পরিশিষ্ট ১ – শিলচরে ’৬১-র ভাষা শহিদেরা

পরিশিষ্ট ১ – শিলচরে ’৬১-র ভাষা শহিদেরা

১. শহিদ কমলা ভট্টাচার্য

কমলা ভট্টাচার্য উপমহাদেশ তো বটেই সম্ভবত বিশ্বের প্রথম নারী যিনি মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষায় শিলচর স্টেশন এলাকায় ১৯ মে ১৯৬১-তে পিকেটিংরত অবস্থায় সরকারি বাহিনীর গুলিতে সত্যাগ্রহী প্রাণত্যাগ করেন। গুলি চোখ ভেদ করে মস্তিষ্কে প্রবেশ করে। এ বছরেই দরিদ্র পরিবারের এই মেয়ে শিলচর সরকারি বালিকা বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়েছিলেন। স্বপ্ন দেখেছিলেন বি এ পাস করবেন, চাকরি করে সংসারের ভার কিছুটা লাঘব করবেন। কিন্তু ঘাতকের বুলেট তাঁকে চিরতরে স্তব্ধ করে দেয়। যথাসময়ে পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হলে দেখা গেল কমলা পাস করেছেন।

কমলার ছোটো বোন মঙ্গলা ভট্টাচার্যকেও পুলিশের নারকীয় নির্যাতনে গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। মঙ্গলা প্রাণে বেঁচেছিলেন বটে, কিন্তু চলার মতো শক্তি তাঁর ছিল না।

অবিভক্ত ভারতের সিলেট জেলার ঢাকা দক্ষিণের আমুরা গ্রামে ১৯৪৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন কমলা। শৈশবেই পিতা রামরমণ ভট্টাচার্যকে হারান। পরিবারের অভিভাবক বলতে ছিলেন মা সুপ্রভাসিনী ভট্টাচার্য। কমলারা ছিলেন দুভাই, চার বোন। বড়দা রমেন্দ্র ভট্টাচার্য এবং ছোড়দা বকুল ভট্টাচার্য। বোনেরা ছিলেন—বেণুবালা ভট্টাচার্য, প্রতিভা ভট্টাচার্য, কমলা ভট্টাচার্য এবং মঙ্গলা ভট্টাচার্য। পিতৃহারা পরিবারে অভাব ছিল নিত্যসঙ্গী।

১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ হয়। গণভোটে আসামের সঙ্গে যুক্ত সিলেট জেলাও ভাগ হয়ে যায়। ভাগাভাগিতে সিলেটের প্রায় সবটাই পাকিস্তানভুক্ত হয়। এ সময় সিলেটে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাও দেখা দেয়। ১৯৫০ সালে পূর্ববঙ্গে দাঙ্গা ভয়াবহ রূপ নেয়। একই সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ এবং আসামেও দাঙ্গা শুরু হয়। কমলাদের বাড়িঘর, বিষয়-আশয় পাকিস্তানভুক্ত সিলেটে পড়ায় তাঁরা রাতারাতি হয়ে পড়লেন ‘পাকিস্তানি’। কিন্তু সেখানে থাকা যাচ্ছে না। মা সুপ্রভাসিনী ছেলে-মেয়েদের হাত ধরে অপর প্রতিবেশীদের সঙ্গে দেশত্যাগে বাধ্য হন। তাঁদের নতুন পরিচয় জোটে ‘উদবাস্তু’। এই উদবাস্তু পরিবার ১৯৫০ সালে শিলচর বিলপার পেদাপট্টিতে এক ভাড়াঘরে বসবাস শুরু করেন।

তারপর তো নিরন্তর বাঁচার লড়াই। কেবল বেঁচে থাকার জন্য নয়, ভাষার লড়াইয়েও নেমেছিলেন। দুই বোন-ই সত্যাগ্রহী কার্ড সংগ্রহ করে অন্য সাথি, বন্ধুদের সঙ্গে রেল রুখতে শিলচর স্টেশন এলাকায় খুব ভোরে পৌঁছে গিয়েছিলেন। ওঁরা ছিলেন নিরস্ত্র, অহিংস। কমলাকে ওরা বাঁচতে দিল না। মায়ের বড়ো আশা ছিল কমলাকে নিয়ে, কিন্তু সে-আশা আর পূরণ হয়নি। কমলা শহিদ হলেন।

পেদাপট্টি আজ শহিদ কমলা রোড— যা শহিদের স্মৃতিকেই স্মরণ করিয়ে দেবে পথ চলতি পথিককে।

২. শহিদ শচীন্দ্রচন্দ্র পাল

শচীন্দ্রকে নিয়ে পরিবারের অনেক স্বপ্ন ছিল। ম্যাট্রিক পাস করে সে কোন বিষয় নিয়ে পড়বে— বিজ্ঞান, আর্টস না কর্মাস— এই নিয়ে পরিবারে জোর আলোচনা হত। এমনকী ঠাকুরমা পর্যন্ত তর্কে জড়িয়ে পড়তেন। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হওয়া নিয়েও কথা চলত পরিবারে। কিন্তু তাঁদের সতু আকস্মিকভাবেই সবাইকে অবাক করে দিয়ে অনন্তলোকে পাড়ি দিলেন। স্বচ্ছল পরিবার। পিতা গোপেশচন্দ্র পাল দেওয়ানজি বাজারের বড়ো ব্যবসায়ী। মাতা সুবর্ণপ্রভা গৃহিণী। পিতামহ গোপালচন্দ্র পাল।

শচীন্দ্র পালের জন্ম ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ১৯ আশ্বিন। ভাই-বোনের মধ্যে দ্বিতীয়। দাদা গঙ্গেশচন্দ্র পাল এ সময় গুরুচরণ কলেজের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। অপর ভাইয়েরা ছিলেন— অরবিন্দ পাল, গীতেশচন্দ্র পাল এবং গৌতমচন্দ্র পাল। একমাত্র বোন সুলেখা পাল।

শচীন্দ্রদের আদিবাড়ি ছিল শ্রীহট্ট জেলার হবিগঞ্জ মহকুমায়। আর দশজনের মতো তাঁদেরকেও ভিটেমাটি ত্যাগ করে শিলচরে চলে আসতে হয়। শিলচরের নাজিরপট্টি মডেল প্রাইমারি স্কুল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা এবং কাছাড় হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেন ১৯৬১ সালে, সতেরো বছর বয়সে। দাদার মতো তিনিও ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিলেন। ১৭ মে পরীক্ষা শেষে শিলচর গণসংগ্রাম পরিষদ অফিস থেকে সত্যাগ্রহী কার্ডও সংগ্রহ করেন ১৯ মে অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেবেন বলে।

১৯ মে ভোররাতে জানিগঞ্জ-গোপালগঞ্জ এলাকার প্রায় আড়াইশো মতো সত্যাগ্রহী শচীন্দ্রদের বাড়িতে জমায়েত হন। সংগ্রাম পরিষদ থেকে বলা হয়েছিল, ভোর পাঁচটার পূর্বেই তারাপুর স্টেশন এলাকায় রেল অবরোধের জন্য পৌঁছে যেতে হবে। সত্যাগ্রহীরা তৈরি। শচীন্দ্রর ঠাকুরমা, জ্যাঠাইমা, মাসি, দিদি— সবাই সত্যাগ্রহীদের কপালে চন্দনের ফোঁটা দিয়ে আশীর্বাদ করলেন যেন বাংলা ভাষার জয় হয়। সত্যাগ্রহীরাও তাঁদের প্রণাম করলেন।

ভাষা-সৈনিকরা ভোর পাঁচটার মধ্যে রেললাইন ধরে পদব্রজে অতিদ্রুত সবাই নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে যান। তাঁরা ছিলেন নিরস্ত্র, নিরুপদ্রব। সরকারি বাহিনী ট্রেন চালাতে না পেরে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। এক পর্যায়ে সত্যাগ্রহীদের ওপর বেপরোয়া লাঠি চালায়। কিন্তু না, নড়েননি কেউ। কিছুক্ষণ পর আবারও লাঠি চার্জ, টিয়ার গ্যাস সেল জনতাকে লক্ষ করে ছোড়া হয়। এই হামলার হাত থেকে নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ কেউ-ই বাদ গেলেন না। তারপরও তারা স্টেশন থেকে ট্রেন নড়াতে পারেনি। কিন্তু বিকেল আড়াইটার দিকে হঠাৎ করেই নিরস্ত্র জনতাকে লক্ষ করে গুলিচালানো হল। আর তাতেই গুলিবিদ্ধ হলেন শচীন্দ্র পালসহ অসংখ্য মানুষ। সাধারণ মানুষই শচীন্দ্রকে তুলে নিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্র এবং সেখান থেকে তাঁদের বাড়ি দেওয়ানজি বাজারে নিয়ে যায়। পরে শিলচর সিভিল হাসপাতালে নেওয়া হয়। ততক্ষণে শচীন্দ্রর জীবনদীপ নিভে গেছে। পাড়ি দিয়েছেন অনন্তলোকে। তিনি শহিদ হলেন। দেওয়ানজি বাজার সড়কটির নতুন নামকরণ করা হল শহিদ শচীন্দ্রচন্দ্র পাল অ্যাভিনিউ নামে। শিলচর পৌর সভাপতি মহীতোষ পুরকায়স্থের যত্ন ও প্রয়াসে একে একে গড়ে ওঠে শহিদ সড়ক।

(তথ্য উৎস— আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৫ মে ১৯৬১ এবং বার্ষিক রক্তিম দিগন্ত, মিতা দাশপুরকায়স্থ সম্পাদিত, শিলচর, ১৯ মে ২০১৩)

৩. শহিদ বীরেন্দ্র সূত্রধর

বীরেন্দ্র সূত্রধর শ্রীহট্ট জেলার হবিগঞ্জ মহকুমার বহরমপুরে ১৯৩৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন। এ সময় শ্রীহট্ট বা সিলেট আসাম প্রদেশের অন্তর্গত একটি জেলা। পিতার নাম নীলমণি সূত্রধর। টানাটানির সংসার। বীরেন্দ্র শৈশবেই প্রথমে মা এবং পরে পিতৃদেবকে হারান। পিতৃ-মাতৃহীন এই শিশুকে ঠাকুরমা পরমযত্নে কোলে তুলে নেন। ঠাকুরমা বীরেন্দ্রকে স্কুলে ভরতি করে দেন। সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত ভালোভাবেই পড়াশুনো চালিয়ে যান। কিন্তু বীরেন্দ্র বুঝতে পারলেন ঠাকুরমার পক্ষে তাঁর পড়াশুনো অব্যাহত রাখা সম্ভব নয়।

আসে দেশভাগের ঝড়, সিলেটও ভাগ হল। সাম্প্রদায়িক সংঘাত দেখা দিল। চেনা মানুষও অচেনা হয়ে গেল। কিশোর বীরেন্দ্র ভালোই বুঝতে পারলেন এখানে আর থাকা সম্ভব নয়, পালাতে হবে। ঠাকুরমাকে বুঝিয়ে তাঁকে নিয়ে দেশ ছাড়লেন, চলে আসেন শিলচরে। শুরু হয় নতুন জীবন।

বংশপরম্পরায় বীরেন্দ্ররা কাঠের কাজে ছিলেন সিদ্ধহস্ত। শিলচরে এসে সেই কাঠের কাজকেই আঁকড়ে ধরলেন তিনি। এক ঠিকাদারের অধীনে কাজও পেয়ে গেলেন। ঘরের আসবাব এবং গৃহ-নির্মাণ দুটোতেই তিনি পারদর্শী ছিলেন। ঠাকুরমাকে নিয়ে বীরেন্দ্র-র বেশ ভালোই দিন কাটছিল। কিন্তু ঠাকুরমা জেদ ধরলেন বিয়ে করতে হবে, কারণ তিনি কবে আছেন; কবে নেই। শেষপর্যন্ত বীরেন্দ্র রাজি হলেন। ১৯৫৯ সালে বীরেন্দ্র বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন ধনকুমারী দেবীর সঙ্গে। স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা হলে তাঁকে ধর্মনগরে দাদার কাছে রেখে আসেন। সেখানেই জন্ম হয় বীরেন্দ্র সূত্রধরের একমাত্র কন্যা রানির। বীরেন্দ্র স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে শিলচরে ফিরে আসেন।

সংসার বড়ো হচ্ছে, ব্যয়ও বাড়ছে। সুতরাং, আয় বাড়াতে হবে। সুঠাম দেহের অধিকারী বীরেন্দ্র পরিশ্রম করতে পারতেন, একগুঁয়েও বটে। স্ত্রী-কন্যার ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে অর্থ রোজগারে চলে যান মিজোরামের আইজলে। স্ত্রী-কন্যাকে রেখে আসলেন হাইলাকান্দির মণিপুরে, কাকার কাছে। বীরেন্দ্র আইজলে এক কনট্রাক্টরের অধীনে কাজ জুটিয়ে নিলেন। আইজল তখন কাঁচা পয়সার দেশ হিসেবে খ্যাত। তাঁর রোজগার কয়েকগুণ বেড়ে গেল। কাঠমিস্ত্রি হিসেবে তখন তাঁর বেশ নামডাক।

হঠাৎ মেয়ের অসুখের সংবাদ পেয়ে কনট্রাক্টরের বার বার অনুরোধ-নিষেধ উপেক্ষা করে হাইলাকান্দিতে কাকার বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিয়ে শিলচর পৌঁছোন বীরেন্দ্র। শিলচর তখন ভাষা আন্দোলনে তোলপাড়। সকাল-সন্ধ্যে মিটিং, মিছিল, স্লোগানে সরগরম। ১৯ মে বাংলা ভাষার দাবিতে অসহযোগ, সব বন্ধ থাকবে, রেলের চাকাও ঘুরবে না। গণসংগ্রাম পরিষদে নাম লেখালেন বীরেন্দ্র। ভিটেমাটি স্বদেশ ছেড়ে আসতে বাধ্য হয়েছেন, এখানে মুখের ভাষাটাও কি হারাতে হবে? রাগে, ক্ষোভে সিংহপুরুষ বীরেন্দ্র আপন মনেই হয়তো বলে উঠেছিলেন ‘জান দেব, জবান দেব না।’

১৯ মে ভোররাতে শিলচর রেলস্টেশনের পথে পা বাড়ালেন তিনি আরও অনেক সত্যাগ্রহীদের সঙ্গে। সরকারি পুলিশ, আধাসেনা তো ছিলই, নিরস্ত্র সত্যাগ্রহী রুখতে সেনাবাহিনী পর্যন্ত নামানো হয়। ট্রেন চালাতে ব্যর্থ সরকারপক্ষ দু-দফায় লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস ছুড়ে সাধারণ মানুষদের আধমরা করেও ক্ষান্ত দেয়নি। দুপুর আড়াইটার দিকে যখন পরিস্থিতি শান্ত তখনই বেপরোয়া গুলি চালানো হয় জনতাকে লক্ষ করে। বীরেন্দ্র গুলিবিদ্ধ হন। তাঁকে ধরাধরি করে সাধারণ মানুষই শিলচর সিভিল হাসপাতালে নিয়ে যায়। ২০ মে ভোরে সামান্য সময়ের জন্য তাঁর জ্ঞান ফিরলে তিনি স্ত্রী-কন্যাকে দেখতে চাইলেন। হাসপাতাল কতৃপক্ষ স্ত্রী-কন্যাকে আনতে ছুটলেন হাইলাকান্দি। স্ত্রী-কন্যাকে হাসপাতালে আনা হয় বটে, কিন্তু ততক্ষণে বীরেন্দ্রর প্রাণ-পাখি অনন্তযাত্রায় পাড়ি দিয়েছেন। স্ত্রী-কন্যার সঙ্গে শেষ দেখাটা তাঁর আর হল না। বীরেন্দ্র সূত্রধর শহিদ হলেন।

শিলচরের মালুগ্রাম কালিবাড়ি থেকে শিববাড়ি পর্যন্ত সড়কটির নামকরণ করা হল ‘শহিদ বীরেন্দ্র’ সূত্রধর রোড— যা আজও শহিদের স্মৃতিকেই স্মরণ করিয়ে দেয়।

৪. শহিদ তরণীমোহন দেবনাথ

তরণীমোহন দেবনাথ বর্তমান বাংলাদেশ ভূখন্ডে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর থানায় জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪০ সালে। এ সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়া ছিল কুমিল্লা জেলার একটি মহকুমা। ব্রাহ্মণবাড়িয়া শিক্ষা-সংস্কৃতি ক্ষেত্রে উজ্জ্বলতম স্থান হিসেবে খ্যাতি ছিল। বিশ্বখ্যাত ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁসহ অসংখ্য গুণী শিল্পীর জন্ম এই মাটিতেই।

তরণীমোহন দেবনাথ-এর পিতা ছিলেন যোগেন্দ্রচন্দ্র দেবনাথ, মাতা জগতীবালা। ব্যবসায়ী পরিবার। বংশানুক্রমে সুতোর ব্যাবসা ছিল। তরণীর দাদার নাম রমণীমোহন দেবনাথ। বাবা-মা দুই ছেলেকে নিয়ে সুখেই ছিলেন। কিন্তু সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা তাঁদের দেশত্যাগে বাধ্য করে। দেশভাগের পরপরই এই পরিবার শিলচর চলে আসেন এবং রাঙ্গিরখাড়িতে ঘর বাঁধলেন।

পিতা-মাতার কনিষ্ঠ সন্তান তরণীমোহন অম্বিকাপট্টির দুর্গাশংকর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশুনো শুরু করেন। প্রাথমিক শিক্ষা শেষে তিনি ভরতি হন শিলচর পাবলিক হাই স্কুলে। দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় পিতা গুরুতর অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। ফলে, দাদা রমণীমোহন দেবনাথকে পিতার ব্যাবসা এবং সংসারের হাল ধরতে হয়। এই অবস্থায় তরণীমোহন দেবনাথকেও পড়াশুনো ছেড়ে দিয়ে পৈতৃক ব্যবসায়ে নেমে পড়তে হয়। তিনি বয়নশিল্পীদের একত্রিত করার চেষ্টা করেন এবং তাঁদের দাবিদাওয়া, অভাব-অভিযোগ যথাযথ স্থানে তুলে ধরতে গড়ে তোলেন ‘বয়ন সমিতি’। তরণী দেবনাথের সাংগঠনিক শক্তির গুণে এই সংগঠন অচিরেই শক্তপোক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে যায়। সমিতির তিনি সম্পাদক ছিলেন আমৃত্যু। ‘ক্ষুদিরাম ক্লাব’ নামক একটি সংগঠনেরও তিনি সম্পাদক ছিলেন। সংগঠক হিসেবে তাঁর দক্ষতা এবং কর্মতৎপরতার কারণেই ১৯৬১ সালে ভাষা আন্দোলনের একজন উল্লেখযোগ্য সংগঠক হিসেবে তিনি পরিচিতি লাভ করেন।

১৯ মে ১৯৬১। তরণীমোহন পিসতুতো ভাই ক্ষেত্রমোহন ও অন্যান্য সত্যাগ্রহীদের নিয়ে ভোর চারটেয় শিলচর রেলস্টেশনের উদ্দেশে রওনা দেন। রেল রুখতে হবে। সবাই স্টেশন এলাকায় যার যার মতো রেললাইনে বসে পড়লেন। ট্রেন চালানো সম্ভব হয়নি। ক্ষিপ্ত পুলিশ ও অন্যান্য ফোর্স লাঠিচার্জ করে সকালের দিকেই। কাঁদানে গ্যাসও ছোড়া হয়। কিন্তু সত্যাগ্রহী তরণীসহ কেউ-ই জায়গা ছাড়েননি অসহ্য যন্ত্রণা সত্ত্বেও। কারণ লাঠিপেটা আর গ্যাসের জ্বালায় অধিকাংশ মানুষই আহত হয়েছেন। কিন্তু তারপরও তরণীমোহন ধ্বনি দিয়ে চলেছেন—মাতৃভাষা জিন্দাবাদ, বন্দে মাতরম। উত্তেজিত তরণী একপর্যায়ে দাঁড়িয়ে পড়েন এবং স্লোগান দেওয়া অব্যাহত রাখেন। তখন দুটো বেজে গেছে। হঠাৎ করেই গুলি। কিন্তু তখন পরিস্থিতি ছিল শান্ত। আর এসময় ঘাতকের বুলেট এসে তরণীর মাথায় বিদ্ধ হয়। তিনি লুটিয়ে পড়েন এবং ঘটনাস্থলেই তাঁর মৃত্যু ঘটে। বাংলা ভাষার মান রাখতে তিনি শহিদ হলেন।

সরকারিভাবে রাঙ্গিরখাড়ি সড়ক আজ শহিদ তরণীমোহন দেবনাথ রোড। ভাষা সৈনিকরা তো চির অমর।

৫. শহিদ চন্ডীচরণ সূত্রধর

চন্ডীচরণ সূত্রধর সিলেট জেলার হবিগঞ্জ মহকুমার উচাইল অন্তর্গত জাফরপুরে ১৩৩৩ বঙ্গাব্দের জ্যৈষ্ঠ মাসে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম নিয়ে মতান্তর রয়েছে। দিলীপকান্তি লস্কর তাঁর গ্রন্থে চিন্তাহরণ সূত্রধর বলে উল্লেখ করেছেন।

বার্ষিক রক্তিম দিগন্ত পত্রিকাতেও পিতার নাম চিন্তাহরণ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু কানু আইচ তাঁর বরাকের পঞ্চদশ ভাষা শহিদ গ্রন্থে শহিদের পিতার নাম চন্দ্রকান্ত সূত্রধর বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু কেউ-ই তথ্য সূত্র উল্লেখ করেননি।

শহিদ চন্ডীচরণরা কয় ভাই-বোন ছিলেন—তা নিয়েও রয়েছে বিভ্রান্তি। দিলীপকান্তি লস্কর চন্ডীচরণ সূত্রধর-এর একমাত্র বোনের কথা উল্লেখ করেছেন। বার্ষিক রক্তিম দিগন্ত-তে বলা হয়েছে দু-ভাইয়ের কথা। কানু আইচ জানিয়েছেন, চন্ডীচরণের কেবল এক বোন ছিল এবং তিনি তাঁর বিয়ে দেন সিলেট জেলাতেই (বরাকের পঞ্চদশ ভাষা শহিদ, পৃ. ১৮)। ইমাদ উদ্দিন বুলবুল তাঁর অপ্রকাশিত পান্ডুলিপিতে চন্ডীচরণেরা দুভাই এবং এক বোন বলে উল্লেখ করেছেন। ভাই-বোন নিয়ে বিভ্রান্তি আজও বর্তমান।

আমাদের কাছে যে তথ্য রয়েছে তা থেকে পিতার নাম চিন্তাহরণ সূত্রধর বলেই মনে হয়। চন্ডীচরণ সূত্রধর লেখাপড়া করেছিলেন এম ই পর্যন্ত। তিনি দেশত্যাগে বাধ্য হন। ১৯৫০ সালে চলে আসেন শিলচরে। শিলচরের রাঙ্গিরখাড়িতে চন্দ্রমোহন সূত্রধরের বাড়িতে আশ্রয় নেন। শৈশবেই তিনি পিতৃ-মাতৃহীন হয়েছেন, একা বাঁধনহীন জীবন। পৈতৃক পেশা কাঠের কাজেই তিনি মনোনিবেশ করেন। অচিরেই মিস্ত্রি হিসেবে নিজেকে গ্রহণযোগ্য করে তোলেন।

১৯৬১ সালের মে মাস, কাছাড়ে বাংলা ভাষা আন্দোলন তখন তুঙ্গে। রাঙ্গিরখাড়িতে চন্ডীচরণের আস্তানায় একদিন তরণীমোহন দেবনাথ ও তাঁর সঙ্গীদের কয়েকজন চলে আসেন ভাষা আন্দোলন নিয়ে কথা বলার জন্য। চন্ডীচরণ সব শুনে ১৯ মে সত্যাগ্রহ আন্দোলনে যোগ দিতে প্রস্তুত বলে জানিয়ে দিলেন। তিনি নাকি বলেছিলেন, ‘আমার তো কেউ নেই, কিছুই নেই, সর্বস্বহারা, বাংলা ভাষার জন্য না হয় আমার জীবনটাও দিয়ে দেব।’

১৯ মে শেষ রাতের দিকে কয়েকজন সহযাত্রীসহ শিলচর রেলস্টেশনের দিকে রওনা দিলেন চন্ডীচরণ। নির্বিঘ্নে স্টেশন এলাকায় পৌঁছে রেললাইন বরাবর অবস্থান নেন। ভোর ছ-টা থেকেই রেললাইন ও তার আশপাশ এলাকা থেকে সত্যাগ্রহীদের হটাতে দফায় দফায় লাঠিচার্জ এবং কাঁদুনে গ্যাস ছোড়া হয়। কিন্তু কেউ-ই নিজের অবস্থান থেকে নড়েননি। ট্রেনের চাকা ঘোরেনি, ট্রেনও চলেনি, চলতে পারেনি হাজার হাজার জনতার অবরোধের কারণেই। কিন্তু বিনামেঘে বজ্রপাতের মতোই হঠাৎ গুলি চালানো হল সরাসরি জনতাকে লক্ষ করে। মানুষের মধ্যে হুড়োহুড়ি, ছুটোছুটি পড়ে যায়। আর এসময়ই চন্ডীচরণ গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে পড়ে যান। শিলচর সিভিল হাসপাতালে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় বটে, কিন্তু ততক্ষণে প্রাণ-পাখিটি খাঁচা ছেড়ে পালিয়েছে।

তাঁর স্মৃতিকে জাগরুক রাখতে রাঙ্গিরখাড়ির একটি সড়কের নামকরণ করা হয় ‘শহিদ চন্ডীচরণ সূত্রধর রোড’। তিনি আজ নেই, কিন্তু তাঁর উত্তরসূরিরা আছেন।

৬. শহিদ হীতেশ বিশ্বাস

হীতেশ বিশ্বাসদের আদিনিবাস পূর্ববঙ্গে। সিলেট জেলার হবিগঞ্জ মহকুমার ব্রাহ্মণডোরা গ্রামে ১৩৪৩ বঙ্গাব্দে তাঁর জন্ম। পিতা হরিশচন্দ্র বিশ্বাস পোস্ট অফিসে স্বল্প বেতনের চাকরি করতেন। মায়ের নাম কিরণবালা। হীতেশরা চার ভাই-বোন ছিলেন। দুই ভাই, দুই বোন। বোন সবার বড়ো, বাসন্তীবালা, দ্বিতীয়জন হীতেশ। তৃতীয় অজিত এবং চতুর্থ কন্যা শংকরী।

মাত্র বারো বছর বয়সে হীতেশ পিতৃহারা হন। ১৯৪৭-এ সিলেট গণভোটকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। পরিস্থিতি বেশ নাজুক অবস্থায় চলে যায়। ফলে, দলে দলে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ মাতৃভূমি ত্যাগ করে ভারত অভিমুখে রওনা দেন। হীতেশ বিধবা মা, ভাই-বোনদের সঙ্গে নিয়ে ত্রিপুরা চলে আসেন। ঠাঁই পেলেন খোয়াইয়ের একটি শরণার্থী ক্যাম্পে। সরকারি অর্থ সহায়তায় হীতেশ নিজেদের জন্য একটি ছোট্ট মাথা গোঁজার ঠাঁই গড়ে তোলেন। তারপর চলে চাকরির খোঁজ। কিন্তু কোনো কাজ তিনি পেলেন না। কোনো পথ না পেয়ে পিতার স্বল্প সঞ্চয় সম্বল করে একটি দোকান খোলেন; ভাইকে ভরতিও করে দিলেন স্কুলে। কিন্তু দোকান জমল না। পুঁজি ক্রমশ পেটপুজোতেই ব্যয় হয়ে যায়।

ইতিমধ্যে দিদি বাসন্তীর বিয়ে দিয়েছেন শিলচরের অম্বিকাপট্টিতে। ভাগ্যান্বেষণে হীতেশ ছুটলেন জামাইবাবু গজেন্দ্রচন্দ্র করের মতান্তরে রমেশ করের বাড়িতে। আর ছোটোভাই অজিত চলে যান আসামের যোরহাটে। সেখানে তিনি ছোটো একটি দোকান খোলেন। হীতেশের জামাইবাবুর প্রচেষ্টায় জানিগঞ্জের শ্রীদুর্গা স্টোর্স নামের একটি কাপড়ের দোকানে কাজ পান তিনি। দু-ভাই মাসে মাসে মা-কে টাকা পাঠাতে শুরু করেন। সংসারে খানিকটা স্বস্তি ফিরে আসে। দিদি-জামাইবাবু হীতেশের বিয়ের তোড়জোড় শুরু করলেন। কিন্তু বিধি বাম।

১৯৬১ সাল থেকে ভাষা আন্দোলন ক্রমশ জোরদার হয়। হীতেশও আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। ১৯ মে ছিল অসহযোগ আন্দোলনের প্রথম দিন। শিলচর গণসংগ্রাম পরিষদ থেকে দু-টি সত্যাগ্রহী কার্ডও সংগ্রহ করেন তিনি। কারণ তাঁর দিদিও সঙ্গী হবেন। এ দিন ভোর না হতেই আরও অনেকের সঙ্গে ভাই-বোন রওনা দিলেন শিলচর স্টেশন এলাকায় রেল অবরোধে। লাঠিচার্জ, টিয়ারগ্যাস তো ছিলই, কিন্তু দুপুরের পরপরই হঠাৎ করে গুলিচালানো হল জনতাকে উদ্দেশ করে। হীতেশ গুলিবিদ্ধ হলেন, গুলি লাগে পায়ে। তিনি চিৎকার করে দিদিকে গুলি লাগার কথা জানান এবং তাঁকে পালাতে বলেন। আবারও গুলি। আর এই গুলিই তাঁর দেহকে ঝাঁঝরা করে দেয়। হীতেশ ভাষার জন্য প্রাণ দিলেন।

হীতেশ স্মরণে টিকরবস্তী সড়কের নামকরণ করা হয় ‘শহিদ হীতেশ বিশ্বাস রোড’। হীতেশ থাকলেন মানুষের হৃদয়ে।

৭. শহিদ কুমুদরঞ্জন দাস

অতিসাধারণ ঘরের সন্তান কুমুদরঞ্জন দাস। কিন্তু কাজ করলেন অসাধারণ, দৃষ্টান্তমূলক। ১৯৪০ সালে সিলেটের মৌলভিবাজার মহকুমার জুরি গ্রামে তাঁর জন্ম। সিলেট এ সময় আসাম প্রদেশের একটি জেলা। পিতা কুঞ্জমোহন দাস। কুমুদ শৈশবেই মাতৃহারা হন। ফলে, মায়ের স্নেহ-আদর তিনি পাননি। পিতা কুঞ্জমোহন দ্বিতীয় দার পরিগ্রহ করেন। দ্বিতীয় স্ত্রীর গর্ভে সন্তান লাভের পর থেকে কুমুদের ভাগ্যে কেবলই অবহেলা, বঞ্চনা, লাঞ্ছনা। তাঁকে স্কুলে ভরতি করে দেওয়া হয় বটে, কিন্তু বেশি পথ পেরোতে পারেননি। পঞ্চম শ্রেণি পাস করে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ওঠার পর তাঁকে পড়াশুনোয় ইতি টানতে হয়। টানাটানির সংসার, পিতা কুঞ্জমোহন তাঁর মুদি-দোকানে ছেলেকে কাজে লাগিয়ে দেন।

সাতচল্লিশে ভারত ভাগ হওয়ার পর গণভোটে সিলেটও ভাগ হয় এবং প্রায় পুরোটাই পাকিস্তানভুক্ত হয়ে যায়। সাম্প্রদায়িক সংঘাত পরিবেশকে অশান্ত করে তোলে। কুমুদদের দেশত্যাগ অনিবার্য হয়ে পড়ে। কুমুদের মামা নলিনীমোহন দাস জন্মভূমি ত্যাগ করে শিলচরে চলে আসেন। সঙ্গে আসেন কুমুদরঞ্জন। শিলচরে মামা-মামির আদরযত্নে দিনগুলো ভালোই কাটছিল।

কিন্তু কুমুদরঞ্জন একটা কিছু করতে চাচ্ছিলেন। মামার প্রচেষ্টায় তিনি আগরতলা রওনা দিলেন প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ড্রাইভিং শিক্ষার উদ্দেশ্যে। অনেকদূর অগ্রসরও হয়েছিলেন। কিন্তু হঠাৎ মামার অসুস্থতার খবর পেয়ে দ্বিতীয়বার কিছু না ভেবে শিলচর চলে যান এবং সব ভার নিজের কাঁধে তুলে নেন।

এ সময় শিলচর বাংলা ভাষা আন্দোলন নিয়ে সরগরম ছিল। কুমুদও এ আন্দোলনে যোগ দিলেন। সত্যাগ্রহী কার্ডও সংগ্রহ করেন। ১৯ মে রেল অবরোধে শিলচর স্টেশন এলাকায় অবস্থান নেওয়ার কথা সংগ্রাম পরিষদ অফিস থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়। এ দিন ভোররাতে অপর সত্যাগ্রহীদের সঙ্গে রেল অবরোধে রওনা দিলেন কুমুদ। নিরাপদে স্টেশন এলাকায় পৌঁছে সকলের সঙ্গে পিকেটিং শুরু করেন ঘন ঘন স্লোগানে — ‘বাংলা ভাষা জিন্দাবাদ’। ট্রেন চলেনি। সরকারি বাহিনী দফায় দফায় লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে। এত অত্যাচারেও জনতা হার মানেনি। শেষপর্যন্ত সরকারি বাহিনী মানুষ হত্যায় মেতে ওঠে। হঠাৎ করেই গুলি চালানো হল। কোনো সতর্কতা নয়, সরাসরি মানুষ লক্ষ করেই গুলি। গুলিতে লুটিয়ে পড়লেন কুমুদরঞ্জন। সব শেষ, ভাষার জন্য প্রাণ দিলেন খেটে-খাওয়া এই মানুষটি, শহিদ হলেন তিনি।

শিলচরের ম্যাগাজিন রোড আজ শহিদ কুমুদরঞ্জন দাস রোড—যা শহিদের স্মৃতিকেই স্মরণ করিয়ে দেবে বারংবার।

৮. শহিদ সত্যেন্দ্র দেব

সিলেটের হবিগঞ্জ মহকুমার দেওন্দি গ্রামে ১৯৩৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন ভাষা শহিদ সত্যেন্দ্র দেব। পিতার নাম শশীমোহন দেব এবং মাতার নাম সুরবালা দেব। সাতচল্লিশে ভারত ভাগের পর আর পাঁচটা পরিবারের মতো শশীমোহনকেও জন্মভূমি ছাড়তে হয়। তাঁদের নতুন পরিচয় জোটে উদবাস্তু। শশীমোহন হবিগঞ্জ থেকে স্ত্রী সুরবালা, পুত্র সত্যেন্দ্র দেব ও তিন মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে ত্রিপুরার উদ্দেশে রওনা দিলেন নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য। সত্যেন্দ্র দেবরা ত্রিপুরার কৈলাশহরে ফটিক রায় রাজনগর কলোনিতে আশ্রয় লাভ করেন। নতুন আশ্রয়, নতুন ঠিকানায় পিতা শশীমোহন পরলোকে গমন করলে সত্যেন্দ্র মা-বোনদের নিয়ে অথৈ সমুদ্রে পড়লেন। তাঁর লেখাপড়া নিম্ন প্রাইমারি, বয়সও খুব বেশি না, কী করবেন তিনি?

শেষপর্যন্ত রাজমিস্ত্রির কাজে লেগে পড়লেন। সতেন্দ্র পাকা রাজমিস্ত্রিতে পরিণত হন। একসময় কনট্রাক্টরের অধীনে কাজ নিয়ে মা, বোনদের ত্রিপুরা রেখে শিলচর চলে যান। ফাটকবাজারে থাকার জায়গা করে নিলেন। এ সময় শিলচরে বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাজ্যভাষা করার জন্য জোরদার আন্দোলন চলছিল। তিনি মা-বোনের কথা ভুলে ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন। বাংলা ভাষার দাবির লড়াইয়ে তাঁদের জিততে হবে—এ ছিল তাঁর মনের কথা। ১৯ মে সত্যেন্দ্র অন্যান্য স্থানের সত্যাগ্রহীদের সঙ্গে রেল রুখতে ফাটকবাজার থেকে তারাপুর রেলস্টেশনের উদ্দেশে রওনা দেন ভোররাতে। নির্বিঘ্নে যথাস্থানে পৌঁছে নিজের অবস্থানে বসে পড়েন। সকাল গড়িয়ে দুপুর। ইতিমধ্যে পুলিশি হামলা কয়েকদফা হয়ে গেছে। উপস্থিত সত্যাগ্রহীরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন ট্রেন চলতে দেবেন না, চলেওনি। সত্যেন্দ্র এ সময় দেখলেন, স্টেশন থেকে বেশ খানিকটা দূরে একটি মোটরগাড়িতে আগুন জ্বলছে এবং মানুষজন আগুন নেভাতে ছুটোছুটি করছে— কেউ জল, কেউ নিকটবর্তী পুকুর থেকে কচুরিপানা এনে আগুন নেভাতে চেষ্টা করছে। সত্যেন্দ্র ছুটলেন আগুন লক্ষ করে, তিনিও আগুন নেভানো কাজে অংশ নিতে চান। কিন্তু হঠাৎ বেপরোয়া গুলি শুরু হয়। সত্যেন্দ্র রেলওয়ে পুকুর থেকে কচুরিপানা নিয়ে যেতে মনস্থ করেছিলেন। কিন্তু সে-সুযোগ তাঁর হয়নি। ব্যাপক গুলি তাঁদের দিকটাতেই। গুলি থেকে বাঁচতে সত্যেন্দ্র পুকুরে নেমে পড়েন হয়তো ভেবেছিলেন গুলিবৃষ্টি থেমে গেলে তিনি স্বস্থানে ফিরে যাবেন। কিন্তু তা হয়নি। পুকুরেই গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণত্যাগ করেন। এ ঘটনা কারো নজরে আসেনি। পরদিন অর্থাৎ ২০ মে তাঁর মৃতদেহ ভেসে ওঠায় মানুষ তাঁকে পুকুর থেকে উদ্ধার করেন। এদিকে বীরেন্দ্র সূত্রধর শিলচর সিভিল হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে এ দিন অনন্তলোকে যাত্রা করেন। এই দুই শহিদের দেহ নিয়ে ২১ মে বিশাল শোক মিছিল বের করা হয়। হাজার হাজার মানুষ এই শোকযাত্রায় অংশ নেন।

শিলচর পৌরসভার পক্ষ থেকে সত্যেন্দ্র দেব-এর স্মৃতি স্মরণে পানপট্টির রাস্তাটির নামকরণ করা হয় ‘শহিদ সত্যেন্দ্র দেব রোড’।

৯. শহিদ সুনীল সরকার

সুনীল সরকার পূর্ববঙ্গের ঢাকা জেলার মানুষ ছিলেন। পিতার নাম সুরেন্দ্র দে সরকার এবং মাতা সুভাষিণী দে সরকার। সুনীলরা ছিলেন চারভাই—রঞ্জন দে সরকার, বীরেন্দ্রকুমার দে সরকার, অনিলকুমার দে সরকার এবং সর্বকনিষ্ঠ সুনীল দে সরকার। বোনেরা ছিলেন— নীহারকণা দে সরকার, মলিনা দে সরকার এবং গীতা দে সরকার।

সুনীল সরকার ঢাকা জেলার মুন্সীগঞ্জ মহকুমার স্বর্ণগ্রামে ১৯৩৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন। সাতচল্লিশে দেশভাগজনিত দাঙ্গা কেবল পূর্ববঙ্গে নয়, পশ্চিমবঙ্গ এবং আসামেও ছিল। এই পরিস্থিতিতে পরিবারপ্রধান সুরেন্দ্র সরকার ছেলে-মেয়ে-স্ত্রী সকলকে নিয়ে বহু পথ পাড়ি দিয়ে শিলচর চলে আসেন। বসবাস শুরু করেন নতুনপট্টিতে।

শিলচরে সুনীল সরকারকে ভরতি করে দেওয়া হয় অভয়াচরণ পাঠশালাতে। প্রাথমিক শিক্ষা শেষে তাঁকে ভরতি করা হয় নরসিং হাই স্কুলে। কিন্তু আর্থিক কারণে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর তাঁকে পড়াশোনার পাঠ চুকাতে হয়। সংসারে আর্থিক টানাটানি কিছুটা লাঘব করতে সেই বয়সে সেন্ট্রাল রোড মোড়ে একটা দোকান খোলেন। শুরু করলেন পান, বিড়ি, সিগারেট ইত্যাদি দিয়ে। ক্রমশ দোকানে অন্যান্য সামগ্রীও আনা হয়। দোকানটা একটু বড়োও করলেন। দিন ভালোই যাচ্ছিল, পরিবারে বেশ খানিকটা অর্থ সাহায্যও করতে পারতেন।

১৯৬১ সালের শুরু থেকেই শিলচরে বাংলা ভাষা আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠে। সুনীল সরকারও ভাষা আন্দোলনে যোগ দিলেন। দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন, আবার মুখের ভাষাটাও কি চলে যাবে— এই ভাবনা তাঁকে তাড়িত করছিল। সত্যাগ্রহী কার্ড সংগ্রহ করলেন ১৯ মে অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিতে। গণসংগ্রাম পরিষদ অফিসে তিনি নাম লেখালেন ‘সুনীল সরকার’ এবং তারপর থেকেই তিনি পরিচিত হলেন সুনীল সরকার নামে।

১৯ মে ভোরে অন্ধকার থাকতেই তিনি শিলচর স্টেশন এলাকায় পৌঁছে যান। তাঁদের ওপর দায়িত্ব ছিল ট্রেন অবরোধ, ট্রেন চলতে দেওয়া হবে না এ দিন। পুলিশি নির্যাতন চলে, কাঁদানে গ্যাসে পরিবেশকে বিষাক্ত করে তোলা হয়, কিন্তু তারপরও সত্যাগ্রহীরা অবস্থান ছেড়ে যাননি। শুধুই কি পুরুষ, পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও অবস্থান নিয়েছিলেন। দুপুরে হঠাৎ করেই গুলি চালানো হয়। আর তাতেই অনেকের সঙ্গে সুনীলও গুলিবিদ্ধ হন এবং ঘটনাস্থলেই তাঁর মৃত্যু হয় বলে জানা যায়। সুনীল বাংলা ভাষার মান রাখতে গিয়ে প্রাণ দিলেন, শহিদ হলেন।

তাঁর স্মৃতি রক্ষার্থে শিলচর পৌরসভা হাসপাতাল রোড থেকে শ্মশান রোডের সংযোগকারী রাস্তাটিকে ‘শহিদ সুনীল সরকার রোড’ নামে ঘোষণা করে।

(তথ্য উৎস: ১৯-এর ভাষা শহিদেরা, দিলীপকান্তি লস্কর সম্পাদিত ২০০২ এবং বার্ষিক রক্তিম দিগন্ত, ২০১৩, মিতা দাস পুরকায়স্থ সম্পাদিত)

১০. শহিদ কানাইলাল নিয়োগী

বর্তমান বাংলাদেশ ভূখন্ডের টাঙ্গাইলের কালিহাতি থানার খিলদা গ্রামে ১৯২২ সালে জন্মগ্রহণ করেন কানাইলাল নিয়োগী। পিতা দ্বিজেন্দ্রলাল গুহ নিয়োগী এবং মাতা মনোরমা গুহ নিয়োগী। কানাইলাল স্থানীয় স্কুল থেকে প্রাইমারি ও হাই স্কুল থেকে ১৯৪০ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন। কানু আইচ কানাইলাল সম্পর্কে জানান, ‘১৯৪৫ সালের এপ্রিলে উত্তর-পূর্ব সীমান্ত রেলে টালি ক্লার্ক হিসাবে নিয়োগ পেতে কাছাড়ের বদরপুর রেলস্টেশনে যোগ দিলেন। কিছুদিন বদলি হয়ে হাইলাকান্দিতেও কাজ করেছেন, এর পরে শিলচরে’। (কানু আইচ, বরাকের পঞ্চদশ ভাষা শহিদ, শিলচর, ২০১৩, পৃ. ১৬)।

তিনি আরও জানান, ‘১৯৪৭ সালের শেষের দিকে বাংলার ২০ মাঘ যতীন্দ্র সরকারের প্রথমা কন্যা শান্তিকণার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।’

অপরদিকে শহিদের স্ত্রী একষট্টির ভাষা আন্দোলনের প্রত্যক্ষদর্শী শান্তিকণা নিয়োগী শিলচরের মাসিমপুর রোডের নিজবাড়িতে দিলীপকান্তি লস্করের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে ১৯৯৭ সালের ২২ মে বলেন, ‘… দেশ বিভাগের পর পরই কানাইলাল নিয়োগী (তখন তিনি রেলে চাকরি করতেন আখাউড়ায়) অপশন নিয়ে চলে আসেন শিলচরে রেল বিভাগে। ভাষা আন্দোলনের সময় উনি শিলচরে রেলের পার্সেল-ক্লার্ক হিসেবে কাজ করছিলেন। সে-সময় তিনি রেলের মজদুর ইউনিয়নের শিলচর শাখার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ভাষা আন্দোলনের আগে থেকেই তিনি রাজনৈতিক কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। কমরেড অচিন্ত্য ভট্টাচার্য, বীরেশ মিশ্র, দিগেন দাশগুপ্ত, প্রিয় গুপ্ত প্রমুখ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। এই সূত্রেই তিনি কাছাড়ের ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন।’ (১৯-এর ভাষা শহিদেরা, পৃ. ৩১-৩২)

আমরা লক্ষ করব, বিশিষ্ট লেখক কানু আইচের বক্তব্যের সঙ্গে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী কানাইলাল নিয়োগীর স্ত্রী শান্তিকণা নিয়োগীর বয়ানে স্পষ্ট পার্থক্য বর্তমান। সেক্ষেত্রে আমরা শহিদের স্ত্রীর সাক্ষ্যকেই মান্যতা দেব। কানাইলাল দুই ছেলে, দুই মেয়ে, স্ত্রীকে নিয়ে রেলওয়ে কোয়ার্টারে থাকতেন। অফিস ছিল রেলওয়ে স্টেশনে। ১৯ মে তিনি অফিসেই ছিলেন। এ দিন কানাইলাল দুপুরে বাড়ি থেকে খাওয়া-দাওয়াও সেরে আসেন। স্টেশনে এসে অস্থিরভাবে তিনি পাইচারি করছিলেন। হঠাৎ-ই গুলি। অথচ গুলি চালাবার মতো পরিস্থিতি তখন ছিল না। তিনি নিকটবর্তী মানুষজনকে সামলাতে বিশেষ করে মেয়েদের নিরাপদে রাখার জন্য দৌড়াদৌড়ি করছিলেন। আর এ সময় ঘাতকের বুলেট তাঁকে স্তব্ধ করে দেয়। শহিদ হলেন তিনি।

তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে স্থানীয় পৌর প্রশাসন শিলচর স্টেশন রোড ও মাদার টেরেসা রোড সংযোগকারী তারাপুর পুলিশ ফাঁড়ি সংলগ্ন সড়কটিকে ‘শহিদ কানাইলাল নিয়োগী রোড’ হিসেবে চিহ্নিত করেন।

১১. শহিদ সুকোমল পুরকায়স্থ

করিমগঞ্জ মহকুমার বাগবাড়ি গ্রামে ১৯২৫ সালে সুকোমল পুরকায়স্থ জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম সঞ্জীব পুরকায়স্থ এবং মাতা শৈবলিনী পুরকায়স্থ। সুকোমলরা ছিলেন সাত ভাই-বোন। তিন ভাই, চার বোন। ভাইয়েরা ছিলেন— স্বর্ণকমল, সুকোমল ও সুনির্মল। বোনেরা ছিলেন—নীহারনলিনী, বিভা, ইভা ও কনকনলিনী (মিলি)।

শিলচরে থাকতেন জ্যাঠামশায় মহেন্দ্র পুরকায়স্থের বাড়িতে। সেখানে থেকেই প্রাথমিক এবং হাই স্কুলে পড়াশুনো করেছিলেন সুকোমল। অভয়াচরণ পাঠশালায় প্রাথমিক শিক্ষা এবং নরসিং হাই স্কুলে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশুনো করেছিলেন। দারিদ্র্যের কারণে তাঁকে পড়াশুনো ছাড়তে হয়। শেষপর্যন্ত রোজগারের পথ খুঁজতে লাগলেন তিনি। ভাগ্যান্বেষণে বহুদূরের পথ ডিব্রুগড় চলে গেলেন। সেখানে একটি দোকান খোলেন। ছোটো আকারে হলেও ব্যাবসা ভালোই শুরু হয়। নিজে পড়াশুনো করতে পারলেন না বলে মনে কষ্ট ছিল। আর এই না পাওয়ার অতৃপ্তি মেটাতে চাইলেন ভাই-বোনদের শিক্ষিত করার মধ্য দিয়ে। ভাই-বোনদের তাঁর কাছে নিয়ে আসলেন লেখাপড়া করাবেন বলে।

১৯৬০ সালে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় ভয়াবহ ভাষা দাঙ্গা সংঘটিত হয়। দাঙ্গায় অসমিয়াদের হামলার শিকার হন এই অঞ্চলে বসবাসরত বাঙালি জনগোষ্ঠী। ভয়াবহ এই দাঙ্গা ‘বঙ্গাল খেদা আন্দোলন’ নামে পরিচিত ছিল। অসমিয়াদের এই হামলা থেকে নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধ-বৃদ্ধা কেউ-ই রেহাই পাননি। ধর্ষণের শিকার হন অসংখ্য বাঙালি নারী। তাই সুকোমল তাঁর বোনদের ডিব্রুগড়ে রাখার ভরসা পেলেন না। এ সময় সুকোমলের দাদা স্বর্ণকমল শিলচরের শ্রীকোণাতে চাকরি সূত্রে অবস্থান করছিলেন। দাদার কাছেই বোনদের রেখে আসলেন তিনি।

১৯৬১ সালের মে মাসের দিকে সুকোমল ছোটো বোন মিলির বড়ো রকমের অসুখের সংবাদ পেয়ে ছুটে চলে যান শিলচরে দাদার বাড়িতে। সেখানে পৌঁছে বোনের উপযুক্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। তিনি শিলচরে কিছুদিন থাকারও মনস্থির করেন।

এ সময় ভাষা আন্দোলন তুঙ্গে, রোজই সভা, মিছিল। সুকোমল সংগ্রাম পরিষদে গিয়ে নাম লেখালেন। অফিস থেকে সত্যাগ্রহী কার্ডও সংগ্রহ করেন। ১৯ মে সুকোমল আরও অনেক সত্যাগ্রহীর সঙ্গে শিলচর স্টেশন এলাকায় ভোররাতে পৌঁছে রেললাইনে বসে পড়েন। দায়িত্ব ছিল যেন ট্রেন চলতে না পারে। আর আসাম সরকার চেয়েছেন যেকোনো শক্তি প্রয়োগ করে ট্রেন চালাতে হবে।

১৯-এর সকালে সবাই লক্ষ করলেন যে, স্টেশন ও সংলগ্ন এলাকায় পুলিশ, আধা সেনা, সেনাবাহিনী ও অন্যান্য বাহিনীতে ছয়লাপ। জনতা স্লোগান তোলেন ‘বাংলা ভাষা জিন্দাবাদ’ ‘জান দেব, জবান দেব না’, ‘বন্দে মাতরম’। শুরু হয় নিরাপত্তা বাহিনীর লাঠিচার্জ, বেত্রাঘাত টিয়ার গ্যাসের শেল নিক্ষেপ। কিন্তু তারপরও জনতাকে হটিয়ে দেওয়া যায়নি। রক্তাক্ত, আহত অবস্থাতেই ‘মাতৃভাষা জিন্দাবাদ’ বলে চলেন তাঁরা। ট্রেন চলতে পারেনি। অস্থির নিরাপত্তা বাহিনী শেষে গুলিচালিয়ে বসল। না, কোনো সতর্ক বার্তা নয়, সত্যাগ্রহীদের লক্ষ করে সরাসরি গুলি। হায়েনাদের গুলি সুকোমলের বাম ঊরু ভেদ করে চলে যায়। তীব্র বেগে রক্তপাত শুরু হয়। সকলে ধরাধরি করে সুকোমলকে নিয়ে যায় প্রথমে প্রাথমিক চিকিৎসাকেন্দ্রে যা ভাষা আন্দোলনকারীগণই প্রস্তুত রেখেছিলেন এবং সেখান থেকে শিলচর সিভিল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু না, চিকিৎসকদের নিরলস চেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়ে সুকোলম পাড়ি দিলেন অনন্তলোকে। তাঁর রক্তপাত কিছুতেই বন্ধ করা যায়নি। আর এভাবেই নি:সাড় হয়ে পড়েন তিনি। বাংলা ভাষার মান বাঁচাতে সুকোমল স্বতঃস্ফূর্তভাবেই এগিয়ে এসেছিলেন, জীবনও দিলেন। কিন্তু মাতৃভাষা বাংলা কি তাঁর যোগ্য মর্যাদা লাভ করেছে?

শিলচর পৌরসভা শহিদের স্মৃতি রক্ষার্থে শ্মশান সড়কের নামকরণ করেন ‘শহিদ সুকোমল পুরকায়স্থ রোড’।

কেবল মাতৃভাষার জন্য একজন নারীসহ ১১ জনের প্রাণহানি খুব ছোটো ঘটনা ছিল না। কিন্তু তারপরও বিষয়টি কাছাড়ের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবেই থেকে গেল। এমনকী পশ্চিমবঙ্গের মানুষ পর্যন্ত মিটিং, মিছিল, বক্তৃতা ছাড়া প্রতিকারের পথ বের করতে পারেননি। এক্ষেত্রে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ, কবি-সাহিত্যিক (কিছু ব্যতিক্রম ব্যতীত) একই পথ অনুসরণ করেছেন— যা বেদনাদায়ক। আরও যন্ত্রণাদায়ক যে, অর্ধশতাব্দী পার হয়ে গেলেও শহিদেরা আজও বিচার পেলেন না। তাঁদের পরিবার বা কাছাড়বাসী আজও জানলেন না শহিদদের কেন গুলি করে হত্যা করা হল, কী তাঁদের অপরাধ? আন্দোলন ছিল গণতান্ত্রিক, শান্তিপূর্ণ। কোনো সশস্ত্র বিপ্লব ছিল না, সরকারি বাহিনীর ওপর হামলা বা সরকারি সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতিতেও কেউ নিয়োজিত ছিলেন না। সত্যাগ্রহীরা সকলেই ছিলেন নিরস্ত্র। বিচারের বাণী নীরবেই থেকে গেল। শহিদদের সংক্ষিপ্ত জীবনবৃত্তান্ত থেকে যেসব বিষয় আমাদের সামনে আসে তা হল এ রকম:

এক. শহিদেরা সবাই বাঙালি এবং সম্প্রদায়গতভাবে হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত।

দুই. সকলেই সাবেক পূর্ববঙ্গ থেকে আগত। এঁদের মধ্যে বৃহত্তর সিলেট জেলারই ৮ জন, ঢাকা থেকে একজন, টাঙ্গাইল থেকে একজন এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একজন। সুতরাং, শহিদদের মূল শিকড় ছিল পূর্ববঙ্গে, পূর্ববঙ্গের বাঙালি। উদবাস্তু হয়ে এ সব মানুষ প্রাণ এবং মান রক্ষার্থে ভারতে চলে আসেন।

তিন. ১১ জন শহিদের মধ্যে কেবল একজন—কানাইলাল নিয়োগী ম্যাট্রিক পাস করেছিলেন এবং রেলওয়েতে চাকরিরত ছিলেন। দু-জন শহিদ—কমলা ভট্টাচার্য ও শচীন্দ্রচন্দ্র পাল ১৯৬১-র মে মাসে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেন। মৃত্যুর পর ফল প্রকাশিত হলে দেখা যায় দু-জনেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। অবশিষ্ট আর কেউ-ই মাধ্যমিক পর্যন্ত পৌঁছোতে পারেননি—তার প্রধানতম কারণ দারিদ্র্য, দেশভাগ।

চার. পেশাগত দিক থেকে একমাত্র কানাইলাল ব্যতীত আর প্রায় সকলেই ছিলেন শ্রমজীবী। ছাত্রাবস্থা ছিল দু-জনের, কেউ উচ্চশিক্ষিত নন।

পাঁচ. শহিদদের প্রায় সকলেই নিম্নবিত্ত ঘর থেকে উঠে এসেছেন। তাঁরা রাজনৈতিক নেতাও ছিলেন না।

ছয়. শহিদদের কেউ ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন না। কেবল বাংলা ভাষার জন্য, প্রাণের টানে স্বতঃস্ফূর্তভাবে আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন। আসলে লড়াইটা ছিল সাধারণ গণ মানুষের। আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী মানুষের চরিত্র তো সে-কথাই বলে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *