তুই হুইলচেয়ারে কেন রে?
আমাকে সবাই যে রুগি বানিয়ে রাখতে চায়, কী করব বলো তো সেজদা!
তুই তো একটু-আধটু হাঁটতে পারছিলি।
এখনও কি পারি না? পারি। দেখবে?
থাক গে। বসে আছিস বসেই থাক।
সারাদিন বসে থাকি। তুমি কতকাল পরে এলে।
সময় পাই না রে। মনটাও ভাল নেই।
তোমার মনের আবার কী হল? চাকরি যায়নি তো!
না, চাকরিটা আছে।
পার্মানেন্ট হয়েছ?
এবার হয়তো হয়ে যাব।
প্রীতম খুব সুন্দর একরকম হেসে বলে, অবশ্য সেটা জেনেই বা আমার কী হবে? জাগতিক ব্যাপার-স্যাপার নিয়ে আজকাল ভাবি না।
না ভাবাই ভাল। জগৎটা তো ভাল কিছু নয়। তোর মাথায় কোনওকালেই বিষয়বুদ্ধি ছিল না। তুই ছিলি আনমনা, ফিলজফার টাইপের।
প্রীতম একমুখ হাসি নিয়ে বলল, তার মানে তো হাঁদা।
একটু লজ্জা পায় দীপনাথ। ছেলেবেলায় অন্যমনস্ক প্রীতমকে সে নিজেই হাঁদা বলে ডাকত। তাই থেকে পাড়ায় তার নামই হয়ে গিয়েছিল হাঁদা। বলল, হাঁদা থাকাই ভাল।
প্রীতম মাথা নেড়ে বলে, এ সমাজে হাঁদার জায়গা নেই সেজদা। চার চৌকো না হলে টেকা যায় ‘না।
দীপ স্মিতমুখে বলে, তা যদি বলিস তবে আমিও তোর চেয়ে কম দা নই। তুই তবু একটা ভাল চাকরি করছিলি। আমার মতো ওপরওয়ালার ফাইফরমাশ খাটতে হয়নি তোক।
প্রীতম একটু থমকে গিয়ে বলে, ওপরওয়ালা কি তোমাকে ফাইফরমাশ করে?
বেফাঁস কথাটা বলে ফেলেছে দীপনাথ। প্রীতম তাকে এতটাই ভালবাসে যে, তার আর বোস সাহেবের আসল সম্পর্কটা জানলে দুঃখ পাবে। তাই সে তাড়াতাড়ি বলল, চাকরি করতে গেলে ওরকম একটু আধটু করতে হয় রে।
প্রীতম মাথা নেড়ে বলে, ঠিক বুঝলাম না। বুঝিয়ে বলো।
বোঝানোর কিছু নেই। ফাইফরমাশ মানে তো আর সেরকম কিছু নয়।
আগেও তুমি এরকম কিছু কথা বলেছ। তখন গুরুত্ব দিইনি। কিন্তু আজ তোমার মুখ দেখে অন্যরকম লাগছে।
অন্যরকম লাগবার কী? আমি ঠিক আছি। চাকরি পাকা হলে সবই স্বাভাবিক হয়ে যাবে।
প্রীতম অনেকক্ষণ গুম হয়ে রিল। আস্তে হুইলচেয়ারটা ঘুরিয়ে মেঝের ওপর খানিকটা গড়িয়ে গিয়ে ফিরে এল। বলল, শুধু চাকরিই নয়, আরও কিছু ব্যাপার ঘটেছে সেজদা। তোমার চোখ অন্যরকম।
মনে মনে প্রীতমের নজর থেকে রেহাই চাইছিল দীপনাথ। আগে ওর নজর এত তীক্ষ্ণ ছিল না। রোগে ভুগলে কি মানুষের অনুভূতি বাড়ে? বাড়ে হয়তো। দীপনাথ জানে, টি বি রোগীদের মধ্যে অনেকেই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কবি বা শিল্পী হয়েছে। হয়তো শরীরের ক্ষয় অন্যদিকে স্নায়ুকে স্পর্শকাতর করে তোলে। সে একটু অস্বস্তিতে ভরা গলায় বলল, কিছুই পালটায়নি। তুই ভুল দেখছিস।
তুমি নিজে কিছু টের পাও না?
না তো! কী টের পাব?
আশ্চর্য! যদি সত্যি টের না পেয়ে থাকো তবে এখন থেকে খুব সাবধান হোয়ো সেজদা।
কিসের জন্য সাবধান করছিস?
প্রীতম মৃদু স্বরে বলল, যে মানুষ নিজের বশে থাকে না সে নানা অবস্থার চাপে পড়ে নানারকম মানুষের একটা সমষ্টি হয়ে দাঁড়ায়।
দূর! কথাটার মানেই বুঝলাম না।
তোমাকে কি আমি বোঝাতে পারি? তুমি চিরকালই আমার চেয়ে সবকিছু বেশি বোঝে।
চিরকালই তোর মাথায় অদ্ভুত সব কথা আসে। একবার যেন কোন মহাপুরুষের একটা কথা তুলে শুনিয়েছিলি, শয়তান আর কেউ নয়, শয়তান হল মানুষের প্রতিদ্বন্দ্বী ইচ্ছা। কথাটার মানে অনেক ভেবে ভেবে শেষকালে বের করেছি। অদ্ভুত কথা।
প্রীতম ভ্রু কুঁচকে বলে, অন্য সব কথা ছেড়ে এ কথাটাই বা মনে রাখলে কেন তুমি?
প্রতিদ্বন্দ্বী ইচ্ছা কাকে বলে তা বুঝতে পেরেছি বলে।
তোমার প্রতিদ্বন্দ্বী ইচ্ছা কিছু হয়?
সকলেরই হয়।
প্রীতম মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। তারপর আবার ভ্রু কুঁচকে কী যেন ভাবে। খানিক বাদে বলে, আমার মাথা পর্যন্ত এখনও রোগটা পৌঁছয়নি। যতদিন না পৌঁছয় ততদিন আমি সব বুঝতে পারব সেজদা। কিন্তু আমার আজকাল কিছু বুঝতে ইচ্ছে করে না। মনে হয় রোগটা তাড়াতাড়ি মাথায় পৌঁছে গেলে বুঝি ভাল হয়।
দীপনাথ একটু অবাক হয়ে বলে, সে কী? তুই যে নেগেটিভ চিন্তা করতে ভালবাসতি না! তুই যে আমাকে রোগের কথাটাও উচ্চারণ করতে বারণ করেছিলি?
এখন আর বারণ করছি না।
হাল ছেড়ে দিচ্ছিস?
তোমরা সংসারটাকে বেঁচে থাকার যোগ্য করে রাখোনি। এখানে কি কারও বাঁচতে ইচ্ছে করে? কদিন আগেও তো এই পৃথিবীটাই ছিল। হঠাৎ রাতারাতি তো পালটে যায়নি।
বড় পৃথিবী না পালটাক, মানুষের নিজস্ব জগতের নিজস্ব সংসারের পৃথিবী তো পালটে যেতে পারে।
তোর পৃথিবীর আবার কী অদলবদল হল?
প্রীতম ভ্রু কুঁচকে রোগা হাতে নিজের নীচের ঠোঁটটা টেনে ধরে চুপ করে থাকে। জবাব দেয় না।
খুব গাঢ় স্বরে এবং বুকে ভয় নিয়ে দীপনাথ জিজ্ঞেস করে, কিছু হয়েছে রে?
প্রীতম হঠাৎ খুব স্পোর্টসম্যানের মতো হেসে ওঠে। সোজা হয়ে বসার চেষ্টা করতে করতে বলে, হলেই বা কী? আমার তো কিছুই যায় আসে না।
দীপনাথের মনে পড়ে বিলুর সাজগোজ, অরুণ ওকে মাঝে মাঝে গাড়িতে লিফট দেয়। অক্ষম প্রীতম পড়ে থাকে ঘরে। বিলু টাটকা যুবতী।
দীপনাথ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, কী জানি কী হল!
দুনিয়া পালটে যাচ্ছে সেজদা।
হুঁ। কিন্তু পালটানোর কারণটা তো বলবি!
সব কি বলা যায়? তোমার কথাই কি তুমি আমাকে বলতে পারো? পারো না।
আমার বলার মতো কিছু নেই।
কে জানে! হয়তো আছে। হয়তো নেই।
প্রীতম, তুই কেন খামোখা আমাকে নিয়ে ভাবিস?
খামোখা নয় সেজদা। আমি একা একা সারাদিন সকলের কথা যদি না ভাবি তবে আমার সময় কাটবে কী করে?
শুধু সময় কাটানোর জন্য হলে বই পড়িস না কেন?
আমি তো নাটক নভেল ভালবাসি না। ঘরে তেমন বই নেইও কিছু। বিলু কখনওই বইটই পড়ে। আমারও ভাল লাগে না। তার চেয়ে বরং জ্যান্ত মানুষদের নিয়ে ভাবলে অনেক বেশি ভাল লাগে।
ভাল আর লাগছে কই? আমরা তো কেউ তোর মনের মতো ভাল নই!
প্রীতম হাসে না। গম্ভীর মুখেই বলে, কথাটা মিথ্যে নয় সেজদা, তোমরা কেউ আমার মনের মতো ভাল নও। কিংবা হয়তো আজকাল আমার ভালর সঙ্গে তোমাদের ভাল মিলছে না।
তা নয় রে ঘরে বসে থেকে তুই তো বাইরের সঙ্গে সম্পর্ক বেশি রাখিস না। তাই হয়তো ঠিকঠাক সব জিনিস বুঝিস না।
প্রীতম একটু হাসে। বলে, তুমি এখনও আমাকে সেই শিলিগুড়ির বাচ্চা প্রীতম বলে ভাবো বোধহয়।
কেন, তাই বললাম বুঝি?
শোনো সেজদা, আমি বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক মিটিয়েছি। শিগগিরই আমার ঘর-সংসারের সঙ্গে যে সম্পর্কটুকু আছে তাও মিটে যাবে। তখন তোমাদের ভাল নিয়ে তোমরাই একটা বিচার করে দেখো।
বহুবচনে বলছিস কেন রে? আমার সঙ্গে কাকে জড়াচ্ছিস?
এই কথায় হঠাৎ প্রীতমের ঠোঁট দুটো কি কেঁপে উঠল? টপ করে মাথা নোয়াল কেন? চোখে জল এল নাকি? একটু দূরে চেয়ারে বসেছিল দীপনাথ। কাছে উঠে এসে প্রীতমের কাঁধে আলতো করে হাত রেখে বলল, আমাকে বিশ্বাস হয় না তোর?
হয়।—খুব ক্ষীণ গলায় বলে প্রীতম, একমাত্র তোমাকেই হয়।
তা হলে সব বল। শুনি। কী হয়েছে?
প্রীতম আবার মুখ তোলে। একটা খাস ছেড়ে বলে, বাদ দাও। ওসব কিছু নয়। দুনিয়ায় সম্পর্কটার কোনও মানে নেই। এ দুনিয়ায় কে কার ভাই, কে কার বউ, তা দিয়ে কী হয় বলো তো? মারা গেলে কোন অসীম অন্ধকারে হারিয়ে যাব সবাই, কে কার থাকবে?
এ কথাটার মানেও বুঝলাম না। সহজ করে বুঝিয়ে দে।
কিছু বোঝানোর নেই।
বিলু কি তোর দিকে নজর দিচ্ছে না?
প্রীতম এ কথাটার জবাব চট করে দিল না। একটু অস্থির হল যেন। দুটো হাত বারবার কোল থেকে হাতলে, হাতল থেকে চাকায় স্থানান্তরিত করল। চোখের পলক ফেলল ঘন ঘন। তারপর বলল, বিল বিলুর মতোই।
বুঝিয়ে বল।
প্রীতম খুব আস্তে করে বলল, মাঝখানে ক’দিন বিলু খুব আপনজন হয়ে উঠেছিল। ঠান্ডা বিলুর ভিতর খানিকটা উত্তাপ টের পেতাম। তুমিও হয়তো লক্ষ করেছ। আমি ইচ্ছাশক্তির কথা বলতাম। ও সেটা বিশ্বাসও করত।
চমৎকার। তারপর কী হল?
ও আমাকে অন্য চোখে দেখতে লাগল হঠাৎ। খুব বেশি নজর রাখত, খুব বেশি ভাবত আমাকে নিয়ে। তারপরই চাকরিতে ঢুকে গেল। গোটা একটা ছবিই যেন ভেঙে পড়ে গেল আচমকা।
চাকরিতে ঢুকলে মেয়েদের একটু বদল হয়। সারাদিন খাটে, ঘরে এসে আবার সংসারের ঝামেলা পোয়ায়।
আমার সেই কনসিডারেশন নেই ভাবছ? থাকলে ভালই তো।
মেয়েদের চাকরি করা আমি পছন্দ করি না ঠিকই। কিন্তু যখন বিলু চাকরিতে ঢুকল তখন থেকেই আমি মনকে প্রস্তুত করেছি। মন নিয়েই তো আমার সারাদিন কাটে। সারাদিন তো শরীরের লড়াইতে হেরে যাচ্ছি, তাই মনকে খুব শাসনে রাখি। যে-কোনও অবস্থার জন্য আমার মন তৈরি থাকে।
তা হলে অসুবিধেটা কোথায়?
বাইরে থেকে দেখলে বোঝা যাবে না, সেজদা। ছোটখাটো অনেক ব্যাপার ঘটে যায়।
কীরকম? একটু খুলে বল।
বিলু চাকরি করতে যাওয়ার পর প্রথম-প্রথম সবই ঠিক ছিল। কোনও কিছুই পালটায়নি! শুধু ও না থাকলে বাড়িটা ফাঁকা লাগে মাত্র। সারাদিন বিলুর জন্য অপেক্ষা করতাম। বিলুও ফিরত আমার জন্য আকুলি ব্যাকুলি হয়ে। তারপর ক্রমে ক্রমে বিলুর বোধহয় ক্লান্তি এল। অনেকদিন ধরে এক রুগি-স্বামীর ঘর করছে। ক্লান্তি আসা স্বাভাবিক। সঙ্গে অফিসের খাটুনিও যোগ হয়েছে। কিন্তু সে ক্লান্তি একরকম। অন্যদিকে আর-একটা ক্লান্তিও আছে। সেটা হল আশা বা ভরসার ক্লান্তি। ও আমাকে একদিন বলল, ইচ্ছাশক্তির জোরে মানুষ সবকিছুকে জয় করতে পারে না। আধুনিক বিজ্ঞানে ইচ্ছাশক্তির কোনও দাম নেই। তুমি ঠিকমতো ওষুধ খাও, চিকিৎসা করা হচ্ছে, ঠিক সেরে যাবে।
কেন বলল ওকথা?
ওর ধারণা সারাদিন ইচ্ছাশক্তির ব্যায়াম করলে আমার মন ক্লান্ত হয়ে পড়বে। মাথাও বিগড়ে যাবে।
দীপনাথ একটু হেসে বলে, তাতেই বা কী? ও যদি বলেই থাকে তো বলুক না। তুই কান দিস কেন?
প্রীতম মাথা নেড়ে বলে, কান দিই কারণ কথাটা ওর নিজের নয়। আর কেউ ওর মুখে কথাটা বসিয়েছে। বিলু আধুনিক বিজ্ঞানের খবর রাখে না, ইচ্ছাশক্তির কার্যকারণও ওর জানা নেই।
হয়তো হঠাৎ ভেবে ফেলেছে, জেনে ফেলেছে!
তা নয়। আমার অনুভূতি তোমাদের চেয়ে এখন অনেক বেশি প্রখর। আমি তো বাইরে যাই না। তাই চারদিকের সঙ্গে ঘষা খেয়ে খেয়ে আমার অনুভূতি ভোতা হয়ে যায়নি। আমি নিজেকে নিয়ে থাকি, মনে শান দিই, যুক্তি দিয়ে সবকিছুকে বিশ্লেষণ করার অবসর পাই।
বুঝলাম। বল।
আমি যে মরতে চাই না এটা বিলুর চেয়ে আর বেশি কে জানে বলল! আমার নিজস্ব পদ্ধতিতে আমার লড়াই চালাচ্ছি। আমার আশা ছিল, বিলু অদ্ভুত সে লড়াইতে আমাকে সাপোর্ট দেবে। কিন্তু সেই প্রথম দিককার বিলুকে যেমন ঠান্ডা আর পর মনে হত, আজকাল বিলু যেন তাই হয়ে গেছে। কোনওদিন আমার ভাবনা-চিন্তার সঙ্গে বিলু তো একমত ছিল না। মাঝখানে একটু হয়েছিল। আবার এখন সেই আগেকার বিলু।
তোর কী ধারণা?
প্রীতম মাথা নেড়ে বলে, অন্য কেউ বিলুর ভাবনা-চিন্তাকে প্রভাবিত করে এটা আমার পছন্দ নয় সেজদা।
অন্য কেউটা কে? অরুণ?
তার আমি কী জানি! আমি তো ওদের দুজনের মধ্যে কী কথা হয় তা জানি না।
দীপনাথের বুকের ভিতরটা ফাঁকা লাগছিল। এরকম কিছু হবে তা তো সে জানতই। মুখে অবশ্য বলল, বিলুর কথা নিয়ে তুই মাথা ঘামাস না।
একেবারে উদাসীনও থাকতে পাবি না। বললাম যে মৃত্যুর সঙ্গে আমার লড়াই একেবারেই আমার নিজস্ব। ওষুধ বলো, ডাক্তার বলো, কেউ তো আমাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারবে না। হয়তো আমার ইচ্ছাশক্তিরও তেমন ক্ষমতা নেই। কিন্তু তা বলে লড়াইটায় এত সহজে হেরে যাব? কেউ আমার লড়াইটাকে বুঝবে না?
বিলু ভুল করেছে। আমি ওকে বুঝিয়ে বলব।
প্রীতম মাথা নাড়ে, তার চেয়ে তুমি আমার বাড়িতে একটা চিঠি লিখে দাও। শতম এসে আমাকে নিয়ে যাক।
শিলিগুড়িতে যাবি?–হঠাৎ উৎসাহে একটু চেঁচিয়ে ওঠে দীপনাথ।
প্রীতম ম্লান মুখে ক্লিষ্ট একটু হাসি ফুটিয়ে দীপনাথের দিকে চেয়ে বলে, তুমি ভুলে গেছ সেজদা?
কী ভুলেছি?
তোমাকে বলিনি কখনও আমাকে আমার মায়ের কথা, ভাইদের কথা, শিলিগুড়ির কথা বোলো! ওসব মনে পড়লে আমি হাল ছেড়ে দিই, আমার লড়াই করার জোর থাকে না। বলিনি?
দীপনাথ একটু অবাক হয়ে বলে, কিন্তু এখন যে তুই নিজেই বললি!
কেন বললাম তা তো ভেবে দেখলে না সেজদা!
কেন?
প্রীতম ঠোঁটকে রবারের মতো টেনে হাসিটা বজায় রাখল। বলল, তার মানে তো দাঁড়ায়, আমি হাল ছেড়ে দিয়েছি, লড়াইয়ে হেরে গেছি। এখন আমার মন মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত।
দীপনাথের কপালে ভাজ পড়ে। বহুকাল বাদে সে আজ খুব সিরিয়াস হয়। গম্ভীর গলায় বলে, শোন প্রীতম, বিলুর সামান্য কথায় তোর এত কিছু হয়নি। তুই আমার কাছে কিছু লুকোচ্ছিস। বল তো কী হয়েছে।
না, না…
বলতে বলতে কোনওদিন যা হয় না তা আজ হল। আচমকা প্রীতমেব গলা ভেঙে বসে গেল। চোখ দুটো পলকে রাঙা হয়ে উঠল। সে দু’হাতে মুখ ঢাকল।
প্রীতম! প্রীতম! এই পাগলা! ওরকম করছিস কেন?
প্রীতম সাড়া দিল না। মুখ ঢেকে কয়েকটা হেঁচকি তুলল। তারপর গোঁজ হয়ে স্থির হয়ে রইল অনেকক্ষণ। যখন মুখ তুলল তখন সে মুখ পাথরের মতো হয়ে গেছে।
দীপনাথ ওকে একটা ঝাকুনি দিয়ে বলল, বলবি না তো বলিস না। আমি কিছু শুনতেও চাই না। কিন্তু দোহাই আমার মুখ চেয়ে অন্তত ভেঙে পড়িস না। আর কেউ চাক বা না চাক, আমি চাই তুই বেঁচে থাক। আমি তোর ইচ্ছাশক্তির জয় দেখতে চাই। আমি নিজে ইচ্ছের লড়াইতে মার খেয়ে গেছি। আই হ্যাভ নো মর্যালিটি। কিন্তু আমার চোখের সামনে তুই তো আছিস!
প্রীতমের মুখের পাথর নরম হল। একটু হাসলও সে। বলল, সেজদা, তুমি কোনওদিন সাবালক হবে না। ওসব কী বলছ? আমি তোমার আইডিয়াল?
দীপনাথ একটু ধাতস্থ হয়। একটু লজ্জাও পায়। তারপর ক্ষোভের সঙ্গে বলে, একটু ইমোশন এসে গিয়েছিল। তুই এরকমভাবে কথা বলিস কেন?
ঠিক আছে, বলব না। কিন্তু আমি তো বলতে চাইনি। তুমিই তখন থেকে বলতে বলছ।
দীপনাথ গম্ভীর হয়ে বলে, কিছু কথা আছে না শোনাই ভাল। ওগুলো চাপা থাকলে শান্তিতে থাকব।
আমিও তাই বলি।
দীপনাথ ঘড়ি দেখে বলে, সাতটা বাজতে চলল, বিলু এখনও এল না? লাবুই বা কোথায়?
লাবু পাশের ফ্ল্যাটে ওর সমবয়সি একটি মেয়ের সঙ্গে মাদ্রাজি টিচারের কাছে প্রাইভেটে পড়ে।
অচলা? বিন্দু?
বিন্দু রান্নাঘরে আছে। অচলার ছেলের অসুখ বলে ক’দিন আসছে না।
তুই তা হলে একা?
ঠিক একা নই। আমার সঙ্গে হাজারও ভূতের ভাবসাব। তারা আছে।
দীপনাথ হেসে বলে, তোর সঙ্গী ভূত ছাড়া আর কে হবে? অত পাগলামি সইবে কে?
তুমি কি এখনই যাবে?
দীপনাথের একটু কাজ আছে। ঘড়ি দেখে বলল, রাত হল।
যাবে তো যাও।
একটু বসি। বিলুর সঙ্গেও দেখাটা হয়ে যাবে।
প্রীতম মাথা নেড়ে বলে, না, যাও সেজদা! আমি এখন একটু একাই ভাল থাকব। আমার মনে মনে কিছু হিসেব কষতে হবে।
কর তা হলে। কিন্তু হিসেবের অঙ্কে মাইনাস বসাস না। সব প্লাস।
ঠিক আছে। চেষ্টা করব। অন্তত একজন তো আমাকে বেঁচে থাকতে দেখতে চায়।
অনেকেই চায়। তুই জানিস না।
দীপনাথ বেরিয়ে আসে। আজকাল মন ভাল থাকে কমই। তবু আজ বিকেলে যেন আরও ভরাড়ুবি হল। খুব আনমনে সে নিউ আলিপুরে যাওয়ার একটা ভিড়ঠাসা বাসে উঠে পড়ল। বহুদিন বোস সাহেবের বাড়িতে যায়নি।
বাসে আচমকাই বেলফুলের ঝাঁঝালো গন্ধ এল নাকে। এই এক গন্ধই মনের বিষাদকে উড়িয়ে নিয়ে যায়। আজ বোধহয় বিয়ের তারিখ।