২.৪ এক সনাতন পুরঞ্জয়

১০. এক সনাতন পুরঞ্জয়

বাবর তার পেছনে সারিবদ্ধভাবে বিন্যস্ত ঘোড়সওয়ার বাহিনীর দিকে ঘুরে তাকায়। তাদের বহন করা উজ্জ্বল হলুদ বর্ণের সগর্বে ঘোষণা করছে তারা সবাই ফারগানা থেকে আগত যোদ্ধা। আভ্যন্তরীণ গোত্র সংঘাত আর শাহী বিবাদ ভুলে তারা সনাতন এক পুরঞ্জয়ের বিপক্ষে যুদ্ধে নেমেছে। তিন ঘণ্টা আগে, দূর্গের জেনানামহলে নিজেদের কামরায় এসান দৌলত আর খুতলুঘ নিগার তাকে তাদের আশীর্বাদ জানিয়েছেন আর আম্মিজান বাবরের বাবার তরবারি আলমগীরের ঈগল আকৃতির বাঁটে চুমো খেয়েছেন ধাতব- নকশা করা বেল্টে যেটা ঝুলছে। সে অবাক হয়েছে এটা দেখে যে দু’জনেই আসলে সেয়ানা পাগল। তার সৎ-ভাইয়ের সাথে আপোষরফায় তারা কোনো আপত্তিই জানাননি- এসান দৌলত আবার এক কাঠি সরেস, তিনি বাস্তবিক অর্থে তার দূরদর্শিতা আর সাহসের প্রশংসাই করেছেন। খানজাদাই কেবল তার আবাল্যের পরিচিত জন্মভূমি আকশি হয়তো আর কখনও দেখতে পাবে না সেই আশঙ্কায় আপাতভাবে খানিকটা বিচলিত।

গতরাতে সে আয়শার কাছে শেষবারের মতো সংক্ষিপ্ত সময় কাটাতে গিয়েছিলো। সে যদি আর ফিরে না আসে, তাহলে তার গর্ভে অন্তত সে একজন উত্তরাধিকারী রেখে যেতে চায়, নিরানন্দ কিন্তু প্রচণ্ড বেগে, তার অনুভূতি শূন্য ঈষৎ ফিরিয়ে নেয়া চোখের দিকে না তাকিয়ে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে, উপগত হবার ফাঁকে ভেবেছিলো। বাবর শীর্ষ অনুভূতির তুঙ্গে পৌঁছাবার সাথে সাথে- আয়েশা বরাবর যা করে থাকে আজও তাই করেছিলো তার কাছ থেকে গড়িয়ে সরে গিয়ে নিজের নগ্ন দেহ চাদর দিয়ে ঢেকেছে। দ্রুত পোশাক পরার অবসরে সে একবারও তার দিকে তাকায়নি এবং কোনো ধরণের বিদায় সম্ভাষণ বা অন্য কোনো কিছু না বলে সে আয়েশার কক্ষ থেকে বের হয়ে এসেছে। আবেগঘটিত আগন্তুক ছাড়া তারা একে অপরের কাছে কখনও অন্য কিছু ছিলো না।

একটাই বাঁচোয়া, আয়েশার বাবার অন্তত সুমতি হয়েছে। লম্বা সামরিক সারির একেবারে শেষ মাথায়, ফারগানার হলুদ নিশানের শেষে, কালো আর লাল পোশাক পরিহিত অশ্বারোহী মাঙ্গলিঘ তীরন্দাজ বাহিনীর একটা দলকে দেখা যায়। সাইবানি খানের বিরুদ্ধে বাবর আর জাহাঙ্গীরের মাঝে সন্ধির বিষয়টা আঁচ করতে পারার সাথে সাথে ইবরাহিম সারু তাদের শাহরুখিয়ায় পাঠিয়ে দিয়েছেন।

ওয়াজির খান আর বাইসানগার তার দু’পাশে রয়েছে এবং তার অশ্বারোহী বাহিনীর মাঝে কোথাও অবস্থান করছে বাবুরী। সমরকন্দ পতনের সংবাদ পাবার পর থেকে বন্ধুর সাথে তার একটা কি দুটো কথা হয়েছে এবং তার চপল সঙ্গের অভাব সে বোধ করেছে। কিন্তু বন্ধুত্ব- সাহচর্য- এসব বোধহয় রাজাদের জন্য নয়। বাবর ভাবে, আরও বড় কিছুর প্রতি তাদের সর্বদা দৃষ্টি সজাগ রাখতে হয়।

গ্রীষ্মের দাবদাহে শুকিয়ে শক্ত হয়ে যাওয়া সমভূমির উপর দিয়ে তারা ঘোড়াগুলি দুলকিচালে দাবড়ে যায়। তাদের সঙ্গে জিনিসপত্রও খুব অল্প রয়েছে। বাবর সিদ্ধান্ত নিয়েছে গন্ধমাদন অবরোধ অনুষঙ্গগুলোর এবার তাদের প্রয়োজন হবে না। দ্রুত অপ্রত্যাশিত আক্রমণের উপরেই সে তার বাজি রেখেছে। আজ পর্যন্ত তৈমূরের কোনো না কোনো বংশধর সমরকন্দের শাসক ছিলো। সমরকন্দের অধিবাসীদের যারা বেঁচে গিয়েছে- সাইবানি খানের মতো অনাহুত, নিষ্ঠুর লুণ্ঠকের হাত থেকে মুক্তি পেতে মরিয়া হয়ে উঠা উচিত। তার বাহিনীকে অগ্রসর হতে দেখলে, নিপীড়কের বিরুদ্ধে তারাও রুখে দাঁড়াবে বলেই তার ধারণা।

সবকিছুর পরে, শেষ কথা হলো সাইবানি খানের নিজস্ব পরিকল্পনা। শরৎকাল প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। সে কি সমরকন্দেই শীতকাল কাটাবার ফন্দি এঁটেছে? বাবর তার বাদামী রঙের আজদাহাটার ছন্দোবদ্ধ খুরের শব্দে এগিয়ে যেতে যেতে, ভ্র কুচকে তার শত্রুর মনে ভেতরে প্রবেশ করতে চেষ্টা করে। সে আসলে কি চায়? সমরকন্দ লুণ্ঠন আর ধর্ষণের অপমানে ডুবিয়ে দিয়ে তারপরে সে কি তার লুণ্ঠনকারী নেকড়ের দল নিয়ে কি উত্তরের তৃণভূমিতে ফিরে যাবে লুট করা মালামাল উপভোগের অভিপ্রায়ে? নাকি তার অন্য কোনো মহাপরিকল্পনা রয়েছে? সমরকন্দে তার আক্রমণ কি কেবলই একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নাকি তার নিজের একটা রাজবংশ আর সাম্রাজ্য স্থাপনের অভিপ্রায় রয়েছে?

 বাবর তার বাল্যকালে যে সব গল্প শুনেছিলো, তা যদি সত্যি হয়ে থাকে তাহলে সমরকন্দের প্রতি সাইবানি খানের একটা আক্রোশ রয়েছে। তার মরহুম আব্বাজানের বলা গল্পগুলো সে মনে করে। কিভাবে এক উজবেক বসতিতে সমরকন্দের শাহী বাহিনীর এক হামলার সময় সাইবানি খান তাদের হাতে ধরা পড়েছিলো, তার তখন নিতান্তই অল্প বয়স। তার বাবা আর ভাইয়েরা সেই হামলার। সময়ে মারা যায়। কিন্তু কেবল দশ বছর বয়স হবার কারণে তার গলায় একটা চামড়ার দড়ি বেঁধে সেটা উটের লেজের সাথে আটকে ক্রীতদাস হিসাবে তাকে সমরকন্দের দাসবাজারে নিয়ে আসা হয়। উপস্থিত বুদ্ধি আর ভীষণ চালাক হবার কারণে সে কামারশালার কঠিন পরিবেশে মানিয়ে নেয়। সেখানেই ক্রীতদাসের প্রতীক তার বাম গালে পুড়িয়ে এঁকে দেয়া হয় এবং সে কোক সরাইয়ের এক অমাত্যের চোখে পড়ে।

অভিজাত সেই ভদ্রলোক তার উপযুক্ত শিক্ষার বন্দোবস্ত করেন এবং মুনশি হিসাবে তাকে একটা ভালো পরিচয় দান করেন। কিন্তু একই সাথে তাকে বাধ্য করেন তার শয্যাসঙ্গী হতে। এক রাতে সাইবানি খান তার প্রভুর গলা দু’ফাঁক করে দেয়। নিহত প্রভুর রক্তে আঙ্গুল ডুবিয়ে মুনশি হিসাবে সে তার শেষ বাণীটা লিখে দেয়ালে লেখা সেই বাণী শহরটার উপরে যেনো একটা অভিশাপ বয়ে নিয়ে আসে। সে পুনরায় তার নিজের লোকদের মাঝে ফিরে যায়। নিজের গোত্রের সাথে পুনরায় মিলিত হয়ে সে ধীরে ধীরে নিজেকে উজবেকদের অবিসংবাদিত অধিরাজে পরিণত করে এবং তখন থেকে তৈমূরের বংশধরদের প্রতি একটা আক্রোশ সে লালন করে আসছে। সে এখন আনুমানিক পঁয়ত্রিশটা গ্রীষ্মকাল দেখেছে এমন একজন পূর্ণবিকশিত পুরুষ। একজন দুর্ধর্ষ শত্ৰু, যে সামনে ধ্বংসের অশুভ ছায়া বিস্তার করে পেছনে কেবল মৃত্যুর বরাভয় রেখে যায়। এমন একজনকে পরাস্ত করাটা মোটেই সহজ কাজ না…

 এক্ষেত্রে শক্তির চেয়ে কৌশলের আশ্রয় নেয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে। আনুমানিক চারদিনের ভিতরে, যদি তারা তাদের বর্তমান এই গতিবেগ বজায় রাখতে পারে তবেই, তারা সমরকন্দে হামলা চালাবার মতো দূরত্বে পৌঁছে যাবে। কিন্তু সাইবানি খানকে তার অভিপ্রায়ের ব্যাপারে একটা ধন্দে রাখাটাই বোধহয় ভালো হবে- বা, তারচেয়েও ভালো হয় যদি তাকে ভুল পথে পরিচালিত করা যায়। সে যদি গাড়লটাকে বোঝাতে পারে যে, সে ফারগানা থেকে পালাতে চাইছে সমরকন্দকে পাশ কাটিয়ে তার অভিপ্রায় পশ্চিমে গমন করা- সে হয়তো তাহলে তার শত্রুকে শহর থেকে বের করে আনতে পারবে।

 সেদিন সন্ধ্যাবেলা, বাবর, ওয়াজির খান, আর বাইসানগারের সাথে অস্থায়ী শিবিরে একটা অগ্নিকুণ্ডের পাশে বসে, স্থির দৃষ্টিতে আগুনের দিকে তাকিয়ে থাকে। সে এখনও নিজের মাঝে উদ্দীপনার অভাব বোধ করছে। তারা যেখানে শিবির স্থাপন করেছে সে জায়গাটা কেমন বালুময়। সহসা সে উঠে দাঁড়ায়, এবং মাটি থেকে একটা কাঠি তুলে নিয়ে সমরকন্দের একটা মানচিত্র অঙ্কন করে- পাঁচ মাইল বিস্তৃত দেয়ালের একটা ব্যুহ যা ছয়টা তোরণদ্বার দ্বারা সম্পূর্ণ, আশেপাশে তৃণভূমি, ফলের বাগার আর উদ্যান, উত্তর আর পূর্বদিকে নহর আর নদীর আবছা ধারা বহমান। “আমরা যদি আব-ই-সিয়া নদীর অপর পারে, সমরকন্দের উত্তর ধারের দেয়ালের সমান্তরালে, আমাদের সেনাদলের একটা অংশ পাঠাই তাহলে কি হবে… লোহার দরোজা আর শেখজাদা তোরণদ্বারের পাহারায় নিয়োজিত প্রহরীর দল তাদের দেখতে পাবে বটে কিন্তু উজবেকরা তাদের শক্তিমত্তা যাচাই করানো পক্ষে অনেক দূরেই থাকবে। আমরা হয়তো তাদের বিশ্বাস করতে বাধ্য করতে পারি যে, ওটাই আমাদের পুরো সেনাবাহিনী…”

“এবং, তারপরে কি হবে, সুলতান?” বাইসানগার জানতে চায়।

“ভাগ্য যদি আমাদের সহায় থাকে, উজবেকরা তাহলে ধাওয়া করবে এবং আমরা তখন আমাদের কাঙ্ক্ষিত সুযোগটা পাবো। কান-ই-গিল তৃণভূমির লাগোয়া ঝোপঝাড় আর করকটে গাছের বনে আমাদের বাকি সৈন্যদের লুকিয়ে রাখি লোহার দরোজার পূর্ব দিকে। আমরা তাহলে দেখতে পাবো যে ঠিক কি ঘটছে। আল্লাহতালা যদি আমাদের সহায় থাকেন এবং উজবেকরা সত্যিই বিভ্রান্ত হয় সবুজাভ-নীল তোরণদ্বারের কাছে শহরের পূর্ব দিকের দেয়ালে আমরা হামলা করবো।”

 বালির উপরে আঁকা মানচিত্রটার দিকে চিন্তিত মুখে ওয়াজির খান তাকিয়ে থাকেন, যার উপর দিয়ে লম্বা-দেহের পিপড়ার একটা সারি, যোদ্ধার মতো নিষ্ঠায় এগিয়ে চলেছে। কেউ কেউ তাদের বাসার জন্য পাতার টুকরো বয়ে নিয়ে চলেছে। “উজবেকদের শহর থেকে টেনে বের করে আনতে আমরা যাদের পাঠাবো তাদের অবশ্যই আমাদের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ আর দ্রুতগামী অশ্বারোহী দলের সদস্য হতে হবে। ধাওয়াকারীদের যেনো তারা সহজেই পেছনে ফেলতে সক্ষম হয়। বৃত্তাকারে ঘুরে এসে মূল বাহিনীর সাথে যোগ দিয়ে শহর আক্রমণে অংশ নিতে পারে।”

“হ্যাঁ।” বাইসানগার জোরে জোরে মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। “দক্ষিণে আর পূর্ব দিকে তাদের এভাবে অগ্রসর হতে হবে…” বাবরের ফেলে দেয়া কাঠিটা সে তার বাম হাত দিয়ে তুলে নেয় এবং বালির উপর তীরচিহ্ন আঁকতে আরম্ভ করে। চাহাররাহা তোরণদ্বার অতিক্রম করে দক্ষিণের দেয়াল ঘুরে এসে সুইপ্রস্তুতকারকদের তোরণদ্বার অতিক্রম করে সেটা সবুজাভ-নীল তোরণদ্বারের কাছে এসে শেষ হয়। আর পুরো পরিকল্পনাটা বালির বুকে আঁকতে গিয়ে সে কতিপয় পিঁপড়ের ভবলীলা সাঙ্গ করে ফেলে। কিন্তু তাদের বাকী বেঁচে থাকা সহযোদ্ধার দল কিছুই হয়নি এমন ভঙ্গি করে পুনরায় সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে তাদের এগিয়ে যাবার গতি অব্যাহত রাখে।

“সুলতান, পুরো পরিকল্পনাটা কিন্তু সাংঘাতিক বিপজ্জনক।” বাইসানগারকে উদ্বিগ্ন দেখায়। আমরা জানি না ঠিক কত উজবেক শহরে অবস্থান করছে বা এর রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছে। আমরা যদি তাদের একটা অংশকে বাইরে টেনে বের করে আনতে পারিও, ভেতরে প্রতিরক্ষার দায়িত্বে থেকে যাওয়া বাহিনীর সংখ্যা। তখনও হয়তো আমাদের জন্য অনেক বেশি বলে প্রতিয়মান হতে পারে। আমাদের প্রথমে বোধহয় গুপ্তচরদের সাহায্য নেয়া উচিত।”

“আমি যেমন এক সময়ে গুপ্তচর ছিলাম?” নর্দমায় বাস করা ইঁদুরের মতো কিভাবে সে গুঁড়ি দিয়ে শহরে প্রবেশ করেছিলো, বাবর সে কথা ভাবে। “না, আমাদের হাতে এতো সময় নেই। আমরা যদি উজবেকদের ফাঁদে ফেলতে চাই তাহলে সেটা অবশ্যই দ্রুত করতে হবে আর ঝুঁকিও নিতে হবে।”

বাবর নিশ্চিত তার কোনো ভুল হয়নি কিন্তু তার পরিকল্পনা যদি ব্যর্থ হয় তাহলে বিপর্যয়ের মাত্রা কতটা ভীষণ হতে পারে? সে মাত্রা নিয়ে ভাববার কোনো চেষ্টাই করে না। ফারগানায় একটা কথা প্রচলিত আছে: “সুযোগ নেবার সাহস যার নেই, বুড়ো বয়স পর্যন্ত সে এর জন্য আফসোস করবে।”

বুড়ো বয়স পর্যন্ত বেঁচে থাকার চেয়ে আফসোস করে জীবননাশ করাও শ্রেয়।

***

তিনদিন পরের কথা- বাবর যেমন আশা করেছিলো তার চেয়েও দ্রুতগতিতে তারা দেড়শ মাইল পথ অতিক্রম করে সামনের দু’সারি পাহাড়ের পেছনেই, যা এই মুহূর্তে গ্রীষ্মের দাবদাহে খয়েরী বর্ণ ধারণ করেছে, রয়েছে সমরকন্দ যা কয়েক সপ্তাহ পরেই পাহাড়গুলো আবার তুষারপাতে রূপালি বর্ণ ধারণ করতে আরম্ভ করবে। গত তিন ঘণ্টা যাবৎ বাবরের প্রত্যক্ষ আদেশে, তার লোকেরা প্রায় নিঃশব্দে ধৌরিতক চালে ঘোড়া হাঁকিয়েছে। সামনে কেউ ওঁত পেতে আছে কিনা জানতে গুপ্তদূতের দল নিয়মিত বিরতিতে ফিরে এসে জানিয়েছে যে তারা কিছুই দেখেনি, শোনেনি যা তাদের মনোযোগ আকৃষ্ট করতে পারে।

 বাবর, তারপরেও কোনো সুযোগ নিতে চায় না। উজবেকরা পোড়খাওয়া সব যোদ্ধা। তাজা মাংসের জন্য বেপরোয়া শেয়ালের ধূর্ততা তাদের সহজাত। আর তারা সেভাবেই হত্যা করে থাকে। মুরগির খোঁয়াড়ে প্রবেশ করা শেয়ালের মতো নির্বিচারে তারা প্রতিটা মুরগিকে হত্যা করে। কিন্তু চোয়ালে করে কেবল একটাই চুরি করে নিয়ে যায়।

 অন্ধকার রক্তাভ হতে দৃশ্যপট অস্পষ্টভাবে আকার নিতে শুরু করলে, যোদ্ধাদের একটা নিঃশব্দ সারি অবশেষে কোলবা পাহাড়ের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। সমরকন্দের আগে শেষ উঁচু পাহাড়ের সারি। পাঁচ বছর আগে বাবর যেখান থেকে প্রথমবারের মতো শহরটা দেখেছিলো। এইবার অবশ্য চূড়োর দিকে না উঠে সে দলটাকে দাঁড়াতে বলে। ওয়াজির খান, বাইসানগার আর অন্যান্য সর্দারদের ডেকে এনে তার শেষ আদেশ দেয়। “কোলবা পাহাড়কে আড়াল হিসাবে ব্যবহার করে। আমরা পশ্চিমে যাবে এবং কোলবা তৃণভূমির লাগোয়া গাছের সারির নিচে ছাউনি স্থাপন করবো। সেখানেই আক্রমণের চুড়ান্ত প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হবে। আমাদের অবস্থান জানাজানি হতে পারে। সেজন্য কোনো আগুন জ্বালান হবে না। আগামীকাল সূর্য উঠবার ঠিক আগে, বাইসানগার তুমি আমাদের হয়ে ফাঁদ পাতা শুরু করবে। আমাদের তিনশ শ্রেষ্ঠ ঘোড়সওয়ার তোমার সাথে থাকবে। আব-ই-সিয়ার তীর ধরে নিচে নেমে তারপরে পশ্চিমে রওয়ানা দেবে। শহরের দেয়ালে নিয়োজিত প্রহরীরা যেনো তোমাদের দেখতে পায় সেটা অবশ্যই নিশ্চিত করবে। সকালের কুয়াশায় তোমাদের প্রকৃত সংখ্যা প্রহরীর দল বুঝতে পারবে না। কোনো ধরণের ঝুঁকি নেবে না। শেখজাদা তোরণদ্বার অতিক্রম না করা পর্যন্ত নদী অতিক্রম করতে যেও না। আমাদের সাথে তোমাদের পুনরায় মিলিত হবার উপরে আমি অনেকাংশে নির্ভর করছি এবং আমরা দুটো দলে বিভক্ত হবার পরে সবুজাভ-নীল তোরণদ্বারের কাছে শহরের প্রতিরক্ষা দেয়াল আক্রমণ করার সময়ে আমাদের সাথে আবার যোগ দিতে তোমাদের যেনো চার ঘণ্টার বেশি দেরি না হয়।”

 “ওয়াজির খান, উজবেকরা টোপ গিলেছে এবং বাইসানগারকে ধাওয়া করতে শুরু করেছে এটা দেখামাত্র আমরা পূর্ব দিক থেকে শহরের দেয়াল আক্রমণ করবো। আমরা শহরে প্রবেশ করার পরে, আমি আদেশ দিচ্ছি উজবেক দেখামাত্র খুন করবে- তাদের কোনো ধরণের দয়া দেখাবে না। কারণ তারা আমাদের লোকদের। প্রতিও কোনো ধরণের করুণা দেখায়নি কিন্তু সমরকন্দের অধিবাসী আর তাদের সম্পত্তির হেফাজত করবে। তারা আমার প্রজা।”

 “হ্যাঁ, সুলতান।” তার সেনাপতিরা মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। সবাই আপন আপন ভাবনায় বিভোর। সম্ভবত ভাবছে আগামীকালের সূর্যোদয় দেখবার জন্য কি সে। বেঁচে থাকবে। যুদ্ধক্ষেত্রে সাইবানি খান কখনও পরাজিত হয়নি। কিন্তু অস্ত্রের ধারের সাথে এবার বুদ্ধির ক্ষিপ্রতাও বিবেচ্য শক্তি এবং ভাবনাটা বাবরকে নতুন সাহসে বলীয়ান করে তোলে।

***

বাইসানগার আর তার লোকেরা আধঘণ্টা আগে রওয়ানা দিয়েছে। একটা পোক্ত আপেল গাছের গুঁড়িতে, যার শাখাপ্রশাখা আপেলে ভর্তি। পাকা আপেলের গন্ধ বাবরকে খানিকক্ষণের জন্য হলেও ইয়াদগারের কথা মনে করিয়ে দেয়। সে পিঠ ঠেকিয়ে বসে। সকালের কুয়াশায় গাছপালা, ঝোপঝাড় সবকিছু অস্পষ্ট দেখায়। দেয়াল বেয়ে উঠার জন্য মই তৈরি করা শেষ এবং তিনজন লোক পাশাপাশি উঠতে পারে এমন চওড়া করে সেগুলো বানানো হয়েছে। দুটো ঘোড়ার মাঝে ঝুলিয়ে মইগুলো আক্রমণ স্থলে নিয়ে যাওয়া হবে। ওয়াজির খান নিরবে নামাজ আদায় করেন। সেজদার সময়ে তার কপাল ভক্তি ভরে মাটি স্পর্শ করে।

বাবর ভাবে, তারও কি নামাজ পরা উচিত। নামাজ না পড়ে সে কয়েক মুহূর্ত নিরবে বসে চিন্তা করে। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই যুদ্ধের চিন্তা তাকে আচ্ছন্ন করে। তার গুপ্তদূতেরা এসে খবর দিয়েছে শহর রক্ষাকারী দেয়ালের বাইরে বড়সড় ধরণের কোনো উজবেক ছাউনি আশেপাশে কোথাও নেই। যার মানে সম্ভবত সাইবানি খানের বাহিনীর একটা অংশ ইতিমধ্যে আশেপাশে লুটতরাজ শুরু করেছে। সমরকন্দের এখন যখন পতন হয়েছে- লোভের মাত্রা আশেপাশের গ্রামাঞ্চল আর লোকালয়ে তার নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে ডাকাতি করাতেই অনেকে বেশি আগ্রহ দেখাবে। কপাল ভালো হলে, সাইবানি খানের দেহের উপরাংশে সংবদ্ধ উদ্ধত মস্তিষ্কে এটা ঢুকবে না যে তাকে কেউ আক্রমণ করার দুঃসাহস দেখাতে পারে। আর এ কারণেই সে পরিতৃপ্ত মনে তাদের যেতে দিয়েছে।

 সহসা, বাবরের মনে হয় সে কোনো শব্দ শুনতে পেয়েছে এবং তার কল্পনার জাল নিমেষে ছিঁড়ে যায়। গাছপাকা আপেলে অর্ধেক পিছলে সে উঠে দাঁড়াবার ফাঁকে সে গাছের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখতে চেষ্টা করে। দূরে নদীর উপরে জমে থাকা কুয়াশার উপর দিয়ে সে সমরকন্দের পরিচিত দেয়াল দেখতে পায় এবং এখানে সেখানে প্রাকারবেষ্টিত ছাদে আলোর ক্ষুদ্র রশ্মি চোখে পড়ে।

তারপরে, চোখ কান খাড়া করতে, সে আবার শব্দটা শুনতে পায়: ঢাকের মন্দ্র ছন্দোবদ্ধ আওয়াজ, খানিক পরে আরও ঢাকের শব্দ শোনা যায়। সহসা ছাদে মানুষের চলাচল বেড়ে যায়। সে যেমনটা চেয়েছিলো, বাইসানগার আর তার লোকেরা নিশ্চয়ই বৃত্তাকার পথে পশ্চিমে যাবার সময়ে প্রতিপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এখন প্রশ্ন হলো সাইবানি খান কি টোপটা গিলবে?

“আপনাদের লোকদের ঘোড়া নিয়ে প্রস্তুত থাকতে বলেন, কিন্তু আমি আদেশ না দেয়া পর্যন্ত কেউ যেনো তার জায়গা থেকে না নড়ে।” বাবর নিচু স্বরে তার সেনাপতিদের সাথে কথা বলে, যারা এসে তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে তার মতোই ঢাকের বাদ্যি শুনছে।

 আনতাবাড়ি বোল শীঘ্রই একটা মন্দ্র ভয়ঙ্কর ছন্দে পরিণত হয়। বাবর ভাবে সে যে ঢাকের আওয়াজ শুনছে সেটা মাহমুদের চামড়া দিয়ে তৈরি ঢাকের আওয়াজ নিশ্চয়ই না। একেকটা মুহূর্ত অতিক্রম করার সাথে সাথে অনিশ্চয়তা সবার উপরে একটা চাপ সৃষ্টি করে। কুয়াশার আড়ালে আত্মগোপন করে বাবর সামনে এগিয়ে যায়, আরেকটু ভালো করে চারপাশটা দেখার জন্য এবং দেয়ালের কাছেই জন্মানো ছোট গাছের একটা ঝাড়ের পাশে সে নিজেকে লুকিয়ে রাখে। তার নতুন সুবিধাজনক অবস্থান থেকে লোহার দরোজা আর তার পরে শেখজাদা তোরণদ্বারের যতোটুকু সে দেখতে পায়- বাইসানগার আর তার লোকেরা, যাদের ভিতরে বাবুরীও রয়েছে, যার। কাছ দিয়ে অতিক্রম করেছে– বুঝতে পারে সেগুলো এখনও বন্ধ রয়েছে। কিন্তু তারপরে, বাবরের যখন মনে হতে শুরু করেছে এই উত্তেজনা সে আর সহ্য করতে পারছে না। লোহার দরোজার উত্তোলন আর অধঃকরণের উপযোগী লোহার গরাদ উপরে উঠতে শুরু করে। গরাদ অশ্বারোহী বের হয়ে আসতে পারে এমন উচ্চতায় উঠতেই, পাশাপাশি দুজন করে অশ্বারোহী বাহিনীর একটা স্রোত দুলকিচালে বের হয়ে এসে বল্পিতবেগে উত্তর-পশ্চিম দিকে ধাওয়া করে। অশ্বারোহীরা বের হয়ে। আসা শেষই হতে চায় না- চারশো হবে কম করে হলেও। সে ভেবে উত্তেজিত হয়ে উঠে। অবশেষে শেষ যোদ্ধাটাও ভেতর থেকে বের হয়ে এসে ছায়ামূর্তির মতো কুয়াশার ভেতরে হারিয়ে যেতে একটা সাময়িক স্তব্ধতা এসে ভর করে। বাবর আশা করেছিলো, লোহার দরোজার গরাদ এবার নেমে আসবে কিন্তু এক নিঃসঙ্গ অশ্বারোহী মন্থর বেগে ভেতর থেকে বের হয়ে আসে। দরোজা থেকে কয়েক কদম এগিয়ে এসে সে লাগাম টেনে ধরে মাথা ঘুরিয়ে ডানে বামে তাকিয়ে দেখে। শিকারের আগে বাতাসে নাক উঁচিয়ে শিকারী কুকুর যেমন করে, অবিকল সেই ভঙ্গিতে সে বাতাসে শ্বাস নেয়। মুহূর্তের জন্য তার মনে হয় নিঃসঙ্গ অশ্বারোহী নিচু জমি আর তৃণভূমির উপর দিয়ে কুয়াশার চাদর ভেদ করে সরাসরি বাবরের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। যদিও সে জানে সেটা অসম্ভব।

বাবরের মনে লোকটার পরিচয়ের ব্যাপারে সামান্যই সন্দেহ রয়েছে- সাইবানি খান। স্বয়ং। উজবেক দলপতির কি অভিপ্রায়? অবশেষে নিঃসঙ্গ অশ্বারোহী তার হাত উঁচু করে। লোহার দরোজার ভিতর থেকে আরো যোদ্ধারা এসে তার পেছনে জড়ো হতে সে ঘোড়ার পাজরে খোঁচা দিয়ে কর্কশ কণ্ঠে তার লোকদের চিৎকার করে কিছু একটা বলে, যা বাবরের কাছে পৌঁছাতে পৌঁছাতে একটা অস্পষ্ট গুঞ্জনে পরিণত হলেও সে সেটা ঠিকই শুনতে পায়, উত্তর-পশ্চিম দিকে হারিয়ে যায়। আরো কয়েক মিনিট পরে, সব অশ্বারোহী যোদ্ধার দল বিদায় নিতে লোহার গরাদ ধীরে ধীরে নিচে নেমে আসে।

নিজের অস্থিরতা দমন করে, বাবর তার মূল বাহিনীর কাছে ফিরে এসে তার লোকদের আরো একবার চুপ করে নিরবে দাঁড়িয়ে থাকবার আদেশ দেয়। তারা যদি এখনই শহর আক্রমণ করতে যায় তাহলে কোলাহলের শব্দ শুনে সাইবানি খান। হয়তো ফিরেও আসতে পারে। ওয়াজির খান চুপ করে দাঁড়িয়ে না থেকে নিজের ঘোড়ার পেটি শক্ত করে বাঁধে এবং নিজের আয়ুধের ধার পরখ করে দেখে তরবারি, খঞ্জর আর রণকুঠার। বাবর তার বিজ্ঞ পরামর্শদাতার স্থিরতা আর বিচক্ষণতার প্রতি কৃতজ্ঞ বোধ করে নিজেও তাকে অনুসরণ করে। তার পিঠে চামড়ার তূণ ঝুলছে, এবং সদ্যই কামারশালা থেকে তৈরি হয়ে আসা লম্বা তীরের তীক্ষ্ণ সূচাল ডগায় হাত বুলাতে সে আত্মবিশ্বাসে ভরপুর হয়ে উঠে। সে তার বাঁকানো ধনুক আলতো করে খাপ থেকে ধরে বের করে তেল দিয়ে পাকা করে তোলা গুণের স্থিতিস্থাপকতা পরীক্ষা করে দেখে। সন্তুষ্টির সাথে নাক দিয়ে ঘোঁত করে অব্যক্ত শব্দ করে। সে বের হবার আগে যেমন শক্ত করে বেঁধেছিলো এখনও ঠিক তেমনই আছে।

অবশেষে আক্রমণের চুড়ান্ত সময় উপস্থিত হয়। দূর্গের ছাদে সবকিছু আবার আগের মতো নিরব হয়ে এসেছে এবং সাইবানি খান তার দলবল নিয়ে এতক্ষণে নিশ্চয়ই শ্রবণ সীমার বাইরে চলে গিয়েছে।

 “যাত্রা শুরু হোক!” উত্তেজনায় অধীর কণ্ঠে বাবর চিৎকার করে উঠে। নিজের ঘোড়র উপরে লাফিয়ে উঠে বসে সে গাছের আড়াল থেকে বের হয়ে আসে এবং তার লোকদের আক্রমণের ছকে বিন্যস্ত হতে দেয়। ওয়াজির খানের নেতৃত্বে তার দেহরক্ষী বাহিনী বিলম্ব না করে তার পেছনে এসে অবস্থান নেয়। তাদের পরেই থাকে আরোহন সহায়ক মই বহনকারী জোড়া ঘোড়সওয়ারের দল। তারপরে থাকে অশ্বারোহী বাহিনীর বাকি অংশ আর ইব্রাহিম সারুর তীরন্দাজ দল থাকে একেবারে শেষে।

 বাবর ঘোড়ার পেটে গোড়ালী দিয়ে গুতো দিতে সেটা লাফিয়ে উঠে সামনে এগিয়ে যায়। ক্রমশ হাল্কা হয়ে আসা কুয়াশার মাঝে তারা তৃণভূমির বুক চিরে দক্ষিণে এগিয়ে যায়। সবুজাভ-নীল তোরণদ্বারের দিকে এগিয়ে যাবার সময়ে শহর রক্ষাকারী দেয়াল তাদের ডান দিকে থাকে। তারা দেয়ালের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর দূরবর্তী পাড় ধরে এগোতে থাকে এবং এবার আর অগভীর অংশ দিয়ে নদী পার হবার দরকার নেই। কারণ কাঠের তক্তার তৈরি একটা চওড়া মজবুত সেতু– সদ্য নির্মিত, কোনো সন্দেহ নেই উজবেকদের কীর্তি- সবুজাভ-নীল তোরণদ্বার থেকে তিনশ গজ দূরে উজানে দেখা যায়।

বাবর তার তার বাহিনী খুরে বজ্রের বোল তুলে সেটা পেরিয়ে আসে এবং সোজা তোরণ রের দিকে ধেয়ে যায়। দূর্গের ছাদ থেকে আতঙ্কিত চিৎকার শুরু হতে, মাঙ্গলিং তীরন্দাজ বাহিনী ঢেউয়ের পরে ঢেউ তীরের ঝাপটা শূন্যে ভাসিয়ে দেয়। কয়েক মিনিটের ভিতরে সবুজাভ-নীল তোরণদ্বারের দুপাশের সবচেয়ে নিচু স্থানে আরোহন মই স্থাপন করা হয়। ঘোড়া থেকে নামার ফাঁকে সে উপরের দিকে তাকিয়ে সেখানে একজনকেও প্রতিরক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত দেখতে না পেয়ে সে বিস্মিত হয়।

মই বেয়ে উপরে উঠতে কয়েক মিনিটের বেশি সময় লাগে না এবং শেষ কয়েক ফিট তারা পাথরের উপরে হাত দিয়ে বেয়েই উঠে যায়। তার যোদ্ধারা তার পাশে ভিড় করলে নড়াচড়ার জায়গা থাকে না। তরবারি কোষমুক্ত করা তো আরো পরের কথা। কিন্তু উজবেক রক্ষীবাহিনীর মাঙ্গলিঘ তীরন্দাজদের নিক্ষিপ্ত তীরে শজারুর মত আকৃতি নিয়ে পড়ে থাকা মৃত যযাদ্ধাদের ছাড়া অবশিষ্টাংশের কোনো চিহ্ন কোথাও দেখা যায় না।

 তারপরে, একশ গজ দূরে একটা শক্তিশালী ঘাঁটি থেকে নিক্ষিপ্ত তীরের ঝাপটা বুঝিয়ে দেয় উজবেক রক্ষীবাহিনীর সব সদস্যই পালিয়ে যায়নি। কালো পালকযুক্ত একটা তীর বাবরের গম্বুজাকৃতি শিরস্ত্রাণে আঘাত করে দিকভ্রষ্ট হয়। আরেকটা তীর তার ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা এক দেহরক্ষীর উরুর গভীরে কামড় বসায়। তৃতীয় আরেকটা তীর মই বেয়ে উঠে এসে প্রাকারের উপর দিয়ে ছাদে ধড়ফড় করে নামতে ব্যস্ত সৈনিকের গালে বিদ্ধ হয়। তার মুখ দিয়ে গলগল করে রক্ত পড়তে শুরু করতে, তার হাত মই থেকে ছুটে যায় এবং তার ঠিক নিচে মই বেয়ে উঠে আসা অপর এক সৈন্যকে সাথে নিয়ে নিচের পাথুরে ভূমির দিকে মরণ পতন যাত্রা করে। তীরের পরের ঝাপটা থেকে বাঁচতে বাবর ঢাল উঁচু করে নিজের লোকদেরও তাই। করতে বলে দুর্ভেদ্য অবস্থানটার দিকে ধেয়ে যায়। আরো দুটো তীর ঢালে এসে আছড়ে পড়ে। কিন্তু পুরু চামড়া আর কাঠের কাঠামো দক্ষতার সাথে তাদের দায়িত্ব পালন করে। অবশ্য বাবরের পেছনের এক সৈন্য গলায় তীরবিদ্ধ হয়ে ভূমি শয্যা নেয়। বাবর তারপরেই দুর্ভেদ্য অবস্থানটায় পৌঁছে যায়। সেখানে প্রবেশ করার জন্য কোনো দরোজা নেই। সে প্রথম যাকে সামনে পায় তাকে কোনো বাছবিচার ছাড়া কোপ বসিয়ে দেয়। বেচারা ধনুক ছেড়ে তখনও তলোয়ার বের করতে পারেনি। অন্যজনের আঙ্গুল তরবারির বাট আকড়ে ধরেছে। কিন্তু বাবর তার কব্জি লক্ষ্য করে তরবারি চালাতে, হাত দেহ থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। লোকটা ঘুরে দাঁড়িয়ে অপর দিকের দরজা দিয়ে দৌড়ে পালায় এবং দেয়ালের পাশ দিয়ে পঞ্চাশ গজ দূরে অবস্থিত সবুজাভ-নীল তোরণদ্বারের তোরণ রক্ষীর কক্ষের দিকে ছুটে যায়।

 দুর্ভেদ্য স্থানের অন্য যোদ্ধারা তাকে অনুসরণ করতে চেষ্টা করে। কিন্তু হাতাহাতি লড়াইয়ের হাত থেকে তারা পালিয়ে যেতে চাইলে বাবর আর তার লোকেরা তাদের নির্দ্বিধায় হত্যা করে। তার তীরন্দাজেরা আরো দু’জনকে তোরণ রক্ষকের কক্ষে দৌড়ে যাবার সময়ে ভূপাতিত করে। অবশ্য তাদের মধ্যে একজন তারপরেও টলমল পায়ে কোনোমতে গড়িয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে সরে যেতে সক্ষম হয়।

 “সুলতান, আমাদের দেখে ব্যাটাদের পাখা গজিয়েছে!”

 বাবর ঘুরে তাকিয়ে এক হাতে খঞ্জর অন্য হাতে রক্তাক্ত তরবারি হাতে হাঁফাতে হাঁফাতে কিন্তু গর্বিত ভঙ্গিতে দাঁড়ানো ওয়াজির খানকে দেখতে পায়। “এখনও না। তোরণ আর দেয়ালের এই অংশ পাহারা দেবার জন্য প্রহরী নিয়োগ করেন। আপনি নিজে এখানের দায়িত্বে থাকবেন। ইত্যবসরে আমি বাকিদের নিয়ে তোরণ রক্ষকের কক্ষে প্রবেশ করে তোরণদ্বার খুলে আমাদের বাকি লোকদের ভেতরে প্রবেশের ব্যবস্থা করা যায় কিনা দেখি।”

ওয়াজির খানকে বকুনি খাওয়া বালকের মতো অপ্রতিভ দেখায়। কিন্তু বাবর ক্রমেই দুর্বল হয়ে উঠা তার সবচেয়ে বিজ্ঞ অমাত্যকে শহরের রাস্তায় হাতাহাতি লড়াইয়ের মধ্যে ফেলতে চায় না, যেখানে একজন লোকের দ্রুত দৌড়াবার ক্ষমতা অনেক সময় জীবন মৃত্যুর মধ্যে ভেদ রেখা টেনে দিতে পারে।

মাথার উপরে ঢাল ধরে এবং কুঁজো হয়ে বাবর পঞ্চাশ গজ দূরে অবস্থিত তোরণ রক্ষকের কক্ষের দিকে দৌড়ে যায়। সে ভেতরে এক হাত প্রায় কাটা পড়া সেই উজবেক যোদ্ধাকে পড়ে থাকতে দেখে। দেয়ালে হেলান দিয়ে সে দ্রুত শ্বাস নেয়। তার হাতের ক্ষতস্থান থেকে রক্ত ছিটকে এসে পাথরের মেঝে লাল করে দিয়েছে। যন্ত্রণায় সে শাপশাপান্ত করছে। নিচের তোরণদ্বারের দিকে নেমে যাওয়া সিঁড়ি থেকে দুদ্দাড় ভেসে আসা পায়ের আওয়াজ বলে দেয় বাকী রক্ষীদের কোথায় পাওয়া যাবে। সে আর তার লোকেরা সন্তর্পনে পায়ের শব্দ অনুসরণ করে। আশঙ্কা করে সিঁড়ি থেকে বের হওয়া মাত্র হামলার মুখে পড়তে হতে পারে, কিন্তু সেরকম কিছুই ঘটে না।

 “তালাটা ভেঙে দরজাটা খুলে দাও।” বাবর চেঁচিয়ে উঠে বলে।

 রণকুঠার হাতে তার দুই দেহরক্ষী আদেশ পালন করতে দৌড়ে যায়। তাদের কুঠার তোরণের তালার উপরে সজোরে নেমে আসতে ধাতুর সাথে ধাতুর সংঘর্ষের কর্কশ শব্দ উঠে এবং কিছুক্ষণ পরে একটা শেষ ঘাইয়ের সাথে তারা তাদের কাজ সমাপ্ত করে। শীঘ্রই প্রাচীন, লোহার-কীলক দিয়ে সজ্জিত দরজা দোল খেয়ে খুলে যায় বাবরের অবিশিষ্ট যোদ্ধার দলকে ভেতরে প্রবেশের সুযোগ দিতে। যাদের ভিতরে মাঙ্গলিঘ তীরন্দাজের দলও রয়েছে।

 আলমগীর হাতে নিয়ে বাবর চারপাশে তাকায়। বড্ড বেশিই যেনো নির্জন চারপাশটা। উজবেক শেয়ালের দল কোথায় লুকিয়ে আছে? বাবর সতর্কতার তাবিজ খুলে রেখে চওড়া গলিপথ ধরে ফারগানার নামে জয়ধ্বনি দিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে শুরু করে।

নিস্তব্ধতার মাঝে বাবরের চিৎকারের প্রতিধ্বনি শোনা যায়। তীরের কোনো ঝাঁক আর তাদের দিকে ধেয়ে আসে না বা উজবেক অবজ্ঞার কোনো চিৎকারও শোনা যায় না। তারপরে বাবরকে চমকে দিয়ে বন্ধ দরোজা, জানালার পাল্লা খিড়কি একে একে খুলতে শুরু করে। সে দৌড়ে আড়াল খোঁজে এবং পুনরায় তার তীর ধনুকের দিকে হাত বাড়ায়। কিন্তু দেখা যায় উঁকি দেয়া মাথাগুলো কোনো উজবেক যোদ্ধার না। তারা সবাই সমরকন্দের সাধারণ মানুষ বণিক, দোকানদার, সরাইখানার মালিক- যারা বাবর আর তার লোকদের চিনতে পেরে তাদের স্বাধীন করায় তার জন্য দোয়া করছে। শীঘ্রই তারা পিলপিল করে বাইরের গলিতে বেরিয়ে আসতে শুরু করে। খুশিতে সবার প্রায় পাগল হবার দশা।

“জলদি! এই দিকে!” একটা অপরিচিত লোক চিৎকার করে বলে। “আমি এক উজবেক বদমাশকে এদিকে পালাতে দেখেছি।” সে একটা সংকীর্ণ গলির দিকে ইশারা করে দেখায়। যেখানে পড়ে থাকা রক্তের ফোঁটা ইতিমধ্যে ধূলোয় জমাট বাঁধতে শুরু করেছে। ব্যাপারটা দেখার জন্য বাবর তার লোকদের কিছু বলার আগেই, দু’জন সাধারণ নাগরিক। তাদের একজনকে দেখে মনে হয় কসাই হবে। অন্যজন গাট্টাগোট্টা দেখতে তারের মতো পাকানো শরীর যার নাকের পাশে জরুল রয়েছে- গলির ভিতরে দৌড়ে প্রবেশ করে। কিছুক্ষণের ভিতরে তারা এক তরুণ উজবেকের পা ধরে টানতে টানতে নিয়ে আসে। ফলে বেচারার মাথা রাস্তায় বলের মত লাফাতে থাকে। তার বুক ভেদ করে একটা মাঙ্গলিঘ তীরের মাথা বের হয়ে আছে এবং বাতাসের জন্য হাঁসফাঁস করার ফাঁকে সে করুণা ভিক্ষা করে। বাবর কিছু বলার আগেই কসাইর মতো দেখতে লোকটা একটা চাকু বের করে ছেলেটার কণ্ঠনালী থেকে কান পর্যন্ত কেটে ফাঁক করে দেয়। তাজা রক্ত ছিটকে তার পায়ের নাগরা ভিজিয়ে দিতে তার চেহারা খুশিতে বাকবাক করতে থাকে। চারপাশে সবাই হাতের কাছে যে যা পাচ্ছে তাই নিয়ে নিজেদের যুদ্ধের জন্য সজ্জিত করে- পাথরের টুকরো, কামারের হাতুড়ি, খড় তোলার কাঁটা লাগানো দণ্ড…বাবর আর তার সৈন্যদের সাথে তারা দৌড়াতে শুরু করলে তাদের জ্বলজ্বল করতে থাকা চোখের দৃষ্টি দেখে বাবরের বুনো কুকুরের কথা মনে পড়ে। গলি থেকে গলিতে তারা উজবেকদের খুঁজতে থাকে এবং তাদের ঘৃণার তীব্রতা এতো বেশি, তারা এতো অপমান সহ্য করেছে যে, মৃত কোনো উজবেককে দেখতে পেলে তাকেও নির্বিচারে চাকু দিয়ে কোপাতে থাকে।

দেয়ালের কাছে যারা আহত হয়েছিলো তারা বেশিদূর পালাতে পারেনি। প্রতিরোধের মাত্রা অনেক অল্প- প্রায় নেই বললেই চলে। উজবেকরা নিশ্চয়ই তাদের আগে আগে পালিয়ে যাচ্ছে। রেজিস্তান চত্বরে পৌঁছে বাবর সেখানে সাময়িক যাত্রা বিরতির ঘোষণা করে। উজবেকরা সম্ভবত ভেবেছে যে, সে আসলেই অনেক বড় বাহিনী নিয়ে আক্রমণ করেছে। কিংবা পুরো বিষয়টাই একটা ফাঁদ। সামনেই কোথাও তারা তাদের জন্য ওঁত পেতে আছে। বাবর তার সেনাপতিদের সাথে একটা সংক্ষিপ্ত আলোচনায় বসে এবং তারপরে সৈন্যদের সাবধানে শহরের উত্তর, পূর্ব আর পশ্চিমে পাঠায়। আসলেই ব্যাপারটা কি সেটা দেখতে।

ভোরের সূর্য এতক্ষণে মধ্য সকালের আলোয় সমাসীন এবং নির্মেঘ উজ্জ্বল আকাশের নিচে আরো বেশি বেশি লোক এসে চত্বরে হাজির হয়। সবাই খাবার নিয়ে এসেছে- রুটি, শুকনো ফল, এমনকি সুরা ভর্তি মশক- যা বাবরের লোকদের নেবার জন্য জোরাজুরি করছে। তার চারপাশে উত্তেজিত সব কণ্ঠস্বরের একটা কোলাহল ধীরে ধীরে দানা বেঁধে উঠে। চরম বিশৃঙ্খলা- উজবেকরা যদি শক্তি সঞ্চয় করে পাল্টা আক্রমণ করে তাহলে কি হবে? বাবরের লোকেরা এই হট্টগোলের ভিতরে কোনো প্রতিরোধই তৈরি করতে পারবে না।

বাবর তার দেহরক্ষীদের আদেশ দেয় শহরের জনগণকে একটু দূরে সরিয়ে দেয়ার জন্য। দেহরক্ষীর দল বর্শা দিয়ে একটা বেষ্টনী তৈরি করে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চারপাশে চাপ দিতে শুরু করে এবং ধীরে ধীরে সাফল্যের সাথে বিশৃঙ্খল জনতাকে ঠেলে সরিয়ে দিতে সক্ষম হয় এবং চত্বরে প্রবেশ আর বর্হিগমনের গলি ভীড়মুক্ত করে। এই বেশ হয়েছে। “আমি চাই আশেপাশের এইসব ভবনগুলো ভালো করে তল্লাশি করা হোক আর চত্বরের চারপাশের প্রতিটা কৌশলগত স্থানে প্রহরী নিয়োগ করা হোক।” বাবর আদেশ দেয়। উজবেক তীরন্দাজের দল হয়তো এতোক্ষণে চত্বরের আশেপাশের সব প্রাসাদ, মসজিদ আর মাদ্রাসার মিনার আর নীল টালি শোভিত গম্বুজের সুবিধাজনক স্থানে অবস্থান নিয়ে সুযোগের অপেক্ষা করছে।

 “সুলতান…” ঘামে ভেজা চওড়া মুখের এক তরুণ সৈন্য বাবরের কনুইয়ের কাছে দাঁড়িয়ে ছিলো। তার কণ্ঠস্বর শুনে মনে হয় সে এতোক্ষণ জোরে দৌড়ে এসেছে। “কি হয়েছে?”

 “সাইবানি খানের সাথে যোগ দেবার আশায় উজবেকদের একটা বিশাল সংখ্যা শেখজাদা তোরণ দিয়ে উত্তর দিকে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করছে। তারা বের হবার চেষ্টা করলেই আমাদের তীরন্দাজ বাহিনী তাদের লক্ষ্য করে তীর ছুঁড়ে মারছে। অবশ্য, স্থানীয় লোকজন লোহার দরোজার প্রহরীর কক্ষে কিছু উজবেককে আটকাতে সক্ষম হয়েছে।”

‘চমৎকার। আমরা আমাদের শত্রুর শেষ নিশানাও এই শহর থেকে বিতাড়িত করবো এবং সাইবানি খান ফিরে আসবার আগেই শহর রক্ষাকারী দেয়াল পাহারা দেবার বন্দোবস্ত করো।” বাবর তার ঘোড়া নিয়ে আসতে বলে এবং দেহরক্ষীর দল নিয়ে লোহা দরোজার দিকে এগিয়ে যায়। তৈমূরের মসজিদের চমৎকার নীল গম্বুজ আলোয় ঝকঝক করে। কিন্তু তার পেছনেই সে কুণ্ডলী আকারে ধোয়া উঠতে দেখে এবং বাবর চিৎকারের আওয়াজ শুনতে পায়। লোহা দরোজার দিকে এগিয়ে যেতে সে প্রহরীর কক্ষের ছাদ ভেদ করে বের হয়ে আসা আগুনের শিখা দেখতে পায় এবং চিৎকার করছে ভেতরে আটকে পড়া উজবেক রক্ষীর দল। আরো কাছে যেতে, সে দেখে বেপরোয়া এক উজবেক জানালা গলে বাইরে বের হয়ে আসতে চেষ্টা করলে সমরকন্দের কিছু লোক তাকে আবার জোর করে ভেতরে ঠেলে দিয়ে জানালার খড়খড়ি বন্ধ করে দিয়ে সেটা বাইরে থেকে তক্তা দিয়ে বন্ধ করে দেয়। আরেক উজবেক, কাপড়ে আগুন নিয়ে ছাদ থেকে নিচে লাফিয়ে পড়তে উপস্থিত জনতা সাথে সাথে তাকে ঘিরে ধরে উন্মত্তের মতো তার দেহ ছুরি চাকু দিয়ে কোপাতে থাকে বেচারার মৃত্যু নিশ্চিত করতে। শীঘ্রই উল্লসিত জনতা তার কাটা মাথাটা একটা স্মারকের মতো প্রদর্শন করতে থাকে।

 বাবর সেখানে এসে পৌঁছাতে, উপস্থিত জনতার একজন তার মুখ ধোয়ায় কালো হয়ে গেছে তার দিকে দৌড়ে আসে এবং বাবরের দেহরক্ষী দলের একজনের হাতে ফারগানার রাজকীয় প্রতীক দেখে চিনতে পেরে, হাঁটু মুড়ে বসে পড়ে। “সুলতান আমরা শয়তানগুলোকে আটকে তাদের এখন পোড়াচ্ছি। আমাদের যেমন কষ্ট দিয়েছে তারা এখন তার প্রতিদান পাচ্ছে। আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, কেউ বিনা কষ্টে মরবে না।” বাহবার জন্য বাবরের দিকে তাকিয়ে থাকা লোকটার চোখে কেবল রক্ত লোলুপতা খেলা করতে থাকে। কিন্তু মানুষের মাংস পোড়ার মিষ্টি গন্ধে বাবরের গা গুলিয়ে উঠলে কোনো কথা না বলে সে হাত নেড়ে তাকে যেতে বলে। প্রজ্জ্বলিত প্রহরী কক্ষের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নয়ে। ইতিমধ্যে ভিতরে বন্দি উজবেকদের যন্ত্রণাক্লিষ্ট চিৎকারের মাত্রা কমে এসেছে। সে রেজিস্তান চতুরের দিকে ধীরে ধীরে ফিরে চলে। সমরকন্দ বোধহয় সে আবার ফিরে পেলো, কিন্তু যতো দ্রুত আর অনায়াসে শহরটার পতন হলো সেটা তার কেনো যেনো বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়।

 সামনে থেকে ঘোড়ার ধাবমান খুরের শব্দ ভেসে আসে এবং একটা পরিচিত মুখ সে দেখতে পায়। বাইসানগার এবং তার সহযোদ্ধাদের ভিতরে সে বাবুরীকেও দেখতে পায়।

“সমরকন্দের সুলতান মির্জা বাবরের জয় হোক!” বাইসানগার গলার সর্বশক্তি দিয়ে জয়ধ্বনি দেয় এবং বাকি লোকেরা তার সাথে গলা মেলায়। বাবর হাত উঁচু করে তাদের অভিবাদনের জবাব দেয় এবং ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে যায়। সব কিছু তার কাছে কেমন স্বপ্নের মতো মনে হয়। তার উৎফুল্ল হবার কথা, কিন্তু কেমন একটা অদ্ভুত বিচ্ছিন্নতা তার মাঝে ভর করে। সহসা, ভাববার জন্য সময় আর নির্জনতা তার পরম কাম্য বলে মনে হয়।

***

সেই রাতে কোক সরাইতে, বাবর তার খিদমতগারকে কাগজ আর কলম নিয়ে আসার জন্য আদেশ দেয়। খিদমতগার যখন জানতে চায় মুনশিকেও ডেকে আনবে কিনা। সে মাথা নেড়ে নিষেধ করে। সে কিছু একটা সিদ্ধান্তে পৌঁচেছে। সে এখন উনিশ বছরের পূর্ণ বয়স্ক এক পুরুষ, এবং চাঞ্চল্যকর ঈর্ষণীয় সাফল্য সে অর্জন করেছে। আজ থেকে সে রোজনামচা লিখবে। যেখানে সে তার হৃদয়ের কথাই কেবল লিপিবদ্ধ করবে। সে কেবল জানবে রোজনামচায় কি লেখা আছে। দোয়াতদানিতে কলমের নিব ডুবিয়ে নিয়ে এক মুহূর্ত ভেবে নিয়ে সে লিখতে শুরু করে; প্রথমে লেখনীর গতি মন্থর থাকে কিন্তু ধীরে ধীরে আবেগের উৎসমুখে বাঁধ খুলে যেতে লেখার গতি বৃদ্ধি পায়:

যুগ যুগ ধরে সমরকন্দ তৈমূরের বংশধরেরা শাসন করে এসেছে। তারপরে উজবেকরা- আমাদের সভ্য দুনিয়ার বাইরে মানবতার প্রান্তে বসবাসকারী এক বহিরাগত শত্রু- এটা দখল করে একে বিধ্বস্ত করে। এখন আল্লাহতা’লার কৃপায় আমাদের হাতছাড়া হওয়া এই শহরটা আবার আমাদের হাতে ফিরে এসেছে। সমৃদ্ধ সমরকন্দ আবার আমার হয়েছে।

একটা গভীর শ্বাস নিয়ে সে ফুঁ দিয়ে মোমবাতি নিভিয়ে দেয় এবং লেখনী নামিয়ে রাখে। সেদিন বিছানায় গিয়ে শোয়ার প্রায় সাথে সাথে সে গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *