৩. তুঙ্গ অবস্থা

৩. তুঙ্গ অবস্থা

এক নয়া ব্যবস্থা (৯৩৫-১২৫৮)

দশম শতাব্দী নাগাদ এটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে অখণ্ড রাজনৈতিক একক হিসাবে ইসলামী বিশ্ব আর কার্যকরভাবে ক্রিয়াশীল থাকতে পারবে না। খলিফাহ্ উম্মাহর নামমাত্র প্রধান হিসাবে ছিলেন এবং প্রতীকী ধর্মীয় কর্মকাণ্ড বজায় রেখেছেন, কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যের বিভিন্ন এলাকা স্বাধীনভাবে পরিচালিত হয়েছে। মিশর থেকে ইসমায়েলি ফাতেমীয়দের’ বিচ্ছিন্ন খেলাফত উত্তর আফ্রিকা, সিরিয়া, আরবের সিংহভাগ অঞ্চল এবং প্যালেস্টাইন শাসন করেছে; ইরাক, ইরান এবং মধ্য এশিয়ায় তুর্কি সেনা অফিসারগণ (আমির) ক্ষমতা দখল করে প্রকৃতপক্ষে স্বাধীন রাজ্যসমূহের প্রতিষ্ঠা করেন, যেগুলোর পরস্পরের সঙ্গে সামরিকভাবে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত ছিল। দশম শতাব্দীকে শিয়া-শতক হিসাবে অভিহিত করা হয়, কারণ এসব রাজবংশের অনেকগুলোরই শিয়াদের প্রতি প্রচ্ছন্ন ঝোঁক ছিল। কিন্তু আমিরদের সকলেই আব্বাসীয় খলিফাঁকে উম্মাহর সর্বাধিনায়ক হিসাবে স্বীকার করা অব্যাহত রাখেন, একচ্ছত্র রাজতন্ত্রের আদর্শ এমনই সুরক্ষিত ছিল। এসব রাজবংশ কিছু মাত্রায় রাজনৈতিক সাফল্য অর্জন করেছিল। একটা এমনকি একাদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে উত্তর-পশ্চিম ভারতে স্থায়ী মুসলিম ঘাঁটি স্থাপনেও সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু ১০৫৫-তে নিম্ন সির (Syr) বেসিন হতে আগত সেলজুক তুর্করা বাগদাদে ক্ষমতা দখল করে খলিফার সঙ্গে বিশেষ চুক্তিতে উপনীত হওয়ার আগ পর্যন্ত কেউই দীর্ঘদিন টিকে থাকতে পারেনি। খলিফাহ্ তাদের সমগ্র দার আল-ইসলামে তাঁর সহকারী হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। সেলজুকদের বিজয় অর্জনের পূর্ববর্তী বছরগুলোয় এমন ধারণা সৃষ্টি হয়েছিল যেন সাম্রাজ্য চিরদিনের জন্য ছিন্নভিন্ন হতে চলেছে। একটি রাজবংশ যেভাবে অপরটির স্থান দখল করছিল আর যেভাবে বদলে যাচ্ছিল সীমান্ত, একজন বহিরাগত পর্যবেক্ষকের এমন ধারণা করা অযৌক্তিক হত না যে, এক স্বল্পস্থায়ী প্রাথমিক সাফল্যের পর ইসলামী বিশ্ব পতনোন্মুখ হয়ে পড়েছে।

কিন্তু এমন ধারণা হত ভুল। প্রকৃতপক্ষে, প্রায় দুর্ঘটাক্রমেই এক নতুন ব্যবস্থার আবির্ভাব ঘটছিল যা মুসলিম চেতনার অনেক কাছাকাছি হয়ে উঠেছিল। রাজনৈতিক অস্থিরতা সত্ত্বেও ইসলামী ধর্ম ক্রমেই শক্তিশালী হয়ে উঠছিল। প্রত্যেক অঞ্চলের আলাদা রাজধানী ছিল বলে কেবল বাগদাদে একটিমাত্র সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের পরিবর্তে একাধিক কেন্দ্র গড়ে ওঠে। ফাতিমীয়দের অধীনে কায়রো শিল্পকলা ও জ্ঞানার্জনের এক গুরুত্বপূর্ণ নগরীতে পরিণত হয়। এখানে দর্শন বিকাশ লাভ করে এবং দশম শতাব্দীতে খলিফাগণ আল-আযহার মহাবিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা করেন, যা একসময় পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়। সমরকন্দেও পারসিয়ান সাহিত্য রেনেসাঁ সংগঠিত হয়। এ পর্যায়ের একজন উজ্জ্বল নক্ষত্র হলেন ফায়লাসুফ আবু আলী ইবন সিনা (৯৮০-১০৩৭), পাশ্চাত্যে যিনি আভিসেনা নামে খ্যাত। ইবন সিনা ছিলেন আল-ফারাবির অনুসারী, কিন্তু ধর্মকে অনেক বেশী গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছিলেন তিনি। তাঁর চোখে একজন পয়গম্বর হলেন আদর্শ দার্শনিক, সাধারণ জনগণের কাছে বিমূর্ত যৌক্তিক সত্যের বাহকমাত্র নন, কেননা তাঁর এমন অন্তর্দৃষ্টির কাছে পৌঁছার ক্ষমতা ছিল যা এলোমেলো সামঞ্জস্যহীন চিন্তা-ভাবনার ওপর নির্ভরশীল নয়। ইবন সিনা সুফিবাদে আগ্রহী ছিলেন এবং স্বীকার করতেন যে অতীন্দ্রিয়বাদীরা অলৌকিকের এমন এক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে যৌক্তিক প্রক্রিয়ায় যা সম্ভব নয়, তবে ফায়লাসুফদের ধারণার সঙ্গে যার সামঞ্জস্য রয়েছে। সুতরাং, ফায়লাসুফ ও অতীন্দ্রিয়বাদীদের বিশ্বাস আর প্রচলিত মতে ধার্মিকদের মাঝে ঐক্যতান রয়েছে।

যদিও ১০১০-এ স্পেনে উমাঈয়াহ্ খেলাফত শেষ পর্যন্ত ভেঙে গিয়ে বেশ কিছু সংখ্যক প্রতিদ্বন্দ্বী স্বাধীন রাজদরবার সৃষ্টি হয়েছিল, তথাপি কর্ডোভাও এক সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণ প্রত্যক্ষ করে। স্প্যানিশ রেনেসাঁ বিশেষভাবে এর কাব্যসাহিত্যে জন্যে বেশী খ্যাতি লাভ করে যা ফরাসি ট্রোবাডোর কোর্টলি ঐতিহ্যের অনুরূপ। মুসলিম কবি ইবন হাযাম (৯৯৪-১০৬৪) অপেক্ষাকৃত সরল ধার্মিকতার উদ্ভাবন করেন, যা কেবল আহাদিসের ওর নির্ভরশীল এবং জটিল ফিক্হ্, ম্যাটাফিজিক্যাল দর্শন পরিত্যাগ করেছিল। এসব সত্ত্বেও স্পেনের শেষ পর্যায়ের তারকা বুদ্ধিজীবীদের অন্যতম ছিলেন ফায়লাসুফ আবু আল-ওয়ালিদ আহমাদ ইবন রূশদ (১১২৬-৯৮), যিনি মুসলিম বিশ্বে সুফিবাদের প্রতি অনুরক্ত ইবন সিনার তুলনায় কম গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন বটে, কিন্তু তাঁর যুক্তিনির্ভর ধ্যান-ধারণা মায়মোনাইডস (Maimonides), টমাস অ্যাকুইনাস (Thomas Aquinas) এবং (Albert the Great) অ্যালবার্ট দ্য গ্রেটের মত ইহুদি ও ক্রিশ্চান দার্শনিকদের প্রভাবিত করেছিল। নবম শতাব্দীতে ফিলোলজিস্ট আর্নেস্ট রেনান (Ernest Renan) ইবন রূশদকে (পাশ্চাত্যে অ্যাভেরোস নামে খ্যাত) মুক্ত মনের অধিকারী বলে প্রশংসা করেছিলেন, অন্ধ বিশ্বাসের বিরোধিতাকারী যুক্তিবাদের আদি পতাকাবাহী ছিলেন ইনি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ইবন রূশদ ধার্মিক মুসলিম ছিলেন, শরিয়াহ্ আইনের কাজিও। ইবন সিনার মত তিনি বিশ্বাস করতেন যে ধর্ম ও ফয়ালসুফদের মাঝে কোনও বিরোধ নেই, কিন্তু ধর্ম যেখানে সর্বজনীন, একমাত্র মননশীল সংখ্যাঘরিষ্ঠেরই উচিত দর্শনের দিকে যাওয়া।

মনে হয় যেন খেলাফত- সকল বাস্তব দিক থেকেই- পরিত্যক্ত হওয়ার পর ইসলাম নতুন করে প্রাণশক্তি ফিরে পেয়েছিল। চরম রাজতন্ত্র আর কুরানের আদর্শের মাঝে একটা টানাপোড়েন সবসময়ই ছিল। ইসলামী বিশ্বে ক্রমপ্রয়াসের ভেতর দিয়ে আবির্ভূত নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থা ইসলামী আদর্শের অনেক কাছাকাছি ছিল। এমন নয় যে সকল নতুন শাসকই ধার্মিক মুসলিম ছিলেন–বরং উল্টো –কিন্তু স্বাধীন রাজদরবার এবং শাসকবৃন্দের ব্যবস্থা- সবাই সমমর্যাদার কিন্তু এক শিথিল জাতীয় ঐক্যের অধীন- কুরানের সাম্যবাদী চেতনার অনেক নিকটবর্তী ছিল। এটা সেই সময়ে মুসলিম বিশ্বে বিকাশমান শিল্পকলার সঙ্গেও সঙ্গতিপূর্ণ ছিল। অ্যাবারাস্ক কোনও একটি হরফকে অন্য হরফের চেয়ে বেশী গুরুত্ব দেয় না, প্রত্যেকটা হরফের নিজস্ব অবস্থান রয়েছে এবং তা সমগ্রে নিজস্ব আলাদা অবদান রাখে। ইবন ইসহাক এবং আবু জাফর আল-তাবারি (মৃত্যু: ৯৩২)র মত মুসলিম ঐতিহাসিকগণ পয়গম্বরের জীবনের কখনও কখনও পরস্পর বিরোধী বিবরণের মাঝে সামঞ্জস্য বিধানের খুব একটা প্রয়াস পাননি, বরং পরস্পর বিরোধী বিবরণ পাশাপাশি উল্লেখ করে গেছেন, সমান গুরুত্ব দিয়ে। উম্মাহর ঐক্যের নিশ্চয়তা দেয়ার কারণেই মুসলিমরা খেলাফতকে মেনে নিয়েছিল; কিন্তু যেই খলিফারা দেখালেন যে তাঁদের দ্বারা আর সাম্রাজ্যকে সংহত রাখা সম্ভব নয়, তখন তাঁরা তাদের প্রতীকী মর্যাদায় নামিয়ে এনে সন্তোষ বোধ করল। ইসলামী ধার্মিকতায় একটা পরিবর্তন এসেছিল। এতদিন পর্যন্ত মুসলিম জনগোষ্ঠীর ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতের প্রতি রাজনৈতিক সাড়ার মাঝেই থিয়োলজি ও আধ্যাত্মিকার মূল নিহিত ছিল। কিন্তু এবার মুসলিমরা আরও অনুকূল রাজনৈতিক ব্যবস্থা লাভ করায়, মুসলিম চিন্তা আর ভক্তি চলমান ঘটনাপ্রবাহ দ্বারা আগের মত চালিত হচ্ছিল না। তাৎপর্যপূর্ণভাবে, আধুনিক কালে ইসলাম অধিকতর রাজনৈতিক হয়ে পড়েছে, যখন মুসলিমরা নতুন নতুন বিপদের মোকাবিলা করেছে, যা উম্মাহর সাংস্কৃতিক, নৈতিক এবং ধর্মীয় কল্যাণকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিচ্ছে বলে মনে হয়েছে তাদের এবং এমনকি অস্তিত্বকেই হুমকির সম্মুখীন করে তুলেছে।

পরিকল্পিত নয় বরং কাকতালীয়ভাবেই সেলজুক তুর্করা ফার্টাইল ক্রিসেন্টে (Firtile Crescent) নতুন ব্যবস্থার পর পূর্ণ বিকাশ ঘটিয়েছিল। বিকেন্দ্রীকরণ অনেক বেশী অগ্রসর ছিল এখানে। সেলজুকরা ছিল সুন্নী, সুফিবাদের প্রতি জোরাল ঝোঁক ছিল তাদের। ১০৬৩ থেকে ১০৯২ পর্যন্ত তীক্ষ্ণধী পারসিয়ান উযির নিযামুলমুলক কর্তৃক তাদের সাম্রাজ্য শাসিত হয়, যিনি সাম্রাজ্যের ঐক্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে পুরনো আব্বাসীয় আমলাতন্ত্রের পুনর্গঠনের লক্ষ্যে তুর্কিদের কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বাগদাদকে পুনরুজ্জীবিত করার সময় আর ছিল না, কেননা এর অর্থনীতির মূল ভিত্তি কৃষিপ্রধান এলাকা সোয়াদ অপরিবর্তনীয় অবনতির দিকে ধাবিত হচ্ছিল। সেলজুক সেনাদেরও সামাল দিতে পারেননি নিযামুলমুলক। যাযাবর গোষ্ঠীর এক অশ্বারোহী বাহিনী ছিল এরা, যেখানে ইচ্ছা তাদের পাল নিয়ে হাজির হত তারা। কিন্তু নতুন দাস-বাহিনীর সহায়তায় নিযামুলমুলক এমন এক সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন যার সীমানা দক্ষিণে ইয়েমেন আর পুবে সির-ওক্সাস বেসিন এবং পশ্চিমে সিরিয়া পর্যন্ত পৌঁছেছিল। এই নতুন সেলজুক সাম্রাজ্যের খুব বেশী আনুষ্ঠানিক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ছিল না, স্থানীয় পর্যায়ে আমির এবং উলেমাগণ আদেশ কার্যকর করতেন, যাঁরা অস্থায়ী অংশীদারী গড়ে তুলেছিলেন। বিভিন্ন এলাকায় দায়িত্বপ্রাপ্ত আমিরগণ নিযামুলমুলকের কেন্দ্রীকরণ পরিকল্পনায় বাদ সেধে কার্যত: স্বাধীনভাবে যার যার এলাকা শাসন করতে থাকেন এবং বাগদাদের পরিবর্তে অধিবাসীদের কাছ থেকে সরাসরি ভূমিকর আদায় করতে থাকেন। সামন্ত বাদী ব্যবস্থা ছিল না এটা, কারণ উযিরের ইচ্ছা যাই থাকুক না কেন আমিরগণ খলিফাহ্ বা সেলজুক সুলতান মালিকশা সামন্ত ছিলেন না। আমিরগণ যাযাবর ছিলেন বলে তাদের এলাকায় চাষাবাদ করার ব্যাপারে তাঁদের আগ্রহ ছিল না, সুতরাং ভূমি সংশ্লিষ্ট সামন্ত ধাঁচের কোনও অভিজাতন্ত্র গড়ে তোলেননি তাঁরা। তাঁরা সৈনিক ছিলেন, তাই প্রজাদের নাগরিক জীবনের প্রতি আগ্রহী ছিলেন না, যা কার্যত: উলেমাদের এলাকায় পরিণত হয়।

উলেমাগণ এইসব বিচ্ছিন্ন সামরিক রাজ্যগুলোকে একত্রিত রেখেছিলেন। দশম শতাব্দীতে নিজেদের শিক্ষার মানের ব্যাপারে অসন্তুষ্ট হয়ে ওঠেন তাঁরা এবং ইসলামী বিজ্ঞানের গবেষণার লক্ষ্যে প্রথমবারের মত মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। এতে করে তাদের প্রশিক্ষণ আরও সুসামজ্ঞস্যপূর্ণ এবং শিক্ষা আরও সমরূপ হয় এবং পুরোহিত গোষ্ঠীর মর্যাদা বেড়ে যায়। সেলজুক সাম্রাজ্যে জুড়ে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠাকে উৎসাহিত করেন নিযামুলমুলক, শিক্ষাক্রমের সঙ্গে এমন সব বিষয় যোগ করেছিলেন যা উলেমাদের স্থানীয় সরকার পরিচালনায় সক্ষম করে তুলবে। ১০৬৭তে বাগদাদে নিযামিয়াহ্ মাদ্রাসা স্থাপন করেন তিনি। নিজস্ব প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠায় উলেমাগণ এবার ক্ষমতার একটা ভিত্তি পান, যা আমিরদের সামরিক দরবারের চেয়ে আলাদা কিন্তু সমমানের হয়ে দাঁড়ায়। শ্রেণীকৃত মাদ্রাসাসমূহ সমগ্র সেলজুক অঞ্চলে শরিয়াহ্ নির্দেশিত পথে মুসলমানদের একই রকম জীবনযাত্রা উৎসাহিত করে। উলেমাগণ শরিয়াহ্ আদালতের আইনি ব্যবস্থায়ও একচেটিয়া কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। এভাবে আপনাআপনি রাজনৈতিক ক্ষমতা ও সমাজের নাগরিক জীবনে একটা বিভেদ তৈরি হয়। আমির শাসিত ছোট ছোট রাষ্ট্রগুলোর কোনওটিই টেকেনি; কোনও রাজনৈতিক আদর্শ ছিল না তাঁদের। আমিররা খুব স্বল্প বা অস্থায়ী দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি ছিলেন এবং সাম্রাজ্যের সামগ্রিক আদর্শবাদ সরবরাহ করতেন উলেমা আর সুফি শিক্ষক (পির)গণ, যাদের সম্পূর্ণ আলাদা বলয় ছিল। পণ্ডিত উলেমাগণ মাদ্রাসা হতে মাদ্রাসায় ঘুরে বেড়াতেন; সুফি পিরগণও সবসময় চলিষ্ণু ছিলেন, এক শহর বা কেন্দ্র থেকে অন্য শহর বা কেন্দ্র দারুণভাবে সফরে যেতেন। ধর্মীয় ব্যক্তিরা বিচ্ছিন্ন সমাজকে একসূত্রে গাঁথার সুতোর যোগান দিতে শুরু করেছিলেন।

এভাবে খেলাফতের কার্যকর বিলুপ্তির পর সাম্রাজ্য আরও ইসলামী হয়ে ওঠে। নিজেদের আমির শাসিত স্বল্পায়ু রাষ্ট্রের বাসিন্দা ভাবার বদলে মুসলিমরা নিজেদের উলেমাদের প্রতিনিধিত্বশীল অধিকতর আন্তর্জাতিক সমাজের সদস্য হিসাবে দেখতে শুরু করে, যা দার আল-ইসলামের সঙ্গে সহাবস্থানের যোগ্য। উলেমাগণ এই নয়া অবস্থার সঙ্গে শরিয়াহ্কে মানিয়ে নেন। মুসলিম আইনকে পাল্টা সংস্কৃতি গড়ে তোলার কাজে ব্যবহারের পরিবর্তে শরিয়াহ্ নতুন খলিফাঁকে পবিত্র আইনের প্রতীকী অবিভাবক হিসাবে দেখল। আমিরগণ এসেছেন, বিদায় নিয়েছেন; কিন্তু শরিয়াহ্র সমর্থক বলে উলেমাগণ একমাত্র স্থিতিশীল কর্তৃপক্ষে পরিণত হন; এবং সুফিবাদ আরও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, সাধারণ মানুষের ধার্মিকতা গম্ভীর হয় এবং এক অভ্যন্তরীণ মাত্রা লাভ করে।

এসময় সর্বত্র সুন্নী ইসলামের অগ্রযাত্রা যেন স্পষ্ট হয়ে ওঠে। অধিকতর চরমপন্থী ইসমায়েলিদের কেউ কেউ, যারা ফাতিমীয় সাম্রাজ্যের বেলায় আশাহত হয়েছিল, উম্মাহ্ মাঝে যা প্রকৃত ধর্ম বিশ্বাস প্রতিষ্ঠায় লক্ষ্যণীয়ভাবে ব্যর্থ হয়, গেরিলাদের এক আন্ডারগ্রাউন্ড নেটওঅর্ক গঠন করে, সেলজুকদের উৎখাত এবং সুন্নীদের ধ্বংসের কাজে নিবেদিত ছিল এরা। ১০৯০ থেকে কাযভিনের উত্তরে অবস্থিত আলামুতের পাহাড়ী দুর্গ থেকে হামলা পরিচালনা শুরু করে তারা, সেলজুকদের শক্ত ঘাঁটি দখল করে আর নেতৃস্থানীয় আমিরদের প্রাণনাশ করতে থাকে। ১০৯২ নাগাদ তা পূর্ণাঙ্গ বিদ্রোহের রূপ নিয়েছিল। প্রতিপক্ষের কাছে বিদ্রোহীরা হ্যাঁশিশিন (যেখান থেকে আমাদের “অ্যাসাসিন” শব্দটি এসেছে) নামে পরিচিত হয়ে উঠেছিল, কারণ তারা নাকি আত্মঘাতী এসব হামলায় যোগ দানে উৎসাহিত হবার জন্যে হ্যাঁশিস সেবন করত। ইসমায়েলিরা নিজেদের সাধারণ মানুষের রক্ষক বলে বিশ্বাস করত, যারা নিজেরাই প্রায়ই আমিরদের হয়রানির শিকার হত, কিন্তু এই সন্ত্রাসী কার্যক্রম অধিকাংশ মুসলিমকে ইসমায়েলিদের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তোলে। উলেমাগণ তাদের নিয়ে অবিশ্বাস্য আর ভ্রান্ত কাহিনী ছড়াতে থাকেন (হ্যাশিসের গল্প এসব কিংবদন্তীর অন্যতম), সন্দেহভাজন ইসমায়েলিদের ধরে এনে হত্যা করা হয়, যার ফলে আবার নতুন করে ইসমায়েলি হামলার ঘটনা ঘটে। কিন্তু এই বিরোধিতা সত্ত্বেও ইসমায়েলিরা আলামুতের আশপাশে একটা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হয়েছিল, যা ১৫০ বছর টিকে ছিল এবং কেবল মঙ্গোল হানাদাররাই একে ধ্বংস করতে পেরেছিল। অবশ্য তাদের জিহাদের প্রত্যক্ষ ফলাফল আশানুযায়ী মাহদির আগমন ছিল না, বরং গোটা শিয়া সম্প্রদায়ের অপমান ছিল। ইসমায়েলি বিদ্রোহে অংশগ্রহণ হতে বিরত থাকা দ্বাদশবাদীরা (Twelvers) সুন্নী কর্তৃপক্ষকে সযত্নে খুশি রাখে এবং যেকোনও রাজনৈতিক সংশ্রব থেকে দূরে সরে থাকে। সুন্নীরা তাদের দিক থেকে একজন থিয়োলজিয়ানের ভূমিকায় সাড়া প্রদানে প্রস্তুত ছিল যিনি তাদের ধর্ম বিশ্বাসের প্রামাণিক সংজ্ঞা প্রদানে সক্ষম হয়েছিলেন, যাঁকে পয়গম্বর মুহাম্মদের(স:) পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুসলিম বলে অভিহিত করা হয়।

আবু হামিদ মুহাম্মদ আল-গাযযালি (মৃত্যু: ১১১১) উযির নিযামুলমুলকের আশ্রয়প্রাপ্ত ছিলেন, এবং বাগদাদস্থ নিযামিয়াহ্ মাদ্রাসার লেকচারার এবং ইসলামী আইনের বিশেষজ্ঞ ছিলেন তিনি। ১০৯৫-তে এক নার্ভাস ব্রেকডাউনের শিকার হন। এই সময়ে ইসমায়েলি বিদ্রোহ তুঙ্গে পৌঁছেছিল, কিন্তু আল-গায্যালি বিশ্বাস হারাচ্ছেন ভেবেই প্রধানত হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। নিজেকে পক্ষাঘাতগ্রস্ত অবস্থায় আবিষ্কার করেন তিনি, কথা বলতে পারছিলেন না; চিকিৎসকগণ তাঁর মাঝে গভীর মানসিক আবেগাসঞ্জাত দ্বন্দ্ব আবিষ্কার করেন; পরে গাযালি ব্যাখ্যা দিয়েছেন যে যদিও ঈশ্বর সম্পর্কে অনেক কিছু জানতেন; কিন্তু স্বয়ং ঈশ্বরকে জানেন না বলে উদ্বিগ্ন ছিলেন তিনি। তো জেরুজালেমে চলে যান তিনি, সেখানে সুফি চর্চা করেন, দশ বছর পর ইরাকে ফিরে আসার পর রচনা করেন অসাধারণ গ্রন্থ ইয়াহ্ আলাম আল-দিন (দ্য রিভাইভাল অভ দ্য রিলিজিয়াস সায়েন্সেস)। এটা কুরান এবং আহাদিসের পর সর্বাধিক উদ্ধৃত গ্রন্থে পরিণত হয়েছে। এর গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক ভিত্তি হল কেবল আচার-অনুষ্ঠান এবং প্রার্থনাই মানুষকে ঈশ্বর সম্পর্কে প্রত্যক্ষ জ্ঞান জোগাতে পারে; কিন্তু থিয়োলজি (কালাম) এবং ফালসাফার যুক্তিসমূহ ঈশ্বর সম্পর্কে কোনও নিশ্চয়তা দিতে পারে না। ইয়াহ্ মুসলিমদের এক দৈনন্দিন আধ্যাত্মিক ও প্রায়োগিক কর্মধারার যোগান দেয়, যা তাদের এই ধর্মীয় অভিজ্ঞতা অর্জনে প্রস্তুত করে তোলে। খাওয়া, ঘুমানো, ধোয়া, স্বাস্থ্য এবং প্রার্থনা সংক্রান্ত সকল শরিয়াহ্ আইনের ভক্তিমূলক ও নৈতিক ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে, ফলে সেগুলো আর নেহাত বাহ্যিক নির্দেশাবলী না থেকে মুসলিমদের কুরান উল্লেখিত ঈশ্বর সম্পর্কে চিরন্তন সচেতনতার বিকাশ ঘটাতে সক্ষম করে তুলেছে। এভাবে শরিয়াহ্ সামাজিক ঐক্য বজায় রাখার কায়দা এবং পয়গম্বর ও তাঁর সুন্নাহ্র যান্ত্রিক বাহ্যিক অনুকরণের অতিরিক্ত কিছুতে পরিণত হয়েছে: এটা হয়ে দাঁড়িয়েছে অভ্যন্তরীণ ইসলাম অর্জনের উপায়। আল-গায্যালি ধর্মীয় বিশেষজ্ঞদের জন্যে লেখেননি, বরং সাধারণ ধার্মিকদের উদ্দেশ্যে লিখেছেন। তিনি মনে করতেন তিন ধরনের মানুষ আছে: যারা বিনা প্রশ্নে ধর্মীয় সত্যকে মেনে নেয়, যারা কালামের যুক্তিভিত্তিক অনুশীলনে তাদের বিশ্বাসের পক্ষে যুক্তির সন্ধান করে; আর সুফিগণ, যাদের ধর্মীয় সত্যের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা রয়েছে।

নতুন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে মানুষের ভিন্ন ধর্মীয় সমাধানের প্রয়োজন সে সম্পর্কে সজাগ ছিলেন আল-গাযযালি। একজন নিষ্পাপ ইমামের প্রতি ইসমায়েলিদের অগাধ ভক্তি অপছন্দ ছিল তাঁর: কোথায় আছেন এই ইমাম? সাধারণ মানুষ কীভাবে তাঁর সাক্ষাৎ লাভ করবে? একজন কর্তৃত্বময় ব্যক্তিত্বের ওপর এই নির্ভরশীলতাকে কুরানের সাম্যবাদের লঙ্ঘন বলে মনে হয়েছে তাঁর। ফালসাফাঁকে তিনি গণিত আর চিকিৎসা বিজ্ঞানের মত শাস্ত্রের জন্যে অপরিহার্য হিসাবে মেনে নিয়েছিলেন, কিন্তু যুক্তি প্রয়োগের অতীত আধ্যাত্মিক বিষয়াবলী সম্পর্কে এটা নির্ভরযোগ্য পথনির্দেশ দিতে পারে না। আল-গাযযালির দৃষ্টিতে সুফিবাদই সমাধান, কারণ এর অনুশীলন ঈশ্বরের প্রত্যক্ষ উপলব্ধির দিকে পরিচালিত করতে পারে। প্রাথমিককালে উলেমাগণ সুফিবাদ সম্পর্কে সতর্ক ছিলেন এবং একে বিপজ্জনক প্রান্তিক আন্দোলন হিসাবে দেখেছেন। আল-গাযযালি এবার ধর্মীয় পণ্ডিতদের সুফি অতীন্দ্রিয়বাদীদের উদ্ভাবিত ধ্যানের আচারগুলো পালন এবং শরিয়াহ্র বাহ্যিক নিয়মাচারের প্রচারণার পাশাপাশি এই অভ্যন্তরীণ আধ্যাত্মিকতায়ও উৎসাহিত করার আহ্বান জানালেন। ইসলামের জন্যে উভয়ই গুরুত্বপূর্ণ। এভাবে আল-গাযালি অতীন্দ্রিয়বাদকে সোচ্চার স্বীকৃতি দিয়েছেন, নিজের কর্তৃত্ব আর মর্যাদা ব্যবহার করে মুসলিম জীবনের মূলধারায় এর অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করেছেন।

আপন সময়ের সর্বোচ্চ ধর্মীয় কর্তৃপক্ষ হিসাবে স্বীকৃত ছিলেন আল-গাযযালি। এই সময়ে সুফিবাদ জনপ্রিয় আন্দোলনে রূপ নিয়েছিল, এটা আর সংখ্যালঘুদের মাঝে সীমিত থাকেনি। এ পর্যায়ে অতীতের মত জনগণের ধার্মিকতা উম্মাহর রাজনীতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জাড়িত না থাকায় তারা অতীন্দ্রিয়বাদীর ইতিহাস নিরপেক্ষ, কিংবদন্তীর অভ্যন্তরীণ অভিযাত্রার জন্যে প্রস্তুত হয়েছিল। গূঢ় বিদ্যার্থী মুসলিমদের একান্ত অনুশীলনের পরিবর্তে জিকর (dhikr)– ঐশী নাম জপ– দলীয় চর্চায় পরিণত হয়, যা মুসলিমদের পিরের নির্দেশনায় চেতনার বিকল্প স্তরে পৌঁছে দিয়েছিল। সুফিরা তাদের দুর্জ্জেয়ের সচেতনতা বাড়ানোর লক্ষ্যে সঙ্গীত শুনত। পিরের চারপাশে জমায়েত হত তারা, শিয়ারা যেমন এককালে ইমামদের ঘিরে থাকত, তাঁকে ঈশ্বরের পথে পরিচালক হিসাবে দেখত। যখন কোনও পির পরলোকগমন করতেন, কার্যত: একজন “সাধু” (“Saint”)তে পরিণত হতেন তিনি- পবিত্রতার কেন্দ্রবিন্দু– আর লোকে তাঁর সমাধিতে প্রার্থনা আর জিকর অনুষ্ঠান করত। প্রত্যেক শহরে এসময় মসজিদ বা মাদ্রাসার মত আলাদা খানকাহ্ (আশ্রম) ছিল, যেখানে স্থানীয় পির তাঁর অনুসারীদের নির্দেশনা দান করতেন। নতুন নতুন সুফি পদ্ধতি (ত্বরিকাহ্) গড়ে ওঠে, যেগুলো নির্দিষ্ট কোনও এলাকায় সীমিত না থেকে সমগ্র দার আল-ইসলামে শাখা বিস্তার করে আন্তর্জাতিক রূপ নিয়েছিল। এসব ত্বরিকাহ্ এভাবে বিকন্দ্রীয়ায়িত সাম্রাজ্যের ঐক্য বজায় রাখার আরেকটা উপায়ে পরিণত হয়েছিল। বিভিন্ন শহরের কারুশিল্পী এবং বণিকদের জন্যে নতুন ভ্রাতৃসংঘ আর সমিতি (ফুতুওয়াহ্- futuuwah) গুলোও একই উদ্দেশ্য পূরণ করেছিল, যেগুলো প্রবলভাবে সুফি আদর্শে প্রভাবিত ছিল। ইসলামী প্রতিষ্ঠানগুলোই ক্রমবর্ধমানহারে সাম্রাজ্যকে ঐক্যবদ্ধ রাখছিল এবং একই সময়ে একেবারে অশিক্ষিতদের ধর্ম বিশ্বাসও এক ধরনের অভ্যন্তরীণ অনুরণন লাভ করেছিল, যা এক সময় কেবল অভিজাত এবং বিচ্ছিন্ন গোষ্ঠীর করায়ত্ত ছিল।

এরপর আর আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে গভীরভাবে সংমিশ্রিত নয় এমন ধর্মতাত্ত্বিক বা দার্শনিক আলোচনার অস্তিত্ব থাকেনি। নতুন “থিয়োসফাররা” (Theosophers) এই নয়া মুসলিম সিনথেসিসের প্রচার করেন। আলেপ্পোয় ইয়াহিয়া সুহ্রাওয়ার্দি (মৃত্যু: ১১৯১) প্রাচীন প্রাক ইসলামী ইরানি অতীন্দ্রিয়বাদের ওপর ভিত্তি করে আলোকনের (আল-ইশরাক) নতুন মতবাদের প্রতিষ্ঠা করেন। প্রকৃত দর্শনকে তিনি ফালসাফার মাধ্যমে মননের সুশৃঙ্খল প্রশিক্ষণ এবং সুফিবাদের মাধ্যমে হৃদয়ের অভ্যন্তরীণ পরিবর্তন, এ দুয়ের মিশেলের ফলাফল হিসাবে দেখেছেন। যুক্তি এবং অতীন্দ্রিয়বাদকে অবশ্যই হাত ধরাধরি করে এগোতে হবে; মানুষের জন্যে উভয়ই গুরুত্বপূর্ণ এবং সত্যের অনুসন্ধানে উভয়ের প্রয়োজন রয়েছে। অতীন্দ্রিয়বাদীদের দর্শন (Vision) এবং কুরানের প্রতীকসমূহ (যেমন স্বর্গ, নরক ও শেষ বিচার) অভিজ্ঞতার আলোকে প্রমাণ করা যাবে না; বরং ধ্যানীর প্রশিক্ষিত সজ্ঞামূলক গুণাবলী দিয়ে প্রত্যক্ষ করা যেতে পারে। অতীন্দ্রিয় মাত্রার বাইরে ধর্মের কিংবদন্তী কোনও অর্থ বহন করে না, কেননা সেগুলো আমাদের স্বাভাবিক সচেতনতা দিয়ে অনুভূত জাগতিক ঘটনাবলীর মত “বাস্তব” (“real”) নয়। একজন অতীন্দ্রিয়বাদী নারী বা পুরুষ নিজেকে সুফি অনুশীলনের মাধ্যমে জাগতিক অস্তিত্বের অভ্যন্তরীণ স্বরূপ প্রত্যক্ষ করার জন্যে প্রশিক্ষিত করে তোলে। মুসলিমদের আলম আল-মিথালের– “খাঁটি প্রতিবিম্বের জগৎ” (the world of pure images )– অনুভূতি গড়ে তুলতে হয়, যা নশ্বর জগৎ আর ঈশ্বরের মাঝে বিরাজমান। এমনকি যারা প্রশিক্ষিত অতীন্দ্রিয়বাদী নয় তারাও নিদ্রিত অবস্থায় বা ঘোরে থাকার সময় স্বপ্ন বা হিপনোগোগিক ইমেজারিতে এই জগৎ সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠতে পারে। সুহরাওয়ার্দি বিশ্বাস করতেন, যখন কোনও পয়গম্বর বা অতীন্দ্রিয়বাদী কিছু প্রত্যক্ষ করেন (vision), তিনি অন্তস্থঃ জগৎ সম্পর্কে সজাগ হয়ে ওঠেন, যা আজকের দিনে আমরা যাকে অবচেতন মন বলি তার অনুরূপ।

ইসলামের এই ধরন হাসান আল-বাসরি বা শাফীর কাছে অচেনা ঠেকত। নিজের দৃষ্টিভঙ্গির জন্য সুহ্রাওয়ার্দির মৃত্যুদণ্ড হতে পারত, কিন্তু ধার্মিক মুসলিম ছিলেন তিনি, অতীতের যেকোনও ফায়লাসুফের তুলনায় অনেক বেশী কুরান থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন। তাঁর রচনা আজও অতীন্দ্রিয়বাদী ধ্রুপদী সাহিত্য হিসাবে পঠিত হয়ে থাকে। একই রকম পঠিত হয় দ্রুতপ্রজ এবং প্রবল প্রভাবশালী স্প্যানিশ থিয়োসফার মুঈদ আদ-দিন ইবন আল-আরাবিব (মৃত্যু: ১২৪০) গ্রন্থসমূহ। আল- আরাবিও মুসলিমদের নিজের মাঝে আলম আল-মিথাল অনুসন্ধানের তাগিদ দিয়েছেন। তিনি শিক্ষা দিয়েছেন যে, ঈশ্বরকে পাওয়ার উপায় সৃজনশীল কল্পনার (Creative Imagination) মাঝে নিহিত। ইবন আল-আরাবির গ্রন্থসমূহ সহজপাঠ্য নয়, কিন্তু অধিকতর মননশীলদের কাছে আবেদন সৃষ্টি করেছে; তবে তিনি বিশ্বাস করতেন, যে কেউই সুফি হতে পারে এবং সবারই উচিত ঐশী গ্রন্থের প্রতীকী, গুপ্ত অর্থের সন্ধান করা। মুসলিমদের দায়িত্ব রয়েছে নিজেদের কল্পনাকে শাণিত করার মাধ্যমে উপরিতলের অভ্যন্তরে সর্বত্র এবং সর্বজনে বিরাজমান পবিত্র সত্তাকে দেখে নিজস্ব থিয়োফ্যানি সৃষ্টি করা। প্রতিটি মানুষই অনন্য এবং ঈশ্বরের কোনও না কোনও গুপ্ত গুণাবলীর অপুনরাবৃত্তিযোগ্য উন্মোচন এবং আমাদের সত্তার গভীরতম প্রদেশে খোদিত স্বর্গীয় নাম দিয়েই আমরা ঈশ্বরকে জানতে পারব। ব্যক্তিগত প্রভুর ( Personal Lord) দর্শন ব্যক্তির জন্মগত ধর্মবিশ্বাসের শর্তাধীন। এভাবে অতীন্দ্রিয়বাদীকে সকল ধর্মবিশ্বাসকে সম বৈধভাবে দেখতে হবে এবং তাকে সিনাগগ, মসজিদ, গির্জা বা মন্দিরে সমান স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতে হবে, যেমন কুরানে ঈশ্বর বলেছেন: “আর যেদিকেই তুমি মুখ ফেরাও, সেদিকই আল্লাহ্র দিক।”[২]

এভাবে খেলাফতের বিলোপের পর এক ধর্মীয় বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল। এতে করে সাধারণ শিল্পী এবং অভিজাত বুদ্ধিজীবীগণ সমভাবে প্রভাবিত হয়েছেন। একটি প্রকৃত মুসলিম জাতি অস্তিত্ববান হয়ে উঠেছিল, যারা ধর্মকে গভীর স্তরে মেনে নিতে শিখেছিল। মুসলিমরা এক ব্যাপক আধ্যাত্মিক নবজাগরণের মাধ্যমে রাজনৈতিক বিপর্যয়ের প্রতি সাড়া দিয়েছিল যা নতুন অবস্থার সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্যে ধর্মকে নতুন ভাবে ব্যাখ্যা করেছে। ইসলাম এসময় রাষ্ট্রীয় সমর্থন ছাড়াই বিকশিত হচ্ছিল। প্রকৃতপক্ষেই রাজনৈতিক পরিবর্তনশীল বিশ্বে এটাই কেবল অপরিবর্তনীয়।

ক্রুসেডসমূহ

একাদশ শতাব্দীর শেষ নাগাদ সেলজুক তুর্কিদের সাম্রাজ্যের পতন ঘটতে শুরু করলেও তাদের অধীনে বিকাশ লাভ করা রাজনৈতিকভাবে স্বায়ত্তশাসিত আমিরদের ব্যবস্থা টিকে ছিল। এব্যবস্থার সুস্পষ্ট ঘাটতি ছিল। আমিরগণ অবিরাম পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত থাকতেন, ফলে বহিস্থঃ কোনও শত্রুর মোকাবিলায় ঐক্যবদ্ধ হতে পারতেন না কিছুতেই। এ ব্যাপারটি দুঃখজনকভাবে জুলাই ১০৯৯-তে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে, যখন পশ্চিম ইউরোপ থেকে আগত ক্রিশ্চান ক্রুসেডাররা মক্কা ও মদীনার পর মুসলিম বিশ্বের তৃতীয় পবিত্র নগরী জেরুজালেম আক্রমণ করে, এখানকার অধিবাসীদের নির্বিচারে হত্যা করে এবং প্যালেস্টাইন, লেবানন ও আনাতোলিয়ায় রাষ্ট্র স্থাপন করে তারা। সেলজুক সাম্রাজ্যের পতনোন্মুখ অবস্থায় পরস্পরের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত অঞ্চলের আমিরগণ ঐক্যবদ্ধ পাল্টা আঘাত হানতে পরেননি। আগ্রাসী পশ্চিমা অনুপ্রবেশের বিরুেদ্ধে তাদের অসহায় বলে মনে হয়েছে। এরপর প্রায় পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে যাবার পর মসুল ও আলেপ্পোর আমির ইমাদ আদ-দিন যাঙ্গি ১১৪৪-এ আর্মেনিয়া থেকে ক্রুসেডারদের বিতারিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং আরও প্রায় অর্ধশতাব্দী কাল অতিক্রান্ত হবার পর পশ্চিমে সালাদিন নামে খ্যাত কুর্দিশ সেনাপতি ইউসুফ ইবন আইয়ুব সালাহ্ আদ-দিন ১১৮৭-তে ক্রুসেডারদের দখল থেকে জেরুজালেম ছিনিয়ে নিয়েছিলেন, ক্রুসেডাররা অবশ্য ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষ অবধি নিকট প্রাচ্যে উপকূলবর্তী একটা অবস্থান ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছিল। এই বহিস্থঃ হুমকির কারণে সালাদিন প্রতিষ্ঠিত আইয়ুবীয় রাজবংশ ফার্টাইল ক্রিসেন্টের আমির শাসিত স্বল্পায়ু রাষ্ট্রগুলোর চেয়ে বেশী দীর্ঘস্থায়ী হতে পেরেছিল। অভিযানের প্রাথমিক পর্যায়ে সালাদিন মিশরের ফাতিমীয় রাজবংশকে পরাজিত করে এর এলাকাকে নিজের ক্রমবর্ধমান সাম্রাজ্যের অঙ্গীভূত করে নেন এবং অধিবাসীদের সুন্নি ইসলামে ফিরিয়ে আনেন।

ক্রুসেডসমূহ ন্যাক্কারজনক হলেও পাশ্চাত্য ইতিহাসের ক্ষেত্রে গঠনমূলক ঘটনা ছিল; এগুলো নিকট প্রাচ্যের মুসলিমদের পক্ষে বিপর্যয়কর ছিল বটে, কিন্তু ইরাক, ইরান, মধ্য এশিয়া, মালয়, আফগানিস্তান এবং ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের জন্যে ছিল সুদূর কোনও সীমান্ত সংঘর্ষের মত। একেবারে বিংশ শতাব্দীতে পাশ্চাত্য অধিকতর শক্তিশালী ও হুমকিতে পরিণত হবার পরেই কেবল মুসলিম ঐতিহাসিকগণ মধ্যযুগের ক্রুসেডসমূহের ব্যাপারে সচেতন হয়ে উঠেছেন, বিজয়ী সালাদিনের কথা স্মরণ করে নস্টালজিয়াগ্রস্ত হয়ে তেমনি এক নেতার আকাঙ্ক্ষা করেছেন, যিনি পাশ্চাত্যের সাম্রাজ্যবাদের নব্য ক্রুসেড প্রতিরোধ করতে সক্ষম হবেন।

সম্প্রসারণ

ক্রুসেডের প্রত্যক্ষ কারণ ছিল ১০৭০-এ ফাতিমীয়দের কাছ থেকে সেলজুকদের সিরিয়া দখলের ঘটনা। এই অভিযানকালে দুর্বল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে রুগ্ন বাইযানটাইন সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধেও সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছিল তারা। সেলজুকরা যখন সীমান্ত অতিক্রম করে আনাতোলিয়ায় পা রাখে, ১০৭১-এ মানযিকুর্টের যুদ্ধে তারা বাইযানটাইনদের শোচনীয়ভাবে পরাস্ত করে। এক দশক সময়কালের মধ্যেই তুর্কি যাযাবররা সমগ্র আনাতোলিয়ায় তাদের পশুপাল নিয়ে ছড়িয়ে পড়ে আর আমিরগণ ছোট ছোট রাষ্ট্রের পত্তন করেন যেগুলোর পরিচালনায় ছিল মুসলিমরা, যারা আনাতোলিয়াকে নতুন সীমান্ত আর সম্ভাবনাময় দেশ বলে মনে করেছিল। তুর্কিদের এই অগ্রযাত্রা প্রতিরোধের ক্ষমতাহীন বাইযানটাইন সম্রাট প্রথম আলেক্সাস কমনেনাস ১০৯১তে পোপের কাছে সাহায্যের আবেদন জানান। আবেদনে সাড়া দিয়ে পোপ দ্বিতীয় আরবান প্রথম ক্রুসেডের আহ্বান জানান। অনাতোলিয়ার অংশবিশেষ ক্রুসেডাররা অধিকার করলেও তাতে করে তুর্কিদের ঐ অঞ্চলে অগ্রাভিযান রুদ্ধ হয়নি। ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষ নাগাদ তুর্কিরা ভূমধ্যসাগরীয় এলাকায় পৌঁছে যায়; চতুর্দশ শতাব্দীতে তারা এজিয়ান সাগর অতিক্রম করে; বলকান এলাকায় বসতি গড়ে তোলে এবং পৌঁছে যায় দানিউব অবধি। অতীতে কখনও কোনও মুসলিম শাসক বাইযানটিয়ামকে এত শোচনীয়ভাবে পরাস্ত করতে পারেনি, এই সাম্রাজ্যটির প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যের সম্মানজনক ইতিহাসের পটভূমি ছিল। সুতরাং অহঙ্কার বশতই তুর্কিরা আনাতোলিয়ায় তাদের নতুন রাষ্ট্রটিকে “রাম” (Rum) বা রোম নামে অভিহিত করেছিল। খেলাফতের পতন সত্ত্বেও মুসলিমরা এবার এমন দুটি এলাকায় সম্প্রসারিত হল যা কখনওই দার-আল-ইসলামের অংশ ছিল না –পূর্ব ইউরোপ এবং উত্তর-পশ্চিম ভারতের একটা অংশ- এবং যে এলাকাটি অদূর ভবিষ্যতে অত্যন্ত সৃজনশীল অঞ্চলে পরিণত হয়।

খলিফাহ্ আল-নাসির (১১৮০-১২২৫) বাগদাদ এবং এর আশপাশে খেলাফত পূন:প্রতিষ্ঠার প্রয়াস পেয়েছিলেন। ধর্মীয় পুনর্জাগরণের শক্তি উপলব্ধি করে ইসলামের আশ্রয় নেন তিনি। আদিতে খেলাফত শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদস্বরূপ শরিয়ার আবির্ভাব ঘটেছিল, কিন্তু আল-নাসির আলিম হওয়ার লক্ষ্যে এবার চারটি সুন্নী মতবাদ নিয়েই পড়াশোনায় লিপ্ত হলেন। এক ফুতুওয়াহ্ সংগঠনেও যোগ দিয়েছিলেন তিনি, উদ্দেশ্য ছিল নিজেকে বাগদাদের সকল ফুতুওয়াত্র মহাগুরু (Grand Master) হিসাবে গড়ে তোলা। আল-নাসিরের পরলোকগমনের পর তাঁর উত্তরাধিকারীগণ এই নীতিমালা অব্যাহত রাখেন। কিন্তু বড্ড দেরি হয়ে গিয়েছিল। অচিরেই ইসলামী জগৎ এক মহাবিপর্যয়ের মুখে পড়ে, যা শেষ পর্যন্ত আব্বাসীয় খেলাফতের সহিংস ও করুণ পরিসমাপ্তি ডেকে এনেছিল।

মঙ্গোল (১২২০-১৫০০ )

দূরপ্রাচ্যে মঙ্গোল গোত্র অধিপতি জেংঘিস খান এক বিশ্ব-সাম্রাজ্য গড়ে তুলছিলেন, ইসলামী জগতের সঙ্গে তাঁর সংঘাত ছিল অনিবার্য। সেলজুকদের বিপরীতে তিনি তাঁর যাযাবর বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণে রেখে শৃঙ্খলাবদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি তাদের এমন এক যুদ্ধবাজ যন্ত্রে পরিণত করেন যে তাদের মত ধ্বংসাত্মক ক্ষমতার অধিকারী বাহিনী বিশ্ব এর আগে কখনও প্রত্যক্ষ করেনি। কোনও শাসক যদি অবিলম্বে এই মঙ্গোল গোত্রপতির কাছে নতি স্বীকার না করতেন, অনায়াসে ধরে নেয়া যেত যে তাঁর রাজ্যের প্রধান প্রধান নগর ভূমিস্মাৎ হয়ে গেছে, হত্যাযজ্ঞে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে অধিবাসীরা। মঙ্গোলদের হিংস্রতা পরিকল্পিত কৌশল ছিল বটে; কিন্তু তা নাগরিক সংস্কৃতির বিরুদ্ধে যাযাবর গোষ্ঠীর তীব্র অসন্তোষেরও পরিচায়ক। খয়ারাযমিয়ান তুর্কিদের শাহ্ মুহাম্মদ (১২০০-১২২০) যখন ইরান এবং ওক্সাস অঞ্চলে নিজস্ব মুসলিম খেলাফত গড়ে তোলার প্রয়াস পান, মঙ্গোল সেনাপতি হুলেগু (Hulegu) বেপরোয়া ঔদ্ধত্য বলে ধরে নেন একে। ১২১৯ থেকে ১২২৯ পর্যন্ত মঙ্গোলরা মুহাম্মদ এবং তাঁর পুত্র জালাল আল-দিনকে গোটা ইরান থেকে আযেরবাইজান হয়ে সিরিয়া পর্যন্ত মৃত্যু আর ধ্বংসের তাণ্ডবলীলা চালিয়ে ধাওয়া করে বেরিয়েছে। ১২৩১-এ নতুন করে আবার উপর্যুপরি হামলার সূচনা ঘটে। একের পর এক মুসলিম নগরী ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। ধূলিসাৎ হয়ে যায় বুখারা, একমাত্র যুদ্ধে পতন ঘটে বগদাদের, সেই সঙ্গে অবসান ঘটে মৃত্যুপথযাত্রী খেলাফতের: পথে পথে লাশের স্তূপ পড়েছিল, শরণার্থীরা পালিয়ে গিয়েছিল সিরিয়া, ইরাক আর ভারতে। আলামুতের ইসমায়েলিদের নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হয় এবং যদিও রামে সেলজুকদের নতুন রাজবংশ দ্রুত মঙ্গোলদের কাছে নতি স্বীকার করেছিল, কিন্তু তা আর কখনওই সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। প্রথম যে মুসলিম শাসক মঙ্গোলদের ঠেকিয়ে দিতে সক্ষম হন তিনি হলেন তুর্কি দাস বাহিনী শাসিত নতুন মিশরীয় রাষ্ট্রের সুলতান বায়বরস। মামলুকরা (দাস) সালাদিন প্রবর্তিত আইয়ুবীয় সাম্রাজ্যের সেনাবাহিনীতে প্রাধান্য বিস্তার করেছিল; ১২৫০-এ মামলুক আমিরগণ আইয়ুবীয় রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সফল অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিয়ে নিকট প্রাচ্যে নিজস্ব সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। ১২৬০-এ উত্তর প্যালেস্টাইনের আইন জালুটে বায়বরস মঙ্গোল সেনাবাহিনীকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেন। ভারতে পরিচালিত আক্রমণ দিল্লীর নয়া সালতানাত ঠেকিয়ে দেয়ার পর মঙ্গোলরা বিজয়ের ফল ভোগ করার উদ্দেশ্যে স্থির হয়, চীনে অবস্থানরত মঙ্গোল খান কুবলাইয়ের অনুগত ইসলামী জগতের কেন্দ্রভূমিতে সাম্রাজ্য গড়ে তোলে তারা।

মঙ্গোলরা চারটি বৃহদাকার রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে ছিল। ইল-খানস্ নামে পরিচিত (মহাশক্তিধর খানের প্রতিনিধি) হুলেগুর বংশধররা প্রথমে তাদের পরাজয়কে চূড়ান্ত বলে মানতে চাননি, দামাস্কাস ধ্বংস করার পর অবশেষে ক্ষান্ত হন তাঁরা এবং টাইগ্রিস-ইউফ্রেটিস উপত্যকা আর ইরানের পার্বত্য অঞ্চলে আপন সাম্রাজ্যে প্রত্যাবর্তন করেন। চ্যাঘাতাই মঙ্গোলরা সির-ওক্সাস বেসিনে একটি রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিল, অন্যদিকে হোয়াইট হোর্ডরা (White Horde) আরটিশ (Irtish) এলাকায় আর গোল্ডেন হোর্ডরা (Golden Horde) ভলগা নদীর আশেপাশে বসতি গড়ে। সপ্তম শতাব্দীর আরবীয় আগ্রাসনের পর এটাই ছিল মধ্যপ্রাচ্যে সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক পট পরিবর্তন; কিন্তু আরব মুসলিমদের বিপরীতে মঙ্গোলরা সঙ্গে করে কোনও আধ্যাত্মিকতা নিয়ে আসেনি। অবশ্য তারা সকল ধর্মের প্রতি সহিষ্ণু ছিল, যদিও ঝোঁক ছিল বুদ্ধ মতবাদের দিকে। তাদের আইন কাঠামো, ইয়াসা (Yasa) যা স্বয়ং জেংঘিস খানের অবদান, ছিল একেবারেই সামরিক ব্যবস্থা, যা সাধারণ জনগণকে প্রভাবিত করেনি। মঙ্গোলদের নীতি ছিল কোনও এলাকা কুক্ষিগত করার পর সেখানকার স্থানীয় ট্র্যাডিশনের অনুযায়ী অগ্রসর হওয়া, ফলে এয়োদশ শতাব্দীর শেষ এবং চতুর্দশ শতাব্দীর শুরু নাগাদ চারটি মঙ্গোল সাম্রাজ্যই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল।

তো মঙ্গোলরা কেন্দ্রীয় ইসলামী মূল এলাকার প্রধান মুসলিম শক্তি হয়ে ওঠে। কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলামের প্রতি আনুগত্য যাই হোক না কেন তাদের রাষ্ট্রীয় মূল আদর্শ ছিল “মঙ্গোলিজম” যা মঙ্গোলদের সাম্রাজ্যবাদী এবং সামরিক শক্তিকে মহিমান্বিত করেছে আর বিশ্ব বিজয়ের স্বপ্ন দেখিয়েছে। গোটা রাজ্য সামরিক কায়দায় পরিচালিত হত। সম্রাট ছিলেন সর্বাধিনায়ক এবং তিনি স্বয়ং সেনাদলের নেতৃত্ব দেবেন বলে প্রত্যাশিত ছিল, অভিযানের দায়িত্ব সহকারীদের ওপর ছেড়ে দেবেন না। এই কারণে গোড়ার দিকে কোনও রাজধানী ছিল না। খান এবং তাঁর সেনাবাহিনী যখন যেখানে শিবির স্থাপন করতেন সে জায়গাই রাজধানীতে পরিণত হত। রাজ্যের পুরো প্রশাসনিক ব্যবস্থা সেনাবাহিনীর মত পরিচালিত হত, প্রশাসন সেনাবাহিনীর সঙ্গে অভিযানে যোগ দিত। জটিল শিবির সংস্কৃতি অসাধারণ দক্ষতার সঙ্গে পরিচালিত হয়েছে। প্রধান দুটো রাজনৈতিক লক্ষ্য ছিল: বিশ্ব শাসন আর শাসক রাজবংশের স্থায়িত্ব নিশ্চিতকরণ, যে জন্যে সবরকম নিষ্ঠুরতাই বৈধ। এই আদর্শের সঙ্গে প্রাচীন অ্যাবসোলিউটিস্ট পলিটির সাদৃশ্য আছে, যেখানে বিশ্বাস করা হত যে শাসনকর্তার ক্ষমতা যত বেশী হবে রাজ্যের শান্তি আর নিরাপত্তাও তত দৃঢ় হবে। কোনও রাজবংশের সকল সম্রাটের জারি করা আদেশ পরিবার যতদিন ক্ষমতাসীন থাকত ততদিন কার্যকর বলে বিবেচিত হত, ফলে অন্য সব আইনগত ব্যবস্থা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ত। সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সকল দায়িত্ব পরিবারের সদস্য আর স্থানীয় ক্লায়েন্ট ও আশ্রিতদের মাঝে বণ্টন করা হত, যাদের সবাইকে রাজ্যের কেন্দ্রে বিশাল যাযাবর বাহিনীর অনুগামীতে পরিণত করা হত।

ইসলামের সাম্যবাদী চেতনার সঙ্গে এমন ব্যাপক পার্থক্য আর কিছু হতে পারে না; কিন্তু এক অর্থে এটা ছিল আব্বাসীয় খেলাফতের শেষ পর্যায়ে সংঘটিত সমাজ ব্যবস্থার সামরিকীকরণেরই ধারাবাহিকতা, যেখানে আমিরগণ গ্যারিসনে অবস্থান করে শাসন কাজ চালাতেন আর সাধারণ মানুষ ও উলেমাগণ চলতেন তাদের নিজস্ব ইসলামী ব্যবস্থায়। কোনও আমির স্থিতিশীলতার অনুরূপ কিছু অর্জনে সক্ষম হলে নাগরিক জীবনে সামরিক হস্তক্ষেপের প্রবল সম্ভাবনা সবসময়ই রয়ে যেত। মঙ্গোল শাসকদের অধীনে একটা পর্যায় পর্যন্ত এমনটি ঘটেছে, যারা উলেমাদের ওপর নতুন নতুন বিধিনিষেধ আরোপের মত যথেষ্ট ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। শরিয়াহকে আর সম্ভাব্য রাজদ্রোহী আইন থাকতে দেয়া হয়নি। পঞ্চদশ শতাব্দী নাগাদ ঐক্যমত প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় যে উলেমাগণ আর নিজস্ব স্বাধীন বিবেচনা বোধ (ইজতিহাদ) প্রয়োগ করে আইন নির্মাণ করতে পারবেন না; বলা হয় যে “ইজতিহাদের দ্বার” বন্ধ হয়ে গেছে। মুসলিমরা অতীতের কর্তৃপক্ষের বিধিবিধান মেনে নিতে বাধ্য হল। নীতিগতভাবে শরিয়াহ্ প্রতিষ্ঠিত নিয়মকানুনের একটা ব্যবস্থায় পরিণত হল, যা শাসক পরিবারের অধিকতর গতিশীল বংশগত আইনকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিতে পারবে না।

মুসলিম জীবনে মঙ্গোল হস্তক্ষেপ ছিল বেদনাদায়ক। মঙ্গোলরা তাদের পেছনে ধ্বংসপ্রাপ্ত নগরী আর লাইব্রেরির ভস্মস্তূপ রেখে গিয়েছিল, সেই সঙ্গে অর্থনৈতিক পঙ্গুভাব। কিন্তু বিজয় অর্জন করার পর মঙ্গোলরা ধ্বংস করা নগরীগুলোকে চোখ ধাঁধানো রূপে পুনর্নির্মাণ করে। জাঁকাল দরবারও প্রতিষ্ঠা করে তারা যেখানে বিজ্ঞান, শিল্পকলা, ইতিহাস আর অতীন্দ্রিয়বাদ পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছে। মঙ্গোলদের ধ্বংস ভয়াবহ হলেও, মঙ্গোল শাসকরা মুসলিম প্রজাদের দৃষ্টিতে আকর্ষণীয় ছিলেন। তাদের রাজনৈতিক কাঠামোগুলো নীরব স্থায়ীত্ব পেয়েছে এবং আমরা লক্ষ্য করব, পরবর্তীকালের মুসলিম সাম্রাজ্যগুলো এর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। মঙ্গোলদের ক্ষমতা নতুন দিগন্তের আভাস দিয়েছিল। তারা যেন গোটা বিশ্ব জয় করবে বলে মনে হয়েছিল। এক নতুন ধরনের সাম্রাজ্যবাদের প্রতিভূ ছিল তারা যা প্রবল ধ্বংসযজ্ঞের সঙ্গে যোগ করেছিল বিশ্ব শাসনের সম্ভাবনা। তাদের সাম্রাজ্যের জাঁকজমকে চোখ ধাঁধিয়ে গেছে। তারা মুসলিমদের পূর্ব-ধারণাকে বিনষ্ট করলেও মুসলিমরা কিন্তু তাদের প্রত্যক্ষ করা হিংস্রতায় নিষ্ক্রিয় হয়ে হয়ে পড়েনি, কিংবা এইসব মঙ্গোলরাজ্যগুলোর তুলে ধরা রাজনৈতিক পরাজয় হতদ্যোম করেনি তাদের। ইসলাম একটি স্থিতিস্থাপক ধর্ম। মুসলিমরা তাদের ইতিহাসে বারবার বিপর্যয়ের প্রতি ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে এবং নতুন ধর্মীয় দর্শন (insight) পাবার লক্ষ্যে গঠনমূলকভাবে একে ব্যবহার করেছে। তো মঙ্গোল-আগ্রাসনের পরেও তাই ঘটেছে; মানুষ তখন অনুভব করল যে তাদের চেনা জগতের অবসান ঘটতে যাচ্ছে, কিন্তু আবার একেবারে নতুন এক বৈশ্বিক ব্যবস্থাও সম্ভব হয়ে উঠতে পারে।

সুফি অতীন্দ্রিয়বাদী জালাল আল-দিন রুমির (১২০৭-৭৩) দর্শনে এ ব্যাপারটা পরিষ্কার ধরা পড়েছে। নিজে মঙ্গোলদের শিকার ছিলেন তিনি, কিন্তু তাঁর শিক্ষা মঙ্গোলদের বয়ে আনা সীমাহীন সম্ভাবনার বোধটিকেই তুলে ধরে। রুমির জন্ম হয়েছিল খুরাসানে, তাঁর পিতা ছিলেন একজন আলিম এবং সুফিগুরু। রুমি স্বয়ং ফিক্হ, থিয়োলজি, আরবী এবং পারসিয়ান সাহিত্যে বুৎপত্তি অর্জন করেছিলেন। কিন্তু অগ্রসরমান মঙ্গোল অশ্বারোহীবাহিনীর কবল থেকে রক্ষা পেতে তাঁর পরিবার পালাতে বাধ্য হয়। তাঁরা আনাতোলিয়ায় রাম সালতানাতের রাজধানী কোনিয়ায় শরণার্থী হিসাবে আসেন। রুমির আধ্যাত্মিকতা সৃষ্টির গৃহহীনতা আর ঐশী উৎস ঈশ্বর হতে বিচ্ছিন্নতার অনুভূতিতে পরিপূর্ণ। মানুষের উপর নেমে আসা সবচেয়ে মারাত্মক দুর্ভাগ্য হল, জোর দিয়ে বলেছেন রুমি, বিচ্ছিন্নতার যন্ত্রণা অনুভব না করা, যা নারী বা পুরুষকে ধর্মীয় অনুসন্ধানে তাড়িত করে। আমাদের অবশ্যই নিজের অসম্পূর্ণতা উপলব্ধি করতে হবে, বুঝতে হবে যে আমাদের আত্মবোধ এক মায়া। আমাদের অহম বাস্তবতাকে আড়াল করে রাখে এবং অহমবোধ ও স্বার্থপরতাকে বিসর্জন দেয়ার ভেতর দিয়ে আমরা আবিষ্কার করব যে একমাত্র ঈশ্বরই অস্তিত্ববান।

রুমি ছিলেন “মাতাল সুফি” (Drunken Sufi)। তাঁর আধ্যাত্মিক ও ব্যক্তিজীবন বিভিন্ন চরম আবেগের পর্যায় স্পর্শ করেছে; নৃত্য, সঙ্গীত, কবিতা এবং গানে পরমানন্দের (ecstacy) অনুসন্ধান করেছেন তিনি এবং তাঁর প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থার সদস্যদের প্রায়ই তাদের অনন্য ঘূর্ণি-নৃত্যের কারণে “ঘূর্ণায়মান দরবেশ” (Whirling Dervishes) বলে অভিহিত করা হয়; এই নাচ অতিলৌকিকের এক ঘোরলাগা অবস্থার সৃষ্টি করে। রুমি তাঁর স্পষ্ট অস্থিতিশীলতা সত্ত্বেও জীবৎকালে অনুসারীদের কাছে মাওলানাহ্ (আমাদের প্রভু) হিসাবে পরিচিত ছিলেন এবং আজও টার্কিতে তাঁর মাওলানাহ্ ব্যবস্থার বিপুল প্রভাব রয়েছে। তাঁর প্রধান রচনা মাসনাবি (Mathnawi) সুফি ধর্মগ্রন্থ হিসাবে পরিচিত। ইবন আল-আরাবি যেখানে মননশীলদের জন্যে লেখালেখি করেছেন রুমি সেখানে সমগ্র মানব জাতিকে নিজেদের ঊর্ধ্বে ওঠার আহবান জানিয়েছেন, দৈনন্দিন জীবনের নৈমিত্তিকতাকে ছাড়িয়ে যেতে বলেছেন। মাসনাবি সুফি জীবনধারাকে বিধি-সম্মত করে তোলে যা যে-কাউকে স্বর্গলোক এবং আত্মার মাঝে চিরন্তন যুদ্ধে অপরাজেয় বীরে রূপান্তরিত করতে পারে। মঙ্গোল আগ্রাসনসমূহ এক অতীন্দ্রিয়বাদী আন্দোলনের জন্ম দিয়েছিল, জনগণকে তাদের মনের গভীরে অনুভূত বিপর্যয় সামলে ওঠার শক্তি জুগিয়েছে তা এবং রুমি ছিলেন এক্ষেত্রে সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব এবং আদর্শ। এই সময়ে প্রতিষ্ঠিত নতুন সুফি তরিকাসমূহ মানবজীবনের সীমাহীন সম্ভাবনার ওপর জোর দিয়েছে। মঙ্গোলরা জাগতিক রাজনীতিতে যা অর্জন করেছিল সুফিগণ সেটাই আধ্যাত্মিক পর্যায়ে অনুভব করতে পারে।

অন্যরা এসময়ের উত্থান-পতনে ভিন্নভাবে সাড়া প্রদান করেছিল। আগ্রাসনের ফলে সৃষ্ট ধ্বংসযজ্ঞ, যখন অনেক কিছুই হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিল, এক ধরনের রক্ষণশীলতার জন্ম দিয়েছিল, কৃষিভিত্তিক সমাজের যা চিরন্তন বৈশিষ্ট্য। সীমিত সম্পদ যখন থাকে তখন, আধুনিক পাশ্চাত্যে যেমন পারি আমরা, তেমনিভাবে আবিষ্কার বা মৌলিক উদ্ভাবনে উৎসাহ জোগানো সম্ভব হয় না। পাশ্চাত্যে আমরা আমাদের পিতা-মাতার প্রজন্মের চেয়ে আরও বেশী জানতে চাই এবং আমাদের সন্তানরা আরও সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ ভোগ করবে বলে আশা করি। আমাদের পূর্ববর্তী কোনও সমাজের এভাবে বর্তমান কালের উদ্ভাবনের দাবী অনুযায়ী কর্মীদের লাগাতারভাবে পুন:প্রশিক্ষণ আর অবকাঠামোর পরিবর্তন আনার সাধ্য ছিল না। পরিণামস্বরূপ, প্রাক-আধুনিক সকল সমাজে, কৃষিভিত্তিক ইউরোপসহ, শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য ছিল ইতিমধ্যে যা কিছু অর্জিত হয়েছে তাকে টিকিয়ে রাখা এবং ব্যক্তিবিশেষের উদ্ভাবনী ক্ষমতা ও কৌতূহলে প্রতিবদ্ধকতা সৃষ্টি করা, যেন সমাজ বা গোষ্ঠীর স্থিতিশীলতা বিনষ্ট না হয়। কেননা, ওই সামজের নবনব ধারণার সংহতি ও প্রয়োগ করার কোনও উপায় ছিল না। উদাহরণস্বরূপ, মাদ্রাসাসমূহে ছাত্ররা প্রাচীন বিবরণ ও টীকাভাষ্য মন দিয়ে মুখস্থ করেছে এবং শিক্ষার উপাদান ছিল একটি মান-গ্রন্থের শাব্দিক ব্যাখ্যা। পণ্ডিতদের মধ্যে প্রকাশ্য বিতর্কের ক্ষেত্রে ধরেই নেয়া হত যে বিতর্কে অংশগ্রহণকারীদের একজন সঠিক ও অন্যজন অসঠিক। প্রশ্নোত্তরমূলক ধরনের পাঠে বিপরীতমুখী দুটি পক্ষের মাঝে বিরোধের ভেতর দিয়ে কোনও নতুন সিন্থেসিস বের করে আনার ভাবনা ছিল না। এভাবে মাদ্রাসাসমূহ সেইসব ধ্যান- ধারণার গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর প্রয়াস পেয়েছে যেগুলোর সাহায্যে সারা বিশ্বের মুসলিমদের ঐক্যবদ্ধ করা যাবে এবং ধর্ম বিরোধী ধ্যান ধারণাকে চাপা দেয়া যাবে, যেন বিরোধ সৃষ্টির ফলে মানুষ সরল পথ ত্যাগ করে আপন পথ বেছে না নেয়।

চতুর্দশ শতাব্দী নাগাদ একমাত্র শরিয়া পাঠ ও পালনই সুন্নী, শিয়া, সুফি এবং ফায়লাসুফ- অর্থাৎ সকল মুসলিমের গৃহীত ধার্মিকতার রূপ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এই সময়ের উলেমারা বিশ্বাস করতে থাকেন যে ইসলামী ইতিহাসের একেবারে সূচনাকাল থেকেই এসব আইনের অস্তিত্ব রয়েছে। এভাবে রুমির মত কিছু সুফি যখন নতুন দিগন্তের দিকে তাকানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন, উলেমাদের অনেকেই তখন বিশ্বাস করছিলেন যে কিছুই পরিবর্তিত হয়নি। এ কারণে “ইজতিহাদের দ্বার” রুদ্ধ হওয়ায় সন্তুষ্ট ছিলেন তাঁরা। অতীতের শিক্ষার ব্যাপক ক্ষতি, পাণ্ডুলিপির বিনাশ এবং জ্ঞানী-গুণীদের নির্বিচারে হত্যার পর সম্পদের পুনরুদ্ধারই নতুন কোনও পরিবর্তন আনার চেয়ে ঢের বেশী গুরুত্বপূর্ণ ছিল। মঙ্গোল সামরিক আইনে সাধারণ নাগরিকদের বিষয়ে কোনও বিধিব্যবস্থা না থাকায় উলেমারা বিশ্বাসীদের জীবনধরন পরিচালনা অব্যাহত রাখেন এবং তাঁদের প্রভাব রক্ষণশীলতার দিকে ধাবিত হয়। রুমির মত সুফিরা যেখানে সকল ধর্মকেই বৈধ বলে বিশ্বাস করেছেন, চতুর্দশ শতাব্দী নাগাদ উলেমাগণ সেখানে কুরানের বহুত্ব মতবাদকে কঠিন সাম্প্রদায়িকতায় রূপ দিয়েছেন, যেখানে অন্য ট্র্যাডিশনসমূহকে অতীতের মূল্যহীন নজীর হিসাবে দেখা হয়। অমুসলিমদের জন্যে এই সময় পবিত্র নগরী মক্কা ও মদীনা সফর নিষিদ্ধ হয়ে যায়, আর পয়গম্বর মুহাম্মদ(স:) সম্পর্কে কোনও আপত্তিকর মন্তব্য প্রকাশ পরিণত হয় মৃত্যুদণ্ডযোগ্য অপরাধে। এখানে বিস্ময়ের কিছু নেই, আগ্রাসনের যাতনা মুসলিমদের মাঝে নিরাপত্তাহীনতার বোধ জাগিয়েছিল। ভিনদেশীরা কেবল সন্দেহভাজনই নয়, তারা মঙ্গোলদের মতই ভয়ঙ্কর হতে পারে।

কিন্তু “ইজতিহাদের দ্বার” রুদ্ধ হওয়ার ব্যাপারটি মেনে নিতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপনকারী উলেমাগণও ছিলেন। সমগ্র ইসলামী ইতিহাস জুড়ে, রাজনৈতিক সংকটের সময়–বিশেষ করে বিদেশী দখলদারিত্বের সময়- একজন সংস্কারক (মুজদাদিদ) প্রায়শ বিশ্বাসের জাগরণ ঘটান যাতে তা নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে। এইসব সংস্কারক সাধারণত একই প্যাটার্ন অনুসরণ করে থাকেন। এগুলো রক্ষণশীল, কেননা একেবারে নতুন সমাধান সৃষ্টির বদলে তা মূলে প্রত্যাবর্তনের প্রয়াস পায়। কিন্তু কুরান ও সুন্নাহর আদি ইসলামে ফিরে যাবার আকাঙ্ক্ষা থেকে সংস্কারকারকগণ প্রায়শই পবিত্র বলে বিবেচিত পরবর্তী মধ্যযুগীয় সকল পরিবর্তনকে প্রতিমা পূজার বিরোধিতার মত বিতাড়ন করতে চান। এঁরা বিদেশী প্রভাবের বেলায়ও সন্দিহান হন এবং ভিনদেশী সংযোগও– যা তাঁদের দৃষ্টিতে ধর্মবিশ্বাসের খাঁটিত্বকে বিনষ্ট করে। এধরনের সংস্কারকগণ মুসলিম সমাজের একটা বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছেন। আমাদের বর্তমান সময়ে যাদের “মুসলিম মৌলবাদী” বলে আখ্যায়িত করা হয়, তাদের অনেকেই মুজদাদিদদের রেখে যাওয়া পুরনো প্যাটার্নই হুবহু বেছে নিয়েছে।

মঙ্গোল পরবর্তীকালের পৃথিবীর যুগ-শ্রেষ্ঠ সংস্কারক ছিলেন আহমাদ ইবন তাঈমিয়াহ্ (১২৬৩-১৩২৮)। দামাস্কাসের আলিম ছিলেন তিনি, মঙ্গোলদের চরম ধ্বংসযজ্ঞের শিকার হয়েছিল নগরীটি। হানবালি মাযহাবের অনুসারী এক প্রাচীন উলেমা পরিবারে ইবন তাঈমিয়ার জন্ম, শরিয়া মূল্যবোধ সুসংহত করতে চেয়েছিলেন তিনি। তিনি ঘোষণা করেন যে, যদিও মঙ্গোলরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে, কিন্তু আসলে তারা অপশক্তি এবং ধর্মত্যাগী, কেননা তারা শরিয়াহ্র পরিবর্তে ইয়াসা জারি করেছে। একজন প্রকৃত সংস্কারকের মতই পয়গম্বর ও রাশিদুন পরবর্তী যুগে ইসলামের বিকাশকে –যেমন শিয়াবাদ, সুফিবাদ এবং ফালসাফাহ্- মেকি হিসাবে আক্রমণ করেছেন তিনি,। তবে তাঁর একটা ইতিবাচক কর্মসূচীও ছিল। পরিবর্তিত এই সময়ে মুসলিমদের প্রকৃত অবস্থার সঙ্গে সামজ্ঞস্যপূর্ণ করার স্বার্থে শরিয়াহ্কে সময়োপযোগী করতে হবে, সেজন্যে যদি কয়েক শতাব্দী ধরে গড়ে ওঠা ফিক্হ’র বেশীরভাগ বিসর্জনও দিতে হয়। সুতরাং শরিয়ার চেতনামুখী বৈধ সমাধান আবিষ্কারের লক্ষ্যে জুরিস্টদের জন্যে ইজতিহাদের প্রয়োগ আবশ্যক, যদি তাতে সাম্প্রতিককালে যেভাবে আইনের ভাষ্য নেয়া হচ্ছে তার লঙ্ঘনও ঘটে। প্রশাসনের জন্যে উদ্বেগজনক ব্যক্তি ছিলেন ইবন তাঈমিয়াহ্। কুরান ও সুন্নাহ’য় তাঁর প্রত্যাবর্তন এবং ইসলামের সমৃদ্ধ আধ্যাত্মিকতা ও দর্শনের বেশীরভাগেরই প্রত্যাখ্যান হয়ত প্রতিক্রিয়াশীলতা ছিল, কিন্তু আবার বিপ্লবীও। রক্ষণশীল উলেমাদের খেপিয়ে তুলেছিলেন তিনি, যাঁরা গ্রন্থভুক্ত জবাব আঁকড়ে ছিলেন; সিরিয়ার মামলুক সরকারেরও সমালোচনা করেছেন তিনি, তাঁর দৃষ্টিতে ইসলামী আইনবিরোধী আচার অনুষ্ঠান অনুসরণ করার কারণে। ইবন তাঈমিয়াহকে কারারুদ্ধ করা হয়েছিল এবং বলা হয় যে মনের দুঃখে মারা গেছেন তিনি, কারণ আটককারীরা তাঁকে লেখালেখির অনুমতি দেয়নি। কিন্তু দামাস্কাসের সাধারণ মানুষ তাঁকে ভালোবেসেছিল, কেননা তারা বুঝতে পেরেছিল যে তাঁর শরিয়ার সংস্কার উদারপন্থী ছিল এবং তিনি মনেপ্রাণে তাদের প্রয়োজনের কথা ভেবেছেন। তাঁর শেষকৃত্যানুষ্ঠানটি গণস্বীকৃতির এক বিশাল প্রদর্শনীতে পরিণত হয়েছিল।

পরিবর্তন উত্তেজনাকর হতে পারে, আবার বিব্রতকরও। টিউনিসে আব্দ আল- রাহমান ইবন খালদুন (১৩৩২-১৪০৬) ইসলামী জগতের পশ্চিম প্রান্ত, মাগরিবে একের পর এক রাজবংশের পতন প্রত্যক্ষ করেছেন। প্লেগ মহামারিতে ধ্বংস হয়ে গেছে অসংখ্য জনবসতি। যাযাবর গোত্রগুলো মিশর থেকে উত্তর আফ্রিকায় এসে ব্যাপক বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়, সেই সঙ্গে যোগ হয় ঐতিহ্যবাহী বারবার (Berbar) সমাজের নিম্নমুখী যাত্রা। ইবন খালদুন স্বয়ং টিউনিসিয়ায় এসেছিলেন স্পেন থেকে, যেখানে ক্রিশ্চানরা মুসলিম এলাকায় এক সফল রিকনকুইস্টা (reconquista) পরিচালনা করে ১২৩৬-এ কর্ডোভা এবং ১২৪৮-এ সেভিল দখল করে নিয়েছিল। সমৃদ্ধ মুসলিম রাজ্য আল-আন্দালুসের বাকি রয়ে গিয়েছিল কেবল নগর-রাজ্য গ্রানাডা, যা ১৪৯২তে ক্রিশ্চানদের কাছে পরাস্ত হয়, কিন্তু তার আগেই চতুর্দশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে অনন্যসাধারণ আলহাম্বরা প্রাসাদ নির্মিত হয়ে গিয়েছিল। স্পষ্টতই সঙ্কটে নিপতিত ছিল ইসলাম। “যখন পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন ঘটে,” বলেছেন ইবন খালদুন, “সেটা যেন গোটা সৃষ্টি বদলে যাওয়া, বদলে যাওয়া গোটা বিশ্বেরই, যেন নতুন করে সৃষ্টি ঘটছে, এক পুনর্জন্ম, নতুন করে অস্তিত্ব পেয়েছে জগৎ।”

ইবন খালদুন এই পরিবর্তনের অন্তর্নিহিত কারণগুলো আবিষ্কার করতে চেয়েছিলেন। সম্ভবত: তিনি ছিলেন সর্বশেষ প্রধান স্প্যানিশ ফায়লাসুফ; তাঁর অসাধারণ উদ্ভাবন ছিল ইতিহাসের পর্যালোচনার ক্ষেত্রে দার্শনিক যুক্তিবাদের নীতিমালার প্রয়োগ, এর আগে পর্যন্ত যা দার্শনিকদের মনোযোগের বাইরে ছিল বলে মনে করা হয়, কেননা এটা চিরন্তন সত্যের পরিবর্তে কেবল অস্থায়ী, অনিশ্চিত ঘটনাবলী নিয়ে কাজ করে। কিন্তু ইবন খালদুন বিশ্বাস করতেন যে, ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহের অন্তরালে বিশ্বজনীন আইন সমাজের ভাগ্যকে পরিচালিত করে। তিনি সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে দলীয় সংহতির (আসিবীয়াহ্-asibiyyah) প্রবল বোধই কোনও জাতিকে টিকে থাকতে সক্ষম করে তোলে এবং অনুকূল পরিস্থিতিতে অন্য জাতিকে বশীভূত করা যায়। এই অধিকার বোঝায় যে প্রভাবশালী দলটি অধীনের লোকদের সম্পদ আত্মীকরণ করে সংস্কৃতি আর জটিল নাগরিক জীবন গড়ে তুলতে পারে। কিন্তু শাসকশ্রেণী যখন বিলাসবহুল জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ে, আত্মপ্রসাদ জাঁকিয়ে বসে তখন এবং তারা তাদের প্রাণশক্তি হারাতে শুরু করে। তারা আর তখন প্রজাদের দিকে যথেষ্ট মনোযোগ দেয় না, নিজেদের মাঝে ঈর্ষা আর কোন্দল শুরু হয়ে যায়; অর্থনীতি নিম্নগামী হতে শুরু করে। এভাবে রাষ্ট্রটি এক নয়া গোত্রীয় বা যাযাবর বাহিনীর কাছে, যারা তাদের নিজস্ব আসিবীয়ার প্রথম পর্যায়ে, নাজুক হয়ে পড়ে এবং আবার চক্রটির সূচনা ঘটে। ইবন খালদুনের প্রধান রচনা আল- মাকাদ্দিমাহ্: অ্যান ইনট্রোডাকশন টু হিস্ট্রি’ ইসলামের ইতিহাসে এই তত্ত্বের প্রয়োগ দেখিয়েছে, যা পরবর্তী বছরগুলোয় মুসলিম সাম্রাজ্য নির্মাণকারীগণ ও উনবিংশ শতাব্দীর পাশ্চাত্য ঐতিহাসিকগণ নিবিষ্ট মনে পাঠ করেছেন। ইবন খালদুনকে ইতিহাসের বিজ্ঞানভিত্তিক পর্যালোচনার ক্ষেত্রে পথপ্রদর্শক হিসাবে দেখেছেন এঁরা চতুদর্শ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে মঙ্গোল রাজ্যগুলোর পতন প্রত্যক্ষ করতে পেরেছিলেন ইবন খালদুন, যা তাঁর তত্ত্বকে স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে। তাদের আদি আসিবীয়াহ্ চরমে পৌঁছেছিল, আত্মপ্রসাদ জাঁকিয়ে বসেছিল, এবং মঞ্চ তৈরি হয়ে গিয়েছিল অন্য প্রভাবশালী দলের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করার। এটা স্বাভাবিক বলে মনে হয়েছিল যে নতুন নেতাদের আগমন ঘটবে ইসলামের প্রাণকেন্দ্র থেকে নয় বরং মুসলিম বিশ্বের প্রান্তবর্তী এলাকা থেকে, যা মঙ্গোল শাসনাধীন ছিল না। ইতিমধ্যে মিশর ও সিরিয়ায় মামলুক সাম্রাজ্যেরও পতন শুরু হয়ে গিয়েছিল। তুঙ্গ সময়ে মামলুকরা শক্তিশালী esprit de corps এর এক বিকাশমান সংস্কৃতিক প্রাণবন্ত সমাজ নির্মাণ করেছিল। কিন্তু পঞ্চদশ শতাব্দী নাগাদ যেকোনও কৃষিভিত্তিক রাজ্যের মত সম্পদ ফুরিয়ে যাওয়ায় সাম্রাজ্যটি ধসে পড়তে শুরু করে।

সময়ের চেতনা পূর্ণাঙ্গভাবে প্রকাশ করেছিলেন যে শাসক, তিনি সির (Syr) উপত্যকাবাসী এক তুর্কি, সমরকন্দে মঙ্গোল চ্যাঘাতাই রাজ্যে বেড়ে উঠেছিলেন তিনি এবং মঙ্গোল আদর্শের প্রতি প্রচণ্ড দুর্বল ছিলেন। টিমুর (১৩৩৬-১৪০৫), যিনি টিমুর ল্যাঙ্ক (খোঁড়া টিমুর) নামে পরিচিত, কারণ স্পষ্ট খুঁড়িয়ে চলতেন তিনি, পাশ্চাত্য যার পরিচয় টাম্বুর লেইন, পতনোম্মুখ চ্যাঘাটাই সাম্রাজ্যের ক্ষমতা দখল করে নিজেকে মঙ্গোল বংশোদ্ভূত দাবী করেন এবং অতীতের হামলাগুলোর মতই একই রকম বর্বরতায় পুরনো মঙ্গোল এলাকা পুনর্দখলে নামেন। টিমুর তাঁর সাফল্যের তীব্র আকাঙ্ক্ষা আর ধ্বংসলীলার প্রতি আকর্ষণকে ইসলামের প্রতি আবেগের সঙ্গে মিশিয়ে ফেলেছিলেন, আর যেহেতু তিনি তাঁর সময়ের চেতনাকে নিখুঁতভাবে ধারণ করেছেন, একজন লোকনায়কে পরিণত হন তিনি। সমরকন্দে দৃষ্টিনন্দন প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন, সেখানে জাঁকজমকপূর্ণ দরবারে বসতেন। তাঁর ইসলামের- গোঁড়ামিপূর্ণ, নিষ্ঠুর এবং সহিংস –সঙ্গে উলেমাদের রক্ষণশীল ধার্মিকতা বা সুফিদের ভালোবাসার মতবাদের সামান্যই মিল ছিল। নিজেকে আল্লাহ্র শাস্তিদূত হিসাবে দেখেছেন তিনি, মুসলিম আমিরদের অন্যায় আচার অনুষ্ঠানের কারণে শাস্তি দিতে প্রেরিত হয়েছেন। তাঁর মূল উদ্দেশ্য ছিল শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা এবং দুষ্টের দমন; যদিও প্রজারা টিমুরের নিষ্ঠুরতাকে ভয় পেত, তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোর বিচ্ছিন্নতার পর তাঁর শক্তিশালী সরকারের গুণও গেয়েছে। পূর্বসূরী মঙ্গোলদের মত টিমুরকেও অপ্রতিরোধ্য মনে হয়েছিল এবং একসময় ধারণা জন্মেছিল যে তিনি বিশ্ব জয় করতে যাচ্ছেন। ১৩৮৭ নাগাদ গোটা ইরানি উঁচু অঞ্চল এবং মেসোপটেমিয়ার সমভূমি অধিকার করে নেন তিনি। ১৩৯৫তে রাশিয়ায় গোল্ডেন হোর্ড দখল করেন এবং ১৩৯৮তে চড়াও হন ভারতের ওপর, এখানে হাজার হাজার হিন্দুকে হত্যা করেন, ধ্বংস করে দেন দিল্লী। এর দু’বছর পর আনাতোলিয়া জয় করেন তিনি, দামাস্কাসকে কুক্ষিগত করেন এবং এক হত্যাযজ্ঞ চালান বাগদাদে। অবশেষে ১৪০৪-এ চীনের দিকে অগ্রসর হন তিনি, পরের বছর নিহত হন সেখানে।

কেউই টিমুরের সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখতে পারেনি। বিশ্ব জয় তখনও এক অসম্ভব স্বপ্ন রয়ে গিয়েছিল, কিন্তু পঞ্চদশ শতাব্দীতে গানপাউডারের আবিষ্কার মুসলিম শাসকদের পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষ এবং ষোড়শ শতাব্দীর গোড়ার দিকে বৃহৎ কিন্তু অধিকতর নিয়ন্ত্রণযোগ্য সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে সফল করে তুলেছিল। এখানেও ইসলামের সঙ্গে মঙ্গোল আদর্শের মিশ্রণের প্রয়াস ছিল। এসব নতুন সাম্রাজ্য ভারত, আযেরবাইজান এবং আনাতোলিয়ায় ভিত্তি পেয়েছিল।

ত্রয়োদশ শতাব্দীতে দিল্লীর সালতানাত প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল আর চতুর্দশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে সুদূর রেঙ্গুন পর্যন্ত গাঙ্গেয় উপত্যকায় ইসলাম ভালোভাবেই শেকড় গেড়ে বসে। পার্বত্য এলাকা সমূহের নগণ্য সংখ্যক হিন্দু রাজপুত, ভারতীয় শাসক শ্রেণী, দূরত্ব বজায় রেখেছিল, কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু মুসলিম আধিপত্য মেনে নেয়। যেমন মনে হয়, ব্যাপারটা ততটা বিস্ময়কর ছিল না। জাতপ্রথা রাজনৈতিক ক্ষমতার অনুশীলন মুষ্টিমেয়ে পরিবারের হাতে সীমিত রেখেছিল এবং এই পরিবারগুলো নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবার পর হিন্দুরা তাদের জায়গায় যেকাউকে গ্রহণ করার জন্যে প্রস্তুত ছিল, যদি তাতে তাদের জাতপ্রথার বিধিবিধান লঙ্ঘিত না হয়। বহিরাগত হিসাবে মুসলিমরা এসব বিধিনিষেধ অনুসরণে বাধ্য ছিল না, এবং তাদের পেছনে শক্তিশালী আন্তর্জাতিক সমাজের শক্তি ছিল। মুসলিমরা ভারতে সংখ্যালঘু রয়ে যায়। নিম্নবর্ণের কিছু হিন্দু, অস্পৃশ্যদের একটা অংশসহ, মূলত সুফি পিরদের প্রচারণার ফলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী তাদের হিন্দু, বুদ্ধ এবং জৈন আনুগত্য বজায় রাখে। একথা ঠিক নয় যে, যেমনটি জোরের সঙ্গে বলা হয়ে থাকে, মুসলিমরা ভারতে বুদ্ধধর্ম ধ্বংস করেছে। মাত্র একটা মঠে আক্রমণের একমাত্র প্রমাণ আছে, ব্যাপক হত্যাযজ্ঞের সমর্থনসূচক কোনও অকাট্য দলিল বা তথ্য নেই। ১৩৩০ নাগাদ উপমহাদেশের বৃহত্তর অংশ দিল্লীর সালতানাতের কর্তৃত্ব মেনে নেয়, কিন্তু সুলতানদের পক্ষের অবিবেচক সরকার মুসলিম আমিরদের মাঝে বিদ্রোহ জাগিয়ে দেয় এবং এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে একজন ব্যক্তির শাসনের পক্ষে সালতানাতের আকার অনেক বড়। স্বাভাবিকভাবেই, কেন্দ্রীয় ক্ষমতা ভেঙে পড়ে এবং আমিরগণ উলেমাদের সাহায্যে যাঁর যাঁর রাজ্য পরিচালনা করতে থাকেন। গানপাউডার আবিষ্কারের আগ পর্যন্ত দিল্লীর সালতানাত মুসলিম ভারতের অনেক শক্তির মাঝে অন্যতম ছিল।

মঙ্গোল রাজ্যসমূহের প্রান্তবর্তী এলাকায় গাজী যোদ্ধাদের তাদের নিজস্ব আমিরাত পরিচালনা করার সুযোগ দেয়া হয়েছিল, মঙ্গোল শাসকদের অধিরাজ বলে স্বীকার করে নিয়েছিল তারা। গাজীরা সাধারণভাবে ধার্মিক এবং সুফিবাদের প্রতি প্রবলভাবে ঝুঁকে ছিল। আযেরবাইজান ও আনাতোলিয়ায় বিভিন্ন তরিকাহ্ গড়ে উঠেছিল যেগুলো সুফিবাদের কোনও কোনও চরমপন্থী ধরনের সঙ্গে প্রাচীন বিপ্লবাত্মক শিয়া বৈশিষ্ট্যের মিশ্রণ ঘটিয়েছিল। তারা “চরমপন্থী” ঘুলুউ (ghuliw) ধর্মতত্ত্বের পুনর্জাগরণ ঘটায় যা প্রাথমিক যুগের শিয়াদের অনুপ্রাণিত করেছিল, এই মত অনুযায়ী আলীকে ঈশ্বরের অবতার হিসাবে শ্রদ্ধা করা হয়, এরা বিশ্বাস করত যে, পরলোকগত আমিরগণ “ঊর্ধ্বগামী” (Occultation) হয়েছেন এবং প্রায়শ: নেতাদের মাহুদি হিসাবে শ্রদ্ধা জানাত, যিনি ন্যায়-বিচারের নবযুগের সূচনা ঘটাতে ফিরে এসেছেন। আনাতোলিয়ার বক্তাশি দরবেশদের (Bekhtashe dervishes) ব্যাপক অনুসারী ছিল; তারা অত্যাসন্ন নতুন ব্যবস্থার কথা বলত যা প্রাচীন ধর্মীয় নিয়মকানুন ঝেড়ে বিদায় করবে। আযেরবাইজানের সাফাভিয়াহ্ ব্যবস্থাও একই রকম গোঁড়া বিশ্বাসের অনুসারী ছিল। সুন্নী তরিকাহ্ হিসাবে সূচিত হলেও পঞ্চদশ শতাব্দী নাগাদ তা ঘুলুউ ধ্যানধারণার প্রতি আকৃষ্ট হয়, এই মতাবলম্বীরা নিজেদের দ্বাদশবাদী শিয়া বলে আখ্যায়িত করত। নেতাকে তারা সপ্তম ইমামের বংশধর হিসাবে বিশ্বাস করত; সেকারণে তিনিই মুসলিম উম্মাহর একমাত্র বৈধ নেতা। ষোড়শ শতাব্দীর গোড়ার দিকে এই মতবাদের পির ইসমায়েল, যিনি হয়ত নিজেকে গুপ্ত ইমামের অবতার বলে বিশ্বাস করতেন, ইরানে এক শিয়া সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন।

মঙ্গোল রাজ্যসমূহের পতন ঘটলে, সমগ্র আনাতোলিয়া ছোট ছোট স্বাধীন গাজী রাজ্যে ভাগ হয়ে যায়, যেগুলো আবার ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষপর্যায় থেকে পতনশীল বাইযানটাইন সাম্রাজ্যের শহর আর গ্রামাঞ্চল ছিনিয়ে নিতে শুরু করে। এই রাজ্যগুলোর অন্যতম ক্ষুদ্র রাজ্য শাসিত হচ্ছিল ওসমানলি পরিবারের হাতে; যা চতুদর্শ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ক্রমবর্ধমান হারে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ১৩২৬-এ ওসমানলি বা অটোমানরা বাসরাহ্ দখল করে নেয়, যা তাদের রাজধানীতে পরিণত হয়। ১৩২৯-এ তারা ইযনিক ছিনিয়ে নেয় এবং ১৩৭২ নাগাদ বাইযানটিয়ামের বৃহত্তর এলাকা দখল করে। এডিরনে (অ্যাড্রিয়ানোপল) এক নতুন রাজধানী প্রতিষ্ঠা করে তারা এবং বাইযানটাইন সম্রাটকে নির্ভরশীল মিত্রে পরিণত করে। অটোমানদের সাফল্যের রহস্য ছিল তাদের প্রশিক্ষিত পদাতিক বাহিনীর শৃঙ্খলা; এ বাহিনী “নয়া বাহিনী” (veni-cheri বা Janissary) নামে পরিচিত এক দাসবাহিনী 1 প্রথম মুরাদ (১৩৬০-৮৯) সবচেয়ে শক্তিশালী পশ্চিমা মুসলিম শাসকে পরিণত হন। ১৩৭২-এ বলকান এলাকায় অগ্রসর হওয়ার জন্যে প্রস্তুত হয়ে যান তিনি, বলকান পেনিনসূলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শক্তি স্বাধীন বুলগার এবং সারবিয়া রাজ্যে আক্রমণ চালান। ১৩৮৯তে অটোমানরা মধ্য সার্বিয়ায় কসোভো যুদ্ধক্ষেত্রে সার্বীয় সেনাবাহিনীকে পরাস্ত করে। মুরাদ নিহত হন, কিন্তু সারবীয় যুবরাজ হেলবেলিয়ানোভিচ লাযার (Hrevlbeljanovic Lazar) কে বন্দী ও পরে হত্যা করা হয়। এর সঙ্গে সমাপ্তি ঘটে সারবিয়ার স্বাধীনতার এবং আজও সাবরিয়রা যুবরাজ লাযারকে একজন শহীদ এবং জাতীয় বীরের মর্যাদা দিয়ে থাকে; ইসলামের প্রতি গভীর ঘৃণা পোষণ করে তারা। কিন্তু অটোমানদের অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকে এবং তা কোনওভাবেই বাইযানটাইন প্রজাসাধারণের সিংহভাগের কাছে অজনপ্রিয় ছিল না। বিশৃঙ্খল অবস্থায় নিপতিত ছিল পুরানো সাম্রাজ্য; অটোমানরা শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনে, চাঙা করে তোলে অর্থনীতি; আর জনগণের অনেকেই ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয়। ১৪০২তে অ্যাঙরায় টিমুর তাদের সেনাদলকে পরাজিত করলে অটোমানরা প্রথম বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখে পড়েছিল, কিন্তু টিমুরের মৃত্যুর পর তারা আবার শক্তি সংহত করতে সক্ষম হয়; এবং ১৪৫৩তে দ্বিতীয় মেহমেদ (১৪৫১-৮১) খোদ কনসট্যান্টিনোপলই অধিকার করে নিতে সক্ষম হন– নতুন গানপাউডার অস্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে।

শতাব্দীর পর শতাব্দী বাইযানটাইন সাম্রাজ্য, মুসলিমরা যাকে “রাম” (রোম) বলে অভিহিত করত, ইসলামকে ঠেকিয়ে রেখেছিল। একের পর এক খলিফাহ্ পরাজয় মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন। এবার “মেহমেদ দ্য কনকোয়েরার” পুরনো স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিলেন। এক নতুন যুগের সন্ধিক্ষণে এসে পৌঁছাল তখন মুসলিমরা। মঙ্গোল-বিপর্যয় কাটিয়ে উঠে নতুন এক শক্তির সন্ধান পেল তারা। পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষ নাগাদ ইসলামী জগৎ বিশ্বের বৃহত্তম পরাশক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। পূর্ব-ইউরোপে ঢুকে পড়েছিল তা, মুসলিম বণিকদের সুবাদে ইউরেশিয়ান প্রান্তরে আর সাব-সাহারান আফ্রিকায়। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে মুসলিম বণিকগণ পূর্ব-আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলীয় উপকূল, দক্ষিণ আরব এবং ভারতীয় উপমহাদেশের পশ্চিম উকূলবর্তী এলাকায়ও নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে নিয়েছিল। মুসলিম বণিকগণ, প্রত্যেকেই ধর্মের একেকজন প্রচারক, এমন একটা সময়ে মালয়ে বসতি করে যখন সেখানে বুদ্ধদের বাণিজ্য ভেঙে পড়েছিল, অচিরেই তারা যারপরনাই মর্যাদার অধিকারী হয়ে ওঠে। সুফি ধর্মপ্রচারকগণ ব্যবসায়ীদের অনুসরণ করে এবং চতুদর্শ ও পঞ্চদশ শতাব্দী নাগাদ মালয় মুসলিম আধিপত্যের দেশে পরিণত হয়। গোটা বিশ্বই ইসলামী হতে যাচ্ছে বলে মনে হয়েছিল: এমনকি যারা মুসলিম শাসনাধীনে ছিল না তারাও আবিষ্কার করেছিল যে মুসলিমরা মহাসাগরগুলো নিয়ন্ত্রণ করছে, এবং নিজের দেশ ছেড়ে বের হতে গেলেই ইসলামী রাজ্যের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। এমনকি পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষ এবং ষোড়শ শতাব্দীর সূচনার দিকে ইউরোপীয় নাবিকরা যখন বিস্ময়কর আবিষ্কারগুলো করছে, তখনও তারা মুসলিমদের সাগরপথ থেকে সরিয়ে দিতে পারেনি। ইসলামকে অপরাজেয় মনে হয়েছে যেন। মুসলিমরা এখন নয়া সাম্রাজ্যসমূহ প্রতিষ্ঠার জন্য প্রস্তুত, যা হবে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী এবং সর্বাধুনিক।

তথ্যসূত্র

১. কায়রোর ইসমায়েলি রাজবংশকে প্রায়শ “ফাতিমীয়” রাজবংশ বলে অভিহিত করা হয়, কারণ দ্বাদশবাদীদের মত ইসমায়েলিরা আলী ও পয়গম্বরের কন্যা ফাতিমার প্রত্যক্ষ বংশধর ইমামদের শ্রদ্ধা করত।

২. কুরান ২:১০৯ (বাংলা অনুবাদে ১১৫- অনুবাদক)।

৩. আল-মুকাদ্দিমাহ, ইউসেফ এম. চৌউয়েরি, ইসলামিক ফান্ডামেন্টালিজম (লন্ডন ১৯৯০) ১৮-এ উদ্ধৃত

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *