১৫
অন্য কিছু হলে উত্তরণ কিছুতেই রাজি হতেন না, কিন্তু সঞ্জয়দা যে দুর্গাপুজো করার অনুরোধ নিয়ে এসেছিলেন! কীভাবে ‘না’ বলতেন উত্তরণ? সঞ্জয়দার মুখে কথাটা শুনেই চলে গিয়েছিলেন সেই সময়ে, যখন ব্রহ্মচারী ঠাকুর ওঁকে বিশুদ্ধানন্দজির সহযোগী হিসেবে দুর্গাপূজা করতে পাঠাচ্ছেন, যাদবপুরের এক বারোয়ারি পুজোয়। সেখানকার পূজা যিনি করবেন বলে ঠিক ছিল, হঠাৎ করে মা মারা যাওয়ায় তিনি পুরোহিত হতে অসমর্থ হয়ে পড়েন সে-বছর। কিন্তু দুর্গাপুজো যাতে বন্ধ না হয়, তা নিশ্চিত করতেই ঠাকুর তাঁর একজন সন্ন্যাসীকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। তন্ত্রধারক হিসেবে উত্তরণকে দিয়েছিলেন সঙ্গে।
“একজন সন্ন্যাসীকে ক্লাবে পুজো করতে পাঠাচ্ছেন?” বিজয়দা এসে জিজ্ঞেস করেছিলেন ঠাকুরকে।
“প্রয়োজন হলে আমি নিজে যেতাম। মায়ের পূজার থেকে বড় তো এই গেরুয়া বস্ত্রটা নয়?” ঠাকুর উত্তর দিয়েছিলেন।
বিজয়দা আর কিছু না বলে, সরে গিয়েছিলেন সামনে থেকে।
সঞ্জয়দা যখন উত্তরণকে বলছিলেন যে তিনি আটলান্টার ভিড় থেকে, চেনা বাঙালিদের থেকে দূরে সরে যেতে চাইছেন, একটু শান্তি পেতে চাইছেন নতুন একটা দুর্গাপুজোর সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে, উত্তরণ ভাবছিলেন বলবেন যে অচেনা বাঙালিরাও তো চেনা হয়ে উঠবে শিগগিরই। তখন তাদের থেকে কোথায় পালাবেন? নাকি জীবনভর এই পালানোর খেলা চলতেই থাকবে?
বলেননি, কারণ লোকটা যে মাতৃ-আরাধনার কথা বলতে এসেছিল। আটলান্টা থেকে কম-বেশি সত্তর কিলোমিটার বা তেতাল্লিশ-চুয়াল্লিশ মাইলের দূরত্বে গ্রিফিন শহরে বসবাস করা পঁচিশ-তিরিশ ঘর বাঙালি এ বছরই প্রথম নিজেরা মিলে দুর্গাপুজোর আয়োজন করেছে। নামে বারোয়ারি হলেও, একেবারেই ঘরোয়া একটা পূজা। দুনিয়ার সব বাঙালির সঙ্গেই যেহেতু কোনও না কোনওভাবে সঞ্জয়দার যোগাযোগ, তাই ওখানকার উদ্যোক্তারা ওঁকেই ধরেছিল পুরোহিত জোগাড় করে দেওয়ার জন্য। সেই অনুরোধ আসামাত্রই সঞ্জয়দার মনে পড়েছে উত্তরণের কথা।
চার দিনের পুজো দু’দিনে করার ব্যাপারে রীতিমতো দ্বিধা ছিল উত্তরণের, কিন্তু ‘যস্মিন্ দেশে যদাচার’-এর ধুয়ো তুলে সঞ্জয়দা ওঁকে রাজি করিয়ে ফেললেন। সঞ্জয়দার পক্ষে বোঝা সম্ভব ছিল না যে উত্তরণের কাছে এই প্রস্তাবটা গুরুদেবের নির্দেশ হয়েই এসেছে, মা দুর্গার পূজার মধ্যে দিয়ে উত্তরণ আর-একবার ফিরে যাওয়ার রাস্তা পেয়েছেন নিজের শৈশবে, যেখানে মহাষ্টমীর দিন ব্রহ্মচারী ঠাকুর স্বয়ং যজ্ঞে বসতেন এবং সেই যজ্ঞের বিভূতি পাওয়ার জন্য হুড়োহুড়ি পড়ে যেত ভক্ত-শিষ্যদের মধ্যে।
গ্রিফিন শহরটার মধ্যে বলার মতো তেমন কিছুই নেই, শুধু সত্যদাস বলে এক আমেরিকান বাবার ডেরা আছে কাছাকাছি। এই ভদ্রলোক নাকি যৌবনে ঘোর নাস্তিক ছিলেন এবং তেড়ে নেশাভাঙ করতেন। একবার ভারতে গিয়ে কোন এক সন্ন্যাসীকে এলএসডি খাইয়ে মজা দেখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেই সন্ন্যাসী এলএসডি হজম করে বসেছিলেন সাহেবের সামনে, বিন্দুমাত্র বিকার হয়নি তাঁর। ওই একটি ঘটনায় রবার্ট স্যামসন নিজের পুরনো পথ ছেড়ে ভারতীয় আধ্যাত্মিকতার রাস্তা বেছে নেন। আমেরিকার নানা প্রান্ত ঘুরে নিজের জন্মস্থান গ্রিফিনেই ফিরে আসেন জীবনের উপান্তে। খুব বেশি লোক যে তাঁর বাড়ি চেনে তা নয়, তবে দশ-কুড়িজন লোকের ভিড় সবসময়ই লেগে থাকে সেখানে, কারণ প্রতি উইকএন্ডে নামগান হয় ওই বাড়িতে। আমেরিকার একটা ছোট্ট শহরে এসে ‘হরে-কৃষ্ণ, হরে-রাম’ শুনতে পাবেন, স্বপ্নেও ভাবেননি উত্তরণ। কিন্তু গ্রিফিনে পা রেখে একটা শুক্রবারের বিকেলে খোল-করতালের আওয়াজ আর তারকব্রহ্ম নাম সংকীর্তনের মধ্যে ঘণ্টাখানেক কাটিয়ে বেরিয়ে আসার সময় মনে হচ্ছিল, আমেরিকায় পা রাখাটা এঁকে ‘রিলিজ’ করে দেয়নি, বরং আরও পোেক্ত একটা বাঁধনে বেঁধেছে গুরুদেবের সঙ্গে। তাই প্রায় প্রতিটি রাস্তার মোড়েই তিনি ঠাকুরের ইচ্ছাকে ফলবতী হতে দেখছেন নিজের জীবনে।
“দু’-একটা চমৎকার জায়গা আছে ধারেকাছে। রাতের দিকে তোমাকে ঘুরিয়ে নিয়ে আসব।” সঞ্জয়দা বললেন।
উত্তরণ বললেন, “আমার যা দেখার ছিল, দেখা হয়ে গিয়েছে। আপনি আমায় পুজোর জায়গায় নিয়ে চলুন।”
কোত্থেকে একটা ‘পুরোহিত দর্পণ’ জোগাড় করে এনেছিলেন সঞ্জয়দা। কিন্তু চার দিনের পুজো আড়াই দিনে করার ফ্যাচাং অনেক। তার উপর পূজার নির্ঘণ্ট নয়, শনি-রবির সুবিধা দেখে পুজো করতে হয় বলে এখানে তিথি ধরে সংকল্প করা যায় না। কারণ যে শনিবার অষ্টমীর অঞ্জলি দেবে এখানে প্রবাসীরা, আসলে সেদিন হয়তো একাদশী তিথি। তবু ঈশ্বর যেমন এক পলের ভিতরে কোটি কল্পান্ত ভরে দেন, উত্তরণও তেমন নিজেকে ঈশ্বর ভেবে তিথি-নক্ষত্ৰ-বিধানের পরোয়া না করেই পুজো শুরু করলেন। দেবী দুর্গার প্রাণপ্রতিষ্ঠা কবে যে মানুষ, তাকে তো ঈশ্বর হতেই হবে!
স্মৃতিকে যতদূর সম্ভব ধারালো করে সেই বেলগাছটার কাছে নিয়ে গেলেন উত্তরণ, যার তলায় বসে আশ্রমের প্রবীণ সন্ন্যাসী বিশুদ্ধানন্দজি দেবীর বোধন করেছিলেন কখনও।
আচমনের পর বিষ্ণুস্মরণ, স্বস্তিবাচন… তারপর একে-একে স্বস্তিসূক্ত পাঠ, সংকল্প, ঘটস্থাপন, ভূপসারণ, মাতৃকান্যাস, গঙ্গা-যমুনা-লক্ষ্মী-সরস্বতী বন্দনা, পুজোয় নিজেকে হারিয়ে ফেললেন উত্তরণ। যখন উচ্চারণ করছিলেন, “তামগ্নিবর্ণাং তপসা জ্বলন্তীং/বৈরোচনীং কর্মফলেষু জুষ্টাম।/ দুর্গাং দেবীং শরণমহং প্রপদ্যে/ সুতরসি তরসে নমঃ,” উত্তরণের শিরায়-শিরায় একটা লাভাস্রোত বয়ে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, দুর্গম ভবসাগর থেকে উদ্ধার করবে বলে নৌকা চালিয়ে তাম্রবর্ণা একটি মেয়ে এসে উপস্থিত হয়েছে, গ্রিফিন শহরের ওই হলে। দেখতে না পেলেও, তাকে অনুভব করছে অনেকেই। সেই মেয়েটিই সব মেয়ের অন্তরে, আবার সব মেয়ের আশ্রয়ও সেই মেয়েটিই। কালিকাপুরাণ তাই বলছে, যিনি যোগনিদ্রা মহামায়া, তিনিই জগদ্ধাত্রী জগন্ময়ী। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ জানাচ্ছে, অম্বিকা, বৈষ্ণবী, গৌরী আর পার্বতীর মধ্যে কোনও তফাত নেই। ব্রহ্মার শক্তিস্থল যে ব্রহ্মাণী, সে-ই আবার নারায়ণের শক্তির উৎস নারায়ণী। যে মহামায়া, সে-ই মহালক্ষ্মী।
পুজোর সঙ্গে-সঙ্গে শাস্ত্রের ব্যাখ্যা দিয়ে যাচ্ছিলেন উত্তরণ। অঞ্জলির মন্ত্র পড়ানোর সময় বলছিলেন প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বাক্যের মানে। উপস্থিত প্রত্যেককে একাত্ম করে নিতে চাইছিলেন আরাধনায়।
ফলও হচ্ছিল নিশ্চয়ই। নইলে এক ফাঁকে সঞ্জয়দা এসে বলবেন কেন, “সবাই বলছে, এরকম পুজো কখনও দেখেনি। তোমাকে প্রণাম করার জন্য খেপে উঠেছে সব ইয়ং মেয়েরা। কোথায় জড়িয়ে ধরবে, তা নয়…”
সঞ্জয়দাকে থামিয়ে দিয়ে উত্তরণ বললেন, “মা দুর্গাকে প্রণাম করতে বলুন, তা হলেই হবে।”
সঞ্জয়দা এক মুহূর্ত চুপ করে গিয়ে বললেন, “কমলিকা এলে খুব আনন্দ পেত।”
“নিয়ে এলেন না কেন কমলিকাদিকে?”
“আসবে ভেবেছিল। কিন্তু আমার সঙ্গে এলেই এখানকার অনেকে কৌতূহলী হয়ে উঠত। কমলিকা তখন নিজের কী পরিচয় দিত?”
পরিচয়? মা দুর্গার কাছে আসতেও পরিচয় জরুরি? সত্যি, পৃথিবীর নিয়ম অদ্ভুত! উত্তরণ নীরব হয়ে গেলেন।
“কিন্তু তোমার মন্ত্রপাঠ ইত্যাদির যেহেতু ভিডিয়ো রেকর্ডিং হচ্ছে, কমলিকা পরে সবটাই দেখতে পাবে। দুধের স্বাদ ঘোলেই মেটাক আপাতত। তবে আমার কপাল ভাল বলতে হবে। সেই কোন ছোটবেলায় পড়েছিলাম, ‘ত্বং হি দুর্গা দশপ্রহরণধারিণী/ কমলা কমলদল বিহারিণী…’ মাতৃভূমি আর মা এক হয়ে গিয়েছিলেন পড়তে-পড়তে। তুমি যেভাবে পুজো করছ, দেখতে-দেখতে মনে হচ্ছে, দেবী আর দেশ যে শুধু এক হয়ে যায় তা-ই নয়, দেবী আর স্বর্গও এক হয়ে যায় সময়-সময়।” সঞ্জয়দার গলা ধরে এল।
নরকের অভিজ্ঞতা আগেও হয়েছে। কিন্তু স্বর্গ যেখানে, সেখানেই যে নরক নেমে আসতে পারে, তার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না উত্তরণ। দর্পণে প্রতিমার বিসর্জন সম্পন্ন করে যখন শান্তিজল দিতে উঠে দাঁড়িয়েছেন, তখনই হুল্লোড় শুরু হল। পুজো চলাকালীন প্রায় সারাক্ষণই একটা ঘোরের মধ্যে ছিলেন বলে উত্তরণ প্রথমে খেয়াল করেননি চিৎকার-চেঁচামেচিটা। কিন্তু শান্তিজল দেওয়া শেষ হয়ে যাওয়ার পরও যখন সেটা থামল না, তখন বিরক্ত হয়ে হলের যেদিক থেকে আওয়াজটা আসছিল, সেদিকে তাকালেন একবার।
মাতালটা ততক্ষণে চিৎকার করতে-করতে মা দুর্গার বেদির কাছে চলে এসেছে। পিছন থেকে দু’-তিনজন টেনে ধরে রাখতে পারছে না লোকটাকে।
“আমি অন্যায় কী বলছি? আমি তো স্বীকার করছি ও হেব্বি পুজো করেছে। আমি জাস্ট বলতে চাইছি যে, এই লোকটার বহুমুখী প্রতিভা। পর্নোগ্রাফিটাও দারুণ করে।”
কথাটা মুখ দিয়ে বেরোনোমাত্রই সঞ্জয়দা ঠাসিয়ে একটা চড় লাগিয়ে দিল ছেলেটার গালে, “এক্ষুনি চুপ কর, ইতর কোথাকার!”
ছেলেটা ঝাঁঝিয়ে উঠল, “ভুল বলছি নাকি? মিথ্যে বলছি? আমি আর আপনাদের পুরোহিত একটা রাত্রি সেম লক-আপে ছিলাম না? ও অবশ্য টান্টু মাল, পরদিন সকালেই ম্যানেজ করে ছাড়া পেয়ে গিয়েছিল, আমাকে শালা তেইশ দিন কয়েদ থাকতে হয়েছিল। কিন্তু চার্জ তো একই ছিল দু’জনের বিরুদ্ধে — পর্নোগ্রাফি বানানো আর ছড়ানো। সেই অপরাধে, ধারা কত ভুলে গেছি এখন, আমি আর উনি…কী ঠাকুরমশাই, একবার একটু সাড়া দাও! নইলে সবার সামনে বেইজ্জত হয়ে যাচ্ছি তো! জাস্ট বলল যে তুহিন ঘোষ আর তুমি একসঙ্গে, এক লক-আপে রাত কাটিয়েছ! যদি বাপ-কা-বেটা হও, তা হলে বলো।”
উত্তরণ স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে রইলেন ছেলেটার দিকে। এই ছেলেটাই ছিল সেদিন রাত্রে ওঁর পাশে? কেন তবে কিছু মনে করতে পারছেন না? কিন্তু ছেলেটা যখন এত জোর দিয়ে বলছে, তখন নিশ্চয়ই এও ছিল ওঁর সঙ্গে সেই কালরাত্রিতে!
কী করবেন এখন উত্তরণ? সবার সামনে স্বীকার করবেন সেই কথা? কিন্তু স্বীকার করার সঙ্গে-সঙ্গেই অর্ধসত্যটা যে সত্যি হয়ে যাবে! উত্তরণ হাজতে ছিলেন, এই কথা যারা শুনবে, তাদের একজনও কি মানবে যে বিনা দোষে হাজতে যেতে হয়েছিল ওঁকে? এবং পুলিশ ছেড়ে দেওয়ার সময় দুঃখপ্রকাশ করেছিল? উত্তর যদি, ‘না’ হয়, তা হলে সত্যসেবী আশ্রমের একজন শিষ্য হিসেবে মিথ্যাকে কীভাবে উনি সত্যের প্রতিষ্ঠা দেবেন? আবার এই তাণ্ডবের সামনে চুপ করেই বা থাকবেন কেমন করে?
মদ খেলে মানুষ বেশি বকে, উত্তরণ আমেরিকাতে এসেই খেয়াল করেছেন। তুহিন ঘোষও অনর্গল বকে যাচ্ছিল। ওর ওই বকবকানিতে সেই রাত্রিটা সহস্র ফণা মেলে কালনাগ হয়ে উঠল গ্রিফিন শহরের বুকে। সত্যসেবী আশ্রম থেকে দূরে, কলকাতা থেকে কত দূরে, সেই ঘটনার সময়কাল থেকে বহুদূরে দাঁড়িয়েও উত্তরণ নিজের মুখে-চোখে আগুনের ঝাপটা টের পেতে লাগলেন। ক্যানসার যেমন রিল্যাপস করে, ওই বিভীষিকা যেন সেভাবেই রিল্যাপস করল। এরপর এখান থেকে ওই ছেলেটার বকে যাওয়া শব্দগুলো চার থেকে আট, ষোলো থেকে চৌষট্টি হবে। ওগুলো তাড়া করবে উত্তরণকে, ঘিরে ধরবে… রটনা হয়ে, কুৎসা হয়ে। যে কুৎসার ভয়ে কমলিকাদি সঞ্জয়দার সঙ্গে দুর্গাপুজোয় যোগ দিতে আসতে পারেননি গ্রিফিনে, সেই কুৎসাই উত্তরণকেও একটা গর্তে নিয়ে গিয়ে ফেলবে। মাটি চাপা দিয়ে মারবে ওঁকে। কুৎসা যারা শোনে তারা বিচার করে না তার পিছনে ভিত্তি আছে না নেই। লোকে কুৎসা বিশ্বাস করতে চায় বলেই তার এত বাজার।
কিন্তু উত্তরণ অন্ধের মতো বিশ্বাস করেছিলেন, ঠাকুর ওই অমানিশার স্মৃতি আর ফিরতে দেবেন না ওঁর জীবনে। কখনও আর ওই বিষবাষ্প ছুঁয়ে যাবে না ওঁকে৷ তা হলে? দুর্গাপূজা করতে এসে কি কোনও অন্যায় করেছেন? যদি না করে থাকেন, তবে কেন? কেন অকারণে ওঁকে সহ্য করতে হবে, না-করা অপরাধের গ্লানি? দেশ পেরিয়ে বিদেশেও? সারা জীবন হয়তো এই ময়লা কলুষিত করবে উত্তরণকে, যদি না জীবন শেষ হয়ে যায় এখনই, এখানেই।
উত্তরণ এই চিৎকার এবং ঝামেলা সহ্য করার মতো মানসিক অবস্থায় ছিলেন না। সঞ্জয়দা ব্যাপারটা বুঝতে পেরেই গাড়িতে ওঁকে বসিয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন গ্রিফিন থেকে। স্টার্ট দিয়ে শুধু বললেন, “কোথাকার কোন মাতাল-দাঁতাল কী বলল, তাতে বেশি পাত্তা দিয়ো না। তুমি যা খেল দেখিয়েছ, তাতে গোটা গ্রিফিন মুগ্ধ। আমার ধারণা মা দুর্গা নিজেও। আই অ্যাম রিয়েলি প্রাউড অফ ইউ।”
“মা দুর্গা যা খেল দেখালেন, তাতে আমিও মুগ্ধ।” উত্তরণ হেসে উঠলেন।
ওঁর ওই কথা আর হাসির মধ্যে কি অস্বাভাবিক কিছু ছিল? নইলে গাড়ি স্লো করে ওঁর দিকে তাকালেন কেন সঞ্জয়দা?
“কী হয়েছে তোমার উত্তরণ? একটা ফালতু ঘটনাকে তুমি এত গুরুত্ব দিচ্ছ কেন? লোকে তোমার করা, শ্লোকগুলোর ব্যাখ্যা নিয়ে কথা বলছে। অমন উচ্চারণ আর ওরকম বিশ্লেষণ জীবনে শোনেনি ওরা। আর তুমি ওই পাগলের প্রলাপ নিয়ে…”
“আজকে যারা কথাটাকে পাগলের প্রলাপ মনে করছে, কাল তাদেরই মনে সংশয় জাগ্রত হবে! তারা তো লোকটাকে বহুদিন ধরে চেনে। সে তো গ্রিফিনে আমার মতো আগন্তুক নয়। ওদের প্রতিবেশী। এবার সেই লোকটা মাতাল অবস্থাতে নতুন পুরোহিতের সম্বন্ধে যা বলল, তা কেন বলল? কিছুই কি সত্যতা নেই তার মধ্যে? লোকজন ভাববেই।”
“ভাবলে ভাববে! কে কী ভাবল না ভাবল, তা নিয়ে তোমার কী? বিখ্যাত লোকেদের নিয়েই ভুলভাল গল্প ছড়ায়। আর তুমি এখন বিখ্যাত! আমি হলফ করে বলতে পারি। শুধু গ্রিফিনে নয়, আটলান্টাতেও। পরেরবার আটলান্টার দু’-তিনটে পুজো কমিটি তোমায় অ্যাপ্রোচ করবে, মিলিয়ে নিয়ো।”
সঞ্জয়দা ভবিষ্যতের কথা বলছিলেন, আর উত্তরণ ভাবছিলেন অতীতের কথা। স্পষ্ট টের পাচ্ছিলেন যে ওই অতীত ওঁকে ছাড়বে না। গুরুদেব বলেছিলেন, সাধনপথ থেকে বিচ্যুত না হতে। কিন্তু ওই কয়েক ঘণ্টা উত্তরণকে এমন ধাক্কা মেরেছে যে তিনি সাধনপথ শুধু নয়, সুস্থ স্বাভাবিক জগৎ থেকেই একেবারে ছিটকে সরে গিয়েছেন। আর কখনও ফিরতে পারবেন না।
“তুমি কী ভাবছ বলো তো?” আটলান্টায় ঢুকতে-ঢুকতে সঞ্জয়দা জিজ্ঞেস করলেন।
উত্তরণ ততক্ষণে চোখ বন্ধ করে ওঁর ঘরের খাটের নীচে থাকা ইনসেক্ট কিলারের বোতলটা দেখতে পাচ্ছেন। ঘরে কোনও পোকাই নেই, তবু ডিপার্টমেন্টাল স্টোর থেকে কিনেছিলেন বোতলটা। এইভাবে কাজে লাগাবেন বলে?
“উত্তরণ, এবার কিন্তু আমার রাগ হচ্ছে তোমার উপর।”
“আচ্ছা সঞ্জয়দা, যদি শোনেন যে সত্যিই আমি পর্নোগ্রাফিক র্যাকেটের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে একটা রাত্রি হাজতে ছিলাম, অভিযোগটা যাচাই করার আগেই ঘেন্না করতে শুরু করবেন আমায়?”
“এই প্রশ্নের উত্তরটা তুমিও জানো৷ তাই কথা বাড়ানো অবান্তর।”
“এড়িয়ে যাবেন না প্লিজ়। উত্তরটা জানা দরকার।”
“এড়িয়ে যাচ্ছি না তো। ওই তুহিন, গতকাল রাতে আমার কাছে এসেই ওর আষাড়ে গপ্পো ফেঁদে বসেছিল। তখন যেমন পাঁচ মিনিটের মাথায় ভাগিয়ে দিয়েছিলাম ওকে, ভবিষ্যতেও…”
“গতকালও এই নিয়ে কথা হয়েছে?”
“আর সবকিছুর মতো, কুৎসারও একটা প্রস্তুতি থাকে, ভুলে যেয়ো না। যারা সবার সামনে কারওর নামে কুৎসা করবে ঠিক করে, তারা আগে দু’তিন জনের সামনে কথাগুলো বলে দেখে নিতে চায়, কেমন রেসপন্স আসছে। কাল আমি ওকে থ্রেট দিয়ে দূর করে দিয়েছিলাম একরকম। তারপরও ও কীভাবে সাহস পেল, জানি না?”
“কিন্তু আমি তো ওই ছেলেটার কোনও ক্ষতি করিনি। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে পুলিশ আমায় তুলে নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বিশ্বাস করুন…”
“স্টপ ইট। তুমি বলবে তারপর তোমায় বিশ্বাস করব আমি? তুহিন যেটা করেছে, সেটা কেন করেছে বোঝার জন্য আইনস্টাইন হওয়ার দরকার নেই।”
“কেন করেছে?”
“হিংসে। পাতি হিংসে। ও তিন বছর এই শহরে থেকে যা পায়নি, তুমি একদিনে সেই সম্মান, সেই প্রতিপত্তি পাচ্ছ, সেটা ওর সহ্য হয়নি। আর হয়নি বলেই জেলে থাকার বৃত্তান্ত শুনিয়ে ও তোমার বদনাম করতে চাইছিল। আর সেই নোংরামিটাকে আউটবার্স্ট হিসেবে দেখানোর জন্য মাতাল হয়ে কিংবা সেজে এসেছিল।”
“বদনাম তো করে দিল সঞ্জয়দা। শেষ করে দিল আমায়।”
“তুমি এবার নামো তো গাড়ি থেকে। তোমার ঘর এসে গিয়েছে। ভাল করে ঘুমোও। কাল-পরশু এসে আমি স্বামী বিবেকানন্দের উপর একটা বই দিয়ে যাব। স্বামীজি সম্বন্ধে যদি ‘মিট ইটিং সোয়ামি’, ‘হ্যাজ় মেনি ফরেন গার্লফ্রেন্ডস’ লিখতে পারে সেই সময়ের নিন্দুকেরা, তা হলে তুমি কোন হরিদাস পাল? পাত্তা দিয়ো না, স্রেফ পাত্তা দিয়ো না।”
“আপনি পাত্তা দেন না? যখন আপনার আর কমলিকাদির নামে…”
“আমার তো সন্ন্যাসী বা ব্রহ্মচারীর ট্রেনিং নেই। তোমার আছে। তুমি দেবে কেন? জাস্ট ফরগেট।” গাড়ি ঘুরিয়ে চলে যাওয়ার আগে বলে গেলেন সঞ্জয়দা।
উত্তরণের মনে দাগ কাটল না কথাগুলো। বরং ওই ইনসেক্ট কিলারের বোতলটা ওঁকে টানতে লাগল। উত্তরণ স্বামীজি নন। ব্রহ্মচারী ঠাকুরও নন। তাই পারবেন না। কুৎসার এই সাইক্লোন নিতে পারবেন না। তার চেয়ে নিজেকে শেষ করে দেবেন। বোতলটা কিছু তো কাজে লাগুক।
লিফটে ওঠার আগে, “মুখার্জি, মুখার্জি” শুনে রিসেপশনে বসা মেয়েটার দিকে তাকালেন উত্তরণ। জেনিফার ওঁকে ইশারায় ডাকল। উত্তরণ সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই একটা সাদা খাম ধরিয়ে দিল হাতে।
খামের উপরে কিছুই লেখা ছিল না, উত্তরণের নামটাও নয়। খামটা ছিঁড়ে চিঠিটা পেতেই তাই চমকে গেলেন উত্তরণ। সত্যসেবী আশ্রমের বর্তমান সভাপতি বিরজানল, মানে অনিলদা চিঠি লিখেছেন ওঁকে। তিন-চার লাইনের চিঠি। অনিলদা তাঁর পূর্বাশ্রমের কিছু টাকা উত্তরণের নামে জমা করে রেখেছেন। অনিলদার দেহাবসানের পর, উত্তরণ যেন সেই টাকাটা সংগ্রহ করে নেন, এইটুকুই তাঁর ইচ্ছা। গুরুদেবের কাছে উত্তরণের মঙ্গলকামনা করে অনিলদা চিঠি শেষ করেছেন। কোথাও এতটুকু বাড়তি কথা নেই। একজন সন্ন্যাসী তাঁর সঞ্চিত অর্থ এমন একজনের হাতে দিয়ে যাচ্ছেন, যে আমেরিকায় এসে তাঁকে একটা ফোনও করেনি।
গুরুদেব, আপনি আমায় ভোলেননি! আত্মহত্যা করতে দেবেন না বলে, আজ এই মুহূর্তেই চিঠিটা পাঠিয়েছেন। ভাবতে-ভাবতে উত্তরণের চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ল দু’-এক ফোঁটা কান্না।
“নো ব্যাড নিউজ়, আই হোপ?” জেনিফার ভয়ের গলায় বলে উঠল।
“গুড নিউজ়। বাট হু ব্রট দিস লেটার ফর মি?”
জেনিফার একটা কাগজ ওঁর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, যে এনেছে সে নিজের নামটা লিখে রেখে গিয়েছে এখানে।
উত্তরণ যন্ত্রচালিতের মতো কাগজটা হাতে নিয়ে দেখলেন, একটাই শব্দ বাংলায়। ‘অনসূয়া’।
১৬
হোটেলের ঘরে শুয়ে থাকতে থাকতে উঠে দাঁড়ালেন উত্তরণ। বর্তমান আর অতীত যখন জায়গা বদলাবদলি করে খেলে তখন দিশা পাওয়া যায় না, কোন ঘরে থাকবেন আর কোনটা ছেড়ে আসবেন। সেই রাতেও আর-একটু হলে অন্য একটা ঘরে চলে যাচ্ছিলেন উত্তরণ। জীবন আর মৃত্যু একই বাড়ির ভিতর দু’টো আলাদা-আলাদা ঘরই তো। মৃতেরাও ক্ষেত্রবিশেষে জীবিত, আবার জীবিতরাও মৃত, সময়-সময়। ওঁর ভাই-ই যেমন উত্তরণকে ‘মৃত’ ঘোষণা করে সব সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়েছে। কেন মৃত? না, উত্তরণ ভাইকে আমেরিকায় নিয়ে আসেননি বলে।
অনসূয়ার কথা ভাবতে গিয়ে, ভাইয়ের কথা মনে পড়ে গেল উত্তরণের। কতদিন দেখেননি ছেলেটাকে। দেখা তো দূর, কথাও হয় না আর। তবু কলকাতায় এসেছেন বলেই হয়তো উত্তরণের সেই বাচ্চাটার কথা মনে পড়ছিল, যাকে কাঁধে করে ঘুরেছেন এক সময়। আশ্রমে চলে আসার আগে, মা বেশি অসুস্থ থাকলে, নিজের হাতে ভাত মেখে ভাইকে খাইয়ে দিয়েছেন এক-একদিন। যখন কলকাতায় থেকে কলেজে পড়ত কোনও-কোনও মাসে দু’বার টাকা পাঠাতে হত উত্তরণকে, তখনও একবার আমেরিকা থেকে, দু’সপ্তাহের জন্য দেশে গিয়ে উজ্জীবনকে নিয়ে কামাখ্যায় গিয়েছিলেন, সেখানে হোটেলে ভাত মেখে খাইয়ে দিয়েছিলেন ছোট ভাইকে।
“আমেরিকা কি চিড়িয়াখানা যে চাইলেই নিয়ে আসা যায় কাউকে? আমেরিকায় আসা হয়তো সহজ, কিন্তু থেকে যাওয়ার প্রক্রিয়া অনেক জটিল। সেটা দিন-দিন জটিলতর হচ্ছে।” উত্তরণ তবু বলতে বাধ্য হলেন একদিন।
“গল্প দিস না। আমি একটা টিভি প্রোগ্রামে দেখেছি, লোকে কিউবা থেকে সাঁতরে আমেরিকায় চলে যাচ্ছে, মেক্সিকো থেকে চুপি-চুপি ঢুকে পড়ছে আমেরিকায়। তাদের মধ্যে ক’জন ফিরে আসছে? তুই আমাকে একবার নিয়ে তো চল, তারপর কীভাবে থেকে যেতে হয়, আমি বুঝব।”
“কী করবি তুই, আমেরিকায় এসে? কে চাকরি দেবে তোকে?”
“কেন, তোদের ইউনিভার্সিটিতে পিয়োন-ফিয়োন নেয় না?”
“আমেরিকায় ওইভাবে রিক্রুটমেন্ট হয় না রে।”
“দরকার নেই চাকরির! আমি ট্যাক্সি চালাব, ওই বড়-বড় দোকানগুলোয় ট্রলি ঠেলব, কিছু না কিছু করে ঠিক থেকে যাব।”
“আমি বুঝতে পারছি না, একটা অনার্স গ্র্যাজুয়েট ছেলে হয়ে তুই এতটা অসম্মান মেনে নিবি কেন? তার থেকে তুই দেশে চাকরির চেষ্টা কর, চাকরি না পেলে প্রাইভেট টিউশন…”
“তোর বাতেলা রাখ তো তোর কাছে। দাদা আমেরিকায় নামজাদা প্রফেসর আর ভাই কলকাতায় ফ্যা-ফ্যা করে ঘুরছে, কেউ ভাল চোখে দেখবে?”
“আমি কী করছি, কোথায় আছি তাই দিয়ে তোর বিচার হবে কেন?”
“হবে না-ই বা কেন? রাখীর বাবা-মা চান যে আমি তাঁদের মেয়েকে নিয়ে গিয়ে আমেরিকার কোথাও একটা সংসার পাতি।”
“রাখী কে?”
“আমার উড-বি ওয়াইফ। বলেছিলাম তোকে ওর কথা।”
“তোকে ভালবাসে?”
“অবভিয়াসলি।”
“কিন্তু ভালবাসলে তো আমেরিকায় যাওয়ার উপর সংসার পাতা নির্ভর করবে না। গড়িয়ায় পাতলেই বা ক্ষতি কী? ভালবাসা থাকলে খুব কিছু তফাত হওয়ার তো কথা নয়।”
“এটা তোর ফিলোসফির ক্লাস নয় যে তুই লেকচার দিবি আর আমি বসে-বসে শুনব। কিছু করতে পারবি কি না আমার জন্য, সেটা বল।”
“তুই যেভাবে চাইছিস, সেভাবে হয়তো সত্যিই পারব না।”
“পারবি না, না চাইবি না?”
“দ্বিতীয়টাও ঠিক। আমি চাইব না যে আমার ভাই আমেরিকায় এসে বাসন মাজার কাজ করুক।”
“এটাই আন্দাজ করেছিলাম। তোর মতো স্বার্থপর লোকের কাছে অন্য কিছু আশা করাও অন্যায়। চিরকাল শুধুনিজের স্বার্থই বুঝে এসেছিস। মামরে বেঁচেছে, নইলে মাকেও দেখতিস না। আমাকে বোর্ডিংয়ে রেখে দায় এড়িয়েছিলি…”
“আর কী-কী করেছি বল, বলে হালকা হ।”
“সাধু সাজিস না। সাধু সাজতে আশ্রমে গিয়েছিলি। সেখানেও গুরুদেবের সঙ্গে বেইমানি করে আমেরিকায় পালিয়েছিস। স্বার্থপর না হলে তো ইন্ডিয়ায় থেকে আশ্রমের মঙ্গলঘট কালেকশন করতিস, সেবা করতিস ঠাকুরের।”
“ঠিকই বলেছিস। আচ্ছা আমি যদি আমার স্বার্থপরতাকে বিসর্জন দিই, আবার ভারতে ফিরে এসে আশ্রমবাসী হয়ে যাই, মঙ্গলঘটের চাল তুলতে যাই, গোয়ালঘর পরিষ্কার করি, তুই খুশি হবি?”
“এসব তুই কখনওই করবি না, খালি আমাকে কাটানোর জন্য বুকনি দিচ্ছিস। তুই কত বড় শয়তান, আমি চিনি না? তোর ভালমানুষির মুখোশ খুলে গিয়েছে, আর কাউকে তুই ভোলাতে পারবি না?”
“ভোলাতে চাইলে তো আমেরিকাতেই নিয়ে যেতাম। ভুলে থাকতিস, ভাল ভাবতিস আমায়।”
“তা নিয়ে যাবি কেন? আমি ভাল থাকি, তুই চাস না তো! তবে তুই নিজেও কোনওদিন সুখী হতে পারবি না, বলে দিলাম তোকে। নেভার। মিলিয়ে নিস?” উজ্জীবন চিৎকার করে উঠল।
সেই শেষ কথা ভাইয়ের সঙ্গে। তবু তারপরও উত্তরণ যখনই ডলার পাঠিয়েছেন, তা ব্লটিং পেপারে কালির মতো মিলিয়ে গিয়েছে। সব কথোপকথন, সব সম্পর্ক ভেঙে পড়ার পরেও ডলার হয়তো মাধ্যম হিসেবে কাজ করতে পারে। ডলারই হয়তো সেই ধ্রুবতারা, অনাত্মীয়তার ঘন অন্ধকারেও যা জ্বলজ্বল করে।
অনসূয়ার আমেরিকায় আসতে কত ডলার খরচ হয়েছে, তার কতটুকু স্কলারশিপের টাকা আর কতটা ওর নিজের, উত্তরণ জানেন না। কেবল এটুকু বুঝতে পারেন যে, অনসূয়া আমেরিকায় এসেও ডলারের পরোয়া করবে না, যেমন টাকার তোয়াক্কা করেনি ভারতে থাকতে। উত্তরণের জন্য নিজেকে আর নিজের সবকিছু খরচ করার মধ্যেই ছিল ওর চরম আনন্দ। সেই আনন্দ আবারও পেতে চায় বলেই কি আটলান্টায় ছুটে এসেছিল মেয়েটা?
গ্রিফিন থেকে পুজো সেরে ফেরার পরের ছ’দিন-ছ’রাত্রি অসহ্য উৎকণ্ঠায় কাটালেন উত্তরণ। কাউকে কিছু বলতে পারলেন না, নিজেকে বোঝাতেও অপারগ হলেন। কাজ করতে পারছিলেন না, খেতে-ঘুমোতেও নয়। প্রতি মুহূর্তে মনে হচ্ছিল, এই বুঝি অনসূয়া আসবে, এখন না এলেও একটু পরেই আসবে। তারপর একটা করে দিন যখন পেরিয়েছে, অথচ অনসূয়া আসেনি, উত্তরণের মনে হতে শুরু করল, যে চিরকুটটা তিনি হাতে পেয়েছিলেন, সেটা সত্যিই তো? নাকি কোনও হ্যালুসিনেশন? কিন্তু অনিলদার লেখা ওই চিঠিটা কীভাবে এল? নিশ্চয়ই অনসূয়া আশ্রমে গিয়েছিল আর ওর হাত দিয়ে অনিলদা পাঠিয়েছেন চিঠিটা।
সেটাই স্বাভাবিক, সেটাই হওয়ার কথা। কিন্তু রোববার রাতের পর থেকে শুক্রবার হয়ে গেল, অনসূয়া কোথায়? এল না কেন? কেন একটা ফোনও করছে না উত্তরণের ইউনিভার্সিটিতে?
অনসূয়ার ছবি তো উত্তরণের কাছে নেই। চেহারার বর্ণনা দিয়ে কি একবার মিলিয়ে নেবেন জেনিফারের সঙ্গে, এই মেয়েটাই এসেছিল কি না? লরা যেমন প্রয়োজনের অতিরিক্ত কথা বলত না, জেনিফার অনেকটা খোলামেলা। কথা বলে, উত্তর দেয়। অনসূয়ার আসা নিয়ে দু’-একটা কথা জানার জন্য রিসেপশনে জেনিফারের খোঁজ করলেন উত্তরণ। কিন্তু শুনলেন যে জেনিফার ব্যক্তিগত ছুটিতে আছে। বুকটা ধক করে উঠল উত্তরণের। সেই রাতেও জেনিফার হয়তো ছুটিতেই ছিল, কিন্তু গুরুদেব উত্তরণকে বাঁচিয়ে রাখবেন বলে মেয়েটার প্রতিমূর্তি বসিয়ে রেখেছিলেন রিসেপশনে। ‘অনসূয়া’ লেখা যে কাগজটা গত ছ’দিনে চারশো চবিবশবার নাড়াচাড়া করলেন উত্তরণ, সেটাও হয়তো, অনিলদার চিঠিটার মতোই, ঠাকুরের স্বহস্তে লিখে দেওয়া।
ঠাকুরের ছবির দিকে তাকিয়ে উত্তরণের চোখ জলে ভরে গেল। কিন্তু সেই কান্না যে ঠাকুরের জন্য নয়, সেটা কি ঠাকুরের অজানা থাকল?
আমেরিকায় আসার কয়েকদিন আগে ভিসা সংক্রান্ত কোনও একটা কাজে কলকাতার আমেরিকান কনস্যুলেটে আসছিলেন উত্তরণ। ভোরের বাস ফাঁকা-ফাঁকাই ছিল৷ উত্তরণের ঠিক সামনের সিটে গেরুয়াধারী দুই সন্ন্যাসী বসেছিলেন। উত্তরণ তাঁদের তত খেয়াল করতেন না, যদি না তাঁদের কথাবার্তা কানে আসত।
এক সন্ন্যাসী আর-একজনকে বলছিলেন, “সংসারে আশ্রয় নিতে হতেই পারে, কিন্তু সংসারে জড়িয়ে যাওয়াটা কোনও কাজের কথা নয়।”
“যে আশ্রয় দিল তাকে কী বলব তবে? তার তো একটা আশা তৈরি হতে পারে।
“কিছুই বলবে না। ঈশ্বরের কাছে তার মঙ্গলকামনা করে তুমি তোমার পথে এগিয়ে যাবে। কারওর আশা পূরণ করার দায় তো সন্ন্যাসীর হতে পারে না। সাধন-ভজন করাটা সন্ন্যাসীর কাজ।”
“কিন্তু তাতে যদি মনে আঘাত দেওয়া হয়?
“কেউ মনে আঘাত পেলে তোমার কিছু করার নেই। তোমার গেরুয়ায় যাতে দাগ না লাগে, সেটাই তোমাকে দেখতে হবে।”
হিন্দিতে কথা বলছিলেন সন্ন্যাসী দু’জন। কিন্তু ভোরের বাতাসে তাঁদের কথাগুলো উত্তরণের কাছে মাতৃভাষার চেয়েও প্রাঞ্জল হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। বাস থেকে নেমে কনস্যুলেটের দিকে যেতে-যেতে, কনস্যুলেট থেকে ফেরার পথে, উত্তরণ বুঝে গিয়েছিলেন কী করতে হবে।
আমেরিকায় পৌঁছে, কেবল পৌঁছনোর সংবাদটুকু দেওয়া ছাড়া তাই অনসূয়ার সঙ্গে আর একটাও কথা বলেননি উত্তরণ। ওকে নিজের আস্তানার ঠিকানা দেননি। ইউনিভার্সিটির ঠিকানায় ওর চিঠি এলে, খুলে দেখেননি পর্যন্ত। পড়লে পাছে দুর্বল হয়ে যান, উত্তর দিতে গিয়ে নিজেকেই যদি দিয়ে দেন নিজের অজান্তে? দূরত্বে মনের উপর চাপ তো আরও বেশি পড়ে।
বারবার মনে হয়েছে তিনি অন্যায় করছেন, কিন্তু পরক্ষণেই মনে পড়েছে সেই সন্ন্যাসীর কথা। জড়িয়ে যেতে-যেতে, কোথাও তো একটা ছাড়িয়ে নিতে হবে। ছাড়িয়ে না নিলে তো ঘি হয়ে আগুনে, ভাল হয়ে ভাতে, শিশির হয়ে ঘাসে মিশে যেতে হবে। স্বতন্ত্র অস্তিত্বই থাকবে না।
কিন্তু গত পাঁচ দিনের টানাপড়েনে উত্তরণের কাছে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে, মানুষ আর পাঁচজনের মধ্যে থাকে বলেই তার পরিচয়ের দরকার হয়। একা একটা জঙ্গলের মধ্যে থাকা মানুষের কোনও পরিচয়ের প্রয়োজন নেই। সে ওই গাছপালা, পশুপ্রাণী সবার থেকে স্বতন্ত্র বটে, কিন্তু তার কোনও আলাদা অস্তিত্ব আছে কি?
যে মেয়েটার সঙ্গে আমেরিকায় আসা ইস্তক একবারের বেশি দু’বার কথা বলেননি, তার বিহনে এই যে ছটফট করছেন উত্তরণ, তা কি ভালবাসা? নিজের কাছেই জানতে চাইলেন উত্তরণ। উত্তরে স্পষ্ট একটা হ্যাঁ এল না। অনেক মন্থনশেষে অনুভব করলেন যে কোথাও তিনি নিজের সেই অকলঙ্ক ইমেজটাকেও খুঁজছেন। যে ইমেজ দিনরাতের প্রতিটা সেকেন্ড-মিনিট, অনসূয়ার চোখে দেখতে পেতেন উত্তরণ। দেখতে পেতেন বলেই নিজেকে আরও উচুতে ধরে রাখার ইচ্ছে হত। সেতারের তারের মতো। যাতে আঙুল ছোঁয়ালেই মুর্চ্ছনার সৃষ্টি হয়।
কিন্তু গ্রিফিনের ওই আধ ঘণ্টা নিজের কাছেই অনেকটা ধ্বংস করে দিয়েছে উত্তরণকে। মনে হচ্ছে আঙুল ছোঁয়ালে ‘উত্তরণ’ অবয়বটার ভিতর থেকে কেবল কাদা উঠে আসবে। সেই দুর্বিষহ অভিজ্ঞতা দূর করতেই উত্তরণ চাইছিলেন, অনসূয়া অন্তত একবার ওঁর সামনে এসে দাঁড়াক।
কিন্তু অনসূয়া সত্যিই কি এসেছে আমেরিকায়?
১৭
অনসূয়া এল ঠিক ছ’দিনের মাথায়, পরের শনিবার সকালে। এসেই কোনও ভণিতা না করে উত্তরণকে জিজ্ঞেস করল, “আমি যে আসতে পারি, এসে আবার তোমার সামনে দাঁড়াতে পারি, তুমি ভাবোনি, তাই না?”
অপারেশনের পর রোগীর জ্ঞান আসার মুহূর্তে যেমন চারদিকটা কুয়াশায় ঢাকা থাকে, উত্তরণও তেমন একটা কুয়াশার সামনেই দাঁড়িয়েছিলেন। কেবল মনে হচ্ছিল, যে অনসূয়া ওঁকে ‘আপনি’ ছাড়া অন্য কিছু বলেনি কোনওদিন, সে কীভাবে, এত সহজে, ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করছে!
“ভগবানকে কি ভক্ত ‘আপনি’ বলে ডাকে?” সেদিন দুপুরে নিজের হাতে রান্না করে উত্তরণকে বেড়ে দিতে দিতে অনসূয়া যেন সেই প্রশ্নটারই উত্তর দিয়ে দিল, প্রশ্নের ঢঙে।
উত্তরণ নীরব থেকে মেয়েটিকে দেখছিলেন। থ্রি-কোয়ার্টার প্যান্ট আর টি-শার্ট পরা মেয়েটির সঙ্গে বছরতিনেক আগের মেয়েটির পোশাক-আশাকে হয়তো অনেকটাই তফাত, সেই লম্বা বেণির জায়গা নিয়েছে কাঁধ-ছোঁওয়া চুল, কিন্তু ভিতরে-ভিতরে একই থেকে গিয়েছে মেয়েটা। ওর ধ্যান-জ্ঞান যে ছিল, সে-ই আছে।
অনেকদিন পর কেউ ভাত বেড়ে খেতে দিল বলে একটু বেশিই খেয়ে ফেললেন উত্তরণ। খেয়ে উঠে চোখটা ঘুমে জড়িয়ে আসছিল। ঘুমটা তাড়াবেন বলে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি কোথায়-কোথায় অ্যাপ্লাই করেছিলে?”
“ইউনিভার্সিটি অফ এথেন্সে পেলে ভাল হত, জর্জিয়া স্টেট-এর ভিতরেই জায়গাটা। এক ঘণ্টা ড্রাইভ করলেই চলে আসতাম। কিন্তু কপাল অত ভাল নয় আমার। ন্যাশভিল-এও হয়ে যাচ্ছিল, তবে ওখান থেকে তোমার ডেরা আরও দূর হয়ে যেত। তাই শেষমেশ কলম্বিয়ার সাউথ ক্যারোলাইনা ইউনিভার্সিটিতেই…”
“তুমি তো পড়াশোনা করতে আসছিলে, আমার কাছে তো…”
উত্তরণকে থামিয়ে দিয়ে অনসূয়া বলে উঠল, “শিষ্যা কি গুরুর অনেক দূরে থেকে পড়াশোনা করতে পারে?”
“আমি কারওর গুরু নই অনসূয়া। হওয়ার যোগ্যতাই নেই। নিজের গুরুর প্রকৃত শিষ্যই হওয়া হল না।”
“কে বলল? তা যদি না হতে পারতে তা হলে অনিল মহারাজ তোমার জন্য টাকা জমাতেন?”
“সেটা অপত্য স্নেহ বলতে পারো। বিজয়দা আর অনিলদা কী যে ভালবাসতেন আমাকে…” গলা ধরে এল উত্তরণের।
“ভালবাসার কারণ ছিল, তাই বাসতেন। তোমার মতো ক’জন এসেছিল আশ্রমে? তুমি আশ্রমের জুয়েল।”
“এসব বোলো না, শোনাও পাপ।”
“পাপ হলে, সেই পাপ স্বামী বিরজানন্দ করেছেন। তিনিই তো আমাকে বললেন কথাটা। আমি আমেরিকায় আসছি শুনে, ওই চিঠিটা আমার হাত দিয়ে তোমায় পাঠিয়েছেন। তুমি কী গো, ওঁদের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখোনি? আচ্ছা, কেন ফোন করোনি, কেন চিঠি লেখোনি আশ্রমের কাউকে?”
“তুমি যখন আমার জীবনী লিখবে, তখন উত্তর দেব। এখন বলো, এই ইউনিভার্সিটি অফ সাউথ ক্যারোলাইনা কেমন? ধারে-ভারে?”
“আমি কি অত বিচার করতে গিয়েছি নাকি? আমি শুধু খোঁজ করছিলাম, ওখান থেকে আটলান্টা পৌঁছতে কতক্ষণ লাগবে। যখন দেখলাম, সওয়া তিন ঘণ্টা মতো, তখন আর দ্বিতীয়বার ভাবিনি।”
“আমার কাছে আসাটাই মোক্ষ ছিল?”
“অবশ্যই। নইলে সাড়ে তিন ঘণ্টা ড্রাইভ করে…”
“একটু আগে সওয়া তিন বললে যে?”
“সাড়ে তিনই লাগে। আসার পথে অগাস্টায় একটা স্যান্ডউইচ ব্রেক নিয়েছিলাম, পনেরো-কুড়ি মিনিটের। তবে কলম্বিয়া খুব সুন্দর। যখন নিয়ে যাব দেখবে, কঙ্গারি নদীটা শহরটাকে একটা আলাদা রূপ দিয়েছে। তা ছাড়া ফোর্ট জ্যাকসন…”
“সেটা কী?”
“জানো না? ইউএসএ-র সবথেকে বড় আর্মি ইনস্টলেশন, ফর বেসিক কমব্যাট ট্রেনিং। মাটিতে দাঁড়িয়ে যে সৈনিকরা যুদ্ধ করে, তাদের সবচেয়ে বড় সাপ্লাই সেন্টার বলতে পারো। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় হাজার-হাজার সৈন্য এখান থেকে প্যাঁচঘোঁচ শিখে এশিয়ায় যেত।”
ভিয়েতনাম, সৈন্য, আর্মি ইনস্টলেশন… কীরকম ঠান্ডা লাগছিল উত্তরণের। ঘর সেন্ট্রালি হিটেড হওয়া সত্ত্বেও। কয়েকদিন আগেই একটা সেমিনারে বলতে এসে একজন অধ্যাপক বলছিলেন, ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় আমেরিকান সৈন্যদের মধ্যে একটি নোট বিলি হয়। তাতে লেখা ছিল, ‘যা কিছু হলুদ চামড়ার আর হেঁটে-চলে বেড়ায়, তা-ই শত্রু।’ অবশ্য শত্রুতার ধারণা আরও ছড়ানো ছিল। গেরিলা যোদ্ধারা গ্রামেই আশ্রয় পায়, সুতরাং গ্রাম উড়িয়ে দেওয়া না গেলে গেরিলারা আশ্রয় পেতেই থাকবে, এই তত্ত্বে বিশ্বাসী কর্তৃপক্ষ কত-কত বাঁধ ধ্বংস করে দিয়েছে, গুড়িয়ে দিয়েছে কত স্কুল…
“কী ভাবছ? আমেরিকার সৈন্যরা কত অত্যাচার করেছে দেশ-বিদেশে?”
“তুমি কি থট রিড করতে পারো নাকি এখন?”
“আর কার ক্ষেত্রে কী পারি তা জানি না, কিন্তু তোমার মাথায় আর মনে কী চলছে তা স্পষ্ট বুঝতে পারি। তাই তো ন’হাজার মাইল দূরত্ব কাটিয়ে চলে এলাম। তাও দুশো পনেরো মাইল দূরত্ব রয়ে গেল।” অনসূয়া হেসে উঠল।
“কিন্তু আমি যা ভাবছিলাম সেটা হল…”
অনসূয়া উত্তরণকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “কী ভাবছ বুঝতে পেরেছি। কিন্তু কথাটা হল, শুধু তো খারাপ করেনি, ভালও করেছে অনেক। জায়গায়-জায়গায় আমেরিকান লাইব্রেরি বানিয়েছে, যা না থাকলে আমাদের পড়াশোনার অনেক অসুবিধে হয়ে যেত। আর খারাপ যা করার, তা তো সেনাবাহিনী করেছে, দুনিয়ার কোথায় সেনাবাহিনী সম্বন্ধে অভিযোগ থাকে না? পাকিস্তানের সেনা কী করেছিল একাত্তরে? লাখ-লাখ বাঙালিকে নির্বিচারে মারেনি? হাজার হাজার বাড়িতে, দেবস্থানে আগুন দেয়নি? অসংখ্য বাঙালি মেয়েকে গণধর্ষণ করেনি? চরম অত্যাচার নামিয়ে আনেনি একটা জাতির উপর? ভারতীয় সেনা নিয়ে কোথাও কারওর কোনও নালিশ নেই? পৃথিবীতে কবে কার সৈন্যরা ধোয়া তুলসীপাতা ছিল?”
উত্তরণের মনে হল, অল্পদিনেই অনসূয়া অনেক বেশি আমেরিকান হয়ে গিয়েছে, যা তিনি তিন বছরের উপরে আমেরিকায় এসেও হতে পারেননি। যদিও খোলা মনে বিচার করলে, অনসূয়ার কথাগুলোকেও ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। মন্দ’-র পাশাপাশি আমেরিকার অনেক ‘ভাল’-কে উত্তরণ নিজেই তো উপলব্ধি করেছেন বিগত কয়েক বছর ধরে।
উত্তরণকে চুপ করে যেতে দেখে অনসূয়া বলল, “সৈন্যদের থেকে তুমি কম অত্যাচারী? ওরাও রাস্তায় দেখা হলে হাসে, নড করে… তুমি আমেরিকা চলে এসে সব যোগাযোগ ছিন্ন করে দিলে। চিঠির উত্তর অবধি দাওনি, ফোন নম্বর দেওয়া তো দূরের কথা।”
“আমি তোমার অনেক ক্ষতি করেছি। আর ক্ষতি করতে চাইছিলাম না।”
“এইসব যাত্রার ডায়ালগ অন্যকে শোনাবে। এখানে কে রাঁধছে, কী খাচ্ছ, কেমন আছ, গাড়ি চালাতে শিখলে কি না, ঠান্ডা কীভাবে সামলাচ্ছ ভেবে আমি ঘুমোতে পারতাম না।”
অনসূয়ার কথা বলার ধরন চমকে দিচ্ছিল উত্তরণকে। কিন্তু কোথাও একটা ভালও লাগছিল ওঁর। মনে হচ্ছিল, বহুদিন পর নিজের কেউ, কাছের কেউ ওঁকে হাওয়ায়-হাওয়ায় স্পর্শ করে আছে। গলা নামিয়ে উত্তরণ বললেন, “এখানে তুত ঠান্ডা পড়ে না তো?”
“এখন আমি এসে গেছি, আর একেবারেই ঠান্ডা লাগবে না।” বলতে-বলতে অনসূয়া উত্তরণের খাটে এসে বসল।
উত্তরণ একটু সরে বসলেন, অভ্যাসবশতই। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার ডক্টরেটের বিষয় নিয়ে কিছু বলো।”
“‘দ্য ডিসইউনিটি অফ মর্যাল জাজমেন্ট,’ ওয়র্কিং টাইটেল এটাই হয়েছে।”
“একটু ডিটেলে বলো।”
“বলছি। তবে তার আগে বলো, তুমি মার্কণ্ডেয় মুনির গল্পটা শুনেছ তো?”
“কোনটা?”
“যেখানে মার্কণ্ডেয় মুনিকে কৃষ্ণ নিমন্ত্রণ পাঠিয়েছেন, আর তিনি বলরামকে মুখের উপর অপমান করে বলেছেন, ‘গোয়ালার ভাত খাই না।’ বলরাম খুব রেগেমেগে ফিরে এসে কৃষ্ণকে কথাটা বলতেই, কৃষ্ণ দাদাকে হাতে-পায়ে ধরে আর-একবার মুনির কাছে পাঠালেন, কানে-কানে একটা কথা বলে দিয়ে। বলরাম, মার্কণ্ডেয় মুনিকে আবার নিমন্ত্রণ করতে যেতেই মুনি ভীষণ রেগে উঠলেন। তখনই বলরাম বলে বসলেন যে তাঁর ভাই একটি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে বলেছে, গোয়ালার ঘরের ভাত কি কুকুরের মাংসের চেয়েও খারাপ? মার্কণ্ডেয় কথাটা শুনে চমকে গেলেন, কারণ মহাপ্রলয়ের সময় তিনি যে কুকুরের মাংস খেয়ে প্রাণধারণ করেছিলেন, তা তো কেবল বিষ্ণুরই জানা। তা হলে কে নেমন্তন্ন করেছে তাঁকে?”
“হ্যাঁ, শুনেছি। কিন্তু হঠাৎ এই গল্প?”
“গল্পটা তোমায় বলতাম না। কেন বললাম বলো তো? আমি খাটে বসতেই এই যে তুমি সরে বসলে, এটা খুব খারাপ লাগল আমার। আগে হলে কিছুই বলতাম না, কারণ তুমি যা করো, যা বলো সবই দৈব ব্যাপার বলে ভাবতাম। এখনও যে ভাবি না তা নয়, কিন্তু তোমার কয়েকটা কনফিউশন একটু দূর করা উচিত বলে মনে হয়।”
“আমার কোনও কনফিউশন নেই।”
“আছে গো, আছে। তুমি হাজতে, ক্রিমিনালদের গায়ে গা ঠেকিয়ে বসে থাকতে পারো, কিন্তু অনসূয়া খাটে এসে বসলে তোমায় সরে বসতে হয়। কেন? কী হবে তোমার গায়ের সঙ্গে আমার গা ঠেকে গেলে? মহাপ্রলয়?”
উত্তরণের মুখটা সাদা হয়ে গেল অনসূয়ার কথা শুনে।
“কী হল, ওরকম স্ট্যাচু হয়ে গেলে কেন?”
“তুমি জানো, গ্রিফিনে কী হয়েছিল?”
“না, জানি না। আমি তো কলকাতার কথা বলছি।”
“কে বলেছিল তোমায়?”
“শুনেছিলাম ইউনিভার্সিটিতে। কে বলেছিল, আর মনে নেই।”
“আমাকে খারাপ মনে হয়নি তোমার?”
“একটুও নয়। যাকে রোজ নিজের চোখে দেখছি, তাকে লোকের কথায় খারাপ বা ভাল মনে হতে যাবে কেন? সে কী, আমি তো জানি।”
“কিন্তু সেই হাজতে আমার পাশে বসে থাকা লোকটা আমেরিকায় এসেছে। গ্রিফিনে দুর্গাপুজো করতে গিয়েছিলাম আমি, তখন সে চিৎকার করতে শুরু করে। এখন সবাই সব জেনে গিয়েছে।”
“জানলে জেনেছে। আবার ভুলে যেতে কতক্ষণ?”
“কিন্তু আমার নামের সঙ্গে যে কলঙ্ক…”
“সূর্য যেমন পশ্চিমদিকে উঠতেই পারে না, তুমিও তেমনই ননাংরা কিছুতে জড়িত থাকতেই পারো না। কেউ মাইক নিয়ে বললেও লোকে বিশ্বাস করবে না।”
“কিন্তু খোঁচা তো দেবে! খোঁটা তো দেবে! যেমন তুমি দিলে। কেন দিলে, কেন?” বলতে-বলতে কেঁদে ফেললেন উত্তরণ।
উত্তরণের কান্নার থেকে অনেক জোরে কেঁদে উঠল অনসূয়া। কাঁদতে-কাঁদতে বলল, “তোমার জন্য এই কষ্টটা আমি রোজ পেয়েছি। যবে থেকে তুমি আমার চোখের সামনে নেই, তবে থেকে, প্রতিটা মিনিটে পেয়েছি। আর তুমি বলছ, তুমি যোগাযোগ করলে নাকি ক্ষতি হয়ে যেত আমার। যে মেয়েটা তোমায় দেখবে বলে অতক্ষণ গাড়ি চালিয়ে এসেছিল আগের রবিবার, তারপর আবারও একই ডিসট্যান্স পার করে রাত্রি দেড়টায় ফিরেছে, তাকে বলছ! যে আমেরিকায় এসেই গাড়ি চালানোর লাইসেন্স বার করেছে তোমার কাছে আসবে বলে, তাকে বলছ! তুমি খোঁটা দাওনি আমায়?”
উত্তরণ কথাগুলো শুনতে-শুনতে কেমন একটা অন্যরকম কষ্ট অনুভব করলেন। অনুভব করলেন বলেই বললেন, “তুমি এসে চলে গিয়েছ ভেবে আমারও কষ্ট হচ্ছিল। তুমি সাত সমুদ্র পারে, সেটা একরকম, কিন্তু তুমি এখানেই, অথচ দেখা হল না…”
“আমার সঙ্গে দেখা হওয়া বা না হওয়ায় কী এসে যায় তোমার?”
“বারবার মনে হচ্ছিল একবার যদি…”
“একবার কী?”
উত্তরণ উত্তর দিতে পারলেন না।
উত্তর না পেয়ে অনসূয়া যখন নিজের সবটুকু আবেগ নিয়ে জড়িয়ে ধরল ওঁকে, ছাড়াতেও পারলেন না মেয়েটাকে।
ছাড়াতে চাইলেন কি না, তা-ই বা কে জানে।
১৮
উত্তরণের ভিতরে অস্বস্তি থাকলেও অনসূয়া এতটাই আত্মবিশ্বাসী যে কোনও সংশয়ই ওকে স্পর্শ করত না। উত্তরণের দ্বিধার উত্তরে ওর তাই সাফ জবাব ছিল যে, একটা বাড়িতে যদি দু’জন চার বছরের উপর থাকতে পারে, একটা ঘরে দু’জনের একসঙ্গে থাকতেই বা অসুবিধে কী?
উত্তরণের কাছে উত্তর ছিল না বলেই অনসূয়া থেকে গেল শনিবার রাতটা। পরদিন সন্ধ্যায় কলম্বিয়া ফিরে যাওয়ার আগে উত্তরণকে নিয়ে আটলান্টা ঘুরতে বেরোল।
গাড়িতে অনসূয়ার পাশে বসে উত্তরণ খেয়াল করলেন যে আটলান্টায় বেশ কিছুদিন হয়ে গেলেও, এই মেয়েটা বোধহয় ওঁর থেকে বেশিই চেনে রাস্তাঘাট।
“এর কারণ কী বলো তো? তুমি সবসময় স্বর্গের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক নিয়ে চিন্তিত, আর আমি পৃথিবীর সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক নিয়ে ভাবি। অতএব এটা তো স্বাভাবিক যে আমি একটু বেশি চিনব জাগতিক সবকিছু।” মার্টিন লুথার কিং (জুনিয়র)-এর বাড়ির সামনে গাড়িটা দাঁড় করিয়ে বলল অনসূয়া।
বাড়িটা আগে দু-একবার দেখলেও, এখানে আসা হয়ে ওঠেনি। আজ অনসূয়া ওঁকে এখানে কেন নিয়ে এল জিজ্ঞেস করবেন ভেবে, ওর মুখের দিকে তাকালেন উত্তরণ।
অনসূয়া একটু মুচকি হেসে বলল, “এখানে তোমাকে নিয়ে এলাম কেন, সেটাই জিজ্ঞাসা তো? উত্তরটা হল, মার্টিন লুথার কিং বলতেন যে, ‘ইউ হ্যাভ টু বি এক্সট্রিম ইন লাভ।’ আমি চাই যে তুমি এই কথাটা একটু শোনো। ভালবেসে একটু উথালপাথাল হও। তা হলেই তুমি আমাকেও বুঝতে পারবে।”
“বুঝলেও কি আমি তোমার মতো হতে পারব অনসূয়া? আমরা তো শুধু দুটো আলাদা শরীর নই, দুটো আলাদা মানুষ। আলাদা-আলাদা মনোবৃত্তি আমাদের, আলাদা-আলাদা স্বপ্ন, চিন্তা, সংকল্প।”
উত্তরণ বললেন বটে, কিন্তু বলতে-বলতেই বুঝছিলেন যে অনসূয়ার তীব্র প্যাশনের সামনে ওঁর কথাগুলো দাঁড়াতে পারছে না। দাঁড়াচ্ছে না বেদ-বেদান্ত কিছুই, থই পাচ্ছে না লক-হিউম-হেগেল-রাসেল। ভালবাসা আসলে এমনই এক টর্নেডো, যা সবকিছু উড়িয়ে নিয়ে যায়। জ্ঞান কিংবা তর্ক দিয়ে তার মোকাবিলা করা যায় না। যায় না বলেই অনসূয়া যতবার বলত, “তুমি আমার মতো ইনটেন্সলি ভালবাসতে পারো না, পারবেও না,” ততবারই খুব অসহায় বোধ করতেন উত্তরণ।
আরও একটা পরিবর্তন হয়েছিল অনসূয়ার। যে কোনও আলোচনায়ও এখন মেয়েদের দৃষ্টিকোণ তুলে ধরতে চাইত। বারবার করে লোপামুদ্রা, গার্গী, অপালার কথা বলে জিজ্ঞেস করত, নারী কেন মন্দিরের গর্ভগৃহে ঢুকতে পারবে না? নারীর গর্ভগৃহ থেকেই তো প্রত্যেকটি মানুষের পৃথিবীতে আসা। তা হলে কীভাবে অপবিত্র হতে পারে একটা মেয়ে?
উত্তরণ প্রথম-প্রথম একটু বিব্রত হতেন, কীভাবে অনসূয়া এত তার্কিক হয়ে উঠল সেটা ভাবতেন। কিন্তু প্রতি শুক্রবার করে অনসূয়ার আসা আর রোববার ওর ফিরে যাওয়ার মধ্যে যে একসঙ্গে থাকা, তা উত্তরণের দৃষ্টিভঙ্গিও পালটে দিচ্ছিল অনেকটা।
অনসূয়ার সঙ্গে এক ঘরে থাকলেও আলাদাই শুতেন উত্তরণ। কিন্তু অত নিয়মকানুন তো পুরুষ আর নারীর মধ্যে চলে না, তাই হামেশাই দেখতেন ডিভান ছেড়ে খাটে ওঁর পাশে কিংবা খাট ছেড়ে ডিভানে নিজের হাঁটুতে মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে অনসূয়া। ভোরের প্রথম আলোয় উত্তরণের ঘুম ভাঙলেও অনসূয়ার ভাঙত না। তখনই উত্তরণ খেয়াল করতেন, একটি মেয়ের সঙ্গে থাকা মানে কেবল তার শরীরটার সঙ্গেই থাকা নয়… তার চুলের গন্ধ নেওয়া বা তার বুকে মুখ ডোবানোই নয়। একটি মেয়ের সঙ্গে থাকা মানে কোথাও নিজের নিশ্বাস সেই মেয়েটির ফুসফুসে ঢুকছে অনুভব করা এবং একইভাবে সেই মেয়েটির নিশ্বাস নিজের ফুসফুসে ধারণ করা।
“তোমার এই টোনড মিল্কের মতো জীবন, যেখানে একটুও ট্রান্স ফ্যাট নেই বলে কোনও সর পড়ে না, সেখানে আমি কীভাবে টিকে যাওয়ার চেষ্টা করছি, এই প্রশ্ন যে আমি নিজেকে নিজে করি না, তা ভেবো না। সবসময়ই করি।” অনসূয়া বলল।
“কী উত্তর পাও?”
“উত্তর পাই যে আমার সবটা জুড়েই তুমি, শুধু তুমি।”
“কিন্তু তোমার তো অসুবিধে হয় আমার মতো নিরামিষ খেয়ে থাকতে।”
“যাক আমেরিকা তোমায় কিছুটা হলেও চেঞ্জ করতে পেরেছে তা হলে। কলকাতায় থাকতে তুমি কোনওদিন খবর নাওনি, আমি কী খাচ্ছি না খাচ্ছি। খবর নাওনি বলেই জানোনি যে আমি অনেকদিন মাছ-মাংস ছেড়ে দিয়েছিলাম। বাবা মাছ না খেয়ে থাকতে পারত না বলে বাবার জন্য বাজার করতাম। কিন্তু সেই রান্নাটা পুষ্পমাসিই করত। আমার কেমন মনে হত, মাছ খেয়ে বা রান্না করে তোমার কাজ করা উচিত নয়।”
“আমাকে কখনও বলোনি তো?”
“আমি ভেবেছিলাম তুমি নিজেই বুঝে নেবে। কিন্তু তুমি কবে কখন আমার কথা বুঝেছ? তুমি স্টেটসে চলে আসার পরও প্রায় মাসছয়েক আমি নিরামিষই খেতাম, এমন অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। তারপর যখন মেল-এর পর মেল পাঠিয়েও কোনও উত্তর পেতাম না, চিঠির পর চিঠি গারবেজে গিয়ে জমা হত হয়তো, তখন …”
“আমাকে খুব খারাপ লোক মনে হল, তাই তো?”
“তুমি আসলে কীরকম, সেটা আর খুব একটা ম্যাটার করে না আমার কাছে। আমার মনে তোমার যে ইমেজটা আছে, সেটাই সর্বগ্রাসী। অন্তত আমার জন্য।”
“তুমি তাই আমেরিকায় আমার ঘরে এসেও মাছ খাও না?
“আসলে তোমার ঘরটা এত পবিত্র যে আমার কেমন বাবো-বাধো ঠেকে…”
“মাছ-মাংস খেলে ঘর অপবিত্র হয়ে যাবে না। দেশে যখন আবার খাওয়া শুরু করেছিলে, এখানেও খেয়ো। যা খেতে ইচ্ছে করছে তা খাওয়ার মধ্যে কোনও দোষ নেই। আমি খাই না কারণ আমার ইচ্ছে করে না। আশ্রমে যাওয়ার পর থেকেই আর করেনি।”
অনসূয়া একটু চুপ করে থেকে বলল, “আমেরিকায় মাংসের গায়ে রক্ত লেগে থাকে না, খেয়াল করেছ? শাইলক রক্তের থেকে মাংসকে আলাদা করতে পারেনি, কিন্তু আমেরিকা পেরেছে। সব এমন নিটলি প্যাকেজড যে কোথাও এতটুকু রক্তের দাগ নেই। কিন্তু সেই আমেরিকাও তোমার থেকে আমাকে আলাদা করতে পারল না। আশ্চর্য না?”
“আশ্চর্য তো বটেই। ক্লিন-শেভন সন্ন্যাসী মহারাজ আর অনসূয়া ইউএসএ-র ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে বাজার করছে একসঙ্গে, অ্যামেজ়িং নয়? কিন্তু তোদর বিয়ের খবর তো পাইনি!” পিছন থেকে যে ছেলেটা বাংলায় বলে উঠল, উত্তরণ তাকে ইউনিভার্সিটিতে দেখে থাকলেও, নাম মনে করতে পারলেন না।
অনসূয়া এক মুহূর্ত চুপ থেকে বলল, “খবর পাওনি, কারণ এখনও আমরা বিয়ে করিনি প্রতিমদা।”
প্রতিম হেসে উঠল, “লিভ-টুগেদার করছিস? সন্ন্যাসী ঠাকুরের সঙ্গে লিভ-টুগেদার?”
উত্তরণের মাথাটা নিজের অজান্তেই একটু নিচু হয়ে গেল। কিন্তু অনসূয়া স্ট্রেট ব্যাটে বলটা খেলল।
“উত্তরণ কি তোমাকে দীক্ষা দিতে গিয়েছিল যে ও সন্ন্যাসী ঠাকুর হবে? আর যদি হয়েও থাকে, সন্ন্যাসীর বিয়ে করার মধ্যে আমি তেমন পাপ দেখি না, জানো! পাপ দেখি একটি মেয়েকে ফাঁসিয়ে দিয়ে তারপর তাকে অ্যাবর্ট করতে বাধ্য করে, তাকে ছাড়াই আমেরিকা চলে আসার মধ্যে। বাই দ্য ওয়ে, চৈতালি ভাল আছে এখন?”।
কথাটা শুনেই প্রতিম ছিটকে সরে গেল সামনে থেকে। বোধহয় ডিপার্টমেন্টাল স্টোর থেকেই পালিয়ে গেল।
উত্তরণ অবাক চোখে তাকালেন অনসূয়ার দিকে।
অনসূয়া একটু হেসে বলল, “ঠাকুর বলেছিলেন না যে, না কামড়ালেও ফোঁস করতে হয়। যে যেরকম তাকে ঠিক সেরকম ভাষায় উত্তর না দিলে উত্তরটা লোকটা পর্যন্ত পৌঁছয় না।”
“কিন্তু আমি ঠিক চিনতে পারলাম না ওকে। আমাদের ডিপার্টমেন্টেই ছিল?”
“না, হিস্ট্রি পড়ত। পড়াশোনায় কতটা ভাল ছিল জানি না, তবে ঘাগু ছিল প্রচণ্ড। আমায় টার্গেট করেছিল একটা সময়।”
“তুমি রাজি হলে না কেন?” ঘরে ফিরে জিজ্ঞেস করলেন উত্তরণ।
“দুটো কারণে। এক আমি তোমাকে, কেবল তোমাকেই ভালবেসেছি। আর দুই, উপরচালাক লোক আমার অসহ্য লাগে।”
“আমেরিকায় এসে তুমি কিন্তু খুব চ্যাটাং-চ্যাটাং কথা বলতে শিখেছ?”
অনসূয়া হেসে উঠল, “তোমার অসুবিধে হচ্ছে তাতে? আমি চলে যাব? কিন্তু এখন যদি চলেও যাই, আর কখনও না আসি, তবু প্রতিমের সৌজন্যে সারা দুনিয়া জানবে যে আমরা একসঙ্গে থাকতাম। কেউ বিশ্বাস করবে যে আমরা এখানে দুটো চালের দানার মতো আছি? আমাদের মধ্যে কোনও সংযোগ হয়নি?”
“আমি তো সংযোগের থেকে নিজেকে বাঁচাতে চেয়েছি অনসূয়া। আমি তো একটা আধ্যাত্মিকতার মধ্যে থাকার চেষ্টা করেছি প্রতিনিয়ত। তবে কেন অকারণ গসিপ আমাকে ঘিরে থাকবে বলো তো?” খানিকটা স্বার্থপরের মতোই বলছেন বুঝেও, না বলে পারলেন না উত্তরণ।
“এটাই হয়তো তোমার ঠাকুরের ইচ্ছা। তোমার ঠাকুর নিশ্চয়ই চান তুমি সংসার করো।”
“হতে পারে না।”
“কেন পারে না? বিজয়দার কথা ধোরো না, তোমার ঠাকুর নিজে তোমাকে কিছু বলেছিলেন?”
“বিজয়দাকে তুমি চেনো না বলে বলছ। বিজয়দার মধ্যে দিয়ে কথাটা এলেও, ওটা আসলে…”
“তোমার মুখ থেকে স্বামী অমলানন্দের বিষয়ে যা-যা শুনেছি তাতে ওঁর প্রতি আমার সর্বোচ্চ শ্রদ্ধাই আছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও বলছি, উনি হয়তো ঠাকুরের কথাটাকে নিজের মতো করে ইন্টারপ্রেট করেছিলেন। ঠাকুর কী চেয়েছিলেন, তুমি কী করে জানবে? তুমি গেরুয়া কাপড় পরে ঠাকুরের কাজ করতে পারবে, ট্রাউজ়ার্স আর টি পরলে পারবে না? আর তা-ই যদি হত, ঠাকুর তোমার স্বপ্নে আসছেন না কেন? কেন বারণ করছেন না তোমাকে? কেন বলছেন না যে তুমি বিরাট অপরাধ করছ একটি মেয়েকে প্রতি সপ্তাহে দু’দিন তোমার ঘরে রেখে, এক্ষুনি ওই অনসূয়াকে বের করে দাও?” বলতে-বলতে অনসূয়া খিমচে ধরল উত্তরণের বুকের কাছটা।
“ঠাকুর কী চেয়েছেন আমি সত্যিই বলতে পারব না। কিন্তু আমি তো চাইনি।” উত্তরণ একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।
“কী চাওনি? আমি যখন স্নানে যাই আর তুমি আমার স্নানের শব্দ শোনো, সেই শব্দ তোমার ভিতরে কোনও দৃশ্যের জন্ম দেয় না? যখন আমি ঘুমের মধ্যে পাশ ফিরি আর তুমি চোখ মেলে একবার আমার দিকে তাকিয়ে চোখটা সরিয়ে নাও, তখন তোমার কিছু হয় না? তোমার একটা ট্রেনিং আছে, আমি জানি। কিন্তু সমস্ত ট্রেনিংয়ের পরেও শিম্পাঞ্জি যেমন শিম্পাঞ্জিই থাকে, সমস্ত সংযমের শেষেও একজন রক্তমাংসের পুরুষ একটি পুরুষই। সে পাথর হয়ে যায় না।” বলতে-বলতে উত্তরণকে জড়িয়ে ধরল অনসূয়া। ওঁর ঠোঁটে ঠোঁট রাখল নিজের।
উত্তরণ বাধা দিতে গিয়েও পারলেন না যখন টের পেলেন যে ওঁর ঠোঁটদুটোও সাড়া দিচ্ছে।
সেই সাড়া দিতে দিতে উত্তরণের ভয়টা আনন্দে অনূদিত হতে শুরু করল। ঠাকুর বলেছিলেন, ‘সোনার গায়ে পারা লাগলে সোনা কালো হয়ে যায়।’ কিন্তু কই, তিনি তো কালো হয়ে যাচ্ছেন না! বারাণসীর আশ্রমে চেতনানন্দ বলে একজন তান্ত্রিক আসতেন। কথায়-কথায় উত্তরণকে তিনি জানিয়েছিলেন যে একা শিবলিঙ্গের কোনও অর্থ হয় না, যতক্ষণ না তা যোনিপীঠের উপর স্থাপিত হয়। নারীহীন পুরুষ আর রাত্রিহীন দিন একই ব্যাপার।
উত্তরণের প্রথমে মনে হচ্ছিল, অনসূয়ার প্রত্যেকটা চুমু ওঁর মুখে সেভাবে পড়ছে, যেভাবে জিশুর গায়ে পেরেক পড়েছিল। কিন্তু পরমুহূর্তেই মনে হল, পুরাকালের কোনও অপ্সরার মতো, ধ্যান ভাঙিয়ে ওঁকে সজীব করে তুলছে অনসূয়া, একটা কাষ্ঠখণ্ডকে আনন্দময় অস্তিত্বের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। সেই আদরে ডুবে যেতে-যেতেও উত্তরণ, কে জানে কেন, সামলে নিলেন নিজেকে।
“অনসূয়া থামো। আমাদের আগে স্বামী-স্ত্রী হতে দাও। আমাদের মাঝখানে একটা মন্ত্রকে জন্ম নিতে দাও।”
“সেই মন্ত্র তো আমরা এখানে এই মুহূর্তে উচ্চারণ করতে পারি।”
“না। তার একটা স্থান-কাল-পাত্র আছে।”
কথাটা বলে অনসূয়াকে থামিয়ে দিলেন উত্তরণ। পরদিনই আটলান্টার একটি মন্দিরে গিয়ে অনসূয়ার সিঁথিতে সিঁদুর টেনে দিলেন। সেই সময় উত্তরণের মনে হচ্ছিল যে ঠাকুর চেয়েছিলেন এক, আর তিনি করলেন অন্য কিছু৷ ঘরে ফেরার মুহূর্তে খেয়াল পড়ল, বিজয়া বলতেন যে ঠাকুরের ইচ্ছে ছাড়া একটা পাতাও নড়ে না। তা হলে অনসূয়া আর ওঁর বিয়ে কীভাবে ঠাকুরের ইচ্ছা ব্যতিরেকে হতে পারে?
উত্তরণ ভেবেছিলেন আটলান্টার কয়েকজনকে ডেকে খাওয়াবেন ওঁদের বিয়ে উপলক্ষে। কিন্তু সঞ্জয়দাকে ফোনে না পেয়ে বিনা নোটিসে তাঁর বাড়ি গিয়ে যখন একজন শ্বেতাঙ্গ মহিলার কাছে শুনলেন, সঞ্জয়দা ওখানে থাকেন না আর, দমে গেলেন ভিতরে ভিতরে। মনে হল, বাড়িতে থেকেও দেখা করলেন না সঞ্জয়দা, হয়তো গ্রিফিনের ঘটনার প্রতিবর্ত্ম ক্রিয়াতেই। একটা সংকোচ ঘিরে ধরল উত্তরণকে।
অনসূয়া ব্যাপারটা বুঝেই বলল, এখনও যেহেতু ওঁরা দু’জনে দুই শহরের বাসিন্দা, তাই এক্ষুনি ব্যাপারটা চাউর করে লাভ নেই। কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করলে পরে দেখা যাবে।
‘জিজ্ঞাসা করবে কোথায়? আমি তো সামাজিক গেট-টুগেদারগুলোয় যাওয়া বন্ধই করে দিয়েছি।” উত্তরণ বললেন।
“রাস্তাঘাটে দেখা হলেও করতে পারে। প্রতিম যেমন করেছিল।”
“কিন্তু আমি তো ফেরারি আসামীও নই যে সারা জীবন পালিয়ে বেড়াব।” উত্তরণ চিৎকার করে উঠলেন।
অনসূয়া ওঁর দিকে তাকাল। বরফে আগুন লেগেছে দেখে অবাকই হল।
মানুষের চিৎকারের বিপ্রতীপে থাকে প্রকৃতির নিস্তব্ধতা। তাই প্রকৃতির সামনে এসে চুপ করে যায় মানুষ। নিজেকে তুচ্ছ, অনেকের ভিতরে এক বলে অনুভব করে। লেক ল্যানিয়র-এ দু’দিনের জন্য এসে, সেই অনুভবই হল উত্তরণের।
অনসূয়াই খুঁজে বার করেছিল লেকটার হদিশ। প্রায় চল্লিশ হাজার একর জুড়ে ষাট বর্গমাইল জল আর জল। কবি সিডনি ল্যানিয়রের নামে নামাঙ্কিত হ্রদটায় কত যে পাখি!
“বিউফোর্ড বাঁধ বানানোর পাশাপাশি ওরা এই হ্রদটাও বানিয়েছিল। যাতে প্রকৃতিকে একদিকে বাঁধলে, অন্যদিকে খুলে দেওয়া যায়।” অনসূয়া বলল।
হ্রদের জলে ঢেউ না থাকলেও চলাচল ছিল। একটা হালকা স্রোত সাদা আলোর মতো কিনার অবধি এগিয়ে আসছিল, আবার ফিরে যাচ্ছিল। সেদিকে তাকিয়ে বসে থাকতে-থাকতে উত্তরণ বললেন, “তুমিও কি আমাকে বেঁধে রাখার পাশাপাশি খুলে দিতে চাও?” বলতে-বলতে ওই উন্মুক্ত চরাচরে হয়তো জীবনে প্রথমবার সচেতনে বাসনাকে অনুভব করলেন উত্তরণ। একই সঙ্গে টের পেলেন, যে সংশয়, যে দ্বিধা ওঁকে কুরে-কুরে খেয়ে এসেছে এতদিন, প্রকৃতিতে তার কোনও অনুরণন নেই। সে মুহূর্তমাত্ৰ থামে না। না মৃত্যুতে, না জরায়, না যন্ত্রণায়, না আনন্দে, না বার্ধক্যে, না যৌবনে।
উত্তরণের আলিঙ্গনে ধরা দিয়ে অনসূয়া বলল, “আমি ছাড়া অন্য কোনও মেয়ে তোমার জীবনে আসতেই পারে না, এই বিশ্বাসেই তো লড়ে গেলাম। আর এই বিশ্বাস আছে কেন জানো? তোমার জীবনে আসার জন্য তপস্যা করতে হয়। সেই তপস্যার শক্তি আমি ছাড়া অন্য কোনও মেয়ের মধ্যে দেখেছ তুমি? তোমার জন্য তপস্যা করেছি বলেই তোমার অপেক্ষায় শান্ত থাকতে পেরেছি। আমি জেনেছি, একদিন আমার এই তপস্যা তোমাকে আমার দিকে টেনে আনবে। তোমার ভিতরে যে ঝরনাটা আছে, সেই ঝরনাটাকে সমুদ্র করে তুলবে।”
সেই রাত্রে উত্তরণ নিজের শরীরের নীচে এক নারীকে আবিষ্কার করলেন, নিজেকেও নতুন করে চিনলেন।
অনসূয়া বলছিল, “আমি এখনও তোমার পুরোটা পাইনি। হিমশৈলের চূড়াটুকু মাত্র পেয়েছি। বাকি সবটুকু তোমার সাধনায় লুকিয়ে আছে। আমি জানি।”
উত্তরণ প্রবল ক্লান্তি আর ভাললাগায় ডুবে যেতে-যেতে বললেন, “সমস্ত ভালবাসার শেষেও আমার ওই সাধনাটুকু বাঁচিয়ে রেখো অনসূয়া। ওটাই আমার দাঁড়ানোর জায়গা। এটা বাদ দিয়ে দিলে, আমি কেবল ইট-কাঠ-পাথরের টুকরো।”
“আমি তোমার থেকে কিছু বাদ দিতে চাইনি। চাই না। শুধু তোমাকে তোমার সবটুকু নিয়ে পেতে চাই।”
সমস্ত প্রতিরোধ খসে যাওয়ার মুহূর্তে ফুল যেভাবে ঝরে পড়ে ডাল থেকে মাটিতে, উত্তরণ সেভাবেই যেন ঝরে পড়লেন এতদিনের কৃচ্ছ্রসাধন থেকে।
ওঁর মনে হতে লাগল, শরীরের উরু, জঙ্ঘা, নাভি, স্তন, সমস্ত অতিক্রম করে নারী হল বালি, আর পুরুষ সমুদ্রের জল, যা বালির ভিতরে প্রবেশ করে যায়। একবার প্রবেশ করার পর জলকে আর আলাদা করে চেনা যায় না, শুধু ভেজা বালির গায়ে তার চিহ্ন থাকে। সেই বালি আর সমুদ্রের মিলন, সেই প্রকৃতি-পুরুষ দ্বৈতবাদই উদ্যাপন করে দুনিয়া।
উত্তরণ যখন এইসব ভাবছেন, তখন উদ্যাপন নয়, সমর্পণের সততায় অনসূয়া জড়িয়ে ছিল নিজের স্বামীকে। জড়িয়ে ধরেই রইল, যতক্ষণ না ভোরের পাখির প্রথম গানটা বাতাসের সঙ্গে মিশে গেল।
১৯
অনসূয়া কিছুটা উদ্যোগ নেওয়ার জন্যই হোক, বা একেবারে নতুনরকম কাজ বলেই হোক, উত্তরণ ওঁর নিজস্ব ‘গীতা’-ব্যাখ্যার জন্য অনেক জায়গায় সমাদৃত হচ্ছিলেন। ওঁর থিসিস বই হিসেবে ছাপতে চাইছিলেন দু’জন প্রকাশক। বিষয়টা অভিনব ছিল বলেই হয়তো দেশ-বিদেশের সেমিনার থেকে ডাক আসছিল। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অর্জুনের সামনে যদি কৃষ্ণের বদলে বুদ্ধ কিংবা জিশু থাকতেন, তা হলে কী বলতেন ওঁরা অর্জুনকে? যুদ্ধ করতে, নাকি অস্ত্র তুলে রাখতে? উত্তরণের সহপাঠী সুব্রত একবার এই প্রশ্নটা করেছিলেন ওঁকে, এম এ ক্লাসে। উত্তরণ তখন কোনও উত্তর দিতে পারেননি। কিন্তু সুব্রতর প্রশ্ন দিয়ে শুরু হয়ে, দ্বন্দ্ব এবং মীমাংসার ভিতর দিয়ে এগোতে-এগোতে শেষ অবধি উত্তরণের থিসিস মানুষের ভিতরকার সেই দ্বৈততা তুলে আনে, যা যুদ্ধ করতে-করতে শান্তি চায়, আপাত-শান্তির মধ্যে যুদ্ধের জন্য খেপে ওঠে।
অনসূয়া রিসার্চ করছিল নৈতিক আচরণের ফাঁকফোকর নিয়ে। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে আমরা যেমন, অন্যরাও কি তেমন? আমাদের নিজেদের জন্য যা পরীক্ষা, অন্যদের ক্ষেত্রে তা-ই তো পাপ! ‘হোয়াট ইজ় সিন ফর আদার্স, ইজ় অ্যান এক্সপেরিমেন্ট ফর আস। অনসূয়ার থিসিসের সাব-হেডিং ছিল এটাই।
পোস্ট-ডক্টরাল কাজের সূত্রে তিন-সাড়ে তিন বছর আটলান্টায় কাটিয়ে উত্তরণ ভাবছিলেন, অনসূয়ার কতটা কাছাকাছি চাকরি নেওয়া যায়।
ওদিকে অনসূয়া উত্তরণকে বলে বসল, “আমি না, তোমায় ঠিক বুঝতে পারি না।”
উত্তরণ ওর মুখ থেকে থার্মোমিটারটা বার করে জ্বর দেখছিলেন তখন। টেম্পারেচার দেখে থার্মোমিটারটা ঝাঁকাতে-ঝাঁকাতে বললেন, “না বোঝার মতো কিছু করার শক্তি হারিয়ে ফেলেছি আমি।”
“আমার জ্বর হয়েছে বলে আটলান্টা থেকে তিন ঘণ্টা ড্রাইভ করে আসাটাকেই স্বামী হওয়ার অতুলনীয় নিদর্শন বলে মনে কোরো না। তোমার জায়গায় যে হাজ়ব্যান্ড থাকত, সে একই কাজ করত।”
“তাই তো বললাম, স্বাতন্ত্র্য বলে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই আমার। এখন সবাই যা করে, আমিও তাই করি। বাসন মাজা থেকে গাড়ি চালানো, বাজার থেকে লন্ড্রি — সব। শুধু সংসারটাই যা লং ডিসট্যান্স।”
“সংসার লং ডিসট্যান্সই থাকবে। বাট টেল মি ওয়ান থিং, আর ইউ সরি ফর দ্যাট?”
“সরি কেন হব?”
“না, এই যে তোমাকে সাংসারিক সব কাজ করতে হচ্ছে, তার জন্য আমাকে দায়ী মনে হয়?”
“স্টেটসে বাঁচতে গেলে তো গাড়ি চালাতেই হত। তবে সত্যিটা স্বীকার করতে যদি বলল, এতটা রাস্তা চালাতে আমার বেশ ভয়ই করছিল। তুমি তো শুধু ওই অগাস্টা শহরে একবার থামো, আমি গোটা জার্নিটায় তিনবার না চারবার থামলাম।”
“গাড়িটা এখানেই রেখে যাও তুমি। বাসে ফিরে যেয়ো আটলান্টায়।”
“পাগল, আমাকে বেরোতে হবে না?”
“তুমি তো ড্রাইভিং না শিখেই দিব্যি চালিয়ে নিয়েছিলে দেড়-দু’বছর। শেখার পরও বোধহয় এক লপ্তে পাঁচ মাইলের বেশি চালাওনি কোনওদিন তোমার ওই সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়িটা। আমি না এলে হয়তো আরও বহু বছর ওটাই চলত, ওভাবেই চলত। আমিই তোমাকে…”
“বাজে বকা বন্ধ করো। তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠো।”
“কিন্তু আমার সুস্থতা যদি তোমার অসুস্থতার কারণ হয়? তুমি যে জীবন চাও না, তার দিকে যদি আমার তথাকথিত সুস্থ মস্তিষ্ক ছুটিয়ে নিয়ে যায় তোমাকে? অন্যায় হবে না?”
“তুমি আর-একটু ঘুমোনোর চেষ্টা করো।”
“ঘুম আসবে না। তুমি আমায় বলো, কেন তুমি আমার কাছাকাছি থাকার কথা ভাবছ?”
“এটা একটা প্রশ্ন হল অনসূয়া? একটি দম্পতির একজন আর-একজনের কাছে থাকতে চাইবে না?”
“কিন্তু আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, কারণ এটা নয়। আমার অন্যায় হলে ক্ষমা কোরো, কিন্তু আমি মিথ্যাচার করতে পারব না তোমার সঙ্গে।”
“কী হয়েছে বলো তো তোমার? আমি তো কিছু বুঝতে পারছি না।”
“না বুঝেই আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দাও। তুমি পোস্ট-ডক্টরাল অ্যাসোশিয়েট না হয়ে পোস্ট-ডক্টরাল ফেলো-ই রয়ে গেলে কেন?”
“দুটোর মধ্যে তেমন কোনও ফারাক নেই। তাই অত ভাবিনি…”
“অবশ্যই ফারাক আছে। পোস্ট-ডক্টরাল অ্যাসোসিয়েটরা স্যালারি পায়, ফেলোরা পায় স্টাইপেন্ড! অ্যাসোসিয়েটদের নাম ইউনিভার্সিটি পে-রোলে থাকে, তারা এমপ্লয়ি হিসেবে গণ্য হয়, চিকিৎসার খরচাপাতি পায়, আরও হাজার সুবিধের হকদার তারা।”
“একই সঙ্গে তাদের গলায় একটা বকলস থাকে, তারা দু’পা এগোতে গেলে ইউনিভার্সিটি এক পা পিছনে টানে…”
“পিছনে টানলে না-হয় পিছিয়ে আসতে। কিন্তু আসল কারণ তো সেটা নয়। কারণটা হল, ফেলো-দের প্রতি মুহূর্তে পারফর্ম করতে হয় না গ্রান্ট পাওয়ার জন্য। তারা আক্ষরিক অর্থেই অনেক বেশি স্বাধীন…”
“হ্যাঁ, সেই কারণেই…”
“অনেক কম সুবিধা সত্ত্বেও, তুমি ফেলো-ই থেকে গিয়েছ। অ্যাসোসিয়েট হওয়ার চেষ্টাও করোনি। তানইলে তো তোমাকে প্রিন্সিপাল ইনভেস্টিগেটরের আন্ডারে কাজ করতে হত। সুবিধা নেওয়ার পাশাপাশি ডেডলাইন সামলাতে হত। তোমার সাধন-ভজনের অনেক ক্ষতি হয়ে যেত।”
“তুমি শেষে টন্ট করছ আমায়?”
“আমি মন থেকে বলছি সোনা, টন্ট করার ইচ্ছে আমার মনের ত্রিসীমানাতেও নেই। এই যে এখন তুমি আমার কাছাকাছি থাকবে বলে আটলান্টার পাট চুকিয়ে টেনেসি, শার্লট, চার্লসটন, অ্যালাবামা যেখানে হোক একটা চাকরি জোটাতে চাইছ, তার কারণও তো ওই একই। কাজের তত চাপ নেই, এমন কোথাও ঢুকতে পারলে তোমার আধ্যাত্মিক যাত্রা ব্যাহত হয় না।”
“বিকল্প আছে তোমার কাছে?”
“অবশ্যই। আর সেটা তোমার মাথাতেও ঘাই মারেনি, এমনটা মানতে আমি রাজি নই।”
“হেঁয়ালি না করে বললা।”
“হেঁয়ালির প্রশ্নই ওঠে না। আমেরিকার আইভি লিগ ইন্সটিটিউশনগুলোর নাম তুমি জানো না, তা তো নয়। সেরারা যেখানে পড়ায়, গবেষণা করে, সেরার সেরা হয়ে কেন সেখানে যাবে না তুমি?”
“হার্ভার্ডে পড়ালেই পড়ানো?”
“কেবল হার্ভার্ডের কথা তো বলিনি। ব্রাউন, ইয়েল, কর্নেল কী দোষ করল?”
“ব্রাউন ইউনিভার্সিটি কোথায়?”
“প্রভিডেন্সে।”
“আর ইয়েল?”
“কানেটিকাট। কিন্তু আমি কি জিকে-র পরীক্ষা দিচ্ছি?”
“দিলে পাশ করতে পারবে? প্রভিডেন্স আর কানেটিকাটে কীরকম ঠান্ডা পড়ে, তোমার কোনও আইডিয়া আছে?”
“ঠান্ডার জন্য চান্স ছেড়ে দেব? ওখানে মানুষ বেঁচে নেই?”
“কিন্তু আমি যদি কলকাতার মতোই ওয়েদার, এমন কোনও জায়গায় পেয়ে যাই, মরতে যাব কেন…”
“তোমার কথা শুনে দেওয়ালে মাথা ঠুকতে ইচ্ছে করে আমার। ঠান্ডা বেশি বলে নাকি লোকে আইভি লিগ ইন্সটিটিউশনে যাবে না! এ অনেকটা সোনা দেখে চোখ বন্ধ করে হাঁটার মতো ব্যাপার। আচ্ছা, নিউ জার্সিতে তো তত ঠান্ডা নেই, তাহলে প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি নয় কেন?”
“ইউ-পেন বাদ দিলে ফিলাডেলফিয়া শহরটাও তো দিব্য রঙিন।”
“ইয়ার্কি মেরো না। আছে আমার প্রশ্নের উত্তর তোমার কাছে?”
“না নেই। কিন্তু তোমার কাছেও আমার প্রশ্নের উত্তর নেই অনসূয়া। কী আছে কি ‘আইভি লিগ’ শব্দটার মধ্যে প্রচুর মশলা দেওয়া খাবার মানেই ডাল-ভাত-আলুভাজার চেয়ে সুস্বাদু?”
“এসব কুযুক্তি দিয়োনা। যে সুখ’ আইভি লিগের একজন হয়ে পাওয়া যায়…”
“আমি পাব না। আমার যা খ্যাতি, প্রতিপত্তি হওয়ার, তা ওই তথাকথিত সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েই জুটবে। আর যদি না পাওয়ার হয় তা হলে দরকার নেই। আমার এক বন্ধু বলত যে এই ‘ফ্যাসিজ়ম অফ হ্যাপিনেস’ থেকে মুক্তি আবশ্যক। সবাই সবসময় তুরীয় অবস্থায় থাকতে পারে না। যন্ত্রণা, বেদনা জীবনের জরুরি অঙ্গ, তারই ভিতর থেকে সুখ উঁকি মারবে মাঝে-সাঝে, কুয়াশার ভিতর থেকে রোদ যেভাবে উঁকি দেয়।”
“এইসব তোমার কোনও বন্ধুর কথা, না তোমার নিজেরই?”
“সন্দেহ করাও শুরু করলে?”
“সন্দেহ নয়, জাস্ট ভাবছিলাম।”
“ঠিকই বলেছ, সেরকম কোনও বন্ধুই নেই আমার। হয়নি। হলে, কী নিয়ে কথা বলতাম? সব আলোচনাই তো সেভিংস, নয়তো সেক্স কিংবা পলিটিক্স নিয়ে। তুমি খুব খারাপ ভাবতে পারো, কিন্তু সদ্য পরিচিতদের সঙ্গে কথা শুরু হলেই, কাশীর সেই পাগলা সাধু আত্মানন্দের কথা মনে পড়ে যায় আমার। সারাদিন এই ঘাট থেকে ওই ঘাটে ঘুরে গঙ্গার জল পরীক্ষা করে বেড়াতেন আত্মানন্দ। পছন্দ হলে মাথায় দিতেন, নয়তো মুখের ভিতরে নিয়ে কুলকুচি করে ফেলে দিতেন। সেই সাধু কী বলতেন জাননা? বলতেন, ‘তোরা বলিস মানুষ। আমি তো মানুষ দেখি না। আমি দেখি কারওর ভিতর শকুন, কেউ বা শেয়াল, কারওর মধ্যে যাঁড়, কারওর ভিতর বাছুর, কিংবা কুকুর। মানুষ পাই কই?’”
“আমি তোমায় অনর্থক কষ্ট দিলাম। আমার মানসিকতাটাই এরকম। ক্ষমা করে দিয়ো।”
“ক্ষমার প্রশ্নই ওঠে না। তুমি যা মনে করেছ, বলেছ।” উত্তরণ উঠে দাঁড়ালেন।
“আবার আসবে তো? নাকি রাগ করে…” অনসূয়া কথাটা শেষ করল না।
“আমি না এলে, তুমি যাবে। আমরা তো স্বামী-স্ত্রী। আর স্বামী-স্ত্রী তো সাত দিনের জন্য হয় না, সারা জীবনের জন্য হয়।”
“আমি তোমার স্ত্রী, শুধু এটাই কি তোমার কাছে যাওয়ার ভিসা আমার? তুমিও কি কেবলমাত্র স্বামীর পরিচয়ে আমার কাছে এসছে?”
“এই তর্কগুলো পরেও করা যাবে অনসূয়া। তুমি এখন অসুস্থ।”
“আমি তর্ক করিনি, একটা প্রশ্ন করেছি। তার উত্তর না পেলে আরও অসুস্থ হয়ে যাব। প্লিজ় বোসো আর-একটু। একবার বলো, একা আমিই কি ভালবেসে এলাম তোমাকে, তুমি কি কোথাও কিছু ফিল করো না?”
“আমার অনুভব আমি তো তোমার মতো করে ব্যক্ত করতে পারি না। তা ছাড়া আমার মনে হয়, ‘ভালবাসি’ বলে ভালবাসা জাহির করারও কোনও অর্থ হয় না। সারা জীবনের একাগ্রতা দিয়ে ভালবাসা বোঝাতে হয়।”
“আমি তোমার গুরু নই উত্তরণ, আই অ্যাম জাস্ট অ্যানাদার রেচেড গার্ল, হু হ্যাপেনস টু লাভ ইউ, হোপলেসলি, শেমলেসলি অ্যান্ড…”
“ফিয়ারলেসলি৷” উত্তরণ অনসূয়াকে কথাটা সম্পূর্ণ করতে না দিয়ে বলে উঠলেন।
আধশোওয়া হয়ে নিজের হাতদুটো বাড়িয়ে দিল অনসূয়া।
উত্তরণ মাথা ঝুঁকিয়ে চুমু খেলেন ওকে।
মহাকাল একটা মুহূর্তে এসে স্থির হল।