২.১ দ্বিতীয় খণ্ড – সালতানাৎবিহীন এক সুলতান

দ্বিতীয় খণ্ড – সালতানাৎবিহীন এক সুলতান

০৭. আয়োধন আর অন্তর্ধান

 বৃষ্টি আর তুষারপাতের মিশ্রণের প্রকোপ বাবরের ভেড়ার চামড়ার প্রলেপ দেয়া ভারী জ্যাকেটের আবরণও আটকাতে ব্যর্থ হয়। ফারগানার উত্তরে উঁচু পর্বতমালার অভ্যন্তরে এক প্রত্যন্ত উপত্যকার ভিতর দিয়ে বয়ে যাওয়া একটা ক্ষুদ্র স্রোতস্বিনীর তীরের প্রায় কাদা হয়ে থাকা বরফের ভিতর দিয়ে তার অবশিষ্ট লোকদের সামনে থেকে ঘোড়া নিয়ে এগিয়ে চলেছে, বৃষ্টি আর তুষারপাতের হাত থেকে বাঁচতে মাথা নিচু করে রাখা।

নিজের দুটো সালতানাই হারিয়েছে এটা অনুধাবন করার পরের প্রথম দিকের মুশকিল দিনগুলোতে, বাবর আকশি দূর্গের আশেপাশেই থাকবে বলে ভেবেছিলো আশা করেছিলো সব কিছু বাজি রেখে হলেও সে তার পরিবারকে মুক্ত করতে পারবে। ওয়াজির খান অনেক কষ্টে তাকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছে যে, তার শত্রুরাও এমনই একটা মরীয়া প্রচেষ্টা আশা করছে আর তারা সেজন্য পুরোপুরি প্রস্তুত হয়ে রয়েছে। ওয়াজির খান, তার চিরাচরিত পিতৃসুলভ ভঙ্গিতে তাকে আশ্বস্ত করে পরামর্শ দিয়েছে, “আপনি যদি আপনার আম্মিজান, নানীজান আর বোনকে বাঁচাতে চান তাহলে নিজেকে বিপদের মুখে না ফেলে বরং শত্রুদের তটস্থ করে তুলেন, যাতে তারা আপনার নাম শুনলেই ভয় পায়। আর সেটা করতে হলে তাদের চাপের ভিতরে রাখেন। এখানে সেখানে তাদের আক্রমণ করে, আপনার বিরুদ্ধে সৈন্য সমাবেশ করবার আগেই সেখান থেকে সরে আসেন। ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে সবসময়ে একটা ভীতির সঞ্চার করতে থাকেন। আপনার শত্রুরা যাতে শান্তিতে ঘুমাতে না পারে। আর এটা করতে পারলেই সুলতান, তারা আপনার পরিবারের ক্ষতি করার কথা চিন্তাও করতে পারবে না।”

বাবর ওয়াজির খানের বক্তব্য মোটের উপরে বুঝতে পারে। সাবধানে বিবেচনা করে, সে একটা পরিকল্পনার কথা বলে। আমাদের একটা নিরাপদ আশ্রয়স্থল চাই। যেখানে আমরা শীতকালটা কাটাতে পারবো এবং প্রথম হামলার ছক কষতে পারবো। আমার মনে আছে যে প্রতিবার গ্রীষ্মের সময়ে সামরিক প্রশিক্ষণের অংশ হিসাবে আপনি একবার আমাকে উত্তরের পার্বত্য অঞ্চলে একটা অভিযানে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং উপত্যকার কেন্দ্রস্থলে একটা মাটির দূর্গে আমরা অবস্থান করেছিলাম। তামবালের অনুগত এক জায়গীরদার সেই নগণ্য সেনাছাউনির প্রধানের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলো। সেই দূর্গটা আমাদের জন্য চমৎকার আশ্রয়স্থল হিসাবে প্রতিপন্ন হতে পারে। কারো মাথাতেই বিষয়টা আসবে না। আপনি কি বলেন?”

“জায়গার কথা আমার মনে আছে। বাস্তবিকই প্রত্যন্ত অঞ্চলে দূর্গটা অবস্থিত, আর আমাদের উদ্দেশও হাসিল হবে।”

আর সে জন্যই সে ওয়াজির খানকে নিয়ে পাহাড়ের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেছিলো। তাদের সাথে কেবল দুশো লোক ছিলো। ওয়াজির খানের সাহায্যে বাবর অনেক যত্ন নিয়ে তাদের বাছাই করেছে, সে কেবল তাদেরই বাছাই করেছে যাদের বয়স অল্প আর কোনো পারিবারিক পিছুটান নেই বা বাইসানগারের মতো যারা তার বিশ্বস্ত অন্তরঙ্গ। বাকি সবাইকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে, তার ডাকের অপেক্ষা করতে বলেছে, যা তারা নিশ্চিতভাবেই পাবে। তাদের যাত্রার দ্বিতীয় সপ্তাহে তুষারপাত শুরু হয় এবং উচ্চতা বাড়বার সাথে সাথে তুষারের স্তর বৃদ্ধি পেয়ে তাদের যাত্রাকে শ্লথ করে তুলেছে।

 “ওয়াজির খান, আপনার কি মনে হয় আমরা দূর্গ থেকে কতোটা দূরে অবস্থান করছি?”

“সুলতান, আবহাওয়া যদি এতোটা বিরূপ না হতো, আমরা তাহলে দূর্গটা এতক্ষণে দেখতে পেতাম। অবশ্য সুবিধাও হয়েছে, দূর্গের নিরাপত্তা রক্ষীরা আমাদের আগে থেকে দেখতে পাবে না। দূরের ঐ গাছগুলোর আড়ালে আমরা অবস্থান নেবো আর সামনেটা রেকী করার জন্য গুপ্তদূত পাঠিয়ে আমরা পর্যাণে যেটুকু শুকনো মাংস রয়েছে সেটা দিয়ে আহার সেরে নেবো।”

তাদের পাঠানো গুপ্তদূতেরা রেকী করে ফিরতে যে নব্বই মিনিট সময় লাগে তার পুরোটা সময়ই অবিশ্রান্তভাবে তুষারপাত হয়। কখনও ভারী বা কখনও হাল্কাভাবে। তার লোকেরা ফিরে আসতে দেখা যায়, ঘোড়া আর তার আরোহী তুষারে পুরো ঢেকে গেছে এবং গুপ্তদূতদের দলনেতা ঠাণ্ডায় নীল হয়ে আসা ঠোঁটে কোনোমতে কথা বলে। “এখান দু’মাইল দূরে একটা বাকের পরেই দূর্গটা অবস্থিত। দূর্গের বাইরে আমরা কোনো ঘোড়ার বা পায়ের ছাপ দেখতে পাইনি যাতে বোঝা যায়, আজ ভেতর থেকে কেউ টহল দিতে বা পর্যবেক্ষণ-ফাঁড়িতে যায়নি। আমরা যখন ঘোড়া থেকে নেমে দূর্গের কাছে এগিয়ে যাই, দূর্গের এক অংশ থেকে আমরা ধোয়া উঠতে দেখেছি- সম্ভবত রসুইখানা- কিন্তু তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো দূর্গের মূল ফটক তখন ভোলা ছিলো। স্পষ্টতই এই আবহাওয়ায় কেউ আক্রমণ করতে পারে সেই ব্যাপারটা তাদের মাথাতেও নেই।”

“চমৎকার, শীঘ্রই তাদের এই নিশ্চয়তা নরকে পরিণত হতে চলেছে। ওয়াজির খান, এটা ইতস্তত করার সময় না, সবাইকে এই মুহূর্তে প্রস্তুত হতে বলুন এবং তুষারপাতের মাঝে আমরা আত্মগোপন করে গুপ্তদূতদের সহায়তায় দূর্গে পৌঁছাবার পথের শেষ বাঁকে দ্রুত আর নিরবে গিয়ে হাজির হবো। সেখান থেকে মূল ফটকের উদ্দেশ্যে ঘোড়া দাবড়ে যাবো।”

 ওয়াজির খান মাথা নেড়ে সম্মতি জানায় এবং পাঁচ মিনিট পরে অশ্বারোহী বাহিনীর একটা সারিকে মন্থর গতিতে পাহাড়ী পথ বেয়ে উপরের দিকে উঠে যেতে দেখা যায়। তুষারাবৃত প্রেক্ষাপটের মাঝ দিয়ে প্রায় দু’মাইল এগিয়ে যায়। তুষারপাত এখন আগের চেয়ে অনেক কমে এসেছে। বাবরের চোখের সামনে একটা পাথুরে অবয়ব ভেসে ওঠে। দূর্গটা আর মাত্র হাজারখানেক গজ সামনে অবস্থিত। এখান। থেকে দূর্গ পর্যন্ত রাস্তাটা বেশ প্রশস্ত।

 “আমরা এখান থেকেই আক্রমণ শুরু করবো। লোকদের বলেন অপ্রয়োজনীয় সবকিছু এখানে পাথরের আড়ালে রেখে কেবল হাতিয়ার নিয়ে প্রস্তুত হতে। যাতে বরফের উপর দিয়ে যতোটা সম্ভব দ্রুত ঘোড়া দাবড়ে আমরা দূর্গে পৌঁছাতে পারি।” তার লোকেরা নিরবে প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। কিন্তু তারা প্রস্তুত হতে হতে তুষারপাত একেবারে বন্ধ হয়ে যায় এবং সামনে- সাদা প্রেক্ষাপটের মাঝে একটা কালো আকৃতির মত দূর্গটা ভেসে উঠে।

 “যারা প্রস্তুত, ঘোড়ায় আরোহন করো! কারো চোখে পড়ে যাবার আগেই আমাদের আক্রমণ করতে হবে!” বাবর চিৎকার করে কথাটা বলার ফাঁকে ময়ান থেকে আলমগীর বের করে আনে। সে লাফিয়ে জিনের উপরে উঠে বসে এবং তার বিশাল কালো ঘোড়াটাকে দূর্গের দিকে এগোতে বলে পেটে খোঁচা দেয় যার ফটক সে খোলা দেখতে পেয়েছে। দশজন যোদ্ধা পরিবেষ্টিত অবস্থায় এবং বাকীরা তার পেছনে সারিবদ্ধভাবে বিন্যস্ত। ঘোড়ার কাধ ধরে ঝুঁকে ছুটে যাবার সময়ে বাবর টের পায় তার কানে রক্তের চাপ বৃদ্ধি পেয়েছে। দূর্গের ফটক থেকে সে যখন মাত্র দুশো গজ দূরে, তখন ভেতর থেকে একটা চিৎকার তার কানে ভেসে আসে- শত্রুরা তাদের দেখে ফেলেছে। ভেতরের লোকেরা বিপদ টের পায়। তারা ফটকের পাল্লা বন্ধ করার চেষ্টা করতে সেটা কেঁপে উঠে। কিন্তু নতুন জমা বরফ পাল্লা নড়তে বাধা দেয়। দু’জন লোক বাইরে ছুটে আসে, বরফের স্তূপে লাথি দেয় এবং বৃথাই চেষ্টা করে পাল্লাটা বরফের উপর দিয়ে সরাতে।

 “ব্যাটাদের পেড়ে ফেলো!” বাবর হুঙ্কার দিয়ে বলে। কিন্তু ঘোড়ার গতি বিন্দুমাত্র হ্রাস করে না। নিমেষের ভিতরে সে একজনকে মাটিতে পড়ে যেতে দেখে, একটা তীর তার গলায় বিদ্ধ হয়েছে। একই সাথে সে নিজেও দূর্গের তোরণদ্বারের কাছে পৌঁছে যায়। দ্বিতীয় লোকটাকে সে আলমগীর দিয়ে একটা কোপ বসিয়ে দেয়। টের পায় তার তরবারি জায়গা মতোই নরম মাংসপেশীতে কামড় বসিয়েছে। কিন্তু কোথায় সেটা দেখবার জন্য সে ঘোড়ার গতি একটুও হ্রাস করে না। তার বদলে, সে তার হাতে ধরা লাগামে একটা ঝাঁকি দিয়ে ঘোড়ার মাথা তখনও আংশিক খোলা ফটকের দিকে ঘুরিয়ে দেয়। বিশাল কালো ঘোড়াটা নাক দিয়ে একটা শব্দ করে এবং বাবর টের পায় ঘোড়াটার একটা পা পিছলে গেছে কিন্তু কালো পাহাড় ঠিকই ঘুরে দাঁড়ায়। একই সাথে তার পেছনে তিনজন যোদ্ধা এসে হাজির হয়।

কিন্তু চতুর্থজন ঢুকতে ব্যর্থ হয়। ভেতরে প্রবেশপথ আটকে ঘোড়া আর তার আরোহীর ভূপাতিত হবার শব্দ বাবর শুনতে পায়। সে দূর্গের ভিতরে প্রবেশ করেছে বটে। কিন্তু তাকে সহায়তা করবার জন্য মাত্র তিনজন যোদ্ধা তার সাথে রয়েছে। চারপাশে তাকালে সে সারি সারি স্থাপিত উঁচু দরজার পেছন, সম্ভবত দূর্গের প্রধান সেনানিবাস থেকে পিলপিল করে লোকজনকে বের হয়ে আসতে দেখে। কেউ কেউ ইস্পাতের বর্ম গায়ে চাপাতে ব্যস্ত। আর বাকিরা ইতিমধ্যে অস্ত্রধারণ করেছে।

“আমার সাথে এসো! এখনই আক্রমণ করতে হবে!” বাবর পেটে খোঁচা দিয়ে পুনরায় তার ঘোড়ার গতি বৃদ্ধি করে। আর একটু পরেই তাকে তার তিনজন সহযোদ্ধাকে নিয়ে আতঙ্কিত লোকগুলোকে কচুকাটা করতে দেখা যায়। সহসা একটা লম্বা লোক বাবরের নজর কাড়ে, যাকে দেখে সেনাপতিদের একজন বলে মনে হয়। ব্যাটকে মাথা নিচু করে পুনরায় ঘরের ভিতরে প্রবেশ করতে দেখলে সেও ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে সেদিকে এগিয়ে যায়। কাঠের সরদলের নিচে দিয়ে ঝুঁকে পার হয়ে সে ভেতরের আধো অন্ধকারে চোখ পিটপিট করে প্রবেশ করতে যে বিশ ত্রিশজন সেখান থেকে বের হয়ে এসেছে, বুঝতে হবে সেটাই এই দূর্গের মোট জনবল। কেবল সেনাপতিগোছের লোকটাই এখন ভেতরে রয়েছে। লোকটা দৌড়ে একটা অস্ত্র সজ্জিত তাকের দিকে ছুটে গিয়ে সেখান থেকে একটা বর্শা আর ঢাল তুলে নিয়ে বাবরের দিকে ঘুরে দাঁড়ায়।

“ফারগানার ন্যায়সঙ্গত সুলতান, আমি বাবর তোমাকে আদেশ দিচ্ছি অস্ত্র নামিয়ে রাখো।”

 “আমি আত্মসমর্পন করবো না। তোমাকে আমি সুলতান বলে মানি না। আমার নাম হানিফ খান। আমি তামবালের প্রতি অনুগত, সেই এখন পুরো এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে। পারলে সম্মুখ যুদ্ধে আমাকে পরাস্ত করো।”

বাবর তার কালা পাহাড়ের উপর থেকে লাফিয়ে নামে এবং আলমগীর হাতে ধরা অবস্থায় হানিফ খানের দিকে এগিয়ে যায়। যে তক্কে তক্কে ছিলো বাবর তার। কাছাকাছি যেতেই হাতের বর্শা দিয়ে সে বাবরকে আঘাতের চেষ্টা করে। বাবর লাফিয়ে একপাশে সরে যায়। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে অর্ধভুক্ত খাবারে ভর্তি একটা নিচু টেবিলের পায়ার সাথে তার বাম পা আটকে যায়। বেকায়দা ভঙ্গিতে সে টেবিলের উপরে আছড়ে পড়ে। টেবিলের উপরে থাকা কাঠের পেয়ালা আর তার ভেতরের খাবার ছিটকে ফেলে। মাংসের সুরুয়া অর্ধেকটা ভর্তি একটা বিশাল ধাতব পাত্রের মুখে তার তরবারি ধরা হাতের কব্জি আটকে যেতে, আলমগীর তার মুঠো থেকে ছুটে যায়।

হানিফ খান বাবরের অসহায় অবস্থার সুযোগে তাকে একেবারে শেষ করে দেবার জন্য ছুটে আসে। তার বর্শাটা দু’হাতে মাথার উপরে তুলে বাবরের উন্মুক্ত গলায় সেটা সর্বশক্তিতে নামিয়ে আনবে। বাবর একটা কাঠের বড় বারকোশ তখন তুলে নিয়ে সেটাকে ঢালের মত ব্যবহার করে। বর্শা বারকোশে বিদ্ধ হয়। তবে সেটাকে ছিন্ন করতে পারে না। ছিটকে পড়া খাবারের উষ্ণ চটচটে সুরুয়ার ভিতরে গড়িয়ে একপাশে সরে যাবার সময়ে সে বারকোশটা ফেলে দিয়ে বর্শার হাতল ধরে মোচড় দেয় এবং হানিফ খানের হাত থেকে সেটা টেনে নেয়।

বিন্দুমাত্র দমে না গিয়ে হানিফ খান, লাফিয়ে পেছনে সরে গিয়ে কোমরের পরিকর থেকে একটা সরু খঞ্জর টেনে বের করে। আলমগীর কোথায় পড়েছে সেটা দেখার সময় নেই বাবরের, হাতের বর্শাটা দিয়ে সে লোকটাকে সজোরে আঘাত করলে ফলার মাথায় আটকানো বারকোশটা খুলে পড়ে। আর একই সময়ে, নিজের গালে সে একটা তীক্ষ্ণ ব্যাথা অনুভব করে। হানিফ খান বাবরের গলা লক্ষ্য করে খঞ্জরটা চালিয়েছিলো কিন্তু লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে। বাবর এবার বশার ফলাটা সজোরে তাকে লক্ষ্য করে আঘাত করে হানিফ খান একপাশে ঘুরে আঘাতটা এড়াতে চেষ্টা করে। কিন্তু ফলাটা তাকে বামদিকে স্পর্শ করলে সে টেবিলের পাশে রাখা শক্ত কুশনের উপরে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। বাবর এবার বর্শাটা মোচড় দেয় এবং মুহূর্ত মাত্র চিন্তা না করে প্রতিপক্ষের কণ্ঠনালী লক্ষ্য করে সজোরে বর্শাটা নামিয়ে এনে গালিচার উপরে তাকে গেথে ফেলে। যা অচিরেই ফিনকি দিয়ে রক্তে ভিজে লাল হয়ে যায়।

ইতিমধ্যে ওয়াজির খান, বাইসানগার আর বাকী লোকেরা এসে তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে তার সাহসিকতার জন্য তাকে শুভেচ্ছা জানায়। দূর্গটা এখন তাদের দখলে। ফারগানা উদ্ধারের বন্ধুর পথে সে মাত্র প্রথম পদক্ষেপটা সাফল্যের সাথে রেখেছে। বাইরে বের হয়ে এসে বাবর দেখে আবার তুষারপাত শুরু হয়েছে। শত্রুর পড়ে থাকা দেহের চারপাশের লাল রঙ ইতিমধ্যে অনেকটাই ঢাকা পড়েছে। একটু আগে তামবালের চামচার ভবলীলা সে যেভাবে সাঙ্গ করেছে, সেভাবে পালের গোদাটাকে কখন মুঠোর ভেতরে পাবে সেই মুহূর্তটার জন্য সে অধীর হয়ে রয়েছে।

*

আর এভাবেই পুরো ঘটনাটার সূচনা হয়। বাবর একজন হানাদারে পরিণত হন। ঝটিকাবেগে আক্রমণ করেন এবং ফিরে যাবার সময় প্রতিবারই মৃত শত্রুর কারো একজনের মুখে রক্ত দিয়ে নিজের নাম লেখা একটা কাগজ গুঁজে দিয়ে যান। আর তার সাফল্য ক্রমশ বাড়তে থাকে। তার বাহিনীর সংখ্যা, মিষ্টি কথা আর মধুর প্রতিশ্রুতি, সেই সাথে শক্তি বা তার অভিযানে প্রাপ্ত সম্পদের বিচক্ষণ ব্যবহার নতুন সমর্থকদের আকৃষ্ট করে এবং প্রতিপক্ষকে দলে টেনে, ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায়। মাটির দূর্গ দখলের বিশ মাসের মধ্যে, নিষ্ঠা আর একাগ্রতার সাথে একটার পরে একটা ছোট দূর্গ আর গ্রামের পর গ্রাম দখল করে ফারগানার পশ্চিমাঞ্চলের অধিকাংশই সে দখল করে নেয়। তার কৌশল কার্যকরী বলে প্রতীয়মান হয়। তামবাল আকশির উত্তর বা পশ্চিমে বাবরের শক্ত ঘাঁটির দিকে বেশিদূর অগ্রসর হবার মতো সাহস দেখায় না। আর বাবরও মনে করে এবার সময় হয়েছে নিজের দাবির কথা প্রকাশ করবার।

 প্রথম দাবিটা সে ছয়মাস আগে জানায় এবং তারপরে প্রায়শই তার পুনরাবৃত্তি করেছিলো তার আম্মিজান, নানীজান আর বোনের মুক্তির বদলে এক বছর আকশি দূর্গ আক্রমণ না করবার প্রতিশ্রুতি। তিনমাস আগে তামবাল এক বার্তাবাহকের মাধ্যমে প্রেরিত এক চিঠিতে অনেক মধুর ভাষায় জানায় এসান দৌলত, খুতলাঘ নিগার আর খানজাদা প্রত্যেকেই সুস্থ আছে এবং শাহী পরিবারের উপযুক্ত ব্যবহারই করা হচ্ছে তাদের সাথে। কিন্তু চিঠিতে সে তাদের মুক্তি দেবার তার কোনো অভিপ্রায়ের কথা উল্লেখ করেনি।

 বাবর এখন পূর্বদিকে পঞ্চাশ মাইল দূরে অবস্থিত শহর গাভার দিকে অগ্রসর হচ্ছে কিছুদিন আগে তামবাল ভাড়াটে চকরাখ যোদ্ধাদের সহায়তায় সেখানের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করেছে। সেখানে একটা হিসাব মেলানো এখনও বাকি আছে। সেখানকার দূর্গের চাকরাখ সর্দার তার সৎভাই আর তামবালকে শাহী প্রতিনিধি হিসাবে মেনে নিয়ে প্রথম আনুগত্য প্রদর্শনকারীদের অন্যতম। শহরটা দখল করলে তামবালকে আরেকটা জোরালো সঙ্কেত পাঠানো হবে যে, সময় হয়েছে বাবরের কাছে তার পরিবারকে ফেরত পাঠাবার।

এক ক্ষুদ্র নহরের পাশে সাময়িক যাত্রাবিরতি করে বাবর আর তার লোকেরা ঘোড়াগুলোকে পানি পান করার সুযোগ দেয়। ঘোড়ার দুধ থেকে তৈরি টক পনির কোনোক্রমে গলধঃকরণের ফাঁকে বাবর তাকিয়ে দেখে তার এক গুপ্তদূত ঘোড়ায় চড়ে এগিয়ে আসছে। বাবর চমকে উঠে দেখে তার পর্যানে একটা দেহ আড়াআড়িভাবে বাঁধা রয়েছে। লোকটার দিকে দৌড়ে গিয়ে বাবর চিৎকার করে জানতে চায়, “কি হয়েছিলো? এই লোকটা কে?”

“লোকটা একটা ব্যবসায়ী। পথের পাশে পেটে তরবারির আঘাত নিয়ে নিজেরই রক্তে অর্ধচেতন অবস্থায় পড়ে থাকার সময়ে তাকে আমি খুঁজে পেয়েছি। আমি তাকে আমার ঘোড়ার পিঠে তুলে নেবার কিছুক্ষণ পরেই বেচারা মারা যায়। অবশ্য মারা যাবার আগে সে আমাকে বলেছে যে আরও তিনজন ব্যবসায়ীর সাথে সে। এখান থেকে দশ মাইল দূরে একটা ছোট সরাইখানার উদ্দেশ্যে যাবার পথে তারা চকরাখ হানাদারদের হামলার শিকার হয়। তার তিন সঙ্গীকে হত্যা করে তাকেও মৃত ভেবে তাদের সব মালপত্র নিয়ে তারা চলে গেছে।”

 “চকরাখ হানাদারদের অবশ্যই খুঁজে বের করে তার হত্যার আমরা বদলা নেবো। তোমার অধীনস্ত কয়েকজন গুপ্তদূতকে হত্যাকারীদের খুঁজতে পাঠাও।”

 “সুলতান, আমার মনে হয় না তার কোনো দরকার আছে। বণিক লোকটা মারা যাবার আগে আমাকে বলেছে যে, সে চকরাখদের বলতে শুনেছে তারা সরাইখানায় যাচ্ছে, সেখানে আরও শিকার যদি তারা খুঁজে পায়…”

“তাহলে আমরা প্রথমে সরাইখানায় যাবো।”

***

গানের সুর বন্য আর কর্কশ চকরাখদের নিজেদের মতোই অনেকটা। মদের নেশায় চুরচুর হয়ে থাকা পুরুষদের কণ্ঠস্বর নতুন মাত্রায় উঠে এমন সব অশ্লীল ক্রিয়াকলাপের বর্ণনায় মেতেছে যা একাধারে শারিরীকভাবে অসম্ভব আর মোটাদাগের যে বাবর চেষ্টা করেও হাসি চাপতে পারে না। সে আড়চোখে ওয়াজির খানের দিকে তাকিয়ে দেখে সেও হাসছে।

লম্বা ঘাসের আড়ালে বাবর তার চারপাশে শুয়ে থাকা লোকদের ইশারা করে। সবাই। তারমতো পেটের উপরে ভর দিয়ে শুয়ে আছে, লুকিয়ে অপেক্ষা করছে। তারপরে সে গুঁড়ি মেরে মাটির ইট দিয়ে তৈরি একতলা সরাইখানার দিকে এগিয়ে যায় যেটা ফারগানার অন্যতম খরস্রোতা একটা নদীর অগভীর অংশের পাড়ে অবস্থিত। যেখানে হল্লাবাজেরা মচ্ছবে মেতেছে। নূপুরের নিক্কন ধ্বনি ভেসে আসতে বোঝা যায় ভেতরে বাইজি মেয়েরাও আছে। সেই সাথে কুপিত নারী কণ্ঠের সহসা একটা তীক্ষ্ণ চিৎকার আর তার সঙ্গে ভেসে আসে- পুরুষ কণ্ঠের অট্টহাসি।

দুপুর মাত্র অতিক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু বিশজন বা তার কিছু বেশি চাকরাখরা ইতিমধ্যেই বেহেড মাতাল হয়ে পড়েছে। তারা এমনকি তাদের ঘোড়াগুলিকে ঠিকমতো বাঁধার কষ্টও করেনি এবং কিছু ঘোড়া, যাদের কেশর পুরু আর লেজ এতো লম্বা যে মাটিতে ঘষা খাচ্ছে, ইতিমধ্যেই ছুটে পালিয়েছে। চারো ব্যবসায়ীর কাছ থেকে লুট করা মালামালও তারা ভিতরে নিয়ে যাবার গরজ দেখায়নি। বণিকদের মালবাহী ধুসর খচ্চরগুলো দড়ি দিয়ে একত্রে বাঁধা এবং মনোযোগ দিয়ে চরে বেড়াচ্ছে। তাদের পিঠে আটকানো বেতের ঝুড়িগুলো দেখে মনে হয় এখনও চামড়া আর লোমে ঠাসা। চাকরাখরা মনে হয় কেবল মদের পিপে নিয়ে সরাইখানার ভিতরে প্রবেশ করেছে।

বর্বর অসভ্য, বাবর ভাবে। তাদের কপালে আজ কি লেখা আছে সেটা এখনই ব্যাটারা টের পাবে। আর এই ভাবনাটা তাদের উৎফুল্ল করে তোলে। লম্বা ঘাসের উপরে মাথা তুলে বাবর চারপাশে তাকায়। কিন্তু কাউকে দেখতে পায় না। সে ঠিক যেমনটা ভেবেছিলো, ঘোড়া বা মালামাল দেখার জন্য বাইরে কোনো বাচ্চাকে রাখার কথা ব্যাটাদের মাথাতেই আসেনি। সে এবার উঠে দাঁড়িয়ে, গুটিগুটি পায়ে সরাইখানার নীচু প্রবেশদ্বারের ডান দিকে মোটা দেয়ালের গায়ে জানালার মতো দেখতে একটা ফাঁকা জায়গার দিকে এগিয়ে গিয়ে ভেতরে সতর্কতার সাথে উঁকি দেয়। ঘরটা প্রায় খালি, কেবল ভেতরের দেয়ালের গায়ে ঠেকানো অবস্থায় একটা লম্বা কাঠের টেবিল দেখা যায়। কয়েকটা তেপায়া টুল আর একটা আধ ভাঙা বেঞ্চি দেখা যায়। ঘরের মাঝে মোটাসোটা, বোচা-নাকের একটা মেয়ে পরনে রঙচটা হলুদ রঙের ঢোলা সালোয়ারের উপরে লাল ফুলের ছাপ দেয়া একটা আঁটোসাঁটো কামিজ, পায়ে আর হাতের কব্জিতে ঘুঙুর বাঁধা। নীল সালোয়ার কামিজ পরিহিত লম্বা আরেকটা মেয়ে তার নোংরা হাতে একটা খঞ্জনী, বর্গাকার পাথরের মেঝের উপরে খালি পায়ে সজোরে পদাঘাত করে বৃত্তাকারে আবর্তিত হচ্ছে। সে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই চকরাখদের কয়েকজন, ভেড়ার চামড়ার তৈরি টুপির নিচে তাদের গোলাকার মুখ ঘামে ভিজে আছে, টলোমলো পায়ে মেয়েদের বুকে পাছায় বৃথা চেষ্টা করে থাবা দিতে এবং মুখ থুবড়ে মাটিতে আছড়ে পড়লে তাদের সঙ্গীসাথীদের উদ্দীপনা আরও বেড়ে যায়।

এক কোণে ধোঁয়া উঠতে থাকা অগ্নিকুণ্ডের উপরে বিশাল একটা কেতলি ঝুলতে দেখা যায়। আরেক কোণে, বাবর এক চকরাখ দুবৃত্তকে কাপড় খুলে ব্যস্ত ভঙ্গিতে হাল্কা হতে দেখে, দুর্গন্ধে তার সঙ্গীসাথীদের আপাতভাবে কোনো অসুবিধা হয় না। আরেক বদমাশ উঠে দাঁড়িয়ে হলুদ বমি বৃত্তচাপ তৈরি করে ছুঁড়ে ফেলে আবার বসে পড়ে আর মনোযোগ দিয়ে জামার হাতায় পড়া বমির ফোঁটা বড়বড় নখ দিয়ে টুসকি দেয়। বাবর পুনরায় মাথা নামিয়ে নেয়। সে যা দেখার তা দেখে নিয়েছে।

 মাটিতে গুঁড়ি দিয়ে সে পুনরায় ওয়াজির খান যেখানে আছে সেখানে ফিরে আসে। “মদ্যপ আহাম্মকগুলো আমাদের হাতে মারা যাবার জন্য মুখিয়ে রয়েছে। ব্যাটারা তাদের তরবারি আর ঢাল পর্যন্ত দরজার কাছে স্তূপ করে রেখেছে।”

 ওয়াজির খানের একটা ক্ৰ উপরে উঠে যায়। “সুলতান, এখনই?”

“হ্যা!”

 বাবর আর ওয়াজির খান উঠে দাঁড়িয়ে তাদের লোকদেরকেও উঠে দাঁড়াবার ইশারা করে। তারা এই কাজটা আগে এতোবার করেছে যে, মৌখিক আদেশের আর কোনো প্রয়োজন হয় না। ঠোঁটের উপরে আঙ্গুল চেপে, ওয়াজির খান ইশারায় ঘুরে কয়েকজনকে সরাইখানার পেছনে যেতে বলে। যদি সেখান দিয়ে পালাবার কোনো পথ থেকে থাকে। তারপরেই কেবল বাবর তার প্রিয় রণহুঙ্কারে চারপাশ প্রকম্পিত করে: “ফারগানা!”

 বাবর একেবারে সামনে থেকে তার লোকদের নেতৃত্ব দেয়। মদের নেশায় মাতাল আর বিস্ময়ে আড়ষ্ঠ চকরাখরা সামান্যই প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে। বাবর আর তার লোকেরা নির্মমভাবে প্রতিপক্ষের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়লে বোঁচা-নাকের সেই মেয়েটার কাছ থেকেই কেবল বলার মতো প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। মেয়েটা তার কাচুলির ভিতর থেকে একটা খঞ্জর বের করে এবং বাবরের বাহুতে সেটা মরিয়া ভঙ্গিতে গেথে দিতে চাইলে, বাবর অনায়াসে তার ঘুঙুর পরা হাতের কব্জি ধরে এবং তাকে ঘুরিয়ে দিয়ে তার নধর নিতম্বে বুট দিয়ে একটা সপাট লাথি বসিয়ে দিতে বেচারী ছিটকে দূরে গিয়ে পড়ে।

কয়েক মিনিটের ভিতরে সবকিছু শেষ হয় এবং বাবরের লোকদের হাঁপিয়ে ওঠার আগেই নিজেদের তরবারির ফলা পরিষ্কার করে কোষবদ্ধ করতে দেখা যায়। তার লোকদের গায়ে একটা আঁচড়ও লাগেনি। অবশ্য তার লোকদের সবাই পোড়খাওয়া যোদ্ধা, এসব মদ্যপ মাতালদের চেয়ে অনেক দক্ষ লোকদের সাথে তারা আগে লড়াই করেছে। “লাশগুলো বাইরে নিয়ে যাও দেখা যাক আমরা কাদের হত্যা করেছি,” বাবর আদেশটা দিয়ে কৃতজ্ঞচিত্তে দ্রুত পূতিগন্ধময়, ধোঁয়াটে ঘরটা থেকে বাইরের খোলা বাতাসে বের হয়ে আসে।

 তার লোকেরা চকরাখদের লাশগুলি তাদের বুট-পরা পা ধরে হেঁচড়ে বাইরে এনে সারিবদ্ধভাবে সাজালে, বাবর লাশগুলো শুনে দেখে। মোট পনেরটা লাশ। কারো গলা দুভাগ হয়ে আছে, কোনোটা আবার কবন্ধ। তার লোকেরা অবশ্য কাটাপড়া মাথাগুলো সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছে। কোনোটার মাথায় তখনও ভেড়ার চামড়ার টুপি রয়েছে। কাটা মুণ্ডগুলোর দিকে তাকিয়ে যখন বাবর একটা বিশেষ মুখ চিনতে পারে, তখন তার মুখ থেকে সন্তুষ্টিসূচক একটা শব্দ ধ্বনিত হয়। তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে এমন সব চকরাখকে সে হত্যা করবে বলে মনস্থ করেছে। এবং প্রতিটা হত্যাযজ্ঞ যা তাকে তার লক্ষ্যের নিকটবর্তী করছে প্রচণ্ড তৃপ্তিদায়ক।

 তারস্বরের চিৎকার শুনে বাবর ঘুরে তাকায়। তার দু’জন যোদ্ধা বাইজি মেয়েদের ধরে তাদের টেনে সরাইখানার বাইরে বের করে আনে। “তাদের উপরে বল প্রয়োগ করবে না। আমার আদেশ তোমরা জানেনা। অর্থের বিনিময়ে যদি তারা স্বেচ্ছায় তোমাদের সঙ্গ দিতে রাজি হয় তবে সেটা আলাদা কথা।” কথাটা বলে বাবর আবার ঘুরে দাঁড়ায়।

দেখা যায় মেয়েগুলো আদতেই ব্যবসায়ী এবং কয়েক মুহূর্তের দ্রুত আলোচনার পরে, সরাইখানার পেছনের এক আপেল বাগিচায় তারা তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যায়। বাবর ধারণা করে বাইজি দু’জন সরাইখানার শকুনের মতো দেখতে মালিকের মেয়ে হবে। যে ঝামেলার গন্ধ পাওয়া মাত্র সেই যে টেবিলের তলায় গিয়ে ঢুকেছে তারপরে আর বের হবার কথা চিন্তাও করেনি। আপেল বাগিচায় শীঘ্রই বাবরের লোকদের দল বেঁধে আসা যাওয়া করতে দেখা যায়। বাগান থেকে হাসিমুখে তাদের বের হয়ে আসা দেখে বোঝা যায় মেয়ে দু’জন তাদের বাবার সরাইখানায় আসা। অতিথিদের খেদমত করতে ভালোই অভ্যস্ত।

 ওয়াজির খান ইতিমধ্যে চকরাখদের পালিয়ে যাওয়া ঘোড়াগুলো ধরে আনবার বন্দোবস্ত করেছেন এবং বণিকদের কাছ থেকে লুট করা মালপত্রগুলো পর্যবেক্ষণ। করছেন। “সুলতান, দেখেন,” দুটো উজ্জ্বল বর্ণের গালিচা বের করে সে বাবরের। দৃষ্টি সেদিকে আকর্ষণ করে। গালিচা দুটোর জেল্লা দেখে বোঝা যায় তন্তুবায়ের দল। সেটা বুননের সময়ে রেশমের সাথে উলের মিশ্রণ ঘটিয়েছে আর গালিচাগুলোর নকশাও অপরিচিত- বণিকের দলটা সম্ভবত পূর্বের, কাশগর থেকে এসেছিল। যেখানের তাঁতিরা এ ধরণের গালিচা তৈরিতে দক্ষ। উল আর চামড়া বেচে ভালো অর্থই পাওয়া যাবে, বাবর ভাবে, যা দিয়ে তার লোকদের সে বকেয়া বেতন দিতে পারবে।

তার যোদ্ধাদের জন্য একটা ভোজসভার আয়োজন করলে মন্দ হয় না। তারা ভালো। কাজ দেখিয়েছে এবং তারও উচিত এর মূল্যায়ন করা। পশ্চিমে, শাহরুখিয়ায় ফিরে যাওয়া মাত্রই সে এই ভোজসভার ঘোষণা দেবে। সেখানে, ছয়মাস আগে। তামবালের কাছ থেকে সে দূৰ্গটা ছিনিয়ে নিয়েছে এবং নিজের ঘাঁটিতে পরিণত করেছে। সমরকন্দে খুন হবার আগে শাহরুখিয়ার সর্দার আলি মজিদ বেগের পূণ্য স্মৃতির প্রতি তারা তাদের শ্রদ্ধা জানাবে। তারা তার উপযুক্ত সন্তানের আত্মার মাগফেরাত কামনা করবে। যে তামবালের চকরাখ যোদ্ধাদের হাত থেকে দূর্গটা রক্ষা করতে গিয়ে শহীদ হয়েছে। আলি মজিদ বেগের নিহত হবার সংবাদ ফারগানায় পৌঁছানো মাত্র তামবাল দূর্গটা দখল করতে তাদের পাঠিয়েছিলো।

নিজের বিশ্বস্ত সর্দারের কথা মনে পড়তে বাবরের ভাবনা বিষণ্ণ হয়ে উঠে। আজকাল তার প্রায়ই এমন হচ্ছে। সবুজাভ-নীল তোরণদ্বারে আলি মজিদ বেগের মৃতদেহ প্রদর্শিত হবার পরের দু’বছরে সে কি অর্জন করেছে? নিজের পরিবারকে মুক্ত করার ব্যাপারে বা ফারগানা পুনরায় অধিকার করার ব্যাপারে সে কতটা অগ্রসর হয়েছে, সমরকন্দের কথা না হয় সে বাদই দিল? আর কতদিন তাকে সালতানাৎবিহীন একজন সুলতান হিসাবে দিন কাটাতে হবে? আকশি আক্রমণ করে তার পরিবারকে মুক্ত করে সিংহাসন পুনরুদ্ধার করার মতো একটা সেনাবাহিনী গঠন করা একটা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। আর সমরকন্দ, সেখানে শাসক হিসাবে কাটানো কয়েকটা দিন এখন কেবল ধূসর স্মৃতি। মাঝে মাঝে তার বিশ্বাস করতেই কষ্ট হয় যে এমন কিছু আসলেই ঘটেছিলো। গ্রান্ড উজিরের কথাই শেষ পর্যন্ত সত্যি হলো।

ভাবনাটা বাবরকে ক্রুদ্ধ করে তোলে। সে তার পায়ের কাছে পড়ে থাকা একটা কর্তিত মস্তকে লাথি বসিয়ে দিলে সেটা ছিটকে দূরে গিয়ে পড়ে। তার লোকদের যেমন, তারও বিনোদনের দরকার আছে। কয়েকটা ডাল কেটে পোলো খেলার লাঠি তৈরি করো।” সে চিৎকার করে বলে। “এইসব দুবৃত্তদের মাথা দিয়ে পোলো খেলা যাক। গোলপোস্ট হবে ঐ দূরের গাছগুলো।”

পুরো একটা ঘণ্টার জন্য, উদ্দাম খেলায় বাবর নিজেকে ডুবিয়ে রাখে। চকরাখদের ক্ষিপ্রগামী টাটুঘোড়ার একটা নিয়ে সে একেবেঁকে দাবড়ে বেড়ায় এবং শাখাপ্রশাখা ছেটে ফেলা গাছের ডাল দিয়ে ছিন্ন মস্তকগুলোকে সজোরে আঘাত করে। যাতে ঘাসের উপর দিয়ে লাফাতে লাফাতে সেগুলো গড়িয়ে যায়। শীঘ্রই সেগুলোকে আর কাটা মাথা বলে চেনার কোনো উপায় থাকে না- নাক, কান গুঁড়িয়ে যায়, অক্ষিকোটর থেকে অক্ষিগোলক বের হয়ে আসে এবং বাবর আর তার ঘর্মাক্ত সাথী খেলোয়াড়েরা আর সেই সাথে তাদের সবার ঘোড়া, রক্তের ফুটকিতে চিত্রিত হয়ে উঠে।

 অবশেষে খেলাটার প্রতি তার বিরক্তি জন্মায় কিন্তু ভেতরের জমে ওঠা হতাশা আর ক্ষোভ নিঃসৃত হওয়ায়, বাবর ঘামে ভিজে ওঠা ঘোড়াটাকে অবশেষে রেহাই দেয়। চারপাশে তাকাতে সে দেখে ওয়াজির খান তার দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। এই প্রথম সে তার চোখে বিরক্তি দেখতে পায়। কিন্তু বাবর তাতে বিন্দুমাত্র লজ্জি বোধ করে না। জীবিত বা মৃত, সে তার শত্রুদের সাথে তাদের প্রাপ্য ব্যবহারই করেছে।

 “চলো এবার যাওয়া যাক।” সে আদেশ দেয়। “গাভা এখনও অনেক দূরে, আর আমাদের গৃহকর্তাকে অপেক্ষা করিয়ে রাখাটা ঠিক হবে না।” বাবর ঘোড়ার পাঁজরে এত জোরে খোঁচা দেয় যে সেটা ছুটতে শুরু করে। বাবর সরাইখানা থেকে সোজা নদীর অগভীর অংশের দিকে এগিয়ে যায়।একবারও পেছনে ফিরে তাকায় না। আঙ্গিনায় পড়ে থাকা রক্তাক্ত মাথাগুলোকে ইতিমধ্যে কাকের দল ঠোকরাতে শুরু করেছে এবং সরাইখান মেয়ে দুটো পা ঈষৎ ধনুকের মত ফাঁক করে এগিয়ে গিয়ে চকরাখদের লাশগুলো হাতিয়ে দেখে যে বাবরের লোকেরা ভুলে কিছু রেখে। গেছে নাকি, যা তাদের বেশ্যাবৃত্তির পাওনার উপরি বলে বিবেচিত হতে পারে।

***

তিন সপ্তাহ পরে। উঁচু পাহাড়ী এলাকার তৃণভূমির উজ্জ্বল সবুজ ঘাসের মাঝে মাঝে ফুটে থাকা হলুদ গোলাপী আর সাদা ফুলের মাঝ দিয়ে বাবর আর তার লোকেরা দুলকি চালে ঘোড়া দাবড়ে শাহরুখিয়ার দিকে এগিয়ে যায়। গাভার অভিযানে ক্ষয়ক্ষতি হলেও তারাই জয়ী হয়েছে। তিনশ গজ দূরে ঘোড়ার পিঠে বসে থাকা অবস্থায় বাবর নিজে তীর ছুঁড়ে দূর্গের সেনাপতিকে হত্যা করেছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তার নিজের ব্যবহৃত ছোট নিখুঁতভাবে বাঁকানো ধনুক দিয়ে তীর ছোঁড়ার অভ্যাসে কাজ হয়েছে। ত্রিশটা শর ভর্তি তূণীর সে এক মিনিটের ভিতরে খালি করে ফেলতে পারে।

সেনাপতি মারা যাবার পরে, প্রতিরোধকারীদের মনোবল ভেঙে যায়। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সেনানিবাসের সৈন্যরা কেবল আত্মসমর্পনই করেনি, নিজেদের লুটের মাল পুরো তাদের হাতে তুলে দিয়েছে। যা বাবর আর তার লোকদের ঘোড়ার পিঠে ঝোলানো চামড়ার থলির উপচে পড়া আকৃতি সাক্ষ্য দিচ্ছে।

 ওয়াজির খান খুব খুশি হবে। এবারের অভিযান বাবরকে তার বুড়ো বন্ধুটির সহায়তা ছাড়াই পরিচালনা করতে হয়েছে। সরাইখানা আক্রমণ করার পরের দিন ওয়াজির খানের ঘোড়া সাপের ভয়ে বেমাক্কা লাফিয়ে উঠতে সে পড়ে গিয়ে উরুতে ব্যথা পেয়েছিলো। বাবরের সনির্বন্ধ অনুরোধে তিনি শাহরুখিয়ায় ফিরে যেতে রাজি হন বাইসানগারের সাথে যোগ দিতে, যাকে তারা সেখানের নিরাপত্তার দায়িত্ব দিয়ে এসেছে।

আজ রাতে তারা বিজয় উদযাপন করবে। সে তার লোকদের সম্মান জানাতে তাদের মাঝে উলুশ বিতরণ করবে। যোদ্ধাদের ভিতরে যারা সবচেয়ে সাহসিকতা আর বীরত্ব প্রদর্শন করেছে প্রথা অনুযায়ী আজ সে ভোজসভার শেষে তাদের মাঝে লুটের মালের সিংহভাগ বিলিয়ে দেবে এবং বাইসানগার আর ওয়াজির খানকে গাভা আক্রমণের কাহিনী শোনাবে। তার গল্প শুনে ওয়াজির খান সম্ভবত হেসে অস্থির হবেন এবং সদা গম্ভীর বাইসানগারের মুখেও সে আজ হয়তো হাসির আভাস দেখতে পাবে।

 পাথরের তৈরি দূর্গের অভ্যন্তরস্থ প্রাঙ্গনে প্রবেশের সাথে সাথে, বাবর তার ঘোড়ার পিঠ থেকে লাফিয়ে নেমে তাদের খোঁজে আশেপাশে তাকায়। বাইসানগারকে সে কোথাও খুঁজে পায় না। কিন্তু ওয়াজির খানকে আস্তাবলের সামনে দাঁড়িয়ে ঘোড়ার খুরের উপরের আর পেছনের অংশের কেশগুচ্ছ পর্যবেক্ষণ করতে দেখে। তার বুড়ো বান্ধবকে সামান্য খোঁড়াতে খোঁড়াতে তার দিকে এগিয়ে আসতে দেখলে: বাবর ভ্রূ কোঁচকায়। তারপরে সে তাকিয়ে দেখে ওয়াজির খানের মুখ আনন্দে আলোকিত হয়ে রয়েছে।

 “সুলতান, দারুণ সুখবর আছে! সত্যিই চমকে দেবার মত সুখবর!”

 “কি হয়েছে?”

 “এক সপ্তাহ আগে আকশি থেকে এক বার্তাবাহক এসেছে। আপনার সৎ-ভাই জাহাঙ্গীরের পক্ষে তামবালের বাণী নিয়ে সে এসেছে। অন্তত বার্তাবাহকের তাই ভাষ্য এবং সে বলেছে তারা আপনার আম্মিজান, নানীজান আর আপনার বোনকে আপনার কাছে পাঠাতে সম্মত আছেন।”

 “সে কি এর বিনিময়ে কিছু দাবি করেছে?”

 “সুলতান, প্রকাশ্যে তারা কিছু দাবি করেনি। আপনাকে সে কতোটা শ্রদ্ধা করে কেবল সে সম্পর্কে কিছু মধুর বাক্য ছাড়া।”

বাবরের হৃৎপিণ্ড আনন্দে নেচে উঠে। তার পরিবার শীঘ্রই তার সাথে মিলিত হবে। এই খবরটা আবার তাকে আবেগতাড়িত করে তোলে।

 “তারা এখানে কবে নাগাদ পৌঁছাবে?”

“সবকিছু ঠিক থাকলে আগামীকাল সূর্যাস্ত নাগাদ তাদের এখানে পৌঁছাবার কথা।”

 পরের দিন সন্ধ্যাবেলা, গোধূলির অস্তমিত আলোয় বাবরকে দূর্গের প্রকারবেষ্টিত সমতল ছাদে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। আজকের দিনের অধিকাংশ সময় সে এখানেই কাটিয়েছে। অস্থিরচিত্তে রাস্তাটা যেখানে একটা গিরিখাদের দিকে বাঁক নিয়েছে, সেদিকে চোখ কুঁচকে তাকিয়ে রয়েছে। ঘনায়মান আধো-অন্ধকারের ভিতর থেকে সে পিঠের দুপাশে ঝুড়ি ঝুলছে উটের এমন একটা তরঙ্গায়িত সারিকে বাঁক ঘুরে এগিয়ে আসতে দেখে। তাদের ঠিক পেছনেই রয়েছে যাত্রার শেষ পর্যায়ে মেয়েদের অভ্যর্থনা জানাতে। আর তাদের নিরাপদে দূর্গে নিয়ে আসবার জন্য, ওয়াজির খানের পরামর্শে, বাইসানগারের অধীনে পাঠানো সৈন্যবাহিনীর একটা চৌকষ দল।

বাবর এতদূর থেকে ঝুড়িতে ভ্রমণকারীদের চেহারা দেখতে পায় না। নিজেকে আর সামলে রাখতে না পেরে, এবং দেহরক্ষীদের কাউকে ডাকবার বা ঘোড়ার পিঠে জিন চাপাবার মতো ধৈর্যের মারাত্মক অভাব দেখা দেয়ায়, সে লাফিয়ে একটা খালি ঘোড়ার পিঠে চেপে বসে এবং সবুজ ঘাসে আচ্ছাদিত তৃণভূমির উপর দিয়ে ছোট কাফেলাটার দিকে ছুটে যায়।

তার রোদে পোড়া গাল বেয়ে দরদর করে কান্না ঝরতে থাকে। কিন্তু সেসব সে মোটেই পরোয়া করে না। আশেপাশে কেউ নেই তার কান্না দেখবার মতো এবং তার চেয়েও বড় কথা, দেখলে দেখুক সে থোড়াই পরোয়া করে। দুর্বলতার না, আজ এটা আনন্দের অশ্রু। এক হাতে ঘোড়ার কেশর আঁকড়ে ধরে সে অন্য হাতে গাল থেকে কান্না মুছে। বাবর ঘোড়াটার কানে কানে তাকে এমন গতিতে ছুটতে বলে, যাতে মনে হয় হঠাৎ তার পাখা গজিয়েছে।

কাফেলাটাকে পাহারা দিয়ে নিয়ে আনা সৈন্যদের থেকে চারজন সহসা আলাদা হয়ে বর্শা নিচু করে তার দিকে এগিয়ে আসে। যদিও বাইসানগার সম্ভবত ধারণা করতে পেরেছিলো খালি ঘোড়ার পিঠে এমন উদ্দাম ভঙ্গিতে কে তাদের দিকে ছুটে আসছে। কিন্তু তার মত অভিজ্ঞ পোড়খাওয়া যোদ্ধা তার কাছে এটাই প্রত্যাশিত যে সে নিজের লোকদের আদেশ দিয়েছে তার পরিচয় নিশ্চিত করতে। অশ্বারোহী দল নিকটবর্তী হতে, বাবর জোর করে নিজের ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে তাকে থমকে দাঁড়িয়ে পড়তে বাধ্য করে। ঘামে জবজব করতে থাকা দেহে নাক ঝেড়ে নিজের বিরক্তি প্রকাশ করে ঘোড়াটা।

 বাবর মাথাটা পেছনে হেলিয়ে দিয়ে তার পূর্বপুরুষের রণহুঙ্কার কণ্ঠে তুলে নেয়। “ফারগানা!”

 অশ্বারোহী দল এখন আরো কাছে চলে আসায় তারা তাকে চিনতে পেরে অভিবাদন জানায়। বাবর কোনোমতে তাদের অভিবাদনের জবাব দিয়ে উটের কাফেলা যেখানে যাত্রা বিরতি করেছে সেদিকে ঘোড়া ছোটায়। তার হৃদয় যদি আবেগে ভারাক্রান্ত না থাকত অন্যসময় হলে তাহলে সে হয়তো বাজারে নিয়ে যাওয়া মুরগীর মতো ভীরু ভঙ্গিতে বেতের ঝুড়ির ভিতর থেকে এসান দৌলতের উঁকি দেবার হাস্যকর ভঙ্গি দেখে হয়তো হেসেই ফেলতো। তার ওজন এতোটাই হাল্কা যে অন্যপাশের ঝুড়িতে ভারসাম্য রক্ষার জন্য বাঁধাকপির চেয়ে ভারী কিছু রাখতে হয়নি। আর তার বীণা ঝুড়ির বাইরে চামড়ার ফালি দিয়ে আটকানো রয়েছে। একটা বিশাল পুরু লোমের দুধসাদা রঙের উট যা বাবরকে এগোতে দেখে পচাৎ করে থুতু ফেলে সেটার দু’পাশে দুটো ঝুড়িতে খুতলাঘ নিগার আর খানজাদা আরোহন করেছেন। উটের পেছনে বাবর তার আম্মিজানের পরিচারিকা দলের কয়েকজন পরিচিত সদস্য, যাদের ভিতরে ফাতিমাও রয়েছে আর তার উজির কাশিমকে দেখতে পায়।

উটের চালকরা লাফিয়ে নেমে, উটের গ্রন্থিযুক্ত হাঁটুতে তাদের হাতের লাঠি দিয়ে আঘাত করে উটগুলোকে বাধ্য করে মাটিতে বসতে। বয়োবৃদ্ধ হবার কারণে, বাবর দৌড়ে প্রথমে এসান দৌলতের কাছে যায় এবং হাঁটু মুড়ে বসে তাকে আলতো করে ঝুড়ি থেকে তুলে আনে। বাবর কোনো কথা খুঁজে পায় না, আর এই প্রথমবারেরমতো মুখরা এসান দৌলতও বাক্যহারা হয়ে পড়েন। সে টের পায় নানীজান তার মাথা আলতো স্পর্শ করেন। সে উঠে দাঁড়িয়ে তার ছোট ছোট উজ্জ্বল চোখের দিকে তাকালে সেখানে তার পুরানো সত্ত্বার ঝলক দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। নানীজানকে এখন তিনি বরাবর যার জন্য গর্ব করেন,সেই খামের- চেঙ্গিস খানের রক্তের উত্তরসুরী এক নারীর মতোই দেখাচ্ছে।

সে এবার ঘুরে দাঁড়িয়ে তার আম্মিজানকে ঝুড়ি থেকে তুলে মাটিতে নামিয়ে দেয় এবং তাকে জড়িয়ে ধরে তার আশৈশব পরিচিত চন্দনকাঠের উষ্ণ সুগন্ধে বুক ভরে শ্বাস নেয়। সে তার আলিঙ্গন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে তাকিয়ে দেখে আম্মিজানের চোখে অশ্রু টলটল করছে। “বাছা তোমাকে আবার দেখতে পেয়ে খুশি হলাম,” কোনো রকমের আবেগ না দেখিয়ে তিনি বলেন, এবং তার মুখে একটা হাসির আভাস ফুটে উঠে যা বাবরের যেমনটা মনে আছে তার চেয়েও ম্লান এবং বলিরেখায় আকীর্ণ।

 খানজাদা ইতিমধ্যে তাকে বহনকারী ঝুড়ি থেকে নিজেই ধড়ফড় করে নেমে এসেছে। এবং সে সোজা ভাইকে লক্ষ্য করে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তার পোষা বেজী যেটা সে বামহাতে ধরে রেখেছে, কুইকুই করে প্রতিবাদ জানায়। শেষবার বাবর তার বোনকে দেখেছিলো হাড্ডিসার একটা মেয়ে, যার মুখে কয়েকটা দাগ রয়েছে। খানজাদা এখন রীতিমত একজন মহিলাতে পরিণত হয়েছে, তার দেহে ভরা নদীর জোয়ার বইছে। মুখ আগের চেয়ে অনেক দাগহীন আর সুন্দর। কিন্তু ফিচেল হাসি আগের মতোই আছে দেখে সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। সে তাকে জড়িয়ে ধরে এবং তারপরে ছেড়ে দিয়ে এক পা পিছিয়ে আসে ভালো করে তাকে দেখবে বলে।

 খানজাদাও কম যায় না সেও ভাইকে জরিপ করে। “তুমি লম্বা হয়েছে।” সে বলে, “আর তোমার কাঁধ আগের চেয়ে চওড়া হয়েছে। কিন্তু একি চেহারা হয়েছে। তোমার থুতনিতে ছাগলের মত দাড়ি আর চুলের অবস্থা যাচ্ছেতাই- তোমার চুল দেখছি আমার মত লম্বা! আর নখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না- কালো হয়ে আছে।”

বাবর পেছন থেকে, খানজাদার নাক কোঁচকানো বিশেষণগুলোর সমর্থনে এসান দৌলতকে জিহ্বা আর টাকরার সাহায্যে একটা শব্দ করতে শোনে এবং সে হেসে ফেলে। অবশেষে তার প্রিয়জনেরা তার কাছে এসেছে এবং সবকিছু যেমনটা থাকার কথা তেমনই রয়েছে। তাদের সাথে সে পরে কথা বলবে এবং শুনবে বিগত দিনগুলো তাদের কেমন কেটেছে। কিন্তু এখনকার মতো এই যথেষ্ট।

তারা দূর্গের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। অবশেষে মুক্তি লাভ করা ফারগানার শাহী রমণীদের অভ্যর্থনা জানাতে তূর্যনিনাদ আর রণভেরী গমগম আওয়াজে বেজে উঠে- অন্তত এখনকার জন্য হলেও তারা নিরাপদ।

দূর্গের উপরের তলায় প্রস্তুত রাখা জেনানামহলে মেয়েদের পৌঁছে দিয়ে, বাবর তার বঁধুনিকে ডেকে পাঠায়। তার পরিকল্পিত ভোজসভার সব আয়োজন কি অবস্থায় আছে তা জানতে। এখানের ভোজসভা সমরকন্দের মতো জাঁকজমকপূর্ণ হবে না। যেভাবে সে তাদের অভ্যর্থনা জানাতে চেয়েছিলো। অবশ্য, তাহলেও বিশটা ভেড়া জবাই করা হয়েছে আর আঙ্গিনায় সেগুলোকে আগুনে ঝলসানো হচ্ছে। মুরগীর পালক ছাড়িয়ে, আখরোট আর খুবানির সাথে মাখন দিয়ে সিদ্ধ করা হচ্ছে। আস্ত আপেল ঘন সোনালী বর্ণের মধু আর লাল রসে ভরা ডালিমের দানার সাথে কাঠবাদাম আর পেস্তার মিশ্রণে চিকচিক করছে। তাদের কোনো এক অভিযানে তার লোকদের লুট করা রূপালি বর্ণের কাঠবাদামের স্তূপের দিকে সে বিশেষ সন্তুষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে। এসান দৌলত অন্য যে কোনো মিষ্টির চেয়ে এগুলো বেশি পছন্দ করেন।

নির্মেঘ, তারা-শোভিত আকাশে চাঁদ উঠলে, এবং কোনো আকষ্মিক হামলা থেকে আগেই সাবধান করতে দূর্গপ্রাকারে সৈন্য মোতায়েন করে ভোজসভা শুরু হয়। বাবর আর তার লোকেরা নিচুলার একটা নিচু, লম্বা কামরায় আহার সারে। যখন উপরে নিজেদের কামরায় মেয়েদের তাদের পছন্দের অংশ পরিবেশন করা হয়। মোমবাতির কাঁপা আলোতে বাবরের লোকেরা উদাত্ত কণ্ঠে গান শুরু করে। বাকীরা যে নিচু কাঠের টেবিলের চারপাশে আসনসিঁড়ি হয়ে বসে আছে তাতে চাকুর বাট দিয়ে আঘাত করে তাল দেয়। বাবর ভাবে, তার লোকেরা খুশি হয়েছে। মেয়েদের মুক্তিতে তারাও প্রীত হয়েছে। তার সাথে সাথে তার লোকদেরও এটা সম্মানহানির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলো- যেনো মেয়েদের মুক্ত করার সামর্থ্য তাদের নেই।

বাবর খেতে চেষ্টা করে কিন্তু কিছুই খেতে পারে না। তার ইচ্ছা করে এখান থেকে উঠে যায় এবং তার আম্মিজান, খানজাদা আর এসান দৌলতের সাথে নিভৃতে সময় কাটায়। কিন্তু তার অনুসারীদের প্রতি সৌজন্যতাবশত তাকে আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। গানের মাত্রা ধীরে ধীরে চড়তে শুরু করে এবং ক্রমশ কর্কশ হয়ে উঠে। যোদ্ধার দল উচ্চকণ্ঠে নিজেদের পূর্বপুরুষের বীরত্বের কথা বয়ান করতে থাকে এবং বাবরও এবার তাদের সাথে কণ্ঠ মেলায়। কিন্তু অবশেষে, কেউ কেউ টেবিলের উপরে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়ে। আর অন্যেরা ঝাপসা চোখে টলোমলো পায়ে কামরা থেকে বের হয়ে বাইরের আঙ্গিনায় নিজেদের হাল্কা করতে শুরু করলে, বাবর তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে পাথরের বাঁকানো সিঁড়ি বেয়ে জেনানামহলের দিকে রওয়ানা দেয়।

 খুতলাঘ নিগার দু’হাত বাড়িয়ে দিয়ে তাকে স্বাগত জানায় এবং সে ভিতরে প্রবেশ করে গালিচা পাতা মেঝেতে তার পাশে এসে বসে। তাদের সামনের পিতলের থালায় পড়ে থাকা খাবারের অবশিষ্টাংশ দেখে সে বুঝতে পারে মেয়েরা ভালমতোই খেয়েছে। কিন্তু তারপরেও সে এখন যখন তাদের মুখের দিকে তাকায় সেখানে সে একটা টানটান অভিব্যক্তি লক্ষ্য করে। তাদের তিনজনকেই ফ্যাকাশে আর বিবর্ণ দেখায়। যেনো বহুকাল সূর্যের আলোর উষ্ণতা অনুভব করেনি বা তাজা বাতাসে তারা শ্বাস নেয়নি। কাউকে না কাউকে অবশ্যই এর মূল্য দিতে হবে- রক্ত দিয়ে। কিন্তু মেয়েদের খাতিরে আপাতত সে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করে না। তারা যাই বলুক তাকে, সে অবশ্যই সব কিছু শান্ত ভঙ্গিতে শুনবে।

 কিছুক্ষণ সবাই চুপচাপ বসে থাকে। প্রাথমিক উত্তেজনা প্রশমিত হতে, কেউই বুঝতে পারে না কোথা থেকে শুরু করা উচিত।

অবশেষে এসান দৌলত শুরু করেন: “বাবর তুমি তাহলে সরমকল দখল করেছিলে।” তার বিচক্ষণ মুখে বিরল একটা হাসির আভাস ফুটে উঠে।

“অধিকার করেছিলাম বটে, কিন্তু দখলে রাখতে পারিনি।” বাবর তার মাথা নিচু করে। এমন কিছু কথা আছে যা তাকে বলতেই হবে। “নানীজান, আমি আপনাকে হতাশ করেছি। আপনি আমার সাহায্য চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছিলেন এবং আমি সাহায্য করতে ব্যর্থ হয়েছি। আমার আসতে বড্ড দেরি হয়ে গিয়েছিল আর লোকজন ছিল অনেক অল্প।”

“আমাদের তুমি মোটেই হতাশ করনি। আর জেনে রেখো, আমাদের কারণেই তুমি সমরকন্দ হারিয়েছে। আমাদের সাহায্য করার জন্য তুমি সাথে সাথে যাত্রা করেছিলে। তুমি এরচেয়ে বেশি আর কিইবা করতে পারতে?”

বাবর আক্ষেপের সাথে মাথা নাড়ে। “ফারগানা আর আপনারা ছিলেন আমার প্রধান দায়িত্ব। সমরকন্দে আমি নতুন কোনো খেলনা হাতে পাওয়া শিশুর মতো আচরণ করেছিলাম। আমার তখন অন্য কিছু সম্বন্ধে ভাববার সামান্যই অবকাশ ছিলো। আপনাদের আর ফারগানার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য আমার উচিত ছিলো ওয়াজির খানকে পাঠিয়ে দেয়া।” সে তার মায়ের গায়ে হেলান দেয় এবং বরাবরের মতোই মায়ের আঙ্গুল তার চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে টের পায়। এতে সে কিছুটা শান্ত হয়।

“কিছু কিছু বিষয় তামবাল আমাদের কাছে কখনও গোপন করেনি।” খুতলাঘ নিগার বলেন। “আমার মনে হয় এতে সে আনন্দই পেতো। আমরা, তোমার চাচাতো ভাই মাহমুদের বিশ্বাসঘাতকতার কথা অবশ্যই জানি- আমরা জানি সেই সমরকন্দ তোমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে। বাছা, সে আর তামবাল মিলে তোমার জন্য একটা ফাঁদ পেতেছিলো। তারা দু’জনে মিলে ঠিক করেছিলো, ফারগানায় সে তোমাকে মসনদ থেকে সরিয়ে দিয়ে জাহাঙ্গীরকে তোমার স্থলাভিষিক্ত করবে। তারা জানতো এর ফলে তুমি বাধ্য হবে- তোমার বেশিরভাগ সৈন্য নিয়ে ফারগানায় ফিরে আসতে। আর মাহমুদ এর ফলে তার কাঙ্ক্ষিত সুযোগ পায়। তুমি তখন সদ্য সমরকন্দের সুলতান হয়েছে। তারা বলেছে যে সেখানকার অভিজাত ব্যক্তিরা তোমার প্রতি তেমন একটা আনুগত্য বোধ না করায়, মাহমুদ আর তার কলহপ্রিয় স্ত্রী, গ্রান্ড উজিরের কন্যা সহজেই ঘুষ দিয়ে তাদের কিনতে পেরেছে।”

 নিজের সবচেয়ে জঘন্য সন্দেহটা প্রমাণিত হতে বাবর চোখ বন্ধ করে ফেলে। কি আহাম্মকই না সে ছিলো।

“তোমার এটাও জেনে রাখা উচিত, মাহমুদের স্ত্রীর কারণে সে গো ধরায় আলি মজিদ বেগকে হত্যা করা হয়েছিলো।” এসান দৌলতের কণ্ঠস্বর তিক্ত শোনায়। নিহত গোত্রপতির মা ছিলো তার বান্ধবী আর তিনি নিজেও তাকে পছন্দই করতেন। “সে নাকি বলেছে তোমার শিরোচ্ছেদ করতে না পারায়, তাকে শিরোচ্ছেদ করলেই আপাতত চলবে- তার বাবার মৃত্যুর প্রতিশোধ হিসাবে। মাহমুদ তার কথা ফেলতে পারেনি। সবাই বলে সেই আসলে সমরকন্দের নতুন শাসক। নিজের বাবার চেয়েও সে বেশি লোভী আর প্রতিহিংসাপরায়ণ।”

বাবর বিস্ময়ে চোখ পিটপিট করে। সে ভাবতেও পারেনি সেই সুঠামদেহী তরুণী, যে এমন সাহসিকতার সাথে গ্রান্ড উজিরের প্রাণ ভিক্ষা চেয়েছিলো কিভাবে এতো অনুভূতিহীন নিষ্ঠুর আর নির্মম হতে পারে। একদিন তাকে অবশ্যই তার এই স্পর্ধার জন্য জবাবদিহি করতে হবে। কিন্তু সেটা পরেও হতে পারে। তার আগে তাকে অন্য অনেক বিষয় জানতে হবে এবং সেগুলো মেনে নিতে হবে।

সে আলতো করে দু’হাতের মাঝে মায়ের হাত জড়িয়ে ধরে। “আমাকে তোমাদের কথা বলল। তোমরা বন্দি থাকা অবস্থায় কেমন আচরণ করছে তারা তোমাদের সাথে?”

 “কয়েকজন মাত্র পরিচারকসহ আমাদের একটা ছোট জায়গায় আটকে রাখা হয়েছিলো কিন্তু আমাদের বংশ গৌরব আর মর্যাদার কারণে তারা বাধ্য হয়েছিলো আমাদের যথাযথ সম্মান দেখাতে। তামবাল আমাদের অপমান বা হুমকি দেয়নি।” তার মা বলে, “আর সম্প্রতি- সম্ভবত তোমার সাফল্যের কথা যখন সে জানতে পারে- আমাদের বড় একটা মহলে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো।”

“আর সে রোক্সানাকে আমাদের গহনা কেড়ে নিতে দেয়নি। অবশ্য অন্যদের মুখে শুনেছি সে ক্রুদ্ধ হয়ে চেঁচামেচি করেছে, যদিও সে তামবালের অঙ্কশায়িনী ছিলো।” এসান দৌলত কুপিত কণ্ঠে কথাগুলো বলেন।

 “আর আমার সৎ-ভাই জাহাঙ্গীর? এসবে তার ভূমিকা কতটুকু?” বাবর প্রায়ই তার স্থান দখল করে নেয়া বালকটার কথা ভাবে যাকে সে কখনও দেখেনি। শেষবার আকশি থেকে আসবার সময়ে, সমরকন্দ অবরোধের প্রস্তুতি নেবার সময়ে, ছোঁড়া অসুস্থ ছিলো।

 “বেচারা পরিস্থিতির শিকার, আর প্রায়ই অসুস্থ থাকে। তামবালের পুরো শরীরে কয়েক চামচ পরিমাণ রাজরক্ত থাকায় সে কখনও নিজে সিংহাসন দাবি করতে পারবে না। অন্য গোত্রপতিরা সেটা তাকে করতেও দেবে না। কিন্তু জাহাঙ্গীরের রাজপ্রতিভূ হিসাবে যে ক্ষমতার জন্য সে লালায়িত সেটা অর্জন করতে পারবে।” এসান দৌলত ভাবাবেগশূন্য কণ্ঠে কথাগুলো বলেন। “সে এখন তোমাকে ভয় পায়। সে যদি তোমাকে খুশি করতে না চাইতো, তাহলে আমাদের এতো সহজে মুক্তি দিতো না?”

 সুলতান হিসাবে বাবর নিজের প্রথম দিনগুলোর কথা ভাবে, তার মনে পড়ে তামবাল তখন কিভাবে অন্য নেতাদের মনে সন্দেহের বীজ বপনের চেষ্টা করেছে। সব সময়ে সে নিজের উচ্চাকাঙ্ক্ষা নিবৃত্ত করার চেষ্টারত ছিলো। কী সাংঘাতিক সুবিধাবাদি এক লোক- কামবার আলীর ষড়যন্ত্রে যোগ দেবার ব্যাপারে ভীষণ বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে সঠিক সময়ের জন্য ধৈর্যসহকারে অপেক্ষা করেছে। এজন্যই কি সমরকন্দ দুবার অবরোধ করতে সে তাকে প্ররোচিত করেছিলো? বাইসানগার যখন তৈমূরের অঙ্গুরীয় নিয়ে এসেছিল তখন আগ্রহে চকচক করতে থাকা তামবালের চেহারা তার এখনও মনে আছে। তার আরো মনে আছে, সমরকন্দ অধিকার করার পরে কি রকম তাড়াহুড়ো করে সে ফারগানা ফিরে এসেছিলো।

“আমাদের জন্য সবচেয়ে কঠিন সময় ছিলো প্রথম কয়েক মাস, যখন আমরা জানতাম না তোমার ভাগ্যে কি ঘটেছে। ফাতিমা- তুমি জান সে কেমন গপ্পোবাজ সে একবার একটা কথা শুনে আসে- একটা গুজব কিন্তু সেটাই আমাদের আতঙ্কিত করে তোলার জন্য যথেষ্ট ছিলো- যে তুমি ফারগানায় ফিরে আসার সময়ে পথে অসুস্থ হয়ে মারা গিয়েছে। তার মায়ের কণ্ঠস্বর কেঁপে যায়। কিন্তু তারপরেই আমরা শুনতে পাই যে তুমি সুস্থ আছো, আর পাহাড়ে আত্মগোপন করে রয়েছে। আমরা জানতাম না কোনটা সত্যি। যতদিন না তামবাল ক্রুদ্ধ হয়ে আমাদের কাছে আসে…সে আমাদের বলে তুমি গ্রামের পর গ্রাম আক্রমণ করে, সবকিছু জ্বালিয়ে দিচ্ছ, তছনচ করে দিচ্ছ এবং নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছো, কাউকে রেয়াত না দিয়ে।”

 “তামবাল যা বলেছে, সেটাই তাহলে সত্যি, তাই না বাবর? যে তুমি একজন সাধারণ দস্যু আর গরু-চোরে পরিণত হয়েছো?” এসান দৌলত প্রশ্রয়ের কণ্ঠে বলেন।

বাবর সম্মতি প্রকাশ করে মাথা নাড়ে এবং মুহূর্ত পরে নানীজানের দিকে তাকিয়ে সেঁতো হাসি হাসে। তার মা আর নানী তার সম্বন্ধে কি ভাববে সেটা নিয়ে সে প্রায়ই দুশ্চিন্তা করতো। তারা কি কখনও বুঝতে পারবে কেনো একজন শাহজাদা পাহাড়ী দুৰ্বত্তের জীবন গ্রহণ বাস্তবিক পক্ষে উপভোগ করতে পারে।”

“বাবর, আমাদের সেসব কথা বল।”

পশুর চর্বি দিয়ে তৈরি মোমবাতির দপদপ করতে থাকা শিখা নিভু নিভু হয়ে আসতে, বাবর তার সময় কিভাবে কেটেছে সেটা তাদের কাছে বর্ণনা করতে চেষ্টা করে। দুইশ কি তিনশ অভিযাত্রীর একটা বাহিনী নিয়ে, পাহাড়ের উপর থেকে ধেয়ে আসবার উত্তেজনাই আলাদা। রাতের বেলা তামবালের অনুগত বাহিনীর দূর্গ ঝটিকা আক্রমণের উল্লাস। আর তার পরে রাতের আঁধারে হারিয়ে যাবার, তার পর্যাণে বাধা শিকারের ছিন্নমস্তক থেকে টপটপ করে ঝরে পড়া রক্তের ধারার অনুপ্রেরণা। প্রাচীন মোঙ্গল প্রণালী অনুসরণে তার দলের এক লোক। ঘোড়ার দুধ গজিয়ে যে খভাস তৈরি করতো সেটা পান করার কারণে মাথা ঘুরতে থাকলে সারা রাত ধরে পানোন্মত্ত অবস্থায় ফুর্তি করা। চকরাখদের ছিন্নমস্তক দিয়ে উদ্দাম পোলো খেলার কথা সে কেবল এড়িয়ে যায়। যদিও খানজাদাকে হয়তো পরে সে সেটাও বলবে। তার কথা বলার সময়ে খানজাদার চোখ চকচক করতে থাকে। তার হাতের মুঠি খোলে আর বন্ধ হয়, যেনো সে নিজে সেখানে ছিলো। তার সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছে। এসান দৌলতও মগ্ন হয়ে শোনেন। কিন্তু সে খেয়াল করে মৃত্যুর করাল থাবার হাত থেকে অল্পের জন্য বেঁচে যাবার ঘটনাগুলো শোনার সময়ে তার মায়ের ভ্রু কুঁচকে উঠে।

 “আমি কিন্তু কেবল যারা আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে তাদেরই আক্রমণ করেছি। আর আমি কখনও তোমাদের কথা ভুলে যাইনি। তোমাদের স্বাধীনতা আমার মসনদের চেয়েও বেশি কাম্য ছিল আমার কাছে।” চারপাশে তাকিয়ে, বাবর দেখে গবাক্ষের সরু ফাঁক দিয়ে ফ্যাকাশে, ধুসর আলোর একটা ধারা লুকিয়ে কখন যেন কামরায় প্রবেশ করেছে। প্রায় সকাল হয়ে এসেছে।

 “তুমি এটা অর্জন করেছে। কিন্তু যা হয়ে গেছে তা হয়ে গেছে। এখন আমাদের ভবিষ্যতের দিকে তাকাতে হবে।” এসান দৌলতের কণ্ঠে একটা সতেজতা ফুটে থাকে এবং তার দৃষ্টি বাবর নিজের উপরে অনুভব করলে সে অস্বস্তিবোধ করে, যেন কোনো বাচ্চা ছেলে এখনই তার ওস্তাদের কাছে ধমক খাবে। “বাবর, তুমি এই ক’দিনে কি শিখেছো?” নানীজান তার দিকে ঝুঁকে এসে তার কব্জি আঁকড়ে ধরে। “ তোমার কথা অনুযায়ী মসনদহীন দিনগুলো থেকে তুমি কি শিখেছো?”

যুক্তিসঙ্গত একটা প্রশ্ন। এই বিপজ্জনক, মরীয়া সময় তাকে কি শিক্ষা দিয়েছে? “বিশ্বস্ত বন্ধু আর মিত্রের গুরুত্ব,” সে অবশেষে কথা খুঁজে পেয়ে বলে, “এবং তাদের যোগ্যতা অনুসারে প্রতিদান দেয়া। এছাড়া পরিষ্কার উদ্দেশ্য, একাগ্রচিত্ত কৌশল আর সেটা অর্জনের পথে কোনো কিছুকে বাধা হিসাবে গণ্য না করার প্রয়োজনীয়তা।”

এসান দৌলত সন্তুষ্টির মাথা নাড়েন। “অবশ্যই। এবং এছাড়া আর কি?”

“আমি শিখেছি একজন সুলতানের পক্ষে সবসময়ে উদারতা দেখান সম্ভব না, শ্রদ্ধা অর্জনের জন্য তাকে কঠোর হতে হবে- কখনও নির্মম। অন্যথায় তাকে দুর্বল মনে হবে। নেতৃত্ব দেবার বদলে সবার ভালবাসার পাত্রে পরিণত হবার ঝুঁকি দেখা দিতে পারে। আর সেই সাথে মিষ্টিভাষী ষড়যন্ত্রকারীর ফাঁদে পা দিয়ে বসতে পারে। আমি শিখেছিঃ আনুগত্য অর্জন করতে হলে কেবল কৃতজ্ঞতা আর সম্ভ্রম উদ্রেক করলেই চলবে না। এর সাথে সামান্য ভয়েরও মিশেল থাকতে হবে। আমি প্রথমবার ফারগানার শাসক হবার পরে বাকী বেগ, বাবা কাশক, আর ইউসুফকে প্রাণদণ্ড দেয়া উচিত ছিলো। তার বদলে আমি কেবল তাদের শাহী দায়িত্বপালন থেকে অব্যাহতি দিয়েছিলোম এবং জীবন ধারণের জন্য কোনো বাধা না দিয়ে বরং মনের ভিতরে তাদের তিক্ততা পোষণের সুযোগ দিয়েছি। এছাড়া, সমরকন্দ দখল করার পরে গ্রান্ড উজিরের কতিপয় সমর্থককেও কড়কে দেয়া উচিত ছিলো।

 “তারচেয়েও বড় কথা, আমার নিয়তির প্রতি আমি আর কখনও অবহেলা প্রদর্শন করবো না। আমাদের সাথে আমার সাথে যা ঘটেছে তারপরেই কেবল আমি হাল্কা হাল্কা বুঝতে পারছি মানুষ তৈমূর লোক হিসাবে কেমন ছিলেন। মাঝে মাঝে তার নিজেকে কেমন একা মনে হয়েছে- নিজের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কাজ করতে গিয়ে তাকে কেমন অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়েছিলো। আর তাছাড়া, তাদের সব দায়দায়িত্ব পরে বহুবছর ধরে তাকে নিজের কাঁধে বহন করতে হয়েছিলো… আমি নেতৃত্ব দেবার মতো সাহসও অর্জন করেছি…ওয়াজির খানের মতো আমার যতো দক্ষ পারিষদ থাকুক আমার নিয়তি কেবল আমিই নির্ধারণ করতে পারি।

বাবর মুখ তুলে তার নানীজানের দিকে তাকায়। “দেখে নিয়ে, আমি ঠিক তৈমূরের মতই বীর হবো। আমি শপথ করে বলছি…”

 “কথাগুলো সত্যিই শুনতে ভাল লাগে।” এসান দৌলত মন্তব্য করেন। “চলো আমাদের অনেক কাজ এখনও বাকি আছে। একটা নতুন দিনের প্রভাত হচ্ছে।”

দ্বিতীয় খণ্ড – সালতানাৎবিহীন এক সুলতান

০৭. আয়োধন আর অন্তর্ধান

 বৃষ্টি আর তুষারপাতের মিশ্রণের প্রকোপ বাবরের ভেড়ার চামড়ার প্রলেপ দেয়া ভারী জ্যাকেটের আবরণও আটকাতে ব্যর্থ হয়। ফারগানার উত্তরে উঁচু পর্বতমালার অভ্যন্তরে এক প্রত্যন্ত উপত্যকার ভিতর দিয়ে বয়ে যাওয়া একটা ক্ষুদ্র স্রোতস্বিনীর তীরের প্রায় কাদা হয়ে থাকা বরফের ভিতর দিয়ে তার অবশিষ্ট লোকদের সামনে থেকে ঘোড়া নিয়ে এগিয়ে চলেছে, বৃষ্টি আর তুষারপাতের হাত থেকে বাঁচতে মাথা নিচু করে রাখা।

নিজের দুটো সালতানাই হারিয়েছে এটা অনুধাবন করার পরের প্রথম দিকের মুশকিল দিনগুলোতে, বাবর আকশি দূর্গের আশেপাশেই থাকবে বলে ভেবেছিলো আশা করেছিলো সব কিছু বাজি রেখে হলেও সে তার পরিবারকে মুক্ত করতে পারবে। ওয়াজির খান অনেক কষ্টে তাকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছে যে, তার শত্রুরাও এমনই একটা মরীয়া প্রচেষ্টা আশা করছে আর তারা সেজন্য পুরোপুরি প্রস্তুত হয়ে রয়েছে। ওয়াজির খান, তার চিরাচরিত পিতৃসুলভ ভঙ্গিতে তাকে আশ্বস্ত করে পরামর্শ দিয়েছে, “আপনি যদি আপনার আম্মিজান, নানীজান আর বোনকে বাঁচাতে চান তাহলে নিজেকে বিপদের মুখে না ফেলে বরং শত্রুদের তটস্থ করে তুলেন, যাতে তারা আপনার নাম শুনলেই ভয় পায়। আর সেটা করতে হলে তাদের চাপের ভিতরে রাখেন। এখানে সেখানে তাদের আক্রমণ করে, আপনার বিরুদ্ধে সৈন্য সমাবেশ করবার আগেই সেখান থেকে সরে আসেন। ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে সবসময়ে একটা ভীতির সঞ্চার করতে থাকেন। আপনার শত্রুরা যাতে শান্তিতে ঘুমাতে না পারে। আর এটা করতে পারলেই সুলতান, তারা আপনার পরিবারের ক্ষতি করার কথা চিন্তাও করতে পারবে না।”

বাবর ওয়াজির খানের বক্তব্য মোটের উপরে বুঝতে পারে। সাবধানে বিবেচনা করে, সে একটা পরিকল্পনার কথা বলে। আমাদের একটা নিরাপদ আশ্রয়স্থল চাই। যেখানে আমরা শীতকালটা কাটাতে পারবো এবং প্রথম হামলার ছক কষতে পারবো। আমার মনে আছে যে প্রতিবার গ্রীষ্মের সময়ে সামরিক প্রশিক্ষণের অংশ হিসাবে আপনি একবার আমাকে উত্তরের পার্বত্য অঞ্চলে একটা অভিযানে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং উপত্যকার কেন্দ্রস্থলে একটা মাটির দূর্গে আমরা অবস্থান করেছিলাম। তামবালের অনুগত এক জায়গীরদার সেই নগণ্য সেনাছাউনির প্রধানের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলো। সেই দূর্গটা আমাদের জন্য চমৎকার আশ্রয়স্থল হিসাবে প্রতিপন্ন হতে পারে। কারো মাথাতেই বিষয়টা আসবে না। আপনি কি বলেন?”

“জায়গার কথা আমার মনে আছে। বাস্তবিকই প্রত্যন্ত অঞ্চলে দূর্গটা অবস্থিত, আর আমাদের উদ্দেশও হাসিল হবে।”

আর সে জন্যই সে ওয়াজির খানকে নিয়ে পাহাড়ের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেছিলো। তাদের সাথে কেবল দুশো লোক ছিলো। ওয়াজির খানের সাহায্যে বাবর অনেক যত্ন নিয়ে তাদের বাছাই করেছে, সে কেবল তাদেরই বাছাই করেছে যাদের বয়স অল্প আর কোনো পারিবারিক পিছুটান নেই বা বাইসানগারের মতো যারা তার বিশ্বস্ত অন্তরঙ্গ। বাকি সবাইকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে, তার ডাকের অপেক্ষা করতে বলেছে, যা তারা নিশ্চিতভাবেই পাবে। তাদের যাত্রার দ্বিতীয় সপ্তাহে তুষারপাত শুরু হয় এবং উচ্চতা বাড়বার সাথে সাথে তুষারের স্তর বৃদ্ধি পেয়ে তাদের যাত্রাকে শ্লথ করে তুলেছে।

 “ওয়াজির খান, আপনার কি মনে হয় আমরা দূর্গ থেকে কতোটা দূরে অবস্থান করছি?”

“সুলতান, আবহাওয়া যদি এতোটা বিরূপ না হতো, আমরা তাহলে দূর্গটা এতক্ষণে দেখতে পেতাম। অবশ্য সুবিধাও হয়েছে, দূর্গের নিরাপত্তা রক্ষীরা আমাদের আগে থেকে দেখতে পাবে না। দূরের ঐ গাছগুলোর আড়ালে আমরা অবস্থান নেবো আর সামনেটা রেকী করার জন্য গুপ্তদূত পাঠিয়ে আমরা পর্যাণে যেটুকু শুকনো মাংস রয়েছে সেটা দিয়ে আহার সেরে নেবো।”

তাদের পাঠানো গুপ্তদূতেরা রেকী করে ফিরতে যে নব্বই মিনিট সময় লাগে তার পুরোটা সময়ই অবিশ্রান্তভাবে তুষারপাত হয়। কখনও ভারী বা কখনও হাল্কাভাবে। তার লোকেরা ফিরে আসতে দেখা যায়, ঘোড়া আর তার আরোহী তুষারে পুরো ঢেকে গেছে এবং গুপ্তদূতদের দলনেতা ঠাণ্ডায় নীল হয়ে আসা ঠোঁটে কোনোমতে কথা বলে। “এখান দু’মাইল দূরে একটা বাকের পরেই দূর্গটা অবস্থিত। দূর্গের বাইরে আমরা কোনো ঘোড়ার বা পায়ের ছাপ দেখতে পাইনি যাতে বোঝা যায়, আজ ভেতর থেকে কেউ টহল দিতে বা পর্যবেক্ষণ-ফাঁড়িতে যায়নি। আমরা যখন ঘোড়া থেকে নেমে দূর্গের কাছে এগিয়ে যাই, দূর্গের এক অংশ থেকে আমরা ধোয়া উঠতে দেখেছি- সম্ভবত রসুইখানা- কিন্তু তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো দূর্গের মূল ফটক তখন ভোলা ছিলো। স্পষ্টতই এই আবহাওয়ায় কেউ আক্রমণ করতে পারে সেই ব্যাপারটা তাদের মাথাতেও নেই।”

“চমৎকার, শীঘ্রই তাদের এই নিশ্চয়তা নরকে পরিণত হতে চলেছে। ওয়াজির খান, এটা ইতস্তত করার সময় না, সবাইকে এই মুহূর্তে প্রস্তুত হতে বলুন এবং তুষারপাতের মাঝে আমরা আত্মগোপন করে গুপ্তদূতদের সহায়তায় দূর্গে পৌঁছাবার পথের শেষ বাঁকে দ্রুত আর নিরবে গিয়ে হাজির হবো। সেখান থেকে মূল ফটকের উদ্দেশ্যে ঘোড়া দাবড়ে যাবো।”

 ওয়াজির খান মাথা নেড়ে সম্মতি জানায় এবং পাঁচ মিনিট পরে অশ্বারোহী বাহিনীর একটা সারিকে মন্থর গতিতে পাহাড়ী পথ বেয়ে উপরের দিকে উঠে যেতে দেখা যায়। তুষারাবৃত প্রেক্ষাপটের মাঝ দিয়ে প্রায় দু’মাইল এগিয়ে যায়। তুষারপাত এখন আগের চেয়ে অনেক কমে এসেছে। বাবরের চোখের সামনে একটা পাথুরে অবয়ব ভেসে ওঠে। দূর্গটা আর মাত্র হাজারখানেক গজ সামনে অবস্থিত। এখান। থেকে দূর্গ পর্যন্ত রাস্তাটা বেশ প্রশস্ত।

 “আমরা এখান থেকেই আক্রমণ শুরু করবো। লোকদের বলেন অপ্রয়োজনীয় সবকিছু এখানে পাথরের আড়ালে রেখে কেবল হাতিয়ার নিয়ে প্রস্তুত হতে। যাতে বরফের উপর দিয়ে যতোটা সম্ভব দ্রুত ঘোড়া দাবড়ে আমরা দূর্গে পৌঁছাতে পারি।” তার লোকেরা নিরবে প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। কিন্তু তারা প্রস্তুত হতে হতে তুষারপাত একেবারে বন্ধ হয়ে যায় এবং সামনে- সাদা প্রেক্ষাপটের মাঝে একটা কালো আকৃতির মত দূর্গটা ভেসে উঠে।

 “যারা প্রস্তুত, ঘোড়ায় আরোহন করো! কারো চোখে পড়ে যাবার আগেই আমাদের আক্রমণ করতে হবে!” বাবর চিৎকার করে কথাটা বলার ফাঁকে ময়ান থেকে আলমগীর বের করে আনে। সে লাফিয়ে জিনের উপরে উঠে বসে এবং তার বিশাল কালো ঘোড়াটাকে দূর্গের দিকে এগোতে বলে পেটে খোঁচা দেয় যার ফটক সে খোলা দেখতে পেয়েছে। দশজন যোদ্ধা পরিবেষ্টিত অবস্থায় এবং বাকীরা তার পেছনে সারিবদ্ধভাবে বিন্যস্ত। ঘোড়ার কাধ ধরে ঝুঁকে ছুটে যাবার সময়ে বাবর টের পায় তার কানে রক্তের চাপ বৃদ্ধি পেয়েছে। দূর্গের ফটক থেকে সে যখন মাত্র দুশো গজ দূরে, তখন ভেতর থেকে একটা চিৎকার তার কানে ভেসে আসে- শত্রুরা তাদের দেখে ফেলেছে। ভেতরের লোকেরা বিপদ টের পায়। তারা ফটকের পাল্লা বন্ধ করার চেষ্টা করতে সেটা কেঁপে উঠে। কিন্তু নতুন জমা বরফ পাল্লা নড়তে বাধা দেয়। দু’জন লোক বাইরে ছুটে আসে, বরফের স্তূপে লাথি দেয় এবং বৃথাই চেষ্টা করে পাল্লাটা বরফের উপর দিয়ে সরাতে।

 “ব্যাটাদের পেড়ে ফেলো!” বাবর হুঙ্কার দিয়ে বলে। কিন্তু ঘোড়ার গতি বিন্দুমাত্র হ্রাস করে না। নিমেষের ভিতরে সে একজনকে মাটিতে পড়ে যেতে দেখে, একটা তীর তার গলায় বিদ্ধ হয়েছে। একই সাথে সে নিজেও দূর্গের তোরণদ্বারের কাছে পৌঁছে যায়। দ্বিতীয় লোকটাকে সে আলমগীর দিয়ে একটা কোপ বসিয়ে দেয়। টের পায় তার তরবারি জায়গা মতোই নরম মাংসপেশীতে কামড় বসিয়েছে। কিন্তু কোথায় সেটা দেখবার জন্য সে ঘোড়ার গতি একটুও হ্রাস করে না। তার বদলে, সে তার হাতে ধরা লাগামে একটা ঝাঁকি দিয়ে ঘোড়ার মাথা তখনও আংশিক খোলা ফটকের দিকে ঘুরিয়ে দেয়। বিশাল কালো ঘোড়াটা নাক দিয়ে একটা শব্দ করে এবং বাবর টের পায় ঘোড়াটার একটা পা পিছলে গেছে কিন্তু কালো পাহাড় ঠিকই ঘুরে দাঁড়ায়। একই সাথে তার পেছনে তিনজন যোদ্ধা এসে হাজির হয়।

কিন্তু চতুর্থজন ঢুকতে ব্যর্থ হয়। ভেতরে প্রবেশপথ আটকে ঘোড়া আর তার আরোহীর ভূপাতিত হবার শব্দ বাবর শুনতে পায়। সে দূর্গের ভিতরে প্রবেশ করেছে বটে। কিন্তু তাকে সহায়তা করবার জন্য মাত্র তিনজন যোদ্ধা তার সাথে রয়েছে। চারপাশে তাকালে সে সারি সারি স্থাপিত উঁচু দরজার পেছন, সম্ভবত দূর্গের প্রধান সেনানিবাস থেকে পিলপিল করে লোকজনকে বের হয়ে আসতে দেখে। কেউ কেউ ইস্পাতের বর্ম গায়ে চাপাতে ব্যস্ত। আর বাকিরা ইতিমধ্যে অস্ত্রধারণ করেছে।

“আমার সাথে এসো! এখনই আক্রমণ করতে হবে!” বাবর পেটে খোঁচা দিয়ে পুনরায় তার ঘোড়ার গতি বৃদ্ধি করে। আর একটু পরেই তাকে তার তিনজন সহযোদ্ধাকে নিয়ে আতঙ্কিত লোকগুলোকে কচুকাটা করতে দেখা যায়। সহসা একটা লম্বা লোক বাবরের নজর কাড়ে, যাকে দেখে সেনাপতিদের একজন বলে মনে হয়। ব্যাটকে মাথা নিচু করে পুনরায় ঘরের ভিতরে প্রবেশ করতে দেখলে সেও ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে সেদিকে এগিয়ে যায়। কাঠের সরদলের নিচে দিয়ে ঝুঁকে পার হয়ে সে ভেতরের আধো অন্ধকারে চোখ পিটপিট করে প্রবেশ করতে যে বিশ ত্রিশজন সেখান থেকে বের হয়ে এসেছে, বুঝতে হবে সেটাই এই দূর্গের মোট জনবল। কেবল সেনাপতিগোছের লোকটাই এখন ভেতরে রয়েছে। লোকটা দৌড়ে একটা অস্ত্র সজ্জিত তাকের দিকে ছুটে গিয়ে সেখান থেকে একটা বর্শা আর ঢাল তুলে নিয়ে বাবরের দিকে ঘুরে দাঁড়ায়।

“ফারগানার ন্যায়সঙ্গত সুলতান, আমি বাবর তোমাকে আদেশ দিচ্ছি অস্ত্র নামিয়ে রাখো।”

 “আমি আত্মসমর্পন করবো না। তোমাকে আমি সুলতান বলে মানি না। আমার নাম হানিফ খান। আমি তামবালের প্রতি অনুগত, সেই এখন পুরো এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে। পারলে সম্মুখ যুদ্ধে আমাকে পরাস্ত করো।”

বাবর তার কালা পাহাড়ের উপর থেকে লাফিয়ে নামে এবং আলমগীর হাতে ধরা অবস্থায় হানিফ খানের দিকে এগিয়ে যায়। যে তক্কে তক্কে ছিলো বাবর তার। কাছাকাছি যেতেই হাতের বর্শা দিয়ে সে বাবরকে আঘাতের চেষ্টা করে। বাবর লাফিয়ে একপাশে সরে যায়। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে অর্ধভুক্ত খাবারে ভর্তি একটা নিচু টেবিলের পায়ার সাথে তার বাম পা আটকে যায়। বেকায়দা ভঙ্গিতে সে টেবিলের উপরে আছড়ে পড়ে। টেবিলের উপরে থাকা কাঠের পেয়ালা আর তার ভেতরের খাবার ছিটকে ফেলে। মাংসের সুরুয়া অর্ধেকটা ভর্তি একটা বিশাল ধাতব পাত্রের মুখে তার তরবারি ধরা হাতের কব্জি আটকে যেতে, আলমগীর তার মুঠো থেকে ছুটে যায়।

হানিফ খান বাবরের অসহায় অবস্থার সুযোগে তাকে একেবারে শেষ করে দেবার জন্য ছুটে আসে। তার বর্শাটা দু’হাতে মাথার উপরে তুলে বাবরের উন্মুক্ত গলায় সেটা সর্বশক্তিতে নামিয়ে আনবে। বাবর একটা কাঠের বড় বারকোশ তখন তুলে নিয়ে সেটাকে ঢালের মত ব্যবহার করে। বর্শা বারকোশে বিদ্ধ হয়। তবে সেটাকে ছিন্ন করতে পারে না। ছিটকে পড়া খাবারের উষ্ণ চটচটে সুরুয়ার ভিতরে গড়িয়ে একপাশে সরে যাবার সময়ে সে বারকোশটা ফেলে দিয়ে বর্শার হাতল ধরে মোচড় দেয় এবং হানিফ খানের হাত থেকে সেটা টেনে নেয়।

বিন্দুমাত্র দমে না গিয়ে হানিফ খান, লাফিয়ে পেছনে সরে গিয়ে কোমরের পরিকর থেকে একটা সরু খঞ্জর টেনে বের করে। আলমগীর কোথায় পড়েছে সেটা দেখার সময় নেই বাবরের, হাতের বর্শাটা দিয়ে সে লোকটাকে সজোরে আঘাত করলে ফলার মাথায় আটকানো বারকোশটা খুলে পড়ে। আর একই সময়ে, নিজের গালে সে একটা তীক্ষ্ণ ব্যাথা অনুভব করে। হানিফ খান বাবরের গলা লক্ষ্য করে খঞ্জরটা চালিয়েছিলো কিন্তু লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে। বাবর এবার বশার ফলাটা সজোরে তাকে লক্ষ্য করে আঘাত করে হানিফ খান একপাশে ঘুরে আঘাতটা এড়াতে চেষ্টা করে। কিন্তু ফলাটা তাকে বামদিকে স্পর্শ করলে সে টেবিলের পাশে রাখা শক্ত কুশনের উপরে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। বাবর এবার বর্শাটা মোচড় দেয় এবং মুহূর্ত মাত্র চিন্তা না করে প্রতিপক্ষের কণ্ঠনালী লক্ষ্য করে সজোরে বর্শাটা নামিয়ে এনে গালিচার উপরে তাকে গেথে ফেলে। যা অচিরেই ফিনকি দিয়ে রক্তে ভিজে লাল হয়ে যায়।

ইতিমধ্যে ওয়াজির খান, বাইসানগার আর বাকী লোকেরা এসে তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে তার সাহসিকতার জন্য তাকে শুভেচ্ছা জানায়। দূর্গটা এখন তাদের দখলে। ফারগানা উদ্ধারের বন্ধুর পথে সে মাত্র প্রথম পদক্ষেপটা সাফল্যের সাথে রেখেছে। বাইরে বের হয়ে এসে বাবর দেখে আবার তুষারপাত শুরু হয়েছে। শত্রুর পড়ে থাকা দেহের চারপাশের লাল রঙ ইতিমধ্যে অনেকটাই ঢাকা পড়েছে। একটু আগে তামবালের চামচার ভবলীলা সে যেভাবে সাঙ্গ করেছে, সেভাবে পালের গোদাটাকে কখন মুঠোর ভেতরে পাবে সেই মুহূর্তটার জন্য সে অধীর হয়ে রয়েছে।

*

আর এভাবেই পুরো ঘটনাটার সূচনা হয়। বাবর একজন হানাদারে পরিণত হন। ঝটিকাবেগে আক্রমণ করেন এবং ফিরে যাবার সময় প্রতিবারই মৃত শত্রুর কারো একজনের মুখে রক্ত দিয়ে নিজের নাম লেখা একটা কাগজ গুঁজে দিয়ে যান। আর তার সাফল্য ক্রমশ বাড়তে থাকে। তার বাহিনীর সংখ্যা, মিষ্টি কথা আর মধুর প্রতিশ্রুতি, সেই সাথে শক্তি বা তার অভিযানে প্রাপ্ত সম্পদের বিচক্ষণ ব্যবহার নতুন সমর্থকদের আকৃষ্ট করে এবং প্রতিপক্ষকে দলে টেনে, ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায়। মাটির দূর্গ দখলের বিশ মাসের মধ্যে, নিষ্ঠা আর একাগ্রতার সাথে একটার পরে একটা ছোট দূর্গ আর গ্রামের পর গ্রাম দখল করে ফারগানার পশ্চিমাঞ্চলের অধিকাংশই সে দখল করে নেয়। তার কৌশল কার্যকরী বলে প্রতীয়মান হয়। তামবাল আকশির উত্তর বা পশ্চিমে বাবরের শক্ত ঘাঁটির দিকে বেশিদূর অগ্রসর হবার মতো সাহস দেখায় না। আর বাবরও মনে করে এবার সময় হয়েছে নিজের দাবির কথা প্রকাশ করবার।

 প্রথম দাবিটা সে ছয়মাস আগে জানায় এবং তারপরে প্রায়শই তার পুনরাবৃত্তি করেছিলো তার আম্মিজান, নানীজান আর বোনের মুক্তির বদলে এক বছর আকশি দূর্গ আক্রমণ না করবার প্রতিশ্রুতি। তিনমাস আগে তামবাল এক বার্তাবাহকের মাধ্যমে প্রেরিত এক চিঠিতে অনেক মধুর ভাষায় জানায় এসান দৌলত, খুতলাঘ নিগার আর খানজাদা প্রত্যেকেই সুস্থ আছে এবং শাহী পরিবারের উপযুক্ত ব্যবহারই করা হচ্ছে তাদের সাথে। কিন্তু চিঠিতে সে তাদের মুক্তি দেবার তার কোনো অভিপ্রায়ের কথা উল্লেখ করেনি।

 বাবর এখন পূর্বদিকে পঞ্চাশ মাইল দূরে অবস্থিত শহর গাভার দিকে অগ্রসর হচ্ছে কিছুদিন আগে তামবাল ভাড়াটে চকরাখ যোদ্ধাদের সহায়তায় সেখানের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করেছে। সেখানে একটা হিসাব মেলানো এখনও বাকি আছে। সেখানকার দূর্গের চাকরাখ সর্দার তার সৎভাই আর তামবালকে শাহী প্রতিনিধি হিসাবে মেনে নিয়ে প্রথম আনুগত্য প্রদর্শনকারীদের অন্যতম। শহরটা দখল করলে তামবালকে আরেকটা জোরালো সঙ্কেত পাঠানো হবে যে, সময় হয়েছে বাবরের কাছে তার পরিবারকে ফেরত পাঠাবার।

এক ক্ষুদ্র নহরের পাশে সাময়িক যাত্রাবিরতি করে বাবর আর তার লোকেরা ঘোড়াগুলোকে পানি পান করার সুযোগ দেয়। ঘোড়ার দুধ থেকে তৈরি টক পনির কোনোক্রমে গলধঃকরণের ফাঁকে বাবর তাকিয়ে দেখে তার এক গুপ্তদূত ঘোড়ায় চড়ে এগিয়ে আসছে। বাবর চমকে উঠে দেখে তার পর্যানে একটা দেহ আড়াআড়িভাবে বাঁধা রয়েছে। লোকটার দিকে দৌড়ে গিয়ে বাবর চিৎকার করে জানতে চায়, “কি হয়েছিলো? এই লোকটা কে?”

“লোকটা একটা ব্যবসায়ী। পথের পাশে পেটে তরবারির আঘাত নিয়ে নিজেরই রক্তে অর্ধচেতন অবস্থায় পড়ে থাকার সময়ে তাকে আমি খুঁজে পেয়েছি। আমি তাকে আমার ঘোড়ার পিঠে তুলে নেবার কিছুক্ষণ পরেই বেচারা মারা যায়। অবশ্য মারা যাবার আগে সে আমাকে বলেছে যে আরও তিনজন ব্যবসায়ীর সাথে সে। এখান থেকে দশ মাইল দূরে একটা ছোট সরাইখানার উদ্দেশ্যে যাবার পথে তারা চকরাখ হানাদারদের হামলার শিকার হয়। তার তিন সঙ্গীকে হত্যা করে তাকেও মৃত ভেবে তাদের সব মালপত্র নিয়ে তারা চলে গেছে।”

 “চকরাখ হানাদারদের অবশ্যই খুঁজে বের করে তার হত্যার আমরা বদলা নেবো। তোমার অধীনস্ত কয়েকজন গুপ্তদূতকে হত্যাকারীদের খুঁজতে পাঠাও।”

 “সুলতান, আমার মনে হয় না তার কোনো দরকার আছে। বণিক লোকটা মারা যাবার আগে আমাকে বলেছে যে, সে চকরাখদের বলতে শুনেছে তারা সরাইখানায় যাচ্ছে, সেখানে আরও শিকার যদি তারা খুঁজে পায়…”

“তাহলে আমরা প্রথমে সরাইখানায় যাবো।”

***

গানের সুর বন্য আর কর্কশ চকরাখদের নিজেদের মতোই অনেকটা। মদের নেশায় চুরচুর হয়ে থাকা পুরুষদের কণ্ঠস্বর নতুন মাত্রায় উঠে এমন সব অশ্লীল ক্রিয়াকলাপের বর্ণনায় মেতেছে যা একাধারে শারিরীকভাবে অসম্ভব আর মোটাদাগের যে বাবর চেষ্টা করেও হাসি চাপতে পারে না। সে আড়চোখে ওয়াজির খানের দিকে তাকিয়ে দেখে সেও হাসছে।

লম্বা ঘাসের আড়ালে বাবর তার চারপাশে শুয়ে থাকা লোকদের ইশারা করে। সবাই। তারমতো পেটের উপরে ভর দিয়ে শুয়ে আছে, লুকিয়ে অপেক্ষা করছে। তারপরে সে গুঁড়ি মেরে মাটির ইট দিয়ে তৈরি একতলা সরাইখানার দিকে এগিয়ে যায় যেটা ফারগানার অন্যতম খরস্রোতা একটা নদীর অগভীর অংশের পাড়ে অবস্থিত। যেখানে হল্লাবাজেরা মচ্ছবে মেতেছে। নূপুরের নিক্কন ধ্বনি ভেসে আসতে বোঝা যায় ভেতরে বাইজি মেয়েরাও আছে। সেই সাথে কুপিত নারী কণ্ঠের সহসা একটা তীক্ষ্ণ চিৎকার আর তার সঙ্গে ভেসে আসে- পুরুষ কণ্ঠের অট্টহাসি।

দুপুর মাত্র অতিক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু বিশজন বা তার কিছু বেশি চাকরাখরা ইতিমধ্যেই বেহেড মাতাল হয়ে পড়েছে। তারা এমনকি তাদের ঘোড়াগুলিকে ঠিকমতো বাঁধার কষ্টও করেনি এবং কিছু ঘোড়া, যাদের কেশর পুরু আর লেজ এতো লম্বা যে মাটিতে ঘষা খাচ্ছে, ইতিমধ্যেই ছুটে পালিয়েছে। চারো ব্যবসায়ীর কাছ থেকে লুট করা মালামালও তারা ভিতরে নিয়ে যাবার গরজ দেখায়নি। বণিকদের মালবাহী ধুসর খচ্চরগুলো দড়ি দিয়ে একত্রে বাঁধা এবং মনোযোগ দিয়ে চরে বেড়াচ্ছে। তাদের পিঠে আটকানো বেতের ঝুড়িগুলো দেখে মনে হয় এখনও চামড়া আর লোমে ঠাসা। চাকরাখরা মনে হয় কেবল মদের পিপে নিয়ে সরাইখানার ভিতরে প্রবেশ করেছে।

বর্বর অসভ্য, বাবর ভাবে। তাদের কপালে আজ কি লেখা আছে সেটা এখনই ব্যাটারা টের পাবে। আর এই ভাবনাটা তাদের উৎফুল্ল করে তোলে। লম্বা ঘাসের উপরে মাথা তুলে বাবর চারপাশে তাকায়। কিন্তু কাউকে দেখতে পায় না। সে ঠিক যেমনটা ভেবেছিলো, ঘোড়া বা মালামাল দেখার জন্য বাইরে কোনো বাচ্চাকে রাখার কথা ব্যাটাদের মাথাতেই আসেনি। সে এবার উঠে দাঁড়িয়ে, গুটিগুটি পায়ে সরাইখানার নীচু প্রবেশদ্বারের ডান দিকে মোটা দেয়ালের গায়ে জানালার মতো দেখতে একটা ফাঁকা জায়গার দিকে এগিয়ে গিয়ে ভেতরে সতর্কতার সাথে উঁকি দেয়। ঘরটা প্রায় খালি, কেবল ভেতরের দেয়ালের গায়ে ঠেকানো অবস্থায় একটা লম্বা কাঠের টেবিল দেখা যায়। কয়েকটা তেপায়া টুল আর একটা আধ ভাঙা বেঞ্চি দেখা যায়। ঘরের মাঝে মোটাসোটা, বোচা-নাকের একটা মেয়ে পরনে রঙচটা হলুদ রঙের ঢোলা সালোয়ারের উপরে লাল ফুলের ছাপ দেয়া একটা আঁটোসাঁটো কামিজ, পায়ে আর হাতের কব্জিতে ঘুঙুর বাঁধা। নীল সালোয়ার কামিজ পরিহিত লম্বা আরেকটা মেয়ে তার নোংরা হাতে একটা খঞ্জনী, বর্গাকার পাথরের মেঝের উপরে খালি পায়ে সজোরে পদাঘাত করে বৃত্তাকারে আবর্তিত হচ্ছে। সে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই চকরাখদের কয়েকজন, ভেড়ার চামড়ার তৈরি টুপির নিচে তাদের গোলাকার মুখ ঘামে ভিজে আছে, টলোমলো পায়ে মেয়েদের বুকে পাছায় বৃথা চেষ্টা করে থাবা দিতে এবং মুখ থুবড়ে মাটিতে আছড়ে পড়লে তাদের সঙ্গীসাথীদের উদ্দীপনা আরও বেড়ে যায়।

এক কোণে ধোঁয়া উঠতে থাকা অগ্নিকুণ্ডের উপরে বিশাল একটা কেতলি ঝুলতে দেখা যায়। আরেক কোণে, বাবর এক চকরাখ দুবৃত্তকে কাপড় খুলে ব্যস্ত ভঙ্গিতে হাল্কা হতে দেখে, দুর্গন্ধে তার সঙ্গীসাথীদের আপাতভাবে কোনো অসুবিধা হয় না। আরেক বদমাশ উঠে দাঁড়িয়ে হলুদ বমি বৃত্তচাপ তৈরি করে ছুঁড়ে ফেলে আবার বসে পড়ে আর মনোযোগ দিয়ে জামার হাতায় পড়া বমির ফোঁটা বড়বড় নখ দিয়ে টুসকি দেয়। বাবর পুনরায় মাথা নামিয়ে নেয়। সে যা দেখার তা দেখে নিয়েছে।

 মাটিতে গুঁড়ি দিয়ে সে পুনরায় ওয়াজির খান যেখানে আছে সেখানে ফিরে আসে। “মদ্যপ আহাম্মকগুলো আমাদের হাতে মারা যাবার জন্য মুখিয়ে রয়েছে। ব্যাটারা তাদের তরবারি আর ঢাল পর্যন্ত দরজার কাছে স্তূপ করে রেখেছে।”

 ওয়াজির খানের একটা ক্ৰ উপরে উঠে যায়। “সুলতান, এখনই?”

“হ্যা!”

 বাবর আর ওয়াজির খান উঠে দাঁড়িয়ে তাদের লোকদেরকেও উঠে দাঁড়াবার ইশারা করে। তারা এই কাজটা আগে এতোবার করেছে যে, মৌখিক আদেশের আর কোনো প্রয়োজন হয় না। ঠোঁটের উপরে আঙ্গুল চেপে, ওয়াজির খান ইশারায় ঘুরে কয়েকজনকে সরাইখানার পেছনে যেতে বলে। যদি সেখান দিয়ে পালাবার কোনো পথ থেকে থাকে। তারপরেই কেবল বাবর তার প্রিয় রণহুঙ্কারে চারপাশ প্রকম্পিত করে: “ফারগানা!”

 বাবর একেবারে সামনে থেকে তার লোকদের নেতৃত্ব দেয়। মদের নেশায় মাতাল আর বিস্ময়ে আড়ষ্ঠ চকরাখরা সামান্যই প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে। বাবর আর তার লোকেরা নির্মমভাবে প্রতিপক্ষের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়লে বোঁচা-নাকের সেই মেয়েটার কাছ থেকেই কেবল বলার মতো প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। মেয়েটা তার কাচুলির ভিতর থেকে একটা খঞ্জর বের করে এবং বাবরের বাহুতে সেটা মরিয়া ভঙ্গিতে গেথে দিতে চাইলে, বাবর অনায়াসে তার ঘুঙুর পরা হাতের কব্জি ধরে এবং তাকে ঘুরিয়ে দিয়ে তার নধর নিতম্বে বুট দিয়ে একটা সপাট লাথি বসিয়ে দিতে বেচারী ছিটকে দূরে গিয়ে পড়ে।

কয়েক মিনিটের ভিতরে সবকিছু শেষ হয় এবং বাবরের লোকদের হাঁপিয়ে ওঠার আগেই নিজেদের তরবারির ফলা পরিষ্কার করে কোষবদ্ধ করতে দেখা যায়। তার লোকদের গায়ে একটা আঁচড়ও লাগেনি। অবশ্য তার লোকদের সবাই পোড়খাওয়া যোদ্ধা, এসব মদ্যপ মাতালদের চেয়ে অনেক দক্ষ লোকদের সাথে তারা আগে লড়াই করেছে। “লাশগুলো বাইরে নিয়ে যাও দেখা যাক আমরা কাদের হত্যা করেছি,” বাবর আদেশটা দিয়ে কৃতজ্ঞচিত্তে দ্রুত পূতিগন্ধময়, ধোঁয়াটে ঘরটা থেকে বাইরের খোলা বাতাসে বের হয়ে আসে।

 তার লোকেরা চকরাখদের লাশগুলি তাদের বুট-পরা পা ধরে হেঁচড়ে বাইরে এনে সারিবদ্ধভাবে সাজালে, বাবর লাশগুলো শুনে দেখে। মোট পনেরটা লাশ। কারো গলা দুভাগ হয়ে আছে, কোনোটা আবার কবন্ধ। তার লোকেরা অবশ্য কাটাপড়া মাথাগুলো সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছে। কোনোটার মাথায় তখনও ভেড়ার চামড়ার টুপি রয়েছে। কাটা মুণ্ডগুলোর দিকে তাকিয়ে যখন বাবর একটা বিশেষ মুখ চিনতে পারে, তখন তার মুখ থেকে সন্তুষ্টিসূচক একটা শব্দ ধ্বনিত হয়। তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে এমন সব চকরাখকে সে হত্যা করবে বলে মনস্থ করেছে। এবং প্রতিটা হত্যাযজ্ঞ যা তাকে তার লক্ষ্যের নিকটবর্তী করছে প্রচণ্ড তৃপ্তিদায়ক।

 তারস্বরের চিৎকার শুনে বাবর ঘুরে তাকায়। তার দু’জন যোদ্ধা বাইজি মেয়েদের ধরে তাদের টেনে সরাইখানার বাইরে বের করে আনে। “তাদের উপরে বল প্রয়োগ করবে না। আমার আদেশ তোমরা জানেনা। অর্থের বিনিময়ে যদি তারা স্বেচ্ছায় তোমাদের সঙ্গ দিতে রাজি হয় তবে সেটা আলাদা কথা।” কথাটা বলে বাবর আবার ঘুরে দাঁড়ায়।

দেখা যায় মেয়েগুলো আদতেই ব্যবসায়ী এবং কয়েক মুহূর্তের দ্রুত আলোচনার পরে, সরাইখানার পেছনের এক আপেল বাগিচায় তারা তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যায়। বাবর ধারণা করে বাইজি দু’জন সরাইখানার শকুনের মতো দেখতে মালিকের মেয়ে হবে। যে ঝামেলার গন্ধ পাওয়া মাত্র সেই যে টেবিলের তলায় গিয়ে ঢুকেছে তারপরে আর বের হবার কথা চিন্তাও করেনি। আপেল বাগিচায় শীঘ্রই বাবরের লোকদের দল বেঁধে আসা যাওয়া করতে দেখা যায়। বাগান থেকে হাসিমুখে তাদের বের হয়ে আসা দেখে বোঝা যায় মেয়ে দু’জন তাদের বাবার সরাইখানায় আসা। অতিথিদের খেদমত করতে ভালোই অভ্যস্ত।

 ওয়াজির খান ইতিমধ্যে চকরাখদের পালিয়ে যাওয়া ঘোড়াগুলো ধরে আনবার বন্দোবস্ত করেছেন এবং বণিকদের কাছ থেকে লুট করা মালপত্রগুলো পর্যবেক্ষণ। করছেন। “সুলতান, দেখেন,” দুটো উজ্জ্বল বর্ণের গালিচা বের করে সে বাবরের। দৃষ্টি সেদিকে আকর্ষণ করে। গালিচা দুটোর জেল্লা দেখে বোঝা যায় তন্তুবায়ের দল। সেটা বুননের সময়ে রেশমের সাথে উলের মিশ্রণ ঘটিয়েছে আর গালিচাগুলোর নকশাও অপরিচিত- বণিকের দলটা সম্ভবত পূর্বের, কাশগর থেকে এসেছিল। যেখানের তাঁতিরা এ ধরণের গালিচা তৈরিতে দক্ষ। উল আর চামড়া বেচে ভালো অর্থই পাওয়া যাবে, বাবর ভাবে, যা দিয়ে তার লোকদের সে বকেয়া বেতন দিতে পারবে।

তার যোদ্ধাদের জন্য একটা ভোজসভার আয়োজন করলে মন্দ হয় না। তারা ভালো। কাজ দেখিয়েছে এবং তারও উচিত এর মূল্যায়ন করা। পশ্চিমে, শাহরুখিয়ায় ফিরে যাওয়া মাত্রই সে এই ভোজসভার ঘোষণা দেবে। সেখানে, ছয়মাস আগে। তামবালের কাছ থেকে সে দূৰ্গটা ছিনিয়ে নিয়েছে এবং নিজের ঘাঁটিতে পরিণত করেছে। সমরকন্দে খুন হবার আগে শাহরুখিয়ার সর্দার আলি মজিদ বেগের পূণ্য স্মৃতির প্রতি তারা তাদের শ্রদ্ধা জানাবে। তারা তার উপযুক্ত সন্তানের আত্মার মাগফেরাত কামনা করবে। যে তামবালের চকরাখ যোদ্ধাদের হাত থেকে দূর্গটা রক্ষা করতে গিয়ে শহীদ হয়েছে। আলি মজিদ বেগের নিহত হবার সংবাদ ফারগানায় পৌঁছানো মাত্র তামবাল দূর্গটা দখল করতে তাদের পাঠিয়েছিলো।

নিজের বিশ্বস্ত সর্দারের কথা মনে পড়তে বাবরের ভাবনা বিষণ্ণ হয়ে উঠে। আজকাল তার প্রায়ই এমন হচ্ছে। সবুজাভ-নীল তোরণদ্বারে আলি মজিদ বেগের মৃতদেহ প্রদর্শিত হবার পরের দু’বছরে সে কি অর্জন করেছে? নিজের পরিবারকে মুক্ত করার ব্যাপারে বা ফারগানা পুনরায় অধিকার করার ব্যাপারে সে কতটা অগ্রসর হয়েছে, সমরকন্দের কথা না হয় সে বাদই দিল? আর কতদিন তাকে সালতানাৎবিহীন একজন সুলতান হিসাবে দিন কাটাতে হবে? আকশি আক্রমণ করে তার পরিবারকে মুক্ত করে সিংহাসন পুনরুদ্ধার করার মতো একটা সেনাবাহিনী গঠন করা একটা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। আর সমরকন্দ, সেখানে শাসক হিসাবে কাটানো কয়েকটা দিন এখন কেবল ধূসর স্মৃতি। মাঝে মাঝে তার বিশ্বাস করতেই কষ্ট হয় যে এমন কিছু আসলেই ঘটেছিলো। গ্রান্ড উজিরের কথাই শেষ পর্যন্ত সত্যি হলো।

ভাবনাটা বাবরকে ক্রুদ্ধ করে তোলে। সে তার পায়ের কাছে পড়ে থাকা একটা কর্তিত মস্তকে লাথি বসিয়ে দিলে সেটা ছিটকে দূরে গিয়ে পড়ে। তার লোকদের যেমন, তারও বিনোদনের দরকার আছে। কয়েকটা ডাল কেটে পোলো খেলার লাঠি তৈরি করো।” সে চিৎকার করে বলে। “এইসব দুবৃত্তদের মাথা দিয়ে পোলো খেলা যাক। গোলপোস্ট হবে ঐ দূরের গাছগুলো।”

পুরো একটা ঘণ্টার জন্য, উদ্দাম খেলায় বাবর নিজেকে ডুবিয়ে রাখে। চকরাখদের ক্ষিপ্রগামী টাটুঘোড়ার একটা নিয়ে সে একেবেঁকে দাবড়ে বেড়ায় এবং শাখাপ্রশাখা ছেটে ফেলা গাছের ডাল দিয়ে ছিন্ন মস্তকগুলোকে সজোরে আঘাত করে। যাতে ঘাসের উপর দিয়ে লাফাতে লাফাতে সেগুলো গড়িয়ে যায়। শীঘ্রই সেগুলোকে আর কাটা মাথা বলে চেনার কোনো উপায় থাকে না- নাক, কান গুঁড়িয়ে যায়, অক্ষিকোটর থেকে অক্ষিগোলক বের হয়ে আসে এবং বাবর আর তার ঘর্মাক্ত সাথী খেলোয়াড়েরা আর সেই সাথে তাদের সবার ঘোড়া, রক্তের ফুটকিতে চিত্রিত হয়ে উঠে।

 অবশেষে খেলাটার প্রতি তার বিরক্তি জন্মায় কিন্তু ভেতরের জমে ওঠা হতাশা আর ক্ষোভ নিঃসৃত হওয়ায়, বাবর ঘামে ভিজে ওঠা ঘোড়াটাকে অবশেষে রেহাই দেয়। চারপাশে তাকাতে সে দেখে ওয়াজির খান তার দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। এই প্রথম সে তার চোখে বিরক্তি দেখতে পায়। কিন্তু বাবর তাতে বিন্দুমাত্র লজ্জি বোধ করে না। জীবিত বা মৃত, সে তার শত্রুদের সাথে তাদের প্রাপ্য ব্যবহারই করেছে।

 “চলো এবার যাওয়া যাক।” সে আদেশ দেয়। “গাভা এখনও অনেক দূরে, আর আমাদের গৃহকর্তাকে অপেক্ষা করিয়ে রাখাটা ঠিক হবে না।” বাবর ঘোড়ার পাঁজরে এত জোরে খোঁচা দেয় যে সেটা ছুটতে শুরু করে। বাবর সরাইখানা থেকে সোজা নদীর অগভীর অংশের দিকে এগিয়ে যায়।একবারও পেছনে ফিরে তাকায় না। আঙ্গিনায় পড়ে থাকা রক্তাক্ত মাথাগুলোকে ইতিমধ্যে কাকের দল ঠোকরাতে শুরু করেছে এবং সরাইখান মেয়ে দুটো পা ঈষৎ ধনুকের মত ফাঁক করে এগিয়ে গিয়ে চকরাখদের লাশগুলো হাতিয়ে দেখে যে বাবরের লোকেরা ভুলে কিছু রেখে। গেছে নাকি, যা তাদের বেশ্যাবৃত্তির পাওনার উপরি বলে বিবেচিত হতে পারে।

***

তিন সপ্তাহ পরে। উঁচু পাহাড়ী এলাকার তৃণভূমির উজ্জ্বল সবুজ ঘাসের মাঝে মাঝে ফুটে থাকা হলুদ গোলাপী আর সাদা ফুলের মাঝ দিয়ে বাবর আর তার লোকেরা দুলকি চালে ঘোড়া দাবড়ে শাহরুখিয়ার দিকে এগিয়ে যায়। গাভার অভিযানে ক্ষয়ক্ষতি হলেও তারাই জয়ী হয়েছে। তিনশ গজ দূরে ঘোড়ার পিঠে বসে থাকা অবস্থায় বাবর নিজে তীর ছুঁড়ে দূর্গের সেনাপতিকে হত্যা করেছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তার নিজের ব্যবহৃত ছোট নিখুঁতভাবে বাঁকানো ধনুক দিয়ে তীর ছোঁড়ার অভ্যাসে কাজ হয়েছে। ত্রিশটা শর ভর্তি তূণীর সে এক মিনিটের ভিতরে খালি করে ফেলতে পারে।

সেনাপতি মারা যাবার পরে, প্রতিরোধকারীদের মনোবল ভেঙে যায়। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সেনানিবাসের সৈন্যরা কেবল আত্মসমর্পনই করেনি, নিজেদের লুটের মাল পুরো তাদের হাতে তুলে দিয়েছে। যা বাবর আর তার লোকদের ঘোড়ার পিঠে ঝোলানো চামড়ার থলির উপচে পড়া আকৃতি সাক্ষ্য দিচ্ছে।

 ওয়াজির খান খুব খুশি হবে। এবারের অভিযান বাবরকে তার বুড়ো বন্ধুটির সহায়তা ছাড়াই পরিচালনা করতে হয়েছে। সরাইখানা আক্রমণ করার পরের দিন ওয়াজির খানের ঘোড়া সাপের ভয়ে বেমাক্কা লাফিয়ে উঠতে সে পড়ে গিয়ে উরুতে ব্যথা পেয়েছিলো। বাবরের সনির্বন্ধ অনুরোধে তিনি শাহরুখিয়ায় ফিরে যেতে রাজি হন বাইসানগারের সাথে যোগ দিতে, যাকে তারা সেখানের নিরাপত্তার দায়িত্ব দিয়ে এসেছে।

আজ রাতে তারা বিজয় উদযাপন করবে। সে তার লোকদের সম্মান জানাতে তাদের মাঝে উলুশ বিতরণ করবে। যোদ্ধাদের ভিতরে যারা সবচেয়ে সাহসিকতা আর বীরত্ব প্রদর্শন করেছে প্রথা অনুযায়ী আজ সে ভোজসভার শেষে তাদের মাঝে লুটের মালের সিংহভাগ বিলিয়ে দেবে এবং বাইসানগার আর ওয়াজির খানকে গাভা আক্রমণের কাহিনী শোনাবে। তার গল্প শুনে ওয়াজির খান সম্ভবত হেসে অস্থির হবেন এবং সদা গম্ভীর বাইসানগারের মুখেও সে আজ হয়তো হাসির আভাস দেখতে পাবে।

 পাথরের তৈরি দূর্গের অভ্যন্তরস্থ প্রাঙ্গনে প্রবেশের সাথে সাথে, বাবর তার ঘোড়ার পিঠ থেকে লাফিয়ে নেমে তাদের খোঁজে আশেপাশে তাকায়। বাইসানগারকে সে কোথাও খুঁজে পায় না। কিন্তু ওয়াজির খানকে আস্তাবলের সামনে দাঁড়িয়ে ঘোড়ার খুরের উপরের আর পেছনের অংশের কেশগুচ্ছ পর্যবেক্ষণ করতে দেখে। তার বুড়ো বান্ধবকে সামান্য খোঁড়াতে খোঁড়াতে তার দিকে এগিয়ে আসতে দেখলে: বাবর ভ্রূ কোঁচকায়। তারপরে সে তাকিয়ে দেখে ওয়াজির খানের মুখ আনন্দে আলোকিত হয়ে রয়েছে।

 “সুলতান, দারুণ সুখবর আছে! সত্যিই চমকে দেবার মত সুখবর!”

 “কি হয়েছে?”

 “এক সপ্তাহ আগে আকশি থেকে এক বার্তাবাহক এসেছে। আপনার সৎ-ভাই জাহাঙ্গীরের পক্ষে তামবালের বাণী নিয়ে সে এসেছে। অন্তত বার্তাবাহকের তাই ভাষ্য এবং সে বলেছে তারা আপনার আম্মিজান, নানীজান আর আপনার বোনকে আপনার কাছে পাঠাতে সম্মত আছেন।”

 “সে কি এর বিনিময়ে কিছু দাবি করেছে?”

 “সুলতান, প্রকাশ্যে তারা কিছু দাবি করেনি। আপনাকে সে কতোটা শ্রদ্ধা করে কেবল সে সম্পর্কে কিছু মধুর বাক্য ছাড়া।”

বাবরের হৃৎপিণ্ড আনন্দে নেচে উঠে। তার পরিবার শীঘ্রই তার সাথে মিলিত হবে। এই খবরটা আবার তাকে আবেগতাড়িত করে তোলে।

 “তারা এখানে কবে নাগাদ পৌঁছাবে?”

“সবকিছু ঠিক থাকলে আগামীকাল সূর্যাস্ত নাগাদ তাদের এখানে পৌঁছাবার কথা।”

 পরের দিন সন্ধ্যাবেলা, গোধূলির অস্তমিত আলোয় বাবরকে দূর্গের প্রকারবেষ্টিত সমতল ছাদে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। আজকের দিনের অধিকাংশ সময় সে এখানেই কাটিয়েছে। অস্থিরচিত্তে রাস্তাটা যেখানে একটা গিরিখাদের দিকে বাঁক নিয়েছে, সেদিকে চোখ কুঁচকে তাকিয়ে রয়েছে। ঘনায়মান আধো-অন্ধকারের ভিতর থেকে সে পিঠের দুপাশে ঝুড়ি ঝুলছে উটের এমন একটা তরঙ্গায়িত সারিকে বাঁক ঘুরে এগিয়ে আসতে দেখে। তাদের ঠিক পেছনেই রয়েছে যাত্রার শেষ পর্যায়ে মেয়েদের অভ্যর্থনা জানাতে। আর তাদের নিরাপদে দূর্গে নিয়ে আসবার জন্য, ওয়াজির খানের পরামর্শে, বাইসানগারের অধীনে পাঠানো সৈন্যবাহিনীর একটা চৌকষ দল।

বাবর এতদূর থেকে ঝুড়িতে ভ্রমণকারীদের চেহারা দেখতে পায় না। নিজেকে আর সামলে রাখতে না পেরে, এবং দেহরক্ষীদের কাউকে ডাকবার বা ঘোড়ার পিঠে জিন চাপাবার মতো ধৈর্যের মারাত্মক অভাব দেখা দেয়ায়, সে লাফিয়ে একটা খালি ঘোড়ার পিঠে চেপে বসে এবং সবুজ ঘাসে আচ্ছাদিত তৃণভূমির উপর দিয়ে ছোট কাফেলাটার দিকে ছুটে যায়।

তার রোদে পোড়া গাল বেয়ে দরদর করে কান্না ঝরতে থাকে। কিন্তু সেসব সে মোটেই পরোয়া করে না। আশেপাশে কেউ নেই তার কান্না দেখবার মতো এবং তার চেয়েও বড় কথা, দেখলে দেখুক সে থোড়াই পরোয়া করে। দুর্বলতার না, আজ এটা আনন্দের অশ্রু। এক হাতে ঘোড়ার কেশর আঁকড়ে ধরে সে অন্য হাতে গাল থেকে কান্না মুছে। বাবর ঘোড়াটার কানে কানে তাকে এমন গতিতে ছুটতে বলে, যাতে মনে হয় হঠাৎ তার পাখা গজিয়েছে।

কাফেলাটাকে পাহারা দিয়ে নিয়ে আনা সৈন্যদের থেকে চারজন সহসা আলাদা হয়ে বর্শা নিচু করে তার দিকে এগিয়ে আসে। যদিও বাইসানগার সম্ভবত ধারণা করতে পেরেছিলো খালি ঘোড়ার পিঠে এমন উদ্দাম ভঙ্গিতে কে তাদের দিকে ছুটে আসছে। কিন্তু তার মত অভিজ্ঞ পোড়খাওয়া যোদ্ধা তার কাছে এটাই প্রত্যাশিত যে সে নিজের লোকদের আদেশ দিয়েছে তার পরিচয় নিশ্চিত করতে। অশ্বারোহী দল নিকটবর্তী হতে, বাবর জোর করে নিজের ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে তাকে থমকে দাঁড়িয়ে পড়তে বাধ্য করে। ঘামে জবজব করতে থাকা দেহে নাক ঝেড়ে নিজের বিরক্তি প্রকাশ করে ঘোড়াটা।

 বাবর মাথাটা পেছনে হেলিয়ে দিয়ে তার পূর্বপুরুষের রণহুঙ্কার কণ্ঠে তুলে নেয়। “ফারগানা!”

 অশ্বারোহী দল এখন আরো কাছে চলে আসায় তারা তাকে চিনতে পেরে অভিবাদন জানায়। বাবর কোনোমতে তাদের অভিবাদনের জবাব দিয়ে উটের কাফেলা যেখানে যাত্রা বিরতি করেছে সেদিকে ঘোড়া ছোটায়। তার হৃদয় যদি আবেগে ভারাক্রান্ত না থাকত অন্যসময় হলে তাহলে সে হয়তো বাজারে নিয়ে যাওয়া মুরগীর মতো ভীরু ভঙ্গিতে বেতের ঝুড়ির ভিতর থেকে এসান দৌলতের উঁকি দেবার হাস্যকর ভঙ্গি দেখে হয়তো হেসেই ফেলতো। তার ওজন এতোটাই হাল্কা যে অন্যপাশের ঝুড়িতে ভারসাম্য রক্ষার জন্য বাঁধাকপির চেয়ে ভারী কিছু রাখতে হয়নি। আর তার বীণা ঝুড়ির বাইরে চামড়ার ফালি দিয়ে আটকানো রয়েছে। একটা বিশাল পুরু লোমের দুধসাদা রঙের উট যা বাবরকে এগোতে দেখে পচাৎ করে থুতু ফেলে সেটার দু’পাশে দুটো ঝুড়িতে খুতলাঘ নিগার আর খানজাদা আরোহন করেছেন। উটের পেছনে বাবর তার আম্মিজানের পরিচারিকা দলের কয়েকজন পরিচিত সদস্য, যাদের ভিতরে ফাতিমাও রয়েছে আর তার উজির কাশিমকে দেখতে পায়।

উটের চালকরা লাফিয়ে নেমে, উটের গ্রন্থিযুক্ত হাঁটুতে তাদের হাতের লাঠি দিয়ে আঘাত করে উটগুলোকে বাধ্য করে মাটিতে বসতে। বয়োবৃদ্ধ হবার কারণে, বাবর দৌড়ে প্রথমে এসান দৌলতের কাছে যায় এবং হাঁটু মুড়ে বসে তাকে আলতো করে ঝুড়ি থেকে তুলে আনে। বাবর কোনো কথা খুঁজে পায় না, আর এই প্রথমবারেরমতো মুখরা এসান দৌলতও বাক্যহারা হয়ে পড়েন। সে টের পায় নানীজান তার মাথা আলতো স্পর্শ করেন। সে উঠে দাঁড়িয়ে তার ছোট ছোট উজ্জ্বল চোখের দিকে তাকালে সেখানে তার পুরানো সত্ত্বার ঝলক দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। নানীজানকে এখন তিনি বরাবর যার জন্য গর্ব করেন,সেই খামের- চেঙ্গিস খানের রক্তের উত্তরসুরী এক নারীর মতোই দেখাচ্ছে।

সে এবার ঘুরে দাঁড়িয়ে তার আম্মিজানকে ঝুড়ি থেকে তুলে মাটিতে নামিয়ে দেয় এবং তাকে জড়িয়ে ধরে তার আশৈশব পরিচিত চন্দনকাঠের উষ্ণ সুগন্ধে বুক ভরে শ্বাস নেয়। সে তার আলিঙ্গন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে তাকিয়ে দেখে আম্মিজানের চোখে অশ্রু টলটল করছে। “বাছা তোমাকে আবার দেখতে পেয়ে খুশি হলাম,” কোনো রকমের আবেগ না দেখিয়ে তিনি বলেন, এবং তার মুখে একটা হাসির আভাস ফুটে উঠে যা বাবরের যেমনটা মনে আছে তার চেয়েও ম্লান এবং বলিরেখায় আকীর্ণ।

 খানজাদা ইতিমধ্যে তাকে বহনকারী ঝুড়ি থেকে নিজেই ধড়ফড় করে নেমে এসেছে। এবং সে সোজা ভাইকে লক্ষ্য করে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তার পোষা বেজী যেটা সে বামহাতে ধরে রেখেছে, কুইকুই করে প্রতিবাদ জানায়। শেষবার বাবর তার বোনকে দেখেছিলো হাড্ডিসার একটা মেয়ে, যার মুখে কয়েকটা দাগ রয়েছে। খানজাদা এখন রীতিমত একজন মহিলাতে পরিণত হয়েছে, তার দেহে ভরা নদীর জোয়ার বইছে। মুখ আগের চেয়ে অনেক দাগহীন আর সুন্দর। কিন্তু ফিচেল হাসি আগের মতোই আছে দেখে সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। সে তাকে জড়িয়ে ধরে এবং তারপরে ছেড়ে দিয়ে এক পা পিছিয়ে আসে ভালো করে তাকে দেখবে বলে।

 খানজাদাও কম যায় না সেও ভাইকে জরিপ করে। “তুমি লম্বা হয়েছে।” সে বলে, “আর তোমার কাঁধ আগের চেয়ে চওড়া হয়েছে। কিন্তু একি চেহারা হয়েছে। তোমার থুতনিতে ছাগলের মত দাড়ি আর চুলের অবস্থা যাচ্ছেতাই- তোমার চুল দেখছি আমার মত লম্বা! আর নখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না- কালো হয়ে আছে।”

বাবর পেছন থেকে, খানজাদার নাক কোঁচকানো বিশেষণগুলোর সমর্থনে এসান দৌলতকে জিহ্বা আর টাকরার সাহায্যে একটা শব্দ করতে শোনে এবং সে হেসে ফেলে। অবশেষে তার প্রিয়জনেরা তার কাছে এসেছে এবং সবকিছু যেমনটা থাকার কথা তেমনই রয়েছে। তাদের সাথে সে পরে কথা বলবে এবং শুনবে বিগত দিনগুলো তাদের কেমন কেটেছে। কিন্তু এখনকার মতো এই যথেষ্ট।

তারা দূর্গের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। অবশেষে মুক্তি লাভ করা ফারগানার শাহী রমণীদের অভ্যর্থনা জানাতে তূর্যনিনাদ আর রণভেরী গমগম আওয়াজে বেজে উঠে- অন্তত এখনকার জন্য হলেও তারা নিরাপদ।

দূর্গের উপরের তলায় প্রস্তুত রাখা জেনানামহলে মেয়েদের পৌঁছে দিয়ে, বাবর তার বঁধুনিকে ডেকে পাঠায়। তার পরিকল্পিত ভোজসভার সব আয়োজন কি অবস্থায় আছে তা জানতে। এখানের ভোজসভা সমরকন্দের মতো জাঁকজমকপূর্ণ হবে না। যেভাবে সে তাদের অভ্যর্থনা জানাতে চেয়েছিলো। অবশ্য, তাহলেও বিশটা ভেড়া জবাই করা হয়েছে আর আঙ্গিনায় সেগুলোকে আগুনে ঝলসানো হচ্ছে। মুরগীর পালক ছাড়িয়ে, আখরোট আর খুবানির সাথে মাখন দিয়ে সিদ্ধ করা হচ্ছে। আস্ত আপেল ঘন সোনালী বর্ণের মধু আর লাল রসে ভরা ডালিমের দানার সাথে কাঠবাদাম আর পেস্তার মিশ্রণে চিকচিক করছে। তাদের কোনো এক অভিযানে তার লোকদের লুট করা রূপালি বর্ণের কাঠবাদামের স্তূপের দিকে সে বিশেষ সন্তুষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে। এসান দৌলত অন্য যে কোনো মিষ্টির চেয়ে এগুলো বেশি পছন্দ করেন।

নির্মেঘ, তারা-শোভিত আকাশে চাঁদ উঠলে, এবং কোনো আকষ্মিক হামলা থেকে আগেই সাবধান করতে দূর্গপ্রাকারে সৈন্য মোতায়েন করে ভোজসভা শুরু হয়। বাবর আর তার লোকেরা নিচুলার একটা নিচু, লম্বা কামরায় আহার সারে। যখন উপরে নিজেদের কামরায় মেয়েদের তাদের পছন্দের অংশ পরিবেশন করা হয়। মোমবাতির কাঁপা আলোতে বাবরের লোকেরা উদাত্ত কণ্ঠে গান শুরু করে। বাকীরা যে নিচু কাঠের টেবিলের চারপাশে আসনসিঁড়ি হয়ে বসে আছে তাতে চাকুর বাট দিয়ে আঘাত করে তাল দেয়। বাবর ভাবে, তার লোকেরা খুশি হয়েছে। মেয়েদের মুক্তিতে তারাও প্রীত হয়েছে। তার সাথে সাথে তার লোকদেরও এটা সম্মানহানির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলো- যেনো মেয়েদের মুক্ত করার সামর্থ্য তাদের নেই।

বাবর খেতে চেষ্টা করে কিন্তু কিছুই খেতে পারে না। তার ইচ্ছা করে এখান থেকে উঠে যায় এবং তার আম্মিজান, খানজাদা আর এসান দৌলতের সাথে নিভৃতে সময় কাটায়। কিন্তু তার অনুসারীদের প্রতি সৌজন্যতাবশত তাকে আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। গানের মাত্রা ধীরে ধীরে চড়তে শুরু করে এবং ক্রমশ কর্কশ হয়ে উঠে। যোদ্ধার দল উচ্চকণ্ঠে নিজেদের পূর্বপুরুষের বীরত্বের কথা বয়ান করতে থাকে এবং বাবরও এবার তাদের সাথে কণ্ঠ মেলায়। কিন্তু অবশেষে, কেউ কেউ টেবিলের উপরে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়ে। আর অন্যেরা ঝাপসা চোখে টলোমলো পায়ে কামরা থেকে বের হয়ে বাইরের আঙ্গিনায় নিজেদের হাল্কা করতে শুরু করলে, বাবর তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে পাথরের বাঁকানো সিঁড়ি বেয়ে জেনানামহলের দিকে রওয়ানা দেয়।

 খুতলাঘ নিগার দু’হাত বাড়িয়ে দিয়ে তাকে স্বাগত জানায় এবং সে ভিতরে প্রবেশ করে গালিচা পাতা মেঝেতে তার পাশে এসে বসে। তাদের সামনের পিতলের থালায় পড়ে থাকা খাবারের অবশিষ্টাংশ দেখে সে বুঝতে পারে মেয়েরা ভালমতোই খেয়েছে। কিন্তু তারপরেও সে এখন যখন তাদের মুখের দিকে তাকায় সেখানে সে একটা টানটান অভিব্যক্তি লক্ষ্য করে। তাদের তিনজনকেই ফ্যাকাশে আর বিবর্ণ দেখায়। যেনো বহুকাল সূর্যের আলোর উষ্ণতা অনুভব করেনি বা তাজা বাতাসে তারা শ্বাস নেয়নি। কাউকে না কাউকে অবশ্যই এর মূল্য দিতে হবে- রক্ত দিয়ে। কিন্তু মেয়েদের খাতিরে আপাতত সে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করে না। তারা যাই বলুক তাকে, সে অবশ্যই সব কিছু শান্ত ভঙ্গিতে শুনবে।

 কিছুক্ষণ সবাই চুপচাপ বসে থাকে। প্রাথমিক উত্তেজনা প্রশমিত হতে, কেউই বুঝতে পারে না কোথা থেকে শুরু করা উচিত।

অবশেষে এসান দৌলত শুরু করেন: “বাবর তুমি তাহলে সরমকল দখল করেছিলে।” তার বিচক্ষণ মুখে বিরল একটা হাসির আভাস ফুটে উঠে।

“অধিকার করেছিলাম বটে, কিন্তু দখলে রাখতে পারিনি।” বাবর তার মাথা নিচু করে। এমন কিছু কথা আছে যা তাকে বলতেই হবে। “নানীজান, আমি আপনাকে হতাশ করেছি। আপনি আমার সাহায্য চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছিলেন এবং আমি সাহায্য করতে ব্যর্থ হয়েছি। আমার আসতে বড্ড দেরি হয়ে গিয়েছিল আর লোকজন ছিল অনেক অল্প।”

“আমাদের তুমি মোটেই হতাশ করনি। আর জেনে রেখো, আমাদের কারণেই তুমি সমরকন্দ হারিয়েছে। আমাদের সাহায্য করার জন্য তুমি সাথে সাথে যাত্রা করেছিলে। তুমি এরচেয়ে বেশি আর কিইবা করতে পারতে?”

বাবর আক্ষেপের সাথে মাথা নাড়ে। “ফারগানা আর আপনারা ছিলেন আমার প্রধান দায়িত্ব। সমরকন্দে আমি নতুন কোনো খেলনা হাতে পাওয়া শিশুর মতো আচরণ করেছিলাম। আমার তখন অন্য কিছু সম্বন্ধে ভাববার সামান্যই অবকাশ ছিলো। আপনাদের আর ফারগানার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য আমার উচিত ছিলো ওয়াজির খানকে পাঠিয়ে দেয়া।” সে তার মায়ের গায়ে হেলান দেয় এবং বরাবরের মতোই মায়ের আঙ্গুল তার চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে টের পায়। এতে সে কিছুটা শান্ত হয়।

“কিছু কিছু বিষয় তামবাল আমাদের কাছে কখনও গোপন করেনি।” খুতলাঘ নিগার বলেন। “আমার মনে হয় এতে সে আনন্দই পেতো। আমরা, তোমার চাচাতো ভাই মাহমুদের বিশ্বাসঘাতকতার কথা অবশ্যই জানি- আমরা জানি সেই সমরকন্দ তোমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে। বাছা, সে আর তামবাল মিলে তোমার জন্য একটা ফাঁদ পেতেছিলো। তারা দু’জনে মিলে ঠিক করেছিলো, ফারগানায় সে তোমাকে মসনদ থেকে সরিয়ে দিয়ে জাহাঙ্গীরকে তোমার স্থলাভিষিক্ত করবে। তারা জানতো এর ফলে তুমি বাধ্য হবে- তোমার বেশিরভাগ সৈন্য নিয়ে ফারগানায় ফিরে আসতে। আর মাহমুদ এর ফলে তার কাঙ্ক্ষিত সুযোগ পায়। তুমি তখন সদ্য সমরকন্দের সুলতান হয়েছে। তারা বলেছে যে সেখানকার অভিজাত ব্যক্তিরা তোমার প্রতি তেমন একটা আনুগত্য বোধ না করায়, মাহমুদ আর তার কলহপ্রিয় স্ত্রী, গ্রান্ড উজিরের কন্যা সহজেই ঘুষ দিয়ে তাদের কিনতে পেরেছে।”

 নিজের সবচেয়ে জঘন্য সন্দেহটা প্রমাণিত হতে বাবর চোখ বন্ধ করে ফেলে। কি আহাম্মকই না সে ছিলো।

“তোমার এটাও জেনে রাখা উচিত, মাহমুদের স্ত্রীর কারণে সে গো ধরায় আলি মজিদ বেগকে হত্যা করা হয়েছিলো।” এসান দৌলতের কণ্ঠস্বর তিক্ত শোনায়। নিহত গোত্রপতির মা ছিলো তার বান্ধবী আর তিনি নিজেও তাকে পছন্দই করতেন। “সে নাকি বলেছে তোমার শিরোচ্ছেদ করতে না পারায়, তাকে শিরোচ্ছেদ করলেই আপাতত চলবে- তার বাবার মৃত্যুর প্রতিশোধ হিসাবে। মাহমুদ তার কথা ফেলতে পারেনি। সবাই বলে সেই আসলে সমরকন্দের নতুন শাসক। নিজের বাবার চেয়েও সে বেশি লোভী আর প্রতিহিংসাপরায়ণ।”

বাবর বিস্ময়ে চোখ পিটপিট করে। সে ভাবতেও পারেনি সেই সুঠামদেহী তরুণী, যে এমন সাহসিকতার সাথে গ্রান্ড উজিরের প্রাণ ভিক্ষা চেয়েছিলো কিভাবে এতো অনুভূতিহীন নিষ্ঠুর আর নির্মম হতে পারে। একদিন তাকে অবশ্যই তার এই স্পর্ধার জন্য জবাবদিহি করতে হবে। কিন্তু সেটা পরেও হতে পারে। তার আগে তাকে অন্য অনেক বিষয় জানতে হবে এবং সেগুলো মেনে নিতে হবে।

সে আলতো করে দু’হাতের মাঝে মায়ের হাত জড়িয়ে ধরে। “আমাকে তোমাদের কথা বলল। তোমরা বন্দি থাকা অবস্থায় কেমন আচরণ করছে তারা তোমাদের সাথে?”

 “কয়েকজন মাত্র পরিচারকসহ আমাদের একটা ছোট জায়গায় আটকে রাখা হয়েছিলো কিন্তু আমাদের বংশ গৌরব আর মর্যাদার কারণে তারা বাধ্য হয়েছিলো আমাদের যথাযথ সম্মান দেখাতে। তামবাল আমাদের অপমান বা হুমকি দেয়নি।” তার মা বলে, “আর সম্প্রতি- সম্ভবত তোমার সাফল্যের কথা যখন সে জানতে পারে- আমাদের বড় একটা মহলে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো।”

“আর সে রোক্সানাকে আমাদের গহনা কেড়ে নিতে দেয়নি। অবশ্য অন্যদের মুখে শুনেছি সে ক্রুদ্ধ হয়ে চেঁচামেচি করেছে, যদিও সে তামবালের অঙ্কশায়িনী ছিলো।” এসান দৌলত কুপিত কণ্ঠে কথাগুলো বলেন।

 “আর আমার সৎ-ভাই জাহাঙ্গীর? এসবে তার ভূমিকা কতটুকু?” বাবর প্রায়ই তার স্থান দখল করে নেয়া বালকটার কথা ভাবে যাকে সে কখনও দেখেনি। শেষবার আকশি থেকে আসবার সময়ে, সমরকন্দ অবরোধের প্রস্তুতি নেবার সময়ে, ছোঁড়া অসুস্থ ছিলো।

 “বেচারা পরিস্থিতির শিকার, আর প্রায়ই অসুস্থ থাকে। তামবালের পুরো শরীরে কয়েক চামচ পরিমাণ রাজরক্ত থাকায় সে কখনও নিজে সিংহাসন দাবি করতে পারবে না। অন্য গোত্রপতিরা সেটা তাকে করতেও দেবে না। কিন্তু জাহাঙ্গীরের রাজপ্রতিভূ হিসাবে যে ক্ষমতার জন্য সে লালায়িত সেটা অর্জন করতে পারবে।” এসান দৌলত ভাবাবেগশূন্য কণ্ঠে কথাগুলো বলেন। “সে এখন তোমাকে ভয় পায়। সে যদি তোমাকে খুশি করতে না চাইতো, তাহলে আমাদের এতো সহজে মুক্তি দিতো না?”

 সুলতান হিসাবে বাবর নিজের প্রথম দিনগুলোর কথা ভাবে, তার মনে পড়ে তামবাল তখন কিভাবে অন্য নেতাদের মনে সন্দেহের বীজ বপনের চেষ্টা করেছে। সব সময়ে সে নিজের উচ্চাকাঙ্ক্ষা নিবৃত্ত করার চেষ্টারত ছিলো। কী সাংঘাতিক সুবিধাবাদি এক লোক- কামবার আলীর ষড়যন্ত্রে যোগ দেবার ব্যাপারে ভীষণ বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে সঠিক সময়ের জন্য ধৈর্যসহকারে অপেক্ষা করেছে। এজন্যই কি সমরকন্দ দুবার অবরোধ করতে সে তাকে প্ররোচিত করেছিলো? বাইসানগার যখন তৈমূরের অঙ্গুরীয় নিয়ে এসেছিল তখন আগ্রহে চকচক করতে থাকা তামবালের চেহারা তার এখনও মনে আছে। তার আরো মনে আছে, সমরকন্দ অধিকার করার পরে কি রকম তাড়াহুড়ো করে সে ফারগানা ফিরে এসেছিলো।

“আমাদের জন্য সবচেয়ে কঠিন সময় ছিলো প্রথম কয়েক মাস, যখন আমরা জানতাম না তোমার ভাগ্যে কি ঘটেছে। ফাতিমা- তুমি জান সে কেমন গপ্পোবাজ সে একবার একটা কথা শুনে আসে- একটা গুজব কিন্তু সেটাই আমাদের আতঙ্কিত করে তোলার জন্য যথেষ্ট ছিলো- যে তুমি ফারগানায় ফিরে আসার সময়ে পথে অসুস্থ হয়ে মারা গিয়েছে। তার মায়ের কণ্ঠস্বর কেঁপে যায়। কিন্তু তারপরেই আমরা শুনতে পাই যে তুমি সুস্থ আছো, আর পাহাড়ে আত্মগোপন করে রয়েছে। আমরা জানতাম না কোনটা সত্যি। যতদিন না তামবাল ক্রুদ্ধ হয়ে আমাদের কাছে আসে…সে আমাদের বলে তুমি গ্রামের পর গ্রাম আক্রমণ করে, সবকিছু জ্বালিয়ে দিচ্ছ, তছনচ করে দিচ্ছ এবং নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছো, কাউকে রেয়াত না দিয়ে।”

 “তামবাল যা বলেছে, সেটাই তাহলে সত্যি, তাই না বাবর? যে তুমি একজন সাধারণ দস্যু আর গরু-চোরে পরিণত হয়েছো?” এসান দৌলত প্রশ্রয়ের কণ্ঠে বলেন।

বাবর সম্মতি প্রকাশ করে মাথা নাড়ে এবং মুহূর্ত পরে নানীজানের দিকে তাকিয়ে সেঁতো হাসি হাসে। তার মা আর নানী তার সম্বন্ধে কি ভাববে সেটা নিয়ে সে প্রায়ই দুশ্চিন্তা করতো। তারা কি কখনও বুঝতে পারবে কেনো একজন শাহজাদা পাহাড়ী দুৰ্বত্তের জীবন গ্রহণ বাস্তবিক পক্ষে উপভোগ করতে পারে।”

“বাবর, আমাদের সেসব কথা বল।”

পশুর চর্বি দিয়ে তৈরি মোমবাতির দপদপ করতে থাকা শিখা নিভু নিভু হয়ে আসতে, বাবর তার সময় কিভাবে কেটেছে সেটা তাদের কাছে বর্ণনা করতে চেষ্টা করে। দুইশ কি তিনশ অভিযাত্রীর একটা বাহিনী নিয়ে, পাহাড়ের উপর থেকে ধেয়ে আসবার উত্তেজনাই আলাদা। রাতের বেলা তামবালের অনুগত বাহিনীর দূর্গ ঝটিকা আক্রমণের উল্লাস। আর তার পরে রাতের আঁধারে হারিয়ে যাবার, তার পর্যাণে বাধা শিকারের ছিন্নমস্তক থেকে টপটপ করে ঝরে পড়া রক্তের ধারার অনুপ্রেরণা। প্রাচীন মোঙ্গল প্রণালী অনুসরণে তার দলের এক লোক। ঘোড়ার দুধ গজিয়ে যে খভাস তৈরি করতো সেটা পান করার কারণে মাথা ঘুরতে থাকলে সারা রাত ধরে পানোন্মত্ত অবস্থায় ফুর্তি করা। চকরাখদের ছিন্নমস্তক দিয়ে উদ্দাম পোলো খেলার কথা সে কেবল এড়িয়ে যায়। যদিও খানজাদাকে হয়তো পরে সে সেটাও বলবে। তার কথা বলার সময়ে খানজাদার চোখ চকচক করতে থাকে। তার হাতের মুঠি খোলে আর বন্ধ হয়, যেনো সে নিজে সেখানে ছিলো। তার সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছে। এসান দৌলতও মগ্ন হয়ে শোনেন। কিন্তু সে খেয়াল করে মৃত্যুর করাল থাবার হাত থেকে অল্পের জন্য বেঁচে যাবার ঘটনাগুলো শোনার সময়ে তার মায়ের ভ্রু কুঁচকে উঠে।

 “আমি কিন্তু কেবল যারা আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে তাদেরই আক্রমণ করেছি। আর আমি কখনও তোমাদের কথা ভুলে যাইনি। তোমাদের স্বাধীনতা আমার মসনদের চেয়েও বেশি কাম্য ছিল আমার কাছে।” চারপাশে তাকিয়ে, বাবর দেখে গবাক্ষের সরু ফাঁক দিয়ে ফ্যাকাশে, ধুসর আলোর একটা ধারা লুকিয়ে কখন যেন কামরায় প্রবেশ করেছে। প্রায় সকাল হয়ে এসেছে।

 “তুমি এটা অর্জন করেছে। কিন্তু যা হয়ে গেছে তা হয়ে গেছে। এখন আমাদের ভবিষ্যতের দিকে তাকাতে হবে।” এসান দৌলতের কণ্ঠে একটা সতেজতা ফুটে থাকে এবং তার দৃষ্টি বাবর নিজের উপরে অনুভব করলে সে অস্বস্তিবোধ করে, যেন কোনো বাচ্চা ছেলে এখনই তার ওস্তাদের কাছে ধমক খাবে। “বাবর, তুমি এই ক’দিনে কি শিখেছো?” নানীজান তার দিকে ঝুঁকে এসে তার কব্জি আঁকড়ে ধরে। “ তোমার কথা অনুযায়ী মসনদহীন দিনগুলো থেকে তুমি কি শিখেছো?”

যুক্তিসঙ্গত একটা প্রশ্ন। এই বিপজ্জনক, মরীয়া সময় তাকে কি শিক্ষা দিয়েছে? “বিশ্বস্ত বন্ধু আর মিত্রের গুরুত্ব,” সে অবশেষে কথা খুঁজে পেয়ে বলে, “এবং তাদের যোগ্যতা অনুসারে প্রতিদান দেয়া। এছাড়া পরিষ্কার উদ্দেশ্য, একাগ্রচিত্ত কৌশল আর সেটা অর্জনের পথে কোনো কিছুকে বাধা হিসাবে গণ্য না করার প্রয়োজনীয়তা।”

এসান দৌলত সন্তুষ্টির মাথা নাড়েন। “অবশ্যই। এবং এছাড়া আর কি?”

“আমি শিখেছি একজন সুলতানের পক্ষে সবসময়ে উদারতা দেখান সম্ভব না, শ্রদ্ধা অর্জনের জন্য তাকে কঠোর হতে হবে- কখনও নির্মম। অন্যথায় তাকে দুর্বল মনে হবে। নেতৃত্ব দেবার বদলে সবার ভালবাসার পাত্রে পরিণত হবার ঝুঁকি দেখা দিতে পারে। আর সেই সাথে মিষ্টিভাষী ষড়যন্ত্রকারীর ফাঁদে পা দিয়ে বসতে পারে। আমি শিখেছিঃ আনুগত্য অর্জন করতে হলে কেবল কৃতজ্ঞতা আর সম্ভ্রম উদ্রেক করলেই চলবে না। এর সাথে সামান্য ভয়েরও মিশেল থাকতে হবে। আমি প্রথমবার ফারগানার শাসক হবার পরে বাকী বেগ, বাবা কাশক, আর ইউসুফকে প্রাণদণ্ড দেয়া উচিত ছিলো। তার বদলে আমি কেবল তাদের শাহী দায়িত্বপালন থেকে অব্যাহতি দিয়েছিলোম এবং জীবন ধারণের জন্য কোনো বাধা না দিয়ে বরং মনের ভিতরে তাদের তিক্ততা পোষণের সুযোগ দিয়েছি। এছাড়া, সমরকন্দ দখল করার পরে গ্রান্ড উজিরের কতিপয় সমর্থককেও কড়কে দেয়া উচিত ছিলো।

 “তারচেয়েও বড় কথা, আমার নিয়তির প্রতি আমি আর কখনও অবহেলা প্রদর্শন করবো না। আমাদের সাথে আমার সাথে যা ঘটেছে তারপরেই কেবল আমি হাল্কা হাল্কা বুঝতে পারছি মানুষ তৈমূর লোক হিসাবে কেমন ছিলেন। মাঝে মাঝে তার নিজেকে কেমন একা মনে হয়েছে- নিজের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কাজ করতে গিয়ে তাকে কেমন অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়েছিলো। আর তাছাড়া, তাদের সব দায়দায়িত্ব পরে বহুবছর ধরে তাকে নিজের কাঁধে বহন করতে হয়েছিলো… আমি নেতৃত্ব দেবার মতো সাহসও অর্জন করেছি…ওয়াজির খানের মতো আমার যতো দক্ষ পারিষদ থাকুক আমার নিয়তি কেবল আমিই নির্ধারণ করতে পারি।

বাবর মুখ তুলে তার নানীজানের দিকে তাকায়। “দেখে নিয়ে, আমি ঠিক তৈমূরের মতই বীর হবো। আমি শপথ করে বলছি…”

 “কথাগুলো সত্যিই শুনতে ভাল লাগে।” এসান দৌলত মন্তব্য করেন। “চলো আমাদের অনেক কাজ এখনও বাকি আছে। একটা নতুন দিনের প্রভাত হচ্ছে।”

দ্বিতীয় খণ্ড – সালতানাৎবিহীন এক সুলতান

০৭. আয়োধন আর অন্তর্ধান

 বৃষ্টি আর তুষারপাতের মিশ্রণের প্রকোপ বাবরের ভেড়ার চামড়ার প্রলেপ দেয়া ভারী জ্যাকেটের আবরণও আটকাতে ব্যর্থ হয়। ফারগানার উত্তরে উঁচু পর্বতমালার অভ্যন্তরে এক প্রত্যন্ত উপত্যকার ভিতর দিয়ে বয়ে যাওয়া একটা ক্ষুদ্র স্রোতস্বিনীর তীরের প্রায় কাদা হয়ে থাকা বরফের ভিতর দিয়ে তার অবশিষ্ট লোকদের সামনে থেকে ঘোড়া নিয়ে এগিয়ে চলেছে, বৃষ্টি আর তুষারপাতের হাত থেকে বাঁচতে মাথা নিচু করে রাখা।

নিজের দুটো সালতানাই হারিয়েছে এটা অনুধাবন করার পরের প্রথম দিকের মুশকিল দিনগুলোতে, বাবর আকশি দূর্গের আশেপাশেই থাকবে বলে ভেবেছিলো আশা করেছিলো সব কিছু বাজি রেখে হলেও সে তার পরিবারকে মুক্ত করতে পারবে। ওয়াজির খান অনেক কষ্টে তাকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছে যে, তার শত্রুরাও এমনই একটা মরীয়া প্রচেষ্টা আশা করছে আর তারা সেজন্য পুরোপুরি প্রস্তুত হয়ে রয়েছে। ওয়াজির খান, তার চিরাচরিত পিতৃসুলভ ভঙ্গিতে তাকে আশ্বস্ত করে পরামর্শ দিয়েছে, “আপনি যদি আপনার আম্মিজান, নানীজান আর বোনকে বাঁচাতে চান তাহলে নিজেকে বিপদের মুখে না ফেলে বরং শত্রুদের তটস্থ করে তুলেন, যাতে তারা আপনার নাম শুনলেই ভয় পায়। আর সেটা করতে হলে তাদের চাপের ভিতরে রাখেন। এখানে সেখানে তাদের আক্রমণ করে, আপনার বিরুদ্ধে সৈন্য সমাবেশ করবার আগেই সেখান থেকে সরে আসেন। ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে সবসময়ে একটা ভীতির সঞ্চার করতে থাকেন। আপনার শত্রুরা যাতে শান্তিতে ঘুমাতে না পারে। আর এটা করতে পারলেই সুলতান, তারা আপনার পরিবারের ক্ষতি করার কথা চিন্তাও করতে পারবে না।”

বাবর ওয়াজির খানের বক্তব্য মোটের উপরে বুঝতে পারে। সাবধানে বিবেচনা করে, সে একটা পরিকল্পনার কথা বলে। আমাদের একটা নিরাপদ আশ্রয়স্থল চাই। যেখানে আমরা শীতকালটা কাটাতে পারবো এবং প্রথম হামলার ছক কষতে পারবো। আমার মনে আছে যে প্রতিবার গ্রীষ্মের সময়ে সামরিক প্রশিক্ষণের অংশ হিসাবে আপনি একবার আমাকে উত্তরের পার্বত্য অঞ্চলে একটা অভিযানে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং উপত্যকার কেন্দ্রস্থলে একটা মাটির দূর্গে আমরা অবস্থান করেছিলাম। তামবালের অনুগত এক জায়গীরদার সেই নগণ্য সেনাছাউনির প্রধানের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলো। সেই দূর্গটা আমাদের জন্য চমৎকার আশ্রয়স্থল হিসাবে প্রতিপন্ন হতে পারে। কারো মাথাতেই বিষয়টা আসবে না। আপনি কি বলেন?”

“জায়গার কথা আমার মনে আছে। বাস্তবিকই প্রত্যন্ত অঞ্চলে দূর্গটা অবস্থিত, আর আমাদের উদ্দেশও হাসিল হবে।”

আর সে জন্যই সে ওয়াজির খানকে নিয়ে পাহাড়ের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেছিলো। তাদের সাথে কেবল দুশো লোক ছিলো। ওয়াজির খানের সাহায্যে বাবর অনেক যত্ন নিয়ে তাদের বাছাই করেছে, সে কেবল তাদেরই বাছাই করেছে যাদের বয়স অল্প আর কোনো পারিবারিক পিছুটান নেই বা বাইসানগারের মতো যারা তার বিশ্বস্ত অন্তরঙ্গ। বাকি সবাইকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে, তার ডাকের অপেক্ষা করতে বলেছে, যা তারা নিশ্চিতভাবেই পাবে। তাদের যাত্রার দ্বিতীয় সপ্তাহে তুষারপাত শুরু হয় এবং উচ্চতা বাড়বার সাথে সাথে তুষারের স্তর বৃদ্ধি পেয়ে তাদের যাত্রাকে শ্লথ করে তুলেছে।

 “ওয়াজির খান, আপনার কি মনে হয় আমরা দূর্গ থেকে কতোটা দূরে অবস্থান করছি?”

“সুলতান, আবহাওয়া যদি এতোটা বিরূপ না হতো, আমরা তাহলে দূর্গটা এতক্ষণে দেখতে পেতাম। অবশ্য সুবিধাও হয়েছে, দূর্গের নিরাপত্তা রক্ষীরা আমাদের আগে থেকে দেখতে পাবে না। দূরের ঐ গাছগুলোর আড়ালে আমরা অবস্থান নেবো আর সামনেটা রেকী করার জন্য গুপ্তদূত পাঠিয়ে আমরা পর্যাণে যেটুকু শুকনো মাংস রয়েছে সেটা দিয়ে আহার সেরে নেবো।”

তাদের পাঠানো গুপ্তদূতেরা রেকী করে ফিরতে যে নব্বই মিনিট সময় লাগে তার পুরোটা সময়ই অবিশ্রান্তভাবে তুষারপাত হয়। কখনও ভারী বা কখনও হাল্কাভাবে। তার লোকেরা ফিরে আসতে দেখা যায়, ঘোড়া আর তার আরোহী তুষারে পুরো ঢেকে গেছে এবং গুপ্তদূতদের দলনেতা ঠাণ্ডায় নীল হয়ে আসা ঠোঁটে কোনোমতে কথা বলে। “এখান দু’মাইল দূরে একটা বাকের পরেই দূর্গটা অবস্থিত। দূর্গের বাইরে আমরা কোনো ঘোড়ার বা পায়ের ছাপ দেখতে পাইনি যাতে বোঝা যায়, আজ ভেতর থেকে কেউ টহল দিতে বা পর্যবেক্ষণ-ফাঁড়িতে যায়নি। আমরা যখন ঘোড়া থেকে নেমে দূর্গের কাছে এগিয়ে যাই, দূর্গের এক অংশ থেকে আমরা ধোয়া উঠতে দেখেছি- সম্ভবত রসুইখানা- কিন্তু তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো দূর্গের মূল ফটক তখন ভোলা ছিলো। স্পষ্টতই এই আবহাওয়ায় কেউ আক্রমণ করতে পারে সেই ব্যাপারটা তাদের মাথাতেও নেই।”

“চমৎকার, শীঘ্রই তাদের এই নিশ্চয়তা নরকে পরিণত হতে চলেছে। ওয়াজির খান, এটা ইতস্তত করার সময় না, সবাইকে এই মুহূর্তে প্রস্তুত হতে বলুন এবং তুষারপাতের মাঝে আমরা আত্মগোপন করে গুপ্তদূতদের সহায়তায় দূর্গে পৌঁছাবার পথের শেষ বাঁকে দ্রুত আর নিরবে গিয়ে হাজির হবো। সেখান থেকে মূল ফটকের উদ্দেশ্যে ঘোড়া দাবড়ে যাবো।”

 ওয়াজির খান মাথা নেড়ে সম্মতি জানায় এবং পাঁচ মিনিট পরে অশ্বারোহী বাহিনীর একটা সারিকে মন্থর গতিতে পাহাড়ী পথ বেয়ে উপরের দিকে উঠে যেতে দেখা যায়। তুষারাবৃত প্রেক্ষাপটের মাঝ দিয়ে প্রায় দু’মাইল এগিয়ে যায়। তুষারপাত এখন আগের চেয়ে অনেক কমে এসেছে। বাবরের চোখের সামনে একটা পাথুরে অবয়ব ভেসে ওঠে। দূর্গটা আর মাত্র হাজারখানেক গজ সামনে অবস্থিত। এখান। থেকে দূর্গ পর্যন্ত রাস্তাটা বেশ প্রশস্ত।

 “আমরা এখান থেকেই আক্রমণ শুরু করবো। লোকদের বলেন অপ্রয়োজনীয় সবকিছু এখানে পাথরের আড়ালে রেখে কেবল হাতিয়ার নিয়ে প্রস্তুত হতে। যাতে বরফের উপর দিয়ে যতোটা সম্ভব দ্রুত ঘোড়া দাবড়ে আমরা দূর্গে পৌঁছাতে পারি।” তার লোকেরা নিরবে প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। কিন্তু তারা প্রস্তুত হতে হতে তুষারপাত একেবারে বন্ধ হয়ে যায় এবং সামনে- সাদা প্রেক্ষাপটের মাঝে একটা কালো আকৃতির মত দূর্গটা ভেসে উঠে।

 “যারা প্রস্তুত, ঘোড়ায় আরোহন করো! কারো চোখে পড়ে যাবার আগেই আমাদের আক্রমণ করতে হবে!” বাবর চিৎকার করে কথাটা বলার ফাঁকে ময়ান থেকে আলমগীর বের করে আনে। সে লাফিয়ে জিনের উপরে উঠে বসে এবং তার বিশাল কালো ঘোড়াটাকে দূর্গের দিকে এগোতে বলে পেটে খোঁচা দেয় যার ফটক সে খোলা দেখতে পেয়েছে। দশজন যোদ্ধা পরিবেষ্টিত অবস্থায় এবং বাকীরা তার পেছনে সারিবদ্ধভাবে বিন্যস্ত। ঘোড়ার কাধ ধরে ঝুঁকে ছুটে যাবার সময়ে বাবর টের পায় তার কানে রক্তের চাপ বৃদ্ধি পেয়েছে। দূর্গের ফটক থেকে সে যখন মাত্র দুশো গজ দূরে, তখন ভেতর থেকে একটা চিৎকার তার কানে ভেসে আসে- শত্রুরা তাদের দেখে ফেলেছে। ভেতরের লোকেরা বিপদ টের পায়। তারা ফটকের পাল্লা বন্ধ করার চেষ্টা করতে সেটা কেঁপে উঠে। কিন্তু নতুন জমা বরফ পাল্লা নড়তে বাধা দেয়। দু’জন লোক বাইরে ছুটে আসে, বরফের স্তূপে লাথি দেয় এবং বৃথাই চেষ্টা করে পাল্লাটা বরফের উপর দিয়ে সরাতে।

 “ব্যাটাদের পেড়ে ফেলো!” বাবর হুঙ্কার দিয়ে বলে। কিন্তু ঘোড়ার গতি বিন্দুমাত্র হ্রাস করে না। নিমেষের ভিতরে সে একজনকে মাটিতে পড়ে যেতে দেখে, একটা তীর তার গলায় বিদ্ধ হয়েছে। একই সাথে সে নিজেও দূর্গের তোরণদ্বারের কাছে পৌঁছে যায়। দ্বিতীয় লোকটাকে সে আলমগীর দিয়ে একটা কোপ বসিয়ে দেয়। টের পায় তার তরবারি জায়গা মতোই নরম মাংসপেশীতে কামড় বসিয়েছে। কিন্তু কোথায় সেটা দেখবার জন্য সে ঘোড়ার গতি একটুও হ্রাস করে না। তার বদলে, সে তার হাতে ধরা লাগামে একটা ঝাঁকি দিয়ে ঘোড়ার মাথা তখনও আংশিক খোলা ফটকের দিকে ঘুরিয়ে দেয়। বিশাল কালো ঘোড়াটা নাক দিয়ে একটা শব্দ করে এবং বাবর টের পায় ঘোড়াটার একটা পা পিছলে গেছে কিন্তু কালো পাহাড় ঠিকই ঘুরে দাঁড়ায়। একই সাথে তার পেছনে তিনজন যোদ্ধা এসে হাজির হয়।

কিন্তু চতুর্থজন ঢুকতে ব্যর্থ হয়। ভেতরে প্রবেশপথ আটকে ঘোড়া আর তার আরোহীর ভূপাতিত হবার শব্দ বাবর শুনতে পায়। সে দূর্গের ভিতরে প্রবেশ করেছে বটে। কিন্তু তাকে সহায়তা করবার জন্য মাত্র তিনজন যোদ্ধা তার সাথে রয়েছে। চারপাশে তাকালে সে সারি সারি স্থাপিত উঁচু দরজার পেছন, সম্ভবত দূর্গের প্রধান সেনানিবাস থেকে পিলপিল করে লোকজনকে বের হয়ে আসতে দেখে। কেউ কেউ ইস্পাতের বর্ম গায়ে চাপাতে ব্যস্ত। আর বাকিরা ইতিমধ্যে অস্ত্রধারণ করেছে।

“আমার সাথে এসো! এখনই আক্রমণ করতে হবে!” বাবর পেটে খোঁচা দিয়ে পুনরায় তার ঘোড়ার গতি বৃদ্ধি করে। আর একটু পরেই তাকে তার তিনজন সহযোদ্ধাকে নিয়ে আতঙ্কিত লোকগুলোকে কচুকাটা করতে দেখা যায়। সহসা একটা লম্বা লোক বাবরের নজর কাড়ে, যাকে দেখে সেনাপতিদের একজন বলে মনে হয়। ব্যাটকে মাথা নিচু করে পুনরায় ঘরের ভিতরে প্রবেশ করতে দেখলে সেও ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে সেদিকে এগিয়ে যায়। কাঠের সরদলের নিচে দিয়ে ঝুঁকে পার হয়ে সে ভেতরের আধো অন্ধকারে চোখ পিটপিট করে প্রবেশ করতে যে বিশ ত্রিশজন সেখান থেকে বের হয়ে এসেছে, বুঝতে হবে সেটাই এই দূর্গের মোট জনবল। কেবল সেনাপতিগোছের লোকটাই এখন ভেতরে রয়েছে। লোকটা দৌড়ে একটা অস্ত্র সজ্জিত তাকের দিকে ছুটে গিয়ে সেখান থেকে একটা বর্শা আর ঢাল তুলে নিয়ে বাবরের দিকে ঘুরে দাঁড়ায়।

“ফারগানার ন্যায়সঙ্গত সুলতান, আমি বাবর তোমাকে আদেশ দিচ্ছি অস্ত্র নামিয়ে রাখো।”

 “আমি আত্মসমর্পন করবো না। তোমাকে আমি সুলতান বলে মানি না। আমার নাম হানিফ খান। আমি তামবালের প্রতি অনুগত, সেই এখন পুরো এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে। পারলে সম্মুখ যুদ্ধে আমাকে পরাস্ত করো।”

বাবর তার কালা পাহাড়ের উপর থেকে লাফিয়ে নামে এবং আলমগীর হাতে ধরা অবস্থায় হানিফ খানের দিকে এগিয়ে যায়। যে তক্কে তক্কে ছিলো বাবর তার। কাছাকাছি যেতেই হাতের বর্শা দিয়ে সে বাবরকে আঘাতের চেষ্টা করে। বাবর লাফিয়ে একপাশে সরে যায়। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে অর্ধভুক্ত খাবারে ভর্তি একটা নিচু টেবিলের পায়ার সাথে তার বাম পা আটকে যায়। বেকায়দা ভঙ্গিতে সে টেবিলের উপরে আছড়ে পড়ে। টেবিলের উপরে থাকা কাঠের পেয়ালা আর তার ভেতরের খাবার ছিটকে ফেলে। মাংসের সুরুয়া অর্ধেকটা ভর্তি একটা বিশাল ধাতব পাত্রের মুখে তার তরবারি ধরা হাতের কব্জি আটকে যেতে, আলমগীর তার মুঠো থেকে ছুটে যায়।

হানিফ খান বাবরের অসহায় অবস্থার সুযোগে তাকে একেবারে শেষ করে দেবার জন্য ছুটে আসে। তার বর্শাটা দু’হাতে মাথার উপরে তুলে বাবরের উন্মুক্ত গলায় সেটা সর্বশক্তিতে নামিয়ে আনবে। বাবর একটা কাঠের বড় বারকোশ তখন তুলে নিয়ে সেটাকে ঢালের মত ব্যবহার করে। বর্শা বারকোশে বিদ্ধ হয়। তবে সেটাকে ছিন্ন করতে পারে না। ছিটকে পড়া খাবারের উষ্ণ চটচটে সুরুয়ার ভিতরে গড়িয়ে একপাশে সরে যাবার সময়ে সে বারকোশটা ফেলে দিয়ে বর্শার হাতল ধরে মোচড় দেয় এবং হানিফ খানের হাত থেকে সেটা টেনে নেয়।

বিন্দুমাত্র দমে না গিয়ে হানিফ খান, লাফিয়ে পেছনে সরে গিয়ে কোমরের পরিকর থেকে একটা সরু খঞ্জর টেনে বের করে। আলমগীর কোথায় পড়েছে সেটা দেখার সময় নেই বাবরের, হাতের বর্শাটা দিয়ে সে লোকটাকে সজোরে আঘাত করলে ফলার মাথায় আটকানো বারকোশটা খুলে পড়ে। আর একই সময়ে, নিজের গালে সে একটা তীক্ষ্ণ ব্যাথা অনুভব করে। হানিফ খান বাবরের গলা লক্ষ্য করে খঞ্জরটা চালিয়েছিলো কিন্তু লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে। বাবর এবার বশার ফলাটা সজোরে তাকে লক্ষ্য করে আঘাত করে হানিফ খান একপাশে ঘুরে আঘাতটা এড়াতে চেষ্টা করে। কিন্তু ফলাটা তাকে বামদিকে স্পর্শ করলে সে টেবিলের পাশে রাখা শক্ত কুশনের উপরে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। বাবর এবার বর্শাটা মোচড় দেয় এবং মুহূর্ত মাত্র চিন্তা না করে প্রতিপক্ষের কণ্ঠনালী লক্ষ্য করে সজোরে বর্শাটা নামিয়ে এনে গালিচার উপরে তাকে গেথে ফেলে। যা অচিরেই ফিনকি দিয়ে রক্তে ভিজে লাল হয়ে যায়।

ইতিমধ্যে ওয়াজির খান, বাইসানগার আর বাকী লোকেরা এসে তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে তার সাহসিকতার জন্য তাকে শুভেচ্ছা জানায়। দূর্গটা এখন তাদের দখলে। ফারগানা উদ্ধারের বন্ধুর পথে সে মাত্র প্রথম পদক্ষেপটা সাফল্যের সাথে রেখেছে। বাইরে বের হয়ে এসে বাবর দেখে আবার তুষারপাত শুরু হয়েছে। শত্রুর পড়ে থাকা দেহের চারপাশের লাল রঙ ইতিমধ্যে অনেকটাই ঢাকা পড়েছে। একটু আগে তামবালের চামচার ভবলীলা সে যেভাবে সাঙ্গ করেছে, সেভাবে পালের গোদাটাকে কখন মুঠোর ভেতরে পাবে সেই মুহূর্তটার জন্য সে অধীর হয়ে রয়েছে।

*

আর এভাবেই পুরো ঘটনাটার সূচনা হয়। বাবর একজন হানাদারে পরিণত হন। ঝটিকাবেগে আক্রমণ করেন এবং ফিরে যাবার সময় প্রতিবারই মৃত শত্রুর কারো একজনের মুখে রক্ত দিয়ে নিজের নাম লেখা একটা কাগজ গুঁজে দিয়ে যান। আর তার সাফল্য ক্রমশ বাড়তে থাকে। তার বাহিনীর সংখ্যা, মিষ্টি কথা আর মধুর প্রতিশ্রুতি, সেই সাথে শক্তি বা তার অভিযানে প্রাপ্ত সম্পদের বিচক্ষণ ব্যবহার নতুন সমর্থকদের আকৃষ্ট করে এবং প্রতিপক্ষকে দলে টেনে, ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায়। মাটির দূর্গ দখলের বিশ মাসের মধ্যে, নিষ্ঠা আর একাগ্রতার সাথে একটার পরে একটা ছোট দূর্গ আর গ্রামের পর গ্রাম দখল করে ফারগানার পশ্চিমাঞ্চলের অধিকাংশই সে দখল করে নেয়। তার কৌশল কার্যকরী বলে প্রতীয়মান হয়। তামবাল আকশির উত্তর বা পশ্চিমে বাবরের শক্ত ঘাঁটির দিকে বেশিদূর অগ্রসর হবার মতো সাহস দেখায় না। আর বাবরও মনে করে এবার সময় হয়েছে নিজের দাবির কথা প্রকাশ করবার।

 প্রথম দাবিটা সে ছয়মাস আগে জানায় এবং তারপরে প্রায়শই তার পুনরাবৃত্তি করেছিলো তার আম্মিজান, নানীজান আর বোনের মুক্তির বদলে এক বছর আকশি দূর্গ আক্রমণ না করবার প্রতিশ্রুতি। তিনমাস আগে তামবাল এক বার্তাবাহকের মাধ্যমে প্রেরিত এক চিঠিতে অনেক মধুর ভাষায় জানায় এসান দৌলত, খুতলাঘ নিগার আর খানজাদা প্রত্যেকেই সুস্থ আছে এবং শাহী পরিবারের উপযুক্ত ব্যবহারই করা হচ্ছে তাদের সাথে। কিন্তু চিঠিতে সে তাদের মুক্তি দেবার তার কোনো অভিপ্রায়ের কথা উল্লেখ করেনি।

 বাবর এখন পূর্বদিকে পঞ্চাশ মাইল দূরে অবস্থিত শহর গাভার দিকে অগ্রসর হচ্ছে কিছুদিন আগে তামবাল ভাড়াটে চকরাখ যোদ্ধাদের সহায়তায় সেখানের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করেছে। সেখানে একটা হিসাব মেলানো এখনও বাকি আছে। সেখানকার দূর্গের চাকরাখ সর্দার তার সৎভাই আর তামবালকে শাহী প্রতিনিধি হিসাবে মেনে নিয়ে প্রথম আনুগত্য প্রদর্শনকারীদের অন্যতম। শহরটা দখল করলে তামবালকে আরেকটা জোরালো সঙ্কেত পাঠানো হবে যে, সময় হয়েছে বাবরের কাছে তার পরিবারকে ফেরত পাঠাবার।

এক ক্ষুদ্র নহরের পাশে সাময়িক যাত্রাবিরতি করে বাবর আর তার লোকেরা ঘোড়াগুলোকে পানি পান করার সুযোগ দেয়। ঘোড়ার দুধ থেকে তৈরি টক পনির কোনোক্রমে গলধঃকরণের ফাঁকে বাবর তাকিয়ে দেখে তার এক গুপ্তদূত ঘোড়ায় চড়ে এগিয়ে আসছে। বাবর চমকে উঠে দেখে তার পর্যানে একটা দেহ আড়াআড়িভাবে বাঁধা রয়েছে। লোকটার দিকে দৌড়ে গিয়ে বাবর চিৎকার করে জানতে চায়, “কি হয়েছিলো? এই লোকটা কে?”

“লোকটা একটা ব্যবসায়ী। পথের পাশে পেটে তরবারির আঘাত নিয়ে নিজেরই রক্তে অর্ধচেতন অবস্থায় পড়ে থাকার সময়ে তাকে আমি খুঁজে পেয়েছি। আমি তাকে আমার ঘোড়ার পিঠে তুলে নেবার কিছুক্ষণ পরেই বেচারা মারা যায়। অবশ্য মারা যাবার আগে সে আমাকে বলেছে যে আরও তিনজন ব্যবসায়ীর সাথে সে। এখান থেকে দশ মাইল দূরে একটা ছোট সরাইখানার উদ্দেশ্যে যাবার পথে তারা চকরাখ হানাদারদের হামলার শিকার হয়। তার তিন সঙ্গীকে হত্যা করে তাকেও মৃত ভেবে তাদের সব মালপত্র নিয়ে তারা চলে গেছে।”

 “চকরাখ হানাদারদের অবশ্যই খুঁজে বের করে তার হত্যার আমরা বদলা নেবো। তোমার অধীনস্ত কয়েকজন গুপ্তদূতকে হত্যাকারীদের খুঁজতে পাঠাও।”

 “সুলতান, আমার মনে হয় না তার কোনো দরকার আছে। বণিক লোকটা মারা যাবার আগে আমাকে বলেছে যে, সে চকরাখদের বলতে শুনেছে তারা সরাইখানায় যাচ্ছে, সেখানে আরও শিকার যদি তারা খুঁজে পায়…”

“তাহলে আমরা প্রথমে সরাইখানায় যাবো।”

***

গানের সুর বন্য আর কর্কশ চকরাখদের নিজেদের মতোই অনেকটা। মদের নেশায় চুরচুর হয়ে থাকা পুরুষদের কণ্ঠস্বর নতুন মাত্রায় উঠে এমন সব অশ্লীল ক্রিয়াকলাপের বর্ণনায় মেতেছে যা একাধারে শারিরীকভাবে অসম্ভব আর মোটাদাগের যে বাবর চেষ্টা করেও হাসি চাপতে পারে না। সে আড়চোখে ওয়াজির খানের দিকে তাকিয়ে দেখে সেও হাসছে।

লম্বা ঘাসের আড়ালে বাবর তার চারপাশে শুয়ে থাকা লোকদের ইশারা করে। সবাই। তারমতো পেটের উপরে ভর দিয়ে শুয়ে আছে, লুকিয়ে অপেক্ষা করছে। তারপরে সে গুঁড়ি মেরে মাটির ইট দিয়ে তৈরি একতলা সরাইখানার দিকে এগিয়ে যায় যেটা ফারগানার অন্যতম খরস্রোতা একটা নদীর অগভীর অংশের পাড়ে অবস্থিত। যেখানে হল্লাবাজেরা মচ্ছবে মেতেছে। নূপুরের নিক্কন ধ্বনি ভেসে আসতে বোঝা যায় ভেতরে বাইজি মেয়েরাও আছে। সেই সাথে কুপিত নারী কণ্ঠের সহসা একটা তীক্ষ্ণ চিৎকার আর তার সঙ্গে ভেসে আসে- পুরুষ কণ্ঠের অট্টহাসি।

দুপুর মাত্র অতিক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু বিশজন বা তার কিছু বেশি চাকরাখরা ইতিমধ্যেই বেহেড মাতাল হয়ে পড়েছে। তারা এমনকি তাদের ঘোড়াগুলিকে ঠিকমতো বাঁধার কষ্টও করেনি এবং কিছু ঘোড়া, যাদের কেশর পুরু আর লেজ এতো লম্বা যে মাটিতে ঘষা খাচ্ছে, ইতিমধ্যেই ছুটে পালিয়েছে। চারো ব্যবসায়ীর কাছ থেকে লুট করা মালামালও তারা ভিতরে নিয়ে যাবার গরজ দেখায়নি। বণিকদের মালবাহী ধুসর খচ্চরগুলো দড়ি দিয়ে একত্রে বাঁধা এবং মনোযোগ দিয়ে চরে বেড়াচ্ছে। তাদের পিঠে আটকানো বেতের ঝুড়িগুলো দেখে মনে হয় এখনও চামড়া আর লোমে ঠাসা। চাকরাখরা মনে হয় কেবল মদের পিপে নিয়ে সরাইখানার ভিতরে প্রবেশ করেছে।

বর্বর অসভ্য, বাবর ভাবে। তাদের কপালে আজ কি লেখা আছে সেটা এখনই ব্যাটারা টের পাবে। আর এই ভাবনাটা তাদের উৎফুল্ল করে তোলে। লম্বা ঘাসের উপরে মাথা তুলে বাবর চারপাশে তাকায়। কিন্তু কাউকে দেখতে পায় না। সে ঠিক যেমনটা ভেবেছিলো, ঘোড়া বা মালামাল দেখার জন্য বাইরে কোনো বাচ্চাকে রাখার কথা ব্যাটাদের মাথাতেই আসেনি। সে এবার উঠে দাঁড়িয়ে, গুটিগুটি পায়ে সরাইখানার নীচু প্রবেশদ্বারের ডান দিকে মোটা দেয়ালের গায়ে জানালার মতো দেখতে একটা ফাঁকা জায়গার দিকে এগিয়ে গিয়ে ভেতরে সতর্কতার সাথে উঁকি দেয়। ঘরটা প্রায় খালি, কেবল ভেতরের দেয়ালের গায়ে ঠেকানো অবস্থায় একটা লম্বা কাঠের টেবিল দেখা যায়। কয়েকটা তেপায়া টুল আর একটা আধ ভাঙা বেঞ্চি দেখা যায়। ঘরের মাঝে মোটাসোটা, বোচা-নাকের একটা মেয়ে পরনে রঙচটা হলুদ রঙের ঢোলা সালোয়ারের উপরে লাল ফুলের ছাপ দেয়া একটা আঁটোসাঁটো কামিজ, পায়ে আর হাতের কব্জিতে ঘুঙুর বাঁধা। নীল সালোয়ার কামিজ পরিহিত লম্বা আরেকটা মেয়ে তার নোংরা হাতে একটা খঞ্জনী, বর্গাকার পাথরের মেঝের উপরে খালি পায়ে সজোরে পদাঘাত করে বৃত্তাকারে আবর্তিত হচ্ছে। সে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই চকরাখদের কয়েকজন, ভেড়ার চামড়ার তৈরি টুপির নিচে তাদের গোলাকার মুখ ঘামে ভিজে আছে, টলোমলো পায়ে মেয়েদের বুকে পাছায় বৃথা চেষ্টা করে থাবা দিতে এবং মুখ থুবড়ে মাটিতে আছড়ে পড়লে তাদের সঙ্গীসাথীদের উদ্দীপনা আরও বেড়ে যায়।

এক কোণে ধোঁয়া উঠতে থাকা অগ্নিকুণ্ডের উপরে বিশাল একটা কেতলি ঝুলতে দেখা যায়। আরেক কোণে, বাবর এক চকরাখ দুবৃত্তকে কাপড় খুলে ব্যস্ত ভঙ্গিতে হাল্কা হতে দেখে, দুর্গন্ধে তার সঙ্গীসাথীদের আপাতভাবে কোনো অসুবিধা হয় না। আরেক বদমাশ উঠে দাঁড়িয়ে হলুদ বমি বৃত্তচাপ তৈরি করে ছুঁড়ে ফেলে আবার বসে পড়ে আর মনোযোগ দিয়ে জামার হাতায় পড়া বমির ফোঁটা বড়বড় নখ দিয়ে টুসকি দেয়। বাবর পুনরায় মাথা নামিয়ে নেয়। সে যা দেখার তা দেখে নিয়েছে।

 মাটিতে গুঁড়ি দিয়ে সে পুনরায় ওয়াজির খান যেখানে আছে সেখানে ফিরে আসে। “মদ্যপ আহাম্মকগুলো আমাদের হাতে মারা যাবার জন্য মুখিয়ে রয়েছে। ব্যাটারা তাদের তরবারি আর ঢাল পর্যন্ত দরজার কাছে স্তূপ করে রেখেছে।”

 ওয়াজির খানের একটা ক্ৰ উপরে উঠে যায়। “সুলতান, এখনই?”

“হ্যা!”

 বাবর আর ওয়াজির খান উঠে দাঁড়িয়ে তাদের লোকদেরকেও উঠে দাঁড়াবার ইশারা করে। তারা এই কাজটা আগে এতোবার করেছে যে, মৌখিক আদেশের আর কোনো প্রয়োজন হয় না। ঠোঁটের উপরে আঙ্গুল চেপে, ওয়াজির খান ইশারায় ঘুরে কয়েকজনকে সরাইখানার পেছনে যেতে বলে। যদি সেখান দিয়ে পালাবার কোনো পথ থেকে থাকে। তারপরেই কেবল বাবর তার প্রিয় রণহুঙ্কারে চারপাশ প্রকম্পিত করে: “ফারগানা!”

 বাবর একেবারে সামনে থেকে তার লোকদের নেতৃত্ব দেয়। মদের নেশায় মাতাল আর বিস্ময়ে আড়ষ্ঠ চকরাখরা সামান্যই প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে। বাবর আর তার লোকেরা নির্মমভাবে প্রতিপক্ষের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়লে বোঁচা-নাকের সেই মেয়েটার কাছ থেকেই কেবল বলার মতো প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। মেয়েটা তার কাচুলির ভিতর থেকে একটা খঞ্জর বের করে এবং বাবরের বাহুতে সেটা মরিয়া ভঙ্গিতে গেথে দিতে চাইলে, বাবর অনায়াসে তার ঘুঙুর পরা হাতের কব্জি ধরে এবং তাকে ঘুরিয়ে দিয়ে তার নধর নিতম্বে বুট দিয়ে একটা সপাট লাথি বসিয়ে দিতে বেচারী ছিটকে দূরে গিয়ে পড়ে।

কয়েক মিনিটের ভিতরে সবকিছু শেষ হয় এবং বাবরের লোকদের হাঁপিয়ে ওঠার আগেই নিজেদের তরবারির ফলা পরিষ্কার করে কোষবদ্ধ করতে দেখা যায়। তার লোকদের গায়ে একটা আঁচড়ও লাগেনি। অবশ্য তার লোকদের সবাই পোড়খাওয়া যোদ্ধা, এসব মদ্যপ মাতালদের চেয়ে অনেক দক্ষ লোকদের সাথে তারা আগে লড়াই করেছে। “লাশগুলো বাইরে নিয়ে যাও দেখা যাক আমরা কাদের হত্যা করেছি,” বাবর আদেশটা দিয়ে কৃতজ্ঞচিত্তে দ্রুত পূতিগন্ধময়, ধোঁয়াটে ঘরটা থেকে বাইরের খোলা বাতাসে বের হয়ে আসে।

 তার লোকেরা চকরাখদের লাশগুলি তাদের বুট-পরা পা ধরে হেঁচড়ে বাইরে এনে সারিবদ্ধভাবে সাজালে, বাবর লাশগুলো শুনে দেখে। মোট পনেরটা লাশ। কারো গলা দুভাগ হয়ে আছে, কোনোটা আবার কবন্ধ। তার লোকেরা অবশ্য কাটাপড়া মাথাগুলো সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছে। কোনোটার মাথায় তখনও ভেড়ার চামড়ার টুপি রয়েছে। কাটা মুণ্ডগুলোর দিকে তাকিয়ে যখন বাবর একটা বিশেষ মুখ চিনতে পারে, তখন তার মুখ থেকে সন্তুষ্টিসূচক একটা শব্দ ধ্বনিত হয়। তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে এমন সব চকরাখকে সে হত্যা করবে বলে মনস্থ করেছে। এবং প্রতিটা হত্যাযজ্ঞ যা তাকে তার লক্ষ্যের নিকটবর্তী করছে প্রচণ্ড তৃপ্তিদায়ক।

 তারস্বরের চিৎকার শুনে বাবর ঘুরে তাকায়। তার দু’জন যোদ্ধা বাইজি মেয়েদের ধরে তাদের টেনে সরাইখানার বাইরে বের করে আনে। “তাদের উপরে বল প্রয়োগ করবে না। আমার আদেশ তোমরা জানেনা। অর্থের বিনিময়ে যদি তারা স্বেচ্ছায় তোমাদের সঙ্গ দিতে রাজি হয় তবে সেটা আলাদা কথা।” কথাটা বলে বাবর আবার ঘুরে দাঁড়ায়।

দেখা যায় মেয়েগুলো আদতেই ব্যবসায়ী এবং কয়েক মুহূর্তের দ্রুত আলোচনার পরে, সরাইখানার পেছনের এক আপেল বাগিচায় তারা তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যায়। বাবর ধারণা করে বাইজি দু’জন সরাইখানার শকুনের মতো দেখতে মালিকের মেয়ে হবে। যে ঝামেলার গন্ধ পাওয়া মাত্র সেই যে টেবিলের তলায় গিয়ে ঢুকেছে তারপরে আর বের হবার কথা চিন্তাও করেনি। আপেল বাগিচায় শীঘ্রই বাবরের লোকদের দল বেঁধে আসা যাওয়া করতে দেখা যায়। বাগান থেকে হাসিমুখে তাদের বের হয়ে আসা দেখে বোঝা যায় মেয়ে দু’জন তাদের বাবার সরাইখানায় আসা। অতিথিদের খেদমত করতে ভালোই অভ্যস্ত।

 ওয়াজির খান ইতিমধ্যে চকরাখদের পালিয়ে যাওয়া ঘোড়াগুলো ধরে আনবার বন্দোবস্ত করেছেন এবং বণিকদের কাছ থেকে লুট করা মালপত্রগুলো পর্যবেক্ষণ। করছেন। “সুলতান, দেখেন,” দুটো উজ্জ্বল বর্ণের গালিচা বের করে সে বাবরের। দৃষ্টি সেদিকে আকর্ষণ করে। গালিচা দুটোর জেল্লা দেখে বোঝা যায় তন্তুবায়ের দল। সেটা বুননের সময়ে রেশমের সাথে উলের মিশ্রণ ঘটিয়েছে আর গালিচাগুলোর নকশাও অপরিচিত- বণিকের দলটা সম্ভবত পূর্বের, কাশগর থেকে এসেছিল। যেখানের তাঁতিরা এ ধরণের গালিচা তৈরিতে দক্ষ। উল আর চামড়া বেচে ভালো অর্থই পাওয়া যাবে, বাবর ভাবে, যা দিয়ে তার লোকদের সে বকেয়া বেতন দিতে পারবে।

তার যোদ্ধাদের জন্য একটা ভোজসভার আয়োজন করলে মন্দ হয় না। তারা ভালো। কাজ দেখিয়েছে এবং তারও উচিত এর মূল্যায়ন করা। পশ্চিমে, শাহরুখিয়ায় ফিরে যাওয়া মাত্রই সে এই ভোজসভার ঘোষণা দেবে। সেখানে, ছয়মাস আগে। তামবালের কাছ থেকে সে দূৰ্গটা ছিনিয়ে নিয়েছে এবং নিজের ঘাঁটিতে পরিণত করেছে। সমরকন্দে খুন হবার আগে শাহরুখিয়ার সর্দার আলি মজিদ বেগের পূণ্য স্মৃতির প্রতি তারা তাদের শ্রদ্ধা জানাবে। তারা তার উপযুক্ত সন্তানের আত্মার মাগফেরাত কামনা করবে। যে তামবালের চকরাখ যোদ্ধাদের হাত থেকে দূর্গটা রক্ষা করতে গিয়ে শহীদ হয়েছে। আলি মজিদ বেগের নিহত হবার সংবাদ ফারগানায় পৌঁছানো মাত্র তামবাল দূর্গটা দখল করতে তাদের পাঠিয়েছিলো।

নিজের বিশ্বস্ত সর্দারের কথা মনে পড়তে বাবরের ভাবনা বিষণ্ণ হয়ে উঠে। আজকাল তার প্রায়ই এমন হচ্ছে। সবুজাভ-নীল তোরণদ্বারে আলি মজিদ বেগের মৃতদেহ প্রদর্শিত হবার পরের দু’বছরে সে কি অর্জন করেছে? নিজের পরিবারকে মুক্ত করার ব্যাপারে বা ফারগানা পুনরায় অধিকার করার ব্যাপারে সে কতটা অগ্রসর হয়েছে, সমরকন্দের কথা না হয় সে বাদই দিল? আর কতদিন তাকে সালতানাৎবিহীন একজন সুলতান হিসাবে দিন কাটাতে হবে? আকশি আক্রমণ করে তার পরিবারকে মুক্ত করে সিংহাসন পুনরুদ্ধার করার মতো একটা সেনাবাহিনী গঠন করা একটা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। আর সমরকন্দ, সেখানে শাসক হিসাবে কাটানো কয়েকটা দিন এখন কেবল ধূসর স্মৃতি। মাঝে মাঝে তার বিশ্বাস করতেই কষ্ট হয় যে এমন কিছু আসলেই ঘটেছিলো। গ্রান্ড উজিরের কথাই শেষ পর্যন্ত সত্যি হলো।

ভাবনাটা বাবরকে ক্রুদ্ধ করে তোলে। সে তার পায়ের কাছে পড়ে থাকা একটা কর্তিত মস্তকে লাথি বসিয়ে দিলে সেটা ছিটকে দূরে গিয়ে পড়ে। তার লোকদের যেমন, তারও বিনোদনের দরকার আছে। কয়েকটা ডাল কেটে পোলো খেলার লাঠি তৈরি করো।” সে চিৎকার করে বলে। “এইসব দুবৃত্তদের মাথা দিয়ে পোলো খেলা যাক। গোলপোস্ট হবে ঐ দূরের গাছগুলো।”

পুরো একটা ঘণ্টার জন্য, উদ্দাম খেলায় বাবর নিজেকে ডুবিয়ে রাখে। চকরাখদের ক্ষিপ্রগামী টাটুঘোড়ার একটা নিয়ে সে একেবেঁকে দাবড়ে বেড়ায় এবং শাখাপ্রশাখা ছেটে ফেলা গাছের ডাল দিয়ে ছিন্ন মস্তকগুলোকে সজোরে আঘাত করে। যাতে ঘাসের উপর দিয়ে লাফাতে লাফাতে সেগুলো গড়িয়ে যায়। শীঘ্রই সেগুলোকে আর কাটা মাথা বলে চেনার কোনো উপায় থাকে না- নাক, কান গুঁড়িয়ে যায়, অক্ষিকোটর থেকে অক্ষিগোলক বের হয়ে আসে এবং বাবর আর তার ঘর্মাক্ত সাথী খেলোয়াড়েরা আর সেই সাথে তাদের সবার ঘোড়া, রক্তের ফুটকিতে চিত্রিত হয়ে উঠে।

 অবশেষে খেলাটার প্রতি তার বিরক্তি জন্মায় কিন্তু ভেতরের জমে ওঠা হতাশা আর ক্ষোভ নিঃসৃত হওয়ায়, বাবর ঘামে ভিজে ওঠা ঘোড়াটাকে অবশেষে রেহাই দেয়। চারপাশে তাকাতে সে দেখে ওয়াজির খান তার দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। এই প্রথম সে তার চোখে বিরক্তি দেখতে পায়। কিন্তু বাবর তাতে বিন্দুমাত্র লজ্জি বোধ করে না। জীবিত বা মৃত, সে তার শত্রুদের সাথে তাদের প্রাপ্য ব্যবহারই করেছে।

 “চলো এবার যাওয়া যাক।” সে আদেশ দেয়। “গাভা এখনও অনেক দূরে, আর আমাদের গৃহকর্তাকে অপেক্ষা করিয়ে রাখাটা ঠিক হবে না।” বাবর ঘোড়ার পাঁজরে এত জোরে খোঁচা দেয় যে সেটা ছুটতে শুরু করে। বাবর সরাইখানা থেকে সোজা নদীর অগভীর অংশের দিকে এগিয়ে যায়।একবারও পেছনে ফিরে তাকায় না। আঙ্গিনায় পড়ে থাকা রক্তাক্ত মাথাগুলোকে ইতিমধ্যে কাকের দল ঠোকরাতে শুরু করেছে এবং সরাইখান মেয়ে দুটো পা ঈষৎ ধনুকের মত ফাঁক করে এগিয়ে গিয়ে চকরাখদের লাশগুলো হাতিয়ে দেখে যে বাবরের লোকেরা ভুলে কিছু রেখে। গেছে নাকি, যা তাদের বেশ্যাবৃত্তির পাওনার উপরি বলে বিবেচিত হতে পারে।

***

তিন সপ্তাহ পরে। উঁচু পাহাড়ী এলাকার তৃণভূমির উজ্জ্বল সবুজ ঘাসের মাঝে মাঝে ফুটে থাকা হলুদ গোলাপী আর সাদা ফুলের মাঝ দিয়ে বাবর আর তার লোকেরা দুলকি চালে ঘোড়া দাবড়ে শাহরুখিয়ার দিকে এগিয়ে যায়। গাভার অভিযানে ক্ষয়ক্ষতি হলেও তারাই জয়ী হয়েছে। তিনশ গজ দূরে ঘোড়ার পিঠে বসে থাকা অবস্থায় বাবর নিজে তীর ছুঁড়ে দূর্গের সেনাপতিকে হত্যা করেছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তার নিজের ব্যবহৃত ছোট নিখুঁতভাবে বাঁকানো ধনুক দিয়ে তীর ছোঁড়ার অভ্যাসে কাজ হয়েছে। ত্রিশটা শর ভর্তি তূণীর সে এক মিনিটের ভিতরে খালি করে ফেলতে পারে।

সেনাপতি মারা যাবার পরে, প্রতিরোধকারীদের মনোবল ভেঙে যায়। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সেনানিবাসের সৈন্যরা কেবল আত্মসমর্পনই করেনি, নিজেদের লুটের মাল পুরো তাদের হাতে তুলে দিয়েছে। যা বাবর আর তার লোকদের ঘোড়ার পিঠে ঝোলানো চামড়ার থলির উপচে পড়া আকৃতি সাক্ষ্য দিচ্ছে।

 ওয়াজির খান খুব খুশি হবে। এবারের অভিযান বাবরকে তার বুড়ো বন্ধুটির সহায়তা ছাড়াই পরিচালনা করতে হয়েছে। সরাইখানা আক্রমণ করার পরের দিন ওয়াজির খানের ঘোড়া সাপের ভয়ে বেমাক্কা লাফিয়ে উঠতে সে পড়ে গিয়ে উরুতে ব্যথা পেয়েছিলো। বাবরের সনির্বন্ধ অনুরোধে তিনি শাহরুখিয়ায় ফিরে যেতে রাজি হন বাইসানগারের সাথে যোগ দিতে, যাকে তারা সেখানের নিরাপত্তার দায়িত্ব দিয়ে এসেছে।

আজ রাতে তারা বিজয় উদযাপন করবে। সে তার লোকদের সম্মান জানাতে তাদের মাঝে উলুশ বিতরণ করবে। যোদ্ধাদের ভিতরে যারা সবচেয়ে সাহসিকতা আর বীরত্ব প্রদর্শন করেছে প্রথা অনুযায়ী আজ সে ভোজসভার শেষে তাদের মাঝে লুটের মালের সিংহভাগ বিলিয়ে দেবে এবং বাইসানগার আর ওয়াজির খানকে গাভা আক্রমণের কাহিনী শোনাবে। তার গল্প শুনে ওয়াজির খান সম্ভবত হেসে অস্থির হবেন এবং সদা গম্ভীর বাইসানগারের মুখেও সে আজ হয়তো হাসির আভাস দেখতে পাবে।

 পাথরের তৈরি দূর্গের অভ্যন্তরস্থ প্রাঙ্গনে প্রবেশের সাথে সাথে, বাবর তার ঘোড়ার পিঠ থেকে লাফিয়ে নেমে তাদের খোঁজে আশেপাশে তাকায়। বাইসানগারকে সে কোথাও খুঁজে পায় না। কিন্তু ওয়াজির খানকে আস্তাবলের সামনে দাঁড়িয়ে ঘোড়ার খুরের উপরের আর পেছনের অংশের কেশগুচ্ছ পর্যবেক্ষণ করতে দেখে। তার বুড়ো বান্ধবকে সামান্য খোঁড়াতে খোঁড়াতে তার দিকে এগিয়ে আসতে দেখলে: বাবর ভ্রূ কোঁচকায়। তারপরে সে তাকিয়ে দেখে ওয়াজির খানের মুখ আনন্দে আলোকিত হয়ে রয়েছে।

 “সুলতান, দারুণ সুখবর আছে! সত্যিই চমকে দেবার মত সুখবর!”

 “কি হয়েছে?”

 “এক সপ্তাহ আগে আকশি থেকে এক বার্তাবাহক এসেছে। আপনার সৎ-ভাই জাহাঙ্গীরের পক্ষে তামবালের বাণী নিয়ে সে এসেছে। অন্তত বার্তাবাহকের তাই ভাষ্য এবং সে বলেছে তারা আপনার আম্মিজান, নানীজান আর আপনার বোনকে আপনার কাছে পাঠাতে সম্মত আছেন।”

 “সে কি এর বিনিময়ে কিছু দাবি করেছে?”

 “সুলতান, প্রকাশ্যে তারা কিছু দাবি করেনি। আপনাকে সে কতোটা শ্রদ্ধা করে কেবল সে সম্পর্কে কিছু মধুর বাক্য ছাড়া।”

বাবরের হৃৎপিণ্ড আনন্দে নেচে উঠে। তার পরিবার শীঘ্রই তার সাথে মিলিত হবে। এই খবরটা আবার তাকে আবেগতাড়িত করে তোলে।

 “তারা এখানে কবে নাগাদ পৌঁছাবে?”

“সবকিছু ঠিক থাকলে আগামীকাল সূর্যাস্ত নাগাদ তাদের এখানে পৌঁছাবার কথা।”

 পরের দিন সন্ধ্যাবেলা, গোধূলির অস্তমিত আলোয় বাবরকে দূর্গের প্রকারবেষ্টিত সমতল ছাদে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। আজকের দিনের অধিকাংশ সময় সে এখানেই কাটিয়েছে। অস্থিরচিত্তে রাস্তাটা যেখানে একটা গিরিখাদের দিকে বাঁক নিয়েছে, সেদিকে চোখ কুঁচকে তাকিয়ে রয়েছে। ঘনায়মান আধো-অন্ধকারের ভিতর থেকে সে পিঠের দুপাশে ঝুড়ি ঝুলছে উটের এমন একটা তরঙ্গায়িত সারিকে বাঁক ঘুরে এগিয়ে আসতে দেখে। তাদের ঠিক পেছনেই রয়েছে যাত্রার শেষ পর্যায়ে মেয়েদের অভ্যর্থনা জানাতে। আর তাদের নিরাপদে দূর্গে নিয়ে আসবার জন্য, ওয়াজির খানের পরামর্শে, বাইসানগারের অধীনে পাঠানো সৈন্যবাহিনীর একটা চৌকষ দল।

বাবর এতদূর থেকে ঝুড়িতে ভ্রমণকারীদের চেহারা দেখতে পায় না। নিজেকে আর সামলে রাখতে না পেরে, এবং দেহরক্ষীদের কাউকে ডাকবার বা ঘোড়ার পিঠে জিন চাপাবার মতো ধৈর্যের মারাত্মক অভাব দেখা দেয়ায়, সে লাফিয়ে একটা খালি ঘোড়ার পিঠে চেপে বসে এবং সবুজ ঘাসে আচ্ছাদিত তৃণভূমির উপর দিয়ে ছোট কাফেলাটার দিকে ছুটে যায়।

তার রোদে পোড়া গাল বেয়ে দরদর করে কান্না ঝরতে থাকে। কিন্তু সেসব সে মোটেই পরোয়া করে না। আশেপাশে কেউ নেই তার কান্না দেখবার মতো এবং তার চেয়েও বড় কথা, দেখলে দেখুক সে থোড়াই পরোয়া করে। দুর্বলতার না, আজ এটা আনন্দের অশ্রু। এক হাতে ঘোড়ার কেশর আঁকড়ে ধরে সে অন্য হাতে গাল থেকে কান্না মুছে। বাবর ঘোড়াটার কানে কানে তাকে এমন গতিতে ছুটতে বলে, যাতে মনে হয় হঠাৎ তার পাখা গজিয়েছে।

কাফেলাটাকে পাহারা দিয়ে নিয়ে আনা সৈন্যদের থেকে চারজন সহসা আলাদা হয়ে বর্শা নিচু করে তার দিকে এগিয়ে আসে। যদিও বাইসানগার সম্ভবত ধারণা করতে পেরেছিলো খালি ঘোড়ার পিঠে এমন উদ্দাম ভঙ্গিতে কে তাদের দিকে ছুটে আসছে। কিন্তু তার মত অভিজ্ঞ পোড়খাওয়া যোদ্ধা তার কাছে এটাই প্রত্যাশিত যে সে নিজের লোকদের আদেশ দিয়েছে তার পরিচয় নিশ্চিত করতে। অশ্বারোহী দল নিকটবর্তী হতে, বাবর জোর করে নিজের ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে তাকে থমকে দাঁড়িয়ে পড়তে বাধ্য করে। ঘামে জবজব করতে থাকা দেহে নাক ঝেড়ে নিজের বিরক্তি প্রকাশ করে ঘোড়াটা।

 বাবর মাথাটা পেছনে হেলিয়ে দিয়ে তার পূর্বপুরুষের রণহুঙ্কার কণ্ঠে তুলে নেয়। “ফারগানা!”

 অশ্বারোহী দল এখন আরো কাছে চলে আসায় তারা তাকে চিনতে পেরে অভিবাদন জানায়। বাবর কোনোমতে তাদের অভিবাদনের জবাব দিয়ে উটের কাফেলা যেখানে যাত্রা বিরতি করেছে সেদিকে ঘোড়া ছোটায়। তার হৃদয় যদি আবেগে ভারাক্রান্ত না থাকত অন্যসময় হলে তাহলে সে হয়তো বাজারে নিয়ে যাওয়া মুরগীর মতো ভীরু ভঙ্গিতে বেতের ঝুড়ির ভিতর থেকে এসান দৌলতের উঁকি দেবার হাস্যকর ভঙ্গি দেখে হয়তো হেসেই ফেলতো। তার ওজন এতোটাই হাল্কা যে অন্যপাশের ঝুড়িতে ভারসাম্য রক্ষার জন্য বাঁধাকপির চেয়ে ভারী কিছু রাখতে হয়নি। আর তার বীণা ঝুড়ির বাইরে চামড়ার ফালি দিয়ে আটকানো রয়েছে। একটা বিশাল পুরু লোমের দুধসাদা রঙের উট যা বাবরকে এগোতে দেখে পচাৎ করে থুতু ফেলে সেটার দু’পাশে দুটো ঝুড়িতে খুতলাঘ নিগার আর খানজাদা আরোহন করেছেন। উটের পেছনে বাবর তার আম্মিজানের পরিচারিকা দলের কয়েকজন পরিচিত সদস্য, যাদের ভিতরে ফাতিমাও রয়েছে আর তার উজির কাশিমকে দেখতে পায়।

উটের চালকরা লাফিয়ে নেমে, উটের গ্রন্থিযুক্ত হাঁটুতে তাদের হাতের লাঠি দিয়ে আঘাত করে উটগুলোকে বাধ্য করে মাটিতে বসতে। বয়োবৃদ্ধ হবার কারণে, বাবর দৌড়ে প্রথমে এসান দৌলতের কাছে যায় এবং হাঁটু মুড়ে বসে তাকে আলতো করে ঝুড়ি থেকে তুলে আনে। বাবর কোনো কথা খুঁজে পায় না, আর এই প্রথমবারেরমতো মুখরা এসান দৌলতও বাক্যহারা হয়ে পড়েন। সে টের পায় নানীজান তার মাথা আলতো স্পর্শ করেন। সে উঠে দাঁড়িয়ে তার ছোট ছোট উজ্জ্বল চোখের দিকে তাকালে সেখানে তার পুরানো সত্ত্বার ঝলক দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। নানীজানকে এখন তিনি বরাবর যার জন্য গর্ব করেন,সেই খামের- চেঙ্গিস খানের রক্তের উত্তরসুরী এক নারীর মতোই দেখাচ্ছে।

সে এবার ঘুরে দাঁড়িয়ে তার আম্মিজানকে ঝুড়ি থেকে তুলে মাটিতে নামিয়ে দেয় এবং তাকে জড়িয়ে ধরে তার আশৈশব পরিচিত চন্দনকাঠের উষ্ণ সুগন্ধে বুক ভরে শ্বাস নেয়। সে তার আলিঙ্গন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে তাকিয়ে দেখে আম্মিজানের চোখে অশ্রু টলটল করছে। “বাছা তোমাকে আবার দেখতে পেয়ে খুশি হলাম,” কোনো রকমের আবেগ না দেখিয়ে তিনি বলেন, এবং তার মুখে একটা হাসির আভাস ফুটে উঠে যা বাবরের যেমনটা মনে আছে তার চেয়েও ম্লান এবং বলিরেখায় আকীর্ণ।

 খানজাদা ইতিমধ্যে তাকে বহনকারী ঝুড়ি থেকে নিজেই ধড়ফড় করে নেমে এসেছে। এবং সে সোজা ভাইকে লক্ষ্য করে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তার পোষা বেজী যেটা সে বামহাতে ধরে রেখেছে, কুইকুই করে প্রতিবাদ জানায়। শেষবার বাবর তার বোনকে দেখেছিলো হাড্ডিসার একটা মেয়ে, যার মুখে কয়েকটা দাগ রয়েছে। খানজাদা এখন রীতিমত একজন মহিলাতে পরিণত হয়েছে, তার দেহে ভরা নদীর জোয়ার বইছে। মুখ আগের চেয়ে অনেক দাগহীন আর সুন্দর। কিন্তু ফিচেল হাসি আগের মতোই আছে দেখে সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। সে তাকে জড়িয়ে ধরে এবং তারপরে ছেড়ে দিয়ে এক পা পিছিয়ে আসে ভালো করে তাকে দেখবে বলে।

 খানজাদাও কম যায় না সেও ভাইকে জরিপ করে। “তুমি লম্বা হয়েছে।” সে বলে, “আর তোমার কাঁধ আগের চেয়ে চওড়া হয়েছে। কিন্তু একি চেহারা হয়েছে। তোমার থুতনিতে ছাগলের মত দাড়ি আর চুলের অবস্থা যাচ্ছেতাই- তোমার চুল দেখছি আমার মত লম্বা! আর নখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না- কালো হয়ে আছে।”

বাবর পেছন থেকে, খানজাদার নাক কোঁচকানো বিশেষণগুলোর সমর্থনে এসান দৌলতকে জিহ্বা আর টাকরার সাহায্যে একটা শব্দ করতে শোনে এবং সে হেসে ফেলে। অবশেষে তার প্রিয়জনেরা তার কাছে এসেছে এবং সবকিছু যেমনটা থাকার কথা তেমনই রয়েছে। তাদের সাথে সে পরে কথা বলবে এবং শুনবে বিগত দিনগুলো তাদের কেমন কেটেছে। কিন্তু এখনকার মতো এই যথেষ্ট।

তারা দূর্গের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। অবশেষে মুক্তি লাভ করা ফারগানার শাহী রমণীদের অভ্যর্থনা জানাতে তূর্যনিনাদ আর রণভেরী গমগম আওয়াজে বেজে উঠে- অন্তত এখনকার জন্য হলেও তারা নিরাপদ।

দূর্গের উপরের তলায় প্রস্তুত রাখা জেনানামহলে মেয়েদের পৌঁছে দিয়ে, বাবর তার বঁধুনিকে ডেকে পাঠায়। তার পরিকল্পিত ভোজসভার সব আয়োজন কি অবস্থায় আছে তা জানতে। এখানের ভোজসভা সমরকন্দের মতো জাঁকজমকপূর্ণ হবে না। যেভাবে সে তাদের অভ্যর্থনা জানাতে চেয়েছিলো। অবশ্য, তাহলেও বিশটা ভেড়া জবাই করা হয়েছে আর আঙ্গিনায় সেগুলোকে আগুনে ঝলসানো হচ্ছে। মুরগীর পালক ছাড়িয়ে, আখরোট আর খুবানির সাথে মাখন দিয়ে সিদ্ধ করা হচ্ছে। আস্ত আপেল ঘন সোনালী বর্ণের মধু আর লাল রসে ভরা ডালিমের দানার সাথে কাঠবাদাম আর পেস্তার মিশ্রণে চিকচিক করছে। তাদের কোনো এক অভিযানে তার লোকদের লুট করা রূপালি বর্ণের কাঠবাদামের স্তূপের দিকে সে বিশেষ সন্তুষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে। এসান দৌলত অন্য যে কোনো মিষ্টির চেয়ে এগুলো বেশি পছন্দ করেন।

নির্মেঘ, তারা-শোভিত আকাশে চাঁদ উঠলে, এবং কোনো আকষ্মিক হামলা থেকে আগেই সাবধান করতে দূর্গপ্রাকারে সৈন্য মোতায়েন করে ভোজসভা শুরু হয়। বাবর আর তার লোকেরা নিচুলার একটা নিচু, লম্বা কামরায় আহার সারে। যখন উপরে নিজেদের কামরায় মেয়েদের তাদের পছন্দের অংশ পরিবেশন করা হয়। মোমবাতির কাঁপা আলোতে বাবরের লোকেরা উদাত্ত কণ্ঠে গান শুরু করে। বাকীরা যে নিচু কাঠের টেবিলের চারপাশে আসনসিঁড়ি হয়ে বসে আছে তাতে চাকুর বাট দিয়ে আঘাত করে তাল দেয়। বাবর ভাবে, তার লোকেরা খুশি হয়েছে। মেয়েদের মুক্তিতে তারাও প্রীত হয়েছে। তার সাথে সাথে তার লোকদেরও এটা সম্মানহানির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলো- যেনো মেয়েদের মুক্ত করার সামর্থ্য তাদের নেই।

বাবর খেতে চেষ্টা করে কিন্তু কিছুই খেতে পারে না। তার ইচ্ছা করে এখান থেকে উঠে যায় এবং তার আম্মিজান, খানজাদা আর এসান দৌলতের সাথে নিভৃতে সময় কাটায়। কিন্তু তার অনুসারীদের প্রতি সৌজন্যতাবশত তাকে আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। গানের মাত্রা ধীরে ধীরে চড়তে শুরু করে এবং ক্রমশ কর্কশ হয়ে উঠে। যোদ্ধার দল উচ্চকণ্ঠে নিজেদের পূর্বপুরুষের বীরত্বের কথা বয়ান করতে থাকে এবং বাবরও এবার তাদের সাথে কণ্ঠ মেলায়। কিন্তু অবশেষে, কেউ কেউ টেবিলের উপরে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়ে। আর অন্যেরা ঝাপসা চোখে টলোমলো পায়ে কামরা থেকে বের হয়ে বাইরের আঙ্গিনায় নিজেদের হাল্কা করতে শুরু করলে, বাবর তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে পাথরের বাঁকানো সিঁড়ি বেয়ে জেনানামহলের দিকে রওয়ানা দেয়।

 খুতলাঘ নিগার দু’হাত বাড়িয়ে দিয়ে তাকে স্বাগত জানায় এবং সে ভিতরে প্রবেশ করে গালিচা পাতা মেঝেতে তার পাশে এসে বসে। তাদের সামনের পিতলের থালায় পড়ে থাকা খাবারের অবশিষ্টাংশ দেখে সে বুঝতে পারে মেয়েরা ভালমতোই খেয়েছে। কিন্তু তারপরেও সে এখন যখন তাদের মুখের দিকে তাকায় সেখানে সে একটা টানটান অভিব্যক্তি লক্ষ্য করে। তাদের তিনজনকেই ফ্যাকাশে আর বিবর্ণ দেখায়। যেনো বহুকাল সূর্যের আলোর উষ্ণতা অনুভব করেনি বা তাজা বাতাসে তারা শ্বাস নেয়নি। কাউকে না কাউকে অবশ্যই এর মূল্য দিতে হবে- রক্ত দিয়ে। কিন্তু মেয়েদের খাতিরে আপাতত সে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করে না। তারা যাই বলুক তাকে, সে অবশ্যই সব কিছু শান্ত ভঙ্গিতে শুনবে।

 কিছুক্ষণ সবাই চুপচাপ বসে থাকে। প্রাথমিক উত্তেজনা প্রশমিত হতে, কেউই বুঝতে পারে না কোথা থেকে শুরু করা উচিত।

অবশেষে এসান দৌলত শুরু করেন: “বাবর তুমি তাহলে সরমকল দখল করেছিলে।” তার বিচক্ষণ মুখে বিরল একটা হাসির আভাস ফুটে উঠে।

“অধিকার করেছিলাম বটে, কিন্তু দখলে রাখতে পারিনি।” বাবর তার মাথা নিচু করে। এমন কিছু কথা আছে যা তাকে বলতেই হবে। “নানীজান, আমি আপনাকে হতাশ করেছি। আপনি আমার সাহায্য চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছিলেন এবং আমি সাহায্য করতে ব্যর্থ হয়েছি। আমার আসতে বড্ড দেরি হয়ে গিয়েছিল আর লোকজন ছিল অনেক অল্প।”

“আমাদের তুমি মোটেই হতাশ করনি। আর জেনে রেখো, আমাদের কারণেই তুমি সমরকন্দ হারিয়েছে। আমাদের সাহায্য করার জন্য তুমি সাথে সাথে যাত্রা করেছিলে। তুমি এরচেয়ে বেশি আর কিইবা করতে পারতে?”

বাবর আক্ষেপের সাথে মাথা নাড়ে। “ফারগানা আর আপনারা ছিলেন আমার প্রধান দায়িত্ব। সমরকন্দে আমি নতুন কোনো খেলনা হাতে পাওয়া শিশুর মতো আচরণ করেছিলাম। আমার তখন অন্য কিছু সম্বন্ধে ভাববার সামান্যই অবকাশ ছিলো। আপনাদের আর ফারগানার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য আমার উচিত ছিলো ওয়াজির খানকে পাঠিয়ে দেয়া।” সে তার মায়ের গায়ে হেলান দেয় এবং বরাবরের মতোই মায়ের আঙ্গুল তার চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে টের পায়। এতে সে কিছুটা শান্ত হয়।

“কিছু কিছু বিষয় তামবাল আমাদের কাছে কখনও গোপন করেনি।” খুতলাঘ নিগার বলেন। “আমার মনে হয় এতে সে আনন্দই পেতো। আমরা, তোমার চাচাতো ভাই মাহমুদের বিশ্বাসঘাতকতার কথা অবশ্যই জানি- আমরা জানি সেই সমরকন্দ তোমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে। বাছা, সে আর তামবাল মিলে তোমার জন্য একটা ফাঁদ পেতেছিলো। তারা দু’জনে মিলে ঠিক করেছিলো, ফারগানায় সে তোমাকে মসনদ থেকে সরিয়ে দিয়ে জাহাঙ্গীরকে তোমার স্থলাভিষিক্ত করবে। তারা জানতো এর ফলে তুমি বাধ্য হবে- তোমার বেশিরভাগ সৈন্য নিয়ে ফারগানায় ফিরে আসতে। আর মাহমুদ এর ফলে তার কাঙ্ক্ষিত সুযোগ পায়। তুমি তখন সদ্য সমরকন্দের সুলতান হয়েছে। তারা বলেছে যে সেখানকার অভিজাত ব্যক্তিরা তোমার প্রতি তেমন একটা আনুগত্য বোধ না করায়, মাহমুদ আর তার কলহপ্রিয় স্ত্রী, গ্রান্ড উজিরের কন্যা সহজেই ঘুষ দিয়ে তাদের কিনতে পেরেছে।”

 নিজের সবচেয়ে জঘন্য সন্দেহটা প্রমাণিত হতে বাবর চোখ বন্ধ করে ফেলে। কি আহাম্মকই না সে ছিলো।

“তোমার এটাও জেনে রাখা উচিত, মাহমুদের স্ত্রীর কারণে সে গো ধরায় আলি মজিদ বেগকে হত্যা করা হয়েছিলো।” এসান দৌলতের কণ্ঠস্বর তিক্ত শোনায়। নিহত গোত্রপতির মা ছিলো তার বান্ধবী আর তিনি নিজেও তাকে পছন্দই করতেন। “সে নাকি বলেছে তোমার শিরোচ্ছেদ করতে না পারায়, তাকে শিরোচ্ছেদ করলেই আপাতত চলবে- তার বাবার মৃত্যুর প্রতিশোধ হিসাবে। মাহমুদ তার কথা ফেলতে পারেনি। সবাই বলে সেই আসলে সমরকন্দের নতুন শাসক। নিজের বাবার চেয়েও সে বেশি লোভী আর প্রতিহিংসাপরায়ণ।”

বাবর বিস্ময়ে চোখ পিটপিট করে। সে ভাবতেও পারেনি সেই সুঠামদেহী তরুণী, যে এমন সাহসিকতার সাথে গ্রান্ড উজিরের প্রাণ ভিক্ষা চেয়েছিলো কিভাবে এতো অনুভূতিহীন নিষ্ঠুর আর নির্মম হতে পারে। একদিন তাকে অবশ্যই তার এই স্পর্ধার জন্য জবাবদিহি করতে হবে। কিন্তু সেটা পরেও হতে পারে। তার আগে তাকে অন্য অনেক বিষয় জানতে হবে এবং সেগুলো মেনে নিতে হবে।

সে আলতো করে দু’হাতের মাঝে মায়ের হাত জড়িয়ে ধরে। “আমাকে তোমাদের কথা বলল। তোমরা বন্দি থাকা অবস্থায় কেমন আচরণ করছে তারা তোমাদের সাথে?”

 “কয়েকজন মাত্র পরিচারকসহ আমাদের একটা ছোট জায়গায় আটকে রাখা হয়েছিলো কিন্তু আমাদের বংশ গৌরব আর মর্যাদার কারণে তারা বাধ্য হয়েছিলো আমাদের যথাযথ সম্মান দেখাতে। তামবাল আমাদের অপমান বা হুমকি দেয়নি।” তার মা বলে, “আর সম্প্রতি- সম্ভবত তোমার সাফল্যের কথা যখন সে জানতে পারে- আমাদের বড় একটা মহলে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো।”

“আর সে রোক্সানাকে আমাদের গহনা কেড়ে নিতে দেয়নি। অবশ্য অন্যদের মুখে শুনেছি সে ক্রুদ্ধ হয়ে চেঁচামেচি করেছে, যদিও সে তামবালের অঙ্কশায়িনী ছিলো।” এসান দৌলত কুপিত কণ্ঠে কথাগুলো বলেন।

 “আর আমার সৎ-ভাই জাহাঙ্গীর? এসবে তার ভূমিকা কতটুকু?” বাবর প্রায়ই তার স্থান দখল করে নেয়া বালকটার কথা ভাবে যাকে সে কখনও দেখেনি। শেষবার আকশি থেকে আসবার সময়ে, সমরকন্দ অবরোধের প্রস্তুতি নেবার সময়ে, ছোঁড়া অসুস্থ ছিলো।

 “বেচারা পরিস্থিতির শিকার, আর প্রায়ই অসুস্থ থাকে। তামবালের পুরো শরীরে কয়েক চামচ পরিমাণ রাজরক্ত থাকায় সে কখনও নিজে সিংহাসন দাবি করতে পারবে না। অন্য গোত্রপতিরা সেটা তাকে করতেও দেবে না। কিন্তু জাহাঙ্গীরের রাজপ্রতিভূ হিসাবে যে ক্ষমতার জন্য সে লালায়িত সেটা অর্জন করতে পারবে।” এসান দৌলত ভাবাবেগশূন্য কণ্ঠে কথাগুলো বলেন। “সে এখন তোমাকে ভয় পায়। সে যদি তোমাকে খুশি করতে না চাইতো, তাহলে আমাদের এতো সহজে মুক্তি দিতো না?”

 সুলতান হিসাবে বাবর নিজের প্রথম দিনগুলোর কথা ভাবে, তার মনে পড়ে তামবাল তখন কিভাবে অন্য নেতাদের মনে সন্দেহের বীজ বপনের চেষ্টা করেছে। সব সময়ে সে নিজের উচ্চাকাঙ্ক্ষা নিবৃত্ত করার চেষ্টারত ছিলো। কী সাংঘাতিক সুবিধাবাদি এক লোক- কামবার আলীর ষড়যন্ত্রে যোগ দেবার ব্যাপারে ভীষণ বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে সঠিক সময়ের জন্য ধৈর্যসহকারে অপেক্ষা করেছে। এজন্যই কি সমরকন্দ দুবার অবরোধ করতে সে তাকে প্ররোচিত করেছিলো? বাইসানগার যখন তৈমূরের অঙ্গুরীয় নিয়ে এসেছিল তখন আগ্রহে চকচক করতে থাকা তামবালের চেহারা তার এখনও মনে আছে। তার আরো মনে আছে, সমরকন্দ অধিকার করার পরে কি রকম তাড়াহুড়ো করে সে ফারগানা ফিরে এসেছিলো।

“আমাদের জন্য সবচেয়ে কঠিন সময় ছিলো প্রথম কয়েক মাস, যখন আমরা জানতাম না তোমার ভাগ্যে কি ঘটেছে। ফাতিমা- তুমি জান সে কেমন গপ্পোবাজ সে একবার একটা কথা শুনে আসে- একটা গুজব কিন্তু সেটাই আমাদের আতঙ্কিত করে তোলার জন্য যথেষ্ট ছিলো- যে তুমি ফারগানায় ফিরে আসার সময়ে পথে অসুস্থ হয়ে মারা গিয়েছে। তার মায়ের কণ্ঠস্বর কেঁপে যায়। কিন্তু তারপরেই আমরা শুনতে পাই যে তুমি সুস্থ আছো, আর পাহাড়ে আত্মগোপন করে রয়েছে। আমরা জানতাম না কোনটা সত্যি। যতদিন না তামবাল ক্রুদ্ধ হয়ে আমাদের কাছে আসে…সে আমাদের বলে তুমি গ্রামের পর গ্রাম আক্রমণ করে, সবকিছু জ্বালিয়ে দিচ্ছ, তছনচ করে দিচ্ছ এবং নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছো, কাউকে রেয়াত না দিয়ে।”

 “তামবাল যা বলেছে, সেটাই তাহলে সত্যি, তাই না বাবর? যে তুমি একজন সাধারণ দস্যু আর গরু-চোরে পরিণত হয়েছো?” এসান দৌলত প্রশ্রয়ের কণ্ঠে বলেন।

বাবর সম্মতি প্রকাশ করে মাথা নাড়ে এবং মুহূর্ত পরে নানীজানের দিকে তাকিয়ে সেঁতো হাসি হাসে। তার মা আর নানী তার সম্বন্ধে কি ভাববে সেটা নিয়ে সে প্রায়ই দুশ্চিন্তা করতো। তারা কি কখনও বুঝতে পারবে কেনো একজন শাহজাদা পাহাড়ী দুৰ্বত্তের জীবন গ্রহণ বাস্তবিক পক্ষে উপভোগ করতে পারে।”

“বাবর, আমাদের সেসব কথা বল।”

পশুর চর্বি দিয়ে তৈরি মোমবাতির দপদপ করতে থাকা শিখা নিভু নিভু হয়ে আসতে, বাবর তার সময় কিভাবে কেটেছে সেটা তাদের কাছে বর্ণনা করতে চেষ্টা করে। দুইশ কি তিনশ অভিযাত্রীর একটা বাহিনী নিয়ে, পাহাড়ের উপর থেকে ধেয়ে আসবার উত্তেজনাই আলাদা। রাতের বেলা তামবালের অনুগত বাহিনীর দূর্গ ঝটিকা আক্রমণের উল্লাস। আর তার পরে রাতের আঁধারে হারিয়ে যাবার, তার পর্যাণে বাধা শিকারের ছিন্নমস্তক থেকে টপটপ করে ঝরে পড়া রক্তের ধারার অনুপ্রেরণা। প্রাচীন মোঙ্গল প্রণালী অনুসরণে তার দলের এক লোক। ঘোড়ার দুধ গজিয়ে যে খভাস তৈরি করতো সেটা পান করার কারণে মাথা ঘুরতে থাকলে সারা রাত ধরে পানোন্মত্ত অবস্থায় ফুর্তি করা। চকরাখদের ছিন্নমস্তক দিয়ে উদ্দাম পোলো খেলার কথা সে কেবল এড়িয়ে যায়। যদিও খানজাদাকে হয়তো পরে সে সেটাও বলবে। তার কথা বলার সময়ে খানজাদার চোখ চকচক করতে থাকে। তার হাতের মুঠি খোলে আর বন্ধ হয়, যেনো সে নিজে সেখানে ছিলো। তার সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছে। এসান দৌলতও মগ্ন হয়ে শোনেন। কিন্তু সে খেয়াল করে মৃত্যুর করাল থাবার হাত থেকে অল্পের জন্য বেঁচে যাবার ঘটনাগুলো শোনার সময়ে তার মায়ের ভ্রু কুঁচকে উঠে।

 “আমি কিন্তু কেবল যারা আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে তাদেরই আক্রমণ করেছি। আর আমি কখনও তোমাদের কথা ভুলে যাইনি। তোমাদের স্বাধীনতা আমার মসনদের চেয়েও বেশি কাম্য ছিল আমার কাছে।” চারপাশে তাকিয়ে, বাবর দেখে গবাক্ষের সরু ফাঁক দিয়ে ফ্যাকাশে, ধুসর আলোর একটা ধারা লুকিয়ে কখন যেন কামরায় প্রবেশ করেছে। প্রায় সকাল হয়ে এসেছে।

 “তুমি এটা অর্জন করেছে। কিন্তু যা হয়ে গেছে তা হয়ে গেছে। এখন আমাদের ভবিষ্যতের দিকে তাকাতে হবে।” এসান দৌলতের কণ্ঠে একটা সতেজতা ফুটে থাকে এবং তার দৃষ্টি বাবর নিজের উপরে অনুভব করলে সে অস্বস্তিবোধ করে, যেন কোনো বাচ্চা ছেলে এখনই তার ওস্তাদের কাছে ধমক খাবে। “বাবর, তুমি এই ক’দিনে কি শিখেছো?” নানীজান তার দিকে ঝুঁকে এসে তার কব্জি আঁকড়ে ধরে। “ তোমার কথা অনুযায়ী মসনদহীন দিনগুলো থেকে তুমি কি শিখেছো?”

যুক্তিসঙ্গত একটা প্রশ্ন। এই বিপজ্জনক, মরীয়া সময় তাকে কি শিক্ষা দিয়েছে? “বিশ্বস্ত বন্ধু আর মিত্রের গুরুত্ব,” সে অবশেষে কথা খুঁজে পেয়ে বলে, “এবং তাদের যোগ্যতা অনুসারে প্রতিদান দেয়া। এছাড়া পরিষ্কার উদ্দেশ্য, একাগ্রচিত্ত কৌশল আর সেটা অর্জনের পথে কোনো কিছুকে বাধা হিসাবে গণ্য না করার প্রয়োজনীয়তা।”

এসান দৌলত সন্তুষ্টির মাথা নাড়েন। “অবশ্যই। এবং এছাড়া আর কি?”

“আমি শিখেছি একজন সুলতানের পক্ষে সবসময়ে উদারতা দেখান সম্ভব না, শ্রদ্ধা অর্জনের জন্য তাকে কঠোর হতে হবে- কখনও নির্মম। অন্যথায় তাকে দুর্বল মনে হবে। নেতৃত্ব দেবার বদলে সবার ভালবাসার পাত্রে পরিণত হবার ঝুঁকি দেখা দিতে পারে। আর সেই সাথে মিষ্টিভাষী ষড়যন্ত্রকারীর ফাঁদে পা দিয়ে বসতে পারে। আমি শিখেছিঃ আনুগত্য অর্জন করতে হলে কেবল কৃতজ্ঞতা আর সম্ভ্রম উদ্রেক করলেই চলবে না। এর সাথে সামান্য ভয়েরও মিশেল থাকতে হবে। আমি প্রথমবার ফারগানার শাসক হবার পরে বাকী বেগ, বাবা কাশক, আর ইউসুফকে প্রাণদণ্ড দেয়া উচিত ছিলো। তার বদলে আমি কেবল তাদের শাহী দায়িত্বপালন থেকে অব্যাহতি দিয়েছিলোম এবং জীবন ধারণের জন্য কোনো বাধা না দিয়ে বরং মনের ভিতরে তাদের তিক্ততা পোষণের সুযোগ দিয়েছি। এছাড়া, সমরকন্দ দখল করার পরে গ্রান্ড উজিরের কতিপয় সমর্থককেও কড়কে দেয়া উচিত ছিলো।

 “তারচেয়েও বড় কথা, আমার নিয়তির প্রতি আমি আর কখনও অবহেলা প্রদর্শন করবো না। আমাদের সাথে আমার সাথে যা ঘটেছে তারপরেই কেবল আমি হাল্কা হাল্কা বুঝতে পারছি মানুষ তৈমূর লোক হিসাবে কেমন ছিলেন। মাঝে মাঝে তার নিজেকে কেমন একা মনে হয়েছে- নিজের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কাজ করতে গিয়ে তাকে কেমন অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়েছিলো। আর তাছাড়া, তাদের সব দায়দায়িত্ব পরে বহুবছর ধরে তাকে নিজের কাঁধে বহন করতে হয়েছিলো… আমি নেতৃত্ব দেবার মতো সাহসও অর্জন করেছি…ওয়াজির খানের মতো আমার যতো দক্ষ পারিষদ থাকুক আমার নিয়তি কেবল আমিই নির্ধারণ করতে পারি।

বাবর মুখ তুলে তার নানীজানের দিকে তাকায়। “দেখে নিয়ে, আমি ঠিক তৈমূরের মতই বীর হবো। আমি শপথ করে বলছি…”

 “কথাগুলো সত্যিই শুনতে ভাল লাগে।” এসান দৌলত মন্তব্য করেন। “চলো আমাদের অনেক কাজ এখনও বাকি আছে। একটা নতুন দিনের প্রভাত হচ্ছে।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *