১. সূচনা
পয়গম্বর (৫৭০-৬৩২)
খ্রিস্টিয় ৬১০ সালের রমযান মাসে আরবের একজন বণিক এমন এক অভিজ্ঞতা অর্জন করেন যা বিশ্বের ইতিহাস বদলে দিয়েছে। প্রতি বছর এসময়ে মুহাম্মদ ইবন আবদাল্লাহ্ সাধারণত আরবীয় হিজাযের মক্কার ঠিক বাইরে হিরা পর্বতের একটি গুহায় ধ্যানে বসতেন। সেখানে প্রার্থনা করতে তিনি, উপবাস পালন করতেন এবং দরিদ্র জনসাধারণকে সাহায্য দিতেন। দীর্ঘদিন ধরে তাঁর বিশ্বাস অনুযায়ী আরবীয় সমাজের এক সঙ্কট নিয়ে উদ্বেগে ভুগছিলেন তিনি। সাম্প্রতিক কয়েক দশকে তাঁর গোত্র কুরাইশ আশপাশের দেশসমূহের সঙ্গে বাণিজ্য পরিচালনার মাধ্যমে ধনী হয়ে উঠেছিল। মক্কা এক সমৃদ্ধ বাণিজ্য নগরীতে রূপান্তরিত হয়েছিল বটে, কিন্তু অর্থ- বিত্তের জন্যে আগ্রাসী প্রতিযোগিতার কারণে বেশ কিছু গোত্রীয় মূল্যবোধ হারিয়ে গিয়েছিল। যাযাবর জীবন যাত্রার রেওয়াজ অনুযায়ী গোত্রের অসহায়-দুর্বল সদস্যদের প্রতি নজর দেয়ার পরিবর্তে কুরাইশরা এখন গোত্রের অপেক্ষাকৃত দরিদ্র গ্রুপিং বা ক্ল্যানের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে অর্থ উপার্জনে আরও বেশী মনোযোগী হয়ে পড়েছে। মক্কা এবং গোটা পেনিনসূলা জুড়ে আধ্যাত্মিক অস্থিরতাও বিরাজ করছিল। আরবদের জানা ছিল যে বাইযানটাইন ও পারসিয়ান সাম্রাজ্যগুলোয় অনুশীলিত জুডাইজম ও ক্রিশ্চানিটি তাদের নিজস্ব পৌত্তলিক ঐতিহ্যের তুলনায় ঢের বেশী উন্নততর। কেউ কেউ বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল যে তাদের দেব-নিচয়ের পরম ঈশ্বর (High God) আল-লাহ্ (যাঁর নামের অর্থ স্রেফ “ঈশ্বর”)-ই ইহুদি ও ক্রিশ্চানদের উপাস্য দেবতা, কিন্তু তিনি আরবদের কাছে তাদের নিজস্ব ভাষায় কোনও পয়গম্বর এবং ঐশীগ্রন্থ প্রেরণ করেননি। প্রকৃতপক্ষেই, যেসব ইহুদি ও ক্রিশ্চানের সঙ্গে তাদের সাক্ষাৎ হত তারা আরবরা ঐশী পরিকল্পনা থেকে বাদ পড়ে গেছে বলে বিদ্রূপ করত। সমগ্র আরব বিশ্বে গোত্রগুলো হিংসা ও প্রতিহিংসার এক ভয়ঙ্কর চক্রে পড়ে ঘুরপাক খেয়ে মরছিল। আরবের বহু চিন্তাশীল ব্যক্তির মাঝে ধারণা জন্মেছিল যে আরবরা বিস্তৃত জাতি, সভ্য জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন এবং স্বয়ং ঈশ্বর কর্তৃক উপেক্ষিত। কিন্তু ১৭ রমযানের রাতে এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটে, যখন মুহাম্মদ(স:) ঘুম থেকে জেগে উঠে নিজেকে এক ভয়ঙ্কর সত্তার আলিঙ্গনাবদ্ধ অবস্থায় আবিষ্কার করেন: এই সত্তা তাঁকে প্রবলভাবে আলিঙ্গন করে যতক্ষণ না তিনি তাঁর মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসা আরবের এক নতুন ঐশীগ্রন্থের প্রথম বাণীসমূহ উচ্চারিত হতে শুনলেন।
প্রথম দু’বছর আপন অভিজ্ঞতার ব্যাপারে নীরবতা বজায় রাখেন মুহাম্মদ(স:)। নতুন নতুন প্রত্যাদেশ পেয়েছেন তিনি, কিন্তু সেগুলো কেবল স্ত্রী খাদিজা এবং খাদিজার চাচাত ভাই ক্রিশ্চান ওয়ারাকা ইবন নওফলের কাছে প্রকাশ করেছেন। দু’জনই একথা মেনে নিয়েছিলেন যে প্রত্যাদেশগুলো ঈশ্বরের কাছ থেকেই আগত, কিন্তু কেবল ৬১২-তেই মুহাম্মদ (স:) নিজেকে প্রচারণা চালানোর মত যথেষ্ট শক্তিশালী বোধ করেন এবং আস্তে আস্তে অনুসারী লাভ করেন: তাঁর তরুণ চাচাত ভাই আলী ইবন আবি তালিব, বন্ধু আবু বকর এবং তরুণ ব্যবসায়ী উসমান ইবন আফফান, যিনি ক্ষমতাশালী উমাঈয়াহ্ পরিবারের সদস্য ছিলেন। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী সদস্যসহ নব ধর্মদীক্ষিতদের অধিকাংশই ছিল অপেক্ষাকৃত দরিদ্র ক্ল্যানের সদস্য; অন্যরা মক্কার নতুন বৈষম্য নিয়ে অসুখী ছিল, আরব চেতনার সঙ্গে যাকে মানানসই মনে হয়নি তাদের কাছে। মুহাম্মদের(স:) বাণী ছিল সাধারণ। আবরদের তিনি ঈশ্বর সম্পর্কে নতুন কোনও মতবাদ (doctrine) শিক্ষা দেননিঃ সংখ্যাগরিষ্ঠ কুরাইশ ইতিমধ্যে বিশ্বাস করছিল যে আল্লাহ্ বিশ্বজগত সৃষ্টি করেছেন এবং শেষ বিচারের দিনে মানব জাতির বিচার করবেন, যেমনটি ইহুদি ও ক্রিশ্চানরা বিশ্বাস করত। একটি নতুন ধর্ম প্রতিষ্ঠা করতে যাচ্ছেন বলে ভাবনেনি মুহাম্মদ(সঃ), বরং তিনি কেবল আরবদের কাছে একমাত্র ঈশ্বরের প্রাচীন বিশ্বাসই আবার ফিরিয়ে আনছেন, যাদের এতদিন কোনও পয়গম্বর ছিল না। তিনি জোর দিয়ে বলেছেন যে, ব্যক্তিগত সম্পদ গড়ে তোলা ঠিক নয় বরং সম্পদ বণ্টন করাই মঙ্গল আর এমন একটি সমাজ গড়ে তোলা উচিত যেখানে অসহায় ও দুর্বলেরা সম্মানের সঙ্গে বিবেচিত হবে। কুরাইশরা যদি তাদের পথ ঠিক না করে তাহলে তাদের সমাজ ধসে পড়বে (যেমন অতীতে অন্যান্য অন্যায় আচরণ ভিত্তিক সমাজ ধ্বংস হয়ে গেছে), কেননা তারা অস্তিত্বের মৌলনীতিমালা লঙ্ঘন করছে।
এটাই কুরান (আবৃত্তি) নামে অ্যাখ্যায়িত নতুন ঐশী গ্রন্থের মূল শিক্ষা, কুরান নাম হওয়ার কারণ স্বয়ং মুহাম্মদ(স:) সহ অধিকাংশ বিশ্বাসী নিরক্ষর ছিলেন বলে এর অধ্যায় (সুরা) সমূহের প্রকাশ্য আবৃত্তি শুনে শিক্ষা গ্রহণ করতেন। মুহাম্মদের(স:) কাছে কুরান পঙক্তির পর পঙক্তি, সুরার পর সুরা এইভাবে পরবর্তী একুশ বছর ধরে, কখনও কোনও সঙ্কটের সমাধান হিসাবে আবার কখনও বিশ্বাসীদের ছোট গোষ্ঠীর মাঝে উদ্ভূত কোনও জিজ্ঞাসার জবাব স্বরূপ অবতীর্ণ হয়েছে। প্রত্যাদেশ সমূহ মুহাম্মদের (স:) জন্য কষ্টদায়ক অভিজ্ঞতা ছিল, যিনি বলেছেন: “আমি কখনও এমন কোনও প্রত্যাদেশ লাভ করিনি যখন আমার আত্মাকে ছিনিয়ে নেয়ার মত অনুভূতি জাগেনি।”[১] প্রথম দিকে প্রভাব এমন ভয়ঙ্কর ছিল যে তাঁর গোটা শরীর থরথর করে কাঁপত; এমনকি প্রবল ঠাণ্ডার দিনেও ঘামতেন দরদর করে, প্রবল ভার অনুভব করতেন তিনি অথবা অদ্ভুত শব্দ বা কণ্ঠস্বর শুনতে পেতেন। একেবারে সেক্যুলার পরিভাষায় আমরা বলতে পারি মুহাম্মদ (স: ) তাঁর সমসাময়িকদের তুলনায় অনেক গভীর স্তরে তাঁর জাতির সামনে বিরাজিত সমস্যাবলী উপলব্ধি করেছেন, এবং ঘটনাপ্রবাহ “শ্রবণ করার” সময় অন্তরের অন্তস্ত লে গভীর ও কষ্টকরভাবে ডুব দিতে বাধ্য হয়েছেন যাতে কেবল রাজনৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্যই নয়, সঙ্গে সঙ্গে আধ্যাত্মিক দিক দিয়ে আলোকময় সমাধান লাভ করা যায়। তিনি এক নতুন সাহিত্য ধরন এবং আরবীয় গদ্য ও পদ্য সাহিত্যের একটি মাস্টারপিসও নির্মাণ করছিলেন। প্রথম দিকের বিশ্বাসীদের অনেকেই কুরানের অসাধারণ সৌন্দর্যের কারণেই ধর্মান্তরিত হয়েছিল, যা তাদের গভীর আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে অনুরণিত হয়েছে, মহৎ শিল্পকর্মের আকারে তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক পূর্ব ধারণাকে ভেদ করে গেছে এবং তাদের সমগ্র জীবনধারাকে বদলে দেয়ার জন্য যুক্তির চেয়ে গভীর কোনও স্তরে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। এসব ধর্মান্তরকরণের ঘটনার মধ্যে সবচেয়ে নাটকীয়টি হচ্ছে উমর ইবন আল-খাত্তাবের ইসলাম গ্রহণ, যিনি প্রাচীন পৌত্তলিকতাবাদের প্রতি বিশেষ অনুরক্ত ছিলেন, প্রবলভাবে মুহাম্মদের(স:) বাণীর বিরোধিতা করতেন, নতুন গোত্রটিকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য ছিলেন দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। কিন্তু আরবীয় কাব্য-সাহিত্যের একজন বিশেষজ্ঞও ছিলেন তিনি, এবং প্রথম বারের মত কুরানের বাণী শোনামাত্র এর অসাধারণ অলঙ্কারময় ভাষায় মুগ্ধ হয়ে যান। যেমন তিনি বলেছেন, ভাষা এর বাণী সম্পর্কে তাঁর সব সংস্কার ভেদ করে গেছে: “যখন আমি কুরান শুনলাম, আমার হৃদয় কোমল হয়ে গেল, আমি কাঁদলাম আর ইসলাম আমার মাঝে প্রবেশ করল।”[২]
নতুন গোত্রটি শেষ পর্যন্ত ইসলাম (আত্মসমর্পণ) নামে অভিহিত হয়; একজন মুসলিম সেই নারী বা পুরুষ যে তার সমগ্র সত্তা আল্লাহ্ এবং তাঁর ইচ্ছা যে মানুষ পরস্পরের সঙ্গে ন্যায়সঙ্গত সাম্য আর সহানুভুতির সঙ্গে ব্যবহার করবে, তার প্রতি সমর্পণ করেছে। এটা একটি ভঙ্গি বা আচরিক প্রার্থনার (সালাত) ভঙ্গিতে প্রকাশ পায়, মুসলিমদের প্রতিদিন তিনবার যা পালন করতে হত। (পরবর্তীকালে এই প্রার্থনা দিনে পাঁচ বারে বৃদ্ধি পায়)। প্রাচীন গোত্রীয় নীতি বা মূল্যবোধ ছিল সমতাভিত্তিক; আরবরা রাজতন্ত্রের ধারণা সমর্থন করত না এবং ক্রীতদাসের মত মাটিতে মাথা ঠোকার ব্যাপারটি তাদের কাছে ঘৃণিত ছিল। কিন্তু প্রার্থনার ভঙ্গি নির্ধারণ করা হয়েছিল মক্কায় দ্রুত বেড়ে ওঠা কঠিন ঔদ্ধত্য আর স্বয়ংসম্পূর্ণতার অনুভূতির পাল্টা ব্যবস্থা হিসাবে। মুসলিমদের দেহের ভঙ্গিমা তাদের পুন:শিক্ষা দান করবে, তাদের অহঙ্কার আর স্বার্থপরতা ভুলে যাবার শিক্ষা দেবে এবং স্মরণ করিয়ে দেবে যে ঈশ্বরের সামনে তারা কিছুই নয়। কুরানের কঠোর শিক্ষা পালন করার জন্যে মুসলিমদের তাদের আয়ের একটি নির্ধারিত অংশ দান (যাকাত) হিসাবে দরিদ্রদের মাঝে বণ্টন করতে হত। দরিদ্রদের বঞ্চনার কথা উপলব্ধি করার জন্য, যারা পছন্দ মত খেতে বা পান করতে পারে না। রমযান মাসে উপবাসও পালন করতে হত।
সুতরাং সামাজিক ন্যায়বিচারই ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। মুসলিমদের প্রধান কর্তব্য হিসাবে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল যে: এমন একটি সমাজ (উম্মাহ্) গড়ে তুলতে হবে বাস্তব সহমর্মিতাই যার প্রধান বৈশিষ্ট্য, যেখানে সম্পদের সুষ্ঠু বণ্টন রয়েছে। ঈশ্বর সম্পর্কে যেকোনও মতবাদ ভিত্তিক শিক্ষার চেয়ে এটা অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ। প্রকৃত প্রস্তাবে ধর্মতাত্ত্বিক আঁচ-অনুমান সম্পর্কে কুরানের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে, যাকে যান্নাহ্ বলে অভিহিত করা হয়েছে, যার অর্থ, কারও পক্ষেই ধারণা করা অসম্ভব এমন অলৌকিক বিষয়ে স্বকপোলকল্পিত ধারণা প্রদান। এধরনের বিমূর্ত ডগমা নিয়ে তর্ক করা অর্থহীন বলে মনে করা হয়; বরং ঈশ্বর মানুষের জন্য যেমন জীবন-ধারা নির্ধারণ করে দিয়েছেন সেভাবে জীবনধারণ করার প্রয়াস (জিহাদ) চালানো অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ। উম্মাহর রাজনৈতিক ও সামাজিক কল্যাণ মুসলিমদের জন্য পবিত্র মূল্যবহ। যদি উম্মাহ্ সমৃদ্ধি লাভ করে তাহলে সেটা মুসলিমরা যে ঈশ্বরের ইচ্ছানুযায়ী জীবনযাপন করছে তারই লক্ষণ; এবং একটি প্রকৃত ইসলামী সমাজে বসবাসের অভিজ্ঞতা, যা ঈশ্বরের কাছে সর্বাঙ্গীনভাবে আত্মসমর্পণ করেছে, মুসলিমদের পবিত্র দুর্ভেয়ের অনুভূতি যোগাবে। পরিণামে তারা উম্মাহ্ যেকোনও দুভার্গ্য বা অপমানে প্রবলভাবে তাড়িত হবে যেমন ক্রিশ্চানরা কাউকে অপমানকরভাবে বাইবেল মাড়িয়ে যেতে দেখলে কিংবা শেষ ভোজের ছবি ছিঁড়তে দেখলে তাড়িত হয়।
এই সামাজিক উদ্বেগ বরাবরই মহান বিশ্ব ধর্মসমূহের আবশ্যকীয় অংশ ছিল যা ঐতিহাসিকরা যাকে অ্যাক্সিয়াল যুগ (Axial Age c.৭০০ বিসিই থেকে ২০০ বিসিই) বলেছেন সেই সময় বিকাশ লাভ করেছিল, যখন আমাদের পরিচিত সভ্যতা কনফেশনাল ধর্মবিশ্বাস সমূহের পাশাপাশি গড়ে উঠছিল, মানবজাতিকে যা অব্যাহতভাবে উন্নত করে তুলেছে: চীনের তাওবাদ এবং কনফুসিয়ানিজম; ভারতীয় উপমহাদেশে হিন্দু ধর্মমত ও বুদ্ধধর্ম; মধ্যপ্রাচ্যে একেশ্বরবাদ; এবং ইউরোপে যুক্তিবাদ। এইসব বিশ্বাস প্রাচীন পৌত্তলিকতাবাদের সংস্কার সাধন করেছে, যা কিনা অধিকতর বৃহৎ এবং আরও জটিল সমাজে এই সাংস্কৃতিক প্রয়াসকে সমর্থন জোগাতে সক্ষম বাণিজ্য ভিত্তিক অর্থনীতি গড়ে তোলার পর আর পর্যাপ্ত বলে মনে হচ্ছিল না। বৃহত্তর রাজ্যসমূহের মানুষ আরও প্রশস্ত দিগন্তের সন্ধান লাভ করেছিল এবং স্থানীয় কাল্টসমূহ যথার্থতা হারাচ্ছিল; ক্রমবর্ধমানহারে অ্যাক্সিয়াল যুগের ধর্মবিশ্বাসগুলো একক উপাস্য বা দুর্জেয়ের সর্বোচ্চ প্রতাঁকের দিকে মনোযোগী হয়ে উঠেছিল। প্রত্যেকটি বিশ্বাসই যার যার সমাজে বিরাজিত মৌল অবিচার সম্পর্কে উদ্বিগ্ন ছিল। প্রাক-আধুনিক সকল সভ্যতাই অর্থনেতিকভাবে উদ্বৃত্ত কৃষিপণ্যের ওপর নির্ভরশীল ছিল; সুতরাং কৃষকদের শ্রমের ওপর নির্ভর করতে হত তাদের যারা আবার তাদের উন্নত সংস্কৃতির অংশীদার হতে পারত না, যা ছিল কেবল অভিজাতদের জন্যে। এর মোকাবিলা করার জন্য নতুন ধর্মবিশ্বাসসমূহ সহমর্মিতার গুরুত্বের ওপর জোর দেয়। আরব সভ্য জগতের বাইরে রয়ে গিয়েছিল। এর অবাধ্য জলবায়ুর অর্থ ছিল, আরবরা অনাহারের উপান্তে বসবাস করছে; তাদের এমন কোনও উপায় আছে বলে মনে হয়নি যে তাদের পক্ষে কৃষি ভিত্তিক উদ্বৃত্ত অর্জন করে স্যাসানিয় পারসিয়া বা বাইযানটিয়ামের সঙ্গে এক কাতারে দাঁড়ানো সম্ভব হবে। কিন্তু কুরাইশরা বাজার অর্থনীতি গড়ে তোলার পর তাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যেতে শুরু করেছিল। অনেকেই তখনও প্রাচীন পৌত্তলিকতাবাদ নিয়ে সন্তুষ্ট ছিল, কিন্তু মাত্র একজন ঈশ্বরের উপাসনা করার ক্রমবর্ধমান একটা প্রবণতারও বর্ধিষ্ণু অস্বস্তি ও ছিল। আরবরা এখন তাদের নিজস্ব অ্যাক্সিয়াল-যুগ ধর্ম বিশ্বাসের জন্য প্রস্তুত।
কিন্তু তার মানে ঐতিহ্যের পাইকারী প্রত্যাখ্যান ছিল না। অ্যাক্সিয়াল যুগের পয়গম্বর এবং সংস্কারকগণ তাদের অঞ্চলের প্রাচীন পৌত্তলিক আচারের উপর নির্ভর করেছেন এবং মুহাম্মদ(স:)ও তাই করবেন। অবশ্য তিনি মানাত, আল-লাত এবং আল-উযযাহ্’র মত জনপ্রিয় আরবীয় দেবীদের কাল্ট উপেক্ষা করার দাবী জানিয়েছেন, কেবল আল্লাহ্র উপাসনার কথা বলেছেন। প্যাগান দেবতাদের কুরানে দুর্বল গোত্র প্রধানদের মত বলে উল্লেখ করা হয়েছে যারা তাদের জাতির জন্য দায় বিশেষ, কারণ তারা তাদের পর্যাপ্ত প্রতিরক্ষা দিতে অক্ষম। কুরান একেশ্বরবাদের পক্ষে কোনও দার্শনিক যুক্তি তুলে ধরেনি; এর আহবান বাস্তববাদী এবং সেকারণে বাস্তববাদী আরবদের কাছে আবেদন সৃষ্টি করতে পেরেছে। কুরান দাবী করেছে, প্রাচীন ধর্ম আর কাজ কারছে না।[৩] আধ্যাত্মিক অস্থিরতা, পৌনঃপুনিক ও ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ-বিগ্রহ আর অবিচার আরব ঐতিহ্য আর গোত্রীয় মূল্যবোধের লঙ্ঘন করে চলছে। মাত্র একজন ঈশ্বর এবং ন্যায় বিচার ও সাম্যতার ভিত্তিতে পরিচালিত ঐকবদ্ধ উম্মাহর মাঝেই সমাধান নিহিত।
একেবারে নতুন শোনালেও, কুরান জোর দিয়ে বলেছে এর বাণী সর্বজনবিদিত সত্যের “স্মারক” মাত্র।[৪] এটাই আদি ধর্মবিশ্বাস যা অতীতের পয়গম্বরগণ গোটা মানবজাতির কাছে প্রচার করে গেছেন। মানব জাতির যেভাবে চলা উচিত ঈশ্বর সে সম্পর্কে তাকে অজ্ঞ রাখেন নাঃ পৃথিবীর সকল জাতির নিকট তিনি বার্তাবাহক প্রেরণ করেছেন। ইসলামী বিবরণসমূহ পরবর্তীকালে এধরনের ১,২৪,০০০ পয়গম্বর আগমন করেছিলেন বলে উল্লেখ করে, অসীমতা বোঝানোর জন্য ব্যবহৃত এটি একটি প্রতীকী সংখ্যা। প্রত্যেকেই তাদের জাতির জন্য ঐশ্বরিক অনুপ্রেরণাজাত গ্রন্থ পৌঁছে দিয়েছেন; সেগুলো ঈশ্বরের ধর্মের সত্যকে ভিন্নভাবে প্রকাশ করে থাকতে পারে, কিন্তু অত্যাবশ্যকীয়ভাবে মূলবাণী বরাবর একই ছিল। অবশেষে এবার ঈশ্বর কুরাইশদের কাছে একজন পয়গম্বর এবং একটি ঐশীগ্রন্থ প্রেরণ করেছেন। কুরান বারবার উল্লেখ করেছে যে, মুহাম্মদ (স:) পুরনো ধর্মসমূহকে রদ করার জন্য আসেননি, তাদের পয়গম্বরদের বিরোধিতা করতে বা নতুন ধর্ম প্রবর্তন করতে ও নয়। তাঁর বাণী আব্রাহাম, মোজেস, ডেভিড, সলোমন কিংবা জেসাসের বাণীর অনুরূপ।[৫] কুরান কেবল আরবদের পরিচিত পয়গম্বরদের নামই উল্লেখ করেছে, কিন্তু বর্তমানে মুসলিম পণ্ডিতগণ যুক্তি দেখান যে মুহাম্মদ(স:) যদি বৌদ্ধ বা হিন্দু, অস্ট্রেলীয় আদিবাসী বা আদি আমেরিকানদের কথা জানতেন, কুরান তাদের সাধুদেরও স্বীকার করত, কারণ সঠিক পথে পরিচালিত সকল ধর্মবিশ্বাস যা পরিপূর্ণভাবে ঈশ্বরের কাছে সমর্পিত, যা মানবসৃষ্ট দেবতাকে উপাসনা করতে অস্বীকৃতি জানায় এবং ন্যায়বিচার ও সাম্যের কথা বলে তা একই স্বর্গীয় উৎস থেকে আগত। এই কারণে মুহাম্মদ(স:) ইহুদি বা ক্রিশ্চানদের তারা নির্দিষ্টভাবে ইচ্ছা প্রকাশ না করলে ইসলাম গ্রহণের আহবান জানাননি; কেননা তারা পূর্ণাঙ্গ বৈধ নিজস্ব প্রত্যাদেশ লাভ করেছিল। কুরান জোরের সঙ্গে বলেছে যে, “ধর্মের ব্যাপারে কোনও জোরজবরদস্তি নেই,”[৬] এবং মুসলিমদের ইহুদি ও ক্রিশ্চানদের বিশ্বাসের মর্যাদা দিতে নির্দেশ দিয়েছে, কুরান যাদের আহল্ আল-কিতাব বলে আখ্যা দিয়েছে। সাধারণভাবে “ঐশী গ্রন্থধারী জাতি” হিসাবে এই শব্দবন্ধটি অনুদিত হয়ে থাকে, কিন্তু অধিকতর সঠিকভাবে যা “পূর্বের প্রত্যাদেশেপ্রাপ্ত জাতি” বোঝায়:
তোমরা কিতাবীদের সঙ্গে তর্কবিতর্ক করবে, কিন্তু সৌজন্যের সাথে, তবে যারা ওদের মধ্যে সীমালঙ্ঘন করবে তাদের সাথে নয়। আর বলো, “আমাদের ওপর ও তোমাদের ওপর যা অবতীর্ণ হয়েছে তাতে আমরা বিশ্বাস করি। আর আমাদের উপাস্য ও তোমাদের উপাস্য তো একই, আর তাঁরই কাছে আমরা আত্মসমর্পণ করি।”[৭]
কেবল আমাদের অধিকতর আধুনিক সংস্কৃতির পক্ষেই মৌলিকত্বের কদর এবং ঐতিহ্যকে পাইকারিভাবে পরিত্যাগ পরিত্যাগ করা সম্ভব। প্রাক-আধুনিক সমাজে ধারাবাহিকতা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। মুহাম্মদ(স:) অতীতের সঙ্গে প্রবল বিচ্ছেদ বা অন্য বিশ্বাসের সমাজের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতার কথা চিন্তা করেননি। নতুন ঐশীগ্রন্থকে তিনি আরবের আধ্যাত্মিক দৃশ্যপটে স্থাপন করতে চেয়েছেন।
একারণেই মুসলিমরা মক্কার কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত চৌকো-আকৃতির উপাসনাগৃহ কাবা প্রথাগত আচার অব্যাহত রেখেছিল, যা আরবের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাসনা কেন্দ্র ছিল। এমনকি মুহাম্মদের(স:) সময়কালেও একেবারে প্রাচীন ছিল উপাসনা গৃহটি, এর সঙ্গে সম্পর্কিত কাল্টের মূল তাৎপর্য হারিয়ে গিয়েছিল বিস্মৃতির আড়ালে, কিন্তু প্রতিবছর সমগ্র পেনিনসূলা থেকে হজ্জ তীর্থযাত্রা উপলক্ষ্যে আগত আরবদের কাছে অত্যন্ত প্রিয় ছিল এটি। তারা পৃথিবীর চারদিকে সূর্যের গতিপথ অনুসরণ করে উপাসনাগৃহকে ঘিরে সাতবার প্রদক্ষিণ করত; কাবার দেয়ালে গাঁথা কৃষ্ণ-পাথর চুম্বন করত, যা সম্ভবত: পৃথিবীর বুকে এসে পড়া উল্কাপিণ্ড ছিল, স্বর্গীয় জগতের সঙ্গে উপাসনাগৃহের অবস্থানের সংযোগ স্থাপন করেছিল। এসব আচার (উমরাহ্ নামে পরিচিত) যে কোনও সময় পালন করা যেত; কিন্তু হজ্জ তীর্থযাত্রার সময়েও তীর্থযাত্রীরা কাবাহর পার্শ্ববর্তী আল-সাফা পাহাড় থেকে উপত্যকার উপর দিয়ে আল-মারওয়াহ্ অবধি দৌড়াত, সেখানে গিয়ে প্রার্থনা করত তারা। এরপর তারা মক্কার উপকণ্ঠে এসে আরাফাতের ময়দানে সারারাত জাগ্রত অবস্থায় পাহারায় থাকত, সদলবলে তারা মুয্দালিফাহ্ উপত্যকায় ছুটে গিয়ে মিনার একটা পাথরকে লক্ষ্য করে নুড়ি পাথর নিক্ষেপ করত, মাথা মুণ্ডন করত এবং তীর্থযাত্রার শেষ দিন ঈদ-আল-আযহায় পশু উৎসর্গ করত।
সমাজবদ্ধতার আদর্শ ছিল কাবার কাল্টের মূল বিষয়। মক্কা এবং এর আশপাশের সকল এলাকায় সব সময়ের জন্যে সবরকম সহিংসতা নিষিদ্ধ ছিল। কুরাইশদের বাণিজ্যিক সাফল্যের পেছনে এটা ছিল একটা প্রধান উপাদান, কেননা এতে করে প্রতিহিংসামূলক বৈরিতার প্রতিশোধ গ্রহণের আশঙ্কা থেকে মুক্ত থেকে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে সক্ষম হত আরবরা। হজ্জের সময় তীর্থযাত্রীদের অস্ত্রবহন, বাকবিতণ্ডায় লিপ্ত হওয়া, কোনও পশু, এমনকি কীট-পতঙ্গ হত্যা বা বাঁকা কথা বলার উপরও নিষেধাজ্ঞা থাকত। এসবই উম্মার জন্যে মুহাম্মদের(স:) আদর্শের পক্ষে অনুকূল ছিল। তিনি স্বয়ং উপাসনাগৃহের প্রতি নিবেদিত-প্রাণ ছিলেন, প্রায়ই উমরাহ্ পালন করতেন তিনি এবং কাবাহ্’র পাশে কুরান আবৃত্তি করতেন। আনুষ্ঠানিকভাবে উপাসনাগৃহটি এক নাবাতিয় দেবী হুবালের উদ্দেশ্যে নিবেদিত ছিল। কাবার চারপাশে ৩৬০টি প্রতিমা সাজানো ছিল, সম্ভবত বছরের দিনগুলোর স্মারক ছিল ওগুলো। কিন্তু মুহাম্মদের(স:) কাল আসতে আসতে ধারণা জন্মে যে কাবাগৃহকে পরমঈশ্বর আল্লাহ্র উপাসনালয় হিসাবে মর্যাদা দেয়া হচ্ছে আর ব্যাপক বিস্তারি বিশ্বাস ছিল যে আল্লাহ্ই পৌত্তলিকদের পাশাপাশি হজ্জ পালনে আগত বাইযানটাইন সীমান্তবর্তী এলাকায় বসবাসকারী ক্রিশ্চান ধর্ম গ্রহণকারী একেশ্বরবাদী গোত্রসমূহের উপাস্য। কিন্তু এসব কারণেই মিশনের গোড়ার দিকে মুহাম্মদ(স: ) তখনও মুসলিমদের তখনও মুসলিমদের আহল্ আল-কিতাব-এর পবিত্র নগরী জেরুজালেমের দিকে ফিরে সালাত প্রার্থনায় যোগ দিতে বলেছেন, কাবার সঙ্গে পৌত্তলিকদের সম্পর্ক থাকায় উপাসনাগৃহটিকে পেছনে রেখে দাঁড়াত তারা। এ থেকে তাঁর আরবদের একেশ্বরবাদী পরিবারে নিয়ে আসার আকাঙ্ক্ষাই প্রকাশ পায়।
ছোট আকারের অনুসারী লাভ করেন মুহাম্মদ(স:) এবং এক পর্যায়ে মোটামুটি সত্তরটি পরিবার ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। প্রথম দিকে মক্কার ক্ষমতাশালী ব্যক্তিরা মুসলিমদের উপেক্ষা করেছিল, কিন্তু ৬১৬ নাগাদ তারা মুহাম্মদের(স:) উপর চরম ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। তারা অভিযোগ তোলে যে মুহাম্মদ(স:) তাদের পূর্বপুরুষের ধর্ম বিশ্বাসকে বিদ্রূপ করছেন এবং তিনি নিঃসন্দেহে একজন প্রতারক, যিনি পয়গম্বরের ভান করছেন মাত্র। তারা বিশেষ করে শেষ বিচারের দিন সম্পর্কে কুরানের বিবরণে ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছিল, একে তারা আদিম এবং যুক্তিবর্জিত বলে নাকচ করে দিয়েছিল। আরবরা পারলৌকিক জীবনে বিশ্বাসী ছিল না এবং এধরনের “রূপকথা”য়[৮] আমলই দিতে চাইত না। কিন্তু তারা এটা দেখে বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিল যে কুরানে এই জুডো-ক্রিশ্চান বিশ্বাসটি তাদের গলাকাটা পুঁজিবাদের আঁতে ঘা দিয়ে বসেছে। শেষ বিচারের দিন, আরবদের সতর্ক দেয়া হয়েছে, তাদের গোত্রের ক্ষমতা ও ঐশ্বর্য কোনও কাজে আসবে না; প্রত্যেককে তার নিজস্ব গুণাগুণের ভিত্তিতে যাচাই করা হবে: কেন তারা দরিদ্রের সেবা করেনি? কেন তারা সম্পদ বণ্টনের বদলে তা পুঞ্জীভূত করেছে? যেসব কুরাইশ নতুন মক্কায় সমৃদ্ধি অর্জন করছিল এধরনের কথাবার্তা তাদের ভাল লাগার কথা নয়, ফলে বিরোধী শক্তি জোরাল হয়ে উঠল আৰু আল-হাকাম (কুরানে যাকে আবু জাহল, “মিথ্যার পিতা” বলা রয়েছে), অসাধারণ তীক্ষ্ণধী ব্যক্তি আবু সুফিয়ান, যিনি একসময় মুহাম্মদের(স:) ব্যক্তিগত বন্ধু ছিলেন এবং নিবেদিতপ্রাণ পৌত্তলিক সুহায়েল ইবন আমর এর নেতৃত্বে। এঁরা সবাই তাঁদের পূর্বপুরুষের ধর্মবিশ্বাস পরিত্যাগের ধারণায় অস্বস্তিতে ভুগছিলেন, প্রত্যেকের ইসলাম ধর্ম গ্রহণকারী আত্মীয়-স্বজন ছিল: এবং সবার আশঙ্কা ছিল যে মুহাম্মদ (স:) বুঝি মক্কার নেতৃত্ব নিজ হাতে তুলে নেয়ার পরিকল্পনা করছেন। কুরান জোর দিয়ে বলেছে যে মুহাম্মদের(স:) কোনও রাজনৈতিক ভূমিকা নেই, বরং তিনি একজন নাজির, “সতর্ককারী”[৯] মাত্র, কিন্তু যে ব্যক্তিটি আল্লাহ্র কাছ থেকে নির্দেশ লাভের দাবী করছেন, তিনি কতক্ষণ তাদের মত সাধারণ মরণশীলদের শাসন মেনে চলবেন?
দ্রুত অবনতি ঘটে সম্পর্কের। আবু জাহ্ মুহাম্মদের(স:) ক্ল্যানের বিরুদ্ধে অবরোধ আরোপ করেন, মুসলিমদের সঙ্গে কুরাইশদের ব্যবসা বা বিয়ে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন তিনি। এর মানে ছিল কেউই তাদের কাছে খাদ্য বিক্রি করতে পারবে না। দু’বছর স্থায়ী ছিল অবরোধ, এবং খাদ্যাভাবই হয়ত মুহাম্মদের(স:) প্রাণপ্রিয় স্ত্রী খাদিজার মৃত্যুর জন্য দায়ী ছিল আর এর ফলে নির্ঘাৎ কয়েকজন মুসলিম আর্থিক ভাবে দেউলিয়া হয়ে গেছে। ইসলাম গ্রহণকারী ক্রীতদাসরা বিশেষভাবে অত্যাচারিত হয়েছিল, বেঁধে কড়া রোদে ফেলে রাখা হত তাদের। সবচেয়ে মারাত্মক, ৬১৯-এ অবরোধ উঠে যাওয়ার পর মুহাম্মদের(স:) চাচা এবং আশ্রয়দাতা (ওয়ালি) আবু তালিব মারা যান। মুহাম্মদ (স: ) এতীম ছিলেন, শৈশবেই তাঁর পিতা-মাতা পরলোকগমন করেছিলেন। আরবের কঠোর প্রতিহিংসা-মতবাদ অনুযায়ী হত্যার বদলা নেয়ার মত আশ্রয়দাতা না থাকলে যে কাউকে শাস্তির ভয় ছাড়াই হত্যা করা যেত। মক্কার কোনও চীফটেইনকে পৃষ্ঠপোষক হিসাবে পেতে কঠিন সমস্যার মুখে পড়তে হয়েছিল মুহাম্মদকে(স:)। মক্কায় উম্মাত্র অবস্থান নাজুক হয়ে পড়ছিল, একটা নতুন সমাধান খুঁজে বের করা হয়ে পড়েছিল অপরিহার্য।
সুতরাং মুহাম্মদ(স:) মক্কার আনুমানিক ২৫০ মাইল উত্তরে অবস্থিত কৃষিভিত্তিক বসতি ইয়াসরিব থেকে আগত গোত্রপ্রধানদের বক্তব্য শুনতে প্রস্তুত হলেন। বেশ কয়েকটি গোত্র যাযাবর জীবন ত্যাগ করে বসতি গড়েছিল সেখানে, কিন্তু মরুপ্রান্ত রের কয়েক শতাব্দীব্যাপী যুদ্ধ বিগ্রহের পর শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করা কঠিন হয়ে পড়েছিল। গোটা বসতি একের পর এক ভয়ঙ্কর বিবাদে জড়িয়ে পড়ছিল। এসব গোত্রের কোনও কোনওটি জুডাইজমে দীক্ষা নিয়েছিল কিংবা ইহুদি বংশোদ্ভূত ছিল। সুতরাং, ইয়াসবিরের জনগণ একেশ্বরবাদী ধারণার সঙ্গে পরিচিত ছিল, তারা প্রাচীন পৌত্তলিকতাবাদের প্রতি অনুরুক্ত ছিল না; এছাড়া, একটা নতুন সমাধান পেতে মরিয়া হয়ে ছিল তারা যাতে তাদের জাতি একটি মাত্র গোষ্ঠীর সদস্য হিসেবে একসঙ্গে বাস করতে পারে। ৬২০ এর হজ্জের সময় ইয়াসরিব থেকে আগত প্রতিনিধিদল ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে এবং মুসলিমদের সঙ্গে অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়: উভয়পক্ষ শপথ নেয় যে তারা পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়াই করবে না, সাধারণ শত্রুর বিরুদ্ধে পরস্পরকে রক্ষা করবে। পরবর্তীকালে, ৬২২-এ মুসলিম পরিবারগুলো একে একে পালিয়ে ইয়াসরিবে অভিবাসন (হিজরা) করে। নতুন আশ্রয়দাতা সম্প্রতি মৃত্যুবরণ করায় মুহাম্মদ(স:) প্রাণ হারাতে হারাতে আবু বকরকে নিয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন।
হিজরা থেকে মুসলিমদের বর্ষ গণনা শুরু হয়েছে, কারণ এই পর্যায়ে এসে মুহাম্মদ(স:) কুরানের আদর্শ পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়নে সক্ষম হন এবং ইসলাম ইতিহাসের একটা উপাদানে পরিণত হয়। এটা ছিল এক বিপ্লবী পদক্ষেপ। হিজরা কেবল ঠিকানা পরিবর্তন ছিল না। প্রাক-ইসলামী আরবে গোত্রের পবিত্র মূল্য ছিল। রক্ত-সম্পর্কিতদের ত্যাগ করে অন্য গোত্রে যোগদানের কথা ছিল অশ্রুতপূর্ব; এটা আবশ্যকীয়ভাবেই ব্লাসফেমাস কর্মকাণ্ড এবং কুরাইশরা এই পক্ষত্যগ ক্ষমা করতে পারেনি। তারা ইয়াসরিবের উম্মাহকে নিশ্চিহ্ন করার শপথ নেয়। মুহাম্মদ(স:) রক্ত নয় বরং আদর্শের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হওয়া গোত্রীয় দলের প্রধান হিসাবে আবির্ভূত হয়েছিলেন, আরবীয় সমাজে যা ছিল এক বিস্ময়কর উদ্ভাবন। কুরানের ধর্ম গ্রহণে কাউকে বাধ্য করা হয়নি, কিন্তু মুসলিম, পৌত্তলিক এবং ইহুদিদের সকলে একমাত্র উম্মাহর সদস্য ছিল, পরস্পরকে আক্রমণ করতে পারত না তারা, পরস্পরকে আশ্রয় দিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিল। এই অসাধারণ নতুন “অতিগোত্রে”র (Supertribe) সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে এবং যদিও গোড়ার দিকে এটা টিকে থাকবে বলে মনে করেনি কেউ, কিন্তু এটা একটা অনুপ্রেরণা বলে প্রমাণিত হয়েছে যা হিজরার দশ বছর পর, ৬৩২- এ পয়গম্বরের পরলোকগমনের আগে আরবে শান্তি ফিরিয়ে এনেছিল।
ইয়াসরিব মদীনা (নগরী) নামে পরিচিত হয়ে ওঠে, কারণ এটা প্রকৃত মুসলিম সমাজের আদর্শ রূপ ধারন করে। মদীনায় পৌঁছার পর মুহাম্মদের(স:) প্রথম কাজগুলোর মধ্যে একটি ছিল একটা সাধারণ মসজিদ (আক্ষরিক অর্থে সেজদার স্থান) নির্মাণ করা। একটা কর্কশ ভবন ছিল এটা যা প্রাথমিক ইসলামী আদর্শের কৃচ্ছ্রতা প্রকাশ করে। গাছের কাণ্ডের ওপর বসানো হয়েছিল ছাদ, একটা পাথর খণ্ড কিবলাহ্ (প্রার্থনার দিক) নির্দেশ করত এবং ধর্ম প্রচারের জন্য একটা গাছের গুঁড়িতে দাঁড়াতেন পয়গম্বর। ভবিষ্যতের সকল মসজিদ যতদূর সম্ভব এই মডেল অনুসারে নির্মিত হয়েছে। একটা উঠানও ছিল, যেখানে মুসলিমরা উম্মাহর সকল সমস্যা-সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সামরিক, ধর্মীয়- নিয়ে আলোচনায় মিলিত হত। উঠানের সীমান্তে ছোট ছোট কুটিরে বাস করতেন মুহাম্মদ(স:) এবং তাঁর স্ত্রীগণ। ক্রিশ্চান চার্চের বিপরীতে, যা জাগতিক কর্মকাণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন এবং যা কেবল উপাসানার জন্যই নিবেদিত, মসজিদে কোনও কিছুই নিষিদ্ধ ছিল না। কুরানের দর্শনে পবিত্র-অপবিত্র, ধর্মীয়-রাজনৈতিক, যৌনতা-উপাসনার মাঝে কোনও বিভাজন নেই। সমগ্র জীবনই মূলত: পবিত্র এবং স্বর্গের চৌহদ্দির মধ্যে আনতে হয়েছিল তাকে। লক্ষ্য ছিল তাওহীদ (একক করা), গোটা জীবনকে একটি একীভূত গোষ্ঠীতে পরিণত করা, যা মুসলিমদের একত্বের অর্থাৎ ঈশ্বরের সংবাদ দেবে।
মুহাম্মদের(স:) অসংখ্য স্ত্রী পাশ্চাত্যে যথেষ্ট বিকৃত কৌতূহলের জন্ম দিয়েছে, কিন্তু পয়গম্বর ইন্দ্রিয় সুখে নিমজ্জিত ছিলেন কল্পনা করা ভুল হবে, যেমনটি পরবর্তী কালের কিছু ইসলামী শাসক হয়েছিলেন। মক্কায় একগামী ছিলেন মুহাম্মদ(সঃ), কেবল খাদিজাকে বিয়ে করেছিলেন, যদিও বহুগামিতা আরবে খুব সাধারণ ব্যাপার ছিল। খাদিজা বয়সে তাঁর চেয়ে অনেক বড় ছিলেন, কিন্তু তাঁকে অন্তত ছ’টি সন্তান উপহার দিয়েছেন তিনি, যাদের মধ্যে মাত্র চারজন কন্যা জীবিত ছিলেন। মদীনায় মুহাম্মদ(স:) একজন মহান সায়ীদ (প্রধান)-এ পরিণত হন, তাঁর একটা বিশাল হারেম থাকবে বলে প্রত্যাশিত ছিল সবার, কিন্তু এসব বিয়ের অধিকাংশই ছিল রাজনৈতিকভাবে অনুপ্রাণিত। নিজস্ব অতিগোত্র গঠন করার সময় তিনি তাঁর কয়েকজন ঘনিষ্ঠ সহচরের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্কে গড়ে তুলতে আগ্রহী ছিলেন, যাতে তাদের আরও কাছাকাছি আনা যায়। তাঁর প্রিয়তমা নতুন স্ত্রী আয়েশা ছিলেন আবু বকরের মেয়ে; তিনি উমর ইবন আল-খাত্তাবের মেয়ে হাফসাকেও বিয়ে করেছিলেন। নিজের দুই মেয়েকে তিনি উসমান ইবন আফফান এবং আলী ইবন আবি তালিবের সঙ্গে বিয়ে দেন। তাঁর অপরাপর স্ত্রীদের বেশীরভাগই ছিলেন বয়স্কা নারী, যাদের আশ্রয়দাতা ছিল না বা যা সেইসব গোত্রের প্রধানদের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিলেন যে গোত্রগুলো উম্মাহর মিত্রে পরিণত হয়েছিল। তাঁদের কেউই পয়গম্বরের কোনও সন্তান ধারন করেননি।[১০] তাঁর স্ত্রীগণ মাঝে মাঝে আনন্দের চেয়ে বরং সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছেন। একবার যখন তাঁরা এক হামলার পর লুণ্ঠিত মাল বণ্টন নিয়ে ঝগড়ায় লিপ্ত হয়েছিলেন, পয়গম্বর তাঁদের সবাইকে ত্যাগ করার হুমকি দিয়েছিলেন, যদি না তাঁরা কঠোরভাবে ইসলামী মূল্যবোধ অনুযায়ী জীবনযাপন করেন।[১১] কিন্তু তারপরেও একথা সত্যি যে মুহাম্মদ (স:) ছিলেন সেইসব বিরল মানুষদের একজন যাঁরা প্রকৃতই নারীসঙ্গ উপভোগ করেন। তাঁর পুরুষ সহচরদের কেউ কেউ স্ত্রীদের প্রতি তাঁর কোমল আচরণ আর যেভাবে তাঁরা তাঁর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পাল্টা জবাব দিতেন, দেখে বিস্মিত হয়েছেন। মুহাম্মদ(স: ) সুবিবেচকের মত তাঁদের কাজ-কর্মে সাহায্য করতেন, নিজের কাপড় নিজেই সেলাই করতেন তিনি এবং স্ত্রীদের সঙ্গ খুঁজে বেড়াতেন। প্রায়ই স্ত্রীদের কাউকে না কাউকে নিয়ে অভিযানে বের বের হতেন তিনি, তাঁদের সঙ্গে পরামর্শ করতেন, তাঁদের পরামর্শ গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করতেন। একবার তাঁর সবচেয়ে বুদ্ধিমতী স্ত্রী উম্ম সালামাহ্ এক বিদ্রোহ ঠেকাতে সাহায্য করেছিলেন।
নারী মুক্তির প্রয়াস ছিল পয়গম্বরের হৃদয়ের অংশ। পাশ্চাত্যের নারীদের বহু শতাব্দী আগেই কুরান মহিলাদের সম্পদের উত্তরাধিকার এবং স্বামী বিচ্ছেদের ক্ষমতা দিয়েছে। কুরান পয়গম্বরের স্ত্রীগণের নির্দিষ্ট মাত্রা পর্যন্ত বিচ্ছিন্নতা ও পর্দার কথা বলেছে, কিন্তু কুরানে এমন কিছু নেই যা সকল নারীর জন্য পর্দার আবশ্যকতা বা তাদের বাড়ির আলাদা অংশে বিচ্ছিন্ন রাখার কথা বলে ৷ পরলোকগমনের প্রায় তিন কি চার প্রজন্ম পরবর্তী সময়ে এই রীতি গ্রহণ করা হয়েছে। মুসলিমরা সেই সময় বাইযানটিয়ামের গ্রিক ক্রিশ্চানদের অনুকরণ করছিল, যারা তাদের মহিলাদের এভাবে দীর্ঘ আচ্ছাদনে আচ্ছাদিত ও বিচ্ছিন্ন অবস্থায় রাখত; তারা তাদের ক্রিশ্চান নারী বিদ্বেষও খানিকটা আয়ত্ত করেছিল। কুরান নারী- পুরুষকে ঈশ্বরের সামনে অংশীদার বানিয়েছে, যাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য একই রকম[১২] কুরান বহুগামিতাকে স্বীকৃতি দিতে এগিয়ে এসেছে এমন এক সময়ে যখন মুসলিমরা মক্কার বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্রাণ হারাচ্ছিল এবং যার ফলে নারীরা আশ্রয়হীনা হয়ে পড়েছিল; পুরুষদের চারজন পর্যন্ত স্ত্রী গ্রহণের অনুমতি দেয়া হয়, যদি তারা সকলের সঙ্গে সমান ব্যবহার করতে পারে এবং কারও প্রতি পক্ষপাতিত্ব না দেখায়।[১৩] মদীনায় প্রথম উম্মাহর নারী সদস্যারা প্রকাশ্য জীবনে পুরোপুরি অংশ নিয়েছে এবং কেউ কেউ আরবের প্রচলিত রীতি অনুযায়ী রণক্ষেত্রে পুরুষের পাশাপাশি যুদ্ধও করেছে। তারা ইসলামকে নিপীড়নমূলক ধর্ম বলে মনে করেছিল বলে মনে হয় না৷ যদিও পরবর্তীকালে, ক্রিশ্চান ধর্মের ক্ষেত্রে যেমনটি ঘটেছে, পুরুষরা ধর্মবিশ্বাসকে ছিনতাই করে এবং একে বিরাজিত পুরোহিত তন্ত্রের সঙ্গে মিশিয়ে দেয়।
মদীনার প্রাথমিক বছরগুলোতে দুটো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ঘটে। মুহাম্মদ (স:) ইহুদি গোত্রগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার সম্ভাবনায় দারুণ উত্তেজিত ছিলেন এবং এমনকি, হিজরার অব্যবহিত আগে কিছু কিছু রেওয়াজ (যেমন শুক্রবার অপরাহ্নে সমবেত প্রার্থনা, এসময় ইহুদিরা সাবাথের প্রস্তুতি গ্রহণ করত এবং ইহুদি প্রায়শ্চিত্ত দিবসে উপবাস পালন করত) যোগ করেন যাতে ইসলামকে আরও বেশী জুডাইজমের সঙ্গে মেলানো যায়। মদীনার ইহুদিরা যখন তাঁকে সত্য পয়গম্বর হিসাবে মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানাল, জীবনের সবচেয়ে বড় দুঃখ পেয়েছিলেন তিনি। ইহুদিদের কাছে পয়গম্বরত্বের যুগ শেষ হয়ে গিয়েছিল। সুতরাং মুহাম্মদকে(স:) স্বীকার করে নিতে না চাওয়াটা তাদের পক্ষে বিস্ময়কর ছিল না। তবে মদীনাবাসী ইহুদিদের বিরুদ্ধে যুক্তিসমূহ কুরানের উল্লেখযোগ্য অংশ দখল করে আছে যা দেখায় যে ব্যাপারটি মুহাম্মদকে(স:) উৎকণ্ঠিত করে তুলেছিল। নোয়াহ্ ও মোজেসের মত পয়গম্বরদের কাহিনী বাইবেলের তুলনায় ভিন্নভাবে কুরানে উপস্থাপিত হয়েছে। এসব বিবরণ যখন মসজিদে আবৃত্তি করা হত তখন ইহুদিরা বিদ্রূপ করত। ইহুদি গোত্রগুলোর মধ্যে প্রধান তিনটি গোত্র মুহাম্মদের(স:) উত্থানে বিক্ষুব্ধ ছিল, বসতিতে তাঁর আগমনের আগে একটা শক্তিশালী জোট গড়ে তুলেছিল তারা, এখন তারা নিজেদের অপদস্থ ভেবে মুহাম্মদকে(স:) অপসারণ করার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়ে উঠল।
কিন্তু অপেক্ষাকৃত ছোট ক্ল্যানগুলোর কোনও কোনও ইহুদি বন্ধুভাবাপন্ন ছিল, তারা ইহুদি ঐশীগ্রন্থ সম্পর্কে মুহাম্মদের(স:) জ্ঞান সমৃদ্ধ করে তোলে। বুক অভ জেনেসিসে আব্রাহামের দুই পুত্র: ইসহাক ও ইশমায়েল (আরবীতে যাঁর নাম ইসমায়েল হয়েছে), উপপত্নী হ্যাঁগারের (হাজেরা) সন্তান ছিলেন জানতে পেরে দারুণ খুশি হয়েছিলেন তিনি। হ্যাঁগার এবং ইসমায়েলকে বিরান প্রান্তরে নির্বাসন দিতে বাধ্য হয়েছিলেন আব্রাহাম, কিন্তু ঈশ্বর তাদের রক্ষা করেন এবং প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে ইসমায়েলও এক মহান জাতি-আরবদের পিতা হবেন।[১৪] স্থানীয় কিংবদন্তী অনুযায়ী সবাই জানত যে হ্যাঁগার এবং ইসমায়েল মক্কায় বসতি করেছিলেন আর আব্রাহাম সেখানে তাদের দেখতে এসেছেন এবং আব্রাহাম ও ইসমায়েল মিলিতভাবে কাবাহ্ (যা আদিতে অ্যাডাম নির্মাণ করেছিলেন-কিন্তু ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল) নির্মাণ করেন।[১৫] মুহাম্মদের(স:) কাছে একাহিনী অসাধারণ মনে হয়েছে। মনে হয়েছে আরবরা আসলে স্বর্গীয় পরিকল্পনা হতে বাদ পড়েনি এবং কাবার শ্রদ্ধা করার মত একেশ্বরবাদী পরিচয় রয়েছে।
৬২৪ সাল নাগাদ এটা পরিষ্কার হয়ে যায় যে মদীনার সংখ্যা গরিষ্ঠ ইহুদি কখনওই পয়গম্বরের সঙ্গে সমন্বয়ে আসবে না। মুহাম্মদও(স:) একথা জানতে পেরে হতাশ হয়েছিলেন যে ইহুদি ও ক্রিশ্চানদের (যাদের তিনি একই ধর্ম বিশ্বাসের ধারক ধরে নিয়েছিলেন) মাঝে আসলে তীব্র ধর্মতাত্ত্বিক পার্থক্য রয়েছে, যদিও তাঁর এমন ধারণা জন্মেছিল বলে মনে হয় যে, সকল আহল আল-কিতাব এই অমর্যাদাকর বিভেদ স্বীকার করে না। জানুয়ারি ৬২৪-এ তিনি এমন এক সিদ্ধান্ত নেন যা ছিল তাঁর অন্যতম সৃজনশীল কর্ম। সালাত প্রার্থনার সময় গোটা জমায়েতকে তিনি উল্টোদিকে ঘোরার আদেশ দেন, ফলে জেরুজালেমের পরিবর্তে মক্কার দিকে ফিরে প্রার্থনা করে তারা। তাঁর কিবলা এই পরিবর্তন ছিল স্বাধীনতা ঘোষণা। জেরুজালেম থেকে মুখ ফিরিয়ে কাবার দিকে, যার সঙ্গে জুডাইজম বা ক্রিশ্চানটির কোনওই সম্পর্ক ছিল না, ঘোরার মাধ্যমে মুসলিমরা নীরবে দেখিয়ে দিয়েছিল যে তারা আব্রাহামের খাঁটি এবং আদি একেশ্বরবাদের দিকে ফিরে যাচ্ছে, যিনি তোরাহ্ কিংবা গসপেলের প্রত্যাদেশ অবতীর্ণ হওয়ার আগেই জীবনযাপন করে গেছেন, ঈশ্বরের ধর্ম বিভিন্ন বিবদমান গোত্রে ভাগ হওয়ার আগের সময় সেটা।[১৬] মুসলিমরা একমাত্র ঈশ্বরের দিকেই ধাবিত হবে: স্বয়ং ঈশ্বরকে বাদ দিয়ে কোনও মানব সৃষ্ট ব্যবস্থা বা কোনও প্রতিষ্ঠিত ধর্মের কাছে নতি স্বীকার করা বহুঈশ্বরবাদীতা:
অবশ্য যারা ধর্ম সম্পর্কে নানা মতের সৃষ্টি করেছে ও বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়েছে তাদের কোন কাজের দায়িত্ব তোমার নয়… বলো, “নিশ্চয় আমার প্রতিপালক আমাকে পরিচালিত করেছেন সরল পথে, সুপ্রতিষ্ঠিত ধর্মে- একনিষ্ঠ ইব্রাহিমের সমাজে, আর সে তো অংশীবাদীদের অন্তর্ভুক্ত ছিল না।” বলো, “আমার নামাজ, আমার উপাসনা, আমার জীবন ও আমার মৃত্যু বিশ্বের প্রতিপালক আল্লাহ্ই উদ্দেশ্যে।”[১৭]
কিবলার পরিবর্তন আরব মুসলিমদের, বিশেষ করে অভিবাসী, যারা মক্কা থেকে মদীনায় হিজরা করেছিল, তাদের কাছে আবেদন সৃষ্টি করে। মুসলিমরা আর অসহায়ের মত ইহুদি ও ক্রিশ্চানদের পেছনে ঘুরবে না, যারা তাদের আকাঙ্ক্ষাকে বিদ্রূপ করে; বরং ঈশ্বরের কাছে পৌঁছবার জন্যে নিজস্ব পথ বেছে নেবে।
দ্বিতীয় প্রধান ঘটনাটি ঘটে কিবলাহ্ পরিবর্তনের অল্প কিছুদিন পরেই। মুহাম্মদ(স:) এবং মক্কা থেকে আগত অভিবাসীদের মদীনায় জীবিকা নির্বাহের কোনও উপায় ছিল না; কৃষিকাজ করার মত পর্যাপ্ত জমি ছিল না তাদের জন্য; তাছাড়া তারা ছিল বণিক ও ব্যবসায়ী, কৃষিজীবী নয়। আনসার (সাহায্যকারী ) হিসাবে পরিচিত মদিনাবাসীদের পক্ষে তাদের বিনে পয়সায় বহন করে চলা সম্ভব ছিল না, ফলে অভিবাসীরা ঘায়ু বা হানা’র আশ্রয় গ্রহণ করে, যা ছিল আরবের জাতীয় ক্রীড়ার মত, আবার একই সঙ্গে সেটা ছিল অপর্যাপ্ত সম্পদের দেশে সম্পদ পুনঃবণ্টনের কর্কশ এবং প্রচলিত উপায়। হানা পরিচালনাকারী দল প্রতিদ্বন্দ্বী কোনও গোত্রের ক্যারাভান বা দলের ওপর আক্রমণ চালিয়ে মালামাল ও গবাদি পশু ছিনিয়ে নিত, তবে খেয়াল রাখত যেন কেউ প্রাণ না হারায়, কেননা সেক্ষেত্রে প্রতিশোধ উৎসাহিত হতে পারে। মিত্র বা “ক্লায়েন্ট”-এ (অধিকতর শক্তিশালী গোত্রগুলোর নিরাপত্তাকাঙ্ক্ষী দুর্বলতর গোত্র) পরিণত গোত্রের বিরুদ্ধে আক্রমণ পরিচালনা নিষিদ্ধ ছিল। কুরাইশদের হাতে নির্যাতিত এবং দেশত্যাগে বাধ্য হওয়া অভিবাসীরা ধনী মক্কান ক্যারাভান সমূহের ওপর ঘায়ু পরিচালনা শুরু করে, যার ফলে অর্থের সমাগম ঘটে তাদের, কিন্তু আপন গোত্রের বিরুদ্ধে ঘায়ু পরিচালনা ছিল অতীতের মারাত্মক লঙ্ঘন। হানা পরিচালনাকারী দলগুলো কিছু প্রাথমিক সাফল্য অর্জন করেছিল, কিন্তু মার্চ ৬২৪-এ মুহাম্মদ(স:) সেবছরের একটা বিরাট মক্কান ক্যারাভানকে কব্জা করার উদ্দেশ্যে এক বিরাট বাহিনী নিয়ে উপকূলের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। এই দুঃসহসের খবর পেয়ে কুরাইশরা ক্যারাভান রক্ষা করার জন্যে সেনাবাহিনী প্রেরণ করে, কিন্তু প্রতিকূল অবস্থায়ও বদর কূপের কাছে মুসলিমরা কুরাইশদের শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে। যদিও মক্কাবাসীরা সংখ্যার দিক দিয়ে শক্তিশালী ছিল, তারা বেপরোয়া সাহসিকতা দেখিয়ে প্রাচীন আরবীয় কায়দায় যুদ্ধ করে প্রত্যেক সর্দার তার নিজস্ব দলকে নেতৃত্ব দিচ্ছিল। কিন্তু মুহাম্মদের(স:)-এর বাহিনীকে সযত্নে প্রস্তুত করা হয় এবং তারা তাঁর একক নির্দেশের অধীনে লড়াই করে। এই কায়দাটি বেদুইন গোত্রগুলোকে অভিভূত করে, তাদের কেউ কেউ শক্তিশালী কুরাইশদের নতি স্বীকারের দৃশ্য উপভোগও করেছে।
এরপর উম্মার জন্যে কঠিন সময় নেমে আসে। মদীনায় কিছু সংখ্যক পৌত্তলিকের সঙ্গে বৈরিতা মেনে নিয়ে চলতে হচ্ছিল মুহাম্মদ(স:)কে, এরা নবাগত মুসলিমদের ক্ষমতায় অসন্তুষ্ট ছিল এবং বসতি থেকে তাদের উৎখাতে বদ্ধপরিকর ছিল। মক্কার সঙ্গেও যুঝতে হচ্ছিল তাঁকে, আবু সুফিয়ান সেখান থেকে তখন যুদ্ধ পরিচালনা করছিলেন, তিনি মদীনায় বাসরত মুসলিমদের বিরুদ্ধে দুদুটো আক্রমণ শানিয়েছিলেন। উম্মাহকে কেবল যুদ্ধ পরাজিত করাই তাঁর উদ্দেশ্য ছিল না, বরং সমগ্র মুসলিম গোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চেয়েছেন তিনি। মরুভূমির কঠিন নীতিমালা অনুযায়ী যুদ্ধে মাঝামাঝি বলে কোনও সমাধান ছিল নাঃ সম্ভাব্য ক্ষেত্রে বিজয়ী গোত্র প্রধান শত্রুপক্ষকে নিশ্চিহ্ন করে দেবেন বলেই ধরে নেয়া হয়; সুতরাং, উম্মাহ্ পুরোপুরি অস্তিত্ব হারানোর হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়েছিল। ৬২৫-এ উঁহুদের যুদ্ধে মক্কা উম্মাহর উপর মারাত্মক পরাজয় চাপিয়ে দেয়, কিন্তু এর দুবছর পর মুসলিমরা মক্কাবাসীদের পরিখার যুদ্ধে শোচনীয়ভাবে পরাজিত। পরিখার যুদ্ধ নাম হবার কারণ মুহাম্মদ(স:) মদীনার চারপাশে পরিখা খনন করে বসতিকে রক্ষা করার ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। কুরাইশরা তখনও যুদ্ধকে বরং বীরত্বব্যাঞ্জক খেলা হিসাবেই বিবেচনা করত, এধরনের অসমর্থনযোগ্য কৌশলের কথা তাদের কাছে অশ্রুতপূর্ব ছিল, ফলে দ্বিধায় পড়ে গিয়েছিল তারা এবং তাদের অশ্বারোহী বাহিনী অকেজো হয়ে পড়ে। সংখ্যার দিক থেকে শক্তিশালী কুরাইশদের বিরুদ্ধে (মক্কাবাসীর সংখ্যা ছিল দশ হাজার আর মুসলিমরা ছিল তিন হাজার) মুহাম্মদের(স:) দ্বিতীয় বিজয় ছিল বাঁক পরিবর্তনকারী ঘটনা। যাযাবর গোত্রগুলোর কাছে স্পষ্ট হয়ে যায় যে মুহাম্মদ(স:)ই আগামীর নেতা, আর কুরাইশদের মনে হয়েছে বিগত যৌবন। তারা যেসব দেবতার নামে যুদ্ধ করছিল তারা আর তাদের পক্ষে কাজ করছিল না। বহু সংখ্যক গোত্রই উম্মাহর সঙ্গে মৈত্রী স্থাপনে আগ্রহী হয়ে ওঠে, এবং মুহাম্মদ (স:) একটি গোত্রীয় শক্তিশালী কনফেডারেসি গড়ে তুলতে শুরু করেন, যার সদস্যরা পরস্পরের ওপর আক্রমণ না চালানো এবং পরস্পরের শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার শপথ নিয়েছিল। মক্কাবাসীদেরও কেউ কেউ পক্ষ ত্যাগ করে মদীনায় হিজরা শুরু করে; অবশেষে পাঁচ বছরের ভয়ঙ্কর বিপদ-সঙ্কুল সময় পেরিয়ে মুহাম্মদ (স:) আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন যে উম্মাহ্ টিকে থাকবে।
মদীনায় এই মুসলিম সাফল্যের প্রধান বলী ছিল তিন ইহুদি গোত্র কায়নুকাহ্ নাদির এবং কুরাঈযাহ্, যারা মুহাম্মদকে(স:) ধ্বংস করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল এবং স্বাধীনভাবে মক্কার সঙ্গে মৈত্রী গড়ে তুলেছিল। শক্তিশালী সেনাদল ছিল তাদের এবং নিঃসন্দেহে মুসলিমদের জন্যে হুমকি স্বরূপ ছিল তারা, কেননা তাদের আবাসিক এলাকার অবস্থান এমন ছিল যে তাদের পক্ষে অনায়াসে আক্রমণকারী মক্কা-বাহিনীর সঙ্গে যোগদান বা পেছন থেকে উম্মাহকে আক্রমণ করা সম্ভব ছিল। ৬২৫-এ কায়নুকাহ্ যখন মুহাম্মদের(স:) বিরুদ্ধে এক ব্যর্থ বিদ্রোহ পরিচালনা করে, আরবের রেওয়াজ অনুযায়ী তাদের মদীনা থেকে বহিষ্কার করা হয়। নাদির গোত্রকে আশ্বস্ত করার প্রয়াস পেয়েছিলেন মুহাম্মদ(স:), বিশেষ চুক্তিতে উপনীত হয়েছেন তাদের সঙ্গে, কিন্তু যখন জানতে পেলেন যে তারাও তাঁকে গুপ্তহত্যার ষড়যন্ত্র করছে, নির্বাসিত করলেন তাদের। সেখানে তারা নিকটবর্তী খায়বরের ইহুদি বসতির সঙ্গে যোগ দেয় এবং উত্তরাঞ্চলীয় আরব গোত্রগুলোর মাঝে আবু সুফিয়ানের সমর্থন সৃষ্টি করার প্রয়াস পায়। মদীনার বাইরে নাদির আরও বেশী বিপজ্জনক বলে প্রতিভাত হয়, তো পরিখার যুদ্ধে, ইহুদি গোত্র কুরাঈযাহ্ যখন, মুসলিমরা একটা সময়ে পরাজিত হতে যাচ্ছে বলে মনে হয়েছিল, মক্কার পক্ষ অবলম্বন করল, মুহাম্মদ ( স: ) একটুও দয়া দেখাননি। কুরাইযা সাতশত পুরুষকে হত্যা করা হয় এবং গোত্রের নারী-শিশুদের ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি করে দেয়া হয়।
কুরাঈয়ার হত্যাকাণ্ড একটা ভয়ঙ্কর ব্যাপার, কিন্তু তাকে আমাদের বর্তমান সময়ের মানদণ্ডে বিচার করতে যাওয়া ভুল হবে। অত্যন্ত আদিম সমাজ ছিল এটা: মুসলিমরা সবে অস্তিত্বের বিনাশ থেকে রক্ষা পেয়েছে, মুহাম্মদ (স:) যদি কুরাঈয়াকে স্রেফ নির্বাসিত করতেন, তারা খায়ররে ইহুদি প্রতিপক্ষকে শক্তিশালী করে তুলত, উম্মাহর ওপর আরও একটা যুদ্ধ চাপিয়ে দিত। সপ্তম শতকের আরবে কুরাঈযাহ্র মত বিশ্বাসঘাতকদের প্রতি কোনও গোত্রপতি অনুকম্পা প্রদর্শন করবেন, এটা ছিল অপ্রত্যাশিত। হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি খায়বরে এক ভায়াল বার্তা পৌঁছে দিয়েছিল এবং মদীনায় পৌত্তলিক প্রতিপক্ষকে ক্ষান্ত করার ক্ষেত্রে সাহায্য করেছে, কেননা পৌত্তলিক নেতারা বিদ্রোহী ইহুদিদের মিত্র ছিল। জীবন বাঁচানোর যুদ্ধ ছিল এটা, সবারই জানা ছিল যে ঝুঁকি অত্যন্ত ব্যাপক। সংগ্রামের ব্যাপারটি সামগ্রিকভাবে ইহুদিদের প্রতি কোনওরকম বৈরিতার ইঙ্গিত দেয় না, কেবল তিনটি বিদ্রোহী গোত্রের সঙ্গে শত্রুতা বুঝিয়েছে। কুরান ইহুদি পয়গম্বরদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশ অব্যাহত রাখে এবং ঐশীগ্রন্থধারী জাতিসমূহের প্রতি সম্মান জানানোর তাগিদ দিয়েছে। ছোট ছোট ইহুদি গোত্রগুলো মদীনায় বসবাস অব্যাহত রাখে এবং পরবর্তীকালে ক্রিশ্চানদের মত ইহুদিরাও ইসলামী সাম্রাজ্য সমূহে পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা ভোগ করেছে। অ্যান্টি-সেমিটিজম একটা ক্রিশ্চান অভিশাপ। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল সৃষ্টি এবং পরবর্তী সময়ে আরব প্যালেস্টাইন হাতছাড়া হওয়ার পরেই কেবল মুসলিম বিশ্বে ইহুদি বিদ্বেষ প্রকট হয়ে ওঠে। এটা তাৎপর্যপূর্ণ যে মুসলিমরা ইউরোপ থেকে ইহুদি মিথ আমদানি করতে বাধ্য হয়েছিল, প্রটোকলস অভ দ্য এল্ডার্স অভ যায়ন (Protocal of the Elders of Zion)-এর মত ভীষণ অ্যান্টি- সেমিটিক রচনার আরবী অনুবাদও করেছে, কারণ তাদের এমন কোনও নিজস্ব ট্র্যাডিশন ছিল না। ইহুদি জাতির প্রতি এই নতুন বৈরিতার কারণে আজকাল কোনও কোনও মুসলিম কুরানের সেইসব অনুচ্ছেদের উদ্ধৃতি দেয় যেগুলোয় তিন ইহুদি গোত্রের বিরুদ্ধে মুহাম্মদের(স:) সংঘাতের প্রসঙ্গ আছে-তাদের কুসংস্কার বৈধ প্রমাণ করার জন্য। এইসব পঙক্তিকে প্রাসঙ্গিকতার বাইরে এনে তারা কুরানের বাণী এবং পয়গম্বরের দৃষ্টিভঙ্গি উভয়কেই বিকৃত করে, যাঁর জুডাইজমের প্রতি কোনও ঘৃণাবোধ ছিল না।
কুরাঈযাহর বিরুদ্ধে মুহাম্মদের(স:) নিষ্ঠুরতা পরিকল্পনা করা হয়েছিল সকল বৈরিতার দ্রুততর অবসান ঘটানোর লক্ষ্যে। কুরান শিক্ষা দেয় যে যুদ্ধ এমন এক বিপর্যয় যে মুসলিমদের অবশ্যই সংক্ষিপ্ততম সময়ের মধ্যে শান্তি ও স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্যে তাদের সাধ্য অনুযায়ী সবরকম কৌশল ব্যবহার করতে হবে।[১৮] আরব পৌনঃপুনিকভাবে সহিংস সমাজ ছিল এবং শান্তির লক্ষ্যে উম্মাহকে যুদ্ধ করতে হয়েছে। মুহাম্মদ (স:) পেনিনসুলায় যে ধরনের সামাজিক পরিবর্তন আনার প্রয়াস পাচ্ছিলেন সে ধরনের পরিবর্তন কদাচিৎ রক্তপাত ছাড়া অর্জিত হয়। কিন্তু পরিখার যুদ্ধের পর, মুহাম্মদ (স:) যখন মক্কাকে অপদস্থ আর মদীনার প্রতিপক্ষকে দমন করেন, তার ধারণা জন্মে যে জিহাদ পরিত্যাগ করে শান্তি প্রয়াস চালানোর সময় হয়েছে। ৬২৮ এর মার্চে তিনি বেশ কিছু বেপরোয়া এবং সৃজনশীল প্রয়াস অবলম্বন করেন যার ফলে সংঘাতের অবসান ঘটে। তিনি হজ্জ করার উদ্দেশ্যে মক্কায় যাবার ঘোষণা দেন এবং সফরসঙ্গী হবার জন্যে স্বেচ্ছাসেবকদের আহ্বান জানান। যেহেতু তীর্থযাত্রীদের অস্ত্র বহন নিষিদ্ধ ছিল, মুসলিমদের তাই সরাসরি সিংহের ডেরায় গিয়ে নিজেদের বৈরী এবং ক্ষুদ্ধ কুরাইশদের করুণার ওপর ছেড়ে দেয়ার মত একটা ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল সেটা। তা সত্ত্বেও আনুমানিক একহাজার মুসলিম পয়গম্বরের সঙ্গে যোগ দিতে সম্মত হয় এবং তারা মক্কার পথে বেরিয়ে পড়েন। তাদের পরনে ছিল হজ্জের ঐতিহ্যবাহী শাদা পোশাক। কুরাইশরা যদি আরবদের কাবাহ্য় যেতে বাধা দেয় বা প্রকৃত তীর্থযাত্রীদের উপর আক্রমণ চালায় তাহলে সেটা উপাসনাগৃহের অভিভাবক হিসাবে তাদের পবিত্র দায়িত্বের অমর্যাদা হবে। কুরাইশরা অবশ্য তীর্থযাত্রীদল নগরীর বাইরে সহিংসতা নিষিদ্ধ এলাকায় পৌঁছার আগেই আক্রমণ চালানোর জন্য বাহিনী প্রেরণ করেছিল, কিন্তু মুহাম্মদ(স:) তাদের এড়িয়ে যান এবং কয়েকটি বেদুঈন মিত্রের সহায়তায় স্যাঙ্কচুয়ারির প্রান্তে পৌঁছতে সক্ষম হন, হুদাইবিয়া শিবির স্থাপন করে ঘটনাপ্রবাহের গতি দেখার অপেক্ষায় থাকেন। শেষ পর্যন্ত কুরাইশরা এই শান্তিপূর্ণ অবস্থানের চাপে পড়ে উম্মাহর সঙ্গে একটা চুক্তি স্বাক্ষরে বাধ্য হয়। উভয় পক্ষের জন্যেই অজনপ্রিয় একটা পদক্ষেপ ছিল এটা। মুসলিমদের অনেকেই অ্যাকশনের জন্য ব্যাগ্র ছিল, তারা এই চুক্তিকে লজ্জাকর মনে করেছে, কিন্তু মুহাম্মদ(স:) শান্তি পূর্ণ উপায়ে বিজয় অর্জনে বদ্ধপরিকর ছিলেন।
হুদাইবিয়াহ্ ছিল আরেকটি বাঁক বদল। এতে করে বেদুঈনরা আরও অধিক মাত্রায় প্রভাবিত হয় আর ইসলাম ধর্ম গ্রহণের ব্যাপারটি এক অপরিবর্তনীয় ধারায় পরিণত হয়। অবশেষে ৬৩০-এ কুরাইশরা যখন মুহাম্মদের(স:) এক গোত্রীয় মিত্রকে আক্রমণ করার মাধ্যমে চুক্তির লঙ্ঘন করল, দশ হাজার সদস্যের এক বিশাল বাহিনী নিয়ে মক্কার উদ্দেশ্যে রওনা হন মুহাম্মদ(স:)। এই বিশাল বাহিনীর মুখোমুখি হবার পর বাস্তববাদী বলে এর তাৎপর্য বুঝতে পেরে কুরাইশরা পরাজয় মেনে নেয়, খুলে দেয় নগরীর দ্বার এবং বিনা রক্তপাতে মক্কা অধিকার করে নেন মুহাম্মদ(স:)। তিনি কাবার চারপাশের প্রতিমাসমূহ ধ্বংস করেন, একে একমাত্র ঈশ্বর আল্লাহ্র নামে আবার নিবেদন করেন; আর প্রাচীন পৌত্তলিক আচার হজ্জকে আব্রাহাম, হ্যাঁগার ও ইসমায়েলের কাহিনীর সঙ্গে সম্পর্কিত করে একে ইসলামী তাৎপর্য দান করেন। কুরাইশদের কাউকেই মুসলিম হতে বাধ্য করা হয়নি, কিন্তু মুহাম্মদের(স:) বিজয়ে তাঁর বেশীরভাগ নীতিবান প্রতিপক্ষ, যেমন আবু সুফিয়ান, উপলব্ধি করেছিল যে, প্রাচীন ধর্ম ব্যর্থ হয়েছে। ৬৩২-এ মুহাম্মদ(স:) যখন তাঁর প্রাণপ্রিয় স্ত্রী আয়েশার হাতে পরলোকগমন করেন, তখন আরবের প্রায় সকল গোত্র কনফেডারেট বা ধর্মান্তরিত মুসলিম হিসাবে উম্মাহ যোগ দিয়েছে। যেহেতু উম্মাহর সদস্যরা পরস্পরকে আক্রমণ করতে পারে না, সেহেতু গোত্রীয় যুদ্ধ-বিগ্রহ, প্রতিহিংসা এবং পাল্টা প্রতিহিংসার দুষ্টচক্রের অবসান ঘটেছিল। একক প্রয়াসে যুদ্ধ বিধবস্ত আরবে শান্তি ফিরিয়ে এনেছিলেন মুহাম্মদ(স:)।
রাশিদুন (৬৩২-৬৬১)
মুহাম্মদের(স:) জীবন ও সাফল্যসমূহ চিরকাল মুসলিমদের আধ্যাত্মিক, রাজনৈতিক এবং নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রভাবিত করে চলবে। এগুলো “মুক্তি অর্জনে”র ইসলামী অনুভূতি প্রকাশ করে যা কোনও “আদিপাপে’র প্রায়শ্চিত্ত,” যা আদম করেছিলেন এবং অনন্ত জীবনে প্রবেশ করার মধ্যে নয় বরং এমন একটা সমাজ নির্মাণে নিহিত যেখানে মানব জাতির জন্য ঈশ্বরের ইচ্ছার বাস্তবায়ন ঘটে। এটা মুসলিমদের কেবল ইসলামপূর্ব কালে বিরজিত রাজনৈতিক ও সামাজিক নরক থেকেই মুক্তি দেয়নি বরং তাদের এমন একটা প্রেক্ষিত দান করেছে যার আওতায় মুসলিমরা আরও সহজে মনপ্রাণ দিয়ে ঈশ্বরের কাছে আত্মসমর্পণ করতে পেরেছে, যা তাদের পরিপূর্ণতা দিতে পারে। মুহাম্মদের(স:) ঈশ্বরের কাছে নিখুঁত আত্মসমর্পণের আদর্শ উদাহরণে পরিণত হয়েছেন এবং আমরা দেখব, মুসলিমরা তাদের আধ্যাত্মিক ও সামাজিক জীবনে এই পর্যায়ে উন্নীত হতে চায়। মুহাম্মদ(স:) কখনও অলৌকিক চরিত্র হিসাবে সম্মানিত হননি, কিন্তু তাঁকে আদর্শ মানব ( Perfect Man) বলে মনে করা হয়ে থাকে। ঈশ্বরের কাছে তাঁর আত্মসমর্পণ এমন পরিপূর্ণ ছিল যে তিনি সমাজকে বদলে দিয়েছিলেন এবং আরবদের একসঙ্গে বসবাসে সক্ষম করে তুলেছিলেন। উৎপত্তিগতভাবে ইসলাম শব্দটিকে সালাম (শান্তি)র সঙ্গে সম্পর্কিত এবং এই প্রাথমিক বছরগুলোর ইসলাম প্রকৃতই ঐক্য এবং সমন্বয়কে উৎসাহিত করেছিল।
কিন্তু মুহাম্মদ(স:) এই সাফল্য অর্জন করেছিলেন এক ঐশী প্রত্যাদেশের গ্রহীতা হিসাবে। তাঁর জীবদ্দশায় ঈশ্বর তাঁকে বাণী পাঠিয়েছেন যার মাধ্যমে কুরান সৃষ্টি হয়েছে। যখনই মুহাম্মদ(স:) কোনও সঙ্কট বা দ্বিধার মুখোমুখি হয়েছেন, নিজের গভীরে প্রবেশ করেছেন তিনি এবং ঐশ্বরিক প্রেরণা সঞ্জাত সমাধান শ্রবণ করেছেন। এই দিক দিয়ে তাঁর জীবন দুর্ভেয় সত্তা আর পার্থিব জগতের ভীষণ বিভ্রান্তিকর ও বিব্রতকারী ঘটনাপ্রবাহের মাঝে অব্যাহত সংলাপের পরিচয় তুলে ধরে। সুতরাং কুরান সাধারণ মানুষের জীবন ও চলতি ঘটনাপ্রবাহ অনুসরণ করেছে, রাজনীতিতে ঐশ্বরিক দিকনির্দেশনা আর আলো যোগ করেছে। কিন্তু মুহাম্মদের (সঃ) উত্তরাধিকারীগণ পয়গম্বর ছিলেন না, বরং তাঁদের নিজস্ব মানবীয় অন্তর্দৃষ্টির ওপর নির্ভর করতে হয়েছে। কীভাবে তাঁরা নিশ্চিত করবেন যে মুসলিমরা এই পবিত্র আদেশের প্রতি সৃজনশীলতার সঙ্গে সরাসরি সাড়া দান অব্যাহত রাখবে? তাদের শাসিত উম্মাহর আকার আরও বড় হবে এবং মদীনার ক্ষুদ্র গোষ্ঠীটির তুলনায় ক্রমবর্ধমানহারে জটিল হয়ে উঠবে। মদীনায় সবাই সবাইকে চিনত, সেখানে অফিস-আদালত আর আমলাতান্ত্রিকতার কোনও প্রয়োজনই ছিল না। মুহাম্মদের(স:) নতুন ডেপুটিরা (খলিফাহ্) সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রেক্ষাপটে প্রথম উম্মা মূলধারা কীভাবে বজায় রাখবেন।
