৪০. হাত কখনো ছাড়ব না

৪০

‘আমি প্রতিজ্ঞা করছি, এই হাত কখনো ছাড়ব না। আজীবন তোর পাশে থাকব। প্রতিজ্ঞা করছি, ধর্ম, পরিবার, সমাজ কোনো কিছু আমাকে তোর। থেকে দূরে সরাতে পারবে না। প্রতিজ্ঞা করছি, কখনো তোকে কাঁদাব না। প্রতিজ্ঞা করছি, তুই ছাড়া অন্য কোনো মেয়ে আমার জীবনে আসবে না। প্রতিজ্ঞা করছি, পরীক্ষার হলে তোকে একা রেখে বের হব না। প্রতিজ্ঞা করছি, তোকে প্রতিদিন চালতার আচার কিনে দেব। প্রতিজ্ঞা করছি, বৃষ্টির মধ্যে টংদোকানে বসে চা খেতেও আপত্তি করব না আর। প্রতিজ্ঞা করছি, তোর সব প্র্যাকটিক্যাল আমি করে দেব। আর…ঐশ্বরিয়ার পেটের দিকেও তাকাব না।’

এই প্রতিজ্ঞাগুলো করেই প্রিয় পেট্রাকে নিজের জীবনে এনেছিল। কয়টা রাখতে পেরেছে? সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণগুলোই রাখতে পারে নি। গভীর রাতে সিগারেট খেতে খেতে এসবই ভাবছিল প্রিয়। নিজেকে খুব নিকৃষ্ট প্রাণী বলে মনে হচ্ছিল।

তার পেছনে লাগিয়ে রাখা গুপ্তচর কবিরের সঙ্গে বাবর খানের কথা লুকিয়ে শুনেছে নিকিতা। মাত্র কয়েকদিন আগে কবিরের পাসপোর্টের মেয়াদ ফুরিয়ে যাওয়ায় নাকি প্রিয়র পেছনে পেছনে এবার যেতে পারে নি বাবর খানও দেশের বাইরে থাকায় নিজে যেতে পারেন নি। এর আগে প্রিয় যতবার যেখানেই গেছে, কবির নাকি ফলো করেছে। সর্বনাশ! ভাগ্যিস, আগেরগুলো সত্যি সত্যিই অফিশিয়াল ট্যর ছিল। প্রিয় এবারের মতো বেঁচে গেছে। না হলে বাবা কী করত কে জানে! লোকটা যদি তার কোনো ক্ষতি করত, তাহলে সে তাকে ভয় পেত না। লোকটা সব সময় তার প্রিয়জনদের ক্ষতি করে তাকে কষ্ট দেয়। আর সে যা-ই করে, তা টের পাওয়া যায় করার পর। আগে ঘুণাক্ষরেও জানা যায় না। তাই তাকে সত্যিই ভয় হয়। তবে কবিরের ব্যাপারটা জানায় ভালো হয়েছে। এরপর থেকে সাবধানে থাকতে হবে।

.

পেট্রা ঘুম থেকে উঠতে না উঠতেই প্রিয়র ফোন এল। প্রিয়র নম্বর দেখেই যথারীতি হার্টবিট ফাস্ট হয়ে গেল, যেমনটা সব সময় হয়। পেট্রা বুঝতে পারছে না ফোন ধরাটা ঠিক হবে কি না। প্রিয় গেছে এক মাস হয়ে গেছে। এর মধ্যে সে অনেকবারই ফোন করেছে কিন্তু মাত্র দুবার ফোন ধরেছে পেট্রা। প্রিয়র সঙ্গে কথা না বলে সে থাকতে পারে। বরং কথা বলেই থাকতে পারে না। একবার কিছুক্ষণ কথা বললেই বুকের ভেতর ঝড় শুরু হয়ে যায়। দিনরাত ২৪ ঘণ্টা কথা বলতে ইচ্ছা করে। সবকিছু অসহনীয় হয়ে ওঠে। প্রিয় এতবার ফোন দিচ্ছে, শেষমেশ ধরল পেট্রা। ফোন ধরার সঙ্গে সঙ্গেই প্রিয়র ধমক, ‘সমস্যা কী তোর?

‘ঘুমিয়ে ছিলাম। কেমন আছিস?

‘জাহান্নামে যেমন থাকা যায়।

‘কী হলো আবার?

‘এক শবার ফোন দিছি, পেট্রা।

‘আমি ফোন সাইলেন্ট করে ঘুমাই প্রিয়।’

‘বাহ দারুণ! আজকে না হয় ঘুমাচ্ছিলি। এত দিন?

‘ব্যস্ত ছিলাম।

‘শুদ্ধর সাথে প্রতিদিন কথা বলার সময় তো তুই ব্যস্ত থাকিস না।’

‘উফ। ঝগড়া করতে ফোন করেছিস?

প্রিয় এবার একটু নরম হলো। তারপর জিজ্ঞেস করল, ‘না, তোর অবস্থা কী? সুখবর আছে কোনো?

পেট্রা হেসে বলল, এত তাড়াতাড়ি?

‘কই তাড়াতাড়ি? এক মাস হয়ে গেছে তো?

‘আমি টেস্ট করি নি।

‘কেন?

‘ভয় লাগছে, যদি রেজাল্ট নেগেটিভ হয়!

‘বেক্কল! টেস্ট করাবি আজই। প্রতিদিন অপেক্ষা করি এই সুখবরটার জন্য। চিন্তায় আমার অবস্থা নাজেহাল।

‘আজ সম্ভব না। এই মাসেই রায়ান এসেছে, বাড়তি খরচ গেছে অনেক। তাই হাত একদম খালি। স্যালারি পাই নি এখনো।

‘আমি টাকা পাঠাই, প্লিজ?

‘না প্রিয়, প্লিজ। আমি সপ্তাহখানেকের মধ্যে স্যালারি পেয়ে যাব। তারপর টেস্ট করে তোকে জানাব।’

‘জানতাম আমার টাকা নিবি না। ঠিকাছে, আজকাল তো ঘরে বসেও টেস্ট করা যায়। করে জানা, প্লিজ।

‘আরে ধুর, ওসবে ভরসা নেই। আমি হসপিটালেই যাব।’

‘ঠিকাছে, আমাকে যত দ্রুত সম্ভব জানাবি।’

‘হুম, জানাব, তবে প্রিয়, এই জানানো পর্যন্তই। তারপর এই বাচ্চার অছিলায় তুই আমার সাথে যোগাযোগ রাখতে পারবি না। বাচ্চার সব দায়িত্ব শুধুই আমার।

প্রিয় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘জানতাম এটা বলবি।’

‘যৌক্তিক কথা বলেছি। এই অছিলায় তোর সাথে যোগাযোগ রাখলে তো তোর সাথে ঘর করতেও পারতাম, তাই না?

‘বাচ্চাটা তো আমারও।’

‘হ্যাঁ, কিন্তু আমি তোর কাছে চেয়ে নিয়েছি।

‘ঠিকাছে অন্তত বাচ্চার জন্ম পর্যন্ত যোগাযোগ রাখ। তেমন কিছুই তো করতে পারব না, শুধু দূর থেকে একটু সাপোর্ট দিতে দে।

পেট্রা হেসে বলল, আচ্ছা, সেটা যখনকারটা তখন দেখা যাবে।

‘আর শোন না, পেট বড় হলে তাকে কেমন লাগবে, একটু দেখতেও পারব না?

‘আরে পাগল, তুই আরেকবার আসতে গেলে তোর বাপের কাছে ধরা খাবি।’

‘উফ, তাহলে কি আমি আমার ছেলেটাকেও একবার দেখতে পাব না?’

‘ছবি পাঠাব, তা-ই দেখিস। ভিডিও কলে দেখিস। দেখা করতে এলে হয়তো…’

‘হয়তো?

পেট্রার বলতে ইচ্ছা করল, হয়তো জন্মেই মরা লাগবে বাচ্চাটার, কিন্তু এ কথা বললে প্রিয় কষ্ট পাবে। তাই বলল না। শুধু বলল, ‘সাবধানে চলবি প্রিয়, তোর বাবা যেন এই বাচ্চার কথা কখনো জানতে না পারে।

‘জানবে না। তুই দেখিস।’

‘কীভাবে এত শিওর হচ্ছিস?

প্রিয় কবিরের ব্যাপারে সব খুলে বলতেই পেট্রা বলল, ‘দেখলি তো, আমি বলেছিলাম না নিকিতা খারাপ নয়, ও শুধু ইম্যাচিওরিটি থেকে উল্টোপাল্টা কাজ করত। এখন বয়স বেড়েছে, ভুল থেকে শিখেছে, বুঝদার হয়েছে। এখন তার বাবার লাটাই তার বিরুদ্ধেই ঘুরছে।

‘হুম, এখন ও আমার স্পাই হয়ে গেছে। সারা দিন বাবার ঘরে আড়ি পেতে সব খবরাখবর আমাকে দেয়।

‘দারুণ, এই না হলে বউ!’

বউ কথাটা কানে লাগল প্রিয়র। যদিও জানে পেট্রা ওটা সরল মনেই বলেছে। প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য বলল, ‘আচ্ছা শোন, তোর কি কোনো সিম্পটমস আছে?

‘কিসের সিম্পটমস?

‘ওই যে আমার ছেলেটা যে আসছে, সেই সিম্পটমস।’

পেট্রা হেসে ফেলল, তুই জেনেই বসে আছিস যে ছেলে হবে?

‘কী জানি, মনে তো হচ্ছে ছেলেই হবে।

পেট্রা খুশিতে গদগদ হয়ে বলল, ‘ইশ প্রিয়, সত্যিই যদি ছেলে হয়, আমি তো খুশিতে মরেই যাব। শুদ্ধকে ছাড়া থাকার কষ্টটা ভুলতে পারব।

প্রিয়র খুব ভালো লাগছিল এত দিনে পেট্রাকে একটু খুশি দেখে।

.

প্রিয় অফিস থেকে ফিরে দেখল, নিকিতা বারান্দায় মনমরা হয়ে বসে আছে। এটা খুব অস্বাভাবিক। সে আসার আগেই নিকিতার চঞ্চলতা শুরু হয়ে যায়। প্রজাপতির মতো উড়তে থাকে যে মেয়েটা, সে আজ চুপচাপ বসে আছে! তার আসাটা টেরই পায় নি। প্রিয় ঘর থেকেই ডাকল। ডাক শুনে ঘরে এল নিকিতা। বলল, তুমি কখন এলে?

প্রিয় ঘড়ি খুলতে খুলতে বলল, ‘এইমাত্র। তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন? মন খারাপ?

‘তুমি ফ্রেশ হয়ে রেস্ট নাও, পরে বলি।

প্রিয় শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে বলল, এখনই বললো, ব্যাপারটা সিরিয়াস মনে হচ্ছে।’

নিকিতা উশখুশ করছে। প্রিয়র শার্টের বোতাম অর্ধেক খোলা হয়েছিল, বাকিটা ও রকমই রইল। নিকিতার কাছে গিয়ে বলল, ‘কী হয়েছে?

‘সর্বনাশ হয়ে গেছে।’

‘কী?

‘আনিসা পেট্রা আপুর ভাইয়ের সাথে প্রেম করছে।

‘হোয়াট!

‘কেউ ওদের দুজনকে রাস্তায় দেখে মা-বাবাকে জানিয়েছিল। পরে বাবা আনিসাকে জিজ্ঞেস করতেই ও হড়হড় করে সব বলে দিয়েছে। কোনো ভয়ডর নেই প্রাণে। কত্ত ডেসপারেট!

‘বলো কী!’

হ্যাঁ, ওরা এক কলেজে পড়ত। সেই থেকে প্রেম। হায় খোদা, এখন কী হবে?

‘তুমি এত কিছু কীভাবে জানলে? তোমার মা-বাবা বলেছে?

‘মা বলল খ্রিষ্টান এক ছেলের সাথে প্রেম। ছেলের নাম রায়ান। ছেলে কয়েক দিন আগেই মালয়েশিয়াতে গেছে, মেডিকেলে পড়ছে। এসব শুনে আমি মিলিয়ে নিয়েছি যে পেট্রা আপুর ভাই হবে। কী হবে? কী করব আমি?

‘তুমি আবার কী করবে? তোমার মা-বাবাই সিদ্ধান্ত নেবে।’

নিকিতা প্রিয়র হাত চেপে ধরে বলল, ‘মা-বাবাকে তুমি চেনো না। ধরে বিয়ে দিয়ে দেবে এবার ওকে। এমনিতেই আমাদের পরিবারে প্রেম করে বিয়ে করা হারাম, তার ওপর খ্রিষ্টান ছেলে! ছেলে দেশেও নেই। সবচেয়ে বড় চিন্তার বিষয় হলো, আনিসা রিদিমার মতো গাধী না। ওর খুব জেদ, খুব সাহস। কী থেকে কী করে ফেলবে, ঠিক নেই। আমার বোনটাকে কীভাবে বাঁচাব, প্রিয়?

প্রিয় নিকিতার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ‘আচ্ছা, তুমি এত চিন্তা কোরো না। আমি ভেবে দেখি কী করা যায়।’

.

পেট্রা এসির মধ্যে বসেও ঘামছে। হাত-পা কাঁপছে। এমনিতে তার সাহস ও আত্মবিশ্বাস–দুটোই প্রচুর পরিমাণে রয়েছে। তাই কোনো কাজেই বিচলিত হয় না। জীবনে কখনো এতটা বিচলিত হয় নি সে, যতটা আজ। একটু পরই তার মেডিকেল রিপোর্ট দেবে। যদি প্রেগন্যান্ট হয়ে যায়, তবে জীবনের সবচেয়ে বড় জ্যাকপট সে পেয়ে যাবে। কিন্তু যদি না হয়? আর ভাবতে পারছে না। চুপচাপ বসে আছে।

কিছুক্ষণ পর রিপোর্ট হাতে পেল পেট্রা। রেজাল্ট নেগেটিভ দেখার সঙ্গে সঙ্গে চোখ ফেটে কান্না এল। এবং যেটা সে কখনো করে না, তা-ই করল। ডাক্তারের সামনেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। ডাক্তার হাসিমুখে বোঝাল, ‘মিস রোজারিও, ভেঙে পড়বেন না। আপনার কোনো শারীরিক সমস্যা নেই। ট্রাই করতে থাকুন, সাকসেসফুল হবেন।

পেট্রা কিছুতেই কান্না থামাতে পারছিল না। জীবনে এত কিছু হয়ে গেছে, এত কিছু হারিয়েছে, কখনো মরে যেতে ইচ্ছা করে নি। যুদ্ধ করে বেঁচে থাকার চিন্তা করেছে সব সময়। এমনকি করেছে, কিন্তু এখন ঠিক এই মুহূর্তে তার মরে যেতে ইচ্ছা করছে।

.

প্রিয় লাঞ্চ করছিল। ঠিক তখনই একটা মেসেজ এল। পেট্রার মেসেজ দেখে হার্টবিট বেড়ে গেল। কতবার ফোন করেছে মেয়েটাকে, সে ধরে নি। আজ নিজেই মেসেজ পাঠিয়েছে! মেসেজটা ওপেন করতেই শুধু দুটো শব্দের একটা মেসেজ দেখতে পেল, ‘Result negative’। প্রিয়র পৃথিবীটা ভেঙে পড়ল। সৃষ্টিকর্তা এত নিষ্ঠুর? খাওয়া ছেড়ে উঠে গেল। হাত ধুতে ধুতেই কল করল পেট্রাকে। প্রিয়র কল দেখে পেট্রা ফোনটা সাইলেন্ট করে রেখে দিল। এখন প্রিয়র সঙ্গে কথা বললে সে আরও আবেগপ্রবণ হয়ে পড়বে।

অনেকবার ফোন করার পরও পেট্রা যখন ফোন ধরল না, প্রিয় ফোন ধরার রিকোয়েস্ট করে মেসেজ পাঠাল। ততক্ষণে পেট্রার কান্না থেমে গেছে। পেট্রা ফোন করল, ‘প্রিয়, এত কল দেওয়া লাগে? আমি অফিসে ব্যস্ত ছিলাম।

‘সরি। দুশ্চিন্তায় আমার মাথা কাজ করছিল না।’

‘কেন? সব টেনশন তো শেষ। রেজাল্ট তো পেয়ে গেছিস।

‘আমি এখনো মানতে পারছি না।’

‘যা হয়, ভালোর জন্যই নাকি হয়। দেখি এতে কী ভালো হবে আমার?

‘মন খারাপ করিস না। আমরা আবার চেষ্টা করব।’

‘আর কখনো না, প্রিয় জেনে বুঝে এক ভুল বারবার করা যায় না। উচিতও নয়।

‘পেট্রা!

‘একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে রে। অফিসে মন দিয়ে কাজটাজ করে ভালোই উন্নতি করছিলাম আমি। এখন বাচ্চা হলে তো অনেক দিনের গ্যাপ পড়ে যেত।

‘আমাকে মাফ করে দে, পেট্রা। আমি সারা জীবনেও তোকে কিছু দিতে পারি নি।

‘অনেক ভালোবাসা দিয়েছিস, প্রিয়। যা সব মেয়ে পায় না। আচ্ছা, এখন রাখছি। অফিসে আমি।’

.

সারাটা দিন প্রিয়র যে কীভাবে গেল, তা প্রিয় নিজেও বলতে পারবে না। এত অসহায় লাগছিল। তার ভিসার মেয়াদ শেষ, চাইলেও এখনই পেট্রার কাছে যেতে পারবে না। বাসা থেকে অনেকবার কল এসেছে, ধরে নি। অফিসে কী করেছে না করেছে জানে না। অফিস শেষে যখন বাসায় এল, দেখল বাসাভর্তি লোকজন। এত লোক কোত্থেকে এসেছে, কেন এসেছে, কে জানে! নিকিতার মা-বোনদেরও দেখতে পেল। সে বাসায় ঢুকতেই সবাই হইচই শুরু করে দিল। বাবর খান কাছে এসে কাঁধে হাত রেখে বললেন, ‘কংগ্রাচুলেশনস, মাই বয়।

প্রিয় কনফিউজড হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কিসের জন্য?

তিনি হেসে বললেন, তুমি বাবা হতে যাচ্ছ। নিকিতা প্রেগন্যান্ট।

প্রিয় এত বড় ধাক্কার জন্য প্রস্তুত ছিল না। তার মাথা ঘুরতে লাগল। তাকে দেখতে পেয়ে শুদ্ধ দৌড়ে এসে বলল, ‘বাবা বাবা, জানো, কী মজা, আমার একটা ছোট্ট ভাই অথবা বোন আসবে।’

প্রিয় নিকিতার দিকে তাকাল। নিকিতা শুকনো মুখে মাথা নিচু করে মায়ের পাশে বসে আছে। প্রিয় কোনো কথা না বলে সোজা নিজের ঘরে চলে গেল। কী হচ্ছে এসব? প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই নিকিতা এল ঘরে। প্রিয় বলল, এসবের মানে কী, নিকিতা?

নিকিতা ভয়ে ভয়ে বলল, ‘আমি কিছু জানি না, বিশ্বাস করো। কদিন ধরেই আমার শরীরটা ভালো লাগছিল না। কিন্তু আমি কিছু বুঝতে পারি নি। আজকে ক্যাম্পাসে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলাম। আমার বন্ধুরা তোমাকে ফোন করেছিল। তুমি ধরো নি। পরে বাবাকে ফোন করায় বাবা গিয়ে নিয়ে এসেছে। ডাক্তার এসে দেখে বলল আমি নাকি প্রেগন্যান্ট!

‘আমি তোমাকে বলেছিলাম না আমি বাচ্চা চাই না?

‘আমার কী দোষ? প্রটেকশন তো তুমি ইউজ করো। তাহলে ভুলটা কি আমার?

প্রিয় নিকিতাকে ধরে বলল, ‘নিকিতা, ভুলটা হয়তো আমারই ছিল। আমি জানি না কেন আমি তোমাকে প্রশ্নগুলো করলাম। কিন্তু আমি এই বাচ্চা চাই না। কালকেই আমি তোমাকে হসপিটালে নিয়ে যাব অ্যাবরশন করাতে। এখন কাউকে কিছু বলবে না। পরে বলবে মিসকারেজ হয়ে গেছে। প্লিজ আমার এই কথাটা তুমি রাখো।’

নিকিতার চোখে জল এল। সঙ্গে সঙ্গে সে বলল, ‘অসম্ভব, আমার প্রথম বাচ্চা।’

‘প্রথম বা শেষ বুঝি না, নিকিতা। আমার সাথে থাকতে হলে তুমি কখনো মা হতে পারবে না। শুদ্ধ আছে তো? ও আমাদের একমাত্র ছেলে হয়ে থাকবে। আর কোনো বাচ্চা আমাদের দরকার নেই।

নিকিতা হঠাৎ বসে পড়ে প্রিয়র পা জড়িয়ে ধরল। কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘মাফ করো আমাকে। যখন তুমি বলেছিলে কখনো বাচ্চা নেবে না, আমি মেনে নিয়েছিলাম। কিন্তু অ্যাকসিডেন্টলি যখন এসে পড়েছে, আমি ওকে মারতে পারব না।’

‘ঠিকাছে, তাহলে আমাকে ছেড়ে দাও। তারপর তোমার বাচ্চা নিয়ে তুমি যেখানে খুশি চলে যাও।

‘এভাবে বলছ কেন? বাচ্চাটা তো তোমারও।

‘আমি অস্বীকার করছি না। কিন্তু আমি এই বাচ্চা চাই না, নিকিতা।

‘আমি জানি তুমি শুদ্ধকে নিয়ে ভয় পাচ্ছ। বিশ্বাস করো আমি নিজের বাচ্চা হওয়ার পরও ওকে ঠিক এখনকার মতোই আদর-যত্ন করব। ও তো আমার বড় সন্তান।’

‘নিকিতা, পা ছাড়া। আমি যা বলার বলে দিয়েছি। আমি কিছুতেই এই বাচ্চার জন্ম হতে দেব না।’

নিকিতা উঠে দাঁড়াল। প্রিয়র মুখটা দুহাতে ধরে বলল, তুমি এমন কেন করছ? আমি কী অপরাধ করেছি? তুমি যা বলবে, আমি শুনব। যেভাবে বলবে, সেভাবেই চলব। তুমি যদি পেট্রা আপুর সাথেও সম্পর্ক রাখতে চাও, আমি তোমাকে সাহায্য করব, যাতে বাবা টের না পায়, সন্দেহ না করে। তবু তুমি প্লিজ, আমার বাচ্চাটাকে মারতে বোলো না। আমি পারব না।’

এ কথা বলেই নিকিতা প্রিয়কে জড়িয়ে ধরে পাগলের মতো কাঁদতে লাগল। প্রিয় নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, ‘নিজের মা-বোনদের সময় দাও। আমি এখন একটু একা থাকতে চাই।’

নিকিতা তখনো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদছিল। প্রিয় হাতজোড় করে বলল, দয়া করে এখান থেকে যাও।’

নিকিতা প্রচণ্ড ভয় নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে গেল। প্রিয় দরজা আটকে বসে রইল। বুকটা ফেটে যাচ্ছিল তখন। চোখের জলের বাঁধ ভেঙে গেছে আজ। কাঁদতে কাঁদতে প্রিয় এটাই ভাবছিল, সে বাবা হতে পারছে

বলেই দুপুরবেলা খুব কষ্ট হচ্ছিল, আর এখন বাবা হতে যাচ্ছে বলেই এত কষ্ট হচ্ছে! যে মেয়েটার কাছে স্বামী, সন্তান, শ্বশুরবাড়ি, বাপের বাড়ি-সব আছে, তাকে আল্লাহ একটা বাচ্চা দিয়ে দিল, আর যে মেয়েটা এতিম, কেউ নেই পাশে, তাকে আল্লাহ এভাবে নিরাশ করল? আর এই দুটো খবর আজ একই দিনে পাওয়া লাগল? এ সৃষ্টিকর্তার কেমন লীলাখেলা? নিকিতা তো কোনোভাবেই বাচ্চাটা নষ্ট করতে চাইছে না। কোনো মা-ই চাইবে না। প্রিয় কী করবে তাহলে? এই বাচ্চা জন্মানোর আগে ওর কি মরে যাওয়া উচিত না?

৪১

কদিন ধরে নিকিতার শরীর বেশ খারাপ। প্রিয় অফিস থেকে ফিরতেই শুদ্ধ দৌড়ে এল, ‘বাবা, নিকিমা খুব অসুস্থ। আমার ভাইবোন চাই না, ডক্টর নিয়ে আসো, নিকিমাকে সুস্থ করে দিতে বলো। প্লিজ বাবা।

‘কী হয়েছে আবার?

‘জানি না, খুব অসুস্থ, শুধু শুয়ে শুয়ে কান্না করে।’

প্রিয় ঘরে ঢুকে দেখল, নিকিতা বিছানার মাঝখানে গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে। প্রিয় কাছে গিয়ে বসে মাথায় হাত রাখতেই নিকিতা চোখ মেলল। উঠতে চাইলে প্রিয় বলল, ‘কী হয়েছে? অসুস্থ লাগছে? ডাক্তার ডাকব?

‘ডাক্তার লাগবে না। অনেকবার বমি হয়েছে, খারাপ লাগছিল, তাই শুয়ে ছিলাম।

ততক্ষণে শুদ্ধ নিকিতার মাথার কাছে বসে চুলে বিলি কেটে দিতে শুরু করেছে। নিকিতা চোখ তুলে তাকিয়ে শুদ্ধর হাতটা ধরে সেই হাতে চুমু খেল। প্রিয় বলল, ‘বিশ্রাম নাও তাহলে!’

প্রিয় ফ্রেশ হয়ে কাজের মেয়ের কাছে চা চাইতে গেল। তখন মেয়েটা বলল, ভাইজান, ভাবি কিন্তু সারা দিন কিছু খায় নাই। প্রতিদিন তো তার মা বইনেরা আইসা খাওয়াইয়া যায়, আজকে ক্যান জানি কেউ আসে নাই। সে ও রইছে না খাইয়া। খালি পেটে কত্তবার বমি করছে, তাইলে বুঝেন অবস্থা!

‘আচ্ছা, ওর খাবার রেডি করে দাও, আমি খাইয়ে দেব।’

টিচার আসায় শুদ্ধ পড়তে বসেছে। নিকিতা নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে। বিছানায়। প্রিয় অফিসের টুকটাক কাজ করছিল। কাজের মেয়ে খাবার দিয়ে যেতেই ওসব রেখে প্লেটটা নিয়ে প্রিয় নিকিতার কাছে গেল। নিকিতা ঘুমিয়ে আছে। খেতে ডাকতেই সে বলল, আমি খাব না।’

‘না খেলে সুস্থ বাচ্চার জন্ম দেবে কীভাবে?

নিকিতা চুপ। প্রিয় বলল, ‘শুনলাম সারা দিন কিছু খাও নি। এভাবে খেয়ে থাকলে বাচ্চা আর তুমি দুজনই দুর্বল হয়ে পড়বে। তারপরের ঝামেলা পড়বে আমার ঘাড়ে। ওসব ঝামেলা নিতে পারব না। আমি খাইয়ে দিচ্ছি, খেয়ে নাও।

প্রিয় নিকিতার মুখে খাবার তুলে দিতে গেলেই নিকিতার চোখেমুখে আতঙ্ক দেখতে পেল প্রিয়। নিকিতা নিজের মুখ চেপে ধরে বলল, ‘আমি খাব না।”

প্রিয় অবাক। সে খাইয়ে দিতে চাচ্ছে অথচ নিকিতা খাচ্ছে না! নিকিতার এমন আচরণ দেখে প্রিয়র খটকা লাগল। তাই আর জোর করল না। যা হওয়ার হবে, তার কী? সে তো খাওয়াতে চেষ্টা করেছে। প্রিয় হাতের কাজ শেষ করে শুয়ে পড়ল। তবে ঘুম আসছিল না। হাজার রকম চিন্তা মাথায় ঘুরছে। তবু চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিল প্রিয়। হঠাৎ মনে হলো নিকিতা নড়ে উঠল। চোখ মেলে আবছা আলোয় প্রিয় দেখতে পেল নিকিতা বিছানা থেকে উঠে যাচ্ছে। ঘর থেকে বের হতেই প্রিয়ও উঠল। চোরের মতো পেছন পেছন গিয়ে দূর থেকে দেখল নিকিতা ডিম ভাজছে। ডিম ভেজে সে ভাত খেতে বসল। এটুকু দেখে প্রিয় নিজের ঘরে ফিরে এল। তখনই মনে পড়ল, গত শুক্রবার প্রিয় শখ করে রান্না করেছিল, নিকিতা তার করা একটা খাবারও খায় নি। সে বাইরে থেকে কোনো খাবার আনলেও খায় না।

প্রিয় দরজার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। নিকিতা ঘরে ঢুকতেই প্রিয় তার হাত ধরে একটানে বাহুডোরে নিয়ে নিল। নিকিতা এটার জন্য প্রস্তুত ছিল না। প্রিয় বলল, ‘তোমার কী মনে হয়, আমি খাবারে কিছু মিশিয়ে বাচ্চাটাকে মেরে ফেলব?’

হুট করে প্রিয়র এমন প্রশ্নে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল নিকিতা। প্রিয় কীভাবে টের পেল সে কথা ভাবতে লাগল। প্রিয় আবার জিজ্ঞেস করল, ‘বলো? সত্যি কথা বলো।

নিকিতা চুপ করে রইল। কিছু বলার সাহস তার নেই। প্রিয় বলল, ‘এত অমানুষ মনে হয় আমাকে? আমি তোমাকে বলেছিলাম যে আমি বাচ্চাটা চাই না। তার মানে এই না যে আমি এ রকম কিছু করব।

নিকিতা কান্না করে দিল। প্রিয় বলল, কাঁদছ কেন আবার?

প্রিয় নিকিতাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আল্লাহ আমার জীবনের সাথে তোমাকে না জড়ালেও পারতেন। একটা স্বাভাবিক বিয়ে হলে আজ তুমি অনেক সুখী হতে পারতে।’

নিকিতার যে কী হলো! সে প্রিয়কে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। কান্নাও বেড়ে গেল। প্রিয় নিকিতার মাথাটা বুকে চেপে ধরে বলল, ‘বাচ্চাটা যে আমি কেন চাই না, তা তুমি কখনো বুঝতে পারবে না, নিকিতা। আমার সমস্যাটা অনেক জটিল। বাচ্চা যদি রাখোই, তাহলে এভাবে আতঙ্ক নিয়ে থেকো না। এমনিতেই প্রেগন্যান্সিতে অনেক রকম ডিপ্রেশন কাজ করে, তার ওপর এসব আলগা প্যারা নিয়ো না। দরকার হলে বাপের বাড়িতে চলে যাও কিছুদিনের জন্য।’

নিকিতা কাঁদতে কাঁদতেই বলল, আমি তোমাকে রেখে কোথাও যাব না।’

.

অনেক দিন কেটে গেছে। এখনো পেট্রা স্বাভাবিক হতে পারে নি। কারও বাচ্চা মিসকারেজ হলে যে অবস্থা হয়, তার এখন সেই অবস্থা। ঠিকমতো খেতে পারে না, ঘুমাতে পারে না। একদম ভেঙে পড়েছে, অনেক বেশি স্বপ্ন দেখে ফেলেছিল। প্রিয় অসংখ্যবার ফোন করেছে, সে ধরে নি। সম্পর্কটা পুরোপুরি শেষ কেন হচ্ছে না? ডিনারের পর যখন শুতে যাচ্ছিল পেট্রা, তখন রায়ান ডাকল, ‘দি, একটা কথা ছিল। জানি, শুনলে তুই কষ্ট পাবি, তবু না বলে পারছি না।’

‘কী কথা?

‘তুই যার কথা ভেবে এখনো কষ্ট পাচ্ছিস, সে কিন্তু খুব সুখে আছে। তুইও তোর ভালোটা বুঝে নে দি। বিয়ে করে ফেল, এখনো সময় আছে।

‘রায়ান, আমি তোকে বারণ করেছি আমার বিয়ে নিয়ে তুই কোনো কথা বলবি না। এটা সম্পূর্ণ আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। আমি সিদ্ধান্ত নেব।

‘আমি এসব বলছি, কারণ, আনিসার কাছ থেকে শুনলাম নিকিতা আপু প্রেগন্যান্ট।

পেট্রা মনে মনে অবাক হলো কিন্তু রায়ানকে বুঝতে দিল না। বলল, আমি জানি সে কথা। তাতে কী হয়েছে? বিয়ের চার বছর হয়ে গেছে, এখন বাচ্চা হবে না তো কবে হবে? তা ছাড়া, তোর গায়ে লাগছে কেন? ওদের ফ্যামিলি প্ল্যানিং কি তুই করে দিবি?

রায়ান অবাক হয়ে বলল, ‘দি, তোর মতো মানুষ আমি আর একটাও দেখি নি।

পেট্রা আর কোনো কথা না বলে শুতে চলে গেল। নিকিতা প্রেগন্যান্ট শুনে ওর খারাপ লাগছে না ভালো লাগছে, ঠিক বুঝতে পারছে না। তবে একদিক দিয়ে ভালোই লাগছে, প্রিয় এবার পাগলামি কমাবে। সে না চাইলেও নিকিতার সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়বে।

আনিসার বিয়ে খুব দ্রুতই ঠিক করা হয়েছিল। প্রিয় নিকিতার বাবার সঙ্গে কথা বলে আনিসার বিয়েটা পেছাল। পরে ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে, ওরা আরেকটু বড় হোক। নিকিতার বাবাও বড় জামাইয়ের কথা ফেলতে পারে নি। প্রভাবশালী মন্ত্রীর ছেলে বলে কথা! প্রিয় আনিসাকেও আলাদাভাবে বলেছে রায়ানের সঙ্গে যোগাযোগটা যাতে সাবধানে করে। অফিস থেকে ফেরার পথেই প্রিয় নিকিতাদের বাসায় গিয়েছিল আনিসার ব্যাপারে কথা বলতে। নিকিতার বাবার সঙ্গে কথা বলে প্রিয় বাসায় চলে গেল। নিকিতার প্রেগন্যান্সির এখন ছয় মাস চলছে। মেয়েটা এমনিতেই খুব সুন্দরী, কিন্তু প্রিয় সৌন্দর্যে কখনো মুগ্ধ হয় না। নিকিতার বেলায়ও হয় নি। তবে খেয়াল করেছে, নিকিতা ইদানীং অনেক বেশি সুন্দর হয়ে গেছে। ইয়া বড় একটা পেট তার সৌন্দর্য চার গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। আগের চেয়ে আরও বেশি ফরসা হয়েছে, মোটা হয়েছে, একটু চোখমুখ ফুলেছে। সব মিলিয়ে মনে হয় যেন নুরের পরশ পেয়েছে সে। পেট্রাকেও কি প্রেগন্যান্ট হলে এমনই লাগত? একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জুতার ফিতা খুলছিল প্রিয়। হঠাৎই তার ঘর থেকে একটা শব্দ ভেসে এল। হালকা শব্দ। কিন্তু তার ঘরে এটা কিসের শব্দ? জুতা না খুলেই প্রিয় দৌড়ে গেল। কিন্তু দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করা। পকেট থেকে চাবি বের করে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতেই দেখতে পেল নিকিতা ফ্যানের সঙ্গে ঝুলছে!

৪২

মানুষের জীবনে এমন অনেক জটিল পরিচ্ছেদ থাকে, যা কিনা এতই বিভ্রান্তিকর যে বছরের পর বছর পার হয়ে গেলেও আমরা বুঝতে পারি না। অথচ প্রথমে আমরা ভাবি বুঝে গিয়েছি। তারপর আসলেই যখন বুঝতে পারি, তখন মনে হয়, হায়, এত দিন তাহলে কী বুঝেছিলাম? প্রিয়র জীবনে এমনই একটা পরিচ্ছেদ নিকিতা। বিয়ের পর প্রথম দুই বছর নিকিতা যেভাবে জীবন অতিষ্ঠ করে ফেলেছিল, প্রিয় সেভাবেই নিকিতাকে ঘৃণা করত। কিন্তু তারপর ভুল বুঝতে পেরে মেয়েটা যেভাবে নিজেকে শুধরে নিয়েছিল, তাতে করে ওকে আর ঘৃণা করা যায় না। তাই বলে প্রিয় কখনো তাকে ভালোবাসতেও পারে নি। নিকিতার অমন অকৃত্রিম পাগলপারা ভালোবাসা দেখেও পারে নি। সেই নিকিতার জন্যই আজ তার এত কষ্ট কেন হচ্ছে? কেন বুক ফেটে যাচ্ছে? নিকিতার ভেতরে এখন তার সন্তানের বসবাস বলেই কি এমন লাগছে?

প্রিয় যখন জুতা খুলছিল, ঠিক তখন সম্ভবত নিকিতা গলায় দড়ি দিয়ে পায়ের নিচের টুলটা ফেলে দিয়েছিল। সেই শব্দ শুনেই প্রিয় দৌড়ে গিয়েছিল। কীভাবে কী হলো, সেসব চিন্তা প্রিয়র মাথায় আসে নি। যেটা এসেছিল তা হলো নিকিতা এবং বাচ্চাকে বাঁচাতে হবে। দৌড়ে গিয়ে তাকে নামিয়ে সোজা হাসপাতালে নিয়ে এসেছে। হাসপাতালে ইমার্জেন্সিতে ঢুকিয়ে দিয়ে অপেক্ষা করছে প্রিয়। এসির মধ্যে দাঁড়িয়েও দরদর করে ঘামছে। খুব বেশি দেরি কি হয়ে গিয়েছিল? নাকি সময়মতো হাসপাতালে আনা গেছে? ডাক্তাররা এখনো কিছু জানায় নি। নিকিতা বাঁচবে তো? বাচ্চাটা কি পৃথিবীতে আসার আগেই…নাহ, আর ভাবতে পারছে না প্রিয়।

শারীরিক সম্পর্ক দুটি মানুষকে কাছে আনে, ওদেরও এনেছে, কিন্তু তাতে কোনো ভালোবাসা ছিল না। নিকিতার দিক থেকে অবশ্য প্রবল ভালোবাসা ছিল। যা-ই হোক না কেন, দুদিক থেকে ভালোবাসা না থাকলে সেটাকে ভালোবাসাহীন সম্পর্ক বলাই ভালো। তবে এই ভালোবাসাহীন সম্পর্কটায় অনেক বোঝাপড়া ছিল, বন্ধুত্ব ছিল, নিয়মিত শারীরিক মিলন ছিল, পরস্পরের প্রতি পরস্পরের দায়িত্ব, কর্তব্য ও যত্নও ছিল। তবে প্রিয় নিকিতাকে এখনো স্ত্রী বলে মেনে নেয় নি। এমনকি সপ্তাহখানেক আগেও নিকিতা বলছিল, ‘আচ্ছা, তুমি তো আমাকে স্ত্রী বলে মানো না, নাকি মেনে নিয়েছ?

‘প্রশ্নই ওঠে না। আইন ও ধর্মীয় নিয়মকানুন অনুযায়ী আমাদের বিয়ে হয়েছে। কিন্তু হৃদয়ের নিয়ম অনুযায়ী বিয়ে হয় নি। তাই আমি তোমাকে স্ত্রী বলে মানি না। বন্ধুবান্ধব ও পরিচিত মহলে কখনো তোমাকে স্ত্রী বলে পরিচয় করিয়েছি?

‘না।

‘বন্ধ দরজার ভেতরেও কি কখনো তোমাকে স্ত্রী বলে স্বীকার করেছি?

না।

‘তাহলে?

‘তাহলে তুমি আমার এত যত্ন নাও কেন?

‘কী যত্ন নিলাম?

‘এই যে না খেয়ে থাকলে খাইয়ে দাও। যখন যেটা খেতে চাই, সিজন না হলেও কোত্থেকে যেন এনে দাও! সকালে আমাকে নিয়ম করে হাঁটাও। ইদানীং এত বড় পেট নিয়ে গোসল করতে অসুবিধা হয় বলে তাও করিয়ে দাও। কেন করো এসব?

‘সেটা তো তুমি আমার বাচ্চার মা হচ্ছ বলে।

‘বাব্বা, বাচ্চাই তো চাচ্ছিলে না। এমনকি বাচ্চাটাকে মেরে ফেলতে চাচ্ছিলে। এখন আবার বাচ্চার মা হচ্ছি বলে এত আদর?

প্রিয় নিকিতার পেটে হাত রেখে বলেছিল, ‘নিকিতা, তখন তো বাচ্চার শরীর তৈরি হয় নি, শরীরে প্রাণও আসে নি। কিন্তু এখন তো সে জলজ্যান্ত একটা মানুষ। হ্যাঁ, আমি চাই নি তাকে; কিন্তু বাচ্চা যেহেতু আমার একার না, তাই তাকে রাখা না-রাখার সিদ্ধান্তটা আমি একা নিতে পারি নি। এখন আমার বাচ্চা দুনিয়ায় আসার পথে। তার জন্য তোমার এত কষ্ট করতে হচ্ছে, নিজের চোখেই তো দেখছি। আমি তাই বাচ্চার বাবা হিসেবে দায়িত্বটুকু পালন করছি, এই তো। আর সেদিন কেন বাচ্চা অ্যাবরশনের জন্য অমন করছিলাম তা তুমি বুঝবে না নিকিতা। সেই দিনটা আমার জীবনের চরম ব্যর্থতা, হতাশা ও অসহায়ত্বের দিন ছিল।

‘কেন? কী হয়েছিল সেদিন?

‘বাদ দাও।’

‘খুব অদ্ভুত সম্পর্ক আমাদের! এমন অদ্ভুত সম্পর্ক কখনো দেখি নি, জানো?”

‘হ্যাঁ, খুব অদ্ভুত। অনেক রাত হয়েছে, তুমি এখন ঘুমাও।

‘তোমার বুকে ঘুমাব।’

‘এসো।’

নিকিতার এমন অনেক আবদারই প্রিয় মিটিয়েছে। অফিসের সময়টুকু ছাড়া পুরো সময়টা সে বাসায় থেকেছে। যখন যেটার দরকার, সেটার ব্যবস্থা করেছে। কারণ, প্রথম দিকেই ডাক্তার বলেছিল, নিকিতা হতাশায় ভুগছে। সব মেয়েই প্রেগন্যান্সির সময় শারীরিক পরিবর্তনের জন্য হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। নিকিতার হতাশা ছিল অতিমাত্রায়। তাই তাকে সময় দিতে হবে, যত্ন নিতে হবে, নতুবা মা ও বাচ্চা দুজনেরই ক্ষতি হতে পারে। নিকিতার ডিপ্রেশনের কারণ শুধু শারীরিক পরিবর্তন নয়, তা জানে প্রিয়। বাচ্চা নষ্ট করতে বলায় প্রচণ্ড পরিমাণে ভয় ঢুকে গিয়েছিল তার মনে। প্রিয় চাইলেও বাচ্চাটা তারই, পৃথিবীর মুখ দেখার অধিকার তারও আছে।

প্রিয় ডাক্তারের পরামর্শ অনুয়ায়ী নিকিতাকে সময় দিয়েছে, খেয়াল রেখেছে, যত্ন নিয়েছে। তিন মাস যেতে না যেতেই সব হতাশা কেটে গিয়েছিল। মেয়েটা আবার হাসিখুশি আর প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছিল। তারপর যখন জানতে পারল ছেলে হবে, তখন তো আনন্দে আত্মহারা সে। দুই ছেলেকে নিয়ে এই করবে, সেই করবে। কত পরিকল্পনা! গতকালও তো কত খুশিমনে বাচ্চার নাম ঠিক করল। আর আজ? আজ এমন কী হলো যে তার আত্মহত্যা করতে যেতে হলো?

বাবা শুদ্ধকে নিয়ে হাসপাতালে এসেছে। শুদ্ধ অনবরত কাঁদছে। নিকিতার বাড়ির লোকজনও এসে পড়েছে। প্রায় সবাই কাঁদছে। সবাইকে আলাদা আলাদাভাবে প্রিয় অনেক প্রশ্ন করল। সবাই জানাল, তাদের সঙ্গে শেষবার যখন কথা হয়েছে বা দেখা হয়েছে, সবকিছু স্বাভাবিক ছিল। প্রিয়র সঙ্গে শেষ কথা হয়েছিল আনিসার ব্যাপারে কথা বলতে ওদের বাসায় যাওয়ার সময়। প্রিয় বলেছিল, তোমার বাবার সাথে কথা বলেই বাসায় ফিরছি। কিছু আনব? কিছু খেতে ইচ্ছা করছে?

‘হুম, খুব খেতে ইচ্ছা করছে।

‘কী?

‘এক শটা চুমু।’

‘এক শ কত দিন বসে খাবে? অল্প আনলে হয় না, চুমু! আমি গরিব মানুষ।

‘উঁহু, আমার এক শটাই চাই।’

‘আচ্ছা, এক হাজারটা আনব। এখন ফোন রেখে আমাকে উদ্ধার করুন। আমি আপনাদের বাসার সামনেই দাঁড়িয়ে আছি।

‘আচ্ছা আচ্ছা, ওগুলো নিয়ে তাড়াতাড়ি আসুন জনাব। আপনার বউ, যে মেয়েটা কিন্তু আপনার দুই ছেলের মা, সেই মেয়েটা আপনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। খুব খিদে পেয়েছে তার।’

এই তো ছিল প্রিয়-নিকিতার শেষ কথোপকথন। এরপর ওইটুকু সময়ের মধ্যে কী এমন হলো? সবাই বলছে কিছু হয় নি, সব স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু কিছু তো একটা হয়েছেই এবং সিরিয়াস কিছু। না হলে নিকিতা এমনটা কখনোই করত না। এত সহজে আত্মহত্যা করার মতো মেয়ে হলে সে বহু আগেই তা করত। নিকিতার যদি কিছু হয়ে যায়, তাহলে তো কখনো জানতেও পারবে না কী হয়েছিল আসলে। এর বেশি কিছু ভাবতে পারছে না প্রিয়। দুশ্চিন্তায় তার মাথা কাজ করছে না। শুদ্ধ কাছে এসে আগের মতোই কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘বাবা, নিকিমা কি বাঁচবে না? ভাইকে কি পাব না?

প্রিয় শুদ্ধকে জড়িয়ে ধরে বলল, এসব বলে না, বাবা। মা আর ভাইয়ের জন্য দোয়া করো।

৪৩

নিকিতা সুস্থ হয়ে বাসায় ফেরার পর সবার মুখে হাসি ফুটল। বাচ্চার কোনো ক্ষতি হয় নি। কিন্তু নিকিতার দড়িতে ঝুলে পড়ার পর জিহ্বা বের হয়ে যাওয়ায় পঁাতে চাপ লেগে জিহ্বা খানিকটা কেটে গিয়েছিল। দড়ির ধারে গলার চামড়া ছিলে গিয়েছিল। তবে প্রিয় যতক্ষণ না জানতে পারছে নিকিতা কেন আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল, ততক্ষণ তার শান্তি নেই। হাসপাতালে ইচ্ছা করেই কিছু জিজ্ঞেস করে নি। কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করতে দেয়ও নি। বাসায় ফিরে রাতের বেলা যখন তারা একা হলো, তখন সে ধরল নিকিতাকে।

‘তোমার সাহস হলো কী করে ছয় মাসের বাচ্চা পেটে নিয়ে তুমি মরতে গেলে?

নিকিতা মাথা নিচু করে চুপ করে রইল। প্রিয় বলল, ‘তাকাও আমার দিকে। পরিষ্কার করে বলো কেন করলে এটা?

নিকিতা চোখ তুলে তাকাল, সে কাঁদছে। তার চাহনিতে অদ্ভুত রকমের ভেঙে পড়ার আলামত রয়েছে। প্রিয় এবার একটু নরম হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘আমাকে বলো নিকিতা। এত অবহেলা, অপমান করেছি, সহ্য করেছ। সেই তুমি আমার বাচ্চার মা হয়ে, আমার আদর পেয়ে এভাবে চলে যেতে চাচ্ছিলে কেন? বাচ্চা একটা মেয়ে তুমি, তোমার এখনই কেন মরতে হবে?

এবার নিকিতার কান্নার মাত্রা বেড়ে গেল। হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে সে কী বলল, কিছুই বুঝল না প্রিয়। প্রিয় নিকিতার চোখ মুছে আবার জিজ্ঞেস করল, ‘শান্ত হও নিকিতা, ধীরে সুস্থে বলো কী হয়েছে?

‘আমার বাবা আমার সবচেয়ে ভালোবাসার মানুষ, সবচেয়ে বিশ্বাস আর ভরসার মানুষ।’

‘কী হয়েছে আঙ্কেলের?

‘বাবা আমাকে তোমার বাবার কাছে বিক্রি করে দিয়েছিলেন প্রিয়।

প্রিয় চমকে উঠে বলল, ‘কী বলছ?

‘তোমার বাবা তোমাকে পথে ফেরানোর জন্য আমাকে কিনে এনেছেন। যাতে বউ কখনো অবাধ্য না হয়, সে জন্য গরিব ঘরের মেয়েকে টাকার বিনিময়ে কিনে এনেছেন। আসলে আমি তো তোমার বউ হওয়ার যোগ্য নই। পেট্রা আপুর কথা আমার বাবা আমাদের বিয়ের আগে থেকেই জানত, জানো? অথচ আমাকে বলেছিল তোমার বউ বাচ্চা রেখে মরে গেছে। বাবা সব জেনেশুনে টাকা নিয়ে তোমার সাথে আমার বিয়ে দিয়েছে। বাবা জানত আমার সংসারে অশান্তি হবে, আমি কখনো ভালোবাসা পাব না।’

প্রিয়র মাথা ঘুরছে। সে জানে তার বাবা অনেক নিচ, সব পারে সে। তাই বলে নিকিতার বাবাও? নাকি কোনো ভুল হচ্ছে নিকিতার? প্রিয় বলল, ‘এসব কথা কীভাবে জেনেছ তুমি?

নিকিতা কাঁদতে কাঁদতেই বলল আবার, তোমার বাবা বলেছে। তারপর আমার বাবাকে জিজ্ঞেস করেছি। সে-ও সব স্বীকার করেছে।

‘বাবা হঠাৎ এসব তোমাকে কেন বলতে গেল?

নিকিতার কান্না কোনোভাবেই থামছিল না। বলল, ‘বাবা কোনোভাবে তোমার মালয়েশিয়ায় যাওয়ার ব্যাপারটা জেনে গিয়েছিল। তারপর সেদিন বিকেলে বাবা আমাকে ডেকে বলছিল আমি কেন তোমার খোঁজখবর রাখি না? তুমি কোথায় যাও, কী করো, আমি যতটুকু জানব যেন ওনাকে জানাই। আরও কী কী সব বলছিল। আমি মাথা ঠান্ডা রাখতে পারি নি। বলে বসেছি আমার স্বামী আরও চৌদ্দটা প্রেম করুক, আমি মানতে পারলে আপনার সমস্যা কী?

‘সর্বনাশ করেছ, নিকিতা। তারপর?

‘তারপর উনি তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন। আর আমাকে শোনাতে লাগলেন আমি নাকি তোমার জন্য টাকা দিয়ে কিনে আনা রক্ষিতা, আমাকে তিনি তোমার জন্য কিনে এনেছেন আমার বাপের কাছ থেকে। এখন উনি যা বলবেন, তা-ই শুনতে হবে।

‘ছি!”

তারপর আমার মাথা আরও গরম হয়ে যায়। আমি বাবাকে ফোন করে বাবার সাথে চেঁচামেচি করি। তখন বাবা বলে যে সংসারে টানাটানি ছিল, তাই সে এই কাজ করেছে। প্রিয়, আমার বাবা আমাকে ৫০ লাখ টাকায় বিক্রি করেছে। আমার দাম ৫০ লাখ টাকা।

কথাগুলো কোনোরকমে শেষ করেই নিকিতা চিৎকার করে কাঁদতে লাগল। প্রিয় বিস্ময় কাটিয়ে নিকিতার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল, ‘বাবর খান অনেক ভয়ংকর মানুষ। তোমার উচিত হয় নি তার সাথে জেদ দেখানো। যা হয়েছে, খুব খারাপ হয়েছে। কিন্তু এ জন্য মরতে হবে, নিকিতা? আমাদের ছোট্ট ছেলেটার কথা একবারও ভাবলে না? আর আমাদের বড় ছেলে? ওর কথাও ভাবলে না? তুমি জানো ও কত কেঁদেছে তোমার জন্য?

‘এসব ভাবার মতো অবস্থা আমার ছিল না তখন। আমার বাবাকে আমি ছোটবেলা থেকে চিনি, জানি, ভালোবাসি, শ্রদ্ধা-ভক্তি করি। সে এমন একটা কাজ করেছে, আমি মানব কীভাবে প্রিয়? তোমার বাবার সাথে তোমার সম্পর্ক খারাপ। তাই সে খারাপ কিছু করলে তুমি মেনে নিতে পারো, তুমি অভ্যস্ত হয়ে গেছ। কিন্তু আমার সাথে তো আমার বাবার সম্পর্ক খারাপ ছিল না। বাবার চেয়ে আপন দুনিয়াতে আর কে থাকে? বাবা যদি এমনটা করতে পারে, তাহলে তো দুনিয়ায় কাউকেই বিশ্বাস করা যায় না। ওই মুহূর্তে আমার মনে হচ্ছিল আমি জন্মেই পাপ করেছি। তুমি সব সময় বলেছ–তুমি এই বিয়ে মানো না, আমি তোমার বউ না। তারপরও যখন কাছে এসেছ, আদর করেছ, আমার একফোঁটাও খারাপ লাগে নি। কারণ, আমি তো জানি তুমি আমার স্বামী! কিন্তু ওই মুহূর্তে আমার সবকিছু ওলটপালট হয়ে গিয়েছিল। মনে হয়েছিল, হ্যাঁ সত্যিই আমি শুধুই রক্ষিতা তোমার।

প্রিয় আচমকা নিকিতাকে একটা চড় মারল। নিকিতা ভড়কে গেল। পরমুহূর্তেই প্রিয় তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, তুমি আমার বউ, আমার বাচ্চাদের মা। খবরদার, আর কোনোদিনও যেন না শুনি এসব কথা।

নিকিতা চমকে তাকাল প্রিয়র দিকে। প্রিয় নিকিতার চোখে চোখ রেখে বলল, ‘আমি তোমাকে কখনো ভালোবাসতে পারব না এটা যেমন সত্যি, তুমি আমার স্ত্রী এটাও সত্যি। আমি নিজের অজান্তেই তোমাকে স্ত্রীর জায়গা দিয়ে ফেলেছি আরও বহু আগেই। বলা হয় নি শুধু। কী করে বলব, আমি নিজেই তো টের পাই নি।

এ কথা বলে প্রিয় নিকিতার কপালে ঠোঁট চেপে ধরে একটা গাঢ় চুমু দিল। নিকিতার চোখে জমে থাকা ফোঁটা ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। এ জীবনে আর কিছু চায় না সে।

.

অনেক রাতে ভিডিও কলে কথা হচ্ছিল পেট্রা ও শুদ্ধর! মা-ছেলেতে খুব হাসাহাসি হচ্ছিল। ঠিক তখনই নিকিতা শুদ্ধকে দেখতে এল, ছেলেটা ঠিকভাবে শুয়েছে কি না, কে জানে! নিকিতাকে দেখে শুদ্ধর কথা বলা থেমে গেল। নিকিতা বলল, ‘বাবা, তুমি এখনো ঘুমোও নি কেন?

‘নিকিমা, আমি এক্ষুনি ঘুমিয়ে পড়ব।’

ওপাশ থেকে পেট্রা ডাক দিল, ‘নিকিতা…’

নিকিতা পেট্রার গলা শুনে কোনো কারণ ছাড়াই বিচলিতবোধ করল। তবু ডেকেছে যখন, যাওয়া উচিত। নিকিতা শুদ্ধর পাশে গিয়ে বসল। পেট্রা হেসে বলল, ‘ওম্মা, কী সুন্দর হয়েছ দেখতে!’

নিকিতা হেসে বলল, ‘কেমন আছ, আপু?

‘ভালো। তুমি কেমন আছ? শরীর ঠিক আছে?

‘হ্যাঁ, ভালো আছি।’

‘ওভাবে উঁকি মেরে কথা বলছ কেন? একটু পেটটা দেখাও না। দেখি তোমাকে কেমন দেখাচ্ছে।

নিকিতা কী করবে বুঝতে পারছিল না। ওর খুব লজ্জা লাগছিল। পেট্রার খেয়াল হলো, শুদ্ধ আছে এখানে। তাই বলল, ‘শুদ্ধ, মা, একটু অন্য রুমে যাবে? আমি একটু নিকিতা মার সাথে কথা বলি?

‘ওকে মা, টা টা।

শুদ্ধ চলে যেতেই পেট্রা বলল, ‘আরে বাবা, অস্বস্তিবোধ করছ কেন? সামনে এসো একটু দেখি।

নিকিতা সামনে আসতেই পেট্রা আহ্লাদ করে বলল, ‘আহা! কী মিষ্টি লাগছে! তুমি সামনে থাকলে তোমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরতাম।

নিকিতা এখন আরও বেশি লজ্জা পাচ্ছে। পেট্রা হেসে বলল, ‘নিকিতা, প্লিজ একটু ফ্রি হও। তুমি আমার প্রাক্তন স্বামীর স্ত্রী বলে প্রেগন্যান্সি নিয়ে আমার কাছে এত অস্বস্তিবোধ করার কিছু নেই। বাচ্চা হলো ঈশ্বরের আশীর্বাদ। সে তোমার পেটেই হোক বা আমার পেটেই হোক, আমার একই রকম খুশি লাগছে। প্রিয়র বাচ্চা যে!’

নিকিতা হাসল। পেট্রা বলল, ‘জানো, তোমার প্রেগন্যান্সির খবর পেয়ে অনেক দিন চেয়েছি তোমার সাথে কথা বলতে। তারপর আবার নানান ব্যাপার চিন্তা করে বলি নি। তোমার যে মার্কামারা শ্বশুর!

নিকিতা এবার সশব্দে হেসে দিল। পেট্রা প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য বলল, ‘ডেলিভারি ডেট দিয়েছে?

‘হ্যাঁ, সামনের মাসের ১২ তারিখ।

‘বাচ্চাকে ভিডিও কলে দেখিয়ো কিন্তু।

‘দেখাব আপু।

‘নাম ঠিক করেছ?

‘প্রসন্ন।’

‘বাহ, খুব সুন্দর নাম। বড়ভাইয়ের নামের সঙ্গে অর্থগতভাবে মিলে গেছে।

‘মিলিয়েই রেখেছে প্রিয়।

পেট্রা হেসে মাথা ঝুলিয়ে বলল, ‘ও। আচ্ছা শোনো, প্রিয়কে বলো না আমার সাথে কথা হয়েছে। শুনলে রেগে যাবে, ওর ফোন ধরি না তো। মেসেজে বা মেইলে হাজারটা কথা শোনাবে আমাকে।

‘আচ্ছা আপু, বলব না।

‘ঠিকাছে, আজকে তাহলে রাখি। টেক কেয়ার।

৪৪

ফুটফুটে একটা ছেলে হয়েছে প্রিয়-নিকিতার। প্রিয়র মতো দেখতে হয়েছে। তবে গায়ের রঙটা নিকিতার মতো ধবধবে ফরসা। ছেলেটাকে কোলে নিয়ে অদ্ভুত একটা অনুভূতি হলো প্রিয়র। মনে হলো কিছু নরম তুলো হাতে নিয়েছে। পৃথিবীর সব আলো, সকল ফুলের সৌরভ যেন এসে পড়েছে তার কোলের মধ্যে। শুদ্ধকে যখন প্রথমবার কোলে নিয়েছিল প্রিয়, তখন শুদ্ধর বয়স দশ দিন। আর প্রসন্ন তো কিছুক্ষণ আগে পৃথিবীর মুখ দেখল। তাই এই অনুভূতির সঙ্গে পরিচিত নয় প্রিয়। প্রসন্ন কেমন গটগটে চোখে তাকিয়ে আছে প্রিয়র দিকে। হয়তো অভিমানী গলায় বলছে, ‘মেরে ফেলতে চেয়েছিলে, না? এখন এত মায়া দেখানো হচ্ছে কেন? নামাও আমাকে কোল থেকে। এ কথা ভাবতেই প্রিয় সশব্দে হেসে উঠল। বাবর খান, নিকিতা, নিকিতার বাপের বাড়ির লোকজন সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছে প্রিয়কে।

প্রিয়কে স্বাভাবিক দেখে বাবর খান কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়েছেন। শুধু কি স্বাভাবিক, পেট্রার সঙ্গে কোনোরকম যোগাযোগ নেই তার। এর চেয়ে আনন্দের বিষয় আর কী হতে পারে? তবে পাহারা সরান নি ছেলের ওপর থেকে। কবির প্রিয়র হাতে ধরা খাওয়ার পর তিনি অন্য প্রাইভেট গোয়েন্দা নিয়োগ দিয়েছেন। যার কথা এখনো জানে না প্রিয় হয়তো কখনো জানতে পারবেও না। এবার তিনি আরও সাবধান। প্রিয় কী যেন বলতে চায়। সেই নিয়েই বারান্দায় বাপ-ছেলের মিটিং বসেছে। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বাবর খান প্রিয়কে জিজ্ঞেস করলেন, ‘বলো প্রিয়, কী বলতে চাও।’

‘বাবা, আশা করি আমি এখন তোমার মনের মতো হতে পেরেছি?

বাবর খান চমকে উঠলেন, প্রিয় অনেক বছর পর তাকে বাবা বলে ডাকল। কম করে হলেও পাঁচ-ছয় বছর হয়ে গেছে প্রিয়র মুখ থেকে বাবা ডাকটা শুনতে পান নি তিনি। দিনের পর দিন অপেক্ষা করে গেছেন কবে প্রিয় আবার বাবা বলে ডাকবে তাকে। কিন্তু ছেলেটা বরাবরই নাম ধরে ডেকেছে অথবা বলেছে ‘মন্ত্রীসাহেব’। আজ এতদিন পর বাবা ডাক শুনতে পেয়ে তার ভীষণ আনন্দ হলো। তিনি হেসে বলল, তুমি সব সময়ই আমার মনের মতো ছিলে, প্রিয়। শুধু মাঝখানে কয়েকটা বছর না বুঝে কিছু ভুল করেছ। তোমরা ছোট মানুষ, ভুল করবেই। আমাদের দায়িত্ব সেসব ভুল থেকে তোমাদের সরিয়ে আনা। তার জন্য আমাদের মাঝেমধ্যে কঠোর হতে হয়।’

তারপরও বাবা, আমি তো এখন বউ-বাচ্চা নিয়ে পুরোপুরি সংসারী হয়ে গেছি। এখন নিশ্চয়ই আমাকে নিয়ে তোমার আর কোনো সংশয় নেই।’

‘না, নেই।

এবার আমি তোমার কাছে কিছু চাই, বাবা।

‘কী চাও, বলো।’

‘শুদ্ধকে পেট্রার কাছে পাঠাতে চাই।’

বাবর খান চমকে উঠলেন। গরম চা ছলকে পড়ল সাদা পাঞ্জাবিতে। প্রিয় বলল, তুমি ভুল বুঝো না, বাবা। শুদ্ধ মুসলিম ধর্মই পালন করবে।

আমাদেরই থাকবে শুদ্ধ। শুধু বাস করবে পেট্রার সাথে।

‘এ কেমন অবুঝ আবদার, প্রিয়?

‘অবুঝ আবদার না, বাবা। পেট্রা এতিম একটা মেয়ে। ভরসা করার মতো কেউ নেই ওর এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার একটা অবলম্বন নেই। শুদ্ধকে পেলে ও ভালো থাকবে, বাবা। এইটুকুই শুধু চাই তোমার কাছে।

‘অসম্ভব। পেট্রাকে বলো বিয়ে করে সংসারী হতে। পরের বাচ্চা আর কত পালবে?

‘বাবা, আমার মনে হয় না ও কখনো বিয়ে করবে। আর যদি করেও শুদ্ধকে না হয় তখন আবার নিয়ে আসব।

‘প্রিয়, এ বিষয়ে আমি আর কথা বলতে চাই না। শুদ্ধ এখানেই থাকবে।’

‘প্লিজ বাবা, আমাকে বলার সুযোগ দাও। আমি জানি তুমি ভাবছ শুদ্ধকে দিলে আমাদের মধ্যে আবার যোগাযোগ শুরু হবে, সম্পর্ক তৈরি হবে। কিন্তু পেট্রা নিজেই চায় না আমাকে আর। ও যদি একবার বলত, প্রিয়, আমি তোকে চাই। তুমি কেন, পুরো পৃথিবী আমাকে আটকে রাখতে পারত না, বাবা। এই পৃথিবীতে আমি ওর থেকে বেশি ভালো আর কাউকেই বাসি না। এ অদ্ভুত এক ভালোবাসা। এই ভালোবাসা যেন হৃদয়ের না বাবা, এই ভালোবাসা যেন রক্তের। নিকিতা কী ছিল আর কী হয়ে গেছে, চিন্তা করো। এটাও কিন্তু পেট্রারই অবদান। পেট্রাই কিন্তু কলকাঠি নেড়ে আমার আর নিকিতার সম্পর্কটা সাবলীল করেছে। ও যে কত বড় মনের মানুষ, তুমি জানো না। একটা এতিম মেয়েকে তুমি দয়া করো বাবা, শুদ্ধকে দিয়ে দাও। শুদ্ধর জন্মের এক ঘণ্টার মধ্যে ও শুদ্ধকে বুকে তুলে নিয়েছে। অবিবাহিত হয়েও শুদ্ধর মা হওয়ার চ্যালেঞ্জটা নিয়েছে। ও না থাকলে শুদ্ধ আজ কোথায় থাকত, আমরা তা জানতামও না। যে বাচ্চাটাকে ও নিজের বাচ্চার মতো করে পেলেপুষে বড় করল, তার ওপর কি ওর একটু অধিকারও নেই?

‘প্রিয়, পেট্রার জন্য আমি আমার বড় ছেলেকে হারিয়েছি। তারই সন্তানকে আমি পেট্রার হাতে তুলে দেব? অসম্ভব।

‘বাবা, এটা তোমার ভুল ধারণা। ভাইজান আর সাদিয়া আপুর সম্পর্কের ব্যাপারে পেট্রার কোনো হাত নেই। ও কিছুই জানত না। ওরা একই হলে রুমমেট ছিল। এর বাইরে ওদের কোনো সম্পর্কই ছিল না। তুমি সাদিয়া আপুকে মানো নি বলে ভাইজান জেদ করে বিয়েটা করেছিল।

‘এত কিছু আমি এখন শুনতে চাই না, প্রিয়। আমার বড় ছেলের একমাত্র স্মৃতি শুদ্ধ। ওকে আমি কারও কাছে দেব না।’

‘বাবা প্লিজ। মনে করা শুদ্ধ পড়তে যাচ্ছে বাইরে। ও প্রতিবছর আসবে বাংলাদেশে। ও তো আমাদেরই থাকবে।

‘না। এটা সম্ভব না।

‘শুদ্ধও এতে ভালো থাকবে, বাবা। তুমি কি জানো পেট্রার কথা ভেবে শুদ্ধ কত চোখের জল ফেলে? ও তো জন্মের পর থেকে পেট্রাকেই মা বলে জেনেছে, পেট্রাকেই পেয়েছে। তুমি একবার নিজের মায়ের কথা চিন্তা করে দেখো তো, বাবা। তুমি কি পারতে শুদ্ধর মতো দশ বছর বয়সে নিজের মাকে ছাড়া থাকতে? শুদ্ধ সেই তিন-চার বছর থেকে আছে। ও হাঁপিয়ে উঠেছে, বাবা।

‘কেন, নিকিতাকে তো ও নিজের মায়ের মতোই দেখে আর নিকিতাও তো ওকে আদর করে। মা তো আছেই।

‘বাবা, নিকিতাকে ও মা ডাকে কিন্তু পেট্রা ওর মা। ওর চোখের জল তুমি দেখো না, বাবা?

‘পেট্রা একটা খ্রিষ্টান মেয়ে। শুদ্ধকে ও কিছু শেখাতে পারবে না।

‘যা শেখার তা তো শুদ্ধ শিখেই নিয়েছে, বাবা। তা ছাড়া আমরা প্রায় তিন বছর একসাথে ছিলাম। দুজন দুজনের ধর্ম পালন করেছি, কখনো কোনো সমস্যা হয় নি। পেট্রা কখনো ইসলাম ধর্মকে অসম্মান করে নি। শুদ্ধ নিজের মতো ধর্ম পালন করবে, পেট্রা তাতে সাহায্য করবে, তুমি দেখো, বাবা।’

‘কয় টাকা ইনকাম পেট্রার? আমার নাতিকে পড়াশোনা করাবে কীভাবে? অভাবে বড় হবে আমার নাতি?

‘সেটা না হয় আমি দেব। আমার ছেলের খরচ আমারই তো দেওয়া উচিত।’

বাবর খান আবার কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, তার আগেই নিকিতা প্রসন্নকে কোলে করে বারান্দায় এল। নিকিতাকে দেখে উনি আলোচনা থামিয়ে দিলেন। কিন্তু নিকিতাই নতুন করে আলোচনা শুরু করল, ‘বাবা, বেয়াদবি হলে মাফ করবেন, আমি একটা কথা বলি। আনিসার সাথে পেট্রা আপুর ভাইয়ের দু-তিন বছর ধরে সম্পর্ক চলছে। ওরা বিয়েও করবে। আনিসা কিছুদিনের মধ্যেই ওখানে চলে যাচ্ছে। আনিসা মুসলিম ধর্ম পালন করবে, রায়ান তার ধর্ম। আনিসা ওখানে থাকলে শুদ্ধর তো এ ব্যাপারে কোনো সমস্যা হওয়ার কথাই না।’

বাবর খান এবার বেশ অবাক হলেন। প্রিয় বলল, ‘হ্যাঁ, বাবা, তাই তো। আর দেখো প্রসন্নকে। তোমার এক নাতি তত তোমার কাছে থাকবেই। আমি আর নিকিতা তোমাকে আরও অনেক নাতি-নাতনি দেব। তুমি শুধু শুদ্ধকে পেট্রার কাছে যাওয়ার অনুমতি দাও।’

এ কথায় নিকিতা লজ্জা পেল। প্রিয়র আসলে মাথাটা গেছে। বাবাকে রাজি করানোর জন্য সে মরিয়া হয়ে গেছে। কিন্তু বিশেষ লাভ হলো না। বাবর খান এতক্ষণ ঠান্ডা মাথায় কথা বললেও এবার রেগে গেলেন। চেঁচামেচি করে ওদের ঘর থেকে বের করে দিলেন।

নিজের ঘরে এসে প্রিয় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বুকে একটা চাপা কষ্ট অনুভব করছে। খুব কাঁদতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু কান্না কি এতই সহজ?

.

কদিন পর বাবর খান প্রিয় ও নিকিতাকে ডেকে পাঠালেন তার ঘরে। ওরা গিয়ে বসতেই তিনি বললেন, আমি শুদ্ধর সাথে কথা বলেছি। ও পেট্রার কাছে যেতে চায়।’

প্রিয় একটা আশার আলো দেখতে পেল। বাবর খান আবার বললেন, ‘পেট্রার কথা বলতেই শুদ্ধ খুব কান্নাকাটি করল, অনুরোধ করল যাতে ওকে যেতে দিই। কিন্তু আমার মন এখনো সায় দিচ্ছে না।

প্রিয় চুপ করে শুনছিল। বাবর খান এবার বললেন, ‘তবু শুদ্ধর মুখের দিকে তাকিয়ে যেতে দিতে পারি, তবে কয়েকটা শর্ত আছে।

‘তোমার সব শর্ত মানতে আমি রাজি, বাবা। বলো কী শর্ত।

‘প্রথম শর্ত হলো, তুমি যখন শুদ্ধকে মালয়েশিয়াতে নিয়ে যাবে, তখন তোমার সাথে আমি এবং নিকিতাও যাব।’

‘যাবে বাবা, আমার কোনো আপত্তি নেই।

‘দ্বিতীয় শর্ত হলো শুদ্ধকে যখন আসতে বলব, তখনই আসতে হবে। খরচ আমি দেব। আর শুদ্ধকে মুসলিম ধর্মই মানতে হবে সঠিকভাবে। আনিসা সাহায্য করলে ভালো।

‘হ্যাঁ, সেটা তো অবশ্যই।

‘তৃতীয় শর্ত হলো শুদ্ধর সব খরচ তুমি বা আমি পাঠাব। আমার নাতি যাতে অভাবে বড় না হয়।’

‘আচ্ছা বাবা, তা-ই হবে।’

‘আচ্ছা, এবার চতুর্থ কিন্তু প্রধান শর্ত হলো, পেট্রার সাথে তোমার ডিভোর্স পেপারে তোমাকে সাইন করতে হবে।

চমকে উঠল প্রিয়, সঙ্গে নিকিতাও। প্রিয় বলল, ‘বাবা, আমাদের ডিভোের্স হয়ে গেছে। যে-কোনো এক পক্ষ সাইন করলেই তো তিন মাস পর ডিভোর্স আপনা-আপনি কার্যকর হয়ে যায়। পেট্রা তো সাইন করেছেই?

‘কিন্তু প্রিয় তোমার সাইনটা আমার কাছে জরুরি। এই শর্ত মানলেই শুদ্ধ পেট্রার কাছে যাবে।

প্রিয় চুপ করে রইল। বাবর খানও ধীরেসুস্থে উত্তরের জন্য বসে রইলেন। নিকিতাকে তিনি কিছু বলছেন না, তাহলে কেন ডাকলেন, তা বুঝতে পারছে না। সে অসহায়ের মতো চুপচাপ বসে আছে। কিছুক্ষণ পর প্রিয় বলল, আমি রাজি, বাবা।’

গলা দিয়ে যেন কথা বের হলো না প্রিয়র, আগুন বের হলো। সেই আগুনে তার নিজেরই ভেতরটা পুড়ে খাক হয়ে গেল। বাবা বললেন, ‘দ্যাটস লাইক মাই গুড বয়।

ডিভোর্স পেপারটা বাবর খান যত্ন করে রেখে দিয়েছিলেন। তিনি সেটা বের করে দিলেন। প্রিয় সাইন করতে গিয়ে নিঃশব্দে কেঁদে ফেলল। বাবর খান নির্বিকারভাবে চেয়ে রইলেন। নিকিতা পাশে দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য দেখল। সাইন করে প্রিয় আর একমুহূর্ত দাঁড়াল না, সোজা নিজের ঘরে চলে গেল।

নিজের ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল প্রিয়। সে নিজেও জানে না আজ কেন এতটা খারাপ লাগছে। সম্পর্ক তো ছিলই, এমনকি যোগাযোগটাও ছিল না। ডিভোর্সও বহু বছর আগেই কার্যকর হয়ে গিয়েছিল। তবু এই না করা স্বাক্ষরটা প্রিয়র কাছে ছেলেভুলানোর মতো একটা ব্যাপার ছিল, যা দিয়ে সে নিজেই নিজেকে ভোলাত। আজ থেকে কী দিয়ে ভোলাবে সে নিজেকে? বুকের ভেতরটা ফাঁকা হয়ে গেছে, সব শেষ, সব। ওদিকে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে নিকিতা কাঁদছে। সে নিজেই অবাক হয়ে যাচ্ছে, যা হয়েছে তাতে তার কেন এত খারাপ লাগছে?

.

প্রিয় অনেকক্ষণ ধরে ফোন করছে পেট্রাকে। পেট্রা ফোন ধরছে না। প্রিয় একটা মেসেজ পাঠাল, একটা কথা বলব শুধু, জালাব না।’ এবার পেট্রা ফোন ধরল।

‘হ্যালো।

‘প্রিয়, কী খবর?

‘একটা কথা বলতে ফোন করেছি।’

‘বল।

‘তুই হয়তো এখন আর সেভাবে বিশ্বাস করবি না কিন্তু এখনো আমি তোকে ভালোবাসি, শুধু তোকে।

‘আমি জানি, প্রিয়। অবিশ্বাস করার মতো কিছু হয় নি।

‘ঠিকাছে, আমার একটা কথা বলা শেষ। এখন রাখি।

‘এই শোন শোন…রাখিস না।

‘কী?

‘রাখতে চাচ্ছিস কেন? ফোনে টাকা নেই?

পেট্রার এই রসিকতায় প্রিয় হেসে দিল। পেট্রাও হেসে দিল। তারপর কিছুক্ষণ অর্থহীন, অপ্রয়োজনীয় কথা হলো এবং প্রিয় শান্ত হলো।

*

উপসংহার

পেট্রা রান্না করছিল। এর মধ্যেই দুবার কলিং বেল বাজল। পেট্রা রায়ানকে বলল দরজা খুলতে কিন্তু তার কোনো সাড়াশব্দ নেই। উফ, রায়ানটা কি এখনো ঘুমাচ্ছে! পেট্রা চুলা বন্ধ করে দরজাটা খুলল। দরজা খুলে যা দেখল, তাতে তার নিঃশ্বাস আটকে যাওয়ার জোগাড়। শুদ্ধ দাঁড়িয়ে আছে, একা। মুহূর্তের মধ্যে শুদ্ধ দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরল। পেট্রা শুদ্ধকে কোলে নিয়ে ভেতরে চলে এল। খুশি সামাল দিতে না পেরে কেঁদে ফেলল সে। তার সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার, শুদ্ধ কাঁদল না। উল্টো হাসছে। শুদ্ধ বলল, ‘মা, আমি এত বড় হয়ে গেছি। দশ বছর বয়স আমার। তুমি এখনো আমাকে কোলে নিচ্ছ!’

‘মায়ের কাছে বাচ্চারা কখনো বড় হয় না, বাবু।

শুদ্ধ মায়ের গালে চুমু দিল। পেট্রা শুদ্ধর কপালে চুমু দিল। তারপর শুদ্ধ কোল থেকে নেমে জড়িয়ে ধরে রাখল। পেট্রা বলল, কার সাথে এসেছিস, বাবা? কীভাবে এলি? আমার মাথায় কিছু আসছে না।

ঠিক এমন সময় প্রিয় বলল, আমরা নিয়ে এসেছি।’

পেট্রা তাকিয়ে দেখে প্রিয়, নিকিতা ও আনিসা দাঁড়িয়ে আছে দরজায়। তিনজনের মুখেই হাসি। পেট্রা হেসে এগিয়ে গেল। নিকিতার কোল থেকে প্রসন্নকে কোলে নিল। কপালে একটা চুমু দিয়ে বলল, ‘কী সৌভাগ্য আমার, বাবা, তোকে কোলে নিতে পারব, কখনো ভাবি নি!

প্রিয়র বাচ্চাকে কোলে নিয়ে এক অদ্ভুত অনুভূতি হলো পেট্রার। চোখ বেয়ে তখনো খুশির অশ্রু ঝরে চলেছে। মুখে হাসি, কণ্ঠে উত্তেজনা। আনন্দে দিশেহারা সে। প্রিয় মুগ্ধ চোখে দেখছে পেট্রার এই আনন্দ। তার বুকের চাপা আর্তনাদ ও অজস্র চোখের জলের বিনিময়ে সে কিনেছে এই আনন্দ। পেট্রা বলল, আমার মাথায় ঢুকছে না। তোমরা কী করে এলে! আর আসার আগে একবার জানালে না?

প্রিয় চুপ।

নিকিতা বলল, তাহলে কি এ রকম সারপ্রাইজ দিতে পারতাম, বলো?’

শুদ্ধ বলল, ‘মা, জানো, বাবা, নিকিমা, প্রসন্ন আর আমি মিলে এই সারপ্রাইজ প্ল্যানটা বানিয়েছি।

পেট্রা হেসেই চলেছে। বলল, ‘এই, তোমরা সবাই ভেতরে এসে বসো।

আনিসা আমতা আমতা করে বলল, ‘দি, রায়ান বাসায় নেই?

পেট্রা হেসে বলল, ‘আছে তো, ঘুমাচ্ছে। ওই ঘরটা ওর, যাও না, ডেকে তোলো।’

আনিসা শুধু এইটুকুর অপেক্ষায় ছিল। এবার সে দ্রুত রায়ানের ঘরে গিয়ে ঢুকতেই দেখল রায়ান ঘুমাচ্ছে। দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে সে রায়ানকে ডেকে তুলল। রায়ান চোখ মেলে তাকাতেই তার পিলে চমকে গেল। উঠে বসে বলল, তুমি!

আনিসা ঘুরে ঘুরে নেচে নেচে গাইতে লাগল,

‘আমি রূপনগরের রাজকন্যা রূপের জাদু এনেছি,

ইরান-তুরান পার হয়ে আজ তোমার দেশে এসেছি।’ রায়ান হা করে তাকিয়ে আছে। তার কাছে এখনো সবকিছু অবিশাস্য লাগছে। স্বপ্ন দেখছে না তো সে? আনিসা নিজের পাগলামিতে নিজেই হেসে কুটিকুটি হলো। রায়ানের তখনো ঘোর কাটে নি।

নিকিতাই মূলত তার ফ্যামিলিকে রাজি করিয়েছে রায়ান-আনিসার বিয়ের ব্যাপারে। প্রিয় সাপোর্ট দিয়েছে। নিকিতার কথা একটাই, সে আরেক জোড়া প্রিয়-পেট্রাকে চায় না। হয়তো কোনো নিকিতা রায়ানের জীবনে আসবে। রায়ান হয়ে যাবে প্রিয় আর আনিসা সারা জীবন পেট্রার মতো কষ্ট পাবে। এটা সে হতে দেবে না। রাজি হলে হবে, না হলে আনিসাকে ভাগিয়ে নিয়ে যাবে, এমনটাই বলছিল নিকিতা। মেয়ে বিয়ে দিয়ে তার শ্বশুরের কাছ থেকে টাকা খাওয়ার অপরাধে নিকিতার বাবা তেমন কিছু বলতে পারল না। যা-ও বলল, নিকিতা সে কথাকে দাঁড়াতে দিল না। উল্টো বলল, ‘আনিসাকে বিক্রি করার ব্যবস্থাও করে ফেলেছ। নাকি?’ পরে প্রিয় ধমকে থামিয়েছে তাকে।

আনিসা-রায়ানের বিয়ে দিয়ে প্রিয়-নিকিতা দেশে ফিরবে। তাই চা খেতে খেতে এ ব্যাপারে পেট্রার সঙ্গে কথা বলে নিল তারা। এক সপ্তাহ তারা থাকবে, এর মধ্যেই বিয়ের ব্যবস্থা করবে। ভিডিও কলে নিকিতার বাবা-মা উপস্থিত থাকবেন। কথাবার্তা শেষ করে প্রিয় উঠে যেতেই পেট্রা বলল, ‘আরে, এখনই যাবি কেন? লাঞ্চ করে যাবি।’

প্রিয় বলল, লাঞ্চ করব রায়ান-আনিসার বিয়ের দিন। আজকে যেতে হবে। বাবা এসেছে। হোটেলে আছে।

পেট্রা অবাক।

‘উনি কেন এসেছেন?

‘আমাকে পাহারা দিতে।

এ কথা বলে প্রিয় হেসে দিল। প্রিয়র দেখাদেখি সেই হাসি ছড়িয়ে পড়ল পেট্রা আর নিকিতার মাঝেও। যাওয়ার আগমুহর্তে প্রিয় বলল, ‘তোর জন্য আরেকটা সারপ্রাইজ আছে। সেটা কী, জানিস?

পেট্রা হেসে বলল, ‘আরও সারপ্রাইজ! বদহজম না হয়!

প্রিয় বলল, ‘শুদ্ধ আজ থেকে তোর কাছে থাকবে। বাবার অনুমতি নিয়েই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’

পেট্রা বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। প্রিয়র পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল নিকিতা। বলল, ‘আরে, শ্বশুরসাহেবকে রাজি করাতে গিয়ে কত যে কসরত করতে হলো! প্রিয় কত যে শর্ত মেনেছে! অবশ্য আমারও একটু ক্রেডিট আছে।

ওদের অবাক করে দিয়ে পেট্রা প্রিয়-নিকিতা দুজনকে দুহাতে জড়িয়ে ধরল। ওরাও ধরল। প্রিয় পেট্রার চুলের ঘ্রাণ নিল, হয়তো শেষবার।

.

রায়ান-আনিসার বিয়ের পর যেদিন প্রিয়-নিকিতা চলে যাচ্ছিল, সেদিন রায়ান, আনিসা, শুদ্ধ ও পেট্রা এসেছিল তাদের সি-অফ করতে। চলে যাওয়ার আগমুহূর্তে পেট্রা-প্রিয় দুজন একসঙ্গে বলে উঠল, একটা কথা বলার ছিল।’

তারপর দুজনই হেসে দিল। পেট্রা বলল, ‘তুই আগে বল।

‘উঁহু, তুই আগে বল।

পেট্রা হেসে বলল, ‘বিশ্বাস কর প্রিয়, সেবার রেজাল্ট যদি পজেটিভ হতো এবং তোর-আমার নিজেদের একটা বাচ্চা হতো, তবু এত খুশি হতাম না, যতটা শুদ্ধকে ফিরে পেয়ে হয়েছি।’

‘আমি জানি, পেট্রা।’

পেট্রা জিজ্ঞেস করল, এবার বল তুই কী বলতে চেয়েছিলি?’

প্রিয় হেসে বলল, ‘দূরে গেলেই আসলে ভালোবাসাটা সবচেয়ে বেশি করে টের পাওয়া যায়। তোর থেকে দূরে থেকে বুঝেছি তোকে কতটা ভালোবাসি। আজও।

.

কিছু কিছু প্রেমিক-প্রেমিকা থাকে, যারা ভালোবাসা কী, তা বুঝতে শেখার আগেই পরস্পরকে ভালোবাসে। তারা ভালোবাসে পাগলের মতো। সমাজ, পরিবারের কথা চিন্তা করার মতো বয়স হওয়ার আগেই তারা ভালোবেসে ফেলে। তাদের ভালোবাসাটা হয়ে যায় রক্তের সম্পর্কের মতো। মাতাল করা ভালোবাসা তাদের উড়িয়ে, ভাসিয়ে, ডুবিয়ে দিয়ে যায়। জাগতিক নিয়ম হয়তো তাদের আলাদা করে দেয়, জড়িয়ে দেয় অন্যের সঙ্গে। তবু তারা দূর থেকে দুজন দুজনকে ভালোবাসে, যে ভালোবাসায় কোনো চাওয়া-পাওয়ার ব্যাপার নেই। কে কী করছে, কীভাবে আছে, কেমন আছে, তা তারা জানে না হয়তো, কিন্তু তারা একে অপরকে ভালোবাসে। হ্যাঁ, আগের মতোই পাগলের মতো ভালোবাসে। তাদের সম্পর্কটা ফানুসের মতো। ফানুস ওড়ানোর সময় সবাই যেমন ভীষণ আনন্দিত থাকে। তারা জানে ফানুস আজীবন আলো জ্বেলে আকাশে উড়তে পারে না। মোম ফুরোলেই নিভে কোথাও পড়ে যাবে। তবু লোকে ফানুস ওড়ায়, আনন্দ নিয়েই ওড়ায়। ঠিক তেমনি, তারাও প্রেমে পড়ে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *