকল সদস্য বিরোধিতা করে ব্যর্থ হলে মুখ্যমন্ত্রী বিমলাপ্রসাদ চালিহা (কাছাড়ের বদরপুর চক্র থেকে নির্বাচিত), কৃষি ও সরবরাহ মন্ত্রী মঈনুল হক চৌধুরীসহ জেলার সকল সদস্য পদত্যাগ করে পরিষদ গৃহত্যাগ করবেন।
প্রস্তাবের সমর্থনে বিশিষ্ট সাংবাদিক, করিমগঞ্জ ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক, রেলওয়ে বোর্ড প্রতিনিধি শ্রী মোহিতমোহন দাস প্রস্তাবের যৌক্তিকতা বিশ্লেষণ করে বলেন, ‘বাঙালি অঞ্চল থেকে অসহায় চালিহার নির্বাচনের পরিপ্রেক্ষিতে বাঙালি স্বার্থবিরোধী এমন একটা ভাষাবিল রাজ্য পরিষদে উপস্থাপনের পূর্বে নিজ নির্বাচনী এলাকা ও জেলার জনমত যাচাই করা একান্তই কর্তব্য ছিল, শ্রী চালিহার এই উদ্যোগ নির্বাচনী এলাকার প্রতি বিশ্বাসভঙ্গের কাজ হয়েছে। এই আচরণ তাঁর কাছ থেকে প্রত্যাশিত ছিল না’। প্রস্তাবটি সর্ব সম্মতিক্রমে গৃহীত হয়।
চতুর্থ প্রস্তাব উত্থাপন করেন বিধান পরিষদ সদস্য গৌরীশঙ্কর রায়। শ্রী রায় ‘আসাম উপত্যকায় বাঙালি ও অন্যান্য অনসমিয়া ভাষাভাষীর ওপর যে অত্যাচারের তান্ডব চলছে তার তীব্র নিন্দা জানিয়ে হাইকোর্টের একজন বিচারপতিকে দিয়ে ঘটনার তদন্ত, প্রকৃত ঘটনা, ঘটনার কারণ, প্রতিকার ইত্যাদি বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকবে। বাঙালিরা নির্বিঘ্নে নিরুপদ্রবে যাতে বাস করতে পারেন—তার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণে সরকারকে অনুরোধ জানানো হয়। প্রস্তাবের সমর্থনে রথীন্দ্রনাথ সেন বলেন, কাছাড় জেলার কোথাও এপর্যন্ত অসমিয়াদের ওপর কোনোরূপ অন্যায় আচরণ করা হয়নি।
কিন্তু তারপরও এই জেলায় অসমিয়া সরকারি কর্মচারীদের বাসগৃহে পুলিশ পাহারার যে ব্যবস্থা করা হয়েছে—তা কাছাড়ের মানুষকেই অপমানিত করা হচ্ছে। আসাম উপত্যকায় যে অরাজকতা চলছে— তারই মধ্যে অনসমিয়া সরকারি কর্মচারী যাঁরা নিজেদের প্রাণ বিপন্ন করে সরকারের কাজ করে যাচ্ছেন, তাঁদের নিরাপত্তার জন্য সরকার কি পুলিশ পাহারার ব্যবস্থা করেছেন? ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় অরাজকতার ফলে যারা আহত হয়েছেন অথবা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন— তাঁদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ এবং সরকারকে ক্ষতিপূরণদানের যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের উদাত্ত আহ্বান জানান।’৪৫
পঞ্চম প্রস্তাব উত্থাপন করেন শ্রী সুরঞ্জন নন্দী। তিনি তাঁর প্রস্তাবে গৌহাটিতে কলকাতার সংবাদপত্র দহনের তীব্র নিন্দা জানান। যুগশক্তি সম্পাদক শ্রী বিধূভূষণ চৌধুরী প্রস্তাব সমর্থন করে বিরোধী দলীয় নেতা শ্রী হরেশ্বর গোস্বামীর সাম্প্রতিক বিবৃতির তীব্র সমালোচনা করেন। তিনি বলেন যে, আসামের একশ্রেণির লোকের নীচতা সমগ্র আসামের ও অসমিয়াদের মুখে কালিমা লেপন করে দিয়েছে।
ষষ্ঠ প্রস্তাব আনেন রাজ্য পরিষদ সদস্যা শ্রীমতী জ্যোৎস্না চন্দ। তিনি আগামী লোকগণনা যাতে নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হয় তার প্রতি সরকার এবং জনসাধারণের বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণে যে প্রস্তাব আনেন— তা গৃহীত হয়। বিশিষ্ট জাতীয়তাবাদী নেতা, সাংবাদিক মো: হুরমত আলি বড়লস্কর প্রস্তাব সমর্থন করে বলেন, ‘সত্যমেব জয়তে’—এই আদর্শ গভর্নমেন্ট গ্রহণ করেছেন। লোকগণনার কাজেও যাতে সরকারি কর্মচারীদের মনে এই আদর্শ জাগরূক থাকে তার ব্যবস্থা করার জন্য তিনি সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
সপ্তম প্রস্তাবে পরিষদ সদস্য বিশ্বনাথ উপাধ্যায় আসামের ভাষা সম্পর্কে পরামর্শদানের জন্য একটি কমিশন নিয়োগের প্রস্তাব করলে আসাম প্রদেশ কংগ্রেস সদস্য আলতাফ হোসেন মজুমদার সেটির প্রতি সমর্থন জানালে প্রস্তাবটি গৃহীত হয়।
অষ্টম প্রস্তাব উত্থাপন করেন ছাত্রনেতা শ্রী সুকেশচন্দ্র বিশ্বাস। প্রস্তাবে গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় এম এ পঠনপাঠনের জন্য দাবি জানানো হয়। শ্রী সুজিৎ চৌধুরী প্রস্তাবটি সমর্থন জানালে সভায় সেটি গৃহীত হয়।
সর্বশেষ প্রস্তাব উত্থাপন করেন বিশিষ্ট রাজনীতিক শ্রী সতীন্দ্রমোহন দেব এবং সেটি সমর্থন করেন এমএলএ জনাব তজম্মুল আলি বড়লস্কর। ভাষা সম্মেলনে গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহ বাস্তবায়নে আসাম বিধান পরিষদ এবং পার্লামেন্টের বাংলা ও অন্যান্য অনসমিয়া ভাষাভাষী অঞ্চলের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি কো-অর্ডিনেশন কমিটি গঠনের প্রস্তাব করা হয়। এমএলএ শ্রীনন্দকিশোর সিংহকে এই কমিটির কনভেনর মনোনীত করা হয়। সতীন্দ্রমোহন দেব বলেন, স্বাধীনতা লাভের পর শিলচরে এত বড়ো সভা আর হয়নি। সকল দল একমত হয়েই অগ্রসর হয়ে এসেছেন। আমাদের এই ঐক্যকে রক্ষা করেই কাজে অগ্রসর হতে হবে।
সম্মেলনে সমাপনী ভাষণে সভাপতি শ্রী চপলাকান্ত ভট্টাচার্য বলেন, ‘গৃহীত প্রস্তাবগুলি প্রথম পদক্ষেপ মাত্র। শেষ অস্ত্র নিক্ষেপের সময় এখনও আসেনি। গান্ধীজীর নীতির উল্লেখ করে তিনি বলেন, মৃদুভাবেই আরম্ভ করা ভালো। আসামের ভৌগোলিক অবস্থান খুবই বিপজ্জনক, অবশিষ্ট ভারতের সঙ্গে আসামের যোগসূত্র খুবই ক্ষীণ। এই অবস্থায় আসামের বর্তমান ভাষা আন্দোলন থেকে এটাই মনে হয় যে, অসমিয়া বন্ধুগণের দৃষ্টিশক্তিও খুবই ক্ষীণ। সমগ্র অঞ্চলের কল্যাণের কথা চিন্তা করাই আসাম গভর্নমেন্টের বিশেষ দায়িত্ব। অসমিয়াগণ যে অরাজকতার পথ ধরেছেন— তা অধর্মের পথ। অধর্মের পথে সাময়িকভাবে কিছুকালের জন্য জয়লাভ করা যেতে পারে, কিন্তু এর পরিণামে সমূলেই বিনষ্ট হতে হবে। শ্রী বিমলাপ্রসাদ চালিহা যদি এখনও সৎসাহস প্রদর্শন করে অসমিয়া ভাষা প্রবর্তনের এই প্রয়াস থেকে বিরত হন— তাহলে সকল পক্ষেরই মঙ্গল। বাংলা ভাষাকে উচ্ছেদ করবার শক্তি কারো নেই। বাংলা ভাষা সগৌরবেই আসামের ভূমিতে প্রতিষ্ঠিত থাকবে।’৪৬
সম্মেলন সভাপতির পর অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি শ্রী বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায় সম্মেলনকে সফল করে তোলার জন্য যাঁরা অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন— তাঁদের সকলকে ধন্যবাদ জানিয়ে ত্রুটিবিচ্যুতির জন্য তিনি সকলের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করেন। সমাগত অতিথিবৃন্দ ও সভাপতি মহোদয়কে সকলের পক্ষ থেকে অকুন্ঠ ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, ‘বাঙালি এবং অনসমিয়া ভাষাভাষী সকলে স্ব স্ব ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য চরম আত্মত্যাগ করতে প্রস্তুত হয়েছেন— এ কথা সম্মেলনে প্রমাণিত হয়েছে। প্রতিপক্ষের সুমতি প্রার্থনা এবং পুনরায় সকলকে ধন্যবাদ জানিয়ে শ্রী মুখোপাধ্যায় তাঁর বক্তব্য শেষ করেন। জাতীয় সংগীতের পর বিপুল ‘বন্দে মাতরম’ ধ্বনির মধ্য দিয়ে দু-দিনব্যাপী নিখিল আসাম বাংলা ভাষা সম্মেলনের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়।’
সম্মেলন যখন শুরু হয়েছে তখন কিন্তু আসাম উপত্যকায় বঙ্গাল খেদা অভিযান পুরো মাত্রায় চলছে— যার মূল উদ্যোক্তা-প্রবক্তা ছিলেন অসমিয়া সমাজ। এ বিষয়ে বিস্তারিত বিবরণ আমরা পূর্ববর্তী অধ্যায়ে তুলে ধরেছি। বাঙালি জীবনে এক চরম দুঃসময়ে এই সম্মেলন আয়োজন ছিল অত্যন্ত ইতিবাচক পদক্ষেপ। আসামের বাঙালি তথা বাংলাভাষীদের মনে আশার সঞ্চার হয়, তাঁরা প্রাণ ফিরে পান, নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখেন।
জুলাই মাসে পার্বত্য নেতৃবৃন্দের দু-দিনব্যাপী সম্মেলন শিলং-এ মন্ত্রী উইলিয়ামসন সাংমার বাসভবনে অনুষ্ঠিত হয়। কেবল মিকির পাহাড় ব্যতীত সব পার্বত্য জেলা থেকেই পাহাড়ি নেতৃবৃন্দ এই সম্মেলনে যোগদান করেন। সম্মেলনে বিধানসভার আগামী অধিবেশনে অসমিয়া ভাষাকে রাজ্যভাষা করার লক্ষ্যে যে বিল উত্থাপন করা হবে— তার বিরোধিতা করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। অপর আর এক প্রস্তাবে সরকারের ভাষানীতি মাঝে মাঝে পর্যালোচনার জন্য একটি ‘যুক্ত সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করা হয়।৪৭
জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে শিলচরে অনুষ্ঠিত বাংলা ভাষা সম্মেলনে গৃহীত সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে আসামের ভাষা সমস্যা এবং ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় বাঙালি নির্যাতন বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণে কাছাড় নেতৃবৃন্দ— দ্বারিকানাথ তেওয়ারি এমপি, সুরেশচন্দ্র দেব, এম পি, নিবারণচন্দ্র লস্কর, এমপি এবং এমএলএ জ্যোৎস্না চন্দ, নন্দকিশোর সিংহ ও বিশ্বনাথ উপাধ্যায় নয়া দিল্লি সফর করেন। সফরকালে প্রতিনিধিদল রাষ্ট্রপতি ড. রাজেন্দ্রপ্রসাদ, প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গোবিন্দবল্লভ পন্থ ও রেলওয়ে মন্ত্রী জগজীবন রাম-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁদের বক্তব্য পেশ করেন। ‘কেন্দ্রের হস্তক্ষেপ ব্যতীত যে আসামের ভাষা সমস্যার সুমীমাংসা হবে না— সে-বিষয়ে সকল কেন্দ্রীয় নেতৃত্বই এক মত পোষণ করেন।’৪৮
কাছাড় নেতৃবৃন্দ বুকভরা আশা নিয়ে দিল্লি থেকে ১৮ জুলাই শিলচর পৌঁছোলেন। কিন্তু কাছাড় নেতৃবৃন্দের সেই আশা দুরাশায় পরিণত হতে বেশিদিন সময় লাগেনি।
করিমগঞ্জে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে ১১ জুলাই সর্বাত্মক ধর্মঘট পালিত হয়। এ দিন দোকানপাট, স্টেট ট্রান্সপোর্টসহ সব ধরনের যানবাহন, স্কুল-কলেজ, সরকারি-বেসরকারি অফিস, আদালত, সরকারি ট্রেজারি, স্টেট ব্যাঙ্কসহ অন্যান্য ব্যাঙ্ক সম্পূর্ণ বন্ধ ছিল। বিকালে অনুষ্ঠিত এক বিশাল জনসভায় ভাষা প্রশ্নে কেন্দ্রীয় সরকারের হস্তক্ষেপ দাবি করা হয়।৪৯
আগস্ট মাসের তৃতীয় সপ্তাহে শিলচরে আসাম সফররত সংসদীয় প্রতিনিধিদলের সঙ্গে এমএলএ হেমচন্দ্র চক্রবর্তীর নেতৃত্বে করিমগঞ্জ, শিলচর এবং হাইলাকান্দির কংগ্রেস কমিটি সদস্যদের ভাষা বিষয়ে এক ঘণ্টা কাল আলোচনা হয়। কংগ্রেস প্রতিনিধিদল সংসদীয় কমিটিকে হিন্দি, অসমিয়া ও বাংলাকে আসামের সরকারি ভাষা হিসেবে মান্যতা দিয়ে আসামকে একটি বহুভাষী রাজ্য হিসেবে ঘোষণার দাবি জানান। কংগ্রেস প্রতিনিধিদল একথাও বলেন যে, যদি এই মুহূর্তে তা ঘোষণা করা সম্ভব না হয়— তাহলে ‘শান্তি ও স্বাভাবিক অবস্থা পুনপ্রতিষ্ঠা পর্যন্ত সরকারি ঘোষণা স্থগিত রেখে ‘স্থিতাবস্থা’ বজায় রাখার আবেদন জানান।’৫০
এদিকে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির আসাম কাউন্সিলে গৃহীত প্রস্তাবে অসমিয়া ভাষাকেই রাজ্যের সরকারি ভাষা হিসেবে গ্রহণের সুপারিশ করা হয়। ৫ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত সভায় বলা হয়:
যেহেতু অসমিয়া আসাম রাজ্যের অধিকাংশ লোকের ভাষা, সেইজন্য অসমিয়ারই রাজ্যভাষার স্থান অধিকার করা উচিত। সঙ্গে সঙ্গে বাংলা এবং পার্বত্য উপজাতীয়দের নির্বাচিত এক বা একাধিক ভাষাকেও ন্যায়সংগত সরকারি মর্যাদা দিতে হইবে, যাহাতে এইসব সংখ্যালঘু অধিবাসী সাংস্কৃতিক, শাসনগত ও অন্যান্য ক্ষেত্রে সমান সুযোগ ও অধিকার ভোগ করিতে পারে—এইসব ভাষাকে এমন সব সরকারি কাজে ব্যবহার করিতে হইবে।৫১
কমিউনিস্ট পার্টির এই অবস্থান আসাম সরকারের হাতকেই যে শক্ত করবে সে-বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। কমিউনিস্ট পার্টি কোনো পরিসংখ্যান তুলে ধরেননি— তাদের যুক্তির পিছনে। পার্বত্যবাসী, বাঙালি— এঁরা কি অসমিয়া ভাষায় কথা বলেন? বহু ভাষা ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যমন্ডিত আসামে ভাষাগত সংখ্যানুপাত কি অসমিয়া ভাষা একক স্থান লাভের অধিকারী? আমরা তা মনে করি না।
আসাম সরকারের অর্থমন্ত্রী জনাব ফকরুদ্দীন আলি আহমদ ভাষা বিষয়ে আলোচনার জন্য একজন প্রতিনিধি পাঠানোর অনুরোধ জানিয়ে শিলচর বার লাইব্রেরি বরাবর একটি চিঠি পাঠান। এই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে সংগঠনের পক্ষ থেকে পরেশচন্দ্র চৌধুরীকে প্রতিনিধি মনোনীত করা হয়। বার সদস্যগণ ৬ সেপ্টেম্বর এক সভায় মিলিত হয়ে ভাষা বিষয়ে নিম্নলিখিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন:
১. সমতলের কোনো ভাষা পার্বত্য অঞ্চলের মানুষের ইচ্ছার বিরুদ্ধে সরকারি ভাষা হিসেবে তাঁদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। পার্বত্য অঞ্চলের জন্য সরকারি ভাষা কী হবে তা পার্বত্য অঞ্চলের অধিবাসীগণই স্থির করবেন।
২. ভারতীয় সংবিধানে বাংলা এবং অসমিয়া দু-টিই জাতীয় ভাষারূপে স্বীকৃতি লাভ করেছে। পার্বত্য অঞ্চলের অধিবাসীদের অভিমত সাপেক্ষ বাংলা এবং অসমিয়া উভয় ভাষাকেই আসামে সমান মর্যাদা দান করতে হবে।
৩. অন্য ভাষাগুলিকে উপেক্ষা করে কোনো বিশেষ আঞ্চলিক ভাষাকেই সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণা করা যাবে না।
৪. ভাষা সমস্যা সম্পর্কে কোনো সর্ববাদীসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্ভব না হলে স্থিতাবস্থাই বজায় থাকবে।৫২
আসাম প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি সিদ্ধিনাথ শর্মা ২৩ সেপ্টেম্বর শিলং-এ বলেন যে, ‘অসমিয়াকে সরকারি ঘোষণা সংক্রান্ত বিলটি বিধানসভার আগামী অধিবেশন (যা ৬ অক্টোবর আরম্ভ হওয়ার কথা) পরবর্তী সময় পর্যন্ত পিছিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। সরকারি ভাষা সম্পর্কে অন্যান্য ভাষাগত সম্প্রদায় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনার জন্য প্রদেশ কংগ্রেস তিন সদস্যবিশিষ্ট এক কমিটি গঠন করেন। কমিটির সদস্যত্রয় হলেন— মুখ্যমন্ত্রী বিমলাপ্রসাদ চালিহা, অর্থমন্ত্রী ফকরুদ্দীন আলি আহমদ এবং প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি সিদ্ধিনাথ শর্মা। শ্রী শর্মা বলেন, ‘মুখ্যমন্ত্রী যদি অন্যান্য ভাষাগত সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে মতৈক্যে পৌঁছান, তবে বিলটি এই অধিবেশনেই সর্বদলের সম্মতিক্রমে গৃহীত হবে। যদি ঐক্যমতে পৌঁছানো সম্ভব না হয়— তাহলে বিলটি উত্থাপন করে সম্ভবত সিলেক্ট কমিটিতে প্রেরণ করা হবে।’৫৩
সেপ্টেম্বর মাসে কাছাড় কংগ্রেসের পক্ষ থেকে এক তারবার্তায় আসামের সরকারি ভাষা বিষয়ে নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির অভিমত জানার জন্য আবেদন করা হয়। বার্তায় বলা হয়, ‘কমিটির সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিলম্ব হলে বিধানসভায় সরকারি ভাষা সংক্রান্ত বিল উত্থাপন করা যেন স্থগিত রাখা হয়, অথবা যদি উত্থাপন করাও হয়— তা হলে সদস্যদের যেন স্বাধীন মতামত প্রদানের অনুমতি দেওয়া হয়।’৫৪
এ মাসেই যোরহাটে আসাম প্রজা সমাজতন্ত্রী দলের দু-দিনব্যাপী প্রাদেশিক কর্মপরিষদ সভায় ‘অবিলম্বে অসমিয়াকে আসামের সরকারি ভাষারূপে ঘোষণা’-র দাবি জানিয়ে এক প্রস্তাব গৃহীত হয়। দলের চেয়ারম্যান অশোক মেহতা সভায় বলেন যে, ‘আসামের সরকারি ভাষা প্রসঙ্গটি নিয়ে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হওয়ার ফলে যথেষ্ট অসুবিধার সৃষ্টি করেছে। ‘এখন আরও বিলম্ব ঘটলে—তার পরিণতি বিপজ্জনক হবে।’ পি এস পি কর্মপরিষদ সভায় আরও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, ‘বাংলা ভাষাভাষী কাছাড় অধিবাসীরা যদি জেলার প্রশাসনিক কাজের জন্য বাংলাকে অতিরিক্ত ভাষারূপে ব্যবহারের দাবী করেন, তাহলে তাঁদের সেই অধিকার দিতে হবে।’ পার্বত্য জেলা সম্পর্কে পি এস পি-র সিদ্ধান্তে বলা হয়, ‘পার্বত্য এলাকার অধিবাসীদের ওপর সরকারি ভাষা চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। কখন এবং কীভাবে এই সরকারি ভাষা নির্ধারণ করা হবে, তার দায়িত্ব তাঁদের ওপরে থাকবে।’৫৫
পিএসপি-র এই সিদ্ধান্ত চালিহা সরকারের হাতকে আরও শক্তিশালী করবে— সে-বিষয়ে সকলেই সহমত পোষণ করবেন বটে—কিন্তু কাছাড়ের মানুষ এই সিদ্ধান্তে মোটেও অবাক হবেন বলে মনে হয় না।
অসমিয়াকে রাজ্যের একমাত্র সরকারি ভাষা করার প্রতিবাদে করিমগঞ্জে ২৯ সেপ্টেম্বর এক বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন করিমগঞ্জ বার অ্যাসোসিয়েশন সম্পাদক সুরেন্দ্রনাথ চৌধুরী। সংবাদে বলা হয়, ‘কাছাড়ের জনসাধারণ তাঁদের পূর্বদাবী পূর্ববর্তন করে অসমিয়াকেই রাজ্যের সরকারি ভাষা করার পক্ষে মত দিয়েছেন বলে আসামের অর্থ ও স্বরাষ্ট্রসচিব ফকরুদ্দীন আলি আহমদ যে উক্তি করেছেন, সভায় তার সত্যতা অস্বীকার এবং মন্ত্রীর এই উক্তির তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বলা হয় যে, ২ ও ৩ জুলাই শিলচরে অনুষ্ঠিত বঙ্গভাষা সম্মেলনে আসামের সরকারি ভাষা বিষয়ে যে প্রস্তাব গৃহীত হয়, কাছাড়ের জনগণ এখনও পর্যন্ত সেই দাবীতে অবিচল রয়েছেন।’
সভায় আরও বলা হয়, আগামী বিধানসভায় ভাষা বিষয়ক যে বিল উত্থাপন করা হবে বলে ঘোষণা করা হয়েছে, রাজ্য সরকারকে তা মুলতুবি রাখার অনুরোধ এবং কেন্দ্রীয় সরকারকে এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার আবেদন জানানো হয়। সভায় আরও ঘোষণা করা হয় যে, ‘বর্তমান সময়টি ভাষার ব্যাপারে কোনো দুঃসাহসিকতা দেখাবার পক্ষে মোটেও উপযোগী নয়। এই দুঃসাহসের ফলে একদিকে শরণার্থীদের পুনর্বাসন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা যেমন আছে, অন্যদিকে আসামের সংহতি বিনষ্ট হওয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে।’ সভায় ‘বাংলা ভাষাকে অসমিয়ার সমান মর্যাদাদানের দাবি জানিয়ে বলা হয়, এ সব দাবিকে তুচ্ছ করে যদি বিধানসভার আগামী অধিবেশনে ভাষাবিলটি উত্থাপন করা হয়, তাহলে কাছাড় থেকে নির্বাচিত বিধানসভার সকল সদস্য, মুখ্যমন্ত্রী বিমলাপ্রসাদ চালিহা এবং সরবরাহ ও কৃষিমন্ত্রী মঈনুল হক চৌধুরীকে পদত্যাগ করতে হবে।’৫৬
সভায় মুনীন্দ্রকুমার দাস, কুমুদরঞ্জন লুহ, রথীন্দ্রনাথ সেন, ভূপেন্দ্র সিংহ, নৃপতি চৌধুরী প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। এই সভাতেই আসাম উপজাতিদের দাবির প্রতিও পূর্ণ সমর্থন জানানো হয়।
২৯ সেপ্টেম্বর শিলং-এ পার্বত্য উপজাতি নেতৃ সম্মেলনে উপজাতি বিভাগীয় মন্ত্রী ক্যাপ্টেন সাংমা ভাষা বিষয়ে মতভেদের কারণে আসাম মন্ত্রিসভা থেকে একজন মন্ত্রী, একজন উপমন্ত্রী এবং তিনজন পার্লামেন্টারি সেক্রেটারির পদত্যাগের সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করেন। ক্যাপ্টেন সাংমা নেতৃ সম্মেলনে বলেন, ‘সরকারি ভাষার ন্যায় গুরুতর প্রশ্নে যেখানে মতভেদ রয়েছে— সেখানে তাঁর পক্ষে মন্ত্রিত্বে থাকা সম্ভব নয়। তাই তিনি, একজন উপমন্ত্রী এবং তিনজন পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।’৫৭
শিলচরে ১ অক্টোবর ‘শিলচর, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দি কংগ্রেস কমিটির কার্যনির্বাহক সমিতি সদস্য, কাছাড়ের সকল সংসদ সদস্য, নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটি সদস্য, আসাম প্রদেশ কংগ্রেস কমিটি সদস্য এবং অন্যান্য রাজনৈতিক সংস্থাসমূহের প্রতিনিধিগণ এক সভায় মিলিত হয়ে দীর্ঘ আলোচনার পর গৃহীত এক প্রস্তাবে বলা হয়, বহু ভাষাভাষী আসাম রাজ্যে কেবল অসমিয়াকে সরকারি ভাষা হিসেবে গ্রহণের যৌক্তিক কারণ নেই। সভায় সরকারি উদযোগের তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয়।’৫৮
আমরা ইতিমধ্যে জেনেছি যে, আসাম পিএসপি রাজ্যভাষা হিসেবে অসমিয়া ভাষার প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। সম্প্রতি বিধানসভার বিরোধী দলীয় পিএসপি নেতা হরেশ্বর গোস্বামী অসমিয়া ভাষার পক্ষে মত দেন। কিন্তু ওই দলের কাছাড় ইউনিটের সকল সদস্য এ বিষয়ে ভিন্ন মত পোষণ করেন।
৪ অক্টোবর শিলং-এ পিএসপি দলীয় তিনজন প্রভাবশালী সদস্য বিশ্বনাথ উপাধ্যায়, রথীন্দ্রনাথ সেন এবং মোহিত দাস এক বিবৃতিতে জানান, ‘আসামের সরকারি ভাষা সম্পর্কে হরেশ্বর গোস্বামীর মতামত কাছাড়ের সমাজতন্ত্রীদলের কর্মীদের বা নেতৃবৃন্দের মতামতের প্রতিনিধিত্ব করে না। তাঁরা বলেন, ‘আসামের ন্যায় বহুভাষিক রাজ্যে কেবল অসমিয়া ভাষাকে সরকারি ভাষা বলে ঘোষণা করা যায় না। এবং আসাম উপত্যকার নেতৃবৃন্দ এ সম্পর্কে যে পথ অবলম্বন করছেন, তা প্রকৃতপক্ষে আসামের ন্যায় বহুভাষী, বহুজাতি অধ্যুষিত ও বিচিত্র সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যমন্ডিত অনসমিয়াদের ওপর প্রভুত্ব বিস্তারের প্রচেষ্টা মাত্র।’ বিবৃতিতে তাঁরা আরও বলেন যে, ‘গতকাল (৩ অক্টোবর) এখানে আসার পর আমাদের বন্ধুগণ জানান যে, কংগ্রেসের আলাপ-আলোচনাকারী উপসমিতি আসামের সরকারি ভাষা সম্পর্কে আসাম রাজ্যের প্রজাসমাজতন্ত্রীদলের মতামত কি, তা হরেশ্বর গোস্বামীকে জানাতে অনুরোধ করেন। তিনি অসমিয়া ভাষার পক্ষে মত দেন। এ সম্পর্কে আমরা সুনির্দিষ্টভাবে বলতে চাই যে, শ্রী গোস্বামী আর রাজ্য প্রজাসমাজতন্ত্রী দলের চেয়ারম্যান নন। সুতরাং, তিনি আসামের সমগ্র প্রজা সমাজতন্ত্রীদলের মতামতের প্রতিনিধিত্ব করেন— এ আশা করা যেতে পারে না। আমরা জনসাধারণকে আরও জানাতে চাই যে, ‘প্রজা সমাজতন্ত্রী দলের বরপেটা ও যোরহাট প্রস্তাবকে কাছাড় দল সমর্থন করে না—যদিও নিখিল ভারত প্রজা-সমাজতন্ত্রী দলের চেয়ারম্যান অশোক মেহতা যোরহাটে উপস্থিত ছিলেন। আমরা এসব প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছি।’৫৯
আসামের জনমনে বিশেষত বাঙালি অধ্যুষিত এলাকায় পিএসপি সম্পর্কে নানা প্রশ্নের জন্ম দেওয়ায় আমরা বিষয়টির অন্দরের খবর দিতে চেয়েছি। রথীন্দ্রনাথ সেন এবং তাঁর অপর দুই সহকর্মী বাংলা ভাষার পক্ষে সোচ্চার ছিলেন বরাবরই। তার অর্থ বিষয়টি জাতিগত ছিল— এমনটা ভাবা ঠিক হবে না— বরং বাংলা এবং পার্বত্যবাসীদের দাবি যে অনেক বেশি যৌক্তিক, সত্যনিষ্ঠ— তা বলার অপেক্ষা রাখে না। নেতৃত্রয় দলের প্রতি অন্ধ আনুগত্যের চাইতে সত্যকে ধারণ করেই অগ্রসর হতে চেয়েছেন বলে আমাদের মনে হয়েছে।
সরকারি ভাষা বিষয়ে আলোচনার লক্ষ্যে মুখ্যমন্ত্রী বি পি চালিহা আহূত ‘বিভিন্ন রাজনৈতিক ও ভাষাভাষীর ৭৫ জন প্রতিনিধি ৪ অক্টোবর শিলং-এ এক বৈঠকে মিলিত হন। সম্মেলনে দীর্ঘ পাঁচ ঘণ্টাব্যাপী রাজ্য ভাষা বিষয়ে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় কংগ্রেস প্রতিনিধি ছাড়াও প্রজা সমাজতন্ত্রী দল, কমিউনিস্ট পার্টি, বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি, সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ, পার্বত্য নেতৃ সম্মেলন এবং কাছাড় জেলার বাংলা ভাষাভাষী বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রতিনিধি যোগদান করেন। কিন্তু এ দিনের আলোচনা অসমাপ্ত থাকে। বলা হয়, একটি পূর্ণাঙ্গ সম্মেলনে আলোচনা পুনরায় শুরু হবে। এ দিন রাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গোবিন্দবল্লভ পন্থ আসাম পৌঁছোন এবং তিনি ভাষা সমস্যা মীমাংসায় আগামী দু-দিন সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করবেন বলে জানা যায়।’
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পন্ডিত পন্থ ৫ অক্টোবর বিভিন্ন রাজনৈতিক ও ভাষাগত প্রতিনিধিদলের বৈঠকে সরকারি ভাষা সমস্যা সমাধানে সচেষ্ট হওয়ার আহ্বান জানান। মন্ত্রী বলেন, ‘এমনভাবে করিতে হইবে— যাহা ঐক্য ও ভাবগত অখন্ডতা রক্ষার উপযোগী হয়।’ এ দিনের আলোচনা ন-ঘণ্টা ব্যাপী স্থায়ী হলেও কোনো সমাধানসূত্র পাওয়া সম্ভব হয়নি।৬০
কার্যত, তিনদিনব্যাপী নিরন্তর চেষ্টা করেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রীপন্থ আসামের রাজ্যভাষা বিষয়ে কোনো সমাধানসূত্র বের করতে ব্যর্থ হন। তিনি এ দিন অর্থাৎ ৭ অক্টোবর রাতে শেষ মুহূর্তে অসমিয়া এবং ইংরেজিকে আসামে সরকারি ভাষা হিসেবে মেনে নেওয়ার আহ্বান জানান। পরে উপযুক্ত সময়ে ইংরেজির পরিবর্তে হিন্দি স্থানলাভ করবে বলে মন্ত্রী উল্লেখ করেন। কিন্তু সর্বদলীয় নেতৃ সম্মেলন কর্মপরিষদ এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। এ দিন ব্যর্থ মনোরথ গারো পাহাড় জেলা থেকে পূর্ব ভারত খন্ডজাতীয় ইউনিয়ন নির্বাচিত ও খন্ড জাতি বিষয়ক দপ্তর মন্ত্রী ডব্লিউ এ সাংমা পদত্যাগপত্র পেশ করেন। সাংমা বলেন, ‘কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সংগ্রাম পরিষদের সিদ্ধান্ত সংশোধনের আবেদন জানিয়েছেন। … সংগ্রাম পরিষদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে দৃঢ়কন্ঠে জানিয়ে দেন যে, হিন্দীই আসামের একমাত্র সরকারি ভাষা হোক এবং জনগণ উত্তমরূপে হিন্দী শিক্ষালাভ না করা পর্যন্ত ইংরেজি চালু রাখা হোক। তাঁরা দ্বিভাষিক ফর্মূলা মানবেন না। অন্যদিকে কাছাড় জেলার বাংলাভাষী একজন নেতা জানান, তাঁরা এখনও অসমিয়া, বাংলা এবং হিন্দী—এই ত্রিভাষিক প্রস্তাবে অটল রয়েছেন।’৬১
৮ অক্টোবর দিল্লি রওয়ানা হওয়ার পূর্বে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রী পন্থ শিলং-এ উপস্থিত সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘… অসমিয়াকে রাজ্যের সরকারি ভাষারূপে স্বীকৃতির দাবীকে ভিত্তি করেই মূল প্রস্তাবটি রচিত হয়, তবে তাঁর ধারণায় এখন হিন্দীর বদলে ইংরেজিকে স্থান দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। অসমিয়াসহ হিন্দীই হবে আসামের সরকারি ভাষা। তবে, আপাতত হিন্দীর পরিবর্তে ইংরেজিই সরকারি ভাষার স্থান অধিকার করবে এবং পরে হিন্দী আসামের অন্যতম সরকারি ভাষায় পরিণত হবে।
পন্ডিত পন্থ আরও বলেন, যাতে কারও কোনো অসুবিধা না হয়, সেজন্য সরকারি দপ্তরখানায় এবং বিভিন্ন বিভাগীয় প্রধানদের অফিসে বর্তমানের ন্যায় ইংরেজিতেই কাজকর্ম চালু থাকবে। আসাম উপত্যকার জেলাসমূহে অসমিয়া ভাষায়, কাছাড় জেলায় বাংলা ভাষায় এবং পার্বত্য জেলাসমূহে তাঁদের পছন্দমতো ভাষায় কাজকর্ম চলবে। প্রত্যেকেই নিজ নিজ অভিরুচিমতো নিজের নিজের ভাষা নির্বাচন করতে পারবেন। প্রস্তাবে জোরজবরদস্তি করে কিছু চাপিয়ে দেওয়া হয়নি। প্রত্যেকের নিজ নিজ জেলায় নিজ নিজ ভাষা চালু থাকবে এবং প্রত্যেকটি ভাষার উন্নতি ও প্রসারের সুযোগ লাভ করবে। …. ‘হিন্দি ভারতের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গৃহীত হয়েছে। অসমিয়াকেও আপনারা স্বীকার করে নিয়েছেন, উভয় ভাষাকেই আপনারা স্বীকৃতি দিয়েছেন। সুতরাং, এ ব্যাপারে কারও কোনো আপত্তি থাকবে না বলেই আমি মনে করি।’৬২
ইতিপূর্বে খাসিয়া নেতা হুভার হানিউতা এম পি অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে শিলং অপেরা হলে এক বিশাল সভায় বাঙালি ও আদিবাসী উভয় সম্প্রদায়কে একজোট হয়ে অসমিয়া ভাষার একাধিপত্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামের আহ্বান জানান। হুভার বলেন, ‘অসমিয়া ভাষাকে চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে আদিবাসীরা যে কোনো ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত। তিনি বলেন, অনসমিয়া অধিবাসীদের এখন এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় উপস্থিত হয়েছে। অনসমিয়া ভাষাভাষী মানুষের মধ্যে ঐক্যবোধ এখন জাগ্রত করতে হবে।
পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের ওপর উর্দু ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা হলে সেখানকার হিন্দু ও মুসলমানগণ একযোগে তার বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম করেছিলেন— শ্রী হুভার আসামের বাঙালিদের সেই গৌরবোজ্জ্বল দৃষ্টান্ত অনুসরণ করার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, বাঙালি হিন্দু ও মুসলমানের সম্মিলিত সংগ্রামের ফলেই পূর্ব পাকিস্তানে উর্দুর সমর্থকগণ শেষপর্যন্ত নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিল।
খাসিয়া নেতা হুভার বলেন, কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে বাঙালিরা যে নির্দয় ও সহানুভূতিহীন ব্যবহার পেয়েছেন, তাতে তিনি দুঃখিত হয়েছেন। তিনি বলেন, ভারতের স্বাধীনতার জন্য হাজার হাজার বাঙালি প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন এবং বাঙালির আত্মত্যাগের জন্যই দেশের বর্তমান নেতৃবৃন্দ শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে পেরেছেন। বাঙালির রচিত সংগীতই আজ ভারতের জাতীয় সংগীতরূপে সমাদৃত হয়েছে। সুতরাং আজ যখন বাঙালির অস্তিত্বই বিলুপ্ত হতে চলেছে, তখন বাঙালিকে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে নিজ স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করতে হবে এবং ভারতের জনগণকে সঠিকভাবে পরিচালিত করতে হবে।’…
সভায় শ্রীহুভার কাছাড় নেতা রথীন্দ্রনাথ সেনকে পরিচয় করিয়ে দেন। শ্রী সেন বলেন, ‘অসমিয়া ভাষার একাধিপত্য দ্বারা যদি আসামের জনগণ প্রভুত্ব করার চেষ্টা করে— তাহলে বাঙালি এবং আসামের অন্যান্য সংখ্যালঘু দল তার বিরুদ্ধে তীব্র সংগ্রাম করবে। তিনি আসামের বাঙালি যুবকগণকে যেকোনো প্রকার ত্যাগ স্বীকারের জন্য প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানান। সভায় পি এস পি নেতা মোহিতমোহন দাস, হেম দত্ত, রাজকুমার ভট্টাচার্য ও এস বি সেনগুপ্ত বক্তব্য রাখেন।’৬৩
শেষপর্যন্ত সকল আপত্তি ও জল্পনার অবসান ঘটিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বিমলাপ্রসাদ চালিহা বিতর্কিত ভাষা বিলটি ১০ অক্টোবর ১৯৬০ তারিখ সকালে শিলংস্থ আসাম বিধানসভায় পেশ করেন। আটটি ধারা সংবলিত এই বিলে অসমিয়া ও ইংরেজিকে আসামের সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। বিলটি বিধানসভায় উপস্থিতকালে স্পিকার এম এম চৌধুরী বিষয়টি ভোটে দেওয়ার প্রাক্কালে পার্বত্য জেলাসমূহের ১৫ জন সদস্যের মধ্যে ৯ জন সদস্য প্রাক্তন উপজাতীয় বিষয়ক মন্ত্রী ডব্লিউ এ সাংমার নেতৃত্বে সভাকক্ষ ত্যাগ করেন। কাছাড় থেকে নির্বাচিত একমাত্র প্রজা-সমাজতন্ত্রী সদস্য বিশ্বনাথ উপাধ্যায়ও এ সময় সভাকক্ষ ত্যাগ করেন।
পিটিআই পরিবেশিত সংবাদে জানা যায়, পার্বত্য সদস্যদের মধ্যে ‘পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি শ্রী সোই সোই তেরাং, মিকির পাহাড় কংগ্রেস সদস্য শ্রীছত্র সিং তেরন এবং খাসি পাহাড়ের মিল্লিয়েম রাজ্যের শ্রী জোরমানিক সভাকক্ষেই অবস্থান করেন। সভায় অনুপস্থিত ৫ জন সদস্যের মধ্যে চেরাপুঞ্জি থেকে নির্বাচিত কংগ্রেস সদস্য শ্রীমাহম সিং ছিলেন অন্যতম।’
‘কাছাড় জেলার ১০ জন সদস্যের মধ্যে বিল উত্থাপনের সময় মুখ্যমন্ত্রীসহ কেবল কৃষিমন্ত্রী মঈনুল হক চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন। অবশিষ্ট সদস্যগণ তাঁদের নীতি নির্ধারণে আলোচনার উদ্দেশ্যে বিধানসভার হোস্টেলে মিলিত হন। মঈনুল হক চৌধুরী পি টি আই-কে জানান যে, কংগ্রেস সদস্য হিসেবে তিনি কাজ চালিয়ে যেতে চান এবং এ অবস্থায় তিনি কংগ্রেস পার্লামেন্টারি বোর্ড ও কংগ্রেস সভাপতির নির্দেশ মতো কাজ করবেন।’ ‘কাছাড় থেকে নির্বাচিত একমাত্র কমিউনিস্ট সদস্য গোপেশচন্দ্র নমঃশূদ্র সবসময়ই বিধানসভা কক্ষে উপস্থিত ছিলেন।’
‘প্রজাসমাজতন্ত্রী বিরোধী নেতা হরেশ্বর গোস্বামী, কমিউনিস্ট পার্টি নেতা গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য এবং আরসিপিআই সদস্য খগেন বড়ুয়া বিধানসভায় বলেন, বিল উত্থাপনে তাঁরা সম্মত থাকলেও এদ্বারা এরূপ বোঝায় না যে, তাঁরা বিলের মূলনীতি গ্রহণ করছেন। তিন জন সদস্যই বলেন, বস্তুতপক্ষে তাঁরা বিলের বিরোধী। তাঁরা সংখ্যালঘুদের জন্য সর্বাধিক রক্ষাকবচসহ একমাত্র অসমিয়াকেই রাজ্যের সরকারি ভাষা করার পক্ষপাতী।
প্রাক্তন মন্ত্রী সাংমা পূর্বেই বলেন যে, ‘বিলটি উত্থাপনের পক্ষে এটা মোটেই উপযুক্ত সময় নয়, কারণ এর ফলে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পথ সুগম হবে।’
মুখ্যমন্ত্রী চালিহা দুঃখপ্রকাশ করে বলেন যে, বিলটি তিনি পূর্বাহ্নে প্রচার করতে পারেননি। কারণ অধিকাংশ মানুষের গ্রহণীয় একটি ফর্মূলা বের করার জন্য তাঁরা শেষমুহূর্ত পর্যন্ত ঐকান্তিকভাবে চেষ্টা করছিলেন। বিলটি উত্থাপনে কন্ঠভোটে অনুমোদিত হয়।৬৪
বিধানসভায় বিলটি উত্থাপনকালেই রাজনৈতিক দলগুলির অবস্থান স্পষ্ট হয়ে যায়। কমিউনিস্ট পার্টি, পিএসপি, আরসিপিআই একজোট। তাঁরা কেবল অসমিয়াকেই রাজ্যের সরকারি ভাষা হিসেবে চান। পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিভাজন স্পষ্ট। যদিও বেশিরভাগ সদস্যই অসমিয়া ভাষাকে মেনে নেননি। কংগ্রেসে বিভাজন আরও স্পষ্ট। কেবল কাছাড়ের কতিপয় সদস্য সরকারি প্রস্তাবের বিরোধিতা করে পরিষদকক্ষ ত্যাগ করেন। সুতরাং, ভাষা বিষয়ে আইনি ফলাফল কী হতে যাচ্ছে, তা জলের মতো পরিষ্কার।
১০ অক্টোবর বিধানসভা অধিবেশন শুরুর পূর্বেই বহুল বিতর্কিত ভাষা বিল উত্থাপনের প্রতিবাদে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর প্রায় বিশ হাজার নারী-পুরুষ শিলং শহরের রাজপথ প্রকম্পিত করে তোলেন। প্রায় দু-মাইল ব্যাপী মানুষের এই মহামিছিলের নেতৃত্ব দেন পাহাড়ি নেতা, প্রাক্তন মন্ত্রী শ্রীসাংমা। এত বড়ো মিছিল শিলং শহর ইতিপূর্বে আর কখনো প্রত্যক্ষ করেনি। শোভাযাত্রায় কেবল ৮ থেকে ৫০ বছর বয়সি নারীর সংখ্যাই ছিল আট হাজার। তাঁরা নানা স্লোগান সংবলিত বহু প্ল্যাকার্ড বহন করছিলেন। এ সব প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল:
‘আমরা অসমিয়াকে সরকারি ভাষা করার বিরোধী’, ‘আমরা অসমিয়া ভাইদের প্রতি কোনো বিদ্বেষভাব পোষণ করি না।’, ‘আমরা আমাদের অধিকারের জন্য সংগ্রাম করছি’, ‘আমরা শান্তিতে স্বতন্ত্র হতে চাই’, ‘স্বতন্ত্র পার্বত্য রাজ্য দাও, নয়তো বিদায় হও’ প্রভৃতি। সর্বদল পার্বত্য নেতৃ সম্মেলন সংগ্রাম পরিষদ এই শোভাযাত্রার আয়োজন করে। মিছিল ছিল সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ। কিন্তু তারপরও সরকার অধিকতর নিরাপত্তার জন্য পুলিশ ও সেনাবাহিনী মোতায়েন করেছিলেন।’৬৫
১১ অক্টোবর কাছাড় জেলার সাত জন কংগ্রেসদলীয় এমএলএ বিধানসভায় ভাষা বিলের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে স্বাধীনভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ ও মত প্রকাশের অনুমতি প্রার্থনা করে মুখ্যমন্ত্রী বি পি চালিহার নিকট আবেদন জানিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখ্যান করায় বিধায়কগণ পদত্যাগের আবেদন জানান। সাত জন এমএলএ ছিলেন— সর্বশ্রী নন্দকিশোর সিংহ, জ্যোৎস্না চন্দ, রণেন্দ্রমোহন দাস, গৌরীশঙ্কর রায়, রামপ্রসাদ চৌবে, তজাম্মল আলি বড়লস্কর ও হেমচন্দ্র চক্রবর্তী।৬৬
এ দিন শিলচর পৌরসভা ও কাছাড় দাঙ্গাপীড়িত সাহায্য সমিতির সভাপতি সতীন্দ্রমোহন দেব এক বিবৃতিতে জানান যে,
‘আসামের সরকারি ভাষা বিলে কাছাড়ের দাবী পূরণ করা হয়নি। তিনি বলেন, ‘বাংলাকে অন্যতম সরকারি ভাষারূপে ঘোষণা করা উচিত।’ নিখিল আসাম বাংলা ভাষা সম্মেলনের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক শরৎচন্দ্র নাথ ‘বিলটিকে পিছনের দরজা দিয়ে অসমিয়াকে চাপিয়ে দেবার কৌশল বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, বাংলা, খাসিয়া, গারো এবং লুসাই ভাষাকে সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকার করে নেওয়া উচিত।’৬৭
বাংলা ভাষা বিষয়ে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাংলাভাষীরাও চুপ করে বসে থাকেননি। এই উপত্যকায় বসবাসকারী বাঙালি নেতৃত্ব বাংলাকে আসামের অন্যতম সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণার দাবি জানান। রমণীকান্ত বসু (অ্যাডভোকেট, ধুবড়ি), কালীপদ ঘটক (সম্পাদক, হিন্দ মজদুর সভা), বিনয় সরকার (সভাপতি, সংযুক্ত ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস, লামডিং), এস আর দাশগুপ্ত (সভাপতি, মিল মালিক সমিতি, নওগাঁ), সাধন সরকার (সম্পাদক, হোজাই মন্ডল কংগ্রেস কমিটি, নওগাঁ), এম বিশ্বাস এবং পি সি ভট্টাচার্য (সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক, বাংলাভাষী নাগরিক সমিতি, ডিগবয়) প্রমুখ এক যুক্ত বিবৃতিতে বলেন,
‘… অবিলম্বে অসমিয়া ও আদিবাসীদের নির্বাচিত একটি ভাষার সঙ্গে বাংলাকেও ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় অন্যতম সরকারি ভাষার মর্যাদা দিতে হবে। তাঁরা বলেন, ১৯৫৫ সালের রাজ্য পুনর্গঠন কমিশনের নিকট তদানীন্তন মেধী সরকার অত্যন্ত সুস্পষ্ট এক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, আসামের রাজ্যভাষা সম্পর্কে কোনো বিল উত্থাপন করা হবে না। তাঁরা আরও বলেন, কয়েকটি ক্ষেত্রে ভীতি প্রদর্শন করে বা পারিপার্শ্বিক কারণে কয়েকজন বাংলাভাষী ব্যক্তি বাধ্য হয়ে অসমিয়াকে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় একমাত্র সরকারি ভাষা বলে মেনে নিয়েছিলেন। এই স্বীকৃতির কোনো মূল্য নেই।’
রাজ্য সরকারের ইচ্ছা না থাকলেও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পন্থের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাঙালি নেতৃবৃন্দ উপরিউক্ত মর্মে স্মারকলিপি পেশ করেন।৬৮
এদিকে শিলং-এ ১৪ ও ১৫ অক্টোবর অনুষ্ঠিত আসাম প্রদেশ কংগ্রেস কমিটি সভায় ইতিমধ্যে বিধান পরিষদে আনীত ভাষা বিষয়ক বিলটি সংশোধন করা হয়। লক্ষ্মীকান্ত বরা উত্থাপিত সংশোধনীতে বলা হয়, ‘আসামের সর্বপ্রকার সরকারি কাজে অসমিয়া ভাষা ব্যবহার করতে হবে।’৬৯
১৮ অক্টোবর বিধানসভায় পুনরায় আসাম সরকারি ভাষা বিল নিয়ে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় মুখ্যমন্ত্রী শ্রী চালিহা আনীত সরকারি বিলটি ৫৪-১৭ ভোটে আলোচনার জন্য গৃহীত হয়। এ সময় ‘মুখ্যমন্ত্রী শ্রী চালিহা, মইনুল হক চৌধুরী ও আবদুল মতলিব মজুমদার ব্যতীত কাছাড়ের অন্যান্য সদস্য ভোটদানে বিরত থাকেন। বিধানসভায় জ্যোৎস্না চন্দ, নন্দকিশোর সিংহ, হেমচন্দ্র চক্রবর্তী, গৌরীশংকর রায় ও রামপ্রসাদ চৌবে বক্তৃতা করেন। বিধায়কগণ আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে, ‘বিলটি গৃহীত হলে আসামের সংহতি নষ্ট হবে এবং বিভেদমূলক শক্তি বৃদ্ধি পাবে।’ জ্যোৎস্না চন্দ তাঁর ভাষণে বলেন, ‘রাজ্যে পুনর্গঠন কমিশনের কাছে মেধী সরকার আসামকে বহু ভাষাভাষী রাজ্য বলে স্বীকার করেছিলেন। কিন্তু এখন কার্যত তা অস্বীকার করা হচ্ছে।’
হেমচন্দ্র চক্রবর্তী বলেন যে, ‘বিলটি গৃহীত হলে কাছাড় আসাম থেকে বিচ্ছিন্ন হবার চেষ্টা করতে বাধ্য হবে।’
পার্বত্য অঞ্চল প্রতিনিধি ক্যাপ্টেন সাংমা তাঁর ভাষণে বিলটির বিরোধিতা করে বলেন যে:
এই বিল গৃহীত হলে পার্বত্য ও সমতল ভূমির মধ্যে বিচ্ছেদ অনিবার্য হয়ে উঠবে। ভূতপূর্ব পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি থাংলুরা বলেন যে, আসামের সংহতি ধ্বংসকারীদের ইচ্ছা-ই এই বিলে রূপায়িত হয়েছে।৭০
মুখ্যমন্ত্রী বিলটির প্রথম দফা আলোচনার উত্তরদানের পর এবং অধ্যক্ষ প্রস্তাবটি ভোটে দেওয়ার পূর্বেই কাছাড় থেকে নির্বাচিত কংগ্রেস সদস্যা জ্যোৎস্না চন্দ সভাকক্ষ ত্যাগ করেন। অধ্যক্ষ প্রস্তাব সম্পর্কে ভোট গ্রহণের নির্দেশদানের প্রাক্কালে উপজাতি দপ্তরের প্রাক্তন মন্ত্রী ডব্লিউ এ সাংমা অধ্যক্ষকে জানান যে, তিনি ও পার্বত্য জেলা থেকে নির্বাচিত তাঁর সহকর্মীগণ ভোটদানে অংশগ্রহণ করতে চান না। এরপরই তিনি সভাকক্ষ ত্যাগ করেন এবং তার পর পরই অন্যরাও তাঁকে অনুসরণ করেন। ভোট গ্রহণের সময় পার্বত্য জেলা থেকে নির্বাচিত কংগ্রেস সদস্যগণ উপস্থিত ছিলেন। বিরোধীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে অধ্যক্ষ ভোটের ফলাফল প্রকাশ করে বলেন যে, আগামী ২৪ অক্টোবর বিল সম্পর্কে দফাওয়ারি আলোচনা শুরু হবে।৭১
১৪ অক্টোবর করিমগঞ্জে সর্বদল ও সর্বধর্মের মানুষ বিধানসভায় বিতর্কিত ভাষা বিল উত্থাপনের প্রতিবাদে এক বিশাল শোভাযাত্রা ও জনসমাবেশের মধ্য দিয়ে ‘প্রতিবাদ দিবস’ পালন করেন। এ দিন শহরে এবং বাজারের প্রতিটি দোকান ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বন্ধ থাকে। রিকশাচালকরাও পূর্ণ ধর্মঘট পালন করেন। অসমিয়া ভাষার প্রতি নির্লজ্জ পক্ষপাতমূলক সরকারি ভাষা বিলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাবার এবং বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাজ্যভাষারূপে স্বীকৃতিদানের দাবিতে বেলা সাড়ে তিনটায় পাঁচ সহস্রাধিক ছাত্র-যুবক এবং সর্বস্তরের সাধারণ নাগরিক প্রতিবাদে শোভাযাত্রায় যোগদান করেন। শহরের সর্বদলীয় বিশিষ্ট হিন্দু-মুসলমান-খ্রিস্টান, হিন্দুস্থানি ও মণিপুরি নাগরিকবৃন্দ এবং বহু বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ওই শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করেন।
‘বাংলা ভাষাকে রাজ্যভাষা করো’, ‘আসামকে বহুভাষাভাষী রাজ্য ঘোষণা করো’, ‘কাছাড়ের এম এল এ, এম পি-রা পদত্যাগ করুন,’ ‘কাছাড়ের প্রতিনিধি মুখ্যমন্ত্রী শ্রীবিমলাপ্রসাদ চালিহার পদত্যাগ চাই’, ‘মন্ত্রী মইনুল হক চৌধুরী পদত্যাগ করুন’ প্রভৃতি ধ্বনি সহকারে শোভাযাত্রীগণ শহরের বিভিন্ন রাস্তা পরিভ্রমণ করেন। …
বিকাল সাড়ে পাঁচটায় কংগ্রেস অফিসের সম্মুখস্থ প্রাঙ্গণে যুগশক্তি সম্পাদক শ্রীবিধুভূষণ চৌধুরীর সভাপতিত্বে এক বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় নাগরিক সমিতির সম্পাদক শ্রীনলিনীকান্ত দাস, বার অ্যাসোসিয়েশন সেক্রেটারি শ্রীসুরেন্দ্রনাথ চৌধুরী, (অ্যাডভোকেট), ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক শ্রীমোহিতমোহন দাস, জেলা কংগ্রেস সম্পাদক শ্রীমন্মথনাথ দত্ত, জেলা পিএসপি সম্পাদক শ্রীকুমুদরঞ্জন লুহ, জনসংঘ সম্পাদক শ্রীননীগোপাল বণিক, সুরমা উপত্যকা চা-শ্রমিক ইউনিয়ন সাধারণ সম্পাদক শ্রীব্যোমকেশ দাস, স্কুল বোর্ড চেয়ারম্যান শ্রীঅরবিন্দ চৌধুরী (কংগ্রেস), বিশিষ্ট কংগ্রেস নেতা শ্রীহরিপদ দত্ত, মণিপুরি যুবনেতা শ্রীভূপেন্দ্র সিংহ, ছাত্রনেতা ও কমিউনিস্টকর্মী শ্রীনিশীথরঞ্জন দাস, ছাত্র ও যুবনেতা শ্রীবিজিৎ চৌধুরী এবং যুব কংগ্রেস সম্পাদক শ্রীনৃপতি চৌধুরী সভায় বক্তৃতা করেন।৭২
সভায় আসাম বিধানসভায় উপস্থাপিত বিলের তীব্র প্রতিবাদ, বাংলাকে রাজ্যের অন্যতম সরকারি ভাষা করা, কাছাড়ের বিধানসভা, লোকসভা ও রাজ্যসভার সদস্যদের পদত্যাগ, গত জুলাই মাসে শিলচরে অনুষ্ঠিত বাংলা ভাষা সম্মেলনে গৃহীত সিদ্ধান্তের প্রতি পুনর্সমর্থন এবং পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর দাবির প্রতি সমর্থনসূচক প্রস্তাব গৃহীত হয়।
আসাম বিধানসভায় পেশকৃত ভাষা বিলের প্রতিবাদে হাইলাকান্দির মানুষও ২২ অক্টোবর এক গণজমায়েতে মিলিত হন। এদিন কালীবাড়ি বারোয়ারি পূজা ময়দানে আয়োজিত সভায় মাড়োয়ারি, হিন্দুস্থানি ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের বহু মানুষ যোগদান করেন। হরিশচন্দ্র চক্রবর্তীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় অন্যান্যের মধ্যে হাইলাকান্দি জেলা কংগ্রেস সভাপতি সন্তোষকুমার রায়, কাছাড় উদবাস্ত সমিতির সভাপতি অমিয়কুমার নন্দী, আবদুর রহমান চৌধুরী (অ্যাডভোকেট), মহম্মদ আলি, হরিদাস দেব, ভক্তিধর চৌধুরী এবং মহিমচন্দ্র দাস ভাষা বিলের বিরুদ্ধে সকলকে সোচ্চার এবং সংঘবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেন। তাঁরা জনগণকে সকল প্রকার ত্যাগের আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘আসাম সরকারের দুরভিসন্ধিমূলক প্রচেষ্টা রোধ করতে এবং বাংলা ভাষাকে আসামের অন্যতম সরকারি ভাষারূপে গণ্য করতে আসাম সরকারকে বাধ্য করতে বদ্ধপরিকর হতে হবে।’৭৩
এদিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ২১ অক্টোবর নয়াদিল্লিতে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন যে, ‘অসমিয়া ভাষা সম্পর্কে কেন্দ্রীয় সরকারের অভিমত এই যে, এই ভাষাকে উৎসাহ দেওয়া উচিত, তবে অনসমিয়া জনগণের ওপর তা বাধ্যতামূলকভাবে চাপিয়ে দেওয়া চলবে না। নেহরু বলেন,
আপাতত আসাম ভাষা বিলের আলোচনা সংগত নয়— কেন্দ্রীয় সরকারের এই সনির্বন্ধ পরামর্শ আসাম সরকার উপেক্ষা করেছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন যে, ভাষা নিয়ে যে বিরোধ দেখা দিয়েছে, তা খুবই দুর্ভাগ্যের বিষয়। আসামে ভাষার প্রশ্নে এত সংকীর্ণ দৃষ্টির পরিচয় দেওয়া হয়েছে এবং অপর জনগণের মনোভাব এত বেশি উপেক্ষিত হয়েছে যে, আমি বাস্তবিকই অত্যন্ত বেদনাবোধ করছি। জনসাধারণের একটি বা একাধিক ভাষায় উৎসাহদান এবং একের ভাষা অপরের ওপর চাপিয়ে না দেওয়া— এটাই আমাদের নীতির মূলকথা।
নেহরু আরও বলেন, অসমিয়াকে উৎসাহ দেওয়া উচিত এবং দেওয়া হবে। কিন্তু উৎসাহ দেওয়ার অর্থ এই নয় যে, অনসমিয়াদের ওপর এই ভাষা চাপিয়ে দিতে হবে। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের দায়িত্ব প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘স্বভাবতই আসামে আমাদের কিছু কিছু দায়িত্ব আছে এবং আমরা যেমন উচিত মনে করব, সেভাবেই আমাদের দায়িত্ব পালন করব।’’৭৪
কেন্দ্রীয় সরকার কী দায়িত্ব পালন করবেন, কখন করবেন—তা আমাদের জানা নেই। তবে মুখ্যমন্ত্রী শ্রীচালিহা যে দায়িত্ব পালন করেছেন, তা আমরা জেনেছি। কেন্দ্রীয় কংগ্রেস পার্লামেন্টারি বোর্ড মুখ্যমন্ত্রীকে অনুরোধ করেছিলেন যে, ‘আসামের সরকারি ভাষা বিলটি যেন সিলেক্ট কমিটিতে পাঠিয়ে দেওয়া হয় অথবা আগামী ৩০ অক্টোবর রায়পুরে নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির অধিবেশনে মুখ্যমন্ত্রী ও প্রাদেশিক কংগ্রেস সভাপতি সিদ্ধিনাথ শর্মার সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা না হওয়া পর্যন্ত যেন বিলটি স্থগিত রাখা হয়। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী তাঁর অক্ষমতার কথা পার্লামেন্টারি বোর্ডকে জানিয়ে দিলেন। তিনি লিখলেন, ‘বিলটির প্রথম দফা আলোচনা ইতিমধ্যে সমাপ্ত হয়েছে। এখন পুনরায় তা শুরু করা অথবা সিলেক্ট কমিটিতে পাঠানো সম্ভব নয়। ২৪ অক্টোবর বিলটি সম্পর্কে আরও বিবেচনা করা হবে বলে স্থির হয়েছে। বর্তমানে বিলটি স্থগিত রাখা সুবিবেচনার কাজ হবে না।’৭৫
অনড় মুখ্যমন্ত্রী ভারতের প্রধানমন্ত্রী, কেন্দ্রীয় কংগ্রেস পার্লামেন্টারি বোর্ড, সর্বোপরি জনমত— কোনো কিছুরই তোয়াক্কা করলেন না। গান্ধী অনুরাগী তথা ভালোমানুষ (! ) বলে খ্যাত এই রাজনীতিক দ্বিধাহীন চিত্তে, নির্ভাবনায় ভাষা বিল নিয়ে এগিয়ে গেলেন।
আসামের বাঙালি তথা পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর জন্য ২৪ অক্টোবর ছিল কালো দিন। এ দিনেই তাঁদের সকল যুক্তি, প্রতিবাদকে অগ্রাহ্য করে আসাম বিধানসভায় চালিহা সরকার একমাত্র অসমিয়াকে রাজ্যের সরকারি ভাষা হিসেবে অনুমোদন করিয়ে নিলেন। ভাষা বিল অনুমোদন লাভ করে ৫৬-০ ভোটে, একতরফাভাবে।
‘…. ভাষা বিল সম্পর্কে আলোচনা শুরু হলে বাংলাভাষী কাছাড় জেলার কংগ্রেসি সদস্যগণ এবং সংগ্রাম পরিষদের প্রতি অনুগত পার্বত্য জেলার সদস্যগণ বিধানসভা ত্যাগ করেন। তাঁরা বলেন যে:
নীতিগতভাবে তাঁরা ওই বিলের বিরোধী, সুতরাং আলোচনায় অংশ নেবেন না। কৃষিমন্ত্রী মইনুল হক চৌধুরী প্রশ্নোত্তরের সময় বিধানসভা কক্ষে উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু ভাষা বিলের আলোচনা আরম্ভ হওয়ার পূর্বে তিনিও সভাকক্ষ ত্যাগ করেন।
পার্বত্য জেলাগুলির তিন জন কংগ্রেস দলীয় সদস্যের মধ্যে ছত্র সিং টেরন ও পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি সোই সোই টেরন বিধানসভায় উপস্থিত ছিলেন। তবে তৃতীয় সদস্য মাহম সিং-কে বিধানসভা ভবনে দেখা গেলেও সভাকক্ষে ছিলেন না। কাছাড় সদস্যদের মধ্যে কংগ্রেস দলীয় আবদুল মতলিব মজুমদার, মুখ্যমন্ত্রী বি পি চালিহা ও প্রজা সোশালিস্ট পার্টি সদস্য বিশ্বনাথ উপাধ্যায় সভায় উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু পরে কমিউনিস্ট সদস্য গোপেশচন্দ্র নমঃশূদ্র সভাকক্ষ ত্যাগ করেন। পি এস পি সদস্য বিশ্বনাথ উপাধ্যায় তাঁর একটি সংশোধনী প্রস্তাব বাতিল হওয়ায় তিনিও সভাকক্ষ ত্যাগ করেন।
এদিন অধিবেশনের মেয়াদ ছ-ঘণ্টা বৃদ্ধি করা হয়। সারাদিন এবং রাত প্রায় দশটা পর্যন্ত ভাষা-বিতর্ক অব্যাহত ছিল। অবশেষে রাত দশটার কিছু পূর্বে বিতর্কিত ‘আসাম সরকারি ভাষা বিল ১৯৬০’ গৃহীত হয়।’৭৬
আমরা জানি, পার্বত্য জেলাগুলির সদস্য ডব্লিউ এ সাংমার নেতৃত্বে এবং কাছাড় কংগ্রেস সদস্যগণ রণেন্দ্রমোহন দাস ও তজম্মুল আলি বড়লস্করের নেতৃত্বে বিধানসভা কক্ষ ত্যাগ করেন। তাঁরা এই মর্মে বিবৃতি দেন যে, এই বিলের ফলে রাজ্যের সংহতি নষ্ট হবে বলে মনে করায় তাঁরা এর পক্ষভুক্ত হতে পারেন না। বিলটির দফাওয়ারি আলোচনা আরম্ভ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা সভাকক্ষ ত্যাগ করেন।
এ দিনের বিধানসভায় রণেন্দ্রমোহন দাস-এর ভাষণ ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, ইতিহাস সৃষ্টিকারী এক দলিল। আমরা তাঁর ভাষণের কিছু অংশ এখানে তুলে ধরব। শ্রীদাস জানালেন:
… Sir, Assam is a multilingual State. There are three linguistic groups. One group is Assamese speaking, the second group is Bengali speaking and the third group consists of Tribal people. There are many languages amongst the Tribal People and English is their medium of expression. The Hill people therefore demanded Hindi as their State Language.
Accordingly, we also demanded that there should be three state languages viz. Assamese, Bengali and Hindi in order to satisfy all groups. …
Sir, if the census figure of 1951 are found incorrect and disputed where from should we get the figures about the different linguistic groups in the State? …..In a meeting at Nalbari Shri Motiram Bora, the then Finance Minister of Assam, said in April, 28, 1953- ‘Out of 96 Lakhs of Assam’s population only 30 Lakhs were pure Assamese’— it was reported in the Assam Tribune of 5th May, 1953. Further, I beg to state that Shri Bishnuram Medhi, the then Chief Minister of Assam, spoke about the subject at Silchar in April, 1955, he said that various minority communities in Assam constitute 66% of the population. The statements was published in the Statesman of the 15th April, 1955. In absence of any contradiction from any quarter, we can safely accept this figures as authentic Government figures, that Assamese speaking people constitute roughly only one-third of the total population of the State.
Now, Sir, is it fair and wise to impose the language of the one-third upon the rest of the population against their wishes? In the above context I am firmly of opinion that the Bengali speaking population in the State including up-to-date influx of refugees would not be less than 30 lakhs or so.
Considering all these factors the-then Chief Minister, Shri BishnuRam Medhi, who wanted that integrity of the State should not be disturbed like a wise statement made it clear to the members of the State Re-organisation Commission in 1955, that Government had no intension to bring forward any legislation to make Assamese the State language. He further stated that the problem of language would only be settled with the concurrence of minorities. This fact was brought to our notice by Dr. Kunjru and Mr. Pannikar, two members of the S.R.C. in their speaches delivered in the Rajya Sabha on 7th September 1960.
The Jain Commission … Stated that ‘Assam is a polyglot State where virtue of a linguistic formula will depend more upon its acceptibility by the linguistic groups then on any other consideration, and our affort should be directed to that end.’
If we analyse the language resolution adopted in the meeting of the working Committee of the A I C C held on 29th July, 1960, we would find very clearly that Assamese language has to be encouraged and progressively used by the people whose mother tongue it is. So, even in the Brahmaputra Valley, People having different mother tongues, should not be disturbed by imposition of assamese language upon them. They further stated that many areas of India are Bilingual or multilingual and each of the languages in use has to be protected and encouraged. The question of language in Assam is one that should be settled co-operatively by representatives of various parts of Assam State.
Sir, here, I would be failing if I do not mention about the statement of our Chief Minister, Shri Chaliha, made in this House on the 3rd March, 1960. The most important of the statement runs like this—‘Government would prefer to wait till they get the same demand; from the non-Assamese speaking population for declaration of Assamese as State Language. Government feel that this question should be judged more from the view of appreciation and acceptance than from the point of view of majority or minority the Government is afraid, that its object would be defeated’.
It is most unfortunate for us that the same Chief Minister within a very short time changed his entire policy and issued another statement on the 23rd June, 1960 declaring that Government have now decided to introduce a Bill on official Language for the State more or less on the basis of the recommendation of the resolution of the Assam Pradesh Congress Committee with Assamese as the sole official language of the State. … I want to know from the Chief Minister in clear terms, if he has changed his earlier policy under pressure, or he has changed his own conviction about the language policy of the State? As a true follower of Mahatma Gandhi, was it not his duty to stand alone with the Principle and policy which he considered to be right, just and honest even when the whole country goes against him? …
… Acharyya kripalani, then Congress president, has rightly said that Assamese are living on a volcano, they must settle the quarrels with the Bengalees and the Hill people. If they do not do it, they will suffer, the province will suffer and India will suffer. …
I would therefore, with utmost humility request you to give up this short sighted and parochial policy, and look to the path showed not only by the eminent persons of the country but also by the Govt. of India and Congress High Command— the path of emotional integration and cultivation of feelings of mutual respect and tolerance for the language and culture of others and this is the only way to save Assam and its people in this critical period of History.৭৭
আসাম বিধানসভায় সরকারি ভাষা বিল অনুমোদিত হলেও মানুষের প্রতিবাদ থেমে যায়নি। বিল অনুমোদনের দিনেই পাহাড়ি জনগোষ্ঠী তথা কাছাড়ের বাংলাভাষীরা প্রতিবাদে পথে নামেন। ২৪ অক্টোবর রাজধানী শিলং-এর নগরজীবন সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে। সংবাদপত্রে বলা হল:
ভাষা বিলের প্রতিবাদে আজ সর্বাত্মক হরতালের ফলে শিলংয়ের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা একেবারে বিপর্যস্ত হইয়া পড়ে। পঁচিশ হাজার লোকের এক বিরাট শোভাযাত্রা শহরের বিভিন্ন পথ পরিভ্রমণ করে। শোভাযাত্রীদের মধ্যে ফেস্টুন ও ব্যানার হাতে বহু নারীও ছিল। ব্যানারগুলিতে লেখা ছিল: ‘আমরা পৃথক হইতে চাই’, ‘ভালোয় ভালোয় আমাদের ছাড়াছাড়ি হউক’। ‘পৃথক পার্বত্য রাজ্যের দাবী না মানা পর্যন্ত পার্বত্য জনগণ শান্ত হইবে না’, ‘অসমিয়া চাই না’ ইত্যাদি। শোভাযাত্রা নংথাইমাই ময়দানে গিয়া শেষ হয়। শোভাযাত্রার শেষে খাসি নেতা টি কাজীর নেতৃত্বে এক বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। শিলংয়ের ইতিহাসে এতবড়ো শোভাযাত্রা কেবল অভূতপূর্বই নয়, আমাদের পার্বত্য জেলাসমূহে, এমনকী সমতল অঞ্চলেও সম্ভবত এমন গণবিক্ষোভ ইতিপূর্বে আর দেখা যায় নাই।
আজিকার হরতালের ফলে সমস্ত হাটবাজার, ব্যাবসাবাণিজ্য, সরকারি-বেসরকারি অফিস একেবারে বন্ধ থাকে। পথে যানবাহন আদৌ চোখে পড়ে নাই। বিভিন্ন রাস্তার মোড়ে বালক-বালিকারা দলবদ্ধভাবে অফিসযাত্রীদের কাজে যাইতে বাধা দেয়। মিজো ও গারো পাহাড়ের বিভিন্ন স্থানেও আজ (২৪ অক্টোবর) হরতাল পালন করা হয়।৭৮
ভাষা বিলের প্রতিবাদে কাছাড় জেলার শিলচর, করিমগঞ্জ এবং হাইলাকান্দিতেও ২৪ অক্টোবর হরতাল পালিত হয়। হরতাল পালিত হয়— শ্রীগৌরী, ভাঙাবাজার, মুর্জাতকান্দি, রামকৃষ্ণনগর, দুর্লভছড়া এবং বারৈ গ্রামে। পূজার ছুটির পর এ দিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি খুললেও ছাত্ররা ক্লাসে যোগদান করেনি। দোকানপাট, যানবাহন চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ থাকে। এ দিন বিকালে করিমগঞ্জ, পাথারকান্দি এবং বদরপুরে জনসভা অনুষ্ঠিত হয়।
করিমগঞ্জে ২৪ অক্টোবর অনুষ্ঠিত জনসভা বিষয়ে সংবাদপত্র জানাল:
‘আসাম রাজ্যভাষা বিলে বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাজ্যভাষা হিসেবে স্বীকার না করায় এখানে এক বিরাট জনসভায় তার প্রতিবাদ জানিয়ে সংবাদপত্র সম্পাদক বিধুভূষণ চৌধুরী, কুমুদরঞ্জন লুহ, মন্মথ দত্ত, নলিনীকান্ত দাস, মনীন্দ্রকুমার দাস, ননীগোপাল স্বামী, ভূপেন্দ্র সিং প্রমুখ বক্তৃতা করেন। বক্তাগণের প্রায় সকলেই বাংলা ভাষার সম্মান রক্ষার্থে পূর্ববাংলার যুব সম্প্রদায়ের দুঃখ এবং ত্যাগের কথা উল্লেখ করে কাছাড়ের বাঙালি তরুণদের সেই মহান আদর্শ অনুসরণ করার অনুরোধ জানান। কোনো কোনো বক্তা সভায় বাংলা ভাষার জন্য গণ-আন্দোলনের ডাক দেন। আসাম প্রদেশ কংগ্রেসকমিটি সদস্য ও করিমগঞ্জ রাজ্য কংগ্রেস কমিটির ভূতপূর্ব সভাপতি মনীন্দ্রকুমার দাস কাছাড় এবং অন্যান্য অনসমিয়া ভাষাভাষী অঞ্চলের জন্য একটি পৃথক আঞ্চলিক কংগ্রেস গঠনের প্রস্তাব করেন। আসামের প্রাক্তন মন্ত্রী খান বাহাদুর হাজী মাহমুদ আলি সভায় সভাপতিত্ব করেন। সভাপতির ভাষণে তিনি সকলকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির জন্য সংগ্রামের আহ্বান জানান।’৭৯
ভাষা বিলের প্রতিবাদে ২৪ অক্টোবর হাফলংয়েও হরতাল পালিত হয়। ‘উত্তর কাছাড় পার্বত্য মহকুমার সকল রাজনৈতিক দলের আহ্বানে অসমিয়াকে একমাত্র সরকারি ভাষা ঘোষণা করে যে বিল গৃহীত হয়েছে, তার প্রতিবাদে এখানে আজ সকাল থেকে বেলা দুটো পর্যন্ত পূর্ণ হরতাল পালন করা হয়। হরতালের ফলে শহরের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা অচল হয়ে পড়ে। মহকুমার বিভিন্ন উপজাতি ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের এক বিশাল শোভাযাত্রা শহরের প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে এবং পরে টাউন ফাণ্ড ফিল্ডে সংসদ সদস্য জে বি হাগজের সভাপতিত্বে এক বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। বক্তাগণ বিলের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জ্ঞাপন করে সেটি প্রত্যাহারের অনুরোধ জানান। এই মর্মে একটি সিদ্ধান্তও গৃহীত হয় এবং সিদ্ধান্তের অনুলিপি প্রধানমন্ত্রী শ্রী নেহরু এবং মুখ্যমন্ত্রী চালিহার নিকট প্রেরিত হয়।’৮০
নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির রায়পুর অধিবেশন শেষে আসাম ফেরার পথে ১ নভেম্বর কলকাতায় সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে মুখ্যমন্ত্রী বি পি চালিহা বলেন, ‘আসাম বিধানসভায় গৃহীত আসামের সরকারি ভাষাবিলের কোনো পরিবর্তন বা সংশোধনের আশু সম্ভাবনা নেই। শ্রীচালিহা আরও বলেন, ভাষার প্রশ্নে আসামের বিভিন্ন শ্রেণির লোকের মধ্যে মতানৈক্য দেখা দিয়েছে এবং বিচ্ছিন্নতার আশঙ্কা তাঁদের কাছে আজ আশু সমস্যারূপে দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে পার্বত্য রাজ্যগঠনের দাবীই সর্বাধিক গুরুত্বলাভ করেছে। তিনি বলেন, রায়পুর অধিবেশনে প্রকাশ্যভাবে আসামের ভাষাবিল নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি, তবে ঘরোয়াভাবে আলোচনা হয়েছে।’৮১
অন্যদিকে আসামের খাদ্য ও কৃষিমন্ত্রী মইনুল হক চৌধুরী রায়পুর অধিবেশন শেষে শিলং ফেরার পথে ২ নভেম্বর কলকাতা দমদম বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের জানালেন, ‘কাছাড়ের জনগণের দাবীর প্রতি কংগ্রেসের ঊর্ধ্বতন কতৃপক্ষ অত্যন্ত সহানুভূতিশীল। তিনি প্রতিশ্রুতি দেন যে, বাংলা ভাষার দাবী আদায়ের সংগ্রামে কখনোই তাঁর এলাকার জনগণের কাছ থেকে সরে আসবেন না।’৮২
কিন্তু আমরা জানি, তিনি তাঁর কথা রাখেননি, বরং বাংলা ভাষা ও বাঙালি জাতির সঙ্গে নোংরা রাজনীতির খেলা খেলেছেন।
‘নবগঠিত ‘কাছাড় সংগ্রাম পরিষদ’-এর উদ্যোগে করিমগঞ্জের প্রবীণ জননায়ক ও চা-বাগান মালিক শ্রীইন্দ্রকুমার দত্ত-এর সভাপতিত্বে ২ নভেম্বর অপরাহ্ণে স্থানীয় টাউন ব্যাঙ্ক প্রাঙ্গণে অসমিয়াকে একমাত্র রাজ্যভাষা করে আসাম বিধানসভায় সরকারি ভাষা বিল গৃহীত হওয়ায় যে গুরুতর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, তার পর্যালোচনা ও সাধারণের কর্তব্য নির্ধারণের জন্য এক বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়।
সভায় প্রারম্ভিক ভাষণে শ্রীইন্দ্রকুমার বলেন, জনমতের প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শন করে ব্রিটিশ সরকার একদিন বঙ্গভঙ্গ করে ঘোষণা করেছিলেন— এটাই স্থির সিদ্ধান্ত, এর অন্যথা হবে না। কিন্তু বাঙালির আন্দোলনে সেদিন স্থির সিদ্ধান্তকে ব্রিটিশ সরকার পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছিলেন। আজ বঙ্গভাষাভাষী ও অন্যান্য অনসমিয়া ভাষাভাষীর ন্যায়সংগত দাবিকে উপেক্ষা করে অসমিয়াকেই একমাত্র রাজ্যভাষা করে, কেবল অসমিয়াভাষীর ভোটে ভাষা বিল গ্রহণ করে আসাম রাজ্য সরকার আমাদের সংগ্রামের আহ্বান জানিয়েছেন। আমরা বাধ্য হয়ে আমাদের সংবিধান প্রদত্ত অধিকারের পূর্ণ মর্যাদা রক্ষার জন্য অবশ্যই সংগ্রাম করব। আমরা কোনো অবস্থাতেই আমাদের মাতৃভাষার অধিকারকে ক্ষুণ্ণ হতে দিতে পারি না।
সভাপতির আহ্বানে স্থানীয় যুব কংগ্রেস সম্পাদক শ্রীনৃপতিরঞ্জন চৌধুরী বলেন যে, ২ ও ৩ জুলাই তারিখে শিলচর শহরে নিখিল আসাম বাংলা ও অন্যান্য অনসমিয়া ভাষা সম্মেলনে সর্বসম্মতিক্রমে প্রস্তাব অনুযায়ী আসাম বিধানসভার সদস্যদের অবিলম্বে পদত্যাগ করা উচিত। …
যুগশক্তি সম্পাদক শ্রীবিধুভূষণ চৌধুরী তাঁর ভাষণে বলেন,
নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির রায়পুর অধিবেশনে ভাষা বিলে সৃষ্ট আসামের গুরুতর পরিস্থিতি সম্পর্কে নেতাদের কোনো উদবেগ পরিলক্ষিত না হওয়ায় বিস্ময় প্রকাশ করে লাভ নেই; আসামের এই অকল্যাণকর কার্যাবলী কংগ্রেসের ঊর্ধ্বতন কতৃপক্ষ কি কারণে উপেক্ষা করছেন, তা দেখতে হবে। শ্রী চালিহা বলেছেন, অসমিয়াভাষী জনমতের দাবীতে ভাষাবিল এভাবে গ্রহণ করা ছাড়া তাঁর গত্যন্তর ছিল না। শ্রীচালিহা জনমত বলতে কি গৃহদাহ, লুন্ঠন, হত্যাকান্ড বোঝেন? হরতাল-মিছিল, বিরাট জনসমাবেশে অভিমত প্রকাশ ইত্যাদি কি জনমতের অভিব্যক্তি নয়? নতুবা বাংলা ভাষাভাষী কাছাড় জেলার বদরপুর কেন্দ্র থেকে নির্বাচিত শ্রীচালিহা কেন এখানকার জনমতের দাবীকে মর্যাদা দান করে পদত্যাগ না করে গদি আঁকড়ে বসে রয়েছেন? … শ্রীচৌধুরী নবগঠিত কাছাড় সংগ্রাম পরিষদকে অভিনন্দিত করেন এবং বর্তমান পরিস্থিতিতে দক্ষিণ করিমগঞ্জ নির্বাচন বর্জন করবার যৌক্তিকতা প্রদর্শন করে কংগ্রেস প্রার্থী খান বাহাদুর মাহমুদ আলিকে নির্বাচন থেকে সরে আসার আবেদন জানান।
নাগরিক কমিটির সম্পাদক শ্রীনলিনীকান্ত দাস বলেন, কাছাড়ের বিধানসভা সদস্যগণ ভাষা-বিলের প্রতিবাদে পদত্যাগ না করায় কংগ্রেসের ঊর্ধ্বতন কতৃপক্ষ ও কেন্দ্রীয় সরকার বাংলা ভাষার দাবির প্রতি উপেক্ষা করতে পারছেন। কেন্দ্রীয় সরকার ন্যায়নীতি চান না, আন্দোলন চান। আমরা যদি আন্দোলন মারফত আমাদের দাবিকে তীব্রতর করে তুলতে পারি, কেন্দ্রীয় সরকার আমাদের দাবি মেনে নেবেন। তিনি নবগঠিত সংগ্রাম পরিষদের উল্লেখ করে এর উদ্দেশ্য সফল করবার জন্য সকলের সাহায্য,সহযোগিতা প্রার্থনা করেন।
শ্রীরথীন্দ্রনাথ সেন তাঁর বক্তৃতায় বলেন, মানুষের কল্যাণের জন্য দল, দলের জন্য মানুষ নন। আজ ভারতে দলের স্বার্থে মানুষকে বলিদান করা হচ্ছে। এই দলীয় মনোবৃত্তি ও সংকীর্ণ ভাবধারা আজ ভারতের সংহতি নষ্ট করছে, ভারতের প্রত্যেকটি প্রদেশের ওপর চরম আঘাত হানতে উদ্যত হয়েছে। বিশেষভাবে শাসনক্ষমতাধিকারী কংগ্রেস দল কতৃপক্ষ ও কেন্দ্রীয় সরকার স্বীয় দুর্বলতার জন্য এরূপ সংকীর্ণ মনোভাবকে প্রশ্রয়দান করছেন। আজ শুধু আসাম নয়—সারা ভারতই সংকটের সম্মুখীন। নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির রায়পুর অধিবেশনে আসামেরসংকটপূর্ণ পরিস্থিতির প্রতি যে উপেক্ষা প্রদর্শন করেছেন তা অমার্জনীয়।
ভূপেন্দ্র সিংহ বলেন, অসমিয়াকে রাজ্যভাষা হিসেবে গ্রহণ করাবার লক্ষ্যে আসামে যে— নারকীয় পটভূমিকার সৃষ্টি করা হয়েছিল তা জাতির জন্য কলঙ্কজনক। চালিহা মন্ত্রিসভার নাম আসামের ইতিহাসে চিরদিন মসিলিপ্ত হয়ে থাকবে। ভাবীকাল কোনোদিনই একে ক্ষমার চোখে দেখবে না। করিমগঞ্জ লোকাল বোর্ডের প্রাক্তন চেয়ারম্যান ননীগোপাল স্বামীও সভায় বক্তৃতা করেন।
সভায় কাছাড় জেলার সর্বদলীয় বিধানসভা, লোকসভা ও রাজ্যসভা সদস্যদের প্রতি অন্যায় ভাষাবিলের প্রতিবাদে অবিলম্বে পদত্যাগ করার দাবিসহ দু-টি প্রস্তাব সর্বসম্মিতক্রমে গৃহীত হয়।
সভাপতি সভার সমাপ্তি টেনে বলেন, কেন্দ্রীয় সরকার দলীয় মনোবৃত্তিতেই আসামের কংগ্রেস সরকারকে অন্যায় প্রশ্রয়দান করছেন, এর প্রতিকার করতে হবে। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় সভার সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়।৮৩
শিলচর জেলা বারের উদ্যোগে, অ্যাডভোকেট শ্রীউপেন্দ্রশংকর দত্তের সভাপতিত্বে ৪ নভেম্বর অনুষ্ঠিত সভায় আসাম ‘বিধানসভায় গৃহীত ভাষা বিল’-কে গণতন্ত্রবিরোধী অভিহিত করে কাছাড়ের কংগ্রেসকর্মী ও জেলা কংগ্রেস কমিটিসমূহকে আসাম প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির সঙ্গে সর্বপ্রকার সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করার আহ্বান জানানো হয়। গৃহীত ভাষাবিলে অনুমোদন না দিয়ে বাংলা ভাষাকেও উপযুক্ত স্থান দেওয়ার উদ্দেশ্যে বিলটি ভারতের প্রেসিডেন্টের নিকট পাঠাবার জন্য আসামের গভর্নরকে অনুরোধ জানিয়ে এক প্রস্তাব গৃহীত হয়। এই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে কাছাড়বাসীকে সর্বপ্রকার ত্যাগের জন্য প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানানো হয়।’৮৪
ভাষাবিলের প্রতিবাদে শিলচরে ৫ নভেম্বর জেলা কংগ্রেস কমিটির উদ্যোগে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন ভারতীয় জাতীয় ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস সহসভাপতি শ্রীরামপ্রসাদ চৌবে (এমএলএ)। অধ্যাপক নিবারণচন্দ্র লস্কর (এমপি), শ্রীদ্বারিকানাথ তেওয়ারি (এমপি), শ্রীনন্দকিশোর সিংহ (এমএলএ) প্রমুখ বক্তা অসমিয়াকে রাজ্যের একমাত্র সরকারি ভাষা করায় রাজ্য কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ তথা সরকারের তীব্র সমালোচনা করেন। তাঁরা বাংলা ভাষাকে বিলের অন্তর্ভুক্ত করার জন্য রাজ্যের রাজ্যপাল ও রাষ্ট্রপতির নিকট আবেদন জানান।৮৫
প্রথম বক্তা হিসেবে জেলা কংগ্রেস সভাপতি শ্রীনন্দকিশোর সিংহ (এমএলএ) ভাষাবিলের বিরোধিতায় কাছাড়ের অধিকাংশ প্রতিনিধির ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করে জনসাধারণকে দাবি আদায়ে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানান। তিনি দৃপ্তকন্ঠে ঘোষণা করেন যে, কাছাড়বাসী কখনো ওই অন্যায় ভাষাবিল মেনে নেবে না।
সাংসদ নিবারণচন্দ্র লস্কর তাঁর ভাষণে প্রদেশ কংগ্রেস ও অসমিয়া নেতৃত্বের অ-সমদর্শী ও দেউলিয়া নেতৃত্বের তীব্র সমালোচনা করে এই অভিমত প্রকাশ করেন যে, কাছাড় ও অন্যান্য অনসমিয়া অঞ্চলসমূহের কংগ্রেস কমিটিসমূহ সমবায়ে স্বতন্ত্র প্রদেশ কংগ্রেস গঠন করার সময় এসেছে। ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থে পরিচালিত হয়ে যাঁরা কাছাড়ের বৃহত্তর স্বার্থের বিরোধিতা করছেন, তিনি তাঁদেরও নিন্দা করেন। শ্রীলস্কর বলেন যে, যেহেতু কাছাড়বাসীর কাছে ভাষাবিলের মূলনীতিই গ্রহণযোগ্য নয়, সেহেতু কাছাড় কখনো সংবিধানের ৩৪৭ ধারা অনুসারে রাষ্ট্রপতির করুণা ভিক্ষা করবে না— এর প্রশ্নই উঠতে পারে না। ঐক্যবদ্ধ এবং সুশৃঙ্খলভাবে ভাষাবিল প্রতিরোধে অগ্রসর হওয়ার জন্য তিনি জেলাবাসীর কাছে আবেদন জানান।
সাংসদ শ্রীদ্বারিকানাথ তেওয়ারি ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার উগ্রপন্থী নেতৃত্বের কঠোর সমালোচনা করে বলেন যে, সেখানকার সব ক-টি দলই অর্থাৎ কংগ্রেস, পিএসপি, কমিউনিস্ট পার্টি এবং আর সিপিআই সংকীর্ণমনা, দেউলিয়া নীতি অনুসরণ করছেন। এ সব দলের জবরদস্তির কাছে কাছাড় কখনো নতিস্বীকার করবে না বলে তিনি অভিমত প্রকাশ করেন। শ্রোতৃমন্ডলীর মুহুর্মুহু করতালির মধ্যে শ্রীতেওয়ারি ঘোষণা করেন যে, সরকারি ভাষা বিলটি প্রত্যাহৃত না হলে কাছাড় আসাম থেকে বের হয়ে আসবে।
পৌরপিতা শ্রীসতীন্দ্রমোহন দেব, প্রবীণ জাতীয়তাবাদী নেতা জনাব গোলাম ছবির খান এবং শহর কংগ্রেস সম্পাদক শ্রীপ্রণয়কুমার চন্দ ভাষাবিল প্রতিরোধে কাছাড়বাসীর ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে বক্তৃতা করেন।৮৬
হোজাই-এ নিখিল আসাম বাংলা ভাষাভাষী সম্মেলন ৫-৬ নভেম্বর ১৯৬০
রাজ্য ভাষাবিল বিরোধী আন্দোলন যখন ক্রমশ জোরদার হয়ে উঠছে, ঠিক তখনই আসামে বসবাসকারী বাঙালি তথা বাংলা ভাষাভাষীদের একত্র করার প্রয়াস অত্যন্ত তাৎপর্যবহ। এই সম্মেলনের মূল উদ্দেশ্য ছিল বাঙালি মানসে শক্তি সঞ্চার, নির্ভয়ে পথচলা, আপন অস্তিত্ব জাগরূক রাখা।
আসাম উপত্যকার নওগাঁ জেলার একটি ছোট্ট শহর হোজাই। এই শহরের সংখ্যাগুরু অধিবাসী বাঙালি। লামডিং-গৌহাটি মেন লাইনের ওপর লামডিং থেকে ৪০ মাইল দূরে হোজাই স্টেশন। রেলওয়ে লাইনের দু-দিকেই হোজাই শহর। এই শহর চালের মিলের জন্য প্রসিদ্ধ। এই অঞ্চলে যে-পরিমাণ ধান হয়, আসামের আর কোনো অঞ্চলে সেই পরিমাণ ধান উৎপাদিত হয় কি না সন্দেহ। হোজাই ও সন্নিকটবর্তী লঙ্কা, যমুনামুখ প্রভৃতি অঞ্চল বাংলা ভাষাভাষী অধ্যুষিত। শতকরা ১০ জনও অসমিয়া ভাষাভাষী আছেন কি না সন্দেহ। … ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর হোজাই শহরে রূপান্তরিত হয়। শহরে বৈদ্যুতিক বাতি এসেছে, রাস্তাঘাটেরও উন্নতি হয়েছে।
এমন একটি শহরে কতিপয় বাঙালির উদ্যোগে ১৯৬০ সালের ৫, ৬ নভেম্বর, শনি ও রবিবার অনুষ্ঠিত হয় ‘নিখিল আসাম বাংলা ভাষাভাষী সম্মেলন’। লক্ষ্য— আসামে বসবাসকারী বাঙালিদের একজোট করা। তাঁদের অভাব-অভিযোগ আসাম তথা ভারতের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়া এবং নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন ও একে অপরের সুখ-দুঃখের সাথি হওয়া।
সম্মেলন উদবোধন করা হয় ৫ নভেম্বর, শনিবার সন্ধ্যা ৬-১৫-তে। বিপুল আনন্দ-উদ্দীপনার মধ্যদিয়ে মনোরম সাজে সজ্জিত দুর্গামন্ডপে অনুষ্ঠান শুরু হয়। আসাম উপত্যকার বিভিন্ন শহর ও পল্লি অঞ্চল থেকে কাছাড় জেলার তিনশো প্রতিনিধি এবং বিপুলসংখ্যক স্থানীয় ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের অধিবাসী সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। শিলং, গৌহাটি, নওগাঁ এবং কাছাড় জেলা থেকে বিশিষ্ট সাংবাদিকগণও সম্মেলনে যোগদান করেন। কলকাতার সংবাদপত্র প্রতিনিধিও সংবাদ সংগ্রহে সম্মেলনে উপস্থিত হয়েছিলেন। ত্রিশ সহস্রাধিক নর-নারীর উপস্থিতিতে অতুলপ্রসাদ সেন-এর ‘মোদের গরব মোদের আশা আ মরি বাংলা ভাষা’ শীর্ষক সংগীত পরিবেশনের মধ্যদিয়ে সম্মেলনের সূত্রপাত করা হয়। এরপর অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি শান্তিরঞ্জন দাশগুপ্ত তাঁর ভাষণে ভাষা-দাঙ্গার পটভূমিতে আসামের পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে বলেন, ‘ভাষা আন্দোলনের নামে আসামে নির্বিবাদে বাংলা ভাষাভাষীদের ওপর নির্মম অত্যাচারের প্রবাহ দুর্দম গতিতে বইয়ে দিয়ে নিরীহ অধিবাসীদের শান্ত জীবনধারার আঙিনায় রক্তধারার বন্যা বইয়ে দেওয়া হয়েছে। তাঁরাও তো এই রাজ্যের বিভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন ও তার উন্নতিতে-সমৃদ্ধিতে সম্ভাব্য সাহায্যাদিও করে আসছেন।
আসামের মাটিতে বাঙালিদের ওপর এই রাজ্যের অধিবাসীদের ‘মালিকসুলভ’ মনোভাব এবং বাঙালিরা তাঁদের অনুগৃহীত মনে করার ভাব থেকেই আসামে বাঙালিদের ওপর বার বার আঘাত হানা হচ্ছে। রাজ্য সরকার নিশ্চেষ্ট দর্শকের ভূমিকা ছাড়া সময়মতো শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষার কোনো ব্যবস্থা অবলম্বন করেননি। ভাষাবিল গ্রহণ সম্পর্কে শ্রীদাশগুপ্ত বলেন, বহুভাষাভাষী অধ্যুষিত আসামে ভাষা সংক্রান্ত বিষয় সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত না হওয়ার পূর্বেই আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। এর ফলে রাজ্যের অন্যান্য ভাষাগোষ্ঠীর অস্তিত্ব বিপন্ন। শ্রীদাশগুপ্ত তাঁর দীর্ঘ ভাষণে লোকগণনায় কারচুপি, দাঙ্গার পূর্বের সময়কার ও বর্তমান পরিস্থিতির গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উঘাটন ও বিশ্লেষণ করে উপসংহারে বলেন, অন্যান্য অধিবাসীদের মতো আমরাও এ দেশের (আসাম) সন্তান। এই দেশেই বসবাস করব এবং এ দেশেই আমাদের মৃত্যু হবে। অতীতের মতো বর্তমান এবং ভবিষ্যতেও আমরা এ দেশের কল্যাণ ও উন্নতির জন্য আপ্রাণ চেষ্টিত হব। অন্যান্য ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি অকৃত্রিম সম্মান প্রদর্শন করেও বলব, আমাদের মাতৃভাষা, আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের প্রাণধারার সঙ্গে যুক্ত। আমাদের দাবি, আমাদের জন্মগত অধিকারের সীমানায় সংরক্ষিত।’৮৭
সম্মেলনের আনুষ্ঠানিক উদবোধন করে জাতীয়তাবাদী নেতা, সাংবাদিক মো. হুরমত আলি বড়লস্কর বলেন:
‘সীমান্তবর্তী জটিল সমস্যাসংকুল আসামের অধিবাসীদের মধ্যে পর পর মারামারির ফলে আসামের অস্তিত্বকেই বিপন্ন করে তুলেছে। বাংলা সর্বদাই আসামকে কনিষ্ঠ সহদরের মতো দেখেছে, আসামের সমস্যাকে বাংলা, দিল্লির দরবারে উপযুক্ত গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরে প্রতিকারের পথে জোর দিয়েছে। আসামে যখন কোনো সংবাদপত্রই ছিল না, তখন বাংলার সংবাদপত্র দুর্গত আসামের স্বার্থরক্ষা করে চলেছে। সম্প্রতি আসামে যে নারকীয় ও নৃশংস কান্ড ঘটে গেল, সেই উচ্ছৃঙ্খলতার স্রোতে কাছাড় গা ভাসিয়ে দেয়নি।
আমরা তথা কাছাড়ের বাঙালিরা কঠোর আত্মসংযম রক্ষা করে চলেছি। আমরা সংবিধান স্বীকৃত মৌলিক অধিকারে প্রতিষ্ঠিত হয়ে ‘live and let live’— যা ভারতীয় সংস্কৃতির মূলনীতি, তাই-ই অধিকারের গণতান্ত্রিক পথে চলেছি। আমাদের সংঘবদ্ধ আসামের সংহত রূপ নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। বাঙালিকে অসমিয়াগণ যেন ‘জিম্মি’ মনে না করেন। কারণ বাঙালিরা আসামে মহাকাশ থেকে সহসা পতিত কোনো কিছু নন। বাঙালিরাও আসামেরই নিজস্ব সন্তান, আসামের মাটির সঙ্গে তার একাত্ম যোগ। আসামে সম্প্রতি বিধানসভায় অসমিয়াকে বহুভাষী এই রাজ্যের একমাত্র সরকারি ভাষা হিসেবে গ্রহণ করে বিল পাস করায় রাজ্যে বিভেদের সৃষ্টি করা হয়েছে—যা আত্মঘাতী। একমাত্র অধিবাসীনির্বিশেষে যৌথ সংগঠনের পথেই সমৃদ্ধ আসাম গঠন সম্ভব;আমাদের সে-পথেই চলতে হবে।’৮৮
সম্মেলনের শুভকামনায় যে-সকল বিশিষ্টজন, সংগঠন শুভেচ্ছাবার্তা প্রেরণ করেছিলেন— এ সময় সেগুলি পাঠ করা হয়। যাঁরা শুভেচ্ছাবার্তা প্রেরণ করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, এন সি চ্যাটার্জি, বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়, সৌমেন ঠাকুর, জে এল সিং, নিখিল আসাম হিন্দুস্থানি সম্মেলন, জ্যোতিষ জোয়ারদার, লীলা রায়, সচ্চিদানন্দ ঘোষ, দ্বারিকানাথ তেওয়ারি, মুনীন্দ্রনাথ দাস, রণেন্দ্রমোহন দাস, এস এম দেব প্রমুখ।
প্রথম অধিবেশনের নির্বাচিত সভাপতি আসামের প্রাক্তনমন্ত্রী শ্রীবৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায় তাঁর অভিভাষণে বলেন, ‘আসামের সংখ্যাগুরু অধিবাসীর অযৌক্তিক ও অনমনীয় মনোভাব এবং স্বার্থপরতাহেতু আজ তাড়াহুড়ো করে বিধানসভায় ভাষাবিলটি বর্তমান আকারে গৃহীত হয়েছে। আসাম রাজ্যের সামগ্রিক কল্যাণের জন্য আসাম ও ভারতের নেতৃবৃন্দ এই বিলের ভাবী ফলাফল অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে অনুধাবন না-করলে এই সীমান্তবর্তী রাজ্যে সংকট অবশ্যম্ভাবী। বহু ভাষাভাষী অধ্যুষিত আসাম রাজ্যে অনসমিয়া অধিবাসীদের ওপর এই ভাষাবিল ঘোরতর বিপর্যয় টেনে এনেছে। এই অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করবার জন্য তিনি জাতি-ধর্ম দলমত-নির্বিশেষে সকলকে আহ্বান জানান।
শ্রীমুখোপাধ্যায় বলেন, ভাষা বিলের উদ্যোক্তারা ঘোষণা করে থাকেন যে, এই বিলের মধ্য দিয়ে অনসমিয়া ভাষাভাষী কারও ওপর অসমিয়া ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার অভিপ্রায় নেই। কিন্তু কেউ যদি এই ভাষা বিলটি একটু খতিয়ে দেখেন তাহলে তিনি সহজেই বুঝতে পারবেন যে, অন্যান্য ভাষাভাষীর ওপর অসমিয়া ভাষাকে চাপিয়ে দেওয়ার একমাত্র উদ্দেশ্য নিয়েই বিলটি রচিত হয়েছে।
তিনি বলেন, আমি অসমিয়াভাষী না হলেও অসমিয়া ভাষার সর্বাঙ্গীণ উন্নতি কায়মনোবাক্যে কামনা করি। কিন্তু বাংলা বা অন্য কোনো সমৃদ্ধিশালী ভাষাকে বর্জন করে অসমিয়া ভাষা কেন, কোনো ভাষারই উন্নতি হতে পারে না। যাঁরা মনে করছেন বাংলা ভাষা বর্জন করে অসমিয়া ভাষার উন্নতি করবেন তাঁরা ভ্রান্ত। অসমিয়া এবং বাংলা ভাষার আদান-প্রদানই উভয় ভাষার উন্নতি ও শ্রীবৃদ্ধিসাধন করবে।
তিনি আরও বলেন, সরকারের নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে এমন সুব্যবস্থা করার প্রয়োজন যাতে শিক্ষা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে রাজ্যের প্রত্যেক অধিবাসীই স্ব স্ব মাতৃভাষা ব্যবহারের পূর্ণ সুযোগ লাভ করেন। বহু ভাষাভাষী এই রাজ্যে সকল ভাষাই যেন সমান মর্যাদা লাভ করতে পারে।
গত জঘন্য দাঙ্গায় বাস্তুচ্যুতগণ যাতে অবিলম্বে পুনর্বসতির সুযোগ লাভ করেন এবং ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিগণের অবিলম্বে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা হয়, তার জন্য তিনি সরকারের কাছে আবেদন জানান।
আগামী আদমশুমারিতে সকলে যাতে নির্ভয়চিত্তে তাঁদের সত্যিকার পরিচয় ও মাতৃভাষা সঠিকভাবে উল্লেখ করেন, তার জন্য আসামের সর্বশ্রেণির অধিবাসীর প্রতি আহ্বান জানান। পরবর্তী ভোটার তালিকায় অবহেলা ও উপেক্ষায় যেন কারও নাম বাদ না যায় সেদিকে তিনি সকলের সতর্ক দৃষ্টি রাখার অনুরোধ করেন।
সভাপতি উপসংহারে সকলকে ঐক্যের আহ্বান জানিয়ে তাঁর ভাষণ শেষ করেন।
প্রধান অতিথি শ্রীমতী জ্যোৎস্না চন্দ (এম এল এ) তাঁর সংক্ষিপ্ত ভাষণে বলেন, ‘স্বাধীনতালাভের পর গত তেরো বছরে আসামের বাঙালিরা তাঁদের স্বাধিকারের বিষয়ে সচেতন ছিলেন না। কিন্তু সাম্প্রতিক অমানুষিক নারকীয় লীলার পর আসামের বাংলাভাষীগণ তাঁদের ভাষা, সংস্কৃতি ও ন্যায়সংগত অধিকার রক্ষণের জন্য সংগত কারণেই জাগ্রত হয়েছেন। বহু ভাষাভাষী অধ্যুষিত আসামে নিজ নিজ মাতৃভাষার যথাযোগ্য মর্যাদা পরিপূর্ণভাবে লাভ না করা পর্যন্ত সকলে যাতে সংঘবদ্ধভাবে সর্বপ্রকার ত্যাগ ও দুঃখবরণ করে অগ্রসর হন— এই মর্মে সকলের কাছে তিনি আবেদন জানান।’৮৯
রাত ন-টায় প্রথম অধিবেশনের সমাপ্তি ঘোষণা এবং পরদিন সকাল ন-টায় দ্বিতীয় অধিবেশনের সূচনা হবে বলেও ঘোষণায় উল্লেখ করা হয়। এ দিন রাত দশটা থেকে রাত একটা পর্যন্ত বিভিন্ন প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। আসামের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আগত প্রতিনিধিবৃন্দ গত দাঙ্গার অভিজ্ঞতা থেকে বাংলা ভাষাভাষীদের মধ্যে একতা ও সংহতি স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে একটি স্থায়ী সমিতি গঠনে আগ্রহ প্রকাশ করেন। পরদিন সকাল সাড়ে সাতটায় বিষয় নির্বাচনীর স্থগিত অধিবেশন ও সকাল ন-টায় দ্বিতীয় অধিবেশন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেওয়া হয়।
৬ নভেম্বর সকাল ন-টায় দ্বিতীয় অধিবেশনে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব গৃহীত হয়। এসব প্রস্তাবের মধ্যে ‘নিখিল আসাম বাংলা ভাষাভাষী সমিতি’ (স্থায়ী সংস্থা) ছিল অন্যতম। সভাপতি শ্রীবৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায় তাঁর ভাষণের উপসংহারে উপস্থিত সকলের নিকট আবেদন জানিয়ে বলেন যে, গৃহীত প্রস্তাবগুলি যেন যথার্থই বাস্তবায়ন করা হয়। এবং তাহলে কেবল বাংলা ভাষাভাষী নন, সামগ্রিকভাবে আসামেরই কল্যাণ সাধিত হবে।
অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি শ্রীশান্তিরঞ্জন দাশগুপ্ত সকলকে ধন্যবাদ জানিয়ে দুপুর বারোটায় দ্বিতীয় অধিবেশনের সমাপ্তি ঘোষণা করেন। ঘোষণায় আরও বলা হয় দুপুর দটোতে সমিতি আয়োজিত জনসভা অনুষ্ঠিত হবে। এদিনের সভা সম্পর্কে সংবাদপত্রে বলা হয়:
হোজাইয়ের গান্ধী মাঠে জনসভার স্থান নির্দিষ্ট হয় এবং মাঠের একপাশে এক বৃহৎ মঞ্চনির্মাণ করে নানাবিধ কারুশিল্পে সজ্জিত করা হয়। মঞ্চের পশ্চাৎভাগে নবোদিত অরুণ চিত্রি করে তার মধ্যে নিখিল আসাম বাংলা ভাষাভাষী সম্মেলন লিখে ‘নব জাগরণের’ রূপদান করা হয়। মাঠের প্রবেশপথে অভিজ্ঞ শিল্পী নির্মিত একটি মনোরম তোরণ শোভা পায় এবং সেখানেই জনসাধারণ আমন্ত্রিত প্রতিনিধি এবং বিশিষ্ট অতিথিদের স্বাগত জানানো হয়। … ন্যূনধিক ৪০ সহস্র হিন্দু ও মুসলমান নর-নারী সভায় সমবেত হয়েছিলেন। মিকির পাহাড় অঞ্চলের সুদূর পল্লী থেকেও বহু লোক সভায় যোগদান করেন। এত মানুষের ভিড়েও সভাস্থল ছিল অত্যন্ত শান্ত ও নীরব।৯০
সভার কাজ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হওয়ার পূর্বেই উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে মোহিতমোহন দাস সমবেত জনতাকে স্বাগত জানিয়ে বলেন:
‘আসামে বসবাসকারী বাঙালি সমাজকে মাথা তুলে দাঁড়াতে হবে; নিজের ভাষা, সংস্কৃতি ও সভ্যতা রক্ষার জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসতে হবে। আসামে কীভাবে তাঁদের নিজেদের ন্যায্য অধিকার ও সুযোগসুবিধা নিয়ে বাস করতে পারেন, সেই কর্মপন্থা স্থির করার জন্য তিনি সকলের প্রতি আহ্বান জানান।’
‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু’ শীর্ষক নজরুলগীতি পরিবেশনের মধ্য দিয়ে সভার কাজ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়। সভার নির্বাচিত সভানেত্রী শ্রীমতী জ্যোৎস্না চন্দ (এম এল এ)-কে স্বাগত জানিয়ে অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি শান্তিরঞ্জন দাশগুপ্ত ব্যাজ ও মাল্যভূষিত করেন। সভা উদবোধনের জন্য নির্বাচিত বিশ্বনাথ উপাধ্যায় (এম এল এ)-কেও ব্যাজ ও মালা পরিয়ে বরণ করা হয়। অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি সমবেত জনসমুদ্রকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, ‘বর্তমান সময়ে এই সম্মেলনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে এই ক্ষুদ্র শহরে আমরা আপনাদের আহ্বান জানিয়েছি। আপনাদের আন্তরিক সহযোগিতায় আমাদের প্রয়াস সার্থক হয়েছে। আসামের বাংলা ভাষাভাষীর একটি স্থায়ী সমিতি গঠিত হয়েছে। এই সমিতি আমাদের মধ্যে একযোগে কাজ করবার সুযোগ দান করে অশেষ কল্যাণসাধন করবে।’
প্রারম্ভিক ভাষণে সভানেত্রী জ্যোৎস্না চন্দ বলেন:
‘মাতৃজাতির প্রতীক হিসেবেই বোধহয় এই মহতী জনসভায় আপনারা আমাকে সভানেত্রীর আসনে নির্বাচিত করেছেন। অমোঘ মাতৃশক্তি আপনাদের উদ্দেশ্য সফল করবেন—এটা আমি বিশ্বাস করি।’
এরপর সভানেত্রীর আহ্বানে শ্রীবিশ্বনাথ উপাধ্যায় সভার উদবোধন ঘোষণা করে বলেন: ‘আসামের শোচনীয় দাঙ্গায় কেবল বাঙালিরই ক্ষতি সাধিত হয়নি, অসমিয়াগণ নিজেরাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তাঁদের শুধু আর্থিক ও বৈষয়িক ক্ষতিই হয়নি, তাঁদের সুনাম, তাঁদের সংস্কৃতি ও সভ্যতা কলঙ্কিত হয়েছে। এই দাঙ্গায় তাঁদের মর্যাদা আজ সারা ভারতের কাছে অতি নিম্নে নেমে গেছে। ফলে, শিল্প-বাণিজ্যে আসামে মূলধন নিয়োগ নিরাপদ নয় মনে করায় তা সংকুচিত হচ্ছে। আসামের দাঙ্গা সম্পর্কে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় দাঙ্গার সমালোচনা করে একটি নিন্দাসূচক প্রস্তাব গৃহীত হওয়ায় আসাম বিধানসভায় তাতে উষ্মা প্রকাশ করা হয়। এই উষ্মার সমালোচনা করে শ্রীউপাধ্যায় বলেন, ভারতের প্রত্যেক নাগরিকের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবার অধিকার আছে। আসাম ভারত রাষ্ট্রের অধীন, এখানে অনুষ্ঠিত কোনো অন্যায়-অবিচারের প্রতিক্রিয়া অন্যত্র প্রতিফলিত হতে বাধ্য। বিশেষত দাঙ্গাপীড়িত বাস্তুহারাগণ পশ্চিমবঙ্গে ব্যাপক সংখ্যায় আশ্রয় গ্রহণ করায় পশ্চিমবঙ্গ আজ বিপর্যয়ের সম্মুখীন। শ্রীউপাধ্যায় সম্মেলন ও জনসভার প্রতি সহমত পোষণ করে উদ্যোক্তাদের উদ্যোগের প্রশংসা করেন।’৯১
জাতীয়তাবাদী নেতা মহ. হুরমত আলি বড়লস্কর সভায় বলেন: ‘আসামের বাংলা ভাষাভাষীদের মধ্যে একমাত্র ঐক্যের অভাবের জন্যই বাঙালি বার বার মার খেয়েছে। … বাঙালিরা আসামের উন্নতিই কামনা করে, আসামকে কোনোদিনই গ্রাস করতে চায় না। আসামের স্বার্থরক্ষার জন্য সারাভারতকে তিন ভাগে বিভক্ত করার ক্যাবিনেট মিশন প্রস্তাবের বিরোধিতা বাঙালিরাই করেছিলেন। এই বাঙালি নেতা সমগ্র আসামের বাঙালিদের মধ্যে ঐক্য ও সংহতির জন্য আবেদন জানান।’
ধুবড়ির বিশিষ্ট নাগরিক শ্রীরমণীকান্ত বসু তাঁর ভাষণে বলেন, ‘বহু ভাষাভাষী অধ্যুষিত, বহু সংস্কৃতির ধারক ও বাহক আসাম প্রদেশ সারাভারতের এক ক্ষুদ্র ও সংক্ষিপ্ত সংস্করণ। অসমিয়া ভাষার উন্নতির জন্য বাঙালির অবদান উল্লেখযোগ্য। ভাষা ও সংস্কৃতির আদান-প্রদানের মধ্যে জাতীয় কল্যাণ নির্ভর করে। বিরোধ ও বর্জন কোনোদিনই শুভ হয়নি। আসামে বাঙালিদের ন্যায্য দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে’।
সভায় রথীন্দ্রনাথ সেন বলেন: ‘আমরা এখানে অসমিয়ার বিরোধিতা করতে আসিনি। অসমিয়া ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি আমরা কোনো বিদ্বেষভাব পোষণ করি না, বরং অসমিয়া ভাষা ও সাহিত্যের সর্বাঙ্গীণ উন্নতি কামনা করি। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে আমার মাতৃভাষার, আমার সংস্কৃতির সংরক্ষণ, উন্নতি ও নিরাপত্তা কামনা করি। আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতির অধিকারের ওপর অন্যায় হস্তক্ষেপ আমরা সহ্য করব না। মাতৃভাষার সম্মান রক্ষা করা আমাদের অবশ্য কর্তব্য। তিনি বলেন, … যিনি যেখানেই থাকুন না কেন, মাতৃভাষার সেবা তার জন্মগত অধিকার। শ্রীসেন উপসংহারে আসামের সরকার ও অসমিয়াভাষীদের কাছে আবেদন জানান যে, আসাম রাজ্যে বাংলা ভাষাভাষীদের মাতৃভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষা করে শান্তিতে বাস করতে দিন।’৯২
ডা. ডি এন রায় তাঁর ভাষণে বলেন, ‘আসাম সরকারের সংজ্ঞা কি এই যে, অসমিয়াদের সরকার অসমিয়াদের দ্বারা গঠিত ও কেবল অসমিয়াদের জন্য?’ গোয়ালপাড়ার সুবোধ রায় বলেন, ‘নবগঠিত আসাম বাংলা ভাষাভাষী সমিতি অসমিয়াদের ভাষা ও সংস্কৃতি বিরোধী নয়, বাঙালিরা যেমন অসমিয়া ভাষার শ্রীবৃদ্ধি কামনা করেন, অনুরূপ তাঁরা চান তাঁদের ভাষাকে সমমর্যাদায় সরকারি স্বীকৃতি দান করা হোক। তাঁরা তাঁদের মাতৃভাষা চর্চায় ও লালনে কোনোরূপ অন্যায় সহ্য করতে চান না। বাঙালির ন্যায়সংগত স্বার্থ, অধিকার ও মর্যাদার জন্য নবগঠিত নিখিল আসাম বাংলা ভাষাভাষী সমিতি ঐক্যবদ্ধ সহযোগিতা আহ্বান করেন।’৯৩
সভার সভানেত্রী বিধায়ক শ্রীমতি জ্যোৎস্না চন্দ তাঁর ভাষণে বলেন, ‘ভারতের নাগরিক হিসেবে আসামের বাঙালিদের সংবিধানে প্রদত্ত অধিকারের জন্য সংগ্রাম করা উচিত।’ তিনি বলেন:
বাংলাকে আসামের অন্যতম সরকারি ভাষারূপে স্বীকার করে নেওয়ার জন্য দৃঢ়কন্ঠে দাবি জানাতে আসামের বাঙালিরা যদি পশ্চাৎপদ হন, তবে ভবিষ্যৎ বংশধরগণ আমাদের ক্ষমা করবে না। শ্রীমতি চন্দ বলেন, ‘ভাষাবিলটি বর্তমান আকারে গৃহীত হলে আসামে বাঙালিরা চাকরি, ভাষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্র থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে এবং এর ফলে আসাম খন্ড খন্ড হয়ে যাবে।’ দাঙ্গাপীড়িত বাঙালিদের দ্রুত পুনর্বাসনে সাহায্যের জন্য শ্রীমতী চন্দ আসামের অধিবাসীদের প্রতি আবেদন জানান।
তিনি আগামী, লোকগণনায় সম্ভাব্য কারচুপি, ছলচাতুরী সম্পর্কে সকলকে সতর্ক থাকার অনুরোধ করেন। চল্লিশ হাজার নর-নারীর এই সভায় উলুধ্বনি ও করতালির মধ্যে শ্রীমতী চন্দ ‘নিখিল আসাম বাংলা ভাষাভাষী সমিতি’ গঠনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন। আসামের ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় সাম্প্রতিক দাঙ্গায় যাঁরা প্রাণ হারিয়েছেন, তাঁদের উদ্দেশ্যে গভীর শোক প্রকাশ এবং অগ্নিসংযোগ, লুঠতরাজ, ধর্ষণ প্রভৃতির ফলে যাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাঁদের জন্য সহানুভূতি প্রকাশ করে সভানেত্রী একটি প্রস্তাব উত্থাপন করলে উপস্থিত সকলে উঠে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন।
আজ সকালে অর্থাৎ ৬ নভেম্বর সকালের অধিবেশনে গৃহীত ছ-টি প্রস্তাব সভায় পাঠ করা হয় এবং জনতা তার প্রতি সমর্থন জানান। শ্রীমতী চন্দ বলেন, ‘বাঙালিরা ইতিপূর্বে আর কখনও সংঘবদ্ধ হননি। এর কারণ বোধ হয় এই ছিল যে, সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের হাতে তাঁদের ভাষা, শিক্ষা ও সংস্কৃতি নিরাপদ থাকবে। গত তেরো বৎসরের ইতিহাসে তাঁদের সেই বিশ্বাসের মূলে আঘাত হানা হয়েছে। সুতরাং, সংগতকারণেই আজ তাঁরা এমন একটি সংস্থা গঠন করছেন, যার মাধ্যমে তাঁদের অধিকার আদায় করতে পারবেন বলে তাঁরা আশা করেন। এই সংস্থাকে শক্তিশালী করার জন্যে তিনি ঐক্যের আবেদন জানান।’
আসাম সরকারি ভাষাবিল ভাষাগত সংখ্যালঘুদের ভাষা, সংস্কৃতি ও শিক্ষা কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে—তার বিস্তৃত বিবরণ তিনি সভায় তুলে ধরেন। ‘আসামের বাঙালিরা নেতৃত্ব ও প্রেরণার জন্য পশ্চিমবঙ্গের মুখাপেক্ষী বলে প্রায়শই যে অভিযোগ করা হয়ে থাকে, শ্রীমতী চন্দ তার প্রতিবাদ করেন। তিনি বলেন, আসামে বাঙালিরা অবিচ্ছিন্নভাবে আসামেরই অধিবাসী এবং আসামের ভবিষ্যৎ তাঁদের ভবিষ্যৎ। সচেতন নাগরিকের ন্যায় এখানেই তাঁদের বসবাস করতে হবে।
গত আদমশুমারিতে আসামের বাঙালি অধিবাসীদের প্রকৃত সংখ্যা চাপা দেওয়ার জন্য নানারূপ কলাকৌশল অবলম্বিত হয়েছিল বলে শ্রীমতী চন্দ অভিযোগ করেন এবং প্রত্যেক সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোককে আগামী আদমশুমারির সময় তাঁদের ভাষা ও অন্যান্য বিষয়ে নির্ভুল বিবরণ প্রদানের জন্য সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন।’৯৪
এরপর অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি শান্তিরঞ্জন দাশগুপ্ত সভায় উপস্থিত হওয়ার জন্য সকলকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান। কাছাড়ের বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ পরেশচন্দ্র চৌধুরী অভ্যাগতদের পক্ষ থেকে অভ্যর্থনা সমিতির কর্মকর্তাদেরও আন্তরিক ধন্যবাদ জানান।
বিকাল সাড়ে পাঁচটায় জনসভার সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়। সভায় ‘নিখিল আসাম বাংলা ভাষাভাষী সমিতি’ গঠনসহ যেসব প্রস্তাব গৃহীত হয়—তা ছিল নিম্নরূপ:
১. ১৯৬০ সালের জুন-জুলাই মাসে আসামের ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় সংঘটিত দাঙ্গায় যাঁরা প্রাণ হারিয়েছেন, এই সম্মেলন তাঁদের প্রতি গভীর শোক প্রকাশ করছে এবং অগ্নি সংযোগ, লুঠতরাজ, ধর্ষণ প্রভৃতির ফলে যাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাঁদের প্রতি সহানুভূতি জানাচ্ছে।
২. দাঙ্গা-হাঙ্গামার সময় আসাম ও ভারত সরকার বাংলাভাষীদের জীবন ও সম্পত্তি রক্ষায় সম্পূর্ণ ব্যর্থ হওয়ায় সম্মেলন দুঃখ প্রকাশ করছে।
৩. এই সম্মেলন মনে করে যে, অপরাধীদের শাস্তিদানে সরকারের ব্যর্থতা, দুর্বল নীতি এবং অপর্যাপ্ত পুনর্বাসন ব্যবস্থার জন্য হাজার হাজার ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি এখনও নিজ নিজ গৃহে প্রত্যাবর্তন করতে পারছেন না। এ বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণে সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।
৪. যে-সকল ব্যক্তি তাঁদের গৃহ ও সম্পত্তি হারিয়েছেন, তাঁদের পুনর্বাসন কাজের বিশেষ কোনো অগ্রগতি না হওয়ায় সম্মেলন দুঃখ প্রকাশ করছে এবং ওই সকল ব্যক্তিদের দ্রুত পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণ দাবি করছে।
৫. সম্মেলন মনে করে সরকারের ভাষাবিলটি বিভেদাত্মক ও সংবিধানবিরোধী। এই বিল আসামের জনগণের কোনো অংশেরই আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। বিলটি বর্তমান আকারেই যদি চূড়ান্তভাবে অনুমোদিত হয়, তাহলে পরিণামে বিভেদের সৃষ্টি হবে এবং এই সীমান্তবর্তী প্রদেশে অগ্রগতি ও উন্নয়ন ব্যাহত করবে।
৬. দাঙ্গা-হাঙ্গামা সম্পর্কে লোকসভা ও রাজ্য বিধান পরিষদ বিচারবিভাগীয় তদন্তের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, অবিলম্বে তা কার্যকর করতে হবে।
৭. সম্মেলন দাবি জানাচ্ছে যে, সমস্ত রাজ্যে বাংলাকে সরকারি ভাষা ও অপর অনসমিয়া ভাষাকে উপযুক্ত মর্যাদা দেওয়া হোক এবং এই দাবি পূরণের জন্য ‘নিখিল আসাম বাংলা ভাষাভাষী সমিতি’-র ওয়ার্কিং কমিটিকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অধিকার দিচ্ছে।৯৫
হোজাই সম্মেলনে গঠিত নিখিল আসাম বাংলা ভাষাভাষী সমিতির কার্যকরী কমিটির সদস্যদের নামের তালিকা এরূপ: সভানেত্রী শ্রীমতী জ্যোৎস্না চন্দ, এমএলএ, সহসভাপতিবর্গ শ্রীরমণীকান্ত বসু, জনাব হুরমত আলি বড়লস্কর, ডা. হেমচন্দ্র দাস, শ্রীঅনাথবন্ধু বসু, সাধারণ সম্পাদক— শান্তিরঞ্জন দাশগুপ্ত, যুগ্ম-সম্পাদকবর্গ— মোহিতমোহন দাস, সুবোধ রায়, সুবোধ ভৌমিক, সহকারী সম্পাদকবর্গ— বিনয় সরকার, দক্ষিণারঞ্জন দেব, কালীপদ ঘটক, কোষাধ্যক্ষ— গণেশচন্দ্র সেন, সদস্যমন্ডলী— সর্বশ্রী-কালীকৃষ্ণ ব্যানার্জি, দেবপ্রসাদ সেন, ভূপেন্দ্রশঙ্কর গুহ, মনোরঞ্জন ব্যানার্জি, অখিলচন্দ্র ভট্টাচার্য, সুধীন্দ্রভূষণ চৌধুরী, শচীন্দ্রবিনোদ সেনগুপ্ত, সৌরীন্দ্রকুমার ভট্টাচার্য, সুখেন্দুবিকাশ সেনগুপ্ত, অখিল দত্ত, নিরঞ্জন বিশ্বাস, স্বর্ণকমল দত্ত, অমর ভৌমিক, ক্ষীরোদরঞ্জন নাগ, অজিত সেনগুপ্ত, সাধনরঞ্জন সরকার, আবদুল খালেক, কালিকারঞ্জন রায়, নগেন দে, ডা. গোপাল পাল, পঞ্চানন গাঁওবুড়া, পরমেশ ভট্টাচার্য, রাখাল মজুমদার, নলিনীকান্ত দাস, দীনেশ সিংহ, রথীন্দ্রনাথ সেন, তজম্মুল আলি বড়লস্কর, আলতাফ হুসেন মজুমদার, পরিতোষ পালচৌধুরী, পরেশচন্দ্র চৌধুরী, সুধীরকুমার ভদ্র। পৃষ্ঠপোষক— শ্রীবৈদ্যনাথ মুখার্জি।৯৬
এদিকে নরসিংপুরে ১৯৬০ সালের ১৮, ১৯ ও ২০ নভেম্বরে অনুষ্ঠিত হয় ‘কাছাড় যোগী সম্মিলনী’-র ৩৬-তম বার্ষিক অধিবেশন। সম্মেলনে সভাপতি ছিলেন প্রত্ন-ইতিহাসবিদ শ্রীরাজমোহন নাথ। সভায় অন্যান্য প্রস্তাব গ্রহণের পাশাপাশি বাংলা ভাষা বিষয়েও একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। বলাবাহুল্য এই সম্প্রদায়ের সকলেই ছিলেন বাংলাভাষাভাষী, বাঙালি। ভাষা সংক্রান্ত প্রস্তাব গ্রহণকালে আসাম সরকারের ভাষানীতি ও রাজ্য ভাষাবিলের তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয়। বলা হয়, সরকারি ভাষা বিল শোধন করে যদি বাংলা ভাষাকে আসামের অন্যতম সরকারি ভাষা হিসেবে গ্রহণ করা না হয় তাহলে বাঙালি ও বাংলা ভাষা অধ্যুষিত অঞ্চলগুলির আসাম থেকে পৃথক হয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না। যোগী সম্প্রদায়ের এই সিদ্ধান্ত সেদিন বিধ্বস্ত বাঙালি মনকে নিশ্চয়ই প্রাণিত করেছিল।
৬ নভেম্বর শ্রীমতী জ্যোৎস্না চন্দের সভানেত্রীত্বে অনুষ্ঠিত নিখিল আসাম বঙ্গ ভাষাভাষী সমিতির ওয়ার্কিং কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক শ্রীশান্তিরঞ্জন দাশগুপ্ত নতুন দিল্লিতে আসামের রাজ্যপালের নিকট ভাষা বিষয়ে ৮ নভেম্বর এক তারবার্তা প্রেরণ করেন। তারবার্তায় বলা হয়:
প্রাক্তন মন্ত্রী শ্রীবৈদ্যনাথ মুখার্জির সভাপতিত্বে হোজাইয়ে (অসম অনুষ্ঠিত বঙ্গভাষী সম্মেলনে এবং শ্রীমতী জ্যোৎস্না চন্দের (কংগ্রেস এম.এল.এ) সভানেত্রীত্বে অনুষ্ঠিত ৪০ হাজার নর-নারীর এক মহতী জনসভায় সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত প্রস্তাবে আসাম বিধানসভায় উত্থাপিত আসাম সরকারি বিলটি বৈষম্যমূলক ও সংবিধানবিরোধী বলিয়া উহার বিরুদ্ধে অসন্তোষ জ্ঞাপন করা হইয়াছে। উক্ত বিল যে কোনো সম্প্রদায়ের লোকেরই আকাঙ্ক্ষা পূরণে ব্যর্থ হইয়াছে এবং উহাতে সম্মতি দেওয়া হইলে রাজ্য বিভাগ অবশ্যম্ভাবী হইবে এবং শেষপর্যন্ত ইহা দ্বারা উন্নয়ন ও প্রগতি ব্যাহত হইবে।
সম্মেলনে রাজ্যের বিভাগ রোধের জন্য এবং সকল সম্প্রদায়ের লোকের বৈধ দাবি পূরণের জন্য বিলটি যাহাতে সংশোধিত হয়, সেই মর্মে সকলের উদ্দেশ্যে আবেদন জানানো হইয়াছে।৯৭
১৭ নভেম্বর কাবুগঞ্জ মন্ডল কংগ্রেসের নতুন গৃহের দ্বারোদঘাটন উৎসব উপলক্ষ্যে জেলা কংগ্রেস কমিটিরও এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। ‘জেলা কংগ্রেস সভাপতি শ্রীনন্দকিশোর সিংহ, এমএলএ, শ্রীমতি জ্যোৎস্না চন্দ, এমএলএ, শ্রীরামপ্রসাদ চৌবে, এমএলএ, শ্রীআর টিকমানি, শ্রীবিনোদবিহারী চৌধুরী, শ্রীপ্রণয়কুমার চন্দ প্রমুখ আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন। শিলচর মহকুমার বিভিন্ন স্থান থেকে কংগ্রেস সদস্যরা সভায় যোগদান করেন। সভায় ভাষা বিষয়ে পরিষদ সদস্যগণ এ পর্যন্ত যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন—তার প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানানো হয়। অসমিয়া ভাষাকে আসামের একমাত্র রাজ্যভাষা করার প্রস্তাব করে যে বিল গৃহীত হয়েছে সভা তার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জ্ঞাপন করেন।’৯৮
আমরা জানি, আসাম সরকারি ভাষাবিল ১৯৬০, আসাম বিধানসভায় ২৪ অক্টোবর অনুমোদিত হয়—যেখানে অসমিয়াকে রাজ্যের একমাত্র সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষিত হয়। বহু বিতর্কিত এই বিলের প্রতিবাদে বাঙালি তথা বাংলাভাষী সমাজে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যায়। আর এই প্রতিক্রিয়ার প্রতিফলন ঘটে একাধিক বিশাল জনসমাবেশে, মিছিলে, শোভাযাত্রায়। পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই বিলবিরোধী প্রতিক্রিয়া আরও তীব্রতর আকারে দেখা দেয়। তাঁরা অসমিয়া ভাষার বিরুদ্ধাচরণ করেই ক্ষান্ত থাকেননি— পৃথক পার্বত্য রাজ্যও দাবি করেছেন। এমন একটি বিতর্কিত বিলে আসামের রাজ্যপাল শ্রীবিষ্ণু সহায় অবলীলায় অনুমোদন দিলেন ১৭ ডিসেম্বর ১৯৬০ তারিখে।৯৯
রাজ্যপালের এই অনাকাঙ্ক্ষিত অনুমোদনের পর করিমগঞ্জে ইতিমধ্যে গঠিত ‘কাছাড় সংগ্রাম পরিষদ’ এক বৈঠকে মিলিত হয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে এবং এই আইন প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে উপায় নির্ধারণে আগামী জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়ে একটি সর্বদলীয় সম্মেলন আহ্বানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।১০০
ইতিপূর্বে শিলচর জেলা কংগ্রেস কমিটি ৭ ডিসেম্বর এক সভায় মিলিত হয়ে বর্তমান আকারের ভাষাবিল যাতে প্রত্যাহার করা হয় সেই মর্মে আসাম প্রদেশ কংগ্রেসকে অনুরোধ জানিয়ে এক প্রস্তাব গৃহীত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন শ্রীনন্দকিশোর সিংহ। প্রস্তাবে এই মর্মে সতর্কবাণী উচ্চারণ করা হয় যে, ‘বর্তমান ভাষাবিলটি যদি প্রত্যাহার করা না হয়, তাহলে দেশের ঐক্য ও অখন্ডতা বিনষ্ট হবে। সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত প্রস্তাবে জেলা কংগ্রেস কমিটি এটাও ব্যক্ত করেন যে, ত্রিপুরা, মণিপুর এবং নেফা এলাকাকে আসামের অন্তর্ভুক্ত করে আসামকে আরও বড়ো এবং সমৃদ্ধিশালী করাই তাঁদের লক্ষ্য। এই অবস্থায় বর্তমান ভাষাবিলটি অনসমিয়া জনগণের মনে রীতিমতো আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে। প্রস্তাবে একথাও বলা হয়, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পন্ডিত গোবিন্দবল্লভ পন্থ এই সমস্যা সমাধানের জন্য যেভাবে সুপারিশ করেছিলেন, আলোচ্য বিলে তা অগ্রাহ্য করা হয়েছে।’১০১
‘১২ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে এগারোটায় শিলচর কংগ্রেস ভবনে হাইলাকান্দি কংগ্রেস কমিটির প্রেসিডেন্ট শ্রীসন্তোষকুমার রায়ের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত শিলচর জেলা কংগ্রেস, হাইলাকান্দি জেলা কংগ্রেস ও করিমগঞ্জ জেলা কংগ্রেস কার্যকরী কমিটির সদস্যবৃন্দ এক সভায় মিলিত হয়ে কাছাড় জেলার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এ সব প্রস্তাবের মধ্যে কাছাড় জেলার প্রশাসন ব্যবস্থাকে আসাম রাজ্য থেকে পৃথককরণ এবং কাছাড়ের জেলা কংগ্রেস তিনটিকে আসাম প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটি থেকে পৃথক করার প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়।
শ্রীহেমচন্দ্র চক্রবর্তী, এমএলএ উত্থাপিত এবং রণেন্দ্রমোহন দাস এমএলএ, সমর্থিত প্রথম প্রস্তাবে আসাম বিধান পরিষদে গৃহীত ভাষাবিল বিষয়ে বলা হয় যে, এই বিল পাস করার ফলে সমগ্র কাছাড় জেলায় ব্যাপক বিক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। পন্ডিত গোবিন্দবল্লভ পন্থ-এর সঙ্গে আলোচনাক্রমে অসমিয়া এবং হিন্দিকে রাজ্যভাষা করার যে নীতি স্বীকৃত হয়েছিল, গৃহীত ভাষাবিলে তাও সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখাত হয়েছে। কংগ্রেসের উচ্চতম কতৃপক্ষ আসাম প্রদেশ কংগ্রেস এবং সরকারকে যে পরামর্শ প্রদান করেছিলেন, তাও প্রত্যাখাত হয়। প্রস্তাবে আরও বলা হয় যে, ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার উদভ্রান্ত জনমতের চাপে পড়ে বিলটি যেভাবে গৃহীত হয়েছে তা সম্পূর্ণভাবে আইন বিগর্হিত এবং সংবিধানবিরোধী। আরও বলা হয়, ভারতের রাষ্ট্রপতি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং কংগ্রেস সভাপতির নিকট অনুরোধ জ্ঞাপন করা হয়েছে যে, তাঁরা যেন অবিলম্বে এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে সুমীমাংসার ব্যবস্থা করেন। গৃহীত প্রস্তাবে কাছাড়ের মূল দাবিকে পুনরায় সমর্থন করে বাংলা, অসমিয়া এবং ইংরেজি—এই তিনটিকে আসামের রাজ্যভাষা করার কথা বলা হয়।’
সভায় গৃহীত দ্বিতীয় প্রস্তাবে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার অধিবাসীগণের স্বার্থকেই প্রতি পদে বড়ো করে তোলার ফলে যেভাবে আসামের সংখ্যালঘিষ্ঠ ভাষাভাষীগণের স্বার্থ পদদলিত হচ্ছে—তার উল্লেখ করে কাছাড়ের ন্যায্য অধিকার রক্ষা করবার জন্য কাছাড়ের জেলা কংগ্রেস কমিটিগুলিকে আসাম প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির আওতা থেকে পৃথক করার জন্য দাবি জানানো হয়। আসামের অন্যান্য যে-সমস্ত অঞ্চল আসাম থেকে পৃথক করার জন্য দাবি জানাচ্ছেন—তাঁদের সঙ্গে একযোগে একটি পৃথক প্রাদেশিক কংগ্রেস গঠন করতে কাছাড়ের জনগণ প্রস্তুত আছেন বলেও প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়।
তৃতীয় প্রস্তাবে কাছাড় জেলার জন্য আসাম থেকে সম্পূর্ণ পৃথক প্রশাসনিক ব্যবস্থা দাবি করা হয়। কাছাড়ের জনমত এবং এ সমস্ত দাবি সম্পর্কে দিল্লি কতৃপক্ষকে অবহিত করার জন্য অবিলম্বে দিল্লিতে একটি প্রতিনিধিদল প্রেরণের সিদ্ধান্তও গৃহীত হয়। জানুয়ারি মাসের তৃতীয় সপ্তাহে করিমগঞ্জে কাছাড় জেলার কংগ্রেসসেবীদের এক কনভেনশন আহ্বানেরও সিদ্ধান্ত হয়’।১০২
ভাষাবিলে রাজ্যপালের অনুমোদনের প্রতিবাদে করিমগঞ্জে সর্বদলীয় জনসভা থেকে প্রচন্ড ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করা হয়। ‘১৯ ডিসেম্বর বিকাল চারটায় করিমগঞ্জ উদবাস্তু বাজারে সকল রাজনৈতিক দলের আহ্বানে এক জনসভায় রাজ্যপাল অনুমোদিত ভাষাবিলের তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয়। সকল রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ ও বিশিষ্ট নাগরিকগণ সভায় যোগদান করেন। করিমগঞ্জ জেলা কংগ্রেস কমিটির প্রাক্তন সভাপতি শ্রীমুনীন্দ্রকুমার দাস সভায় সভাপতিত্ব করেন।’
করিমগঞ্জ যুব কংগ্রেস সম্পাদক শ্রীনৃপতিরঞ্জন চৌধুরী নিম্নলিখিত প্রস্তাব উত্থাপন করে বলেন, রাজ্যপাল আসাম ভাষাবিলে সম্মতিদান করে অন্যায় ব্যবস্থাকে কায়েম করলেন। এর বিরুদ্ধে প্রতিকারের জন্য যে আন্দোলনের প্রয়োজন, আজকের জনসভা তারই পটভূমিকা। বিষয়ের গুরুত্ব উপলব্ধি করে আমাদের ভাষার পূর্ণ মর্যাদা ও সংবিধানপ্রদত্ত অধিকার লাভের সংগ্রামের জন্য ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
সর্বদলীয় সভার প্রস্তাবে বলা হয়, ‘আসাম রাজ্যের শতকরা ষাট ভাগ বাংলা ও অন্যান্য অনসমিয়া ভাষাভাষী নাগরিকের ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে উপেক্ষা এবং ন্যায় নীতিকে লঙ্ঘন করে রাজ্য বিধানসভায় গোষ্ঠী সদস্যদের ভোটাধিক্যের সুযোগে যে ভাষা বিল গৃহীত হয়, আসামের রাজ্যপাল সেই বহুনিন্দিত ও বহুবিতর্কিত ভাষাবিলে সম্মতিদান করায় করিমগঞ্জের সর্বদলীয় জনসাধারণের এই সভা অত্যন্ত বেদনাহত হয়ে গভীর ক্ষোভ সহকারে রাজ্যপাল স্বীকৃত ভাষা-বিলের তীব্র প্রতিবাদ করছে। এই সভা আরও মনে করে যে, এই ভাষা-বিল দ্বারা রাজ্যের অবশিষ্ট ষাট ভাগ বিভিন্ন অনসমিয়া ভাষাভাষীর ভারতীয় সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকার সর্বক্ষেত্রে নির্মমভাবে দলিত হয়েছে; কেননা, অনসমিয়া ভাষাভাষীর ওপর অসমিয়াভাষীদের আধিপত্য ও প্রাধান্যলাভের দুরভিসন্ধি নিয়েই এই ভাষাবিল প্রবর্তন করা হয়েছে। এই অন্যায় দাবির কাছে নতিস্বীকার ভারতীয় শাসনতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রের বিরোধী এবং জাতি ও দেশের পক্ষে সর্বাঙ্গীণভাবে অকল্যাণকর। এই জনসভা উক্ত অকল্যাণকর ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিকারের জন্য জনসাধারণকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে।’
‘করিমগঞ্জ প্রজা সমাজতন্ত্রী দলের সেক্রেটারি শ্রীকুমুদরঞ্জন লুহ উত্থাপিত প্রস্তাব সমর্থন করে বলেন, রাজ্যপালের ভাষাবিলে সম্মতিদানে এটাই প্রমাণিত হয় যে, গুণ্ডামি ও পশুবলের কাছে নতিস্বীকার করা হয়েছে।
করিমগঞ্জ জেলা কংগ্রেস কমিটির সভাপতি শ্রীরণেন্দ্রমোহন দাস এমএলএ বলেন, স্বাধীনতা লাভের পর গত ১৩ বছর যাবৎ অনসমিয়া ভাষাভাষী হিসেবে আমরা নানাভাবে উৎপীড়িত হয়ে আসছি, কিন্তু ভাষার প্রশ্নে আমাদের প্রতিবাদ সত্ত্বেও যে চরম সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে তা আমাদের চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন করেছে।
যুগশক্তি-সম্পাদক শ্রী বিধুভূষণ চৌধুরী বলেন, যাঁরা কর্মক্ষেত্রে জনসেবায় ব্রতী আছেন, তাঁরা যদি কথায় এবং কাজে এক হতেন, তবে এই ভাষাবিলের বিপর্যয় রোধ করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হত। তিনি বলেন, শিলচরে ভাষা সম্মেলনে হাজার হাজার নর-নারীর সমক্ষে যে প্রতিশ্রুতি নেতৃবৃন্দ দিয়েছিলেন এবং যে পবিত্র দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন—তা যদি আমাদের কাছাড় জেলার জনপ্রতিনিধিগণ অক্ষরে অক্ষরে প্রতিপালন করতেন, তবে বর্তমান ইতিহাস অন্যরূপ হত। শ্রীচৌধুরী বলেন, তিনি এখনও আশা করেন যদি কাছাড় থেকে নির্বাচিত লোকসভা ও বিধানসভা সদস্যগণ অবিলম্বে সদস্যপদ ত্যাগ করে জনগণকে প্রয়োজনীয় নেতৃত্ব দিতে অগ্রসর হন, তবে লক্ষ লক্ষ বাংলা তথা অনসমিয়া ভাষাভাষীদের ভাগ্যবিপর্যয় প্রতিরোধ করা সম্ভব হতে পারে।’১০৩
সভায় কমিউনিস্ট নেতা শ্রীযজ্ঞেশ্বর দাস, প্রজাসমাজতন্ত্রী নেতা শ্রীরথীন্দ্রনাথ সেন, ডা. নীরদভূষণ দে প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।
সভাপতি তাঁর ভাষণে বলেন, অসমিয়াকে একমাত্র রাজ্যভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ায় সংবিধানপ্রদত্ত মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ণ হয়েছে, স্বদেশে আমরা আজ পরদেশি।
শিলচর কংগ্রেস ভবনের শ্যামাচরণ হলে তিনটি জেলা কংগ্রেস— শিলচর, হাইলাকান্দি ও করিমগঞ্জের কার্যকরী কমিটির এক যুক্ত বৈঠক ২৬ ডিসেম্বর সকাল এগারোটায় অনুষ্ঠিত হয়। হাইলাকান্দি কংগ্রেস কমিটির সভাপতি শ্রীসন্তোষকুমার রায় সভায় সভাপতিত্ব করেন। ইতিপূর্বে জেলা কংগ্রেসসমূহের যুক্ত অধিবেশনে এবং শিলচর জেলা কংগ্রেস কমিটির বিগত সভায় যেসব প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল—তার পরিপ্রেক্ষিতে ভবিষ্যৎ কর্মসূচি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা হয়।
করিমগঞ্জের শ্রীমনীন্দ্রচন্দ্র দাস, শ্রীরণেন্দ্রমোহন দাস, শ্রীমন্মথ দত্ত, মওলানা আবদুল জলিল, শিলচরের মহ. হুরমত আলি বড়লস্কর, মহ. গোলাম ছবির খান, শ্রীসুরেশচন্দ্র বিশ্বাস, শ্রীনন্দ কিশোর সিংহ, শ্রীললিতমোহন সিংহ, খান বাহাদুর মাহমুদ আলি, শ্রীসনৎকুমার দাস, শ্রীহেমচন্দ্র চক্রবর্তী, শ্রীমতী জ্যোৎস্না চন্দ, শ্রীরায়চাঁদ নাথ, দীনেশচন্দ্র সিংহ প্রমুখ সভায় উপস্থিত ছিলেন।
‘সভায় গৃহীত প্রস্তাবে বলা হয় যে, কাছাড়ের কংগ্রেস প্রতিনিধিদল ভারতের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সংবিধানের ৩৪৭ অনুচ্ছেদ অনুসারে আসামের অন্যতম রাজ্যভাষা হিসাবে বাংলা ভাষার পূর্ণ স্বীকৃতির জন্য রাষ্ট্রপতিকে অনুরোধ করবেন। ভাষা প্রশ্নে কাছাড় কংগ্রেসের ভূমিকা সম্পর্কে সর্বসাধারণকে অবহিত করার উদ্দেশ্যে মুদ্রিত পুস্তিকার ব্যাপক প্রচারের জন্য এক সাব-কমিটি গঠনেরও সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
আগামী জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়ে করিমগঞ্জে এক সম্মেলন আহ্বান এবং সেই সম্মেলনে রাজ্য ভাষা প্রশ্নে ভবিষ্যৎ কর্মসূচি বিষয়ে প্রস্তাব গ্রহণের কথাও সিদ্ধান্তে উল্লেখিত হয়।’১০৪
ভাষাবিলে রাজ্যপালের অনুমোদন দেওয়ায় বাংলাভাষীদের প্রতিবাদ অব্যাহত থাকল।
১ জানুয়ারি ১৯৬১ তারিখে নিখিল আসাম বাংলা ভাষা সমিতির উদ্যোগে শিলচর নরসিংটোলা মাঠে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। অধ্যাপক শরৎচন্দ্র নাথ সভায় সভাপতিত্ব করেন। ‘কাছাড় ও পার্বত্যবাসীর ঐক্যবদ্ধ বিরোধিতা অগ্রাহ্য করে অসমিয়া ভাষাকে একমাত্র রাজ্য ভাষা ঘোষণার ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কাছাড়বাসীর করণীয় নির্ধারণে প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে সভাটি আহূত হয়।
করিমগঞ্জের শ্রীনলিনীকান্ত দাস এবং শ্রীবিধুভূষণ চৌধুরী আনুপূর্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে ঐক্যবদ্ধ গণ-আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। মৌলবি হুরমৎ আলি বড়লস্কর মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার সংগ্রামে বাঙালি হিন্দু-মুসলমানের সম্মিলিত উদ্যমের আহ্বান জানান। নিজেদের মধ্যে ভেদ-বিভেদ ভুলে যদি অগ্রসর না হওয়া যায়, তা হলে ভবিষ্যৎ বংশধরগণ বর্তমান কাছাড়বাসীগণকে ক্ষমা করবে না। রাজ্য বিধানসভা কংগ্রেসি সদস্য শ্রীমতী জ্যোৎস্না চন্দ তাঁর বক্তৃতায় শিলচরের জনগণের কাছ থেকে নির্দেশ আহ্বান করে বলেন যে, তাঁদের বিরোধিতা সত্ত্বেও ‘অন্যায়’ ভাষাবিল রাজ্যপালের অনুমোদন লাভ করেছে। এই অবস্থা মেনে নেওয়া যায় না। সুতরাং বাংলা ভাষাকে অন্যতম সরকারি ভাষারূপে স্বীকৃতি আদায় করে নেওয়ার জন্য ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের প্রয়োজন বলে তিনি উল্লেখ করেন। জেলার বিশিষ্ট প্রজাসমাজতন্ত্রী নেতা শ্রীরথীন্দ্রনাথ সেন তাঁর ভাষণে কাছাড়বাসীকে গণসংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানান। সভাপতি শ্রীশরৎচন্দ্র নাথ তাঁর ভাষণে আসামের বহুভাষী চরিত্রের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন।’১০৫
একমাত্র অসমিয়াকে রাজ্যের সরকারি ভাষা করার প্রতিবাদে এবং বাংলাকে অন্যতম সরকারি ভাষা করার লক্ষ্যে গোটা কাছাড় জেলা যখন আন্দোলন, প্রতিবাদ মিছিলে উদবেলিত তখন করিমগঞ্জে রমণীমোহন ইনস্টিটিউট হলে ১৯৬১ সালের ১৫ জানুয়ারি তারিখে অনুষ্ঠিত হল কংগ্রেস কর্মী সম্মেলন। সংগতকারণেই ভারতের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হিসেবে কংগ্রেসের প্রতি কাছাড়ের মানুষের প্রত্যাশা একটু বেশিই ছিল। কিন্তু বাঙালি অধ্যুষিত কাছাড়ের মানুষের সেই প্রত্যাশা কি পূরণ হয়েছিল? সেদিন সভায় বেশ কয়েকটি সিদ্ধান্তের সঙ্গে ‘রাষ্ট্রপতি, কংগ্রেস সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রীর নিকট কাছাড়ের দাবি উপস্থিত করবার জন্য একটি ডেপুটেশন প্রেরণের সিদ্ধান্তও গৃহীত হয়।’ কিন্তু তারপর?
সভায় সভাপতিত্ব করেন এমপি শ্রীশীলভদ্র যাজি। করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দি ও শিলচর শহরের কংগ্রেসকর্মী ছাড়াও গ্রামাঞ্চল থেকে দুশোরও বেশি নারী-পুরুষ কংগ্রেসকর্মী সম্মেলনে যোগদান করেন। ‘আসাম প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির আওতার বাইরে কাছাড়ের জন্য একটি পৃথক কংগ্রেস সংস্থা গঠনের দাবি সভায় সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। কাছাড়ের স্বার্থ রক্ষার জন্য বর্তমানে পৃথক প্রশাসন ব্যাবস্থাও অপরিহার্য হয়ে পড়েছে বলে সম্মেলনে প্রস্তাব গৃহীত হয়।’
অতুলপ্রসাদ সেন-এর ‘মোদের গরব, মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা’ শীর্ষক সংগীতটি পরিবেশনের মধ্যদিয়ে সভার কাজ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়।
কাছাড় জেলা কংগ্রেসকর্মী সম্মেলনের আহ্বায়ক শ্রীরণেন্দ্রমোহন দাস এমএলএ তাঁর প্রারম্ভিক বক্তৃতায় বলেন, ‘বিগত জুলাই মাসে শিলচরে অনুষ্ঠিত ভাষা সম্মেলন সকল দলের সহযোগিতায় বিশেষ সাফল্যের সঙ্গে অনুষ্ঠিত হয়। এমতাবস্থায় এখন কেন অন্যান্য সকল রাজনৈতিক দলের লোকদের বাদ দিয়ে শুধু কংগ্রেস কর্মীদের মধ্যেই এই সম্মেলন সীমাবদ্ধ রাখা হচ্ছে, সে প্রশ্নও কেউ কেউ তুলেছেন। এ সম্পর্কে শ্রীদাস মনে করেন যে, ভাষা আইন গৃহীত হওয়ার পর এখন কাছাড়ের মানুষের কী কর্তব্য সে-সম্পর্কে কংগ্রেসকর্মীরাই সকলে একমত নন। ভাষা আইন সম্পর্কে কমিউনিস্ট পার্টি যে অভিমত পোষণ করেন, তার ফলে, তাঁদের সঙ্গে একত্রে আন্দোলন করার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। কাছাড়ের কর্তব্য সম্পর্কে কংগ্রেসসেবীরা একমত হলে পর অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সহযোগিতায় আন্দোলন আরম্ভ করার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। শ্রীদাস বলেন যে, প্রাক্তন মন্ত্রী জনাব আবদুল মতলিব মজুমদারকে আমন্ত্রণ জানিয়ে যে চিঠি দেওয়া হয়েছিল, তিনি তার কোনো উত্তর দেননি।’১০৬
নির্বাচিত সভাপতি, এমপি শ্রীশীলভদ্র যাজি সভায় সর্বশ্রী ফিরোজ গান্ধী, এমপি, শৈলজামোহন দাস, হিলালউদ্দিন চৌধুরী এবং আসাম উপত্যকায় ভাষার নামে নারকীয় দাঙ্গায় যাঁরা প্রাণ হারিয়েছেন তাঁদের বিদেহী আত্মার শান্তি কমনা এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়ে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে দু-মিনিটকাল নীরবে দাঁড়িয়ে থাকনে। সভায় উপস্থিত সকলে দাঁড়িয়ে সভাপতিকে অনুসরণ করেন।
সম্মেলনে যোগদান করতে না পারায় দুঃখ প্রকাশ এবং সম্মেলনের সাফল্য কামনা করে যেসব চিঠি, টেলিগ্রাম প্রেরিত হয়, সভায় তা পাঠ করা হয়। মুখ্যমন্ত্রী বিমলাপ্রসাদ চালিহা সম্মেলনে উপস্থিত থাকতে না পারায় যে চিঠি পাঠিয়েছিলেন—তাতে বলা হয়, ‘ভাষা আইন যেভাবে পাস হয়েছে, তাতে যদিও কাছাড়ের দুঃখবোধ করার কারণ হয়েছে, তথাপি তিনি আশা করেন যে, কাছাড়ের মানুষেরা ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার ছ-টি জেলার লোকের হৃদয়ের আবেগও অনুভব করতে চেষ্টা করবেন।’
সভায় শোকপ্রস্তাবসহ দশটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। শ্রীদ্বারিকানাথ তেওয়ারি তৃতীয় প্রস্তাব উত্থাপন করে বলেন, ‘আসাম গভর্নমেন্টের বৈষম্যমূলক ব্যবহারের ফলে কাছাড়ের লোকের কর্মে নিয়োগ এবং আর্থিক অবস্থার উন্নয়ন ব্যাহত হয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে যে আসাম উপত্যকার লোকের ব্যবহারের কোনো পরিবর্তন ঘটবে, তারও কোনো সম্ভাবনা নেই। অসমিয়াদের বৈষম্যমূলক এবং প্রতিহিংসামূলক মনোভাবের ফলে এটা এখন সুস্পষ্ট যে, তাঁদের সঙ্গে একই প্রশাসনিক ব্যবস্থায় থাকা সম্ভব নয়। কেন্দ্রীয় গভর্নমেন্টের কাছে কাছাড়ের দাবি এই যে, অবিলম্বে কাছাড়ের জন্য উপযুক্ত প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক—যার ফলে কাছাড়ের লোকের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের সুযোগ পাওয়া যায়। মহ. হুরমত আলি বড়লস্কর, আবদুল হামিদ মজুমদার ও নৃপতিরঞ্জন চৌধুরীর সমর্থনের পর প্রস্তাবটি সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। ১০৭
আমরা সম্মেলনে গৃহীত দশটি প্রস্তাবই গভীর মনোযোগের সঙ্গে পাঠ করেছি। কিন্তু পরিতাপের বিষয় বাংলা ভাষার দাবি সংবলিত কোনো প্রস্তাব সেখানে স্থানলাভ করেনি। এ বিষয়ে অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি অ্যাডভোকেট আবদুর রহমান চৌধুরী। তিনি কংগ্রেসসেবীও বটে। তিনি একস্থানে উল্লেখ করেন:
… বিগত ১৯৬১ জানুয়ারি মাসের ১৫ তারিখে হাইলাকান্দি, শিলচর ও করিমগঞ্জ জেলা কংগ্রেসের এক যুক্ত অধিবেশনে ৩নং প্রস্তাবে কাছাড়কে আলাদা করিয়া এক পৃথক শাসনতান্ত্রিক সংস্থা গঠনের দাবি এবং ২নং প্রস্তাবে কাছাড় কংগ্রেসকে আসাম কংগ্রেস হইতে আলাদা করার প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু … আশ্চর্যের বিষয় যে, উক্ত কংগ্রেসের সভায় বাংলা ভাষাকে আসামের অন্যতম রাজ্য ভাষারূপে মর্যাদা দেওয়ার কোনো প্রস্তাব নেওয়া হয় নাই। সেইহেতু আমারই সভাপতিত্বে করিমগঞ্জে অনুষ্ঠিত বিগত ৫ ফেব্রুয়ারি তারিখে কাছাড় জেলা জনসম্মেলনের ৩য় প্রস্তাব অনুযায়ী অবিচারমূলক রাজ্যভাষা আইন প্রত্যাহারক্রমে বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাজ্যভাষা করা এবং অন্যান্য অনসমিয়া ভাষাকেও যোগ্য মর্যাদা দানের ব্যবস্থা করার দাবি জানানো হয় এবং ইহাকে কার্যকারী করার জন্য সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। সংগ্রাম পরিষদ কাছাড় জেলাকে আসাম হইতে বিচ্ছিন্ন করার জন্য কোনো আন্দোলন করে নাই।১০৮
কাছাড় কংগ্রেসিরা এক থাকতে পারেননি, সে তো দিবালোকের মতোই স্পষ্ট। রণেন্দ্রমোহন দাস সম্মেলন মঞ্চে দাঁড়িয়ে সেকথা স্বীকারও করেছেন। ওঁরা যখন বাঙালির মায়ের ভাষা, আর মুখের ভাষাকে ‘কেড়ে নিতে চায়’ তখন সেই বাঙালির বাংলা ভাষাকে অগ্রাধিকার না দিয়ে আসাম থেকে পৃথক হওয়ার খেলায় মেতে ওঠার প্রয়াসকে মানুষ যে সুনজরে দেখেননি, তা তো ক-দিনেই স্পষ্ট হয়ে গেল।
বিষয়টি আরও স্পষ্ট করেন ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী বিশিষ্ট গবেষক শ্রী সুজিৎ চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘…এই কংগ্রেস কনভেনশনের বাইরের সমারোহের অন্তরালে যে সংকীর্ণ অন্তর্দ্বন্দ্বের বীজ নিহিত ছিল, তার লক্ষণ সম্মেলনের সময়েই প্রকাশিত হয়েছিল। স্বতন্ত্র প্রদেশ কংগ্রেস এবং স্বতন্ত্র প্রশাসনিক ইউনিট গঠন সম্পর্কে প্রস্তাব দু-টি গ্রহণের সময়ে মৌলানা আবদুল জলিল চৌধুরী তীব্র আপত্তি করেন এবং শেষপর্যন্ত সভা ছেড়ে বেরিয়ে যান। মৌলানা সাহেবের আচার-আচরণে এক ধরনের সহজ সরলতা ছিল। মুখে এক, মনে আর একজাতীয় ভন্ডামি তিনি পরিহার করতেন। এই দু-টি প্রস্তাব কার্যকর করার চেষ্টা হলে বরাক উপত্যকার অভ্যন্তরেই যে শক্তিশালী চক্র থেকে তার বিরোধিতা হওয়া সম্ভব, সে-সম্পর্কে মৌলানা সাহেব সম্পূর্ণ সচেতন ছিলেন এবং সে-ধরনের বিরোধিতা এলে যে কংগ্রেসিরা এক পাও অগ্রসর হতে পারবেন না, তাও মৌলানা সাহেব জানতেন। কার্যত তাই হয়েছিল।’১০৯
২০ জানুয়ারি ’৬১, ভারতের জাতীয় কংগ্রেস সভাপতি শ্রীসঞ্জিব রেড্ডি শিলচর পৌঁছোলেন কাছাড় কংগ্রেসসেবীদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য। আসলে কংগ্রেস সভাপতি মহোদয় যে বর্তমান পরিস্থিতিজনিত কারণে কাছাড় রাজনীতির হালহকিকত সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হতেই এসেছেন —তা মনে করার যথেষ্ট কারণ বর্তমান।
এ দিন বিকালে সংস্কৃতি ভবনে দু-শো লোকের উপস্থিতিতে স্থানীয় কংগ্রেসের পক্ষ থেকে সভাপতি শ্রীরেড্ডিকে সংবর্ধনা প্রদান করা হয়। শিলচর জেলা কংগ্রেস সভাপতি শ্রীনন্দকিশোর সিংহ ‘আসাম প্রদেশে কাছাড় জেলার উপেক্ষিত অবস্থার চিত্র তুলে ধরে এক স্মারকলিপি পাঠ করেন এবং তা কংগ্রেস সভাপতির হাতে অর্পণ করেন। শ্রীরেড্ডি অভ্যর্থনার উত্তরে আসাম দাঙ্গার জন্য অসমিয়ারাও নিশ্চয় লজ্জাবোধ করেন—এই কথা বলে তিনি শান্তিপূর্ণ উপায়ে সকল সমস্যার মীমাংসা করার জন্য সকলের কাছে আবেদন জানান।’১১০
শিলচর থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক পত্রিকা জনশক্তি-র প্রথম পৃষ্ঠায় বক্স করে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে মুদ্রিত হয় ‘করিমগঞ্জে কনভেনশন, ৫ ফেব্রুয়ারি ’৬১ শীর্ষক সংবাদ। এই সংবাদের মধ্য দিয়ে কার্যত বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলনের ধারায় এক নতুন মাত্রা সংযোজিত হল বলে মনে করা যেতে পারে। সংবাদে বলা হয় : ‘‘কাছাড় জেলা কর্ম পরিষদের উদ্যোগে আগামী ৫ ফেব্রুয়ারি রবিবার অপরাহ্ণ ৩ ঘটিকায় করিমগঞ্জ টাউন হল প্রাঙ্গণে কাছাড় জেলার সমস্ত জাতি, সম্প্রদায় এবং দল ও মতের অনুগামীদের এক কনভেনশন অনুষ্ঠিত হইবে। আসামের ভাষা আইনের ফলে কাছাড়ের স্বার্থকে যেভাবে পদদলিত করা হইয়াছে তাহার প্রতিবিধানের উদ্দেশ্যেই সম্মেলন আহ্বান করা হইয়াছে। এই সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কর্মপন্থা স্থির করিবার জন্য কাছাড় জেলার সমস্ত জাতি, সম্প্রদায় এবং দল ও মতের অনুগামীদের সম্মেলন আহ্বান করিয়া উদ্যোক্তাগণ কাছাড়বাসী সর্বসাধারণের সমর্থন, সহযোগিতা ও শুভেচ্ছা প্রার্থনা করিয়াছেন।
কাছাড় জেলা কর্ম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক শ্রীনলিনীকান্ত দাস, করিমগঞ্জ— এই ঠিকানায় পূর্বাহ্নে সংবাদ পাঠাইয়া যেকোনো সংখ্যক প্রতিনিধি কাছাড় জেলার যেকোনো স্থান হইতে এই সম্মেলনে যোগদান করিয়া স্ব স্ব মতামত দিতে পারিবেন। আবেদনের মাধ্যমে জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে সকলকে অনুরোধ জ্ঞাপন করা হইয়াছে—বিষয়ের গুরুত্ব বিবেচনায় প্রত্যেকেই যেন স্বকীয় প্রয়াসে এই সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। ৫ ফেব্রুয়ারি পূর্বাহ্ন দশ ঘটিকায় করিমগঞ্জ রমণীমোহন ইনস্টিটিউটে বিষয় নির্বাচনী সভার অনুষ্ঠান হইবে।’১১১
ইতিমধ্যে কাছাড় জেলা জনসম্মেলন আয়োজকদের পক্ষ থেকে সংবাদপত্রে একটি প্রচারপত্র প্রকাশ করা হয়। পঞ্চান্ন বছরের পুরোনো সেই দলিলটি বর্তমানে এবং আগামী প্রজন্মের উদ্দেশ্যে তুলে ধরা প্রয়োজন বলেই আমাদের মনে হয়েছে। সংবাদপত্রে বলা হল:
বহু ভাষাভাষী অধ্যুষিত আসাম রাজ্যের বিধান সভায় অসমিয়াভাষী সদস্যের সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুযোগে একমাত্র অসমিয়া ভাষাকেই রাজ্যভাষা করিয়া যে বহুনিন্দিত ও বিতর্কিত ভাষা বিল গৃহীত হইয়াছিল, অনসমিয়া ভাষাভাষীদের ন্যায়সংগত ও বিধিসম্মত তীব্র প্রতিবাদ সত্ত্বেও আসামের রাজ্যপাল ওই আপত্তিকর বিলে সম্মতিদান করিয়া উহাকে আইনে পরিণত করিয়াছেন। ইহার ফলে এই রাজ্যের অনসমিয়া ভাষাভাষীগণ, বিশেষভাবে বাংলাভাষাভাষীগণ এক দারুণ সংকটের সম্মুখীন। সংকীর্ণ প্রাদেশিকতা ভারতের মহান ঐতিহ্য ও আদর্শকে কলঙ্কিত করিতেছে দেখিয়াও শাসনক্ষমতায় আসীন কতৃপক্ষ নির্বিকার ও উদাসীন। বাংলাভাষাভাষী অধ্যুষিত কাছাড় জেলার জনচিত্ত আজ বিক্ষুব্ধ ও ভাবী বিপদের আশঙ্কায় দারুণ চিন্তাগ্রস্ত। যে কোনো সক্রিয় পন্থাবলম্বনে এই চমর সংকট হইতে মুক্তির জন্য সকলেই উদগ্রীব।
এই পরিস্থিতিতে কাছাড়বাসীর কর্তব্য নির্ধারণ ও বিপত্তি প্রতিরোধার্থ প্রস্তাবিত কার্যক্রমে জনমতের সম্মতি গ্রহণের উদ্দেশ্যে আগামী ৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৬১ ইং রবিবার করিমগঞ্জ সহরে কাছাড় জেলা জনসম্মেলনের এক অধিবেশন হইবে। এই গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলনে দল-মত-জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে দেশের কল্যাণকামী সর্বশ্রেণির জনগণকে যোগদান করিতে ও সুচিন্তিত কর্মপন্থা গ্রহণের ব্যবস্থা করিতে আবেদন জ্ঞাপন করা যাইতেছে। সকলের সক্রিয় সহযোগিতায় সম্মেলনের উদ্দেশ্য সাফল্যমন্ডিত হইয়া উঠুক।১১২
কার্যসূচি
তারিখ : ৫/২/৬১ ইং (রবিবার)
পূর্বাহ্ন ১০ ঘটিকা হইতে মধ্যাহ্ন
১ ঘটিকা। বিষয়— নির্বাচনী সভা।
স্থান : করিমগঞ্জ রমণীমোহন ইনস্টিটিউট;
অপরাহ্ণ ৩ ঘটিকা— প্রকাশ্য অধিবেশন
স্থান : টাউন ব্যাঙ্ক প্রাঙ্গণ, করিমগঞ্জ
ইতি
নিবেদক
সুরেন্দ্রনাথ চৌধুরী, সভাপতি; নলিনীকান্ত দাস,
সাধারণ সম্পাদক; নীরদভূষণ দে, নৃপতি চৌধুরী,
যুগ্ম সম্পাদক; নিরঞ্জন চৌধুরী, কোষাধ্যক্ষ,
অভ্যর্থনা সমিতি, কাছাড় জেলা জনসম্মেলন।
জনসম্মেলনকে কেন্দ্র করে কাছাড়ের মানুষের মধ্যে বিপুল উৎসাহ, উদ্দীপনা লক্ষ করা যায়। সকল মত-পথ, জাতি-ধর্ম-সম্প্রদায়কে সঙ্গে নিয়েই তাঁরা অন্যায়-অবিচারের প্রতিকার চান, তাঁরা চান বাংলা ভাষার মান বাঁচাতে। সম্মেলন থেকে যেন সঠিক পথ নির্দেশিত হয়, সে-বিষয়েও সতর্কবাণী উচ্চারিত হয় বিভিন্ন মহল থেকে। বলা হয়: ‘সম্মেলনের সিদ্ধান্ত ও নির্ধারিত কার্যক্রমের ওপর এই জেলার ভাবী কল্যাণ বহুলাংশে নির্ভর করবে বলেই আমাদের ধারণা। সম্মেলনের নির্দেশের প্রতি এই জেলাবাসী আগ্রহ সহকারে চেয়ে আছেন। জন প্রতিনিধিগণ সম্মেলনের গুরুত্ব উপলব্ধি এবং পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে ধীর ও স্থিরভাবে সিদ্ধান্তগ্রহণ করবেন বলেই বিশ্বাস। ব্যক্তিগত স্বার্থ, পদমর্যাদার লোভ, দলীয় মোহ, ব্যক্তিগত বিরোধ, বিদ্বেষ ও দুর্বল মনোভাব যেন কাছাড়ের সামগ্রিক কল্যাণকে ব্যাহত না করে। কোনো অবস্থায়ই যেন অসমিয়া স্বেচ্ছাচারকে প্রশ্রয় না দেওয়া হয়। সর্বধিক সংকীর্ণতা ও হীনতার ঊর্ধ্বে থেকে দেশ ও জাতির কল্যাণে, সংকীর্ণ মনোবৃত্তিসজ্ঞাত অবিচারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সর্বশক্তি প্রয়োগে এর প্রতিরোধের জন্য উদবুদ্ধ হতে হবে। আত্মমর্যাদাবোধে সচেতন জাতি হিসেবে আমরা যেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুদ্রের মতো কঠোর হতে পারি। আমাদের জীবনবীণার সুপ্ত তন্ত্রীগুলি পুনরায় ঝংকৃত হয়ে উঠুক।’১১৩
পূর্বঘোষণা অনুযায়ী ৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৬১, সকাল দশটায় স্থানীয় রমণীমোহন ইনস্টিটিউটে চার শতাধিক প্রতিনিধির উপস্থিতিতে অধিবেশন আরম্ভ হয়। শিলচর, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দি মহকুমার শহর ও গ্রামাঞ্চল থেকে এ সব প্রতিনিধি আসেন। অভ্যর্থনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক শ্রীনলিনীকান্ত দাস সম্মেলনে উপস্থিত সকলকে স্বাগত জানিয়ে সংক্ষেপে সম্মেলনের উদ্দেশ্য বর্ণনার পর সম্মেলনে সভাপতিত্ব করার জন্য প্রাক্তন হাইলাকান্দি লোকাল বোর্ড চেয়ারম্যান— আইনজীবী জনাব আবদুর রহমান চৌধুরীর নাম প্রস্তাব করলে পর শ্রীব্যোমকেশ দাস তাতে সমর্থন জানান। বিপুল হর্ষধ্বনির মধ্যদিয়ে আবদুর রহমান চৌধুরী সভাপতির আসন গ্রহণ করেন। এরপরই অভ্যর্থনা কমিটি চেয়ারম্যান শ্রীসুরেন্দ্রনাথ চৌধুরী সম্মেলন সভাপতি ও উপস্থিত প্রতিনিধিবর্গকে স্বাগত জানান।
অনুষ্ঠানের মূলপর্বে প্রবেশের পূর্বেই সভাপতি আবদুর রহমান চৌধুরী এক শোক প্রস্তাব উত্থাপন করেন। গত জুলাই মাসে ‘ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় নারকীয় কান্ডে যে সব নির্দোষ ও নিরীহ বাঙালি ‘‘বঙ্গাল খেদা’’ আন্দোলনে উন্মত্ত অসমিয়া আততায়ীর হাতে প্রাণদান করেছেন—, তাঁদের পুণ্যস্মৃতির উদ্দেশে সকলে দাঁড়িয়ে নীরবতা পালন করেন। অভ্যর্থনা সমিতি প্রণীত খসড়ার মূল প্রস্তাব উত্থাপন করেন কুমুদরঞ্জন লুহ এবং সমর্থন জানান হাইলাকান্দির শ্রীদীনেশচন্দ্র সিংহ। আলোচনায় অংশ নিয়ে সুনির্দিষ্ট মতামত ব্যক্ত করেন সর্বশ্রী- মহ. হুরমত আলি বড়লস্কর, বিনয়েন্দ্র চৌধুরী, প্রফেসর যতীন্দ্রনাথ দে, পরিতোষ পালচৌধুরী, সনৎকুমার চক্রবর্তী, শক্তিধর চৌধুরী, অমিয়কুমার নন্দী, রথীন্দ্রনাথ সেন, বিধুভূষণ চৌধুরী, ভূপেন্দ্র সিংহ প্রমুখ।
জননেতা শ্রীঅনিলকুমার বর্মণ তাঁর উদবোধনী ভাষণে বলেন:
…আমরা ভাষা আইনের জন্য দারুণ বিপর্যয়ের মুখে পতিত হয়েছি। গত জুলাই মাসে আমরা শিলচর সম্মেলনে যে যুক্তিপূর্ণ দাবি জানিয়েছিলাম, তা প্রত্যাখ্যাত হয়ে কুখ্যাত ভাষা আইন গ্রহণ করতে আসাম উপত্যকায় যে অরাজকতা সৃষ্টি করা হয়েছিল, তার বীভৎসতার তুলনা মেলে না।
আসাম বিধানসভায় কাছাড়ের সদস্য ও কাছাড়ের লোকসভার প্রতিনিধিগণের দ্বিধাজড়িত আচরণে কাছাড়ের মানসম্মান আহত ও স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হতে চলেছে। শিলচর সম্মেলনের মাধ্যমে কাছাড় জেলাবাসী দাবি করেছিল— বিধানসভা ও লোকসভার সদস্যদের উপস্থিতিতে অসমিয়াকে একমাত্র রাজ্য ভাষা স্বীকারে ভাষাবিল সভায় উপস্থিত হলে তাঁরা তা প্রত্যাখ্যান করে পদত্যাগ করবেন। যে কংগ্রেস সরকার শাসনক্ষমতা হাতে রেখে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার নারকীয় কান্ডের নির্মম অত্যাচারের প্রতিকারের কোনো ব্যবস্থা করতে পারেননি, সেই কংগ্রেসের নামে কংগ্রেস সরকারের বিধানসভায় থাকা কোনো অবস্থায়ই সম্মানজনক বিবেচিত হতে পারে না। পূর্ববঙ্গে বাঙালিগণ বাংলা ভাষার জন্য মৃত্যুকে তুচ্ছ করে যে সংগ্রাম করেছিলেন, আমাদের উচিত তাঁদের সংগ্রাম থেকে প্রেরণা লাভ করা—এই কথা বলেই আজকের এই গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলন উদবোধন করছি, এবং আপনারা আমাকে এই সুযোগদানের জন্য নিজেকে ধন্য জ্ঞান করছি।১১৪
অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি শ্রীসুরেন্দ্রনাথ চৌধুরী তাঁর লিখিত অভিভাষণ পাঠ করেন। শ্রীচৌধুরী বিরাজমান পরিস্থিতির ব্যাখ্যা দিয়ে মাতৃভাষার মান রক্ষায় কাছাড়বাসীকে দৃঢ়পায়ে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
প্রধান অতিথি অধ্যাপক শরৎচন্দ্র নাথ তাঁর ভাষণে বলেন:
আজ এই সম্মেলনে, কাছাড়ের সংকটজনক পরিস্থিতি বিবেচনায় এক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে উপস্থিত হয়েছি। গত ১৩ বছরে আমাদের এই জেলার কোনো প্রকার আর্থিক উন্নতি হয়নি কতৃপক্ষের স্বেচ্ছাকৃত অবহেলার জন্য। অধিকন্তু আজ আমাদের ভাষা, আমাদের সংস্কৃতি বিপন্ন। শুধু বাংলাভাষাভাষী আমাদের নয়—এই রাজ্যের অন্যান্য অনসমিয়া ভাষা এবং তাঁদের কৃষ্টিও বিপন্ন। পশ্চিম মহাদেশে বহু রাজ্য আছে বহুভাষাভাষী। কিন্তু সেখানে প্রত্যেক ভাষার যথাযোগ্য মর্যাদা দিয়েই ভাষা সমস্যার সমাধান করা হয়েছে। সেখানে এক ভাষা একচ্ছত্র প্রাধান্য নিয়ে অন্য ভাষাকে দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করছে না। দৃষ্টান্ত স্বরূপ উল্লেখ করতে পারি যুগোস্লাভিয়া ও ইজরায়েলের কথা। যুগোস্লাভিয়ায় মাত্র ৮০ হাজার ইটালিয়ান আছেন। মোট জনসংখ্যার তুলনায় ইটালিয়ান অতি নগণ্য—কিন্তু যুগোস্লাভিয়ায় ইটালিয়ান ভাষাকে যোগ্য মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, তাঁদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রক্ষার জন্য সরকার অকৃপণ হস্তে অর্থদান করেছেন। আমাদের সরকারকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখালেও দেখেন না। ভাষা ও কৃষ্টির সমস্যা সংখ্যাগুরু (majority) ও সংখ্যালঘু (minority) ভোট দিয়ে মীমাংসা হয় না। শিলচর সম্মেলনে আমাদের যুক্তিপূর্ণ প্রস্তাবের প্রতি কী কেন্দ্রীয় সরকার কী রাজ্য সরকার কেউই দৃষ্টি দেননি। রাজ্যের সমস্যা আপোশে ও সর্বসম্মতিতে মীমাংসায় পৌঁছোনোই সত্যিকার গণতন্ত্র। সংখ্যালঘুর ওপর সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুযোগে সংখ্যাগুরুর অযৌক্তিক অভিমত চাপানো সত্যিকারের গণতন্ত্র নয়। এটা গণতন্ত্রের বিকার। ভাষা আইনে সৃষ্ট সংকটজনক পরিস্থিতিতে আমাদের বলিষ্ঠ পন্থা অবলম্বন করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। আমরা আমাদের ভাষা ও কৃষ্টি অন্যের ওপর চাপাতে চাই না, কিন্তু আমাদের ভাষা ও কৃষ্টিকে সর্বপ্রযত্নে রক্ষা করতে চাই। আজ আমাদের দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করে অন্যায়ের প্রতিরোধ করতে হবে।১১৫
জাতীয়তাবাদী নেতা, বিশিষ্ট সাংবাদিক শিলচরের মহ. হুরমত আলি বড়লস্কর দ্বিতীয় প্রস্তাব উত্থাপন করে বলেন, ‘গত জুন-জুলাই মাসে আসামের সংবাদপত্রসমূহ দাঙ্গার সময় রহস্যজনকভাবে সংবাদপত্রের দায়িত্বে ও কর্তব্যে অবহেলা করে হাঙ্গামার সত্য বিবরণ প্রকাশে বিরত থাকেন। সত্য সংবাদকে গোপন রেখে অন্ধকূপ হত্যার এক চক্রান্ত যখন আসামে চলেছিল, তখন কলকাতার সংবাদপত্রসমূহ সত্য প্রকাশে অগ্রসর হয়ে সাংবাদিকতার যে মর্যাদা রক্ষা করেছিলেন, তাতে তাঁরা আমাদের কৃতজ্ঞতাভাজন ও ধন্যবাদার্হ হয়েছেন। কলকাতার সংবাদপত্রসমূহের প্রতিনিধিগণ আসামে বিপদের ঝুঁকি নিয়ে সংবাদ সংগ্রহ করেছেন। তাঁদের প্রতিনিধি নিহতও হয়েছেন। কিন্তু পুরস্কার তাঁরা পেয়েছেন এই যে, তাঁদের ওপর অযথা অন্যায় দোষারোপ করা হয়েছে এই বলে যে, তাঁরা সংবাদ প্রকাশ করে দাঙ্গার প্ররোচনা দিয়েছেন! এখন, প্রকাশ হচ্ছে যে, তাঁরা যে সংবাদ প্রকাশ করেছিলেন তা সবই সত্য।’
প্রস্তাব সমর্থন করে শিলচরের অপর বিশিষ্ট নাগরিক শ্রীতারাপদ ভট্টাচার্য বলেন, ‘প্রাদেশিকতার দোষে দুষ্ট হলে সাংবাদিকের কর্তব্য ও উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়। প্রাদেশিকতার মোহে অন্ধ হয়ে আসামের পত্রিকাসমূহ শুধু তাঁদের পবিত্র কর্তব্যে অবহেলা করেননি—বিকৃত ও মিথ্যা সংবাদ পরিবেশন করে উত্তেজনা বৃদ্ধিতে সহায়তা করেছেন। সেই দারুণ বিপর্যয়ে পশ্চিমবঙ্গের সংবাদপত্রের অবদানেই দিল্লির কর্তাদের টনক নড়েছিল। তাঁরাই দাঙ্গার বীভৎস রূপ সত্যিকারভাবে প্রকাশ করে আসামের প্রতি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। …সেজন্য আমরা তাঁদের কাছে কৃতজ্ঞ। প্রস্তাবটি করতালির মাধ্যমে সর্বসম্মতিতে গৃহীত হয়।’
তৃতীয় অর্থাৎ মূল প্রস্তাব উত্থাপন করেন শ্রী কুমুদরঞ্জন লুহ এবং সমর্থন জানান হাইলাকান্দির শ্রীদীনেশচন্দ্র সিংহ। দীর্ঘ প্রস্তাবে বলা হল: ‘স্বাধীনতা লাভের পরবর্তী অধ্যায়ে বাঙালি ও অনসমিয়া ভাষাভাষী কাছাড় জেলা আসাম সরকার ও ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার নেতৃবৃন্দ কতৃক সর্বদিকে ও সর্বস্তরে উপেক্ষিত এবং স্বাধীনতালব্ধ স্বাভাবিক উন্নতি ও সর্বাঙ্গীণ বিকাশ লাভে বঞ্চিত। আসাম সরকারের বৈষম্যমূলক আচরণের নির্লজ্জ অভিব্যক্তি জনজীবনে এক হতাশার সৃষ্টি করেছে এবং জেলাবাসীর অর্থনৈতিক কাঠামো প্রায় ভেঙে পড়েছে। বহু ঘোষিত পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার মাধ্যমে শিল্পায়ন ও ধন বৃদ্ধির পথ সুগম না করে বরং অবরুদ্ধ করা হচ্ছে; এই জেলার ভাষা ও ঐতিহ্য ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার নেতাদের স্বৈরাচার ও হিংসাত্মক কার্যকলাপ এবং তাতে আসাম সরকারের প্রকাশ্য ও পরোক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় দারুণ সংকটের সম্মুখীন হয়েছে। কাছাড় জেলাবাসী অগণিত ছাত্র ও শিক্ষিত যুবকদের সুপরিকল্পিত বঞ্চনা ব্যবস্থায় কারিগরি ও উচ্চশিক্ষা এবং সর্বস্তরের চাকরি থেকে দূরে রাখার অপপ্রয়াস পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে;’
‘গোয়ালপাড়া জেলায় নানারূপ অবৈধ ও হীন উপায়ে ইতিপূর্বে বাংলা ভাষার মাধ্যমে শিক্ষালাভের সুযোগ থেকে যেভাবে বাঙালিদের বঞ্চিত করার ব্যবস্থা হয়েছে—এর পুনরাবৃত্তি এই জেলায়ও সুপরিকল্পিতভাবে সংঘটিত হবে বলে এই জেলাবাসী আশঙ্কা করছেন এবং ইতিমধ্যেই অনুরূপ অপচেষ্টার পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অসমিয়া নেতৃবৃন্দ আদর্শ ও নীতি বিস্মৃত হয়ে এই জেলার ন্যায়সংগত জনমতকে পদদলিত করতে লজ্জাবোধ করছেন না। উপরন্তু বিধানসভায় সংখ্যাধিক্যের সুযোগ নিয়ে তাঁদের ইচ্ছাকেই অনিচ্ছুক এই জেলাবাসীর ওপর চাপিয়ে অকল্যাণকর সংকটপূর্ণ পরিস্থিতির সৃষ্টি করে তুলেছেন।’
‘বিগত জুন-জুলাই মাসে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় ভাষার প্রশ্নে বাংলা ভাষাভাষী জনসাধারণের ওপর যে অত্যাচারের তান্ডব বয়ে গেল, সভ্যজগতের ইতিহাসে এরূপ কলঙ্ককালিমাময় অধ্যায় বিরল, স্ত্রী-পুরুষ-শিশু নির্বিশেষে বাঙালির ওপর অমানুষিক নির্যাতন, লুন্ঠন, অগ্নিদাহ, হত্যা ও নারীধর্ষণ প্রভৃতি পাশবিক দুষ্কর্মে বর্তমান শাসকগোষ্ঠীর প্রশাসনিক ব্যবস্থায় অমার্জনীয় ঔদাসীন্য ও নিদারুণ ব্যর্থতা এবং দাঙ্গা প্রপীড়িতদের স্বস্থানে পুনর্বাসনে অক্ষমতার পরিচয় দান করেছে। বস্তুত, একটি শাসনব্যবস্থা চালু থাকা অবস্থায় রাজ্যমধ্যে এই অবাধ অরাজকতা সংঘটনে তথাকথিত অসমিয়া নেতৃবৃন্দ ও অসমিয়া শাসকগোষ্ঠীর যোগসাজশ আছে বলে জনসাধারণ একান্তভাবে মনে করে। অধিকন্তু এই নিদারুণ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ও পটভূমিকায় রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ অনসমিয়াভাষীদের প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও অসমিয়া ভাষাবিল আইনে পরিণত হওয়ায় শক্তিমত্ততা ও স্বেচ্ছাচারের বিকট রূপ এই জেলাবাসীকে ভয়ার্ত করে তুলেছে। দাঙ্গার মূল কারণ অনুসন্ধানে বিচারবিভাগীয় তদন্তের দাবিকে উপেক্ষা করবার জন্য কেন্দ্র থেকে রাজ্য সরকার পর্যন্ত যে দ্বিধাজড়িত পক্ষপাতমূলক মনোবৃত্তির পরিচয় দান করেছেন, তাতে এই কাছাড় জেলাবাসী ভবিষ্যতেও সুবিচারের আশায় নৈরাশ্যবোধ করছেন।’
শত শত নির্মম দুষ্কৃতকারী ও সমাজদ্রোহীর নির্ভয়ে বিচরণ কোনো শান্তিকামী আইনানুগ স্বাধীন নাগরিক সহ্য করতে পারে না। বস্তুত, জনসাধারণ নিজের মাতৃভাষাকে পবিত্রতম সম্পদ বলেই মনে করে; মাতৃভাষার মাধ্যমেই এক-একটি জাতির সংস্কৃতি, কৃষ্টি, শিক্ষাদীক্ষা ও প্রতিভা গড়ে ওঠে। বর্তমানে বাংলা ও অন্যান্য অনসমিয়া ভাষাভাষীগণ সেই পবিত্রতম সম্পদকে হারাতে বসেছে, ভাষার ওপরে এই উন্মত্ত আক্রমণ এই জেলাবাসী কখনো বরদাস্ত করতে পারে না। সুতরাং, কাছাড় জেলা জনসম্মেলন সংগত কারণেই মনে করে যে, এই জেলা আসাম রাজ্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকলে এতদঞ্চলবাসীর আশা-আকাঙ্ক্ষা সর্বতোভাবে ব্যাহত হবে। অতএব কাছাড় জেলা জনসম্মেলন সর্বসম্মতিক্রমে এই প্রস্তাব গ্রহণ করে ভারত সরকারের কাছে দাবি করছে যে, যদি এই অবিচারমূলক রাজ্যভাষা আইন অবিলম্বে প্রত্যাহারক্রমে বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাজ্য ভাষা করে অন্যান্য অনসমিয়া ভাষাকেও যোগ্য মর্যাদাদানের ব্যবস্থা কতৃপক্ষ না করেন, তবে কাছাড় জেলা ও প্রয়োজন বোধে অন্যান্য সংলগ্ন অনসমিয়া অঞ্চলকে আসাম রাজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন করে স্বতন্ত্র প্রশাসনিক সংস্থার স্বীকৃতি অবিলম্বেই ঘোষণা করা হোক এবং আরো প্রস্তাব গ্রহণ করছে যে, আগামী ৩০ চৈত্র ১৩৬৭ বঙ্গাব্দ তারিখের মধ্যে ভারত সরকার যদি এই প্রস্তাবকে চরমপত্র বিবেচনা করে প্রস্তাবিত দাবি পূরণ না করেন, তা হলে আগামী ১ বৈশাখ ১৩৬৮ বঙ্গাব্দ তারিখ থেকে সর্বাত্মক ও অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে কাছাড় জেলায় বর্তমান অকল্যাণকর প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ অচল করে তুলবার জন্য এই জেলা জন সম্মেলন জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে আপামর জনসাধারণকে প্রস্তুতির আহ্বান জানাচ্ছে এবং এতদুদ্দেশ্যে নিম্নলিখিত ব্যক্তিবর্গকে নিয়ে একটি সংগ্রাম পরিষদ গঠনের নির্দেশ দান করছে :
শিলচর : শ্রী যতীন্দ্রমোহন পাল (বড়খলা), শ্রীসনৎকুমার চক্রবর্তী, শ্রী অনিলকুমার বর্মণ, শ্রীযতীন্দ্র দেব, শ্রীপরিতোষ পালচৌধুরী, শ্রীসুখময় সিংহ, জনাব গোলাম ছবির খান, শ্রীপরেশচন্দ্র চৌধুরী, শ্রীপ্রমোদকুমার আদিত্য এবং মৌলানা রফিকুর রহমান।
হাইলাকান্দি :জনাব আবদুর রহমান চৌধুরী, শ্রীঅমিয়কুমার নন্দী, জনাব মাহমুদ আলি বড়ভুঁইয়া, শ্রীহরিদাস দেব, শ্রীদীনেশচন্দ্র সিংহ, শ্রীকেশবচন্দ্র চক্রবর্তী, শ্রীজ্ঞানরঞ্জন ব্যানার্জি ও শ্রীশ্যামচাঁদ দেবনাথ।
করিমগঞ্জ : শ্রীবিধুভূষণ চৌধুরী, শ্রীসুরেন্দ্রনাথ চৌধুরী, শ্রীনৃপতিরঞ্জন চৌধুরী, শ্রীভূপেন্দ্রকুমার সিংহ, শ্রীদক্ষিণারঞ্জন দেব, শ্রীরথীন্দ্রনাথ সেন, শ্রীমোহিতমোহন দাস, শ্রীমতিলাল দত্ত চৌধুরী, শ্রীঅন্নদামোহন কর ও শ্রীনলিনীকান্ত দাস (আহ্বায়ক)। কাজের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে আরো সদস্য গ্রহণের ক্ষমতা থাকল।’১১৬
এ দিন বিকাল সাড়ে চারটায় টাউন ব্যাঙ্ক প্রাঙ্গণে সম্মেলনের উদ্দেশ্যে নির্মিত মন্ডপে প্রকাশ্য অধিবেশন আরম্ভ হয়। ‘মন্ডপের উত্তর-পশ্চিম অংশে একটি সজ্জিত মঞ্চ। মন্ডপের দু-পাশে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর পূর্ণাবয়ব দু-টি প্রতিকৃতি ছিল— একটি আজাদ হিন্দ ফৌজের সেনাধ্যক্ষের পোশাক পরিহিত নেতাজি, অন্যটি বাঙালির পোশাকে সজ্জিত দেশগৌরব সুভাষচন্দ্র।’ এমন একটি মঞ্চে দাঁড়িয়ে ভিড়ে-ঠাসা প্রকাশ্য অধিবেশনে সভার সভাপতি জনাব আবদুর রহমান চৌধুরী ‘কাছাড়ের জনগণকে ক্ষুদ্র বাগবিতন্ডা পরিহার করে বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য একতাবদ্ধ হয়ে সংগ্রাম করবার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘বাংলা ভাষা না থাকলে বাঙালির আর কী থাকবে।’১১৭
করিমগঞ্জে ৫ ফেব্রুয়ারি গঠিত ‘কাছাড় জেলা গণসংগ্রাম পরিষদ’-এর প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয় ১২ ফেব্রুয়ারি হাইলাকান্দিতে, বিশিষ্ট নাগরিক শ্রীঅমিয়কুমার নন্দীর বাসভবনে। সভায় সভাপতিত্ব করেন জনাব আবদুর রহমান চৌধুরী। সংগ্রাম পরিষদ আহ্বায়ক শ্রীনলিনীকান্ত দাস সভার উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করেন। সভায় শিলচর, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দির সভ্যগণ যোগদান করেছিলেন। গণসংগ্রাম পরিষদের সাংগঠনিক কাঠামো ও অন্যান্য বিষয়ে এ দিন বিস্তারিত আলোচনা এবং বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। স্থির করা হয়—সভাপতি হিসেবে আবদুর রহমান চৌধুরী, সম্পাদক হিসেবে শ্রীনলিনীকান্ত দাস এবং কোষাধ্যক্ষ হিসেবে শ্রীবিধুভূষণ চৌধুরীকে। আরও স্থির হয় যে, ‘প্রতি মহকুমায় মহকুমা সমিতি, শাখা সমিতি ইত্যাদি এ মাসের মধ্যে গঠিত হবে এবং এই উদ্দেশ্যে করিমগঞ্জ মহকুমায় শ্রীভূপেন্দ্রকুমার সিংহ, শিলচর মহকুমায় শ্রীসত্য দাস রায় ও হাইলাকান্দি মহকুমায় কেশবচন্দ্র চক্রবর্তীকে সংগঠক হিসেবে নির্বাচিত করা হয়।
সংগঠন, অসহযোগ আন্দোলন ইত্যাদির ব্যয় নির্বাহের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ করা হবে এবং এই উদ্দেশ্যে করিমগঞ্জের শ্রীরথীন্দ্রনাথ সেন ও হাইলাকান্দির শ্রীঅমিয়কুমার নন্দী অতিশীঘ্র জেলার বিভিন্ন স্থান সফর করবেন বলে সভাপতি উল্লেখ করেন।
ব্যাপক প্রচার কাজ পরিচালন, স্বেচ্ছাসেবক দল গঠন ও কর্মী সংগ্রহ করারও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। নলিনীকান্ত দাস সভায় জানান যে, করিমগঞ্জের সভায় গৃহীত ৩নং প্রস্তাব ভারতের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আসামের রাজ্যপাল ও মুখ্যমন্ত্রীকে ইতিমধ্যেই রেজিস্টারি ডাকে পাঠানো হয়েছে।’১১৮
এ সময় গণসংগ্রাম পরিষদ-এর পক্ষ থেকে সভাপতি আবদুর রহমান চৌধুরী, সম্পাদক শ্রীনলিনীকান্ত দাস ও কোষাধক্ষ্য শ্রীবিধুভূষণ চৌধুরী কাছাড়বাসীর উদ্দেশ্যে এক বিবৃতি প্রচার করেন। বিবৃতিতে বলা হয়:
আসামের লক্ষ লক্ষ বাঙালি ও অন্যান্য অনসমিয়া ভাষাভাষীদের ন্যায্য দাবি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করিয়া একমাত্র অসমিয়াকে সরকারি ভাষার মর্যাদা দিয়া আসাম বিধানসভায় যে ভাষাবিল গৃহীত হইয়াছিল, তাহাতে রাজ্যপাল সম্মতি দেওয়ায় উহা আইনে পরিণত হইয়াছে। এই অন্যায় ও অযৌক্তিক আইনের প্রতিরোধকল্পে বিগত ৫ ফেব্রুয়ারি করিমগঞ্জে যে কাছাড় জেলা জনসম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, তাহাতে বাংলাকে অন্যতম রাজ্য ভাষা এবং অন্যান্য অনসমিয়া ভাষাকেও যোগ্য মর্যাদাদান করিবার দাবি করা হয়। অন্যথায় কাছাড় জেলা ও প্রয়োজনবোধে অন্যান্য সংলগ্ন অসমিয়াভাষী অঞ্চলকে আসাম রাজ্য হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া স্বতন্ত্র প্রশাসনিক সংস্থার স্বীকৃতি অবিলম্বেই ঘোষণার দাবি জানানো হয় এবং আগামী ৩০ চৈত্র ১৩৬৭ বঙ্গাব্দ তারিখের মধ্যে ভারত সরকার যদি এই প্রস্তাবকে চরমপত্র বিবেচনা করিয়া প্রস্তাবিত দাবি পূরণ না করেন, তাহা হইলে ১ বৈশাখ ১৩৬৮ বঙ্গাব্দ হইতে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে কাছাড় জেলায় বর্তমান-অকল্যাণকর প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ অচল করিয়া তুলিবার জন্য জেলা সম্মেলন জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে আপামর জনসাধারণকে প্রস্তুতির আহ্বান জানান এবং এতদুদ্দেশ্যে একটি সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়।
এই প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা কাছাড় জেলার দলমত নির্বিশেষে সর্বশ্রেণির জনসাধারণের নিকট আবেদন জানাইতেছি যে, আমাদের এই জাতীয় বিপর্যয়ে সম্মেলনের সিদ্ধান্তকে কার্যকরী করিতে আমরা যেন চরম ত্যাগ স্বীকারেও কুন্ঠিত না হই।
আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছিবার জন্য যে সংগ্রাম অপরিহার্য, তাহার জন্য প্রচুর অর্থ, কর্মী ও স্বেচ্ছাসেবক যেমন প্রয়োজন, তেমনি কাছাড়বাসী সকলের আন্তরিক সাহায্য, সহানুভূতি এবং সহযোগিতাও একান্ত আবশ্যক।
আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, আমাদের মাতৃভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষা এবং অর্থনৈতিক বিপর্যয় প্রতিরোধের চূড়ান্ত সংগ্রামে সর্বস্তরের কাছাড়বাসীর অকুন্ঠ সমর্থন অবশ্যই পাওয়া যাইবে। ইতি—১২/২/৬১ ইং।১১৯
বাংলা ভাষার পক্ষাবলম্বনকারী সংগঠন বা সংস্থা ‘কাছাড় গণসংগ্রাম পরিষদ’ বা সংগ্রাম পরিষদ আসামের ভাষা আন্দোলনে এক সুনির্দিষ্ট পথনির্দেশ বা ধারা সৃষ্টি করল, যেখানে আসামের রাজনৈতিক অঙ্গনের বড়ো কোনো নেতা-নেত্রীকে আপাতত লক্ষ করা যাচ্ছে না। সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে আপাতযুক্ত নেতাদের সবাই মাঝারি মানের এবং বিভিন্ন দল ও মতের। পরবর্তীতে এই সংগঠনের ভূমিকার প্রতি আমরা নজর দেব।
জাতিগত লোকগণনার প্রতি অসমিয়া সমাজের অতি আগ্রহ লক্ষ করার মতো। তাঁরা বরাবরই যেনতেন প্রকারে বা ‘মারি অরি পারি যে কৌশলে’-র পথ অনুসরণ করে নিজেদের আসন পাকাপোক্ত করেছেন। আর এ কাজে যে আসাম সরকার ও অসমিয়া নেতৃত্ব মুক্তহস্তে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন, তা তো ১৯৫১ সালের লোকগণনার ফলাফলেই স্পষ্ট। বিষয়টি সবমহলে নিন্দার ঝড় তুলেছিল।
লোকগণনা ১৯৬১। আসামের বাংলাভাষাভাষী সমিতি এই লোকগণনাকে প্রহসনে পরিণত করা হয়েছে বলে অভিযোগ উত্থাপন করে। ২৬ ফেব্রুয়ারি ডিগবয়ে শ্রীঅনাথবন্ধু বসুর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ‘নিখিল আসাম বঙ্গভাষাভাষী সমিতি’-র ওয়ার্কিং কমিটির দু-দিনব্যাপী অধিবেশনের সমাপ্তি দিন। এ দিন বেশ কয়েকটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। প্রস্তাবে বলা হয়, বাংলা ভাষাকে আসামের অন্যতম সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণা এবং অন্যান্য অনসমিয়া ভাষাকে যথোচিত স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানিয়ে একটি স্মারকলিপি ভারতের রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাবার সিদ্ধান্ত হয়।
অপর প্রস্তাবে আসামে সম্প্রতি দাঙ্গাবিধ্বস্ত গৃহগুলির শতকরা দশ ভাগের অধিক পুনর্নির্মিত হয়নি, তাঁদের কোনো ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়নি, ঋণ বিতরণে দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়া হচ্ছে এবং আসাম সরকার ভাষাগত সংখ্যালঘিষ্ঠদের মনে নিরাপত্তার ভাব ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ হয়েছেন।
অপর প্রস্তাবে আসামের লোকগণনা প্রহসনে পরিণত হয়েছে উল্লেখ করে ‘আসামের প্রত্যেক অধিবাসীর মাতৃভাষা সঠিকভাবে লিপিবদ্ধ করবার জন্য নতুন করে আদমশুমারি পরিচালনার অনুরোধ জানানো হয়।’ দুর্নীতি সম্পর্কে বলা হয় : ১. ‘বিশেষ করে চা-বাগানে ও গ্রামাঞ্চলে অনসমিয়া ভাষাভাষী জনসাধারণের মাতৃভাষা হিসেবে অসমিয়া লিপিবদ্ধ করা হয়েছে, ২. যারা একেবারে সামনে ছিল—তাদের মাতৃভাষা ইচ্ছা করে লিপিবদ্ধ করা হয়নি, ৩. লোকগণনার সময় বিশেষ করে অনসমিয়া ভাষাভাষী জনসাধারণের মধ্যে অনেকের সম্বন্ধে মাতৃভাষা সংক্রান্ত অনুসন্ধান কাজ ইচ্ছাকৃতভাবে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে, ৪. জনসাধারণের একাংশকে তাঁদের মাতৃভাষা সম্পর্কে মিথ্যা বিবৃতি দেবার জন্য প্ররোচনা কিংবা চাপ দেওয়া হয়েছে,৫. কোনো কোনো ক্ষেত্রে গণনাকারীরা কী কী তথ্য লিপিবদ্ধ করা হল, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদেরও তা জানাতে অস্বীকার করে, ৬. হাঙ্গামায় বাস্তুচ্যুত যে-সকল ব্যক্তি আত্মীয়স্বজনের গৃহে অবস্থান করছে, তাদের গণনার মধ্যে ধরা হয়নি এবং ৭. অনেক গণনাকারী সন্দেহজনক কতক গণনাফর্ম ব্যবহার করছেন।’১২০
এ সময় ভাষা বিষয়ে আচার্য বিনোবাভাবের মন্তব্য নিয়ে আলোড়নের সৃষ্টি হয়। বিবৃতি, পালটা বিবৃতিও পরিলক্ষিত হয়। মার্চ মাসে কোচবিহার জেলায় প্রবেশ করে পদযাত্রী সন্ত আচার্য বিনোবাভাবে বলেন যে, ‘লোকে ভাষা লইয়া ঝগড়া করে, ইহাতে তিনি অত্যন্ত আশ্চর্যবোধ করেন। বিনোবাজি বলেন, ‘প্রেমের ভাষা পশুতেও বোঝে। গোরু বাংলা ভাষাও বোঝে না, অসমিয়া ভাষাও বোঝে না, বোঝে শুধু প্রেমের ভাষা। সুতরাং মানুষ যে ভাষা লইয়া বিবাদ করে উহা সংস্কৃতির লক্ষণ নয়, বিকৃতির লক্ষণ।’১২১
কিন্তু এরপরও বিনোবাজি অসমিয়া ভাষার প্রতিই তাঁর সমর্থন ব্যক্ত করেন।
কাছাড় জেলা গণসংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে মওলানা গোলাম ছবির খানের সভাপতিত্বে ১৯ ফেব্রুয়ারি শিলচরের নরসিংটোলায় এক বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। শিলচরের শ্রীসত্যদাস রায়, শ্রীপরিতোষ পালচৌধুরী, শ্রীসনৎকুমার চক্রবর্তী, শ্রীজিতেন্দ্রনাথ চৌধুরী, হাইলাকান্দির শ্রীকেশবচন্দ্র চক্রবর্তী, শ্রীশক্তিধর চৌধুরী ও করিমগঞ্জের শ্রীরথীন্দ্রনাথ সেন, শ্রীনলিনীকান্ত দাস প্রমুখ বক্তৃতা করেন। সভাপতি জনাব গোলাম ছবির খানের ভাষণের পর সভার সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়। এ দিন ‘শিলচর মহকুমায় শ্রীজিতেন্দ্রনাথ চৌধুরীকে সভাপতি ও শ্রীপরিতোষ পালচৌধুরীকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করে শিলচর মহকুমা সমিতি গঠিত হয়। হাইলাকান্দির বিশিষ্ট আইনজীবী ও হাইলাকান্দি বার অ্যাসোসিয়েশন সম্পাদক শ্রীকেশবচন্দ্র চক্রবর্তীকে আহ্বায়ক করে হাইলাকান্দি মহকুমা সমিতি এবং শ্রীব্যোমকেশ দাসকে সভাপতি, শ্রীভূপেন্দ্র সিংহকে সহসভাপতি, শ্রীনৃপতি চৌধুরীকে সম্পাদক এবং শ্রীভূপেন্দ্র ভট্টাচার্য ও শ্রী সতু রায়কে যুগ্ম সম্পাদক করে করিমগঞ্জ মহকুমা সমিতি ইতিমধ্যেই গঠিত হয়েছে।১২২
‘১২ ফেব্রুয়ারি গণসংগ্রাম পরিষদের প্রথম সভায় বেশ কয়েকজনকে সংগ্রাম পরিষদ ভুক্ত করা হয় (Co-opted members)। এ সব সদস্য হলেন— শিলচর-শ্রীসত্যদাস রায় ও শ্রীবিজন আচার্য; হাইলাকান্দি— জনাব আবদুল লতিফ বড়ভুঁইয়া, শ্রীনৃপেন্দ্রকুমার চৌধুরী ও শ্রীসুরেন্দ্রকুমার শর্মা; করিমগঞ্জ— শ্রীকুমুদরঞ্জন লুহ, রেভা. ডি কে বাদশা, শ্রীননীগোপাল বণিক. জনাব সৌকত আলি ও শ্রীনদীয়াচাঁন্দ রাজকুমার।’১২৩
হাইলাকান্দিতে সংগ্রাম পরিষদ আয়োজিত ২১ ফেব্রুয়ারি অধ্যাপক ‘শরৎচন্দ্র নাথ-এর সভাপতিত্বে এক বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় কেশবচন্দ্র চক্রবর্তী, আবদুর রহমান চৌধুরী, নৃপতিরঞ্জন চৌধুরী, নলিনীকান্ত দাস, যুগশক্তি সম্পাদক বিধুভূষণ চৌধুরী, রথীন্দ্রনাথ সেন প্রমুখ বক্তৃতা করেন। বক্তাগণ জনসম্মেলনে গৃহীত প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে সকলকে দাবি আদায়ে সক্রিয় হওয়ার আহ্বান জানান। রথীন্দ্রনাথ সেন-এর আবেগাপ্লুত ভাষণে শ্রোতৃমন্ডলী অভিভূত হয়ে পড়েন। তাঁরা মুহুর্মুহু করতালি দিয়ে শ্রীসেন-এর বক্তব্যের প্রতি সমর্থন জানান।’১২৪
এদিকে ‘করিমগঞ্জে মহকুমা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে ১৭ মার্চ সকাল সাতটা থেকে বিকাল চারটা পর্যন্ত পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। এ দিন সমস্ত দোকান, পান-বিড়ি, চা-স্টল, স্কুল-কলেজ, বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠান, মোক্তার ও উকিল লাইব্রেরি, বাস-ট্রাক-রিকশা-ঠেলা গাড়ি সম্পূর্ণ বন্ধ ছিল।’
ইতিপূর্বে ‘করিমগঞ্জে ১২ মার্চ শ্রীহরিসাধন চক্রবর্তীর সভাপতিত্বে কাছাড় জেলা যুব কংগ্রেস কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয়। কনভেনশনে কাছাড় ও সন্নিহিত এলাকার জন্য যুব কংগ্রেসের একটি পৃথক শাখা গঠনের দাবি সংবলিত এক প্রস্তাব গৃহীত হয়। প্রস্তাবে আরও বলা হয় যে, যুব কংগ্রেসের এই পৃথক শাখা নিখিল ভারত যুব কংগ্রেসের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত থাকবে।’
অপর প্রস্তাবে বলা হয়, ‘সরকার যাতে অবিলম্বে আসাম সরকারি ভাষা আইন বাতিল অথবা সংশোধন করে এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অনসমিয়া ভাষাগুলিকে উপযুক্ত স্বীকৃতি দিয়ে বাংলা ভাষাকে সরকারি ভাষাগুলির অন্যতম ভাষা হিসেবে স্বীকার করে নেন— সেই মর্মে দাবি জানানো হয়।
ন্যায় বিচার, মর্যাদার সমতা ও সুযোগসুবিধার ব্যাপারেও আসাম সরকারের পক্ষপাতমূলক নীতির অবসানের জন্য যাতে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়, তার জন্যও দাবি জানানো হয়। প্রস্তাবে আরও বলা হয় যে, এ সম্পর্কে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া না হলে বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে কাছাড় ও তার সন্নিহিত অঞ্চল নিয়ে একটি পৃথক প্রশাসনিক সংস্থা স্থাপন করতে হবে।’
‘কনভেনশনে কাছাড়ের যুবসমাজকে ঐক্যবদ্ধ হবার জন্য আবেদন জানানো হয়। জনস্বার্থের খাতিরে প্রয়োজনের সময়ে যুবসমাজকে যেকোনো রূপ আত্মত্যাগের জন্য প্রস্তুত থাকারও আহ্বান জানানো হয়। কনভেনশনে গৃহীত প্রস্তাবগুলি বাস্তবায়নে একটি কমিটি গঠিত হয়। শ্রীনৃপতি চৌধুরী ও শ্রীনির্মলেন্দু দাসকে কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক নির্বাচিত করা হয়। কমিটির অন্যান্য ২৪ জন সদস্যের মধ্যে সর্বশ্রী হরিসাধন চক্রবর্তী, বিভাস পুরকায়স্থ, আবদুর রসিদ লস্কর, চপলা ভট্টাচার্য, প্রভাস সেনমজুমদার, সতু রায়, আজিজুর রহমান ও মণীন্দ্র পুরকায়স্থও রয়েছেন।’
‘আসাম প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির সদস্য ও অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি শ্রীমুনীন্দ্রকুমার দাস অনসমিয়া জনসাধারণ সম্পর্কে আসাম সরকারের পক্ষপাতমূলক নীতির ওপর দীর্ঘ আলোচনা করেন। জনসাধারণের দাবিকে সফল করে তুলবার জন্য এবং বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির মর্যাদা রক্ষা করবার জন্য যুবসমাজ যাতে ঐক্যবদ্ধ হন, সেজন্য সকলের প্রতি আকুল আবেদন জানান।’১২৫
ইতিমধ্যে আসামের লোকগণনায় মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণের বিষয়টি নিখিল আসাম বঙ্গভাষী সমিতিসহ বিভিন্ন মহলে উদবেগের জন্ম দেয়। ১৯৬১ সালের মার্চে সেন্সাস সূত্রে জানা গেল দশ বছরে অর্থাৎ ১৯৫১ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত আসামে লোকসংখ্যা বৃদ্ধির হার ভারতের সকল প্রদেশকে ছাপিয়ে গেছে। সেন্সাস সুপারিনটেণ্ডেন্ট ই এইচ প্যাকিনটাইন জানালেন, ‘গত দশ বছরে আসামের লোকসংখ্যা শতকরা ৩৪.৩০ বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৫১ সালে যেখানে লোকসংখ্যা ৮৮,৩০,৭৫২ জন; সেখানে দশ বছরে বৃদ্ধি পেয়ে তা দাঁড়িয়েছে ১,১৮,৬০,০৫৯ জন। প্যাকিনটাইন জানান, সংযুক্ত মিকির ও উত্তর কাছাড় পার্বত্য জেলায় লোকসংখ্যা বৃদ্ধির হার শতকরা ৬৮.৮৬ জন।’১২৬
আমরা জানি, ১৯৫১ সালের লোকগণনার ফলাফলে বিভিন্ন মহলে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। এমনকী সংসদীয় প্রতিনিধিদল বা রাজ্য পুনর্গঠন কমিশনও লোকগণনার ফলাফলে সন্তুষ্ট হতে পারেননি। অনেকে এই ফলাফলকে ‘জীবতাত্ত্বিক বিস্ময়’ বলেও অভিহিত করেছেন। এমন এক পরিস্থিতিতে ‘নিখিল আসাম বঙ্গ ভাষাভাষী সমিতি’-র এক প্রতিনিধিদল দিল্লি রওয়ানা হন। সংবাদপত্রে বলা হল:
আসামের সাম্প্রতিক লোকগণনায় অসমীয়াভাষীর সংখ্যা পরিকল্পিত পদ্ধতিতে ফাঁপাইয়া দেখানো হইয়াছে বলিয়া বিভিন্ন মহল হইতে অভিযোগ উঠিয়াছে। অভিযোগে প্রকাশ, বহুক্ষেত্রে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বিভিন্ন স্থানে বঙ্গভাষী অধিবাসীর গৃহ চিহ্নিত হয় নাই, অনসমীয়াদের ভাষা অসমীয়ারূপে দেখানো হইয়াছে, অসংখ্য বঙ্গভাষীকে আদৌ গণনা করা হয় নাই এবং গণনাকারীরা কারচুপির জন্য বিভিন্ন ক্ষেত্রে সন্দেহজনক ফর্ম ব্যবহার করিয়াছে।
ওই সকল অভিযোগের পটভূমিকায় নিখিল আসাম বঙ্গভাষাভাষী সমিতি কেন্দ্রীয় সরকারের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে এবং কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মচারীদের দ্বারা নির্ভুলভাবে মাতৃভাষা লিপিবদ্ধ করিয়া পুনরায় আসামে লোকগণনার দাবি তুলিয়াছেন। এক প্রতিনিধিদল উপরিউক্ত অভিযোগগুলি কেন্দ্রীয় সরকারের গোচরে আনিতে নয়াদিল্লি গিয়াছেন। তাঁহারা রাষ্ট্রপতি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী এবং আদমশুমারি কমিশনারের নিকট দেখা করিয়া এক স্মারকলিপি পেশ করিতেছেন। …রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন এবং ১৯৬০ সালের লোকসভা প্রতিনিধিদল পর্যন্ত ওই আদমশুমারি সম্পর্কে বিস্ময় প্রকাশ করিয়াছেন।
নিখিল আসাম বঙ্গভাষাভাষী সমিতির পক্ষ হইতে অভিযোগ করা হয়, ‘১৯৬০ সালে আসামের ‘বঙ্গাল খেদা’ আন্দোলনই প্রমাণ করিয়া দিয়াছে যে, অসমীয়ারা নিজেদের সংখ্যা স্ফীতাকারে দেখাইবার জন্য কত আকুল।’১২৭
নয়াদিল্লিতে বঙ্গভাষী প্রতিনিধিদল ৪ এপ্রিল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁদের দাবি পেশ করেন। সংবাদপত্র জানাল:
নিখিল আসাম বঙ্গভাষাভাষী সমিতির পক্ষ হইতে ১৪ জন সদস্যবিশিষ্ট এক প্রতিনিধিদল ভারতের রাষ্ট্রপতির নির্দেশ অনুসারে আজ নয়াদিল্লিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রীলালবাহাদুর শাস্ত্রীর সহিত সাক্ষাৎ করেন এবং সংবিধানের ৩৪৭ অনুচ্ছেদ অনুসারে রাষ্ট্রপতি কতৃক বাংলা ভাষাকে আসামের অন্যতম সরকারি ভাষারূপে ঘোষণার জন্য তাঁহার নিকট তাঁহাদের দাবি পেশ করেন।
আসামে গত আদমশুমারির কার্য পরিচালনাকালে লোকগণনাকারীরা যেসব কারচুপির আশ্রয় গ্রহণ করেছে, প্রতিনিধিদল তৎসংক্রান্ত ঘটনাবলির বিষয়ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নিকট পেশ করেন। লোকগণনার সময় বহুসংখ্যক বঙ্গভাষীকে হয় লোকগণনার আওতা হইতে বাদ দেওয়া হইয়াছে, নয়তো তাহাদিগকে অসমীয়াভাষী বলিয়া দেখানো হইয়াছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ধৈর্যসহকারে প্রতিনিধিদের বক্তব্য শ্রবণ করেন এবং তাঁহারা যেসব বিষয় উত্থাপন করিয়াছেন, তাহা তিনি বিবেচনা করিয়া দেখিবেন বলিয়া তাঁহাদিগকে আশ্বাস দেন।
আসামে গত জুলাই মাসের হাঙ্গামায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের পুনর্বাসন সংক্রান্ত বিষয় সম্পর্কেও আলোচনা হয় এবং ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের উপযুক্ত পুনর্বাসনের নিশ্চয়তাবিধানের জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে অনুরোধ করা হয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অনুরোধে এই সাক্ষাৎকারকালে কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী শ্রীঅশোক সেন উপস্থিত ছিলেন।
নিখিল আসাম বঙ্গভাষাভাষী সমিতির সভানেত্রী শ্রীমতী জ্যোৎস্না চন্দ, এম এল এ এই প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব করেন। এই প্রতিনিধিদলের অন্যান্য সদস্য হইতেছেন— সমিতির সহকারী সভাপতি শ্রীরমণীকান্ত বসু, সাধারণ সম্পাদক শ্রীশান্তিরঞ্জন দাশগুপ্ত, যুগ্ম সম্পাদক শ্রীসুবোধ ভৌমিক ও শ্রীসুবোধ রায়, শ্রীপরেশচন্দ্র চৌধুরী, শ্রীরথীন্দ্রনাথ সেন, শ্রীসাধনরঞ্জন সরকার, শ্রীদীপেন্দ্রচন্দ্র চৌধুরী ও শ্রীমতী শীলা রায়।
প্রতিনিধিদল রেজিস্ট্রার জেনারেল ও সেন্সাস কমিশনার শ্রীঅশোক মিত্রের সহিতও সাক্ষাৎ করিয়া তাঁহার নিকট আসামে লোকগণনায় কারচুপির নির্দিষ্ট ঘটনাবলির বিষয় পেশ করেন।১২৮
এ বিষয়ে আরও কিছু তথ্য পাওয়া যায় করিমগঞ্জ থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক পত্রিকা যুগশক্তি-তে। পত্রিকায় বলা হয়:
… উগ্র অসমীয়া নেতারা জানেন, যেনতেনপ্রকারেণ নিজেদের সংখ্যা আরও বাড়াইতে না পারিলে ভাষার প্রশ্নে ভবিষ্যতে গন্ডগোল দেখা দিতে পারে। তাই ১৯৬১ সালের আদমশুমারিতে অসমীয়াভাষীর সংখ্যা ফাঁপাইয়া দেখানোর সর্বাত্মক চেষ্টা চলিয়াছে।
সমিতি অভিযোগ করিয়াছেন, আদমশুমারির কারচুপি শুধু গ্রামাঞ্চলেই হয় নাই, গৌহাটির মতো বড়ো সহরের খ্যাতনামা বাঙালি ডাক্তার, সরকারি কর্মচারী প্রভৃতিও বাদ পড়িয়াছেন।
অভিযোগে আরও প্রকাশ, শিবসাগর জেলার ভোজো এলাকার কয়েক হাজার বাঙালিকে আদৌ গণনা করা হয় নাই। শুধু তাহাই নহে, চা-বাগানের বাঙালি শ্রমিকদের (যাহাদের বাড়ি পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, বীরভূম) গণনাকারীরা নাকি বলিয়াছেন যে, প্রত্যেক চা-শ্রমিককে অসমীয়াভাষী বলিয়া লিপিবদ্ধ করিতে সরকার নির্দেশ দিয়াছেন।
অবাঙালি ও অনসমিয়া চা-শ্রমিকদেরও অসমীয়াভাষীরূপে দেখানো হইয়াছে। আরও আশ্চর্যের বিষয়, গ্রামাঞ্চলের বাঙালি মুসলমানগণ, নিজেদের বঙ্গভাষী বলিয়া ঘোষণা করা সত্ত্বেও তাঁহাদিগকে অসমীয়াভাষীরূপে লিপিবদ্ধ করা হইয়াছে। অভিযোগে আরও বলা হয়, গত জুন-জুলাইয়ের হাঙ্গামায় যে সকল আসামবাসী বাঙালি উদবাস্তু অন্যত্র চলিয়া যান এবং পরে পুনরায় আসামের ট্রানজিট ক্যাম্পে আসিয়াছেন, তাঁহাদের পর্যন্ত গণনা হইতে বাদ দেওয়া হইয়াছে।১২৯
নিখিল আসাম বঙ্গভাষাভাষী সমিতির এই আবেদন-নিবেদন, তথ্য প্রমাণ কিছুতেই ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের মন টলাতে পারেনি। তাঁরা সরাসরি কেন্দ্রের তত্ত্বাবধানে পুনরায় লোকগণনার দাবি নাকচ করে দেন— যা আমরা জানি। প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু যে আসামের মুখ্যমন্ত্রী বি পি চালিহার প্রতি বেশ দুর্বল— তা তো আমরা ১৯৬০ সালের দাঙ্গা চলাকালীন সময়ে প্রধানমন্ত্রীজির বিভিন্ন সময়ে দেওয়া বক্তৃতা, বিবৃতি থেকেই স্পষ্ট।
‘৯ এপ্রিল করিমগঞ্জে কাছাড় জেলা গণসংগ্রাম পরিষদ কার্যালয়ে হাইলাকান্দির বিশিষ্ট আইনজীবী শ্রীকেশবচন্দ্র চক্রবর্তীর সভাপতিত্বে জেলা সংগ্রাম পরিষদ কার্যনির্বাহক কমিটির এক গুরুত্বপূর্ণ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় শিলচর, হাইলাকান্দি ও করিমগঞ্জের সদস্যবৃন্দ এবং বিশেষভাবে আমন্ত্রিত নেতৃবৃন্দ যোগদান করেন।
বিশদ আলোচনার পর ১ বৈশাখ ১৩৬৮ বঙ্গাব্দ তারিখে গ্রহণের জন্য ‘সংকল্প বাক্যে’-র চূড়ান্ত রূপদান করা হয় এবং গণ আন্দোলনের সাধারণ কর্মসূচি প্রণীত হয়। এ দিন একটি পরিচালন কমিটিও গঠিত হয় এবং জরুরি অবস্থা দেখা দিলে আন্দোলন চালিয়ে যাবার জন্য বিকল্প ব্যবস্থারও নির্দেশ দেওয়া হয়।১৩০ এ দিন রূপায়িত সংকল্প বাক্য ছিল এরকম:
আমরা বিশ্বাস করি সার্বভৌম গণতান্ত্রিক ভারতের স্বাধীন নাগরিকরূপে আমরা প্রত্যেকে সংবিধানসম্মত সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায় বিচার, চিন্তা, ভাবপ্রকাশ, ধর্মবিশ্বাস ও উপাসনার স্বাধীনতা, নাগরিক মর্যাদা ও সুযোগসুবিধা লাভের সমান অধিকারী। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আসামের বাংলা ও অন্যান্য অনসমীয়া ভাষাভাষী অধিবাসীগণ রাজ্য সরকার কতৃক সর্বদিকে অবজ্ঞাত ও উপেক্ষিত হইয়া আসিতেছেন এবং বাংলা ভাষাভাষী অধ্যুষিত কাছাড় জেলায় শিক্ষার ব্যাপারে, স্বাস্থ্যের ব্যবস্থায়, শিল্প প্রতিষ্ঠায় বহু বিজ্ঞাপিত পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা রূপায়ণে ও সরকারি চাকুরিতে যোগ্যতাসম্পন্ন এই জেলাবাসীকে গ্রহণে রাজ্য সরকার ক্রমাগত উপেক্ষা প্রদর্শন করিয়া আসিতেছেন। বস্তুত আসাম সরকারের বৈষম্যমূলক আচরণে এই জেলায় বেকার সমস্যা তীব্র আকার ধারণ করিয়াছে এবং ছাত্র, যুবক, কৃষিজীবী, শ্রমজীবী, মধ্যবিত্ত, ব্যবসায়ী প্রভৃতি কাছাড় জেলার সর্বশ্রেণির অধিবাসীকে এক চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন করিয়াছে। রাজ্য সরকারের নির্লজ্জ ভেদনীতির সহায়তায় অসমীয়াভাষীদের একচেটিয়া প্রভুত্ব কায়েমের অপপ্রয়াসে এই জেলাবাসী বিক্ষুব্ধ ও বিপর্যস্ত। সর্বোপরি আসাম রাজ্যের বাংলা ও অন্যান্য ভাষাভাষীর ন্যায়সংগত ও বিধিসম্মত প্রতিবাদ উপেক্ষা করিয়া এবং লুন্ঠন, অগ্নিদাহ, নর-হত্যা, শিশু-হত্যা ও নারীধর্ষণাদির মাধ্যমে যে সন্ত্রাসজনক পটভূমিকা সৃষ্টি হইয়াছিল— সেই অকল্যাণকর পরিস্থিতির সুযোগ লইয়া বহু ভাষাভাষী অধ্যুষিত এই রাজ্যে একমাত্র অসমীয়াকে সরকারি ভাষা করিয়া স্বীকৃতিদানে আইন প্রণয়ন দ্বারা রাজ্যের অন্যান্য ভাষাভাষীর মৌলিক অধিকার হরণ তথা ভাষা, কৃষ্টি, ঐতিহ্য ও সম্ভাবনাকে সমূলে ধ্বংস করিবার ব্যবস্থা করিয়া চরম সংকট আনয়ন করা হইয়াছে। এই বিষয়ে বারবার কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে আমাদের প্রতিকার প্রার্থনা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হইয়াছে। তাই অনন্যোপায় হইয়া ৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৬১ তারিখে অনুষ্ঠিত কাছাড় জেলা গণসম্মেলন অধিবেশনে গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দাবি আদায়ের জন্য অদ্য ১ বৈশাখ ১৩৬৮ বঙ্গাব্দ (১৪ এপ্রিল ১৯৬১) তারিখে অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের সংকল্প গ্রহণ করিয়া ঘোষণা করিতেছি যে, ভারতীয় নাগরিক হিসেবে সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকারসমূহ রক্ষার জন্য যেকোনো দুঃখবরণ ও ত্যাগ স্বীকার করিব এবং সরকার আমাদের ন্যায্য দাবি মানিয়া লইতে অগ্রসর না হওয়া পর্যন্ত কাছাড় জেলা গণসংগ্রাম পরিষদের নির্দেশে জীবনপণ করিয়া আন্দোলন চালাইয়া যাইব।১৩১
এ দিনের সভায় আন্দোলনের বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্যে অন্যতম ছিল ‘পদযাত্রা’। ১৫ এপ্রিল অর্থাৎ ২ বৈশাখ থেকে ১৫ মে বা ২ জ্যৈষ্ঠ পর্যন্ত সমগ্র কাছাড় জেলা জুড়ে পদযাত্রার কর্মসূচি নেওয়া হয়। লক্ষ্য, প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত জনসংযোগ গড়ে তোলা এবং এর মধ্য দিয়ে কেন এই পদযাত্রা, বাংলা ভাষার দাবি, আসাম সরকারের স্বেচ্ছাচার, কাছাড় জেলার প্রতি বিমাতৃসুলভ আচরণ ইত্যাদি বিষয়গুলি জনমানসে তুলে ধরা।
পদযাত্রা : করিমগঞ্জ
করিমগঞ্জ সফরসূচি ছিল এরকম:
১৯ এপ্রিল ’৬১ : বুধবার ভোর সাড়ে চারটায় করিমগঞ্জ টাউনব্যাঙ্ক প্রাঙ্গণ থেকে যাত্রা করে বাজার পরিভ্রমণের পর নয়াগ্রাম, সাদারাশী এবং গিরিশগঞ্জ বাজার হয়ে সকাল ন-টায় লক্ষ্মীবাজার উপনীত। বিকাল চারটায় লক্ষ্মীবাজার থেকে লাফাসাইল, পানিঘটি, সুতারকান্দি হয়ে ফকিরের বাজারে জনসভা এবং রাতে লাতুতে গণসংযোগ ও বিশ্রাম।
২০ এপ্রিল : বৃহস্পতিবার ভোর চারটায় লাতু থেকে মহিষাসন, বারপুঞ্জি হয়ে ন-টায় গান্ধাই উপনীত। বিকাল চারটায় গান্ধাই থেকে নিলামবাজার পৌঁছে সেখানে জনসভা। রাতে কায়স্থগ্রামে গণসংযোগ ও বিশ্রাম।
২১ এপ্রিল : শুক্রবার ভোর চারটায় কায়স্থ গ্রাম থেকে রওয়ানা হয়ে বারৈগ্রাম, কানাইবাজার, আছিমবাজার হয়ে চারটায় পাথারকান্দি উপনীত এবং সেখানে জনসভা।
২২ এপ্রিল : শনিবার, ভোর চারটায় পাথারকান্দি থেকে দোহালিয়া হয়ে সকাল ন-টায় বাজারঘাটে পৌঁছোনো এবং বিকাল চারটায় কাজিরবাজার হয়ে আনিপুরে জনসভা ও বিশ্রাম।
২৩ এপ্রিল : রবিবার, ভোর চারটায় আনিপুর থেকে দুর্লভছড়া। বিকালে সেখানে জনসভা এবং দুর্লভছড়া থেকে রামকৃষ্ণনগর পৌঁছে গণসংযোগ ও বিশ্রাম।
২৪ এপ্রিল : সোমবার, বিকালে রামকৃষ্ণনগরে জনসভা।
২৫ এপ্রিল : মঙ্গলবার, ভোর চারটায় রামকৃষ্ণনগর থেকে ডলু হয়ে কালীবাড়ি বাজার; বিকালে জনসভা।
২৬ এপ্রিল : বুধবার, ভোর চারটায় কালীবাড়ি বাজার থেকে ভৈরবনগর, মদনমোহন হয়ে এরালিগুল বাজার, দুপুরে বিশ্রাম। বিকালে এরালিগুল বাজার থেকে যাত্রা করে মর্জাতকান্দি, দত্তপুর, খলা, বচলার এবং রাত্রিবাস।
২৭ এপ্রিল : বৃহস্পতিবার, ভোর চারটায় রওয়ানা হয়ে রাঙ্গারপাড়া, অ্যাংলারবাজার, বড়গুল হয়ে বদরপুর, বিকালে জনসভা।
২৮ এপ্রিল : শুক্রবার ভোর চারটায় যাত্রা করে শ্রীগৌরী, মালুয়া, মহাখল, কনকলস, সরপুর হয়ে ভাঙাবাজার এবং সেখানে বিকালে জনসভা।
২৯ এপ্রিল : শনিবার, ভোর চারটায় যাত্রা করে মাছলি, মির্জাপুর, লামাজোয়ার হয়ে আরাঙ্গাবাদ। বিকালে চরগোলা বাজারে জনসভা।
৩০ এপ্রিল : রবিবার, ভোর চারটায় রওয়ানা হয়ে নাইরগ্রাম, আমবাড়ি, ঘোড়ামারা, রায়পুর হয়ে কালীগঞ্জ বাগবাড়ি। বিকালে কালীগঞ্জ বাজারে জনসভা।
১ মে ’৬১ : সোমবার, ভোর চারটায় রওয়ানা হয়ে সুপ্রাকান্দী, নলুয়া, নাগকাপন, জিয়াধরা হয়ে কর্ণমধু; বিকালে জনসভা।
২ মে ’৬১ : মঙ্গলবার, এওলাবাড়ি, বিস্কুট, মাইজগ্রাম, আম্বরখানা, লঙ্গাই হয়ে করিমগঞ্জ প্রত্যাবর্তন এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বিকালে টাউন ব্যাঙ্ক প্রাঙ্গণে জনসভা এবং সেখানে পরবর্তী সংগ্রামসূচি ঘোষণা।১৩২
করিমগঞ্জ তথা কাছাড়ের মানুষ গণসংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে যে কর্মসূচি পেশ করেছেন— এককথায় তা অভিনব, অসাধারণ। আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে যে, কাছাড় জেলা বা বরাক উপত্যকা সমগ্র আসামের একটি অংশমাত্র। এই অঞ্চলেই বসবাস করেন বাঙালিদের বড়ো অংশ। মা, মাতৃভাষার প্রতি কতটা প্রাণের টান থাকলে, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা থাকলে, প্রেম জন্মালে একটি এলাকার জনগোষ্ঠী এমনভাবে ঝাঁপ দিয়ে পড়তে পারেন— বিষয়টি ভেবে দেখার বিষয় বই কী?
আমরা করিমগঞ্জের কর্মসূচি প্রত্যক্ষ করেছি, কিন্তু কার্যত উদ্যোক্তাগণ উপস্থাপিত কর্মসূচির কতটা বাস্তবায়ন করতে পেরেছেন— সেটা খুঁজে ফেরাটাই জরুরি। এ কাজে আমরা করিমগঞ্জের কাগজেরই সাহায্য নেব। সেদিনের কাগজে লেখা হল: ‘বহুভাষাভাষী অধ্যুষিত আসাম রাজ্যে ও অন্যান্য ভাষার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির দাবিতে সংগ্রামব্রতী সত্যাগ্রহীগণ অসহযোগ আন্দোলনের প্রস্তুতি ও গণসংযোগের জন্য সমগ্র করিমগঞ্জ মহকুমা পরিভ্রমণের উদ্দেশ্যে গত ১৯ এপ্রিল বুধবার প্রত্যুষে ৫ ঘটিকার সময় পদযাত্রা আরম্ভ করেন। রাত চারটা থেকে ঝোলা কাঁধে সত্যাগ্রহীগণ ও দলমত নির্বিশেষে নরনারীগণ স্থানীয় টাউন ব্যাঙ্ক প্রাঙ্গণে দলে দলে সমবেত হতে থাকেন। মহিলাগণ সত্যাগ্রহীদের কপাল চন্দনচর্চিত করে দেন, নির্মাল্য দান করেন ও উলুধ্বনির মধ্যে সত্যাগ্রহীদের মাথায় লাজভার দধি ছড়াতে থাকেন। যাত্রাপথ শুভ ও জয়যুক্ত হবার উদ্দেশ্যে স্তুতিবাচন পাঠ করা হয়। ৩১ বছর পূর্বে মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে লবণ আইনভঙ্গ আন্দোলনের সময় এই শহর থেকে সত্যাগ্রহীদের পদযাত্রার স্মৃতি বয়োজ্যেষ্ঠদের মনে জাগরিত হয়। সেই আন্দোলনের সময় যাঁরা লবণ আইন ভঙ্গ করবার জন্য শ্রীহট্ট থেকে নোয়াখালি যাত্রা করেছিলেন—তাঁদের মধ্যে এই পদযাত্রায় সত্যাগ্রহীদের পুরোভাগে ছিলেন যুগশক্তি সম্পাদক শ্রীবিধুভূষণ চৌধুরী ও যুবনেতা শ্রীরথীন্দ্রনাথ সেন। তখন তাঁরা ছিলেন তরুণ ও যুবক। স্বাধীন ভারতে ভাষাজননীর মর্যাদা রক্ষার জন্য পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়সে তাঁদের পদযাত্রায় যোগদান উল্লেখযোগ্য। ৭৫ বৎসর বয়স্ক বৃদ্ধ শ্রীপ্রিয়লাল চক্রবর্তী স্বেচ্ছায় ও সানন্দে পদযাত্রায় যোগদান করেন। পদযাত্রার মহান ও পবিত্র দৃশ্য সমবেত জনতাকে আপ্লুত করে।
সত্যাগ্রহীদের পক্ষ থেকে শ্রীরথীন্দ্রনাথ সেন জনগণের ও দেশবাসীর আশীর্বাদ ও শুভেচ্ছা কামনা করেন। পদযাত্রীদের মধ্যে করিমগঞ্জ স্কুল বোর্ডের চেয়ারম্যান সর্বশ্রী— অরবিন্দ চৌধুরী, ব্যোমকেশ দাস, অন্নদামোহন কর, স্বদেশরঞ্জন ভট্টাচার্য, প্রেমানন্দ মুখার্জি, যুব কংগ্রেস সম্পাদক নৃপতি চৌধুরী, ভানু দাশগুপ্ত, নির্মল দাস পুরকায়স্থ, মোহিতমোহন দাস, নলিনীকান্ত দাস, বাদল ভট্টাচার্য, মতিলাল দত্তচৌধুরী, নরেন্দ্র সিংহ, ছাত্র সংহতির যুগ্মসম্পাদক শুভেন্দু দাস, ননীগোপাল স্বামী প্রমুখ সর্বদলীয় ও অদলীয় সত্যাগ্রহী আছেন। সত্যাগ্রহীগণ সমস্ত বাজার ও শহর প্রদক্ষিণ করে এখান থেকে ৮ মাইল দূরবর্তী লক্ষ্মীবাজার অভিমুখে যাত্রা করেন। সমবেত জনতা বন্দেমাতরম ও বাংলা ভাষার দাবির ধ্বনিসহ শহরের বাইরে বহুদূর পর্যন্ত তাঁদের অনুগমন করে।
করিমগঞ্জ থেকে লক্ষ্মীবাজারের পথে তাঁরা নয়াবাড়ি, চান্দশ্রীকোণা, গিরিশগঞ্জ বাজার, সাদারাশী প্রভৃতি গ্রামের মধ্যে দিয়ে চারণের মতো তাঁদের পদযাত্রার উদ্দেশ্য বর্ণনা করেন। মধ্যাহ্নে লক্ষীবাজারে শ্রীরুক্মিণীকুমার দাসের বাড়িতে আহার ও বিশ্রাম নিয়ে সুতারকান্দি হয়ে তাঁরা ৫ ঘটিকায় ফকিরের বাজার পৌঁছোন। লক্ষ্মীবাজার থেকে শ্রীরাসবিহারী নাথ প্রমুখ তাঁদের সহযাত্রী হন। ফকিরের বাজারে হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের এক সম্মিলিত সভায় সর্বশ্রী অরবিন্দ চৌধুরী, মোহিতমোদন দাস ও রথীন্দ্রনাথ সেন পদযাত্রার উদ্দেশ্য ও ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা সম্পর্কে ভাষণ দান করেন। সভার পর পদযাত্রীদল লাতু অভিমুখে যাত্রা করেন। লাতু বাজারে এক বিরাট জনতা তাঁদের অভ্যর্থনার জন্য উপস্থিত ছিলেন। এই সমাবেশে সর্বশ্রী নলিনীকান্ত দাস, নৃপতি চৌধুরী, ব্যোমকেশ দাস, রথীন্দ্রনাথ সেন এবং লাতুবাসীর পক্ষে সর্বশ্রী ননীগোপাল স্বামী ও সাজ্জাদ আলি ভাষণ দান করেন। রাতে লাতুগ্রামে অরুণচন্দ্র স্বামীর বাড়িতে আহারাদি ও বিশ্রাম করেন।
২০ এপ্রিল ভোর ৫টায় লাতু থেকে রওয়ানা হয়ে চারণের দল মহিশাষণ, বালিদাড়া, বড়পুঞ্জি, ব্রাহ্মণশাসন প্রভৃতি গ্রাম হয়ে বেলা ১০টায় গান্ধাই গ্রামে পৌঁছোন। সেখানে হিন্দু-মুসলমানের একটি মিলিত জনসমাবেশ এবং পৃথকভাবে আর একটি ছাত্র সমাবেশে সর্বশ্রী- ব্যোমকেশ দাস, নলিনীকান্ত দাস, মোহিতমোহন দাস, নৃপতি চৌধুরী ও রথীন্দ্রনাথ সেন ভাষণ দান করেন। প্রত্যেক বক্তাই সংগ্রামের বিভিন্ন দিক ও পর্যায় আলোচনাক্রমে কি পরিস্থিতির চাপে এই সংগ্রাম আরম্ভ করতে বাধ্য করা হয়েছে— তার বিশদ বর্ণনা দান করেন।
গান্ধাই থেকে পদযাত্রীদল এক বিরাট বাহিনী নিয়ে বিকাল ৫টায় নিলামবাজার পৌঁছোন এবং বাজারে এক জনসমাবেশে সর্বশ্রী— মোহিতমোহন দাস, ভূপেন্দ্রকুমার সিংহ ও নৃপতি চৌধুরী বক্তৃতা দেন। নিলামবাজার থেকে পদযাত্রীদল সন্ধ্যা ৭টায় কায়স্থ গ্রাম পৌঁছোন। সেখানে তাঁরা অভূতপূর্ব অভ্যর্থনা লাভ করেন। গ্রামবাসী আবালবৃদ্ধবনিতা প্রায় অর্ধমাইল রাস্তা অগ্রসর হয়ে বাদ্যভান্ডসহ বৃষ্টির মধ্যেও শঙ্খ ও উলুধ্বনিসহ অভ্যর্থনা করেন। কায়স্থ গ্রামবাসীর পক্ষে সর্বশ্রী- ঈশানচন্দ্র ভট্টাচার্য, কৃপাময় ভট্টাচার্য ও ডা. রাজেন্দ্রকুমার ভট্টাচার্য পদযাত্রীদের স্বাগত জানান এবং তদুত্তরে শ্রীনলিনীকান্ত দাস ও শ্রীরথীন্দ্রনাথ সেন তাঁদের বক্তৃতায় পদযাত্রার উদ্দেশ্য ও কর্মপন্থা ঘোষণা করেন।
রাতে শ্রীকৃপাময় ভট্টাচার্যের বাড়িতে এই দল আহারাদি সেরে বিশ্রাম নেন। অদ্য শুক্রবার ভোর ৫টায় তাঁরা পাথারকান্দির দিকে রওয়ানা হন।’১৩৩
বিভিন্ন স্থান থেকে অসংখ্য মানুষ পদযাত্রীদলের সঙ্গী হওয়ায় পদযাত্রী সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। পদযাত্রীদল সমবেতভাবে কখনও ‘মোদের গরব, মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা’, কখনো বা ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু’ …, অথবা ‘চল চল চল, ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল, নিম্নে উতলা ধরণীতল’ প্রভৃতি সংগীত পরিবেশন করে সবাইকে মাতিয়ে রাখেন। এরই ফাঁকে ফাঁকে ‘বন্দেমাতরম, ‘আল্লা হো আকবর’, ‘বাংলা ভাষার স্বীকৃতি চাই’, ‘অন্যান্য অনসমিয়া ভাষার মর্যাদা চাই’, ‘অসমীয়া স্বৈরাচার মানি না, মানব না’ ইত্যাদি ধ্বনির মাধ্যমে তাঁরা আকাশ বাতাস মথিত করে তোলেন। এ যেন স্বদেশি আন্দোলন, স্বাধীন ভারতে নতুন করে শুরু হল?
‘২১ এপ্রিল ভোরে পদযাত্রীদল কায়স্থ গ্রাম থেকে যাত্রা করে সকাল ৯টায় পাথারকান্দিতে পৌঁছোলে পর উপস্থিত জনতা তাঁদের অভ্যর্থনা জানান। পদযাত্রীদল মন্ডল কংগ্রেস অফিসে অবস্থান করেন এবং দুপুরে ও রাতে তাঁরা মন্ডল কংগ্রেস সভাপতি শ্রীনরেন্দ্র সিংহের বাড়িতে আহার করেন। পথে তাঁরা বারইগ্রাম, কানাইবাজার, আছিমগঞ্জ প্রভৃতি স্থানে সমবেত জনসমাবেশে বক্তৃতা করেন।
বিকেল চারটায় শ্রীনরেন্দ্র সিংহের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক বিরাট জনসভায় সর্বশ্রী— অরবিন্দ চৌধুরী, ননীগোপাল স্বামী, রথীন্দ্রনাথ সেন, মোহিতমোহন দাস, নৃপতি চৌধুরী, আবদুল রসিদ, গোপেশ নমঃশূদ্র, এম এল এ, মণি সিংহ প্রমুখ বক্তৃতা করেন। পাথারকান্দি মোটর স্ট্যাণ্ডে সহস্রাধিক লোকের এক জনসমাবেশ প্রবল বৃষ্টির মধ্যেও দাঁড়িয়ে তাঁদের বক্তৃতা শ্রবণ করেন। পাথারকান্দি থেকে দু-মাইল এগিয়ে এসে আবালবৃদ্ধবনিতার এক অগ্রবর্তী দল এই পদযাত্রীদলকে পুষ্প চন্দনে চর্চিত ও মাল্যভূষিত করে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন। রাতে তাঁরা পাথারকান্দিতেই বিশ্রাম করেন।’
২২ এপ্রিল ভোর ৫টায় অবিশ্রাম বর্ষণ উপেক্ষা করে পদযাত্রীদল পাথারকান্দি থেকে রওয়ানা দেন। দোহালিয়া পৌঁছানোমাত্রই তাঁদের কলোনিবাসীরা অভ্যর্থনা জানান। শ্রীযুক্তা নলিনীবালা চৌধুরী তাঁদের চা-পানে আপ্যায়ন করেন। সকাল ৯টায় তাঁরা বাজারঘাট পৌঁছোন এবং রামকৃষ্ণনগর আঞ্চলিক পঞ্চায়েত সভাপতি শ্রীঅন্নদামোহন নাথ, শ্রীসুখময় পুরকায়স্থ ও শ্রীকৃষ্ণপদ গোস্বামী তাঁদের অভ্যর্থনা জানান। তাঁরা বাজারঘাটের এক জনসমাবেশে সত্যাগ্রহের উদ্দেশ্য ও কর্মপন্থা বর্ণনা করেন।
দোহালিয়া থেকে ১০ জন এবং বাজারঘাট থেকে ৪ জন পদযাত্রীদলে যোগদান করেন। মধ্যাহ্ন আহার ও বিশ্রামের পর বেলা সাড়ে তিনটায় রওয়ানা হয়ে তাঁরা কাজীরবাজার পৌঁছোন। কাজীরবাজারে এক বিশাল জনসভায় জনাব আর্জামন্দ আলী সভাপতিত্ব করেন। সভার মদরিছ আলি, আবদুল রসিদ, আবদুল মজিদ ও নৃপতি চৌধুরী বক্তৃতা করেন এবং তাঁরা আন্দোলনের প্রতি পূর্ণ সহানুভূতি ও সমর্থন জানান। বাজারঘাট গাঁও সভাপতি আবদুল মজিদ অত্যন্ত জোরালো ভাষায় নিজের ভাষাকে রক্ষা করার জন্য যেকোনো ত্যাগ স্বীকারের আহ্বান জানান। সভায় মুসলমান ও মণিপুরী লোকই অধিক সংখ্যায় উপস্থিত ছিলেন। কাজীরবাজার থেকে শতাধিক মুসলমান যুবক বাংলা ভাষার স্বীকৃতির দাবি সংবলিত বিভিন্ন ধ্বনি দিতে দিতে তাঁরা আনিপুর পর্যন্ত পদযাত্রীদলের অনুগমন করেন। সত্যাগ্রহীদল কাজীরবাজার থেকে রওয়ানা হয়ে সন্ধ্যা ৬টায় আনিপুর পৌঁছোন। আনিপুরে হিন্দু-মুসলমান সমবেতভাবে পদযাত্রীদের অভ্যর্থনা জানান। এখানে এক বিরাট জনসভায় মণিপুরী সম্প্রদায়ের নেতা শ্রীভারত মুখার্জি সভাপতিত্ব করেন।
সভায় শ্রীসুরেন্দ্রচন্দ্র নাথ, মৌলানা ফৈজুর রহমান, শ্রীনলিনীকান্ত দাস, মণিপুরী যুবসমাজের নেতা কবি শ্রীমদনমোহন মুখার্জি, শ্রীরথীন্দ্রনাথ সেন, শ্রীনৃপতি চৌধুরী ও শ্রীমতিলাল দত্তচৌধুরী বক্তব্য রাখেন। সভায় অভূতপূর্ব লোক সমাগম হয় এবং কেউ-ই সভা শেষ না হওয়া পর্যন্ত স্থান ত্যাগ করেননি। এখানে সকল সম্প্রদায়ের মানুষ ভাষার প্রশ্নে একমত পোষণ করেন। পদযাত্রীদল আনিপুরে রাতে আহারান্তে বিশ্রাম করেন।
২৩ এপ্রিল ভোর ৬টায় পদযাত্রীদল দুর্লভছড়ার পথে আনিপুর ত্যাগ করেন। আনিপুর ও কাজীরবাজার থেকে হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের বহু মানুষ পদযাত্রীদলের সঙ্গী হন। দুর্লভছড়ায় সর্বশ্রী— ভাগীরথী চৌবে, চন্দ্রধর চৌবে, ব্রজমোহন গোস্বামী, মণিপুরী সম্প্রদায়ের বাগীন্দ্র চ্যাটার্জি, নিশিকান্ত সিংহ, দ্রোণাচার্য সিংহসহ অসংখ্য মানুষ সত্যাগ্রহীদের অভ্যর্থনা জানান। সত্যাগ্রহীরা শ্রীসতেন্দ্রকুমার দাসের বাসভবনে চা-পানের পর সেখানে ও অন্যান্য বাড়িতে আহারপর্ব সম্পন্ন করেন। নিশিকান্ত সিংহের সভাপতিত্বে ক্লাব ময়দানে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় সর্বশ্রী— নলিনীকান্ত দাস, ব্যোমকেশ দাস, রথীন্দ্রনাথ সেন, ভূপেন্দ্র সিংহ, ধনীন্দ্রচন্দ্র সাহা প্রমুখ বাংলা ভাষার দাবি ও সত্যাগ্রহের তাৎপর্য সভায় তুলে ধরেন। বিকাল সাড়ে চারটায় বিদ্যানগর বাগান হয়ে পদযাত্রীদল দুর্লভছড়া থেকে রামকৃষ্ণ নগরের পথে অগ্রসর হন। দুর্লভছড়া থেকে পদযাত্রীদের সঙ্গে বহুলোক রামকৃষ্ণনগর পর্যন্ত আসেন।
সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় পদযাত্রীদল রামকৃষ্ণনগর পৌঁছোন এবং সেখানকার জনসাধারণ সত্যাগ্রহীদের বিপুলভাবে বাদ্যভান্ডসহযোগে সংবর্ধনা জানান। দলমত নির্বিশেষে সকলেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে অভ্যর্থনায় যোগদান করে বাংলা ভাষার প্রতি তাঁদের অকুন্ঠ সমর্থন জানান। রাতে রামকৃষ্ণনগরে সত্যাগ্রহীগণ আহার ও বিশ্রাম করেন।
২৪ এপ্রিল বিকেল সাড়ে চারটায় শ্রীবিশ্বনাথ উপাধ্যায়, এম এল এ-র সভাপতিত্বে কয়েক সহস্র লোকের এক সমাবেশে বিভিন্ন বক্তা ভাষণ দেন। সভারম্ভের পূর্বে সত্যাগ্রহীদের মাল্যদান ও চন্দন চর্চিত করে তাঁদের ওপর লাজ বর্ষণ করা হয়। পদযাত্রীদের পক্ষে শ্রীনলিনীকান্ত দাস, রামকৃষ্ণনগরবাসীদের ধন্যবাদ জানিয়ে বর্তমান আন্দোলনের পটভূমিকা বর্ণনা করে আন্দোলন সফল করে তোলার জন্য সকলের সহযোগিতা কামনা করেন। শ্রীভূপেন্দ্র সিংহ বলেন, বাংলা ভাষাভাষী গোষ্ঠীর সঙ্গে কাছাড়ের মণিপুরী অথবা অন্যান্য ভাষাভাষীদের স্বার্থ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সুতরাং, নিজ নিজ স্বার্থে একতাবদ্ধ হয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে। প্রত্যেক জাতির মধ্যে বিশ্বাসঘাতকের দল ইতিহাসের আদিযুগ থেকে যে বিভীষণের ভূমিকা নিয়েছে— তার অবসান ঘটাতে হবে। অত্যন্ত আশার কথা, আমরা পাদপরিক্রমায় দেখেছি জাতির রক্তে প্রলয়ের নাচন ধরেছে। আসন্ন অসহযোগ আন্দোলনে কার আগে কে প্রাণ দেবে তার জন্য কাড়াকাড়ি লেগে যাবে। শ্রীবিধুভূষণ চৌধুরী বাংলাভাষীদের দাবির তাৎপর্য ও বর্তমান আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা কেন— সে-বিষয়ে দীর্ঘক্ষণ বক্তব্য রাখেন। সভায় মো. নিয়াজ আলি, সভাপতি, গাঁও পঞ্চায়েত, রথীন্দ্রনাথ সেন, যুবকর্মী কালা মিয়াও বক্তব্য রাখেন। সভার সভাপতি তাঁর ভাষণে ভাষা আন্দোলনে সকলের সহযোগিতার আহ্বান জানান। কংগ্রেস নেতা শ্রীমতিলাল দত্তচৌধুরী, শ্রীধীরেন্দ্রচন্দ্র পাল, কালা মিয়া এবং সর্বোপরি শ্রীবিশ্বনাথ উপাধ্যায়, এম এল এ পদযাত্রীদলে যোগ দেওয়ায় দলের শক্তি বহুল পরিমাণে বৃদ্ধি পায়।’১৩৪
২৫ এপ্রিল সকাল সাড়ে পাঁচটায় পদযাত্রীদল রামকৃষ্ণনগর ত্যাগ করেন। সুরুচিগঞ্জ, পদ্মার-পার, সিংলারপার হয়ে তাঁরা ডলুগ্রাম পৌঁছোন। সিংলারপারের জগন্নাথের আখড়ার মোহান্ত পদযাত্রীদলকে পুষ্পমাল্যে ভূষিত করেন ও তাঁদের মধ্যে প্রসাদ বিতরণ করেন। এরপর পদযাত্রীগণ ডলুগ্রামে শ্রীযতীন্দ্রকুমার পালের বাড়িতে আহার ও বিশ্রাম করেন। মন্ডল কংগ্রেস সভাপতি শ্রীধীরেন্দ্রচন্দ্র পাল, শ্রীবিনোদচন্দ্র পাল, শ্রীসুনীলচন্দ্র পাল, শ্রীঅনিল চক্রবর্তী, শ্রীরাজকিশোর পাল, শ্রীফুলচাঁদ দাস প্রমুখ কালীবাড়ি বাজার পর্যন্ত পদযাত্রীদের অনুগমন করেন ও কয়েকজন পদযাত্রীদলে যোগদান করেন। শ্রীকালিকাপ্রসাদ পাল ডলুগ্রামে পদযাত্রীদের দারুণ গ্রীষ্মে শীতল পানীয় দান করেন।
বিকাল সাড়ে চারটায় কালীবাড়ি বাজারে হিন্দু-মুসলমানের এক মিলিত জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভাপতিত্ব করেন শ্রীনর্মদাকুমার দেব। শোনবিল অঞ্চলের অধিবাসীদের পক্ষ থেকে শ্রীনগেন্দ্রচন্দ্র দাস (কল্যাণপুর) ও শ্রীমতিলাল দাস (স্বস্তিপুর) একটি মুদ্রিত অভিনন্দনপত্র পাঠের মধ্যদিয়ে পদযাত্রীদের সংবর্ধনা জ্ঞাপন করেন।
জেলা সংগ্রাম পরিষদ সেক্রেটারি শ্রীনলিনীকান্ত দাস অভিনন্দনের উত্তরদান করেন এবং সংগ্রামের পটভূমিকা ব্যাখ্যা করেন। শ্রীবিশ্বনাথ উপাধ্যায়, এম এল এ বলেন,
… যে মুহূর্তে আপনারা আদেশ দেবেন— সেই মুহূর্তেই আমি পদত্যাগ করব। তিনি বলেন, আসাম সরকার দুর্নীতির একটি পঙ্ককুন্ড হয়েছে। সদস্য ও মন্ত্রীদের মধ্যেও দুর্নীতির অভাব নেই। … বাংলা ভাষাভাষী পরিষদ সদস্যরা জাতির প্রয়োজনের সময়ে নিজেদের স্বার্থ আঁকড়ে ধরে বাংলা ভাষাভাষীদের প্রতি কর্তব্য পালন করেননি। এই আন্দোলনে সকলকে পূর্ণ সমর্থন জানাবার আহ্বান জানান তিনি।
শ্রীব্যোমকেশ দাস বলেন, বড়োই দুঃখের বিষয় যে, স্বাধীন দেশের সরকারের কার্যাদির বিরুদ্ধেও আবার আমাদের সংগ্রাম করতে হচ্ছে। তিনি হিন্দু-মুসলমান সকলকে একযোগে সংগ্রামে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। শ্রীনৃপতি চৌধুরী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যোগদানের জন্য ছাত্র ও যুব সম্প্রদায়কে আহ্বান করেন।
এ দিনের সভায় রথীন্দ্রনাথ সেন, শান্তিরঞ্জন দাস, ধীরেন্দ্রচন্দ্র পাল, রাধিকা চক্রবর্তী এবং শেষে সভাপতি সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেন। তখন সন্ধ্যা সাড়ে ছ-টা। পদযাত্রীদল শনবিল তীরস্থ কল্যাণপুর গ্রামে রাত্রিবাস করেন। সেখানে রাত দশটায় গ্রামবাসীদের এক বিশাল সমাবেশে রথীন্দ্রনাথ সেন অত্যন্ত সহজ-সরল ভাষায় পদযাত্রার উদ্দেশ্য বর্ণনা করেন।
২৬ এপ্রিল ভোর ৫.৫০-এ কল্যাণপুর থেকে রওয়ানা হয়ে শোনবিলের পূর্ব পার দিয়ে সমৃদ্ধিপুর, দরগারবন্দ, আনন্দপুর, শ্রীপুর, সিঙ্গুয়া, দেবদ্বার হয়ে পদযাত্রীদল তুলাধুনায় কিছু সময় বিশ্রাম নেন। সেখানে একটি জনসমাবেশও আয়োজিত হয়। সমাবেশে আন্দোলনের উদ্দেশ্য বুঝিয়ে বলা হয়। পদযাত্রীদল বেলা সাড়ে দশটায় চন্দ্রপুর বাজারে পৌঁছোন। সেখানে তাঁরা সারদাচরণ চক্রবর্তীর বাড়িতে দুপুরের আহার গ্রহণ করে বিশ্রাম নেন। চন্দ্রপুরে রাকেশচন্দ্র দাস, আতর আলিসহ গ্রামের বহুসংখ্যক উৎসাহী মানুষ তাঁদের অভ্যর্থনা জানান। কল্যাণপুর ও চন্দ্রপুর থেকে কিছুসংখ্যক নতুন সত্যাগ্রহী পদযাত্রীদলে যোগদান করেন।
বদরপুর আঞ্চলিক পঞ্চায়েত সভাপতি শ্রীরাকেশচন্দ্র দাসের পৌরোহিত্যে বিকাল চারটায় চন্দ্রপুর বাজারে এক বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ব্যোমকেশ দাস পদযাত্রার উদ্দেশ্য বর্ণনা করেন। জনসভায় শ্রীবিশ্বনাথ উপাধ্যায়, এম এল এ, নৃপতিরঞ্জন চৌধুরী, রথীন্দ্রনাথ সেন, অবসরপ্রাপ্ত হেডমাস্টার শ্রীসুরেন্দ্রকুমার দাস, গাঁও পঞ্চায়েত সভাপতি শ্রীসারদাচরণ চক্রবর্তী প্রমুখ আন্দোলন কেন? সে-বিষয়ে এবং বাংলা ভাষার স্বীকৃতির প্রশ্নটিও বিস্তৃত আকারে তুলে ধরেন। বক্তাগণ এই আন্দোলনে হিন্দু-মুসলমান তথা জাতি ধর্ম নির্বিশেষ সকলকে এগিয়ে আশার আহ্বান জানান।
শ্রীরাকেশচন্দ্র দাসের নেতৃত্বে শতাধিক লোক মর্যাদাকান্দি পর্যন্ত পদযাত্রীদলের অনুগমন করে সকলকে উৎসাহ দান করেন। মর্যাদাকান্দিতে হিন্দু-মুসলমানের এক বিরাট জনতা পদযাত্রীদলকে অর্ভ্যথনা জানান। শ্রীঅতুলচন্দ্র দাস সকলকে চা-পানে আপ্যায়িত করেন। রথীন্দ্রনাথ সেন এখানে এক সংক্ষিপ্ত ভাষণে পদযাত্রার উদ্দেশ্য বর্ণনা করেন।
মর্যাদাকান্দিতে হাজী সৈদ আলির (?) নেতৃত্বে দত্তপুরের এক বিরাট জনতা পদযাত্রীদলকে অর্ভ্যথনা জানিয়ে দত্তপুর নিয়ে আসেন। পদযাত্রীদল রাত আটটার পর দত্তপুর বাজারে পৌঁছোন এবং অল্পক্ষণ বিশ্রামের পর এক সভায় স্থানীয় মানুষের সঙ্গে মত বিনিময় করেন। সভায় শ্রীনির্মলচন্দ্র দাস পুরকায়স্থ পদযাত্রীদের যাত্রার উদ্দেশ্য বর্ণনা করেন। রাত দশটায় সভার কাজ সমাপ্ত হয়। রাতে দত্তপুরে বিশ্রাম নিয়ে পদযাত্রীদল পরদিন ভোরে বদরপুরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন।
২৭ এপ্রিল ভোর সাড়ে পাঁচটায় দত্তপুর বাজার ত্যাগ করে পদযাত্রীদল বিভিন্ন গ্রামের ভিতর দিয়ে গণসংযোগ করে সকাল সাড়ে ছ-টায় এংলার বাজার পৌঁছে যান। হরিণাদি গ্রামে শ্রীছাতির আলি সকলকে চা-পানে আপ্যায়িত করেন। এখানে জনাব সুনাহর আলি, ছাতির আলিসহ বেশ কয়েকজন পদযাত্রীদলের সঙ্গী হন। বেলা সাড়ে দশটায় প্রখর রৌদ্র, জলকাদা উপেক্ষা করে তাঁরা বদরপুর পৌঁছোন। সেখানে কালীবাড়ি নাটমন্দিরে শুচিস্নিগ্ধ পরিবেশে মহিলা ও বালিকারা উলু ও শঙ্খধ্বনি দিয়ে পদযাত্রীদের চন্দন তিলক পরিয়ে স্বাগত ও আশীর্বাদ জানান। এ সময় মুহুর্মুহু শঙ্খধ্বনি ও পুষ্পবৃষ্টি হতে থাকে। সত্যিই সে এক দুর্লভ মুহূর্ত। কালীবাড়ির অভ্যর্থনায় সর্বশ্রী রমেন্দ্রলাল সেন, বারীন্দ্রকুমার পুরকায়স্থ, যতীন্দ্র চক্রবর্তী প্রমুখের তত্ত্বাবধানে বিপুলসংখ্যক নারী-পুরুষ অংশগ্রহণ করেন। বিকাল চারটায় পদযাত্রীদল স্থানীয় মানুষের এক বিশাল শোভাযাত্রাসহ বদরপুরঘাট ঘুরে বদরপুর বাজার পৌঁছোন। বাজারের শত শত গণ্যমান্য ভদ্রলোক ও সাধারণ মানুষ বাংলা ভাষার দাবিতে ধ্বনি দিয়ে বহু রাস্তা অগ্রসর হয়ে পদযাত্রীদের স্বাগত জানিয়ে নিয়ে আসেন। বিকেল সাড়ে পাঁচটায় মোটর স্ট্যাণ্ডের ওপর ডা. বি কে ঘোষের সভাপতিত্বে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। হিন্দু-মুসলমান ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের সহস্রাধিক মানুষ জনসভায় যোগদান করেন। সভায় জেলা সংগ্রাম পরিষদ সম্পাদক শ্রীনলিনীকান্ত দাস পদযাত্রার উদ্দেশ্য বর্ণনা করে এই জীবনমরণ সংগ্রামে সকলকে যোগদানের আহ্বান জানান।
শ্রীরথীন্দ্রনাথ সেন তাঁর ভাষণে বলেন, আজ ১৩ বছর হল, আমরা স্বাধীনতা লাভ করেছি। ভারতের বহু অঞ্চলে ভাষাভিত্তিক প্রদেশ গঠন করা হয়েছে। কিন্তু কংগ্রেসের প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও আসামের ক্ষেত্রে তা উপেক্ষিত হয়েছে। তিনি মাদ্রাজ, বোম্বাই ও পূর্বপাঞ্জাবের অবস্থা সবিস্তারে বর্ণনা করে বলেন, আজ বাঙালির দুর্দিন। … আসাম সরকারের কারাগারে আজ ভাষাজননী বন্দিনি হয়ে মুক্তির জন্য হাহাকার করছেন। এগিয়ে এসো ভাই মুসলমান, এগিয়ে এসো ভাই হিন্দু, ধর্মের গ্লানিতে শ্রীভগবান যেমন যুগে যুগে অবতীর্ণ হন— সেই সম্ভাবনায় তোমরা তৈরি হও।
উল্লেখযোগ্য যে, এই বদরপুরে বিমলাপ্রসাদ চালিহা তাঁর নির্বাচনকালে এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘রবীন্দ্রনাথের ভাষা, ভারতবর্ষের গৌরবের ভাষাকে আসামে আমরা পূর্ণ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করব।’ শিলচরের ছাত্রনেতা শ্রীবিজন রায় শিলচরে আন্দোলনের অগ্রগতির বর্ণনা দিয়ে বলেন, রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ উপলক্ষ্যে যখন পৃথিবীব্যাপী উৎসব, অনুষ্ঠান হচ্ছে—তখন সেই বাংলা ভাষার পূজারি রবীন্দ্রনাথের ভাষা আজ আসাম সরকারের জুলুমবাজিতে এখানে লোপ পেতে বসেছে। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে এখানে কীসের উৎসব, কীসের আড়ম্বর?
সভাপতির ভাষণের পর শ্রীনৃপতি চৌধুরী সভাপতিকে ধন্যবাদ জানিয়ে যুবসমাজকে এই আন্দোলনে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। অধিক রাতে সভা ভঙ্গ হয়। স্থানীয় মানুষ সঙ্গে সঙ্গে পদযাত্রীদের আহারের আয়োজন করেন।’১৩৫
‘২৮ এপ্রিল ভোর পাঁচটায় পদযাত্রীগণ শোভাযাত্রা সহকারে ধ্বনি দিতে দিতে বদরপুর ত্যাগ করে ভাঙাবাজারের দিকে অগ্রসর হন। পথে শ্রীগৌরীগ্রামের সাধারণ মানুষ তাঁদের অভ্যর্থনা জানান ও চা-পানে আপ্যায়িত করেন। সকাল ন-টায় পদযাত্রীদল ভাঙা পৌঁছোলে সেখানে বিপুলভাবে তাঁরা সংবর্ধিত হন। পদযাত্রীদলকে শ্রীশান্তিলাল সেনগুপ্ত-র বাংলোয় নিয়ে যাওয়া হলে সেখানে মহিলাগণ তাঁদের চন্দনতিলক পরিয়ে স্বাগত জানান। শ্রীসেন-এর বাংলোয় তাঁরা আহার ও বিশ্রাম গ্রহণ করেন। বিকাল পাঁচটায় ভাঙাবাজারে এক বিশাল জনসভায় শ্রীনলিনীকান্ত দাস পদযাত্রার উদ্দেশ্য বর্ণনা করেন। শ্রীবনওয়ারীলাল দত্তচৌধুরী সভায় সভাপতিত্ব করেন।’
‘২৯ এপ্রিল ভোর পাঁচটায় ভাঙাবাজার থেকে রওয়ানা হয়ে পদযাত্রীদল মাছলি, মির্জাপুর, শেরখালিপুর হয়ে লামাজোয়ার অতিক্রম করবার সময় শ্রান্ত পদযাত্রীদল শ্রীপরাণচন্দ্র নাথের বাড়িতে উপস্থিত হলে গ্রামের মানুষ তাঁদের আন্তরিক অর্ভ্যথনা জানান। সেখানে সকলকে সকালের জলখাবার ও পানীয় দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়। সকাল সাড়ে আটটায় পদযাত্রীদল হারাঙ্গাবাজ গ্রামে পৌঁছোলে সেখানেও সকলকে অর্ভ্যথনা জানানো হয়। পদযাত্রীদল চরগোলাগাঁও পঞ্চায়েত সভাপতি ও মন্ডল কংগ্রেস সম্পাদক শ্রীতরণীমোহন দে-র বাড়িতে বিশ্রাম গ্রহণ করেন। বিকাল চারটায় শোভাযাত্রা সহকারে পদযাত্রীদল চরগোলাবাজার পৌঁছোন। সেখানে এক সভায় সহস্রাধিক মানুষ সমবেত হন। সভায় শ্রীনলিনীকান্ত দাস পদযাত্রার উদ্দেশ্য ও সংগ্রাম পরিষদের আন্দোলনের পটভূমি বর্ণনা করেন। রথীন্দ্রনাথ সেন জাতীয় ঐক্যের ওপর বিশেষ জোর দিয়ে বলেন যে, জাতির ভবিষ্যৎ আজ বিপন্ন। আজ আর আমাদের হিন্দু, মুসলমান, তপশিলিদের মধ্যে ভেদ রাখবার দিন নয়। তিনি বলেন:
আমাদের মাতৃভাষাও চরম সংকটের দিনে আজ আমাদের এক হয়ে লড়তে হবে। আমরা এই সংগ্রামের জন্য আপনাদেরই নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ওপর বিশ্বাস করে প্রতারিত হয়েছি। সময় ও সুযোগের যদি তাঁরা সদব্যবহার করতে পারতেন এবং নিজের মাতৃভাষারা ওপর তাঁদের প্রকৃত মমতাবোধ থাকত তবে আজ পদযাত্রায় বের হয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরবার হয়তো প্রয়োজন হত না। শ্রীনৃপতি চৌধুরী আবেগময়ী ভাষায় ছাত্র ও যুবকদের সত্যাগ্রহী তালিকায় নাম লেখাবার জন্য আহ্বান জানান। মানুষ ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে নীরবে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা শোনেন।
সভা শেষ হওয়ার পর পদযাত্রীদল শোভাযাত্রা সহকারে জবাইনপুর গ্রামে যান এবং সেখানে গণসংযোগ শেষে শ্রীসুধাংশুবিকাশ দাসের বাড়িতে উপস্থিত হয়ে চা-জল খাবার গ্রহণ করেন। রাত ন-টা পর্যন্ত গ্রামে গ্রামে ঘুরে হারাঙ্গাবাদ গ্রামের আতিথ্য গ্রহণ করে শ্রীতরণীকুমার দে-র বাড়িতে রাত্রিযাপন করেন।’
‘৩০ এপ্রিল হারাঙ্গাবাদ থেকে ভোর পাঁচটায় রওয়ানা হয়ে পদযাত্রীদল বিভিন্ন গ্রামে গণসংযোগ শেষে সকাল ন-টায় কালীগঞ্জ বাজার হয়ে বাগবাড়ি পৌঁছোলে জনগণ তাঁদের বিপুলভাবে সংবর্ধনা দেন। বিকাল পাঁচটায় অনুষ্ঠিত হয় জনসভা। সভাপতিত্ব করেন জেলা কংগ্রেস কার্যকরী কমিটি সদস্য শ্রীসুশীলকুমার দেব। সেদিন ভিড়ে ঠাসা জনসভায় যোগদানকারীদের মধ্যে ছিলেন সর্বশ্রী মৌলবি সিরাজুল ইসলাম, ওয়াছিদ আলি, সৈদউদ্দিন চৌধুরী, মন্ডল কংগ্রেস সভাপতি ইয়াকুব আলি পাটাদার, সুখময় ভট্টাচার্যসহ অসংখ্য ছাত্র-যুবক।
শ্রীনলিনীকান্ত দাস সভায় সত্যাগ্রহীদলের পক্ষে পদযাত্রার উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে মাতৃভাষার মর্যাদারক্ষার সংগ্রামে সকলের সহযোগিতা প্রার্থনা করেন। শ্রীব্যোমকেশ দাস বলেন, স্বাধীনতা-লাভের পর আমরা যা চেয়েছিলাম— তা পাইনি। বরং অসমীয়া ভাষীগণ ও আমার সরকার এখন আমাদের মাতৃভাষার ওপরও হামলা আরম্ভ করেছেন। এই অবস্থায় আমাদের কর্তব্য স্থির করতে হবে। আমরা এমন আন্দোলন গড়ে তুলব যাতে আমরা আমাদের ন্যায়সংগত দাবি আদায় করতে পারি।
সভায় মোহিতমোহন দাস বলেন, ধর্ম, স্বাধীনতা ও মাতৃভাষা আমাদের জন্মগত অধিকার। এতে কারো হস্তক্ষেপ চলে না। কিন্তু আসাম সরকার আমার ঘাড়ের ওপর জোর করে তাঁদের অসমীয়া ভাষা চাপিয়ে দিয়েছেন। কাজেই সংগ্রাম না করলে আমাদের দাবি আদায় করতে পারব না।
শ্রীবিশ্বনাথ উপাধ্যায়, এম এল এ বলেন, ‘ভাষা আইন সম্পর্কে আমার সহকর্মী কংগ্রেস সদস্যরা তাঁদের ভোটদাতাদের প্রতি কর্তব্য পালন করেননি। আগামী ২ মে করিমগঞ্জ শহরে ফিরে গিয়ে সকলের মত নিয়ে চূড়ান্ত সংগ্রামের কর্মসূচি স্থির করা হবে। আপনারা সকলে এগিয়ে আসবেন— এটাই আমাদের বিশ্বাস।’ শ্রীনৃপতিরঞ্জন চৌধুরী আন্দোলনের উদ্দেশ্য বর্ণনা করে বলেন, ‘মহকুমার বিভিন্ন স্থানে পথপরিক্রমায় আমরা হিন্দু, মুসলমান, মণিপুরী, হিন্দুস্থানি— সব শ্রেণির জনসাধারণের কাছ থেকে অকুন্ট সমর্থন পেয়েছি। এখানে বা অন্য কোথাও যদি কোনো দালাল বা দালালেরা বিভ্রান্ত করে— তবে সেইসব বেইমানদের সম্পর্কে আপনারা সাবধান থাকুন।’
জনাব মানিক মিয়া ও ওয়াছির আলি চৌধুরী পদযাত্রীদের অভিনন্দন জানিয়ে আন্দোলনে সর্বপ্রকার সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন। মৌলবি সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘কংগ্রেস কনভেনশন করার পর বড়ো বড়ো নেতারা কী করেছেন তা আমি জানি না, তবে এখন যে সংগ্রাম আপনারা আরম্ভ করেছেন সুষ্ঠুভাবে তা পরিচালিত হলে বাংলা ভাষা কায়েম করার জন্য আমরা সকলেই আপনাদের সঙ্গে আছি।’
শ্রীরথীন্দ্রনাথ সেন মৌলবি সিরাজুল ইসলামের বক্তৃতার সমর্থনে বলেন যে, ‘মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে আমরা যে অসহযোগ আন্দোলন করেছিলাম, সেটাই হবে আমাদের আন্দোলনের আদর্শ।’
সভাপতি শ্রীদেব তাঁর ভাষণে ভাষা আন্দোলনে সর্বপ্রকার সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন। সভা শেষ হওয়ার পর মানিক মিয়া সত্যাগ্রহীদের চা-পানে আপ্যায়িত করেন। রাতে পদযাত্রীদল শ্রীসুশীলকুমার দেব-এর বাড়িতে আহার করেন।’১৩৬
১ মে ভোর সাড়ে পাঁচটায় পদযাত্রীদল বাগবাড়ি ত্যাগ করেন। এই পদযাত্রায় শ্রীসুশীলকুমার দেব ও শ্রীযামিনীকুমার শুক্ল যোগ দেন। সকাল ৭.১০ মিনিটে সুপ্রাকান্দি স্টেশনে পৌঁছোনোমাত্র সত্যাগ্রহীদের সর্বশ্রী শশীন্দ্রমোহন বিশ্বাস, প্রেসিডেন্ট গাঁও সভা, তারিণীশঙ্কর রায়, সভাপতি পীননগর গাঁও সভা, সুনীলচন্দ্র দে, মনোমোহন আদিত্য, সেক্রেটারি মন্ডল কংগ্রেস (নলুয়া, সুপ্রাকান্দি মন্ডল), জগদীশ চক্রবর্তী, সেক্রেটারি, পীননগর গাঁও সভা, পরিমল রায়, সেক্রেটারি পল্লিমঙ্গল প্রতিষ্ঠান, জ্যোতির্ময় অধিকারী, মেম্বার, দক্ষিণ করিমগঞ্জ আঞ্চলিক পঞ্চায়েত, সন্তোষ চৌধুরী, খুশীন্দ্র নমঃশূদ্র এবং সিডিউল কাস্ট অ্যাসোসিয়েশন জয়েন্ট সেক্রেটারি অনিলচন্দ্র রায় প্রমুখ শ্রীরায়ের বাড়িতে মাঙ্গলিক পুষ্পমাল্য দিয়ে অর্ভ্যথনা করেন এবং প্রচুর চা-মিষ্টিযোগে আপ্যায়িত করেন। উপস্থিত বিশিষ্টজনদের মধ্যে ডা. কামিনীকুমার রায়, প্রসন্নকুমার নমঃশূদ্র, অশ্বিনীকুমার বিশ্বাস প্রমুখের নামও উল্লেখযোগ্য।
এ দিন গাঁওসভার প্রেসিডেন্ট শ্রীশশীন্দ্রকুমার বিশ্বাসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় পদযাত্রীদের স্বাগত জানানো হয়। পদযাত্রীদের অভিনন্দন জ্ঞাপন করে সুপ্রাকান্দি অঞ্চলের পক্ষ থেকে একটি মানপত্র পাঠ করা হয়। এই মানপত্রের জবাবে শ্রীনলিনীকান্ত দাস সকলকে পদযাত্রার কারণ বর্ণনা করেন। তিনি আবেগময়ী ভাষায় সত্যাগ্রহী ও পদযাত্রীদলে যোগদানের জন্য যুবক ও ছাত্রদের আহ্বান জানান। রথীন্দ্রনাথ সেন বলেন, ‘সর্বশ্রেণির লোকের যে আন্তরিক অর্ভ্যথনা ও বাংলা ভাষা আন্দোলনের প্রতি অকুন্ঠ সমর্থন লক্ষ করেছি, তা সত্যিই অপূর্ব। আপনাদের আশীর্বাদ আমি মাথা পেতে নিচ্ছি।’
মোহিতমোহন দাস বলেন, কাছাড় সবসময়েই সরকারের বৈষম্যের শিকার, উপেক্ষিত। চালিহা সরকারের আমলে আমরা আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি হারাতে বসে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত হতে চলেছি। আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার জন্য আজ এই সংগ্রাম।
বেলা সাড়ে ন-টায় পদযাত্রীদল নওয়াগ্রামের শ্রীকালীকৃষ্ণ শুক্লের বাড়িতে উপস্থিত হন। শ্রীশুক্ল প্রাথমিক আপ্যায়নের পর দুপুরে তাঁদের ভূরিভোজে আপ্যায়িত করেন। বেলা দুটোয় শ্রীশুক্লর বহি:প্রাঙ্গণে সুদৃশ্য চন্দ্রাতপের নীচে নিকটস্থ গ্রামবাসীদের নিয়ে এক সভার আয়োজন করেন। শ্রীকোকিলচন্দ্র শুক্লবৈদ্য সভাপতির আসন গ্রহণ করেন। নওয়াগ্রামবাসীদের পক্ষ থেকে শ্রীকালীকৃষ্ণ শুক্ল একটি মানপত্র দেন এবং শ্রীমনোমোহন আদিত্য সেটি পাঠ করেন।
মানপত্রের উত্তরদানকালে শ্রীঅরবিন্দ চৌধুরী বলেন, মানপত্র গ্রহণ করার মতো সময় বোধ হয় এখনও আসেনি। আপনারা সম্মিলিতভাবে যদি সংগ্রামে যোগ দেন এবং আপনাদের কাছ থেকে আহরিত শক্তি দিয়ে সংগ্রাম করে তাতে জয়ী হতে পারি, তবেই এই অভ্যর্থনা সার্থক হবে। আজ কংগ্রেস বা অন্য কোনো দলের এই আন্দোলন নয়, এ আন্দোলন মানবতার। শ্রীনৃপতি চৌধুরী আন্দোলনের উদ্দেশ্য ও পটভূমিকা বর্ণনা করে সত্যাগ্রহী হিসেবে যোগদানের জন্য সকলকে আহ্বান জানান। রথীন্দ্রনাথ সেন আসামের ভাষা আইনের পরিপ্রেক্ষিতে অসমিয়ারা কী করে আমাদের ওপর অসমিয়া ভাষা চাপিয়ে দিয়েছে তা বর্ণনা করেন।
শ্রীবিশ্বনাথ উপাধ্যায় বলেন, শিলচরে বাংলা ভাষা সম্মেলনের নির্দেশ অনুযায়ী আমাদের ওপর আদেশ দেওয়া হয় যে, আসাম রাজ্যভাষা আইনের প্রতিবাদে আমাদের পদত্যাগ করতে হবে। কংগ্রেসের এম. এল. এ.-রা পদত্যাগ করেননি। তাই আমার একার সদস্যপদ ত্যাগে কোনো ফল হবে না। আমি বাংলা ভাষাভাষী লোকের ভোটে নির্বাচিত হয়েছি, কাজেই আপনাদের নির্দেশ আমি সবসময়ই মেনে চলব এবং পদত্যাগ করতে বললেই তা করব। সভাপতি তাঁর ভাষণে ভগবানের কাছে ন্যায়ের আন্দোলনে জয়যুক্ত হওয়ার জন্য প্রার্থনা করেন ও সকলকে আন্দোলনের সমর্থনে দাঁড়াতে বলেন। বেলা সাড়ে তিনটায় সভা শেষ হয় এবং পদযাত্রীদল কর্ণমধু-র দিকে রওয়ানা হন।
বেলা পাঁচটা পনেরো মিনিটে পদযাত্রীদল কর্ণমধু পৌঁছোন। কর্ণমধু ও তার সন্নিহিত গ্রামাঞ্চল থেকে পাঁচ শতাধিক লোক শোভাযাত্রা করে অগ্রসর হয়ে পদযাত্রীদলকে অভ্যর্থনা জানান। প্রত্যেক হিন্দুবাড়ি থেকে এসময় মুহুর্মুহু উলু ও শঙ্খধ্বনি হতে থাকে। ধূপ, ধুনা, পুষ্প ও মাল্যদান করে মেয়েরা রাস্তায় পদযাত্রীদের সংবর্ধনা জানান।
বিকাল সাড়ে পাঁচটায় কর্ণমধু স্কুল মাঠে সভার কাজ আরম্ভ হয়। এই বিশাল জনসভায় সভাপতিত্ব করেন মৌলবি হাজী নিমার আলি (আঞ্চলিক পঞ্চায়েত সভ্য)। প্রথমেই জেলা সংগ্রাম পরিষদ সম্পাদক শ্রীনলিনীকান্ত দাস পদযাত্রার পটভূমি ও করিমগঞ্জবাসীর অভূতপূর্ব জাগরণ সম্পর্কে ভাষণ দেন।
এর পর শ্রীনৃপতি চৌধুরী, অসমিয়া নেতৃবৃন্দ যে অত্যাচার ও নির্যাতনের ভেতর দিয়ে ভাষা আইন প্রবর্তন করেন তা বর্ণনা করে আন্দোলনকে শক্তিশালী করবার আহ্বান জানান। প্রবীণ নেতা শ্রীব্যোমকেশ দাশও সভায় বক্তব্য রাখেন।
বিশিষ্ট কংগ্রেস-নেতা মতিলাল দত্তচৌধুরী বলেন যে, তিনি আজীবন কংগ্রেসসেবী এবং বাকি জীবনও কংগ্রেসের কাজ করে যাবেন। কিন্তু তাই ভাষার প্রশ্নে, জনসাধারণের মৌলিক অধিকারের প্রশ্নে, জনসাধারণের সঙ্গে নিজের দাবির জন্য সংগ্রাম করায় তিনি কোনো বাধা দেখেন না। বাংলা ভাষার দাবি আদায়ের জন্য তিনি সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যোগদান করেছেন। শ্রীরথীন্দ্রনাথ সেনও ওজস্বিনী ভাষায় আন্দোলনের পটভূমিকা বর্ণনা করে ন্যায়ধর্মের এই আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়বার জন্য হিন্দু-মুসলমান সকলকে আহ্বান জানান।
কর্ণমধু গ্রামের যেসব বিশিষ্ট ব্যক্তি এই আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন— তাঁরা হলেন সর্বশ্রী-জিতেন্দ্র পালচৌধুরী, রত্নগোপাল অধিকারী, মেম্বার, দক্ষিণ করিমগঞ্জ আঞ্চলিক পঞ্চায়েত, প্রমেশচন্দ্র দেব, সভাপতি, নাগকাপন গাঁওসভা, নিমার আলি, মেম্বার, আঞ্চলিক পঞ্চায়েত, রহমান আলি, হাজী নমরুজ আলি, প্রেসিডেন্ট, উজানটী গাঁওসভা, বিপিনরাম রুদ্রপাল, নিবারণচন্দ্র পাল, নৃপেন্দ্রকুমার পালচৌধুরী প্রমুখ। রাতে পদযাত্রীদল শ্রীনৃপেন্দ্রকুমার পালচৌধুরীর বাড়িতে আহার ও বিশ্রাম করেন।
সভার পর পদযাত্রীদল সারাদিনের পরিশ্রম ও ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে ভগীসগী (?) গ্রামের আঞ্চলিক পঞ্চায়েত সভাপতি জনাব নুরুল হক চৌধুরীর বাড়িতে নিমন্ত্রণ রক্ষার্থে যান এবং সেখানে গ্রামবাসীদের সঙ্গে মত বিনিময় শেষে জনাব চৌধুরীর বাড়িতে চা-মিষ্টিযোগে আপ্যায়িত হন। অধিক রাতে তাঁরা কর্ণমধু ফিরে আসেন।
২ মে, ৬১, সকাল ৬টা পনেরোতে কর্ণমধু থেকে পদযাত্রীদল আম্বরখানার পথে রওয়ানা হন। এওলাবাড়ি বাগানে ম্যানেজারের বাংলায় পদযাত্রীদলকে চা ও লুচি পায়েসযোগে প্রাতরাশ করানো হয়। প্রত্যেক পদযাত্রীকে মালা-চন্দন দিয়ে সংবর্ধনা জানানো হয়।
সকাল সাড়ে আটটায় আয়োজিত সভায় সভাপতির আসন গ্রহণ করেন বাগান পঞ্চায়েত সম্পাদক শ্রীমানিক কর্মকার। এই সভাতেও বাগানের পক্ষ থেকে পদযাত্রীদলকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সভায় শ্রীমোহিতমোহন দাস ও শ্রীবিশ্বনাথ উপাধ্যায়, এম এল এ, বক্তব্য রাখেন। এই সভায় জেলা কংগ্রেস কমিটি সদস্য শ্রী জ্যোর্তিময় দাস ও আরও অনেক মানুষ আনুষ্ঠানিকভাবে আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন। সভার সভাপতি বলেন, ‘আমরা বাংলায় কথা বলি, বাংলাই আমাদের ভাষা’ বলে দাবি করেন। সভা সমাপ্ত হলে পর বেলা সাড়ে দশটায় পদযাত্রীদল আম্বরখানা পৌঁছোন। সেখানে তাঁরা শ্রীকরুণাময় পালের বাড়িতে আহার ও বিশ্রাম নিয়ে বেলা তিনটায় করিমগঞ্জ শহরের দিকে রওয়ানা হন।’১৩৭
আমরা করিমগঞ্জের পদযাত্রার তারিখভিত্তিক কর্মসূচি তুলে ধরেছি। কর্মসূচি বাস্তবায়নে কাছাড় গণসংগ্রাম পরিষদ যে কতটা একনিষ্ঠ— তাও আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। অভাবনীয়, যেকোনো মানুষই এই বিশাল কর্মযজ্ঞকে শ্রদ্ধা না জানিয়ে পারবেন না। করিমগঞ্জ মহকুমার পদযাত্রীদল ২ মে, ৬১-তে নিজ শহরে ফিরে এলেন দীর্ঘ পদযাত্রা শেষে। এ দিন মানুষের মধ্যে সে কী উন্মাদনা, উচ্ছ্বাস, আবেগ। করিমগঞ্জের সংবাদপত্র যুগশক্তি সেদিনের কথা জানাল এভাবে: ‘দু-সপ্তাহকাল সমগ্র মহকুমার পল্লি অঞ্চলে প্রায় ২২৫ মাইল অতিক্রম ও গ্রামে গ্রামে বাংলা ভাষা আন্দোলনের আদর্শ ও উদ্দেশ্য প্রচার করে পদযাত্রীদল গত ২রা মে, মঙ্গলবার বিকাল চারটার সময় করিমগঞ্জ শহরে প্রত্যাবর্তন করলে শতশত মহিলাসহ সহস্র সহস্র নাগরিকবৃন্দ শহরের প্রবেশমুখে পেট্রল পাম্পের নিকট তাঁদের সংবর্ধনা জ্ঞাপন করবার জন্য সমবেত হয়েছিলেন। মহিলাদের হাতে ছিল মালা চন্দন ও লাজ। ব্যাণ্ডবাদকের একটি দলও উপস্থিত ছিল। পদযাত্রী সত্যাগ্রহীগণ যখন দৃঢ় পদক্ষেপে ধীরে ধীরে সেই বিপুল জনসমাবেশের সম্মুখীন হন— পথশ্রমে ক্লান্ত হলেও তাঁদের মুখে আদর্শ ও সংকল্পের প্রতি নিষ্ঠা ফুটে ওঠে। এই মহান দৃশ্যে জনতা উদবেলিত হয়ে ওঠে। মহিলাগণ অগ্রসর হয়ে সত্যাগ্রহীদের চন্দনচর্চিত ও মাল্যভূষিত করে তাঁদের মস্তকোপরি লাজভার বর্ষণ করতে থাকেন। ভাবগভীর পরিবেশের মধ্যে সত্যাগ্রহীগণ সংবর্ধিত হন। শহরের দিকে যখন তাঁরা অগ্রসর হতে থাকেন—তখন তাঁদের অনুসরণ করে ব্যাণ্ডের বাদ্যসহ একদল গায়ক-গায়িকা ও বিপুল জনতা। গায়ক-গায়িকাদের সমবেত কন্ঠে ‘মোদের গরব, মোদের আশা, আ মরি বাংলাভাষা’ সংগীত অপূর্ব প্রেরণার সৃষ্টি করে। নির্ধারিত সভাস্থল টাউন ব্যাঙ্ক প্রাঙ্গণে পদযাত্রীদের শোভাযাত্রা সহকারে নিয়ে আসা হয়। সত্যাগ্রহীগণ পৌঁছোবার পূর্বেই সভাস্থল লোকে পরিপূর্ণ ছিল—সহস্র সহস্র নর-নারী সভায় সমবেত হয়েছিলেন। এমন জনসমাগম ও অপূর্ব উদ্দীপনা বহুদিন দৃষ্ট হয়নি। স্থানাভাবে হাজার হাজার লোক দাঁড়িয়েছিলেন।
শ্রীভূপেন্দ্র সিংহের প্রস্তাবে ও শ্রীদক্ষিণারঞ্জন দেব-এর সমর্থনে প্রবীণ জননেতা শ্রীইন্দ্রকুমার দত্ত মহাশয় সভাপতির আসন গ্রহণ করেন। করিমগঞ্জ জেলা কংগ্রেস কমিটির সভাপতি শ্রীরণেন্দ্রমোহন দাস, এম এল এ, সত্যাগ্রহীদের সকলকে মাল্যভূষিত করে সাদর অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করেন। এরপর শ্রীকুমুদরঞ্জন লুহ তাঁর ভাষণদানকালে বলেন, সত্যাগ্রহীদের দুঃখবরণ ও ত্যাগ নিষ্ফল হবে না—‘আমাদের জয় সুনিশ্চিত, কারণ আমাদের উদ্দেশ্য ও পন্থা সৎ।’ শ্রীলুহ অসমীয়াগোষ্ঠী ও আসাম সরকারকে সাবধান করে বলেন— গৃহদাহ, লুন্ঠন, নরহত্যা ও নারীধর্ষণে কোনো সদুদ্দেশ্য সিদ্ধ হয় না— অধর্ম দ্বারা সাময়িক ফললাভ হতে পারে— সাময়িক মঙ্গলও দেখা যেতে পারে, এমনকী সাময়িকভাবে শত্রুকে জয় করাও যেতে পারে; কিন্তু অধর্মের জন্যই পরিণামে সমূলে বিনাশ হবে।
শিলং-এর বিশিষ্ট কংগ্রেস নেতা শ্রীসুনির্মল দত্ত তাঁর ভাষণে বলেন, নিপীড়িত শক্তি আজ জাগ্রত। ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের সম্মুখে লোকগণনার মিথ্যা চাতুরী, অন্যের অধিকার হরণাদি অপপ্রয়াস ব্যর্থ হবেই। ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনেই দিল্লির কর্তাদের ঘুম ভাঙবে— সিংহাসন টলবে। শ্রীদত্ত সত্যাগ্রহীদের শক্তি বৃদ্ধি করতে জনসাধারণের কাছে আবেদন করেন।
করিমগঞ্জের প্রবীণ নাগরিক ও লব্ধপ্রতিষ্ঠ উকিল শ্রীসুখময় দত্ত তাঁর সংক্ষিপ্ত ভাষণে আন্দোলনের উদ্দেশ্য ও আদর্শের প্রতি দৃঢ় সমর্থন জ্ঞাপন করে বলেন, মায়ের সন্তান হয়ে মাতৃভাষার মর্যাদা না রাখলে আমরা কুপুত্র বিবেচিত হব। শ্রীদত্ত অভিমত প্রকাশ করেন যে, মুখ্যমন্ত্রী চালিহার ভাষাবিল সম্পর্কে মত পরিবর্তন এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নেহরুর উক্ত বিল স্বীকার করে নেওয়া বিকারগ্রস্ত মনের পরিচায়ক। কিন্তু জানবেন সত্যমেব জয়তে। আপনারা সত্যাশ্রয়ী থাকবেন—মহাত্মার নির্দিষ্ট পন্থায় আপনারা অগ্রসর হন, আপনাদের জয় অবশ্যম্ভাবী।
কাছাড় জেলা গণসংগ্রাম পরিষদের জেনারেল সেক্রেটারি শ্রীনলিনীকান্ত দাস তাঁর ভাষণে ১৪ দিন পরিক্রমার এক সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়ে বলেন, যেখানেই গিয়েছি পূর্ণ সমর্থন ও অপূর্ব সাড়া পেয়েছি। হিন্দুর কাছ থেকে, মুসলমান ভাইদের কাছ থেকে, মণিপুরী সমাজ নেতৃবৃন্দের কাছ থেকে, হিন্দুস্থানী বন্ধুদের কাছ থেকে আন্তরিক ও দৃঢ় সমর্থন পেয়েছি। তাঁদের উৎসাহ, উদ্দীপনা আমাদের শক্তিশালী করেছে, আমাদের আন্দোলনে করেছে নতুন প্রাণসঞ্চার।
আসাম বিধানসভা সদস্য শ্রীবিশ্বনাথ উপাধ্যায় বলেন, ‘আমাদের আন্দোলন কারও অধিকার হরণের জন্য নয়, আমাদের অপহৃত অধিকার পুনরুদ্ধারের জন্য। আমাদের উদ্দেশ্য সিদ্ধ না হওয়া পর্যন্ত আমরা থামব না। আমাদের ন্যায়সংগত ও বিধিবদ্ধ অধিকার নিয়েই এখানে থাকব। বিধায়ক শ্রীরণেন্দ্রমোহন দাস বলেন, সত্যাগ্রহীদের মনোবল দেখে আমি বিস্মিত হয়েছি। আসামে ভাষা সম্পর্কে সরকারের সিদ্ধান্ত ন্যায়বিচারসম্মত হয়নি, তা হয়েছে রাজনীতির কূটকৌশলে। আমরা এই অন্যায় স্বীকার করতে পারি না। আমি প্রথমাবধিই এর বিরোধিতা করে আসছি। এবং এই জন্যই কাছাড় কংগ্রেস আসাম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পৃথক কংগ্রেস সংস্থা ও কাছাড়ের জন্য স্বতন্ত্র প্রশাসনিক ব্যবস্থা দাবি করেছে। আগামী ১২ মে কংগ্রেস প্রতিনিধিদল দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে দৃঢ়ভাবে তাঁদের দাবি জানাবেন।
স্কুল বোর্ডের সভাপতি ও পদযাত্রীদলের অন্যতম কংগ্রেসি নেতা শ্রীঅরবিন্দ চৌধুরী তাঁর ভাষণে বলেন,
আমাদের গন্তব্যপথে যদি হিমালয়ের বাধা আসে— আমরা হিমালয়ের বুক চিরে পথ সুগম করব। এই আন্দোলনে কংগ্রেসের পথ ভিন্ন নয়, আমরা এক। আসাম সরকার ঘুমন্ত সিংহকে জাগ্রত করেছেন। আসন্ন প্রত্যক্ষ সংগ্রামের মধ্যে আমাদের আন্দোলনের তৃতীয় পর্যায় আরম্ভ হবে— সেটা সংগ্রামের চূড়ান্ত পর্যায়। জয় আমাদের সুনিশ্চিত। শ্রীচৌধুরী বিপথগামী অসমীয়া নেতৃত্বকে সতর্ক করে বলেন, ‘তোমাকে মারিবে যে, গোকুলে বাড়িছে সে।
মণিপুরী যুব-নেতা শ্রীভূপেন্দ্র সিংহ (মণি সিং) বলেন, ‘আমাদের সংগ্রাম নতুন নয়— বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন থেকে আমাদের সংগ্রাম বংশপরম্পরায় চলছে। এ আন্দোলন শুধু বাংলা ভাষার আন্দোলন নয়, আমাদের সকলের বেঁচে থাকার আন্দোলন। দিল্লিতে জওহরলাল ডেকেছেন— এটা বড়ো কথা নয়, আন্দোলন শক্তিশালী করতে পারলে জওহরলাল সমস্যা সমাধানের জন্য এখানে আসবেন। এটা কোনো দলের আন্দোলন নয়, এটা মানুষের জন্মগত অধিকার অর্জনের আন্দোলন।’
করিমগঞ্জ লোকাল বোর্ড প্রাক্তন চেয়ারম্যান শ্রীননীগোপাল স্বামী (পদযাত্রী) বলেন, জওহরলাল যুক্তি মানেন না, মানেন ডাণ্ডা। রামালুর আত্মত্যাগে সৃষ্ট আন্দোলনে জওহরলাল নতিস্বীকার করেন। আমরাও আমাদের বলিষ্ঠ আন্দোলনের মাধ্যমে প্রতিক্রিয়াশীল সরকারকে আমাদের পাকা ধানে মই দিতে দেব না, এটা আমাদের দৃঢ় সংকল্প।
করিমগঞ্জ মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশন সেক্রেটারি শ্রীমোহিতমোহন দাস (পদযাত্রী) বলেন, শিলচর ভাষা সম্মেলনে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলাম— মাতৃভাষার সম্মান রক্ষা করব। মাতৃভাষাকে উপেক্ষা করে আমরা বাঁচতে পারি না। ১৪ হাজার সত্যাগ্রহী আমাদের সঙ্গে যোগদান করেছেন। আমাদের আবেদন ছাত্রদের কাছে এই বলে যে, জগতে সর্বত্র ছাত্রেরাই মুক্তির আলোক জ্বালিয়েছে, এখানকার ছাত্ররা কি পিছনে থাকবে? ছাত্র ও যুবকরা অগ্রসর হও— জয় আমাদের অবশ্যম্ভাবী।
শ্রীনৃপতি চৌধুরী নবজাগরণকে অভিনন্দিত করে বলেন, ভাষাজননীকে মর্যাদা না দিতে পারলে বৃথাই আমাদের বেঁচে থাকা। তিনি যুবশক্তিকে আহ্বান করে বলেন, আপনাদের সহযোগিতা আমাদের যে শক্তি দান করবে তা অক্ষয় হবে।
পদযাত্রীদলের অধিনায়ক, স্বাধীনতা সংগ্রামী শ্রীরথীন্দ্রনাথ সেন তাঁর ভাষণে বলেন, করিমগঞ্জের আজকের পরিচয় তার সত্য পরিচয়। অত্যাচারী আসাম সরকারের শক্তি নেই আমাদের ভাষাজননীকে শৃঙ্খলিত করে কন্ঠরোধ করতে পারে। আজ গণদেবতা জাগ্রত। গণদেবতার সমর্থনপূর্ণ আশীর্বাদ আমাদের রক্ষা করবে। ১৪ দিন পরিক্রমায় যজ্ঞকাষ্ঠ আহরণ করে এনেছি, আপনারা যজ্ঞ সম্পূর্ণ করুন, যজ্ঞে আত্মাহুতি দেবার জন্য প্রস্তুত হন। আজ আর ভাঁওতায় ভুলব না, সংগ্রামে বিরতি দেব না— দাবি পরিপূর্ণরূপে আদায় না হওয়া পর্যন্ত। …সমগ্র কাছাড় জেলা আজ জাগ্রত। আজ আমাদের মধ্যে দল নাই, জাতি নাই, কোনো বিভেদ নাই; মায়ের সন্তান সবাই আমরা—আমরা এক। কুরুক্ষেত্রের পাঞ্চজন্যের ধ্বনিতে যুদ্ধশেষে ধর্মের জয়— অধর্মের পরাজয় সুনিশ্চিত।
এরপর শ্রীসেন গণসংগ্রাম পরিষদের পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করেন— ১৯ মে সর্বাত্মক ধর্মঘট ও পূর্ণ হরতাল। দোকানপাট, অফিস-আদালত, সরকারি-বেসরকারি যানবাহনাদি সব বন্ধ থাকবে। এরপর সরকারি প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে অচল করবার জন্য অন্যান্য পন্থা গৃহীত হবে। দ্বিতীয় ঘোষণা— বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাজ্য ভাষা করা এবং অন্যান্য অনসমিয়া ভাষার যোগ্য মর্যাদা না দেওয়ার প্রতিবাদে করিমগঞ্জ পৌরসভার আসন্ন নির্বাচন বর্জন করতে হবে। এখন এই নির্বাচন আমরা হতে দেব না। …
সভাপতি শ্রী দত্ত তাঁর ভাষণে সত্যাগ্রহীদের সংবর্ধনা জানিয়ে বলেন, তাঁদের আদর্শ, নিষ্ঠা ও দুঃখবরণ ব্যর্থ হতে পারে না। তাঁদের দৃঢ়চিত্ততা, উদ্দীপনা ও উৎসাহ জাতির প্রাণে নবচেতনার সঞ্চার করবে। সত্যাগ্রহীদের সাধনা সম্পূর্ণ সাফল্যমন্ডিত হোক— এটাই ঐকান্তিকভাবে কামনা করি।১৩৮
এপ্রিল মাসে শিলচর থেকেও পদযাত্রা শুরু হল। তবে পদযাত্রার পূর্বে শিলচর মহকুমা গণসংগ্রাম পরিষদের সাংগঠনিক কাঠামো সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা দেওয়া বাঞ্ছনীয়। আমরা বলেছি, শ্রীজিতেন্দ্রনাথ চৌধুরীকে সভাপতি এবং শ্রীপরিতোষ পালচৌধুরীকে সাধারণ সম্পাদক করে শিলচর মহকুমা গণসংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। কিন্তু কমিটির অন্যান্য সদস্যদের নাম সেদিন ঘোষিত হয়নি। আমরা সেদিকে দৃষ্টি দেব। আমাদের এ বিষয়ও স্মরণে রাখতে হবে যে, কাছাড় গণসংগ্রাম পরিষদের সদর দফতর ছিল করিমগঞ্জে। করিমগঞ্জের কেন্দ্রীয় কমিটিই সামগ্রিক আন্দোলন পরিচালনা করেছেন। এই কমিটির সিদ্ধান্তই ছিল চূড়ান্ত। করিমগঞ্জ, শিলচর এবং হাইলাকান্দি মহকুমার জন্য পৃথক কমিটি গঠিত হলেও শেষকথা বলতেন কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। আবার এ কথাও সত্য যে, কাছাড় জেলা সদর হিসেবে শিলচরের গুরুত্ব ছিল প্রশ্নাতীত। আসাম এবং কেন্দ্রীয় সরকারের নজরও ছিল শিলচরের প্রতি, যার পরিচয় আমরা পরবর্তীতে প্রত্যক্ষ করব।
ইতিপূর্বেই উল্লেখিত হয়েছে যে, ১৯ ফেব্রুয়ারি বিকাল চারটায় শিলচরের নরসিংটোলা ময়দানে এক বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভার প্রচারে ১৫ ফেব্রুয়ারি এক প্রচারপত্র প্রচারিত হয়। প্রচারপত্রটি যাঁদের নামে সর্বসাধারণ্যে প্রচারিত হয়, তাঁরা হলেন— সর্বশ্রী উপেন্দ্রশঙ্কর দত্ত, (অ্যাডভোকেট), বীরেশরঞ্জন আচার্য (অ্যাডভোকেট), অনিলকুমার বর্মণ (অ্যাডভোকেট), সুরেশচন্দ্র বিশ্বাস (অ্যাডভোকেট), প্রমোদকুমার আদিত্য (অ্যাডভোকেট), সনৎকুমার চক্রবর্তী (অ্যাডভোকেট), নিতাইচাঁদ পাটনী (অ্যাডভোকেট), পরেশচন্দ্র চৌধুরী (অ্যাডভোকেট), নুরুল হুসেইন মজুমদার (অ্যাডভোকেট), গোলাম ছবির খান, পরিতোষ পালচৌধুরী, মনোরঞ্জন চক্রবর্তী এবং সত্যদাস রায়।
১৯ ফেব্রুয়ারি সকালে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের উপস্থিতিতে ওরিয়েন্টাল সিনেমা হলে শিলচর মহকুমা গণসংগ্রাম পরিষদ গঠনে এক প্রতিনিধি সভা অনুষ্ঠিত হয়। প্রবীণ স্বাধীনতা সংগ্রামী গোলাম ছবির খান গুরুত্বপূর্ণ এই সভায় সভাপতিত্ব করেন। সভায় মোট উপস্থিত সদস্য সংখ্যা ছিল বত্রিশ জন।
প্রতিনিধি সভায় বিস্তারিত আলোচনার পর নিম্নলিখিত ব্যক্তিদের নিয়ে শিলচর মহকুমা গণসংগ্রাম পরিষদ কার্যকরী কমিটি গঠিত হয়।
সর্বশ্রী— জিতেন্দ্রনাথ চৌধুরী (সভাপতি), অনিলকুমার বর্মণ (সহসভাপতি), ভূদেব ভট্টাচার্য (সহসভাপতি), পরিতোষ পালচৌধুরী (সাধারণ সম্পাদক), নুরুল হুসেইন মজুমদার, গৌরাঙ্গ দেবনাথ, দেবেন্দ্র মহাপাত্র, সত্যদাস রায়, তারাপদ ভট্টাচার্য, সাজিদ রাজা মজুমদার, নিতাইচাঁদ পাটনী, সুশীতকুমার দত্ত এবং শঙ্করপ্রসাদ সিংহ প্রমুখগণ সদস্য।
এ ছাড়াও শিলচর মহকুমা থেকে জেলা কমিটিতে যাঁরা সদস্য আছেন,তাঁরাও মহকুমা সদস্য বলে বিবেচিত হবেন।১৩৯
আর এ দিন থেকেই কমিটির অভ্যন্তরে টানাপোড়েন শুরু হয়ে যায়। এদিন কমিটি সদস্য সুখময় সিংহ ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে তাঁর পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন। কমিটি গঠনের পর সদস্যদের দৈনন্দিন কাজ পরিচালনে একটি অফিস ঘর জরুরি হয়ে পড়ে। এগিয়ে আসেন ডা. ননীগোপাল চক্রবর্তী, তিনি তাঁর পানপট্টিস্থ ‘সুরধনী হোমিও স্টোর্স’-এর দোতলায় গণসংগ্রাম পরিষদ কার্যালয় খোলার আমন্ত্রণ জানালেন উদ্যোক্তাদের। এ কাজে ডা. চক্রবর্তী তাঁর বাড়ির নীচতলাও ব্যবহার করা যাবে বলে জানিয়ে দিলেন। খোলা হল মহকুমা সংগ্রাম পরিষদের যুব শাখা অফিস। সেদিন ছিল ৭ মার্চ ১৯৬১। যুব সংগঠনের সভাপতি হলেন পরিতোষ পালচৌধুরী এবং সম্পাদক নির্বাচিত হন ডা. ননীগোপাল চক্রবর্তী। আন্দোলন সংগঠিত করার কাজ পূর্ণোদ্যমে শুরু হল।
সবাইকে অবাক করে শিলচর মহকুমা গণসংগ্রাম পরিষদ সভাপতি শ্রীজিতেন্দ্রনাথ চৌধুরী এপ্রিলের ১০ তারিখে তাঁর পদে ইস্তফা দিয়ে সাধারণ সম্পাদককে জানিয়ে দিলেন: তিনি সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন। এ সময় সহসভাপতি শ্রীঅনিল বর্মণও পদত্যাগ করলেন। কার্যকরী সদস্য তারাপদ ভট্টাচার্যও তাঁর পদে ইস্তফা দিলেন। পরিস্থিতি অত্যন্ত নাজুক হয়ে দাঁড়ায়। আন্দোলন যখন ধাপে ধাপে এগিয়ে চলছিল, শিলচরের সংগঠন যখন এক শক্তপোক্ত ভিতের ওপর দাঁড়াতে চলেছে, ঠিক তখনই বিনা মেঘে বজ্রাঘাতের মতো পদত্যাগ ঢেউয়ের দাপটে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যগণ বিচলিত হয়ে পড়েন এবং সেটাই স্বাভাবিক। শিলচর মহকুমা কমিটি পরিস্থিতি মোকাবিলায় জরুরি ভিত্তিতে এক সভা আহ্বান করেন। পানপট্টির সংগ্রাম পরিষদ কার্যালয়ে ১২ এপ্রিল সন্ধ্যার পর মহকুমা কমিটির এক জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়।
কমিটির সাধারণ সম্পাদক পরিতোষ পালচৌধুরী এ প্রসঙ্গে জানান:
১২ তারিখ সন্ধ্যার পর পানপট্টির কার্যালয়ে মহকুমা কমিটির জরুরি সভা বসল। কার্যকরী কমিটির সাত জন সদস্য উপস্থিত। কয়েকজন বিশেষ আমন্ত্রিতও আছেন। আলোচনান্তে এই ঠিক হল যে, উক্ত পদত্যাগসমূহের খবর সরকার এবং জনসাধারণ যাতে না পান-সেই ব্যবস্থা নিতে হবে। পদত্যাগীদের সংবাদপত্রে বিবৃতি প্রকাশের রাস্তাও বন্ধ করে দিতে হবে। সুতরাং, এই মুহূর্তেই মহকুমা কমিটি ভেঙে দিয়ে জেলা গণসংগ্রাম পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মহকুমার দায়িত্ব একজন ডিকটেটরের হাতে তুলে দেওয়া হোক। সনৎবাবু প্রস্তাব করলেন মহকুমা কমিটি ভেঙে দিয়ে পরিতোষ পালচৌধুরীকে ডিকটেটর নিযুক্ত করার জন্য। প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হল। সভায় পৌরহিত্য করেন শ্রী সত্যদাস রায়। সংক্ষিপ্ত প্রস্তাবটি ছিল এরকম: ‘সংগ্রামের বৃহত্তর প্রয়োজনে শিলচর মহকুমা কমিটি বাতিল করে দিয়ে শ্রীপরিতোষ পালচৌধুরীকে ডিকটেটর নিযুক্ত করা হল। আজ থেকে শ্রীপালচৌধুরী তাঁর নিজস্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মহকুমার সংগ্রাম পরিচালনা করবেন।’১৪০
এই পটপরিবর্তনে পরিতোষ পালচৌধুরীর ওপর কাজের দায়িত্ব ও পরিধি বৃদ্ধি পেলেও আসন্ন ১ বৈশাখ সামাল দিতে সকলে একজোট হয়েই কাজে নেমে পড়েন— শিলচরের মান বাঁচানো বলে কথা।
পরিতোষ পালচৌধুরীর বয়ানকে আমরা মৌলিক তথ্য হিসেবে গ্রহণ করতে পারি। কারণ ‘সমাজবিজ্ঞানের পরিভাষায় গবেষকদের কাছে প্রত্যক্ষদর্শীর জবানবন্দি যা মৌলিক তথ্যের সমতুল্য।’ পরিতোষ পালচৌধুরী ভাষার লড়াই কেবল প্রত্যক্ষ করেননি, একজন অংশগ্রহণকারী হিসেবে শেষ অবধি লড়াইয়ে নেতৃত্বও দিয়েছেন। এ বিষয়ে ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী একাধিক বিশিষ্টজনের বক্তব্য আমরা তুলে ধরব। গণসংগ্রাম পরিষদ সভাপতি অ্যাডভোকেট আবদুর রহমান চৌধুরী জানিয়েছেন:
১৯৬১ ইংরেজির ৫ ফেব্রুয়ারি করিমগঞ্জে অনুষ্ঠিত জনসম্মেলনে ‘গণসংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়। আমাকে নির্বাচিত করা হয় কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি। শ্রী পরিতোষ পালচৌধুরী জনসম্মেলনে যোগদান করেন ও কেন্দ্রীয় কার্যকরী সমিতির সদস্য নির্বাচিত হন। পরে তাঁকে শিলচর মহকুমা সংগঠনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। আমার মনে আছে, নানাবিধ কারণে শিলচর মহকুমা কমিটি ভেঙে গেলে শ্রীপালচৌধুরীর হাতেই একক দায়িত্ব অর্পণ করা হয় ও তাঁকে শিলচর মহকুমার সংগ্রাম পরিচালনার জন্য ডিকটেটর নিযুক্ত করা হয়। শ্রীপালচৌধুরী দক্ষতার সঙ্গে সেই দায়িত্ব পালন করেছেন।১৪১
করিমগঞ্জ মহকুমা গণসংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক, বিশিষ্ট সংগঠক ও প্রাক্তন সাংসদ নৃপতিরঞ্জন চৌধুরী বলেন:
শ্রীপরিতোষ পালচৌধুরী ১৯৬১ সালে ভাষা আন্দোলনে শিলচর মহকুমা সংগ্রাম পরিষদের সম্পাদক ও পরে ‘ডিকটেটর’ নির্বাচিত হয়েছিলেন। শ্রীকেশব চক্রবর্তীর বিরুদ্ধে ১০৭ ধারায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছিল। আমরা তিনজন আন্দোলনের স্বার্থেআত্মগোপন করে আন্দোলন পরিচালনায় বৃত ছিলাম।
গণসংগ্রাম পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য-সংগঠক ভূপেন্দ্রকুমার সিংহ জানিয়েছেন:
কেন্দ্রীয় কমিটির একজন সংগঠক হিসেবে আমি জানি—শিলচর মহকুমা কমিটির সদস্যরা যখন একে একে সরে যাচ্ছিলেন এবং শেষপর্যন্ত সভাপতিসহ অধিকাংশ সদস্য পদত্যাগ করে শিলচর মহকুমার সংগ্রামকে এক অনিশ্চয়তার মুখোমুখি এনে দাঁড় করিয়েছিলেন, সেই কঠিন মুহূর্তে পরিতোষই ছিল একমাত্র ভরসা এবং সে এই কঠিন দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছে। মহকুমা কমিটি ভেঙে দিয়ে পরিতোষকে ডিকটেটর নিযুক্ত করা হয় এবং তাঁর হাতে শিলচর ভাষা সংগ্রামের একক দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। সেদিনের আনন্দবাজার, যুগান্তর এবং স্টেটসম্যান পত্রিকা সাক্ষ্য বহন করছে কতখানি দক্ষতার সঙ্গে পরিতোষ সে-দায়িত্ব পালন করেছে।
এরপর এ বিষয়ে আর কোনো কথা বলার সুযোগ আছে বলে মনে হয় না।
পদযাত্রা: শিলচর
আমরা ইতিমধ্যে করিমগঞ্জ মহকুমার বিস্তৃত বিবরণ তুলে ধরেছি। বর্ণাঢ্য সেই পদযাত্রা যেমন ছিল আড়ম্বরপূর্ণ তেমনি আনন্দোৎসব মুখরও। সর্বক্ষেত্রে ছিল প্রাণের স্পর্শ। শিলচরে পদযাত্রা শুরু হল ২৪ এপ্রিল থেকে। পরিতোষ পালচৌধুরী জানালেন:
ঠিক হয়ে গেল ২৪ এপ্রিল থেকে পদযাত্রা শুরু হবে। শুরু হবে দক্ষিণ মুখে। ক্রমশ দক্ষিণে এগিয়ে পুবে মোড় নিয়ে সমগ্র পূর্ব পরিক্রমা করে উত্তরে পৌঁছে পশ্চিম ঘুরে প্রায় পৌনে দুশো কিলোমিটার হেঁটে আমরা শিলচর ফিরব।
যেই কথা সেই কাজ। ভ্রমণসূচি ছাপা হয়ে গেল। শহরে মাইক বেরিয়ে পড়ল। ২৪ তারিখ পদযাত্রীদের আশীর্বাদ করুন। মাতৃপূজার অগ্রগামী দলকে এগিয়ে দিন উদয়ের পথে। সেইসঙ্গে চলল মহড়া। …. স্বেচ্ছাসেবকরা আসে। নাম লেখায়।১৪২
হ্যাঁ, পদযাত্রা সূচি সেদিন মুদ্রিত হয়েছিল, বিলিও করা হয়। শিলচরের মানিকচাঁদ প্রেস থেকে মুদ্রিত প্রচারপত্রে শিলচর মহকুমা গণসংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে পরিতোষ পালচৌধুরী জনসাধারণের উদ্দেশে, ‘নিবেদন’ জানিয়েছিলেন এ ভাবে: মহকুমাবাসী প্রতিটি মানুষ, নারী, পুরুষ, ছাত্র-যুবক জনসাধারণের কাছে পদযাত্রীদের সাহায্য, সহযোগিতা ও আশীর্বাদ জানাতে আবেদন জানাই। যেখানে যেখানে পদযাত্রীরা বিশ্রাম গ্রহণ করবে— প্রতিটি জায়গার স্থানীয় জনসাধারণ ও নেতৃবৃন্দকে পদযাত্রীদের উৎসাহিত ও পদযাত্রায় অংশগ্রহণ করতে আবেদন জানাই। মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার এই ঐতিহাসিক অভিযান সফল করতে আবেদন জানাই। ইতি—
মুদ্রিত পদযাত্রা সূচি ছিল নিম্নরূপ:
২৪ এপ্রিল, সোমবার— শিলচর থেকে ভোরে সোনাবাড়ি, সৈদপুর হয়ে নরসিংপুর। নরসিংপুরে প্রচার ও রাত্রিযাপন।
২৫ এপ্রিল, মঙ্গলবার— ভোরে নরসিংপুর থেকে কাবুগঞ্জ, চাঁদপুর হয়ে সোনাই। সোনাইতে প্রচার, সভা ও রাত্রিযাপন।
২৬ এপ্রিল, বুধবার— সোনাই থেকে বাঁশকান্দি হয়ে লক্ষ্মীপুর। লক্ষ্মীপুরে প্রচার, সভা ও রাত্রিযাপন।
২৭ এপ্রিল, বৃহস্পতিবার— লক্ষ্মীপুর থেকে ফুলেরতল, পয়লাপুর হয়ে জয়পুর। জয়পুরে প্রচার, সভা ও রাত্রিযাপন।
২৮ এপ্রিল, শুক্রবার— জয়পুর থেকে কুম্ভা, শালগঙ্গা হয়ে উদারবন্দ। উদারবন্দে প্রচার, সভা ও রাত্রিযাপন।
২৯ এপ্রিল, শনিবার— উদারবন্দ থেকে মধুরামুখ ও জাঠিঙ্গা হয়ে বড়খলা। বড়খলায় প্রচার, সভা ও রাত্রিযাপন।
৩০ এপ্রিল, রবিবার— বড়খলা থেকে বুড়িবাইল হয়ে কাঠিগড়া। কাঠিগড়ায় প্রচার, সভা ও রাত্রিযাপন।
১ মে, সোমবার— কাঠিগড়া থেকে পাঁচগ্রাম, কাটাখাল হয়ে শালচাপরা। শালচাপরায় প্রচার, সভা ও রাত্রিযাপন।
২ মে, মঙ্গলবার— শালচাপরা থেকে শ্রীকোনা ও মাছিমপুর হয়ে শিলচর। শিলচরে জনসভা ও পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা।১৪৩
মুদ্রিত এই সফরসূচি সে-সময় কতটা বাস্তবায়িত হয়েছিল, আদৌ সম্ভব হয়েছিল কি না— এ সবেরই উত্তর মেলে পরিতোষ পালচৌধুরীর বয়ানে। তিনি লিখলেন:
২৪ এপ্রিল বেলা তিনটেয় নরসিংটোলা ময়দানে গিয়ে সমবেত হলাম। এখান থেকে আমাদের যাত্রা শুর হবে। এক জন দু-জন করে ব্যাগ পিঠে করে এসে হাজির হল। ননীগোপাল খুঁজছে তাঁর লিস্টের কে কে এল। যারা যাবে, তাদের প্রত্যেকের বাড়ি থেকে এসেছে মা, ভাই, বোন। তাদের সঙ্গে এসেছে আরও অনেকে। মাঠের উপর ক্রমেই জমে উঠল এক বিরাট সমাবেশ। দুর্গমগিরি কান্তার মরু পথের যাত্রীদের সবাই জানাবেন আশীর্বাদ। এগিয়ে দেবে শহরতলি পর্যন্ত। ননী চক্রবর্তী মাইকে ঘোষণা করল: পদযাত্রীদল যাত্রা শুরু করবে। আর দেরি নেই। … বিজন রায় একটি প্রাণ-মাতানো ভাষণ দিল। তারপর প্রত্যেকের মা এসে ধান, দূর্বা ও চন্দনের তিলক কেটে আশীর্বাদ জানালেন। জানালেন বহু অশীতিপর মা ও দিদিমা। সেইসঙ্গে বোনেরা। …
শঙ্খধ্বনি, উলুধ্বনি এবং মাতৃভাষা জিন্দাবাদ, বাংলা ভাষা জিন্দাবাদ, গণসংগ্রাম পরিষদ জিন্দাবাদ, পদযাত্রী বাহিনী জিন্দাবাদ স্লোগানের মধ্যে আমাদের যাত্রা শুরু হল। নরসিংটোলা, সেন্ট্রাল রোড, নাজির পট্টি, প্রেমতলা হয়ে হসপিটাল রোড ধরে আমরা এগিয়ে চললাম। ননীগোপাল মাইক নিয়ে বহু আগে আগে এগিয়ে চলেছে। ডাক দিয়ে যাচ্ছে সবাইকে— এগিয়ে আসছে পদযাত্রী বাহিনী, একটু আগে নরসিংটোলা থেকে যাত্রা শুরু হয়েছে তাদের।…
এ এক বিস্ময়কর ঘটনা। পদযাত্রী বাহিনী এগিয়ে আসছে আর ঘরে ঘরে উঠছে উলুধ্বনি। … বুঝতে পারছি মানুষ আমাদের অনুসরণ করছে। এ যেন মহাপ্রভুর প্রেমযাত্রা। রাস্তার দু-পাশে দর্শক জনতার সারি। কিন্তু কেউ আনন্দে উচ্ছল নয়— ভাবগম্ভীর। … খই বিছানো শুভ্র পথে এগোতে এগোতে আমরা রাস্তার দু-পাশ থেকে পেয়ে চলেছি অসংখ্য আশীর্বাদ। প্রেমতলায় আটকা পড়লাম। চেংকুড়ি পথের জংশনে আটকা পড়লাম। একটু এগিয়ে আবার। সাংবাদিক বিনয়েন্দ্রকুমার চৌধুরীর অশীতিপর বৃদ্ধা মাতা অতিকষ্টে রাস্তায় এসে কপালে এঁকে দিলেন বিজয়তিলক। বাঙ্গিরখাড়ি তেমাথায় আবার আটকে গেলাম। মালা, ফুলের তোড়া আর চন্দনের তিলক, করমর্দন, আলিঙ্গন সেরে সোনাই রোড দিয়ে অগ্রসর হলাম।
হোলিক্রস স্কুলের সামনে শহরতলির শেষ শিরীষ গাছ পর্যন্ত এসে জনতা থামল। এখন তো সোনাই রোড দিয়ে শহর অনেক বিস্তৃত। কিন্তু সেদিন এরপর আর শহরের চিহ্ন নেই। আমি হাতে মাইক নিলাম। সকলের কাছে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বিদায় নিয়ে সামনের পথে পা বাড়ালাম। এবার আমরা মাত্র চোদ্দোজন—
১. পরিতোষ পালচৌধুরী, ২. মণীন্দ্র রায়, ৩. কার্তিক দে, ৪. হরিপদ দে, ৫. নিখিল সাহা, ৬. ব্যোমকেশ বর্ধণ, ৭. বেণুলাল রায়, ৮. সুবোধচন্দ্র পাল, ৯. সুধাংশু দাশগুপ্ত, ১০. কৃষ্ণকুমার সেনগুপ্ত, ১১. গৌরাঙ্গ ভট্টাচার্য, ১২. জগদীশ পাল, ১৩. বিনয় দেব, ১৪. মৃণালকান্তি রায়।
এখানে উল্লেখযোগ্য, আমাদের পদযাত্রী দলে সবচাইতে কম বয়স্ক মৃণাল— ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। বয়স মাত্র বারো। কিন্ত সে যাবেই। অগত্যা তাকে নিতে হয়েছে। বাকিদের সকলেরই বয়স কুড়ির নীচে নয়তো উপরে। গান গেয়ে আমরা এগিয়ে চললাম। সন্ধ্যা উতরে গেছে। তমসা নেমে এসেছে। … সন্ধ্যা উতরে রাত প্রায় সাতটা। আমরা সোনাবাড়ি ঘাটে এসে পৌঁছোলাম। … এগিয়ে এল ছোট্ট এক জনতা। মাতৃভাষা জিন্দাবাদ, বাংলা ভাষা জিন্দাবাদ, কাছাড়বাসী ভাই ভাই স্লোগান দিয়ে তাঁরা আমাদের বরণ করল। সোনাবাড়ি ঘাটের তেমাথায় আমি এক পথসভায় ভাষণ দিলাম। ‘বন্ধুগণ, আমরা আমাদের মাতৃভাষা, বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠাকামী পদযাত্রী দল। আমাদের মাতৃভাষা আজ দানবের নিষ্ঠুর আঘাতে পদদলিত। আমরা চাই আমাদের মাতৃভাষা যথাযোগ্য স্বীকৃতি লাভ করুক। গণসংগ্রাম পরিষদের সিদ্ধান্ত— জীবন দিয়ে আমরা মাতৃভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করব।’ …
জান দেব জবান দেব না। সহস্র কন্ঠে উঠল আওয়াজ। বন্দেমাতরম। আল্লাহো আকবর। মাতৃভাষা জিন্দাবাদ। প্রাণ ভরে গেল, আবেগে বাকরুদ্ধ হল আমার। সভা শেষে ‘ওরা আমাদের চা-পানে আপ্যায়িত করলেন। আমরা নরসিংপুরের পথে রওনা দিলাম। সোনাবাড়িঘাটের ভাইরা আমাদের ‘বাকরশা’ মোকাম পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন। …
রাত প্রায় দশটায় নরসিংপুর নতুন বাজারে আমরা গিয়ে পৌঁছোলাম।’১৪৪
নরসিংপুরের সেদিনের কথা স্মরণ করে বিশ্বম্ভর নাথ জানিয়েছেন:
নরসিংপুরের তরুণ ছাত্ররা সেদিন মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় টগবগ করছিল। আমিও তখন যুবক। আমি আমার সহকর্মীদের নিয়ে পদযাত্রী দলকে স্বাগত জানাবার জন্য গভীর আগ্রহে অপেক্ষায় ছিলাম। আমি ও আমার ‘জয় হিন্দ ক্লাব’-এর সদস্যরা নরসিংপুরে (নতুন বাজার) পদযাত্রী দলকে সেদিন পরম সমাদরে বরণ করেছিলাম। আমাদের ক্লাবের তৎপরতায় ও উদ্যোগে সেদিন এখানে এক জনসভারও আয়োজন করা হয়। পদযাত্রী দলকে আমার বাড়িতে রাতে থাকাসহ খাওয়ার ব্যবস্থাও করে দিয়েছিলাম।১৪৫
শ্রীপালচৌধুরী জানিয়েছেন, ‘পদযাত্রীরা জয়হিন্দ ক্লাবে ঘুমোলেন। আমি বিপিনবাবুর দোকানে একটা জায়গা পেলাম। ভোর পাঁচটায় উঠে সবাইকে ডেকে আমি তৈরি করিয়ে নিলাম। নিত্যকর্ম সেরে হাত-মুখ ধুয়ে ব্যাগ পিঠে ফেলে …
‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু’ গান গেয়ে আমাদের যাত্রা শুরু হল। সাতটার মধ্যে আমরা কাবুগঞ্জ পৌঁছে গেলাম। … আমি প্রভাতী পথসভায় কৌতূহলী জনতার উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলাম। এক ভদ্রলোক একটি চা দোকানে আমাদের চা ও পুরি-তরকারি এবং রসগোল্লা খাবার অর্ডার দিলেন। গরম পুরি-তরকারি খেয়ে আমার ভাইরা অনেক চাঙ্গা। কাবুগঞ্জে অনেক লোক আমরা পেলাম। আমরা তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নগদির গ্রাম, চাঁদপুর হয়ে সোনাই রওনা হলাম। …
নগদির গ্রাম, চাঁদপুরের মানুষকে সংগ্রামের বার্তা জানিয়ে আমরা বেলা প্রায় ১০টার সময় সোনাই এসে পৌঁছোলাম। আমাদের স্লোগান শুনে একদল ছাত্র-যুবক এগিয়ে এল। ওরা আমাদের কন্ঠে কন্ঠ মিলিয়ে কিছুদূর এগিয়ে একটি নির্দিষ্ট স্থানে নিয়ে গেল। ছাত্র-যুবক, ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষের এক বিরাট সমাবেশে তখনই আমাকে আমাদের উদ্দেশ্য তুলে ধরতে হল। তারপর নিয়ে গেল মজুমদারদের বাড়িতে বিশ্রামের জন্য। বিশ্রামের ফাঁকে ফাঁকে চলল স্থানীয় মুরুব্বিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ ও আলোচনা। আবেদন, নিবেদন। বিকেল সাড়ে তিনটেয় আবার জনসভায় ভাষণদান। সন্ধ্যার পর স্থানীয় ছাত্র-যুবকদের নিয়ে ঘরোয়া বৈঠক। … সোনাই মোটর স্টেশনের ম্যানেজার মনু মিয়া এবং ছাত্রকর্মী রবিজুল সেদিন প্রাণ ঢেলে প্রতিটি কর্মসূচি সার্থক করে তুলেছিলেন।
২৫ এপ্রিল ভোরবেলা আবার আমাদের যাত্রা শুরু হল। ডা. রাধানাথ মজুমদারের বাড়িতে আমরা রাত কাটিয়েছি। খেয়েছি। ভোরবেলাই রবিজুলেরা এগিয়ে এল। নদী পার করে দিল। আমরা ছোট্ট নদী সোনাইয়ের পূর্ব তীর বেয়ে এগিয়ে চললাম।
কাপ্তানপুর, টিলাবাজার, ডলুগ্রাম, রূপাইবালি, সিংহেরবন্দ হয়ে আমরা লক্ষ্মীপুর পৌঁছোলাম বেলা ১১টায়। উৎসুক জনতা আমাদের খেয়াঘাটে স্বাগত জানাল। সঙ্গে সঙ্গে ভাষার দাবিতে স্থানীয় হাই স্কুলে হরতাল হয়ে গেল। পদযাত্রীদের সামনে নিয়ে বের হল এক মিছিল। সেই মিছিলেই ঘোষিত হল বিকেলবেলা জনসভা।
… বিকেলবেলা লক্ষ্মীপুর বাজার প্রাঙ্গণে সভা শুরু হল। সভাপতি স্থানীয় বিশিষ্ট ব্যক্তি করুণাময় দাস। গণসংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে মনীন্দ্র রায় ও আমি বক্তব্য রাখলাম, কেন এই সংগ্রাম। স্থানীয় সমাজসেবী কামাখ্যা চক্রবর্তী ভাষণ দিলেন। জিতেনবাবুর লিখিত প্রতিবেদন পাঠ করা হল, যেখানে তিনি এই সংগ্রামে সবাইকে অংশ নেওয়ার আবেদন জানান।
গৌর সিংহ তাঁর ভাষণে বলেন, এ সংগ্রাম তিনি সমর্থন করেন। তিনি বলেন, বাংলা যদি তার বিপুল সংখ্যা নিয়ে আত্মরক্ষা করতে না পারে, তবে ছোট্ট ভাষাগোষ্ঠী মণিপুরী বাঁচবে কী করে? ভাষার নামে কোনো আগ্রাসন সমর্থন করা যায় না।
সভাপতি করুণাময় দাসের আবেগ আপ্লুত ভাষণের পর সভা শেষ হয় বিরাট সাফল্যের সঙ্গেই। লক্ষ্মীপুর উত্তাল হয়ে উঠল ‘মাতৃভাষা জিন্দাবাদ’ ধ্বনিতে। যে লক্ষ্মীপুর ছিল সর্বাধিক চিন্তার কারণ, সেই লক্ষ্মীপুরেই তৈরি হল দুর্ভেদ্য দুর্গ।’১৪৬
‘২৬ এপ্রিল প্রভাতফেরির মধ্যে দিয়ে আমাদের যাত্রা শুরু হল। লক্ষ্মীপুরের ছেলেরা আমাদের ফুলেরতল পর্যন্ত এগিয়ে দিল। ফুলেরতলে পথসভায় ভাষণ দিয়ে আমরা পয়লাপুলের পথে পা বাড়ালাম। পয়লাপুল বাজারে পথসভা করে আমরা লাবক চা-বাগান, দেওয়ান চা-বাগান হয়ে জয়পুর রাজাবাজারে গিয়ে পৌঁছোলাম।
জয়পুরের প্রবেশদ্বারে শিবের মতো আশীর্বাদের ডালি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন জীবন ব্যানার্জি। আশীর্বাদ করলেন। জয়টিকা পরিয়ে দিলেন। জয়পুরেও হল স্কুল ধর্মঘট। বের হল বিরাট মিছিল। অনুষ্ঠিত হল বিরাট জনসভা। সভায় পৌরহিত্য করেন স্থানীয় বিশিষ্ট ব্যক্তি দেবেন্দ্রকুমার কর। বিশিষ্ট কাছাড়ি নেতা ননীগোপাল বর্মণ, জীবন ব্যানার্জি এবং কমিউনিস্ট নেতা মতিলাল জায়গিরদার সভায় ভাষণ দেন। তাঁরা সকলকে সংগ্রামে অংশগ্রহণের আহ্বান জানান। আমরা হৃষীপদ পুরকায়স্থের বাড়িতে রাত কাটিয়ে ২৭ এপ্রিল প্রত্যুষে প্রাতরাশ সেরে আবার সামনের পথে পা বাড়ালাম। পথেই বড়থল চা-বাগান। বড়থলের সীমানায় একদল বাগানকর্মী আমাদের পথ আটকালেন। ‘আমাদের আনন্দ পরিষদে আপনাদের একটু যেতে হবে।’ আমরা এগিয়ে গেলাম। ‘আনন্দ পরিষদ’ বাগানবাবুদের গড়া ঐতিহ্যমন্ডিত এক সাংস্কৃতিক সংস্থা। সেখানে আমাদের সংবর্ধনা জানানো হল। খাওয়ানো হল গরম সিঙাড়া ও চা। দারুণভাবে উজ্জীবিত হয়ে আমরা পা বাড়ালাম। আনন্দ পরিষদের প্রাণপুরুষ কবি করুণা চক্রবর্তী আমাদের কিছুটা পথ এগিয়ে দিলেন। বড়থল চিরস্মরণীয় হয়ে রইল আমাদের হৃদয়ে।’১৪৭
তারপর শুধু বাগান আর বাগান। সবুজের সমারোহ। চায়ের সমুদ্রে ডুবে গেছি আমরা। দূর থেকে শুধু আমাদের মাথা দেখা যায়। বড়থল, থাইলু, বানডুর সবুজ পার হয়ে আমরা কুম্ভীরগ্রাম পৌঁছোলাম। এখানে একটি পথসভায় সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা শেষে শালগঙ্গার দিকে এগিয়ে গেলাম। শালগঙ্গায় জনসংযোগ শেষে অপরাহ্ণে আমরা উদারবন্দ এসে পৌঁছোলাম। কিন্তু যাঁদের আমরা পূর্ব থেকেই চিঠি দিয়ে আমাদের আসার সংবাদ জানিয়েছিলাম, তাঁরা কেউ আসেননি। স্থানীয় ব্যবসায়ী যোগেশচন্দ্র পাল আমাদের থাকা-খাওয়ার সকল ব্যবস্থাই অতিদ্রুত সেরে ফেললেন। ইতিমধ্যে শিলচর থেকে মনীন্দ্র, ননীগোপাল, বিজন তাঁদের দায়িত্ব পালন শেষে আমাদের সঙ্গে যোগ দিল। ওরা শিলচর থেকে মাইক নিয়ে এসেছে। বাজারের কেন্দ্রস্থলে সভা অনুষ্ঠিত হল। ছাত্রনেতা সলিল চক্রবর্তীর সভাপতিত্বে খুব ভালো সভা হল। শিলচরের কর্মীরা শিলচর ফিরে গেল পদযাত্রী দলের এগিয়ে আসার খবর শহরবাসীকে জানাবার জন্য। ওরা বলে গেল প্রতিদিনের খবর শুনে—শহর গরম হয়ে উঠেছে। পরিশ্রান্ত আমরা। যোগেশচন্দ্র পালের বাড়িতে ডাল-ভাত আর ইলিশ মাছের ঝোল খেয়ে শুয়ে পড়লাম তাঁর বিশাল মোকাম ঘরে। ভোরবেলা উঠে দোকানে চা-পুরি খেয়ে মাতৃভাষা জিন্দাবাদ ধ্বনি তুলে আমরা রওনা দিলাম। আমরা হাতিছড়ার পথে পা বাড়ালাম। হাতিছড়া, ময়নাগড় পেরিয়ে আমরা ডলু এসে পৌঁছোলাম। এখানে কালীসদয় বর্মণ, রুক্ষ্মিণী বর্মণসহ একদল মানুষ আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন। পথসভায় আমি গণসংগ্রাম পরিষদের উদ্দেশ্য বর্ণনা করলাম। স্থানীয় হাই স্কুলের শিক্ষকগণ আমাদের চা-পানে আপ্যায়িত করলেন। আমরা এগিয়ে গেলাম বড়খলার পথে।
বড়খলা পৌঁছোনোর সঙ্গে সঙ্গে একদল ছাত্র এসে আমাদের অভ্যর্থনা জানাল। এক বিশাল ঘানিঘরে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হল। আমরা স্নানাদি সেরে খিচুড়ি খেলাম। এর পর পরই এক জনসভায় যোগদান করলাম। রাজকুমার কৈরি নামের এক ছাত্রের নেতৃত্বে বড়খলাতে গড়ে উঠল আমাদের সংগ্রামী বাহিনী। ঘানিঘরেই সেদিন রাত কাটালাম। ঘানিঘরে রাতে এক কর্মীসভা অনুষ্ঠিত হল। উদ্যোক্তা রাজকুমার কৈরি (?)।
২৯ এপ্রিল বড়খলা থেকে জারইলতলা, বিক্রমপুর, বিহাড়া, নাবাইনছড়া সর্বত্র পথসভা করে কালাইন পৌঁছোবার আগেই কুরকুরি পর্যন্ত এগিয়ে আসে ছাত্র যুবশক্তি। পদযাত্রা এক শোভাযাত্রার রূপ নিল। পঞ্চায়েত নেতা কুমুদ পাল, আঞ্চলিক পঞ্চায়েত সভাপতি আবদুল হামিদ মজুমদার, জগন্ময় ভট্টাচার্য প্রমুখ আমাদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলেন। কাটিগড়ায় খবর পৌঁছে আমরা কালাইন এসে পৌঁছোলাম।
সাইকেল নিয়ে ছুটে এল দেবপ্রসাদ, আমরা তখন খেতে বসেছি। ঠিক হল খাওয়ার পরই আমাদের যাত্রা শুরু হবে। পদযাত্রীদের নিয়ে দেবু এগিয়ে যাবে। সন্ধ্যার পর জনসভা। সন্ধ্যার পর খুব সুন্দর জনসভা হয়েছে কালাইনে। হিন্দু-মুসলমান, মণিপুরি, হিন্দুস্থানির এক অপূর্ব সমন্বয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন কংগ্রেস নেতা প্রমোদকুমার চক্রবর্তী। সভা থেকে সমবেত ধ্বনি উঠল মাতৃভাষা জিন্দাবাদ, বাংলা ভাষা জিন্দাবাদ, বন্দেমাতরম। আবার ঘরোয়া সভা। রাত একটা বাজল। একটা শক্ত ইউনিট তৈরি হল কালাইনে।’
‘খুব ভোরে উঠে রওনা দিলাম, কিন্তু তবুও কাটিগড়া পৌঁছোতে ন-টা বেজে গেল। কাটিগড়া থেকে সময়মতো যাত্রা করতে না পারলে সব ওলটপালট হয়ে যাবে। কিন্তু না, কিছুতেই জনসভা না করে যেতে দেবে না কাটিগড়ার মানুষ। অগত্যা থাকতেই হল। কালীবাড়ি আমাদের আস্তানা। দলে দলে মানুষ আসে। ছাত্র আসে। কথা বলে, দীক্ষা নেয় সংগ্রামের।
দিগেন্দ্রনাথ পালিতের পৌরহিত্যে বিকাল সাড়ে তিনটায় জনসভা আরম্ভ হল। সভায় বক্তব্য রাখলাম আবেগময় ভাষায়, বললাম:
বন্ধুগণ! এই ভাষাতেই তো ঈশ্বরের আরাধনা করি। আল্লাকে ডাকি। এই ভাষাতেই তো বাঙালির প্রাণ, বাঙালির মান। এই ভাষার সঙ্গেই তো জড়িয়ে আছে আমাদের পূর্বপুরুষের স্মৃতি। নজরুল, বিশ্বকবি তো এই ভাষাতেই মানবতার গান গেয়ে গেছেন। আজ আমাদের পবিত্র ভাষা-জননীর কন্ঠে যখন দানবের হস্ত, তখন আমরা অসহায় কাতর দৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে দেখব? কোনো কর্তব্য নেই আমাদের?.. জনতা স্লোগান তুলল—‘মাতৃভাষা জিন্দাবাদ’। ‘জান দেব জবান দেব না’। দেবপ্রসাদ, সুবিনয় জ্বালাময়ী ভাষায় ভাষণ দিল। সভা শেষে বের হল এক বিরাট মিছিল। বাংলা ভাষাকে রাজ্যের অন্যতম সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। মিছিল শেষে আমরা শিয়ালটেকের পথে পা বাড়ালাম। …
খুব সন্তর্পণে হেঁটে চলেছি আমরা। আমাদের আজ বিকেলে কাটাখাল গিয়ে পৌঁছোবার কথা। শিয়ালটেক বাজারে খেয়া পার হয়ে আমরা দুর্যোগের মুখোমুখি হলাম। ঝড় আসছে, প্রচন্ড বৃষ্টির মহড়া শুরু হয়েছে। বাতাস বইছে তুফান বেগে। কাছে কোথাও কোনো বাড়িঘর নেই। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। সবাই দৌড়োতে শুরু করলাম। কিন্তু শেষরক্ষা হল না। কালীনগর প্রাইমারি হেলথ ইউনিটের বারান্দায় আশ্রয় নিলাম। কিন্তু ততক্ষণে ভিজে আমরা ঝড়ের কাক হয়ে গেছি।
…সমস্ত রাত চলল এই তান্ডব। সমস্ত রাত আমরা কাটালাম এই বারান্দায়। অথচ একটু দূরেই আমাদের জন্য যাবতীয় ব্যবস্থা রয়েছে। ধীরে ধীরে রাত ভোর হয়ে এল। দিনের আলো ফুটল। ভেজা কাপড় গায়েই শুকিয়ে গেছে। ‘মাতৃভাষা জিন্দাবাদ’ ধ্বনিতে ভোরের আকাশ বিদীর্ণ করে পথে নামলাম আমরা। মাইল দেড়েক হাঁটার পরই কাটাখাল পেয়ে গেলাম। স্লোগান শুনে জ্ঞান ব্যানার্জি ছুটে এলেন। সংগ্রাম পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য তিনি। কাটাখাল রাইস মিলে চাকরি করেন। অগ্নিযুগের বিপ্লবী। আমরা মিল মালিক বিনোদ দেব-এর বাড়িতে এসে প্রবেশ করলাম। বরাক-কাটাখালের সঙ্গমস্থলে অপূর্ব মনোরম পরিবেশে বিনোদবাবুর বাড়ি। নদীর ঘাটে হাত-মুখ ধুয়ে প্রচার কাজে বেরিয়ে পড়লাম। বাজারে পথসভার আয়োজন হয়েছে। অধ্যাপক শরৎচন্দ্র নাথ এবং দীনেশচন্দ্র সিংহ হাইলাকান্দি থেকে এসেছেন। উভয়েই জনসভায় ভাষণ দিলেন।
‘বিনোদবাবুর বাড়িতে গরম খিচুড়ি আর আলুভাজা খেয়ে আমরা পথে নামলাম। শালচাপড়ার পথ ধরে এগিয়ে গেলাম। কাল ছিল বৃষ্টি। আজ প্রচন্ড রোদ। রাস্তার পিচ গলে গেছে। দু-ধারের ঘাস দিয়ে আমরা হাঁটছি। শালচাপড়া থেকে শুকতারা পর্যন্ত রাস্তার দু-পাশে কোনো গাছ নেই। অতিকষ্টে শুকতারা পর্যন্ত পৌঁছে ব্রিজের মুখে একটি শিমুল গাছের ছায়ায় আমরা শুয়ে পড়লাম। প্রায় আধ ঘণ্টা জিরিয়ে আবার রওনা দিলাম। বেলা দুটো নাগাদ আমরা শ্রীকোণা পৌঁছে গেলাম। শিলচর থেকে সহকর্মীরা মাইক নিয়ে এসেছে। শ্রীকোণার জনসাধারণের কাছে বক্তব্য রেখে আমরা শিলচর রওনা হলাম। এখন আমরা সংখ্যায় অনেক বেশি।’
পরিতোষ পালচৌধুরী জানিয়েছেন, শ্রীকোণার পাহাড় পেরিয়ে আমরা যখন রামনগর পৌঁছোলাম, ক্লান্ত অবসন্ন পদযাত্রীরা যেন মুহূর্তে পালটে গেল। তাদের মুখে বিজয়ীর হাসি। আর দু-মাইল। … ‘মাতৃভাষার রাখিতে মান, জীবন দানিতে হও আগুয়ান’ গান গেয়ে মার্চ করে চলেছি আমরা।
রামনগর রেলওয়ে গেটে ছুটে এসেছে মানুষ। প্রথম রেলগেটে পদযাত্রীদের সংবর্ধিত করা হল গণসংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে। কিন্তু এ কী! শহর যে ভেঙে পড়েছে। রাস্তার দু-ধারে কাতারে কাতারে মানুষ। আমরা এগিয়ে চলেছি। দু-পাশে উঠছে শঙ্খধ্বনি, উলুধ্বনি। দ্বিতীয় রেলগেটে পৌরসভার নবনির্বাচিত সভাপতি মহিতোষ পুরকায়স্থ পৌরসভার পক্ষে পদযাত্রীদের সংবর্ধনা জানালেন। সাংবাদিক বিনয়েন্দ্রকুমার চৌধুরী কাছাড় জেলা সাংবাদিক সমিতির পক্ষে সংবর্ধনা জানালেন। অসংখ্য মানুষের ফুল, মালা ও তোড়া আমাদের ঢেকে ফেলল। পথ ভরে গেল ফুলে ফুলে। তারাপুর বাস স্টেশনের সামনে তৈরি করা হয়ছে তোরণ। এখানে তারাপুরবাসীদের পক্ষে ধীরেন্দ্রমোহন দেব টাকার তোড়া দিয়ে সম্মানিত করলেন পদযাত্রী বাহিনীকে। সকলকে মিষ্টিমুখ করানো হল। আমরা এগিয়ে চললাম নরসিংটোলা মাঠের দিকে, যেখান থেকে আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল। তারাপুর থেকে নরসিংটোলার দিকে এগিয়ে চলল এক বিশাল মিছিল।
নরসিংটোলার মাঠে যখন পৌঁছোলাম, তখন আমরা এক জনসমুদ্রে নিমজ্জিত। মাঠে লোক। রাস্তায় লোক। পুকুরের চারপাড়ে লোক। সভা শুরু হল প্রবীণ সাংবাদিক হুরমত আলি বড়লস্করের পৌরহিত্যে। সভায় ভাষণ দিলেন— অধ্যাপক শরৎচন্দ্র নাথ, পৌরসভাপতি মহীতোষ পুরকায়স্থ, বিশিষ্ট ডিমাচা নেতা অ্যাডভোকেট অনিলকুমার বর্মণ, গোলাম ছবির খান, ভূদেব ভট্টাচার্য, বিনয়েন্দ্রকুমার চৌধুরী প্রমুখ। আমি পদযাত্রার বিস্তৃত রিপোর্ট তুলে ধরে বললাম, আপনাদের আশীর্বাদে আমাদের কারোর কোনো অসুখ হয়নি। আমরা দ্বিগুণ হয়ে ফিরে এসেছি। প্রায় জায়গাতেই নতুন নতুন ভাই আমদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। সর্বত্র পেয়েছি আমরা বিপুল সমর্থন। এবার একটি কাঠির ঠেকামাত্র আগুন জ্বলে উঠবে। বন্ধুগণ, আগামী ১৯ মে তারিখেই শুরু হবে আমাদের সংগ্রাম— শান্তিপূর্ণ, নিরস্ত্র, সত্যাগ্রহ তথা আইন অমান্য আন্দোলন।’১৪৮
শ্রীপালচৌধুরী পদযাত্রায় পরে যাঁরা তাঁর সঙ্গী হয়েছিলেন, তাঁদের নাম জানিয়েছেন। অপর পদযাত্রীরা হলেন— ইমামউদ্দিন চৌধুরী, কেতবী চন্দ, অরুনেন্দু রায়, ননীগোপাল পাল, প্রীতিভূষণ দাশগুপ্ত, গোপেশচন্দ্র পাল, সত্যরঞ্জন ঘোষ, রণধীর ভট্টাচার্য, সত্যেন্দ্রকুমার চক্রবর্তী, গোপেন্দ্রচন্দ্র দেব, পরিমল ভট্টাচার্য, উমাকান্ত বণিক, প্রজেশ চক্রবর্তী প্রমুখ।
সভা শেষ হল। এদিন ছিল ২ মে, মঙ্গলবার ১৯৬১। এই সভা সম্পর্কে সমকালীন সংবাদপত্র যুগশক্তি-তে বলা হয়েছিল:
…সহরে প্রবেশের পথে তারাপুরে স্থানীয় অধিবাসীদের এক সভায় নবনির্বাচিত পৌরসভাপতি শ্রীমহীতোষ পুরকায়স্থ সর্বপ্রথম পদযাত্রীগণকে অভিনন্দিত করেন। তাঁদের ১০১ টাকার একটি তোড়া দান করা হয়। সেখান থেকে পদযাত্রীদল নরসিংটোলা ময়দানে পৌঁছোলে এক বিরাট জনসমাবেশ তাঁদের অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করে। অধ্যাপক শ্রীশরৎচন্দ্র নাথের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় পৌরসভাপতি শ্রীমহীতোষ পুরকায়স্থ পুনরায় ওজস্বিনী ভাষায় তরুণ পদযাত্রী দলকে অভিনন্দন জ্ঞাপন করেন। পদযাত্রীদের নেতা শ্রী পরিতোষ পালচৌধুরী বক্তৃতা প্রসঙ্গে বলেন যে, এই ক-দিনের পদযাত্রার ফলে তাঁদের ধারণা হয়েছে যে, কাছাড়ের জনমানস এক বারুদের স্তূপে পরিণত হয়েছে। ছাত্রনেতা শ্রীমনীন্দ্র রায় ও শ্রীবিজনশঙ্কর রায়ের বক্তৃতার পর মৌলবি হুরমত আলি বড়লস্কর সংগ্রামী যুবকগণকে অভিনন্দিত করে বক্তৃতা দান প্রসঙ্গে ঘোষণা করেন যে, ভাষার ব্যাপারে কাছাড়ের কংগ্রেস নেতৃত্বের দুর্বল নীতির প্রতিবাদে তিনি কংগ্রেসের সদস্যপদ ত্যাগ করেছেন। গণসংগ্রামে মৃত্যু পণ করে তিনি আত্মনিয়োগ করবেন বলে প্রতিজ্ঞা করেন।
শ্রীঅনিলকুমার বর্মণ, শ্রীগোলাম ছবির খান, শ্রী বিনয়েন্দ্রকুমার চৌধুরী, শ্রীসত্যদাস রায়, শ্রী গৌরাঙ্গ দেবনাথ প্রমুখের বক্তৃতার পর সভাপতির ভাষণ শেষে বিপুল উৎসাহ, উদ্দীপনার মধ্যে সভার কাজ শেষ হয়।’১৪৯
এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, শিলচর পদযাত্রী দলনেতা পরিতোষ পালচৌধুরী তাঁর বয়ানে ২মে নরসিংটোলা মাঠের সভা ‘প্রবীণ সাংবাদিক হুরমত আলি বড়লস্কর-এর পৌরহিত্যে’ অনুষ্ঠিত হয় বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু সমকালীন সংবাদপত্রে অধ্যাপক শ্রী শরৎচন্দ্র নাথের সভাপতিত্বে সভা অনুষ্ঠিত হয় বলে জানিয়েছে। এক্ষেত্রে আমরা সমকালীন সংবাদপত্রকেই মান্যতা দেব, কারণ সেটি অপরিবর্তনীয়।
শিলচর পদযাত্রায় ‘হেভিওয়েট’ কোনো মানুষকে দেখা যায়নি— যেমনটা দেখা গেছে করিমগঞ্জের ক্ষেত্রে। অথচ শিলচরে তেমন মানুষের খামতি ছিল এমনটা বলা যাবে না। এমনকী পদযাত্রার দিনটিতেও নরসিংটোলা ময়দানে তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো ব্যক্তির উপস্থিতি লক্ষ করা যায়নি।
পদযাত্রী দলের নেতা পরিতোষ পালচৌধুরী এবং তাঁর সঙ্গীরা অতিসাধারণ ঘরের, সাধারণ মানের, বয়সে তরুণ স্কুল-কলেজের ছাত্র বা অন্যান্য পেশার তরুণ। কিন্তু এই অতিসাধারণ মানুষগুলোই সেদিন অসাধারণ কাজ সম্পন্ন করে নির্বিঘ্নে ঘরে ফিরেছিলেন। সফল সেনাপতি। এটা সম্ভব হয়েছে তাঁদের অফুরন্ত প্রাণশক্তি, বাঙালি ও বাংলা ভাষার প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা আর মানবতার প্রতি গভীর শ্রদ্ধাবোধজনিত কারণেই।
পদযাত্রা: হাইলাকান্দি
হাইলাকান্দি মহকুমার পদযাত্রা শুরু হয় ১০ মে ১৯৬১-তে। রাজ্য ভাষা আইনের প্রতিবাদে গণ-আন্দোলনের অংশ হিসেবে এই পদযাত্রায় হাইলাকান্দির মানুষও স্বতঃস্ফূর্তভাবে মাতৃভাষার মান বাঁচাতে এগিয়ে আসেন। এদিন অর্থাৎ ১০ মে পদযাত্রীদের তিনটি দল একইসঙ্গে তিন দিক থেকে পদযাত্রা শুরু করেন। ‘যে-সকল পদযাত্রী হাইলাকান্দি শহর থেকে উত্তর হাইলাকান্দির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবেন— তাঁদের শুভেচ্ছা জানাতে এক বিশাল জনতা হাইলাকান্দি টাউন হল প্রাঙ্গণে সমবেত হন। মহিলাগণ পদযাত্রীদের ললাটে চন্দনতিলক এঁকে দেন এবং লাজবর্ষণ করেন। উলুধ্বনি আর শঙ্খনিনাদে সামগ্রিক পরিবেশ হয়ে ওঠে আনন্দময়, পূত পবিত্র। তিনটি পদযাত্রী দলে শতাধিক পদযাত্রী, যাঁদের নেতৃত্বে রয়েছেন— গণসংগ্রাম পরিষদ সভাপতি আইনজ্ঞ সর্বশ্রী আবদুর রহমান চৌধুরী, কেশব চক্রবর্তী, হরিদাস দেব, রবীন্দ্রকুমার সেন, নৃপেন্দ্র চৌধুরী প্রমুখ।’১৫০
‘১৩ মে, গ্রাম-গ্রামান্তর পরিক্রমা শেষে পদযাত্রী দল হাইলাকান্দি শহরে প্রত্যাবর্তন করলে হাজার হাজার নর-নারী বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনা নিয়ে তাঁদের অভ্যর্থনা জানান। পৌর সভাপতি শ্রী প্রমোদরঞ্জন ভট্টাচার্য ও কাছাড় জেলা গণসংগ্রাম পরিষদের সভাপতি শ্রী আবদুর রহমান চৌধুরী সত্যাগ্রহী পদযাত্রী দলের প্রতিনিধিদের মাল্যভূষিত করে বরণ করলেন। উদবাস্তু সমিতির সভাপতি শ্রীনিমাইচাঁদ দেবনাথ, মোক্তার বারের পক্ষ থেকে শ্রী আমির আলি, ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষে শ্রীনবেন্দু দত্ত, উইভার্স অ্যাসোসিয়েশনের হয়ে শ্রীসচ্চিদানন্দ ভৌমিক, ব্যবসায়ী সমিতির পক্ষে শ্রীতুলসীদাস রায়, রিকশা মজদুর অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষে শ্রীউপেন্দ্র দত্ত, সাংবাদিকদের পক্ষে কাছাড় জেলা সাংবাদিক সংস্থার সহসভাপতি শ্রীশক্তিধর চৌধুরী প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তি ও নেতৃবৃন্দ পদযাত্রী দলকে স্বাগত সম্ভাষণ জ্ঞাপন করেন। এরপর সমস্ত শহর পরিক্রমা করে উদবেল জনসমুদ্র কালীবাড়ি ময়দানে পৌঁছে সভায় মিলিত হয়। আবদুর রহমান চৌধুরীর পৌরহিত্যে অনুষ্ঠিত এই সভায় করিমগঞ্জের যুবনেতা শ্রীনৃপতিরঞ্জন চৌধুরী, ছাত্রনেতা শ্রীনিশীথরঞ্জন দাস, হাইলাকান্দির শ্রী মাহমুদ আলি বড়ভুঁইয়া, শ্রী অভিজিৎ দত্তরায় সম্মিলিত জনতার উদ্দেশ্যে আন্দোলনের নানা দিক বিশ্লেষণ করে তাদের সহযোগিতা ও আশীর্বাদ প্রার্থনা করেন। পদযাত্রী দলের পক্ষে এই সভায় আরও যাঁরা ভাষণ দান করেন, তাঁরা ছিলেন— সর্বশ্রী হরিদাস দেব, নৃপেন্দ্র চৌধুরী, রবীন্দ্রকুমার সেন ও বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী।
নেতৃবৃন্দ আবেগাপ্লুত কন্ঠে পদযাত্রার অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করে যে অভূতপূর্ব জনসমর্থন প্রত্যক্ষ করেছেন, তার বিশদ বিবরণ সভায় তুলে ধরেন। শ্রী মাহমুদ আলি বড়ভুঁইয়া তাঁর ভাষণে বলেন:
মাতৃভাষার মর্যাদা ও অধিকার আদায়ের জন্য আমাদের ন্যায় ও বিধিসম্মত আন্দোলনকে পর্যুদস্ত করার উদ্দেশ্যে আসাম সরকার যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি মোকাবিলার সময় যেমন হয়— ঠিক তেমনি সমগ্র জেলায় পুলিশ ও মিলিটারির সমাবেশ ঘটিয়েছেন। কিন্তু জিজ্ঞাসা করি, বিগত জুন-জুলাই মাসে যখন সমগ্র ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় দাঙ্গাকারী পশুরা মা-বোনের ইজ্জত লুন্ঠন করল, হাজার হাজার অসহায় বাঙালির ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিল, নিরীহ মানুষকে হত্যা করল, গোরেশ্বরের যে নৃশংস বর্বর হত্যাকান্ড যা যেকোনো সভ্যজাতির পক্ষে কলঙ্কজনক; তখন কোথায় ছিল আসাম সরকার, তার গুণ্ডা পুলিশবাহিনী আর সেনারা? তখন তাদের এই বীরত্ব ও সমরায়োজন নিষ্ক্রিয় ছিল কেন? কিন্তু আজ যখন আমরা অহিংসভাবে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের জন্য বাধ্য হয়ে পথে নেমেছি তখন এই তৎপরতার উদ্দেশ্যটা কি তা সহজেই অনুমান করা যায়।
মাহমুদ আলী তাঁর ভাষণে মুসলমান সম্প্রদায়কে উদ্দেশ করে বলেন:
বাংলা শুধু হিন্দুর নয়, বাংলা ভাষা মুসলমানদেরও মাতৃভাষা। মুসলমানদের প্রতি আসাম ট্রিবিউন পত্রিকার সাম্প্রতিক জেহাদ-এর উল্লেখ করে তিনি আহ্বান জানান যে, হিন্দু-মুসলমানের ভেদাভেদ ভুলে আজ সকল বাঙালির একসঙ্গে নিজেদের মাতৃভাষার সংগ্রামে আত্মবলিদানের জন্য প্রস্তুত হতে হবে।
সভায় আবদুর রহমান চৌধুরী তাঁর বক্তব্যে:
দলমত, জাতি-বর্ণ-ধর্ম-নির্বিশেষে মাতৃভাষার সংগ্রামকে জয়যুক্ত করে তুলতে জনতার উদ্দেশে আহ্বান জানান। তিনি কাছাড় জেলাবাসীর পক্ষ থেকে এক ফরমান জারি করে বলেন, উত্তর হাইলাকান্দির বদরপুর নির্বাচন চক্র থেকে নির্বাচিত আসামের মুখ্যমন্ত্রী শ্রীবিমলাপ্রসাদ চালিহাকে, অন্ততপক্ষে তাঁর ভোটদাতাদের প্রতি যে বিশ্বাসঘাতকতা তিনি করেছেন— সেই কথা স্মরণ রেখে, নীতি, আদর্শ ও সততার স্বার্থে তাঁকে পদত্যাগ করতে হবে। আগামী ১৯ মে তারিখের মধ্যে শ্রীচালিহা যেন আসাম বিধানসভা থেকে পদত্যাগ করেন, তাঁর নির্বাচন চক্রের জনসমষ্টির এটাই আজকের রায়।১৫১
হাইলাকান্দি মহকুমার সর্বত্র এই পদযাত্রা বিপুল সাড়া জাগায়। মানুষ বলা শুরু করে— ‘জান দেব, জবান দেব না, ‘মাতৃভাষা জিন্দাবাদ’।
কাছাড়ের মানুষের প্রতিবাদ থামল না। বাংলাভাষার দাবিতে তাঁদের বিক্ষোভ-প্রতিবাদ জারি থাকল। সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে শিলচরে ২২ এপ্রিল স্কুল-কলেজের ছাত্ররা ধর্মঘট পালন করে। প্রায় দশ হাজার ছাত্রের এক বিশাল মিছিল শিলচরের বিভিন্ন রাজপথ পরিভ্রমণ করে গান্ধীবাগে গিয়ে তাঁরা এক সভায় মিলিত হয়। সভায় বাংলা ভাষাকে রাজ্যের অন্যতম সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকারের দাবি করে প্রস্তাব গৃহীত হয়।১৫২
কেবল কাছাড়ের মানুষের শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে স্তব্ধ করে দেওয়ার লক্ষ্যে আসাম সরকার যুদ্ধকালীন তৎপরতা শুরু করে দিলেন,যা সত্যিই চোখে পড়ার মতো। ৬ মে শিলং রাজভবনে আসামের রাজ্যপাল জেনারেল শ্রীনাগেশ-এর সভাপতিত্বে ১৯ মে থেকে অনুষ্ঠিতব্য অসহযোগ আন্দোলন প্রতিরোধে এক উচ্চপর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী শ্রী বিমলাপ্রসাদ চালিহা, চিফ সেক্রেটারি শ্রী এ এন কিদোয়াই, পুলিশের ইনস্পেকটর জেনারেল শ্রী হায়দার হোসেন এবং অত্র অঞ্চলের সেনাবাহিনীর কয়েকজন প্রতিনিধি বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।
সরকারি মুখপাত্র জানান যে:
আইন ও শৃঙ্খলাভঙ্গের কোনো পরিস্থিতি দেখা দিলে সরকার তাহা দমন করিবার ব্যবস্থা করিবেন। জেলায় স্পেশাল পুলিশের সংখ্যা প্রায় পাঁচগুণ বৃদ্ধি করা হইতেছে এবং সৈন্যবাহিনীকে ডিরেক্টর অব পাবলিক ইনস্ট্রাকশনের নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করিবার জন্য প্রস্তুত থাকিতে বলা হইয়াছে।১৫৩
বাংলা ভাষা আন্দোলন ও পার্বত্যবাসীদের দাবি দমনে আসাম সরকার যে কতটা ‘সিরিয়াস’ তার পরিচয় পাওয়া যায় আসাম রাজ্যপাল জেনারেল শ্রীনাগেশ-এর কর্মতৎপরতা সংবাদের মধ্য দিয়ে। সংবাদে বলা হল:
‘আসামের রাজ্যপাল জেনারেল শ্রীনাগেশ আগামী ১২ মে নয়াদিল্লি যাবেন এবং প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে পার্বত্য রাজ্য দাবি ও সংগ্রাম পরিষদের দাবি নিয়ে আলোচনা করবেন।
আসামের রাজ্যপাল রাষ্ট্রপতির সঙ্গেও সাক্ষাৎ করবেন। শ্রীনেহরুর আসন্ন উত্তর-পূর্ব সীমান্ত এজেন্সি ভ্রমণ সম্পর্কে চূড়ান্ত কার্যসূচিও রাজ্যপাল শ্রীনেহরুর সঙ্গে পরামর্শক্রমে স্থির করবেন। রাজ্যপাল শ্রীনাগেশ ১১ মে নয়াদিল্লি যাত্রা করবেন।’১৫৪
এ সব সংবাদ থেকে এ কথা স্পষ্ট যে, ভারতের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বিশেষত প্রধানমন্ত্রী শ্রীনেহরু কাছাড় বা পার্বত্যবাসীর আন্দোলন সম্পর্কে পূর্ণ ওয়াকিবহাল ছিলেন। অথচ বিগত ১৯৬০ সালের জুন-জুলাই মাসে আসামের ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় সংঘটিত নারকীয় দাঙ্গা প্রতিরোধে রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকার এই উদ্যমের সিকিভাগও কাজে লাগাতেন, তাহলে অনেক বাঙালিই সেদিন প্রাণে বাঁচতে পারতেন, নারীরাও পৈশাচিক নির্যাতনের হাত থেকে রেহাই পেতেন। এরই নাম কি রাজনীতি!
কেবল রাজ্য-কেন্দ্র নয়— আসামের সংবাদপত্রও নেতিবাচক ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। দি আসাম ট্রিবিউন পত্রিকায় ৯ মে তারিখের সম্পাদকীয় নিবন্ধে জানানো হয়েছিল, ‘এই আন্দোলনের কোনো অর্থই হয় না। রাজ্যভাষা আইন পাস হওয়ার পর যদি কোনো বিক্ষোভ থাকে (তাঁরা মনে করেন ওইরূপ বিক্ষোভের কোনো যুক্তিসংগত কারণ নাই— যেহেতু আইনটি সংবিধানসম্মত এবং তাতে সংখ্যালঘুদের ন্যায্য অধিকার সংরক্ষিত হয়েছে) তবে পার্লামেন্টে বা রাজ্য বিধানসভায় আলোচনা করবার যথেষ্ট সুযোগ ছিল— আন্দোলন করবার কোনো যৌক্তিকতা নেই। উক্ত সম্পাদকীয় প্রবন্ধে রাজ্যপালকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে যে, তিনি যেন নয়াদিল্লিতে বাংলাকে অন্যতম রাজ্য ভাষা করবার দাবির অসারতা বুঝিয়ে দেন। আরও বলা হয় ‘কাছাড়ের ভাষা আন্দোলনকারীগণ কতৃক আইন-শৃঙ্খলা ভঙ্গের প্রতিক্রিয়া রাজ্যের অন্যত্রও অনুভূত হতে পারে।’ অবশেষে বলা হয় যে, যুক্তি দ্বারা বুঝিয়ে নিবৃত্ত করবার সমস্ত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও যদি আন্দোলনকারীগণ সত্যাগ্রহের পরিকল্পনা পরিত্যাগ না করে, তবে পুলিশ-মিলিটারির সাহায্যে এই আন্দোলন দমন করা ভিন্ন আর কোনো পন্থা সরকারের নিকট উন্মুক্ত নাই।’১৫৫
রীতিমতো হুমকি। অতীতে অসমিয়া সমর্থনপুষ্ট এই ইংরেজি দৈনিকটির মতামতকেই সরকার শিরোধার্য জ্ঞান করেছেন। এ ক্ষেত্রেও কি তাই ঘটতে যাচ্ছে? সময়ই এ প্রশ্নের উত্তর দেবে।
এ সময় আসাম সফররত আচার্য বিনোবা ভাবের বাঙালি এবং বাংলা ভাষা সম্পর্কে বেশ কিছু মন্তব্যকে কেন্দ্র করে বিতর্ক তৈরি হয়। সংবাদপত্রে বলা হয়:
‘বর্তমানে আসাম পরিভ্রমণকালে আচার্য বিনোভাভাবে সেখানে যেসব উক্তি করেন তা সংখ্যালঘু বাঙালি সম্প্রদায়ের মৌলিক স্বার্থের পরিপন্থী। আশঙ্কা হয় যে, তাঁর এ সব উক্তির ফলে অসমিয়া সংকীর্ণতাকেই সম্ভবত উসকানি দেওয়া হয়েছে। আচার্য ভাবে আসামের দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্ত বাঙালিদের বেদান্তের কথা শুনিয়েছেন এবং ভাষাগত দাঙ্গাহাঙ্গামায় যাঁরা নিহত হয়েছেন, তাঁদের কথা চিন্তা করে মনকে ভারাক্রান্ত না করতে উপদেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, বেদান্তবাদী হিসেবে তাঁর নিকট জীবন-মৃত্যু দুই-ই সমান। আচার্য ভাবের মন্তব্য আসামে বাঙালি অধিবাসীদের নিকট অত্যন্ত তিক্ত ও নির্দয় বলে মনে হয়েছে। অথচ আচার্য ভাবে বোম্বাইয়ের ভাষা সংক্রান্ত দাঙ্গাহাঙ্গামায় মহারাষ্ট্রীয়দের বোম্বাই দাবি সমর্থন করেছিলেন।’
আসামে ভাষা সংক্রান্ত দাঙ্গাহাঙ্গামার ফলে সংখ্যালঘু বাঙালি সম্প্রদায়ের হৃত আস্থা পুনরুদ্ধারের জন্যই আচার্য ভাবে আসাম সফরে যান। জানা গেছে যে, আসামের বাংলা ভাষাভাষী লোকেদের এক প্রতিনিধি দল সম্প্রতি বিনোবাভাবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং দাঙ্গার দশ মাস পরে এখনও তাঁরা যেসব অসুবিধা ভোগ করছেন, তা তাঁর কাছে পেশ করেন। কিন্তু আচার্য তাঁদের যা বলেছেন তাতে আসামের সংখ্যালঘু বাঙালি সম্প্রদায়ের মনে এক অসহায় ভাব সৃষ্টি করেছে। আচার্যভাবে অভিমত দেন: ‘অসমিয়াই একমাত্র সরকারি ভাষারূপে গণ্য হওয়া উচিত এবং অসমিয়া ভাষাকে স্বীকার করে নিতে বাংলা ভাষাভাষী লোকেদের আপত্তি থাকা উচিত নয়। সংবিধানের ৩৪৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির কাছে যে আবেদন পেশ করা হয়েছে, তিনি প্রতিনিধিদলকে তা অবিলম্বে প্রত্যাহার করে নিতে বলেন। যদি তাঁরা তা না করেন, তাহলে তিনি (আচার্য ভাবে) রাষ্ট্রপতিকে তা অগ্রাহ্য করবার পরামর্শ দেবেন। ওই আবেদন প্রত্যাহৃত হলে রাজ্য সরকার যাতে সমগ্র রাজ্যব্যাপী বাংলা ভাষাভাষীদের জন্য শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলা ভাষা পুনঃপ্রবর্তন করেন তা তিনি দেখবেন। বাঙালিগণ তাঁদের আচরণ পরিবর্তন না করলে তাঁরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে বলে আচার্য সতর্ক করে দেন। কারণ প্রতিবেশী রাজ্যসমূহে বাঙালিদের কেউ-ই পছন্দ করে না বলে তিনি মনে করেন।’১৫৬
একজন ধর্মগুরুর এহেন মন্তব্যে বাঙালি সমাজে বেদনার ছায়া নেমে আসে এবং সেটাই স্বাভাবিক। বাঙালি সমাজ সত্য থেকে সরে আসেননি, আবেদনপত্র প্রত্যাহার করেননি। ফলে যা হওয়ার তাই তো হল।
আন্দোলনকারীদের ওপর সকল দিক থেকে এবং সর্ব পর্যায়ে চাপ প্রয়োগ অব্যাহত থাকল। কংগ্রেস দলীয় পর্যায়েও নিষ্ঠাবান সদস্যদের ওপর চাপ সৃষ্টি শুরু করে। শিলচরের নিষ্ঠাবান, সৎ, সজ্জন মানুষ হিসেবে খ্যাত জাতীয়তাবাদী কংগ্রেস সদস্য মহঃ হুরমত আলি বড়লস্করের ওপর কারণ দর্শাও নোটিশ জারি করা হল। আর এই চিঠিতে স্বাক্ষর করলেন এমন এক ব্যক্তি, যিনি আসাম বিধানসভায় সরকারি ভাষা বিলের বিরোধিতা করেছিলেন প্রচন্ডভাবে। শিলচর জেলা কংগ্রেস কমিটির সভাপতি শ্রীনন্দকিশোর সিংহ স্বাক্ষরিত ১১ মে তারিখের ডিসিসি ৫/৬১/৩০০ সংখ্যক চিঠি মারফত মহঃ হুরমত আলি বড়লস্করকে বলা হল:
It has come to our notice that you being a prominent member of the DCC Executive Committee, Silchar, deliberately acting and carrying a propoganda in different platforms criticising Congress Organisation and Congress MLA.s in various ways which is sure to lower the prestige of the Congress Organisation in the eye of Public at large. This is not at all desirable for a member of the DCC to discredit the Congress in such a naked way.
You are hereby asked to show cause to the DCC Office, Silchar, within two weeks from the date of receipt of this notice, why appropriate diciplinary action shall not be taken against you, in default exparte orders in respect of action will be passed against you.১৫৭
মহ. হুরমত আলি শিলচর জেলা কংগ্রেস কমিটি সভাপতি শ্রীনন্দকিশোর সিংহের কারণ দর্শাও নোটিশের জবাব দিয়েছিলেন। তিনি লিখেছিলেন:
বাংলা ভাষার ব্যাপারে আমি বরাবরই আমার স্বাধীন মত দৃঢ়ভাবে পোষণ করি। আমি বাঙালি ও বাংলা সাহিত্যিক। কাজেই কোনো অবস্থাতেই বাংলা ভাষার কন্ঠরোধ আমি বরদাস্ত করিতে পারি না। … আসাম রাজ্যে বাংলা ভাষার রাজ্যিক মর্যাদা আদায়ের ব্যাপারে আমি আমার বাঙালিত্বকে ও মাতৃভাষাকে সর্বোপরি স্থান দিব। কেননা, ভাষাভিত্তিক প্রদেশ গঠন ও ভাষা ব্যাপারে নিজস্ব মত ব্যক্ত করার অধিকার কংগ্রেস আমাদিগকে দিয়াছে।১৫৮
বাঙালিত্ব এবং বাংলা ভাষার প্রতি এমন শর্তহীন, নির্ভেজাল আনুগত্য, নি:শঙ্কচিত্ত কঠোর-কঠিন অথচ কোমল হুরমত আলি বড়লস্করদের পক্ষেই সম্ভব। তিনি নমস্য।
আসাম প্রদেশ কংগ্রেস কমিটিও কাছাড়ের দলীয় সদস্যদের ওপর চাপ প্রয়োগে এক বিজ্ঞপ্তি জারি করে। কমিটির জেনারেল সেক্রেটারি শ্রীশরৎচন্দ্র সিংহ ৮ মে তারিখে জারিকৃত বিজ্ঞপ্তিতে জানালেন:
শিলচর, করিমগঞ্জ এবং হাইলাকান্দি জেলা কংগ্রেস কমিটিসমূহের কতিপয় সদস্য আসামের সরকারি ভাষা আইনের বিরুদ্ধে আসামের প্রশাসন ব্যবস্থাকে অচল করিবার উদ্দেশ্যে প্রবর্তিত সংগ্রাম পরিষদের আন্দোলনকে সক্রিয়ভাবে সমর্থন করিতেছেন বলিয়া রিপোর্ট পাওয়া গিয়াছে। প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির কোনো সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কোনো কংগ্রেস সদস্যের অভিযোগ থাকিলে তিনি তাহা নিখিল ভারত কংগ্রেস সমিতির নিকট পেশ করিতে পারেন। অনুরূপভাবে রাজ্য গভর্নমেন্টের কোনো কার্যের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় গভর্নমেন্টের নিকট অভিযোগ উপস্থিত করা যাইতে পারে। কিন্তু ইহার অর্থ নিশ্চয়ই এই নয় যে, এরূপ ব্যাপারে কংগ্রেসি সদস্যগণ যাহারা কংগ্রেসের এবং কংগ্রেস গভর্নমেন্টের বিরোধী তাহাদের সহিত হাত মিলাইতে পারেন। শিলচর, করিমগঞ্জ এবং হাইলাকান্দির সকল সদস্যদের নিকট আমাদের আবেদন তাঁহারা যেন কংগ্রেসবিরোধীদের দ্বারা এই প্রশ্নে ভ্রান্ত পথে পরিচালিত না হন। আমরা আশা করি এবং বিশ্বাস করি তাঁহারা সংগ্রাম পরিষদের কার্যাবলির সহিত যোগদান করা হইতে বিরত থাকিবেন।১৫৯
১৬ মে নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির সভাপতি শ্রীসঞ্জীব রেড্ডি শিলচর, করিমগঞ্জ এবং হাইলাকান্দি জেলা কংগ্রেস কমিটি নেতৃত্বকে সংগ্রাম পরিষদের কোনো কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ না-করার নির্দেশ পাঠালেন তারবার্তা মারফত।
কংগ্রেসের পক্ষ থেকে এ সব পদক্ষেপ গ্রহণের মধ্য দিয়ে এ সত্য প্রতিষ্ঠিত যে, কংগ্রেস হাই-কমাণ্ড সংগ্রাম পরিষদ আহূত অসহযোগ আন্দোলন কর্মসূচিতে বেশ বিচলিত। অন্যদিকে সংগ্রাম পরিষদ নেতৃত্ব তাঁদের কর্মসূচি বাস্তবায়নে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এবং এ জন্য তাঁরা জীবনদানে প্রস্তুত। তাঁরা তো বলেইছেন, ‘জান দেব, জবান দেব না।’
এমন এক সংকটময় মুহূর্তে কাছাড় কংগ্রেস নেতৃত্ব বাংলা ভাষার দাবি বিস্মৃত হয়ে আসাম কংগ্রেস থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার দাবি নিয়ে দিল্লি পর্যন্ত পৌঁছে গেলেন। তাঁরা কাছাড়, মণিপুর, ত্রিপুরা এবং পার্বত্য জেলাসমূহ নিয়ে পৃথক কংগ্রেস গঠন করতে চান। তাঁরা ‘মণিপুর, ত্রিপুরা এবং পার্বত্য জেলাসমূহের মতো কাছাড়কে আসাম প্রদেশ কংগ্রেস কমিটি থেকে বিচ্ছিন্ন করে স্বায়ত্তশাসন দানের জন্য স্মারকলিপিতে ওয়ার্কিং কমিটির কাছে দাবি জানান।’ এই লক্ষ্যে কাছাড়ের এক কংগ্রেস প্রতিনিধিদল দিল্লিতে ১৩ মে কংগ্রেস হাইকমাণ্ডের বিবেচনার জন্য এক দীর্ঘ স্মারকলিপি পেশ করেন। এ সময় কাছাড় সংগ্রাম পরিষদের কোনো প্রতিনিধি দিল্লি যাননি বা প্রধানমন্ত্রী নেহরুর সঙ্গে সাক্ষাৎও করেননি।১৬০
এ দিকে আসাম পুলিশের ইনস্পেকটর জেনারেল হায়দার হোসেন দু-দিন ব্যাপী কাছাড় সফর শেষে ১৫ মে রাতে শিলং ফিরে আসেন। পরদিন অর্থাৎ ১৬ মে সাংবাদিকদের বলেন, ‘আসামের অন্যতম সরকারি ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষা গ্রহণের দাবিতে ১৯ মে থেকে যে গণ-আন্দোলন সংগ্রাম পরিষদ আরম্ভ করবে, তার ফলে যাতে আইন-শৃঙ্খলা ভঙ্গ না হয়, সেজন্য কাছাড়ের আইন-শৃঙ্খলা ব্যবস্থা সুদৃঢ় করা হয়েছে। উক্ত জেলার সেনাদলের ইউনিটকে প্রস্তুত থাকবার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং অতিরিক্ত সশস্ত্র ও নিরস্ত্র পুলিশবাহিনী পাঠানো হয়েছে। পুলিশের ডেপুটি ইনস্পেকটর জেনারেল লালা বি কে দে-কে অভিযান পরিচালনার দায়িত্ব দিয়ে কাছাড় জেলায় মোতায়েন করা হয়েছে।’১৬১
১৯ মে তারিখের কর্মসূচি বাস্তবায়নে সংগ্রাম পরিষদ সদস্যগণ শিলচরে ব্যাপক জনসংযোগ শুরু করেন। গুরুচরণ কলেজ ছাত্র সংসদ সাধারণ সম্পাদক বিজনশংকর রায় ছিলেন শিলচর গণসংগ্রাম পরিষদের একজন সক্রিয় সদস্য। তুখোড় বক্তা হিসেবে পরিচিত সেদিনের কলেজ ছাত্র শ্রীরায় জানান: ‘১০ মে থেকে শুরু হল শহরের আনাচেকানাচে বক্তৃতার অভিযান। দিনের পর দিন রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে আমরা সংকল্পকে সার্থক করবার প্রচেষ্টায় আরও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে উঠলাম। ১৫ তারিখ বিকেল। মনে হল আমাদের সংকল্প সফল। আধ ঘণ্টা একটানা বক্তৃতা দিয়ে চলেছি। ঘাম ঝরছে, অসহ্য গরম। হঠাৎ মনে হল কোথা থেকে বাতাস এসে লাগল গায়ে, তখন ঠিক বুঝতে পারিনি, বক্তৃতা শেষে তাকিয়ে দেখি পাশে দাঁড়িয়ে আছেন একজন বৃদ্ধা মা, হাওয়া করছেন তালপাতার পাখা দিয়ে। চারদিকে অনেক লোক। সকলের চোখে-মুখে যেন কীসের আবেগ, উত্তেজনা আর দৃঢ়তা। সেদিনই যখন শিলচর শহরের দক্ষিণ প্রান্তে বক্তৃতা শেষ করে ‘জয়হিন্দ’ বলি, একজন মাতৃস্থানীয়া এসে মঙ্গলচন্ডীর আশীর্বাদ দিলেন। ১৭ মে শহিদ শচীনের দাদার বন্ধু গঙ্গেশ পালের সহযোগিতায় ছ-টি বোন আমাদের কাজে বিশেষভাবে এগিয়ে এল। পথে পথে তারা মাইকে আবেদন জানাতে লাগল প্রত্যেক মা-বোনকে সংগ্রামে যোগ দেওয়ার জন্য। ওদের সঙ্গে আমিও যোগ দিতাম।
১৮ মে, সারাদিন আগামীকালের প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনা চলল নেতৃবৃন্দের সঙ্গে। সেদিন বিকেলে বিরাট জনসভার আহ্বায়ক ছিলাম আমি। কিন্তু বন্ধুরা জোর করে আমাকে আটকে রাখল। বক্তব্য লিখে পাঠালাম সভায়। সেদিন সন্ধ্যায় আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখলাম সন্ধ্যার সেই বিরাট মিছিল। এদিন রাত দশটা অবধি করিমগঞ্জের জননেতাদের সঙ্গে গোপন বৈঠকে কাটল।’১৬২
লড়াইয়ের চূড়ান্ত প্রস্তুতিকালের কথা স্মরণ করে শিলচরের ডিকটেটর পরিতোষ পালচৌধুরী জানালেন:
৭মে সংগ্রাম পরিষদের ‘কাউন্সিল অব অ্যাকশন’-এর চূড়ান্ত সভা হাইলাকান্দিতে অনুষ্ঠিত হয়। শিলচর থেকে সত্যদাস রায় এবং গোলাম ছবির খান গেছেন। সভাপতি আবদুর রহমান চৌধুরীর বৈঠকখানায় সভা বসেছে। অনেক বিতর্কের পর ঠিক হল ১৯মে তারিখেই সরকারকে চরম আঘাত হানা হবে। রেল, মোটরসহ সর্বপ্রকার যানবাহন, হাটবাজার, অফিস-আদালত, কেন্দ্রীয় এবং প্রাদেশিক সরকারের সর্বপ্রকার কার্যালয়ে পিকেটিং করা হবে। সত্যাগ্রহ, আইন অমান্য আন্দোলন। অবশ্যই শান্তিপূর্ণ উপায়ে। ভোর পাঁচটা থেকে বিকাল চারটা পর্যন্ত। জেলা কাউন্সিল অব অ্যাকশন বড় করা হল। অধ্যাপক শরৎচন্দ্র নাথ, দীনেশচন্দ্র সিংহ, শক্তিধর চৌধুরী, সৈয়দ আহমদ লস্কর, হরিদাস দেব, হুরমত আলি বড়লস্কর, গোলাম ছবির খান, নরেন্দ্রচন্দ্র সিংহ, ভূপেন্দ্রকুমার সিংহ, মোহিতমোহন দাস এবং নৃপতি চৌধুরীকে কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হল। এর আগে বিধুভূষণ চৌধুরী, অমিয়কুমার নন্দী, আবদুর রহমান চৌধুরী, রথীন্দ্রনাথ সেন, নলিনীকান্ত দাস, কেশবচন্দ্র চক্রবর্তী, সত্যদাস রায় ও আমাকে নিয়ে কমিটি গঠন করা হয়েছিল। এই কমিটিই সংগ্রামের নীতি নির্ধারণের মালিক। ১৯ জনের এই কমিটির ৭ জন একত্রিত হলেই যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারবেন। নেতৃবৃন্দ যদি গ্রেপ্তার হন, এক জন বাইরে থাকলে তিনি একাই সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। …
বড়খলা, বিহাড়া, কালাইন, জালালপুর, গোমড়া, কাটিগড়া, পয়লাপুল, উদারবন্দ, গাগলাছড়া, দিদারকোশ, লক্ষ্মীপুর, জয়পুর, কুম্ভীরগ্রাম, পালংঘাট, কাবুগঞ্জ, ডলু, বাঁশকান্দি, সোনাই, ধলাই, নারাইনছড়া, লাবক, দোয়ারবন্দ, রানিনগর, কচুদরম, পানিভরা, শালগঙ্গা, দিগরকাল, বালাছড়া, শিয়ালটেক, গঙ্গানগর, মতিনগর, জালেঙ্গা, আইরংমারা, মেহেরপুর, সোনাবাড়িঘাট, নূতন বাজার, অরুণাচল সর্বত্র গড়ে উঠেছে গণসংগ্রাম পরিষদের শাখা। প্রায় পঁয়ত্রিশটি মফসসল ইউনিট এবং বারোটি শহর ইউনিট। …. বিজন রায়ের কন্ঠ ঝড় তুলেছে শহরে। ‘একফোঁটা বাঙালি রক্ত যার দেহে আছে, তাকেই অংশগ্রহণ করতে হবে এই সংগ্রামে। বুকে হাত দিন, নিজের বিবেককে জিজ্ঞাসা করুন আপনি কে? যদি আপনি বাঙালি হন, কোনো অধিকার নেই দূরে দাঁড়িয়ে থেকে মজা দেখার।’ … শ্রীপালচৌধুরী জানিয়েছেন:
… পৌরসভার সভাপতি মহীতোষ পুরকায়স্থ আহ্বান করেছেন এক নাগরিক সভা। দলমত নির্বিশেষে শহরের বিশিষ্ট নাগরিকরা আমন্ত্রিত এই সভায়। ১৫ মে সন্ধ্যার পর শিলচর পৌরসভা ভবনে শ্রীযুক্তা জ্যোৎস্না চন্দ, এম.এল.এ.-এর পৌরহিত্যে সভা আরম্ভ হল। আমাকেও ডাকা হয়েছে। সভায় দু-এক জন বক্তা সংগ্রামসূচি থেকে রেলকে বাদ দেওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন। এই সভায় কমিউনিস্ট নেতা বীরেশ মিশ্রও উপস্থিত ছিলেন। তিনি রেলকে বাদ রাখার প্রস্তাব করেন।
এই পরিপ্রেক্ষিতে শ্রীচৌধুরী বলেন,
আমি নিতান্তই সৈনিক। সিদ্ধান্ত মেনে চলাই আমার শিক্ষা। গণসংগ্রাম পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সিদ্ধান্ত আগেই আমরা মেনে নিয়েছি। কর্মসূচির অদলবদল করার সাধ্য আমার বা আমাদের নেই। আমরা এখন হারি-জিতি নাহি লাজ এই চেতনায় জীবন দিয়ে দেখব।১৬৩
শিলচর পৌরসভা সভাপতি মহীতোষ পুরকায়স্থ আহূত ১৫ মে তারিখের নাগরিক সমাজের সভা সম্পর্কে আনন্দবাজার পত্রিকা-য় ছোট্ট একটি সংবাদ ছাপা হয়েছে। বলা হয়েছে:
বাংলা ভাষাকেও আসামের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়ার জন্য কাছাড় সংগ্রাম পরিষদ কতৃক আগামী ১৯ মে হইতে যে গণসংগ্রাম আরম্ভ করা হইতেছে তৎসম্পর্কে আলোচনার জন্য মিউনিসিপ্যাল চেয়ারম্যান শ্রীমহীতোষ পুরকায়স্থের আহ্বানে গত ১৫ মে সন্ধ্যার পর শিলচর মিউনিসিপ্যাল হলে শিলচর শহরের প্রতিনিধিস্থানীয় বিশিষ্ট ব্যক্তিদের এক সভা হইয়া গিয়াছে। শ্রীযুক্তা জ্যোৎস্না চন্দ, এম.এল.এ. সভানেত্রীত্ব করেন। উপস্থিত ভদ্রমহোদয়গণ প্রস্তাবিত আন্দোলনের বিভিন্ন দিক আলোচনার পর ইহাকে সম্পূর্ণ অহিংস ও নিরুপদ্রব রাখার ওপর জোর দিয়া বলেন যে, ইহার উপরই আন্দোলনের সাফল্য নির্ভর করে।১৬৪
১৯ মে তারিখের কর্মসূচি সফল করার লক্ষ্যে শিলচরে ১৬মে দু-টি প্রচারপত্র প্রকাশিত হয়। একটি শিলচর মহকুমা গণসংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে এবং অপরটি শিলচর নাগরিক সভার বিশিষ্ট নাগরিকদের।
প্রথমটি শিলচর গণসংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে ডিকটেটর পরিতোষ পালচৌধুরীর নামে প্রচারিত হয়। শিলচর, মানিকচাঁদ প্রেস থেকে মুদ্রিত ১৬মে তারিখের ‘জনসাধারণের প্রতি নিবেদন’ শীর্ষক প্রচারপত্রে বলা হল:
বন্ধুগণ,
মাতৃভাষা বাংলাভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার পবিত্র সংগ্রাম গণসংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে সমস্ত জেলাব্যাপী আরম্ভ হবে আগামী ১৯ মে, শুক্রবার। ইহা সংগ্রামের তৃতীয় এবং চূড়ান্ত পর্যায়। ইতিপূর্বে প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ে সমস্ত জেলায় সংকল্প গ্রহণ ও পথপরিক্রমায় শক্তিশালী সংগঠন তৈরি করে জেলার আবালবৃদ্ধবনিতাকে এই সংগ্রামের জন্য উদবুদ্ধ অনুপ্রাণিত করা হয়েছে। আগামী ১৯ মে কাছাড়বাসীর সামনে এক অগ্নিপরীক্ষার দিন। এইদিন প্রমাণ হবে আমরা আমাদের মাকে, মাতৃভাষাকে, ধর্ম, কৃষ্টি ও সংস্কৃতিকে কতটুকু ভালবাসি। ভাষা দিয়ে জাতির পরিচয়। ভাষা না রইলে জাতি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। আজ এই সংগ্রাম তাই ভাষা, জাত ও ধর্ম রক্ষার সংগ্রাম। কাছাড়ের হাজার হাজার তরুণ, কিশোর, ছাত্র, যুবক আজ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এই সংগ্রামে নিজের মাতৃ মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য। রবীন্দ্রনাথের ভাষা, নজরুল ইসলামের ভাষা ও জাতি ব্যর্থ হতে পারে না। তাই আহ্বান জানাই ওরে ভাই ছাত্র-যুবক জনসাধারণ এগিয়ে এসো তোমাদের মাতৃকন্ঠ অত্যাচারীর হাত হতে মুক্ত করো। উত্তরাধিকারীর ভবিষ্যৎ নির্মল করো। ১৯ তারিখ সর্বাত্মক হরতাল অনুষ্ঠিত হবে স্কুল-কলেজ, বাজার, দোকানপাট, সর্বপ্রকার অফিস-আদালত, পোস্ট অফিস, রেল, বাস, রিকশা, সাইকেলসহ সর্বপ্রকার যানবাহন বন্ধ থাকবে, সর্বত্র পিকেটিং পরিচালিত হবে। প্রতিটি মানুষকে জানাই এই কর্মসূচিতে সর্বত্র অংশগ্রহণ করতে, ভোর হতে বিকাল চারটা পর্যন্ত কাছাড় জেলার শাসনব্যবস্থাকে অচল করে দিতে। শান্তিপূর্ণভাবে, কোনো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না করে সফল করুন ১৯ তারিখ। আকাশে-বাতাসে ধ্বনিত হউক—বাংলা ভাষা জিন্দাবাদ, মাতৃভাষা জিন্দাবাদ।১৬৫
১৬ মে প্রচারিত শিলচর নাগরিক সমাজের বিশিষ্ট ৪৬ জন ব্যক্তি স্বাক্ষরিত প্রচারপত্রে যাঁদের নাম মুদ্রিত হয় তাঁরা হলেন— সর্বশ্রী জ্যোৎস্না চন্দ, মহীতোষ পুরকায়স্থ, নন্দকিশোর সিংহ, প্রমোদকুমার আদিত্য, প্রণয়কুমার চন্দ, সুরেশচন্দ্র বিশ্বাস, বীরেশ মিশ্র, গোলাম ছবির খান, শরৎচন্দ্র নাথ, সত্যদাস রায়, বিষ্ণুমোহন গুপ্ত, উপেন্দ্রকুমার ধর, গৌরাঙ্গচন্দ্র দাশ, প্রজেশচন্দ্র চক্রবর্তী, নৃপেন ভট্টাচার্য, শিশিরকুমার দাশ, সুনীলবরণ নাথ, শঙ্করপ্রসাদ সিং, শচীন দাশগুপ্ত, বিবেকানন্দ ভাওয়াল, আবদুল হক মজুমদার, গৌরাঙ্গ দেবনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল সেনগুপ্ত, অচিন্ত্যকুমার ভট্টাচার্য, কর্ণেন্দু ভট্টাচার্য, দীপক ভট্টাচার্য, সুশীতকুমার দত্ত, জিতেন্দ্রচন্দ্র গুহ, যশোদানন্দন ভট্টাচার্য, শিবচন্দ্র ভট্টাচার্য, আলতাফ হোসেন মজুমদার, হিরন্ময় সিংহ, দীপেন্দ্রচন্দ্র চৌধুরী, সনৎকুমার চক্রবর্তী, শৈলেশ কর পুরকায়স্থ, রাধারমণ দাস, অমিতকুমার নাগ, সুনীলকুমার দত্তরায়, রোহিনীকুমার পাল, অমিয় চক্রবর্তী, সুশীল দেবরায়, শ্রীশচন্দ্র দেবনাথ, অবনীনাথ বিশ্বাস, সুবোধ চক্রবর্তী এবং অরবিন্দ দত্তচৌধুরী।
বিশিষ্টজনেরা ১৯মে হরতাল সম্পর্কে জনসাধারণের নিকট ‘আবেদনে’ জানালেন:
কাছাড়বাসী জনগণের বাঙ্গলাভাষার দাবির সংগ্রামে জেলাবাসীর সুগভীর বিক্ষোভ প্রদর্শনের জন্য আগামী ১৯ মে যে প্রতিবাদ হরতাল আহূত হইয়াছে, এই সম্পর্কে আমরা স্বাক্ষরকারীগণ শিলচরবাসীর নিকট আবেদন জানাইতেছি, দোকানপাট, যানবাহন ও প্রাত্যহিক কাজকর্ম বন্ধ রাখিয়া তাঁহারা এই হরতালকে সর্বতোভাবে সফল করুন।
রেল ও বাসযাত্রীদের নিকট আমাদের আবেদন, তাঁহারা বাস ও রেল যাতায়াত ওইদিন সম্পূর্ণ বন্ধ রাখিয়া এই বিক্ষোভ প্রদর্শনকে সফল করুন।
এই ন্যায্য প্রতিবাদ হরতালের বিরুদ্ধে সরকার উগ্র দমননীতির যে মহড়া দিতে আরম্ভ করিয়াছেন, তাহা অপ্রয়োজনীয় বিবেচনায় আমরা তাহার প্রতিবাদ জানাইতেছি। ইহাতে শান্তিরক্ষায় মহড়া না হইয়া অহেতুক প্ররোচনা ও চাপ সৃষ্টি হইতে পারে। আমরা আশা করি, সরকার দমননীতির পন্থা গ্রহণ করিবেন না।
সর্বশেষে আমরা নাগরিকদের নিকট আবেদন জানাইতেছি যে, তাঁহারা যেন সর্বাবস্থায় শান্তিপূর্ণ থাকিয়া জনসাধারণের অনমনীয় দৃঢ়তা ও শক্তিকে প্রকাশ করেন। যত প্ররোচনাই আসুক দেশবাসী সম্পূর্ণ শান্ত ও অহিংসভাবেই তাহার যথাযোগ্য প্রত্যুত্তর প্রকাশ করিবেন বলিয়া আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।১৬৬
‘১৮ মে করিমগঞ্জে এক বিরাট ছাত্র শোভাযাত্রা শহরের বিভিন্ন রাস্তা পরিভ্রমণ করে টাউন ব্যাঙ্ক প্রাঙ্গণে এক সভায় মিলিত হয়। প্রায় পনেরো হাজার ছাত্র-ছাত্রী শোভাযাত্রায় যোগদান করেন। এত বড়ো শোভাযাত্রা বিগত দশ বছরের মধ্যে করিমগঞ্জে হয়নি। ছাত্র-সভায় ছাত্রসংস্থার সাধারণ সম্পাদক শ্রীনিশীথরঞ্জন দাস ও ছাত্রসংহতির সাধারণ সম্পাদক শ্রীদেবপদ চৌধুরী ছাত্র-ছাত্রীদের মাতৃভাষা রক্ষার সংগ্রামে সক্রিয় সহযোগিতা করবার আহ্বান জানান। ছাত্রসংহতির প্রাক্তন সভাপতি শ্রীরবিজিৎ চৌধুরী ও কলেজ ইউনিয়নের সহসভাপতি শ্রীশান্তিময় ভট্টাচার্য শোভাযাত্রা সফল করার জন্য ছাত্র-ছাত্রীদের অভিনন্দন জানান।’১৬৭
এ দিন করিমগঞ্জ গণসংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকেও জনগণের উদ্দেশে প্রচারপত্র প্রচার করা হয়। প্রচারপত্রে বলা হয়:
ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য সরকারের নিকট সংবিধানসম্মত জন্মগত অধিকার রক্ষার জন্য এই জেলাবাসীর পক্ষ হইতে আবেদন-নিবেদন করা সত্ত্বেও আমাদের মাতৃভাষার ন্যায্য মর্যাদার দাবি অবহেলার সঙ্গে উপেক্ষা করা হইয়াছে। তজ্জন্য স্বাধীন ভারতের সংবিধানসম্মত জন্মগত অধিকার রক্ষার দাবির ভিত্তিতে আগামী ১৯ মে, ১৯৬১ ইংরেজি হইতে সমগ্র কাছাড়ে জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে অহিংস অসহযোগ গণ-আন্দোলন চালাইয়া যাইবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হইয়াছে। এমতাবস্থায় দেখা যায় যে, উক্ত অহিংস আন্দোলনকে দমননীতি দ্বারা প্রতিহত করার জন্য কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার কঠোর ব্যবস্থা অবলম্বন করিয়া সিপাহি সান্ত্রী মোতায়েন করিয়াছেন। ইহাতে শান্ত জেলাবাসীর বিক্ষুব্ধ হওয়ার প্রভূত সম্ভাবনা আছে বলিয়া আশঙ্কা করা যায়। স্বাধীন ভারতের নাগরিক হিসেবে নিজ জাতীয় সরকারের নিকট হইতে ন্যায় বিচার পাওয়ার মৌলিক অধিকার সংক্রান্ত দাবির আন্দোলনকে এইভাবে সশস্ত্র মিলিটারি ও পুলিশ দ্বারা দমাইবার অপচেষ্টা দ্বারা শান্ত জনগণের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করা হইতেছে।
এমতাবস্থায় কাছাড়বাসী, জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে এই জেলাবাসীর জাতীয় সংগ্রাম হিসেবে গ্রহণক্রমে ১৯ মে পুণ্য দিবস স্মরণে গণকল্যাণ নিমিত্ত সংঘবদ্ধ ঐক্যশক্তির মাধ্যমে সংবিধানসম্মত মৌলিক অধিকার রক্ষার সংগ্রামে দলে দলে যোগদান করুন। অন্যথায় কাছাড়বাসীকেই ইহার কুফল ভুগিতে হইবে, ভবিষ্যৎ বংশধরের নিকট জবাবদিহি করিতে হইবে। গণ-আন্দোলনকারী কাছাড় জেলার সকল কর্মী-ছাত্র-যুবক ও নেতৃবৃন্দের নিকট আবেদন এই, যাহাতে শান্তিপূর্ণ অহিংস আন্দোলন পরিচালিত হয় তৎপ্রতি তীক্ষ্ণ কঠোর দৃষ্টি রাখিবার জন্য সনির্বন্ধ অনুরোধ করা যাইতেছে। যদি কোনো কারণে আন্দোলনকারী সত্যাগ্রহীদের ওপর কোনো প্রকার জুলুম বা অত্যাচার হয়— তবে আপনারা ধৈর্যচ্যুত বা ভীত না হইয়া অবিচলিত ও নি:শঙ্কচিত্তে সংগ্রাম চালাইয়া যাইবেন এই দৃঢ় বিশ্বাস জেলাবাসীর আছে। বাংলা ভাষা জিন্দাবাদ, গণ-আন্দোলন জিন্দাবাদ।১৬৮
এদিকে কমিউনিস্ট পার্টির উদ্যোগে ১৭ মে শিলচর গান্ধীবাগে এক বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। অন্যূন পাঁচ হাজার লোকের এই সমাবেশে শ্রীবীরেশচন্দ্র মিশ্র, শ্রীঅচিন্ত্যকুমার ভট্টাচার্য প্রমুখ ভাষণ দেন। ‘আসামের বিশ লক্ষাধিক বাঙালিকে কীভাবে নিষ্পেষিত করা হচ্ছে তার বিবরণ তুলে ধরে বলেন যে, এরূপ বিরাট সংখ্যক লোকের এরূপ সম্পন্ন একটি ভাষাকে দাবিয়ে রাখার প্রচেষ্টার মতো গর্হিত কাজ করে যেতেও আসামের বর্তমান নেতৃবৃন্দ মোটেই সংকোচবোধ করছেন না। সর্বক্ষেত্রেই বাঙালিরা অবহেলিত, অন্যান্য অনসমিয়াদেরও তারা তাঁদের ন্যায্য দাবি দিতে নারাজ। মিকির পাহাড় জেলার দুরধিগম্য জঙ্গল পরিষ্কার করে তাকে বাঙালিরা শস্যশ্যামলা করে তোলার পর আসাম সরকার হাতি দিয়ে ঘরবাড়ি ভাঙিয়ে তাদের পথের ভিখারি করে তাড়িয়ে দিতেও লজ্জাবোধ করেন নাই।
বাংলা ও অন্যান্য অনসমিয়া ভাষা সমিতির সম্পাদক অধ্যাপক শরৎচন্দ্র নাথ ভারতের রাষ্ট্রপতি ও উপরাষ্ট্রপতির নিকট এক তারবার্তায় সাংবিধানিক হস্তক্ষেপ করে কাছাড়ের বর্তমান দুর্বিপাক পরিহার করবার ব্যবস্থা করতে আবেদন জানান।’১৬৯
আসাম সরকার আন্দোলন বানচাল করার লক্ষ্যে সকল প্রকার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখল। মানুষের মধ্যে ভীতিসঞ্চারে বিভিন্ন স্থানে সেনা মোতায়েনও শুরু করা হয়। ‘পুলিশবাহিনীকে অধিকতর শক্তিশালী করা ছাড়াও কাছাড়ের পুলিশ সুপারিনটেণ্ডেন্ট পুলিশ আইন অনুযায়ী তাঁর পূর্ব অনুমতি ব্যতিরেকে জেলার সর্বত্র সভা, শোভাযাত্রা ইত্যাদি ১৫ মে থেকে চার মাসের জন্য নিষিদ্ধ করে হুকুম জারি করেন।
আসামের শিক্ষা অধিকর্তা কাছাড়ের যাবতীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এক সার্কুলার পাঠিয়ে ছাত্র ও শিক্ষকদের কোনো প্রকার আন্দোলনে যোগদান নিষিদ্ধ করে জানিয়ে দেওয়া হয় যে, কেউ আন্দোলনে যোগদান করলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা অবলম্বিত হবে। অপরদিকে কাছাড়ের স্কুলসমূহের ইনস্পেকটর পৃথক এক হুকুমনামা জারি করে কাছাড়ের স্কুলসমূহের গ্রীষ্মের ছুটি পূর্ব নির্ধারিত ১৯ মে তারিখের স্কুলের পর আরম্ভ না-করে ১৮ মে তারিখেই আরম্ভ করার নির্দেশ দেন এবং সঙ্গে সঙ্গে স্কুল কতৃপক্ষকে এবং তাদের মারফত অভিভাবকদের জানিয়ে দেন যে, কোনো ছাত্র বা শিক্ষক নিয়মভঙ্গকারী কোনো আন্দোলনে যোগদান করলে কঠোর শাস্তি দেওয়া হবে।
ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার সংবাদপত্রসমূহ তীব্র ভাষায় সম্পাদকীয়সমূহ লিখে অবিলম্বে সংগ্রাম পরিষদকে বেআইনি ঘোষণা করে পুলিশ ও মিলিটারি দিয়ে সর্বপ্রকার আন্দোলন প্রচেষ্টাকে অঙ্কুরে নিষ্পেষিত করার জন্য প্ররোচিত করছে: কারণ তাদের মতে আসামে বাংলা ভাষার কোনো স্থান হতে পারে না।’১৭০
আসামের পার্বত্যবাসীদের দাবির বিষয়টি আমাদের স্মরণে রাখতে হবে। কারণ একদিকে যেমন বাংলা ভাষা তথা বাঙালিদের দাবির প্রতি তাঁরা সহানুভূতিশীল, সহমর্মী— অন্যদিকে তারাও আসামে নানাভাবে, নানা বিষয়ে বঞ্চিত, পীড়িত। পার্বত্যবাসীরা রাজ্য ভাষা হিসেবে অসমিয়াকে স্বীকার করেন না। কিন্তু বাংলাভাষীরা কখনোই অসমিয়া ভাষাকে অস্বীকার করেননি বরং উন্নয়নে এগিয়ে এসেছেন, সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। তারপরও বাঙালিরাই বার বার আক্রান্ত হয়েছেন।
‘১৭ মে সকালে আসামের পার্বত্য জেলাসমূহের সাত সদস্যবিশিষ্ট এক প্রতিনিধিদল পররাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে প্রধানমন্ত্রী শ্রীনেহরুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁকে জানান যে, আসাম পার্বত্য অঞ্চলের জন্য স্কটল্যাণ্ডের ধাঁচে সীমাবদ্ধ স্বায়ত্তশাসনের যে প্রস্তাব তিনি করেছেন প্রতিনিধিদল তা গ্রহণে অসমর্থ। পার্বত্য প্রতিনিধি দলে ছিলেন— শ্রীসংমা, শ্রীটি ক্যাজি, শ্রীরায়দাং ইংতি, শ্রীপিসি লাংথসা, শ্রীসাপরানগা, শ্রীহুভার হাইনিওয়েতা, এমপি এবং শ্রী এসডিডি নিকলস রায়। এ সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রীলালবাহাদুর শাস্ত্রী উপস্থিত ছিলেন। আলোচনা দু-ঘণ্টা ধরে চলে। বৈঠকের পর প্রতিনিধি দলনেতা সাংবাদিকদের বলেন, ভাষাবিরোধ সাম্প্রতিক কালের, আর রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে তাঁদের অভিযোগ বহুকালের। তবু তাঁরা ভাষা সমস্যার সমাধান আগে চান। তিনি বলেন, ‘তাঁরা অসমিয়াকে সরকারি ভাষা করার বিরোধী। তাঁরা হিন্দি অথবা ইংরেজিকে সরকারি ভাষা হিসাবে চান। পন্থ ফর্মূলা বানচাল করার সময়ে আসাম সরকারের মনোভাব প্রকাশ হয়ে পড়েছে। তাই তাঁরা নিজেদের নিজস্ব রাজ্য দাবি করছেন। … রাজ্যের শতকরা ৫০ ভাগেরও কম লোক অসমিয়াভাষী হয়েও তারা কীভাবে বাকি অধিবাসীদের ওপর প্রভুত্ব করছেন— তার বিবরণ তাঁরা স্মারকলিপিতে উল্লেখ করেন। স্মারকলিপিতে একথাও বলা হয় যে, গত ভাষা আন্দোলন এটাই প্রমাণ করে যে, অসমিয়ারা রাজ্যের অন্য ভাষাভাষীদের ওপর প্রভুত্ব করতে দৃঢ়সংকল্প। আসাম আইনসভা ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা অনসমিয়াদের ওপর শুধু অত্যাচার নয়— তাদের অসমিয়া ভাষা ও রীতিগ্রহণে বাধ্য করতে যে দৃঢ়পরিকর তাও স্মারকলিপিতে উল্লেখ করা হয়।’১৭১
কাছাড়ে পুলিশি তৎপরতা শুরু হয়ে গেল। ১৮ মে বৃহস্পতিবার, পুলিশ রাত ১২টায় করিমগঞ্জ ‘গণসংগ্রাম পরিষদ অফিসষ-এ হানা দিয়ে পরিষদের অন্যতম সংগঠক স্বাধীনতা সংগ্রামী যুবনেতা শ্রীরথীন্দ্রনাথ সেনকে গ্রেপ্তার করে। রাত সাড়ে তিনটায় যুগশক্তি সম্পাদক, স্বাধীনতা সংগ্রামী সংগ্রাম পরিষদ কোষাধ্যক্ষ শ্রীবিধুভূষণ চৌধুরীকে গ্রেফতার করা হয়। এ দিন রাতেই বিভিন্ন সময়ে জেলা সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক শ্রীনলিনীকান্ত দাস, কমিউনিস্ট নেতা শ্রীযজ্ঞেশ্বর দাস ও ছাত্রনেতা শ্রীনিশীথরঞ্জন দাসকে গ্রেপ্তার করা হয়। বিশিষ্ট কর্মী শ্রীপ্রেমানন্দ মুখার্জি, শ্রীশান্তিময় ভট্টাচার্য ও শ্রীবিজয় সেনকেও ওই রাতেই গ্রেপ্তার করা হয়। মহকুমা সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক শ্রীনৃপতি চৌধুরী ও মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশন-এর সাধারণ সম্পাদক শ্রীমোহিত দাসের নামেও পরোয়ানা ছিল, কিন্তু পুলিশ তাঁদের নাগাল পায়নি। রথীন্দ্রনাথ সেন, শ্রীনলিনীকান্ত দাস ও শ্রীনিশীথরঞ্জন দাসকে নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করা হয় এবং তাঁদের শিলচর পাঠিয়ে দেওয়া হয়।’১৭২
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি মুখপত্র স্বাধীনতা পত্রিকা জানাল যে, ‘১৭ মে করিমগঞ্জে কমিউনিস্ট পার্টি অফিসে হানা দিয়ে সম্পাদক ও ৫ জন কমিউনিস্ট পার্টি সদস্যসহ ১২জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। সংবাদে আরও বলা হয়, গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে কমরেড রসেন্দ্র শর্মা, ব্রাঞ্চ সেক্রেটারি মুদরিছ আলি, কিষানসভা সম্পাদক, সাধন দাস, হারু দাস, মুছদ্দর আলি ও মইয়ব আলি রয়েছেন। এঁরা সবাই পার্টি সভ্য। অপর ৬ জন নাগরিক হলেন— শ্রীমুকুন্দ ভট্টাচার্য, নাসির আলি, বিজয় সেন, পুতুল দাস, রাকেশ দেব ও শ্রীশ্যামসুন্দর দেব। ডিএসপি যতীন্দ্র দেব নিজে পাঁচটি গাড়িসহ বিরাট পুলিশবাহিনী নিয়ে এই অভিযান পরিচালনা করেন। সংবাদে বলা হয়: বর্তমান ভাষা আন্দোলনে কমিউনিস্ট পার্টির নীতি ব্যাখ্যা করার প্রয়োজনে পার্টি আহূত অন্যূন পাঁচ হাজার লোকের এক জনসভা শেষ হওয়ার পরই এই ঘটনা ঘটে। কমরেড ডা. নীরোদভূষণ দে-র সভাপতিত্বে এই সভায় কমরেড অচিন্ত্য ভট্টাচার্য, যজ্ঞেশ্বর দাস ও সভাপতি সমস্ত হিংসাত্মক কার্যকলাপ ও প্ররোচনা থেকে দূরে থেকে সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন চালাতে সকলের নিকট সনির্বন্ধ আহ্বান ও সাবধানবাণী জ্ঞাপন করেন। এবং একইসঙ্গে কাছাড় জেলায় সরকার এই গণ-আন্দোলন ধ্বংস করার জন্য যে অভূতপূর্ব বিরাট সুসজ্জিত সেনাবাহিনী ও পুলিশি ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে তার তীব্র নিন্দা করেন। ঘন ঘন পুলিশ ও মিলিটারি ক্যাম্প, স্টেনগানধারী টহলদারি সেনা প্রতিদিনই বর্ধিত করা হচ্ছে এবং জেলার সর্বত্র জেলগুলি সম্প্রসারিত করা হচ্ছে।
সম্ভবত ভবিষ্যৎ দমনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের অজুহাত সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই গত রাতের গ্রেপ্তার পরিকল্পিত হয়েছে। পুলিশের এই জুলুমের বিরুদ্ধে জেলা সম্পাদক কমরেড অচিন্ত্য ভট্টাচার্য ঘটনার সঙ্গে সঙ্গেই এর প্রতিবাদ করেন।’১৭৩
সরকারি তৎপরতার আরও সংবাদ পাওয়া যায় আনন্দবাজার পত্রিকা-য়। ১৮মে পত্রিকার শিলচর প্রতিনিধি জানাল: ‘কাছাড় গণসংগ্রাম পরিষদ আহূত কাছাড়ে আসন্ন ভাষা আন্দোলন দমনের জন্য সরকার পক্ষের বিরাট ‘‘সমর প্রস্তুুতি’’ সম্পূর্ণ প্রায়। সরকারি কর্মচারীদের ওইদিন অনুপস্থিত থাকলে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা অবলম্বিত হবে বলে জানান হয়েছে। ট্রাক-বাস-ট্যাক্সি ইত্যাদি রিকুইজিশন করে পুলিশ হেফাজতে রাখা হয়েছে। পুলিশবাহিনীকে বহুগুণ বর্ধিত করার ওপর ও বিভিন্ন স্থানে সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। স্পেশাল সংরক্ষিত বাহিনী আমদানি করে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। সেনাবাহিনী বড়ো বড়ো রাস্তায় টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে। আনাচেকানাচে গুপ্তচরবাহিনী নিয়োগ করা হয়েছে— তারা দিন-রাত তৎপর আছে। আহতদের স্থান সংকুলানের জন্য হাসপাতালসমূহে শয্যাসমূহ মজুত রাখা হয়েছে। জেলসমূহ শূন্য করে ও নতুন ছাউনি ফেলে ধৃত সত্যাগ্রহীদের জন্য স্থান করা হয়েছে। সরকারের প্রস্তুতি দেখে মনে হয় যে, কাছাড় সত্বরই একটা ‘রণক্ষেত্রে’ পরিণত হচ্ছে।
পাকিস্তান সীমান্তে ক্রমাগত আক্রমণ চলাকালীন সময়ে অথবা চীনা আক্রমণের সময়েও এর আংশিক পরিলক্ষিত হয়নি। গত জুলাই মাসের ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাঙালি নিধনযজ্ঞের কথা না-ই বললাম— কারণ তখন আসাম সরকারের তা দমন করার মতো সময় ও ক্ষমতা ছিল না।
অপরদিকে কাছাড় সংগ্রাম পরিষদ যাতে জনসাধারণ ও সত্যাগ্রহীরা সম্পূর্ণ নিরুপদ্রব ও অহিংসভাবে তাঁদের উদ্দেশ্যসিদ্ধির পথে অগ্রসর হন তজ্জন্য আবেদন জানিয়ে ক্রমাগত চেষ্টা করে চলেছেন। দলে দলে সত্যাগ্রহীরা গ্রামে গ্রামে ও শহরের পাড়ায় পাড়ায় প্রচারকাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।
আগামীকালের সর্বাত্মক ধর্মঘটের সাফল্যের জন্য দলমত নির্বিশেষে সকলেই বদ্ধপরিকর। অফিস-আদালত, ট্রেন-বাস, বাজার-হাট, রিকশা প্রভৃতি সবই বন্ধ থাকবে বলে বিশ্বাস। জনসাধারণ ওই দিন ভোর থেকে বিকাল চারটা পর্যন্ত ঘরের বাইরে না যেতেই কৃতসংকল্প। স্থানীয় বার লাইব্রেরি, মোক্তার অ্যাসোসিয়েশন প্রভৃতি তাদের অফিসের দরজাই ওই দিন খুলবেন না বলে স্থির করেছেন। প্রাইভেট অফিসসমূহও আগামীকাল সম্পূর্ণ বন্ধ রাখা হবে।’১৭৪
এদিকে ১৮ মে ‘করিমগঞ্জ শহরের গৃহকর্ত্রীরা এক সভায় মিলিত হয়ে স্থির করেন যে, আগামীকাল অর্থাৎ ১৯ মে থেকে সমগ্র কাছাড়ে যে সত্যাগ্রহ আন্দোলন আরম্ভ হবে— সেই আন্দোলনে তাঁরাও যোগদান করবেন।
সংগ্রাম পরিষদ সেক্রেটারি এ দিন করিমগঞ্জে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন যে, প্রায় ১৪ হাজার সত্যাগ্রহীর নাম ইতিমধ্যেই তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।’১৭৫
গণসংগ্রাম পরিষদের মূল দাবি বাংলা ভাষাকে আসামের অন্যতম সরকারি ভাষার স্বীকৃতি এবং এ জন্য আসাম সরকার তথা কেন্দ্রকে সময় সুনির্দিষ্টও করে দিয়েছিলেন। সেই শেষ সময় আজ ১৮ মে, ১৯৬১। এই সময়কালে আসাম সরকার অনড় মনোভাবে অটল থাকলেন। উগ্র অসমিয়া জাতীয়তাবাদে দীক্ষিত মুখ্যমন্ত্রী শ্রীচালিহা ও তাঁর অনুসারীরা দ্বিগুণ উৎসাহে কাছাড়ে নরমেধ আয়োজনে, বাঙালি উৎসাদনে আবারও মেতে উঠলেন। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার? প্রধানমন্ত্রী শ্রীনেহরু? তাঁরাও তো হাতগুটিয়ে বসে থাকলেন। অথচ এই অঞ্চলের মানুষের বড়ো ভরসা ছিল প্রধানমন্ত্রী নেহরুর ওপর। আসামের ভাষা প্রশ্নে বহু ভাষাবিদ ড. সুনীতিকুমার চ্যাটার্জিও কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর ভরসা করেছিলেন সেই ১৯৪৭ সালে, নভেম্বরে, শিলচরে দাঁড়িয়ে। না, শ্রীচ্যাটার্জিকেও নিরাশ হতে হয়েছিল। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা ১৯৬১ সালের ১৯ মে প্রকাশিত ‘কাছাড় সত্যাগ্রহ’ শীর্ষক সম্পাদকীয় নিবন্ধের প্রতি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করব:
শুক্রবার হইতে কাছাড়ে সত্যাগ্রহ আন্দোলন আরম্ভ হইতেছে। আসামের বঙ্গভাষী অধিবাসীগণ নিরূপায় হইয়া শেষপর্যন্ত এই কঠিন সংগ্রামে অবতীর্ণ হইবার সংকল্প গ্রহণ করিয়াছেন। বাংলা ভাষাকে আসামের অন্যতম সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতির দাবি লইয়া কাছাড় গণসংগ্রাম পরিষদ এই সত্যাগ্রহের আয়োজন করিয়াছেন। আসাম রাজ্য সরকার এবং কেন্দ্রীয় সরকার যে এই সত্যাগ্রহ আন্দোলনকে প্রীতির চক্ষে দেখিতেছেন না তা বলাই বাহুল্য। নয়াদিল্লি এবং শিলংয়ের ক্ষমতাধরদের রোষদৃষ্টি বর্তমানে শিলচরের ওপর নিবদ্ধ। পরিণাম যাহাই হউক, কাছাড়ের বঙ্গভাষী অধিবাসীগণ অসমিয়া একাধিপত্যের প্রতিরোধের জন্য তাহাদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী হইয়াছেন, ইহাই সবচেয়ে বড় কথা।
কাছাড়ের বাঙালিরা যে সংগ্রামী সংকল্প গ্রহণ করিয়াছেন তাহাকে কোনোমতেই দায়িত্বহীন হঠকারিতা বলিয়া উড়াইয়া দেওয়া যায় না। ন্যায়বিচারের আশায় আসামের বাঙালিরা দীর্ঘকাল ধৈর্য ধরিয়াছেন। অনুনয়-বিনয় ও আবেদন-নিবেদনে ত্রুটি হয় নাই। চালিহা-মন্ত্রিসভা অসমিয়া প্রাধান্য সর্বপ্রকারে বজায় রাখিতে দৃঢ়সংকল্প:
বাঙালি এবং পার্বত্য উপজাতীয় অধিবাসীরা যাহারা অসমিয়াদের অপেক্ষা সংখ্যায় বেশি তাহাদের নাগরিক স্বার্থ দেখিতে আসাম রাজ্য সরকার বিন্দুমাত্র গরজ দেখাইতে রাজি নহেন। আসাম কংগ্রেস সংগঠনের নেতারাও বাঙালি ও পার্বত্য উপজাতিদের মতামত বিবেচনা করা পর্যন্ত দরকার মনে করেন না। ইহা বিদ্বেষপ্রসূত অথবা কাল্পনিক অভিযোগ নয়। শ্রীঅজিতপ্রসাদ জৈন তাঁহার রিপোর্টে বলিয়াছেন, আসামের কংগ্রেস দল সংখ্যালঘুদের ভালো-মন্দ সম্পর্কে উদাসীন। এই যখন অবস্থা, রাজ্যের ক্ষমতাধর ও প্রভাবশালী ব্যক্তিগণের নিকট যখন নিয়মসংগত উপায়ে সুবিচার পাইবার বিন্দুমাত্র আশা নাই, তখন বাঙালি এবং পার্বত্য অধিবাসীগণ যে নিজেদের ন্যায্য নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হইবে ইহা খুবই স্বাভাবিক। …
কাছাড়ের বঙ্গভাষী অধিবাসীগণকে বাধ্য হইয়াই শান্তিপূর্ণ সংগ্রামের পথ লইতে হইয়াছে। এখানেও মর্মান্তিক পরিহাসের অভাব নাই। যে গভর্নমেন্ট ভারতীয় নাগরিকমন্ডলীর একটি বৃহৎ অংশের প্রতি ন্যায়বিচার করিতে পারেন না, করিতে চাহেন না, সেই গভর্নমেন্টরই আবার ন্যায়সংগত গণ-আন্দোলনের বিরুদ্ধে দমনপীড়নের আয়োজন করিতে উৎসাহের সীমা দেখা যাইতেছে না। গত বৎসর বাঙালিনিধন উৎসাদনযজ্ঞ যখন পুরোদমে চলিতেছে তখন অসমে আইন-শৃঙ্খলার অভিভাবকদের নড়িতে-চড়িতে দেখা যায় নাই। আর এবার কাছাড়ে বঙ্গভাষী অধিবাসীদের সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু হইবার পূর্বেই আসামের সরকারি ওপরওয়ালা মহলে ‘সাজসাজ’ রব উঠিয়াছে। গত বৎসর বাঙালিনিধন উৎসাদন অভিযানের বিরুদ্ধে সৈন্যবাহিনী নিয়োগ করিতে অসমিয়া সরকারি কর্তারা বিস্তর গড়িমসি করিয়াছিলেন: এবার কাছাড়ের বঙ্গভাষী অধিবাসীদের সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু না হইতেই চালিহা-মন্ত্রিসভা সৈন্যদল তলব করিয়াছেন।
প্রধানমন্ত্রী নেহরুও আসাম সফরে যাইতেছেন। তাঁহার উপস্থিতিতেই আসামের একটি অঞ্চলের ভারতীয় নাগরিকগণের অগ্নিপরীক্ষা। অগ্নিপরীক্ষা কেবল কাছাড়ের বঙ্গভাষী অধিবাসীগণের নহে, ভারত রাষ্ট্রেরও প্রচন্ড দমনপীড়ন দ্বারা আসাম সরকার কাছাড়ের সত্যাগ্রহীদের কতখানি শায়েস্তা করিতে পারিবেন তাহা এমন কিছু বড়োকথা নয়, ভারতেরই একটি অঙ্গরাজ্যের লক্ষ লক্ষ নাগরিকের ভাষাগত অধিকার ও মর্যাদা অন্যায়ভাবে কাড়িয়া যে দুর্বিষহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হইতেছে— তাহা আজ হউক, কাল হউক, ভারত রাষ্ট্রের বিপর্যয় ঘটাইবে।১৭৬
সত্যদ্রষ্টা নিবন্ধকারের এই সত্যকথনকে অস্বীকার করার উপায় নেই, প্রতিবাদ জানাবারও সাধ্যি নেই, না রাজ্যের, না কেন্দ্রীয় সরকারের। নিবন্ধকারের একটি বাক্যে আমরা বিচলিত। তিনি জানিয়েছেন, ‘নয়াদিল্লি এবং শিলংয়ের ক্ষমতাধরদের রোষদৃষ্টি বর্তমানে শিলচরের উপর নিবদ্ধ। কেন? বিপ্লবী আর স্বাধীনতা সংগ্রামীদের আস্তানা তো করিমগঞ্জে, পোড়খাওয়া ঝানু রাজনীতিকের বসবাসও করিমগঞ্জে। তবে কেন শিলচরের ওপর বাড়তি রোষদৃষ্টি? উত্তর পাওয়ার জন্য ১৯ মে পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতেই হবে। আর সেদিন তো আগামীকালই, পরবর্তী অধ্যায়ে।’
তথ্যনির্দেশ
১. জনশক্তি (সাপ্তাহিক) নীরেন্দ্রনাথ দেব সম্পাদিত, শিলচর, ৩ ফ্রেব্রুয়ারি, ১৯৬০
২. জনশক্তি, শিলচর, ১৬ মার্চ, ১৯৬০
৩. প্রাগুক্ত
৪. জনশক্তি, শিলচর, ২৩ মার্চ, ১৯৬০
৫. প্রাগুক্ত
৬. জনশক্তি, শিলচর, ৩০ মার্চ, ১৯৬০
৭. প্রাগুক্ত
৮. প্রাগুক্ত
৯. জনশক্তি, শিলচর, ১৩ এপ্রিল, ১৯৬০
১০. প্রাগুক্ত
১১. জনশক্তি, শিলচর, ২০ এপ্রিল, ১৯৬০
১২. প্রাগুক্ত
১৩. প্রাগুক্ত
১৪. The Assam Tribune, Gauhati, April 20, 1960
১৫. জনশক্তি, শিলচর, ২৭ এপ্রিল, ১৯৬০
১৬. প্রাগুক্ত
১৭. The Assam Tribune, Gauhati, April 23, 1960
১৮. The Assam Tribune, Gauhati, May 1, 1960
১৯. জনশক্তি, শিলচর, ৪ মে, ১৯৬০
২০. প্রাগুক্ত
২১. জনশক্তি, শিলচর, ১১ মে, ১৯৬০
২২. জনশক্তি, শিলচর, ২৫ মে, ১৯৬০
২৩. যুগান্তর, কলকাতা, ২৩ জুন, ১৯৬০
২৪. প্রাগুক্ত
২৫. The Assam Tribune, Gauhati, June 24, 1960
২৬. যুগান্তর, কলকাতা, ২৬ জুন, ১৯৬০
২৭. প্রাগুক্ত
২৮. জনশক্তি, শিলচর, ২৯ জুন, ১৯৬০
২৯. যুগান্তর, কলকাতা, ২ জুলাই, ১৯৬০
৩০. প্রাগুক্ত
৩১. প্রাগুক্ত
৩২. যুগান্তর, কলকাতা, ২ জুলাই ১৯৬০ এবং জনশক্তি, শিলচর, ৬ জুলাই, ১৯৬০
৩৩. স্বাধীনতা (কমিউনিস্ট পার্টির দৈনিক পত্রিকা), কলকাতা, ১ জুলাই, ১৯৬০
৩৪. জনশক্তি, শিলচর, ২০ এপ্রিল, ১৯৬০
৩৫. প্রাগুক্ত
৩৬. জনশক্তি, শিলচর, ২৯ জুন, ১৯৬০
৩৭. প্রাগুক্ত
৩৮. যুগান্তর, কলকাতা, ২ জুলাই, ১৯৬০
৩৯. যুগশক্তি (সাপ্তাহিক), বিধুভূষণ চৌধুরী সম্পাদিত, করিমগঞ্জ, ১ জুলাই ১৯৬০
৪০. যুগান্তর, কলকাতা, ২ জুলাই, ১৯৬০
৪১. জনশক্তি, শিলচর, ৬ জুলাই, ১৯৬০
৪২. প্রাগুক্ত
৪৩. যুগান্তর, কলকাতা, ৩ জুলাই, ১৯৬০
৪৪. জনশক্তি, শিলচর, ৬ জুলাই, ১৯৬০
৪৫. প্রাগুক্ত
৪৬. প্রাগুক্ত
৪৭. যুগান্তর, কলকাতা, ৯ জুলাই, ১৯৬০
৪৮. জনশক্তি, শিলচর, ২০ জুলাই, ১৯৬০
৪৯. প্রাগুক্ত
৫০. যুগান্তর, কলকাতা, ২৩ আগস্ট, ১৯৬০
৫১. যুগান্তর, প্রাগুক্ত
৫২. জনশক্তি, শিলচর, ১৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৬০
৫৩. যুগান্তর, কলকাতা, ২৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৬০
৫৪. যুগান্তর, কলকাতা, ২৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৬০
৫৫. প্রাগুক্ত
৫৬. যুগান্তর, কলকাতা, ৩০ সেপ্টেম্বর, ১৯৬০
৫৭. প্রাগুক্ত
৫৮. যুগান্তর, কলকাতা, ৩ অক্টোবর, ১৯৬০
৫৯. যুগান্তর, কলকাতা, ৫ অক্টোবর, ১৯৬০
৬০. যুগান্তর, কলকাতা, ৬ অক্টোবর, ১৯৬০
৬১. যুগান্তর, কলকাতা, ৮ অক্টোবর, ১৯৬০
৬২. যুগান্তর, কলকাতা, ৯ অক্টোবর, ১৯৬০
৬৩. যুগান্তর, কলকাতা, ৬ অক্টোবর, ১৯৬০
৬৪. যুগান্তর, কলকাতা, ১১ অক্টোবর, ১৯৬০
৬৫. প্রাগুক্ত
৬৬. যুগান্তর, কলকাতা, ১২ অক্টোবর, ১৯৬০
৬৭. প্রাগুক্ত
৬৮. যুগশক্তি, করিমগঞ্জ, ১৪ অক্টোবর, ১৯৬০
৬৯. যুগান্তর, কলকাতা, ১৬ অক্টোবর, ১৯৬০
৭০. জনশক্তি, শিলচর, ২৬ অক্টোবর, ১৯৬০
৭১. যুগান্তর, কলকাতা, ১৯ অক্টোবর, ১৯৬০। আরও দ্র. জনশক্তি, ২৬ অক্টোবর ১৯৬০
৭২. যুগশক্তি, করিমগঞ্জ, ২১ অক্টোবর, ১৯৬০
৭৩. যুগান্তর, কলকাতা, ২৪ অক্টোবর, ১৯৬০
৭৪. জনশক্তি, শিলচর, ২৬ অক্টোবর, ১৯৬০
৭৫. প্রাগুক্ত
৭৬. আনন্দবাজার পত্রিক ও যুগান্তর কলকাতা, ২৫ অক্টোবর, ১৯৬০
৭৭. আসাম বিধান পরিষদে ২৪ অক্টোবর ১৯৬০ তারিখে করিমগঞ্জ থেকে নির্বাচিত কংগ্রেস এম. এল. এ. রণেন্দ্রমোহন দাস-এর দেওয়া ভাষণের অংশবিশেষ। উদ্ধৃত উনিশে মে-র ইতিহাস, দিলীপকান্তি লস্কর সম্পাদিত, করিমগঞ্জ, ২০০২, লালনমঞ্চ প্রকাশনী, পৃ. নথি ৫৩-৭১
৭৮. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ২৫ অক্টোবর, ১৯৬০
৭৯. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ২৬ অক্টোবর, ১৯৬০
৮০. যুগান্তর, কলকাতা, ২৯ অক্টোবর, ১৯৬০
৮১. যুগান্তর, কলকাতা, ২ নভেম্বর, ১৯৬০
৮২. যুগান্তর, কলকাতা, ৩ নভেম্বর, ১৯৬০
৮৩. যুগশক্তি, করিমগঞ্জ, ৪ নভেম্বর, ১৯৬০
৮৪. জনশক্তি, শিলচর, ৯ নভেম্বর, ১৯৬০
৮৫. যুগান্তর, কলকাতা, ৭ নভেম্বর, ১৯৬০
৮৬. জনশক্তি, শিলচর, ৯ নভেম্বর, ১৯৬০
৮৭. প্রাগুক্ত
৮৮. প্রাগুক্ত
৮৯. যুগশক্তি, করিমগঞ্জ, ১১ নভেম্বর, ১৯৬০
৯০. প্রাগুক্ত
৯১. প্রাগুক্ত
৯২. যুগশক্তি, করিমগঞ্জ, ১৮ নভেম্বর, ১৯৬০
৯৩. প্রাগুক্ত
৯৪. যুগান্তর, কলকাতা, ৮ নভেম্বর, ১৯৬০
৯৫. যুগান্তর, কলকাতা, ৯ নভেম্বর, ১৯৬০ ও যুগশক্তি, করিমগঞ্জ, ১১ নভেম্বর ১৯৬০
৯৬. যুগশক্তি, করিমগঞ্জ, ২৫ নভেম্বর, ১৯৬০
৯৭. যুগান্তর, কলকাতা, ১০ নভেম্বর, ১৯৬০
৯৮. জনশক্তি, শিলচর, ২৯ নভেম্বর, ১৯৬০
৯৯. যুগান্তর, কলকাতা, ১৮ ডিসেম্বর, ১৯৬০
১০০. যুগান্তর, কলকাতা, ২৬ ডিসেম্বর, ১৯৬০
১০১. জনশক্তি, শিলচর, ১৪ ডিসেম্বর, ১৯৬০
১০২. প্রাগুক্ত
১০৩. যুগশক্তি, করিমগঞ্জ, ২৩ ডিসেম্বর, ১৯৬০
১০৪. যুগান্তর, কলকাতা, ২৭ ডিসেম্বর, ১৯৬০, আরও দ্র. জনশক্তি, শিলচর, ২৮ ডিসেম্বর ১৯৬০
১০৫. জনশক্তি, শিলচর, ৪ জানুয়ারি, ১৯৬১
১০৬. জনশক্তি, শিলচর, ১৮ জানুয়ারি, ১৯৬১
১০৭. প্রাগুক্ত
১০৮. উদ্ধৃত-সুবীর কর, বরাক উপত্যকার ভাষা সংগ্রামের ইতিহাস, (শিলচর : ২০১২, সৃজন গ্রাফিক্স অ্যাণ্ড পাবলিশিং হাউস), পৃ. ৩১৩
১০৯. সুজিৎ চৌধুরী, বরাক উপত্যাকার একষট্টি সালের ভাষা আন্দোলন: স্থানীয় রাজনীতির সদর-অন্দর, বরাক উপত্যকার সমাজ ও রাজনীতি, (করিমগঞ্জ:২০০৭, যুগশক্তি প্রকাশন), পৃ. ৬১-৬২
১১০. জনশক্তি, শিলচর, ২৫ জানুয়ারি, ১৯৬১
১১১. প্রাগুক্ত
১১২. জনশক্তি, শিলচর, ১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬১
১১৩. যুগশক্তি, করিমগঞ্জ, ৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬১
১১৪. যুগশক্তি, করিমগঞ্জ, ১০ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬১
১১৫. প্রাগুক্ত
১১৬. প্রাগুক্ত
১১৭. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬১
১১৮. যুগশক্তি, করিমগঞ্জ, ১৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬১
১১৯. জনশক্তি, শিলচর, ৮ মার্চ, ১৯৬১
১২০. প্রাগুক্ত
১২১. প্রাগুক্ত
১২২. যুগশক্তি, করিমগঞ্জ, ২৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬১
১২৩. প্রাগুক্ত
১২৪. প্রাগুক্ত
১২৫. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ১৪ মার্চ, ১৯৬১
১২৬. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ২১ মার্চ, ১৯৬১
১২৭. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ৩ এপ্রিল, ১৯৬১
১২৮. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ৫ এপ্রিল, ১৯৬১
১২৯. যুগশক্তি (সাপ্তাহিক), করিমগঞ্জ, ৭ এপ্রিল, ১৯৬১
১৩০. যুগশক্তি, করিমগঞ্জ, ১৪ এপ্রিল, ১৯৬১
১৩১. দৈনিক বসুমতী, কলকাতা, ১৫ এপ্রিল, ১৯৬১
১৩২. যুগশক্তি, করিমগঞ্জ, ২১ এপ্রিল, ১৯৬১
১৩৩. প্রাগুক্ত
১৩৪. যুগশক্তি, করিমগঞ্জ, ২৮ এপ্রিল, ১৯৬১
১৩৫. প্রাগুক্ত
১৩৬. যুগশক্তি, করিমগঞ্জ, ১২ মে, ১৯৬১
১৩৭. প্রাগুক্ত
১৩৮. যুগশক্তি, করিমগঞ্জ, ৫ মে, ১৯৬১
১৩৯. পরিতোষ পালচৌধুরী, রক্তাঞ্জলি (কলকাতা: ২০০০, বিশ্ববাণী প্রকাশনী), পৃ. ৭১-৭২
১৪০. রক্তাঞ্জলি, পৃ. ৮৭-৮৮
১৪১. প্রাগুক্ত, শুভেচ্ছাবাণী অংশ দ্রষ্টব্য
১৪২. রক্তাঞ্জলি, পৃ. ৯৪
১৪৩. প্রচারপত্র, শিলচর মানিকচাঁদ প্রেস থেকে মুদ্রিত, এপ্রিল, ১৯৬১
১৪৪. রক্তাঞ্জলি, পৃ. ৯৬-৯৭
১৪৫. প্রান্তজ্যোতি দৈনিক, শিলচর, ২৯ জুন ২০১২ দ্রষ্টব্য (পরিতোষ পালচৌধুরীর একটি লেখার পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বম্ভর নাথ-এর পত্র)
১৪৬. রক্তাঞ্জলি, পৃ. ৯৯-১০০
১৪৭. প্রাগুক্ত
১৪৮. রক্তাঞ্জলি, পৃ. ১০৩-১০৪
১৪৯. যুগশক্তি, শিলচর, ১২ মে, ১৯৬১
১৫০. প্রাগুক্ত
১৫১. সুবীর কর, বরাক উপত্যকার ভাষা সংগ্রামের ইতিহাস, (শিলচর: ২০১২, দ্বিতীয় সংস্করণ, সৃজন গ্রাফিক্স অ্যাণ্ড পাবলিশিং হাউস), পৃ. ৮৪-৮৬
১৫২. দৈনিক বসুমতী, কলকাতা, ২৪ এপ্রিল, ১৯৬১
১৫৩. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ৮ মে, ১৯৬১
১৫৪. প্রাগুক্ত
১৫৫. স্বাধীনতা (ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র), কলকাতা, ১৬ মে, ১৯৬১
১৫৬. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ১১ মে, ১৯৬১
১৫৭. উদ্ধৃত, সুবীর কর, বরাক উপত্যকার ভাষা সংগ্রামের ইতিহাস, পৃ. ৯০
১৫৮. প্রাগুক্ত, পৃ. ৯০-৯১
১৫৯. প্রাগুক্ত, পৃ. ৮৯-৯০
১৬০. বিস্তৃত দ্রষ্টব্য আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ১৫ মে, ১৯৬১
১৬১. দৈনিক বসুমতী, কলকাতা, ১৮ মে, ১৯৬১
১৬২. বিজনশঙ্কর রায়, ভাষা-সংগ্রামের পূর্ব প্রস্তুতি ও আমি, আমরা বাঙালী, শিলচর শহিদ স্মরণী সংখ্যা, সুধাংশু বকসী সম্পাদিত, শিলচর, জুলাই, ১৯৬১, পৃ. ১৬৪
১৬৩. রক্তাঞ্জলি, পৃ. ১০৮-১০৯
১৬৪. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ১৮ মে, ১৯৬১
১৬৫. রক্তাঞ্জলি, পৃ. ১০৯-১১০
১৬৬. প্রাগুক্ত
১৬৭. যুগশক্তি, করিমগঞ্জ, ১৯ মে, ১৯৬১
১৬৮. উদ্ধৃত বরাক উপত্যকার ভাষা সংগ্রামের ইতিহাস, পৃ. ৯৮-৯৯
১৬৯. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ১৯ মে, ১৯৬১
১৭০. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ১৮ মে, ১৯৬১
১৭১. প্রাগুক্ত
১৭২. যুগশক্তি, করিমগঞ্জ, ১৯ মে, ১৯৬১
১৭৩. স্বাধীনতা, কলকাতা, ১৯ মে, ১৯৬১
১৭৪. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ১৯ মে, ১৯৬১
১৭৫. প্রাগুক্ত
১৭৬. প্রাগুক্ত