২০. পরের চার-পাঁচটা বছর

২০

পরের চার-পাঁচটা বছর যেন ঝড়ের বেগে উড়ে গেল। অনসূয়া নিজের পিএইচ ডি শেষ করে মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পোস্ট-ডক্টরাল ফেলো হিসেবেই যোগ দিল। উত্তরণ নর্থ ক্যারোলাইনা রাজ্যের ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছিলেন, আইভি লিগের সদস্য না হলেও যার খ্যাতি আমেরিকার সর্বত্র। কিন্তু মেরিল্যান্ডে প্রাচ্য দর্শনের একজন অধ্যাপকের পদ খালি হতেই, ডিউক-এর চাকরি ছেড়ে দিয়ে মেরিল্যান্ডে চলে এলেন উত্তরণ।

“ডিউক ছেড়ে লোকে হার্ভার্ডে যায়, উনি মেরিল্যান্ডে এলেন!” অনসূয়া স্বগতোক্তি করল।

“আমাদের ভিতরের এই তিন-চার ঘণ্টার দূরত্বটা অনেকদিন চলছে বলে তোমার মনে হয় না?”

“কী করব, আমি তো ডিউক-এ পেলাম না। পেলে চাকরি ছাড়তে হত তোমাকে।”

“তোমার কী মনে হয় জানি না, কিন্তু আমার আমেরিকার প্রায় সবক’টা শহরকেই একরকম লাগে। আমাদের দেশে অনেক দারিদ্র্য, কিন্তু একটা বৈচিত্র্যও রয়েছে। কাশীর সঙ্গে পটনাকে কেউ গুলিয়ে ফেলতে পারবে না হাজার চেষ্টা করেও শান্তিপুর আর নবদ্বীপও আলাদা-আলাদা বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। কিন্তু এখানে যে শহরেই যাই, হরেদরে সেই একইরকম। হয়তো অত চমৎকার রাস্তাঘাট বলেই…”

অনসূয়া থামিয়ে দিল উত্তরণকে, “মোটই না। নিউ ইয়র্ক, আর-পাঁচটা শহরের মতো নাকি?”

“নিউ ইয়র্ক আলাদা, শিকাগো বা সান ফ্রানসিসকোও আলাদা। কিন্তু সংখ্যায় ক’টা এই শহরগুলো? বেশির ভাগই ওই থোড়-বড়ি-খাড়া… বাহ্যিকভাবে যাও বা আলাদা, ভিতরে সব এক।”

“কী বলছ তুমি? আমেরিকার দক্ষিণের লোক ফিউডাল মানসিকতার, উত্তরের লোক অনেক মুক্তমনা।”

“সেটা আপাত-ধারণা অনসূয়া। উত্তরের কারখানাগুলোর জন্য প্রচুর শ্রমিক দরকার ছিল। তারা তুলোখেতে আটকে থাকলে অসুবিধে হচ্ছিল কারখানার মালিকদের। ওহায়ো নদীর ওপাশে থাকলে ক্রীতদাস আর সাঁতরে এপারে চলে এলে ফ্রি-ম্যান, এই গল্পগুলো অর্থনৈতিক প্রয়োজন থেকেই উঠে এসেছে। তাই বলে তাদের জুতোয় অন্য কেউ পা গলালে উত্তরাংশের লোকেরা কিছু কম প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। হ্যাঁ, দক্ষিণে গুলি করে মেরেছে, জ্যান্ত পুড়িয়ে দিয়েছে, কিন্তু বস্টনে যখন সাদাদের স্কুলে কালোদের অ্যাডমিশন দেওয়া শুরু হল, তখন রায়ট বাধেনি?”

“আমাদের বাচ্চা হলে, কোন স্কুলে পড়বে? সাদাদের না কালোদের?”

উত্তরণ এই প্রশ্নটার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না, খানিকটা চমকে গিয়ে বললেন, “মানুষের স্কুলে পড়ুক, সেটুকুই চাইব। কিন্তু এই দেশে বা এই পৃথিবীতেই, তেমন স্কুল আদৌ আছে কি না…”

“না থাকলেও, বাচ্চা তো একটা চাই-ই। আমি তো সে কারণেই অ্যাসোসিয়েট হলাম না, ফেলো হয়েই রইলাম। মনে আছে, কত ঝাড় দিয়েছিলাম তোমায়?”

“আমরা কি সত্যিই প্রস্তুত সন্তানের জন্য? যে যার নিজের কাজ নিয়ে, পড়াশোনা নিয়ে এত ব্যস্ত আমরা…”

“নোবেল প্রাইজ় যারা পায়, তাদের বাচ্চা হয় না? সেদিন একটা আর্টিকল পড়ছিলাম নোবেল লরিয়েটদের পারিবারিক জীবন নিয়ে। তিনটে-চারটে করে বাচ্চা প্রত্যেকের…”

“ওরা পারে।”

“আমরাও পারব। তুমি যখন মেরিল্যান্ডে চলেই এসেছ, তখন…”

“কিন্তু আমাদের নিজেদের বাড়ি-ই তো নেই এখনও…”

অনসূয়া অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল, “বহতা পানি আর রমতা যোগী। আমার সন্নিসি ঠাকুর যে এখন মার্কিন মুলুকে বাড়ি বানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন! শোনো, বাড়ি পাঁচ বছর পরেও কেনা যাবে, কিন্তু বাচ্চা আসতে যত দেরি হবে তত কমপ্লিকেশন বাড়বে…”

অনসূয়ার আগের কথাটায় খানিকটা আঘাত পেয়েই হয়তো উত্তরণ রোগে উঠলেন, “বাচ্চা-বাচা করে খেপে উঠলে কেন হঠাৎ? মাথার ঠিক আছে তো?”

“মাথা তোমারই ঠিক নেই। অবশ্য তুমি তো সমাজে বাস করো না, তোমার ভাবের রাজ্যে থাকো, তাই ঠিক থাকলেই বা কী আর না থাকলেই বা কী? উইক এন্ড পার্টিগুলোয় যেতে হলে বুঝতে আমার কথা।”

“কেন যাব? অন্যের বউয়ের কোমর ধরে লোকে নাচছে, তা দেখতে?”

“তুমি কি নিজের বউয়ের কোমর ধরে কোনওদিন নেচেছ?”

“তোমার থেকে এই প্রশ্নটা আশা করিনি। যখন করলেই, তখন জিজ্ঞেস করি, তুমি কি সেরকম কোনও আশা নিয়ে আমাকে বিয়ে করেছিলে?”

“না। করিনি।”

“তা হলে হিমালয় পর্বতের সামনে দাঁড়িয়ে সমুদ্রের ঢেউ দেখতে চাইছ কেন?”

“সবসময় দার্শনিকের মতো বাণী দিয়ো না তো?”

“কী করব, দর্শনই যে আমার বিষয়। আমি তো ট্যাঙ্গো নাচে পিএইচ ডি করিনি।”

অনসূয়া ফুপিয়ে উঠল, “তুমি জানো না, আমাদের নিয়ে আলোচনা হয়? আমাদের আদৌ কোনও সেক্স লাইফ আছে কি না, সেটাই এখানকার অনেকের গবেষণার বিষয়। আমার কানে আসে সব।“

“গসিপটাই এখন গবেষণা নাকি? কিন্তু আমাদের তো উইকএন্ড রিলেশনশিপ। আমি যেমন মেরিল্যান্ডে আসি, তুমিও তো ডারহ্যামে যাও। কই, আমি তো শুনিনি কিছু।”

“একটা ছেলেকে শুনতে হয় না, মেয়েকে হয়। তা ছাড়া কলম্বিয়া কিংবা ডারহ্যামে ক’টা আর বাঙালি, এখানে বাঙালি সংখ্যায় অনেক বেশি।”

“চুলোয় যাক সংখ্যা। স্বামী বিবেকানন্দ যখন আমেরিকা জয় করে ভারতে ফিরে গিয়েছিলেন, তার পরও তৎকালীন মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন বেলুড় মঠকে ‘প্লেজ়ার হাউস’ ছাড়া অন্য কিছুর স্বীকৃতি দিতে চায়নি। বিবেকানন্দের কিছু এসে গিয়েছে তাতে?”

“তুমি বিবেকানন্দ নও। আর শোনো, সম্রাটের দরবার, গৃহস্থের বেডরুম, সন্ন্যাসীর ভজন-কুটির… সন্ন্যাসী হতে পারেনি বলে তোমার বেডরুমটা তো আর মন্দির হয়ে যাবে না।”

“এসব কী বলছ অনসুয়া?”

“কী বলছি জানি না। কিন্তু আমি আর এত কথা নিতে পারি না।” অনসূয়া চুপ করে গেল।

কিন্তু ও যে নিঃশব্দে কাঁদছে, উত্তরণের বুঝতে অসুবিধে হল না।

উত্তরণ ইউনিভার্সিটিতে যাবেন বলে বেরিয়ে গেলেন। তখনকার মতো ব্যাপারটা ধামাচাপা পড়ে গেল। হয়তো তলিয়েই যেত, কিন্তু সপ্তাহখানেকের মধ্যেই মেরিল্যান্ডের একটা কলেজ ক্যাম্পাসে একজন সাইকোপ্যাথ লাইট মেশিনগান চালিয়ে ষোলোটা ছেলেমেয়েকে পাঁচ মিনিটের মধ্যে খুন করে দিল। হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে যুঝতে থাকল আরও দশ-বারোজন।

তাদের মধ্যে একজন করে যখন মারা যেতে থাকল, শিউরে উঠতে লাগলেন উত্তরণ। খবরের কাগজে পড়লেন, টিভিতে দেখলেন, খুনি নাকি মানসিকভাবে অসুস্থ। আচ্ছা, একটা বাইশ-তেইশ বছরের ছেলের মধ্যে কতখানি অসুস্থতা থাকতে পারে যে, সে এতগুলো লোককে গুলি করে মেরে দেবে?

প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে একা হয়ে যেতে শুরু করলেন উত্তরণ। কিন্তু সেই একা হয়ে যাওয়ার মুহূর্তেও ওঁর মনে হচ্ছিল, বৈরাগ্যের ভিতরে একটা মায়া থাকা চাই। সেই মায়ার স্বাদ দিয়েছিলেন বলেই ব্রহ্মচারী ঠাকুর লক্ষ-লক্ষ ভক্ত-শিষ্যের আশ্রয় হয়ে উঠেছিলেন। মায়া ছাড়া বৈরাগ্য, মাখন ছাড়া পাউরুটির মতোই রুক্ষ।

খরখরে একটা জীবনের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে উত্তরণ অনুভব করছিলেন যে পৃথিবীতে ধর্মনিষ্ঠ কামের প্রয়োজন আছে। মৃত্যুর ওই ঘনঘোর বীভৎসতার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে একমাত্র জন্ম। আর প্রাণীর জন্ম তো কামকে বাদ দিয়ে সম্ভব নয়।

অনসূয়া সেদিন অনেক রাত অবধি পড়ছিল। উত্তরণ পিছন থেকে গিয়ে একটা হাত রাখলেন ওর পিঠে। অনসূয়া তাকাল উত্তরণের দিকে। নিজের বরের চোখে এমন কিছু দেখল, যার পরে আর কোনও সংশয় থাকে না। আর থাকে না বলেই অনসূয়া উত্তরণের বুকে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করল নিশ্চিন্তে। উত্তরণ জড়িয়ে ধরলেন অনসূয়াকে। জোরে।

তারপর একটা অন্তহীন স্ফুলিঙ্গে বারুদ হয়ে নিজেকে মিশিয়ে দিতে-দিতেও উত্তরণের মাথার ভিতর বুলেটে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া অসংখ্য মৃতদেহ ভেসে উঠল। উত্তরণ প্রাণপণ চেষ্টায় দৃশ্যটাকে সরিয়ে দিতে চাইলেন।

বাইরের আকাশে ধ্রুবতারাটা তখন জ্বলজ্বল করছে। অনেক মৃত্যুর মধ্যে একটা জীবনের মতো।

২১

হাতে মেহেন্দি করা থাকলে যেমন হাতের আসল রং বোঝা যায় না, সংসারের মধ্যে ডুবে থাকলেও তেমন বড়-বড় চিন্তা কোথায় তলিয়ে যায় নিত্যি ডামাডোলের চাপে। সেই চাপমুক্তির রাস্তা হিসেবে যখন শরীর সামনে এসে দাঁড়ায়, উত্তরণের মতো মানুষের বিস্ময়ের অন্ত থাকে না। যে শরীরকে চিরকাল এড়িয়ে এসেছেন, যার উল্লেখেও অস্বস্তি বোধ করেছেন, সেই শরীর যে আদতে সেতু হয়ে দুটো মানুষকে একটা অচ্ছেদ্য বন্ধনে বেঁধে ফেলতে পারে, সেটাই, প্রায় প্রতিদিন আবিষ্কার করছিলেন আর উত্তরোত্তর অবাক হচ্ছিলেন, উত্তরণ।

অনসূয়া যখন ওঁর কাছে এসে গায়ে হাত রাখত, আলতো করে কামড়ে ধরত গাল, চুমু খেত গলায়, উত্তরণ বইয়ের পৃথিবী থেকে সরে এসে অনসূয়ার সঙ্গে এমন একটা পৃথিবী তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে উঠতেন, সভ্যতার আদিকাল থেকে যে পৃথিবী, কোনও সঙ্গী বা সঙ্গিনী ছাড়া মানুষ একা তৈরি করতে পারেনি। তার জন্য একটা অপরাধবোধ যে মাঝে-মাঝে জেগে উঠত না তা নয়, কিন্তু যৌনতা তো একটা অ্যাডভেঞ্চারও বটে! অ্যাডভেঞ্চারের সামনে কোনও অপরাধবোধ টিকতে পারে?

একদিন রাত্রে ভালবাসাবাসির পর অনসূয়া বলল, “আমি তোমার মধ্যেই ঈশ্বরকে দেখেছি বলে কিনা জানি না, আমি চাই তোমার প্রচুর খ্যাতি হোক। ইন ফ্যাক্ট একটা ক্রেজ় দেখতে চাই তোমায় ঘিরে। অনেক-অনেক মেয়েরা ছুটছে তোমার অটোগ্রাফ নিতে…”

“মানে?”

“মানে, কোনও খেলোয়াড় বা আর্টিস্টের পিছনে যেমন ছোটে।”

“কিন্তু আমি তো এই দুটোর কোনওটাই নই। সবার কথা বাদ দাও, দু’-তিনজন আমার পিছনে দৌড়তে শুরু করলেও ঘাবড়ে যাব আমি।”

“আমার কিন্তু ভাল লাগবে, জানো! সেই যে এক বিখ্যাত শিল্পী বলেছিলেন, “নতুন মেয়েরা নতুন সংগীত সৃষ্টির অনুপ্রেরণা নিয়ে আসে আমার কাছে… নতুন-নতুন সম্পর্ক নতুন সুরের জন্ম দেয় আমার মধ্যে।” তুমিও হয়তো নতুন শীর্ষ ছোঁয়ার উদ্দীপনা পেতে সদ্যযুবতী মেয়েদের সান্নিধ্যে এলে… অবশ্য তাতে শেষমেশ আমারই কপাল পুড়ত।” অনসূয়া হেসে ফেলল।

অনসূয়া ঘুমিয়ে পড়ার পরও কথাটা জেগে রইল উত্তরণের মধ্যে। শেষে সুন্দরী মেয়েরা ওঁর সাফল্যের কারণ হবে? কোন সাফল্য? তিনি তো জানতেন যে সাফল্য মানে রাতের পর রাত জপে পার করে দেওয়া। ‘গু’ শব্দের অর্থ অন্ধকার আর ‘রু’ শব্দের অর্থ বিনাশ। গুরু তিনিই, যিনি অন্ধকার বিনাশ করে শিষ্যকে আত্মশুদ্ধির দিকে এগিয়ে দেন। সেই গুরুর চরণ-বন্দনা করে শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা পার করে দেওয়াই জীবন।

কিন্তু জীবনই তো ওঁকে পূর্বনির্দিষ্ট ধারণা থেকে সরিয়ে নতুন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন করেছে। কীভাবে অস্বীকার করবেন তাকে? সন্ন্যাসী নিজের আগের জীবনকে পুড়িয়ে দিয়ে সন্ন্যাসাশ্রমে ঢোকে, উত্তরণের ক্ষেত্রে সন্ন্যাসটাই পূর্বাশ্রম।

নাকি ভুল ভাবছেন? সন্ন্যাস তো উত্তরণ পাননি। ত্রিকালজ্ঞ গুরু নিশ্চয়ই জানতেন উত্তরণের জীবন কোন রাস্তা নেবে, তাই তিনি সন্ন্যাস নিতে দেননি ওঁকে। এবার যে গার্হস্থ্যে প্রবেশ করেছেন, তাতেই মনোনিবেশ করবেন না কেন? সন্ন্যাসী হতে গিয়ে হেরেছেন। সংসারী হতে গিয়েও হারবেন?

তার থেকে অ্যাকাডেমিকসের রাজনীতি বুঝে এগোবেন, কোন জার্নালে লেখা পাঠাবেন আর কোথায় নয়, কোন সেমিনারে যাবেন আর কোনটায় যাবেন না, সেই সিদ্ধান্তগুলো আরও নিখুঁতভাবে নেওয়ার চেষ্টা করবেন। সাঁতার কাটতে-কাটতে যেমন মাটিতে হাঁটা যায় না, সন্ন্যাসী হয়েও সংসার করা যায় না। মূর্তি গড়তে গেলে হাতে কাদা মাখতেই হবে।

কাদা-ই বা ভাবছেন কেন? এই পুঁজিবাদী দেশটা মানুষকে শিক্ষায়-স্বাস্থ্যে যতটা সুবিধা দেয়, ক’টা সমাজতান্ত্রিক দেশ তা দিতে পারে? নতুন করে ভাবতে শুরু করলেন উত্তরণ। যে পুঁজির বিরুদ্ধে এত চেঁচামেচি হল, সেই পুঁজি নিজেকে মস্ত সব কারখানা থেকে সরিয়ে পরিষেবায় স্থানান্তরিত করতে শুরু করে দিয়েছে। আর সঙ্গে-সঙ্গে মিইয়ে যাচ্ছে বিক্ষোভ। কারখানার শ্রমিকরা স্ট্রাইক করতে পারে, কিন্তু হোটেলের ওয়েটার বা হাসপাতালের নার্স শোষিত হলেও ধর্মঘটের রাস্তায় যেতে পারে না সচরাচর। সমাজ ততটা স্পেস দেয় না তাদের।

উত্তরণ নিজের ক্লাস-থিসিস-লেকচারের মধ্যে ওই স্পেস-এর কথা ভাবতেন। সন্ন্যাসীর আসনটুকু হলেই চলে, কিন্তু সংসারীকে যে নিজের সন্তানের ব্যবস্থা করতেই হয়। অনসূয়া কনসিভ করার পর থেকে ওর শরীরের পরিবর্তনগুলো যত প্রকট হচ্ছিল, আগামীর চিন্তা তত বাড়ছিল উত্তরণের।

হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের অন্তর্গত কাওয়াই বলে একটা জায়গায় বেড়াতে গিয়েছিলেন উত্তরণ অনসূয়ার সঙ্গে। সেই দ্বীপে অজস্র নারকেলগাছের ভিতর দিয়ে সমুদ্রের দিকে হেঁটে গেলে দেখা যেত একটা লাইটহাউস। তার দিকে তাকিয়ে উত্তরণ প্রার্থনা করতেন, ওঁর আর অনসূয়ার জীবনের চলার পথটা যেন ব্রহ্মচারী ঠাকুর আলোকিত করে রাখেন, যতদূর দেখা যায় ততদূর অবধি।

অনসূয়ার যখন অ্যাডভান্সড স্টেজ, তখন একদিন উত্তরণ জিজ্ঞেস করলেন, “জ্ঞান যদি আপেক্ষিক হয়, মানুষ তার ‘পরম’-এর উপলব্ধি করবে কী করে?”

অনসূয়া উত্তরণকে অবাক করে দিয়ে বলল, “দরকার নেই উপলব্ধির। ‘পরম’-এর সাহায্যে তো জীবন চলে না। প্রতিটা মুহূর্তই যখন ‘চরম’ পরিস্থিতির সামনে এনে দাঁড় করায়, সেটার মোকাবিলা করাই জরুরি।”

‘সবসময় মোকাবিলার মোডে থাকলে আমরা কেবল শরীর হয়েই বেঁচে থাকব। সেটা কি বাঁচা?”

“কে বলল বাঁচা নয়? ওভাবেই তো বাঁচে মানুষ। রক্তে, মাংসে, চেষ্টায়, চরিত্রে। এক-একটা এক্সপেরিমেন্টে অংশগ্রহণ করে। আমরা শুধু পর্যবেক্ষক হতে পারি না, পরীক্ষায় ভাগও নিতে হয়। আর সেই প্রক্রিয়াটা আমাদের এমনভাবে পালটাতে থাকে যে অন্যদের পর্যবেক্ষণের বস্তু হয়ে উঠি আমরা।”

অনসূয়ার বোধের বিস্তৃতি ছুঁয়ে গেল উত্তরণকে। ওর চুলগুলো কপাল থেকে সরিয়ে দিতে-দিতে বললেন, “ঠিকই বলেছ। পর্যবেক্ষক থেকে পরীক্ষার্থীতে উত্তীর্ণ হওয়াটাই জীবনের ধর্ম।”

পরদিন ভোরেই ব্যথা শুরু হল অনসূয়ার। নাইন-ওয়ান-ওয়ান এদেশের ব্ৰহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর, যে কোনও বিপদে ডাকলেই হাজির, কিন্তু উত্তরণ মনস্থির করলেন, নিজেই গাড়ি চালিয়ে অনসূয়াকে নিয়ে যাবেন হাসপাতালে।

এখানে সন্তানের জন্মের সময় বাবার উপস্থিতি ভীষণভাবে কাম্য। বাবা-ও যাতে সন্তানের জন্মের মুহূর্তের সঙ্গে একাত্ম বোধ করতে পারে, সেটা নিশ্চিত করতে, ‘ড্যাডি’স স্ক্রাবস’ বলে বিশেষ একরকম পোশাক বানিয়েছে এরা। অনসূয়া যখন লেবারে, সেই পোশাক গায়ে দিয়ে উত্তরণ ভাবছিলেন পৃথিবীর সেই প্রাচীন দার্শনিকের কথা, যিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন, পৃথিবীর সব জিনিস যেরকম, তা আসলে সেরকম কী কারণে? তিনি সারা পৃথিবীর সূত্র হিসেবে জলকে নির্বাচন করেছিলেন। কেন নির্বাচন করেছিলেন? জলের মধ্যে গর্ভস্থ সন্তানের বাস, তাই?

তারপর অন্য একজন দার্শনিক এলেন। তিনি সবকিছু বিচার করে বললেন, জল নয়, বাতাসই পৃথিবীর সবকিছুর সূত্র। এই জল আর বাতাসের মধ্যে সম্পর্ক ঠিক করতে-করতেই দর্শনের কতদিন চলে গেল। গেল, কারণ দর্শন তো কেবল ঈশ্বর আছেন না নেই, ঈশ্বর খাচ্ছেন না ঘুমোচ্ছেন, তার রূপরেখা নয়! দর্শন ধর্মের বিকল্প হয়ে উঠতে চায়নি। বরং ধর্ম আর কিংবদন্তিকে বিজ্ঞানের আলোয় বিশ্লেষণ করার নামই হয়তো দর্শন।

উত্তরণের মনে পড়ছিল সক্রেটিসের আগে জন্মানো গ্রিক দার্শনিক পারমেনিডিস-এর কথা। তিনি চেয়েছিলেন এমন একটা যুক্তির ধারা তৈরি করতে, যেটা ইন্ডিপেন্ডেন্ট অফ অবজারভেশন, যেখানে দেখার দ্বারা বিচার করতে হয় না সবকিছুর। কিন্তু বিশ্বজুড়ে মানুষ যা দেখছে, তার দ্বারাই চালিত হচ্ছে। ওই যে এক রূপসী হেঁটে যাচ্ছে, ব্যস তার পিছনে ছুটল দশজন। ওই যে এক দম্পতি হাত ধরাধরি করে রাস্তা পেরোচ্ছে, সবাই ধরে নিল, তারা ভীষণই সুখী। যা দেখছি তা যে ঠিক না-ও হতে পারে, ‘বেশ’-এর বদলে, ‘ছদ্মবেশ’ হতে পারে, কার সময় আছে তা নিয়ে ভাবার?

উত্তরণের ডাক এল যখন, ভাবনায় বাধা পড়ল। এদেশে যেহেতু কেউ লিঙ্গের ভিত্তিতে গর্ভপাত করায় না, তাই এখানে ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণ কোনও অপরাধ নয়। উত্তরণ আর অনসূয়া জানতেন যে একটি কন্যার বাবা-মা হতে চলেছেন। সেই মেয়ের একটি নাম ঠিক করেও অনসূয়াকে জানিয়েছিলেন উত্তরণ।

স্বাভাবিকভাবেই চলছিল সব, কিন্তু মেয়ের জন্ম-মুহূর্তে যখন উত্তরণ নিজেও জন্মাচ্ছেন বাবা হিসেবে, চারপাশটা ঝাপসা হয়ে আসছিল। এরা সহজে সিজ়ার করতে চায় না, কিন্তু অনসূয়ার ক্ষেত্রে যখন লেবার পেন ওঠা সত্ত্বেও কিছু জটিলতার কারণে করতেই হল, উত্তরণ কেবিনে থেকেই দেখলেন পুরো প্রক্রিয়াটা। অনসূয়ার ভিতর থেকে রক্ত-মাংসের পুঁটুলিটা যখন এই পৃথিবীর অংশ হয়ে উঠল, উত্তরণের পা কেঁপে গেল সামান্য।

কিন্তু শুধু পা নয়, সারা পৃথিবী কাঁপতে শুরু করল যখন পরদিন হাসপাতালে যেতেই দু’জন ডাক্তার ওঁকে জানালেন যে খুব সম্ভব কনজেনিটাল আজেনেসিস অফ ভোকাল কর্ড নিয়ে জন্মেছে ওঁর মেয়ে। আর সেই কারণে সে কথা বলতে পারবে না ঠিকঠাক।

“কিন্তু আমি যে ওর কান্নার শব্দ…”

উত্তরণকে থামিয়ে দিয়ে একজন ডাক্তার বললেন, “অস্পষ্ট কিছু শব্দ আপনার বেবি সারাক্ষণই উচ্চারণ করতে পারবে, কিন্তু তার বেশি আশা না করাই ভাল।”

“আজীবনই কি আমার মেয়ের এই অবস্থা থাকবে?”

“আগামী দিনে কী হবে, এখনই বলা যায় না। কিন্তু আজকে দাঁড়িয়ে বিরাট পজ়িটিভ কোনও আশ্বাস দিতে পারছি না।” লম্বা ডাক্তারবাবু বলে উঠলেন।

উত্তরণের চারপাশের পৃথিবী তখন গুটিয়ে ছোট হয়ে আসতে শুরু করেছে। যে মেয়ের নাম রাখবেন ভেবেছেন ‘মন্ত্র’, সেই মেয়ে আদৌ কিছু উচ্চারণ করতেই পারবে না? কীভাবে কথাটা বলবেন অনসূয়াকে?

ঘোর ভেঙে গেলেও আর-একটা ঘোরেই ঢুকে পড়ে মানুষ। উত্তরণ সেই ঘোরের ভিতর থেকে চেঁচিয়ে উঠলেন, “বোবা? আমার মেয়ে বোবা হয়ে জন্মেছে?”

২২

অনেক বছর কেটে যাওয়ার পর একটা ঘটনার দিকে যখন ফিরে তাকানো যায়, তখন তার অভিঘাত আপনিই মোলায়েম হয়ে আসে। উত্তরণ ভাবছিলেন, হাসপাতাল থেকে মন্ত্রকে আর অনসূয়াকে বাড়িতে নিয়ে আসার কথা। সবকিছু সুন্দর, তবু সবটার গায়েই যেন একটা স্লানচ্ছায়া লেগে আছে। ভোকাল কর্ড অগঠিত থাকলে এমনটা নাকি হয়! অপারেশন করে খুব যে কিছু লাভ হবে তা নয়, তবু একটা চেষ্টা করা যেতে পারে। কিন্তু সে এখন নয়, পরে। কত পরে? প্রতিটা দিন যখন মানুষের নিজেকে ব্যর্থ মনে হতে থাকে, তখন সে কতটা অপেক্ষা করতে পারে অনাগত কোনও তারিখের জন্য? সব ঠিক হয়ে যাওয়ার ক্ষীণ আশায়?

“সবার তো নর্মাল বাচ্চা হয়, আমাদের বাচ্চা এরকম হল কেন?” অনসূয়া মন্ত্রকে কোল থেকে নামিয়ে বলে উঠল একদিন।

“ওর ভোকাল কর্ড ঠিকমতো তৈরি হয়নি কোনও কারণে…”

“তুমি চুপ করো তো, কর্ড-ফর্ডের গল্প শুনিয়ো না। আমাদের মেয়ে বোবা! ওই ল্যারিংক্স আর ফ্যারিংক্স দিয়ে কখন কী উচ্চারণ করবে, তার ভরসায় ওকে সুস্থ, স্বাভাবিক বলে মানাটা চরম ভণ্ডামি। আমার কথা হচ্ছে, আমাদের বংশে তো কেউ বোবা নেই… যতদূর জানি, তোমাদের বংশেও না। তা হলে বেছে-বেছে আমাদের মেয়েটাই এরকম হয়ে জন্মাল কেন?” অনসূয়া কীরকম তীব্র গলায় জানতে চাইল।

অনসূয়ার মনে নিজের মেয়ে সম্বন্ধেই একটা অনীহা জন্ম নিয়েছে, উত্তরণের মনে হল। ও মন্ত্রকে ব্রেস্টফিড করায় তো ঠিকমতো? নাকি বাচ্চার যা প্রাথমিক অধিকার, তার থেকেই ওঁর মেয়ে বঞ্চিত? |

মেয়েকে দেখবেন বলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কাজ সেরে বাড়ি ফিরে আসতেন উত্তরণ। অনুভব করতেন যে সন্তানের জন্মের পর বাবা-মায়ের জীবন সন্তানের চাহিদা মতো চলে। বাচ্চা ঘুমোলে তারা ঘুমোত পারে, বাচ্চা জাগলেই আবার উঠে পড়তে হয়।

মন্ত্রর দেখভালে কোথাও যে কোনও ত্রুটি রাখত অনসূয়া, তা নয়। এমনকী উত্তরণ খুব কিছু সাহায্য করুন, তাও চাইত না। কিন্তু ভিতরে-ভিতরে একটা যন্ত্রণা লালন করত অহরহ। সেটাই বাস্ট করল সেদিন।

“তুমি চাওনি বলেই এমন হল।”

“আমি কী চাইনি?” অনসূয়ার কথা বুঝতে না পেরে উত্তরণ জিজ্ঞেস করলেন।

“সন্তান, সংসার কিছুই চাওনি। চেয়েছিলে সন্ন্যাসী হতে। কিন্তু পারোনি। সেই না-পারার দীর্ঘশ্বাস আমার সব ধ্বংস করে দিল।”

“কেন আবোল তাবোল বকছ?”

“আবোল তাবোল? তুমি কয়েকদিন আগে ডায়েরিতে লেখোনি এগুলো? এই যে, আমি পাতাটা ছিঁড়ে রেখেছি। তোমায় শোনাচ্ছি, শোনো।”

“তুমি আমার ব্যক্তিগত ডায়েরির পাতা…”।

“স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে আবার ‘ব্যক্তিগত’ কী? আমি পড়ছি তোমার লেখা, মন দিয়ে শোনো… “ঠাকুর চাননি আমি সংসারে প্রবেশ করি। চাননি কোনও মহিলার সঙ্গে আমার সংযোগ হোক। ঠাকুর তাঁর মন্ত্রকে আমার মধ্যে দিয়ে প্রচার করতে চেয়েছিলেন। আমি ঠাকুরের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছি। তার শাস্তি তিনি আমায় দিলেন। কিন্তু আমার সন্তান শাস্তি পেল কেন? তবে কি আমার সন্তানের মধ্যে দিয়েই আমি প্রতি মুহূর্তে অনুভব করব যে আমি নিজে সন্তান হয়ে কোন যন্ত্রণা দিয়েছি ঠাকুরকে? বাবা না হলে আমি বুঝতাম, বাবার কষ্ট কতটা! তাই কি আমায় বাবা করলেন ঠাকুর? আচ্ছা, বাসে সেই বোবা মেয়েটির পাশে বসিয়ে ঠাকুর কি আমায় একটা ইঙ্গিত দিতে চেয়েছিলেন যে আমি বিয়ে করলেও ওরকম সন্তানের বাবা হতে পারি?

উফ, আমি যে আর সহ্য করতে পারছি না! বুকটা গুঁড়িয়ে যাচ্ছে। বাবা হয়েও সন্তানের মুখ থেকে, ‘বাবা’ ডাক শুনতে না পাওয়ার এই ব্যথা…”

“এগুলো আমার মনে উড়ে বেড়ানো কতগুলো কথা। রানডম থটস, তার বেশি কিছু নয় অনসূয়া।”

“না, এগুলোই তুমি। তুমি বিশ্বাস করো যে আমার সঙ্গে জড়িয়েছ বলেই, বিকলাঙ্গ বাচ্চা জন্মেছে তোমার।”

“বিকলাঙ্গ কেন হবে? ও শুধু কথা বলতে পারে না!”

“সেটাই তো সবথেকে বড় পঙ্গুত্ব। তুমি সারা দুনিয়ায় মন্ত্র প্রচার করে ইন্টারন্যাশনাল গুরু হবে ভেবেছিলে… তা না পেরে সেই মন্ত্রের ভার আমার উপর চাপাতে চেয়েছিলে। আমি একটা সাধারণ কামনা-বাসনার মানুষ, আমি সেই ভার বইতে পারব কেন? পারিনি। বোবা বাচ্চার জন্ম দিয়েছি।”

“এসব বোলো না। আমি গুরুর শিষ্য হতে চেয়েছিলাম। গুরু নয়।”

“চেয়েছ, চেয়েছ। অবচেতনে চেয়েছ। আর মনে-মনে আমিও তোমাকে গুরুই ঠাওরেছি। তোমারই দীক্ষা নিতে চেয়েছি, নিয়েওছি মনে-মনে। কখনও তোমাকে বলিনি যে আমাকে ব্রহ্মচারী ঠাকুরের দীক্ষা পাওয়ার ব্যবস্থা করে দাও। তুমিও সেদিকে এগিয়ে দাওনি আমায়। কেন? কত স্বামী-স্ত্রী তো একই গুরুর দীক্ষা নেয়। আমার নিজের পিসেমশাই পিসিকে বিয়ের পরপরই দীক্ষা নেওয়াতে নিয়ে গিয়েছিল। তুমি আমায় নিয়ে যাওনি কেন? আজ আমারও দীক্ষা নেওয়া থাকলে হয়তো এই সর্বনাশ হত না আমাদের…”

“আমি বিশ্বাস করি যে দীক্ষা যদি কারওর পাওয়ার থাকে, তা হলে ঠাকুর নিজেই তাকে ডেকে নেবেন। আমাকে যেমন নিয়েছিলেন। রেফারেন্সে দীক্ষা হয় না। তোমার মনে যদি ঠাকুরের জন্য আকুলতা আসে, তবে ঠাকুর নিশ্চয়ই তোমায় দূরে রাখবেন না।”

“তোমার মনে তো এত আকুলতা ঠাকুরের জন্য! তোমার আশ্রমে ঢাকাই বন্ধ হয়ে গেল কেন?”

“কেউ আমার ঢোকা বন্ধ করেনি। হয়তো আমি কোনও কারণে সংকোচ বোধ করেছি, কিন্তু তাই বলে…”

“কথা ঘুরিয়ো না। তুমি নিজে আশ্রমে যাওয়ার জোর পাও না আর। এবং আমি যে গিয়েছি, মহারাজের সঙ্গে কথা বলেছি, তাতে তুমি খুব খুশি হওনি। মনে-মনে আমায় নিজের ক্রীতদাসী করেই রাখতে চেয়েছ কেবল…”

“উফ, অনসূয়া চুপ করো! এগুলো বলে নিজের পাপ বাড়িয়ো না।”

“পাপ তো করেছি তোমায় ভালবেসে। বাবার যে মত ছিল তা নয়, থাকলে পরে তো কলকাতায় বড় করে রিসেপশন পার্টি দিতেন একমাত্র মেয়ের বিয়ের, কই দেননি তো! বন্ধুরা বারণ করেছিল, কিন্তু আমি অন্ধ ছিলাম তোমার প্রেমে, তাই শুনিনি। সেই না-শোনার শাস্তি পাচ্ছি। সারা জীবন ধরে পেতে হবে, জানি। কারণ তুমি তো কোনওদিন আমায় ভালবেসে আমার কাছে আসোনি। যখন সেক্স চাগাড় দিয়েছে তোমার ভিতরে, তখনও ভেবেছ যে ঠাকুর যখন তোমার বিয়ে করায় রাগ করেননি, এতেও নিশ্চয়ই করবেন না। মনে-মনে একটা কাল্পনিক অনুমতি পেলে আমার দিকে এগিয়েছ, না পেলে এগোওনি। কখনও ভেবেছ যে আমিও একটা মানুষ, আমার ইচ্ছা-অনিচ্ছা তোমার ভক্তির রিমোটচালিত হতে পারে না চিরকাল?” অনসূয়া চিৎকার করে উঠল।

যেভাবে যন্ত্রে একটা পশুর শরীর টুকরো-টুকরো হয়, অনসূয়ার কথার অভিঘাতে সেভাবেই টুকরো-টুকরো হচ্ছিলেন উত্তরণ। অনসূয়ার বাবা চাননি? অনসূয়ার বন্ধুরা বারণ করেছিল ওকে উত্তরণের কাছে আসতে? কারা বন্ধু ছিল অনসূয়ার? ও তো উত্তরণের মতোই একা ছিল।

তিন বছরের মাথায় মন্ত্রর গলার আওয়াজ ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টায় একটা অপারেশন হল। কিন্তু ডাক্তাররা যা বলেছিলেন, বাস্তবেও তেমনটাই হল। মানে, লাভ হল না তেমন কিছু।

তারপর যতদিন যেতে লাগল, অনসূয়ার হতাশা বাড়তে লাগল। আর হতাশা বাড়লেই তা ক্রোধের চেহারা নেয়। সেই ক্রোধ সংসারের খুঁটিনাটি সবকিছুতে আছড়ে পড়তে লাগল। উত্তরণের বাড়িতে ফিরতে ভয় করত। আবার না ফিরলেও দায়িত্ব এড়াচ্ছেন, সেই গঞ্জনা শোনার আতঙ্ক তো ছিলই।

“পোস্ট-ডক্টরাল ফেলোশিপ তো পাঁচ বছরের বেশি দেবে না কোনও অবস্থাতেই। তুমি কোথায়-কোথায় অ্যাপ্লাই করবে ভাবছ?”

“ওকলাহোমা, নেব্রাসকা, কিংবা সিয়াটল, সান হোসে… কোথায় গেলে তোমার থেকে সবচেয়ে দূরে যাওয়া যায় বলো, সেখানেই অ্যাপ্লাই করব। তুমিও তো তা-ই চাও। চাও না?” অনসূয়া বলে উঠল।

“চাইলে তো আমি নিজেই চলে যেতাম। অন্য যে কোনও জায়গায়।”

“হ্যাঁ, আমি তো ভুলেই যাই, কত বড় পণ্ডিতের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে আমার। পৃথিবীর সব বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজা তার জন্য খোলা, কিন্তু সে শুধু আমায় দয়া করে এই মেরিল্যান্ডে পচে মরছে। তুমি চলে যাও, আইভি লিগ তোমায় ডাকছে, যাও। আমাকে নিয়ে, মেয়েকে নিয়ে ভেবো না। কেন ভাববে, সংসার তো তোমার জন্য নয়?”

“একশোবার আমার জন্য। আমি সংসার করব। সংসারই করব।” বলতে-বলতে অনসূয়ার দিকে এগিয়ে গেলেন উত্তরণ। ওকে জাপটে ধরে নিয়ে যেতে লাগলেন বিছানার দিকে। অনসূয়া নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিল। কিন্তু জীবনে প্রথমবার যে বলপ্রয়োগ করে, তার জোর কিছু বেশিই হয় সম্ভবত। তাই জিত উত্তরণেরই হচ্ছিল।

“কী চাও? সব ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর আবার কী চাও?” উত্তরণের কাছে নিজেকে সমর্পণ করতে-করতে জিজ্ঞেস করল অনসূয়া।

“নতুন করে বাঁচতে চাই।” চুমুর পর চুমুতে অনসূয়ার প্রায় দমবন্ধ করে দিলেন উত্তরণ।

“বাঁচাতে চাও, না?” শ্বাস নেওয়ার জন্য নিজের মুখটা উত্তরণের থেকে কয়েক সেকেন্ডের জন্য সরিয়ে অনসূয়া জিজ্ঞেস করল।

তখনই কর্কশভাবে বেজে উঠল বাড়ির ল্যান্ডলাইনটা। বাজতেই থাকল।

২৩

বাবার মৃত্যুর খবর পেয়ে দেশে ফিরতে চাইবে না কোন মেয়ে? অনসূয়া তবু প্রথমটা ইতস্তত করছিল, মন্ত্রকে ছেড়ে যেতে। কিন্তু উত্তরণই ওর টিকিটের ব্যবস্থা করে দিলেন। নিজেও সঙ্গে যেতে চেয়েছিলেন, মন্ত্রকে নিয়ে। কিন্তু অনসূয়া চাইল না। কথা বলতে না-পারা মেয়েকে নিয়ে আত্মীয়স্বজনের সামনে দাঁড়াতে অনসূয়ার অসুবিধে আছে, উত্তরণ বুঝতে পারলেন। জোর করলেন না তাই।

“তুমি পারবে তো, এই কয়েকটা দিন ম্যানেজ করতে?” এয়ারপোর্টে ঢোকার আগে জিজ্ঞেস করল অনসূয়া।

“তুমি নিশ্চিন্তে যাও, আমাদের নিয়ে কোনও দুশ্চিন্তা কোরো না।” উত্তরণ জবাব দিলেন।

দেশে ফেরার আগে চার দিনের কাজ উত্তরণ নিজেই করাতে চেয়েছিলেন অনসূয়াকে। কিন্তু অনসূয়া স্থানীয় একটি রাধাকৃষ্ণ মন্দিরে গিয়ে বাবার পারলৌকিক কাজ সেরে এল।

“আমি করালেও শাস্ত্র মেনেই করাতাম।” উত্তরণ বলেছিলেন।

“জানি। কিন্তু শ্বশুরের কাজ জামাই করাচ্ছে, ঠিক দেখায় না সেটা।” অনসূয়া জবাব দিয়েছিল।

“কোনটা ঠিক দেখায় আর কোনটা নয়, কোনটা সাংসারিক আর কোনটা নয়, সেই বোধ আমার কবেই বা ছিল?” উত্তরণ বিড়বিড় করে বললেন উত্তরে।

অনসূয়া শুনতেও পেল না।

মন্ত্রর প্রতিটা আওয়াজ যতই অস্ফূট হোক, শুনতে পেতেন উত্তরণ। হপ্তাদুয়েক ছুটি নিয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, প্রায় সারাক্ষণ নিজের মেয়ের সঙ্গেই কাটাতেন। সন্তান এবং পিতার মধ্যে যে মায়ানদী বয়ে চলে, তাতে ডুবতে-ডুবতে নতুন এক তটে ভেসে উঠতেন, যার নাম বন্ধন।

“মায়াই অচ্ছেদ্য। বাকি সব ছেদন করা যায়। এই মায়া থেকেই মহামায়ার উৎপত্তি৷” অনিলদা বলতেন।

মেয়েকে নিজের কোলে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়তে-পড়তে উত্তরণ ভাবতেন, যে সংসারে সবকিছুই নশ্বর, সেখানে একমাত্র মায়াই অনশ্বর?

অনসূয়ার ফেরার টিকিট ছিল গিয়ে পৌঁছনোর পনেরো দিনের মাথায়। কিন্তু সেই টিকিট দু’বার পিছোনোর পরে শেষে ক্যানসেল হয়ে গেল। উত্তরণ কয়েকবার ফোন করে একই কথা শুনলেন। বাবার টাকাপয়সা এবং সম্পত্তির বিলি-ব্যবস্থা করে আসতে হবে। অনসূয়ার দাদাও নাকি তা-ই চাইছে।

“থাকার মধ্যে তো উত্তর কলকাতার একটা বাড়ি। সেটা বিক্রি করতে হবেই বা কেন?”

“রেখেই বা কী হবে? কে দেখাশোনা করবে?”

“একটা কেয়ারটেকার রেখে দিলেই হয়।”

“কীরকম কেয়ারটেকার? আমি যেমন তোমার ছিলাম?” অনসূয়া অচেনা মানুষের মতো হেসে উঠল ফোনের ওপ্রান্তে।

অবাক হয়ে গেলেন উত্তরণ। আরও অবাক হলেন যখন অচেনা একটা আইডি থেকে নিজের মেল-এ কতগুলো ছবি পেলেন। সঙ্গে একটা দু’লাইনের চিঠি। প্রায় এক মাস মন্ত্রকে একা দেখভাল করার সময় উত্তরণ প্রতিদিন ভাবতেন, কালই হয়তো অনসূয়া ফিরে আসবে। কিন্তু ছবিগুলো বারবার দেখতে-দেখতে কেমন একটা শীত এসে ঘিরে ধরল ওঁকে। তবে কি সেতুর একটা দিক ভেঙেই গিয়েছে? নদী এখন পারাপারহীন?

ঘুমন্ত মেয়েকে চুমু দিয়ে উত্তরণ রাতেই বেরোলেন গাড়ি নিয়ে। একঘণ্টা, অনর্থক ড্রাইভ করে ফিরে এলেন। আবার অনর্থক নয়ও। ওই তীব্র গতি কিছুক্ষণের জন্য হলেও ওঁকে মুক্তি দিল। মাথার ভিতর যে বকরাক্ষসটা যাপিত জীবনের প্রতিটা দিন, প্রত্যেকটি স্মৃতি চিবিয়ে খাচ্ছে, তার থেকে মুক্তি।

“তুমি জেনে যখন গিয়েছ, আমায় জানাওনি কেন?” অনসূয়া স্বাভাবিক গলায় বলল।

“কী জানাব? অভিনন্দন? তুমি এক্সট্রা-ম্যারিটাল করছ বলে?” উত্তরণ চিৎকার করে উঠলেন।

“গলা নামিয়ে কথা বলে। আর কথা বলার আগে, নিজেকে জিজ্ঞেস করো, বিয়ে বলে আদৌ কিছু হয়েছিল আমাদের?”

“তা হলে এতদিন কী করছিলাম আমরা, সার্কাস?”

“এগজ়্যাক্টলি! তুমি সেই সার্কাসের মালিক আর আমি সেখানে বাঘের মুখে মাথা ঢোকানোর খেলাটা দেখাই। সরি, দেখিয়েছি। কিন্তু আর নয়।”

“এগুলো কী বলছ অনসূয়া?”

“যা তুমি শুনছ। কলকাতা থেকে দু’দিনের জন্য মুম্বই এসে রঞ্জিতের সঙ্গে দেখা না হলে আমি আবার হয়তো তোমার মৃত্যুপুরীতে ফিরে যেতাম। কিন্তু ওই দু’দিনে আমি জেনেছি স্বর্গসুখ কাকে বলে। তা পিএইচ ডি করার মধ্যে নেই, পোস্ট-ডক’এ নেই, আছে রাস্তায় দাঁড়িয়ে পাওভাজি খাওয়ার মধ্যে। বান্দ্রার সি-বিচে যে দোকানগুলো আছে, সেখানে একটা অদ্ভুত শরবত পাওয়া যায় জানো, ‘কালাখোট্টা’ না ‘কালাঘোড়া’ কী যেন একটা নাম। রঞ্জিত বলতে পারবে। শরবতটা খেলে এমন ফুর্তি জাগে, মনে হয় যেন নেশা করেছি। তুমি জীবনে নেশা করেছ?”

“তুমি কি হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছ অনসূয়া? তোমার একটা সংসার আছে।”

“কার সঙ্গে সংসার? যে সারা জীবন মনে-মনে গেরুয়া কাপড় পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তার সঙ্গে?”

“একটা মেয়ে আছে তোমার।”

“আমি ওকে তোমায় দিয়ে দিলাম। নিঃশর্ত দান করলাম। তুমি ওকে যেভাবে খুশি মানুষ করো। আর মানুষ না করতে পারলে অনাথ আশ্রমে দান করে দাও।”

“শাট আপ, জাস্ট শাট আপ।”

“ইউ শাট আপ। রঞ্জিত বালকৃষ্ণন কবিতা লেখে। হি ইজ় ওয়ান অফ দ্য লিডিং ইন্ডিয়ান ইংলিশ পোয়েটস অফ আওয়ার টাইম। ওর একটা কবিতা আছে… ‘যে ফসল নষ্ট হয়ে জন্মেছে, তাকে অস্বীকার করে এগিয়ে যাও নতুন শস্যক্ষেত্রের দিকে।’ আমি নতুন পৃথিবীর দিকে এগিয়ে গিয়েছি। তাই তোমাকে আর তুমি রিলেটেড যা কিছু আছে আমার জীবনে, সবটা ডিসওন করতে চাই।”

“নিশির ডাকে সাড়া দিয়ে মানুষ যেমন অন্ধকারে বেরিয়ে পড়ে, তুমি সেরকম বেরিয়ে পড়েছু অনসূয়া। একটু ঠান্ডা মাথায় ভাবো। আমার আর তোমার কত বছরের সম্পর্ক।”

“সম্পর্ক? আমি তোমার পায়ে-পায়ে ঘুরতাম। এটাই ছিল সেই সম্পর্কের মূল কথা। আর হলই বা সেই ব্যর্থ যোগাযোগ অনেক বছরের। তুমিই বলতে না, হাজার বছরের অন্ধকার ঘর, একটা দেশলাই জ্বালালে মুহূর্তে আলোকিত হয়ে যায়! ধরে নাও, আমার জীবনে সেই দেশলাইটা জ্বলে উঠেছে। রঞ্জিত জ্বালিয়েছে।”

“ভুল করছ, চরম ভুল করছ।”

“তা হলে ভুলই করতে চাই। ভুল করার স্বাধীনতা চাই। রঞ্জিতের আর-একটা কবিতা আছে… ‘পৃথিবী মানুষের কাছে এলে, মানুষকেও পৃথিবীর কাছে আসতে হয়।’ আমি পৃথিবীর কাছে অ্যাভেলেবল হতে চাই। তোমার মতো শাপভ্রষ্ট দেবতা আমার জীবনের অর্ধেকটা খেয়ে নিয়েছে। বাকি অর্ধেকটা আমি মানুষের মতো বাঁচতে চাই।”

“কবে এই ডিসিশনে এলে? রঞ্জিতকে দেখার পর?”

“না। প্লেনে ভারতে আসার সময়। তোমার মনে আছে, বহুদিন আমাদের মধ্যে কোনও স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক ছিল না? মন্ত্র হওয়ার পর ক’দিন ক্লোজ় হয়েছি, হাতে গুনে বলা যাবে। কিন্তু সেই রাত্রে আমি প্রথম একটা প্যাশনেট লোককে আবিষ্কার করছিলাম। মনে হচ্ছিল, যতটা খিদে, ততটাই ভালবাসা পাব। কানায়-কানায় উপচে পড়ব একদম। কিন্তু তখনই ফোনে বাবার মৃত্যুসংবাদ এল।”

“সেটার উপর তো আমার কোনও হাত ছিল না।” উত্তরণ প্রায় আর্তনাদের গলায় বলে উঠলেন।

“আমি জানি, ছিল না। কিন্তু কারওর তো হাত ছিল। কে তিনি? তোমার ভগবান? তিনি তা হলে চাননি যে তুমি আর আমি মন্ত্রের জন্মের যন্ত্রণা পেরিয়ে আবারও মিলিত হই! আমাদের বিচ্ছেদটাই তিনি চেয়েছেন। তুমি মিনমিন করে আমাকে যে কথাটা বহুবার বলেছ, আমি সেটা ওই মুহূর্তে বুঝে গেলাম। আমি ভুল, তুমিই ঠিক। ঈশ্বর চাননি তুমি সংসারী হও। আর ঈশ্বর যা চান না তা মানুষ চাইলেও হয় না। সো উই মাস্ট লিভ ইচ আদার।”

“কিন্তু মন্ত্র?”

“ওকে তুমি একা কীভাবে মানুষ কবে, তা-ই ভাবছ তো? আমেরিকার চাইল্ড প্রোটেকশন স্কিম খুব দড়। ওদের জানাও তুমি পারছ না, ওরা মানুষ করার ব্যবস্থা করবে।”

“এটা কি একটা মায়ের কথা? একজন মা চাইছে যে তার মেয়ে অনাথের মতো বড় হোক?”

“একটা মানুষের কথা, যে ক্লান্ত, যে কিছুদিন একটু সুখে বাঁচতে চায়।”

“চায়, শুধু চায়। বাড়িটা চাও না? এত কষ্টে যে বাড়ি…”

“না, চাই না। আমি শুধু ডিভোর্স চাই উত্তরণ। তাড়াতাড়ি দিতে পারো?”

২৪

অনসূয়ার ইচ্ছেতেই ‘ক্রেমার ভার্সেস ক্রেমার’ ছবিটা দেখেছিলেন উত্তরণ। মাঝে-মাঝে হোম থিয়েটারে এক-আধটা ছবি দেখার জন্য জোর করত অনসূয়া। এটাও তেমনই একটা ছবি ছিল। সন্তান নিয়ে বাবার একার লড়াইয়ের গল্প। অনসূয়া যে ওঁর জীবনেই গল্পটা সত্যি করে দিয়ে যাবে, তা কল্পনাও করতে পারেননি তখন। কিন্তু যা কল্পনা করা যায় না, তাও যখন বাস্তব হয়ে যায়, তখন কীভাবে যেন তার সঙ্গে যুঝতে শিখে যায় মানুষ। উত্তরণও শিখলেন। কখনও মন্ত্রকে ক্ৰেশে রেখে, কখনও ওকে নিয়ে ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে… যে জীবন কিছুতেই থেমে থাকবে না, তাতে ভেলা ভাসানোর কৌশল আয়ত্ত করে নিলেন একরকম।

এক-একদিন তার মধ্যেও একটু অন্যরকমভাবে বাঁচতে ইচ্ছে করত। সেই দিনগুলো তিনি নাচ দেখাতেন মেয়েকে, ওকে পিঠে নিয়ে হামাগুড়ি দিতেন মেঝেজুড়ে, মন্ত্রকে নিয়ে খেতেও বেরোতেন। আমেরিকায় এতদিন থেকেও নিরামিষ থেকে আমিষে অভ্যস্ত হননি উত্তরণ। মেয়ের প্রোটিনের অভাব যাতে না হয় তার জন্য ওকে মাছ মাংস সবই বেঁধে খাওয়াতেন। কিন্তু নিজের ঠিক খেতে ইচ্ছে করত না। তাই বাইরে বেরোলে ওঁর গন্তব্য ছিল মূলত একটা গুজরাতি রেস্তরাঁই। সেই দোকানের মালিক হংসরাজ পটেল মাঝে-মাঝে গল্প করতেন উত্তরণের সঙ্গে। শৈশব-কৈশোর কলকাতায় কাটিয়েছেন বলে ভাঙা-ভাঙা বাংলা বলতেন ভদ্রলোক। পুরনো কলকাতার প্রসঙ্গ উঠলে নস্ট্যালজিক হয়ে পড়তেন খানিকটা।

“যেতে ইচ্ছে করে না আর কলকাতায়?” উত্তরণ জিজ্ঞেস করেছিলেন একবার।

“করে তো। গিয়েছিলাম একবার। কিন্তু সকাল থেকে ইয়ং ছেলেদের রাস্তায় বসে তাস খেলতে দেখে বিমার বনে যাচ্ছিলাম। এত লস অফ এনার্জি… হাউ ডু ইউ অ্যালাও দিস?”।

হংসরাজের প্রশ্নটার কোনও উত্তর ছিল না উত্তরণের কাছে। ওঁর নিজের জীবনটাই যে লস অফ লাভ, লস অফ ট্রাস্ট, লস অফ এনার্জি — সবকিছুর যৌথ খামার।

কিন্তু হারিয়ে ফেলার বেদনার ভিতরেই ফিরে পাওয়া থাকে। নইলে একদিন রাতে ওঁর আর মন্ত্রর উলটোদিকের টেবিলে কমলিকাদিকে দোসা খেতে দেখবেন কেন উত্তরণ? প্রথমে বিশ্বাস হচ্ছিল না। কমলিকাদি? আটলান্টা ছেড়ে মেরিল্যান্ড?

উত্তরণের বিস্ময়ের ভিতরেই কমলিকাদি ওঁর সামনে এসে জানালেন যে, ওই হোটেলে সপ্তাহে দু’দিন রান্না করার কাজে বহাল হয়েছেন বলে, ওখান থেকে খাবার সস্তায় পান।

“সঞ্জয়দা কেমন আছেন?”

“নিজেই দেখবে চলো।” কমলিকাদি হাসলেন।

হংসরাজের হোটেল থেকে প্রায় কুড়ি মাইল দূরে মূলত কৃষ্ণাঙ্গদের একটা পাড়ায়, একতলার একটা ঘরে সঞ্জয়দা আর কমলিকাদির সংসারে উত্তরণ যখন পৌঁছলেন, তখন রাত হয়ে গিয়েছে অনেকটাই।

সঞ্জয়দা সম্ভবত চিনতে পারলেন না ওঁকে। চেনার কথা নয়। সেরিব্রাল অ্যাটাক হয়ে গিয়েছে দুটো। কথা বলতে গেলে জড়িয়ে যায়। যা বলেন তারও অর্ধেক বোঝা যায় না। কিন্তু জীবনের এই অবস্থাতেও লোকটার একটা রক অফ জিব্রাল্টার আছে। তার নাম কমলিকা।

“সারার দোষ নেই। ইউরোপিয়ান হোক বা ইন্ডিয়ান, শেষ পর্যন্ত ও তো একটা মেয়ে! কাঁহাতক সহ্য করতে পারে? কিন্তু ও আমার বিরুদ্ধে যেতেই আমি যদি রুখে না দাঁড়াতাম, যদি না বলতাম যে ওরা আমাকে খাটাতে নিয়ে এসেছে আমেরিকায়, তা হলে এখানকার সরকার আমায় ডিপোর্ট করে দিত।”

“কিন্তু ওদের সংসার সেই জন্যই নষ্ট হয়ে গেল না তো?”

“আগেই গিয়েছিল। সঞ্জয়, প্রথম সেরিব্রালের পর মাটিতে পড়ে ছিল সাত ঘণ্টা। সারা কাজে চলে গিয়েছিল, সঞ্জয়কে অসুস্থ দেখেও। তখন আমি ওদের বাড়িতে ছিলাম না। হোমলেসদের শেল্টারে ছিলাম। কিন্তু ঘটনাটা জেনেই আমার মনে হয়, আমি চলে গেলে, সঞ্জয় পচে মরে যাবে। তাই ওকে আঁকড়ে ধরলাম। আটলান্টা ছাড়তে চাইছিলাম। ওখানকার এক মেমসাহেব হেল্প করলেন মেরিল্যান্ডের কাজগুলো পেতে। নইলে সারভাইভ করতাম না। আচ্ছা বলো, দেশে ফিরে গেলেই বা কী ক্ষতি হত আমার? সঞ্জয়কে বাঁচাব বলেই রিস্কটা নিলাম উত্তরণ। যৌবনে ওকে ছেড়ে এসে ইহকালটা নষ্ট করেছি। বার্ধক্যে ওর সেবা করে পরকালটা ভাল করে যাই। যাতে নেক্সট জন্মে অন্তত…” কমলিকাদি চুপ করে গেলেন।

কথা বলতে-বলতেই সঞ্জয়দার বুকে তোয়ালে বেঁধে মানুষটাকে চামচে করে কী একটা ওষুধ খাওয়াচ্ছিলেন কমলিকাদি।

উত্তরণের মনে হচ্ছিল, প্রেমিকা থেকে মায়ে রূপান্তরিত হয়েছেন কমলিকাদি। উলটোদিকে মা থেকে প্রেমিকা হবে বলে সমস্ত বন্ধন ছিঁড়ে অনসূয়া চলে গিয়েছে।

উত্তরণ খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, “আপনারা আমার বাড়িতে এসে থাকতে পারেন না কমলিকাদি?”

“না, পারি না। যৌবনে তো ওকে আলাদা করে পাইনি। কিন্তু এখন আর কেউ নেই আমাদের মধ্যে। দারিদ্র আছে। আমি আড়াইখানা চাকরি করি। আধখানা তো তুমি দেখলেই। কিন্তু এত পরিশ্রমেও আমার কষ্ট নেই, কারণ এই প্রথম সঞ্জয়কে একদম নিজের করে পেয়েছি। সেই পাওয়াটাকে উপভোগ করতে চাই।”

কে জানে কী বুঝে, সঞ্জয়দা হেসে উঠলেন কমলিকাদির কথা শেষ হতেই।

উত্তরণ কমলিকাদির হাতে পাঁচশো ডলার দিয়ে বললেন, “এটুকু আমি করতে পারি তো?”

কমলিকাদি টাকাটা নিয়ে বললেন, “বালিশের তলায় রেখে গেলে অপমানিত হতাম।”

মন্ত্রকে গাড়ি থেকে নামাননি উত্তরণ। সঞ্জয়দা-কমলিকাদির ঘর থেকে বেরিয়ে যখন গাড়িতে উঠতে যাবেন, কমলিকাদি এগিয়ে এলেন মন্ত্রকে একটু আদর করবেন বলে।

“আপনি রেস্তরাঁয় খেয়াল করেননি কমলিকাদি, রাস্তাতেও নয়, আমার মেয়ে স্পিচ ইমপেয়ার্ড। ও কথা বলতে পারে না। আর ওর মা আমাকে ডিভোর্স দিয়ে আর-একজনের সঙ্গে ঘর বেঁধেছে।”

কমলিকাদি যেন একটা চাপা আর্তনাদ করে উঠলেন।

“রক্তাক্ত হওয়ার জন্যই তো আমরা যুদ্ধক্ষেত্রে আসি, রক্তাক্ত হতে ভয় পেলে চলবে কেন?” উত্তরণ গাড়িতে উঠতে-উঠতে বললেন।

মন্ত্র তখন হেসে হাত নাড়ছে, কমলিকাদির দিকে তাকিয়ে।

সেই হাসির সঙ্গে সঞ্জয়দার হাসির তেমন কোনও তফাত নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *