২. বিকাশ

২. বিকাশ

উমাঈয়াহ্ এবং দ্বিতীয় ফিৎনাহ্

খলিফাহ্ মুয়াবিয়াহ্ (৬৬১-৮০) সাম্রাজ্যের ঐক্য পূন:প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হন। ফিৎনাহ্ প্রত্যক্ষ করে আতঙ্কিত হয়ে উঠেছিল মুসলিমরা, তারা উপলব্ধি করেছিল যে স্বজাতি আরবদের থেকে বিচ্ছিন্ন এবং সম্ভাব্য বৈরী প্রজাদের ঘেরাওয়ের মধ্যে গ্যারিসন শহরে তাদের অবস্থান কত নাজুক। এরকম ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ মেনে নিতে পারেনি তারা। শক্তিশালী সরকার চেয়েছিল তারা এবং দক্ষ শাসক মুয়াবিয়াহ্ এমন একটি সরকার দেয়ার যোগ্য ছিলেন। তিনি আবার আরব মুসলিমদের প্রজাসাধারণ থেকে বিচ্ছিন্ন রাখার উমরের অনুসৃত ব্যবস্থা চালু করলেন এবং যদিও কিছু সংখ্যক মুসলিম তখনও অধিকৃত এলাকাসমূহে জমিদারি প্রতিষ্ঠা করার দাবীতে সোচ্চার ছিল, মুয়াবিয়াহ্ তার ওপর নিষেধাজ্ঞা বজায় রাখেন। তিনি ধর্মান্তরকরণও নিরুৎসাহিত করেছেন এবং একটা দক্ষ প্রশাসন যন্ত্র গড়ে তোলেন। এভাবে ইসলাম বিজয় অর্জনকারী আরব অভিজাতদের ধর্ম রয়ে যায়। প্রথম দিকে আরবরা, যাদের রাজকীয় সরকার পরিচালনার কোনও অভিজ্ঞতা ছিল না, অমুসলিমদের দক্ষতার ওপর নির্ভর করেছিল, যারা অতীতের বাইযানটাইন ও পারসিয়ান শাসকদের সেবা দিয়েছে; কিন্তু আস্তে আস্তে আরবরা উচ্চ পদসমূহ থেকে জিম্মিদের বিতাড়ন শুরু করে। পরবর্তী শতাব্দীকালে উমাঈয়াহ্ খলিফারা ক্রমশ: মুসলিম বাহিনীর অধিকৃত বিসদৃশ এলাকাগুলোকে একটি সাধারণ আদর্শের ভিত্তিতে একক সাম্রাজ্যে পরিণত করেন। এক অসাধারণ সাফল্য ছিল এটা; কিন্তু রাজদরবার স্বভাবতই এক উন্নত সংস্কৃতি আর বিলাসবহুলে জীবন ধারা গড়ে তুলতে শুরু করে এবং বহু দিক থেকেই অন্য যেকোনও শাসক শ্রেণী হতে আলাদা করা কঠিন হয়ে পড়ে তা।

এর মাঝেই ছিল এক দ্বিধার অবস্থান। কয়েক শতাব্দীর অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে জানা গিয়েছিল যে কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত প্রাক-আধুনিক কোনও সাম্রাজ্য শাসনের একমাত্র কার্যকর পদ্ধতি হল পরম রাজতন্ত্র; এবং তা সামরিক অলিগারকির (military oligarchy) চেয়ে অনেক বেশী সন্তোষজনক– যেখানে সেনাপ্রধানরা সাধারণত ক্ষমতার জন্য পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত থাকে। আমাদের গণতান্ত্রিক যুগে একজন ব্যক্তিকে এমন সুবিধাপ্রাপ্ত করে তোলা, যেখানে ধনী-দরিদ্র সমানভাবে তার সামনে নাজুক অবস্থানে পড়ে, তা আমাদের চোখে ঘৃণিত, কিন্তু আমাদের অবশ্যই বুঝতে হবে যে শিল্প-উন্নত সমাজের কারণেই  গণতন্ত্র সম্ভবপর হয়ে উঠেছে, যে সমাজের এর সম্পদসমূহ অনির্দিষ্ট মাত্রায় বাড়িয়ে তোলার প্রযুক্তি রয়েছে। পাশ্চাত্যের আধুনিকতার আবির্ভাবের আগে যা সম্ভব ছিল না। প্রাক-আধুনিক বিশ্বে শক্তিশালী একজন রাজার, যার কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী নেই, সশরীরে যুদ্ধে অংশ নেয়ার প্রয়োজন হত না, অভিজাতদের বিবাদ মীমাংসা করতে পারতেন এবং দরিদ্রদের পক্ষে বক্তব্য দানকারীদের আবেদন অগ্রাহ্য করার কোনও কারণ থাকত না তাঁর। রাজার বেলায় এই সুবিধাটি এত জোরাল ছিল যে, আমরা দেখব, এমনকি যখন বৃহৎ সাম্রাজ্যের স্থানীয় প্রকৃত ক্ষমতা স্থানীয় শাসকরা নিয়ন্ত্রণ করছে তখনও তারা রাজার গুণ গাইছে এবং নিজেদের তাঁর সেবক বলে দাবী করছে। উমাঈয়াহ্ খলিফাগণ এক সুবিশাল সাম্রাজ্য শাসন করেছেন, যা তাঁদের শাসনকালে অব্যাহতভাবে বিস্তার লাভ করে। তাঁরা বুঝতে পেরেছিলেন, শান্তি বজায় রাখার স্বার্থে তাঁদের একচ্ছত্র রাজা হওয়াই প্রয়োজন, কিন্তু কীভাবে তা একদিকে আরব ঐতিহ্য আর অন্যদিকে কুরানের চরম সাম্যবাদী নীতির সঙ্গে খাপ খাবে?

প্রথম দিকের উমাঈয়াহ্ খলিফাগণ একচ্ছত্র রাজা ছিলেন না। মুয়াবিয়াহ্ একজন আরব গোত্রপতির মতই শাসন করেছেন, প্রাইমাস ইন্টার পেয়ারেস-এর মত। আরবরা চিরকাল রাজতন্ত্রকে অবিশ্বাস করে এসেছে, অসংখ্য ছোট ছোট গ্রুপ যেখানে অপ্রতুল সম্পদের অংশ পেতে প্রতিযোগিতা করে, সেখানে তা সম্ভবও নয়। বংশ পরম্পরা শাসনের কোনও ব্যবস্থা তাদের ছিল না, কেননা গ্রোত্র প্রধান হিসাবে সবসময় গোত্রের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিটিকে পেতে চাইত তারা। কিন্তু ফিৎনাহ্ই বুঝিয়ে দিয়েছিল বিতর্কিত বিচ্ছেদের বিপদ। উমাঈয়াদের “সেক্যুলার” শাসক মনে করাটা ভুল হবে। মুয়াবিয়াহ্ ধার্মিক ব্যক্তি ছিলেন, নিবেদিতপ্রাণ মুসলিম-ইসলামের চলমান ধারণা অনুসারে। মুসলিমদের প্রথম কিবলাহ্ এবং অতীতের বহু মহান পয়গম্বরের আবাসভূমি জেরুজালেমের পবিত্রতার প্রতি নিবেদিত ছিলেন তিনি। উম্মাহর ঐক্য বজায় রাখার জন্যে কঠোর পরিশ্রম করেছেন তিনি। তাঁর শাসনের ভিত্তি ছিল কুরানের তাগিদ যে সকল মুসলিম পরস্পরের ভাই, তারা অবশ্যই পরস্পরের সঙ্গে সংঘাত থেকে বিরত থাকবে। কুরানের শিক্ষা অনুযায়ী তিনি জিম্মিদের ধর্মীয় স্বাধীনতা ও ব্যক্তিগত অধিকার দিয়েছিলেন। কিন্তু ফিৎনার অভিজ্ঞতা খারেজিদের মত কোনও কোনও মুসলিমের মনে দৃঢ় ধারণার জন্ম দিয়েছিল যে রাষ্ট্রিয় ও ব্যক্তি পর্যায়ে ইসলামের অর্থ আরও ব্যাপক হওয়া উচিত।

সুতরাং কৃষিভিত্তিক রাষ্ট্রের চাহিদা এবং ইসলামের মধ্যে একটা প্রচ্ছন্ন সংঘাত ছিল এবং মুয়াবিয়ার পরলোকগমনের পর তা দুঃখজনক ভাবে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। তিনি আগেই বুঝতে পেরেছিলেন যে উত্তরাধিকারী, নিশ্চিত করার জন্যে তাঁকে অবশ্যই আরব ঐতিহ্য থেকে সরে আসতে হবে এবং পরলোকগমনের আগেই পুত্র প্রথম ইয়াযিদের (৬৮০-৮৬) ক্ষমতারোহনের ব্যবস্থা গিয়েছিলেন। কিন্তু এর পরপরই প্রবল গোলমাল শুরু হয়ে যায়। কুফা আলীর অনুগতরা আলীর দ্বিতীয় পুত্র হুসেইনের শাসন দাবী করে বসে। অল্পক’জন অনুসারী এবং তাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে মদীনার উদ্দেশে অগ্রসর হন হুসেইন। এদিকে স্থানীয় উমাঈয়াহ্ গভর্নর কুফাবাসীদের ভীতি প্রদর্শন করায় তারা সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়। আতসমর্পণে অস্বীকৃতি জানান হুসেইন, তাঁর অবশ্য জোর বিশ্বাস ছিল প্রকৃত ইসলামী মূল্যবোধের সন্ধানে স্বয়ং পয়গম্বরের পরিবারের অভিযাত্রা উম্মাহকে তার মূল দায়িত্বের কথাটি স্মরণ করিয়ে দেবে। কুফার অনতিদূরে, কারবালা প্রান্তরে সসৈন্য উমাইয়াদের বাহিনী দ্বারা অবরুদ্ধ হয়ে প্রাণ হারান তিনি। সদ্যজাত শিশুকে কোলে নিয়ে সবার শেষে প্রাণ দেন হুসেইন। সকল মুসলিমই পয়গম্বরের দৌহিত্রের করুণ মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে, কিন্তু নিজেদের যারা শিয়া-ই-আলী বলে মনে করে পয়গম্বরের বংশধরদের ক্ষেত্রে হুসেইনের পরিণতি অনেক গভীরভাবে তাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে থাকে। আলীর হত্যাকাণ্ডের মত কারবালার করুণ ঘটনাটিও শিয়া মুসলিমদের চোখে মানবজাতিকে ঘিরে রাখা অবিরাম অবিচারের প্রতাঁকে পরিণত হয়েছে; এটা যেন রাজনীতির কঠিন জগতের সঙ্গে ধর্মীয় আদেশ বাস্তবায়নের অসম্ভাব্যতাও দেখিয়ে দেয়, যার সঙ্গে রয়েছে এর প্রবল বিরোধ।

হিজাযে আবদাল্লাহ ইবন আল-যুবায়েরের নেতৃত্বে সংঘটিত অভ্যুত্থানটি ছিল আরও বেশী ভয়াবহ। যুবায়ের ছিলেন উটের যুদ্ধে আলীর বিরুদ্ধে অংশগ্রহণকারী এক বিদ্রোহীর সন্তান। এটা উমাঈয়াদের কাছ থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নিয়ে তা আবার মক্কা ও মদীনায় পুনঃস্থাপনের মাধ্যমে প্রথম উম্মাহ্ উন্নত মূল্যবোধে ফিরে যাবার প্রয়াসও ছিল। ৬৮৩তে উমাঈয়াহ্ বাহিনী মদীনা দখল করে নেয়, কিন্তু সেবছর প্রথম ইয়াযিদ এবং তার শিশু পুত্র দ্বিতীয় মুয়াবিয়াহ্ অকাল মৃত্যু পরবর্তী ধোয়াঁটে পরিস্থিতিতে মক্কা নগরী হতে অবরোধ তুলে নেয়। আরও একবার গৃহযুদ্ধের কারণে বিভক্ত হয়ে পড়ে উম্মাহ্। ইবন আল-যুবায়ের খলিফাহ্ হিসাবে ব্যাপক স্বীকৃতি লাভ করেন, কিন্তু ৬৮৪তে খারেজি বিদ্রোহীরা মধ্য আরবে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে বসলে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন তিনি; ইরাক এবং ইরানেও খারেজি বিদ্রোহ সংঘটিত হয়; হুসেইনের হত্যাকাণ্ডের বদলা নেয়ার জন্য কুফার শিয়ারা ক্ষেপে ওঠে, তারা আলীর অপর পুত্রকে প্রার্থী হিসাবে দাঁড় করাতে চায়। বিদ্রোহীদের সকলেই কুরানের সাম্যবাদী নীতির পক্ষে কথা বলেছে, কিন্তু সফলকাম হয়েছিল সিরিয়ানরা- প্রথম মুয়াবিয়া এক উমাঈয়াহ্ কাজিন মারওয়ান এবং তার পুত্র আব্দ আল-মালিকের নামে। ৬৯১ নাগাদ তারা সকল বিদ্রোহীকে দমন করে এবং এর পরের বছর স্বয়ং ইবন আল-যুবায়েরকে পরাস্ত ও হত্যা করে।

আব্দ আল-মালিক (৬৮৫-৭০৫) আবার উমাঈয়াহ্ শাসন ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর শাসনামলের শেষ বার বছর ছিল শান্তি আর সমৃদ্ধির কাল। তিনিও নিরঙ্কুশ ক্ষমতাবান রাজা ছিলেন না, কিন্তু দ্বিতীয় ফিৎনাহ্’র পর স্পষ্টতই সেদিকে ধাবিত হচ্ছিলেন। স্থানীয় আরব গোত্র প্রধানদের বিরুদ্ধে উম্মাহর সংহতি বজায় রাখেন তিনি, বিদ্রোহীদের সামাল দেন আর কেন্দ্রীকরণের সুসংহত নীতি অনুসরণ করেন। সাম্রাজ্যের রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসাবে আরবী পারসির স্থান অধিকার করে; প্রথম বারের মত ইসলামী মুদ্রা চালু হয় যাতে কুরানের বাণী উৎকীর্ণ ছিল। জেরুজালেমে ৬৯১-তে ডোম অভ দ্য রক- প্রথম প্রধান ইসলামী মন্যুমেন্ট- এর নির্মাণকাজ শেষ হয়- যা গর্বের সঙ্গে পবিত্র নগরীটিতে ইসলামের প্রাধান্য ঘোষণা করেছে- বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ ক্রিশ্চানদের বাস ছিল এখানে। ‘ডোম’ ইসলামের অনন্যসাধারণ স্থাপত্য ও শিল্পকলার রীতির ভিত্তিও স্থাপন করেছিল: কোনওরকম শারীরিক অবয়ব থাকতে পারবে না, যা উপাসনাকারীদের দুর্ভেয় সত্তা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে পারে–মানুষের কল্পনায় সঠিকভাবে যার প্রকাশ করা যায় না। এর বদলে ডোমের অভ্যন্তর সাজানো হয় ঈশ্বরের বাণী কুরানের পঙক্তি দিয়ে। মুসলিম স্থাপত্যকলার প্রধান বৈশিষ্ট্যে পরিণত হওয়া খোদ ডোমটি বিশ্বাসীদের আকাঙ্ক্ষিত স্বর্গে আরোহণের আধ্যাত্মিক প্রতীক, অবশ্য তাওহীদের নিখুঁত ভারসাম্যও প্রকাশ করে তা। এর বাইরের অংশ, যা অসীম আকাশের দিকে উঠে গেছে, অভ্যন্তরীণ মাত্রারই নিখুঁত অনুকৃতি। এটা দেখায় কীভাবে মানুষ এবং ঈশ্বর, অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক জগৎ, একটি পূর্ণাঙ্গ জিনিসের দুটি অংশ হিসাবে পরস্পরকে পূর্ণতা দেয়। মুসলিমরা আরও আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠছিল এবং তারা তাদের নিজস্ব অনন্য আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরছিল।

এই পরিবর্তিত পরিবেশে যে কঠোর নিয়মের কারণে মুসলিমরা প্রজা সাধারণ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল ধীরে ধীরে তা শিথিল হয়ে আসে। অমুসলিমরা গ্যারিসন শহরগুলোয় বসতি শুরু করে; কৃষিজীবীরা মুসলিম এলাকায় কাজ পায় এবং আরবীতে কথা বলা শেখে। বণিকগণ মুসলিমদের সঙ্গে বাণিজ্য শুরু করে, এবং যদিও ধর্মান্তরকরণের বিষয়ে উৎসাহ দেয়া হচ্ছিল না, কোনও কোনও রাজকীয় কর্মকর্তা ইসলাম গ্রহণ করে। কিন্তু পুরনো বিভেদ ভেঙে পড়ায় সাধারণ মানুষ আরব মুসলিমদের বাড়তি সুবিধার ব্যাপারে অসন্তোষ প্রকাশ করতে শুরু করে। খারেজি এবং শিয়াদের দমন এক তিক্ত অনুভূতি সৃষ্টি করে রেখেছিল। আব্দ আল-মালিক আরব এবং গ্যারিসন শহরগুলোয় এক নতুন আন্দোলন সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন, যারা ইসলামী আদর্শের আরও কঠোর প্রয়োগের ব্যাপারে চাপ দিচ্ছিল। আব্দ আল-মালিক এসব নতুন ধারণায় আগ্রহী থাকলেও দাবী করেন যে কুরান তাঁর নীতির সমর্থন করে। এসব নব্য ধর্মানুরাগীদের কেউ কেউ অবশ্য কুরানের আরও সক্রিয় ভূমিকা চেয়েছিল এবং সমর্থক বা শিখণ্ডি হিসাবে ব্যবহৃত না হয়ে কুরান নেতৃত্ব দেবে এটাই চেয়েছে তারা।

ধর্মীয় আন্দোলন

গৃহযুদ্ধগুলো বহু জটিল প্রশ্নের জন্ম দিয়েছিল। যে সমাজ-এর নিবেদিত নেতাদের (ইমাম) হত্যা করেছে সেটি ঈশ্বর পরিচালিত বলে দাবী করে কীভাবে? কোন ধরনের লোকের উম্মাহর নেতৃত্ব দেয়া উচিত? খলিফাঁকে কী সবচেয়ে ধার্মিক মুসলিম (খারেজিরা যেমন বিশ্বাস করে), পয়গম্বরের সরাসরি বংশধর (শিয়ারা যেমন মনে করে) হতে হবে নাকি বিশ্বাসীদের উচিত শান্তি আর ঐক্যের খাতিরে সকল ব্যর্থতা ত্রুটি সত্ত্বেও উমাঈয়াদেরই মেনে নেয়া? প্রথম ফিৎনার সময় কে সঠিক ছিলেন, আলী না মুয়াবিয়াহ্? আর উমাঈয়াহ্ রাষ্ট্র কতখানি ইসলামী? যেসব শাসক এমন বিলাসী জীবনযাপন করে আর বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের দারিদ্র্য মেনে নেয় তারা কি প্রকৃত মুসলিম হতে পারে? আর যেসব আরব ইসলাম গ্রহণ করে কোনও না কোনও আরব গোত্রের “ক্লায়েন্টে” (মাউয়ালি) পরিণত হয়েছে তাদের অবস্থানটা কী? এতে করে কি একথাই বোঝায় না যে, এখানে এমন এক শভিনিজম আর বৈষম্য রয়েছে যা কুরানের সঙ্গে সম্পূর্ণই বেমানান?

এইসব রাজনৈতিক আলোচনার ভেতর দিয়েই আমাদের পরিচিত ইসলামের ধর্ম ও ধার্মিকতার বিষয়টি বেরিয়ে আসতে শুরু করে। কুরান আবৃত্তিকার এবং অন্য চিন্ত–াশীল ব্যক্তিরা প্রশ্ন উত্থাপন করে যে মুসলিম হওয়ার প্রকৃত অর্থ কী? তারা তাদের সমাজকে প্রথমত ইসলামী এবং তারপর আরব হিসাবে দেখতে চেয়েছে। কুরান সমগ্র মানব জীবনের একীভূতকরণের (তাওহীদ) কথা বলে, যার মানে ব্যক্তিবিশেষ এবং রাষ্ট্রীয় সকল প্রতিষ্ঠানের সকল কর্মকাণ্ডে ঈশ্বরের ইচ্ছার প্রতি নতি স্বীকার করার কথা প্রকাশ পাওয়া উচিত। বিকাশের একই রকম পর্যায়ে ক্রিশ্চানরা জেসাসের প্রকৃতি ও ব্যক্তিত্ব নিয়ে বারবার তপ্ত-বিতর্কে লিপ্ত হয়েছিল, যা তাদের ঈশ্বর, মোক্ষ লাভ এবং মানবীয় অবস্থা সম্পর্কে নিজস্ব আলাদা দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে। গৃহযুদ্ধগুলোর পরবর্তী কালের উম্মাহ্ রাজনৈতিক নেতৃত্ব সম্পর্কে প্রবল বিতর্ক ইসলামে চতুর্থ ও পঞ্চম শতকে খ্রিষ্টধর্মের ক্ষেত্রে ক্রিস্টোলজিক্যাল বিতর্কের অনুরূপ ভূমিকা পালন করেছে।

এই নয়া মুসলিম ধার্মিকতার প্রটোটাইপ এবং শ্রেষ্ঠ আদর্শ পুরুষ ছিলেন হাসান আল-বাসরি (মৃত্যু ৭২৮), যিনি পয়গম্বরের পারিবারিক বলয়ে বেড়ে উঠেছিলেন এবং উসমানের মৃত্যুর পরও বেঁচে ছিলেন। পরবর্তী সময়ে বসরায় চলে যান তিনি যেখানে পার্থিব জিনিসের প্রতি বৈরাগ্যের ওপর ভিত্তি করে পয়গম্বরের সহজ-সরল জীবনধারার অনুরূপ এক আধ্যাত্মিকতা গড়ে তোলেন। কিন্তু বসরার সবচেয়ে খ্যাত ধর্মপ্রচারকে পরিণত হন হাসান, তাঁর সাধারণ জীবন-যাপন রাজদরবারের বিলাসীতার বাঙ্ময় এবং প্রচ্ছন্ন বিরোধিতাপূর্ণ সমালোচনার রূপ নেয়। বসরা এক ধর্মীয় সংস্কারের কাজ শুরু করেন হাসান, অনুসারীদের গভীরভাবে কুরান নিয়ে ধ্যান করার তাগিদ দেন এবং এই শিক্ষা দেন যে গভীর চিন্তা, আত্মপর্যালোচনা এবং ঈশ্বরের ইচ্ছার প্রতি পূর্ণ আত্মসমর্পণই প্রকৃত সুখের উৎস, কেননা এগুলো মানবীয় আকাঙ্ক্ষা এবং মানুষের জন্যে ঈশ্বরের ইচ্ছার মাঝে বিরাজিত টানাপোড়েন দূর করে। হাসান উমাঈয়াদের সমর্থন করেছিলেন বটে, কিন্তু এটা স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন যে প্রয়োজনে তাঁদের সমালোচনা করার অধিকার তিনি রাখেন। তিনি কাদেরিয়াহ্ নামে পরিচিত থিয়োলজির পক্ষ বেছে নেন, কারণ তা ঈশ্বরের বিধানসমূহ (কাদার) নিয়ে কাজ করে। মানবজাতির স্বাধীন ইচ্ছা রয়েছে এবং মানুষ তার কর্মকাণ্ডের জন্যে দায়ী; কোনও সুনির্দিষ্ট কাজ করার ব্যাপারে বাধ্য নয় তারা, ঈশ্বর যেহেতু ন্যায় বিচারক সেহেতু মানুষের সাধ্যের মধ্যে না থাকলে তিনি তাদের সৎপথে জীবনযাপনের নির্দেশ দিতেন না। সুতরাং খলিফাঁদের অবশ্যই তাঁদের কাজের জবাবদিহি করতে হবে এবং যদি তাঁরা ঈশ্বরের সুস্পষ্ট শিক্ষা অমান্য করেন তাহলে অবশ্যই প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে। খলিফাহ্ আব্দ আল-মালিক যখন হাসানের এরকম প্রচ্ছন্ন বিদ্রোহমূলক মতবাদ প্রচারের সংবাদ পেলেন, রাজদরবারে তলব করলেন তাঁকে, কিন্তু হাসানের তুমুল জনপ্রিয়তার কারণে তাঁকে শান্তি দেয়ার সাহস পাননি তিনি। হাসান সুশৃঙ্খল আত্মিকজীবনের সঙ্গে সরকারের রাজনৈতিক বিরোধিতার মিশেল ঘটিয়ে এক শক্তিশালী মুসলিম ধারার সূচনা করেছিলেন।

কাদেরিয়ারা উমাঈয়াহ্ শাসন মেনে নিয়েছিল, কারণ একেই উম্মাহর ঐক্য রক্ষায় সক্ষম বলে মনে হয়েছিল; সুতরাং খারেজিদের বিরোধিতা করেছে তারা যাদের বিশ্বাস ছিল উমাঈয়ারা ধর্মত্যাগী এবং মৃত্যুদণ্ড লাভের যোগ্য। হাসানের শিষ্য ওয়াসান ইবন আতা (মৃত্যু: ৭৪৮) এক মধ্যপন্থী মতবাদ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, এ দুটো চরম অবস্থান থেকে “প্রত্যাহারের” (ইতাযাহু) মাধ্যমে। মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতার প্রতি জোর দেয়া, রাজদরবারের বিলাসীতার নিন্দা জানানো এবং মুসলিমদের সাম্যতার ব্যাপারে গুরুত্ব আরোপের দিক থেকে মুতাযিলারা কাদেরিয়াদের সঙ্গে একমত হয়েছিল। কিন্তু ঈশ্বরের ন্যায় বিচারের প্রতি জোর দেয়ার ফলে মুতাযিলারা যেসব মুসলিম অন্যদের প্রতি শোষণমূলক আচরণ করে তাদের প্রতি চরম সমালোচনামুখর হয়ে ওঠে। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তারা আলী এবং মুয়াবিয়ার ব্যাপারে রায় দেয়া থেকে বিরত থাকে, কারণ তাদের দাবী ছিল একমাত্র ঈশ্বরই জানেন মানুষের মনে কী আছে। এর সঙ্গে খারেজিদের চরমপন্থার পার্থক্য স্পষ্ট, কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রায়ই মুতাযিলাদের রাজনৈতিক কর্মী হতে দেখা গেছে। কুরান মুসলিমদের “সৎকাজে নির্দেশ আর অসৎ কাজ থেকে দূরে থাকার আদেশ”[১] দেয়ার পরামর্শ দিয়েছে এবং কোনও কোনও খারেজির মতই মুতাযিলারা এ বাণীকে গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেছিল। কেউ কেউ শিয়া বিদ্রোহে সমর্থন দেয়, আর হাসান আল-বাসরির মত অন্যরা যেসব শাসক কুরানের আদর্শ অনুযায়ী চলেনি তাদের নিন্দা জানিয়েছেন। শতাব্দী কাল সময়ের মধ্যে মুতাযিলারা ইরাকের বুদ্ধিবৃত্তিক জগতে প্রাধান্য বিস্তার করেছিল। একটা যুক্তি ভিত্তিক থিয়োলজি (কালাম) গড়ে তুলেছিল মুতাযিলারা যেখানে ঈশ্বরের কঠোর একত্ব আর সরলতার ওপর জোর দেয়া হয়েছে, উম্মাহর সংহতির মধ্য দিয়ে যা প্রতিফলিত হওয়ার কথা।

আরেকটি মতবাদ, মুরজিয়াও আলী ও মুয়াবিয়াহ্ ক্ষেত্রে রায় প্রদানে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল, কারণ মানুষের মনের অবস্থাই আসল। মুসলিমদের অবশ্যই কুরান অনুযায়ী রায় ঘোষণা “স্থগিত” (আর্জা) রাখতে হবে। সুতরাং, উমাঈয়াদের তারা এমন কিছু করে বসার আগেই অবৈধ শাসক বলে বিচার বা নাকচ করে দেয়া ঠিক হবে না, বরং যদি তারা ঐশীগ্রন্থের মানদণ্ড লঙ্ঘন করে তাহলে তাদের তীব্র ভাষায় ভর্ৎসনা করা যেতে পারে। এই মতবাদের সবচেয়ে বিখ্যাত অনুসারী ছিলেন কুফার একজন বণিক আবু হানিফাহ্ (৬৯৯-৭৬৭)। তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন এবং জুরিসপ্রুডেন্সের (ফিকহ্) এক নতুন ধারার নেতৃত্ব দেন যা ইসলামী ধার্মিকতায় ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে এবং মুসলিম বিশ্বের উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে মূল শাস্ত্রে পরিণত হয়। ফিকহ্’র মূলেও রয়েছে গৃহযুদ্ধ পরবর্তী ব্যাপক অসন্তোষ। লোকেরা পরস্পরের বাড়ি বা মসজিদে মিলিত হয়ে উমাঈয়াহ্ সরকারের অযোগ্যতা নিয়ে আলোচনা করত। ইসলামী নীতিমালা অনুসারে কীভাবে সমাজ পরিচালনা করা যায়? জুরিস্টরা এমন সুনির্দিষ্ট এক আইনী বিধিমালা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন যা ঈশ্বরের ইচ্ছার কাছে সম্পূর্ণ নিখুঁতভাবে আত্মসমর্পণকারী একটা সমাজ গঠনে কুরানে প্রদত্ত নির্দেশ পবিত্র স্বপ্নের বদলে বাস্তব সম্ভাবনায় পরিণত করবে। এই প্রাথমিক জুরিস্টগণ (ফাকিহ্) বসরাহ্, কুফাহ্, মদীনা এবং দামাসকাসে যাঁর যাঁর নির্দিষ্ট সমাজের জন্য আইনগত পদ্ধতি বের করেন। সমস্যা ছিল তাঁদের, কুরানে খুব কমই আইন রয়েছে এবং যেসব আইন আছে তাও তৈরি হয়েছে অনেক সরল- সমাজের জন্য। তো জুরিস্টদের কেউ কেউ পয়গম্বর এবং তাঁর সহচরবৃন্দ বিভিন্ন পরিস্থিতিতে কেমন আচরণ করেছিলেন তার “সংবাদ” বা “প্রতিবেদন” (আল- হাদিস, একবচনে: হাদিস) সংগ্রহ শুরু করেন। অন্যরা সূচনা স্বরূপ তাঁদের শহরে মুসলিমদের প্রথাগত অনুশীলন (সুন্নাহ্)কে বেছে নেন এবং সেটাকে গোড়ার দিকে সহচরদের- যাঁরা ওখানে বসতি করেছিলেন- তাঁদের কারও সঙ্গে সম্পর্কিত করার প্রয়াস পান। তাঁদের বিশ্বাস ছিল এভাবে তাঁরা প্রকৃত ইল্‌ম, কোনটা সঠিক এবং কেমন করে চলতে হবে সে জ্ঞান অর্জন করতে পারবেন। আবু হানিফাহ্ উমাঈয়াহ্ আমলের শ্রেষ্ঠ আইনবিদে পরিণত হয়েছিলেন এবং তিনি জুরিসপ্রুডেন্সের একটি মতবাদ (মাযহাব) প্রতিষ্ঠা করেন মুসলিমরা যা আজও অনুসরণ করে। তিনি নিজে খুব বেশী লেখালেখি করেননি, কিন্তু তাঁর অনুসারীরা উত্তর প্রজন্মের জন্যে তাঁর শিক্ষা লিপিবদ্ধ করে গেছে; অন্যদিকে পরবর্তী সময়ের জুরিস্টগণ সামান্য পৃথক তত্ত্ব আবিষ্কার করে নতুন মাযহাব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

ইসলামী ইতিহাস রচনাও একই ধরনের আলোচনাচক্র হতে আবির্ভূত। চলমান সমস্যাদির সমাধান বের করতে গিয়ে মুসলিমরা উপলদ্ধি করে যে তাদের পয়গম্বর এবং বাঁশিদুনের আমলের শরণ নিতে হচ্ছে। খলিফা কী কুরাইশ গোত্রের সদস্য হওয়া উচিত নাকি কোনও আনসারের বংশধর গ্রহণযোগ্য? মুহাম্মদ(সঃ) কি এ বিষয়ে কোনও বক্তব্য রেখে গেছেন? উত্তরাধিকার সম্পর্কে কী ব্যবস্থা করেছিলেন মুহাম্মদ(সঃ)? উসমানের হত্যাকাণ্ডের পর আসলে কী ঘটেছিল? মুহাম্মদ ইবন ইসহাকের মত ঐতিহাসিকগণ (মৃত্যু: ৭৬৭) ওইসমস্ত আহাদিস সংগ্রহ শুরু করলেন যেগুলো কুরানের কোনও কোনও অনুচ্ছেদকে পয়গম্বর যে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে বিশেষ প্রত্যাদেশ লাভ করেছেন তার সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপনের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করে। ইবন ইসহাক পয়গম্বর মুহাম্মদের(স:) এক বিস্তারিত জীবনী (সিরাহ্) রচনা করেন যা আনসারদের গুণাবলীর ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছে এবং মুহাম্মদের(সঃ) বিরোধিতাকারী মক্কাবাসীদের দুষ্কর্ম তুলে ধরেছে। তিনি স্পষ্টতই শিয়াদের দৃষ্টিভঙ্গির পক্ষ নিয়েছেন যে মুসলিমদের আবু সুফিয়ানদের বংশধরদের দ্বারা শাসিত হওয়া উচিত নয়। এইভাবে ইতিহাস এক ধর্মীয় কাজে পরিণত হয় যা পরস্পরের বিরুদ্ধে নীতিভিত্তিক বিরোধিতাকে যৌক্তিকতা দান করে।

সুতরাং উম্মাহ্ রাজনৈতিক সুস্থতা উদীয়মান ইসলামী ধার্মিকতার কেন্দ্রবিন্দু ছিল। খলিফাহ্ ও তাঁর প্রশাসন যেখানে যেকোনও কৃষিভিত্তিক সাম্রাজ্যের ওপর নেমে আসা নানা সমস্যা মোকাবিলায় এবং একটি শক্তিশালী রাজশক্তি প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট ছিলেন, সেখানে ধার্মিক ব্যক্তিরা এধরনের যেকোনও সমাধানের চরম বিরোধিতা করেছে। সুতরাং একেবারে গোড়া থেকেই কোনও শাসকের আচরণ এবং নীতিমালা এক ধর্মীয় তাৎপর্য পেয়ে এসেছে যার সঙ্গে মুসলিম বিশ্বের ভাববাদ, অতীন্দ্রিয়বাদ, পবিত্র জুরিসপ্রুডেন্স এবং প্রাথমিক থিয়োলজিক্যাল চিন্তার ভাবনা গভীর বিপরীত সম্পর্ক ছিল।

উমাঈয়াহদের শেষ বছরগুলো (৭০৫-৭৫0)

অধিকতর ধার্মিক ব্যক্তিদের অসম্মতি সত্ত্বেও আব্দ আল-মালিক তাঁর ছেলে প্রথম আল-ওয়ালিদের উত্তরাধিকার নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন: ইসলামী বিশ্বে প্রথম বারের মত বংশধারার নীতি বিনা আপত্তিতে গৃহীত হয়। উমাঈয়াহ্ বংশ এর সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছে গিয়েছিল। আল-ওয়ালিদের অধীনে মুসলিম সেনাবাহিনী উত্তর আফ্রিকা অধিকার করে এবং স্পেনে একটি রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। এটাই ইসলামের পশ্চিম অভিমুখী বিস্তারের সীমা চিহ্নিত করে দেয়। ৭৩২-এ চার্লস মারটেল যখন পয়টিয়ার্সে মুসলিম বাহিনীকে পরাজিত করেন, মুসলিমরা একে বড় কোনও বিপর্যয় বলে ভাবেনি। পশ্চিমের লোকজন প্রায়ই পয়টিয়ার্সের গুরুত্বে অতিরঞ্জন আরোপ করে, যা মোটেই ওয়াটারলু ছিল না। আরবরা ইসলামের নামে পশ্চিমে ক্রিশ্চান জগৎ অধিকার করার ধর্মীয় বা অন্য কোনওরকম তাগিদ বোধ করেনি। প্রকৃতপক্ষে ইউরোপ লক্ষ্যণীয়ভাবে অনাকর্ষণীয় বলে মনে হয়েছে: পশ্চাদপদ ওই অঞ্চলে ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ খুব একটা ছিল না, লুণ্ঠিত মালের পরিমাণও উল্লেখযোগ্য হত না, পরিবেশ ছিল জঘন্য।

দ্বিতীয় উমর (৭১৭-২০)-এর শাসনামলের শেষ দিকে ঝামেলায় পড়ে সাম্রাজ্য। প্রাক-আধুনিক যে কোনও সাম্রাজ্যেরই আয়ুষ্কাল ছিল সীমিত, যেহেতু এর ভিত্তি ছিল কৃষিজাত উদ্বৃত্ত, এমন একটা পর্যায় অনিবার্য যখন এক বিশাল সম্প্রসারণশীল রাষ্ট্র এর সম্পদ শেষ করে ফেলবে। কনসট্যান্টিনোপল দখল করার এক বিপর্যয়কর প্রয়াসের মাসুল গুনতে হয়েছিল উমরকে, যা কেবল ব্যর্থই হয়নি বরং প্রচুর লোকবল আর সাজসরঞ্জামের ক্ষতি সাধিত হয়েছিল। উমরই প্রথম খলিফাহ্ যিনি জিম্মিদের ইসলাম ধর্ম গ্রহণে অনুপ্রাণিত করেন, তারাও গতিশীল নতুন ধর্মবিশ্বাসকে আলিঙ্গন করতে উদগ্রীব ছিল; কিন্তু যেহেতু তাদের আর টোল ট্যাক্স (জিযিয়াহ্) দেয়ার বাধ্যবাধকতা থাকত না, সে কারণে নতুন নীতি রাজস্ব আয়ের পরিমাণ বিপুলভাবে কমিয়ে দিয়েছিল। ধার্মিক মানুষ ছিলেন উমর, যিনি মদীনায় বড় হয়েছেন এবং সেখানকার ধর্মীয় আন্দোলন দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। নিজের আচরণকে তিনি রাশিদুনদের আদলে গড়ে তোলার প্রয়াস পেয়েছিলেন, ইসলামী ঐক্যের ওপর জোর দিয়েছেন, সকল অঞ্চলকে সমতার ভিত্তিতে বিবেচনা করেছেন (সিরিয়ার প্রতি পক্ষপাত না দেখিয়ে) আর জিম্মিদের প্রতি মানবিক আচরণ করেছেন। অসম্ভব জনপ্রিয় ছিলেন তিনি; কিন্তু তাঁর ইসলামী নীতিমালা, যা তাঁকে ধার্মিকদের কাছে আপন করে তুলেছিল, সাম্রাজ্যের রুগ্ন অর্থনীতির জন্য সঠিক ছিল না। তাঁর উত্তরসূরীদের শাসনামলগুলো বিদ্রোহ আর তীব্র অসন্তোষে আকীর্ণ ছিল। খলিফারা দ্বিতীয় ইয়াযিদের (৭২০-২৪) মত অসচ্চরিত্রের হোক কিংবা হিশামের (৭২৪-৪৩) মত ধার্মিকই হোন, তাতে আর কিছু এসে যায়নি। হিশাম শক্তিশালী এবং কার্যকর খলিফাহ্ ছিলেন, সাম্রাজ্যকে অধিকতর শক্ত অর্থনৈতিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি, কিন্তু সেটা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়েছিল রাষ্ট্রকে কঠোরভাবে কেন্দ্রীকরণ এবং আপন শাসনকে আরও স্বৈরাচারী করার ফলে। তিনি অধিকহারে প্রচলিত একচ্ছত্র রাজাধিপতিতে পরিণত হচ্ছিলেন, এতে রাজনৈতিক দিক দিয়ে সাম্রাজ্য লাভবান হয়েছিল। কিন্তু সমস্যা হল, এধরনের স্বৈরাচারী ব্যবস্থা আবার ধার্মিকদের চোখে ঘৃণিত এবং মৌলিকভাবে অনৈসলামিক। তবে কি নীতির ভিত্তিতে কোনও রাষ্ট্র পরিচালনা সম্ভব নয়? শিয়ারা ক্রমবর্ধমান হারে সক্রিয় হয়ে উঠছিল। তাদের নেতারা আলীর বংশধর হিসাবে দাবী করেন নিজেদের, তাঁদের বিশ্বাস ছিল, যে ইল্‌ম মুসলিমদের ন্যায়-বিচারভিত্তিক সমাজ গঠনে সক্ষম করে তুলতে পারে তা কেবল মুহাম্মদের(স:) পরিবারের মাঝেই সম্পূর্ণভাবে রক্ষিত আছে এবং কেবল তাদেরই শাসন করার অধিকার আছে। অধিকতর চরমপন্থী শিয়ারা উম্মাহর বর্তমান সব সমস্যার জন্য প্রথম তিন রাশিদুনকে (আবু বকর, উমর এবং উসমান) দায়ী করে, যাঁদের উচিত ছিল প্রথমেই আলীর হাতে নেতৃত্ব তুলে দেয়া। আরও চরমপন্থী শিয়াদের (ঘুলাত: অতিরঞ্জনকারী হিসাবে পরিচিত) বেশীর ভাগ ছিল ধর্মান্তরিত মুসলিম এবং তারা তাদের পুরনো কিছু বিশ্বাসও বজায় রেখেছিল। আলীকে তারা ঈশ্বরের এক অবতার (জেসাসের মত) হিসাবে দেখেছে, তাদের বিশ্বাস ছিল বিদ্রোহে নিহত শিয়া নেতৃবৃন্দ এক অস্থায়ী “গোপন স্থানে” (“occultation”) অবস্থান করছেন এবং তাঁরা শেষ জমানায় ন্যায়-বিচার ও শান্তির এক স্বপ্নরাজ্যের উদ্বোধন করার জন্য ফিরে আসবেন।

কিন্তু কেবল ধার্মিক ব্যক্তিরাই উমাঈয়াদের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন বোধ করেনি। ধর্মান্ত রের মাধ্যমে ইসলাম গ্রহণকারী (মাওয়ালি: ক্লায়েন্ট) তাদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক মর্যাদায় আপত্তি উত্থাপন করে। আরব মুসলিমদের গোত্রীয় বিভাজনও ছিল, যাদের কেউ কেউ সাধারণ প্রজাদের মাঝে বসতি স্থাপন করে তাদের সঙ্গে মিশে যেতে চেয়েছে, আবার অন্যরা পুরনো সম্প্রসারণবাদী যুদ্ধ অব্যাহত রাখার পক্ষে মত দিয়েছে। কিন্তু ইসলামী সেন্টিমেন্ট এমন ব্যাপক হয়ে পড়েছিল যে বিভিন্ন বিদ্রোহ আর আন্দোলনের সকল পক্ষই ধর্মীয় কোনও আদর্শ বেছে নিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত উমাঈয়াহ্ রাজবংশকে উৎখাতকারী বিদ্রোহের বেলায় এ কথাটি সর্বাংশেই সত্যি। আব্বাসীয় উপদলটি সিংহাসনে মুহাম্মদের(স:) পরিবারের কোনও সদস্যকে দেখার ব্যাপক আকাঙ্ক্ষাকে পুঁজি করে এবং জোর দিয়ে বলে যে তাদের নেতা পয়গম্বরের চাচা আব্বাস এবং তাঁর পুত্র প্রাথমিক কালের কুরান আবৃত্তিকারকদের অন্যতম আবদাল্লাহ্ বংশধর। ৭৪৩-এ তারা ইরানের বিভিন্ন অঞ্চলে সমর্থন আদায়ে সক্ষম হয় এবং ৭৪৯-এর আগস্টে কুফাহ্ অধিকার করে নেয়, এর পরের বছর ইরাকে শেষ উমাঈয়াহ্ খলিফাহ্ দ্বিতীয় মনসুরকে পরাস্ত করে। অবশেষে যখন তারা সাম্রাজ্য অধিকার করে নেয়, আব্বাসীয় খলিফাগণ সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের সমাজ গঠন শুরু করেন।

আব্বাসীয় যুগ: খেলাফতের সুবর্ণসময় (৭৫০-৯৩৫)

নিজেদের সযত্নে শিয়া আলোয় তুলে ধরার মাধ্যমে সমর্থন আদায় করেছিল আব্বাসীয়রা, কিন্তু ক্ষমতায় আরোহণের পর তারা এই ধর্মীয় ক্যামোফ্লাজ ঝেড়ে ফেলে এবং পরিষ্কার করে দেয় যে, প্রচলিত কৃষিভিত্তিক চরম রাজতন্ত্র গড়ে তুলতে তারা বদ্ধ পরিকর। প্রথম আব্বাসীয় খলিফাহ্ আবু আল-আব্বাস আল-সাফাহ্ (৭৫০-৫৪) যেখানে উমাঈয়াদের যাকে পেয়েছেন নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিলেন। এর আগে পর্যন্ত কোনও অভিজাত আরব পরিবারের সকল সদস্যেকে নির্বিচারে হত্যা করার ব্যাপারটি ছিল অকল্পনীয়। খলিফাহ্ আবু জাফর আল-মনসুর (৭৫৪-৭৫) তাঁর ক্ষমতার প্রতি হুমকি বিবেচিত সকল শিয়া নেতাকে হত্যা করান। এই খলিফাগণ নিজেদের এমন ধরনের উপাধি দিয়েছিলেন যাতে ক্ষমতাকে স্বর্গপ্রদত্ত অধিকার বোঝায়। আল-মনসুর বোঝায় যে বিজয় অর্জনে ঈশ্বর তাঁকে বিশেষ সাহায্য দেবেন; তাঁর ছেলে আল-মাহদি (পথপ্রাপ্ত) উপাধি নিয়েছিলেন, শিয়ারা এ উপাধিটি প্রয়োগ করে এমন নেতার কথা বোঝানোর জন্য যিনি ন্যায় বিচার আর শান্তির কাল প্রতিষ্ঠা করবেন।

উপাধি নির্বাচন করার সময় খলিফাহ্ আল-মাহদি (৭৭৫-৮৫) হয়ত শিয়াদের তাঁর পিতার সংঘটিত রক্তপাতের ঘটনার পর সন্তুষ্ট করতে চেয়েছিলেন। উমাঈয়াদের পতন ত্বরান্বিতকারী অসন্তোষের ব্যাপারে সচেতন ছিল আব্বাসীয়রা এবং উপলব্ধি করেছিল যে তাদের অবশ্যই বিক্ষুদ্ধ দলগুলোর কাছে কিছু ছাড় দিতে হবে। যদিও তারা নিজেরা আরব ছিল, কিন্তু তাদের বিজয়ের ফলে সাম্রাজ্যে আরবদের বিশেষ সুবিধা লাভের প্রচলিত রেওয়াজের অবসান ঘটে। তারা দামাস্কাস থেকে ইরাকে রাজধানী সরিয়ে নেয়, প্রথমে কুফাহ্ এবং পরে বাগদাদে স্থায়ী হয়। তারা সকল অঞ্চলকে একইভাবে শাসন করার প্রতিশ্রুতি দেয় এবং কোনও জাতিগত গোষ্ঠীকে বিশেষ মর্যাদা না দেয়ার ঘোষণা দেয় যা মাওয়ালিদের সন্তুষ্ট করেছিল। সাম্রাজ্য এই অর্থে সাম্যবাদী ছিল যে যে-কোনও লোকের পক্ষে রাজদরবার বা আদালতে হাজির হওয়া সম্ভব ছিল তখন। কিন্তু কুফাহ্ থেকে বাগদাদে স্থানান্তর ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। খলিফাগণ পুরনো গ্যারিসন শহরগুলোর আবহ পেছনে ফেলে গেছেন, যেগুলো প্রাচীন গোত্রীয় নকশানুযায়ী নির্মাণ করা হয়েছিল, যেখানে প্রত্যেক অংশ ছিল সমান ও স্বাধীন। বাগদাদের কেন্দ্রস্থল ছিল বিখ্যাত “রাউন্ড সিটি” যেখানে প্রশাসন, রাজদরবার আর রাজপরিবারের অবস্থান ছিল। বাজার আর কর্মী ও দাসদের আবাসস্থলের অবস্থান ছিল সীমানায়। টাইগ্রিসের তীরে ইরাকের কৃষিভিত্তিক সোয়াদের কাছাকাছি এক সুবিধাজনক স্থানে নির্মিত হয়েছিল বাগদাদ, কিন্তু তা পারসিয়ান স্যাসানিয়দের রাজধানী সেটিফনেরও কাছাকাছি ছিল: এবং নতুন খেলাফত প্রাচীন প্রাক-ইসলামী ধারায় গড়ে উঠেছিল।

খলিফাহ্ হারূন আল-রশিদের (৭৮৬-৮০৯) আমল নাগাদ পরিবর্তন চূড়ান্ত হয়ে যায়। আল-রশিদ রাশিদুনদের মত নয়, বরং প্রাচীন কেতার রাজাধিরাজের মত শাসন করেছেন। প্রজাদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন তিনি, প্রথম খলিফাঁদের আমলের বৈশিষ্ট্য, অনানুষ্ঠানিকতার স্থান দখল করে নিয়েছিল চোখ টাটান জাঁকজমক। দরবারের সদস্যরা তাঁর সামনে উপস্থিত হবার পর এমন ভঙ্গিতে মাটিতে চুম্বন করতে যা খোদ আরবরা যখন ঈশ্বরের সামনে নত হয়েছিল সেই সময় চিন্তা করাও অসম্ভব ছিল। পয়গম্বরকে যেখানে আর দশজন সাধারণ মানুষের মতই অনানুষ্ঠানিকভাবে তাঁর নাম ধরেই সম্বোধন করা হত খলিফাহ্ সেখানে “পৃথিবীতে ঈশ্বরের ছায়া” উপাধি ধারণ করে বসেন। খলিফার পেছনে জল্লাদ দাঁড়িয়ে থাকত একথা বোঝাতে যে তাঁর প্রাণ দেয়া এবং নেয়ার ক্ষমতা আছে। উম্মাহর খবরদারি আর নিজে করছিলেন না খলিফাহ্ বরং উজিরের হাতে সরকারের দায়িত্ব তুলে দিয়েছিলেন। তাঁর ভূমিকা দাঁড়িয়েছিল চূড়ান্ত আপীলের দরবার হিসাবে, উপদল বা রাজনীতিকদের নাগালের বাইরে। শুক্রবার অপরাহ্নের প্রার্থনায় নেতৃত্ব দিতেন তিনি আর বড় ধরনের যুদ্ধে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে থাকতেন। অবশ্য সেনাবাহিনীও বদলে গিয়েছিল। এটা আর তখন যেকোনও মুসলিমের জন্যে উন্মুক্ত জনগণের সেনাদল ছিল না, বরং পারসিয়দের একটি বাহিনী হয়ে গিয়েছিল যারা আব্বাসীয়দের ক্ষমতায় আরোহণে সাহায্য করেছিল, খলিফার ব্যক্তিগত বাহিনী হিসাবে বিবেচনা করা হত তাদের।

এটা অবশ্যই ধর্মীয় আন্দোলনের চোখে ঘৃণিত ছিল– আব্বাসীয়রা প্রথম ক্ষমতায় আসার সময় যাদের সদস্যরা আশায় বুক বেঁধেছিল। কিন্তু যত অনৈসলামিকই হোক না কেন গোড়ার দিকে নয়া খেলাফত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে সফল ছিল। প্রজাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ছিল খলিফার দায়িত্ব এবং হারূন আল-রশিদের অধীনে, খেলাফত যখন তুঙ্গ সময়ে অবস্থান করছে, সাম্রাজ্য নজিরবিহীন শান্তি প্রত্যক্ষ করে। অভ্যূত্থানসমূহ নির্দয়ভাবে দমন করা হয়েছিল, জনগণ বুঝতে পেরেছিল যে এই শাসকের বিরুদ্ধে আন্দোলন করা বৃথা, কিন্তু ভাল দিক ছিল এই যে সাধারণ মানুষ নিশ্চিন্তে অধিকতর স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পেরেছে। চিত্রকলা আর বিদ্যা অর্জনের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন হারূন আল-রশিদ, এক মহান সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণে ‘অনুপ্রেরণা দিয়েছিলেন তিনি। সাহিত্য সমালোচনা, দর্শন, কাব্য, ওষুধ, গণিত আর জ্যোতির্বিদ্যা কেবল বাগদাদেই নয় বরং কুফাহ্, বসরাহ্, জানজিবার এবং হারানেও বিকাশ লাভ করেছিল। জিম্মিরা ক্লাসিক্যাল হেলেনিজমের দার্শনিক ও চিকিৎসা বিজ্ঞান বিষয়ক বিবরণ গ্রিক এবং সিরিয়াক থেকে আরবীতে অনুবাদ করে এই আলোকময় কর্মকাণ্ডে অংশ নেয়। এভাবে অতীতের শিক্ষা নাগালে আসায় এর ওপর ভিত্তি করে মুসলিম পণ্ডিতগণ এই সময়কালে অতীতের লিপিবদ্ধ গোটা ইতিহাসের চেয়ে ঢের বেশী বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছিলেন। শিল্প আর বাণিজ্যও বিকশিত হয় আর অভিজাতরা উন্নত এবং বিলাসী পরিবেশে বাস করে। কিন্তু এই শাসনামলটি কিভাবে ইসলামী সেটা বোঝা কঠিন। খলিফাহ্ এবং তাঁর সঙ্গীরা দারুণ বিচ্ছিন্নভাবে বাস করতেন যার সঙ্গে পয়গম্বর এবং রাশিদুনদের সরল জীবন ধারার প্রকট বৈপরীত্য ছিল। কুরান নির্দেশিত চারজন স্ত্রীতে নিজেদের সীমিত রাখার বদলে তাঁদের স্যাসানিয় রাজাদের মত বিরাট হারেম ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও ধর্মীয় সংস্কারকদের পক্ষে আব্বাসীয়দের মেনে নেয়া ছাড়া উপায় ছিল না। ইসলাম একটা বাস্তববাদী ও বাস্তবমুখী ধর্ম বিশ্বাস যা সাধারণভাবে শহীদি চেতনা বা অর্থহীন ঝুঁকি গ্রহণ উৎসাহিত করে না।

এই বাস্তববাদীতা বিশেষভাবে শিয়াদের মাঝে বেশী দেখা যায়। কারবালা হুসেইনের দুঃখজনক মৃত্যুর পর তাঁর নিকট বংশধরেরা মদীনায় যথারীতি ধার্মিকের জীবনযাপন করে গেছেন, যদিও অনেকেই তাঁদের উম্মাহর সঠিক ইমাম হিসাবে দেখেছিল। হুসেইনের জ্যেষ্ঠ পুত্র আলী যায়েন আল-আবিদিন (মৃত্যু: ৭১৪), শিয়ারা যাকে চতুর্থ ইমাম হিসাবে জানে- যেহেতু তিনি আলী, হাসান এবং হুসেইনের পরবর্তীজন ছিলেন- একজন সাধু ছিলেন, চমৎকার এক প্রার্থনা সংকলন রেখে গেছেন তিনি। পঞ্চম ইমাম মুহাম্মদ আল-বাকির (মৃত্যু: ৭৩৫) কুরান পাঠের এক গূঢ় পদ্ধতির আবিষ্কার করেন: কুরানের প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি পঙক্তির একটি গোপন (বাতিন) অর্থ রয়েছে, যা কেবল মনোযোগ নিবদ্ধ করার অতীন্দ্রিয় কৌশলের সাহায্যেই উপলব্ধি করা সম্ভব, এসব কৌশল অন্যান্য বিশ্ব ধর্মে বিকাশিত সত্তার গভীরে প্রবেশ করার পদ্ধতির অনুরূপ। এই বাতিন অর্থই সম্ভবত ইমামতি সম্পর্কে আল-বাকিরের নতুন মতবাদের ব্যাখ্যা দেয়। তাঁর ভাই যায়েদ ইবন আলী একজন রাজনৈতিক কর্মী ছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত ৭৪০-এ উমাঈয়াহ্রদের বিরুদ্ধে সংঘটিত এক অভ্যুত্থানে প্রাণ হারান। সে সময়ের ইমাম হিসাবে যায়েদের দাবীর বিপরীতে আল-বাকির যুক্তি তুলে ধরেছিলেন যে পয়গম্বরের অনন্য ইলম আলীর নিকটতম বংশধরদের মাধ্যমে প্রবাহিত হয়েছে। প্রত্যেক ইমাম তাঁর উত্তরাধিকারী মনোনীত করেছেন এবং ঐশীগ্রন্থের গুপ্ত অর্থ আবিষ্কারে সক্ষম করার জন্য গুপ্তবিদ্যা তুলে দিয়েছেন তাঁর হাতে। একমাত্র ইমাম যিনি তাঁর পূর্বসূরীর কাছ থেকে বিশেষ খেতাব (নাস) লাভ করেছেন তিনিই মুসলিমদের বৈধ নেতা। তিনি– আল-বাকির- তাঁর পিতার কাছ থেকে নাস পেয়েছেন, যায়েদ পাননি। অবশ্য ৭৪০-এ অল্প সংখ্যক অনুসারী ছিল আল-বাকিরের; অধিকাংশ শিয়া আল-বাকিরের অতীন্দ্রিয়বাদী শান্তি বাদের চেয়ে যায়েদের বিপ্লবী নীতিমালা বেশী পছন্দ করেছিল। কিন্তু শিয়া ভিন্ন মতাবলম্বীর ওপর আব্বাসীয়দের নির্বিচার নিষ্ঠুর নিপীড়নের প্রেক্ষিতে তারা ষষ্ঠ ইমাম জাফর আল-সাদিকের (মৃত্যু: ৭৬৫) নির্দেশনা মানতে প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিল, আল-সাদিক স্বয়ং আল-মনসুর কর্তৃক কারাগারে অবরুদ্ধ হয়েছিলেন। আল-সাদিক নাসের মতবাদকে উন্নত এবং নিশ্চিত করে ঘোষণা দেন যে যদিও নির্বাচিত ইমাম হিসাবে তিনিই উম্মাহর প্রকৃত নেতা, কিন্তু তিনি তাঁর প্রজন্মকে স্বর্গীয় ইলম শিক্ষা দেবেন এবং কুরানের বাতিন পাঠে পথনির্দেশ যোগাবেন, কিন্তু শিয়াদের অবশ্যই এই বিপদসঙ্কুল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তাদের সব মতবাদ এবং রাজনৈতিক বিশ্বাস গোপন রাখতে হবে।

কিন্তু এই মতবাদ কেবল সংখ্যালঘু অতীন্দ্রিয়বাদে আগ্রহী অভিজাতদের কাছে আবেদন সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিল। অধিকাংশ মুসলিমের আরও সহজগম্য ধার্মিকতা প্রয়োজন ছিল এবং এক নতুন ধরনের ভক্তিতে সেটা তারা আবিষ্কার করে, যা উমাঈয়াহ্ শাসনামলের শেষদিকে আবির্ভূত হলেও হারূন আল-রশিদের আমলে ব্যাপকতা লাভ করে। এটা জেসাসের প্রতি ক্রিশ্চানদের ভক্তিবাদের অনুরূপ, যেহেতু এখানে কুরানকে ঈশ্বরের অনির্মিত বাণী (Uncreated Word) হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছে, যা অনন্তকাল ধরে তাঁর সঙ্গে অস্তিত্ববান ছিল এবং যা, যেমন বলা হয়ে থাকে, মুহাম্মদের(স:) কাছে প্রত্যাদিষ্ট ঐশীগ্রন্থের ভেতর রক্তমাংসের মনুষ্যরূপ নিয়েছে। মুসলিমরা ঈশ্বরকে দেখতে পায় না, কিন্তু যখনই তারা কুরানের আবৃত্তি শোনে তখন তাঁর কথা শুনতে পায় এবং স্বর্গীয় সত্তায় প্রবেশের অনুভূতি লাভ করে। যখন তারা অনুপ্রাণীত বাণী উচ্চারণ করে, ঈশ্বরের বক্তব্য তাঁদের জিহ্বা আর মুখে আন্দোলিত হয়; যখন তারা পবিত্র গ্রন্থটি ধারণ করে তখন তাঁকেই হাতে পায়। এ বক্তব্য মুতাযিলাদের আতঙ্কিত করে তুলেছিল, যেহেতু এটা তাদের যুক্তিনির্ভর ধার্মিকতা এবং ঈশ্বরের একত্ব এবং পরম সরলতার ধারণাকে আক্রান্ত করেছিল। এ মতবাদ যেন কুরানকে দ্বিতীয় স্বর্গীয় সত্তায় পরিণত করেছিল। কিন্তু গুপ্ত শিয়ার মত মুতাযিলা মতবাদও সংখ্যালঘু বুদ্ধিজীবীদের বিষয় ছিল এবং কুরানের প্রতি এই ভক্তি অসম্ভব জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এর অনুসারীগণ আহল আল-হাদিস, হাদিসের জনগণ নামে পরিচিতি লাভ করে, কারণ তারা জোর দিয়ে বলেছে মুসলিমদের আইনকে অবশ্যই পয়গম্বরের আদর্শ এবং সাধারণ অনুশীলনের (সুন্নাহ্ ) প্রত্যক্ষদর্শীর “প্রতিবেদনে”র ভিত্তিত প্রণীত হতে হবে। তারা আবু হানিফাহ্ অনুসারীদের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছে, যিনি মনে করেছিলেন যে জুরিস্টদের “স্বাধীন যুক্তি প্রয়োগের” (ইজতিহাদ) ক্ষমতা ব্যবহার করা আবশ্যক। তাঁর যুক্তি ছিল, তাঁদের অবশ্যই নতুন নতুন আইন নির্মাণের স্বাধীনতা থাকতে হবে, যদি কোনও হাদিস বা কুরানের কোনও উচ্চারণের ওপর নির্ভর করতে নাও পারেন।

সুতরাং আহল আল-হাদিস’রা ছিল রক্ষণশীল; এক আদর্শে রূপান্তরিত অতীতের প্রেমে নিমগ্ন ছিল তারা; সকল রাশিদুনকে শ্রদ্ধা করত তারা এবং এমনকি পয়গম্বরের অন্যতম সহচর মুয়াবিয়াহকেও। মুতাযিলাদের বিপরীতে- যাদের প্রায়ই স্থানীয় রাজনৈতিক কর্মী হতে দেখা গেছে- তারা জোর দিয়ে বলেছে “সৎ কাজে নির্দেশ ও মন্দ কাজে বাধা দেয়া”র দায়িত্ব কেবল নগণ্য সংখ্যকের: নিম্ন পর্যায়ের লোকদের অবশ্যই খলিফাঁকে মানতে হবে, তাঁর ধর্মীয় পরিচয় যাই হোক না কেন। হারুন আল-রশিদের কাছে এ বক্তব্য আকর্ষণীয় ঠেকেছিল। আরও ধর্মীয় আন্দোলনের শুভেচ্ছা লাভের দরকার ছিল তাঁর, আহল আল-হাদিসের প্রতি- বিপ্লবাত্মক প্রবণতার অনুমোদন দেন তিনি। মুতাযিলারা বাগদাদের সুনজরে থেকে বঞ্চিত হয়ে পড়ে এবং হাদিসের জনগণ তাদের সামাজিকভাবে একঘরে করার ব্যাপারে উৎসাহিত হয়ে ওঠে। কখনও কখনও তাদের অনুরোধে সরকার এমনকি নেতৃস্থানীয় মুতাযিলাদের কারাগারেও নিক্ষেপ করে।

ধর্মীয় আন্দোলনের শক্তি সম্পর্কে সচেতন ছিল আব্বাসীয়রা, ফলে রাজবংশ প্রতিষ্ঠায় সফল হওয়ার পর তারা নিজেদের শাসনকে ইসলামী বৈধতা দেয়ার প্রয়াস পায়। সেকারণেই তারা জনগণের জীবনধারা নিয়ন্ত্রণ করার উদ্দেশ্যে ফিকহ্ র বিকাশ উৎসাহিত করেছে। সাম্রাজ্যে এক ধরনের বিভেদ সৃষ্টি হয়েছিল। সাধারণ জনগণের জীবনধারা প্রকৃতই শরিয়াহ্ নামে আখ্যায়িত ইসলামী আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়েছিল, কিন্তু রাজদরবার বা সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রে মুসলিম নীতিমালা প্রয়োজ্য হয়নি। তারা আব্বাসীয় শাসনকে টিকিয়ে রাখার জন্যে প্রাক- ইসলামী স্বৈরাচারী নিয়মকানুনের প্রতিই বেশী অনুরক্ত ছিল।

উমাঈয়াদের অধীনে প্রত্যেক শহরে আলাদা নিজস্ব ফিক্হ গড়ে ওঠে, কিন্তু আব্বাসীয়রা আরও সংহত আইনগত ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্যে জুরিস্টদের ওপর চাপ প্রয়োগ করে। কুরানের আমলের তুলনায় মুসলিম জীবনযাত্রা আমূল বদলে গিয়েছিল। ইসলাম ধর্ম গ্রহণে উৎসাহিত করা হচ্ছিল বলে জিম্মিরা সংখ্যালঘু দলে পরিণত হচ্ছিল। মুসলিমরা আর গ্যারিসন শহরে অমুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ হতে বিচ্ছিন্ন ছোট অভিজাত গ্রুপ ছিল না। তারাই এখন সংখ্যাগরিষ্ঠ। মুসলিমদের কেউ কেউ সম্প্রতি ধর্ম বিশ্বাস গ্রহণ করেছিল, তখনও তারা তাদের পুরনো বিশ্বাস আর আচার অনুষ্ঠানে আঁকড়ে রেখেছিল। জনগণের জন্য ইসলামী জীবন নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে অধিকতর সংহত এবং স্বীকৃত ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। উলেমাদের (ধর্মীয় পণ্ডিত: একবচনে: আলিম) একটা আলাদা শ্ৰেণী আবির্ভূত হতে শুরু করেছিল তখন। বিচারকগণ (কাজি) আরও কঠোর প্রশিক্ষণ লাভ করেছেন। আল-মাহদি এবং হারুন আল-রশিদ দু’জনই ফিক্’র পৃষ্ঠপোষক হওয়ার মাধ্যমে আইন গবেষণায় উৎসাহ জুগিয়েছেন। দু’জন অসাধারণ পণ্ডিত চিরন্তন অবদান রেখে গেছেন। মদীনায় মালিক ইবন আনাস (মৃত্যু: ৭৯৫) একটি সংকলন গ্রন্থিত করেন যার নাম আল-মুতাওয়াত্তাব (দ্য বীটেন পাথ: The Beaten Path)। এটা ছিল মদীনার প্রচলিত আইন ও ধর্মীয় অনুশীলনের বিস্তারিত বিবরণ যা পয়গম্বরের সমাজের মূল বা আদি সুন্নাহ্ ধরে রেখেছে বলে মালিকের বিশ্বাস ছিল। মালিকের অনুসারীরা তাঁর ধর্মতত্ত্ব সমূহকে মালিকি মতবাদ (মাযহাব) হিসাবে পূর্ণাঙ্গ করে তুলেছিল যা মদীনা, মিশর এবং উত্তর আফ্রিকায় বিস্তার লাভ করে।

কিন্তু অন্যরা একথা মানতে চায়নি যে, বর্তমান কালের মদীনা আদি ইসলামের পথে সত্যিই নির্ভরযোগ্য পথপ্রদর্শক হতে পারে। মুহাম্মদ ইদ্রিস ইবন আল-শাফী (মৃত্যু: ৮২০), গাযায় দারিদ্র্যের মধ্যে যাঁর জন্ম এবং যিনি মদীনায় মালিকের সঙ্গেই পড়াশোনা করেছিলেন, যুক্তি তুলে ধরেন যে মাত্র একটি ইসলামী শহরের ওপর নির্ভর করা নিরাপদ নয়, এর মর্যাদা যত উন্নতই হোক না কেন। তাঁর পরিবর্তে সকল জুরিসপ্রুডেন্সের ভিত্তি হওয়া উচিত পয়গম্বর সম্পর্কিত আহাদিস, যাঁকে কেবল কুরানের প্রচারক হিসাবে নয় বরং অনুপ্রাণিত ব্যাখ্যাকারী হিসাবে দেখা উচিত। ঐশীগ্রন্থের নির্দেশ ও আইন-কানুন মুহাম্মদের(স:) বাণী এবং কর্মধারার আলোকে উপলব্ধি করা যেতে পারে। কিন্তু, শাফী জোর দিয়ে বললেন যে, প্রত্যেকটা হাদিসকে অবশ্যই নির্ভরযোগ্যভাবে ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের একটি পরম্পরা (ইসনাদ) দ্বারা স্বয়ং পয়গম্বর অবধি সমর্থিত হতে হবে। ইসনাদকে অবশ্যই কঠোরভাবে যাচাই করতে হবে। যদি পরম্পরায় বিচ্যুতি ঘটে বা কোনও “সংযোগকারী”কে যদি অবিশ্বস্ত মুসলিম হতে দেখা যায়, তাহলে হাদিসটিকে অবশ্যই বাদ দিতে হবে। আল-শাফী আহল আল-হাদিস এবং ইজতিহাদের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব আরোপকারী আবু হানিফার মত জুরিস্টদের মাঝে মধ্যস্থতার প্রয়াস পেয়েছিলেন; শাফী একটা মাত্রা পর্যন্ত ইজতিহাদের প্রয়োজনীয়তা মেনে নিয়েছিলেন; কিন্তু তিনি বিশ্বাস করতেন, একে পয়গম্বরের রীতি (customs) আর সমসাময়িক আচার অনুষ্ঠানের কঠোর মিলের (কিয়াস) মধ্যে সীমিত থাকতে হবে। আল-শাফী শিক্ষা দিয়েছেন পবিত্র আইনের (উসুল আল-ফিক্হ) চারটি “মূল” রয়েছে: কুরান, পয়গম্বরের সুন্নাহ, কিয়াস (analogy) এবং ইজমাহ, সমাজের “ঐকমত্য” (consensus)। ঈশ্বর সমগ্র উম্মাহকে ভ্রান্তিতে আক্রান্ত হতে দিতে পারেন না, সুতরাং কোনও আচার যদি সকল মুসলিম কর্তৃক গৃহীত হয়, তাকে অবশ্যই সঠিক হিসাবে স্বীকৃতি দিতে হবে, যদি এর সমর্থনে কুরানের কোনও সূত্র বা হাদিস নাও পাওয়া যায়। আল-শাফীর পদ্ধতি- সঠিকতার আধুনিক মানদণ্ড অনুযায়ী পয়গম্বরের সুন্নাহ্ কঠিন এতিহাসিক বাস্তবতা নিশ্চিত করার উপযুক্ত ছিল না- কিন্তু এতে করে গভীর এবং সন্তোষজনক ধর্মীয় অনুভূতি দানকারী একটা জীবনধারা নির্মাণের অবলম্বন পেয়েছিল মুসলিমরা।

আল-শাফীর অসাধারণ কাজের ফলে অন্য পণ্ডিতগণ তাঁর মানদণ্ড অনুযায়ী আহাদিস গবেষণায় উৎসাহিত হয়ে ওঠেন। আল-বুখারি (মৃত্যু: ৮৭০) এবং মুসলিম (মৃত্যু: ৮৭৮) দু’টি নির্ভরযোগ্য এবং কর্তৃত্বপূর্ণ সংকলন সম্পাদন করেন যা ফিক্হ’র প্রতি আগ্রহ জোরাল করে তোলে এবং শেষ পর্যন্ত শরিয়াহ্ আইনের ভিত্তিতে এক বিশাল ইসলামী সমরূপ ধর্মীয় জীবন সৃষ্টির পথ প্রশস্ত করে। আইনের অনুপ্রেরণা ছিলেন ব্যক্তি পয়গম্বর, সাম্রাজ্য জুড়ে আদর্শ মানুষ। তাঁর ব্যবহারিক জীবনের তুচ্ছ বিষয়টির অনুকরণের মাধ্যমে– তাঁর খাদ্য গ্রহণের ভঙ্গি, হাত-মুখ ধোয়া, ভালোবাসা, কথপকথন আর প্রার্থনার ভঙ্গি অনুকরণ করে মুসলিমরা ঈশ্বরের প্রতি আত্মসমর্পণের তাঁর নিখুঁত ভঙ্গি অর্জনের আশা করে থাকে। ধর্মীয় আচরণ এবং ধারণাসমূহের ভিত্তি পাওয়ার কারণ এই নয় যে সেগুলো শক্তিমান থিয়োলজিয়ান দ্বারা প্রচারিত বা সেগুলোর শক্ত ঐতিহাসিক বা যৌক্তিক ভিত্তি রয়েছে; বরং এগুলো অনুসৃত হতে দেখা যাওয়ার কারণ বিশ্বাসীকে তা পবিত্র অলৌকিকের অনুভূতি যোগায়। মুসলিমরা আজও গভীরভাবে শরিয়াকে আঁকড়ে রেখেছে যা তাদের খুবই গভীর স্তরে মুহাম্মদের(স:) আদর্শ চরিত্রকে আত্মীকরণে সাহায্য করে এবং তাঁকে সপ্তম শতাব্দী থেকে মুক্ত করে এনে তাদের জীবনে জীবন্ত সত্তা এবং তাদের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত করে।

কিন্তু অন্য সকল ইসলামী ধার্মিকতার মত শরিয়াহ্ও রাজনৈতিক। এতে ধার্মিকদের চোখে দুর্নীতিগ্রস্ত সমাজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের বিধান রয়েছে। মালিক ইবন আনাস এবং আল-শাফী উভয়েই আব্বাসীয়দের সূচনার দিকে শিয়া বিদ্রোহে অংশ নিয়েছিলেন, উভয়কেই তাঁদের রাজনীতির কারণে কারাভোগ করতে হয়েছিল, যদিও আল-মাদি এবং হারূন আল-রশিদ তাঁদের মুক্তি এবং পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছেন- যাঁরা তাঁদের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে সাম্রাজ্য জুড়ে একটা একক আইনগত ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। শরিয়াহ্ রাজদরবারের আভিজাত্য ও বিশেষ প্রথা পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করেছে। এটা খলিফা ক্ষমতাকে সীমিত করেছে, জোরের সঙ্গে বলেছে যে তাঁর ভূমিকা পয়গম্বর বা রাশিদুনদের অনুরূপ নয়, বরং তাঁকে পবিত্র. আইন প্রয়োগের অনুমতি দেয়া হয়েছে মাত্র। রাজদরবারের সংস্কৃতি এভাবে পরোক্ষে অনৈসলামিক হিসাবে নিন্দিত হয়েছে। কুরানের মত শরিয়ার বৈশিষ্ট্যও সাম্যবাদী। দুর্বলদের রক্ষা করার জন্য বিশেষ বিধি-বিধান রয়েছে এতে এবং খেলাফত বা রাজদরবারের মত কোনও প্রতিষ্ঠানের ব্যক্তি বিশেষের নিজস্ব সিদ্ধান্ত এবং বিশ্বাসে নাক গলানোর কোনও ক্ষমতা ছিল না। প্রত্যেক মুসলিমের ঈশ্বরের নির্দেশ প্রতিপালন করার বিশেষ দায়িত্ব রয়েছে এবং কোনও ধর্মীয় কর্তৃপক্ষ বা প্রতিষ্ঠান (“গির্জার” মত) এবং “পুরহিত”দের বিশেষায়িত কোনও দল ঈশ্বর এবং ব্যক্তি মুসলিমের মধ্যে নাক গলাতে পারবে না। সকল মুসলিমের অবস্থান সমপর্যায়ের, এখানে মধ্যস্থতাকারী হিসাবে যাজকগোষ্ঠী বা পুরহিততন্ত্রের অস্তিত্ব থাকতে পারবে না। এভাবে রাজদরবারের মানদণ্ড থেকে সম্পূর্ণ আলাদা মান অনুযায়ী সমাজ পুর্নগঠনের একটা প্রয়াস ছিল শরিয়াহ্। একটা পাল্টা সংস্কৃতি আর প্রতিবাদ আন্দোলন গড়ে তোলা ছিল এর উদ্দেশ্য যা অচিরেই একে খেলাফতের বিরুদ্ধে সংঘাতের দিকে ঠেলে দিয়েছিল।

হারুন আল-রশিদের শাসনামলের শেষনাগাদ এটা পরিষ্কার হয়ে যায় যে খেলাফত এর তুঙ্গ সময় অতিক্রম করে এসেছে। আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা আর নির্যাতনের আধুনিক উপায় আরিষ্কারের আগে একক সরকারের পক্ষে এমন বিশাল সাম্রাজ্য অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব ছিল না। স্পেনের (যেখানে একজন পলাতক উমাইয়াহ্ ৭৫৬-তে প্রতিদ্বন্দ্বী রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন) মত সীমান্তবর্তী প্রদেশগুলো বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করেছিল। অর্থনীতির পড়তি দশা চলছিল। সাম্রাজ্যকে দুই পুত্রের মাঝে ভাগ করে এই সমস্যা সমাধানের প্রয়াস পেয়েছিলেন হারূন আল-রশিদ, কিন্তু তাতে কেবল তাঁর মৃত্যুর পর দু’ভাইয়ের মাঝে গৃহযুদ্ধই (৮০৯-১৩) পাওয়া গেছে। এটা ছিল রাজদরবারের সেক্যুলার চেতনার লক্ষণ, অতীতের ফিৎনাহ্ যুদ্ধের বিপরীতে এই সংঘাতে কোনও আদর্শিক বা ধর্মীয় অনুপ্রেরণা ছিল না, এটা ছিল স্রেফ ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষার সংঘাত। আল-মামুন যখন বিজয়ী হিসাবে আবির্ভূত হয়ে শাসন শুরু করেন (৮১৩-৩৩), তখন এটা স্পষ্ট ছিল যে সাম্রাজ্যের দু’টি প্রধান ক্ষমতা বলয় রয়েছে। একটা রাজদরবারের অভিজাত গোষ্ঠী, অন্যটি শরিয়াহ্-ভিত্তিক সাম্যবাদী এবং “সংবিধানবাদী” গোষ্ঠী।

নিজের নাজুক শাসন সম্পর্কে সচেতন ছিলেন আল-মামুন। গৃহযুদ্ধ, কুফাহ্ এবং বসরা শিয়া বিদ্রোহ (৮১৪-১৫), এবং খুরাসানে খারেজি বিদ্রোহের ভেতর দিয়ে সূচিত হয়েছিল তাঁর রাজত্ব। এইসব বিক্ষুদ্ধ গ্রুপকে বশ মানানোর প্রয়াস পেয়েছেন তিনি যাতে ধর্মীয় টানাপোড়েন হ্রাস পায়। কিন্তু তাঁর অনুসৃত নীতি পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটায়। নিজে বুদ্ধিজীবী হওয়ায় স্বভাবতই মুতাযিলাদের প্রতি আকৃষ্ট বোধ করেছেন এবং তাদের আবার আনুকূল্যে ফিরিয়ে এনেছেন। এটাও তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, ঐশী আইন প্রত্যেক মুসলিমের সরাসরি বোধগম্য বলে দাবীদার আহল আল-হাদিসের জনপ্রিয় আন্দোলন একচ্ছত্র রাজতন্ত্রের সঙ্গে খাপ খায় না। যাহোক, আবার ক্ষমতার কাছাকাছি আসায় মুতাযিলারা এতদিন ধরে তাদের ওপর নিপীড়ন পরিচালনাকারী আহল আল-হাদিসের ওপর চড়াও হয়। এক “ইনকুইজিশন” (মিনাহ্) শুরু হয়েছিল যার ফলে নেতৃস্থানীয় ‘হাদিসপন্থী’রা, যেমন উল্লেখযোগ্য, জনপ্রিয় আহমাদ ইবন হানবাল (মৃত্যু: ৮৩৩) কারারুদ্ধ হন। ইবন হানবাল পরিণত হন গণমানুষের নেতায়। মুতাযিলাদের পৃষ্ঠপোষকতা দান আল-মামুনের জন্য কোনও ফায়দা বয়ে আনেনি; বরং সাধারণ জনগণকে আরও দূরে ঠেলে দিয়েছিল। এক পর্যায়ে, শিয়াদের অষ্টম ইমাম আলী আল-রিদাকে নিজের উত্তরাধিকারী ঘোষণা করে শিয়াদের কাছে টানার প্রয়াস পান খলিফাহ্, কিন্তু মুতাযিলাদের মত শিয়ারাও স্রেফ আরেকটা সংখ্যালঘু আধ্যাত্মিক ও বুদ্ধিজীবী অভিজাত গোষ্ঠী ছিল বলে সাধারণ নাগরিকদের সমর্থন আদায় করতে পারেনি। কয়েক মাস পরে সুবিধাজনকভাবেই পরলোকগমন করেন আল রিদা –সম্ভবত: বাঁকা পথে।

পরবর্তী খলিফাগণও শিয়াদের কাছে টানার প্রয়াস পেয়েছিলেন এবং বিভিন্ন ধর্মীয় উপদলের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা চালান, কিন্তু কোনও ফল মেলেনি তাতে। খলিফাহ্ আল-মুতাসিম (৮৩৩-৪২) সেনাবাহিনীকে ব্যক্তিগত বাহিনীতে পরিবর্তনের মাধ্যমে রাজতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে চেয়েছিলেন। এই সৈন্যরা ছিল তুর্কি ক্রীতদাস যাদের ওক্সাস নদীর অপর পাড় থেকে ধরে এনে ইসলামে ধর্মান্তরিত করা হয়েছিল। কিন্তু এই পদক্ষেপ তাঁকে জনগণ থেকে আরও বিচ্ছিন্ন করে দেয় এবং টার্কিশ সৈন্য ও বাগদাদের জনগণের ভেতর উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। এই উত্তেজনা দূর করতে খলিফাহ্ আনুমানিক ষাট মাইল দক্ষিণে, সামারায় রাজধানী স্থানান্তরিত করেন, কিন্তু এতে করে তাঁর বিচ্ছিন্নতা আরও বৃদ্ধি পায়। এদিকে জনগণের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্কবিহীন তুর্কিরা দশকে দশকে ক্রমাগত শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং শেষ পর্যন্ত খলিফাঁদের কাছ থেকে সাম্রাজ্যের প্রকৃত নিয়ন্ত্রণভার ছিনিয়ে নেয়ার ক্ষমতা অর্জন করে তারা। নবম শতাব্দীর শেষ এবং দশম শতাব্দীর শুরুর দিকে যেসব জঙ্গি শিয়া রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিবেদিত ছিল বলে অতীন্দ্রিয়বাদী শান্তি বাদের পথে পা বাড়ায়নি তাদের দ্বারা অসংখ্য সশস্ত্র বিদ্রোহ সংঘটিত হয়, ফলে অর্থনৈতিক সঙ্কট আরও ঘনীভূত হয়।

কিন্তু রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতাবাদের এই সময়কালে সুন্নী ইসলাম নামে পরিচিতি হয়ে ওঠা অংশটি শক্তিশালী হয়ে ওঠে। আস্তে আস্তে বিভিন্ন আইনবিদ, মুতাযিলা এবং আহল আল-হাদিস তাদের মতভেদ বিসর্জন দিয়ে পরস্পরের কাছাকাছি হয়। এই প্রক্রিয়ার একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন আবু আল-হাসান আল-আশারি (মৃত্যু: ৯৩৫), যিনি মুতাযিলা এবং হাদিসপন্থীদের থিয়োলজি সমন্বিত করার প্রয়াস পেয়েছিলেন। এতদিন পর্যন্ত মুতাযিলারা ঈশ্বরের মানুষরূপী ধারণার প্রতি এতই আতঙ্কিত ছিল যে ঈশ্বরের কোনও “মানবীয়” গুণ থাকার ব্যাপারটি অস্বীকার করে এসেছিল তারা। আমরা কেমন করে বলি যে ঈশ্বর “কথা বলেন” বা “সিংহাসনে বসেন” –যেভাবে কুরান নিশ্চিত করে বলছে– কীভাবে আমরা ঈশ্বরের “জ্ঞান” বা “ক্ষমতা” নিয়ে আলোচনা করতে পারি? আহল আল-হাদিস পাল্টা যুক্তি দেখিয়েছে যে, এই সতর্কতা ঈশ্বরের অনুভূতি পুরোপুরি নষ্ট করে দিয়ে ঈশ্বরকে বিমূর্ত দার্শনিক বিষয়ে পরিণত করে যার কোনও ধর্মীয় তাৎপর্য থাকে না। একমত হন আল- আশারি, কিন্তু মুতাযিলাদের একথা বলে আশ্বস্ত করেন যে, ঈশ্বরের গুণাবলী মানুষের বৈশিষ্ট্যের মত নয়। কুরান ঈশ্বরের অনির্মিত বক্তব্য (Uncreated Speech), কিন্তু যে মানবীয় ভাষা একে প্রকাশ করে এবং খোদ গ্রন্থটির কালি এবং কাগজ নির্মিত। বাস্তবতার গভীরে রহস্যময় কোনও মূলসুর অনুসন্ধানের কোনও যুক্তি নেই। আমরা নিশ্চিত করে কেবল ইতিহাসের নিরেট বাস্তবকেই জানতে পারি। আল-আশারির দৃষ্টিতে প্রাকৃতিক নিয়ম বলে কিছু নেই। ঈশ্বরের প্রত্যক্ষ নির্দেশে প্রতিমূহূর্তে বিশ্বজগৎ সংগঠিত হচ্ছে। স্বাধীন ইচ্ছা বলে কিছু নেই: ঈশ্বর যতক্ষণ তাদের মাঝে এবং মাধ্যমে চিন্তা না করছেন ততক্ষণ নারী বা পুরুষ কোনও কিছু ভাবতে পারে না; আগুন জ্বলে, তার কারণ এটা তার বৈশিষ্ট্য বলে নয়, বরং ঈশ্বর ইচ্ছা করেছেন বলে।

মুতাযিলারা আগাগোড়াই সংখ্যাগরিষ্ঠ বিপুল মুসলিমদের কাছে ভালোরকম দুর্বোধ্যই ছিল। আশারিবাদ সুন্নী ইসলামের প্রভাবশালী দর্শনে পরিণত হয়েছিল। অবশ্যই এটা যুক্তিনির্ভর বিশ্বাস নয়, বরং অধিকহারে অতীন্দ্রিয়বাদী ও ধ্যাননির্ভর অনুশীলন। এটা মুসলিমদের সর্বত্র ঐশী উপস্থিতি প্রত্যক্ষ করতে উৎসাহ যোগায়, বাহ্যিক বাস্তবতার “ভেতর” দিয়ে অন্তস্থঃ দুর্ভেয় সত্তাকে দেখতে বলে, যেভাবে কুরান নির্দেশ দিয়েছে। এতে করে “হাদিসপন্থী”দের ধারণায় স্পষ্ট হয়ে ওঠা নিরেট বাস্তবতায় ঈশ্বরের প্রত্যক্ষ অনুভূতি লাভের বাসনা পূর্ণ হয়েছিল। এই দৰ্শন শরিয়ার চেতনার সঙ্গেও মানানসই ছিল। জীবনের সর্বক্ষেত্রে পয়গম্বরের সুন্নাহ্ অনুসরণের মাধ্যমে মুসলিমরা নিজেদের পয়গম্বরের সঙ্গে একীভূত করে-যাঁর জীবন ঐশ্বরিক উপাদানে সম্পৃক্ত ছিল। ঈশ্বরের প্রিয় (হাবিব)কে অনুকরণ করলে– এতীম, দরিদ্র বা পশু-পাখির প্রতি দয়া প্রদর্শন করে কিংবা খাদ্য গ্রহণের সময় সৌজন্য এবং সংস্কৃত আচরণ করে- স্বয়ং ঈশ্বরের ভালোবাসাই লাভ করা যায়। জীবনের অতি ক্ষুদ্র অংশে ঐশী আজ্ঞার বাস্তবায়নের মাধ্যমে মুসলিমরা কুরান নির্দেশিত অবিরাম ঈশ্বরের স্মরণ (জিকর-dhikr) করছে। দশম শতাব্দীর মাঝামাঝি নাগাদ এই শরিয়াহ্ ভিত্তিক ধার্মিকতা গোটা সাম্রাজ্য জুড়ে প্রতিষ্ঠা পেয়ে যায়। মোট চারটি স্বীকৃত আইন মতবাদ রয়েছে যার প্রতিটিই মুসলিম সাম্যবাদী দৃষ্টিতে সমভাবে বৈধ : হানাফি, মালিকি, শাফীই এবং হানবালি মতবাদ। শেষোক্তটি ইবন হানবাল এবং হাদিস-পন্থীদের আদর্শ ধারণ করে। প্রায়োগিক ক্ষেত্রে, এই চারটি মাযহাব লক্ষণীয়ভাবে আলাদা নয়। প্রত্যেক মুসলিম অনুসরণ করার জন্য যেকোনওটি বেছে নিতে পারে, যদিও স্থানীয়ভাবে প্রচলিতটির দিকেই অধিকাংশজন আকৃষ্ট হয়ে থাকে।

কিন্তু প্রত্যাশিতভাবেই সুন্নী মুসলিমদের একত্রিতকারী মূল বা প্রধান উপাদানটি ছিল রাজনৈতিক। সমাজের গৃহীত আকারে ঈশ্বর অনুভূত হন এবং এটা একজন মুসলিমের ব্যক্তিগত ধার্মিকতাকে প্রভাবিত করে। সুন্নী মুসলিমদের সবাই মুহাম্মদ(স:) এবং চার রাশিদুনের সকলকে শ্রদ্ধা করে থাকে। উসমান বা আলীর ব্যর্থতা সত্ত্বেও এই শাসকগণ ধর্মপরায়ণ ব্যক্তি ছিলেন যাঁরা ঈশ্বরের কাছে আত্মসমর্পণের ক্ষেত্রে সমসাময়িক সকল শাসককে ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন। সুন্নীরা শিয়াদের মত প্রথম তিন রাশিদুনকে অবজ্ঞা করে না; শিয়াদের বিশ্বাস অনুযায়ী কেবল আলীই উম্মাহ্ বৈধ ইমাম ছিলেন। সুন্নী ধার্মিকতা শিয়াদের ট্র্যাজিক দৃষ্টিভঙ্গির তুলনায় অনেক বেশী আশাবাদী। এখানে সুদৃঢ় ঘোষণা দেয়া হয়েছে যে, এমনকি ব্যর্থতা এবং বিরোধের সময়ও ঈশ্বর উম্মাহর সঙ্গে থাকতে পারেন। সমাজের ঐক্য এক পবিত্র মূল্য, কেননা তা ঈশ্বরের একত্ব প্রকাশ করে। এটা যেকোনও সাম্প্রদায়িক বিভাজন থেকে অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং শান্তির স্বার্থে খলিফাঁদের সুস্পষ্ট দোষত্রুটি সত্ত্বেও বর্তমান খলিফাঁদের স্বীকৃতি দান অত্যন্ত জরুরি। মুসলিমরা যদি শরিয়াহ্ অনুযায়ী জীবন যাপন করে, তাহলে তারা একটা প্রতি-সংস্কৃতি সৃষ্টিতে সক্ষম হবে যা তাদের সময়ের দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে বদলে দেবে এবং একে ঈশ্বরের ইচ্ছার কাছে নতি স্বীকারে বাধ্য করবে।

গোপন ধর্মীয় আন্দোলন

এই ধার্মিকতা অবশ্য সকল মুসলিমকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি, যদিও তা সংখ্যাগরিষ্ঠজনের বিশ্বাসে পরিণত হয়েছিল। যারা অধিকতর বুদ্ধিজীবী বা অতীন্দ্রিয়বাদের প্রতি আকৃষ্ট ছিল ধর্মকে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করার আবশ্যকতা ছিল তাদের। আব্বাসীয় আমলে আরও চারটি জটিল ধরনের ইসলামী দর্শন এবং আধ্যাত্মিকতার আবির্ভাব ঘটেছিল যেগুলো অভিজাতদের কাছে আকর্ষণীয় ঠেকেছে। এসব ধারণা সাধারণ জনগোষ্ঠীর কাছ থেকে গোপন রাখা হয়েছিল, কারণ শিক্ষানবীশদের বিশ্বাস ছিল স্থুল বুদ্ধির লোকজন তাদের ভুল বুঝতে পারে এবং কেবল প্রার্থনা আর ধ্যানের প্রেক্ষিতেই এসবের অর্থ বোধগম্য হতে পারে। এই গোপনীয়তা আবার স্বয়ং-রক্ষক ব্যবস্থাও ছিল। শিয়াদের ষষ্ঠ ইমাম জাফর আস- সাদিক তাঁর অনুসারীদের আপন নিরাপত্তার স্বার্থেই তাক্বিয়াহ (গোপনীয়তা) বজায় রাখার পরামর্শ দিয়েছিলেন। শিয়াদের জন্য সঙ্কটময় সময় ছিল এটা, রাজনৈতিক প্রশাসনের তরফ থেকে বিপদের আশঙ্কায় ছিল তারা। ধর্মীয় পণ্ডিত, উলেমাগণও এসব গুপ্ত সংগঠনের অর্থডক্সির ব্যাপারে সন্দিহান ছিলেন। তাক্বিয়াহ্ সংঘাতকে সীমিত পর্যায়ে রেখেছিল। ক্রিশ্চান জগতে প্রশাসনের সঙ্গে ভিন্নমত অবলম্বনকারীরা প্রায়শ ধর্মদ্রোহী হিসাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছে। ইসলামে এইসব প্রচ্ছন্ন ভিন্ন মতাবলম্বীরা নিজেদের ধ্যানধারণা সম্পর্কে নীরবতা বজায় রেখেছিল এবং সাধারণত নিরাপদে স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করতে পেরেছে। তবে গোপনীয়তার নীতির ভিন্ন তাৎপর্যও ছিল। গুপ্ত আদর্শবাদীদের কিংবদন্তী (Myths) এবং ধর্মতাত্ত্বিক দর্শন (Theological insights) সামগ্রিক জীবনযাত্রারই অংশ ছিল। অতীন্দ্রিয় মতবাদসমূহ বিশেষত কাল্পনিক এবং স্বজ্ঞা মূলকভাবে বৈধ হিসাবে অনুভব করা যেতে পারে, কিন্তু তাই বলে সেগুলো বহিরাগত কারও যৌক্তিক উপলব্ধির নাগালের মধ্যে নাও থাকতে পারে। এগুলো কবিতা বা সঙ্গীতের মত যার প্রভাব যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না এবং যার পরিপূর্ণ উপলব্ধির জন্য প্রায়শ বিশেষ মাত্রার সৌন্দর্য বিদ্যাগত জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা থাকার প্রয়োজন হয়।

নিগূঢ় বিদ্যাধারীরা তাদের ধারণাকে ধর্মদ্রোহী বলে ভাবেনি। তারা উলেমাদের তুলনায় অধিকতর গভীরভাবে প্রত্যাদেশ উপলব্ধি করার ক্ষমতা রাখে বলে বিশ্বাস করত। একথা আবার মনে করা আবশ্যক যে ইসলামে বিশ্বাস (Beliefs) এবং মতবাদ (Doctrines) ক্রিশ্চান ধর্মের মত অত গুরুত্বপূর্ণ নয়। জুডাইজমের মত ইসলাম এমন একটি ধর্ম যেখানে মানুষকে এক বিশেষ পদ্ধতি অনুসারে জীবনযাপন করতে হয়, স্রেফ নির্দিষ্ট কতগুলো বিশ্বাসগত প্রস্তাবনা মেনে নেয়া নয়। এখানে অর্থডক্সি নয় বরং অর্থপ্রাক্সির ওপরই গুরুত্ব দেয়া হয়। গূঢ় বিদ্যার প্রতি আকৃষ্ট সকল মুসলিমই ইসলামের অত্যাবশ্যকীয় অনুশীলন বা পাঁচ “স্তম্ভ” (রুকন) মেনে চলেছে। তারা মুসলিম বিশ্বাসের সংক্ষিপ্ত ঘোষণা শাহাদা: “আল্লাহ্ ছাড়া আর কোনও ঈশ্বর নেই এবং মুহাম্মদ (স:) তাঁর পয়গম্বর” সম্পূর্ণ মেনেছে। দৈনিক পাঁচবার সালাত প্রার্থনা করেছে তারা, যাকাত দান করেছে, রমজান মাসে উপবাস পালন করেছে এবং অনুকূল পরিস্থিতিতে জীবনে অন্তত একবার মক্কায় গেছে হজ্জ করার উদ্দেশ্যে। স্তম্ভসমূহের প্রতি বিশ্বস্ত যে কেউ অবশ্যই প্রকৃত মুসলিম, তার বিশ্বাস যাই হোক না কেন।

আমরা আব্বাসীয়দের ক্ষমতারোহনের পরপর জাফর আস-সাদিক প্রবর্তিত শিয়াবাদের নীরবতম ধরন সম্পর্কে ইতিমধ্যে আলোচনা করেছি। যদিও শিয়ারা সুন্নীদের মতই শরিয়াহ্ ভিত্তিক ধার্মিকতার প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ ছিল এবং তাদের নিজস্ব মাযহাব (জাফরি মতবাদ, স্বয়ং জাফর আস-সাদিকের নামানুসারে) ছিল, কিন্তু তারা প্রধানত দিক-নির্দেশনার জন্য বর্তমান ইমামের দিকে চেয়ে থাকত, যিনি তাঁর প্রজন্মের জন্য স্বর্গীয় ইমের গ্রহীতা। ইমাম নিষ্পাপ আধ্যাত্মিক পরিচালক এবং আদর্শ কাজি। সুন্নীদের মত শিয়ারাও প্রথম গোষ্ঠীর মুসলিমদের মত, যারা সচক্ষে পয়গম্বরের প্রতি কুরান উন্মোচিত হতে দেখেছিল– সরাসরি ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ করতে চেয়েছিল। ঐশ্বরিক প্রেরণাপ্রাপ্ত ইমামের প্রতীকটি শিয়াদের পবিত্র সত্তার অনুভূতি প্রতিফলিত করে যা কেবল প্রকৃত ধ্যানীর কাছে ধরা পড়ে, কিন্তু তা সত্ত্বেও যা ঝঞ্ঝাবিক্ষুদ্ধ বিপজ্জনক বিশ্বে পরিব্যাপ্ত। ইমামতের মতবাদ এও দেখায় যে সাধারণ রাজনৈতিক জীবনের করুণ পরিবেশে স্বর্গীয় আজ্ঞা বাস্তবায়ন কতখানি কঠিন। শিয়ারা মনে করে যে ইমামদের প্রত্যেকেই তাঁর সময়কালের খলিফার হাতে নিহত হয়েছেন। কারবালায় তৃতীয় ইমাম হুসেইনের শাহাদৎত্বরণ এই জগতে ঈশ্বরের ইচ্ছানুযায়ী চলার প্রয়াস কী পরিণতি ডেকে আনতে পারে তার এক বিশেষ বাঙ্ময় উদাহরণ। দশম শতাব্দী নাগাদ শিয়ারা আশুরার (১০ মুহররম) উপবাসের দিন, মৃত্যু বার্ষিকীতে প্রকাশ্যে হুসেইনের শোকে মাতম করা আরম্ভ করে। তারা রাস্তায় মিছিল করে কেঁদে কেঁদে বুকে চাপড় বসিয়ে মুসলিমদের রাজনৈতিক জীবনের দুর্নীতির বিরুদ্ধে জীবন-বাজি বিরোধিতার ঘোষণা দেয়, যার কারণে কুরানের সুস্পষ্ট বিধান সত্ত্বেও ধনীরা দুর্বলদের ওপর নির্যাতন করার সুযোগ পাচ্ছে। জাফর আস-সাদিকের অনুসারী শিয়ারা হয়ত রাজনীতি পরিত্যাগ করেছিল, কিন্তু সামজিক ন্যায়বিচারের প্রতি আবেগ ছিল তাদের প্রতিবাদী ধার্মিকতার প্রাণ কেন্দ্ৰে ৷

নবম শতাব্দীতে খেলাফতের পতনোন্মুখ অবস্থায় আব্বাসীয় প্রশাসন এবং শিয়াদের মধ্যকার বৈরিতা আবার প্রকাশিত হয়ে পড়ে। খলিফাহ্ আল-মুতাওয়াক্কিল (৮৪৭-৬১) দশম ইমাম আলী আল-হাদিকে মদীনা থেকে সামারায় ডেকে এনে গৃহবন্দী করে রাখেন। পয়গম্বরের এই সরাসরি বংশধরকে মুক্ত রাখা নিরাপদ নয় বলে ভেবেছিলেন তিনি। এরপর থেকে ইমামগণ কার্যত: শিয়াদের নাগালের বাইরে চলে যান এবং কেবল “প্রতিনিধি”র মাধ্যমেই বিশ্বাসীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেন। ৮৭৪-এ একাদশ ইমামের পরলোকগমনের পর বলা হয় যে তিনি একজন তরুণ পুত্র সন্তান রেখে গেছেন যিনি আত্মরক্ষার খাতিরে আত্মগোপন করেছেন। দ্বাদশ ইমামের কোনও সন্ধান স্বভাবতই আর পাওয়া যায়নি, হয়ত আগেই পরলোকগমন করে থাকতে পারেন তিনি। কিন্তু আজও প্রতিনিধিগণ তাঁর পক্ষে শিয়াদের শাসন করছেন, তাদের কুরানের গূঢ়ার্থ পাঠে সাহায্য করছেন, যাকাত আদায় করছেন এবং আইনি রায় প্রদান করছেন। ৯৩৪-এ গোপন ইমাম স্বাভাবিক জীবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছালে “প্রতিনিধি” শিয়াদের জন্য তাঁর কাছ থেকে এক নতুন বাণী এনে হাজির করেন। তিনি “গোপন স্থানে” (occultation) চলে গেছেন এবং ঈশ্বর অলৌকিক উপায়ে তাঁকে লুকিয়ে রেখেছেন; তিনি আর শিয়াদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবেন না। একদিন আবার ফিরে আসবেন তিনি, ন্যায় বিচারের যুগের উদ্বোধন করার জন্যে, কিন্তু সেটা দীর্ঘ কয়েক যুগ অতিবাহিত হওয়ার পর। গোপন ইমামের “গোপন স্থানে” যাবার কিংবদন্তী আক্ষরিক অর্থে পার্থিব ঘটনার বিবরণ হিসাবে গ্রহণ করার উদ্দেশ্যে অবতারণা করা হয়নি। এটা অতীন্দ্রিয়বাদী মতবাদ যা ঈশ্বর সম্পর্কে আমাদের অনুভূতিকে ধোঁয়াটে, অস্পষ্ট বা ধরা-ছোঁয়ার অতীত হিসাবে প্রকাশ করে, এই জগতে উপস্থিত থাকলেও তা জগতের অংশ নয়। এটা এই জগতে প্রকৃত ধর্মীয় নীতির বাস্তবায়নের অসম্ভাব্যতাকেও প্রতীকায়িত করে, কেননা খলিফাগণ পৃথিবী হতে আলীর বংশধারা ধ্বংস করে দিয়েছেন এবং ইলম্ নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছেন। এরপর থেকে শিয়া উলেমাগণ গুপ্ত ইমামের প্রতিনিধিতে পরিণত হন এবং তাঁর ইচ্ছা উপলব্ধি করার জন্যে তাঁদের নিজস্ব অতীন্দ্রিয়বাদী ও যৌক্তিক দর্শনের প্রয়োগ করেন। দ্বাদশবাদী (Twelver) শিয়ারা (যারা বারজন ইমামে বিশ্বাসী) আর রাজনৈতিক জীবনে অংশগ্রহণ করেনি, কেননা উম্মাহর প্রকৃত নেতা গোপন ইমামের অনুপস্থিতিতে কোনও সরকার বৈধ হতে পারে না। তাদের মেসিয়ানিক ধর্মানুরাগ, যা ইমামের প্রত্যাবর্তনের প্রতীক্ষায় রয়েছে, সমাজের অবস্থার সঙ্গে স্বর্গীয়লোকের অসন্তোষের পরিচয় প্রকাশক।

শিয়াদের সবাই দ্বাদশবাদী ছিল না, সবাই রাজনীতিও ত্যাগ করেনি। কেউ কেউ (সপ্তবাদী– Seveners বা ইসমায়েলি) মনে করে যে আলীর বংশধারা জাফর আস- সাদিকের পুত্র ইসমায়েলের সঙ্গেই শেষ হয়ে গেছে, যিনি মনোনীত ইমাম ছিলেন কিন্তু পিতার আগেই পরলোকগমন করেছেন। সুতরাং তারা জাফরের দ্বিতীয় পুত্র মুসা আল-কাযিমের বৈধতা স্বীকার করেনি, দ্বাদশবাদীরা যাকে সপ্তম ইমাম হিসাবে মর্যাদা দিয়েছিল। তারাও এক গূঢ় আধ্যাত্মিকতার বিকাশ ঘটিয়েছিল যা ঐশীগ্রন্থের গোপন (বাতিন) অর্থের সন্ধানী কিন্তু প্রকাশ্য জীবনধারা থেকে সরে যাবার বদলে তারা একেবারে ভিন্নতর রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের প্রয়াস পেয়েছিল এবং প্রায়ই সক্রিয় কর্মী ছিল তারা। ৯০৯-এ এক ইসমায়েলি নেতা টিউনিসিয়ার এক প্রদেশের নিয়ন্ত্রণ আয়ত্ত করতে সক্ষম হলে নিজেকে মেসিয়ানিক খেতাব আল- মাহদি (নির্বাচিত ব্যক্তি) প্রদান করেন। ৯৮৩-তে ইসমায়েলিরা আব্বাসীয়দের কাছ থেকে মিশর ছিনিয়ে নিয়ে কায়রোয় পাল্টা খেলাফত প্রতিষ্ঠা করে, যা প্রায় দু’শ’ বছর টিকে ছিল। সিরিয়া, ইরাক, ইরান এবং ইয়েমেনেও গোপন ইসমায়েলি সেল ছিল। সদস্যরা স্থানীয় দাই (dai: প্রতিনিধি) দ্বারা আস্তে আস্তে সম্প্রদায়ের অঙ্গীভূত হত। নিম্ন পর্যায়ের অনুসৃত ধর্ম সুন্নীবাদের বিপরীত কিছু ছিল না, কিন্তু শিক্ষার্থী অগ্রসর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে আরও বিমূর্ত দর্শন ও আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়া হত যেখানে দুয়ের বিস্ময়ের অনুভূতি জাগিয়ে তোলার জন্যে গণিত আর বিজ্ঞানের প্রয়োগ করা হত। কুরান নিয়ে ইসমায়েলিদের ধ্যান ইতিহাস সম্পর্কে তাদের মাঝে আবর্তনশীল দৃষ্টিভঙ্গি জাগিয়েছিল, যাকে তারা ঈশ্বরের সঙ্গে শয়তানের বিরোধিতার পর থেকে ক্রমাবনতিশীল বলেই বিশ্বাস করেছে ৷ মোট ছয়জন মহান পয়গম্বর ছিলেন [অ্যাডাম, নোয়াহ্, আব্রাহাম, মোজেস, জেসাস এবং মুহাম্মদ(স:)] যাঁদের প্রত্যেকেই এই নিম্নমুখী প্রবণতা উল্টে দিয়েছেন। প্রত্যেক পয়গম্বরের একজন করে “কর্মী” (executor) ছিলেন যিনি তাঁর বাণীর গোপন অর্থ যোগ্যদের শিক্ষা দিয়েছেন। যেমন উদাহরণস্বরূপ, অ্যারন ছিলেন মোজেসের কর্মী আর আলী ছিলেন মুহাম্মদের(স:)। বিশ্বাসীরা যখন তাদের শিক্ষা বাস্তবায়নের সংগ্রামে লিপ্ত হবে তখন তারা পৃথিবীকে চূড়ান্ত শান্তির পর্বের জন্যে প্রস্তুত করে তুলবে, সপ্তম পয়গম্বর মাহুদি যার সূচনা ঘটাবেন।

আকর্ষণীয় আন্দোলন ছিল এটা। রাজদরবারের বিরুদ্ধে সুন্নীদের প্রতিবাদ যেখানে তাদের শিল্পকলা আর বিজ্ঞানের প্রতি সন্দিহান করে তুলেছিল, ইসমায়েলবাদ অপেক্ষাকৃত বুদ্ধিজীবী মুসলিমকে ধর্মীয় পথে নতুন দর্শন গবেষণার পথ খুলে দিয়েছিল। তাদের ব্যাখ্যা ছিল তাওয়িলের (আদিতে প্রত্যাবর্তন- Carryingback) প্রক্রিয়া যার ফলে উপাসনাকারীর মনোযোগ ঐশীগ্রন্থের আক্ষরিক অর্থ অতিক্রম করে এর মূল উৎস গুপ্ত স্বর্গীয় বাস্তবতার দিকে নিয়ে যায়। কুরান জোর দিয়ে বলেছে যে ঈশ্বর “প্রতাঁকে”র (আয়াত) মাধ্যমে বিশ্বাসীদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন, কেননা ঈশ্বরকে কখনও সম্পূর্ণ যুক্তিভিত্তিক বা যৌক্তিক ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। ইসমায়েলিরা সবসময় ঈশ্বরকে “চিন্তার তীক্ষ্ণতা যাঁকে ধারণ করতে পারে না” বাগধারার মাধ্যমে পরোক্ষ উল্লেখ করে এসেছে। তারা এও বিশ্বাস করেছে যে কোনও বিশেষ প্রত্যাদেশ বা ধর্মতাত্ত্বিক ব্যবস্থা চূড়ান্ত হতে পারে না, কেননা ঈশ্বর চিরকালই মানবীয় ভাবনার চেয়ে বিশাল। ইসমায়েলিরা মুহাম্মদকে(স:) ছয়জন প্রধান পয়গম্বরের সর্বশেষ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে স্বীকার করে, কিন্তু এটাও জোর দিয়ে বলে যে আরবদের কাছে অবতীর্ণ প্রত্যাদেশের পূর্ণ তাৎপর্য স্পষ্ট হয়ে উঠবে কেবল ইমাম মাহদির আগমনের পরেই। সুতরাং তারা সত্যের সম্ভাবনার ব্যাপারে প্রস্তুত ছিল যা অধিকতর রক্ষণশীল উলেমাদের জন্য ছিল উদ্বেগজনক। কিন্তু ইসমায়েলিরা কেবল চিন্তাশীল একটা গোত্র ছিল না, সকল প্রকৃত মুসলিমের মত তারা উম্মাহর ভবিষ্যতের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন ছিল এবং বিশ্বাস করত যে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা ছাড়া ধর্মবিশ্বাস মূল্যহীন। একটি ন্যায়বিচার ভিত্তিক সমাজের জন্যে কাজ করার মাধ্যমে তারা মাহদির আগমনের পথ নির্মাণ করতে সক্ষম হবে। একটি দীর্ঘস্থায়ী খেলাফত প্রতিষ্ঠায় ইসমায়েলিদের সাফল্য দেখায় যে তাদের আদর্শের রাজনৈতিক সম্ভাবনা ছিল, কিন্তু তা সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের কাছে আবেদন সৃষ্টি করতে পারেনি। ইসমায়েলি দর্শন মাত্রাতিরিক্ত পৌরহিত্যমূলক এবং অভিজাত্যপূর্ণ হওয়ায় স্বল্প সংখ্যক বুদ্ধিজীবী মুসলিমের কাছেই আবেদন সৃষ্টি করতে পেরেছিল।

ইসমায়েলিরা তাদের সৃষ্টি সম্পর্কিত প্রতীকসমূহের উল্লেখযোগ্য অংশই এসময়ে আবির্ভূত তৃতীয় গূঢ় তত্ত্বীয় আন্দোলন ফালসাফাহ্ থেকে গ্রহণ করেছিল। আব্বাসীয়দের সময় সূচিত সাংস্কৃতিক রেনেসাঁ, বিশেষ করে গ্রিক দর্শন, বিজ্ঞান আর চিকিৎসা শাস্ত্র সেই সময় আরবী ভাষায় মুসলিমদের নাগালের মধ্যে আসায় সেখান থেকে উদ্ভূত হয়েছিল এই আন্দোলন। ফায়লাসুরা হেলেনিস্টিক যুক্তিবাদ দ্বারা আলোড়িত হয়েছিল, তারা যুক্তিবাদকে ধর্মের সর্বোচ্চ পর্যায় বলে বিশ্বাস করত এবং একে অধিকতর উচ্চ স্তরের দর্শনকে কুরানের প্রত্যাদেশের সঙ্গে সম্পর্কিত করতে চেয়েছিল। কাজটা কঠিন ছিল তাদের পক্ষে। অ্যারিস্টটল এবং প্লটিনাসের পরম উপাস্য (Supreme Deity) ছিলেন আল্লাহ্ থেকে একেবারে আলাদা। এই উপাস্য জাগতিক ঘটনাবলীর সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেন না, তিনি বিশ্বজগৎ সৃষ্টি করেননি এবং সময়ের সমাপান্তে এর বিচারও করবেন না। একেশ্বরবাদীরা যেখানে ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহে ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ করেছে ফায়লাসুফরা সেখানে গ্রিকদের সঙ্গে একমত পোষণ করেছে যে ইতিহাস কুহেলিকা; এর কোনও আদি মধ্য বা অন্ত নেই, কেননা বিশ্বজগৎ আদি কারণ (First Cause) হতে চিরন্তনভাবে উৎসারিত হচ্ছে। ফায়লাসুফরা ইতিহাসের ক্ষণস্থায়ী প্রবাহের অতীতে গিয়ে এর অভ্যন্তরস্থ স্বর্গীয় পরিবর্তনহীন আদর্শ জগৎ প্রত্যক্ষ করতে শিখতে চেয়েছিল। মানুষের যুক্তিজ্ঞানকে তারা পরম কারণ (Absolute Reason) অর্থাৎ ঈশ্বরের প্রতিবিম্ব হিসাবে দেখেছে। আমাদের বুদ্ধির অযৌক্তিক অংশগুলোকে পরিশুদ্ধ করার মাধ্যমে এবং সম্পূর্ণ যৌক্তিক উপায়ে জীবন যাপন শিক্ষা করে মানুষ স্বর্গীয় জগৎ থেকে চিরন্তন উৎসারণ বিপরীতমুখী করে এই মর্ত্য জগতের বহুমাত্রিকতা (multiplicity) এবং জটিলতা (Compexity) থেকে এক (One)-এর সারল্য এবং একত্বে আরোহণ করতে পারবে। ফায়লাসুফরা বিশ্বাস করত ক্যাথারসিসের (Catharsis) এই প্রক্রিয়া গোটা মানব জাতির আদি ধর্ম। অন্যসব বিশ্বাস (Cult) স্রেফ যুক্তির প্রকৃত ধর্মের অপূর্ণাঙ্গ রূপ মাত্র।

কিন্তু ফায়লাসুফরা সাধারণভাবে ধার্মিক ছিল, নিজেদের তারা ভাল মুসলিম বলে বিশ্বাস করত। খোদ তাদের যুক্তিবাদ এক ধরনের ধর্মবিশ্বাস ছিল, কারণ বিশ্বজগৎ যৌক্তিকভাবে শৃঙ্খলিত ভাবার জন্যে সাহস আর প্রখর আস্থার প্রয়োজন। একজন ফায়লাসুফ যৌক্তিক ভিত্তিকে তার গোটা জীবনযাপনে নিবেদিত করে, সে তার সামগ্রিক অভিজ্ঞতা আর মূল্যবোধ একত্রিত করতে চায় যাতে করে বিশ্ব সম্পর্কে একটা সামজ্ঞস্যপূর্ণ সামগ্রিক এবং যৌক্তিক দৃষ্টিভঙ্গি পাওয়া যায়। এটা সম্ভবত তাওহীদের একটা দার্শনিক রূপ ছিল। সামাজিক প্রেক্ষিতেও ফায়লাসুফরা ভাল মুসলিম ছিল: রাজদরবারের বিলাসী জীবন ধারা অপছন্দ করেছে তারা, খলিফাঁদের উৎপীড়ন অপছন্দ করেছে। কেউ কেউ তাদের আদর্শ অনুসারে সমাজকে বদলে দিতে চেয়েছে। রাজদরবার এবং অন্যান্য বড় বড় প্রাসাদে জ্যোতির্বিদ এবং চিকিৎসকের দায়িত্ব পালন করেছে তারা। সংস্কৃতিতে সামান্য হলেও এর প্রভাব পড়েছে। অবশ্য ফায়লাসুফদের কেউই উলেমাদের মত ব্যাপক সংস্কার প্রয়াসের দিকে যায়নি, শরিয়ার সাধারণ জনপ্রিয়তার সমকক্ষ কিছু উদ্ভাবন করতে পারেনি।

ইয়াকুব ইবন ইসহাক আল-কিন্দি (মৃত্যু: ৮৭০) ছিলেন মুসলিম বিশ্বের প্রথম প্রধান ফায়লাসুফ বা “দার্শনিক”। কুফা জন্ম গ্রহণকারী আল-কিন্দি বসরা পড়াশোনা করেন এবং শেষ পর্যন্ত বাগদাদে স্থায়ী হন। সেখানে তিনি আল-মামুনের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিলেন। রাজধানীতে তিনি ঘনিষ্ঠভাবে মুতাযিলাদের সঙ্গে তাদের ধর্মত্ত্বকে (কালাম) মানবীয় গুণাবলী হতে মুক্ত করার প্রয়াসে যোগ দিয়েছেন কিন্তু নিজেকে তাদের মত মুসলিম উৎসগুলোর কাছে সীমাবদ্ধ করে ফেলেননি, বরং গ্রিক সাধুদের কাছ থেকেও জ্ঞান অন্বেষণ করেছেন। এভাবে তিনি “আদি কারণে র (First Cause) সপক্ষে অ্যারিস্টটলের প্রমাণকে কুরানের ঈশ্বরের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেছেন। পরবর্তীকালের সকল ফায়লাসুফের মত তিনি বিশ্বাস করতেন যে মুসলিমদের সর্বত্র সত্যের সন্ধান করা উচিত, এমনকি যদি তা একেবারে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের কাছ থেকেও হয়। ঈশ্বর এবং আত্মা সম্পর্কে কুরানে প্রত্যাদিষ্ট শিক্ষা সম্পূর্ণ দার্শনিক সত্যের প্রতীক যার মাধ্যমে এগুলো সাধারণ মানুষের বোধগম্য– যাদের যৌক্তিক চিন্তাভাবনার যোগ্যতা নেই-হয়ে উঠেছে। সুতরাং বলা হয়ে থাকে প্রত্যাদিষ্ট ধর্ম “দরিদ্র-ব্যক্তির ফালসাফাহ্”। আল-কিন্দির মত একজন ফায়লাসুফ প্রত্যাদেশকে যুক্তির বশীভূত করতে চাননি বরং ঐশীগ্রন্থের অভ্যন্তরীণ সত্তা দেখতে চেয়েছেন তিনি, অনেকটা শিয়ারা যেভাবে কুরানের বাতিন অর্থ অনুসন্ধান করেছে সেরকম।

অবশ্য তুর্কি বংশোদ্ভূত একজন সঙ্গীতযন্ত্রবাদকই যুক্তিভিত্তিক দর্শনের ইসলামী ট্র্যাডিশনের পূর্ণ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আবু নাসর আল-ফারাবি (মৃত্যু: ৯৫০ ) দর্শনকে প্রত্যাদিষ্ট ধর্মের তুলনায় উন্নত বিবেচনার ক্ষেত্রে আরও অনেক বেশী অগ্রসর হন, ধর্ম তাঁর কাছে নিতান্ত সুবিধাজনক একটা বিষয় এবং স্বাভাবিক সামাজিক প্রয়োজনীয়তায় পরিণত হয়েছে বলে মনে হয়েছে। অবশ্য আল-ফারাবি যেখানে গ্রিক যুক্তিবাদী এবং ক্রিশ্চান দার্শনিকদের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেছেন সেটা হল রাজনীতির প্রতি তাঁর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ। তিনি যেন বিশ্বাস করেছিলেন যে ইসলামের বিজয়ের ফলেই প্লেটো আর অ্যারিস্টটল যে যৌক্তিক সমাজ গঠনের স্বপ্নই দেখেছিলেন সেটা গঠন করা সম্ভব হয়েছে। ইসলাম এর পূর্বসূরীদের চেয়ে ঢের বেশী যুক্তিভিত্তিক ধর্ম। এর ট্রিনিটি (ত্রিত্ববাদ)র মত কোনও অযৌক্তিক মতবাদ নেই, বরং এখানে আইনের গুরুত্বের ওপর জোর দেয়া হয়েছে। আল-ফারাবি বিশ্বাস করতেন, সমাজের পথপ্রদর্শক স্বরূপ ইমামদের নিয়ে শিয়া ইসলাম সাধারণ মুসলিমদের যৌক্তিক নীতিমালার ভিত্তিতে একজন দার্শনিক-রাজার শাসনাধীন সমাজে বসবাসের উপযোগী করে তুলতে সক্ষম। প্লেটো যুক্তি দেখিয়েছিলেন যে কোনও সু-শৃঙ্খল সমাজের এমন কিছু মতবাদের প্রয়োজন রয়েছে যাকে সাধারণ মানুষ ঐশী অনুপ্রেরণাজাত বলে বিশ্বাস করে। মুহাম্মদ (স:) এমন একটা আইন এনেছেন যেখানে ঐশী শাস্তি স্বরূপ নরকের ব্যবস্থা রয়েছে, যা একজন অজ্ঞ ব্যক্তিকে এমনভাবে প্রভাবিত করবে যা অধিকতর যৌক্তিক বক্তব্যে সম্ভব নয়। এভাবে ধর্ম রাষ্ট্র বিজ্ঞানেরই একটা শাখা এবং একজন ভাল ফায়লাসুফ দ্বারা এর গবেষণা ও পর্যবেক্ষণ হওয়া প্রয়োজন, যদিও গড়পড়তা মুসলিমের তুলনায় ধর্মের অনেক গভীর পর্যন্ত আলোক করতে পারবে সে।

অবশ্য এটা তাৎপর্যপূর্ণ যে আল-ফারাবি একজন সক্রিয় (Practising) সুফি ছিলেন। বিভিন্ন গূঢ়বিদ্যা সম্পর্কিত দলগুলোর মাঝে পরস্পরের সঙ্গে অংশতঃ মিলে যাবার প্রবণতা ছিল এবং অধিকতর রক্ষণশীল উলেমাদের চেয়ে অনেক সাধারণ বৈশিষ্ট্য ছিল তাদের মাঝে। অতীন্দ্রিয়বাদের প্রতি আকৃষ্ট শিয়া ও ফায়লাসুফরা শিয়া ও সুফিদের মত পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে, যাদের ভিন্ন রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকলেও আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল একই রকম। সুন্নী ইসলামের অতীন্দ্রিয় রূপ সুফিবাদ আমাদের আলোচিত অন্যান্য মতবাদের চেয়ে আলাদা। কেননা এটা রাজনীতি প্রবণ দর্শন গড়ে তোলেনি। পরিবর্তে এটা যেন আবার পুরনো ইতিহাসে প্রত্যাবর্তন করেছে; এবং সুফিরা চলমান ঘটনাবলীর পরিবর্তে নিজেদের সত্তার গভীরে ঈশ্বরের অনুসন্ধান করেছে। কিন্তু ইসলামের প্রায় সকল ধর্মীয় আন্দোলন অন্তত রাজনৈতিক কোনও দৃষ্টিভঙ্গি হতেই সূচিত হয়, সুফিবাদও তার ব্যতিক্রম ছিল না। উমাঈয়াহ্ আমলে মুসলিম সমাজে দৃষ্ট ক্রমবর্ধমান ইহজাগতিকতা আর বিলাসীতার প্রতিক্রিয়াস্বরূপ গড়ে ওঠা তপস্যায় (যুদ) এর শেকড় নিহিত। উম্মাহ্ আদি সমাজে ফিরে যাবার প্রয়াস ছিল এটা যেখানে সকল মুসলিম সমান মর্যাদা নিয়ে বসবাস করেছে। সাধুগণ প্রায়শই এক ধরনের কর্কশ উলের পোশাক পরত (তাসাউফ), দরিদ্রদের মাঝে যার চল ছিল, পয়গম্বর যেমন পরতেন। নবম শতাব্দীর গোড়ার দিকে তাসাউফ (যেখান থেকে আমাদের “সুফি” শব্দটি এসেছে) শব্দটি আব্বাসীয় সমাজে ধীর গতিতে গড়ে ওঠা অতীন্দ্রিয়বাদী আন্দোলনের সমার্থক হয়ে দাঁড়ায়।

সুফিবাদ সম্ভবত জুরিসগ্রুডেন্সের বিকাশের প্রতিক্রিয়াও ছিল, যাকে কোনও কোনও মুসলিমের কাছে ইসলামকে কতগুলো বাহ্যিক নিয়মকানুনের সেটে পর্যবসিত করার মত ঠেকেছিল। সুফিরা নিজেদের মাঝে সেই মানসিক অবস্থার পুনরাবৃত্তি ঘটাতে চেয়েছিল যার দরুণ মুহাম্মদের (স:) পক্ষে কুরানের প্রত্যাদেশ গ্রহণ করা সম্ভব হয়েছিল। জুরিস্টদের উসুল আল-ফিক্হ’র নয় বরং তাঁর অন্তরের ইসলামই আইনের মূল ভিত্তি। রাষ্ট্রীয় ইসলামের সহিষ্ণুতা যেখানে কমে আসছিল, কুরানকে একমাত্র বৈধ ঐশীগ্রন্থ এবং মুহাম্মদের(স:) ধর্মকে দেখা হচ্ছিল একমাত্র সত্যি ধর্মবিশ্বাস হিসাবে, সুফিরা সেখানে অন্যান্য ধর্মের অস্তিত্ব মেনে নিয়ে কুরানের মূল চেতনায় ফিরে গেছে। কেউ কেউ, উদাহরণস্বরূপ, বিশেষভাবে জেসাসের প্রতি অনুরক্ত ছিল, তাঁকে আদর্শ সুফি হিসাবে দেখেছে, কেননা তিনি ভালোবাসার গসপেল প্রচার করেছিলেন। অন্যরা এমনকি এমনও মনে করেছে একজন পৌত্তলিক যে পাথরের সামনে প্রণামে নত হচ্ছে সেও আসলে সত্যের (আল-হাক্ব) উপাসনা করছে, যা সকল বস্তুর মাঝে বিরাজমান। উলেমা ও জুরিস্টরা যেখানে ক্রমবর্ধমান হারে প্রত্যাদেশকে পূর্ণাঙ্গ ও চূড়ান্ত মনে করছিলেন, সেখানে শিয়াদের মত সুফিরাও নতুন সত্যের সম্ভাবনার ব্যাপারে ছিল উদার, যা যেকোনও স্থানেই মিলতে পারে, এমনতি অন্য ধর্মীয় ট্র্যাডিশনসমূহেও। কুরান যেখানে কঠোর বিচারক ঈশ্বরের বর্ণনা দিয়েছে, সেখানে মহান মহিলা সাধু রাবিয়াহ্ (মৃত্যু: ৮০১)র মত সুফিরা একজন ভালোবাসার ঈশ্বরের কথা বলেছেন।

সমগ্র বিশ্ব এবং প্রধান প্রধান ধর্মীয় ট্র্যাডিশনে এই ধরনের অভ্যন্তরীণ যাত্রার যোগ্যতার অধিকারী নারী এবং পুরুষ এমন নির্দিষ্ট কিছু কৌশল আবিষ্কার করেছে যা তাদের অবচেতন মনের গভীরে প্রবেশে সক্ষম করে তোলে এবং এমন অনুভূতি যোগায় যাকে তাদের সত্তার গভীরস্থ কোনও সত্তা বলে মনে হয়। ছন্দোময় ভঙ্গিতে গভীর শ্বাসপ্রশ্বাস গ্রহণের সময় মানসিক শক্তি একত্রিত করতে শেখে সুফিরা; তারা উপবাস করে, রাত্রি জাগরণ করে এবং মন্ত্রের মত কুরানে প্রদত্ত ঈশ্বরের গুণসূচক নাম উচ্চারণ করে চলে। মাঝে মাঝে তারা একধরনের বুনো, সীমাহীন আনন্দে উদ্ভাসিত হয়, এই অতীন্দ্রিয়বাদীরা “মাতাল সুফি” (“drunken sufis”) হিসাবে পরিচিতি লাভ করেছে। এধরনের সুফিদের প্রথম দিকের একজন হলেন আবু ইয়াযিদ আল-বিস্তামি (মৃত্যু: ৮৭৪), যিনি আল্লাহকে একজন প্রেমিকের মত মিনতি জানিয়েছেন। তবে তিনি ফানাহ্র (বিলীন) কৌশলও শিখেছিলেন: আস্তে আস্তে অহমবোধের সমস্ত স্তর (যা, সকল অধ্যাত্মিক লেখক একমত পোষণ করেছেন, ঐশী উপলব্ধি থেকে আমাদের দূরে সরিয়ে রাখে) খসিয়ে ফেলার মাধ্যমে আল-বিস্তামি আপন সত্তার (being) ভিত্তিভূমিতে এক বর্ধিত সত্তার (Self) সাক্ষাৎ লাভ করেছিলেন যা স্বয়ং আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কেউ নন, যিনি বিস্তামিকে বলেছেন; “তোমার মাধ্যমেই আমি; তুমি ছাড়া আর কোনও ঈশ্বর নেই।” শাহাদায় সম্ভাব্য আঘাত সৃষ্টিকারী এই পুনর্বিন্যাস এক গভীর সত্য প্রকাশ করে, যা অন্য বহু ট্র্যাডিশনের অতীন্দ্রিয়বাদীরাও আবিষ্কার করেছে। শাহাদা ঘোষণা দেয় যে, আল্লাহ্ ছাড়া আর কোনও ঈশ্বর, কোনও সত্তা নেই, সুতরাং এটা সত্যি হতে বাধ্য যে যখন সত্তা ইসলামের নিখুঁত কাজের মাধ্যমে নাকচ হয়ে যায়, তখন সকল মানুষই কার্যত: স্বর্গীয়। হুসেইন আল-মনসুর (মৃত্যু: ৯২২) যিনি আল-হাল্লাজ বা উল-কারডার নামেও পরিচিত, একই রকম ঘোষণা দিয়েছিলেন বলে কথিত আছে। তিনি চিৎকার করে বলেছিলেন: “আনা আল-হাক্ক।” (“আমিই সত্য!” বা “আমিই বাস্তব!”), যদিও কোনও কোনও পণ্ডিতের মতে এটা হওয়া উচিত: “আমি সত্য দেখছি!”

বাড়িতে অবস্থান করেই আত্মার মাধ্যমে বৈধ হজ্জ করা সম্ভব দাবী করার কারণে উলেমাদের হাতে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হন হাল্লাজ। তাঁর মৃত্যু সুফি এবং উলেমাদের মাঝে ক্রমবর্ধমান বৈরিতারই পরিচায়ক। বাগদাদের যুনায়েদ (মৃত্যু: ৯১০) যিনি ছিলেন প্রথম তথাকথিত “স্থির সুফি” (“Sober Sufi”), এই জাতীয় চরমপন্থা থেকে সরে আসেন। তিনি মনে করেছেন, বিস্তামির অনুভূত উন্মাদনা একটা পর্যায় মাত্র, সত্তার বর্ধিত উপলব্ধি এবং আরও পূর্ণাঙ্গ আত্ম-নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে অতীন্দ্রিয়বাদীকে যা অতিক্রম করে যেতেই হবে। একজন সুফি যখন প্রথম ঐশী আহ্বান শুনতে পায়, সে নারী বা পুরুষ যেই হোক, অস্তিত্বের সকল উৎসের সঙ্গে কষ্টকর বিচ্ছেদ সম্পর্কে সজাগ হয়ে ওঠে। অতীন্দ্রিয় যাত্রা মানুষের জন্য যা একেবারেই স্বাভাবিক সেখানে ফিরে যাওয়া মাত্র। এই মতবাদ বুদ্ধদের অনুসৃত মতবাদের অনুরূপ। আব্বাসীয় আমলে সুফিবাদ প্রান্তিক আন্দোলন ছিল, কিন্তু পরবর্তীকালে সুফি সাধকরা জুনায়েদের পদ্ধতির উপর ভিত্তি করে এক গূঢ় আন্দোলন গড়ে তোলে যা আমাদের আলোচিত অন্যান্য আন্দোলনের বিপরীতে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের আকৃষ্ট করেছিল।

নিজেদের যদিও তারা ধার্মিক, নিবেদিত মুসলিম বলে দাবী করেছিল, কিন্তু গূঢ় তাত্ত্বিকরা সবাই পয়গম্বরের ধর্মকে বদলে ফেলেছে। ফায়লাসুফদের মতবাদ শুনলে মুহাম্মদ(স:) হয়ত হতবাক হয়ে যেতেন এবং আলী নির্ঘাত তাঁর দলের লোক বলে ঘোষণাদানকারী শিয়াদের ধারণা ও কিংবদন্তী বুঝতেই পারতেন না। কিন্তু যেকোনও ট্র্যাডিশনের অধিকাংশ বিশ্বাসীর দৃঢ় বিশ্বাস সত্ত্বেও, যারা মনে করে যে ধর্ম কখনও বদলায় না এবং তাদের বিশ্বাস ও আচরণ ধর্ম প্রবর্তকদের অনুরূপ, টিকে থাকার স্বার্থেই ধর্মকে পরিবর্তিত হতে হয়। মুসলিম সংস্কারকগণ ইসলামের অতীন্দ্রিয়বাদী ধরনকে নির্ভরযোগ্য নয় বলে আবিষ্কার করেছেন এবং পরবর্তীকালের সংযোজনে বিকৃত হবার আগের প্রথম উম্মাহ্ নিখাঁদ অবস্থায় ফিরে যাবার প্রয়াস পেয়েছেন। কিন্তু সময়ের স্রোতের উল্টোদিকে কখনও যাওয়া যায় না। যেকোনও “সংস্কার,” এর উদ্দেশ্য যত রক্ষণশীলই হোক না কেন, সব সময়ই তা নতুন বিচ্যুতি এবং সংস্কারকের আপন সময়ের নির্দিষ্ট চ্যালেঞ্জসমূহের সঙ্গে ধর্ম বিশ্বাসের অভিযোজন। যদি কোনও ট্র্যাডিশনের মাঝে বিকাশ ও বৃদ্ধির অবকাশ না থাকে, তা বিলুপ্ত হবে। ইসলাম প্রমাণ করেছে যে এর সেই সৃজনশীল ক্ষমতা রয়েছে। পয়গম্বরের হতাশ নিষ্ঠুর আমল হতে সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিস্থিতিতে বসবাসকারী নারী এবং পুরুষের মাঝে এক গভীর স্তরে এটা আবেদন সৃষ্টি করতে পারে। তারা কুরানের শব্দের আক্ষরিক অর্থের অতীত অর্থ দেখতে পায় যা মূল প্রত্যাদেশের পরিস্থিতিকে অতিক্রম করে যায়। কুরান তাদের জীবনে একটা শক্তিতে পরিণত হয়েছে যা তাদের পবিত্রতার অনুভূতি যোগায় এবং প্রবল শক্তি আর অন্তর্দৃষ্টির নতুন আধ্যাত্মিকতা গড়ে তুলতে সক্ষম করে তোলে।

নবম ও দশম শতাব্দীর মুসলিমরা মদিনার প্রথম অবরুদ্ধ ক্ষুদ্র উম্মাহর চেয়ে বহুদূর অগ্রসর হয়েছিল। তাদের দর্শন, ফিক্হ এবং অতীন্দ্রিয়বাদী অনুশীলনের মূলে ছিল কুরান এবং প্রাণপ্রিয় পয়গম্বরের চরিত্র, কিন্তু ঐশীগ্রন্থ যেহেতু ঈশ্বরের বাণী, এটা মনে করা হয়েছে যে এর অসংখ্যরূপে ব্যাখ্যায়িত হওয়ার ক্ষমতা আছে। এভাবে তারা প্রত্যাদেশকে এমন এক পৃথিবীর মুসলিমদের কাছে অর্থময় করে তুলেছে যার কথা হয়ত পয়গম্বর এবং রাশিদুন কল্পনাই করেননি। কিন্তু একটা বিষয় অপরিবর্তনীয় রয়ে গেছে। একেবারে গোড়ার উম্মাহর ধর্মের মত ইসলামের দর্শন, আইন এবং আধ্যাত্মিকতা গভীরভাবে রাজনৈতিক। মুসলিমরা- প্রশংসনীয়ভাবেই- গভীর সচেতন ছিল যে, সব উল্লেখযোগ্য সাংস্কৃতিক অর্জন সত্ত্বেও তাদের সৃষ্ট সাম্রাজ্য কুরানের নির্দেশিত মানদণ্ড অনুযায়ী চলেনি। খলিফাহ্ উম্মাহর নেতা, কিন্তু তিনি এমনভাবে জীবন কাটিয়েছেন এবং শাসন করেছেন যা হয়ত পয়গম্বরকে শঙ্কিত করে তুলত। যখনই কুরানের আদর্শের সঙ্গে চলমান রাজনীতির উল্লেখযোগ্য বিচ্যুতি দেখা গেছে, মুসলিমরা মনে করেছে তাদের সবচেয়ে পবিত্র মূল্যবোধ লঙ্ঘিত হয়েছে। উম্মাহ্ রাজনৈতিক স্বাস্থ্য তাদের সত্তার গভীরতম সত্তা স্পর্শ করতে পারে। দশম শতাব্দীর অধিকতর চিন্তাশীল মুসলিমরা বুঝতে পেরেছিল খেলাফত সঙ্কটাপন্ন, কিন্তু খেলাফত ইসলামের চেতনা থেকে এত দূরবর্তী ছিল যে মুসলিমরা এর পতনকে এক ধরনের মুক্তি হিসাবেই অনুভব করেছে।

তথ্যসূত্র

১. কুরান ৪৯:১২।

২. কুরান ৯:১০৬-৭।

৩. প্রাথমিক শিয়াদের সম্পর্কে খুব বেশী জানা নেই। আমরা নিশ্চিত করে জানি না যে সত্যিই আলীর পুরুষ বংশধরগণ অতীন্দ্রিয়বাদের দিকে ঝুঁকে পড়া শিয়াহদের দ্বারা শ্রদ্ধেয় ছিলেন নাকি বংশধারা লুপ্ত হয়ে যাবার পর এবং যখন “দ্বাদশবাদী শিয়া”(“Twelver”) মতবাদ সুস্পষ্ট রূপ লাভ করে তখন ইতিহাসকে পেছনে আদি ইমামদের প্রতি প্রক্ষেপ করা হয়েছে।

৪. কুরান ২:২৩৪; ৮:২;২৩:৫৭-৬১।

৫. “সপ্তবাদী” (“Sevener”) বা ইসামায়েলি শিয়াবাদের উদ্ভব অস্পষ্ট। ইসমায়েলি অবস্থানের যৌক্তিকতা প্রতিষ্ঠার জন্যে দ্বাদশবাদী শিয়াবাদ-এর থিওলজি গড়ে ওঠার পর ইমাম ইসমায়েলের প্রতি গোত্রীয় আনুগত্যের কাহিনী গড়ে উঠতে পারে। সাধারণত রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় সপ্তবাদীরা “যায়দীয়” হয়ে থাকতে পারে, অর্থাৎ যেসব শিয়া পঞ্চম ইমামের ভাই যায়েদ ইবন আলীর পথ অনুসরণ করত এবং বিশ্বাস করত যে অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা মুসলিমদের কর্তব্য।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *