১১. সন্ধে সাতটা নাগাদ

১১.

আসার কথা ছিল সন্ধে সাতটা নাগাদ, ঘড়িতে সোয়া সাতটা বেজে যাওয়ার পরও লোচন আসছে না দেখে মিহিরবাবু চঞ্চল হয়ে উঠছিলেন। ব্যবস্থা তিনি সবই করে রেখেছেন, এখন শুধু নোচনের অপেক্ষা।

সাড়ে সাতটা নাগাদ কিকিরা এলেন। সঙ্গে লোচন। তারাপদও ছিল।

ঘরে ঢুকেই লোচন উত্তেজিত গলায় বলল, “এ-সমস্ত কী হচ্ছে মিহিরকাকা? শেষ পর্যন্ত আপনি…!”

মিহিরবাবু স্বাভাবিক গলায় বললেন, “বোসো। আমি আবার কী করলাম হে?”

লোচন উত্তেজিত। ক্রুদ্ধ। বলল, “এঁরা বলছেন, আপনি একটা চোর-জোচ্চোরকে বাড়িতে আসা-যাওয়া করতে দিচ্ছেন?”

মিহিরবাবু হাসিমুখে বললেন, “আমি উকিল মানুষ, আমার কাছে সাধুও যা, চোরও তাই। মক্কেলের জাত-বিচার থাকে না।”

“আপনি ওকালতি ছেড়ে দিয়েছেন?”

“তা দিয়েছি। তবে মাঝে-মাঝে পুরনো মক্কেলদের অ্যাডভাইস দিতে হয় বইকি! কমলা ছাড়লেও কমলি কি আর ছাড়ে! বাসো বোসো। দাঁড়িয়ে আছ কেন?”

লোচন বসল না। রাগের গলায় বলল, “এঁরা বলছেন, আপনার এখানে সেই জোচ্চোরটা লুকিয়ে লুকিয়ে আসে?”

মিহিরবাবু শান্তভাবেই বললেন, “আগে বোসো। তুমি তো এসেই রাগারাগি শুরু করলে! বোসো আগে, তারপর তোমার কথা শুনি।”

লোচন বসল।

কিকিরারা আগেই বসে পড়েছিলেন। বসে পড়ে অন্যমনস্কভাবে টেবিল থেকে সেই নতুন লাইটারটা তুলে নিয়ে জ্বালালেন। নিভিয়ে দিলেন আবার।

মিহিরবাবু বললেন, “এবার বলো, কী বলছিলে?”

লোচন বলল, “আমি সেই জোচ্চোর লোকটার কথা বলছি। “

“মোহনের কথা?”

“কে মোহন? জাল-জালিয়াত একটা লোককে আপনি মোহন বলছেন?”

“জাল-জালিয়াত…!” মিহিরবাবু বললেন। বলে মাথা নাড়ালেন, “তুমি বলছ জাল-জালিয়াত। সে বলছে, ও মোটেই জাল নয়।”

“ও বলছে! ও কে?…আপনি মোহনকে চেনেন না? তাকে ছেলেবেলা থেকে দেখেননি? মোহন না আপনার আদরের ছেলে ছিল?”

মাথা হেলিয়ে মিহিরবাবু বললেন, “মোহনকে আমি সব দিক দিয়েই ভাল করে চিনি বলেই বলছি, ও মোহন। “

লোচন একেবারে হতভম্ব। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল মিহিরবাবুর দিকে। কী বলবে যেন বুঝে উঠতে পারছিল না। ক্রমেই তার মাথায় যেন রক্ত চড়তে লাগল। চেঁচিয়ে বলল, “আপনি বলছেন মোহন। আশ্চর্য! আপনি একটা জালিয়াতকে মোহন বলছেন?”

“তুমি কি ভাবছ, আমার মাথা খারাপ হয়েছে?”

