৩০. রাতে খাওয়ার পর

৩০

রাতে খাওয়ার পর নিকিতা কাজের মেয়েটার সঙ্গে বাড়তি খাবারগুলো গোছাচ্ছিল। প্রিয় ড্রয়িংরুমে টিভিতে খবর দেখছিল। হঠাৎ ডাইনিংরুমে একটা আওয়াজ হলো। প্রিয় দৌড়ে গিয়ে দেখল, নিকিতা অচেতন অবস্থায় মেঝেতে পড়ে আছে। সঙ্গে সঙ্গে প্রিয় ওকে কোলে তুলে ঘরে নিয়ে গেল। বিছানায় শুইয়ে দিল। শ্বাস চলছে কি না পরীক্ষা করল। তারপর ফ্যানটা ফুল স্পিডে ছেড়ে দিল। কী হলো আবার এই মেয়ের? একটা হাত তার দুহাতের মধ্যে নিয়ে ঘষে দিল। পায়ের তালুতেও হাত দিয়ে ঘষে দিল। তারপর চোখেমুখে পানির ছিটা দিতেই চোখ খুলল নিকিতা। অস্পষ্ট স্বরে পানি খেতে চাইল। প্রিয় পানি ঢেলে তাকে ধরে উঠাল, তারপর পানি খাইয়ে দিল। খানিকটা পানি গ-স থেকে ছলকে বাইরে পড়ল। নিকিতার জামা কিছুটা ভিজে গেল। প্রিয় ওড়না দিয়ে চেপে চেপে মুছে দিল। তারপর আবার শুইয়ে দিল। প্রিয় নিকিতার মাথায় হাত রেখে বলল, ‘কী হয়েছে তোমার?

নিকিতা অস্পষ্ট স্বরে বলল, ‘কিছু না।

‘বেশি খারাপ লাগছে? ডাক্তার ডাকব?’

নিকিতা না-সূচক মাথা নেড়ে আগের মতোই অস্পষ্টভাবে বলল, ‘ঠিক হয়ে যাব।’

প্রিয় এবার নিকিতার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ‘আচ্ছা এখন চুপচাপ শুয়ে থাকো। সকালে না হয় ডাক্তার ডেকে আনব।’

এমন সময় কাজের মেয়েটা দরজায় নক করল। প্রিয় বলল, কে? দরজা খোলা আছে, ভেতরে এসো।

মেয়েটা ভেতরে ঢুকে বলল, ‘ভাবির কী হইসে ভাইজান? আমারে লাগব?

‘কিছু হয় নি। তুমি যাও শুয়ে পড়ো।

‘আইচ্ছা।’

মেয়েটা দরজা লাগিয়ে চলে গেল। প্রিয় আবার নিকিতার দিকে তাকাল। চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। কী হয়েছে ওর কে জানে! কখনো ওর কোনো খোঁজখবর রাখে না সে। সত্যি বলতে নিকিতার তো কোনো দোষ নেই। অল্পবয়সে বিয়ে হলো। কত স্বপ্ন নিয়ে শ্বশুরবাড়ি এসেছিল। অথচ তার পর থেকে শুধু কষ্টই পেল। ঠিক যেমনটা পেয়েছে পেট্রা। তার জীবনের সঙ্গে যার জীবন জড়ায়, তার জীবনটাই তছনছ হয়ে যায়। কাউকে সুখী করার যোগ্যতা তার নেই। সে একটা অকালকুষ্মাণ্ড।

.

শুদ্ধর ফাইনাল পরীক্ষা শেষ, তাই দাদার সঙ্গে কয়েকদিনের জন্য সাভার বেড়াতে গেছে। নিকিতা যায় নি। প্রথম দিন থেকেই প্রিয় তাকে অন্যঘরে শুতে বলেছে। প্রিয়কে রাগাতে চায় না বলে নিকিতা বিনা বাক্যব্যয়ে তা-ই করেছে। কিন্তু রাতে একফোঁটা ঘুম হয় না। এমন না যে প্রিয়র সঙ্গে ঘুমালে তার সেরকম কোনো লাভ আছে তবু এক বিছানায় ঘুমানোটাও অনেক, অন্তত চোখের সামনে তো থাকে। তাই বহু ভেবে এই অসুস্থতার নাটক করার পরিকল্পনা করেছে নিকিতা। চেহারায় অসুস্থ ভাব এনে পড়ে থাকলেও মনে মনে হাজার গোলাপের বাগানে প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়াচ্ছে সে। মনে মনে আউড়ে গেল, এক বিছানায় ঘুমাবে না! এখন তো নিজেই কোলে করে বিছানায় তুলেছ। পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে কেমন লাগছে জনাব?

.

ডাক্তার নিকিতার কোনো অসুস্থতা খুঁজে পায় নি। বলছে শরীর দুর্বল। ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করলে, রেস্ট নিলে ঠিক হয়ে যাবে। ডাক্তার চলে যাওয়ার পর প্রিয় বিছানার পাশে বসে বলল, তুমি ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করো না?

নিকিতা শুয়ে ছিল। বলল, ‘করি তো।

‘তাহলে এই অবস্থা কেন?’

‘জানি না।’

মাথা নিচু করে বলল নিকিতা। প্রিয় উঠে গিয়ে অফিসের জন্য রেডি হতে হতে বলল, তোমার শ্বশুরকে জানাও যে তুমি অসুস্থ। ফিরে আসতে বলো।

‘বাবা এমনিতেই পরশু ফিরে আসবে। তা ছাড়া ডাক্তার তো বলেছে আমার কিছু হয় নি।

‘আচ্ছা, ঠিকাছে।

প্রিয় ঘড়ি পরতে গিয়ে টেবিলের ওপর নিকিতার বইখাতা দেখে জিজ্ঞেস করল, পড়াশোনা করে ঠিকমতো, নাকি সব গোল্লায় দিয়েছ?”

‘আমি একদম লক্ষ্মী মেয়ের মতো পড়াশোনা করি।’

‘তাহলে তো ভালোই। শোনো নিকিতা, আজ না বুঝলেও একদিন বুঝবে যে এই গ্র্যাজুয়েশনটা করে তোমার জন্য কত ভালো হয়েছে।’

‘দুনিয়ার প্যারা এসব পড়াশোনায়। তুমি যে কী ফাঁসানো ফাঁসিয়েছ আমাকে!

প্রিয় শব্দ করে হেসে দিল। বলল, তুমি নিজেই তো একটা প্যারা। পড়াশোনার চেয়েও অনেক বড় প্যারা। পড়াশোনা তোমার কাছে নস্যি।

নিকিতা মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে রইল। প্রিয় চুল আঁচড়াচ্ছিল। হঠাৎ নিকিতার পাশে বসে পড়ে বলল, আচ্ছা, ক্যাম্পাসে তোমার কোনো বন্ধু হয় নি?

‘হ্যাঁ, অনেক বন্ধুই তো হয়েছে, কেন?

‘আমি বলতে চাচ্ছি বিশেষ কোনো বন্ধু হয় নি? খুব কাছের হয়ে যায় নি কেউ?

‘হ্যাঁ, লিসা আর মায়া সবচেয়ে কাছের বন্ধু। আমার সাথে ওদের অনেক যায়।

‘আহা, অবুঝের মতো কথা বলছ কেন? আমি জানতে চাইছি তোমার কোনো বয়ফ্রেন্ড হয় নি?

‘ছি ছি ছি, তুমি আমাকে কী মনে করো? আমি বিবাহিত হয়েও বয়ফ্রেন্ড বানাব?

‘আরে বাব্বা, সেন্টি খাচ্ছ কেন? তুমি যে সুন্দরী, তোমার পেছনে তো ছেলেদের লাইন লাগার কথা।’

‘লাইন আছে, লম্বা লাইন। কিন্তু আমি তাদের দিকে ফিরেও তাকাই। আমার সব সৌন্দর্য আমার স্বামীর জন্য।’

কিন্তু তোমার স্বামী তো তোমাকে অবহেলা করে, তার ওপর অল্পবয়স তোমার। তুমি যদি দু-একটা প্রেম করে সেটা দোষের কিছু হবে না। তোমার স্বামী তোমাকে সুখ দিচ্ছে না বলেই তো তুমি অন্য পুরুষ থেকে নিচ্ছ। এটা খুব স্বাভাবিক, নিকিতা।

নিকিতা প্রিয়র দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বলল, ‘শোনো, আমি কাঙালি না যে যার তার সাথে গিয়ে যৌবনের জ্বালা মেটাব। যদি সারা জীবন কুমারী হয়েও থাকতে হয় তা-ই থাকব, কুমারীত্ব নিয়েই মরব।’

‘বাপরে, তুমি তো মারাত্মক কথা জানো!’

‘তুমি বলতে পারলে আমি বলতে পারব না কেন? তোমার কাছে নিজেকে বিলিয়ে দিতে চাই মানে এটা না যে যৌবনের জ্বালায় আমি তা চাই। আমি কি সস্তা নাকি? তোমাকে ভালোবাসি, তাই তোমাকে কাছে পেতে চাই। তুমি না নিলে ফেলে রাখবে, এভাবেই পড়ে থাকব আজীবন।

‘আচ্ছা ভাই, থামো। তোমরা মেয়েরা না বহুত ঝগড়াটে হও। গেলাম আমি।’

প্রিয় বেরিয়ে যাওয়ার পর নিকিতা বিছানায় উঠে বসল। আজ সে খুব খুশি। রাতে সে প্রিয়কে জড়িয়ে ধরেছিল। প্রিয় নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় নি। প্রিয় ঘুমিয়ে ছিল নাকি জেগে তা সে জানে না, তবে সে জেগে ছিল। জেগে জেগে নিঃশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে প্রিয়র বুকের ওঠানামা, প্রিয়র গায়ের গন্ধ, প্রিয়র স্পর্শ–সবকিছু অনুভব করেছে। এত ভালো কাউকে কী করে লাগতে পারে? প্রিয় রাগী, বদমেজাজি, উদ্ধত; কিন্তু ভেতরটা ভীষণ নরম। তাকে তো প্রিয় ভালোবাসে না কিন্তু সে অসুস্থ জেনে ঠিকই সেবা করল। অনেকক্ষণ মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। এমনটা পাওয়ার সৌভাগ্য তার কখনো হবে, তা সে স্বপ্নেও ভাবে নি। তার সঙ্গেই এমনটা করল, ইশ না জানি পেট্রা আপুকে কতটা যত্ন করত। তারা যখন একসঙ্গে ছিল, নিশ্চই খুব সুখী ছিল। আচ্ছা, প্রিয় তো পেট্রা আপুকে অনেক ভালোবাসত। নিশ্চয়ই ভীষণ আদরও করত। প্রিয় কি সত্যিই আদর করতে জানে! কীভাবে আদর করে সে? তার সবকিছুর মতো আদরটাও কি খুব আলাদা রকমের? এসব ভাবতে ভাবতে কেন জানি লজ্জা লাগল নিকিতার।

পেট্রা আপুর কথা মনে হতেই খেয়াল হলো, তিনি বলেছিলেন তার বাবাকে শ্বশুর সাহেব মেরেছেন। আবার প্রিয় বলেছিল, তার অবৈধ অস্ত্র ধরা পড়েছে। উনি কি তাহলে বড় কোনো ক্রিমিনাল? একটা ক্রিমিনালের বাড়িতে সে এত দিন ধরে আছে, যার কাছে মানুষের জীবনের কোনো দাম নেই। অবাধ্য হলে তাকেও যদি মেরে ফেলে? প্রিয় নিশ্চয়ই বাঁচাবে। আজকাল প্রিয়কে আর অত ভয় লাগে না। বরং অনেকটা ভরসা জন্মেছে ওর ওপর।

.

সন্ধ্যায় প্রিয় অফিস থেকে ফেরার সময় পেট্রার অফিসের সামনে গেল। তবে কাছে গেল না। দূর থেকে তাকিয়ে রইল। পেট্রা যতই যোগাযোগ করতে নিষেধ করুক, পেট্রাকে একদম না দেখে সে থাকতে পারে না। ট্টো বেরিয়ে চলে যাওয়া পর্যন্ত দেখল। তারপর গাড়িতে উঠে বাসার উদ্দেশে রওনা হতেই নিকিতা ফোন করল, আমার জন্য পিজ্জা নিয়ে আসবে? খুব খেতে ইচ্ছা করছে।’

‘আমাকে কি ডেলিভারি বয় মনে হয়? খেতে ইচ্ছা করলে অনলাইন অর্ডার করে খাও।

‘এমন করো কেন? সারা দিন কিছু খেতে পারি নি। এখন পিজ্জা খেতে ইচ্ছা করছে।

‘আমি পারব না।’

এ কথা বলেই ফট করে ফোন কেটে দিল প্রিয়। তারপর রেস্টুরেন্টগুলোর সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় মনে পড়ল ডাক্তার বলেছে নিকিতা ঠিকমতো খায় না বলে দুর্বল হয়ে পড়েছে। সারা দিন না খেয়ে রাত্রিবেলা পিজা খেতে চাওয়ার মানে কী? একটা রেস্টুরেন্টের সামনে গাড়ি থামিয়ে পিজ্জা নিল। এই মেয়েগুলো শুধু পারে ভেজাল করতে। তাও ভালো আগের মতো মাথায় ভূত চাপে না। উল্টোপাল্টা কিছু করে না। হুটহাট গায়ের ওপর হামলে পড়ে না। অনেক শুধরে গেছে, ম্যাচিওরিটি এসেছে ওর মধ্যে। এ রকম হয়ে থাকলেই ভালো। প্রথম প্রথম সে চেয়েছে নিকিতা চলে যাক। এখন আর চায় না। নিকিতা চলে গেলে বাবা আবার কোন ফন্দি আঁটবে কে জানে! ব্ল্যাকমেল করার অস্ত্রের তো অভাব নেই। এর চেয়ে নিকিতাই থাক। এত দিনে আয়ত্বে এসেছে মেয়েটা। অন্য কেউ এলে তাকে এমন আয়ত্বে রাখা না-ও যেতে পারে। ও ইদানীং ইচ্ছা করেই নিকিতার সঙ্গে বন্ধুর মতো মেশে। ঝামেলা যত এড়িয়ে চলা যায়, ততই ভালো।

.

প্রিয়াঙ্কা বলল, ‘পেট্রা, তোর পায়ে পড়ি, এত দূরে যাস না। তোকে আর রায়ানকে ছাড়া আমি থাকব কীভাবে?

পেট্রা প্রিয়াঙ্কার একটা হাত নিজের দুহাতের মধ্যে নিয়ে বলল, ‘তোর স্বামী আছে, বাচ্চা আছে, শ্বশুর-শাশুড়ি, দেবর-ননদ সবাই আছে। তুই একা কোথায়? আর আমরা দূরে যাচ্ছি বলেই তো পর হয়ে যাচ্ছি না। আমরা আসব, তোরা যাবি। মালয়েশিয়া খুব দূর তো না।’

‘কদিন আগেও তুই প্রিয়দার জন্য কাঁদতি। আর আজ তুই সব ছেড়ে চলে যাচ্ছিস কেন?’

‘আমি এখনো কাদি, প্রিয়াঙ্কা। প্রিয়কে আমি আজও ততটাই ভালোবাসি। কিন্তু আমি ওর এই তছনছ হয়ে যাওয়া জীবন দেখতে পারি না। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি বিয়ে করব না, সেটা একটা অন্য বিষয়। প্রিয় বিয়ে না করলে আমার কিছু বলার ছিল না। কিন্তু প্রিয় তো বিয়ে করে ফেলেছে। আর মেয়েটা ওকে পাগলের মতো ভালোবাসে। নিকিতার চোখে আমি যে ভালোবাসা দেখেছি, তা তুই না দেখলে বুঝবি না। ওর সাথে প্রিয় ভালো থাকবে।

‘ওহ! প্রিয়দার জীবন তছনছ হয়েছে আর তোরটা খুব ভালো আছে?

‘আমার কথা বাদ দে। আমি সব পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারি, যেটা প্রিয় পারে না। আমি প্রিয়কে না দেখে, যোগাযোগ না করে সারা জীবন থাকতে পারব। কিন্তু প্রিয় পারছে না। ওকে আমি আমার সামনে আসতে নিষেধ করেছি। ফোনকল, মেসেজ দিতেও নিষেধ করেছি। তাই ও কী করে জানিস? অফিসের সামনে, বাসার সামনে এসে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখে যায়।

‘তুই কী করে জানলি?

‘কয়েক দিন আমি নিজেই দেখে না-দেখার ভান করেছি, ও লুকিয়ে থাকায় সুবিধা হয়েছে। কয়েক দিন রায়ান দেখেছে, অফিসের দারোয়ান দেখেছে।’

‘তাতে সমস্যা কী? এত দিনের ভালোবাসা এত সহজে ভোলা যায় নাকি?’

‘ভুলতে কেউ বলে নি। কিন্তু স্বাভাবিক লাইফ লিড তো করবে! তা ও করে না। ও কষ্ট পুষে রেখেছে। এভাবে কি সারা জীবন কাটাবে? আমার থেকে দূরে থাকলেই একসময় সব ঠিক হয়ে যাবে। তা ছাড়া দূরে গেলে আমার নিজের জন্যও বাঁচাটা সহজ হবে। আজও ওকে দেখলে প্রথম প্রেমের মতোই হৃৎপিণ্ড কেঁপে ওঠে।

‘পেট্রা, ভুল করছিস তুই।

‘তুই বুঝবি না, প্রিয়াঙ্কা।

‘আচ্ছা, তোদের মধ্যে কী এমন হলো যে তুই এত ভালোবাসা সত্ত্বেও প্রিয়দাকে আর চাস না?’।

‘সব কথা বলা যায় না, প্রিয়াঙ্কা।’

প্রিয়াঙ্কা অবাক হয়ে বলল, ‘আমাকেও বলা যায় না?

পেট্রা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘কিছু কথা থাকে প্রিয়াঙ্কা, যা নিজেকেও বলতে ইচ্ছা করে না।

৩১

কয়েক মাস পর।

ছুটির দিন। বিকেলবেলা প্রিয় ঘুম থেকে উঠতেই নিকিতা বলল, ‘আমার একটা কথা রাখবে?

প্রিয় আড়মোড়া ভেঙে বলল, ‘একদম না।

‘প্লিজ প্লিজ প্লিজ। তোমার পায়ে পড়ি।

‘উফ, এত জ্বালাও কেন? পায়ে পড়ার মতো আবার কী হলো?’

‘আজ রিদিমার বিয়ে। তুমি চলো না আমাদের সাথে।

‘রিদিমা কে আবার? নিকিতা অভিমান করে বলল, আমার ছোট বোন।

‘ও আচ্ছা। কিন্তু আমি তোমাকে আগেই বলেছি, আমার সাথে একদম বউ টাইপ ব্যবহার করবে না। তোমার বাপের বাড়ি আমি কেন যাব?

‘আমার বাপের বাড়ি না তো। বিয়ে তো কমিউনিটি সেন্টারে ‘

‘থাপ্পড় মেরে চেহারা বদলে দেব। তারপর মেকআপ করেও ঠিক করতে পারবে না। যাও, ভাগো।

‘আমার স্বামী হিসেবে না, আমার বন্ধু হিসেবে চলো।’

‘আমি তোমার ১১ বছরের বড়। আমি কীভাবে তোমার বন্ধু?

১১ না, ১০ বছর।

‘১০ বছর না, ১০ বছর ৯ মাসের বড়। খুচরো মাস যেহেতু ৬ মাসের বেশি, তাই ১১ বছরই কাউন্ট করতে হবে।’

‘আচ্ছা, যা-ই হোক, প্লিজ চলো। বেশিক্ষণ থাকা লাগবে না।

‘আচ্ছা, তোমার বোনের বিয়ে, তুমি এক মাস আগে না গিয়ে বিয়ের দিন যাচ্ছ কেন?

‘প্রতিদিনই তো গেছি। বিয়ের কত কাজ করেছি আমি। আজ ভালো করে সাজগোজ করার জন্য এখান থেকে যাচ্ছি।’

‘আসলে আমাকে নেওয়ার ধান্দায় এসেছ।

প্লিজ প্লিজ, চলো। তোমার কাছে জীবনে আর কিছু চাইব না। শুধু এই কথাটা রাখো।

‘প্রতিবার আবদার করার সময়ই তুমি এই কথাটা বলল।

‘আচ্ছা, এই কান ধরছি। আর এমন বলব না, তুমি শুধু আজকে চলো।

‘স্বামী ছাড়া বাপের বাড়ির প্রোগ্রামে গেলে অনেক কথা শুনতে হয়, তাই না, নিকিতা?

‘তা তো হয়ই। বিয়ের পর একবারও তো যাও নি। তবু তো কখনো বলি না।’

‘আর যাওয়ার পর যে জামাই জামাই করে মানুষজন এসে হামলে পড়বে, শালা-শালিরা এসে দুষ্টুমি করবে, তখন প্রচণ্ড বিরক্ত হওয়া সত্ত্বেও আমাকে প্রাস্টিক হাসি ঝুলিয়ে তাদের সাথে খাতির জমাতে হবে। অসহ্য! যাও তো, ভাগো। আমি যাব না।’

এমন সময় শুদ্ধ রুমে ঢুকল। ও আজ খুব সুন্দর একটা শেরওয়ানি পরেছে। দেখতে বেশ লাগছে। প্রিয়কে দেখেই বলল, ‘বাবা, তুমি রেডি হও নি যে! রিদিমা আন্টির বিয়েতে যাবে না?

‘না, তোরা যা বাপ।

‘না, প্লিজ, চলো বাবা, প্লিজ প্লিজ। নানুবাড়িতে অনেক মজা হয়।’

হঠাৎ শুদ্ধর চোখ পড়ল নিকিতার দিকে। বলল, ওয়াও, নিকিতা আন্টি, তোমাকে তো এঞ্জেলের মতো লাগছে। বাবা দেখো, আন্টি কী সুন্দর!

প্রিয় এবার খেয়াল করে তাকাল। নিকিতা একটা সোনালি রঙের শাড়ি পরেছে। খুব সুন্দর করে সেজেছে। হালকা গয়না পরেছে। যে কোনো ছেলের মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো। প্রিয় হেসে বলল, ‘হ্যাঁ, বাহ, খুব সুন্দর লাগছে তো! দেখিস, আজকে রিদিমা আন্টির বিয়েতে কত ছেলে তোর নিকিতা আন্টির ওপর ক্রাশ খায়।’

এ কথা শুনে শুদ্ধ হাসতে লাগল। নিকিতা বলল, ‘ছি ছি, ছেলের সামনে কী বলছ এসব?

প্রিয় বলল, ‘তাতে কী হয়েছে, ছেলে তো বড় হয়ে গেছে।’

শুদ্ধকে তার দাদা ডাক দিতেই সে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। নিকিতা ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে গয়নাগাটি সব খুলতে লাগল। প্রিয় বলল, ‘একী! খুলছ কেন? ছেলেরা ক্রাশ খাওয়া ভালো তো।

নিকিতা মুখ বেজার করে বলল, ‘আমি যাবই না।’

এ কথা বলে নিকিতা যখন নেকলেসটা খুলছিল, প্রিয় বাধা দিল। নিকিতাকে নিজের সামনে দাঁড় করাল। তারপর গাল টিপে দিয়ে বলল, ‘আরে যাও, এত কষ্ট করে এত সুন্দর করে সেজেছ। কয়েকটা ছেলের মাথা ঘুরিয়ে এসো।’

‘আবার! আমি যাব না, যাব না, যাব না।’

‘তোমার ইচ্ছা। কিন্তু তোমার ছোট বোনটার বিয়ে, না গেলে কষ্ট পাবে না?

‘তোমার কী তাতে?

প্রিয় হাসছে। নিকিতা হঠাৎ কান্না শুরু করে দিল। প্রিয় বলল, ‘আরে আরে, মেকআপ নষ্ট হয়ে যাবে তো। আচ্ছা, ঠিকাছে, যাও, আমি যাব। কিন্তু একটা শর্ত আছে।

নিকিতার মুখে হাসি ফুটল। বলল, ‘একশটা শর্ত মানতে রাজি আমি।’

‘আমি যাব আর আসব। বেশিক্ষণ থাকব না।’

‘ঠিকাছে, তা-ই হবে।’

‘ওকে ডান। এখন বের হও, আমি রেডি হব।

নিকিতা খুশিতে লাফিয়ে উঠে প্রিয়র গালে একটা চুমু খেল। প্রিয় বিরক্ত হয়ে বলল, ‘যাব না, যাহ।’

নিকিতা শাড়ির আঁচল দিয়ে প্রিয়র গালটা মুছে দিয়ে বলল, ‘সরি, আর হবে না।

‘রাখ তোর সরি। বেশি লাই দিয়ে ফেলেছি, না?

নিকিতা নিজের গাল পেতে দিয়ে বলল, ‘আচ্ছা ভুল হয়ে গেছে, আমার চুমুটা আমাকে ফিরিয়ে দাও তাহলে শোধবোধ হয়ে যাবে।’

‘থাপ্পড় মারব আমি তোমাকে!’

নিকিতা সরি বলতে বলতে দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। প্রিয় বিরক্ত হয়ে গালটা বারবার মুছতে মুছতে বিড়বিড় করল, ‘পাগল-ছাগল কোথাকার!

.

পেট্রা ময়ূরকণ্ঠী রঙের একটা জামদানি শাড়ি পরেছে। কানে সোনালি ঝুমকা। গলা খালি, হাতে দুটো চুড়ি, হালকা সাজগোজ। আজ আনিসার বড় বোনের বিয়ে। আনিসা নিজে এসে দাওয়াত দিয়ে গেছে। পেট্রা যেতে চাইছিল না, আনিসা ও রায়ানের জোরাজুরিতে যাচ্ছে। একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে। আনিসার পরিবার সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যাবে। কিন্তু কমিউনিটি সেন্টারে ঢুকেই পেট্রার চোখ কপালে উঠে গেল। নিকিতা এখানে! আশপাশে প্রিয় বা শুদ্ধকে তো দেখছে না। নিকিতা একা এসেছে? ও কি ছেলেপক্ষ, না মেয়েপক্ষ? এসব ভাবতে ভাবতেই নিকিতা ওকে দেখে দৌড়ে এল? হেসে বলল, ‘আরে পেট্রা আপু, তুমি এখানে!

পেট্রাও হেসে রায়ানকে দেখিয়ে বলল, ‘আমার ভাই রায়ান। কনের ছোট বোন ওর বন্ধু।

‘তাই? আনিসার বন্ধু, নাকি আনিকার?

পাশ থেকে রায়ান বলল, ‘আনিসা।

পেট্রা জিজ্ঞেস করল, তুমিও মেয়েপক্ষ?

নিকি হেসে বলল, ‘ওরা আমার ছোট বোন আপু। আমি সবার বড়, তারপর রিদিমা, তারপর আনিসা, আর সবার ছোট আনিকা।’

পেট্রার পিলে চমকে গেল। কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। নিকিতা অবশ্য কিছুই খেয়াল করতে পারল না। পেট্রার হাত ধরে টেনে অন্যদিকে নিয়ে যেতে যেতে বলল, ‘আপু, ভাই ওর বন্ধুদের সাথে থাকুক। তুমি এসো আমার সাথে। শুদ্ধ তোমাকে দেখলে খুব খুশি হবে।

রিদিমা, আনিসা, আনিকা–সবাই শুদ্ধকে খুব আদর করে। তাই শুদ্ধও তাদের খুব পছন্দ করে। আনিসা ও আনিকা আন্টির মাঝখানে বসে যখন গল্প করছিল শুদ্ধ, দূর থেকে দেখতে পেল নিকিতা আন্টি ওর মাকে হাত ধরে নিয়ে আসছে। কয়েক সেকেন্ড ও কিছু বুঝতে পারছিল না। তারপর এক দৌড়ে মায়ের কাছে চলে গেল। পেট্রা ওকে কোলে তুলে নিল। শুদ্ধর বয়স প্রায় ৯। হাতে-পায়েও বড় হয়েছে, তবু পেট্রা ওকে কোলে নেয়। তা ছাড়া সে শান্তি পায় না। শুদ্ধ যথারীতি মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। পেট্রার চোখেও জল এল। কিন্তু মুখে হাসি। শুদ্ধ ও পেট্রা যে দেখা হলেই কান্নাকাটি করে, তা আসলে এত দিন না পাওয়ার কষ্ট থেকে নয়, হুট করে পেয়ে খুশিতে কাঁদে। পেট্রা বলল, ‘ইশ, আমার ছেলেটা এত বড় হয়েও কাঁদছে দেখো। লোকে দেখলে কী বলবে!”

পাশে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে মা-ছেলের মিলনদৃশ্য দেখছিল নিকিতা। ওর কাছে দারুণ লাগছিল। যেন তারই বহুদিন পর দেখা হয়েছে তার ছেলের সঙ্গে। শুদ্ধর কান্নাটা কমে এলেই ও নিকিতার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘নিকিতা আন্টি, তুমি আমার মাকে নিয়ে এসেছ আমার কাছে। তুমি খুব ভালো, খুব খুব খুব।

নিকিতা হাসল। পেট্রা বলল, ‘একী বাবু! তুমি ওকে আন্টি বলছ কেন? মা হয় তো তোমার।

নিকিতা অবাক হলো পেট্রার কথা শুনে। আর নিজের গালেই নিজের চড় মারতে ইচ্ছা হচ্ছিল এমন মানুষকে বারবার ভুল বোঝার জন্য। পেট্রার জায়গায় থাকলে ও এমনটা কখনোই পারত না। শুদ্ধ বলল, ‘সরি। নিকিতা মা, তুমি অনেক ভালো। আর তুমি আমার আন্টি না, তুমি আমার মা।’

নিকিতা এক ভুলে মা ডাক শোনা থেকে বঞ্চিত থেকেছে অনেক দিন। এখন আবার মা ডাক শুনতে পেয়ে খুশিতে মনটা নেচে উঠল। শুদ্ধর মতো ছেলের মা হতে যে-কেউ চাইবে। ওর মুখের মা ডাক পৃথিবীর যে-কোনো মিষ্টির থেকে বেশি মিষ্টি। নিকিতা কিছু বলতে পারল না, শুধু হাসল।

দূর থেকে এই দৃশ্য দেখছিল প্রিয়। ট্রেী এখানে কীভাবে এল, তা সে বুঝতে পারছে না। কিন্তু নিকিতাকে ওর বিশ্বাস হচ্ছিল না। নিকিতা এত সহজ-সাবলীল আছে কীভাবে? যে মেয়ে পেট্রার নাম শুনলে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠত, তার এখন পেট্রার সঙ্গে এত খাতির! এর পেছনের রহস্য কী? এর আগেও কি ওদের দুজনের কোথাও দেখা হয়েছিল? কিন্তু সেটা হওয়া সম্ভব না। আর হলে তো সে জানত।

বছরখানেক বাদে তাদের আজ সরাসরি দেখা। ঠিক প্রথম প্রেমের মতোই হৃৎস্পন্দন চক্রবৃদ্ধিহারে বাড়ছে। দূর থেকে প্রিয় পেট্রাকে লুকিয়ে দেখছে। চোখে চোখ পড়তেই চোখ সরিয়ে নিচ্ছে। পেট্রা অবশ্য তাকাচ্ছে না। কেউ কারও সঙ্গে কথা বলে নি। পেট্রা ইচ্ছা করেই দূরে দূরে আছে। যত যা-ই হোক, এটা প্রিয়র শ্বশুরবাড়ির অনুষ্ঠান।

পেট্রা ও রায়ান রিদিমাকে গিফট দিয়ে, শুভেচ্ছা জানিয়ে যত দ্রুত সম্ভব চলে যেতে চাইছিল। কিন্তু নিকিতা ডিনার না করে কিছুতেই যেতে দেবে না ওদের। বাধ্য হয়েই থাকতে হলো। পেট্রা খাওয়ার সময় শুদ্ধকে পাশে বসিয়ে খাইয়ে দিল। ওদিকে রায়ান বা পেট্রা কারও গলা দিয়ে খাবার নামছে না। আনিসা নিকিতার বোন, এটা জানার পর থেকে দুজন দুরকম ভয়ে চুপসে আছে।

নিকিতা পেট্রাকে এগিয়ে দিতে এল। শুদ্ধ তখনো পেট্রার কোলে। পেট্রা শুদ্ধকে নামিয়ে নিচু হয়ে কপালে চুমু দিয়ে বলল, ‘ঠিকভাবে পড়াশোনা করবে, মা-বাবার সব কথা শুনবে। লক্ষ্মী ছেলে হয়ে থাকবে, আচ্ছা মা?’

শুদ্ধ পেট্রার গালে চুমু দিয়ে হেসে বলল, ‘আচ্ছা মা।

নিকিতা একটু আস্তেই বলল যাতে রায়ান বা শুদ্ধ না শোনে, ‘আপু, তোমাকে ভুল বুঝে অনেক খারাপ ব্যবহার করেছি। সেসবের জন্য এখন খুব লজ্জা লাগে।’

পেট্রাও আস্তে করেই বলল, ওহ গড! তুমি এখনো সেসব মনে রেখেছ? আমি তো কবেই ভুলে গিয়েছি। তুমিও ভুলে যাও। জীবনে খারাপ-ভালো অনেক রকম ঘটনা ঘটে। খারাপগুলো ভুলে ভাললাগুলো নিয়ে বাঁচতে হয়, এটাই সুখী হওয়ার মূলমন্ত্র।

‘এখন বুঝতে পারছি প্রিয় তোমাকে কেন এত ভালোবাসে!’

পেট্রা বিব্রত বোধ করল। তড়িঘড়ি করে বলল, ‘নিকিতা, আমরা এখন আসি।’

‘আচ্ছা আপু। আর একটা কথা, তোমার যখন শুদ্ধকে দেখতে ইচ্ছা করবে, তুমি আমাকে ফোন করবে। আমি প্রিয়কে না জানিয়েই তোমাদের দেখা করিয়ে দেব। তাতে শুদ্ধও ভালো থাকবে।

পেট্রা হেসে বলল, তোমার শ্বশুর ব্যাপারটা ভালোভাবে নেবে না। উনি আমাকে সব সময় মনিটরিং করেন।’

নিকিতার মুখ থেকে হাসিটা মিলিয়ে গেল। পেট্রা একটু থেমে শুদ্ধর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ‘তবে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কারণে একবারই দেখা করতে চাইব, তুমি নিয়ে যেয়ো।’

‘আচ্ছা আপু।

‘ওদের দেখে রেখো।

নিকিতা হাসিমুখে মাথা সামান্য কাত করে সম্মতি জানাল।

.

প্রিয় বেশিক্ষণ থাকবে না বলে গেলেও অনেকক্ষণই রইল। তারপর যখন বাসায় ফিরে এল, নিকিতাও তার সঙ্গেই ফিরল। শুদ্ধ গাড়িতেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। প্রিয় ওকে কোলে করে এনে বিছানায় শুইয়ে দিল। তারপর পাঞ্জাবি খুলে ট্রাউজার নিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেল। ফ্রেশ হয়ে যখন বের হলো, তখন নিকিতা গয়নাগাটি খুলে মেকআপ তুলছে। প্রিয় কোনো কথা না বলে শুয়ে পড়ল। নিকিতা ফ্রেশ হয়ে আসতেই প্রিয় জিজ্ঞেস করল, ‘রিদিমার বিয়েতে পেট্রা কীভাবে ইনভাইটেড ছিল?

‘আপুর ভাই আছে না রায়ান? ও আনিসার বন্ধু।

প্রিয় অবাক হলো। রায়ান ভার্সিটিতে ভর্তি হবে, আর আনিসা মাত্র ইন্টার ফার্স্ট ইয়ার। ওরা কীভাবে বন্ধু হয়? বন্ধু নাকি অন্য কিছু নিকিতা বলল, কী ভাবছ?’

‘তুমি আগে থেকে জানতে পেট্রা আসবে?

‘আরে না। আমি তো আপুকে ওখানে দেখে অবাক। আমি জানতামও ওর ভাই আনিসার বন্ধু।

‘আচ্ছা। কিন্তু তোমাদের এত খাতির হলো কবে?

‘মানে!

‘তুমি তো পেট্রাকে দেখতেই পারতে না। আর আজ তো দেখলাম ভালোই মাখামাখি।’

‘তখন তো আমি আপুকে ভুল বুঝে খারাপ ব্যবহার করেছিলাম।

‘ঠিকাছে, কিন্তু এই ভুল-বোঝাবুঝিটা মিটল কীভাবে?

‘আপুই তো ফোনে বোঝাল।

‘হুম, কিন্তু প্রথম দেখায় দুজন মানুষ এভাবে মিশতে পারে না। এর আগে তোমাদের কোথায় দেখা হয়েছে?

নিকিতার ভয় করতে লাগল। পেট্রার সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা তো ও জানায় নি প্রিয়কে জানানো ঠিক হবে কি না, বুঝতে পারছিল না। পেট্রা আপু এ ব্যাপারে কিছু বলে নি। প্রিয় কী-না-কী রিঅ্যাক্ট করে, সেই ভয়ে ও এত দিন চুপ ছিল। কিন্তু এখন তো প্রিয় ধরেই ফেলেছে। ভয়ে ভয়ে বলল, তুমি যখন রাগ করে চলে গিয়েছিলে, তখন দেখা হয়েছিল একদিন। অনেক কথাও হয়েছিল। সেদিনই আরও ভালো করে বুঝলাম আমি আপুকে শুধু শুধু ভুল বুঝেছি। পরে মাফ চেয়ে নিয়েছি।’

প্রিয় একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ওহ।’

আর ঘটাল না। নিকিতা হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। বকা খাওয়ার মতো কিছু করে নি, বুঝে গেল। সাহস করে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি পেট্রা আপুর সাথে কথা বললে না যে?’

প্রিয় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, তোমার শ্বশুর গ্যাঞ্জাম করত।

‘কেন? তোমরা যে আগে মাঝেমধ্যে দেখা করতে, সেটা তো সে জানত। তখন তো কিছু বলে নি।

‘হুম, কিন্তু এটা তোমার বাপের বাড়ির প্রোগ্রাম তো। অলরেডি শুদ্ধ ওর কাছেই ছিল পুরোটা সময়। আমিও কথা বলতে গেলে ওনার মান সম্মানে লাগত। এমনিতেও আমি কথা বলতাম না। কারণ, পেট্রা সেটা পছন্দ করত না। তাও উনি এসে আমাকে সাবধান করে গেছেন, যাতে আমি পেট্রার কাছে না যাই।’

নিকিতা অবাক হয়ে প্রিয়র পাশে বসে বলল, ‘বলো কী, এত ঘটনা কখন ঘটল?

‘তোমার শ্বশুর কখন কী করে, তা কাউকে টের পাইয়ে করে না।

‘আমি ওনাকে ঠিক বুঝতে পারি না। কখন যে কী চায়, বোঝ মুশকিল।

প্রিয় নিকিতার গাল টিপে হেসে বলল, ‘এসব মানুষ সম্পর্কে সবটা বুঝতে নেই। বুঝলে দেখবে তার ছায়াও বিষাক্ত, প্রচণ্ড ভয়ংকর!

.

পুরো রাস্তা রিকশায় দুই ভাইবোন কোনো কথা বলল না। বাসায় ঢুকে পেট্রা রুমে ঢুকতে যাবে, তখন রায়ান বলল, ‘দি সরি। আমি জানতাম না আনিসা প্রিয়দার শালিকা।

‘সেটা আমি জানি।

‘কী করব আমি, দি?

‘কী করবি বলতে? তুই কি ভয় পাচ্ছিস?

রায়ান মাথা নিচু করে বলল, আমি চাই না আমার জন্য তোকে কারও কাছে অপমানিত হতে থোক। আর আনিসাকেও ছাড়তে পারব না। অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছি।’

‘ভয় পাস না। আনিসাকে কাল বাসায় নিয়ে আসিস। আমি একটু কথা বলব।’

‘আচ্ছা দি।

‘এখন যা, ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়।

রায়ানকে ভয় পেতে নিষেধ করলেও পেট্রার নিজেরই ভয় করছিল। নিকিতার প্রচণ্ড মাথাগরম। এমনিতেই ওর জন্য নিকিতার সংসারে অশান্তি। আবার ওর ভাইয়ের জন্য যদি বাপের বাড়িতেও অশান্তির সৃষ্টি হয়, তাহলে নিকিতা কীভাবে রিঅ্যাক্ট করবে, সে বুঝতে পারছে না। এই ভালো সম্পর্ক হয়তো থাকবেই না, উল্টো…আর কিছু ভাবতে পারছে না পেট্রা। তার জন্য মা-বাবা কষ্ট পেতে পেতে দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছে। শেষ পর্যন্ত তার পুত্রতুল্য ছোটভাইটাও তারই জন্য কষ্ট পাবে? বুক ফেটে কান্না আসছিল, কিন্তু ভাইটা ঘাবড়ে যাবে বলে শক্ত ছিল। ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ল পেট্রা।

৩২

জীবনে এমন অনেক পরিস্থিতি আসে, যখন নিজেকে বড় অসহায় লাগে। পেট্রা বহুদিন আগে থেকেই বারবার এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে। কিন্তু আজকের মতো বোধ হয় কখনো না। এতটাই শাস্তি পাওয়া বাকি আছে তার এখনো? তা নয়তো কী? না হলে দুনিয়াতে এত মেয়ে থাকতে নিকিতার বোনের সঙ্গেই কেন সম্পর্ক হবে রায়ানের? আর ওদের কী হবে, সেই সিদ্ধান্তটা পেট্রাকেই কেন নিতে হবে? মা-বাবা থাকলে সে শুধু সাপোর্ট দিত তাদের কিন্তু এভাবে পুরোটা নিজের ওপর পড়ত না। এখন কী করবে সে? তার নিজের ক্ষেত্রে যেমন হৃদয়ের চেয়ে মস্তিষ্কের ওপর বেশি গুরুত্ব দিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ভাইয়ের বেলায় তো সেটা সে কখনো পারবে না। এমনিতেই সে বলেছিল একদিন আনিসাকে বাসায় নিয়ে আসতে, কথা বলবে। কিন্তু আজ রায়ান বলল, কাল নাকি রিদিমার বিয়েতে কেউ আনিসাকে দেখে তাদের ছেলের জন্য পছন্দ করেছে। বিয়ের প্রস্তাবও দিয়ে দিয়েছে। এখন দুশ্চিন্তায় ওদের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। তাই আবার আজই ওকে নিয়ে আসতে বলেছে। ওদিকে প্রিয়াঙ্কাকেও আসতে বলেছে।

পেট্রা-প্রিয়াঙ্কা দুজনের সঙ্গেই আনিসার আগেও বহুবার দেখা হয়েছে, কোনো জড়তা থাকার কথা না, তবু আজ জড়তা কাজ করছে আনিসার। ভাগ্যিস, তারা অনেক স্বাভাবিক আছে। না হলে আনিসা এতক্ষণে টেনশনেই মরে যেত। রায়ান অবশ্য আছে পাশে কিন্তু চুপ করে আছে, সে এমনিতেও কথা একটু কম বলে। নানান কথার মাঝে এই বিষয়টা পেট্রাই তুলল, ‘আমি যে শুদ্ধর মা, এটা কি তুমি জানতে?

আনিসা বলল, ‘না আপু, কালই জানলাম।

‘আচ্ছা। তোমার কি মনে হয় রায়ানের সাথে তোমার সম্পর্কের কথা তোমার পরিবার জানলে তাদের প্রতিক্রিয়া কী হবে?

‘মানবে না, উল্টো মেরেও ফেলতে পারে আমাকে। রিদিমা আপুর বয়ফ্রেন্ডের তো সবই ঠিক ছিল, তাও মানে নি। জোর করে বিয়ে দিয়ে দিল। ওর বয়ফ্রেন্ডের অপরাধ ছিল সে এখনো স্টুডেন্ট। দুই বছর সময় চেয়েছিল। বাবা সময় দিল না। এরপর তো আমার সিরিয়াল আপু। অলরেডি বিয়ের কথা চলছে।’

‘হ্যাঁ, রায়ানের কাছে শুনলাম। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি!

‘বাবা বলে যে বয়স হয়ে গেলে মেয়েদের বিয়ে দেওয়া যায় না। নিকিতা আপুকে ১৮ বছর বয়সে বিয়ে দিয়েছিল। রিদিমা আপুকেও তো ১৮-তেই দিয়ে দিল। কিন্তু আমার মাত্র ১৭। আমাকে কেন এত তাড়াতাড়ি দিতে চাচ্ছে, বুঝলাম না।’

প্রিয়াঙ্কা এতক্ষণ চুপ করে ছিল। এখন জিজ্ঞেস করল, তোমার যে অ্যাফেয়ার আছে, এটা কি কোনোভাবে জানতে পেরেছে?

‘না আপু, জানে না কিছু, আমি খুব সাবধানে থাকি।

পেট্রা বলল, তুমি এখন কী করতে চাও?

‘আমি পালাব। তাদের বললেও তারা মানবে না, তাহলে বলব কেন বলো?

‘একটা সুযোগ দেওয়ার জন্য বলবে।’

‘জানি তো আপু, কিছুতেই মানবে না। যদি শোনে ধর্ম আলাদা, সাথে সাথে আমাকে কেটে ভাসিয়ে দেবে।

এসব কথার মাঝে হঠাৎ প্রিয়াঙ্কা বলে উঠল, ‘আমি ভাবছি নিকিতা কী রিঅ্যাক্ট করবে!

আনিসা বলল, ‘বড়াপু সবচেয়ে বেশি ঝামেলা করবে। শুনলেই তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠবে। ওর ভয়ংকর রাগ। বড়লোক বাড়ির বউ হওয়ার পর তো আমাদের বাসায় তার পাওয়ার আরও বেড়ে গেছে। মা বাবাও ওর কথা শোনে। মা-বাবার বাধ্য মেয়ে যে ও। শুধু দুলাভাইয়ের সামনে মুখ দিয়ে কথা বের হয় না।’

পেট্রা কিছুক্ষণ চুপচাপ ভাবল, আনিসার কথা বলার ধরনই কি এমন? নাকি রায়ানের জন্য ডেসপারেট হওয়ায় উত্তেজনার বশে এভাবে বলছে! যাক, যেমনই হোক, যার পার্টনার হবে, সে সুখী থাকলেই হলো। পেট্রাকে চিন্তিত দেখে আনিসা কিছু বলবে কি না ভাবছে, কিন্তু আর কী বলবে, বুঝতে পারছে না। তাই চুপ করে আছে। রায়ান ও প্রিয়াঙ্কাও চুপচাপ মুখ-চাওয়াচাওয়ি করছে। পেট্রাই আবার আলোচনায় ফিরে এল, ‘আমি সামনের মাসেই মালয়েশিয়া যাচ্ছি। রায়ান তিন মাস পর যাবে। এটুকু সময়ের মধ্যে কী করব বুঝতে পারছি না। আর তোমাদের দুজনেরই বয়স খুব কম, এটাই সবচেয়ে বড় সমস্যা। তা না হলে অনেক কিছুই করা যেত।

রায়ান-আনিসা চুপ। পেট্রা বলল, ‘রায়ান, তুই কী করতে চাস?

‘বুঝতে পারছি না, দি। তুই বল কী করা উচিত।

পেট্রা আনিসার দিকে তাকিয়ে বলল, আমাকে সেই স্কুল লাইফ থেকে বিয়ে দিতে চেয়েছিল, বুঝেছ? আমি নানান বাহানা দিয়ে ঠেকিয়েছি। তুমিও একটা বছর ঠেকিয়ে রাখো। এইচএসসি পরীক্ষাটা শেষ করো। ততদিনে আমরা ওদিকে সব গুছিয়ে নিতে পারব। তারপর আমরা তোমাকে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করব। তখন আমরা তোমার পরিবারের সাথে কথা বলব। প্রিয়াঙ্কা তোমাকে এখান থেকে সাহায্য করবে। এর মধ্যে কোনো সমস্যায় পড়লে ওর কাছে আসবে।

প্রিয়াঙ্কা বলল, ‘হ্যাঁ, ফোন নম্বর নিয়ে নাও। আর রায়ান, তুই একদিন ওকে আমার বাসায় নিয়ে যাবি। বাসাটা চেনা থাকলে ভালো হবে।

রায়ান বলল, ‘আচ্ছা।’

আনিসা বলল, কিন্তু আপু, বিয়ে যদি ঠিকই করে ফেলে, সেটা ঠেকাব কীভাবে?

পেট্রা বলল, ‘বিয়েতে আপত্তি করবে না। শুধু বলবে যে এইচএসসির পর বিয়ে করবে। তাহলে আশা করি তোমার পরিবার আর জোর করবে না। প্রথমেই যদি আপত্তি করো, তাহলেই বরং জোর করবে।

‘ঠিকাছে আপু, তা-ই করব। কিন্তু আমার খুব ভয় করছে।’

পেট্রা-প্রিয়াঙ্কা একসঙ্গেই বলে উঠল, ‘ভয়ের কিছু নেই।’

তারপর দুজনেই হেসে দিল। তারপর পেট্রা বলল, আমরা আছি তো।’

রায়ান বলল, ‘দি, তোরা কেউ এটা কেন জিজ্ঞেস করলি না যে পেট্রাদিকে দেখেও আমার শিক্ষা হয় নি, মুসলিম একটা মেয়েকে কেন ভালোবেসেছি! কেন করলাম?

প্রিয়াঙ্কা বলল, ‘যা করার তা তো করেই ফেলেছিস। এখন আর এসব বলে কী হবে?

পেট্রা বলল, এমন বোকা প্রশ্ন আমি কেন করব, রায়ান? ভালোবাসা এত কিছু চিন্তা করে হয় না। হলে আমারটাও হতো না।

আনিসা চুপ করে আছে। সে বুঝতে পারছে না তার কী বলা উচিত। তবে এটুকু বুঝতে পারছে, দুনিয়ার সেরা বোনদের কাছে এসে পড়েছে সে।

.

রিদিমার বউভাতের অনুষ্ঠানে নিকিতা শুদ্ধকে খাইয়ে শ্বশুরের কাছে রেখে কাজিনদের কাছে যাচ্ছিল। এমন সময় তার বড় মামি ডেকে বলল, এই নিকিতা, এদিকে শোন।

নিকিতা এগিয়ে গেল, ‘হা মামি, বলো। তোমরা খেয়েছ?

‘আরে না, পরে খাব, শোন এদিকে। তোর ওই সতিনটা আজও এসেছে নাকি? কোন পক্ষের ও?’

এ কথা শুনে নিকিতার মাথায় আগুন জ্বলে উঠল। তবু মাথা ঠান্ডা রেখে বলল, ‘আজ আসে নি। আর কিছু বলবে?

‘কী আর বলব বল, তোর বাবা তোর জীবনটা একেবারে নষ্ট করে দিল। ছেলেটা দেখতে-শুনতে তো ভালোই কিন্তু কেমন অহংকারী। কারও সাথে কথাই বলে না। খুব দুঃখ হয় তোর জন্য, মা।

নিকিতা রাগ ঝাড়ার জন্য তৈরি হচ্ছিল, এর মধ্যেই মামি আবার বলল, এমন চাঁদের মতো মুখ তোর। তোর জন্য আরও ভালো পাত্র পাওয়া যেত। জীবিত বউকে মৃত বলে বিয়ে করল। আল্লাহই জানে আরও বিয়েশাদি করেছে কি না! বড়লোকের ছেলেদের বিশ্বাস নেই, বাবা। তার উপর মন্ত্রীর ছেলে। এখন তার জীবনটা ওই বাচ্চা পালতে পালতেই যাবে।

এবার আর নিকিতা নিজেকে সামলাতে পারল না। মামিকে একটা ধাক্কা দিয়ে দেয়ালের ওপর ফেলে দিল। তারপর চিৎকার করে বলল, ‘আমার স্বামী এক শটা বিয়ে করবে আর ওর হাজারটা বাচ্চা আমি পালব। তোমার বাপের কী?

দেয়ালের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে ভদ্রমহিলা প্রচণ্ড ব্যথা পেল। ঘটনার আকস্মিকতায় ভয়ে চুপসে গেল। নিকিতা এমন কেন করল?

বিয়েবাড়ির সবার দৃষ্টি এখন নিকিতার দিকে। চিৎকার শুনে নিকিতার মা-বাবা এবং প্রিয়ও ছুটে এসেছে। এমনকি বাবর খানও এসে অবাক হয়ে সব দেখছেন। নিকিতা এবার মামির কাছে গিয়ে বলল, ‘তোমাকে কি বলেছি আমার বাচ্চা পালায় সাহায্য করো? নাকি বলেছি আমি সুখে নেই? আমার স্বামীকে নিয়ে, ওর বিয়ে নিয়ে তোমার এত চুলকানি কেন? তোমাকে বিয়ে করেছে? নাকি তোমার মেয়েকে বিয়ে করেছে? আসল কথা হলো, তোমরা মানুষের সুখ দেখে ঠিক থাকতে পারো না, তোমাদের জলে।

অবস্থা বেগতিক দেখে প্রিয় এগিয়ে গিয়ে নিকিতাকে ধরে আনতে চাইল, ‘নিকিতা, ছি, কী বলছ তুমি এসব? চলো আমার সাথে।

প্রিয় যাওয়ায় নিকিতার মা-বাবা আর এগোলেন না। এদিকে নিকিতার গায়ের জোর দেখে এবার অবাক হওয়ার পালা প্রিয়র। তাকে কিছুতেই সরানো যাচ্ছে না। সে আবার মামিকে মারতে যাচ্ছে। রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে বলল, তুমি জানো সে কী বলেছে? সে বলেছে…’

প্রিয় এবার উপায় না দেখে পেছন থেকেই এক হাতে নিকিতার মুখ চেপে ধরল। আরেক হাতে তার কোমর জাপটে ধরে বাচ্চাদের মতো উঁচু করে নিয়ে বের হয়ে গেল ওখান থেকে। পেছন পেছন শুদ্ধ দৌড় দিল।

প্রিয় একেবারে গাড়িতে নিয়ে বসাল নিকিতাকে। ততক্ষণে শুদ্ধও পেছনের দরজা খুলে উঠে গেছে। নিকিতার এত রাগ উঠেছে এবং এত জোরে চিৎকার করেছে যে গলা শুকিয়ে গেছে, এখন শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। শুদ্ধ বলল, ‘বাবা, কী হয়েছে নিকিতা মার?

প্রিয় ততক্ষণে গাড়ি স্টার্ট দিয়েছে। নিকিতা রাগে ফোঁস ফোঁস করছে, চোখে জল। প্রিয় একটু দূরে গিয়ে একটা দোকানে গাড়ি থামিয়ে পানি কিনল। তারপর আবার গাড়িতে ফিরে পানিটা নিকিতার হাতে দিতেই নিকিতা বোতলটা ছুঁড়ে ফেলে দিল। প্রিয়র কেন যেন পুরো ঘটনাটায় প্রচণ্ড হাসি পাচ্ছে। প্রিয় হেসেই বলল, ‘এক শটা বিয়ে করব?

নিকিতা আবার চিৎকার দিল, ‘করবে, প্রয়োজনে হাজারটা করবে, ওই বেটি বলার কে?’

শুদ্ধ বলল, ‘বেটি কী জিনিস, মা? আর বাবা এক শ বিয়ে কেন করবে?

নিকিতা চুপ। প্রিয় বলল, ‘দেখেছ ছেলে কী সব শিখছে? ওর সামনে ভুলেও এসব বলবে না আর।

শুদ্ধ নিকিতার চোখ মুছে দিয়ে বলল, ‘কান্না কোরো না, মা। সব ঠিক হয়ে যাবে।

নিকিতা শুদ্ধকে কাছে টেনে কোলে নিল। প্রিয় হাসছে। প্রিয়র এই হাসি নিকিতার সহ্য হচ্ছে না। কিন্তু প্রিয়র খুব মজা লাগছে, আরও হাসতে ইচ্ছা করছে। হঠাৎ প্রিয় সজোরে হেসে দিল।

৩৩

প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছে। আশপাশে কিছুই ঠিকভাবে দেখা যাচ্ছে না। তাই অফিস থেকে বের হতে পারছে না পেট্রা। অবশ্য অত তাড়াও নেই। সমস্যা একটাই, ফোনটার যেন কী হয়েছে। দুপুরে হুট করেই বন্ধ হয়ে গেছে, আর স্টার্ট হচ্ছে না। ফোনেরই-বা কী দোষ, অনেক বৃদ্ধ হয়ে গেছে। একটা নতুন ফোন কিনতে হবে।

অফিসে আজই তার শেষ দিন। মায়া পড়ে গিয়েছিল এই অফিসে। কয়েকদিন পরেই তার ফ্লাইট। নতুন চাকরি, নতুন জায়গা। জীবনে একটা পরিবর্তন দরকার ছিল খুব। চলে যাচ্ছে বলে খুশি কিন্তু নিশ্চিন্তে নেই সে। রায়ান-আনিসার ব্যাপারটা তাকে এখনো ভাবাচ্ছে। কত দিনের সম্পর্ক ওদের? এইটুকু ছেলেমেয়ে, যদি ম্যাচিওরড হওয়ার পর দুজনের দুজনকে আর ভালো না লাগে? নিজের পরিবার ছেড়ে এভাবে গিয়ে আনিসা কি ভালো থাকতে পারবে? তা ছাড়া আনিসা বাসায় কেন বলতে চায় না? মানুক না মানুক, অন্তত বাসায় জানানোটা তো জরুরি। তা না করেই পালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এসব ভাবনার মাঝেই স্মরণ ডাক দিল, ‘পেট্রা।’

পেট্রা স্মরণের দিকে তাকাল। স্মরণ বলল, ‘কোথায় যাবে এখন?

‘সরাসরি বাসায়।

‘চলো আমি নামিয়ে দিই।’

‘না না, বৃষ্টি একটু থামলেই আমি চলে যাব।’

‘আজই তো শেষ। আজকের পর থেকে তো এই স্মরণ চাইলেও আর তোমাকে জ্বালাতে পারবে না। প্লিজ পেট্রা। আর আজকে তোমার হাতের এক কাপ চা খাব। শেষ আবদার।

পেট্রা হেসে বলল, ‘আচ্ছা, চলো।’

বাইরে তুফান হচ্ছে। অফিসের গেট থেকে বের হয়ে পেট্রার চোখ শুধু একজনকেই খুঁজছিল। সে প্রিয় ছাড়া আর কেউ না। নয় বছর আগের এই দিনে ওরা বিয়ে করেছিল। সেদিনও ঠিক একই রকম বৃষ্টি হচ্ছিল। আজ কি প্রিয় এসেছে? সে যোগাযোগ করতে নিষেধ করেছে, তাও প্রিয়। আসে মাঝেমধ্যে। আজও নিশ্চয়ই আসবে। আবার না-ও আসতে পারে। ডিভোর্সের পর এই দিনটিকে ঘটা করে পালন করার কোনো মানে হয় না। বিগত বছরগুলোতেও করেও নি অবশ্য। কিন্তু স্মৃতি! স্মৃতি তো প্রতারণা করে না। প্রিয়কে কোথাও দেখতে পাচ্ছে না পেট্রা। আসে নি তাহলে? অবশ্য পরিস্থিতি এখন যেমন, এটাই তো স্বাভাবিক। তবু তার কেন খারাপ লাগছে?

.

দশ দিন আগে ছিল শুদ্ধর জন্মদিন। পেট্রা নিকিতার মাধ্যমে শুদ্ধর সঙ্গে দেখা করেছে, উপহার দিয়েছে কিন্তু প্রিয়র সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করে নি। এমনকি একটা ফোনকলও না। তাই প্রিয় বুঝেই গেছে পেট্রা আজও যোগাযোগ করবে না। কিন্তু আজকের দিনটায় প্রিয় মনকে কিছুই বোঝাতে পারল না। আজ সে পেট্রাকে পেয়েছিল। জীবনে পাওয়া শ্রেষ্ঠ সম্পদ। ঠিক করল আজ পেট্রার কাছে কিছু সময়ের সঙ্গ আবদার করবে সে, পেট্রা মানলে মানল, না মানলে না মানল, চাইতে তো কোনো দোষ নেই। এসব হাবিজাবি ভেবে শেষমেশ প্রিয় ফোনটা করেই ফেলল। নম্বরটা নিকিতার কাছ থেকেই চেয়ে নিয়েছে। কিন্তু পেট্রার ফোন বন্ধ। না বলে সামনে যেতে না করেছে, গেলে হয়তো রাগ করবে। তাই প্রিয় সেসব ইচ্ছেকে বিসর্জন দিয়ে শুধু দূর থেকে দেখে আসার সিদ্ধান্ত নিল। তাই পেট্রার অফিসের সামনে চলে এল। ঠিক অফিসের সামনে না, রাস্তার মাথায়। যাতে বের হওয়ার সময় একটু দেখতে পায়। দূর থেকে দেখে চলে আসবে।

বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর খেয়াল করল পেট্রা স্মরণের গাড়িতে। পেট্রা-স্মরণ একসঙ্গে কীভাবে? তারা কীভাবে একজন আরেকজনকে চেনে? প্রিয় দূর থেকে তাদের অনুসরণ করল। যখন গাড়িটা পেট্রাদের বাসার দিকে যাচ্ছিল, প্রিয়র বুকের ভেতর কেউ হাতুড়ি পেটাচ্ছিল। সে সবচেয়ে বেশি অবাক হলো পেট্রা স্মরণকে নিয়ে ওদের বাসায় ঢুকল দেখে। দুজনের কী সম্পর্ক? কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল কিন্তু স্মরণ বের হলো না। তার মানে, বাসায় পৌঁছে দিতে আসে নি। অন্য কোনো কারণে? কী সেই কারণ?

প্রিয় পেট্রাদের এলাকা থেকে বেরিয়ে এল। কোথাও যাবে না, আন্দাজে এদিক-ওদিক ঘুরছে। একটার পর একটা সিগারেট খাচ্ছে। সবকিছু অসহ্য লাগছে ওর। রাত দশটার দিকে আবার ফোন করল পেট্রাকে। পেট্রা ফোন ধরল না। এবার ফোন করল স্মরণকে।

স্ক্রিনে প্রিয়র নম্বর দেখে অবাক হলো স্মরণ। সচরাচর ফোন করে না সে। আজ হঠাৎ? ফোন ধরে বলল, ‘হ্যালো প্রিয় ভাইয়া।

‘হ্যালো স্মরণ, কেমন আছ?

‘ভালো আছি, ভাইয়া। হঠাৎ কী মনে করে?

‘কিছু মনে কোরো না, একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করতে পারি?

‘বলুন।

‘পেট্রাকে তুমি কীভাবে চেনো?

‘হঠাৎ এই প্রশ্ন?

‘আমি আজ সন্ধ্যায় তোমাদের ওর বাসায় যেতে দেখলাম। আসলে আমি ওই রাস্তা দিয়েই যাচ্ছিলাম, দূর থেকে দেখলাম।

‘ও আচ্ছা। পেট্রা আমার কলিগ।’

‘কলিগ, তাহলে ওর বাসায় গেলে যে!’

‘কলিগের বাইরেও আমাদের বাড়তি একটা সম্পর্ক আছে। ভালোবাসার সম্পর্ক, তাই আমি যেতেই পারি ওর বাসায়। কিন্তু আপনি ওকে কীভাবে চেনেন?’

ও আচ্ছা। পেট্রা আমার বন্ধু।

‘ও হ্যাঁ, আপনিও তো বুয়েটে পড়তেন। বুয়েটের বন্ধু?

‘হ্যাঁ, আচ্ছা স্মরণ, রাখি তাহলে, ভালো থেকো।

লাইন কেটে প্রিয় ফোনটা আছাড় দিল। নিজেকেই নিজের খুন করতে ইচ্ছা করছে এখন তার। মাথাটা পুরো খারাপ হয়ে গেল। পেট্রা তাহলে স্মরণের সাথে প্রেম করছে! ও কি মুসলিম কাউকে বিয়ে করে এটাই প্রমাণ করতে চাচ্ছে যে প্রিয় যেটা পারে নি, সেটা চাইলেই অনেকে পারে? পরমুহূর্তেই মনে হলো, ধুর পেট্রাকে কেন ভুল বুঝছে সে। পেট্রাকে তো সে নিজেই বলেছে বিয়ে করতে। পেট্রার একটা ভালো বিয়ে হলেই তো সে নিজের অপরাধবোধ থেকে মুক্তি পাবে। তাহলে এসব দেখে কষ্ট পাচ্ছে কেন? সে নিজে তো একটা ইউজলেস, ভালোবাসাকে তাই আজ অন্য কারও সঙ্গে এভাবে সহ্য করতে হচ্ছে।

গাড়ির ইঞ্জিনে পানি ঢুকে গেছে। গাড়িটা গ্যারেজে দিয়ে রিকশা নিল প্রিয়। শিলাবৃষ্টি হচ্ছে, ঠান্ডায় রীতিমতো কাঁপছে সে, তবু পর্দা নিল না, হুডও তুলল না। শরীরে আগুন জ্বলছে, বৃষ্টির পানিতে নিভুক একটু। কিন্তু এ দাবানল নিভবে বলে মনে হচ্ছে না। কত দিন ধরে চলছে ওই সম্পর্ক কে জানে! তাকে জানালও না পেট্রা! এভাবে জানতে হলো নিজের ভালোবাসা হারানোর গল্প! পেট্রা তাহলে এখন আর তার নেই। ভালোবাসা হারানোর যন্ত্রণা, রাগ, অভিমান, নিজের অপারগতা, নিজের প্রতি ঘৃণা– সব মিলেমিশে একাকার হয়ে প্রিয়কে গ্রাস করেছে।

.

বেল বাজাতেই নিকিতা দরজা খুলে বলল, ‘ইশ, একদম ভিজে গেছ। এত ভিজলে কী করে?

প্রিয় কিছু না বলে সোজা ঘরে চলে গেল। নিকিতাও পেছন পেছন গিয়ে তোয়ালে বের করতে করতে বলল, কোথায় ছিলে তুমি?

প্রিয় কোনো কথা বলছিল না। ভেজা শার্টের বোতাম খুলছিল। শার্টটা খুলে রাখতেই নিকিতা সামনে দাঁড়িয়ে তোয়ালে দিয়ে চুল মুছে দিতে দিতে বলল, ‘শুদ্ধ তোমাকে কী যেন আনতে বলবে, এতবার ফোন দিল। তোমার ফোন বন্ধ। শেষমেশ বাচ্চাটা দাদার কাছে গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে গেল। আমরা দুশ্চিন্তা করছিলাম খুব।

প্রিয় ভাবছিল, শুধু পেট্রার জন্য, পেট্রাকে ভালোবেসে, তার প্রতি সম্মান রেখে, গত ছয় বছর ধরে কোনো নারী শরীর স্পর্শ করে নি। নিকিতাও চার বছর ধরে দিনরাত তার সঙ্গেই থাকছে, সে না মানলেও বিয়ে করা বউ! কতভাবে গলাতে চেয়েছে, তবু তো এক মুহূর্তের জন্যও গলে নি প্রিয়। অথচ পেট্রা কিনা…মনে হচ্ছিল সারা শরীরে কেউ ধারালো ছুরি দিয়ে খোঁচাচ্ছে।

নিকিতা বলল, ‘ইশ, একদম বরফ হয়ে গেছ। তুমি কাপড় বদলে নাও, আমি তাড়াতাড়ি এক মগ কফি বানিয়ে দিই।

কথাটা কেবল শেষ করল নিকিতা। তারপর কিছু বুঝে ওঠার আগেই প্রিয় আচমকা এক হাতে তাকে কাছে টেনে ঠোঁটে চুমু খাওয়া শুরু করল। নিকিতার হাত থেকে তোয়ালে পড়ে গেল। সে এত অবাক হলো যে কোনো সাড়া দিতে পারল না। প্রিয় চুমু খেতে খেতেই তাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরল। হাত-পা অবশ হয়ে আসছে, সে প্রিয়কে জড়িয়ে ধরতেও পারল না। প্রিয় এবার তাকে কোলে তুলে বিছানায় নিয়ে গেল। সে এত অবাক জীবনে কোনো দিন হয় নি। কী করতে যাচ্ছে প্রিয়? দরজাটা লক করাও হয় নি। অবশ্য এত রাতে কেউ জেগে নেই, থাকলেও নক না করে ঢুকবে না। ব্যস, এর বেশি আর কিছু ভাবতে পারল না নিকিতা। এরপর ভাবনাচিন্তা করার ক্ষমতাটাও অবশ হয়ে গেল।

৩৪

পেট্রার লাগেজ গোছানো যদিও হয়ে গেছে, তারপরও প্রতিদিন এটা-ওটা টুকটাক জিনিসের কথা মনে পড়ছে, পরে সেগুলো নিচ্ছে। গোছগাছের মাঝেই রায়ান দরজায় নক করল! পেট্রা বলল, ‘কিরে, এত রাত হয়ে গেছে, ঘুমাস নি?

‘কত ঘুমাতে পারব! তুই তো কদিন পরেই চলে যাবি।

পেট্রা হেসে বলল, ‘গল্প করতে এসেছিস?

‘হ্যাঁ।

‘বসে পড়।’

রায়ান বসতে বসতে বলল, ‘আজ সন্ধ্যায় তুই যখন চা বানাতে গেলি, স্মরণ ভাই আমাকে কী বলেছে, জানিস?

‘কী বলেছে।’

‘বলেছে…’

‘আমতা আমতা করিস না। কী বলেছে সে?

‘এখনো আমাকে বলে তোকে বিয়েতে রাজি করাতে! প্রিয়াঙ্কাদির ফোন নম্বরও চাইল।

‘যত্ত সব! প্রিয়াঙ্কার নম্বর কেন আবার?

‘ওনার ধারণা, প্রিয়াঙ্কাদি চাইলে তোকে রাজি করাতে পারবে হয়তো। এ জন্য উনি দির সাথে কথা বলবে ব্যাপারটা নিয়ে।’

‘বিরক্তিকর ছেলে একটা। এতবার বলার পরও বোঝে না। এই জন্য এসব ছেলেপেলেকে সহ্য হয় না আমার। সবকিছুতেই বাড়াবাড়ি।’

‘দি, আসলে ভাইয়া তোকে অনেক ভালোবাসে, এই কদিনে আমি এটুকু বুঝেছি।’

‘রায়ান, তুই কি ওর হয়ে অ্যাডভোকেসি করতে এসেছিস?

পেট্রার ধমকে ঘাবড়ে গেল রায়ান। বলল, ‘না, দি। তুই যেটা ভালো বুঝবি, অবশ্যই সেটা করবি। আমি তো শুধু…’।

‘রায়ান, আমরা এখন টিনএজে নেই যে এ রকম অসম সম্পর্কে যাব। এবং দিওয়ানা হয়ে যাব। তা ছাড়া স্মরণের এটা কোনো ভালোবাসাই না, নিছক পাগলামি। বড়লোকের ছেলে, যখন যা মন চেয়েছে, করেছে। জীবনকে কতটুকু চেনে সে? আমাকে বিয়ে করলে যেসব সমস্যার মুখোমুখি সে হবে, তার কথা তো এখনো ভাবতেই পারছে না। কিন্তু আমি খুব ভালোভাবে জানি এসব। সবচেয়ে বড় কথা, আমার বিয়ে করার কোনো ইচ্ছে নেই। আল্লাহ বাঁচাচ্ছে, যাচ্ছি, আপদ ঘাড় থেকে নামল।

‘সারা জীবন একা থাকবি? প্রিয়দা তো…’

‘রায়ান! সারা জীবন আমি একা থাকব, না কী করব, সেটা সম্পূর্ণ আমার ব্যাপার। এ ব্যাপারে তোরা কেউ কোনো কথা বলবি না। প্রিয়র সম্পর্কেও কিছু বলবি না। প্রিয়র পরিস্থিতি বোঝার মতো বয়স বা

ম্যাচিওরিটি কোনোটাই তোর এখনো হয় নি।

‘সরি দি।

‘কদিন পর চলে যাব। এর আগে তোকে বকাবকি করতে চাই নি আমি। কিন্তু তুই…’।

পেট্রা কথা শেষ করার আগেই রায়ান পেট্রাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘ছোটবেলা থেকে প্রিয়দার কাঁধে, কোলে চড়ে বড় হয়েছি। দাদাকে তোর হাজব্যান্ড ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারি না। তাকে অন্য কারও সাথে আমি সহ্য করতে পারি না। তুই কীভাবে করিস?

পেট্রা রায়ানের পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, ‘প্রিয়কে ভুল বুঝিস না ভাই। কাউকে বাইরে থেকে দেখে তার ভেতরের রক্তক্ষরণ বোঝা যায় না।’

.

বছরে এই একটা দিন, যেদিন প্রিয়র কথা ভেবে মন খারাপ হয় না পেট্রার। আর এই দিনই পেট্রা প্রিয়কে নিয়ে বেশি ভাবে। সারা রাত ঘুমাতে পারে না উত্তেজনায়। এদিন ওদের বিয়ে হয়েছিল, বাসর হয়েছিল। পেট্রার চেয়ে বেশি নার্ভাস ছিল প্রিয়। দুজনই অনভিজ্ঞ, কিছুই করতে পারছিল না। সারা রাত প্রচেষ্টা ও গবেষণার পর ভোরবেলা সফল হয়েছিল। মনে পড়তেই নিজের অজান্তে হেসে ফেলল। বাইরে এখনো তুমুল বৃষ্টি। একটু শীত শীত করছে। পেট্রা বালিশটা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করে ভাবতে থাকল সেই রাতের কথা। ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মাথায় ভূত চাপল। প্রিয়কে আসতে বলতে ইচ্ছা হলো। পরক্ষণেই থেমে গেল। মনে হলো, কী ভুলটাই না করতে যাচ্ছিল ও। এখন প্রিয়কে এভাবে ডাকা মানে ওকে প্রশ্রয় দেওয়া। এত দিন কষ্ট করে যতটুকু দূরত্ব বাড়িয়েছিল, তা একনিমেষেই শেষ হয়ে যাবে। পেট্রা মনে মনে প্রার্থনা করল, ‘হে ইশ্বর, ধৈর্য দাও, শক্তি দাও।

.

নিকিতা ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। কিন্তু প্রিয় সারা রাত একফোঁটা ঘুমাতে পারে নি। গত নয় বছর ধরে বিশেষ এই রাতে সে কখনো ঘুমাতে পারে নি। প্রথম তিন বছর পেট্রাকে আদর করে, গল্প করে এবং পরের ছয় বছর ওকে মিস করে করে কেটেছে। ওর আদরের জন্য বড় কাঙাল ছিল পেট্রা। সেই পেট্রা আজকাল কী করে কাটায় একেকটা রাত ওকে ছাড়া? স্মরণ-পেট্রা কবে বিয়ে করবে? ওকে কি জানাবে না? নাই-বা থাকল ওদের সম্পর্ক, ওরা তো বন্ধুও ছিল, সেই অধিকারেও কি জানতে পারে না? করুক তারা বিয়ে, সুখী হোক। পেট্রার জীবনটা তো ওর জন্যই এমন হয়েছে। কিন্তু স্মরণ ওকে সুখে রাখবে তো? নিঃশ্বাসটা আটকে আসছে। এত কেন মিস করছে পেট্রাকে? পেট্রাও কি মিস করছে? না করে যাবে কোথায়? যত স্মরণই আসুক ওর জীবনে, প্রিয়কে কখনো ভুলতে পারবে না…এতটাই তো ভালোবাসা দিয়ে রেখেছে সে। এসব ভাবতে ভাবতে ভোরের দিকে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিল প্রিয়। ঘুম ভাঙল দেরিতে। ছুটির দিন বলে কেউ ডাকেও নি। দ্রুত গোসল করে বের হয়ে দেখল, শুদ্ধ আর বাবা অলরেডি নামাজে চলে গেছে। অবশেষে সে একাই গেল।

ঘুম থেকে ওঠার পর নিকিতার সঙ্গে দেখা হয় নি। লাঞ্চের সময় দেখা হলো এবং প্রিয় খেয়াল করল, নিকিতা লজ্জা পাচ্ছে, ওর দিকে তাকাচ্ছে না। এত লজ্জার কী আছে? এত দিন যা চাইছিল, তা-ই তো সে পেয়েছে। এত দিন চাওয়ার সময় তো লজ্জা পায় নি।

চুপচাপ খেয়ে উঠে গেল প্রিয়। বারান্দায় গিয়ে একটা সিগারেট ধরাল। কিছুক্ষণ পর শুদ্ধ এসে দাঁড়াল। প্রিয় সিগারেটটা ফেলে দিয়ে শুদ্ধকে কাছে টেনে নিল। দুই বাপ-ছেলেতে কিছুক্ষণ ধরে গল্প হলো। শুদ্ধ বলল, ‘জানো বাবা, দাদাভাই বলেছে, পাশের রুমটা এখন থেকে আমার। আমি ওখানেই থাকব। কী সুন্দর করে সাজিয়ে দিয়েছে!

প্রিয় বেশ অবাক হলো। বলল, ‘কেন? তুই আমার সাথে ছিলি, আমার সাথেই থাকবি।’

‘না বাবা, আমি ওই রুমেই থাকব। আমি তো অনেক বড় হয়ে গেছি। আমার বয়স এখন নয় বছর। এখনো কেউ বাবার সাথে থাকে নাকি? এখন তো সবাই একাই থাকে, আমার বন্ধুরাও তো।’

প্রিয় আর ঘাটাল না। এভাবে আসল কথাটা বের করা যাবে না, অন্যভাবে চেষ্টা করতে হবে। শুদ্ধ খেলতে চলে গেল। শুদ্ধ চলে যাওয়ার পর প্রিয় ঘরে ঢুকল। ঠিক তখনই নিকিতাও ঘরে ঢুকল। প্রিয় পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা প্যাকেট বের করে নিকিতার হাতে দিল। নিকিতা বলল, ‘কী এটা?

‘প্যাকেটটা খোলো। এটা কন্ট্রাসেপটিভ পিল।

নিকিতা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। প্রিয় বলল, ‘এত অবাক হওয়ার কিছু নেই। আমি কোনো বাচ্চা চাই না, আমার একটা বাচ্চা আছে, তাতেই হবে। রিস্ক নিতে চাচ্ছি না।’

নিকিতা আমতা আমতা করে বলল, ‘একবারেই কিছু হয় নাকি?

‘ব্যাটে-বলে মিলে গেলে একবারই যথেষ্ট।

পানি এগিয়ে দিল প্রিয়, ‘নাও, এক্ষুনি খাও, আমার চোখের সামনে।

নিকিতা মন খারাপ করেই পিলটা খেয়ে নিল। প্রিয় বলল, ‘আচ্ছা নিকিতা, বাবা শুদ্ধর জন্য আলাদা রুম দিয়েছে?

‘ও হ্যাঁ, এটা কালই বলতে চেয়েছিলাম তোমাকে। কিন্তু…’

‘শুদ্ধ রাজি হলো কীভাবে? আর শুধু রাজি না, ওকে দেখে অনেক খুশি মনে হলো।’

‘আমিও তো তাই ভাবছি। কদিন আগেও তো বলত বাবাকে ছাড়া ঘুমাতে পারি না।’

‘তুমি সত্যি জানো না?

‘খোদার কসম। যদি এই ঘটনার সাথে কোনোভাবে জড়িত থাকি, তুমি আমাকে খুন করে ফেলল।

প্রিয় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, কী হলো ছেলেটার কে জানে! দিনদিন যত বড় হচ্ছে আমার দুশ্চিন্তা বাড়ছে। বাবার সাথে কথা বলতে হবে।’

এ কথা শুনে হঠাৎ মনে পড়ায় নিকিতা বলল, ‘শোনো, বাবা শুদ্ধকে একটা ট্যাব কিনে দিয়েছে কাল।’

‘হোয়াট?

‘নতুন ঘর, নতুন ফার্নিচার, নতুন স্কুলব্যাগ, নতুন জামাকাপড়, সাথে একটা ট্যাব।’

‘এই ব্যাপার তাহলে?

‘কী ব্যাপার?

‘আগে আমি নিশ্চিত হয়ে নিই।

প্রিয়র মনে হচ্ছে শুদ্ধ ট্যাব দিয়ে রাতে মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবে বলে আলাদা রুম পেয়ে খুশি।

প্রিয় বিছানায় শুয়ে পড়ল। এখনো ঘুম পাচ্ছে তার। নিকিতা তার পাশে গিয়ে বসল। প্রিয় চুপ। নিকিতা হঠাৎ প্রিয়র বুকের ওপর ঝুঁকে বলল, ‘কী হয়েছে তোমার?

প্রিয় মনে মনে ভাবল, কী সহজে সে নিকিতাকে কাছে আসার সুযোগ করে দিয়েছে। অবশ্য এটার দরকার ছিল। নিকিতা আরও কাছে আসুক। পেট্রা খালিঘর পূরণ করেছে, এবার তার পালা। প্রিয় নিকিতার কোমর জড়িয়ে ধরে বলল, ‘কী আবার হবে? কিছু হয় নি।

নিকিতা প্রিয়র চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘স্বপ্নপূরণ হলে অদ্ভুত লাগে। পাগল করে দিলে কাল রাতে তুমি আমাকে।’

প্রিয়ও নিকিতার চোখে চোখ রেখে বলল, আমি কিন্তু তোমাকে ভালোবাসি না নিকিতা। কখনো ভালোবাসতে পারবও না।’

নিকিতা আরও একটু কাছে এসে বলল, ‘আরে, রাখো তোমার ভালোবাসা। কে চাইছে? দুনিয়ার সব স্বামী কি স্ত্রীদের খুব ভালোবাসে?

প্রিয় হেসে বলল, ‘মতলব কী তোমার? নিকিতা প্রিয়র বুকে মুখ লুকাল। প্রিয় বলল, ‘দূরে থাকো নিকিতা।

নিকিতা বলল, ‘ইশ, বয়েই গেছে! আমার হাতে এখন সময় নেই। রেডি হতে হবে। কিছুক্ষণ পরই শুদ্ধ আর আমি বাইরে যাব।

‘কোথায় যাবে?

নিকি হেসে বলল, ‘পেট্রা আপু শুদ্ধর সাথে দেখা করতে চেয়েছে। আজ।

‘শুদ্ধর জন্মদিনেই না দেখা হলো? আবার আজ কেন?

‘তা তো জানি না।’

‘আচ্ছা।

‘এই, তুমি যাবে?

নিকিতাকে উৎসাহী দেখাল। প্রিয় বলল, ‘না, তোমরা যাও।

.

প্রিয়র সঙ্গে নিকিতার এখন স্বাভাবিক স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক। কিন্তু নিকিতা বোঝে, এর মধ্যে প্রিয়র কোনো ভালোবাসা নেই, প্রিয় অবশ্য নিজ মুখে বলেছেও। ইদানীং প্রিয় সারাক্ষণ খুব বিষণ্ণ হয়ে থাকে। নিকিতা আজও জানে না কেন প্রিয় হঠাৎ করেই ওর সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্কে এল। কিন্তু এর চেয়ে আগে যখন বন্ধুর মতো ছিল, তখনই ভালো ছিল। অন্তত প্রিয়র মুখে হাসি ছিল।

প্রিয়র পানির পিপাসা লেগে হঠাৎই ঘুমটা ভেঙে গেল। উঠে দেখল নিকিতা বিছানায় নেই। পানি খেয়ে ঘড়ি দেখল। রাত ৩টা ৪৫ মিনিট বাজে। এত রাতে ও গেল কোথায়? রুম থেকে বের হয়ে আশপাশে কোথাও দেখতে পেল না। তারপর গেল শুদ্ধর রুমে। শুদ্ধ আলাদা রুমে ঘুমানো শুরু করার পর থেকে শান্তিতে ঘুমাতে পারে না প্রিয়। রাতে দু তিনবার এসে ছেলেটাকে দেখে যায়। শুদ্ধর ঘরে ঢুকে প্রিয়র মনটা কানায় কানায় ভরে গেল। নিকিতা শুদ্ধকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে। শুদ্ধ যত দিন ওদের কাছে ছিল, শেষের দিকে শুদ্ধ ওকে না, নিকিতাকেই জড়িয়ে ধরে ঘুমাত। বুকভরা ভালোলাগা নিয়ে ফিরে এসে ঘুমিয়ে পড়ল প্রিয়।

৩৫

কয়েক মাস পর।

ইদানীং অফিস থেকে প্রিয় সোজা বাসায় আসে। পেট্রা ও স্মরণকে একসঙ্গে দেখার পর থেকে সে আর জিমে যায় না। স্মরণের মুখ দেখতে চায় না সে। কাপড় বদলে ফ্রেশ হয়েই শুদ্ধর রুমে গিয়ে ঢুকল। শুদ্ধ কাঁদছে। ঘটনা কী? ছেলেটা কেন কাঁদছে!

‘কী হয়েছে, শুদ্ধ? তুই একা একা বসে কাঁদছিস কেন? নিকিতা কই?

‘নিকিমা ভার্সিটিতে। বাবা, আজ পর্যন্ত তুমি বা মা যে যা বলে সিক্রেট রাখতে বলেছ, আমি রেখেছি।’

প্রিয় হেসে বলল, ‘হ্যাঁ, সেটা তো জানি। কিন্তু আজ কী হয়েছে?

একটা কথা আমি আর সিক্রেট রাখতে পারছি না। আমার খুব কান্না। পাচ্ছে মায়ের জন্য।

প্রিয়র বুক কেঁপে উঠল। বলল, কী হয়েছে মায়ের?

‘মা মালয়েশিয়া চলে গেছে, বাবা।

‘কী বলছিস? কেন?

‘ওখানে চাকরি নিয়েছে।

‘কবে গেছে?

‘কয়েকমাস আগে।’

‘এত দিন বলিস নি কেন আমাকে?

‘মা বলতে না করেছিল তো।’

প্রিয় শুদ্ধর শেষ কথাটা আর শুনতে পেল না। পাগল হয়ে গেল। একটার পর একটা ফোন করতে লাগল প্রিয়াঙ্কা ও রায়ানকে। কিন্তু ওরা কেউই ফোন ধরল না। প্রিয় শুদ্ধকেই জিজ্ঞেস করল, ‘জানি, তোর মায়ের সাথে যোগাযোগ আছে। প্লিজ বল কীভাবে যোগাযোগ করিস?’

‘আমার ট্যাবে হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবার, স্কাইপে–এসব দিয়ে।

ফোন নম্বর আছে?

‘আছে।’

‘এক্ষুনি দে।’

শুদ্ধ নম্বর দিল। প্রিয় টাইপ করতে করতে জিজ্ঞেস করল, তোদের প্রতিদিন কথা হয়?

‘না, বাবা। মা খুব বিজি থাকে। কয়েক দিন ধরে কথা হয় না।’

প্রিয় নম্বরটাতে ডায়াল করল। কিছুক্ষণের মধ্যেই শুনতে পেল সেই চেনা কণ্ঠ…

‘Hello, this is Cleopatra Zenny Rozario. I’m busy now. Please leave a message.’

পেট্রার ভয়েস মেইল শুনে ফোন রেখে বসে পড়ল প্রিয়। পেট্রা তাকে বলে পার্মানেন্টলি দেশ ছাড়ল! একবার বলে গেলে কী হতো? বলবেই বা কেন, পেট্রা তো এখন তাকে হিসাবেই ধরে না। এসব ভাবনার মাঝে প্রিয়াঙ্কা ফোন করল।

‘সরি প্রিয়দা। ফোনের কাছে ছিলাম না, তাই ধরতে পারি নি।

‘প্রিয়াঙ্কা, তুই আমাকে বল পেট্রা মালয়েশিয়া কেন গেল?

‘চাকরি নিয়ে গেছে। অনেক ভালো একটা চাকরি পেয়েছে।

‘পার্মানেন্টলি গেছে?

‘আপাতত। পরে ওখান থেকে সব গুছিয়ে অন্য কোথাও গিয়ে সেটেল হওয়ার ইচ্ছা।’

‘বাংলাদেশে আর ফিরবে না?

‘না, তবে বেড়াতে আসবে।

প্রিয়র বুকটা ছিঁড়ে যাচ্ছিল। দেশে থাকলেও সেভাবে দেখা হতো না। তবু দূর থেকে দেখতে তো পারত। বলল, ও আমাকে না জানিয়ে চলে গেল। চলে যাওয়ার আগে তোরাও একবার জানালিও না আমাকে? তোদের তো নিজের আপন ভাইবোনের মতো দেখে এসেছি। তোরাও সব খবরাখবর দিতি। আর আজ এত বড় একটা কথা জানালি না?

‘মাফ করো, দাদা। জানাতে চেয়েছিলাম, কিন্তু পেট্রা কঠিনভাবে নিষেধ করেছিল তোমাকে জানাতে। আমরা জানালে আমাদের ওপর রাগ

করত। হয়তো আমাদেরও না বলে চলে যেত। ওকে তো চেনো।

‘ও কি একা গেছে?

‘হ্যাঁ।’

‘ও বিয়ে করবে কবে?

‘ও বিয়ে করবে না বলে দিয়েছে। এত বোঝালাম, কোনো লাভ হলো না। বলে, ওর জীবনে নাকি কোনো পুরুষমানুষের দরকার নাই।

বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠল প্রিয়র। প্রিয়াঙ্কা বলল, ‘পেট্রার অফিসের এক কলিগ ওর জন্য পাগল। ওর পেছনে লেগেই থাকত। বিয়ে করতে চেয়েছিল, এমনকি মা বেঁচে থাকতে ভাইয়াটা তার মাকে নিয়ে এসে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল। মা অবশ্য রাজি হয় নি–ছেলে মুসলিম, তাই। এদিকে পেট্রা তো আগাগোড়া কখনো তাকে পাত্তাই দিল না। এই বিয়েটা পেট্রার করা উচিত ছিল। ভাইয়াটা ওকে অনেক ভালোবাসত।

‘স্মরণের কথা বলছিস?

‘হ্যাঁ। তুমি জানো তার কথা?

প্রিয়র এবার নিজেকে খুন করতে ইচ্ছা হলো। সে পেট্রাকে এভাবে ভুল বুঝেছিল!

প্রিয়াঙ্কার সঙ্গে কথা শেষ করে সে স্মরণকে ফোন করল। কেন মিথ্যা বলেছিল জিজ্ঞেস করতেই স্মরণ বলল, ‘দেখেন ভাই, আমি কী বলেছি, তার জন্য আপনার কাছে জবাবদিহি করতে আমি বাধ্য নই। আপনার ভাগ্য ভালো পেট্রা আমাকে বিয়ে করে নি। করলে আপনাকে আমি ভালোভাবে বুঝিয়ে দিতাম কত ধানে কত চাল।

এ কথা বলে প্রিয় কিছু বলার আগেই স্মরণ ফোন রেখে দিল। প্রিয় স্মরণকে নিয়ে আর মাথা ঘামানোর প্রয়োজন মনে করল না। ঘরের মধ্যে অস্থিরভাবে পায়চারি করতে লাগল। শুদ্ধ এখনো চুপচাপ বসে কাঁদছে। প্রিয়র মাথায় ঢুকছে না এত বাজেভাবে কী করে বুঝল সে পেট্রাকে! পেট্রা স্মরণকে পাত্তা দেয় না তো বাসায় নিয়ে যাওয়ার কী দরকার ছিল? ওই ঝড়বৃষ্টির রাতে স্মরণকে নিয়ে বাসায় যেতে দেখেই তার মাথাটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। পেট্রাও তো ভুল বোঝার সব রাস্তা খুলে দিয়েছিল। যোগাযোগ একেবারেই বন্ধ করে দিয়েছিল, যা সে আগে কখনো করে নি। ভুল না ঠিক, তা জানার জন্যই ফোন করেছিল, ফোনটাও বন্ধ ছিল। পরেরবার ধরে নি। তবু, তবু সে কী করে পারল পেট্রাকে ভুল বুঝতে? রাগে মাথার রগ ছিঁড়ে যাচ্ছিল। তৎক্ষণাৎ সে আলমারির আয়নায় প্রচণ্ড একটা ঘুষি দিল। সঙ্গে সঙ্গে আয়নাটা চুরচুর করে ভেঙে পড়ল। শুদ্ধ একটা চিৎকার দিল। প্রিয় আবার সেই ভাঙা আয়নায় এলোপাতাড়ি ঘুষি দিতে দিতে নিজের হাতকে রক্তাক্ত করল। কত কাঁচের টুকরো যে প্রিয়র হাতে ঢুকে গেল, তার হিসাব নেই। হাত থেকে টপটপ করে রক্ত পড়তে লাগল। তবু প্রিয়র রাগ, অস্থিরতা কমছে না। অবশেষে সব রাগ, কষ্ট ও অসহায়তা চোখের জল হয়ে ঝরে পড়তে লাগল।

.

প্রিয় হাতে ব্যান্ডেজ নিয়ে বিছানায় বসে আছে। ডাক্তার চলে যেতেই বাবর খান বললেন, ‘তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে, প্রিয়? এসব কেন করেছ?

প্রিয় আক্রোশে ফেটে পড়ে বলল, ‘বাবর খান, এই কাঁচের টুকরোগুলো যদি আমি তোমার বুকে ঢোকাতে পারতাম, তাহলে আমার শান্তি হতো।

‘ঠিকাছে, সব হবে। আগে নিজে সুস্থ হও।

প্রিয় বিস্ফারিত চোখে তাকাল, বাবর খান ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। নিকিতা অনেক্ষণ ধরে কেঁদেছে। চোখমুখ লাল হয়ে গেছে। শ্বশুর বেরিয়ে যেতেই সে প্রিয়র কাছে এসে বসল। বলল, তুমি কেন এভাবে নিজেকে কষ্ট দিলে?

প্রিয় স্বাভাবিকভাবে বলল, ‘শুধু কষ্ট দিয়েছি। আমার তো নিজেকে খুন করা উচিত এখন।

‘কী এমন হয়েছে, আমাকে বলে? অনেক দিন ধরেই দেখছি তুমি খুব আনমনা, বিষণ্ণ। আর আজ তো…’

‘তুমি বুঝবে না, নিকিতা। শুদ্ধ কোথায়?

‘ওর টিচার এসেছে। পড়তে বসেছে।

‘আচ্ছা

নিকিতা কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই প্রিয়র ফোনটা বেজে উঠল। নম্বর কোড +৬০ দেখেই বুকের ভেতরটায় কেমন করে উঠল। প্রিয় বলল, ‘নিকিতা, তুমি একটু বাইরে যাবে?

নিকিতা বাইরে চলে গেল। প্রিয় শুদ্ধকে দিয়ে মেসেজ পাঠিয়েছিল এই নম্বর থেকে। এটা প্রিয়র নতুন অফিসের নম্বর। পেট্রা জানে না। শুদ্ধ লিখেছিল ফ্রি হয়ে কল করতে, মেসেজ পেয়েই বোধ হয় কল করেছে। ফোন ধরতেই পেট্রা বলল, ‘হ্যালো, শুদ্ধ?

প্রিয় বলল, ‘শুদ্ধর বাবা।

পেট্রা কয়েক সেকেন্ড কোনো কথা বলতে পারল না। প্রিয়ও চুপ। হঠাই লাইনটা কেটে গেল। তারপর থেকে ফোনটা বন্ধ পাওয়া গেল।

পেট্রা লাইন কেটে ফোন বন্ধ করে দিল। কত দিন পর প্রিয়র গলা শুনল। চোখে জল এসে গেল তার। চোখ মুছে বড় একটা নিঃশ্বাস নিল। তাকে শক্ত হতে হবে। অনেক শক্ত। শুদ্ধর সঙ্গে অন্য কোনোভাবে যোগাযোগ করতে হবে। ল্যাপটপ নিয়ে বসল। তারপর শুদ্ধকে একটা মেসেজ দিল যে বাবাকে ফোন নম্বর দেওয়াটা ঠিক হয় নি, রাতে ঘুমানোর সময় যাতে একা নক করে।

.

আগামীকাল থাইল্যান্ড যাচ্ছে প্রিয়। সেখান থেকে মালয়েশিয়া। মূলত থাইল্যান্ডে তার কোনো কাজ নেই। কিন্তু বাবর খান যাতে বাধা না দিতে পারে, তাই অফিস থেকে থাইল্যান্ডে কাজে পাঠাচ্ছে বলেই যাচ্ছে। ভাগ্যিস, মালয়েশিয়ান ভিসা ছিল তার। নতুন করে করাটা সম্ভব হতো না মন্ত্রী সাহেবের জন্য। যদিও এখনো সে নিশ্চিত না সে সত্যিই যেতে পারবে কি না। সত্যিটা টের পেলে কখনোই যেতে দেবে না। সব সময় স্পাই তো লাগিয়েই রাখে। কিন্তু স্পাইটা যে কে, আজও বের করতে পারল না। হয়তো চোখের সামনেই আছে, সে ধরতে পারছে না। রাত্রিবেলা শুয়ে শুয়ে এসবই ভাবছিল প্রিয়। নিকিতা হঠাৎ কপালে হাত রাখল। বলল, ‘ঘুম আসছে না?

‘না।

‘বিশ্বাস করো, পেট্রা আপু যখন শুদ্ধর সাথে দেখা করল, আমাকে বলে নি যে সে চলে যাবে। এমনকি শুদ্ধকে কখন বলেছে আমি জানি না। আমি জানলে তোমাকে বলতাম।’

‘জানি।’

নিকিতা প্রিয়র চুলে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। প্রিয় নিকিতার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘নিকিতা, তুমি কি জানো প্রথম দিন আমি তোমার সাথে রাগের মাথায় ওসব করেছিলাম।’

‘সেদিন বুঝি নি। পরে বুঝেছি।’

‘তুমি তো জানো আমি তোমাকে ভালোবাসি না। তারপরও তোমার খারাপ লাগে নি?

‘খারাপ লাগবে কেন? ভালো বাসো বা না বাসো, তুমি আমার স্বামী, আমি তোমার স্ত্রী। পবিত্র কালেমা পড়ে কবুল করেছ। আমাদের দুজনেরই অধিকার আছে।’

‘কিন্তু আমি তো তোমাকে স্ত্রী বলেও মানি না, তুমি জানো। তারপরও ইন্টিমেট হচ্ছি। তোমার কি মনে হয় না আমি তোমাকে ইউজ করছি?

‘মানো আর না মানো, আমরা তো স্বামী-স্ত্রী হয়েই গেছি। আমি যখন অসুস্থ হয়েছিলাম, তুমি আমাকে কোলে করে তোমার বিছানায় এনেছিলে, সেবা করেছিলে। রিদিমার বউভাতের দিন যখন মামির সাথে ঝগড়া করছিলাম, তুমি আমাকে ওখান থেকে সরিয়ে এনেছিলে। তোমার ছেলে আমাকে মা বলে ডাকে। যে-কোনো বিপদে তুমিই আমার কাছে এগিয়ে আসো, আগলে রাখো। তুমি নিজের অজান্তেই এসব করেছ, যা স্বামীরা স্ত্রীদের জন্য করে। শুধু মুখে বলেছ আমাকে স্ত্রী বলে মানো না। তোমার অমন মৌখিক স্ত্রী আমার না হলেও চলবে। আমি তোমার সাথে থাকতে পারছি, নিজেকে তোমার স্ত্রী বলে গর্ব করে পরিচয় দিতে পারছি, তোমার বুকে ঠাই পেয়েছি। আমি আর কিছু চাই না।’

প্রিয় অবাক হয়ে গেল নিকিতার কথা শুনে। এবার নিকিতা প্রিয়র আরও একটু কাছে এসে বলল, ‘আমি তোমার স্ত্রী বলেই রাগের মাথায় হোক আর যে কারণেই হোক, আমার সাথেই করেছ। কারণ, তুমি জানো এটা তোমার অধিকার, এ জন্য তোমার কোনো পাপবোধও হয় নি। তা ্না হলে দুনিয়াতে তো আর মেয়ের অভাব ছিল না। আমার সাথেই করতে গেলে কেন? স্ত্রী বলেই তো। আর স্বামী এসব করতে এলে স্ত্রী কখনো সেটাকে ইউজ করা ভাবতে পারে না।’

প্রিয় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ দুটো বন্ধ করল। সম্পর্ক ও অদৃষ্টের খেলা এত জটিল কেন?

৩৬

অফিস থেকে ফিরে পেট্রার এত ক্লান্ত লাগছিল যে সে রান্নাবান্নার ধারেও গেল না। কিছু ফাস্টফুড কিনে এনেছিল, গোসল করে তা-ই খেয়ে নিল। গোসল করে খুব ফ্রেশ লাগছিল। চুল মুছে তোয়ালে মেলে দিচ্ছিল। তখনই ফোনটা বেজে উঠল। ফোন ধরতেই প্রিয়র গলা ওকে অবাক করে দিল, ‘পেট্রা, ফোন রাখবি না, শুদ্ধর কসম।

পেট্রা নম্বরটা ভালো করে দেখল, মালয়েশিয়ান নম্বর। বলল, ‘তুই মালয়েশিয়াতে কীভাবে? কবে এসেছিস?’

‘অনেক কাহিনি করে এসেছি শুধু তোর সাথে দেখা করার জন্য। মাত্র ল্যান্ড করলাম। বাসার অ্যাড্রেস দে।’

‘বাসার অ্যাড্রেস!’

‘ও! সমস্যা আছে? ঠিকাছে, বাইরেই দেখা করি। কখন কোথায় আসতে পারবি, বল।

‘বাসার অ্যাড্রেস মেসেজ করে দিচ্ছি। ট্যাক্সি নিয়ে চলে আয়।

‘আচ্ছা।’

পেট্রার হাত-পা সব কাঁপছে। প্রিয় এল কেন? প্রিয়র কাছ থেকে দূরে থাকার জন্য দেশ ছেড়েছে। অথচ সেই প্রিয় এখানে এসে হাজির। প্রিয় সামনে এলে কী করবে সে? ঠিক থাকতে পারবে তো? এখন দেখা না করেই-বা কী উপায়? এত দূর এসেছে! জেনেও দেখা না করে থাকবে কী করে সে? দ্রুত পায়ে রান্নাঘরে ঢুকল। বাসায় যা ছিল, তা দিয়েই ঝটপট রান্নাটা সেরে ফেলল।

দরজা খুলতেই প্রিয় হড়হড় করে ভেতরে ঢুকে এল। কোনো কুশল বিনিময় না, কোনো ফর্মালিটি না। প্রিয়কে দেখে পেট্রার হার্টবিট বেড়ে গেল। পেট্রা কিছু বলার আগেই প্রিয় ধমকে উঠল, ‘তুই আমাকে না বলে এলি কী করে, পেট্রা? এত দূর আসার আগে একবার আমাকে বলে আসার প্রয়োজন মনে করলি না? এতটাই ফেলনা আমি তোর কাছে?

পেট্রা কাছে এগিয়ে এল। হাত ধরে বলল, ‘মাথা ঠান্ডা কর, বলছি। সব।

‘ফাক ইওর ঠান্ডা মাথা।

‘মুখ খারাপ করবি না প্রিয়।’

‘এক শ বার করব।’

পেট্রা হেসে বলল, ‘বলে এলে তুই দেখা করতে চাইতি, শুধু চাইতিই না, দেখা করেই ছাড়তি। আমাকে ফেরাতে চাইতি। কে জানে কখন পটে যেতাম, সেই ভয়ে বলি নি। সেজন্য সরি।

‘এভাবে আমার কলিজাটা ছিঁড়ে নিলি, পেট্রা। দেখা না হলেও, যোগাযোগ না থাকলেও, কাছেই ছিলি। কিছু একটা হলে আমি দৌড়ে যেতে পারতাম। আমাকে পুরোপুরি মুছে ফেলতে চাস তোর জীবন থেকে?

পেট্রা প্রিয়র পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, ‘সরি দোস্ত, মাথাটা একটু ঠান্ডা কর। এত দূর থেকে আমার কাছে এসেছিস কি ঝগড়া করতে?

প্রিয় পেট্রাকে ধাক্কা দিয়ে বলল, ‘খুন করতে এসেছি তোকে।

পেট্রা আবারও হেসে ফেলল। প্রিয় বলল, হাসবি না, দাঁত ভেঙে দেব।’

পেট্রা মুচকি হেসে বলল, ‘আচ্ছা সরি। আগে ফ্রেশ হয়ে কিছু খেয়ে নে।

প্রিয়র রাগ মিটছিল না। এবার হুট করেই বলল, তুই আমাদের অ্যানিভার্সারির দিন স্মরণকে বাসায় নিয়ে গিয়েছিলি কেন?

‘স্মরণকে তুই কীভাবে চিনিস?

‘একই জিমে জিম করতাম।

‘ও। স্মরণ আমার কলিগ। চলে আসব বলে আমার হাতে চা খেতে চেয়েছিল, সে জন্যই বাসায় নিয়ে যাওয়া।

‘কেন, বাপের বয়সে চা খায় নি? চা খেতে চাইলেই ঝড়বৃষ্টির রাতে তুই একটা ছেলেকে খালি বাসায় নিয়ে যাবি?

‘খালি বাসা কই? রায়ান ছিল তো বাসায়।

প্রিয় চুপ। পেট্রা বলল, ‘বাব্বা, এত জেলাস! তুই কীভাবে জানলি আমি ওকে বাসায় নিয়ে গিয়েছিলাম?

‘আমি দেখেছি।’

‘ফলো করছিলি আমাকে?

‘করছিলাম। সেদিন আমাদের ম্যারেজ অ্যানিভার্সারি ছিল।

পেট্রা চুপ। প্রিয় চুপ। কিছুক্ষণ পর পেট্রা উঠে গিয়ে প্রিয়র জন্য বানিয়ে রাখা অরেঞ্জ জুস নিয়ে এল। গ্লাসটা প্রিয়র হাতে দিয়ে বলল, ‘তুই কয় দিনের জন্য এসেছিস?

প্রিয় একটানে জুসটা শেষ করল। তারপর বলল, ‘ভিসার মেয়াদ শেষ প্রায়। দুদিন পর চলে যেতে হবে।’

‘আচ্ছা, তুই ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নে। তারপর কথা বলছি। তোয়ালে দিচ্ছি দাঁড়া।’

পেট্রা ভোয়ালে দেওয়ার জন্য উঠে দাঁড়াতেই প্রিয় পেছন থেকে তাকে জড়িয়ে ধরল। পেট্রা সর্বাঙ্গে কেঁপে উঠল। যেন প্রথম প্রেমের প্রথম স্পর্শ! ওদিকে পেট্রাকে অবাক করে দিয়ে প্রিয় বলল, আমাকে মাফ করে দে পেট্রা। আমি তোক ভুল বুঝেছিলাম।’

পেট্রা ঘুরে দাঁড়াল। কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ‘কী ভুল বুঝেছিলি?

‘আমি ভেবেছিলাম স্মরণের সাথে তোর অ্যাফেয়ার চলছে। তোরা বিয়ে করবি!’

পেট্রা হেসে বলল, ‘কী দেখে এমন মনে হলো?

প্রিয় বিছানায় বসল। পেট্রা তার সামনেই একটা চেয়ারে বসল। তারপর প্রিয় পুরো ঘটনাটা খুলে বলল। স্মরণের সঙ্গে ফোনের কনভারসেশনগুলো রেকর্ড করা ছিল, সেগুলো শোনাল। পেট্রা অবাক হলো এবং রেগে গেল স্মরণের ওই কথাটা শুনে, আপনার ভাগ্য ভালো পেট্রা আমাকে বিয়ে করে নি, করলে আপনাকে ভালোভাবে বুঝিয়ে দিতাম কত ধানে কত চাল।’

প্রিয় আবার মাফ চাইল, ‘তুই আমাকে মাফ করেছিস তো?

পেট্রা বলল, ‘মাফ চাওয়ার কী আছে? সন্দেহ হওয়ার মতো যথেষ্ট কারণ ছিল।’

‘তবু আমার তোর ওপর বিশ্বাস রাখা উচিত ছিল।’

‘দূরত্ব বাড়লে বিশ্বাসটা আস্তে আস্তে কমে যায়। কারণ, মানুষ প্রতিনিয়ত বদলায়। মানুষকে দিয়ে সব সম্ভব।’

এ কথা বলে পেট্রা প্রিয়র দিকে তাকাতেই দেখল প্রিয়র চোখে পানি। পেট্রা দেখে ফেলার আগেই মুছে নিতে চাইল। কিন্তু পেট্রা দেখেই ফেলল। পেট্রা উঠে প্রিয়র সামনে দাঁড়াল। প্রিয়র মুখটা ধরে বলল, কী হয়েছে? চোখে পানি কেন?

প্রিয় এবার কেঁদে ফেলল। সে নিজেকে সামলাতে চাচ্ছে কিন্তু পারছে না। কারও সামনে কাঁদতে পারে না, একমাত্র পেট্রার কাছে এসে সে সব পারে। তার কাছে কোনো লজ্জা নেই। প্রিয়কে এমন অবস্থায় দেখে পেট্রার বুকের ভেতরটায় একটা চাপা কষ্ট অনুভূত হচ্ছিল। সিরিয়াস কিছু কি হয়েছে? না হলে সে এভাবে কেন কাঁদছে? পেট্রা প্রিয়র মাথাটা তার বুকে জড়িয়ে ধরল। প্রিয়ও কোমর জড়িয়ে ধরল। পেট্রা প্রিয়র মাথায় চুমু খেয়ে বলল, ‘ইশ প্রিয়, তুই কি কখনো বড় হবি না রে?

এ কথা শুনে প্রিয় হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। পেট্রা কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই প্রিয় বলল, ‘আমি আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটা করে ফেলেছি পেট্রা। তাও নিরপরাধ তোর ওপর রাগ করে, তোকে ভুল বুঝে।

‘কী করেছিস?

‘নিকিতার সাথে ইন্টিমেট হয়েছি আমি।’

‘এত দিনে!’

পেট্রার এমন প্রতিক্রিয়া আশা করে নি প্রিয়। সে পেট্রাকে ছেড়ে দিয়ে চোখে চোখ রেখে বলল, ‘মানে কী বলতে চাস তুই?

পেট্রা প্রিয়র চোখ মুছে দিয়ে বলল, ‘আমি ভেবেছিলাম আরও আগে সেসব হয়েছে। নিকিতা পুরোপুরি বদলে গেছে, ওর আচরণ অনেক ভালো হয়ে গেছে। এ জন্যই আমি এমনটা ভেবেছিলাম। তোর বিয়ে করা বউ, তুই ইন্টিমেট হবি না কেন? এ জন্য আমাকে কেন সরি বলছিস? পাগল নাকি তুই?

রাগে, দুঃখে, অভিমানে প্রিয়র মনে চাইছিল নিজের চুল ছিঁড়তে। পেট্রা আচমকা প্রিয়র কোলে বসে ঠোঁটে চুমু খাওয়া শুরু করল। পেট্রা জানে পাগল কীভাবে থামাতে হয়।

৩৭

পেট্রার ঠোঁটের স্পর্শ পেয়ে প্রিয়র প্রতিটা ইন্দ্রিয় জেগে উঠল। কান্না থেমে গেল, অভিমানও উবে গেল। শরীরের প্রতিটা লোমকূপ অন্য কোনো অনুভুতির জানান দিল। প্রিয়র হাত দুটো পেট্রার কোমরে ছিল। টপসের ভেতর ধীরে ধীরে সেই হাতদুটো আরেকটু উপরে গিয়েই আবার থেমে গেল। মনে হলো কী করতে যাচ্ছে সে? পেট্রা যদি ভুল বুঝে? গত ছয় বছর তারা বাইরে বাইরেই দেখা করেছে। গাড়ির ভেতর পেট্রার নিষেধকে পাত্তা না দিয়ে একরকম জোর করেই চুমু খেয়েছে কয়েকবার। কিন্তু এরকম পরিবেশ-পরিস্থিতি কখনো তৈরি হয় নি। সে বুঝতে পারছে না আরও এগুবে, নাকি থেমে যাবে। পেট্রা যদি তাকে চরিত্রহীন ভাবে, বউয়ের সঙ্গে করে এখন আবার তার সঙ্গে করতে যাচ্ছে! ভাবলে ভাবুক। সে ভালোবাসে পেট্রাকে। কিন্তু তবু সাহস হচ্ছিল না। পেট্রা যদি ভাবে সে শুধু এ কাজ করতেই বাসায় এসেছে, তাহলে? প্রিয় এসব ভাবছিল এবং অবাক হচ্ছিল, যার শরীরের প্রতিটি বাঁক তার মুখস্থ, আজ তারই শরীরে হাত দিতে এত ভয় পাচ্ছে! খুব কাছে দুজনে। একজনের নিঃশ্বাস আরেকজনের নিঃশ্বাসের সাথে মিশে গেছে। প্রিয় খুব দ্রুত টোক গিলছিল, গলা শুকিয়ে গেছে উত্তেজনা ও দুশ্চিন্তায়! পেট্রা আবার প্রিয়র ঠোঁটে ঠোঁট রাখল। এত দিন পর প্রিয়কে এভাবে পেয়ে পাগল হয়ে গেছে সে। দুজনেরই উত্তেজনা চক্রবৃদ্ধিহারে বাড়ছে। মনেপ্রাণে চাইছে দুজন দুজনকে কিন্তু প্রিয় এখনো দ্বিধাগ্রস্ত।

প্রিয়র দ্বিধা পেট্রা নিজ হাতেই কাটিয়ে দিল নিজের পরনের টপসটা খুলে ফেলে। প্রিয় এবার সাহস পেল, পেট্রার চুলটাও খুলে দিল। পেট্রা তাকে ধাক্কা দিয়ে বিছানার ওপর ফেলে দিল। প্রিয় পেট্রাকে কাছে টেনে তার কপালের ওপর পড়ে থাকা চুলগুলো সরিয়ে কপালে একটা চুমু দিয়ে বলল, ‘আমি তোকে আজও ঠিক আগের মতোই ভালোবাসি পেট্রা।

পেট্রা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, আমিও তোকে ভালোবাসি প্রিয়। কিন্তু এটাকে ইস্যু বানাবি না।’

প্রিয় বিরক্ত হয়ে বলল, ‘এখন তোর এসব কথা না বললে হচ্ছে না?

পেট্রা হেসে বলল, ‘সরি।’

প্রিয় পেট্রাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে নিজের শার্টটা খুলে ফেলল। শার্ট খুলতেই তার বুকের পার্মানেন্ট ট্যাটুটার দিকে চোখ চলে গেল পেট্রার। তার নাম, বহু বছর আগে এটা করিয়েছিল প্রিয়। সে প্রিয়র বুকে হাত রেখে হেসে বলল, ‘কী বডি বানিয়েছিস!”

প্রিয় হেসে বলল, ‘খেয়ে ফেল।

পেট্রা ঝাঁপিয়ে পড়ল প্রিয়র বুকে। প্রিয়র সারা দেহে বিদ্যুৎ বয়ে যেতে লাগল। পেট্রা চোখের পলকে ছয় বছর আগের সেই ছেলেমানুষ পেট্রা হয়ে গেল। কোনো হুঁশ নেই।

প্রিয় বেশিক্ষণ নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। জোর করে পেট্রার হাত দুটো আটকে তাকে নিজের দখলে নিল। তার গলায় চুমু দিতে দিতে বুকে নামল। আলতো কামড়ে কামড়ে পাগল করে ফেলল। পেট্রা বলল, ‘আমাকে ক্ষতবিক্ষত করে ফেল প্রিয়, যাতে তোর স্পর্শের চিহ্ন সারা জীবন এই শরীরে থাকে।

প্রিয় বলল, ‘কী বলছিস! বিয়ে করবি না তুই?

‘করব। তোকে জেনে যে বিয়ে করবে, তাকেই করব।’

পেট্রা এ কথা বলল প্রিয়কে একটা বুঝ দেওয়ার জন্য। সে আসলে আর কখনোই বিয়ে করবে না। প্রিয় বলল, ‘তাহলে তুই আগে আমাকে ক্ষতবিক্ষত কর।’

‘না, নিকিতা দেখলে কষ্ট পাবে।

‘তোর তাতে কী?

‘অনেক কিছু। নিকিতা আমার বোনের মতো। এত দিনে মেয়েটার মাথা ঠান্ডা হয়েছে, সংসারে শান্তি এসেছে। আমার প্রিয়, আমার শুদ্ধ সবাই ভালো আছে। আমি তো এটুকুই চেয়েছিলাম।

প্রিয় উঠে গেল। বলল, ‘ঠিকাছে, তাহলে বাকিটা না হয় বাংলাদেশে গিয়ে ওর সাথেই করব।’

পেট্রা প্রিয়র সামনে দাঁড়িয়ে গলা জড়িয়ে হেসে বলল, ‘উঁহু, তা হবে না। নিকিতারটা নিকিতার সাথে করবি, আর আমারটা আমার সাথে।

‘পারব না।’ পেট্রা আবার হেসে দিল, ‘পারতে হবে, শুরু করেছিস কেন?

এ কথা বলে পেট্রা ধাক্কা দিয়ে প্রিয়কে বিছানার ওপর ফেলে দিল। প্রিয় হেসে ফেলল। বহুদিন! বহুদিন পর পেট্রা নিজেকে সমর্পণ করল তার ভালোবাসার মানুষের কাছে। যার একটু অধর ছোঁয়ার জন্য প্রতিদিন প্রতি অঙ্গ কাঁদে তার। ভেতরে একটা অদ্ভুত আনন্দ হচ্ছিল। পরিকল্পনা করে হয়তো কখনো হতো না। ভাগ্যিস, প্রিয় এভাবে এসেছিল। খুশিতে পেট্রার চোখের কোণ গড়িয়ে জল পড়তে লাগল। প্রিয় তখন এতই ব্যস্ত ও উত্তেজিত ছিল যে এই চোখের জল তার দেখা হলো না। সব চোখের জল দেখতে নেই। পৃথিবীটাকে এখানেই থামিয়ে দিতে ইচ্ছা করছিল পেট্রার। ওদিকে প্রিয়র ইচ্ছা করছিল এই মধুর সময়টা শেষ হওয়ার পর পেট্রাকে খুন করে নিজেও আত্মহত্যা করবে। কিন্তু এই ভালোবাসাটাকে খুন করা কীভাবে সম্ভব? সে পেট্রার কপালে চুমু দিল। পেট্রা বিড়ালছানার মতো চোখ বন্ধ করে উপভোগ করল। ছেলেরা কি জানে তারা যখন কপালে চুমু দেয়, তখন মেয়েদের কত গর্ব হয়? এই গর্ববোধ কিসের তা জানে না পেট্রা। তবে প্রতিবার এই চুমু পেয়ে মনে হয় এ যেন কোনো বড় একটা অর্জন।

প্রিয় গোসল করতে ঢুকলেই পেট্রা গিয়ে নক করল। প্রিয় দরজা খুলে বলল, কী?

‘আমি আসি? অনেক বছর দুজনে একসাথে গোসল করি না।’

প্রিয় হাত বাড়াল। পেট্রা এগিয়ে যেতেই প্রিয় তাকে জড়িয়ে ধরে শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে রইল। কিছুক্ষণ পর প্রিয় বলল, ‘পেট্রা, একটা কথা রাখবি?

‘বল।’

‘চল দুজন মিলে দূরে কোথাও চলে যাই। এমন কোথাও যেখানে বাবর খান আমাদের খুঁজে পাবে না।

‘এ কথা তো তুই আগেও বলেছিস।’

‘হ্যাঁ, তুই না করেছিলি। তবু আবার বলছি।

পেটা প্রিয়র বুকে মাথা রেখে বলল, ‘শুদ্ধর পাসপোর্ট, ভিসা তই কোনোভাবে ম্যানেজ করতে পারবি না। যে কয়বার চেষ্টা করেছিস, তোর বাবার জন্য পারিস নি। আর শুদ্ধকে ফেলে যাওয়া অসম্ভব। তা ছাড়া আমি নিজেই এটা করতে চাই না। তোকে আমি ভালোবাসি। আমি যদি অন্য কাউকে বিয়ে করি, হয়তো তখনো আমি তোকে ভালোবাসব। তুই আমার রক্ত, মাংস, হাড্ডিতে মিশে গেছিস। কিন্তু তোর সাথে আমি সারা জীবন থাকতে চাই না, প্রিয়। তাতে আমার বাবা অপমানিত হবে, কষ্টও পাবে।

‘কিন্তু পেট্রা, আঙ্কেলের মৃত্যুতে আমার কোনো হাত নেই, এটা তো তুই জানিস। বাবর খানের দোষে আমি কেন শাস্তি পাব? সে আমার জন্মদাতা বলে?

পেট্রা এবার প্রিয়র চোখে চোখ রেখে ব্যাকুল হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘আমার বাবা কেন শাস্তি পেয়েছে? কেন আমি আমার বাবাকে এভাবে হারালাম? সে আমার জন্মদাতা বলে?

প্রিয় চুপ করে রইল। পেট্রা ভোয়ালে পেঁচিয়ে বাথরুম থেকে বের হয়ে গেল। প্রিয় একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।

.

পেট্রা খুব ভালো রান্না করে, তা নয়। তবু এত দিন পর পেট্রার রান্না খেয়ে খুব ভালো লাগল প্রিয়র। খেয়েদেয়ে প্রিয় একটা সিগারেট ধরাতেই পেট্রা প্রিয়র কোলে গিয়ে বসল। প্রিয় পেট্রাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘সরি।

‘কেন?

‘বাবর খানের ছেলে হওয়ার জন্য।’

পেট্রা প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, ‘বাদ দে সেসব। আমি কিছু চাই তোর কাছে।

‘হুম, বল।

তোর ফ্লাইট কবে?

‘পরশুর পরের দিন।’

‘আমি কোনোভাবে এই দুদিনের ছুটি ম্যানেজ করে নেব।’

‘আমার তো রাতে ফ্লাইট।

পেট্রা উঠে প্রিয়র মুখোমুখি হয়ে বলল, ‘আচ্ছা যা, তিন দিনই ছুটি নেব। এই তিন দিন আমরা ইচ্ছেমতো কাটাব। যা ইচ্ছা হবে করব, যা ইচ্ছা হয় বলব। যেখানে ইচ্ছা ঘুরব। কিন্তু কখনো আমাদের পাস্ট অ্যান্ড ফিউচার নিয়ে কোনো কথা বলব না। এই তিন দিন আমাদের মধ্যে তোর বাবা থাকবে না, আমার মা-বাবা থাকবে না, নিকিতা থাকবে না, কোনো পরিণতির চিন্তাও থাকবে না। এই তিন দিন শুধু তুই আর আমি। শুধু শুদ্ধ থাকবে আমাদের মাঝে। এই তিন দিন কোনো আফসোস না, কোনো হাহুতাশ না, বুঝলি?

প্রিয় হেসে বলল, ‘বুঝলাম।

‘এই তিন দিন হবে আমাদের জীবনের সেরা তিন দিন। আর…’

‘আর?

‘আমি তোর কাছে একটা বাচ্চা চাই প্রিয়। জানি না এই তিন দিনেই ওপরওয়ালা মুখ তুলে তাকাবেন কি না। তবু চেষ্টা করতে তো দোষ নেই।

‘কী বলছিস!’

‘আমিই তোকে বলেছিলাম আমি কখনো বাচ্চা নেব না। কারণ, তখন শুদ্ধ আমার কাছে ছিল। আমি শুধু শুদ্ধর একার মা হয়ে থাকতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এখন তো আর আমার কাছে শুদ্ধ নেই। তাই আমি একটা বাচ্চা দত্তক নেওয়ার কথা ভাবছিলাম। কিন্তু এখন যখন সুযোগ এসেছে নিজের বাচ্চা হওয়ার, তখন চেষ্টা করতে চাচ্ছি।’

‘আমার সাথে থাকবি না বলছিস, আবার আমার বাচ্চার মা হতে চাচ্ছিস?

‘তাতে অসুবিধা কী? তোর সাথে থাকব না কেন, তা তুই জানিস। তোর বাচ্চা আমার কাছে থাকা মানে অনেক কিছু। তুই বুঝবি না।

‘পেট্রা, তার মানে বাচ্চা হলে তুই আর কখনো বিয়ে করবি না?

‘কেন করব না? বাচ্চাসহ ডিভভার্সি মেয়েদের বিয়ে কোনো বিষয় না। তা ছাড়া আমি বছরখানেক পর জার্মানিতে শিফট হয়ে যাব। ওখানে আরও সহজ হবে। কাউকে ভালো লাগলেই বিয়ে করে ফেলব।’

‘আমার কেন জানি মনে হচ্ছে বিয়ে করার কোনো পরিকল্পনা তোর নেই।’

পেট্রা হেসে বলল, ‘কেন বিয়ে করব না? সারা জীবন একা থাকব নাকি? আচ্ছা, তুই স্মরণকে আমার সাথে দেখে জ্বলেপুড়ে ছাই হয়ে গেলি। আর এখন আমার বিয়ের জন্য উঠে পড়ে লেগেছিস! সহ্য করতে পারবি?

‘তোর বোঝায় ভুল আছে। আমি যে-কোনো মানুষের সাথে তোকে সহ্য করতে পারব। এমনকি স্মরণের সাথেও, কিন্তু সেটা আমি অন্য কোনোভাবে জানতে চাই না। সরাসরি তোর কাছ থেকে জানতে চাই।’

‘বুঝেছি। আচ্ছা বাদ দে না এসব। বলেছি না এই তিন দিন এ ধরনের কোনো কথা হবে না? যে এ ধরনের কোনো কথা বলবে, সে অন্যজনের কাছে শাস্তি পাবে। এখন থেকেই শুরু।

‘আচ্ছা, বল কী শাস্তি দিবি?

‘এই কদিন সিগারেট খেতে পারবি না।’

‘কঠিন শাস্তি। তবে মধু থাকলে সিগারেট না হলেও চলবে।

এ কথা বলেই প্রিয় হাতের সিগারেটটা নিভিয়ে পেট্রার ঠোঁটে ঠোঁট বসাল। পেট্রা তার গলা জড়িয়ে ধরল। দীর্ঘ একটা চুমুর পর প্রিয় পেট্রাকে কোলে তুলে বিছানায় নিয়ে গেল। পেট্রা হেসে বলল, আজ রাতে ঘুমাব না, প্রিয়!

‘তোকে আজ ঘুমাতে দিলে তো ঘুমাবি!

৩৮

কীভাবে প্রিয় এতটা কাছে এল বা সে নিজেই প্রিয়র কাছে চলে গেল, এখনো ঠিক বুঝে উঠতে পারে না নিকিতা। মাত্র চার-পাঁচ দিনের অনুপস্থিতিও এখন সহ্য হয় না। অথচ কিছুদিন আগেও কত দূরের মানুষ ছিল প্রিয়। আগেও তো অফিসের কাজে এখানে-ওখানে চলে যেত। কই, তখন তো এমন লাগত না। কিন্তু ভালো লো নিকিতা তখনো বাসত। কিন্তু তখন প্রিয়র শরীরের ওপর কোনো অধিকার ছিল না। তাকে ছোঁয়াও নিষেধ ছিল। অথচ এখন পুরো অধিকার আছে তার শরীরের ওপর। যা ইচ্ছা তা-ই করতে পারে সে এখন, প্রিয় বাধা দেয় না। সারা রাত প্রিয়র বুকে মাথা রেখে ঘুমাতে পারে। এটাও তার জন্য অনেক বড় কিছু। কারণ, সে প্রিয়কে ভালোবাসে। প্রিয় নাই-বা বাসুক। গত কয়েক মাসের নিয়মিত শারীরিক মিলনের ফলে সে আরও বেশি ভালোবেসে ফেলেছে প্রিয়কে। চরমভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে। এটা কি এতটাই গুরুত্বপূর্ণ ভালোবাসা বাড়ানোর ক্ষেত্রে? তাহলে প্রিয়র কেন তার ওপর ভালোবাসা জন্মাচ্ছে না? সে যা করেছে, প্রিয়ও তো তা-ই করেছে। সে এত দুর্বল হয়ে গেলে প্রিয় কেন হচ্ছে না? নাকি প্রিয়ও দুর্বল হচ্ছে কিন্তু প্রকাশ করছে না নিজের বাবার কাছে হেরে যাওয়ার ভয়ে? সব মাথার ভেতর জটলা পাকিয়ে যাচ্ছে।

পরশু ফোন করেছিল প্রিয়। কাল করে নি, তাতেই নিকিতার মনে হচ্ছে। যে-কোনো মুহূর্তে তার নিঃশ্বাস আটকে যাবে। সে মেসেজ দিয়ে রেখেছে। চব্বিশ ঘণ্টা ওয়াইফাই চাল করে রাখছে। বাইরে গেলেও মোবাইল ডেটা অন করে রাখছে। প্রিয়র একটা কলও সে মিস করতে চায় না।

.

পেট্রা শুদ্ধর সঙ্গে তার সময়মতো কথা বলে। আবার প্রিয় বলে আলাদাভাবে। তারা শুদ্ধকেও জানাতে চায় না যে তারা এখন একসঙ্গে আছে। প্রিয় মালয়েশিয়ায় আসার পর থেকে ফোন ব্যবহার করছে না। সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে কথা বলছে শুদ্ধর সঙ্গে। কোনো রিস্ক সে নিতে চায় না।

সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই প্রিয় শুদ্ধকে ফোন করল। শুদ্ধর সঙ্গে কথা বলা শেষ করতেই পেট্রা বলল, তুই নিকিতার সাথে কথা বলছিস না কেন? সে তত দুশ্চিন্তা করবে। তার দুশ্চিন্তা দেখে তোর বাবা যদি কিছু গেস করে, তাহলে কিন্তু বিপদ হবে, প্রিয়।

‘আমি ওকে এত ফোন করি না। তা ছাড়া পরশু তো কথা বললাম। আবার কী?

‘আজকেও বলবি। উল্টাপাল্টা জেদ দেখাবি না! যা করলে সবার ভালো হবে, তা-ই করবি।’

প্রিয় অগত্যা ফোন করল নিকিতাকে। পেট্রা ল্যাপটপ নিয়ে চলে গেল শুদ্ধর সঙ্গে কথা বলতে, যাতে প্রিয় নিকিতার সঙ্গে নিঃসংকোচে কথা বলতে পারে। এদিকে নিকিতা ঘুমিয়ে ছিল। লাফিয়ে উঠে ফোন ধরতেই প্রিয় বলল, ‘বাপরে! ফোন হাতে নিয়ে বসে ছিলে নাকি? কল দেওয়ার

সাথে সাথে ধরলে!

নিকিতা অভিমানের সুরে বলল, এই তোমার সময় হলো আমাকে ফোন করার? এমন কেন তুমি? প্রতিদিন একবার ফোন দিলে কী হয়?

‘যত পাই তত চাই না? আগে যে মোটেও ফোন দিতাম না, তখন খুব ভালো লাগত? শোনো, একদম বউগিরি করবে না। আমি তোমাকে বউ বলে মানি না।’

‘বউ না। একসাথে থাকি, সেই হিসেবেও তো একটু খবরাখবর দেওয়া যায়।

‘না, যায় না। এত বাঁধাধরা নিয়মের মধ্যে আমি চলতে পারব না।

‘আচ্ছা বাবা, সরি। ভুল হয়েছে আমার। একটু ভিডিও কলে আসো না, প্লিজ।

প্রিয় ভিডিও কল করল। তারপর হেসে বলল, ‘আরে বাপরে বাপ, আমার দুঃখে কি তুমি দেবদাসী হয়ে গেলে নাকি? চেহারার এই অবস্থা কেন?

‘ঘুম হয় না আমার। প্রায় সারা রাত জেগে থাকি।’

‘আহা রে!’

‘মজা নিচ্ছ?

‘না। শোনো, তোমার ঘুমের ব্যবস্থা করছি।

‘কীভাবে?

‘কাল ঢাকা আসছি।’

নিকিতা খুশিতে লাফিয়ে উঠল, ‘সত্যি?

‘হ্যাঁ। রাতের ফ্লাইটে ফিরছি। একটা-দুটো নাগাদ বাসায় পৌঁছে যাব।’

.

পেট্রা প্রিয়র জুতার ফিতা বাঁধছিল। প্রিয় তাকিয়ে তাকিয়ে সেই দৃশ্য দেখছিল। কিছু মুহূর্ত এত মধুর কেন হয়? ফিতা বাঁধা শেষ করে পেট্রা উঠে দাঁড়াল। তারপর শার্টের কলার ঠিক করতে করতে বলল, ‘তোর জুতার ফিতা এখন কে বেঁধে দেয়?

‘আমি নিজেই বাঁধি।

‘বাব্বাহ! আর নখ কেটে দেয় কে?

‘আমি নিজেই। তোর অনুপস্থিতি আমাকে সব শিখিয়ে দিয়েছে।’

পেট্রা হাসল। তারপর প্রিয়কে জড়িয়ে ধরল। প্রিয়ও ধরল। পেট্রা প্রিয়র বুকে মাথা রেখে বলল, ‘থ্যাংক ইউ, প্রিয়।

‘কেন?’

‘এই ম্যাজিক্যাল তিনটি দিনের জন্য।

প্রিয় আরও ভালো করে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘থ্যাংক ইউ টু।’

এবার পেট্রা সরে গিয়ে মুখোমুখি দাঁড়াল। চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা প্রিয়, সত্যি করে বল তো, শুধু আমি তোকে না বলে চলে এসেছি বলে তুই এত রিস্ক নিয়ে এখানে এলি?

‘না। আসলে কনফেস করতে এসেছি।

‘কিসের জন্য?

‘তোকে ভুল বোঝার জন্য।’

পেট্রা হেসে আবার জড়িয়ে ধরল, ‘তুই এত ভালো কেন, প্রিয়? তুই না বললে আমি কখনো জানতে পারতাম না যে তুই আমাকে ভুল বুঝেছিলি। এ জন্যই তোকে এত ভালোবাসি, প্রিয়।

এয়ারপোর্টে বিদায় জানাতে এসেছে পেট্রা। যাওয়ার আগমুহূর্তে বলল, ‘বিদায় দিতে খারাপ লাগছে না। বরং একটা ভালোলাগা কাজ করছে।

‘আমারও খারাপ লাগছে না। আনএক্সপেকটেডলি যা পেয়েছি, তা স্বপ্নেও ভাবি নি। এটা আমার জন্য অনেক।

পেট্রা হেসে বলল, আমার জন্য দোয়া করিস প্রিয়, যাতে মা হতে পারি।’

প্রিয় পেট্রাকে কাছে টেনে কপালে একটা চুমু দিয়ে বলল, পারবি ইনশা আল্লাহ।’

পেট্রা হেসে বলল, ‘ফিঙ্গার ক্রসড।

পেট্রার চোখ পানিতে ছলছল করছে। এই দৃশ্য দেখে প্রিয়র চোখও ভিজে উঠল। একটা মানুষ চোখের সামনে দিয়ে কীভাবে দূরে চলে যায়, অথচ হাত বাড়িয়ে ধরে রাখারও কোনো উপায় নেই।

৩৯

এয়ারপোর্ট থেকে বাসায় পৌঁছতে রাত দুটো বেজে গেল। এত রাত হয়ে যাওয়ায় বেল বাজাল না প্রিয়। নিকিতাকে ফোন করল। নিকিতা জেগেই ছিল, প্রায় দৌড়ে এসে দরজা খুলল। প্রিয়কে দেখেই একটা হাসি দিল। প্রিয়ও হাসল। লাগেজটা নিকিতা নিতে চাইলে প্রিয় বলল, ‘পাগল নাকি? আমি নিচ্ছি, সরো তুমি।

প্রিয় ভেতরে ঢুকেই বলল, ‘শুদ্ধ কি ঘুমিয়ে?

নিকিতা বলল, ‘হ্যাঁ।’

লাগেজটা নিজের ঘরে রেখে প্রিয় শুদ্ধর ঘরে ঢুকল। পেছন পেছন নিকিতাও এল। প্রিয় শুদ্ধর বিছানায় বসে তাকে আদর করে নিকিতাকে জিজ্ঞেস করল, কেমন আছে ছেলেটা? সুস্থ আছে তো? মন ভালো তো?

‘সব ঠিক আছে। আমরা এই কদিন এত মজা করেছি যে ও তোমাকে মিস করার সুযোগই পায় নি।’

প্রিয় শুদ্ধর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, ‘তাই নাকি?

‘হ্যাঁ, আমাদের বাসায় ছিলাম দুই দিন। আনিসা-আনিকার সাথে ওর খুব খাতির।’

প্রিয় শুদ্ধর কপালে একটা চুমু দিয়ে উঠে নিজের ঘরে গেল। নিকিতাও গেল পেছন পেছন। গিয়েই প্রিয়কে জড়িয়ে ধরল। প্রিয় বলল, ‘নিকিতা, আমি খুব টায়ার্ড। ফ্রেশ হতে দাও।

নিকি হেসে বলল, ‘কলিজাটা একটু ঠান্ডা করে নিলাম। এখন যাও, ফ্রেশ হও।’

প্রিয় ফ্রেশ হয়ে আসতেই নিকিতা বলল, ‘খেতে দিয়েছি, আসো।’

‘আমি খেয়ে এসেছি। এখন আর খাব না, তুমি খেয়ে নাও।

নিকিতার একা খেতে ইচ্ছা করছিল না। কিন্তু খুব খিদে লাগায় দৌড়ের ওপর খেয়ে নিল একটু। তারপর যখন ঘরে এল, দেখল প্রিয় ঘুমে কাবু হয়ে আছে। নিকিতা কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল প্রিয়র মুখের দিকে। একদম বাচ্চাদের মতো লাগছে। এরপর প্রিয় পাশ ফিরতেই নিকিতা গিয়ে শুয়ে পড়ল। খুব লোভ হচ্ছে ওকে আবার জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু ও তো টায়ার্ড। যদি রাগ করে? ধুর, রাগ করলে করুক, বড়জোর একটা ধমকই তো খাবে। ওতে কিছু যায় আসে না। এসব ভেবেই যখন সে প্রিয়কে জড়িয়ে ধরল, প্রিয় তখন অবাক করে দিয়ে তাকে আরও ভালো করে জড়িয়ে ধরল। মুখটা গুঁজে দিল তার ঘাড়ের ভাঁজে। নিকিতা ভালো করে খেয়াল করল, প্রিয় গভীর ঘুমে মগ্ন। প্রিয়র প্রতিটা নিঃশ্বাস লাগছে। নিকিতার ঘাড়ে। ইশ, সজাগ প্রিয় এ রকমটা করলে কতই না ভালো হতো! পরক্ষণেই মনে হলো, ঘুমন্ত অবস্থায় অবশ্য অন্য রকম একটা অনুভূতি হচ্ছে। এটাও ভালো।

সকাল সকাল প্রিয় শুদ্ধকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। শুদ্ধকে স্কুলে দিয়ে সে অফিসে যাবে। যেহেতু রাতে ফিরে দেখা হয় নি, সকালবেলা কিছু সময় ছেলের সঙ্গে কাটানোর উদ্দেশ্যেই এই ব্যবস্থা। বেলা দশটার দিকে নিকিতা রেডি হচ্ছিল ক্যাম্পাসে যাওয়ার জন্য। ঠিক তখনই বাবর খান। ডেকে পাঠালেন। নিকিতা যেতেই বললেন, ‘নিকিতা, প্রিয় কাল রাতে কখন ফিরেছে?

‘বাবা, ও তো রাত দুটার দিকে ফিরেছে।

‘ওর লাগেজ, কাপড়চোপড়–সব খুঁজে দেখো টিকিট পাবে। আই মিন কাল ও যে ফ্লাইটে ফিরেছে, ওই টিকিটটা একটু লাগবে। খুঁজে নিয়ে এসো।’

‘ঠিকাছে, বাবা।

নিকিতা লাগেজের বাইরের পকেটেই টিকিটটা পেয়ে গেল। টিকিটটা হাতে নিয়ে থমকে গেল নিকিতা। প্রিয় মালয়েশিয়ায় গিয়েছিল! পেট্রা আপুর কাছে? একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে টিকিটটা নিজের হ্যান্ডব্যাগে চালান করে দিল। তারপর বাবর খানকে গিয়ে বলল, ‘বাবা, লাগেজে কোনো টিকিট পেলাম না। ও যে জামাকাপড়গুলো পরে ছিল, ওসবের মধ্যেও নেই। আলমারিতে কি খুঁজব? নাকি ওকে ফোন করে জিজ্ঞেস করব কোথায় রেখেছে?

বাবর খান বললেন, ‘না না, ঠিকাছে, লাগবে না। তুমি কি ভার্সিটিতে যাচ্ছ নাকি?

‘জি বাবা।’

‘ঠিকাছে, যাও তাহলে।

নিকিতা বেরিয়ে যেতে যেতে শ্বশুরের ঘরে একটা লোককে দেখতে পেল। লোকটা সামনের বাসায় থাকে। প্রায়ই দেখেছে নিকিতা। একদিন তো সরাসরি ওদের ঘরের দিকেই তাকিয়ে থাকতে দেখেছিল। তারপর থেকে নিকিতা ওদিকটার জানালায় পর্দা টেনে রাখত। যেহেতু শ্বশুরের কর্মচারী, তাই ভেবেছিল শ্বশুরকে ব্যাপারটা জানাবে কিন্তু পরে আর জানায়। নি। কারণ, তার আগেই খেয়াল হয়েছে, এই লোকটা যখনই বাসায় আসে, বাবা প্রিয়কে নিয়ে কথাবার্তা বলে। আর লোকটা তখনই আসে, যখন প্রিয় বাসায় থাকে না। তার কাছে প্রিয় সম্পর্কে এটা-ওটা জিজ্ঞেস করে। কিন্তু কেন? কে এই লোক?

সকালে-বিকেলে অনেকবার ফোন করল নিকিতা, কিন্তু প্রিয় ধরল না। সন্ধ্যাবেলা নিজেই ফোন করল, ‘হ্যালো নিকিতা, বলো কেন ফোন করেছিলে?

‘যখন ফোন করেছি, তখন ধরতে পারলে না? এখন তো আমি বাসায় চলে এসেছি।’

‘আরে ভাই, আমি ব্যস্ত ছিলাম। কয় দিন পর আজকে অফিসে ঢুকেছি? দুনিয়ার কাজ পড়ে রয়েছে। বলো কী বলবে?

‘এখন আর বলা যাবে না। বাসায় আসো, তারপর বলব।

‘কেন বলা যাবে না?

‘সেটাও বলা যাবে না।

‘উফ নিকিতা, তুমি দিন দিন বহুত ঢঙি হচ্ছ। রাখলাম আমি।

এ কথা বলে প্রিয় ফোন রেখে দিল। নিকিতা মনে মনে বলল, রাখো তুমি ফোন। এসব এখন বলে বিপদে পড়ি আর কী! অত গাধা-গরু না আমি।’

.

প্রিয় চলে গেছে কাল রাতে। অথচ এখনো ওর রেশ রয়ে গেছে পেট্রার ছোট্ট বাসাটাতে। তোয়ালে, বিছানা-বালিশ থেকে শুরু করে সবকিছুতেই ওর শরীরের ঘ্রাণ। তার জন্য থাইল্যান্ড থেকে আনা ব্যাগ, জুতা, ঘড়ি, কসমেটিকস এখনো খোলে নি। সবকিছুতে প্রিয়র স্পর্শ! সব জায়গায় যেন প্রিয় এখনো আছে। অফিস থেকে ফিরে এসবই আবিষ্কার করল সে। কাল এমন সময় সে প্রিয়র সঙ্গে কত পাগলামি করছিল! প্রিয় কেন তাকে এত ভালোবাসে? মাঝেমধ্যে গর্ব হয় প্রিয়কে নিয়ে। গত তিন দিনে প্রিয় তার সব কষ্ট, না-পাওয়া, গ্লানি নিমেষেই মুছে দিয়েছে। এই তিন দিনের স্মৃতিগুলো নিয়ে বাকিটা জীবন সে অনায়াসে পার করে দিতে পারবে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের পেটের দিকে তাকাল। পেটে হাত রেখে চোখ বন্ধ করে মনে মনে প্রার্থনা করল পেট্রা, ‘হে ঈশ্বর প্লিজ, একটা ছোট্ট প্রিয় আমাকে দাও। জীবনে আর কিছু চাইব না তোমার কাছে।

.

প্রিয় অফিস থেকে বাসায় ফিরতেই শুদ্ধ এল ঘরে। দুই বাপ-ছেলে অনেক গল্প করল, খেলল। প্রিয় শুদ্ধর জন্য যেসব গিফট এনেছিল, সেসব দিল। নিকিতা উশখুশ করতে লাগল কিন্তু কিছু বলার সাহস পেল না। শুদ্ধর সামনে তো আর এসব বলা যায় না। ডিনারের পর শুদ্ধ ঘুমাতে গেলে প্রিয় নিজের ঘরে এল। বারান্দার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরাতে ধরাতে নিকিতাকে বলল, তোমার জন্য থাইল্যান্ড থেকে কিছু ব্যাগ আর অর্নামেন্টস এনেছিলাম। লাগেজে আছে।

‘ওসব পরে দেখব। আগে আমার জরুরি কথা শোনো।’

‘কী জরুরি কথা?

‘যেজন্য ফোন করেছিলাম।

ও হ্যাঁ, বলো।’ নিকিতা প্রিয়র সামনে গিয়ে দাঁড়াল। বলল, এই যে আমি দক্ষিণের জানালাটা সব সময় বন্ধ করে পর্দা ফেলে রাখি, কখনো জিজ্ঞেস করলে না তো কেন রাখি?

‘বাসায় থাকিই তো রাতটুকু। কোন জানালা বন্ধ, কোনটা খোলা, এত সব দেখব কখন?

‘তোমার যে খানদানি বাপ, তোমার আরও সাবধান হওয়া উচিত ছিল।’

‘মানে? কী বলতে চাচ্ছ, সরাসরি বলো।’

‘ওই দিকের বিল্ডিংয়ে তোমার বাবার এক কর্মচারী থাকে। হাঁ করে তাকিয়ে থাকে এই দিকে।’

‘তোমাকে দেখে বোধ হয়। সুন্দরীদের এই এক বিপদ বুঝলে, সবাই হাঁ করে গিলে।’

এ কথা বলে প্রিয় হাসল। নিকিতা বলল, আমার মনে হয় ওই লোক তোমার বাবার স্পাই। সেই লোকই সব খবরাখবর তোমার বাবাকে দেয়।

চমকে গেল প্রিয়। বলল, ‘কী বলো? এ রকম মনে হওয়ার আর কোনো কারণ আছে?

‘আছে। লোকটা যখনই আসে, তখনই বাবা তার সাথে তোমাকে নিয়ে আলোচনা করে। তার সাথে কোনো কাজের আলাপ করতে দেখি নি। কখনো আর উনি এলে প্রায়ই আমাকে ডেকে তোমার ব্যাপারে এটা-ওটা জিজ্ঞেস করে।

‘আমাকে আগে বলে নি কেন?’

‘আগে ব্যাপারগুলো খেয়াল করি নি। আজই সব মিলিয়ে দেখলাম– দুয়ে-দুয়ে চার হয়ে গেল।

‘আজ কি বিশেষ কিছু ঘটেছে?

‘হ্যাঁ। আজ বাবা আমাকে তোমার লাগেজ আর কাপড়চোপড় ঘেঁটে ফ্লাইটের টিকিট খুঁজে দিতে বলেছিল। কী কারণে যেন লাগবে। ওই লোকটা তখন বাবার ঘরেই ছিল।

প্রিয়র চোখ কপালে উঠল, ‘সর্বনাশ! দিয়ে দিয়েছ?

‘না। প্রথমে ব্যাপারটা নিয়ে মাথা ঘামাই নি। বাবার কথামতো খুঁজে বের করেছি। কিন্তু যখন দেখলাম মালয়েশিয়ার টিকিট, তখন আর দিই নি। বলেছি কোনো টিকিট পাই নি।

প্রিয়র অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। নিকিতা চুপ করে মাথা নিচু করে রইল। প্রিয় কাছে এসে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিকিতার ঘাড়ে হাত রেখে বলল, ‘নিকিতা!

নিকিতা তাকাল। প্রিয় বলল, ‘তার মানে তুমি জেনে গেছ আমি পেট্রার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। তবু তুমি বাবাকে টিকিটটা দিলে না কেন?

‘হুম, বুঝেছি, পেট্রা আপুর সাথে দেখা করতে গিয়েছ। পেট্রা আপু হুট করে না বলে চলে যাওয়াতে তুমি খুব কষ্ট পেয়েছ, অস্থিরতার মধ্যে ছিলে। তাই হয়তো একটা বোঝাপড়া করতে গিয়েছ বা অন্য কিছুও হতে পারে। আমি ঠিক জানি না। কিন্তু বাবা এভাবে তোমার পেছনে লোক লাগিয়ে রাখে, ভাবতেই গা গুলিয়ে উঠছে আমার। আগেও বাবা অনেকবার বলেছে যে তোমাকে ফলো করার জন্য তার লোক আছে। তুমি যা-ই করবে, তার কানে চলে যাবে। কিন্তু ব্যাপারটা যে এ রকম বেডরুমে উঁকি দেওয়ার মতো বিশ্রী, তা ভাবতেই ঘৃণা লাগছে আমার। তোমার ফ্লাইটের টিকিট আমি কেন দেব ওদের? তুমি পেট্রা আপুর কাছে গিয়েছিলে এটা জানতে পারলে বাবা কী-না-কী করবে, তার নেই ঠিক। টিকিটটা আমি আমার ব্যাগে রেখে দিয়েছি। তুমি ওটা পুড়িয়ে দাও।

‘পেট্রার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম জেনেও এত স্বাভাবিক আছ। কী করে? আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে।’

‘আগে যা উল্টোপাল্টা করেছি, তা আমি না বুঝেই করেছি। তার জন্য আমি লজ্জিত। পেট্রা আপুকে তো আমি চিনতাম না, ভাবতাম সে আমার শত্রু। আমার ঘর ভাঙবে হয়তো। এখন জানি পেট্রা আপু কখনো আর তোমার জীবনে ফিরবে না। আমার জন্য তোমরা আলাদা হও নি, আমি না থাকলে তোমরা আবার এক হতে পারবে, এমনও না ব্যাপারটা। তাই তাকে শত্রু ভাবার কোনো মানে হয় না। আপুর জন্যই আমি শুদ্ধর মুখে মা ডাক শুনতে পাচ্ছি। বিয়ের আগে যখন শুনেছিলাম যে তোমার পাঁচ বছর বয়সী একটা ছেলেকে পালতে হবে, তখন কষ্ট পেয়েছিলাম কিন্তু আজ এই ছেলের মা হতে পেরেই আমি খুশি। এমন ছেলের মা হওয়া সৌভাগ্যের ব্যাপার। সব আপুর জন্যই হয়েছে। কারণ, আপুই ওকে শিখিয়েছে আমাকে মা ডাকতে। কত বড় মন হলে মানুষ এটা পারে! আমি হলে কখনো পারতাম না। উল্টো খারাপ ব্যবহার করতে শিখিয়ে দিতাম।

শেষ কথাটা শুনে প্রিয় হেসে ফেলল। তারপর বলল, ‘নিকিতা, এত বুঝতে শিখলে কবে তুমি?

‘তোমাকে হারিয়ে শিখেছি। তুমি যখন বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিলে, তখন পেট্রা আপু আমার সাথে দেখা করে আমার ভুল ভাঙিয়ে দিয়েছিল। তার ওপর তোমার বাবার হুমকি-ধমকি আর তোমার অনুপস্থিতি, এসবই আমাকে সবকিছু বুঝতে শিখিয়ে দিয়েছে। তুমি ফিরে এলে পেট্রা আপুর সব জিনিস ফিরিয়ে দিয়ে বলেছিলাম না একটা সুযোগ দাও, আর ভুল করব না?

অদ্ভুত একটা চিনচিনে ব্যথা হচ্ছে প্রিয়র বুকের মধ্যে। নিঃশ্বাস নেওয়াটাও এখন একটা যুদ্ধ বলে মনে হচ্ছে। প্রিয় দুহাতে নিকিতার মুখটা ধরল। নিকিতা চোখ নামিয়ে নিল। প্রিয় এবার বলল, ‘নিকিতা, সব বউই যেমন তাদের স্বামীদের ভালোবাসে, তুমি প্রথম প্রথম আমাকে তেমন ভালোবাসতে। কিন্তু তুমি বোধ হয় এখন আমাকে সত্যিকারভাবে ভালোবাসছ, যাকে বলে পৃথিবীর শুদ্ধতম ভালোবাসা। যখন অন্যায় কাজ করতে, চেঁচামেচি করতে, আমিও তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করতাম। আমার মধ্যে কোনো গ্লানি ছিল না। অপরাধবোধ ছিল না। কিন্তু আজ থেকে যে তুমি আমার বোঝা বাড়িয়ে দিলে! তোমার এই শুদ্ধতম ভালোবাসা শোধ করব কীভাবে আমি? আমি তো কখনো তোমাকে ভালোবাসতে পারব না!

নিকিতা চমকে তাকাল প্রিয়র দিকে। প্রিয়র শেষ কথাটা ওর বুকে বিধল। প্রিয়র মুখে সে বহুবার শুনেছে এ কথা। তবু বারবার কেন একই রকম কষ্ট হয়? সেকেন্ডের মধ্যেই কখন চোখ বেয়ে টপটপ করে পানি পড়তে লাগল, নিজেই টের পেল না। প্রিয় দুহাতে নিকিতার চোখের পানি মুছে দিয়ে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘সরি নিকিতা। সত্যিই আমি কখনো তোমাকে ভালোবাসতে পারব না।’

‘ভালোবাসতে হবে না তোমার। দোহাই লাগে, চুপ করো।’

নিকিতা এবার প্রিয়কে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *