অধ্যায়: দুই
ঈশ্বর বিশ্বাস: পুরাণ ও ইতিহাসে মুখ দেখাদেখি বন্ধ
কারণ: তেরো
বেদ-মনুস্মৃতি-কোরআন-বাইবেল নাকি অপৌরুষেয়, অর্থাৎ ভগবানের নিজের লেখা!
বিভিন্ন ধর্ম-বিশ্বাসীদের মধ্যে একটি দৃঢ়বদ্ধ ধারণা আছে, তাঁদের ধর্মগ্রন্থ আপৌরুষেয়। অর্থাৎ মানুষের রচিত নয়। অর্থাৎ ঈশ্বর-রচিত। ঈশ্বর-রচিত এসব ধর্মগ্রন্থ পাঠ করলে জানা যায়, ঈশ্বরের জাগতিক প্রার্থণা পুরাণের ক্ষমতা আছে। উদাহরণ হিসেবে যে কোনও একটি তথাকথিত ঈশ্বর-রচিত গ্রন্থকে পাঠ করলেই এই বক্তব্যের সত্যতা বুঝতে পারবেন। বেদ-এ চোখ বোলান, দেখতে পাবেন বিভিন্ন দেবতাদের উদ্দেশে রয়েছে প্রার্থনা—আমাকে দীর্ঘ আয়ু দাও, আমাকে সুস্বাস্থ্য দাও, নারীদের বশ করার ক্ষমতা দাও, নারীসংগমে দীঘ আনন্দ পেতে প্রচুর বীর্য দাও, অনেক খাবার দাও, অনেক গরু-ঘোড়া-মোষের মাংস খেতে দাও, যুদ্ধে জয় দাও ইত্যাদি ‘দাও দাও’-এব মেলা। এই মেলা ‘দাও দাও’ প্রার্থণা করতে মানুষকে যেহেতু ঈশ্বর-ই নির্দেশ দিয়েছেন, তাই ধরে নিতেই পারি ঈশ্বরের এমনি হাজারো প্রার্থণা পুরাণের ক্ষমতা আছে। ক্ষমতা না থাকলে, ‘আমার কাছে প্রার্থণা কর’ বলাতে যাবেন কেন? মিথ্যে প্রলোভন দেখাবেন কেন?
সব ধর্মগ্রন্থেই এমন বহু প্রার্থনা পূরণের বিপুল আয়োজন। সেই সঙ্গে বিভিন্ন অপৌরষেয় ধর্মগ্রন্থে নারীকে পুরুষ শাসনে অবদমিত রাখার ও তাকে মহিমাম্বিত করার প্রচেষ্টা। শুধু কি তাই, শাসক ও শোষকদের শাসন-শোষণের অধিকারকে ধর্মীয় সমর্থনও জানানো হয়েছে।
হিন্দুদের অপৌরুষেয় ধর্মগ্রন্থে বাড়তি যা তা হল, চতুর্বর্ণ প্রথা তৈরি করে কৃষক-শ্রমিক শ্রেণীকে নিংড়ে নেওয়ার নিষ্ঠুর প্রয়াস।
এইসব ধর্মগ্রন্থকে ঈশ্বর-রচিত বলে মেনে নিলেই স্বতঃস্ফূর্ততার সঙ্গেই সারিবদ্ধ কিছু চিন্তার উদয় হয়।
এক: ঈশ্বর কোনও নিরাকার শক্তি নন।
দুই: ঈশ্বর নারী বিরোধী, অর্থাৎ পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক মানুষের বিরোধী ও নিপীড়ণকারী।
তিন: ঈশ্বর নারীদের সঙ্গে সঙ্গে কৃষক-শ্রমিকদের প্রতি নিষ্ঠুর মনোভাবাপন্ন।
চার: ঈশ্বর তোয়াজ পছন্দ করেন। চাটুকারিতা পছন্দ করেন|
এরপর কিছু প্রশ্ন এসে হাজির হয়—ঈশ্বর যা বলেন, তা সবই কি সত্যি? বাস্তবিকই কি ঈশ্বরের প্রার্থনা পূরণের ক্ষমতা আছে? আদৌ কি সকলের প্রার্থনা পূরণের ক্ষমতা ঈশ্বরের পক্ষে থাকা সম্ভব? দুই শত্রপক্ষ আন্তরিকতার সঙ্গে যুদ্ধ জয়ের প্রার্থনা জানালে দুজনেরই জয় এনে দেওয়া কি ঈশ্বরের পক্ষে সম্ভব? আদৌ নয়।
O
আদৌ কি সকলের প্রার্থনা পূরণের ক্ষমতা ঈশ্বরের পক্ষে থাকা সম্ভব? দুই শত্রুপক্ষ আন্তরিকতার সঙ্গে যুদ্ধ জয়ের প্রার্থনা জানালে দুজনেরই জয় এনে দেওয়া কি ঈশ্বরের পকে সম্ভব? আদৌ নয়।
O
যে ঈশ্বরের নির্ধারিত নীতি অমানবিক, যে ঈশ্বর মানুষে-মানুষে বিভাজনের স্রষ্টা, শোষণ ও নিপীড়নের পৃষ্ঠপোষক, সেই ঈশ্বরকে ‘ভাল’, ‘করুণাময়’, ‘পূজনীয়’, ‘শ্রদ্ধেয়’, ইত্যাদি বিশেষণে বিশেষিত করা কি মিথ্যা উক্তি নয়?
এত মিথ্যাচারিতায় ভরা, নিষ্ঠুর, অমানকি ধর্মগ্রন্থগুলো বাস্তবিকই যদি অপৌরুষেয় হয়, তবে বলতেই হয় ঈশ্বর চাটুকার পরিবৃত হয়ে থাকতে চাওয়া এক অসৎ ও নিষ্ঠুর সাকার কিছু এবং একই সঙ্গে শোষক ও শাসকদের পৃষ্ঠপোষক। ঈশ্বর যদি বাস্তবিকই দুর্নীতি ও অসততার মূর্ত প্রতিমূর্তি না হন, তবে একথাই স্বীকার করতে হয়, অসৎ ও নিষ্ঠুর শাসক-শাসকদের টিকে থাকার স্বার্থে এইসব ধর্মগ্রন্থগুলো বুদ্ধিজীবী, সুবিধাভোগী পুরোহিতরা ও ধর্মগুরুরাই রচনা করেছিলেন এবং অপৌরুষেয় বলে প্রচার করেছিলেন। উদ্দেশ্যে অতি স্পষ্ট শোষক-শাসক-পুরুষতন্ত্রের স্বার্থ রক্ষা করা।
কারণ: চোদ্দ
ঈশ্বর মানুষকে সৃষ্টি করলেন কবে?
ইসলামে ও খ্রিস্ট ধর্মে বিশ্বাসীরা মনে করেন পৃথিবীর আদি মানুষ আদমের জন্ম খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০৪ সালে। ঈশ্বর বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করার পর এক জোড়া করে প্রাণী তৈরি করে তাতে প্রাণ সঞ্চার করেছিলেন। আদমের জন্ম-ও একইভাবে।
গোটা ব্যাপারটাই যে নেহাতই কল্পনা, তারই প্রমাণ হিসেবে কিছু ঘটনার শুধু উল্লেখ করছি।
খ্রিস্টপূর্ব ৪২২১ সালে মিশরে পঞ্জিকা তৈরি হয়। খ্রিস্টপূর্ব ৪২৪১ সালে মিশরে বর্ষ গণনার শুরু। মিশরের নেগাদা, এমিডোস ইত্যাদি অঞ্চলের কবর খুঁড়ে পাওয়া যায় পাথরের হাতিয়ার, সোনা, রূপো ও তামার ব্যবহারের নানা নিদর্শন। প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে এগুলো খ্রিস্টপূর্ব ৫০০০ বছরের প্রাচীন। খ্রিস্টপূর্ব ৭০০০ সাল নাগাদ লোকবসতির প্রমাণ পাওয়া গেছে টেপ পাওয়াতে। খ্রিস্টপূর্ব ৮০০০ সালেও যে লোকবসতি ছিল, তারই প্রমাণ মিলেছে সিরিয়ার উপকূলে ‘বাসসামরা’তে ৪০ ফুট ঢিবির নীচে।
এরপরও পবিত্র বাইবেল ও পবিত্র কোরআন-এর কথা মত খ্রিস্টপূর্ব ৪০০৪ সালে পৃথিবীতে প্রথম মানুষ তত্ত্ব বা তথ্যকে আমরা মানি কী করে?
হিন্দু ধর্মে বিশ্বাসীরা মনে করেন, পৃথিবীর আদি মানুষটির নাম মনু। মনু থেকেই মানুষ প্রজাতির বিস্তার। মনু কোনও রমণীর গর্ভজাত নন। ভগবান ব্রহ্মার দেহ থেকে মনুর সৃষ্টি।
মান কত দিন এই পৃথিবীতে এসেছে? এ’বিষয়ে হিন্দু ধর্মের মত—সেই সত্য যুগ। হিন্দু ধর্মশাস্ত্র মতে তিনটি যুগ অতিক্রম করে এখন চতুর্থ যুগ চলছে। অতিক্রান্ত যুগ তিনটি হল—সত্য, ত্রেতা ও দ্বাপর। এখন চলছে কলি যুগ।
যুগের হিসেব না হয়, বোঝা গেল; কিন্তু কত বছর আগে মানুষ পৃথিবীতে এসেছে?
যুগের হিসেব ধরেই তারও হিসেব মিলবে।
যুগ সত্য ত্রেতা দ্বাপর | ব্যাপ্তিকাল ১৭, ২৮, ০০০ বছর ১২, ৯৬, ০০০ বছর ৮, ৬৪, ০০০ বছর |
অর্থাৎ, কলি যুগে পড়ার আগেই মানুষ অতিক্রম করেছে ৩৮,৮৮,০০০ বছর। বিজ্ঞানীদের মতে বিবর্তনের পথ ধরে মাত্র ২৫ হাজার থেকে ৩০ হাজার বছর আগে আধুনিক মানুষ এসেছে পৃথিবীর বুকে।
বলুন তো, এরপরও ঈশ্বরের সৃষ্টিতত্ত্বকে মানি কী করে, এবং ঈশ্বরকে স্রষ্টা হিসেবে মানি কী করে?
কারণ: পনেরো
অবতাররা কেন খালি ভারতে, পয়গম্বররা কেন খালি আরব ভূমিতে জন্মান?
হিন্দুদের বিশ্বাস, পৃথিবীর মানুষ যখন নানা পাপ কাজে পৃথিবীর পরিবেশকে দৃষিত করে তোলে, তখন মানুষদের উদ্ধারের জন্য অবতাররা পৃথিবীতে জন্মান। অবতাররা দেবতারই অংশ।
মানুষের উদ্ধারের জন্য এপর্যন্ত পৃথিবীতে জন্মেছেন মোট দশজন অবতার। তাঁরা হলেন—মৎস্য, কূর্ম, বরাহ, নৃসিংহ, বামন, পরশুরাম, রামচন্দ্র, বলরাম, বুদ্ধ ও কল্কি।
কিন্তু এঁরা সবাই ভারতেই জন্মালেন কেন? পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মানুষরা কি তবে তখনও খুবই সৎ ছিল? নাকি, এই অবতাররা জন্মানো পর্যন্ত ভারত ছাড়া পৃথিবীর আর কোনও দেশেই মানুষ বাস করত না? বুদ্ধের জন্মাবার সময় কি ভারত ছাড়া আর কোনও দেশেই মানুষ বাস করত না?
খ্রিস্টপূর্ব ৪০০৪ সালে আদমের জন্ম থেকে আজ পর্যন্ত মানুষদের উদ্ধারের জন্য পয়গম্বর জন্মেছেন ১,২৪,০০০। এবং এঁরা প্রায় সকলেই জন্মালেন আরব ভূখণ্ডে। কেন শুধু আরবে? আরবেই কি শুধু পাপীদের বাস ছিল? নাকি অন্য সব দেশে মনুষ্য বসতি ছিল না?
O
খ্রিস্টপূর্ব ৪০০৪ সালে আদমের জন্ম থেকে আজ পর্যন্ত মানুষদের উদ্ধারের জন্য পয়গম্বর জন্মেছেন ১,২৪,০০০। এবং এঁরা প্রায় সকলেই জন্মালেন আরব ভূখণ্ডে। কেন শুধু আরবে? আরবেই কি শুধু পাপীদের বাস ছিল? নাকি অন্য সব দেশে মনুষ্য বসতি ছিল না?
O
কারণ: ষোল
ঈশ্বর কি সত্যিই মহাপ্লাবন সৃষ্টি করেছিলেন?
খ্রিস্ট ধর্মে বিশ্বাসী ও মুসলিম ধর্মে বিশ্বাসীরা মনে করেন, পৃথিবীতে প্রথম মানুষ আদম জন্মাবার ১৬৫৬ বছর পর ঈশ্বর পৃথিবীকে পাপ মুক্ত করতে এনেছিলেন মহাপ্লাবন। সে সময় পাপে ভরে গিয়েছিল পৃথিবী। তাই জীবজগৎকে ধ্বংস করতে ঈশ্বর এনেছিলেন মহাপ্লাবন। জীব বলতে প্রাণী ও উদ্ভিদ সবই। সবার মধ্যেই বাসা বেঁধেছিল পাপের কালো অন্ধকার। সবার মধ্যেই জমে উঠেছিল পাপের বিষ। পৃথিবীকে সুন্দর করে তুলতেই সেদিন অসুন্দরকে, পাপকে পৃথিবীর বুক থেকে মুছে ফেলার প্রয়োজন হয়েছিল। প্রয়োজন বোধ করেছিলেন ঈশ্বর। পৃথিবীকে আবার সুন্দর করে গড়ে তুলতে ঈশ্বর সেদিন মহাপ্লাবনের থেকে রক্ষা করেছিলেন একজোড়া করে প্রাণীকে।
মহাপ্লাবন হয়েছিল প্রথম মানুষ বা আদম বা হজরত আদম-এর জন্মের (খ্রিস্ট পূর্ব ৪০০৪ সালে) ১৬৫৬ বছর পর। অর্থাৎ খ্রিস্ট পূর্ব ২৩৪৮ সালে।
মহাপ্লাবনের পর অতিক্রান্ত হয়েছে (২ ৩৪৮ + ১৯৯৫ =) ৪৩৪৩ বছর। আর একটি বারের জন্যেও মহাপ্লাবন হয়নি। তার মানে, পৃথিবীতে প্রথম মানুষ এলো, এবং তারপর দেড় হাজার বছর যেতে না যেতেই মানুষ তথা প্রাণিকুল। এতই দুর্নীতির সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করল, যার ফলে ঈশ্বর ধ্বংসের পথ বেছে নিতে বাধ্য হলেন।
প্রথম মহাপ্লাবনের পর প্রায় সাড়ে চার হাজার বছর কেটে গেছে। মানুষ ও প্রাণীর সংখ্যা বেড়েছে। উৎপাদনের নানা উন্নততর পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছে। প্রতিটি দিন পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে মানুষের লোভও লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। তারই সঙ্গে বাড়ছে যেন-তেন-প্রকারেণ লাভের পাহাড়, সঞ্চয়ের পাহাড় গড়ে তোলার প্রচেষ্টা। এই মুহূর্তে অবক্ষয়ের থাবার নীচে গোটা পৃথিবী। দুর্নীতির অপর নাম আজ ‘ক্যারিয়ারিজম’। পুলিশদের কাজ চুরি, মন্ত্রীদের কাজ লুট, ধর্মগুরুদের কাজ মন্ত্রীদের অকুণ্ঠ আশীর্বাদ দান। এমন শোষণ, এমন দুর্নীতি, এমন অবক্ষয়ের রেকর্ড প্রায় সাড়ে চার হাজার বছর আগেকার মানুষ ভেঙে দিয়েছিল, একথাও কোন ভাবে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। তখনকার সামাজিক প্রক্রিয়া এখনকার তুলনায় ছিল অনেক বেশি সহজ-সরল। লোকসংখ্যাও ছিল এখনকার তুলনায় খুবই কম। তবু ঈশ্বর সেই সময়কার পৃথিবীর পাপ দেখে বিচলিত হয়ে মহাপ্লাবন এনেছিলেন। আজ সর্বব্যাপী পাপ দেখেও ঈশ্বর কেন বিচলিত নন? কেন আবার মহাপ্লাবন ঘটাবার প্রয়োজন অনুভব করছেন না? না কি বর্তমান পৃথিবীতে পাপ নেই? অথবা ‘মহাপ্লাবন’ আদৌ হয়নি? সবটাই গপ্পো? খ্রিস্টধর্মের ও মুসলিম ধর্মের এই ‘অভ্রান্ত-সত্য’ আসলে ‘অভ্রান্ত মিথ্যা’?
O
আজ সর্বব্যাপী পাপ দেখেও ঈশ্বর কেন বিচলিত নন? কেন আবার মহাপ্লাবন ঘটাবার প্রয়োজন অনুভব করছেন না? না কি বর্তমানপৃথিবীতে পাপ নেই? অথবা ‘মহাপ্লাবন’ আদৌ হয়নি? সবটাই গপ্পো’?
O
কারণ: সতেরো
মহাপ্রলয়ের জাহাজে পৃথিবীর সমস্ত প্রাণীর একজোড়ার কি জায়গা হওয়া সম্ভব?
বাইবেলে বলা হয়েছে এবং মুসলিমরাও বিশ্বাস করেন, মহাপ্রলয়ের আগে একমাত্র পুণাবান মানুষ নোয়া’কে আসন্ন ধ্বংস সম্বন্ধে ঈশ্বর সাবধান করে দিয়েছিলেন। সেই সঙ্গে নির্দেশ দিয়েছিলেন একটা তিনতলা জাহাজ তৈরি করতে, যেটা হবে ৩০০ হাত লম্বা, ৫০ হাত চওড়া ও ৩০ হাত উঁচু।
জাহাজ তৈরি হল। এরপর শুরু হল মহাপ্লাবন। চল্লিশ দিন, চল্লিশ রাত ধরে অঝোরে বৃষ্টি ঝরল। বৃষ্টির প্রাবল্যে পৃথিবীর সব পর্বতের চুড়োগুলো পর্যন্ত গেল ডুবে। ডুবে মরল পৃথিবীর প্রাণিকুল। বেঁচে রইল তারা, যারা আশ্রয় পেয়েছিল জাহাজে। সেই কৃপাধন্য কারা? একজোড়া করে পৃথিবীর সমস্ত প্রাণী। হ্যাঁ, এত প্রলয়ের পরও তারা বেঁচে ছিল, কারণ জাহাজে শুধু জোড়ায় জোড়ান প্রাণীই ছিল না, ছিল তাদের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় পর্যাপ্ত খাবার-দাবার।
এতো গেল ধর্মীয় বিশ্বাস। এবার আসুন দেখা যাক, বিশ্বাসটা সত্যি হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু?
আবহবিদ্যার বই থেকে আমরা জানতে পারি, এক বর্গমিটার জমির উপর যে বায়ুমণ্ডল রয়েছে, তাতে গড়ে মোটামুটি ১৮ কিলোগ্রাম জল থাকে। তবে কোনও ভাবেই ২৫ কিলোগ্রামের বেশি নয়। বায়ুমণ্ডলের এই আদ্রতা ঘনীভূত হয়ে একসঙ্গে যদি ঝরে পড়ে, তাহলে পৃথিবীর জলের গভীরতা কতটা বাড়ে, আসুন আমরা এবার সেটাই দেখি।
১ বর্গমিটার জায়গায় সবচেয়ে বেশি জল থাকতে পারে ২৫ কিলোগ্রাম, অর্থাৎ ২৫০০০ ঘন সেণ্টিমিটার। অর্থাৎ কিনা, ২৫০০০ ঘন সেণ্টিমিটার জল ঝরবে ১ বর্গ মিটার বা ১০০x ১০০ = ১০,০০০ বর্গ সেণ্টিমিটার জমির উপর। অথাৎ মহাপ্লাবনে সবচেয়ে বেশি জল জমা হলে তা হতে পারে ২.৫ সেণ্টিমিটার গভীর। অর্থাৎ মহাপ্লাবনে পৃথিবীর সব জায়গায় গড়ে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হলে ২.৫ সেণ্টিমিটার জল জমতে পারে।
বিশ্বাস করুন, মহাপ্লাবনে সত্যিই এর চেয়ে বেশি জল কোনও ভাবেই জমা সম্ভব নয়। পৃথিবীর কোনও কোনও জায়গায় এর চেয়ে বেশি বৃষ্টি অবশ্য হয়। কিন্তু সেই ক্ষেত্রগুলোতে আশেপাশের অঞ্চলের মেঘ হাওয়ায় ভেসে বৃষ্টিপাত অঞ্চলে চলে আসে। কিন্তু মহাপ্লাবনে সারা পৃথিবী জুড়েই যদি প্লাবন হয়, তবে কোথায়ও কম, কোথাও বেশি বৃষ্টির জল জমার ব্যাপার নেই। সব জল ঝরে গোটা পৃথিবীতে জল জমলে ওই জলের গভীরতা হবে ২.৫ সেণ্টিমিটারের মত। তার বেশি কোনও ভাবেই হওয়া সম্ভব নয়।
খ্রিস্ট ধর্মে ও মুসলিম ধর্মে বিশ্বাসীদের মতে, মহাপ্লাবনে ডুবে গিয়েছিল পৃথিবীর সব পর্বতের চুড়োগুলোও। এভারেস্টের উচ্চতা ৯ কিলোমিটার। অর্থাৎ মহাপ্লাবনে বৃষ্টির পরিমাণটা একটু বাড়িয়ে বলা হয়েছিল। এমন কিছু নয়, একটুই। মাত্র ৩,৬০,০০০ গুণ বাড়িয়ে বলা হয়েছিল।
এবার আসা যাক দ্বিতীয় প্রশ্নে। পৃথিবীর সমস্ত প্রাণীদের একজোড়া করে নেওয়া কি সম্ভব ছিল নোয়ার জাহাজে? সম্ভব ছিল, সেই সঙ্গে সমস্ত প্রাণীদের বেঁচে থাকার উপযোগী পর্যাপ্ত পরিমাণ খাবার ঐ জাহাজেই নেওয়া?
বাইবেলে আছে, নোয়ার জাহাজটা ছিল তিনতলা। প্রতি তলা ৩০০ হাত লম্বা আর ৫০ হাত চওড়া। তখনকার দিনের লোকেদের এক হাত মানে মোটামুটি ৪৫ সেণ্টিমিটার। অর্থাৎ জাহাজের প্রতিটা তলা ছিল ৩০০ x ০.৪৫ = ১৩৫ মিটার লম্বা, আর ৫০ x ০.৪৫ = ২২.৫ মিটার চওড়া। অর্থাৎ প্রতিটা তলায় জায়গা ছিল ১৩৫ x ২২.৫ = ৩০৩৭.৫ বর্গ মিটার। তিনটে তলা মিলিয়ে জাহাজে মোট জায়গা ছিল ৩ x ৩০৩৭,৫ = ৯১১২,৫ বর্গ মিটার।
পৃথিবীতে শুধু প্রাণীই আছে দশ রকমের PHYLUM-এর (গাছ না হয় বাদই দিলাম):—
1) Protozoa (2) Porifera (31 Coelcnterata (4) Platyhelminthes (5) Nemathelminthes (h) Annelida (7) Arthropoda (8) Mollusca (9) Echinodermata (10) Chordata.
এর মধ্যে থেকে আমরা শুধুমাত্র একটা ফাইলামকেই বেছে নিচ্ছি। Chordata অর্থাৎ মেরুদণ্ডী প্রাণী। এই Chordata-দেরও আবার পাঁচটা ভাগে ভাগ করা যেতে পারে:—
(১) পাখি (২) মাছ (৩) সরীসৃপ (8) উভচর ও (৫) স্তন্যপায়ী।
পৃথিবীতে শুধু স্তন্যপায়ী প্রাণীই আছে ৩৫০০ জাতের। নোয়ার জাহাজে যদি শুধুমাত্র স্তন্যপায়ী জানোয়ারই নেওয়া হয়ে থাকে তাহলেও দেখা যাচ্ছে যে প্রতি জোড়া স্তন্যপায়ীর জনা জায়গা ছিল:
৯১১২.৫÷৩৫০০=২.৬ বর্গমিটার। যথেষ্ট জায়গা নয় নিশ্চয়ই, বিশেষত যখন স্তনাপায়ীদের মধ্যে তিমি, ডলফিন, হাতি, রাইনো, হিপ্লোদের মতো বিশাল আকারের জন্তুরাও আছে। স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে, নোয়ার জাহাজে শুধুমাত্র স্তন্যপায়ীদের জনোই যথেষ্ট জায়গা ছিল না। আর স্তন্যপায়ীরা তো সমগ্র প্রাণিকূলের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র একটি ভগ্নাংশ মাত্র। তারপরও তো রয়েছে সক্কলের জন্য নিদেন বেশ কয়েক মাসের খাবার-দাবার রাখার জায়গায় প্রশ্ন। সমস্ত পৃথিবী মহাপ্লাবনে শেষ হয়ে যাওয়ার পর জল সরলেও খাবার মিলবে কোথা থেকে?
বাঘ, সিংহের মত মাংসাশীরা যে মাংস খবে, সেই সব মাংসল প্রাণীরা কোথায়? গরু, মোষ, ছাগল, ভেড়া, ইত্যাদির মত তৃণভোজী প্রাণীদের জন্য তৃণ কোথায়? হাতি, জিরাফ, ইত্যাদি প্রাণীদের খাওয়ার মত গাছ-গাছড়া কোথায়?
তিমি থেকে ভোঁদড় পর্যন্ত মৎসাভোজীদের জন্য মাছ কোথায়? সবার খাবার আবার নতুন করে যত দিন না পৃথিবীর বুকে আবির্ভূত হচ্ছে, ততদিন তো এই নোয়ার জাহাজে রেখে দেওয়া খাবার খেয়েই প্রাণটা রাখতে হবে। অতএব জাহাজে খাবারের স্টক বেশ কয়েক মাসের বদলে বেশ কয়েক বছরের রাখাটাই স্বাভাবিক নয় কি? ওই বিশাল পরিমাণ খাদ্য রাখার জায়গা চাই। কিন্তু জাহাজে জায়গা কই?
এটা এখন নিশ্চয়ই স্পষ্টতর হয়েছে, মহাপ্লাবনের মতই নোয়ার জাহাজের ধর্মীয় বিশ্বাসও উদ্ভট কল্পনা বই কিছু নয়।
কারণ: আঠেরো
‘ফেরেস্তা’, ‘বেহেস্ত’ ও ‘দোজখ’ তৈরিতে আল্লাহের পরিকল্পনার অভাব এবং গোর আজাবে পক্ষপাত কেন?
মুসলিম ধর্মে বিশ্বাসীরা মনে করেন, ‘বেহেস্ত’ ও ‘দোজখ’ সৃষ্টি হলেও সম্পূর্ণ অব্যবহৃত অবস্থায় তা পড়ে রয়েছে। এই দু’য়ের ব্যবহার শুধু হবে ‘কেয়ামত’ বা ‘মহাপ্রলয়’-এর পর। ‘মহাপ্রলয়’ কবে শুরু হবে? এস্রাফিল ফেরেস্তা যবে শিঙায় তিনবার ফুঁ দেবে। শিঙায় ফুঁ পড়তেই বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড অর্থাৎ আল্লাহের যাবতীয় সৃষ্টিই ধ্বংস হয়ে যাবে। থাকবেন শুধু আল্লাহ এবং তাঁর তৈরি বেহেস্ত ও দোজখ। এস্রাফিল ফেরেস্তা কে? একজল ফেরেস্তা। ফেরেস্তা কী? বলা চলে আল্লাহের দূত। এরা স্বর্গ-মর্ত্য সব জায়গাতেই বিচরণ করেন। আল্লাহ বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করেছিলেন। সৃষ্টির পর পালনের জন্য আল্লাহ সৃষ্টি করলেন অসংখ্য ফেরেস্তা। (তবে কি আমরা ধরে নেব-সৃষ্টিকে পালন করার ক্ষমতা সর্বশক্তিমান আল্লাহের ছিল না, তাই ফেরেস্তাদের সাহায্য গ্রহণ?)
ফেরেস্তাদের মধ্যে প্রধান চারজন (১) জেব্রাইল, (২) মেকাইল, (৩) এস্রাফিল, (৪) আজ্রাইল। জেব্রাইল ফেরেস্তার কাজ পয়গম্বরদের কাছে খোদাতালার আদেশ পৌঁছে দেওয়া। হজরত মোহাম্মদ পৃথিবীর শেষ পয়গম্বর। আর কোনও পয়গম্বর যেহেতু জন্মাবেন না, তাই জেব্রাইল ফেরেস্তার কাজ শেষ। কে জানে, বেচারা এখন কী করছেন? হয়তো তাঁর অবস্থা এখন—’ছুঁচোর গোলাম চামচিকে, তার মাইনে চোদ্দ সিকে’।
মেকাইল ফেরেস্তার হাতে রয়েছে আবহাওয়া ও খাদ্য দপ্তর| মেকাইল যে খুবই অকর্মণা ফেরেস্তা, এটুকু বুঝতে বেশি আলোচনার প্রয়োজন নেই। অকর্মণ্যতার জ্বলন্ত নিদর্শন পয়গম্বরের দেশ আরবেই বৃষ্টিপাতের নামগন্ধ নেই, নেই চাষবাস। সোমালিয়ার মুসলিমরা মারা যায় দুর্ভিক্ষে। ফি বছর বাংলাদেশের মুসলিমরা সাইক্লোন ও বন্যার কবলে পড়েন। তার দরুন ঘটে বিপুল মৃত্যু ও সম্পত্তিহানি। আল্লাহ যদি নিরপেক্ষই হন, তবে তাঁর ফেরেস্তা কী করে পক্ষপাতিত্ব দেখাবার সুযোগ পান। কী করে কোনও অঞ্চল হয় শস্যশ্যামলা, কোনও অঞ্চল চূড়ান্ত অনুর্বর; কোনও অঞ্চলে বন্যার আধিক্য, কোনও অঞ্চলে খরার; কোনও মানুষের ঘরে খাদ্যের প্রাচুর্য, কোনও মানুষের ঘরে চরম দারিদ্র্য।
O
আল্লাহ যদি নিরপেক্ষই হন, তবে তাঁর ফেরেস্তা কী করে পক্ষপাতিত্ব দেখাবার সুযোগ পান। কী করে কোনও অঞ্চল হয় শস্যশ্যামলা, কোনও অঞ্চল চূড়ান্ত অনুর্বর; কোনও অঞ্চলে বন্যার আধিক্য, কোনও অঞ্চলে খরার; কোনও মানুষের ঘরে খাদ্যের প্রাচুর্য, কোনও মানুষের ঘরে চরম দারিদ্র্য।
O
এস্রাফিল ফেরেস্তা একটা শিঙা হাতে নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়েই আছেন, কবে আল্লাহ শিঙা ফোঁকার আদেশ দেবেন—এই প্রত্যাশায়। কেয়ামত বা মহাপ্রলয়ের মুহূর্তটি কবে আসবে—তা কি আল্লাহের অজানা? তাই বহু কোটি বছর আগে থেকেই এস্রাফিলকে সৃষ্টি করে শিঙা হাতে দাঁড় করিয়ে রেখেছেন? আল্লাহকে কেউ কি তবে কেয়ামতের দিনটি জানাবেন? কে জানাবেন?
আজ্রাইল ফেরেস্তার ডিউটিটা অনেকটা হিন্দুদের যমদূত’–এর মত। আজ্রাইল-ই মানুষের মৃত্যুর কারণ। রোগ, দুর্ঘটনা—ইত্যাদি নিমিত্ত মাত্র।
মানুষের মৃত্যু থেকে কেয়ামত পর্যন্ত আত্মার কাজ কী? মুসলিম ধর্মবিশ্বাসীরা মনে করেন মৃতকে কবর দেওয়ার পরই ‘মনকির’ ও ‘নকির’ নামের দই ফেরেস্তা এসে মৃতকে আবার বাঁচিয়ে তোলে এবং তাকে নানা প্রশ্ন করে পরীক্ষা নেয়। উত্তরে খুশি না হলে ওই দুই ফেরেস্তা মৃতের উপর অমানুষিক অত্যাচার চালায়। শেষ অবধি গদার আঘাতে মৃতদেহকে ৭০ গজ মাটির নীচে পুঁতে রাখে। আবার মৃতদেহ তুলে এনে অত্যাচার চালায় এবং সুড়ঙ্গপথে দোজখ বা নরকের আগুন এসে আত্মাকে জ্বালাতে থাকে। পুণ্যবানদের ক্ষেত্রে সুড়ঙ্গপথে আসতে থাকে বেহেস্তের বাতাস।
এরপর কিছু প্রশ্ন স্বভাবতই মাথায় নড়া-চড়া করে—ফেরেস্তা দু’জন মৃতদের প্রশ্ন করেন কোন ভাষায়? ফেরেস্তাদের নিজস্ব ভাষায়, না মৃত মানুষটির মাতৃভাষায়? ফেরেস্তি ভাষায় কথা বললে মৃতরা বোঝে কী করে, উত্তরই বা দেয় কী করে? মৃতের মাতৃভাষায় প্রশ্ন করতে গেলে ফেরেস্তাদের মৃতের ভাষা জনতে হবে। পৃথিবীতে প্রায় ৩৫০০ ভাষা প্রচলিত। ফেরেস্তারা এত ভাষা জানেন? গোর আজাব ভোগের সময়সীমা মৃতকে কবরস্থ করা থেকে কেয়ামত পর্যন্ত। কিন্তু কেউ যদি বাঘের পেটে যায়, কিম্বা যায় জলে ডুবে, অথবা কোনও প্রাকৃতিক বিপর্যয় বা অন্য কোনও ধর্মীয় রীতি বা কারণের জন্য মৃতদেহকে কবর দেওয়া না গেলে, গোর আজাব হবে কী করে? কেয়ামতের পর আল্লাহ তাদের বিচার করবেন কী করে?
ধরা যাক, একজন পাপীকে কবর দেবার পর সে পাঁচ লক্ষ বছর পর্যন্ত গোর আজাবের বর্বরোচিত শাস্তি ভোগের পর কেয়ামত হল, আর এক পাপী ব্যক্তির কবর দেবার এক মিনিটের মধ্যে কেয়ামত হল। লোকটি পাপী হওয়া সত্বেও গোর আজাব ভোগ করার সময়ই পেল না। ফেরেস্তা দু’জনের প্রশ্নোত্তর পালা শেষ হওয়ার আগেই এসে গেল কেয়ামত। এই ক্ষেত্রে দু’জনেই পাপী। হওয়া সত্ত্বেও সমান বিচার পেল কি? না, আদৌ না। একজন পেল পাঁচ লক্ষ বছরের জন্য গোর আজবে পাপের শাস্তি, আর একজন পাপ করেও গোর আজাবের শাস্তি পেল না। আল্লাহের এ কেমন সমান বিচার পদ্ধতি? এর পরও আল্লাহের বিচার ক্ষমতাকে ‘শ্রেষ্ঠ’ বলে চিহ্নিত করি কী করে? এত ভুল, এত পক্ষপাতিত্ব, এত আজগুবি সমবিচারের প্রহসনের পরও আল্লাহকে নির্ভুল, পক্ষপাতশূনা এক শ্রেষ্ঠ বিচারক বলা যায় কি?