০৯. বাবুরী
শাহরুখিয়ার আশেপাশের এলাকা শিকারের জন্য বিখ্যাত। ঘন জঙ্গলে হরিণ আর সারাক্ষণ ভয়ে আর্তস্বরে চেঁচাতে থাকা নধর শূকর প্রচুর রয়েছে। পশুচারণভূমি আর ছোট ছোট বৃক্ষপ্রধান এলাকাগুলোতে খরগোস, শেয়াল আর লম্বা লেজের রঙিন পাখির প্রাচুর্যের কারণে শিকারের জন্য আদর্শ বলে বিবেচিত। বাবর চোখ কুঁচকে ধনুকের ছিলা পেছনে টেনে আনে। তারপরে যখন তাকিয়ে দেখে তার ছোঁড়া তীর বাতাস কেটে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করেছে। সে হাসে- একটা নাদুসনুদস হাঁসের সাদা গলায় তীর বিদ্ধ হতে সেটা ছটফট করতে করতে আছড়ে পড়ে। দু’মাস আগে জামমীন থেকে বিয়ে করে আসবার পরে, অধিকাংশ সময় সে শিকার করেই কাটিয়েছে।
এখন সন্ধ্যার অন্ধকার চারপাশে ছেয়ে আসতে শুরু করলে, বাবর দূর্গের উদ্দেশ্যে তার ঘোড়া ঘুরিয়ে নেয়। তার শিকারী বাজ গিল্টি করা চামড়ার টোপরের নিচে পুনরায় নিষ্ক্রিয় হয়। বাঁশে বাঁধা হরিণ এবং তার সাথে আসা ব্যাধের পর্যাণ থেকে খরগোস, আর রঙিন পালকের ফিজ্যান্ট নিস্তেজ ভঙ্গিতে ঝুলতে থাকে। সে টের পায় একটা অস্থিরতা তাকে ছেয়ে আছে। সে তার নানীজানের সাথে জীবনে কখনও উঁচু গলায় কথা বলেনি। কিন্তু দিন দিন এসান দৌলতের সব কিছুতে নাক গলানোর স্বভাব অসহনীয় হয়ে উঠছে। পাজি বুড়ি আক্ষরিক অর্থে আয়েশার সাথে তার মিলনের হিসাব রাখতে আরম্ভ করেছে আর অনবরত অভিযোগ জানাচ্ছে। প্রথম দিকে তুমি সপ্তাহে দু’বার তার সাথে রাত কাটাতে। এখন কেবল সাতদিন অন্তর কখনও আরও দীর্ঘসময় পরে তুমি তার সান্নিধ্যে রাত অতিবাহিত করো… মেয়েটাকে তুমি অপমান করছে। ফারগানার প্রতি তোমার কর্তব্যের কথা ভুলে গেলে চলবে কেন।” আজ সকালেই তার অস্বস্তি আর ক্রোধের তোয়াক্কা না করে তিনি তিরস্কারের সুরে কথাগুলো বলেছেন। “যোদ্ধা হিসাবে তোমার ভিতরে কোনো ধরণের ভয় কাজ করে না, তাহলে একটা মেয়ের কাছ থেকে লুকিয়ে থাকো কেনো…?”
খোঁচা খেয়ে সে পাল্টা চিৎকার করে, “আপনি মোটেই আমার মালিক নন, আর আমিও কোনো প্রজনন ঘোড়া নই যে আদেশ করা মাত্র প্রজনন ঘুড়ির উপরে উপগত হবো।”
বিয়ের ব্যাপারে সে কোনো আপত্তি করেনি, এবং এর প্রয়োজনীয়তা সে অনুধাবন করতে পেরেছে। কিন্তু সে নিজে যেচে পড়ে বিয়ে করতে চায়নি এবং তার স্ত্রীর শীতল অবজ্ঞা- তাদের বিয়ের দিনই যা আপাতভাবে প্রতিয়মান হয়ে উঠেছিলো একটুও কমেনি বরং দিন দিন সেটা আরও কঠিন হয়েছে। আয়েশা বাবরের সাথে কদাচিৎ কথা বলে, আর যা বলে সেটাও তার কোনো অনুরোধ বা প্রশ্নের জবাবে এক শব্দের উত্তর। সে কখনও তার মুখে হাসি দেখেনি- একবারের জন্যও না। হাসলে হয়তো তার চেহারা একটু কোমল হয়তো এবং আয়েশার প্রতি তার নিজের অনুভূতিও হয়তো বদলাতো। আয়েশার সাথে শয্যায় তার কেবল মনে হয় একটা। উষ্ণ মৃতদেহের সাথে সে শুয়ে আছে তার অপ্রতিরোধী দেহের মাঝে সে নিজেকে যখন নিঃশেষ করছে, তখন তার আপাত পলকহীন কালো চোখ দুজনের মাঝের শূন্যতার দিকে তাকিয়ে রয়েছে, কোনো আবেগ, কোনো প্রতিক্রিয়া বা কোনো ধরণের নৈকট্য ব্যাতিরেকে।
আয়েশার মনের ভিতরে কি খেলা করে? বসন্তের আগমনে অঙ্কুরোদগমের ফলে সবুজ হয়ে উঠা বনানীর মাঝে একটা পথ ধরে ঘোড়া নিয়ে এগিয়ে যাবার সময়ে বাবর আবারও কল্পনা করতে চেষ্টা করে মানসিক বা শারীরিক কোনোভাবেই কেননা আয়েশা কোনো ধরণের প্রতিক্রিয়া তার প্রতি প্রদর্শন করে না। দোষটা কি তার নাকি আয়েশার? আয়েশারই দোষ নিশ্চয়ই। মেয়েটার সমস্যাটা কোথায়? আয়েশার অনুরোধে জেনানামহল থেকে দূরে তার আর তার মাঙ্গলিঘু পরিচারিকাদের জন্য আলাদা বাসস্থানের বন্দোবস্ত করা হয়েছে। সে যখনই আয়েশার মহলের দিকে হেঁটে যায় দূর থেকে তাদের বিচিত্র ভাষায় কথা বলতে শোনে। কখনও তাদের। হাসির আওয়াজও ভেসে আসে। কিন্তু সে যাহা মাত্র ভিতরে প্রবেশ করে তারা সাথে সাথে নিরব হয়ে যায়। আয়েশা তার মাথা নুইয়ে তাকে আনুষ্ঠানিক অভিবাদন জানায়। তারপরে তার উদ্যোগের জন্য, ভাবলেশহীন চোখ নিচের দিকে নামিয়ে নিরবে অপেক্ষা করে। স্ত্রীর চেয়ে ক্রীতদাসীর সাথেই তখন তার সাদৃশ্য বেশি। অবশ্য একটা পার্থক্য আছে সেটা হলো ক্রীতদাসী বিনয়ী হয় কিন্তু আয়েশার মাঝে সেটাও নেই।
বাবরের কাছে মনে হয় আয়েশা তার অহংকার বর্মের মতো ব্যবহার করছে নিজেকে আড়াল করে রাখতে। তার এই নির্লিপ্ততা তাকে তাড়িত করে। মাঝেমাঝে তাদের যান্ত্রিক রমণক্রিয়ার সময়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও সে তার সাথে কঠোর আচরণ করে, নিজের শারীরিক শক্তির রূঢ় প্রয়োগ করে আশা করে সে কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করবে- তা সে যাই হোক। কিন্তু তার মনোবাসনা পূর্ণ হয় না, এবং আয়েশা যদিও তাকে কোনো ধরণের বাধা দেয় না কিন্তু বাবরের নিজেকে আইনসঙ্গত স্বামীর চেয়ে নারীর প্রতি নিপীড়নকারী বলে তখন মনে হয়। আবার কখনও সে তার সাথে নম্র আচরণ করে প্রেমিক পুরুষের মতো তার দেহের কোমনীয় বাঁকে স্পর্শ করে, তার স্তনবৃন্তে চুম্বন দিয়ে তার নিটোল উদরে মুখ রাখে- বয়ঃসন্ধিক্ষণের স্বপ্নে সুখনম্য রমণীদের প্রতি সে যেমন আচরণ করেছে। কিন্তু আয়েশা তাদের মতো কোনো প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন না করে, আড়ষ্ঠভঙ্গিতে ততোধিক অনীহার মাঝে নিজেকে আড়াল করে রাখে।
খানজাদাকে সে যখন লাল হয়ে তোতলাতে তোতলাতে জিজ্ঞেস করে- যে শাহী বিয়ের সহযাত্রী হবার জন্য মুখিয়ে ছিলো আর যত্ন নিয়ে বাছাই করা উপহার সামগ্রীর ব্যাপারে ছিলো এত উদার- আয়েশা তার বা তার আচরণের ব্যাপারে তার সাথে কখনও কোনো আলাপ করেছে কিনা, সে মাথা নেড়ে অপারগতা প্রকাশ করে। সে অবশ্য তাকে একটা কথা বলে যে, বিয়ের পর পর সে যখন আয়েশার সাথে তার মহলে দেখা করতে যেতো, তখন সে সব সময়ে তাকে শীতল উদাসীন ভঙ্গিতে অভ্যর্থনা জানিয়েছে। কোনো ধরণের আবেগ দেখানো দূরে থাক, আলাপ করার কোনো ইচ্ছাই সে দেখাতো না- সে তাই বাধ্য হয়ে একতরফা যাওয়া বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে। খানজাদা বলে, ব্যাপারটা অনেকটা এমন যে, আয়েশা যেনো অন্য কোথাও থাকতে চায়, আর সেখানেই রয়েছে বলে মনে মনে ধরে নিয়েছে।
শাহরুখিয়ার দূর্গপ্রাকারের নিচে যত্রতত্র গড়ে উঠা কাঠের চালাঘর। মাটির ইটের বাসা এবং চামড়ার গোলাকৃতি তাঁবুর দঙ্গলের ভিতর দিয়ে বাবর আর তার লোকেরা ঘোড়া ছুটিয়ে অতিক্রম করার সময়েও সে নিজের ভাবনায় বিভোর হয়ে থাকে। হতদরিদ্র কাপড় পরিহিত অধিবাসীরা আগুনের ধোয়ার পাশে আসনপিড়ি হয়ে বসে রাতের খাবারের আয়োজন করছে, যখন তাদের বাচ্চারা ঢালু গলিপথে খালি পায়ে দৌড়ে বেড়ায়। সংকীর্ণ নালা, যেখান দিয়ে বর্জ্য প্রবাহিত হয় তার উপর দিয়ে লাফিয়ে যায় আর অন্যরা আবর্জনা এবং জঞ্জালের ঢিপির উপর দিয়ে বীরবিক্রমে লাফ দেয়। তারা পাথর নির্মিত তোরণদ্বারের লোহা দিয়ে বাঁধানো দরজার দিকে এগিয়ে যেতে, একটা বাচ্চা ছেলে- দুই কি তিন বছরের বেশি বয়স হবে না সহসা দৌড়ে বাবরের সামনে এসে পড়ে। আতঙ্কে চিহি শব্দ করে উঠে তার ঘোড়া পিছনের পায়ে লাফিয়ে দাঁড়িয়ে যায়।
বাবর গায়ের সর্বশক্তি দিয়ে লাগাম টেনে ধরে বাদামী আজদাহাটার মুখ ঘুরিয়ে নেয়। যাতে আতঙ্কিত হয়ে এলোপাথাড়ি চালাতে থাকা ঘোড়ার খুরের আঘাত থেকে বাচ্চাটা বেঁচে যায়, যে এখন চোখ বড় বড় করে উচ্চস্বরে কাঁদছে এবং ভয়ে অনড় হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বাবরের ঠিক পেছনের একজন অশ্বারোহীর ব্যাপারটা বুঝতে দেরি হয়ে যায় এবং মনে হয় যেনো সে বাচ্চাটাকে মাড়িয়ে যাবে। কিন্তু। পথের ধারে দাঁড়িয়ে থাকা সুঠামদেহী এক তরুণ সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাচ্চাটাকে জড়িয়ে ধরে মাটিতে শুয়ে পড়ে নিজের দেহ দিয়ে তাকে আড়াল করে রাখে। উচ্চস্বরে অভিশাপ দিতে দিতে আগুয়ান অশ্বারোহী তার বিশাল কালো ঘোড়াটা। নিয়ন্ত্রণ করতে চেষ্টা করে। কোনোমতে তাদের উপর দিয়ে লাফিয়ে পার হয়ে যায়। কিন্তু ঘোড়ার পেছনের পায়ের একটা খুর তরুণের মাথার পেছনে খুব জোরে আঘাত করে।
বাবর জিনের উপর থেকে নেমে অচেতন তরুণের পাশে হাঁটু মুড়ে বসে বাচ্চাটাকে সে তখনও নিজের বাহু দিয়ে আগলে রেখেছে- বাবর এখন দেখতে পায় একটা বাচ্চা মেয়ে। মেয়েটা তখনও ফোঁপাচ্ছে। শিকনির সরু একটা ধারা তার উপরের ঠোঁট বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে। বাবরের লোকজন তাকে সরিয়ে নিতে সে এবার ছেলেটাকে পিঠের উপর শোয়ায়। বাবর ভাবে, আমারই মতো বয়স দেখছি। ঈগলের মত বাঁকানো নাক, চোখের নিম্নাংশের হাড় উঁচু এবং থুতনিতে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। অসংখ্য যুদ্ধের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন চোখে সে ছেলেটার মাথার আঘাত খুটিয়ে দেখে এবং কালো চুলের নিচে একটা জায়গা দেখে যেখানটা থেতলে গিয়ে রক্তে চটচট করছে। তরুণ ছেলেটা যার ভাসাভাসা শ্বাসপ্রশ্বাস দেখে। মনে হয় গভীরভাবে অচেতন হয়ে রয়েছে। বাচ্চা মেয়েটাকে বাঁচাতে গিয়ে বেচারা বেশ ভালোই আঘাত পেয়েছে। মেয়েটাকে যে বাঁচিয়েছে এটা জানার জন্য যদি সে জীবিত না থাকে তবে ব্যাপারটা দুঃখজনক হবে।
“একে দূর্গে নিয়ে চলো। দেখা যাক আমাদের হেকিম তার কোনো কিছু করতে পারে কিনা।” বাবর ঘোড়ায় উঠে বসে এবং দূর্গের তোরণের দিকে এগিয়ে যাবার সময়ে সে আগের চেয়েও বিষণ্ণ হয়ে উঠে।
***
সেই রাতে, বাবর বুঝতে পারে তার আয়েশার কাছে যাওয়া উচিত। তার নানীজান আর আম্মিজান তাহলে খুশি হবে এবং একবার গর্ভবতী হলে সম্ভবত আয়েশা নিজেও খানিকটা পরিতৃপ্তি খুঁজে পাবে। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো দৌহিত্রের সম্ভাবনায় হয়তো ইবরাহিম সারু প্রতিশ্রুত তীরন্দাজ বাহিনী দিয়ে বাবরকে তার জন্মস্থান আকশি পুনরুদ্ধারের সহায়তা করবে। এখন ভরা বসন্তকাল। তার সৎ-ভাই জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করার উপযুক্ত সময়। অথচ সে যখনই জামমীনে তার বার্তাবাহক পাঠায় কখন তীরন্দাজ বাহিনী পৌঁছাবে জানতে, প্রতিবারই সেখান থেকে একই উত্তর আসে: তীরন্দাজ বাহিনী শীঘ্রই পৌঁছাবে, শীঘ্রই…
হাম্মামখানা থেকে বের হয়ে এসে বাবর তার স্ত্রীর মহলের দিকে কর্তব্যপরায়ন ভঙ্গিতে হাঁটতে শুরু করে। কিন্তু সামনে সবুজ চামড়া দিয়ে মোড়া দুই দরজা বিশিষ্ট প্রবেশপথ চোখে পরতে সে থমকে দাঁড়িয়ে যায়। না। এসান দৌলতকে যেমন বলেছে, সে কারো আদেশে প্রজনন অশ্বের ভূমিকা পালন করবে না। সে একজন পুরুষ যে নিজেকে জানে তার কি ভাললাগে এবং সে তাই করবে। গোড়ালির উপরে ঘুরে দাঁড়িয়ে সে দ্রুত ফিরতি পথে রওয়ানা দেয়।
***
তরুণের আঘাতের ব্যাপারে বাবরের আশঙ্কা অবশ্য ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়। ছয় ঘণ্টা পরে এক পরিচারক এসে তাকে জানায় যে তার জ্ঞান ফিরে এসেছে। ব্যাপারটা সেখানেই শেষ হওয়া উচিত ছিলো। কিন্তু কোনো একটা কারণে বাবর আরও জানতে আগ্রহী হয়ে উঠে এবং দুর্ঘটনার দ্বিতীয় দিন সে আদেশ দেয় যদি সম্ভব হয় তবে একটা খাঁটিয়ায় করে ছেলেটাকে যেনো তার কাছে নিয়ে আসা হয়।
ছেলেটাকে ভীষণ ফ্যাকাশে দেখায়। কিন্তু নিজের অধোমুখ অবস্থান থেকে হাত বুকের উপরে রেখে মাথা নুইয়ে সে বাবরকে অভিবাদন জানায়- ভঙ্গিটা করতে তার কষ্ট হয় সেটা পরিষ্কার বোঝা যায় কারণ বেচারা ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠে।
“বাচ্চা মেয়েটাকে ওভাবে বাঁচিয়ে তুমি দারুণ সাহসের পরিচয় দিয়েছে। আমি কৃতজ্ঞ যে তোমার নিজের জীবন বখশ দিয়ে আল্লাহ তোমার প্রতি উপযুক্ত করুণা প্রদর্শন করেছেন। তোমার নাম কি?”
“বাবুরী, সুলতান।”
বাবর স্পষ্টতই বিস্মিত দৃষ্টিতে এবার তার দিকে তাকায়। বাবুরী একটা অপ্রচলিত নাম। কিন্তু সেই সাথে তার নিজের নামের সাথে দারুণ মিল রয়েছে নামটার। “তুমি কোথাকার বাসিন্দা? তোমার গোত্রের নাম কি?”
“আমার বাবা ছিলেন বারীন গোত্রের একজন যোদ্ধা এবং আপনার মরহুম পিতার অধীনে লড়াই কিন্তু আমি যখন নিতান্তই শিশু তখন তিনি মারা যান। আমার বাবার কথা আমার মনে নেই। আমার মা আমাকে নিয়ে সমরকন্দ চলে যান। কিন্তু সেখানে আমার যখন সাত বছর বয়স, তখন গুটিবসন্তে তিনি মারা যান। তখন থেকেই আমি একা একা মানুষ হয়েছি।”
“তুমি কি করো? যোদ্ধা?”
“না, সুলতান।” বাবুরী এবার বাবরের চোখের দিকে তাকায়। চোখের মণি গাঢ় প্রায় ধূম্রনীল।
“কিছু দিন আগেও আমি বাজারে বাজারে ফেরি করে বেড়াতাম। সমরকন্দের সড়কে আমি বাঁধাকপি ফেরি করেছি।”
“তুমি শাহরুখিয়ায় কিভাবে এসেছো?”
“সুলতান, আপনি যখন সমরকন্দ অবরোধ করেছিলেন তখন আমি আপনার এক সর্দারের অধীনে পানি বাহকের কাজ নেই। তিনি ফারগানা চলে যাবার পরে আমি থেকে যাবার সিদ্ধান্ত নেই।” কোনো রকমের ভনিতা না করে বাবুরী কথা বলে যায়।
“কিন্তু আমি তোমাকে আগে কখনও দেখিনি?”
“এতে অবাক হবার কিছু নেই। আমি এখন রসুইখানায় কাজ করি। ভেড়ার চামড়া ছাড়াই, মুরগীর নাড়িভূড়ি পরিষ্কার করি। বলবার মতো কোনো কাজ না তবে কাজ।” তার ঠোঁটের কোণে একটা আধো হাসি ফুটে উঠে। “আরও খারাপ কিছু কপালে জুটতে পারতো।”
বাবর বিস্মিত হয়ে ভাবে সে আমাকে নিয়ে রসিকতা করছে। আমি তার কাছে আনন্দের উপকরণ। “আমি নিশ্চিত আরো খারাপ কিছু হতে পারতো- মাঝে মাঝে নিয়তি যা নির্ধারিত করে রেখেছে আমাদের সেটাই মেনে নিতে হয়, এমনকি সেটা মুরগীর নাড়িভূড়ি বের করা হলেও। কিন্তু নিয়তি সম্ভবত এবার অন্য কিছু ঠিক করেছে। তোমার সাহসিকতা দেখে মনে হয়েছে সৈন্য হবার যোগ্যতা তোমার রয়েছে।”
“আমারও সেটা পছন্দ যে…তাছাড়া, আমি প্রমাণ করেছি আঘাত সহ্য করার মতো যথেষ্ট মোটা মাথা আমার রয়েছে…এবং রসুইখানায় কাজ করার চেয়ে সেটা অনেক বেশি কাম্য- কখনও কখনও যদি আমাকে মানুষের নাড়িভূড়ি বা নিজেরও কিছু খোয়াতে হয়, তারপরেও।” ছেলেটা এখনও হাসছে।
“খুব ভালো কথা। তুমি দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠো, আমার অশ্বারোহী বাহিনীতে তুমি যোগ দেবে।”
বাবর ভেবেছিলো ছেলেটা আনন্দে অধীর হয়ে তাকে কৃতজ্ঞতা জানাবে। কিন্তু দেখে উল্টো তার মুখের হাসি উবে যায়। তার অভিব্যক্তিতে একটা আড়ষ্ঠতা ফুটে উঠে এবং তার ফ্যাকাশে মুখ লাল দেখায়। “কি ব্যাপার কি হয়েছে?”
“সুলতান, আমি ঘোড়ায় চড়তে জানি না।”
নিজের নির্বুদ্ধিতায় বাবর নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরে। যাযাবর সমাজে যেখানে কেবল হতদরিদ্ররাই ঘোড়ার ব্যাপারে অজ্ঞ হয়, সেখানে সেটা স্বীকার করাটা লজ্জাজনক। এক গরীব ফেরিওয়ালা কিভাবে অশ্বারোহী বাহিনীতে যোগ দেবার মতো দক্ষ ঘোড়সওয়ার হবে?
বাবুরীকে আরও অস্বস্তিতে ফেলার আগেই সে দ্রুত বলে, “তুমি ইতিমধ্যে প্রমাণ করেছো যে ঘোড়া দেখে তুমি মোটেই ভীত বোধ করো না। সুস্থ হয়ে অশ্বশালার আধিকারিকের কাছে গিয়ে বলবে সে তোমাকে প্রশিক্ষণ দিয়ে অশ্বারোহী বাহিনীর যোগ্য করে তুলবে।”
***
“আমরা তাহলে একমত। আগামী পূর্ণিমার পূর্বে যদি জামমীন থেকে মাঙ্গলিঘ তীরন্দাজের দল এসে না পৌঁছে, আমরা তারপরেও আকশির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেব।” বাবর তাকে অর্ধবৃত্তাকারে ঘিরে আসনসিঁড়ি হয়ে বসে থাকা পারিষদবৃন্দের দিকে তাকায়।
মাঙ্গলিঘ থেকে আগত অতিরিক্ত সৈন্যবাহিনীর এখনও কোনো খবর নেই এবং বাবরেরও ধৈৰ্য্যচ্যুতি ঘটেছে। তার অধিকৃত ভূখণ্ড এখনও নিরাপদে তার আয়ত্ত্বে আছে। দূর্গগুলোতে তার বিশ্বস্ত সর্দারদের অধীনে ভালোমতো রক্ষীবাহিনী মোতায়েন করা রয়েছে, কিন্তু তার পক্ষে আর অপেক্ষা করা সম্ভব না। আকশি তাকে অতিসত্ত্বর পুনরায় দখল করতে হবে। তারপরেই সে কেবল নিজেকে ফারগানার সত্যিকারের সুলতান বলে অভিহিত করতে সক্ষম হবে এবং ভবিষ্যতের জন্য উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা হাতে নিতে পারবে।
“সুলতান ইত্যবসরে আমাদের উচিত সৈন্যবাহিনীর কুচকাওয়াজ অব্যাহত রাখা। অবরোধ যন্ত্র আর নিক্ষেপক আমাদের যথেষ্ট রয়েছে কিন্তু সৈন্যবাহিনীর একটা বিরাট অংশ এখনও সুশৃঙ্খল বাহিনী হিসাবে জমাট বাঁধেনি। যুদ্ধাবস্থায় আমরা তাদের মাথায় যা ঢোকাতে চেয়েছি, সেটা হয়তো তারা বেমালুম ভুলে বসে থাকবে। আর আমাদের উচিত রসদের পরিমাণ বৃদ্ধি করা। আমরা যদিও দীর্ঘ অবরোধের পক্ষপাতি নই, শেষ পর্যন্ত হয়তো সেটাই অবধারিত হয়ে উঠতে পারে, ওয়াজির খান বলেন।
“আপনি ঠিকই বলেছেন। আর আমরা যখন অভিযান শুরু করবো, আমাদের উচিত হবে আগেই হামলাকারী বাহিনী পাঠিয়ে গবাদি পশুর পাল দখল করে নেয়া। আকশির রক্ষীবাহিনী নিজেদের খাবার জন্য সেগুলো দখল করার আগেই। বাইসানগার, এই কাজের উপযুক্ত বাহিনী গড়ে তোলার জন্য আমি আপনার উপরে নির্ভর করছি- এমন লোক যাদের আমরা বিশ্বাস করতে পারি। আমার লোকেরা হত্যাযজ্ঞের শিকার যেন না হয় বা তাদের উপরে যেন লুটতরাজও চালান না হয়। আমরা সব কিছু অর্থের বিনিময়ে কিনে নেব। আমি একজন সুলতান যে তার নিজের রাজ্যে ফিরে আসছে, লুটতরাজে প্রবৃত্ত কোনো উজবেক দস্যু নই।”
বাবর উঠে দাঁড়ায়, নিজে নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেছে বলে খুশি হয় এবং অপেক্ষার পালা শীঘ্রই শেষ হবে। অস্থিরবোধ করতে, সে আঙ্গিনায় বের হয়ে আসে এবং তার প্রিয় ঘোড়াকে প্রস্তুত করতে বলে। বিস্মিত সহিসের দল দৌড়ে যায় তার আদেশ পালন করতে। তার দেহরক্ষীর দল নিজেদের ঘোড়ার জন্য চেঁচামেচি শুরু করতে বিভ্রান্তি আরো বেড়ে যায়। সবাই অলস আর অগোছালো হয়ে পড়েছে। সে বাবুরীর চওড়া কাঁধ আর সরু কোমরযুক্ত অবয়ব লক্ষ্য করে, ঝাড়ু হাতে আস্তাবল থেকে বের হয়ে আসতে সে তাকে হাতের ইশারায় কাছে আসতে বলে।
“সুলতান?” আজ বাবুরীকে কোনো কারণে বাবরের চোখের দিকে তাকাতে অনিচ্ছুক মনে হয়।
“তোমার ঘোড়ায় চড়ার প্রশিক্ষণ কেমন চলছে?”
নিরবতা।
“আমি আদেশ দিয়েছিলোম অশ্বারোহী বাহিনীর সদস্য হবার জন্য তুমি প্রশিক্ষণ নেবে?”
আবারও নিরবতা।
“আর আমি আদেশ অমান্য করা দেখতে অভ্যস্ত নই।” বাবর বিস্মিত হয়। ছেলেটাকে তার আগ্রহী বলেই মনে হয়েছিলো। কিন্তু সে এখনও প্রশিক্ষণ আরম্ভ করেনি। সে বাবুরীকে সাহায্য করতে চায় এবং ভেবেছিলো তার ভিতরে সে একটা আগ্রহ দেখতে পেয়েছে। কিন্তু তার নিশ্চয়ই কোথাও ভুল হয়েছে। বাবুরী যে বাঁধাকপি ফেরি করতে সে সেগুলোর মতই অকর্মণ্য। হতাশ হয়ে বাবর ঘুরে দাঁড়ায়। ঘুরে দাঁড়াতে গিয়ে সে বাবুরীর চোখের নিচের হাড়ে একটা কালশিটে দাগ দেখতে পায়। “দাঁড়াও, দাঁড়াও। ওটা কিসের দাগ?”
“আপনার অশ্বশালার প্রধান আমাকে মেরেছে।”
“কেন?”
বাবুরী এতক্ষণ পরে এবার চোখ তুলে তাকায়। “কারণ আমি তাকে বলেছিলাম অশ্বারোহী বাহিনীতে যোগ দেবার জন্য ঘোড়ায় চড়া শিখতে চাই। সে বলেছে আমি ঘোড়ার বিষ্ঠা পরিষ্কার করার যোগ্য।”
“তুমি কি তাকে বলেছে যে আমি ব্যক্তিগতভাবে এর জন্য ইচ্ছা পোষণ করেছি?”
“সম্ভবত এভাবে আমি কথাটা তাকে বলিনি। আমি ভেবেছিলাম সে বিষয়টা জানে। আর আঘাত করার আগে সে আমাকে সেটা বলবার কোনো সুযোগও দেয়নি। পরে, আমি কেবল তাকে পাল্টা আঘাত করা থেকে বহু কষ্টে নিজেকে বিরত রেখেছি। ব্যাখ্যা করার জন্য সেটা উপযুক্ত সময় ছিলো না, বা আর্জি জানাবার। আপনি যদি সত্যিই চান আমি ঘোড়া চালনা শিখি তবে সেটার বন্দোবস্ত হয়ে যাবে। আর তা যদি না হয়, তাহলে রসুইখানার চেয়ে আস্তাবল অনেক ভাল, বলতেই হবে।”
বাবর তার এক দেহরক্ষীর দিকে তাকায়। “আলী গোসতকে ডেকে আন।”
কিছুক্ষণ পরে, লোকটাকে তার সামনে নতজানু অবস্থায় বসে থাকতে দেখা যায়। সে বাবরের মতই, চেঙ্গিস খানের বংশধর, সাগরিচি গোত্রে অন্তর্গত আর ঘোড়ার ব্যাপারে তার দক্ষতা সর্বজনবিদিত। বলা হয় সে একটা স্ট্যালিয়ন মাত্র দু’দিনে বশ মানাতে পারে। বদরাগী আর নিজের বহু কষ্টে অর্জিত মর্যাদা সম্পর্কে সচেতন আলী গোসত বিশ্বস্ত আর বিবেকবুদ্ধিসম্পন্ন। বাবরের ধারণা বাবুরী নিজের বক্তব্য পেশ করার সময় বা তরিকার ব্যাপারে খুব একটা সচেতন ছিলো না। কোনো সন্দেহ নেই আলী গোসত ভেবেছে বাবুরী বড়াই করছে- বারীন গোত্রের এ ব্যাপারে আবার দারুণ সুনাম রয়েছে। বাবর ভাবে, তারই ভুল হয়েছে, পরিষ্কার করে আদেশটা না দিয়ে।
“আমি চাই এই লোকটা আমার অশ্বারোহী বাহিনীর একজন সদস্যে পরিণত হোক। আমরা এখন তার প্রশিক্ষণ আরম্ভ করবো। শাহী আস্তাবল থেকে তার জন্য একটা ঘোড়ার ব্যবস্থা করো।”
“এখনই করছি, সুলতান।”
কয়েক মিনিট পরে বাবর, সাথে বাবুরী তার বাহনের কেশর আঁকড়ে- একটা শান্ত ঘোটকী- শাহরুখিয়ার দূর্গ থেকে দুলকি চালে বের হয়ে আসে। রক্ষীবাহিনী বরাবরের মতো একটু পেছনে থেকে তাকে অনুসরণ করে। চমৎকার উষ্ণ এক দুপুরবেলা এবং তৃণভূমিতে ফুটে থাকা গবাদি পশুর ভোজ্য এক বোঁটায় তিনপাতা বিশিষ্ট ছোট গাছের সাদা পুষ্ট ফুলে মৌমাছির দল ব্যস্ত ভঙ্গিতে উড়াউড়ি করছে এবং বাতাসে একটা মিষ্টি গন্ধ ভেসে আছে। বাবর লাগাম টেনে ধরে এবং ঘুরে তাকায় বাবুরীর হালহকিকত দেখতে। সামান্য সোজা অবস্থায় তাকে এখন উপবিষ্ট দেখা যায়, ঘোটকীর কেশর টানা বন্ধ করেছে। “হাঁটু দিয়ে আঁকড়ে ধরে থাকো। গোড়ালির গাঁট ভিতরের মুখ করে নিচের দিকে নামিয়ে রাখবে এবং পায়ের পাতা থাকবে রেকাবের উপরে।”
বাবুরী মাথা নাড়ে, মনোসংযোগের তাগিদে তার ভ্রু কুঁচকে আছে। বাবর ভাবে, ব্যাটার জিনে বসার একটা সহজাত ভঙ্গি রয়েছে এবং ভালো অশ্বারোহী হবে। তার জীবন এতোদিন কেমন কেটেছে? বাবরের পক্ষে সেটা কল্পনা করাটা কঠিন। বাবরের চোখে কেবল সুড়ঙ্গ পথে লুকিয়ে সন্তর্পনে সমরকন্দে প্রবেশের পরে লুকিয়ে থাকার সময়ে প্রাঙ্গনের সেই হাড্ডিসার বুড়ো আর তার সেই ছত্রাক আক্রান্ত পেঁয়াজের দৃশ্য ভাসতে থাকে। সেইদিন সকালে বাবুরীও সম্ভবত প্রাঙ্গণের কোথাও দাঁড়িয়ে ছিলো।
“জলদি এসো।” বাবর তাড়া দেয়। “দ্রুত ঘোড়া হাঁকাও।”
“আমি সেটাই চাইছি, কিন্তু সুলতান আমি এই ঘোটকীটাকে মোটেই রাজি করাতে পারছি না।”
***
কয়েকদিন পরের কথা, আস্তাবলের বাইরে বাবর তার ঘোড়ার লাগাম একজন সহিসের কাছে বুঝিয়ে দিচ্ছে যখন, সে বাবুরীকে আস্তাবলের ভিতরে দেখতে পায়। তার দিকে পেছন ফিরে ঝুঁকে নিজের ঘোড়ার পা মালিশ করছে। বাবর সন্তর্পনে তার দিকে হেঁটে যায় এবং তার প্রশিক্ষণ কেমন চলছে জানার জন্য হাত বাড়ায় তার কাঁধে টোকা দেবে বলে। টোকা দিতে গিয়ে সে তার কাঁধ আঁকড়ে ধরে এবং তার দিকে মোচড় দেয়। বাবুরী ধনুকের ছিলার মতো ছিটকে ঘুরে দাঁড়িয়ে তাকে আঘাত করার জন্য জড়িয়ে ধরে। সে কাকে ধরেছে সেটা দেখা মাত্র অবশ্য সে বাবরকে ছেড়ে দেয় এবং হাঁটু মুড়ে নতজানু হয়। “আমাকে মার্জনা করবেন, সুলতান। আমি বুঝতে পারিনি।”
“অবশ্যই তুমি বুঝতে পারনি। কিন্তু এমন প্রতিক্রিয়ার কি বিশেষ কোনো কারণ আছে?”
“সহজাত প্রবৃত্তি। আপনার বাল্যকাল যদি রাস্তায় কাটে এবং টের পান আপনার পেছনে কিছু একটা ঘাপটি মেরে রয়েছে, আপনার যথাসর্বস্ব হতে পারে সেটা একটা তামার পয়সা, খাবার বা হয়তো আপনার নিজের স্বাধীনতা- বাঁচাতে আপনাকে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অনেক লোক আছে যারা বাচ্চাদের অপহরণ করে ক্রীতদাস বা আরো জঘন্য উদ্দেশ্যে বিক্রি করে দেয়।”
“তোমার খেয়াল রাখার মতো কেউই কি ছিলো না?”
“আমার আম্মিজান মারা যাবার পরে আর কেউ ছিল না। কিছু মানুষ আসলেই দয়ালু কিন্তু বাকী সবাই সাধারণত বিনিময়ে কিছু চায় হতে পারে সেটা নিতান্তই কতজ্ঞতা বা চাটুবাদিতা কিংবা তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী কোনো কিছু করা। আপনি সবচেয়ে বেশি নির্ভর করতে পারেন- রুটির টুকরো চুরি করতে রুটিঘরের পেছনের পথের দিশা বা শীতের রাতে ঘুমাবার গরম জায়গা কোথায় পাওয়া যাবে আরেকটা রাস্তার ছেলের উপরে যদিও সেও আগে নিজের খেয়ালই রাখবে।” “বাইরের পৃথিবীটা কি আসলেই এমন? মানুষ কি এতোই স্বার্থপর?”
“হতে পারে আমি বাড়িয়ে বলেছি। আমার কিছু ভালো বন্ধু ছিলো” বাবুরী বলে, তারপর তার মুখে একটা রহস্যময় হাসি ফুটে ওঠে। “দরবারের কথা একেবারেই আলাদা? আপনার পারিষদবর্গের ভিতরে কতোজনের উপরে আপনি নির্দ্বিধায় নির্ভর করতে পারেন? নিজের সমগোত্রীয়দের উপরে উঠার জন্য তুচ্ছ সম্মান বা উপহার বা মামুলী সুবিধার জন্য আপনার স্বার্থের বিনিময়ে কে এমন আছে যে নিজের স্বার্থকে প্রাধান্য দেবে না? আপনার সমগোত্রীয় কতজন শাসক- আত্মীয় হোক বা না হোক- রুটিঘরের মালিক অন্য খদ্দেরকে বিদায় করতে যখন ব্যস্ত, সেই সুযোগে আমি যেমন রুটিঘরে চুরি করেছি, ঠিক তেমনি, আপনার মনোযোগর বিক্ষিপ্ততার সুযোগ নিয়ে আপনারই রাজ্যে লুটতরাজ চালানো থেকে বিরত থাকবে?”
বাবর নিজের সৎভাই জাহাঙ্গীর, চাচাতো ভাই মাহমুদ আর তামবাল তার সাথে কি করেছে ভেবে ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে ভ্রুকুটি করে। “আমি তারপরেও রাস্তার জীবনের চেয়ে দূর্গের জীবনই বেছে নেবো- আর তুমিও তাই চাও, নতুবা আজ তুমি এখানে থাকতে না।”
“আমার অন্তত পছন্দ করার সুযোগ ছিলো। আপনি হয় সর্দার হবেন নতুবা আপনার জীবন বৃথা। আপনার পক্ষে কখনও অখ্যাত অবস্থায়, নিরূপদ্রব জীবন কাটানো সম্ভব না। কেউ না কেউ আপনাকে হুমকি হিসাবে দেখবে আর হত্যা করবে। নিজের ভাগ্য বেছে নেবার স্বাধীনতা আমার রয়েছে, আমার সামনে তাই। সম্ভাবনা প্রচুর, যদিও সবই কম উত্তেজনাপূর্ণ। হ্যাঁ, আমি এখানে থাকতে পছন্দ করি, কিন্তু এখানে থাকাটা আমি আমার অভ্যেসে পরিণত করবো না।”
“খুবই সত্যি কথা। আমার মরহুম আব্বাজান প্রায়ই একটা কথা বলতেন, নিজের ভালো একজন খুব ভালোই বুঝতে পারে এবং আমার মনে হয় কথাটা একজন শাহজাদা আর ভিখারীর জন্য সমান প্রযোজ্য।” কথাটা বলেই বাবর ঘুরে দাঁড়ায় এবং শেষ কথাটার জন্য সে নিজেই নিজেকে বাহবা দেয়।
***
সাম্প্রতিক সময়গুলোতে সে বারবার যা করেছে, বাবর নিজের কোমরে আরও একবার মোটা নীল কাপড়ের একটা ফালি কষে বাঁধে। তার পরণের কালো সালোয়ার ছেঁড়াফাটা এবং পিঙ্গল বর্ণের জোব্বার উপরের পরা চামড়ার আঁটসাট জ্যাকেট চকচকে আর পুরাতন।
“সুলতান, সাবধানে থাকবেন।” ওয়াজির খানকে উদ্বিগ্ন দেখায়।
বাবর ধারণা করে, তার এইসব নৈশ অভিযান আর তারচেয়েও বড় কথা বাবুরীর সাথে তার ক্রমবর্ধমান ঘনিষ্ঠতা, আর রাতের বেলার এইসব অভিযানে তার সঙ্গী হওয়ার ব্যাপারটা তিনি মেনে নিতে পারছেন না। কিন্তু তার লোকজন কিভাবে বসবাস করছে সেটার একেবারে আসল অবস্থা দেখার এইসব অভিযান বাবরের কাছে ক্রমশ একটা নেশার মতো হয়ে উঠছে। “আমি সতর্ক থাকবো।” তার বুড়ো হয়ে উঠা বিশ্বস্ত বন্ধুর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বাবর চুপিসারে কক্ষ থেকে বের হয়ে এসে পেছনের একটা সংকীর্ণ সিঁড়ি দিয়ে দূর্গের পেছনের অংশে অবস্থিত একটা ছোট প্রাঙ্গণে নেমে আসে, যেখানে অন্ধকারে বাবুরী তাদের আগে থেকে ঠিক করা স্থানে তার জন্য অপেক্ষা করছে।
তারা নিরবে পাশের একটা দরজার দিকে এগিয়ে যায়, যেখানে অবস্থানরত ওয়াজির খানের প্রহরীকে আগে থেকেই সতর্ক করে দেয়া হয়েছে তাদের ব্যাপারে। ফলে সে, নিরবে তাদের বাইরে যেতে দেয়। বাবর চোখ কুঁচকে তাকিয়ে দূর্গ থেকে কয়েকশ গজ দূরে তার আদেশমতো দুটো টাটু ঘোড়াকে জিন চাপানো অবস্থায় দড়ি দিয়ে বাঁধা দেখতে পায়।
তারা ঘোড়াগুলোর বাঁধন খুলে লাফিয়ে পিঠে চেপে বসে এবং টাকরার সাহায্যে একটা শব্দ করে আর ঘোড়াগুলোর পুষ্ট পাঁজরে গোড়ালি দিয়ে তবলার বোল তুলে, অর্ধবল্পিত বেগে অন্ধকারে হারিয়ে যায়। অসাধারণ একটা ব্যাপার। বাবুরী যেভাবে মাত্র কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে, বাবর ভাবে, তার কখনও ছিলো এমন রক্ত সম্পর্কীয় ভাইয়ে পরিণত হয়েছে। সে তাকে অসি চালনা, আর কুস্তি করতে শিখিয়েছে। এমন কি কিভাবে ঘোড়ায় উপবিষ্ট অবস্থায় তীর ছুঁড়তে হয়- ঠিক যেমন ওয়াজির খান তাকে একসময়ে শিখিয়েছিলো। বাবুরী যে আসলেই একজন সহজাত ঘোড়সওয়ার সেটা সে প্রমাণ করেছে এবং কয়েকবার পটকান খেয়ে তার বোধবুদ্ধিও ভালোই হয়েছে, এখন সে বাবরের সাথে প্রায় সমান তালেই ঘোড়া ছোটাতে পারে।
বাবুরী তাকে এর বদলে শিখিয়েছে লোকগান আর নৃত্য- এবং ছিঁচকে চোর হতে হলে লুকিয়ে থাকার যে কৌশল আর পটুতা দরকার সেটাও বাবর তার কাছে থেকে শিখেছে। কিভাবে একজন কৃষকের মতো পোশাক পরতে হবে, যা তাদের নৈশ অভিযানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সেটাও বাবুরীই তাকে শিখিয়েছে। তারা যখন রাতের বেলা ঘোড়া নিয়ে বেড়াতে বের হয়, তখন গ্রামে আর অস্থায়ী বসতির আশেপাশের বাজারে জিনিসপত্রের দরদাম করে এবং উবু হয়ে গ্রামের বারোয়ারী আগুনের পাশে বসে ধূমায়িত চা পানের ফাঁকে বয়স্কদের গল্প শোনে।
কখনও তার আর অন্যান্য গোত্রপতিদের বিরুদ্ধে বাবর তাদের বিষোদগার করতে শোনে। যাদের কল্যাণে সাধারণ মানুষের জীবন এখন পুরোপুরি অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। প্রথম প্রথম এইসব মন্তব্য তাকে ক্রুদ্ধ করে তুলতো, কিন্তু এখন সে শোনার চেষ্টা করে বুঝতে চায়, তার লোকদের মনে আর মননে কি ভাব খেলা করছে। অবশ্য দূর্গে বসবাসকারীদের চারিত্রিক দুর্বলতার বিষয়ে যেসব সম্ভব অসম্ভব গুজব বাজারে প্রচলিত রয়েছে তারা দুজনেই সেসব দারুণ উপভোগ করে। কাশেম- বাবরের নির্বিরোধী আর ধীরস্থির উজির- গুজব রয়েছে তার নাকি এমন একজন পুরুষ সঙ্গী রয়েছে যার যন্ত্র নাকি প্রজনন অশ্বকেও ঈর্ষান্বিত করবে। কিন্তু মুশকিল হলো মেয়েদের মতো পোশাকে সজ্জিত হলে আর বিছানায় বাধা অবস্থায় কেবল তার রমণ প্রবণতা জাগ্রত হয়।
অবশ্য আজ রাতে কাশেমের রুচি রমণের চেয়ে আরেকটা বীর্যবান আকর্ষণ রয়েছে। আজ রাতে তারা যে গ্রামে যাচ্ছে, জহাজাক, সেটা আসলে একটা বেশ্যালয়। যেখানে তারা আগেও অনেকবার গিয়েছে- কাঠের একটা প্রায় ধ্বসে পড়া চালাঘর। যেখানে আগুনের আলোয় মেয়েরা নাচে, সগর্বে নিজেদের পোশাক জাহির করে এবং পুরুষরা তাদের মধ্যে থেকে পছন্দসই মেয়ে নিজের অঙ্কশায়িনী করতে বেছে নেয়। এইসব মেয়েদের একজন ইয়াদগার, তার আকর্ষণীয় স্তন আর প্রশস্ত কটিদেশের কথা চিন্তা করতেই বাবরের শ্বাসপ্রশ্বাসের গতি দ্রুততর হয়ে উঠে। আজকের পুরোটা দিন আসন্ন অভিযানের প্রস্তুতির ভাবনায় তার কেটেছে। কিন্তু এখন রাত নামতে ইয়াদগারের কোমল আঁধারে নিজেকে প্রোথিত করার তাড়না সে কোনোমতেই দমন করতে পারে না।
ইয়াদগারের উষ্ণ আর সহজলভ্য দেহ, অনুসন্ধানী ওষ্ঠ তাকে একটা নতুন জগতের সন্ধান দিয়েছে। আর অনেক কৌশল এবং রোমাঞ্চকর অনুভূতির উপস্থিতি সম্পর্কে অভিজ্ঞ করে তুলেছে। আয়েশার থেকে মেয়েটা কতো আলাদা, তাদের এতোদিনের যৌনসম্পর্কের বেলায় মেয়েটা তাকে একবারও প্রণয়সিক্ত স্পর্শ করেনি। তার দু’হাত অসারের মতো শয্যার দুপাশ আঁকড়ে থাকে। তার ওষ্ঠদ্বয় শীতল আর বাবরের জন্য সবসময়েই বন্ধ থাকে। বাসর শয্যায় যদি সে আরও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন। প্রেমিকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারতো, সবকিছু তখন হয়ত অন্যভাবে ঘটতো… কিন্তু সেটা এখন অতীতের বিষয়। সে আবার যখন ফারগানার সুলতান হবে তখন সে ইয়াদগারকে তার উপপত্নী করবে। উজ্জ্বল রত্নের সমাহারে ইয়াদগারের বাড়িয়ে। তোলা সৌন্দর্য সে উপভোগ করবে এবং তার হলুদাভ ত্বকে ঝলমল করতে থাকা সোনার মালা আর তাদের প্রণয় অভিসাড়ের ঘামে সিক্ত মুক্তার দীপ্তি কোমল স্তনের ভজে উঠানামা করছে তাকিয়ে দেখবে। ভাবনাটার রেশ অনুভব করে বাবরের টাট্ট ঘোড়াটা পাঁজরে তীব্র এতটা গুঁতো খেয়ে।
শীঘ্রই তারা জহাজাকের প্রান্তদেশে অবস্থিত উইলোর বনে এসে পৌঁছে। এবং নৈশপ্রহরীকে ডেকে বলে যে, তারা মুসাফির রাতের মতো আশ্রয় চায়। নৈশপ্রহরী তার হাতে ধরা মশালের কাঁপা কাঁপা আলো তাদের মুখের কাছে ধরে ভালো করে দেখে নিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে এবং তাদের যেতে দেয়। তারা ঘোড়া থেকে। নামে এবং নিচু, কাঁচা-ইটের তৈরি বাড়ির মাঝ দিয়ে ঘোড়ার দড়ি ধরে এগিয়ে যায় এবং সরু গলিপথ অতিক্রম করে বাজারে পৌঁছে, যেখানে সওদাগরদের তেলের প্রদীপের মৃদু হলুদ আলোতে কাকর ভর্তি, নিম্নমানের চাল আর মাটির নিচে জন্মান সজির ছাতা পরা একটা স্তূপ আবছা আলোকিত হয়েছে। পুরো মেঝেতে ভেড়া আর ছাগলের লাদি এবং হাড্ডিসার কয়েকটা মুরগীর বিষ্ঠা ফুটকির মত পড়ে রয়েছে। বেশ্যালয়টা বাজারের অন্যপ্রান্তে অবস্থিত। হাঁ, ইয়াদগার এখানেই আছে। ঘুঁটে পোড়ান আগুনে ওম পোহাতে থাকা তার হাত বাবর এখান থেকেই দেখতে পেয়েছে। বাবুরীর বরাবরের পছন্দের মেয়েটাও রয়েছে- হাল্কা পাতলা, বালকসুলভ, বুনো পাহাড়ী একটা মেয়ে। মাথার চুলে লালচে দীপ্তি এবং প্রগলভ মুখাবয়ব।
ইয়াদগার তাদের দেখামাত্র দৌড়ে এসে বাবরের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে দু’হাত বাড়িয়ে গলা জড়িয়ে ধরতে। তার গাট্টাগোট্টা গোড়ালীতে পরা সস্তা নুপূরের ঝঙ্কার উঠে। তার ঠোঁট কাক্ষিত গন্তব্য খুঁজে নিতে ব্যস্ত। সে নিজের পুরো ওজন বাবরের উপরে চাপিয়ে দিয়ে সাথে সাথে তার উত্তেজনা অনুভব করে খিলখিল করে হেসে ওঠে। হাত ধরে সে এবার তাকে গণিকালয়ের ভেতর নিয়ে আসে, যেখানে একটা কাঠের প্রকোষ্ঠের মেঝেতে কোনোমতে একটা গালিচা পাতা রয়েছে, সে ত্রস্ত হাতে নিজের কাপড় খুলে এবং উরুদ্বয় উন্মোচিত করে নিজের উষ্ণ আর্দ্র অভ্যন্তরে তাকে প্রবেশের অনুমতি দেবার আগে হাত আর ঠোঁট দিয়ে দক্ষতার সাথে বাবরকে জাগিয়ে তোলে।
ধুসর গোলাপী বর্ণের সকাল হতে হতে সন্তুষ্ট, আর উজ্জ্বল আর গণিকালয়ে পরিবেশিত শক্তিশালী পানীয়ের কল্যাণে সামান্য মাতাল বাবর এবং বাবুরী শাহরুখিয়ার দৃষ্টিসীমার ভিতরে পৌঁছে যায়। ফিরতি পথে নিজ নিজ রক্ষিতার আর নিজ নিজ মাত্রা এবং উদ্ভাবন কুশলতার বিষয়ে কিছু অকপট মন্তব্য ছাড়া পুরোটা পথ তারা নিরবে এসেছে। দূর্গের ভিতরে পৌঁছে বাবর নিজের মহলে ফিরে যায়, স্বাধীনতা আর বেপরোয়া কাটানো সময়ের শেষ রেশটুকু তাড়িয়ে উপভোগ করার আগেই ভোজবাজির মতো চোখের সামনে এসে দাঁড়ানো পরিচারকের দলকে হাতের ইশারায় চোখের সামনে থেকে বিদায় করে।
নিজের কামরায় প্রবেশ করে দরজা ঠিকমতো বন্ধ করার আগেই সে পরণের কাপড় খুলতে শুরু করেছে। বাম কানে তীক্ষ্ণ একটা টান পড়তে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে সে ঘুরে দাঁড়ায়। সে ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখে এসান দৌলত। হাত তখনও উঁচিয়ে রেখেছেন, দু’চোখ ধকধক করছে। তার নিজস্ব কামরায় তিনি আগে কখনও এভাবে এসে হাজির হননি। নানীজানের পেছনে তার দুই বয়স্ক পরিচারিকা। বাবর জানে দুটোই পাজির হদ্দ। ভাজা মাছ উল্টাতে জানে না এমন ভঙ্গিতে মাটির দিকে হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে রয়েছে।
“তুমি আর তোমার ঐ বাজারু ছোকরার মাগিবাজি যদি শেষ হয়ে থাকে, তবে আমাদের এবার আলাপ করার সময় হয়েছে।” তার নানীজান ধমকে উঠে বলেন। “গতরাতে সমরকন্দ থেকে আগত বার্তাবাহক একটা বার্তা নিয়ে এসেছে। তোমার প্রাণপ্রিয় চাচাতো ভাই মাহমুদের মহাফেজ বার্তাটা পাঠিয়েছে।” তার মুখের সামনে নানীজান একটা কাগজের টুকরো মেলে ধরেন।
“আমার ভাইজানের কি বক্তব্য? চুরি করে নেয়া সালতানাৎ কি তিনি আমাকে উপহার হিসাবে দিতে চান?” বাবর কান ডলতে ডলতে বলে। সে যে নারী সংসর্গে সময় কাটিয়ে এসেছে, সেটা এসান দৌলত জানে দেখে বাবর খুব একটা অবাক হয় না। এই বুড়ির কাছে কিছু গোপন করা অসম্ভব। কিন্তু চাষাভূষোর বেশে, ইয়াদগারের আলিঙ্গন থেকে সদ্য আগত। সম্ভবত এখনও তার গন্ধ গায়ে লেগে রয়েছে, এভাবে তার হাতে ধরা পড়ে সে একটু অস্বস্তিবোধ করে।
“তোমার গুণধর ভাই কিছু বলেনি- এবং আর বলবেও না কখনও। তুমি কেবল জয়ঢাকের আওয়াজ শুনতে পাবে। সাইবানি খান সমরকন্দ দখল করেছে, আর জীবন্ত অবস্থায় মাহমুদের ছাল ছাড়িয়েছে। তার চামড়া দিয়ে হারামজাদা একটা জয়ঢাক তৈরি করে সেটা সবুজাভ-নীল তোরণদ্বারের শীর্ষে স্থাপন করেছে। যা প্রতিবার শূয়োরটা শহরে প্রবেশ আর বের হবার সময় বাজানোর আদেশ দিয়েছে। তৈমূর বংশের এক শাহজাদার উজবেক অসভ্যের হাতে এমন অপমানিত নাজেহাল হওয়ায় এসান দৌলতের বিচক্ষণ বয়স্ক চোখে ক্রোধের সুনিশ্চিত সংঘাত।
“শোন।” চোখ কুঁচকে তিনি পড়তে আরম্ভ করেন। পঙ্গপালের মতো উজবেকরা আমাদের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। সংখ্যার ভারে তারা শহরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা তছনচ করে আমাদের বাসিন্দাদের নির্বিচারে কচুকাটা করেছে। বাজারের প্রাঙ্গন আর কুয়োগুলো লাশে বোঝাই হয়ে গেছে, পচছে। আমি আর দরবারের গুটি কয়েক সদস্য এখনও তাদের নজর এড়িয়ে লুকিয়ে আছি কিন্তু আমাদের সামনে সমূহ বিপর্যয়…আমাদের লুকিয়ে থাকার মতো অল্প কয়েকটা স্থানই এখন পর্যন্ত টিকে আছে। মহান আল্লাহতালার অপার করুণা, তার অসীম প্রজ্ঞার বলে যা তিনি অন্যদের দেখানো থেকে বিরত ছিলেন, আমাদের উপরে যেনো বর্ষিত হয়।”
বাবরের মনটা সাথে সাথে ধীর-স্থির হয়ে যায়। সে যখন উত্তেজনায় মনে মনে ছটফট করতে শুরু করেছে এমন সময় বিদ্যুৎ চমকের মতো তার কিছু একটা মনে হয়। “ আমি এখনই আমার দরবার আহ্বান করছি এবং সেখানেই ঠিক করবো। আমাদের কি করণীয়। কিন্তু তার আগে আমাদের আরও তথ্য প্রয়োজন। চিঠির এই সংবাদ অনেক পুরাতন। পশ্চিম দিকে আমি আমার গুপ্তদূত পাঠাবো…”
এসান দৌলত সম্মতি জানান। তাকে দেখে মনে হয় তিনি আর কিছু বলতে আগ্রহী নন। আঙ্গুলের এক তুড়িতে তার দু’পাশে পরিচারিকাদ্বয় এসে দাঁড়ায় এবং তিনি দরজার দিকে হাঁটা ধরেন। বাবর নিজে দরজা খুলে দেয় এবং পেছনে মাথা নত করে অনুসরণরত পরিচারিকাদের নিয়ে মৃদু আলোকিত অলিন্দ দিয়ে দ্রুত জেনানামহলের দিকে হেঁটে যাওয়া তার ঋজু অবয়বের দিকে সে অপলক তাকিয়ে রয়।
সমরকন্দের ঘটনাপ্রবাহে তখনও বিক্ষিপ্ত বাবর দ্রুত হাতমুখ ধুয়ে নেয়। যতো যাই হোক, মাহমুদের এমন নির্মম পরিণতি বাবর কামনা করেনি এবং সাইবানি খানের লোকেরা তৈমূরের অপূর্ব সুন্দর শহরটা কলুষিত করছে, এর লোকদের হত্যা করছে। ভাবতেই তার মন বিষাদ ভারাক্রান্ত হয়ে উঠে। সে যদি তার চাচাতো ভাই বা সমরকন্দের দোদুল্ল্যমান বাসিন্দাদের উপরে প্রতিশোধ নিতে চাইতো তারপরেও সে এমন অশ্লীল কষাইয়ের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারত না…।
পৌনে এক ঘণ্টা পরে, আরো একবার সুলতানের উপযুক্ত পোশাকে সজ্জিত হয়ে বাবর তার পারিষদবর্গের দিকে তাকায়। সকালের এই বৈঠকের জন্য অনেকেই মাত্র ঘুম থেকে উঠে এসেছে। তার আঙ্গুলে তৈমূরের অঙ্গুরীয় শোভা পায়- যা পরিস্থিতির গুরুত্বের মাত্রা নির্দেশ করে। “আপনারা নিশ্চয়ই খবরটা শুনেছেন?”
পারিষদবর্গ মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়।
“আমার আশঙ্কা ঘটনাটা সত্যি। কিন্তু আকশি আক্রমণ থেকে আমাদের বিরত রাখতে এটা কোনো ষড়যন্ত্র কি না সেটা জানতে, আমি চাই বাইসানগার আপনি পশ্চিমে সমরকন্দের অভিমুখে গুপ্তদূতের দল পাঠাবেন। দেখতে যে তারা কি জানতে পারে। তাদের অনুসন্ধানের প্রাত্যহিক প্রতিবেদন আমি চাই সবকিছু শান্তি পূর্ণ হলেও। শহরের কাছে তারা যখন পৌঁছাবে- আমি তার একটা বিশদ বিবরণ চাই। উজবেকরা যদি সত্যি সেখানে থাকে তাহলে আমি জানতে চাই সাইবানি খান শহরটা দখলে রাখার পরিকল্পনা করেছে, নাকি এটা কেবলই একটা ঝটিকা হামলা। এখন আপনি যেতে পারেন।”
বাইসানগার যাবার জন্য উঠে দাঁড়ায়।
বাবর এবার তার মুনশির দিকে তাকায়। “আমি একটা চিঠি পাঠাতে চাই।” কাঠের লেখার টুকরোর উপরে লোকটা একটা কাগজ সমান করে বিছায়। তারপরে গলায় চামড়ার ফালি দিয়ে ঝোলানো পাথরের দোয়াতদানে কলম ডোবায়। যেখানে সে প্রতিদিন সকালে ঘন কালো কালির মিশ্রণ প্রস্তুত করে রাখে।
“আমার পরম শ্রদ্ধেয় আব্বাজান।” বাবর বলতে আরম্ভ করে। তারপরে দ্রুত সৌজন্যমূলক সব বিশেষণ আউড়ে যায়- ইবরাহিম সারুর স্বাস্থ্যের ব্যাপারে খোঁজ খবর নেয়, তার সীমাহীন সমৃদ্ধি কামনা করে, আন্তরিকতাহীন অথচ বলার জন্য অনেক কিছু বলে বাবর আসল প্রসঙ্গে আসে: “আপনার বদান্যতা, আমার মসনদ পুনরুদ্ধারে এবং আপনার মেয়েকে আক্ষরিক অর্থে সালতানাতের সুলতানা হতে সাহায্য করতে আপনি তীরন্দাজবাহিনী দিয়ে সহায়তা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। আমি মর্মাহত যে আমার বারংবার তাগিদ সত্ত্বেও সেই প্রতিশ্রুত বাহিনী এসে এখনও পৌঁছেনি। আমার দরবারে কানাঘুষো শুরু হয়েছে যে আপনার কথার বোধহয় কোনো দাম নেই। এমন ভাবনা আমি আমার চিন্তাতেও আনতে চাই না। আপনি যদি আমাকে এখন নিশ্চিত করতে না পারেন যে, তীরন্দাজ বাহিনী শাহরুখিয়ার পথে রওয়ানা হয়েছে, তাহলে আমি ধরতে বাধ্য হবো যে আপনি আসলেই আমাদের মধ্যে হওয়া চুক্তির বরখেলাপ করেছেন।”
সে স্বাক্ষর করে এবং মুনশীকে বলে তার সীলমোহর সংযুক্ত করতে। ইবরাহিম সারুর এটাই শেষ সুযোগ। তার সাথে একটা গ্রাম্য গোত্রপতির এমন ছলনা মেনে নেয়া যায় না।
বাবর আর তার পারিষদবর্গ, চিন্তিত চেহারায় এবং আন্তরিকভাবে আলোচনা করে। কিন্তু তাদের হাতে পর্যাপ্ত তথ্য না থাকায় তারা কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হতে ব্যর্থ হয়। তারা সবাই কেবল প্রশ্ন উত্থাপন করে, যার উত্তর তাদের কারো জানা নেই। বাবর হতাশ হয়ে একটা পর্যায়ে দরবার ভেঙে দেয়, কেবল ওয়াজির খানকে থাকতে বলে।
“সুলতান?”
“সাইবানি খান যদি সমরকন্দ দখল করেই থাকে, তাহলে আমি ভাবছি তার জায়গায় আমি থাকলে তারপরে আমি কি করতাম। আর আমি কেবল একটাই উত্তর পাচ্ছি। আমি আমার সৈন্যদের পূর্বে পাঠাতাম এখানে আমাদের পরাস্ত করতে। তারপরে আকশি গিয়ে তামবাল আর জাহাঙ্গীরকে পরাজিত করতাম। সাইবানি খান তৈমূরের বংশ নির্বংশ করার শপথ নিয়েছে। ফারগানার শেষ দুই বংশধরকে নিমূর্ল করার এই সুযোগ ঘটে বুদ্ধি থাকলে সে হাতছাড়া করবে না।”
ওয়াজির খান আশ্বস্ত করার মতো কোনো কথা খুঁজে পান না। তারা দুজনেই চুপচাপ বসে থাকে। প্রত্যেকেই নিজ নিজ ভাবনার রাজ্যে হারিয়ে গেছে।
নতুন সংবাদের জন্য অবশ্য তাদের বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় না। শাহরুখিয়ার পশ্চিম থেকে প্রলয়ংকরী বিপর্যয়ের খবর সূর্যাস্তের আগেই এসে পৌঁছে। সওদাগরদের একটা ক্ষিপ্ত কাফেলা যারা সমরকন্দ ছাড়িয়ে এসে পাহাড়ে ছাউনি ফেলেছিল তারা শহর রক্ষাকারী দেয়ালের বাইরে ঘোড়সওয়ার বাহিনীর মাঝে খণ্ডযুদ্ধের খবর দেয়। তারা যুদ্ধের ফলাফল দেখার জন্য অপেক্ষা করেনি। নিজেদের মালবাহী পশুর পাল নিয়ে কোনমতে পূর্বদিকে পালিয়ে এসেছে। অন্য মুসাফিররা চলার পথে শোনা গল্প এসে বলে যে উত্তর থেকে সাইবানি খান আর তার দস্যু বাহিনী এসে সমরকন্দের উপর হামলে পড়েছে।
বাবর সে রাতে ঘুমাতে পারে না, উষ্ণ, গুমোট বাতাস ভারী আর দম আটকানো তার অস্থিরতা আরও বাড়িয়ে তোলে। গতকালই সে হয়তো বাবুরীকে ডেকে পাঠাতো মজার সব গল্প বলে তাকে উৎফুল্ল রাখতে বা ইয়াদগারের কাছে যাবার সময় তাকে সঙ্গ দিতে। কিন্তু এখন সব কিছু বদলে গেছে। সে একাকী জানালায় বসে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার আঙ্গুলের ভারী আংটিটা চকচক করে। তৈমূর তার স্থানে থাকলে কি করতো? তিনি কি নিয়তির উপরে নির্ভর করে চুপচাপ বসে থাকতেন, কি হয় সেটা দেখার জন্য? না। তিনি পরিস্থিতি নিজের অনুকূলে আনতে কোনো একটা উপায় ঠিকই বের করতেন।
একটার পরে একটা নিভে আসা মোমবাতির আলোয় বাবর গালে হাত দিয়ে বসে থাকে এবং একটা সময়ে সে অন্ধকারে ডুবে যায়। বারবার সে সব কিছু নিজের মনে বিবেচনা করে। পূর্বের আকাশে সোনালী আভা দেখা দিতে তার হতাশ মনের কোণে আশার ঝিলিক উঁকি দিতে আরম্ভ করে। সহসা নিজের কর্তব্যকর্ম সম্পর্কে সে নিশ্চিত হয়ে যায়। একটা ঝুঁকির কথা সে বিবেচনা করছে এবং ব্যর্থ হলে ঘুরে দাঁড়ানো তার জন্য মুশকিল হবে। কিন্তু এটাই তার একমাত্র সুযোগ…
ভোরের আলো ঠিকমতো ফোঁটার সাথে সাথে সে তার সব পারিষদকে ডেকে পাঠায়। “সাইবানি খান তৈমূরের বংশের সবার জন্য একটা জলজ্যান্ত হুমকী। সে যদি আমাকে পরাস্ত করতে পারে, তাহলে তার পরবর্তী লক্ষ্য হবে আমার সৎ-ভাই জাহাঙ্গীর। সেটা তখন কেবল সময়ে ব্যাপার। সে তৈমূরের পুরো এলাকা দখল করতে চায় এবং সে ঠিক তাই করবে- যদি না আমরা আমাদের মধ্যকার বিরোধ আপাতত ভুলে না যাই। তামবাল আর জাহাঙ্গীরের সাথে আমি ঠিক এ কারণেই মিত্ৰতা করতে আগ্রহী। এই উজবেক বলদটাকে সমরকন্দ থেকে বিতাড়িত করতে সদি তারা আর তাদের অনুগত গোত্র আমাকে সহায়তা করে, তাহলে আমি কথা দিচ্ছি ফারগানার উপর থেকে আমি আমার দাবি প্রত্যাহার করে নেবো…”
ওয়াজির খানের আঁতকে উঠে শ্বাস নেবার শব্দ শুনে বাবর আন্দাজ করে বুড়ো লোকটাকে সে কতোখানি চমকে দিয়েছে। কিন্তু, সুলতান-”।
“আমাদের সামনে আর কোনো পথ খোলা নেই। কাশিম, তুমি আমার বিশেষ দূত হিসাবে দায়িত্ব পালন করবে।”
বাবর কঠোর দৃষ্টিতে তার পারিষদবৃন্দের দিকে তাকায়, সহসা নিজের মাঝে সে নতুন দৃঢ়তা অনুভব করছে। “আকশি থেকে কোনো সংবাদ না আসা পর্যন্ত এ বিষয়ে আপনারা কারো সাথে কোনো ধরণের আলোচনা করবেন না। এটা আমার আদেশ।”
বাবর উঠে দাঁড়াবার ফাঁকে ওয়াজির খানের দিকে তাকিয়ে দেখে তাকে কেমন বিভ্রান্ত দেখাচ্ছে। আগের দিন হলে সে তার পরিকল্পনা নিয়ে বৃদ্ধ শার্দুলের সাথে বিস্তারিত আলোচনা করতে চেষ্টা করতো, তাকে রাজি করাতে। কিন্তু এখন কেউ তাকে সাহায্য করতে পারবে না। তার নিয়তি এটা, নিজেরই বেছে নেয়া। তার সাহসিকতায় যদি কাজ হয়, তবে শীঘ্রই সে আবার সমৃদ্ধ সমরকন্দের মসনদে অধিষ্ঠিত হবে। একে নিজের ন্যায়সঙ্গত সম্পত্তি হিসাবে সে সবসময়ে ভেবে এসেছে বা এটা হারাবার শোক তার কখনও কমেনি। তার মরহুম আব্বাজান এই শহরটার জন্য নিজের মনে গুমরে কষ্ট পেয়েছেন এবং যার কাছে পার্বত্যময় ক্ষুদ্র ফারগানা আর তার অবাধ্য সর্দার আর ভ্যা ভ্যা করা ছাগলের পাল সবসময়েই দ্বিতীয় পছন্দ। তার স্বর্গীয় পিতার ব্যর্থতাকে যদি সে সাফল্যে পর্যবসিত করতে চায়, তাহলে আবেগের বদলে উচ্চাকাঙ্ক্ষা হবে তার মূল চালিকাশক্তি।
***
পরবর্তী দিনগুলোতে শাহরুখিয়ার চারপাশে প্রথমে একজন দু’জন করে শরণার্থী এসে হাজির হতে শুরু করে। একটা পর্যায়ে গিয়ে সেটা আশেপাশের বসতিতে বাধভাঙা ঢলের মত হাজির হতে শুরু করে। বাবর তার লোকদের পাঠায় তাদের জেরা করতে এবং জানা যায় বেশিরভাগ লোকই সমরকন্দের আশেপাশের গ্রামাঞ্চল থেকে এসেছে। মূল শহর থেকে আগত লোকজনের সংখ্যা আশঙ্কাজনক রকমের অল্প এবং তাদের ভিতরে সাহায্য চেয়ে আকুল হয়ে খবর পাঠানো মাহমুদের মহাফেজকে খুঁজে পাওয়া যায় না। মাহমুদের স্ত্রী, গ্রান্ড উজিরের কন্যারও কোনো খবর নেই…
দূর্গের প্রকারবেষ্টিত সমতল ছাদ থেকে বাবর ভ্রমণ ক্লান্ত লোকদের বিষণ্ণ শোভাযাত্রার দিকে তাকিয়ে থাকে। হাতের কাছে যা কিছু পেয়েছে তাই নিয়ে কোনোমতে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে এসেছে- বৃদ্ধ আর নাকে শ্লেষ্ম জমা বাচ্চারা গাড়িতে, যার কোনোটাকে দেড়শ মাইল পথ হাতে টেনে আনা হয়েছে। দিশেহারা মায়েদের শুকনো স্তনবৃন্তে নবজাতকের দল মুখ দিয়ে বৃথাই দুধের সন্ধান করে। ক্ষুধার্ত এসব মুখ- কোনো সাহায্য করবে না বরং তারা একটা বোঝ। বাবর তার সব দূর্গের শস্যভাণ্ডার খুলে দিতে বলে। কিন্তু সেসবও বেশি দিন চলবে না।
বাবর আশা করেছিলো সমরকন্দের কিছু যোদ্ধা অন্তত উজবেকদের নাগাল এড়িয়ে পূর্ব দিকে পালিয়ে আসবে। কিন্তু বাইসানগারের প্রেরিত গুপ্তদূতের পাঠানো খবর সে আশায় পানি ঢেলে দেয়। বিজয়ের পথ উজবেকরা কুপিয়ে কেটে পরিষ্কার করায় একটা বিষয় স্পষ্ট যে, সেখানে একটা গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে। সমরকন্দের আশেপাশের সমভূমিতে তার সৈন্যদের ফুলেফেঁপে উঠা বীভৎস লাশে ভরে গিয়েছে। সামান্য কয়েকজনই পালিয়ে বেঁচেছে। বাবরের সাহায্যে কেবল অশরীরি সৈন্যদের আত্মাই এখন এগিয়ে আসতে পারে।
জাহাঙ্গীর আর তামবালের উপরে এখন সবকিছু নির্ভর করছে। সন্ধির নিশান উড়িয়ে তার কি নিজেরই প্রস্তাব নিয়ে যাওয়া উচিত ছিলো? সে ভাবে। কাশিম কি জাহাঙ্গীর আর তামবালকে বোঝাতে পারবে যে তাদের মঙ্গল কেবল- সম্ভবত অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার ক্ষীণ সম্ভাবনা তার প্রস্তাবিত শান্তি চুক্তি গ্রহণের মধ্যে নিহিত রয়েছে। এবং সাইবানি খানের বিরুদ্ধে জোট গঠন। নাকি তারা তার উদ্দেশ্যের ব্যাপারে সন্দিহান হয়ে সাইবানি খানের হুমকি উপেক্ষা করবে।
কাশিমের ফিরে আসবার খবর বাবর যখন পায় তখন সে তার আম্মিজান আর নানীজানের সাথে ছিলো। কোনো ধরণের ব্যাখ্যার ভিতরে না গিয়ে এবং এসান দৌলতের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এড়িয়ে সে নিজের কামরার দিকে এগিয়ে যায়, যেখানে সে কাশিমকে নিয়ে আসবার আদেশ দিয়েছে। কাশিমের চিরাচরিত শান্ত সমাহিত ভাব ভঙ্গি দেখে তার বয়ে নিয়ে আসা বার্তা সম্পর্কে সামান্যতম উত্তেজনা বা বিক্ষোভের আঁচ পাওয়া যায় না।
“বেশ?” বাবর তাকে আঁকড়ে ধরার ইচ্ছা প্রাণপণে দমন করে কোনোমতে কেবল বলে।
“সুলতান আমি আপনার প্রস্তাবের উত্তর নিয়ে এসেছি। তারা আপনার শর্ত মেনে নিয়েছে।” এতক্ষণ পরে কাশিমের মুখে একটা মৃদু হাসির আভাস দেখা যায়। “সুলতান, এই দেখুন।” একটা কৃষ্ণ-লাল বর্ণের উটের চামড়ার থলির ভিতর থেকে, যার মুখটা হাতির দাঁতের বন্ধনী দিয়ে বন্ধ, সে একটা চিঠি বের করে।
সেটার দিকে তাকিয়ে বাবরের হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন দ্রুত হয়ে উঠে। হ্যাঁ! সৌজন্যমূলক সম্ভাষণের ফালতু অংশ বাদ দিয়ে সে যা খুঁজছিলো সেটা দেখতে পায়। লেখাগুলো সে নিজে বারবার পরে, শব্দগুলোর মর্মার্থ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করে। “ভাইজান আপনি যা প্রস্তাব দিয়েছেন উজবেক হুমকির হাত থেকে বাঁচবার সেটাই একমাত্র পথ। এই চিঠিটা আপনি যখন পাবেন ততোক্ষণে আমার সেনাবাহিনী জানবেন শাহরুখিয়ার পথে রওয়ানা হয়ে গেছে। আমি আমার সামর্থ অনুযায়ী চার হাজার অশ্বারোহী আর একহাজার তীরন্দাজের একটা বাহিনী পাঠালাম।” চিঠিটা ফারগানার রাজকীয় সীলমোহরের উপরে জাহাঙ্গীরের দস্তখত সম্বলিত।
ঘন মোমের উপর আঙ্গুল বোলাবার সময়ে বাবর একটা যন্ত্রণার খোঁচা অনুভব করে- রাজকীয় সীলমোহর ব্যবহারের অধিকার কেবল তারই রয়েছে: জন্মসূত্রে আর রক্তের অধিকার বলে সেই ফারগানার সুলতান। কিন্তু সে তার পছন্দ বেছে নিয়েছে। এবং তাকে অবশ্যই সেটা মান্য করতে হবে। জাহাঙ্গীর আর তার নিয়ন্ত্রক তামবাল তাদের কথা রাখবে বলে তাকে বিশ্বাস করতেই হবে। এখন যদি তারা তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে তাহলে বিপর্যয়ের হাত থেকে কেউ তাদের বাঁচাতে পারবে না।