৩০. স্নানের পর জপ-ধ্যান

৩০

সকালে উঠে স্নানের পর জপ-ধ্যান সেরে মন্ত্রর কাছে যাবেন বলে বেরোবেন, উত্তরণ টের পেলেন যে ওঁর কিছু খেয়ে নেওয়া দরকার। ব্রেকফার্স্টের সময়ই অনসূয়ার ফোনটা এল।

“কাগজে তোমার ছবি দেখে সোমনাথদার থেকে তোমার ইন্ডিয়ার নম্বর নিয়ে ফোন করছি। আমি এখন দিল্লিতে।”

“হাইডেলবার্গ ইউনিভার্সিটিতে জয়েন করেছ শুনলাম।”

“আমার খবর রাখো তা হলে।”

“ভুল খবর?”

“না ঠিকই। কিন্তু জার্মানি আমার পোষাচ্ছে না। আমি স্টেটসে ফিরে যেতে চাই।”

“কে বারণ করেছে?”

“বারণ না করলেও, ব্যবস্থাও তো করে রাখেনি কেউ। যে বাড়িটা আমার ছিল, সেখানে অন্য একটা মেয়ে…”।

“সেই মেয়েটা বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছে। তুমি চাইলে মেরিল্যান্ডে ফিরতেই পারো। তোমার বাড়ির দরজা কেউ বন্ধ করে রাখেনি তোমার জন্য।”

“ছেড়ে চলে গিয়েছে? তা হলে তোমার জীবনে এখন…”

“কেউ নেই। কেউ ছিলও না। ঘাসের উপর এসে বসলেই ঘাসটা পতঙ্গের হয়ে যায় না।”

“তোমাকে আমি যতটুকু চিনি, তাতে তোমার পক্ষে অন্য কারওর সঙ্গে থাকা কতটা সম্ভব, তাই নিয়ে আমার সংশয় আছে। তাই ভাবি, জীবন তো একটা কোনও মুহূর্তে, তোমাকে আমাকে আবার মিলিয়েও দিতে পারে। যে বাড়িটা দু’জনে মিলে তৈরি করেছি, সেখানে দু’জনেই আবার…”

“তুমি ঠিক কী বলার জন্য ফোন করেছ অনসূয়া?”

“আমি এটা বলার জন্য ফোন করেছি যে মন্ত্রর মা হিসেবে আমি মন্ত্রর বাবার সঙ্গে যখন খুশি কথা বলতে পারি। দরকারে-অদরকারে কাছেও যেতে পারি।”

“অবশ্যই পারো। কিন্তু জীবন আমাকে কখন, কোথায় রাখবে আমি জানি না।”

“কেন, ফিলাডেলফিয়া তো ভাল জায়গা। সেখানে কোনও অসুবিধে হওয়ার তো কথা নয়।”

“ফিলাডেলফিয়ার কথা কে বলল তোমায়?”

“ব্যক্তিগত ব্যাপার-স্যাপার তুমি না জানালে জানতে না-ও পারি। কিন্তু এইসব খবর কি চাপা থাকে?”

“আমি এখনও নিশ্চিত নই, জয়েন করব কি না। মনের মধ্যে একটা দোলাচল চলছে।”

“অবশ্যই জয়েন করবে। তোমার বয়স এখন পঁচিশ নয়। সামনের মাসেই তুমি বাহান্নয় পা রাখবে ভুলে যেয়ো না। সিকিয়োরিটিটাই প্রাইম কনসার্ন এখন।”

“প্রাণীজগতে কারওর কিন্তু কোনও নিরাপত্তা নেই অনসূয়া। বাঘ থেকে হরিণ, কেউ শুয়ে বা বসে থাকলে খেতে পায় না। প্রতিটা দিন প্রতিটা প্রাণীর জন্য অনিশ্চিত। সিকিয়োরিটি মানুষের তৈরি করা একটা মিথ, একটা মিথ্যে। তার পিছনে জীবনভর দৌড়ে মরব কেন বলো তো?”

“তুমি সেই একইরকম পাগল রয়ে গেলে মনে হচ্ছে। তবু একটা কথা আবারও না বলে পারছি না। তোমাকে দেখার পর থেকে প্রতি ক্ষণ আমি শুধু তোমাকেই ভালবেসেছি। এমনকী, রঞ্জিতের সঙ্গে থাকতে-থাকতেও। ফিলাডেলফিয়ার খবরটা কানে আসা ইস্তক আমি খুব এক্সাইটেড। তোমার সাফল্যে নিজের থেকে অনেক বেশি খুশি হতাম চিরকাল। আজও হই। প্লিজ় রিফিউজ় কোরো না অফারটা। অ্যাকসেপ্ট অ্যান্ড জয়েন। আমাকেও কাছাকাছি যেতে হেলপ করো। একটা কাগজে সই করেছি বলে কিচ্ছু বদলায় না। মন্ত্র-আমি-তুমি এক সুতোয় বাঁধা। ছিলাম, আছি, থাকব।”

মন্ত্রকে হাসপাতালে ভর্তি করেই যখন ফোন করেছিলেন উত্তরণ, অনসূয়া ফোনটা ধরতে পারেনি। মন্ত্র যে চার মাস ফস্টার কেয়ারে ছিল, সপ্তাহে একদিন করে খোঁজ নিত। হয়তো বৈদেহী ছিল বলে… হয়তো রঞ্জিতের সঙ্গে সম্পর্কটার চিতা পুরোপুরি জ্বলে ওঠেনি তখনও। হয়তো উত্তরণের অপারগতায় ওঁর প্রতি সঙ্গত ক্ষোভ জমে ছিল অনসূয়ার অন্তরে। হয়তো উত্তরণকেই দায়ী ভাবত, নিজের জীবনের সব দুর্বিপাকের জন্য।

উত্তরণ আর কারওর বিচার করতে চান না।

কারওর বিচারের পরোয়াও করেন না।

ঠাকুর ছাড়া।

৩১

মেয়ের হাত ধরে সত্যসেবী আশ্রমে ঢোকার মুহূর্তে উত্তরণের মনে হল, পরিবর্তন বাদ দিয়ে কিছুই চলতে পারে না, কোনও আশ্রমও নয়। তবু তার ভিতরেই থেকে যায় অনেক কিছু, যা অপরিবর্তনীয়। ওই তো সেই ছাতিমগাছটা, এখনও একইরকম। সারা গায়ে মানতের সুতো নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মানত যাদের পূর্ণ হয়, তারা এসে সুতোগুলো খুলে দিয়ে যাবে, এমনটাই নিয়ম। কিন্তু খুলতে যদি কেউ আসেও, সে কি নিজের বাঁধা সুতো নিজে চিনতে পারে? নাকি যার মানত পূর্ণ হয়েছে, সে মানত পূর্ণ না হওয়া একটা লোকের সুতো খুলে দিয়ে চলে যায়? এই পূর্ণ, অপূর্ণ, পাওয়া, না-পাওয়ার মধ্যেই সবাই বেঁধে রেখেছে ভগবানকে। তাঁরই বা মুক্তি কোথায়? চাইলেও কাকে সরিয়ে দিতে পারবেন তিনি নিজের থেকে? একাত্ম হবেনই বা কার সঙ্গে?

ভজন-কুটির আজ আশ্চর্য ফাঁকা। বহুদিন পর ধুতি-পাঞ্জাবি পরা উত্তরণের শিহরন জাগছিল সেখানে প্রবেশ করতে। ওই রত্নবেদিতেই তো বসতেন ঠাকুর, যেখানে তাঁর জ্যোতির্ময় প্রতিকৃতি রাখা এখন। গলায় রজনীগন্ধার মালা ঝুলছে। স্বয়ং ঠাকুরই যেন বসে আছেন। সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করলেন উত্তরণ, পাদুকায় মাথা রেখে। আমেরিকায় থাকতেই বাবার দেখাদেখি প্রণাম শিখে গিয়েছিল মন্ত্রও। প্রণাম করে উঠে সে-ও উত্তরণের পাশে বসল। অনসূয়ার হাত ধরে যে ভজন-কুটিরে এসে প্রণাম করে যেতে পারেননি, আজ অনসূয়া আর এঁর মেয়ে, মন্ত্রকে সঙ্গে নিয়ে সেখানে আসতে পেরেছেন উত্তরণ। না-পাওয়ার মধ্যে দিয়েই তো পাওয়া। আনন্দের ভিতর যন্ত্রণা জেগে না থাকলে, সে কেমন আনন্দ?

বেশ কিছুক্ষণ জপ করার পর উত্তরণের মনে হল, আজ ওঁর কণ্ঠস্বর যেমন ঠাকুর অবধি পৌঁছয় না, মেয়েটার আওয়াজও তেমনই পৌঁছয় না নিজের বাবার কাছে। পৌঁছলে সে তো বলতই, চার মাস অন্যের বাড়িতে কেমন ছিল। উত্তরণের মতোই ওঁর মেয়েটাও অসহায়, এই যোগাযোগ অসম্ভব বিশ্বসংসারে।

ভাবনায় ছেদ পড়ল একটি শব্দে। কোথা থেকে এল শব্দটা? উত্তরণ চমকে গিয়ে দেখলেন, ওঁর পাশে বসে মন্ত্র উচ্চারণ করছে, ব্রহ্মচারী ঠাকুরের বীজমন্ত্র। নিখুতভাবে। যে মন্ত্র, উত্তরণ, বিন্দুমাত্র আশা ছাড়া নিজের মেয়ের কানে দিয়েছিলেন এক সকালে, সেই মন্ত্রই ঠাকুরের ভজন-কুটিরে বসে ফিরিয়ে দিচ্ছে ওঁর বোবা মেয়ে। আপাতভাবে এতে অলৌকিক কিছুই নেই। বীজমন্ত্র তো একাক্ষরা; আর বোবারাও এক-দেড় অক্ষর দিব্যি উচ্চারণ করতে পারে। কিন্তু আজ এখানে ওই একটি অক্ষরের উচ্চারণ যেন মহাপৃথিবী আর মহাপ্রকৃতিকে মিশিয়ে দিচ্ছে।

উত্তরণের রোম খাড়া হয়ে উঠল। শরীরের ভিতর দিয়ে চারশো চল্লিশ ভোল্ট বিদ্যুৎ দৌড়তে লাগল। যে মেয়ে কপাল কেটে রক্ত গড়ালেও স্পষ্ট করে বলতে পারেনি কিছু, সে আজ নির্ভুল উচ্চারণ করছে ওই মহামহিম মন্ত্র! ওই বীজমন্ত্র যেন বেদ-উপনিষদের সবক’টা স্তোত্রের অধিক হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে হাওয়ায়। যা উচ্চারণ করা নিষেধ, বাকশক্তিরহিত কন্যার কণ্ঠে তা-ই হয়ে উঠেছে পরম প্রার্থনা। জীবনে আর কী দেখা বাকি রইল উত্তরণের?

ক্ষমা করেছেন ঠাকুর ওঁকে। সব অপরাধ, সমস্ত ভুল, অবান্তর উচ্চাশা, অপ্রয়োজনীয় নেশা, সব ক্ষমা করে দিয়েছেন। আবারও একবার প্রতিষ্ঠার গরাদ ভেঙে জামিন করিয়ে এনেছেন। আর এনেছেন যখন, তখন আবারও সত্যসেবী আশ্রমেই থাকার অনুমতি চাইবেন উত্তরণ। গোয়ালে গোবর সংগ্রহ করবেন, উঠোনের পাতা কাচাবেন, আশ্রমে আসা ভক্ত-শিষ্যদের জুতো সামলে রাখবেন, স্বপনে-শয়নে-জাগরণে নাম করবেন। নাম, তাঁর নাম। নামই শক্তি, নামই মুক্তি।

মন্ত্র, বীজমন্ত্র উচ্চারণ করল আবার। আবারও। উত্তরণ ঠাকুরকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করলেন ফের একবার। তারপর মেয়ের হাত ধরেই উঠে দাঁড়ালেন। দু’জনে ধীর পায়ে একসঙ্গে ভজন-কুটিরের বাইরে বেরোলেন।

‘সিটি অফ ব্রাদারলি লাভ’ ফিলাডেলফিয়া নয়, তা এই সত্যসেবী আশ্রম। এখানেই তো সম্পূর্ণ অপরিচিতরা গুরুর আশ্রয়ে এসে পরস্পরের ভাই হয়ে ওঠে। ঠাকুরও তাই কৈশোরেই এখানে আসা বুবাইকে আবার ফিরিয়ে নেবেন, নিজের রাতুল চরণে। মেয়েটাকে উত্তরণ এখানকার কোনও স্পেশাল স্কুলে পড়াবেন, তারপর বড় হয়ে সে নিজের জন্য কোন দেশ বেছে নেবে, সেটা সে আর তার ঈশ্বর মিলে ঠিক করবে।

গায়ক যেমন নিজের সবথেকে জনপ্রিয় গান রোজ গায় আর রোজই হাততালি পায়, ঈশ্বরের কৃপাও তেমন বারবার করে উত্তরণের জীবনে সত্যি হয়েছে। ওঁর দুঃখ আর অপমানে ঈশ্বর নিজের স্বাক্ষর রেখে গিয়েছেন। সেই স্বাক্ষরে শুধু ইনিশিয়াল নয়, পূর্ণতাও দেখতে পেলেন উত্তরণ আজ। যদি কোনও আঘাত ঠাকুরকে দিয়ে থাকেন, ঠাকুর তাকেও ভালবাসায় বদলে ফিরিয়ে দিলেন। তাই কি ওঁর জীবনে শব্দই হয়ে উঠল মন্ত্র?

কাল সকালে এসে উত্তরণ কথা বলবেন আশ্রমের বর্তমান সভাপতির সঙ্গে। আজকের সন্ধ্যাটা ঠাকুর আর মন্ত্রেরই থাক। ভাবতে-ভাবতে মেয়ের হাত ধরে আশ্রমের গেট পেরোতেই উত্তরণের খেয়াল হল, আজ কোনও প্রণামী ছাড়াই এঁরা দু’জন প্রণাম করে এসেছেন ব্রহ্মচারী ঠাকুরকে। একদম খালি হাতে।

তবে কি আবার ফিরে যাবেন?

তখনই বিদ্যুতের মতো মাথায় ঝিলিক দিল, ঠাকুরেরই একটা কথা।

“আত্মোৎসর্গের থেকে বড় কোনও নিবেদন হয় না, তা জেনো।’

মেয়ের হাতটা শক্ত করে ধরলেন উত্তরণ।

সন্ধ্যার শাঁখ বেজে উঠল চরাচরে।

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *