৩.১ তৃতীয় খণ্ড – তরবারির বরাভয়ে শাসন

তৃতীয় খণ্ড – তরবারির বরাভয়ে শাসন

১৫. ধনুর্ধর সর্দার

শহরের কোষাগার বাবর যেমনটা আশা করেছিলো তারচেয়েও বেশি সম্পদে পূর্ণ ছিলো। শহরদূর্গের আস্তাবলের নিচে পুঁতে রাখা সিন্দুক হাজারারা খুঁজে পাবে না

বলে ওয়ালি গুল যেমন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো কার্যত তাই হয়েছে। “সুলতান, ব্যাটারা যদি কেবল ঘোড়ার লাদি সরিয়ে দেখতো, তাহলেই তারা হয়তো সিন্দুক দেখতে পেতো, কিন্তু এমন কাজ করাটা হাজারীদের মর্যাদার পক্ষে অচিন্তনীয়।” বৃদ্ধ লোকটা পুরোটা সময় আনন্দে খিলখিল করে হাসতে থাকে যখন ভৃত্যেরা হাঁটু পর্যন্ত গভীর তাজা ধোঁয়া উঠতে থাকা ঘোড়ার লাদি আর খড়কুটো সরিয়ে গোপন দরজা আর সিঁড়ির ধাপ উন্মোচিত করে যা আটটা ভূগর্ভস্থ কক্ষের দিকে নেমে গেছে। পুরু লোহা দিয়ে বাঁধানো ওক কাঠের দরজার পেছনে পর্যাপ্ত সোনা আর রূপার মোহর ছিল যা দিয়ে বাবর তার লোকদের ভালোমত পুরস্কৃত করতে পারে। নতুন লোক নিয়োেগ করতে পারে। আর তার নতুন সাম্রাজ্যের সৌন্দর্যবর্ধন করতে পারে।

সে পর্যালোচনা করতে থাকা বিশাল পরিকল্পনার ছকটা গুটিয়ে রাখে। নকশাটায় কাবুলের কেন্দ্রস্থলে সদ্যপ্রাপ্ত সম্পদের কিছুটা ব্যয় করে সে যে বিশাল গম্বুজযুক্ত মসজিদ নির্মাণের নির্দেশ দিয়েছে। সেটা চারকোণা প্রকোষ্ঠের আকারে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাকে যদিও কাবুল আর এর চারপাশে বিশাল অঞ্চলে এখানকার সর্দারটা আমন্ত্রণ করে নিয়ে এসেছে এবং তার নতুন প্রজারা তাকে স্বাগত জানিয়েছে সমতলে বসবাসকারী আইমাক, পাসাহিস, তাজিক, বারাকিস, এবং পাহাড়ের হাজারা আর নেগুডারিস, এবং কাবুলের বাসিন্দা- এদের ভিতর ফারগানার গোত্রগুলোর চেয়ে ঈর্ষা আর রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ কার্যত বেশি। তাদের মনে করিয়ে দিতে কোনো ক্ষতি নেই- তার মতো সুন্নী মুসলমান- আল্লাহতালার ইচ্ছা যে সে তাদের শাসক হবে।

আর তাছাড়া শহরটায় তার নিজের একটা স্থায়ী ছাপ রেখে যাওয়ার অনুভূতিই আলাদা- এমন একটা সৌধ যা আগামী শাসকদের তার কথা মনে করিয়ে দেবে। সমরকন্দে যা তৈরি করার সুযোগ সে পায়নি। সেখানে সে দীর্ঘ সময় অবস্থান করতে পারেনি। আর তাছাড়া তৈমূরের দ্বারা আগেই সৌন্দর্যমণ্ডিত করে তোলা শহর সে কিভাবে নতুন করে অলঙ্কৃত করতো। কাবুলে অবশেষে সে সুযোগ পেয়েছে। তৈমূরের উত্তরসুরী শাহজাদার মহিমায় শহরটাকে সাজিয়ে তোলার এমন একটা স্থান যেখানে শিল্পী আর সাহিত্যিকেরা এসে মিলিত হবেন।

এখন অবশ্য তাকে কিছু অপ্রিয় কাজ করতে হবে। একমাস আগে বাইসানগার তাকে বলেছিলো আলী ঘোসত- বাবরের অশ্বশালার প্রধান, যাকে সে সেনাবাহিনীর রসদের প্রধান ভারপ্রাপ্ত অমাত্য নিয়োগ করেছিলো- কাবুলে নির্দিষ্ট কিছু ঘোড়া আর ঘোড়ার খাদ্য সরবরাহকারীদের কাছ থেকে ঘুষ নিয়ে তাদের প্রতি বেশি উদারতা দেখিয়েছেন। বাবরের প্রত্যক্ষ আদেশের বিরুদ্ধে এটা। সে স্থানীয় লোকদের কাছে বারবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে, সে তাদের সাথে নায্য আচরণ করবে। এখন আলী ঘোসতের লোভের কারণে, সুলতান এতো সহজে তার কথার বরখেলাপ করেছেন বলে তারা যে ফিসফিস শুরু করেছিলো তার যথোপযুক্ত প্রমাণ পাবে…।

কোনো পদক্ষেপ নেবার আগে বাবর আরো প্রমাণ চেয়েছিলো- সে ছোটবেলা থেকেই আলী ঘোসতকে চেনে, এই লোকটার কাছেই সে ঘোড়ায় চড়া আর পোলো খেলা শিখেছিলো। কিন্তু বাইসানগার যখন আরো প্রমাণ হাজির করায়, তাকে এখন ব্যবস্থা নিতেই হবে। সে তার খিলানাকৃতি দরবার মহলের দিকে এগিয়ে যায়। যেখানে তার গিল্টি করা সোনার সিংহাসনের দুপাশে তার পারিষদবর্গ মর্যাদা অনুসারে দাঁড়িয়ে রয়েছে, সবচেয়ে বয়স্ক আর মর্যাদাবান তার সিংহাসনের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। সিংহাসনে উপবিষ্ট হয়ে। বাবর বাইসানগারকে ইঙ্গিত করে। “রসদের দায়িত্বপ্রাপ্ত অমাত্যকে নিয়ে আসা হোক।”

সে চোখেমুখে নির্বিকার অভিব্যক্তি নিয়ে তাকিয়ে দেখে, আলী ঘোসত তার পরিচিত প্রগতজানু হাঁটার ভঙ্গিতে এখন শিকলের কারণে অনেক বেশি প্রকট পা হেচড়ে হেচড়ে এগিয়ে আসে। তাকে আপাতদৃষ্টিতে অবজ্ঞাপূর্ণ দেখালেও বাবর জানে লোকটা ভেতরে ভেতরে শঙ্কিত। তার মুখে যুদ্ধের ক্ষতচিহ্ন স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি স্পষ্ট এবং ভীতচকিত চোখে উপস্থিত অমাত্যদের দিকে তাকাতে তাকাতে সে সিংহাসনের দিকে এগিয়ে আসে। সে পুরোটা সময় একবারও বাবরের দিকে তাকায় না এবং তার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা প্রহরীরা তাকে তাদের বর্শার উল্টোদিক দিয়ে ধাক্কা দেবার আগেই সে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ে।

 “আপনি জানেন আপনার বিরুদ্ধে কি অভিযোগ আনা হয়েছে…”

 “সুলতান আমি-”

 “আমার প্রশ্নের উত্তর দিন।”

“হ্যাঁ, সুলতান।”

 “আর সেটা কি সত্যি?”

“সবসময়ে এভাবেই বিষয়গুলো চলে এসেছে…”

“কিন্তু আমি আপনাকে পরিষ্কার করে বলেছিলাম, ঘোড়ার ব্যাপারীদের সাথে ন্যায্য আচরণ করতে। আপনি আমার কথা অমান্য করেছেন…”।

আলী ঘোসত মাথা তুলে তাকিয়ে শুকনো ঠোঁট জিহ্বা দিয়ে ভেজাতে চেষ্টা করে। “সুলতান, চেঙ্গিস খানের আমল থেকে আমার লোকদের মাঝে প্রচলিত প্রথা সম্পর্কে সুলতান আপনি জানেন। দরবারের সর্বোচ্চ অমাত্য নয় বার আদেশ অমান্য না করা পর্যন্ত শাস্তি পায় না।”

 “আর আপনি কমপক্ষে বারোবার আমার আদেশ অমান্য করেছেন…আমার কাছে পুরো বিবরণ আছে।”

ঘোড়ার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বপ্রাপ্ত অমাত্য আরো নতজানু হয়ে যায়। বাবর তার নতজানু হয়ে থাকা মাথার দিকে তাকিয়ে থাকে মোটা পেষল গর্দানটা জল্লাদের খড়গের কাছে কেমন অরক্ষিত মনে হয়। আলী ঘোসতও নিশ্চয়ই জানেন পৃথিবীর বুকে তার অন্তিম মুহূর্ত ঘনিয়ে এসেছে। সে এখন কি ভাবছে?

 দীর্ঘ মন্দ্র নিরবতায় বাবরের মনে হয় তার চারপাশের সব পারিষদবর্গ তাদের নিঃশ্বাস চেপে রেখেছেন।

“আপনাকে দরবারের কাজ থেকে বরখাস্ত করা হলো। আজ সূর্যাস্তের পরেও যদি আপনাকে কাবুলে দেখা যায়, তাহলে কেউ আপনার মৃত্যু ঠেকাতে পারবে না। আমার সামনে থেকে একে নিয়ে যাও।”

 “আপনার উচিত ছিলো তাকে প্রাণদণ্ড দেয়া।” বাবুরী পরে বাজপাখি উড়াতে তারা শহরের অভ্যন্তরে অবস্থিত প্রাসাদ থেকে বের হলে বলে। বাবরের বাজপাখি একটা সোনালী শেকল দিয়ে তার দস্তানার কব্জির সাথে আটকানো, মাথায় পরানো হলুদ চামড়ার টোপরের নিচে অস্থিরভাবে পাখিটা মাথা নাড়ছে, বুঝতে পেরেছে শীঘ্রই আবার সে আকাশে উড়বার সুযোগ পাবে।

 “তুমি কথাটা বলছো কারণ আলী ঘোসতকে তুমি অপছন্দ করতে…সে তোমাকে বেধড়ক পিটিয়েছিলো…”

“সে আমাকে আরো বলেছিলো ঘোড়ার লাদি পরিষ্কার করাই আমার পক্ষে উপযুক্ত কাজ…না, অবশ্যই আমি তাকে পছন্দ করি না। আপনি জানেন বুড়ো ছাগলটাকে ঘৃণাই করি। সে ছিলো একজন উদ্ধত, আত্মগর্বী শূরন্মন্য যে তার উধ্বতনদের তোষামদ করে, আর অধস্তনদের সবসময়ে তোপের মুখে রাখে। কিন্তু আমি কথাটা, সেজন্য বলিনি। আপনার নিজের লোকেরা আর কাবুলের বাসিন্দারা এর ফলে মনে করবে আপনি আবেগপ্রবণ আর দুর্বল।”

বাবর ঘোড়র উপরে ঝুঁকে বসে বাবুরীর কব্জি আঁকড়ে ধরে। “কেউ যদি এমনটা ভাবে তাহলে ভুল করবে। তাকে প্রাণে বাঁচিয়ে দিয়ে আমি বরং সাহসের পরিচয় দিয়েছি। তার প্রাণদণ্ডের আদেশ দেয়াটাই আমার পক্ষে সহজ ছিলো। আমার যখন মাত্র বারো বছর বয়স, তখন আমি আমার মরহুম আব্বাজানের কুচক্রী উজির কামবার আলীর গর্দান নিজে নিয়েছিলাম। কিন্তু আলী ঘোসত, আমি যখন সিংহাসনবিহীন অবস্থায় ভবঘুরে জীবনযাপন করেছি, তখন আমার প্রতি বিশ্বস্ত থেকেছে এবং সেজন্য সে সামান্যই অর্জন করেছে। সে যাই হোক, ভবিষ্যতে আমার কোনো লোক যদি আমার আদেশ অমান্য করে- সে যেই হোক- নির্ঘাত মারা পড়বে।”

*

যদিও সেটা ছিলো বসন্তের শুরুর দিকে, কিন্তু কাবুলের লোকেরা উত্তরের হিমশীতল এই বাতাসকে পারওয়ান বলতো। শহরের আস্তানার নিচের হ্রদের গাঢ় সবুজ পানিতে তখনও সাদা বরফের ছিটেফোঁটা দেখা যেত আর লতাগুল্মের আড়ালে আশ্রয় নেয়া হাঁসের পালকে আলোড়িত হয়। কিন্তু বরফ এ বছরের মতো গলে গিয়েছে। তৃণভূমি আর পশুচারণভূমিতে আবার নতুন প্রাণের আগমনী ধ্বনিত হচ্ছে। পাহাড়ের পাদদেশ লাল টিউলিপ ফুলে ভরে উঠেছে আর জঙ্গলে বিরহকাতর বনমোরগ সঙ্গীর খোঁজে অনরবত ডেকে চলেছে। কৃষকরা গরম কাপড়ে দেহ। ভালমত আবৃত করে দ্রাক্ষাকুঞ্জের সারি সারি গাছের যত্ন নেয়। কয়েকমাসের ভিতরে যা সোনালী রঙের মিষ্টি আব-আরে ভরে উঠবে যা থেকে প্রস্তুত সুরা গ্রীষ্মকালে আর্মত্যরা পাহাড় থেকে নিয়ে এসে সংরক্ষণাগারে রক্ষিত বরফের। সাহায্যে উপভোগ করবেন।

 বাবর নেকড়ের চামড়ার কম্বলের নিচে থেকে নিজের দেহ বের করে আনে। এখনও রাতেরবেলা উষ্ণতার জন্য কম্বলটা তার দরকার হয়। যদিও নেদারি মেয়েটা সে যেখান থেকে এসেছে সেই পাহাড়ে সংগৃহীত উজ্জ্বল তামাটে রঙের মধুর মত তার ত্বক- সকাল পর্যন্ত সে তার সাথে বিছানায় অবস্থান করে, রক্ত উষ্ণ রাখার জন্য যা যথেষ্ট। আজ পরে কোনো সময়ে সে হয়ত বাবুরীর সাথে শিকারে যাবে। যদিও অল্পই শিকার পাওয়া যায়। পাহাড়ী ভেড়ার পাল তাদের শীতকালীন আর গ্রীষ্মকালীন চারণভূমির মাঝে আনাগোনা করছে আর মাঝে মাঝে বন্য গাধার দেখা পেলে বেশ ভালোই আমোদ হয়।

অথবা সে সম্ভবত কাবুলের উপরে পাহাড়ের অবস্থিত তৃণভূমিতে তৈরি করা বাগান প্রদর্শনে যেতে পারে। পাটমুনিষের দল ইতিমধ্যে মাটি পরিষ্কার করতে শুরু করেছে এবং শীতল মাটি খুড়ে পানি সরবরাহের নালা, কেন্দ্রীয় জলাধার এবং কাছের নদী থেকে পানি এনে ঝর্ণা তৈরির কাজ শুরু করেছে। শীঘ্রই তার সাম্রাজ্যের পূর্বদিক থেকে নিয়ে আসা টক-চেরীর চারা, আপেল, ডালিম আর লেবুর চারার সাথে রোপিত হবে। উর্বর ভূমিতে গাছগুলো দ্রুত বেড়ে উঠবার কথা। তার আম্মিজান আর নানীজান তার কাছে এসে পৌঁছাবার আগেই আশা করা যায় দেখার মতো একটা বাগান তৈরি হবে।

বাবর কম্বলটা ছুঁড়ে ফেলে উঠে দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙে। তার কক্ষের পূর্বদিকের চন্দনকাঠের দরজায় খোদাই করা জাফরির ভিতর দিয়ে সূর্যের আলো ভিতরে প্রবেশ করছে। দরজাটা খুলতে অন্যপাশে একটা পাথরের বারান্দা রয়েছে যেখান থেকে নিচের আঙ্গিনা দেখা যায়। বহু শতাব্দি ধরে কাবুলের সুলতানেরা উৎসবের সময়ে এই বারান্দায় দাঁড়িয়ে প্রজাদের দর্শন দিতেন। সেই অধিকার সেও লাভ করেছে ভাবতেই তার ভালো লাগে।

*

“আপনি কি করছেন? আমি এই নিয়ে তিনবার দেখলাম আপনি কাগজে কি হিবিজিবি দাগ কাটছেন।” বাবুরীর ছায়া বাবরের কাগজের উপরে পড়ে।

 “এটা একটা দিনলিপি। আমি সমরকন্দ যখন সাইবানি খানের কাছ থেকে দখল করি, তখনই ঠিক করেছিলাম আমার জীবনের উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলো লিপিবদ্ধ করে রাখবো… কিন্তু শহরটার কর্তৃত্ব হারাবার পরে…আমি যখন প্রাণে ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছিলাম, আমি এই লেখার কাজটা তখন বন্ধ রেখেছিলাম…”

“আপনি কেনো বন্ধ করেছিলেন? আপনি হয়তো মনে শান্তি পেতেন…”

 বাবর তার লেখনী নামিয়ে রাখে। “কিছু বিষয় আছে যার সাথে মানিয়ে নেয়াটা খুবই কষ্টকর ছিলো- খানজাদার পরিণতি, ওয়াজির খানের মৃত্যু…আর আমি যখন ভবঘুরে জীবনযাপন করছি তখন ব্যর্থতা ছাড়া, বেঁচে থাকবার প্রাণান্তকর প্রয়াস ছাড়া এবং ক্ষুধার্ত অবস্থায় আধবাটি বজরার গুড়ো কেমন মুখরোচক মনে হয়, এসব ছাড়া আমি আর কি লিখতাম? এসব কথা লিখে কোনো প্রশান্তি লাভ করা যায় না…কেবল লজ্জাই প্রকট হয়ে উঠে…কেবলই আত্ম-বঞ্চনা যা থেকে তুমি একবার আমাকে রক্ষা করেছিলে…”

“আর এখন?”

“আমি এখন আবার সুলতান হয়েছি…আমার মনে হয়েছে আমার স্মৃতিকথার এখন কিছুটা হলেও মূল্য রয়েছে…কিন্তু এর সাথে আরো কিছু আছে। হিন্দুকুশ পর্বতমালা অতিক্রম করে আসার সময় তোমার কি মনে আছে আমরা ক্যানোপাস তারা কেমন উজ্জ্বল হয়ে চমকাতে দেখেছিলাম। সেই মুহূর্তে, আমি শপথ নিয়েছিলাম আমি যদি কাবুল অধিকার করতে পারি। তাহলে আমি আর কখনও আমার অভিমন্ত্রণ হারাবো না। সাইবানি খানের মতো খুনী, উচ্চাকাঙ্ক্ষী সম্পর্ক আর বিদ্রোহী প্রজাদের আর কখনও আমার আশেপাশে ভিড়তে দেব না। আমি নিজের নিয়তির নিয়ন্ত্রক হবো। আমি এটা অর্জন করতে পারবো বলে আমার মনে হয়েছে…”

“আর আপনি কি এসবই লিখে রাখছেন?”

“একরকম সেটাই বলতে পারো…আমি চাই আমার সন্তান, তাদের সন্তানরাও যেন জানতে পারে আমার সাথে কি হয়েছিলো। আমার শক্তি আমার অর্জনের কথা সেই সাথে আমার ভুলের কথাও…আমার ব্যর্থতা…আমার ভাবনা…বেঁচে থাকার জন্য আমি কি সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছিলোম…আজ থেকে আমি সবকিছু লিপিবদ্ধ করতে চাই- ভালো অথবা খারাপ- সতোর আর নিষ্ঠার সাথে…”

 “গতরাতে আপনি নেদারি মেয়েটার সাথে কতবার মিলিত হয়েছেন সেটাও?”

“সেটাও…একটা মানুষ নানা কারণে গর্বিতবোধ করে থাকে…” বাবর খিকখিক করে হেসে উঠে। কিন্তু পরমুহূর্তে সে বিষণ্ণ হয়ে উঠে। সে তার উজিরের সাথে আজকের আলোচনার কথাটা কিছুতেই ভুলতে পারছে না। “বাহলুল আইয়ুব আজ আমার সাথে দেখা করতে চেয়েছেন।”

 “সেই বকরবাজ বৃদ্ধার মতো কথা বলতে থাকা লোকটা, সে-সে কি চায়?” বয়স বা মর্যাদার প্রতি বাবুরীর বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধাবোধ নেই। আর গ্রান্ড উজিরের তীক্ষ্ণ, কম্পিত কণ্ঠস্বর আর কথা বলার সময়ে হাত নাড়া নকল করতে সে পছন্দই করে। “সে খারাপ খবর নিয়ে এসেছে। যদিও সেটা অপ্রত্যাশিত ছিলো না। কাবুলে প্রবেশ আর নির্গমনের পথে সওদাগরী কাফেলা আক্রমণ করছে। হাজারারা- আমার নির্দেশ সত্ত্বেও যে কাফেলাগুলোকে কোনোভাবে বিরক্ত করা যাবে না। আর আমার জরিমানা বাবদ ধার্য করা মেষ আর ঘোড়ার পাল দিতেও তারা অস্বীকৃতি জানিয়েছে…মুহাম্মদ-মুকিম আরগুনের কাছে জরিমানা আদায়ের তাগাদা জানাতে ওয়ালি গুল গিয়েছিলো। সে আজ ফিরে এসেছে…তার কান কেটে দিয়ে হাজারারা আমার শাসনের প্রতি তাদের অনীহা জানিয়ে দিয়েছে…”

 “তাহলে বলতেই হবে মুহাম্মদ-মুকিম আরগুন তাকে যেমন দেখায় তারচেয়েও মস্ত বড় আহাম্মক…”

 “তার ঔদ্ধত্য তার মস্তিষ্কের চেয়েও বড় আর হাজারারা একটা শৃঙ্খলাহীন গোত্র। আমি যদি তাদের দ্রুত শায়েস্তা না করি, তাহলে অন্য আরো অনেক ক্ষেত্রে বিদ্রোহী হয়ে উঠবে। আমি ইতিমধ্যে আমার করণীয় ঠিক করেছি…বার্তাবাহকের কান কাটার অপরাধে বন্দি সব হাজারা যযাদ্ধাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হবে। তৈমূর যতো বড় তৈরি করেছিলেন আমি তারচেয়েও বড় কর্তিত মুণ্ডের পিরামিড তৈরি করববা…”

“আমাকে আদেশ দিন একটা বাহিনী নিয়ে আমি নিজে যাই। আমি হারামজাদাদের পাহাড়ের কোটর থেকে তাড়িয়ে বের করে আনবো আর তাদের দেহ কবন্ধ করব…”।

বাবর তার বন্ধুর দিকে তাকায়। তার আন্তরিকতায় কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই: আবেগে তার কণ্ঠস্বর কাঁপছে আর চোখের পাতায় একটা উদগ্র দ্যুতি বিচ্ছুরিত হচ্ছে। সে একজন ভাল সৈন্য কিন্তু আগে কখনও নেতৃত্ব দেয়নি।

 “তুমি ঠিক জানো নেতৃত্ব দিতে পারবে?”

 অবশ্যই। কেবল আপনারই নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস নেই অন্য কারোও…”

 বাবর কিছুক্ষণ চিন্তা করে। আরো অনেকে হয়তো বিড়বিড় করবে, অবাক হবে তাদের বাদ দিয়ে বাবুরীকে মনোনীত করায়। এমনকি বাইসানগারও হয়তো ব্যাপারটা মেনে নিতে চাইবে না। কিন্তু নিজের অনুভূতিকে প্রাধান্য দিয়ে বাবুরীকে সে যে সুযোগের জন্য মরীয়া হয়ে আছে দিতে আপত্তি কোথায়?

 “ঠিকাছে। তুমিই যাবে।”

 “আর আপনার আদেশ কোনো দয়া দেখানো চলবে না?”

 “মুহাম্মদ-মুকীম আরগুন আর তার স্যাঙাতদের প্রতি কোনো ধরণের করুণা দেখাবে না। তবে মেয়েমানুষ আর বাচ্চাদের কোনো ক্ষতি কোরো না।”

 “আমি আপনাকে নিরাশ করবো না।” বাবুরীর চোখের নিচের উঁচু হাড়ের জন্য তার চেহারায় একটা শিকারী নেকড়ের মতো অভিব্যক্তি ফুটে উঠে।

বাবুরী চলে যাবার পরেও বাবর চুপ করে অনেকক্ষণ ভাবে। তারপরে বাবুরী এসে বিঘ্ন ঘটাবার আগে সে যা লিখছিলো সেটা শেষ করার জন্য আবার লেখনী তুলে নেয়: “এই সাম্রাজ্য লেখনী না তরবারির সাহায্যে শাসিত হবে।”

*

শিকারীদের দণ্ড থেকে ইতিমধ্যে ছয়টা ছাল ছাড়ানো হরিণ ঝুলছে, কিন্তু নীলগাইটা হল বোনাস। বাবর এন্টিলোপের নীলচে-ধূসর চামড়া, কালো কেশর আর গলার নিচে লম্বা, পুরু, রেশমী লোমের আবরণ সম্পর্কে আগে পড়েছিলো, কিন্তু নিজে কখনও চোখে দেখেনি। তার সাম্রাজ্যের পূর্বদিকে ওক আর জলপাই গাছের ঘন অরণ্যে আত্মগোপন করে থাকা প্রাণীর দল- তীক্ষ্ণ কণ্ঠী ময়না, ময়ূর, বানর, আর জমকালো তোতাপাখি- তাকে বিমোহিত করে। বাবুরী হাজারা বিদ্রোহ দমন করে আসার পরে সে এই এলাকায় বিজয় উদযাপনের জন্য শাহী শিকারের আয়োজন করেছিলো বলে সে নিজের কাছেই কৃতজ্ঞ বোধ করে। পাঁচদিন আগে বাবুরী তার লোকদের নিয়ে কাবুলে ফিরে এসে বাবরের পায়ের কাছে আরগুনের কাটা মাথাটা অর্পণ করেছিলো। এখন সেও নীলগাইটার দিকে তাকিয়ে আছে।

‘তোমার পালা।” বাবর ফিসফিস করে বলে। সেটাই উপযুক্ত পুরষ্কার হবে।

বাবুরী জুনিপারের ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে থাকা নীলগাইটার দিকে নীলচোখে তাকিয়ে থাকার অবসরে ধনুকে তীর যুক্ত করে ছিলাটা কানের কাছে টেনে আনতে থাকে, যতক্ষণ না মনে হতে থাকে যে ধনুকটা ভেঙে যাবে।

বাবর তাকিয়ে দেখে সাদা পালকযুক্ত তীরটা অসন্দিগ্ধ এ্যান্টিলোপটার কোমল গলায় আমূল বিদ্ধ হয়, কোনো ধরণে শব্দ বা লম্বা পাপড়িযুক্ত চোখে কোনো পলক না ফেলে মাটিতে একপাশে কাত হয়ে উল্টে পড়ে। মুহূর্তের জন্য বাবর কোনো শরাহত প্রাণী দেখতে পায় না। তার চোখে ওয়াজির খান ভাসতে থাকে, গলায় উজবেক তীর বিদ্ধ হয়ে ঘোড়া থেকে খরস্রোতা নদীতে পিছলে পড়ছেন এবং চোখ ঘুরিয়ে নেয়। আবেগ আর স্মৃতি কখন মানুষকে তাড়িত করবে কিছু বলা যায় না। এই একটা বিষয় সে এতোদিনে ভালোই বুঝতে পেরেছে। “চমৎকার। তোমার নিশানভেদের দক্ষতা অসাধারণ।”

 “বাজারের বালকের তুলনায় বলছেন…’

 কাবুল বিজয় উদযাপনের পরে সেদিন রাতের ভোজসভাটা ছিলো সবচেয়ে জৌলুসময়। মশালের কমলা আলোতে, সাধারণ দূর্গ যেটাতে সে এবার শিকারের জন্য এসে উঠেছিলো, তার আঙ্গিনায় একটা পাইনকাঠের মঞ্চে বাবর উপবেশন করে তার পাশে ছিলো বাবুরী। বাবর শীঘ্রই উলুসের আদেশ দেবে- বিজয়ীর অংশ- বাবুরীকে প্রথম ভেড়াটা পরিবেশন করতে বলে। সে কাবুলের তীব্র লাল সুরা তার উদ্দেশ্যে পান করে বাবুরীকে কোর বেগী, যুদ্ধক্ষেত্রে তার পারদর্শিতার জন্য, ধনুকের সর্দার উপাধিতে ভূষিত করবে।

 কিন্তু সেদিন গভীর রাতে, মোষের শিং আর রূপা দিয়ে তৈরি দুই হাতল যুক্ত পানাধার থেকে পান করতে করতে, মাঠের অন্যপ্রান্ত থেকে তার লোকদের হৈ-হুল্লোড়ের শব্দ আর বীরত্ব গাঁথার আওয়াজ এবং বিছানায় তাদের প্রবল নাক ডাকার শব্দের মাঝে, সে টের পায় নিজের ভেতর অসন্তোষ ধীরে ধীরে দানা বাঁধছে। সুরার পরিমাণের সাথে ঠিক যখন অন্য শাসকরা সন্তুষ্টি বোধ করবে। বাবুরী হাজারাদের বিদ্রোহ দমন করেছে এবং পথের পাশে তাদের ছিন্ন মস্তকের যথেষ্ট বড় স্তূপ তৈরি করেছে, যা পথিকদের মনে ভয় আর ভবিষ্যত বিদ্রোহীদের প্রশমিত করতে সাহায্য করবে। কাবুল তার স্বর্গ তার সম্মানের শান্তি প্রলেপ-এখন নিরাপদ। তার রাজধানীকে সুশোভিত করতে সে নিত্য নতুন উদ্যান আর ভবনরে নকশা পরিকল্পনা করছে। কিন্তু তারপরেও সে কেন শান্তি পাচ্ছে না? কারণ উচ্চাশা তার অন্তরকে কুরে কুরে খাচ্ছে প্রতিনিয়ত, সুখ শান্তি সব হরণ করে নিচ্ছে।

সুরার পাত্রে আরেকটা লম্বা চুমুক দিয়ে, বাবর ভাবতে থাকে। আর কয়েকদিন পরেই তার আম্মিজান আর নানীজান কিশিম থেকে এখানে এসে পৌঁছাবেন। আম্মিজান তার সাথে মিলিত হতে পেরে যারপরনাই আনন্দিত হবেন সত্যি, কিন্তু তার মনে অব্যক্ত প্রশ্নটা তিনি ঠিকই বহন করে যাবেন-কবে বোনকে উদ্ধারের প্রতিশ্রুতি সে পূর্ণ করবে। এসান দৌলতের তীক্ষ্ণ চোখের দৃষ্টিতে সে একই প্রশ্ন দেখতে পাবে যা তাকে বিব্রত করছে: এর পরে কি? নতুন কোনো অভিযান? কখন এবং কোথায়? তৈমূর কিংবা তার পরম শ্রদ্ধেয় চেঙ্গিস খান কখনও একই স্থানে বেশিদিন কাটাননি। নিজের অর্জন কখনও তাদের সন্তুষ্ট করেনি, কোনো সন্দেহ নেই এসব কথাই বৃদ্ধা তাকে আবার মনে করিয়ে দেবেন…

 “আপনাকে দেখে অভিযানের আগে কারো প্রিয় ঘোড়া খোঁড়া হয়ে গেলে যেমন দেখাবে, অবিকল সেই রকম দেখাচ্ছে।” বাবুরীর অস্থিসর্বস্ব মুখ সুরার প্রভাবে চকচক করছে এবং হাজারাদের বিরুদ্ধে সাহসিকতা আর চাতুর্য দেখাবার পুরষ্কার হিসাবে বাবরের দেয়া সোনার মালা তার গলায় লটকে আছে।

“আমি ভাবছিলাম… দশ বছর আগে আমি যখন একেবারেই ভাবিনি তখন আমি সুলতান হই। কিন্তু আমি সবসময়ে ভেবে এসেছি- সুলতান হবার আগে নিয়তি আমার ভাগ্যে বিশেষ কিছু রেখেছে…” বাবুরীর চিরাচরিত সন্দিহান অভিব্যক্তি বাবর অগ্রাহ্য করে। সে যেভাবে বেড়ে উঠেছে সেটা বেচারা কিভাবে বুঝবে, যেখানে তার প্রিয় জন্মদাতা যাকে তুমি ভালোবাস সে কেবল সম্ভাব্য মহত্ত্বের আর এখনও অর্জিত হয়নি সেই সম্ভাবনার কথা বলেন…

“সত্যি কথা হলো আমি অস্থির হয়ে উঠেছি- অসন্তুষ্ট। কাবুল ঠিকই আছে, কিন্তু আমি আরো চাই। প্রতিদিন আমি যখন ডায়েরী খুলে বসি কিছু লিখতে, আমি ভাবি ভবিষ্যতের পাতায় আমি কি লিখবো…সেখানে কি মহান কোনো গৌরব, মহান। কোনো বিজয়ের কথা লেখা হবে, নাকি সেগুলো ফাঁকাই থাকবে…? আমার বিশ্রাম নেবার সময় নেই, আমাকে শক্ত করে নিয়তির হাল ধরতে হবে। আমি আমার জীবনের সময়গুলো উল্লেখিত কিছু না করে বৃথাই নষ্ট করতে চাই না।”

 “আপনি ঠিক কি করবেন বলে ভাবছেন…? সাইবানি খানকে আক্রমণ করবেন?”

 “আমার সেনাবাহিনী আক্রমণের যোগ্য হয়ে উঠলে তোমার পরামর্শের জন্য অপেক্ষা করবো না। কিন্তু এখনই না। তাকে এখন আক্রমণ করলে আহাম্মকি করা হবে…”

“তাহলে আপনি কি করতে চান?”

 বাবর আরেকটা লম্বা চুমুক দেয়, টের পায় সুরাটা ভেতরে প্রবেশ করে তার বাচন শক্তি আর কল্পনাকে মুক্ত করে। সহসা তার মনের গভীরে থাকা একটা ধারণা স্ফটিক স্বচ্ছ রূপ লাভ করে। “হিন্দুস্তান… আমি সেখানেই যেতে চাই। রেহানার গল্প তোমার মনে আছে? আমি যদি সম্পদ কুক্ষিগত করতে পারি, তৈমূর যেমন করেছিলেন। তাহলে সাইবানি খান বা পারস্যের শাহ্ কেউ আমার সামনে দাঁড়াতে পারবে না।” সে তার আসনে বসে উত্তেজনায় দুলতে থাকে। বাবুরী তার কাঁধে একটা হাত রেখে তাকে সুস্থির করতে চায়। কিন্তু সে এক ঝটকায় তার হাত সরিয়ে দেয়। সে তার কল্পনার চোখে রুবির চোখযুক্ত সোনার হাতিটা দেখতে পায়…

“আপনার উচিত হবে নিজের সহজাত অনুভূতি অনুসরণ করা।”

বাবর ঝাপসা চোখে তার দিকে তাকায়। “কি…?”

 “আমি আপনাকে বলতে চেয়েছি নিজের অনুভূতির কথা শুনতে… আপনার তথাকথিত ভাগ্য যার কথা বলতে আপনি ভীষণ পছন্দ করেন সেটা আপনাকে কোথায় নিয়ে যায় দেখা যাক…”

বাবুরীর কণ্ঠস্বর যদিও অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে বলে মনে হয় এবং চারপাশের হট্টগোলের ভিতরে যা অনেকটাই হারিয়ে যায়। কিন্তু বার্তাটা পরিষ্কারভাবে বাবরের ভিতরে প্রবেশ করে। তার সুরার নেশা নিমেষে ঘুচিয়ে দেয়…হ্যাঁ, সে একটা বাহিনী নিয়ে কাবুল নদী বরাবর দক্ষিণে হিন্দুস্তানের দিকে এগিয়ে যাবে। সে প্রশস্ত সিন্ধুর দিকে তাকিয়ে দেখবে, অন্য তীরের অবিশ্বাস্য সম্পদের কথা বিবেচনা করবে, এবং সম্ভবত নিজের জন্য কিছু দখলও করতে পারে।

***

বাবরের অনুরোধে শাহী জ্যোতিষী গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান পর্যালোচনা করে দেখেন। রাতের পরে রাত তারা তাদের চার্ট পর্যবেক্ষণ করেন আর কাবুলের উপরের অন্ধকার আকাশ আলোকিত করে থাকা তারকারাজির অসম্ভব জটিল বিন্যাস পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করেন। জানুয়ারি মাসে, সূর্য যখন কুম্ভরাশিতে অবস্থান করছে তখন অভিযান শুরু করার একটা শুভ সময় তারা দাড়িতে টোকা দিতে দিতে। অবশেষে খুঁজে পান। বাবর ঠিক বুঝতে পারে না তাদের ভবিষ্যদ্বাণী সে নিজে বিশ্বাস করে কিনা, কিন্তু তার লোকেরা করে। অজানা অঞ্চলে তাদের অভিযানে গ্রহ-নক্ষত্রের বরাভয় রয়েছে এটা মনোবল বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে। জ্যোতিষদের পরামর্শ অবশেষে তাকে অভিযান শুরুর প্রস্তুতি নিতে সহায়তা করবে: আগামী কয়েকটা মাস সে সেনাবাহিনী গঠন আর অভিযানের পরিকল্পনা নিয়ে ব্যস্ত থাকবে।

*

শরতের শেষ ফলটাও কাবুলের চারপাশের বাগান থেকে সংগৃহীত হবার পরেই কেবল কিশম থেকে বাবরের আম্মিজান আর নানীজান এসে পৌঁছান। সে আরও আগেই তাদের আনতে লোক পাঠাতে চেয়েছিলো কিন্তু হাজারা বিদ্রোহের কারণে সে সতর্কতা অবলম্বন করে। কিন্তু তূর্যধ্বনি আর তোরণদ্বারের উপরে ঢাকের আওয়াজের মাঝে তারা তাদের দলবল নিয়ে দূর্গপ্রাসাদে প্রবেশ করতে তার মনটা গর্বে ভরে উঠে। খুতলাঘ নিগারের স্বাস্থ্য অনেক খারাপ হয়ে গিয়েছে এবং দীর্ঘ ভ্রমণের ধকলের কারণে তাকে ক্লান্ত আর দুর্বল দেখায়- বাবর দেখে ফাতিমার উপরে তিনি ভীষণভাবে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন- কিন্তু এসান দৌলত বরাবরের মতোই প্রাণবন্ত রয়েছেন।

তারা নিজেদের কক্ষের অবস্থান গ্রহণ করা মাত্র তিনি দু’হাতে তার মুখ ধরে তাকিয়ে থাকেন। “আমার বাছা দেখছি পুরুষ হয়ে উঠেছে, তার মুখ ছেড়ে দিয়ে সন্তুষ্টির সাথে মাথা নেড়ে তিনি বলেন। “খুতলাঘ দেখো তোমার ছেলে গত কয়েক মাসে কেমন বদলে গিয়েছে- দেখো তার কাঁধ কেমন চওড়া হয়ে উঠেছে।” তিনি তার বুকে চাপড় দিয়ে তার বাহুর উধ্বাংশে আঙ্গুল দিয়ে খোঁচা দিয়ে দেখেন। যেনো কেনার আগে ঘোড়া খুটিয়ে পরখ করছেন। “সিংহের মত পেশী।”

খুতলাঘ নিগার তার দিকে তাকিয়ে থাকে কিন্তু কিছু বলে না। তিনি আগের চেয়ে অনেক নিরব হয়ে গেছেন- আব্বাজানের আকস্মিক মৃত্যুর পরে তাকে যে মহিলা ফারগানার সিংহাসনের জন্য প্রস্তুত করে তুলেছিলেন সেই মানসিকভাবে শক্তিশালী মহিলা যেনো অন্য কেউ ছিলো- দু’বছর আগেও পাহাড়ে পাহাড়ে অবিশ্রান্ত ঘুরে বেড়ান সেই মহিলার চেয়ে এখন তিনি অনেক দুর্বল একজন।

 “আপনাদের দুজনের সাথে আমার জরুরি কথা আছে। আসছে জানুয়ারি মাসে আমি কাবুল ত্যাগ করে দক্ষিণে আমার বাহিনী নিয়ে হিন্দুস্তানে আমার ভাগ্য পরীক্ষা করতে যাবো। আমার অবর্তমানে বাইসানগার রাজপ্রতিভূর দায়িত্ব পালন করবে…”

তার কথা শেষ হতে, এসান দৌলত সম্মতির সাথে মাথা নাড়েন। কিন্তু খুতলাঘ নিগারকে কিছু একটা বিচলিত করে তুলে। সোনালী জরির কারুকাজ করা তাকিয়া, যেখানে তিনি হেলান দিয়ে ছিলেন সেখান থেকে ধীরে ধীরে উঠে বসে, মাথা নাড়তে থাকেন, যেনো কোনো কথা খুঁজে পাচ্ছেন না। তাকে কাঁদতে দেখে বাবর চমকে উঠে- তিনি কান্না মোছার কোনো চেষ্টাও করেন না। তার সামনে তিনি প্রবলভাবে কাঁপতে থাকেন এবং হাত দিয়ে নিজের মাথার লম্বা চুল মোচড়াতে থাকেন যেখানে এখন সাদার ছোপ দেখা দিয়েছে।

 “মেয়ে…” এসান দৌলতের কণ্ঠস্বরে স্পষ্ট অসন্তুষ্টি প্রকাশ পায়।

বাবর তার আম্মিজানের হাত ধরে তাকে প্রবোধ দিতে চেষ্টা করে। যেনো তিনি একটা বাচ্চা মেয়ে আর সে তার বাবা। “আমাকে বলেন কি হয়েছে?”

 “খানজাদা- বাবর তুমি তোমার প্রতিশ্রুতির কথা ভুলে গেছো? তুমি কথা দিয়েছিলে তাকে উদ্ধার করবে। দক্ষিণে কেন তুমি তোমার সময় নষ্ট করছো…”

 তিনি তাকে আঘাত করলেও হয়তো বাবর এতটা কষ্ট পেতো না। লজ্জা, হতাশা আর বেদনার একটা পরিচিত রঙে তার চেহার লাল হয়ে উঠে। তার কথা আমার সবসময়ে মনে আছে। আমি আমার প্রতিশ্রুতি রাখবো। কিন্তু এখনও সময় হয়নি। সাইবানি খানকে মোকাবেলা করতে হলে আমাকে আরও সৈন্য আরও অর্থ সংগ্রহ করতে হবে। এবারের অভিযানে হয়তো আমি সেটা অর্জন করতে পারবো। কিন্তু আমি শপথ করছি যতো শীঘ্রই সম্ভব আমি খানজাদাকে খুঁজে বের করবো…”

 তার আম্মিজানের ফোঁপানি ধীরে ধীরে প্রশমিত হয়ে আসে এবং তার শরীর শান্ত হয়। বাবর তার কপালে আলতো করে চুমু দেয়। কিন্তু তিনি তার ভেতরে যে অশান্তির আগুন জ্বেলে দিলেন, সেটা প্রশমিত হতে অনেক সময় লাগবে…

আগামী সপ্তাহগুলোতে সে হিন্দুস্তান অভিযানের প্রস্তুতিতে নিজেকে ডুবিয়ে রাখতে চেষ্টা করে। সে একই পথ ধরে যাবে- কাবুল নদী বরাবর দক্ষিণ-পূর্ব দিকে এগিয়ে গিয়ে খাইবার গিরিপথ অতিক্রম করবে- এক শতাব্দি আগে তৈমূর যে পথ দিয়ে এগিয়ে গিয়েছিলেন।

 বরফ পড়া শুরু হবার আগের স্বল্প সময়ে, তৃণভূমি সাদা হয়ে উঠতে আর দৃশ্যপট ঝাপসা হতে শুরু করতে, যখন বোঝা দুস্কর কোথায় পর্বতমালা শেষ হয়েছে, আর কোথায় ধূসর আকাশ শুরু হয়েছে। বাইসানগার আর বাবুরী লোকদের অভিযানের জন্য প্রশিক্ষিত করে তাদের নিজস্ব বাহিনী আর স্থানীয় উপজাতিগুলো থেকে সংগৃহীত নতুন সৈন্য। উপজাতি লোকগুলো খারাপ না… বাবর তাদের ঘোড়ার পিঠে সওয়ার অবস্থায় খড়ের নিশানায় তীর ছুঁড়তে বা বর্শা দিয়ে দ্রুত বেগে ঘোড়া দাবড়ে তরমুজ আর ভেড়ার মাথা বিদ্ধ করতে দেখে ভাবে…কিন্তু কে জানে তাদের ভাগ্যে কি অপেক্ষা করছে?

অনেক রাত বাবর ভ্রাম্যমাণ বণিকদের ঝুলেপড়া মুখের অবিশ্বাসী শ্রোতাদের সামনে বিচিত্রসব প্রাণীর গল্প বড়াই করে বলতে শুনেছে- এমনকি দানবের গল্প হিন্দুস্তানের বটগাছের অরণ্যে ঘুরে বেড়ায়। যাদের উধ্বমুখী শুড় অসতর্ক পথিকের গলা টিপে ধরে দম আটকে ফেলে। নগ্ন সাধু সন্ন্যাসীর দল, মুখে ছাই ভস্ম মাখা প্রতিমা পূজারীর দল, যারা অন্ধকার গুহায় বাস করে আর জীবনেই চুল দাড়ি কাটে না। বেশিরভাগটাই বালখিল্যসুলভ অর্থহীন…কিন্তু সে তারপরেও খারাপ কিছুর জন্যই প্রস্তুত থাকতে চায়।

 শেষ পর্যন্ত জানুয়ারী মাস আসতে সে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। যদিও চারপাশে এখনও পুরু বরফ জমে আছে। কিন্তু শীতের ভয়ঙ্কর তুষারঝড় শেষ হয়েছে এবং তারা ঘোড়া নিয়ে বেরিয়ে পড়তে পারে।

 ছয়দিন একটানা অগ্রসর হয়ে অগ্রসর হবার গতি নির্দিষ্ট করেছে ঢোলের শব্দ বাবর তার দু’হাজার সৈন্যের শক্তিশালী বহর নিয়ে খাইবার গিরিপথের মুখে এসে উপস্থিত হয়। কিন্তু সাতদিনের দিন, সূর্য যখন মাথার উপরে ক্রমশ রুক্ষ্ম হয়ে ওঠা ভূপ্রকৃতি থেকে রঙের স্পর্শ শুষে নিচ্ছে, বাবরের মনে হয় সে ঠিক তার সামনে ডানদিকের পাহাড়ে কিছু একটা নড়াচড়া দেখতে পেয়েছে। সে তীক্ষ্ণ চোখে সেদিকে তাকিয়ে থেকে থামবার নির্দেশ দেয়।

 “কি ওটা?” বাবুরীর কথার মাঝেই পাহাড়ের নিচের ঢাল বেয়ে নুড়ি পাথর গড়িয়ে পড়ার শব্দ হয়।

 “আমি জানি না। আমি সারির চারদিকে রক্ষামূলক বেষ্টনীতে প্রহরী নিয়োগ করেছি। তারপরেও গুপ্তঘাতক কিভাবে বেষ্টনীর ভিতরে প্রবেশ করেছে? চলো আমরা সামনের পাহাড়ে উঠে ভালো করে দেখি…”

বাবর তার ঘোড়া থেকে লাফিয়ে নামে। “তোমরা তীর তৈরি রাখো, আর আমাদের রক্ষা করো।” সে তার দেহরক্ষীদের উদ্দেশ্যে বলে। বাকিরা সবাই আমাদের সাথে এসো।”

কয়েক মিনিট পরে, বাবর জনমানবহীন, বিরাম পাথুরে চূড়ার দিকে হতাশ চোখে তাকিয়ে থাকে। কিছু নেই, খালি ফাঁকা সব। মানুষ বা পশুর পাল যাই থাকুক পগাড় পাড় হয়ে গিয়েছে। তারপরে সে আবার দূরবর্তী কিনার থেকে পাথর গড়িয়ে পড়ার আওয়াজ পায়। সে আড়াআড়ি দৌড়ে গিয়ে বাদামী জোব্বা আর ঢোলা পাজামা পরিহিত একজনকে নুড়ি পাথরের উপর দিয়ে পাগলের মতো পিছলে পালিয়ে নেমে যেতে দেখে। বাবর নিমেষে তার ধনুক নামিয়ে, লোকটাকে লক্ষ্য করে একটা তীর ছুঁড়ে মারে। লোকটা চিৎকার করে উঠে এবং পাহাড়ের পাদদেশে পাথুরে ভূমিতে কোনোমতে লুকিয়ে পড়ে।

পেছনে বাবুরী আর দেহরক্ষীর দলকে নিয়ে বাবর পাথরের উপর দিয়ে পিছলে নিজের শিকারের পেছনে ধাওয়া করে। পাহাড়ের পাদদেশে পৌঁছে বাবর লোকটা আধা দৌড়ে আধা হেচড়াতে হেচড়াতে পাথরের মাঝ দিয়ে এগিয়ে যেতে দেখে। তীরটা ডান বাহুতে কাঁধের ঠিক নিচে বিদ্ধ হয়েছে। দ্রুত দৌড়ে বাবর তার কাছে পৌঁছে একটা লাফ দিয়ে লোকটাকে নিয়ে পাথরের উপরে আছড়ে পড়ে। শীঘ্রই তার দেহরক্ষীর দল এসে উপস্থিত হয় এবং লোকটাকে বেঁধে ফেলে।

বাবর উঠে দাঁড়িয়ে নিজের আলখাল্লা থেকে ধূলো ঝাড়ে। “তুমি কে?”

 “পিখী, গাগিয়ানিসদের সর্দার…” লোকটা হাঁফাতে হাঁফাতে বলে।

 “তুমি এখানে কি করছিলে?”

পিখীর চোখ- পাহাড়ী বিড়ালের মতো অনেকটা দেখতে- পিটপিট করে। কিন্তু সে যদি মিথ্যা বলতে চেয়েও থাকে কিন্তু সেটা অবান্তর ভেবে বিরত থাকে। “গিরিপথের দিকে আপনাদের গতিবিধির উপর নজর রাখছিলাম।”

 “আর সেটা তুমি কেনো করছিলে?”

“এখানে পাঠানরা থাকে যারা লুটপাটের মতো কাফেলার সন্ধান দিতে পারলে আমাকে আর আমার লোকদের পুরস্কৃত করে। গত বছর ফসল ভাল হয়নি। তার উপরে শীতকালটাও দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে…আমার লোকেরা কখনও সচ্ছল ছিল না। কিন্তু এবছর আমি যদি লুটপাটের সন্ধান না দিতে পারি তবে আমাদের সবাইকে না খেয়ে থাকতে হবে।”

 “আমি একজন সুলতান, আমার সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছি… উটের বহর নিয়ে আসা কোনো হোতকা সওদাগর না।”

 “আমি কি ব্যাটার গলা ফাঁক করে দেবো?” বাবুরী কোমর থেকে খঞ্জর বের করে গুপ্তচরদের স্বাভাবিক শাস্তি কার্যকর করতে প্রস্তুত।

 “না…আমার মাথায় আরেকটা ভালো বুদ্ধি এসেছে।”

বাবর আবার পিখীর দিকে তাকায় যে সম্ভবত সর্দার হিসাবে মৃত্যুর জন্য নিজেকে প্রস্তুত করেছে। “তুমি এই পাহাড় ভালো করে চেনো আর তুমি বাঁচতেও চাও?”

“হ্যাঁ অবশ্যই দুটোই চাই- আর তাছাড়া আমি আপনার নিরাপত্তা বেষ্টনী অনায়াসে অতিক্রম করেছি, তাই না?”

“তোমার জীবন বাঁচাবার বিনিময়ে তুমি গিরিপথের আশেপাশে তোমার মিত্রদের খবর পাঠাবে যে, আমি সুলতান বাবর গিরিপথ দিয়ে আসছি। আমাকে যদি কোনো গোত্র আক্রমণ করার দুর্মতি দেখায় তবে তাদের নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হবে…আর তুমি আমাদের পথপ্রদর্শক হবে। কোনো ধরণের ঝামেলা পাকাবার চেষ্টা করলে আগে তুমি মারা পড়বে। পরিষ্কার বোঝাতে পেরেছি?”

*

পিখীকে বখশ দেবার সিদ্ধান্ত লাভজনক প্রতিপন্ন হয়। তিনটা লম্বা যাত্রার মাধ্যমে সে পুরো বহরটাকে খাইবার গিরিপথের ববফাবৃত, জনশূন্য আঁকাবাঁকা পাথুরে খাঁজের ভিতর দিয়ে পার করে নিয়ে আসে। জামের মাটির তৈরি বসতবাটির বসতিতে তারা নেমে আসতে বাতাস ততক্ষণে উষ্ণ হয়ে উঠেছে এবং আরো তিনদিনের ক্রমাগত যাত্রা তাদের সিন্ধুর কাছে পৌঁছে দেয়। বাবর প্রশস্ত নদীর দিকে তাকিয়ে থাকে। বরফ গলা পানিতে এতটাই পূর্ণ হয়ে আছে যে, দু’তীর ছাপিয়ে তার স্রোতধারা বয়ে চলেছে। তার পৃথিবী আর হিন্দুস্তানের উষ্ণ রহস্যময় ভূমির মাঝে সীমানা চিহ্নিত করে এই নদীটা বয়ে চলেছে…

“এটাই তাহলে সিন্ধু নদী?” বাবুরী তার পাশে একটা গাট্টাগোট্টা খোঁজা করা ঘোড়ায় উপবিষ্ট। যা পানি খাবার জন্য অস্থির ভঙ্গিতে মাথা নাড়াচ্ছে।

 “হ্যাঁ।” বাবর প্রমত্তা নদীর স্রোতের দিকে তাকিয়ে থাকে তার মাঝের পূর্বেকার উল্লাস অনেকটাই কমে এসেছে। আমরা এখানে নদী অতিক্রম করতে পারবো না। আমাদের বেশিরভাগ ঘোড়া আর মালপত্রের দশা তাহলে আর দেখতে হবে না… আমরা সর্বসান্ত হব। পিখীকে আমার কাছে পাঠাও। আমার লোকদের লুটপাটের সামান্য সুযোগ অন্তত আমার দেয়া উচিত।”

 দশ মিনিট পরে আদিষ্ট লোকটা তার সামনে হাজির হয়, মাথার খয়েরী মখমলের টুপি তার হাতে ধরা।

 “আমরা এখানে নদী পার হতে পারবো না। আমাকে হয় পানি কমা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে, নতুবা এমন একটা স্থান খুঁজে পেতে হবে যেখানে আমাদের ঘোড়াগুলো নিরাপদে সাঁতরে ওপারে যেতে পারবে।”

 পিখী কাঁধ ঝাঁকায়। “নদী এ বছর বেশ প্রমত্তা, দেখতেই পাচ্ছেন। পানি কমতে কমতে তাও কয়েক সপ্তাহের ব্যাপার। ততোদিন অন্যকোনো জায়গা দিয়ে অতিক্রম করা অসম্ভব ব্যাপার।”

 “নৌকার বন্দোবস্ত? নদীতে কোনো জেলে দেখছি না কেন?”

“মাঝি ছিলো, সুলতান কিন্তু গিরিপথ দিয়ে আপনার আগমনের সংবাদ পেয়ে দেখতেই পাচ্ছেন ব্যাটারা নৌকা নিয়ে ভেগে গিয়েছে…”

বাবর গালবকে। “নদীর পানি কমার অপেক্ষা থাকার সময়ে আমরা এপার দিয়ে আর কোথায় যেতে পারি?”

“কোহাট এখান থেকে দু’দিনের যাত্রা পথ। শস্য আর গবাদিপশুতে সমৃদ্ধ একটা বসতি।” পিখীকে ধূর্ত দেখায়। “সেখানের বাসিন্দারা আমার জাত শত্রু। গত বছর গ্রীষ্মে পাহাড়ে তারা আমার গ্রামে হামলা করেছিলো। আমার লোকদের খুন করে, মেয়েদের তুলে নিয়ে যাবার সময়ে আমাদের গবাদিপশুর পালও তাড়িয়ে নিয়ে যায়। তাদের কোনো ক্ষতি করতে পারলে আমার ভালোই লাগবে।”

 “আমাদের সেখানে নিয়ে চলো, তারপরে তুমি মুক্ত।”

*

এই নিয়ে দশবার, বাবর নিজের আহাম্মকির জন্য গাল দেয়। মাত্র এপ্রিল মাস, কিন্তু এখনই সূর্যের উত্তাপ তাকে আর তার লোককে পাগল করে তুলেছে। বাতাসের আর্দ্রতায় বৃষ্টির প্রতিশ্রুতি যা স্থানীয় লোকদের মতে কয়েকদিনের ভিতরে বৃষ্টি হয়ে ঝরতে শুরু করবে। বর্মের নিচে তারা ঘেমে অস্থির হতে থাকে।

এটা সত্যি, গত কয়েক সপ্তাহ পশ্চিমে ক্রমাগত আফগান উপজাতিদের পাহাড়ী এলাকা আর তাদের পাথরের তৈরি আশ্রয়স্থলে হামলা- সাঙগারস ঈগলের বাসার মতো যা তারা পাহাড়ের উঁচুতে সতর্কতার সাথে নির্মাণ করে সাফল্যজনক বলে প্রতিয়মান হয়েছে। কাটা মুণ্ডের কয়েকটা স্তূপ তৈরি হতেই বেশিরভাগ গোত্রের লড়াইয়ের শখ উবে গিয়েছে এবং অন্তত দশজন সর্দার তাদের প্রথা অনুযায়ী চার হাতপায়ে ভর দিয়ে, মুখে ঘাস নিয়ে তার প্রতি আনুগত্যের শপথ নিয়েছে। যার মানে “আমি এখন আপনার গরুর মতো। আমার সাথে আপনার যা ইচ্ছা আচরণ করতে পারেন।”

 কিন্তু সে কেবলই ভেড়া, গরু, উট, চিনি, সুগন্ধি কন্দ আর কাপড়ের গাইট লুট করতে পেরেছে। তার লোকেরা আপাতদৃষ্টিতে সন্তুষ্ট। কিন্তু কাবুল থেকে এতো হ্যাপা সামলে কয়েক হাজার লোক আর অগণিত ভারবাহী পশু নিয়ে আসাটা বাবরের কাছে অপব্যয় বলে মনে হয়। তার আরও অসন্তুষ্টির কারণ ইত্যবসরে সিন্ধু নদীর পানি বিন্দুমাত্র হ্রাস পায়নি। যার ফলে নদী অতিক্রম করে হিন্দুস্তানের গভীরে অভিযান শুরু করতে পারে। উত্তরের সীমানা বরাবর পাহাড়ী আর সমতলের লোকদের বশ মানানো তার কাছে মর্যাদাহানিকর বলে প্রতিয়মান হতে আরম্ভ করেছে। অবশ্য এসব সত্ত্বেও এবারের অভিযানে একটা উদ্দেশ্য অন্তত হাসিল হয়েছে, কপালের ঘাম চোখে গড়িয়ে পড়ার আগে মুছতে মুছতে বাবর ভাবে। তার সৈন্যদের একটা মহড়া হয়ে গেলো। সেই সাথে তার নিজেরও-একটা বড় অভিযানের প্রস্তুতি হিসাবে।

সে এখন তার লোকদের লম্বা সারি, পেছন পেছন আসা ভারবাহী ঘোড়া, গাধা আর উটের বহর গজনী নদী বরাবর উত্তর-পশ্চিম দিকে বেঁকে গিয়ে সওয়ারন গিরিপথের দিকে এগিয়ে চলেছে। যা তাদের পুনরায় পাহাড়ের মাঝ দিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। আল্লাহতা’লা সহায় থাকলে তারা শীঘ্রই কাবুলের দেখা পাবে এবং উত্তরের পাহাড় থেকে বয়ে আসা শীতল বাতাসের পরশ তাদের শুষ্ক, রোদেপোড়া ত্বকে অনুভব করবে। সেখানে পৌঁছে সে আবার নতুন করে পরিকল্পনা করবে।

 “ওটা কি?” বাবুরীর তীক্ষ্ণ চোখ দিগন্তের কাছে কিছু একটা দেখতে পায়। ঠিক তাদের মুখের সামনে একটা বিশাল কমলা রঙের গোলকের মতো। সূর্য অস্ত যাবার কারণে ঠিকমতো দেখা যায় না। কিন্তু বাবর তার ঘোড়ার লাগাম জিনের সাথে বেঁধে দু’হাত দিয়ে চোখের সামনে একটা আড়াল তৈরি করে। সেও কিছু একটা দেখতে পায়- আলো পড়ে খুব সম্ভবত ধাতব কিছু একটা চমকাচ্ছে। কিন্তু তারা আরও সামনে এগিয়ে আসতে দেখা যায় আকাশ আর দিগন্তের মাঝে ঝুলে থাকা পানির একটা বিশাল বিস্তার।

পানির উপরিভাগে লালচে আলো এই আছে এই নাই ভঙ্গিতে চমকায়। সম্ভবত অস্তমিত সূর্যের প্রতিফলন। না…বাবর তার পাশে বাবুরীকেও অসাধারণ দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে থেকে আঁতকে উঠতে শোনে। হাজার হাজার লম্বা পায়ের লাল পালকের পাখি তাদের ডানা ঝাপটাচ্ছে, আকাশে উড়তে প্রাণবন্ত আকাশের গায়ে রক্তের একটা ঝাপটার মতো দেখায় তাদের। ভয়ঙ্কর সুন্দর একটা দৃশ্য।

 গরমের তাণ্ডব সত্ত্বেও, বাবর উত্তেজনায় কেঁপে উঠে…দক্ষিণের ভূখণ্ডের চমক এখনও তার জন্য শেষ হয়নি। পাখিগুলোর মতোই, সেও এলাকাটা ত্যাগ করছে কিন্তু তাদের মতোই সে আবার ফিরে আসবে। আর মানুষ তখন সে দৃশ্য দেখে আঁতকে উঠবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *