০১. অ্যালার্ম বাজছে

ফানুস – মৌরি মরিয়ম

উৎসর্গ

একজন মানুষের সঙ্গে আমার অনেক কিছু মিলে যায়। পছন্দ, অপছন্দ, অভ্যাস, মানসিকতা, চিন্তাভাবনার ধরনসহ আরও অনেক কিছুই। আমার সব প্রয়োজন নিয়ে ভাবেন এই মানুষটি। সময়ের মধ্যে আমার কাজ শেষ হলো কি না সেই দুশ্চিন্তাও তিনি করেন। হঠাৎ হঠাৎ আমার মুখ দেখে বুঝে ফেলেন ভেতরে কী চলছে!

আরেকজন মানুষ আমাকে আমার বাবার মতো করেই ‘মা’ বলে ডাকেন। আমার জন্য অপরাজিতার চারা রাখেন, চারাটা চুরি হয়ে যাওয়ায় আফসোস করেন।

আল্লাহতায়ালা আমার জীবনে এই দুজন মানুষকে আশীর্বাদস্বরূপ পাঠিয়েছেন, যেমনটা পাঠিয়েছেন তাদের ছেলেকে। আমার শাশুড়ি-মা বিউটি সুলতানা এবং শ্বশুর-বাবা সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। প্রিয় বইটি উৎসর্গ করছি তাঁদের।

ভূমিকা

আমরা যারা হুমায়ূনভক্ত, অন্যপ্রকাশ তাদের কাছে অন্যরকম এক আবেগের নাম। অন্যপ্রকাশ’ থেকে বই বের করার সুযোগ তাই আমার মতো ক্ষুদ্র এক লেখকের কাছে বিস্ময়কর। কিন্তু এ সুযোগটা যখন এল ততদিনে ২০২১ সালে ‘মহাযাত্রা’ বইটি বের হচ্ছে এটা চূড়ান্ত হয়ে গেছে। আমি পড়লাম উভয় সংকটে। একান্ত ইচ্ছা ‘অন্যপ্রকাশ’ থেকে বই বের হোক, কিন্তু নতুন কোনো পাণ্ডুলিপিও এত অল্পসময়ে তৈরি করা সম্ভব নয়। সংকটের আরও একটি কারণ আছে–একই মেলায় দুটো বই বের করার সাহস আমার কোনোকালেই ছিল না। সত্যি বলতে কী, এখনো সে সাহস তৈরি হয় নি।

‘অন্যপ্রকাশ’ থেকে বই বের করার প্রবল ইচ্ছেটা সামলাতে পারলাম না। তাই পুরোনো লেখার পোঁটলার মধ্য থেকে খুঁজে বের করলাম ‘ফানুস’। এই লেখাটি আমি খুব যত্ন করে রেখেছিলাম। প্রিয় অনুভব আর ভালোবাসার জিনিস একান্তে আগলে রাখার মতো। ভেবেছিলাম বহু বছর পর ‘ফানুস’ প্রকাশের কথা ভাবব। কিন্তু তা আর হলো না। অন্যপ্রকাশের প্রধান নির্বাহী মাজহার ভাইকে বললাম, এটা আমার কাঁচা হাতের লেখা কিন্তু ভীষণ পছন্দের গল্প। এডিটের জন্য আমাকে অনেক সময় দিতে হবে। তিনি সময় দিলেন। সময় নিয়ে আমি পুফের কাগজগুলো লাল কালিতে ভরিয়ে দিলাম।

পাঁচ বছর আগে, ২০১৬ সালের শেষের দিকে, আমি এই উপন্যাসটি লেখা শুরু করি। তার কয়েকবছর আগে থেকেই গল্পটি আমাকে ভীষণভাবে বিরক্ত করত। যেটাই লিখতে যেতাম এর চরিত্রগুলো মাঝখানে এসে মাথার ভেতর ঘুরঘুর করত। একরকম অতিষ্ঠ হয়েই লেখা শুরু করলাম। কিন্তু কিছু পর্ব লেখার পরে নিজের ওপর নিজে বিরক্ত হচ্ছিলাম। কারণ যা লিখছিলাম তা আমার নিজেরই পছন্দ হচ্ছিল না। তাই তখনকার মতো লেখা বন্ধ করে দিলাম। আরও দুটো উপন্যাস লিখতে গিয়ে অর্ধেক অর্ধেক লিখে রেখে দিলাম।

কয়েক মাসের রাইটার্স ব্লকের পর ২০১৭ সালের জুন মাসে উপন্যাসটি লেখার জন্য ভীষণ তৃষ্ণা অনুভব করলাম। লিখতে গিয়ে দেখলাম এবার আমি লিখতে পারছি। তখনই একটানা লিখে শেষ করে ফেলি। তারপর রেখে দেই পুরোনো লেখার সঙ্গে। চার বছর পরে আবার এডিট করলাম। আশা করছি, পাঠকেরা ফানুস পছন্দ করবেন।

মৌরি মরিয়ম
খিলগাঁও, ঢাকা।

অ্যালার্ম বাজছে। লেপের ভেতর থেকে হাত বের করে অ্যালার্ম বন্ধ করেই যত দ্রুত সম্ভব হাতটা আবার ভেতরে ঢুকিয়ে নিল প্রিয়। যদিও অ্যালার্মের ক্যারক্যারে শব্দে ঘুম ভেঙে গেছে, তবু এমন শীতের সকালে আয়েশি বিছানা রেখে উঠতে ইচ্ছা করে না। কিন্তু অফিস নামক বিভীষিকার জন্য উঠতেই হয়।

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে টাই বাঁধছিল প্রিয়। শুদ্ধ পাশে দাঁড়িয়ে বলল, ‘বাবা, আই নিড সাম প্যাস্টেল কালার।’

প্রিয় বলল, ‘সেদিন না নিকিতাকে বলেছিলাম কিনে দিতে? দেয় নি?

‘না। কাল আমার আর্ট এক্সাম। পুরো বক্সটাই তো হারিয়ে ফেলেছি আজ যদি না কেনা হয়, এক্সাম কীভাবে দেব?

‘ঠিক আছে, আজ আমি তোকে স্কুলে নিয়ে যাচ্ছি। যা যা লাগে, কিনে দিচ্ছি।

‘আর কিছু লাগবে না, বাবা। কিন্তু আমাকে স্কুলে দিতে গেলে তোমার অফিসে দেরি হয়ে যাবে তো!

‘একদিন দেরি হলে কিছু হবে না বাবু। ম্যানেজ করে নেব।’

‘ওকে বাবা।

এমন সময় নিকিতা ঘরে ঢুকে বলল, ‘এই, তোমরা খেতে এসো। ব্রেকফাস্ট রেডি।

প্রিয় বলল, ‘শুদ্ধ, তুই গিয়ে দাদার সাথে খেতে বস, আমরা আসছি।’

শুদ্ধ বেরিয়ে গেল। নিকিতা বলল, কিছু বলবে?

প্রিয় ঘড়ি পরতে পরতে বলল, তুমি শুদ্ধকে কালার কিনে দাও নি কেন? টাকাটা কি তোমার বাপের বাড়ি থেকে আসে? টাকাটা তো আসে আমার পকেট থেকে।

‘কেন দিই নি, সেটা আগে শুনে তারপর না হয় বাপের বাড়ির খোটাটা দিতে!

‘কেন, বাপের বাড়ির কথা বলায় গায়ে ফোঁসকা পড়ল?

‘আমি ভুলে গিয়েছিলাম।’

‘ভুলে গিয়েছিলাম মানে? ছেলের ব্যাপারে এত বেখেয়ালি কেন তুমি? যে কাজটা ঠিকভাবে করতে পারবে না, তার দায়িত্ব কেন নেবে? তোমার আর শুদ্ধকে স্কুলে দিতে যেতে হবে না। আমি অফিসে যাওয়ার সময় দিয়ে যাব। স্কুলবাসের জন্য কথা বলছি। ওরা বাসায় দিয়ে যাবে।

নিকিতা একটু ধমকের সুরেই বলল, এমন কথা কেন বলছ? একদিন একটা ভুল হয়েছে মানে যে প্রতিদিন হবে, তা তো না।’

‘একটা ভুল? একটা? ছেলের ব্যাপারে তোমার গাফিলতির শেষ নেই। ধমক তোমার বাপেরে গিয়ে দাও।’

এ কথা বলে প্রিয় ডাইনিংয়ে গিয়ে খেতে বসল। নিকিতার চোখে জল এসে গেল। কিন্তু সে কাঁদল না।

.

পেট্রা অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিল। শিখা তখন ঘরে ঢুকে বললেন, ‘পেট্রা, তোর কি আজ অফিসে না গেলে হয় না?

পেট্রা চোখে কাজল দিতে দিতে বলল, না মা। তুমি যদি আমাকে আগে বলে রাখতে, তাহলে আমি ছুটি নিয়ে রাখতাম।’

‘আগে কীভাবে বলব? ওরা তো গতকাল জানাল যে আজ আসবে।

‘ঠিকাছে, তুমি আটটায় আসতে বলে। আমি এর মধ্যে চলে আসব।’

‘সারা দিন খেটেখুটে আসবি, ফকিন্নির মতো লাগবে তখন।

‘লাগলে লাগবে, কিছু করার নেই আমার।

এ কথা বলতে বলতে পেট্রা কুর্তির ওপর জ্যাকেটটা গায়ে দিয়ে ব্যাগটা তুলে বেরিয়ে পড়ল। শিখা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, তার চেহারায় চিন্তার ছাপ।

.

বাবর খান এই নিয়ে পরপর দুবার মন্ত্রিত্ব পেলেন। দুই পুরুষ ধরে এ বাড়িতে বংশীয় রাজনীতি চলছে। বাবর খানের পিতাও প্রথমে এমপি ও পরবর্তী সময়ে মন্ত্রী হয়েছিলেন। বাবর খানের ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে। কিন্তু এই বংশীয় রাজনীতির সমাপ্তি এখানেই। তার বড় পুত্র সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে। একই দুর্ঘটনায় তিনি স্ত্রীকেও হারিয়েছেন। ছোটপুত্র প্রিয় হয়েছে ইঞ্জিনিয়ার। রাজনীতিতে কোনো আগ্রহ নেই। অল্প বয়স থেকে পড়াশোনার প্রতি ঝোঁক থাকায় তিনিও ছেলেকে রাজনীতিতে আসতে জোর করেন নি।

প্রিয়র জন্য নাশতার টেবিলে অপেক্ষা করছিলেন বাবর খান। কিন্তু প্রিয় এসে তার সঙ্গে কথা না বলেই নাশতা খাওয়া শুরু করে দিল। অবশ্য তিনি কথা না বললে প্রিয় কখনোই আগ বাড়িয়ে কথা বলে না। ব্যাপারটা সূক্ষ্ম একটা ব্যথা তোলে তার হৃদয়ে। তাই প্রিয়কে দেখামাত্র তিনি আগে কথা বলে নিজেকে এই ভেবে সান্তনা দেন যে, তিনি আগে কথা বলেন, তাই প্রিয় বলার সুযোগ পায় না।

বাবর খান বললেন, ‘গুড মর্নিং প্রিয়।

প্রিয় বাবার দিকে না তাকিয়ে বলল, গুড মর্নিং।

বাবর খান উৎসুক হয়ে বললেন, ‘আমাকে কংগ্রাচুলেট করবে না?

প্রিয় হেসে বলল, ওহ, তুমি তো আবার মন্ত্রী হয়েছে? কগ্রাচুলেশনস।

‘ধন্যবাদ প্রিয়। এবার আমার অনুরোধটা রাখো, এলজিইডির নিয়োগ পরীক্ষায় বসো শুধু। বাকি সব ব্যবস্থা আমি করে দেব।’

শুদ্ধর খাওয়া শেষ। সে বাবার জন্য বসে রয়েছে। কিন্তু শুদ্ধকে আর এখানে থাকতে দেওয়া যাবে না। প্রিয় বলল, ‘শুদ্ধ, ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসো। আমি আসছি। শুদ্ধ চলে গেলে বাবর খান বললেন, ‘আমি কিছু বলছি প্রিয়।

প্রিয় না তাকিয়ে বলল, ‘তোমার সাহায্যের আমার কোনো দরকার নেই। বেসরকারি হলেও আমি নিজের যোগ্যতায় অনেক ভালো চাকরি করি।’

‘তা করো, কিন্তু সরকারিতে যে সুবিধা পাবে তা বেসরকারিতে পাবে না। নিজের কথা না ভাবলেও এখন স্ত্রী-সন্তান আছে, তাদের কথা ভাবো। তাদের একটা ভবিষ্যৎ আছে না?

‘আমি আমার স্ত্রী-সন্তানের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে যথেষ্ট সক্ষম, এটা তুমি নিজেও জানো।

প্রিয়র নাশতা পুরোপুরি শেষ হয় নি। কিন্তু সে বাবর খানকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বেরিয়ে পড়ল।

পেট্রা অফিসের ক্যানটিনে বসে লাঞ্চ করছিল। স্মরণ পাশে দাঁড়িয়ে বলল, ‘বসতে পারি?

.

পেট্রা তাকাল। কালো রঙের স্যুট পরা সুদর্শন স্মরণ আহমেদ হাসি হাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। পেট্রা হেসে বলল, ‘শিওর স্যার।

স্মরণ বসতে বসতে বলল, আপনাকে অসংখ্যবার বলেছি আমাকে স্যার বলবেন না।

‘সিনিয়রদের তো স্যারই বলতে হয়। এটাই নিয়ম।

‘আমাকে বলবেন না। আমি তো আপনার ডিপার্টমেন্টের না।

পেট্রা হাসল। স্মরণ বসে বেয়ারাকে বলল খাবার দিতে। তারপর পেট্রাকে বলল, ‘একী! শুধু গাজর আর শসা? এ যুগের মেয়েদের ডায়েট নামক জিনিসটা একেবারে শেষ করে দিল।

পেট্রা হাসল। স্মরণ বলল, ‘হাসির কী বললাম?

‘এটা আমার প্রি-লাঞ্চ, এরপর ভাত খাব।

স্মরণ হেসে বলল, ‘ও আচ্ছা, তা-ই বলো।’

সঙ্গে সঙ্গেই আবার বলল, এই সরি সরি, তুমি করে বলে ফেললাম।

প্রতিবারই স্মরণ এমন বলে। পেট্রার ধারণা, স্মরণ এটা ইচ্ছা করেই বলে। যাতে সমস্যা নেই, আমাকে তুমি করে বলতে পারেন’—ধরনের কিছু পেট্রা বলে। কিন্তু সে ইচ্ছা করেই এ কথা বলে না। পেট্রা বলল, ‘আসলে ভাত আমার খুব প্রিয় একটা জিনিস। অনেক ভাত খাই আমি। কিন্তু এত ভাত খেলে তো মোটা হয়ে যাব। আবার ভাত না খেলেও দুর্বল হয়ে যাই। খাওয়ার আগে সালাদ খেলে স্টমাকে বেশি ভাত খাওয়ার মতো জায়গা থাকে না। তাই এই ব্যবস্থা।

‘তুমি মোটা! কোন হিসেবে?

‘না, আমি মোটা নই। তবে মোটা যাতে না হই, তাই এই ব্যবস্থা। মোটা হয়ে গেলে বেশি কাজ করতে পারি না।

‘ওহ!

খাবার চলে এল। স্মরণ খেতে খেতে বলল, ‘অফিসের খাবার এভাবে রেগুলার খেলে আমি মারা যাব সম্ভবত। এত ঝাল মসলা দেয়!

‘প্রবাসীদের এই একটা সমস্যা।

‘এই যে ম্যাম, আমি প্রবাসী ছিলাম, কিন্তু এখন আর নেই।

‘কয় বছর ছিলেন অস্ট্রেলিয়াতে?

‘সাত বছর।

‘চলে এলেন কেন? লোকজন তো একবার বিদেশি জীবনের স্বাদ পেলে আর দেশে ফেরার নাম নেয় না।

‘ধুর। বিদেশি জীবন ওরকমই। দূর থেকে খুব সুখের মনে হয়। আসলে খুবই কষ্টের। হ্যাঁ, বিলাসিতার অভাব নেই কিন্তু সুখের বড় অভাব। আমি তো হায়ার সেকেন্ডারির পরই চলে গিয়েছিলাম। স্টুডেন্ট লাইফ ভালোই কেটেছে। পড়াশোনার পাশাপাশি চাকরির সুবিধাটাই সবচেয়ে বড় সুবিধা। কিন্তু গত এক বছর প্রফেশনাল লাইফটা আমার ভালো লাগে নি। গাধার খাটুনি খেটে একটু সময়ের জন্য বাসায় ফেরা। আত্মীয়স্বজন নেই, আপনজন নেই, প্রাণ খুলে বাংলায় কথা বলার মতো মানুষ নেই। কিছু নেই আসলে!

পেট্রা চুপচাপ খাচ্ছে। স্মরণ বলল, আপনি কত দিন আছেন এখানে?

‘দুই বছর।

‘আমার তো দুই মাস প্রায়। এই অফিসের পরিবেশ ভালো, কাজ করে শান্তি পাচ্ছি।’

পেট্রা হাসল। স্মরণ তাকিয়ে রইল। মেয়েটাকে আহামরি সুন্দরী বলা যায় না। আবার অসুন্দরীও নয়। গায়ের রং স্বাভাবিক ফর্সা, গড়পড়তা মেয়েদের তুলনায় বেশ লম্বা, শরীরের গড়ন শক্তপোক্ত আকর্ষণীয়, চেহারা মোটামুটি। সাজগোজ তেমন নেই। চোখের নিচে ডার্ক সার্কেল। কিন্তু তার ভেতর কোথায় যেন একটা আভিজাত্য আছে, একটা ভিন্নতা, একটা আকর্ষণ! কিন্তু কোথায়? ধরতে পারছে না কেন স্মরণ?

লাঞ্চ শেষে যার যার ডেস্কে যেতে যেতে স্মরণ বলল, ‘অফিস শেষে সময় হবে? একটু কফি খেতে যেতাম।

পেট্রা বলল, ‘সরি, আজ তো হবে না। আজ আমাকে দেখতে আসবে, তাই তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে হবে।’

‘ও, ইটস ওকে।

পেট্রা চলে গেল। স্মরণের খারাপ লাগল। পেট্রাকে আজ দেখতে আসবে!

.

ছেলেপক্ষ চলে যাওয়ার পর পেট্রা শাড়ি পাল্টে চুলে তেল দিতে বসল। প্রিয়াঙ্কা বলল, ‘লোকটাকে তোর কেমন লাগল?

পেট্রা বলল, ‘কোন লোক?

‘তোর ক্যান্ডিডেট। ছেলেটাকে কেমন লাগল বলা উচিত ছিল। কিন্তু ছেলে তো নয়, লোকই তো।’

‘আমার ভালো লাগালাগির কিছু নেই। মা যাকে ঠিক করবে, তাকেই বিয়ে করব।

‘তাই বলে এই ভুঁড়িওয়ালা লোকটাকে? কোনো ম্যানার জানে না। গাবরের মতো শব্দ করে খাচ্ছিল। এমন একটা লোক হবে আমার বড় বোনের হাজব্যান্ড? তুই এত শিক্ষিত, স্মার্ট। তুই কেন ও রকম কাউকে বিয়ে করবি?

পেট্রা চুপচাপ চুলে তেল দিচ্ছে। কিছু যায়-আসে না তার। এখন বিয়ে হলেই সে বাঁচে। তা যার সঙ্গেই হোক। প্রিয়াঙ্কা বলল, কিছু বল?

‘মায়ের যখন এই ছেলেকে পছন্দ হয়েছে, আমার আর কিছু বলার নেই।

‘সে তো ছেলের অনেক টাকা আছে বলে। জানি মানুষের জীবনে টাকা অনেক জরুরি জিনিস, কিন্তু…’

প্রিয়াঙ্কা কথাটা শেষ করার আগেই শিখা দরজা ঠেলে ভেতরে ঢোকেন। হতাশ গলায় বললেন, ‘পেট্রা, ছেলের বাবা ফোন করেছিল।

প্রিয়াঙ্কা বা পেট্রা কেউ কিছু বলল না। শিখাই আবার বললেন, ‘তারা তোকে পছন্দ করে নি।

পেট্রা ভাবলেশহীন মুখে মনে মনে প্রস্তুত হচ্ছিল মায়ের পরের কথাগুলো শোনার জন্য। প্রিয়াঙ্কা বলল, ‘ভালো হয়েছে। ওই ভোেটকুকেও আমার পছন্দ হয় নি। কিন্তু ওরা আমার বোনকে পছন্দ করে নি কোন সাহসে? ওদের ছেলে কি আমার বোনের যোগ্য?

শিখা রেগেমেগে বললেন, তাহলে কোন রাজপুত্র আসবে তোমার বোনকে বিয়ে করতে, শুনি? ওরা তোমার বোনকে পছন্দ করে নি, কারণ তোমার বোনের বয়স বেশি। ত্রিশ বছর বয়সী কোন মেয়েকে কেউ ঘরের বউ করতে চায় না। তার ওপর চেহারার এই তো ছিরি। ইশ, কত ফুটফুটে ছিলি পেট্রা তুই, রাস্তা দিয়ে হাঁটলে ছেলেরা চেয়ে থাকত। সকাল-বিকাল প্রপোজাল আসত। কত ভালো ভালো প্রপোজাল! তুই রাজি হতি না। আর আজ! ঘটক লাগিয়েও ছেলে পাই না। যা-ও পাই, তা-ও তোকে পছন্দ করে না। সবকিছুরই একটা বয়স থাকে পেট্রা। চাহিদা থাকতে মেয়েদের বিয়ে দিতে হয়। ঘরে বসে বুড়ি হলে সেই মেয়ের আর বিয়ে হয় না।’

প্রিয়াঙ্কা চিৎকার করে উঠল, এহ্, ওদের ছেলে কী? বুড়ো ভুড়িওয়ালা আনস্মার্ট ব্যাটা একটা।

শিখা বললেন, ‘তুই চুপ থাক। ওই ছেলে ঠিকই একটা কচি মেয়ে পেয়ে যাবে।

হ্যাঁ, টাকা হলে বাঘের চোখও কিনতে পাওয়া যায়। সেখানে কচি মেয়ে তো খুবই সহজলভ্য।

‘এই, তুই এখানে কেন? তুই জামাইর সাথে চলে গেলি না কেন?

প্রিয়াঙ্কা বলল, ‘শোনো মা, আমি আমার বাপের বাড়িতে যত দিন ইচ্ছা থাকব। তুমি না চাইলেও থাকব।’

পেট্রা বলল, ‘প্রিয়াঙ্কা, তুই থামবি? মায়ের সাথে এভাবে কথা বলিস না। যত দিন ইচ্ছা থাক, কেউ তো না করে নি।

বোনের ধমক খেয়ে প্রিয়াঙ্কা চুপ হয়ে গেল। শিখা বিছানায় বসে পড়লেন। উসখুস করতে করতে বললেন, ‘সবারই এক প্রশ্ন। বড় বোনের আগে কেন ছোট বোনের বিয়ে হলো?

প্রিয়াঙ্কা কিছু বলতে যাচ্ছিল, পেট্রা চোখ বড় করে তাকাতেই থেমে গেল। শিখা বলে যেতে লাগলেন, চেহারাটা তো একদম নষ্ট করে ফেলেছিস। চোখের নিচে কালি পড়ে কী অবস্থা হয়েছে! সারা রাত ঘুমাস না নাকি?’

পেট্রা বলল, ‘ঘুমাই মা। কালি কেন পড়ে, আমি জানি না।’

‘আজকালকার মেয়েরা পারলারেই পড়ে থাকে। তুই তো ভুলেও যাস। স্কিনের কী অবস্থা?

‘পারলারের খরচটা কে দেবে, মা? আয় তো করি ওই কটা টাকা। তুমি তো জানো বাসাভাড়া, সংসার খরচ আর রায়ানের পড়াশোনাতেই সব শেষ হয়ে যায়। তারপর সামান্য কিছু হাতখরচ থাকে, সেটা আর পারলারে ঢালতে ইচ্ছা করে না।

‘ঠিকাছে, এই মাস থেকে দুধ-চা খাওয়া বন্ধ। এটা একটা ফালতু খরচ। দুধ-চায়ের জন্য মাসে চার প্যাকেট দুধ লাগে। মানে এক হাজার টাকা, এতে ফেশিয়াল হয়ে যাবে। আমিও কি নিজের ছেলের জন্য মেয়ে দেখতে গেলে এমন মেয়ে পছন্দ করতাম? কখনো না।’

পেট্রা চুলে বেণি করতে করতে বলল, ‘অসম্ভব, চা না খেলে বাঁচব না।’

‘রং-চা খাবি।

‘তুমি জানো আমি রং-চা খাই না।

প্রিয়াঙ্কা বলল, ‘আচ্ছা, তোমরা এভাবে এত কষ্ট করে থাকো, আমি কতবার টাকা দিতে চেয়েছি। নাও না কেন তোমরা?

শিখা বললেন, ‘জামাইয়ের টাকায় খাব নাকি? মরে গেলেও না।’

‘ও, তার মানে কি পেট্রার বিয়ে হয়ে গেলে ওর কাছ থেকেও টাকা নেবে না? তাহলে তোমার আর রায়ানের চলবে কীভাবে?

শিখা বললেন, ‘পেট্রা তো জামাইয়ের টাকা দেবে না। ও নিজে চাকরি করে আয় করা টাকা দেবে। তুই চাকরি করে টাকা দিলে তোর টাকাও নেব। তা তো পারবি না। সেরকম পড়াশোনা তো করিস নি। ফাঁকি কাকে দিয়েছিলি এখন বুঝতে পারছিস?

পেট্রা বলল, ‘আচ্ছা, ঠিকাছে ঠিকাছে, তোমরা থামো। মা, আমি এই মাস থেকেই প্রতি মাসে আমার হাতখরচের টাকা থেকে ফেশিয়াল করব।

প্রিয়াঙ্কা মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, এবার তোমার শান্তি হয়েছে?

‘আমার শান্তি সেদিন হবে, যেদিন পেট্রাকে বিয়ে দিতে পারব। কতবার বলেছি, পেট্রা, বাপ থাকতে বিয়েটা কর। বাপ মরা মেয়েদের বিয়ে দিতে কত কষ্ট, এবার বুঝতে পারছিস তো?’

কেউ আর কোনো কথা বলল না। শিখা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। মায়ের এতক্ষণ বলা কোনো কথাই গায়ে লাগে নি পেট্রার। সে জানে মা কতটা মানসিক চাপে থাকেন তাকে নিয়ে। কিন্তু বাপ মরা মেয়ে, এই কথাটা পেট্রা কখনোই সহ্য করতে পারে না। বাবার মুখটা মনে পড়ল পেট্রার। বুকটা চিরে যাচ্ছে। চোখে আগুন জ্বলছে। প্রিয়াঙ্কা পেছন থেকে পেট্রার গলা জড়িয়ে ধরে বলল, ‘সরি।

‘ফর হোয়াট?

‘আমি আগে বিয়ে করে ফেলেছি সেটা নিয়েও তোকে কথা শুনতে হচ্ছে।

প্রিয়াঙ্কা কান্না শুরু করে দিল। পেট্রা প্রিয়াঙ্কাকে ধরে সামনে এনে জড়িয়ে ধরল। মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ‘পাগলি, কাঁদে না। একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে, দেখিস।’

পেট্রা কাঁদতে পারল না। তার চোখের জল কবেই ফুরিয়ে গেছে!

.

শুদ্ধ ঘুমিয়ে পড়েছে। পাশে শুয়ে আছে নিকিতা। তাকিয়ে আছে প্রিয়র দিকে। প্রিয় সোফায় বসে ল্যাপটপে কিছু করছে। কী করছে, তা নিকিতা দেখতে পারছে না। কারণ, ল্যাপটপ প্রিয়র দিকে ফেরানো। প্রিয়র পরনে কালো রঙের ট্রাউজার আর কালো টি-শার্ট। চুলগুলো এলোমেলো, একটু পরপর দুহাতে চুলগুলো এলোমেলো করে দিতে দিতে কিছু ভাবছে। কী সুন্দরই না লাগছে প্রিয়কে! নিকিতার জীবনে দেখা সবচেয়ে সুদর্শন পুরুষ প্রিয়। প্রিয়র শ্যামবর্ণ শরীর, কাটা কাটা চেহারা, হাসি, হাঁটার স্টাইল সবকিছুই ক্ষণে ক্ষণে পাগল করে দেয় নিকিতাকে। তবে মানুষটার হাসি খুব কমই দেখা যায়। সে বোধ হয় দুনিয়ার সবচেয়ে রাগী মানুষ। এত সুদর্শন একজন পুরুষের কেন এত রাগ থাকতে হবে?

প্রিয়র কাজ শেষ হতেই আলো নিভিয়ে বিছানায় এসে শুয়ে পড়ল। দুজনের মাঝখানে শুদ্ধ। চাঁদের আলো এসে পড়েছে ঘরে। কম্বলের নিচে শীত করছে নিকিতার। শুদ্ধর জন্য আলাদা কম্বল। প্রিয়র কম্বল পছন্দ নয়, লেপ নিয়ে ঘুমায়। ঠিকাছে, নিকিতাও না হয় প্রিয়র লেপের মধ্যেই ঘুমাত। তা নয়, সব সময় ত্যাড়ামি। তোমার ত্যাড়ামি আমি একদিন তাড়াবই, মনে মনে এ কথা বলল নিকিতা।

বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেল। প্রিয় ঘুমিয়ে পড়েছে। নিকিতা শুদ্ধকে আলতো করে ধরে নিজের জায়গায় এনে নিজে গিয়ে মাঝখানে শুয়ে পড়ল। তারপর প্রিয়র লেপের নিচে ঢুকে প্রিয়কে জড়িয়ে ধরল। প্রিয়ও জড়িয়ে ধরল। ভীষণ ভালো লাগছিল। কিছুক্ষণ পর নিকিতা খুব সন্তর্পণে প্রিয়র ঠোঁটে চুমু খেল। প্রিয়র ঘুম ভেঙে গেল এবং নিকিতাকে সরিয়ে দিয়ে বিছানা থেকে উঠে গেল। আলো জ্বালিয়ে বলল, তোমার সমস্যা কী?

নিকিতা কিছু বলল না, অদ্ভুত নেশাতুর চোখে তাকিয়ে ছিল। যদি এতে কাবু করা যায়। খুব কম পুরুষমানুষই আছে, যারা এই দৃষ্টিকে উপেক্ষা করতে পারে। প্রিয় রেগে গিয়ে আঙুল উঁচিয়ে বলল, ‘লিসেন, বাবর খানের জন্য তুমি এই ঘরে এখনো থাকতে পারো। গট ইট?

এ কথা বলে প্রিয় লেপ-বালিশ নিয়ে সোফায় শুয়ে পড়ল। নিকিতা প্রিয়র কাছে গিয়ে বলল, ‘সরি প্রিয়, ভুল হয়েছে আমার। বিছানায় এসো, প্লিজ। এখানে ঘুমাতে তোমার কষ্ট হবে।

‘আস্তে কথা বলো, শুদ্ধ উঠে যাবে।

‘সরি, সরি। বিছানায় এসো।

‘আমি এখানেই ঠিক আছি। তুমি ঘুমাতে যাও।

‘না, তুমি এসো।

‘নিকিতা, আমার মেজাজ প্রচণ্ড খারাপ। তুমি ঘুমাতে যাও। আমাকে বিরক্ত কোরো না।

নিকিতা প্রিয়র পা ধরে বলল, পায়ে ধরি তোমার, প্রিয়, এসো না। আমি আর এমন করব না।’

প্রিয় উঠে বসে হাতজোড় করে বলল, আল্লাহর দোয়াই লাগে, এই পায়ে ধরার অভ্যাসটা তুমি ছাড়ো, আমি এটা খুব অপছন্দ করি।’

‘ক্লিওপেট্রা’–ফেসবুক প্রোফাইল নাম এটুকুই শুধু। আগে-পিছে কিছু নেই। স্মরণ বেশ কিছুদিন আগেই ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট দিয়েছিল, পেট্রা অ্যাকসেপ্টও করেছে। কিন্তু পেট্রার অ্যাবাউটে কিছুই লেখা নেই, কোন স্কুল, কোন কলেজ এবং অন্য কোনো তথ্য নেই। তবে ছবি আছে অনেক। ছবিগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল স্মরণ এবং ভারী অবাক হলো। কয়েক বছর আগে পেট্রা দেখতে হুরপরির মতো ছিল। গায়ের রঙটা সুন্দর! এখনকার মতো ম্যাটমেটে ফরসা নয়, ধবধবে ফরসা ছিল। পেট্রার চোখ, হাসি–সবকিছু যেন কথা বলত। এখনো পেট্রার চোখগুলো খুব গভীর, হাসিটাও আকর্ষণীয়; কিন্তু এই পুরোনো ছবির মেয়েটার কাছে সব ম্লান। ছবি বলে এমন লাগছে তা কিন্তু নয়, কারণ এখনকার ছবিগুলো আগে দেখেছে স্মরণ। আকাশপাতাল তফাত। দুই সময়ের পেট্রাকে দেখলে মনে হয় বর্তমান পেট্রা বহু অবহেলায় পড়ে আছে। মেয়েটা কি কোনো ব্যাপারে ফ্রাস্টেটেড?

দিন দিন পেট্রার ব্যাপারে আকর্ষণ বেড়েই চলেছে। তার মধ্যে কী আছে, যা এত টানছে স্মরণকে! প্রতিদিন অফিসে যেতে-আসতে দেখা হয়, লাঞ্চের সময়। তার নাম পেট্রা, সে একজন আর্কিটেক্ট, বুয়েট থেকে পাস করা। ব্যস, এটুকুই শুধু জানে। অফিসে স্মরণকে নিজের ভাবমূর্তি বজায় রেখে চলতে হয়। কেউ এখনো অতটা বিশ্বস্ত হয় নি, যার কাছ থেকে পেট্রার ব্যাপারে জানা যায়।

দরজায় টোকা দিয়ে স্মরণের মা বললেন, ‘আসব বাৰু?

স্মরণের মাকে দেখলে কেউ বলবে না উনি স্মরণের মা। স্মরণের বন্ধুরা তো তার বড় বোন বলে ভুল করত। বয়সও খুব বেশি নয়, তার ওপর খুব স্মার্ট মহিলা তিনি। খুব সুন্দরী হওয়ায় অল্পবয়সে বিয়ে হয়েছিল তাঁর। পরের বছরই স্মরণের জন্ম হয়। স্মরণ একটু বড় হলে উনি স্বামীর অনুপ্রেরণায় অনেক দূর পড়াশোনাও করেছেন। একমাত্র ছেলে স্মরণ তাঁর বন্ধুসম। স্মরণ বলল, ‘মাম্মা, এসো এসো।’

মা ঘরে ঢুকে একটা ছবি এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘দেখ তো মেয়েটা কেমন?

মা স্মরণের জন্য মেয়ে দেখছেন। দুদিন পরপরই একেকটা মেয়েকে দেখান। এবার স্মরণ মেয়েটাকে না দেখেই ল্যাপটপটা মায়ের দিকে ঘুরিয়ে বলল, ‘দেখো তো মাম্মা, এই মেয়েটা কেমন?

স্মরণ পেট্রার বর্তমান একটা ছবিই দেখাল। মা বললেন, ‘আমার ছেলের মনে ধরেছে নাকি? তাহলে তো অবশ্যই সে এক্সেপশনাল।

‘আহ্ মাম্মা, একটু ভালো করে দেখে বলল না?

মা দেখেশুনে বললেন, ‘ছবি দেখে কাউকে জাজ করাটা ঠিক না, বাবা। একদিন বাসায় নিয়ে আয় না, সামনাসামনি দেখেই না হয় বলব।’

‘মাম্মা, সে আমার গার্লফ্রেন্ড নয়।

মা চোখ কপালে তুলে বললেন, তাহলে? একতরফা?

‘না, মানে সে আমার কলিগ। দুমাস ধরে চিনি, খুব ভালো লাগে, মাম্মা! অদ্ভুতভাবে আকর্ষণ বোধ করি। তাকে কিছু বলি নি এখনো। বোঝাই তো, অফিসে তো অনেক বুঝেশুনে চলতে হয়। রেপুটেশনের ব্যাপার।’

মা মিষ্টি করে হেসে স্মরণের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘আচ্ছা, সময় নে। কিন্তু বাবু, বেশি সময় না, মাম্মার কিন্তু তাড়াতাড়ি বউ চাই।

স্মরণ বলল, ‘শিওর।’

‘নাম কী?

‘পেট্রা।

মা চোখ দুটো বড় বড় করে হেসে বলল, ক্লিওপেট্রা?

‘মে বি, মে বি নট।

‘ঠিকাছে, তাহলে এসব ছবি ফেরত দিয়ে দিই।

স্মরণ হেসে বলল, ‘দাও। এই প্রজেক্ট ক্যানসেল হলে না হয় আবার দুজন মিলে মেয়ে খুঁজব।

মা-ও হাসিতে হাসি মিলিয়ে চলে যাচ্ছিলেন। স্মরণ পেছন থেকে বলল, ‘কিন্তু মাম্মা, একটা প্রবলেম আছে।

মা ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, ‘কী প্রবলেম?

‘পেট্রা আমার চেয়ে বড়।

মা এবার অবাক হলেন, এটাও বড়! হা রে বাবু, বড় ছাড়া কি তোর কাউকে চোখে পড়ে না?

‘আমার কী দোষ? যদি বড়রা এত অ্যাট্রাকটিভ হয়? ছোট ছোট মেয়েগুলোকে আমার একটুও ভাল্লাগে না মাম্মা, সব ইমম্যাচিউর।’

মা মুচকি হাসছিলেন। স্মরণ বলল, ‘তবে পেট্রা বেশি বড় না, মাত্র এক বছর। তাও পড়াশোনার হিসেবে। বয়সে ছোটও হতে পারে। আমি ঠিক জানি না। অত কথা বলার সুযোগ হয় নি। তবে অফিসে আমি ওর সিনিয়র।

‘তুই তো ধরা খেয়ে গেছিস বাবু।

এ কথা বলেই খিলখিলিয়ে হেসে উঠলেন মা। স্মরণও হেসে ফেলল। স্মরণ জানে ওর মা আজও ইমম্যাচিউর। তার ধারণা, ইমম্যাচিওরিটি শুধু তার মাকেই মানায়।

.

প্রিয় প্রতিদিন রাত আটটায় অফিস থেকে ফিরে নয়টায় জিমে যায়। জিম থেকে ফেরে রাত এগারোটায়। ততক্ষণে মা-বাবা, শুদ্ধ–সবাই ঘুমিয়ে পড়ে। নিকিতা বহু কষ্টে জেগে থাকে। মাঝেমধ্যে অবশ্য যেখানে-সেখানে ঘুমিয়ে পড়ে। কিন্তু কাজের মেয়েকে শেখানো আছে প্রিয় এলে তাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে পরে দরজা খুলতে। সে চায় না প্রিয় এসে দেখুক সে অপেক্ষা না করে ঘুমিয়ে পড়েছে। শুধু এই কাজের জন্য গোপনে সে মেয়েটাকে আলাদা করে বেতন দেয়। আজও প্রিয় বেল বাজাতেই মেয়েটা নিকিতাকে উঠিয়ে দিল। নিকিতা দরজা খুলে দিল। প্রিয় ভেতরে ঢুকে জুতা খুলতে খুলতে বলল, ‘কেন জেগে থাকো, নিকিতা? শুদ্ধর সাথে শুয়ে পড়লেই তো পারো, কতবার বলেছি।’

‘তোমার গরম পানি লাগবে? গিজারে কী যেন সমস্যা হয়েছে। চুলায় পানি গরম করে দেই?

প্রিয় হেসে নিজের ভেজা চুলগুলোকে ইশারায় দেখিয়ে হাসল। তারপর বলল, ‘জিম থেকে শাওয়ার নিয়ে এসেছি। কিন্তু গিজার নষ্ট তো লোক ডাকো নি কেন ঠিক করতে?

‘আমি সন্ধ্যার পর টের পেয়েছি।’

‘ঠিক আছে, সকালে চুলায় পানি গরম করে দিয়ো তাহলে। এখন ভাত দাও।’

এ কথা বলে প্রিয় নিজের ঘরে গেল।

নিকিতা খুব অবাক হলো। প্রিয় অকারণেই হেসে কথা বলল। গিজারের লোক ডাকা হয় নি বলে বকা দেওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল। এটাই প্রিয় করে, কিন্তু আজ হাসিমুখে মেনে নিল কেন? প্রিয়র কি আজ মুড ভালো? খেতে বসে ব্যাপারটা দেখতে হবে।

খেতে খেতে প্রিয় বলল, পাবদা মাছটা কে বেঁধেছে? নিকিতা বলল, ‘কে আর! মানিকের মা বেঁধেছে।’

‘ওহ, অসাধারণ হয়েছে। সে আসলেই খুব ভালো রাধে। সামনের মাস থেকে তার বেতন এক হাজার টাকা বাড়িয়ে দিয়ো।’

‘আচ্ছা দেব।’ নিকিতা সুযোগ বুঝে বলল, আমাকে কি মাফ করা যায় না?

‘কী বিষয়ে? আচ্ছা থাক, এখন না, ঘরে গিয়ে বোলো। নিকিতা চুপচাপ খেয়ে উঠল।

বারান্দায় চেয়ারে বসে সিগারেট খেতে খেতে প্রিয় ডাকল নিকিতাকে। নিকিতা শাল মুড়ি দিয়ে কাঁপতে কাঁপতে গেল। ওদিকে প্রিয় শুধু ট্রাউজার আর টি-শার্ট পরা ছিল। প্রিয় বলল, ‘আরে, এত শীত লাগছে। তোমার!

নিকিতা প্রিয়র পাশের চেয়ারটাতে বসতে বসতে বলল, ‘সমস্যা নেই।

‘আচ্ছা এবার বলো, কী যেন বলছিলে তখন?

‘আমাকে কি এবারের মতো কোনোভাবে মাফ করা যায় না?

‘শুদ্ধর ব্যাপারে?

‘হুম।

‘দেখো, তোমাকে প্রথমেই তো বলেছিলাম শুদ্ধর ব্যাপারে কোনো অবহেলা আমি মানব না। তুমি শুদ্ধকে আদর করো ঠিকাছে, কিন্তু মন থেকে না, আমাকে খুশি করার জন্য, আমাকে দেওয়া কথা রাখার জন্য করো। তাই বারবার ভুল হয় তোমার। কিন্তু নিকিতা, ও একটা মা-হারা নিষ্পাপ শিশু, কেন তুমি ওকে নিজের ছেলে ভাবতে পারো না?

নিকিতা বলল, ‘শুদ্ধ যেদিন আমাকে মা ভাবতে পারবে, সেদিন আমি ওকে ছেলে ভাবতে পারব। ও আমাকে নিকিতা আন্টি বলে ডাকে, মা তো ডাকে না!”

‘ও মায়ের ব্যাপারে একটু সেনসিটিভ। বড় হতে হতে ঠিক হয়ে যাবে। ও ছোট মানুষ, ওর সাথে তোমার অভিমান মানায় না। ওর আন্টি ডাককে কীভাবে মা ডাক বানাতে হবে, সেটা একটা মেয়ে হিসেবে তোমার জানার কথা।

নিকিতা চুপ। প্রিয় বলল, ‘ঠিকাছে, কাল থেকে তুমিই আগের মতো শুদ্ধকে স্কুলে নিয়ে যাবে, নিয়ে আসবে এবং অন্য ব্যাপারগুলো দেখবে। তবে খেয়াল রাখবে, আর যেন ভুল না হয়। শুদ্ধ আমার প্রাণ।

‘আর ভুল হবে না।’

‘যাও, শুয়ে পড়ো।

‘তুমি?

‘আমি পরে শোব।

তাহলে আমিও এখানেই থাকি কিছুক্ষণ।

‘না, তুমি ঘরে যাও। আর আমাকে শালটা দিয়ে যাও।

নিকিতা শালটা দিয়ে ঘরে চলে গেল। প্রিয় তার শালটা চেয়ে নিয়ে পরেছে, এটাও তার জন্য অনেক। নিকিতা শুয়ে পড়ল কিন্তু ঘুম আসছে না। সে দেখে যাচ্ছে প্রিয় কীভাবে বারান্দায় বসে একটার পর একটা সিগারেট খেয়ে রাত পার করে দিচ্ছে।

.

এমডি স্মরণকে ডেকে পাঠিয়েছে। যাওয়ার পথে কাঁচের দেয়ালের ওপারে পেট্রাকে দেখতে দেখতে গেল। স্মরণ এমডির চেম্বারে ঢুকতেই তিনি বললেন, ‘স্মরণ, তুমি বাসায় চলে যাও। লাগেজ গুছিয়ে নাও। নেক্সট ফ্লাইটে তুমি দুবাই যাচ্ছ।’

স্মরণ অবাক হয়ে চেয়ে রইল। এমডি সব সময় সিরিয়াস কথাগুলো এত হুটহাট বলেন যে ভিরমি খেতে হয়। এরপর এমডি বললেন, ‘দুবাইয়ের কাজটা আমাদেরই পেতে হবে। আমি জানি তুমি ওদের কনভিন্স করতে পারবে।’

‘কিন্তু স্যার, আপনার নিজের ডিল করার কথা ছিল যে!

‘আমার সন্তান দুনিয়াতে আসছে, স্মরণ। এমন সময় আমি আমার স্ত্রীর থেকে দূরে থাকতে পারব না। আমার কোটি টাকার লোকসান হলেও আমি যাব না। আমার কাজটা তাই তুমি করবে।’

‘ওকে স্যার। কিন্তু আপনি কাল মিটিংয়েও তো কিছু বলেন নি এ ব্যাপারে।

‘ইচ্ছা করেই বলি নি। কিন্তু আমার প্ল্যান ছিল যে তুমিই যাবে। তোমার সাথে এই প্রজেক্টের আর্কিটেক্টও যাবে।’

স্মরণের বিশ্বাস হচ্ছিল না। পেট্রা যাবে তার সঙ্গে এই প্রজেক্টের আর্কিটেক্ট তো পেট্রাই। হার্টবিট বেড়ে গেল তার।

.

দলের লোকজনদের সঙ্গে মিটিং করার জন্য বাবর খানের আলাদা বসার ঘর রয়েছে। সেখানেই তিনি ডেকে পাঠালেন নিকিতাকে। নিকিতা ঘরে ঢুকতেই তিনি বললেন, সকাল থেকে বেশ খুশি খুশি লাগছে আজ? কী হয়েছে?

নিকিতা হেসে বলল, আপনার ছেলে কাল আমার সাথে একটুও রাগারাগি করে নি, বাবা। শুদ্ধর সব দায়িত্ব আমাকে আবার ফিরিয়ে দিয়েছে।’

‘বাহ্! এভাবেই থাকো, মা। আজ না হোক কাল, একদিন বুঝবে– কোনো জল্লাদ না, ভালো একজন মানুষের সাথে তোমাকে করিয়ে দিয়ে নিয়ে এসেছি আমি। শুধু ওর মনটা জিতে নাও।

‘বাবা, আমি কখনো আপনার ছেলেকে জল্লাদ মনে করি না।’

‘মনে করাটাই স্বাভাবিক, সে রকমই ব্যবহার করে সে তোমার সাথে।

নিকিতা মাথা নিচু করে রইল। কী অদ্ভুত ব্যাপার! একটা মানুষ, যে কিনা তার সঙ্গে দিনের পর দিন খারাপ ব্যবহার করেছে, চরম নিষ্ঠুর হয়েছে; অথচ তার সম্পর্কেই এসব কথা শুনতে খারাপ লাগছে। তাও আবার তার বাবার কাছ থেকে। বাবর খান বললেন, তবে মা, প্রিয়র চক্ষুশূল কিন্তু তুমি নিজেই হয়েছ।

নিকিতা অবাক হয়ে তাকাল শ্বশুরের দিকে। তিনি বললেন, ‘শুদ্ধর গায়ে হাত তুলেছ তুমি!

‘বাবা, শুদ্ধ সেদিন অনেক বেপরোয়া হয়ে গিয়েছিল। ওকে থামানোর জন্য…তাও শুধু একটা চড় দিয়েছিলাম। না জানি ও ওর বাবাকে কী কী বাড়িয়ে বলেছে!’

‘চুপ করো, নিকিতা। খবরদার, এ ধরনের কথা প্রিয়র সামনে ভুলেও কখনো বলবে না। শুদ্ধ একটা সাত বছরের বাচ্চা, ও কখনো মিথ্যা বলে না। যা হয়েছিল, তা-ই বলেছে শুদ্ধ, তাতেই প্রিয় রেগে গিয়েছিল।

‘এত কিছু আমি ভাবি নি বাবা। মা হিসেবেই আমি শাসন করেছিলাম ওকে।

‘কিন্তু তুমি ওর নিজের মা নও! একটা চড় তো অনেক! ওর সাথে উঁচু গলায় কথা বললেও তোমার দোষ হবে। প্রিয় মারবে, বকবে–সব করবে। ওর দোষ হবে না। কারণ, শুদ্ধ ওর রক্ত, ওর ছেলে।

নিকিতা কিছু বলল না। শ্বশুর আবার বললেন, ‘শুদ্ধকে ধমকাধমকি বা মারধর কখনো করবে না। ও ওর বাবার মতো ঘাড়ত্যাড়া হয়েছে। কথা না শুনলে ওর মায়ের কথা বলবে। বলবে, এটা কোরো না, তোমার মা কষ্ট পাবে। এতেই কাজ হবে।

‘যে নেই, সে-ই রাজত্ব করছে আমার এই সংসারটাতে, আর আমি থেকেও কিছু করতে পারছি না।’

এ কথা বলতে বলতেই নিকিতার চোখে জল এল। বাবর খান হেসে বললেন, ‘কেঁদো না মা। ওকে হিংসা করাটা বোকামি! প্রিয়র মন পেলেই সব পেয়ে যাবে তুমি। আমার ছেলে পাগলের মতো ভালোবাসতে জানে।

‘আপনার ছেলের মন তো আপনার ছেলের কাছে নেই বাবা, আমি কী করে পাব?

‘শোনো নিকিতা, বাস্তব জীবনের ভালোবাসা সিনেমার মতো নয় যে একজনকে ভালোবেসে সারা জীবন কাটিয়ে দেবে। তোমাকে আমি প্রিয়র সব দুর্বলতা বলেছি। এখন কেন তুমি পারবে না? এভরিথিং ইজ ফেয়ার ইন লাভ অ্যান্ড ওয়ার। আর তোমারটা তো ভালোবাসা, যুদ্ধ–দুটোই।

‘আমার ভয় করে, বাবা।’

‘একদম ভয় পাবে না, আমি সারা জীবন যে-কোনো বিপদে তোমার সাথে থাকব।’

.

স্মরণ এয়ারপোর্টে যাওয়ার পথে পেট্রাকে পিক করে নিল। গাড়িতে ওঠার পর থেকে স্মরণ বকবক করেই চলেছে। এটা-ওটা অনেক কিছু জিজ্ঞেস করছে। কথা যেন শেষ হয় না। এর মধ্যে তুমি করে বলাটাও আদায় করেছে। তার চোখে ভালোবাসা দেখছে পেট্রা! আজ নয়, কিছুদিন আগেই ব্যাপারটা খেয়াল করেছে। এটা না থাকলে হয়তো পেট্রার ভালো লাগত। ভালো-খারাপ যা-ই লাগুক না কেন, পেট্রা স্বাভাবিক রয়েছে। তবে এটা খুব ভালোভাবে বুঝতে পারছে, স্মরণকে থামাতে হবে। কিন্তু তার ভালোবাসা হলো কী করে? অবাক লাগছে পেট্রার। হঠাৎ মনে হলো, স্মরণ কি তাহলে তার ব্যাপারে না জেনেই ভালোবাসছে? সেটা কী করে সম্ভব? একই অফিসে কাজ করে, এটুকু না জানার তো কথা নয়। আর না জানলে এক্ষুনি জানাতে হবে। সুযোগের অপেক্ষায় রইল পেট্রা এবং সুযোগ খুব তাড়াতাড়িই চলে এল। কথায় কথায় যখন স্মরণ জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা, তার মানে তোমার ছোট বোনের আগেই বিয়ে হয়ে গেছে। নাম কী ওর?

‘প্রিয়াঙ্কা লিংকি রোজারিও।

স্মরণ মাথা হেলিয়ে-দুলিয়ে কথা বলছিল। নামটা শুনে থমকে গেল। এমনকি হৃদয়ের একটা কম্পনও বুঝি মিস করল। চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। জিজ্ঞেস করল, তোমার পুরো নাম কী?

‘ক্লিওপেট্রা জেনি রোজারিও।

‘তুমি খ্রিষ্টান!

পেট্রা মুখটা স্বাভাবিক রেখেই বলল, তুমি জানতে না?

‘না।

‘কেন, তুমি তো আমার ফেসবুক ফ্রেন্ডলিস্টে আছ, দেখো নি আমার নাম যে ক্লিওপেট্রা? মুসলিমদের নাম কি ক্লিওপেট্রা হয় নাকি?’

স্মরণ স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করল, ‘আজকাল সব ধর্মেই সব নাম রাখা হয়। তা ছাড়া তোমার প্রোফাইলে তো সারনেম দেওয়া নেই, আর অ্যাবাউটেও এটা বোঝার মতো কিছু ছিল না।’

ও হ্যাঁ।

স্মরণ স্বাভাবিক হওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করছে, সে পেট্রাকে বুঝতে দিতে চাচ্ছে না তার ভেতরে কী ঘটে যাচ্ছে। হেসে বলল, ‘যা-ই হোক,

এটা জানা না-জানায় কী যায়-আসে? ইটস নট আ বিগ ডিল।

‘তা অবশ্য ঠিক।

পেট্রাও হাসল। স্মরণ কথা ঘোরানোর জন্য বলল, তোমার বোন বিয়ের পর সারনেম চেঞ্জ করে নি?

পেট্রা হেসে বলল, ‘ওর হাজব্যান্ডও রোজারিও।

‘আচ্ছা আচ্ছা!’

এসব টুকটাক কথাবার্তা বলে পরিবেশ হালকা করতে লাগল স্মরণ।

দুঃস্বপ্ন দেখে প্রিয়র ঘুম ভেঙে গেল। পাশ ফিরে শুদ্ধকে জড়িয়ে ধরতে গিয়ে আবিষ্কার করল, শুদ্ধ বিছানায় নেই। লাফিয়ে উঠে লাইট জ্বালাল–নিকিতা ঘুমাচ্ছে, ঘরে নেই শুদ্ধ। বাথরুমে দেখল, বারান্দায় দেখল। নেই, কোথাও নেই। প্রিয় ঘর থেকে বেরিয়ে পুরো বাড়ি খুঁজতে লাগল। অবশেষে বসার ঘরে পেল। প্রিয় দূর থেকেই দেখতে পেল শুদ্ধ মোবাইল হাতে নিয়ে কাঁদছে। বুঝতে বাকি রইল না যে সে মায়ের ছবি দেখছে। প্রিয় কাছে গিয়ে বসতেই শুদ্ধ বলল, ‘সরি বাবা, আমি পারমিশন না নিয়েই তোমার মোবাইলটা এনেছি। মাকে খুব দেখতে ইচ্ছা করছিল। একদম ঘুম আসছিল না।’

প্রিয় শুদ্ধর চোখের পানি মুছে দিয়ে তাকে কোলে উঠিয়ে জড়িয়ে ধরল। তারপর বলল, ‘ইটস অলরাইট বাবা! কাঁদিস না। তুই কাঁদলে কিন্তু মা খুব কষ্ট পায়।’

শুদ্ধর কান্না বেড়ে গেল, কাঁদতে কাঁদতেই বলল, ‘মায়ের ছবি দেখলেই আমি মায়ের গন্ধ পাই, বাবা। মায়ের কোলে যেতে ইচ্ছা করে, আমার কান্না পায়।

ছেলের এমন কান্না দেখে প্রিয়র মন খারাপ হয়ে গেল। বলল, চল, ঘরে চল।’

প্রিয় কোলে করেই শুদ্ধকে ঘরে নিয়ে গেল। তারপর তাকে বিছানায় বসিয়ে ওয়ার্ডরোবের ওপরের ড্রয়ার খুলল। শুদ্ধর মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সে জানে এই ড্রয়ারে তার মায়ের অনেক জিনিসপত্র আছে। প্রিয় একটা ওড়না বের করে শুদ্ধকে দিয়ে বলল, ‘তোর মায়ের এটা।’

শুদ্ধ সঙ্গে সঙ্গে কান্না থামিয়ে ওড়নাটা দুহাতে নিয়ে চুমু খেল, গন্ধ নিল। তারপর হাসতে হাসতে ওড়নাটা শালের মতো গায়ে জড়িয়ে নিয়ে বলল, এটা থেকে সত্যি সত্যি মায়ের গায়ের গন্ধ আসছে, বাবা।

প্রিয় হেসে বলল, ‘জানি তো। এ জন্যই তো দিলাম। খুব যত্ন করে রাখবি। এবার শুয়ে পড় বাবা।

শুদ্ধ শুয়ে পড়ল। প্রিয় ড্রয়ারে তালা দিয়ে লাইট বন্ধ করে বিছানায় এল। শুদ্ধ বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘বাবা, তুমিও একটু মায়ের গন্ধ নাও না।’

প্রিয় শুদ্ধর গায়ে প্যাচানো ওড়নাটাতে নাক ডোবাল, ঠোঁট ছোঁয়াল। মুহূর্তের মধ্যেই চোখের কোণটা জলে ভরে উঠল তার।

.

কাজটা তারা পেয়ে গেছে। মিটিং শেষ করে বিকেলের মধ্যেই হোটেলে ফিরে এসেছে পেট্রা ও স্মরণ। পেট্রা ঘুমিয়ে পড়েছিল। সন্ধ্যা নাগাদ স্মরণের ফোন পেয়ে ঘুম ভাঙল। স্মরণ বলল, ‘ঘুমাচ্ছিলে?

হ্যাঁ।

‘ওহ্, সরি।’

‘আরে না না, আমি উঠতাম এখনই। তুমি বলো না কী বলবে।

‘তোমার আপত্তি না থাকলে বাইরে কোথাও ডিনার করি? আফটার অল এত বড় একটা কাজ পেয়েছি, একটু তো সেলিব্রেট করা উচিত।

‘আচ্ছা, কখন যাবে?

‘এই ধরো এক ঘণ্টা পর।

‘ঠিকাছে, আমি রেডি হয়ে এক ঘণ্টা পর ফোন করছি।’

সমুদ্রের পাশেই একটা রেস্টুরেন্টে ডিনারে বসেছে স্মরণ ও পেট্রা। বসার কিছুক্ষণ পরই স্মরণের মনে হলো, এখানে বসা উচিত হয় নি। সমুদ্রের ঢেউয়ের শব্দ এসে কানে লাগছে। ওরা যেন বলছে, ‘স্মরণ, আমাদেরও তোমার মতো মন খারাপ। আরও বিষণ্ণ লাগছে। পেট্রাও খেয়াল করেছে, সে খ্রিষ্টান, এটা জানার পর থেকেই স্মরণের মন খারাপ হয়ে গেছে। চঞ্চল-ছটফটে ছেলেটাকে বিমর্ষ দেখতে ভালো লাগছে না। এত কথা বলা ছেলেটা একদমই কথা বলছে না। পেট্রাই খেতে খেতে টুকটাক গল্প চালিয়ে যেতে লাগল। দুটো মানুষ মুখোমুখি একদম চুপচাপ তো আর থাকা যায় না। স্মরণ হঠাৎ করে বলল, ‘পেট্রা, আমার একটা গার্লফ্রেন্ড ছিল। লং ডিসটেন্স রিলেশনশিপ। আমি ছিলাম অস্ট্রেলিয়াতে আর সে বাংলাদেশে।

হঠাৎ এ কথায় অবাক হলো পেট্রা। বলল, ‘আচ্ছা! পরে?

‘বিয়ে করতে চেয়েছিলাম ওকে।

‘হুম।

‘আমাদের আগে থেকেই পরিচয় ছিল। কিন্তু যখন সম্পর্ক হয়েছিল, আমি তখন বাইরে। ফোন, ইন্টারনেট–এই ছিল আমাদের যোগাযোগের মাধ্যম। সে আমার এক বছরের বড় ছিল। যা-ই হোক, আমাদের ফার্স্ট লাভ অ্যানিভার্সারিতে দেশে এসে ওকে সারপ্রাইজ দিয়েছিলাম। যে কদিন ছিলাম, প্রতিদিন দেখা করেছি আমরা। চলে যাওয়ার পরও মনটা পড়ে ছিল ওর কাছেই। ভালোই চলছিল। কিন্তু হঠাৎই ও সবকিছু থেকে ডিসকানেক্টেড হয়ে গেল। কোনোভাবেই ওর সাথে আর যোগাযোগ করতে পারলাম না। আমার এক বন্ধুর ভাবির বোন ছিল। ওই বিয়েতেই পরিচয় হয়েছিল। ভাবিকে দিয়ে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম, ওর বিয়ে হয়ে গেছে। জানি না কেন সে আমার সাথে এমন করেছিল। আমাদের কোনো ঝগড়া হয় নি, অন্য কোনো প্রবলেমও ছিল না। আমার মা-বাবা আমার বন্ধুর মতো। মা তো আমার বেস্ট ফ্রেন্ড, সে সব জানত। তখন বিয়ে করতে চাইলে তখনই দিত। তবু কেন সে এমন করল, জানার অনেক ইচ্ছা ছিল। আজও জানতে পারি নি। সে আমাকে অ্যাভয়েড করে। স্বামী সন্তান নিয়ে নিশ্চয়ই সুখে আছে। যা-ই হোক, ধাক্কাটা কম ছিল না। তারপর থেকে প্রেমকে না বলেছি। ফ্লার্ট করেছি শুধু। ঠিক করেছিলাম, একেবারে বিয়ের পর প্রেম করব। অথচ জানি না কেমন করে তোমার প্রেমে পড়লাম আমি!

পেট্রা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল চুপ করে। স্মরণও সরাসরি পেট্রার চোখের দিকে তাকিয়ে ছিল। পেট্রা ভাবতে পারছে না স্মরণ কতটা অবলীলায় কথাটা বলে দিল। আর কেনই-বা বলল এখন? স্মরণ বলল, যেদিন প্রথম তোমাকে দেখেছি, জানি না কেন, কীভাবে তুমি আমার মনে জায়গা করে নিয়েছিলে। তোমার মধ্যে কিছু একটা আছে, যা অদ্ভুতভাবে টানে আমাকে। আমি সত্যি জানতাম না তুমি খ্রিষ্টান। যদি প্রথম দিনই জানতে পারতাম, তাহলে হয়তো কষ্ট পেতে হতো না আজ আমার।

পেট্রা চুপ। স্মরণ পকেট থেকে মেটালের একটা ছোট জুয়েলারি বক্স বের করে টেবিলের ওপর রাখল। তারপর সেটা খুলল, ভেতরে একটা আংটি। স্মরণ বলল, এই রিংটা দিয়ে এই রেস্টুরেন্টেই আমি তোমাকে ফিল্মি স্টাইলে প্রপোজ করতে চেয়েছিলাম। যখনই খবর পেয়েছি তুমি আর আমি আসব, আমি খুশিতে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিলাম। কারণ, এই সুযোগে অনেকটা সময় তোমার সাথে কাটাতে পারব, অনেকটা কাছে আসতে পারব তোমার। নিজের ওপর আমার কনফিডেন্স ছিল, তাই সাথে সাথে ছুটে গিয়ে এই রিংটা কিনেছিলাম। তোমার জন্যও বাসায় ছেলে দেখছে, আমার জন্যও মেয়ে দেখছে। ভেবেছিলাম কোনো বাধা আসবে না। কিন্তু…আমার কপালটাই আসলে খারাপ।

পেট্রা বলল, ‘আই অ্যাম সরি, স্মরণ।’

‘ইটস নট ইওর ফল্ট।’

‘আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে তুমি আমার ধর্মের ব্যাপারে জানো না। চাচ্ছিলাম না এই পরিস্থিতিটা ফেস করতে। তাই তোমাকে টেকনিক্যালি জানিয়ে দিয়েছিলাম। অথচ তুমি আমাকে এই পরিস্থিতিটা ফেস করালেই।

‘জানি পেট্রা, আমিও পারতাম ব্যাপারটা গোপন রেখেই মিটিয়ে দিতে। কিন্তু আমি সত্যিই তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি। পাব না জানি, তবু এই ভালোবাসার কথা না জানিয়ে আমার শান্তি ছিল না। তাই জানালাম।

পেট্রা তাকিয়ে রইল স্মরণের দিকে। সে সত্যিই কখনো চায় নি এমন পরিস্থিতি সামনে আসুক। স্মরণ বলল, ‘রিংটা আমি তোমার জন্য কিনেছিলাম। তুমি নিলে খুশি হব। যেভাবে চেয়েছিলাম, সেভাবে তো দিতে পারব না, কিন্তু তোমার উদ্দেশে কেনা, এটা তুমি ছাড়া আর কারও আঙুলে উঠবে না।’

‘আমি এটা নিতে পারব না।’

‘তাহলে এখন এটা আমি কী করব? এটার মালিক তো তুমি।

‘আপাতত রেখে দাও, আমার বিয়েতে গিফট দিয়ো।’

‘এটা ভালো বুদ্ধি, ঠিকাছে।’

স্মরণ আংটির বক্সটা যত্ন করে তুলে আবার পকেটে রাখল।

আলমারি গোছাতে গিয়ে বিয়ের শাড়িটায় চোখ পড়ল নিকিতার। শাড়িটা হাতে নিয়ে দেখতে লাগল। প্রত্যেকটা মেয়ের মনেই কিশোর বয়স থেকে বিয়ে ও বিয়ের দিনটি নিয়ে অনেক স্বপ্ন থাকে। তারও ছিল। প্রথম দিকে বিয়েতে আপত্তি ছিল তার। উপরন্তু পাত্র এক বাচ্চার বাবা। কে চায় এক বাচ্চার বাবাকে বিয়ে করতে? কিন্তু প্রিয়র ছবি ও পরিবার দেখে নিকিতার খুব পছন্দ হয়ে যায়। এমন রাজপুত্রের মতো ছেলে সচরাচর পাওয়া যায় না। তার ওপর ভালো চাকরি করে, বাড়ি-গাড়ি আছে। শ্বশুর বিশিষ্ট মন্ত্রী। মা-বাবাও খুব চাচ্ছিল, সব মিলিয়ে শেষ পর্যন্ত রাজি হয় নিকিতা। বিয়ের আগে প্রিয়র সঙ্গে তার দেখা হয় নি, এমনকি কথাও হয় নি। আজকালকার যুগের ছেলে পাত্রী না দেখে বিয়ে করে, এটা অবাস্তব একটা ব্যাপার। কিন্তু এটাই ঘটেছিল তার সঙ্গে।

বিয়ের আগে দেখা হয় নি, হুট করে বাসরঘরে কী করে স্বাভাবিকভাবে কথা বলবে? প্রথম দেখাতেই একটা অপরিচিত মানুষের সঙ্গে কীভাবে এক বিছানায় শোবে? যদি প্রথম দিনই ইন্টিমেট হতে চায়। বাসরঘরে বসে যখন এমন নানান চিন্তায় গলা শুকিয়ে গিয়েছিল, বুক ঢিপঢিপ করছিল, তখন প্রিয় ঘরে এসে অবাক করে দিল নিকিতাকে। কারণ, প্রিয় তার কাছেও আসে নি, কোনো কথাও বলে নি। বারান্দায় বসে একনাগাড়ে সিগারেট খাচ্ছিল। নিকিতার আগবাড়িয়ে কিছু বলতে সংকোচ হচ্ছিল। আবার এত ভারী শাড়ি ও গয়নাগাটি পরে বসে থাকতে পারছিল না আর। এমনিতেই ভীষণ ক্লান্ত ছিল।

ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করার পর নিকিতা বারান্দায় গিয়ে বলেছিল, ‘আমার অনেক ঘুম পাচ্ছে।

প্রিয় শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেছিল, আমি কী করতে পারি?

প্রিয়র তাকানো, বাচনভঙ্গি, কণ্ঠস্বর–সবকিছুতে ঘোর লেগে গেল নিকিতার। সে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ‘আমি ঘুমিয়ে পড়ব?

‘অ্যাজ ইউর উইশ।’

নিকিতা ঘরে ফিরে এল। ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে গয়না খুলতে খুলতে ভাবতে লাগল, মানুষটার কি তবে তাকে পছন্দ হয় নি? নাকি বিয়েতে রাজি ছিল না? সে জন্যই কি দেখা করে নি বিয়ের আগে? নাকি সে এখনো তার প্রাক্তন স্ত্রীকে ভুলতে পারে নি বিধায় শোক পালন করছে? যদি তা-ই হয়, তাহলে তাকে কেন বিয়ে করল? এমন হাজারো প্রশ্ন মাথায় নিয়ে রাগে কাঁপতে লাগল নিকিতা। বাসরঘরে এমন হয় কোনো স্বামীর ব্যবহার!

মেকআপ তুলে ফ্রেশ হয়ে এসে যখন বিছানায় গেল, তখনই ঘরে এল প্রিয়। কিন্তু তার দিকে তাকাল না। আরেক দফা অবাক হলো নিকিতা। প্রিয় না তাকালেও নিকিতা তাকিয়েছিল প্রিয়র দিকে, তখনই দেখল প্রিয়র চোখটা ভেজা। কাঁদছিল নাকি? কিন্তু কেন কাঁদছিল? কেমন জানি মনটা নরম হয়ে গেল নিকিতার। বলে বসল, তুমি কাঁদছ কেন?

প্রিয় চমকে তাকাল। তারপর ভুরু কুঁচকে বলল, আমি কাঁদি বা হাসি, বাঁচি বা মরি, তাতে তোমার কিছু বলার অধিকার নেই।’

এমন কথায় মাথা গরম হয়ে গেল নিকিতার। সে কোনো অবলা নারী নয়। ছোটবেলা থেকেই রগচটা, জেদি। কাউকে পাত্তা দেয় নি কখনো। কথার বেলায় নিজের বাপকেও ছাড়ে না। প্রিয়কে ছাড়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। বলল, ‘অধিকার অবশ্যই আছে। কারণ আমি তোমার স্ত্রী। কিছুক্ষণ আগেই তুমি আমাকে বিয়ে করেছ।

‘আমি তোমাকে বলেছিলাম আমাকে বিয়ে কোরো না, স্ত্রীর জায়গা কখনো পাবে না। এখন স্ত্রীগিরি ফলাচ্ছ?

অবাক হলো নিকিতা, ‘মানে? তোমার সাথে তো আমার দেখাই হয় নি, বললে কবে আবার?

‘হ্যাঁ, দেখা হয় নি ঠিক, কিন্তু ফোনে তো বলেছি।

নিকিতা আরও অবাক হয়ে মেজাজ দেখিয়ে বলল, আমার সাথে মোটেও তোমার ফোনে কথা হয় নি। আমি চেয়েছিলাম কথা বলতে, আমার মা বলেছে, তুমি যেখানে কথা বলতে চাও না, সেখানে আমার বলতে চাওয়াটা নির্লজ্জতা হবে।’

‘তাহলে কার সাথে কথা হয়েছিল আমার?

‘আমি কী জানি!’

‘আমার কাছে সম্ভবত রেকর্ডিংও আছে। খুঁজলে হয়তো পাব।’

নিকিতা তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল, ‘তাই নাকি? তাহলে রেকর্ডিং খুঁজে বের করুন। শুনি আপনার সাথে আমার কেমন কথা হয়েছে?

প্রিয় বিরক্ত হয়ে রেকর্ডিংটা খুঁজতে লাগল। পাশাপাশি ভয় হতে লাগল। নিকিতা কি সত্যি বলছে? তাহলে কি মন্ত্রীসাহেব নাটক করিয়েছে কাউকে মেয়েটি সাজিয়ে? রেকর্ডিংটা খুঁজে পেয়েই প্লে করল প্রিয়। তারপর ফোনটা নিকিতার হাতে দিল। কনভারসেশনটা অনেকটা এ রকম ছিল,..

‘হ্যালো।

‘হ্যালো, নিকিতা বলছেন?

‘হ্যাঁ, আপনি কে বলছেন?

নিকিতা অবাক হলো। এটা ওর কণ্ঠ নয়। সবচেয়ে বড় কথা, ও তো জানে কথা হয় নি, তাহলে এই মেয়েটা কে! এসব ভাবতে ভাবতেই আবার রেকর্ডিংয়ে মনোযোগ দিল নিকিতা।

‘আমি প্রিয়। চিনতে পেরেছেন?

‘হ্যাঁ। কেমন আছেন আপনি?’

‘ভালো। আপনার সাথে কিছু জরুরি কথা ছিল।’

‘হ্যাঁ, বলুন।

‘আপনি আমাকে বিয়ে করবেন না, প্লিজ। আমি এই বিয়েতে রাজি নই।

কিন্তু আপনার বাসার লোকজন বলেছে আপনি রাজি আছেন।

‘তারা এটাই বলবে। কিন্তু আমি প্রিয়, আমি স্বজ্ঞানে বলছি, আমি রাজি নই। আমার পাঁচ বছরের একটা ছোট ছেলে আছে, সে-ও রাজি নয়। এই বিয়ে হলে আপনার জীবনটা নষ্ট হয়ে যাবে আর আমার জীবনটা অতিষ্ঠ হয়ে যাবে।

‘আপনার কথা আমি বুঝতে পারছি না। পরিষ্কার করে বলুন।

‘আমি আমার প্রাক্তন স্ত্রীকে এখনো ভালোবাসি। সারা জীবন ভালোবাসব। এমনকি আমি আমাদের সম্পর্কটা আবার ঠিক করতে চেষ্টা করছি। তা ছাড়া আমার ছেলেও কোনো দিন অন্য কাউকে মা বলে মানতে পারবে না।’

‘আমি শুনেছি আপনার স্ত্রী বেঁচে নেই।

‘আলবত বেঁচে আছে।

‘এখন আমার কী করার থাকতে পারে?

‘বিয়ে ভেঙে দিন।’

‘সেটা আমি কী করে করব? আমার ফ্যামিলি ঠিক করেছে এই বিয়ে। আর আমি কখনোই তাদের ওপর কোনো কথা বলি না।

‘তাদের বলুন আমি এই বিয়েতে রাজি নই। ইচ্ছা করলে আমার নামে ইচ্ছেমতো বদনামও বলতে পারেন।

‘আচ্ছা, বলব।

থ্যাংক ইউ। প্লিজ, বিয়েটা করবেন না। যদি করেন আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না।

‘আরে, আপনি নিজে আপনার ফ্যামিলিকে বলতে পারছেন না যে আপনি বিয়ে করবেন না?

‘বলেছি। ইমোশনাল ব্ল্যাকমেলে পড়ে গেছি। আমার হাতে আর কিছু নেই, তাই আপনার সাহায্য চাচ্ছি।

‘আচ্ছা, আমি চেষ্টা করব।’

রেকর্ডিংটা শেষ হতেই নিকিতা বলল, এটা আমি নই। আমাকে কি পাগলা কুকুরে কামড়েছে যে পাত্র রাজি নয় শুনেও বিয়ে করব? আমার কি পাত্রের অভাব?

প্রিয় মেজাজ খারাপ করে বলল, কী বলতে চাচ্ছ তুমি?

নিকিতা নিজের ফোনটা বিছানার ওপর থেকে তুলে প্রিয়র হাতে দিয়ে বলল, ‘নম্বর টাইপ করো।’

‘কার নম্বর?

‘তোমার নম্বর, আবার কার?

‘এই মেয়ে, খবরদার, চেঁচাবে না আমার সাথে।

এবার নিকিতা রাগের বশে ঢং করে বলল, ‘আচ্ছা ঠিকাছে, জান, বাবু, কলিজা আমার, তোমার নম্বরটা একটু টাইপ করো।

‘হোয়াট রাবিশ!’

প্রিয় প্রচণ্ড বিরক্ত হয়ে ফোনটা নিয়ে নিজের নম্বর টাইপ করে ফেরত দিল। নিকিতা প্রিয়র নম্বরে ডায়াল করে বারান্দায় চলে গেল। প্রিয় বুঝতে পারল নিকিতা কী করতে চাচ্ছে এবং নিশ্চিত হলো, ওর বাবাই প্যাঁচটা লাগিয়েছে। রাগে সমস্ত শরীর জ্বলে যাচ্ছিল। ফোন বেজে উঠল। প্রিয় ফোন ধরতেই নিকিতা বলল, ‘হ্যালো মিস্টার প্রিয়, আমি নিকিতা। আমার কণ্ঠস্বর ভালোমতো শোনো। এটাও রেকর্ড হচ্ছে। একটু পরে দুটো রেকর্ডিং মেলাতে হবে তোমাকে। ওকে? শুনেছ ভালোমতো? হ্যালো হ্যালো।’

প্রিয় ফোন কেটে দিল। নিকিতা ঘরে ফিরে এল। প্রিয় বলল, ‘আমি তাহলে অন্য কারও সাথে কথা বলেছি!’

‘জি। আচ্ছা, ওই নম্বরটা দেখতে পারি?

হ্যাঁ, শিওর।

প্রিয় নম্বরটা বের করে দিল। নিকিতা বলল, ‘চিনি না। আর আমার তো এই একটাই নম্বর, যেটা দিয়ে আপনাকে মাত্র কল করলাম।

‘বুঝতে পারছি।

প্রিয় ওই নম্বরটাতে কল করল। কিন্তু কেউ ফোন ধরল না। কয়েকবার কল করার পর নম্বরটা বন্ধ পেল। প্রিয় একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘আসলে মন্ত্রীসাহেব অনেক দিন ধরেই আমাকে বিয়ে দিতে চাচ্ছিলেন। সব সময় এভাবেই পাত্রীর সাথে কথা বলে বিয়ে ভেঙে দিয়েছি। সেটা বুঝতে পেরেই তিনি এবার এই কাজটা করলেন।

‘তার জন্য আমাকে ভুগতে হবে কেন, মিস্টার প্রিয়?

‘সরি নিকিতা। আমার কিছু করার নেই। আমার দিক থেকে আমি ঠিক ছিলাম, বুঝতেই পারছ নিশ্চয়ই। আমি ভুল মানুষের সাথে কথা বলেছিলাম, সেটা তো আমি জানতাম না।’

‘আমি কালকেই চলে যাব।’

‘শিওর, অ্যাজ ইওর উইশ।

নিকিতা মুখ ঝামটা দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ পর প্রিয় শুতেই লাফিয়ে উঠল নিকিতা। বলল, আমি তোমার সাথে এক বিছানায় শোব নাকি? ঘর করলে শুতাম। ঘর তো করব না। কালই চলে যাব। এরপর তালাক দিয়ে দেব। আর শোনো, আমি তোমার মতো বিবাহিত নই, একটাই বয়ফ্রেন্ড ছিল, ব্রেকআপ হয়ে গিয়েছে কিন্তু এখনো ভার্জিন। সুতরাং, খবরদার, আমাকে ছোবে না।

রাগে প্রিয়র শরীরের রক্ত টগবগ করতে লাগল। নিকিতার দিকে এমনভাবে তাকাল, যেন একটা মরা ইঁদুরের দিকে তাকিয়েছে। কিন্তু কিছু বলল না। হয়তো ভাবছিল কাল চলে যাবে, আপদ ঘাড় থেকে নামবে, এটাই বড় শান্তির কথা।

প্রিয় বালিশ তুলে সোফায় গিয়ে শুয়ে পড়ল। তারপর আড়চোখে দেখল, নিকিতা ফলের ঝুড়ি থেকে ছুরি তুলে বালিশের পাশে নিয়ে শুল। মেজাজটা প্রচণ্ড খারাপ হলো। নিকিতাও প্রিয়র তাকানোটা খেয়াল করল। তবু নিশ্চিন্ত হতে পারছিল না। আতঙ্ক নিয়ে ঘুমিয়েছিল সারা রাত।

এভাবেই কেটেছিল তাদের বাসর রাত। সেদিনের কথা মনে পড়লে এখন হাসি পায় নিকিতার। কত চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বলেছিল সেদিন সে। অথচ মাত্র দুবছরে কত বদলে গেছে সে! মানুষটাকে পাওয়ার জন্য কত কিছুই না করেছে এ দুবছরে কিন্তু মানুষটা আজ অবধি তাকে স্পর্শ করে নি।

ঘুম আসছিল না, তাই পেট্রা একটা মুভি দেখছিল। মুভি শেষ হওয়ার পর ঘড়ির দিকে তাকাল। রাত ২টা ২৭ মিনিট। এখনো ঘুম আসছে না। রাত তিনটা-চারটার আগে একদিনও ঘুম আসে না। অফিসের জন্য আবার সকাল আটটায় উঠতে হয়। সন্ধ্যায় অফিস থেকে ক্লান্ত হয়ে ফিরে মায়ের কাছে কথা শুনতে হয়। শুনতে হবে নাই-বা কেন, যা করে এসেছে অতীতে, তারই ফল ভোগ করছে এখন। এ জীবনের শেষ কোথায়?

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল! তারপর ল্যাপটপ বন্ধ করতে যাবে, এমন সময় হঠাৎ ফেসবুকে স্মরণের একটা মেসেজ এল। স্মরণ আর পেট্রা এত দিনে খুব ভালো বন্ধু হয়ে গেছে। মেসেজটা ওপেন করল পেট্রা। স্মরণ লিখেছে, এত রাত জাগো কেন তুমি?

পেট্রা লিখল, ‘ঘুম আসে না, তাই। তুমি কেন জাগো?

‘আমি তো জাগি না! আজ খেলা ছিল, খেলা দেখার জন্য জেগেছি।’

‘বুঝলাম।

‘আচ্ছা, তোমার কেন ঘুম আসে না, সেটা জিজ্ঞেস করা কি আমার অনধিকার চর্চা হবে?

‘না। এমনিই ঘুম আসে না!’

‘ঘুম পাড়িয়ে দেব? পাগলাটে ছেলেটার কথা শুনে হাসল পেট্রা। লিখল, কীভাবে?

‘অনুমতি দিয়ে দেখো কীভাবে?

‘আচ্ছা দিলাম।

‘ফোন করছি তাহলে।

ফোন কেন?

উত্তর না দিয়েই স্মরণ ফোন করল। পেট্রা ফোন ধরতেই স্মরণ বলল, ‘চ্যাটে কি ঘুম পাড়ানো যায় নাকি? ঘুম পাড়াতে হয় সামনাসামনি। যেহেতু সেটা সম্ভব নয়, ফোনে ট্রাই করছি। ফ্রেন্ড হিসেবে আমি এটা করতেই পারি, তাই না?

পেট্রা হেসে বলল, ‘আচ্ছা, ঠিক আছে, করো।

এই গভীর রাতে পেট্রার জাদুমাখা কণ্ঠস্বর শুনে আধপাগল হয়ে গেল স্মরণ। কথা বলতে ভুলে গেল। পেট্রা বলল, ‘কী ব্যাপার, চুপ কেন?

‘নাহ, এমনি। তুমি কী করছ?

‘এতক্ষণ মুভি দেখছিলাম। এখন কিছু করছি না।’

‘আচ্ছা, ঘরের সব লাইট বন্ধ করে শুয়ে পড়ো!’

পেট্রা কথা বলতে বলতেই লাইট বন্ধ করল। তারপর কম্বল টেনে শুয়ে পড়ল। স্মরণ বলল, ‘মশা আছে? থাকলে তো ঘুমাতে পারবে না।

‘অ্যারোসল দিয়েছিলাম। এখন মশা নেই।

‘আচ্ছা। এবার চোখ বন্ধ করো।’

চোখ বন্ধ করল পেট্রা। স্মরণ ল্যাপটপ থেকে ইউটিউবে ঢুকে শিব কুমার শর্মার বাজানো সানতুর ছেড়ে দিল। তারপর বলল, ‘ভাবো যে খুব নরম তুলতুলে একটা বিছানায় শুয়ে আছ তুমি। তোমার প্রিয় কম্বলটা তোমার গায়ে। আর তোমার মাথাটা সবচেয়ে প্রিয় মানুষটার কোলে। যাকে তুমি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসো। মানুষটা তোমার মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে, আবেশে তোমার ঘুম এসে যাচ্ছে।’

সঙ্গে পেট্রার চোখে ভেসে উঠল প্রিয়র মুখটা। মনে হলো বালিশে নয়, সে প্রিয়র কোলেই শুয়ে আছে। প্রিয় তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। এমনটাই তো করত মানুষটা। স্মরণ নিজে কথা বলা বন্ধ করে সানতুরের ভলিউম বাড়িয়ে দিল। পেট্রা প্রিয়র কথা ভাবতে ভাবতে সানতুরের সুরে হারিয়ে গেল। কখন যে ঘুমিয়ে পড়ল, নিজেও টের পেল না। ওদিকে অনেকক্ষণ পর স্মরণের মনে হলো, পেট্রা যখন কথা বলছে না, তখন নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে পড়েছে। পরীক্ষা করার জন্য ডাকল, ‘পেট্রা?

স্মরণ সানতুর বন্ধ করল। তারপর ফোনে কান পাততেই পেট্রার নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পেল। যাক, মেয়েটা ঘুমিয়ে পড়েছে। স্মরণও ফোন। রেখে শুয়ে পড়ল।

.

পেট্রা মাথায় একটা ছোট্ট নরম তুলতুলে হাতের স্পর্শ পেল। চোখ খুলতেই শুদ্ধকে দেখতে পেল। শুদ্ধ বলল, ‘মা! বাবা তোমার জন্য মাঝেমধ্যে কাঁদে। আর আমিও প্রায়ই কাঁদি তোমার জন্য। আমরা তোমাকে খুব ভালোবাসি, মা। তুমি কি আমাকে একটু আদর করবে?

ঠিক তখনই আরও একটা হাতের স্পর্শ পেল পেট্রা। লাফিয়ে উঠল। শিখা বললেন, কী হয়েছে, পেট্রা? দুঃস্বপ্ন দেখছিলি নাকি?

পেট্রা আশপাশে তাকিয়ে কোথাও শুদ্ধকে দেখতে পেল না। এটা স্বপ্ন ছিল তাহলে? স্বপ্নে এসেছিল শুদ্ধ? তা-ই হবে, বাস্তবে তো আর সম্ভব নয়।

মা বলল, ‘অফিসে যাবি না? ওঠ ওঠ।’

পেট্রা উঠে ফ্রেশ হতে গেল। ফ্রেশ হয়ে তড়িঘড়ি করে দুই পিস ব্রেড খেয়ে বেরিয়ে পড়ল। রিকশা নিলে দেরি হয়ে যাবে, তাই সিএনজি নিল।

পেট্রা দাঁড়িয়ে আছে একটা স্কুলবাসের পেছনে। এমন জায়গায় দাঁড়াল, যাতে রাস্তা দিয়ে যারা আসবে, তাদের সে দেখতে পারে। অপেক্ষা করতে লাগল কখন শুদ্ধ আসে! ছেলেটাকে কত দিন দেখে না। আজ স্বপ্নে দেখার পর মনকে আর আটকে রাখতে পারে নি।

বাচ্চারা আসতে শুরু করেছে। প্রত্যেকেই একে একে স্কুলে ঢুকে যাচ্ছে, শুদ্ধ কেন আসছে না? নাকি শুদ্ধ আগেই এসে পড়েছে? সে দেরি করে ফেলল! আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিল, ঠিক তার পরপরই প্রিয়র গাড়ি দেখতে পেল। সঙ্গে সঙ্গেই ঘোমটা দিয়ে মুখ ঢেকে দাঁড়াল পেট্রা। শুদ্ধ গাড়ি থেকে নামল। সবচেয়ে অবাক কাণ্ড, প্রিয়ও নামল। প্রিয়র পরনে কালো স্যুট। শুদ্ধকে কিছু একটা বলে স্কুলের দিকে পাঠিয়ে দিল। শুদ্ধ হেঁটে হেঁটে স্কুলের গেটে গিয়ে বাবাকে হাত তুলে টা টা দিল, প্রিয়ও হেসে বিদায় জানাল। তারপর ভেতরে ঢুকল শুদ্ধ। কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে রইল প্রিয়। তারপর গাড়িতে উঠে চলে গেল। পেট্রা অদূরে দাঁড়িয়ে সবটা দেখল। প্রিয়কে দেখতে পেয়ে কখন যেন চোখদুটো ভিজে উঠল তার। সব সময় তো নিকিতাই শুদ্ধকে স্কুলে নিয়ে আসে, আজ হঠাৎ প্রিয়? এটা কি তবে ওর ভাগ্য? এ কেমন ভাগ্য? সৌভাগ্য নাকি দুর্ভাগ্য?

.

প্রিয়র সঙ্গে পেট্রার শেষ দেখা হয়েছিল তার গত বছরের জন্মদিনে। প্রিয় এসেছিল। তখন অফিশিয়ালি তাদের কোনো সম্পর্ক ছিল না ঠিকই কিন্তু কেউই যেন কারও ভেতর থেকে বের হতে পারছিল না। বারো বছরের একটা সম্পর্ক ছিন্ন করা কোনো মামুলি কাজ নয়।

সেদিন পেট্রা অফিসের জন্য বের হতেই দেখতে পেয়েছিল প্রিয় একটা গোলাপের বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দূর থেকে একে অন্যকে দেখে হেসেছিল। সেদিনও তাদের ছয়-সাত মাস পর দেখা হয়েছিল। পেট্রা সামনে যেতেই প্রিয় বুকেটা দিয়ে বলেছিল, ‘হ্যাপি বার্থডে, শুদ্ধর মা।’

বুকেটা নিয়ে পেট্রা একগাল হাসি দিয়ে বলেছিল, ‘থ্যাংক ইউ, শুদ্ধর বাবা।

প্রিয় বলেছিল, ‘এত সেজেছিস কেন? আবার শাড়িও পরেছিস দেখছি! জানতি আমি আসব। ঠিক বলেছি না?

‘কখনো না! অফিসে যাব বলে বেরিয়েছি। আজকাল প্রায়ই শাড়ি পরে যাই।

‘শোন, পার্ট কম নে, তোকে আমি চিনি।

‘কচু চিনিস, শুদ্ধকে এনেছিস?

‘নাহ, ও তো স্কুলে।

‘একদিন স্কুলে না গেলে কী হতো? আমার ছেলেটা তো অনেক ব্রিলিয়ান্ট। কোনো ক্ষতি হতো না।

পেট্রা মন খারাপ করেছিল। প্রিয় বলেছিল, ‘আচ্ছা সরি, ভুল হয়েছে আমার, এখন চল, গাড়িতে ওঠ।

‘কোথায় যাব?’

‘যেদিকে দুচোখ যায়।

‘না, আমার অফিস আছে।

‘শালি আজ তোর অফিস নেই আমি তোকে বলেছি না!

‘নেই মানে? আমি ছুটি নিই নি।

‘এখন নিয়ে নে।’

‘কতক্ষণ থাকৰি তুই?

‘জানি না, প্রয়োজনে সারা দিন থাকব।

পেট্রা ফোন করে ছুটি নিয়ে চলে গিয়েছিল প্রিয়র সঙ্গে। প্রিয় সত্যি উদ্দেশ্যহীনভাবে যেদিকে দুচোখ যায়, গাড়ি চালাচ্ছিল। পেট্রা বলছিল, ‘প্রিয়, এখন আমাদের এভাবে দেখা করাটা পাপ।

প্রিয় পেট্রার দিকে না তাকিয়েই ড্রাইভ করতে করতে বলছিল, ‘হুম, জগতের সবকিছুই পাপ। অন্তত, আমি যা যা করতে চাইব, তা তো পাপ হবেই।’

পেট্রা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল প্রিয়র দিকে। তারপর বলেছিল, ‘কেমন আছিস?

‘যেমন থাকা যায়। তুই কেমন আছিস?

‘তুই যেমন আছিস, তেমনই।’

‘কাজটাজ কেমন চলছে?

‘ভালো।

‘অনেক দিন পর তোক দেখছি, পেট্রা।

‘শুদ্ধকে দেখতে ইচ্ছা করছে খুব। কেন আনলি না?

প্রিয় চুপ। পেট্রা বলেছিল, ‘চল ওকে স্কুল থেকে নিয়ে আসি। আজ সারা দিন নাহয় আমরা একসাথে কাটালাম। একটা দিনই তো। কাটুক না একটু স্বপ্নের মতো।’

প্রিয় একটু সিরিয়াস হয়ে বলেছিল, ‘শুদ্ধকে আমি ইচ্ছা করেই আনি নি। আসতে চাইছিল খুব। বলছিল, আজকে মায়ের বার্থডে, আমি আজকে স্কুলে যাব না; মাকে দেখতে যাব। আমি আনি নি। কারণ, জানিসই তো–যতই তোর কাছে আসবে, ততই ও দুর্বল হয়ে পড়বে। তোকে ছাড়া থাকতে পারবে না আর। কিন্তু ও যে অভিশপ্ত পরিবারে জন্মেছে, ওকে তো শক্ত হতে হবে।

‘আমার ছেলেকে আমার থেকে দূরে রাখার কোনো অধিকার কিন্তু তোর নাই।’

এখানে অধিকারের কথা আসছে কোত্থেকে? যতটা অধিকার আমার, ততটা তো তোরও। তুই ওর মা। কিন্তু তুই ভেবে দেখ পরিস্থিতিটাই তো এমন।’

পেট্রা চুপ করে ছিল। একে তো ছেলেকে আনে নি, তার ওপর আবার বলছে ছেলে আসতে চেয়েছিল। এটা তাকে বলার কি খুব দরকার ছিল? প্রিয় বলেছিল, ‘রাগ করিস না, পেট্রা। এত দিন পর কোনোরকম ঝুঁকির পরোয়া না করে তোর হাসিমুখটা দেখতে এসেছি। তোর পেঁচি মুখটা না।

প্রিয়র এমন রসিকতায় আরও মেজাজ খারাপ হয়ে গিয়েছিল পেট্রার। বলল, ‘তোর আমাকে দেখতে ইচ্ছা করে, আমার ছেলের করে না?

‘আমি তো আবার নিজেকে সামলে নিতে পারব। তোর ছেলে তো পারবে না। এখানে তোর সামনে খুব হাসিখুশি থাকবে, তারপর বাসায় গিয়েই ভ্যা ভ্যা করে কাঁদবে। তখন কে সামলাবে?

‘তুই সামলাবি, ওর নতুন মা সামলাবে।

‘ওকে শুদ্ধ মা ডাকে না। আন্টি ডাকে।

পেট্রার আর কোনো কথাই বলতে ইচ্ছা করছিল না। প্রিয় একটা বক্স বের করে বলল, ‘তোর জন্য কেক বানিয়ে এনেছি। তুই আমাকে কতবার নিজ হাতে বানানো ক্রিসমাসের কেক খাইয়েছিস, আমি তো জীবনেও বানাই নি।

পেট্রার রাগ কমছিল না। সে শুধু ভাবছিল শুদ্ধর কথা। প্রিয় এবার বক্সের ঢাকনা খুলে দিয়ে বলল, ‘চামচ আনতে ভুলে গেছি, হাত দিয়েই খা।

‘আমি খাব না।’

‘শুদ্ধ বড় হোক, ম্যাচিওরিটি আসুক। তারপর যত ইচ্ছা দেখা করিস, কখনো বাধা দেব না। কেকটা খা প্লিজ, নিজে বানিয়েছি।’

‘আমি খাব না।’

প্রিয় দুষ্টুমি করে বলল, ঠিকাছে, তাহলে নিকিতাকেই নাহয় খাওয়াব। ভাগ্যিস, কেকের ওপর হ্যাপি বার্থডে বা তোর নামটাম লিখি নি।

যদিও পেট্রা জানে এটা দুষ্টুমি তবু রাগ হলো। যাও খাবে ভেবেছিল, এবার বলল, ‘হুম, বউ থাকতে অন্য মেয়ের জন্য এসব করতে নেই প্রিয়। তোর বানানো কেক তোর বউই ডিজার্ভ করে।

‘বাদ দে। এই নে, তোর জন্য অনেক খুঁজে এনেছি এটা।

এ কথা বলে প্রিয় একটা গিফট বক্স এগিয়ে দিল। কালো রঙের বক্স লাল রিবন দিয়ে বাঁধা। পেট্রা বলল, ‘এটাও নিকিতাকে দিয়ে দিস, খুশি হবে।

‘আচ্ছা বাবা, সরি। ওর কথা বলাটা আমার ভুল হয়েছে। আমি দুষ্টুমি করছিলাম, তুই যে বুঝবি না, আমি সেটা বুঝি নি।

পেট্রার কান্না পাচ্ছিল। বারবার শুদ্ধর মুখটা চোখের সামনে ভাসছিল। প্রিয়র কোনো কথাকে গুরুত্ব দেওয়ার মতো মনের অবস্থা তার তখন ছিল না। কান্নাটা প্রিয়কে দেখাতে চায় নি সে, তাই বলেছিল, ‘প্রিয়, আমি বাসায় ফিরে যাব, আমার কিছু ভালো লাগছে না।

এ কথা বলে গাড়ি থেকে নামছিল পেট্রা। প্রিয় হাত ধরে ফেলল। বলল, ‘পেট্রা, থাম থাম। সরি ফর এভিরিথিং, শুধু আজকের দিনটা আমাকে দে। অনেক প্ল্যান ছিল আমার।’

পেট্রা কেঁদেই ফেলল। কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, আমি আজকে তোর সাথে আমার ছেলেকেও এক্সপেক্ট করেছিলাম, প্রিয়।

প্রিয় অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। পেট্রা অপেক্ষা করছিল প্রিয় হয়তো বলবে চল শুদ্ধকে স্কুল থেকে নিয়ে আসি। কিন্তু প্রিয় বলে নি। পেট্রার হাতটা ধরে চুপ করে বসে ছিল। পেট্রা হাত ছাড়িয়ে গাড়ি থেকে নেমেই বাসায় ফিরে গিয়েছিল। একবারও পিছনে ফিরে তাকায় নি।

.

সেই ছিল শেষ দেখা, তারপর কথা হলেও দেখা আর হয় নি। আজ এভাবে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে দেখতে পেয়ে বুকের ভেতরটা দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে। প্রিয় আগের চেয়ে আরও হ্যান্ডসাম হয়েছে। পেট্রা দিনকে দিন অযত্নে বুড়ি হচ্ছে, আর সে দিনকে দিন হ্যান্ডসাম হচ্ছে!

হোক, তাতে তার কী? কাউকে দরকার নেই তার এ জীবনের পথচলায়। চোখে জমে থাকা জলটুকু এবার গড়িয়ে পড়ল।

পেট্রা চোখ মুছতে মুছতে ফুটপাত ধরে বাসস্ট্যান্ডের দিকে হাঁটতে শুরু করল। সিক্স প্যাক বুঝি এত দিনে প্রিয়র হয়েই গেছে। হলেই-বা কী! ওর তো আর দেখার সৌভাগ্য হবে না! সমস্যা কি এই ছেলেটার? সে কি দুনিয়ার সব মেয়েদের হার্টথ্রব হতে চায়?

হঠাৎ কোত্থেকে স্মরণ দৌড়ে এল।

‘আরে পেট্রা, তুমি এখানে!

পেট্রা নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, এই তো, অফিসে যাচ্ছি।’

স্মরণ অবাক হয়ে বলল, ‘কাঁদছ কেন তুমি?

‘কই, না তো।

‘তোমার চোখ দেখেই তো বুঝতে পারছি। কী হয়েছে, বলো না আমাকে?’

‘কিছু হয় নি। তুমি এখানে কী করছ?

‘আমি এই রোড দিয়েই তো অফিসে যাই। গাড়ি থেকে দেখলাম তুমি কাঁদতে কাঁদতে হাঁটছ। তাই নেমে এলাম।’

ও।

‘চলো একসাথে যাই।’

গাড়িতে বসে স্মরণ জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি তো এদিকে থাকো না। তো এখানে কেন?

পেট্রা চুপ করে রইল। স্মরণ বলল, আচ্ছা, বলতে না চাইলে ঠিকাছে।

পেট্রা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, আমি এই স্কুলটাতে এসেছিলাম।

‘ও। তোমার কেউ পড়ে এখানে? নাকি অন্য কোনো কাজে এসেছিলে?

‘আমার ছেলে পড়ে এখানে। ওকে দেখতে এসেছিলাম।’

স্মরণ অবাক! কোনো রকমে বলল, তোমার ছেলে মানে? কেমন ছেলে?

‘আমার নিজের ছেলে।

‘আমার মাথায় কিছু ঢুকছে না। তুমি না সিঙ্গেল? তোমার না বিয়ের জন্য পাত্র দেখা হচ্ছে?

‘হ্যাঁ, সিঙ্গেলদের কি বাচ্চা থাকতে পারে না?

‘তা পারে। কিন্তু কাঁদছ কেন?

‘ছেলেকে অনেক দিন পর দেখলাম। একটু আদর করতে পারি নি, কোলেও নিতে পারি নি। তাই কান্না পাচ্ছে।

মানে তোমার ছেলে তোমার কাছে থাকে না?

‘নাহ, বাবার কাছে থাকে।

‘ও। আদর করতে পারো নি কেন?

‘ওর বাবা নিয়ে এসেছিল।

‘তো?’

পেট্রা স্মরণের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তুমি বুঝবে না।’

‘কান্নার দ্বৈত কারণের একটি ছেলের বাবা নয়তো?

পেট্রা তাকাল স্মরণের দিকে। স্মরণ মিটিমিটি হাসছে। পেট্রা কিছু বলল না।

.

একই সময়ে প্রিয় অফিসের উদ্দেশে গাড়ি চালাতে চালাতে ভাবছিল, আজ এত অস্থির লাগছে কেন? পেট্রাকে খুব দেখতে ইচ্ছা করছে। আজই কেন এমন বেপরোয়াভাবে ইচ্ছাটা হচ্ছে? আজ তো কোনো বিশেষ দিনও না। পেট্রাও কি তবে আজ তার কথাই ভাবছে? পাশাপাশি টেলিপ্যাথিক্যালি ওকেও ভাবাচ্ছে?

.

স্মরণ টিস্যু এগিয়ে দিল। পেট্রা টিস্যুতে চোখ মুছল। স্মরণ বলল, ‘তোমার সম্পর্কে কি আর কিছু জানা বাকি আছে আমার? দুদিন পরপর একেকটা জানছি আর ধাক্কা খাচ্ছি।’

‘অনেক কিছু জানা বাকি আছে। কিন্তু এখনো ধাক্কা কেন খাচ্ছ? আমার সাথে তো আর তোমার কিছু হবে না।’

‘হবে না জানি, কিন্তু তাই বলে কি ফিলিংসটা চলে যাবে? মনের ভেতর তো আর ডিলিট বাটন নেই যে ফিলিংসটা ডিলিট করে দেব।

‘যত তাড়াতাড়ি পারো এই ফিলিংস থেকে বের হয়ে এসো।

‘চেষ্টা করছি।’

কিছুক্ষণ দুজনেই চুপচাপ রইল। স্মরণই আবার কথা বলা শুরু করল, ‘তোমার ছেলের বয়স কত?

‘সাত বছর।

‘বাপ রে! তোমার বয়স কত?

‘ত্রিশ।’

স্মরণ মুখ কাঁচুমাচু করে বলল, আমার আটাশ।

পেট্রা হেসে দিল। কিন্তু তখনো তার জলটলমল চোখ। পেট্রার মুখে হাসি দেখে স্মরণের ভালো লাগল। তারপর নিজেও হেসে বলল, ‘আমি সব সময় আমার থেকে বড়দের প্রেমে পড়ি। জানি না কেন।

পেট্রা কিছু বলল না। স্মরণ বলল, ‘আচ্ছা, তোমার ছেলে তোমার কাছে থাকে না কেন?

কিছু সত্য দুনিয়ার কাউকে বলা যায় না, তাই পেট্রা বলল, ‘আগে আমার কাছেই ছিল। এখন আমি ইচ্ছা করেই ওর বাবার কাছে রেখেছি। বাবার কাছে আছে বলেই এমন স্কুলে পড়তে পারছে। ভালো একটা লাইফ লিড করতে পারছে। আমার কাছে থাকলে তো সাধারণ কোনো বাংলা মিডিয়াম স্কুলে পড়াতে হতো। আসলে আমার ফ্যামিলিতে একমাত্র আর্নিং মেম্বার আমি। বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে সংসার, মা ও ছোট ভাইবোনদের দায়িত্ব আমার ওপরেই।

‘কিন্তু তাতে কী, বাংলা মিডিয়াম খারাপ কিসে?

‘আমি বলি নি বাংলা মিডিয়াম খারাপ। ভালো স্কুলের কথা বলেছি। আমার ছেলে ক্লাস টুতে পড়ে। সাধারণ একটা বাংলা মিডিয়ামের ক্লাস ফাইভের স্টুডেন্ট থেকেও বেশি জানে, সব বিষয়েই। সম্ভবত তুমি বুঝবে পার্থক্যটা।’

‘তা ঠিক।

‘আমি সব সময় চাই আমার বাচ্চা ভালো থাকুক, ভবিষ্যতটা খুব সুন্দর হোক ওর।

‘মায়েরা সন্তানের সুখের কথা ভেবে কত স্যাক্রিফাইসিং হয়!’ স্মরণ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘তোমাদের ছাড়াছাড়ি হলো কেন?

পেট্রা হেসে বলল, ‘এত কিছু জেনে কী করবে?

‘না, মানে…যদি তোমার কোনো আপত্তি না থাকে, তাহলে জানতে চাই। তোমার চোখে আমি আজ গভীর এক ভালোবাসার কান্না দেখলাম। এত ভালোবাসো যে মানুষটাকে, কেন তুমি তার থেকে দূরে, সেটা জানতে খুব ইচ্ছা করছে।’

‘কারণ ও মুসলিম।

স্মরণ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘মানে? তাহলে বাচ্চা হলো কীভাবে?’

বাচ্চা যেভাবে হয়, সেভাবেই হয়েছে। স্মরণ লজ্জা পেয়ে বলল, ‘না মানে, আমি জানতে চাচ্ছিলাম ধৰ্মই যদি বাধা হয়, তাহলে তোমরা এক হয়েছিলে কী করে? আর এক হয়েছিলেই যখন, তখন আলাদা হলে কী করে?

‘অফিসে নতুন প্রজেক্টের অনেক জরুরি কাজ আছে, তুমি তো জানো। তাড়াতাড়ি চালাও, অফিস টাইম হয়ে এসেছে।’

নিকিতা আজ শাড়ি পরেছে। শাড়িটা আজই শ্বশুর তাকে দিয়েছেন। হালকা সাজগোজ করেছে। নিজের কাছেই নিজেকে সুন্দর লাগছে। কিন্তু লাভ কী? একজন তো ফিরেও তাকাবে না। শুদ্ধ বলল, ‘নিকিতা আন্টি, তুমি কোথাও যাচ্ছ?

‘না তো বাবা। কোথায় যাব?

‘ও। সুন্দর দেখে একটা শাড়ি পরেছ তো, তাই আমি ভেবেছি বাইরে যাচ্ছ।’

নিকিতা শুদ্ধকে কাছে টেনে নিয়ে বলল, ‘কেমন লাগছে আমাকে, বলো তো?

‘খুব সুন্দর। তুমি এত সুন্দর যে আমার শুধু দেখতে ইচ্ছা করে।’

নিকিতা শুদ্ধর কপালে চুমু খেয়ে বলল, ‘বাবা আমার! যত ইচ্ছা দেখবে।’

এমন সময় প্রিয় ঘরে ঢুকল। নিকিতাকে দেখে বলল, ‘কোথাও যাচ্ছ নাকি?

নিকিতা বলল, ‘না।”

ততক্ষণে শুদ্ধ দৌড়ে গেছে ওর বাবার কাছে। প্রিয় শুদ্ধকে কোলে নিয়ে আদর করল। শুদ্ধ বলল, ‘বাবা, শুধু তুমিই আছ যে আমাকে এখনো কোলে নিতে পারে, আর কেউ পারে না।’

‘আমি তো তোকে আজীবন কোলে নিতে পারব, বাবা।

‘আর যখন আমি বড় হয়ে যাব, তখন তো তুমি বুড়ো হয়ে যাবে। তখন আমি তোমাকে কোলে নিতে পারব।’

প্রিয় হেসে বলল, আচ্ছা, ঠিকাছে, নিস।

প্রিয় শুদ্ধকে নামিয়ে স্যুট খুলল, টাই খুলল। শার্টের বোতাম খোলার আগেই নিকিতা বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। সে দেখতে চায় না প্রিয়র বুকের ওই দুর্বিষহ ট্যাটুটা।

প্রিয় শার্টটা খুলতেই শুদ্ধ প্রিয়র কাছে গিয়ে প্রিয়র বুকের বাঁ পাশে আঁকানো ‘পেট্রা লেখা ট্যাটুটা ছুঁয়ে বলল, আমার মা।

প্রিয় হেসে বলল, ‘আমার বউ।’

‘না, আগে আমার মা।

প্রিয় আরও হেসে বলল, আগে আমার বউ বেক্কল।

‘বউ বেক্কল কী বাবা?

প্রিয় হা হা করে হাসতে লাগল। তারপর বলল, ‘বেক্কল তো তোকে বলেছি।

‘বেক্কল মানে কী, বাবা?

‘বেক্কল মানে বোকা।’

‘বাবা, তুমি আমাকে বোকা বললে? আমি ক্লাসে ফার্স্ট হই।

‘বড় হলে বুঝবি কেন বলেছি।’

‘আচ্ছা বাবা, তুমি বলেছিলে এই ট্যাটুটা পারমানেন্ট। তার মানে কি জীবনে কোনো দিনও এটা মুছে যাবে না?

‘উঁহু।

‘তাহলে আমিও এমন একটা ট্যাটু করব।’

‘গার্লফ্রেন্ড হয়েছে নাকি তোর? শুদ্ধ রাগ করে প্রতিবাদ জানাল, ‘বাবা!

‘আচ্ছা সরি। তো কার নাম লেখাবি? তুইও কি পেট্রার নাম লেখাবি?

‘হ্যাঁ। একদম সেম সেম।

‘অনেক ব্যথা কিন্তু। ট্যাটু একধরনের পেন দিয়ে করে। ওই পেনের মাথায় অসংখ্য সুচ থাকে।

‘সুচ কী, বাবা?

‘আই মিন নিড়ল।

‘আল্লাহ! তাহলে অনেক খোঁচা লাগবে, ইনজেকশনের মতো।

‘সেটাই তো৷ ইনজেকশনকে তো যমের মতো ভয় পাস। আর ট্যাটু করাতে চাস?

‘তুমি ব্যথা পাও নি, বাবা?

‘পেয়েছি, তাতে কী? অনেক ভালোবাসি তো তোর মাকে।

‘আমিও ট্যাটু করাব, বাবা। আমিও মাকে অনেক ভালোবাসি। আমি ব্যথাকে ভয় করি না।’

প্রিয় হেসে বলল, আচ্ছা করিস, কিন্তু এখন না। যখন এইটিন হবি, তখন করিস।

‘আরও ইলেভেন ইয়ারস! তত দিনে তো আমি মরেই যাব।’

প্রিয়র মনে পড়ে গেল পেট্রার কথা। কোনো কিছুর সময় পিছিয়ে দিলেই পেট্রা অধৈর্য হয়ে বলত, তত দিনে তো আমি মরেই যাব। কথা বলতে শেখার সময়টা মায়ের সঙ্গে থেকে ছেলেটা মায়ের মতো কথা শিখেছে। প্রিয় শুদ্ধকে জড়িয়ে ধরে বলল, এইটিনের আগে ট্যাটু করতে পারমিশন দিলে তোর মা আমাকে অনেক বকবে, বাবা। খুব রাগ হয়ে যাবে।

‘সত্যি?

‘হুম, ট্যাটু তো বড়দের জিনিস।

‘আচ্ছা বাবা, তাহলে এইটিন যেদিন হব, সেদিনই এই সেম ট্যাটু করাব।’

প্রিয় শুদ্ধর কপালে চুমু দিয়ে বলল, ‘ওকে, ডান।

প্রিয় চেঞ্জ করে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় শুয়ে রইল। আজ কিছুই ভালো লাগছে না। শুদ্ধ পাশেই বসে হোমওয়ার্ক করছে। নিকিতা নাশতা নিয়ে ঘরে ঢুকল। বলল, ‘ঘুমিয়ে পড়লে? নাশতা এনেছিলাম।

প্রিয় উঠে বলল, ‘না, ঘুমাই নি। এসব খাব না, চা খাওয়াও তো একটু।’

‘আমি এক্ষুনি আনছি।’

কিছুক্ষণ পরই চা নিয়ে এল নিকিতা। প্রিয় চা খেতে শুরু করল, নিকিতা শুদ্ধর হোমওয়ার্ক কত দূর হলো দেখতে বসল। শুদ্ধ হঠাৎ বলল, ‘বাবা, দেখো নিকিতা আন্টিকে আজ কত সুন্দর লাগছে, চলো না আজ আমরা বাইরে খেতে যাই।

প্রিয় অবাক হয়ে তাকাল শুদ্ধ ও নিকিতার দিকে। নিকিতাও বেশ অবাক হলো। প্রিয় বলল, ‘আজ? আজ কি কোনো বিশেষ দিন?

‘হ্যাঁ বাবা, আজ তো তোমার জিম নেই। তাই আমরা এই সুযোগে বাইরে খেতে যাব।’

প্রিয় হাসতে হাসতে বলল, আজ জিম নেই বলে আজ বিশেষ দিন! পাকনা ছেলে কোথাকার!

‘যাবে না, বাবা?

‘আচ্ছা যাব, হোমওয়ার্ক শেষ কর তাড়াতাড়ি।

.

বাইরে খেতে যাওয়ার সময় প্রিয় ড্রাইভ করছিল। শুদ্ধ যথারীতি প্রিয়র পাশের সিটেই বসল, আর নিকিতা পেছনে একা চোখ বন্ধ করে ঝিমুচ্ছিল।

নিকিতা পড়াশোনায় খুব একটা ভালো ছিল না। মধ্যবিত্ত পরিবারের চার বোনের মধ্যে সবার বড় সে। তাই মা-বাবা তাড়াতাড়ি ভালো দেখে একটা বিয়ে দিতে চেয়েছিল। এইচএসসি পরীক্ষার পরই বিয়ে দিয়ে দিল। প্রিয়র বাবা ভার্সিটিতে ভর্তি করাতে চেয়েছিলেন কিন্তু নিকিতাই আগ্রহ দেখায় নি। এ জগতের কোনো কিছুর প্রতিই তার আর কোনো আগ্রহ নেই। এর চেয়ে যদি কম পয়সাওয়ালা একজনের সঙ্গে বিয়ে হতো আর সে ভালোবাসত, সে জীবনও সুখের হতো!

বিয়ের পরের দিনও প্রিয় অফিসে গিয়েছিল। নিকিতাও কাউকে কিছু না জানিয়ে বাসায় ফিরে গিয়ে মা-বাবার সঙ্গে চেঁচামেচি করেছিল। কিন্তু কোনো লাভ হয় নি। মা-বাবা আবার বুঝিয়ে-সুঝিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। মায়ের বক্তব্য ছিল, ‘যা হয়ে গেছে, মেনে নে, মা। জামাইয়ের সাথে থাক, একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে।’

নিকিতা রেগেমেগে বলেছিল, এমন মানুষের সাথে আমি থাকতে পারব না।’

‘তাহলে কী করবি? এখন যদি তুই চলে আসিস, আমি তোকে আবার বিয়ে দেব কীভাবে? একবার বিয়ে করা মেয়েকে কে বিয়ে করবে?

‘বিয়ে হয়েছে তো কী হয়েছে? উনি আমার সাথে কিছু করেন নি।

‘এটা কি কাউকে বোঝাতে পারব? তা ছাড়া কত টাকাপয়সা খরচ করে বিয়ে দিলাম, সব জলে যাবে?

নিকিতা অবাক হয়ে বলেছিল, ‘টাকা জলে যাবে ভাবছ আর এদিকে তোমার মেয়ের জীবনটা যে জলে গেল, এটা কিছু না?

‘জলে যাবে কেন? মাটি কামড়ে পড়ে থাক। শ্বশুরের মন জয় কর। জামাই বাবার সব কথা শোনে। একদিন জামাইয়ের মনও পাবি।’

‘আমি কি এখন তোমাদের কাছে বোঝা হয়ে গেছি, মা?’

‘বোঝা না রে মা। কিন্তু তোর ছোট বোনদের কথা একবার ভাব। তোর বোনদেরও তো বিয়ে দিতে হবে। তুই এখন এ বাড়িতে এসে উঠে থাকলে ওদের বিয়ে দেব কীভাবে? লোকে বদনাম করবে তোর।

‘আশ্চর্য তো! আমার স্বামীকে জোর করে বিয়ে দিয়েছে, সে আমার সাথে থাকতে চায় না। আমি চলে এসেছি, ব্যস। এখানে আমার কেন বদনাম হবে?’

‘সমাজের লোক এত কিছু বোঝে না, মা।

‘গোল্লায় যাক তোমাদের সমাজ। আই ডোন্ট কেয়ার।

‘মেয়েমানুষের এত রাগ থাকলে হয় না মা। একটু সহ্য করে থাক, সব ঠিক হয়ে যাবে।’

এ রকমই আরও অনেক কিছু সেদিন নিকিতাকে বুঝিয়েছিলেন তার মা। সেসব কথা বুঝতে পেরে নয়, মা-বাবার ওপর রাগ করেই ফিরে এসেছিল শ্বশুরবাড়িতে ফিরতেই শ্বশুর ডেকে পাঠিয়েছিলেন। নিকিতা যেতেই বাবর খান বললেন, কোথায় গিয়েছিলে, মা?

‘আমি একটু বিউটি পার্লারে গিয়েছিলাম বাবা।

‘ও আচ্ছা। তা বলে যাবে তো, মা। খুব টেনশন করছিলাম।’

নিকিতা উপায় না দেখে মিথ্যা বলল, বলে গিয়েছিলাম তো, বাবা।’

‘কাকে বলে গিয়েছিলে?

‘আন্টিমতোন একজন। এত মানুষজন, আমি তো তেমন কাউকেই চিনি না।’

‘আচ্ছা ঠিকাছে। এরপর থেকে কোথাও গেলে আমাকেই বলে যেয়ো, মা। যখন যেখানে ইচ্ছা যেয়ো কিন্তু বলে যাবে।

‘জি আচ্ছা।’

নিকিতা জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একটু থেমে বাবর খান জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেমন লাগছে এখানে তোমার?

‘ভালো।

‘পুরো বাড়িটা ঘুরে দেখেছ?

না।

‘দেখো, ভালো লাগবে। ছাদেও যেয়ো। ছাদটা খুব সুন্দর। অনেক গাছ আছে, দোলনা আছে, বেশকিছু পাখিও আছে।’

‘জি যাব।’

‘তোমার হয়তো এখানে একটু বোরিং লাগবে। বউভাতের পর তো সবাই চলে যাবে। আমি, শুদ্ধ, প্রিয় আর কাজের লোকেরা ছাড়া এ বাড়িতে আর কেউ থাকে না।

নিকিতা চুপ। বাবর খান জিজ্ঞেস করলেন, ‘পছন্দ হয়েছে তো আমার ছেলেকে?’

নিকিতা সামান্য হাসল, কিছু বলল না। কীই-বা বলার থাকতে পারে ওনাকে? উনিই আবার বললেন, ‘তোমাদের দুজনের তো বিয়ের আগে দেখা হয় নি, আন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়েছে তো, মা?’

নিকিতা সাহস করে বলে ফেলল, কী করে হবে? আপনার ছেলের তো এই বিয়েতে মত ছিল না। জোর করে বিয়ে দিয়ে আপনি সর্বনাশ ডেকে এনেছেন। আমার জীবনটাই নষ্ট হয়ে গেল।

বাবর খান ভাবতে পারেন নি নিকিতা এমন করে সরাসরি এসব কথা বলবে। তিনি বললেন, ‘দেখো মা, সন্তানের জন্য যেটা ভালো, আমরা বাবা-মায়েরা তা-ই করি সব সময়। অনেক সময় সন্তানেরা তা বুঝতে পারে না। তুমি ছোট মানুষ, হয়তো বুঝতে পারছ না। কিন্তু মা, আমার ছেলে একদিন তোমাকে খুব ভালোবাসবে দেখো।’

‘আপনার ছেলে এখনো শুদ্ধর মাকে ভালোবাসে। সে আমাকে কখনোই ভালোবাসতে পারবে না।’

‘পারবে মা, পারবে, তুমি শুধু একটু ধৈর্য ধরে থাকবে।

নিকিতা ঠান্ডা মাথায় নিচু গলায় বলল, আপনারা বলেছিলেন শুদ্ধর মা বেঁচে নেই। এই মিথ্যেটা বলা উচিত হয় নি। কোনো এক মেয়েকে আমি সাজিয়ে ওনার সাথে কথা বলিয়েছেন, এটাও ঠিক হয় নি। উনি রাজি না, এ কথা জানলে আমি বিয়ে করতাম না। প্রত্যেকটা মেয়েই চায় তার স্বামী তাকে ভালোবাসবে। আমি প্রেম করে বিয়ে করি নি। মা-বাবার ইচ্ছা অনুযায়ী বিয়ে করেছি, তাহলে আমাকে কেন ভুগতে হবে? বিয়ের রাতেই কেন স্বামীর দুর্ব্যবহার সহ্য করতে হবে, বলতে পারেন, বাবা? এখানে আমার কী অপরাধ?

সদ্য বিয়ে হয়ে আসা পুত্রবধূর মুখে এ ধরনের কঠিন কথা বাবর খান আশা করেন নি। তিনি মনে মনে নিজেকে কিছুটা প্রস্তুত করে নিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ, এর কোনোটাই আমাদের উচিত হয় নি, মা। তোমার সাথে আমরা অন্যায়ই করেছি। কিন্তু আমার ছেলেকে বিপথ থেকে ফিরিয়ে আনার জন্যই এই অন্যায় করতে হয়েছে। প্রিয় আমার অমতে ওই মেয়েটাকে বিয়ে করেছিল। যে-কোনো একটা মেয়েকে বিয়ে করত, আমরা মেনে নিতাম। কিন্তু মেয়েটা খ্রিষ্টান। একটা খ্রিষ্টান মেয়ের সাথে কীভাবে সংসার করি, বলো মা?’।

নিকিতা এ কথায় প্রচণ্ড অবাক হয়েছিল! শ্বশুর বললেন, ‘আমরা বলেছিলাম, মেয়ে যদি মুসলমান হয়ে যায়, তাহলে বিয়েতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু মেয়ের বাবার এত বড় সাহস, আমার ছেলেকে বলে খ্রিষ্টান হতে! যদিও প্রিয় রাজি হয় নি খ্রিষ্টান হতে আর ওই মেয়েও রাজি হয় নি মুসলমান হতে। কিন্তু দুই পরিবার রাজি না হওয়ায় ওরা নিজেরাই বিয়ে করে ফেলেছিল। যে যার ধর্ম পালন করত। এমনটা আমরা মেনে নিতে পারছিলাম না, মা। একই ঘরে স্বামী-স্ত্রী দুই ধর্ম পালন করবে! নাউজুবিল্লাহ। ওদের তো বিয়েই বৈধ হয় নি। বছরের পর বছর আমরা ছেলেকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি, আর ওরা আমাদের বোঝানোর চেষ্টা করেছে। বহু ঘটনা ও দুর্ঘটনার পরে ওদের ডিভোর্স করাতে সক্ষম হয়েছি। তারপর তো প্রিয়কে কোনোভাবে আবার বিয়েতে রাজি করাতে পারছিলাম না। আমার ছেলেটা এই বয়স থেকে সারা জীবন একা থাকবে, তা কি আমি বাবা হয়ে দেখতে পারি, বলো? তার ওপর ডিভোর্সের পরেও ওই মেয়ের ভূত মাথা থেকে নামছিল না ওর। একসময় অনেক কষ্টে রাজি করাতে পারলাম। কিন্তু এত মেয়ে দেখলাম অথচ সব বিয়ে শেষ পর্যন্ত ভেঙে যেত। পরে বুঝলাম, প্রিয় নিজেই বিয়ে ভাঙছে। তাই এবার আর তোমার সাথে কথা বলতে দিই নি।

নিকিতা চুপ করে ছিল। কী বলবে বুঝতে পারছিল না। বাবার বয়সী একজন মানুষের মুখে এসব কথা শুনে কেন যেন ভীষণ মায়াও লাগছিল। উনি আবার বললেন, ‘আমাকে শ্বশুর ভাববে না। ভাববে আমি তোমার বাবা। তোমার যখন যা লাগবে, আমাকে বলবে। আমি সব ব্যবস্থা করে দেব। আমি তোমাকে বুঝিয়ে দেব কীভাবে কী করলে তুমি প্রিয়র মন পাবে। ওর সব দুর্বলতা আমি তোমাকে বলব। তুমি শুধু আমাদের ছেড়ে চলে যেয়ো না, মা। আমার ছেলে তোমাকে তাড়াতে চাইবে। সে আমাদের এটা বোঝাতে চায় যে সে অন্য কোনো মেয়ের সাথে সুখী হবে না। তার নিজের ধারণাও এটা। তার এই ভুল ধারণাটা ভেঙে দিতে পারবে না, মা?

মায়ায় পড়ে গিয়েছিল নিকিতা। কিন্তু কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না। প্রচণ্ড রাগ হচ্ছিল সবার ওপর। নিজের ঘরে গিয়ে বসে ছিল। ফ্রেমে রাখা প্রিয়র ছবি দেখছিল। ছেলেটাকে দেখে যতটা লোভ হচ্ছিল, ততটাই বিরক্তি লাগছিল। সে কেন পড়ে থাকবে এই ছেলেটার মনে ভালোবাসা জাগানোর জন্য? সে তো ছেলেটাকে ভালোবাসে না!

রাতে এসে প্রিয় নিকিতাকে বাসায় দেখে বলল, তুমি এখনো যাও নি? গতকাল তো বলেছিলে যে আজ চলে যাবে!

‘গিয়েছিলাম, আমার বাপ-মা আমাকে রাখবে না। রাখলে নাকি আমার ছোট বোনদের বিয়ে দিতে পারবে না।’

প্রিয় আলমারি খুলে বাসায় পরার কাপড় বের করতে করতে বলল, ‘তুমিই তো বাচ্চা মেয়ে। তোমাকে বিয়ে দিয়ে এখন আবার তোমার ছোটগুলোকেও দেবে!

‘হ্যাঁ, আমাদের মতো গরিব ঘরে মেয়েদের খুব তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়।’

‘তাহলে কী করবে?

নিকিতা মাথা নিচু করে বলল, ‘কী আর করব, এখানেই থাকব। কপালে যা আছে, তা-ই হবে। গরিবের মেয়ে হয়ে জন্মালে অনেক জ্বালা।

রাইটিং টেবিলের ওপর রাখা পানির বোতলটা খুলে একঠোক পানি খেয়ে প্রিয় বলল, ‘দেখো, আমার সাথে পেট্রার সম্পর্ক আর কখনো জোড়া লাগার সম্ভাবনা নেই। যদিও আমি চাচ্ছিলাম কিন্তু আলটিমেটলি সেটা সম্ভব নয়। তাই, তুমি চাইলে এ বাড়িতে থাকতেই পারে। কারণ, তুমি গেলে আমার বাপ আরেকটা নিয়ে আসবে। আই মিন আমাকে আবার বিয়ে করানো হবে। কিছু বাধ্যবাধকতার কারণে আমি মন্ত্রীসাহেবের কথা মানতে বাধ্য হই। আর এ বাড়িতে থাকলে তোমার এই ঘরেই থাকতে হবে। কারণ, আমাদের মধ্যে যে স্বাভাবিক সম্পর্ক নেই, সেটা মন্ত্রীসাহেবকে জানতে দেওয়া যাবে না।

মনে মনে ভয় পেয়ে গেল নিকিতা। সে তো ইতিমধ্যে শ্বশুরকে বলে দিয়েছে! যা-ই হোক, সেটা প্রিয়কে জানতে দেওয়া যাবে না। চুপ থাকাই ভালো। পরক্ষণেই খুব অবাক হলো নিকিতা। আরে, সে যে প্রিয়কে ভয় পাচ্ছে! প্রিয়র দৃষ্টি, কথা বলার ধরন–সবকিছু ভীষণ তীক্ষ্ণ! প্রিয় বলল, ‘শুদ্ধর সাথে কখনো খারাপ ব্যবহার করবে না এবং তুমি আমার ব্যক্তিগত কোনো ব্যাপারে নাক গলাবে না। বাকি যা ইচ্ছা, করতে পারো। আর হ্যাঁ, আমি কখনো তোমার গায়ে হাত দেব না। তাই নিশ্চিন্তে এ ঘরে থাকতে পারো।’

নিকিতা হাঁ হয়ে গেল। এত সরাসরি কেউ এসব কথা বলে! প্রিয় তার মুখ দেখেই হয়তো বুঝল। পানির বোতলটা আবার টেবিলে রেখে প্রিয় বলল, কিছু মনে কোরো না। আমি সরাসরি কথা বলতে পছন্দ করি।’

প্রিয় ফ্রেশ হতে বাথরুমে ঢুকে গেল। নিকিতা ওখানেই দাঁড়িয়ে থেকে মনে মনে বলল, তোমার গুমর যদি আমি না ভেঙেছি, আমার নাম নিকিতা না। ভালোবাসিয়ে ছাড়ব তোমাকে!

প্রিয়র ডাকে চোখ খুলল নিকিতা, ‘নিকিতা? ঘুমিয়ে গেলে নাকি?

নাহ, এমনি চোখ বন্ধ করে ছিলাম।

আচ্ছা নামো, রেস্টুরেন্টে চলে এসেছি।

পেট্রা অফিস থেকে ফিরতেই রায়ান এল ঘরে। পেট্রা তাকে দেখে বলল, ‘তুই এ সময় বাসায়? কোচিংয়ে যাস নি?

‘গিয়েছিলাম, ম্যাথ ক্লাস না করে চলে এসেছি।’

পেট্রা চুলটা খোঁপা করে ভাইয়ের সামনে গিয়ে বলল, ‘কেন? কী হয়েছে?

‘সরি দি।

‘কী আকাম করেছিস?

‘সায়েন্টিফিক ক্যালকুলেটরটা হারিয়ে ফেলেছি। ক্যালকুলেটর ছাড়া ক্লাসে গেলে স্যার মারে।

‘কবে হারিয়েছে?

‘সপ্তাহখানেক।

‘এত দিন আগে হারিয়েছিস আর আজকে বলছিস?

‘আমি খুঁজছিলাম, যদি পাই।’

‘এখন ক্যালকুলেটরের দাম কত?

‘তেরো-চৌদ্দ শ-তে পাওয়া যাবে সম্ভবত।’

পেট্রা আলমারি থেকে ১৫০০ টাকা বের করে রায়ানের হাতে দিল। রায়ান বলল, তোর অনেক সমস্যা হয়ে যাবে এই মাসে। তাই না দি?

‘কিছু হবে না। তুই তাড়াতাড়ি ক্যালকুলেটরটা কিনে নিস।’

‘দি আরেকটা কথা।’

‘কী, বল।

‘মাকে বলিস না। আমাকে কেটে ফেলবে।’

পেট্রা ভাইয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, এটা কি আমাকে শিখিয়ে দিতে হবে পাগল?

‘লাভ ইউ দি।’

পেট্রা হাসল। ভাইয়ের গালটা ধরে বলল, ‘লাভ ইউ টু। পরীক্ষার তো বেশি দেরি নেই। রেজাল্টটা ভালো করিস, ভাই। আমি মেডিকেলে পড়তে পারি নি, মা-বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে পারি নি। প্রিয়াঙ্কা তো ধারেকাছেও ছিল না। কিন্তু তোর যোগ্যতা আছে, আমি জানি তুই চেষ্টা করলেই পারবি। এই একটাই চাওয়া তোর কাছে আমার। এই চাওয়াটা পূরণ কর, সব কষ্ট ভুলে যাব।’

‘আমি পারব, দি। তুই দেখিস, আমি পারব।’

পেট্রা তৃপ্তির হাসি হাসল।

রাতে খাওয়ার পর পেট্রা ও রায়ান টিভির সামনে বসল। শিখা বাড়তি খাবারদাবার ফ্রিজে তুলে রাখছিলেন। পেট্রা বলল, ‘মা, ক্রিসমাসের শপিংয়ে যাব কাল সকালে। অন্য কোনো কাজ রেখো না।’

শিখা নিজের কাজ করতে করতেই বললেন, আমার জন্য একটা কফিন কিনিস।’

পেট্রা ও রায়ান চমকে তাকাল। পেট্রা বলল, তুমি কী বলছ এসব?

‘এই বিয়েটাও ভেঙে গেছে। ছেলেপক্ষ খোঁজ নিয়ে শুদ্ধর কথা জানতে পেরেছে। এমনসব কাজ করেছিস, মানুষের কাছে মুখ দেখাতে পারি না। এর চেয়ে মরণ ভালো।

পেট্রা বলল, তুমি গোপন রাখো কেন? আমি তো আগেই বলে দিয়েছি, কোনো বিয়ের কথাবার্তা বললে তুমি আগেই প্রিয়, শুদ্ধর ব্যাপারে সব বলে নেবে।’

‘এসব জেনে কোনো রিকশাওয়ালাও তোকে বিয়ে করবে না। আর খবরদার, ওই বিশ্বাসঘাতক ছেলেটার নাম নিবি না আমার সামনে।

‘মা, প্রিয়র সম্পর্কে এসব কথা বলবে না। ওর পরিস্থিতিটা তুমি বুঝবে না।

‘ওর জন্য অপেক্ষা করে করে সময়মতো বিয়ে করিস নি তুই। এরপর নিজেরা বিয়ে করে কত ইতিহাস তৈরি করলি। এরপর সেই বিয়েও টিকিয়ে রাখতে পারলি না। এদিকে এখন আমি তোক বিয়ে দিতে পারছি না। এখন কোথায় সে? নিজে তো ঠিকই বিয়ে করে সুখের সংসার করছে।”

রায়ান এসব আর শুনতে পারছিল না। তাই উঠে নিজের ঘরে চলে গেল। পেট্রা বলল, ‘তো কী হয়েছে, মা? সে বিয়ে করে সুখী হয়েছে, আমিও বিয়ে করে সুখী হব।’

‘তোকে কেউ বিয়ে করলে তো তুই সুখী হবি। আমাদের দেশে কয়জন খ্রিষ্টান আছে? পাত্রই তো পাই না। যা-ও পাই, একটা না একটা গ্যাঞ্জাম লেগেই যায়। ইশ, কত ভালো ভালো প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছি তোর কথায়। তখন যদি জানতাম পড়াশোনা হলো একটা ছুতা, তুই আসলে ওই হিপোক্র্যাটের জন্য বিয়ে করছিস না, তাহলে বেঁধে বিয়ে দিয়ে দিতাম।’

পেট্রা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। শিখা বললেন, ‘এই ক্রিসমাসে আমার কিছু লাগবে না। শুধু এক শিশি বিষ কিনে দিস। তোকে খাইয়ে মেরে তারপর আমিও খেয়ে মরে যাব। এ ছাড়া নিষ্কৃতি নেই আমার। তোর বাপটা তো মরে বেঁচে গেছে।

নিজের ঘরে বসে এসব কথা শুনে রায়ান আর চোখের জল ধরে রাখতে পারল না। দি খুব শক্ত, সে কাঁদছে না। কিন্তু কষ্টে নিশ্চয়ই বুক ফেটে যাচ্ছে। মা কি এটুকু বুঝতে পারছে না, যা হয়েছে, তাতে দির কোনো দোষ নেই? মা কেন দিকে এসব কথা বলছে? মা কি দির কষ্টটা একটুও বোঝে না?

.

গভীর রাতে বন্ধ দরজার ভেতর কাঁদতে কাঁদতে মাথাব্যথা হয়ে গেল পেট্রার। কী করবে সে? কী করবে? অভিমানে মাথা কাজ করছিল না। মা ইতিমধ্যে অনেকবার তাকে মরার কথা বলেছে। সে মরে গেলে কি সত্যিই মা শান্তি পাবে? কিন্তু সে তো মরার কথা ভাবতেও পারে না। সে মরে গেলে রায়ানের পড়াশোনার কী হবে? সংসার কীভাবে চলবে? আর শুদ্ধ? প্রিয়র বিয়ের দিন শুদ্ধর বলা কথাগুলো আজও কানে বাজে পেট্রার। শুদ্ধ প্রিয়র মোবাইল থেকে কল করেছিল। পেট্রা শুদ্ধর গলা শুনে অবাক হয়ে বলেছিল, ‘শুদ্ধ! বাবা তুই কী করে ফোন করলি? তোর বাবা ফোন করতে দিল?

‘আজকে জুম্মাবার। বাবা তো নামাজ পড়তে গিয়েছে, মা। আর আমি সে জন্য চুরি করে ফোন করতে পেরেছি।’

‘আচ্ছা। কেমন আছে আমার বাবাটা?

‘ভালো না, মা। তোমাকে দেখতে ইচ্ছা করছে।’

পেট্রার চোখের জল সেদিন কোনো বাধা মানে নি। শুদ্ধকে বুঝতে দিচ্ছিল না যদিও। শুদ্ধ বলেছিল, ‘মা, আজকে নাকি বাবার বিয়ে। তুমি কি জানো, মা?

হ্যাঁ, জানি।

‘সত্যিই কি বাবার বিয়ে হয়ে যাবে, মা?

পেট্রার বুকভাঙা কান্নায় কোনো শব্দ ছিল না।

হ্যাঁ।

‘আর বাবার বিয়ে হয়ে গেলে কি বাবা আর আমাদের ভালোবাসবে না?

‘অবশ্যই বাসবে, বাবা।

‘দাদা বলেছে যে আন্টিটা বাবার বউ হয়ে যাবে, তাকে নাকি আমার মা বলে ডাকতে হবে?

পেট্রা কিছু বলতে পারল না। শুদ্ধ বলল, আমি কোনোদিনও আর কাউকে মা বলব না। কোনো আন্টিকেও না, আর কাউকেই। আন্টিই বলব।’

পেট্রা কিছু বলতে পারছিল না। কেবল অবুঝ শিশুটির অভিমানী কথাগুলো শুনে যাচ্ছিল।

‘আমি কদিন ধরে বাবাকে ভালোবাসছি না, মা।

‘কেন বাবা? কেন ভালোবাসছিস না বাবাকে?

‘কারণ, বাবা তোমার সাথে আর দেখা করতে দেবে না বলেছে। বাবা খুব নিষ্ঠুর, বাবা খুব পচা, বাবা খুব খারাপ। আমাদের স্কুলের আইসিটি টিচারের চেয়েও খারাপ বাবা।

‘ছি বাবা, বাবার সম্পর্কে এসব কথা বলতে হয় না। বাবা সবার ভালোর জন্যই এসব করছে। বাবা একটু রাগী, একটু কঠিন, কিন্তু খারাপ না। বাবা পৃথিবীর সেরা মানুষ। বাবা মাকে অনেক ভালোবাসে। কিন্তু আমাদের যে ধর্ম আলাদা, সে জন্য আমরা কখনো একসাথে থাকতে পারব না।’

‘ধর্ম কি খুব ইম্পরট্যান্ট, মা?

‘হা মা, ধর্মের চেয়ে ইম্পরট্যান্ট কিছু নেই।

‘এ জন্যই কি বাবার বিয়ে হচ্ছে?

‘হ্যাঁ।’

‘আমাকে এসব কেউ বলে না কেন, মা? বাবার কেন বিয়ে হচ্ছে, তা আমি দাদাকে অনেকবার জিজ্ঞেস করেছি, আমার তো মা আছে, তাহলে কেন আরেকটা মা আসবে? দাদা বলেছে, আমি ছোট, আমি বুঝব না। কিন্তু এই যে তুমি বললে আমি তো বুঝেছি, মা।’

‘বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলে?

‘না, বাবাকে ভয় পাই। যদি তোমার ছবিও না দেখতে দেয়!

পেট্রা মুখে ওড়না চেপে ধরল। কান্নাটা ছেলেকে শোনাতে পারবে না সে। শুদ্ধ বলল, একটা ভালো কথা আছে, জানো মা?

‘কী ভালো কথা, মা?

‘বাবা আমাকে বলেছে, আমি বড় হলে তোমার সঙ্গে মিট করতে পারব।’

‘আচ্ছা, এটা তো খুব ভালো কথা।

‘তুমি চিন্তা কোরো না, মা, আমি যখন বড় হয়ে যাব, তখন আমি তোমার কাছে যাব। আমি বড় হয়ে গেলেও তোমাকে চিনতে পারব, সত্যিই চিনতে পারব। যদি দূর থেকেও দেখি, আর যদি দাদার মতো আমার মোটা চশমাও লাগে, তবু আমি তোমাকে চিনতেই পারব। আমি তো তোমার ঘ্রাণ শুঁকেই তোমাকে চিনতে পারি! তোমার মনে নেই, প্রিয়াঙ্কা আন্টি সব সময় আমার চোখ বেঁধে দিয়ে তুমি সাজত কিন্তু আমি চিনে ফেলতাম?

‘হ্যাঁ বাবা, আমার সব মনে আছে।

একসময় শুদ্ধও কান্না শুরু করে দিল। হাউমাউ করে কাঁদছিল আর বলছিল, ‘আমি বড় হলেই তোমার কাছে চলে যাব। কেউ আমাকে জোর করতে পারবে না। এখন তো আমি রাস্তা চিনি না, তাই যেতেও পারি না। কিন্তু তুমি দেখো মা, আমি ঠিকই একদিন রাস্তা চিনে চলে যাব। তুমি কিন্তু আমাকে কোলে নিয়ো, বড় হয়ে গিয়েছি, তাই বলে কোলে না নিয়ে থেকো আবার।’

মা-ছেলে সেদিন হাউমাউ করে কেঁদেছিল। পাগলের মতো উল্টোপাল্টা বলছিল। সেদিনের কথা পেট্রা কোনোদিন ভুলবে না। সে কীভাবে মরবে তার ছেলেটাকে রেখে! ছেলেটা তো বড় হয়ে তার কোলে ফিরে আসবে। তত দিন তো অন্তত বেঁচে থাকতে হবে। জীবনে যত কষ্টই আসুক, যত কঠিন সময়ই আসুক, বেঁচে থাকতেই হবে!

.

প্রিয় রেস্টুরেন্টে প্রিয়াঙ্কার জন্য অপেক্ষা করছিল। প্রিয়াঙ্কা এসে বসতেই প্রিয় বলল, ‘এই, তোর কি বাচ্চাকাচ্চা হবে নাকি?

প্রিয়াঙ্কা লজ্জা পেয়ে বলল, ‘জানতাম তোমার মতো ঠোঁটকাটা লোক এ কথা বলবেই। এ জন্য আসতে চাচ্ছিলাম না।

প্রিয় হেসে বলল, ‘আকাশে চাঁদ উঠলে সবাই দেখে, সুইটহার্ট। এত বড় একটা খুশির খবর আমাকে জানালি না কেন?

একেবারে জানাতাম।

‘কয় মাস?’

‘পাঁচ মাস।

‘কগ্রাচুলেশনস।

‘থ্যাংক ইউ, প্রিয়দা। এবার বলো কেন ডেকেছ?

‘সামনে ক্রিসমাস না?

প্রিয়াঙ্কার মনে পড়ে গেল, প্রত্যেক ক্রিসমাসে ঘুম থেকে উঠেই বালিশের পাশে উপহার ও চকলেট পেত। তাদের বিশ্বাস ছিল, ওই উপহার সান্তাক্লজ এসে দিয়ে যেত। কিন্তু বড় হতে হতে বুঝল, উপহারগুলো আসলে বাবা রাখত। তারা তিন ভাইবোন সারা বছর এটার জন্য অপেক্ষা করত। বাবা মারা যাওয়ার পরও তারা এই উপহার পেত। প্রিয় কখনো বাবার অভাবটা বুঝতে দিতে চাইত না। বাপহীন অচল এই তিন ভাইবোনের মাথার ওপর ছায়ার মতো থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করত সে। অথচ জীবনটা কত অদ্ভুত! এখন শুধু পেট্রার ছায়া হয়েও থাকতে পারল না প্রিয়! প্রিয়াঙ্কাকে চুপ হয়ে থাকতে দেখে প্রিয় বলল, কী ভাবছিস এত?

‘কিছু না।

‘রায়ানকে বলেছিলাম এবার একটু সাহায্য করতে।

প্রিয়াঙ্কা চমকে উঠল, সর্বনাশ! প্রিয় এত কিছুর পর পেট্রাকে ছেড়ে দিয়েছে বলে রায়ান তাকে দুচোখে দেখতে পারে না, আবার কিছু বলে বসে নি তো! প্রিয়াঙ্কা বলল, ‘দাদা, রায়ান কি সাহায্য করবে না বলেছে?

‘হ্যাঁ, ওর বোধ হয় আমার ওপর খুব রাগ।

‘ভাইয়া, আমি ওর হয়ে মাফ চাচ্ছি। বোঝোই তো, ছোট মানুষ, মাথা গরম। তোমার কাছে অনেক এক্সপেক্টেশন ছিল ওর, তাই ও ব্যাপারটা মেনে নিতে পারে নি। ও তো আর আমাদের মতো এত কিছু বোঝে না।

‘পেট্রা অনেক কষ্টে আছে, তাই না?

‘এ কথা বলছ কেন, দাদা? রায়ান তোমাকে কিছু বলেছে?

রায়ান খুব কড়া কথা শুনিয়েছে। মা পেট্রার সঙ্গে কী ধরনের কথা বলে, সেটাও বলেছে। রায়ানের ধারণা, প্রিয় ইচ্ছা করে পেট্রার সঙ্গে টাইম পাস করেছে। বিয়ে নামক খেলা খেলেছে এবং পেট্রার জীবনটা নরক করে দিয়েছে। কিন্তু এসব কথা প্রিয়াঙ্কাকে বলার কোনো মানে হয় না। তাই প্রিয় বলল, ‘না, তেমন কিছু না। শুধু সাহায্য করবে না, এটাই বলেছে। পেট্রা থেকে দূরে থাকতে বলেছে। যা-ই হোক, বাদ দে এসব কথা। তুই তো জানিস শুদ্ধর সাথে দেখা করতে দিই না বলে তোর বোনের আমার ওপর রাগ। দেখা তো দূরের কথা, আমার ফোনও ধরে না। আমি কিছু উপহার আর চকলেট এনেছি, এগুলো ক্রিসমাসের সকালে যে কোনোভাবে হোক পেট্রার মাথার কাছে চলে যাওয়া চাই। এখানে কোথাও আমার নাম লিখি নি, কারও কোনো সন্দেহ হওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই।’

‘তুমি কী দিয়েছ আমি জানি না। কিন্তু এটুকু জানি যা-ই দিয়েছ, পেট্রা দেখেই বুঝে ফেলবে যে তুমি দিয়েছ।

প্রিয় হেসে বলল, ‘পেট্রা তো বুঝবেই। আমি অন্যদের কথা বলছি। বাসায় ঢোকানোর সময় আশা করি কোনো সমস্যা হবে না।

‘আচ্ছা। এবার বলো আমার ভাগেরটা কই?

প্রিয় তিনটা ব্যাগ দিয়ে বলল, ‘তোদের তিন ভাইবোনের জন্য। ব্যাগের ওপর যার যার নাম লেখা আছে।’

প্রিয়াঙ্কা নিজের ব্যাগটা খুলে দেখল র‍্যাপিং করা উপহার, সঙ্গে কিছু চকলেট। ওখান থেকে একটা চকলেট তুলে খেতে শুরু করে দিল। প্রিয় হাসল। তারপর কী ভেবে প্রিয়াঙ্কা হঠাৎ আবেগী হয়ে পড়ল। চোখে জল এসে গেল। বলল, ‘দাদা, সারা জীবন যদি পেট্রা তোমার সাথে থাকতে পারত, তাহলে দুনিয়াটাই ওর কাছে স্বর্গ হয়ে যেত।

‘উঁহু। যদি আমি আর শুদ্ধ পেট্রার সাথে সারা জীবন থাকতে পারতাম, তাহলে আমাদের দুনিয়াটা স্বর্গ হয়ে যেত।

.

রাতে সবার আগে শুদ্ধ শুয়ে পড়ে। তারপর প্রিয় শোয় { সবার শেষে নিকিতা আসে। আজ প্রিয় বিছানায় শুতেই শুদ্ধ উঠে বসল। নিকিতা তখনো ঘরে আসে নি। প্রিয় জানত, আজ শুদ্ধ কিছুতেই ঘুমাবে না। তাই মোটেও অবাক হলো না। বলল, কিরে ব্যাটা, জেগে আছিস যে!

‘বাবা, তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি?

‘কী কথা, বাবা?

শুদ্ধ বাবার কোলের কাছে এসে পা গুটিয়ে বসল। তারপর বলল, ‘আচ্ছা বাবা, কারোর কি দুইটা মা থাকতে পারে?

প্রিয় অবাক! না জানি কী হয়েছে যে এটুকু বাচ্চার মুখে এই কথা! বলল, ‘কী হয়েছে, শুদ্ধ? কেউ কিছু বলেছে?

‘হ্যাঁ, দাদু আমাকে বলে কিনিকিতাকে আন্টি বলো কেন? ও তো তোমার মা হয়। তোমাদের বিয়ে হয়ে যাওয়ার আগেও বলেছে, যে আসবে, তাকে মা ডাকতে হবে। কিন্তু বাবা, দুইটা মা কী করে হয়? সবার তো দেখি একটাই মা। তোমারও তো একটাই মা ছিল, তাই না? তাহলে আমার কেন দুইটা মা হবে?

কী জবাব দেবে প্রিয়? শুদ্ধর কিছু প্রশ্নের সামনে পড়ে অসহায় লাগে নিজেকে। প্রিয় শুদ্ধকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘বাবা, দুনিয়াতে এমন অনেক ঘটনা ঘটে, যা একটু অন্যরকম, আমরা যা জানি, তার সাথে মেলে না। অনেক প্যাঁচ আছে। যখন বড় হবি, তখন নিজের বুদ্ধি দিয়ে বিচার করে যেটা ঠিক মনে হবে, সেটাই ঠিক। আজকের এই প্রশ্নের উত্তরও সেদিন পাবি।

‘বাবা, একটা কথা বলি, রাগ কোরো না?

‘বল।’

‘তোমাদের কাছে কিছু জিজ্ঞেস করলেই তোমরা বলল, এখন বুঝবি না, বড় হলে বুঝবি কিন্তু মাকে কিছু জিজ্ঞেস করলে মা বুঝিয়ে বলত আর আমি বুঝে ফেলতাম।

‘মা অনেক বোঝাতে পারে যে।’

‘আমি মাকে অনেক ভালোবাসি, বাবা। তুমি দাদুকে বলে দিয়ো, আমি নিকিতা আন্টিকে মা বলতে পারব না। নিকিতা আন্টি তো আন্টি, অনেক ভালো একটা আন্টি, আমি খুব পছন্দ করি আন্টিকে। কিন্তু আন্টি কি কখনো মা হয় নাকি, তুমি বলো তো? তুমি কি তোমার আন্টিদের কাউকে মা বলতে পারবে?

কথাগুলো একনাগাড়ে বলে গেল শুদ্ধ। প্রিয় সব শুনে বলল, ‘তা তো ঠিকই। কিন্তু ব্যাপারটা টেকনিক্যালি হ্যাঁন্ডেল করতে হবে, বুঝেছিস?

‘কীভাবে, তুমি শিখিয়ে দাও।’

‘এই ধর, দাদার সামনে নিকিতাকে কিছুই বলবি না। মাও না, আন্টিও না, তাহলে তো আর সে প্রেশার দিতে পারবে না।’

‘হুম, ইউ আর রাইট। কিন্তু বাবা, তার মানে কি নিকিতা আন্টিও আমার মা হয়?

প্রিয় একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘হয়, আবার হয় না। এটা শুধু বড় হলেই বুঝবি। তোর মা হয়তো বোঝাতে পারত কিন্তু আমি পারছি না।’

শুদ্ধ নিমগ্ন হয়ে কী যেন ভাবল, তারপর হেসে বলল, ‘ঠিকাছে বাবা।

শুদ্ধ শুয়ে পড়ল। প্রিয় এবার অবাক হলো। সে ভেবেছিল আজ শুদ্ধ তার মায়ের সঙ্গে কথা বলতে চাইবে। তা না করে এসব বলল। ভালো হয়েছে, কথা বলতে চাইলেই কি দিতে পারত? শুদ্ধ বাবার গলা জড়িয়ে ধরে বলল, ও বাবা, বারোটা তো বেজে গেছে, ক্রিসমাস আজ। আজ কি মায়ের সাথে কথা বলতে পারব? যদি ঈদের দিন সবার সাথে কথা বলতে হয়, মোবারক বলতে হয়, তাহলে ক্রিসমাসেও তো বলতে হয়।

প্রিয় ছেলেকে শক্ত করে বুকের মধ্যে চেপে ধরে বলল, ঠিকাছে কিন্তু এখন না, কাল কথা বলিস।

শুদ্ধ লাফিয়ে উঠে বাবার গালে চুমু দিতে লাগল। প্রিয় হাসছিল। এমন সময় নিকিতা ঘরে ঢুকল। হেসে বলল, ‘ও মা গো! বাপ-ছেলে এত খুশি যে?

শুদ্ধ বাবাকে ছেড়ে বিছানা থেকে নেমে দৌড়ে গিয়ে নিকিতাকে জড়িয়ে ধরল। নিকিতাও ধরল। শুদ্ধ নিকিতাকে টেনে বিছানায় বসিয়ে দুই গালে দুটো চুমু দিল। তারপর বলল, আন্টি, তুমি ভালো আছ?

প্রিয় এসব দেখে হাসছিল। নিকিতাও হাসতে হাসতে বলল, ‘হ্যাঁ বাবা, অনেক ভালো আছি। তুমি আছ যে আমার সাথে! তুমি কেমন আছ?

শুদ্ধ বলল, আমিও অনেক ভালো আছি। পুরো গ্যালাক্সির সমান ভালো আছি।’

নিকিতা বুঝতে পারছিল না এত খুশির কারণ কী! প্রিয় বলল, ‘এই পাগলা! ঘুমাতে আয়।

শুদ্ধ শুয়ে পড়ল। নিকিতাও আলো বন্ধ করে শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণের মধ্যে শুদ্ধ ঘুমিয়েও গেল। নিকিতা বলল, তুমি ঘুমিয়ে পড়েছ?

প্রিয় ঘুমায় নি কিন্তু সাড়া দিল না, চোখ বন্ধ করে ছিল। হয়তো শুদ্ধর খুশির কারণ জানতে চাইবে কিংবা অন্য কিছু। কিন্তু সে এখন কোনো কথা বলতে চাচ্ছে না, তার আগামীকালের কথা ভেবে খুব নার্ভাস লাগছে। এখনো এমন কেন হয়?

নিকিতা উঠে বসল। শুদ্ধর মাথার ওপর দিয়ে প্রিয়র একটু কাছে গেল। কিন্তু আর কিছু করার সাহস হচ্ছে না। কিছু করতে গেলেই তো বকে। কিন্তু মাঝেমধ্যে মনটা যে মানতে চায় না। স্বামী তো! অনেক উল্টাপাল্টা কথা ভেবেও নিকিতা প্রিয়র আরও একটু কাছে গেল। প্রিয়র গলার কাছে নাক নিয়ে ঘ্রাণ নিল। মনে মনে বলল, ‘কবে তুমি আমাকে কাছে টেনে নেবে, প্রিয়? এই অপেক্ষার শেষ কি কখনো হবে না?

প্রিয়র অস্বস্তি হচ্ছিল। এর চেয়ে কথা বলাটাই ভালো ছিল। মেয়েটাকে এত বকে, এত বাজে কথা বলে, তবু সে কোথায় পায় এত সাহস? প্রথম থেকেই বাজে ব্যবহার করে এসেছে। তাহলে ভালোবাসা হলো কী করে তার? অবশ্য মেয়েটার বয়সটাই তো এমন। এই বয়সে তো সবারই ভালোবাসা পেতে ইচ্ছা করে, স্বামী থাকতেও তার আদর, ভালোবাসা কিছুই পায় না। মেয়েটা ভাগ্যদোষে বাবা এবং তার যুদ্ধের মাঝে পড়ে কষ্ট পাচ্ছে! কিন্তু সে-ইবা কী করবে? সে তো পেট্রা ছাড়া অন্য কারও কথা ভাবতেই পারে না। তার মন, শরীর–সবই যে শুধু পেট্রাকেই চায়!

নিকিতা প্রিয়র চুলের ভেতর হাত বোলাতে লাগল। সে জানে না প্রিয় জেগে আছে না ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে থাকলে থাকুক, সেই সুযোগে একটু অনুভব করুক। আর জেগে থাকলেও থাকুক, বুঝুক সে কতটা চায় প্রিয়কে! প্রিয় মনে মনে বলতে লাগল, ‘প্লিজ, ডোন্ট কিস মি।’

নিকিতা প্রিয়র কপালে খুব ভয়ে ভয়ে ঠোঁট ছোঁয়াল। প্রিয় কি ধমক দেবে, নাকি আরেকটু বাড়াবাড়ি করলে ধমক দেবে, সেটা ভাবতে ভাবতেই নিকিতা নিজের জায়গায় সরে গেল। প্রিয় হাঁপ ছেড়ে বাঁচল।

ঘুম থেকে উঠেই বালিশের পাশে একটা র‍্যাপিং বক্স আর অনেকগুলো চকলেট পেয়ে পেট্রার মুখে হাসি ফুটে উঠল। বাবা চলে যাওয়ার পর একজনই ছিল ভরসা করার মতো কিছু কাজে এখনো ভুল হয় না মানুষটার। বাইরে যতটা কঠোর সে, ভেতরটা ততটাই কোমল।

ফ্রেশও হতে গেল না। র‍্যাপিং বক্সটা খুলতেই কালো পাড়ের সাদা রঙের একটা শিফনের শাড়ি পেল। সঙ্গে ম্যাচিং ব্লাউজ। ব্লাউজটায় তার টেইলার্সের ট্যাগ দেখে হেসে ফেলল। চাঁদনী চকের দোতলায় এই টেইলার্সটা। ভিড় আর গরমের কারণে প্রিয়কে ধরেবেঁধেও ওখানে নেওয়া যেত না। পেট্রা বলত, ‘চিনে রাখ, যখন তোর ছেলেমেয়ে পেটে নিয়ে হাতি হয়ে যাব, তখন আমি তো আসতে পারব না। তুই এখানে এসে আমার ব্লাউজ বানিয়ে নিয়ে যাবি। এখান থেকে না বানালে আমি পরতে পারি না।

শাড়ির সঙ্গে একটা চিরকুট। চিরকুটে লেখা,

‘শাড়িটা পরলে তোকে কতটা সুন্দর লাগবে, ভেবেই আমি খুন হয়ে যাচ্ছি! একটু কাছে এসে খুন করবি, প্লিজ? শুদ্ধকে নিয়ে আসব ভাবছি। ও আগের চেয়ে একটু শক্ত হয়েছে এখন আর তোর কথা বলার সময় তেমন কাঁদে না। আমাদের সেই ছোট্ট ছেলেটা সাত বছরে পা দিয়েছে। এখন অনেক কিছু বোঝে।
কোথা থেকে তোকে পিক করব, সব চিরকুট পাওয়ামাত্রই জানিয়ে দিস। আর না এলে সেটাও জানাবি।

টেনশনে সম্ভবত সারা রাত আমার ঘুম হবে না।’ চিরকুট পড়ে পেট্রা হেসে ফেলল। সঙ্গে সঙ্গে ফোন করল প্রিয়কে। ফোন পেয়েই প্রিয়র ঘুম ভাঙল। তাড়াতাড়ি রিসিভ করে বলল, হ্যাপি ক্রিসমাস।’

‘হ্যাপি ক্রিসমাস। টেনশনে ঘুমাতে পারবি না লিখেছিস? এখন তো দেখছি নাক ডাকছিস।’

প্রিয় হেসে বলল, ‘কোথায় আসব?

‘আমার বাসার নিচে, সাতটার মধ্যে।

‘এখন কয়টা বাজে?

পেট্রা কিছু বলার আগেই প্রিয় ঘড়ি দেখে বলল, ‘ছয়টা বাজে, তুই এত ভোরে উঠিস কবে থেকে?

পেট্রা উত্তর না দিয়ে বলল, ‘ছেলেকে ঘুম থেকে ওঠা, রেডি কর এবং দ্রুত চলে আয়।”

প্রিয় ফোন রেখেই শুদ্ধকে ডাকল। শুদ্ধ নড়েচড়ে বলল, ‘আরেকটু। ঘুমাই, বাবা।’

প্রিয় কানে কানে বলল, ‘মায়ের সাথে দেখা করতে যাচ্ছি। একাই যাব তাহলে?

শুদ্ধ একলাফে উঠে বসল। বলল, ‘সিরিয়াসলি, বাবা?

‘হুম।

শুদ্ধ দৌড়ে গিয়ে দাঁত ব্রাশ করতে শুরু করে দিল। দুই বাপ-ছেলে রেডি হতে লাগল।

ওদিকে পেট্রাও এত দ্রুত বোধ হয় শাড়ি পরে নি কখনো।

সাতটা বাজার দশ মিনিট আগেই প্রিয় চলে এল। পেট্রা গেট থেকে বেরুতেই দেখতে পেল জিনসের প্যান্ট আর সাদা পাঞ্জাবি পরা প্রিয় রাস্তায় পায়চারি করছে। গায়ে একটা কালো শাল। প্রিয় ছাড়া রাস্তায় একটা কাকও নেই। চোখে চোখ পড়তে দুজনই হাসল। শুদ্ধ কোথায়? ও কি গাড়িতে? নাকি আনে নি! পেট্রাকে দেখেই প্রিয় এগিয়ে আসছিল। কাছাকাছি আসতেই একে অন্যকে জড়িয়ে ধরল। প্রিয় জড়িয়ে ধরার সময় মাথা নামিয়ে পেট্রার গালে চুমু দিল। পেট্রা হেসে বলল, ‘আমার ছেলে কোথায়?

প্রিয় চুপ। পেট্রা চিন্তিত মুখে জানতে চাইল, ‘আনিস নি?’

প্রিয় কিছু বলার আগেই পেট্রা নিজেই গাড়ির কাছে চলে গিয়ে জানালা দিয়ে তাকাল। শুদ্ধ হাঁ করে তাকিয়ে আছে। পেট্রা দ্রুত হাতে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতেই শুদ্ধ ঝাঁপিয়ে পড়ল পেট্রার কোলে। পেট্রা বুকে চেপে ধরে বলল, ‘জান আমার। কেমন আছিস, মা?

শুদ্ধ একটা কথাও বলতে পারল না। দুবছর পর দেখছে মাকে। তার সারা শরীর কাঁপছে। কাঁকড়ার মতো চার হাত-পায়ে মাকে আঁকড়ে ধরেছে, যেন মেরে ফেললেও মায়ের কোল থেকে কেউ তাকে আর সরাতে পারবে। প্রিয় এগিয়ে এসে দেখল–ছেলে দুজনই হাউমাউ করে কাঁদছে।

সকালে নাশতার টেবিলে প্রিয় ও শুদ্ধকে না দেখতে পেয়ে বাবর খান নিকিতাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘বাপ-ছেলে কি এখনো ওঠে নি নাকি?

নিকিতা খাবার সার্ভ করতে করতে বলল, ‘ওরা বাসায় নেই, বাবা।

‘এত সকালে কোথায় গেছে? প্রিয়র অফিস নেই?

‘বাবা, আজ তো অফিস নেই, আজ বড়দিন।’

বাবর খান কী যেন চিন্তা করলেন। তারপর বললেন, কোথায় গেছে, বলে গেছে?

‘না বাবা। আমি ঘুম থেকে উঠেই দেখি ওরা বাসায় নেই।

‘কোথায় গেছে, বুঝতে পারছ?

‘আমি কীভাবে জানব বাবা, আপনার ছেলে কি আমাকে বলে কোথাও যায়?

‘ওরা পেট্রার সাথে দেখা করতে গেছে, আজ বড়দিন যে!’

‘আপনাকে বলে গেছে?

‘না, অনুমান করছি। এত সকাল সকাল আর কোথায় যাবে এই দিনে!’

‘ওরা এখনো দেখা করে, বাবা?

‘জানতাম তো করে না। কী যে করি! কীভাবে আমি ছেলেটাকে ফেরাব ওই পথ থেকে!

নিকিতা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘আমার আর সহ্য হয় না, বাবা। এমন কী ছিল ওই মেয়েটার মধ্যে? ডিভোর্সের পর, এমনকি আমাকে বিয়ে করার পরও ও সেই সম্পর্ক থেকে বের হতে পারছে না!

ওদের মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই। প্রিয়র পেছনে সব সময় নজর রাখার জন্য লোক রাখা আছে। সেই সূত্রেই জানি। কিন্তু ওরা আসলে দুজন দুজনকে প্রচণ্ড ভালোবাসে। তাই সম্পর্ক না থাকলেও টানটা রয়েই গেছে। সেই টানেই বোধ হয় মাঝেমধ্যে দেখা করে।

নিকিতার গা জ্বলে গেল এসব কথা শুনে। কিন্তু মাথা নিচু করে বলল, ‘ছোট মুখে একটা বড় কথা বলি বাবা, বেয়াদবি নেবেন না। এতই যখন বোঝন ওদের ভালোবাসার ব্যাপারে, তখন ওদের আলাদা না করলেই পারতেন। আমার জীবনটা অন্তত নষ্ট হতো না।

‘বুড়ো বাপটাকে মাফ করো, মা। কীই-বা করার ছিল আমার? পেট্রাকে নিয়ে আমাদের কোনো অভিযোগ ছিল না। ছোটবেলা থেকে চিনি ওকে, খুব ভালো মেয়ে। কিন্তু ও যে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে রাজি হয়। নি! বিধর্মী মেয়েটাকে নিয়ে একসাথে সংসার করতে পারতাম না। বড় ছেলেটা মারা যাওয়ার পর থেকে প্রিয়ই তো আমাদের সব। একমাত্র ছেলেটা বিপথে চলে যাচ্ছিল, এই পাপের ভার তো আমাদেরও বইতে হতো। আমরা ছেলেটাকে যে-কোনো মূল্যে ফেরাতে চেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম ঘরে বউ এলে শুদ্ধ মা পাবে। প্রিয়র জীবনেও আস্তে আস্তে পেট্রার অভাবটা পূরণ হবে। প্রিয় সুখী হবে।

‘হয় নি তো, বাবা।’

‘হবে, আমি এখনো এটা বিশ্বাস করি। একটু সময় লাগবে। ধৈর্য ধরো, মা।’

নিকিতার অনেক কথা বলতে ইচ্ছা করছে কিন্তু কিছুই বলল না। কপালে ছিল এসব তার। বাবর খান বললেন, ‘দেখা করতে গিয়েছে, একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে।’

নিকিতা অধৈর্য গলায় বলল, এটা কেমন ভালো বাবা?

‘আজ দেখো প্রিয়র ব্যবহার কেমন হয়। খুব খুশি থাকবে সে। সেই সুযোগে তুমি ফায়দা নেবে। গল্পের ছলে তার কাছে তুমি পেট্রার কথা জিজ্ঞেস করবে।

‘আমি কেন ওই মেয়ের কথা জিজ্ঞেস করব? আমার কোনো আগ্রহ নেই।

‘বোকা মেয়ে। আমি জানি নিজের স্বামীকে অন্য কারও সাথে ভাগ করা যায় না। কিন্তু সেইসব অনুভূতি তুমি আপাতত তোমার ভেতরে রাখো। প্রিয়কে বুঝতে দিয়ো না। পেট্রার কথা জিজ্ঞেস করলেই সে বলবে তোমাকে। বলতে বলতে সে ফ্রি হয়ে যাবে তোমার সাথে। তোমার ওপর ভরসা করবে সে। তখন সে শুধু তার ভেতরে থাকবে না, একটা ঘোরের মধ্যে চলে যাবে। সেই সুযোগে তুমি তার মনের ভেতর ঢুকে পড়বে, কিন্তু সে টেরও পাবে না। প্রথমে বন্ধু হও, ভালোবাসা তো তার পর আসতে বাধ্য। একটা কথা সব সময় মনে রাখবে, তোমার সবচেয়ে বড় জোর তুমি তার স্ত্রী।

শ্বশুরের শেষ কথাটায় নিকিতা মনে জোর পেল। তবু বলল, কিন্তু বাবা, আমার সবচেয়ে বড় দোষ হচ্ছে আমি মাথা ঠান্ডা রাখতে পারি না। হুট করে রেগে কী বলতে কী বলে বসি! দেখেছেন তো বেয়াদবের মতো আপনাকেও অনেক সময় উল্টোপাল্টা বলে ফেলি, যা আমার বলা উচিৎ নয়। কিছুক্ষণ আগেও বলেছি।

‘আমি কিছু মনে করি না মা। তুমি আমার মেয়ের মতো। তুমি বলতেই পারো।

‘কিন্তু বাবা আমি পেট্রাকে সহ্যই করতে পারি না, তার কাহিনি শুনব কী করে?

‘পারতে হবে। সংসারে সুখ আনতে হলে পারতে হবে।’

নিকিতার চোখে প্রিয়র মুখটা ভেসে উঠল। শুধু সংসারে সুখ বা স্ত্রীর অধিকার নয়, ভালোবাসা চাই তার। নিজেও যে প্রিয়কে ভালোবেসে ফেলেছে!

.

কাঁদতে কাঁদতে শুদ্ধ ঘুমিয়ে পড়েছে। পেট্রা তাকে বুকে নিয়ে বসে আছে প্রিয়র পাশের সিটেই। প্রিয় গাড়ি চালাচ্ছে, গন্তব্য অজানা। পেট্রা শুদ্ধর গালে হাত বুলিয়ে বলল, এই গালে একদিন দাড়ি গজাবে, বাচ্চা ছেলেটা পুরুষ হয়ে উঠবে। আমার কি দেখার সৌভাগ্য হবে! ঈশ্বরই ভালো জানেন।

‘কেন হবে না? তোর ছেলে বড় হলে নিজেই তোর কাছে আসতে পারবে। তখন কি আর আমার অনুমতির অপেক্ষা করবে!

পেট্রা চুপ। সে জানে না ভবিষ্যতে কী ঘটবে! একটা অজানা ভয়, অজানা আশঙ্কা। মুক্তি নেই এর থেকে। বলল, ‘ইশ, ছেলেটা ঘুমিয়েই পড়ল। একটু কথাও বলতে পারলাম না।

প্রিয় বলল, ‘ঘুম থেকে উঠলে বলিস। আসলে রাতে অনেক দেরিতে ঘুমিয়েছিল। খুব সকালে উঠেছে। কান্নাকাটি করেছে। তার ওপর মায়ের কোল পেয়েছে। আর কী চাই বল?

পেট্রা হেসে বলল, কিন্তু আজ ক্রিসমাস। সারা দিন তো থাকতে পারব না। দুপুরের আগে ফিরতে হবে।

‘লাঞ্চ করে যা।’

‘সম্ভব না, সরি।

প্রিয় গাড়িটা রাস্তার পাশে থামাল। তারপর পেট্রার দিকে তাকাল। বড় বড় চোখে টেনে কাজল পরেছে সে। ঠোঁটে ভুবনভোলানো হাসি। এই হাসির জন্য প্রিয় পেট্রাকে বলত সূচিস্মিতা। যার হাসিতে কোনো ভান নেই। অদ্ভুত ভালো লাগায় মনটা ভরে যাচ্ছে! প্রিয় বেশ কিছুক্ষণ পেট্রার চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। পেট্রাও তাকিয়ে রইল। প্রিয়র দুটো চোখ পেট্রার চোখ দিয়েই কোনো এক গহিন অরণ্যে ঘুরে বেড়াতে লাগল। এক হাতে সে পেট্রার মুখটা ধরে চোখের নিচে আঙুল বুলিয়ে বলল, সেই চোখ, সেই ঠোঁট, সেই মুখ অথচ কত অযত্নে আছে সব। এই অবস্থা হয়েছে কেন?

পেট্রা হেসে বলল, বয়স হচ্ছে তো।’

‘বয়সের জন্য না। আমি জানি কেন হচ্ছে এসব। একটু যত্ন নিতে পারিস না, পেট্রা? দেখ, নিজের কত যত্ন নিই আমি।’

পেট্রা প্রিয়র পুরো শরীরে চোখ বুলিয়ে নিল। চোখগুলো আগের মতোই যেন হাজারটা নেশাদ্রব্য মেশানো, একবার তাকালেই ঘোর লেগে যায়। চুল-দাড়ি সব স্টাইল করে কাটা। মুখটা তরতাজা। কোথাও কোনো অযত্নের চিহ্ন নেই। পেট্রা বলল, তুই তো হিরো, এভারগ্রিন।’

‘তোর চোখ দেখলে মনে হয় কত বছর যেন তুই ঘুমাস না। কত সুন্দর সিল্কি চুল ছিল তোর! এত রাফ হলো কী করে? প্রতিটা চুলের আগা ফেটে দুভাগ হয়ে গেছে, কাটিস না কেন? কত স্মথ স্কিন ছিল তোর, ধরলে মনে হতো মাখন ধরেছি। সেই স্কিন এত খসখসে কী করে হলো?

‘তুই কি গার্লস বিউটি পারলার দিয়েছিস?

‘মজা নিস না, মার খেয়ে মরে যাবি।

পেট্রা মিটিমিটি হাসছিল। প্রিয় বলল, এভাবে থাকিস না, পেট্রা। নিজের যত্ন নিবি আর ভাববিনিজের জন্য অন্তত এটুকু তো করতে পেরেছি! দেখবি শান্তি লাগবে। তোর এই অবস্থা দেখে আমার নিজেকে অপরাধী লাগছে। শেষমেশ কথা রাখতে পারি নি আমি। অথচ সম্পর্ক হওয়ার আগে-পরে কত সময় কতভাবে কতবার তুই আমাকে সাবধান করেছিলি, আমাদের একসাথে থাকা কখনো সম্ভব না। অথচ আমি শুনি নি। পাগলের মতো যখন যা ইচ্ছা হয়েছে, করেছি।’

‘আমি তোকে কোনো দোষ দিচ্ছি না। তুই কেন নিজেকে অপরাধী মনে করবি?’

প্রিয় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। অন্যদিকে তাকিয়ে বলল, ‘প্লিজ, তাড়াতাড়ি বিয়ে কর তুই। একটু হলেও শান্তি পাব।

পেট্রা মাথা নেড়ে হাসিমুখে বলল, ‘করব। প্রিপারেশন চলছে।’

‘আমাকে মিথ্যে বলিস না।’

‘সত্যি বলছি।

প্রিয় আবার পেট্রার দিকে তাকাল। পেট্রার ঠোঁটে চোখটা আটকে যাচ্ছে বারবার। নিজেকে সামলানো মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। পেট্রা প্রিয়র দৃষ্টি দেখেই বুঝে গেল। বহু চেনা ওই দুটি চোখ, ওই দৃষ্টি। প্রিয় কাছে আসতেই পেট্রা বলল, তোর কি ভয় নেই?

প্রিয় থেমে গিয়ে বলল, ‘কিসের ভয়?

‘এটা পাপ। পরকীয়াকে আমরা দুজনই ঘৃণা করতাম।’

‘এটা কীভাবে পরকীয়া হলো? আমার বিয়ে, বউ কীভাবে হয়েছে আর কীভাবে আছে, তুই তো জানিস সব। তা ছাড়া তুইও তো আমার বউ ছিলি।

‘ছিলাম, এখন তো আর নেই।’

‘তো? বিয়ের আগে যেন আমরা এসব করি নি?

তখনকার ব্যাপার অন্যরকম ছিল। তখন আমাদের দুজনের মাঝে আর কেউ ছিল না।’

‘এখনো কেউ নেই।

‘আছে, তুই অস্বীকার করলেই সব সত্যিটা মিথ্যা হয়ে যাবে না।’

‘আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিস না, পেট্রা।

‘শোন প্রিয়…’

পেট্রা এটুকু বলতেই প্রিয় তার মুখটা ধরে ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়ালো। যদিও শুদ্ধ ঘুমিয়ে আছে, তবু পেট্রা একটা হাতে আলগাভাবে শুদ্ধর চোখ ঢেকে রাখল।

.

শুদ্ধর যখন ঘুম ভাঙল, মায়ের কোলে বসে দুহাতে সে মায়ের মুখটা ধরে তাকিয়ে ছিল। পেট্রা বলল, ‘মাকে দেখা হয় নি?

শুদ্ধ হেসে বলল, ‘মুখস্থ করে রাখছি, পরে মন চাইলেই দেখতে পারব।’

পেট্রা ও প্রিয় হেসে দিল। শুদ্ধ বলল, ‘মা, তুমি অনেক সুন্দর।

পেট্রা শুদ্ধর গালে চুমু দিয়ে বলল, তোমার মা যে আমি।’

‘আমি তোমার কাছে থাকব, মা।’

প্রিয় বলল, বাবাকে ছেড়ে থাকতে পারবি?

শুদ্ধ চুপ করে রইল। পেট্রা হেসে ফেলল। তারপর শুদ্ধ বলল, আমি তোমাদের দুজনের সাথে থাকতে চাই।’

প্রিয় ও পেট্রা দুজন দুজনের দিকে তাকাল। কারও মুখে কোনো কথা নেই। পেট্রা শুদ্ধর দিকে ফিরে বলল, ‘সেটা যে কখনো কোনোভাবে সম্ভব না, মা।

শুদ্ধ বলল, ‘মা, আমি মুসলিম, সে জন্য কি আমি বাবার সাথে থাকি?

‘ঠিক সে জন্য না। যেহেতু এটা মুসলিম কান্ট্রি, তাই তোমাকে বাবার ধর্ম দেওয়া হয়েছে। যদি খ্রিষ্টান কান্ট্রি হতো, তাহলে হয়তো মায়ের ধর্ম দেওয়া হতো।

‘কে দিয়েছে?

‘আমি আর তোমার বাবা মিলে ঠিক করেছিলাম যে তুমি মুসলিম হবে।’

‘ও। আমি মুসলিম, তাই বাবার কাছে থাকি। আচ্ছা, আমি যদি খ্রিষ্টানও হই, তাহলে আমি তোমাদের দুজনের কাছেই থাকতে পারব?

‘না বাবা, একই সাথে দুটো ধর্মে বিলং করা যায় না।

‘কেন যায় না মা?

প্রিয় বলল, ‘নে, এবার ঠেলা সামলা। আমাকে সারাক্ষণ এমন কঠিন কঠিন প্রশ্নের সামনে পড়তে হয়। আমি বলি, বড় হলে বুঝবি। পাত্তা দেয় না তোর ছেলে।

পেট্রা বলল, এটা কেন বলবি? বুঝিয়ে বললেই বোঝে আমার ছেলে।’

তারপর শুদ্ধর দিকে তাকিয়ে পেট্রা বলল, ‘প্রত্যেকটা মানুষকে যে কোনো একটা ধর্মে বিলং করতে হয়, বাবা। সেই ধর্মকেই মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতে হয়। এটাই নিয়ম, সে জন্যই একসাথে দুটো ধর্ম মানা যায় না। যদি তুমি চাও, তাহলে তোমার একটা ধর্মও ঠিকভাবে মানা হবে না। পাপ হবে।’

‘আর মায়ের কাছে না থাকলে পাপ হবে না?

পেট্রা হেসে বলল, ‘না।’

শুদ্ধ চিন্তিত মুখে বলল, তাহলে দাদা যে বাবাকে বলেছিল বাবা যদি দাদার কাছে না থাকে, তাহলে বাবার পাপ হবে?

পেট্রা প্রিয়র দিকে তাকাল। পেট্রা জানে না কবে এসব কথা বলেছেন তিনি। প্রিয় না শোনার ভান করে অন্য দিকে তাকিয়ে রইল। শুদ্ধ আবার বলল, ‘দাদা আরও বলেছে, বাবা-মায়ের সব দায়িত্ব নাকি ছেলেকে নিতে হয়? আমিও তোমার সব দায়িত্ব নেব।’

পেট্রা হেসে বলল, ‘দায়িত্ব মানে কী, জানো তুমি?

‘হ্যাঁ, দায়িত্ব মানে রেসপনসিবিলিটি।

পেট্রা, প্রিয় দুজনেই হেসে দিল। পেট্রা শুদ্ধর কপালে একটা চুমু দিয়ে বলল, ‘বড় হ আগে বাবা, তারপর তোর যা ইচ্ছা তা-ই করিস।

প্রিয় নাশতা করার জন্য একটা রেস্টুরেন্টের সামনে গাড়ি থামাল। পেট্রার শুদ্ধকে কোলে নিয়ে নামতে কষ্ট হচ্ছিল। প্রিয় কোলে নিতে চাইছিল, শুদ্ধ যাবে না। প্রিয় বলল, তাহলে হেঁটে চল।

শুদ্ধ মায়ের গলাটা আরও ভালোভাবে জড়িয়ে বলল, ‘নাহ, আমি মায়ের কোল থেকে নামব না।’

‘এখনো মনে হয় ছোট আছিস?

পেট্রা বলল, ‘অসুবিধা নেই, আমি পারব।’

শুদ্ধ প্রিয়র দিকে তাকিয়ে বলল, তোমাদের কথাবার্তা বুঝি না, একটু আগেই তো বললে বড় হলে করবি, বড় হলে বুঝবি। তার মানে তো আমি ছোটই এখন।

প্রিয় একটা ধমক দিতে যাচ্ছিল। তার আগেই পেট্রা শুদ্ধকে নিয়ে নেমে গেল। পেট্রা যখন ওকে কোলে নিয়ে হাঁটছিল, প্রিয় গাড়ি পার্ক করতে গেল। তখন শুদ্ধ বলল, ‘মা, সত্যি কি তোমার কষ্ট হচ্ছে? তাহলে বলো আমি হেঁটেই যাচ্ছি।’

পেট্রা শুদ্ধর নাকে নাক ঘষে বলল, ‘একটুও কষ্ট হচ্ছে না, বাবা।

‘আচ্ছা মা, আমাকে তোমার ফোন নম্বরটা দেবে? বাবার মোবাইলে আগে ছিল, এখন খুঁজে পাই না। তাই তো আমি তোমাকে একবারও ফোন করতে পারি না। নম্বর দিলে বুঝবে আমি তোমাকে কত ফোন করি।’

‘তোমার বাবার মোবাইলে আমার ফোন নম্বর নেই! ঠিক বলছো?

‘হ্যাঁ মা!

পেট্রার মনটা হঠাৎ খারাপ হলো। ওর নম্বরটা মোবাইলে না রাখার মতো কী হলো! তারপর বলল, আমার নম্বর কোথায় লিখে দেব, বলো তো? তোমার সাথে কোনো কাগজ-কলম আছে? আমার কাছে তো কিছু নেই।’

‘না না, লিখে নিলে বাবা দেখে ফেলবে, তারপর যদি রাগ করে? তুমি বলো। আমি মখস্থ করে ফেলি।

পেট্রা নম্বর বলল এবং শুদ্ধ মুখস্থ করে ফেলল। বলল, ‘বাহ মা, তোমার নম্বর মনে রাখা তো অনেক সোজা।

পেট্রা হাসল। এত সুখ কেন এই ছোট্ট মুখটাতে? পেট্রা লিফটের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। প্রিয় এসে লিফট কল করে তার কোমরে হাত রেখে দাঁড়াল। পেট্রা তাকিয়ে বলল, ‘এটা পাবলিক প্লেস।

প্রিয় বলল, ‘সে জন্যই তো এটুকু।’

শুদ্ধ বলল, ‘কী মা?’

‘কিছু না, মা।

প্রিয় দুষ্টু ছেলেদের মতো হাসতে লাগল। শুদ্ধ বলল, ‘বাবা, তুমি হাসছ কেন?

‘এমনি বাপ। তুইও হাস।

শুদ্ধও হাসল। বাপ-ছেলের বোকা বোকা হাসি দেখে পেট্রাও হাসল। এর মধ্যে লিফট চলে এল। ওরা লিফটে উঠল। ফাঁকা লিফটে প্রিয় পেট্রার কাছে গিয়ে কোমরে হাত বোলাতে লাগল। পেট্রা বলল, ‘তুই কি পাগল হয়ে গেছিস?

প্রিয় হাসতে হাসতে বলল, ‘আগে ছিলাম না?

বলতে বলতেই প্রিয় এবার হাতটাকে আস্তে আস্তে ওপরে ওঠাতে লাগল। পেট্রা বলল, ‘মেরে ফেলতে চাস তুই আমাকে?

‘অবশ্যই।’

শুদ্ধ বলল, ‘বাবা, তুমি মাকে কেন মেরে ফেলতে চাও? তুমি কি কিলার? মাকে মেরে ফেললে তোমাকে খুব হেট করব আমি।’

লিফট চলে এল গন্তব্যে। পেট্রা হাসতে হাসতে নামল। তারপর শুদ্ধর গাল ধরে বলল, এই মারা সেই মারা না, বাবু।

‘তাহলে কোন মারা, মা? এটাও কি বড় হলে বুঝব?

‘হ্যাঁ।

‘ও! আচ্ছা মা, তুমি যে এত পাতলা একটা শাড়ি পরেছ তোমার শীত করছে না?

‘কই, না তো? শাড়ি পরলে শীত লাগে না অত।

প্রিয় নিজের শাল খুলতে খুলতে বলল, ‘শীত করলে আমার শাল নিতে পারিস।

পেট্রা বলল, ‘দরকার নেই, লাগলে বলব।

প্রিয় রেস্টুরেন্টে ঢুকতে ঢুকতে বলল, দরকার না থাকলেই ভালো, চোখটা জুড়াবে আমার।’

পেট্রা হাসতে লাগল।

পেট্রা শুদ্ধকে খাইয়ে দিতে দিতে বলল, ‘স্বপ্নের মতো লাগছে দিনটা।’

শুদ্ধ খেতে খেতে বলল, হ্যাঁ, আমারও।

প্রিয় চুপচাপ খেতে লাগল। পেট্রা বলল, ‘দেখেছিস, তুই চাইলে আমরা সবাই ভালো থাকতে পারি।’

প্রিয় না তাকিয়েই বলল, ‘উইদাউট মি।’

‘কেন?

‘দুটো কারণ। প্রথমত, আমি ছেলের কান্না দেখতে পারি না। অথচ তোর সাথে দেখা করলে প্রত্যেকবার সেটা আমাকে দেখতে হয়। এবং দ্বিতীয়ত, তোকে একটু পেয়ে আমার মন ভরে না, পেট্রা। একটু পেলে তোকে আরও বেশি করে পেতে ইচ্ছা করে। একদিন দেখা হলে পরের দিনও দেখা করতে ইচ্ছা করে, প্রতিদিন দেখা করতে ইচ্ছা করে। ফোন করতে থাকি আমি। কথা হলে অস্থির লাগে, কথা না হলে আরও অস্থির লাগে। তোর সাথে দেখা হলে…’

থেমে গেল প্রিয়। পেট্রা তাকিয়ে রইল। প্রিয় আবার বলতে শুরু করল, আমি নিজেকে সামলাতে পারি না। সামলাতে পারি না নিজের চোখকে, হাতকে, ঠোঁটকে…। আমি যখন হৃদয় উজাড় করা ভালোবাসা নিয়ে তোকে ছুঁতে যাই তখন তুই বিশেষভাবে আমাকে মনে করাস যে, আমরা কেউ কারও নই।’

শুদ্ধ চুপচাপ শুনছে, কিছু বলছে না। কেমন একটা থমথমে পরিবেশের সৃষ্টি হলো। পেট্রা সেটা দূর করার জন্য সরাসরি প্রিয়র চোখের দিকে তাকাল। তারপর হেসে বলল, ‘তাহলে আজ দেখা করলি কেন?

প্রিয় হেসে বলল, ‘কী করব? দেখা না করেও যে থাকতে পারছিলাম না আর। কতগুলো দিন হয়ে গেছিল তোকে দেখি নি।

শুদ্ধ বলল, ‘মা, আমিও অনেক দিন দেখি নি তোমাকে। একদম দুই বছর।

পেট্রা শুদ্ধকে বুকে টেনে নিল। প্রিয় তাকিয়ে রইল। পেট্রা প্রিয়কে বলল, আমি কী করব, সেটা বলে দে। এভাবে নিয়মিত দেখা করব? তুই যা চাইবি, তা-ই করব? নিয়মিত ফোনে কথা বলব? সেটা কীভাবে সম্ভব? আমরা ডিভোর্সি, তুই ইতিমধ্যে বিবাহিত। তোর বিয়ের আগপর্যন্ত তো সেপারেটেড হওয়া সত্ত্বেও কমবেশি সম্পর্ক রেখেছি। এখন বিয়েটা যখন হয়ে গেছে, সবকিছু মেনে নেওয়াটাই শ্রেয়।

‘কীভাবে তুই পারিস এসব বলতে? কষ্ট তো তুইও কিছু কম পাস না। তাহলে?

‘আমি বাস্তবকে মেনে নিতে জানি।

এ কথা বলতে বলতে পেট্রার চোখ জলে ভরে উঠল। ব্যাপারটা খেয়াল করে প্রিয়র খুব খারাপ লাগল। পেট্রার একটা হাত ধরে বলল, ‘সরি।’

শুদ্ধ পেট্রার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কী হয়েছে, মা? বাবা সরি কেন বলছে? বাবা কি তোমাকে কষ্ট দিয়েছে?

পেট্রা হেসে বলল, ‘নাহ মা, তোমার বাবা দুষ্টুমি করেছিল, তাই সরি বলেছে।

তারপর শুদ্ধর কপালে একটা চুমু দিল। সেই সময় পেট্রা তাকিয়ে ছিল। প্রিয়র দিকে। প্রিয় হাসল।

প্রিয় ও নিকিতার একটু স্পেস দরকার। যা শুদ্ধর জন্য তারা পায় না। তাই বাবর খান অনেক ভেবে একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। উত্তরবঙ্গে একটি প্রজেক্ট পরিদর্শনে যাচ্ছেন। শুদ্ধকে সঙ্গে নিয়ে যাবেন। শুদ্ধকেও পটিয়ে ফেলেছেন তিনি। প্রিয় প্রথমে শুদ্ধকে যেতে দিতে চাচ্ছিল না। কিন্তু শুদ্ধের আগ্রহে রাজি হতে হলো। স্কুলে শীতের ছুটি চলছে। ছেলেটারও কিছুদিনের জন্য হাওয়া বদল হওয়া দরকার।

ছুটির দিন পুরো বিকেল, সন্ধ্যা প্রিয় ড্রয়িংরুমে মুভি দেখে কাটিয়ে দিল। নিকিতা টিভি দেখেই একটু সময় কাটায়, আজ তা পারছে না। কিন্তু দূর থেকে প্রিয়কে দেখেই সময় কাটিয়ে দিচ্ছে সে ভালো লাগছে খুব। প্রিয় রাত নয়টা বাজতেই চিৎকার করে বলল, ‘নিকিতা, খেতে দাও। ছেলেটা নেই, বোর লাগছে। তাড়াতাড়ি ঘুমাব।’

খেতে খেতে প্রিয় বলল, ‘মাংসটা তুমি বেঁধেছ?’

‘ভালো হয় নি, না? বুয়া তাড়াতাড়ি চলে গেছে আজ, বেশি কিছু রান্না করতে পারে নি। সে জন্যই পরে মাংসটা আমি বেঁধেছিলাম।’

‘মোটামুটি হয়েছে। আসলে ছোটবেলা থেকে ভালো রান্না খেয়ে অভ্যাস তো, এ রকম খেতে পারি না। এক কাজ করি চলো।

‘কী কাজ?

‘সামনের শুক্রবার আমি তোমাকে মাংস আর বড় মাছ ভুনা করা শেখাব। শনিবার আবার ভাজাভুজি আর ছোট মাছের কারি শিখিয়ে দেব। তুমি শুধু ওই প্রসেস ফলো করে রান্না করবে, প্রথম প্রথম একটু উল্টোপাল্টা হবে। পরে প্র্যাকটিস করতে করতে দেখবে মানুষ তোমার হাত চেটে খেতে চাইবে।

‘ঠিকাছে, আমি শিখব।’

নিকিতার ভালো লাগছিল। প্রচণ্ড ভালো লাগছিল। নিকিতার মনে পড়ে গেল শ্বশুর তাকে বলেছিলেন পেট্রার সঙ্গে দেখা করলে মন ভালো থাকবে প্রিয়র। সত্যিই সেদিনের পর থেকে প্রিয়র কথা বলার ধরনটাই বদলে গেছে। আগে যতবার খারাপ বেঁধেছে, প্রিয় বকেছে। বলেছে, রান্না করতে হবে না আর। আর আজ নিজ হাতে রান্না শেখাতে চাচ্ছে!

প্রিয় শুয়ে পড়ার কিছুক্ষণ পরই নিকিতা ঘরে এল। ঘরে ঢুকতেই প্রিয়র চোখে চোখ পড়ল। প্রিয় চোখ ফিরিয়ে নিল। নিকিতা ঘুরঘুর করে কী কী যেন করল, তারপর বিছানায় আসতেই প্রিয় বলল, ‘আজ তো বাবা বাড়িতে নেই। আজ আমাদের এক বিছানায় ঘুমানোর কী দরকার?

‘বিছানা বদল হলে আমি ঘুমাতে পারি না।’

‘ঠিকাছে।

প্রিয় আর কথা বাড়াল। নিকিতা বিছানায় শুয়ে প্রিয়র লেপের ভেতর ঢুকতেই প্রিয় লেপটা টেনে ধরে বলল, ‘তোমার কম্বল কোথায়?

নিকিতা ভয়ে ভয়ে বলল, ‘আমি তোমার লেপের ভেতর শুলে কি তোমার গায়ে ফোঁসকা পড়বে?

প্রিয় হেসে লেপটা ছেড়ে দিল। নিকিতা লেপের ভেতর ঢুকল। প্রিয় হেসে বলল, ‘সুযোগ পেয়ে উল্টোপাল্টা কিছু কোরো না আবার, মাঝেমধ্যে যেই অ্যাটাক দাও, ভয় লাগে ভাই।’

নিকিতা প্রচণ্ড অবাক হলো। প্রিয়র এতটা পরিবর্তন? এত সুন্দর করে কথা বলছে ওর সঙ্গে? এটুকু সব সময় পেলেও সে সুখী হতো। প্রিয় নিকিতাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করল, ‘কী হলো, কী দেখছ?

নিকিতা কোত্থেকে যে সাহস পেল! পুরোপুরি প্রিয়র দিকে ফিরে হাতের ওপর মাথা ভর দিয়ে বলল, আমি কি পরনারী? আমি ছুঁলেই তোমার পাপ হবে?

নিকিতার মুখে এমন কথা শুনে প্রিয় যা বোঝার বুঝে গেল। মেয়েটা বহুত সেয়ানা। প্রিয় কিছু না বলে উল্টোদিকে ফিরে শুয়ে রইল। নিকিতা বুঝতে পারল না প্রিয় রাগ করেছে, নাকি স্বাভাবিকই আছে। তাই আর কিছু বলার সাহস পেল না। আজ না হয় এটুকুই থাক, সপ্তাহখানেক তো বাসা খালিই।

.

প্রিয়র সঙ্গে দেখা হওয়ার পর কয়েকদিন কেটে গেছে। কিন্তু স্বাভাবিক হতে পারছে না পেট্রা। গভীর রাতে হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে কাঁদছে। বুকটা ভার হয়ে আছে। মনে হচ্ছে নিঃশ্বাসটা যে-কোনো সময় আটকে যাবে। প্রিয় এমন পাগলের মতো কেন করে? এভাবে পাওয়াকে কি পাওয়া বলে? সে কি বোঝে না তার প্রতিটা স্পর্শে পেট্রার কেমন। লাগে? সে তো চলে গেছে, অথচ তার স্মৃতিগুলো একটু একটু করে পুড়িয়ে শেষ করে দিচ্ছে পেট্রাকে। কান্নার মাঝেই প্রিয়াঙ্কার ফোন এল। রাত বাজে দেড়টা, এত রাতে ওর ফোন কেন? চোখ মুছে ফোন ধরল পেট্রা। প্রিয়াঙ্কা বলল, এই পেট্রা, তুই কি ঘুমিয়ে পড়েছিলি?

‘না, বল।

প্রিয়াঙ্কা আঁতকে উঠে বলল, ‘তুই কাঁদছিলি?

‘বুঝতেই যখন পারছিস, তখন আবার জিজ্ঞেস করছিস কেন?

‘সরি, কী হয়েছে রে? কেন কাঁদছিস?

‘আমার মনে হয় প্রিয় কোনো মেন্টাল ডিজঅর্ডারের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। কী বলে, কী করে কোনো ঠিক নেই।

‘কেন, কী হয়েছে?

‘প্রিয় এখনো অনেক পাগলামি করে, যেন এখনো আমি তার বউ আছি।’

‘আহা, বেচারা কী করবে আর? তুই তো বুঝিস প্রিয়দাকে?

‘আমি আর পারছি না রে প্রিয়াঙ্কা, ক্রিসমাসের দিন ওকে আর শুদ্ধকে দেখে আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল। কত সুখে ছিলাম আমরা! আর এখন?

প্রিয়াঙ্কা অস্থির হয়ে বলল, ‘কলিজাটা আমার, এভাবে কাঁদিস না, আমার ইচ্ছা করছে দৌড়ে তোর কাছে চলে যাই। তোকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে বসে থাকি।

পেট্রার কান্না থামল না, সে উতলা হয়ে বলল, ‘কী করব আমি, প্রিয়াঙ্কা? কী করব? ছোটবেলা থেকে তো সারা জীবন একজনকেই চিনেছি, জেনেছি, ভালোবেসেছি। নিজের সব বিসর্জন দিয়েছি এই একটি মানুষের জন্য। আমার রক্তে মিশে আছে যে মানুষটি, তাকে ছাড়া বাকিটা জীবন কী করে কাটাব?

ওদিকে প্রিয়াঙ্কাও কান্না শুরু করে দিল। বলল, ‘ফর গড সেক, তুই কাঁদিস না, পেট্রা।

পেট্রা গলাটা একটু স্বাভাবিক করে বলল, তুই কাদিস না, বাচ্চার ক্ষতি হবে। আমি রাখছি।’

পেট্রা ফোন রাখতেই দেখল একটা মেসেজ এসে রয়েছে। তার বুক কাঁপছে। কারণ মেসেজটা প্রিয় পাঠিয়েছে। সে মেসেজটা ওপেন করল। প্রিয় লিখেছে, ‘সেদিন চলে আসার সময় তোকে খুব জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছা করছিল। ঝগড়ার পর মিটমাট হলে যেমন খাবলে-খুবলে ধরতাম, তেমন করে।

পেট্রার যতটা কষ্ট হচ্ছিল, তা শত গুণ বেড়ে গেল মেসেজটা পড়ে। পেট্রা হঠাই শব্দ করে কেঁদে উঠল! কান্নাটা আটকাতেও পারছে না সে। ছোট ফ্ল্যাট, রুমগুলো কাছাকাছি। শেষমেশ কেউ আবার না শুনে ফেলে তাই বালিশ কামড়ে ধরে কাঁদতে লাগল। তার মতো মেয়েদের কাঁদতেও হয় লুকিয়ে লুকিয়ে।

.

বালিশে হেলান দিয়ে বসে সিগারেট খেতে খেতে পেট্রাকে মেসেজটা দিয়েছে প্রিয়। কোনো রিপ্লাই এল না! পেট্রা কি ঘুমিয়ে পড়েছে? কিন্তু সে হয়তো জানেও না তার কথা ভেবে প্রিয় এখনো দুচোখের পাতা এক করতে পারে নি। এখনো পেট্রার চোখজোড়া যেন দেখতে পাচ্ছে। এখনো তার ঠোঁটের স্পর্শ অনুভবে রয়ে গেছে। নিজের হাতের দিকে তাকাল, এই হাত সেদিন অনেক অবাধ্যতা করেছে। যা করেছে, তা কি সত্যি পাপ? পরিবারকে রাজি করানোর জন্য বিয়ে করেছিল তারা। কিন্তু বিয়ের আগেও পেট্রা তার কাছে যা ছিল, বিয়ের পরও তা-ই। যখন থেকে তাকে ভালোবেসেছে, তখন থেকেই নিজের সারা জীবনের সঙ্গী মেনে এসেছে। তাকে। কলমের কালি খরচ করে স্বাক্ষর করে বিয়ে করা আর স্বাক্ষর করে ডিভোর্স করাটা কি এতই জরুরি? মনের এখানে কোনো জায়গা নেই? মন কাকে চাইছে, সেটার কোনো গুরুত্ব নেই? তাহলে যখন কলম ও কালি আবিষ্কৃত হয় নি, তখন কি বিয়েই হতো না? তখন কি পাপ-পুণ্যের কোনো বিষয় ছিল না? যদি তাই হয়, তাহলে তো তখন জন্ম নিলেই ।ভালো হতো। মগ্ন হয়ে এসব ভাবছিল প্রিয়। ব্যাঘাত ঘটাল নিকিতা। বলল, ‘সিগারেটটা ফেলো, তোমার তো হাত পুড়ে যাবে।

প্রিয় চমকে বলল, ‘হ্যাঁ? ও হ্যাঁ, ফেলছি।

প্রিয় সিগারেটের ফিল্টারে আরও একটা টান দিল। নিকিতার মনে হলো, প্রিয়র ঠোঁটটা বুঝি পুড়ে যাবে এবার। নিকিতা বলল, তুমি কি পাগল? সিগারেট শেষ, তাও টানছ? দরকার হলে আরেকটা ধরাও!

প্রিয় হেসে বলল, ‘আরে নাহ, সিগারেটের শেষ টানের অনুভূতি যে কী শান্তির, তুমি তা বুঝবে না। বলা হয় সিগারেটের শেষ টানের অনুভূতি ষোলো বছরের কোনো তরুণীর ঠোঁটে চুমু খাওয়ার অনুভূতির সমান।

‘তুমি আবার এসব বোঝো নাকি?

প্রিয় হাসল। নিকিতা সাহস করে বলল, চোখের সামনে দিয়ে আঠারো বছরের এক তরুণীর বিশ বছর হয়ে গেল। একবার চুমু খেলে না হয় বুঝতাম যে তুমি এসব বোঝে।

এবার প্রিয় হো হো করে হেসে ফেলল। নিকিতার ভয়টা কমে গেল। প্রিয় হাসি থামিয়ে হঠাৎ সিরিয়াস হয়ে বলল, তুমি খুব চাও আমাকে, তাই না?

‘তুমি আমার স্বামী। তোমাকে চাওয়াটাই কি যৌক্তিক না?

‘অবশ্যই, তা ছাড়া তোমার বয়সটাই এমন।

নিকিতা কী বলবে, ভাবতে ভাবতেই প্রিয় জিজ্ঞেস করে বসল, ‘আচ্ছা, তুমি না বাসর রাতে বলেছিলে তোমার একটা বয়ফ্রেন্ড ছিল। ওর কাছে চলে যাও না কেন?

‘আশ্চর্য তো, ওর কাছে যাব কেন? ওর সাথে তো কত আগেই ব্রেকআপ হয়ে গেছে।

‘তো কী! প্যাঁচআপ করে নাও।

‘সে রকম হলে তো বিয়ের আগেই করতাম। তোমাকে বিয়েই করতাম না।’

প্রিয় যেন সেকথা শুনলে না। হঠাৎ কেমন অন্যমনস্ক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা নিকিতা, তুমি কি কখনো চলে যাবে না? এভাবেই থাকবে। সারা জীবন?

‘হ্যাঁ থাকব।’

‘তোমার এমন সুন্দর যৌবন বিফলে যাবে?

এ কথায় লজ্জা পেল নিকিতা। প্রিয় বলল, ‘আরে, এতক্ষণ তো খুব নির্দ্বিধায় কথা বলছিলে, এখন আবার লজ্জা পাচ্ছ কেন?

নিকিতা একটু ভাব ধরে বলল, আমার এত লজ্জা নেই।’

প্রিয় হেসে বলল, ‘তাও ঠিক। অত লজ্জা থাকলে কি আর নিজ থেকে রাতবিরাতে আমাকে অ্যাটাক দিতে?

নিকিতা হাসল। বলল, ‘অ্যাটাক দিয়েই-বা লাভ কী! ধমক ছাড়া এই জীবনে আর তো কিছু পেলাম না।

প্রিয় আরেকটা সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, ‘আসলে তোমার দুর্ভাগ্য কোথায় জানো? তুমি একটা যুদ্ধের মাঝে পড়ে গেছ। বাপ-ছেলের যুদ্ধ। তোমাকে আমি কখনো স্ত্রীর জায়গা দেব না, দিলে যুদ্ধে আমি হেরে যাব। আর আমি তো হার মানব না। অন্যদিকে ভালোও বাসতে পারব না তোমাকে। তোমাকে কেন, এই পৃথিবীর আর কোনো মেয়েকেই ভালোবাসা আমার পক্ষে সম্ভব না।

নিকিতার খারাপ লাগল। তবু কথাটা এড়িয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা, তোমার কি শুদ্ধর মায়ের সাথে কোনো সম্পর্ক আছে এখনো?

‘নাহ, নেই। তোমার আমার বিয়ের পর ও আমার সাথে সম্পর্ক রাখে নি। তবে কয়েকদিন আগে দেখা হয়েছিল আমাদের। প্রায় এক বছর পর।

‘তাহলে তুমি থাকো কীভাবে?

প্রিয় অবাক হয়ে বলল, ‘ঠিক বুঝলাম না।’

‘আই মিন, তুমি তো ডিভোর্সি। শুদ্ধর মায়ের সাথে কোনো সম্পর্ক নেই, মানে তার সাথে কিছু হয় না, আমার সাথেও কিছু করো না। তোমার কষ্ট হয় না? আই মিন সবারই তো একটা ফিজিক্যাল নিড় থাকে।

প্রিয় হেসে জিজ্ঞেস করল, ‘গুড কোশ্চেন। তার আগে বলল, তুমি তোমার ফিজিক্যাল নিড কীভাবে ফুলফিল করো?

নিকিতা চোখ বড় বড় করে বলল, ‘আরে, আমি এখনো ভার্জিন। আমি কি তোমার মতো বিবাহিত ছিলাম নাকি? আর তোমার মতো তাগড়া পুরুষমানুষও না আমি।’

প্রিয় হো হো করে হেসে দিল। নিকিতার ভালো লাগছিল। কী সুন্দর হাসি প্রিয়র! খুব কমই দেখার সৌভাগ্য হয়েছে তার। আজ সে নিজেই হাসাচ্ছে, ভাবতেই বুকের ভেতর ঝড় বইছে।

প্রিয় হাসতে হাসতে বলল, ‘তাগড়া পুরুষমানুষ! হোয়াট আ ডায়ালগ ইয়ার!

‘উত্তরটা এড়িয়ে যেয়ো না।’

‘কেন এড়িয়ে যাব? আমি কারও সাথেই কিছু করি না। তোমার মতো

সাথে করে ঘুমাই। কোনোদিন চোখ বুলিয়ে দেখিও নি তোমার শরীরে। আমার কন্ট্রোল পাওয়ার সম্পর্কে তোমার ধারণা সবচেয়ে বেশি থাকার কথা।

‘কিন্তু একটা ছেলে হয়ে কীভাবে পারো তুমি?

প্রিয় হেসে বলল, আমার তো লাগবে পেট্রাকে, অন্য কোনো নারী শরীর দিয়ে আমার হবে না। যে হাত তাকে ছুঁয়েছে, সে হাত অন্য কাউকে ছুঁতে দ্বিধাবোধ করে। আর ফিজিক্যাল নিডের কথা বলছ, আই থিংক ইটস অল অ্যাবাউট লাভ।’

কীভাবে? তাহলে কি দেশে প্রস্টিটিউশন থাকত?

‘প্রস্টিটিউশনে যারা যায় বেশির ভাগেরই ঘরে বউ আছে, তাও টেস্ট চেঞ্জের জন্য যায়।

‘কী বলে? বিবাহিতরাও যায়?

‘বিবাহিতরাই বেশি যায়।’

নিকিতা সন্দেহের গলায় বলল, তুমি জানো কীভাবে?

প্রিয় হাসতে হাসতে বলল, ‘কী মনে হয়, আমিও যাই?

নিকিতা ভ্যাবাচেকা খেয়ে বলল, ‘না না, তা নয়। কিন্তু তোমার জানার সোর্সটা কী, তাই জানতে চাচ্ছিলাম। আমি তো এসব জানি না, তাই।

‘আমি কলেজে পড়ার সময় একবার প্রস্টিটিউশনে গিয়েছিলাম।

নিকিতার চোখ বড় বড় হয়ে গেল! বলল, ‘হোয়াট? আমি ভাবতেও পারছি না।’

প্রিয় হেসে বলল, ‘পেট্রার অনুমতি নিয়েই গিয়েছিলাম। আমার আসলে ওই মেয়েগুলোর সম্পর্কে জানার খুব ইচ্ছা ছিল, তাই গিয়েছিলাম। কিছু করি নি। নট আ সিঙ্গেল কিস। গল্প করেছি সারা রাত।

‘পেট্রা তোমাকে অনুমতি দিল?

‘আপু বলল, তোমার চেয়ে দশ বছরের বড়।

‘সরি, আসলে ওনাকে তো কখনো দেখি নি, তাই খেয়াল ছিল না।’

‘ঠিকাছে ঠিকাছে। আর না বললেই হলো।

‘আচ্ছা, এবার বলো পেট্রা আপু তোমাকে অনুমতি দিল কীভাবে? আই মিন, দুনিয়ার কোনো মেয়ে এটা মানতে পারবে? আমি হলে জীবনেও পারমিশন দিতাম না।’

প্রিয় হেসে বলল, এখানেই পেট্রার সাথে বাকি সবার পার্থক্য। আমি যখন ইচ্ছাটার কথা জানিয়েছি, ও বলেছিল, ইচ্ছা হলে যাবি কিন্তু এটাকে রেগুলার অভ্যাস বানিয়ে ফেলিস না। তারপর যখন বলেছি, শুধু একবারই যাব, তখন ও আর কিছু বলে নি। আসলে ওর আমার ওপর বিশ্বাস ছিল। আমাকে পেট্রা যতটা চেনে, ততটা দুনিয়ার কেউ চেনে না। আর আমিও কখনো বিশ্বাস হারানোর মতো কিছু করি নি। উল্টোপাল্টা কিছু করলে ওর অনুমতি নিয়ে নিতাম, এটাতে লাভও ছিল। পরবর্তী সময়ে কোনো ঝামেলা হলে ওর সাহায্য পেতাম।

‘উল্টোপাল্টা কিছু বলতে?

‘একটা তো শুনলেই, এমন আরও অনেক উদ্ভট কাজ করতাম।

‘যেমন? একটা বলো।

‘যেমন ড্রিংক করা, কোনো মেয়ে শত্রুতা করলে বন্ধুদের নিয়ে তাকে আটকে ভয় দেখানো–এ রকম আরও অনেক ছিল। বাদ দাও তো। ছোটবেলায় কত আকাম করেছি!

‘তোমাদের সম্পর্কটা অদ্ভুত ছিল। এমন সম্পর্কের কথা আগে কখনো শুনি নি।

প্রিয় হাসল। হাসিটা মলিন। নিকিতা বলল, আচ্ছা, তোমরা দুজন দুজনকে তুই করে বলতে কেন?

‘বন্ধু ছিলাম যে।’

‘আমাকে বলবে তোমাদের লাভ স্টোরিটা?”

প্রিয় অবাক হয়ে বলল, তুমি শুনবে?

‘আমার খুব জানতে ইচ্ছা করে।

প্রিয় নড়েচড়ে বসল। হেসে বলল, আমি যখন ক্লাস থ্রিতে পড়ি তখনকার একদিনের ঘটনা। আমাদের হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষার রেজাল্ট দিল এবং আমি অবাক হয়ে দেখলাম, আমি সেকেন্ড হয়েছি। আমার শরীর ঠান্ডা হয়ে গেল। একদম নার্সারি ক্লাস থেকে কখনো কোনো পরীক্ষায় আমি সেকেন্ড হই নি। সব সময় ফাস্ট। এমনকি যে সেকেন্ড হতো, তার সাথে আমার অনেক নম্বরের ডিফারেন্স থাকত। আমি ঘামতে লাগলাম। চোখে অন্ধকার দেখতে লাগলাম। আমার এত খারাপ লাগছিল, যা বলে বোঝানোর মতো না। তাও আবার ফার্স্ট হয়েছে একটা মেয়ে, যে কিনা ওই বছরই আমাদের স্কুলে নতুন এসেছে। বুঝলে, মানসম্মানের তেরোটা বেজে গিয়েছিল আমার। একটা মেয়ে আমাকে ডিঙিয়ে ফাস্ট হয়েছে। সবার মুখে একটাই কথা। প্রিয় এবার ফাস্ট হতে পারে নি, নতুন একটা মেয়ে ফাস্ট হয়েছে। রাগে আমার মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছিল।

নিকিতা হেসে বলল, ‘মেয়েটা পেট্রা আপু ছিল?

প্রিয় হেসে বলল, ‘হুম।

‘তারপর?

‘তারপর আর কী, পেট্রা আমার শত্রু হয়ে গেল। এই একজনই ছিল ক্লাসে, যার সাথে আমি কথা বলতাম না। আমার জীবনের তখন একটাই লক্ষ্য, ফাস্ট হওয়া। তারপর ফাইনালে ঠিকই আমি ফার্স্ট হলাম। এবার আমি ওর শত্রু হয়ে গেলাম। উড়োকথা শুনলাম, ও নাকি কখনো সেকেন্ড হয় নি, তাই এটা মেনে নিতে পারছে না। এখন আরও বেশি পড়াশোনা করছে যাতে আবার ফাস্ট হতে পারে। কিন্তু পারল না। হাফ ইয়ার্লিতে আমিই ফার্স্ট হলাম। কিন্তু ফাইনালে গিয়ে ও ফার্স্ট হলো। আমি হলাম সেকেন্ড।

নিকিতা হেসে ফেলল। প্রিয় হাসতে হাসতে বলল, বোঝো অবস্থা, ক্লাস ফাইভে আমার রোল নম্বর হলো ২। কী লজ্জা, কী লজ্জা! ক্লাস ফাইভে ও একবারও ফার্স্ট হতে পারে নি, কিন্তু সিক্সে আবার আমি হাফ ইয়ার্লিতে ফার্স্ট হলেও ফাইনালে হতে পারি নি। এভাবেই আমরা ক্লাস এইটে উঠলাম। এই পাঁচ বছরে আমরা কেউ কারও সাথে হাই-হ্যালোও করি নি। দুজন দুজনকে শত্রু মনে করেছি।’

‘ক্লাস এইটে কী হলো?

‘ক্লাস এইট মানে তো বোঝেই, মোটামুটি ভালোই বড় হয়েছি আমরা, বয়ঃসন্ধিকাল চলছে। তো আমার একটা বন্ধু একদিন পেট্রাকে নিয়ে রসিয়ে রসিয়ে কথা বলছিল।’

‘তখন তুমি ওই ফ্রেন্ডকে মেরেছিলে?

‘আরে নাহ। শোনোই না, ওর কথা শুনে আমি পেট্রার দিকে তাকাই এবং তখনই খেয়াল করি, মেয়েটা বড় হয়ে গেছে। চোখে পড়ার মতো সুন্দর হয়েছে। আমি তো ওকে সব সময় শক্ৰই ভেবেছি, কখনো তো ওভাবে তাকিয়ে দেখি নি।

‘তারপর?

তারপর থেকে আমার চোখ আপনাআপনি ওর দিকে চলে যেত। আমি দেখতাম ওকে। একদিন স্পোর্টস ক্লাসে ওর পা কেটে গিয়েছিল। স্পোর্টস টিচার আমাকেই বলল ব্যান্ডেজ করে দিতে। কারণ, এই কাজটা আমি ভালো করতাম। আমি দিলামও। আর হাঁ করে চেয়ে দেখছিলাম ওর পা কতটা সুন্দর। ও নিজেও অবাক হয়ে দেখছিল আমি ইদানীং শত্রুতা কম করি। নিজ হাতে ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছি, এটা তো অবিশ্বাস্য একটা ব্যাপার ছিল। কিন্তু ওই দিন এত কাছে থেকেও আমরা দুজন দুজনের সাথে কোনো কথা বলি নি।

‘তারপর কী হলো?

‘তারপর হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষার মাঝখানে ও অসুস্থ হয়ে পড়ে। প্রচণ্ড জ্বর নিয়ে এল ম্যাথ এক্সাম দিতে। ওর রোল নম্বর এক আর আমার দুই তাই পরীক্ষার হলে ও আমার সামনে। আমার পরীক্ষা শেষ করে ওর খাতার দিকে তাকিয়ে দেখি, ও একটা উপপাদ্য শুরু করে বসে আছে। বাকিটা সম্ভবত ভুলে গেছে। আমি ওই উপপাদ্যটা লুজ পেজে করেছিলাম। ওই পেজটা আলাদা করে এমনভাবে রাখলাম, যাতে ও পেছনে তাকালে দেখতে পায়। আমাদের ক্লাসরুম অনেক বড় ছিল। টিচাররা সাধারণত পেছন দিকেই ঘুরঘুর করত বেশি। তো আমি ওর চুল ধরে টান দিলাম। ও অবাক হয়ে ভুরু কুঁচকে তাকাল। আমি ইশারায় বোঝলাম আমার খাতা থেকে দেখে নিতে। ও খুব অবাক হয়েছিল, তবে দেখেছিল। খাতা জমা দিয়ে বের হওয়ার পর ও আমার কাছে এসে থ্যাংকস দিল আর বলল, আমি না দেখালে ও লিখতে পারত না। জ্বর নিয়ে পড়েছিল, তাই ভুলে গিয়েছিল। আমিও বললাম যে আমি বুঝেছি ব্যাপারটা, সে জন্যই সাহায্য করেছি। এত থ্যাংকফুল হওয়ার কিছু নেই। অন্য কোনো এক্সামে আমাকে হেল্প করে শোধ করে দিলেই হবে। এ কথা বলার পর ও হেসেছিল। সেদিনই প্রথম খেয়াল করলাম, ওর হাসিটা ভীষণ সুন্দর, চোখ দুটোও সুন্দর।

‘তারপর প্রেম হলো কবে? কী করে?

প্রিয় নিকিতার দিকে তাকিয়ে রহস্যময় ভঙ্গিতে হাসল।

নিকিতা বলল, তুমি আমার দিকে তাকিয়ে এমন রহস্যময় হাসি দিচ্ছ কেন?

প্রিয় মিটিমিটি হেসে বলল, ‘বারে, তোমার না অভিযোগ যে আমি তোমার দিকে তাকাই না? এখন তাকিয়েছি, এটাতেও দোষ?

‘আমি বলি নি দোষ। সেভাবে তাকালে তো জীবন ধন্য হয়ে যেত কিন্তু তোমার এই দৃষ্টিটা রহস্যময়।’

প্রিয় একইভাবে তাকিয়ে রইল। ঠোঁটে মুচকি হাসি। নিকিতাও তাকিয়ে রইল, যেভাবেই তাকাক না কেন, আজ প্রথম প্রিয় হাসিমুখে তার চোখের দিকে তাকিয়েছে। কিছুক্ষণ এভাবে তাকিয়ে থাকার পর প্রিয় বলল, তোমার চোখে আমি হিংসার আগুন দেখছি, নিকিতা।’

নিকিতা চোখ সরিয়ে নিল। ইতস্তত করে বলল, ‘কই, না তো।’

‘তুমি কীভাবে আমাকে ভালোবাসলে, বলো তো?

নিকিতা এই প্রশ্নে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। প্রিয় আবার বলল, ‘প্রথম প্রথম তত বোধ হয় খুব ঘৃণা করতে আমাকে।

হ্যাঁ, করতাম।’

‘তাহলে অনুভূতিটা বদলে গেল কী করে?

‘তোমরাও তো প্রথম প্রথম দুজনকে ঘৃণা করতে। পরে তো ঠিকই ভালোবেসেছিলে।’

‘আমাদের ব্যাপার আর তোমার ব্যাপার এক না।

‘তুমি আমার স্বামী! স্বামীকে ভালোবাসার জন্য কোনো কারণ লাগে না।’

‘তুমি কি বলতে চাও দুনিয়ার সব মেয়ে তার স্বামীকে ভালোবাসে?

‘মেয়েটার কোনো পিছুটান না থাকলে অবশ্যই বাসে।

‘তোমার পিছুটান থাকলেই আমার বড় সুবিধা হতো।

‘কেন? তুমি তো বলেছিলে তোমাদের সম্পর্ক আর কখনো জোড়া লাগা সম্ভব না। তাহলে আমি থাকলে অসুবিধা কী?

‘আসলে তুমি অনেক ভালো মেয়ে। আমার পরিবার তোমাকে ঠকিয়েছে, আমার গিলটি ফিলিং হতো। আর যেদিন থেকে তুমি আমাকে ভালোবাসো, সেদিন থেকে আরও বেশি খারাপ লাগে। তুমি বাচ্চা একটা মেয়ে, বাকি জীবনটা তো তোমার পড়েই আছে। চলে গেলে আবার সব নতুন করে শুরু করতে পারবে। সুখী হবে।

প্রিয়র মুখে এমন কথা শুনে বড় ভালো লাগছে নিকিতার। মানুষ ঠিকই ওপরে ওপরে খারাপ ব্যবহার করলেও ভেতরে তাকে নিয়ে ভাবে! শ্বশুর বাবা ঠিকই বলেন। প্রিয় অনেক ভালো মানুষ। নিকিতা বলল, আমি তোমার সাথে সুখী হতে চাই। ভালোবাসা কি ফেরানো যায়, বলো? এত কিছুর পরও তুমি কি পেরেছ ফেরাতে?

প্রিয় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, এই কথাটা ঠিকই বলেছ।’

প্রিয় ভাবছিল ভাগ্য কেন এমন খেলা করল! নিকিতা তাকে আনমনে দেখে আরেকটু কাছে গিয়ে বসল। প্রিয় টের পেল না। নিকিতা হাঁটুতে মুখ খুঁজে প্রিয়র দিকে মাথা দিয়ে বলল, বাদ দাও না। তোমার রাগী রাগী মুখটাও ভালো লাগে, হাসিখুশি মুখ তো ভালো লাগেই; কিন্তু এই বিষণ্ণ মুখটা একদম ভালো লাগে না।’

প্রিয় নিকিতার দিকে তাকিয়ে ম্লান হাসল। নিকিতা বলল, ‘তোমাদের কাহিনিটা কন্টিনিউ করো।’

‘তোমার তো শুনতে খারাপ লাগছে।’

‘একদম না। বরং বাকিটা জানতে ইচ্ছা করছে। তুমি বলো প্লিজ।

প্রিয় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বালিশে হেলান দিয়ে বলতে শুরু করল, ‘আমার জন্ম, ছোটবেলা সব সাভারে কেটেছে। পেট্রা ক্লাস থ্রিতে সাভারে এসেছিল। কারণ ওর বাবা তখন সাভারে ট্রান্সফার হয়। তারপর থেকে ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার আগপর্যন্ত আমরা সাভারেই থাকতাম।

‘আচ্ছা।’

‘ক্লাস এইটের হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষা পর্যন্ত বলেছি।

‘হুম।

‘পরীক্ষার পর দুই সপ্তাহ ছুটি ছিল। এই দুই সপ্তাহে আমি অস্থির হয়ে গিয়েছিলাম। আমার শুধু পেট্রাকে দেখতে ইচ্ছা করত। খুব মিস করতে লাগলাম ওকে। কিন্তু বুঝতাম না এমন কেন লাগত। স্কুল খোলার পর। আমি ওকে দেখে শান্তি পেলাম। সারাক্ষণ শুধু তাকিয়ে থাকতাম ওর দিকে। তখন আমরা প্রতিদিনই টুকটাক কথাবার্তা বলতাম। আস্তে আস্তে আমরা বন্ধু হয়ে গেলাম। ফাইনাল পরীক্ষায় ও ফাস্ট হলো আর আমি সেকেন্ড। এই প্রথম সেকেন্ড হয়েও আমার খারাপ লাগল না। বাসায় আসার সময় ভাইজান আমাকে বলল, ‘কী ব্যাপার প্রিয়, তুই সেকেন্ড হয়েছিস অথচ মন খারাপ করছিস না!”

নিকিতা বলল, ‘ভাইজান কে?

প্রিয় বলল, আমার বড়ভাই, রোড অ্যাকসিডেন্টে মারা গেছে। মাসহ।

‘সরি। আমি জানতাম কিন্তু খেয়াল ছিল না।

‘ইটস ওকে। ওই অ্যাকসিডেন্টের কথা আমি মনে করতে চাই না। যাই হোক, আমি ওকে ভাইজান বলে ডাকতাম। আমার বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল সে, আমার আইডল ছিল। সে তখন ক্লাস টেনে পড়ত, আমাদের স্কুলেই। ভাইজান ওই কথা জিজ্ঞেস করতেই আমি বললাম, সমস্যা কী, পেট্রাই তো ফাস্ট হয়েছে, অন্য কেউ তো না।

ভাইজান অবাক হয়ে বলল, শালা, এত দিন তো পেট্রা ফার্স্ট হতো বলেই তুই দুনিয়া উদ্ধার করতি।

আমি আমতা আমতা করতে লাগলাম। আমি নিজেও খুব অবাক হলাম। বললাম, না, মানে ভাইজান, এখন তো ও আমার বন্ধু হয়ে গেছে।

ভাইজান বলল, তুই কি ওর প্রেমে পড়েছিস প্রিয়? খবরদার, এই ভুল করিস না। ও খ্রিষ্টান, এটা মনে রাখিস। বাবা জানলে খুন করে ফেলবে। তাও তোকে না, পেট্রাকে।

আমি ভাইজানকে বললাম, আরে না ভাইজান, প্রেমে কেন পড়ব? জানি তো ও খ্রিষ্টান।

কিন্তু তারপর থেকে আমি ভাবতে লাগলাম, আসলেই কি আমি ওর প্রেমে পড়েছি? দিনরাত শুধু এ কথাই ভাবতাম। অস্থির লাগতে লাগল এই ভেবে যে, কবে স্কুল খুলবে? অবশেষে স্কুল খুলল। ক্লাস নাইনে আমরা দুজনই সায়েন্সে চলে গেলাম। আমাদের সব বন্ধুই অন্যান্য গ্রুপে। এ কারণেই আমরা একা হয়ে গেলাম। তাই আমি প্রতিদিন আগে আগে স্কুলে যেতাম এবং ওর পাশে বসতে চেষ্টা করতাম। পেট্রাও মানা করত না। তত দিনে বুঝে গেছি আমি পেট্রাকে ভালোবেসে ফেলেছি। কিন্তু যেহেতু ও খ্রিষ্টান, ওর সাথে তো প্রেম হওয়া অসম্ভব। ওর থেকে দূরেও থাকতে পারতাম না। তাই ভেবেছিলাম অন্তত ওর বেস্ট ফ্রেন্ডের জায়গাটা আমার হোক। আস্তে আস্তে আমরা বেস্ট ফ্রেন্ড হয়ে গেলাম। তখনই আমরা তুই তুই করে বলতে শুরু করি। আমরা পড়াশোনায় দুজন দুজনকে সাহায্য করতাম। দুজনই ফিজিকস, কেমিস্ট্রি, বায়োলজি, ইংলিশ আর ম্যাথ স্কুলের টিচারদের কাছে পড়তে শুরু করলাম। বুঝতেই পারছ, স্কুল, পড়তে যাওয়া–সব মিলিয়ে সারা দিন একসাথে থাকতাম। আস্তে আস্তে এমন অবস্থা হলো যে একজনকে ছাড়া আরেকজনের চলত না। ভাইজানও তত দিনে বুঝে গেছে যে আমি পেট্রাকে ভালোবাসি। কিন্তু আগবাড়িয়ে কিছু বলত না। ক্লাস নাইনের হাফ ইয়ার্লি এক্সামের পর স্কুল আবার বন্ধ। স্যারের বাসায়ও পড়তে যাই না। সপ্তাহখানেকের ছুটি! আমি পাগল হয়ে গিয়েছিলাম পেট্রাকে দেখার জন্য। তখনকার যুগে তো আর মোবাইল এত অ্যাভেইলেবল ছিল না। আমাদের বাসায় ল্যান্ডফোন ছিল। ভাইজানের পারসোনাল মোবাইল ছিল, ও তো তখন কলেজে পড়ত। পেট্রা প্রায় প্রতিদিনই ওর বাবা বা মায়ের মোবাইল থেকে টিঅ্যান্ডটি ফোনে বা ভাইজানের ফোনে ফোন করত। তখন আমাদের কথা হতো। এবং আমি বুঝতে পারলাম, পেট্রাও আমাকে মিস করে। তা না হলে ছোট ছোট সব কারণে ও আমাকে ফোন করবে কেন?

নিকিতা জিজ্ঞেস করল, ‘আসলেই কি আপুও তোমাকে ভালোবাসত? পরে নিশ্চয়ই জেনেছ?

হ্যাঁ, জেনেছি। পেট্রাও ক্লাস নাইনে ওঠার পরই বুঝে ফেলেছিল আমি ওকে ভালোবাসি। আস্তে আস্তে ও নিজেও আমাকে ভালোবেসে ফেলেছিল, আমি মুসলিম বলেই ও ব্যাপারটা চেপে রেখেছিল।

‘আচ্ছা, তারপর?

‘ছুটির মধ্যে চার-পাঁচ দিন হয়ে গেল দুজন দুজনকে দেখি না। পাগলপ্রায় অবস্থা আমার। ভাইজানকে বাসা থেকে বাইরে নিয়ে গিয়ে সব বললাম। ভাইজান বলল ও আগেই বুঝেছিল। আমি ভাইজানের কাছে জিজ্ঞেস করলাম, কী করব?

ভাইজান বলল, দ্যাখ, অনেক সময় এমন পরিস্থিতি আসে যে মনকে কোনোভাবে সামলানো যায় না। পেট্রাও বোধ হয় তোকে ভালোবাসে। এখন তো তোর পক্ষে নিজেকে সামলানো আরও মুশকিল। যাতে তুই ভালো থাকবি, তা-ই কর। কিন্তু আগেই বলে রাখি, আমি তোকে গ্যারান্টি দিতে পারি, বাবা-মা জীবনেও মানবে না এই সম্পর্ক। তবে হ্যাঁ, তুই যা-ই করিস না কেন, আমি আজীবন তোর পাশে থাকব।

আমি সেদিন সারা দিন ভাবলাম, ভেবে কোনো কূলকিনারা করতে পারলাম না। শেষমেশ সিদ্ধান্ত নিলাম, মন যা চাইবে তা-ই করব, কিছু ভাবব না। ভাবতে গেলেই সব গুলিয়ে যায়। রাতে মন চাইল পেট্রাকে দেখব। যদিও এক এলাকাতেই থাকি কিন্তু পেট্রার বাসা তো চিনি না, কীভাবে যাব? এমন সময় পেট্রা ভাইজানের মোবাইলে ফোন করল। আমি বললাম, পেট্রা, তোর বাসাটা কোথায় রে? ঠিকানা দে। পেট্রার অভ্যাস ছিল, প্রশ্ন করলে আগে উত্তর দিত। তারপর কারণ জানতে চাইত। সেদিনও বাসার ঠিকানা বলে তারপর জানতে চাইল কেন চাইলাম। আমি বললাম, আমি আসছি, ফোন কাছে রাখিস।

ও বলল, রাত বাজে একটা, প্রিয়। তুই এখন কেন আসবি?

আমি বললাম, খুব জরুরি কাজ আছে, আমাকে আসতেই হবে। আমি তোকে একটা জিনিস দেব।

ও বলল, ঠিকাছে, কাল সকালে আয়।

আমি খামোখাই ওকে ধমক দিলাম। বললাম, আমাকে এক্ষুনি আসতে হবে। এই মুহূর্তে।

ও বলল, এত রাতে বের হতে পারব না।

আমি বললাম, আমি জানি না তুই কীভাবে বের হবি। আমি গিয়ে ফোন করব।

আমার জেদ দেখে ও বলল, আচ্ছা আয়, তোর বাসা থেকে এখানে আসতে কতক্ষণ লাগবে?

আমি তো অনুমতি পেয়ে মহাখুশি। বললাম, দশ মিনিট।

ও বলল, আমাদের বাসায় শুধু আমরাই থাকি। একতলা বাসা। বাসার পেছনে আমবাগান আছে। আমি দশ মিনিট পর ওখানে থাকব। তুই আগে এলে অপেক্ষা করবি, আমি আগে গেলে আমি অপেক্ষা করব। কিন্তু ফোন দিস না। ফোন চুরি করে এনেছিলাম, আবার চুরি করে রেখে আসতে হবে।

আমি আমবাগানে গিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। কয়েক মিনিটের মধ্যে পেট্রা চলে এল। ও চোরের মতো এসে ফিসফিস করে বলল, কী ব্যাপার, কী এমন জিনিস দিতে এসেছিস? কাল পর্যন্ত কি আমরা মরে যেতাম?

আমি বললাম, আমাকে দিতে এসেছি।

ও ভয় পেয়ে গেল। ও চাচ্ছিল না আমি প্রপোজ করি। বলল, প্রিয়, তুই পাগল হয়ে গেছিস। তুই বাসায় যা।

এ কথা বলে ও চলে যাচ্ছিল। আমি ফট করে বলে ফেললাম, আই লাভ ইউ।

ও বলল, ফর গড সেক, এই কথাটা ভুলেও বলিস না। তুই মুসলিম, আমি খ্রিষ্টান। আমাদের ভালোবাসা অপরাধ, পাপ।

এটুকু বলে প্রিয় থেমে গেল। নিকিতা বলল, তারপর কী হলো? প্রিয় বলল, তারপর আর কী? ও আমাকে ফিরিয়ে দিল। আমি অনেক বোঝালাম, সারা জীবন পাশে থাকার প্রমিজ করলাম। কাজ হলো না। ও হঠাৎ কান্নাকাটি শুরু করে দিল। বাসায় চলে যেতে চাচ্ছিল। তারপর যেতে দিলাম, আমিও বাসায় ফিরে এলাম।

নিকিতা জিজ্ঞেস করল, তাহলে প্রেম হলো কবে?

‘ফাইনাল পরীক্ষার সময় হয়েছিল। বাকিটা আবার কাল বলব। এখন ঘুমাব। অলরেডি তিনটা বাজে। কাল অফিস আছে, ভোরে উঠতে হবে।’

‘আচ্ছা, ঠিকাছে।

প্রিয় শুয়ে পড়ল। নিকিতাও আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ল। ওর কেন যেন মনে হচ্ছে প্রিয় ঘুমানোর জন্য গল্প বলা বন্ধ করে নি। হয়তো আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছে। ওর মুখটা কেমন যেন হয়ে গেছে। ও কি প্রপোজালের রাতের কথা সব বলেছে, নাকি কিছু স্কিপ করেছে? নিকিতার কেন যেন খুব খারাপ লাগছিল প্রিয়র জন্য। ইচ্ছা করছিল প্রিয়কে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে রাখতে। কিন্তু সেই অধিকারও তত তার নেই।

নিকিতার ধারণা সত্যি। প্রিয় শুয়ে পড়ল ঠিকই কিন্তু ঘুমানোর জন্য নয়। আজ তো কিছুতেই ঘুম আসবে না। নিজের আবেগপ্রবণ চেহারাটা নিকিতাকে দেখাতে চাচ্ছিল না, তাই শুয়ে পড়েছে। স্মৃতিগুলো একটু ঝাপসাও হয় না কেন? কত বছর আগের কথা। অথচ মনে হয় যেন কয়েক দিন আগেরই ঘটনা। পেট্রা চোরের মতো পা ফেলে ফেলে এসেছিল আমবাগানে। প্রিয় প্রপোজ করেছিল। পেট্রা কোনোভাবেই মানছিল না। যখন চলে যাচ্ছিল, তখন প্রিয় তার হাত ধরে থামিয়েছিল। পেট্রা বলছিল, ‘প্রিয়, কী করছিস? হাত ছাড়, আমাকে যেতে দে।

প্রিয় পেট্রাকে গাছের সঙ্গে ঠেকিয়ে মুখ চেপে ধরে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘তুই আমাকে ভালোবাসিস না?

পেট্রা অনেক চেষ্টা করেও প্রিয়র হাত সরাতে পারল না। তারপর ইশারায় বোঝাল যে, মুখ চেপে ধরে রাখলে বলবে কীভাবে? প্রিয় বোকা বনে গেল। মুখ ছেড়ে দিয়ে বলল, ‘বল, সত্যি কথা বলবি।’

পেট্রা বড় বড় শ্বাস নিতে নিতে বলেছিল, ‘হারামি, মুখ চেপে ধরার যোগ্যতাও নাই? নাকসহ কেউ ধরে? আরেকটু হলে আমি মরে যেতাম।

প্রিয় ধমক দিয়ে বলেছিল, ‘আনসার মি।’

পেট্রা খুব স্বাভাবিক গলায় মিথ্যা কথাটা বলেছিল, না, আমি তোকে ভালোবাসি না।

‘তুই নিশ্চিত?

‘শতভাগ নিশ্চিত। তুই শুধু আমার বেস্ট ফ্রেন্ড।

প্রিয় সঙ্গে সঙ্গে দুহাতে পেট্রার মুখটা ধরে গাছের সঙ্গে ঠেকিয়ে চুমু খেয়েছিল ঠোঁটে। পেট্রা প্রচণ্ড অবাক হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ভালো তো সেও বাসত। সে টেরও পেল না কখন তার হাত দুটো প্রিয়কে জড়িয়ে ধরল। কখন তার ঠোঁট জোড়া প্রিয়র ঠোঁটের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করে দিল। প্রিয়ই একসময় থেমেছিল। হেসে বলেছিল, তার মানে তুইও আমাকে ভালোবাসিস। নাহলে একটা চড় মারতি এক্ষুনি।’

পেট্রা তখন কাঁদতে শুরু করে দিয়েছিল। কারণ, ওই মুহূর্তেই সে বুঝেছিল, সে শুধু ভালোই বাসে না প্রিয়কে, সে প্রিয়কে চায়ও। প্রিয় পেট্রার হাত দুটো নিজের দুহাতে ধরে দুই হাঁটু গেড়ে বসল। পেট্রা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদছিল। প্রিয় পেট্রার হাতের পিঠে চুমু খেয়ে বলল, আমি প্রতিজ্ঞা করছি, এই হাত কখনো ছাড়ব না, আজীবন তোর পাশে থাকব। প্রতিজ্ঞা করছি, ধর্ম, পরিবার, সমাজ–কোনো কিছু আমাকে তোর থেকে দূরে সরাতে পারবে না। প্রতিজ্ঞা করছি, কখনো তোকে কাদাব না। প্রতিজ্ঞা করছি, তুই ছাড়া অন্য কোনো মেয়ে আমার জীবনে আসবে না। প্রতিজ্ঞা করছি, পরীক্ষার হলে তোকে একা রেখে বের হব না। প্রতিজ্ঞা করছি, তোকে প্রতিদিন চালতার আচার কিনে দেব। প্রতিজ্ঞা করছি, বৃষ্টির মধ্যে টংদোকানে বসে চা খেতেও আপত্তি করব না আর। প্রতিজ্ঞা করছি, তোর সব প্র্যাকটিক্যাল আমি করে দেব। আর…’।

পেট্রা এসব শুনতে শুনতে কাঁদছিল। প্রিয় থেমে যাওয়ায় জিজ্ঞেস করল, আর কী?

প্রিয় আমতা আমতা করে বলল, আর ঐশ্বরিয়ার পেটের দিকেও তাকাব না।’

শেষ কথাটা শুনে পেট্রা কাঁদতে কাঁদতেই হেসে দিল। প্রিয়ও হাসল। বলল, ‘মজা করছি না। আমি সত্যি এগুলো করব।

পেট্রা হাত ছেড়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল, এটা হয় না, তুই চলে যা। আমরা যেমন বন্ধু ছিলাম, তেমনই থাকব আজীবন।

এ কথা বলে পেট্রা চলে গিয়েছিল। প্রিয়ও বাড়ি ফিরে গিয়েছিল। একটুও মন খারাপ করে নি। কারণ ওর ভেতর একটা আত্মবিশ্বাস চলে এসেছিল। পেট্রা যত যা-ই বলুক, ওকে ভালো তো বাসে। ওই মুহূর্তে ওটাই যথেষ্ট ছিল। তার ওপর জীবনের প্রথম চুমুর অনুভূতিটা প্রিয়র মস্তিষ্কে আর কিছু আসতে দেয় নি। হাসতে হাসতে সিটি বাজাতে বাজাতে চলে গিয়েছিল। সারা রাত একফোঁটা ঘুমাতে পারে নি। কী সুখের রাত যে ছিল!

অথচ সেই সুখানুভূতির কথা ভাবতেই আজ চোখে জল এসেছে প্রিয়র।

প্রিয় চোখ মুছে পেছন ফিরে দেখল নিকিতা ঘুমিয়ে পড়েছে। কত সহজে ঘুমিয়ে যেতে পারে মানুষ। ও কেন পারে না? পেট্রা কি ঘুমাতে পারে? খুব সম্ভবত পারে না। পেট্রা কী করছে এখন? ফোন করবে? ফোন করলে কি ধরবে পেট্রা? প্রিয় বিছানা থেকে পা নামিয়ে বসল কিছুক্ষণ। তারপর স্যান্ডেল পায়ে দিয়ে ধীর পায়ে ওয়ার্ডরোবের কাছে গেল। এই ওয়ার্ডরোবের চারটা ড্রয়ারই লক করা থাকে, যার চাবি শুধু প্রিয়র কাছেই আছে। ওপরের ড্রয়ারটা খুলল প্রিয়। এই ড্রয়ারে পেট্রার স্মৃতিবিজড়িত সব জিনিসপত্র আছে। সবকিছুর ওপর হাত বুলিয়ে নিল। তারপর ড্রয়ারটা বন্ধ করে দ্বিতীয় ড্রয়ারটা খুলল।

দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ–এই তিনটা ড্রয়ার ভর্তি হয়ে আছে পেট্রার লেখা অজস্র চিঠি। প্রতিদিন রাতে চিঠি লিখত তারা। ক্লাসে দিত দুজন দুজনকে। কিন্তু শর্ত ছিল, বাসায় যাওয়ার আগে কেউ চিঠি পড়তে পারবে না। ওরা কেউই শর্ত ভাঙে নি। দুজনেই রাত হলে চিঠি পড়ত। কলেজে উঠে দুজনই পারসোনাল মোবাইল পেয়েছিল। অনেক রাত পর্যন্ত ফোনে কথা বলত ওরা। তারপরও চিঠি লেখা কখনো বন্ধ হয় নি। বিয়ের পর যখন একসঙ্গে থাকত, তখনো দুজনই সারা দিনে কোনো এক ফাঁকে চিঠি লিখে লেটার বক্সে ফেলে রাখত। একইভাবে দুজনই লেটার বক্স চেক করত। সবগুলো চিঠিই যে বড় তা নয়, অনেক ছোট ছোট চিঠিও আছে। শেষ চিঠিটা প্রিয় পেয়েছিল নিকিতার সঙ্গে ওর বিয়ের দিন।

প্রিয় একটা চিঠি উঠিয়ে ভাঁজ খুলল। কালি ছড়িয়ে লেখা এপাশ ওপাশ হয়ে গেছে। তবু পড়া যাচ্ছে। প্রিয় পড়তে শুরু করল,

‘আমার প্রিয়,

মাত্রই তোর সাথে কথা বলে ফোন রাখলাম। এখন পড়তে বসেছি। কিন্তু পড়তে ইচ্ছা করছে না। আমি মেডিকেলে চান্স পাব না দেখিস! তুই ঠিকই পেয়ে যাবি। তখন আমরা দুজন আলাদা জায়গায় পড়ব। প্রতিদিন আর দেখা হবে না। এসব ভেবে আরও মন খারাপ লাগছে। এসব কথা পড়ে রাগ করিস না, প্লিজ। কী করব বল, তোর থেকে দূরে যাওয়ার কথা ভাবতে পারি না তো।

জানিস, এখন আমার তোর হাতের টমেটোভর্তা খেতে ইচ্ছা করছে! সাথে ভর্তায় মাখা তোর হাতটা চেটে চেটে খেতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু পাব কোথায়? ছি ছি, কী সব ইচ্ছা করে আজকাল আমার! সব তোর দোষ।

-তোর পেট্রা

প্রিয় চিঠিটা পড়ে আবার ভাজ করে রাখল। ডয়ার লক করে দিল পানি খেলো, পুরো বাড়িতে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করল। তারপর ঘরে ফিরে সিগারেট ধরাল। সিগারেট টানতে টানতে ঘরের মধ্যেই এদিক-ওদিক পায়চারি করতে লাগল। বদ্ধ ঘরের মধ্যে ধোয়া জমতে শুরু করল। ধোয়ায় তার চোখ জ্বলতে লাগল। ভালোই হলো, এই সুবাদে বেশ কিছুটা চোখের জল বেরিয়ে আসতে সুযোগ পেল। সিগারেট একটা শেষ হতেই দ্রুত হাতে আরেকটা ধরাল। একটু ড্রিংক করতে পারলে ভালো হতো, ঘুমাতে পারত। কিন্তু বাড়িতে কিছু নেই, সেই কবে শেষ হয়েছে। তারপর আর আনা হয় নি। মন্ত্রীসাহেবের ঘরে আছে কি না কে জানে! আর থাকলেও নিশ্চয়ই ওপরেই রেখে যায় নি। এসব ভাবতে ভাবতেই আজান দিয়ে দিল। প্রিয় অবাক হলো না। এ রকম কত নিঘুম রাত কেটেছে তার জীবনে, সেই হিসেব নেই।

নিকিতা চোখ খুলে দেখল প্রিয় তাকে ডাকছে, ‘নিকিতা? এই নিকিতা? আরে ওঠো।’

নিকিতা ঘুমের চোখেই যখন দেখল প্রিয় অফিসের জন্য রেডি, তখন লাফিয়ে উঠল। কম্বল সরাতেই দেখল তার শাড়ি ঠিক নেই। সঙ্গে সঙ্গেই প্রিয় অন্যদিকে তাকাল। নিকিতা শাড়ি ঠিক করতে করতে বলল, ‘ইশ,

সরি সরি। এত দেরি হয়ে গেছে, তুমি আমাকে ডাকো নি কেন?

প্রিয় তার স্বভাবসুলভ গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ‘সমস্যা নেই। আমি তোমাকে ডাকতাম না। দরজা লাগানোর জন্য ডেকেছি। কাজের লোকদের কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। আমি চলে গেলে তোমার এভাবে ঘুমানোটা বিপজ্জনক, মন্ত্রীসাহেবের বাসা তো, শত্রুর অভাব নেই।’

নিকিতা তড়িঘড়ি করে বিছানা থেকে নেমে চুল বাঁধতে বাঁধতে বলল, ‘তুমি পাঁচ মিনিট সময় দাও আমাকে, আমি নাশতা রেডি করে দিচ্ছি।’

‘আমি নাশতা করে নিয়েছি।’

নিকিতা অবাক হয়ে বলল, ‘কী নাশতা করেছ? কে বানাল?

‘ব্রেড ছিল দেখলাম। টোস্ট-ওমলেট বানিয়ে নিয়েছি।’

‘সরি, তোমাকে কষ্ট করতে হলো। আমি টেরই পাই নি তুমি কখন উঠেছ।

প্রিয় হেসে বলল, ‘এত অপ্রস্তুত হওয়ার কিছু হয় নি। আমার নাশতা তৈরি করা তোমার চাকরি নয়। দেরি হয়ে যাচ্ছে, আমি বেরোচ্ছি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *