অধ্যায়: এক
ঈশ্বর বিশ্বাস: কিছু বেয়াড়া আটপৌরে প্রশ্ন
করণ: এক
মাতৃস্নেহ, বন্ধু-প্রেমের মতই ঈশ্বর-প্রেমও কি একান্ত অনুভবের ব্যাপার?
বেশ কয়েক বছর আগে এক হেমামালিনী-প্রেমে পাগল যুবক আমাকে একান্তে ফিস্ফিস্ করে জানিয়েছিলেন, প্রেম হল অনুভবের বিষয়, অন্তর দিয়ে গভীর অনুভবের বিষয়। আমি আর হেমা দু’জনে যে দু’জনকে ভালবাসি, ভালবাসা কি চোখে দেখার, না ছুঁয়ে অনুভব করার? এই যে আমি এই মুহূর্তে আপনাকে আমাদের দুজনের প্রেমের কথা বললাম, অমনি হেমা কথাগুলো অনুভব করতে – পারল। আর পেরেই আমাকে লক্ষ্য করে শূন্যে চুমু ছুঁড়ে দিল। আপনি দেখতে পেলেন? না, ছুঁতে পেলেন? কিন্তু আমি পেলাম, অনুভবে পেলাম। মায়ের স্নেহ, বন্ধুর ভালবাসা হাত দিয়ে ছোঁয়া যায় না, দেখা যায় না। তবু তার বাস্তব অস্তিত্ব আছে। আমার-হেমার প্রেম সম্বন্ধেও এই একই কথা প্রযোজ্য।
যুবকটিকে স্বাভাবিক ও সুস্থ চিন্তায় ফিরিয়ে আনতে মানসিক চিকিৎসার প্রয়োজন হয়েছিল। সঙ্গে ওকে বসিয়ে বেশ কয়েকটা সিটিং-এ বোঝাতে হয়েছিল—মায়ের স্নেহের বহিঃপ্রকাশ প্রতিটি দিনই নানাভাবে উৎসারিত হতেই থাকে। এই বহিঃপ্রকাশ কখনও পরিপাটি করে সাজিয়ে দেওয়া খাবারের থালায়, কখনও বা অসুস্থ কপালে রাখা হতে। বন্ধুর ভালবাসা কখনও আপনার অসুস্থ বাবার জন্য হাসপাতালের বারান্দায় সতর্কতার সঙ্গে রাত জাগে, আক্রমণ থেকে আপনাকে বাঁচাতে মাথা ফাটিয়ে আসে। হেমার ভালবাসা একটি বার, শুধু একটি বারের জন্যেও কি এভাবে বাস্তব রূপ নিয়ে বেরিয়ে এসেছে? একটি বারের জন্যেও এমনটি না ঘটে থাকলে একে বলতেই হবে ‘কল্পনা’। এই ‘কল্পনা’কে গভীরভাবে বিশ্বাস করাকে মনোবিজ্ঞানের ভাষায় বললে বলতে হয় ‘মানসিক রোগ।’
যুবকটির নাম আজও মনে আছে। গৌরীশঙ্কর। ‘ঝিন্দের বন্দী’ উপন্যাসের নায়কের নামে নাম। তাই মনে আছে। পদবী কী ছিল, মনে নেই।
তারপর, অনেক দিন পর ২৮ ডিসেম্বর ‘৯৪ আনন্দবাজার পত্রিকায় জনৈক গৌরীশঙ্করের চিঠি পড়ে কিছুটা শঙ্কিত হলাম। পত্র-লেখক গৌরীশঙ্কর চট্টোপাধ্যায়। ওই গৌরীশঙ্করের পদবী কী ছিল? চট্টোপাধ্যায়? হতেও পারে, নাও হতে পারে। দু’জনের বক্তব্যের কী আশ্চর্য রকম মিল।
গৌরীশঙ্কর চট্টোপাধ্যায় লিখছেন—মাতৃস্নেহ বা বন্ধুপ্রেমকে হাত দিয়ে ছোঁয়া বা চোখে দেখা যায় না। কিন্তু তার অস্তিত্ব কে অস্বীকার করবে? ঈশ্বর বিশ্বাস সম্বন্ধেও এই কথা প্রযোজ্য। এ হল অন্তরের সামগ্রী। অনুভবের ধন।
দুজনের বক্তব্যে কী আশ্চর্য রকমের মিল! পার্থক্য শুধু কল্পনায় একজন হেমাকে বসিয়েছেন, একজন ঈশ্বরকে। আগের গৌরীশঙ্কর হেমা মাতোয়ারা হওয়ায় তাঁর আপনজনেরা পাগল ভেবে মনোচিকিৎসকের সাহায্য নিয়েছিলেন এবং তাঁকে সুস্থ করে তুলেছিলেন। কিন্তু এই গৌরীশঙ্কর হেমার জায়গায় ঈশ্বরকে বসানোয় তাঁর আপনজনেরা পাগল না ভেবে পরম ঈশ্বরভক্ত ভেবে সন্তোষ লাভ করবেন। আমাদের এই সমাজে কত পাগল অবতার বলে পৃজিত হয়ে আসছে। এই তো আমাদের ঐতিহ্য, এই তো আমাদের সংস্কৃতি! গৌরীশঙ্কর চট্টোপাধ্যায়ের কী হবে? আমি শঙ্কিত।
আমাদের এই সমাজে কত পাগল অবতার বলে পূজিত হয়ে আসছে। এই তো আমাদের ঐতিহ্য, এই তো আমাদের সংস্কৃতি।
কারণ: দুই
বায়ু দেখেননি, পিতামহকে দেখেননি, সম্রাট অশোককেও দেখেননি, তা সত্ত্বেও সবই তো মানছেন। অথচ ঈশ্বকে দেখেননি বলে মানছেন না-একি যুক্তিবাদীর লক্ষণ?
ঈশ্বর বিশ্বাসীদের তরফ থেকে একটি প্রশ্ন প্রায়শই বর্ষিত হয়, “আপনি কি বায়ু দেখেছেন? বিদ্যুৎ দেবছেন? সম্রাট অশোককে দেখেছেন? দেখেছেন আপনার প্রপিতামহকে? গিয়েছেন লণ্ডনে? এত কিছু না দেখেও যদি আপনি এদের অস্তিত্ব পরম পরিতোষের সঙ্গে মেনে নিতে পারেন, তবে ঈশ্বর মানতে অসুবিধে কোথায়?”
যাঁরা এইজাতীয় প্রশ্ন করেন, তাঁরা সম্ভবত শুধুমাত্র প্রত্যক্ষ প্রমাণ মানতে আগ্রহী থাকেন। আজ থেকে হাজার হাজার বছর আগের বহু মানুষই শুধুমাত্র ‘প্রত্যক্ষ প্রমাণ’ নয়, ‘পূর্ব প্রত্যক্ষ’ অর্থাৎ প্রত্যক্ষের ওপর নির্ভর করা জ্ঞান বা অনুমানকে মর্যাদা দিতেন। যেমন ধোঁয়া দেখলে আগুনের অনুমান, গর্ভ দেখে অতীত মৈথুনের অনুমান ইত্যাদি। আজও যুক্তি এবং বিজ্ঞান পূর্ব প্রত্যক্ষ বা প্রত্যক্ষের ওপর নির্ভর পরোক্ষ প্রমাণকে পরিপূর্ণভাবে মর্যাদা দিয়ে থাকে। আমরা বায়ু চোখে না দেখতে পেলেও বায়ুর স্পর্শ অনুভব করতে পারি। ফাঁকা বেলুনকে বায়ু পূর্ণ করে বেলুনের বাড়তি ওজন দ্বারা বায়ুর অস্তিত্ব প্রমাণ করতে পারি। বায়ুকে কাজে লাগিয়ে উইন্ড মিল চলছে, পতাকা উড়ছে, বায়ু রাসায়নিক বিক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে। বিদ্যুৎ তামার তারে দৃশ্যমান না হলেও আলোয়, পাখায়, ফ্রিজে, টেপরেকর্ডারে, নানা যন্ত্রপাতিতে তার অস্তিত্বকে সোচ্চারেই ঘোষণা করে। সম্রাট অশোকের কথা প্রামাণ্য ঐতিহাসিক দলিলে পাই বলেই মানি। প্রপিতামহের অস্তিত্ব ছাড়া আমার অস্তিত্ব তাত্ত্বিকভাবেই অসম্ভব। তাই আমার অস্তিত্বই আমার প্রপিতামহের অস্তিত্বের প্রমাণ। পত্র-পত্রিকা ও দূরদর্শন যেমন লণ্ডনের অস্তিত্ব প্রমাণ করে, তেমনই অর্থ ব্যয় করতে পারলে, সরকারি নিয়ম-কানুন মেনে ডাং-ড্যাং করেই লণ্ডনে ঘুরে আসা সম্ভব। অতএব প্রমাণহীনভাবে এ-সবের অস্তিত্ব মেনে নেবার অভিযোগ কখনই আমাতে বর্তাতে পারে না। কারুর উপরেই বর্তাতে পারে না।
কারণ: তিন
ঈশ্বর আজও প্রমাণিত নন বলে কোনও দিনই হবেন না, এমন গ্যারাণ্টি আপনাকে কে দিল?
বছর দু’য়েক আগে শারদোৎসবের প্রাক্কালের এক সন্ধ্যায় পশ্চিমবঙ্গের এক প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী তাঁর প্রজ্ঞা শুনিয়েছিলেন, “মানছি, ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করা যায়নি। কিন্তু একথাও আপনাকে মানতে হবে ‘ঈশ্বর নেই’ এটাও কেউ প্রমাণ করতে পারেনি। এমন তো অতীতে বহুবারই ঘটেছে—অতীতে যা প্রমাণিত সত্য ছিল না, বর্তমানে তা প্রমাণিত সত্য বলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সুতরাং ঈশ্বরের অস্তিত্বকে এই মুহূর্তে অস্বীকার করলেও ভবিষ্যতে যে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণিত হবে না—এমন গ্যারাণ্টি দেওয়া কি কোনও যুক্তিবাদীর পক্ষে উপযুক্ত কাজ?”
প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী প্রাজ্ঞ-দার্শনিক এবং বিশিষ্ট অধ্যাত্মবাদী হিসেবে পরিচিত। পেশায় অধ্যাপক-এই বিশিষ্ট ব্যক্তিটি যুক্তিকে গলার জোরে চাপা দেওয়ার চেষ্টা করবেন না ভরসায় বিনয়ের সঙ্গে জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি কি ভূত-পেত্নী-শাকচুন্নি-ব্রহ্মদত্তিতে বিশ্বাস করেন?”
প্রাজ্ঞ দার্শনিক আমার প্রশ্নটি চাপা দেওয়ার চেষ্টা না করে আঙুলের টোকায় কাঁধ থেকে পোকা ঝাড়ার মতই ঝেড়ে ফেললেন, “ওসব কুসংস্কারে বিশ্বাস করব, ভাবলেন কী করে?”
আমি আবার বৈষ্ণব বিনয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি কি বিশ্বাস করেন-ঘোড়ার ডিম, ট্যাশ গরু, হাঁসজারু, হাতিমি, বকচ্ছপ, রামগরুড়ের ছানা, পক্ষীরাজ ঘোড়া, এসবের বাস্তব অস্তিত্ব আছে?”
আমার প্রশ্ন শুনে রাজনীতি করা পণ্ডিত ব্যক্তিটির মুখ মেঘলা হলো। জানি না, সেটা প্রশ্নের গতি-প্রকৃতি দেখে পরবর্তী চাল অনুমান করে শঙ্কা থেকে কি না।
নীরবতা ভঙ্গ করতে হলো আমাকেই, “আপনাকে মানতেই হবে ভূত থেকে পক্ষীরাজ ঘোড়া ইত্যাদির অস্তিত্ব নেই এ’কথা বিজ্ঞান প্রমাণ করতে পারেনি, এমন কি, কেউই প্রমাণ করতে পারেনি। ভবিষ্যতে এসবের অস্তিত্ব প্রমাণিত হতেও তো পারে। অতএব কোন যুক্তিতে আপনি এসবের অস্তিত্বকে অস্বীকার করছেন? আপনি যে যুক্তির সাহায্যে ঈশ্বরের অস্তিত্বকে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন, সে ধরনের যুক্তির সাহায্যে যে কোনও কিছুর অস্তিত্বই প্রমাণ করা সম্ভব, তাই নয় কি?”
প্রাজ্ঞ দার্শনিক উত্তর দেননি।
কারণ: চার
প্রমাণ করতে পারেন, ঈশ্বর নেই?
প্রায়শই দুটি আপাত চোখা প্রশ্নর মুখোমুখি হতে হয়, “আপনি কি প্রমাণ করতে পারবেন ঈশ্বর নেই? জ্যোতিষশাস্ত্র ভাঁওতা?”
হ্যা, ঠিক এই দুটি প্রশ্নেরই মুখোমুখি হয়েছিলাম ২৩ জানুয়ারি ‘৯০ নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগর টাউন হলের মাঠে। ‘জ্যোতিষ বনাম বিজ্ঞান’ শিরোনামের এক বিতর্ক সভায় কিছু জ্যোতিষী ও তন্ত্রসিদ্ধ জোতিঘীদের সঙ্গে আমিও বক্তব্য রাখার জন্য আমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছি। আর সেখানেই এক যোগীতান্ত্রিক-জ্যোতিষী আমাকে লক্ষ্য করে বিস্ফোরক প্রশ্ন দুটি ছুঁড়ে দিলেন। প্রশ্ন দুটি শ্রোতাদের যে যথেষ্টই নাড়া দিয়েছিল, সেটুকু বুঝতে কোনও অসুবিধে হয়নি।
অতি বিনীতভাবে হাত জোড় করে বললাম, “আপনি যদি মনে করে থাকেন আমি খুব জানি, বুঝি, প্রমাণ-ট্রমাণ করতে বেজায় পটু, তাহলে কিন্তু ভুল করবেন। সত্যি বলতে কি আমি নিজেই কি ছাই সব ঘটনার কার্য-কারণ সম্পর্ক বুঝি নাকি! আমার জীবনেই একটা ঘটনা মাঝে-মাঝেই ঘটে, যার ব্যাখ্যা আমার জানা নেই। জানি না, সত্যিই ব্যাপারটা লৌকিক? না অলৌকিক? আমি দেখেছি জোড়া পায়ে তিন বার লাফালে অনেক সময়ই আমার উচ্চতা তিন ইঞ্চি বেড়ে যায়। ব্যাপারটা মোটেই গাল-গপ্পো নয়। আপনাদের সামনেই ঘটিয়ে দেখাচ্ছি।”
মঞ্চের পাশেই একটি স্তম্ভ, সম্ভবত কোনও কিছুর স্মৃতিতে তৈরি। যোগীতান্ত্রিক-জ্যোতিষীকে ডেকে নিয়ে সিঁড়ি বেড়ে দু’জনেই উঠে গেলাম স্তম্ভের বেদিমূলে। আমার অনুরোধে যোগীতান্ত্রিক আমার উচ্চতা চিহ্নিত করে স্তম্ভে দাগ দিলেন। জনতা অধীর আগ্রহ আর উত্তেজনা নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন। আমি জোড়া পায়ে তিনবার লাফালাম। যোগীবাবাকে বললাম, “এবার মাপলেই দেখতে পাবেন তিন ইঞ্চি বেড়ে গেছি।”
কিছু দর্শকের কথা কানে আসছিল, “ওই তো বেড়ে গেছেন”, “বেড়েছেন, এখান থেকেই বোঝা যাচ্ছে” ইত্যাদি ইত্যাদি।
যোগীবাবা আমার উচ্চতা মাপলেন। মাপতে গিয়ে বোধহয় কিছু গণ্ডগোলে পড়লেন। আবার মাপলেন। আবারও। তারপর অবাক গলায় বললেন, “আপনার উচ্চতা তো একটুও বাড়েনি!”
আমি কম অবাক হলাম না, “সে কী! আমি বাড়িনি? ঠিক মেপেছেন তো?”
“হ্যা, ঠিকই মেপেছি। যে কেউ এসে দেখতে পারেন।”
বললাম, “না না, আপনাকে অবিশ্বাস করছি না। যাই হোক, আজ আমি আপনাদের অবাক করতে পারলাম না। যে কোনও কারণে ব্যর্থ হয়েছি। কিন্তু আজ ব্যর্থ হওয়ার মানে এই নয় যে, আমি পারি না। আমি পারি। আমি তিন লাফে তিন ইঞ্চি বাড়ি। আবার কিছুক্ষণের মধ্যেই স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসি। কেন এমনটা হয়? যুক্তিতে এর ব্যাখ্যা পাইনি। এই রহস্যের কারণ আপনারা কেউ বলতে পারবেন?
আমার কথায় দর্শকদের মধ্যে গুঞ্জন শোনা গেল। অনেকেই বোধহয় আমার কথায় বিশ্বাস রাখতে পারলেন না। প্রথম জোরালো প্রতিবাদ জানালেন যোগীবাবাই, “আপনি যে বাড়েন, সে কথাই প্রমাণ করতে পারলেন না। সুতরাং বাড়ার ব্যাখ্যা দেওয়ার প্রসঙ্গ আসছে কোথা থেকে?”
আমাকে সবার সামনে এভাবে মিথ্যেবাদী প্রমাণ করার চেষ্টায় ব্যথিত হলাম। বললাম, “ভাই, আজ লাফিয়েও লম্বা হতে ব্যর্থ হয়েছি। কিন্তু বিশ্বাস করুন, ‘আমি সত্যিই লাফিয়ে এমনটা ঘটাতে পারি। অনেক বার ঘটিয়েছি। এখন নিশ্চয় আপনি ও দর্শকরা সবাই আমার কথায় বিশ্বাস স্থাপন করতে পারছেন?”
আমার এমন আন্তরিক কথাকে বিন্দুমাত্র পাত্তা না দিয়ে যোগীবাবা বললেন, “সরি, আমি অন্তত আপনার কথায় বিশ্বাস করতে পারছি না। এবং আশা করি কোনও যুক্তিবাদী মানুষই আপনার দাবিকে শুধুমাত্র আপনার মুখের কথার উপর নির্ভর করে মেনে নেবেন না।”
এবার আমার রাগ হওয়ারই কথা। একটু চড়া গলাতেই বলে ফেললাম, “অর্থাৎ আমাকে অবিশ্বাস করছেন। কিন্তু আমার এই ব্যর্থতার দ্বারা আদৌ প্রমাণ হয় না, আমি মিথ্যেবাদী। আপনি প্রমাণ করতে পারবেন—আমি মাঝে-মধ্যে তিন লাফে তিন ইঞ্চি লম্বা হই না?”
যোগীবাবা এবার আর নিজেকে সংযত রাখতে পারলেন না। চড়া গলায় বললেন, “আমার প্রমাণ করার কথা আসছে কোথা থেকে? আপনি ভালো করেই জানেন, এমনটা প্রমাণ করা আমার কেন, কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। দাবি করেছেন আপনি। প্রমাণের দায়িত্ব আপনার। দাবির যথার্থতা প্রমাণের দায়িত্ব দাবিদারের।”
হেসে ফেললাম। বললাম, “সত্যিই সুন্দর যুক্তি দিয়েছেন। এই যুক্তিটা আপনার মুখ থেকে বের করতেই লাফিয়ে বাড়ার গল্পটি কেঁদেছিলাম। আমার কোনও দিনই লাফিয়ে বাড়ার ক্ষমতা ছিল না। থাকা সম্ভবও নয়। কিন্তু তা সত্বেও এমন উদ্ভট দাবি করে যদি বলি—আপনারা প্রমাণ করতে পারেন, আমি কোনও দিনই তিন লাফে তিন ইঞ্চি বাড়িনি? আপনারা প্রমাণ করতে পারবেন। বাস্তবিকই দাবির সমর্থনে প্রমাণ করার দায়িত্ব দাবিদারের। ঈশ্বরের অস্তিত্ব ও জ্যোতিষশাস্ত্রের অভ্রান্ততা প্রমাণের দায়িত্ব আস্তিকের এবং জ্যোতিষে বিশ্বাসীদেরই। যুক্তি ও বিজ্ঞানে বিশ্বাসীরা সেই দাবির বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলে নিঃসন্দেহ হওয়ার পরই তা গ্রহণ করবে, এটাই তো সঙ্গত।”
O
দাবির সমর্থনে প্রমাণ করার দায়িত্ব দাবিদারের। ঈশ্বরের অস্তিত্ব ও জ্যোতিষশাস্ত্রের অভ্রান্ততা প্রমাণের দায়িত্ব আন্তিকের এবং জ্যোতিষে বিশ্বাসীদেরই। যুক্তি ও বিজ্ঞানে বিশ্বাসীরা সেই দাবির বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলে নিঃসন্দেহ হওয়ার পরই তা গ্রহণ কবে, এটাই তো সঙ্গত।”
O
উপস্থিত শ্রোতারা তুমুল হাসি ও হাততালিতে বুঝিয়ে দিলেন, আমার যুক্তি তাঁদের খুবই মনের মতো ও উপভোগ্য হয়েছে। এরপর বাড়তি মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।
কারণ: পাঁচ
সাংঘাতিক দুর্ঘটনায় বহু মৃত্যুর মাঝে হঠাৎ হঠাৎ এক-আধনের বেঁচে যাওয়ায় পরেও কি বিশ্বাস করব না-‘রাখে হরি মারে কে?’
ঈশ্বর-নির্দেশিত মানুষের ভাগ্যের পক্ষে জোরালো প্রমাণ হিসেবে অনেকেই ছুঁড়ে দেন একটি প্রশ্ন। প্রশ্নটি ঈশ্বর ও ভাগ্যে বিশ্বাসী বহু বুদ্ধিজীবীদের কাছেই যে জোরালো হাতিয়ার, তার প্রমাণ বার বার পেয়েছি। প্রশ্নটা এই ধরনেরঃ
এই যে প্লেন আক্সিডেণ্ট হচ্ছে, লঞ্চডুবি হচ্ছে, নৌকোডুবি হচ্ছে, ট্রেন আক্সিডেণ্ট ঘটছে, ঘটছে আরও নানা ধরনের বড়-সড় আকারের দুর্ঘটনা, তাতে বহু মানুষ মারা যাচ্ছে, বহু মানুষ সাংঘাতিকভাবে আহত হচ্ছে, আবার তারই মধ্যে দেখতে পাচ্ছি, কেউ কেউ অদ্ভুত ভাবে বেঁচে যাচ্ছে। এমনটা ঘটার পিছনে কোনও ব্যাখ্যা থাকতে পারে কি? যুক্তিতে এর ব্যাখ্যা মেলে না বলেই একে আমরা ‘ঈশ্বর শক্তির অপর লীলা’ নামে অভিহিত করতে পারি। অথবা চিহ্নিত করতে পারি ‘ভাগ্য’ বলে, যা অবশ্যই ঈশ্বর দ্বারাই নির্ধারিত।
এই যে বেশ কিছু লক্ষ মানুষদের মধ্যে একজন লটারিতে ফাস্ট প্রাইজ পাচ্ছে, ঠিক সেই কী করে পাচ্ছে? এটা কি পরম-করুণাময় ঈশ্বরের লীলা নয়? এটা কি ঈশ্বরের নির্ধারিত করে দেওয়া ভাগ্য নয়? যদি তেমনটা না-ই হয়, তবে যুক্তিতে এর ব্যাখ্যা কী দেবেন?
এমন দুর্ঘটনা থেকে রেহাই পাওয়া বা লটারি জেতা ‘ঈশ্বরের কৃপা’ বা ‘ঈশ্বর নির্ধারিত ভাগ্য’ যে আদৌ নয়, এবং এ জাতীয় ঘটনার ব্যাখ্যা পেতে যে আদৌ কোনও জটিল যুক্তির প্রয়োজন হয় না-তাই নিয়ে এ’বার আলোচনায় ঢুকি আসুন।
যে কোনও দুর্ঘটনার পিছনেই থাকে অবশ্যই কিছু কারণ। দৃষ্টান্ত হিসেবে আমরা যদি বিমান দুর্ঘটনাকে আলোচনার জন্য বেছে নিই, তাহলে দুর্ঘটনার সম্ভাব্য কারণ কী কী হতে পারে—আসুন দেখি। বিমান তৈরির কারিগরিগত ত্রুটি বা ওই মডেলের বিমান চালানর বিষয়ে চালকের প্রশিক্ষণগত ত্রুটি, কিংবা বিমান ওড়ার আগে প্রয়োজনীয় পরীক্ষায় গাফিলতি, অথবা অন্তর্ঘাত, কিংবা দুর্যোগ ইত্যাদি এক বা একাধিক কারণ দুর্ঘটনার জন্য দায়ী হতেই পারে। দুর্ঘটনা হলে সকলেই মারা যাবে, এমনটা সবক্ষেত্রেই ঘটবে; ভাবার মত কোনও কারণ নেই। এক্ষেত্রে দুর্ঘটনার ব্যাপকতার অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। বিস্ফোরিত বিমান আকাশে টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়লে একটি যাত্রীকেও বাঁচাবার ক্ষমতা কোনও ধর্মের ঈশ্বরের পক্ষেই সম্ভব হবে না। দুর্ঘটনায় বিমানের কোনও অংশ-বিশেষের ক্ষতি হলে সেই অংশের যাত্রীদের ক্ষতিগ্রস্ত হবার, এমন কি মৃত্যুর সম্ভাবনাও বাড়বে। বিমানের কোনও অংশ কম ক্ষতিগ্রস্ত হলে বা অক্ষত থাকলে, ওই অঞ্চলে যাত্রীদের ক্ষতিগ্রস্ত হবার সম্ভাবনাও কম থাকবে। এরই পাশাপাশি দুর্ঘটনার মুহূর্তে যাত্রীর কোমরের বেল্ট বাঁধা ছিল কি না, যাত্রীর থেকে বাইরে বেরবার দরজা কতটা দূরে ছিল, যাত্রী সেই সময় কীভাবে অবস্থান করছিল, যাত্রীর মানসিক ও হার্টের অবস্থা এবং আরও বহুতর কারণই যাত্রীর মৃত্যু হওয়া এবং না হওয়ার ক্ষেত্রে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে থাকে। এবং এগুলো নেহাতই ঘটনা বই বাড়তি কিছু নয়।
লঞ্চ বা নৌকোডুবি হচ্ছে। মানুষ মরছে। লঞ্চ বা নৌকোডুবির ক্ষেত্রে ঝড় বা জলোচ্ছ্বাস যেমন অনেক সময়ই কারণ, তেমনই বেশিরভাগ সময়ই কারণ হয়ে দাঁড়ায় ক্ষমতার বেশি যাত্রী-বহন (অন্তত আমাদের দেশের ক্ষেত্রে)। প্রশাসনের গাফিলতি, অপ্রতুল পরিবহন ব্যবস্থার জন্যই যাত্রীরা প্রচণ্ড ঝুঁকি নিয়েই নৌকোয় উঠতে বাধ্য হন। অনেক সময়ই বহন ক্ষমতার দেড়-দুগুণ যাত্রী ওইসব লঞ্চ ও নৌকোয় তোলা হয়। ফলে দুর্ঘটনাও ঘটে। কেউ বাঁচেন। অনেকেই মারা যান। এই বাঁচা-মরার ক্ষেত্রেও যাত্রীর সাঁতার জানা না জানা, এবং ডোবার সময় যাত্রীর অবস্থান, ডোবার সময় কাছাকাছি অন্য নৌকো ও লঞ্চের হাজির থাকা না থাকাও অবশ্যই একটা প্রয়োজনীয় বিবেচ্য বিষয়। কিন্তু এই পরিবহনের সমস্যা মেটাবার ব্যবস্থা যদি প্রশাসন করে, তবে প্রতিটি ক্ষেত্রেই বেশি যান্ত্রীবহনের জন্য নৌকো বা লঞ্চডুবিতে মারা যাওয়া বা বেঁচে যাওয়া মানুষগুলোর ‘ঈশ্বর নির্ধারিত ভাগ্য’ পাল্টে যেতে বাধ্য। তখন কোনও ধর্মের কোনও ঈশ্বরেরই সাধ্য হবে না ‘ডুবিজনিত’ বাঁচা-মরা নিয়ন্ত্রণ করা—কারণ নৌকোই তো তখন ডুববে না।
ঝড় বা জলোচ্ছাসজনিত দুর্ঘটনা এড়াতে প্রশাসন যদি আবহাওয়া বিষয়ে সঠিক তথ্য সংগ্রহে সচেতন হয় এবং সময়মত নৌকো ও লঞ্চগুলোকে বিপদ সংকেত দেয়, তবে আবহাওয়াজনিত দুর্ঘটনা এড়ানো যায়।
এবার আসুন আমরা লটারিতে ঢুকি। লটারি, তা সে পাড়ার ক্লাবের লটারিই হোক, আর কোটি কোটি টাকা বাজেটের লটারিই হোক, তাতে একটা নম্বর প্রথম পুরস্কার দেওয়ার জন্য তোলা হবেই। বহুর মধ্যে থেকে কয়েকটি নম্বর তুলে এইসব নম্বরের টিকিট মালিকদের পুরস্কৃত করার ওপরেই লটারি ব্যবসা দাঁড়িয়ে রয়েছে। প্রথম পুরস্কার এমনই একটি তোলা নম্বর। এই তোলা টিকিটের একজন ক্রেতা থাকবেই। তাকেই দেওয়া হবে প্রথম পুরস্কারটি। এটি একটি পদ্ধতির মাধ্যমে বেরিয়ে আসা ঘটনা মাত্র। অর্থাৎ, মোদ্দা কথায়, স্রেফ একটি ঘটনা মাত্র, এর বেশি কিছুই নয়। যত বেশি বেশি করে নতুন নতুন লটারি ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে, যত বেশি বেশি করে লটারি মাসের সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে পাক্ষিক, সাপ্তাহিক বা দৈনিক হবে, ততই বেশি বেশি করে মানুষ এই সব লটারির পুরস্কারও পেতে থাকবে। অর্থাৎ ঈশ্বর-লীলায় বিশ্বাসীদের ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয়-ততই বেশি বেশি করে মানুষ এমন লটারি বিজেতার ‘ভাগ্য’ অর্জন করবে।
লটারি, সাট্টা, ঘোড়দৌড় ইত্যাদি যতদিন থাকবে, ততদিন ‘ঈশ্বরের কৃপাধন্য বিজেতা’ও থাকবেই। আইনের খোঁচায় লটারি-সাট্টা-ঘোড়দৌড় ইত্যাদি জুয়া বন্ধ হয়ে গেলেই ঈশ্বরের কৃপা বিলোবার ক্ষমতাও তামাদি হয়ে যাবে। মানুষের আইনের কাছে ঈশ্বরের ক্ষমতা কত অকিঞ্চিৎকর, একবার ভাবুন তো!
O
লটারি, সাট্টা, ঘোড়দৌড় ইত্যাদি যতদিন থাকবে, ততদিন ঈশ্বরের কৃপাধন্য বিজেতাও থাকবেই। আইনের খোঁচায় লটারি-সাট্টা-ঘোড়দৌড় ইত্যাদি জুয়া বন্ধ হয়ে গেলেই ঈশ্বরের কৃপা বিলোবার ক্ষমতাও তামাদি হয়ে যাবে। মানুষের আইনের কাছে ঈশ্বরের ক্ষমতা কত অকিঞ্চিৎকর, একবার ভাবুন তো!
O
সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের ক্ষমতা মানুষের ক্ষমতার কাছে কত তুচ্ছ, একবার ভাবুন তো!
কারণ: ছয়
বাবাকে তো বিনা প্রমাণেই ‘জন্মদাতা’ বলে বিশ্বাস করেন, তাহলে ঈশ্বরের বেলায় খালি ‘প্রমাণ চাই’ ‘প্রমাণ চাই’ বলে চেঁচান কেন?
বছর কয়েক আগের ঘটনা। কলকাতা পুস্তক মেলায় আমাদের সঙ্গে তুমুল বিতর্ক বাধিয়ে তুলেছিলেন এক আর্চ-বিশপ। বিতর্কের বিষয়-ঈশ্বর বিশ্বাস। তুমুল বিতর্ক, যুক্তি ও পাল্টা যুক্তির লড়াই দেখতে ভিড়ও তুমুল। আর্চ-বিশপের যুক্তিগুলো ছিল প্রাথমিকভাবে খুবই আকর্ষণীয়। এবং জনচিত্তে প্রভাব সৃষ্টিকারী। আর্চ-বিশপের বক্তব্য তুলায় দিলাম।
আমরা কজন নিজের প্রপিতামহকে দেখেছি? প্রায় কেউই দেখিনি। তবু আমরা প্রপিতামহের নাম তো বলি। তাঁকে না দেখলেও তিনি ছিলেন, এই বিশ্বাসেই বলি।
আমাদের বাবার নাম জিজ্ঞেস করলে, আমরা মায়ের স্বামীর নামই উল্লেখ করি। তিনি যে বাস্তবিকই আমাদের জন্মদাতা বাবা, তার প্রমাণ কী? এখানেও তো আমরা আমাদের বিশ্বাসকেই আঁকড়ে ধরি।
আমরা সম্রাট আকবরকে দেখিনি, গৌতম বুদ্ধকে দেখিনি। তবু বিশ্বাসকরি ওঁরা ছিলেন। কোনও প্রত্যক্ষ বা চাক্ষুস প্রমাণ ছাড়াই শুধুমাত্র বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে যখন এমনি হাজারো কিছুর অস্তিত্বকে আমরা মেনে নিতে পারছি, তখন ঈশ্বরের অস্তিত্বকে মেনে নেবার বেলায় কোন যুক্তিতে আমরা বিশ্বাসের উপর নির্ভরতার বিরোধিতা করব? ‘প্রমাণ ছাড়া মানছি না, মানব না’ বলে হাঁক পাড়ব?
যুক্তিগুলো আপাত ভাবে জোরালো মনে হলেও, বাস্তবিকপক্ষে এগুলো কোনও যুক্তিই নয়। কেন নয়? এই প্রশ্নের আলোচনায় এবার ঢুকি আসুন।
প্রাচীন যুগ থেকেই পণ্ডিত মহল প্রত্যক্ষ প্রমাণকে শ্রেষ্ঠ বললেও প্রত্যক্ষ-অনুগামী পুর্ব-প্রত্যক্ষ প্রমাণকে অবশ্যই স্বীকার করেছেন। ‘চরক সংহিতা’য় প্রত্যক্ষ-অনুগামী তিন ধরনের অনুমানের কথা বলা হয়েছে। (১) বর্তমান ধূম দেখে বর্তমান অগ্নির অনুমান। (২) বর্তমান গর্ভবতী মহিলা দেখে তার অতীত মৈথুনের অনুমান। (৩) বর্তমান সুপুষ্ট বীজ দেখে ভবিষ্যৎ বৃক্ষ ও ফলের অনুমান।
এখানে আমরা দেখতে পাচ্ছি, আগের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করেই বিভিন্ন অনুমানের কথা বলা হয়েছে। অনুমানগুলো বর্তমান দেখে বর্তমান, বর্তমান দেখে অতীত এবং বর্তমান দেখে ভবিষ্যৎ বিষয়ে।
এই একই নিয়মে এখনও আমরা পূর্ব অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলিয়ে বর্তমান, অতীত ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বিভিন্ন বিষয়ে অনুমান ও সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারি। আমার বর্তমান অস্তিত্ব থেকেই অনুমান করতে পারি, আমার প্রপিতামহের অস্তিত্ব অবশ্যই ছিল। প্রপিতামহের অস্তিত্ব ছাড়া আমার অস্তিত্বই সম্ভব নয়।
একই ভাবে, আমার জন্মদাতা কোনও পুরুষের অস্তিত্ব ছাড়া আমার বর্তমান অস্তিত্ব অসম্ভব। আমার জন্মদাতা পূরুষটি তাত্ত্বিকভাবে মায়ের বিবাহিত জীবনসঙ্গী হতেও পারেন, নাও পারেন। প্রত্যেকটি মানুষের ক্ষেত্রেই এই সম্ভাবনা অবশ্যই আছে। সমাজের প্রচলিত রীতি অনুসারে আমরা সাধারণভাবে মায়ের বিবাহিত জীবন সঙ্গীকেই ‘বাবা’ বলে থাকি। এটা রীতির প্রশ্ন, প্রমাণের প্রশ্ন নয়|
বুদ্ধের মূর্তি, শিলালিপি, সম্রাট আকবরের বিভিন্ন দলিলের বর্তমান অস্তিত্বের ওপর নির্ভর করেই আমরা তাঁদের অতীত অস্তিত্ব অনুমান করতে পারি। কিন্তু এ জাতীয় কোনও প্রমাণই আমাদের সামনে ঈশ্বর বিশ্বাসীরা হাজির করতে পারেননি, বা আমাদেরও নজরে আসেনি, যার দ্বারা আমরা অনুমান করতে পারি বা সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারি—ঈশ্বর আছেন।
O
বুদ্ধের মূর্তি, শিলালিপি, সম্রাট আকবরের বিভিন্ন দলিলের বর্তমান অস্তিত্বের ওপর নির্ভর করেই আমরা তাঁদের অতীত অস্তিত্ব অনুমান করতে পারি। কিন্তু এ’জাতীয় কোনও প্রমাণই আমাদের সামনে ঈশ্বরবিশ্বাসীরা হাজির করতে পারেননি, বা আমাদের নজরে আসেনি, যার দ্বারা আমরা অনুমান করতে পারি বা সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারি—ঈশ্বর আছেন।
O
কারণ: সাত
অন্তত এটা তো মানবেন, যে—“বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর।”
বাংলাদেশের বিখ্যাত ধর্মীয় নেতা হুজুর সাইদাবাদী আমাকে ‘লাখ কথার এক কথা’ শুনিয়েছিলেন, “আল্লাহর অনুভব হয় বিশ্বাসে, যুক্তিতে নয়। পূর্বে লোকের আল্লাহে বিশ্বাস ছিল। তাদের অভাবও ছিল না। কোনও অতিথি বাড়িতে আইলে আনন্দ পাইত। খাওয়াইয়া আনন্দ পাইত। এখন অতিথি দ্যাখলে লোকের মুখ ভারি হয়। আজকাল মানুষের আল্লাহে বিশ্বাস নাই বইল্যাই অভাব ঘোচে না। আল্লাহে বিশ্বাস নাই বইল্যাই ক্ষ্যাতে আর সাবেক ফসল ফলে না, পুকুর-খাল-বিলে সাবেক মাছ পড়ে না। আল্লাহে বিশ্বাস নাই বইল্যাই খোদার গজবে প্রত্যেক বছর মহামারি। হজরত সোলেমান নবী সিংহাসনে বইস্যা পারিষদ সহ শূন্যে ভ্রমণ করতেন কিসের জোরে? এই আল্লাহে বিশ্বাসের জোরেই।”
জাতির জনক বলে চিহ্নিত গান্ধীজিও মনে করতেন বিহারের ভূমিকম্পে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু ও সম্পত্তিহানির একমাত্র কারণ স্থানীয় মানুষের ‘পাপ’, ‘ঈশ্বরে অবিশ্বাস।’
আমাকে আমার এক মাস্টারমশাই ‘সত্যি-ঘটনা’র শিলমোহর দেগে একটা ঘটনা শুনিয়েছিলেন। মাস্টারমশাইদের বাড়ি ছিল ওপার বাংলায়, পদ্মাপাড়ে। বাবার ছিল ভোরে বেড়াবার অভ্যেস। এক ঊষালগ্নে নদীর পাড় ধরে হাঁটছেন, হঠাৎ দেখেন, নদীর উপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে আসছেন এক সাধু। সাধু এপারে আসতেই বাবা আছড়ে পড়লেন তাঁর পায়ে। এমন একটা অলৌকিক ঘটনা দেখার পর এমনটা ঘটাই স্বাভাবিক। বাবা সাধুকে নিয়ে এলেন নিজের বাড়িতে। সাধুবাবা জানালেন, তিন রাতের বেশি কোনও জায়গায় তিনি থাকেন না। বাবা ও বাড়ির সকলেই সাধুর খুব সেবা-যত্ন করলেন। তিন দিনের মাথায় সাধুর কাছে বাবা জানতে চাইলেন জলে হাঁটার রহস্য। সাধু অমনি এক টুকরো কাগজে খসখস করে কী সব লিখে বাবার জামার বুক পকেটে গুঁজে দিয়ে বললেন, নে চল, যে মন্ত্র লিখে দিলাম, সেই মন্ত্রের জোরেই তুই হেঁটে কেমন সুন্দর নদী পার হয়ে যেতে পারবি, দেখবি চল।
বাবা পদ্মার জলে পা রাখলেন। যতই এগোন, পায়ের পাতা ডোবে না। বাবা যখন মাঝ নদীতে, তখন দেখা মিলল কয়েকটা নৌকোর। নৌকোর মাঝিরা অবাক। এক মাঝি জিজ্ঞেস করল, “ঠাকুর, এমন ক্ষমতা পাইলা কেমনে?”
অমনি বাবার মাথায় চিন্তা চম্কাল—সত্যিই তো, কী এমন মন্ত্র লেখা আছে কাগজের টুকরোয়, যার শক্তিকে জলে হাঁটছি? বাবা পকেট থেকে কাগজের টুকরোটা বের করলেন। ভাঁজ খুললেন। ও হরি, এতে যে কিছুই মন্ত্র-টন্ত্র লেখা নেই। লেখা আছে—‘রাম রাম রাম’। মাত্র তিনবার ‘রাম’ লিখে পকেটে রাখলে হেঁটে নদী পার হওয়া যায়!! বাবার বিশ্বাস হল না। ভয় পেলেন। ‘রাম’ নামে পদ্মা পারা-পার হওয়ার প্রচেষ্টা তাঁর কাছে মুহূর্তে অসম্ভব বলে মনে হল। আর অমনি বাবা ডুবে গেলেন। নেহাত সাঁতার জানতেন, আর পাশেই নৌকো ছিল বলে বেঁচে গেলেন।
এই গল্পটা (মাস্টারমশাইয়ের কথা মত ‘সত্যি’ ঘটনা) বলে মাস্টারমশাই যে নীতি উপদেশ দিয়েছিলেন, সেটা হল—“বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহু দূর’’।
প্রবীণ সাংবাদিক এবং ভাগ্যফল, আত্মার অবিনশ্বরতা ও ঈশ্বরের অস্তিত্বে অন্ধ বিশ্বাসী প্রণবেশ চক্রবর্তী মশাই যুক্তিহীন বিশ্বাসের পক্ষে জোরালো যুক্তি খাড়া করে বলেছেন, (সম্পাদকীয় প্রবন্ধ, যুগান্তর, ৩ মার্চ ১৯৯৪) “জীবনের সব কিছুই কি যুক্তিতর্কের উপর দাঁড়িয়ে আছে, জীবনের সকল সমস্যার সমাধানই কি যুক্তিতর্কের মাধ্যমে করা সম্ভব? কথায় বলে ‘বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহু দূর’…আমরা যখন ট্রেনে উঠি—তখন কি আমাদের রেল ইঞ্জিনের উপর নির্ভরতা, ড্রাইভারের উপর ভরসা স্থাপন ইত্যাদি যাবতীয় ব্যাপারগুলি নিছকই বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে থাকে না?”
সালটা ৯৫। দোলের আগের রাতে আমরা কয়েক বন্ধুতে যুক্তিবাদী সমিতির পক্ষ থেকে যাচ্ছিলাম কল্যাণীর ‘ঘোষপাড়া’য়। উদ্দেশ্য—সতী মেলা নিয়ে একটা তথ্যচিত্র ভোলা। সতী মেলার কল্যাণে ট্রেনে বুকের পাঁজরা-ভাঙা ভিড়। সহযাত্রী এক বাউলকে জিজ্ঞেস করলাম, “গান গাওয়ার আনন্দে সতী মেলায় যাচ্ছেন, না সতী মা’র থানের অলৌকিক মাহাত্ম্যে বিশ্বাসের টানে যাচ্ছেন?”
“বিশ্বাস যে কী জিনিস, যে করে সে জানে। আপনাকে একটা ঘটনা শোনাই। আমাদের গ্রামে থাকত হানিফ। খেতে জন খাটত। ধান খেতের ধেড়ে ইঁদুর ধরে রান্না করে খাওয়ার রেওয়াজ আছে আমাদের গ্রামে। হানিফ এমনি একটা ধেড়ে ইঁদুর ধরতে গিয়ে ইঁদুরের গর্তে হাত ঢুকিয়ে ইঁদুর পাওয়ার বদলে পেল ইঁদুরের কামড়। তার দিন কয়েক পর ইঁদুরটাকে ধরবে বলে ওই গর্তটা শাবল মেরে ভাঙতেই গর্ত থেকে বেরিয়ে এল একটা কেউটে। হানিফের বুঝতে বাকি রইল না, সেদিন ওকে কেউটেই কেটেছিল। এতদিন ইঁদুরে কাটার বিশ্বাসই ওকে বাঁচিয়ে রেখেছিল। কেউটে দর্শনে সে বিশ্বাস ভেঙে যেতেই হানিফের সারা শরীর কালীবর্ণ। মুখ থেকে গ্যাঁজলা। হানিফকে বাঁচানো গেল না। সাপের কামড়কে ইঁদুরের কামড় বলে গভীর বিশ্বাস করলে বিষক্রিয়াও থেমে যায়।”
এ জাতীয় গল্প আমার মত, আপনাদেরও অনেকেরই শোনার অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই আছে। এ’সব গল্পে সারবত্তা না থাকলেও বহু মানুষকে আবেগে আপ্লুত করার ক্ষমতা যথেষ্টই। অথচ দেখুন, অতি সাধারণ ও স্বাভাবিকভাবে উঠে আসা যুক্তির আঘাতেই এই সব গল্পের পাহাড় রেণু বেণু হয়ে যায়।
যে কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম, সেখানে এবার আমরা ফিরে যাব। সেখানে হুজুর সাঈদাবাদীর বক্তব্যের উত্তরে আমি সে কথাই বলেছিলাম, যা আপনিও বলতেন। বলেছিলাম, “এপার বাংলায় বা ওপার বাংলায় বিঘে প্রতি যে পরিমাণ ফসল হয়, তার বহুগুণ বেশি ফসল হয় ইউরোপের প্রতিটি দেশে, আমেরিকায়, অস্ট্রেলিয়ায়, এমন কি এই মহাদেশের জাপানেও। ওরা কেউই আল্লাহের অস্তিত্বেই বিশ্বাস করে না। তবু আল্লায় বিশ্বাসী দু’বাংলার মুসলিম চাষীদের চেয়ে বেশি ফসল ফলায়। এমন কি মজা হল এই যে, ইউরোপে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মে বিশ্বাসহীন ব্যক্তিরা সংখ্যাগুরু হওয়া সত্ত্বেও ওসব দেশে বিপুল সংখ্যক আস্তিক অধু্যষিত দু’বাংলার চেয়ে ফসল উৎপাদন অনেক বেশি এবং মহামারির সংখ্যাও অনেক কম। এর কারণ, বিজ্ঞানকে ওসব দেশ কৃষিকাজে ও শারীরবিজ্ঞানে বেশি বেশি করে কাজে লাগিয়েছে। উৎপাদনহীনতা, অভাব, শোষণ, রোগ, মহামারি, এর কোনওটির জন্যই ঈশ্বরজাতীয় কোনও কিছুতে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের সামান্যতম ভূমিকা নেই।
“হুজুর সাহেব, আপনি মক্কায় গিয়েছেন?”
—“হ্যা।” হুজুর সাহেবের তৎপর উত্তর।
—“কিসে গিয়েছিলেন? জাহাজে না প্লেনে?”
—“প্লেনে।”
—“কেন, প্লেনে যেতে গেলেন কেন? আপনি আল্লাহর প্রিয় ভক্ত। আপনি আল্লাহে পরম বিশ্বাসী, কেন এই বিশ্বাস রাখলেন না, আপনি চাইলে চোখের নিমেষে আল্লাহ আপনাকে মক্কায় পৌঁছে দেবেন? বেশ তো, সেই সময় যদি অমন সোজা কথাটা মনে নাই পড়ে থাকে, এর বাংলাদেশে ফেরার সময় আল্লাহর কাছে আবেদন রাখুন না, সপারিষদ আপনাকে চোখের নিমেষে ঢাকায় পোঁছে দেবার। এতে বিশ্বাসের ক্ষমতার পরীক্ষা নেবার পাশাপাশি প্লেনের ভাড়া ও সময় দুই-ই বাঁচবে।”
তার পরও কিন্তু হুজুর সাঈদাবাদী প্লেনেই ঢাকা ফিরেছেন। আমি জানি, আল্লাহে বিশ্বাসের ক্ষমতার দৌড় হুজুর সাহেবের ভাল মতই জানা আছে। মুখে যা বলেন, সে কথায় আদৌ বিশ্বাস করেন না। তাঁর ব্যবহারই এ কথা আমাকে বুঝিয়ে দিল। আমাদের ‘জাতির জনক’-এর বক্তব্যে চিন্তার মূর্খতা এতই বিরাট আকারে ধরা পড়ে সে, এ বিষয়ে আলোচনা একান্তভাবেই অবান্তর।
মাস্টারমশাইয়ের গল্প (ঘটনা না বলে আমরা একে গল্পই বলব) প্রসঙ্গে আমাদের উত্তর এমনটাই বেরিয়ে আসা স্বাভাবিক-তাত্ত্বিকভাবেই কোনও মানুষের পক্ষে কৌশলের সাহায্য ছাড়া জলের উপর দিয়ে এ’ভাবে হাঁটা সম্ভব নয়। আজ পর্যন্ত কেউ প্রকাশ্যে হেঁটেও দেখাননি। এর পরও কেউ যদি এমন হাঁটার দাবি করেন, তবে তাঁকে দাবির পক্ষে প্রমাণও হাজির করতে হবে বই কি। প্রমাণ না দিয়ে যে কেউ যা খুশি উদ্ভট দাবি করলেই যদি মেনে নিতে হয়, তাহলে তো বেজায় মুশকিল। আর মুশকিল সবচেয়ে বেশি মনোরোগ চিকিৎসকদের। তাঁদের কাছে নিত্যই এমন প্রচুর মানুষ হাজির হন, যাঁদের মধ্যে কেউ কেউ দাবি করেন, আমেরিকার প্রেসিডেণ্ট স্যাটেলাইটের মাধ্যমে তাঁর মাথার সমস্ত চিন্তা ধরে নিচ্ছেন, এবং সেই চিন্তাকে কাজে লাগিয়েই আমেরিকা সব দেশের ওপর ছড়ি-ঘোরাচ্ছে। কেউ বা মনে করেন, তিনি যে কোনও পশু-পাখির ভাষা বুঝতে পারেন। কেউ বা ভাবেন প্রতি রাতে তিনি একটা সাপ হয়ে যান। আমি এক উগ্র ধর্মীয় সংগঠনের নেতাকে পেয়েছিলাম, যিনি মনে করতেন বিশ্বব্রহ্মাণ্ড-ঈশ্বর-আল্লা সব তারই সৃষ্টি।
আমার দেওয়া উদাহরণগুলোর কথা শুনে মাস্টারমশাই বলতে পারেন- বাবার ঘটনার বিশ্লেষণ করতে এঁদের টেনে আনার কোনও মানেই হয় না। কারণ, এঁরা পাগল। বাবা কখনই পাগল ছিলেন না।
মাস্টারমশাইয়ের কথাগুলো আমরা যদি সত্যি বলেই ধরে নিই, অর্থাৎ মাস্টারমশাইয়ের বাবা এমনটাই বলেছিলেন, তবে মাস্টারমশাইকে আমাদের একটি রূঢ় সত্যের সামনে দাঁড় করিয়ে দিতে হবে—যাঁরা মিথ্যে কথা বলেন, তাঁরাও কারও না কারও মা-বাবা-ভাই-বোন-মাস্টারমশাই ইত্যাদি, ইত্যাদি। এমনটা হতে পারে, মাস্টারমশাই বাবার কাছ থেকে ঘটনাটা শুনে বিশ্বাস করেছিলেন। মিথ্যেকেই সত্যি বলে বিশ্বাস করেছিলেন। ‘অলৌকিক ঘটনা ঘটা সম্ভব’, এই আজন্মলালিত ধারণা থেকেই বিশ্বাস করেছিলেন। তাত্ত্বিকভাবেই যেহেতু কৌশল ছাড়া জলে হাঁটা সম্ভব নয়, তাই এর বাইরে কোনও সিদ্ধান্তে যাওয়াও আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।
এবার আসুন, সাংবাদিক প্রণবেশ চক্রবর্তীর বক্তব্যের পোস্টমর্টেম-এ বসি আমরা। প্রণবেশবাবুর বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে যে যে উত্তর উঠে আসে: জীবনের সব কিছুই যুক্তিতর্কের উপর দাঁড়িয়ে নেই। তার হাতে-গরম উদাহরণ-প্রণবেশবাবুর এই যুক্তিহীন বক্তবা। অবশ্য এমনও হতে পারে, আমার এই বক্তব্যে গোড়ায় গলদ রয়ে গেছে। প্রণবেশবাবু হয়তো এমন যুক্তিহীন বক্তব্য পেশ করেছেন বিশেষ উদ্দেশ্যে। এবং তাঁর এই বক্তব্য পেশের পিছনে রয়েছে গভীর যুক্তি-বুদ্ধি-ব্যক্তিস্বার্থ-শ্রেণীস্বার্থ।
উদ্দেশ্য স্পষ্ট শোষক শ্রেণীর ভাড়াটে বুদ্ধিজীবী হিসেবে নিজের দায়িত্ব পালন করা।
দায়িত্বটা কী? শোষিত মানুষ যেন যুক্তিবুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে তাদের শোষণের কারণ হিসাবে শোষকদের চিহ্নিত না করে। বিশ্বাসবাদের ধোঁয়াশায় তারা যেন শোষণের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করে ভাগ্য, কর্মফল, ঈশ্বরের ইচ্ছা ইত্যাদিকে।
প্রণবেশবাবু বলেছেন, “জীবনের সকল সমস্যার সমাধানই কি যুক্তিতর্কের মাধ্যমে করা সম্ভব?”
সমস্যাটা কী ধরনের, তার উপর নির্ভর করছে যুক্তিতর্কের মাধ্যমে সমাধান সম্ভব কি না। প্রণবেশবাবুর সমস্যাটা যদি হয় আক্ষরিক অর্থে অমর থাকার, বা পুরুষ হয়ে গর্ভে সন্তান ধারণ করার ক্ষমতা লাভের, অথবা বৃদ্ধকে এক লাফে বালকে পরিণত করার—তবে যুক্তি নিশ্চয়ই সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ হবে। প্রণবেশবাবু, আপনি কি বিশ্বাস করেন এসব সমস্যার সমাধান বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে সম্ভব?
মাননীয় প্রণবেশবাবু, আপনি কি বাস্তবিকই জ্যোতিষীদের বিজ্ঞাপনে ব্যবহৃত কথায় বিশ্বাস করেন? বিশ্বাস করেন হুজুর সাঈদাবাদীর দাবিতে-বিজ্ঞানের সমস্ত জ্ঞান ও ধারণাকে উল্টে দিয়ে গ্রহরত্নের সাহায্যে বা মন্তরে গর্ভ উৎপাদন দ্বারা মাতৃত্বকামীদের সমস্যা সমাধান সম্ভব?
মাননীয় প্রণবেশবাবু, বহু ধর্মীয় রচনা ও গ্রন্থের প্রণেতা আপনি, এবং আপনিই জ্যোতিষীদের পক্ষে সবচেয়ে ধারাল কলমধারী সাংবাদিক। আপনিই পারেন গোলা গোলা কথা হেঁকে বলতে, “অপরের বিরুদ্ধে কুৎসা ও বিষোদগার করাটাই নাকি যুক্তিবাদের পরাকাষ্ঠা!…এদেশের জ্যোতিষ-বিদ্যা খারাপ—অর্থাৎ এদেশের সবই খারাপ। তাহলে ভালোটা কে?” (ধুর মশাই, জ্যোতিষী আর ধর্মগুরু, যারা শোষিত মানুষদে গরু বানাতে চায়, তাদের খারাপ বললে দেশের সব্বাইকে খারাপ বলা হল কী করে!! প্রতারককে ‘প্রতারক’ বললে দেশের লক্ষ-কোটি ভাল মানুষকে গাল-পাড়া হয় কীভাবে? ধর্মীয় মৌলবাদীদের পুরোন কৌশল, তাদের অন্যায়ের বা হামলার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুললে প্রতিরোধ ভাঙতে জনসাধারণের সেণ্টিমেণ্ট সুড়সুড়ি দিয়ে তাদের মধ্যে উন্মাদনা সৃষ্টি করা। মাননীয় প্রণবেশবাবু, একজন প্রকৃত ধর্মীয় মৌলবাদী হিসেবে আপনি সেই কৌশলটিকে কাজে লাগাতেই পরিকল্পিতভাবে জনগণের সেণ্টিমেণ্টকে আমাদের বিরুদ্ধে সমাবেশিত করতে এমন বস্তা পচা কুযুক্তির অবতারণা করছেন।)
প্রণবেশবাবু, সকালে ঘুম থেকে উঠে ব্রাশে পেস্টটা লাগিয়ে যখন দাঁত মাজতে শুরু করেন, তখন কি অন্ধ বিশ্বাসের উপর দাঁত পরিষ্কার হওয়াকে সঁপে দিয়ে বসে থাকেন? না কি পূর্ব অভিজ্ঞতা, পূর্ব-প্রত্যক্ষ জ্ঞান থেকে জানার ফলে আপনি নিশ্চিন্তে থাকেন—ব্রাশে পেস্ট লাগিয়ে দাঁত মাজলে দাঁত পরিষ্কার হবে? আপনার বাড়ির কলিংবেলটা বাজলে আপনি কারও আগমন প্রত্যাশা করে দরজা খুলতে যান না? কেন আগমন প্রত্যাশা করেন? পূর্ব-প্রত্যক্ষ জ্ঞান বা অভিজ্ঞতার সাহায্যেই তো? এ পর্যন্ত ঠিক-ঠাক বলেছি তো প্রণবেশবাবু? এবার আসুন আমরা আপনার ‘ট্রেন’ ও ‘ড্রাইভার’ প্রসঙ্গে আসি। আমরা যারা রেল ইঞ্জিনের আবিস্কার থেকে শুরু করে রেল উন্নতির ইতিহাসের মোটামুটি খবরটুকুও জানি না, তারাও কিন্তু পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, ট্রেনে চাপলে ট্রেন গন্তব্যে পৌঁছে দেয়। আমরা যারা জানি না, একজন যখন ড্রাইভারের পদে নিযুক্ত হন, তখন তাঁকে দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে, প্রয়োজনীয় নানা ট্রেনিং-এর মধ্য দিয়ে ড্রাইভার হিসেবে গড়ে তোলা হয়, তারাও কিন্তু পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকেই জেনেছি ট্রেন চালায় ড্রাইভার। এবং ড্রাইভারই ট্রেন চালিয়ে আমাদের গন্তব্যে পৌঁছে দেয়। সুতরাং ‘ট্রেন’ ও ‘ড্রাইভার’ এই দু’য়ের ক্ষেত্রেই আমাদের পূর্ব অভিজ্ঞতাই প্রত্যয় যোগায়—নির্দিষ্ট ট্রেনে চাপলে নির্দিষ্ট স্টেশনে নামতে পারব। ট্রেনে উঠে গন্তব্যে পৌঁছতে কোনও সুস্থ মানসিকতার মানুষকেই প্রত্যয় বিসর্জন দিয়ে অন্ধ বিশ্বাসের উপর নিজেকে সঁপে দিয়ে বসে থাকতে হয় না। জানি, এরপরও দুর্ঘটনা ঘটে। কিন্তু তাতে আমাদের বক্তব্যই আরও বেশি করে প্রতিষ্ঠিত হয়, কারণ প্রত্যেকটা দুর্ঘটনার পিছনেই কার্য-কারণ সম্পর্ক থাকে। রেল দুর্ঘটনার পিছনে থাকতে পারে ড্রাইভারের কুশলতার অভাব (সমাজের দুনীতির অংশ হিসেবে ড্রাইভারের ট্রেনিং প্রক্রিয়ার মধ্যে ফাঁকি থাকতে পারে, যার নামই ‘কুশলতার অভাব, গার্ডের কুশলতার অভাব, ড্রাইভার বা গার্ডের অন্যমনস্কতা, গাড়ি চালাবার আগে গাড়ি পরীক্ষার ক্ষেত্রে ও রেল লাইন পরীক্ষার ক্ষেত্রে কুশলতার অভাব বা ফাঁকি, নাশকতা, যাত্রীর অসাবধানতা (যাত্রীর বহন করা দাহ্য পদার্থ থেকেও দুর্ঘটনা ঘটে, রেলের ফেরিওয়ালাদের অসাবধানতা (চা-কফি তৈরির জন্য বহন করা জলন্ত চুল্লি থেকেও দুর্ঘটনা ঘটে, টিকিট পরীক্ষক ও রেল পুলিশদের অসাবধানতা (যাঁরা যাত্রী ও ফেরিওয়ালাদের দাহ্য পদার্থ বহন আটকাতে পারেন, কিন্তু আটকান না), সিগনালম্যানের কুশলতার অভাব বা অসাবধানতা, লেভেল ক্রসিং-এর গেটকিপারদের অসাবধানতা ইত্যাদি নানা ধরনের কারণে দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। দুর্ঘটনার সম্ভাবনাকে কমিয়ে আনা যায় যাত্রীদের সচেতনা এবং রেলকর্মীদের কুশলতা বৃদ্ধি ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত আইন-কানুন কঠোরভাবে মেনে চলার মধ্য দিয়েই। ভাগ্যে বা পরমপিতায় বিশ্বাস সমর্পণের উপর কখনই নিরাপত্তা নির্ভরশীল নয়।
আচ্ছা, প্রণবেশবাবু, কলিংবেলের শব্দ শুনে আপনি নিশ্চয়ই কখনও-সখনও দরজার দিকে পা বাড়িয়েছেন। আপনি নিশ্চয় শুনেছেন বা জানেন, শুকনো মাটিতে আছাড় খেয়েও মানুষ মারা যায়। আপনি যখন দরজা খুলতে এগেন, তখন কি নিজের পূর্ব অভিজ্ঞতার উপর ও দু’পায়ের উপর আস্থা রেখেই দরজা খুলতে এগোন? নাকি, আত্মবিশ্বাস জলাঞ্জলি দিয়ে শুকনো মাটিতে আছাড় খেয়ে মরতে পারি ভেবে নিছকই পরম বিশ্বাসের কাছে আত্মসমর্পণ করে এগোন?
বাস্তবিকই যদি এত বেশি বিশ্বাস নির্ভর হয়ে থাকেন, একাত্ত মানবিক কারণেই আপনার কাছে অনুরোধ রাখছি—ভাল মানসিক চিকিৎসকের সাহায্য নিন। যদি ঈশ্বর-বিশ্বাস ও নিয়তি-বিশ্বাসকে প্রতিষ্ঠা করার পরিকল্পনা নিয়ে এমনটা বলে থাকেন এবং প্রত্যয় অন্য রকম হয়ে থাকে, তাহলে বলব, আপনার শ্রম ও আপনার পত্রিকা কোম্পানির একগাদা নিউজপ্রিণ্ট বৃথাই ব্যয়িত হল। কারণ, আপনার ছেঁদো যুক্তির গ্যাস বেলুনটায় এতক্ষণে যে একটা বড়সড় মাপের ছ্যাঁদা হয়ে গেছে, সেটা তো বুঝতেই পারছেন।
এখন আমরা সতী-মেলার সহযাত্রী বাউলের বক্তব্য বিশ্লেষণে কিঞ্চিৎ তৎপর হই আসুন। বাউলের কথা মত, সাপের কামড়কে ইঁদুরের কামড় বলে বিশ্বাস করায় বিষাক্ত সাপের বিষও শরীরে নিষ্কর্মা ছিল।
কিঞ্চিত সাধারণজ্ঞান প্রয়োগেই বোঝা যায় শরীরে বিষক্রিয়া কখনই বিশ্বাস বা অবিশ্বাস নির্ভর নয়। এই সত্যটুকু জানার জন্য বাস্তবিকই শারীর-বিজ্ঞান নিয়ে বিস্তর পড়াশুনার কোনও প্রয়োজন হয় না। সত্যি কথা বলতে কি ‘সামান্য’ পড়াশুনার ও প্রয়োজন হয় না। খাবারে বিষ মিশিয়ে হত্যার ষড়যন্ত্রের ইতিহাস বহু প্রাচীন। বড়যন্ত্রকারীরা বিষ মেশাতে শারীর-বিজ্ঞান পড়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেনি। সুখাদ্য বিশ্বাসে বিষ-খাবার গ্রহণের জন্য বিষ কিন্তু তার ক্রিয়া বন্ধ রাখেনি। এরপর নিশ্চয়ই বাউলের গল্পটা যে নেহাৎই ‘গপ্পো’, এবিষয়ে কোনও সন্দেহের অবকাশ থাকে না।
‘বিশ্বাসে মিলায় বস্তু’র দোহাই দিয়ে ঈশ্বরতত্বে ও অলৌকিকতন্ত্রে বিশ্বাস স্থাপন করা যে নেহাতই বড় মাপের বোকামি, এটা নিশ্চয়ই এতক্ষণের আলোচনায় স্পষ্টতর হয়েছে।
কারণ: আট
‘ঈশ্বর যদি অলীকই হবেন, তাহলে পৃথিবীর সবচয়ে বেশি মানুষ কেন আজও ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাসী?
উপরের এই প্রশ্নটাই ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে নানাভাবে প্রায়ই আমাদের শুনতে হয়। যুক্তিবাদীদের বিপক্ষে ঈশ্বরবাদীদের এই জোরালো সওয়ালের জোরটা নেহাতই সংখ্যাধিক্যের, ঈশ্বর বিশ্বাসীদের সংখ্যাধিক্যের। উত্তরটা পেতে আমাদের ফিরে তাকাতে হবে ইতিহাসের দিকে।
মাত্র শ’পাঁচেক বছর আগের কথা। পোল্যাণ্ডের নিকোলাস কোপারনিকাস পুস্তকাকারে তুলে ধরলেন এক বৈজ্ঞানিক সত্যকে—সূর্যকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে পৃথিবীসহ গ্রহগুলো। তাঁরই উত্তরসূরী হিসেবে এলেন ইতালির জিয়োর্দানো ব্রুনো, গ্যালিলিও গ্যালিলেই। সেদিন পৃথিবীর তামাম বিজ্ঞানী, বুদ্ধিজীবী, দার্শনিক থেকে সাধারণ মানুষ তাঁদের তত্ত্বকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। এমন এক ‘গাঁজাখুরি’, ‘অদ্ভুতুড়ে’ ও ধর্মবিরোধী মত প্রকাশের জন্য সেদিন ব্রুনোকে বন্দী করা হয়েছিল। রাখা হয়েছিল এমন এক কম উচ্চতার ঘরে, যার ছাদ সীসেতে মোড়া। গ্রীষ্মে ঘর হত চুল্লি, শীতে বরফ। এমনি করে দীর্ঘ আট বছর ধরে তাঁর উপর চালানো হয়েছিল বর্বরোচিত ধর্মীয় অত্যাচার। তথাকথিত সত্যের পূজারী, ঈশ্বর প্রেমিক ধর্মযাজকরা শেষবারের মত ব্রুনোকে বাঁচার সূযোগ দিল। নিজের মতকে ভ্রান্ত বলে স্বীকার করে নিয়ে বাঁচার সুযোগ। অসীম সাহসী ব্রুনো সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। বাইবেল বিরোধী অসত্য ভাষণের অপরাধে ব্রুনোকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হল প্রকাশ্যে।
গ্যালিলিও গ্যালিলেইকেও ধর্মান্ধতার বিচারে অর্ধামিক ও অসত্য মতবাদ প্রচারের অপরাধে জীবনের শেষ আটটা বছর বন্দী জীবন কাটাতে হয়েছিল।
কিন্তু এত করেও সর্বশক্তিমান ঈশ্বর, ঈশ্বর-পুত্র, পোপ এবং সংখ্যাগুরু জনমত সূর্যের চারপাশে পৃথিবীর ঘোরা বন্ধ করতে পারেনি।
আনাক্সাগোৱাস বলেছিলেন, চন্দ্রের কোনও আলো নেই। সেই সঙ্গে তিনি ব্যাখ্যা করেছিলেন চন্দ্রের হ্রাস-বৃদ্ধির কারণ ও চন্দ্রগ্রহণের কারণ। সেদিন আনাক্সাগোরাসের তত্বের প্রতিটি সত্যই ছিল ধর্মবিশ্বাসী বিশ্ববাসী সংখ্যাগুরুদের চোখে মিথ্যে। ঈশ্বর বিরোধিতা, ধর্ম বিরোধিতা ও অসত্য প্রচারের অপরাধে দীর্ঘ ও নিষ্ঠুর নির্যাতনের পর তাঁকে দেশ থেকে নির্বাসিত করা হয়। কিন্তু এত করেও সেদিনের সর্বশক্তিমান ঈশ্বর, ঈশ্বর-পুত্র ও জনগণের অজ্ঞানতা নির্বাসনে পাঠাতে পারেনি আনাক্সাগোরাসের জ্ঞানকে, সত্যকে। সেদিনের সংখ্যাগুরু মানুষের দ্বারা সমর্থিত চন্দ্র বিষয়ক ঈশ্বরের অভ্রান্ত বাণীই আজ শিক্ষিত সমাজে নির্বাসিত।
ষোড়শ শতকেও পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি মানুষ বিশ্বাস করত, অসুখের কারণ পাপের ফল বা অশুভ শক্তি। ষোড়শ শতকে সুইজারল্যাণ্ডের বেসেল বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নশাস্ত্র ও ভেষজবিদ্যার অধ্যাপক ডাক্তার ফিলিপ্রাস অ্যাউরেওলাস প্যারাসেলসাস ঘোষণা করলেন- মানুষের অসুস্থতার কারণ কোনও পাপের ফল বা অশুভ শক্তি নয়, রোগের কারণ জীবাণু। পরজীবী এই জীবাণুদের শেষ করতে পারলেই নিরাময় লাভ করা যাবে।
প্যারাসেলসাসের এমন উদ্ভট ও ধর্মবিরোধী তত্ত্ব শুনে তাবৎ ধর্মের ধারক-বাহকরা রে-রে করে উঠলেন। এ কী কথা। রোগের কারণ হিসেবে ধর্ম আমাদের যুগ যুগ ধরে যা বলে এসেছে, তা সবই কি একজন উন্মাদ অধ্যাপকের কথায় মিথ্যে হয়ে যাবে? শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে পবিত্র ধর্মনায়কেরা যা বলে এসেছেন, ধর্মগ্রন্থগুলোতে যা লেখা রয়েছে, যুগ যুগ ধরে কোটি কোটি মানুষ যা বিশ্বাস করে আসছে, সবই মিথ্যে? সত্যি শুধু প্যারাসেলসাসের কথা?
প্যারাসেলসাসকে হাজির করা হল ‘বিচার’ নামক এক প্রহসনের মুখোমুখি। ধর্মান্ধ বিচারকরা রোগের কারণ জীবাণু বলার অপরাধে মৃত্যুদণ্ড দিল। প্যারাসেলসাস সেদিন নিজের জীবন বাঁচাতে নিজের দেশ সুইজারল্যাণ্ড ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। সেদিনের জনসমর্থন পুষ্ট ধমীয় সত্য আজ শুধু সুইজারল্যাণ্ড বাসীদের মন থেকেই নয়, সারা পৃথিবীর শিক্ষার আলো দেখা মানুষদের মন থেকেই নির্বাসিত।
ইতিহাস বার বার আমাদের এই শিক্ষাই দিয়েছে, যুক্তি ও প্রমাণের কাছে সংখ্যাগুরুর মতামতের দাম এক কানাকড়িও নয়। বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিনির্ভর মানুষ সিদ্ধান্তে পৌঁছতে চায় পরীক্ষা-পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে। কোন পক্ষ সংখ্যাগুরু, কোন পক্ষে নামী-দামিদের সমর্থন বেশি, তা দেখে নয়। আর সেটাই যে সঠিক পথ, তারই প্রমাণ, বহু ক্ষেত্রেই সংখ্যাগুরুদের, বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বদের মতামতও বাতিল হয়েছে আবর্জনার মতই। তেমনটি না হলে আজও আমাদের মেনে নিতে হত—পৃথিবীর চারপাশে সূর্য ঘোরে; গ্রহণের কারণ রাহুর গ্রাস; চন্দ্রের হ্রাস-বৃদ্ধির কারণ—অভিশাপে চন্দ্রের ক্ষয় রোগ ও বর লাভে ক্ষয় রোগ থেকে উত্তরণের রাস্তা জানার পর ক্ষয় রোগ ও পুষ্টিলাভের ঘটনা নিরন্তর ঘটেই চলেছে; রোগের কারণ রোগীর পাপ অথবা অশুভ শক্তি।
সংখ্যাতত্ত্বের নিরিখে ‘সত্য’ নির্ধারিত হলে আজও পৃথিবীর চারিদিকে সূর্য ঘুরত, আজও যে কত শত সহস্র অন্ধ বিশ্বাসকে মেনে নিতে হত, তার ইয়ত্তা নেই। সুদীর্ঘ কাল ধরে বহু অন্ধ বিশ্বাস, বহু বিজ্ঞানী, বুদ্ধিজীবী ও সংখ্যাগুরু জনগণের সমর্থন পেয়েও বাঁচতে পারেনি। কারণ অনিবার্য রূপে যুক্তির কাছে অন্ধবিশ্বাসের পরাজয় ঘটেছে, ঘটছে এবং ঘটবে। ঈশ্বর-বিশ্বাসের ক্ষেত্রেও অপেক্ষা করে আছে একই অনিবার্য পরিণতি। ঈশ্বর-বিশ্বাসীরা যুক্তির অনিবার্য জয়কে বিলম্বিত করতে পারে মাত্র। অন্ধবিশ্বাসীরা যুক্তির জয়যাত্রার গতি স্তব্ধ করতে পারেনি, পারবেও না।
O
সংখ্যাতত্ত্বের নিরিখে ‘সত্য’ নির্ধারিত হয়ে আজও পৃথিবীর চারিদিকে সূর্য ঘুরত, আজও যে কত শত সহস্র অন্ধ বিশ্বাসকে মেনে নিতে হত, তার ইয়ত্তা নেই। ঈশ্বর-বিশ্বাসের ক্ষেত্রেও অপেক্ষা করে আছে একই অনিবার্য পরিণতি। ঈশ্বর-বিশ্বাসীরা যুক্তির অনিবার্য জয়কে বিলম্বিত করতে পারে মাত্র। অন্ধ-বিশ্বাসীরা যুক্তির জয়যাত্রার গতি স্তব্ধ করতে পারেনি, পারবেও না।
Oকারণ: নয়
ঈশ্বর যদি প্রত্যেকের মনের কথা সরাসরি জানতেই পারেন, তাহলে কেন অষ্টপ্রহর ঢাক-ঢোল সহযোগে ‘দাও-দাও’ সংকীর্তন?
ঈশ্বর বিশ্বাসীদের বৃহত্তর অংশই মনে করেন—ঈশ্বর অন্তর্যামী। তিনি প্রতিটি মানুষের মনের কথাই জানেন। অতএব প্রতিটি ভক্তের মনের হদিশ যে তাঁর অজানা নয়—এটা স্পষ্ট। কিন্তু যেটা অস্পষ্ট ধোঁয়াশা, তা হল, তারপরও কেন ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা। এমন কি মসজিদে মাইক লাগিয়ে, পুজো প্যাণ্ডেলে মাইক লাগিয়ে প্রার্থনা! এ’সবই কি অপ্রয়োজনীয় ও মূলাহীন নয়?
যদি সোচ্চার প্রার্থনার প্রয়োজনকে মেনে নিতে হয়, তবে বলতেই হয়—ঈশ্বর অন্তর্যামী নন।
O
যদি সোচ্চার প্রার্থনার প্রয়োজনকে মেনে নিতে হয়, তবে বলতেই হয় ঈশ্বর অন্তর্যামী নন।
O
কারণ: দশ
শুনলাম, ঈশ্বর-বিশ্বাস কাল্পনিক হলেও, মিথ্যে হলেও, বিশ্বাসটা নাকি ভাল?
এক ধরনের বুদ্ধিজীবী ও বিজ্ঞানীদের আজকাল প্রায়ই দেখা পাওয়া যায়, যাঁরা মনে করেন ঈশ্বরের বাস্তব অস্তিত্ব নাও থাকতে পারে। হতে পারে, গোটা ব্যাপারটাই কাল্পনিক। তবু এই ঈশ্বর বিশ্বাসের একটা ভাল দিকও আছে। ঈশ্বর বিশ্বাস মানুষের আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধিতে টনিকের কাজ করে। এই সমস্ত বুদ্ধিজীবী ও বিজ্ঞানীদের এমনতর উদারনীতি বিষয়ে আমার যা বলার তা বলতে বরং শোনাই নোবেল পুরস্কার বিজয়ী বিজ্ঞানী স্টিফেন ভাইনবার্গ-এর সম্প্রতি করা দারুণ মজার মন্তব্য। স্টিফেন-এর কথায়—আমার মনে হয় ধর্মীয় উদারনীতিবাদীদের চেয়ে মৌলবাদীরা বরং বিজ্ঞানীদের বেশি কাছের লোক। হাজার হোক, বিজ্ঞানীদের মতই মৌলবাদীরা অন্তত এইটুকু বিশ্বাস করেন যে, তাঁদের বিশ্বাসটা সত্যি। কিন্তু ধর্মীয় উদারনীতিবাদীরা বলেন যে, তাঁদের বিশ্বাসটা মিথ্যে হতে পারে, কিন্তু তাঁদের বিশ্বাসটা ভাল।
এমন কুযুক্তির হাত ধরে ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাসের অপর নাম ‘সুবিধাবাদ’ বা ঐ জাতীয় অন্য কিছু হতে পারে, কিন্তু কোনও ভাবেই ঈশ্বরের প্রতি অন্তরের গভীর বিশ্বাস হতে পারে না।
এ জাতীয় মন্তব্য যাঁরা করেন, তাঁরা নিজেরা ঈশ্বর বিশ্বাস না করলেও অনো ভুল ধারণা নিয়ে, বোকা-বোকা ধারণা নিয়ে বেঁচে থাকুক, এমনটা চান। কেন চান? ওইসব অজ্ঞতা না ভাঙিয়ে বিজ্ঞের এক নতুন শ্রেণী সৃষ্টির চেষ্টায় কি?
ঈশ্বরজাতীয় কল্পনার শুরু তো মাত্র আঙুল গোনা কয়েক হাজার বছর আগে। তার আগে মনুষ্য প্রজাতি পৃথিবীতে টিকে থাকার সংগ্রাম চালিয়ে ছিল কার উপর ভরসা করে?
O
ঈশ্বরজাতীয় কল্পনার শুরু তো মাত্র আল গোনা কয়েক হাজার বছর আগে। তার আগে মনুষ্য প্রজাতি পৃথিবীতে টিকে থাকার সংগ্রাম চালিয়ে ছিল কার উপর ভরসা করে?
O
নিশ্চয়ই নিজের উপরই ভরসা করে।
কারণ: এগারো
এইসব নিরীশ্বরবাদ-টা আর কদ্দিন? রক্তের জোর ফুরোলেই তো খেল খতম?
আমার এক অধ্যাপক বন্ধু প্রাক্তন নকশাল নেতা, অধুনা তিনি লেখায় ও কথায় মার্কসবাদের সঙ্গে অধ্যাত্মবাদের মেলবন্ধনে সচেষ্ট। ফি বছর সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় বিদেশ যান। বিবেকানন্দের চোখে তিনি এখন দেখতে পান ভারত-আত্মাকে। রামকৃষ্ণের ভিতরে বিজ্ঞানেরও বিজ্ঞানকে। এক সন্ধায় কলেজ স্ট্রিটের কফি হাউসে কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে আমাকে বললেন, “রক্তের জোর থাকলে সবকিছুকেই নাকচ করার ঔদ্ধত্য আসে। রক্তের জোর কমলেই ঔদ্ধত্যের জায়গায় আসে স্থিতি। নেতির জায়গায় ইতি। আর তখন সেই ইতির বোধ থেকেই আত্মা, পরমাত্ম ঈশ্বর ইত্যাদির অস্তিত্ব ভাস্বর হয়ে ওঠ।”
এই একই সুরের কথা বহু সাধারণ মানুষের কষ্ট থেকেও উঠে আসে, এখন রক্তের জোর বেশি, তাই ঈশ্বর মানেন না! রক্তের জোর কমলেই দেখতে পাবেন! কত নাস্তিক বুড়ো বয়সে আস্তিক হয়েছেন।”
হাতেই পারে। এমন ঘটনা বার বার ঘটতে পারে, কিন্তু তাতে ঈশ্বরের অস্তিত্ব তো আদৌ প্রমাণিত হল না। বরং এ কথাই প্রমাণিত হল—বার্ধক্যের দুর্বলতার বন্ধু পথে, মৃত্যু ভয়ের পথে প্রবেশ করে ঈশ্বরজাতীয় কল্পনা।
আবার এর বিপরীত ঘটনাও বারবার ঘটতে দেখেছি, বরং বলা ভাল-দেখেই চলেছি। শান্তিদা, দুই জ্যোতিদা, উমাদা, রাসবিহারীদা, কামাক্ষাদা, নৃপেনদা, বেলাদি, সুনেত্রাদি, কাঞ্চনদির মত বহু আস্তিক, পরম ঈশ্বর-বিশ্বাসী, আত্মার অনিত্যতায় বিশ্বাসী জীবনের সায়াহ্নে এসে নিরীশ্বরবাদী হয়েছেন। এরা কেউই খামখেয়ালীপনা করে নিরীশ্বরবাদী সাজেননি। অনেক জিজ্ঞাসার উত্তর খুঁজে, অনেক ভেবে, বুঝে তবেই নিরীশ্বরবাদী হয়েছেন। শান্তিদা’র মত মানুষ পরিবেশগতভাবেই রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের পরম ভক্ত ছিলেন যৌবনের সীমানা পেরুবার আগে পর্যন্ত। বইমেলায় আমাদের বই হাতে পড়েছে। নেড়ে-চেড়ে কিনেছেন। পড়েছেন, চিন্তা নাড়া খেয়েছে। নতুন করে ধর্মের বইয়ে মনোনিবেশ করেছেন। প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই করেছেন। যতই গভীরে গেছেন, ততই তাঁর চোখে ধরা পড়েছে ফাঁক আর ফাঁকিগুলো। উৎসাহিত শান্তিদা জীবনের শেষ লগ্নে পড়েছেন বিজ্ঞান-দর্শন-রাজনীতি। তারপর উল্লিখিত প্রতিটি মানুষের মতই শেষ পর্যন্ত বেছে নিয়েছেন যুক্তিবাদ ও মানবতাবাদের পথ।
বরং একথা আমরা জোরের সঙ্গেই বলতে পারি—এইসব ঈশ্বরাদীর জোর আর কদ্দিন? চেতনায় যুক্তির ছোঁয়া পোঁছলেই তো খেল খতম।
O
একথা আমরা জোরের সঙ্গেই বলতে পারি—এইসব ঈশ্বরবাদীর জোর আর কদ্দিন? চেতনায় যুক্তির ছোঁয়া পৌঁছলেই তো খেল খতম।
O
কারণ: বারো
এতো ভাল দুশ্চিন্তায় পড়া গেল! সব কিছু নিয়ন্তা ঈশ্বর কেন যুক্তিবাদীদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না?
ঈশ্বর, আল্লাহ সব কিছুর নিয়ন্তা। সর্বশক্তিমান। তাঁর ইচ্ছে ছাড়া গাছের পাতাটি নড়ে না, মানুষের নিঃশ্বাস পড়ে না। তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছিলেন তাঁরই ভজনার জন্য। তাঁরই গুণ-কীর্তনের জন্য। তাহলে সমস্ত মানুষকে দিয়ে তাঁর গুণ-কীর্তন করাতে পারছেন না কেন? যুক্তিনিষ্ঠ মানুষগুলো ঈশ্বর, আল্লাহের গুণ-কীর্তন করা তো দূরের কথা, বরং অস্তিত্ব নিয়েই টানা-হ্যাঁচড়া শুরু করেছে। ঈশ্বর এইসব যুক্তিবাদী মানুষদের কেন নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না? কেন ওইসব বে-আক্বেলেদের মুখ থেকে ঈশ্বর-আল্লাহের ভজনা বের করতে পারছেন না? তবে কি যুক্তিবাদীদের নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা তাঁদের নেই? যুক্তিবাদীদের কাছে ঈশ্বরজাতীয়দের সব জারিজুরিই কি তবে নেহাতই ফক্কা?