১০. বৈঠকখানাতেই ছিলেন মিহিরবাবু

১০.

নিজের বৈঠকখানাতেই ছিলেন মিহিরবাবু; সাদরে অভ্যর্থনা করলেন কিকিরাদের। কিকিরা আর তারাপদর সঙ্গে চন্দনও এসেছে আজ।

মিহিরবাবু বললেন, “আসুন ম্যাজিকবাবু! আসুন। বসুন।” বলে রহস্যময় চোখ করে চন্দনকে ইশারা করলেন। “এটি কি আপনার দু নম্বর অ্যাসিস্ট্যান্ট?”

কিকিরা যেন কতই লজ্জা পেয়েছেন এমন মুখ করে বললেন, “আজ্ঞে, ঠিক তা নয়, আমার এজেন্সির পার্টনার?”

“পার্টনার! কী এজেন্সি আপনার?”

“কুটুস!”

“কুটুস! তার মানে?”

“স্যার, হওয়া উচিত ছিল কিকিরা-তারাপদ-চন্দন, ছোট করে কে. টি. সি.। তারাপদ একটু পালটে নিয়ে নাম দিয়েছে “কুটুস’।”

মিহিরবাবু হো-হো করে হেসে উঠলেন। হাসি আর থামতে চায় না। শেষে বললেন, “রিয়েলি, আপনি ফানি লোক মশাই। বসুন বসুন। তোমরা বসো। সিট ডাউন। তা ম্যাজিকমশাই, থিয়েটারে আমরা আজকাল ডিরেক্টর, মিউজিক, আলোকসম্পাত রাখি। আপনার এ দুটি বোধ হয় তাই, সঙ্গীত আর আলো, তাই না?”

কিকিরা হাতজোড় করে বললেন, “থিয়েটারের খোঁজ আমি রাখি না স্যার। সেই বড়বাবু, মানে শিশিরবাবুর আমলে রাখতাম।”

মিহিরবাবু মজার মুখ করে দেখলেন কিকিরাকে, চোখের ভঙ্গি থেকে মনে হল, তিনি যেন ঠাট্টা করে বলছেন, তাই নাকি?

কিকিরা এবার পকেট থেকে দুটো লাইটার বের করে মিহিরবাবুর সামনে টেবিলে রাখলেন। বললেন, “স্যার, আমায় আপনি মাফ করবেন। ম্যাজিশিয়ানদের হাত বড় চঞ্চল। লোভ সামলাতে পারে না। নো থিফিং সার, জাস্ট মজাফ্যায়িং…।”

“থিফিং? মানে?”

“মানে, ইয়ে, বলছি চুরি করিনি স্যার, মজাফ্যায়িং-মানে ইয়ে মজা করেছিলাম।”

মিহিরবাবু আবার হেসে উঠলেন জোরে। বিষম খান আর কি! কাশি সামলে বললেন কোনোরকমে, “মশাই, আপনি আমায় নাকের জলে চোখের জলে করে ফেলবেন! ইংরেজরা এদেশে থাকলে আপনাকে শূলে চড়াত।”

“থাকল কোথায়! তাড়িয়ে ছাড়লাম…।”

“বেশ করলেন। তা একটু চা হোক।” বলে টেবিলের সঙ্গে লাগানো ঘন্টি-বোম বাজালেন। মানে, খবর গেল ভেতরে। “দুটো লাইটার কেন? নিয়েছিলেন একটা, দিচ্ছেন দুটো।”

“একটা স্যার আমার প্রণামী! উপহার। বেলজিয়ান লাইটার। যখন জ্বলে তখন লাইটারটার বডিও কালারফুল হয়ে যায়। বেশ দেখতে দেখুন না!”

মিহিরবাবু নতুন লাইটারটা জ্বেলে দেখলেন। দেখতে ভাল–তবে সামান্য বড়। ছোট সিগারেটের প্যাকেটের সাইজ। খুশি হলেন। “দাম কত?”।

“দামের জন্যে কী স্যার!…এটা হল টেবল লাইটার, মানে টেবিলে রাখার। সাইজটা একটু বড় দেখছেন না!”

“না না, তবু…”

“প্লিজ! এটা আমার গুরুদক্ষিণা।”

“গুরুদক্ষিণা?” মিহিরবাবু অবাক।

চন্দন আর তারাপদ মুখ টিপে হাসছিল।

বাড়ির ভেতর থেকে কাজের লোক এল। দাঁড়াল এসে। মিহিরবাবু চায়ের কথা বললেন। তারপর বললেন, “জলুকে বলে দিস, কেউ এলে যেন বলে দেয়, আজ দেখা হবে না, আমি ব্যস্ত রয়েছি। কাল সকালে আসতে।”

লোকটি চলে গেল।

মিহিরবাবু ডিবে থেকে পান তুলে নিতে-নিতে বললেন, “কিকিরাবাবু আপনি মজাদার লোক, ভেরি ইন্টারেস্টিং ম্যান, আবার গোয়েন্দা। ম্যাজিশিয়ান-গোয়েন্দা। তা এ-সবই না হয় মানলুম। কিন্তু মশাই, আপনার গুরুদক্ষিণার ব্যাপারটা তো বুঝলাম না?”

কিকিরা অমায়িক মুখ করে হাসলেন। “বোঝার কী আছে?”

“নেই?”

“না স্যার। যেটুকু আছে পরে বুঝিয়ে দেব।”

“আপনি মশাই আমার পেছনে দুই চেলাকে লাগিয়েছেন?” বলে তারাপদদের দেখালেন।

সঙ্গে-সঙ্গে জিভ বের করে নিজের কান মললেন কিকিরা। “ছিঃ ছিঃ, আপনি বলছেন কী! আপনার পেছনে লোক লাগাব! না না, আপনি ভুল বুঝছেন। আমাদের একটু দেখার ইচ্ছে হয়েছিল–অমলেন্দু আপনার সঙ্গে ওই ক্লাবের আশেপাশে দেখা করে কি না! কৌতূহল মাত্র।…তা এক রিকশাঅলা..” বলতে বলতে কিকিরা তারাপদদের দিকে তাকালেন। বললেন, “রিকশাঅলার কথাটা বলো তো?”

তারাপদ বলল সব।

মিহিরবাবু শুনলেন। চুপ করে থাকলেন কিছুক্ষণ। কপাল কুঁচকে দুশ্চিন্তার ভান করলেন। পরে বললেন, “ব্যাপারটা নতুন মনে হচ্ছে! তা পাড়ার মধ্যে আমাকে কাবু করার সাহস কার হবে? লোচনেরও হবে না।”

“ধরুন, ও যদি আপনার ওপর নজর রাখার জন্যে…”

মিহিরবাবু এবার সকৌতুক মুখে বললেন, “না, আপনারা ভুল করছেন। রিকশাঅলা আমারই লোক। কদিন ধরে ওকে রাখছি। একটু নজর রাখে।”

কিকিরা থ হয়ে গেলেন। “আপনার লোক?”

“হুঁ”

“আমাকে স্যার কে যেন শাসিয়েছে উড়ো চিঠি দিয়ে। বলেছে, দাদু, তুমি নিজের চরকায় তেল দাও।”

তারাপদ বলল, “একটা উটকো লোক এসে কিকিরাদের ট্রামের ওপর ঠেলে ফেলে দিতে গিয়েছিল।”

মিহিরবাবু কিছু বললেন না। জর্দা মুখে দিলেন।

 কিকিরা বললেন, “লোচনের সঙ্গে আমি গত পরশু দেখা করেছিলাম।”

পান-জর্দা মুখে মিহিরবাবু শঙ্কিত গলায় বললেন, “অমলেন্দুর কথা বলেছেন নাকি?”

“পাগল নাকি! তা আমি বলি?”

“তবে কী বললেন?”

“বললাম, জাল মোহনকে প্রায় ধরে ফেলেছি। আর দু-চারটে দিন।”

“বিশ্বাস করল?”

“বুঝতে পারলাম না। তবে জাল মোহনকে দেখতে ওর খুব আগ্রহ।”

“দেখিয়ে দিন।”

কিকিরা একটু হাসলেন। বললেন, “লোচনকে নিয়ে একটু খেলা খেলতে চাই। এখন আপনার দয়া।”

“দয়া?” সন্দেহের চোখে কিকিরাকে দেখলেন মিহিরবাবু, “আপনার মতলবটা কী মশাই? খোলসা করে বলুন তো?”

কিকিরা হাত বাড়িয়ে মিহিরবাবুর সিগারেটের প্যাকেটটা টেনে নিলেন। যেন কিছুই নয়, ধীরেসুস্থে একটা সিগারেট ধরালেন। বললেন, “স্যার, আমার মতলব ভেরি সিম্পল। আমি লোচনকে আপনার এখানে হাজির করাতে চাই।”

এরকম একটা মামুলি কথা শুনতে হবে, মিহিরবাবু ভাবেননি। খানিকটা অবাক হয়ে বললেন, “এর মধ্যে দয়া করার কী আছে, মশাই? লোচন থাকে কাছেই। ক’-পা দূরে; পাড়ার ছেলে, তাকে হাজির করাতে চান, করাবেন।”

“সেইসঙ্গে আপনাকে যে একটা কাজ করতে হবে।”

“কী কাজ?”

“মোহনকে এখানে হাজির করাতে হবে।”

“মোন?” মিহিরবাবু অবাক। “মোহনকে আমি কোথায় পাব?”

 কিকিরা সিগারেটে টান মেরে ধোঁয়া গিললেন। কাশলেন অল্প। তারাপদ আর চন্দনকে এক পলক নজর করে নিলেন। আবার মিহিরবাবুর দিকে তাকালেন। বললেন, “আপনি ছাড়া একাজ কে করবে! আপনিই পারেন

“ধ্যুত মশাই, আমি কি ভগবান? না, আপনার মতন ম্যাজিশিয়ান যে, মরা মানুষ আবার জ্যান্ত করতে পারি?”

“আপনি স্যার আসল। মানে আপনি যন্ত্রী, আমরা যন্ত্র।“

 “তার মানে?”

“তার মানে, এই রহস্যের চাবিকাঠিটি আপনার হাতে। আপনি যতক্ষণ না তালাটা খুলে দিচ্ছেন, কিস্যু করার নেই।”

মিহিরবাবু চুপ। তাকিয়ে থাকলেন কিকিরার দিকে। শেষে বললেন, “মোহনকে আমি কোথায় পাব! সে আর নেই।” বলার সঙ্গে সঙ্গে মিহিরবাবুর চোখ-মুখ কঠিন হয়ে উঠল। কেমন যেন হতাশ, ক্রুদ্ধ!

কিকিরা বললেন, “জাল মোহনের কথা বলছি। আমি জানি আসল মোহন আর নেই।”

মিহিরবাবু কথা বললেন না। তাঁর মুখ আরও থমথমে হয়ে উঠল। দুটি চোখ যেন কঠিন হল। অন্যমনস্ক হয়ে পড়লেন।

কিকিরা অপেক্ষা করতে লাগলেন।

শেষে মিহিরবাবু বললেন, “আপনি কি সব বুঝতে পেরেছেন?”

 মাথা হেলিয়ে কিকিরা বললেন, “খানিকটা। আমি বুঝতে পেরেছি এই জাল মোহনকে আপনি এনেছেন? ঠিক কি না?”

মিহিরাবাবু তাকিয়ে থাকলেন অন্যদিকে। তবে মাথা নাড়লেন। হ্যাঁ, তিনিই এনেছেন।

কিকিরা বললেন, “লোচনকে আপনি সব দিক থেকে কোণঠাসা করে ফেলতে চান, তাই না?”

“হ্যাঁ।”

“কেন?”

মিহিরবাবু এবার যেন আচমকা জ্বলে উঠলেন। বললেন, “সে খুনি। মাডারার। শয়তান।”

“আপনি কি শুধু খুনি লোকটাকে ধরার জন্যে এত চেষ্টা করছেন?”

মিহিরবাবুর আর যেন ধৈর্য থাকল না। বললেন, “শুধু খুনি বলে…? না, তার চেয়েও বেশি। আপনি কেমন করে জানবেন মোহনের সঙ্গে আমার সম্পর্ক কী ছিল! আপনি জানেন না। আমি ওকে নিজের ছোট ভাইয়ের। চেয়েও বেশি ভালবাসতাম। বলতে পারেন, ছেলের মতনই। ও এত ভাল, সরল, শান্ত ছিল। সবাই ওকে ভালবাসত। তা ছাড়া রামদা, মানে মোহনের বাবা আমায় বিশ্বাস করতেন, স্নেহ করতেন। তিনি আমায় বারবার বলেছেন, “মিহির, সংসার বড় খারাপ জায়গা, আমার ছেলেটাকে তুমি দেখো।” আমি তখন অত কিছু ভাবিনি, বলেছিলাম, আপনি ভাবছেন কেন, নিশ্চয় দেখব।’

মিহিরবাবু থেমে গেলেন। কে যেন আসছিল।

বাড়ির লোক ঘরে এল। চা রেখে গেল টেবিলের ওপর। চায়ের সঙ্গে কিছু প্যাসট্রি।

মিহিরবাবু বললেন, “নিন, চা খান…যা বলছিলাম ৷ সংসার বড় অদ্ভুত জায়গা। এখানে কী না হয়। আমি তো কিছুকাল ওকালতি করেছি। ক্রিমিনালও না ঘেঁটেছি এমন নয়। লোচন একটা পাক্কা ক্রিমিনাল। মোহনকে সে মেরেছে। হি হ্যাজ কিলড হিম।”

“আমারও তাই সন্দেহ।”

“সন্দেহ নয়, সত্যি। …আপনি বলবেন, প্রমাণ কী? প্রমাণ নেই। লোচন অত্যন্ত চালাক, ওর মগজ ক্রিমিনালের। ভাইকে খুন করার পর ও এমনভাবে জিনিসগুলো ওর তরফে সাজিয়ে নিয়েছে যে, আইনমাফিক ওকে ধরবার উপায় রাখেনি। আইন প্রমাণ চায়–অনুমান সন্দেহ এ-সব স্বীকার করে না। লোচন এক দেহাতি ডাক্তারের ডেথ সার্টিফিকেট জোগাড় করেছে। থানা আর ডাক্তারকে টাকাও খাইয়েছে নিশ্চয়। আইডেনটিফিকেশন করিয়ে নিয়েছে ওর মেজো শ্যালক আর অমলেন্দুকে দিয়ে। সব পথ ও মেরে রেখেছে।”

“তা হলে?”

“তা হলেও সব চাপা দেওয়া যায় না। আইন আইন, মানুষ মানুষ। অমলেন্দুর মুখে সব শুনে আমি বুঝতে পারি, লোচন কেমনভাবে সাজিয়ে-গুছিয়ে একাজ করেছে।”

“অমলেন্দু কী বলেছে?”

“বলেছে, ঝরনা দেখতে যাওয়ার প্ল্যানটা লোচনের। অবশ্য তাতে কিছু প্রমাণ হয় না। কিন্তু পাহাড়ের যে-জায়গায় মোহনকে সে নিয়ে গিয়েছিল, সেখানে মোহন যেতে চায়নি। মোহন বরাবরই ভিতু ধরনের। সাবধানী। লোচন তাকে ভুলিয়েভালিয়ে নিয়ে গিয়েছিল।”

“অমলেন্দুরা কাছে ছিল না?”

“না। যাওয়ার সময় পাহাড়ের মাথায় লোচনের মেজো শ্যালক চালাকি করে এক জায়গায় বসে পড়ল। বলল, পায়ের শিরায় টান ধরে গিয়েছে, একটু ম্যাসাজ করে নিয়ে উঠে দাঁড়াবে। সে অমলেন্দুকে ছুতো করে কিছুক্ষণ আটকে রাখল। ততক্ষণে লোচন আর মোহন অন্তত ত্রিশ-চল্লিশ গজ এগিয়ে গিয়েছে। তা ছাড়া পাহাড়ি জায়গা, ওরা খানিকটা আড়ালে পড়ে গিয়েছিল। লোচন যখন মোহনকে ঠেলে দেয় ঝরনার স্রোতে, তখন আশেপাশে কেউ ছিল না।”

চন্দন বলল, “একেবারে প্ল্যানড ব্যাপার।”

“একেবারে ছক কেটে খুন করা। …আমার মনে হয় না, মোহনের বডি যখন দেড়দিন পরে পাওয়া গেল–ওকে পোস্টমর্টেম করলেও প্রমাণ করা যেত এটা অ্যাকসিডেন্ট নয়, অন্য কিছু?” বলে চন্দনের দিকে তাকালেন মিহিরবাবু।

চন্দন বলল, “আমারও মনে হয় না, পোস্টমর্টেম রিপোর্ট থেকে বলা যেত কেউ মোহনকে জলে ঠেলে ফেলে দিয়েছে। ঝরনার স্রোত, জল, পাহাড়, পাথর, খানাখন্দ–শরীরের কোন “জখম কেমন করে হয়েছে তা বলা যেমন মুশকিল ছিল, তেমন বলা যেত না, ওটা অ্যাকসিডেন্ট নয়, কিলিং। আমারও তাই মনে হয়। তা ছাড়া ডেডবডিও পাওয়া গেছে প্রায় দেড়দিনের মাথায়। …তা পোস্টমর্টেম যখন হয়নি, হওয়া সম্ভব ছিল না ওখানে, তখন আর ও নিয়ে মাথা ঘামিয়ে কী লাভ!”

মিহিরবাবু বললেন, “আমি এসব কথা অমলেন্দুর মুখে শুনেছি।”

“ও কি আপনাকে আগেই এসব কথা বলেছিল?”

“ফিরে এসেই বলেছিল। মোহনকে সে খুবই ভালবাসত। তবে–গোড়ায় তার সন্দেহ ততটা হয়নি। আমার হয়েছিল। আমি যখন বারবার তাকে খুঁচিয়ে নানা কথা জিজ্ঞেস করতে লাগলাম, তখনই তার সন্দেহ হতে লাগল।”

কিকিরা বললেন, “ও দিল্লি চলে গেল কেন? ঘটনাটার পরই যেন পালাল।”

“একটা কাজ পেয়ে গেল। তা ছাড়া আমিও ওকে চলে যেতে বললুম। বলা কি যায়, কোনো কারণে যদি লোচনের সন্দেহ হয় ওর ওপর, তাতে বিপদ হতে পারে।”

তারাপদ কথা বলল এবার। বলল, “তখন থেকেই কি আপনি…”

তারাপদকে কথা শেষ করতে না দিয়েই মিহিরবাবু বললেন, “অমলেন্দু দিল্লি যাওয়ার আগে আমি তাকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছিলুম, একদিন না একদিন–এই খুনের শোধ আমরা নেব। লোচনকে ফাঁসিকাঠে ঝোলাব।”

কিকিরা বললেন, “আজ পাঁচ বছর ধরে আপনারা সে-চেষ্টা করেছেন?”

“হ্যাঁ, পাঁচ বছর ধরে। ধীরে ধীরে। …লোচনকে ভুলে যেতে দিয়েছি তখনকার ঘটনা। ভুলে যেতে দিয়েছি তার ওপর কোনো সন্দেহ রয়েছে। কারও। সে ভাবতেই পারেনি তার কোনও চরম শত্রু আছে, যে তাকে খুনের মামলায় আসামি করতে পারে। সে এই ক’ বছর নাকে তেল দিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়েছে, সম্পত্তি ভোগ করেছে। নিজের খেয়ালে যা পেরেছে বেচেছে, দেনা বাড়িয়েছে, এমনকী অন্য জায়গায় চলে যাওয়ার তোড়জোড় করছে নতুন বাড়ি করে। আর আমি তলায়-তলায় নিজের কাজ করে গিয়েছি।”

চা শেষ হল কিকিরাদের। একটা পান নিলেন তিনি।

মিহিরবাবু অন্যমনস্কভাবে সিগারেট নিলেন। লাইটার জ্বালিয়ে হাত বাড়িয়ে দিলেন কিকিরা।

সিগারেট ধরিয়ে নিয়ে মিহিরবাবু বললেন, “আমি তাড়াহুড়ো করে কিছু করিনি। ধৈর্য ধরে ধীরে-ধীরে করতে হয়েছে যা করার। একদিকে লোচন যেমন নিশ্চিন্ত হয়ে দিন কাটিয়েছে, ভেবেছে সে নিরাপদ, তার কোনো ভয়। নেই, অন্যদিকে তার গলায় ফাঁস বাঁধার সবরকম চেষ্টা আমি গুছিয়ে নিয়েছি।”

কিকিরা বললেন, “ আপনি জাল মোহনকে আসল মোন করতে চেয়েছেন বুদ্ধি করে।”

“হ্যাঁ। জালকে আসল করা যায় না। কিন্তু ধোঁকা দেওয়া যায়।”

তারাপদ বলল, “অনিলবাবু, সতীশবাবু, তুলসীবাবু-মানে এদের সকলকে আপনিই বেছে নিয়েছিলেন?”

মিহিরবাবু মাথা নাড়লেন। “ভেবে-ভেবে এদেরই বেছে নিয়েছিলাম। এরা কেউ লোচনের আত্মীয়, কেউ বন্ধু, কেউ পুরনো কর্মচারী। লোচন যখন এদের কাছ থেকে একে একে মোহনের কথা শুনবে, ধাঁধায় পড়ে যাবে। পাপের মন যার, সে কি আর নিশ্চিন্ত হয়ে থাকতে পারে। লোচনের এখন মনের অবস্থা বুঝতেই পারছ। তার ঘুম বন্ধ হয়ে গেছে।”

কিকিরা বললেন, “আপনাকে অনেক খবর জোগাড় করতে হয়েছে।”

“অনেক। লোচনরা আমাদের প্রতিবেশী। তাদের বাইরের খবর কম-বেশি আমি জানি। তা ছাড়া রামদার কাছে শুনেছি নানা কথা। …তবু বাড়ির ভেতরের খবর? সে সব তো আমার অত জানা নেই। এক-এক করে কুড়িয়ে বাড়িয়ে এখান-ওখান থেকে সেগুলো জোগাড় করতে হয়েছে কাঠখড় পুড়িয়ে। ওই খবরগুলো যদি না জানা থাকে, নকল মোহনকে আসল মোহন বলে ধোঁকা দিয়ে চালানোর চেষ্টা করা যেত না।”

“ছাপাখানার খবরও নিয়েছেন দেখছি?”

“নিয়েছি। না নিলে কেমন করে লোচন আর তুলসীবাবু ধোঁকা খাবে।”

“তুলসীবাবুর কাছে আপনি অমলেন্দুকে মোহন সাজিয়ে পাঠিয়েছিলেন।”

“হ্যাঁ। কারণ তুলসীবাবু নোচনের বিশ্বস্ত কর্মচারী। কর্মচারী বিশ্বস্ত হলেও, ভদ্রলোক এখন চোখে ভাল দেখেন না। এই সুযোগটা নিয়েছি। তা ছাড়া আপনাকে আগেই বলেছি, অমলেন্দু মেক-আপটা ভাল নিতে পারে; গলার স্বর পালটাবারও ক্ষমতা রয়েছে ওর। …শুনতে চান তো শুনিয়ে দিতে পারি।”

তারাপদ বলল, “শুনি একটু।”

 মিহিরবাবু তাঁর সেক্রেটারিয়েট টেবিলের তালা-লাগানো ড্রয়ার খুলে একটা ছোট টেপ রেকর্ডার মেশিন আর টেপ বের করলেন। দেখেই বোঝা গেল, বিদেশি মেশিন।

“এখন যার গলা শুনবেন এটা আসলে অমলেন্দুর, কিন্তু নকল মোহনের।” বলে মিহিরবাবু মেশিন চালিয়ে দিলেন। ব্যাটারি তাজাই ছিল। টেপ বাজতে লাগল। তারাপদরা ঝুঁকে পড়ে শুনতে লাগল নকল মোহনের গলা।

কিছুক্ষণ পরে মিহিরবাবু বললেন, “এই গলার সঙ্গে আসল মোহনের গলার স্বর আপনারা চট করে ঠাওর করতে পারবেন না। শোনাচ্ছি সেই আসল গলা।”

মেশিন থেকে ক্যাসেটটা খুলে নিয়ে অন্য একটা ক্যাসেট ঢুকিয়ে দিলেন মিহিরবাবু। বললেন, “এই গলাটা আসল মোহনের। তবে এখানে যা শুনবেন–সেটা আমাদের নাটক থেকে। মাঝে-মাঝে শখ করে আমরা নাটকের কিছু কিছু অংশ টেপ করে রাখি। শুনুন এবার।”

মেশিন চালিয়ে দিলেন মিহিরবাবু।

দু জনের গলার স্বরের পার্থক্য ধরা সত্যিই মুশকিলের। হয়ত বারবার শুনলে.ধরা যেতে পারে। নয়ত ধরা যাবে না।

কিকি বললেন, “বুঝেছি। আর দরকার নেই।”

মেশিন বন্ধ করলেন মিহিরবাবু। বললেন, “অমলেন্দু প্র্যাকটিস করে গলাটা ধরেছে বেশ।”

কিকিরা হঠাৎ বললেন, “হাতের লেখা? সেটাও কী..”।

মিহিরবাবু একটু হাসলেন। বললেন, “মোহন আমাদের নাটকের সময় রিহার্সাল দেওয়ার কপি তৈরি করত। পার্ট মুখস্থ করার কপি লিখত। তার হাতের লেখা আমার কাছে অনেক আছে। অমলেন্দুকে দিয়ে দিনের পর দিন তা নকল করিয়েছি।”

“এখানে?”

“না, দিল্লিতে থাকতেই এ-সব করেছে অমলেন্দু। একাজ দু-একদিনে হয় না। সময় লাগে।“

কিকিরা চুপ করে থাকলেন। মিহিরবাবুর ধৈর্য ও অধ্যবসায়কে প্রশংসা করতে হয়। বুদ্ধিকেও।

শেষমেশ কিকিরা বললেন, “আপনি এত কষ্ট করলেন যে-জন্যে তার চৌদ্দ আনাই কাজে লেগেছে। লোচনকে চারপাশ থেকে আপনি চেপে ধরেছেন। সে ভয় পেয়েছে। ভীষণ অশান্তির মধ্যে রয়েছে।”

“আমি তাই চেয়েছিলাম। চারদিক থেকে প্রেশার দিয়ে ওর মনের ডিফেন্সট্রা আগে ভেঙে দিতে.”

“বাকি দু আনা কাজই আসল। তাই না, স্যার?…ওটা আমায় করতে দিন।”

“কী কাজ?”

“লোচনকে আমি আপনার কাছে নিয়ে আসতে চাই। …ওকে এখানে আনার পর বাকি কাজটাও আপনি করবেন।”

“সে আসবে?”

“মনে হয় আসবে। জাল মোহনকে ধরার জন্যে সে উন্মাদ। লোচন বুঝতে পেরেছে, এই জাল মোহনকে ধরতে না-পারা পর্যন্ত তার শাস্তি হবে না। যদি নকল মোহন এইভাবেই থেকে যায়, সে তাকে জ্বালাবে। দিনের পর দিন।”

মিহিরবাবু কী যেন ভাবলেন। বললেন, “লোচনকে আপনি আনবেন কেমন করে?”

কিকিরা রহস্যময় হাসি হাসলেন। “আনব। সে-দায়িত্ব আমার।”

“আপনি বলবেন, জাল মোহন আমার কাছে আসা-যাওয়া করে, এই তো?”

“ধরেছেন ঠিক। বলব, জাল মোহন আপনার কাছে হালে বার কয়েক এসেছে। সে চাইছে আপনার পরামর্শ নিয়ে মামলা-মোকদ্দমা কিছু একটা লাগিয়ে দিতে। তাকে ভয় দেখাব। বলব, মামলা যদি একবার লেগে যায়–এ সেই দীনরাম মামলার মতন হয়ে যাবে। কত বছর চলবে কেউ জানে না।“ বলে কিকিরা হাত বাড়িয়ে ডিবে থেকে একটা পান নিলেন। বললেন, “লোচনের কাগজে নোটিস ছাপার উদ্দেশ্য কী ছিল? কী চেয়েছিল সে? চেয়েছিল জাল মোহনের খোঁজ। কে সে, কোথায় আছে, কী তার মতলব, দেখে নিতে। তা স্যার, এখন যদি লোচন সেই জাল মোহনকে সরাসরি হাতে পায়, ছাড়বে কেন?”

মিহিরবাবু মাথা হেলালেন। “বেশ, আনুন। কিন্তু..”

“কিন্তুর কিছু নেই। আপনি তৈরি থাকুন। একেবারে পাকাপাকিভাবে।” বলে কিকি নতুন লাইটারটা দেখিয়ে ইঙ্গিতে কিছু বুঝিয়ে দিলেন।

মিহিরবাবু ভাবলেন কিছুক্ষণ। “কবে আনবেন লোচনকে?”

“আপনি বলুন?”

“আসছে বুধবার আনুন। আমি ক্লাবে যাব না।”

“সন্ধেবেলাতেই আসব।”

“আসুন। ..আমি তৈরি থাকব।”