কলকাতায় এবার খুব বৃষ্টি হচ্ছে। ভীষণ বৃষ্টি। দুপুর বা বিকেলের দিকে প্রায়দিনই ঝমাঝম বৃষ্টি এসে পথঘাট ডোবাচ্ছে। ট্রাফিক জ্যাম। বৃষ্টির জ্বালাতেই ক’দিন প্রীতমের কাছে যাওয়া হয়নি দীপনাথের। অবশ্য অফিসের কাজও বেড়েছে। প্রায় দিনই কাজ শেষ করতে সন্ধে সাতটা-আটটা বেজে যায়। নতুন অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারদের মধ্যে একজন মাত্র কাজে যোগ দিয়েছে। বাকিরা আরও দিন পনেরো পরে আসছে। সুতরাং দীপনাথকে একাই তিনগুণ খাটতে হচ্ছে।
সপ্তাহখানেকের মাথায় দুপুরে বিলুর টেলিফোন এল।
সেজদা! আমি ভেবেছিলাম তুমি বুঝি টুরে বাইরে গেছ। বহুদিন খবর নিচ্ছ না।
না রে। নতুন পোস্টে কাজের প্রেশার ভীষণ। রোজ বিকেলের দিকে বৃষ্টিও নামছে এখন। প্রীতম কেমন?
খোঁজও তো নাওনি। আমার অফিস তোমার অফিস থেকে মোটে দু’কদম।
বিলু ঠিক এভাবে অভিমানের গলায় কখনও কথা বলে না। বরাবরই ও একটু কাঠ কাঠ। তাই সামান্য অবাক হচ্ছে দীপনাথ। সে বলল, রোজই যাব-যাব করছি বলে আর খোঁজ নেওয়া হয়নি। তোরা সবাই ভাল আছিস তো? প্রীতম কেমন আছে আগে বল।
মাঝখানে একটু ক্রাইসিস গেছে। একদিন অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল।
বলিস কী?
সিরিয়াস কিছু নয়, তুমি তো খবর রাখো না, এর মধ্যে অনেক ঘটনা ঘটে গেছে।
কী ঘটনা?–উদ্বেগের গলায় দীপনাথ বলে।
এসো বলব। আজ আসবে?
ঘড়ি দেখে দীপনাথ বলে, মোটে পাচটা বাজে। যেতে দেরি হবে।
হোক, তবু এসো। আজ আমাদের ওখানেই রাতে থেকো। অনেক কথা আছে।
থাকব?—বলে একটু দ্বিধা করে দীপনাথ। দ্বিধার কিছু নেই, বোনের বাড়িতে লোকে থাকতেই পারে। তবু ওই হল দীপনাথের স্বভাব।
তুমি বোধহয় জানো না, শতম এসেছে।
তাই বুঝি! কবে এল?
দিন আট-দশ। প্রীতমকে শিলিগুড়ি নিয়ে যাচ্ছে।
শিলিগুড়ি!—খুব অবাক হয়ে দীপনাথ বলে, সে কী রে! প্রীতম যে শিলিগুড়ি যাবে না বলেছিল আমাকে।
মত পালটেছে।
যাচ্ছে তা হলে?
গলাটা হঠাৎ একটু ভেঙে গেল বিলুর! বলল, যাচ্ছে। তুমি আজ এসো কিন্তু। ভীষণ দরকার।
তুই প্রীতমকে যেতে দিতে রাজি হয়েছিস?
আনাব মতামতে কিছু যায় আসে না।
কবে যাচ্ছে?
পরশু। রিজার্ভেশন হয়ে গেছে। বাঁধাছাঁদা চলছে।
তুই সঙ্গে যাবি না?
আমাকে তো যেতে বলেনি। বললে হয়তো কিছুদিনের জন্য যেতাম।
টেলিফোনে আর কিছু বলল না দীপনাথ। যদিও একটা রাগের হলকা তার মগজটাকে চেটে নিচ্ছিল। কিন্তু রাত্রে প্রীতমের বাড়ি গিয়ে বাইরের ঘরে বিলুকে ধরল দীপনাথ।
বিলু, প্রীতমের চেয়ে কি চাকরিটা বেশি ইম্পর্ট্যান্ট? তুই ওর সঙ্গে যাচ্ছিস না কেন?
বললাম তো, ওরা আমাকে যেতে বলেনি।
এটা কি প্রোটোকলের সময় যে, না বললে যাবি না?
ওরা যদি আমাকে না চায়, তবে কেন যাব?
তবু যাবি। হয়তো তুই যেতে চাস না ভেবে ওরা বলছে না। ওদেরও প্রেস্টিজ আছে।
বিলু মুখ নিচু করে শক্ত হয়ে রইল। ভীষণ গোঁ।
ছুটি পাবি না?—দীপনাথ কোমল গলায় জিজ্ঞেস করে।
হয়তো পাব, তবে বেশিদিন নয়।
তবে চাকরিটা ছেড়ে দে না কেন?
আজকাল একবার চাকরি ছাড়লে আর কি সহজে পাওয়া যায়?
চাকরিটাকে অত ইম্পর্ট্যান্স দিচ্ছিস কেন?
বিলু ধীরে ধীরে মুখ তুলল। বেশ কঠিন মুখ। ধীর শান্ত গলায় বলল, চাকরিটা এখন আমাদের কাছে খুব জরুরি।
প্রীতমের চেয়েও?
একটা শ্বাস ফেলে বিলু বলল, প্রীতম তো বাঁচবে না, সেজদা। তারপর আমার আর লাবুর কী হবে? কে দেখবে আমাদের? অনেক ভেবেচিন্তে তাই চাকরিটাকে ধরে রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ বলে ঠিক করেছি।
কথাটা নির্ভেজাল ভাবাবেগহীন সত্য। তবে বড্ড বেশি নির্লজ্জ অকপট। দীপনাথ এ ধরনের নগ্ন সত্যকে পছন্দ করে না। বিরক্ত হল, অস্থির বোধ করল, কিন্তু সঠিক কোনও জবাবও এল না মুখে।
শতম বেরিয়েছে, প্রীতম অঘোরে ঘুমোচ্ছে। তাই দীপনাথ বাইরের ঘরেই বসে রইল অনেকক্ষণ। বিলু গিয়ে নিজে চা করে আনল, একটা ধোয়া পাজামা এনে রাখল পাশে। দীপনাথ আনমনে খানিকক্ষণ আকাশ-পাতাল ভাবল।
হঠাৎ বলল, তুই তা হলে এই ফ্ল্যাটে একাই থাকবি?
আমি আছি, লাবু আছে, অচলা আর বিন্দুও থাকছে। ঠিক একা তো নয়।
তবু একে একাই বলে। পুরুষ অভিভাবক তো থাকছে না।
খুব ভাল হত যদি তুমি এসে থাকতে। তিনটে ঘর আছে, তোমার কোনও অসুবিধা হত না।
দীপনাথ মাথা নেড়ে বলল, সেটা সম্ভব নয়। এ বাড়িতে প্রীতম নেই, এটা আমার সহ্য করা মুশকিল।
তুমি বড্ড সেন্টিমেন্টাল সেজদা। প্রীতমকে আমি কারও চেয়ে কম ভালবাসি না, কিন্তু রিয়্যালিটিকে তো মেনে নিতেই হবে। প্রীতম চলে গেলে এ বাসায় আমিও তত থাকব।
দীপনাথ জবাব দিল না। বিলুও আর দ্বিতীয়বার তাকে এ বাসায় থাকার কথা বলল না।
দীপনাথ জিজ্ঞেস করে, প্রীতম কেন অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল বললি না?
ভ্রু কুঁচকে বিলু বলে, কী করে বলব? তবে সেদিন অফিস থেকে ফিরে এসে ওকে খুব ইমোশনাল দেখেছিলাম। এমন সব কথা বলছিল যার কোনও মানে হয় না।
কীরকম কথা?
বলছিল, ও শিগগিরই মরে যাবে। তারপর আমি যেন বিয়ে করি। এইসব কথা।
এরকম কথা তো সহজে বলে না প্রীতম। সেদিন কেন বলল?
তা তো জানি না।—বলে বিলু চোখ সরিয়ে নিল।
ও কখনও মরার কথা ভাবে না। অসম্ভব বেঁচে থাকার ইচ্ছে ওর। তবে কেন ওরকম কথা বলব? তোকে আবার বিয়ে করতে বলবে এমন ছেলেমানুষও তো প্রীতম নয়।
বলল তো।
প্রীতমের ওপর একটু রাগ হয় দীপনাথের। বলে, তা পাত্রটাও প্রীতমই ঠিক করে দিয়ে যেত না হয়।
বিলু খুবই অস্বস্তি বোধ করছে। আঁচলটা গায়ে টান টান করে জড়িয়ে শাড়ির খুটটা আঙুলে জড়াচ্ছে। মুখ তুলছে না, কিন্তু ওর ছটফটানি স্পষ্ট বোঝা যায়। দীপনাথ খর চোখে বোনকে। দেখছিল। একটা আবছা সন্দেহ খেলে যায় মনে।
বিলু কিছু বলল না। খানিক অপেক্ষা করে দীপনাথ বলল, প্রীতমকে আজ একটু বকব। এসব কথা কেন বলবে ও?
মৃদু দৃঢ়স্বরে বিলু বলে, না। কিছু বলার দরকার নেই। হয়তো ভুল বুঝবে। ভাববে, আমি তোমার কাছে নালিশ করেছি।
নালিশ তো করাই উচিত।
ওর এখন ন্যায়-অন্যায় বোধ নেই। অন্যরকম হয়ে গেছে। কিছু বললে হয়তো খেপে উঠবে।
প্রীতম খেপে উঠবে! কথাটা বিশ্বাসই করা যায় না। প্রীতমের কোনওদিন রাগ দেখাই যায়নি। সেই ছেলেবেলায় শিলিগুড়ির হাকিমপাড়ার রাস্তায় দীপনাথের হাতে মার খেয়ে ছেলেমানুষের মতো অসহায় আক্রোশে চেঁচিয়েছিল প্রীতম। বড় হয়ে সে হয়ে উঠেছে শান্ত, নির্বিরোধী এবং প্রায় ব্যক্তিত্বহীন এক মানুষ। স্ত্রৈণ? না, ঠিক স্ত্রৈণও বলা যায় না প্রীতমকে। কোনওদিন ঝগড়া করেনি বিলুর সঙ্গে, মতে মত দিয়ে চলেছে, তবু আলাদা একটা সত্তাও বেঁচে ছিল তার মধ্যে। বিলু প্রীতমকে হয়তো কোনওদিনই ঠিকমতো বোঝেনি।
অচলা এসে খবর দিল, প্রীতম জেগেছে।
নিঃশব্দে দীপনাথ গিয়ে প্রীতমের পাশটিতে বসে। ওর রোগা দুর্বল হাতখানা নিজের হাতে তুলে নেয়।
প্রীতমের মুখে আজ হাসি ফুটল অনেক দেরিতে। মৃদু স্বরে বলল, ক’বছর পরে এলে?
বছর! দূর পাগলা। অফিসে দিন সাতেক খুব ভুতুড়ে খাটুনি চলছে।
জানি তুমি কাজের লোক।
অপদার্থ বলেই তো খাটতে হয় বেশি। তোর মতো কোয়ালিফিকেশন থাকলে খাটতে হত না।
কোয়ালিফিকেশন কোন কাজে লাগল, সেজদা?
লাগবে। সেরে ওঠ, দেখবি।
তুমি কি ছেলেমানুষ হয়ে গেলে, সেজদা! সেরে ওঠ বললেই কি সেরে উঠব?
তোর কী হয়েছে বল তো? আগে তো সবসময়ে বলতিস ভাল আছি।
আজকাল আমি ভাল নেই।
কেন ভাল থাকিস না? কেন মেজাজ খারাপ করিস?
বেঁচে থেকে কী হবে? কিসের ওপর দাঁড়িয়ে বাঁচে মানুষ? কোন আশায় রোজগার করে কোন পিপাসায় সারাদিন ভূতের মতো খেটে বিকেলে বাড়ি ফিরে আসে?
কী সব যা-তা বলছিস?
পায়ের নীচে মাটি সরে গেলে মানুষ আর বেঁচে থাকবে কেন?
অনেক রোগা, দুর্বল, নির্জীব দেখাচ্ছে প্রীতমকে। কণ্ঠস্বর তত স্পষ্ট নয়। তবু তার ভিতর থেকে একটা ঝাঝ আসছে।
দীপনাথ মৃদু স্বরে বলল, চুপ কর। দুনিয়ার সবকিছু নিয়ে মাথা ঘামাতে নেই।
তার মানে?
তুই বা বলতে চাইছিস তা আমি জানি।
সামান্য অবাক হয়ে প্রীতম বলে, জানো? কী জানো বলো তো?
দীপনাথ মাথা নেড়ে বলে, এ ঠিক জানা নয়। আন্দাজ। তবে আন্দাজটা হয়তো মিথ্যে নয়। বলব? শুনে তোর কী লাভ, প্রীতম? বরং জেনে রাখ, তুই যেমন জানিস, আমিও তেমন জানি।
দীপনাথের হাতটা কাকের পায়ের সরু দাঁড়ার মতো আঙুলে চেপে ধরার চেষ্টা করে প্রীতম এই প্রথম মন খুলে হাসল। গভীর একটা শ্বাস ফেলে বলল, জানো! তুমি জানো! কী করে জানলে? নিজের চোখে কিছু দেখেছ?
দূর বোকা! আমি কি গোয়েন্দাগিরি করে বেড়াই? তুই যেভাবে জেনেছিস আমিও ঠিক সেইভাবে… আন্দাজ, অনুমান।
প্রীতম গভীর দৃষ্টিতে দীপনাথের দিকে চেয়ে বলে, তোমার খুব সূক্ষ্ম অনুভব আছে, সেজদা।
মোটেই নয়। কিন্তু আমি বলি, তুই ওসব নিয়ে কেন ভাবিস? মানুষ একটা বিশ্বাসের জায়গা চায়, নির্ভরতা চায়, আশ্রয় চায়—এসব তো পুরনো কথা। কিন্তু তোর তো তা নয়। বিলু তোর বউ বটে, কিন্তু তুই বেঁচে আছিস নিজের জোরে। বউ যদি বিশ্বাস না রাখে, তাতেও তোর কিছু এসে যায় না, প্রীতম। বেঁচে থাকাটাই যে তোর আসল পায়েব তলার মাটি। তুই কেন ছিচকাঁদুনের মতো অন্যের ওপর নির্ভর করবি?
তুমি কেন এতদিন এলে না সেজদা? এসব কথা কেন আগে এসে বললে না আমায়? সমস্যাটা নিয়ে আমি রোজ শুয়ে শুয়ে ভাবছি আর জড়াচ্ছি।
প্রীতমের চুলে আঙুল দিয়ে বিলি কেটে দীপনাথ বলে, বিলু বা অরুণ তো তোর কোনও প্রবলেম নয়, প্রীতম। তবু যে ওটা নিয়ে ভেবেছিস তার কারণ, পুরুষের স্বাভাবিক অধিকারবোধ। বিয়ের পর একজন মেয়েকে পুরোপুরি পাব, সে আমার সম্পূর্ণ বিশ্বস্ত হবে, তার ওপর পরিপূর্ণ নির্ভর করা যাবে, এসব হল পুরুষদের মজ্জাগত আকাঙক্ষা। কিন্তু ভেবে দেখলে দেখবি, বড় করে পাত পেতে লাভ নেই, যে দেয় সে তার আন্দাজ মতোই দেয়। বিলু বা সংসারের আর কারও কাছ থেকে কিছু চাসনি, প্রীতম। শুধু বেঁচে থাকাটাকই বড় করে দেখ।
প্রীতম মাথা নেড়ে বলে, আমি আর মাথা ঘামাচ্ছি না সেজদা। ঘটনা যাই হোক, আমার তো সত্যিই তাতে কিছু যায় আসে না।
এতক্ষণে বুঝেছিস বোকারাম।
কিন্তু বেঁচে থাকারও তো আর আমার কোনও দরকার নেই।
কেন? ওকথা কেন বলছিস? এতক্ষণ তা হলে কী বুঝলি?
আমি যা বুঝেছি তা তুমি কোনওদিন বুঝবে না। তোমাকে কী করে ভালবাসার তত্ত্ব বোঝাব বলো তো?
বোঝালে বুঝব। বল শুনি।
আমি যে বিলুকে ভালবাসি সেটা বোঝো?
দীপনাথ গম্ভীর হল। সে ভেবেছিল বিলুকে গুরুত্বহীন করে দিয়ে প্রীতমকে শান্ত করা যাবে। সেটা হয়নি। এর মধ্যে একটা ভালবাসার চোরকাটাও বিধে আছে তা হলে। সে বলল, ভালবাসবি না কেন?
অত আলগাভাবে কথাটা ভেবো না। আমি জানি তুমি আজও সত্যি করে কাউকে ভালবাসোনি। বেসেছ?
কে জানে বাবা!
বাসোনি। সংসারে তোমার কোনও ইনভলভমেন্ট নেই বলেই অত সহজে সব ঘটনাকে উড়িয়ে দিতে পারলে। আমি তোমার মতো অত বেপরোয়া হব কী করে? ভালবাসলে তা হওয়া যায় না।
তা হলে কী করবি?
বিলু কোথায়? তাকে ডাকো, আমি আজ তোমার সামনে বিলুকে কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করব।
দীপনাথ চমকে ওঠে, বলিস কী? তুই কি পাগল? ওসব কথা এভাবে বলতে নেই।
প্রীতম শান্তভাবে অকপট চোখে চেয়ে বলল, কথাটা বিলুকে এতদিন জিজ্ঞেস করতে সাহস পাইনি। কী জানি যদি অপমান বোধ করে দোতলা থেকে ঝাপ দেয়। আজ তুমি আছ, তোমাকে মাঝখানে রেখে কথাগুলো বলব।
দীপনাথ শক্ত করে প্রীতমের হাত চেপে ধরে কঠিন গলায় বলে, না প্রীতম, এ কাজ করিস না।
সেজদা, আমি শিলিগুড়ি চলে যাচ্ছি। শেষবারের মতো। আর কখনও বিলুর সঙ্গে দেখা হবে না। কথা কা জেনে গেলে নিশ্চিন্তে যাওয়া হবে। নইলে বড় ছটফট করব যে।
না, প্রীতম।
কেন নয়?
আমি বিলুর দাদা। খুব লজ্জার ব্যাপার হবে।
আমি খারাপ কিছু বলব না, সেজদা। শুধু জিজ্ঞেস করব, ও অরুণকে সত্যিই ভালবাসে কি না। যদি বাসে তা হলে কী করে বাসে? কীভাবে সেটা সম্ভব হল? আর যদি সম্ভব হয়েই থাকে তবে আমি কোন বিশ্বাসে এতকাল বেঁচে ছিলাম? কার জন্য রোজগার করেছি, কাকে ভেবে দিনের শেষে বাড়ি ফিরে এসেছি?
পৃথিবীটা কীরকম তা কি জানিস না, প্রীতম?
না জানি না। আমি বিলুকে আজও ভালবাসি। তাই আমি ওকে জিজ্ঞেস করব, বাকি জীবন ও অরুণকে ঠকাবে কি না। যদি ঠায় তবে ঘরে ঘরে সেই ঠকানোর হাওয়া গিয়ে লাগবে কি না। আমি স্পষ্ট কথা জানতে চাই।
তুই আজ বড় ছেলেমানুষি করছিস, প্রীতম। তোর বোঝা উচিত, দুনিয়ার সব সত্য জানতে নেই। এগুলো না জানলেও তোর চলবে।
তুমি ভাবছ আমি মরে যাব বলেই এসব কথা না জানা ভাল। তাই না সেজদা?
না প্রীতম, তা নয়।
আমি জানি।
তুই ভুল জানিস।
বিলুকে ডাকো।
না। তুই একটু শান্ত হ।
নিজের বোনকে আড়াল করতে চাইছ না তো?
ছিঃ প্রীতম। তুই কি জানিস না, বিলুর চেয়েও আমার কাছে তুই-ই বেশি ইম্পর্ট্যান্ট?
প্রীতম ক্লান্তিতে চোখ বুজল। তারপর সামান্য দমফোট গলায় বলল, বিলুকে ডাকার দরকার নেই। ও সবই শুনেছে। ভিতরের ঘরের পরদার আড়ালে এতক্ষণ ছিল।
দীপনাথ একটু তটস্থ হয়, তাই তো। বিলুর না শোনার কথা নয়। ফ্ল্যাটবাড়ির ঘরের মধ্যে ঘর। কান পাতলেই শোনা যায়। সে নিচু হয়ে ফিস ফিস করে বলল, কেন শোনালি, প্রীতম?
প্রীতম চোখ বুজে রেখেই হাসল। বলল, শোনাতে চেয়েছিলাম। একটু শুনুক। তাতে ওর ভাল হবে।
দীপনাথ স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। ইদানীং তাকে বড় বেশি স্বামী-স্ত্রীর সমস্যায় জড়িয়ে পড়তে হচ্ছে। অভিজ্ঞতা বড় কম হল না। তবু প্রীতমের এই নিষ্ঠুরতার কোনও তুলনা হয় না। তার মেজদা প্রকাশ্যে বউয়ের নামে কুৎসা রটিয়েও এতটা তীক্ষ লড়াই তৈরি করেনি।
ভিতরের ঘরের পরদা সরিয়ে হঠাৎ বিলু চৌকাঠে দেখা দেয়। মৃদু স্বরে বলে, সেজদা, শোনো।
দীপনাথ জড়তা কাটিয়ে ওঠে।
পাশের ঘরে নিয়ে গিয়ে বিলু মৃদু স্বরে বলে, ও কী বলছিল, সেজদা?
কেন, তুই শুনিসনি?
একটু-আধটু কানে এসেছে।
না শুনলেই ভাল করতিস।
আমি শুনতে চাই। তুমি বলো।
কী বলব? বলার কিছু নেই।
ও কি শিলিগুড়ি যাবেই?
তাই তো মনে হচ্ছে। যাওয়াই ভাল।
একটু আগের কাঠিন্য হঠাৎ ঝরে গেছে বিলুর। কেমন সাদা পাঁশুটে মুখে চেয়ে থাকে দীপনাথের দিকে। হলুদ আলোয় ঠোঁট দুটো বিবর্ণ দেখায়। অনেক রোগাও হয়ে গেছে বিলু। গলার স্বর আবার হঠাৎ ভেঙে গেল ওর। বলল, যাক না! যাক। কে আটকাচ্ছে?
এসব কথা বলে সাধারণ মেয়েরা হঠাৎ কেঁদে ফেলে বা ভেঙে পড়ে। বিলু তা করল না। খাটের বাজুতে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল, যেমন ছিল। খাটে সবুজ নাইলনের মশারির মধ্যে লাবু নিশ্চিন্তে ডান কাতে ঘুমোচ্ছে। খুব আস্তে ঘুরছে সিলিং-এর পাখা।
কিছুক্ষণ কেউ কোনও কথা বলল না। তারপর বিলুই হঠাৎ বলল, ও আমাকে সন্দেহ করে।
সন্দেহ কেন করবে? সন্দেহ নয়।
তোমাকে কিছু বলেনি?
বলেছে। তবে সেটা সন্দেহ নয়, বিলু। আমিও জানি সেটা সত্য।
বিলু মেঝেতে পা ঘষল। মুখ তুলল না। মৃদু স্বরে বলল, তুমিও আমাকে বিশ্বাস করো না সেজদা?
দীপনাথ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, অরুণকে ছেড়ে দে না কেন বিলু! কেন অশান্তি বাড়াচ্ছিস?
একটু তেজের গলায় বিলু বলে, ছাড়ার কিছু তো নেই। অরুণের মতো শুভাকাঙ্ক্ষী আমার কে আছে?
এ সময়ে দীপনাথের আর-একটা দীর্ঘশ্বাস ঝরে গেল। বিলুর দেওয়া পাজামাটা সে এখনও পরেনি। মৃদু স্বরে বলল, আজ যাই রে বিলু। পরে একদিন এসে থাকব।
বিলু অবাক হল না। পরিস্থিতি পালটে গেছে। বলল, খেয়ে যাও।
না, খিদে নেই।
জটা সময়ে এক্সটেনশনস্টাল ফ্যানের সাইরে।
মেসে ফিরতে রাত হয়ে গেল। ঢাকা খাবার খুঁয়েও দেখল না দীপনাথ। বিছানায় শুয়ে জেগে রইল। ঘুম এল ভোরের দিকে, যখন দীর্ঘ বিরতির পর আবার বৃষ্টি নামল বাইরে।
পরদিন আধভেজা হয়ে অফিসে পৌঁছে পেডেস্টাল ফ্যানের সামনে দাঁড়িয়ে প্যান্ট শার্ট শুকিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিল সে। এ সময়ে এক্সটেনশন লাইনে তার টেবিলের টেলিফোন বেজে ওঠে। হঠাৎ কেন যেন আওয়াজটা শুনেই মনে হল, মণিদীপা। বহুকাল তার ডাক আসেনি।
রিসিভার কানে তুলতেই নির্ভুল গলাটি বলল, আমি ভীষণ আটকে পড়েছি এক জায়গায়। একটু হেলপ করবেন?
দীপনাথ কাচের শার্শি দিয়ে বাইরে বৃষ্টির প্রচণ্ড তাণ্ডব দেখতে পাচ্ছিল। ভরদুপুরেও প্রায় ঘুটঘুট্টি অন্ধকার চারদিকে। রাস্তায় কোনও চলমানতা নেই। গাড়ি না, মানুষ না, গোরুটা পর্যন্ত না। সে মৃদু স্বরে বলল, এই ওয়েদারে ঈশ্বর আপনার সহায় হোন। কোথায় আটকে পড়েছেন?
বাগবাজারের এক মিষ্টির দোকান থেকে ফোন করছি। রাস্তায় হাঁটুজল।
দীপনাথ বলল, এখানে কোমর সমান। কিছু করার নেই। অপেক্ষা করুন। বোস সাহেবকে লাইনটা দেব?
বিরক্ত মণিদীপা বলে, তা হলে আর আপনাকে ফোন করছি কেন?
সত্যিই তো, কেন?
প্রমোশন পাওয়ার পর খুব চোপা হয়েছে তো আপনার!
প্রমোশন পেলেও আমি এখনও বোস সাহেবের আন্ডারে। আপনার মতোই।
আমি কারও আন্ডারে নই। আই অ্যাম নট এ শ্লেভ লাইক ইউ।
সেকথা থাক। আপনার জন্য কী করা যায় বলুন তো!
সেটাই তো আপনাকে ভাবতে বলছি।
বোস সাহেবকে বলি, তিনিও না হয় একটু ভাবুন।
আপনাদের কাউকেই ভাবতে হবে না। আমিই ভাবব।
রাগ করলেন? আপনার ভয়ের কিছু নেই। এখন বেলা বারোটা মাত্র বাজে। বৃষ্টি থামবে, গাড়িঘোড়াও চলবে। একটু অপেক্ষা করতে হবে এই যা। বাগবাজারে কোথায় গিয়েছিলেন?
যেখানে আমার খুশি। শুনুন, অফিসের একটা গাড়ি পাঠাতে পারেন না?
গাড়ি? আমার চোখের সামনে অন্তত দশবারোখানা গাড়ি রাস্তায় জলবন্দি হয়ে পড়ে আছে। গাড়ির কথা ভুলে যান। গরিবের বন্ধুরা বিপদে পড়লেই কেন গাড়ির কথা ভাববে?
আবার কটকটে কথা! আমার আধুলিটা তা হলে ফেরত চাইব কিন্তু।
ওই যাঃ। আধুলিটা ফেরত দিইনি আপনাকে?
কই আর দিলেন!
তা হলে শিগগিরই একদিন যাচ্ছি ফেরত দিতে।
মণিদীপার পরের কথাটা অস্পষ্ট এল। লাইন ডেড। সম্ভবত আন্ডারগ্রাউন্ড কেবল-এ জল ঢুকেছে। তবু মনে হল মণিদীপা জিজ্ঞেস করছিল, উইথ লাভ?