মুহাম্মদের(স:) উত্তরাধিকারী প্রথম চারজন খলিফাহ্ এইসব কঠিন প্রশ্ন দ্বারা তাড়িত হয়েছিলেন। তাঁরা পয়গম্বরের ঘনিষ্ঠ সহচরদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন এবং মক্কা ও মদীনায় নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁরা বাঁশিদুন, সঠিকপথে পরিচালিত খলিফাহ্ হিসাবে পরিচিত, তাঁদের শাসনকাল ছিল স্বয়ং পয়গম্বরের সময়ের মতই গঠনমূলক। মুসলিমরা এই সময় কালের উন্মাতাল, মহীয়ান আর করুণ ঘটনাবলীর পর্যালোচনার ভেতর দিয়ে নিজেদের সংজ্ঞায়িত করবে আর নিজস্ব থিয়োলজি গড়ে তুলবে।
পয়গম্বরের পরলোকগমনের পর নেতৃস্থানীয় মুসলিমদের উম্মাহর প্রকৃতি কি হওয়া উচিত সেই সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল। কেউ কেউ হয়ত বিশ্বাস করেনি যে আরবে যার নজীর নেই এমন একটা “রাষ্ট্র”, প্রশাসনিক কাঠামোর প্রয়োজন আছে। কেউ কেউ মনে করেছে যেন প্রত্যেক গোত্রীয় গ্রুপের নিজস্ব ইমাম (নেতা) নির্বাচন করা উচিত। কিন্তু পয়গম্বরের সহচর আবু বকর এবং উমর ইবন আল-খাত্তাব যুক্তি দেখালেন যে, উম্মাহকে অবশ্যই একটি এক্যবদ্ধ সমাজ হতে হবে এবং পয়গম্বরের অধীনে যেমন ছিল, একজন মাত্র শাসক থাকতে হবে এর। কারও কারও বিশ্বাস ছিল যে মুহাম্মদ (স:) তাঁর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ পুরুষ আত্মীয় আলী ইবন আবি তালিবকে উত্তরাধিকারী হিসাবে দেখতে চাইতেন। আরবে, যেখানে রক্তের সম্পর্ক ছিল পবিত্র, এটা মনে করা হত যে গোত্রপতির গুণাবলী তাঁর উত্তরাধিকারীদের মাধ্যমে প্রবাহিত হয় এবং কোনও কোনও মুসলিমের বিশ্বাস ছিল যে আলী মুহাম্মদের (স:) বিশেষ কারিশমার কোনও অংশ বহন কেেছন। কিন্তু যদিও আলীর ধার্মিকতা প্রশ্নাতীত ছিল, কিন্তু তিনি তখনও তরুণ এবং অনভিজ্ঞ; সুতরাং সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে আবু বকর পয়গম্বরের প্রথম খলিফাহ্ নির্বাচিত হন।
আবু বকরের শাসনামল (৬৩২-৩৪) ছিল সংক্ষিপ্ত অথচ সঙ্কটময়। তাঁকে প্রধানত তথাকথিত রিদ্দাহ্ (ধর্মত্যাগ)র যুদ্ধ নিয়ে মাথা ঘামাতে হয়েছিল, বিভিন্ন গোত্র উম্মাহ্ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তাদের সাবেক স্বাধীনতা ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করছিল তখন। অবশ্য একে ব্যাপক ধর্মীয় পক্ষত্যাগের ঘটনা হিসাবে দেখা ভুল হবে। বিদ্রোহের ঘটনাগুলো একেবারেই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ছিল। ইসলামী কনফেডারেসিতে যোগ দেয়া বেশীরভাগ বেদুঈন গোত্রেরই মুহাম্মদের(স:) ধর্মের বিস্তারিত্ব নিয়মকানুনে আগ্রহ ছিল না। বাস্তববাদী পয়গম্বর বুঝতে পেরেছিলেন যে তাঁর গঠিত অনেক মৈত্রীই সম্পূর্ণ রাজনৈতিক, আরবীয় মরুপ্রান্তরে যেমন রেওয়াজ ছিল সে অনুযায়ী একজন গোত্রপতি আরেকজনের সঙ্গে যোগ দিচ্ছেন। কোনও কোনও গোত্রপতি এটা মনে করে থাকতে পারেন যে তাঁদের চুক্তি কেবল মুহাম্মদের(স:) সঙ্গে ছিল, উত্তরাধিকারীর সঙ্গে নয় এবং তাঁর পরলোকগমনের পর তাদের উম্মাহর বিভিন্ন গোত্রের ওপর হামলা চালানোয় আর বাধা নেই, এইভাবে তারা নিজেদের ওপর পাল্টা আঘাত আহ্বান করেছিল।
এটা অবশ্য তাৎপর্যপূর্ণ যে বিদ্রোহীদের অনেকেই তাদের বিদ্রোহকে ধর্মীয় সিদ্ধতা দেয়ার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেছিল; নেতারা প্রায়শ: নিজেদের পয়গম্বর দাবী করেছেন এবং কুরানের স্টাইলে “প্রত্যাদেশ” খাড়া করেছেন। আরবরা একটা গভীর অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে গিয়েছিল। আমাদের আধুনিককালের অর্থ অনুযায়ী এটা “ধর্মীয়” ছিল না, কেননা অনেকের কাছেই এটা ব্যক্তিগত বিশ্বাসের ব্যাপার ছিল না, অন্তরের দীক্ষা অনুসরণ করেনি তারা। পয়গম্বর পুরনো ছাঁচ ভেঙে ফেলেছিলেন এবং আকস্মিকভাবে- সাময়িক হলেও- আরবরা প্রথমবারের মত নিজেদের লাগাতার শক্তি হ্রাসকারী যুদ্ধ-বিগ্রহের ভার হতে মুক্ত একটা ঐক্যবদ্ধ সমাজের সদস্য হিসাবে আবিষ্কার করেছিল। মুহাম্মদের(স:) সংক্ষিপ্ত শাসনকালে তারা সম্পূর্ণ ভিন্ন জীবন ধারার আস্বাদ পেয়েছিল, এক ধর্মীয় পরিবর্তন দ্বারা আবদ্ধ হয়েছিল। ঘটে যাওয়া ঘটনাটি এত বিহ্বলকারী ছিল যে এমনকি যারা উম্মাহ্ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চেয়েছে তারাও পয়গম্বরীয় ধারাতেই চিন্তা করতে বাধ্য হয়েছিল। সম্ভবত: রিদ্দাহ্ যুদ্ধ চলার সময়ই মুসলিমরা এই সব রিদ্দাহ্ পয়গম্বরদের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে গিয়ে ধারণা করতে শুরু করে যে মুহাম্মদ(স:) ছিলেন শেষ এবং মহানবী, যে দাবী কুরানে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়নি ৷
প্রজ্ঞা ও ক্ষমাপ্রদর্শনের মাধ্যমে আবু বকর এইসব বিদ্রোহ প্রশমিত করেছেন এবং আরবের ঐক্যপ্রয়াস শেষ করেছেন। তিনি বিদ্রোহীদের অভিযোগ সৃজনশীলতার সঙ্গে সমাধান করেছেন। যারা প্রত্যাবর্তন করেছিল তাদের বিরুদ্ধে কোনও রকম প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। কেউ কেউ আশপাশের এলাকায় লোভনীয় ঘায়ু হামলায় অংশ নেয়ার সম্ভাবনা দেখে ফিরে এসেছিল- দ্বিতীয় খলিফা হ উমর ইবন আল-খাত্তাবের (৬৩৪-৪৪) শাসনামলে যা নাটকীয় গতি পায়। এসব হামলা ছিল পেনিনসূলায় প্রতিষ্ঠিত নয়া ইসলামী শান্তি থেকে উদ্ভূত এক সমস্যার প্রতি সাড়া বিশেষ। শত শত বছর ধরে আরবরা তাদের সম্পদের প্রয়োজন মিটিয়ে এসেছিল ঘায়ুর মাধ্যমে, কিন্তু ইসলাম এর অবসান ঘটিয়েছিল, কারণ উম্মাহ্ গোত্র সমূহের পরস্পরের ওপর হামলা চালানোর অনুমোদন ছিল না। ঘায়ুর বিকল্প কী হবে যা মুসলিমদের সামান্য জীবীকা সংগ্রহে সক্ষম করে তুলবে? উমর অনুধাবন করেছিলেন যে, উম্মাত্র শৃঙ্খলা প্রয়োজন। আইন-বিরোধী উপাদানগুলোকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে হবে এবং যে শক্তি এতদিন যাবৎ হানাদারি যুদ্ধ বিবাদে ব্যয়িত হয়েছে তাকে এবার একটি সাধারণ কর্মধারায় চালিত করতে হবে। স্পষ্ট সমাধান ছিল প্রতিবেশী দেশসমূহের অমুসলিম গোষ্ঠীগুলোর ওপর ঘায়ু হামলা পরিচালনা করা। উম্মাহর ঐক্য বাইরের দিকে পরিচালিত আক্রমণাত্মক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে রক্ষিত হবে। এতে খলিফার কর্তৃত্বও বৃদ্ধি পাবে। আরবরা ঐতিহ্যগতভাবে রাজতন্ত্র অপছন্দ করত আর রাজকীয় আচরণ প্রদর্শনকারী যেকোনও শাসকের প্রতি বিদ্রূপ প্রদর্শন করত। কিন্তু তারা সামরিক অভিযানের সময় বা নতুন কোনও চারণ ভূমির উদ্দেশ্যে যাত্রায় গোত্রপতির কর্তৃত্ব মেনে নিত। সুতরাং উমর নিজেকে আমির আল-মুমীনিন (বিশ্বাসীদের নেতা) বলে আখ্যায়িত করেন, ফলে গোটা উম্মাহর সঙ্গে সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়ে মুসলিমরা তাঁর নির্দেশ বা সমাধান মেনে নিয়েছিল। কিন্তু ব্যক্তিগত পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে এমন বিষয়ের সিদ্ধান্ত মানেনি।
তো উমরের নেতৃত্বে আরবরা লাগাতার বিস্ময়কর বিজয় অর্জনের ভেতর দিয়ে ইরাক, সিরিয়া এবং মিশরে হাজির হয়েছিল। কাদিসিয়ার যুদ্ধে (৬৩৭) তারা পারসিয়ান সেনাবাহিনীকে নাস্তানাবুদ করে, যার ফলে পারসিয়ান স্যাসানিয় রাজধানী সেসিফনের পতন ঘটে। পর্যাপ্ত লোকবল সংগ্রহ হওয়ামাত্র মুসলিমরা এভাবে গোটা পারসিয়ান সাম্রাজ্য অধিকার করে নিতে সক্ষম হয়। বাইযানটাইন সাম্রাজ্যে তারা কঠিন প্রতিরোধের মুখোমুখি হয় এবং বাইযানটাইনের প্রাণকেন্দ্র আনাতোলিয়ায় কোনও এলাকা দখলে ব্যর্থ হয়। তা সত্ত্বেও, মুসলিমরা উত্তর প্যালেস্টাইনে ইয়ারমুকের যুদ্ধে (৬৩৬) বিজয় লাভ করে এবং ৬৩৮-এ জেরুজালেম অধিকার করে, আর ৬৪১ নাগাদ গোটা সিরিয়া, প্যালেস্টাইন ও মিশরের নিয়ন্ত্রণাধিকার পেয়ে যায়। মুসলিম বাহিনী সুদূর সেরেনাইকা পর্যন্ত উত্তর আফ্রিকান উপকূল দখল করার উদ্দেশ্যে অগ্রসর হয়। বদরের যুদ্ধের মাত্র বিশ বছর পর আরবরা নিজেদের এক উল্লেখযোগ্য সাম্রাজ্যের মালিক হিসাবে আবিষ্কার করে। সম্প্রসারণ অব্যাহত থাকে। পয়গম্বরের পরলোকগমনের একশ’ বছর পর, ইসলামী সাম্রাজ্য পিরেনিস থেকে হিমালয় পর্বতমালা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল। একে আরেকটা অলৌকিক ঘটনা আর ঈশ্বরের অনুগ্রহের লক্ষণ বলে মনে হয়েছে। ইসলাম ধর্মের আবির্ভাবের আগে আরবরা ছিল ঘৃণিত অস্পৃশ্য জাতি; কিন্তু আশ্চর্য সংক্ষিপ্ত সময় পরিসরে তারা দু’দুটো প্রধান সাম্রাজ্যের ওপর শোচনীয় পরাজয় চাপিয়ে দিয়েছিল। বিজয়ের অভিজ্ঞতা তাদের মনে এই ধারণা জোরাল করে তোলে যে তাদের ভাগ্যে অসাধারণ একটা কিছু ঘটেছে। এভাবেই উম্মাহর সদস্যপদ ছিল এক দুয়ে অভিজ্ঞতা, কারণ তাদের জানা বা প্রাচীন গোত্রীয় আমলে কল্পনাযোগ্য যেকোনও কিছুকে তা অতিক্রম করে গিয়েছিল। তাদের সাফল্য কুরানের বাণীকেও সত্য বলে প্রতিষ্ঠিত করেছে যেখানে বলা হয়েছে যে সঠিক পথে পরিচালিত সমাজ অবশ্যই সমৃদ্ধি অর্জন করবে কেননা তা ঈশ্বরের আইনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। ঈশ্বরের ইচ্ছার কাছে আত্মসমৰ্পণ করার ফলে কী পরিবর্তন এসেছে ভাব একবার! ক্রিশ্চানরা যেখানে দৃশ্যত: ব্যর্থতা বা পরাজয়ে ঈশ্বরের ভূমিকা দেখতে পায়, জেসাস যেখানে ক্রুশবিদ্ধ হয়ে পরলোকগমন করেছেন, মুসলিমরা সেখানে রাজনৈতিক সাফল্যকে পবিত্র হিসাবে অনুভব করেছে, একে তাদের জীবনে স্বর্গীয় সত্তার প্রকাশ হিসেবে দেখেছে।
অবশ্য একটা ব্যাপার পরিষ্কার করে রাখা প্রয়োজন যে আরবরা যখন আরব বিশ্ব হতে ছড়িয়ে পড়েছিল তখন তারা “ইসলামে”র প্রবল শক্তি দ্বারা তাড়িত হয়নি। পাশ্চাত্যের লোকেরা প্রায়ই ধরে নেয় যে ইসলাম একটি সহিংস এবং সমরভিত্তিক ধর্ম বিশ্বাস, যা তরবারির মাধ্যমে অধীনস্ত প্রজাদের ওপর চেপে বসেছে। এটা মুসলিমদের সম্প্রসারণের যুদ্ধের ভুল ব্যাখ্যা। এসব যুদ্ধে ধর্মীয় কোনও বিষয় জড়িত ছিল না, উমরও একথা বিশ্বাস করতেন না যে তিনি বিশ্ব দখল করে নেয়ার ঐশী অধিকার লাভ করেছেন। উমর এবং তাঁর যোদ্ধাদের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য ছিল একেবারে বাস্তবমুখী: তারা লুণ্ঠন ও সাধারণ কর্মধারার মাধ্যমে উম্মাহর ঐক্য ধরে রাখতে চেয়েছেন। বহু শতাব্দী ধরে আরবরা পেনিনসূলার বাইরের ধনী বসতিগুলোয় হামলা চালানোর চেষ্টা চালিয়ে এসেছিল। পার্থক্য হল এই পর্যায়ে তারা ক্ষমতা– শূন্যতার মুখোমুখি হয়েছিল। পারসিয়া ও বাইযানটিয়াম কয়েক দশক ধরে পরস্পরের বিরুদ্ধে দীর্ঘ এবং শক্তি ক্ষয়কারী লাগাতার যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। দুটো শক্তিই ছিল ক্লান্ত। পারসিয়ায় চলছিল উপদলীয় কোন্দল আর বন্যায় দেশের কৃষিসম্পদ ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। স্যাসানিয় বাহিনীর সিংহভাগই ছিল আরব বংশোদ্ভূত, তারা যুদ্ধের সময় আক্রমণকারী শক্তির সঙ্গে যোগ দিয়েছে। বাইযানটিয়ামের সিরিয়া ও উত্তর আফ্রিকার প্রদেশগুলোয় স্থানীয় জনসাধারণ গ্রিক অর্থোডক্স প্রশাসনের ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার কারণে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল, আরবীয় আক্রমণের সময় তারা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়নি, যদিও মুসলিমরা বাইযানটাইন মূলকেন্দ্র আনাতোলিয়া পর্যন্ত পৌঁছতে পারেনি।
পরবর্তী সময়ে মুসলিমরা এক সুবিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করার পর ইসলামী আইন এই বিজয়ের ধর্মীয় ব্যাখ্যা দিয়েছে– গোটা বিশ্বকে দার আল-ইসলাম (ইসলামের ঘর), যা দার আল-হার্ব (যুদ্ধের ঘর)-এর সঙ্গে চিরন্তন যুদ্ধে লিপ্ত, এই রকম বিভক্ত করার মাধ্যমে। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে মুসলিমরা মেনে নিয়েছে যে এতদিনে তারা তাদের সম্প্রসারণের শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে এবং অমুসলিম বিশ্বের সঙ্গে আন্তরিকভাবেই সহাবস্থান করছে। কুরান যুদ্ধ-বিগ্রহকে পবিত্র করেনি। এটা আত্মরক্ষার জন্যে ন্যায়-যুদ্ধের ধারণা গড়ে তুলেছে যার মাধ্যমে শুভ মূল্যবোধ রক্ষা করা যায়, কিন্তু হত্যা আর আগ্রাসনের নিন্দা জানায়। ১৯ এছাড়া একবার পেনিনসূলা ত্যাগ করার পর আরবরা আবিষ্কার করে যে প্রায় সবাই আহল আল- কিতাবের অন্তর্ভুক্ত, ঐশীগ্রন্থধারী জাতি যারা ঈশ্বরের কাছ থেকে সত্য ঐশীগ্রন্থ লাভ করেছে। সুতরাং তাদের জোর করে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করা হয়নি; প্রকৃতপক্ষে অষ্টম শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ের আগে ধর্মান্তরকরণকে উৎসাহিত করা হয়নি। মুসলিমরা মনে করেছে ইসলাম ইসমায়েলের বংশধরদের ধর্ম, জুডাইজম যেমন ইসহাকের পুত্রদের ধর্মবিশ্বাস। আরবীয় গোত্রসদস্যরা সবসময়ই অপেক্ষাকৃত দুর্বল আশ্রিতদের (মাওয়ালি) নিরাপত্তা দিয়ে এসেছে। তাদের নয়া সাম্রাজ্যে ইহুদি, ক্রিশ্চান আর যরোস্ট্রিয়ানরা জিম্মি (নিরাপত্তাপ্রাপ্ত প্রজা) তে পরিণত হওয়ার পর তাদের ওপর আর কোনওভাবেই হানা বা আক্রমণ চালানোর উপায় ছিল না। আশ্রিতদের সঙ্গে সদাচরণ করা, তাদের সাহায্যে এগিয়ে যাওয়া, তাদের যেকোনও ক্ষতির প্রতিশোধ গ্রহণ করার ব্যাপারটি আরবদের জন্যে বরাবরই ছিল মর্যাদার প্রশ্ন। সামরিক নিরাপত্তার বিনিময়ে জিম্মিরা পোল ট্যাক্স প্রদান করত এবং কুরানের নির্দেশনা অনুযায়ী নিজস্ব ধর্ম বিশ্বাসের অনুশীলন করার অনুমতি পেত তারা। প্রকৃত পক্ষে, রোমান ক্রিশ্চানদের কেউ কেউ ধর্মবিরোধী মত অবলম্বনের জন্য গ্রিক অর্থোডক্সদের হাতে নির্যাতিত হওয়ায় বাইযানটাইন শাসনের চেয়ে মুসলিমদেরই পছন্দ করেছিল বেশী।
উমর ছিলেন কঠোর শৃঙ্খলা বজায় রাখার ব্যাপারে বদ্ধপরিকর। আরব সৈন্যদের বিজয়ের ফল ভোগ করার সাধ্য ছিল না; অধিকৃত সকল এলাকা সেনা প্রধানদের মাঝে বণ্টিত হত না, বরং বর্তমান আবাদীদের হাতেই রাখা হত যারা মুসলিম রাষ্ট্রকে খাজনা প্রদান করত। মুসলিমদের নগরে বসতি করার অনুমতি ছিল না। তার পরিবর্তে বিভিন্ন কৌশলগত স্থানে নতুন নতুন “গ্যারিসন শহর” (আমসার) নির্মাণ করা হয়েছিল তাদের জন্য: ইরাকের কুফা এবং বসরা, ইরানের কুমে এবং নীল নদের উৎসমুখ, ফুস্ট্যাটে। পুরনো শহরের মধ্যে একমাত্র দামাস্কাসই মুসলিম কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। প্রত্যেকটি আমসারে একটি করে মসজিদ নির্মিত হয় যেখানে মুসলিম সৈন্যরা শুক্রবারের প্রার্থনায় যোগ দিত। এইসব গ্যারিসন শহরে সৈন্যদের ইসলামী জীবনযাপনের শিক্ষা দেয়া হত। উমর পারিবারিক মূল্যবোধের গুরুত্বের ওপর জোর দিয়েছেন, মদ্যপানের বেলায় কোঠর ছিলেন আর পয়গম্বরের সুন্দর বৈশিষ্ট্যসমূহকে উঁচু করে তুলেছেন। খলিফার মত পয়গম্বরও সবসময় সাধাসিধে জীবনযাপন করে গেছেন। তবে গ্যারিসন শহরগুলো আবার আরবীয় ছিটমহলের মতই ছিল যেখানে বিশ্ব সম্পর্কে কুরানের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে খাপ খায় এমন ঐতিহ্যগুলোও বিদেশের মাটিতে অব্যাহত থাকে। এই পর্যায়ে ইসলাম আবিশ্যিকভাবেই আরবীয় ধর্ম ছিল। কোনও জিম্মি ধর্মান্তরিত হলে তাকে বাধ্যতামূলকভাবে যেকোনও একটি গোত্রের “আশ্রিত” (Client) হতে হত এবং সে আরবীয় ব্যবস্থায় অঙ্গীভূত হয়ে যেত।
কিন্তু ৬৪৪-এর নভেম্বরে মদীনার মসজিদে ব্যক্তিগতভাবে ক্ষুব্ধ এক পারসিয়ান যুদ্ধ বন্দীর হাতে উমর ছুরিকাহত হলে বিজয়ের এই ধারা আকস্মিকভাবে রুদ্ধ হয়ে যায়। রাশিদুন এর শেষ দিকের বছরগুলো ছিল সহিংসতায় আকীর্ণ। উসমান ইবন আফফান পয়গম্বরের সহচরদের ছয়জন দ্বারা খলিফাহ্ নির্বাচিত হয়েছিলেন। পূর্বসূরীদের তুলনায় দুর্বল ব্যক্তিত্ব ছিলেন তিনি, কিন্তু তাঁর আমলের প্রথম ছ’টি বছর উম্মাহর সমৃদ্ধি অব্যাহত ছিল। উসমান চমৎকার শাসনকাজ পরিচালনা করেছেন; মুসলিমরাও নতুন নতুন অঞ্চল দখল করেছে। তারা বাইযানটাইনদের কাছ থেকে সাইপ্রাস ছিনিয়ে নিয়ে অবশেষে তাদের (বাইযানটাইন) পূর্ব- ভূমধ্যসাগরীয় এলাকা থেকে উৎখাত করে, এবং উত্তর আফ্রিকায় সেনাদল বর্তমান লিবিয়ার ত্রিপোলি পর্যন্ত পৌঁছে যায়। পুবে, মুসলিম বাহিনী আর্মেনিয়ার অধিকাংশ এলাকা দখল করে, প্রবেশ করে ককেশাস এবং ইরানের ওক্সাস নদী অবধি, আফগানিস্তানের হেরাত আর ভারতীয় উপমহাদেশের সিন্ধে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা করে।
কিন্তু এসব বিজয় সত্ত্বেও সৈন্যরা অসন্তুষ্ট হয়ে উঠতে শুরু করেছিল। ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছিল তাদের ভেতর। মাত্র এক দশক সময়কালের মধ্যে তারা একটি কঠিন যাযাবর জীবনধারার বিনিময়ে এক পেশাদার সেনাবাহিনীর একেবারে ভিন্ন জীবন ধারা বেছে নিয়েছিল। গ্রীষ্মকাল যুদ্ধ করে আর শীতকালে বাড়ি থেকে দূরে গ্যারিসন শহরে দিন কাটাচ্ছিল তারা। দূরত্ব ব্যাপক হয়ে ওঠায় সমর অভিযানগুলো ক্লান্তিকর হয়ে উঠেছিল, আগের তুলনায় লুণ্ঠিত মালের পরিমাণও গিয়েছিল কমে। উসমান তখনও বর্তমান ইরাকের মত দেশগুলোয় সেনাপ্রধান ও ধনী মক্কাবাসী পরিবারগুলোকে ব্যক্তিগত এস্টেট স্থাপনের অনুমতি দিতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছিলেন। এটা তাঁর জনপ্রিয়তা কমিয়ে দেয়, বিশেষ করে কুফাহ্ এবং ফুস্ট্যাস্টে। নিজ উমাঈয়াহ্ পরিবারের সদস্যদের সম্মানজনক পদ দেয়ার ভেতর দিয়ে মদীনার মুসলিমদের ক্ষুব্ধ করে তুলেছিলেন উসমান। তারা তাঁর বিরুদ্ধে স্বজনপ্রীতির অভিযোগ তুলেছে, যদিও উমাঈয়াহ্ কর্মকর্তাদের অনেকেরই অনেক যোগ্যতা ছিল। উদাহরণস্বরূপ, উসমান মুহাম্মদের (স:) পুরনো শত্রু আবু সুফিয়ানের পুত্র মুয়াবিয়াকে সিরিয়ার গভর্নর নিয়োগ দেন। ভাল মুসলিম ছিলেন তিনি, দক্ষ প্রশাসকও; ধীরস্থির চরিত্র এবং পরিস্থিতি বোঝার দক্ষতার জন্য সুপরিচিত ছিলেন। কিন্তু মদীনার মুসলিমদের চোখে, যারা তখনও নিজেদের পয়গম্বরের আনসার (সাহায্যকারী) হিসাবে গর্ব করছিল, অন্যায় বলে মনে হয়েছে, আবু সুফিয়ানের বংশধরের স্বার্থে তাদের পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে ভেবেছে তারা। কুরান- আবৃত্তিকারীগণ, যাদের ঐশীগ্রন্থ মুখস্থ ছিল, তারা প্রধান ধর্মীয় কর্তৃপক্ষে পরিণত হয়েছিল এবং উসমান যখন গ্যারিসন শহরগুলোয় পবিত্র বিবরণের কেবল একটি পাঠ ব্যবহার করার ওপর জোর দেন তখন তারাও ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। অন্যান্য পাঠ তিনি বাদ দেন, যা তাদের অনেকেরই পছন্দের ছিল, যদিও সামান্য পার্থক্য ছিল সেসবে। ক্রমবর্ধমান হারে অসন্তুষ্ট গোষ্ঠীটি পয়গম্বরের চাচাত ভাই আলী ইবন আবি তালিবের মুখাপেক্ষী হতে শুরু করে; উমর এবং উসমান উভয়ের নীতির বিরোধী ছিলেন আলী, কেন্দ্রীয় কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে “সেনাদলের অধিকারে”র পক্ষে ছিলেন তিনি।
৬৫৬ সালে অসন্তোষ স্পষ্ট বিদ্রোহে রূপ নেয়। আরব সেনাদের একটা দল প্রাপ্য বুঝে নিতে ফুস্ট্যাট থেকে মদীনায় ফিরে এসেছিল, তাদের বঞ্চনার মাধ্যমে বিদায় করা হলে তারা উসমানের সাধারণ বাড়ি অবরোধ করে, জোর করে ভেতরে প্রবেশ করে হত্যা করে তাঁকে। বিদ্রোহীরা আলীকে নতুন খলিফাহ্ হিসাবে ঘোষণা করে।
প্রথম ফিৎনাহ্
আলীকেই যোগ্যতম প্রার্থী বলে মনে হয়েছে। পয়গম্বরের আপন নিবাসে বেড়ে উঠেছেন তিনি এবং মুহাম্মদ(স:) কর্তৃক প্রচারিত আদর্শে অনুপ্রাণিত ছিলেন। দক্ষ সৈনিক ছিলেন তিনি, সৈন্যদের উৎসাহ জুগিয়ে চিঠি লিখেছেন আজও যেগুলো ধ্রুপদী মুসলিম বিবরণ হিসাবে টিকে আছে; তিনি ন্যায় বিচারের প্রয়োজনীয়তা শিক্ষা দিয়েছেন, প্রজা সাধারণকে ভালোবাসার সঙ্গে দেখার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। কিন্তু পয়গম্বরের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও তাঁর শাসন সর্বজনীনভাবে গৃহীত হয়নি। মদীনার আনসার এবং উমাঈয়াদের উত্থানে মক্কার অসন্তুষ্ট গোষ্ঠীটির সমর্থন পেয়েছিলেন আলী। তখনও ঐতিহ্যবাহী যাযাবর জীবনযাপনকারী, বিশেষত ইরাকের মুসলিমরাও তাঁকে সমর্থন দিয়েছিল, যাদের কুফাস্থ গ্যারিসন শহর ছিল আলীর শক্তঘাঁটি। কিন্তু উসমানের হত্যাকাণ্ড, যিনি স্বয়ং আলীর মত মুহাম্মদের(স:) মেয়ে জামাই এবং প্রাথমিক ইসলাম গ্রহণকারীদের অন্যতম ছিলেন, ছিল এক অতিশয় বেদনাদায়ক ঘটনা যা উম্মাহর মাঝে পাঁচ বছর মেয়াদী গৃহযুদ্ধের সূচনা করেছিল, যা ফিৎনাহ্, প্রলোভনের কাল হিসাবে পরিচিত।
সংক্ষিপ্ত সময় ক্ষেপণের পর মুহাম্মদের(স:) প্রিয়তম স্ত্রী আয়েশা তাঁর আত্মীয় তালহা এবং মুহাম্মদের(স:) অন্যতম মক্কাবাসী সহচর যুবায়েরকে নিয়ে উসমানের হত্যাকারীদের বিচার না করায় আলীর ওপর হামলা চালান। সেনাবাহিনী যেহেতু বিভিন্ন প্রদেশে ছড়িয়ে ছিল, বিদ্রোহীরা মদীনা থেকে কুচকাওয়াজ করে বসরা উদ্দেশে এগিয়ে যায়। সমস্যায় পড়েছিলেন আলী। তিনি নিজেও নিশ্চয়ই উসমানের হত্যাকাণ্ডে আঘাত পেয়েছিলেন, একজন ধার্মিক মানুষ হিসাবে ব্যাপারটাকে ক্ষমা করতে পারেননি। কিন্তু তাঁর সমর্থকরা উসমান কুরানের আদর্শ অনুযায়ী ন্যায়সঙ্গতভাবে শাসন করেননি বলে মৃত্যু তাঁর পাওনা ছিল বলে জোর দিচ্ছিল। আলী তাঁর পক্ষাবলম্বনকারীদের ত্যাগ করতে পারেননি, কুফায় আশ্রয় নেন তিনি, সেখানে রাজধানী স্থাপন করেন। এরপর সেনাবাহিনী নিয়ে এগিয়ে যান বসরার উদ্দেশ্যে এবং অতি সহজে উটের যুদ্ধে বিদ্রোহীদের পরাজিত করেন– এমন নাম হওয়ার কারণ: সেনাদলের সঙ্গে অবস্থানকারী আয়েশা নিজের উটের পিঠে বসে যুদ্ধ অবলোকন করেছিলেন। বিজয় অর্জনের পর আলী তাঁর সমর্থকদের উচ্চপদে আসীন করেন, সম্পদ ভাগ করে দেন তাদের মাঝে, কিন্তু তারপরও তিনি তাদের কুফাহর উর্বর কৃষি জমি সোয়াদকে কুক্ষিগত করার মাধ্যমে পরিপূর্ণ “সৈনিকের অধিকার” প্রদান করেননি। এ এলাকাটি পারসিয়ান সাম্রাজ্যের সিংহভাগ খাজনা যোগাত। নিজ দলকেও সন্তুষ্ট করতে পারছিলেন না তিনি, কেবল তাই নয় উসমানের হত্যাকারীর নিন্দা না জানানোয় নিজের ওপরও গভীর সন্দেহের ছায়া টেনে এনেছিলেন।
সিরিয়ায় আলীর শাসন মেনে নেয়া হয়নি, সেখানে বিরোধী পক্ষের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন মুয়াবিয়াহ্, দামাস্কাসের তাঁর রাজধানী থেকে। উসমান ছিলেন তাঁর আত্মীয় এবং উমাঈয়াহ্ পরিবারের নতুন নেতা হিসাবে এবং একজন আরব গোত্রপ্রধান হিসাবে উসমানের হত্যার বদলা নেয়া দায়িত্ব ছিল তাঁর। মক্কার ধনীক গোষ্ঠি আর সিরিয়ার আরবরা তাঁকে সমর্থন জোগায়, যারা তাঁর শক্তিশালী ও প্রাজ্ঞ সরকারের প্রশংসামুখর ছিল। আলী হয়ত মুয়াবিয়া অবস্থানের প্রতি কিছুটা সহানুভূতি বোধ করেছিলেন এবং প্রাথমিক অবস্থায় তাঁর বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেননি। কিন্তু পয়গম্বরের আত্মীয় পরিজন ও সহচরগণের পরস্পরের ওপর হামলে পড়ার অবস্থাটি দারুণ বিব্রতকর দৃশ্য ছিল। মুহাম্মদের(স:) মিশন ছিল মুসলিমদের মাঝে একতাবোধের বিস্তার আর উম্মাহকে সংগঠিত করা যাতে ঈশ্বরের একত্ব প্রকাশ পায়। আরও বিবাদের আশঙ্কাজনক সম্ভাবনা ঠেকানোর লক্ষ্যে উভয় পক্ষ ৬৫৭-এ ইউফ্রেটিসের উজানে সিফফিনের এক বসতিতে সমাধানে পৌঁছার লক্ষ্যে আলোচনায় মিলিত হয়; কিন্তু কোনও সিদ্ধান্ত ছাড়াই শেষ হয় তা। মুয়াবিয়ার সমর্থকরা বর্শার শীর্ষে কুরানের কপি বিঁধিয়ে নিরপেক্ষ মুসলিমদের প্রতি ঈশ্বরের বাণী মোতাবেক প্রতিদ্বন্দ্বীদের মাঝে একটা ফয়সালা করার আহ্বান জানায়। এটা প্রতীয়মান হয় যে, সালিশির ফলাফল আলীর বিপক্ষে গিয়েছিল এবং তাঁর অনেক অনুসারী তাঁকে রায় মেনে নিতে সম্মত করাতে চেয়েছে। এতে করে নিজেকে ক্ষমতাবান ভেবে মুয়াবিয়াহ্ আলীকে পদচ্যুত করেন, ইরাকে সেনাবাহিনী প্রেরণ করেন এবং জেরুজালেমে নিজেকে খলিফাহ্ হিসাবে ঘোষণা দেন।
কিন্তু আলীর কিছু সংখ্যক চরমপন্থী সমর্থক সালিশের রায় মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানায়, আলীর নতি স্বীকারে প্রচণ্ড আহত বোধ করেছিল তারা। তাদের দৃষ্টিতে উসমান কুরানের নির্দিষ্ট মান অনুযায়ী চলতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। আলীও উসমানের ভুল শোধরানোতে ব্যর্থ হয়ে অন্যায়ের সমর্থকদের সঙ্গে আপোস করেছেন, সুতরাং তিনি প্রকৃত মুসলিম নন। তারা নিজেদের উম্মাহ্ থেকে বিচ্ছিন্ন করে নেয়, যা কিনা তাদের দাবী অনুযায়ী কুরানের চেতনার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে; একজন স্বাধীন কমান্ডারের অধীনে নিজস্ব শিবির স্থাপন করে তারা। আলী এসব চরমপন্থীকে দমন করেন, যারা খারেজি (বিচ্ছিন্নতাবাদী) নামে পরিচিত হয়েছে; মূল বিদ্রোহীদের নিশ্চিহ্ন করলেও গোটা সাম্রাজ্যে আন্দোলন বেগবান হয়ে ওঠে। অনেকেই উসমান- আমলের স্বজনপ্রীতির কারণে অসহিষ্ণু বোধ করেছিল, কুরানের সাম্যতার চেতনা বাস্তবায়ন করতে চেয়েছিল তারা। খারেজিরা আগাগোড়াই সংখ্যালঘু দল, কিন্তু তাদের অবস্থানের গুরুত্ব রয়েছে, কেননা এটাই এক গুরুত্বপূর্ণ মুসলিম ধারার প্রথম নজীর, যার দ্বারা উম্মাহর নৈতিক বোধকে প্রভাবিতকারী রাজনীতি এক নয়া থিয়োলজিক্যাল বিকাশের পথে অগ্রসর হয়েছিল। খারেজিরা জোর দিয়েছিল যে ইসলামী গোষ্ঠীর শাসককে সবচেয়ে শক্তিশালী হওয়ার প্রয়োজন নেই, তাঁকে বরং সবচেয়ে নিবেদিত মুসলিম হতে হবে; খলিফাঁদের মুয়াবিয়ার মত ক্ষমতাকাঙ্ক্ষী হওয়া উচিত নয়। ঈশ্বর মানবজাতিকে স্বাধীন ইচ্ছা দান করেছেন- যেহেতু তিনি ন্যায় বিচারক, তিনি অবশ্যই মুয়াবিয়াহ্, উসমান এবং আলীর মত অন্যায়কারীদের শাস্তি দেবেন, যাঁরা ইসলামের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে ধর্মত্যাগী হয়ে গেছেন। খারেজিরা চরমপন্থী বটে, কিন্তু মুসলিমদের তারা ভাবতে বাধ্য করেছিল কে মুসলিম আর কে নয় সেটা বিবেচনা করার জন্যে। ধর্মীয় ধারণা হিসাবে রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রশ্নটি এতই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে তা ঈশ্বরের প্রকৃতি, পূর্ব-নির্ধারিত নিয়তি আর মানুষের স্বাধীনতার মত বিষয়ে আলোচনার সূত্রপাত ঘটিয়েছিল।
খারেজিদের প্রতি আলীর কঠোর আচরণে তাঁর বহু সমর্থক, এমনকি কুফায়ও, সমর্থন প্রত্যাহার নিয়েছিল। ক্রমশঃ শক্তশালী হয়ে ওঠেন মুয়াবিয়াহ্, আরবদের অনেকেই নিরপেক্ষতা বজায় রাখে। সালিশের দ্বিতীয় প্রয়াস, যেখানে আরেকজন খলিফাহ্ প্রার্থী খোঁজার চেষ্টা হয়েছিল, ব্যর্থ হয়; মুয়াবিয়ার সেনাবাহিনী আরবে তাঁর শাসনের বিরোধিতাকারীদের পরাস্ত করে এবং ৬৬১তে জনৈক খারেজির হাতে প্রাণ হারান আলী। কুফায় যারা আলীর আদর্শের প্রতি বিশ্বস্ত রয়ে গিয়েছিল তারা আলীর পুত্র হাসানকে খলিফাহ্ হিসাবে ঘোষণা দেয়, কিন্তু হাসান মুয়াবিয়াহ্র সঙ্গে চুক্তিতে উপনীত হন এবং অর্থের বিনিময়ে মদীনায় ফিরে যান। সেখানেই তিনি ৬৬৯-এ পরলোকগমনের আগ পর্যন্ত রাজনীতি নিরপেক্ষ জীবনযাপন করেন।
এইভাবে উম্মাহ্ এক নয়া পর্যায়ে পৌঁছে। মুয়াবিয়াহ্ দামাস্কাসে রাজধানী স্থাপন করে মুসলিম সমাজের ঐক্য ফিরিয়ে আনার পদক্ষেপ নেন। কিন্তু একটা প্যাটার্ন খাড়া হয়ে গিয়েছিল। এবার ইরাক এবং সিরিয়ার মুসলিমরা পরস্পরের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ হয়ে পড়ে। অতীতের আলোকে আলীকে ভদ্র, ধার্মিক মানুষ হিসাবে মনে হয়েছে যিনি বাস্তব রাজনীতির যুক্তির কাছে হেরে গিয়েছেন। ইসলাম ধর্ম গ্রহণকারী প্রথম পুরুষ এবং পয়গম্বরের ঘনিষ্ঠতম পুরুষ আত্মীয় আলীর হত্যাকাণ্ডকে সঙ্গত কারণেই ন্যাক্কারজনক ঘটনা হিসাবে দেখা হয়েছে, ঘটনাটি উম্মাহর নৈতিক- সততাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে দিয়েছিল। সাধারণ আরব বিশ্বাস অনুযায়ী আলী পয়গম্বরের ব্যতিক্রমী গুণাবলীর কিছুটা ধারণ করেছিলেন বলে ভাবা হত এবং তাঁর পুরুষ বংশধরদের নেত্বস্থানীয় ধর্মীয় কর্তৃপক্ষ হিসাবে শ্রদ্ধা করা হয়ে থাকে। মিত্র এবং প্রতিপক্ষের বিশ্বাসঘাতকতার শিকার একজন মানুষ হিসাবে আলীর পরিণতি জীবনের অন্তর্গত অবিচারের প্রতাঁকে পরিণত হয়েছে। সময়ে সময়ে শাসক খলিফার আচরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জ্ঞাপনকারী মুসলিমরা খারেজিদের মত নিজেদের উম্মাহ্ থেকে বিচ্ছিন্ন করে সকল প্রকৃত মুসলিমদের আহ্বান জানিয়েছে আরও উন্নতর ইসলামী মানে উন্নীত হওয়ার জন্যে তাদের সঙ্গে সংগ্রামে (জিহাদ) যোগ দেয়ার। প্রায়শঃ তারা নিজেদের শিয়াহ-ই-আলী’র অংশ- আলীর পক্ষাবলম্বনকারী হিসাবে দাবী করেছে।
অবশ্য অন্যরা অধিকতর নিরপেক্ষ অবস্থান গ্রহণ করে। উম্মাহকে বিচ্ছিন্নকারী ভয়ানক বিভক্তি দেখে আশঙ্কিত হয়ে উঠেছিল তারা এবং সেই থেকে ইসলামে ঐক্য আগের তুলনায় আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। অনেকেই আলীর প্রতি অসন্তুষ্ট ছিল, কিন্তু তারা বুঝতে পেরেছিল যে মুয়াবিয়াহ্ মোটেই আদর্শ শাসক নন। তারা তখন চার রাশিদুনের শাসনামলের কথা ভাবতে শুরু করে যখন মুসলিমরা নিবেদিত ব্যক্তি দ্বারা শাসিত হয়েছে, যাঁরা ছিলেন পয়গম্বরের ঘনিষ্ঠ মানুষ, কিন্তু দুষ্কৃতকারীদের কারণে অসম্মানিত হয়েছেন। প্রথম ফিৎনার ঘটনাবলী প্রতীকী রূপ পেয়েছে, প্রতিদ্বন্দ্বীপক্ষগুলো এখন তাদের ইসলামী প্রয়াসের অর্থের খোঁজে এইসব করুণ ঘটনার নজীর টানে। অবশ্য একটা কথা সবাই স্বীকার করে যে পয়গম্বর এবং রাশিদুনের রাজধানী মদীনা থেকে উমাঈয়াহ্-দামাস্কাসে স্থানান্তর রাজনৈতিক সুবিধার চেয়ে অতিরিক্ত কিছু ছিল। উম্মাহ্ যেন পয়গম্বরের জগৎ থেকে সরে যাচ্ছিল এবং মূল আদর্শ হারানোর বিপদে পড়েছিল। অধিকতর ধার্মিক এবং উদ্বিগ্ন মুসলিমরা একে আবার ঠিক পথে ফিরিয়ে আনার উপায় সন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।
তথ্যসূত্র
১. জালাল আল-দিন সুয়ূতি, আল-ইফকান ফি উলুম আল আকরাম, ম্যাক্সিম রডিনসনের মোহাম্মেদ (অনু: অ্যান কার্টার, লন্ডন, ১৯৭১), ৭৪।
২. মুহাম্মদ ইবন ইসহাক, সিরাত রাসুল আল্লাহ্ (অনু ও সম্পা এ. গিয়োম, দ্য লাইফ অভ মুহাম্মদ, লন্ডন, ১৯৫৫), ১৫৮।
৩. কুরান, ২৫:৩, ২৯:১৭, ৪৪:৪৭, ৬৯:৪৪। কুরানের সকল উদ্ধৃতি মুহাম্মদ আসাদ (অনু) দ্য মেসেজ অভ দ্য কুরান, জিব্রালটার, ১৯৮০ হতে গৃহীত। (অনুবাদের সুবিধার্থে আমি বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান এর “কোরান শরীফ: সরল বঙ্গানুবাদ” হতে উদ্ধৃতি দিয়েছি– অনুবাদক)।
৪. কুরান ৮০:১১।
৫. কুরান ২:১২৯-৩২; ৬১:৬।
৬. কুরান ২:২৫৬।
৭. কুরান ২৯:৪৬।
৮. কুরান ২৫:৪-৭।
৯. কুরান ৭৪:১-৫, ৮-১০, ৮৮:২১-২।
১০. মুহাম্মদেও (স:) উপপত্নী মারিয়াম, যিনি ক্রিশ্চান ছিলেন, কিন্তু স্ত্রী নন, পয়গম্বরকে একজন পুত্র সন্তান উপহার দিয়েছিলেন, ছেলেটি তাঁকে অসীম শোকে ভাসিয়ে শিশু অবস্থায় মারা যায়।
১১. কুরান ৩৩:২৮-৯।
১২. কুরান ৩৩:৩৫।
১৩. কুরান ৪:৩।
১৪. জেনেসিস ১৬; ১৮:১৮-২০।
১৫. ডি. সিডারস্কি, লেস অরিজিনস ড্যানস লেজেন্ডেস মুসলমানস ড্যানস লে কোরান এট ড্যানস লেস ভাইস ডেস প্রোফেটেস (প্যারিস, ১৯৩৩)।
১৬. কুরান ২: ১২৯-৩২; ৩:৫৮-৬২; ২:৩৯।
১৭. কুরান ৬:১৫৯, ১৬১-২।
১৮. কুরান ৮:১৬-১৭।
১৯. কুরান ২:১৯৪, ২৫২; ৫:৬৫; ২২:৪০-৪২।