৩. বিজ্ঞান-সভ্যতা-অগ্রগতি

অধ্যায়: তিন

ঈশ্বর বিশ্বাস: বিজ্ঞান-সভ্যতা-অগ্রগতি


কারণ: উনিশ

আসলে একটা পাওয়ার যে গোটা বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডকে নিখুঁত নিয়মের বাঁধনে সৃষ্টি ও নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে, এটাকে তো আমরা অস্বীকার করতে পারি না। এই পাওয়ারকে ‘ঈশ্বর’ বললে ক্ষতি কী?


রাণা ও দোলন আমার পুরোন বন্ধু। দু’জনে বিয়ে করেও ঠিক জমিয়ে সংসার পাততে পারেননি। রাণা বি ডি ও দোলন ইনকামটান্সের অ্যাসিস্ট্যাণ্ট কমিশনার। দু’জনে দু’শহরে থাকেন। মাসে একটি দিনের জন্য সাধারণত দুজনের দেখা হয়। বছর খানেক আগে ওদের আমন্ত্রণে কাঁকুড়গাছির ফ্ল্যাণ্টে গিয়েছিলাম। তুমুল আড্ডার মাঝে বহু প্রসঙ্গের মধ্যে আমাদের সমিতির কাজ-কর্মও কেমনভাবে যেন ঢুকে গেল। দুজনেই শিব-কালী-আল্লা ইত্যাদির অস্তিত্বকে ‘বোগাস’ বলে উড়িয়ে দিয়ে বললেন, “আসলে একটা পাওয়ার যে গোটা বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডকে নিখুঁত নিয়মের বাঁধনে সৃষ্টি ও নিয়ণ করে চলেছে, এটাকে তো আমরা অস্বীকার করতে পারি না। এই পাওয়ারকে কেউ যদি ঈশ্বর বলে, ক্ষতি কী?”

 প্রায় একই সুরে কথা বলেছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রবীণ বিজ্ঞানের অধ্যাপক, “জোতির্বিজ্ঞানের এইসব উন্নতির ফলে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি পদ্ধতির অনেক কিছুই আমরা জানতে পেরেছি। কিন্তু আজও জানতে পারিনি এই আলোকবর্ষের পর আলোকবর্ষ জুড়ে যে বিশাল বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে, তার স্রষ্টা ও পরিচালনকারী শক্তি কে? এই স্রষ্টা ও নিয়ন্ত্রক শক্তির নাম যদি দিই ঈশ্বর, তবে তার অস্তিত্ব মানতে অসুবিধে কোথায়?”

 প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত অনেকেই যুগের তালে তাল মিলিয়ে কিছুটা প্রগতি, কিছুটা আশৈশব বহন করা ঈশ্বর-বিশ্বাস, কিছুটা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের তুলনায় অতি অকিঞ্চিৎকর আমিত্বের পরম বিস্ময় এবং কিছুটা অস্বচ্ছ ধারণাকে মিশিয়ে ব্রহ্মাণ্ডের এক স্রষ্টা নিয়ন্ত্রক সৃষ্টি করে। এই সর্বশক্তিমান স্রষ্টা ও নিয়ন্ত্রকই ঈশ্বর। এইসব উচ্চকোটির শিক্ষিতেরা আরও একটি যুক্তিকে কাজে লাগান—বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড যখন সৃষ্টি হয়েছে, তখন নিশ্চয়ই তার স্রষ্টাও আছে।

 কিন্তু তাঁরা তাঁদের যুক্তিকে লক্ষণের গণ্ডির মতো এখানে আটকে রাখাকে নিরাপদ বিবেচনা করে আর এগুতে চান না। আরও একটু এগুলেই, আরও একটু যুক্তিনিষ্ঠ হলেই স্বতস্ফূর্ততার সঙ্গেই প্রশ্ন আসবে-ব্রহ্মাণ্ডকে নয় সৃষ্টি করলেন ঈশ্বর, কিন্তু ঈশ্বরকে সৃষ্টি করলেন কে? প্রশ্ন কিন্তু এখানেই থেমে থাকবে না। তারপরও প্রশ্ন আসবে—ঈশ্বরের স্রষ্টাকে সৃষ্টি করলেন কে? সেই স্রষ্টাকেই বা কে সৃষ্টি করলেন? এমনি করে প্রশ্নমালা চলতেই থাকবে, শেষ সমাধানে কখনই পৌঁছানো যাবে না।

O

ব্রহ্মাণ্ডকে নয় সৃষ্টি করলেন ঈশ্বর, কিন্তু ঈশ্বরকে সৃষ্টি করলেন কে? প্রশ্ন কিন্তু এখানেই থেমে থাকবে না। তারপরও প্রশ্ন আসবে—ঈশ্বরের স্রষ্টাকে সৃষ্টি করলেন কে? সেই স্রষ্টাকেই বা কে সৃষ্টি করলেন? এমনি করে প্রশ্নমালা চলতেই থাকবে, শেষ সমাধানে কখনই পৌঁছানো যাবে না।

O

 আমার এমনতর উত্তর শুনে কেউ কেউ বলতেই পারেন, “ঈশ্বর স্বয়ম্ভু”। আবারও স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠে আসবে, “ঈশ্বর যে স্বয়ম্ভু, আপনি কী করে জানলেন? কে জানালেন? কেউ জানিয়ে থাকলে, তাঁর জানাটাই যে ঠিক, তার প্রমাণ কী? আর যে যুক্তিতে ঈশ্বর স্বয়ম্ভু, সেই যুক্তিতেই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি, সৃষ্টিকর্তা ছাড়া হতে বাধা কোথায়?

O

যে যুক্তিতে ঈশ্বর স্বয়ম্ভু, সেই যুক্তিতেই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি, সৃষ্টিকর্তা ছাড়া হতে বাধা কোথায়?

O

 প্রকৃতিকে যাঁরা ঈশ্বর সংজ্ঞা দিতে চান, তারা প্রকৃতির নিয়মকে সর্বশক্তিমান, সর্বনিয়ন্তা ভাবলে বেজায় মুশকিল। বিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষ যেভাবে প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করেছে, তাতে মানুষকে ঈশ্বরের নিয়ন্তা বলতে তো কোনও অসুবিধে দেখি না।

 মজার কথা হলো, এই ধরনের চিন্তার মানুষরা নিজেদের উচ্চশিক্ষিত ও আধুনিক বলে ভাবতে অভস্ত। এরা অনেকেই প্রকৃতি বা পরমব্রহ্ম নামক ঈশ্বরের সঙ্গে নিজের আত্মাকে (!) যুক্ত করতে যোগ, মেডিটেশন, প্রাণায়ম ইত্যাদি করার প্রয়োজনীয়তাকে স্বীকার করেন। এঁদেরই অনেকে আবার শব্দ = বুহ্ম বলে, বিশেষ ভাবে বিশেষ মন্ত্রোচ্চারণের সাহায্যে পরমব্রহ্মের সঙ্গে যোগাযোগ ও পরমব্রহ্মকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব বলে বিশ্বাস করেন। বাস্তবে এসবই তাঁদের অলীক চিন্তা। এসবের কোনওটির দ্বারাই প্রকৃতিকে সামান্যতমও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি, সম্ভব হবেও না।


কারণ: কুড়ি

ঈশ্বর মানুষকে ‘নিয়তি’ দিয়েছেন? না, ‘সৃজনীশক্তি’?


ঈশ্বর যে ‘নিয়তি’ বা ‘ভাগ্য’ নির্ধারণ করেন—এমনটা বহু ঈশ্বর-বিশ্বাসীরাই মনে করে থাকেন।

 আবার এমনটাও অনেকেই মনে করে থাকেন—’প্রতিভা’ বা ‘সৃজনীশক্তি’ ঈশ্বরেরই দান। তাই যদি না হবে, তবে আর একটা রবীন্দ্রনাথ, আর একটা আইনস্টাইন কেন জন্মাচ্ছেন না?

 আবার এমনও অনেকে আছেন? যাঁরা মনে করেন ঈশ্বর একই সঙ্গে মানুষের নিয়তির নিয়ন্তা এবং সৃজনীশক্তির স্রষ্টা।

 প্রিয় পাঠক-পাঠিকা, একবার ভাবুন তো, ঈশ্বরের পক্ষে একই সঙ্গে মানুষের ভাগ্যকে পূর্বনির্ধারিত করে দেওয়া এবং সৃজনীশক্তির অধিকারী করে দেওয়া সম্ভব কি না! উত্তর একটাই পাবেন—সম্ভব নয়। কারণ, ভাগ্য আগে থেকেই ঠিক থাকলে সৃজনীশক্তি অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। আর, সৃজনীশক্তিতেই মানুষ যদি সব কিছু গড়ে তোলে, তাহলে ভাগ্যের ভূমিকা ‘ফালতু’ হয়ে পড়ে।

 প্রিয় পাঠক-পাঠিকা, আর একটা দিক থেকে ভাবুন তো, মানুষ তার সৃজনীশক্তিতেই যদি সব কিছু গড়ে তোলে, মানব সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যায়, তবে ঈশ্বরের নিয়ন্ত্রণ শক্তি কি তলানিতে এসে ঠেকে না? মানুষই কি মানব সভ্যতার নিয়ন্তক শক্তি হয়ে দাঁড়ায় না?

O

মানুষ তার সৃজনীশক্তিতেই যদি সব কিছু গড়ে তোলে, মানব সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যায়, তবে ঈশ্বরের নিয়ন্ত্রণ শক্তি কি তলানিতে এসে ঠেকে না? মানুষই কি মানব সভ্যতার নিয়ন্তক শক্তি হয়ে দাঁড়ায় না?

Oকারণ: একুশ

ঈশ্বরই সবকিছুর নিয়ন্তা হলে পুলিশ-প্রশাসনের ভূমিকা কি অর্থহীন হয়ে যায় না?


ঈশ্বরের নিয়ন্ত্রক শক্তিকে স্বীকার করলে, অর্থাৎ ঈশ্বরকে সব কিছুর একমাত্র নিয়ন্তা বলে ধরে নিলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে পুলিশ, প্রশাসন, আইনের শাসন, সব কিছুকেই অস্বীকার করতে হয়। ঈশ্বরের ইচ্ছেয় অপরাধ যখন সংগঠিত হবার তখন হবেই। অপরাধীদের শাস্তি দেওয়া যদি ঈশ্বরের অভিপ্রেত হয়, তবে অপরাধী শাস্তি পাবেই। পুলিশ রেখে ঈশ্বরের ইচ্ছেয় সংগঠিত কোনও অপরাধ কি ঠেকান যেতে পারে? ঈশ্বরই সব কিছুর নিয়ন্তা হলে কখনই ঠেকান যেতে পারে না। এরপর কি পুলিশ পোষার জন্য ব্যয় একান্তই অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে না?

 একজন অপরাধী বিচারে শাস্তি পাবে কি পাবে না, তা নির্ধারণ করার ক্ষমতা যখন বিচারকদের পরিবর্তে ঈশ্বরেরই হাতে, তখন কেন এই বিচারের প্রহসন? এই প্রহসন কি ঈশ্বরের ক্ষমতার প্রতি মানুষের আস্থাকে আঘাত দিচ্ছে না? সব ধর্মের ধর্মগুরুদের কি উচিত নয়, এই বিষয়ে সরকারকে ওয়াকিবহাল করিয়ে বিচার ব্যবস্থাকে ঝেটিয়ে বিদায় করতে আন্তরিকতার সঙ্গে সচেষ্ট হওয়া? সেই সচেষ্ট হওয়াটা অন্তত বাবরি মসজিদ আবার গড়ে দেবার দাবির মত, বা বাবরি ভেঙে রাম মন্দির গড়ে তোলার দাবির মত জোরাল ও জঙ্গি হবে, এটুকু প্রত্যাশা নিশ্চয়ই রাখতে পারি।

 আচ্ছ, এই রামমন্দির বা বাবরি মসজিদ গড়ার আন্দোলনের সত্যিই কি এক বিন্দু প্রয়োজন আছে? কিসের জন্য এই আন্দোলন গড়ে তোলা? রামের ইচ্ছে হলে রামমন্দির গড়ে উঠবেই। পৃথিবীর কোনও শক্তির সাধ্য নেই, তাতে বাধ সাধে। আল্লাহের ইচ্ছে হলে বাবরি মসজিদ আবার গড়ে উঠবেই। কোনও শক্তির ক্ষমতা নেই, তাকে প্রতিহত করে। এই পরিস্থিতিতে ধর্ম-বিশ্বাসীদের সমস্ত রকম আন্দোলনই অপ্রয়োজনীয় এবং একান্তভাবেই মূল্যহীন। মূল্যহীন সরকারের যে কোনও উদ্যোগ |

 যখন রামমন্দির বা বাবরি মসজিদ গড়তে সরকারের উপর চাপ দিতে ধর্মগুরুরা গণউন্মাদনা তৈরি করেন, তখন অবাক হতেই হয়। কারণ, ওঁরা মুখে যা বলেন, কাজে তা বিশ্বাস করেন না। ওঁরা খুব ভাল মতই জানেন, ঈশ্বর বা আল্লাহের ক্ষমতার দৌড় কত দুর। জানেন বলেই, বিশ্বাস করেন, বিতর্কিত জমিতে মন্দির হবে কি মসজিব, অথবা অন্য কিছু, তা পুরোপুরি নির্ভর করছে সরকারের ইচ্ছের উপর। আর তাই তাঁদের ইচ্ছে পূরণের জন্য ঈশ্বরবা আল্লাহের কাছে প্রার্থনা না জানিয়ে সরকারকে ভোটবাক্সের জুজুর ভয় দেখিয়ে দু’পক্ষই বাগে আনতে চাইছে।

 একটা সামান্য চুড়ো বা মসজিদ গড়তে যাঁদের সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়, তাঁরা যখন মুখে বলেন, “ঈশ্বর বা আল্লাহের ইচ্ছেতেই সব কিছু হয়”—তখন সেই ধর্মগুরুদের ‘দ্বিচারী’ ও ‘বুজরুক’ উপাধিতে ভূষিত করলে কোনও ভুল করা হবে কি?

O

একটা সামান্য চুড়ো বা মসজিদ গড়তে যাঁদের সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়, তাঁরা যখন মুখে বলেন, “ঈশ্বর বা আল্লাহের ইচ্ছেতেই সব কিছু হয়”—তখন সেই ধর্মগুরুদের ‘দ্বিচারী’ ও ‘বুজরুক’ উপাধিতে ভূষিত করলে কোনও ভুল করা হবে কি?

O


কারণ: বাইশ

ঈশ্বরই যখন সবকিছুর নিয়ন্তা, তখন রোগমুক্তির জন্য চিকিৎসাশাস্ত্রের ভূমিকা কী?


‘ঈশ্বরই সব কিছুর নিয়ন্তা’—বলে যারা বিশ্বাস করেন এবং সে কথা প্রচারও করেন, তাঁরা কি সত্যি সতািই কথায়-কাজে একাত্ম মানুষ? তাঁরা কি অসুখ হলে ডাক্তারের কাছে যান না?

 ঈশ্বরকে সব কিছুর নিয়ম্ভা বলে স্বীকার করলে চিকিৎসাশাস্ত্রকে অবশ্যই অস্বীকার করতে হয়। কারণ ঈশ্বরের ইচ্ছেতেই রোগ ও তার মুক্তি হলে চিকিৎসাশাস্ত্রের রোগমুক্তির ক্ষেত্রে কোনও ভূমিকাই থাকতে পারে না।

 আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা অবশ্য বড়ই করুণ। বিজ্ঞানাচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসুর সাটিফিকেট পাওয়া ধর্মগুরু গৌরাঙ্গ ভারতী সবার রোগ গ্যারাণ্টি দিয়ে সারাবার দাবি করলেও, নিজের হেঁচকি রোগ (সব সময়ই হেঁচকি ওঠা) সারাতে তাবড় তাবড় কত যে ডাক্তার দেখিয়েছিলেন তার ইয়ত্তা নেই। জন্মসিদ্ধ বালক ব্রহ্মচারী দুনিয়ার মানুষের ক্যানসার থেকে এইডস পর্যন্ত সরিয়ে নিজের অসুখ সারাতে হাজির হয়েছিলেন কোঠারি হসপিটালে। সাঁইবাবা সবার বোগই সারান, নিজের রোগ সারাতে পাড়ি দেন বিদেশে। আজ পর্যন্ত যত অবতার দেখেছি, সব অবতাররাই রোগমুক্তির জন্য রোগীকে ঈশ্বরের উপর ভরসা রাখতে বললেও নিজেরা ভরসা রাখেন ঈশ্বরের পরিবর্তে ডাক্তারের উপর। কেন এই দ্বিচারিতা।

O

আজ পর্যন্ত যত অবতার দেখেছি, সব অবতাররাই রোগমুক্তির জন্য রোগীকে ঈশ্বরের উপর ভরসা রাখতে বললেও নিজেরা ভরসা রাখেন ঈশ্বরের পরিবর্তে ডাক্তারের উপর।

O ঈশ্বর বিশ্বাসীদের প্রতি অনুরোধ, অসুখ করলে আপনারা আর ডাক্তারের কাছে না গিয়ে ঈশ্বরের ইচ্ছার কাছে নিজেকে সমর্পণ করে ঈশ্বরের বিশ্বাসের প্রতি সততা দেখান। তাতে আপনার সততাই শুধু প্রমাণিত হবে না,হাসপাতালগুলোতে ভিড় কমবে, সরকারও হাঁফ ছেড়ে বাঁচবেন।


কারণ: তেইশ

যুদ্ধের জয় পরাজয় যদি ঈশ্বরই নির্ধারণ করেন, তবে যুদ্ধ খাতে ব্যয় বরাদ্দ অর্থহীন নয় কী?

পাণিপথের যুদ্ধে বাবর কেন জয়ী হয়েছিলেন? দ্বিতীয় বিশ্ব মহাযুদ্ধে হিটলারপক্ষের পরাজয়ের কারণ কী? সাদ্দাম হুসেনের ইরাক জর্জ বুশের আমেরিকার কাছে যুদ্ধে ‘গো-হারা’ হারল কেন? ইত্যাদি জাতীয় প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে যাঁরা ইতিহাসের পাতা ওল্টাতে চাইবেন, হাজির করতে চাইবেন নানা তথ্য ও তত্ত্ব, ঈশ্বর-তত্ত্ব তাঁদের সমস্ত প্রচেষ্টাকে, সমস্ত খুঁজে বের করা কারণকে ফুৎকারে উড়িয়ে দেবার পক্ষে যথেষ্ট। ঈশ্বর-তত্ত্ব মানলে মানতেই হবে—মানুষ যুদ্ধ লাগাবার কে? মানুষ তো যন্ত্র মাত্র। যন্ত্রী ঈশ্বর চাইলে তবেই যন্ত্র চলে। ঈশ্বর চাইলে যুদ্ধ হবে—তাকে লঙ্ঘাবে কোন মানুষ? যুদ্ধে হার-জিৎ? সেও তো ঈশ্বরেরই হাতে। ঈশ্বর কাউকে জেতাতে চাইলে বিরুদ্ধে যত বড় সেনাবাহিনীই থাকুক, যত আধুনিকতম অস্ত্রই তারা প্রয়োগ করুক, ঈশ্বর-কৃপাধন্যের জয় হবেই; তা সে পেঁপের ডাঁটা নিয়ে পারমাণবিক বোমা, লেজারগান ও মিশাইলের বিরুদ্ধে লড়লেও হবে।

 বাস্তবিকই ঈশ্বরের ইচ্ছেয় যুদ্ধের জয়-পরাজয় নির্ধারিত হলে যে কোনও রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেই বাজেটে সেনা-খাতে ব্যয় অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে।

O

বাস্তবিকই ঈশ্বরের ইচ্ছেয় যুদ্ধের জয়-পরাজয় নির্ধারিত হলে যে কোনও রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেই বাজেটে সেনা-খাতে ব্যয় অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে।

O

 ঈশ্বর-আল্লায় পরম বিশ্বাসী রাষ্ট্র নায়ক যখন সেনা-খাতে ব্যয় বরাদ্দ করে, তখন তাদের স্ব-বিরোধী চরিত্রই প্রকট হয়ে ওঠে; যে চরিত্র একই সঙ্গে ঈশ্বরের শক্তিকে বিশ্বাস ও অবিশ্বাস করে!

কারণ: চব্বিশ

মানুষের ভাগ্যের নিয়ন্তক শক্তি ঈশ্বর, না গ্রহ-নক্ষত্র?

জ্যোতিষ শাস্ত্র বলে—মানুষের ভাগ্য পূর্বনির্ধারিত। জন্মের সময়ে গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান অনুসারে মানুষের ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে যায়।

 জ্যোতিষীদের এই দাবিকে স্বীকার করার অর্থ মানুষের ভাগ্যের নির্ধারক ও নিয়ন্ত্রক হিসেবে ঈশ্বরকে অস্বীকার করা।

O

জ্যোতিষ শাস্ত্র বলে মানুষের ভাগ্য পূর্বনির্ধারিত। জন্মের সময়ে গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান অনুসারে মানুষের ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে যায়। জ্যোতিষীদের এই দাবিকে স্বীকার করার অর্থ মানুষের ভাগ্যের নির্ধারক ও নিয়ন্ত্রক হিসেবে ঈশ্বরকে স্বীকার করা।

O


 অর্থাৎ স্পষ্টতই জ্যোতিষ বিশ্বাস ও ঈশ্বর বিশ্বাস একে অন্যের অস্তিত্বকে স্বীকার করে না। দুই বিশ্বাস একান্তভাবেই পরস্পর বিরোধী। কিন্তু মজার কথা হল এই যে, প্রত্যেক জ্যোতিষীর কি চেম্বারে, কি বাড়িতে, ঠাকুর-দেবতার ছবির ঠাসাঠাসি ভিড়। ধর্মগুরু ও অবতারদের হাতের আঙুলে, বাহুতে, গলায় গ্রহরত্নের চলমান প্রদর্শনী।

 এমন স্ববিরোধিতার কারণ কী? তবে কি ঈশ্বর-বিশ্বাসীরা ততটা জোরালভাবে ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন না? দ্বিধাগ্রস্ত? জ্যোতিষীরাও ততটা গ্রহ-নক্ষত্রের ক্ষমতায় বিশ্বাস করেন না? দ্বিধাগ্রস্ত?

ঈশ্বর-বিশ্বাসকে জীবিকা করা ধর্মগুরুরাই যদি ঈশ্বরের অস্তিত্বে দ্বিধাগ্রস্ত হন, তবে সাধারণ মানুষ দ্বিধামুক্ত হবে কোন যুক্তিতে? এরপর যদি বলি, “ঈশ্বর-নির্ভর ধর্মশাস্ত্র আরামভোগী, অন্নচিন্তাহীন, পরের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খাওয়া একদল ‘ধর্মগুরু’ নামের প্রতারকদের করে খাওয়ার শাস্ত্র”-ভুল বলা হবে কি?


কারণ: পঁচিশ

‘বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি’—তবু সেই স্বপ্ন জ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে ঈশ্বকে অস্বীকার করা কি বুদ্ধিমানের কাজ?

সালটা ১৯৬২। তখন কলেজে পড়ি। গ্রীষ্মের ছুটিতে গিয়েছিলাম দেওঘর। দেখা করলাম পুরুষোত্তম ঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের সঙ্গে। কথায় কথায় জিজ্ঞেস করেছিলাম—ঈশ্বরকে না দেখা পর্যন্ত, অথবা ঈশ্বর কৃপায় অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী বলে প্রচারিত কারও সে ক্ষমতা বাস্তবিকই আছে, প্রমাণ না পাওয়া পর্যন্ত ঈশ্বর বিশ্বাসী হওয়াটা কি ঠিক? আপনি যদি ঈশ্বর দেখার একটা ব্যবস্থা করে দেন, বা কোনও অলৌকিক ক্ষমতা দেখান, তারপর আমার পক্ষে ঈশ্বরে বিশ্বাসী হওয়াটা যুক্তিপূর্ণ হবে।

 উত্তরে অনুকূলচন্দ্র যা বলেছিনে, তা মোটামুটি এই: আজ কিছুই দেখাচ্ছি না। না ঈশ্বর, না অলৌকিক ক্ষমতা। আজ শুধু রবীন্দ্রনাথের সেই কথাটা মনে করিয়ে দিই, “পৃথিবীতে কত কিছু তুমি জানো না, তাই বলে সে সব কি নেই? কতটুকু জানো? জানাটা এতটুকু, না জানাটাই অসীম। সেই এতটুকুর উপর নির্ভর করে চোখ বন্ধ করে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া চলে না।”

 অনুকূলচন্দ্র তারপর কোনও দিনই আমাকে ঈশ্বর বা অলৌকিক ক্ষমত দেখাননি। তবে তিনি পরিবর্তে যে কথাগুলো বলেছিলেন, সে কথা বহুবার বহুজনের মুখ থেকেই শুনতে হয়েছে। তাঁদের বক্তব্যের মূল সুর এই রকম-যারা ঈশ্বরে অবিশ্বাস করে, তা না জেনেই করে, অজ্ঞতা থেকেই করে, অনেক কিছু জানার অহমিকা বোধ থেকেই করে। যদি জানত তাদের জানাটা কত ক্ষুদ্র, আর না জানাটা কত অসীম, তা হলে এভাবে কোনও কিছুকে এক কথায় নাকচ করত না, ঈশ্বরের অস্তিত্বকে তো নয়ই। আমাদের উচিত যুক্তিনিষ্ঠ মানসিকতার পরিচয় দিয়ে না জানা বিষয়কে নাকচ না করা।


 প্রিয় পাঠক-পাঠিকারা, আপনারা একটু লক্ষ্য করলেই দেখতে পাবেন, এই ধরনের যুক্তির সাহায্যে যে কোনও অস্তিত্বহীনের অস্তিত্বই প্রমাণ করা যায়। যেমন ধরুন, আমি যদি বলি, আকাশ থেকে মাঝে-মাঝে ডিম বৃষ্টি হয়। তবে এই ডিম-বৃষ্টি কখন কোথায় হবে, তার আগাম হদিস অবশ্য দেওয়া সম্ভব নয়। এই ডিমগুলো মাটিতে পড়ার আগেই সেগুলো ফুটে বের হয় চব্বিশ কারেট সোনার দুশো গ্রাম ওজনের একটা করে জীবন্ত পাখির পচ্চিা। বাচ্চাগুলো জন্মে মাটিতে না পড়ার আগেই উড়তে উড়তে চলে যায়।

 অনুকূলচন্দ্র ইত্যাদিদের যুক্তিতে বিশ্বাসী হলে আপনি কোনওভাবেই আমার এই বক্তব্যকে নাকচ করতে পারছেন না। আপনি কোনওভাবে যুক্তি হাজির করতে গেলে আমি বলব, “পৃথিবীর কতটুকু আপনি জানেন? এই ধরনের পাখির অস্তিত্ব বিষয়ে আপনার জানা নেই বলে এর অস্তিত্বকে আপনি অস্বীকার করতে পারেন না।”

 এই একই কারণে কতটুকু জানি মার্কা কথার ধোঁয়াশার বিভ্রান্তিতে বিভ্রান্ত হয়ে আমরা ঈশ্বর-বিশ্বাসী হয়ে উঠতে পারি না। যতটুকু জানি, সেইটুকুতে আস্থা আছে বলেই পারি না।

কারণ: ছাব্বিশ

ঈশ্বরবাদীদের প্রশ্ন—অনেক বিজ্ঞানীদের ঈশ্বর অবিশ্বাসই শেষ কথা হতে পারে কি?


বিশ্বের বহু বরেণ্য বিজ্ঞানীদের ক্ষেত্রেই তাঁদের নবতম আবিষ্কারকে, তাঁদের দেওয়া নবতম তত্ত্বকে বিজ্ঞানীরাই সবচেয়ে বেশি সন্দেহের চোখে দেখেছেন। শেষ পর্যন্ত সত্যের জয় হয়েছে। সন্দিগ্ধ বিজ্ঞানীরা ওইসব বরেণ্যদের মতামতকে শেষ পর্যন্ত মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন। আজ কিছু বিজ্ঞানীদের ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রতি সন্দেহে আদৌ প্রমাণিত হয় না যে, ঈশ্বর-বিশ্বাস ভ্রান্ত এক অন্ধবিশ্বাস। বিজ্ঞানীদের সন্দেহই যদি শেষ কথা হত, তবে নিউটন থেকে শুরু করে ফ্র্যাংক জে টিপলার পর্যন্ত বহু বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ঈশ্বরে বিশ্বাসী হতেন না বিজ্ঞানাচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসু থেকে জে. বি. এস. হ্যালডেন পর্যন্ত ঈশ্বরতত্ত্বে, অধ্যাত্মবাদে ও অলৌকিকতায় আস্থাশীল হতেন না। সর্বকালের অন্যতম সেরা বিজ্ঞানী আইনস্টাইন ঈশ্বরে গভীর প্রত্যয় ব্যক্ত করতেন না।

 বিজ্ঞান যেহেতু পরীক্ষা পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়েই সিদ্ধান্তে পৌঁছয়, তাই প্রতেকটি ক্ষেত্রেই আসে পরীক্ষার প্রশ্ন, সন্দেহের প্রশ্ন। এসবের পরিবর্তে ব্যক্তি-বিশ্বাসকে মর্যাদা দিতে গেলে, ব্যক্তি-বিশ্বাস বা বাক্তির দাবিকে বিনা প্রশ্নে মেনে নিলে বিজ্ঞান আর বিজ্ঞান থাকত না। পরীক্ষিত সত্যকে বিজ্ঞান মর্যাদা দেয়। ঈশ্বর বিশ্বাসীরা যেদিন ঈশ্বরের সংজ্ঞা দিতে পারবেন, পারবেন সেই সংজ্ঞায় বাঁধা ঈশ্বরের অস্তিত্বকে প্রমাণ করতে, সেদিন নিশ্চয়ই বিজ্ঞান ঈশ্বরের অস্তিত্বকে মেনে নেবে।

O

ঈশ্বর বিশ্বাসীরা যেদিন ঈশ্বরের সংজ্ঞা দিতে পারবেন, পারবেন সেই সংজ্ঞায় বাঁধা ঈশ্বরের অস্তিত্বকে প্রমাণ করতে, সেদিন নিশ্চয়ই বিজ্ঞান ঈশ্বরের অস্তিত্বকে মেনে নেবে।

O

 আমরা নিশ্চয়ই এইসব ঈশ্বর-বিশ্বসী ও অধ্যাত্মবাদে আস্থাশীল বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদদের মূলগতভাবে অশ্রদ্ধেয় মনে করি না, বা অধ্যাত্মবাদী সংস্কৃতি প্রচারের ষড়যন্ত্রের অংশীদার বলেও মনে করি না। বরঞ্চ স্ব-স্ব ক্ষেত্রে তাঁদের কাজকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্বীকার করি ও স্মরণ করি। আমরা জানি তাঁদের এই সীমাবদ্ধতার পিছনে রয়েছে তাঁরা যে সমাজ-সাংস্কৃতিক পরিবেশে বড় হয়ে উঠেছেন, সেই পরিবেশের প্রভাব।

 স্বীকার করছি, শুধু এদেশের নয়, পৃথিবী জুড়েই বহু বিজ্ঞান পেশার মানুষই ঈশ্বর-বিশ্বাসী। আবার একথাও অস্বীকার করার উপায় নেই, প্রতিটি ক্ষেত্রেই এই সব বিশিষ্ট বিজ্ঞানীদের বিশ্বাসের পিছনে রয়েছে যুক্তিহীন এক অন্ধ-বিশ্বাস। অর্থাৎ একই সঙ্গে পেশায় বিজ্ঞানী কিন্তু মানসিকতায় বিজ্ঞান-বিরোধী। এমন স্ববিরোধিতার কারণ, আমাদের সমাজ-সাংস্কৃতিক পরিবেশ।

 আপনার আশে-পাশে একটু তাকান। দেখতে পাবেন প্রায় প্রতিটি পরিবারের শিশুরাই বেড়ে উঠছে ধর্মীয় ধ্যান-ধারণার মধ্যে, ঈশ্বর-বিশ্বাসের মধ্যে, আত্মার অমরত্বে বিশ্বাসের মধ্যে। শিশুকে পরিবারের মানুষরা শেখান। “ঠাকুর নম কর”। শিশু দেখে ‘রোজা’ ‘নামাজ’। শেখে ফি হপ্তায় গির্জায় যেতে। স্কুলে পড়ে ঠাকুর-দেবতা, আল্লাহ, যিশুর নানা অলৌকিক কাহিনী! সিনেমায়, টিভিতে, যাত্রায় কত না ঈশ্বর-তত্ত্বের, ভুতুড়ে কাহিনীর, অলৌকিক-ব্যাপার-স্যাপারের ছড়াছড়ি। পরিচিত হয়, নানা ধর্মের নানা আচার-আচরণের সঙ্গে। শোনে নানা ভরের কাহিনী। কোথাও ভর করে মনসা-শীতলা-কালী কি মহাদেব, কোথাও বা ভয় করে জীন কি ফেরেস্তা। ভরগ্রস্তদের প্রতি বিশ্বাস নিয়ে হাজার হাজার মানুষ ভিড় জমান। তাঁদের বিশ্বাস, তাঁদের মুখের কাহিনী অন্যকেও প্রভাবিত করে। প্রভাবিত করে ধর্মীয়-গ্রন্থ, প্রচারমাধ্যম ধর্মীয় উন্মাদনা। এমনই পরিবেশের মধ্যে প্রায় সকলেই বেড়ে উঠেছে, তা সে ভাল ছাত্রই হোক বা খারাপ ছাত্রই হোক। ফলে লেখা-পড়ায় ভাল ছেলে-মেয়েরাও যুক্তিহীন ধর্মীয় ধ্যান-ধারণার মধ্যেই পরীক্ষায় ভাল রেজাল্ট করার সুবাদে সাধারণভাবে দৌড়োয় ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং বা বিজ্ঞান বিভাগে পড়াশুনো করতে। আমাদের এই অনিশ্চয়তায় ভরা সমাজে ভবিষ্যতে আর্থিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হবার সম্ভাবনা এখনও এইসব বিজ্ঞান বিষয় নিয়ে পড়াশুনা শেষ করে বেরলে বেশি বলেই, ভাল ছাত্র-ছাত্রীদের মা-বাবারা তাঁদের এসব লাইনে পড়তে ঠেলে দেন। ফলে এরা বিজ্ঞান শিক্ষা শুরু করে ধর্ম বিশ্বাসে গা ডুবিয়ে রেখেই। যখন সাফল্যের সঙ্গে এঁরা ছাত্রজীবন শেষ করে কর্মজীবনে প্রবেশ করেন তখন এঁরা—বিজ্ঞানেও থাকেন, ধর্মেও থাকেন। এঁরা জীবনের ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিকে গ্রহণ করেন না। বিজ্ঞান এঁদের অনেকের কাছেই শুধুই একটা পেশা থেকে যায়, যেমন পেশা জমির দালালি বা আলু-পটলের ব্যবসা।

 এঁদের সকলেই যে বিজ্ঞানকে শুধু একটা পেশা হিসাবে গ্রহণ করে সুখী থাকেন, তেমন নয়। ব্যতিক্রমী কেউ কেউ বিজ্ঞানকে ‘জীবনের শ্বাস-প্রশ্বাস’, ‘বেঁচে থাকার অনিন্দ’ হিসেবেই গ্রহণ করেন। কিন্তু, তাঁদেরও অনেকের মধ্যে থেকে যায় আজন্ম-লালিত ঈশ্বর-বিশ্বাস থেকে শুরু করে অনেক বিষয়েই অন্ধ-বিশ্বাস।

O

এইসব ঈশ্বর-বিশ্বাসী বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদদের কেউ যেদিন বিশ্বাসের গণ্ডি পেরিয়ে ঈশ্বরের অস্তিত্বের পক্ষে কোনও প্রমাণ হাজির করতে পারবেন, সেদিন তাঁদের মতকে নিশ্চয়ই আমরা মেনে নেব।

O এইসব ঈশ্বর-বিশ্বাসী বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদদের কেউ যেদিন বিশ্বাসের গণ্ডি পেরিয়ে ঈশ্বরের অস্তিত্বের পক্ষে কোনও প্রমাণ হাজির করতে পারবেন, সেদিন তাঁদের মতকে নিশ্চয়ই আমরা মেনে নেব। কিন্তু তার আগে শুধুমাত্র বিখ্যাত বিজ্ঞানীর বিশ্বাস বলে মেনে নিই কী করে? তেমন করতে হলে বহু অস্তিত্বহীন বিষয়কে এক্ষুনি-এক্ষুনি আমাদের মেনে নিতে হয়। বিজ্ঞানাচার্য সত্যেন্দ্রনাথ জীবনে অনেক অলৌকিকবাবার চরণেই মাথা ঠেকিয়েছেন। কিছু কিছু অলৌকিকবাবাজী-মাতাজীরা আচার্যদেবের ভক্তিগদগদ সার্টিফিকেট ও ছবি নিজেদের প্রচারমূলক বইতে ছেপে থাকেন। বিজ্ঞানাচার্য অলৌকিকের অস্তিত্বে বিশ্বাস করতেন, এই দোহাই দিয়ে কি আমরা তবে অলৌকিকের মত অলীক, অন্ধ বিশ্বাসকে মেনে নেব? হ্যালডেন টেলিপ্যাথিতে বিশ্বাস করতেন, বিশ্বাস করতেন আত্মার অমরত্বে। তাই বলে কি আমরা তাঁর এইসব অদ্ভুত ছাই-পাঁশ চিন্তায় বিশ্বাস করব? যে কারণে তাঁদের এই অন্ধবিশ্বাসকে বিজ্ঞান মানে না, যুক্তি মানে না, আমরা মানি না, সেই একই কারণে তাঁদের ঈশ্বর বিশ্বাসও বিজ্ঞান মানে না, যুক্তি মানে না, আমরা মানি না।

 একটি বিখ্যাত বাংলা পত্রিকায় সম্পাদকীয় কলমে ঈশ্বর বিশ্বাসের পক্ষে লেখা হয়েছিল, “চিকিৎসক অস্ত্রোপচারের আগে ঈশ্বরের উদ্দেশে শ্রদ্ধা জানান, বিজ্ঞানী রকেটের মহাকাশ-যাত্রার সাফল্য কামনায় ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেন এ ঘটনা বিরল নয়।”

 কিন্তু এই ধরনের কিছু ঘটনা কখনই ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণ নয়। বড় জোর এটুকুই প্রমাণিত হতে পারে, ওই বিজ্ঞানীরা ঈশ্বরে বিশ্বাসী। কিন্তু তাতে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণিত হচ্ছে কি?

আইনস্টাইন নিয়ে বিভ্রান্তি

 এরপরও আইনস্টাইনের ঈশ্বর বিশ্বাস নিয়ে বাড়তি কিছু বলার প্রয়োজন অনুভব করছি। সম্প্রতি এদেশের জনপ্রিয়তার নিরিখে প্রথম শ্রেণীর প্রচার মাধ্যমগুলো বিশ্বের সর্বকালের অনাতম মনীষা, আইনস্টাইনকে ‘ঈশ্বরে গভীর বিশ্বাসী’ বলে কোনও বিশেষ পরিকল্পনার ছক মাথায় রেখে যেভাবে চিত্রিত করে চলেছে, বাস্তব চিত্র কিন্তু আদৌ তা নয়। বরং প্রথমেই নির্দ্বিধায় জানিয়ে রাখি, আইনস্টাইন যে কোনও স্থূল কুসংস্কার, পৌত্তলিকতা, ধর্মীয় বিশ্বাস ও স্বর্গ-নরক মার্কা পাপ-পূণ্যবোধে আদৌ বিশ্বাসী ছিলেন না। একথাও বলে রাখা ভাল, তিনি ঈশ্বর পরম বিশ্বাসী হলে, কখনই তাঁকে অন্যরকমভাবে চিত্রিত করতে সচেষ্ট করতাম না। কারণ ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণ আইনস্টাইনের একান্ত ব্যক্তি বিশ্বাসের ওপর নির্ভরশীল নয়। কারও ব্যক্তি বিশ্বাসের উপরই নির্ভশীল নয়। আইনস্টাইনের বিশাল মনীর সঙ্গে সুসমঞ্জসভাবে জড়িয়ে ছিল এক মানবতাবাদী, মুক্ত মনন। ধর্মের যে সব স্থূল দিকগুলো মানুষকে চোখ রাঙিয়ে আনুগত্য শেখায়, তাকে তিনি বলেন ‘রিলিজিয়ন অফ ফিয়ার। এবং তাকে তিনি আন্তরিকতার সঙ্গে ঘৃণা করতেন। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের পুরোহিততন্ত্রকে চূড়ান্ত অপছন্দ করতেন। একইভাবে অপছন্দ করতেন লাভ-ক্ষতি-নরকভীতি থেকে উৎসারিত ধর্মভীরুতা। বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে যে নিজস্ব বিশ্বাস, প্রথা, আচার-আচরণগত ঐতিহ্য থাকে, সে বিষয়ে তিনি বলেছিলেন, ধর্মীয় “সম্প্রদায়গত ঐতিহ্যগুলোকে আমি শুধু ইতিহাস ও মনস্তত্ত্বের দিক থেকেই গুরুত্ব দিতে পারি; এসবের আর কোনও গুরুত্ব আমার কাছে নেই।” [আইডিয়াস্ অ্যাণ্ড ওপিনিয়নস, ১৯৯৫, পৃষ্ঠা ২৬২|

 যুক্তি ও বিজ্ঞানের আলো ধর্মীয় কুসংস্কারের অন্ধকারকে আক্রমণ করলেই ধর্মীয় শিবির সেই আক্রমণের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জবাব না দিয়ে পালাবার ফিকির খোঁজে। বিজ্ঞান এখনও যে সব বিষয়ে জানতে পারেনি, সেদিকে আঙুল দেখায়। বিজ্ঞানের ও যুক্তির আলো থেকে ধর্মের এই ক্রমাগত অন্ধকারে পালিয়ে বেড়ানোর স্বভাবকে আইনস্টাইন কঠোর ভাষায় আক্রমণ করেছিলেন। তাঁর কথায়, “কিন্তু আমি বুঝি যে, ধর্মীয় প্রতিনিধিদের তরফ থেকে এমন ব্যবহার শুধু যে অপদার্থতা, তা নয়, উপরন্তু মারাত্মক। কারণ একটি মতবাদ যা নিজেকে পরিস্কার আলোর মধ্যে বাঁচাতে না পেরে কেবলই অন্ধকারে গিয়ে লুকোয়, তা নিশ্চিতভাবে মানবপ্রগতির গণনাতীত ক্ষতি করে” [ঐ গ্রন্থেরই পৃষ্ঠা ৪৮|

 একজন মানুষের মানুষ হয়ে ওঠার পক্ষে ধর্মীয় অনুশাসনের পরিবর্তে মানবিক মূল্যবোধ গড়ে তোলা যে অনেক জরুরি, এ বিষয়ে স্পষ্ট অভিমত তিনি ব্যক্ত করেছিলেন। তাঁর কথায়, “একজন মানুষের নৈতিক আচার-ব্যবহারের ভিত্তি হওয়া উচিত মানুষের প্রতি সহানুভূতি, শিক্ষা এবং সামাজিক বন্ধন বা সামাজিক দায়বদ্ধতা: কোনও ধর্মীয় ভিত্তির প্রয়োজন নেই। মানুষকে সংযত করার জন্য যদি তাকে শাস্তির ভয় দেখতে হয়, বা মৃত্যুর পরেব পুরস্কারের লোভ দেখাতে হয়, তাহলে মানুষের কাছে তা হলে লজ্জার ব্যাপার।” [ঐ গ্রন্থের পৃষ্ঠা ৩৯|

 আইনস্টাইন ধর্মীয় দর্শনকে তিনটি স্তরে ভাগ করেছিলেন। এক: ‘রিলিজিয়ন অফ ফিয়ার’ বা ভয়ের ধর্ম: যে বিষয়ে তাঁর মনোভাব আগেই জানিয়েছি। দুই: ‘মরাল রিলিজিয়ন’ বা ধর্মের নৈতিকতা: যে বিষয়ে তাঁর মতামত স্পষ্ট—মানবিক মূল্যবোধ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে শিক্ষা-সামাজিক দায়বদ্ধতা—সহানুভূতির ভূমিকা প্রবল। ধর্মের অনুশাসনের নামে ভয় বা লোভ মানুষকে মানুষ করে তোলে না। যা নিয়ে উপরের পংক্তিতেই আলোচনা করেছি। তিন: ‘কসমিক রিলিজিয়ন’ বা মহাজাগতিক ধর্ম। এই ধর্ম ছিল তাঁর কাছে একান্তই এক বিজ্ঞানীর ব্যক্তিগত আবেগ; যে বিজ্ঞানী মহাজগতের জটিলতা, কার্য-কারণ-এর শৃঙ্খলা ইত্যাদি দেখে বিস্ময়াবিষ্ট হয়েছেন এবং সেই রহস্যের গভীরে ডুবে থাকতে চেয়েছেন। এখানেই তিনি তাঁর ঈশ্বর বিষয়ে ধ্যান-ধারণাকে ব্যক্ত করেছেন। তাঁর কথায়, “আমাদের অভিজ্ঞতার জগতে প্রকাশমান এক উচ্চতর মনের অস্তিত্বে এই যে গভীর অনুভূতি মাখানো পরম বিশ্বাস, এই-ই হল ঈশ্বর সম্পর্কে আমার ধ্যান-ধারণা।” [ঐ গ্রন্থের পৃষ্ঠা ২৬২|

 এরপর আমরা নিশ্চয়ই বুঝে নিতে পারি, আইনস্টাইন কোনও সৃষ্টিছাড়া, ব্যাখ্যার অতীত, অলৌকিক ঘটনা বা ক্ষমতার মধ্যে ঈশ্বরকে দেখেননি। বরং তিনি ঈশ্বরকে দেখেন সম্পূর্ণ বুদ্ধিগ্রাহা, কঠোর বৈজ্ঞানিক নিয়মচালিত বিশ্বপ্রকৃতির মধ্যে। তাঁর ধারণার নিরাসক্ত গাণিতিক ঈশ্বর বস্তুবিশ্বে লীন হয়ে আছেন, প্রাকৃতিক নিয়মকানুনের নিখুঁত ছন্দের মধ্যে দিয়ে, তাঁর প্রকাশ ঘটেছে।

 আর এখানেই এসে পড়ে এক অনিবার্য প্রশ্ন। প্রাকৃতিক নিয়মকানুনই যদি ঈশ্বর হয়, আর তা যদি সম্পূর্ণ বুদ্ধিগ্রাহাই হয়, তবে তাকে নিছক ‘প্রাকৃতিক নিয়মকানুন’ না বলে ‘ঈশ্বর’ আখ্যা দিতে যাবার প্রয়োজনটা কী? উত্তরটা শোনা যাক আধুনিককালের একজন প্রথম সারির খ্যাতিমান নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী স্টিফেন ভাইনবার্গের কাছ থেকে। তাঁর কথায়, “বিজ্ঞানী ও অন্যান্যর। মাঝে মাঝে ‘ঈশ্বর’ শব্দটাকে এমন এক বিমূর্ত ও নিরাস অর্থে ব্যবহার করেন যে তাকে প্রকৃতির নিয়ম থেকে আলাদা করাই মুশকিল হয়ে পড়ে। আইনস্টাইন একবার বলেছিলেন যে তিনি বিশ্বাস করেন “স্পিনোজার ঈশ্বরকে, যিনি সমগ্র অস্তিত্বের ছান্দসিক নিয়মিতির মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করেন, কিন্তু যিনি মানুষের কাজকর্ম ও ভাগ্য নিয়ে ব্যস্ত থাকেন সেই ঈশ্বরকে নয়।” [ড্রিমস অফ এ ফাইনাল থিয়োরি, পৃষ্ঠা ১৯৬|

 বিষয়টা আরও একটু পরিষ্কার করতে আরও দু’একটি ঘটনার উল্লেখ করছি। ‘দি ইকোনমিক টাইমস’ পত্রিকায় (১৮ নভেম্বর ‘৯৫) আমার একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। সাক্ষাৎকারটি শেষ করা হয় এভাবে—”বিজ্ঞানই প্রবীরের ঈশ্বর”। এই ‘ঈশ্বর’ প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের দেওয়া ঈশ্বর সংজ্ঞায় আবদ্ধ নয় যেমনটা আবদ্ধ নয় আইনস্টাইনের ঈশ্বর। আমার বান্ধবী মিস্টুন একবার আমাকে বলেছিলেন, “কেউ যদি বলেন, তাঁর কাছে প্রেমই ঈশ্বর, ক্ষতি কী? এই প্রেম মনের এক গভীর অনুভূতি। তাঁর এই ঈশ্বর মানুষের প্রার্থনা পূরণে, পাপ-পুণা নির্ধারণে, ভাগ্য ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত থাকে না।”

 আইনস্টাইনের ‘ঈশ্বর’ কোনও প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের ধারণার ঈশ্বর না হয়ে, হয়ে উঠেছিল বিজ্ঞান বা ‘প্রেম’-এর প্রতীকের মতই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের বিস্ময়কর নিয়মশৃঙ্খলার প্রতীক। এর বাড়তি কিছু নয়।

O

আইনস্টাইনের ‘ঈশ্বর’ কোনও প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের ধারণার ঈশ্বর নাহয়ে, হয়ে উঠেছিল ‘বিজ্ঞান’ বা ‘প্রেম’-এর প্রতীকের মতই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের বিস্ময়কর নিয়মশৃঙ্খলার প্রতীক। এর বাড়তি কিছু নয়।

O


কারণ: সাতাশ

আধুনিক পদার্থ বিজ্ঞান শেষপর্যন্ত পরমচৈতন্যে গিয়ে পৌঁছেছে। পরমব্রহ্ম? শুধু কিছু সময়ের অপেক্ষা।

এ জাতীয় বক্তব্য কোনও হেলাফেলার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়নি। প্রকাশিত হয়েছে এপার বাংলার সবচেয়ে নামী-দামী ঝাঁ চকচকে সাহিত্য পত্রিকা ‘দেশ-এর ২২ এপ্রিল, ১৯৯৫ সংখ্যায়। প্রবন্ধটির শিরোনাম: ‘বিজ্ঞান ও ভগবান’। লেখক হৃষীকেশ সেন। শ্রীসেন জানিয়েছেন, বর্তমান বিজ্ঞান বিশ্ব-রহস্য সম্বন্ধে যেটুকু জানে, প্রাচীন আমলের বা পুরাকলের পিছিয়ে থাকা জ্ঞানভাণ্ডার নিয়ে মানুষ (এই পিছিয়ে থাকা জ্ঞানভাণ্ডারের কথা শ্রীসেনই স্বীকার করেছেন) বহু আগেই সেসব জেনে ফেলেছিল।

 শ্রীসেনের বক্তবোর স্ববিরোধিতাটুকু বড় বেশি নজর কাড়ার মত। তারপরও দেখা যাক, শ্রীসেনের ধারণা মত পিছিয়ে থাকা জ্ঞান ভাণ্ডার নিয়ে পুরাকালের মানুষ কী জেনেছিল?

 হিন্দু দর্শনে জীবের আত্মাকে জীবাত্মা ও বস্তুর আত্মাকে ভূতাত্মা বলে। অর্থাৎ বস্তুর চৈতন্য বা আত্মা যে আছে, এ ধারণায় প্রাচীন হিন্দু দর্শন পৌঁছেছিল। দীর্ঘ সময় অতিক্রম করে আধুনিক বিজ্ঞানে বস্তুর চৈতন্যের ধারণা এলো। এবং আধুনিক পদার্থবিদ্যার রূপকাররা পদার্থবিদ্যার জটিল তত্ত্ব ও জটিলতর অঙ্ক নিয়ে ঘাঁটতে ঘাঁটতে বস্তুজগৎ ছাড়িয়ে শেষপর্যন্ত অখণ্ড পরমচৈতনে গিয়ে পোঁছেছেন।

 শ্রীসেনের এই ধরনের বক্তব্য বহু পাঠক-পাঠিকাকেই দ্বিধা-দ্বন্দ্বে দুলিয়ে দিয়েছে। তারই ফলস্বরূপ এই প্রসঙ্গে আমার মতামত জানতে চেয়ে আমাদের যুক্তিবাদী সমিতির দপ্তরে চিঠিও এসেছে প্রচুর।

 শ্রীসেনের এই অতিসরলীকৃত ধারণা বা উদ্দেশ্যমূলক ধারণা প্রচারের পিছনে আদৌ কোনও বৈজ্ঞানিক ও যৌক্তিক ভিত্তি আছে কি না, দেখা যাক।

 কোয়াণ্টাম বলবিদ্যার নানা ধারা আমাদের পরিচিত করিয়েছে পরমাণুর বিভিন্ন কক্ষপথের ইলেকট্রনের গতিবিধির তাত্ত্বিক নিয়মের সঙ্গে, পরিচিত হয়েছি অন্যান্য বহু কণার সঙ্গে, তাদের নানা ধর্মের সঙ্গে। বস্তুর মৌলকণা অণু-পরমাণুর গণ্ডি ছাড়িয়ে আরও অজস্র কণার সন্ধান আমরা পেয়েছি। জেনেছি, প্রোটন-নিউট্রন ছাড়াও গুচ্ছের বেরিয়ন-কণা, ইলেকট্রন ছাড়াও একগাদা লেপ্‌টন-কণা, সবই বস্তুর সুক্ষ্মতম কণাজগতে ঘাঁটি গেড়েছে। এরই সঙ্গে রয়েছে বলের আদান-প্রদানের জন্য একগুচ্ছ মেসন-কণা ও ফোটন-কণা। অসংখ্য এই কণার রাজ্যে বস্তুর মৌলরূপের পরিচয় এখনও প্রশ্নাতীত ভাবে বিজ্ঞানের কাছে ধরা পড়েনি। গভীর দৃষ্টিতে এই জাতীয় কণাবস্তুর আচরণ কিছুটা অবস্তু-সুলভ ঠেকে, কিন্তু তাকে কোনও ভাবেই চৈতন্যের প্রমাণ হিসেবে বিজ্ঞান গ্রহণ করেনি।

 শ্রীসেন বস্তুর চৈতন্যকে প্রতিষ্ঠা করার তীব্র আকুতিতে কিছু বিজ্ঞানীর মতামত হাজির করেছেন; যে-সব মতামত স্পষ্টতই অনুমানমাত্র, কোনও প্রমাণিত সত্য নয়। চৈতন্য যদি বস্তুর মৌলরূপ হয়, তবে বিজ্ঞান একদিন তা প্রমাণও করবে। যতদিন না প্রমাণ হচ্ছে, ততদিন এই অনুমান বা কল্পনাকে ‘বিজ্ঞানের সিদ্ধান্ত’ বলে প্রচার করাটা আদৌ নৈতিক নয়। তবে সন্দেহের অবকাশ থেকে গেল, এই ভ্রান্ত বা মিথ্যে লেখা ও প্রচারের পিছনে অজ্ঞতা কতটা দায়ী? নাকি এর পিছনে রয়েছে গভীর কোনও পরিকল্পনা?

O

চৈতন্য যদি বস্তুর মৌলরূপ হয়, তবে বিজ্ঞান একদিন তা প্রমাণও করবে। যতদিন না প্রমাণ হচ্ছে, ততদিন এই অনুমান ৰা কল্পনাকে বিজ্ঞানের সিদ্ধান্ত’ বলে প্রচার করাটা আদৌ নৈতিক নয়।

O

কারণ: আঠাশ

ধর্মের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ কি মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হতে শেখায়?


প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের ধারক-বাহকরা, ধর্মীয়বেত্তারা, বুদ্ধিজীবী ধর্মগুরুরা অধুনা প্রচার শুরু করেছেন—প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মই মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হতে শেখায়। ধনী-দরিদ্রের বিভেদ ভুলিয়ে সকলকে একই গণউপাসনায়, গণপ্রার্থনায় মেলাতে পারে এবং মিলিয়ে থাকে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম বা ধর্মীয় সম্প্রদায়।

 কিন্তু, এ তো কোনও কামা মিলন হতে পারে না! এ তো ধনী-দরিদ্রের বাস্তব বিভেদ মেটানোর কোনও পথ নয়! শোষক ও শোষিতের সম্পর্ক ভেঙে সাম্য প্রতিষ্ঠার কোনও দিশা নয়? এ তো অলীক বিশ্বাসের, ভ্রান্ত চেতনার ঐকা! অসাম্যের সমাজ কাঠামোকে টিকিয়ে রাখতে, শোষিতদের ক্ষোভকে বের করে দিতেই এই ঐক্য। শোষিতদের ক্ষোভকে বিস্ফোরিত হতে না দেওয়ার স্বার্থে ঐক্য। এই ঐক্য, এই আবেগময় ধর্মীয় গণজমায়েত প্রায়শই গণহিস্টিরিয়া তৈরি করে। এবং এ জাতীয় গণহিস্টিরিয়া ব্যক্তিমানুষের নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা-সমাজ চেতনা-সামাজিক দায়িত্ববোধকে গুলিয়ে দেয়, ভুল পথে চালিত করে। শেষ পর্যন্ত ধর্মীয় ঐক্য ধনী-দরিদ্র শ্রেণীর বৈষম্য বা অনৈক্যকে বাস্তবে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে অবাস্তব এক ‘ছেলে-ভোলানো ললিপপ’ ছাড়া আর কিছুই হয়ে ওঠে না।

O

শেষ পর্যন্ত ধর্মীয় ঐক্য ধনী-দরিদ্র শ্রেণীর বৈষম্য বা অনৈক্যকে বাস্তবে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে অবাস্তব এক ছেলে-ভোলানো ললিপপ ছাড়া আর কিছুই হয়ে ওঠে না।

O

 বৈষম্যের অনৈক্যকে টিকিয়ে রেখে কখনই সমস্ত মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করা সম্ভব নয়। এই ধরনের অনৈক্যের মধ্যেও ঐকোর অলীক চিন্তা অসাম্যের সমাজ ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থেই উঠে এসেছে।


কারণ: উনত্রিশ

দুর্গা কি দুর্গতি নাশ করেন? লক্ষী কি ধনরত্ন বিলোবার একমাত্র মালকিন? সরস্বতী জ্ঞান দানের একমাত্র দেবী? গণেশ ব্যবসা ভাল-খারাপ চালাবার একমাত্র অধীশ্বর? ‘শবেবরাত’ বা ‘ভাগ্য খোলার রাত’—এ খোদাতালার গুণগান গাইলে তবেই এক বছরের আর্থিক ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়?


দুর্গতিনাশিনী দুর্গা হিন্দু প্রধান এই ভারতে প্রতি বছরই প্রবল থেকে প্রবলতর জাঁকজমক নিয়ে ফিরে আসেন পুজো পেত। বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়, দুর্গাপুজোর রমরমা ও বঞ্চিত সাধারণ মানুষের দুর্গতি প্রতি বছরই বেড়ে চলেছে। দেশে আইন আছে, কিন্তু আইনের প্রয়োগ নেই। আইন আজ পুলিশ-প্রশাসন রাজনীতিক ও ধনীদের বুটের তলায় ফুটবল। পুলিশ বা রাজনীতিকের হাতে আপনি যদি আগামী দিনে খুন হন, আপনার প্রিয়জনেরা খুনিদের বিরুদ্ধে কোনও আইনি ব্যবস্থা নিতে পারবেন না। উল্টে আপনার কপালেই দেগে দেওয়া হবে সমাজবিরোধী শিরোপা। আপনি যদি ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের আশ্রিত দুবৃত্তদের দ্বারা ধর্ষিত হন, ‘খারাপ মেয়েছেলে’ শব্দটি আপনার ওপর বর্ষিত হতে থাকবে। যেন আমাদের দেশের সংবিধান বিচার ব্যবস্থাকে শিকেয় তুলে রেখে সমাজবিরোধীদের খুন করার অধিকার ও খারাপ মেয়েছেলেদের ধর্ষণ করার অধিকার কিছু কিছু বিশেষ ক্ষমতাভোগীদের হাতে তুলে দিয়ে বসে আছে।

 রাজনৈতিক নেতা, রাজনৈতিক দল বা রাষ্ট্রশক্তির প্রচার ভুলে দুনীতির বিরুদ্ধে আপনি যদি কোমর সোজা করে রুখে দাঁড়াতে যান, আপনার কোমর ভাঙতে করুণাহীন দৃঢ় তা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে পুলিশ-প্রশাসন-রাজনীতিকরা। আরও একটু এগিয়ে গিয়ে আপনি যদি দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগঠিত করতে সচেষ্ট হন, রাষ্ট্রশক্তি আপনার পিছনে গোয়েন্দা-ফেউ লাগিয়ে দেবেই, একশো পারসেণ্ট গ্যারাণ্টি দিচ্ছি। অসাম্যের সমাজ কাঠামো ভেঙে সাম্যের সমাজ গড়ার দার্শনিক আত্মোপলব্ধি নিয়ে, বঞ্চনা ও অবিচার সম্পর্কে দার্শনিক আত্মোপলব্ধি নিয়ে আপনি যদি অসুরের বিরুদ্ধে সুসংবদ্ধ সংগ্রামে নামেন, ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ বা ‘উগ্রপন্থী’ তকমা আপনার দলের গায়ে সেঁটে দেওয়া হবে। প্রচারের অপার মহিমায় ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ ও ‘ক্রিমিনাল’ শব্দ দুটি সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রিয়-পাঠক-পাঠিকা, একটু ভাবুন তো, একটা পচন ধরা সমাজে সৎ, আদর্শবাদী, সাম্যকামী মানুষরা বিচ্ছিন্ন হতে বাধ্য কি না? ‘বিচ্ছিন্নতা’ কী? সাধারণের থেকে স্বতন্ত্র, সাধারণের থেকে আলাদা, সকলের সঙ্গে মানিয়ে না নিতে পারা। গ্যালিলিও থেকে বিদ্যাসাগর, প্রত্যেকেই সেই সময়কার সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানবগোষ্ঠীর থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন।

 যে সমাজে দুর্নীতি সমুদ্রগভীর, যে সমাজে শাসকের গদিতে বসতে ধনকুবেরদের কাছে ভিক্ষাপাত্র ধরতে হয়, যে সমাজের অর্থনীতি ও সংস্কৃতি কোন পথে চলবে, তা ঠিক করে দেয় টাকার কুমিররা, যে সমাজে বৈষম্য ও শোষণ লাগামছাড়া, সেই সমাজ থেকে কোনও জনগোষ্ঠী যদি বেরিয়ে যেতে চায়, তবে তাদের সেই উচ্চশির স্পর্ধিত সংগ্রামকে কুর্নিশ জানানই প্রতিটি বঞ্চিত মানুষের স্বাভাবিক অভিব্যক্তি হওয়া উচিত। কিন্তু সেই ‘উচিত’টাই ঘটছে না শাসক ও শোষকশ্রেণীর সুনিপুণ মগজ ধোলাইয়ের কল্যাণে।

 সাহিত্যে নাটকে-পর্দায় এমন অনেক চরিত্র হাজির হয় যারা নৈরাশ্যতাড়িত, বিকারগ্রস্ত, একাকিত্বের শিকার এক মানসিক রোগী। মগজ ধোলাইয়ের কৃপায় শুধু এইসব নেতিবাচক চরিত্রগুলোকে সমাজ-বিচ্ছিন্ন বলে আমরা ধরে নিই। ফলে এই মগজ ধোলাইয়ের ফলস্বরূপ আমরা ভুলে থেকেছি ব্যাধিগ্রস্ত সমাজের বিরুদ্ধে আদর্শবাদী মানুষদের স্বাভাবিক প্রতিবাদ, প্রতিরোধ এবং সংগ্রাম ও বিচ্ছিন্নতা। যে বিচ্ছিন্নতার অর্থ শোষণের অবসানমুখী সংগ্রাম, শোষণযুক্ত সমাজ থেকে বিযুক্ত হওয়ার তীব্র আকুতি, সুস্থ সংস্কৃতির বিকাশমুখী চেতনা, সুস্থ আত্মবিকাশের চেতনা, সেই বিচ্ছিন্নতা অবশ্যই মানুষের কাম্য, মানবসভ্যতার কাম্য। প্রিয় পাঠক-পাঠিকা, এমন ক্ষেত্রে আপনি-আমি-আমরা কি মানব সভ্যতার অগ্রগতির স্বার্থে পচনধরা সমাজের বিরুদ্ধে কোনও জনগোষ্ঠীর বিচ্ছিন্নতার অধিকারকে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করবো না? জনগোষ্ঠীর সংগ্রামগুলোর প্রতি সমর্থনের হাত বাড়িয়ে দেওয়াকে সমর্থন করবো না? অবশই করব।

O

যে বিচ্ছিন্নতার অর্থ শোষণের অবসানমুখী সংগ্রাম, শোষণমুক্ত সমাজ থেকে বিযুক্ত হওয়ার তীব্র আকুতি, সুস্থ সংস্কৃতির বিকাশমুখী চেতনা, সুস্থ আত্মবিকাশের চেতনা, সেই বিচ্ছিন্নতা অবশ্যই মানুষের কাম্য

O এই ধরনের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন কখনই বহু রক্তঝরানো সংগ্রাম ছাড়া সাফল্য অর্জন করতে পারে না। কারণ শোষক-শাসকগোষ্ঠী নিশ্চিতভাবেই কোনও জনগোষ্ঠীকে তাদের শোষণ-আওতার বাইরে যেতে দেবে না। শোষক-শাসকগোষ্ঠীর কাছে এটা শুধুমাত্র একটি জনগোষ্ঠীর আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে কায়েম করার লড়াই নয়। তারা জানে, একটি বিচ্ছিন্নতাকামী জনগোষ্ঠীর জয় আরও বহু সুন্দর সমাজ গড়ার স্বপ্নের জন্ম দেবে, আরও বহু বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের জন্ম দেবে। আর তাই শাসক-শোষকগোষ্ঠী বিচ্ছিন্নতাকামী জনগোষ্ঠীর উপর তীব্র থেকে তীব্রতর সন্ত্রাস চালাতে থাকে। এই সন্ত্রাস থেকে বাঁচতে ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে কায়েম করতে বিচ্ছিন্নতাকামী জনগোষ্ঠীকে পাল্টা সন্ত্রাসের পথ বেছে নিতেই হয়। অমনি শোষক-শাসকগোষ্ঠী তাদের সহযোগী প্রচার মাধ্যম ও বুদ্ধিজীবীদের সহযোগিতায় বিচ্ছিন্নতাকামী জনগোষ্ঠীর গায়ে ‘সন্ত্রাসবাদী’ বা ‘টেররিস্ট” শব্দটি দেগে দেয়। প্রচারের মহান ক্ষমতায় ‘টেররিস্ট’ ও ‘ক্রিমিনাল’ শব্দদুটি আমাদের কাছে সমার্থক হয়ে দাঁড়ায়।

 শোষক-শাসকদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নেওয়া ‘টেররিস্ট’ বা ‘সন্ত্রাসবাদী” এমন একজন মানুষ যে বঞ্চনা ও অবিচারের সমাজ ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে তার উপর গড়ে তুলতে চায় এক বঞ্চনাহীন মানব-সমাজ। একজন টেররিস্ট-এর মধ্যে অবশ্যই রয়েছে জগতের বঞ্চনা ও অবিচার সম্পর্কে দার্শনিক আত্মোপলব্ধি। এই ধরনের দর্শনবোধ দ্বারা পরিচালিত না হয়ে যারা সমাজের উপর ধ্বংসের লীলা চালায় আপন ভোগবাদী মানসিকতাকে চরিতার্থ করতে, তারা ‘ক্রিমিনাল’। শাসক-শোষকগোষ্ঠীর পক্ষে আইনকে পরোয়া না করে লুঠ-ধর্ষণ-অত্যাচার-হত্যার সন্ত্রাস সৃষ্টিকারী ভাড়াটে সেনা-পুলিশরা তাই শেষ পর্যন্ত আর ‘সন্ত্রাসবাদী’ হয়ে ওঠে না, হয়ে ওঠে সবচেয়ে সংগঠিত ক্রিমিনাল।

O

একজন ‘টেররিস্ট’-এর মধ্যে অবশ্যই রয়েছেম জগতের বঞ্চনা ও অবিচার সম্পর্কে দার্শনিক আত্মোপলব্ধি। এই ধরনের দর্শনবোধ দ্বারা পরিচালিত না হয়ে যারা সমাজের উপর ধ্বংসের লীলা চালায় আপন ভোগবাদী মানসিকতাকে চরিতার্থ করতে, তারা ক্রিমিনাল।

O

 রাষ্ট্রশক্তি কিন্তু কোনও জনগোষ্ঠীর গায়ে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ বা ‘সন্ত্রাসবাদী’ শিলমোহর দেগে দিয়ে ‘কাজ শেষ’ ভেবে চুপচাপ বসে থাকে না। ইতিহাস অন্তত একথাই বলে। পৃথিবীর যে কোনও অসাম্যের সমাজ কাঠামোকে বজায় রাখা রাষ্ট্রশক্তি এক্ষেত্রে যা করে তা হল, নিজেদের ভাড়াটে সেনাদের সাহায্যে হাটে-বাজারে-বাসে-ট্রেনে নিরীহ মানুষদের হত্যা করে বিচ্ছিন্নতাবাদী দলের নামে ঘটনাস্থলে কিছু স্লোগান দিয়ে ও প্রচারপত্র ছড়িয়ে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের বিরুদ্ধে ঢালাও জনসমর্থন আদায় করে। এই ধরনের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও ষড়যন্ত্র এ’দেশেও চলছে চলবে। দুর্গতিনাশিনী দুর্গা বঞ্চিত, অত্যাচারিত মানুষদের পক্ষে আজ পর্যন্ত কুটোটি নেড়ে দেখেছেন কি? কার দুর্গতি তবে তিনি নাশ করেন? ধনকুবেরগোষ্ঠী ও তাদের সহায়কদের?


 লক্ষ্মীপুজো করলে ধন-দৌলত যদি উপচেই পড়বে, তবে হিন্দুদের ঘরে ঘরে লক্ষ্মীপুজোর পরেও এত ভয়ংকর দারিদ্র্য কেন?

 ‘শবেবরাত’-এর রাতে খোদাতালার গুণগান গাওয়ার পরও আমাদের প্রতিবেশী বাংলাদেশের ঘরে ঘরে এত করাল দারিদ্র্য কেন?

 আমেরিকা ও জাপানের ধনকুবেররা লক্ষ্মীপুজো না করেও, শবেবরাতের নমাজ না পড়েও যদি প্রাচুর্যের পাহাড় বানাতে পারেন, তবে তো লক্ষ্মীপুজো ও শবেবরাতের নমাজ পড়াই প্রাচুর্য কেনার পক্ষে অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে।

 গণেশ পুজো না করেও মালটিন্যাশানাল কোম্পানিগুলোর বিশ্ববাণিজ্যের অধীশ্বর হয়ে বসা গণেশের ভূমিকাকে বাতিল করার পক্ষে যথেষ্ট নয় কি?

 শেক্সপিয়ার থেকে বিদ্যাসাগর, মেঘনাদ থেকে হকিং সরস্বতী পুজো না করেও বৌদ্ধিক জ্ঞানে হিমালয় হয়ে উঠে প্রমাণ করে দিয়েছেন, জ্ঞানার্জনে সরস্বতীর ভূমিকা শূন্য।


কারণ: বিশ

মানুষের অগ্রগতিতে কার অবদান বেশি? অবতারদের, নাকি বৌদ্ধিক জ্ঞানের সাধক ও স্রষ্টা বিজ্ঞনী-সাহিত্যিক-শিল্পী-কারিগরদের?


প্রিয় পাঠক-পাঠিকা, এবার আমরা একটু হিসেব-নিকেশ নিয়ে বসব। একটু কষ্ট করে একটা নামের তালিকা তৈরি করুন। যাঁরা ধর্মীয় উপাসনা, ধ্যান, প্রার্থনা, যাগ-যজ্ঞ ইত্যাদির মাধমে ঈশ্বরের দেখা পেয়েছেন বলে দাবি করেন; তাঁদের নামের তালিকা। এবার খুঁজে দেখার চেষ্টা করুন তো, মানব প্রজাতির জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে কোনও অবদান এঁরা রেখে যেতে পেরেছেন কি না?

 গুহা থেকে প্রাসাদ, চাকা থেকে মহাকাশযান, আগুন থেকে লেজার রশ্মি, হাতপাখা থেকে এয়ার-কণ্ডিশনার, প্রদীপ ও মশাল থেকে পাওয়ার হাউজ, ফোঁড়া কাটার নরুণ থেকে মাইক্রোসার্জারির যন্ত্রপাতি এই যে মানব প্রজাতির সংস্কৃতির অগ্রগমন, এর কোথাও কি ‘ঈশ্বরদ্রষ্টা’ অবতারদের সামান্যতম অবদান আছে?

 নেই। এই ‘নেই’ উত্তরটাই বার বার ফিরে আসতে বাধ্য। কারণ এই অগ্রগমন স্পষ্টতই বৌদ্ধিক জ্ঞানের সাহাযোই সম্ভব হয়েছে।  এরপরও কেউ কেউ বলতে পারেন—মানব সংস্কৃতির অগ্রগমন শুধুমাত্র বস্তুগত উপাদানের উপর নির্ভর করে না। অবস্তুগত উপাদান, অর্থাৎ শিল্প-সাহিত-ভাস্কর্য-দর্শন ইত্যাদির অগ্রগমনের সঙ্গেও মানব প্রজাতির প্রগতি নির্ভরশীল। দর্শনের ক্ষেত্রে ভাববাদী দর্শন অধ্যাত্মবাদী দর্শন যে মহান মহাজ্ঞান মানব সংস্কৃতিকে দিয়েছে, তা কি অস্বীকার করা যায়?

 হ্যাঁ, স্বীকার করি অবতাররা মানব সংস্কৃতিকে দিয়েছে কিছু মহাজ্ঞান’। এই মহাজ্ঞানের মধ্যে রয়েছে অলীক বিশ্বাস, অলীক নিরাপত্তাবোধ, অলীক ইচ্ছাপূরণ, অলীক পরলোকে সুখভোগের নিশ্চিন্ত, অলীক পরজন্ম চিন্তা, অলীক মানুষে-মানুষে বিভাজন-রেখা, সব মিলিয়ে এক অলীক মহাজ্ঞান। এই অলীক মহাজ্ঞানের বাইরে এইসব অবতার, অধ্যাত্মবাদী নেতাদের কাছ থেকে আমরা কিছু পেয়েছি কি? উত্তর একটাই। না। অর্থাৎ ঈশ্বরদ্রষ্টা এইসব অবতার ও অধ্যাত্মবাদী নেতারা মানব প্রজাতির সংস্কৃতিকে দিয়েছে শুধুই অলীক ও ভ্রান্ত কিছু চিত্তা, যা শেষ পর্যন্ত মানষের দ্বারা মানুষকে শোষণের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। তার মানে, এইসব ঈশ্বরদ্রষ্টা অবতার, অধ্যাত্মবাদী নেতারা মানব সংস্কৃতিতে মিশেল দিয়ে চলেছে খারাপ সংস্কৃতি, অপসংস্কৃতি।

O

ঈশ্বরদ্রষ্টা এইসব অবতার ও অধ্যাত্মবাদী নেতারা মানব প্রজাতির সংস্কৃতিকে দিয়েছে শুধুই অলীক ও ভ্রান্ত কিছু চিন্তা, যা শেষ পর্যন্ত মানষের দ্বারা মানুষকে শোষণের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে।

O

 ঈশ্বরদ্রষ্টারা আজ এক একটি প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মেরই প্রতীক হয়ে উঠেছে। তাই এমনটাই সঠিক মূল্যায়ন হবে, যদি আমরা বলি—ঈশ্বরদ্রষ্টাদের পাশাপাশি যে কোনও প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মই যে সংস্কৃতিকে সৃষ্টি করেছে এবং পালন ও পুষ্ট করে চলেছে, তা হল, অলীক বিশ্বাস, যুক্তিহীনতা, মানবতাহীনতা ও ভক্তির সংস্কৃতি, মানব সভ্যতাকে পশ্চাৎমুখী করার সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতি কোনও ভাবেই যুক্তি-বুদ্ধি ও মানবতার কোনও সংস্কৃতি নয়। এই সংস্কৃতি মানব প্রজাতির অগ্রগমনের কোনও সংস্কৃতি নয়।


কারণ: একত্রিশ

রামকৃষ্ণ ও অন্যান্য ধর্মীয় নেতারা অনেকেই ঈশ্বরকে দেখেছেন বলে শোনা যায়, তাঁরা নিজেরাও বলেছেন। সে সবই কি তবে বানানো, মিথ্যে?

‘৮৬-র ফেব্রুয়ারি। স্থান-আগরতলা প্রেস ক্লাব। সময়—বিকেল। প্রেস কনফারেন্সের আয়োজক—আগরতলা প্রেস ক্লাব। উপলক্ষ—বইমেলা উপলক্ষে আগরতলায় আমার আগমন। হল উপচে পড়া ভিড়। সাংবাদিকরা ছাড়া বহু বিশিষ্ট ব্যক্তিও এসেছেন। প্রশ্নোত্তরে প্রেস কনফারেন্স জমে উঠেছে। এমন সময় উঠে দাঁড়ালেন ত্রিপুরা পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান (নামটা আমার স্মরণে নেই)। জিজ্ঞেস করলেন, “রামকৃষ্ণ, বামাক্ষ্যাপা, তৈলঙ্গস্বামী ইত্যাদি বহু মহাপুরুষই ঈশ্বরকে দেখেছেন বলে যা আমরা জানি, তা কি সবই ভুল?”

 উত্তরে যা বলেছিলাম, তাই এখানে তুলে দিচ্ছি ও মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষের কর্মকাণ্ড নিয়ে যতই বৈজ্ঞানিক গবেষণা এগুচ্ছে, ততই বিচিত্র সব তথ্য আমরা জানতে পারছি। এইসব অবাক করা তথ্য মনোবিজ্ঞানে নতুন নতুন মাত্রা যুক্ত করে চলেছে। মনোবিজ্ঞান যদিও আধুনিকতম বিজ্ঞান শাখাগুলোর মধ্যে একটি, তবুও এটুকু বললে নিশ্চয়ই ভুল বলা হবে না, মনোবিজ্ঞানের পুরোন তথ্যগুলো শুধু সাধারণ মানুষের কাছে নয়, উচ্চশিক্ষিত সংখ্যাগুরু মানুষদের কাছেও অজানা। মস্তিষ্ক-বিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞানের সঙ্গে ভালোমত পরিচয় না থাকার জন্য মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষের অনেক বিচিত্র কর্মকাণ্ডকে আমরা ভূত-ভগবান ও অলৌকিকত্বের পরম লীলা বলে গ্রহণ করেছি। প্রতিটি মনোরোগ চিকিৎসকের কাছেই প্রতিনিয়ত বহু রোগী আসেন যাঁরা ভান্ত অনুভূতি (illusion), অলীক বিশ্বাস (hallucination) অন্ধ প্রান্ত ধারণা (delusion) ইত্যাদি মানসিক রোগের শিকার। ভ্রান্ত অনুভূতির উদাহরণ হিসেবে টেনে আনছি ১৯৬৫-র একটি ঘটনা। এডওয়ার্ড হউমপারের নেতৃত্বে একদল পর্বত অভিযাত্রী অভিযান চালিয়েছিলেন সুইজারল্যাণ্ডের আলপস্ পর্বতের ম্যাটারহর্ন চুড়োয়। অভিযানে বীভৎস এক দুর্ঘটনায় চার অভিযাত্রী দড়ি ছিড়ে পড়ে যান গভীর খাদে। এমনই এক মানসিক বিপর্যয়কর অবস্থায় হুউমপার দেখলেন আকাশজুড়ে অদ্ভুত এক ক্রস চিহ্ন। এই বিপর্যয়ের মাঝে যীশুর করুণা ও শুভেচ্ছার প্রতীক হিসেবেই এই ক্রস চিহ্নের আবির্ভাব ধরে নিয়ে নতুনভাবে মানসিক শক্তিতে বলিয়ান হয়ে অভিযান চালিয়ে গিয়েছিলেন। পৃথিবী বিখ্যাত পর্বত অভিযাত্রী এডওয়ার্ড হুউমপোর তাঁর বিখ্যাত রোজনামচায় এই ঘটনার উল্লেখ করেছিলেন। এই ঘটনার আগে-পরে আরও বহু পর্বত অভিযাত্রীরাই বিভিন্ন শঙ্গে অভিযান চালাবার সময় যীশুর অপার করুণা অনুভব করে নবশক্তি পেয়েছিলেন, আর এই অপার করুণার প্রতীক ছিল আকাশে চকচকে ক্রস চিহ্নের স্পষ্ট অবস্থান। পরবর্তীকালে প্রকৃতি বিজ্ঞানীদের তথ্য থেকে আমরা জেনেছি বৃষ্টিতে রোদ পড়ে যেমন অনেক সময় রামধনু (rainbow) দেখা যায়, তেমনই কুয়াশায় রোদ পড়ে অনেক সময় দেখা যায় কুয়াশাধনু (togbow)। এই কুয়াশাধনুই যীশু খ্রিস্টের অলৌকিক ক্ষমতায় বিশ্বাসীদের চোখে হয়ে উঠেছিল শূন্যে ভাসমান অলৌকিক ক্রস চিহ্ন। এ হলো দর্শনানুভূতির ভ্রম {optical illusion)।

O

মস্তিক-বিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞানের সঙ্গে ভালোমত পরিচয় না থাকারজন্য মন্তিক স্নায়ুকোষের অনেক বিচিত্র কর্মকাণ্ডকে আমরা ভূত-ভগবান ও অলৌকিকত্বের পরম লীলা বলে গ্রহণ করেছি।

O

 এই প্রসঙ্গে আর একটা ঘরোয়া উদাহরণ টানা যাক। আপনি হয়ত সকালবেলা চায়ের কাপটা নিয়ে ইজিচেয়ারে বসে আয়েস করে চা খেতে খেতে গভীর মনোযোগের সঙ্গে খবরের কাগজটা পড়ছেন। পড়ছেন এক অলিম্পিয়ানের ড্রাগ নেওয়া নিয়ে খেলোয়াড়, চিকিৎসক ও কোচদের নানা মতামত। এমন সময় আপনার জীবনসঙ্গিনী বাজারে থলিটি নিয়ে হাজির হলেন। বললেন, “আজ কিন্তু চা আনতে হবে। দু’শো গ্রাম হলুদের গুঁড়ো আনবে। একশো ইসবগুলের ভুসি।”

 আপনি কাগজের পাতায় চোদ্দ আনা মন রেখে দিয়ে মুখে “হুঁ…হুঁ…করে চলেছেন, কাগজে পুরোপুরি মন দিতে অসুবিধা হচ্ছে বলে ব্যাপারটার জের টানতে বললেন, “আর কিছু লাগবে না তো, ঠিক আছে ব্যাগটা এখানেই…”

 কথা শেষ করতে পারলেন না। লাফিয়ে উঠলেন শিরশিরে এক আতঙ্কে। খোলা কাঁধের উপর কি যেন একটা অতি দ্রুততার সঙ্গে কিলবিল করে উঠল। বিছে নয় তো? চলকানো চায়ের কাপটা ইজিচেয়ারের সামনে রাখা টুলটায় ‘দ-ড়া-ম করে নামিয়ে রেখে মুহূর্তে ডান হাত দিয়ে কাঁধ থেকে ঝেড়ে ফেলতে চাইলেন বিছেটাকে! মাটিতে এসে পড়ল এক টুকরো সুতো। সঙ্গিনীর হাত থেকে বা ব্যাগ থেকে সুতোটা কাঁধে এসে পড়েছিল। স্পর্শানুভূতির ভ্রান্তিতে আপনি সুতোটাকেই ভাবছিলেন বুঝি বিছে। অন্য কিছু না ভেবে বিছেই ভাবলেন কেন? রাতে বাথরুমে গেলে ফাটল ধরা সঁতস্যাতে বাথরুমে প্রায়ই আতঙ্ক সৃষ্টিকারী বিছেদের মুখোমুখি হতে হয়। এ বাড়িতে বিছের দেখা মেলে বলেই কিলবিল না করতে পারা সুতোও কিলবিল করে উঠেছে। এ’হলো স্পর্শানুভূতির ভ্রম (talctile illusion)|

 আমাদের পাঁচটা ইন্দ্রিয়কে ভিত্তি করে ভ্রান্ত অনুভূতিতে পাঁচটা ভাগে ভাগ করা হয়। দর্শনানুভূতি ও স্পর্শানুভূতির কথা তো আগেই বললাম। এ ছাড়া আরও তিনটে অনুভূতি হলো শ্রবণানুভূতির ভ্রম (auditory illusion) ঘ্রাণানুভূতির ভ্রম (olfactory illusion) এবং স্বাদগ্রহণের ভ্রম বা জিহ্বানুভূতির ভ্রম (tasle illusion)।

 একইভাবে অলীক দর্শনও পাঁচটি ইন্দ্রিয়কে ভিত্তি করে পাঁচটি ভাগে বিভক্ত। অলীক দর্শনের একটা দৃষ্টান্ত এখানে আনছি।

 কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য ডাঃ সত্যেন সেনের ভাইপো সুজিত সেন মারা যান ৩০ সেপ্টেম্বর ‘৮৫, কেদার-এ। তার আগের বছর সুজিত সেনের একমাত্র সন্তান আত্মহত্যা করেছিলেন। সুজিতবাবু ও তাঁর জীবনসঙ্গিনী মানসিক আঘাত ভুলতেই সেবার কেদারের পথে বেরিয়ে পড়েছিলেন। কেদারের পথে এক চড়াই অতিক্রম করার সময় সুজিতবাবু হার্টে ব্যথা অনুভব করেন। আত্মীয়-বন্ধুহীন এই তীর্যযাত্রায় সুজিতবাবুর একমাত্র সঙ্গী জীবনসঙ্গিনী সাহায্য পাওয়ার আশায় পাগলের মতই চিৎকার করতে থাকেন। এক সময় শ্রীমতী সেন দেখতে পেলেন এক সন্ন্যাসী ছুটতে ছুটতে আসছেন। মরণপথযাত্রী শ্রীসেনের সামনে দাঁড়িয়ে সন্ন্যাসী তাঁর মুখে প্রসাদ ও কমণ্ডুলের জল ঢেলে দিয়ে যেমন এসেছিলেন, তেমনই ছুটতে ছুটতে চলে গেলেন। একটু পরেই শ্রীসেন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। শ্রীমতী সেন কাছাকাছি এক আশ্রমে আশ্রয় নিলেন। শ্রীসেনের ‘শেষকাজ’ শ্রীমতী সেনই করলেন আশ্রমের সন্ন্যাসীদের উপদেশ মতো। সন্ন্যাসীরা এই মৃত্যুকে আধ্যাত্মিক মহাপুরুষের মৃত্যু হিসেবে ধরে নিয়ে মৃতদেহ না পুড়িয়ে নদীর জলে ভাসিয়ে দিলেন। দু’দিন পরে শ্রীমতী সেন কেদারনাথ দর্শন করতে গিয়ে স্তম্ভিত হয়ে পড়লেন। এ কী দেখছি? এই কি কেদারনাথ? ইনিই তো সেদিন সুজিতের মুখে জল ও প্রসাদ তুলে দিয়েছিলেন।

 শ্রীমতী সেন হিন্দু ধর্মে পরম বিশ্বাসী। দীর্ঘদিনের সংস্কার, তীর্থক্ষেত্রে ধর্মীয় পরিবেশ, প্রচণ্ড মানসিক আঘাতের আবেগ ও সন্ন্যাসীদের আধ্যাত্মিক কথাবার্তা, শ্রীসেনকে ঈশ্বর কৃপাধন্য মহাপুরুষ হিসেবে সন্ন্যাসীদের ঘোষণা শ্রীমতী সেনের মধ্যে এই ধরনের অলীক দৃশ্যানুভূতির (Visual hallucination) সৃষ্টি করেছিল। শ্রীমতী সেন যদি পরম খ্রিস্ট ধর্মে বিশ্বাসী হতেন এবং খ্রীষ্টীয় পাদ্রীদের মুখে শুনতেন শ্রীসেন যীশুর পরম কৃপাধন্য, তবে দুর্গম পথযাত্রার শেষ কোনও চার্চে ঢুকে যীশুর মূর্তির মধ্যে মৃত্যুপথযাত্রী জীবনসঙ্গীর মুখে জল তুলে দেওয়া মানুষটিকেই দেখতে পেতেন।

 শ্যামলেন্দু রায় ব্যাঙ্ককর্মী। সুন্দরী তরুণী সুমনার সঙ্গে বিয়ে হয়। দু’জনেই দু’জনের প্রতি ছিলেন দারুণভাবে আকর্ষিত। কিন্তু বছর না ঘুরতেই শ্যামলেন্দু অফিস যাওয়ার পথে স্কুটার অ্যাকসিডেণ্টে মারা যান। শ্যামলেন্দুর ব্যাঙ্কে সুমনা চাকরি পান। সহকর্মী ধ্রুবকে ভালই লাগে। ধ্রুবও সমুনাকে চান, সেটুকু বুঝতে অসুবিধে হয় না। একদিন ধ্রুব বিয়ের প্রস্তাব দিলেন সুমনাকে। আর, সে রাতেই শুতে যাওয়ার আগে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে ক্লিনজিং মিল্ক দিয়ে মুখ পরিষ্কার করতে করতে সুমনা তাকালেন ড্রেসিং টেবিলে রাখা শ্যামলেন্দুর ছবির দিকে। আর অমনি স্পষ্ট শুনতে পেলেন শ্যামলেন্দুর গলা, তুমি আমাকে এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলে, সুমনা?” তারপর থেকে প্রায়ই শ্যামলেন্দুর ছবি কথা বলে। এক সময় ছবিটা সরালেন। কিন্তু শ্যামলেন্দুর কথা বিদায় নিল না। শেষ পর্যন্ত হাজির হয়েছিলেন চিকিৎসার জন্য। শ্রবণানুভূতির অলীক বিশ্বাসের auditory hallucination) এই রোগী এই ধরনের কথা শুনতে পান।

 ৮৫-র কালীপুজোর সময় দমদম চিড়িয়ামোড়ের একটি প্যাণ্ডেলে আগুন লাগে। পুজোর উদ্যোক্তা তরুণরাই বন্ধ ঘরের মতো জ্বলন্ত প্যাভেল থেকে দর্শকদের উদ্ধার করেন। প্যাণ্ডেলে আগুন ঘেরার মধ্যে একজন ছিলেন আমারই বন্ধু-পত্নী। এই আগুন লাগার তিনদিন পর বন্ধু আমাকে ফোনে জানান ওর জীবনসঙ্গিনী নাকি মাঝে মাঝেই তীব্র আতঙ্কে চিৎকার করে উঠছেন। উনি নাকি দেখছেন ওঁর আশে-পাশে দপ্ করে আগুন জ্বলে উঠছে। এমন কি আগুনের তাপও নাকি স্পষ্ট টের পাচ্ছেন। আর এই ব্যাপারটা প্রধানত ঘটছে কোথাও আগুন দেখলেই।

 বন্ধুর বাড়ি গিয়েছিলাম। হিপটিক সাজেশনে তাঁকে আবার ঠিকও করে দিয়েছিলাম। কিভাবে ঠিক করেছিলাম, প্রসঙ্গ সেটা নয়। যে প্রসঙ্গে আসতে ঘটনাটা বললাম, সেটা হলো বন্ধু-পত্নী কেন হঠাৎ অলীক আগুন দেখতে পাচ্ছিলেন? তাপ অনুভব করতে পারছিলেন? মস্তিষ্কের বিশেষ গঠন-বৈশিষ্ট্যের অধিকারী এই ধরনের আবেগপ্রবণ, সংবেদনশীল এবং মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষের কম নমনীয়তা সম্পন্ন মানুষরা অনেক সময় নিজের অজান্তে স্বনির্দেশ (auto-suggestion) পাঠিয়ে অনেক অলীক কিছু দেখেন, অনেক অস্বাভাবিক সব কাণ্ডকারখানা ঘটিয়ে ফেলেন। দুর্ঘটনার দিন আগুনের ঘোরটোপে অনেকেই আটকে পড়েছিলেন সকলেই কিন্তু বন্ধু-পত্নীর মতো আগুন দেখছিলেন না; তাপ অনুভব করছিলেন না। বন্ধু-পত্নী দেখেছিলেন। কারণ তাঁর মস্তিষ্ক বৈশিষ্ট্য, মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষের নমনীয়তা, আবেগপ্রবণতা বহুর তুলনায় নিশ্চয়ই অন্যরকম। আর তাইতেই আগুন দেখলেই দুর্ঘটনার স্মৃতি তীব্র আতঙ্ক ছড়িয়ে পিছু তাড়া করেছে—আর একটু হলেই শরীরটায় আগুন লেগে যেত। শরীরটা পুড়তে থাকত। অসহ্য তাপে ঝলসে যেত রূপ-যৌবন। আর একটু হলেই এমনটা হতো। উঃ, আগুন কী বীভৎস! কী ভয়ংকর! আগুনে পোড়া মানুষ বাঁচলেও তাকে আগুনের কাছেই জমা রেখে আসতে হয় রূপ-যৌবন! বন্ধু-পত্নী বাস্তবিকই সুন্দরী। আর সম্ভবত অনেকটা সেই কারণেই বন্ধু তাঁর জীবন-সঙ্গিনীকে আদরে-সোহাগে ঘিরে রাখতেই খুব বেশি পছন্দ করতেন। সোহাগের এমনতর কারণটা বন্ধু-পত্নীরও অজানা ছিল না। সৌন্দর্য সচেতন আবেগবশ মন তাই তীব্র আতঙ্কে বার-বার ভেবেছেন—আর একটু হলেই পুড়ে যেতাম! পুড়ে গেলে কী হতো! আগুন কী ভয়ংকর! আবার যদি কখনও আগুনে পুড়ি। সামান্য একটু অসতর্কতা থেকে আগুন কত ভয়ংকর সব দুর্ঘটনাই না লাগাতার ভাবে ঘটিয়ে চলেছে? একটু অসতর্কতা…আগুন…উঃ…বন্ধুপত্নী তীব্র আতঙ্ক থেকে অলীক দর্শন ও অলীক স্পর্শানুভূতির শিকার হয়েছেন।

 ঠিক এমনি ভাবে কেউ তীব্র আকুতি নিয়ে যদি ঈশ্বর দর্শন কামনা করতে থাকে, এবং যদি তার মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষের নমনীয়তা কম থাকে এবং সে আবেগপ্রবণ হয় তবে তার পক্ষে অলীক ঈশ্বরদর্শন সম্ভব, অবশ্যই সম্ভব। ধরে নিলাম, রামবাবু পুজো-আর্চা করেন। ঈশ্বরে পরম বিশ্বাসী। মনে তাঁর তীব্র আকুতি—মা দেখা দে মা। অফিস যাওয়ার আগে স্নানটি সেরে ঠাকুর পুজো করেন ঘণ্টা দেড়েক ধরে। সেদিন শনিবার, কালীর ছবিতে নীল অপরাজিতার মালা পরিয়ে প্রদীপ জ্বেলে ধূপ-ধুনো দিয়ে পুজো করছেন, হঠাৎ দেখতে পেলেন মা কালী ছবি ছেড়ে এক পা, এক পা করে বেরিয়ে এলেন।

 Visual hallucination বা Optical hallucination রোগীর পক্ষে এই ধরনের দৃশ্য দেখা সম্ভব। এই একই ঈশ্বর দর্শনের তীব্র অনুভূতি থেকেই কারও কারও পক্ষে ঈশ্বরের বাণী শোনা সম্ভব, ঈশ্বরের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব। এই ঈশ্বরের সঙ্গে কথা বলার মধ্যে ঈশ্বরের বাস্তব অস্তিত্বের কোনও প্রয়োজন হয় না। এগুলো শ্রবণানুভূতির ভ্রম। আরও বহু মানসিক অবস্থায় একজন মানুষের পক্ষে ঈশ্বর দর্শন সম্ভব, ঈশ্বরের বাণী শোনা সম্ভব, ঈশ্বরের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব। এই প্রেস কনফারেন্সে তা নিয়ে বিস্তৃত আলোচনায় না গিয়ে বলছি, আমি সার্কিট হাউজে আছি। কাল বিকেলের ফ্লাইটে কলকাতায় ফিরব। আপনাকে দেখে অনুমান করতে অসুবিধে হচ্ছে না, আপনি ঈশ্বরে বিশ্বাসী। তীব্রভাবে ঈশ্বর দর্শনে ইচ্ছুক। কাল সকালে সার্কিট হাউজে আসুন। আমার সঙ্গে পরিপূর্ণ সহযোগিতা করলে কালকে আপনাকে সম্মোহিত করে আপনার মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষে এমন নির্দেশ পাঠাব যে আপনি আপনার প্রার্থিত ঈশ্বরকে অবশ্যই দেখতে পাবেন। আমি ফিরে যাবার পরও আপনি আমার কথা মতো মনোসংযোেগ করে মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষে স্বনির্দেশ পাঠালেই ঈশ্বর দেখতে পাবেন।

 আমার লেখাটি এতদূর পড়ে যাঁরা একটু তেড়ে-ফুঁড়ে উঠবেন, তাঁদেরকে বলি-ধীরে, একটু ধীরে। যুক্তিটুক্তি সবকিছু আবেগ নামক রসালো নির্বুদ্ধিতার কাছে জমা না রেখে, সম্মোহন করে মানসিক চিকিৎসা করেন, এমন কোনও চিকিৎসকের কাছে মানসিক রোগী সেজে গিয়ে চিকিৎসকের সঙ্গে পরিপূর্ণ সহযোগিতা করলেই মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষের বিচিত্র কর্মকাণ্ডের কিছুটা যা পরিচয় পাবেন, তারপর আর তেড়ে-ফুঁড়ে উঠবেন না।

 প্রেস কনফারেন্সে যা বলেছি তার বাইরেও আর অনেক কারণ আছে, যার জনা কোনও কোনও মানুষের পক্ষে ঈশ্বর দর্শন সম্ভব।

 চিকিৎসকরা অস্ত্রোপচারের আগে রোগীকে যখন আনাসথিসিয়া করেন তখন অনেক রোগী মৃত্যুভয়ে ঈশ্বরকে মনে মনে ডাকতে থাকেন এবং চেতনা হারাবার আগে বা অর্ধচেতন অবস্থায় ঈশ্বর দেখেন, মৃত্যুলোক দেখেন ইত্যাদি ইত্যাদি। এল, এস, ডি, হেরোয়িনের মতো মাদক গ্রহণ করলেও অনেক সময় অদ্ভুত আনন্দ, হুরী-পরী-ঈশ্বর ইত্যাদির দেখা মেলে।

 স্বাভাবিক মানুষও ধর্মীয় উন্মাদনার শিকার হয়ে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ঈশ্বর দর্শন করতে পারেন। নেচে নেচে কীর্তন গাইতে গাইতে যেমন ঈশ্বর অনুভূতি বা ঈশ্বর দর্শন হতে পারে, তেমনই সতী মায়ের থানে সতী মেলার সময় অথবা শ্রাবণ মাসে তারকেশ্বরের মন্দিরে দঙী কাটতে কাটতে এমন অনুভূতি বা দর্শন সম্ভব। মহরমের মিছিলে কাচের টুকরো বা কাঁটা দু’হাতে নিয়ে হাসান-হসান বলে দু’বুক চাপড়াতে চাপড়াতে রক্তাক্ত করে তোলা মানুষদের কেউ কেউ অলীক অনুভূতির শিকার হন। এই সবই ধর্মীয় উন্মাদনা থেকে ঈশ্বর অনুভূতি ও অলীক অনুভূতির উদাহরণ।

 রোগটার নাম কী বলব? স্কিটসোফ্রিনিয়া না স্কিজোফ্রেনিয়া? অনেকে আবার সিজোফ্রেনিয়াও বলে থাকেন। ইংরেজি বানানটা হল schizophrenia! আর সংসদের অভিধানে উচ্চারণ লেখা আছে স্কিটসোফ্রিনিয়া। আমারও না হয় বাংলায় লিখতে স্কিটসোফ্রিনিয়াই লিখব। হ্যাঁ, এই রোগও ঈশ্বর দর্শন সম্ভব এবং এই রোগের অনেক রোগী তা দেখেও থাকেন।

 স্কিটসোফ্রিনিয়া রোগের বিষয়ে বোঝার সুবিধের জন্য একটু ছোট্ট করে আলোচনা সেরে নেওয়া জরুরি। গতিময়তা মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষের একটি বিশেষ ধর্ম। সবার মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষের গতিময়তা সমান নয়। যাদের গতিময়তা বেশি, তারা যে কোনও বিষয় চটপট বুঝতে পারে। বহু বিষয়ে জানার ও বোঝার আগ্রহ ও ক্ষমতা আছে। খুব সাবলীলভাবেই বিভিন্ন ধরনের কাজকর্মে নিজেকে ডুবিয়ে রাখতে পারে এবং সহজেই এক প্রসঙ্গ থেকে অন্য প্রসঙ্গের চিন্তায় বা আলোচনায় নিজের মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষগুলিকে কাজে লাগাতে পারে। সাধারণভাবে রাজনীতিবিদ, শিল্পপতি, প্রশাসক শ্রেণীর মানুষদের মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষের গতিময়তা বেশি। এই ধরনের মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষের অধিকারীদের বলা হয় প্রাণচঞ্চল বা স্যাংগুইনাস (Sanguineous)।

 চিন্তাবিদ, গবেষক, সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী শ্রেণীর মানুষরা সাধারণভাবে কোনও বিষয়ে গভীরভাবে চিন্তা করতে ভালবাসেন। সবকিছুকে ভালমতো জানতে চান, বুঝতে চান। একই সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে ভালোবাসেন না। এরা আত্মস্থ বা ফ্লেমেটিক (Phlegmatic) ধরনের মস্তিষ্কের অধিকারী।

 স্কিটসোফ্রিনিয়া রোগের শিকার হন সাধারণভাবে আত্মস্থ ধরনের মস্তিষ্কের অধিকারীরা। তারা কোনও কিছু গভীরভাবে চিন্তা করতে গিয়ে সঠিকভাবে চিন্তার মূলে পৌঁছতে না পারলে, অথবা কোনও সমস্যা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করেও সমাধানের পথ না পেলে, অথবা কোনও রহস্যময়তা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করতে করতে অতি আবেগপ্রবণতার দরুন রহস্যময়তা থেকে নিজেকে বের করে আনতে না পারলে তাদের মস্তিষ্কের গতিময়তা আরও কমে যায়। তখন তারা আরও বেশি করে নিজের চিন্তার মধ্যে নিজেকে গুটিয়ে নেবার চেষ্টা করে। মস্তিস্কের চালককেন্দ্র (motor centre) এবং সংবেদনকেন্দ্র (sensorium। ধীরে ধীরে কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলতে থাকে, শ্লথ হতে থাকে, অনড় হতে থাকে। এর ফলে এরা প্রথমে বাইরের কর্মগৎ থেকে, তারপর নিজের পরিবারের আপনজনদের কাছ থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে নেয়। অবশেষে এক সময় এরা নিজেদের সত্তা থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে নেয়।

 পরবর্তীকালে দেখা যায়, রোগী মস্তিষ্কর কোষ ঠিক ভাবে উদ্দীপনা সঞ্চালন করতে পারছে না, বা ছড়িয়ে দিতে পারছে না। ফলে একটি কোষের সঙ্গে আর একটি কোষের সংবাদ আদান-প্রদান ব্যাহত হচ্ছে। মস্তিষ্ক কোষের এই বিশৃঙ্খল অবস্থার দরুন রোগীর ব্যবহারে বাস্তববিমুখতা দেখতে পাওয়া যায়। রোগীর এই অবস্থায় অলীক বিশ্বাসের শিকার হয়। পাঁচটি ইন্দ্রিয়ের এক বা একাধিক ইন্দ্রিয় এই অলীক বিশ্বাসের দ্বারা পরিচালিত হয়। এর ফলে ভূত বা ভগবান রোগীর লীলাসঙ্গী হতেই পারে।

 রিলিজিয়াস মিসটিক (Religious Mystic) নামে মনোবিজ্ঞানে এক শ্রেণীর মানুষের কথা বলা হয়েছে যারা নিজেদের অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী, ঈশ্বরের পুত্র, ঈশ্বরের প্রতিনিধি, ঈশ্বরের শেষ প্রতিনিধি ইত্যাদি বলে গভীরভাবে বিশ্বাস করে। এই “রিলিজিয়াস মিসটিক’ শ্রেণীর মানুষরা ঈশ্বরে নিবেদিতপ্রাণ। এরা বিশ্বাস করে সমাধিস্থ অবস্থায় ঈশ্বরের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ স্থাপন করা সম্ভব। আর তেমনটা করলে যে কোনও অতীন্দ্রিয় ক্ষমতা হাতের মুঠোয় ধরা পড়ে।

O

রিলিজিয়াস মিসটিক (Religious Mystic) নামে মনোবিজ্ঞানে এক শ্রেণীর মানুষের কথা বলা হয়েছে যারা নিজেদের অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী, ঈশ্বরের পুত্র, ঈশ্বরের প্রতিনিধি, ঈশ্বরের শেষ প্রতিনিধি ইত্যাদি বলে গভীরভাবে বিশ্বাস করে।

O

 এরা নিজেদের বিশ্বাস মতো ধ্যান করে, উপাসনা করে, সমাধিতে বসে এবং বেশি বেশি করে নিজের চিন্তার মধ্যে নিজেকে আটকে রাখতে থাকে। কর্মজগৎ ও আপনজনদের কাছ থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে নেয়। নিজের কল্পনার জগৎকেই বাস্তব জগৎ হিসেবে এক সময় বিশ্বাস করতে থাকে। এই গভীর বিশ্বাস থেকে এরা দিব্য আলো দর্শন করে; পরমপিতা বা ঈশ্বরের আদেশ শোনে—যেমনটি শুনেছিলেন মোজেস। এদের কেউ বা মনে করে—যা কিছু করছে, তার সব কিছু করাচ্ছে এক অলৌকিক শক্তি। এরা কখনও বা কোনও একটা মুহুর্তে কিছুক্ষণের জন্য পাওয়া অদ্ভুত এক অনুভূতিকে বাকি জীবন দঢ় প্রত্যয়ে বিশ্বাস করে বেড়ায়। এমনই মুহূর্তের কোনও অলীক অনুভূতি থেকে মনে করে-বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের রহস্যের সত্য জানতে পেরেছে। আবার কেউ বা মনে করে—যে পরমব্রহ্মকে জেনেছে। ব্রহ্মাণ্ডের রহস্যময়তাকে জেনেছে, যা বলে বোঝানো যায় না; এ এক অদ্ভুত অনুভূতির ব্যাপার; এই রহস্যের কথা কাউকে জানানো যাবে না ইত্যাদি।

 এই ধরনের মিসটিক ফেনোমেনার (Mystic Phenomena) কেউ কেউ অসংলগ্ন কথা বলে, কারও বা মুখ থেকে এই সময় স্বতস্ফূর্ততার সঙ্গে বেরিয়ে আসে কবিতার ছন্দে নানা ধর্মীয় উপদেশ, কেউ কেউ মনে করে পরমপিতা বা পরমব্রহ্মের সঙ্গে সে একাত্ম হয়ে যাচ্ছে। যদিও মনোরাগ চিকিৎসকরা একটি মাত্র লক্ষণের উপর নির্ভর করে সাধারণত সিদ্ধান্তে পৌঁছতে চান না, তবুও তাঁদের অনেকেই মনে করেন-যীশু, হজরত মহম্মদ, চৈতন্যদেব ছিলেন ‘রিলিজিয়াস মিস্টিক’ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী।

O

এই ধরনের মিসটিক ফেনোমেনার (Mystic Phenomena) কেউ কেউ অসংলগ্ন কথা বলে,কারও বা মুখ থেকে এই সময় স্বতস্ফূর্ততার সঙ্গে বেরিয়ে আসে কবিতার ছন্দে নানা ধর্মীয় উপদেশ, কেউ কেউ মনে করে পরমপিতা বা পরমব্রহ্মের সঙ্গে সে একাত্ম হয়ে যাচ্ছে।

O

 রিলিজিয়াস মিস্টিক’ শ্রেণীকে মনোবিজ্ঞানে ৫টি স্টেজ বা পর্যায়ে ভাগ করা হয়েছে। এই বিষয়ে উৎসাহীদের বিস্তৃত জানতে মনোরোগ চিকিৎসকদের অতি নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ হিসেবে পরিচিত “Modern Synopsis of Comprehensive Text Book o Psychiatrist” দেখতে অনুরোধ করছি। লেখক: Harold l. Kaplan & Benjanin Sadock, 3rd edition। প্রকাশক ও লণ্ডনের উইলিয়ামস অ্যাণ্ড উইলিয়ামস। পৃষ্ঠা-২৩৪-২৩৫।

 এতক্ষণ আমরা আলোচনা করলাম—ঈশ্বরের বাস্তব অস্তিত্ব না থাকা সত্ত্বেও কী মানসিক পরিস্থিতিতে ঈশ্বর দর্শন করা সম্ভব সেই প্রসঙ্গ নিয়ে। ঈশ্বর দর্শনের দাবিদার অনেকেই কিন্তু কোনওভাবেই ঈশ্বর দর্শন না করেই দাবি করে অর্থ ও ক্ষমতার লোভে।


কারণ: বত্রিশ

ঈশ্বর যদি না-ই থাকবে, কালী-মনসা-শীতলা এ’সবের যে ভর হয়, সেগুলো তবে কী? ভরে অনেক অদ্ভুত ব্যাপার-স্যাপার যে ঘটে, সেগুলোর ব্যাখ্যাই বা তবে কী?

এমন কথা শুধু যে আমজনতার মুখ থেকে উঠে আসে, তা তো নয়, অনেক নামী পত্র-পত্রিকায় দামী সাংবাদিকরাও এসব নিয়ে অনেক কিছুই লেখেন। তাতে সাধারণের বিভ্রান্তি বাড়ে, ঈশ্বর-বিশ্বাস গাঢ় হয়। আমাদেরও দায়িত্ব বাড়ে।

 পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনকেই আসুন বিশ্লেষণের জন্য আমরা বেছে নিই।

 ৩০ মে ‘৯০। আনন্দবাজার পত্রিকায় বহুবর্ণের তিনটি ছবি সহ একটি বিশাল প্রতিবেদন প্রকাশিত একটি হলো “পূজারিণীর শরীর বেয়ে” শিরোনামে। শিরোনামের তলায় গোদা বড় হরফে ছাপা “দেবদেবীর ভর হয় পূজারিণীর শরীরে। সে সময় যা বলা যায় তাই মেলে। যা দাওয়াই দেওয়া হয় তাতেই রোগ নির্মূল হয়। ভর হয় কীভাবে?” উৎসাহী পাঠকদের অবগতির জন্য প্রতিবেদনটি এখানে তুলে দিচ্ছি:

 শনিবার বেলা দুটো। ঢাকুরিয়া স্টেশনের পাশে তিন-চার হাত উচু ছোট্ট একটি কালীমন্দির। মন্দিরের মাথায় চক্র ও ত্রিশূল। মন্দিটির নাম ‘জয় মা রাঠের কালী’। মন্দিরের সামনে একটি সিমেণ্টের বাঁধানো চাতাল। সেই চাতাল ও পাশের মাঠে ইতস্তত ছড়ানো অনেক লোক। আর সেই দাওয়ার ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে এক যুবতী, পরনে লাল পাড় সাদা শাড়ি এলোমেলো, চোখ দুটি বোজা, নাকের পাটা ফোলা, মুখের দুপাশে ক্ষীণ রক্তের দাগ। মহিলাটির ভর হয়েছে। কালী পুজো করতে করতে অচেতন হয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়েন মহিলা মুখ দিয়ে রক্ত বেরোতে থাকে। হঠাৎ মহিলা বলে উঠলেন, ‘স্বামীর লগে এয়েছিস কে?’ উপস্থিত জনতার মধ্যে সাড়া পড়ে গেল। শাঁখা-সিঁদুর মাঝবয়সী এক আধা-শহুরে মহিলা ঠেলাঠেলি করে সামনে এলেন। মন্দিরে ছোট দরজার সামনে হাঁটু মুড়ে বসে ‘মা’ বলে হাতজোড় করে ডাকতে লাগলেন। ‘মা’ বললেন-‘সব ঠিক হয়ে যাবে। কিচ্ছু হবে না আমার জল পড়া খাইয়েছিস?’

  ‘খাইয়েছি মা। সারছে না মা।’

  ‘এতেই সব ঠিক হয়ে যাবে।’

 এরপর ‘মা’ উঠলেন, “ব্যবসার জন্য এয়েছিস কে? বোস। আমার কাছে আয়?” শার্ট-প্যাণ্ট পরা মাঝবয়সী ব্যক্তি এগিয়ে এলেন। একইভাবে—হাতজোড়। হাঁটু মুড়ে বসা। মায়ের কাছে সমস্যার কথা জানালেন। মা অভয় দিলেন। ভদ্রলোক চলে গেলেন। ফের ‘মা’ ডাকলেন। ‘কোমরে পিঠে পেটে ব্যথার জন্য এয়েছিস কে? আয়, আয় সামনে আয়।’

 এক এক করে ছেলে মেয়ে বুড়ো মাঝবয়সী সবাই হাজির হতে লাগল। মা তাদের কোমরে, পিঠে পেটে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। তারা এক এক করে চলে গেলে একটি যুবক এগিয়ে এল। ‘মা’ তার পেটে হাত বুলিয়ে দিলেন নাভিতে হাত রাখলেন। ‘মা’য়ের মুখ দিয়ে রক্ত বেরিয়ে এল। মায়ের ‘ঝাড়া’র রকমই এই।

 ‘সন্তানের লগে এয়েছিস কে?’ যুবকটি চলে যেতেই ‘মা’-য়ের ডাক। শিশুকোলে এক রমণী এগিয়ে এলেন। ‘মা’ শিশুটাকে তাঁর বুকের ওপর শুইয়ে দুই হাতে সজোরে শিশুটির পিঠের ওপর চড় মারতে লাগলেন। তারপর শিশুটিকে দুহাত দিয়ে উচু করে তুলে ধরলেন এবং আবার চড় মারতে লাগলেন, এরপর ‘মা’ শিশুটিকে তার মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিলেন।  মায়ের ভরমুক্তির সময় হয়ে এল। মহিলা, পুরুষ ঠেলাঠেলি করে এগোতে লাগলেন। নিজের নিজের সমস্যার কথা বলবেন এঁরা। মায়ের ভরমুক্তি হলো। চিৎ হওয়ার অবস্থা থেকে উপুড় হয়ে শুলেন ‘মা’। কিছুক্ষণ পর উঠে বসলেন তিনি। পুজো করতে লাগলেন। মন্ত্র পড়ে, হাততালি দিয়ে দেবীর আরাধনা চলল।

 এক মধ্যবয়সী মহিলার হাত-পা কাঁপে। উঠে বসতে পারেন না। কথা বলতেও কষ্ট হয়। জানা গেল, তাঁর অসুখ দীর্ঘদিনের। তাঁকে ‘মা’ সামনে বসিয়ে প্রথমে মন্ত্র পড়ালেন। তারপর ওঠ বস করতে বললেন। মহিলা ওঠ বস করতে পারছিলেন না। তাঁকে জল পড়া খাওয়ানো হলো। মহিলা উঠে বসলেন। এক মধ্যবয়স্ক পুরুষের পিঠ ও কোমরের ব্যথা এবং এক মহিলার গ্যাসট্রিকের বেদনার একইভাবে উপশম করলেন ‘মা’। পরিচয় হলো বিজয়ভূষণ গুহর সঙ্গে। তিনি ন্যাশনাল হেরাল্ডের সঙ্গে যুক্ত। তিন-চার বছর আগে তাঁর স্ত্রীর হাঁপানি সেরে যাওয়ার পর থেকে তিনি ‘মা’য়ের একনিষ্ঠ ভক্ত। এখন মায়ের কাছে আসেন নিয়মিত। কোনও উদ্দেশ্য নয়, শুধু ‘মা’য়ের টানে আসেন।

 মহিলার নাম প্রতিমা চক্রবতী। স্বামী রেলে কাজ করেন। ছেলে একটিই, বয়স বারো তেরো। স্বাস্থ্য মাঝারি, চোখগুলি কোটরে বসা, গভীর। চেহারার গড়ন মজবুত হলেও কোথাও একটা ক্লান্তির ছাপ আছে। মাঝে মাঝে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। কাজ করতে পারেন না। মায়ের দয়াতেই তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন।

 যাদবপুর পলিটেকনিকের ঠিক পেছনে শীতলাবাড়িতেও ভর হয়। এখানে একটি নেপালি পরিবার থাকে। যাদবপুর পলিটেকনিকের পিওনের কাজ করতেন ভদ্রলোক। সম্প্রতি রিটায়ার করেছেন। তাঁর স্ত্রীর ভর হয় প্রতি শনিবার। ভদ্রমহিলার বয়স চল্লিশের কোঠায়, গায়ের রঙ কালো হলেও চেহারায় বেশ সুশ্রীভাব আছে। মুখের গড়নটি ভারী সুন্দর। ছেলে, নাতি-নাতনী নিয়ে তিরিশ বছরের পরিপূর্ণ সংসার। ‘৬৫ সালে দেবীর মূর্তি প্রতিষ্ঠা। যাদবপুর পলিটেকনিকের কর্মী হিসেবে পলিটেকনিকের পিছনেই থাকার জায়গা পেয়েছিলেন তারা। ১৯৭০ সালে নকশাল আন্দোলনের সময় দিল্লি থেকে আসা ১৬০০ পুলিশ ইউনিভার্সিটির চত্বরেই বাস করতে থাকে। তারা চাঁদা তুলে ‘মা’য়ের জন্য পাকা দালান তৈরি করে দেয়। এখন সেই দালানে প্রতি শনিবার ভক্ত সমাগম ঘটে। যে যার সমস্যা নিয়ে আসে। পুজো শুরু করার কিছুক্ষণ পরই ‘মায়ে’র ভর হয়। তখন সবাই প্রশ্ন করতে শুরু করে এবং ‘মা’ প্রশ্নের উত্তর দেন। সব মিলে যায়। একটি বোবা মেয়েকে সারিয়ে তুলেছেন ‘মা’। মায়ের দেওয়া জলপড়ায় উপশম ঘটেছে একটি সুন্দরী নববধূর জটিল ব্যাধির, একটি শিশুর কঠিন অসুখ।

 কলকাতার বাইরে আন্দুলের রাস্তা দিয়ে ঘেরা একটি পুকুরের পিছনে বহুদিন থেকে একটি বাড়িতে পাশাপাশি রয়েছে লক্ষ্মী-নারায়ণ, রাধা-কৃষ্ণ ও কালী। বাংলা ১৩৭১ সালে মূর্তি প্রতিষ্ঠা। তার আগে একটি ছোট্ট বেড়া দেওয়া ঘরে পুজো হতো। তখনই ‘মা’-এর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল এখানে ওখানে।

 মন্দিরে যিনি পুজো করেন, তাঁর বয়স ষাটের কোঠায়। শীর্ণকায়! বিধবা, কিছুদিন হলো স্বামী-বিয়োগ হয়েছে। ভক্তদের দেওয়া অর্থেই সংসার চলে। প্রতি শনি ও মঙ্গলবার পুজোয় বসার পর মায়ের ভর হয়। তখন ‘মা’-কে যে প্রশ্ন করা যায়, ‘মা’ তার উত্তর দেন। প্রশ্ন করার জন্য কুড়ি পয়সা দক্ষিণা। পুজোয় বসার কিছুক্ষণ পর মায়ের মাথা দুলতে থাকে। কাঁসর-ঘণ্টার আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে মায়ের মাথার দোলাও ক্রমশ বাড়তে থাকে। তারপর একসময়ে ‘মা’য়ের হাত থেকে ফুল খসে পড়ে, ঘণ্টা স্ফলিত হয়। মা আচ্ছন্ন হয়ে যান। ভর হয়। ভক্তরা তখন প্রশ্ন করতে শুরু করেন। ‘মা’ আচ্ছন্ন অবস্থায় উত্তর দিয়ে থাকেন।

 এবং উত্তর মিলেও যায়। রোগভোগ সেরে যায়। মানুষগুলির ভিড় তাই বাড়ে।


 প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষদের মধ্যে এক তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল। এই প্রসঙ্গ নিয়ে প্রচুর চিঠি পেয়েছি। বিভিন্ন জায়গায় প্রচুর মানুষের প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছি। প্রশ্নগুলো এই ধরনের “আপনারা কি ঈশ্বরের ভরে পাওয়া পূজারিণীর মুখোমুখি হবেন? না কি, তুড়ি দিয়েই প্রতিবেদকের বক্তব্যকে উড়িয়ে দিতে চাইবেন?”

 ঈশ্বরে ভর আর ভূতে ভরের প্রশ্নে আজও বহু মানুষ দ্বিধাগ্রস্ত। আমার পরিচিত এক প্রাক্তন অধ্যাপক গোবিন্দ ঘোষ তুকতাক, ঝাড়-ফুক, জ্যোতিষ এই সব কিছুকেও বুজরুকি বলে উড়িয়ে দিয়েও উড়িয়ে দিতে পারেননি ভরকে। কারণ এ’যে নিজের চোখে দেখা।

 আনন্দবাজারে প্রকাশিত প্রতিবেদনটির উত্তর যথারীতি দিয়েছিলাম। ৩ জুলাই ৯০ চিঠিটি প্রকাশিত হয়েছিল। ভর নিয়ে বিস্তৃত আলোচনায় ঢোকার আগে মুখবন্ধ হিসেবে প্রকাশিত চিঠিটায়, আমরা একবার চোখ বুলিয়ে নিই আসুনঃ

পূজারিণীর শরীরে দেবতার ভর?

 সাবর্ণী দাশগুপ্তের ‘পূজারিণীর শরীর বেয়ে’ প্রতিবেদনটি (৩০ মে) পড়ে অবাক হয়ে গেছি। লেখাটি পড়ে বিশ্বাস করার সঙ্গত কারণ রয়েছে যে, সাবর্ণী দাশগুপ্তের ‘ভর’ হওয়ার বিজ্ঞানসম্মত কারণগুলি বিষয়ে অবহিত নন এবং উনি ভরগ্রস্তদের দ্বারা প্রতারিত হয়েছেন। অবশ্য তিনি যদি তাঁর লেখার সত্যতা বিষয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে থাকেন তবে ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি এ বিষয়ে সত্যানুসন্ধানে মুক্ত মনে তাঁর সাহায্য ও সহযোগিতা কামনা করছে। সাবর্ণীর হাতে তুলে দেব কয়েকজন ব্যক্তি যাঁরা ভরগ্রস্তদের কাছে প্রশ্ন রাখবেন। তুলে দেব পাঁচজন রোগী। ভর লাগা পূজারিণীরা রোগীদের রোগ মুক্ত করতে পারলে এবং প্রশ্নকর্তাদের প্রশ্নের সঠিক উত্তর পেলে আমরা সাবণীর কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকব এবং আমরা অলৌকিকতা-বিরোধী ও কুসংস্কার বিরোধী কাজকর্ম থেকে বিরত থাকব।

 না, ভর লাগা পূজারিণী সত্যানুসন্ধানে সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসেননি। এগিয়ে আসেননি সাবর্ণীও।

‘ভয়’ কখনো মানসিক রোগ, কখনো-বা অভিনয়

 শারীর-বিজ্ঞানের মতানুসারে ‘ভর’ কখনও মানসিক রোগ, কখনও স্রেফ অভিনয়। ভরলাগা মানুষগুলো হিস্টিরিয়া, ম্যানিয়াক ডিপ্রেসিভ, স্কিটসোফ্রিনিয়া ইত্যাদি রোগের শিকার মাত্র। এইসব উপসর্গকেই ভুল করা হয় ভূত বা দেবতার ভরের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে। সাধারণভাবে যে সব মানুষ শিক্ষার সুযোগ লাভে বঞ্চিত, পরিবশভাবে প্রগতির আলো থেকে বঞ্চিত, আবেগপ্রবণ, যুক্তি দিয়ে বিচার করার ক্ষমতা সীমিত তাঁদের মস্তিষ্ককোষের সহনশীলতাও কম। তাঁরা এক নাগাড়ে একই কথা শুনলে বা ভাবলে অনেক সময় মস্তিষ্কের কার্যকলাপে বিশৃঙ্খলা ঘটে। দৈবশক্তির বা ভূতে বিশ্বাসের ফলে অনেক সময় রোগী ভাবতে থাকে, তাঁর শরীরে দেবতার বা ভূতের আবির্ভাব হয়েছে। ফলে রোগী দেবতার বা ভূতের প্রতিভূ হিসেবে অদ্ভুত সব আচরণ করতে থাকেন। অনেক সময় পারিবারিক জীবনে অসুখী, দায়িত্বভারে জর্জরিত মানসিক অবসাদগ্রস্ততা থেকেও ‘ভর’ রোগ হয়। স্কিটসোফ্রিনিয়া রোগীরা হন অতিআবেগপ্রবণ, তা সে শিক্ষিত বা অশিক্ষিত যে শ্রেণীরই হোন না কেন। এই আবেগপ্রবণতা থেকেই রোগীরা অনেকসময় বিশ্বাস করে বসেন তাঁর উপর দেবতা বা ভূত ভর করেছে।

O

শারীর-বিজ্ঞানের মতানুসারে ‘ভর কখনও মানসিক রোগ, কখনও স্রেফ অভিনয়। ভরলাগা মানুষগুলো হিস্টিরিয়া, ম্যানিয়াক ডিপ্রেসিভ, স্কিটসোর্জিনিয়া ইত্যাদি রোগের শিকার মাত্র। এইসব উপসর্গকেই ভুল করা হয় ভূত বা দেবতার ভরের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে।

O তবে ‘ভর’ নিয়ে যারা ব্যবসা চালায় তারা সাধারণভাবে মানসিক রোগী নয়; প্রতারক মাত্র।

 ভর-লাগা মানুষদের জলপড়া, তেলপড়ায় কেউ কেউ রোগমুক্তও হন বটে, কিন্তু যাঁরা অবিশ্বাসী তাঁদের ক্ষেত্রে এসব সামান্যতমও কাজ করে না। কাজ করে তাদেরই কারো কারোর উপর, যাঁরা ভর লাগা মানুষদের প্রতি অন্ধবিশ্বাসী। রোগ নিরাময়ের ক্ষেত্রে বিশ্বাসবোধের গুরুত্ব অপরিসীম। হাড়ে, বুকে বা মাথায় ব্যথা, বুক ধড়ফড়, পেটের গোলমাল, গ্যাসট্রিকের অসুখ, ব্লাডপ্রেসার, কাশি, ব্রঙ্কিয়াল-অ্যাজমা, ক্লান্তি, অবসাদ ইত্যাদি রোগের ক্ষেত্রে রোগীর বিশ্বসবোধকে কাজে লাগিয়ে ওষুধ-মূল্যহীন ক্যাপসুল, ইঞ্জেকশন বা ট্যাবলেট প্রয়োগ করে অনেক ক্ষেত্রেই ভাল ফল পাওয়া যায়। একে বলে ‘প্ল্যাসিবো’ চিকিৎসা পদ্ধতি।

 ‘যা বলা যায় তাই মেলে’—এক্ষেত্রে কৃতিত্ব কিন্তু ভর লাগা মানুষটির নয়; কৃতিত্ব তাঁর খবর সংগ্রহকারী এজেণ্টদের।

 না, সাবর্ণী দাশগুপ্ত বা ভরে পাওয়া পূজারিণীদের কেউই আজ পর্যন্ত আমার বা আমাদের যুক্তিবাদী সমিতির কাছে এগিয়ে আসেননি। কারণটা শ্রদ্ধেয় পাঠকরা নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারছেন। একই সঙ্গে প্রিয় পাঠকদের কাছে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, যে কোনও ঈশ্বর ভরের খবর আমাদের সমিতির যে কোনও শাখায় দিলে প্রমাণ করে দেব-প্রতিটি ভরগ্রস্তই হয় মানসিক রোগী, নতুবা প্রতারক।


মনসা, শীতলা, কালী, তারা, দুর্গা, চড়কের সময় শিব, কীর্তনের আসরে রাধা বা গৌরাঙ্গের ভর, পীরের ভর, জিন বা পরীর ভর, অপদেবতার ভর, ভূতে ভর ইত্যাদি কত রকম ভরই যে হয়, তার ইয়ত্তা নেই। যে কোনও ধরনের ভর হওয়া মানুষগুলোর বেশিমাত্রায় খোঁজ মিলবে মফস্বলে, গ্রামে-গঞ্জে। শহর কলকাতাতেও অবশ্য ভর হয়। শিক্ষার সুযোগ লাভে বঞ্চিত হতদরিদ্র বস্তিবাসীদের মধ্যে ভুতে ভর, জিনে ভরের মানসিক রোগীদের সাক্ষাৎ এখনও মেলে। কিন্তু যেটা অনেকেরই অজানা, সেটা হলো এই কলকাতা, হাওড়া ও দমদম অঞ্চলে বহু ঈশ্বরে ভর হওয়া মানুষের রমরমা ব্যবসা চলছে। এইসব ভরগ্রস্তদের বেশির ভাগই নারী। আর এদের কৃপাপ্রার্থীদের মধ্যে মধ্যবিত্ত, উচ্চমধ্যবিত্ত এবং বিত্তশালীদের দেখা পাবেন। এই ভক্তরা প্রত্যেকেই কম বেশি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত। এই শহরের ঈশ্বরে ও পীরে ভরগ্রস্তদের প্রায় সকলেই প্রতারক, মানসিক রোগী নয়। ভরগ্রস্ত কেউ এই বক্তব্যকে চ্যালেঞ্জ করলে অবশই প্রমাণ করে দেব—এরা বাস্তবে কেউ ঈশ্বরজাতীয় কারও এজেণ্ট নয়, এরা কারও বিষয়ে ভূত-ভবিষ্যৎ বলতে পারে না, পারে না রোগমুক্তি ঘটাতে। চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে ভরগ্রস্ত বা কোনও অলৌকিক ক্ষমতাধর (!) পাঁচ হাজার টাকা জমা দিলে প্রকাশ্যে তার মোকাবিলা করব। এবং আমি পরাজিত হলে এক লক্ষ পঞ্চাশ হাজার টাকা ও জামানতের পাঁচ হাজার টাকা, অর্থাৎ মোট এক লক্ষ পঞ্চান্ন হাজার টাকা দেব।


 এতো গেল ভর ব্যাপারটাই যে ফালতু, এটা প্রমাণ করতে চ্যালেঞ্জ ট্যালেঞ্জের কথা। কিন্তু ভর ব্যাপারটা তবে ঠিক কী? আসুন, এবার সেই বিষয় নিয়ে আলোচনায় ঢুকি।


 ১৯৬৬ সালের মে মাসের ২৭ তারিখ। স্থান—রাঁচীর উপকণ্ঠের পল্লী। সময়-সন্ধ্যা। নায়িকা এক কিশোরী। কোথাও কিছু নেই, বাড়ি ফিরে হঠাৎ প্রচণ্ড মাথা দোলাতে দোলাতে শরীর কাঁপতে কাঁপাতে কী সব আবোল-তাবোল বকতে লাগল।

 সন্ধেবেলায় জল আনতে গিয়েছিল। ফিরে আসার পর থেকেই এমনটা ঘটছে। নিশ্চয়ই ভূতে ধরেছে। শিক্ষার সুযোগ না পাওয়া গরিব পরিবার। ওরা ভরের চিকিৎসার জন্য চিকিৎসকের সাহায্য নেয় না। সাহায্য নেয় ওঝার। এক্ষেত্রেও তাই হলো। ওঝা এসে কাঠকয়লার আগুন জ্বেলে তাতে ধুনো, সরষে আর শুকনো লঙ্কা ছড়াতে শুরু করল। সেই সঙ্গে বিচিত্র অঙ্গভঙ্গি করে মন্ত্র – পাঠ। মেয়েটি কঠিন গলায় ওঝাকে ধমক দিয়ে ওর লাফালাফি বন্ধ করতে বলল। ওঝা তাতে বিন্দুমাত্র ঘাবড়াল না। ওঝা জানে, ভর করা ভূতেরা চিরকালই ক্ষুব্ধ হয়। অতএব ভূতের রাগে ওঝার উৎসাহ তো কমলই না, বরং দ্বিগুণ উৎসাহে মন্ত্রসহ নাচানাচি করতে শুরু করল।

 কিশোরীটি এবার গম্ভীর গলায় জানাল, সে ভূত নয়, ‘বড়ি-মা’ অর্থাৎ দুর্গা। ওঝা আর বেয়াদপি করলে শাস্তি দেবে। ওঝা ভূতেদের অমন অনেক ভড়কি দেওয়া দেখেছে। ভূতের ভয়ে পালিয়ে গিয়ে নিজের সম্মান ও রোজগারের পায়ে কুড়ল মারতে রাজি নয়। সে তার কাজ-কর্ম চালিয়ে যেতে লাগল। ওঝা এক সময় মন্ত্র পড়া-সরষের কিছুটা কাঠকয়লার আগুনে আর কিছুটা কিশোরীটির গায়ে ছুঁড়ে মারতেই কিশোরীটি অগ্নিকুণ্ড থেকে টকটকে লাল একমুখো জ্বলন্ত কাঠকয়লা হাতে তুলে নিয়ে ওঝাকে বলল, “এই নে ধর প্রসাদ।” ওঝার হাতটা মুহূর্তে টেনে নিয়ে ওর হাতে উপুড় করে দিল জ্বলন্ত কাঠকয়লা।

 যন্ত্রণায় তীব্রতায় ওঝা চিৎকার করে এক ঝটকায় হাত উপুড় করে কাঠকয়লাগুলো ফেলে দিলে। মেয়েটি কিন্তু নির্বিকার। ওঝার থেকে বেশিক্ষণ জ্বলন্ত কাঠকয়লা হাতে রাখা সত্ত্বেও ওর চোখে-মুখে যন্ত্রণার সামান্যতম প্রকাশ দেখা গেল না। এমনকি হাতে ফোস্কা পর্যন্ত নয়। উপস্থিত প্রতিটি দর্শক এমন অভাবনীয় ঘটনায় হতচকিত। এ মেয়ে ‘বড়ি-মা’ না হয়েই যায় না। প্রথমেই নতজানু হয়ে মার্জনা ভিক্ষা করল ওঝাটি। তার বশ্যতা স্বীকারে প্রত্যেকেরই বিশ্বাস দৃঢ়তর হলো।  কিশোরীটি তার মা-বাবাকে নাম ধরে সম্বোধন করে জানাল, “আমার কাছে মানত করেও মানত রাখিসনি বলে আমি নিজেই এসেছি।”

 মা-বাবা ভয়ে কেঁপে উঠলেন। মানত করে মানত রাখতে না পারার কথা তো সত্যি! মা-বাবা মেয়ের পায়ের উপর উপুড় হয়ে পড়লেন। মেয়েটি রাতারাতি ‘বড়ি-মা’ হয়ে গেল। আশে-পাশের গ্রামগুলো থেকে দলে দলে মানুষ ‘বড়ি-মা’ দর্শনের আশায়, কৃপালাভের আশায়, রোগমুক্তির আশায় হাজির হতে লাগল। কিশোরীটির ব্যবহারে অদ্ভুত একটা পরিবর্তন এসে গেছে। কেউ জুতো পায়ে, লাল পোশাক পরে অথবা চশমা চোখে ঘরে ঢুকতে গেলেই র্ভৎসনা করছে। বড়দের নানা ধরনের আদেশ করছে। ভক্তরা ফল, ফুল, মেঠাইয়ে ঘর ভরিয়ে তুলতে লাগলেন।

 ‘বড়ি-মা’ আবির্ভাবের দিন দুয়েকের মধ্যে এক বয়স্ক বিবাহিতা ‘বড়ি-মা’র সেবিকা ঘন ঘন মূর্চ্ছা যেতে লাগলেন। তারপর এক সময় ‘বড়ি-মা’র মত মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে ঘোষণা করলেন তিনি ‘ছোট-মা’। একই ঘরে দু’মায়ের পূজো হতে লাগল |

 ৩০ মে এই গ্রামেরই এক অষ্টাদশী তরুণী ঘন ঘন মূর্চ্ছা যাওয়ার পর ঘোষণা করল সে মা-কালী। এখানেও ভক্তের অভাব হলো না।

 ৩১ মে এই গ্রামেরই একটি বিবাহিতা তরুণীকে ভর করলেন ‘মাঝলী-মা’। সে রাতেই আর এক মহিলার উপর ভর করলেন ‘সাঁঝলী-মা’।

 জনমানসে বিপুল আলোড়ন সৃষ্টিকারী এই ঘটনাগুলোর দিকে রাঁচী মানসিক আরোগ্যশালার চিকিৎসকদের দৃষ্টি আকর্ষিত হলো। চিকিৎসকরা ভরগ্রস্তদের পরীক্ষা করে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের সাহায্যেই সাত দিনের মধ্যে ওদের প্রত্যেককে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনলেন। ওই চিকিৎসকরা মত প্রকাশ করলেন-ওই গ্রামের ভরে পাওয়া রোগীরা প্রত্যেকেই পরিবেশগতভাবে বিশ্বাস করত, ঈশ্বর সময় সময় মানুষের শরীরে ভর করেন। প্রথম কিশোরীটি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে হিস্টিরিয়া নামক মানসিক রোগের শিকার হয়ে পড়ে। কিশোরীটি নিজের সত্তা ভুলে গিয়ে ‘বড়ি-মা’র সত্তা নিজের মধ্যে প্রকাশিত ভেবে অদ্ভুত সব আচরণ করতে থাকে। স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্যে বেশিরভাগই শিক্ষার সুযোগ লাভে বঞ্চিত, ধর্মান্ধ, কুসংস্কারে আচ্ছন্ন, যুক্তি-বুদ্ধি কম, আবেগপ্রবণ। ফলে ওদের মস্তিস্ককোষের সহনশীলতাও কম। তাই একজনের হিস্টিরিয়া দ্রুত বহু জনের মধ্যে সঞ্চালিত হয়েছে।

 ‘হিস্টিরিয়া’ মনোবিজ্ঞানের চোখে কী, একটু বোঝার চেষ্টা করা যাক। সাধারণভাবে কুসংস্কারে আচ্ছন্ন, অল্প-শিক্ষিত, শিক্ষার সুযোগ লাভে বঞ্চিত, বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা ও যুক্তির সঙ্গে পরিচিত হবার সুযোগ না পাওয়া বঞ্চিত শোষিত মানুষদের মধ্যেই হিস্টিরিয়া রোগীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। সাধারণভাবে এই শ্রেণীর মানুষদের মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষের সহনশীলতা যাদের কম, তারা এক নাগাড়ে একই কথা শুনলে, ভাবলে বললে মস্তিষ্কের বিশেষ কিছু কোষ বার বার উত্তেজিত হতে থাকে, আলোড়িত হতে থাকে। এর ফলে অনেক সময় উত্তেজিত কোষগুলো অকেজো হয়ে পড়ে, অন্য কোষগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ হারিয়ে ফেলে। ফলে মস্তিষ্কের কাজ-কর্মে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। নাম-গান শুনতে শুনতে বা গাইতে গাইতে আবেগে চেতনা হারিয়ে অদ্ভুত আচরণ করাও হিস্টিরিয়ার অভিব্যক্তি। সভ্যতার আলো, যুক্তি ও জ্ঞানের আলো ব্যক্তি হিস্টিরিয়ার প্রকোপ কমায়। কিন্তু বিশেষ পরিস্থিতিতে সভ্য, শিক্ষিত মানুষরাও দলবদ্ধভাবে হিস্টিরিয়া রোগের শিকার হয়।


 ‘৮৭-র জানুয়ারিতে কলকাতা টেলিফোনে অপারেটরদের মধ্যে তড়িতাহতের ঘটনা এমনই ব্যাপকতা পায় যে, অটোম্যানুয়াল এক্সচেঞ্জ, আস্তর্দেশীয় ও আন্তর্জাতিক এক্সচেঞ্জের টেলিফোন অপারেটররা আন্দোলনে নেমে পড়েন। কানের টেলিফোন রিসিভার থেকে তাঁরা এমনই গভীরভাবে তড়িতাহত হতে থাকেন যে, অনেককে হাসপাতালে ভর্তি পর্যন্ত করতে হয়। পরে রোগীদের মেডিক্যাল রিপোর্টে তড়িতাহতের কোনও সমর্থন মেলেনি। বরং পূর্ণাঙ্গ তদন্তের পর জানা যায় তড়িতাহতের ঘটনাগুলো ছিল সম্পূর্ণ ভয়জনিত কারণে গণ-হিস্টিরিয়া বা গণ-মানসিক রোগ।


 ভরগ্রস্ত রোগীদের সিংহভাগই হিস্টিরিয়া রোগীর শিকার হলেও ‘স্কিটসোফ্রিনিয়া’ বা ‘ম্যানিয়াক ডিপ্রেসিভ’ (Maniac Depresive) বা মানসিক অবসাদের থেকেও ‘ভর’ হয়। স্কিটসোফ্রিনিয়া নিয়ে আগেই কিছুটা আলোচনা করেছি। তাই নতুন করে আবার আলোচনায় না গিয়ে বরং আমরা এখন ‘ম্যানিয়াক ডিপ্রেসিভ বা মানসিক অবসাদ জনিত কারণে ভর হওয়া নিয়ে আলোচনা করব।

 মানসিক অবসাদের রোগীরাও বেশিরভাগই কুসংস্কারে আচ্ছন্ন, শিক্ষা ও যুক্তির সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ না পাওয়া মানুষ। পারিবারিক জীবনে এরা অসুখী এবং দায়িত্বভারে জর্জরিত, এবং তার দরুন মানসিকভাবে অবসাদগ্রস্ত।

 প্রায় তেত্রিশ বছর আগের ঘটনা। খড়গপুরের চিন্তামণি বাড়ি বাড়ি বাসন মাজার কাজ করত। যখনকার কথা বলছি, তখন চিন্তামণি তিন ছেলে-মেয়ের মা। ওর জীবনসঙ্গী রেল ওয়াগন ভেঙে মাঝে-মধ্যে যা রোজগার করে তার প্রায় পুরোটাই নেশা করেই ফুকে দেয়। মাঝে-মধ্যেই জেলের হাওয়া খেয়ে আসে শ্রীমান। চিন্তামণির শশুর-শাশুড়ি তাদের পুত্রের উচ্ছৃঙ্খল আচরাণের জন্য চিন্তামণিকেই দোষ দেয়। শ্রীমান মাঝে-মধ্যে নেশার টাকার জন্য চিন্তামণিকে মারধোর করে। এক সময় শ্রীমান মাস কয়েকের জন্য জেল ঘুরে এসে চিন্তামণির চরিত্র নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে। সন্দেহ থেকে রাগ, আর তার ফলে চিন্তামনির ওপর নেমে আসে শারীরিক ও মানসিকভাবে বীভৎস অত্যাচার। এই অত্যাচার চলাকালীন এক রাতে শ্রীমান তর্জন-গর্জন শুরু করতেই চিন্তামণি ততোধিক গর্জন করে শ্রীমানকে আদেশ করল তাকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করতে। আদেশ শুনে শ্রীমান তাকে প্রহার করতে যেতেই চিন্তামণি পাগলের মত মাথা দোলাতে দোলাতে দিগম্বরী হয়ে শ্রীমানের দু’গালে প্রচও কয়েকটি চড় কষিয়ে বলল, “জানিস আমি কে? আমি মা-কালী।”

চিন্তামণির এই মানসিক অবসাদজনিত কারণে ‘ভর’ হওয়াটা অনেকের কাছেই ছিল ঈশ্বরের লীলা। রেলওয়ে হাসপাতালের চিকিৎসক চিন্তামণির জীবনসঙ্গীকে ডেকে চিন্তামণির চিকিৎসা করাতে বলেছিলেন। বলেছিলেন এই ‘ভর’ কোনও ঈশ্বরের লীলা নয়, এক ধরনের পাগলামো। কিন্তু চিন্তামণির জীবনসঙ্গী, শ্বশুর, শাশুড়ি, কেউই চিকিৎসকের সাহায্য নিতে রাজি হয়নি। রাজি না হওয়ার বড় কারণটা মা-কালীর কৃপায় চিন্তামণির রোজগারপাতি মন্দ হচ্ছিল না।


কারণ: তেত্রিশ

হত্যে দিয়ে পাওয়া স্বপ্নদৃষ্ট ওষুধে, দুয়া-কালামে, পানী-পড়ায়, তাবিজ কবজে কত রোগ ভাল হচ্ছে, দেখেছি মশায়—তারপরও যুক্তিবাদীরা ‘হচ্ছে না, হচ্ছে না’ বলে চেঁচালে মানব কেন মশায়?


দেবস্থানে হত্যে দিয়ে স্বপ্নে দেখা ওষুধ পেয়ে রোগ সেরেছে, পীরের দুয়া-কালামে, পানী-পড়া, তেল-পড়ায় রোগী ভাল হয়েছে, অবতারের স্রেফ আশীর্বাদে ডাক্তারের জবাব দেওয়া রোগী দিব্যি সুস্থ হয়ে উঠেছে, এমন প্রচুর ঘটনার কথা শোনা যায়। এবং এই শোনা ঘটনাগুলো নিয়ে সত্যানুসন্ধান চালালে কিছু কিছু ক্ষেত্রেই দেখা যাবে ব্যাপারটা সত্যি। স্বীকার করছি। দেবতা ও অবতারদের উপর নির্ভর করে রোগী রোগ মুক্ত হলে তা কি প্রকারান্তরে ঈশ্বরের অস্তিত্ব ও ক্ষমতাকেই স্বীকার করা নয়? এমন প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় বারবার। মজাটা হল, যেসব ক্ষেত্রে ওষুধ ছাড়াই রোগ কমে বা নিরাময় হয়, সে’সব ক্ষেত্রেও রোগ কমার কারণ কিন্তু অলৌকিকত্ব নয়। কারণ হল বিশ্বাস। অলৌকিক চিকিৎসার ওপর রোগীর অপার বিশ্বাস।

O

মজাটা হল, যেসব ক্ষেত্রে ওষুধ ছাড়াই রোগ কমে বা নিরাময় হয়, সে’সব ক্ষেত্রেও রোগ কমার কারণ কিন্তু অলৌকিকত্ব নয়। কারণ হল ‘বিশ্বাস’। অলৌকিক চিকিৎসার ওপর রোগীর অপার বিশ্বাস।

O বিষয়টা বোঝাতে আসুন আমরা ফিরে যাই ‘৮৭-র মে মাসের এক সন্ধ্যায়। কলকাতা থেকে প্রকাশিত একটি সুপরিচিত পত্রিকার সম্পাদকের স্ত্রী এসেছিলেন আমার ফ্ল্যাটে। সঙ্গে ছিনে তাঁর পারিবারিক চিকিৎসক, এক সাহিত্যিক-সাংবাদিক এবং জনৈক ভদ্রলোক।

 চিকিৎসক জানালেন বছর আড়াই আগে সম্পাদকের স্ত্রীর ডান ঊরুতে একটা ফোঁড়া হয়েছিল। ছোট্ট অস্ত্রোপচার, প্রয়োজনীয় ইঞ্জেকশন ও ওষুধে ফোঁড়ার ক্ষত সম্পূর্ণভাবে সেরে যায় কিছুদিনের মধ্যেই। কিন্তু এরপর ওই শুকিয়ে যাওয়া ক্ষতস্থান নিয়ে শুরু হয় এক নতুন সমস্যা। মাঝে-মাঝেই ঊরুর শুকিয়ে যাওয়া ক্ষত ও তার আশপাশে প্রচণ্ড ব্যথা হয়। মাঝে মাঝে ব্যথার তীব্রতায় রোগিণী অজ্ঞান হয়ে পড়েন। এই বিষয়ে যেসব চিকিৎসকদের দেখান হয়েছে ও পরামর্শ নেওয়া হয়েছে তাঁরা প্রত্যেকেই কলকাতার শীর্ষস্থানীয়। ব্যথার কোনও যুক্তিগ্রাহ্য কারণ এঁরা খুঁজে পাননি। চিকিৎসকদের ব্যবস্থাপত্র, এক্স-রে ছবি ও রিপোর্ট সবই দেখালেন আমাকে।

 রোগিণীর সঙ্গে প্রাসঙ্গিক-অপ্রাসঙ্গিক নানা বিষয়ে কথা বলতে বলতে ঊরুর শুকনো ক্ষতটা পরীক্ষা করে বললাম, “একবার খড়গপুরে থাকতে দেখেছিলাম একটি লোকের হাতের বিষফোঁড়া সেপটিক হয়ে, পরবর্তীকালে গ্যাংগ্রিন হয়ে গিয়েছিল। বিশ্বাস করুন, সামান্য ফোঁড়া থেকে এই ধরনের ঘটনা ঘটে।

 রোগিণী বললেন, “আমি নিজেই এই ধরনের একটা ঘটনার সাক্ষী। মেয়েটির হাতে বিষ-ফোঁড়াজাতীয় কিছু একটা হয়েছিল। ফোঁড়াটা শুকিয়ে যাওয়ার পরও শুকনো ক্ষতের আশে-পাশে ব্যথা হতো। একসময় জানা গেল, ব্যথার কারণ গ্যাংগ্রিন। কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত কাঁধ থেকে হাত বাদ দিতে হয়।”

 যা জানতে গ্যাংগ্রিনের গল্পের অবতারণা করেছিলাম তা আমার জানা হয়ে গেছে। এটা এখন আমার কাছে দিনের মতই স্পষ্ট যে, সম্পাদকের স্ত্রীর ফোঁড়া হওয়ার পর থেকেই গ্যাংগ্রিন স্মৃতি তাঁর মনে গভীর আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে। এই ফোঁড়া থেকেই আবার গ্যাংগ্রিন হবে না তো? এই প্রতিনিয়ত আতঙ্ক থেকেই এক সময় ভাবতে শুরু করেন, “ফোঁড়া তো শুকিয়ে গেল, কিন্তু মাঝে-মধ্যেই যেন শুকনো ক্ষতের আশেপাশে ব্যথা অনুভব করছি? আমারও আবার গ্যাংগ্রিন হলো না তো? সেই লোকটার মতোই একটা অসহ্য কষ্টময় জীবন বহন করতে হবে না তো?

 এমনি করেই যত দুশ্চিন্তা বেড়েছে, ততই ব্যথাও বেড়েছে। বিশ্বাস থেকে যে ব্যথার শুরু, তাকে শেষ করতে হবে বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়েই।

 আমি আর একবার ঊরুর শুকনো ক্ষত গভীরভাবে পরীক্ষা করে এবং শরীরের আর কোথায় কোথায় কেমনভাবে ব্যথাটা ছড়াচ্ছে, ব্যথার অনুভূতিটা কি ধরনের ইত্যাদি প্রশ্ন রেখে গম্ভীর মুখে একটা নিপাট মিথ্যে কথা বললাম, “একটা কঠিন সত্যকে না জানিয়ে পারছি না, আপনারও সম্ভবত গ্যাংগ্রিনের লক্ষণ দেখা দিচ্ছে একটু একটু করে।”

 আমার কথা শুনে রোগিণী মোটেই দুঃখিত হলেন না। বরং উজ্জ্বল মুখে বললেন, “আপনিই সম্ভবত আমার অসুখের সঠিক কারণ ধরতে পেরেছেন।”

 আমি আশ্বাস দিলাম, “আমি অবশ্য নিশ্চিত নই, তবে আধুনিক মেশিনের সাহায্যে পরীক্ষা করলেই জানা যাবে, আমার অনুমান ঠিক কি না। আমার অনুমান যদি ঠিক হয়, তবে আপনার কর্তাটিকে একটু কষ্ট করতে হবে। বিদেশ থেকে ওষুধ-পত্তর আনাবার ব্যবস্থা করতে হবে। দেখবেন, তারপর সপ্তাহ তিনেকের মধ্যে আপনি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠেছেন।”

 রোগ সৃষ্টি ও নিরাময়ের ক্ষেত্রে আমাদের বিশ্বাসবোধের গুরুত্ব অপরিসীম। আমাদের শরীরে বহু রোগের উৎপত্তি হয় ভয়, ভাবনা, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা থেকে। আমাদের মানসিক ভারসাম্য নির্ভর করে সামাজিক পরিবেশের ওপর। সমাজ জীবনে অনিশ্চয়তা, প্রতিযোগিতা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা, ধর্মোদ্মাদনা, জাত-পাতের লড়াই ইত্যাদি যত বাড়ছে দেহ-মনজনিত অসুখ বা Psycho-somatic Disorder তত বাড়ছে। সাম্প্রদায়িক লড়াইয়ের সময় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় প্রচণ্ড মানসিক চাপের মধ্যে থাকে বলে এই সময় তাঁদের অনেকে দেহ-মনজনিত অসুখের শিকার হয়ে পড়েন।

 মানসিক কারণে যে-সব অসুখ হতে পারে তার মধ্যে রয়েছে, শরীরের বিভিন্ন স্থানের ব্যথা, মাথার ব্যথা, হাড়ে ব্যথা, স্পণ্ডালাইটিস, স্পণ্ডালেসিস,আরথ্রাইটিস, বুক ধড়ফড়, পেটের গোলমাল, পেটের আলসার, গ্যাসট্রিকের অসুখ, ব্লাডপ্রেসার, কাশি, ব্রঙ্কাইল অ্যাজমা, ক্লান্তি, অবসাদ ইত্যাদি। এইসব অসুখে ঔষধি-মূল্যহীন ক্যাপসুল, ইনজেকশন বা ট্যাবলেট প্রয়োগ করে অনেক ক্ষেত্রেই ভাল ফল পাওয়া যায়। এই ধরনের বিশ্বাস-নির্ভর চিকিৎসা পদ্ধতিকে বলে ‘প্ল্যাসিবো’ (Placebo) চিকিৎসা পদ্ধতি। Placebo কথার অর্থ “I will please.” বাংলায় অনুবাদ করে বলতে পারি, “আমি খুশি করব।” ভাবানুবাদ করে বলতে পারি “আমি আরোগ্য করব।”

O

মানসিক কারণে যে-সব অসুখ হতে পারে তার মধ্যে রয়েছে, শরীরের বিভিন্ন স্থানের ব্যথা, মাথার ব্যথা, হাড়ে ব্যথা, স্পণ্ডালাইটিস, স্পভালেসিস, আরথাইটিস, বুক ধড়ফড়, পেটের গোলমাল, পেটের আলসার, গ্যাসট্রিকের অসুখ, ব্লাডপ্রেসার, কাশি, ব্রঙ্কাইল অ্যাজমা, ক্লান্তি, অবসাদ ইত্যাদি। এইসব অসুখে ঔষধি-মূল্যহীন ক্যাপসুল, ইনজেকশন বা ট্যাবলেট প্রয়োগ করে অনেক ক্ষেত্রেই ভাল ফল পাওয়াযায়। এই ধরনের বিশ্বাস-নির্ভর চিকিৎসা পদ্ধতিকে বলে ‘প্ল্যাসিবো’ (Placebo) চিকিৎসা পদ্ধতি।

O

 রোগিণীর পারিবারিক চিকিৎসকের সঙ্গে আলাদাভাবে কথা বলে জানালাম, ব্যথার কারণ সম্পূর্ণ মানসিক। রোগিণীর মনে সন্দেহের পথ ধরে একসময় বিশ্বাসের জন্ম নিয়েছে তাঁর ঊরুর ফোঁড়া সারেনি, বরং আপাত শুকনো ফোঁড়ার মধ্যে রয়েছে গ্যাংগ্রিনের বিষ। রোগিণীর বিশ্বাসবোধকে কাজে লাগিয়ে কেমনভাবে প্ল্যাসিবো চিকিৎসা চালাতে হবে সে বিষয়ে একটা পরিকল্পনার কথা খুলে বললাম।

 এই ঘটনার কয়েকদিন পরে রোগিণীর পারিবারিক চিকিৎসক সম্পূর্ণ শুকিয়ে যাওয়া উরুর ফোঁড়ার ওপর নানা রকম পরীক্ষা চালিয়ে একটা মেশিনের সাহায্যে রেখা-চিত্র তৈরি করে গম্ভীরভাবে মাথা নাড়িয়ে আবার রেখা-চিত্র তোলা হলো। দুবারের রেখা-চিত্রেই রেখার প্রচণ্ড রকমের ওঠা নামা লক্ষ্য করে স্থির সিদ্ধান্তে ঘোষণা করলেন, গ্যাংগ্রিনের বিষের অস্তিত্ব ধরা পড়েছে। একটা হৈ-চৈ পড়ে গেল। নিউইয়র্কে খবর পাঠিয়ে দ্রুত আনানো হলো এমনই চোরা গ্যাংগ্রিনের বিশ্বের অব্যর্থ ইন্‌জেকশন। সপ্তাহে দু’টি করে ইন্‌জেকশন ও দু’বার করে রেখা-চিত্র গ্রহণ চলল তিন সপ্তাহ। প্রতিবার রেখা-চিত্রেই দেখা যেতে লাগল রেখার ওঠা-নামা আগের বারের চেয়ে কম। ওষুধের দারুণ গুণে ডাক্তার যেমন অবাক হচ্ছিলেন, তেমন রোগিণীও। প্রতিবার ইনজেকশনেই ব্যথা লক্ষণীয়ভাবে কমছে। তিন সপ্তাহ পরে দেখা গেল রেখা আর আঁকা-বাঁকা নেই, সরল। রোগিণীও এই প্রথম অনুভব করলেন, বাস্তবিকই একটুও ব্যথা নেই। অথচ মজাটা হলো এই যে বিদেশী দামী ইনজেকশনের নামে তিন সপ্তাহ ধরে রোগিণীকে দেওয়া হয়েছিল স্রেফ ডিসটিল্ড ওয়াটার।

 বছর কয়েক আগে আমার স্ত্রী অসুস্থ হয়ে দমদমের ‘শান্তিসদন’ নার্সিং হোমে ভর্তি হন। ওই সময় শান্তি সদনের অনাতম কর্ণধার অতীন রায়ের সঙ্গে কিছু ঘনিষ্ঠতার সুযোগ হয়। তিনি সেই সময় অতি সম্প্রতি আসা এক রোগিণীর কেস হিস্ট্রি শোনালেন। মাঝে মাঝেই রোগিণীর পেটে ও তার আশেপাশে ব্যথা হত। আশ্চর্য ব্যাপার হল, প্রতিবারই ব্যথাটা পেটের বিভিন্ন জায়গায় স্থান পরিবর্তন করত। এই দিকে আর এক সমস্যা হল, ব্যথার কোনও যুক্তিগ্রাহ্য কারণ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। ডাক্তার রোগিণীকে একটা ক্যাপসুল দিয়ে বললেন, এটা খান, ব্যথা সেরে যাবে। ক্যাপসুল খাওয়ার পর রোগিণীর ব্যথার কিছুটা উপশম হল। অথচ ক্যাপসুলটা ছিল নেহাতই ভিটামিনের। ব্যথা কিন্তু বারো ঘণ্টা পরে আবার ফিরে এলো। আবার ভিটামিন ক্যাপসুল দেওয়া হলো। এবারও উপশম হল সাময়িক। এভাবে আর কতবার চালান যায়। ডাক্তারবাবু শেষ পর্যন্ত রোগিণীকে জানালেন, যে বিশেষ ইনজেকশনটা এই ব্যথায় সবচেয়ে কার্যকর সেটি বহুকষ্টে তিনি যোগাড় করেছেন। এবার ব্যথা চিরকালের মতো সেরে যাবেই।

 ডাক্তারবাবু ইনজেকশনের নামে ভিটামিন পুশ করলেন। রোগিণীর ব্যথাও পুরোপুরি সেরে গেল।


 কয়েক বছর আগে কলকাতা জেনারেল পোস্ট অফিসের আশপাশে এক গৌরকান্তি, দীর্ঘদেহী বৃদ্ধ তান্ত্রিক ঘুরে বেড়াতেন। গলায় মালা (যতদূর মনে পড়ছে রুদ্রাক্ষের)। মালার লকেট হিসেবে ছিল একটা ছোট্ট রূপোর খাঁড়া। বৃদ্ধকে ঘিরে সব সময়ই অফিস-পাড়ার মানুষগুলোর ভিড় লেগেই থাকত। এঁদের উদ্দেশ্য ছিল তান্ত্রিকবাবার অলৌকিক শক্তির সাহায্য নিয়ে নানা ধরনের অসুখ বিসুখ থেকে নিজেকে মুক্ত করা।

 সাধুবাবা রোগীর ব্যথার জায়গায় লকেটের খাঁড়া বুলিয়ে জোরে জোরে বার কয়েক ফুঁ দিয়ে বলতেন, “ব্যথা কমেছে না?”

 রোগী ধন্দে পড়ে যেতেন। সত্যিই ব্যথা কমেছে কি কমেনি, বেশ কিছুক্ষণ বোঝার চেষ্টা করে প্রায় সকলেই বলতেন, “কমেছে, মনে হচ্ছে।”

 এই আরোগ্য লাভের পিছনে তান্ত্রিকটির কোনও অলৌকিক ক্ষমতা কাজ করত না,কাজ করত তান্ত্রিকটির অলৌকিক ক্ষমতার প্রতি রোগীদের অন্ধ বিশ্বাস। কারণ, বেশ কয়েক দিন লক্ষ্য করে দেখেছি এঁদের অসুখগুলো সাধারণত অম্বলের ব্যথা, হাঁপানি, শরীরের বিভিন্ন স্থানের ব্যথা, বুক ধড়ফড়, অর্শ, বাত ইত্যাদি।


 এবারের ঘটনাটা আমার শোনা। বলেছিলেন প্রখ্যাত স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ বিশ্বনাথ রায়। ডাঃ রায়ের সার্জারির অধ্যাপক ছিলেন ডাঃ অমর মুখার্জি। তাঁর কাছে চিকিৎসিত হতে আসেন এক মহিলা। মহিলাটির একান্ত বিশ্বাস, তাঁর গলস্টোন হয়েছে। এর আগে কয়েকজন চিকিৎসকের কাছে গিয়েছিলেন। তাঁরা প্রত্যেকেই পরীক্ষা করে জানিয়েছিলেন পেটে ব্যথার কারণ গলস্টোন নয়। চিকিৎসকদের এই ব্যাখ্যায় মহিলা আদৌ সন্তুষ্ট হতে পারেননি।

 ডাঃ মুখার্জি মহিলার গল-ব্লাডারের এক্স-রে করালেন। দেখা গেল কোনও স্টোন নেই। তবু ডাঃ মুখার্জি তাঁর ছাত্রদের শিখিয়ে দিলেন রোগিণীকে বলতে, তাঁর গলস্টোন হয়েছে। এক্স-রে তো দুটো স্টোন দেখা গেছে। অপারেশন করে স্টোন দুটো বার করে দিলেই ব্যথার উপশম হবে।

 রোগিণীকে জানান হলো অমুক দিন অপারেশন হবে। নির্দিষ্ট দিনে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে গিয়ে অজ্ঞান করে পেটের চামড়া চর্বিস্তর পর্যন্ত কাটলেন এবং আবার সেলাই করে দিলেন। ও, টি. স্টাফের হাতে দুটো রঙিন পাথর দিয়ে ডাঃ মুখার্জী বললেন, রোগিণী জ্ঞান ফেরার পর স্টোন দেখতে চাইলে পাথর দুটো দেখিয়ে বলবেন, এ-দুটো ওঁর পিত্তথলি থেকেই বেরিয়েছে।

 রোগিণী কয়েকদিন হাসপাতালেই ছিলেন। সেলাই কেটেছিলেন ডাঃ রায়। রোগিণী হৃষ্টচিত্তে রঙিন পাথর দুটো নিয়ে ফিরে গিয়েছিলেন। যে ক-দিন হাসপাতালে ছিলেন সে ক-দিন গলব্লাডারের কোনও বাথা অনুভব করেননি। অথচ আশ্চর্য, সাজানো অপারেশনের আগে প্রতিদিনই নাকি রোগিণী গলব্লাডারের প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করতেন।


 এবার যে ঘটনাটি বলছি, তা শুনেছিলাম ডাঃ বিষ্ণু মুখার্জির কাছে। ঘটনাস্থল জামশেদপুর। ডাঃ মুখার্জি তখন জামশেদপুরের বাসিন্দা। নায়িকা তরুণী, সুন্দরী, বিধবা। ডাঃ মুখার্জির কাছে তরুণীটিকে নিয়ে আসেন তাঁরই এক আত্মীয়। তরুণীটির বিশ্বাস তিনি মা হতে চলেছেন। মাসিক বন্ধ আছে মাস তিনেক। ডাঃ মুখার্জির আগেও অন্য চিকিৎসকের কাছে গিয়েছিলেন। তিনি পরীক্ষা করে জানিয়েছেন, মাতৃত্বের কোনও চিহ্নই নেই। ডাক্তারের স্থির নিশ্চিত সিদ্ধান্তে মেয়েটির পরিবারের আর সকলে বিশ্বাস স্থাপন করলেও, মেয়েটি কিন্তু তাঁর পূর্ব বিশ্বাস থেকে নড়েননি। তাঁর এখনও দৃঢ় বিশ্বাস, তিনি মা হতে চলেছেন এবং মা হলে তাঁর সামাজিক সম্মান নষ্ট হবে। ইতিমধ্যে সম্মান বাঁচাতে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন।

 পূর্ব ইতিহাস জানার পর ডাঃ মুখার্জি পরীক্ষা করে মেয়েটিকে জানালেন, “আপনার ধারণাই সত্যি। মা হতে চলেছেন। যদি অবাঞ্ছিত মাতৃত্ব থেকে অব্যাহতি চান নিশ্চয়ই তা পেতে পারেন। তবে সে ক্ষেত্রে অ্যাবরশন করতে হবে।

 সাজানো অ্যাবরশন হল। জ্ঞান ফিরতে রোগিণীকে দেখান হলে অন্য এক রোগিণীর দু’মাসের ফিটাস ট্রেতে রক্তসহ সাজিয়ে।

 মেয়েটি সুখ ও স্বস্তি মেশান নিশ্বাস ছাড়লেন। পরবর্তীকালে মেয়েটি তাঁর স্বাভাবিক শারীরিক ও মানসিক জীবন ফিরে পেয়েছিলেন।


 অনেক পুরনো বা Chronic রোগ আছে যেসব রোগের প্রকোপ বিভিন্ন সময় কমে-বাড়ে। যেমন গেঁটে বাত, অর্শ, হাঁপানি, অম্বল। আবার হাঁপানি, অম্বলের মতো কিছু পুরনো রোগ কিছু কিছু ক্ষেত্রে ওষুধ ছাড়াই স্বাভাবিক প্রাকৃতিক নিয়মে সেরে যায়। অলৌকিক বাবাদের কাছে কৃপা প্রার্থনার পরই এই ধরনের অসুখ বিশ্বাসে বা স্বাভাবিক প্রাকৃতিক নিয়মে কিছুটা কমলে বা সেরে গেলে অলৌকিক বাবার মাহাত্ম্য দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।


 পশ্চিমবঙ্গ সরকারের এক প্রাক্তন চীফ সেক্রেটারি একবার আমাকে বলেছিলেন, “মার্কসবাদে বিশ্বাসী হলেও আমি কিন্তু অলৌকিক শক্তিকে অস্বীকার করতে পারি না। দীঘার কাছের এক মন্দিরে আমি এক অলৌকিক ক্ষমতাবান পুরোহিতের দেখা পেয়েছিলাম। আমার স্ত্রী গেঁটে-বাতে পায়ে ও কোমরে মাঝে-মাঝে খুব কষ্ট পান। একবার দীঘায় বেড়াতে গিয়ে ওই পুরোহিতের খবর পাই। শুনলাম উনি অনেকের অসুখ-টসুখ ভাল করে দিয়েছেন। এক সন্ধ্যায় আমরা স্বামী-স্ত্রীতে গেলাম মন্দিরে। পুজো দিলাম। সন্ধ্যারতির পর পুরোহিতকে প্রণাম করে নিজের পরিচয় দিয়ে আসার উদ্দেশ্য জানালাম। পুরোহিত বিড়-বিড় করে মন্ত্র পড়ে আমার স্ত্রীর কোমর ও পায়ে হাত বুলিয়ে দিলেন। এক সময় জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি, এখন ব্যথা কমেছে না?’ অবাক হয়ে গেলাম আমার স্ত্রীর জবাব শুনে। ও নিজের শরীরটা নাড়া-চাড়া করে বলল, ‘হ্যাঁ, ব্যথা অনেক কমেছে।’ এইসব অতি-মানুষেরা হয়ত কোনও দিনই আপনার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে তাঁর অলৌকিক ক্ষমতার প্রমাণ দিতে হাজির হবেন না, কিন্তু এদের অলৌকিক ক্ষমতার প্রমাণ পাওয়ার পর তা অস্বীকার করব কি ভাবে?”

 আমি বলেছিলাম “যতদূর জানি আপনার স্ত্রীর বাতের ব্যথা এখনও আছে।”

 আমার মুখের কথা প্রায় কেড়ে নিয়ে প্রাক্তন চিফ সেক্রেটারি জবাব দিয়েছিলেন, “পুরোহিত অবশ্য আরও কয়েকবার ঝেড়ে দিতে হবে বলে জানিয়েছিলেন। কাজের তাগিদে আর যাওয়া হয়নি। ত্রুটিটা আমাদেরই।”

 এই সাময়িক আরোগ্যের কারণ পুরোহিতের প্রতি রোগিণীর বিশ্বাস, পুরোহিতের অলৌকিক কোনও ক্ষমতা নয়। অথবা, পুরনো রোগের নিয়ম অনুসারেই স্বাভাবিকভাবেই সেই সময় গেঁটে-বাতের প্রকোপ কিছুটা কম ছিল।


 অর্শ রোগীদের অনেকেরই হাতের আঙুলে শোভিত হয় আড়াই প্যাঁচের একটা রুপোর তারের আংটি। যাঁরা এই আংটি পরেন, তাঁদের কাছে কোনও অর্শ রোগী আংটি ধারণ করে নিরাময় চাইলে সাধারণভাবে আড়াই-প্যাঁচি আংটির ধারক তাঁর আংটির তারের ছোট্ট একটা টুকরো কেটে দেন। ওই টুকরো স্যাঁকরাকে দিয়ে আড়াই-প্যাঁচি আংটি তৈরি করে ধারণ করেন অর্শ রোগী। ধারণ করার পর অর্শ রোগ সত্যিই কি সারে? আমি দীর্ঘদিন ধরে এই বিষয়ে একটা অনুসন্ধান চালিয়েছিলাম। সাধারণত যাঁদের হাতেই আড়াই-প্যাঁচি আংটি দেখেছি, তাঁদের সঙ্গে কথা বলে জানার চেষ্টা করেছি, আংটি পরে কতটা উপকৃত হয়েছেন। শতকরা ৩০ ভাগের মতো ধারণকারী জানিয়েছেন, আংটি পরে উপকৃত হয়েছেন। শতকরা ৪৫ ভাগের মত জানিয়েছেন, আংটির গুণ আছে কি না, এই বিষয়ে স্থির সিদ্ধান্তে আসার মতো কিছু বোঝেননি। বাকি ২৫ ভাগ জানিয়েছেন, কিছুই কাজ হয়নি। অর্শ অনেক সময় স্বাভাবিক প্রাকৃতিক নিয়মেই সারে। যাঁদের সেরেছে, তাঁরা প্রাকৃতিক নিয়মকেই আংটির অলৌকিক নিয়ম বলে ভুল করেছেন।


 এই প্রসঙ্গে আর একটি ঘটনার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। ‘৮৮-র ২৯ জুলাই সাংবাদিক পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের এক প্রতিবেদনে আনন্দবাজার পত্রিকায় মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুকে লেখা প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল সেনের চিঠি প্রকাশিত হয়েছিল। চিঠিটা এখানে তুলে দিচ্ছি।

 “প্রীতিভাজনেষু জ্যোতিবাবু,

 আনন্দবাজার পত্রিকায় পড়লাম আপনি স্পণ্ডিলাইটিসে কষ্ট পাচ্ছেন। আমি স্পণ্ডিলাইটিসে অনেকদিন ধরে ভুগেছি। তখন তদানীন্তন প্রেসিডেন্সী কলেজের অধ্যক্ষ ডঃ প্রতুল মুখার্জি আমাকে একটা বালা দেন যার মধ্যে হাই ইলেকট্রিসিটি ভোল্ট পাস করানো হয়েছে, সেটা পরে কয়েকদিনের মধ্যেই আমি সুস্থ হই। আমি আপনাকে কয়েকদিনের মধ্যেই একটি তামার বালা পাঠাব, আশা করি সেটা পরে আপনি উপকার পাবেন।

 আপনার দ্রুত নিরাময় কামনা করি, আমি এখন আরামবাগে আছি।

 পুনঃ সম্ভবপর হলে সাইকেলে অন্তত দৈনিক আধঘণ্টা চাপবেন। আপনি বোধহয় জানেন আমি সাইকেলে চেপে একদা ভাল ফল পেয়েছি।

স্বা: প্রফুল্লচন্দ্র সেন

২৮.৭.৮৮

 পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের এক প্রশ্নের উত্তরে প্রফুল্লচন্দ্র সেন জানান, তামার বালা পরেছিলেন ১৯৭৯ সালে। শ্রীসেনের কথায়, “স্পণ্ডিলাইটিস হয়েছিল। ডঃ নীলকান্ত ঘোষাল দেখছিলেন। কিছুই হলো না। কিন্তু সেই তামার বালা ব্যবহার করলাম, প্রথম ৭ দিনে ব্যথা কমে গেল। পরের ১৫ দিনে গলা থেকে কলার খুলে ফেললাম।”


 এই প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হওয়ার পর নাকি তামার বালা বিক্রি খুব বেড়ে গিয়েছিল শহর কলকাতায়। প্রফুল্লচন্দ্র সেনের বক্তব্য এবং জ্যোতি বসুকে লেখা চিঠি শুধুমাত্র সাধারণ মানুষদের মধ্যে নয়, বিজ্ঞানকর্মীদের মধ্যেও যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছিল এবং বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছিল। যার ফলশ্রুতি হিসেবে শরীরের ওপর ধাতুর প্রভাব কতখানি অথবা বাস্তবিকই প্রভাব আছে কি না, বহু প্রশ্নের ও পত্রের মুখোমুখি হয়েছি। প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাঁদের জানিয়েছি, ‘শরীরের উপর ধাতুর প্রভাব আছে’, এটা সম্পূর্ণ অলীক ধারণা।

 ‘আর্থ’ না করে তামার বালা পরে জীবনধারণ করার চিন্তাও বাস্তবসম্মত নয়। তামাকে ‘আর্থ’ হওয়া থেকে বাঁচাতে বালাধারণকারীকে তবে পৃথিবীর ছোঁয়া থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখে জীবন ধারণ করতে হয়। কারণ, বালাধারণকারী পৃথিবীর সংস্পর্শে এলেই বালার তামা ‘আর্থ’ হয়ে যাবে। অথচ অনেকেই বলে থাকেন, ‘অর্থ’ না হতে দেওয়া তামার বালা পরলে অব্যর্থভাবে বাত সারে।

 আরও একটি বৈজ্ঞানিক সত্য এই প্রসঙ্গে জেনে রাখা প্রয়োজন, বিদ্যুৎ প্রবাহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার পর তামার মধ্যে বৈদ্যুতিক শক্তি থাকে না।

 মানবদেহে অল্প পরিমাণে বিভিন্ন মৌলিক দ্রব্যের অস্তিত্ব আছে এবং নানা ধরনের অসুখের চিকিৎসাতে মৌলিক দ্রব্যের ব্যবহার সুবিদিত। গর্ভবতীদের রক্তস্বল্পতার জন্য LIVOGEN CAPSULE বা ঐ জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করা হয়, যার মধ্যে সংশোধিত অবস্থায় রয়েছে লৌহ। প্রস্রাব সংক্রান্ত অসুখের জনা কিছু কিছু ক্ষেত্রে MERCUREAL DIURETIC (DIAMOX) দেওয়া হয়, যার মধ্যে সংশোধিত অবস্থায় পারদ রয়েছে। এক ধরনের বাতের চিকিৎসায় অনেক সময় MYOCRISIN দেওয়া হয়, যার মধ্যে সংশোধিত অবস্থায় সোনা রয়েছে।

 যখন রোগিণীকে LIVOGEN CAPSULE বা ঐ জাতীয় ওষুধ দেওয়ার প্রয়োজন তখন পরিবর্তে রোগিণীকে এক কুইণ্টাল লোহার ওপর শুইয়ে রাখলেও প্রার্থিত ফল পাওয়া যাবে না। কারণ, মৌল দ্রব্য বা ধাতু শরীরে ধারণ করলে তা কখনই শোষিত হয়ে দেহে প্রবেশ করে না।

 উপরের দুটি স্তৰকে যা লিখেছি তা আমার ব্যক্তি-বিশ্বাসের কথা নয়, বিজ্ঞানের সত্য।

 এরপর যে প্রশ্নটা সবচেয়ে বড় হয়ে দেখা দেবে, তা হলো প্রফুল্লচন্দ্র কি তবে মিথ্যে কথা বলেছিলেন? যদিও আমরা অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে বুঝতে শিখেছি, সমাজশীর্ষ মানুষরাও মিথ্যাশ্রয়ী হন, তবু তামার বালা পরে প্রফুল্লচন্দ্রের স্পণ্ডিলাইটিস আরোগ্যের মধ্যে কোনও অবাস্তবতা দেখতে পাচ্ছি না।

 আমার এই কথার মধ্যে অনেকেই নিশ্চয়ই পরস্পর বিরোধিতা খুঁজে পাচ্ছেন। কিন্তু যাঁরা এতক্ষণে প্লাসিবো চিকিৎসা পদ্ধতির বিষয়টি বুঝে নিয়েছেন, তাঁদের কাছে নিশ্চয়ই পরিষ্কার হয়েছে প্রফুল্লচন্দ্রের রোগমুক্তির ক্ষেত্রে তামা বা বিদ্যুৎশক্তির কোনও বৈশিষ্ট্য বা গুণই কাজ করেনি, কাজ করেছিল তামা, বিদ্যুৎশক্তি এবং সম্ভবত ডঃ প্রতুল মুখার্জির প্রতি প্রফুল্লচন্দ্রের একান্ত বিশ্বাস।

 অ্যাকুপ্রেসার স্যাণ্ডেলের কথা ব্যাপক বিজ্ঞাপনের দৌলতে অনেকেরই জানা। সর্বরোগহর এক অসাধারণ স্যাণ্ডেল। প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যায় মাত্র দুবার হাঁটলেই নাকি নার্ভে সঞ্জীবনীশক্তির সঞ্চার হয়, দূর হয় হরেক রকমের অসুখ, হজমশক্তির দারুণ রকমের উন্নতি হয়। রোগমুক্তির এমন সহজ-সরল উপায়ে অনেকেই আকর্ষিত হচ্ছেন, কিনেও ফেলেছেন। বাবহারের পর অনেকের নাকি অনেক অসুখ-বিসুখ সেরেও যাচ্ছে। অথচ বাস্তব সত্য হলো এই যে, যাঁরা আরোগ্য লাভ করেছেন, তাঁদের আরোগ্যের পিছনে স্যাণ্ডেলের কোনও গুণ বা বৈশিষ্ট্য সামান্যতম কাজ করেনি, কারণ কাজ করা সম্ভব নয়। কাজ করেছে স্যাণ্ডেলের প্রতি রোগীদের অন্ধ-বিশ্বাস।

 সুকান্ত মুস্তাফি আমার বন্ধু, রক্তচাপের রোগী। বছর কয়েক আগের কথা। ওর সল্টলেকের বাড়িতে গিয়েছি। ওর পরনে ছিল পাজামা ও স্যাণ্ডো গেঞ্জি। ডান বাহুতে দেখতে পেলাম ঘড়ির বেল্টের মত একটা বেল্ট। ওটা কি জিজ্ঞেস করায় জানাল, ম্যাগনেটিক বেল্ট। এক বন্ধু বিদেশ থেকে এনে দিয়েছেন। বলেছেন, রক্তচাপ ঠিক রাখতে নাকি অব্যর্থ। সুকান্তও নাকি বেশ ভালই কাজ পাচ্ছে।

 বুঝলাম বেল্টের প্রতি বিশ্বাস সুকান্তর রক্তচাপকে ঠিক রাখতে সাহায্য করছে। এও প্ল্যাসিবো চিকিৎসারই ফল।

 আবার একই ধরনের বেল্ট পরেও আমার বন্ধু পত্নী অধ্যাপিকা সুচরিতা সান্যাল তাঁর রক্তচাপ স্বাভাবিক রাখতে পারেননি।


 এ-বারের ঘটনার নায়ক ইংরেজ কবি রবার্ট ব্রাউনিং। নায়িকা তাঁর প্রেমিকা এলিজাবেথ। এলিজাবেথ ছিলেন রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে। এলিজাবেথের পরিবারের সকলের না-পছন্দ মানুষ ছিলেন রবার্ট ব্রাউনিং। রবার্ট ব্রাউনিং পরিকল্পনা করেছিলেন এলিজাবেথ নিজের বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এলে দু’জনে বিয়ে করবেন। এলিজাবেথের বাড়ি ছেড়ে বেরোন ছিল একটা সমস্যা। কারণ শিরদাঁড়ার প্রচণ্ড ব্যথায় তিনি ছিলেন শয্যাশায়ী। ব্রাউনিং-এর উৎসাহ এলিজাবেথকে রোগ জয় করতে সক্ষম করেছিল। এলিজাবেথ শিরদাঁড়ার ব্যথা ভুলে বাড়ির উঁচু পাঁচিল টপকে বাইরে এসেছিলেন এবং শেষপর্যন্ত রবার্ট ব্রাউনিংকে বিয়ে করেছিলেন।


 সালটা সম্ভবত ‘৮৪। এক বিখ্যাত পুস্তক প্রকাশকের সঙ্গে শান্তিনিকেতনে গিয়েছি। হোটেলে পৌঁছতেই রাত দশটা পার হয়ে গেল। এগারোটায় খাবারের পাঠ চুকানোর পর প্রকাশক বন্ধুটির খেয়াল হলো সঙ্গে ঘুমের বড়ি নেই। অথচ প্রতি রাতেই ঘুম আনে ঘুমের বড়ি। বেচারা অস্থির ও অসহায় হয়ে পড়লেন। “কি হবে প্রবীর? এত রাতে কোনও ওষুধের দোকান খোলা পাওয়া অসম্ভব। তোমার কাছে কোনও ঘুমের ওষুধ আছে?” বললাম, “আমারও তোমার মতোই ঘুম নিয়ে সমস্যা। অতএব সমাধানের ব্যবস্থা সবসময়ই সঙ্গে রাখি। শোবার আগেই ওষুধ পেয়ে যাবে।”

 শুতে যাওয়ার আগে প্রকাশকের হাতে একটা ওষুধহীন ক্যাপসুল দিয়ে আমিও একটা খেয়ে নিয়ে শুয়ে পড়লাম। ক্যাপসুলটা নেড়ে-চেড়ে দেখে প্রকাশক বললেন, “এটা আবার কি ধরনের ওষুধ? ক্যাপসুলে ঘুমের ওষুধ? নাম কি?”  একটা কাল্পনিক নাম বলে বললাম, “ইউ. এস. এর ওষুধ।” কলকাতার এক সুপরিচিত চিকিৎসকের নাম বলে বললাম,”আমার হার্টের পক্ষে এই ঘুমের ওষুধই সবচেয়ে সুইটেবল বলে প্রতি তিন মাসে একশটা ক্যাপসুলের একটা করে ফাইল এনে দেন। যে চিকিৎসকের নাম বলেছিলাম তিনি যে আমাকে খুবই স্নেহ করেন সেটা প্রকাশক বন্ধুটির জানা থাকায় আমার কথায় পুরোপুরি বিশ্বাস করে ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়লেন। পরের দিন সকালে জিজ্ঞেস করলাম, “কেমন ঘুম হলো?”

 “ফাইন। আমাকেও মাঝে-মধ্যে এক ফাইল করে দিও।”

 প্রকাশকের বিশ্বাস হেতু এ ক্ষেত্রে ওষুধহীন ক্যাপসুলই সে রাতে ঘুম আনতে সক্ষম হয়েছিল।


 কয়েক বছর আগের কথা। আমার কাছে এসেছিলেন এক চিকিৎসক বন্ধু এক বিচিত্র সমস্যা নিয়ে। বন্ধুটি একটি নার্সিংহোমের সঙ্গে যুক্ত। সেখানে এক রোগিণী ভর্তি হয়েছেন, তাঁকে নিয়েই সমস্যা। তিনি মাঝে-মাঝে অনুভব করেন গলায় কিছু আটকে রয়েছে। এইসময় তীব্র শ্বাসকষ্ট হয়। এক্স-রেও করা হয়েছে, কিছু মেলেনি। দেহ-মনজনিত অসুখ বলেই মনে হচ্ছে। এই অবস্থায় কি ধরনের পদক্ষেপ নিলে রোগিণী তাঁর স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবেন বলে আমি মনে করি সেটা জানতেই আসা।

 পরের দিনই নার্সিংহোমে রোগিণীর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ করে দিলেন বন্ধুটি। নানা ধরনের কথাবার্তার মধ্যে দিয়ে রোগিণী তাঁর উপসর্গের কারণ হিসেবে কি ভাবছেন, এইটুকু জানতে চাইছিলাম। জানতেও পারলাম। চিকিৎসক বন্ধুটিকে জানালাম, রোগিণীর ধারণা তাঁর পেটে একটা বিশাল ক্রিমি আছে। সেটাই মাঝে-মাঝে গলায় এসে হাজির হয়। অতএব রোগিণীকে আরোগ্য করতে চাইলে একটা বড় ফিতে ক্রিমি যোগাড় করে তারপর সেটাকে রোগিণীর শরীর থেকে বার করা হয়েছে এই বিশ্বাসটুকু রোগিণীর মনের মধ্যে গেঁথে দিতে পারলে আশা করি তাঁর এই সাইকো-সোমটিক ডিসঅর্ডার ঠিক হয়ে যাবে।


 কয়েক দিন পরে বন্ধুটি আমাকে ফোনে খবর দিলেন রোগিণীর গলা থেকে পেট পর্যন্ত এক্স-রে করে তাঁকে জানান হয়েছিল একটা বিশাল ফিতে ক্রিমির অস্তিত্ব ধরা পড়েছে। অপারেশন করে ক্রিমিটাকে বের করা প্রয়োজন। তারপর পেটে অপারেশনের নামে হালকা ছুরি চালিয়ে রোগিণীর জ্ঞান ফেরার পর তাঁকে ক্রিমিটা দেখান হয়েছে। এরপর চারদিন রোগিণী নার্সিংহোমে ছিলেন। গলার কোনও উপসর্গ নেই। রোগিণীও খুব খুশি। বারবার ধন্যবাদ জানিয়েছেন ডাক্তার বন্ধুটিকে।


 বিশ্বাসবোধকে যে শুধুমাত্র চিকিৎসকেরাই কাজে লাগান, তা নয়। অনেক তথাকথিত অলৌকিক ক্ষমতাধরেরাও বিশ্বাসবোধকে কাজে লাগিয়ে কিছু কিছু ক্ষেত্রে রোগ নিরাময় ঘটিয়ে অলৌকিক ‘ইমেজ’ বজায় রাখেন অথবা বর্ধিত করেন।

O

বিশ্বাসবোধকে যে শুধুমাত্র চিকিৎসকেরাই কাজে লাগান, তা নয়। অনেক তথাকথিত অলৌকিক ক্ষমতাধরেরাও বিশ্বাসবোধকে কাজে লাগিয়ে কিছু কিছু ক্ষেত্রে রোগ নিরাময় ঘটিয়ে অলৌকিক ‘ইমেজ’ বজায় রাখেন অথবা বর্ধিত করেন।

O


কারণ: চৌত্রিশ

ঈশ্বর বিশ্বাস পৃথিবীর সব ধর্মেই আবহমান কাল থেকে চলে আসছে। কোনও ধর্মই এই বিশ্বাসকে কুসংস্কার বলে মনে করে পরিত্যাগ করেনি। সব ধর্মই কি তবে শুরু থেকে ভূলই করে চলেছে?


বিষয়টিকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে আমরা আলোচনা করতে পারি।

 এক: বিভিন্ন ঈশ্বর-বিশ্বাসী ধর্মের সৃষ্টি ও আবির্ভাবের ইতিহাসের দিকে নজর দিলে আমরা দেখতে পাব, ধর্মগুরুরা যখন ধর্মকে সমষ্টিগত রূপ দিলেন, সংঘের রূপ দিলেন, প্রতিষ্ঠানের রূপ দিলেন, তখন ধর্মগুলো হয়ে উঠল প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম। প্রায় সব প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের প্রাথমিক ও আবশ্যিক শর্ত হল—‘আত্মা’ বা ‘পরমাত্মা’য় বিশ্বাস। এই আত্মা-পরমাত্মায় বিশ্বাস নির্ভর মতবাদই ‘অধ্যাত্মবাদ’। অধ্যাত্মবাদের উপর বিভিন্ন নিয়ম-কানুন, আচার-আচরণ চাপিয়েছে বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম। ‘পরমাত্মা’ ও নানা ধর্মে পরিচিত হয়েছে নানা নামে। ভগবান—ঈশ্বর—আল্লা-ব্রহ্ম আরও কত কী!

 শুরু হল এক নতুন যুগ। ব্যক্তিগত ধর্ম বিশ্বাসের স্তর অতিক্রম করে সমষ্টিগত ধর্মের যুগ। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের যুগ। এক সময় প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম পরিণত হল মানুষের উপর প্রভুত্ব করার হাতিয়ারে! শাসক ও শোষকদের সক্রিয় সহযোগিতায় বা স্পনসরশিপে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম কি ভাবে শাসক ও শোষক গোষ্ঠীর স্বার্থের সঙ্গে নিজেদের স্বার্থকে জড়িয়ে ফেলেছিল—সে এক দীর্ঘ পরিক্রমার ইতিহাস। আমরা এখানে সে ইতিহাস নিয়ে আলোচনায় যাব না। আমরা বরং ফিরে তাকাব—ঈশ্বর নির্ভর প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম সৃষ্টির আগের মানুষদের সমাজ-সাংস্কৃতিক পরিবেশের দিকে।

 সে সময় মানুষ নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জনা প্রতিনিয়ত যুদ্ধ চালিয়ে গেছে প্রকৃতির সঙ্গে, পরিবেশের সঙ্গে। এ ছিল প্রতিমুহূর্তে বেঁচে থাকার লড়াই। শিকার করতে গিয়ে কখনও শিকার হয়েছে। জলোচ্ছাসে, বন্যায় আস্তানা ভেসেছে বার-বার। এসেছে মৃত্যু। খরায় মাটি ফেটেছে, ছাতি ফেটেছে। সঙ্গে কত না রোগের আক্রমণ, অপরিশোধিত জল থেকে বাহিত রোগ, অপুষ্টিজনিত রোগ, মশা-মাছি বাহিত রোগ ইত্যাদি তো ছিলই নিত্যসঙ্গী। অসহায় মানুষ প্রকৃতির শক্তিকে ভয় করেছে, শ্রদ্ধা করেছে। ভয় ও শ্রদ্ধা করেছে জল, ঝড়, বৃষ্টি, নদী সমুদ্র, মেঘ, বজ্রপাত, বন্যা, আগুন, পাহাড়-পর্বত, মাটি ইত্যাদিকে। এ সবেরই প্রাণ আছে বিশ্বাসে বসিয়েছে দেবতার আসনে। চন্দ্র, সূর্য, পৃথিবী, বৃহস্পতি, শনি প্রভৃতি জড় নক্ষত্র ও গ্রহগুলো পৃজিত হয়েছে জীবন্ত দেবতা হিসেবে। মানুষের জীবনে সম্পদ হিসেবে প্রবেশ করেছে বৃক্ষ, অরণ্য, গরু-ছাগল, শুয়োর এবং আরও নানা ধরনের গৃহপালিত জন্তু এবং সেই সঙ্গে তারাও দেবতা হিসেবে পুজো পেয়েছে। পুজো পেয়েছে বনের বিপদ হয়ে দাঁড়ান পশু বাঘ, সিংহ, হাতি, হনুমান থেকে সরীসৃপ সাপ, কুমির পর্যন্ত। বিপদ থেকে ভয়, আর ভয় থেকেই বিপদের কারণগুলোকে খুশি করতে চেয়েছে মানুষ। সেই খুশি করতে চাওয়াই হয়ে উঠেছে ‘পুজো’। ওরা শিকারে সফলকাম হতে নাচ করেছে,বর্ষা নামাতে মেঘের দেবতাকে তুষ্ট করতে নেচেছে, জমির উর্বরতা কামনায় নাচে উদ্দাম হয়েছে। ওদের পুজোয় ধর্মগুরুর কোনও ভূমিকা ছিল না। কারণ প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের গুরুদের তখন আবির্ভাবই হয়নি, যে গুরুরা ধর্মকে সমষ্টিতে রূপ দিয়েছিল। তখন এসব পুজোর পুরোহিত ছিল ওঝা, গুনীন, জ্ঞানগুরু ইত্যাদি এবং তাদের স্তরটা ছিল ব্যক্তিগত।

 প্রাচীন ভারতের কর্ম-মীমাংসা দর্শনের দিকে তাকালে দেখাতে পাবেন ওই দর্শন নিখুঁত যাগযজ্ঞগুলোকেই ক্ষমতার উৎস, মনোবাঞ্ছা পূরণের চাবিকাঠি মনে করত। ঈশ্বর বা পরমাত্মাকে সন্তুষ্ট করার মধ্য দিয়ে অভীষ্টে পোঁছবার চেষ্টা করেনি। বলতে কি, ঈশ্বর পরমাত্মার ক্ষমতাকে গণনার মধ্যেই আনতে চায়নি। কর্ম-মীমাংসার যুগে ইচ্ছেপূরণের জন্য প্রয়োজন হয়েছিল যাগযজ্ঞের, ঈশ্বরকে খুশি করার জন্য নয়।

 প্রকৃতি পুজোর সময়কার মানুষ পরমাত্মাজাতীয় ঈশ্বরে বিশ্বাসী ছিল না। প্রকৃতিই ছিল তাদের ঈশ্বর। তাদের ঈশ্বরের সংজ্ঞা ছিল প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের ঈশ্বরের সংজ্ঞার চেয়ে ভিন্নতর। এদের ঈশ্বর প্রকৃতি।

 প্রকৃতি পুজোরও আগের মানুষের ইতিহাসের দিকে চোখ রাখলে দেখতে পাব, তাদের চিন্তা দেবতাশূন্য। প্রকৃতির সমস্ত রকম প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে প্রতিটি পদক্ষেপে টিকে থাকার লড়াই চালাতে সে সময়কার মানুষদের কোনও দেবতার কাছেই নতজানু হতে হয়নি। তবু তারা টিকে ছিল। দেবতাকে পাত্তা না দিয়েও টিকে ছিল। তাদের টিকে থাকার জন্য সেই ভয়ংকর প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও কোনও দেবতার প্রয়োজন হয়নি। তারা যে টিকে ছিল, আমাদের বর্তমান উপস্থিতিই তার প্রমাণ।  সে সময়কার মানুষদেরও একটা ‘ধর্ম’ অবশ্যই ছিল। বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীদের ধর্ম থেকে মানুষের ধর্ম-এর একটা স্পষ্ট পার্থক্যও ছিল। এই পার্থক্যই মানুষকে অন্য প্রাণীদের থেকে আলাদা করেছে, বিশিষ্ট করেছে। সে সময় মানুষের ‘ধর্ম ছিল ‘মনুষ্যধর্ম’, যা বর্তমান মানবতারই প্রাথমিক পর্যায়। অন্যান্য প্রাণীদের সঙ্গে আদিম মানুষদের এই ‘ধর্ম’-এর পার্থক্য ছিল এই, অন্যান্য প্রাণীরা প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকতে প্রকৃতির সঙ্গে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিয়েছিল; কিন্তু মানুষ সেখানে প্রকৃতির সঙ্গে নিজেদের খাপ খাইয়ে নেবার পাশাপাশি প্রতিকূল প্রকৃতিকে নিজেদের অনুকূলে আনতেও সচেষ্ট ছিল।

 এই আলোচনার সূত্র ধরে আমরা এখন নিশ্চয়ই বলতে পারি, “ঈশ্বর বিশ্বাস পৃথিবীর সব ধর্মেই আবহমান কাল থেকে চলে আসছে”—ইত্যাদি জাতীয় প্রতিটি কথা ঐতিহাসিক ভাবেই অসত্য, কারণ ‘ধর্ম বলতে বর্তমানকালের ধর্মীয়বেত্তারা যা বোঝান, সেই ‘ধর্ম’ই আবহমানকালের নয়।

O

“ঈশ্বর বিশ্বাস পৃথিবীর সব ধর্মেই আবহমান কাল থেকে চলে আসছে” ইত্যাদি জাতীয় প্রতিটি কথা ঐতিহাসিক ভাবেই অসত্য, কারণ ‘ধর্ম’ বলতে বর্তমানকালের ধর্মীয়বেত্তারা যা বোঝান, সেই ‘ধর্ম’ই আবহমানকালের নয়।

O


 দুইঃ ঈশ্বর অবিশ্বাসী প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের ইতিহাসও প্রাচীন। এই ঈশ্বর বাদ দেওয়া ধর্মকেও সমষ্টিগত রূপ দেওয়া হয়েছিল, সংঘের রূপ দেওয়া হয়েছিল। বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম এমনই দুই ধর্ম যারা নিরীশ্বরবাদী এবং বেদবিরোধী হিসেবে প্রাচীন ভারতে প্রসিদ্ধ ছিল।

 এই প্রসঙ্গে এটুকু মনে করিয়ে দিলে বোধহয় একটা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, চার্বাক দর্শনের নিরীশ্বরবাদী নাস্তিকতাবাদের সঙ্গে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের নিরীশ্বরবাদী নাস্তিকতাবাদের মৌলিক পার্থক্য ছিল।

 বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম নিরীশ্বরবাদী ও বেদবিরোধী হলেও এই ধর্মের প্রবক্তা চিন্তানায়করা মানুষের পার্থিব জীবনের অনিবার্য পরিণতি দুঃখময় বলে মনে করতেন। পীড়া-জরা-মৃত্যু ইত্যাদি দুঃখময় জীবন থেকে নিজেকে বাঁচাতে জীবন বিচ্ছিন্ন এক জীবনকে খুঁজতে চেয়েছিলেন। তাঁদের এমনই ত্যাগ ও তিতিক্ষার মধ্য দিয়ে জীবনের উদ্দেশ্যকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা ছিল স্পষ্টতই নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচায়ক।

 চার্বাকবাদ নিরীশ্বরবাদী ও বেদবিরোধী অবশ্যই কিন্তু মানুষের পার্থিব জীবনের প্রতি চার্বাক দর্শনের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল যথেষ্ট ইতিবাচক। তাঁদের চিন্তার মধ্যে ছিল যুক্তি ও বিজ্ঞানমনস্কতার বীজ।

 এই আলোচনার পর এ’কথা নিশ্চয়ই বলতে পারি, পৃথিবীর সব প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের ঈশ্বর বিশ্বাস ছিল না। পরন্তু কিছু কিছু প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম ঈশ্বর বিশ্বাসকে কুসংস্কার বলে মনে করত।


 তিন: যুক্তির কাছে অন্ধবিশ্বাস বা ব্যক্তি-বিশ্বাসের কোনও দাম নেই। যুক্তি সিদ্ধান্তে পৌঁছায় পরীক্ষা, পর্যবেক্ষণের পথ ধরে। যুক্তিবাদীদের কাছে তথাকথিত ধর্মই আত্মা ও পরমাত্মা নির্ভর প্রতিটি ধর্মই যখন অন্ধ-বিশ্বাস হিসেবে বাতিল তালিকাভুক্ত, তখন ওইসব ধর্ম বা বহু ধর্ম কোন্‌ বিশ্বাসকে গ্রহণ করল ও কোন বিশ্বাসকে গ্রহণ করল না, তাতে যুক্তিবাদীদের কি এলো-গেলো?

 পৃথিবীর বহু ধর্মের কাছে ঈশ্বর বিশ্বাসের গ্রহণযোগ্যতা বিজ্ঞানের সত্যের আদৌ কোনও প্রমাণ নয়। কোনও ধর্মের ঈশ্বর বিশ্বাস দ্বারা শুধু এটুকুই প্রমাণিত হতে পারে, ধর্মটি নিরীশ্বরবাদী নয়, ঈশ্বরবাদী, অর্থাৎ ধর্মটিতে ‘ঈশ্বর’ নামক এক অলীক-বিশ্বাস জাঁকিয়ে বসে আছে।

O

পৃথিবীর বহু ধর্মের কাছে ঈশ্বর বিশ্বাসের গ্রহণযোগ্যতা বিজ্ঞানের সত্যের আদৌ কোনও প্রমাণ নয়। কোনও ধর্মের ঈশ্বর বিশ্বাস দ্বারা শুধু এটুকুই প্রমাণিত হতে পারে, ধর্মটি নিরীশ্বরবাদী নয়, ঈশ্বরবাদী, অর্থাৎ ধর্মটিতে ‘ঈশ্বর’ নামক এক অলীক-বিশ্বাস জাঁকিয়ে বসে আছে।

O

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *