চাবিটার কথা কিছুতেই ভুলতে পারছে না শ্রীনাথ। তৃষা তাকে গোপন করে ভাবন-ঘরের একটা চাবি করিয়ে রেখেছিল কেন তা বুঝতে অবশ্য তার কষ্ট হয় না। সোজা কথা শ্রীনাথের এই একটেরে ঘরখানার ভিতরেও তুষার দখলদারি রয়ে গেল। অবারিত হল ঘরখানা। শ্রীনাথের কিছু লুকোনোর রইল না, তার অনুপস্থিতিতে নিরাপত্তাও রইল না ঘরখানার।
মানুষ ঘর ঘর’ করে গলা শুকোয়। শ্রীনাথেরও শুকোত এতদিন। আজকাল সে ঘরের অসাড়তা বুঝতে পারে। এই সব অবসেসন অভিভূতির কোনও মানে হয় না। একখানা ঘর আর কতখানিই বা আশ্রয় দেয় মানুষ্য, যদি না ঘরের লোক আপন হয়। মিস্ত্রি এসে যে ঘর তৈরি করে দিয়ে যায় তার কোনও ব্যক্তিত্ব নেই, বিকার নেই। সেই ঘরে যে সব মানুষজন বসবাস করতে আসে তারাই ইট-কাঠ-টিনের ওপর নানা মায়া ভালবাসার পলেস্তারা দেয়, স্মৃতিব রং মাখায়, কত ঠাট্টা ইয়ারকি খুনসুটি, আদর ভালবাসা দিয়ে পূরণ করে তোলে ঘরের শূন্যতাকে। শ্রীনাথ তবে কেন ঘর ঘর করে মরবে? ঘর তো তুষার।
সরিৎ চলে যাওয়ার পর খানিক বসে এই তত্ত্বকথা চিন্তা করল সে। তারপর উঠে খুব তীক্ষ্ণ নজরে নিজের দেরাজ খুলে সব পরীক্ষা করল। বাক্স তোরঙ্গ উলটে পালটে দেখল। সবই ঠিক আছে। দেরাজের বা বাক্সের চাবিও হয়তো করিয়েছে তৃষা। কে জানে? তার চেক বই, পাশ বই, ইনসুয়েরেনসের পলিসি, শেয়ার সার্টিফিকেট, নগদ টাকা এসবই বোধ হয় খুঁটিয়ে দেখেছে।
মালদা থেকে সরিৎকে কেন আনিয়েছে তৃষা তাও খানিকটা আন্দাজ করতে পারে শ্রীনাথ। এ কথা তৃষা ভালই জানে যে জমিজিরেতের ওপর নির্ভর করে থাকার বিপদ আছে। মল্লিনাথের সব জমি আইনত তার নয়ও। ভুতুড়ে জমি মেলাই আছে। যে-কোনওদিন শত্রুরা খবর দিয়ে ধরিয়ে দেবে আর সরকার জমি কেড়ে নেবে। কানাঘুষোয় শ্রীনাথ শুনেছে, তৃষা বড় পাইকারি দোকান দেবে। চালকল খুলবারও ইচ্ছে আছে। হয়তোবা সেই সব কাজের জন্য বিশ্বস্ত লোকের দরকার বলেই আনিয়েছে সরিৎকে।
সরিতের ইতিহাসটা খুব পরিষ্কার জানে না শ্রীনাথ। শেষবার যখন দেখেছিল তখন বোধ হয় সদ্য কলেজে ঢুকেছে। তখনও ব্যক্তিত্ব তৈরি হয়নি। এক বছরে ছেলেটা মানুষ হয়েছে না অমানুষ তা এই অল্প সময়ে বোঝা গেল না। কিন্তু সে যা-ই হোক, শেষ পর্যন্ত সরিৎ তৃষারই লোক, শ্রীনাথের কেউ নয়।
শ্রীনাথের লোক পৃথিবীতে খুবই কম। নেই বললেই চলে।
গভর্নমেন্ট প্রেসে স্ট্রাইক চলছে বলে শ্রীনাথের প্রেসে এখন বিস্তর জব ওয়ার্ক এসে জমা হয়েছে। উঁই ভঁই হরেক রকমের ফর্ম, বিল, বিজ্ঞপ্তি ছাপার কাজ চলছে। মালিক বলে দিয়েছে, কামাই করা চলবে না। কাজ তুলে দিতে পারলে সবাইকে একটা থোক টাকা দেওয়া হবে। মিনি বোনাস।
বোনাসের ওপর শ্রীনাথের কোনও টান নেই। তবে সে হল জব ওয়ার্কের বিশেষজ্ঞ। বহুকাল প্রেসে কাজ করায় সে হেন কাজ নেই যে জানে না। মল্লিনাথের সম্পত্তি হাতে আসায় কিছুকাল আগে সে নতুন ফেসের কিছু টাইপ তৈরি করার জন্য ভূতের মতো খাটছিল। বাংলা টাইপরাইটার সংস্কারের কাজেও বিস্তর মাথা ঘামাচ্ছিল। কাজ এগিয়েছিল অনেকটাই। লেগে থাকলে কিছু একটা হয়ে যেত হয়তে। কিন্তু, দেদার সম্পত্তি আর নগদ টাকা হাতে আসায় কেমন যেন গা ঢিলে দিয়ে দিল। তবু এখনও বোধ হয় প্রেসের কাজকে সে এক রকম ভালই বাসে। প্রেসটার ওপরেও তার গভীর মায়া। তাই এই কাজের চাপের ব্যস্ততা তার খারাপ লাগে না।
স্নান করে খেয়ে বেরোতে একটু দেরি হল তার। তা হোক। মালিকপক্ষ জানে, দেরি করে গেলেও শ্রীনাথ দায়িত্ব নিয়ে কাজ করে। দরকার হলে সারা রাত খেটে কাজ তুলে দেবে। কাজের চাপে থাকলে শ্রীনাথ অন্য মানুষ। সেই কাজের জন্য সে বোনাস ইনক্রিমেন্ট বা প্রোমোশনও চাইবে না! ওসব কথা তার মনেই আসে না। শুধু মনটার মধ্যে একটা কথাই খচখচ করছে, সজলকে বিকেলে আসতে বলেছিল ঘরে। যদি দেরি হয় তবে সজল এসে ফিরে যাবে। কথার খেলাপ হবে তার। বাচ্চাদের কাছে কথার খেলাপ করা ঠিক নয়। এতে ওরা শ্রদ্ধা হারায়, হতাশায় ভোগে।
অফিসে পৌঁছে এক গ্লাস জল খেয়ে, একটা পান মুখে দিয়ে কাজে ড়ুবে গেল শ্রীনাথ। চাবির কথা মনে রইল না, ঘরের কথা মনে রইল না, তৃষা বা সজলের কথাও বেমালুম গায়েব হয়ে গেল মন থেকে।
কিন্তু মনে পড়ল বিকেলের দিকে। মনে করিয়ে দিল সোমনাথ।
বোসবাবু এসে খবর দিলেন, আপনার ভাই এসেছে।
সন্ধে হয়-হয়। শ্রীনাথের ঘাড় টনটন করছিল। কপি ধরে ধরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শোধরানো কম কথা নয়। ভুল থাকলে প্রেসের রাক্ষুসে মেসিন এক লহমায় সেই ভুল কপি কয়েক হাজার ছেপে ফেলবে। ভুল ধরা পড়লে ছাপা কাগজ সব ফেলে দিতে হবে। এখন কাগজ কালি লেবারের খরচার যে বহর তাতে ক্ষতির পরিমাণটা বড় কম দাঁড়াবে না। তাই মালিক নিজে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ কাজ দেখে গেছে। প্রিন্ট-অর্ডার দেওয়ার দায়িত্ব দিয়ে গেছে শ্রীনাথকে। তাতে শ্রীনাথের ঝামেলা বেড়েছে। মাথা তোলার সময় পায়নি।
ভাই কথাটা কানে শুনেই বুঝেছিল সোমনাথ। দীপনাথ কিছুতেই নয়। কারণ দীপ ভাই হলেও একটু দূরের ভাই।
প্রেসটা বিরাট বড় দরের হলেও রিসেপশন বা ওয়েটিং রুম বলে কিছু নেই। বাইরের দিকে সুপারিনটেনডেন্টের ফাঁকা অফিসে বসে আছে সোমনাথ। মুখটায় চোর-চোর ভাব, চোখের দৃষ্টিতে শেয়ালের মতো একটা এড়ানো-এড়ানো ভাব।
প্রকৃতির নিয়মে বাপের মেজো ছেলেরাই নাকি সবচেয়ে পাজি হয়। তাদের ক্ষেত্রে সেটা হয়নি। শ্রীনাথ নিজেই মেজো। সে কতটা পাজি তা হিসেব করে দেখেনি এখনও। কিন্তু পাজি বলতে সত্যিকারের যা বোঝায় তা হল সোমনাথ। মল্লিনাথের সম্পত্তির ভাগ চাইছে বলেই নয়, সোমনাথ বুড়ো বাবাকে নিজের কাছে রেখে অন্য দুই ভাইয়ের কাছ থেকে সেই বাবদ টাকা নেয়। ভয়ংকর কৃপণও বটে। সরকারের একটা বিল সেকশনে কাজ করে। ঠিকাদারদের কাছ থেকে প্রচুর টাকা ঘুষ নেয়।
শ্রীনাথ বলল, কী রে?
তোমার সঙ্গে দেখা করতে এলাম।
সোমনাথের কপালে এখনও সেই মারের দাগ রয়েছে। মরতে মরতে বেঁচে গিয়েছিল।
শ্রীনাথ দারোয়ানকে দু’ভড় চা আনতে পাঠিয়ে বসে বলল, সব ভাল তো?
সোমনাথের চেহারাটা মন্দ নয়। মোটাসোটা, গোলগাল, গোপাল-গোপাল চেহারা। যতদিন বেঁচে ছিল ততদিন ছোট ছেলেকে চূড়ান্ত আদর দিয়ে গেছে। সেই সুবাদেই এই চেহারা।
সোমনাথ বলল, বাবার অবস্থা তো জানোই! যে-কোনওদিন হয়ে যাবে।
জানা কথা। বাবার খবরের জন্য ব্যস্ত নয়ও শ্রীনাথ। এই সব নিষ্ঠুরতা বয়সের সঙ্গে সঙ্গে আসে। বাবা যে কবে ফালতু হয়ে গেল তা টেরও পায়নি। কিন্তু হয়েছে।
শ্রীনাথ একটু দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, সে তো জানি।
সোমনাথ মার খাওয়ার পর দু-তিন বার ওকে দেখতে এসেছিল শ্রীনাথ। তখন বাবার সঙ্গেও দেখা হয়। কিন্তু দেখা হওয়া আর না হওয়া সমান। বাবা এখনও তোক চিনতে পারছেন বটে কিন্তু কারও জনাই কোনও অনুভূতি নেই। সোমনাথ যে হাসপাতালে তা শুনেও নির্বিকার। বিকেলের জলখাবার নিয়ে শমিতার কাছে বায়না করছিল বলে শমিতা কটকট করে উঠল। বলল, আপনার ছেলে হাসপাতালে সিরিয়াস অবস্থায় পড়ে আছে, আর আপনি চিড়েসেদ্ধ চিড়েসেদ্ধ করে পাগল হচ্ছেন! এ রকমই ধারা নাকি আপনাদের?
কথাটা তা নয়। বাবা এখন সুখ-দুঃখ ভাল-মন্দ এই সব অনুভূতির বাইরে চলে গেছে। বোধ-বুদ্ধি ছোট হয়ে হয়ে এখন কেবল নিজের জৈবিক চাহিদাটুকু নিয়ে সীমাবদ্ধ হয়ে আছে। এও হয়তো এক ধরনের পাগলামি। তবে যাই হোক, বাবাকে নিয়ে তাদের আর খুব বেশি ভাবনা-চিন্তা নেই। তৃষা কিছুকাল আগেই শ্রীনাথকে একবার বলেছিল, শ্বশুরমশাইকে এখানে এনে রাখলেই তো হয়। এখানে অনেক ফাঁকা ঘর, খোলামেলা জায়গা, দেখাশুনো করার লোকও আছে, তবে কেন উনি সোমনাথদের খুপরি বাসায় পড়ে থাকবেন?
যখনকার কথা তখনও সোমনাথ মার খায়নি। ফি-রবিবারে সস্ত্রীক ঝগড়া করতে আসত। প্রস্তাব শুনে কিন্তু সোমনাথ বা শমিতা কেউ রাজি হল না। বলল, না, উনি আমাদের কাছেই থাকতে চান। অন্য কোথাও যাওয়ার নাম করলেই রেগে ওঠেন।
কথাটা মিথ্যেও নয়। বুড়ো বয়সে অনেক সময়েই অভ্যস্ত জায়গা ছেড়ে লোকে অন্য কোথাও যেতে চায় না। যুক্তি হিসেবে ছেলেমানুষের মতো বলে, এ বাড়িতে পায়খানাটা কাছে হয়, এখানে জলের সুবিধে, সোমনাথ রোজ মাছ আনে ইত্যাদি। তবু বাবাকে জোর করে আনাও যেত এবং তাতে ফল খারাপ হত না। কিন্তু সোমনাথ রাজি হল না অন্য কারণে। বাবার খরচ বাবদ তৃষা মাসে মাসে ওকে তিনশো টাকা করে পাঠাত এবং শ্রীনাথ যত দূর জানে, এখনও পাঠায়। কর্তব্যের ব্যাপারে তৃষার কোনও ত্রুটি নেই। আর কিছু সোমনাথ আদায় করে বিলু আর দীপনাথের কাছ থেকে। দীপ মাসে মাসে দেয় না, কিন্তু কখনও-সখনও থোক পাঁচ-সাতশো টাকাও দিয়ে ফেলে। সুতরাং বাবাকে নিজের কাছে রাখলে সোমনাথের লাভ ছাড়া ক্ষতি নেই।
সোমনাথ একটু চুপ করে থেকে বাবা সম্পকে ট্র্যাজেডি শ্রীনাথের মাথায় বসতে সময় দিল। তারপর বলল, আমি ছেলে হিসেবে কোনও ত্রুটি রাখি না, সব কর্তব্যই করি।
হুঁ।— শ্রীনাথ ওর মতলব বুঝতে না পেরে সাবধান হয়ে সংক্ষেপে উত্তর দিল।
সোমনাথ দুঃখী-দুঃখী মুখ করে গম্ভীর গলায় বলল, শমিতার শরীরটা ভাল যাচ্ছে না।
কী হয়েছে?
সোমনাথ অপরাধীর মতো মুখ নিচু করে বলে, ছেলেপুলে হবে।
ও।
তাই বলছিলাম এ অবস্থায় বাবার যত্ন-আত্তি ঠিক মতো হবে না। বাবার অবশ্য অত বোধটোধ নেই, কিন্তু আমার তো বিবেক আছে। ডাক্তার শমিতাকে কাজকর্ম করতে একদম বারণ করেছে, বেশি নড়াচড়া করলে মিসক্যারেজ হয়ে যেতে পারে।
কোনও ডিফেক্ট আছে নাকি?
আছে।
তা হলে এখন কী করতে চাস?
যদি কিছু মনে না করো তো বলি, এখন বাবাকে কিছুদিন তোমাদের কাছে নিয়ে রাখো।
শ্রীনাথ টক কবে প্রস্তাবটায় রাজি হতে পারে না। তৃষা এক সময় শ্বশুরকে তার কাছে রাখতে চেয়েছিল বটে, কিন্তু এতদিনে যদি মত পালটে থাকে? বাড়ি তো শ্রীনাথের নয় যে নিজে সিদ্ধান্ত নেবে।
শ্রীনাথ বলল, তোর বউদিকে একটু বলে দেখ।
সোমনাথ একটু উম্মার সঙ্গে বলল, বউদিকে বলব কেন? বউদি কে? তুমি কর্তা, তুমিই ডিসিশন নেবে।
শ্রীনাথ অবাক হয়ে বলে, আমি কিসের কর্তা? কোনও ব্যাপারেই আজকাল আমি থাকি না।
সোমনাথ ওপরওয়ালার মতো চড়া গলায় বলল, থাকো না কেন? থাকো না বলেই তো মেয়েমানুষের বাড় বাড়ে।
বিরক্ত হয়ে শ্রীনাথ বলে, ওসব কথা থাক। আমি না হয় তোর বউদিকে আজ জিজ্ঞেস করব’খন, কাল এসে জেনে যাস।
কী জেনে যাব? জানাজানির মধ্যে আমি নেই। বাবা তো তোমারও। তোমরা এক সময়ে বাবাকে রাখতেও চেয়েছিলে। তা হলে এখন আবার পিছোচ্ছ কেন?
শ্রীনাথ একটা গভীর শ্বাস ছেড়ে চুপ করে রইল। এটা যে পিছানো নয় তা সোমনাথও কি জানে? ও এখন একটা চাল খেলছে, সেটা যে কী তা অবশ্য শ্রীনাথ বুঝতে পারছে না।
সোমনাথ বলল, তা ছাড়া অত মতামতেরই বা দরকার কী বুঝি না, বাবা! বড়দা তো বাবারই ছেলে। তার বাড়িতে বাবা তো নিজের রাইট নিয়েই থাকতে পারে।
ছেলের সম্পত্তির ওপর বাবার অধিকার আছে, এমন কথা কোন আইনের বইতে আছে তা একবার জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করল শ্রীনাথের। কিন্তু তাতে কথা বাড়বে বলে বলল না।
শ্রীনাথ মৃদু স্বরে বলল, আমি তো অমত করছি না। তবে আমার মতামতের দামও নেই।
একশো বার দাম আছে।–সোমনাথ গলার জোরে কথাটাকে যত দূর সম্ভব গেঁথে দিতে চেষ্টা করল শ্রীনাথের মাথায়। তারপর মোলায়েম আদুরে গলায় বলল, তুমি মেজদা, দিনকে দিন কেমন হয়ে যাচ্ছ বলো তো! তোমার টাকাপয়সা বা বিষয়-সম্পত্তির লোভ নেই সেটা আমরা সবাই জানি, কিন্তু তা বলে সংসারের সব কর্তৃত্ব বউদির হাতে ছেড়ে দেবে?
শ্রীনাথ যে নির্লোভ সেটা যে সোমনাথ জানে তা শুনে খুশিই হয় শ্রীনাথ। বলে, আমি যেমন আছি তেমনিই থাকতে দে। গণ্ডগোলে জড়াস না।
সন্নিসি তো নও। সংসারে থাকলে গা বাঁচিয়ে চলবে কী করে? তা ছাড়া চোখের সামনে এত বড় সব অন্যায় ঘটে যাচ্ছে দেখেও যদি চুপ করে থাকো তবে তোমার ভালমানুষির কোনও দাম থাকে
ভালমানুষির দামই বা চাইছে কে! কথাটা বলতে পারত শ্রীনাথ, বলল না। শুধু আনমনে একবার হুঁ দিল।
সোমনাথ বলল, বউদি যে তোমাকে বাড়ির চাকর-বাকর মনে করে সেটা আমাদেরও খারাপ লাগে। তুমি যদি একটু রোখাচোখা হতে তবে এমনটা হতে পারত না।
শ্রীনাথের একটু রাগ হচ্ছিল। কিন্তু সোমনাথকে রাগ দেখিয়ে লাভ নেই। কোনওকালেই ও কারও পরোয়া করে না। শ্রীনাথ তাই চুপ করে থাকে।
সোমনাথ নিজেই বলে, তুমি চুপ করে থাকলেও আমি ছেড়ে দেব বলে ভেবো না। তোমাদের ওখানকার লোকেরা আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখে। তারা কেউ বউদির পক্ষে নয়। তারা নিজেরাই বলছে বড়দার সম্পত্তিতে বউদি কোনও রাইট নেই। দরকার হলে তারা ওখানকার মাতব্বরদের সালিশি মানবে। বউদির রাজত্ব অত নিষ্কণ্টক হবে ভেবো না।
এটা যে অপমান তা শ্রীনাথ বুঝতে পারছে। তৃষার সঙ্গে তার বনিবনা থাক বা না থাক এই কথাগুলো তৃষাকে জড়িয়ে তাকেও বলা। তবু জবাব দেওয়ার মতো জোর পায় না শ্রীনাথ। সে নিজেও বোঝে, দাদার সম্পত্তি নিয়ে একটা অন্যায় দখলদারি চলছে।
শ্রীনাথ বলল, এসব আমাকে বলছিস কেন? আমি তোদের কী করেছি? যা করবি করিস, আমার কিছু বলার নেই।
সোমনাথ একটু নরম হয়ে বলে, তোমাকে কষ্ট দিতে চাইও না। দুঃখ হয় বলে বলি।
ওখানকার কে কে তোর কাছে এসেছিল?
অনেকেই আসে। বহু গুপ্ত খবর দিয়ে যায়। বউদি নাকি তার গুন্ডা ক্লাসের সেই ভাইটিকে মালদা থেকে আনিয়েছে।
শ্রীনাথ অবাক হয়ে বলে, সরিৎ! সরিৎ গুন্ডা নাকি?
সোমনাথ একটু হেসে বলে, তুমি তো মানুষ চেনো না। নিতাই খ্যাপাকে মেরে তোমার শালা পাট পাট করে দিয়েছিল। বউদি ঘটনাটা চেপে দিয়েছে। এতকাল ভাড়াটে গুন্ডা ছিল, এখন নিজের ভাইকে দিয়েই গুন্ডামি চালাবে।
নিতাইকে সরিৎ মেরেছে, এ কথা কেউ তো আমাকে বলেনি।
তুমি কোন খবরটাই বা রাখো! বউদি যে বন্দুকের লাইসেন্স চেয়ে অ্যাপলিকেশন করেছে তা জানো?
না তো। বড়দার একটা জার্মান বন্দুক ছিল তা মনে আছে?
আছে। আমি নিজেও কয়েকবার শিকার করতে গিয়ে চালিয়েছি। তারপর সেটা থানায় জমা করে দিই।
বউদি সেইটেই ফেরত চেয়েছে। তবে লাইসেন্স হবে সরিহেব নামে।
শ্রীনাথের কাছে এগুলো খুব একটা দুশ্চিন্তার ব্যাপার নয়। সে বলল, ও, তা হবে।
ছেলেপুলের ঘর বলে মারাত্মক অস্ত্রটা শ্রীনাথ ঘরে রাখতে চায়নি। নইলে সে দরখাস্ত করলে বন্দুকটার দখল পেয়ে যেত। কিন্তু দখল করার ইচ্ছেই তার ছিল না। তাই থানায় জমা করে দিয়েছিল। তৃষা বন্দুকটা ফেরত চেয়েছে, ভাল কথা, কিন্তু সেটা একবার তাকে জানালেও পারত।
সোমনাথ বলল, সরিৎ হল বউদির রঙ্গরাজ।
শ্রীনাথ বুঝল না। বলল, কে রঙ্গরাজ?
দেবী চৌধুরানির বড় সাকরেদ, মনে নেই? আর বউদি নিজে হতে চাইছে দেবী চৌধুরানি।
শ্রীনাথের গম্ভীর থাকা উচিত ছিল। কিন্তু উপমাটা এমন অদ্ভুত যে, অনিচ্ছেসত্ত্বেও ক্ষীণ একটু হেসে ফেলল।
সোমনাথ আঁশটে মুখে বলে, হেসো না মেজদা। ব্যাপারটা খুবই সিরিয়াস।
শ্রীনাথ এবার গম্ভীর হয়ে বলল, তা আমি কী করব বল?
কিছুই যদি না করো তবে অন্তত দেখে যাও। চতুর্দিকে লক্ষ রেখে চলো।
চাবির কথাটা আবার মনে পড়ে গেল শ্রীনাথের। একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেল সে। বলল, লক্ষ রেখেই বা লাভ কী? আমার কোনও ইন্টারেস্ট নেই।
সোমনাথ অধৈর্যের গলায় বলল, বাবার ব্যাপারটা কী হবে?
বললাম তো।
শোনা, মেজদা!–সোমনাথ খুব জোরালো গলায় বলে, বউদির মত থাক বা না থাক আমি সামনের রবিবার বাবাকে নিয়ে গিয়ে তোমাদের ওখানে পৌঁছে দিয়ে আসছি। তারপর আর আমার দায়িত্ব থাকবে না।
দারোয়ান চা দিয়ে গেল। শ্রীনাথ চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, তাতে হয়তো আপত্তি উঠবে না। কিন্তু আমি বাবার কথাটাই ভাবছি।
কী ভাবছ?
বাবার খুব কষ্ট হবে হয়তো।
বাবার কষ্টের কথা যদি সত্যিই ভাবো তবে কষ্ট দিয়ো না।
মুখের মতো জবাব পেয়ে শ্রীনাথ চুপ করে গেল। চা খেয়ে উঠল সোমনাথ। বলল, তা হলে ওই কথাটাই ফাইনাল।
শ্রীনাথ উর্ধ্বমুখে ভাইয়ের মুখখানা দেখল। বাবাকে ও কেন রতনপুরে চালান করছে তার সত্যি কারণটা বুঝতে চেষ্টা করল। সম্ভবত সোমনাথ বাবাকে ওখানে পাঠিয়ে ক্ষীণ একটা অধিকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে। নইলে মাসে তিনশো টাকার ফালতু আয় জলাঞ্জলি দিত না।
সোমনাথ চলে যাওয়ার পর আরও কিছুক্ষণ কাজ করল শ্রীনাথ। যখন উঠল তখন সন্ধে সাতটা।
খারাপ পাড়ায় যেতে হলে প্রথম প্রথম একটু বুকের জোর চাই। একা যেতে সাহসও হয় না। কিন্তু আশ্চর্য আশেপাশে বন্ধুবেশী আড়কাঠিরা ইচ্ছেটাকে ঠিক টের পেয়ে যায় এবং তারাই পৌঁছে দেয় মেয়েমানুষের ঘরে। শ্রীনাথেরও তাই হয়েছিল। যখন ফেবারিট কেবিনে আড্ডা মারত তখন কানাই বোস নামে একজন ঠিকাদারের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়। সে খারাপ পাড়ায় যেত এবং সেইসব গল্পও করত খুলে মেলে। শ্রীনাথকে খারাপ পাড়ায় নিয়ে গিয়েছিল সে-ই। তারপর থেকে অবশ্য আর বাধা হয়নি। যেতে যেতেই শ্রীনাথের অভিজ্ঞতা হয়েছে, কলকাতা শহরে নাম লেখানো এবং ন-লেখানো খারাপ মেয়ে অঢেল। আজকাল তার চোখ পাকা হয়েছে। রাস্তায় ঘাটে যে-কোনও মেয়েকে একনজর দেখলেই বুঝতে পারে, খারাপ না ভাল। তা ছাড়া যাতায়াতে বহু দালালের সঙ্গে চেনা হয়েছে। তারাও খোঁজ দেয়। বাবুল দস্তিদার নামে একজন বন্ধু গোছের দালাল কদিন আগে বলেছিল, শ্রীনাথবাবু, আপনি লো ক্লাসের মেয়েদের কাছে যান কেন? ওরা তো পান্তা ভাত। কোনও মজা নেই। যাদের রেস্ত আছে তারা নানারকম এনজয়মেন্ট করবে। শরীরের ব্যাপারটারও তো অনেক রকম স্টাইল আছে।
বাবুল তাকে হাওড়া ময়দানের কাছে নমিতার খোঁজ দেয়। দেখে খারাপ মেয়ে মনে করা বেশ কঠিন। একদম আধুনিকা। ফটাফট ইংরেজি বলে, দারুণ সাজে, গিটার বাজায়, বি এ পাশ। রবি ঠাকুর থেকে বিষ্ণু দে পর্যন্ত কোটেশন দেয়।
খরচ অনেক বেশি বটে, কিন্তু নমিতা কেবলমাত্র শরীরী তো নয়। সে শ্রীনাথের সঙ্গে বেড়ায়, রেস্টুরেন্টে খায়, সিনেমা-থিয়েটারও দেখে। সারাক্ষণ বেশ সাজিয়ে গুছিয়ে কথা বলে। বেশির ভাগ কথাই প্রেম-ভালবাসা ঘেঁষা। এমন সব কথা যা শ্রীনাথের বয়ঃসন্ধির যৌবনকে ফিরিয়ে আনে। নমিতার চোখের চাউনি, ঠোঁটের হাসি সব কিছুই অত্যন্ত উষ্ণ, নিবিড় এবং অনেকটাই যেন আন্তরিক। বিভ্রমই বটে, তবে বিভ্রমই তো মানুষ চায়।
শ্রীনাথ তাই সম্প্রতি নমিতার খাতায় নাম লিখিয়েছে। জমানো টাকা হু-হু করে বেরিয়ে যাচ্ছে। তা যাক। জীবনে টাকা দিয়ে তো কিছু পাওয়া চাই। শ্রীনাথ মনে করে নমিতার কাছে সে কিছু পাচ্ছে। কৃত্রিম হলেও পাচ্ছে।
নমিতার খদ্দেরের সংখ্যা বেশি নয়। দিন ও সময় বাঁধা থাকে। অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছাড়া যাওয়া যায় না। এইটেই একমাত্র যা অসুবিধে।
আজ শ্রীনাথের দিন নয়। তবু মনটা ভাল ছিল না বলে হাওড়ায় এসে গাড়ি ধরতে গিয়ে ধরল। বেরিয়ে বাসে উঠে ময়দানের কাছে নমিতার দোতলার ফ্ল্যাটে এসে উঠল।
আশ্চর্য! নমিতা একা ফাঁকা ঘরে সেজেগুজে বসে আছে। তাকে দেখে উজ্জ্বল হয়ে বলল, আজ একটা ছোটলোকের আসার কথা ছিল। দেখো তো, সারা বিকেলটা বসে বসে নষ্ট করলাম। তুমি এলে, কী ভাগ্যি!
খুশি হয়েছ?
সকলের বেলায় হই না। তুমি তো সকলের মতো নও!
নই?
নমিতা হেসে ফেলে বলে, বললে ভাববে তেল দিচ্ছি। তা কিন্তু নয়।
সোফায় বসে শ্রীনাথ হাসিমুখে বলল, আমি কীরকম ৩ আজ তোমার মুখে শুনব। বলো তো।
যাঃ।–লজ্জায় যেন লাল হল নমিতা। মুখ দু’ হাতে ঢেকে বলল, এভাবে বলা যায় কি? বোঝো না কেন?
নমিতার দোভাঁজ করা বিনুনির সঙ্গে অনেকগুলো আলগা ফিতে বাঁধা! তাতে ভারী ছুকরি দেখাচ্ছে ওকে। কানে মস্ত রুপোর কানপাশা। হাতে রুপোর চুড়ি। একটু অবাঙালি সাজে আজ ওর আকর্ষণ তিনগুণ বেড়েছে।
মায়া ও মতিভ্রমের দিকে অভাসবশে হাত বাড়াল শ্রীনাথ।
কিন্তু তারপর শরীরে সেই খিতখিত ভাব। যেন অপবিত্রতা, অশৌচ। বাড়িতে ফিরে কেরোসিন স্টোভ জ্বেলে গরম জল বসিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। স্নান করবে।
এমন সময় দরজার বাইরে সজল এসে দাঁড়ায়।
বাবা!
এসো।
শ্রীনাথ নরম স্বরে ডাকে। মনে মনে ভাবে সজলের সঙ্গে এই দেখা হওয়ার আগে স্নানটা সেরে নেওয়া উচিত ছিল। স্নান না করে যেন এই অবস্থায় ছেলের সঙ্গে কথা বলতে নেই। কোথায় যেন আটকায়।
সজল একটু যেন সংকোচের সঙ্গে ঘরে আসে। মুখে একটু লজ্জার হাসি।
সজল দেখতে ভারী মিষ্টি। মুখখানা যেন নরুন দিয়ে চেঁচে তৈরি। শরীরের হাড়গুলো চওড়া। লম্বাটে গড়ন। বড় হলে ও খুব লম্বা চওড়া আর শক্তিমান পুরুষ হয়ে দাঁড়াবে।
সজল ঘরে ঢুকে কৌতূহলভরে ঘুরে ঘুরে এটা ওটা দেখতে থাকে। হঠাৎ বলে, জল গরম করছ কেন বাবা? চা খাবে? ছোড়দিকে বলো না, করে দেবে।
না, চা খাব না।
তবে?
চান করব।
এত রাতে!–সজল অবাক হয়ে বাবার দিকে তাকায়।
কী বড় বড় অন্তর্ভেদী চোখ। কিছুতেই শ্রীনাথ ওর চোখে চোখ রাখতে পারল না। মাথা নিচু করে বলল, পায়ে নোংরা লেগেছিল।
বুকটা ঢিব ঢিব করে ওঠে শ্রীনাথের। হে ভগবান! আর যাই হোক ছেলের কাছে যেন কোনওদিন মুখ কালো না হয়।
সজল বলে, তোমার শীত করবে না?
শীত করবে বলেই তো গরম জল করছি।
বাড়িতে বলে পাঠালেই তো মা গরম জল করে দিত।
লোককে কষ্ট দিয়ে কী লাভ! এটুকু নিজেই পারা যায়।
তোমার ক্ষুরটা ধরেছিলাম বলে রাগ করেছ, বাবা?
একটু করেছিলাম। এখন আর রাগ নেই। টেবিলের ডান ধারের দেরাজে আছে। বের করে নাও। ওটা তোমাকে দিলাম।
দিলে?–উজ্জ্বল হয়ে সজল জিজ্ঞেস করে।
হুঁ। কিন্তু খুব সাবধান। অসম্ভব ধার। হাত-টাত কেটে ফেলো না।
না, আমি দাড়িই কাটব।
দাড়ি!— অবাক হয়ে শ্রীনাথ তাকায়।
হি হি। নিতাইদা যখন ঘুমোবে তখন চুপি চুপি গিয়ে ওর দাড়ি কামিয়ে দিয়ে আসব।
সর্বনাশ।–শ্রীনাথ প্রায় দাঁড়িয়ে পড়ে, খবরদার ওসব করতে যেয়ো না। কখন গলায় বসিয়ে দেবে অসাবধানে। তা হলে কিন্তু ফাঁসি।
আচ্ছা। তাহলে রেখে দেব। বড় হলে নিজের দাড়ি কামাব।
ক্ষুরটা ওকে দেওয়া ভুল হল কি? হয়তো। কিন্তু এখন দেওয়া জিনিস ফেরত নেওয়া ঠিক হবে না।
শ্রীনাথ বলে, তুমি মাকে জিজ্ঞেস করে এখানে এসেছ তো!
হ্যাঁ।–ঘাড় নাড়ে সজল। বলে, মা বারান্দা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেল।
তোমার মা!— বলে আবার সচকিত হয়ে খাড়া হয় শ্রীনাথ।
ঠিক সেই মুহূর্তে দরজার আড়াল থেকে কালো শাড়ি পরা তৃষা দরজার আলোয় দেখা দেয়।
অস্বাভাবিক কিছুই নয়। তার স্ত্রী এই ঘরে আসতেই পারে। তবু ভীষণ যেন চমকে যায় শ্রীনাথ। যেন তার লুকোনো কোনও ষড়যন্ত্র ধরা পড়ে গেছে। প্রকাশ পেয়েছে তার ভীষণ কোনও গোপনীয়তা।
শ্রীনাথ বলল, তুমি!
তৃষা গম্ভীর মুখে বলে, অবাক হওয়ার কী হল? আমি তো ভূত নই। মানুষ।