৩. স্তালিন শতবর্ষ (১৮৭৯-১৯৭৯) একটি পর্যালোচনা এবং তথ্যানুসন্ধান

জাতি ও ভাষাসমূহের সমানাধিকার যে স্বীকার করে না
এবং তার স্বপক্ষে দাঁড়ায় না, সর্বপ্রকার জাতীয় নিপীড়ন ও
অসাম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করে না,
সে মার্কসবাদী নয়, এমনকি গণতন্ত্রীও নয়।

— ভ. ই. লেনিন

৩. স্তালিন শতবর্ষ (১৮৭৯-১৯৭৯) একটি পর্যালোচনা এবং তথ্যানুসন্ধান

“নেতারা আসবেন ও চলে যাবেন; কেবল জনগণই চিরকাল থাকবেন”- কথাটা স্তালিনেরই। স্তালিন ইতিহাসের সবচেয়ে আলোচিত অন্যতম ব্যক্তিত্ব, বিশ্ব রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের বেশির ভাগের দ্বারা অভিযোগ নিন্দা ও উপহাসের পাত্র, আবার অসংখ্য গুণমুগ্ধদের দ্বারা আকাশ ছোঁয়া প্রশংসিত এবং নিজের জীবনকালে যিনি অসীম সাহস, পূর্ণ মনোযোগ ও অনড় দৃঢ়তার সঙ্গে সোভিয়েত রাষ্ট্রের জাহাজকে মানব ইতিহাসের মহাসমুদ্রের অনেক নতুনতর ঝাক্ষুব্ধ ও বিধ্বংসী মাইন- পাতা পথ পার করে নিয়ে গেছেন।

আবার এই স্তালিনেরই, যার কর্দমাক্ত পদযুগল ও কলঙ্কিত হাতদুটিকে প্রায় উকটভাবে নিপীড়ন করা হয় এবং উন্মত্ত ক্রোধের সঙ্গে চাল-চামড়া আলাদা করে উন্মোচিত করা হয় সোভিয়েত ইউনিয়নের বিংশতিতম কংগ্রেসে (১৯৫৬)।

যে মানুষটির উপর একদা দেবত্ব আরোপ করা হয়েছিল তাকে অকস্মাৎ প্রশংসার চূড়া থেকে টেনে নিচে নামিয়ে এনে কলঙ্কের বন্যা ছোটানো হয়েছিল, যা পরে সোভিয়েতের মানুষ রাশ টানতে ও কিছুটা প্রতিকার করতে চেষ্টা করেছিল, কিন্তু ইতোমধ্যে এর ভিত্তিতে সোভিয়েত ইউরিয়নের এবং প্রকৃতই বিদ্যমান সমাজতন্ত্রের শত্রুরা প্রায় শ্রাব্য উন্মত্ত উল্লাসধ্বনি সহকারে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ঠিক যেন অপ্রত্যাশিত দান হাতে পাওয়ায় সীমাহীন আক্রমণ শানিয়ে তুলেছিল, পরে এমনকি আরও সুচতুরভাবে সমস্বরে সাম্যবাদের তত্ত্ব ও প্রয়োগের উপর, মাকর্সবাদ ও লেনিনবাদের বিশ্ববিক্ষার উপর আঘাত হেনেছিল।

বোধ হয় এমনকি এখনও যে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে আমরা স্তালিনকে বিচার করতে পারি তা খুবই সংক্ষিপ্ত, যেমন বলেছিলেন- ১৯৬৭ সালে আইজ্যাক ডয়েটাের যিনি স্তালিনের গুণমুগ্ধ ছিলেন না কিন্তু আজও পর্যন্ত তিনিই হলেন তার শ্রেষ্ঠ জীবনীকার । স্তালিন ফিনমিন্যান’ (লন্ডন-১৯৭৬)-খ্যাত জঁ এলেইনস্টাইন এর মন্তব্যে হয়তো কিছুটা সত্যতা থাকতে পারে যে সোভিয়েতরা এখনও এই বিষয়ে ‘গভীরে গিয়ে আলোচনা করতে পারেনি, কিন্তু তাঁর নিজের ফিলিস্তাইন। তালগোল পাকানো বা তার চেয়েও খারাপ কৃতি সম্বন্ধে সতর্ক থাকা প্রয়োজন। পাছে অশোভন বলে ধরা হয়, তাই স্মরণ করা যেতে পারে, লেনিন এলেইনস্টাইন-এর মধ্যে তার নিজের অভিজ্ঞতার বিকৃত ও বিকৃত-করা আতসকাঁচে ধরা পড়া বিপ্লবী প্রক্রিয়া কেবল দেখতে পাচ্ছেন” (পৃষ্ঠা-১২২)- কী চূড়ান্ত অযোগ্যতা!–যে, হায়, “মাও মার্কসবাদকে চীনের উপযোগী করে নিয়েছেন, ঠিক যেমন রাশিয়ার উপযোগী করে নিয়েছিলেন স্তালিন” (পৃষ্ঠা ১৬০)- মনে হয় ইয়োরোপীয় ঔদ্ধত্য চীন ও রাশিয়াকে ‘সভ্য বলে গণ্য করে না!- এবং “এখন আমাদের কাছে থাকছে কেবল উন্নত পশ্চিমা পুঁজিবাদী অর্থনীতির ভিত্তিতে সমাজতন্ত্র গড়ে তোলা” (পৃষ্ঠা ২১৮)- সব ক্ষমতা যেন এলেইনস্টাইন-এর নাগালের মধ্যে, কিন্তু মার্কসের দোহাই, তিনি দ্রুত পাততাড়ি গোটানোর জন্য প্রস্তুত হোন! ইতোমধ্যে যেন সম্প্রতি প্রয়াত কিন্তু নিজের সময়ে অদম্য মার্কসতত্ত্ববিদ জর্জ লিখটাইম তাঁর ‘ফ্রম মার্কস টু হেগেল’ গ্রন্থে (নিউইয়র্ক, ১৯৭৪) আলোচ্য বিষয়ের বাইরে বেরিয়ে এসে অবজ্ঞাভরে লিখেছিলেন “সাম্যবাদ হলো একটি আন্তর্জাতিক আন্দোলন; এমনকি স্তালিন বা মাও-এর ‘দার্শনিক বৈশিষ্ট্যহীনতাও তারই অঙ্গ” (পৃষ্ঠা ৪১), এবং মার্কসবাদীদের মুখের ওপর ছুঁড়ে মেরেছিলেন তার নিজের অশ্লীল ভাষায় আখ্যা দেওয়া “স্তালিনের মলদ্বার দিয়ে নির্গত পুঞ্জিত দুর্গন্ধ” (পৃষ্ঠা ১৫৪)। যদিও ‘নিউ লেফট’ দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীতে এর সঙ্গে র‍্যালফ মিলিব্যান্ডের প্রত্যাশা মিলে যায় যে “খুব শিগগিরই সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের দীর্ঘ ও যন্ত্রণাদায়ক প্রাক-ইতিহাসের অবসান ঘটবে”, কোনো সোভিয়েত ট্যাঙ্ক বা কোনো ‘ব্রেজনেভ মতাদর্শ’ তাকে ঠেকাতে পারবে না।

এটা রবার্ট কনকোয়েস্ট এর লক্ষ্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ, যিনি পৈশাচিক উল্লাসে লিপিবদ্ধ করেছিলেন ‘স্তালিন ত্রাস’, মিলে যায় অ্যাডাম উলামাস ও রোনাল্ড হিংলেজদের সঙ্গে যারা লিখেছিলেন স্তালিনের ভয়ংকর জীবনী, সেই সব রাজনৈতিক কারণে স্বদেশ থেকে বিতাড়িতদের সঙ্গে যারা সলঝেনিৎস মার্কা মেকি ভাববাদী বিদ্বেষ নির্গত করে এবং এদের তালিকা সংক্ষিপ্ত করলে লিওপোন্ড ল্যাবেদজদের সঙ্গে যারা এমনকি একনিষ্ঠ ট্রটস্কিপন্থী আইজ্যাক ডয়েটশার-এর উপরও কুপিত হন স্তালিনের জীবন ও কর্মকাণ্ডে কিছুটা ক্ষতিকর মর্যাদা ও অন্ধকারাচ্ছন্ন মোহনীয়তা লক্ষ করার জন্য (এনকাউন্টার-লন্ডন, ৪২ খণ্ড, সংখ্যা ১, জানুয়ারি ১৯৭৯, পৃষ্ঠা ৬৫-৮২-এল ল্যাবেদ-এর ‘আইজাক ডয়েটশার-এর স্তালিন প্রসঙ্গ দ্রষ্টব্য)।

ঊনবিংশ শতাব্দীর মহান ঐতিহাসিক, লর্ড অ্যাকটন কিছু মন্তব্য করেছিলেন যা দুনিয়া কাঁপানো বিষয়গুলো বুঝতে সাহায্য করে। অ্যাকটন একদা লিখেছিলেন, “সবচেয়ে ভালো জিনিস মানুষ যা পছন্দ করে তা হলো ধর্ম ও মুক্তি, আনন্দ বা সমৃদ্ধি নয়, জ্ঞান বা ক্ষমতা নয়। তবুও এই দুটোর পথই অপরিসীম রক্তাক্ত।”

অন্য আর এক উপলক্ষে তিনি লিখেছিলেন, “একটি অভিজাত সমাজ ও একটি রাজতন্ত্রী রাষ্ট্রের সঙ্গে মুক্তিকে মেলানো ছিল বহু শতাব্দীর সংগ্রামের সমস্যা। অবাধ গণতন্ত্রে তাকে রক্ষা করা ভবিষ্যতের কাছে বিশেষ সমস্যা। স্মরণ করা যেতে পারে, ১৮৫১ সালে কার্ল মার্কসও অনুরূপ সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিলেন :”আমরা শ্রমিকদের বলি, কেবল বিদ্যমান অবস্থা পরিবর্তনের জন্যই নয়, সেই সঙ্গে নিজেদেরও বদল করার জন্য এবং রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রয়োগ করতে নিজেদের যোগ্য করার জন্য আপনাদের ১৫, ২০, ৫০ বছরের গৃহযুদ্ধ এবং আন্তর্জাতিক যুদ্ধের মধ্য দিয়ে যেতে হবে।” মাকর্স আমাদের বুঝিয়েছিলেন, বিশ্ব ইতিহাস যেন “খুব সহজেই রচনা করা যাবে।” যদি একজন কেবল “অভ্রান্ত অনুকূল সুযোগ”-এর ভিত্তিতে অগ্রসর হয়। লেনিনও ব্যাখ্যা করেছিলেন কীভাবে ধনতন্ত্র থেকে সমাজতন্ত্রে উত্তরণ কখনোই সরলভাবে প্রত্যাশিত নয়, কয়েক দশক জোড়া তরঙ্গময় একটি সমগ্র ঐতিহাসিক যুগ’! বিপ্লবের পথ, তিনি শিখিয়েছিলেন, কখনই নেভস্কি সড়কের মতো মসৃণ নয়। মনুষ্য প্রকৃতি কী এমন বিচিত্র ও প্রায়শই তাত্ত্বিক ছাচের প্রতি বিরূপ নয় যে এর বাঁকা তক্তা থেকে কান্ট একদা যেমন বলেছিলেন, “কোনো সোজা বস্তু তৈরি করা যায় না?” এই কথার মধ্যে দিয়ে অবশ্য আলেকজান্ডার পোপ-এর ধুয়ো “যাহা বিদ্যমান তাহাই সত্য” অথবা হেগেল-এর নিশ্চয়োক্তি : “যাহাই সত্য তাহাই যুক্তিসঙ্গত” মেনে নেওয়া নয়, বরং বুঝতে সাহায্য করা মার্কসের গভীর পর্যবেক্ষণ : “ইতিহাস এমন কোনো দায়িত্ব অর্পণ করে না যা প্রতিপালিত করা যায় না।”

১৯৬২ সালে একদা ডয়েটশার ঠাট্টাছলে বলেছিলেন : “আমি বুঝি না স্তালিনের অন্যায় কার্যকলাপের উঘাটন কেমন করে কাউকে, আঘাতের আকস্মিকতায় বিহ্বল ব্যক্তিরা ছাড়া, সম্পত্তির বেসরকারি মালিকানায় অথবা বিশ্বজননী মেরির পবিত্র জন্মবৃত্তান্তে বিশ্বাসী করে তুলতে পারে” (এনকাউন্টার। পত্রিকা- পূর্বোক্ত প্রবন্ধ, পৃষ্ঠা ৭৭ দ্রষ্টব্য)। তার এই মন্তব্য যুক্ত করা যেতে পারে সোভিয়েত ইতিহাস সম্পর্কে অ্যাংলো-সাকসন দুনিয়ায় সর্বোচ্চ বিশেষজ্ঞ এবং কোনো মতেই স্তালিনের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট নন, ই এইচ কার-এর সঙ্গে, যিনি উল্লেখ করেছিলেন, (স্তালিনের) “নিষ্ঠা সংগঠন ও নির্ভেজাল কঠিন শ্রম, যা গত । ৬০ বছরে রাশিয়াকে রূপান্তরিত করেছে… পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার প্রধান নীতি- মুনাফা ও বাজারের নিয়মকে বাতিল করে এবং তার জায়গায় সাধারণের কল্যাণের লক্ষ্যে এবং সর্বার্থসাধক অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ব্যবস্থার মাধ্যমে রাশিয়াকে রূপান্তরিত করেছে, এবং আরও বলেছিলেন, “স্তালিনবাদী হিসেবে চিহ্নিতকরণের ঝুঁকি থাকলেও তিনি কোনো ধরনের নৈতিক ব্ল্যাকমেলের কাছে আত্মসমর্পণ করতে প্রস্তুত নন- এমনকি একজন ইংরেজ ঐতিহাসিক অষ্টম হেনরির, স্ত্রীদের শিরোচ্ছেদ ক্ষমা না করেও, শাসনকালে সাফল্যের প্রশংসা করতে পারেন।” (নিউ লেফট রিভিউ, লন্ডন, সেপ্টেম্বর-অক্টোবর, ১৯৭৮, পৃষ্ঠা ২৫-৩৬, পত্রিকায় তাঁর সাক্ষাৎকার দ্রষ্টব্য)। তাই ডয়েটশারের পর্যবেক্ষণ গুরুত্বপূর্ণ: “স্তালিন ছিলেন সেই মহান বিপ্লবী প্রজন্মভুক্ত যেমন ছিলেন ক্রমওয়েল, রবসপিয়ার, ও নেপোলিয়ন।” কোনো সন্দেহ নেই যে স্তালিনের মধ্যে ‘স্বৈরতন্ত্র তাঁর খ্যাতিকে কলঙ্কিত করেছে, কিন্তু তার সহজাত গুণকে (তার মহত্ত্বও) অস্বীকার করা হলে তা হবে বাস্তবতার বিরুদ্ধাচারণ করা। বর্তমান পরিস্থিতিতে যতটা সম্ভব সঠিক মূল্যায়ন করতে সোভিয়েত বিশারদরা সাহায্য করতে পারেন, তবে ইতোমধ্যে যা জানা গেছে তার ভিত্তিতে রয় এ মেদভেদেভ-এর শত্রুতাপূর্ণ রচনা, বহুল প্রচারিত ‘লেট হিস্ট্রি জাজ: দ্য অরিজিনস অ্যান্ড কনসিকোয়েন্সেস অব স্টালিনজ (ম্যাকমিলান ১৯৭২)-কে কার্যকরীভাবে খণ্ডন করা যায়। যাই হোক, তা করার এটাই সময়; স্তালিনের মতো মৌলিক গুণান্বিত ব্যক্তির প্রামাণিক এবং সুষম বর্ণনা আছে (“দোষত্রুটি গোপন না করে বা মেনে না নিয়ে”) এবং যে কোনো বিচারেই তিনি ছিলেন অসাধারণ এবং যে যুগে আমরা বাস করছি তিনি ছিলেন তার স্রষ্টা।

বিপ্লব হলো একদা লেনিন বলেছিলেন, ‘নিপীড়িতদের উৎসব’ । বহুকাল আগে এঙ্গেলস বর্ণনা করেছিলেন বিপ্লবের অধিকার, এমনকি আব্রাহাম লিঙ্কনও নিজের মতো করেই ঘোষণা করেছিলেন, জনগণের একমাত্র ঐতিহাসিক অধিকার হিসেবে। মৌলিক পরিবর্তন অবশ্য সর্বদাই একটি মূল্য ধার্য করে এবং রুশ বিপ্লব, যা কিনা অন্যের মধ্যে সবচেয়ে বিস্ময়কর, সব সময় জনগণের শিরোচ্ছেদ করা থেকে দূরে থাকতে পারেনি যেমন ট্রটস্কি (সকলকে ছাড়িয়ে) ১৯০৩ সালে ভেবেছিলেন তখন তিনি লেনিনকে খোঁচা মেরে ‘ঝাকেবিনবাদী” আখ্যা দিয়েছিলেন (এতে লেনিন বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছিলেন আখ্যাটি ‘অবমাননাকর।) এবং বলেছিলেন, “গিলোটিনে মার্কসেরই প্রথম শিরোচ্ছেদ হবে” (লেনিনের কাছে এই ধরনের বাগাড়ম্বর ছিল অসার ও অতি দাম্ভিক অলঙ্কারপূর্ণ উক্তি)। মহান অক্টোবর বিপ্লব ও তার পরবর্তী ঘটনাবলিকে প্রধানত ধন্যবাদ, ভবিষ্যতে অন্য কোনো দেশকে সমাজতন্ত্র গঠনের জন্য এরকম মানসিক যন্ত্রণাদায়ক অবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে হবে না, তবে অন্য কোনো দেশকে এই ধরনের ভয়ংকর কঠোর পরীক্ষা দিতে হয়নি। যে কোনো ধরনের ঐতিহাসিক অদৃষ্টবাদ মার্কসবাদের সঙ্গে সঙ্গতিহীন, কিন্তু মানুষের কাজ ও যন্ত্রণার বিচারে বিপ্লবের দাহ্য মূর্তি ও তার মূল্য গভীর অনুসন্ধানের দাবি রাখে। মহান ফরাসি বিপ্লব সম্পর্কে মিশেলে, ওলার ম্যাথিয়ে এবং লেফোভর-এর গবেষণা এখনও নতুন তথ্য সন্ধানের ও প্রকৃত ঐতিহাসিক চিন্তার উদ্যোগকে অনুপ্রাণিত করে।

একা নেপোলিয়নকে আলাদা করা যাবে না তার ভ্রান্তি থেকে, যা তাকে রাশিয়া জয়ের যুদ্ধে ঠেলে দিয়েছিল ছয় লক্ষ সৈন্য নিয়ে, যার মাত্র পনেরো হাজার দেশে ফিরে এসেছিল। সেই নম্র কিন্তু অনমনীয় বিপ্লবী রোজা লুক্সেমবার্গ একদা বলেছিলেন, তিনি তাঁর ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গিতে ধীর, স্থির ও আস্থাশীল থাকতে পারেন “প্রতিদিনকার ঘটনার অখ্যাতি ও অস্বাভাবিকতা সত্ত্বেও, কারণ তিনি মনে করেন “সামুদ্রিক ঝড়, প্লাবন অথবা সূর্যগ্রহণের মতো প্রাকৃতিক শক্তির বহিঃপ্রকাশে কোনো নৈতিক বিচারের মানদণ্ড প্রয়োগ করা অবাস্তব।” (নিউ লেফট রিভিউ, নং ১১৩/১১৪, জানুয়ারি-এপ্রিল ১৯৭৯, সংখ্যায় উদ্ধৃত)। লেনিনের উত্তরাধিকারী হিসেবে (যাঁর সঙ্গে, যেমন স্তালিন প্রায়শই বলতেন, তাঁর অনুগামীদের কেউই, তিনি নিজেরও, তুলনার যোগ্য নন), স্তালিনের মাথা ঝিম। ঝিম করা দায়িত্ব এবং অতি মানবীয় সমস্যা ছিল একশো বছর পেছিয়ে পড়া এক বিশাল দেশকে শক্তিতে উদ্বুদ্ধ করার এবং সেই শক্তির পুষ্টিসাধন ও বিকশিত করার, যখন শত্রুতামূলক বিশ্ব সোভিয়েত “কামারের নেহাই”-এ ‘হাতুড়ি’ হওয়ার সব রকম চেষ্টা করেছিল- “হয় আমরা না হয় তারা ছিল হুঁশিয়ারি, তখন সেই সময়-সীমায় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় স্তালিনের নেতৃত্বে সোভিয়েত কমিউনিস্টরা স্বীয় কর্মশক্তি নিয়োগ করেছিলেন। এর জন্য প্রয়োজন ছিল লৌহদৃঢ় শৃঙ্খলা এবং “জনগণকে সৈন্যবাহিনীর ঐক্যে সজ্জিত করার কঠোর কিন্তু একমাত্র পদ্ধতি (জ পল সাত্র’র কথায়) যা প্রয়োগ করেছিলেন স্তালিন প্রাক্তন সাফ সন্তান, লেনিনের চেয়ে বেশি “বঞ্চিত মানুষের ক্রোধের” (ডয়েটশারের কথায়) বশবর্তী হতে সম্ভবত কোনো বিবেক দংশন বোধ করেননি, কিন্তু দায়িত্ব এড়াতে পারেননি এবং রোমন্থনের আশ্রয় নিতে পারেননি, মার্কসীয় মহলে প্রায়ই শোনা যেত যে মার্কস নিজেও কখনো ভাবেননি যে একটি পশ্চাৎপদ দেশে প্রলেতারীয় বিপ্লব ঘটবে এবং এমনকি লেনিনও মনে হয় কখনো ভাবেননি এত দীর্ঘকাল সোভিয়েত রাষ্ট্রকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে হবে। অবশ্য এটা স্তালিন ও সোভিয়েতের ‘অপরাধ’ বা ‘বাড়াবাড়ি’র সাফাই গাওয়া নয়, কিন্তু যেসব অন্যায় অপরাধ হয়েছে, এবং মনে হয় যার রেশ এখনও রয়েছে, সে সম্পর্কে সঠিক বোঝাপড়ার হয়তো গুরুত্ব লাঘবের দিকে একটা পদক্ষেপ।

কিছুকাল হলো, সহজেই বোধগম্য, বিংশতিতম কংগ্রেসের পর, স্তালিনের আমলের সুকৃতিকে বিশেষত বিদেশে শত্রুপক্ষের দ্বারা সচেতনভাবে বরবাদ করার এবং অদ্ভুত কুৎসার সঙ্গে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা চলছে। সোভিয়েত পার্টির বিংশতিতম কংগ্রেসে আপাতদৃষ্টিতে যন্ত্রণাদায়ক যা উদ্ঘাটন করা হয়েছিল তা ছিল পুরোপুরি অস্বাস্থ্যকর। ব্যক্তিপূজা’র শেকড় নিড়েন দিয়ে উপড়ে ফেলার এক ‘শ থেরাপি’। তাতে কিছুটা আত্মনিগ্রহের উপাদানও ছিল।

কিন্তু এটা ছিল বলশেভিক আত্মসমালোচনার এক তীব্র ও চড়া রূপ, যা গোপন রাখা যেত এমন ভুলভ্রান্তি ও অখ্যাতি স্বীকার করে নিতে পিছপা না হওয়ার কমিউনিস্ট দৃঢ়তা চরিত্রের নিদর্শন। বুর্জোয়া সভ্যতার জঘন্য ইতর কার্যকলাপ, একদা সাম্রাজ্যবাদের প্রায় করতলগত সারা বিশ্ব যার সাক্ষ্য বহন করে, সযত্নে গোপন রাখা হয়েছে, কখনো সখনো কলঙ্কের এক ক্ষুদ্র অংশ শয়তানির উত্তেনাকর বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে, কিন্তু সোভিয়েত জনগণ সমাজতান্ত্রিক ন্যায়-নীতি থেকে বিচ্যুতি ও অন্যান্য অপরাধ ও ভ্রান্তির নির্দয় উদ্ঘাটনের দায়িত্ব স্থলন করেনি, কারণ অবশ্যই সময়ের কঠিন চাপ দাবি করেছে লেনিনীয় নীতিতে প্রত্যাবর্তন।

এমনকি স্তালিনের ব্যক্তিবাদ ও অনুষঙ্গের নিন্দার শিখরে থেকেও এন এস কুশ্চভকে বলতে হয়েছিল, ‘সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে আমরা সকলে স্তালিনবাদী। সংশ্লিষ্ট বিষয়ের গভীরে বিশ্লেষণ করা এখনও বাকি আছে, বিশেষত কারণ সাম্রাজ্যবাদ এখনও সম্পূর্ণ পর্যদস্ত হয়নি এবং দুষ্কর্মের ক্ষমতা এখনও ধরে।

খ্যাতনামা লেখক অ্যাডলফ রুদনিস্কি লিখেছিলেন (পোলিশ পার্সপেকটিভ আগস্ট-সেপ্টেম্বর ১৯৬২): বিপ্লব হলো স্থায়ী যুদ্ধ, প্রতি ঘণ্টায় এক যুদ্ধ, যে যুদ্ধ বদলে দেয় স্বার্থ, প্রয়োজন ও অগ্রাধিকার। ৪৪ বছরের লড়াইয়ে এড়ানো যায় না এমন সব ভ্রান্তি, উন্মত্ততার বহিঃপ্রকাশ এবং সাফল্য- যে কোনো ব্যক্তিকেই ফেল করিয়ে দিতে যথেষ্ট। না, বিপ্লব ছেলেখেলা নয়! সমগ্র সোভিয়েত জনগণ (স্তালিন একা নয়, কিন্তু প্রায় একা স্তালিন হাল ধরেছেন সব কিছুর) এই কঠোর শ্রমের মধ্য দিয়ে এগিয়ে গেছেন যা এখনও পুরোপুরি শেষ হয়নি। এবং এর কারণ এই কঠোর পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে তারা সফল হয়ে বেরিয়ে এসেছেন, যার জন্য পৃথিবীতে আজ সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর এক সমষ্টির উদ্ভব হয়েছে, তাদের মধ্যে প্রথম প্রজন্ম ফ্যাসিবাদ-বিজয়ী সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং যেমন জেমস্ অ্যালড্রিজ একদা বলেছিলেন, ভবিষ্যতের মাতৃভূমি’- কোনোভাবেই যাকে চিন্তা করা হয়নি অন্যত্র অনুকরণীয় এক পরম উৎকর্ষের আদর্শ হিসেবে, কিন্তু অবশ্যই ছিল মানবজাতির কাছে এক অনুপ্রেরণা ও নিদর্শন। ভোলা যায় না “এক চমৎকার জর্জিয়াবাসী” বলে লেনিন কর্তৃক সমাদৃত যুবক স্তালিনের আন্দোলনে যোগদান, জার স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে তাঁর বিরামহীন লড়াই ও লেনিনের শিক্ষার বিশ্বস্ত প্রচারক, লেনিনের প্রস্তাব অনুসারে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটিতে তার অন্তর্ভুক্তি, ১৯১৭’র অক্টোবরের প্রাক্কালে এবং প্রাভদায়’ তার ভূমিকা, লেনিনের পরিচালনায় বিপ্লবের জন্য ও তার সুফলকে রক্ষা করার জন্য তার লড়াই। লেনিনের পর স্ত লিনই তার গুণ ও দোষসহ দৃঢ়তার সঙ্গে ভেতরের এবং বাইরের শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এবং বিশ্বের প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে সুরক্ষিত করতে সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টিকে পরিচালনা করেছেন। সমাজতান্ত্রিক শিল্পায়ন ও কৃষিতে যৌথ খামার গড়ে তোলার লাইনকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে সোভিয়েত পার্টি ও জনগণকে এই স্তালিনই নেতৃত্ব দিয়েছেন। আবার সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টি, সোভিয়েত জনগণ এবং লাল ফৌজকে এক অসম্ভব কঠিন তিক্ত লড়াইয়ে ফ্যাসিস্ট শক্তিগগাষ্ঠীর বিরুদ্ধে বিস্ময়কর ঐতিহাসিক বিজয় লাভ না করা পর্যন্ত নেতৃত্ব দিয়েছেন এই স্তালিনই।

.

ট্রটস্কি জিনোভিয়েভ ও কামানেভ, বুখারিন ও বাইকভদের চক্রান্ত

এই দায়িত্বের অন্তর্বর্তী সময়ে যখন পার্টিকে ট্রটস্কি জিনোভিয়েভ ও কামানেভ, বুখারিন ও বাইকভদের নেতৃত্বাধীন চক্রের দ্বারা পরিচালিত পরাজিত মনোভাবসম্পন্ন ও ঐক্য বিনাশী আঘাতকে পর্যুদস্ত করে বিভিন্ন ধরনের সুবিধাবাদ ও বিকৃতির বিরুদ্ধে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে মার্কসবাদ-লেনিনবাদকে রক্ষা ও বিকশিত করতে হয়েছে, তখন এই স্তালিনই ছিলেন পার্টির শীর্ষ নেতৃত্বে। “একটি দেশে সমাজতন্ত্র” প্রসঙ্গে এটা কেবল কথার ফুলঝুরি ছিল না। ছিল দৃঢ় ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে, খুবই জোরের সঙ্গে এবং বিপ্লবী বাগবৈশিষ্ট্যের সঙ্গে তোলা বিতর্ক। যে, পশ্চিমা দুনিয়ায় বিপ্লবের অনুপস্থিতিতে বিষয়টা মেনে নেওয়া ছিল এক মোহ এবং বস্তুতপক্ষে তার মানে ছিল লেনিন অনুসৃত অভীষ্ট লক্ষ্যপথ রাশিয়াকে পরিত্যাগ করা। এ ছিল এক ঐতিহাসিক সাফল্যের রেকর্ড এবং আদৌ অপ্রত্যাশিত ছিল না যে সমাজতন্ত্রের বিজয়ের সঙ্গে স্তালিনের নাম অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত হয়ে গিয়েছিল এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় স্তালিনের নাম হৃদয়ে এবং ঠোঁটে নিয়ে যোদ্ধারা বার্লিনের আগে স্তালিনগ্রাদে ও অন্য সব ফ্রন্টে প্রায় অপরাজেয় ফ্যাসিস্টদের নাড়িভুঁড়ি ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল। অ্যালেক নোড় ও অন্যাডম উলাম রিচার্ড পিপসরা অবজ্ঞাভরে বলুক “চাচা জো’র শাসন,” “বলশিভিক জার”, “বসন্ত রোগের গুটি চিহ্নে ভরা ভগবান”, “ঘোলাটে চোখের বদমাইশ” (কিন্তু যাই হোক, স্পষ্টই প্রতীয়মান, সব কিছু পরিবর্তনের ক্ষমতাসহ!) এটা বোধের অতীত। নয় যে মিলোভান জিলাস, যিনি বহু বছর হলো সব ধরনের প্রকৃত, বিদ্যমান সমাজতন্ত্র’-র পথ পরিহার করেছিলেন, লিখেছিলেন “স্তালিনের সঙ্গে কথোপকথন” গ্রন্থে (১৯৫২) যে, নিষ্ঠুরতা স্তালিনকে বিন্দুমাত্র বিচলিত করত না, কারণ তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে তিনি ইতিহাসের রায় কার্যকরী করছেন। এটা হয়তো ঠিক যে স্তালিন প্রচণ্ডভাবে অনুভব করতেন যে তাকে একটা কর্তব্য সম্পাদন করতে হবে, যেন তা ইতিহাস তার উপর অর্পণ করেছে এবং তার জন্য তাঁকে বিবেকযন্ত্রণা ভোগ করার প্রয়োজন নেই। তবে যাই হোক একটা বিপ্লবী প্রক্রিয়ার এটা কোনো সম্পূর্ণ কাহিনি হতে পারে না, যা বিচিত্র, কখনো সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ব্যক্তিগত ও ব্যক্তি-বহির্ভূত বহু উপাদানে ঘনীভূত হওয়ার লক্ষণযুক্ত মহল থেকে নিরন্তর, নিষ্ঠুর শত্রুতায় নাকাল হয়েছে এবং তাই সহজ সরল সিদ্ধান্ত গ্রহণ এড়াতে হবে। ১৯৫৩ সালে বিশিষ্ট বিজ্ঞানী জে ডি বার্নাল যা বলেছিলেন তা পুরোপুরি মেনে নিতে আপত্তি থাকলেও সাধারণভাবে এখনও প্রাসঙ্গিক স্তালিন “একীভূত করেছিলেন, যা তার সময়ের আগে কোনো ব্যক্তি করেননি, প্রয়োগের অভ্রান্ত কৃতিত্বের সঙ্গে এক গভীর তত্ত্বগত বোঝাপড়া।”

.

তুখোড় ‘মার্কসবাদীদের’ কদর্যতা

এল আলথুসার, তাঁর ‘এসেজ ইন সেলফ-ক্রিটিসিজম-এ (লন্ডন-১৯৭৬) বলেছেন “স্তালিনীয় বিচ্যুতি” তার কাছে মনে হয় “দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক-এর মরণোত্তর প্রতিশোধ”- এক গভীর অর্থপূর্ণ মন্তব্য যা বিবেচনার দাবি রাখে। কিন্তু আবেগপূর্ণভাবে স্মরণ করিয়ে দেন যে, “লক্ষ লক্ষ কমিউনিস্টরা শিখেছিলেন স্তালিনের কাছ থেকে, যদিও আপ্তবাক্য হিসেবে লেনিনবাদের নীতি।” স্তালিনের সমালোচনা ও কলঙ্ক রটনাকারীদের মধ্যে প্রায়শই অতি মার্কসবাদী ঝোঁকসম্পন্ন বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে, তাঁর ভ্রান্তি ও বাড়াবাড়ি এবং তথাকথিত খতমের ঘটনা তুলনামূলকভাবে ক্ষমাযোগ্য বলে ধরা যেতে পারে, কিন্তু সূক্ষ্ম বাছ-বিচার পাণ্ডিত্য ও মস্তিষ্ক ক্রিয়ার গভীর জ্ঞানের নির্দেশক অভ্যন্তরীণ সৌরভের অভাব ক্ষমা করা। যায় না। স্তালিনকে কখনোই তুলনা করা যায় না ট্রটস্কির সঙ্গে, যার লেখায় ও। বক্তৃতায় চোখ ধাঁধানো প্রভাব ছিল এবং ছিল নন্দনতত্ত্বে গভীর প্রতিভা। অগ্নিস্রাবী বিপ্লবী বাকৃবিন্যাসের ক্ষেত্রে, জিনোভিয়েভ স্তালিনের উপরে যেতেন। বুখারিনের মার্কসবাদী পাণ্ডিত্য প্রয়োগ-কৌশল ছিল না তার, তথাপি তিনি ছিলেন খুবই ফলপ্রসূ রাজনৈতিক লেখক ও বক্তা, তাঁর শব্দচয়ন ছিল স্পষ্ট ও সংক্ষিপ্ত, অহংবোধ ও বুদ্ধিজীবীসুলভ ঔদ্ধত্যবিহীন, তবে বাকপটুতা ও কৌতুকরস বর্জিত নয় (রয় এ মেডভেডেভ, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৫৩৮, অবশ্য বলেন যে স্তালিন “বলতেন একরকম কিন্তু কাজ করতেন অন্যরকম”)। কিন্তু যেটা গুরুত্বপূর্ণ এবং যা জোরের সঙ্গে বলতে হবে দুদশক আগে পর্যন্ত বিশ্বের কমিউনিস্টদের মধ্যে কেউই নেই যিনি অস্বীকার করতে পারবেন না তাদের অস্বীকার করার প্রয়োজনও নেই যে তারা স্তালিনের রচনা থেকেই মার্কসবাদ শিখেছেন। অবশ্যই লেনিনের “ঈগল শিখর”-এর তুলনায় তিনি ছিলেন বামনস্বরূপ, কিন্তু কে নয়? “মার্কস লিখেছিলেন লেনিনের জন্য, লেনিন লিখেছিলেন স্তালিনের জন্য, আর স্তালিন লিখেছিলেন আমাদের মতো মানুষদের জন্য।” কখনো কি ভোলা যায় স্তালিনের জ্বালানো আগুনের শিখা থেকেই আমরা অনেকেই আমাদের ছোট্ট প্রদীপটা জ্বালিয়েছি? কেউ হয়তো উপহাস করে বলবে যে এই কথাটির মধ্যেই তো নিহিত আছে। অনেক দেশে কমিউনিস্ট অক্ষমতার ব্যাখ্যা, কিন্তু সেই উন্নাসিকতাকে উপেক্ষা করা যেতে পারে। আনাতোল ফ্লস একদা লিখেছিলেন : “ঈশ্বরের একটা সমস্যা আছে, কারণ তার ইচ্ছা মানুষকে দিয়েই বাস্তবায়িত করতে হয়। সমাজতন্ত্রেরও আছে এই একই সমস্যা।

লক্ষণীয়, জনৈক “মাকর্সবাদী” পাণ্ডিত্যাভিমানী, লুসিয়া কোলেত্তি এঙ্গেলসকেও রেহাই দেননি; কোলেত্তির দৃষ্টিতে, এঙ্গেলসও দোষী “মার্কসের রচনার প্রতিটি পৃষ্ঠার কাঠিন্য ও জটিলতা” থেকে সরে এসে “জনপ্রিয় সাধারণের বোধগম্য মামুলি ও পল্লবগ্রাহিতা”-র জন্য। (ওয়েস্টার্ন মার্কসিজম : আ ক্রিটিক্যাল রিডার”, নিউ লেফট রিভিউ, লন্ডন-১৯৭৭, পৃষ্ঠা ৩২৮-২৯ দ্রষ্টব্য)। মনে পড়ে যখন সোভিয়েত পার্টির পঞ্চদশ কংগ্রেসে (১৯২৬) স্তালিন ট্রটস্কি কী চান?” প্রশ্ন তুলে নিজেই জবাব দিয়েছিলেন: “ট্রটস্কি চান সোভিয়েত সরকার সমাজতন্ত্রের গঠন কাজ স্থগিত রাখুক যতদিন না পশ্চিমা দুনিয়ায় বিপ্লব সংঘটিত হচ্ছে। তিনি চান নবীন ও দুর্বল সোভিয়েত রাষ্ট্র পশ্চিমা শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে হঠকারী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে তার অস্তিত্ব বিপন্ন করুক!” “এই মুহূর্তে এঙ্গেলস যদি জীবিত থাকতেন”, স্তালিন বলেন, “তিনি নিঃসন্দেহে আক্ষেপ করে বলতেন: “শয়তান তার পুরনো গৎ আউড়াক। ইউএসএসআর-এ বিজয়ী বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক।” এটা ছিল সঙ্কট মুহূর্তে তত্ত্বের ভূমিকার স্পষ্টবাদী মূল্যায়ন, কিন্তু তা লেনিনের হৃদয়ে আনন্দের সঞ্চার করত এবং এ ছিল একটি সুন্দর কার্যকরী ও একনিষ্ঠ বৈপ্লবিক তার্কিক সওয়াল।

লেনিনের ‘ইচ্ছাপত্র’ যাতে স্তালিনকে ‘অত্যধিক রূঢ়’ বলে বর্ণনা করা হয়েছিল, ১৯৫৬ সালে প্রকাশিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়নে এবং বিদেশে তা অজানা ছিল। একই দলিলে বলা হয়েছিল ট্রটস্কি ‘বলশেভিক’ নন, জিনোভিয়েভ ও কামানেভ ছিলেন ‘চোরাগুপ্তা রাজনীতিক, বুখারিন পণ্ডিতসুলভ কিন্তু মার্কসবাদী নন। ট্রটস্কি ও স্তালিনকে দুজন যোগ্যতম নেতা বলে লেনিনের উল্লেখ- যা ডয়েটাের লিখেছেন, স্তালিনের সহকর্মীদের নিশ্চিতভাবে নাড়া দিয়ে থাকেত পারে এবং তিনি কোনো বিকল্প সুপারিশও করেননি, কারণ বোধ হয় স্তালিনের মধ্যে তিনি কোনো রাজনৈতিক অসম্পূর্ণতা লক্ষ করেননি, এবং এমন একজনকে চেয়েছিলেন যিনি অন্য কমরেডদের প্রতি সহনশীলতা ও আচরণে কিছুটা উদারতার সঙ্গে স্তালিনের যোগ্যতার মিলন ঘটাতে পারবেন। যে কারণে স্তালিন ত্রয়োদশ কংগ্রেসে পতদ্যাগ করতে ইচ্ছা প্রকাশ করেন, কিন্তু কংগ্রেস সর্বসম্মত ভোটে তার প্রধান প্রতিপক্ষ ট্রটস্কিসহ তাকে পার্টি সম্পাদকের দায়িত্ব চালিয়ে যাবার নির্দেশ দেয়, এই প্রত্যাশায় (শুরুতে হয়তো পূরণ হয়েছিল, কিন্তু পরবর্তী সময়ে নয়) যে, তিনি তার ত্রুটি-বিচ্যুতি সংশোধনে সক্ষম হবেন।”

“স্তালিনের চরিত্রের আবেগপূর্ণ নির্দয় বিপ্লবী প্রগাঢ়তা উদ্ভূত হয়েছিল অদম্য ও দীর্ঘদিন যাবৎ বে-আইনি বিপ্লবী কর্মতৎপরতার জীবনকাল থেকে যার মধ্যে নিহিত ছিল সন্দেহ ও সতর্কতার প্রশিক্ষণ, যার প্রকাশ ঘটেছিল তাঁর সর্বত্র সন্দেহভাজন গুপ্তশত্রুকে ধ্বংস ও নির্মূল করার নিরবচ্ছিন্ন রূঢ়তার মধ্য দিয়ে।” বিপ্লবী কাজকর্মের বিরামহীন, নিদারুণভাবে নিংড়ে নেয়া পরিশ্রান্তির চাপ নিশ্চয়ই এই মানুষটার উপর ছাপ ফেলেছিল। তিনি জন্মেছিলেন ও বড় হয়েছিলেন ককেশাসে, যেখানকার জীবনযাত্রা ছিল খুবই কঠিন ও রূঢ়, তার নিজের অভিজ্ঞতা ছিল বিপ্লবের বাধকতায় অদম্য শত্রুদের সঙ্গে (জেতার জন্য “হয় আমরা, না হয় তারা”) অবিরাম সংঘর্ষ, ক্রোনস্টাড বিদ্রোহে সহযোদ্ধাদের রক্তাক্ত নিপীড়নের মতো ঘটনাবলি, “১৪ রাষ্ট্রের প্রচার” যার মোড়কে স্তালিন বলেছিলেন, “সর্বজনীন শ্রদ্ধেয় উইনস্টন হস্তক্ষেপের যুদ্ধকে আচ্ছাদিত করেছিলেন” প্রভৃতির মিশ্রণ। ঘটনার অনেক পরে কড়া মন্তব্য করা খুবই সহজ যে স্তালিনের ‘গোঁড়ামি’ এমন ধরনের ছিল যেন তিনি চাইতেন “গৃহযুদ্ধের ‘সুসময় দীর্ঘস্থায়ী হোক” (ফোরাম’ পত্রিকায় ১৯৬৮ মে মাসের সংখ্যায় গিওগ্রি লুকাঁচ এটাই যেন লিখতে চেয়েছিলেন, তিনি এতটাই বহন করেছিলেন যে একজন বুঝতে পারবেন, বিশেষত যেমন লুকাঁচ, যদিও কখনো কখনো অখুশি, কিন্তু কখনই লড়াই ছেড়ে চলে আসেননি)।

সরাসরি লড়াই করেনি এমন একজনের পক্ষে লড়াইয়ের বহু যুগ পরে লড়াই কীভাবে করা উচিত ছিল সে সম্পর্কে রায় দেয়া খুব সহজ কাজ নয়। স্তালিন ও সোভিয়েত নেতৃত্বের বিরুদ্ধে এটাই কি বলতে হবে যে যৌথ খামারের জন্য লড়াই, তীব্রতার বিচারে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সঙ্গে তুলনীয়?

স্তালিনের কাজের মূল্যায়ন করা যেতে পারে ১৯১৯ সালে লেনিন তার “হাঙ্গেরির শ্রমিকদের প্রতি অভিনন্দন বার্তায়” যা বলেছিলেন তার আলোকে। তিনি বলেছিলেন, সোভিয়েত শক্তি “এক অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন মন্ত্রপূত রক্ষাকবচ ছিল না এবং যদিও তা “সমাজতন্ত্রের পথ সুগম করেছে”, এর উত্তরণে কোনো পূর্ব প্রদত্ত সাফল্য নেই, কিন্তু আছে “এক দীর্ঘ কঠিন ও অদম্য শ্রেণিসংগ্রাম যা পুঁজিবাদী শাসনব্যবস্থা উৎখাতের পর, বুর্জোয়া রাষ্ট্র ধ্বংস করার পর, প্রলেতারীয় একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করার পর বিলীন হয়ে যায় না, কেবল এর রূপ পাল্টায় এবং অনেক ক্ষেত্রে আরও প্রবল হয়ে ওঠে”, কার্ল মার্কস যাকে ‘যুগের ক্লেদ’ আখ্যা দিয়েছিলেন তা শক্তভাবে সেঁটে থাকে।

‘স্তালিনের সমস্যা’, ‘আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের এক প্রত্যক্ষ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়’, যথেষ্ট বস্তুবাদী বিশ্লেষণ ও মাকর্সবাদী ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে । তবে যাই হোক তার প্রশংসা ও নিন্দার বিভ্রান্তিকর ও স্ববিরোধী ভাবাবেগ, একই ব্যক্তির মধ্যে বিপরীতধর্মী শক্তির যুগপৎ উপস্থিতির অর্থ হলো সোভিয়েত ও বিশ্ব ইতিহাস থেকে স্তালিনকে মুছে ফেলা, যা অনুমোদনযোগ্য নয় এবং অসম্ভব, তার অবসান ঘটাতে হবে।

লেনিনের দায়িত্ব গ্রহণ করুক “দৃঢ় কমিউনিস্টদের একটি মূল অংশ” বলে জুলাই ১৯২১-এর আহ্বান (কলোন্তাই এবং অন্যান্যদের দ্বারা) আজ “এক জাদুঘরের স্মৃতি” হতে পারে, কিন্তু যন্ত্রণাদায়ক ধাপে ধাপে সোভিয়েত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নিশ্বাস প্রশ্বাসের মতোই স্তালিনের একনিষ্ঠ ও নিরবচ্ছিন্ন প্রয়াস, এবং একই সময়ে, লেনিনের মৃত্যুর পর “ট্রটস্কিবাদী বিরোধিতার মঞ্চ”র (১৯২৭) মতো বিভিন্ন শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়া, যখন সমাজতান্ত্রিক পুনর্গঠনরত পার্টিকে “লেনিনের বিপ্লবী নীতির প্রকাশ্য নিবীর্যকরণের অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছিল, তখন তা ভুলে যাওয়া যায় না। কিংবা তার জটিলতা ও গুপ্ত বিপদ উপেক্ষা করা যায় না। পঞ্চদশ কংগ্রেসে (১৯২৭) এমনকি যখন ট্রটস্কি জিনোভিয়েভ ও কামানেভ জনগণকে প্রকাশ্যে পথে নামতে আহ্বান জানিয়েছিলেন তখন এই বিপথগামী কমরেডদের নিয়মানুবর্তী করতে প্রশাসনিক ব্যবস্থা প্রয়োগের বিরোধিতা করেছিলেন স্তালিন এবং বুঝিয়ে সুঝিয়ে সঠিক পথে আনার পরামর্শ দিয়েছিলেন। এটা মনে হয়েছিল যেন স্তালিন তাঁর নিজের ত্রুটি-বিচ্যুতি সম্পর্কে লেনিনের সতর্কবাণী অনুসরণ করে চলেছিলেন, কিন্তু চাপ বাড়ছিল; সমাজতন্ত্রের শত্রুদের কাছ থেকে বিপদ ঠেকাতে অপরিহার্য অতিমানবীয় সোভিয়েত প্রয়াস সম্পর্কে তার উপলব্ধি ক্রমশ উত্তেজনা রূপ পরিগ্রহ করছিল (১৯১১-এর ভাষণ থেকে : “উন্নত দেশগুলোর চেয়ে আমরা ৫০ থেকে ১০০ বছর পিছিয়ে আছি। দশ বছরে এই ব্যবধান আমাদের ঘোচাতে হবে। হয় আমরা এই কাজ করব, নয় ওরা আমাদের খতম করে দেবে।”)

সাম্রাজ্যবাদ পোষিত ও মদদপুষ্ট এবং সোস্যাল ডেমোক্র্যাটদের উপেক্ষিত ফ্যাসিবাদের প্রলম্বিত ছায়া সব কিছুকেই অন্ধকারে ঢেকে দিচ্ছিল। এবং খুব ধীরে নয়, তবে অবশ্যই তার চরিত্রের তীব্র আকুলতা ও পূর্ণ প্রগাঢ়তা, জীবনভর বিরামহীন, বেআইনি, বৈপ্লবিক কর্মতৎপরতার মধ্যে নিহিত ছিল বাড়তি সন্দেহপরায়ণতা ও সতর্ক থাকার প্রশিক্ষণ, দেখা দিয়েছিল প্রায় সর্বত্র সন্দেহজনক ও গুপ্তশত্রুদের নির্মূল করার ক্রমবর্ধমান কঠোরতা প্রদর্শনের। এমনকি সোভিয়েত সূত্রও তুলে ধরে যে ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত স্তালিনের চরিত্রের ইতিবাচক দিকগুলোই ছিল প্রধান এবং লেনিন পরবর্তী যুগের প্রথমার্ধে তিনি যেসব কাজ করেছিলেন তা ছিল সর্বোৎকৃষ্ট। লেনিনের পর স্তালিন ও সোভিয়েত কমিউনিস্টরা এবং কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক সমাজতন্ত্রের বিশ্বব্যাপী লক্ষ্যপূরণের দায়িত্ব পালনের জন্য বিশ্বের শ্রমিকদের স্বেচ্ছা-সৈনিক হিসেবে সোভিয়েত দেশকে গঠন করার কঠিন দায়িত্ব পালনে বলীয়ান করতে প্রলেতারীয় আন্তর্জাতিকতাবাদ অনুসরণে কখনো পিছপা হননি। এটা ছিল সেই ঐতিহাসিক দায়িত্ব যার জন্য সোভিয়েত জনগণের একমাত্র প্রতীক হিসেবে স্তালিন ইতিহাসে এক মহান অনুপনেয় ছাপ রেখে গেছেন।

খুবই দুঃখদায়ক যে ইতিহাস, “সেই নিষ্ঠুর দেবী” (এঙ্গেলস তাঁকে যেভাবে বর্ণিত করেছিলেন) নিদারুণ মূল্য আদায় করে নিয়েছিল, যে নিঃসন্দেহে অন্যায় ও অবিচার করে বার বার বহিষ্কার করা হয়েছে। বিভিন্ন মামলার বিচার ও তার হুবহু কার্যবিবরণী সম্পর্কে অবহিত পর্যবেক্ষকদের ধারণাকে একেবারে নস্যাৎ করে দেওয়া যায় না- এটা অভিযোগ থেকে মুক্তি দিতে বলা হচ্ছে না, বিশেষত যখন সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ নিজেরাই বিচারের বহু রায়কে খণ্ডন করেছেন এবং অভিযুক্তদের পুনর্বাসন দিয়েছেন, কিন্তু তা সত্ত্বেও বলা যায়, তথাকথিত ট্রটস্কিপন্থী’ অথবা সেনাদক্ষদের বিচারের জন্য মামলায় গুরুতর, বোধহয় এমনকি সমাজতন্ত্রের প্রতি নিদারুণ সর্বনাশ নিহিত ছিল। ট্রটস্কির নিজস্ব বুলেটিন (ফেব্রুয়ারি ১৯৩৬) থেকে ডয়েটশার উদ্ধৃত করেছেন (স্তালিন, লন্ডন, ১৯৬৭, পৃষ্ঠা, ৩৭১) : “নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে তেরো বছর যাবৎ নির্যাতন, নিন্দা, অনতিক্রমনীয় প্রতিহিংসাপরায়ণতা ও হিংস্রতা সত্ত্বেও, আত্মসমর্পণ ও দলত্যাগ সত্ত্বেও, নির্যাতনের চেয়েও বেশি বিপজ্জনক, চতুর্থ আন্তর্জাতিক-এর সবচেয়ে শক্তিশালী, সংখ্যায় সবচেয়ে ভারী ও সবচেয়ে অনমনীয় শাখা সোভিয়েত ইউনিয়নেই আজ বিরাজ করছে। প্রচণ্ড উত্তেজনাপূর্ণ লড়াইরত দেশে যেখানে, জনৈক বিদেশি পর্যবেক্ষক বলেছিলেন, ম্যার্ন এর যুদ্ধের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল ফেরাস-মেটালার্জি বা দ্বিযোজী লৌহঘটিত ধাতুবিদ্যার লড়াইয়ে। একটি দেশে যেখানে সমষ্টিগত কৃষি খামার গড়ে তোলার লক্ষ্যে পরীক্ষামূলক নানা পরিবর্তনীয় পদ্ধতির মধ্যে নিহিত ছিল, যাকে চীনা কৌতুকে বলা হয় মাছ ধরতে পুকুরটাকেই ঘেঁচে ফেলা, ভেতরের শত্রুদের দ্বারা সূচিত বিপদ (বাইরের শত্রু সর্বদাই দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে) তীব্র ও মাঝে মাঝে ভয়ংকর প্রতিক্রিয়ার প্ররোচনা দিয়েছে। স্তালিনের ভূমিকা ছিল প্রথম সমাজতান্ত্রিক দেশ, বিশ্বব্যাপী সংগ্রামের আশার কেন্দ্রকে রক্ষা করা ও বিপ্লবের সুফলকে বিকশিত করা, যখন তার এবং সমগ্র সোভিয়েত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সারিবদ্ধ হয়েছিল ট্রটস্কির মতো প্রতিভাধর ব্যক্তিত্ব, প্রভূত ক্ষমতার অধিকারী কিন্তু বিপথগামী প্রতিভার দ্বারা বিকৃত এবং প্রচলিত মতের বিপ্লবী বিরুদ্ধাচারণ করার প্রতি ঝোঁক ও ব্যর্থতা তাদের কাছে স্তালিন ছিলেন একজন ‘এশিয়াটিক এক অসভ্য, যার মতাদর্শগত প্রয়াস ছিল ‘অস্পষ্ট ও দুর্বোধ্য’, ‘খুবই মাঝারি ধরনের সাধারণ ব্যক্তি এবং (ট্রটস্কির প্রচণ্ড আঘাতদায়ী ভাষায়) বিপ্লবের কবর খনকের পদপ্রার্থী!

ট্রটস্কি কিংবা বুখারিনের মতো ব্যক্তির, কারোরই ঐতিহাসিক অস্তিত্ব সরকারিভাবে মুছে দেয়া ও অস্বীকার করা উচিত নয়, বরং প্রয়োজন তাদের রচনাবলি আরও ভালোভাবে অধ্যয়ন করা। কেমন করে ভোলা যায় ট্রটস্কি (১৯২৫ সালে!) অবলীলাক্রমে আগাম জানিয়েছিলেন যে, কয়েক বছরের মধ্যে, অথবা খুব বেশি হলে পাঁচ বছরের মধ্যে, ব্রিটেনে কমিউনিস্ট বিপ্লব দেখা দেবে, অথবা ১৯৪০ সালে তিনি যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, যা ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছিল, তুলে দেবে ‘এক ধ্বংসপ্রাপ্ত গ্রহকে মার্কিন কর্তৃত্বের অধীনে, এবং অবশ্যই তারপরে ঘটবে (যেহেতু বিপ্লবী ধ্যান-ধারণার বিশ্বাযযাগ্যতা থাকতে হবে) অনির্ণীত ভবিষ্যতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিপ্লব এবং সম্ভবত অন্যত্রও।

মনে হয় যেন এর সঙ্গে পারিবারিক সাদৃশ্য আছে চীনের বর্তমান নয়া মাওবাদী প্রত্যাশার সঙ্গে যে, “২০০০ সালের মধ্যে পৃথিবী তার পায়ের তলায় লুটিয়ে পড়বে এবং তারপর তারা বিশ্ব বিপ্লব’-এর জন্য তাদের দায়িত্ব পালন করবে।” যাই হোক, সারা বিশ্ব সোভিয়েত ইউনিয়ন (যার নেতৃত্বে ছিলেন স্তালিন) ও তার সমাজতন্ত্রের স্বার্থে অসাধারণ কঠোর পরিশ্রমের জন্য গভীর ঋণী।

ফরাসি বিপ্লবে (১৭৮৯-৯৯) ব্যাপ্তি ও গভীরতায় অনেক ক্ষুদ্র, পুঁতো, ও মারা রবসপিয়্যার ও স্যা জুস্ত, এব্যার, ও বাব্যফ-এর মতো মহান নেতৃবৃন্দ বেঁচে গিয়েছিলেন, কিন্তু বৈপ্লবিক দহনে যারা প্রাণ হারিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন কাবসে ও ভ্যারেনিও এবং মাদাম ল্যা-র মতো বুদ্ধিজীবীরাই শুধু নয় ছিলেন জ্যোতির্বিদ বাইয়ি ও রসায়নবিদ লাভোয়াজিয়ে-এর মতো বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানীরাও। সোভিয়েত ইউনিয়নে যে মাত্রায় বিতাড়নের ঘটনা সর্বত্র সমাজতন্ত্রের মিত্রদের মনে আঘাত দিয়েছিল, এবং যদিও নিশ্চিতভাবে সায় দেয়া যায় না, তবুও অন্ততপক্ষে সামগ্রিকভাবে উপলব্ধি করা প্রয়োজন অপরাধের গুরুত্ব প্রশমিত করার জন্য গুরুত্ব লাঘবের সেরকমই একটা প্রয়াস দেখা গেছে হেরম্যান হেসের কাছে লেখা রমা রল্যার একটি যন্ত্রণাবিদ্ধ চিঠিতে (৫ মার্চ ১৯৩৮) “যারা ক্ষমতায় আছেন তাদের কাছে দর্শন (রুশোর সময় যা বলা হতো) আর গ্রাহ্য বিষয় নয়; সৌভাগ্যের কথা, হেতুই তার চেয়ে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে” (মেডভেডেভ-এর পূর্বোক্ত গ্রন্থ-, পৃষ্ঠা ২৫০– ২৫১)। তা ছাড়া বিতাড়ন’ মানেই? ক্ষতিকর নয়, নেতিবাচক ‘ত্রাস’ ঘটনায় তাই প্রমাণিত হয়েছিল- শাসনব্যবস্থা এবং জনগণ যারা ত্রিশের দশকে সৃষ্টিশীল সাফল্যের এবং পরে যুদ্ধের ভয়ংকর পরীক্ষার মধ্য দিয়ে উজ্জ্বল হয়ে বের হয়ে এসেছিলেন তাদের সঙ্গে সংহতির অভাব। যুদ্ধের সময়কার স্তালিনের নেতৃত্বাধীন সোভিয়েত এক সমুজ্জ্বল ও মহিমান্বিত অধ্যায়। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করাই যথেষ্ট মার্শাল জুকভের যুদ্ধের স্মৃতিকথা (হ্যারিসন স্যালিসবেরির সংশোধিত সংস্করণ নয়, কিন্তু আসল রচনা, ইংরেজিতেও যা পাওয়া যায়) স্মরণ করা যায়, সোভিয়েত আতঙ্কগ্রস্ত চার্চিল সম্ভাষিত করেছিলেন ‘মহান স্তালিন’ বলে, এবং একদা নিষ্ফলভাবে যা নস্যাৎ করার চেষ্টা হয়েছিল, ১৯৪১-১৯৪৫ সময়কালে ছিল সবচেয়ে উজ্জ্বলভাবে প্রতিভাত এবং সমুজ্জল, যখন তারই অনুরোধে এবং জুকভ ও অন্যান্য কমরেডদের সঙ্গে কথা বলার পর মস্কো (যদিও তখন কামানের গোলার আওয়াজের মধ্যে প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে প্রায় অবরুদ্ধ) ১৯৪১ সালের ৭ নভেম্বর রেড স্কয়ারে বিপ্লব বার্ষিকী উদযাপিত করেছিল। স্তালিনকে ধুরন্ধর সব বুর্জোয়া নেতাদের সঙ্গে আলোচনা চালাতে হয়েছিল, কিন্তু নিজের অবস্থান থেকে তিনি কখনো বিন্দুমাত্র বিচ্যুত হননি। উদাহরণস্বরূপ, ইয়ালটা সম্মেলনের সময় স্ত লিনের স্বাস্থ্যপান করে চার্চিলের তোষামোদী, একটু বাড়াবাড়িভাবেই, ভাষণের জবাবে স্তালিন বলেছিলেন :

“মিত্রজোটের সঙ্গীদের একে অপরকে প্রতারণা করা উচিত না। বোধ হয় এটা একেবারেই কলাকৌশলহীন। অভিজ্ঞ কূটনীতিকরা বলতে পারেন, কেন আমি আমার জোটসঙ্গীকে প্রতারণা করব না? কিন্তু আমি একজন সাদাসিধে মানুষ হিসেবে মনে করি আমার জোটসঙ্গী যদি নির্বোধও হয় তাহলেও তাকে প্রতারণা করা উচিত নয়। সম্ভবত আমাদের মিত্রজোট খুবই দৃঢ়, কারণ আমরা একে অপরকে প্রতারণা করি না; অথবা এটাই কী কারণ যে একে অপরকে প্রতারণা করা অত সহজ নয়? আমি আমাদের তিন মিত্র-শক্তিজোটের দৃঢ়তার স্বাস্থ্যপান করি। এটা আরও শক্তিশালী ও দৃঢ় হোক। আমরা যতটা সম্ভব পরস্পরের প্রতি মন-খোলা হই।”

তাঁর এই চাঁচাছোলা ভাষণে চার্চিল একেবারে হতবুদ্ধিকর, প্রায় কুপোকাত হয়ে গিয়েছিলেন (ভি জি টুখানোভস্কি-র ‘উইনস্টন চার্চিল, মস্কো– ১৯৭৮ পৃষ্ঠা । ৩৫৫-৫৬ দ্রষ্টব্য) এবং এই কথা তার নিশ্চয়ই মনে পড়েছিল যখন তিনি ফুলটন (১৯৪৬)-এ তার ঠান্ডা যুদ্ধ’ অভিযানের সময় এবং অন্যত্র পরামর্শ দিয়েছিলেন, তার চিকিৎসক লর্ড মোরানের সঙ্গে কথাবার্তায় (আগস্ট ১৯৪৬), যে পশ্চিমা দুনিয়া যেন পিছিয়ে না থাকে আণবিক বোমা তৈরি করা থেকে, কারণ তার ভয় ছিল, সোভিয়েত ইউনিয়ন খুব শিগগিরই তা করায়ত্ত করবে (পূর্বোক্ত পৃষ্ঠা ৩৪৩ ৪৪)।

এমনকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিজয়ের পরেও তাঁর অতি সন্দেহপরায়ণতা ও গোপন রাখার স্বভাব প্রসঙ্গে কিছু ব্যাখ্যা এখানে দেয়া যেতে পারে। যদি প্রতিবিপ্লবী শক্তিরা জীবিত থাকে এবং বিশ্ব রাজনীতিতে লাফালাফি করে (যেমন ‘পশ্চিমা গণতন্ত্রের দ্বারা পরিপোষিত হাঙ্গেরি ১৯৫৬, চেকোশ্লোভাকিয়া ১৯৬৮ চিলি, ইসরায়েল, ইন্দো-চীন প্রভৃতি), তাহলে এটা কি বলা যেতে পারে না যে, তিনি যেমন ছিলেন এবং যে সময়ের মধ্যে দিয়ে পার হয়েছেন, তাতে স্তালিনের পক্ষে প্রায় স্বাভাবিক ছিল অস্বাভাবিক দৃঢ়তার সঙ্গে যে কোনো মূল্যে বিপ্লবের সাফল্যকে রক্ষা করা এবং তারপর বিবিধ, ব্যাপক ও অবিশ্রাম শ্রমের চাপে প্রায় নত হয়ে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি নিঃসঙ্গ, কথা বলতে অনিচ্ছুক এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রায় ‘অমানবিক হয়ে যাওয়া? বোধ হয় বলশেভিকদের ব্রাহ্মণরা বছরের পর বছর তাকে অযোগ্য বলে বিদ্রূপ করেছিল তার আঘাত থেকে তিনি কখনো বেরিয়ে আসতে পারেননি। তার মধ্যে, যাই হোক, শক্তি ছিল মানসিক ক্রোধ ঝেড়ে ফেলার, তার স্নায়ু ছিল লৌহ কঠিন। আসল শক্তি অবশ্য নিহিত ছিল জনগণের মধ্যে এবং তাদের অগ্রগামী বাহিনীর আন্দোলনের মধ্যে এবং স্তালিন ইতিহাসের সঙ্গে পা মিলিয়েছিলেন যখন ট্রটস্কি, “সেই আপস করতে অনিচ্ছুক স্পার্টার রাজা লিওনাদাস-এর মতো একাকী ও দুঃখদায়ক”, যেমন একজন তাকে বর্ণনা করেছিলেন, নিজে এমন এক কানাগলির মধ্যে ঢুকে পড়েছিলেন যা থেকে তিনি বেরিয়ে আসতে পারেননি।

.

ইতিহাসের উত্তরাধিকার

ইতিহাসের অপরিহার্য উত্তরাধিকার হিসেবে মানুষের মধ্যে বিদ্যমান দোষ প্রায়শই ভালো-কে মন্দ করে দেয়। একদা এঙ্গেলস যেমন বলেছিলেন, বিপ্লব হলো পৃথিবীতে সবচেয়ে স্বৈরতান্ত্রিক শক্তি, কিন্তু কঠোরভাবে দাবি করে, নিঃসন্দেহে ঝুঁকিপূর্ণ, সমাজের স্বৈরতান্ত্রিক পরিচালনার খামখেয়ালিপনা ও নীতিহীনতা যা কখনো বিপ্লবের তত্ত্ব ও প্রয়োগকে কালিমালিপ্ত করে না। তাছাড়া স্তালিনের মধ্যে এমন কিছু দিক ছিল যা অবশ্যই স্মরণযোগ্য। তিনি বলতেন সিদ্ধান্ত কখনো এক ব্যক্তি নেবে না, নেবে “পার্টির সর্বোচ্চ কর্তৃত্ব (অর্থাৎ তার কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব)”। হয়তো তার কথায় ও কাজে প্রায়শই ফারাক দেখা গেছে, কিন্তু নিয়ম-নীতি থেকে তাঁর বিচ্যুতির সুযোগ করে দিয়েছিল তার কাছে বৃত্তের কয়েকজন যাঁরা তাঁকে ভালো জানতেন। এটা হতে পারে না যে সবাই তার শেষ বছরগুলোতে তার সম্পর্কে ভয়ের মধ্যে বাস করতেন। উদাহরণস্বরূপ, এর কি কোনো বিশেষ যুক্তি ছিল মিকোইয়ানের পক্ষে ঊনবিংশ পার্টি কংগ্রেসে (১৯৫২)

স্তালিন হলেন আজকের লেনিন’ শীর্ষক ভাষণ দেওয়ার এবং কেন, অনেক ঘটনার প্রেক্ষাপটে, কিছুদিনের জন্য অবাস্তব তোশামোদ জিইয়ে রাখা হয়েছিল তার ব্যাখ্যা না দিয়ে তা পরে বছরের পর বছর তার সেই প্রতিপাদ্য বিষয়কে ঘৃণার সঙ্গে পরিহার করা চলে? কোনো পরিপক্ব সমাজতান্ত্রিক সমাজ কারোর সম্পর্কেই, নিশ্চিতভাবে স্তালিন সম্পর্কে তো নয়ই অথবা অদূর ভবিষ্যতে মাও সম্পর্কেও যেন প্রায়-ঈশ্বরত্ব আরোপ না করে। প্রাচীন মূর্তিপূজা ভাঙতে যদি তাদের মানব দেহ উন্মোচন করতে হয়, তাহলে তা করা হোক। কিন্তু সব ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও সমস্যা যেন ভুলে যাওয়া না হয়, এবং ইতিহাস থেকে ইচ্ছাকৃতভাবে মুছে দেয়া ব্যক্তিত্বকে পুনঃস্থাপিত করা হয়, এবং বলশেভিকরা ছিলেন আতঙ্কজনক চক্র’, ‘সমাজতন্ত্র ছিল এক অমানবিক মুখাবয়ব’, একটি নতুন সমাজে অধনতান্ত্রিক নীতির ভিত্তিতে প্রতিটি বৃহদাকার শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার প্রয়াস পুঁজিবাদে যা সহনশীল তার চেয়েও খারাপ দুঃস্বপ্নের জন্ম দেবে বলে আজ যে বিশ্বজোড়া বিপজ্জনক প্রচার চালানো হচ্ছে তাতে যেন মানুষ বিভ্রান্ত না হন।

তার সময়ে অনেকেই যখন স্তালিন নিন্দায় পঞ্চমুখ তখনো পাবলো নেরুদা স্তালিনকে নিন্দা করতে পারেননি যা তখন প্রায় চলতি রীতি!– তিনি তাঁর ‘স্মৃতিকথা’-য় লিখেছিলেন, “আমি মানবজাতির অনমনীয় দ্বন্দ্ব সম্পর্কে খুব একটা বুঝি না।” হয়তো পরিমাপ করা অর্থহীন, কিন্তু যখন কেউ ইতিহাস রচনার ঘটনাবলির “ক্লান্তি, আতঙ্ক ও গৌরবের কথা ভাবেন এবং যে পটভূমিকায় সোভিয়েতের জন্ম হয়েছিল, বিকাশ লাভ করেছিল, এবং লড়াই করে বিজয়ী হয়েছিল তা স্মরণ করেন, তখন স্তালিন সম্পর্কে মাও-এর নিজের বৈশিষ্ট্যসুলভ ব্যক্তিগত মূল্যায়ন “সাত ভাগ সঠিক এবং তিন ভাগ বেঠিক” মেনে নিতেই মন সায় দেয়। স্তালিনকে একরকম “মানুষ খেকো রাক্ষস” (যা বর্তমানে প্রায়ই বলা। হয়ে থাকে) ভাবতে পারেননি। তিনি ছিলেন ইতিহাসের এক ক্ষমতাশালী স্রষ্টা, তবে সেই সঙ্গে মানবিক আবেগসম্পন্ন একজন মানুষও, যেমন তেহরানে ব্রিটিশ রাজার কাছ থেকে মস্কোর জন্য একটি তরবারি পাওয়ায় তাঁর চোখে জল দেখেছিলেন রুজভেল্ট। ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রদূত রাধাকৃষ্ণ স্তালিনের সঙ্গে কথা বলে বিদায় নেবার সময় তাঁকে পিঠ চাপড়িয়ে (যা তিনি তার বন্ধুদের প্রতি প্রায়শই করতেন) বলেছিলেন, “ঈশ্বর আপনাকে আশীর্বাদ করুক’, তখন ইস্পাতে তৈরি মানুষ বলে খ্যাত, দীর্ঘকাল কঠোর একাকিত্বে অভ্যস্ত, স্তালিন অবাক বিস্ময়ে তার দিকে তাকিয়েছিলেন, চোখে তার তখন অশ্রু চক চক করছে!

বিশ্ব ইতিহাসে তার মহান ভূমিকা স্মরণ করা হোক, এবং তাঁর সেই ভূমিকার উৎকৃষ্টতম দিকগুলো লালন-পালন করা হোক। ঐতিহাসিক প্রয়োজনীয়তার দোহাই পেড়ে অসৎ কাজের সাফাই গাওয়ার দরকার নেই, কিন্তু একটা সময়ে যখন সমাজতন্ত্রের ওপর সংঘবদ্ধ আক্রমণ ছিল বিশ্বজোড়া প্রধান উপজীব্য তখন ব্যাপকভাবে উপলব্ধির প্রয়োজন যে এক প্রকৃতই মানবিক সমাজে পৌঁছানোর পথ হিসেবে বিপ্লবের মধ্যে নিহিত আছে একটা মূল্য যা জনগণ আনন্দের সঙ্গে এবং বীরত্বের সঙ্গে দিয়েছে, আজকের পৃথিবীতে হয়তো মূল্যটা দিতে হতো কম (চিকিৎসা শাস্ত্রের অগ্রগতি যন্ত্রণাহীন শিশু প্রসবের কথা বলে না?), কিন্তু জনগণ তার অদম্য লড়াইয়ে আরও বেশি মূল্য দিতে প্রস্তুত হবে।

.

গ্রন্থপঞ্জি

১। স্তালিন উত্তরাধিকার ‘হাতির দাঁতে খুঁত, তবু হাতির দাঁত’– হীরেন মুখার্জি, ন্যাশনাল বুক এজেন্সি প্রাইভেট লিমিটেড। জানুয়ারি, ২০০৫।

২। স্তালিন ফিনমিন্যান– আইজ্যাক ডয়েটশার (লন্ডন-১৯৭৬) ।

৩। স্তালিনের সঙ্গে কথোপকথন –মিলোভান জিলাস। (১৯৫২)

৪। সোভিয়েত সাম্যবাদ এক নতুন সভ্যতা– সিডনি ও বিয়েত্রিচ ওয়েব। (১৯৩৫ সংস্করণ)

৫। ফ্যাসিজম অ্যান্ড সোস্যাল রেভলিউশন –রজনী পাম দত্ত।

৬l Long Live the Universal Contributions of Comrade Joseph Stalin.

৭। The Ukrainian famine-genocide myth– John Puntis, July 2002

৮. Making Sense of Stalin Ñ Peter Myers, October 2000

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *