দ্বিতীয় অধ্যায় – আসামে ভাষা আন্দোলন ও বাঙালি-প্রসঙ্গ (১৯৪৭-১৯৫৯)
স্বাধীনতার প্রাক্কালে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশে রক্তক্ষয়ী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হয় ব্যাপকভাবে। বিশেষত পাঞ্জাব, বিহার, পশ্চিমবঙ্গ এবং পূর্ববঙ্গে তা ছিল উদবেগজনক। ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে পশ্চিমবঙ্গের দাঙ্গা পরিস্থিতি এতটাই প্রবল আকার ধারণ করে যে, উদবিগ্ন মহাত্মা গান্ধি তাঁর নির্ধারিত নোয়াখালি যাত্রা স্থগিত করে কলকাতায় থেকে যান এবং শান্তি প্রতিষ্ঠায় বিভিন্ন এলাকায় একের পর এক সভা করে ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গা বন্ধের আহ্বান জানান। এসময় শান্তি প্রতিষ্ঠায় তিনি অনশনও করেছিলেন। এই শান্তি প্রক্রিয়ায় বাংলার প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দিও গান্ধিজীর সঙ্গী হয়েছিলেন। এমন এক আবহের মধ্যেও স্বাধীনতা লাভের প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছিল দুটি দলই— কংগ্রেস এবং মুসলিম লিগ। ব্রিটিশ সরকার ১৯৪৭ সালের ৪ জুলাই হাউস অব কমনস সভায় ‘India Independence Bill’ পেশ করেন। এই বিলে বলা হল:
… As from August 15, 1947, two Independent Dominions shall be set up in India to be known respectively as ‘India’ and ‘Pakistan’.১
ব্রিটিশ সরকার একথাও ঘোষণা করেন যে, তাঁরা ১৫ আগস্ট তারিখেই ভারতবর্ষের সকল দায়িত্ব ছেড়ে দেবেন।২ আমরা জানি, এই বিল চূড়ান্ত অনুমোদন লাভ করে ১৮ জুলাই ১৯৪৭-এ। লণ্ডন থেকে পাঠানো সংবাদে বলা হয়:
July 18, India and Pakistan become law at 10.40 G.M.T. today (4.10 PM I.S.T.) when the Royal Commission conveyed King George’s assent to the Bill in the House of Lords.৩
অশোক চক্র সংবলিত তিন রংবিশিষ্ট পতাকা স্বাধীন ভারতের জাতীয় পতাকা হিসেবে গণপরিষদে অনুমোদন লাভ করে ১৯৪৭ সালের ২২ জুলাই। সংবাদে বলা হয়:
The Constituent Assembly today decided that the National Flag of India shall be the saffron-white-green tricolour which has long been the Congress Flag, with the Ashoka wheel in blue embossed on it in the middle.
The whole House stood up fervently for half a minute to accord their assent to the resolution. At the suggestion of Pandit Jawaharlal Nehru it was, decided to preserve the two flags which were unfurled in the Assembly today in a national museum.
It was also decided to convey to Mahatma Gandhi the profound gratitude of the House for giving the country the symbol of the ‘Charkha’. Members of all communities present in the House enthusiastically supported the resolution. The House adjourned till tomorrow.
Dr. Rajendra Prasad announced that the present session of the Constituent Assembly would end by July 30 or 31. We shall be required to be here again on August 15 when power will be actually transferred to the people’s representatives by the representatives of the British Government.৪
ভারত স্বাধীন হল ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট। দিনটি একদিকে পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্তির আনন্দে উদবেলিত মানুষের খুশির দিন— অপরদিকে বেদনার দিন, কান্নার দিন, যন্ত্রণার দিনও বটে। এ সময়ই ঘটল স্বজন, স্বভূমি, স্বদেশ ত্যাগের মতো যন্ত্রণাকাতর ঘটনা— যার বলি হলেন লক্ষ লক্ষ নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধ। সংগতকারণেই সিলেট পাকিস্তানভুক্ত হওয়ায় সেখানকার লাখ লাখ হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ—বিশেষত যারা আসামের পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন তাঁরা প্রধানত আসামের কাছাড় জেলার উদ্দেশ্যে পাড়ি দিলেন নিরাপদ আশ্রয়ের আশায়। আসামে তাদের নতুন পরিচয় জুটল ‘উদবাস্তু’। মাত্র ক-দিন আগেও যারা ভারতবাসী ছিলেন— আজ তারা রাতারাতিই সীমানা কমিশনের দেওয়া পুরস্কারের দৌলতে হয়ে পড়লেন ‘পাকিস্তানি’। এসব ছিন্নমূল সহায় সম্বলহীন বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ হয়তো স্বপ্নেও ভাবেননি ভারতভুক্ত নতুন আসামে তাদের জন্য কী দুর্বিষহ যন্ত্রণা অপেক্ষা করছে। ‘এই অতর্কিত জনজোয়ারের ফলে, স্বাভাবিকভাবেই তৎকালীন কাছাড় জেলার আর্থ-সামাজিক জীবন এক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। এসমস্ত হতভাগ্য জনগণ বিভিন্ন শিক্ষায়তন, রেলওয়ে স্টেশন, অস্থায়ী তাঁবু ও কিছু ক্ষেত্রে আত্মীয়-পরিজনদের আবাসগৃহে আশ্রয় গ্রহণ করেন। জীবন, সম্পত্তি, সংস্কৃতি ও ধর্ম ব্যাপারে তাঁদের মধ্যে নিরাপত্তাবোধের চরম অভাব লক্ষ করা যায়।’৫
স্বাভাবিকভাবে উদবাস্তু সমস্যা সমাধানে আসাম সরকারের ওপরেই দায়িত্ব বর্তায়। কিন্তু সমস্যা সমাধানে সরকার চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিলেন। এমনকী প্রাথমিক পর্যায়ে আসামে উদবাস্তু উপস্থিতির বিষয়টিকেই স্বীকার করতে চাননি। করিমগঞ্জে উদবাস্তু উপস্থিতি প্রসঙ্গে সুবীর কর জানিয়েছিলেন:
করিমগঞ্জ শহরে প্রতিদিন হাজার হাজার বাস্তহীন লোকেরা আশ্রয় নিচ্ছেন, খাদ্যের জোগান নেই, পানীয় জল নেই, থাকার জায়গাও অকুলান, স্থানীয় অধিবাসীরা পরম সহানুভূতিতে নিজেদের ভাগ্য ভাগ করেও কুল পাচ্ছেন না, এরই মধ্যে কলেরা ও আমাশয় রোগ মহামারি হয়ে দেখা দিল। সেদিন সরকারের নিকট বারবার আবেদন-নিবেদন করেও কোনো সাহায্য এমনকী সাধারণ চিকিৎসারও বন্দোবস্ত করা যায়নি। হতভাগ্যদের জন্য যদি পশ্চিমবঙ্গের তরফ থেকে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় সাহায্য এসে না পৌঁছাত তাহলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে দাঁড়াত।৬
এসব উদবাস্তু কেবল করিমগঞ্জ নয়— শিলচর এবং হাইলাকান্দিতেও আশ্রয় নিয়েছিলেন হাজারে হাজারে— যাদের সামনে ছিল সম্পূর্ণ অনিশ্চিত এক ভবিষ্যৎ। অনাহার, অর্ধাহার ছিল তাদের নিত্যসঙ্গী; প্রাণ পর্যন্ত দিতে হচ্ছিল চিকিৎসার অভাবে।
এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে কাছাড় জেলার স্থানীয় মানুষ উদবাস্তুদের সাহায্যে এগিয়ে এলেন। তাঁরা চেষ্টা করলেন তাঁদের মতো করে। দিনরাত এক করে কাজ করে চললেন তাঁরা। কিন্তু এই বিশাল মানব বিপর্যয়কারী সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজে পাওয়া এক সুকঠিন কাজ ছিল। এই দুঃসময়ে পরম মমতায় যেসব মানুষ উদবাস্তুদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন— তাঁদের অন্যতম ছিলেন মোহিতমোহন দাস, রণেন্দ্রমোহন দাস, নলিনীকান্ত দাস, সনৎ দত্তচৌধুরী, ননীগোপাল স্বামী, কামিনীকুমার সেন প্রমুখ। ‘এঁরা সবাই স্থানীয় মানুষ, উদবাস্তুদের সেবা ও পুনর্বাসনের ব্যাপারে এদের আন্তরিকতা ছিল প্রশ্নাতীত। … বরাক উপত্যকার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যদি সহানুভূতি সম্পন্ন না হতেন তাহলে উদবাস্তুদের ব্যাপক পুনর্বাসন এ উপত্যাকায় আদৌ সম্ভবপর হত না।’৭ শিলচর এবং হাইলাকান্দিতে সেদিন যারা উদবাস্তুদের সহায়তায় এগিয়ে এসেছিলেন— তাঁদের অন্যতম ছিলেন— পরেশ চৌধুরী, কাছাড় কেশরী সনৎকুমার দাস, হুরমত আলি বড়লস্কর, লালমোহন নাথ প্রমুখ। সামগ্রিকভাবে কাছাড় জেলায় যাঁরা উদবাস্তু হয়ে আশ্রয় নিলেন— তাঁরা ছিলেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। ‘উদবাস্তুদের একটা বড়ো অংশ ছিলেন পেশাদার আইনজীবী, ডাক্তার, শিক্ষক বা সমজাতীয় নাগরিক জীবিকার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। সিলেট জেলার জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত প্রথম সারির রাজনৈতিক নেতাও এঁদের মধ্যে ছিলেন। শহরগুলিতে এঁরা নতুন করে জীবন শুরু করলেন আর তারই অনুসঙ্গ হিসেবে নাগরিক জীবনে তাঁদের প্রভাবও অনুভূত হতে লাগল।’৮ উদবাস্তুদের ত্রাণ ও পুনর্বাসনে সুসংগঠিতভাবে কাজ করার লক্ষ্যে এ সময় বেশ কয়েকটি সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন স্থানীয় মানুষ। এ সব সংগঠনের মধ্যে ‘Cachar Evacuees Relief Committee’, ‘East Bengal Minority Protection and Citizenship Right and Relief Rehabilitation Committee’ এবং ‘Cachar Displaced Persons Association’ ছিল অন্যতম। পরবর্তীতে শিলচর শহরের তিনটি সংগঠন সম্মিলিতভাবে ১৯৫০ সালের ৩০ এপ্রিল তারিখে এক সভায় মিলিত হয়ে গড়ে তোলেন ‘সেন্ট্রাল রিফিউজি বোর্ড’। এই সংগঠন উদবাস্তুদের ত্রাণ ও পুনর্বাসনে বড়ো রকমের ভূমিকা পালন করেছিল। এই সংস্থা উদবাস্তু সমস্যার সুষ্ঠু সমাধানে ১৯৫১ সালের ২৫ ও ২৬ এপ্রিল জেলাভিত্তিক আলোচনা সভার আয়োজন করে। শিলচরের গান্ধীবাগে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনে ‘সেন্ট্রাল রিফিউজি বোর্ড’ ভেঙে দিয়ে ‘কাছাড় রিফিউজি অ্যাসোসিয়েশন’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলা হয়। এই সম্মেলনে উপস্থিত সর্বভারতীয় উদবাস্তু সংগঠনের সভাপতি শ্রী চৈতরাম গিদোয়ানি শিলচরের সভায় জানালেন: এখানে এসমস্ত ছিন্নমূল দুর্ভাগ্যপীড়িত পরিবারের জন্য পুনর্বাসনের কোনো সুবন্দোবস্ত করার বদলে তাদের নির্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। উদবাস্তুদের পুনর্বাসন ব্যাপারে রাজ্য সরকারের চরম ব্যর্থতার ফলে এ অঞ্চলে আগত শরণার্থীদের এক অসহনীয় পরিস্থিতির মধ্যে দিনযাপন করতে হচ্ছে।৯
নবগঠিত ‘কাছাড় রিফিউজি অ্যাসোসিয়েশন’ উদবাস্তুদের পাশে দাঁড়িয়ে প্রদেশ ও কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে লড়াই চালিয়ে বেশকিছু দাবিদাওয়া আদায় করে নিতে পেরেছিল। উদবাস্তুদের সমস্যা সমাধানে, তাদের পুনর্বাসনে কেন্দ্রীয় এবং আসাম সরকারের মধ্যে টানাপোড়েন, পরস্পরের প্রতি অভিযোগ, পালটা অভিযোগের ফলে উদবাস্তুদের দুর্ভোগ বৃদ্ধি ছাড়া প্রকৃত কল্যাণ বয়ে আনেনি। এ প্রসঙ্গে বিস্তৃত আলোচনার সুযোগ এখানে নেই। তবে একথা সত্য যে, ‘উদবাস্তু’ তকমার কারণে আজও সিলেটের হাজারো মানুষকে দুর্ভোগের শিকারে পরিণত হতে হচ্ছে, আসামের বাঙালি সমাজ আজও নানা প্রশ্নের সম্মুখীন।
স্বাধীনতা লাভের মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই অসমিয়া সম্প্রদায় তথা আসাম সরকার উগ্র অসমিয়া, জাতীয়তাবাদকে ধারণ করে, গণতন্ত্র, মানবিক মূল্যবোধ, এমনকী আইনকে পর্যন্ত তুচ্ছ করে বাঙালিদের প্রতি মারমুখী হয়ে উঠলেন। অসমিয়া সমাজের এমন প্রতীতি জন্মেছিল যে, বাঙালিরাই তাদের সকল উন্নতির অন্তরায়। সুতরাং, আসাম থেকে বাঙালিদের তাড়াতে পারলেই সবকিছু তাদের হাতের মুঠোয় চলে আসবে। আর তাই ‘…ভাষা, শিক্ষা, নিয়োগ, ভূমিবণ্টন ও বিলি ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রভৃতি সকল বিষয়ে আসাম সরকারের নীতিই হয়ে দাঁড়াল অনসমিয়া, বিশেষত বাঙালি জাতিগোষ্ঠীর প্রতি অত্যাচার, বঞ্চনা ও বৈষম্যের নীতি। এরই পাশাপাশি চলল সমগ্র ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা জুড়ে ভাষিক ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ও দাঙ্গা।’১০
২৩ আগস্ট ১৯৪৭-এ গৌহাটিতে ‘অহম জাতীয় মহাসভা’-র এক বিশাল সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভার মূল বক্তব্যই ছিল বাঙালিকেন্দ্রিক, বাঙালি বিরোধী। শিলং থেকে ২৮ আগস্ট অমৃতবাজার পত্রিকা-র বিশেষ প্রতিনিধির পাঠানো সংবাদে বলা হয়:
On 23rd August Gauhati saw the biggest meeting of the Jatiya Mohasabha, a chauvinist organisation notorious for Bongal khedao movement. Consequent on the division of the country all-non-Assamese railway, Post and Telegraph employees are now being transferred by the Central Govt. being regarded as foreigners. In the conspiracy to dominate Assam their wrath is being directed against the Bengalees mainly. The heat generated in the meeting roused the worst sentiment when cries of ‘Bongal Khedao’ (drive out Bengaless) rent the sky followed by agitated anti-Bengali demonstrations.১১
স্বাধীনতা লাভের শুরুতেই ‘বঙ্গাল খেদা’। যাত্রা শুরু স্বাধীন ভারতের একটি প্রদেশ আসামে। রাখঢাক নয়— স্পষ্টত সাম্প্রদায়িক চেতনাজাত। অসমিয়া রেলওয়ে কর্মচারী সমিতির সভা অনুষ্ঠিত হয় ২৪ আগস্ট। সভায় সভাপতিত্ব করেন নীলমণি ফুকন। এই সভাতেও বাঙালি বিরোধী স্লোগান দেওয়া হল। সংবাদে বলা হল:
The next meeting held on the 24th under the Assamese Railway Employees’ Association presided over by Mr. Nilmoni Phukan also turned into another edition of the 23rd meeting as an aftermath of which resulted rowdy demonstrations and shouting of anti-Bengali slogans including excesses done to Bengali-owned shops.১২
অসমিয়াদের এই গুণ্ডামির বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ এবং নিন্দা জানায় আসামের কমিউনিস্ট পার্টি। ২৫ আগস্ট অনুষ্ঠিত কমিউনিস্ট পার্টির এই সভা সম্পর্কে পত্রিকায় বলা হল:
The climax was reached when the Assam Communist Party held its meeting on the 25th Aug. and condemned the rowdyism and ventilated their attitude and opinion about Assam’s Constitutional question, its plans for reconstruction etc., a group of rowdies created disturbances and later damaged and looted some Bengali Hindu Muslim shops. A tense situation has been created. The police intervened when the demonstrators dispersed. Next day the Assam Congress leaders sent a peace patrol composed of Sevadal, Police and Military and issued a statement criticising the action of these goondas and asking the Bengalees and Assamese to maintain peace. The Hindus and Muslims alike feel that both the East and West Bengal Govts. should interfere.১৩
শিলং জেলা কংগ্রেস কমিটি ২৮ আগস্ট এক বিশেষ সভায় মিলিত হয়ে এক শ্রেণীর মানুষের মধ্যে প্রাদেশিক ও সাম্প্রদায়িক প্রবণতার প্রতি নিন্দা এবং ভারতীয় জাতীয়তাবাদের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করে প্রস্তাব গ্রহণ করেন। এ.পি. পরিবেশিত সংবাদে বলা হয়:
A special meeting of the Shillong District Congress Committee held under the Presidency of Mr. Rajanikanta Goswami unanimously accepted Mr. Ameer Ali’s resolution directing its representatives of the Assam Provincial Congress Committee to move the following resolution in its forthcoming Shillong session. This meeting of the Assam Provincial Congress Committee views with great concern the growing sentiments of provincialism among a certain section of the population of the Assam Valley and particularly denounces the speeches and writings in a section of the Assam press and platform which are fomenting such anti-national tendencies in the province. To reassure all concerned, this meeting wants to make this unequival declaration that these speeches and writings are not shared by any Congressmen individual or by the Congress Organisation collectively and condemns this sectarian tendency in the interest and proper growth of Indian nationalism for which the Congress fought all these years.১৪
অবশেষে আসাম সরকার গৌহাটিতে সংঘটিত ঘটনা সম্পর্কে মুখ খুললেন। ২৩ এবং ২৪ আগস্টে সংঘটিত ঘটনা সম্পর্কে নীরব থাকলেও কমিউনিস্ট পার্টি আয়োজিত ২৫ আগস্টের সভা সম্পর্কে সরকার প্রেস বিজ্ঞপ্তি জারি করে তাঁদের অবস্থান জানালেন:
…The attention of the Government has been drawn to certain highly inaccurate, misleading, alarming and baseless reports published in some daily papers in connection with an unpleasent incident that took place at Gauhati on the evening of the 25th instant. The Government fell called upon to issue a communique, giving an accurate account of the incident.
On the evening of August 25th there was a meeting at the Jubilee Garden (Gauhati) organised by Communist workers and dissension arose in their own camp over the recruitment of Bengalees from outside to the exclusion of the Assamese and the meeting ended in disorder. …The Bengalee element from outside the province, has of late, increased not only greately in number but also in activity. … It is further alleged that a large number of Assamese recently failed to secure employment while Bengalees from outside have been recruited in large numbers in the Marine Department to replace those who have opted for Pakistan. The feelings amongest the Assamese and Bengalees have in consequence been strained.১৫
সরকারি ভাষ্য থেকে বাঙালিদের প্রতি আসাম সরকারের মনোভাব বুঝতে কষ্ট হয় না। সরকারি ভাষ্যে বাঙালিদের একাধিকবার ‘Bengalees from outside’ বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।
সিলেটের বিশিষ্ট কংগ্রেস নেতা ‘অল ইণ্ডিয়া কংগ্রেস কমিটি’ সদস্য বিনোদবিহারী চক্রবর্তী সিলেটি সরকারি কর্মচারীদের আসামে চাকরি করতে না দেওয়ায় আসাম সরকারের সংকীর্ণ প্রাদেশিক মনোভঙ্গির কথা উল্লেখ করে একটি প্রস্তাব বোম্বে অনুষ্ঠিতব্য এআইসি সভায় উপস্থাপনের জন্য পাঠিয়ে দেন। প্রস্তাবে বলা হল:
…the narrow provincialism of the Government of Assam and the treatment meted out to Government officials who are natives of Sylhet district is not providing them with jobs in Assam, although they had opted to serve in the Indian Union at the instance of the Assam Government.১৬
কেবল বাঙালি সরকারি কর্মচারী নন— স্বাধীনতার উষালগ্নে সামগ্রিকভাবে আসামে বসবাসকারী বাঙালি সমাজই যে উগ্র অসমিয়া জাতীয়তাবাদের আক্রমণের লক্ষ্যে পরিণত হয়েছিলেন— এমন তথ্যও বর্তমান। এ প্রসঙ্গে আমরা দুটি চিঠির উল্লেখ করব। নব প্রতিষ্ঠিত আসাম রেলওয়ে সদর দফতর পান্ডু থেকে যোগেন ব্যানার্জি তাঁর চিঠিতে জানিয়েছিলেন:
Recent happenings in some provinces, specially in Assam, are very painful and require immediate interference by the Central Authority and the Bengal Government. After the Bengal partition it was decided that the Bengal and Assam Railway should be started with its headquaters at Pandu. But just after the arrival of Railway staff from Calcutta, the Assamese people have lanched a movement to driveout not only Railwaymen (Bengalees) but Bengalees as a whole. To achive this end, they are having recourse to direct action. It is further reported that some Railway men and Bengalee public in upper Assam, specially in Gauhati have been attacked and served with 24 hour’s notice to shift their families.১৭
বলা প্রয়োজন যে, বেঙ্গল-আসাম রেলওয়ে হেডকোয়ার্টার বরাবরই ছিল কলকাতায়। পরিকাঠামোসহ সকল সুযোগসুবিধাও ছিল সুপ্রতিষ্ঠিত। কিন্তু তারপরও হেডকোয়ার্টার সরিয়ে আনা হল আসামের পান্ডুতে। এর ফলে, ভারত সরকারকে বিপুল অঙ্কের টাকা গুণতে হয় নতুন সদর দফতর নির্মাণে।
সম্পাদক সমীপে লিখিত দ্বিতীয় চিঠিটি ছিল আসামের তেজপুর থেকে। পত্রলেখক লিখলেন:
Immediate with the transfar of power a great anti-Bengali feeling seems to be prevailing amongest our Assamese brothers. It will be manifested from a leaflet published by one K. Barthakur of the Assam Education Department and an article written by Harendranath Barua and Published in the Independence Number of Dainik Assamiya. The caption of the Article in question in ‘Assam Assamiyar’ is ‘Bengale Kongal Karile.’ The Bengali community in Assam will be doomed for ever if this sort of rank provincialism continues.১৮
সুনির্দিষ্ট তথ্য সংবলিত চিঠিটি ছিল আসামে বসবাসকারী বাঙালিদের কাছে উদবেগজনক, বেদনাদায়ক।
আনুষ্ঠানিক দেশভাগের পূর্বেই সিলেটের আঠারোশো বাঙালি সরকারি কর্মচারী ভারত ইউনিয়নে চাকরি করার লিখিত সম্মতি প্রদান করেন। এসময় ভারত সরকারের সিদ্ধান্ত ছিল: ‘…The number of staff opting for the Indian Union will become surplus after meeting the requirements of the Assam Railway and the sections going to the O.T. and E.I. Railways’.১৯
অসমিয়া কর্মচারীদের দেশভাগের পূর্বেই আসামে বদলি করা হয়েছিল। সিলেটের অতিরিক্ত বাঙালি সরকারি কর্মচারীদের এক প্রতিনিধি দল আসামের প্রধানমন্ত্রী গোপীনাথ বরদলৈ-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাদের চাকরির কথা জানালে প্রধানমন্ত্রী জানিয়ে দিলেন, ‘এই সরকারের গৃহীত নূতন নীতি হইতেছে: আসাম অসমিয়াদের জন্য।’২০ এই পরিপ্রেক্ষিতে সিলেটি কর্মচারী প্রতিনিধি দলের কয়েকজন আদালতের শরণাপন্ন হলে আদালত জানালেন, আসাম গভর্নমেন্টের সিদ্ধান্ত অবৈধ এবং এদের চাকরি বলবৎ আছে। আদালত তীব্র মন্তব্য করে একথাও বলেন যে, নিজের অঙ্গীকার ভঙ্গ করতে আসাম সরকারের বিবেকে বাধে না। এ সময় অর্থমন্ত্রী ছিলেন শ্রী বিষ্ণুরাম মেধী। তিনিও জানিয়েছিলেন: ‘১০ লক্ষ টাকাও যদি খেসারত দিতে হয় দিব— তবু সিলেটী চাকুরিয়া নিব না’। এ সময়ই আসাম উপত্যকায় পঁয়ত্রিশটি ডাক্তারখানাও বন্ধ করে দেওয়া হল —কারণ ওইসব ডাক্তারখানার সকল ডাক্তারই ছিলেন সিলেটি এবং তারা সবাই ছিলেন বাঙালি।২১
‘আসাম অসমিয়াদের জন্য’— আসাম প্রধানমন্ত্রী গোপীনাথ বরদলৈ-এর এই মন্তব্য মহাত্মা গান্ধীর নজরে এসেছিল। এ সময় তিনি কলকাতায় শান্তি প্রতিষ্ঠায় নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছিলেন। তিনি কলকাতার বালিগঞ্জ লেক ময়দানে ২৬ আগস্ট, মঙ্গলবার তাঁর প্রার্থনাত্তোর সভায় বক্তৃতাকালে এক পর্যায়ে জানালেন:
The people of all provinces belong to India and India belongs to all. …Who was referring to the provincial spirit ‘that seemed to be infecting the provinces’ …Gandhiji said that he saw in the papers that some Assamese thought that Assam, belonged exclusively to Assamese. ‘If that spirit fired every province, to whom India would belong?’ …All were servents of India and they lived only in the spirit of service. …২২
এরপরও অক্টোবর মাসে গোলাঘাটে এক ছাত্র সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী বরদলৈ পুনরায় জানালেন: ‘সন্দেহাতীতভাবেই আসাম অসমিয়াদের জন্য’।২৩ একথাও স্পষ্ট করা হল যে, ‘আসাম’ বলতে আসাম রাজ্যের ভৌগোলিক সীমানাকে ধরা হয়েছে এবং ‘অসমিয়া’ বলতে সেই জনসাধারণকে মনে করা হয়েছে—যাদের মাতৃভাষা অসমিয়া।২৪
সেপ্টেম্বর মাসে ‘অসম জাতীয় মহাসভা’ সম্পাদক অম্বিকাগিরি রায়চৌধুরি এক সভায় ‘আসাম অসমিয়াদের জন্য’ বলতে কী বোঝানো হয়েছে— তার ব্যাখ্যা প্রদান করেন। এই সভায় সভাপতিত্ব করেন শ্রীযুক্ত টি বি প্রধান। ১৬ সেপ্টেম্বর আসাম থেকে প্রেরিত সংবাদে বলা হল:
At a meeting here (Margherita, Assam) on Sunday last under the Presidency of SJ. T.B. Pradhan, SJ. Ambica Roy Chowdhury, Secretary of the Assam Jatiya Mahasabha, reiterated that the ‘Assam for Assamese’ cry did not imply driving- out the non-Assamese from Assam. It implied welcoming them to their midst and thus merging them with the indigenous Assamese, if they took Assam sincerely as their homeland. The complicated problems— economic, cultural and political which faced Assam after the attainment of freedom— could only be solved, he said, by the combined and united efforts of the sons of the soil and Marwaries, Nepalese, Beharies, Sikhs and Bengalees, who inhabited Assam.২৫
১৯৪৭ সালের ৩ অক্টোবর গৌহাটিতে প্রধানমন্ত্রী গোপীনাথ বরদলৈ তাঁর সরকারের ভাষা নীতি সম্পর্কে সুস্পষ্ট মতামত তুলে ধরলেন সাংবাদিকদের সম্মুখে।
… the language Policy of Government the Premier said that Assamese would be the official and state language. Steps would be taken as soon as possible to have Government proceedings and records conducted and maintained in Assamese in so far as affairs within the province are concerned. Assamese would also be the medium of instruction in schools. The language of local people in certain areas would not however, be disturbed, but they must have Assamese as compulsory second language.২৬
প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের মধ্যে কোনো অস্পষ্টতা নেই। অসমিয়া ভাষা যে সরকারি কাজকর্ম এবং রাজ্যিক ভাষা হিসেবে স্থান পাবে— সেকথা স্বাধীনতার উষাকালেই দেশবাসীকে জানিয়ে দিলেন তিনি। কেবল তাই নয়— স্কুলেও শিক্ষার মাধ্যম হবে অসমিয়া। অঞ্চলবিশেষে স্থানীয় মানুষের ভাষাকে মর্যাদা দিলেও দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে অসমিয়া ভাষা হবে বাধ্যতামূলক।
কামরূপ জেলা ডেপুটি কমিশনারের ২৫ সেপ্টেম্বর তারিখের এক সার্কুলার— যেখানে বাঙালিদের আসাম থেকে বের করে দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল— সেই সার্কুলারকে কেন্দ্র করে বাঙালিদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা গেল। তাঁরা গৌহাটিতে এক সভায় মিলিত হয়ে সার্কুলারের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে আসাম সরকারকে সেটি প্রত্যাহারের অনুরোধ জানান। আসাম সরকারি প্রশাসন যে কতটা সক্রিয় ছিল তারও প্রমাণ মেলে জারিকৃত সার্কুলার থেকে। আর এসব তথ্য পাওয়া যায় সমকালীন সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি চিঠি থেকে। রায়পুর (সি.পি.) থেকে এ দাশগুপ্ত তাঁর চিঠিতে লিখেছিলেন:
The present campaign against the Bengalees in Assam has recently taken a very ugly turn. It is no secret that the Government of Assam, functioning under the auspices of Congress, is secretely supporting the move contrary to the policy of the Congress against provincial exclusiveness. The circular of the Deputy Commissioner of Kamrup dated the 25th Sept. 1947, is directly aimed at ousting the Bengalee community from the soil of Assam for good. At a representative meeting held at Gauhati dated the 25th October 1947, the Bengalee inhabitants vehemently protested aginst this circular and urged upon the Government of Assam to withdraw the same. In the circumstances the Government of both the West Bengal and East Pakistan, who are vitally interested in the matter, can no longer afford to be silent spectators of this Bengalee-baiting but must take up the matter right away with the Government of Assam.২৭
ভারত ভাগের পর আসাম প্রদেশে প্রথম আইনসভা বসে ৫ নভেম্বর ১৯৪৭-এ। এই সভায় আসাম গভর্নর স্যার আকবর হায়দারি যে ভাষণ দিয়েছিলেন— তা ছিল গণতান্ত্রিক, অহিংস মন্ত্রে দীক্ষিত ভারতের মৌলনীতির পরপন্থী, একদেশদর্শী, জাতিবিদ্বেষপ্রসূত। আর এ ভাষণের মূল সুরটি যে আসাম সরকারই বেঁধে দিয়েছিলেন তা বলাই বাহুল্য।
এ দিন সভার শুরুতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় স্পিকার নির্বাচিত হন লোকেশ্বর বড়ুয়া। সভায় অভিনন্দনের জবাবে মাননীয় স্পিকার ‘assured that he would maintain the dignity and honour of the House and safeguard the rights and privileges of all members.’২৮
এরপরই আসাম গভর্নর সদস্যদের উদ্দেশ্যে ভাষণ প্রদান করেন। গভর্নর হায়দারি তাঁর ভাষণের এক পর্যায়ে জানান:
The natives of Assam are now masters of their own house. They have a Government which is both responsible and responsive to them. They can take what steps are necessary for the encouragement and propagation of Assamese language and culture and of the languages and customs of the tribal peoples, who are their fellow citizens and who also must have a share in the formation of such policies. The Bengalee has no longer the power, even if he had the will, to impose anything on the peoples of these Hills and Valleys which constitute Assam. The basis of such feelings aginst him as exist is fear— but now there is no cause for fear. I would, therefore, appeal to you to exert all the influence you possess to give the stranger in our midst a fair deal, provided, of course, he in his turn deals loyally with us.২৯
স্বাধীনতা লাভের পর ভারতের জাতি, ধর্ম, বর্ণ, ভাষানির্বিশেষে সকল শ্রেণী-পেশার মানুষ যখন সকল ভেদাভেদ, বৈরিতা পরিহার করে নতুন ভারত গড়ার লক্ষ্য নিয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করার দৃঢ় প্রত্যয় ঘোষণা করে এগিয়ে যেতে যত্নবান—তখনই ভারত মানচিত্রের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশ আসাম জাতিগত বিভাজনকে সামনে রেখেই যাত্রা শুরু করল। নিশানা করা হল আসামে বসবাসকারী বাঙালি সমাজকে। আর এসব কিছুই ঘটল জনপ্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে, আসাম আইনসভার আনুষ্ঠানিক সভা চলাকালেই।
অনেকটা আকস্মিকভাবেই আসামের প্রধানমন্ত্রী গোপীনাথ বরদলৈ ১৯৪৭-এর ১৫ নভেম্বর শিলচর পৌঁছোলেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল কাছাড় হয়ে আগরতলা স্টেটের সঙ্গে ভারতের সংযোগ স্থাপনের বিষয়টি খতিয়ে দেখা। এ সময় স্থানীয় বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে কাছাড়ের স্বায়ত্তশাসনসহ বেশ কিছু দাবি সংবলিত একাধিক স্মারকলিপি প্রধানমন্ত্রীকে প্রদান করা হয়। তাঁর সঙ্গে আলোচনাকালে ভাষা, বাঙালি এবং স্বায়ত্তশাসনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ওপরেই অধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়। সংবাদপত্রে বলা হল:
… In course of replying to a memorandum placed before him by the different organisations, the Premier said Bengali schools or education through that medium in Cachar would not be disturbed but Assamese as a State languages would be made compulsory. A second language would be introduced. He Assured that Government grants to the Bengali schools would not be withdrawn in any case.
Replying to Cachar’s united demand for autonomy, the Premier said he liked the principle underlying, but doubted its practicability but again he said if autonomy be granted, Cachar must give up the demand for the provincial services.
Referring to the Governor’s speech on the floor of the Assembly that Bengalees are strangers, recommending a fair deal so long as they remain loyal, the Premier said His Excellency referred to Pakistan Bengalees and not the Cachar Bengalees. But this explanation did not satisfy the Bengalees in Cachar as the Governor’s speech was clear.৩০
প্রধানমন্ত্রী বরদলৈ শিলচরে দাঁড়িয়েও পুনরায় জানালেন, ‘অসমিয়া’ ভাষাকে বাধ্যতামূলকভাবেই রাজ্যিক ভাষা করা হবে। তবে বাংলা স্কুলগুলিতে সরকারি অনুদান কোনোভাবেই বন্ধ করা হবে না। কিন্তু পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী বরদলৈ-এর এই অঙ্গীকার যে কেবলই মিথ্যার ফানুস ছাড়া আর কিছুই ছিল না— তা একের পর এক বাংলা স্কুলগুলি বন্ধ করে দেওয়ার মধ্য দিয়ে যেমন প্রমাণিত— তেমনি সরকারি অনুদানও লজ্জাজনক হারে কমিয়ে দেওয়া হল। কিন্তু অসমিয়া স্কুলগুলিতে সরকারি অনুদান বাড়ল, স্কুল সংখ্যাও বৃদ্ধি পেল ব্যাপক গতিতেই। সমাজ ও রাষ্ট্রের সকল ক্ষেত্রেই অসমিয়াকরণের কাজ এগিয়ে চলল পরিকল্পনামাফিকই।
এমন এক বিব্রতকর আবহাওয়ার মধ্যেই ১৯৪৭ সালের ২৫ নভেম্বর শিলচর নর্মাল স্কুল প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হল ভাষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক সম্মেলন। এই সম্মেলনের মূল বক্তা ছিলেন বিশ্বের অন্যতম বহুভাষাবিদ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতি অধ্যাপক এবং বঙ্গীয় বিধান পরিষদের সভাপতি ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। নর্মাল স্কুল প্রাঙ্গণ সেদিন হাজার হাজার নারী-পুরুষে ছিল পূর্ণ। প্রাঙ্গণ ছাপিয়েও মানুষ। এমন এক সভাতে দাঁড়িয়েই ভাষাবিদ-অধ্যাপক সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় সেদিন জানিয়েছিলেন:
আসামের বাংলা ও অসমিয়া কোনো ভাষাতেই প্রদেশের লোকসংখ্যার অর্ধেকের বেশি লোক কথা বলে না, কাজেই একটা ভাষার দ্বারা অপর ভাষার ওপর প্রাধান্য করার প্রশ্ন এখানে ‘অবান্তর।’ ‘অসমিয়ারা যদি তাহা করেন তবে হাস্যাস্পদই হইবেন, ভারতীয় ইউনিয়ন তাহা সমর্থন করিবে না।’ ‘আসামের ভিতরে বাঙ্গালীত্বের বড় ছাপ আছে ও থাকিবেই। ক্ষমতা হাতে পাইয়া অন্যের সংস্কৃতি ও ভাষার উপর হামলা করা অন্যায় ও অনধিকার চর্চা। বাংলা ভাষাকে রোধ করার কোনো অপচেষ্টা আরম্ভ হইলে তাহা অমার্জনীয়। সর্বশক্তি প্রয়োগে তাহা রোধ করিতে হইবে। জার্মানিতে জার্মান ও চেক ভাষা পাশাপাশি আছে। আসামে অসমিয়া ও বাংলা ভাষা থাকিবে না কেন? হিটলার অপেক্ষা আসামে অন্য কোনো বড়ো শক্তির উদ্ভব হইয়াছে বলিয়া চিন্তা করাও বাতুলতা।
আসাম গভর্নমেন্ট গায়ের জোরে কিছু করিতে পারিবেন না। ভারত গভর্নমেন্ট সকলের উপরে রহিয়াছেন। এক ভাষাভাষী প্রদেশ থাকা অপেক্ষা জিলাকে কেন্দ্রের অধীনে লইয়া যাওয়া বাঁচিয়া থাকার মহত্তর সোপান। আসামে অসমিয়া ভাষা সমৃদ্ধ হউক ইহাতে আপত্তির বা অসন্তোষের কারণ নাই, বাংলা ভাষা ও অসমিয়া ভাষা পাশাপাশি থাকুক। আসামে সত্যিকার সংখ্যাগরিষ্ঠ ভাষা কোনোটিই নহে, কাজেই হাতে ক্ষমতা পাইয়া ভোটের জোরে অন্যের ন্যায্য দাবি দাবাইবার চেষ্টা করা হইলে দিল্লি নীরব থাকিবে না।
ভাষার স্বাধীনতায় অনুচিত হস্তক্ষেপ ও পক্ষপাতিত্ব পৃথিবীর কোথাও বরদাস্ত করা হয় নাই। বন্ধুগণ! আমার শেষ নিবেদন, আপনারা জাগিয়া ঘুমাইবেন না।৩১
বিশিষ্ট ভাষাবিদ ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের উপরিউক্ত ভাষণ ছিল অত্যন্ত সময়পোযোগী, তাৎপর্যময়। স্বাধীনতার উষাকালে আসামে দাঁড়িয়ে অসমিয়া এবং বাংলা ভাষার একত্রে পথচলার উদাত্ত আহ্বান জানালেন তিনি। তিনি বিদেশের উদাহরণ টেনে বললেন, জার্মানিতে জার্মান এবং চেক ভাষা যদি পাশাপাশি থাকতে পারে, একত্রে পথ চলতে পারে— তাহলে অসমিয়া এবং বাংলা ভাষা পাশাপাশি থাকতে পারবে না কেন? তিনি একথাও জানালেন, আসামে অসমিয়া ভাষা সমৃদ্ধ হউক— এতে আপত্তি বা অসন্তোষের কারণ নেই। বাংলা ও অসমিয়া ভাষা পাশাপাশি থাকুক। তিনি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, ‘আসামে সত্যিকার সংখ্যাগরিষ্ঠ ভাষা কোনোটিই নহে।’ এরপরও অসমিয়া সমাজ এবং আসাম সরকার যে অসমিয়া এবং বাংলা ভাষাকে পাশাপাশি রেখে মিলনের বার্তা নিয়ে এগিয়ে আসবেন— এমন লক্ষণ চোখে পড়েনি।
‘অহম জাতীয় মহাসভা’র বাঙালি বিরোধী তৎপরতা ইতিমধ্যে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। এই সংগঠন এখানেই থেমে থাকেনি—তারা ভারত ইউনিয়ন থেকেই বেরিয়ে এসে স্বাধীন আসাম রাজ্য গঠন করতে চাইল। ১৯৪৮ সালের ১ জানুয়ারি চার্চ ময়দানে অনুষ্ঠিত সভা থেকে স্বাধীন আসাম রাজ্যের কথা স্পষ্টত ঘোষিত হল। এ সম্পর্কে The Assam Tribune এক প্রতিবেদনে জানাল:
A meeting of the Ahom Jatiya Mahasabha, Kamrup branch was held on the 1st January in the Church field to discuss the development in the country in all aspects. The President expressed the view that Assam should comeout of the Indian Union and become an Independent country like Burma or any other country.৩২
চার্চ ময়দানের সভার পর পরই ‘অহম জাতীয় মহাসভা’-র সাধারণ সম্পাদক অম্বিকাগিরি রায়চৌধুরী ৩ জানুয়ারি ’৪৮ তারিখে এক টেলিগ্রাম-বার্তায় নাগা জাতীয় কাউন্সিল সভাপতিকে জানালেন, জাতীয় মহাসভা কর্মীগণ নাগা ভাইদের আত্মসঙ্কল্পের প্রতি সহানুভূতিশীল। সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হল:
SJ. Ambicagiri Roy Choudhury, General Secretary, Ahom Jatiya Mahasabha, has this morning [3 January, 1948] sent a telegram from Jorhat to Mr. Aliba Imti, President, Naga National Council, Kohima, SJ. Roy Choudhury in the wire informed the National Council President that the Ahom Jatiya Mahasabha workers assembled at Jorhat have expressed their fullest sympathy with their Naga brothers’ stand for self determination.৩৩
দু-টি সংবাদই ছিল উদবেগজনক। এই উদবেগ বিশেষ কোনো প্রদেশ বা রাজ্যের নয়—বরং সমগ্র ভারতবর্ষের জন্যই ছিল দুঃসংবাদ, বিপজ্জনক। অথচ ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার কার্যত মৌনব্রত অবলম্বন করলেন।
জমি বন্দোবস্ত, ক্রয়-বিক্রয়, ভাষা, চাকরি এবং স্কুল-কলেজসহ সমাজ ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সিলেটের সংখ্যালঘু বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায় যখন একের পর এক বঞ্চনার শিকারে পরিণত হচ্ছিলেন— তখন আসামের ভূতপূর্ব স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বসন্তকুমার দাস, এম এল এ. এর নেতৃত্বে সিলেটের এক প্রতিনিধি দল ১৯৪৮ সালের ২ জানুয়ারি শিলং গভর্নমেন্ট হাউসে ভারতের সহকারী প্রধানমন্ত্রী সরদার বল্লভভাই প্যাটেল-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁদের অভিযোগপত্র তুলে ধরেন। প্রতিনিধি দলে সদস্য ছিলেন— ১. শ্রীহট্টের কর্মচ্যুত সরকারি কর্মচারীদের প্রতিষ্ঠান, ২. শিলং সুরমা সম্মিলনী, ৩. শ্রীহট্ট জেলা কংগ্রেস কমিটি এবং ৪. শ্রীহট্টের ঠিকাদারগণ। প্রত্যেক সংগঠনের পক্ষ থেকেই পৃথক স্মারকলিপি প্রদান করা হয়। এ ছাড়া গৌহাটি থেকে ‘আসাম বেঙ্গলী অ্যাসোসিয়েশন’-এর পক্ষ থেকেও পৃথক স্মারকলিপি প্রদান করা হয়।৩৪
সিলেটের ‘সুরমা সম্মিলনী’-র পক্ষ থেকে দেওয়া স্মারকলিপিতে বলা হয় যে, পুনর্গঠিত আসামের যে-সকল অধিবাসীর জন্মস্থান পাকিস্থানে পড়েছে এবং যাঁরা লোকবল ও অর্থ দিয়ে আসামের যে কোনো নাগরিকের মতোই আসামকে শিল্পে, বাণিজ্যে, আর্থিক সম্পদে, শাসনব্যবস্থায় ও অন্যান্য দিকের উন্নয়নে সাহায্য করেছেন; আসাম সরকার তাঁদেরকে ‘বিদেশি’ বলে গণ্য করেছেন এবং ১. ‘জীবিকা অর্জনের বিভিন্ন পেশা, ২. সরকারি চাকুরিতে নিয়োগ ও পদোন্নতি, ৩. ছাত্রদের বৃত্তি প্রদান, ৪. স্কুল-কলেজে প্রবেশাধিকার, ৫. ভূ সম্পত্তি ক্রয় ও ভোগ-দখল, ইজারা গ্রহণ ইত্যাদি ব্যাপারে কতকগুলি নিষেধাত্মক ও বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা অবলম্বন করেছেন। এই সকল ব্যক্তি বহুকাল যাবৎ এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুরুষানুক্রমে বর্তমান আসাম প্রদেশে বাস করছেন; তা সত্ত্বেও নাগরিক অধিকার লাভের জন্য আসাম সরকার তাদের কাছে ডোমিসাইল সার্টিফিকেট দাবি করছেন। এটা যেমন অযৌক্তিক তেমনি গণপরিষদের উদ্দেশ্যসূচক প্রস্তাবের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন এবং ডোমিসাইল সার্টিফিকেট প্রদানের রীতি সম্পূর্ণ রহিত করার সুপারিশ করে ১৯৩৯ সালে নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটি যে প্রস্তাব গ্রহণ করেন, তারও বিরোধী।’৩৫
স্মারকলিপিতে ভাষা প্রসঙ্গ উত্থাপন করে বলা হয় যে:
…প্রদেশের মোট ৮০ লক্ষ লোকের মধ্যে মাত্র ২২ লক্ষ লোক অসমিয়া ভাষাভাষী; অপরপক্ষে ৩০ লক্ষ ও ২৮ লক্ষ লোক যথাক্রমে বিভিন্ন পার্বত্য ভাষায় ও বাংলা ভাষায় কথা বলিয়া থাকে। কিন্তু আসাম সরকার অসমিয়া ভাষাকে সরকারি ভাষারূপে চালাইবার চেষ্টা করিয়া প্রদেশের দুই-তৃতীয়াংশ লোকের উপর অপেক্ষাকৃত অল্পসংখ্যক লোকের ভাষা চাপাইয়া দিতে চাহিতেছেন। আসাম সরকারের অসমিয়া ভাষাকে ন্যায়সংগতভাবে পরিপুষ্ট করিবার যেমন অধিকার আছে, তেমনি, অন্যান্য ভাষাও সরকারি সাহায্যে পুষ্ট হইবার অধিকার আছে।৩৬
আসামের শিলং গভর্নমেন্ট হাউসে সহকারী প্রধানমন্ত্রী সরদার বল্লভভাই প্যাটেল প্রতিনিধি-দলের বক্তব্য ধৈর্য সহকারে শোনেন এবং দলের মুখপাত্র বসন্তকুমার দাসকে জানিয়ে দেন যে, শ্রীহট্টের সংখ্যালঘুরা আসামে বসবাস করতে পারবেন। এ ছাড়া আর কোনো আশ্বাস তাঁর কাছে থেকে পাওয়া যায়নি।
অবস্থার কোনো পরিবর্তন হল না। বাঙালিদের ওপর চাপ-প্রয়োগ অব্যাহত রইল। ধুবড়ির মাটিয়া গ্রামে ‘নিখিল গোয়ালপাড়া এস্টেট গ্রাম উন্নয়ন প্রজা সম্মিলন’-এর সভা অনুষ্ঠিত হয় ১৯৪৮ সালের ১৯ ও ২০ ফেব্রুয়ারি। সম্মেলন উদবোধন করেন আসামের প্রধানমন্ত্রী গোপীনাথ বরদলৈ। সভায় সভাপতিত্ব করেন অম্বিকাগিরি রায়চৌধুরি। দু-দিনের এই সম্মেলনে বেশ কয়েকটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। এসব প্রস্তাবের মধ্যে ৫ সংখ্যক সিদ্ধান্তটি ছিল চমকে দেওয়ার মতো। সিদ্ধান্তটির অসমিয়া ভাষার বঙ্গানুবাদ ছিল এরকম:
গোয়ালপাড়া জেলার বিদেশী (অর্থাৎ পাকিস্তান হইতে আগত বাঙ্গালী হিন্দুদের বর্তমানে যাহারা পূর্ব পাকিস্তান হইতে প্রত্যহই আসামে আসিতেছেন) লোকদের যাহাতে জমি দেওয়া না হয় তাহার জন্য কতৃপক্ষকে যথাবিহিত ব্যবস্থা অবলম্বন করিতে অনুরোধ করা হউক। আর ১৯৩৭ সালের পর যে সকল লোক পাকিস্তান হইতে আসামে আসিয়াছে, তাহাদিগকে আসাম হইতে বাহির করিয়া দেওয়া হউক।৩৭
সিদ্ধান্তসমূহে সভাপতি হিসেবে স্বাক্ষর করেন অম্বিকাগিরি রায়চৌধুরী। আর এসবই ঘটল গোপীনাথ বরদলৈ-এর উপস্থিতিতেই। বলা প্রয়োজন যে, সভার সিদ্ধান্তসমূহ সরকারিভাবে মুদ্রিত হয় এবং যথাযথ স্থানে প্রেরিত হয়। এ প্রসঙ্গে গোয়ালপাড়ার এস ডি ও. স্বাক্ষরিত একটি চিঠির উল্লেখ করা যায়। চিঠিটি সংবাদপত্রে মুদ্রিত হয়েছে এভাবে:
Office of the Sub-divisional Officer, Goalpara, Dated, Goalpara, the 3rd March 1948. The undermentioned document is forwarded to officer-in-charge, Trust Estate Chapar (P.O. Bilashipara) for favour of necessary action, so far as para 5 is concerned.
Sd/H. Barah
Sub-divisional Officer, Goalpara
Forward by
U.C. Deka
Sr. E.A.C. Goalpara.
One copy of resolution of the ‘Nikhil Goalpara Estate Gaon Unnayan Proja Sammilan’ held at Matia on the 20th February, 1948.৩৮
১৯৪৮ সালের এপ্রিল মাসে ‘অহম জাতীয় মহাসভা’-র ডিব্রুগড় শাখা ডিব্রুগড়ে আয়োজিত এক জনসভায় এই মত প্রকাশ করা হয় যে, গণপরিষদের খসড়া প্রস্তাবে পূর্ববঙ্গ এবং অন্যান্য স্থান থেকে যারা আসামে এসেছেন— তাদের নাগরিক অধিকার প্রদানের যে কথা বলা হয়েছে— আসামের জন্য তা অশনি সংকেত। বক্তাগণ বলেন যে, কেন্দ্রীয় সরকারের এই নীতির ফলে আসামে অসমিয়াগণ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবেন। বক্তাগণ খসড়া প্রস্তাবের ৫বি ২ ধারা পরিবর্তনের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি আবেদন জানান। একই সঙ্গে প্রাদেশিক সরকারকেও এ ব্যাপারে অবিলম্বে ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানান। সভা প্রাদেশিক সরকারের কাছে আরও দাবি জানায় যে: ‘… তাঁহারা যেন অনতিবিলম্বে অসমিয়া ভাষাকে আসামের সরকারি ভাষা বলিয়া ঘোষণা করেন। আসামের ভূতপূর্ব মন্ত্রী বসন্তকুমার দাস পূর্ববঙ্গের আশ্রয়প্রার্থীদের আসামে পুনর্বসতি ব্যবস্থা করিবার জন্য কেন্দ্রীয় গভর্নমেন্টের নিকট যে স্মারকলিপি পেশ করিয়াছেন, তাহা প্রদেশের স্বার্থের প্রতিকূল’।৩৯
এ থেকে দু-টি বিষয় স্পষ্ট— এক, প্রধানত পূর্ববঙ্গ থেকে যেসব বাঙালি হিন্দু জীবন এবং মান-সম্ভ্রম রক্ষার্থে আসামে আশ্রয় নিয়েছেন— তাদের নাগরিক অধিকার দেওয়া যাবে না এবং দুই, অবিলম্বে অসমিয়া ভাষাকে আসামের সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে।
১৯৪৮ সালের ৩ মার্চ আসামের প্রধানমন্ত্রী গোপীনাথ বরদলৈই বিধান পরিষদে ঘোষণা করেন যে, অ-অসমিয়ারা ডোমিসাইল বলে স্বীকৃত হতে গেলে নিম্নলিখিত শর্তাদি তাদের পূরণ করতে হবে:
১. বাড়ি নির্মাণ করিয়া অন্যূন ১০ বৎসরকাল অবিচ্ছিন্নভাবে বাস করিতে হইবে;
২. মৃত্যুকাল পর্যন্ত বাস করার ইচ্ছা প্রকাশ করিতে হইবে (Desire to live till his death);
৩. তাহার পূর্ব বাসস্থানে বা সেই জেলায় পুনঃ পুনঃ যাইতে পারিবে না;
৪. পূর্ব বাসস্থানে কোনো ভূসম্পত্তি থাকিতে পারিবে না;
৫. পূর্ব বাসস্থানের সহিত কোনো স্বার্থ বা সম্পর্ক থাকিবে না।৪০
‘ডোমিসাইল’ প্রসঙ্গে আসাম সরকার যেসব শর্ত আরোপ করেন, তা ছিল প্রকৃত অর্থে ভারতীয় সংবিধানের মূল চেতনার পরিপন্থী। বিচারপতি মেহরোত্রা কমিশনে সওয়াল-জওয়াব কালে ব্যারিস্টার এন সি চ্যাটার্জি তথ্য প্রমাণ তুলে ধরে ডোমিসাইল সার্টিফিকেট নীতির তীব্র সমালোচনা করে জানান যে, অসমিয়া ভিন্ন আসামের অন্যান্য ভাষাভাষী অধিবাসীগণকে সমান নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করাই আসাম সরকারের ঘোষিত নীতি ছিল। ‘বিদেশে গিয়া তথাকার নাগরিক অধিকার অর্জন সম্পর্কে যে সকল আইন আছে, এই ‘ডোমিসাইল’ আইন তাহার চাইতেও কঠোর। ভূমিস্বত্ব সংক্রান্ত নিয়মাবলি এবং অন্যান্য অনেক ব্যবস্থায়ও অসমিয়াভাষী এবং অন্যান্য ভাষাভাষীদের মধ্যে পার্থক্য করা হইয়াছে। এই সকল কারণে পৃথিবীর যেকোনো সরকারই নিন্দনীয় হইতে বাধ্য।’৪১
বাঙালি উদবাস্তুদের কাছে জমি বন্দোবস্ত, হস্তান্তর, বিক্রি ইত্যাদি ক্ষেত্রেও সরকারি বিধিনিষেধ আরোপিত হল। বাঙালিরা বৈষম্যের শিকার হলেন। ১৯৪৮ সালের ৪ মে আসাম সরকারের রাজস্ব বিভাগের সচিব এস জে ডানকান (S J Duncan) স্বাক্ষরিত যে চিঠি জেলার ডেপুটি কমিশনারদের কাছে পাঠানো হল— তা ছিল উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, একদেশদর্শী। চিঠির বয়ান ছিল এরকম: ‘পাকিস্তান থেকে উদবাস্তু আগমনে যে সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে এবং সে-কারণে শান্তি-শৃঙ্খলা ও সামাজিক স্থিতাবস্থা রক্ষার উদ্দেশ্যে গভর্নমেন্ট তাদের নীতির পুনরুল্লেখ করে জানাচ্ছেন যে যারা প্রদেশের প্রকৃত অধিবাসী নন— তাদের যেন কোনো অবস্থায়ই জমি বন্দোবস্ত দেওয়া না হয়। বর্তমান সঙ্কট অবস্থায় যেসব অ-অসমিয়ার আসামে জমিজমা ও বাড়ি আছে— তারা প্রকৃতপক্ষে আসামকে নিজের বাসভূমি বলে গ্রহণ করে থাকলেও Non-indigenous অধিবাসী সংজ্ঞাভুক্ত হবেন। যদি কোনো সরকারি কর্মচারী এই নির্দেশ অমান্য করেন— তাহলে তাকে শাস্তি দেওয়া হবে (if any officer be found to have violated these instructions, his name should be reported to the Government at once for disciplinary action)’৪২ আসাম সরকার ‘Indigenous’ শব্দের ব্যাখ্যাও দিলেন এবং তা ‘গেজেট’ ভুক্তও করা হল। সরকারিভাবে বলা হল:
Indigenous persons of Assam mean persons belonging to the State of Assam and Speaking the Assamese language or any tribal dialect of Assam, or in the case of Cachar, the language of the region.৪৩
লক্ষণীয়, কাছাড় জেলার অধিকাংশ মানুষ বাংলা ভাষাভাষী হলেও সরকার সচেতনভাবেই বাংলা ভাষা পরিহার বা অস্বীকার করে লিখলেন— ‘language of the region’
১৯৪৮ সালেই গোপীনাথ বরদলৈ আসাম আইনসভায় ঘোষণা করলেন:
It is not the intention of the Government to make Assam a bi-lingual State and for the sake of homogenity of the province … all non-Assamese to adopt Assamese language.৪৪
১৯৪৮ সালের মে মাসে গৌহাটি ও তার আশপাশ এলাকায় বাঙালিদের ওপর বড়ো রকমের হামলা চালানো হল। এই হামলা এতটাই ব্যাপক ছিল যে, কেবল পুলিশবাহিনী নয়— অবস্থা নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনীও নামানো হয়েছিল। মারপিট, ছুরিকাঘাত, দোকানপাট ভাঙচুর, মালামাল লুট, বাসগৃহ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ ইত্যাদি ঘটনা ঘটেছিল ব্যাপকভাবে। আহত অবস্থায় ভরতি হয়েছিলেন বহু বাঙালি। অনেকে আহত হলেও রাষ্ট্রিক ও সামাজিক ঝামেলা এড়াতে কোনো সরকারি হাসপাতালে তারা চিকিৎসা গ্রহণ করেননি। একজনের মৃত্যু সংবাদ সরকারিভাবে স্বীকার করা হয়। প্রথম ঘটনা ঘটল এপ্রিল মাসেই।
২৫ এপ্রিল রাতে রাঙ্গিয়ায় একজন আর এম এস কর্মীকে আক্রমণ করে আহত করা হল। বাঙালি এই সরকারি কর্মীকে আক্রমণ করে একজন অসমিয়া মিস্ত্রি। ২৮ এপ্রিল দিনের বেলায় অপর আর একজন বাঙালিকর্মী আক্রান্ত হলেন। রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অসমিয়া খালাসি বাঙালি কর্মীটিকে বেদম প্রহার করে। ফলে, বাঙালিদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার হয়। তাঁরা প্রাণভয়ে অফিস ভবনে আশ্রয় গ্রহণ করেন। তখন থেকে তাদের বন্দিদশা। এ সময় বাঙালি বিদ্বেষ চরম আকার নেয়। বন্দি বাঙালিদের একজন বাইরে এসে পরিত্রাণের আশায় কেন্দ্রীয় সরকারের ডাক ও তার বিভাগীয় মন্ত্রী রফি আহমেদ কিদোয়াই এবং আসামের প্রধানমন্ত্রী গোপীনাথ বরদলৈকে তারাবার্তা পাঠালেন এই বলে যে, তাদেরকে বন্দিদশা থেকে উদ্ধার করে পশ্চিমবঙ্গে বদলি করা হোক।৪৫
গৌহাটিতে রেলকর্মচারী এবং অসমিয়া ছাত্রদের মধ্যে বচসা এক পর্যায়ে সংঘর্ষে রূপ নেয়। ১৭ মে উজানবাজারে কয়েকজন অসমিয়া দু-জন বাঙালি রেলকর্মকর্তা জেলা ট্রাফিক সুপার এস কে মুখার্জি এবং ইলেকট্রিক্যাল ফোরম্যানকে বেদম মারপিট করে। পরদিন রেলকর্মচারীদের নিয়ে একটি শাটেল ট্রেন রেলওয়ে হেডকোয়ার্টার পান্ডু থেকে উজানবাজার ঘাটে যাওয়ার পথে উজানবাজারে ট্রেনটি থামিয়ে দেওয়া হয়। ঠিক তখনই একদল দাঙ্গাকারী যাত্রীদের ওপর হামলা চালায়। পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটে। এ সময় গৌহাটির ডেপুটি কমিশনার এবং একদল পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছোয়। হামলায় ৮/১০ জন যাত্রী আহত হন এবং তাদের হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। রেলকর্মীরা হামলার কোনো প্রতিকার না পাওয়ায় সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেয়। উজানবাজার এলাকা অসমিয়া অধ্যুষিত হওয়ায় বাঙালি রেল কর্মচারীরা তাদের পরিবারবর্গকে ওই এলাকা থেকে সরিয়ে নেন।৪৬
১৯ মে সকালে কয়েকজন বাঙালি উজানবাজার যাওয়ার পথে আক্রান্ত হন এবং তাদের সর্বস্ব লুট করা হয়। এদিন অর্থাৎ ১৯ মে সন্ধ্যায় কয়েকশো অসমিয়া স্থানীয় রেলওয়ে কোয়ার্টারে হামলা চালায় এবং অগ্নিসংযোগ করা হয়। আকস্মিক আক্রমণে দিশেহারা কোয়ার্টারবাসীগণ প্রাণ বাঁচাতে ছোটাছুটি শুরু করেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ার উপক্রম হওয়ায় রেলওয়ে পুলিশ গুলি চালালে বেশ কয়েকজন আহত হয়। এদের মধ্যে দু-জনের অবস্থা গুরুতর বলে জানা যায়। এদিন গৌহাটির এম. ই স্কুলটিও পুড়িয়ে দেওয়া হল। গৌহাটির ঘটনা সম্পর্কে আসাম সরকার ২০ মে এক ইস্তাহারে জানালেন:
অদ্য সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত উপদ্রুত অঞ্চলে অবস্থা সম্পূর্ণ শান্ত ছিল। সন্ধ্যা ৬টার সময় একটি ছাত্র প্রহৃত হইয়াছে বলিয়া গুজব প্রচারিত হইবার সঙ্গে সঙ্গে ছাত্রদের মধ্যে তীব্র উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। ইহার পর হইতে অবস্থার অবনতি ঘটে এবং এই সুযোগে কয়েকজন দূর্বৃত্ত রেল উপনিবেশের কয়েকটি গৃহে অগ্নি সংযোগ করিতে চেষ্টা করে। ইহার পর কয়েকটি ইতস্তত আক্রমণের সংবাদ পাওয়া যায় এবং কয়েকটি দোকানও আক্রান্ত হয়। ঘটনাস্থলে অতিরিক্ত পুলিশবাহিনী আসিয়া পৌঁছায় এবং তাহারা মৃদু লাঠি চালনা করিয়া জনতা ছত্রভঙ্গ করিয়া দেয়। ইহার পরও গৃহে অগ্নিসংযোগের চেষ্টা চলিতে থাকায় পুলিশ কয়েক রাউণ্ড গুলী চালাইতে বাধ্য হয় এবং তৎকালে দুই ব্যক্তি আহত হয়। উক্ত ঘটনায় কয়েকজন ছাত্রসহ প্রায় ছয় ব্যক্তি আহত হয়। গভীর রাত্রি পর্যন্ত ডেপুটি কমিশনার, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও স্থানীয় কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ উপদ্রুত অঞ্চলে ঘন ঘন সফর করেন। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে অবস্থা সম্পূর্ণ আয়ত্তে আসে। ট্রাকযোগে ভ্রাম্যমাণ পুলিশ দল টহল দিতে থাকে এবং শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলিতে পুলিশ প্রহরী মোতায়েন করা হয়। সর্বশ্রেণীর দায়িত্বশীল মহলের সহযোগিতায় স্থানীয় কতৃপক্ষ এরূপ ঘটনা অনুষ্ঠিত হইতে না দিতে বদ্ধপরিকর।৪৭
গৌহাটির রেলওয়ে কলোনিতে হামলার পর পরই পান বাজারের বাঙালি সম্প্রদায়ের কতিপয় দোকান— আসাম ভ্যালি স্টোর্স, মণি মেকিং ফার্মেসি, গৌহাটি ডেয়ারি, দাশ অ্যাণ্ড কোং এবং তিনটি সোনার দোকানে দাঙ্গাবাজরা হামলা চালায়। তারা দরজা ভেঙে দোকানের মালামাল, টাকা-পয়সা লুট করে। এই হামলায় আসাম ভ্যালি স্টোর্সের ম্যানেজার যামিনী চক্রবর্তী এবং ম্যানেজিং ডিরেক্টর ব্রজমোহন লাহিড়ী আহত হন। ম্যানেজার যামিনী চক্রবর্তীর আঘাত গুরুতর বলে জানা যায়।৪৮
গৌহাটি থেকে আনন্দবাজার পত্রিকা-র সংবাদদাতা জানালেন: ‘…সদর পুলিশ স্টেশনের অতি সন্নিকটে উল্লিখিত ঘটনা অনুষ্ঠিত হওয়া বিশেষ আশ্চর্যজনক। অদ্যাবিধি দোকানগুলির জানালা, আলমারি ও আসবাবপত্র ভগ্ন অবস্থায় রহিয়াছে। সেই দৃশ্য মর্মান্তিক। ইহাও বিশেষ উল্লেখ্যযোগ্য যে, কোনো বাঙ্গালী মুসলমানের দোকান লুন্ঠিত অথবা ক্ষতিগ্রস্ত হয় নাই। অদ্য বাঙ্গালী হিন্দুর সমস্ত দোকান ও এখানকার ব্যাঙ্কগুলি বন্ধ রাখা হইয়াছে।’৪৯
ব্যাঙ্কার অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে নিরাপত্তাজনিত কারণে ব্যাঙ্কগুলি বন্ধ রাখার আবেদনপত্র পাওয়ার পর ডেপুটি কমিশনার এম সুলতান ‘অবস্থার উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত আজ থেকে ব্যাঙ্কগুলি বন্ধ রাখার’ আদেশ দিলেন। তিনি গৌহাটি শহরের স্কুলগুলিও বন্ধ রাখার কথা ঘোষণা করলেন শহরের পরিস্থিতির বিষয় বিবেচনা করে।৫০
কামরূপের ডেপুটি কমিশনার ১৯ মে মধ্যরাত থেকে ১৪ দিনের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করে পাঁচ বা ততোধিক ব্যক্তির সমাবেশ, লাঠি বা অস্ত্র নিয়ে ঘোরাফেরা, লরি, গাড়ি, ওয়াগন বা জিপে করে পাঁচ বা ততোধিক ব্যক্তির চলাচল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে এক আদেশ জারি করেন। গৌহাটি মিউনিসিপ্যাল এলাকা ও সন্নিহিত অঞ্চল এবং পান্ডুতে এই আদেশ বলবৎ থাকবে বলেও ঘোষণায় উল্লেখ করা হয়।৫১
সংবাদপত্রে আরও বলা হল— সকালে একটি উন্মুক্ত ট্রাকে কয়েকজন অসমিয়াকে বাঙালি বিরোধী ধ্বনি সহকারে শহর পরিভ্রমণ করতে দেখা যায়। এরূপ ধ্বনিকারীদের বহনকারী ট্রাকটিকে অনেকক্ষণ আদালত প্রাঙ্গণের সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। কেউ তাদের বাধা দেয়নি। সন্ধ্যায়ও একটি উন্মুক্ত ট্রাকে চড়ে একদল অসমিয়া পূর্ববৎ ধ্বনি সহকারে পল্টন বাজারের মধ্যে দিয়ে যায় এবং তারা বাঙালিদের বাসগৃহ ও বাংলা হাই স্কুলে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে।
২০ মে সকালে ডনবসকোর সন্নিকটে একজন আর এম এস ইনস্পেকটর এবং অপর এক ব্যক্তি অসমিয়াদের দ্বারা প্রহৃত হন। ১৪৪ ধারা বলবৎ থাকা সত্ত্বেও অসমিয়াদের দলবদ্ধভাবে মোড়ে মোড়ে লক্ষ করা গেল। বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়কে অসহায় ভীত-সন্ত্রস্ত মনে হল। ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের অন্তর্গত কোনো প্রদেশে এরূপ ঘটনা ঘটতে পারে—এমনটা বিশ্বাস করা যায় না বলে সংবাদপত্রে মত প্রকাশ করা হয়।৫২
হাঙ্গামা আর গৌহাটি শহরে সীমাবদ্ধ থাকেনি, বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে। ভরালমুখ এবং কুমার-পাড়ার বাঙালিরাও আক্রান্ত হলেন। এই এলাকার বহু বাঙালি হিন্দু পরিবারকে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়। কিন্তু তারপরও পুলিশি টহলের মধ্যেই তারা আক্রান্ত হন। গুরুতর আহত রেলওয়ে কর্মচারী উমেশচন্দ্র দাশগুপ্তের অবস্থা সঙ্কটজনক বলে জানা যায় এবং তার মৃত্যুকালীন জবানবন্দি গ্রহণ করা হয়। পরে এই রেলকর্মচারীর মৃত্যু ঘটে। হাঙ্গামায় ২৪ জন আহত বাঙালিকে রেলওয়ে হাসপাতাল এবং অপর আরও কয়েকজন আহতকে সিভিল হাসপাতালে ভরতি করা হয়। আহতদের মধ্যে সরকারি কর্মচারী টেলিগ্রাফিস্ট চিত্ত ঘোষ ছিলেন অন্যতম।৫৩
ব্রহ্মপুত্র নদের অপর পারে বহু বাঙালি ধীবরের গৃহেও অগ্নিসংযোগ করা হল। আগুনের লেলিহান শিখা এতটাই তীব্র ছিল যে, তা গৌহাটি শহর থেকেও প্রত্যক্ষ করা যায়।৫৪ বিক্ষিপ্ত হামলা অব্যাহত থাকায় বাঙালিরা দোকান, ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান খোলা থেকে বিরত থাকেন। বাঙালিদের মধ্যে ভয়, আতঙ্ক তখনও বিরাজমান। কারণ বিনা ওয়ারেন্টে দিনে তো বটেই রাতেও অনেক বাঙালি পরিবারে খানা তল্লাশি চালিয়ে গ্রেফতার অব্যাহত ছিল। বিশিষ্ট রেলকর্মীদের ডেকে এনে বা কর্তব্যরত রেলকর্মীদের ধরপাকড় চলছিলই। ইতিমধ্যে অনেক রেলকর্মী গ্রেফতারও হয়েছিলেন।
২১ মে রাতে আসাম সরকারের প্রচার বিভাগের পরিচালক এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানান যে, গত ২৪ ঘণ্টা গৌহাটি ও তার আশপাশ এলাকা শান্ত আছে। বিক্ষিপ্ত কিছু মারপিট ছাড়া আর কোনো ঘটনা ঘটেনি। পুলিশ ৮ ব্যক্তিকে গ্রেফতার এবং কয়েকটি বাড়িতে হানা দেয়। সশস্ত্র পুলিশ এবং সেনাবাহিনী টহল দিচ্ছে। উত্তেজনাও স্তিমিত হয়ে আসছে। জনসাধারণকে গুজবে বিশ্বাস না করার অনুরোধ জানানো হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয় যে, সরবরাহ সচিব অমিয়কুমার বসু গৌহাটি ডেপুটি কমিশনার সমভিব্যাহারে রেলওয়ে অফিসারদের সঙ্গে দেখা করে বিস্তারিত আলোচনা করেন। পরে তাঁরা শহরের বিভিন্ন স্থান পরিদর্শন এবং উপদ্রুত অঞ্চলে যেসব সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে— সেসবেরও খোঁজখবর নেন।৫৫
২২ মে মধ্য রাতে আসাম সরকার আর এক ইস্তাহার প্রকাশ করে জানালেন যে, শনিবার গৌহাটিতে কোনো ঘটনা ঘটে নাই এবং অবস্থার উন্নতি অব্যাহত রয়েছে। ইস্তাহারে বলা হয় ঘটনার সূত্রপাত থেকে এপর্যন্ত ৩২ জন ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পুলিশ এবং সেনাবাহিনী টহল দিচ্ছে। উত্তর গৌহাটির নিকটবর্তী এক গ্রামে ২০ মে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছিল। সশস্ত্র পুলিশ ঘটনাস্থলে দ্রুত পৌঁছে যায়। ইস্তাহারে আরও বলা হয় যে, প্রচার সচিব মৌলানা তায়েবুল্লা আজ সকালে ১৮ জন আহত ব্যক্তির সঙ্গে হাসপাতালে কথা বলেন। আহতরা উন্নতির দিকে।৫৬
এই ইস্তাহার জারির পরদিনই ২৩ মে নওগাঁয় বাঙালি স্কুলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। সরকার গৌহাটির ঘটনা বিচারে তদন্ত কমিটি গঠন করেন। গৌহাটির দাঙ্গা-হাঙ্গামার বিষয়টি আসাম বিধানসভাতেও উত্থাপিত হয়। সরকার পক্ষ থেকে সভায় জানানো হল— গৌহাটিতে ১ জন নিহত এবং ৪০ জন আহত হয়। ২২টি ঘরবাড়িতে লুটপাট চালানো হয়। মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয় ১১টি বাড়ি, ৩টি ঘরে অগ্নিসংযোগ এবং ২টি ওষুধের দোকান ধ্বংস করা হয়।৫৭
বিধায়কদের উপস্থিতিতে সরকার পক্ষের দেওয়া তথ্য যে সত্যের অপলাপ তা ইতিমধ্যে বর্ণিত তথ্য থেকে স্পষ্ট। গৌহাটির ঘটনায় বিভিন্ন মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যায়। সংবাদপত্র, সংগঠন এবং ব্যক্তি পর্যায়ে যেসব প্রতিক্রিয়া মতামত লক্ষ করা গেছে— তা কোনোভাবেই উপেক্ষণীয় নয়।
শিলং টাইমস গৌহাটি হাঙ্গামার নিন্দা জানিয়ে লিখল: …এ কী হচ্ছে? কিছুদিন ধরে এই শহর সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ প্রচারের কেন্দ্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। গোপীনাথ বরদলৈ মন্ত্রীসভায় তিনজন গৌহাটির মানুষ রয়েছেন। তিনি নিজেও গৌহাটির অধিবাসী, তা সত্ত্বেও আইন ও শৃঙ্খলার এই শোচনীয় পরিণতি কীভাবে সম্ভব হল? শান্তিকামী জনসাধারণের তিনি রক্ষার ব্যবস্থা করতে পারলেন না কেন? এই বেপরোয়া অরাজকতার ফলে শহরের শান্তিপ্রিয় অধিবাসীগণই অত্যাচারিত হয়েছেন। সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ প্রচারের জন্য গৌহাটি কুখ্যাত হয়েছে। শহরের বুকের উপর যে-সমস্ত বক্তৃতা অবাধে দেওয়া হয়েছে এবং সংবাদপত্রে যা লেখা হয়েছে— তা আমরা উপেক্ষা করতে পারি না। সম্প্রতি গৌহাটির এক সংবাদপত্রে আসাম রেলওয়ের জনৈক টিকেট কালেক্টর সম্পর্কে অভিযোগ করা হয়েছে যে, তিনি বৈষম্যমূলক ব্যবহার করে থাকেন। এই দায়িত্বহীন প্রচার কাজের ফলে যদি কোনো টিকেট কালেক্টর এরূপ হাঙ্গামায় জড়িত হয়ে পড়েন এবং রেলের কর্মচারীদের প্রতি এরূপ গুণ্ডামি হয়, তাহলে ষড়যন্ত্রের সূত্র আবিষ্কার করা কঠিন হতে পারে না।
গভর্নমেন্টের গৌহাটি এজেন্টগণ সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের সম্ভাবনা বুঝতে পেরেও সংঘর্ষ নিবারণে বা আপৎকালীন ব্যবস্থা গ্রহণে কেবল ব্যর্থই হননি, প্রথম ঘটনার পর কয়েকদিন ধরে যে হাঙ্গামা চলে— তাঁরা তাও নিবারণ করতে পারেননি। এই হাঙ্গামার সঙ্গে আসাম রেলওয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বা কর্মচারী জড়িত ছিলেন। এই জেলায় শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষা ব্যবস্থার পক্ষে এটা লজ্জার বিষয়। গৌহাটির ন্যায় একটি শহরে এরূপ গুণ্ডামি কেউ-ই সমর্থন করতে পারে না। কিন্তু স্থানীয় কতৃপক্ষ যে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন—তা থেকে তাদের কিছুতেই মুক্ত করা চলে না। ঘটনা সম্পর্কে নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। আমরা আশা করি, অবিলম্বে একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হবে এবং কঠোর হাতে এরূপ হাঙ্গামা দমনের ব্যবস্থা হবে।৫৮
গৌহাটির হাঙ্গামা সম্পর্কে কাছাড় জেলা কংগ্রেস কমিটির সেক্রেটারি পরেশচন্দ্র চৌধুরী এবং ‘সুরমা সম্মিলনী’-র জেনারেল সেক্রেটারি সুনির্মল দত্ত যৌথ বিবৃতিতে জানালেন:
গৌহাটিতে গত কয়েকদিন যে শোচনীয় ঘটনা ঘটিয়া গেল ইহা দ্বারা প্রদেশের শান্তিকামী প্রত্যেক ব্যক্তি প্রকৃত অবস্থা হৃদয়ঙ্গম করিবেন। টিকেটবিহীন এক রেলযাত্রীর সঙ্গে ঝগড়ার গুরুতর পরিণতি দেখিয়া সকলেই বুঝিবেন যে, কোথাও নিশ্চয় কিছু গলদ আছে। ঘটনা বিশ্লেষণ করিলে বুঝা যাইবে এই অবস্থা একদিনে বা হঠাৎ হয় নাই। পান্ডুর ঘটনার বহুপূর্বেই গৌহাটিতে জনসভায় এবং সংবাদপত্র মারফৎ অসমিয়া ও কোনো প্রদেশ বিশেষের অধিবাসীদের মধ্যে বিদ্বেষ প্রচার চলিতেছিল। এই ঘটনার পরে আসামের সংবাদপত্রসমূহ এবং আসাম জাতীয় মহাসভা প্রমুখ প্রতিষ্ঠানসমূহ ইহাকে সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা রূপ দিয়াছে। ইহার ফলেই উত্তেজনা বৃদ্ধি পাইয়া মারপিট, লুন্ঠন ও অগ্নিসংযোগ প্রভৃতিতে পরিণত হয়। জাতীয়তা বিরোধী এক শ্রেণীর লোক ইহার সুযোগ গ্রহণ করিয়াছে— এরূপ হইতে পারে। বরদলৈ মন্ত্রীসভা ও আসামের কংগ্রেস প্রতিষ্ঠানকে হেয় প্রতিপন্ন করাই তাহাদের উদ্দেশ্য। পরে ইহাই দেখা গিয়াছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় গভর্নমেন্ট প্রকৃত অবস্থা বুঝিতে পারেন নাই এবং এ সম্পর্কে ব্যবস্থা করিতে দুর্বলতার পরিচয় দিয়াছেন। প্রবল উত্তেজনা বর্তমান থাকা সত্ত্বেও গভর্নমেন্ট সাম্প্রদায়িক প্রচারকার্য বন্ধ করিবার জন্য যথাসময়ে ব্যবস্থা অবলম্বন করেন নাই। ইহা দ্বারা মনে হয় স্থানীয় কতৃপক্ষ হয় উদাসীন, নয়ত তাঁহারা কোনো ব্যবস্থা করিতে অনিচ্ছুক। এই সমস্ত অত্যাচারমূলক কার্য এক দলই করিয়াছে। কিন্তু গৌহাটি শহরে অন্য দলেরই সংখ্যাধিক্য রহিয়াছে। যদি গৌহাটির ন্যায় শহরেই এরূপ ঘটিতে পারে তখন অন্যান্য স্থানে সংখ্যালঘিষ্ঠ সম্প্রদায় কীরূপে আপনাদের নিরাপদ মনে করিতে পারে? বিলম্বে হইলেও স্থানীয় কতৃপক্ষ হাঙ্গামা দমনের জন্য বাধ্য হইয়া কিছু করিয়াছে। কিন্তু মন্ত্রীসভা এ সম্পর্কে একেবারেই নীরব, অথচ গৌহাটির তিনজন মন্ত্রী মন্ত্রীসভায় রহিয়াছেন। এই ঘটনার নিন্দা করিয়া তাঁহারা একটি বাক্য উচ্চারণ করা সংগত মনে করেন নাই। উত্তেজনার কারণ বর্তমান না থাকা সত্ত্বেও একদল এই গুণ্ডামি করিয়াছে, কিন্তু আর একদল প্ররোচনা সত্ত্বেও অসীম ধৈর্যের পরিচয় দিয়াছে এবং প্রতিশোধ গ্রহণ হইতে বিরত রহিয়াছে।
ইহা ছাড়া অসমিয়া সংবাদপত্রে এই পুরাতন অভিযোগ প্রকাশিত হইতেছে যে, রেল বিভাগে আসামের লোক বেশি নাই। ইহারা প্রকারান্তরে এই গুণ্ডামিকে সমর্থন করিয়াছে। কতৃপক্ষের নীরবতায় দূর্বৃত্তগণ এই সমস্ত কার্যে আরও উৎসাহ পাইতেছে।৫৯
শিলচরে ১৯ মে সন্ধ্যায় প্রাদেশিকতার বিরুদ্ধে এক বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। মণিপুরি নেতা ধনেশ্বর সিংহ সভায় সভাপতিত্ব করেন। বিশিষ্ট কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ সভায় বক্তব্য রাখেন। অধিকাংশ বক্তা অসমিয়াদের উগ্র প্রাদেশিকতার নিন্দা জানান। তাঁরা আসাম সরকারকে অম্বিকাগিরি রায়চৌধুরী প্রভাবিত ‘অসম জাতীয় মহাসভা’-কে নিষিদ্ধ ঘোষণা করারও দাবি জানান। সভায় দু-টি প্রস্তাব গৃহীত হয়। এক. প্রাদেশিকতার নিন্দা, গৌহাটিতে রেলওয়ে ধর্মঘটীদের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন এবং অবিলম্বে নিরপেক্ষ তদন্ত ও সমগ্র প্রতিক্রিয়াশীল সংগঠন নিষিদ্ধকরণ; এবং দুই. অসম জাতীয় মহাসভাকে বেআইনি ঘোষণা।৬০
পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় ২০ মে বি. এ. রেলওয়ে কর্মচারী সমিতির উদ্যোগে আসাম রেলওয়ে কর্মচারীদের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ‘ভ্রান্ত পথে চালিত একদল লোকের বাঙ্গালি বিদ্বেষ প্রচার ও উত্তেজনাপ্রদ বক্তৃতার ফলে আসাম প্রদেশে নিযুক্ত বাঙ্গালি রেলওয়ে কর্মচারীদের ধন ও প্রাণ বিপন্ন হইবার যে আশঙ্কা উত্তরোত্তর বর্ধিত হইতেছে, তাহাতে আতঙ্ক প্রকাশ করা হয়।’৬১ সভায় গৌহাটিতে বাঙালি কর্মচারীদের ওপর আক্রমণের ফলে ৬ জন গুরুতররূপে আহত হওয়ার যে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে তাতে গভীর উদবেগ প্রকাশ করা হয়।
২৬ মে বুধবার সন্ধ্যায় কলকাতার শ্রদ্ধানন্দ পার্কে গৌহাটি ঘটনার প্রতিবাদে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বক্তাগণ বলেন যে, কিছুকাল যাবত আসামে বাঙালি বিদ্বেষ প্রচার করা হচ্ছিল— যার পরিণতি গৌহাটির বর্তমান অবাঞ্ছিত ঘটনা। সভায় সভাপতিত্ব করেন হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ। শ্রী ঘোষ বলেন, আসামে বাঙালিদের লাঞ্ছনা নতুন নয়, সকলের মূলে চাই প্রত্যেক বাঙালির নিজস্ব চেতনা; নতুবা তাঁদেরকে এই লাঞ্ছনা ও অপমানের হাত থেকে কেউ রক্ষা করতে পারবে না। বক্তাগণ উভয়বঙ্গের প্রধানমন্ত্রীকে এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার অনুরোধ জানান। অন্যান্যের মধ্যে প্রফুল্লরঞ্জন ঠাকুর, রঙ্গলাল মন্ডল, সিদ্ধেশ্বর চট্টোপাধ্যায়, অবনীমোহন মজুমদার, রবি চট্টোপাধ্যায়, বীরেন্দ্রচন্দ্র সেন প্রমুখ সভায় বক্তৃতা করেন।৬২
আসামের ডোমিসাইল্ড বাঙালিদের নেতা অ্যাডভোকেট প্রবোধকুমার লাহিড়ী গৌহাটির হাঙ্গামা সম্পর্কে এক বিবৃতিতে জানালেন—বাঙালি টিকিট কালেকটর এবং স্কুল ছাত্রের মধ্যে বচসা-মারপিটকে কেন্দ্র করে যেসব ঘটনা সংঘটিত হয়-সে-সম্পর্কে অনতিবিলম্বে কতৃপক্ষের যুক্ত তদন্তের ব্যবস্থা করা উচিত। আমরা বাঙালিরা আসামে আমাদের পিতা, পিতামহের অর্জিত সমস্ত অর্থ নিয়োগ করেছি। যারা আসামের নন, আমাদের ওপর প্রভুত্ব করবার কোনো অধিকার তাদের নেই। অসমিয়া এবং আসামের বাঙালি অধিবাসীদের মধ্যে উচ্চ-নীচ ভাব থাকতে পারে না। আমরা একই।৬৩
অসম জাতীয় মহাসভার জেনারেল সেক্রেটারি অম্বিকাগিরি রায়চৌধুরী বিবৃতির জবাব দেন। তিনি জানান, যে প্রশ্ন সমগ্র আসামের, সেই প্রশ্ন প্রবোধকুমার সম্যক বুঝতেই পারেননি। তিনি আরও জানান, তাঁরা তাঁদের [প্রবোধকুমার লাহিড়ী] পিতা, পিতামহের সমস্ত অর্থ আসামে নিয়োগ করেছেন, কিন্তু তিনি নিজেকে ‘বাঙালি’ বলেই অভিহিত করেছেন, নিজের স্বাতন্ত্র্য পরিহার করতে পারেননি। রায়চৌধুরী জানান, যাঁরা আসামে চিরস্থায়ীভাবে বাস করবেন—তাঁদের স্বাতন্ত্র্যমূলক মনোভাব থাকলেই তাঁরা কায়েমি স্বার্থ দাবি করবেন। যাঁরা আসামে স্থায়ীভাবে বাস করবেন—তাঁরা আসামের সমস্ত কিছু গ্রহণ করে অসমিয়াদের সঙ্গে একই মনোভাবাসম্পন্ন বা একাত্ম হবেন—এটাই অসমিয়াগণ চান। এ ছাড়া আসামে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে না এবং আসাম ও ভারতের নিরাপত্তাও ফিরে আসবে না।৬৪
অম্বিকাগিরি রায়চৌধুরীর এই বক্তব্য একদিকে যেমন বাঙালি তথা অন্যান্য অ-অসমিয়াদের প্রতি স্পষ্ট বার্তা দেওয়া অন্যদিকে ভারত সরকারকেও সরাসরি চ্যালেঞ্জ জানানো— যা আসামের অ-অসমিয়া অধিবাসীদের উদবেগের কারণ বই কী। কিন্তু তারপরও ভারত সরকার নীরব।
এ সময় সংবাদপত্রে সম্পাদকীয় নিবন্ধে নানা প্রশ্ন উত্থাপিত হয়, সেসব প্রশ্নগুলোও আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে ইতিহাসের ধারাবাহিকতার কথা মনে রেখেই। আনন্দবাজার পত্রিকা-য় ‘বিভ্রান্ত আসাম’ শীর্ষক সম্পাদকীয় নিবন্ধে যা বলা হল— তার সারকথা এরকম: ৮ মে থেকে ২০ মে পর্যন্ত গৌহাটি শহর এবং তার আশপাশ এলাকায় ঘটনা ঘটেছে অনেকগুলো। এসব ঘটনায় নিরীহ নিরপরাধ পথচারীকে আক্রমণ ও প্রহার, দোকান লুঠ, ভদ্রলোকের বাসাবাড়িতে চড়াও, বাসভবনে অগ্নিসংযোগ, ট্রেন আক্রমণ ইত্যাদি নিষ্ঠুর জুলুমবাজির সঙ্গে গালিগালাজ ও ভীতি প্রদর্শন সমানে চলেছে। বিশেষ করে ১৮ ও ১৯ মে তারিখে যে-সকল ঘটনা ঘটেছে, সেগুলোকে একত্রে বিচার করলে দলবদ্ধ দাঙ্গাবাজি ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। প্রাপ্ত বিবরণে স্পষ্ট গৌহাটি শহরের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়েছিল। দু-দিন ডাক বিলি হয়নি। স্থানীয় বহু অফিসে কাজ হয়নি। ব্যাঙ্কগুলি বন্ধ ছিল। ট্রেন চলাচল একদিন বন্ধ থাকার পর সশস্ত্র প্রহরীর সাহায্যে ট্রেন চালানো হয়েছিল।
‘২৩ মে হইতে গৌহাটিতে আর অবাঞ্ছনীয় ঘটনা ঘটিতেছে না’— এটুকু দেখে যদি আসাম সরকার তাঁদের কর্তব্য শেষ করেন এবং ভারত গভর্নমেন্ট এ ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হন, তবে গুরুতর কর্তব্যচ্যুতি হবে। কেননা গৌহাটির এই অশান্তি-কার্যকারণ কোনো আকস্মিক ব্যাপার নয়। এটা একটা গভীর, ব্যাপক এবং জটিল চক্রান্তজাত অসুস্থ উত্তেজনার অভিব্যক্তি।
আসামের ‘বঙ্গাল খেদা’ আন্দোলন একটা প্রাদেশিক ব্যাপার বলেই ধারণা ছিল। কিন্তু গৌহাটির শোচনীয় ঘটনায় দেখা গেছে যে, ‘বঙ্গাল খেদা’ দলের অশোভন উদ্যমে আসামের মুসলিম লিগ দলভুক্তগণের সক্রিয় সংযোগ ঘটেছে। রেল কর্মচারীদের ওপর আক্রমণ মুসলিম ছাত্রাবাসের সন্নিকটেই আরম্ভ হয়েছে এবং অনেক দূর ব্যাপ্ত হয়েছে। ঘটনার সঙ্গে দলবদ্ধ মুসলমান ছাত্রদের যোগাযোগ সকলেরই প্রত্যক্ষ। এটাও লক্ষ করা প্রয়োজন যে, সে-সময়ে গৌহাটিতে বাঙালি হিন্দুর দোকান লুন্ঠিত হয়েছে, প্রভূত সম্পত্তি অপহৃত হয়েছে, কিন্তু পার্শ্ববর্তী বাঙালি মুসলমানদের দোকান অব্যাহত রয়েছে। দাঙ্গার এই রীতি আমাদের অপরিচিত নয়। ঘটনা কোন জটিল আবর্তের মধ্যে পাক খাচ্ছে, তা বুঝতে হলে এ রহস্য ভেদ করা প্রয়োজন।
আর একটি বিষয়ও প্রণিধানযোগ্য। গৌহাটির ঘটনার গোড়ার দিকে কামরূপ জেলার ভারপ্রাপ্ত ডেপুটি কমিশনার এবং পুলিশ সুপার, দু-জনেই ছিলেন মুসলমান। অভিযোগ এই যে, তাঁদের কাছে সাহায্য চেয়েও বহু বিপন্ন মানুষ যথোচিত সাহায্য পাননি। শান্তি রক্ষার্থে নিয়োজিত পুলিশ ও সরকারি কর্মচারীর সম্মুখেই উত্তেজনামূলক অপপ্রচার চলেছে, এমনকী, অন্যায় জুলুমবাজি পর্যন্ত হয়েছে, তবু তা দমনে সক্রিয় সরকারি ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলেই ব্যাপার এতদূর গড়িয়েছে। শেষপর্যন্ত ‘পীড়িত’ বলে ডেপুটি কমিশনার তাঁর কার্যভার অ্যাডিশনাল জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মি. রায়ের হাতে ছেড়ে দেন এবং শিলং থেকে পুলিশের ডেপুটি ইনস্পেকটর জেনারেল মি. চৌধুরী গৌহাটি এসে পুলিশের কার্যভার নেওয়ার পর অবস্থা আয়ত্তে আসে। এর তাৎপর্য কিছুতেই উপেক্ষণীয় নয়।৬৫
এ সময় সংবাদপত্রে এ সংবাদও প্রকাশিত হয় যে, আসামের মুসলিম লিগ নেতা মো: সাদুল্লা ও আদিবাসী সম্প্রদায়ের নেতৃত্বের দাবিদার সুরেন্দ্র গোহাইন নাকি মিলিতভাবে নতুন দল গড়ছেন এবং আগামী নির্বাচনে কংগ্রেস দলকে পরাস্ত করে ক্ষমতায় আসছেন। সম্পাদকীয়তে বলা হল:
… নিয়মতান্ত্রিক প্রণালীতে জনমত প্রভাবিত ও গঠিত করিয়া এই উদ্দেশ্যসিদ্ধির চেষ্টা তাঁহারা অবশ্যই করিতে পারেন। তবে সহজ পন্থা হিসেবে তাঁহারা কি ‘বঙ্গাল খেদা দলে’-র সহিত গোপনে অথবা প্রকাশ্যে হাত মিলাইবার ব্যবস্থা করিয়াছেন? আসাম কংগ্রেসের যাঁহারা নায়ক তাঁহাদের মতিগতিও সম্পূর্ণ নির্ভরযোগ্য নয়। ন্যায়, নীতি ও সংহতির খাতিরে তাঁহারা সকলেই কংগ্রেসের নীতি ও আদর্শ অনুসরণ করিতে বাধ্য। কিন্তু আগামী নির্বাচনে ‘আসাম কেবল অসমিয়াদের জন্যই’— এই সঙ্কীর্ণ স্বার্থবাদ সহজে ভোট বাগাইতে সমর্থ হইবে ভাবিয়া তাঁহাদের মধ্যে কাহারো কাহারো ভ্রান্তপথে পরিচালিত হওয়া বিচিত্র নহে। বস্তুত আশঙ্কা করিবার সংগত কারণ আছে যে, এই ভ্রান্তিই কুখ্যাত ‘বঙ্গাল খেদা’-র প্রশ্রয় দিতেছে। সুতরাং সর্বপ্রযত্নে আসাম কংগ্রেসকে তথা আসাম গভর্নমেন্টকে ভ্রান্তিমুক্ত করিতে হইবে। এ কাজের ভার সর্বভারতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠান এবং ভারত গভর্নমেন্টের গ্রহণ করা উচিত।৬৬
আমরা জানি, রেল দফতর কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে, প্রদেশ সরকারের নয়। সুতরাং রেলে কর্মরত সকল কর্মকর্তা কর্মচারী কেন্দ্রীয় সরকারের। আমরা একথাও জানি যে, গৌহাটিতে অসমিয়া সমাজের প্রথম ও প্রধান আক্রমণের লক্ষ ছিল রেলওয়ের বাঙালি কর্মকর্তা-কর্মচারী ও তাঁদের আবাসস্থল। আর এ কাজে তাঁরা সফলও হয়েছিলেন স্থানীয় প্রশাসনের দুর্বলতার কারণে। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার কি তাঁদের রক্ষা করতে পেরেছেন? পারেননি। রেলওয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের রক্ষা এবং তাঁদের মৌলিক অধিকার অক্ষুণ্ণ রাখার প্রশাসনিক ও শাসনতান্ত্রিক দায় তো তাঁদের ওপরই বর্তায়। এই দায়দায়িত্ব ও কর্তব্য কেন্দ্রীয় সরকারকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হল:
… দুই দিক দিয়া কেন্দ্রীয় গভর্নমেন্টের দায়িত্ব ও কর্তব্য রহিয়াছে— প্রথম ও প্রত্যক্ষ দায়িত্ব এবং কর্তব্য আপনার কর্মচারীদিগের সম্বন্ধে; দ্বিতীয় দায়িত্ব শাসনতন্ত্রগতভাবে বিভিন্ন প্রদেশের ও সমাজের পরস্পরের মধ্যে শান্তি ও সামঞ্জস্যবিধান এবং রাষ্ট্রের সর্বত্র সকলের মৌলিক অধিকার অক্ষুণ্ণ ও অব্যাহত রাখা।
গৌহাটির শোচনীয় ঘটনার প্রত্যক্ষ কারণ স্থানীয় বাঙালি রেল কর্মচারীদিগের উপর আক্রোশ এবং ইহাদের উপর আক্রমণই ঘটনার প্রথম পর্যায়। ইহারা কেহই আসাম গভর্নমেন্টের বেতনভোগী নহেন, কেন্দ্রীয় গভর্নমেন্টের চাকুরিয়া। কেন্দ্রীয় গভর্নমেন্ট কলিকাতার রেলওয়ের হেডকোয়ার্টার ভাঙ্গিয়া দিয়া গৌহাটিতে নূতন হেডকোয়ার্টার স্থাপন করায় ইহাদিগকে বাধ্য হইয়া গৌহাটিতে যাইতে হইয়াছে। বাঙালীদের সম্বন্ধে বিরুদ্ধ প্রচার পূর্ব হইতেই আসামে চলিতেছিল এবং গভর্নমেন্টের নিকট প্রশ্রয় পাইতেছিল। … যদিও রেল কর্মচারীরা আসাম গভর্নমেন্টের বেতনভোগী নহেন তথাপি এতগুলি বাঙালী আসামে বসিয়া খাইতেছে বলিয়া আসামের বঙ্গাল-খেদার দল লোক খ্যাপাইয়াছে। শেষপর্যন্ত তাহা গৌহাটির শোচনীয় কান্ডে পরিণতি লাভ করিয়াছে।…
কেন্দ্রীয় গভর্নমেন্টের বিশেষ দায়িত্ব— গভর্নমেন্ট স্বীয় কর্মচারীদের যথায় লইয়া গিয়াছেন তথায় তাঁহাদের নিরাপত্তা বিধানের ও অন্যান্যভাবে তাঁহাদের স্বার্থ রক্ষার দায়িত্ব। ইহা ছাড়া কেন্দ্রীয় গভর্নমেন্টের একটা শাসনতন্ত্রগত সাধারণ দায়িত্বও আছে। গৌহাটির ঘটনা মাত্র রেলওয়ে কর্মচারীদিগের উপরে আক্রমণেই শেষ হয় নাই। সাধারণ বাঙালী বাসিন্দাদিগের উপরেও আক্রমণ হইয়াছে। আক্রান্তগণ কেহ কোনো অপরাধ করে নাই—তাহারা অসমিয়া ভাষায় কথা না কহিয়া বাঙলা ভাষায় কথা কহে মাত্র— এই অপরাধেই তাহারা আক্রান্ত, আহত, অবমানিত ও হতসর্বস্ব হইয়াছে। ভারত রাষ্ট্রের একাংশের লোককে অপর এক অংশে গিয়া ব্যবসায়সূত্রে বা চাকুরিসূত্রে বাস করিতে হইলে বিনা অপরাধে তাহারা যদি এই প্রকার উৎপীড়নের লক্ষ হয়—তাহা হইলে রাষ্ট্রগঠনের পক্ষে ইহা এক প্রবল সমস্যা হইয়া দাঁড়াইবে। সুতরাং এই দিক দিয়া বিচারে কেন্দ্রীয় গভর্নমেন্ট সমস্ত ব্যাপারটাই আপনার হাতে লইতে পারেন।৬৭…
গৌহাটির দাঙ্গা প্রশ্নে স্বাধীনতার উষাকালে ১৯৪৮ সালে বিভিন্ন সংবাদপত্র, ব্যক্তি বা সংগঠন যেসব প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন, মতামত দিয়েছেন তা যে নেহায়েৎ-ই কথার কথা ছিল না বা অকারণ ছিল না— তার প্রমাণ আমরা পরবর্তী পাঁচ এবং ছয়-এর দশকেও গভীরভাবে প্রত্যক্ষ করব ভাষার নামে সর্বাত্মক বঙ্গাল খেদা অভিযানের মধ্য দিয়ে।
এই অশান্ত পরিবেশের মধ্যেই ১৯৪৮ সালের ২৮ মে আসাম সরকার এক ফরমান জারি করে ভোটার তালিকা প্রণয়ণে যুক্ত সরকারি কর্মকর্তাদের সতর্ক করে জানালেন:
The Government desires to draw your (অর্থাৎ ডেপুটি কমিশনারদের) personal attention with regard to the following non-resident population of the district. These people are not qualified to be voters. They may be staying with friends, relations or as refugees or labourers. Great caution will be necessary on the part of your staff to see that not a single individual of this class manages to creep into the electoral roll by any chance.৬৮
এই মনোভাব সুস্থ মানসিকতার পরিচয় বহন করে না— বরং সরকারের এই মনোভাবের কারণেই পরবর্তীতে সংঘাত—সংঘর্ষ-রক্তপাত ঘটেছে বারংবার।
১৯৫০ সালে প্রায় একই সময়ে পাকিস্তান অন্তর্গত পূর্ববঙ্গ, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ এবং আসাম প্রদেশে ব্যাপক আকারে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হয়। আসামের ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা কেবল নয়—সমগ্র আসাম জুড়েই দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়েছিল। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার গোয়ালপাড়া জেলা ও বড়পেটাতে হামলা ছিল ভয়াবহ। আর এই হামলার শিকার হয়েছিলেন মূলত কৃষিজীবী বাঙালি মুসলিম সম্প্রদায়। আক্রান্ত হলেন হিন্দু সম্প্রদায়ও।
দাঙ্গা কাছাড় জেলা তথা সুরমা উপত্যকার প্রায় সর্বত্রই ছড়িয়ে পড়ে। ঘটনার সূত্রপাত ১৩ ফেব্রুয়ারি করিমগঞ্জে। পূর্ববঙ্গে তখন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা চরম আকার নিয়েছে। এসময়ই আশুগঞ্জ ভৈরব বাজার ব্রিজে ট্রেন থামিয়ে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের কয়েক হাজার নারী-পুরুষ-শিশুকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এমনকী যারা ট্রেন থেকে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে বাঁচার চেষ্টা করেছিলেন তারাও বাঁচতে পারেননি, নদীর দুই তীরে অবস্থানরত দাঙ্গাকারীদের ইটের আঘাতে তাঁরা প্রাণ হারান। এই সংবাদ করিমগঞ্জ এসে পৌঁছোলে ১৩ ফেব্রুয়ারি সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা প্রকট হয়ে ওঠে এবং কয়েকটি দোকানে লুটপাট শুরু হয়। এসময় রেলগেটের ওপার থেকে এক সশস্ত্র জনতা শহর আক্রমণ করার উদ্যোগ নিলে বিধুভূষণ চৌধুরি ও মহকুমা শাসক ধর্মানন্দ দাস (পরবর্তীকালে আসামের মুখ্যসচিব) জনতার সম্মুখীন হয়ে তাদের নিবৃত্ত করতে চান। কিন্তু অকস্মাৎ জাঠা দিয়ে তাঁদের আক্রমণ করা হয়; এতে বিধুভূষণের বাহুতে গুরুতর ক্ষতের সৃষ্টি হয়। সশস্ত্র জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে এদিন পুলিশকে গুলিবর্ষণ করতে হয়েছিল।৬৯
ঘটনার সমাপ্তি কিন্তু এমন সরল রৈখিক ছিল না। করিমগঞ্জে সংঘটিত এই দাঙ্গার ব্যাপ্তি ও বিশালতা ছিল সুদূরপ্রসারী, সমকালীন সংবাদপত্রে যার পরিচয় পাওয়া যায়।
‘The Karimganj Disturbance’ শীর্ষক সংবাদে বলা হল:
Four persons have so far succumbed to their injuries in yesterday’s disturbances at Karimganj. Though no fresh disturbance occurred today, the military are patrolling the streets in the town and suburbs. Many houses were searched this morning by the police and nearly 25 persons were taken into custody.
The incidents occurred yesterday, after an armed mob had threatened to attack the local railway station. When the police intervened, they were also attacked, following which the police opened fire.৭০
১৭ ফেব্রুয়ারি শিলং থেকে পাঠানো অপর আর-এক সংবাদে বলা হয়:
The Assam Government in Press Notes issued today gave details of the recent riotings at Karimganj (Cachar district) and Lumding (Nowgong). The Press Notes stated : Rumours of looting and murder of railway passengers at Bhairab Bazar (Mymensingh)were spread by passengers at Karimganj. On the morning of February 13, a communal riot brokeout in Karimganj town. One person was killed by rioters. The police opened fire to bring the mob under control. One person was killed, stray cases of looting and arson followed.
The Deputy Commissioner and the Superintendent of Police are touring the affected areas. Meeting and processions have been baned by an order under section 144 Cr. P.C. and other executive actions against hooliganism have been taken.
The situation is well under control. Two women travelling from Narayanganj by train arrived at Karimganj on the night of Sunday, February 12, and gave out that Muslims have looted the train and murdered Hindu passangers and threw them into river at Bhairab bridge. On the morning of the 13th, an armed Muslim mob of about 280 faced a similarly armed Hindu mob of about 100 near the railway crossing. The Sub-divisional Officer tried to pacify the mob when the Muslim mob attacked the Hindus and the Police, injuring one Hindu and the town head constable. The police opened fire for dispersing the mob. One dead and one injured were picked up on the spot. Ten more injured were subsequently found in different parts of the town and removed to hospital where three of them died. There was some looting and burning of shops.
Investigation was immediately taken up. Several arrests were made and some looted property recovered.
There has been no incident since February13. The situation is quiet and fully under control. All precautionary steps against further outbreak of violence have been taken.৭১
করিমগঞ্জে সংঘটিত দাঙ্গার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে পুলিশ ৬০ জনকে গ্রেফতার করে। পত্রিকায় বলা হল:
Sixty persons have been arrested so far by the police in connection with the disturbances at Karimganj on February 13. The District and Sub-divisional authorities are taking all possible measures to prevent further troubles. The military are still patrolling the streets and the situation is now normal.৭২
লামডিং-এও হাঙ্গামার সংবাদ পাওয়া গেল। সরকারি প্রেসনোটে বলা হল:
Government have received reports from the Superintendent of Railway police and the Deputy Commissioner, Nowgong, regarding the disturbances.
It would now appear that Hindus, Particularly refugees at Lumding, were highly incensed having read in Calcutta newspapers reports of atrocities being perpetrated on Hindus in East Pakistan. Arrival of a man from East Pakistan on February 2 and his report of his sister having been forcibly taken away by Muslims added fuel to the fire.
A mob stopped a train on the 3rd evening, assaulted Muslim passangers bound for Pakistan and committed looting. The police made a lathi charge on the attackers and made arrests. Eighteen persons were injured and on examination in hospital injuries were found to be simple. Armed police were sent on receipt of information of the disturbance. The police made arrests and recovered some looted property. Investigation is proceeding. It is regrettable that highly exaggerated reports of the incident have appeared in the Press.
The recent happenings, both in West Bengal, East Bengal and in Assam make it clear that there are mischief-makers and that Press and public should be careful in believing or giving currency to any alarmist news calculated to inflame communal passions or to disturb inter-Dominion relations.৭৩
পাকিস্তান সরকার তাঁদের সংবাদপত্র এবং ঢাকা রেডিয়ো মারফত আসামে সংঘটিত দাঙ্গার ভুল ব্যাখ্যা এবং তথ্যের বিকৃতি ঘটিয়ে যে সংবাদ পরিবেশন করেন— আসাম সরকার তার প্রতিবাদ জানিয়ে এক প্রেস বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেন। ২৮ ফেব্রুয়ারি তারিখে প্রকাশিত প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হল:
It has been brought to the notice of this Government that at 19-50 hrs. on the 21st February, 1950, the Pakistan Radio Dacca, broadcast a report that mass slaughter of Muslims was proceeding in Karimganj. Badarpur and other areas and that 40,000 Muslim refugees had crossed the border into Sylhet. To one who is responsible it would seem unthinkable that such sweeping statements, capable of infinite mischief could be made and broadcast without any verification. Yet it is a fact that these statements and others of the same or similar kind were and are published in Pakistan without any attempt at verification and ascertaining the truth.
The Government of Assam have in their previous Press Note issued over a week ago given relevant details as regards the proximate cause of rioting, the turn of events, the loss of life and damage caused in the course of what seemed a sudden outburst. Loss of life on the 13th instant at Karimganj or later at Badarpur, regrettable as it was did not go into two figures. Damage by looting at Karimganj was estimated by the Deputy Commissioner at a little over a lakh of rupees and that by arson at a much smaller figure. At Badarpur three Muslim shops were looted. These disturbances resulted in the exodus of panic-stricken persons on either side. But the exodus could hardly have reached the five figures category mentioned in the Pakistan Radio broadcast. Possibly a zero was added either by inadver inadvertence or for effect.
This, by itself, may mean nothing, but coming after a digit, it has the effect of multiplying the digit ten times and when utilised for propaganda purposes increases the mischief ten-fold.
The Government of Assam have received further material which enables it to trace the roots of the trouble at Karimganj further back. The fundamental cause seems to be the reported plight of the minority community in East Pakistan which finds itself without a ray of hope of any betterment of conditions or prospects. It finds that for all ills, real and imaginary, from which people in Pakistan suffer, Hindus are made or held responsible. If there be a fire, accidental or otherwise, the Hindu is the culprit. The Hindus must not even protest. Protests, if made, are suppressed. Muslim mobs are, it is alleged, incited or encouraged to deal in their own way with Hindu life and property. It is said that an incident happened at Habiganj where Hindus were roughly handled for even protesting. Refugees from Sylhet and relatives in Assam of those who are staying in Sylhet are in a continual disturbed state of mind. Accounts published in Calcutta papers of happenings at the other end of Pakistan have made them feel that they are not the only sufferers and that the plight of Hindus throughout East Pakistan is the same. The incessant singing of a hymn of hate, the constant talk of war, the raising of boundary disputes without sufficient cause, the mobilisation of armed and other forces, the holding of meetings in which the popular mind is shaped and directed to look upon the Hindu as the cause of its troubles and various other matters of a similar kind have depened the anxiety of the Hindu mind in East Pakistan. The tension of the mind has evidently been so acute that some people have found it unbearable. The attack without causing any death on the Lumding train, its repercussions in East Pakistan when on the 12th February several male passangers were reported to have been killed and thrown overboard from a train, form merely some of the immediate links in the chain of cause and effect which led to unfortunate happenings in Karimganj and Badarpur. If Pakistan will apply its mind to this fundamental problem and make its minority community feel safe and secure, it will render to itself and its neighbouring States, not to speak of the world at large, the greatest possible service. The path of strife and hatred may be abandoned and one of peace and progress followed. Therein lies the welfare of all.৭৪
২৮ ফেব্রুয়ারি তারিখে পাকিস্তানের ডেপুটি হাইকমিশনার আবদুল্লা-আল মাহমুদ করিমগঞ্জ পরিদর্শনে আসেন। তিনি সেখানকার নেতৃস্থানীয় মুসলমান এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের সঙ্গে ১৩ ফেব্রুয়ারির ঘটনা সম্পর্কে পৃথক পৃথকভাবে কথা বলেন। তিনি বিভিন্ন শরণার্থী ক্যাম্পও পরিদর্শন করেন। পিটিআইকে উদ্ধৃত করে সংবাদপত্রে বলা হয়:
Abdulla-Al Mahmud, Deputy High Commissioner for Pakistan, visited Karimgang today to gather information regarding the disturbances here on February 13. He met leading Muslims and Hindus separately. Muslim leaders told him that peace in this area depended entirely on the safety and security of the minorities in East Pakistan, especially in the Sylhet District, and added that the condition of Karimganj was normal now.
The Deputy High Commissioner visited the refugee camp, where a large number of refugees from Pakistan border areas within the Sylhet District had been staying. The Deputy High Commissioner also visited the affected areas in Karimganj Bazar. Later, He visited Jakiganj, within Pakistan …৭৫
আমরা জানি, ১৯৫০ সালের মার্চ মাসে গোয়ালপাড়া জেলা এবং বরপেটাতে বড়ো ধরনের দাঙ্গা সংঘটিত হয়। দাঙ্গার কারণে কেবল গোয়ালপাড়া জেলা থেকেই পুলিশ ৭০০ ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে। এ সম্পর্কে গৌহাটি থেকে ১২ মার্চ পাঠানো সংবাদে বলা হল:
Seven hundred persons have been arrested by the local police in Goalpara district in connection with the recent disturbances in that district, according to an official Spokesman.
The Spokesman said that the situation in the Goalpara district was completely under control now and there had been no incidents since March 8. Police precautions including patrolling of the disturbed areas, however continue. During the recent disturbances there had been very few casualties, although cases of arson were reported, the spokesman added. A large quantity of looted properties had been recovered by the police. Peace committees were also working in different places to rescue people. The Spokesman said that only those members of the minority community, who had entered the district recently, had evacuated and gone over to the other side of the border. Very few permanent settlers of the Goalpara district had left their places. Government were taking all possible steps to rehabilitate the permanent settelers who had suffered in the incidents.
A close watch was being kept on certain individuals and political parties who, the spokesman said, were taking advantage of the situation and creating disorders.৭৬
১৪ মার্চ তারিখেও গৌহাটি সংবাদদাতার প্রেরিত অপর আর এক সংবাদে হিন্দু গ্রাম দখলের খবর পাওয়া গেল। খবরটি ছিল এরকম:
According to a message received here from Abhayapuri in Goalpara district, Kokkla and Chakala, two places, have been occupied by Pakistani Muslims. A few days back, Kokkla ‘hat’ was looted by Muslims and the Hindu inhabitants of that area had to flee, leaving all their property behind. Recently, Rangapand, a small Hindu village, was surrounded and attacked by immigrants from the ‘Char’ area. But the raiders were beaten back by the police who rushed to the spot immediately. A boy was kidnapped by the immigrants and remained untraced. On the same day, six Pakistani Muslims attacked at Langti Chinga a mail runner and tried to run away with his mail bag… Four of them were arrested.৭৭
আসামের বরপেটা থেকেও দাঙ্গা হাঙ্গামাজনিত কারণে ২৪জন মুসলমানকে গ্রেফতার করা হয়। ১০ মার্চ, আসামের বরপেটা থেকে সংবাদদাতা জানালেন, সদর থেকে ১৫ মাইল দূরে সরভোগ এলাকায় সংঘটিত হাঙ্গামার কারণে ৯মার্চ ২৪ জন বহিরাগত মুসলমানকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আক্রান্ত এলাকায় সশস্ত্র প্রহরী মোতায়েন করা হয়েছে। তবে হাঙ্গামায় হতাহতের সংখ্যা এখনও জানা যায়নি।৭৮
এ সময় ‘নওগাঁও জেলা ও ব্রহ্মপুত্র তটে মুসলমানদের বিপুল সমাবেশ’-এর সংবাদ পাওয়া যায়। শিলং থেকে ১১ মার্চ ইউ. পি. আই. পরিবেশিত সংবাদে বলা হয়:
বিশ্বাসযোগ্য ও নির্ভরশীল মহলের সংবাদে প্রকাশ, নওগাঁও জেলায় এবং গোয়ালপাড়া জেলার ব্রহ্মপুত্র চর এলাকায় ব্যাপকভাবে মুসলমান সমাবেশ আরম্ভ হইয়াছে। নওগাঁও জেলায় মুসলিম দুর্বৃত্তদের একটি আক্রমণাত্মক কার্যের সংবাদও পাওয়া গিয়াছে। হোজাইয়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাহামাঙ্গাও ঘটিয়াছে, সেখানকার বেঙ্গলী হাইস্কুল ভস্মীভূত হইয়াছে। দারোকায় মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্রের সাহায্যে কয়েক ব্যক্তিকে আক্রমণ করা হয়। একজন হিন্দু আহত অবস্থায় হাসপাতালে রহিয়াছে। জানা গিয়াছে যে, বহিরাগত মুসলমানরা অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ আমদানী করিতেছে এবং পাকিস্তানের আনসার বাহিনীর অনুকরণে বাহিনী গঠন করা হইতেছে।
নওগাঁও জেলার বিভিন্ন স্থানে মুসলিম নেতৃবৃন্দ হিন্দুদের ব্যবসায় বাণিজ্য ও দোকানপাট বয়কটের আন্দোলন চালাইতেছে। কতিপয় অফিসারকে চাকুরি হইতে অপসারণের দাবী উঠিয়াছে। গোয়ালপাড়া জেলায় ব্রহ্মপুত্র চর এলাকার নিকটে যাহারা বসবাস করিতেছে, বিপুল সংখ্যক মুসলমানের আবির্ভাবে তাহারা উদ্বিগ্ন হইয়া উঠিয়াছে এবং তাহাদের মধ্যে অনেকেই তাড়াতাড়ি নিরাপদ অঞ্চলে চলিয়া যাইতেছে।৭৯
গোয়ালপাড়া জেলার বিষয়টি পার্লামেন্টে উত্থাপিত হল। ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ১৭ মার্চ ১৯৫০-এ বিদেশ বিষয়ক বিতর্কের সূচনা করে এক পর্যায়ে তিনি ‘The Goalpara incidents’ বিষয়ে জানালেন:
… Early this month, there were disturbances and incidents in certain towns of Uttar Pradesh. A little later, there were some incidents of this type in Bombay. All these, he greatly deplored. But a major disturbance took place in the Goalpara and Barpeta parts of Assam. About March 6, 7 or 8, there was an upheaval largely of the tribal folk who swept down and committed a good deal of arson and drove away a fairly large number of Muslim inhavbitants either into Pakistan or the nearly State of Cooch-Behar. So far as I know, there was very little killing there, but arson on a large scale. I cannot say how many were driven away because the figures vary from 30,000 to double or more that number.৮০
গৌহাটিতেও দাঙ্গা সংঘটিত হল। ২৪ ফেব্রুয়ারি ‘পিটিআই’ পরিবেশিত সংবাদে জানা যায়:
Two persons are reported to have been killed when thirty thatched houses were set on fire following a clash between two groups of people here tonight. The incident occurred at the foot of Sarania hills in the outskirts of the town. Flames from the burning houses rose very high and could been seen from all parts of the town. Details are not yet known.৮১
এ সময় আসামের আইন-শৃঙ্খলাবাহিনী সন্দেহভাজন অনেক গৃহে আকস্মিক অভিযান চালিয়ে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করে। আসামের ডিব্রুগড়ের এক গৃহে পাওয়া যায় এমন সব সরঞ্জাম।
Seventy swords and a wireless transmitter were seized by the police today [23 Feb.] during the search of a Muslim residence in the town. The owner of the house was arrested. Earlier in the day, a poster threatening ‘direct action’ for refusal of coal export of Pakistan was found on the walls of a local post office.”৮২
আসাম সরকার কাছাড় জেলার কতিপয় নেতৃস্থানীয় মুসলিম নেতার চলাচলের ওপর বিধি-নিষেধ আরোপ করেন। আসামের করিমগঞ্জ থেকে ৭ মার্চ পাঠানো সংবাদে বলা হয়:
Three prominent Muslim leaders of Cachar, Messrs. Namowar Ali, a former member of the Assam Legislative Assembly, Maynul Haque Choudhury and Golam Zilani Choudhury have been served with notices prohibiting their movements outside their respective residences from sunset till sunrise. They have also been asked not to mix with certain persons.
Uptil now, about 124 persons have been arrested in Karimganj in connection with the disturbances on Feb. 13 last. About sixty more arrests were made at Hailakandi. Police pickets have been stationed in the disturbed areas and military is patrolling.৮৩
১৯৫০ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এতটাই ব্যাপক ছিল যে, দাঙ্গার কারণ অনুসন্ধানে আসাম সরকার একটি কমিশন গঠনে বাধ্য হন। কমিশন রিপোর্ট যথাসময়ে সরকারের কাছে জমা দিলেও সেটি আজও আলোর মুখ দেখেনি সরকারিভাবে। ছয়ের দশকে ভাষা দাঙ্গার সময়কালে অনেক সংবাদপত্রই রিপোর্টটির অংশবিশেষ প্রকাশ করে দেয়। কমিশন গঠন প্রসঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী গোপীনাথ বরদলৈ দাঙ্গা চলাকালেই, মার্চ মাসে তা ঘোষণাও করেন:
… the recent happenings in Assam the Chief Minister said that in every single case there was no local cause whatsoever for the incidents. He disclosed that the Government proposed to inquire into the genesis of the trouble and to take action against those who might have been guilty of actions of ommission and commission. About a thousand men had so far been arrested in this connection.৮৪
পঞ্চাশের দাঙ্গায় কাছাড় জেলার বিশিষ্ট ব্যক্তি মইনুল হক চৌধুরীর নাম জড়িত হয়ে পড়ে। সুজিৎ চৌধুরী জানান:
… মইনুল হক চৌধুরী ছিলেন পাকিস্তানপন্থী মুসলিম লিগের ছাত্র সংগঠন ‘অল ইণ্ডিয়া মুসলিম স্টুডেন্টস কনফারেন্স’-এর সাধারণ সম্পাদক। বরাক উপত্যকায় মুসলিম লিগ সংগঠন গড়ে তোলার ব্যাপারে তিনি অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন। ১৯৫০ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় নিরাপত্তা বন্দি হিসেবে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়।৮৫
অপর আর এক সূত্র মইনুল হক চৌধুরী সম্পর্কে জানাল:
… Mr. Huq was a P.A. to Mr. Jinnah. Even after Partition, he was a member of the committee of Action of the Assam Provincial Muslim League ! (vide Organiser, August 22, 1960).
He was detained for his communal activities in 1946 and again in 1950. During the latter detention, the District Magistrate of Cachar’s Charge-Sheet against him read :
1. That you are an active supporter of the Muslim League ideology and you threaten public peace and tranquillity in Cachar District by urging violent methods;
2. Your activity in fomenting troubles and lawlessness among the Muslims of Cachar is prejudicial to public order and maintenance of Public peace;
3. You are taking part in causing incitement and leading ignorant people of Cachar district into unconstitutional and disruptive activity advocating violence among them; and
4. You are actively engaged in the work of the Muslim League having subversive aim calculated to over-throw the present order by violent means. He was also charged with instigating the Muslims of Cachar to organise violent attacks against Hindus there, after Partition.৮৬
In September, 1950, Choudhury was released on his giving an undertaking …that he would whole-heartedly cooperate the Government of India in implementing the Indo-Pakistan Agreement both in letter and spirit. While in detention, he successfully fought a Congress candidate, Gabu Mia Choudhury, in june, 1950. for a seat on the Silchar Local Board. In September 1950, a few days after his release, he went to Sylhet (East Pakistan) and attended the Kashmir Day celebrations there”৮৭
He was accompanied by Golam Jilani Choudhury, Namwar Ali Barbhuiyan and a few others.৮৮
আমরা বলেছি ১৯৫০ সালেই আসাম সরকার দাঙ্গা বিষয়ে একটি কমিশন গঠন করেন। কমিশন রিপোর্ট জমা দিলেও তা প্রকাশিত হয়নি। সেই অপ্রকাশিত দলিলের অংশবিশেষ আমরা উদ্ধৃত করব সাধারণ ধারণা লাভের জন্য। সংবাদপত্রে বলা হল:
…১৯৫০ সনে সমগ্র আসামে প্রলয়ঙ্করী হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা হয়। সেই দাঙ্গা সম্পর্কে কলিকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি শ্রী প্রশান্তবিহারী মুখোপাধ্যায়ের সভাপতিত্বে এক তদন্ত কমিশন গঠিত হয়। কমিশনের অন্য দুই সদস্য ছিলেন শ্রী কামাখ্যারাম বড়ুয়া এবং শ্রী ফৈজনূর আলি। একজন অসমিয়া হিন্দু এবং একজন মুসলমান। সুতরাং আশা করি, কমিশনের সভাপতি শ্রী মুখোপাধ্যায় বাঙালি বলিয়া আসাম বা ভারত সরকার কেহই কমিশনের রিপোর্টকে পক্ষপাতদুষ্ট অপবাদ দিতে পারিবেন না।
কমিশনের মতে কাছাড় আসামের সমস্যাজর্জর জেলা। সেখানে হাঙ্গামা যতখানি, তাহার চেয়ে বেশি রাজনীতি। শ্রীহট্টে গণভোট ও শ্রীহট্ট বিভাগের সময় কাছাড়কে পাকিস্তানভুক্ত করার জন্য মুসলমানরা যে ব্যাপক প্রচার চালান, তাহার ফলে জেলার হিন্দু এবং মুসলমানের মধ্যে চরম তিক্ততা দেখা দেয়। কাছাড়কে পাকিস্তানভুক্ত করিতে না পারিয়া মুসলমান সমাজ হতাশায় ভাঙিয়া পড়ে। র্যাডক্লিফ রোয়েদাদে কাছাড় আসামেই থাকিয়া যায়। এই হতাশা মুসলমানদের গোঁ বাড়াইয়া দেয় এবং কমিশনের মনে হয়, কাছাড়ের মুসলমানেরা দেশবিভাগের ফলে পরিবর্তিত অবস্থার সঙ্গে খাপ-খাওয়াইয়া চলিতে সম্পূর্ণ অসমর্থ হয়।
কমিশন রিপোর্টে বলেন, তাঁহাদের নিকট অনেকে এইরূপ সাক্ষ্য দিয়াছেন যে, স্বাধীনতার পরও ভারতীয় মুসলমানেরা গান গাহিয়া বেড়াইতেছে—সিলেট নিয়েছি ভোটের জোরে, কাছাড় নিব লাঠির চোটে। গ্রামে গ্রামে এইরূপ আরও অনেক গান শোনা যায়। যেমন—আমরা বিশ্বজয়ী মুসলমান, আমরা বীরেরই সন্তান। আমরা সবাই কাছাড় জেলা করব পাকিস্তান। ….. কমিশনের মতে এই সকল উক্তি কাছাড়ের হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে সম্পর্ক বিষাক্ত করিয়া তোলে। তাহা ছাড়া বহু মুসলমান সাক্ষ্য দিতে আসিয়া এবং স্মারকলিপি পেশ করিয়া কাছাড়ের হিন্দুদের সম্পর্কে আপসবিরোধী মনোভাবও দেখান। সর্বাপেক্ষা আক্ষেপের বিষয় এই যে, কাছাড়ের বহু মুসলমান কতৃক প্রদত্ত লিখিত বিবৃতিতে বাঙালি হিন্দুদের সম্পর্কে তিক্ততাপূর্ণ মনোভাব প্রকাশ পায়। ইহাও কমিশনের মনে হয় যে, বাঙালি হিন্দু ও অসমিয়া হিন্দুর মধ্যে বিবাদ বাঁধাইবার চেষ্টাও অনেক মুসলমানের মধ্যে আছে। কমিশন মনে করেন, এই মনোভাব অত্যন্ত আক্ষেপজনক। কারণ, ইহাতে রাষ্ট্রের সংহতির মূলে আঘাত হানিতেছে।
কমিশন আরও মনে করেন, এই মনোভাব যে কাছাড়ের হিন্দু-মুসলমানকে আগাগোড়া আলাদা করিয়া রাখিয়া দিতেছে, সেই সম্পর্কে তর্কের অবকাশ নাই। কমিশন লক্ষ্য করেন, দেশবিভাগের পূর্ব পর্যন্ত কাছাড়ের মুসলমান সমাজের বৃহদংশ ছিলেন মুসলিমলিগপন্থী এবং দ্বিজাতিতত্ত্বে বিশ্বাসী। তদনুযায়ী প্রচারের সাহায্যে কাছাড়কে ঐশ্লামিক করার চেষ্টাও হয়। কিন্তু তাঁহাদের বর্তমান প্রচেষ্টা পূর্বেকার নীতির পুরোপুরি বিপরীত। এখন ওই মুসলমানেরাই বাঙালি হিন্দুর বিরুদ্ধে লড়াই করিতে অসমিয়া হিন্দুর সঙ্গে হাত মিলাইতেছে।
কমিশন বলেন, কাছাড়ে মুসলমানদের আক্রমণাত্মক মনোভাবের সঙ্গে পাল্লা দিতেই সম্ভবত তথায় পূর্বাচল আন্দোলন শুরু হয়। কাছাড় এবং সংলগ্ন মণিপুর ও লুসাই পাহাড় লইয়া একটি পৃথক রাজ্য গঠন ওই আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল। কমিশনের কাছে বলা হয় যে, এই আন্দোলন ১৯৪৮ সালে হিন্দুরা শুরু করে। কিন্তু কংগ্রেস হাইকম্যাণ্ডের নিকট হইতে কোনো পাত্তা না পাইয়া এক বছরের মধ্যেই আন্দোলন মিলাইয়া যায়। কমিশন বলেন, ১৯৪৯ সালের প্রথমভাগ হইতেই পূর্বাচল আন্দোলনের কোনো চিহ্ন নাই। (অথচ আমাদের প্রধানমন্ত্রী ও আসামের অনেক মন্ত্রীর মতে কাছাড়কে পৃথক করার চেষ্টা এখনও বাঙালি হিন্দুর মধ্যে আছে এবং তাহাই নাকি গন্ডগোলের কারণ)।
কমিশন উল্লেখ করেন, ইহা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ যে, পূর্বাচল আন্দোলন চলার সময় মুসলমানদের বিরুদ্ধে কোনো প্রকার হাঙ্গামা অনুষ্ঠিত হয় নাই।৮৯
শেষপর্যন্ত আসামের গভর্নর ৩০ মার্চ ‘Assam Disturbed Areas Ordinance’ জারি করলেন। এদিন শিলং থেকে পাঠানো সংবাদ ছিল এরকম:
An ordinance empowering the Government to take stringen measures to maintain law and order in disturbed areas of the Assam State has been promulgated today by the Governnor. It is called the Assam Disturbed Areas Ordinance, 1950 and extends to the whole of Assam.
Under the Ordinance, the State Government may by a notification declare the whole or any such part of Assam as may be specified in the notification as a disturbed area.
The Ordinance empowers any Magistrate any police officer not below the rank of Assistant Sub-inspector in certain circumstances to fire upon or otherwise use force, even causing death, against any person who is acting in contravention of any law or order for the time being in force in the disturbed area. The districts of Goalpara, Kamrup, Darrang and Cachar were declared ‘disturbed areas’ by the Government in a notification last night.৯০
এ সময় পূর্ববঙ্গে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কারণে সেখানকার সংখ্যালঘু বাস্তুহারা মানুষের ঢল নামল আসামে। সর্বস্বহারা এসব মানুষ কেবল প্রাণে বাঁচতে একটু নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে পথে নামলেন। এই পথচলা ছিল বেদনাদায়ক, বন্ধুর।
… পূর্ব পাকিস্তান হইতে করিমগঞ্জ অভিমুখে অবিরাম বাস্তুহারার স্রোত প্রবাহিত হইতেছে। যদিও পাকিস্তানী পুলিশ, আনসার প্রভৃতি বাধা দিতেছে, তবু গৃহত্যাগী হিন্দুগণের আসাম আশ্রয়ার্থ অভিযান অব্যাহত আছে। প্রকাশ, একখানা যাত্রীবাহী ট্রেন আক্রান্ত হওয়ার ফলে উদবাস্তুগণের মধ্যে বহুলোক হতাহত হয়। …পাকিস্তানীরা মোটর সার্ভিস বন্ধ করিয়া দেওয়াতে বাস্তুহারাগণ পায়ে হাঁটিয়াই আসিতে বাধ্য হইতেছে।৯১
কেবল করিমগঞ্জ নয়— পূর্ববঙ্গের সংখ্যালঘু মানুষ গৌহাটি, নওগাঁ, ধুবড়ি এমনকী আসামের রাজধানী শিলঙে ও আশ্রয় গ্রহণ করেন।
আসাম অন্তর্গত করিমগঞ্জ থেকে ৪ মার্চ পাঠানো সংবাদে বলা হল:
During the last three days about 2,000 refugees came into Karimganj daily by train, and bus and on foot. They reported that they had to undergo the strictest search of their luggages and person at the border stations. In some cases their personal belongings which included cash, ornaments and clothes were taken away. Relief camps have been opened at Karimganj station and volunteers are attending at the time of train arrivals with conveyance, food and water. The local merchants’ association is still maintaining a town refugee camp.৯২
সংবাদপত্র প্রতিনিধি ৮ মার্চ পাঠানো সংবাদে করিমগঞ্জে প্রায় ২০,০০০ উদবাস্তু আসার সংবাদ দিল:
About 20,000 refugees from East Bengal have already arrived in the Karimganj Sub-division during the last fortnight, according to the District Congress Committee. It is stated that the number of refuguees is daily on the increase and ten refugee camps have been started and more will be opened shortly to cope with the situation.৯৩
করিমগঞ্জে আরও উদবাস্তুর ভিড় বাড়ল। সংবাদদাতার ১৪ মার্চ পাঠানো সংবাদে জানা যায়:
Over 30,000 refugees have arrived in this Sub-division from the Sylhet district of East Bengal, according to an estimate made by the District Congress Committee. The Committee has it is learnt, approached the Government of India for including Shaistaganj and Kulaura Junctions as centres for evacuation in Sylhet district by providing facilities for special trains and buses for refugees to India. Owing to lack of accommodation in Pakistan trains and buses, hundreds of refugees have been detained at Kulaura, Sheola and other places.
The local merchants’ association has requested the railway authorities to increase coaches in Assam trains to provide better travelling facilities to the refugees.৯৪
পূর্ববঙ্গ থেকে শিলং শহর এবং তার আশপাশ এলাকায় ছ-হাজারের বেশি উদবাস্তু আসার সংবাদ পাওয়া যায়। The Hindu প্রতিনিধি ১৬ মার্চ শিলং থেকে পাঠানো সংবাদে জানাল:
More than six thousand refugees have arrived from East Pakistan in Shillong and adjoining areas of Dawki, Bhowganj, Lakhabazar and Shellabunji. Since sunday last at least one thousand persons are arriving in Khasi and Jaintia hills every day from East Pakistan.৯৫
পূর্ববঙ্গ থেকে গৌহাটিতে ৪০০-শো উদবাস্তু এসে পৌঁছোলে— তাদের স্থানীয় ধর্মসভা ভবনে স্থান দেওয়া হয়। এরা সকলেই পাকিস্তানভুক্ত সিলেটের মানুষ।
২২ মার্চ পর্যন্ত সিলেটের ১৩০০ জন উদবাস্তু আসামের নওগাঁয় আশ্রয় গ্রহণ করেন। এসব বাস্তুত্যাগীদের বাঙালি নাটমন্দির এবং বাঙালি স্কুলে আশ্রয় দেওয়া হয়। প্রতিদিন প্রায় ১৫০ থেকে ২০০ জন আশ্রয়প্রার্থী পূর্ববঙ্গ থেকে নওগাঁয় আশ্রয় গ্রহণ করছেন। ইতিমধ্যে নওগাঁর বিভিন্ন স্থানে বিশেষত শহরে আরও বেশ কয়েকটি আশ্রয়শিবির খোলা হবে বলে জানা যায়।
ধুবড়িতেও বাস্তুহারা মানুষ আশ্রয় গ্রহণ করেন। সরকারি সাহায্যে ও স্থানীয় মানুষের সহযোগিতায় ধুবড়ি, গৌরীপুর এবং দক্ষিণ শালমারায় ২২ মার্চ পর্যন্ত তিনটি ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে বলে সংবাদে জানা যায়। এসব আশ্রয় শিবিরের অধিকাংশ মানুষই ছিলেন কৃষিজীবী।৯৬
অবশেষে দাঙ্গাহাঙ্গামা স্তিমিত হয়ে আসে উভয় দেশেই। নেহরু-লিয়াকত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ৮ এপ্রিল দিল্লিতে। উভয় দেশের সংখ্যালঘু সমস্যা সমাধানে প্রণীত চুক্তিপত্রটি ‘নেহরু-লিয়াকত প্যাক্ট’ নামে পরিচিত। এই চুক্তির আওতায় আসামে বসবাসকারী মুসলিম সম্প্রদায়— যাদের একটা বড়ো অংশই পূর্ববঙ্গে আশ্রয় নিয়েছিলেন, তাঁরা আসামে ফিরে আসেন এবং রাষ্ট্রীয় সকল সুবিধা ভোগ করেন।
১৯৪৭ সালে ‘সিলেট গণভোট’-জনিত কারণে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কে যে চিড় ধরেছিল, যে অবিশ্বাস, তিক্ততা, বৈরিতার জন্ম দিয়েছিল— ১৯৫০ সালে সৃষ্ট সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা— সেই অবিশ্বাস, বৈরিতা, তিক্ততা, হিংসা আর বিভেদের বেড়াজালের মাত্রা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়। তবে একথাও সত্য যে, ক্ষীণ হলেও একটি অসাম্প্রদায়িক শান্তিপ্রিয় গণতান্ত্রিক মানবমুখী ধারাও বহমান ছিল এসময়। কিন্তু তাঁরা ছিলেন বড়োই দুর্বল।
ব্রিটিশ শাসনে শেষ লোকগণনা হয় ১৯৩১ সালে। স্বাধীন ভারতে প্রথম লোকগণনা হয় ১৯৫১ সালে। ভারত ভাগের পর আসামের মোট জনসংখ্যা ছিল ৯০,৪৩,৭০৭ জন। এর মধ্যে অসমিয়া জনসংখ্যা ছিল ৩১%, বাঙালি ৩১% এবং পার্বত্য ও অন্যান্য জাতি ছিল ৩৮%। কিন্তু গোলটা বাঁধল ১৯৫১ সালে লোকগণনার ফল প্রকাশের পর। ১৯৩১ সালে অসমিয়া জনসংখ্যা যেখানে ১৯, ৯২, ৮৪৬ জন ছিলেন— সেখানে ১৯৫১ সালে অর্থাৎ ২০ বছরে সেই সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়াল ৫৯, ৬৬, ১৫৯ জনে। সকলেই বিস্মিত। প্রশ্ন এটা কেমন করে সম্ভব। ভারতের সেন্সাস কমিশনের মতে ১০ বৎসরে জনসংখ্যা শতকরা ১০ থেকে ১৫ ভাগ বৃদ্ধি পায়, কিন্তু অসমিয়া জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ইঁদুরের জন্মহারকেও হার মানিয়ে দিয়েছে।৯৭
আসলে অসমিয়াদের জন্মহার বাড়েনি, গণনায় কারচুপি করেই সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়েছে। কারচুপি যে হয়েছে তার ভূরি ভূরি প্রমাণ হাজির করা হলেও আসাম সরকার তথা কেন্দ্রীয় সরকার তা মানতে নারাজ। আমরা জানি, কাছাড় জেলার এম. এল. এ. জ্যোৎস্না চন্দ-এর নেতৃত্বে এক প্রতিনিধি দল দিল্লির দরবারে রাষ্ট্রপতি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ অন্যান্য সংশ্লিষ্ট প্রায় সকলের সঙ্গে দেখা করে লোকগণনা বিষয়ে আলোচনা করেন। প্রতিনিধিদল তথ্যপ্রমাণসহ একটি স্মারকলিপিও প্রদান করেছিলেন। কিন্তু পুনর্গণনার বিষয়টি কোনোভাবেই মানা সম্ভব নয় বলে তাঁদের জানিয়ে দেওয়া হয়।
আসাম সরকার জনগণনার ‘ফর্ম-এ’ অন্যান্য প্রশ্নের সঙ্গে ‘প্রকৃত অধিবাসী’-র জমির পরিমাণ (Holding of indigenous persons) বিষয়ে একটি প্রশ্ন অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। আসামের প্রকৃত অধিবাসী বলতে তাদেরকেই মনে করতে হবে— যারা অসমিয়া কিংবা উপজাতিদের ভাষায় কথা বলেন আর কাছাড়ে যারা ওই অঞ্চলের ভাষায় কথা বলেন।
আসাম উপত্যকার পাঁচটি জেলায় অসমিয়াদের সংখ্যা সামান্য বেশি থাকলেও বাঙালিদের সংখ্যাও ছিল উল্লেখযোগ্য। কিন্তু ভাষার কারণে তাঁরা প্রকৃত অধিবাসীর সংজ্ঞায় পড়বেন না; আর এ কারণে তাঁরা জমিজমা হারাবেন তো বটেই পূর্ণ নাগরিক অধিকার থেকেও বঞ্চিত হবেন।
এ সময় ৭লক্ষ হিন্দিভাষী ছিলেন আসামে— যাঁরা ভারতের জাতীয় ভাষা হিন্দিতেই কথা বলেন। কিন্তু আসাম সরকার নির্দেশিত প্রকৃত অধিবাসীর সংজ্ঞায় এঁরা না পড়ায় তাঁরাও সবকিছু থেকে বঞ্চিত হবেন। তাই সংগত কারণেই বেঁচে থাকার তাগিদে তাঁরা নিজেদেরকে অসমিয়াভাষী হিসেবে ঘোষণা করায় অসমিয়া সমাজ সংখ্যায় যেমন ফুলে-ফেঁপে উঠলেন—অন্যদিকে প্রকৃত সংখ্যার চেয়ে নিম্নগামী হয়ে পড়লেন অনসমিয়ারা।৯৮
১৯৫১ সালের লোকগণনার ফলাফলকে কেউ কেউ ‘জীবতাত্ত্বিক বিস্ময়’ বলেও উল্লেখ করেছেন। অভিযোগে আরও প্রকাশ বহুক্ষেত্রে অনসমিয়াদের ভাষা অসমিয়ারূপে দেখানো হয়েছে। বহুসংখ্যক বাংলাভাষীকে আদৌ গণনা করা হয়নি। চা-শ্রমিকেরা তো ব্রাত্যই থেকে গেছেন। এমনকী গণনাকারীগণ ফর্ম ব্যবহারের ক্ষেত্রেও সন্দেহজনক ফর্ম ব্যবহার করেছেন বলে অভিযোগ।৯৯
আমরা ইতিপূর্বেই প্রত্যক্ষ করেছি যে, ১৯৪৮ সালের ২৮ মে ডেপুটি কমিশনারদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে আসাম সরকার ভোটার তালিকা প্রণয়ণ প্রশ্নে এক সার্কুলার জারি করেছিলেন— যেখানে বলা হয় ‘non-resident population’ মোটেও ভোটার হওয়ার যোগ্য নন। চিঠিতে আরও বলা হয়— তারা হয়তো কোনো বন্ধু, আত্মীয়, উদবাস্তু বা কোনো শ্রমিক পরিবারের সঙ্গে বাস করছেন। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই তাদের একজনও যেন ভোটার হতে না পারেন— সেদিকে সরকারি কর্মীদের সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। এই নির্দেশের ফলে জনগণনায় নিয়োজিত কর্মকর্তা— কর্মচারীদের বুঝতে অসুবিধা হয়নি— সরকার কী চাচ্ছেন। আর ব্রিটিশ সৃষ্ট আমলা ডেপুটি কমিশনার ভালোমতোই জানেন— এক্ষেত্রে কর্তার ইচ্ছাই কর্ম— যা আজও বর্তমান। কাজ যে সেভাবেই এগিয়েছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
১৯৬০ সালের আগস্ট মাসে একটি সংসদীয় প্রতিনিধিদল আসাম পরিভ্রমণ করেন। এই দলের লক্ষ্য ছিল জুন-জুলাই মাসে সংঘটিত দাঙ্গাপীড়িত অঞ্চল পরিদর্শন ও তৎসংক্রান্ত তথ্যাদিসংগ্রহ। এই প্রতিনিধিদলও ১৯৫১ সালের জনগণনার ফলাফলে খুশি হতে পারেননি। তাঁরা তাঁদের রিপোর্টের এক অংশে জানিয়েছিলেন:
The Bengali-Speaking people question the accuracy of the 1951 census figures in so far as they relate to the Assamese-speaking population numbered only 19.8 lakhs, which during the 20 years from 1931 to 1951 jumped to over 49 lakhs or by 150% against an increase of about 4 lakhs during the preeding 50 years beginning from 1881. The Bengalees had questioned these figures before the States Re-organisation Commission. Their contention is that these figures were inflated to provide justification for the introduction of the Assamese as the State language. We have tried to seek an explanation for this extra-ordinary increase, which is not warranted by trends of patural growth of population from the Assam Government. We were told that all the Muslim Bengalees of the Brahmaputra Valley, who had formerly registered themselves as Bengali-Speaking. We are not altoghether satisfied with this explanation.১০০
অসমিয়া সমাজ কখনোই চাননি আসামের রাজ্যভাষা একাধিক হোক। গোপীনাথ বরদলৈ বিধানসভায় দাঁড়িয়ে এই মর্মে ঘোষণাও দেন— যা আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি। ‘রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন’ এ সম্পর্কে জানিয়েছেন:
…কোনো রাজ্যের সমগ্র জনসমষ্টির অন্ততপক্ষে শতকরা সত্তর ভাগ বা তদুর্ধ্ব এক ভাষা গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হইলে তবেই সেই রাজ্যকে একভাষী রাজ্য হিসেবে গণ্য করা উচিত। যেখানে জনসংখ্যার ত্রিশভাগের মতো উল্লেখযোগ্য সংখ্যালঘু বর্তমান, সেই রাজ্যকে প্রশাসনিক দিক থেকে দ্বিভাষী রাজ্য হিসেবে গণ্য করা উচিত।১০১
১৯৫১ সালের লোকগণনা সম্পর্কে ভারত সরকারের ‘Census Report’-এ কী বলা হল? সংশ্লিষ্ট দফতরের প্রাণপুরুষ RB Bhagaiwalla এ সম্পর্কে জানালেন:
A comparison with the percentage of population speaking these different languages in 1931 for which alone figures are available, reveals an interesting tale. There was no tabulation in 1941 as a measure of war economy. Hence, we have no figures regarding the distribution of Assam’s population according to language for 1941. There is a striking increase in the percentange of people who speak Assamese in 1951 (56.7) over those of 1931 which was only 31.4%, there is an equally striking decrease in the percentage of the people speaking Bengali in 1951 which is only 16.5 against 26.8 percent in 1931. With the solitary exception of Assamese every single language or language group in Assam shows a decline in the percentage of people speaking the same. All this decline has done to swell the percentage of people speaking Assamese in 1951. The figures do not fail to reflect the aggressive linguistic nationalism now prevailing in Assam, coupled with the desire of many persons among the Muslims as well as teagarden labour immigrants to adopt Assamese as their tongue in the state of their adoption. It is not unlikely that some amongst the persons who have returned their mother tongue as Assamese have done so from devious motives, even though their knowledge of Assamese may not amount to much. The phenomenon is also coupled with the genuine increase in the number of people speaking Assamese with the introduction of more schools in teagarden area in the Assam valley where the medium of instruction is naturally Assamese. These factors partially account for the decline in the percentage of people speaking Hindi which has fallen from 7.6 in 1931 to 3.8 percent in 1951. The accuracy of language statistics in Assam has suffered to a certain extent on account of the census of indigenous persons of Assam and their land holdings being taken along with the main population census. An indigenous persons in Assam was defined as a person belonging to the State of Assam and speaking the Assamese language or any tribal dialect of Assam, or in the case of Cachar, the language of the region the definition gave rise to some apprehension among some sections of the people of Goalpara and Cacahr where it was vehemently resented by certain other sections of the people in the Assam Valley. This was due to the clarification given by the State Govt. that indigenous persons will not merely include persons who speak Assamese at home. The word ‘at home’ were deliberately omitted by the State Govt. to expand the scope of the defination. All assurances to the effect that the collection of these statistics will not be a bar to any rights of any citizens or national of India fail to assurage this apprehension or resentment. On top of it all, same people in Goalpara insisted on returning their mother tongue as Goalparia. I pointed out that on this analogy some people in Kamrup may insist on returning their language as Kamrupi and those in Nowgong as Nowgongian and that the census cannot take cognizance of such idiosyncracies. When some of them insisted on recording their mother tongue as Goalparia in spite of the explanation, the census staff has no option except to record the answer exactly as given by the citizens. As a result 4,088 persons (2,562 males and 1,526 female) returned their mother tongue as Goalparia. There being no such language in existence, these persons were included under Assamese as directed by the Registrar General, after consulting the State Govt.১০২
অভিযোগের পর অভিযোগ, সরকারি রিপোর্ট কোনো কিছুই গোপীনাথ বরদলৈ সরকারকে বিচলিত করতে পারেনি। কেন্দ্রীয় সরকারও বিষয়টি গায়ে মাখলেন না। অসমিয়াকরণ বাধাহীনভাবেই এগিয়ে চলে।
প্রধানমন্ত্রী গোপীনাথ বরদলৈ কাছাড় জেলার শিলচরে দাঁড়িয়ে ১৯৪৭ সালেই ঘোষণা করেছিলেন বাংলা স্কুলগুলির ক্ষেত্রে নীতির কোনো পরিবর্তন হবে না। আর্থিকসহ সবরকমের সহায়তা প্রদান অব্যাহত থাকবে। একই কথা একাধিকবার একাধিক স্থানে উচ্চারণ করেছেন বরদলৈ। কিন্তু তিনি কথা রাখেননি। বরং বাংলা স্কুলগুলি ধ্বংসে নানামুখী প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। লোকাল বোর্ড থেকে স্কুলগুলির আর্থিক অনুদান বন্ধ করে দেওয়া হল অসমিয়া ভাষায় শিক্ষা গ্রহণে অনীহার কারণে। স্বাভাবিকভাবে সরকার বা অন্য কোনো উৎস থেকে আর্থিক সহায়তা না পাওয়ায় বাংলা স্কুলগুলো একে একে বন্ধ হয়ে যায়।
কেবল বাংলা নয়— তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত অসমিয়াকরণে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সরকার পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর অসমিয়া ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার নানা কৌশলের পথও ধরেছিলেন। মিশনারি সংস্থা বা বিদেশ থেকে অনসমিয়া ভাষাগোষ্ঠীর ছাত্র-ছাত্রীর জন্য পাঠানো অর্থ গ্রহণেও আসাম সরকার নানা প্রকার বিধিনিষেধ আরোপ করেন। কয়েক বছরে বাংলা স্কুলগুলোর হাল কী দাঁড়াল—তার একটি পরিসংখ্যান তুলে ধরা যেতে পারে। গোয়ালপাড়া জেলার নিম্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলির সামগ্রিক পরিসংখ্যান ছিল এরকম:১০৩
উপরে বর্ণিত পরিসংখ্যান থেকে একথা বলা অসংগত হবে না যে, সরকার আসামে বসবাসকারী বাঙালি শিশুদের শৈশবেই মাতৃভাষা ‘বাংলা’ ভাষা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করে খাঁটি অসমিয়া সৃষ্টির প্রয়াসী ছিলেন।
কেবল নিম্নপ্রাথমিক বিদ্যালয়গুলিতে নয়— হাই স্কুল বা কলেজে ভরতি, বৃত্তি ইত্যাদি ক্ষেত্রেও আসাম সরকার বাঙালি ছেলে-মেয়েদের বঞ্চিত করেছেন নানা আইন বা পদ্ধতির বেড়াজালে। এসব জারিকৃত আইনের ফলে উচ্চশিক্ষায় বঞ্চিত বাঙালি ছেলে-মেয়েরা আজ হতাশায় নিমজ্জিত। সংস্কৃতিজগৎ-ও তাদের কাছে সীমিত, রুদ্ধ। খোলা হাওয়া বঞ্চিত বাঙালি সন্তানেরা আসামে পদে পদে হোঁচট খাচ্ছেন জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে। তাঁরা জানেন না— তাঁদের অপরাধ কী। তাঁরাও তো স্বাধীন ভারতের নাগরিক। তবে? বাঙালি, বাংলাভাষী হওয়ায়?
আসাম কমিউনিস্ট পার্টি নেতা ফণী বরা বাঙালিদের প্রতি এই অন্যায়, অবিচার বিমাতৃসুলভ আচরণ মেনে নিতে পারেননি। তিনি এর প্রতিবাদ জানান। গৌহাটিতে ২৭ মে আহূত এক সাংবাদিক সম্মেলনে বাংলা স্কুল, বাঙালি সংস্কৃতি ইত্যাদি বিষয়ে এই কমিউনিস্ট নেতা জানালেন:
The Assam Government, through their offical and non-official agents, forcibly sealed off all Bengali schools in Goalpara district, denying safeguards of the Bengalees, cultural and linguistic rights. Such imperialist and reactionary actions of the Assam Congress Government were responsible for encouraging disintegrating elements in Assam, including Naga Hills১০৪
দেশভাগের পর স্বাধীন ভারতের প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৫২ সালে। এ বছর আসাম মন্ত্রিসভারও পরিবর্তন ঘটে। বিষ্ণুরাম মেধীর নেতৃত্বে নতুন মন্ত্রীসভা গঠিত হয় ২৫ ফেব্রুয়ারি। এদিন শিলংস্থ রাজভবনে সকাল ৯-৩০ টায় মুখ্যমন্ত্রী বিষ্ণুরাম মেধীর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস সরকারের দশজন মন্ত্রী এবং দু-জন উপমন্ত্রী শপথ গ্রহণ করেন। মন্ত্রীদের আনুগত্য ও মন্ত্রগুপ্তির শপথবাক্য পাঠ করান রাজ্য গভর্নর জয়রামদাস দৌলতরাম। মন্ত্রীসভায় যাঁরা পূর্ণমন্ত্রী হিসেবে স্থান লাভ করেন তাঁরা হলেন— বিষ্ণুরাম মেধী, মুখ্যমন্ত্রী, মতিরাম বোরা, রেভারেণ্ড জে জে এম নিকোলাস রায়, মহেন্দ্রমোহন চৌধুরী, রামনাথ দাস, রূপনাথ ব্রহ্ম, আবদুল মতলিব মজুমদার, অমিয়কুমার দাস, বৈদ্যনাথ মুখার্জি এবং সিদ্ধিনাথ শর্মা। দু-জন উপমন্ত্রী ছিলেন—হরেশ্বর দাস এবং পূর্ণনন্দ চেটিয়া। বর্তমান মন্ত্রীসভার ৮ জনই ছিলেন পূর্বতন মন্ত্রীসভার সদস্য, কেবল দু-জন নতুন মুখ— বৈদ্যনাথ মুখার্জি এবং সিদ্ধিনাথ শর্মা। এই অনুষ্ঠানে দশজন মন্ত্রীর দফতরও বণ্টন করা হয়।
মন্ত্রীসভা গঠন সম্পর্কে সংবাদপত্র জানাল:
পূর্বতন মন্ত্রিসভার সকল পুরাতন সদস্যকেই বহাল রাখিবার ফলে এখানে জনসাধারণের মধ্যে নানাপ্রকার ধারণার উদ্ভব হইয়াছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকগণ মনে করেন যে, আসামে যেরূপ বিভিন্ন প্রকার সমস্যা রহিয়াছে তাহাতে নূতন মন্ত্রিসভায় পুরাতন মন্ত্রীদের প্রত্যেককে অন্তর্ভুক্ত করায় মুখ্যমন্ত্রী শ্রী মেধীর জনপ্রিয়তার হানি হইবে। অবশ্য একথাও তাঁহারা স্বীকার করেন যে, পুরাতন মন্ত্রীদের কাহাকেও বাদ দেওয়া শ্রী মেধীর পক্ষে সম্ভব ছিল না।
নূতন মন্ত্রিসভার গঠন সম্পর্কে শ্রী মেধীকে বহু সমস্যার সম্মুখীন হইতে হইয়াছে। কিন্তু তিনি সাফল্যের সঙ্গে সমস্ত সমস্যার সমাধান করিয়াছেন। দুইজন বাঙ্গলা ভাষাভাষী সদস্যকে মন্ত্রিসভার অন্তর্ভুক্ত করায় তিনি বাঙ্গালীদের কৃতজ্ঞতা ভাজন হইয়াছেন। এখন হইতে বাঙ্গালীরা আসামের ভবিষ্যৎ গঠনে যথেষ্ট আগ্রহশীল হইবে বলিয়া আশা করা যায়। নূতন মন্ত্রিসভায় শ্রী মেধী দপ্তরগুলি যেভাবে বণ্টন করিয়াছেন তাহাও বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।১০৫
শপথ গ্রহণের পর মুখ্যমন্ত্রী বিষ্ণুরাম মেধী এক আবেদনে জানান:
The country and the vast electorate in this gigantic experiment in democracy fully realised the significance of this general election and felt the need of helping a party informing a stable and progressive Govt. specially in a strategic State like Assam, best with so many special problems awaiting solution and placed their unbounded confidence in the great Congress organisation, of which we are humble servants and afforded a fresh opportunity to serve the people and the country for attaining economic, social, spiritual and moral freedom.
At this hour we can illafford to be carried away by success at the polls. We must, on the other hand, regard it as an opportunity of serving the people for ameliorating their economic condition and for removing all the impediments in the way of all-round progress.
It is with a sense of duty that I have undertaken to shoulder the great resposibility that has been entrusted to me by the electorate throughout the State of Assam, including the tribals and scheduled caste people and other minorities, who have expressed their confidence in our great Congress organisation, of which I am an humble servent…১০৬
আসামে আর এক অধ্যায় শুরু হল বিষ্ণুরাম মেধীর নেতৃত্বাধীন সরকারের শপথ গ্রহণের মধ্য দিয়ে। মানুষ শান্তি প্রত্যাশী, প্রত্যাশা উজ্জ্বলতম ভবিষ্যতের। কিন্তু তা হয়নি। বিশেষত আসামে বসবাসকারী বাঙালির মুখের ভাষা ‘বাংলা’ আক্রান্ত হল বার বার। গোয়ালপাড়ায় বাঙালিরা ব্যাপকভাবে আক্রান্ত হলেন মুখ্যমন্ত্রী বিষ্ণুরাম মেধী যুগেই। বৈষম্যের শিকারও হলেন বাঙালিরা।
আসাম ব্যবস্থাপক পরিষদে বাংলা ভাষায় কথা বলার অধিকার প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন আবদুল হামিদ চৌধুরী (সোনা মিয়া) ১৯২৭ সালে। তিনি এসময় সিলেট সদর থেকে নির্বাচিত সদস্য ছিলেন। এরপর গোয়ালপাড়া থেকে নির্বাচিত সদস্য মতিউর রহমান মিয়া, ধুবড়ি থেকে নির্বাচিত সদস্য মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী প্রমুখ ব্যবস্থাপক পরিষদ বা আইনসভায় বাংলা ভাষাকে সুদুঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।
১৯৫০ সালের বিধানসভা বিধিতে, এ সত্য স্থিতি লাভ করে:
…যদি কোনো সদস্য অসমিয়া ভাষা না জানেন কিংবা এই ভাষা সম্বন্ধে কোনো পরিচিতি না থাকে তাহলে তিনি অধ্যক্ষের অনুমতি সাপেক্ষে সভায় বাংলা, ইংরেজি কিংবা হিন্দি ভাষায় বক্তব্য পেশ করতে পারেন। এমন কি উপরিউক্ত ভাষাগুলির মধ্যে একটিতেও যদি কোনো সদস্যের জ্ঞান না থাকে তাহলে তিনি অধ্যক্ষের অনুমতি নিয়ে নিজ নিজ মাতৃভাষায়ও বক্তব্য উপস্থাপন করতে পারবেন।১০৭
কিন্তু ১৯৫৩ সালের বিধানসভা ১৯৫০ সালের বিধানসভায় অনুমোদিত বিধি বাতিল করে নতুন আইন প্রণয়ন করেন। ১৯৫৩ সালের বিধানসভার নতুন বিধিতে বলা হল— ‘The business of the House shall be transacted in Assamese or in Engligh.’১০৮
১৯৫২ সালে ক্ষমতার পটপরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আসামের নতুন মন্ত্রিসভার নব উপহার অনসমিয়াদের অধিকার হরণ এবং রাজ্যে অসমিয়া ভাষা প্রতিষ্ঠায় কয়েক ধাপ অগ্রসর হওয়া।
চাকরি ক্ষেত্রেও আসাম সরকার বহুবিধ বিধিনিষেধ আরোপ করেন। আর এসব বিধিনিষেধের ফলে একমাত্র অসমিয়া ছাড়া অন্য যেকোনো জাতি, উপজাতি বা পাহাড়ি জনগোষ্ঠীভুক্ত সদস্যের পক্ষে আসামে সরকারি চাকরি লাভ অসম্ভব প্রায়। ১৯৫৩ সালের ৩০ জুলাই আসাম সরকারের এমপ্লয়মেন্ট বিভাগের নিয়োগ শাখার এ-এ-এম ১০/৫৩/১৩৭ সংখ্যক এক চিঠিতে মুখ্যসচিব সরকারি চাকরিলাভের ক্ষেত্রে যা যা প্রয়োজন তার একটি দীর্ঘ তালিকা এবং তার ব্যাখ্যা প্রদান করে জানান:
…যতদিন না ভারতীয় পার্লামেন্ট সংবিধানের ১৬(৩) ধারানুযায়ী প্রবর্তন করেন, ততদিন প্রদেশ সরকারে চাকুরিপ্রার্থী নিম্নোক্ত যে কোনো শ্রেণীর লোককে এই মর্মে সার্টিফিকেট নিতে হইবে যে তিনি আসামের অধিবাসী (native), অথবা ডোমিসাইলড অথবা আসামে আগত উদবাস্তু।১০৯
এই তিন ক্ষেত্রেই একজন অনসমিয়াকে যেসব বিধি এবং নিয়মের বেড়াজাল পেরুতে হবে তাতে কয়েক জনমেও বর্ণিত বিধি পেরুনো দুঃসাধ্যপ্রায়।
সরকার অতিসুকৌশলে বঙ্গভাষী কাছাড় জেলায় অসমিয়া ভাষার অনুপ্রবেশ ঘটাতে যে বেশ তৎপর তারও প্রমাণ পাওয়া গেল পাঁচের দশকেই। সরকারি কাজে কোর্ট বা অন্যান্য অফিসে ব্যবহারের জন্য যেসব ফর্ম ব্যবহার করা হয়— সেগুলো অসমিয়া ভাষায় মুদ্রিত হচ্ছে। বিষয়টি অনেকের নজরে আসে। শিলচর জেলা ‘বার অ্যাসোসিয়েশন’ এর প্রতিবাদে ১৯৫৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি এক সভায় মিলিত হয়ে নিম্নলিখিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে:
The members of the Silchar District Bar Association record their protest against imposition of Assamese language in the district of Cachar by the Assam Government. Though officially Cachar is admitted to be a Bengali speaking district, the Government published printed forms like Kacha Patta, Jamabadi records, summons, notices, etc. in Assamese, to the great disadvantage and inconvenience of the public. Such move is considered by the members as a part of the sinister move of Assamising the State by taking advantage of the name of the State. The meeting requested the representatives in the Assembly from Cachar to oppose all steps and move in this connection, so that the attempt may be nipped in the bud.১১০
১৯৫৪ সালের বাজেট অধিবেশনে কংগ্রেস বিধায়ক ধরণীধর বসুমাতারি অসমিয়া ভাষাকে রাজ্যভাষা করার দাবি সংবলিত একটি বেসরকারি প্রস্তাব উত্থাপন করেন। কংগ্রেসীয় অপর সদস্যগণ বিষয়টি কংগ্রেস সংসদীয় দলের সভায় আলোচনা করা হবে বলে ঘোষণা দিলে বিধানসভায় বিষয়টি স্থগিত রাখা হয়।১১১ কিন্তু জনমনে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যায় অসমিয়া ভাষাকে বিধানসভায় রাজ্যভাষা করার প্রস্তাবকে কেন্দ্র করে। পাহাড়ি জনগোষ্ঠীও এই প্রস্তাবের তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। আপাতত বিষয়টিতে ধাপাচাপা দেওয়া হলেও এজন্য অসমিয়া বন্ধুদের খুব বেশি দিন অপেক্ষা করতে হয়নি। এদিকে কলকাতায় ১৯৫৪ সালের ২৪ মে পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেস কমিটি রাজ্য পুনর্গঠন কমিশনের কাছে প্রায় ২০০ পৃষ্ঠাব্যাপী এক স্মারকলিপি পেশ করেন। সাব কমিটির সম্পাদক বিমলচন্দ্র সিংহ ও অন্যান্য সদস্যের উপস্থিতিতে এক সাংবাদিক সম্মেলনে রাজ্যে পুনর্গঠন কমিশন বরাবর প্রেরিত স্মাকলিপির বিষয়বস্তু প্রকাশ করা হয়।
স্মারকলিপিতে বিহার, উড়িষ্যা ও আসামের বঙ্গভাষী অঞ্চল এবং ‘গ’ শ্রেণিভুক্ত ত্রিপুরা রাজ্যের পশ্চিমবঙ্গ ভুক্তির দাবি করা হয়। বলা হয়, ‘ঐতিহাসিক, ভাষাগত, অর্থনৈতিক, নৃতাত্ত্বিক, আর্থিক, ভৌগোলিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, প্রশাসনিক প্রভৃতি বিভিন্ন দিক থেকে এ সকল অঞ্চল পশ্চিমবঙ্গভুক্তির দাবি রাখে। স্মারকলিপিতে আরও বলা হয়, বিহারের পূর্ণিয়া, মানভূমের পুরুলিয়া ও ধানবাদ, গড্ডা মহকুমা বাদে সাঁওতাল পরগনা, সিংহভূমের ধলভূম ও সেরাইকেলার অংশ, উড়িষ্যা থেকে উত্তর বালেশ্বর, আসাম থেকে গোয়ালপাড়া ও গারো পাহাড় অঞ্চল, ত্রিপুরা রাজ্য ও কাছাড় এবং অতিরিক্ত হিসেবে গারো পাহাড় থেকে কাছাড় পর্যন্ত একটি সংযোজক পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্ভুক্ত করবার দাবি জানানো হয়।
স্মারকলিপিতে পশ্চিমবঙ্গ কংগ্রেস কমিটি জোর দিয়ে বলেন যে, বিহার, উড়িষ্যা ও আসামের যে বঙ্গভাষী অঞ্চলগুলি দাবি করা হয়েছে, তার মোট আয়তন ২১ হাজার বর্গমাইলের কিছু বেশি এবং লোকসংখ্যা প্রায় ৮২ লক্ষ। এসব অঞ্চলগুলিকে পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্ভুক্ত করতেই হবে।১১২
রাজ্য পুনর্গঠন কমিশনের কাছে পাঠানো এই স্মারকলিপির প্রতিক্রিয়া আমরা প্রত্যক্ষ করব পরবর্তীতে, গোয়ালপাড়ায়।
করিমগঞ্জে আসাম-ত্রিপুরা-মণিপুর বঙ্গভাষা ও সাহিত্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৫৪ সালের ১৯-২০ জুন। এই সম্মেলনে যোগদান উদ্দেশ্যে ১৮ জুন আমন্ত্রিত অতিথি, বিভিন্ন অঞ্চলের প্রতিনিধিবৃন্দ এবং বিশিষ্টজনেরাও একে একে পৌঁছোতে শুরু করেন। করিমগঞ্জ হয়ে ওঠে একটি উৎসবমুখর শহর। সম্মেলনে যোগদান উদ্দেশ্যে প্রবীণ সাংবাদিক ও বিশিষ্ট সাহিত্যিক হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ এবং ভারত সরকারের অর্থমন্ত্রকের উপমন্ত্রী অরুণচন্দ্র গুহ করিমগঞ্জ পৌঁছোলে মানুষ উচ্ছ্বাসে ফেটে পেড়ে। হাততালি আর ধ্বনিতে স্থানটি মুখরিত হয়ে ওঠে। আসাম-ত্রিপুরা-মণিপুর বঙ্গভাষা ও সাহিত্য সম্মেলনের অভ্যর্থনা সমিতি ও জনসাধারণের পক্ষ থেকে তাঁদের বিপুল সংবর্ধনা দেওয়া হয়। অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট ধর্মদাস দত্ত শ্রী গুহ ও শ্রী ঘোষকে মাল্যভূষিত করেন। স্থানীয় বিশিষ্ট সরকারি কর্মচারীবৃন্দও সংবর্ধনায় যোগদান করেন।১১৩
১৯৫৪ সালের ১৯, ২০ জুন আসাম-ত্রিপুরা-মণিপুর বঙ্গভাষা ও সাহিত্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় করিমগঞ্জ কলেজ হলে। অপরাহ্নে অনুষ্ঠিত ১৯ জুনের প্রথম দিনের সভায় সভাপতিত্ব করেন প্রবীণ সাংবাদিক-লেখক হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ। অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি ছিলেন অ্যাডভোকেট ধর্মদাস দত্ত। সম্মেলন উদবোধন করেন ভারত সরকারের অর্থমন্ত্রকের উপমন্ত্রী অরুণচন্দ্র গুহ। অভ্যর্থনা সমিতির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন কুশীমোহন দাস। শিশুচিত্র প্রদর্শনী উদবোধন করেন শিলচরের নগেন্দ্রচন্দ্র শ্যাম।
আসাম-ত্রিপুরা ও মণিপুরের বিভিন্ন স্থান থেকে দুই শতাধিক প্রতিনিধি সম্মেলনে যোগদান করেন। সম্মেলন ভবনের ভিতরে ও বারান্দায় তিলধারণেরও স্থান ছিল না। বিশিষ্টজনদের মধ্যে সম্মেলনে রণেন্দ্রমোহন দাস. এম এল এ, মঈনুল হক চৌধুরী এম এল এ, নিবারণচন্দ্র লস্কর এম পি, সুরেশচন্দ্র দেব এম. পি, জ্যোৎস্না চন্দ, এন নয়নী শ্যাম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। সম্মেলন গৃহ অপরূপ সাজে সাজানো হয়েছিল।১১৪
শ্যামপদ ভট্টাচার্য, সুখময় দত্ত, সুপ্রিয় দাস, অর্চনাদেব রায়, ঊষা দাস ও মীরা দাস উদবোধন সংগীত পরিবেশনের পরই অধিবেশন আরম্ভ হয়। সভাপতিত্ব করেন হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ। অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট ধর্মদাস দত্ত তাঁর অভিভাষণ পাঠ করেন। উপমন্ত্রী অরুণচন্দ্র গুহ এরপর সম্মেলনের উদবোধন ঘোষণা করেন।
অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি ধর্মদাস দত্ত তাঁর অভিভাষণে বলেন:
আসাম-মণিপুর-ত্রিপুরা ভারতের এই পূর্ব সীমান্তে বিপুল সংখ্যক বাঙালীর ঐতিহাসিক ও সমাজতাত্ত্বিক পটভূমিকা যাঁহাদের সম্যক জানা আছে তাঁহারা অবশ্যই স্বীকার করিবেন, এখানকার বাঙালী এখানকার রাষ্ট্রিক, অর্থনীতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে প্রভূত কল্যাণ সাধন করিয়াছেন। আসাম প্রদেশবাসী এমন বহু উদারহৃদয় অবাঙালীর সঙ্গে আমাদের সাক্ষাৎ ঘটিয়াছে যাহারা স্থানীয় জীবনে বাঙালীর অবদানের কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন। কিন্তু সেই সঙ্গে আমাদের দুর্ভাগ্যবশতঃ এই আসামেই এমন সব তথাকথিত নেতার সংস্পর্শে আমাদের আসিতে হইয়াছে এবং এখনও অনবরতই হইতেছে যাঁহাদের রাজনৈতিক চেতনা প্রাদেশিক সঙ্কীর্ণতাকে অতিক্রম করিতে বার বার ব্যর্থ হইয়াছে।
শ্রীদত্ত বলেন:
ভারতীয় সংবিধানের সুস্পষ্ট নির্দেশ অগ্রাহ্য এবং মূলনীতিকে অবমাননা করিয়া আসাম রাজ্যের বঙ্গ-ভাষাভাষী কোন কোন অঞ্চলে বাঙলা ভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান প্রথা রহিত হইতেছে। বাঙলা ভাষাভাষীর সংখ্যা হ্রাস ও এই ভাষার উৎখাত সাধনই যে এই প্রচেষ্টার একমাত্র উদ্দেশ্য তাহাতে সন্দেহের অবকাশ নাই। বঙ্গভাষী গোয়ালপাড়া জেলায় ১৯৪৭-১৯৪৮ সালে ২৫০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বাঙলা ভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান করা হইত। ১৯৫০-৫১ সালে এইরূপ বিদ্যালয়ের সংখ্যা দাঁড়ায় মাত্র তিন। আসামের অন্যান্য অঞ্চলে ও বিদ্যালয়-সমূহে বাঙলা ভাষা শিক্ষার মাধ্যমরূপে ব্যবহৃত হওয়ার পথে বিবিধ প্রতিবন্ধক সৃষ্টি করা হইতেছে। আসামের একমাত্র সরকারী আর্টস ও সায়েন্স কলেজে বাঙালী ছাত্রদের অনেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পরীক্ষায় উচ্চ স্থান অধিকার করিয়া যদিও প্রতি বৎসর উক্ত কলেজের সুনাম বৃদ্ধি করিতেছে, তথাপি-তাহাদের জন্য বাঙলা ভাষার পৃথক কোন বিভাগ নাই। নানারূপ অযৌক্তিক ও অহেতুক শর্ত আরোপ করিয়া বাঙালী ছাত্র-ছাত্রীদের উচ্চশিক্ষালাভের পথ প্রায় রুদ্ধ করিয়া আনা হইয়াছে। সরকারী বৃত্তিসমূহ হইতে কৃতী বাঙালী ছাত্র-ছাত্রীদিগকে অন্যায়ভাবে বঞ্চিত করা হইতেছে। ভিন্ন ভাষাভাষী, ছাত্রদের অবশ্য শিক্ষণীয় বিষয়রূপে শুধু অসমীয়া ভাষাই এই রাজ্যে সরকারী অর্থানুকুল্যে বিদ্যালয়সমূহ প্রচলিত হইয়াছে। বাঙলা বা অন্য কোনো বিশিষ্ট ভাষাকে ঐরূপ-মর্যাদাদান করা হইতেছে না। অসমীয়া ভাষা এই রাজ্যের সরকারী ভাষারূপ স্বীকৃত না হইলেও সমস্ত রাজ্যবাসীর উপর এই একটি ভাষাকে জোর করিয়া চাপাইয়া দেওয়ার প্রচেষ্টায় রাজ্য সরকার বাঙলা ও অন্যান্য পার্বত্য ও আঞ্চলিক ভাষাভাষীর উপর জবরদস্তি চালাইতেছেন। সরকারী প্রচারপত্র ও বিজ্ঞপ্তি প্রভৃতিতে ভিন্ন ভাষাভাষীর অঞ্চলসমূহেও অসমীয়া ভাষা ব্যবহৃত হইতেছে। দেশ বিভাগের সন্ধিক্ষণে ভারত তথা আসামে চাকুরী করিতে ইচ্ছাজ্ঞাপনকারী বহু সংখ্যক বাঙালী কর্মচারীকে নিতান্ত অবৈধভাবে কর্মচ্যুত করিয়া অদ্যাবধি অনেককে চাকুরিতে নিয়োগ করা হয় নাই। এই রাজ্যস্থিত তৈল কোম্পানী, চা-বাগান প্রভৃতি শিল্প-বাণিজ্য সংস্থা এবং রেল, পোস্ট, টেলিগ্রাফ প্রভৃতি কেন্দ্রীয় সরকারী সংস্থাগুলিতেও বাঙালী নিয়োগের ক্ষেত্র ক্রমশঃ সঙ্কুচিত করিয়া আনা হইতেছে। পুনর্বাসন, সাহায্যপ্রদান প্রভৃতি ক্ষেত্রে রাজ্য সরকার আসামে আগত বাঙালী উদ্বাস্তুদের প্রতি প্রায়শঃ বিরূপ মনোভাবের পরিচয় প্রদান করিয়া আসিতেছেন। জীবনের নানা ক্ষেত্রে এইভাবে সরকারী সুপরিকল্পিত অবৈধ নীতির ফলে এতদঞ্চলের বঙ্গভাষাভাষীদের মধ্যে সঙ্ঘবদ্ধতা অনেকাংশে ঘুচিয়া গিয়াছে। ইহারই সুযোগ লইয়া আমাদের মধ্যে এই ধরনের মেরুদন্ডহীনতা ক্রমশঃ প্রবেশ লাভ করিতে পারিতেছে। এবং এই মেরুদন্ডহীনদের উপর নির্ভর করিয়াই আমাদের সংহতি বিনষ্ট করিবার সব রকম প্রচেষ্টাই চালান হইতেছে।
শ্রীদত্ত আরও বলেন:
আসাম, ত্রিপুরা ও মণিপুর বিভিন্ন ভাষাভাষী লোকের বাসভূমি। এই অপরূপ ভূখন্ডে বহু বিচিত্র সভ্যতা ও সংস্কৃতি বহু যুগাবধি ভাব বিনিময়ের মধ্য দিয়া একভূত হইয়া কিছুকাল আগেও একটি ঐক্যতানের সৃষ্টি করিয়াছিল। ইতিমধ্যে বিদেশী শাসকের কুখ্যাত ভেদনীতির প্রয়োগের ফলে আমাদের সেই ঐক্যতান স্তব্ধ হইয়াছে। আমরা পরস্পরের মধ্যে বিদ্বেষভাব জাগাইয়া তুলিয়াছি এবং সামান্যতম সহনশীলতাবোধও হারাইয়া আমরা সভ্য মানুষের চরিত্রচ্যুত হইয়াছি। বোধকরি এই জন্যই মাত্র বিশ বৎসর মধ্যে একটি জেলার লক্ষ লক্ষ অধিবাসী তাহাদের পুরুষানুক্রমিক সংস্কৃতিকে হারাইয়া বসিয়াছি।১১৫
ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী অরুণচন্দ্র গুহ সম্মেলন উদ্বোধন করে জানান :
বাঙ্গালীদিগকে এক সময়ে তাঁহাদের শিক্ষা ও সংস্কৃতির জন্য বিভিন্ন প্রদেশে শ্রদ্ধা করা হইত, এখন ভারতের কোন কোন রাজ্যে তাহাদিগকে ঘৃণা করা হয় এবং অনাকাঙ্ক্ষিত বলিয়া গণ্য করা হয়। আমাদিগকে এখন আত্মবিশ্লেষণ দ্বারা পরিবর্তিত অবস্থা অনুযায়ী কাজ করিতে হইবে।
অতঃপর তিনি বলেন যে:
যদি প্রাদেশিকতাকে অবাধ গতি দেওয়া হয়, তাহা হইলে ভারতের সংহতি বিনষ্ট হইবে। ভারতের প্রাচীন ইতিহাস হইতে এই শিক্ষা পাওয়া যায়। পারস্পরিক অবিশ্বাস, অনাস্থা ও বিদ্বেষ ভারতের জাতীয়তাবাদের পক্ষে বিপজ্জনক। বাঙ্গালীদিগকে এই আদর্শ প্রচার করিতে হইবে, কারণ তাঁহারা আপনাদিগকে শিক্ষায় ও সংস্কৃতিতে অগ্রসর বলিয়া বিবেচনা করেন; তাঁহাদিগকে কার্য দ্বারা ইহা প্রমাণ করিতে হইবে।১১৬
তিনি আরও বলেন যে:
পূর্বভারতের বাঙ্গলা, বিহারী ও অসমীয়া ভাষার মূল এক এবং এই সমুদয় একই ব্যাকরণ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। সকল অসমীয়া বাঙ্গলা জানেন; আসামের বাঙ্গালীরা অসমীয়া ভাষা শিখিতে পারেন; ইহার অর্থ এই নহে যে, তাঁহাদের মাতৃভাষাকে অবহেলা করা হইবে। … বাঙ্গলা ভাষা কখনও লুপ্ত হইবে না। বাঙ্গলা ভাষা কোন প্রাদেশিক সরকারের সার্কুলার দ্বারা দমন করা যাইতে পারে, ইহা তিনি বিশ্বাস করেন না। উদ্বাস্তুদের দাবী সম্পর্কে তিনি সম্ভবপর সর্বপ্রকার সাহায্য করিবার আশ্বাস দেন।১১৭
সভাপতি হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ তাঁর ভাষণে বলেন, ‘অন্যায়ের বিরুদ্ধে যুবক ও ছাত্রসমাজ সঙ্ঘবদ্ধ হইতেছেন—ইহা আশার কথা।’
অভ্যর্থনা সমিতির সাধারণ সম্পাদক কুশীমোহন দাস সম্মেলনের সাফল্য কামনা করে যাঁদের বাণী তাঁরা লাভ করেছিলেন—তিনি তাঁদের নাম ঘোষণা করেন। এসব গুণীজনদের মধ্যে ছিলেন বিশ্বভারতীর শ্রীপ্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, মণিপুরীদের জাতীয় নেতা শ্রী বিদ্যাপতি সিংহ, জনাব হুমায়ুন কবীর, মওলানা আবুল কালাম আজাদ, শ্রীযুক্তা বাণী চন্দ, শ্রীপরেশলাল সোম, জনাব হুরমত আলি বড়লস্কর, শ্রীতুষারকান্তি ঘোষ, শ্রীশ্যামাচরণ দেব, কাছাড় জেলার ডেপুটি কমিশনার শ্রী আর. কে. শর্মা, শ্রীমহেন্দ্র চন্দ্র দে, শ্রী রুবী দাশগুপ্ত, গৌহাটি হাইকোর্টের জজ শ্রী এইচ. ডেকা এবং অসম জাতীয় মহাসভা’র নেতা শ্রীঅম্বিকাগিরি রায়চৌধুরী। শ্রীচৌধুরী তাঁর বার্তায় জানান যে, এই সম্মেলনের উদ্দেশ্য অপরের আঞ্চলিক ভাষার সাম্রাজ্যবাদের সম্প্রসারণ। সুতরাং, ভারতের জাতীয় ঐক্যের সমর্থক মাত্রেই তা সমর্থন করতে পারেন না। এই বাণী বা বার্তা পাঠ করার সময় চারিদিক থেকে ‘ধিক ধিক’ ধ্বনি উত্থিত হয়।
বিদায় সংগীত গাওয়ার পর অধিবেশন পরদিন পর্যন্ত স্থগিত রাখা হয়। সম্মেলন শেষ হওয়ার পূর্বে শিলচরের বিশিষ্ট শিল্পী ধীরেশ পাল শ্রী হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ ও শ্রী অরুণচন্দ্র গুহকে তাঁর আঁকা দুটি ছবি দু-জনকে উপহার দেন।১১৮
দ্বিতীয় দিন ২০ জুন শ্রীহেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আসাম-ত্রিপুরা-মণিপুর বঙ্গভাষা ও সাহিত্য সম্মেলন শুরু হওয়ার পরই সম্মেলনে প্রস্তাব গ্রহণ বিষয়ে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনা শেষে সভা এই মর্মে প্রস্তাব গ্রহণ করে যে, ‘আসামে অসমীয়া ভিন্ন অন্য ভাষার প্রতি বৈষম্যমূলক ব্যবহারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাইয়া সকলকে এই মর্মে আবেদন জানানো হয় যে, অবিলম্বে বর্তমান নীতি পরিবর্তিত না হইলে শান্তিপূর্ণ ভাবে নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আন্দোলন করিবার জন্য প্রস্তুত থাকিতে হইবে। মহিলা প্রতিনিধি শ্রীমতী এন নয়না শ্যাম প্রস্তাবটি উত্থাপন করেন।১১৯
এদিন ভারত সরকারের অর্থ মন্ত্রকের উপমন্ত্রী শ্রী অরুণচন্দ্র গুহ এবং বিশিষ্ট সাংবাদিক শ্রী হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ-এর সম্মানার্থে করিমগঞ্জের সাপ্তাহিক পত্রিকা যুগশক্তি-র পক্ষ থেকে এক চা-বৈঠকের আয়োজন করা হয়। সাহিত্য সম্মেলনে আগত অতিথি ও সাংবাদিকগণ এই অনুষ্ঠানে যোগদান করেন। বৈঠকে বিশেষভাবে আসামে বসবাসকারী বাঙালিদের সমস্যাদি সম্পর্কে ঘরোয়া আলোচনা করা হয়। এ ছাড়া স্থানীয় সমস্যাদি নিয়েও কথা হয়।১২০
আসাম-ত্রিপুরা-মণিপুর বঙ্গভাষা ও সাহিত্য সম্মেলন কেবল করিমগঞ্জ বা কাছাড় জেলা নয়— সমগ্র আসাম-ত্রিপুরা এবং মণিপুরবাসীর কাছেই ছিল অতীব গুরুত্ববহ। সম্মেলন উপলক্ষ্যে বিদ্বজ্জন সমাজের যাঁরা শুভেচ্ছাবার্তা পাঠিয়েছিলেন—কেবল তাঁদের নামের তালিকা যদি আমরা পর্যালোচনা করি— তাহলে সম্মেলনের প্রাসঙ্গিকতা এবং গুরুত্ব কতটা ছিল তা অনুধাবন সম্ভব। একইভাবে অসম জাতীয় মহাসভার নেতা শ্রীঅম্বিকাগিরি রায়চৌধুরীর পাঠানো বার্তা থেকেও তাঁকে চিরাচরিত চেনা ছকেই পাওয়া যায়।
অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট ধর্মদাস দত্ত-এর অভিভাষণ থেকে বাঙালি তথা অসমিয়াদের মনের কথা, বঞ্চনার কথা স্পষ্টত পাওয়া যায়। ভারত সরকারের গুরুত্ববহ অর্থ মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী অরুণচন্দ্র গুহ তাঁর ভাষণে যেসব কথা বলেছেন তাও ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। সার্বিকভাবে এই সম্মেলন ছিল সম্পূর্ণত ইতিবাচক এবং ভবিষ্যৎ দিকচিহ্নবাহী এক স্মারকলিপি।
সংবাদপত্রে সিলেট গণভোট প্রসঙ্গটি আবার আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয় ১৯৫৫ সালে। রাজ্য পুনর্গঠন কমিশনে পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ-কংগ্রেস কমিটির পক্ষ থেকে প্রায় ২০০ পৃষ্ঠার এক দীর্ঘ স্মারকলিপি পেশ করা হয় ১৯৫৪ সালের মে মাসে—যেখানে অন্যান্য দাবির পাশাপাশি আসাম সরকারের বিরুদ্ধে বাঙালি অধ্যুষিত সিলেট গণভোট প্রসঙ্গে বহুবিধ অভিযোগ উত্থাপন করা হয়। একইভাবে আসামের কাছাড় রাজ্য পুনর্গঠন কমিটির পক্ষ থেকেও অন্যান্য অভিযোগের সঙ্গে সিলেট গণভোট বিষয়ে অভিযোগও স্মারকলিপিতে তুলে ধরা হয়। পশ্চিমবঙ্গ এবং কাছাড় রাজ্য পুনর্গঠন কমিটি প্রদত্ত স্মারকলিপিতে অন্তর্ভুক্ত দলিল-দস্তাবেজের ভিত্তিতে আনন্দবাজার পত্রিকা-র প্রধান সম্পাদকীয়তে ‘শ্রীহট্ট’ শীর্ষক এক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। এই প্রবন্ধ প্রকাশের পর পরই আসাম সরকার এ সংক্রান্ত এক প্রেসনোট প্রকাশ করেন ১৯৫৫ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি। সরকারের এই প্রতিবাদলিপি আনন্দবাজার পত্রিকা-য় প্রকাশিতও হয়। এই সংবাদ বা প্রেসনোট পড়ার পর শিলচর থেকে কাছাড় রাজ্য পুনর্গঠন কমিটির পক্ষে শ্রীধীরেন্দ্র মোহন দেব, অ্যাডভোকেট এবং শ্রী পরেশচন্দ্র চৌধুরী, অ্যাডভোকেট আসাম সরকারের প্রেসনোটের প্রতিবাদ জানিয়ে পালটা জবাব দেন একই বছরের মার্চ মাসে। এর ফলে সিলেট গণভোট প্রসঙ্গে অনেক অজানা তথ্য উন্মোচিত হয়—যার নিট ফলে সমৃদ্ধ হবেন বর্তমান এবং আগামী প্রজন্ম। আসাম সরকারের প্রেসনোট সম্পর্কে সংবাদে বলা হল:
… প্রকৃত তথ্যের সত্যতা যাচাই না করিয়া এরূপ প্রবন্ধ লেখা উচিত হয় নাই। বিবৃতিতে প্রকাশ পূর্বোক্ত প্রবন্ধে এই মর্মে অভিযোগ করা হয় যে, শ্রীহট্টে স্বাধীনভাবে গণভোট গৃহীত হয় নাই; শ্রীহট্ট জেলাকে পূর্ববঙ্গের নিকট উপঢৌকন দিবার ইহা শুধু একটা উপায় ছিল। এই অভিযোগের সমর্থনে রাজ্য পুনর্গঠন কমিশনের নিকট পশ্চিমবঙ্গ ও কাছাড় রাজ্য পুনর্গঠন কমিটির তরফ হইতে প্রদত্ত লিপির অংশবিশেষ উক্ত প্রবন্ধে উদ্ধৃত করা হইয়াছে। উহাতে আরও বলা হইয়াছে যে, আসাম সরকার গণভোটে জয়লাভের জন্য বিশেষ চেষ্টা করেন নাই; পক্ষান্তরে পাঞ্জাবের মুসলিমলীগ প্রচারকদের সব রকম সুবিধা দেওয়া হয়। এদিকে কলিকাতা হইতে যাঁহারা শ্রীহট্টকে ভারতে রাখিবার পক্ষে প্রচারকার্য করিতে গিয়াছিলেন, তাঁহাদের কাজে সর্ববিধ অসুবিধা সৃষ্টি করা হয়। তাহা ছাড়া, হিন্দু এলাকাসমূহে নদী পারাপারের ব্যবস্থা প্রায় বন্ধ করিয়া দিয়া হিন্দুদের ভোটদান অসম্ভব করিয়া তোলা হয়।
এইসব অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। আশ্চর্যের বিষয়, দায়িত্বশীল বলিয়া বর্ণিত প্রতিষ্ঠান-সমূহ এই সব অভিযোগ করিয়াছে। স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে গণভোট গ্রহণের যথোপযুক্ত ব্যবস্থা করা আসাম সরকারের কর্তব্য ছিল। সরকারী এই কর্তব্য সম্পাদন করেন এবং রাজ্যের সমুদয় পুলিশ ও অন্যান্য বিভাগের কর্মচারীদিগকে গবর্নরের তত্ত্বাবধানে নিয়োগ করেন; কারণ গবর্নরের উপর গণভোট পরিচালনার ভার ন্যাস্ত হইয়াছিল। গবর্নর আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকল্পে স্থায়ী সৈন্য ও আসাম রাইফেলের সাহায্য গ্রহণ করেন। সবাই জানেন, শ্রীহট্ট মুসলমান সংখ্যাগুরু জেলা। গণভোট গ্রহণকালে জেলার মুসলমানদের মধ্যে পাকিস্তানের অনুকূলে মনোভাব উদ্দীপ্ত হয়। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল হইতে লীগ, কংগ্রেস ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের স্বেচ্ছাসেবকগণ শ্রীহট্টে যান। কোন কর্মীর প্রচারকার্য বা অন্যরূপ কাজে বাধা সৃষ্টি করা হয় না। পূর্বোক্ত সম্পাদকীয়তে কাছাড় রাজ্য পুনর্গঠন কমিটির প্রদত্ত বিবৃতির একাংশ উদ্ধৃত করিয়া বলা হইয়াছে যে, আসাম গবর্নমেন্ট প্রেসের তৎকালীন মুসলমান সুপারিন্টেণ্ডেন্ট জাল ভোটপত্র মুদ্রিত করিয়া মুসলিমলীগকে দেন এবং তাহা ভোটদানের ব্যাপারে ব্যবহৃত হয়। গণভোট গ্রহণের কয়েক মাস পর সুপারিন্টেণ্ডেন্টের এই অপকর্ম নাকি ধরা পড়ে। এই হেতু তাঁহাকে বরখাস্ত করা হয়। ইহার পর উক্ত ব্যক্তি নাকি পাকিস্তানে চাকরি লইয়াছে। ইহা অলীক উক্তি। সরকারী প্রেসে অনুমোদিতভাবে কোন জাল ভোটপত্র মুদ্রণের কোন প্রমাণ নাই। তবে ১৯৫২ সালে উক্ত সুপারিন্টেণ্ডেন্টের বিরুদ্ধে কয়েকজন কর্মচারীর কাজের রেকর্ডের অসাধুভাবে রদবদল ও সরকারকে প্রতারণা করা প্রভৃতি অবৈধ কার্যকলাপের অভিযোগ আনয়ন করা হয় এবং ১৯৫৩ সালের এপ্রিল মাসে তাঁহাকে বরখাস্ত করা হয়। তিনি এখন শিলং-এ মুদিখানার দোকান খুলিয়াছেন।
শ্রীহট্ট জেলার গুরুত্ব সম্পর্কে আসাম সরকার সম্যক অবহিত; তাঁহারা শ্রীহট্টের হিন্দু সংখ্যাগুরু বিভিন্ন থানা এবং আঞ্চলিক সংলগ্নতা ও ঘনসংবদ্ধতার জন্য অন্যান্য মুসলমান সংখ্যাগুরু অঞ্চল আসামে রাখার উদ্দেশ্যে র্যাডক্লিফ কমিশনের নিকট যথেষ্ট যুক্তি তথ্য পেশ করেন। অসমীয়া শ্রেণী বহির্ভুত অন্যান্য লোকজনের ভারমুক্ত হওয়ার জন্য আসাম সরকার ১২টি হিন্দু সংখ্যাগুরু অঞ্চল পাকিস্তানকে সঁপিয়া দিয়াছে, একথা বলা কুৎসা রটনা ছাড়া কিছু নয়। আসাম নিজ রাজ্যও ভারত সরকারের আইনসম্মত স্বার্থরক্ষায় উদগ্রীব; ভারতীয় অঞ্চলের এক ইঞ্চি জমিও তাঁহারা ত্যাগ করিবেন না।
শ্রীহট্ট পাকিস্তান স্থানান্তরিত হওয়ায় যে আর্থিক ক্ষতি হইয়াছে, তাহা এবং উদ্বাস্তু সমস্যা ও ত্রিপুরা রাজ্যের অসুবিধা প্রভৃতি সম্পর্কে সরকার সজাগ। কাজেই শ্রীহট্টের অধিকাংশ লোক আসাম হইতে শ্রীহট্টের বিচ্ছিন্ন হওয়ার পক্ষে অভিমত প্রকাশ করায় সরকার কিভাবে দোষী হইতে পারে তাহা বুদ্ধির অগম্য।১২১
আসাম সরকার ‘শ্রীহট্ট’ শীর্ষক প্রবন্ধের প্রতিবাদে যেসব যুক্তি, তর্ক, তথ্যের অবতারণা করেছেন—কাছাড় রাজ্য পুনর্গঠন কমিটির পক্ষে অ্যাডভোকেট ধীরেন্দ্রমোহন দেব এবং অ্যাডভোকেট পরেশচন্দ্র চৌধুরী পালটা যুক্তি, তর্ক, প্রমাণাদি উপস্থাপন করে প্রকৃত সত্য উদঘাটনে প্রয়াসী হয়েছেন। তাঁরা জানিয়েছেন:
ভারতের পূর্বাঞ্চলে একটি পৃথক রাজ্য গঠনের দাবী সম্পর্কে কাছাড় রাজ্য পুনর্গঠন কমিটি সংবাদপত্রে অথবা সভাসমিতিতে কোন আন্দোলন করেন নাই। তাঁহারা তথ্য ও যুক্তি দ্বারা সমর্থিত তাঁহাদের বক্তব্য সীমানা নির্ধারণ কমিশনের নিকট পেশ করিয়া ক্ষান্ত রহিয়াছেন। কিন্তু অপরপক্ষে অসমীয়া শাসকদল ও আসাম সরকার কংগ্রেস অথবা প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ অমান্য করিয়া আমাদের বিরুদ্ধে সময়ে সময়ে বিষোদগার করিতেছেন এবং পরোক্ষ বা অপরোক্ষ বিবৃতি দিয়া ও সভা-সমিতি করিয়া আন্দোলন চালাইতেছেন। আমরা আমাদের স্মারকপত্রে যে সকল তথ্য সন্নিবেশিত করিয়াছি, সেগুলির একটির যাথার্থ্যে সন্দেহ প্রকাশ করিয়া গত ১৬ই ফেব্রুয়ারী আসাম সরকার এক প্রেসনোট প্রচার করিয়াছেন। আসাম কংগ্রেসের সভাপতিও সম্প্রতি তেজপুরে প্রদেশ কংগ্রেস সম্মেলনে আমাদিগকে ‘বহিরাগত’, ‘বিভেদ সৃষ্টিকারী’ ইত্যাদি শব্দ দ্বারা অভিহিত করিয়াছেন। এই অবস্থায় আমরা একটি উত্তর দিবার আবশ্যকতা অনুভব করি।
আমাদের স্মারকপত্র ‘পূর্বাচল পর্যালোচিত’ নামে পুস্তিকাকারে প্রকাশিত হইয়াছে এবং পাদটীকায় পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির প্রদত্ত স্মারকলিপি হইতে অংশবিশেষ উদ্ধৃত করা হইয়াছে। ব্রিটিশ রাজ্যের ‘উত্তরাধিকারী’ অসমীয়াগণ কঠিন প্রতিযোগীদের হাত হইতে নিস্তার পাইবার জন্য ভারত রাষ্ট্রের ক্ষতিসাধন করিয়াও কিভাবে গণভোটের সময় বাংলাভাষী শ্রীহট্ট জেলাকে পাকিস্থানের নিকট তুলিয়া দেন, আমাদের স্মারকপত্রে তাহা বলা হয়। এই বিবৃতির প্রতিবাদেই আসাম সরকার প্রেসনোট প্রচার করেন। শ্রীহট্ট জেলা হস্তচ্যুত হওয়ায় প্রেসনোটে প্রচুর কুম্ভীরাশ্রু মোচন করা হইয়াছে। উহাতে বলা হইয়াছে যে, প্রেস সুপারিন্টেণ্ডেন্ট জাল ব্যালট পেপার ছাপাইয়া মুসলিম লীগের হাতে দেন নাই এবং তাহাকে গণভোটের পরই নয়— ১৯৫৩ সনে বরখাস্ত করা হইয়াছে এবং তিনি পাকিস্তানে যান নাই। তাঁহার বরখাস্তের প্রকৃত কারণ প্রেসনোটে অবান্তর কথা দ্বারা রহস্যাবৃত করিয়া রাখা হইয়াছে। ১৯৪৮ সনের পরিবর্তে ১৯৫৩ সনে বরখাস্ত করা অথবা পাকিস্তানে অফিসার হওয়ার পরিবর্তে শিলংয়ে দোকান পরিচালনা করার কথা মুখ্য কথা নহে। বস্তুতঃ এ সকল আসাম সরকারের অযোগ্যতা এবং দেশপ্রীতির অভাবই সূচিত করে। সুবিদিত যে, অসমীয়া শাসকগণ হতভাগ্য বাঙ্গালী হিন্দুদের চেয়ে এই শ্রেণীর লোকের প্রতিই বেশী অতিথিপরায়ণ। কিন্তু প্রেসনোট এই বিষয়গুলির প্রতি নীরব কেন? যথা— ১. আসামের সরকারী প্রেসে সত্য সত্যই জাল ব্যালট পেপার ছাপা হইয়াছিল কি না এবং এগুলি শ্রীহট্ট গণভোটের সময় ব্যবহার করা হইয়াছিল কি না? ২. গণভোটের সময় শ্রীহট্টকে রক্ষা করিবার জন্য আসাম সরকারের মনোভাব কি ছিল? প্রথম প্রশ্নের জবাবে আমরা প্রমাণ করিয়া দিতে পারি যে, কোন কোন ভোট কেন্দ্রে ভোটপত্রের সংখ্যা ভোটদাতার তালিকাভুক্ত সংখ্যাকেও ছাড়াইয়া গিয়াছে। দ্বিতীয়তঃ আসামের তৎকালীন শাসন কর্তা স্যার আকবর হায়দারী লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে জানাইছিলেন কি যে তাঁহার মন্ত্রিসভায় অসমীয়া-বাঙ্গালী প্রশ্নে দ্বিমতের সৃষ্টি হইয়াছে এবং অসমীয়া প্রধানমন্ত্রী গোপীনাথ বরদলই মহাশয় শ্রীহট্টকে আসামের সহিত যুক্ত রাখিতে চান না? আমাদের পুস্তিকার পরিশিষ্ট (১)-এ এই উক্তির সমর্থনে প্রচুর প্রমাণ সন্নিবেশিত করা হইয়াছে। আসাম সরকার যদি ‘আসাম ট্রিবিউন’ অথবা আসাম জাতীয় মহাসভার যে সকল উক্তি আমরা পরিশিষ্টে উল্লেখ করিয়াছি তাহার দায়িত্ব অস্বীকার করিতে চাহেন, তাহা হইলে আমরা জানিতে চাহি আসাম সরকার ঐ সকল দায়িত্বজ্ঞানহীন উক্তির কি প্রতিবাদ করিয়াছেন? অথবা বাংলা বিরোধী অভিযান ও বাঙ্গালীদের বিরুদ্ধে ঐ সকল কাগজে যেভাবে ঘৃণা ও বিদ্বেষ প্রচার করা হইয়াছে—যাহার ফলে গৌহাটীতে বাঙ্গালীদের বিরুদ্ধে দাঙ্গা সংঘটিত করায় সাহায্য হয়, সেগুলির বিরুদ্ধে সরকার কি পন্থা অবলম্বন করিয়াছেন? ইহা কি সত্য নহে যে, সরকার মহাসভাকে সাহায্য ও ‘আসাম ট্রিবিউন’কে শিল্পঋণ বাবদ ১৯৫৩ সনেও ৫৫০০০ টাকা দিয়াছেন? আসাম সাহিত্যসভা পত্রিকার গত কার্তিক সংখ্যায় (১৮৭৪ শকাব্দ ৩য় সংখ্যা) আসাম জাতীয় মহাসভার সম্পাদক শ্রী অম্বিকাগিরি রায়চৌধুরীর তিন পৃষ্ঠাব্যাপী একটি কবিতায় (পৃ. ১৩৮-৪১) ভারতের জাতীয় সঙ্গীতের রচয়িতা রবীন্দ্রনাথ ও আমাদের প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুকে নিন্দা করা হইয়াছে—কারণ এই জাতীয় সঙ্গীতে আসামের নাম উল্লেখ নাই। লেখক অতি তীব্র ভাষায় সমগ্র বাঙ্গালী জাতি ও ভারতের অপরাপর অংশের অধিবাসীদিগকে ‘গো-মাংস ভক্ষণকারী’, ‘মোগলের দাস’ ইত্যাকার ভাষায় বিভূষিত করিয়াছেন। উক্ত কবিতার ধুয়াতে ‘ওঠ জাগো, আহত মস্তকে রক্তের ঢেউ তোল’ বলিয়া অসমীয়া যুবক সম্প্রদায়কে উত্তেজিত করার চেষ্টা করিয়াছেন। এ সকল কি সত্য নহে? আসাম সরকার এই সম্পর্কে কি করিয়াছেন? যদি কিছু না করিয়া থাকেন—তবে আসাম সরকারের এই নিষ্ক্রিয়তা কি প্রমাণ করে না যে, সরকার তাহাদের নীতির ও মতবাদের পরিপোষক? অধিকন্তু শ্রীঅম্বিকাগিরি রায়চৌধুরী কি সরকারী বৃত্তি পাইতেছেন না? সরকারী উৎস হইতেই আমাদের স্মারকগ্রন্থের প্রথম ৬০ পৃষ্ঠা পরিসংখ্যান ও তথ্য দ্বারা পরিপূর্ণ তাই সরকার উহার একটিরও প্রতিবাদ না করিয়া সরকারী লাল ফিতার গোপনীয় দলিলের আশ্রয় লইয়াছেন। কেননা, সরকার ভাবিয়াছেন উহাতে তাহাদের একমাত্র অধিকার এবং প্রয়োজনবোধে চাপিয়াও যাইতে পারিবেন। কিন্তু এই ধারণাকে নিরাশ করিয়া আমরা তাঁহাদিগকে শ্রীহট্ট গণভোটের ব্যাপারে তাঁহাদের কার্যাবলী ভারত সরকারের নিযুক্ত নিরপেক্ষ কোন অনুসন্ধান কমিটির নিকট উপস্থিত করিবার আবেদন জানাইতেছি।
সিলেট কাছাড়সহ সুরমা উপত্যকা চিরকাল বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির অধীনে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের সহযোদ্ধা হিসাবে কাজ করিয়াছে, সেইহেতুই পশ্চিমবঙ্গ কংগ্রেস কমিটি এই ব্যাপারে শুধু তাঁহাদের কর্তব্যকর্মটুকুই করিয়াছেন। এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে যখন উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিশন ভাষাভিত্তিক প্রদেশ গঠনের তথ্য সংগ্রহ করিতেছেন, তখন তাঁহাদের পুরোনো সহযোদ্ধাদিগকে না ভুলিয়া যথারীতি কর্তব্য করিয়াছেন বলিয়া এই সুযোগে কাছাড়বাসীগণ পশ্চিমবঙ্গ কংগ্রেস কমিটিকে তাঁহাদের আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করিতেছে। আমরা গণভোট সম্পর্কে তাঁহাদের আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করিতেছে। আমরা গণভোট সম্পর্কে তাহাদের বক্তব্য, আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদকীয় এবং আমাদের বক্তব্যকে দলিল দর্শাইয়া প্রমাণ করিবার দায়িত্ব গ্রহণে রাজি আছি।
আমরা আসাম কংগ্রেস সভাপতির মুখ হইতে ক্রমাগত ‘বহিরাগত’, ‘বিভেদপন্থী’ ইত্যাদি শুনিতে শুনিতে ক্লান্ত হইয়া উঠিয়াছি। আমরা যদি বহিরাগত হই, তবে ভারতের প্রতিটি লোকই বহিরাগত এবং আসামের অসমীয়াগণ ব্রহ্মদেশের সান রাজ্য হইতেও বহিরাগত। অসমীয়া ভাষা সম্পর্কে গ্রীয়ারসন সাহেব বলিয়াছেন যে, উহা ‘বিকৃত বাংলা’ এবং যাহারা এই বিকৃত বাংলাকে গ্রহণ না করিয়া বাংলা ভাষা ব্যবহার করেন তাহাদের মতে তাহারাই বহিরাগত। এই নীতির ফলেই সীমান্তবর্তী প্রদেশে অসমীয়া ভাষাভাষী ভিন্ন লোকদিগকে বিদেশী বলিয়া ধরিয়া লওয়া হয়, ফলে ইহাতেই সবচেয়ে বেশী বিভেদের সৃষ্টি হইয়াছে।
বর্তমান আসামের সীমানার চৌহদ্দিতে হাত পড়িলেই যদি ‘বিভেদপন্থী’ হইতে হয় তাহা হইলে বলিতে হয় যে, রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন সমগ্র ভারতবর্ষকেই বিচ্ছিন্ন করিতে নিযুক্ত হইয়াছেন। অসমীয়া ভ্রাতাদের বিশ্বাস যে, আসামের বর্তমান আয়তন ও সীমানাই রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা এবং ঐক্যের একমাত্র মাপকাঠি। সিলেট পাকিস্তানে গেলেও সিলেটী বাঙ্গালীরা আসামে থাকিয়া গেল ইহাই যে অসমীয়া নেতাদের দুঃখের কারণ, তাহা আমরা জানি। সর্বক্ষেত্রে আসামে ভারতের সংবিধানে প্রদত্ত মৌলিক অধিকার আজ বিপর্যস্ত। কাজেই আজ যদি আমরা রাজ্য পুনর্গঠন কমিশনের সম্মুখে প্রতিকারের দাবী লইয়া উপস্থিত হই তাহা হইলে উহাতে নিশ্চয়ই ভারতের জাতীয়তার বিরুদ্ধতা করা হইবে না।১২২
আসাম সরকার চটজলদি প্রেস বিজ্ঞপ্তি জারি না করলেও পারতেন। মুখ্যমন্ত্রী বিষ্ণুরাম মেধী পূর্বসূরির সকল দায় কেন নিজ কাঁধে তুলে নিতে গেলেন—তা বলা মুশকিল। তবে একটা মিথ্যা ঢাকতে গিয়ে পাঁচটি কাহিনি আবিষ্কারে তাঁর আমলারা নিশ্চয়ই গলদঘর্ম হয়েছিলেন। ভিমরুলের চাকে ঘা দিয়ে তাঁরা যে সুবুদ্ধির পরিচয় দেননি—প্রতিপক্ষের প্রতিবাদলিপির প্রতি লাইনেই তাঁরা তা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছেন। আর তাই ‘বহিরাগত’, ‘বিভেদপন্থী’ বন্ধু বিতাড়নে প্রচন্ড আক্রোশে সমবেত শক্তিতে ঝাঁপিয়ে পড়লেন গোয়ালপাড়ায়, শুরু হল ‘বঙ্গাল খেদা’ আন্দোলন।
গোয়ালপাড়ায় বঙ্গাল খেদা আন্দোলন ১৯৫৫
১৯৫০ সালের পর গোয়ালপাড়ায় পুনরায় ‘বঙ্গাল খেদা’ আন্দোলন। বাঙালি বিতাড়নে এবার প্রধানতম লক্ষ্য বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়। প্রধান আক্রমণকারী অসমিয়া সমাজের বৃহৎ অংশ, সীমান্ত অঞ্চলে বসবাসকারী বা সীমান্তের অপর পার থেকে আগত মুসলমান সম্প্রদায়ের একাংশ এবং উপজাতিদের কোনো কোনো সম্প্রদায় বা গোষ্ঠী।
ভারতের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল কংগ্রেস ভাষাভিত্তিক প্রদেশ গঠনের বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিয়েছিল প্রথমাবধি। সেই লক্ষ্যে বেশ কিছু পদক্ষেপও গ্রহণ করেছিল এই দলটি। ‘১৯৫৩ সালের ডিসেম্বর মাসে ভারত সরকার ভাষাভিত্তিক প্রদেশ গঠনের বিষয়টিকে পুনরধ্যায়নের জন্য একটি কমিশন গঠন করেন। জন্ম হয় States Reorganisation Commission-এর। সংক্ষেপে একে বলা হয় এস. আর. সি.।’১২৩
আমরা প্রত্যক্ষ করেছি পরবর্তীতে একে একে ‘মণিপুর’, ‘নাগাল্যাণ্ড’, ‘মেঘালয়’, ‘মিজোরাম’ এবং ‘অরুণাচল প্রদেশ’ পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদালাভ করে। ‘আসামের এই পুনর্বিভাজন ভাষা ও জাতিগত পার্থক্যের ভিত্তিতেই হয়েছে। এ রকম হওয়াটাই ছিল স্বাভাবিক ও ইতিহাসসম্মত প্রক্রিয়া।’১২৪
আমরা ইতিমধ্যে উল্লেখ করেছি যে, পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেস কমিটি বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলগুলি পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে যুক্ত করার আবেদন জানায় রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন বরাবর। কেন বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলগুলি পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে যুক্ত করা উচিত— তারও ব্যাখ্যা প্রদান করা হয়। একইভাবে ‘কাছাড় রাজ্য পুনর্গঠন কমিটি’ এবং গোয়ালপাড়ার বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায় বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলের পক্ষেই অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গের দাবির পক্ষেই মত প্রদান করেন। মূল গোলটা বাধে আসাম রাজ্যে ‘রাজ্য-পুনর্গঠন কমিশন’-র আগমনকে কেন্দ্র করে। অসমিয়া সমাজের মধ্যে এ বিশ্বাস জন্মেছিল যে ‘কমিশন’ গোয়ালপাড়া জেলাকে পশ্চিমবঙ্গ অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করছে বাঙালিদের জোরদার দাবির মুখে। সুতরাং, বাঙালিদের তাড়াও। আসলে আসামে ‘রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন’ আগমনের বিষয়টি ছিল অজুহাতমাত্র। অসমিয়া বন্ধুদের বাঙালি বিতাড়নে মূল লক্ষ্যই ছিল অর্থনৈতিক ফায়দা নেওয়া এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের সকল ক্ষেত্রে নিজেদের প্রতিষ্ঠা পাওয়া। আমরা গোয়ালপাড়া জেলায় সংঘটিত অগুনতি ঘটনা থেকেই এ তথ্যের সত্যতা তুলে ধরব।
১৯৫৫ সালের ১৫ মার্চ ধুবড়ি সংলগ্ন উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চলে বাঙালি হিন্দুর প্রাণের প্রতিমা কালীমন্দির পুড়িয়ে দেওয়া হয়। উপজাতিরা এদিন আরও কয়েকটি বাঙালিদের বাসগৃহ পুড়িয়ে দিয়ে ঘোষণা করে যে, এই অঞ্চলে উপজাতি ছাড়া অপর কেউ বাস করতে পারবে না। অথচ ধুবড়ি সংলগ্ন উপজাতি এলাকায় পূর্ববঙ্গ থেকে আসা বহু উদবাস্তুকে সরকারিভাবেই পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। আতঙ্কিত বাঙালিরা সাহায্যের আশায় সাহায্য ও পুনর্বাসন অফিসের দফতরে চলে আসেন। জেলা কতৃপক্ষের কাছেও এ সংবাদ পৌঁছে যায়। জেলা কতৃপক্ষ যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ায় ঘটনা আর বেশি দূর গড়ায়নি।১২৫
গোয়ালপাড়ায় বাঙালি বিতাড়ন পর্ব মার্চ মাস থেকেই শুরু হয়। কারণ ১৯ মার্চ তারিখেই বিষয়টি নিয়ে আসাম বিধানসভায় প্রশ্নোত্তর পর্ব শুরু হয়। মুখ্যমন্ত্রী বিষ্ণুরাম মেধী শুরুতেই বিধায়কগণ সভায় ‘বঙ্গাল খেদা’-র মতো আপত্তিকর কথা ব্যবহার করায় তার কঠোর সমালোচনা করেন। এ সময় বিধানসভার বিরোধী দলীয় সদস্য রণেন্দ্রমোহন দাস ধুবড়ির গোঁসাই গাঁও ও বিজনী থানা এলাকা থেকে বাঙালিদের অন্যত্র চলে যাওয়া সম্পর্কে এক জরুরি প্রশ্নের উত্তরে মুখ্যমন্ত্রী ‘… কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করে বলেন যে, স্বার্থ সংশ্লিষ্ট পক্ষগণের ‘বঙ্গাল খেদা’ আন্দোলন উহার পশ্চাতে ছিল।’১২৬
স্থানীয় অধিবাসীদের ‘বঙ্গাল খেদা’ আন্দোলনের ফলে ধুবড়ি থেকে বাঙালিরা ব্যাপকভাবে অন্যত্র চলে গেছে কি না—এমন প্রশ্নের উত্তরে মুখ্যমন্ত্রী ‘না’ বলেন। রণেন্দ্রমোহন দাস পুনরায় জিজ্ঞাসা করেন এ সম্পর্কে গত ৬মার্চ গোয়ালপাড়ার ডেপুটি কমিশনারকে লেখা এক পত্রের নকল মুখ্যমন্ত্রী পেয়েছেন কি না—এ প্রশ্নের উত্তরেও মুখ্যমন্ত্রী ‘না’ বলেন। মুখ্যমন্ত্রী আরও বলেন যে, ‘বর্তমান বৎসরের পঞ্জিকায় ১১ই মার্চ রাত্রে আসামে গুরুতর ঘটনা ঘটিবে বলিয়া ভবিষ্যদবাণী করা হইয়াছে। কলিকাতার কোন এক দৈনিক পত্রিকায় ইহার রিপোর্ট প্রকাশিত হইলে পঞ্জিকায় বিশ্বাসী লোকেরা তাহাদের সুবিধামত উহার ব্যাখ্যা করিয়া লয়।’
মুখ্যমন্ত্রী অতঃপর বলেন যে, ‘গবর্নমেন্ট এই মর্মে এক টেলিগ্রাম পাইয়াছিলেন যে, ১১ই মার্চ রাত্রে গোয়ালপাড়ায় মুসলমানদের উপর আক্রমণের সম্ভাবনা আছে বলিয়া গুজব রটিয়াছে। ধুবড়ির ডেপুটি কমিশনারকে যাহাতে সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা না বাঁধে তাহার জন্য আবশ্যক ব্যবস্থা অবলম্বন করিতে নির্দেশ দেওয়া হইয়াছিল। যে সকল অঞ্চলে ঐরূপ গুজব রটিয়াছিল, ডেপুটি কমিশনার সেই সকল অঞ্চল পরিদর্শন করেন এবং সতর্কতামূলক সকল ব্যবস্থা অবলম্বন করেন। অবস্থা স্বাভাবিক দেখা যায়।’১২৭ মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য শেষ হওয়ার পরই রণেন্দ্রমোহন দাস জানান, ‘গোয়ালপাড়ার ডেপুটি কমিশনারের নিকট লিখিত একটি পত্রের নকল আমি পাইয়াছি। আশা করি, মুখ্যমন্ত্রীও একটি নকল পাইয়াছেন এবং আমাকে অনুমতি দেওয়া হইলে আমি উহা পাঠ করিব।’ মুখ্যমন্ত্রী জানান, ‘আমি পাই নাই।’ এসময় রণেন্দ্রমোহন কিছু বলতে চেষ্টা করলে স্পিকার বাধা দিয়ে বলেন, মুখ্যমন্ত্রী যখন বলছেন যে, তিনি কোনো পত্র পান নাই—তখন তাঁর কথা মেনে নিয়ে সন্তুষ্ট থাকা উচিত। এ সময় কমিউনিস্ট পার্টির গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য জিজ্ঞাসা করেন—রাজ্য পুনর্গঠন কমিশনের আগমন সম্পর্কে বরপেটায় বাঙালি বিরোধী আন্দোলনের কোনো সংবাদ মুখ্যমন্ত্রী পেয়েছেন কি? স্পিকার বলেন মূল প্রশ্নের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। এরপর রণেন্দ্রমোহন দাস জানান, ‘বাঙ্গালীরা যাহাতে রাজ্য পুনর্গঠন কমিশনের নিকট সাক্ষ্য না দেয়, তজ্জন্য এই আন্দোলন করা হইতেছে।’১২৮
মার্চ মাসে আসাম বিধানসভায় সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন-উত্তর পর্বের বক্তব্য থেকে ঘটনার গভীরতা সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ সম্ভব। কিন্তু ঘটনা এখানেই থেমে থাকেনি—বরং তা বৃদ্ধি পেয়ে মহিরুহে পরিণত হয়। গোয়ালপাড়া জেলায় বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায় ভয়াবহ হামলার শিকারে পরিণত হলেন দফায় দফায়।
ধুবড়িতে প্রতি বছর অশোকা অষ্টমী উপলক্ষ্যে প্রায় পঁচিশ হাজার পুণ্যার্থী হিন্দু নরনারী ব্রহ্মপুত্র নদে স্নান করেন। পুণ্যার্থীরা সুদূর গ্রামাঞ্চল তো বটেই কোচবিহার থেকেও ১৯৫৫ সালের অশোকা অষ্টমীতে ব্রহ্মপুত্র নদে স্নানের জন্য এসেছিলেন। তাঁরা লক্ষ করলেন গৃহপ্রাচীর এবং রিকশাগুলিতে লেখা রয়েছে ‘আমরা আসাম অথবা গোয়ালপাড়া বিভাগ সহ্য করিব না’ এবং এই লেখাকে কেন্দ্র করে বেশ কয়েকটি অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। এ সময় ‘আসাম ত্যাগ করিতে হইবে’— ধ্বনিসহ কয়েকটি শোভাযাত্রাও বের করা হয়। ছাত্র ও অপর এক শ্রেণির মানুষ দোকানে দোকানে ঘুরে ২ এপ্রিলের মধ্যে বাংলায় লেখা সাইনবোর্ড খুলে ফেলতে বলে এবং তা করা না হলে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের হুমকি দেওয়া হয়। এর ফলে বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। এমতাবস্থায় অপূর্বকুমার ঘোষের নেতৃত্বে এক প্রতিনিধিদল ডেপুটি কমিশনারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাদের আতঙ্কের কথা জানালে ডেপুটি কমিশনার তাদের আশ্বস্ত করে পুলিশি টহল জোরদার করার নির্দেশ দেন।১২৯
বস্তুত ৩১ মার্চ থেকে ধুবড়ির আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটে। বাঙালিদের মধ্যে আতঙ্ক দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
২ এপ্রিল ’৫৫ তারিখে বহু সংখ্যক মানুষ ৫০টি ট্রাকে করে বাঙালিদের গালি দিতে দিতে ধুবড়ির বিভিন্ন রাস্তা প্রদক্ষিণ করে। ট্রাকে অবস্থানরত প্রায় সব মানুষের হাতে লাঠি ছিল। সংবাদে বলা হয়, ‘ধুবড়ির জেলা কংগ্রেসের মৌন অনুমোদনে ঐ বিক্ষোভ প্রদর্শন ব্যবস্থা সংগঠিত হয়। বিক্ষোভ প্রদর্শনকারীরা একটি সভা করে। উহাতে বক্তৃতা করেন জেলা কংগ্রেসের সভাপতি শ্রীশরৎচন্দ্র সিংহ।
এদিন সন্ধ্যায় সাতটি দোকানের মালামাল লুণ্ঠিত হয়। ১লা এপ্রিল তারিখে ছুরিকাঘাতের দুইটি ঘটনার সংবাদ পাওয়া যায়। সন্ধ্যায় বিক্ষোভ প্রদর্শনকারীদের বাঙ্গলা ভাষায় লিখিত সাইন বোর্ড নামাইয়া দিবার জন্য বাজারে দেখা যায়। এ নিয়ে বাকবিতন্ডার সময় দুই-তিনজন পুলিশও আহত হয় বলে জানা যায়।’১৩০
সংবাদে আরও বলা হয় যে, ‘… বাঙ্গালী দোকানদারদের বাঙ্গলা ভাষায় লিখিত সাইনবোর্ডের পরিবর্তে অসমীয়া ভাষায় লিখিত সাইনবোর্ড টাঙ্গাইতে বলা হয়।’
গতকল্যের [২ এপ্রিল] বিক্ষোভ প্রদর্শনকারীরা নানা প্রকার ধ্বনি দিতে দিতে শহরে ঘুরে বেড়ায়। … ‘বাঙ্গালী কুকুর দুর হও’, ‘বাঙ্গালী বিশ্বাসঘাতক দূর হও’ এবং ‘আসাম তার কোন অংশ বিচ্ছিন্ন করতে দেবে না’— এমন সব ধ্বনি দেয়। পথচারীদের প্রতি ইষ্টকখন্ডও নিক্ষিপ্ত হয়। … ট্রাকগুলি ডি কে রোড, নেতাজি রোড, অমর রোড এবং মুনিয়াপট্টিতে ঘুরে বেড়ায় বিনা বাধায়। বিক্ষোভ প্রদর্শনকারীগণ আহূত জনসভায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে জেলা কংগ্রেস সভাপতি বলেন যে, ‘গোয়ালপাড়ার উপর পশ্চিমবঙ্গের দাবী অযৌক্তিক এবং দাবী কখনই মানিয়া লওয়া যাইতে পারে না। … পুলিশ উদাসীন হইয়া রহিয়াছে। আইন ও শৃঙ্খলা রক্ষকের চোখের সম্মুখেই বাঙ্গালীদের ভীতি প্রদর্শন করা হইতেছে। … সংবাদ পাওয়া গিয়াছে যে, আগামীকল্য ধুবড়ির চারিদিকে খন্ড জাতীয়দের বিক্ষোভ প্রদর্শনের আয়োজন করা হইয়াছে।’১৩১
গোয়ালপাড়ার বিলাসীপাড়াতেও বাঙালিরা আক্রান্ত হন। সংবাদে জানা যায়, চার হাজার অসমিয়া সঙ্ঘবদ্ধভাবে বাঙালিদের ওপর চড়াও হয়। এসব বেপরোয়া অসমিয়ারা বাঙালিদের মারপিট, দোকানঘর ভাঙচুর, লুট, বাংলা ভাষায় লেখা সাইনবোর্ড ভাঙচুর এবং বাঙালিদের বাড়িঘরে প্রস্তর নিক্ষেপ করে। বাঙালিদের বাড়িঘরে আগুন দেওয়া হবে, পাহাড়িয়াদের সঙ্গে যোগসাজস করে সঙ্ঘবদ্ধভাবে আক্রমণ চালানো হবে—এমন সব সংবাদও পাওয়া যায়। পুলিশ বাঙালিদের রক্ষায় বা এলাকায় শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখতে কোনো প্রকার পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। পুলিশ ছিল নীরব দর্শক।১৩২
রাজ্য পুনর্গঠন কমিশনের আসাম পরিভ্রমণের দিন যতই নিকটতর হয়—বাঙালিদের ওপর আক্রমণের মাত্রাও ততই বৃদ্ধি পায়। কয়েক সপ্তাহ পূর্বেই বিজনীতে প্রথম গোলমালের সূত্রপাত। তারপর বরপেটা, ধুবড়ি, ফকিরাগ্রাম এবং বিলাসীপাড়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলের বাঙালিরা আক্রান্ত হন। বরপেটার দুজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি শ্রীঅজয় মুখার্জী ও শ্রী-ময়না মোক্তারকে বেদম প্রহার করা হয়। একজন কর্তব্যরত বাঙালি পুলিশ অফিসারও প্রহৃত হন। বাঙালি ব্যবসায়ীদের চারটি দোকানও লুন্ঠিত হয়।১৩৩
আলিপুরদুয়ার থেকে ৪ এপ্রিল পাঠানো সংবাদে বলা হয়: ‘… আসাম হইতে লুঠতরাজ, মারপিট ও ‘বঙ্গাল খেদা’ আন্দোলন প্রবলভাবে পুনরজ্জীবিত হওয়ার সংবাদ আসিতেছে। রাস্তায় এই বলিয়া বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হইতেছে যে, কাছাড়, গারোপাহাড় ও গোয়ালপাড়া আসামের অন্তর্ভুক্তই থাকিবে, ইহা সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত আমরা বিশ্রাম করিব না।’১৩৪
ধুবড়ি শহরের বাঙালি দোকানী ও ব্যবসায়ীগণ তাদের ওপর আক্রমণ, দোকান ও বাড়িঘরে লুট ও ভয়ভীতি প্রদর্শনের কারণে ৪ এপ্রিল ধুবড়িতে হরতাল পালিত হয়। বাঙালি সমাজের প্রতিনিধিগণ ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীনেহরু এবং আসামের মুখ্যমন্ত্রীকে পৃথক পৃথক তারবার্তায় বাঙালিদের জীবনাশঙ্কার কথা উল্লেখ করে এ বিষয়ে তাঁদের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।১৩৫
‘ধুবড়ি নাগরিক সমিতি’ সম্পাদক রমণীকান্ত বসু ৫ এপ্রিল কলকাতায় এক সাংবাদিক সম্মেলনে জানান, গোয়ালপাড়ার ওপর পশ্চিমবঙ্গের দাবী নস্যাৎকল্পে প্রতিবাদীদের সুপরিকল্পিত এই আন্দোলন। শ্রীবসু অভিযোগ করেন যে, ‘রাজ্য পুনর্গঠন কমিশনের আসাম পরিদর্শনের প্রাক্কালে গোয়ালপাড়া জেলার ওপর পশ্চিমবঙ্গের দাবীর প্রতিরোধে যে সুপরিকল্পিত আন্দোলন পরিচালিত হচ্ছে, তারই অবশ্যম্ভাবী পরিণতিতে ধুবড়ি শহরে ও সন্নিহিত এলাকাসমূহে বাঙ্গালী অধিবাসীরা অসহায় অবস্থায় নির্যাতিত হচ্ছেন।’ শ্রীবসু আরও অভিযোগ করেন যে, … প্রতিরোধ আন্দোলন ‘স্থানীয় একদল কংগ্রেস কতৃক পরিচালিত হইতেছে’। তিনি বলেন, ‘ঐ আন্দোলন ‘বঙ্গাল খেদা’ আন্দোলন ছাড়া আর কিছুই নহে।’১৩৬
শ্রীবসু ‘পুলিশের বিরুদ্ধে নিষ্ক্রিয়তার গুরুতর অভিযোগ উত্থাপন করেন এবং বলেন যে, পুলিশ দুষ্কৃতকারীদের বিরুদ্ধে যথোচিত ব্যবস্থা অবলম্বন করতে বিরত থাকছে। …. উপরোক্ত আন্দোলনের সঙ্গে জেলা কংগ্রেসের কোন কোন নেতা জড়িত থাকায় ধুবড়ির সাম্প্রতিক ঘটনা সম্পর্কে পুলিশ ও অপরাপর জেলা কতৃপক্ষ নিষ্ক্রিয় থাকেন।’
শ্রীবসু সাংবাদিক সম্মেলনে এ কথাও বলেন যে: ‘… মধ্যযুগীয় ধর্মযোদ্ধা ও লীগ আমলের প্রত্যক্ষ সংগ্রামকারীদের ন্যায় আগ্রহ ও উৎসাহ নিয়ে ধুবড়ি শহর ও শহরের বাইরের বাঙ্গালীদের ওপর উৎপীড়ন চালান হচ্ছে এবং এ ব্যাপারে ‘চক্রান্তকারীদল’ অফিসারদের পক্ষপাতিত্বের সুযোগ নিয়ে গোয়ালপাড়া জেলার উপর পশ্চিমবঙ্গের দাবী উৎসাদনের নামে বাঙ্গালীদের ওপর চড়াও হবার জন্য হাঙ্গামাকারীদের উস্কানি দিচ্ছেন। … প্রতিরোধ আন্দোলনের নেতৃবর্গ ঘৃণার উৎস মুখ খুলে দিয়েছেন। এ সম্পর্কে ধুবড়িতে যে সকল ধ্বনি দেওয়া হয়—তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে—‘বিশ্বাসঘাতক বাঙ্গালী দূর হও’, ‘শয়তান বাঙ্গালী দুর হও’, ‘ঘৃণ্য বাঙ্গালী দূর হও।’১৩৭
শ্রীবসু বলেন: ‘… জেলা কংগ্রেসের সভাপতি শ্রীশরৎচন্দ্র সিংহের উদ্যোগে প্রতিবাদ সপ্তাহ সূচিত হয় এবং কার্যকারণ সূত্রে এ থেকেই হাঙ্গামার উদ্ভব হয়।’ তিনি জানান ‘…প্রকৃতপক্ষে সৈয়দ আমেদ আলিই (ফকরুদ্দীন আলী আহমদ) ঐ আন্দোলনের মস্তিষ্কস্বরূপ। … ধুবড়ির ফকিরপাড়ার একদল মুসলমান যুবক রাতারাতি অসমীয়া সাজিয়া হাঙ্গামাতে প্রধান অংশগ্রহণ করিয়াছে। … ধুবড়ির অবস্থা ‘অত্যন্ত উদ্বেগজনক’—সেখানে পুলিশের সমক্ষেও মারপিট ও ছুরিকাঘাতের ঘটনা ঘটেছে। বিভিন্ন দোকানে লুট হয়েছে, কতকগুলি পানের দোকান ধূলিসাৎ এবং অন্যান্য গৃহ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাঙ্গলা ভাষায় লিখিত সাইনবোর্ডগুলি ফেলে দেওয়া হয়েছে অথবা অপসারণ করা হয়েছে। … নিরীহ পথচারীর ওপর পুলিশ লাঠি চার্জ করেছে। অপরদিকে হাঙ্গামাকারীরা অবাধে ঘুরে বেড়াচ্ছে। … সব রকম সাক্ষ্য প্রমাণ থেকে দেখা যায় যে, হাঙ্গামাকারী দলের সঙ্গে পুলিশ ছিল, কিন্তু তারা গ্রেফতার করেনি, কিম্বা হাঙ্গামার জন্য যে গাড়িখানি ব্যবহৃত হয়, সেটিও আটক করা হয়নি।’১৩৮
এরপর রমণীকান্ত বসু সাংবাদিক সম্মেলনে ধুবড়িতে বাঙালি অধিবাসীদের ওপর যে আক্রমণ হয় সে সব ঘটনার বিশেষ কয়েকটি ঘটনা তুলে ধরেন। তিনি বলেন ৩১ মার্চ ও ১ এপ্রিল ৫৫-তে অসমিয়া যুবক বাজার এলাকা ঘুরে দোকানদারদের বাঙ্গলা সাইনবোর্ডের পরিবর্তে ২ এপ্রিলের মধ্যে অসমিয়া ভাষায় বোর্ড লাগানোর নির্দেশ দেয়— অন্যথায় ব্যর্থ দোকানদারদের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম শুরু হবে বলেও হুমকি দেয়।
১ এপ্রিল রাতের প্রথমদিকে দুর্বৃত্তেরা তাদের ভীতি প্রদর্শনকে বেপরোয়াভাবে কার্যে পরিণত করে। সে সময় পুলিশ তাদের সঙ্গে ছিল। পুরাতন স্টিমার ঘাট রোড, বাজার ইস্ট রোড, হাওয়েল রোড এবং ফুলার রোডে উক্ত বর্বরতা সংঘটিত হয়। পরের রাতেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে।
১ এপ্রিল রাতে দু-জন বাঙালি— লক্ষ্মী পাল ও রমেশচন্দ্র দে সরকার ছুরিকাহত হন। রমেশচন্দ্রের আঘাত ছিল গুরুতর। তিনি দীর্ঘদিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। ধুবড়িতে এমন ঘটনা ছিল নিত্যদিনের।১৩৯
শেষপর্যন্ত বাঙালিরা আসাম ছাড়তে বাধ্য হলেন। গোয়ালপাড়া জেলার আতঙ্কগ্রস্ত বাঙালিদের অনেকেই প্রাণ, মান রক্ষায় অন্য রাজ্যে পাড়ি দেওয়া শুরু করেন। ‘৫ এপ্রিল পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা ভবনে একজন সদস্যের কাছে আলিপুরদুয়ার থেকে এই মর্মে এক তারবার্তা আসে যে আসাম থেকে সেখানে অনেক বাঙালি পরিবার চলে আসছে এবং ইতিমধ্যেই সেখানে ৩০০ পরিবার চলে এসেছে। আরও বহু পরিবার চলে আসবে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে। তারবার্তায় অভিযোগ করা হয় যে আসামে বাঙালিরা নির্যাতিত হচ্ছে। তারবার্তায় পরিতাপ প্রকাশ করে বলা হয় যে, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার যেন বিষয়টিতে হস্তক্ষেপ করেন। আলিপুরদুয়ার কোর্ট থেকে শ্রীনিত্যেন গোস্বামী ও শ্রীযজ্ঞেশ্বর রায়-এর কাছে ঐ তার প্রেরণ করেন। ঐ অঞ্চলের অন্যতম কংগ্রেস সদস্য শ্রীপীযুষকান্তি মুখার্জী তারটির প্রতি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ডা. বিধানচন্দ্র রায়-এর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।’১৪০
৫ এপ্রিল তারিখেই বিষয়টি পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় আসামে বাঙালিদের ওপর নির্যাতন চলছে বলে অভিযোগ উত্থাপন করা হয়। প্রশ্ন-উত্তর পর্বের পরই ফরোয়ার্ড ব্লক-এর রাধাকৃষ্ণ পাল এবং নেপাল রায় আসন থেকে উঠে ‘স্পিকারকে উদ্দেশ করে বলেন যে, আসামে রাজ্য পুনর্গঠন কমিশনের সফর উপলক্ষ্যে তথায় বাঙালি অধিবাসীদের উপর নানারূপ অত্যাচার চলছে।’ স্পিকার তাঁদেরকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, বিষয়টি বিধিসম্মতভাবে উত্থাপিত হয়নি।
৬ এপ্রিল পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় ডা. রাধাকৃষ্ণ পাল (ফ-ব) এক প্রশ্নযোগে জানতে চান যে, ‘সীমানা নির্ধারণ কমিশনের আসাম যাত্রার পূর্বে আসামের যে সমস্ত অঞ্চল পশ্চিমবঙ্গ সরকার দাবী করেছেন, সেই সমস্ত অঞ্চলে বাঙালি অধিবাসীদের বিরুদ্ধে যে ব্যাপক আক্রমণ, অত্যাচার ও ভীতি প্রদর্শন চলছে সে বিষয়ে সরকারের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে কি না?’ মুখ্যমন্ত্রী ডা. বিধানচন্দ্র রায় প্রশ্নের উত্তরে জানান যে, ধুবড়ি এলাকার প্রকাশিত ঘটনা সম্পর্কে পশ্চিমবঙ্গ সরকার আসামের মুখ্যমন্ত্রীর কাছে পত্র লিখেছেন এবং এ সম্পর্কে তথ্য জানতে চেয়েছেন। ইতোমধ্যে অনেকেই তাঁর কাছে প্রকৃত ঘটনার বিবরণ দিতে চেয়েছেন, পাওয়া গেলে তিনি ওই সব বিবরণী ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বিবেচনার্থে পাঠাবেন। মুখ্যমন্ত্রী আরও বলেন যে, ‘আমি আলিপুরদুয়ার থেকে এই মর্মে এক তার পেয়েছি যে, এই ঘটনায় কামারগঞ্জ থেকে সেখানে বহু লোক এসেছে। আমি জলপাইগুড়ির ডেপুটি কমিশনারের নিকট তারযোগে ব্যাপার জানতে চেয়েছি। ডেপুটি কমিশনার এ সম্পর্কে এখনও কোনো খবর পাননি। আমি প্রধানমন্ত্রীকেও টেলিগ্রাম করেছি।’১৪১
ধুবড়ি, বরপেটা এবং গোয়ালপাড়া জেলার অন্যান্য স্থান থেকেও ভীতসন্ত্রস্ত বাঙালিরা প্রাণরক্ষার্থে আলিপুরদুয়ার এবং কোচবিহার চলে আসায় উদবিগ্ন কোচবিহার জেলা কংগ্রেস কমিটি এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শ্রীনেহরুকে তারবার্তা পাঠিয়ে তাঁর হস্তক্ষেপ কামনা করেন। তারবার্তায় বলা হয়:
…. আপত্তিকর শ্লোগান তুলিয়া বাঙ্গালীদের বিরুদ্ধে তীব্র বিদ্বেষ সৃষ্টি করা হইতেছে। অহম মুসলমান ও খন্ডজাতীয় গুণ্ডাপ্রকৃতির লোকদের কাজে লাগান হইয়াছে এবং তাহারা হিংসাত্মক আচরণ, লুন্ঠন, অগ্নিসংযোগ এমনকি পাশবিক অত্যাচার পর্যন্ত চালাইতেছে। পুলিশ নিষ্ক্রিয় রহিয়াছে।
তারবার্তায় আরও বলা হয় :
… আসাম হইতে আগত আতঙ্কগ্রস্ত লোকেরা প্রত্যহ জেলা কংগ্রেস অফিসে আসিয়া তাহাদের পরিবারবর্গকে উদ্ধারের জন্য আবেদন জানাইতেছে। … জানা গিয়াছে যে, ৩রা এপ্রিল গুণ্ডারা তিনটি বাঙ্গালী দোকান লুঠ করে। ঐ রাত্রে তাঁহারা শ্রীনিরঞ্জন ভাওয়াল এবং শ্রীসুরেশ কবিরাজের গৃহে লুন্ঠন চালায়। ৪ঠা এপ্রিল রাত্রে শ্রী কে. মণ্ডলের গৃহ আক্রান্ত হয়। দুর্বৃত্তেরা শ্রীমন্ডলের পত্নীকে বলপূর্বক লইয়া যায় এবং তাহার উপর পাশবিক অত্যাচার করে। এই ঘটনাগুলি ঘটে অভয়াপুরীতে।১৪২
গোয়ালপাড়া জেলায় বাঙালিদের ওপর নির্মম অত্যাচারের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে কোচবিহার বার অ্যাসোসিয়েশন সভাপতিও প্রধানমন্ত্রীর কাছে তারবার্তা পাঠান। ‘তারবার্তায় গোয়ালপাড়ার বাঙ্গালী পরিবারসমূহের মহিলাদের ওপর বেপরোয়া মারপিট, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুন্ঠন এবং গুণ্ডামির ভয়াবহ কাহিনীর উল্লেখ করা হয়।’ তারবার্তায় বলা হয় : ‘জীবন ও মর্যাদা বিপন্ন। বহু সংখ্যক বাস্তুত্যাগী কোচবিহার এবং আলিপুরদুয়ারে প্রবেশ করিতেছে। প্রবল উত্তেজনা বিদ্যমান। অবিলম্বে হস্তক্ষেপের আবেদন জানাইতেছি।’১৪৩
অবশেষে আসাম সরকার ধুবড়ির ঘটনা সম্পর্কে এক প্রেসনোট প্রকাশ করেন। ৭ এপ্রিল প্রকাশিত প্রেসনোটে বলা হল:
কলিকাতার কোন কোন সংবাদপত্রে ধুবড়ি মহকুমার বাঙ্গালী অধিবাসীদের উপর উৎপীড়নের যে কাহিনী প্রকাশিত হইয়াছে তৎপ্রতি আসাম সরকারের দৃষ্টি আকৃষ্ট হইয়াছে। প্রকৃত ঘটনা হইতেছে এই যে, গত ৩০শে ও ৩১শে মার্চ তারিখে কয়েকটি দোকান ও গাড়ীতে পশ্চিমবঙ্গভুক্তি বিরোধী পোস্টার লাগাইবার ব্যাপারে গোয়ালপাড়ার উপর পশ্চিমবঙ্গের দাবীর বিরোধী এবং ঐ দাবীর সমর্থকদের মধ্যে সামান্য বাকবিতন্ডা হয়। পুলিশের হস্তক্ষেপের ফলে কোন প্রকার সংঘর্ষ হয় নাই। ১লা এপ্রিল হইতে ৪ঠা এপ্রিল পর্যন্ত ধুবড়ি এবং অপর কয়েকটি স্থানে গোয়ালপাড়াকে পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্ভুক্ত করার দাবীর বিরোধিতা করিয়া কয়েকটি শোভাযাত্রা বাহির করা হয় ও কয়েকটি সভা হয়। ৫ই ও ৬ই এপ্রিলও কয়েকটি সভা হয়।
শোভাযাত্রা ও সভাগুলি শান্তিপূর্ণ পরিবেশের মধ্যেই অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় শোভাযাত্রা ও সভা ভাঙ্গিবার সময় বিভিন্ন সম্প্রদায়ের দূর্বৃত্ত শ্রেণীর লোকেরা ইষ্টক নিক্ষেপ করে, দোকানের সাইনবোর্ড নামাইয়া দেয়, দোকান ও লোকজনের উপর আক্রমণ করে। বড়রকমের কোন ঘটনা ঘটে নাই এবং পুলিশ গুরুত্বপূর্ণ স্থানসমূহে টহল দিতেছে। কয়েকটি অভিযোগ গ্রহণ করা হইয়াছে এবং বহুসংখ্যক দূর্বৃত্তকে গ্রেপ্তার করা হইয়াছে। পুলিশের ডেপুটি ইনস্পেক্টর জেনারেলের নেতৃত্বে জেলায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হইয়াছে এবং আতঙ্ক দূর করার জন্য দূরবর্তী স্থানসমূহে সশস্ত্র পুলিশ প্রেরণ করা হইয়াছে। জনসাধারণকে আশ্বস্ত করার জন্য জেলার উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মচারীরা বিশেষভাবে চেষ্টা করিতেছেন। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের দায়িত্বশীল নেতৃবৃন্দ গুণ্ডাদের কার্যের নিন্দা করিয়াছেন। রাজ্য সরকার কোন প্রকার অরাজকতা সহ্য করিবেন না এবং কঠোর হস্তে অরাজকতা দমন করিবার জন্য স্থানীয় সরকারী কর্মচারীদের নির্দেশ দিয়াছেন এবং জনগণের জীবন ও সম্পত্তি রক্ষার আশ্বাস দিতেছেন।
আইন ও শৃঙ্খলা বজায় রাখিবার জন্য অবলম্বিত ব্যবস্থার তত্ত্বাবধান করিবার জন্য সরকার কমিশনারকে প্রেরণ করিয়াছেন। আতঙ্কিত হইয়া কয়েক স্থান হইতে কতকগুলি লোক (তাহাদের মধ্যে অধিকাংশই উদ্বাস্তু) বাড়ী ত্যাগ করিয়া গিয়াছে বলিয়া সরকারকে জানান হইয়াছে। এখন জেলার অবস্থা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ও শান্ত এবং কাহারও আতঙ্কিত হইবার কোন কারণ নাই। যাহারা গৃহত্যাগ করিয়া গিয়াছে তাহাদের আশ্বস্ত করিবার জন্য এবং তাহাদের গৃহে প্রত্যাবর্তনের অনুরোধ করিবার নিমিত্ত ও তাহাদের সর্বপ্রকার রক্ষাব্যবস্থা করার জন্য স্থানীয় কর্মচারীদের নির্দেশ দেওয়া হইয়াছে।১৪৪
ধুবড়ির অদূরে বিলাসীপাড়ার হাট লুন্ঠিত হল। বাঙালি ব্যবসায়ীরা এ বিষয়ে ডেপুটি কমিশনারকে একাধিকবার সতর্ক করেছিলেন, তাঁদের আশঙ্কার কথা জানিয়েছিলেন। কিন্তু তারপরও ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। ধুবড়ির বিশিষ্ট নাগরিকগণ এক আবেদনপত্রে ডেপুটি কমিশনারকে জানিয়েছিলেন:
আমরা বাঙালীরা দুইবার আপনার নিকট আমাদের রক্ষার জন্য আবেদন জানাইয়াছি। তথাপি বাঙ্গালী ব্যবসায়ীদের সাইনবোর্ড টানিয়া নামানো হইয়াছে, দোকান লুন্ঠিত হইয়াছে এবং আমাদের কয়েকজনের বাড়িতে ইট-পাটকেল নিক্ষিপ্ত হইয়াছে। আমরা জানিতে পরিয়াছি, ৫৫টি ট্রাকে করিয়া উপজাতীয়েরা শহরে আসিবে। আমরা আরও হাঙ্গামার আশঙ্কা করিতেছি। আমরা অনুরোধ করিতেছি, আপনি যেন বাহিরের লোকদের এইভাবে শহরে প্রবেশ করিতে না দেন।১৪৫
কিন্তু উপরোক্ত আবেদন ও সতর্কবাণী সত্ত্বেও আবেদনপত্র দাখিলের দিনই পূর্ব ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। এদিন ৫০টি ট্রাকে উপজাতীয় ও মুসলমানদের শহরে আনা হয়। … কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট নেতৃত্বাধীন শোভাযাত্রায় যেসব নোংরা ধ্বনি উচ্চারিত হয়—সেসবের মধ্যে অন্যতম ছিল—‘কুকুর পোয়ালী বঙ্গালী ওলাই যোয়া’ (কুকুরের বাচ্চা বাঙ্গালী চলিয়া যাও), ‘নিমকহারাম বঙ্গালী ওলাই যোয়া’, ‘বিশ্বাসঘাতক বঙ্গালী ওলাই যোয়া’, ‘বঙ্গালী নেতা কোৎ, তিরতার অঞ্চলের ভিতরত’ (বাঙালি নেতারা কোথায়? মেয়েদের আঁচলের ভিতর)। এ সব প্ররোচনামূলক নোংরা উত্তেজনাকর ধ্বনি পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটায়।
৩১ মার্চ থেকে ৬ এপ্রিল পর্যন্ত গোয়ালপাড়ার পশ্চিমবঙ্গ ভুক্তির দাবির প্রতিবাদে ‘প্রতিবাদ সপ্তাহ’ পালিত হয় সমগ্র জেলা জুড়েই। বস্তুত জেলা কংগ্রেসের নেতৃত্বেই ‘প্রতিবাদ সপ্তাহ’ পালিত হয়। আর এই হঠকারি সিদ্ধান্তের ফলেই বাঙালিদের ওপর হামলা, মারধর, লুট, অগ্নিসংযোগ অবাধে পরিচালিত হয়। এই হামলা গোলকগঞ্জ, গৌরীপুর, পাগলাঘাট প্রভৃতি অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়ে। চাপরে মাখন তালুকদারের সুবৃহৎ দোকান এবং শান্তিরঞ্জন দাস-এর দোকান লুন্ঠিত হওয়ায় এলাকায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়।’১৪৬
কাচোখানার (তামার হাট) হাটও প্রকাশ্যে বিনা বাধায় লুন্ঠিত হয়। এক বাঙালি দোকানদারের নগদ ৮৩৫ টাকা এবং ৭/৮ হাজার টাকার মালপত্র ‘অসমীয়া ও রাতারাতি পরিবর্তিত নব-অসমীয়াগণ’ লুন্ঠন করে বলে সংবাদে প্রকাশ।১৪৭
প্রতাপগঞ্জের বাঙালিরাও লাঞ্ছিত হন। নারীরাও বাদ যাননি দূর্বৃত্তদের হাত থেকে। এখানকার কোনো সংবাদ বাইরে গেলে হত্যার হুমকিও দেওয়া হয়। মটরঝার এবং পাগলাহাটের নানা স্থানেও অবাধে লুন্ঠন চলে বলে জানা যায়।
ক্ষুদিমারী থেকেও বাঙালি গৃহে অগ্নিসংযোগ এবং দোকান লুটের সংবাদ পাওয়া গেছে। ৬ এপ্রিল গৌরীপুরে বহিরাগত ব্যক্তিরা এক শোভাযাত্রা বের করে। বাঙালি বিরোধী এই শোভাযাত্রা থেকে বাঙালি নারীদের উদ্দেশে কুৎসিত ভাষায় গালিগালাজ করে। এমনকী তাঁরা লাঞ্ছিতও হন। এর প্রতিবাদে গৌরীপুরের নারীসমাজ এক প্রতিবাদ সভার আয়োজন করেন। সভায় সভানেত্রীর দায়িত্ব পালন করেন রাজকুমারী নীলিমা বড়ুয়া। এদিন হরতালও পালিত হয়।১৪৮
ছাত্রশালেও ৬ এপ্রিল হাট চলাকালীন সময়ে বেশ কয়েকজন বাঙালির দোকান লুন্ঠিত হয়। ‘অসমিয়া মুসলমান গুণ্ডা’রা এ কাজে যুক্ত ছিল বলে অভিযোগ। অভিযোগে আরও বলা হয় যে, অসমিয়া, উপজাতি এবং বাঙালি মুসলমানরা সম্মিলিতভাবে শক্তি বৃদ্ধি করে নির্বিচারে বাঙালিদের (হিন্দু) ওপর অত্যাচার অব্যাহত রাখে। সঙ্ঘবদ্ধ এই দলটি তামারহাটে কৃষ্ণ সাহার গালা মার্লের দোকান লুট করে। এই দলটিই তামারহাট বাজারের বাঙালি বসতি এলাকায় এক সভা করে এবং ওই সভা থেকে হিন্দু বাঙালিদের উদ্দেশে গালিগালাজ করা হয়। ওই সভায় ধুবড়ির মুসলমান নেতা টুকু মিয়াও বাঙালিদের বিরুদ্ধে উত্তেজনাকর বক্তব্য দিয়ে জনতাকে ক্ষেপিয়ে তোলে।১৪৯ অসহায় বাঙালিরা দিনের পর দিন কেবল নির্যাতিত হন। তাঁরা বাড়িঘর, ব্যাবসাবাণিজ্য হারিয়ে অসমিয়া প্রভুদের উপহাসের পাত্রে পরিণত হলেন। এ বড়ো নির্মম, প্রতিকারহীন।
আমরা ইতিপূর্বে আসাম সরকার প্রদত্ত প্রেসনোট তুলে ধরেছি। এই প্রেসনোট সম্পর্কে আনন্দবাজার পত্রিকা ‘আসাম সরকারের প্রেসনোট’ শীর্ষক প্রধান সম্পাদকীয় নিবন্ধে জানাল:
আসামের গোয়ালপাড়া জেলার নানা স্থানে যাহা ঘটিয়াছে এবং ঘটিতেছে বলিয়া প্রকাশ, তাহা প্রকৃতপক্ষে বিহারের অনুকরণ, বিহারী কুকাণ্ডের পুনরাবৃত্তি দ্বারা আসাম হইতে বাঙালী বিতাড়ন এবং আসামের কুখ্যাত বঙাল খেদা আন্দোলনের নূতন সংস্করণ ছাড়া আর কিছুই মনে করিতে পারিতেছি না।
রাজ্য পুনর্গঠন কমিশনের আসাম সফর উপলক্ষ্যে বাঙালী বিদ্বেষের এরূপ উৎকট অভিব্যক্তি কেবল বাঞ্ছনীয় নয়, বহু ভাষাভাষী নরনারী অধ্যুষিত আসামের পক্ষে অত্যন্ত অনিষ্টকর ব্যাপার। ইহাকে আত্মঘাতী ক্ষিপ্ততা বলিলেও বেশী বলা হয় না। বাঙালী বিরোধী অভিযানের নির্বিচার ক্ষিপ্ততা দ্বারা আসাম যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহার প্রশাসনিক মেরুদন্ড যদি ভাঙ্গিয়া পড়ে কিংবা দুর্বল হয়, তবে সমগ্র ভারত রাষ্ট্রেরই ক্ষতি ও সমস্যা দেখা দিবে। আসাম রাজ্য তথা ভারত রাষ্ট্রের এরূপ ক্ষতির সম্ভাবনার পথরোধ করিতে হইবে। ইহার একমাত্র উপায় দৃঢ়তা তৎপরতার সহিত বাঙালী বিরোধী অভিযান দমন এবং আসাম রাজ্যের সর্বত্র শান্তিপূর্ণ স্বাভাবিক অবস্থা আনয়ন। …
… সংবাদপত্রের বিবরণে স্পষ্টই প্রমাণিত হইতেছে যে, পূর্ব হইতে উস্কানি দিয়া একদল লোককে বাঙালী বিতাড়নে উত্তেজিত করা হইয়াছে। আরো লক্ষ্য করিবার বিষয়, শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের আবরণেই বাঙালী বিরোধী প্রচারকার্যের আয়োজন করা হইয়াছে এবং সেই আয়োজন যাঁহারা করিয়াছেন, তাঁহারা পশ্চাতে থাকিয়া পুরোভাগে কিছু সংখ্যক পাহাড়িয়া এবং মুসলমানকে শিখন্ডী খাড়া করিয়াছেন। তারপর আসাম সরকার তাহার প্রেসনোটে ‘বিভিন্ন সম্প্রদায়ের দূর্বৃত্ত শ্রেণির লোকের’ স্কন্ধে দোষ চাপাইয়া মুল প্রেরণার উৎস এবং নাটের গুরুগণকে রেহাই দিয়াছেন। বলা বাহুল্য আসাম হইতে বাঙালী বিদ্বেষ উৎপাটন ও বাঙালী বিরোধী অভিযান দমনের উপায় ইহা নহে। নাটের গুরুগণকে রেহাই দিয়া দুষ্ট প্ররোচনায় ক্ষিপ্ত ও উন্মত্ত কিছু সংখ্যক লোককে দন্ডদান করিলে ক্ষেত্র বিশেষে ক্ষিপ্ততা একবার সংযত হইতে পারে এবং অরাজকতা দমন করিলেন বলিয়া আসাম সরকারও শ্লাঘা বোধ করিতে পারেন। কিন্তু ইহা হইবে অস্থায়ী এবং সাময়িক মুখরক্ষার ব্যাপার মাত্র। স্থায়ী প্রতিকারের জন্য যাহা আবশ্যক, তাহা করিবার, আসাম হইতে বাঙালী বিতাড়নের দুষ্ট প্রেরণা উৎপাটিত করিবার কোন আশ্বাসই আসাম সরকারের প্রেসনোটে পাওয়া যাইতেছে না। সুতরাং আসামে যাহা আরম্ভ হইয়াছে, তাহা আরো বহুদূর গড়াইতে পারে এবং বৃহৎ অনর্থ ঘটাইতে পারে ভাবিয়া উদ্বিগ্ন হইতেছি। অবশ্য আমাদের আশঙ্কা এক্ষেত্রে অমূলক প্রতিপন্ন হইলেই সুখের বিষয় হইবে।১৫০
এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে এন.ই.রেলের একজন বাঙালি অ্যাসিস্টেন্ট ম্যানেজারকে অসমিয়ারা বঙ্গাইগাঁও-এ প্রচন্ড মারধর করে। দোকান ও বাড়ি লুন্ঠিত হয়। উপদ্রুত অঞ্চলসমূহে হাজার হাজার বাঙালিকে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতে দেখা যায়। দূর্বৃত্তরা অপেক্ষমান বাঙালিদের ট্রেনে উঠতে বাধা দেয়।
এ সময়ই বাসুগাঁও বাঙালি বিদ্যালয়টি মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত এক বিরাট জনতা ভেঙে ফেলে এবং স্কুলের সব জিনিসপত্র লুট করে। সীমান্ত এলাকার মুসলমান গুণ্ডাদের বাঙালি বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে দেখা যায়। চাপার ও তার আশপাশ এলাকার বাঙালিরা চরম দুর্ভোগ ও দুশ্চিন্তার মধ্যে দিন কাটান। পুলিশের ইন্সপেক্টর জেনারেল হায়দর হোসেন এবং কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা বিভাগের ডেপুটি ডিরেক্টর এস. এন. দত্ত-কে ধুবড়ি শহর ও পার্শ্ববতী গ্রামাঞ্চল পরিভ্রমণে ব্যস্ত দেখা যায়।১৫১
বাঙালি অধ্যুষিত জেলা কাছাড়ের মানুষও বাঙালি বিরোধী অভিযানে উদবিগ্ন হয়ে পড়েন। কাছাড়ের উকিল-মোক্তারগণ জেলার আইনশৃঙ্খলা রক্ষা এবং মানুষের মধ্যে আতঙ্ক দূরীকরণে আসাম সরকারকে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানান।
৭ এপ্রিল শিলচরের উকিল ও মোক্তারগণ এক সভায় মিলিত হয়ে যৌথ বিবৃতিতে বলেন: … ‘ধুবড়ি ও গোয়ালপাড়ার অন্যান্য অঞ্চলের পরিস্থিতিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। প্রস্তাবে বলা হয় যে, বঙ্গাল খেদা আন্দোলনের সঙ্গে সঙ্গে এইসব স্থানে বিভীষিকার রাজত্ব দেখা দিয়েছে অথচ পুলিশ বা শাসন কতৃপক্ষ কোন রক্ষা ব্যবস্থা করেন নাই। কয়েকদিন যাবৎ-ই এরূপ শোচনীয় অবস্থা চলছে; … মন্ত্রিবর্গ উপদ্রুত অঞ্চলগুলিতে না গিয়ে বরং অবশিষ্ট বঙ্গভাষী অধ্যুষিত জেলা কাছাড়ে সমবেত হচ্ছেন। এমনও আভাস পাওয়া যাচ্ছে যে, অন্য উপত্যকার প্রভাবশালী নেতারা কাছাড়ে অনুরূপ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য উস্কানি দেবার চেষ্টা করছেন। সম্প্রতি শ্রীঅম্বিকা গিরি রায়চৌধুরীর স্বাক্ষরে অসমিয়া ভাষায় যে পুস্তিকা প্রচারিত হয়েছে তার উল্লেখ করে প্রস্তাবটিতে বলা হয় যে, এতে জেলাবাসীর মনে অসন্তোষ সৃষ্টি হচ্ছে এবং এক শ্রেণীর লোককে অপর শ্রেণীর বিরুদ্ধে উস্কিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ….
সভার পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, অনিল চন্দ প্রমুখ ব্যক্তির নিকট তার প্রেরণ করে অবিলম্বে এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপের জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে।১৫২
আমরা বলেছি যে, আসামের গোয়ালপাড়া জেলায় ‘বঙ্গাল খেদা’ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে আক্রান্ত, আতঙ্কিত শ-য়ে শ-য়ে বাঙালি হিন্দু পরিবার প্রাণরক্ষায় পশ্চিমবঙ্গে পাড়ি জমান। প্রথম দফায় যেসব বাঙালি পরিবার পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় গ্রহণ করেন—তাঁদের প্রতি পশ্চিমবঙ্গ সরকার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। ৯ এপ্রিল রাতে পশ্চিমবঙ্গ সরকার প্রকাশিত প্রেসনোটে বলা হয়:
পশ্চিমবঙ্গ গভর্নমেন্ট সংবাদ পাইয়াছেন যে, আসামে ধুবড়ি এবং গোয়ালপাড়া জিলার অন্যত্র হাঙ্গামার ফলে সেখান হইতে বাঙালী পরিবারসমূহ পশ্চিমবঙ্গে চলিয়া আসিতেছে। আসাম হইতে বাঙালী পরিবারসমূহ কোচবিহার এবং জলপাইগুড়ি জিলার আলিপুরদুয়ারে চলিয়া আসিতেছে বলিয়াও সংবাদ পাওয়া গিয়াছে। রাজ্য গভর্নমেন্ট এ বিষয়ে আসাম গভর্নমেন্ট ও ভারত গভর্নমেন্টের সঙ্গে আলোচনা চালাইতেছেন। আসাম গভর্নমেন্ট জানাইয়াছেন যে, সর্বপ্রকার পুলিশী ব্যবস্থা অবলম্বন করা হইয়াছে, কমিশনারের পদমর্যাদা সম্পন্ন এক ব্যক্তির উপর শান্তিরক্ষার ভার অর্পিত হইয়াছে এবং অবস্থা এখন স্বাভাবিক। আসাম সরকার তাঁহাদের প্রেসনোটে বলিয়াছেন যে, তাঁহারা অরাজকতা সহ্য করিবেন না। তাঁহারা নাগরিকদের পরিপূর্ণভাবে রক্ষা করিবেন প্রতিশ্রুতি দিয়াছেন। পশ্চিমবঙ্গে যে সমস্ত খাস বাঙালী পরিবার আসিয়া আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছে তাহাদের ফিরাইয়া লইবার জন্য আসাম গভর্নমেন্ট কতিপয় কর্মচারীকে এখানে পাঠাইবেন। পশ্চিমবঙ্গ গভর্নমেন্ট … কর্মচারীদের প্রতি নির্দেশ দিয়াছেন যে, আসামে বর্তমানে উদ্বেগের কোন কারণ নাই বলিয়া তাঁহারা যেন এই সমস্ত পরিবারকে আসাম প্রত্যাবর্তনে সাহায্য করেন।১৫৩
সংবাদপত্র থেকে জানা যায় যে, বঙ্গাইগাঁও থেকে যাকিরাগ্রাম পর্যন্ত প্রতিটি রেলস্টেশনে শত শত বাঙালি নরনারী আসাম ছেড়ে আসার জন্য সন্ত্রস্তভাবে অপেক্ষা করছে। ‘মুখ্যমন্ত্রীর রেডিওগ্রাম অনুযায়ী জলপাইগুড়ি জেলার ডেপুটি কমিশনারের আদেশে এখানকার একজন সরকারী কর্মচারী গোয়ালপাড়া জেলার উপদ্রুত অঞ্চলে বাঙালিদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করার জন্য বঙ্গাইগাঁও পর্যন্ত যান। তিনিই জলপাইগুড়ি জেলা কতৃপক্ষকে প্রকৃত অবস্থা জানান। আসাম থেকে আলিপুরদুয়ার জংশনগামী প্রত্যেক ট্রেনেই আসাম থেকে বাস্তুত্যাগীরা আসছেন এবং যাত্রীদের ৬০ জনই ‘বঙ্গাল খেদা’ আন্দোলনে প্রপীড়িত। … আলিপুরদুয়ার মহকুমা সংলগ্ন গোয়ালপাড়া জেলার বিলাসীপাড়া, চাপর, বঙ্গাইগাঁও, বাসুগাঁও এবং ধুবড়ি অঞ্চলেই বাঙ্গালীদের উপর আক্রমণের মাত্রা অত্যধিক।’১৫৪
‘… বিলাসীপাড়ায় এ পর্যন্ত ৭টি বাঙালি দোকান লুণ্ঠিত হয়েছে। সেখানে সহস্র সহস্র অসমীয়া ও পার্বত্য জাতীয় লোক বাঙালির ‘রক্ত চাই’ ধ্বনি দিতে দিতে পথ পরিক্রমা করে। বাঙালিরা পথে বের হতে সাহস পাচ্ছেন না। দৈনন্দিন জীবনযাত্রাও ব্যাহত হয়ে পড়েছে। চোখের জল ফেলতে ফেলতে অনেকেই জানান পূর্ববঙ্গ থেকে উদ্বাস্তু হয়ে আসামে গিয়ে পুনরায় উদ্বাস্তু হলাম। … সীমান্ত থেকে বহু পাকিস্তানী মুসলমান গুণ্ডাও আমদানী করা হয়েছে। তারা বাঙালীদের সম্পত্তি লুট করছে। … আলিপুরদুয়ার জংশন থেকে আমিন গাঁ পর্যন্ত প্রত্যেকটি রেল-স্টেশনে ‘অখন্ড আসাম রাজ্য গঠন’, ‘কামরূপ ক্ষত্রিয় কোচ সম্মেলন’, ‘অহম উপজাতি সম্মেলন’ প্রভৃতি শীর্ষক প্রচারপত্র দেখা যায়। আসামের কোনো কোনো শহরের বাজারে গভীর রাত্রিতে অসমীয়াদের বাঙালী বিদ্বেষমূলক গোপন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। রেল কলোনীর বিহারী ও নেপালী মহলে বাঙালীদের বিরুদ্ধে উস্কানি দিতে দেখা গেছে।’১৫৫
অবশেষে আসাম রাজ্য কংগ্রেস সভাপতি মহেন্দ্রমোহন চৌধুরীর বোধোদয় হয় যে, সত্যিই আসামে বাঙালিরা আক্রান্ত এবং এজন্য তিনি লজ্জিত। এ সম্পর্কে পিটিআই পরিবেশিত সংবাদে বলা হয়:
আসাম কংগ্রেসের সভাপতি শ্রীমহেন্দ্রমোহন চৌধুরী সম্প্রতি যে সকল স্থানে বাঙ্গালী বিরোধী আন্দোলন হইয়াছিল, কংগ্রেস কর্মীদিগকে সেই সকল স্থান পরিদর্শন করিয়া বাঙ্গালী সম্প্রদায়ের মধ্যে আস্থার ভাব ফিরাইয়া আনিবার জন্য অনুরোধ জানাইয়াছেন। শ্রীচৌধুরী এক জনসভায় বক্তৃতাদানকালে বলেন যে, আসামের কোন কোন অংশের উপর পশ্চিমবঙ্গের দাবীর জন্য যে অবস্থার উদ্ভব হয়—গুণ্ডা শ্রেণীর লোকেরা তাহার সুযোগ গ্রহণ করে এবং বাঙ্গালী সম্প্রদায়ের প্রভূত ক্ষতি করে। তিনি বলেন, ‘বিলাসীপাড়া, ছাপার এবং বঙ্গাইগাঁও-এ যাহা ঘটিয়াছে তাহার জন্য আমি লজ্জিত। এই প্রকার কাজের দ্বারা আমাদের উদ্দেশ্য সাধিত হইবে না।’ সভার পর শ্রী চৌধুরী বঙ্গাইগাঁও-এর অবস্থা পর্যালোচনার জন্য বঙ্গাইগাঁও যাত্রা করেন।১৫৬
আসামে বাঙালিদের ওপর ধারাবাহিক আক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিমবঙ্গ কংগ্রেস সভাপতি শ্রী অতুল্য ঘোষ এক বিবৃতিতে জানান:
গত এক বৎসর ধরিয়া আমরা আসাম হইতে এই মর্মে সংবাদ পাইতেছি যে, আসামের কয়েকটি জেলায় অসমীয়াদের মধ্যে এক শ্রেণীর লোক বাঙালীদের বিশেষ করিয়া বাঙালীদের মধ্যে যাহারা সীমানা নির্ধারণ সম্পর্কে মতামত প্রকাশ করিতেছেন—তাঁহাদের কুৎসিত ভাষায় গালিগালাজ করিতেছে ও ভীতি প্রদর্শন করিতেছে। এই আন্দোলনের বিপদজনক সম্ভাবনার প্রতি আমরা আসামের প্রভাবশালী নেতৃবৃন্দের দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছি। গত ১৫দিনে পরিস্থিতি গুরুতর আকার ধারণ করিয়াছে। আসামের আঞ্চলিক অখন্ডতা রক্ষা করার অজুহাতে বাঙ্গালীদের দোকান লুট করা হইতেছে, দোকানের সাইনবোর্ড ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দেওয়া হইয়াছে, বাঙ্গালীদের উপর যথেচ্ছ আক্রমণ চালান হইয়াছে এবং বাঙ্গালী মহিলাদের প্রতি অসদাচরণ করা হইয়াছে। সংক্ষেপে বলিতে গেলে আসামে সম্পূর্ণ অরাজকতা সৃষ্টির জন্য সর্বতোভাবে চেষ্টা করা হইয়াছে। ইহার ফলে ভীত হইয়া আসামের অধিবাসী শত শত বাঙ্গালী আলিপুরদুয়ার ও কোচবিহারে আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছে। ….
আমি কোন বিতর্কমূলক সমস্যা লইয়া আলোচনা করিতে চাহি না। রাজ্য পুনর্গঠন কমিশনই পশ্চিমবঙ্গ ও আসামের দাবীর গুণাগুণ বিচার করিবেন। এ সম্পর্কে বিক্ষোভ প্রদর্শনের কারণ কি, আমি তাহা বুঝিতেছি না। আসামের অধিবাসীদের মধ্যে যাহাদের মাতৃভাষা বাংলা, তাহাদের আসামের ও স্বাধীন ভারতের নাগরিক হিসাবে গণ্য করা হইবে না কেন? আমাদের সংবিধানের নাগরিকদের যে সব সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হইয়াছে, তাহারা সেইসব সুযোগ-সুবিধা হইতে বঞ্চিত হইবে কেন?
কখনও কখনও আমরা সংখ্যালঘু, অর্থাৎ মুসলমানদের সম্পর্কে সমান অধিকারের কথা শুনিয়া থাকি। ভারতের প্রত্যেক নাগরিক সেই অধিকার পাইবে না কেন? … আশ্চর্যের বিষয় এই যে, পূর্বাহ্নে সংবাদ পাওয়া সত্ত্বেও আসাম সরকার এই গুণ্ডামি বন্ধ করার জন্য কোন ব্যবস্থা অবলম্বন করেন নাই। এইসব কুৎসিত ঘটনায় আসাম রাজ্যের সুনাম কলঙ্কিত হইয়াছে। আমি আশা করি যে, ভারত সরকার এই বিপর্যয়কর ঘটনার নীরব দর্শক থাকিবে না। ভারত সরকারই রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন গঠন করিয়াছেন। স্বাধীন ভারতের প্রত্যেক নাগরিক যাহাতে রাজ্য পুনর্গঠন কমিশনের নিকট বিনা বাধায় তাহার মতামত ব্যক্ত করিতে পারে, ভারত সরকারের সে জন্য ব্যবস্থা অবলম্বন করা উচিত। … আমি এখানে বাঙালী সংখ্যালঘুদের অথবা ভাষা ভিত্তিক রাজ্য পুনর্গঠনের প্রশ্ন উত্থাপন করিতেছি না। আমার কথা হইতেছে, এই যে, আসামের অধিবাসী প্রত্যেক বাঙালীকে রক্ষার ব্যবস্থা করিতে হইবে এবং স্বাধীন ভারতের নাগরিক হিসাবে তাহাদিগকে সমান সুযোগ-সুবিধা দিতে হইবে। এই ব্যাপারে আসাম সরকার শোচনীয় ব্যর্থতার পরিচয় দিয়াছেন।
অন্য একটি রাজ্যের কংগ্রেস সভাপতি হিসাবে পূর্ণ দায়িত্ব লইয়াই আমি এই অভিযোগ করিতেছি।
পশ্চিমবঙ্গ হইতে আমরা রাজ্য পুনর্গঠন কমিশনের নিকট কতকগুলি প্রস্তাব পেশ করিয়াছি এবং ভারতের অনুগত নাগরিক ও সৎ কংগ্রেসকর্মী হিসাবে আমরা তাহা করিয়াছি। বহু বৎসর ধরিয়া কংগ্রেস জনসাধারণকে এবং কংগ্রেস কর্মীদের এই প্রতিশ্রুতি দিয়াছে যে, ভাষার ভিত্তিতে বিভিন্ন রাজ্যের সীমা পুনর্বণ্টিত হইবে। গত নির্বাচনী ইস্তাহারেও এই প্রতিশ্রুতি প্রদত্ত হয়। …আসামের বাংলা ভাষাভাষী জনগণও এ সম্পর্কে তাঁহাদের কর্তব্য সম্পাদনের চেষ্টা করিতেছেন। সুতরাং যদি জনগণের কন্ঠরোধের জন্য ভীতি ও আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়, তাহা হইলে ভারত সরকারের জনগণকে রক্ষার জন্য ব্যবস্থা অবলম্বন করা কর্তব্য। রাজ্য সরকার তাঁহাদের কর্তব্য পালনে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়াছেন। কংগ্রেস কর্মী হিসাবে আমাদের কর্তব্য সুস্পষ্ট। নাগরিকরা যাহাতে রাজ্য পুনর্গঠন কমিশনের নিকট তাহাদের মতামত পেশ করিতে পারে, সেজন্য তাহাদের সাহায্য করা আমাদের কর্তব্য। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস বৎসরে বৎসরে যে পবিত্র প্রতিশ্রুতি দিয়াছে, তাহা কার্যকরী করার জন্যই রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন গঠিত হইয়াছে।১৫৭
পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি শ্রীঅতুল্য ঘোষ-এর উপর্যুক্ত বিবৃতি অত্যন্ত গঠনমূলক, সুচিন্তিত, প্রাজ্ঞজনোচিত। শ্রীঘোষ আসাম সরকারের দায়িত্ব ও ব্যর্থতা, ভারত সরকারের দায়িত্ব ও করণীয়, বাঙালিদের প্রকৃত অবস্থা, রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন কেন ও তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে বেশ স্পষ্ট করেই উল্লেখ করেছেন অতি সহজ-সরল ভাব ও ভাষায়—যা ঘটনার গতিপ্রকৃতি নির্ণয়ে সহায়ক হবে। এই বিবৃতির পরও হাঙ্গামা থামেনি।
গোয়ালপাড়া জেলার লক্ষ্মীগঞ্জ ও অভয়াপুরীতে নারী লাঞ্ছনা, অপহরণ এবং ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটে ৪ এপ্রিল। অভয়াপুরীতে একদল দূর্বৃত্ত একজন বিবাহিতা স্ত্রীকে ধর্ষণ করে তার স্বামীকে বাড়ির উঠোনে বেঁধে রেখে। এখান থেকে একজন অবিবাহিতা বালিকাও অপহৃত হয়। এ দিনেই লক্ষ্মীগঞ্জে একদল দূর্বৃত্ত একটি বাড়ি ঘেরাও করে ওই বাড়ির ১৭ ও ১৫ বৎসরের দুই মেয়েকে তাদের হাতে তুলে দিতে বলে। তারা একথাও বলে যে, মেয়ে দুটিকে না দিলে তারা ঘরে আগুন ধরিয়ে দেবে। কিন্তু বাড়ির একজন লোকের তৎপরতায় সংবাদটি এলাকার কংগ্রেস সভাপতির কানে পৌঁছুলে তিনি লোকজন নিয়ে মেয়ে দুটিকে উদ্ধার করে নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছে দেন।১৫৮
এ সময় আসাম কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের মধ্যে বেশ তৎপরতা লক্ষ করা যায়। আসাম কংগ্রেস সভাপতি ও অন্যান্য কংগ্রেস নেতা, জেলার ডেপুটি কমিশনার ও সংশ্লিষ্ট সরকারি অফিসাররা দুর্গত অঞ্চল পরিদর্শন করেন এবং শান্তি প্রতিষ্ঠায় ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। ধুবড়ি ইভনিং ক্লাবে আসাম কংগ্রেস সভাপতি মহেন্দ্রমোহন চৌধুরী বলেন, ‘কংগ্রেসের দিক থেকে আমরা গুণ্ডামি বন্ধের জন্য যথাশক্তি চেষ্টা করবো। … দেশবাসী যেন গুজব না ছড়ান। হাঙ্গামা সম্পর্কে যেসব অভিযোগ আমার হাতে এসেছে—সেগুলোর আমি তদন্ত করে সত্যাসত্য যাচাই করবো। … অপরাধী ব্যক্তিদের শাস্তি দেওয়া হবে।’১৫৯
আসাম কংগ্রেস নেতৃত্বের কথা আর কাজের মধ্যে যে বিস্তর ফারাক বর্তমান, তা অতীতে আমরা যেমন প্রত্যক্ষ করেছি—তেমনি বর্তমান ও আগামীতেও লক্ষ করব।
আসাম সরকার ১২ এপ্রিল এক প্রেসনোট প্রকাশ করেন। প্রেসনোটে বলা হয় যে, গোয়ালপাড়া জেলায় পুলিশকে সাহায্য করার জন্য সেনাবাহিনী তলব করা হয়েছে। প্রেসনোটে এ কথাও বলা হয়, সেনাবাহিনী ইতিমধ্যে পর্যবেক্ষণের কাজ শুরু করেছে এবং শীঘ্রই হয়তো তারা অগ্রসর হবে। প্রেসনোটে আরও বলা হয়, অন্যান্য জেলা থেকে বহু সংখ্যক সশস্ত্র পুলিশ সংঘাতপূর্ণ এলাকায় এসে পড়েছে এবং আজ আরও পুলিশ আসার কথা রয়েছে। আরও বলা হয়, গ্রামাঞ্চলে দূর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে ব্যাপক পুলিশি তৎপরতা শুরু হয়েছে। ৮ এপ্রিল বঙ্গাইগাঁও-এ ৯ জনকে গ্রেফতার করা হয়। ৮ ও ৯ এপ্রিল সিদলী ও বিজনা থানা অঞ্চল থেকে ২৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়।১৬০
আসামে বাঙালিদের ওপর হামলা-নির্যাতনের প্রতিবাদে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলে ১২ এপ্রিল সন্ধ্যায় এক বিশাল জনসভায় ‘আসামের গোয়ালপাড়া জেলায় বঙ্গভাষী জনসাধারণের উপর ব্যাপক ও সঙ্ঘবদ্ধ উৎপীড়নে উদবেগ প্রকাশ করে ‘কেন্দ্রীয় সরকারকে অবিলম্বে এক বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি নিয়োগের অনুরোধ জানিয়ে’ এক প্রস্তাব গৃহীত হয়। বক্তৃতাকালে কোনো কোনো বক্তা এই অভিমতও প্রকাশ করেন যে, ‘আসামের এই অংশে যেভাবে স্ত্রীলোকের সম্ভ্রম পর্যন্ত হানি করা হয়েছে—তাতে সেখানকার শাসনব্যবস্থা অন্ততঃ সাময়িকভাবে কেন্দ্রীয়ক্ত করা উচিত।’ শ্রীমতি লীলা রায় উত্থাপিত উপরোক্ত প্রস্তাবটিতে আরও বলা হয় যে, … ‘আসামে রাজ্য পুনর্গঠন কমিশনের আগমন প্রাক্কালে এইসব ঘটনা ঘটছে। ধুবড়ি, বিলাসীপাড়া, চাপর, ফকিরাগ্রাম, বঙ্গাওগাঁও, চাপরাকাটা ও কুরসাকাটা অথবা সংক্ষেপে সারা গোয়ালপাড়া জেলায় সুপরিকল্পিত বাঙালি বিরোধী অভিযান ও গুণ্ডামি পরিচালিত হয়েছে। ভাষার ভিত্তিতে রাজ্য পুনর্গঠনের এবং আসামে ওই নীতি প্রয়োগের বিরোধী একদল অসমিয়া বঙ্গভাষী জনসাধারণকে সন্ত্রস্ত করবার উদ্দেশ্যে প্রাদেশিক, জাতিগত ও সাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তির উস্কানি দিয়েছে। লক্ষ করবার বিষয় যে, এই উত্তেজনা সঞ্চারের জন্য বহু বহিরাগত মুসলমানকে নিয়োগ করা হয়েছিল। …. এই উন্মত্ততা ও হাঙ্গামার সময় নারীহরণ হয়েছে ও তাদের শ্লীলতাহানি করা হয়েছে। আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি অপরিমেয়; কিন্তু তা অপেক্ষাও অধিকতর উদবেগের বিষয় বাঙালি জনসাধারণের মানসিক আঘাত। এরপর যা অনুসৃত হয়েছে তা পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত ঘটনারই পুনরাবৃত্তি। অর্থাৎ ভীতসন্ত্রস্ত জনসাধারণ নিরাপত্তার সকল বোধ হারিয়ে বাস্তুত্যাগ করেছে।’১৬১
সভায় সভাপতিত্ব করেন শ্রীভূপতি মজুমদার। সভায় বক্তব্য রাখেন—দক্ষিণারঞ্জন বসু, বারীণ ঘোষ, ধুবড়ির নাগরিক সমিতির সেক্রেটারি রমণীকান্ত বসু, হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ, অধ্যক্ষ দেবপ্রসাদ ঘোষ, ডা. নলিনাক্ষ সান্যাল প্রমুখ। সভাপতি ভূপতি মজুমদার তাঁর বক্তৃতায় বাংলা ভাগের ইতিবৃত্ত তুলে ধরে জানান যে, ‘‘আমরা আমাদের যাহা ছিল তাহাই ফিরিয়া পাইতে চাই।’’১৬২
প্রধানত আলিপুরদুয়ার এবং কোচবিহারে গোয়ালপাড়া জেলায় আক্রান্ত, সন্ত্রস্ত বাঙালিদের ভিড় ক্রমশ বৃদ্ধি পাওয়ায় উদ্বিগ্ন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ডা. বিধানচন্দ্র রায় ১২ এপ্রিলে বিষয়টি নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীনেহরুর সঙ্গে দীর্ঘ সময় টেলিফোনযোগে কথা বলেন। ডা. রায় উদবাস্তু পরিস্থিতি যে ক্রমশ ভয়াবহরূপ নিচ্ছে সে বিষয়ের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে তাঁর সহায়তা কামনা করেন।১৬৩
এদিকে পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেস সভাপতি অতুল্য ঘোষও ১২ এপ্রিল বিষয়টি নিয়ে সর্বভারতীয় কংগ্রেস সভাপতি শ্রী ইউ এন ধেবরের সঙ্গে টেলিফোনে বিস্তারিত আলোচনা করেন। এদিন সকালে অতুল্য ঘোষ শ্রীধেবর, আসামের মুখ্যমন্ত্রী শ্রীবিষ্ণুরাম মেধী এবং আসামের কংগ্রেস সভাপতি শ্রীমহেন্দ্রমোহন চৌধুরীর কাছে গোয়ালপাড়ার অবস্থা সম্পর্কে তারবার্তা প্রেরণ করেন। সর্ব ভারতীয় কংগ্রেস সভাপতি শ্রীধেবর অতুল্য ঘোষকে টেলিফোনে জানান যে, ‘গোয়ালপাড়া জেলায় শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য সর্বপ্রকার ব্যবস্থা অবলম্বন করা হবে। … তিনি নিজেই বিষয়টি হাতে নিয়েছেন।’ ধেবর আরও জানান, তিনিও ধুবড়ি ও গোয়ালপাড়া জেলার অন্যান্য অংশে বাঙালি বিরোধী বিক্ষোভ প্রদর্শন ও বিসদৃশ ঘটনাবলীর নানা রিপোর্ট পেয়েছেন।১৬৪
১২ এপ্রিল ধেবরের নিকট প্রেরিত তারবার্তায় অতুল্য ঘোষ জানিয়েছিলেন:
আসামে বাঙ্গালী বিরোধী-অভিযান ও মারপিটে কংগ্রেসসেবীরা অংশগ্রহণ করিতেছেন বলিয়া রিপোর্ট পাওয়া গিয়াছে। আমি ইতোমধ্যেই আপনার নিকট বিসদৃশ ঘটনাবলীর রিপোর্টসমূহ পাঠাইয়াছি। দয়া করিয়া আপনি নিজেই পরিদর্শন করুন অথবা সেক্রেটারীকে প্রেরণ করুন। প্রয়োজন হইলে আমি ধুবড়ি পরিদর্শন করিতে পারি।১৬৫
শ্রীঅতুল্য ঘোষ আসামের মুখ্যমন্ত্রী এবং আসাম কংগ্রেস সভাপতির নিকট যে তারবার্তা প্রেরণ করেছিলেন তার বয়ান ছিল এরকম:
আসাম হইতে কোচবিহার ও আলিপুরদুয়ারে শত শত বাঙ্গালী পরিবার আসিয়াছেন, তাঁহারা যে ক্লেশকর সংবাদ বহন করিয়া আনিয়াছেন তাহা অত্যন্ত অশান্তিজনক। আমি প্রত্যহ ‘জুলুম ও ভীতি প্রদর্শনের’ রিপোর্ট পাইতেছি।১৬৬
আনন্দবাজার পত্রিকা-র বিশেষ প্রতিনিধি গোয়ালপাড়া জেলার ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করে কলকাতায় ফিরে যা লিখলেন তার কিছু অংশ আমরা তুলে ধরব। বিশেষ প্রতিনিধি জানান:
গোয়ালপাড়ায় শোচনীয়ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত কয়েকটি গ্রাম পরিদর্শন করিতে যাইয়া যে কল্পনাতীত ভয়াবহ দৃশ্য দেখিলাম, তাহা স্বচক্ষে না দেখিলে বিশ্বাস করা যায় না। আসামের ইতিহাসে এরূপ ব্যাপক হাঙ্গামার নজির অতীব বিরল। … সপ্তাহকাল ধরিয়া গোয়ালপাড়ায় যে তান্ডব চলিয়াছিল, তাহা আসামের ইতিহাসের পৃষ্ঠাকে কলঙ্কিত করিয়াছে। এই হাঙ্গামার পূর্ণ বিবরণ পাইতে সময় লাগিবে। সর্বত্র গুণ্ডাদের অবাধ প্রতিপত্তি দেখা দিয়াছিল, জেলার স্বাভাবিক শাসনব্যবস্থা ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছিল। উপদ্রুত অঞ্চলে প্রাপ্ত প্রাথমিক বিবরণে প্রকাশ, হাঙ্গামার সময় ন্যূনাধিক ৭০টি গ্রামে উপদ্রবের ফলে প্রায় ৩০০ শত গৃহ লুন্ঠিত হইয়াছে; প্রায় ৪০০০ হাজার লোক গৃহত্যাগ করিয়া শিবিরে কিংবা রেল-কলোনিতে আশ্রয় লইয়াছে। আমি যে গ্রামগুলি দেখিলাম, সেগুলির অধিকাংশই পরিত্যক্ত গৃহগুলি লুন্ঠিত অবস্থায় পড়িয়া রহিয়াছে। … দেশ খন্ডনের পূর্বে যেসব মুসলিম আন্দোলনকারী কুখ্যাতি অর্জন করিয়াছিল, তাহারাই গোয়ালপাড়ার হাঙ্গামায় প্রধানত অংশগ্রহণ করে। হাঙ্গামার ব্যাপ্তি ও কারণ অনুসন্ধানের জন্য বিচার বিভাগীয় তদন্তের ব্যবস্থা করা সরকারের উচিত—ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের মধ্যে এই দাবী আজ প্রবল হইয়া উঠিয়াছে। এই হাঙ্গামার জন্য কাহারা দায়ী এবং কাহারা ভুল ত্রুটি করিয়াছে, তাহাও নির্ধারণ করিতে হইবে।১৬৭
১০ এবং ১১ এপ্রিল বিশেষত আসামের গোয়ালপাড়া জেলায় বসবাসকারী হাজার হাজার বাঙালি উদবাস্তুদের ঢল নামল আলিপুরদুয়ারে। এরা সবাই ভীত-ক্লান্ত, কেউ বা ভয়াবহ আক্রমণের শিকার। উদবাস্তুদের সাহায্যের জন্য আলিপুরদুয়ার জংশনের নিকট প্লাটর্ফমে তাঁবু টাঙিয়ে, পরে জিৎপুর উচ্চ বিদ্যালয়, স্থানীয় ক্লাব হাউস, ডাক বাংলো ও কয়েকটি গৃহকেও উদ্বাস্তু ক্যাম্পে পরিণত করা হয়। প্রথম পর্যায়ে স্থানীয় মানুষই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে পশ্চিমবঙ্গ সরকারই সব দায়িত্ব গ্রহণ করেন। গোয়ালপাড়া জেলার অভয়াপুরী থেকে আগত ৪৭টি পরিবার কোচবিহার জেলায় আশ্রয় গ্রহণ করেন। সংবাদে বলা হয়— ‘প্রত্যেক ট্রেনেই দলে দলে দুর্গত নরনারী এখানে চলে আসছে।’১৬৮
আসাম সরকার মাঝে মাঝেই প্রেসনোট প্রকাশ করে গোয়ালপাড়া জেলায় যে তেমন কিছুই ঘটেনি—তা বেশ জোরের সঙ্গেই বলেছেন। মূল বিষয়কে লঘু করে অপ্রাসঙ্গিক অসত্য কিছু কথা প্রেসনোটে জুড়ে দিয়ে মহল বিশেষের হাততালি পাওয়ার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু আসাম সরকারের এই প্রয়াস সফল হয়নি।
সংবাদপত্রে ‘ব্যর্থ শাসনব্যবস্থা’ শীর্ষক মূল সম্পাদকীয় নিবন্ধে গোয়ালপাড়ায় ‘বঙ্গাল খেদা’ আন্দোলন প্রসঙ্গে যেসব প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়েছে তা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হল:
… শাসনের ভারপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা বলিতেছেন বটে যে, গুণ্ডাশ্রেণীর লোকেদের দ্বারাই উপদ্রব সাধিত হইয়াছে এবং তাঁহারা অবস্থা আয়ত্তে রাখিবার যথাসাধ্য চেষ্টা করিতেছেন; কিন্তু ঘটনার প্রতি এবং অবস্থার প্রতি লক্ষ্য রাখিয়া তাঁহাদের এই কথা আন্তরিক বলিয়া স্বীকার করিতে পারিতেছি না। বরং ইহাই বলিতে হইবে, শাসনের ভারপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের গোপন যোগ বা সহানুভূতি না থাকিলে যাহা ঘটিয়াছে, তাহা ঘটিতে পারিত না। আমাদের সংবাদদাতা বলিতেছেন, ধুবড়ি ও অন্যান্য স্থানে বাঙালী বিরোধী বিক্ষোভ প্রদর্শনের জন্য ৬০/৭০ মাইল দূর হইতে ৫০ খানি ট্রাক বোঝাই করিয়া লোক আনা হইয়াছিল। আসাম সরকারের ভারপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা যদি ইহাদিগকে কেবল ‘‘গুণ্ডা’’ পরিচয়ে আখ্যাত করিতে চাহেন করুন; কিন্তু আমাদের প্রশ্ন হইবে—গুণ্ডাদের জন্য এতগুলি ট্রাক সরবরাহ হইল কেমন করিয়া? ৬০/৭০ মাইল দূর হইতে তাহাদিগকে বহন করিয়া আনিবার পেট্রোল কেমন করিয়া পাওয়া সম্ভব হইল? তাহাদিগকে পূর্ব হইতে সঙ্ঘবদ্ধ করিল কে এবং সরকারের দৃষ্টি এড়াইয়া কেমন করিয়া তাহারা সঙ্ঘবদ্ধ হইল? বলিতে লজ্জিত হই এবং কুন্ঠিত হই, কিন্তু বাধ্য হইয়া বলিতে হইতেছে এবং নিতান্ত ক্ষোভের সহিত বলিতে হইতেছে, যাহা নোয়াখালীতে ঘটিতে দেখিয়াছি, আসামের ঘটনা তাহারই ভিন্নতর সংস্করণ; আসামে ইহা দেখিবার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। উপদ্রবের প্রক্রিয়াটা উভয়ত্র একই প্রকারের হইয়াছে এবং তাহা অকারণ নহে। একথা সর্বজনস্বীকৃত ও সুস্পষ্টভাবেই প্রতিপাদিত যে, পাকিস্তান হইতে দলবদ্ধ উপদ্রবকারী আনাইয়া বাঙালী সমাজকে লাঞ্ছিত, নিগৃহীত ও বিধ্বস্ত করা হইয়াছে এবং বিপদের সময়ে বাঙ্গালী সমাজ পুলিশের সাহায্য চাহিয়াও পায় নাই।
পুলিশ নিষ্ক্রিয় থাকিয়াছে, উপহাস করিয়াছে, ক্ষেত্রবিশেষে সাহায্যপ্রার্থীদিগকে তাড়াইয়া দিয়াছে। আসাম সরকার এই সকল ঘটনাকে বাঙালী-অসমীয়া সংঘর্ষ বলিয়া পাশ কাটাইতে চাহিবেন, তাহা জানি। কিন্তু আমরা কেবল বাঙ্গালী সমাজের জন্যই প্রশ্ন তুলিতেছি না। আসাম সরকারের অধীন ভারত রাষ্ট্রের প্রজাসমূহ পাকিস্তান হইতে আগত গুণ্ডাশ্রেণীর দ্বারা নিগৃহীত হইল কেন তাহার জবাবদিহি আসাম সরকারকে করিতে হইবে। ইহা কি তাঁহাদের ব্যর্থতায় ঘটিয়াছে, না ইহাতে তাঁহাদের সম্মতি ছিল? আসামের ঘটনাকে বিহারের বাঙালী-বিরোধী আন্দোলনের সহিত তুলনা করা হইয়া থাকে। কিন্তু উভয়ের মধ্যে একটা অত্যন্ত গুরুতর মৌলিক পার্থক্য আছে। বিহারের ঘটনা অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষ মাত্র, কিন্তু আসামের ঘটনা কেবল অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষ নহে। অভ্যন্তরীণ বিরোধ লইয়া সূচনা হইলেও সেই বিরোধে একপক্ষ অপরপক্ষকে নিগৃহীত করিবার জন্য বাহির হইতে বৈদেশিক আমদানী করিয়াছে এবং আসাম সরকার কেবল যে নিষ্ক্রিয়ভাবে উহা দেখিয়াছেন তাহা নহে, পরন্তু এই বহিরাগত আমদানীর ব্যাপারে শাসন ব্যবস্থার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সাহায্য প্রদত্ত হইয়াছে।১৬৯
আসাম সরকার বা প্রশাসনের বিরুদ্ধে উপযুক্ত অভিযোগ অত্যন্ত গুরুতর। এই অভিযোগকে রাষ্ট্রবিরোধী বা ভারতবিরোধী বলা যায় কি না তাও ভাবনার বিষয়। আসাম সরকার কি উপরোক্ত অভিযোগের প্রতিবাদ করেছেন? প্রেসনোট প্রকাশ করেছেন? যদি তা-না করে থাকেন— তাহলে গোয়ালপাড়ায় বাঙালিবিরোধী অভিযানে প্রশাসনের অন্তত একাংশের যে সমর্থন, সহায়তা ছিল তা নির্দ্বিধায়, বলা যায়।
ধুবড়ি তথা গোয়ালপাড়া জেলায় সেনা মোতায়েনের সংবাদ পাওয়া যায় ১৩ এপ্রিল রাতে। এদিন রাতে আসাম সরকার প্রতিনিধি পিটিআই প্রতিনিধিকে এ সম্পর্কে বলেন:
কিছুকালের জন্য ঐ স্থানে সৈন্য মোতায়েন করা হইবে। অবস্থা এখন স্বাভাবিক, কিন্তু তাহা সত্ত্বেও সরকার এই জেলায় সম্ভাব্য হাঙ্গামা রোধের জন্য সর্বপ্রকার সতর্কতামূলক ব্যবস্থা অবলম্বন করিতে সিদ্ধান্ত করিয়াছেন। গত ১লা এপ্রিল হইতে নয়দিন যাবৎ পশ্চিমবঙ্গের দাবীর বিরুদ্ধে যে বিক্ষোভ চলিয়াছিল, তাহারই ফলে গোয়ালপাড়ার বাঙালী সমাজ আতঙ্কগ্রস্ত হইয়া সন্নিহিত জলপাইগুড়ি ও কোচবিহার জেলায় চলিয়া গিয়াছে। মে মাসের প্রথম দিকে রাজ্য পুনর্গঠন কমিশনের গোয়ালপাড়া পরিদর্শনের কথা।
আসাম সরকারের মুখপাত্র আরও বলেন, গত ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কোন ঘটনা ঘটে নাই। …. আরও বেশী সংখ্যায় সৈন্য প্রেরণ করা হইবে। গ্রামাঞ্চল হইতে ব্যাপকভাবে লোকজন চলিয়া গিয়াছে বলিয়া সেখানেও সৈন্য মোতায়েন করা হইবে। এই সব সেনাদলের ভারপ্রাপ্ত সিনিয়ার আর্মি অফিসার ইতোমধ্যেই গোয়ালপাড়ায় আসিয়া পৌঁছিয়াছেন। এই জেলায় যে পুলিশ বাহিনী নিয়োগ করা হইয়াছে, পুলিশ ইনস্পেক্টর জেনারেল স্বয়ং তাহার ভার স্বহস্তে গ্রহণ করিয়াছেন। উপদ্রুত স্থানগুলি কয়েকটি অঞ্চলে ভাগ করিয়া প্রত্যেকটির ভার সিনিয়ার পুলিশ অফিসারের উপর অর্পণ করা হইয়াছে। পুলিশ বাহিনীর টহলের জন্য বেতার সমন্বিত বহু গাড়ি আনা হইয়াছে। অন্যান্য জেলা হইতে পুলিশ আনিয়া পুলিশের সংখ্যা বৃদ্ধি করাও হইয়াছে।১৭০
আসাম সরকারের মুখপাত্রের দেওয়া বিবৃতি নিয়ে বিশেষত সেনা মোতায়েন প্রসঙ্গে বিতর্কের সৃষ্টি হয়— যা আমরা পরবর্তীতে লোকসভায় গোয়ালপাড়া প্রসঙ্গ আলোচনায় প্রত্যক্ষ করব।
সর্বভারতীয় কংগ্রেস সভাপতি শ্রী ইউ এন ধেবর নয়াদিল্লি থেকে ১২ এপ্রিল এক বিবৃতিতে ধুবড়ি ও গোয়ালপাড়ায় হাঙ্গামা সম্পর্কে কংগ্রেস কর্মীদের রাজ্য পুনর্গঠন প্রশ্নে কোনো আন্দোলনে যোগ না দেবার পরামর্শ দেন। কারণ কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির এ সম্পর্কে সুস্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে। নির্দেশে বলা হয় ‘কংগ্রেস কর্মীগণ রাজ্য পুনর্গঠন সম্পর্কে ব্যক্তিগতভাবে এমন কি যৌথভাবেও নিজ নিজ মতামত ব্যক্ত করিতে পারিবেন, কিন্তু কোন গণআন্দোলনে তাঁহারা অংশগ্রহণ করিতে পারিবেন না।’ শ্রী ধেবর বলেন যে:
যাহা কিছু একজন ভারতীয়কে অপর একজন ভারতীয়ের বিরুদ্ধে অথবা এক রাজ্যকে অপর রাজ্যের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করে, কংগ্রেস তাহার বিরোধী। ভাষাভিত্তিক রাজ্য পুনর্গঠনের সমগ্র প্রশ্নটিকে নিরপেক্ষ ও বাস্তব দৃষ্টিতে বিচার করিতে হইবে।
কংগ্রেস সভাপতি বিশেষভাবে আসামের কংগ্রেস কর্মিগণকে জনসাধারণের উপর তাঁহাদের প্রভাব বিস্তার করিতে এবং এই সকল উগ্র হাঙ্গামায় যাহারা উৎপীড়িত হইয়াছে, তাহাদের আস্থা যাহাতে ফিরিয়া আসে ও তাহারা সম্পূর্ণ নিরাপদ বোধ করিতে পারে, তৎপ্রতি দৃষ্টি দিতে অনুরোধ করেন। শ্রী ধেবর আসামের ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করিয়া বলেন, ‘আমার এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই, যাহারা ওয়ার্কিং কমিটির নির্দেশ অমান্য করিয়াছে, আসাম প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটি তাহাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা অবলম্বন করিবেন। যে কেহ কংগ্রেসের নির্দেশ অমান্য করে এবং জনসাধারণের উপর হিংসাত্মক আচরণ করে, কংগ্রেসে তাহার স্থান নাই। যাঁহারা এই সকল হাঙ্গামায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হইয়াছেন, তাঁহারা যাহাতে সম্পূর্ণ নিরাপদে থাকিতে পারেন ও সম্পূর্ণ সুবিচার পান, তাহা দেখা কংগ্রেসের কর্তব্য। আমি তাঁহাদিগকে এই আশ্বাস দিতেছি যে, কংগ্রেস প্রতিষ্ঠান তাঁহাদের এই দায়িত্ব সম্বন্ধে সম্পূর্ণ সচেতন।’১৭১
সর্বভারতীয় কংগ্রেস সভাপতি শ্রী ধেবর-এর দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ সম্পর্কে আমরাও সচেতন। কিন্তু তাঁর দলীয় নেতা-কর্মীদের তিনি সামলাতে পেরেছেন কি? নেতারাও কি তাঁর অনুসৃত পথে হাটবেন? দুর্ভাগ্যপীড়িত, লাঞ্ছিত, আক্রান্ত বাঙালিরা কি যথাযথ বিচার পাবেন?
আসামে বাঙালি বিদ্বেষ এবং অসমিয়া সমাজের একটি বড়ো অংশের গুণ্ডামির প্রতিবাদে করিমগঞ্জে ১১ এপ্রিল বিকালে আসাম বিধানসভা সদস্য শ্রীরণেন্দ্রমোহন দাসের সভাপতিত্বে এক বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। জনসভায় গৃহীত প্রস্তাবে ‘স্থানীয় কংগ্রেস ও আসাম জাতীয় মহাসভার নেতৃবৃন্দের প্ররোচনায় অসমিয়াদের একটি অংশ ধুবড়ি ও গোয়ালপাড়ার অন্যান্য অংশে বাঙালিদের উপর অত্যাচারের তীব্র নিন্দা করা হয়। এই গুণ্ডামির ফলে দুর্ভাগ্যক্রমে ক্ষতিগ্রস্ত বাঙালি ভ্রাতৃবৃন্দের প্রতি ঐকান্তিক সহানুভূতি প্রকাশ করা হয়। সভায় শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষা এবং বাঙালিদের জীবন ও সম্পত্তি রক্ষায় স্থানীয় কতৃপক্ষের ব্যর্থতা এবং তাঁদের অবহেলার নিন্দা করা হয়। সভায় অভিমত প্রকাশ করা হয় যে এই গুণ্ডামির দ্বারা আসামের কিছু অংশকে পৃথক করে রাজ্য গঠনের দাবির যৌক্তিকতা সমর্থিত হয়েছে। এই দুঃখজনক ও নিন্দনীয় কার্যের প্রতি সভা ভারত সরকার ও রাজ্য পুনর্গঠন কমিশনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং রাজ্য পুনর্গঠন কমিশনের আগমনের পূর্বে এক সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে অপর সম্প্রদায়কে লাগিয়ে দেবার এই জঘন্য নীতির বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ জানানো হয়। সভায় বিভিন্ন বক্তা বাঙালির প্রতি আসাম কংগ্রেস ও রাজ্য সরকারের মনোভাবের তীব্র নিন্দা করেন এবং আসামের এই অংশে শান্তি রক্ষার জন্য সকলের নিকট আবেদন জানান।১৭২
সরকারি মহল থেকে ১০ এপ্রিলের পর বাঙালি বিরোধী আর কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি বলে দাবি করা হলেও গোয়ালপাড়া জেলায় সন্ত্রাস অব্যাহত ছিল, ছিল চরম উত্তেজনাও। আসামের মুখ্যমন্ত্রী বিষ্ণুরাম মেধী ১৪ এপ্রিল বিমানযোগে ধুবড়ি পৌঁছান। তিনি এদিন বিকালে সার্কিট হাউসে সাংবাদিকদের বলেন, ‘অবস্থার উন্নতি হওয়ায় আপাততঃ সেনাবাহিনীকে তলব করার আর প্রয়োজন নাই। তবে তাদের প্রস্তুত থাকার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন যে, ‘কোন জায়গাতেই সেনা মোতায়েন করা হয় নাই।’ সন্ধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী মেধী বঙ্গাওগাঁও ও তামারহাটে বাঙালি ও অসমিয়াদের সভায় বক্তৃতা করেন।১৭৩
এদিন পুলিশের তরফ থেকে বলা হয় যে, ‘এ পর্যন্ত ১৫৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং হাঙ্গামায় আহত হয়েছে ১০ জন। আসাম পুলিশের ইন্সপেক্টর জেনারেল এ আর চৌধুরী বলেন, আনুমানিক দু-হাজার লোক উপদ্রুত অঞ্চল পরিত্যাগ করে আলিপুরদুয়ার, কোচবিহার এবং কামাখ্যাপুরীতে আশ্রয় নিয়েছে। গোলযোগের সময় বিনানুমতিতে ট্রাকে লোক বহন করার অভিযোগে ট্রাকের মালিক ও চালকদের বিরুদ্ধে পঞ্চাশটি মামলা করার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।১৭৪
পুলিশ রিপোর্টের দিকে নজর দিলে মনে হয় এর চাইতে সেরা কৌতুক আর কী হতে পারে। ‘আহত ১০জন’—একেই বলে পুলিশি তৎপরতা।
কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক শ্রী কে পি মাধবন নায়ার ১৭এপ্রিল কংগ্রেস ভবনে অনুষ্ঠিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে জানান গোয়ালপাড়ার ঘটনা সম্পর্কে কংগ্রেস সম্পূর্ণ সজাগ। নায়ার বলেন:
একথা আমরা পরিষ্কার করিয়া বলিতে চাই যে, [গোয়ালপাড়ার] ঘটনার উপর কংগ্রেস বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করিয়াছে। আমাকে কংগ্রেস সভাপতি যে ঘটনাস্থলে পাঠাইতেছেন ইহাতেই আরও বুঝা যাইবে যে, কংগ্রেস অবস্থার গুরুত্ব সম্পর্কে সজাগ।১৭৫
কংগ্রেস সাধারণ সম্পাদক মাধবন নায়ার সভাপতি ধেবরের নির্দেশে ১৮ এপ্রিল বিকালে বাঙালি বিরোধী দাঙ্গা-হাঙ্গামা সরেজমিনে তদন্তের জন্য ধুবড়ি এসে পৌঁছান, সঙ্গে ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেস সভাপতি শ্রীঅতুল্য ঘোষ। রূপসী বিমানবন্দরে আসাম কংগ্রেস সভাপতি ও সরকারের মন্ত্রীবর্গ শ্রীনায়ার ও শ্রীঘোষকে সম্বর্ধনা দেন। যাঁরা সম্বর্ধনা দেন— তাঁদের মধ্যে ছিলেন—বৈদ্যনাথ মুখার্জী, রূপনাথ ব্রহ্ম, মহেন্দ্রমোহন চৌধুরী ও দেবেশ্বর শর্মা। সার্কিট হাউসে অবস্থানরত মাধবন নায়ারের সঙ্গে বাঙালি সম্প্রদায়, ছাত্র সম্প্রদায়, মাড়োয়ারি ব্যবসায়ী সম্প্রদায়, স্থানীয় কংগ্রেস নেতৃত্ব অর্থাৎ, সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গেই শ্রীনায়ার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন। এদিন সন্ধ্যায় শ্রীনায়ার ও শ্রীঘোষ গোয়ালপাড়ার জেলার বেশ কয়েকটি উপদ্রুত অঞ্চল পরিদর্শন করেন।১৭৬
১৮ এপ্রিল রাতে শ্রীমাধবন সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। এ বিষয়ে সংবাদপত্রে জানানো হল: ‘রাজ্য পুনর্গঠন আন্দোলন সম্পর্কে কংগ্রেস হাইকমাণ্ডের নির্দেশ গোয়ালপাড়ায় ঠিক ভাবে পালন করা হয়নি বলে তিনি মনে করেন।’ এই সঙ্গে তিনি আরও বলেন, ‘আসাম প্রদেশ কংগ্রেস কমিটি এ বিষয়ে তদন্ত করিবেন বলিয়া আশা করি।’১৭৭
ধুবড়ি থেকে ৭৫ মাইল দূরবর্তী দুর্গত এলাকা অভয়াপুরীতে দাঁড়িয়ে মাধবন নায়ার সাংবাদিকদের জানান:
তিনি দেখিয়াছেন যে, অবস্থা এখনও স্বাভাবিক হয় নাই এবং জনসাধারণের মধ্যে আস্থা ফিরাইয়া আনিতে সরকার ও কংগ্রেসকে আরও কিছুকাল কাজ করিতে হইবে। সরেজমিন তদন্তে শ্রীনায়ারের সঙ্গে আসাম প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি মহেন্দ্রমোহন চৌধুরী, মন্ত্রী বৈদ্যনাথ মুখার্জী ও রূপনাথ ব্রহ্ম, কয়েকজন সাংসদ এবং বিধায়কও ছিলেন। ধুবড়ি থেকে মোটর যোগে তাঁরা বিলাসীপাড়া, ছাপার ও বঙ্গাইগাঁও পরিদর্শন শেষে সোমবার মধ্যরাত্রে ধুবড়ি ফিরে আসেন।১৭৮
গোয়ালপাড়া জেলায় হাঙ্গামায় ভারত সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গোবিন্দবল্লভ পন্থও গভীর উদবেগ প্রকাশ করেন।১৭৯
গোয়ালপাড়া জেলায় বাঙালি নির্যাতনের বিষয়টি শেষপর্যন্ত লোকসভায় (Parliament) উত্থাপিত হয়। এ সম্পর্কে সংবাদপত্রে বলা হল:
The Home Minister, Pandit Govind Ballabh Pant, told the Loksabha to-day that the latest reports received from the Assam State Government indicated that the situation in Goalpara district had almost returned to normal.
In view of the continued improvement in the situation, the State Government had informed the military authorities on April 15 last that the help asked for would not be required. No troops were actually moved to Goalpara district as it was not found necessary to utilize them, he said.
The Home Minister, who was replying to a short notice question jointly put by nine members on the recent incidents in Goalpara, said that except for one minor incident on April 12, no incidents had beeen reported from anywhere in the district since April 9. No person, Pandit Pant said, had been killed or seriously injured during the disturbances, though 306 miscreants had been arrested and more than 100 cases had been registered. Re-inforcements of armed police had arrived from other parts of the state and confidence had been restored. … The Chief Minister had also ordered immediate transfer of the superintendent of police of Goalpara and a few subordinate officers to restore confidence along all sections of people including minorities, Pandit Pant said.
The Home Minister said the State Government had taken stern measures against rowdy elements and intensive police operations had been started throughout the district of Goalpara. By April 11, six platoons of policemen had been despatched to the affected areas.
These measures, Pandit Pant, had halted the exodus of refugees and a large number had returned to their homes. The State Government had organized relief measures, and a sum of Rs. 40,000 had been sanctioned for rendering immediate relief to the victims of the disturbances. A sum of Rs. 1,00,000 had also been sanctioned by the State Government for the issue of rehabilitation loans, and another Rs. 1,00,000 had been sanctioned by the Relief an Rehabilitation Department.
Recalling that the district of Goalpara had been the subject of conflicting claims before the States Reorganization Commission, the Home Minister said certain people there felt that this district should be merged in the State of West Bengal, while others held the view that it should continue to remain with Assam. During the first week of April, 1955, a number of processions and meetings were organized to oppose the claim for the merge of the district with West Bengal. There were a few incidents like pelting of stones, pulling down the signboards and attacks on persons and shops mostly by hooligans at the time of the dispersal of the processions and meetings. Certain groups of persons, Pandit Pant continued, had been intimidating Bengali refugees from East Bengal, who had settled down in isolated places in the interior of the district, to leave. Some migration of Bengali refugees to places such as Dhubri and across the state boundary into Cooch Behar and Alipurduar was noticed, and according to estimates, 2,500 persons had migrated between April 9 and 13 … On April 12, the State Government requested for military assistance from the Military Headquarters located at Darjeeling.
Accordingly, an Army officer was despatched by the military authorities to Dhubri to establish close contact with the local civil authorities. Two companies of infantry were alerted at Siliguri on April 12 and one of them was moved to Cooch Behar so as to be really available at Goalpara, should military assistance be actually required there.
No troops were actually moved to Goalpara district as it was not found necessary to utilize them.
Sri S. C. Samanta drew the attention of the Home Minister to Press reports to the effect that the General Secretary of the All-India Congress Committee who had visited Goalpara had stated on April 19 that the situation had not come to normal. … Pandit Pant said, I have received a report from the General Secretary of the Congress and it does not seen to quite tally with what has appeared in the papers. Sri Samanta asked if Government was going to hold an impartial inquiry as the State Govt. and the Congress could not handle the matter.১৮০
পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রকাশিত সংবাদপত্রের প্রতি বিশেষত বাংলা পত্রিকার প্রতি অসমিয়া সমাজের ক্ষোভ ছিল প্রচন্ড। এই প্রচন্ডতা, হিংস্রতা, আক্রমণাত্মক মনোভাব অতীতে যেমন প্রত্যক্ষ করা গেছে বর্তমানেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি।
গৌহাটির পানপাজারে অবস্থিত আনন্দবাজার পত্রিকা এবং হিন্দুস্থান স্ট্যাণ্ডার্ড পত্রিকা অফিস ২১ এপ্রিল রাতে ৩০ জনের একটি দল আক্রমণ করে ভাঙচুর চালায়। দূর্বৃত্তদের বর্বরোচিত এই হামলার তীব্র নিন্দা জানান অন্যান্যের মধ্যে আসামের মুখ্যমন্ত্রী বিষ্ণুরাম মেধী। তিনি ঘটনা শোনা মাত্র পুলিশের ডেপুটি ইনস্পেক্টর জেনারেলকে গৌহাটি যাত্রার নির্দেশ দেন। মুখ্যমন্ত্রী কলকাতা থেকে প্রকাশিত পত্রিকা দুটির অফিস রক্ষার সার্বিক ব্যবস্থা গ্রহণেরও অঙ্গীকার করেন।১৮১
আসামের গোয়ালপাড়া জেলায় বাঙালি বিরোধী, অভিযান এতটাই আক্রমণাত্মক, তীব্র ছিল যে তা রাজ্যিক এবং কেন্দ্রীয় পর্যায়ে আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয়। আসাম বিধানসভা, পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা এবং লোকসভাতেও বিষয়টি একাধিকবার আলোচিত হয়। কিন্তু বাঙালি বিতাড়ন আন্দোলন বা প্রক্রিয়া আসামে থেমে থাকেনি।
আমরা জানি, সর্বভারতীয় কংগ্রেস সভাপতির নির্দেশে সাধারণ সম্পাদক শ্রীনায়ার সরেজমিনে তদন্ত শেষে কংগ্রেস সভাপতির নিকট গোয়ালপাড়ায় সংঘটিত হিংসাত্মক ঘটনার রিপোর্ট পেশ করেন। তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পন্ডিত পন্থ-এর কাছেও একটি রিপোর্ট পাঠিয়ে দেন। কিন্তু তারপরও সমস্যার সমাধান হয়নি।
নয়াদিল্লিতে ৫ মে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সভার শেষ দিনে আসামের হাঙ্গামার বিষয়টি আলোচিত হয়। কিন্তু এখানেও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। পর্যালোচনা শেষে সিদ্ধান্ত হয় যে, পশ্চিমবঙ্গ ও আসামের মুখমন্ত্রীদ্বয় যথাক্রমে ডা. বিধানচন্দ্র রায় ও শ্রীবিষ্ণুরাম মেধী এবং উভয় রাজ্যের কংগ্রেস প্রেসিডেন্টদ্বয় শ্রীঅতুল্য ঘোষ ও শ্রীমহেন্দ্রমোহন চৌধুরী ন্যূনতম সময়ে অবস্থা অনুযায়ী এ বিষয়ে আলোচনা করে বহরমপুরে (গঞ্জাম) ওয়ার্কিং কমিটির পরবর্তী অধিবেশনে রিপোর্ট পেশ করবেন। কিন্তু তার পরও শেষ হয়ে হইল না শেষ। গঞ্জামে অনুষ্ঠিত অধিবেশনে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি উভয় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এবং কংগ্রেস সভাপতিদ্বয়কে জুন মাসে উপদ্রুত অঞ্চল পরিভ্রমণ করে পুনরায় রিপোর্ট পেশের কথা জানাল।১৮২
একের পর এক কমিটি গঠন, রিপোর্টের পর রিপোর্ট, নির্দেশের পর নির্দেশ, কংগ্রেস বনাম রাজ্য সরকার, রাজ্য সরকার বনাম কেন্দ্র চিঠি চালাচালি অব্যাহত থাকে। কিন্তু বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদতেই লাগল। বাঙালি, গোয়ালপাড়া, ধুবড়ি, বাড়িঘর প্রজ্জ্বলন, নারী ধর্ষণ, অপহরণ সবই পিছনে পড়ে থাকল। বিচার থাকল অধরাই। ১৯৫৫ সালে গোয়ালপাড়ায় ‘বঙ্গাল খেদা’ আন্দোলনের পরিসমাপ্তি আপাত ঘটলেও, আগামীতে এই আন্দোলন বা অভিযান নবরূপে, কঠোর কঠিন নৃশংসতায়, হিংস্রতায় আত্মপ্রকাশ করে। তখন আর কেবল গোয়ালপাড়া নয়—সমগ্র আসাম-ই হিংসায় উন্মত্ত হয়ে উঠেছিল।
আসামে রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন:
মে ১৯৫৫, ‘রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন’ (States Reorganisation Commission) যাকে সংক্ষেপে এস. আর. সি. বলা হয়— সেই এস. আর. সি-র সফর শুরু হয় শিলচর পরিভ্রমণের মধ্য দিয়ে। ১৯৫৫ সালের ৩মে, এদিন প্রাতঃকালেই কমিশনের অগ্রগামী দফতর শিলচর এসে পৌঁছায়। কমিশনের কাছে যেসব সংস্থা, ব্যক্তি সাক্ষ্য প্রদান করবেন, স্মারকলিপি পেশ করবেন সেসব বা কমিশনের অন্যান্য প্রাথমিক কাজ সম্পন্ন করার লক্ষ্যেই অগ্রগামী দপ্তর ৩ মে সকালেই শিলচর চলে আসে। এদিন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে বেশ কয়েকটি স্মারকলিপি সাত সকালে জমাও পড়ে কমিশন দফতরে।
জানা যায়, কেবল ‘কংগ্রেস’ ও ‘ভারতীয় জাতীয় ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস’ কমিশনের কাছে পৃথক পৃথকভাবে সাক্ষ্য প্রদান করবে। অন্য দিকে কাছাড় রাজ্য পুনর্গঠন কমিটি, কাছাড় আইনজীবী সম্মেলন, করিমগঞ্জ রাজ্য পুনর্গঠন কমিটি, কাছাড়ের আইনজীবী সম্মেলন, করিমগঞ্জ রাজ্য পুনর্গঠন কমিটি, কাছাড়ের বিশিষ্ট নাগরিকগণ, কোনো কোনো কংগ্রেস সদস্য এবং করিমগঞ্জ বণিক ও শিল্পপতিসভাসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান একটি দল বা পক্ষ হিসেবে কমিশনের নিকট সাক্ষ্য দেবে। এই দল বা পক্ষের প্রতিনিধিত্ব করবেন অধ্যক্ষ শ্রীযোগেন্দ্র কুমার চৌধুরী। মিজো স্বাধীনতা সংস্থার সভাপতি এম. এল. এ শ্রীলালমাইয়া কমিশনের নিকট পৃথক পার্বত্য রাজ্য গঠনের দাবি জানাবেন বলেও জানা যায়।
‘কংগ্রেসী দল আসাম, উত্তর পূর্ব সীমান্ত এজেন্সী, মণিপুর, ত্রিপুরা, কোচবিহার, দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ি নিয়ে বৃহত্তর আসাম রাজ্য গঠনের দাবী করা হয়। অপরদিকে পরলোকগত অরুণ চন্দের পত্নী শ্রীমতী জ্যোৎস্না চন্দের নেতৃত্বে কংগ্রেস সদস্যগণের একাংশ সহ অন্যান্য দল কাছাড়কে আসাম থেকে বিচ্ছিন্ন ও ত্রিপুরার সঙ্গে যুক্ত করে কেন্দ্রীয় শাসনাধীনে গণতান্ত্রিক ভিত্তিতে এক পৃথক রাজ্য গঠনের দাবী করা হয়’ বলে সংবাদে উল্লেখ করা হয়।১৮৩ এদিন রাজ্য পুনর্গঠন কমিশনের অভ্যর্থনার জন্য আসাম সরকারের পক্ষ থেকে অমিয়কুমার দাসও শিলচর পৌঁছান।
রাজ্য পুনর্গঠন কমিশনের সদস্য পন্ডিত কূঞ্জরু এবং সরদার পানিক্কর ৪মে মধ্যাহ্নে আগরতলা থেকে বিমানযোগে শিলচর পৌঁছান। কমিশন সদস্যদ্বয়কে কুম্ভীরগ্রাম বিমানবন্দরে অভ্যর্থনা জানান শিক্ষামন্ত্রী অমিয়কুমার দাস, স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন মন্ত্রী আবদুল মতলিব মজুমদার, স্থানীয় এম. এল. এ ও কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ।
এ দিন অর্থাৎ ৪মে বিকালে কমিশন বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিবর্গের সাক্ষ্য গ্রহণ করেন। এসব সাক্ষ্য থেকে সাধারণভাবে তিনটি অভিমত স্পষ্ট হয়। ‘প্রথমতঃ বৃহত্তর আসাম গঠনের দাবী, দ্বিতীয়তঃ স্বতন্ত্র পূর্ব পার্বত্য রাজ্য গঠনের দাবী এবং তৃতীয়তঃ কাছাড়, ত্রিপুরা, মণিপুর, লুসাই, উত্তর কাছাড় ও নাগা পার্বত্য অঞ্চল নিয়ে পূর্বাচল প্রদেশ গঠনের দাবী।’১৮৪ সংবাদপত্রে দাবী করা হয়—‘তৃতীয় দাবীটিই সর্বাপেক্ষা প্রবল বলে অনুভূত হয়। কাছাড় জেলার তিনটি মহকুমার ২৬ জন বিশিষ্ট প্রতিনিধি কমিশনের সমক্ষে সাক্ষ্যদানকালে বিশেষ জোরের সঙ্গে পূর্বাচল প্রদেশ গঠনের দাবী জানান। এসব প্রতিনিধির মধ্যে কংগ্রেস ও প্রজাসমাজতন্ত্রী কর্মী, কয়েকজন এম.এল.এ., মিউনিসিপ্যালিটি ও লোকাল বোর্ডের সভাপতি, সমাজ সেবক ও ট্রেড ইউনিয়ন কর্মী, উকিল ও বণিক সভার প্রতিনিধি এবং আদিবাসীরা তাঁদের মধ্যে ছিলেন।’ ১৮৫
অন্যদিকে ‘আসাম প্রদেশ কংগ্রেস কমিটি আসামের বর্তমান অবস্থা বজায় রাখার পক্ষপাতী। কিন্তু স্থানীয় কংগ্রেসী দল কমিশনের নিকট এরূপ দাবী জানান যে, ভবিষ্যতে আসামের যে মানচিত্র অঙ্কিত হবে— তাতে যেন ত্রিপুরা, মণিপুর, কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং এবং উত্তর-পূর্ব সীমান্ত এজেন্সী এর অন্তর্ভুক্ত হয়।’ …. এ ভাবে মানচিত্র প্রণীত বা অঙ্কিত হলে সমগ্র ভারতবর্ষকে একটি ইউনিটে গঠন করার প্রয়োজন পড়বে—যা আদৌ সম্ভব নয়। এ প্রসঙ্গে কমিশন ‘কংগ্রেসী দলের অন্যতম মুখপাত্র মইনুল হক চৌধুরীকে প্রশ্ন করেন আসামের গোয়ালপাড়া অঞ্চলে যে বাঙ্গালীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল ১০ বৎসরের মধ্যে তাহাদের সংখ্যালঘিষ্ঠে পরিণত হওয়ার রহস্যটা কি? প্রকাশ, জনাব চৌধুরী ইতস্তত করে জবাব দেন যে, গোয়ালপাড়ার একটি স্থানীয় ভাষা আছে। এই ভাষাভাষীদের গত আদমশুমারীতে বাঙ্গালী বলে গণ্য করা হয়নি।’১৮৬
মইনুল হক চৌধুরী জানিয়েছেন, ‘গোয়ালপাড়ার একটি স্থানীয় ভাষা আছে’— যা সঠিক তথ্যনির্ভর নয়।১৮৭ এমন কোনো ভাষার অস্তিত্ব গোয়ালপাড়ায় ছিল না।
এদিকে কলকাতা পূর্বাচল কমিটি ২মে কলকাতাস্থ রাজ্য পুনর্গঠন কমিশনের আসামকে বিভক্ত করার প্রস্তাব সংবলিত এক সংশোধিত স্মারকলিপি পেশ করে। পূর্বাচল কমিটির সংশোধিত প্রস্তাবে বলা হয়:
মণিপুর ও ত্রিপুরাসহ আসাম তিনভাগে বিভক্ত হইতে পারে: ১ম বিভাগ—ইহাতে এই সকল পার্বত্য অঞ্চল থাকিবে— ১. গারো পাহাড়, ২. খাসিয়া ও জয়ন্তিয়া পাহাড়, ৩. উত্তর কাছাড় পাহাড় ব্যতীত মিকির পাহাড়, ৪. নাগা পাহাড় এবং উত্তর-পূর্ব সীমান্ত অঞ্চল। এই বিভাগের আয়তন হইবে—৫৩,১২৪ বর্গমাইল, লোকসংখ্যা ১৫,২৫,৪৯৯ এবং বসতির ঘনত্ব প্রতি বর্গমাইলে ৩০।
২য় বিভাগ— (পূর্বাচল প্রদেশ) এইগুলি লইয়া গঠিত হইবে—১. ত্রিপুরা, ২. কাছাড়, ৩. উত্তর কাছাড়, ৪. লুসাই পাহাড় এবং ৫. মণিপুর। ইহার আয়তন হইবে— ২৫,৩৫৯ বর্গমাইল, লোকসংখ্যা ২৫,৭৩,১৯২ এবং বসতির ঘনত্ব প্রতি বর্গমাইলে ১০১। এই অঞ্চলের বর্তমান সর্বমোট আয় কেন্দ্রীয় সরকার, আসাম সরকারের সাহায্য নিয়া ১৯৬১ (ইংরেজি) পর্যন্ত প্রায় ১০ কোটি টাকা হইবে। তাহাতেই নূতন প্রদেশের ব্যয়ভার কুলাইয়া যাইবে বলিয়া অনুমিত হয়। এই নূতন রাজ্য বহু ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাপূর্ণ এবং ইহার উন্নতি সাধন করিলে ইহা একটি উদবৃত্ত অঞ্চলে পরিণত হইতে পারে। আসাম একটি ঘাটতি রাজ্য, এর প্রতি বৎসর কেন্দ্রীয় সরকার হইতে প্রায় ৬ কোটি টাকা সাহায্য স্বরূপ পাইয়া থাকে।
প্রথম বিভাগের শাসনভার কেন্দ্রীয় সরকারের উপর ন্যস্ত থাকিবে। প্রসঙ্গত ইহাও বলা হইয়াছে যে, যদি পার্বত্য অঞ্চলের অধিবাসীগণ সম্মত হন (এবং প্রকৃতপক্ষে লুসাই প্রভৃতি কোন কোন অঞ্চলের লোক এ বিষয়ে সম্মত আছেন) তবে ১ম ও ২য় বিভাগের শাসন ব্যবস্থা একত্র সংযুক্ত করা যাইতে পারে। ৩য় বিভাগ— ১. কামরূপ, ২. নওগাঁও, ৩. দরং, ৪. শিবসাগর ও ৫. লখিমপুর (অসমীয়াদের প্রকৃত বাসভূমি) লইয়া গঠিত হইবে। ইহার আয়তন হইবে ১৬,৩৫৪ বর্গমাইল, লোকসংখ্যা ৫৫,৮১,৫৬৯ এবং বসতির ঘনত্ব প্রতি বর্গমাইলে ৩৪০। গোয়ালপাড়া বাঙ্গালী অধ্যুষিত অঞ্চল এবং পশ্চিমবঙ্গের সংলগ্ন বলিয়া এই জেলাকে পশ্চিমবঙ্গের সহিত পুনঃসংযুক্ত করিয়া দেওয়া হউক।
এই প্রস্তাবিত বিভাগের দ্বারা রাজস্ব ও অন্যান্য সম্পদ সম্পর্কে আসামের বিশেষ কোন ক্ষতির কারণ ঘটিবে না। আসাম ইহার পরও গবর্নর শাসিত প্রদেশরূপে গণ্য হইতে পারিবে। কোনরূপ বিভাগের ব্যবস্থা না হইলে আসামের বর্তমান বিশৃঙ্খল অবস্থার কোন স্থায়ী সমাধান অপর কিছুতেই হইবে বলিয়া কমিটি মনে করেন না।১৮৮
আসামে ‘রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন’ পরিভ্রমণের দু-মাস পূর্বে অর্থাৎ ১৯৫৫ সালের মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে এ বিষয়ে সংবাদপত্রে যে সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়—নানা দিক থেকেই আজও তা প্রাসঙ্গিক। সেদিন সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়েছিল:
…. ভারত সরকার কতৃক নিযুক্ত রাজ্য পুনর্গঠন কমিশনের কাজ চলিতেছে। এই কমিশনের নিকট বর্তমান আসাম রাজ্য খন্ডিত করিয়া একাধিক নূতন ও পৃথক রাজ্য গঠনের দাবীতে কতকগুলি স্মারকলিপি প্রেরিত হইয়াছে। খাসিয়া জয়ন্তিয়া পাহাড়, গারো পাহাড়, লুসাই পাহাড় ও নাগা পাহাড়,— এই কয়টি পার্বত্য জেলার অধিবাসী আসাম হইতে পৃথক রাজ্য গঠনের দাবী তুলিয়াছেন। কাছাড় জেলা, মণিপুর ও ত্রিপুরার পক্ষ হইতেও একটা পৃথক রাজ্য গঠনের অনুকূলে স্মারকলিপি প্রেরিত হইয়াছে। এই সকলেরই যুক্তি প্রায় এক এবং অভিন্ন। প্রধান যুক্তি এই যে, ভারতের সংবিধানে সমস্ত নাগরিকের সমানাধিকার স্বীকৃত হইয়াছে। কিন্তু বর্তমান আসামের পাঁচটি মাত্র জেলার অধিবাসী অসমীয়া ভাষাভাষী শিক্ষিত ব্যক্তিগণ উল্টা বুঝিয়াছেন। তাঁহারা এমনভাবে আচরণ করিতেছেন যে, আসাম রাজ্যের শাসনকর্তা যেন একমাত্র অসমীয়া ভাষাভাষীগণই, অপর কেহ নহে। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় অবস্থিত মাত্র পাঁচটি জেলাই প্রধানতঃ অসমীয়া ভাষাভাষী। কিন্তু এই পাঁচ জেলার যে আয়তন, তাহার অন্ততঃ কয়েকগুণ অধিক আয়তন লইয়া আসাম রাজ্য। তাহাতে বহু প্রকার ভাষাই প্রচলিত। এরূপ বহু ভাষাভাষী রাজ্যে একমাত্র অসমীয়া ভাষাভাষীর প্রশাসনিক আধিপত্য অনিষ্টকর, অবাঞ্ছনীয়—প্রধানতঃ এই যুক্তিতেই আসামে নূতন ও পৃথক রাজ্য গঠনের দাবী সৃষ্ট ও পুষ্ট হইয়াছে।১৮৯
উপর্যুক্ত বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণের কোনো সুযোগ আছে বলে হয় না। কারণ সংঘটিত ঘটনাই এ সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করবে।
১২ মে সকালে রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন গৌহাটি থেকে গোয়ালপাড়া যাওয়ার পথে খন্ডজাতীয় গারো অধিবাসীগণের বিক্ষোভের সম্মুখীন হন। খন্ড জাতীয়রা স্বতন্ত্র রাজ্যের দাবী জানিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। আসামের বর্তমান অবস্থা বজায় রাখার দাবী এবং গোয়ালপাড়ার যে-কোনো অংশ বিচ্ছিন্ন করার প্রতিবাদেও বহু স্থানে বিক্ষোভ প্রদর্শিত হয়। স্বতন্ত্র পার্বত্য রাজ্য যারা দাবী করে তাদের মধ্যে বহু মহিলাও ছিল। তারা পৃষ্ঠদেশে শিশুদের বেঁধে নিয়ে ‘স্বতন্ত্র পার্বত্য রাজ্য চাই’ ব্যাজ লাগিয়ে কমিশনের পথে নীরবে দাঁড়িয়ে ছিল। বর্তমান অবস্থা বজায় রাখার পক্ষপাতী যারা তারা পথিমধ্যে কয়েকটি তোরণ নির্মাণ করেছিল—যাতে লেখা ছিল: ‘গোয়ালপাড়া আসাম হইতে অবিচ্ছেদ্য।’ কমিশন এরূপ বিরুদ্ধ বিক্ষোভ প্রদর্শনের সম্মুখীন হয়ে এলাকার সাক্ষ্য গ্রহণ সমাপনান্তে অভ্যন্তরীণ কয়েকটি অঞ্চল দেখার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। ঐ সকল অঞ্চল পরিদর্শন সময়ে পন্ডিত কুজ্ঞরু এবং সরদার পানিক্কর গ্রামবাসীদের ভাষা ইত্যাদি সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করেন।’১৯০
এখানে ‘কমিশন যাদের সঙ্গে কথা বলেন, একমাত্র উদ্বাস্তুগণ ব্যতীত অন্যান্য সকলেই গোয়ালপাড়াকে আসামের সঙ্গে রাখার পক্ষে মত দেয়। সংখ্যালঘু মুসলিম প্রতিনিধিগণকে জিজ্ঞাসা করা হয় পূর্ববঙ্গ থেকে আগত বাঙ্গলা ভাষাভাষী ১ লক্ষ ৪৭ হাজার মুসলমান কেমন করে অসমীয়া ভাষাভাষী অসমীয়া জনসাধারণে পরিণত হল? প্রশ্নের চাপে প্রতিনিধিদের মধ্যে কয়েকজন লোকগণনা কতৃপক্ষের ভুল বলে জানান।’১৯১
এ সময় অন্যতম কমিশন সদস্য স্যার ফজল আলি শিলং-এ রাজ্যপাল এবং মুখ্যমন্ত্রী বিষ্ণুরাম মেধীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। স্যার ফজল আলি ১৩ মে মুখ্যমন্ত্রী বিষ্ণুরাম মেধী এবং অন্যান্য মন্ত্রীদের সাক্ষ্য গ্রহণ করেন। এ সময় মুখ্যমন্ত্রী কমিশন সদস্যকে জানান ‘আসামের বর্তমান অবস্থা বজায় থাকা উচিত।’ স্বতন্ত্র পার্বত্য রাজ্য গঠনের দাবীর পক্ষের বিপক্ষ প্রতিনিধিদেরও সাক্ষ্য গ্রহণ করেন স্যার ফজল আলি।১৯২
১৪ মে রাজ্য পুনর্গঠন কমিশনের সভ্যগণ ধুবড়ি পৌঁছান। অত্যন্ত বিপদসঙ্কুল প্রায় তিনশো মাইল পার্বত্যপথ এবং ব্রহ্মপুত্র নদ পাড়ি দিয়ে কর্তব্যকরণে তাঁরা ধুবড়ি আসেন।
কমিশন ১৫মে ধুবড়ি নাগরিক সমিতির সভাপতি রমণী বসুর নেতৃত্বাধীন দলের সাক্ষ্য গ্রহণ করবেন বলে জানা যায়। ধুবড়ি আসার পূর্বে অর্থাৎ ১৩মে তুরায় কমিশন সদস্যগণ চারটি পাহাড়ি জেলার পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বকারী প্রতিনিধিদের সাক্ষ্য গ্রহণ করেন। পাহাড়ি প্রতিনিধিবৃন্দ কমিশনের সম্মুখে বেশ জোরের সঙ্গেই পৃথক পার্বত্য রাজ্যের দাবি জানান। পাহাড়ি জনগোষ্ঠী নেতা ডব্লু এ সাংমা জানান: ‘… পৃথক পার্বত্য রাজ্য গঠনের দাবী কার্যে পরিণত না হলে এবং তাঁরা আসামের অন্তর্ভুক্ত থাকতে বাধ্য হলে ভবিষ্যতে কী ঘটবে তা তাঁরা বলতে অক্ষম। তবে সেরূপ অবস্থায় আসামের কল্যাণধর্মী রূপ লোপ পাবে এবং আসাম পুলিশী রাজ্যে পরিণত হবে।’১৯৩
পাহাড় বা পার্বত্যবাসী মানুষেরা তাঁদের মতামত রাজ্য পুনর্গঠন কমিশনকে লিখিতভাবে জানিয়েছিলেন। তাঁদের লিখিত মতামতের অংশবিশেষ ছিল নিম্নরূপ—রাজ্য পুনর্গঠন কমিশনকে মণিপুর স্টেট কংগ্রেস লিখলেন:
The discriminatory policy and inefficient administration of the Assam State Government have belied the hope that Assam will ever do equitable justice to its component parts. We are afraid,—apart from cultural and linguistic handicaps— the progress and improvement so far made under the Centre will receive a set-back if Manipur is marged with Assam১৯৪
অন্যদিকে মিজো ইউনিয়ন, মিজোরাম (লুসাই হিলস) তাদের স্মারকলিপিতে জানালেন:
The Assamese are given near about 60 percent of the appointments … The State Government allot 70 percent of the total development grant to them. … the Assamese people insist that Assamese should be adopted as the State language of Assam. … Under the existing state of affairs the non-Assamese people could not secure justice, equality and fraternity under the soverign Democratic Republic of India. As we are now it would not be right to call ourselves a free nation.১৯৫
গারো পাহাড়ের মানুষও কমিশনকে স্মারকলিপি দিলেন। স্মারকলিপিতে বলা হল:
The people speaking the Assamese language are determined to do away with the languages and cultures of those who do not belong to the Assamese-speaking community. If this attitude of our Assamese brethren continues there will be no other alternative for the hill people but to go out for a seperate Part A Hills State, which will enable them to preserve their racial identity, culture and language.১৯৬
কাছাড়ের জনগণের পক্ষ থেকেও রাজ্য পুনর্গঠন কমিশনকে স্মারকলিপি প্রদান করা হয়। কাছাড়ের মানুষ এলাকার সমস্যা, সরকারি বঞ্চনা, ভাষা ইত্যাদি বিষয় কমিশন সম্মুখে তুলে ধরার জন্য ১৯৫৪ সালে গড়ে তুলেছিলেন, ‘The Cachar State Reorganisation Committee’। এই কমিটির সভাপতি ছিলেন করিমগঞ্জের বিশিষ্ট আইনজীবী ধর্মদাস দত্ত এবং শিলচরের প্রথিতযশা আইনজীবী পরেশচন্দ্র চৌধুরী ছিলেন কমিটির সাধারণ সম্পাদক। কমিশনের কাছে যে স্মারকলিপিটি পেশ করা হয়েছিল সেটি প্রণয়ন করেন অধ্যক্ষ যোগেন্দ্র কুমার চৌধুরী। তাঁকে সহায়তা করেন সাধারণ সম্পাদক পরেশচন্দ্র চৌধুরী। ‘অক্সফোর্ডের স্নাতক যোগেন্দ্র চৌধুরীর ইংরেজি ভাষার উপর যে দখল ছিল, তাতে স্মারকলিপিটি রচনারীতির দিক দিয়ে এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল। তার সঙ্গে ছিল অসাধরণ তথ্য সম্পদ।’১৯৭
স্মারকলিপির মূল কথা ছিল এরকম:
… We know, most people in Cachar have, by the deprivations and hard experiences of the last seven years, been driven to the belief that Cachar’s future is doomed in Assam.১৯৮
আসাম রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন যখন ভারত সরকারের দায়িত্ব পালন করছিলেন— সেই মুহূর্তেও পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রকাশিত দৈনিক সংবাদপত্র পুনরায় আক্রান্ত হল গৌহাটিতে। ১৫মে খুব সকালে গৌহাটি শহরের উপকন্ঠবর্তী শান্তিপুরে একদল দূর্বৃত্ত ৪৫০টি আনন্দবাজার পত্রিকা, হিন্দুস্থান স্ট্যাণ্ডার্ড, অমৃতবাজার পত্রিকা এবং যুগান্তর পত্রিকার বেশ কয়েকটি বাণ্ডিল পুড়িয়ে দেওয়া হয়। সংবাদে বলা হয়— দু-জন পত্রিকা হকার যখন কাগজ নিয়ে সাইকেল যোগে পাণ্ডু যাচ্ছিলেন—তখন ৭জন লোক হকারদের পথ রোধ করে এবং সাইকেল থেকে নেমে যেতে বলে। এরপরই রুমাল দিয়ে মুখ ঢাকা মানুষেরা সব পত্রিকা পুড়িয়ে দিয়ে সেখান থেকে সরে পড়ে। পুলিশ এ বিষয়ে তদন্ত শুরু করেছে বলে জানানো হয়।১৯৯
ধুবড়িতে ১৫ মে রাজ্য পুনর্গঠন কমিশনে ‘জনমতের বিভিন্ন অংশের প্রতিনিধি স্থানীয় ছ-টি প্রতিনিধি দল সাক্ষ্যদান কালে গোয়ালপাড়া জেলাকে পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্ভুক্ত করার দাবী জানান।’ এ সম্পর্কে সংবাদপত্রে বলা হয়:
… কামতা (যাহারা এককালে উত্তরবঙ্গে ও গোয়ালপাড়ায় আধিপত্য করিয়াছেন) রাজবংশী ও ক্ষত্রিয়দের ইতিহাস বর্ণনা করিয়া ধুবড়ি নাগরিক সমিতির পক্ষ হইতে শ্রীরমণীকান্ত বসু একখানা স্মারকলিপি পেশ করেন। উক্ত স্মারকলিপিতে পরিষ্কারভাবে দেখানো হয় যে, বর্তমানে যাহা পশ্চিমবঙ্গরূপে পরিচিতি লাভ করিয়াছে, গোয়ালপাড়া উহারই উত্তরাঞ্চলের জেলাসমূহের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল। প্রায় একশত সরকারী নথিপত্রের উল্লেখ করিয়া তিনি বলেন, গবর্নমেন্ট বা স্থানীয় অধিবাসী, কেহই কোনদিন গোয়ালপাড়াকে আসামের অংশ বলিয়া মনে করেন নাই।
গোয়ালপাড়া সংক্রান্ত বিরোধে রাজবংশী উপভাষা কমিশনের সর্বাধিক দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছে। শ্রীবসু একথাটি উল্লেখ করিয়া বলেন যে, গ্রীয়ারসন তাঁহার লিংগুয়িসটিক সার্ভে (Linguistic Survey) পুস্তকে পরিষ্কারভাবে বলিয়াছেন যে, পূর্ববঙ্গের কথ্য ভাষার সহিত এই উপভাষাটির গভীর সামঞ্জস্য রহিয়াছে এবং উহা ক্রমশঃ উত্তরবঙ্গ হইতে আসামের গোয়ালপাড়া জেলায় প্রসার লাভ করিয়াছে। অধিকন্তু জেলার সমস্ত প্রাচীন নথিপত্র বাঙ্গলা ভাষায় লিখিত রহিয়াছে—এমনকি, ১৯১১ সাল পর্যন্তও যে সকল সাময়িকপত্রের মাধ্যমে জনমত প্রকাশ পাইত, সেগুলি বাঙ্গলা ভাষাতেই প্রকাশিত হইয়াছে।২০০
স্মারকলিপিতে ভাষাগত শ্রেণিবিভাগ প্রসঙ্গে বলা হয়:
১৯৫১ সালের আদমশুমারীতে গোয়ালপাড়ার অধিবাসীগণকে ভাষা অনুযায়ী যেভাবে বিভক্ত করা হইয়াছে, তাহার উল্লেখ প্রসঙ্গে শ্রীবসু এই অভিযোগ করেন যে, অসমীয়াদের স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যেই উহা করা হইয়াছে। উক্ত আদমশুমারীতে দেখা যায় যে, বর্তমানে বাঙ্গলা ভাষাভাষীর সংখ্যা ১ লক্ষ ৯৩ হাজার এবং অসমীয়া ভাষাভাষীর সংখ্যা ৬ লক্ষ ৮৭ হাজার। বাঙ্গলা ভাষাভাষীগণের মধ্যে আবার ১ লক্ষ ৪৪ হাজার পাকিস্তান এবং পশ্চিমবঙ্গ হইতে আসিয়াছে বলিয়া আদমশুমারীর আর একটি অংশে দেখানো হইয়াছে। অতএব যাহারা মূলতঃ এ জেলার অধিবাসী, এমন বাঙ্গালীর সংখ্যা দাঁড়াইতেছে, মাত্র ৪৮ হাজার। ইহা সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য। কেননা ১৯১১, ১৯২১ ও ১৯৩১ সালের আদমশুমারীতে বঙ্গভাষাভাষীর জনসংখ্যার শতকরা হার ছিল যথাক্রমে ৫২.৭, ৫২.২ এবং ৫৪।২০১
ধুবড়িতে কমিশনের কাছে নাগরিক সমিতি এবং অপর বেশ কয়েকটি সমিতি ও সঙ্ঘ গোয়ালপাড়াকে আসাম থেকে বিচ্ছিন্ন করে পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানালেও সরকারি দল কংগ্রেস এবং অন্য বেশ কয়েকটি দল যারা অবাঙালিদের প্রতিনিধিত্ব করছিলেন— তারা কমিশন সমীপে সাক্ষ্যদানকালে গোয়ালপাড়া জেলাকে আসামে রাখার পক্ষে সওয়াল করেন। এ সময় রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন ওই প্রতিনিধিদলকে বাঙালি বিরোধী হাঙ্গামা সম্পর্কে প্রশ্ন করলে তারা অস্বস্তি বোধ করেন এবং উত্তরদানে বিরত থাকেন। অপরদিকে মুসলিম সম্প্রদায় যাঁরা পূর্ববঙ্গ থেকে আসামে এসেছিলেন—তাঁদের প্রায় সকলের মাতৃভাষা ‘অসমিয়া’ বলে ১৯৫১ সালের আদমশুমারীতে উল্লেখ করা হয়েছে। এ সম্পর্কে কমিশন জনৈক মুসলিম প্রতিনিধিকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি জানান, ‘বহু বাঙ্গালী মুসলমান পূর্ব থেকে আসামে বসবাস করছেন এবং তারা অসমীয়া নারীকে বিয়ে করেছেন। সে জন্যই তাদের মাতৃভাষা অসমীয়া … এবং বঙ্গভাষা বর্জন করা হয়েছে।’২০২ এই বক্তব্যের অর্থ দাঁড়াল স্ত্রীর ভাষাই ‘মাতৃভাষা’।
কার্যত ধুবড়ি পরিভ্রমণের মধ্য দিয়ে রাজ্য পুনর্গঠন কমিশনের আসাম সফর শেষ হয়। আমরা জানি, কমিশন প্রথম শিলচর পরিভ্রমণের মধ্য দিয়ে তাঁদের আসাম সফর শুরু করেছিলেন— যেখানে বাঙালিরা বাংলা ভাষা-সংস্কৃতি তথা রাষ্ট্রিক ক্ষেত্রে নানা বঞ্চনার অভিযোগ উত্থাপন করেছিলেন, কাছাড়কে পশ্চিমবঙ্গভুক্ত করার দাবিও জানিয়েছিলেন। আবার ১২ দিন পর যেখানে পরিভ্রমণ, সাক্ষ্য গ্রহণ ও তথ্যাদি সংগ্রহ শেষ করলেন— সেই বাঙালি অধ্যুষিত ধুবড়ি-গোয়ালপাড়াতে বাংলা ভাষা-সংস্কৃতি তথা বাঙালিদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ উত্থাপন করে আসাম থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার দাবি জানালেন সেখানকার বাঙালি সম্প্রদায়। বিষয়টি কাকতালীয় সন্দেহ নেই। কিন্তু বাংলা, বাঙালির এ এক অদ্ভুত মিলন।
১৯৫৫ সালেই রাজ্য পুনর্গঠন কমিশনের রিপোর্ট সংবাদপত্রে প্রকাশিত হওয়ার পর জনমনে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যায়। বিশেষত গোয়ালপাড়া এবং কাছাড়ের বাঙালিদের মধ্যে কমিশনের মতামতের প্রভাব ছিল লক্ষ করার মতো। কমিশনের বক্তব্যকে তাঁরা যুক্তিগ্রাহ্য বলে মনে করেননি। প্রতিবাদ জানিয়েছেন লিখিতভাবে। সরকারি এবং বেসরকারি দলিল দস্তাবেজ তুলে ধরে পুনরায় তাঁরা স্মারকলিপি পাঠিয়ে দিলেন ভারত সরকারের স্বরাষ্ট্রবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে। ১৯৫৫ সালের ২৮ অক্টোবর প্রেরিত স্মারকলিপিটি ‘কাছাড় রাজ্য পুনর্গঠন কমিটি’, শিলচর এবং করিমগঞ্জ রাজ্য পুনর্গঠন কমিটি’, ‘কাছাড় লয়ার্স কনভেনশন’, ‘সিটিজেন অব কাছাড়’, ‘করিমগঞ্জ চেম্বার অব কমার্স এণ্ড ইণ্ডাস্ট্রিজ, ‘করিমগঞ্জ মার্চেন্ট সমিতি’, ‘কর্মী সঙ্ঘ’ প্রভৃতি সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রেরিত হয়।
স্মারকলিপিতে স্বাক্ষর করেন ৩৪ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি। বিশিষ্ট জনদের মধ্যে ছিলেন— যোগেন্দ্র কুমার চৌধুরী, উপেন্দ্রশঙ্কর দত্ত, সতীন্দ্রমোহন দেব, নগেন্দ্রচন্দ্র শ্যাম, ধীরেন্দ্রমোহন দেব, পরেশচন্দ্র চৌধুরী, ধর্মদাস দত্ত, শশীভূষণ রায়, রাকেশরঞ্জন ভট্টাচার্য, কুঞ্জবিহারী চক্রবর্তী, মেহরাব আলি লস্কর, নামওয়ার আলি বরভূঁইয়া, নিতাইচাঁদ পাটনী, যতীন্দ্রমোহন দেব লস্কর, কৃষ্ণজীবন পুরকায়স্থ, সনৎকুমার দাস, মহেন্দ্রচন্দ্র শর্মা, অনিলকুমার বর্মণ, সুরেশচন্দ্র বর্মণ, শ্রীমতি জ্যোৎস্না চন্দ, সুরেশচন্দ্র বিশ্বাস, রণেন্দ্রমোহন দাস, নলিনীকান্ত দাস, বিনোদবিহারী দাস, বিধুভূষণ চৌধুরী, রবীন্দ্রনাথ আদিত্য, নগেন্দ্রচন্দ্র নাহা, সুবোধচন্দ্র নাহা, মোহিতকুমার দাস, রাজেন্দ্রকুমার ভট্টাচার্য, মণীন্দ্রলাল মল্লিক, নলিনীকুমার নাগ, হরিপ্রসন্ন চৌধুরী প্রমুখ।
‘The case for Cachar’ শীর্ষক স্মারকলিপির শুরুতে সাধারণ আলোচনায় বলা হল:
The Cachar States Re-organisation Committee and allied organisations made out their case for a seperate State on the ground, almost others, that the policy of Assamisation and in the pursuit of it, of discrimination by the Government of Assam against the minorities and more particularly, against the Bengalees, is highly detrimental to their political, economic, cultural and other interests, and creates that kind of estrangement of feeling and resulting conflict as act against the unity of India and its emotional integration and ultimately the stability and security of this region.২০৩
সরকারি-বেসরকারি দলিলে সমৃদ্ধ স্মারকলিপিটি ভারত সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রেরিত হওয়ার পরও কেন্দ্রীয় সরকার নড়েচড়ে বসেননি। বিষয়টি খতিয়ে দেখারও প্রয়োজন বোধ করেননি। কার্যত বিষয়টি হিমঘরেই স্থান লাভ করে।
অসমিয়া সমাজ বার বার অভিযোগ উত্থাপন করে বলেন যে তাঁরা বাঙালিদের কারণে চাকরিক্ষেত্রে বঞ্চিত হচ্ছেন। কেবল অভিযোগ বা সভা, মিছিল, প্রতিবাদ নয়—বাঙালি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সরাসরি আক্রমণও করা হয়। কিন্তু এ অভিযোগ যে সত্য নয়— তা সরকারি দলিলেই স্পষ্ট। ১৯৬০ সালে আসাম সরকার প্রকাশিত ১২৮ নম্বর ‘আসাম সিভিল লিস্ট’, থেকে এ সত্য প্রমাণিত। ১৯৫৮ সালের ১ নভেম্বর পর্যন্ত প্রকাশিত তালিকায় আসাম সরকারের দায়িত্বশীল সরকারি কর্মচারীর মোট সংখ্যা ছিল ২২৯২ জন। এই সংখ্যার মধ্যে ১,৫৮৩ জনই অসমিয়া ভাষাভাষী। অবশিষ্ট ৭০৯ জন অনসমিয়া ভাষাভাষীর মধ্যে ‘আসামের পার্বত্য জাতির লোক, আসামের ও বাইরের বাঙালী এবং মাদ্রাজী, পাঞ্জাবী প্রভৃতি ভারতের অন্যান্য প্রদেশের লোক রয়েছেন।’২০৪
‘অসম সাহিত্য সভা’র ২৭তম বার্ষিক অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় ১৭ থেকে ২০ এপ্রিল নওগাঁয়। ১৯৫৯ সালের ২০ এপ্রিল অনুষ্ঠানের সমাপ্তি দিনে সাহিত্যসভা অতিসত্বর অসমিয়া ভাষাকে রাজ্যের সরকারি ভাষা হিসাবে ঘোষণার দাবি জানায়। কেবল ঘোষণা নয়—১৯৬০ সালের মধ্যেই যে দাবি বাস্তবায়িত করতে হবে—সভা তাও স্পষ্ট করে দেয় আসাম রাজ্য সরকারের কাছে। এ সম্পর্কে The Assam Tribune পত্রিকায় বলা হল:
…. In a resolution adopted on the subject the Sabha expressed concern that the Assamese langauge was not yet declared as State language demands to that effect by the Assam Sahitya Sabha and the people of Assam. The resolution added that this demand was based on the fundamental rights guaranteed by the constitution of India. The Sabha urged the State Government to implement the resolution and also asked the members of the Assam Assembly to adopt a resolution to this effect and to see that Assamese is declared as state language within 1960.২০৫
সাহিত্যসভার অপর এক সিদ্ধান্তে এদিন বলা হল:
…. the Union Government had not yet introduced Assamese in the schools of N.E.F.A. as desired by the tribal people of the region themselves and demanded for immediate introduced for immediate introduction of Assamese there.২০৬ সিদ্ধান্তে আরও বলা হয়, … Assamese should be taught compulsorily in non-Assamese schools of Assam.২০৭
এরপর আসাম গভর্নরের উপদেষ্টা এন. কে. রুস্তমজী ১৯৫৯ সালের ৮ সেপ্টেম্বর ঘোষণা করেন:
…. it has been finally decided to introduce Assamese as the medium of instructions in all schools in the Agency with effect from the next school session. The Adviser said that necessary details to give effect to this decision were being worked out and the machinery for execution of the few policy was being set up ….. The Adviser said that henceforward all teachers for these schools would be recruited from Assam.২০৮
আসাম গভর্নর উপদেষ্টা রুস্তমজীর এই ঘোষণায় স্বভাবতই খুশি সাহিত্যসভার সদস্যবৃন্দ। গৌহাটিতে অসম সাহিত্যসভা সপ্তাহ পালনকালে সংস্থার সভাপতি অতুলচন্দ্র হাজারিকা ৯ সেপ্টেম্বরের সভায় উপদেষ্টার ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়ে বলেন: ‘sounded a note of caution that until the decision was implement, the people should be on guard against reactionary forces.’২০৯
পরবর্তীতে আমরা প্রত্যক্ষ করব জনমতের কোনো তোয়াক্কা না করেই ১৯৬০ সালেই অসমিয়া ভাষা আসাম রাজ্যের সরকারি ভাষার মর্যাদা লাভ করে এককভাবে। পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মধ্যে অসমিয়া ভাষার প্রচলনেও সরকারের ত্বরিৎ ব্যবস্থা গ্রহণ সকল মানুষের নজর কেড়েছে। ‘অসম সাহিত্যসভা’ কি তাহলে অদৃশ্য কোনো বিশেষ শক্তির অধিকারী—যাদের নির্দেশ মানতে সরকার বাধ্য?
১৯৬০ সালের ১১ ও ১২ জুন দু-দিন ব্যাপী দক্ষিণ-পূর্ব আঞ্চলিক অর্থনৈতিক কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয় শিলচরের সংস্কৃতি ভবনে। এই কনভেনশনে কাছাড়, মণিপুর, ত্রিপুরা, মিজো এবং উত্তর কাছাড় নিয়ে একটি সুসংবদ্ধ অঞ্চল গঠন করে ওই অঞ্চলের আর্থিক উন্নয়নের লক্ষ্যে এক ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ এবং তা বাস্তবায়নে একটি সংস্থা গঠন করা যা অত্র অঞ্চলের মানুষ ভারত সরকারের কাছে দাবি জানাবার অভিপ্রায়েই এই কনভেনশন। কাছাড় কংগ্রেস কো-অর্ডিনেশন কমিটি এই সম্মেলন আহ্বান করে। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে বিমান চলাচল না করায় মণিপুর, ত্রিপুরা এবং মিজো প্রতিনিধি সভায় উপস্থিত থাকতে পারেননি। তবে উত্তর কাছাড় থেকে জয়ভদ্র হাগজের এম পি, সোনারাম থাউঙসেন এবং অপর দু-জন প্রতিনিধি যোগদান করেন। সভায় সভাপতিত্ব করেন জয়ভদ্র হাগজের। কাছাড়ের তিনজন এম পি ছাড়াও শিলচর, করিমগঞ্জ এবং হাইলাকান্দি থেকে প্রতিনিধি স্থানীয় নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
১১ জুন শনিবার অপরাহ্ন দু-টোর সময় কনভেনশন উদবোধন করেন শীলভদ্র যাজী এম পি। নিবারণচন্দ্র লস্কর এম পি সভাপতি হিসাবে শীলভদ্র যাজীর নাম প্রস্তাব করেন এবং প্রস্তাব সমর্থন করেন প্রাক্তন মন্ত্রী বৈদ্যনাথ মুখার্জী। সভাপতির আসন গ্রহণের পর ‘ও আমার দেশের মাটি, তোমার পরে ঠেকাই মাথা’—রবীন্দ্রসংগীতের মধ্য দিয়ে সভার কাজ শুরু হয়। উদবোধনী বক্তৃতায় নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর সহকর্মী শীলভদ্র যাজী বলেন: ….অনুন্নত অঞ্চলগুলির উপর বিশেষ দৃষ্টি দিয়া সত্ত্বর ঐ অঞ্চলগুলিকেও উন্নত করিয়া তোলা আবশ্যক হইয়া পড়িয়াছে। সমগ্র দেশের কল্যাণের জন্যই সকল অনুন্নত অঞ্চলকে উন্নত করিয়া তুলিতে হইবে। কাছাড়, উত্তর কাছাড়, মিজো, মণিপুর ও ত্রিপুরার অধিবাসীগণ ইহাই অনুভব করিতেছেন যে, দুইটি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার কার্য্যকাল শেষ হইয়া যাওয়া সত্ত্বেও এই অঞ্চলের কোন উন্নতি বিধানই সম্ভব হয় নাই।২১০
কনভেনশনের আহ্বায়ক নন্দকিশোর সিংহ তাঁর ভাষণে বলেন: ‘…কাছাড়ের জনপ্রতিনিধিগণ দীর্ঘদিন যাবতই অনুভব করছিলেন যে, এই জেলার অবস্থা ক্রমেই অবনতির দিকে যাচ্ছে। ভারতবর্ষের অন্যান্য অংশ অপেক্ষা আসাম অনগ্রসর—আবার এই অনগ্রসর আসামের মধ্যে কাছাড় সর্বাপেক্ষা বেশী উপেক্ষিত।’২১১ সনৎকুমার দাসও এই উদ্যোগের প্রয়োজনীয়তার উল্লেখ করে বক্তব্য রাখেন।
সভাপতি জয়ভদ্র হাগজের বলেন: ‘এই কনভেনশনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে কোনো কোনো মহলে বিরূপ মনোভাব থাকতে পারে। সকল প্রকার বিরোধিতার সম্মুখীন হওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। এদিন সন্ধ্যায় সমাগত প্রতিনিধিবর্গের সম্বর্দ্ধনার জন্য, সংস্কৃতি ভবনে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।’২১২
১২ জুন অপরাহ্নে শুরু হয় দ্বিতীয় দিনের অধিবেশন। এদিন কনভেনশনে উপস্থাপনের জন্য প্রতিনিধিগণ দুটি প্রস্তাবের খসড়া প্রস্তুত করেন। ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে’— রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই সংগীত দিয়ে বেলা দু-টোয় কনভেনশনের প্রকাশ্য অধিবেশন শুরু হয়। আমন্ত্রিতদের যাঁরা কনভেনশনে উপস্থিত হতে পারেননি— তাঁরা দুঃখ প্রকাশ করে যেসব চিঠি, টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিলেন—সেসব চিঠি, টেলিগ্রাম সভায় পাঠ করে শোনান কনভেনশনের আহ্বায়ক নন্দকিশোর সিংহ।
নন্দকিশোর সিংহ তাঁর লিখিত ভাষণে জানান: ‘…. কাছাড়, উত্তর কাছাড়, মিজো, মণিপুর এবং ত্রিপুরায় প্রচুর শিল্প সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও এ পর্য্যন্ত এই অঞ্চলে কোনই কাজ হয়নি। এই অঞ্চলের জন্য একটি পৃথক অর্থনৈতিক ইউনিট গঠন সম্পর্কে ১৯৫৮ ইংরেজিতে শিলচরে অনুষ্ঠিত আসাম প্রাদেশিক কংগ্রেসের সভায় যে প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল—তার অনুসরণেই বর্তমান কনভেনশন আহ্বান করা হয়েছে।’২১৩
দ্বারিকানাথ তেওয়ারী এম পি তাঁর ভাষণে বলেন: ‘… আসামের সংহতি নষ্ট করা এই কনভেনশনের উদ্দেশ্য নহে। আমাদের বাঁচিয়া থাকার তাগিদেই আমরা এই কনভেনশনের মাধ্যমে জনমত সংগঠিত করিতেছি। দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্ত অঞ্চল (South-East Frontier Area) ‘SEFA’ নাম দিয়া একটি পৃথক ইউনিট গঠন করিয়া ব্যাপক তদন্তের পর পরিকল্পনা প্রস্তুতক্রমে সেই পরিকল্পনাকে কার্যে পরিণত করিবার জন্য একটি সংস্থা গঠন করিতে হইবে— প্রস্তাবে কেন্দ্রীয় গবর্নমেন্টের নিকট এই দাবী উপস্থিত করা হইয়াছে। সংবিধানের ৩৭১ নম্বর আর্টিকেলে এরূপ সংস্থা গঠনের ব্যবস্থা রহিয়াছে। … এই অঞ্চলের দশজন এম.পি. একযোগে কেন্দ্রীয় গবর্নমেন্টের নিকট এই দাবী উপস্থিত করিবেন। কিন্তু এই দাবীর পশ্চাতে জনমত থাকা আবশ্যক। …. প্রস্তাবের সমর্থনে সুরেশচন্দ্র দেব বক্তব্য রেখে বলেন, ‘দেশ বিভাগের ফলেই এই অঞ্চলের দুর্দশা ঘটিয়াছে। দেশ বিভাগের জন্য কেন্দ্রীয় গবর্নমেন্টই দায়ী।’২১৪
নিবরণচন্দ্র লস্কর এম পি সভায় বলেন, ‘কেহ কেহ সন্দেহ করিতেছেন যে, এই কনভেনশনের দ্বারা ‘পূর্বাচল আন্দোলনই’ আবার মাথা চাড়া দিয়া উঠিতেছে। এরূপ সন্দেহ অমূলক।’ … মূল প্রস্তাবটি সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়।
গৌরীশঙ্কর রায় এম. এল. এ একটি কমিটি গঠন করে কনভেনশনে গৃহীত প্রস্তাবকে কার্যে পরিণত করার ব্যবস্থাকরণে একটি প্রস্তাব উপস্থিত করলে সেটিও অনুমোদিত হয়।
জয়ভদ্র হাগজের এম পি সভাপতির ভাষণে বলেন: ‘…ভিতর এবং বাহির দুইদিক হইতে এই কার্য্যে বাধা উপস্থিত করা হইবে। সকলে কায়মনোবাক্যে চেষ্টা করিলে সহজেই এই সকল বাধা অতিক্রম করিয়া সাফল্যলাভ করা যাইবে।’২১৫ সতীন্দ্রমোহন দেব সকলকে ধন্যবাদ জানান। জাতীয় সংগীতের পর সভার কাজ শেষ হয়।
‘দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্ত অঞ্চলে’র অর্থনৈতিক উন্নয়নে ঐ অঞ্চলের মানুষ যে পদক্ষেপ নিয়েছিলেন—তা সরকারের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে ভেস্তে যায়। ফলে, বাঙালি জনগোষ্ঠী ছাড়া পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মানুষও যে তিমিরে ছিলেন— সেই তিমিরেই থেকে গেলেন।
ছয়ের দশকের গোড়া থেকে অসমিয়া সমাজ তাঁদের ভাষাকে সামনে রেখে ত্রিমুখী পরিকল্পনা গ্রহণ করে এবং তা বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। প্রথমত আসামের বিশেষ কয়েকটি সংবাদপত্রে ধারাবাহিকভাবে একের পর এক চিঠি ছাপা হয়—যার মূল কথা অসমিয়া ভাষাকে রাজ্যের সরকারী ভাষা করতে হবে; দ্বিতীয়ত ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে সমগ্র ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা জুড়ে ভাষার দাবিতে অসমিয়া ছাত্র-জনতাকে পথে নামানো হয়। এবং তৃতীয়ত চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছুতে আসামের বাঙালিদের ওপর বিশেষত বাঙালি হিন্দু সমাজের ওপর ব্যাপক আক্রমণ নেমে আসে। এই ত্রিমুখী আক্রমণের মূল লক্ষ্যই ছিলো বাঙালিদের আসাম থেকে বিতাড়ন।
এ সময় ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা জুড়ে যেসব সভা আয়োজিত হয়—তার কয়েকটির বিবরণ তুলে ধরা যেতে পারে। সভা আহূত হল জোরহাট এবং ডিব্রুগড়ে। সংবাদপত্রে বলা হল:
…The anti Assamese campaign by a section of refugees at Shillong was condemned and the demand for declaration of Assamese as the State language was renewed at big student rallies held at Jorhat and Dibrugarh. Over ten thousand students including girls paraded the main thoroughfares of Jorhat shouting slogans condeming anti-Assamese campaign at Shillong.২১৬
ডিব্রুগড়ের সভা সম্পর্কে বলা হল: A mile-long procession of students including girls paraded the main roads of Dibrugarh on June 4, shouting slogans in demand of Assamese as the State Language.২১৭
অপর আর-এক সংবাদে বলা হয়:
… Immediate declaration of Assamese as state language was urged at meeting held in several parts of Assam. Hartal was also observed on the State Language issue at Barbarua, Dikom, Tinsukia, Doom Dooma and some other parts of the Dibrugarh sub-division.২১৮
গৌহাটি থেকে প্রেরিত অপর সংবাদে বলা হলো:
Students were taking leading parts in the movement that flared up throughout the state of Assam against the anti-Assamese propaganda launched by a section of people in Shillong and other places of Assam. Processions were taken out, slogans raised and meetings held to condemn severely the vile propaganda. Strong demands were also made for immediate declaration of the Assamese as the state language of Assam and meetings held to condemn severely the vile propaganda. Strong demands were also made for immediate declaration of the Assamese as the stage language of Assam and opportunity sons of the soil in the Gauhati Refinery.২১৯
সভা আয়োজিত হয় শিবসাগর, লঙ্কা, বিশ্বনাথ, সুটিয়া, মঙ্গলদই, বিজনী প্রভৃতি স্থানেও।
এভাবে একের পর এক সংবাদ তুলে ধরা যায়। এসব সংবাদ পরিবেশনের মধ্য দিয়ে অসমিয়া জনমানসে বাঙালি বিরোধী মনোভাব ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। পরবর্তী অধ্যায়ে আমরা অসমিয়াদের সেই বিরূপ মনোভাবের চালচিত্র তুলে ধরতে প্রয়াসী হব।
তথ্যনির্দেশ
১. Amrita Bazar Patrika, Calcutta, July 5, 1947
২. প্রাগুক্ত
৩. Amrita Bazar Patrika, Calcutta, July 19, 1947
৪. Amrita Bazar Patrika, Calcutta, July 23, 1947
৫. দেবশ্রী দত্ত, ‘কাছাড় রিফিউজি অ্যাসোসিয়েশন ও উদ্বাস্তু পুনর্বাসন’, নাইনথ কলাম, দেশভাগ-দেশত্যাগ: প্রসঙ্গ উত্তর-পূর্ব ভারত, প্রসূন বর্মন সংকলিত ও সম্পাদিত, গুয়াহাটি ডিসেম্বর ২০১২, দ্বাদশ বর্ষ: ১০ম সংখ্যা, পৃ. ১২৪
৬. সুবীর কর, বরাক উপত্যকার ভাষা সংগ্রামের ইতিহাস, পৃ. ১৭
৭. সুজিৎ চৌধুরী, বরাক উপত্যকার সমাজ ও রাজনীতি, পৃ. ৭৬
৮. প্রাগুক্ত, পৃ. ৭৫
৯. এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত দ্রষ্টব্য—দেবশ্রী দত্ত, ‘কাছাড় রিফিউজি অ্যাসোসিয়েশন ও উদবাস্তু পুনর্বাসন’, নাইনথ কলাম, পৃ. ১২৫-১৩২
১০. বরাক উপত্যকার ভাষা সংগ্রামের ইতিহাস, পৃ. ১৭
১১. Amrita Bazar Patrika, Calcutta, August 30, 1947
১২. প্রাগুক্ত
১৩. প্রাগুক্ত
১৪. প্রাগুক্ত
১৫. Amrita Bazar Patrika, Calcutta, September 1, 1947
১৬. Amrita Bazar Patrika, Calcutta, September 11, 1947
১৭. Amrita Bazar Patrika, Calcutta, August 28, 1947
১৮. প্রাগুক্ত
১৯. Amrita Bazar Patrika, Calcutta, August 1, 1947
২০. যুগান্তর, কলকাতা, আগস্ট ১৫, ১৯৬০ (দিল্লি থেকে প্রকাশিত আর. এস. পি. দলীয় মুখপত্র মাসিক দি কল পত্রিকা থেকে অনূদিত নিবন্ধ)
২১. আসামের উপেক্ষিত, কলকাতা এপ্রিল ১৯৫৫, কাছাড় রাজ্য-পুনর্গঠন সমিতি, শিলচর, পৃ. ২-৩
২২. Amrita Bazar Patrika, Calcutta, August 27, 1947
২৩. Shillong Times, Shillong , October ১৯, ১৯৪৭, উদ্ধৃত যুগান্তর, কলকাতা, আগস্ট ১৫, ১৯৬০
২৪. যুগান্তর, আগস্ট ১৫, ১৯৬০
২৫. Amrita Bazar Patrika, Calcutta, September 23, 1947
২৬. Amrita Bazar Patrika, Calcutta, October 5, 1947
২৭. Amrita Bazar Patrika, Calcutta, November 7, 1947
২৮. Amrita Bazar Patrika, Calcutta, November 6, 1947
২৯. Appendix 1 of ‘Purbachal Reconsidered’, উদ্ধৃত Sylhet Referendum and Assam Government’s Press Note Dated Feb. 16, 1955, Our Reply, March, 1955, The Cachar States Reorganisation Committee, Silchar (Cachar), Published by Dhirendra Mohan Deb, Advocate, for Cachar states Reorganisation Committee, Silchar (Cachar), pp. 1–16, পুস্তিকা
৩০. Amrita Bazar Patrika, Calcutta, November 16, 1947
৩১. জনশক্তি (সাপ্তাহিক), শিলচর, মার্চ ২৩, ১৯৬০, নীরেন্দ্রনাথ দেব সম্পাদিত, [‘আসামের ভাষা সমস্যা সম্পর্কে বিশ্বখ্যাত ভাষাতত্ত্ববিদ ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় মহাশয় বারো বৎসর পূর্ব্বে যে অভিমত ব্যক্ত করিয়াছিলেন আমরা তাহা নিম্নে উধৃত করিয়া দিতেছি। শ্রদ্ধেয় বন্ধু জনাব হুরমত আলী বড়লস্কর সাহেব ডক্টর চট্টোপাধ্যায়ের ভাষণটির প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়া আমাদের কৃতজ্ঞতা ভাজন হইয়াছেন।’ ] দ্র. জনশক্তি, মার্চ ২৩, ১৯৬০।
৩২. The Assam Tribune, Gauhati, January 4, 1948 উদ্ধৃত Appendix I of “Purbachal Reconsidered”
৩৩. The Assam Tribune, Gauhati, January 3, 1948 উদ্ধৃত, প্রাগুক্ত
৩৪. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, জানুয়ারি ৭, ১৯৪৮
৩৫. প্রাগুক্ত
৩৬. প্রাগুক্ত
৩৭. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, মার্চ ২০, ১৯৪৮
৩৮. প্রাগুক্ত
৩৯. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, এপ্রিল ১৪, ১৯৪৮
৪০. আসামের উপেক্ষিত, পুস্তিকা, শিলচর, এপ্রিল ১৯৫৫, রাজ্য পুনর্গঠন কমিটি, পৃ.৩
৪১. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ফ্রেব্রুয়ারি ১২, ১৯৬১
৪২. আসামের উপেক্ষিত, পৃ. ৫
৪৩. Assam Gazette, Sept. 6, 1955, P. 1464, উদ্ধৃত ‘আসামের উপেক্ষিত’, পৃ. ৫
৪৪. Assam Assembly Proceeding, 1948, P. 511, উদ্ধৃত Report of Non-Official Enquiry Commission on Cachar, A. K. Das Memorial Trust, (পুস্তিকা), P. ৫ এবং আসামের উপেক্ষিত, পৃ. ৬
৪৫. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, মে ৭, ১৯৪৮
৪৬. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, মে ২৫, ১৯৪৮
৪৭. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, মে ২৫, ১৯৪৮
৪৮. প্রাগুক্ত
৪৯. প্রাগুক্ত
৫০. প্রাগুক্ত
৫১. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, মে ২১, ১৯৪৮
৫২. আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৫ মে, ১৯৪৮
৫৩. আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৮ মে, ১৯৪৮
৫৪. আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৪ মে, ১৯৪৮
৫৫. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ২৪ মে, ১৯৪৮
৫৬. প্রাগুক্ত
৫৭. Assam Assembly Proceedings 1948, P. ১৩২৩, উদ্ধৃত সুবীর কর, বরাক উপত্যকার ভাষা সংগ্রামের ইতিহাস, পৃ. ১০
৫৮. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ৩১মে, ১৯৪৮
৫৯. প্রাগুক্ত
৬০. প্রাগুক্ত
৬১. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ২৪ মে, ১৯৪৮
৬২. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ২৮মে, ১৯৪৮
৬৩. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ৩১মে, ১৯৪৮
৬৪. প্রাগুক্ত
৬৫. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ২৫মে, ১৯৪৮
৬৬. প্রাগুক্ত
৬৭. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ১ জুন, ১৯৪৮
৬৮. উদ্ধৃত সুজিৎ চৌধুরী, বরাক উপত্যকার সমাজ ও রাজনীতি, পৃ. ৫৭
৬৯. বাংলা ভাষা আন্দোলন ও যুগশক্তি (১৯৬০-৬১), রণজিৎ চৌধুরী সম্পাদিত (করিমগঞ্জ : ২০০৭, যুগশক্তি প্রকাশন) পৃ. ১৩৫। এ সময় যুগশক্তি সম্পাদক ছিলেন বিধুভূষণ চৌধুরী।
৭০. The Hindu, Madras, February 16, 1950
৭১. The Hindu, Madras, February 19, 1950
৭২. The Hindu, Madras, February 20, 1950
৭৩. The Hindu, Madras, February 19, 1950
৭৪. The Hindu, Madras, March 2, 1950
৭৫. প্রাগুক্ত
৭৬. The Hindu, Madras, March 13, 1950
৭৭. The Hindu, Madras, March 15, 1950
৭৮. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ১২ মার্চ, ১৯৫০
৭৯. প্রাগুক্ত
৮০. The Hindu, Madras, March 18, 1950
৮১. The Hindu, Madras, February 25, 1950
৮২. The Hindu, Madras, February 24, 1950
৮৩. The Hindu, Madras, March 10, 1950
৮৪. The Hindu, Madras, March 16, 1950
৮৫. সুজিৎ চৌধুরী, বরাক উপত্যকার স্বাধীনতা-উত্তর রাজনীতি, বরাক উপত্যকার সমাজ ও রাজনীতি, পৃ. ৭১
৮৬. Organiser (Weekly), ‘M’ সম্পাদিত, Delhi, July 10, 1961
৮৭. Blitz, New Delhi, July 8, 1961
৮৮. Organiser, July 10, 1961
৮৯. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ২ জুলাই, ১৯৬১
৯০. The Hindu, Madras, March 31, 1950
৯১. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ২৫ মার্চ, ১৯৫০
৯২. The Hindu, Madras, March 6, 1950
৯৩. The Hindu, Madras, March 9, 1950
৯৪. The Hindu, Madras, March 15, 1950
৯৫. The Hindu, Madras, March 17, 1950
৯৬. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ২৫ মার্চ, ১৯৫০
৯৭. আসামের উপেক্ষিত, পৃ. ৪-৫
৯৮. প্রাগুক্ত
৯৯. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ৩ এপ্রিল, ১৯৬১
১০০. Report of non-official Enquiry Commission on Cachar [Police Firing of May 19, 1961], A. K. Das Memorial Trust প্রকাশিত। পুস্তিকায় প্রকাশ- কালের উল্লেখ নেই। পৃ. ৮
১০১. এস. আর. সি. রিপোট, অনুচ্ছেদ ৭৮৩, পৃ. ২১২, উদ্ধৃত যুগান্তর, কলকাতা, ১৫ আগস্ট, ১৯৬০
১০২. Census of India 1951, Vide vol. XII, Part –I-A, pp. 413–414, উদ্ধৃত দিলীপকান্তি লস্কর সম্পাদিত, উনিশে মে’র ইতিহাস, (করিমগঞ্জ : ২০০২, লালন মঞ্চ প্রকাশনী) পৃ. লালন মঞ্চ-ভাষা সংগ্রামের নথি ১-৩
১০৩. সুবীর কর, বরাক উপত্যকার ভাষা সংগ্রামের ইতিহাস, পৃ. ১২-১৩
১০৪. Amrita Bazar Patrika, Calcutta, May 29, 1954
১০৫. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ২৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২
১০৬. Amrita Bazar Patrika, Calcutta, February 26, 1952
১০৭. সুবীর কর, বরাক উপত্যকার ভাষা সংগ্রামের ইতিহাস, পৃ. ১৭-১৮
১০৮. কামালুদ্দীন আহমদ, আসামের বাংলা ভাষা সংগ্রাম : একটি ইতিহাস ভিত্তিক পর্যালোচনা পৃ. ৩৭
১০৯. আসামের উপেক্ষিত, পৃ. ৭-৯
১১০. Report of non-official Enquiry Commission on Cachar, p. 9
১১১. সুবীর কর, বরাক উপত্যকার ভাষা সংগ্রামের ইতিহাস, পৃ. ১৮
১১২. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ২৫মে, ১৯৫৪
১১৩. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ২৪ জুন, ১৯৫৪
১১৪. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ২২ জুন, ১৯৫৪
১১৫. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ২৪ জুন, ১৯৫৪
১১৬. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ২১ জুন, ১৯৫৪
১১৭. প্রাগুক্ত
১১৮. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ২২ জুন, ১৯৫৪
১১৯. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ২১ জুন, ১৯৫৪
১২০. আনন্দবাজার পত্রিকা, ২২ জুন, ১৯৫৪
১২১. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ২৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৫
১২২. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ১৪ মার্চ, ১৯৫৫
১২৩. জন্মজিৎ রায়, বাংলা-অসমিয়া ভাষা বিবাদ এবং তৎকালীন কাছাড় জেলায় বাংলা ভাষা আন্দোলন : ঐতিহাসিক পটভূমির সন্ধানে, উদ্ধৃত উনিশে মে’র ইতিহাস, দিলীপকান্তি লস্কর সম্পাদিত, (করিমগঞ্জ : ২০০২, লালন মঞ্চ), পৃ. ১৭৮
১২৪. প্রাগুক্ত, পৃ. ১৭৯
১২৫. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ১৬ মার্চ, ১৯৫৫
১২৬. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ২১ মার্চ, ১৯৫৫
১২৭. প্রাগুক্ত
১২৮. প্রাগুক্ত
১২৯. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ২ এপ্রিল, ১৯৫৫
১৩০. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ৪ এপ্রিল, ১৯৫৫
১৩১. প্রাগুক্ত
১৩২. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ৫ এপ্রিল, ১৯৫৫
১৩৩. প্রাগুক্ত
১৩৪. প্রাগুক্ত
১৩৫. প্রাগুক্ত
১৩৬. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ৬ এপ্রিল, ১৯৫৫
১৩৭. প্রাগুক্ত
১৩৮. প্রাগুক্ত
১৩৯. প্রাগুক্ত
১৪০. প্রাগুক্ত
১৪১. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ৭ এপ্রিল, ১৯৫৫
১৪২. প্রাগুক্ত
১৪৩. প্রাগুক্ত
১৪৪. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ৮ এপ্রিল, ১৯৫৫
১৪৫. প্রাগুক্ত
১৪৬. প্রাগুক্ত
১৪৭. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ৯ এপ্রিল, ১৯৫৫
১৪৮. প্রাগুক্ত
১৪৯. প্রাগুক্ত
১৫০. প্রাগুক্ত
১৫১. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ৯ এপ্রিল, ১৯৫৫
১৫২. প্রাগুক্ত
১৫৩. প্রাগুক্ত
১৫৪. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ১০ এপ্রিল, ১৯৫৫
১৫৫. প্রাগুক্ত (প্রতিবেদক একটি সংস্থার পক্ষ থেকে অনুরুদ্ধ হয়ে বাঙালিদের প্রকৃত অবস্থা প্রত্যক্ষ করার জন্য ১৫ দিন আসাম সফর করেন)।
১৫৬. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ১১ এপ্রিল, ১৯৫৫
১৫৭. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ১২ এপ্রিল, ১৯৫৫
১৫৮. প্রাগুক্ত
১৫৯. প্রাগুক্ত
১৬০. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ১৩ এপ্রিল, ১৯৫৫
১৬১. প্রাগুক্ত
১৬২. প্রাগুক্ত
১৬৩. প্রাগুক্ত
১৬৪. প্রাগুক্ত
১৬৫. প্রাগুক্ত
১৬৬. প্রাগুক্ত
১৬৭. প্রাগুক্ত
১৬৮. প্রাগুক্ত
১৬৯. প্রাগুক্ত
১৭০. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ১৪ এপ্রিল, ১৯৫৫
১৭১. প্রাগুক্ত
১৭২. প্রাগুক্ত
১৭৩. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ১৫ এপ্রিল, ১৯৫৫
১৭৪. প্রাগুক্ত
১৭৫. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ১৮ এপ্রিল, ১৯৫৫
১৭৬. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ১৯ এপ্রিল, ১৯৫৫
১৭৭. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ২০ এপ্রিল, ১৯৫৫
১৭৮. প্রাগুক্ত
১৭৯. প্রাগুক্ত
১৮০. The Assam Tribune, Gauhati, April 23, 1955
১৮১. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ২৩ এপ্রিল, ১৯৫৫
১৮২. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ৬মে, ১৯৫৫
১৮৩. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ৪ মে, ১৯৫৫
১৮৪. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ৫ মে, ১৯৫৫
১৮৫. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ৫ মে, ১৯৫৫
১৮৬. প্রাগুক্ত
১৮৭. Census of India 1951, উদ্ধৃত উনিশে মে’র ইতিহাস দিলীপকান্তি লস্কর সম্পাদিত, পৃ. নথি ১
১৮৮. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ৫ মে, ১৯৫৫
১৮৯. প্রাগুক্ত
১৯০. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ১৪ মে, ১৯৫৫
১৯১. প্রাগুক্ত
১৯২. প্রাগুক্ত
১৯৩. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ১৫ মে, ১৯৫৫
১৯৪. আসামের উপেক্ষিত, পৃ. ১৩
১৯৫. প্রাগুক্ত
১৯৬. আসামের উপেক্ষিত, শিলচর : ১৯৫৫, কাছাড় রাজ্য পুনর্গঠন সমিতি, পৃ. ১৪
১৯৭. সুজিৎ চৌধুরী, বরাক উপত্যকার সমাজ ও রাজনীতি, পৃ. ৯১
১৯৮. আসামের উপেক্ষিত, পৃ. ১৪
১৯৯. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ১৬ মে, ১৯৫৫
২০০. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ১৭ মে, ১৯৫৫
২০১. প্রাগুক্ত
২০২. প্রাগুক্ত
২০৩. Silchar 1955, The Case for Cachar by the Cachar States Re-Organisation Committee and allied organisations (a memorandum), published by the Secretary Cachar States Re-organisation Committee, Silchar, Cachar, p. 1
২০৪. জনশক্তি (সাপ্তাহিক), শিলচর, ৩১ আগস্ট ১৯৬০। জনশক্তি পত্রিকায় ১৯৫৮ সালের ১ নভেম্বর পর্যন্ত সরকারের ‘আসাম সিভিল লিস্ট’-এর একটি পূর্ণ তালিকা পদভিত্তিক মুদ্রিত হয়েছে। এই তালিকায় প্রতিটি পদের মোট সংখ্যা এবং ওই পদে অসমিয়া ভাষাভাষীর সংখ্যা উল্লিখিত আছে। তথ্য অনুযায়ী ওই সময়ে অসমিয়া ভাষাভাষীর সংখ্যা শতকরা ৪০ ভাগের বেশি নয়—অথচ সরকারি ক্ষেত্রে তাঁরা একক ভাবে ৭০ ভাগ পদ দখলে রেখেছেন। এরপরও কি বলা যাবে অসমিয়া সমাজ সরকারি চাকরি ক্ষেত্রে বঞ্চিত হচ্ছেন?
২০৫. The Assam Tribune, Gauhati, April 21, 1959
২০৬. প্রাগুক্ত
২০৭. প্রাগুক্ত
২০৮. The Assam Tribune, Gauhati, September 9, 1959
২০৯. The Assam Tribune, Gauhati, September 10, 1959
২১০. জনশক্তি (সাপ্তাহিক), নীরেন্দ্রনাথ দেব সম্পাদিত, শিলচর, ১৫ জুন, ১৯৬০
২১১. প্রাগুক্ত
২১২. প্রাগুক্ত
২১৩. প্রাগুক্ত
২১৪. প্রাগুক্ত
২১৫. প্রাগুক্ত
২১৬. The Assam Tribune, Gauhati, June 13, 1960
২১৭. প্রাগুক্ত
২১৮. The Assam Tribune, Gauhati, June 22, 1960
২১৯. The Assam Tribune, Gauhati, June 23, 1960