১. স্তালিনবিরোধী মিথ্যাচার এবং প্রাসঙ্গিকতা

১. স্তালিনবিরোধী মিথ্যাচার এবং প্রাসঙ্গিকতা

স্তালিনবিরোধী অপপ্রচারের নেপথ্য কারিগর যে প্রশ্নটি আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে করলে যে উত্তর পাওয়া যেত, সেই একই প্রশ্ন ঠিক এই মুহূর্তে করলে সেই একই উত্তর মিলবে; এবং আজ থেকে শত সহস্র বছর পরও উত্তর সেই আগের মতোই থাকবে! আর সেই প্রশ্নটি হলো সমগ্র পুঁজিবাদী বিশ্বের দিকে তাক করে থাকা সমাজতন্ত্রীদের মারণাস্ত্রের নাম কী? এর উত্তরে সমাজতন্ত্রীরা নয়, খোদ পুঁজিবাদীরাই বলবে; যে দুটি ভয়ংকর মারণাস্ত্র পুঁজিবাদী বিশ্বের দিকে তাক করা রয়েছে তার একটির নাম; কার্ল মার্কসের ‘ডাস ক্যাপিটাল’ এবং অপরটি চার্লস ডারউইনের ‘দ্য অরিজিন অব স্পিসিস’! এটি যেমন একটি সাধারণ ধারণা, তেমনি আরও একটি সাধারণ ধারণা হচ্ছে; জোসেফ স্তালিন একজন স্বৈরশাসক ছিলেন এবং লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছিলেন, আরও লক্ষ লক্ষ মানুষকে সাইবেরিয়ায় নির্বাসনে পাঠিয়েছিলেন। পুঁজিবাদীরা স্তালিনের উপর এই কালিমা লিপ্ত করার আগে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে মহামতি লেনিনের স্তুতি গেয়ে থাকে। যেন লেনিন ছিলেন ভালো ‘স্বৈরশাসক’! সমাজতন্ত্র কমিউনিজম সম্পর্কে যাদের সামান্যতম ধারণাও নেই তারাও স্তালিন প্রসঙ্গে এধরনের সিদ্ধান্তে আসতে পেরে নিজেদের বিরাট তাত্ত্বিক আর বুদ্ধিমান। মনে করে। তাদের এমন ধারণা যে স্তালিনের এই নিষ্ঠুরতা বাদ দিলে সমাজতন্ত্র ব্যাপারটা খুব একটা খারাপ নয়। আবার কেউ কেউ আছেন যারা নিজেরাই সমাজতন্ত্রী, নিজেরাই কমিউনিস্ট, এমনকি মার্কসবাদ-লেনিনবাদ বিষয়ে মোটামুটি বিজ্ঞ তাত্ত্বিক; তারাও শেষ পর্যন্ত তাদের সকল না জানা তথ্য উপাত্ত আর মিথ্যা দিয়ে স্তালিনকে আঘাত করতে পেরে যেন স্বস্তি পান! কিন্তু কেন তাদের এধরনের ভ্রান্তি? কেনইবা তারা স্তালিনকে আক্রমণ করাকে অবশ্যকর্তব্যজ্ঞান করেন? সে উত্তরের জন্য পেছন ফিরে দেখতে হবে।

Daily Mail : In Seo, Stalin wanted to murder at least 20 millions of Jews in the Soviet Union! Where did they all come from, after SIX MILLION were killed?

১৯৫৩ সালে ‘ডেইলি মেইল’ সংবাদ প্রকাশ করে- স্তালিন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে কমপক্ষে ২ কোটি ইহুদি হত্যা করে ফেলতে চেয়েছিলেন! এবং শেষ পর্যন্ত নাকি তিনি ৬০ লক্ষ ইহুদি হত্যা করেছিলেন! ধাপ্পাবাজিরও একটা সীমা থাকতে হয়, তা না হলে সেটা বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে না। ‘ডেইলি মেইল’ এর মতো বিশ্বময় পরিচিত সংবাদপত্রের খবর দেখে সে সময় তো বটেই, তার অর্ধ শতাব্দী পার হলেও আজও সাধারণের ভেতর এই ধারণা প্রবল যে সত্যি সত্যিই বুঝি স্তালিন ২ কোটি ইহুদি হত্যা করতে চেয়েছিলেন এবং শেষতক ৬০ লক্ষ হত্যা করেছিলেন!

বিস্ময়কর তথ্য হচ্ছে সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ইহুদি জনসংখ্যা ছিল ৫৫ থেকে ৫৬ লক্ষের মতো। ১৯৪১ সালে জার্মানি যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করে সে সময় প্রায় ২৫ লক্ষ ইহুদি অন্যান্য ধর্ম এবং ভাষাভাষীদের সঙ্গে নিহত হয়। সে সময় ২৫ লক্ষ নিহত হওয়ার পর আরও প্রায় ২০ লক্ষ নিহত হয় ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত। তার পরও ১৯৫৯ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত সোভিয়েত মেয়াদে ইহুদি জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৯ লক্ষ। এরা কোথা থেকে এল? আর স্তালিনই বা কীভাবে ৬০ লক্ষ ইহুদি হত্যা করলেন?

বরং ইহুদি জনগোষ্ঠির হাতে অইহুদি ৫ কোটি মানুষ নিহত হয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়নে!

তাঁর সম্পর্কে এধরনের অপপ্রচার সে সময় যেমন তীব্র ছিল তাতে করে সারাক্ষণই তার অনুসারীদেরকে ব্যতিব্যস্ত থাকতে হয়েছে কখন কোথায় কীভাবে স্তালিনের অপপ্রচার শুরু হচ্ছে সেই শঙ্কায়। একদিকে সে সময় ডেইলি মেইল যেমন অপপ্রচার চালিয়েছে তেমনি জার্মান পত্রিকা লিখছে- “The claim that 5,7 million Jews were murdered, is not true. The number of Jewish victims can only range between 1 and 1.5 million, because there were not more Jews within Hitler’s reach.”—Ferdinand Otto Miksche, The End of The Present, (Das Ende der Gegenwart) Herbig, Munich 1990, page 107.

রুশ বিপ্লবের মহান নেতা কমরেড লেনিন বলেছেন : কোনো ব্যক্তি, বিষয়, আন্দোলন অথবা কর্মকাণ্ডের মূল্যায়ন পর্যালোচনা করতে হলে তৎকালীন বাস্তব পরিস্থিতি, আন্তর্জাতিক ও জাতীয় অবস্থা, শ্রমিকশ্রেণির অবস্থান, শোষকশ্রেণি ও। শোষিত শ্রেণিগুলোর পারস্পরিক শক্তির অবস্থা এবং সর্বহারা শ্রেণির চরম লক্ষ্য ও সংশিষ্ট ব্যক্তি বা বিষয়ের তৎকালীন আশু কর্মসূচির বিশেষণ করতে হবে। এই। ধরনের বিচারেই সঠিক মার্কসবাদী মূল্যায়ন বা পর্যালোচনা বেরিয়ে আসে। ইতিবাচক ও নেতিবাচক কতগুলো ঘটনার যোগ ও বিয়োগ ফলের দ্বারা তা হয় না। মার্কসবাদী দৃষ্টিতে একটা সামগ্রিক, সার্বিক ও অখণ্ড চিন্তা বেরিয়ে আসবে, নতুবা খণ্ডিত বা আংশিক বিচার হয়ে যায়।

কমরেড লেনিনের এই শিক্ষার আলোতেই তার সুযোগ্য সহকারী কমরেড স্তালিনের বিপ্লবী জীবনের শিক্ষাগুলোকে আয়ত্ত করতে হবে। এবং শ্রেণি আন্দোলন ও গণ-আন্দোলন বিকাশের ক্ষেত্রে তার সঠিক প্রয়োগ ঘটাতে হবে।

রাশিয়ার বুকে জার স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে বলশেভিক পার্টি গড়ে তোলা, শোষিত শ্রমিকশ্রেণির নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবকে সফল করে তোলবার জন্য সংগ্রাম, ট্রটস্কিবাদের বিরুদ্ধে তীব্র আদর্শগত সংগ্রাম, বিপ্লবোত্তর পরিস্থিতিতে সোভিয়েত সমাজতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখবার সংগ্রাম, কমরেড লেনিনের জীবনাবসানের পর সোভিয়েত ইউনিয়নের সমাজতান্ত্রিক অগ্রগতিকে অব্যাহত রাখবার সংগ্রাম এবং সর্বোপরি হিংস্র উন্মত্ত ফ্যাসিবাদের কবল থেকে মানবজাতিকে রক্ষার সংগ্রামে ব্যাপৃত ছিল কমরেড স্তালিনের সমগ্র জীবন। শুধু তাই নয়, সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন ও জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের মধ্যে আন্ত র্জাতিক সম্পর্ককে অটুট রাখতে তিনি পুঁজিবাদী ও ঔপনিবেশিক দেশগুলোতে কমিউনিস্ট পার্টি গঠনে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করে বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনে এক অনবদ্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।

কমরেড স্তালিনই সর্বপ্রথম কমরেড লেনিনের শিক্ষা ও তত্ত্বগুলোকে সূত্রবদ্ধ করে সৃষ্টি করেন- লেনিনবাদ’। এর সংজ্ঞা নির্ধারিত করে তিনি বলেছিলেন : লেনিনবাদ হলো সাম্রাজ্যবাদ ও শ্রমিক-বিপ্লবের যুগের মার্কসবাদ। আরও সঠিকভাবে বলতে গেলে বলতে হয়, লেনিনবাদ হলো সাধারণভাবে শ্রমিক বিপ্লবের মতবাদ ও রণকৌশল এবং বিশেষভাবে এ হলো শ্রমিকশ্রেণির মতবাদ ও রণকৌশল।

লেনিনবাদকে মার্কসবাদের আরও বিকশিত রূপ হিসেবে উল্লেখ করে তার অসামান্য বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন কমরেড স্তালিন। সর্বহারারা যখন বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে, শ্রমিক-বিপ্লব যখন কার্যক্ষেত্রে আশু ও অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠেনি সেই প্রাক্-বিপ্লব যুগে মার্কস আর এঙ্গেলস তাদের কার্যকলাপ চালাতেন। আর মাকর্স-এঙ্গেলসের উত্তরসূরি কমরেড লেনিন তাঁর কাজ চালিয়েছেন বিকশিত সাম্রাজ্যবাদের যুগে, শ্রমিক বিপ্লবের বিকাশের যুগে- যখন শ্রমিক বিপ্লব একটি দেশে ইতোমধ্যেই জয়যুক্ত হয়েছে, বুর্জোয়া গণতন্ত্রকে চূর্ণ করে, শ্রমিকশ্রেণির গণতন্ত্রের, সোভিয়েততন্ত্রের যুগের সূত্রপাত করেছে।

এইভাবে মার্কসবাদ-এর তত্ত্বকে বিকশিত করে তুলেছিলেন কমরেড স্তালিন। তিনিই লেনিনবাদের প্রবক্তা। ১৯২৪-এ প্রকাশিত কমরেড স্তালিনের ‘লেনিনবাদের ভিত্তি’ এবং ১৯২৬-এ ‘লেনিনবাদের সমস্যা’ পুস্তক দুটিতে লেনিনবাদের আরও ব্যাপক বিস্তৃত আদর্শগত ব্যাখ্যা রয়েছে।

দুনিয়ার মুক্তিকামী মানুষের প্রিয় নেতা, শিক্ষক কমরেড লেনিনের জীবনাবসানের পর সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির অভ্যন্তরে তীব্র মতাদর্শগত বিরোধ দেখা দেয়। কমরেড লেনিনের জীবদ্দশাতেই ১৯২২ সালের ৩ এপ্রিল পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে কমরেড লেনিনের প্রস্তাবে কমরেড স্ত লিন পার্টির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। উল্লেখ্য, একই বছরে গঠিত হয়েছিল ইউনাইটেড সোভিয়েত সোস্যালিস্ট রিপাবলিক সংক্ষেপে ইউ এস এস আর। কমরেড লেনিন নেই। একদিকে নবগঠিত সোভিয়েতে সমাজতান্ত্রিক নির্মাণ কাজকে চালু রাখা, অন্যদিকে পার্টির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ট্রটস্কি-বুখারিন-জিনোভিয়েভ কামেনেভ-রাডেক চক্রের পার্টি, কমরেড স্তালিন ও সোভিয়েত সরকারের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যেই চলতে থাকা কার্যকলাপ নবগঠিত এই সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পক্ষে চরম বিপজ্জনক হয়ে উঠেছিল। প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির এই কার্যকলাপ কমরেড স্ত লিনকে এতটুকু বিচলিত করতে পারেনি। এই সঙ্কটের মধ্যেই তিনি লেনিনবাদের তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করে তীব্র আন্তঃপার্টি সংগ্রাম গড়ে তুলে তার সমস্ত বিরোধীদের তত্ত্বগতভাবে ধরাশায়ী করেছিলেন। যার পরিণতিতে পরবর্তীকালে ট্রটস্কি ও তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গরা পার্টির কাছে নিজেদের ভুল স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিলেন।

কমরেড স্তালিনের নেতৃত্বে সোভিয়েতে প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (১৯২৮ ৩২) ছিল সার্বিক অগ্রগতির এক উৎসমুখ। পুঁজিবাদী দুনিয়ার মাতব্বর সংবাদপত্রগুলো কমরেড স্তালিনের এই পরিকল্পনাকে নিয়ে অনেক ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করেছিল। অথচ এই পরিকল্পনার প্রথম চার বছরেই কৃষি, শিল্প, শিক্ষাসহ সবকটি মৌলিক ক্ষেত্রেই গড়পড়তা ৯৩ শতাংশ সাফল্য দেখা দিয়েছিল। এককথায় দুরন্ত অগ্রগতি। তখন ঐসব কুৎসা রটনাকারী সংবাদপত্রগুলো তার প্রশংসায় সরব হতে বাধ্য হয়েছিল। এই সময়ে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো পুঁজিবাদী দুনিয়ার তীব্র সঙ্কট। প্রথম পরিকল্পনার চার বছরে সোভিয়েতে যখন শিল্পোৎপাদন বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে উঠেছে তখন পুঁজিবাদী দেশ যথাক্রমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তা কমেছে শতকরা ৫৭ ভাগ, ব্রিটেনে কমেছে শতকরা ১৮ ভাগ, জার্মানিতে কমেছে শতকরা ৪০ ভাগ এবং ফ্রান্সে কমেছে শতকরা ৩০ ভাগ। পুঁজিবাদের এই সর্বব্যাপী সঙ্কটের যুগে কমরেড স্তালিনের নেতৃত্বে সোভিয়েতে সমাজতন্ত্রের জয়যাত্রা অব্যাহত ছিল। প্রথম পরিকল্পনায় রাশিয়ার কৃষি সমস্যার সম্পূর্ণ সমাধান না হওয়াতে দ্বিতীয় পরিকল্পনায় (১৯৩৩-৩৭) কৃষিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছিল যাতে ১৯৩৫ সালের গোড়াতেই শতকরা ৮৫ ভাগ জমি যৌথ খামারের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল এবং উৎপাদিত পণ্য বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছিল শতকরা ২৬৯ ভাগ।

১৯৩৬ সালে সোভিয়েতের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিতে এক আমূল পরিবর্তন ঘটে গিয়েছিল। শিল্প, কৃষি, শিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিসহ সর্বক্ষেত্রেই উন্নতির ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। এই ব্যাপক উন্নয়নের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ সংবিধান-এর প্রয়োজনীয়তা দেখা দেওয়ায় ১৯২৪ সালে সোভিয়েত প্রণীত সংবিধানকে নতুন রূপ দেওয়া হয়। কমরেড স্তালিনের সভাপতিত্বে মোট ৩১ জনের একটি বিশেষজ্ঞ দল ১৯৩৬ সালে রচনা করেন সোভিয়েতের নতুন সংবিধান। এই সংবিধানে বুর্জোয়া গণতন্ত্রের তুলনায় আরও অনেক বেশি গণতান্ত্রিক অধিকার দেওয়া হলো। এই সংবিধানে ঘোষণা করা হয়েছিল গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র অজেয়। মনীষী রোমা রোলা এই সংবিধানকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেছিলেন : স্বাধীনতা, সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের আদর্শ এতকাল ছিল মানুষের স্বপ্নের বস্তু মাত্র। এই সংবিধান থেকে তারা প্রাণ পেল। চীন থেকে সান ইয়াৎ সেনও অভিনন্দিত করেছিলেন এই সংবিধানকে। ইতিহাসে এই সংবিধান স্তালিন সংবিধান নামে পরিচিত হয়ে আছে। ১৯৩৮ সালে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির অনুমোদনক্রমে কমরেড স্তালিন রচনা করেন। ‘সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টি (বলশেভিক)-র ইতিহাস- ‘সংক্ষিপ্ত পাঠ’। ঐ একই বছরে তিনি লেখেন ‘দ্বন্দ্বমূলক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদ’ যা মার্কসীয় দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের তাত্ত্বিক বিশেষণের এক অমূল্য দলিল।

২২ জুন, ১৯৪১। হিটলার সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করল। কমরেড স্তালিন ঘোষণা করলেন : … কেবল আমাদের দেশকেই মুক্ত করা নয়, ফ্যাসিস্ট প্রভুত্বে নিপীড়িত জনগণকেও আমরা মুক্ত হতে সাহায্য করব। … এ যুদ্ধ সমগ্র মানবজাতির মুক্তি ও গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা সংগ্রামে রূপান্তরিত হবে।

কমরেড স্তালিনের আহ্বানে নাৎসি জল্লাদদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লেনিনগ্রাদে ৩ লক্ষ লালফৌজের পাশে এসে সমবেত হয় সমগ্র লেনিনগ্রাদের জনসাধারণ! প্রবল প্রতিরোধের মুখে পিছু হটতে হয়েছিল হিটলারের ২ লক্ষ সেনা, ৮৪৬টি বিমান এবং ৪০০টি ট্যাঙ্ককে। হিটলারের মস্কো দখলের পরিকল্পনা ‘অপারেশন টাইফুন’ মুখ থুবড়ে পড়েছিল। লালফৌজের সবচেয়ে গৌরবজনক লড়াই ছিল স্তালিনগ্রাদের যুদ্ধ। এর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মার্শাল জুকভ। শুরুতে নাৎসিরা স্তালিনগ্রাদের শতকরা ৭৫ ভাগ অংশই দখল করে ফেলেছিল। স্তালিনগ্রাদের জনসাধারণ ঐক্যবদ্ধভাবে বীরত্বপূর্ণ লড়াই-এর মধ্য দিয়ে পুরোটাই তাদের হাত থেকে কেড়ে নেয়। লেনিনগ্রাদ, মস্কো, স্তালিনগ্রাদের লড়াইতে লালফৌজের কাছে আত্মসমর্পণ হিটলারের কাছে খুব বড় আঘাত হয়ে উঠেছিল। ১ মে, ১৯৪৫ কমরেড স্তালিনের নেতৃত্বে সোভিয়েত লালফৌজ বার্লিনের রাইখৃস্ট্যাগে রক্তপতাকা উড়িয়ে মানবজাতির চরমতম শত্রু ফ্যাসিবাদের পরাজয় ঘোষণা করেছিলেন।

ফ্যাসি-বিরোধী যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল প্রথম স্থানে। এই যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছিলেন ২ কোটি সোভিয়েত জনগণ। যুদ্ধের সময় শিশুসহ ৫০ হাজারের বেশি মানুষকে জার্মানিতে দাস শ্রমিক হিসেবে বন্দী করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। যুদ্ধ চলাকালীন সোভিয়েতে ৫৩ লক্ষ যুদ্ধবন্দির মধ্যে যুদ্ধের শেষে মাত্র ১০ লক্ষকে জীবিত পাওয়া গিয়েছিল। ফ্যাসিস্টদের আক্রমণে চরম ক্ষতি স্বীকার করতে হয়েছিল সোভিয়েতের ছোট-বড় মিলিয়ে ১ হাজারেরও বেশি শহরকে, ৭০ হাজার গ্রামকে, ৩২ হাজার শিল্প সংস্থাকে এবং ৯৮ হাজার যৌথ ও রাষ্ট্রীয় খামারকে। যুদ্ধ যখন চলছে, মিত্রশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সোভিয়েতকে ৬০০ কোটি ডলার ঋণ দেবার প্রতিশ্রুতি দেয়। তখন রুজভেল্ট ছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। রুজভেল্টে’র জীবনাবসানের পর টুম্যান মার্কিন প্রেসিডেন্ট হয়েই সেই প্রতিশ্রুতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। এতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদী চরিত্র প্রকাশ হয়ে পড়ে। অবশ্য কমরেড স্তালিন তাতে বিন্দুমাত্র বিচলিত হননি। তাঁর সুযোগ্য নেতৃত্বে সমস্ত যুদ্ধকালীন ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রমাণ করে দিয়েছিল তার সমাজতান্ত্রিক দৃঢ়তা। শুধু তাই নয়, পূর্ব ইয়োরোপের সদ্য মুক্ত হওয়া দেশগুলোতে সমাজতান্ত্রিক গঠনকার্যেও সোভিয়েত তার সমগ্র শক্তিকে ব্যবহার করেছিল। এইভাবে যুদ্ধে বীভৎসতা কাটিয়ে কমরেড স্তালিনের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে দুনিয়ার তাবৎ শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে অন্যতম হয়ে উঠেছিল।

অক্টোবর, ১৯৫২-তে সোভিয়েত বলশেভিক পার্টির ঊনবিংশতম কংগ্রেসের ভাষণে কমরেড স্তালিন বলেছিলেন : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মান ও জাপানি ফ্যাসিস্ট বর্বরতাকে চূর্ণ করে সোভিয়েত ইউনিয়ন ইয়োরোপ এবং এশিয়ার জনগণকে ফ্যাসিস্ট দাসত্বের বিপদ থেকে মুক্ত করেছে। … যে সকল কমিউনিস্ট শ্রমিক কৃষক ও গণতান্ত্রিক পার্টি আজও বুর্জোয়া শাসনের চাপে শোষিত ও বঞ্চিত, তাদের দিকে আমাদের বিশেষভাবে দৃষ্টি দিতে হবে।

এই পার্টি কংগ্রেস ভবিষ্যতে সোভিয়েতকে যেকোনো বিপদের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ মোকাবিলার আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান করে তুলেছিল। এটাই ছিল কমরেড স্তালিনের জীবনের শেষ পার্টি কংগ্রেস। ৫ মার্চ, ১৯৫৩ সোভিয়েত তথা সমগ্র দুনিয়ার শোষিত জনগণের মুক্তিকামী নেতা কমরেড স্তালিন চিরনিদ্রামগ্ন হন।

.

স্তালিনের নৃশংসতা’ কি যুক্তিযুক্ত ছিল?

প্রায় অর্ধেকের কাছাকাছি রুশিরা মনে করে সোভিয়েত ইউনিয়ন গঠনের জন্য তার শাসনামলে জোসেফ স্তালিনের স্যাকরিফাইজ যথাযথ ছিল। এই বিষয়টি উঠে এসেছে ৩১ মার্চ ২০১৫ দ্য মস্কো টাইমস এর এক জরিপে। সোস্যাল অ্যান্ড কালচারাল স্টাডিস ডিপার্টমেন্ট লেভাদা’ সেন্টার মনে করে পঁয়তাল্লিশ ভাগ মানুষ স্বাধীনভাবে মনে করে সোভিয়েত ইউনিয়ন নির্মাণের সময় স্তালিনের শাসনামলে রুশি জনগণের যে আত্মত্যাগ তা একটি নতুন সোভিয়েত গঠনের জন্য অপিরহার্য ছিল। নতুন গড়ে ওঠা সোভিয়েতকে পরাজিত বুর্জোয়া আর জারের অবশেষদের আক্রমণ থেকে রক্ষা করে বিকাশের জন্য স্তালিন যে শক্ত হাতে শাসন করেছিলেন; তার দরকার ছিল। উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে এই ২০১৫ সালে বর্তমান রাশিয়ার ৪৫ ভাগ মানুষ এটা অকপটে বলছেন। এই সংখ্যাটিই আজ থেকে দুবছর আগে ছিল মাত্র ২৫ ভাগ।

পত্রিকাটির জরিপদল এটা খুঁজে পেয়েছে যে অংশ নেয়া ৫৬ ভাগ মানুষ এখন মনে করে স্তালিনের মৃত্যুর পর সোভিয়েত ইউনিয়ন সত্যিকার সন্ত্রাসী আর লুটেরাদের খপ্পরে পড়েছিল। জরিপদল আরও আবিষ্কার করে রাশিয়ানদের অন্তত ২৪ ভাগ মানুষ এখনও মনে করে কমরেড স্তালিনের মৃত্যু তাদের জন্য বিরাট ক্ষতির বিষয়। এই ২৪ ভাগ সংখ্যাটি মাত্র দুবছর আগে ছিল ১৮ ভাগ।

জরিপদল তাদের জরিপের সারাংশ তুলে ধরে বলেছে; সর্বশেষ জরিপ এটা নির্দেশ করে যে স্তালিন এবং তার অবদান এই একবিংশ শতকেও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। এই মিলেনিয়ামের শুরুতেও স্তালিন বিষয়ে ইতিবাচক ভাবা মানুষের সংখ্যা ছিল ২৫ ভাগ, যা বেড়ে এখন হয়েছে ৩৯ ভাগ।

‘লেভাদা’ সেন্টার তাদের জরিপ বিশ্লেষণ করে জানাচ্ছে বর্তমান রাশিয়ার সরকার, বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন নিজেই সে সময়কার সোভিয়েত নেতা স্তালিনের কর্মপদ্ধতি এবং কর্মদ্যোগকে যথাযথ বলে মনে করেন, এবং তার সরকারও স্তালিন বিষয়ে পুতিনের ‘নীতি’ অনুসরণ করে বলে নিশ্চিত করেন লেভাদা সেন্টার-এর প্রধান অ্যালেক্সি লেভিনসন।

স্তালিনের আমলে যারা নির্বাসিত হয়েছিলেন তাদের পুনর্বাসনের জন্য কাজ করা এনজিও যে বিষয়টি দেখে চমকিত হয়েছে তা হচ্ছে প্রথমত, স্তালিন স্বয়ং একটি পাওয়ার হাউস, যার প্রয়োজনে একটি জাতির জন্য সব সময়েই থেকে যাবে। অন্যদিকে ভোটাভুটিতে অংশ নেয়া অধিকাংশই মনে করে তারা বর্তমান সময়ে বহির্বিশ্বের চাপের মুখে রয়েছে। এ সময় স্তালিনের মতো কারো শাসন দরকারী ছিল।

এনজিওটি এটা ভেবে ‘আশ্চর্য’ হয়েছে, এবং তারা এটিকে ‘অ্যালার্মিং’ বলেছে! ব্যক্তি স্তালিন এখনও রাশিয়ানদের মনে-মননে বীরের প্রতীক। একটি শক্তিশালী জাতি নির্মাণের জন্য তাদের কাছে স্তালিন অপ্রতিদ্বন্দ্বী।

‘দ্য কোমারস্যান্ত’ নামক সংবাদপত্রে ‘লেভাদা’ সেন্টারের আরও একটি জরিপ ছাপা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে : এবছর কমিউনিস্ট পার্টির মিছিল এবং সমাবেশে জনসমাগম আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। সেই সাথে রাশিয়ায় যেখানে যেখানে এখনও কমরেড স্তালিনের মূর্তি রয়েছে সে সব ঝেড়ে মুছে সাফ করা হয়েছে। এবছর ৭ মে তারিখে তারা নাজি জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধজয়ের ৭০ তম বার্ষিকী উদযাপন করতে চায়।

কমিউনিস্ট পার্টি এবং রাশিয়ার ওই ৩৯ ভাগ সাধারণ মানুষ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে স্তালিনের মনুমেন্ট সাফ করার পাশাপাশি আরও নতুন মনুমেন্ট তৈরিও করতে চায়। মহান স্তালিনের শাসনামল (১৯২৪-১৯৫৩) নিয়ে সত্যিকার গর্ব করা মানুষের সংখ্যা যেটি জরিপে পাওয়া গেছে (৩৯ ভাগ এবং ৪৬ ভাগ) তারাই শেষ কথা নয়। লেভাদা সেন্টার তাদের এই জরিপকার্যটি পরিচালনা করেছিল ১ হাজার ৬ শ’ মানুষের ভেতর।

.

স্তালিন সম্পর্কে কমিউনিস্টবিরোধীদের রূপকথার গল্প!

এইসব রূপকথার গল্পের প্রধান উপজীব্য ছিল গুজব, পরনিন্দাচর্চা এবং অসমর্থিত জনশ্রুতি। একটা বিপুল সমর্থিত জনশ্রুতি আছে ইতিহাস নিয়ে। ‘ততক্ষণ পর্যন্ত সঠিক ইতিহাস লেখা যায় না যতক্ষণ ইতিহাসবিদ কোনো না কোনোভাবে যার বিষয়ে বা যাকে নিয়ে লিখছেন তার সাথে মনস্তাত্ত্বিক যোগাযোগ স্থাপন করতে পারেন।’ আর নির্মম সত্য হচ্ছে অধিকাংশ মানুষ এই পরামর্শটি অবজ্ঞা করেন!

স্তালিনকে নিয়ে লক্ষ লক্ষ পৃষ্ঠা নিন্দা, বিষোদগার, হিংসা বর্ষণ, সমালোচনা করা হয়েছে। মানব সভ্যতার ইতিহাসে কোনো একজন মানুষকে নিয়ে এত এত নিন্দুকের তীর ছুটে গিয়েছে যা রীতিমত অভূতপূর্ব। স্তালিন পার্টিতে গুরুত্বপূর্ণ পদ পাওয়ার পরও তাকে নিয়ে কমিউনিজমবিরোধীরা এতটা সরব ছিল না। কিন্তু স্ক্যালিনের হাতে জার্মানির পতন হলে সকল কৃতিত্ব স্ক্যালিনের হাতে ওঠাটা মেনে নিতে পারেনি রুজভেল্ট, চার্চিলরা। জার্মান অগ্রগামী বাহিনী যখন মস্কো দখলের জন্য তাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে তখনো প্রতিআক্রমণের বদলে ‘কৌশলগত পশ্চাদপসারণের’ নাটক করতে চেয়েছে রুজভেল্ট, চার্চিল।

বিশ্বযুদ্ধের আয়ুষ্কাল ৫ বছর ৮ মাস। এই দীর্ঘ সময়ে একের পর এক জনপদ দখল করে নিয়েছিল জার্মান বাহিনী। প্রায় ৬ কোটি মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছিল। যার মধ্যে ৬০ লাখ মানুষকে বন্দিশিবিরে প্রাণ দিতে হয়েছিল। একদিকে জার্মান বাহিনীর অগ্রাভিযান অন্যদিকে জাপানের অগ্রাভিযান। বিশ্বের দুই প্রান্ত থেকে দখলদারিত্ব কায়েম হতে থাকলে সে সময়কার ব্রিটিশ শাসনাধীনের ভারতকেও ২৫ লাখ সৈন্য সরবরাহ করতে হয়েছিল ইয়োরোপ, এশিয়ায়। তাদের মধ্যে অনকে বাঙালিও ছিল। তাদের কে কোথায় শহীদ হয়েছে সেই পরিসংখ্যানটিও আমাদের হাতে নেই। পুঁজিবাদীরা সোভিয়েত ইউনিয়ন আর সমাজতন্ত্রের সবকিছুর বিরোধিতা করলেও এটা স্বীকারে কুণ্ঠাবোধ করে না যে বিপুল বিক্রমে অগ্রসর হওয়া জার্মান বাহিনীর হাতে রাশিয়ার পতন হলে সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বের অর্ধেকটা হিটলারের অধীনে চলে যেত এবং বিশ্বের মানচিত্র নতুনভাবে আঁকতে হতো। সেই ভয়াবহ বিপদ থেকে বিশ্বকে রক্ষা করেছিলেন জোসেফ স্তালিন। তার বিচক্ষণ আর সাহসী নেতৃত্বে জার্মান বাহিনীর অগ্রাভিযান রুখে দিয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের লাল ফৌজ। ইয়োরোপ-আমেরিকা যুদ্ধজয়ের এবং আত্মত্যাগের যে বড়াই করে সেটিও বাতিলযোগ্য, কারণ ওই যুদ্ধে সোভিয়েত সৈন্য মারা গিয়েছিল প্রায় ২ কোটি ৬০ লাখ! তার বিপরীতে বাকি মিত্র বাহিনীর নিহত সৈন্য সংখ্যা মাত্র ১০ লাখ!

কিন্তু স্তালিনের সেই কৃতিত্বকে খাটো করার দুরভিসন্ধী সমালোচকদের এমন এক জায়গায় দাঁড় করিয়েছে যেখান থেকে তারা কেবলই পশ্চিমা কৃতিত্ব দেখে। কখনোই আসল বীরত্ব দেখে না। এমনকি কখনো কোনো আলোচনায় সোভিয়েত ইউনিয়নের কথা বলা হলেও স্তালিনের অবদানের প্রসঙ্গ কৌশলে বাদ দেয়া হয়। স্ক্যালিনের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের জন্য রীতিমত আমেরিকা ব্রিটেনে ফান্ড তৈরি করা হয়। শত শত লেখক, সাংবাদিক, ইতিহাসবিদ ভাড়া করা হয়। তাদের একমাত্র কাজ হয়ে ওঠে যে যেখান থেকে পারে স্তালিনবিরোধী নোট, ঘটনাবলির বর্ণনা, বিবরণ, দলিল, চিঠিপত্র যোগাড় করে তার সাথে মনের মাধুরী মিশিয়ে রূপকথার গল্প তৈরি করে বিশ্বময় ছড়িয়ে দেয়া।

কীভাবে সেই প্রপাগান্ডা চালানো হতো তার বিবরণ পাওয়া যায় সুইডিশ কমিউনিস্ট পার্টির নেতা কমরেড মারিয়া সোসা’র গবেষণায়। সোসা স্তালিন বিরোধী এইসব অপপ্রচার সম্পর্কে একটি অনুসন্ধান চালান।

শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিজ্ঞান, কৃষি, শিল্প ও সামরিক সবদিক থেকে সোভিয়েত সমাজতন্ত্রকে শান্তির পক্ষে এক মহাশক্তিধর রাষ্ট্রে পরিণত করেছিলেন তিনি। বিশ্বের শোষিত মানুষের চোখে তাই স্তালিন হয়ে ওঠেন শোষণমুক্তি ও স্বাধীনতার প্রতীক। আর অন্যদিকে বিশ্বসাম্রাজ্যবাদ-পুঁজিবাদের চোখে তিনি মৃত্যুর আতঙ্করূপ। বিশ্বসাম্রাজ্যবাদ বুঝেছিল, স্তালিনকে কালিমালিপ্ত করতে না পারলে সাম্যবাদী আন্দোলনের অগ্রগতি আটকানো যাবে না, শোষণমূলক পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী নিষ্ঠুর ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখা যাবে না। তাই মিথ্যাচারের নিশানা বানানো হলো স্তালিনকেই! স্তালিনকে আঘাত করা ও কালিমালিপ্ত করার দ্বারা তারা শোষিত মানুষের মুক্তির হাতিয়ার মার্কসবাদ-লেনিনবাদকেই নিশানা বানিয়েছে এবং নির্ভেজাল মিথ্যাকে প্রচারের জোরে এমন পর্যায়ে নিয়ে গেছে যে স্তালিনকে দানব বা স্বৈরশাসক বলার জন্য কারো যোগ্যতা ক্ষমতা বা প্রমাণের দরকার হয় না। যে স্তালিন ছিলেন হিটলার-মুসোলিনি-ফ্রাঙ্কোর ফ্যাসিবাদী আগ্রাসন ও অন্ধতার বিরুদ্ধে শান্তি, যুক্তিবাদ ও মানবতার রক্ষক, আজ তাকেই হিটলার বা অন্য যে কোনো স্বৈরশাসকের সাথে এক কাতারে তুলে দেওয়া হয়!

স্তালিন সম্পর্কে এসব মিথ্যাচারের শিকার অনেকেই, এমনকি বহু বামপন্থিও। এই প্রচার এতই তীব্র যে কেউ কেউ হিটলারের চাইতেও স্তালিনকেই মানবতা ও গণতন্ত্রের পয়লা নম্বর শত্রু মনে করেন!

সুইডিশ কমিউনিস্ট পার্টির নেতা কমরেড মারিয়ো সোসা স্তালিন-বিরোধী এইসব অপপ্রচার সম্পর্কে একটি অনুসন্ধান চালান। মুক্তিসাধক মেহনতি মানুষের সচেতন অংশ স্তালিনবিরোধী মিথ্যাচারের মুখোশ বহুলাংশে খুলে দিয়েছে, সত্য উঘাটিত করেছে।

মারিয়া সোসা তার “Lies concerning the history of the Soviet Union নামক নিবন্ধে লিখছেন :

হিটলার থেকে হার্স্ট, কনকোয়েস্ট থেকে সোলঝিনিৎসিন

স্তালিন আমলে সোভিয়েত ইউনিয়নে গুলাগ লেবার ক্যাম্পগুলোতে অসংখ্য মানুষের মৃত্যু ও খুন সম্পর্কে যেসব ভয়াবহ গল্প চালু আছে তার একটাও কখনো শোনেননি, এরকম মানুষ আজকের দুনিয়ায় মাইক্রোস্কোপিক! তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের ওই সব বন্দিশিবিরে লক্ষ লক্ষ বন্দীকে অনাহারে উপবাসে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। এ রকমই আরও লক্ষ লক্ষ মানুষকে সেদিন সেখানে হত্যা করা হয়েছিল, শুধু এই কারণে যে তারা ক্ষমতাসীনদের বিরোধী। স্তালিন আমলের সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্পর্কে এইসব কাহিনিও বহুল প্রচারিত। পুঁজিবাদী দুনিয়ায় এইসব গল্প বারে বারে নানা বইয়ে, খবরের কাগজে, রেডিওতে, টেলিভিশনে, চলচ্চিত্রে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। তাদের সরবরাহ করা এইসব মনগড়া তথ্যে গত ৬০ বছরে সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার তথাকথিত হৃদয়হীন নিষ্ঠুরতার শিকার এইসব মানুষের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। প্রথম দিকে বলা হতো ৬ লাখ! তার পর দফায় দফায় ২০ লাখ থেকে এক লাফে ৬০ লাখ। এরও পরে বলা হতে থাকল আড়াই কোটি মানুষকে হত্যা করেছে। স্তালিন!

কিন্তু এসব কাহিনির সত্যতা কতখানি? কোথা থেকে এসব কাহিনি এল? এই কাহিনিগুলোর লেখকরা বার বার দাবি করে এসেছেন যে, স্তালিন আমলে সোভিয়েত ইউনিয়নে লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যুর যে কথাগুলো তারা বলে আসছে তা নাকি অক্ষরে অক্ষরে সত্যি। যেদিন সেদেশের সরকারি তথ্যভাণ্ডার খুনে। গোপন নথি সকলের সামনে প্রকাশিত হবে সেদিন নাকি সবাই বুঝতে পারবে, এই কাহিনিগুলোর সত্যতা। সোভিয়েত ইউনিয়ন আজ আর নেই। ১৯৯১ সালেই তার পতন ঘটেছে। ইতিহাস গবেষকদের কাছে তার সমস্ত গোপন নথিপত্রই আজ সম্পূর্ণ উন্মুক্ত। কিন্তু ওই সমস্ত গল্পগুলোর সপক্ষে কোনো তথ্যপ্রমাণ সেখানে। পাওয়া গেল না কেন? এই প্রশ্নটিই কি কেউ করেছেন?

আজ সোভিয়েত আমলের সমস্ত গোপন নথিপত্রই ঘেঁটে দেখে খুব সহজেই বের করা সম্ভব, ঠিক কতজন সেদিন সোভিয়েত ইউনিয়নে বন্দী ছিলেন, কে কত বছর সেখানে বন্দিশালায় কাটিয়েছেন, কতজন বন্দী অবস্থায় মারা গেছেন, বা ঠিক কতজনকে সেদিন মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রকৃত সংখ্যা জানার ক্ষেত্রে আজ আর কোনো বাধা নেই। কিন্তু কী পাওয়া গেল সেখানে? দেখা গেল, এতদিনের বহুল প্রচারিত গল্পের সাথে প্রকৃত সত্যের মিল নেই। কারা এই গল্পগুলো রটিয়েছিল তা খুঁজলে দেখা যাবে, হিটলার থেকে হার্স্ট, কনকোয়েস্ট থেকে সোলঝেনিৎসিন, সকলেই এর সঙ্গে যুক্ত।

.

স্তালিনবিরোধী মিথ্যাচার শুরু হয় হিটলারের হাত দিয়েই

১৯৩৩ সালে জার্মানিতে ফ্যাসিবাদের অভ্যুত্থানের ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী। পরবর্তী কয়েক দশক জুড়ে সারা পৃথিবীর উপরই এর প্রভাব পড়ে। ওই বছর ৩০ জানুয়ারি হিটলার জার্মানির চ্যান্সেলর হন এবং নতুন সরকার গঠন করেন। প্রচণ্ড হিংসা ও প্রচলিত বিভিন্ন আইনকানুনের প্রায় কোনোরকম তোয়াক্কা না রেখেই এই সরকার শুরু করে তার কাজ। দেশের সমস্ত ক্ষমতা পুরোপুরি নিজেদের কুক্ষিগত করতে ৫ মার্চ তারা নতুন করে নির্বাচনের ডাক দেয়। তার আগেই অবশ্য তারা সমস্ত প্রচারযন্ত্রকে নিজেদের কজায় এনে ফেলেছিল। এইভাবে নিছক প্রচারের জোরে তারা নির্বাচনে নিজেদের জয়কে সুনিশ্চিত করার চেষ্টা করে। জনগণকে বিভ্রান্ত করতে নির্বাচনের সপ্তাহখানেক আগে, ২৭ ফেব্রুয়ারি নাৎসিরা নিজেরাই জার্মানির পার্লামেন্ট ‘রাইখস্টাগ’ ভবনে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং মিথ্যা সাক্ষ্যপ্রমাণ সাজিয়ে এই অগ্নিকাণ্ডের সমস্ত দায়ভার চাপিয়ে দেয় কমিউনিস্টদের ওপর। এই অবস্থায় যে নির্বাচন হয়, তাতে সারা জার্মানির প্রায় ১ কোটি ৭৩ লক্ষ ভোট পায় নাৎসিরা, যা ওই নির্বাচনে প্রদত্ত ভোটের প্রায় ৪৮ শতাংশ। রাইখস্টাগে তাদের ২৮৮ জন ডেপুটি নির্বাচিত হয়। কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। নাৎসিদের আক্রমণ এরপর পরিচালিত হয় সোস্যাল ডেমোক্র্যাট ও ট্রেড ইউনিয়নগুলোর দিকে। প্রথম দিকে যেসব কনসেনট্রেশন ক্যাম্পগুলো গড়ে ওঠে, নারীপুরুষ নির্বিশেষে বামপন্থি কর্মীসমর্থকদের ধরে ধরে এসব বন্দিশিবির ভর্তি করা হয়। এদিকে ওই একই সময়ে অন্যান্য দক্ষিণপন্থিদের সহায়তায় রাইখস্টাগে হিটলারের ক্রমাগত শক্তিবৃদ্ধি ঘটতে থাকে। ২৪ মার্চ, সেখানে একটা আইন পাস করানো হয়, যার বলে পরবর্তী চার বছরের জন্য হিটলারের হাতে দেশের সর্বময় ক্ষমতা তুলে দেওয়া হয়। এই ক্ষমতার বলে তিনি তখন থেকে পার্লামেন্টের অনুমতি ছাড়াই যে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা হাতে পান। এই সময় থেকেই শুরু হয় খোলাখুলি ইহুদি নিধন। তাদেরকেও দলে দলে ধরে চালান করা হয় ওই কনসেনট্রেশন ক্যাম্পগুলোতে। ১৯১৮ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানির উপর বিজয়ী সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো আন্তর্জাতিক চুক্তির মাধ্যমে যেসব সামরিক নিষেধাজ্ঞা জারি করে, সেগুলোকেই অজুহাত করেন হিটলার। সওয়াল করা শুরু হয়, তার সর্বময় ক্ষমতার সময়সীমা আরও বাড়ানো হোক। প্রচণ্ড দ্রুতগতিতে শুরু হয় নতুন করে জার্মানির সামরিকীকরণের কাজ। নতুন করে জার্মান সেনাবাহিনীকে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করা হয়। জার্মানির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে স্তালিনের রাশিয়া। ব্রিটেন-আমেরিকা-ফ্রান্স তখন সোভিয়েতের বিরুদ্ধে হিটলারকে প্রশ্রয় দিচ্ছে। গোটা সাম্রাজ্যবাদী দুনিয়ার লুঠের পথে কাঁটা সোভিয়েত ইউনিয়ন। এ রকম একটি আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে হিটলারের প্রচারদফতর। সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্পর্কে এমন সমস্ত ভয়াবহ গল্পকাহিনি তৈরি করে যা বিশ্বব্যাপী প্রচার করার দায়িত্ব নিয়েছিল মার্কিন দেশের সেইসব সংবাদপত্র, যারা চটকদার চাঞ্চল্যকর খবর ছেপে ব্যবসা করে।

.

হিটলারের দাবি; ইউক্রেন জার্মান প্রভাবাধীন অঞ্চল

এ সময়ই হিটলারের প্রচারমন্ত্রী গোয়েবলসকে দায়িত্ব দেওয়া হয়, নাৎসিরা যেমনটি চায় সেই মনোভাব জার্মান জনসাধারণের মধ্যে চারিয়ে দিতে হবে। উগ্র জাত্যাভিমানের ভিত্তিতে এক বৃহত্তর জার্মানি গড়ে তোলার নেশা ধরানো হয়েছিল সেদিন জার্মান জনগণকে বোঝানো হয়েছিল, খাঁটি আর্যরক্তের জার্মান জাতিই হবে সে দেশের একমাত্র অধীশ্বর। এই লক্ষেই শ্লোগান তোলা শুরু হয়, লেবেলস্রাউম’, অর্থাৎ বাঁচবার জন্য যথেষ্ট জায়গা চাই। আসলে এটা ছিল জার্মান সাম্রাজ্যবাদের উপনিবেশ দখলের আগ্রাসী লক্ষ্যের উপর উগ্র জাত্যাভিমানী মুখোশ। এই তথাকথিত লেবেলস্রাউমের লক্ষ্যে যে সমস্ত অঞ্চল চিহ্নিত করা হয়, তারই এক অংশ ছিল জার্মানির পূর্বদিকে অবস্থিত এক বিশাল অঞ্চল, যার আয়তন ছিল খোদ জার্মানির চেয়েও অনেক বড়। কিন্তু এই সমগ্র অঞ্চলটিই ছিল তখনও পর্যন্ত জার্মানির অধিকারের বাইরে। অতএব অবিলম্বে তা দখল করা চাই। এর অনেক আগেই, ১৯২৫ সালে প্রকাশিত ‘মাইন কাফ’ (আমার সংগ্রাম) গ্রন্থেই, হিটলার জার্মান লেবেলস্রাউমের জন্য ইউক্রেনকে এক অতি প্রয়োজনীয় অঞ্চল বলে চিহ্নিত করেছিলেন। তার কথায়, ইউক্রেন এবং পূর্ব ইয়োরোপের অন্যান্য অঞ্চলগুলো একমাত্র জার্মানির অধিকারে থাকলেই ওইসব অঞ্চলগুলোর সম্পদের ঠিকঠাক ও পূর্ণাঙ্গ ব্যবহার হওয়া সম্ভব, নচেৎ নয়। ফলে নাৎসি প্রচারের মূল কথাই দাঁড়াল, জার্মান জাতির স্বার্থে দরকার হলে তরবারির জোরেই এ অঞ্চলগুলোকে মুক্ত করতে হবে। জার্মান জাতিকে বাঁচবার মতো প্রয়োজনীয় জায়গা করে দেওয়ার লক্ষ্যে এ কাজ অবশ্য প্রয়োজনীয়। অধিকার করার পর জার্মান উদ্যোগে, জার্মান প্রযুক্তির সাহায্যে সমগ্র ইউক্রেনকে জার্মানির জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্যের যোগানায় এক শস্যাগারে পরিণত করা হবে। তার জন্য প্রথমে সেখানে বসবাসকারী ‘ইতর’ জাতির মানুষদের হাত থেকে ইউক্রেনকে মুক্ত করতে হবে। এইসব জাতির মানুষদের অবশ্য জার্মান অর্থনীতির স্বার্থে ক্ষেতখামারে, কারখানায় বা জার্মান বাড়িতে পরিচারক হিসেবে দাসের মতো ব্যবহার করা চলতে পারে!

কিন্তু ইউক্রেন দখল করতে হলে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে যুদ্ধ করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। আর এই যুদ্ধের জন্য আগে থেকেই ব্যাপক প্রস্তুতি নেওয়া প্রয়োজন, প্রয়োজনে যুদ্ধের উপযুক্ত উত্তেজনা তৈরি করা। সেই লক্ষ্য সামনে রেখেই গোয়েবলসের নেতৃত্বে নাৎসি প্রচারযন্ত্র শুরু করল মিথ্যা প্রচার যে, ‘বলশেভিকদের নেতৃত্বে ইউক্রেনে ব্যাপক গণহত্যা সংঘটিত হচ্ছে। স্তালিনের নির্দেশ অনুযায়ী সেখানে পরিকল্পিতভাবেই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করা হয়েছে। খেতে না পেয়ে সেখানে দলে দলে মানুষ অসহায়ভাবে মরছে। এইভাবেই সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ চেষ্টা করছে যাতে ইউক্রেনের কৃষকরা বাধ্য হয় তাদের হুকুম অনুযায়ী সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে মেনে নিতে।’ এসব মিথ্যাচারের আসল লক্ষ্য ছিল ইউক্রেনে আসন্ন জার্মান সামরিক অভিযানের সপক্ষে বিশ্ব জনমতকে প্রভাবিত করা। কিন্তু এই উপলক্ষ নাৎসিদের পক্ষ থেকে ব্যাপক প্রচার চালানো সত্ত্বেও বিশ্বজুড়ে আশানুরূপ সাফল্য অর্জন করতে তা ব্যর্থ হয়। ফলে হিটলার ও গোয়েবলস বুঝতে পারেন, তাদের প্রচারকে সারা পৃথিবীতে প্রয়োজনীয় মাত্রায় পৌঁছে দিতে হলে অন্যান্য দেশেও তাদের কিছু বন্ধু দরকার যারা এ বিষয়ে সাহায্য করতে পারবেন। এই সাহায্য এল মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের পক্ষ থেকে।

.

ধনকুবের র‍্যানড হার্স্ট এবং হিটলার হরিহর আত্মা

উইলিয়াম র‍্যানড হার্স্ট ছিলেন একজন মার্কিন কোটিপতি। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে জনমানস বিষিয়ে দেওয়ার কাজে নাৎসিদের প্রতি তিনি সাহায্যের দরাজ হাত বাড়িয়ে দেন। এই উইলিয়াম হার্স্টের আরও কতগুলো পরিচয় রয়েছে। তিনি ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনেকগুলো বিরাট সংবাদপত্রের মালিক। আজকের ‘ইয়েলো প্রেস’ বা চটকদার প্রচারমাধ্যম বলতে আমরা যা বুঝি, তারও জনক বলে হার্স্টকেই অভিহিত করা যায়। এসব বাজারি পত্রিকার কাজই হচ্ছে নানা প্রকারের গরম গরম উত্তেজক খবর পরিবেশন করা।

উইলিয়াম হার্স্ট সংবাদপত্রের সম্পাদক হিসেবে তার কর্মজীবন শুরু করেন ১৮৮৫ সালে। তার বাবা জর্জ হাও ছিলেন একজন কোটিপতি ও সফল ব্যবসায়ী। তিনি নানা খনি এবং সংবাদপত্রের মালিক ছিলেন। মার্কিন সিনেটের একজন প্রতিনিধি হিসেবেও তিনি দীর্ঘদিন কাজ করেন। ১৮৮৫ সালে তিনিই তার ছেলের হাতে ‘সানফ্রান্সিসকো ডেইলি এক্সামিনার’ পত্রিকার দায়িত্ব তুলে দেন। এটিকেই সংবাদপত্র দুনিয়ায় হার্স্ট-সাম্রাজ্যের সূচনা বলা যেতে পারে। উত্তর আমেরিকার বহু মানুষের জীবন ও চিন্তা-চেতনার উপর এই হা-সাম্রাজ্যের প্রবল প্রভাব লক্ষ করা যায়। পরবর্তীকালে তার বাবার মৃত্যুর পর, উইলিয়াম হার্স্ট তার খনিশিল্পের সমস্ত শেয়ার বিক্রি করে দেন। এই সময় থেকে সংবাদপত্র দুনিয়াই হয়ে ওঠে তার পুঁজি বিনিয়োগের প্রধান ব্যবসা। প্রথমেই তিনি নিউইয়র্ক মর্নিং জার্নাল’ নামে একটি পত্রিকা কিনে নেন। এটি ছিল যথেষ্ট ঐতিহ্যসম্পন্ন একটি পত্রিকা। কিন্তু তার হাতে যাওয়ার পর কিছুদিনের মধ্যেই পত্রিকাটির সম্পূর্ণ রূপান্তর ঘটে যায়। খুব দ্রুত এটি উত্তেজক খবর পরিবেশনকারী পত্রিকা হয়ে দাঁড়ায়। চটকদার চাঞ্চল্যকর গল্প কেনার জন্য তিনি কখনো পয়সার কার্পণ্য করতেন না। এমনকি যদি সেই মুহূর্তে কোনো ভয়াবহ অপরাধ বা খুনের মতো উত্তেজক ঘটনা না ঘটে থাকে, এই পত্রিকার সাংবাদিকদের এ ধরনের সাজানো ঘটনার রিপোর্ট পরিবেশন করতে উৎসাহ দেওয়া হতো। হলুদ সাংবাদিকতার বৈশিষ্ট্যই ওটা। মিথ্যা এবং সাজানো নানা উত্তেজক খবরকে সত্যি বলে পরিবেশন করাই এ ধরনের পত্রিকার কাজ।

এইসব মিথ্যা সাজানো, কিন্তু উত্তেজক খবর পরিবেশন করে হার্স্ট কিছুদিনের মধ্যেই বহু কোটি টাকার মালিক হয়ে উঠলেন। সংবাদপত্র দুনিয়ায় ততদিনে তিনি হয়ে উঠেছেন এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। ১৯৩৫ সালে দেখা গেল, পৃথিবীর ধনীতম ব্যক্তিদের মধ্যে একজন হয়ে উঠেছেন তিনি। তার সম্পত্তির পরিমাণ তখন ২৯ কোটি ডলারেরও বেশি। ১৯৪০ এর দশকে দেখা গেল, তিনি মোট ২৫টি সংবাদপত্রের মালিক। শুধু তাই নয়, আরও ২৪টি সাপ্তাহিক সাময়িক পত্রিকা, ১২টি রেডিও স্টেশন ও ২টি বিশ্বসংবাদদাতা সংস্থার মালিকানাও তখন তার হাতে! এছাড়াও যে কসমোপলিটান ফিল্ম কোম্পানি বিভিন্ন সিনেমা তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করত, সেটিও ছিল তার। আরও বহু সংস্থারই তিনি মালিক ছিলেন। ১৯৪৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম টিভি স্টেশনটিও তিনি কিনে নেন। বাল্টিমোরে স্থাপিত এই স্টেশনটির নাম ছিল ‘বি ভবলিও এ এল টিভি’। এই সময় দেখা যায়, হার্স্ট গোষ্ঠীর বিভিন্ন সংবাদপত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিদিন মোট ১ কোটি ৩০ লক্ষ কপি বিক্রি হয়। আর তার পাঠকের সংখ্যা প্রায় ৪ কোটি। শুধু তাই নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বসে বহু মানুষ যেসব সংবাদ প্রতিদিন পড়েন তারও অনেকগুলো ওই হার্স্ট গোষ্ঠীর বিশ্বসংবাদদাতা সংস্থা থেকেই সংগৃহীত হতো। সারা পৃথিবীতেই বিভিন্ন সংবাদপত্র গোষ্ঠী ও সিনেমা কোম্পানিগুলোও এইসব সংবাদদাতা গোষ্ঠীগুলো থেকেই তাদের প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করত ও নিজেদের ভাষায়, নিজস্ব আঙ্গিকে তা পরিবেশন করত। এসব তথ্য থেকেই বোঝা যায়, মার্কিন রাজনীতিতে হার্স্ট-সাম্রাজ্যের প্রভাব ছিল কী বিপুল! পরোক্ষভাবে বিশ্বরাজনীতিকেও যথেষ্ট প্রভাবিত করার ক্ষমতা ছিল এই হার্স্ট-সাম্রাজ্যের। বহু বছর ধরেই তারা এ ক্ষমতার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে এসেছে। বিভিন্ন ইস্যুতে, যেমন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়ন যে-পক্ষে লড়ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সে-পক্ষে যোগ দেওয়া আদৌ উচিত কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা, বা ১৯৫০-এর দশকে মিথ্যা অভিযোগে কমিউনিস্টদের হত্যার কাজে জেনারেল ম্যাক আর্থারের সপক্ষে মার্কিন জনমত সংগঠিত করা ইত্যাদি প্রতিটি ক্ষেত্রেই এর প্রমাণ পাওয়া যায়। উগ্র জাতীয়তাবাদী, অতিরক্ষণশীল ও কমিউনিজমবিরোধী দৃষ্টিভঙ্গির মানুষ ছিলেন উইলিয়াম হার্স্ট। তার রাজনীতি ছিল প্রতিক্রিয়াশীল ও উগ্র দক্ষিণপন্থি।

১৯৩৪ সালে তিনি জার্মানি যান। হিটলার তাকে অতিথি ও বন্ধুর মর্যাদা দেন। হাসেঁর এই জার্মানি ভ্রমণের পর থেকেই তার মালিকানাধীন সংবাদপত্রগুলি আরও খোলাখুলিভাবে প্রতিক্রিয়াশীল মতামত প্রকাশ করতে শুরু করে। এমন কোনো দিন ছিল না যেদিন সেসব সংবাদপত্রে সমাজতন্ত্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন বা বিশেষ করে স্ট্যালিনের বিরুদ্ধে কোনো না কোনো প্রবন্ধ প্রকাশিত হতো। হার্স্ট এই সময় তার মালিকানাধীন সংবাদপত্রগুলোকে প্রায় নাৎসিবাদের নিজস্ব প্রচারপত্র করে তোলারও চেষ্টা করেছিলেন। এই উদ্দেশ্যেই সেখানে গোয়েরিং এর লেখা প্রবন্ধাবলি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা শুরু হয়। কিন্তু নানা পাঠক এই ব্যাপারে তাদের অসন্তোষ ও প্রতিবাদ ব্যক্ত করায় শেষপর্যন্ত এই প্রবন্ধাবলী প্রকাশ করা বন্ধ করতে হয়।

হিটলারের জার্মানি থেকে ঘুরে আসার পর থেকেই হারে সংবাদপত্রগুলোতে সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্পর্কে প্রতিদিন একের পর এক ভয়াবহ সংবাদ প্রকাশিত হতে থাকে। তার কোনোটি খুনের, কোনোটি নির্বিচার গণহত্যার, আবার কোনোটি বা বাধ্যতামূলক দাসত্বের, শাসকদের বিলাসবৈভবের বা সাধারণ মানুষের অভাব দারিদ্র্য-অনাহারের। তাদের মতে, এই সবগুলোই ছিল সোভিয়েত শাসকদের চেপে রাখা তথ্য! প্রকাশিত সংবাদ-প্রবন্ধগুলোতে অত্যন্ত উত্তেজকভাবেই এসব ‘সত্য’ উঘাটন করা হতো। প্রায় প্রতিদিন প্রকাশিত এইসব সংবাদ আসলে সরবরাহ করত নাৎসিদের কুখ্যাত ‘গোপন রাষ্ট্রীয় পুলিশ’ বা গেস্টাপো বাহিনী। প্রায়শই এসব সংবাদপত্রের একেবারে প্রথম পাতাতেই সোভিয়েত সম্পর্কে নানা মিথ্যা কথা ও তাকে ভিত্তি করে ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশ করা হতো। যেমন একটি ব্যঙ্গচিত্র ছিল যেখানে স্তালিন একটি ভোলা ছুরি নিয়ে যেন কাউকে হত্যা করতে উদ্যত। এখানে কিন্তু একটা কথা আমাদের অবশ্যই ভুলে গেলে চলবে না যে, এসব সাজানো কথা, মিথ্যা কথা ও ব্যঙ্গচিত্রের পাঠকসংখ্যা কিন্তু শুধুমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই ছিল দৈনিক ৪ কোটি। এছাড়াও অন্যান্য নানা সংবাদমাধ্যমের সাহায্যে সারা পৃথিবীর আরও কয়েক কোটি মানুষের কাছে এসব সংবাদ পৌঁছে যেত। এই হলো স্তালিনবিরোধী কুৎসা প্রচারের সূচনা।

.

ইউক্রেনে দুর্ভিক্ষের বানানো গল্প

সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে হার্স্ট গোষ্ঠী প্রথম যেসব মিথ্যা প্রচার শুরু করে, যার প্রতিধ্বনি এখনও শোনা যায়, তার মধ্যে অন্যতম ছিল ইউক্রেনে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের গল্প। হাস্টের প্রচার অনুযায়ী ওই দুর্ভিক্ষে নাকি লক্ষ লক্ষ মানুষ না খেতে পেয়ে মারা যায়। শিকাগো আমেরিকান কাগজে ১৯৩৫ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি এই প্রচার প্রথম শুরু হয়। একেবারে প্রথম পাতায় বড় বড় হরফে ‘অনাহারে, ক্ষুধার জ্বালায় সোভিয়েত ইউনিয়নে ৬০ লক্ষ মানুষের মৃত্যু শিরোনামে প্রকাশিত হয় উত্তেজক এই খবর। নাৎসি জার্মানি থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এরপর থেকে হার্স্ট গোষ্ঠীর কাগজগুলোতে একের পর এক প্রকাশিত হতে থাকে দুর্ভিক্ষ সম্পর্কিত বিভিন্ন বানানো গল্প।

কেন তারা স্তালিনকে আক্রমণের নিশানা বানিয়েছিল? সমকালীন বিশ্বসাম্রাজ্যবাদী শিবিরের সঙ্কট, সাম্রাজ্যবাদী-পুঁজিবাদী দেশগুলোর শ্রমিকশ্রেণিসহ গণতন্ত্রকামী-শান্তিকামী মানুষের সোভিয়েতের প্রতি প্রবল আকর্ষণ এবং সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর যুদ্ধপ্রস্তুতির বিরুদ্ধে শান্তির শক্তি হিসেবে স্ক্যালিনের নেতৃত্বে সমাজতন্ত্রের অপ্রতিহত অগ্রগতিতে আতঙ্কিত সাম্রাজ্যবাদ পুঁজিবাদের মরণভীতির পটভূমিতেই বুঝতে হবে, কেন হাস্টের মাধ্যমে ফ্যাসিস্ট শক্তি স্তালিনবিরোধী কুৎসার ঝড় তুলেছিল। ১৯৩৫ সাল সোভিয়েতের ইতিহাসেও সন্ধিক্ষণ। ১৯৩৫ সালে ফ্যাসিস্ট ইতালি আবিসিনিয়া দখল করে বাস্তবে বিশ্বযুদ্ধের সূচনা ঘোষণা করে। লেনিনের মরদেহ স্পর্শ করে সমাজতন্ত্র রক্ষার যে শপথ স্তালিন নিয়েছিলেন, ব্যক্তিগত চরিত্রহননকে উপেক্ষা করে এই মহান বিপ্লবী মানবসভ্যতাকে রক্ষার স্বার্থে সেই শপথ রক্ষায় ছিলেন অবিচল। এই সময়েই স্তালিন বুঝেছিলেন, সামগ্রিক যুদ্ধপ্রস্তুতি ছাড়া সাম্রাজ্যবাদের আসন্ন আক্রমণ রোখা যাবে না। সমাজতন্ত্র রক্ষার সামগ্রিক প্রস্তুতির অঙ্গ হিসেবে শিল্প ও কৃষিক্ষেত্রে দ্রুত অগ্রগতি ঘটানো সোভিয়েতের জন্য মরণবাচন প্রয়োজন হয়ে দাঁড়ায়। দৃঢ় হাতে স্তালিন সেই প্রস্তুতি নেন। যেজন্য যৌথখামার প্রবর্তনের ওপর জোর দিয়ে তিনি বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত কুলাকদের (কৃষি পুঁজিপতি) চোখের বালিতে পরিণত হন। ক্ষমতাচ্যুত কুলাক তথা রুশ পুঁজিপতিদের স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করতেন বুখারিন, ট্রটস্কি প্রমুখ। বুর্জোয়া উদারনীতির পক্ষ সমর্থনের জন্য আজও বহু বুদ্ধিজীবী বুখারিনের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। ফলে দেশের বাইরে মরণভীত সাম্রাজ্যবাদী শক্তি এবং দেশের অভ্যন্তরে ক্ষমতাহারা পুঁজিবাদী শক্তি যখন স্ক্যালিনের বিরুদ্ধে ছুরিতে শান দিচ্ছে, সেই মুহূর্তে ফ্যাসিস্টদের মস্তিষ্কপ্রসূত কুৎসা ও আক্রমণ বিশ্বজুড়ে প্রতিক্রিয়াশীলরা লুফে নেয়। পরবর্তীকালে স্তালিন সমাজতন্ত্র ও মানবমুক্তির প্রতাঁকে পরিণত হওয়ায়, মানবতার শত্রুরা সকলে একজোট হয়ে ফ্যাসিস্টদের কুৎসাকে দুনিয়াময় প্রচার করেছে এবং আজও করছে।

হার্স্ট-প্রচারিত সব গল্পের মূল কথা ছিল একটাই; বলশেভিকরা নাকি ইউক্রেনে ইচ্ছাকৃতভাবে এক প্রকট খাদ্যসঙ্কট তৈরি করেছে। তার ফলে সেখানে লক্ষ লক্ষ মানুষ না খেতে পেয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হচ্ছে। বাস্তবে এটা ছিল যৌথখামার কর্মসূচি বানচালের চক্রান্ত। সত্য ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। ১৯৩০-এর দশকের শুরুর দিনগুলোতে সোভিয়েত ইউনিয়নে বাস্তবে যা ঘটেছিল, তা ছিল একেবারেই অন্য জিনিস। এইসময় সেখানে একটি বড় ধরনের শ্রেণিসংগ্রাম পরিচালিত হচ্ছিল। সেই সংগ্রামে গরিব ভূমিহীন ছোট কৃষকরা ধনী, প্রচুর জমির মালিক, বড় কৃষক বা কুলাকদের বিরুদ্ধে লড়াই করছিলেন। এটা ছিল বাস্তবে যৌথখামার গড়ে তোলার সংগ্রাম।

গোটা দেশের জনগণকে জড়িত করে এতবড় একটা আন্দোলনের টানাপোড়েনে কৃষি উৎপাদনে কিছুটা অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। কিছু কিছু অঞ্চলে এই সময় শস্যের ফলনও খানিকটা কম হয়েছিল। কিন্তু তা এত কম নয় যার জন্য খাদ্যাভাবে মানুষের মৃত্যু ঘটতে পারে। বাস্তবে ওই সময়ে শুধু ইউক্রেনেই নয়, পৃথিবীর বহু অঞ্চলেই একটি মরণব্যাধি মহামারীরূপে ছড়িয়ে পড়েছিল এবং তাতে বহু মানুষেরই মৃত্যু হয়েছিল। এই রোগটির নাম ছিল স্প্যানিশ ফ্ল। এর সাথে খাদ্যাভাবের কোনো যোগ ছিল না। ১৯১৮ থেকে ‘২০ সালের মধ্যে এই মরণব্যাধি মহামারীর আকারে সমগ্র ইয়োরোপ ও আমেরিকাজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল। বিশ্বজুড়ে এই রোগে অন্তত ২ কোটি মানুষের প্রাণহানি ঘটে। কিন্তু এজন্য কেউ এইসব দেশের সরকারগুলোর বিরুদ্ধে এই বলে অভিযোগের আঙুল তোলেনি যে, তারা নিজেরাই নিজেদের নাগরিকদের খুন করেছে। অথচ তাদের প্রচারে, একই কারণে ইউক্রেনে মানুষের মৃত্যু হয়ে গেল যৌথখামার গঠনে স্ক্যালিনীয় সন্ত্রাসের নমুনা! এই হলো তাদের সততা। আসলে সেই সময় কোনো সরকারের পক্ষেই এক্ষেত্রে তেমন কিছু করার ছিল না। কারণ স্প্যানিশ ফ্লয়ের কোনো ওষুধ ছিল না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে পেনিসিলিন নিয়ে গবেষণা আর অনেকটা অগ্রসর হলে কেবল তখনই এই ধরনের রোগ প্রতিরোধের উপায় মানুষের করায়ত্ত হয়। কিন্তু সে তো আরও পরে সেই ১৯৪০’র দশকের কথা।

হার্স্ট-এর প্রচারমাধ্যম এইসব ব্যাপারে টু-শব্দটিও করেনি। বরং তারা। বিস্তারিতভাবে ছক কেটে কীভাবে কমিউনিস্টদের ইচ্ছাকৃতভাবে সৃষ্ট ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ ও খাদ্যসঙ্কটের ফলে ইউক্রেনে অসহায়ভাবে লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু ঘটছে, তা নিয়ে পাতার পর পাতা সাজানো মিথ্যা কিন্তু গরম খবর পরিবেশন করতে থাকে। এই সাজানো মিথ্যাকে যাতে সত্য বলে প্রতিভাত করা যায়, তার জন্য তাদের চেষ্টার কোনো ত্রুটি ছিল না। এইভাবে তারা বিভিন্ন পুঁজিবাদী দেশের জনমতকে প্রভাবিত করতে অনেকটা সফলও হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারের দ্বারা এইভাবেই তারা বিশ্বজুড়ে একটা ব্যাপক বিরুদ্ধ-জনমত সংগঠিত করতে থাকে। এগুলো ব্যাপক প্রচার পায়, কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের বক্তব্য এসব প্রচারমাধ্যমে তুলে ধরা হয়নি। সোভিয়েতের পক্ষ থেকে হার্স্ট গংয়ের এইসব মিথ্যাচারের প্রতিটিরই জবাব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কোনোটিই যথোপযুক্ত গুরুত্বসহকারে পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়নি। ফলে সাম্রাজ্যবাদী মিথ্যার স্বরূপ উঘাটনের জন্য সোভিয়েতের যুক্তিগুলো কেউ জানতেই পারল না। ১৯৩৪ থেকে শুরু করে ১৯৮৭ পর্যন্ত প্রায় ৫০ বছর এই। ছিল আসল পরিস্থিতি।

.

গণমাধ্যম দুনিয়ায় হার্স্টের সাম্রাজ্য

১৯৫১ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার বেভারলি হিলসে তার নিজের বাড়িতেই স্ত লিনবিরোধী মিথ্যার একনিষ্ঠ প্রচারক উইলিয়াম হারে মৃত্যু ঘটে। কিন্তু তিনি রেখে যান এক বিশাল গণমাধ্যম সাম্রাজ্য, যার আধিপত্য আজও সারা বিশ্বজুড়ে বজায় রয়েছে। আজও তারা নানা প্রতিক্রিয়াশীল সংবাদ সরবরাহ করে চলেছে। আজকের বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তর এন্টারপ্রাইজ হলো হার্স্ট কর্পোরেশন যার অধীনে রয়েছে ১০০টি কোম্পানি। ১৫ হাজারের বেশি কর্মী সেখানে কাজ করে। অসংখ্য ম্যাগাজিন, রেডিও, টিভি, কেবল টিভি, নিউজ এজেন্সি, বই ও মাল্টিমিডিয়া আজ তাদের মালিকানায় প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়।

.

সত্য প্রকাশিত হওয়ার ৫২ বছর আগের পরিস্থিতি

ইউক্রেন সম্পর্কে নাৎসিরা যে মিথ্যা প্রচার শুরু করেছিল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তাদের পরাজয়ের সাথে সাথেই কিন্তু তা শেষ হলো না। নাৎসিদের হাত থেকে এবার এই দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিল মার্কিন গুপ্তচর বাহিনী সিআইএ এবং ব্রিটিশ গুপ্তচর বাহিনী এমআই-৫। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে এই সময়ে পুঁজিবাদী দুনিয়ার পক্ষ থেকে যে ব্যাপক প্রচারযুদ্ধ চালানো হয়, তার অন্যতম হাতিয়ারই ছিল এই দুই গুপ্তচর সংস্থার যোগানো সাজানো তথ্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অব্যবহিত পরেই ৫০ এর দশকের গোড়ার দিকে মার্কিন সেনাপতি জেনারেল ম্যাক আর্থারের নেতৃত্বে পূর্ব এশিয়ায় অ্যান্টি কমিউনিস্ট উইচ হান্টের নামে যে ব্যাপক গণহত্যা চালানো হয়, তার পক্ষে যুক্তি খাড়া করার জন্যও কিন্তু সেই ইউক্রেনে লক্ষ লক্ষ মানুষের অনাহারে মৃত্যুর খবরকেই ব্যাপকভাবে প্রচার করা হয়েছিল। ১৯৫৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই বিষয়ে একটি বইও প্রকাশিত হয়। এই বইটির নাম ছিল ‘ব্যাক। ডিডস্ অব ক্রেমলিন’। বইটি প্রকাশের জন্য অর্থের যোগান দেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাসিত ইউক্রেনীয়রাই। বাস্তবে এদের পরিচয় কী ছিল? এরা হলো ইউক্রেনের সেইসব নাগরিক, যারা যুদ্ধের পুরো সময়টা নাৎসিদের পক্ষ হয়ে সোভিয়েতের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল। আর যুদ্ধের শেষদিকে এরা নাৎসিদের সাথে সাথে দেশ থেকে বিতাড়িতও হয়েছিল। পরবর্তীকালে এরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয় লাভ করে এবং বিশ্বের সামনে নিজেদের গণতন্ত্রী বলে দাবি করতে থাকে।

রোনাল্ড রিগান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলে, ১৯৮০-র দশকে তিনিও কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে প্রায় অঘোষিত যুদ্ধ চালাতে থাকেন। এইসময় ইউক্রেনের সেই দুর্ভিক্ষের খবরটিকে নতুন করে আবার পরিবেশন করা শুরু হয়। ১৯৩০’র দশকের সেই নাৎসি অপপ্রচার ১৯৮৪ সালে এসে আবার নতুন করে প্রাণ ফিরে পায়, তবে এবারে একটি অত্যন্ত নামী মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ের মোড়ক গায়ে দিয়ে। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক এই সময় হিউম্যান লাইফ ইন রাশিয়া’ বলে একটি বই প্রকাশ করেন। এই বইতে সেই পুরনো মিথ্যাগুলোরই পুনরাবৃত্তি করা হয়। ১৯৮৬ সালে আরও একটি বই প্রকাশিত হয়, ‘হারভেস্ট অব সরো’। এই বইটির লেখক হলেন রবার্ট কনকোয়েস্ট। ইনি ব্রিটিশ গুপ্তচর বাহিনীরই প্রাক্তন সদস্য। পরবর্তীকালে তিনি ক্যালিফোর্নিয়ার স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক পদে নিযুক্ত হন। অধ্যাপক পরিচয়েই তিনি এই বইটি লেখেন। বইটির জন্য ওই দেশত্যাগী ইউক্রেনীয়দের সংগঠন ইউক্রেন ন্যাশনাল। অর্গানাইজেশনের পক্ষ থেকে পুরস্কার বাবদ তিনি প্রায় ৮০ হাজার ডলার পান। এই একই সংগঠন ১৯৮৬ সালে ওই একই বিষয়ে হারভেস্ট অব ডেসপেয়ার’ বলে একটি সিনেমা প্রযোজনা করে। সেই সিনেমাতে আবার ওই রবার্ট কনকোয়েস্টের বইয়ের তথ্যই ব্যবহার করা হয়। তবে ইউক্রেনে ওই তথাকথিত দুর্ভিক্ষের মৃতের সংখ্যা এবার লাফ দিয়ে বেড়ে যায়। এতদিন ধরে প্রচারিত লক্ষ লক্ষ সংখ্যাটি এখানে হঠাৎ লাফ দিয়ে বেড়ে হয়ে যায় ‘দেড় কোটি’। আর এই আমেরিকাতেই মার্কিন রাষ্ট্রদূত যোসেফ ডেভিসের ‘মিশন টু মস্কো’ বইটি চিত্রায়িত করতে গিয়ে টুয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি ফক্সের মতো বিখ্যাত সিনেমা সংস্থাকেও বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছিল। কারণ ডেভিসের ওই বইতে স্ক্যালিনের যোগ্যতা ও নেতৃত্বের প্রশংসা ছিল।

অবশ্য সেই পুরনো নির্জলা মিথ্যা কথাগুলোই নতুন ভাষায়, নতুন আঙ্গিকে বলা ছাড়া পূর্বোক্ত বই বা সিনেমাতে খুব বেশি কিছু পাওয়া যায়নি। কানাডিয়ান সাংবাদিক ডগলাস টটল ১৯৮৭ সালে টরেন্টো থেকে ‘ফ্রড, ফেমাইন অ্যান্ড ফ্যাসিজম দি ইউক্রেনিয়ান জেনোসাইড মিথ ফ্রম হিটলার টু হার্ভার্ড’ নামে একটি বই প্রকাশ করেন। এই বইটিতে তিনি ধরে ধরে প্রতিটি মিথ্যা তথ্যকেই বিশ্লেষণ করে তাদের স্বরূপ তুলে ধরেন। তিনি দেখান যে, ওই বইতে দুর্ভিক্ষের সাক্ষ্যপ্রমাণ হিসেবে যেসব ছবি ছাপা হয়েছে, সেগুলোরও পর্যন্ত ওই ঘটনার সাথে কোনো যোগাযোগ নেই। অনাহারক্লিষ্ট শিশুদের যেসব ছবি ব্যবহার করা হয়েছে সেগুলো বাস্তবে ১৯২২ সালে তোলা। ওই সময়ে বাস্তবিকই সাম্রাজ্যবাদীদের আক্রমণে বিপর্যস্ত বিপ্লবোত্তর সোভিয়েত ইউনিয়নে কয়েক লক্ষ মানুষের মৃত্যু ঘটেছিল যুদ্ধে ও অনাহারে। কিন্তু এর কারণ কী ছিল? সোভিয়েত কর্তৃপক্ষের ঘাড়ে এর দায় চাপানো কি সতোর পরিচায়ক? ১৯১৮ থেকে ‘২১ সালের মধ্যে সদ্য বিপ্লবোত্তর শিশু সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রটিকে আঁতুড়ঘরেই গলা টিপে মেরে ফেলার উদ্দেশ্যে ১৪টি বিদেশি শক্তি সেদেশের অভ্যন্তরে আগ্রাসন চালায় এবং দেশের অভ্যন্তরে প্রতিবিপ্লবীদের সরাসরি সাহায্য করে গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। এর ফলেই দেশের এক বড় অংশে ওই সময় সত্যি সত্যিই এক খারাপ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।

১৯৩৪ সালের দুর্ভিক্ষের যেসব রিপোর্ট পশ্চিমা সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল, ডগলাস টটল ধরে ধরে তার বইতে সেগুলো বিশ্লেষণ করে দেখান, কীভাবে হার্স্ট প্রেসের প্রত্যক্ষ মদদেই ওই সমস্ত নির্জলা মিথ্যাগুলো জন্ম নিয়েছিল। যেসব সাংবাদিক ওই সময় হার্স্ট প্রেসের তরফ থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নে উপস্থিত থেকে ওইসব সংবাদ ও ছবি পাঠিয়েছিলেন, তাদেরই অন্যতম হলেন টমাস ওয়াকার। তিনি নাকি দীর্ঘদিন ধরেই সোভিয়েত ইউনিয়নে অবস্থান করেন এবং ইউক্রেন ঘুরে ঘুরে সেখানকার ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের খবর সংগ্রহ করেন। ডগলাস টটল দেখান যে বাস্তবে ওয়াকার সারাজীবনের কখনোই ইউক্রেনে যাননি। শুধু তাই নয়, মস্কোতেও তিনি ছিলেন সাকুল্যে মাত্র পাঁচদিন। এই তথ্যটি আসলে ফাঁস করেছিলেন বিখ্যাত সাংবাদিক লুই ফিশার। তিনি ছিলেন আরেকটি মার্কিন সংবাদপত্র ‘দ্য নেশন’-এর মস্কো সংবাদদাতা। এটুকুই শুধু নয়, ফিশার আরও দেখান যে হার্স্ট প্রেসের প্রকৃত মস্কো সংবাদদাতা ছিলেন অন্য আরেক জন, তার নাম এম. প্যারোট। কিন্তু প্যারোট মস্কো থেকে যে সংবাদ বা ছবি পাঠাতেন তা কখনোই ছাপা হতো না। তিনি ওই সময় অর্থাৎ ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দে সোভিয়েত ইউনিয়নে কৃষির ক্ষেত্রে যে বিপুল অগ্রগতি ঘটেছিল তা প্রত্যক্ষ করেছিলেন। ইউক্রেনেও সে সময় কৃষিক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতি হয়েছিল। কিন্তু মিস্টার প্যারোট যতই কৃষি-উন্নয়ন-সংক্রান্ত রিপোর্ট পাঠান না কেন, সেসব ছবি ও রিপোর্ট ছাপার যোগ্য বলেই সেদিন বিবেচনা করা হয়নি। টল আরও প্রমাণ করেন যে, ইউক্রেনে তথাকথিত ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের মিথ্যা ছবি ও রিপোর্টগুলোর উদ্যোক্তা যে টমাস ওয়াকার, তার এই টমাস ওয়াকার নামটিও আসলে ঠিক নয়। তার প্রকৃত নাম হলো রবার্ট গ্রিন। আমেরিকার কলোরাডো রাজ্যের আদালত তাকে একটি ঘটনায় অপরাধী সাব্যস্ত করে ও কারাদণ্ডের নির্দেশ দেয়। সেখানকার রাজ্য কারাগার থেকে তিনি জেল ভেঙে পালান। পরে তিনি আবার দেশে ফিরে গেলে তাকে আবার গ্রেফতার করা হয় এবং মার্কিন আদালতে জেরার মুখে তিনি স্বীকার করতেও বাধ্য হন যে তিনি জীবনে কোনোদিন ইউক্রেনে যাননি। এইভাবে ১৯৮৭ সালে প্রকাশিত ডগলাস টটলের বইতে পরিষ্কারভাবেই প্রমাণ পাওয়া যায়, স্তালিনের সরাসরি নির্দেশে সৃষ্ট ইউক্রেনের ওই তথাকথিত ভয়াবহ দুর্ভিক্ষটি আসলে কী বস্তু! কী মারাত্মক রকমের নির্জলা মিথ্যা কথাকেই এতদিন সত্য বলে চালিয়ে আসা হয়েছে! কিন্তু তারপরও আজকাল এই মিথ্যার চাষ বন্ধ হয়ে গেছে ভাবলে ভুল হবে। একের পর এক নতুন নতুন বইয়ে নিঃসন্দেহে মিথ্যা প্রমাণিত ওই তথ্যগুলোকেই ফের সত্য বলে তুলে ধরা হচ্ছে। আর দক্ষিণপন্থী অগণতান্ত্রিক শক্তির স্বার্থে নীতিহীন এ কাজ করার জন্য এইসব বইয়ের লেখকরাও আর্থিক দিক থেকে যথেষ্ট লাভবান হচ্ছেন।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্তর্গত অনেকগুলো রাজ্যেই সেদিন প্রচারমাধ্যম জগতে হার্স্ট-প্রেসের অবস্থান ছিল অনেকটাই একচেটিয়া। পাশাপাশি তাদের মালিকানাধীন নিউজ এসেন্সিগুলোও সারা পৃথিবীজুড়ে সংবাদ যোগান দেওয়ার কাজ করত। ফলে সব মিলিয়ে নাৎসি গেস্টাপো বাহিনীর মাইক হিসেবে তারা যথেষ্ট যোগ্যতার সাথে কাজ করতে শুরু করে। প্রচারমাধ্যম জগতে তাদের একচেটিয়া আধিপত্যকে কাজে লাগিয়ে নাৎসি মিথ্যাচারকে তারা ডজন ডজন সংবাদপত্র, রেডিও এবং পরবর্তীকালে বিভিন্ন টিভি চ্যানেল থেকে ক্রমাগত প্রচার চালিয়ে ‘সত্য বলে। প্রতিভাত করার চেষ্টা চালিয়েছে। দুনিয়া জুড়ে চলেছে তাদের প্রচার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে এইসব মিথ্যা খবরের উৎস যে নাৎসি গেস্টাপো বাহিনী, তার অবলুপ্তি ঘটল। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে হার্স্ট গোষ্ঠী নিয়ন্ত্রিত প্রচারমাধ্যমের টানা কুৎসা রটনা একদিনের জন্যও ছেদ পড়ল না। এবার তাদের পৃষ্ঠপোষকতার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিল মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা সিআইএ। ফলে মার্কিন প্রচারমাধ্যমে কমিউনিস্ট-বিরোধী প্রচার আগের মতোই পুরোদমে চলতে থাকল।

.

রবার্ট কনকোয়েস্ট, মিথ্যার অন্যতম হাতিয়ার

এবার রবার্ট কনকোয়েস্ট নামক ব্যক্তিটির বিষয়ে একটু মনোযোগ দেওয়া দরকার। পুঁজিবাদী প্রচারমাধ্যম বিভিন্ন ক্ষেত্রে এ সংক্রান্ত লেখায় তাকে উদ্ধৃত করে থাকে। সোভিয়েত ইউনিয়নে লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যুর বিষয়ে যে সমস্ত বইপত্র লেখা হয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম একটি প্রামাণ্য গ্রন্থের রচয়িতা ইনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে সারা বিশ্বজুড়ে সোভিয়েতবিরোধী যেসব কুৎসা নিরন্তর প্রচার করা হয় এর অনেকগুলোরই জন্ম তার হাতে। তার ভয়ংকর কমিউনিজমবিরোধী দুটি বই হলো ‘দ্য গ্রেট টেরর’ (১৯৬৯) ও ‘হারভেস্ট অব সরো’ (১৯৮৬)। মূলত এ বই দুটির জন্যই তিনি বিখ্যাত। এ বইগুলোতে একদিকে যেমন ইউক্রেনের সেই তথাকথিত দুর্ভিক্ষে অনাহারে লক্ষ লক্ষ মানুষের। মৃত্যুর পুরনো মিথ্যাটিকেই নতুনভাবে পরিবেশন করা হয়েছে, অন্যদিকে আবার অভিযোগ আনা হয়েছে যে ১৯৩৬-৩৮ সালে গ্রেট পার্জের সময় শুদ্ধিকরণের। নামেও গুলাগ লেবার ক্যাম্পগুলোতে একইরকম ব্যাপক হত্যাকাণ্ড ও বল্গাহীন অত্যাচার চালানো হয়। এসব লেখার তথ্যগুলো তিনি মার্কিন আশ্রিত দেশত্যাগী ইউক্রেনীয়দের কাছ থেকে সংগ্রহ করেছেন। এই ইউক্রেনীয়রা বেশিরভাগই ছিল সোভিয়েতবিরোধী দক্ষিণপন্থী রাজনীতির সাথে যুক্ত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন এরা দেশদ্রোহিতা করে নাৎসিদের পক্ষ নিয়ে সোভিয়েতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল। পরবর্তীতে, নাৎসিদের পরাজয়ের পর তারাও দেশ থেকে বিতাড়িত হয় ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিকভাবে আশ্রয় লাভ করে। কনকোয়েস্টের বইয়ের অনেক নায়কই বাস্তব জীবনে যুদ্ধাপরাধী বলে গণ্য হয়েছিল। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছিল যে, ১৯৪২ সালে নাৎসি অধিকৃত ইউক্রেনে ইহুদিদের যে ব্যাপকভাবে হত্যা করা হয় তাতে তারা সক্রিয়ভাবেই অংশগ্রহণ করেছিল। এদের মধ্যে একজন হলো মিকোলা লেবেদ। নাৎসি অধিকৃত ইউক্রেনের লভে শহরের প্রধান নিরাপত্তা আধিকারিক ছিল এই ভদ্রলোক। যুদ্ধশেষে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে তার বিচার হয় এবং দোষী প্রমাণিত হওয়ার পর তাকে কারাদণ্ডও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ১৯৪৯ সালে সে জেল ভেঙে পালায় এবং সিআইএ’র সহযোগিতায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে যায়।

১৯৬৯ সালে প্রকাশিত ‘দ্য গ্রেট টেরর’ বইটিতে কনকোয়েস্ট বলেছেন যে ১৯৩২-৩৩ সাল নাগাদ ব্যাপক দুর্ভিক্ষে সারা সোভিয়েত ইউনিয়নে নাকি ৫০ থেকে ৬০ লাখ মানুষের অনাহারে মৃত্যু ঘটেছে। এর মধ্যে অর্ধেক মৃত্যুই নাকি ঘটেছিল ইউক্রেনে। ১৯৮৩ সালে তিনি আবার লেখেন, ওই দুর্ভিক্ষ নাকি চলেছিল ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত। ব্যাপারটা কী দাঁড়াল? এবারে তার হিসাব অনুযায়ী দেখা গেল, মৃত্যুর সংখ্যাও একলাফ দিয়ে বেশ বেড়ে গেছে। এবার তিনি বললেন, ওই দুর্ভিক্ষের শিকার নাকি মোট ১ কোটি ৪০ লক্ষ মানুষ। তা এসব কথার পুরস্কারটাও তিনি অবশ্য ভালোই পেলেন। ১৯৮৬ সালে মার্কিন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সময় তিনি রোনাল্ড রিগানের হয়ে নির্বাচনী প্রচারপত্র লিখে দেওয়ার দায়িত্ব পেলেন।

১৯৮৭ সালের ২৭ জানুয়ারি গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রবন্ধ থেকে জানা যায়, অধ্যাপনার কাজে যোগ দেওয়ার আগে কনকোয়েস্ট ছিলেন ব্রিটিশ গুপ্তচর সংগঠনের ইনফরমাল রিসার্চ ডিপার্টমেন্ট বা আইআরডি’র এজেন্ট। ব্রিটিশ গুপ্তচর সংগঠনের এ বিভাগটি সাধারণত মানুষের কাছে তথ্যবিকৃতি বিভাগ নামেই বেশি পরিচিত। (ইরাক যুদ্ধের অজুহাত তৈরিতে ব্রিটিশ গোয়েন্দা বিভাগের মিথ্যাচারের ইতিহাস বর্তমানে সবাই জানে)। ১৯৪৭ সালে বিভাগটি প্রথম তৈরি হয়। সে সময় অবশ্য এর নাম ছিল কমিউনিস্ট ইনফরমেশন ব্যুরো। তখন এর প্রধান কাজই ছিল ওই সময় বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়তে থাকা কমিউনিজমের প্রভাবকে যে-কোনো মূল্যে আটকানো। এ উদ্দেশ্যে তারা নানা রকম বানানো গল্প ছাড়তে শুরু করে ও নানাভাবে সেগুলোকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলে এবং এর সাহায্যে মূলত বিভিন্ন দেশের রাজনীতিক, সাংবাদিক ও গুরুত্বপূর্ণ বুদ্ধিজীবী মহলকে প্রভাবিত করার চেষ্টা শুরু করে। এসব মানুষদের প্রথমে প্রভাবিত করে, তারপর তাদের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মনোভাবকেও বিশ্বসাম্যবাদী আন্দোলনের বিরুদ্ধে চালিত করা। উদ্দেশ্য যে খুবই মহৎ তা নিয়ে সন্দেহ কী!

আইআরডি’র কাজকর্ম কিন্তু শুধু গ্রেট ব্রিটেনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। বিদেশের মাটিতেও এদের লোকজন নানা রকমের কুৎসা ছড়ানো এবং আরও নানা ধরনের দুষ্কর্মের সাথে যুক্ত ছিল। ১৯৭৭ সাল নাগাদ যখন আইআরডি’র কীর্তিকলাপ সংবাদমাধ্যমে ফাঁস হয়ে যায়, দেখা যায় সারা ব্রিটেন জুড়ে ১০০ জনেরও বেশি বিখ্যাত সাংবাদিক তাদের সাথে যুক্ত। এই সাংবাদিকরা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়, ম্যাগাজিনে যে সমস্ত প্রবন্ধ লিখতেন তার জন্য প্রয়োজনীয় যাবতীয় তথ্য তারা ওই আইআরডি’র কাছ থেকেই নিয়মিতভাবে পেতেন। বিভিন্ন নামকরা ব্রিটিশ সংবাদপত্রেই এসব সাংবাদিকদের লেখা নিয়মিত বেরুত। এসব সংবাদপত্রের মধ্যে এমনকি ‘ফিনান্সিয়াল টাইমস’, ‘দ্য টাইমস’, ‘ইকনমিস্ট’, ‘ডেইলি মেল’, ‘ডেইলি মিরর’, ‘দ্য এক্সপ্রেস’ বা ‘দ্য গার্ডিয়ান’-এর মতো নামজাদা ও বনেদি কাগজও রয়েছে। ফলে ‘দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য থেকে ভালোমতোই বোঝা যায়, কীভাবে সিক্রেট সার্ভিসের এসব কার্যকলাপ বাস্তবে জনমতকে প্রভাবিত করার উদ্দেশ্যেই পরিচালিত করা হচ্ছিল এবং এক্ষেত্রে তারা কী পরিমাণ সাফল্যও অর্জন করতে সমর্থ হয়েছিল।

১৯৪৭ সালে যখন আইআরডি প্রথম তৈরি করা হয়, সে সময় থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত রবার্ট কনকোয়েস্ট এ সংগঠনের সাথেই যুক্ত ছিলেন। সেই সময় কনকোয়েস্টের মূল কাজই ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের তথাকথিত ‘কালো’ ইতিহাসের নামে নানারকম রুদ্ধশ্বাস গাল-গল্প তৈরি করা। এ গল্পগুলোই এরপরে ‘সত্য’ বলে দাবি করা হতো এবং নানা প্রভাবশালী ব্যক্তি ও সাংবাদিকদের হাত করে তাদের মাধ্যমে সংবাদপত্রে রিপোর্ট বা প্রবন্ধের আকারে পরিবেশন করা হতো। এইভাবে তারা সহজেই জনমতকে অনেকটা প্রভাবিত করতে সমর্থও হয়েছিল। পরবর্তীকালে তিনি যখন সরকারিভাবে আইআরডি ছেড়ে চলে যান তারপরও তিনি আইআরডি’র নির্দেশন মতোই বই লেখা চালাতে থাকেন। বলাই বাহুল্য, সেক্ষেত্রেও তথ্যের জন্য তিনি ওই গুপ্তচর সংস্থার যোগানো খবরের ওপরই নির্ভর করতেন। ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত ‘দ্য গ্রেট টেরর’ বইটি বাস্তবে আইআরডি’র হয়ে কাজ করার সময়ে তার রচিত বিভিন্ন গল্পকথারই পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত সংস্করণ। বইটি লেখার সময় ও প্রকাশ করার ক্ষেত্রেও আইআরডি থেকে তাকে সাহায্য করা হয়। শুধু তাই নয়, সেদিনকার সোভিয়েত ইউনিয়নে চলতে থাকা শ্রেণিসংগ্রামের ওপর চরমতম দক্ষিণপন্থি দিক থেকে আলোকপাত করা এই বইটির স্বত্বের এক-তৃতীয়াংশই কিনে নেয় প্রেজার প্রেস। এই প্রেজার প্রেসের অন্য একটি পরিচয়ও আছে। সিআইএ’র মদদে ও তাদের যোগানো তথ্যের ওপর ভিত্তি করে যে সমস্ত বই ছাপা হতো, তাদের অনেকগুলোর ক্ষেত্রেই সাধারণত অ্যাসোসিয়েট প্রেসের দায়িত্ব বর্তাত এদেরই উপর।

.

রাশিয়ার গবেষণা কি নির্দেশ করছে?

রাশিয়ার প্রতিষ্ঠিত গবেষণা সংস্থার রিপোর্টটি ৯ হাজার পৃষ্ঠার! এই বিশাল কর্মযজ্ঞের রচনাকারী অনেকেই, কিন্তু তাদের অন্যতম হলেন রাশিয়ার ইতিহাসবিদ ভি.এন. জেমসকভ, এ.এন. ডাওগিন এবং ও. ভি. জেলভিঝিনিক। তারা কাজ শুরু করেন ১৯৯০ সালে, এবং ১৯৯৩ সালে প্রায় পুরো প্রকাশনার কাজটি শেষ করেন। এই রিপোর্ট দেখায় পশ্চিমা ষড়যন্ত্র এবং সেই ষড়যন্ত্রে নিয়োজিত পশ্চিমা দেশগুলোর নাম।

যে দুজন গবেষক একই রকম কাজ করছিলেন তাদের একজন ফরাসি জার্নাল ‘Histoire in September ১৯৯৩ এ কাজ করেছেন। যেটি লিখেছিলেন ফরাসি বৈজ্ঞানিক রিসার্স সেন্টারের (CNRS) প্রধান নিকোলাস ইউয়ার্থ, এবং গবেষণাটি প্রকাশিত হয় আমেরিকান জার্নাল ‘আমেরিকান হিস্টোরিক্যাল রিভিউ’তে, অধ্যাপক জে আর্চ গেটটি’র তত্ত্বাবধানে।

এই গবেষণা যেন কোনো প্রকার সন্দেহ দেখা না দেয় সে জন্য খুব সতর্ক ছিলেন তৃতীয় গবেষক ভি.এন. জেমসকভ! তিনি বলেন- আমি একটা বিষয়ে পরিষ্কার থাকতে চাই কারণ এই গবেষণায় যে বৈজ্ঞানিকদের অংশগ্রহণ ছিল তারা পুঁজিবাদী দেশের নাগরিক এবং বুর্জোয়া ধ্যান-ধারণা সম্পন্ন।

এটা নিশ্চিত যে পাঠক ধারণা করতে পারবেন না যে কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্রের আউটবাস্ট কেমন হতে পারে? এটা সহজেই অনুমান করা যায় এই তিন গবেষক যখন কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্রকারী কনকোয়েস্ট, সোলঝিনিৎসিন, মেদভেদেভ এবং অন্যান্যদের জনসম্মুখে উন্মুক্ত করেন। তবে তাতেও তাদের তেমন কিছু যায় আসেনি, কারণ তারা ছিলেন প্রফেশনালি প্রপাগাণ্ডাভিস্ট।

এই গবেষণার ফলাফল সোভিয়েত বিচার ব্যবস্থা নিয়ে বিশাল বিশাল প্রশ্নের উত্তর তৈরি করেছিল। এখনকার সময়ের জন্য আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ কারণ এখন গ্রেটেস্ট স্তালিন যুগের বিষয়ে খোঁজ খবর করা হচ্ছে এবং ধুন্ধুমার বিতর্ক করার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে রসদও পাওয়া গেছে। এবার সেই সব ব্যাপ্ত প্রশ্নগুলোকে। সংক্ষিপ্ত করে তার উত্তর IHistoire জার্নালে কীভাবে লিপিবদ্ধ হয়েছে তার দেখা মিলবে। এই প্রশ্ন এবং তার উত্তর সোভিয়েত বিচার ব্যবস্থা বোঝার জন্য সাহায্য করবে।

১। সোভিয়েত বিচার ব্যবস্তা কীভাবে গঠিত হয়েছিল?

২। রাজনৈতিক এবং অরাজনৈতিক কতজন বন্দী ছিল?

৩। শ্রম শিবিরে কতজন মানুষ মারা গিয়েছিল?

৪। ১৯৫৩ সালের আগে কতজন মানুষ যাবজ্জীবন কারাভোগ করেছিল, বিশেষ করে ১৯৩৭-১৯৩৮ সালে?

৫। কারাভোগকারীদের গড় কারাদণ্ড কতদিন ছিল?

এই পাঁচটি প্রশ্নের উত্তরের পরে আলোচনায় আসবে আলোচিত দুটি গ্রুপ যথা, দোষী সাব্যস্ত কুলাক এবং দোষী সাব্যস্ত প্রতিবিপ্লবীদের বিষয়, যারা ১৯৩৬ থেকে ১৯৩৭ সালের মধ্যে বন্দী শিবিরে ছিলেন।

.

বিচার ব্যবস্থার শ্রম শিবিরগুলো

প্রশ্ন এবং প্রশ্নোত্তর দিয়ে সোভিয়েত বিচার ব্যস্থার ধরণ নিরূপণ শুরু করা যেতে পারে । ১৯৩০ সালের পর গুলাগের বন্দী, শ্রম শিবির, শ্রমিক কলোনি সোভিয়েত বিচার ব্যবস্থার অধীনে আনা হয় এবং বিশেষ করে জরিমানা আদায়ের জন্য বিশেষ জোন খোলা হয় তাদের জন্য যারা রিমান্ডের আওতায় ছিলেন। তাদের অপরাধগুলো সাধারণ অপরাধ বিবেচনা করে সামান্য কিছু জরিমানা করেই অনেককে মুক্তি দেয়া হয়েছিল। আর যারা তদন্তে নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছিলেন। তাদেরকে সঙ্গে সঙ্গেই ছেড়ে দেয়া হয়েছিল। এমনও ঘটেছে যে একজন দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তি ট্রায়ালে নির্দোষ প্রমাণিত হলে বেকসুর খালাস পেয়েছে, এবং দোষী সাব্যস্ত হলে জরিমানা দিয়ে পরিত্রাণ পেয়েছে। আর যারা দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন তারা প্রধানত বিচারের সম্মুখীন হয়েছেন, এবং কখনো কখনো মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন। জরিমানা করা হতো সাধারণত তাদের মজুরির ওপর ভিত্তি করে।

গুলাগ শ্রম শিবিরে তাদেরই পাঠানো হতো যারা গুরুতর অপরাধ (ধর্ষণ, ডাকাতি, নরহত্যা, রাষ্ট্রীয় ধন-সম্পদ তসরুপ ইত্যাদি) করতেন। এদের একটি বড় অংশই ছিল প্রতিবিপ্লবী। অন্যান্য অপরাধীদের সাধারণত ৩ বছরের শ্রম শিবিরে সশ্রম কারাদণ্ড হতো। ওই শ্রম শিবিরে কিছু দিন শাস্তি ভোগ করার পর তাদেরকে স্পেশাল ওপেন জোন-এ শ্রমিক কলোনিতে পাঠানো হতো।

শ্ৰম শিবিরগুলো ছিল বিশাল এবং ব্যাপ্ত, যেখানে বন্দীরা নিবিড় নজরদারিতে কাজ করতেন এবং বসবাস করতেন। তারা যেন নিজেদেরকে সমাজের বোঝা মনে না করেন সে জন্যই এই ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থায় কোনো সুস্থ ব্যক্তি কাজ না করে পারতেন না। এটা ঠিক যে এখনকার জনগণ মনে করতেই পারেন সেই সময়কার ওই দিনগুলো ছিল ভয়াবহ! কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে তার চেয়ে ভালো বিচারিক ব্যবস্থা সে সময় প্রতিষ্ঠা করা যায়নি। ১৯৪০ সালে মাত্র ৫৩ টি ‘গুলাগের’ অস্তিত্ব ছিল।

অথচ গুলাগ শ্রমিক কলোনি ছিল ৪শো ২৫টি। সেগুলো তুলনামূলকভাবে গুলাগ শ্রম শিবিরের চেয়ে ছোট ছিল এবং নজরদারিহীন ছিল। ওই শ্রমিক কলোনির বন্দীরা স্বাভাবিক সমাজের মানুষের মতোই মুক্ত স্বাধীনঘোরা ফেরা এবং নিজের পছন্দমত কারখানায় কাজের সুযোগ পেতেন। তারা যে অর্থ আয় করতেন তা একেবারে ‘মুক্ত’ অন্য যে কোনো শ্রমিকের আয়ের সমান।

‘বিশেষ উন্মুক্ত এলাকা’ সাধারণত তাদের জন্য ছিল কৃষি এলাকা এবং যৌথখামার, যারা ছিলেন নির্বাসিত যেমন কুলাকরা। অন্য যারা ছোটখাটো অপরাধে দোষী সাব্যস্ত ছিল তারাও ওই বিশেষ উন্মুক্ত এলাকায় কাজের সুযোগ পেতেন।

.

৪ লাখ ৫৪ হাজার কি ৯০ লাখ?

দ্বিতীয় প্রশ্নটি সন্দিগ্ধ করে তোলে, সেখানে কতজন রাজনৈতিক বন্দী ছিলেন আর কতজনই বা সাধারণ বন্দী। এই প্রশ্নটি আরও নির্দিষ্ট করে দেয় যে যে সকল বন্দী সেখানে ছিলেন তাদের অধিকাংশই পূর্ণ অথবা আধা স্বাধীনতা ভোগ করতেন। আর আমেরিকান হিস্টোরিক্যাল রিভিউতে বর্ণিত তথ্য যা ২০ বছরের পুরনো, এবং সেই সময়ে তৈরি করা যখন রাশিয়ার বিচার ব্যবস্থা একটি কেন্দ্রীয় পরিচালনা পর্ষদের অধীনে পরিচালিত হতো, আর সেটা ১৯৫৩ পর্যন্ত, যে বছর স্তালিন মারা গেলেন!

.

আমেরিকান হিস্টোরিক্যাল রিভিউ-এর ছক

সোভিয়েত ইউনিয়নের কারা হেফাজতে অবস্থানরত জনসংখ্যা ১৯৩৪-১৯৫৩

Table– The American Historical Review
USSR Custodial Population 1934-1953

সোভিয়েত ইউনিয়নের কারা হেফাজতে অবস্থানরত জনসংখ্যা ১৯৩৪-১৯৫৩

উপরের ছক থেকে বিস্ময়কর কিংবা ভয়ংকর উপসংহার টানা যায়। এবং সেই উপসংহার দিয়ে রবার্ট কনকোয়েস্টের তথ্যের সঙ্গে টালি করা যায় যেখানে কনকোয়েস্টের উর্বর মস্তিষ্ক ১৯৩৯ সালে ৯ মিলিয়ন অর্থাৎ ৯০ লাখ বন্দীর কথা এবং লেবার ক্যম্পে ৩ মিলিয়ন বা ৩০ লাখ মানুষের মৃত্যুর তথ্য আবিষ্কার করে! যারা নাকি ১৯৩৭ থেকে ১৯৩৯ সালের মধ্যে মারা গিয়েছিল!

পাঠককে এটা ভুলে গেলে চলবে না যে কনকোয়েস্ট যাদের কথা বলেছিলেন তারা সকলেই ছিলেন রাজনৈতিক বন্দী, এ ছাড়াও নাকি বিরাট সংখ্যক অরাজনৈতিক মানুষও সে সময় বন্দী শিবিরে ছিলেন। ১২ মিলিয়ন বা ১ কোটি ২০ লাখ রাজনৈতিক বন্দী! যে সংখ্যাটির সত্যতা কোনো দূরবর্তী কল্পনাতেও আনা অসম্ভব! ১৯৩৯ সালে বন্দী শিবির, ক্যাম্প, বন্দী কলোনি মিলিয়ে মোটের উপর ২ মিলিয়ন বা ২০ লাখ বন্দীর হিসেব পাওয়া যায়। যার মধ্যে ৪ লাখ ৫৪ হাজার রাজনৈতিক অপরাধী ছিলেন, কোনোভাবেও কনকোয়েস্টের অনুমাননির্ভর ৯০ লাখ নয়। ১৯৩৭ থেকে ১৯৩৯ সালের মধ্যে যাদের মৃত্যু হয়েছিল সেই সংখ্যাটি ছিল ১ লাখ ৬০ হাজার, কনকোয়েস্ট দাবিকৃত ৩০ লাখ নয়! ১৯৫০ সালের হিসেবে শ্রম শিবিরে রাজনৈতিক বন্দী ছিল ৫ লাখ ৭৮ হাজার, ১২ মিলিয়ন বা ১ কোটি ২০ লাখ নয়। পাঠককে এটা ভুলে গেলে চলবে না যে রবার্ট কনকোয়েস্ট সোর্স ছিল কমিউনিস্টবিরোধী উগ্র ডানপন্থী অপপ্রচারকারীরা। এই সকল ডানপন্থী ছদ্ম এবং ভুয়া বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে রবার্ট কনকোয়েস্ট ছিলেন ‘দেবতুল্য ব্যক্তিত্ব। যে ‘দেবতুল্য ব্যক্তি আলেকজান্ডার সসালঝেনিৎসিনের মাধ্যমে ‘চিট’ হয়েছিলেন এবং শ্রম শিবিরে ৬০ মিলিয়ন বা ৬ কোটি মানুষের মৃত্যুর কল্পকাহিনি ফেঁদে বসেছিলেন। এই দুরভিসন্ধীমূলক অপপ্রচারের বিরুদ্ধে বলার কিছু নেই। এটা এখন স্পষ্ট যে সেগুলো ছিল কয়েকজন অসুস্থ এবং বিকৃত মনের মানুষের সঙ্গবদ্ধ অপপ্রচার এবং কুৎসা।

.

ঘরের এবং বাইরের হুমকি

সোভিয়েত ইউনিয়ন এমনই একটা দেশ ছিল যারা সদ্য সামন্তবাদকে ছুঁড়ে ফেলেছে, তার পরও সেই সামন্তবাদের সামাজিক মূল্যবোধ তখনো সমাজের কাঁধে বোঝা হয়ে টিকে রয়েছে। যদিও জনগণের ভেতরে প্রচণ্ড দেশাত্মবোধ কাজ করছিল তার পরও শ্রমজীবী মানুষরা চরম দারিদ্র্যে বসবাস করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। স্বভাবতই মানব জীবন কিছু পরিমাণে হলেও মানবিকতা চায়। অপরদিকে ডাকাতি এবং সন্ত্রাসবাদ দমন করা হচ্ছিল অবিশ্রান্তভাবে। পাশাপাশি প্রাচীন ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ একভাবে ম্যাসাকার প্রতিরোধ করছিল। এইরকম একটি অনিশ্চিত পরিস্থিতি যার সহসা কোনো পরিবর্তন সম্ভব নয় সে সময় সমাজের অভ্যন্তরেই অপরাধ প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার জন্য উপাদান পেয়ে যায়।

অন্য আরেকটি বিষয় ছিল বৈদেশিক আক্রমণের ভয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের ১৬ থেকে ১৭ কোটি মানুষ ভয়ংকরভাবে বৈদেশিক শক্তির আক্রমণের মুখে ছিল। যার ফলে ইয়োরোপে বিরাট রাজনৈতিক পরিবর্তন হতে পেরেছিল ওই ১৯৩০ সালে। সে সময় সোভিয়েতের জন্য অন্যতম ভীতির কারণ হয়ে উঠেছিল জার্মান নাজি। যাদের ভয়ে খেটে খাওয়া মানুষগুলো আতঙ্কে থাকত। সেই আতঙ্কটা আরও ভয়াবহ হয়ে ওঠে পশ্চিমা ব্লকের আগ্রাসনবাদী উচ্চাভিলাষী মনবাঞ্ছায়।

এই পরিস্থিতিকে স্তালিন সাধারণভাবে সংকলিত করেন এভাবে- “আমরা উন্নত দেশগুলো থেকে ৫০-১০০ বছর পিছিয়ে আছি। আমাদেরকে এই ‘দূরত্ব’ কমিয়ে ১০ বছরে আনতে হবে । হয় আমাদেরকে সেটা করতে হবে, অথবা আমরা ধুয়ে-মুছে সাফ হয়ে যাব। ১০ বছর পরে ২২ জুন ১৯৪১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন জার্মান নাজি বাহিনী এবং তাদের মিত্রশক্তি দ্বারা আক্রান্ত হয়। সোভিয়েত সমাজ ১৯৩০ থেকে ১৯৪০ পর্যন্ত দশকজুড়ে যে মহান উদ্যোগ গ্রহণ করে তার সবটুকু তারা নিয়োগ করে আগ্রাসী জার্মান নাজি আক্রমণ ঠেকানোর কাজে। সেটা সম্ভব হয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের মানুষের সৃজনশীলতার কারণে। তারা ব্যক্তি স্বার্থের কথা ভুলে দিনে ৭ ঘণ্টার বদলে সারা দিন কাজ করেছে বৃহত্তর কল্যাণের কথা চিন্তা করে। এইরকম জটিল পরিস্থিতিতেও দুই দশক ধরে এবং ভয়াবহ যুদ্ধের মধ্যেও সোভিয়েত সমাজের নির্মাণ বন্ধ থাকেনি, বরং আরও সৃজনশীল হয়েছে, যদিও ওই যুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের ২ কোটি ৫০ লাখ মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে। সমগ্র দেশের প্রায় অর্ধেকটা জ্বলে পুড়ে খাক হয়েছে। তার পরও সোভিয়েত ইউনিয়নের মানুষ অবদমিত হয়নি। পরাজিত হতে শেখেনি। তাদের বীরত্ব পরবর্তী প্রজন্মকে উদ্বেলিত করেছে।

এই রকম জটিল এবং কঠিন সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন পঁচিশ লাখ মানুষকে বন্দী রাখে! যে অংকটা দেশের মোট পূর্ণবয়স্ক জনসংখ্যার ২.৪%? কীভাবে এর ব্যাখ্যা পাওয়া যায়? এটা কি বিপুল সংখ্যক নয়? নাকি ক্ষুদ্রতর? তুলনা করে দেখা যেতে পারে।

.

অনেক বেশি বন্দী আমেরিকাতে!

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটা উদাহরণ দেখা যাক। ১৯৯৬ সালের তথ্য অনুযায়ী দেশটির জনসংখ্যা ২৫ কোটি ২০ লক্ষ। বিশ্বের সব চেয়ে ধনী দেশ যারা বিশ্বের মোট সম্পদের প্রায় ৬০ ভাগ উপভোগ করে। সেই দেশের কত মানুষ কারাগারে বন্দী আছে? কী তাদের পারিপার্শ্বিক অবস্থা? সামাজিক অসন্তোষ নেই, বৈদেশিক আক্রমণের ভয় নেই, এমনকি অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তাও নেই। সেই দেশের কারাগারে কতজন বন্দী?

১৯৯৭ সালের আগস্ট মাসের একটি সংবাদপত্রের ছোট্ট খবরে দৃষ্টি দেয়া যাক। এপি নিউজ এজেন্সি জানাচ্ছে ১৯৯৬ সালে আমেরিকাতে সমসাময়িক সময়ে সব চেয়ে বেশি বন্দী কারাগারে ছিল যা আগে কখনো ছিল না। কত সেই সংখ্যাটি? ৫.৫ মিলিয়ন বা ৫৫ লক্ষ মানুষ কয়েদি! তার মানে এই পরিমাণ মানুষ আমেরিকার সমাজে অপরাধী যা তাদের মোট পূর্ণবয়স্ক জনসংখ্যার ২.৮% এই তথ্যভাণ্ডারটি উত্তর আমেরিকান বিচার বিভাগের সকলের কাছেই ছিল বা রয়েছে।

5215 a : Bureau of Justice Statistics Home page, http://www.ojp.usdoj.gov/bjs/). দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি বা কয়েদিদের এই সংখ্যা সোভিয়েত ইউনিয়নের মোট সংখ্যার চেয়ে ৩০ লক্ষ বেশি! যেখানে সোভিয়েতে পূর্ণবয়স্ক জনসাধারণের ২.৪% অপরাধী হিসেবে কারাগারে বন্দী, সেখানে ১৮ জানুয়ারি ১৯৯৮ তে ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিস-এর প্রেস রিলিজে দণ্ডপ্রাপ্ত কয়েদির সংখ্যা জানানো হয় ৯৬ হাজার ১ শশা!

যতদূর জানা যায় সোভিয়েত শ্রম শিবির বিষয়ে সে সময়কার শাসকরা জ্ঞাত ছিলেন, এবং এটাও সত্যি যে শাসকরা বন্দীদের জন্য কড়া এবং দুর্বোধ্য ছিলেন, কিন্তু আমেরিকার পরিস্থিতি কী? আজকে আমেরিকাতে লক্ষ লক্ষ মানুষ সন্ত্রাস, মাদক, বেশ্যবৃত্তি এবং যৌন হয়রানির শিকার (এক বছরে ২ লক্ষ ৯০ হাজার ধর্ষণ হয়েছে আমেরিকার বন্দীদের মধ্যে!) অথচ আজকে ঠিক এই সময়ে। আমেরিকানরা অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে ধনী।

.

একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটক ওষুধপত্রের ঘাটতি

এবার তৃতীয় প্রশ্নের উত্তরে কী পাওয়া যায় দেখা যাক। লেবার ক্যাম্পে কত লোক মারা গিয়েছিল? বছরে বছরে যে মৃতের সংখ্যা ওঠা-নামা করেছিল! ১৯৩৪ সালে ৫.২% থেকে ১৯৫৩ সালে ০.৩%! শ্ৰম শিবিরের বন্দীদের মৃত্যুর অনেক কারণের অন্যতম কারণ ছিল প্রয়োজনীয় রসদের মওজুদ পর্যাপ্ত না থাকা, বিশেষ করে জীবনরক্ষাকারী ওষুধপত্রের যোগান, মওজুদ এবং বিতরণের অবস্থা ছিল করুণ। এমনকি মহামারী ঠেকানোর জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধও কখনো কখনো থাকত না। ওই সমস্যাটি কেবলমাত্র শ্রম শিবিরের সমস্যা ছিল ব্যাপারটা তেমন নয়, ওটা ছিল গোটা সমাজের এবং দেশের পরিস্থিতি। পাশাপাশি সে সময়কার বিশ্ব ব্যবস্থাটাই ওরকম ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এক সময় অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কার এবং এর সাধারণ ব্যবহার শুরু হলে বিরাট পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে। সত্যি বলতে কি ওই সময় যে চারটি বছর ছিল জার্মান নাজি নিপীড়নের বছর, সে সময় সোভিয়েত জনগণ কষ্টকর জীবন যাপন করেছে। রোগে শোকে ভুগে মরেছে। সেই ‘কুখ্যাত’ চার বছরে সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রায় পাঁচ লাখের উপর মানুষ মারা গেছেন, যা ২০ বছরে মোট মৃত্যুর অর্ধেক!

তবে একথা ভুলে গেলে চলবেনা যে যুদ্ধের বছরগুলোতে শ্রম শিবিরের বাইরের ২ কোটি ৫০ লক্ষ ‘মুক্ত’ মানুষ মৃত্যুবরণ করেছিল। ১৯৫০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার চালু হলে বন্দী শিবির বা শ্রম শিবিরগুলোতে মৃতের সংখ্যা কমে এসেছিল ০.৩% এ!

এবার চার নম্বর প্রশ্নের দিকে নজর দেয়া যাক। ১৯৫৩ সাল নাগাদ কত জন মানুষকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছিল? বিশেষ করে উত্তাল ঝাবিক্ষুব্ধ ১৯৩০ থেকে ১৯৫৩ পর্যন্ত? ইতোমধ্যেই জানা গেছে বিদ্বেষবিশারদ’ রবার্ট কনকোয়েস্টের দাবি অনুসারে ১৯৩৭ থেকে ১৯৩৮ সালের মধ্যে বলশেভিকরা শ্রম শিবিরে ১ কোটি ২০ লক্ষ রাজনৈতিক বন্দীকে হত্যা করে! সোলঝেনিৎসিনের সংখ্যাটি মিলিয়ন মিলিয়ন! তার মতে কেবলমাত্র ১৯৩৭ থেকে ১৯৩৮ এই এক বছরেই ৩০ লক্ষ বন্দীকে হত্যা করা হয়েছিল। এমনকি সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে এরকম নোংরা প্রচারণাও ছিল। রাশিয়ান ওলগা সাতুনোভোস্কায়াও ১৯৩৭-১৯৩৮ এক বছরে ৭০ লাখ মৃতের উপমা দিতে থাকেন!

যাইহোক, সোভিয়েত আর্কাইভের উদ্ধারকৃত দলিল দস্তাবেজ অন্য গল্পের আভাস দেয়। এটা উল্লেখ করা জরুরি যে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের এই সংখ্যা নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মতামত অন্য গবেষকদের আর্কাইভ থেকে জানা যায়। নিহতের সংখ্যা নিয়ে একেক ধরনের আর্কাইভ থেকে একেক ধরনের তথ্য পুরো বিষয়টিকে গোলমেলে করে দিয়েছিল। সেই সব অংক ভিন্ন সূত্র থেকে যাচাই না হওয়ায় প্রথম থেকেই বিভ্রান্তি রয়েই যায়।

ইয়েলেৎসিন পুরনো সোভিয়েত আর্কাইভের দায়িত্বে যাকে বসান সেই দিমিত্রি ভলকোগোনভের মতে ১ অক্টোবর ১৯৩৬ থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত ৩০ হাজার ৫ শত ১৪ ব্যক্তিকে সামরিক ট্রাইব্যুনালে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল। আবার গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবি ১৯৯০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায় ১৯৩০ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত সেই ২৩ বছরে মোট ৭ লাখ ৮৬ হাজার আটানব্বইজন মানুষকে বিপ্লবের বিরুদ্ধাচারণের জন্য দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছিল।

কেজিবি বর্ণিত সেই দণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে ৬ লাখ ৮১ হাজার ৬৯২ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিল ১৯৩৭ থেকে ১৯৩৮ সালের মধ্যে। এখন আর কেজিবি’র এই তথ্য ক্রসচেক করার উপায় নেই, তবে তথ্যটি যে যথেষ্ট সন্দেহের উদ্রেগ করে তাতে কোনো সন্দেহ নেই, কারণ খুব বেশি মানুষকে এটা বিশ্বাস করানো যাবে না যে মাত্র এক-দেড় বছরে এতগুলো মানুষের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল!

বরং এটাই বিশ্বাসযোগ্য যে এখনকার প্রো-ক্যাপিটালিস্ট কেজিবি আমাদেরকে প্রো-সোস্যালিস্ট কেজিবি’র হয়ে সঠিক তথ্য দিতে পারে। সেক্ষেত্রে আরেকটি সম্ভাবনা উদয় হয় যে তাহলে কোন কেজিবি মিথ্যে? কেননা প্রো ক্যাপিটালিস্ট কেজিবি’র কাছে বিপুব বিরোধিতাকারী অপরাধী আর সাধারণ অপরাধীর মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকার কথা নয়। আবার প্রো-সোস্যালিস্ট কেজিবি’র কাছে সাধারণ অপরাধীদের চেয়ে বিপ্লববিরোধীদের অপরাধের মাত্রা বেশি ছিল। তাই এই দুই আমলের কেজিবি’র তথ্যগুলো ক্রসচেক করার সুযোগ থাকলেও তা যথাযথ হতো বলেও সন্দেহ থেকে যায়। আর আজকের দিনে এই দুই পক্ষের কাছেই দুই ধরনের অপরাধী গড়পড়তা একই রকম।

এই সামগ্রিক বিষয়ে আমরা এই মর্মে উপসংহার টানতে পারি যে ১৯৩৭ থেকে ১৯৩৮ পর্যন্ত মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হওয়া মানুষের সংখ্যা মোটামুটি ১ লাখের মতো, কোনোভাবেও পশ্চিমা অপপ্রচারের মিলিয়ন মিলিয়ন নয়।

অধিকন্তু এটাও ভেবে নেয়া জরুরি যে সকল মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের দণ্ড সোভিয়েত ইউনিয়নে কার্যকর করা হয়েছিল। শ্রম শিবিরে বিরাট সংখ্যক মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধীদের শাস্তি লঘু এবং মওকুফ করা হয়েছিল। এটাও পার্থক্য করা গুরুত্বপূর্ণ যে কারা সাধারণ কয়েদি ছিল, আর কারা প্রতিবিপ্লবী ছিল। তাদের অনেককেই মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিল বীভৎস্য সন্ত্রাস, রাহাজানি, খুন আর ধর্ষণের মতো অপরাধের কারণে। ৬০ বছর আগে এই ধরনের অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ড বলবৎ ছিল বিরাট সংখ্যক দেশে।

প্রশ্ন নম্বর পাঁচ : কারাভোগকারীদের গড় কারাদণ্ড কতদিন ছিল? কারাভোগের সময়-কাল পশ্চিমা নোংরা গুজব আর অপপ্রচারের অন্যতম অনুঘটক। স্বাভাবিক পরোক্ষ ইঙ্গিত এমন ছিল যে সোভিয়েত ইউনিয়ন তার বন্দীদের অযুত অযুত কাল কারাগারে রেখেছিল! বন্দীদের কেউই কোনো দিন কারাগারের বাইরে বেরুতে পারেনি! এসব সম্পূর্ণ মিথ্যাচার। বরং ব্যাপক সংখ্যক কয়েদি স্ক্যালিনের সময়ে সর্বোচ্চ ৫ বছর কারাভোগ করেছে।

আমেরিকান হিস্টোরিক্যাল রিভিউ যেন পরিসংখ্যানের পুনঃজন্ম দেয়! তারা জানায় ১৯৩৬ সালে রাশিয়ান ফেডারেশনের সাধারণ অপরাধীদের কারাভোগের সময়-কাল এইরকম : ৫ বছর পর্যন্ত কারাভোগ ৮২.৪%, ৫ থেকে ১০ বছর পর্যন্ত কারাভোগ ১৭.৬% এবং ১৯৩৭ সালের আগ পর্যন্ত ১০ বছরই ছিল সর্বোচ্চ কারাভোগের কাল। সোভিয়েত ইউনিয়নের বেসামরিক আদালতে ১৯৩৭ সালে রাজনৈতিক বন্দীদের কারাভোগের মেয়াদ ছিল এরকম : ৫ বছর পর্যন্ত ৪৪.২%, ৫ থেকে ১০ বছরের মধ্যে ৫০.৭% এবং এসবই সেই ‘গুলাগ’ এর সময়কালে ঘটিত, যাকে বলা হতো দীর্ঘতম কারাবাসের কাল। ১৯৪০ সালের পরিসংখ্যান দেখায় যে ৫ বছর পর্যন্ত ৫৬.৮%, ৫ থেকে ১০ বছর পর্যন্ত ৪২.২% এবং মাত্র ১% কারাবাস করেছিল সর্বোচ্চ ১০ বছর।

সোভিয়েত কোর্টের মাধ্যমে ১৯৩৯ সালের যে পরিসংখ্যান আমরা পাই। তাতে দেখা যায় ৫ বছর পর্যন্ত কারাবাস ৯৫.৯%, ৫ থেকে ১০ বছর পর্যন্ত ৪% এবং ১০ বছরের বেশি মাত্র ০.১%।

এ থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি সোভিয়েত ইউনিয়নের কারাগারে ‘অনন্ত কালের’ যে মিথ’ পশ্চিমারা তৈরি করেছিল তার উদ্দেশ্যই ছিল সমাজতন্ত্রকে কুপোকাত করা ।

.

সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্পর্কে মিথ্যাচার
গবেষণা প্রতিবেদনের সংক্ষিপ্ত আলোচনা গবেষণা

পরিচালনাকারী রাশিয়ার ইতিহাসবিদরা সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের এক বাস্তবতা তুলে ধরেন। সেই বাস্তবতা হলো পুঁজিবাদী বিশ্বের স্কুল এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ঠান্ডা যুদ্ধের গত ৫০ বছর ধরে সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্পর্কে মিথ্যচার শেখানো হয়েছে, যার প্রভাব বহু মানুষের মধ্যে স্থায়ীভাবে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে।

পুঁজিবাদী রাজনৈতিক অপপ্রচার সব সময় প্রচার করত সোভিয়েত শ্রম শিবিরের বন্দীরা ছিল নিরীহ এবং নির্বিবাদী! এবং ফরাসি আর আমেরিকান গবেষকরা এটাকে বিনা প্রশ্নে গ্রহণ করেছিলেন। যখন তারা তাদের তৈরি রিপোর্ট, প্রবন্ধ এবং ছকের পরিসংখ্যান হাজির করেন তা নিশ্চিতভাবেই বুর্জোয়া আদর্শকেই তুলে ধরে।

যে গবেষণা সোভিয়েত বিচার ব্যবস্থার অধীনের বন্দীদের নিরীহ গোবেচারা হিসেবে চিহ্নিত করে, কিন্তু এই বিষয়ের বাস্তবতা হচ্ছে তাদের ভেতর অনেকেই ছিল চোর, ডাকাত, খুনি, ধর্ষক ইত্যাদি। এই ক্রিমিনালরা যদি ইয়োরোপ বা আমেরিকার অধিবাসী হতো তাহলে এই সকল অপরাধের জন্য কখনোই তাদের মাফ করা হত না। কখনোই ছাড় দেয়া হত না। কিন্তু সেই সময়ে সোভিয়েতের অপরাধগুলোকে একটু আলাদাভাবেই দেখা হতো।

একজন খুনি বা একজন ধর্ষক যে একাধিক ধর্ষণের সঙ্গে জড়িত তাকে নিরীহ গোবেচারা এবং পরিস্থিতির শিকার বলাটা পুঁজিবাদীদের নেহায়েত নোংরা খেলা। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিচার ব্যবস্থা বা বিচার নিয়ে মন্তব্য করার আগে অন্ততপক্ষে কিছু সাধারণ জ্ঞানবোধ থাকা আবশ্যক। নিদেনপক্ষে ক্রিমিনালদের সাজা বিষয়ে কিছু পরিমাণে হলেও বাস্তবজ্ঞান থাকার দরকার ছিল।

.

কুলাক এবং প্রতিবিপ্লব

প্রতিবিপ্লবীদের ঘটনায় এটা বিবেচনায় রাখা দরকার যে তাদেরকে অপরাধের জন্যই দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল। এবার আমরা দুটো উপমা হাজির করব যা এই প্রশ্নের গুরুত্ব তুলে ধরবে। প্রথমত, কুলাকদের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছিল ১৯৩০ সালের শুরুর দিকে, দ্বিতীয়ত, ষড়যন্ত্রকারী এবং প্রতিবিপ্লবীদের দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল ১৯৩৬ থেকে ১৯৩৮ সালের মধ্যে।

তদন্ত রিপোর্ট অনুযায়ী যদুর জানা যায় কুলাকদের মধ্যে ধনী কৃষক যারা প্রায় ৩ লক্ষ ৮১ হাজার পরিবার; তার মানে প্রায় ১.৮ মিলিয়ন মানুষকে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছিল। এদের মধ্যে খুব অল্প সংখ্যক মানুষকে শ্ৰম শিবিরে এবং

শ্রমিক কলোনিতে থাকতে হয়েছিল। কিন্তু এই শাস্তি কী প্রতিদান দিয়েছিল? রাশিয়ার ধনী কৃষক এবং কুলাকরা শত শত বছরব্যাপী দরিদ্র কৃষকদের সীমাহীন নিপীড়ন এবা লাগামহীন শোষণ করে আসছিল। ১৯২৭ সালে ১২ কোটি ধনী কৃষক, ১ কোটি কুলাক বিলাসবহুল জীবন যাপন করত, যখন বাকি ১১ কোটি মানুষ বসবাস করত দারিদ্র্যে। বিপ্লবের আগ পর্যন্ত তারা চরম দারিদ্রে মানবেতর জীবন যাপন করত। অপরদিকে কুলাকদের বিত্ত-বৈভব গড়ে উঠেছিল ওই দরিদ্র কৃষকদের মজুরি ঠকিয়ে, একেবারে নামমাত্র পারিশ্রমিকে তারা কাজ করতে বাধ্য হতো। এই অবস্থায় দরিদ্র কৃষকরা সমবেত হয়ে যৌথ খামার গড়ে তুললে কুলাকদের ধন-সম্পদ অদৃশ্য হতে থাকে। তার পরও কুলাকরা হাল ছেড়ে দেয় না।

তারা দুর্ভিক্ষকে ব্যবহার করে হৃত গৌরব ফিরে পেতে মরিয়া হয়ে ওঠে। দলে দলে সশস্ত্র কুলাকরা কৃষকদের যৌথ খামার আক্রমণ করে, দরিদ্র কৃষক এবং পার্টি কর্মীদের হত্যা করে। তাদের ফসলের ক্ষেত আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়, এবং গবাদি পশুগুলোকেও হত্যা করে। অনাহারের প্ররোচনা চালিয়ে দারিদ্র্যকে চিরস্থায়ী করে কুলাকরা চেয়েছিল নিজেদের হারানো গৌরব, ক্ষমতা ফিরে পেতে এবং ক্ষমতা প্রয়োগ করতে। এই ব্যবস্থাটা হত্যাকারীদের ক্ষমতা নিশ্চিত করে। এই সময় দরিদ্র কৃষকরা বিপ্লব সমর্থন করে এটা প্রমাণ করতে চায় যে তারা কুলাকদের চেয়ে শক্তিশালী। যদিও সে সময় কুলাকরা পরাজিত। আর তাই দরিদ্র কৃষকরা কুলাদের দোষী সাব্যস্ত করে নির্বাসনে পাঠায়, শ্রম শিবিরে বন্দী করে।

১ কোটি কুলাকের মধ্যে ১৮ লক্ষকে দোষী সাব্যস্ত করে নির্বাসনে পাঠানো হয়। সেখানে হয়তো অবিচার করা হয়ে থাকতে পারে। সোভিয়েত গ্রামাঞ্চলে এত বৃহৎ এবং ব্যাপ্ত শ্রেণি সংগ্রামে এধরনের বিচ্যুতি ঘটতেই পারে, যেখানে ১২ কোটি মানুষ জড়িত! কিন্তু তাই বলে কি আমরা ওই দরিদ্র এবং বঞ্চিত কৃষকদের অভিযুক্ত করতে পারি? যেখানে তাদের সংগ্রাম হলো জীবন বাঁচানোর জন্য সংগ্রাম। ওই সংগ্রামই তাদের শিশুদের অশিক্ষার অভিশাপ মুক্ত করে, দাসত্ব মুক্ত করে। আর তাই ওই শ্রেণি সংগ্রামকে যথেষ্ট সভ্য হিসেবে দেখা যায়নি এবং তাদের প্রতিপক্ষের প্রতিও যথেষ্ট পরিমাণ ‘দয়ালু’ দেখা যায়নি। এখন কেউ কি এই দরিদ্র কৃষকদের দিকে অভিযোগের আঙুল তুলতে পারেন, যারা শত শত বছর ধরে নির্মম নিপীড়ন আর নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, এবং যাদের কখনোই ভ্য সমাজে প্রবেশাধিকার ছিল না। কেউ কি বলতে পারেন, কুলাকরা কবে ‘সভ্য’ শোষক এবং দরিদ্র মানুষদের সীমাহীন শোষণের কালে আচরণে ব্যবহারে দরিদ্র মানুষের প্রতি দয়ালু ছিল?

.

১৯৩৭ সালের প্রায়শ্চিত্ত

আমাদের দ্বিতীয় উদাহরণ হলো ১৯৩৬ থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত সাজাপ্রাপ্ত প্রতিবিপ্লবীদের শুনানি কার্যত ছিল পার্টির এক ধরনের প্রায়শ্চিত্ত। এর ফলে পার্টি আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। সেনাবাহিনী, রাষ্ট্রের কলকজাই ছিল রাশিয়ার বিপ্লবী আন্দোলনের ভিত্তিমূল। লক্ষ লক্ষ মানুষ জার এবং জারশাসিত রাশিয়ার বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছে। এদের বেশির ভাগই পরে রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়েছে।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে এদের মধ্যে কিছু সংখ্যক মানুষ পার্টিতে প্রবেশ করে ভিন্ন মতলবে, সমাজতন্ত্র বা সর্বহারার পক্ষে নয়। কিন্তু শ্রেণি সংগ্রামের তাবড়তোড় সে সময় এত ব্যাপ্ত ছিল যে আলাদা আরেকটি যুদ্ধংদেহী পার্টি গঠনের জন্য না সময় ছিল, না সুযোগ ছিল। এমনকি অন্যান্য দলের সশস্ত্র যোদ্ধারা যারা বলশেভিক পার্টির জন্য লড়াই করেছে, এবং কমিউনিস্ট পার্টিতে প্রবেশের জন্য যারা নিজেদেরকে সমাজতন্ত্রী মনে করত। এই নতুন কর্মীদেরকে বলশেভিক পার্টিতে গুরুত্বপূর্ণ পদও দেয়া হয়েছিল। রাষ্ট্র এবং সশস্ত্র বাহিনী এদের ব্যক্তিগত নৈপুণ্যের ওপর ভরসা করত বেশ ভালোভাবেই।

এসবই ছিল শিশু সোভিয়েত রাষ্ট্রের জন্য অত্যন্ত কঠিন সময় এবং পার্টি ক্যাডারের বিরাট শূন্যতা। এমনকি যারা পড়তে পারে তারা পার্টির কাছে নতুন। সদস্য এবং ক্যাডারদের জন্য আবদার করে বসে। কারণ এই সমস্যা চলাকালীন আবার নতুন সমস্যা সৃষ্টি হয়। দুই ভাগে বিভক্ত হওয়া পার্টিকে সঠিক পথে পরিচালিত করানোর কাজটাতে অসঙ্গতি দেখা দেয়। এক পক্ষ চাপ প্রয়োগ করছিল শ্রেণি সংগ্রামের মাধ্যমে সমাজতান্ত্রিক সমাজ গঠনের জন্য। আরেক পক্ষ ছিল যারা মনে করত পরিস্থিতি এখনও সেভাবে সমাজতন্ত্রের জন্য ‘পেকে’ ওঠেনি, এবং তারাই সোস্যাল ডেমোক্র্যাসিকে হাজির করেছিল।

এই ধারণাটির মূলে ছিলেন ট্রটস্কি যিনি পার্টিতে প্রবেশ করেছিলেন ১৯১৭ সালের জুলাই মাসে। বলশেভিকদের মধ্যে ট্রটস্কির সমর্থকদের উপর ট্রটস্কির যথেষ্ট প্রভাব ছিল, এবং ট্রটস্কি সেই সমর্থনকে নিরাপদ করেছিলেন। এই গ্রুপটি আসল বলশেভিক প্ল্যানের বিরুদ্ধে ছিল। ১৯২৭ সালের ২৭ ডিসেম্বরের ভোটের আগে সেই মেরুকরণ বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সে সময় একটি মহান পার্টি বিতর্ক চালু ছিল বহু বছর ধরে। যার ফলাফলে কেউই সন্দেহযুক্ত ছিলেন না। ৭ লক্ষ ২৫ হাজার ভোট পড়েছিল। তার মধ্যে ৬ হাজারই ছিল বিরোধীপক্ষে, এবং মাত্র ১% এরও কম সংখ্যক যুক্ত বিরোধীদলের পক্ষে ছিল।

এই ভোটের ফলাফলে এবং এক সময় বিরোধীরা পলিসি তৈরিতে এবং পলিসি বদলানোতে পার্টি বিরোধী কাজ শুরু করে দিয়েছে, সে সময় কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি সংযুক্ত বিরোধী মোর্চার গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেয়। তাদের কেন্দ্রীয় বিরোধী নেতা ট্রটস্কিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বহিষ্কার করা হয়। কিন্তু তাতে করে সেই বিরোধিতার অবসান ঘটেনি। জিনোভিয়েভ, কামেনেভ এবং জেভিডোকাইন পরে আত্মসমালোচনা করেন। তাদের সঙ্গে ট্রটস্কিপন্থী যেমন পেয়াতোকভ, রাদিক, প্রিয়ভারঝিনিস্কি এবং স্মিরনভও আত্মসমালোচনা করে দলে টিকে যান।

এদের সকলেই আবার মূল পার্টির নিয়ম-শৃঙ্খলা মেনে নতুন কর্মদ্যোগ শুরু করে এবং আবারও পার্টি এবং দেশের গুরুত্বপূর্ণ পদ দখল করে। এ থেকে এটা পরিষ্কার হয় যে তাদের আত্মসমালোচনা আসল বা মন থেকে ছিল না। কেননা তারা বরাবরই বিরোধিতা করেছে এবং আত্মসমালোচনার পরও করেছে। তারা সব সময়েই বিশেষ করে সোভিয়েত শ্রেণি সংগ্রামের কালে শত্রুতার ক্ষেত্রে ঐক্যবদ্ধ ছিল। ১৯৩৭ থেকে ১৯৩৮ সালে পরিস্থিতি সম্পূর্ণভাবে ব্যাখ্যায়িত হওয়ার আগে তারা আবার বহিষ্কার হন এবং ফের পদে বহাল হন!

.

শিল্পখাতের অন্তর্ঘাত

স্ক্যালিনের গায়ে ‘কাদা’ লাগানোর কাজে যত রকম বিষয় হতে পারে তার সবই ব্যবহার করেছিলেন স্তালিনবিরোধীরা। তাদের তুনের ‘তীর’ হিসেবে শিল্প খাতের এই অন্তর্ঘাতও একটি বড় অনুসঙ্গ।

১৯৩৪ সালের ডিসেম্বরে মৃত্যুবরণকারী কিরভ ছিলেন পার্টির লেনিনগ্রাদ অঞ্চলের চেয়ারম্যান এবং কেন্দ্রীয় কমিটির গুরুত্বপূর্ণ মানুষ। তার তদন্তের চৌম্বক অংশ ছিল এটা উঘাটন করে দেখানো যে কীভাবে একটি ষড়যন্ত্রকারী গোপন প্রতিষ্ঠান এবং গ্রুপ ষড়যন্ত্র করে পার্টির নেতৃত্ব দখল করে এবং পার্টি তথা সরকারকে সন্ত্রাসে জড়িয়ে ফেলতে পারে। তাদের মুখ্য রাজনৈতিক সংগ্রাম ছিল এটাই যে তারা ১৯২৭ সালে হেরেছিল এবং এখন আশাবাদী হচ্ছে যে তারা যে করেই হোক আবার জয়ী হবে এবং দেশের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা করবে। তাদের মূল অস্ত্র ছিল শিল্প কারখানায় অন্তর্ঘাত, সন্ত্রাসী কার্যক্রম এবং দুর্নীতি। ট্রটস্কি ছিল বিরোধীদের আদর্শ মূল নেতা ট্রটস্কি বিদেশ থেকে তাদের স্যাবোটাজ পরিচালনা করতেন। শিল্প খাতের ষড়যন্ত্র সোভিয়েত রাজ্যের সীমাহীন ক্ষতি করেছিল, যেমন গুরুত্বপূর্ণ মেশিনপত্তর এমনভাবে ধ্বংস করা হতো যা মেরামতের অযোগ্য এবং কারখানা আর খনিতে মারাত্মকরকম উৎপাদন সংকট দেখা দিয়েছিল।

জনগণের মধ্যে একজন যিনি ১৯৩৪ সালে বর্ণনা দেন যে সমস্যা ছিল আমেরিকান ইঞ্জিনিয়ার জন লিটলপেইজ ছিলেন মূল সমস্যা যাকে বিদেশি বিশেষজ্ঞ বানানো হয়েছিল। লিটলপেইজ সোভিয়েত খনির কাজে (১৯২৭ থেকে ১৯৩৭) ১০ বছর একসঙ্গে কাজ করে কাটিয়ে দিয়েছিলেন, বিশেষত খনির কাজে। প্রধানত সোনার খনিতে। তার বই Search of Soviet Gold-এ তিনি লেখেন- ‘আমি কখনোই রাজনৈতিক কর্তৃত্ব এবং রাজনৈতিক সমাধানের জন্য লালায়িত হইনি। আমার সাবজেক্ট ছিল শিল্প কারখানা। এবং সেই কারখানায় আমার সময়কালে কী ঘটেছিল সেটাও আলোচ্য বিষয়। আমি মোটের উপর পড়াশুনা করে সোভিয়েত শিল্প-কারখানাগুলোর প্রকৃত দুর্দশার চিত্র তুলে ধরতে চাই।’

লিটলপেইজ আরও লেখেন; তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা নিশ্চিত করেছিল যে কেউ বা কোনো একটি গোষ্ঠী দেশের বাইরে থেকে পরিচালিত হচ্ছে। তারা সরকারের পতন ঘটানোর জন্য একের পর এক শিল্প-কারখানায় অন্তর্ঘাত ঘটাতে থাকে। ১৯৩১ সালে লিটলপেইজ ইতোমধ্যেই দুটি পথের একটিকে গ্রহণ করতে চেয়েছিল। আর সিদ্ধান্তটি ছিল কাজাখস্তানের উরালের তামা এবং ব্রঞ্জ খনিতে। সেই খনি ছিল বৃহৎ তামা এবং ব্রঞ্জের অংশ। আর নেতৃত্বে ছিল ভারী শিল্পের পিপলস ভাইস কমিশার পেত্রাকভ। এরকম অনেকগুলো ঘটনা একত্রিত করে লিটলপেইজ এইমর্মে সিদ্ধান্তে পৌঁছুলেন যে সেখানে সুসংগঠিত ধ্বংসাত্মক অন্তর্ঘাত হয়েছে এবং তা এসেছে তামা/ব্রঞ্জ কমপেক্সের শীর্ষ নেতৃত্বের কাছ থেকে।

লিটলপেইজের বই আমাদেরকে আরও জানায় যে বিরোধী টুটস্কাইটরা কোথা থেকে টাকার যোগান পেত, এবং সেই যোগান দিয়ে প্রতিবিপ্লবী গোষ্ঠী কীভাবে গড়ে তুলত। এই গোপন দলের অনেক সদস্য তাদের পার্টি অবস্থান ব্যবহার করে ওই সকল ধ্বংস হয়ে যাওয়া কিংবা ভেঙে পড়া কারখানার যন্ত্রপাতি কেনার অনুমতি পেত। আবার তারাই যখন বাইরের দেশ থেকে কারখানার মেশিন আর যন্ত্রপাতি কিনত তখন একেবারেই নিম্নমানের জিনিসপত্তর কিনে আনত যাতে করে সোভিয়েত ইউনিয়নই ক্ষতিগ্রস্ত হতো। ট্রটস্কির নেতৃত্বে এই সব অন্তর্ঘাত সোভিয়েত ইউনিয়নের কল-কারখানাগুলোকে দ্রুত ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যেতে পেরেছিল। একদিকে তারা অন্তর্ঘাত চালিয়ে কারখানা ধ্বংস করত, আরেক দিকে সেই কারখানা পুনরায় সচল করার জন্য বিদেশ থেকে কম দামি মেশিনপত্তর এবং যন্ত্রাংশ বেশি দামে কিনত, শেষ পর্যন্ত যার দায় মেটাতে হতো সোভিয়েত ইউনিয়নকে।

.

অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা!

চুরি-ছিনতাই, অন্তর্ঘাতসহ ভয়ানক অপরাধ তো নিজেদের মধ্যে ছিলই কিন্তু বিরোধীপক্ষের কার্যকলাপ ছিল অনেক এগিয়ে। একটি প্রতিবিপ্লবী ষড়যন্ত্রকারী চক্র অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সমগ্র সোভিয়েত ক্ষমতা দখল করে নির্মূল করার পরিকল্পনাও করছিল! শুরু করতে চেয়েছিল কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যদের দিয়ে। অপরদিকে মার্শাল তুখাচেভস্কির নেতৃত্বে একটি সামরিক গ্রুপও তৈরি হয়ে গিয়েছিল।

ট্রটস্কিপন্থী আইজ্যাক ডয়েস্টসার যিনি স্তালিনবিরোধী এবং সোভিয়েতৱিরোধী একাধিক বই লিখেছিলেন। তার মতানুসারে ওই গ্রুপটির কাছে ক্রেমলিনবিরোধী অভ্যুত্থান ঘটানোর জন্য সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে আবেদনও এসেছিল। তারা চেয়েছিল প্রধান প্রধান শহর দখল করতে। যেমন মস্কো এরং লেনিনগ্রাদ। আইজ্যাক ডয়েস্টসারের মতানুসারে করে ক্ষমতা দখলের ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত ছিল তুখাচেভকি, তার সাথে আর্মি পলিটিক্যাল কমিশনারেট প্রধান গামানিক, লেনিনগ্রাদ কমান্ডার জেনারেল ইয়াকির, মস্কো মিলিটারি একাডেমির কমান্ডার জেনারেল ইউব্রোভিচ এবং ক্যাভালরি কমান্ডার জেনারেল প্রিমাকভ!

মার্শাল তুখাচেভস্কি ছিলেন প্রাক্তন জারিস্ট আর্মি সদস্য, যিনি বিপ্লবরে পর লাল ফৌজের কাছে ধর্ণা দিয়েছিলেন। ১৯৩০ সালের দিকে ১০ শতাংশের কাছাকাছি (প্রায় ৪,৫০০) ছিলেন প্রাক্তন জারিস্ট অফিসার, যাদের আগমন ঘটেছিল প্রাক্তন জারিস্ট আর্মি থেকে। এদের অধিকাংশই তাদের বুর্জোয়া দৃষ্টিভঙ্গি পরিত্যাগ করেননি উপরন্তু মোক্ষম সুযোগের অপেক্ষা করছিলেন এই বিষয়ে লড়ে যাবার জন্য। শেষ পর্যন্ত এই সুযোগ আসে যখন প্রতিপক্ষ একটি কু ঘটাতে প্রস্তুত হচ্ছিলেন।

বলশেভিকরা শক্তিশালী ছিল কিন্তু সাধারণ মানুষ এবং সেনাষড়যন্ত্রকারীরা। যথেষ্ট পরিমাণে বন্ধুদের জড় করার চেষ্টা করেছিল। ১৯৩৮ সালে পাবলিক ট্রায়ালে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল ট্রটস্কাইট বিরোধিপক্ষ এবং নাজি জার্মানির মধ্যে। সেই ট্রটস্কাইট পক্ষ প্রতিবিপ্লবীদেরকে সাথে নিয়ে কু করে সমগ্র সোভিয়েত ক্ষমতা দখল করতে চেয়েছিল। এসব কারণে নাজি জার্মানি থেকে তারা সব ধরনের সমর্থন পেত প্রতিবিপ্লব সংঘটিত করবার জন্য।

‘রেডিক’ এর মাধ্যমে বুখারিন এই চুক্তি সম্পর্কে খবর পেয়েছিলেন যে রেডিক ট্রটস্কির কাছ থেকে এ বিষয়ে আদেশও পেয়েছিলেন। এই সকল ষড়যন্ত্রকারীরা নেতৃত্ব দেয়ার জন্য উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন পরিচালকের মাধ্যমে সমাজতান্ত্রিক সমাজ রক্ষার নামে কার্যত সমাজতন্ত্র ধ্বংস করতে চেয়েছিল। এই পুরো দরকারী ঘটনাগুলো ঘটেছিল ১৯৩০ সালের দিকে যখন নাজি বিপদ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে এবং নাজি আর্মি সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণের জন্য তৈরি হচ্ছিল।

এই ষড়যন্ত্রকারীরা পাবলিক ট্রায়ালে দোষী সাব্যস্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছিল। যাদেরকে অন্তর্ঘাত চালানো, সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা করা এবং হত্যার চেষ্টা করার জন্য এবং দেশের একটি অংশ নাজি জার্মানির হাতে তুলে দেয়ার ষড়যন্ত্রের জন্য দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল এবং মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল।

.

আরও অসংখ্য মিথ্যাবাদী

এটা দেখতে পাওয়া খুব চমকপ্রদ যে রবার্ট কনকোয়েস্টের মাধ্যমে লাল ফৌজ নিয়ে কীভাবে পশ্চিমা অপপ্রচার চালানো হয়েছিল। কনকোয়েস্ট তার ‘গ্রেট টেরর’ বইতে বলেছিলেন। সে সময় (১৯৩৭ সালে) সেখানে (সোভিয়েত ইউনিয়নে) লাল ফৌজের ৭০ হাজার সেনা কর্মকর্তা কমিশারের মধ্যে ৫০% অর্থাৎ ১৫ হাজার কর্মকর্তা এবং ২০ হাজার কমিশার রাজনৈতিক পুলিশ দ্বারা গ্রেপ্তার হয়েছিল এবং তাদের অধিকাংশই হয় লেবার ক্যাম্পে মারা গিয়েছিল অথবা আজীবন কয়েদ খেটেছিল। এই অভিযোগটি কনকোয়েস্টের পুরো বই জুড়েই ছিল যার একটি বর্ণও সত্যি নয়। ইতিহাসবিদ Roger Reese লাল ফৌজ এবং কথিত মহান শুদ্ধিকরণ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ মতামত এবং সত্য তুলে ধরেন যা ১৯৩৭-৩৮ সালের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরে।

১৯৩৭ সালে লাল ফৌজ এবং কমিশারের সৈন্য সংখ্যা ছিল ১ লক্ষ ৪৪ হাজার ৩০০, ১৯৩৯ সালেই যে সংখ্যা বেড়ে ২ লক্ষ ৮২ হাজার ৩০০ হয়। ১৯৩৭-৩৮ সালের শুদ্ধিকরণের সময় ৩৪ হাজার ৩০০ কর্মকর্তা এবং রাজনৈতিক কমিশারকে রাজনৈতিক কারণেই বহিষ্কার করা হয়েছিল। যা হোক, ১৯৪০ সালের মে মাসের মধ্যে ১১ হাজার ৫ শো ৯৬ জনকে পুনর্বাসিত করে তাদের পুরনো পোস্টে পুনঃনিয়োগ দেয়া হয়েছিল। তার মানে ১৯৩৭-৩৮ শুদ্ধিকরণের কালে ২২ হাজার ৭০৫ জন কর্মকর্তা এবং রাজনৈতিক কমিশারকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছিল যাদের মধ্যে ১৩ হাজারের মতো ছিল সেনা সদস্য, ৪ হাজার ৭০০ বিমান বাহিনী সদস্য এবং ৫ হাজার রাজনৈতিক কমিশার, আর এই সংখাঁটি মোট সেনা কর্মকর্তা এবং কমিশারের ৭.৭%, কোনোভাবেও ৫০% নয় যেটা কনকোয়েস্ট তার বইতে অভিযোগ তুলেছেন। ওই ৭.৭% বিশ্বাসঘাতকতার জন্য দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন, কিন্তু এদের বড় একটি অংশ সাধারণভাবেই তাদের বেসামরিক জীবনে ফিরে যেতে পেরেছিলেন।

শেষ প্রশ্নে আসা যাক। ১৯৩৭-৩৮ সালের অভিযুক্তদের ট্রায়াল’ কি ন্যায্য ছিল? আচ্ছা আমরা পরীক্ষা করে দেখতে পারি। উদাহরণস্বরূপ বুখারিনের ট্রায়ালের কথা ধরা যাক, যিনি পার্টির শীর্ষ কর্মকর্তাদের একজন ছিলেন যিনি গোপন বিরুদ্ধমতকারীদের নিয়ে কাজ করতেন। ওই সময়ে মস্কোতে আমেরিকার রাষ্ট্রদূত জনপ্রিয় আইনজীবী জোসেফ ডেভিস যিনি পুরো ট্রায়ালে সংযুক্ত ছিলেন তিনি জানান বুখারিন তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ নিয়ে মুক্তভাবে যে কারো সঙ্গে আলোচনা করার অনুমতি এবং তার মামলার কাজ এগিয়ে নিতে পেরেছিলেন কোনো রকম অন্তরায় ছাড়াই। জোসেফ ডেভিস ওয়াশিংটনে লেখেন- বিচার কাজ চলার সময় এটা প্রমাণিত হয়ে যায় যে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়েছিল তাদের সকলেরই অপরাধ প্রমাণিত হয়েছিল। সেই বিচার চলাকালীন বিদেশি রাষ্ট্রদূতের মতো নিরপেক্ষ ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন এবং তাদের। সামনেই অপরাধীদের অপরাধ প্রমাণিত হয়েছিল।

.

ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেবার পালা

স্তালিন আমলের সোভিয়েত বিচার ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনায় দেখা যেত হাজার হাজার মিথ্যা নিবন্ধ দিয়ে শত শত সিনেমা বানানো হয়েছে যে সবের মূল উপজীব্য ছিল উদ্দেশ্যমূলক মিথ্যা প্রচার করা। ঘটনা প্রবাহ প্রমাণ করেছে সমাজতন্ত্র সম্পর্কে বুর্জোয়া প্রচারযন্ত্র বেশিরভাগই মিথ্যা প্রচার করেছে। কেননা সে সময় ডানপন্থীরাই রেডিও টেলিভিশনে কর্তৃত্ব করত। তাদের অন্যতম কাজ ছিল সত্যকে ধ্বংস করা, নিশ্চিহ্ন করা। সে কারণে অনেক মানুষ মিথ্যাকেই সত্য বলে ধরে নিত।

ইতিহাসের প্রশ্নে এটাই বিশেষ সত্য হিসেবে সামনে চলে আসে। ডানপন্থীদের যে কোনো নতুন গল্প মিথ্যা দিয়েই শুরু এবং মিথ্যা দিয়েই শেষ। হতো যদি না তাতে রাষ্ট্রের তদন্ত যোগ হতো। এই সন্দেহটাও যুক্তিযুক্ত ছিল। ঘটনা প্রবাহ এমনই ছিল যে রাশিয়ার তদন্ত রিপোর্টকেও তারা মিথ্যা বলে প্রচার চালাত বিগত ৫০ বছর ধরে। এমনকি তাদের মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ার পর এবং জনসম্মুখে উন্মুক্ত হওয়ার পরও তারা মিথ্যা এবং কুৎসা রটনায় বিরতি দিত না। এই নির্ভেজাল মিথ্যা প্রচার ছিল অনেকটা তাদের ঐতিহাসিক ঐতিহ্য। মিথ্যাগুলো ক্রমাগত প্রচার করা হতো যেন এক সময় সেই মিথ্যাগুলোকে সত্য মনে হয়! রাশিয়ার রিসার্চ রিপোর্ট পশ্চিমা দেশে প্রকাশ হওয়ার পর পশ্চিমের বিভিন্ন দেশে অজস্র নতুন বই প্রকাশিত হয়েছিল, তাতে রাশিয়ার তদন্ত রিপোর্টকেই মিথ্যা বানিয়ে নতুন সত্য হিসেবে প্রকাশ করা হয়েছিল। এই বইগুলো ছিল চমৎকার বাঁধাই এবং দৃষ্টি আকর্ষিত হওয়ার মতো, অথচ যার পরতে পরতে ছিল কমিউনিজম এবং সমাজতন্ত্র সম্পর্কে নির্ভেজাল মিথ্যাচার।

দক্ষিণপন্থীদের পুনঃ পুনঃ মিথ্যাচার সেই থেকে এখন পর্যন্ত কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে লড়ছে। তারা ক্রমাগত সমাজতন্ত্রের বিকল্প হিসেবে পুঁজিবাদ এবং নিও লিবারেলিজম প্রচার করে চলেছে। তারা নবীন এবং বিচ্ছিন্ন কমিউনিজমের বিরুদ্ধে নোংরা যুদ্ধও করে চলেছে বছরের পর বছর। তার পরও সমাজতান্ত্রিক সমাজ পুঁজিবাদ এবং নিও-লিবারেলিজমের দিন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

আমাদেরকে অবশ্যই শ্রমিক শ্রেণির সঠিক মতাদর্শের সংবাদপত্র তথা প্রচার মাধ্যমের দায়-দায়িত্ব নিতে হবে, যে প্রচার মাধ্যম বুর্জোয়া মিথ্যাচার এবং অপপ্রচারের বিরুদ্ধে লড়বে। এটা অবিসম্বাদিতভাবে আজকের শ্রেণি সংগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ সংগ্রাম, যে সংগ্রাম একটি নতুন শক্তি জন্ম দেবে যারা সমাজতন্ত্র এবং কমিউনিজমের উত্তরাধিকার ধারণ করবে।

.

আলেকজান্ডার সোলঝেনিৎসিন

৩০-৪০ দশকের সোভিয়েত ইউনিয়নে তথাকথিত লাগামছাড়া অত্যাচার ও বন্দিশিবিরে নিহত বা বন্দী লক্ষ লক্ষ মানুষের বিষয়ে আরও বহু বই ও প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। এসব বইয়ের লেখকদের মধ্যে বিখ্যাত হলেন আলেকজান্ডার সোলঝেনিৎসিন। তিনি নিজেও অবশ্য রাশিয়ারই মানুষ। তার বহুল প্রচারিত বই ‘গুলাগ আর্কিপেলাগো’! এ বইটির জন্য ১৯৬০-এর দশকের শেষের দিকে তাঁর নাম সমগ্র পুঁজিবাদী দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৪৬ সালে তিনি নিজে প্রতিবিপ্লবী কার্যকলাপের দায়ে ৮ বছরের জন্য সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন ও একটি লেবার ক্যাম্পে তাঁকে প্রেরণ করা হয়। সোভিয়েত-বিরোধী প্রচারে সক্রিয় অংশগ্রহণের ফলেই তার এই দণ্ড।

সোলঝেনিৎসিনের নিজের মত ছিল এই যে, হিটলারের সাথে সোভিয়েত সরকার একটু সমঝোতা করে নিলেই নাকি নাৎসিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধটা এড়ানো সম্ভব ছিল। সেটা না করে সোভিয়েত সরকারই নাকি আসলে সেদেশের জনগণের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছিল। আর স্তালিন ছিলেন, তাঁর মতে, এমনকি হিটলারের চেয়েও খারাপ। নাৎসিদের প্রতি তার সহানুভূতি গোপন করতেও সোলঝেনিৎসিন এতটুকু চেষ্টাও করেননি। এসব কারণেই তার কারাদণ্ড হয়।

১৯৬২ সালে সোলঝেনিৎসিনের প্রথম বই সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকেই প্রকাশিত হয়। এই বইটির নাম ছিল ‘ইভান দেনিসোভিচের জীবনের একটি দিন’। একজন কারাবন্দিকে নিয়েই এ গল্পটি। ক্রুশ্চেভ তাঁর স্তালিন-বিরোধী সংশোধনবাদী কর্মসূচিতেও সোলঝেনিৎসিনের লেখাকে ব্যবহার করতে শুরু করেন। ১৯৭০ সালে সোলঝেনিৎসিন তাঁর ‘গুলাগ আর্কিপেলাগো’ বইটির জন্য সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান। এরপর থেকে পুঁজিবাদী দুনিয়াতেও তার বই বিপুল পরিমাণে প্রকাশিত ও বিক্রি হতে শুরু করে। আর সেই সঙ্গে দ্রুত তিনিও হয়ে ওঠেন সাম্রাজ্যবাদীদের হাতে সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে অপপ্রচারের এক অতি গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র! ১৯৭৪ সালে সোলঝেনিৎসিন এমনকি সোভিয়েত নাগরিকত্বও ত্যাগ করেন এবং সুইজারল্যান্ডে আশ্রয় নেন। এরপর তিনি পাড়ি দেন আমেরিকায়। এই সময় পুঁজিবাদী দুনিয়ার গণমাধ্যমে তাঁকে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের প্রায় সর্বশ্রেষ্ঠ সৈনিকের মর্যাদা দেওয়া হতে থাকে। নাৎসিদের প্রতি তাঁর খোলাখুলি সহানুভূতির কথাও তখন এই প্রচারের ঝড়ে বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যেতে শুরু করে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সোলঝেনিৎসিনকে একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ সভা সমাবেশে আমন্ত্রণ জানানো হতে থাকে। তার ওইসব বক্তব্য ছিল প্রায়শই অত্যন্ত উস্কানিমূলক ও হিংস্র। তাঁর মারাত্মক প্রতিক্রিয়াশীল অবস্থানই এসব বক্তব্যের মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হতো। যেমন, ভিয়েতনামে মার্কিন বাহিনীর পরাজয়ের পরও তিনি দাবি তুলেছিলেন যে, আমেরিকার আবার আরও বেশি প্রস্তুতি নিয়ে ভিয়েতনাম আক্রমণ করা উচিত। শুধু তাই নয়, ১৯৭৪ সালে পর্তুগালের সেনাবাহিনীর বামপন্থী মনোভাবসম্পন্ন অফিসারদের বিদ্রোহের ফলে যখন ৪০ বছরের ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন ঘটে তখনও তিনি দাবি তোলেন, আমেরিকার অবিলম্বে সে-দেশে সামরিক হস্তক্ষেপ করা দরকার। তা নাহলে নাকি পর্তুগাল খুব শীঘ্রই ওয়ারশ জোটে (রাশিয়ার নেতৃত্বে যুদ্ধবিরোধী জোট) যোগ দেবে। আফ্রিকাতে পর্তুগালের বিভিন্ন উপনিবেশগুলো স্বাধীন হয়ে যাওয়ার দুঃখও তিনি সারাজীবনে ভুলতে পারেননি। তার বক্তৃতায় বারেবারেই তিনি এ বিষয়ে তাঁর আক্ষেপ প্রকাশ করেন।

কিন্তু তার অধিকাংশ বক্তৃতায় তিনি বলতে গেলে সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে একপ্রকার যুদ্ধই ঘোষণা করেন। সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে যে-কোনো রকমের অভিযোগকেই তাই তিনি সানন্দে লুফে নেন ও তাঁর বক্তৃতায় নির্দ্বিধায় ব্যবহার করে চলেন, তা সে সোভিয়েত ইউনিয়নে ৩০-এর দশকের দুর্ভিক্ষে ও অত্যাচারে লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যুর অভিযোগই হোক, বা উত্তর ভিয়েতনামে কয়েক লক্ষ মার্কিন সেনাকে বন্দী করে রেখে অকথ্য অত্যাচার চালানোর গল্পই হোক, সবই তার বক্তব্যে হয়ে ওঠে নির্ভেজাল সত্য। বলে রাখা ভালো, উত্তর ভিয়েতনামে মার্কিন সেনাদের বন্দী করে রেখে দাস শ্রমিক হিসেবে ব্যবহার করার যে অভিযোগ সোলঝেনিৎসিন তোলেন, জনপ্রিয় হলিউড ফিল্ম ‘র্যাঘো’ তার ওপর ভিত্তি করেই তৈরি হয়। শুধু তাই নয়, যেসব মার্কিন সাংবাদিক এই সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে শান্তির বাতাবরণ তৈরির সপক্ষে মতপ্রকাশ করেন, সোলঝেনিৎসিন তাদের বিরুদ্ধে সরাসরি বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ তোলেন। তিনি এ সময় সর্বত্র সোভিয়েতকে রুখবার উদ্দেশ্যে মার্কিন পক্ষে ব্যাপকতর সমর-প্রস্তুতির পক্ষেই মত প্রকাশ করতে থাকেন এবং এই বিষয়ে জনমত গঠন করতেও উদ্যোগী হন। কারণ তাঁর মতে, সোভিয়েত ইউনিয়ন তখন যে বিপুল সমরায়োজন শুরু করেছিল তাতে নাকি সাধারণ এবং পারমাণবিক উভয় রকম অস্ত্র শক্তিতে তারা অতি শীঘ্রই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের থেকে। দ্বিগুণ, তিনগুণ এমনকি পাঁচগুণ পর্যন্ত শক্তিশালী হয়ে উঠতে চলেছিল। বস্তুত,

সোভিয়েতের বিরুদ্ধে তার বক্তব্যগুলোতে আমরা উগ্র দক্ষিণপন্থার কণ্ঠস্বরই। শুনতে পাই। ব্যক্তিগতভাবে তিনি এই ব্যাপারে এতটাই দক্ষিণপন্থী হয়ে ওঠেন যে, প্রকাশ্যেই ফ্যাসিবাদের পক্ষে মত প্রকাশ করতেও তাকে খুব একটা কুণ্ঠিত হতে দেখা যায়নি।

.

গ্রন্থপঞ্জি

1. Lies Concerning the History of the Soviet Union. From Hitler to Hearst, from Conquest to Solzhenitsyn. The history of the millions of people who were allegedly incarcerated and died in the labour camps of the Soviet Union and as a result of starvation during Stalin’s time.- Mario Sousa, 15 June 1998
2. On The Question Of Stalin. (Second Comment on the Open Letter of the Central Committee of the CPSU)
3. Leon Trotsky, ‘The Stalinist Bureaucracy and the Assassination of Kirov’, On the Kirov Assassination, Eng. ed., Pioneer Publishers New York, 1956
4. The Harvest of Sorrow: Soviet Collectivization and the Terror-Famine by Robert Conquest Paperback 4. Trotskyism: Counter-Revolution in Disguise by M. J. Olgin
5. J. V. Stalin. Works, Vol. 1, 1901-1907. (Foreign Languages Publishing House, Moscow, Lawrence & Wishart, pp. 426. 5s
6. “Pravda Articles, On the Occasion of the 70th Birthday of Joseph Vissarionovich Stalin, December 21, 1949
7. The Great Terror: A Reassessment by Robert Conquest Paperback
8. The Secret File of Joseph Stalin: A Hidden Life- By Roman Brackman
9. Book review by Mario Sousa: ‘Stalingrad’ by Antony Beevor –a piece of Nazi war propaganda
10. Lies Concerning the History of the Soviet Union– Mario Sousa. Northstar Compass
11. Stalin: Breaker of Nations Paperback– November 1, 1992 by Robert Conquest
12. J. V. Stalin Archive
13. THE TRUTH ABOUT STALIN by- Wilf Dixon, 16 October 1994

জনসাধারণের আছে সীমাহীন সৃজনী শক্তি
তারা নিজেদের সংগঠিত করতে পারেন,
যেখানে নিজদের শক্তির স্ফুরণ করা সম্ভব সেসব স্থানে
ও বিভাগে এগিয়ে যেতে পারেন,
উৎপাদনের গভীরে ও ব্যাপ্তিতে এগিয়ে যেতে পারেন
এবং নিজেদের জন্য দিনে দিনে অধিকতর
কল্যাণময় সম্পদ সৃষ্টি করতে পারেন।

— মাও সে তুঙ

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *