৩. লোচন দত্ত ঘর ছেড়ে

০৩.

লোচন দত্ত ঘর ছেড়ে চলে যাওয়ার পর তারাপদ সামান্য অপেক্ষা করল, তারপর দুহাত জোড় করে নিচু গলায় বলল, “স্যার, আপনি সত্যিই গ্রেট, আমাকেও হাঁ করে দিয়েছেন। এত কথা জানলেন কেমন করে?”

কিকিরা মুচকি-মুচকি হাসছিলেন। বললেন, “তোমরা অল্পেতেই হাঁ হও। হাঁ হওয়ার কিছু নেই। বগলাকে পাঠিয়েছিলাম বড়াল গলি আর লোচনের খবর নিতে। বগলা যা খবর দিল আগেই বলেছি। একটা কথা বোধ হয় বলতে ভুলে গিয়েছি। ও শুনেছিল, বাবুদের ছাপাখানা আছে ধর্মতলায়। তা আমার কাছে গোটা দুয়েক পুরনো টেলিফোন-পাঁজি আছে, যাকে তোমরা বলো ডাইরেক্টরি। দুটোই বছর কয়েকের পুরনো। খুব ইউসফুল জিনিস হে তারাবাবু, তুমি ওটা ঘাঁটাঘাঁটি করলে অনেক কিছু পেয়ে যাবে। সেই জন্যেই রেখেছি।”

“আপনি পেলেন?”

“পেলাম। দেখলাম লেখা আছে দত্ত অ্যান্ড সন্স। প্রিন্টার্স অ্যান্ড পাবলিশার্স। ধর্মতলা স্ট্রিট…। ছাপাখানার ফোন নম্বর। পরের লাইনে লেখা ডিরেক্টর এল, দত্ত। রেসিডেন্স ফোন নম্বর… এত এত। ব্যস–সহজ জিনিসটা বেরিয়ে গেল। লোচন দত্ত ছাপাখানার ডিরেক্টর। তার বাড়ির ফোন নম্বর সো অ্যান্ড সো।”

“সে না হয় বুঝলাম। কিন্তু আপনি দত্তদের ছাপাখানা সম্পর্কে যেসব গল্প ঝাড়ছিলেন..”

“সেরেফ গল্পই। লোচন দত্ত নিজেই বলল, তাদের ছাপাখানা সত্তর বছরের। মানে বেশ পুরনো। মামুলি ছাপাখানা সত্তর বছর টিকে থাকে না তারাপদ। তা ছাড়া চোখ বুজে ডাউন দ্য মেমারি লেন করলাম। ধর্মতলা স্ট্রিট আমার খুব চেনা রাস্তা। মনে হল, এরকম একটা নামের সাইনবোর্ড যেন দেখেছি। মৌলালির কাছাকাছি হবে।”

তারাপদ ঠাট্টা করে বলল, “সি আর দাশকেও দেখেছেন নাকি?”

 কিকিরা হাসলে লাগলেন। “ছবি দেখেছি। দেশবন্ধু মারা যান–উনিশশো পঁচিশ-টচিশ হবে। তখন আমি কোথায়, লোচনই বা কোথায়? আর কোথায় বা তাদের প্রেস।”

তারাপদ যেন মজাটা উপভোগ করছিল। কিকিরা লোককে বোকা বানাতে ওস্তাদ। ম্যাজিশিয়ান বলে কথা!

“আপনি কি খেলা দেখাবার জন্যে ওইসব মেডেল পকেটে পুরে এনেছিলেন?”

“রাইট! ম্যাজিশিয়ানদের পকেট কখনও ফাঁকা থাকে না। হুডিনি সাহেব বলতেন, আমাদের ফাঁকা পকেটে ঘুরতে নেই, জাদুকরের জাত যায়। অন্তত একটা রুমাল বা তাসের প্যাকেটও রেখ।”

“পকেটে আর কী কী আছে?”

“তেমন কিছু না। রুমাল আর আই-পিন।”

“আপনি ভাগ্যবান। ম্যাজিকটা কাজে লেগে গেল।”

“লেগে যেত। সাধারণ মানুষের কাছে দুটো জিনিস লেগে যাওয়ার নাইনটি পার্সেন্ট চান্স। হাত দেখা আর ম্যাজিক।” বলে কিকিরা হাসতে লাগলেন। “আমার কাছে আরও একটা তুরুপের তাস ছিল। দরকার হল না।”

পায়ের শব্দ শোনা গেল।

পালোয়ান হরিপ্রসাদ এসে হাজির। বলল, “আইয়ে…!”

তারাপদ অবাক হল। আইয়ে মানে? লোচন কি তাদের পালোয়ান দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিচ্ছে? বলল, “কাঁহা?”

“দপ্তরমে। দুসরা কামরা।”

 কিকিরা উঠে দাঁড়ালেন। “চলো, অফিস ঘরে ডাক পড়েছে।”

 তারাপদও উঠে পড়ল।

.

ঢাকা বারান্দায় খানিকটা এগোলেই দোতলার সিঁড়ি। সিঁড়ির পাশ দিয়ে দশ পা হাঁটলেই অফিস ঘর।

কিকিরাদের অফিস ঘরে পৌঁছে দিয়ে পালোয়ানজি চলে গেল।

অফিস ঘরে লোচন দত্ত বসে ছিল। বলল, “আসুন। এই ঘরে বসেই আমি কাজের কথাবার্তা বলি। এটা আমার বসার ঘর অফিস ঘর দুইই। বসুন। আপনারা। আগের ঘরটায় এখন আমার ছেলেরা পাড়ার বন্ধুদের নিয়ে ক্যারাম খেলতে বসবে। ওদের নাকি ক্যারাম কম্পিটিশন চলছে। ছেলেপুলের কাণ্ড। বসুন আপনারা। চা খান।”

ছেলের কথা উঠলেও কিকিরা লোচনের ছেলে চুরি যাওয়ার কথা তুললেন না।

এই ঘরটা মাঝারি। মোটামুটি সাজানো-গোছানো। সোফা-সেটি চেয়ার। একপাশে লোচন দত্তর কাজকর্মের সেক্রেটারিয়েট টেবিল, গদিআঁটা চেয়ার। দেওয়াল-আলমারিতে নানান জিনিস। ফোনও রয়েছে ঘরে। দেওয়ালে গান্ধীজি আর রামকৃষ্ণের ছবি। চমৎকার একটা ক্যালেন্ডার।

কিকিরারা সোফায় বসলেন। টিপয়ের ওপর দু কাপ চা আর প্লেটে কিছু বিস্কুট।

“নিন, চা খান।”

লোচন দত্তর ব্যবহারও খানিকটা পালটে গিয়েছিল। আগের মতন তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করছিল না কিকিরাদের। খাতির করে চা খাওয়াচ্ছে।

কিকিরা চায়ের কাপ তুলে নিলেন। “কাজের কথা আগে সেরে নিই দত্তমশাই?”

“হ্যাঁ, সেরে নিন। আমার আবার তাড়া আছে। রবিবার হলেও একবার বেরোতে হবে।”

“আপনি বলছিলেন, আপনার এক আত্মীয় প্রথমে মোহনের খবরটা দেয়।”

“হ্যাঁ। আমার এক ডিসট্যান্ট রিলেশান। মাসতুতো ভাই হয় সম্পর্কে।”

“মাস দেড়েক আগের ঘটনা বলছিলেন…”

“ওইরকমই। রাতের দিকে ফোন করে বলল ব্যাপারটা।”

“আত্মীয়ের নাম-ঠিকানা? প্লিজ, স্যার এক টুকরো কাগজ যদি দেন।”

টেবিলের ওপর কাগজ ছিল। কিকিরার ইশারায় তারাপদ উঠে গিয়ে কাগজ নিল। ডট পেন তার পকেটেই ছিল।

ফিরে এসে বসল তারাপদ।

লোচন বলল, “নাম অনিল। অনিলচন্দ্র দেব। ঠিকানা দিনেন্দ্র স্ট্রিট। বাড়ির নম্বর একশো বত্রিশ বাই ওয়ান বোধ হয়।”

“নম্বরটা ঠিক মনে পড়ছে না?”

“ওইরকমই। শ্যামবাজারের দিকে। “

“কী করেন ভদ্রলোক?”

“মেশিনারির ডিলার। অফিস মিশন রো-তে।”

“কী বললেন উনি?”

লোচন সিগারেট ধরিয়ে নিল। বলল, “অনিলদা বলল, একটা লোক দু’দিন ধরে বাড়িতে তাকে ফোন করে বলছে যে, সে মোহন।”

“মাত্র ওইটুকু?”

 “না। বলছে যে, সে মরেনি। বেঁচে আছে। তার মরার খবর মিথ্যে।”

 “একথা কেন বলছে?”

“আমি জানি না। তবে সে বলতে চাইছে, আমি মিথ্যে করে তার মরার বির রটিয়েছি। সে বেঁচে আছে।”

কিকিরা তাপাপদর দিকে তাকালেন। তারাপদ অনিলচন্ত্রের নাম-ঠিকানা কে নিয়েছিল আগেই। চা খাচ্ছিল। কিকিরা বললেন, “আর কিছু?”

“না।”

একটু থেমে কিকিরা এবার বললেন, “অনিলবাবুর সঙ্গে আপনি দেখা করেননি?”

“করেছিলাম। আলাদা কিছু জানতে পারিনি।”

“অনিলবাবুর কী মনে হয়েছে?”

“অনিলদা বলল, পাঁচ-ছ বছর পরে তো গলার স্বর মনে থাকার কথা নয়। তবে লোকটা আমাদের বাড়ি সম্পর্কে যা-যা খবর দিল দু-পাঁচটা, তা ঠিকই। “

কিকিরা চা শেষ করলেন। সামান্য চুপ করে থেকে বললেন, “এর পর? মানে অন্য আর কাদের সঙ্গে মোহন যোগাযোগ করেছে?”

নোচন বললেন, “আমাদের এক মামা আছেন.। মায়ের খুড়তুতো ভাই। বয়েস হয়েছে। ডাক্তারি করতেন। মানে চাকরি করতেন করপোরেশনে। রিটায়ার্ড। তাঁকেও লোকটা ফোন করেছিল।”

“মামার নাম? ঠিকানা?”

“পি সি সেন। প্রফুল্ল সেন। ঠিকানা শোভাবাজার।” লোচন ঠিকানা দিল।

“মামাকেও সেই একই কথা”, লোচন বলল, “সে বেঁচে আছে। আমি নাকি মিথ্যে করে তার মরার খবর রটনা করেছি।”

“আপনার মামা তাকে আসতে বললেন না বাড়িতে?”

“মামা বলেছিলেন। ও আসবে না।”

“কেন?”

“বলল, আসার বিপদ আছে।”

“আপনার মামার কী মনে হল লোকটার কথা শুনে?”

লোচন একটা পেনসিল তুলে নিয়ে ঘাড়ের কাছটায় চুলতে নিতে-নিতে বলল, “মামার ধারণা হল, লোকটা চিট, তবে আমাদের বাড়ির খবরাখবর রাখে।”

কিকিরা বললেন, “এর পর? মানে আর কার কার সঙ্গে সে যোগাযোগ করেছে?”

লোচন খানিকটা বিরক্ত হয়ে বলল, “আরও তিন-চারজনের সঙ্গে। তার মধ্যে রয়েছে আমার বন্ধু ভবানী; আমার শ্বশুরবাড়ির তরফের বলতে বড় শ্যালক; আমাদের প্রেসের পুরনো ম্যানেজার তুলসীবাবু, এই পাড়ার মিহিরকাকা।”

“পুরো নাম-ঠিকানাগুলো বলবেন দয়া করে?”

লোচন তার বন্ধু ভবানীর কথা বলল। ভবানী সরকারি চাকরি করে, থাকে ক্রিক রো-তে। শ্বশুরবাড়ির বড় শ্যালকের নাম সতীশ চন্দ্র। সে থাকে বাগবাজারে। আলাদাই থাকে সতীশদা।

কথার মাঝখানে ফোন এল।

লোচন ফোন তুলল, সাড়া দিল, তারপর বলল, “ধরো, ওপরে তোমার মেজদিকে দিচ্ছি।” বলে নিচের ফোনের লাইন ওপরে জুড়ে দিল। দিয়ে নিচের ফোন নামিয়ে রাখল।

তারাপদ নাম-ঠিকানা টুকে নিচ্ছিল।

 “আপনাদের প্রেসের ম্যানেজার?” কিকিরা বলল।

“তুলসীবাবু। তুলসী সিংহ। আমারা “তুলসীকাকা বলতাম। কাকা বছর চার-পাঁচ হল বাড়িতেই বসে আছেন। বয়েস হয়েছে। তা পঁয়ষট্টির বেশিই হবে। উনি শেষের দিকে বার কয়েক বড় বড় অসুখে পড়েন। শেষে হার্টের গোলমাল। তার ওপর চোখে আর দেখতে পাচ্ছিলেন না। ছানি কাটানো হল একটা। কাজ হল না। কাকা রিটায়ার করলেন।”

“কোথায় থাকেন?”

“পটুয়াটোলা লেনে। …কাকা বাড়িতে একাই থাকেন। বিধবা এক ভাইঝি দেখাশোনা করে। কাকা বিয়ে-থা করেননি। নিজের বলতে কেউ নেই। মানুষটি খুব ভাল। ধার্মিক। একমাত্র কাকার কাছেই লোকটা একদিন হাজির হয়েছিল।”

“সামনাসামনি?”

“হ্যাঁ। বৃষ্টির মধ্যে সন্ধের পর।”

“তুলসীবাবু তাকে দেখেছেন?”

“সামান্য দেখেছেন। যে-মানুষের চোখ নেই বললেই চলে–তার দেখা আর না-দেখা সমান।”

“তবু তিনি কী বললেন?”

“মোহনের মতনই লেগেছে তাঁর।”

“ও!… তা সেই লোকটা সরাসরি দেখা বলতে এই যা তুলসীবাবুর সঙ্গেই করেছেন? অন্যদের বেলায়…”

“ফোন। চিঠি।”

“চিঠি?”

“চিঠিও লিখেছে দু-একজনকে। সেই চিঠি আমি দেখেছি। হাতের লেখা খানিকটা মিলে যায়।”

কিকিরা অবাক হলেন। তারাপদর দিকে তাকালেন।

 তারাপদ বলল, “দু-চার বছর পরেও কারও হাতের লেখা দেখলে তার পুরনো হাতের লেখার সঙ্গে মেলাতে গেলে মুশকিল হয়ে পড়ে। অবশ্য খুব চেনা হাতের লেখা হলে অন্য কথা।”

“হাতের লেখা নকল করাও কঠিন নয়। সই জাল, হাতের লেখা জাল-এ তো আকছার হয়। “ লোচন বলল।

কিকিরা কথা পালটে নিলেন। “আর-একজনের কথা বলছিলেন আপনি, পাড়ার লোক।”

“মিহিরকাকা। উনি এই পাড়াতেই থাকেন। একটা ছোট পার্ক আছে ওদিকে। বাচ্চাদের পার্ক। পার্কের গায়েই ওঁর বাড়ি। মিহিরকাকা উকিল মানুষ। বাবার বন্ধু ছিলেন। ওকালতি মন্দ করতেন না, তবে ওঁর শখ হল নাটক করার। এখানে একটা পুরনো ক্লাব আছে নাটকের, ইভনিং ক্লাব। মিহিরকাকা আজ বছর দশ-পনেরো ক্লাব নিয়ে মেতে আছেন। পয়সাওলা বাড়ির ছেলে। চিন্তা-ভাবনা নেই। তবু মিহিরকাকা একসময় যাও বা কোর্টে আসা-যাওয়া করতেন, বছর কয়েক তাও করেন না।”

“কেন?”

“ওঁর ডান হাত অ্যামপুট করতে হয়েছে। গাড়ির সঙ্গে অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল।”

“ইস!”

“ওকালতি প্রায় ছেড়ে দিলেও ক্লাব ছাড়েননি। ক্লাবই এখন ধ্যান-জ্ঞান।”

“জাল মোহন কি ওঁর কাছে গিয়েছিল?”

“না। ফোনে কথা বলেছে।”

“কী বলেছে?”

“সে বেঁচে আছে। এখন কলকাতায় রয়েছে।”

“লোকটার উদ্দেশ্য কী?”

“জানি না। সে-ই জানে। তবে আমার মনে হচ্ছে, লোকটা ভয় দেখিয়ে আমাকে ব্ল্যাকমেল করতে চায়।”

কিকিরা ভেবেছিলেন লোচন ছেলে-চুরির কথা তুলবে। তুলল না। সামান্য অবাকই হলেন তিনি। খানিকক্ষণ কিছু ভাবলেন। তারপর বললেন, “মোহন কোথায় কীভাবে মারা যায়?”।

লোচন যেন সামান্য ইতস্তত করল। বার কয়েক দেখল কিকিরাকে। হতাশ, করুণ মুখ করল কেমন। আবার সিগারেট ধরাল। বলল, “ঘটনার কথা ভাবতে গেলে আমার কী যে হয়ে যায় মশাই, সারা গা ভয়ে শিউরে ওঠে। মনে হয়, কোনো দুঃস্বপ্ন দেখছি।” লোচন চুপ করে থাকল কিছুক্ষণ। আবার বলল, “আমাদের দুই ভাইয়েরই বেড়াবার শখ ছিল। ছুটিছাটায় তো বটেই–এমনিতেও হুট করে বেরিয়ে পড়তাম কাঁধে একটা ব্যাগ ঝুলিয়ে। সেবার আমরা চারজন একটা জায়গায় বেড়াতে যাই। জায়গাটা আপনারা চিনবেন না। বালিয়া জেলার ছোট্ট এক জায়গায়। জঙ্গল আর ছোট-ছোট পাহাড়। গাছপালা, পাখি তো কতই! তার সঙ্গে ছিল এক ঝরনা, ছোট ঝরনা, ঝরনার শেষে একটা লেক। ওখানকার ভাষায় বলে ‘তাল’। বোধ হয় ‘তালাও’ শব্দ থেকে। বর্ষার শেষ সময় গিয়েছিলাম আমরা। অগস্ট মাসে। …যা বলছিলাম, ‘সারাও তাল’ বলে যে লেকটা আছে–তার কাছাকাছি এক মামুলি সরকারি ডাকবাংলোয় আমরা উঠেছিলাম। দিন পাঁচ-সাত থাকার কথা।”

“আপনারা চারজন কে-কে ছিলেন?”

“আমি, মোহন, আমার মেজো শ্যালক, আর মোহনের এক বন্ধু।”

“তারপর?”

“একদিন আমরা ঝরনা দেখতে পাহাড়ের ওপরে গেলাম। পাহাড় যে খুব উঁচু তা নয়। তবে বড় রাফ। খাড়াই পাহাড়। পাথরে ভরতি। ওপরে গাছপালার ঝোঁপ। বেশিরভাগ গাছই ঝোঁপ ধরনের।”

“আপনারা চারজনেই গিয়েছিলেন?”

“হ্যাঁ। চারজনেই। …পাহাড়ের মাথার কাছে এক জায়গায় যেখান থেকে ঝরনার জল নামছে, সেখানে পা রাখাই কষ্টের। পাথর, ঝোঁপ, শ্যাওলা, জংলা। গাছ। …আমি মোহনকে বারণ করেছিলাম আর না-এগোতে। আমার কথা শুনল না। সে এগিয়ে গেল। আমার মেজো শ্যালক আর মোহনের বন্ধু খানিকটা পেছনেই ছিল। মোহন এগিয়ে যাচ্ছে দেখে বাধ্য হয়ে আমিও গেলাম। হঠাৎ একেবারে ঝরনার মুখের কাছে গিয়ে মোহনের পা পিছলে গেল।” লোচন যেন শিউরে উঠে চোখ বন্ধ করল, দৃশ্যটা সে দেখতে পাচ্ছে এখনো।

কিকিরা আর তারাপদ কোনো কথা বললেন না।

নিজেকে সামলে নিয়ে শেষে লোচন বলল, “ঝরনার জলের সঙ্গে পড়তে-পড়তে সে কোথায় যে আটকে গেল পাথরে, ঝোঁপঝাড়ে–তা আর আমরা দেখতে পেলাম না।”

“আপনারা কী করলেন?”

“নিচে নেমে লোকজন জুটিয়ে আনলাম। মোহনকে খুঁজে পাওয়া গেল না। পুরো একটা দিন কেটে গেল। দেড় দিনের মাথায় তাকে উদ্ধার করা গেল। পাথর আর জলের মধ্যে ঘন শ্যাওলার তলায় আটকে রয়েছে। পড়ার সময় তার যা জখম হয়েছিল–তা তো হয়েই ছিল, তার ওপর জলের স্রোতে এখানে-ওখানে ধাক্কা খেতে-খেতে মোহনের চোখমুখ মাথা বলতে কিছুই প্রায় ছিল না। রক্তমাংসের একটা তাল। জলের মধ্যে পড়ে ছিল বলে পোকামাকড় তার গা ঘেঁকে ধরেছে। সারা শরীর ভাঙাচোরা, মাংস খাবলে নিয়েছে যেন কোনও জন্তুজানোয়ারে। সে দৃশ্য বীভৎস!”

“মোহনকে চেনা যাচ্ছিল?”

“কষ্ট হচ্ছিল। তবে আমি চিনতে পেরেছিলাম।”

“আপনার শ্যালক আর মোহনের বন্ধু?”

“তারাও চিনেছিল।”

“মোহনকে আপনারা ওখানেই দাহ করেন?”

“হ্যাঁ। কাছেই। এক ডাক্তার পাওয়া গিয়েছিল মাইল তিনেক তফাতে। পুলিশ-থানাতেও খবর দেওয়া হয়।”

“কাগজপত্র আছে?”

“না। ডাক্তারের সার্টিফিকেট থানায় জমা নিয়ে নেয়। তার একটা কপি পরে আমি আনিয়েছি।”

“আপনার মেজো শ্যালক এখন কোথায়?”

“ডুয়ার্সে? চা বাগানে। সেখানে চাকরি করে।”

“মোহনের বন্ধু?”

“সে চলে গিয়েছিল দিল্লিতে। সেখানে চাকরি করত। তারপর কোথায় আছে আমি জানি না।”

“আপনি কি এদের কোনো খবর দিয়েছেন?”

“মেজো শ্যালককে চিঠি লিখেছি। মোহনের বন্ধুর ঠিকানা আমি জানি না। …কলকাতায় তাদের কেউ নেই।”

কিকিরা খানিকক্ষণ কোনো কথা বললেন না। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “মোহনের কোনো ফোটো হাতের কাছে আছে?”

“না, হাতের কাছে নেই। তবে ওই দেওয়ালে-ওই ছবিটা দেখতে পারেন। আমরা দুই ভাই-ই রয়েছি ফোটোতে।”

কিকিরা এগিয়ে দেওয়ালের কাছে গেলেন। ফোটোটা দেখলেন কিছুক্ষণ।

“আজ আমরা যাই। পরে আপনার কাছে আবার আসছি।” বলে কিকিরা ইশারায় তারাপদকে উঠতে বললেন।