 রাগে যেন ফেটে পড়ল লোচন। “আপনি, আপনি একটা জালিয়াতকে কেমন করে মোহন ভাবছেন আমি জানি না।”

“প্রমাণ না পেলে ভাবতাম না।”

“প্রমাণ? কী বলছেন? সত্যিই আপনার মাথার গোলমাল হয়েছে। আপনি কি সেই চিঠির হাতের লেখার কথা বলছেন? ওটা কোনো প্রমাণ?”।

মিহিরবাবু বললেন, “লেখা না,হয় নকল হল, কিন্তু মোহনের বন্ধুবান্ধব।” হলে তিনি বইয়ের আলমারির দিকে হাত তুলে কী যেন দেখালেন। বললেন, “ওই যে ওখানে যে-ছেলেটি বসে আছে সে মোহনের ছেলেবেলার বন্ধু।”

লোচন ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল। আলমারির পাশ ঘেঁষে আড়ালে চন্দন বসে ছিল। তাকে দেখল লোচন। অচেনা মানুষ।

মিহিরবাবু বললেন, “ওকে জিজ্ঞেস করো?”

জিজ্ঞেস করতে হল না। চন্দনকে শেখানো ছিল। সে নিজেই বলল, “মোহনদা আমার স্কুলের বন্ধু। আমরা সেন্ট পলস স্কুলে একসঙ্গে পড়তাম। তখন আমি পিসির কাছে গড়পারে থাকতাম। আমার চেয়ে এক বছরের সিনিয়র ছিল মোহনদা। সিনিয়ার হলেও বন্ধু ছিল। কলেজে আমরা ছাড়াছাড়ি হয়ে যাই। মোহনদা সেন্ট পলসেই ছিল, আমি স্কটিশে…। তারপর আমি ডাক্তারিতে..”

লোচন অদ্ভুত চোখে চন্দনকে দেখছিল।

 চন্দন বলল, “আমি এখন ডাক্তার। মোহনদা..”

“কোথায় বাড়ি আপনার?” লোচন বলল হঠাৎ।

 “বাড়ি বহরমপুর। এখানে থাকি কোয়ার্টারে, মেডিকেল মেস…”

“আপনি মোহনকে দেখেছেন?”

“দেখব মানে? কী বলছেন আপনি! আগে প্রায়ই দেখাশোনা হত, তারপর আর হয়নি। শুনেছিলাম মোহনদা মারা গেছে। সেটাই জানতাম। হঠাৎ মাসখানেক আগে দেখা। ট্রামে। আমি অবাক।”

লোচন চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ার মতন করে দাঁড়িয়ে পড়ল। “বাজে কথা। মিথ্যে কথা। মোহন নয়। মোহন হতেই পারে না।”

“মানে! মোহনদা নয়!…আলবাত মোহনদা। আমরা ট্রাম থেকে নেমে চায়ের দোকানে বসে চা খেলাম। কত পুরনো গল্প হল!”

অবিশ্বাসের মুখ করে লোচন বলল, “কখনোই নয়। এ-সবই সাজানো।” বলে মিহিরবাবুর দিকে তাকাল। “আপনি ওকে মিথ্যে সাক্ষী সাজিয়েছেন।”

“আমি! কেন?”

“ওই জালিয়াত আপনাকে ব্রাইব করেছে। ছি ছি, মিহিরকাকা… ছি!”

মিহিরবাবু শান্তভাবেই বললেন, “নোচন, আমাদের পরিবারের কাউকে টাকা দিয়ে এ-পর্যন্ত কেউ কেনেনি। তুমি খুব খারাপ কথা বললে। অন্য সময় হলে তোমাকে আমি এখানে দাঁড়াতে দিতাম না। …যাকগে, সাক্ষীও শুধু একা নয়, আরও আছে।”

চন্দন সঙ্গে-সঙ্গে বললে, “আছে বইকী! মোহনদাকে নিয়ে আজ কদিন আমি অন্তত চার-পাঁচ জায়গায় গিয়েছি। আদিত্য, হরিহর, বিজন… সকলেই আমাদের বন্ধু। ওরা সবাই শুনেছিল মোহনদা মারা গিয়েছে। আজ জানতে পারছে, খবরটা ভুল। “

লোচন মিহিরবাবুর দিকে তাকাল। রাগে গা জ্বলছে, চোখ লাল। গলার স্বর রুক্ষ। বলল, “আমি বুঝতে পেরেছি, আপনি একটা জাল লোকের হয়ে মামলসা সাজাচ্ছেন।”

“হ্যাঁ, সাজাচ্ছি। তবে জাল লোকের নয়, আসল লোকের হয়ে। …হয়ত এ-নিয়ে আমি মাথা ঘামাতাম না। চিঠিটাও জাল বলে ভেবে নিতাম। কিন্তু মোহন জাল নয়। জাল হলে ও বারবার আমার কাছে আসত না। মাঝে-মাঝে এখন সে এখানে আসছে। ওর পুরনো জানাশোনা লোকেদেরও আনছে সঙ্গে করে। আমি এখন কনভিনড় যে, জাল নয়, এই মোহনই আসল।”

“অসম্ভব। হতেই পারে না।”

“তুমি যতই অসম্ভব বলল, আমি মনে করছি, মোহন মারা যায়নি। সে বেঁচে আছে। আর এখন সে কলকাতায়।”

লোচন পাগলের মতন চেঁচিয়ে উঠল। “কোথায় সে! ডেকে আনুন তাকে। আমার সামনে এসে দাঁড়াক। দেখি সে কেমন মোহন?”

কিকিরা এমন মুখ করে বসে থাকলেন যেন তিনি নীরব দর্শক। অবশ্য চোখে-চোখে যেন কিছু বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন মিহিরবাবুকে।

মিহিরবাবু বললেন, “লোচন, তুমি যদি মোহনকে দেখতে চাও দেখাতে পারি। কিন্তু আমি বলি দেখাটা আদালতে হওয়াই ভাল।”

লোচন কাঁপছিল। বলল, “মিহিরকাকা, আমাকে আপনারা ব্ল্যাকমেইল করতে চান? লোচন দত্ত অত সহজে ভয় পায় না।”

“তোমায় কেন ব্ল্যাকমেইল করব হে?”

“করেছেন। আপনি না করুন আপনার মক্কেল করেছে। জাল মোহন। আমার ছেলেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। নেয়নি?”

এবার কিকিরা কথা বললেন। মাথা নেড়ে বললেন, “ওটা আপনারই চলি দত্তবাবু! একবেলার জন্যে ছেলেকে ভবানীপুর পাঠিয়েছিলেন, আপনার এক ভায়রার বাড়ি। নিজেই ছেলেকে সরিয়ে দিয়ে দেখাতে চাইছিলেন জাল মোহন আপনাকে ব্ল্যাক মেইল করতে চায়।”

লোচন থতমত খেয়ে গেল। “আমি? আমি আমার ছেলেকে সরিয়ে রেখেছিলাম? কে বলল?”

“আপনার পালোয়ান দরোয়ান। একশো টাকা খসিয়ে খবরটা পেয়েছি। তারপর ভবানীপুরেও খোঁজ করেছি। …আপনি মশাই, ডালে-ডালে যান, গোয়িং ব্রাঞ্চেস, আর আমি যাই পাতায়-পাতায়, গোয়িং লিফ। আপনি দত্তমশাই আমার পেছনে গুণ্ডাও লাগিয়েছেন। উড়ো চিঠি পাঠিয়েছেন ভয় দেখিয়ে।”

লোচন থরথর করে কাঁপছিল। খেপে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠল। “ভাঁড়ামি করবেন না। আমার ছেলেকে আমি সরাইনি।”

“কেন মিথ্যে কথা বলছেন দত্তবাবু! ধোপে টিকবে না।”

“তাই নাকি!” লোচন যেন ব্যঙ্গ করে হাসল। আপনাদের মোহন ধোপে টিকবে?”

“টিকবে না?”

“না, না, না। নেভার। এ-জন্মে নয়। হাজার চেষ্টা করলেও নয়।”

“নয় কেন? এত সাক্ষীসাবুদ, তবু নয়?”

“বলছি নয়। মোহন নেই। সে ফিরে আসতে পারে না।”

কিকিরা বললেন, “মোহন ফিরে এসেছে। আপনি কি তাকে দেখতে চান?”

লোচন থতমত খেয়ে গেল। কী বলছে ওই ম্যাজিকঅলা! লোকটার গালে থাপ্পড় মারার জন্যে হাত উঠে যাচ্ছিল লোচনের। বিশ্রীভাবে চেঁচিয়ে উঠে সে বলল, “হ্যাঁ, চাই। দেখান তাকে।”

কিকিরা মিহিরবাবুর দিকে তাকাল।

মিহিরবাবু চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন ধীরে ধীরে। বললেন, “দেখাচ্ছি। সে এখানেই আছে। আনছি তাকে।” বলে উনি ডান দিকে এগোলেন। পরদা ফেলা ছিল। পরদা সরিয়ে পাশের ঘরে চলে গেলেন।

লোচন একেবারে খেপে গিয়েছিল। নিজের মনে চেঁচাতে লাগল, গালমন্দ শুরু করল কিকিরা আর মিহিরবাবুকে।

কিকিরা বললেন, “অনর্থক চেঁচাচ্ছেন কেন? দু দণ্ড অপেক্ষা করতে পারছেন না? মোহনকে আগে দেখুন!”

“শাট আপ! মোহনকে দেখুন? আপনারা আমায় মোহন দেখাবেন? যত্তসব ধাপ্পাবাজ চোর-জোচ্চোরের দল! আপনাদের আমি কোর্টে নিয়ে যাব।”

“যাবেন। তার আগে মোহনকে দেখুন।”

“আমায় মোহন দেখাবেন! বেশ, দেখান। তবে জেনে রাখবেন-সূর্য পশ্চিম দিকে ওঠে না। মোহনও আর ফিরে আসবে না। আমার চোখের সামনে সে মারা গেছে।”

“মারা গেছে! …আপনিই তাকে আর কত মারবেন দত্তবাবু! এতকাল তো মেরেই এসেছেন। এবার জ্যান্ত হতে দিন।”

লোচন যেন বোধবুদ্ধি হারিয়ে ফেলল হঠাৎ। উত্তেজনার মাথায় চেঁচিয়ে উঠল, “না, সে জ্যান্ত হবে না। আমি তাকে মেরেছি। আমি। আমি নিজে। মরা মানুষ বেঁচে ফিরে আসে না।”

কিকিরা যেন হাসলেন। “আপনি স্বীকার করলেন আপনি মোহনকে মেরেছেন।”

“করলাম। মুখে করলাম। তাতে আমার কী হবে! আপনারা আমার কী করবেন মশাই! পুলিশে নিয়ে যাবেন? বলব, বাজে কথা, আমি কিছু বলিনি। কোর্ট-কাছারি করবেন? বলব, বানানো কথা সব…।”

লোচনের কথা শেষ হল না, মিহিরবাবু ঘরে এলেন। সঙ্গে অমলেন্দু।

 অমলেন্দুকে দেখে লোচন যেন বুঝতেই পারল না, কাকে দেখছে? চেনা, না, অচেনা কাউকে। স্তম্ভিত। মুখে আর কথা নেই।

মিহিরবাবু লোচনকে বললেন, “একে চেনো না? অমলেন্দু। মোহনের বন্ধু। তোমাদের সঙ্গে সেদিন ছিল।”

লোচনের মুখ কালো হয়ে উঠেছিল। গলা কাঠ। বলল, “ও এখানে কেন? কোত্থেকে এসেছে?”

কিকিরা ততক্ষণে হাত বাড়িয়ে টেবিল থেকে সেই বেলজিয়ান টেবিল লাইটার তুলে নিয়েছেন। তুলে নিয়ে মিহিরবাবুকে বললেন, “এই নিন স্যার। এটা রেখে দিন যত্ন করে। টেপ হয়ে গেছে সব কথাবার্তা। দত্তমশাই স্বীকার করছেন–নিজের ভাইকে তিনি মেরেছেন।” বলে কিকিরা লাইটার-টেপ রেকর্ডারটা চালিয়ে দিলেন।

লোচন চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ল। সে বুঝতে পারছিল না কী করবে। পালাবে, না, কিকিরার হাত থেকে জিনিসটা কেড়ে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেবে।

মিহিরবাবু বললেন, “লোচন, ওই টেপে তোমার স্বীকারোক্তি ধরা থাকল। আর দু নম্বর প্রমাণ, সাক্ষী থাকল এই অমলেন্দু। তুমি মোহনকে ধাক্কা দিয়ে ঝরনার স্রোতে ফেলে দিয়েছিলে। এবার তুমি কেমন করে বাঁচো তা আমরা দেখব। তুমি বাঁচতে পারবে না। ভাইকে তুমি মেরেছ। তুমি ভেবেছিলে তুমিই একমাত্র চালাক লোক, তোমায় কেউ ধরতে পারবে না। তুমি ধরা পড়েছ। পাঁচ বছরের চেষ্টা আজ আমার সফল হয়েছে।”

লোচন পালাবার চেষ্টা করল। পারল না। অমলেন্দু যেন লাফ মেরে গিয়ে তাকে ধরে ফেলল।