১. মানুষ যেমন ভিন্ন-ভিন্ন হয়

মন্ত্র – বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রথম সংস্করণ: জানুয়ারি ২০১৯

পরমারাধ্য গুরুদেব
শ্রীশ্রীঠাকুর দুর্গাপ্রসন্ন পরমহংসদেবের
শ্রীচরণকমলে

মানুষ যেমন ভিন্ন-ভিন্ন হয় দেশে-দেশে, আকাশে উড়ে বেড়ানো মেঘেরাও কি তাই? আর মেঘ থেকে যে বৃষ্টি নেমে আসে সেও স্থান অনুযায়ী আলাদা-আলাদা? নইলে চার-পাঁচ দিন আগে বৃষ্টিতে ঝুপ্পুস ভিজলেন, কিচ্ছু হল না, অথচ কাল দুপুরে দু’-তিন মিনিট ভিজেছেন বড়জোর, ঠান্ডা লেগে গলাব্যথা, নাক বন্ধ, এমনকী জ্বরও?

কেন এমনটা হল ভাবছিলেন উত্তরণ। ভাবার ফাঁকে নেজ়াল ড্রপটা বারদুয়েক নাকে নেওয়ার অবসরে আবারও খেয়াল করলেন, সবাই সবার সঙ্গে কথা বলার নাম করে শো-অফ করছে। এটাই কি এখানকার দস্তুর?

সোমনাথ একবার চোখের ইশারায় সব ঠিক আছে কি না জিজ্ঞেস করল, কিন্তু উত্তরণ কোনও জবাব দেওয়ার আগেই দু’টি অল্পবয়সি মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করে দিল। ওর স্বাভাবিকতা দেখে কিছুটা অবাকই হলেন উত্তরণ। কাল রাতে ওই ফোনটা পেয়ে তিনি তো ধরেই নিয়েছিলেন, বানচাল হয়ে গিয়েছে সব। রাত তখন প্রায় বারোটা বাজে, জ্বরের ওষুধের পাশাপাশি একটা স্লিপিং পিলও খেয়ে ফেলেছেন বলে আস্তে-আস্তে তলিয়ে যাচ্ছেন ঘুমের দেশে, তখনই বেজে উঠেছিল ফোনটা। একবার পুরো বেজে গিয়ে যখন আবারও বাজছে, হাত বাড়িয়ে মোবাইলটা কাছে নিয়ে জড়ানো গলায় উত্তরণ বলেছিলেন, “হ্যালো?”

“আপনি বাবার বন্ধু? বাবার বই উদ্বোধন করতে যাচ্ছেন? আপনি জানেন বাবা কেমন লোক? ওপাশে একটা মেয়ের গলা ফেটে পড়েছিল রাগে।

“কে বলছেন?” আধো-অচেতনেই জিজ্ঞেস করেছিলেন উত্তরণ।

“আমি তনয়া, আপনার বন্ধু সোমনাথের মেয়ে। আপনাকে এত রাতে ফোন করেছি, কারণ বাবা এই একটু আগে ঘুষি মেরে আমার আর মায়ের মুখ ফাটিয়ে দিয়েছে। এখনও রক্ত পড়ছে মায়ের। আপনাকে ঘটনাটা জানালাম। এরপর বাবার কয়েকজন কলিগ, ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলর, সবাইকে জানাব।”

“সোমনাথ হঠাৎ এরকম করতে গেল কেন?” উত্তরণের ঘুম উড়ে গেল এক লহমায়।

“বাবা মদ খেয়ে এসে প্রায় রোজই বাওয়ালি করে। কিন্তু এখন তার মাত্রাটা বেড়েছে, কারণ আপনার মতো হুজ়-হু’রা বাবাকে বেলুনের মতো ফোলাচ্ছেন। সেই তোল্লাই পেয়ে লোকটা ধরাকে সরা জ্ঞান করছে। মায়ের গায়ে হাত তুলছে। আমারও। বাধা দিতে গেলে আরও হিংস্র হয়ে যাচ্ছে। আজকে তো এমন মেরেছে যে আমার একটা কানের পর্দা বোধহয় ফেটে গিয়েছে। এসবের জন্য কে রেসপনসিবল বলুন?”

উত্তরণ একটু চুপ করে থেকে বললেন, “আমার খুব খারাপ লাগছে তোমার কথা শুনে। কিন্তু তুমি আমাকে কেন অ্যাকিউজ় করছ ঠিক বুঝতে পারছি না।”

“আপনাকে বলব না তো কাকে বলব? আপনি কাল বাবার বই লঞ্চ করবেন বলে বাবা নিজেকে সেলেব্রিটি ভাবছে। আর বাড়ি ফিরে এসে আমাদের ওপর চটে যাচ্ছে, কারণ আমরা তো বাবাকে স্টার হিসেবে ট্রিট করতে পারব না, তাই না?”

“তোমার যে কানে লেগেছে তুমি সেই কানে মোবাইল চেপে কথা বলছ তো?”

“ওটা নিয়ে আপনার না ভাবলেও চলবে। কিন্তু আপনাকে যে রিকোয়েস্টটা করছি, সেটা রাখবেন। কাল আসবেন না বাবার বই লঞ্চ করতে।”

উত্তরণ কথাটা শুনে একপলক চোখ বন্ধ করতেই দেখতে পেলেন, একটা ঝলমলে কার্ডে সবার আগে ওঁর নামটা লেখা। সোমনাথের বইপ্রকাশ অনুষ্ঠানের মুখ্য আকর্ষণ যে উনিই। কথা দিয়েও সেখানে না যাওয়া অধর্ম হবে না?

উত্তরণের নীরবতার সুযোগে আরও অনেক কথা বলে গেল তনয়া। উত্তরণ তার কিছুটা শুনতে পেলেন, পেলেন না আরও বেশি। একটা সতেরো-আঠেরো বছরের মেয়ে, প্রায় অচেনা একজনকে মাঝরাতে ফোন করে, নিজের বাবার সম্বন্ধে এত কথা বলতে বাধ্য হচ্ছে কেন? কী এমন হল যে সোমনাথকে এখন প্রত্যেক দিন মদ খেয়ে বাড়ি ফিরে বউ আর মেয়েকে পেটাতে হয়?

উত্তরটা না পেলেও তনয়ার ফোনটা ছাড়ার পর অন্য একটা প্রশ্ন বড় হয়ে উঠেছিল। সোমনাথ না তনয়া, কার কথা রাখবেন উত্তরণ? না, তনয়ার কথাই রাখতে হবে। যে বাবা মেয়েকে এলোপাথাড়ি মারতে পারে, সে যতই বন্ধু হোক তাকে প্রশ্রয় দেওয়া উচিত নয়। এই কথাটা মনে আসতেই একটা দিশা পেলেন উত্তরণ। আর তারপরই সুপ্তিকে পেয়ে গেলেন নাগালে।

সকালে সামান্য দেরি হল ঘুম ভাঙতে। চশমাটা চোখে দিয়ে মোবাইল অন করতেই দেখলেন, সাতটা মিসড কল অ্যালার্ট। বোঝাই যাচ্ছিল, কে সকাল হতে না হতেই ফোন করছে, তবু নিশ্চিত হওয়ার জন্য আঙুল ছোঁয়াতেই স্ক্রিনে ভেসে উঠল সোমনাথের নাম। উত্তরণ রিংব্যাক করার কোনও প্রয়োজন বোধ না করে বাথরুমে চলে গেলেন। গায়ে হালকা টেম্পারেচার থাকলেও গিজার চালিয়ে স্নান করলেন ভাল করে। স্নানের সঙ্গে-সঙ্গে গত রাতের সমস্ত স্লানিমা যেন ধুয়ে যাচ্ছিল শরীর থেকে, তার সঙ্গেই জেট ল্যাগের অবশিষ্ট ক্লান্তিটুকুও। স্নান সেরে জপে বসেছেন, তখনই আবার ফোন আসা শুরু হল। জপের মধ্যেই হাত বাড়িয়ে ভাইব্রেশনে থাকা মোবাইলটাকে বন্ধ করে আবার যথাস্থানে রাখার সময় উত্তরণের মনে হল, গতকাল এয়ারপোর্ট থেকে নতুন সিম নিয়েই ফোন করা উচিত হয়নি সোমনাথকে। যদিও সোমনাথ জানতই যে উত্তরণ আসছেন, তবু ফোনটা আজ সকালে করলেও চলত। সেক্ষেত্রে সোমনাথ খানিকটা সংযত থাকত আর গতকাল রাত্রে সোমনাথের মোবাইল থেকে নম্বর পেয়ে তনয়া উত্তরণকে ফোন করতে পারত না। আচ্ছা, তখন কোথায় ছিল সোমনাথ? কী করছিল?

সোমনাথের ভাবনা থেকে মন সরিয়ে নিজেকে জপে স্থিত করলেন উত্তরণ। জপ শেষ হওয়ার পরপরই ঘরের ফোনটা ফের বাজতে শুরু করল।

উত্তরণ ধরতেই ওপার থেকে কাঁদো-কাঁদো গলায় সোমনাথ বলে উঠল, “প্লিজ় আমাকে যেতে দে তোর ঘরে।”

উত্তরণ অনুমতি দেওয়ার মিনিটখানেকের মধ্যেই ঘরে ঢুকে পড়ল সোমনাথ। বিন্দুমাত্র ভণিতা না করে বলল, “কাল রাতে তুই যা শুনেছিস, তার পুরোটাই মিথ্যে। বরং তার উলটোটা ঘটেছে। আমায় মেরেছে মেয়ে আর মেয়ের মা। ওরা আমাকে প্রায়ই মারে।”

“কেন মারে?”

“আমি জানি না। কাল একটা ছোট্ট ব্যাপার নিয়ে ঝামেলা শুরু হয়েছিল। সেখান থেকে বিশ্রী ঘটনা ঘটে গেল। আমার ভিসিকে অবধি আমার মেয়ে ফোন করেছিল, জানিস! অথচ আসল কালপ্রিট ওরাই। এই দ্যাখ আমার চোখের নীচে কাটা দাগ। আজকে কীভাবে ক্যামেরা ফেস করব, আমি জানি না। কিন্তু তোকে আসতেই হবে।”

উত্তরণ একটু ফাঁপরে পড়ে গেলেন। মেয়ে বাবার সম্বন্ধে বলছিল, এখন আবার বাবা এসে মেয়ের সম্বন্ধে বলছে। কাকে বিশ্বাস করবেন? একটা দোলাচলের মধ্যে পড়ে চুপ করে গেলেন উত্তরণ। সোমনাথ ততক্ষণে একদম অন্য গল্প শোনাতে শুরু করে দিয়েছে, যেখানে ও নিজেই অত্যাচারিত।

উত্তরণ শুনতে-শুনতে জিজ্ঞেস করে বসলেন, “তুই আলাদা থাকি না কেন?”

সোমনাথ জবাব দিল, “আমার জীবনে তো ঈশ্বরের অস্তিত্ব নেই। তাই আমার একা থাকতে ভয় করে। কিন্তু তাকে অনেস্টলি বলছি, মেয়ের হাতে মার খেতে শুরু করেছি যেদিন থেকে, সেদিন থেকে আমার মনে হয়, পরদিন ভোরের সূর্য দেখলেই বা কী আর না দেখলেই বা কী?”

“এভাবে না ভেবে মেয়ের মুখোমুখি বোস। ও তো ভালই কথা বলতে পারে, কাল শুনলাম।”

“যা শুনেছিস তার দ্বারা চালিত হোস না প্লিজ়, আজ একবার আয়। নইলে লজ্জায় মাথা কাটা যাবে আমার। তুই বলবি, মাথা কি আদৌ আছে? হয়তো নেই, তবু বলছি, আমার রিকোয়েস্টটা রাখ। নইলে পাবলিকলি বেইজ্জত হয়ে গিয়ে আমাকে সুইসাইড করতে হবে।”

সোমনাথের ওই কথার পর আর না এসে উপায় ছিল না উত্তরণের। তা ছাড়া উত্তরণ নিজে যখন চরম বিপদে তখন সোমনাথ বহু দিন যোগাযোগ থাকা সত্ত্বেও যেভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, উত্তরণ তা ভুলে যান কেমন করে? আসার পথে চোখে ভাসছিল সোমনাথের নিজের থুতনি, চোখের তলা দেখিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা যে মার আসলে ও-ই খায়। ওর মুখের প্রত্যেকটা দাগ যেন ফুটপাথের এক-একটা দোকান, ভিতরের সব পসরা মেলে ধরেছে। মানুষ তার কষ্ট, আঘাত, একটু সহানুভূতি পাওয়ার জন্য খুলে দেখাতে চায়। চাইতেই পারে। তাতে কি দোষ আছে কিছু?

কলকাতার একটি অভিজাত ক্লাবের লনে নিজের লেখা প্রথম বইয়ের প্রকাশ উপলক্ষে এলাহি পানভোজনের আয়োজন করেছিল সোমনাথ। উত্তরণ বইয়ের আবরণ উন্মোচন করার সঙ্গে-সঙ্গেই শুরু হয়ে গেল মদের ফোয়ারা। এমনটা তো কই বিদেশে হয় না! সেখানে লোকে প্রকাশিত বইটার সম্বন্ধে জানতে আসে। কিন্তু এখানে অধিকাংশ লোক গলা ভেজাতেই এসেছে। আকণ্ঠ মদ্যপ হওয়ার ব্যবস্থা থাকলেই বইটার সম্বন্ধে উৎসাহ দেখাবে তারা, নচেৎ নয়। হয়তো সেই জন্যই অন্যদের বক্তৃতা সংক্ষেপ করিয়ে উত্তরণের হাতে তাড়াতাড়ি মাইক তুলে দিয়েছিল সোমনাথ। কিন্তু যতই প্রধান বক্তা হোন না কেন, উত্তরণ সামনের শ্রোতৃমণ্ডলীর উশখুশ খেয়াল করেছিলেন, তাই দীর্ঘায়িত করেননি নিজের বক্তব্য। প্রায় পাওয়ারপয়েন্ট প্রেজ়েন্টেশনের মতো করে ছুঁয়ে গিয়েছিলেন সাম্প্রতিক ঘটনার প্রেক্ষিতে সোমনাথের লেখা বইটির বৈশিষ্ট্যগুলোকে। বলতে-বলতে নজর গিয়েছিল সোমনাথের মেয়ে তনয়ার দিকে। কৈশোর আর যৌবনের মধ্যে ভাসমান এক উচ্ছল প্রাণপ্রতিমা! কেউ আলাপ না করালেও চিনতে অসুবিধে হয়নি, কারণ সোমনাথের মুখ কেটে বসানো মেয়েটির মুখে। কালকের ঘটনার পরও ও এসেছে আজকের অনুষ্ঠানে? উত্তরণের প্রথমে অবাক লাগলেও, পরে ভালই লাগল। ঘটনাটা যেদিক থেকেই ঘটুক, যে-ই মারুক বা মেরে থাক, আজ যে সেটা অগ্রাহ্য করে তনয়া এসেছে বাবার অনুষ্ঠানে, সেটা একটা সদর্থক ঘটনা৷ নশ্বর এই জীবনে কোনও ঝগড়াই যে অবিনশ্বর নয়, তার এক জ্বলন্ত প্রমাণ। আর এসব বাদ দিলেও বাবা এবং মেয়ের মধ্যে কোনও ভুল বোঝাবুঝিই যে দীর্ঘক্ষণ স্থায়ী হতে পারে না, তনয়ার উপস্থিতি সেই সত্যকে তুলে ধরছিল বলে আরও ভাল লাগছিল উত্তরণের।

মঞ্চ থেকে নামার পর উত্তরণের ইচ্ছে করছিল তনয়ার সঙ্গে কথা বলতে। ওর মা, কোয়েলিও কি এসেছে? আচ্ছা, ওরা বিব্রত বোধ করবে না তো উনি ওদের সামনে গিয়ে দাঁড়ালে? এই দোটানার ভিতরেই খবরের কাগজের সাময়িকীর সেই মেয়েটি আবার ওঁর ইন্টারভিউ নেওয়ার জন্য সামনে এসে পীড়াপীড়ি করতে লাগল। এখানে আসার মুহূর্তে মেয়েটি যখন সামনে এসেছিল, তখন একরকম ভাগিয়েই দিয়েছিলেন উত্তরণ। মনে হয়েছিল, ওঁর ইন্টারভিউ কেন পড়বে লোকে? চতুর্দিকে যেখানে ফিল্মস্টার কিংবা খেলোয়াড়দের নিয়ে হুড়োহুড়ি, সেখানে কোনও দার্শনিকের কথা কেন শুনবে কেউ? সবাই তার কথা শুনতে চাইছে যে যেন-তেন-প্রকারেণ সফল হয়েছে। সেখানে কেউ যদি এসে বলে, সাফল্যের ধারণাটাই ভ্রান্ত, সাফল্য আসলে মেথরের বালতিতে ধরে রাখা অরেঞ্জ স্কোয়াশ বা ম্যাঙ্গো সিরাপ, লোকে মারতে যাবে না তাকে?

মেয়েটি অবশ্য কোনও অজুহাতই শুনতে রাজি ছিল না। নাছোড়বান্দার মতো ঘ্যানঘ্যান করেই যাচ্ছিল। উত্তরণ বাধ্য হয়ে ওকে একটু অপেক্ষা করতে বলে খাবার টেবিলের কাছে গেলেন। দেখলেন, গ্লাসের পর গ্লাস ফাঁকা হচ্ছে আর ভর্তি হয়ে যাচ্ছে পলকে।

এই সন্ধ্যায় এখানে জড়ো হওয়া বেশির ভাগ লোকই বোধহয় ওই হুইস্কির মধ্যে আলতো নেমে যাওয়া বরফের টুকরোর মতো। প্রথমে নিজেকে অটুট রাখলেও ধীরে-ধীরে গলে যাচ্ছে। গলে যাওয়াটাই হয়তো সময়ের ধর্ম, সমাজের ধর্ম। উত্তরণের মনে হচ্ছিল, ওঁকেও কোথাও একটা গলে গিয়ে মিশে যেতে হবে। নইলে যে যন্ত্রণা নিয়ে আমেরিকা থেকে ভারতে এসেছেন, সেই যন্ত্রণা আরও বাড়বে।

খানিকটা সেই কারণেই বারটেন্ডার যখন সোমনাথের নির্দেশে সিঙ্গল মল্টের একটা বড় পেগ বানিয়ে দিল, উত্তরণ না নিয়ে পারলেন না। এমন নয় যে এখনও ছুতমার্গ বেঁচে আছে, কিন্তু মদ ওঁর পছন্দের বিষয়ও নয় তাই বলে। ভিতরের তোলপাড় বাড়লেও সোমনাথকে তিনি ‘না’ বলে দিতেন, যদি না তনয়া ওঁকে দেখেই পিছন ফিরে কারওর সঙ্গে কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে যেত। উত্তরণ একবার ভাবলেন, নিজে থেকে কাছে গিয়ে একটু কথা বলবেন, কিন্তু যে এড়াতে চাইছে তাকে কাছে টানার চেষ্টা অর্থহীন। যদিও বুঝতে পারছিলেন যে তনয়া হয়তো ওঁর মুখখামুখি হতে লজ্জা পাচ্ছে। পারছিলেন বলেই পিছিয়ে এলেন। কিন্ত… পিছিয়ে এলেও মনের অস্বস্তিটা কাটল না। এই মেয়েটা যে উত্তরণের পিতৃহৃদয়ের ক্ষতটা জাগিয়ে তুলেছে কাল রাতের ওই একটা ফোনে!

গলা নয়, সেই ক্ষততেই যেন সিঙ্গল মল্ট ঢাললেন উত্তরণ। খুব তাড়াতাড়ি গ্লাসটা শেষ করে, দ্বিতীয়বারের জন্য ভরিয়ে নিলেন। তারপর এগিয়ে গেলেন সেদিকে, যেখানে ইন্টারভিউ নেওয়ার জন্য সেই সাংবাদিক অপেক্ষা করছিল। কাছে গিয়ে একটা চেয়ার টেনে বসতেই, মেয়েটি তৃতীয়বারের জন্য জানাল যে ওর নাম, লোপামুদ্রা।

উত্তরণ একটু তেতো গলায় বললেন, “বলুন কী জানতে চান?”

“স্যার এবার দেশে ফিরেছেন। কাজে না ছুটি কাটাতে?”

বোধহয় তাড়াতাড়ি প্রথম গ্লাসটা শেষ করেছেন বলেই উত্তরণের ভিতরে সামান্য প্রগলভতা কাজ করছিল। লোপামুদ্রার দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, “কাজ ব্যাপারটা একটা আলেয়া, জানেন! কোনটা কাজ আর কোনটা অকাজ, পৃথিবীর মানুষ তা এখনও বুঝে উঠতে পারেনি। ধরুন যারা বুকে বোমা বেঁধে নিজেদের উড়িয়ে দেয় আর মরে যাওয়ার মধ্যে দিয়ে অজস্র লোককে খুন করে, তাদের কাছে সেটা কিন্তু কাজ।”

“ওরা তো একটা মিথ্যা বিশ্বাসে ভর করে…” লোপামুদ্রা বলে উঠল উত্তরণের কথার মধ্যেই।

“সত্যি আর মিথ্যা বিচার করা কি এত সহজ? শঙ্করাচার্য বলেছিলেন, ‘ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা।’ এবার জগৎ যদি মিথ্যাই হয়, তা হলে এই জগতের মধ্যে যে ঈশ্বরকে দেখছি সেই ঈশ্বরও সত্য কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে।”

“যথার্থ জ্ঞান না থাকলে এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে না।”

উত্তরণ হেসে ফেললেন, “যথার্থ” ব্যাপারটার সংজ্ঞা আগের পৃথিবীতে যেরকম ছিল, আজকের পৃথিবীতে সেরকম নেই। একটি ছেলের কথা বলি। সে কবিতা লিখে হামেশাই ফেসবুকে পোস্ট করত। দু’-চার ডজন লাইকও পেত। হঠাৎ একদিন সে একটি ঝকঝকে মার্সেডিজ়ে পিঠ ঠেকিয়ে ছবি তুলে পোস্ট করে। দু’-তিন ঘণ্টার মধ্যে হাজার লাইক পড়ে যায় সেই ছবিতে। তার মানে ছেলেটির পরিচিত যে লোকেরা ওর কবিতা দেখে চুপ করে থাকত, তারা ওর মার্সেডিজ়ের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে পারছে! ওই গাড়িটা যে মুহূর্তে সে কিনেছে, সেই মুহূর্ত থেকেই সে সমাজের চোখে জয়ী। আর এই ভ্রম ছেলেটির মধ্যেও সঞ্চারিত হচ্ছে, সে নিজেও নিজেকে জয়ী ভেবে নিচ্ছে। তার থেকেও সাংঘাতিক একটা ব্যাপার হতে পারে। ধরা যাক, ছেলেটি গাড়িটা কিনতেই পারেনি। সে তার বন্ধুর মার্সেডিজ়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। তা হলেও কিন্তু তার মনে এই ব্যাপারটা প্রতিষ্ঠা পেয়েই যাচ্ছে, মার্সেডিজ় কিনতে পারাই সফলতা, বাকিটা ব্যর্থতা। আপনাকে কথাগুলো বললাম কারণ আমার বন্ধু সোমনাথের যে বইটির প্রকাশ উপলক্ষে আজ আপনি এখানে এসেছেন, সেটি জীবনচর্যার উপর কয়েকটি প্রবন্ধের সঙ্কলন। কিন্তু কেউ কি নিজের জীবন দিয়ে সেটার বিচার করবে? করলে ভাল; কিন্তু এখানে এসে আমার মনে হচ্ছে, খানাপিনা কীরকম হল, কোন কোন বিখ্যাত ব্যক্তি এলেন, তার উপরেই নির্ভর করছে পেজ থ্রি-তে বইটির প্রকাশ সংক্রান্ত খবর বেরোবে কি না।”

“আপনি একদম ঠিক বলেছেন স্যার, ব্যাপারটা ওরকমই। তবু তারই মধ্যে আমরা আলাদা কিছু করার চেষ্টা করছি, এটুকু দাবি করতে পারি।”

“করুন দাবি। তবে সেই দাবি মেটানোর জন্য ক’জনকে পাবেন, সেটাই কথা।”

“কোনও বাঙালি দার্শনিক আজ অবধি আপনার জায়গায় পৌঁছতে পারেননি। এই ব্যাপারটা নিয়ে যদি কিছু বলেন …”

“একটাই কথা বলব, এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। ব্রজেন্দ্রনাথ শীল বা বিমলকৃষ্ণ মতিলাল যে স্থাপত্য রচনা করেছেন, আমি তার দু’টো-একটা ইট এদিক-ওদিক করছি মাত্র। আসলে দর্শন মানে তো শুধু ‘দর্শন’ নয়, দর্শন মানে ইতিহাস, অর্থনীতি কিংবা সমস্ত মানববিদ্যার সাধ্যমতো নিবিড় পাঠ। রবীন্দ্রনাথের কথায়, ‘অসীমের নূতন সন্ধান’। সেই সন্ধান শতাব্দীর পর শতাব্দী চলতেই থাকে। খোঁজ করার মানুষগুলো কেবল পালটে যায়।”

“চিরন্তনের মধ্যে সাম্প্রতিককে আবিষ্কার করবেন বলেই কি ‘গীতা’-র উপরে কাজ শুরু করেছিলেন?”

“ছোটবেলা থেকেই ‘গীতা’ খুব জরুরি গ্রন্থ বলে মনে হত আমার, আজও হয়। মানুষ কীভাবে নিজের জীবনের মুখোমুখি হবে, ‘গীতা’য় তার একটা রূপরেখা আছে। সেটা আজ আরও বেশি প্রয়োজনীয় বলে বোধ করি।”

“বিদেশে পড়িয়ে আপনার মতো খ্যাতি খুব কম লোকই পেয়েছেন। কীভাবে দেখেন এই খ্যাতিকে?”

“পড়ানোর সঙ্গে খ্যাতির কী সম্পর্ক বলুন তো? আমার ছাত্রছাত্রীরা যখন আমার সামনে আসে, আমি তাদের কোনও নির্দেশ দিই না। বরং আমরা সবাই মিলে চেষ্টা করি একটা সমন্বয়ে আসার। ছাত্র আর শিক্ষক, বোধ আর বিস্ময়, অক্ষর আর দৃষ্টির সমন্বয়। যদি আমি ন্যায়ের দিকে তাকাই, ন্যায় কিন্তু বলছে এই জগৎ যোলো প্রকার পদার্থের সমন্বয়ে গঠিত। প্রমাণ, প্রমেয়, সংশয়, প্রয়োজন, দৃষ্টান্ত, সিদ্ধান্ত, অবয়ব, তর্ক ইত্যাদি ইত্যাদি। এই ষোলোটি পদার্থের যে স্বরূপ, তাদের পারস্পরিক সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য, এদের সমন্বয়েই জাগতিক কর্মবন্ধন থেকে মুক্তিলাভ সম্ভব। শিক্ষাও তো মুক্তিরই পথ। মুক্তি কীসের থেকে? ঈর্ষা-হিংসা-ক্ষোভ-পরশ্রীকাতরতা থেকে। এবার যে মুক্তি দেবে, সে-ই আবার খ্যাতিও এনে দেবে? কখনও হয়?” উত্তরণ বড় একটা চুমুক দিলেন গ্লাসে।

মাথাটা হালকা ঝিমঝিম করছে, নেশার ঝাঁকুনি লাগছে শরীরে। উত্তরণ সামনে বসা মেয়েটির দিকে তাকালেন ভাল করে। সাংবাদিকতাই ওর কাজ, কিন্তু ওর শখ সম্ভবত নিজেকে সুন্দর করে সাজানো। বৈদেহী নিজের ইচ্ছায় বা অভ্যাসে উত্তরণকে যা-যা চিনিয়েছিল, সেইসব ক্লেনজার, ময়েশ্চারাইজ়ার, মাস্কারা, টোনার সবকিছুর একটা সাইনবোর্ড হয়ে মেয়েটি সামনে বসে আছে। কীভাবে ওর সঙ্গে কথা গুটিয়ে আনবেন ভাবতে-ভাবতে উত্তরণ বললেন, “আমাদের জীবনে দর্শন আসলে একটা বিয়োগচিহ্নের মতো। অভিজ্ঞতা থেকে যেমন আমরা প্রতিদিনের ভাবনা সঞ্চয় করি, তেমনই ভাবনা দিয়ে প্রতিদিনের অভিজ্ঞতাকে ছেঁকে নিতে হয়। কারণ আমাদের অভিজ্ঞতাগুলো সবসময় আমাদের ভাবনা অনুযায়ী ঘটে না। এবার আমার অভিজ্ঞতার বাজে অংশটুকু ছেকে যে ভাবনাটুকু আমি নিজের কাছে রাখতে চাই, যেটা নিয়ে পরের দিন আবার রাস্তায় বেরোতে পারব, সেটাই দর্শন। তাই দার্শনিকের কাজটা অনেকটা ডেন্টিস্টের মতো।”

“মানে?”

“দাঁতে পাথর হলে ডেন্টিস্ট যেমন স্কেলিং করে দেন, দার্শনিকের কাজও তেমনই। জীবনটাকে যদি আমি একটা দাঁত হিসেবে ধরি… আমাদের প্রত্যেকের জীবনে অনেক পাথর জমা হয়ে যায় নিজেদের অজান্তেই। জীবনটাকে চালিয়ে যেতে গেলে পাথরগুলো বার করে দিতে হয়। দর্শন ওই নিষ্কাশনের কাজটা করে। পাথর হটিয়ে দন্তরুচি কৌমুদীকে ফুটিয়ে তোলে।”

“কী অপূর্ব বললেন স্যার। মনে হচ্ছিল যেন গান শুনছি।”

“আমি কিন্তু গানের বিরাট কিছু সমঝদার নই। ধ্রুপদী, রবীন্দ্রসংগীত, শুনি সবই, কিন্তু যে গান সবচেয়ে ভালবাসি, তাতে খোল আর করতাল ছাড়া সঙ্গে কোনও বাজনা লাগে না। ঘোর মধ্যরাতে বা একদম ভোরে, ‘হরেকৃষ্ণ হরেকৃষ্ণ, কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে-হরে, হরেরাম হরেরাম, রাম-রাম হরে-হরে…’ শুনেছেন কখনও? যে সংকীর্তনে মহাপ্রভু গৌরাঙ্গ সারা বাংলাকে মাতিয়ে দিয়েছিলেন, এ হচ্ছে সেই সংকীর্তন। যখনই শুনি গায়ে যেন সমুদ্রের বাতাস এসে লাগে।”

“কেমন করে এই ভালবাসাটা তৈরি হল?”

“তা আমি নিজেও খুব ভাল জানি না। ছোটবেলায় আমার শ্মশানে যাওয়ার অভ্যেস ছিল। যে শ্মশানের কথা বলছি, সেখানে তখনও ইলেকট্রিক চুল্লি আসেনি। একটা করে মৃতদেহ আসত আর কাঠের চিতায় তাকে শোওয়ানোর পর, জ্বলে উঠত আগুন। সেই আগুন পা থেকে মাথা পর্যন্ত গ্রাস করে নিত ধীরে-ধীরে আর-একসময় দোদোমা ফাটার মতো ফেটে যেত মাথাটা। ওই শব্দটার সামনে দাঁড়িয়ে ভীষণ আতঙ্কিত হয়ে পড়তাম। জীবনের সবকিছু এত ভঙ্গুর যে ওই একটা আওয়াজেই তার পরিসমাপ্তি? আমার একটা বিপরীত আওয়াজের, অন্য কোনও শব্দের খুব প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। সেটাই আমি সংকীর্তনের মধ্যে পেয়েছিলাম। ‘হরে’, ‘রাম’ আর ‘কৃষ্ণ,’ শব্দ ততা মোটে তিনটে। সুরও ছিল সাদামাটা। তবু তাদের মেলবন্ধনেই আমি একটা নতুন পৃথিবীকে পেতাম, যে পৃথিবীতে মৃত্যু যতটা সত্যি, মাধুর্যও ততটাই। আর মাধুর্য ছাড়া আপনি মৃত্যুর সঙ্গে লড়বেন কী দিয়ে?”

“কিন্তু মৃত্যু তো এখন আচমকা এসে পড়ে…”

“মৃত্যু সবসময়ই আচমকা আসে। মানুষ আগে আরও বেশি অসহায় ছিল। তখন প্লেগে, কলেরায়, যুদ্ধে দেশকে-দেশ উজাড় হয়ে যেত। এখন সেই অসহায়তা অনেকটা জয় করা গিয়েছে। মানুষের গড় আয়ু একশোর কাছাকাছি হতে যাচ্ছে। আমেরিকায় এমন রিসার্চ চলছে যার দৌলতে একটা তিরিশ বছরের মানুষকে পরীক্ষা করে বলে দেওয়া যাবে সত্তর বছরে তার কী রোগ হবে। চল্লিশ বছর আগে থেকে সে প্রিকশন নিতে পারছে। তাই আজকের ভয়টা মৃত্যু নিয়ে তত নয়, কারণ যা অনিবার্য তাকে যদি আমি ঠেলতে-ঠেলতে অনেকটা পিছনে নিয়ে যাই, তা হলে সে একসময় প্রার্থিতও হয়ে উঠতে পারে।”

“আজকের মূল ভয়টা কী?”

“ভয়টা হল, মানুষ তার দৈনন্দিন যাপনে হিংসার কাছে হেরে যাচ্ছে। একটা লেখা পড়ছিলাম, সাম্প্রতিক ভারতের মাওবাদী অধ্যুষিত এলাকা সম্পর্কে। সেখানে গ্রামের পর গ্রামে মাওবাদীরা এসে বলে যাচ্ছে, তাদের দলে যোগ না দিলে গুলি খেয়ে মরতে হবে। তারপরই পুলিশ এসে শাসাচ্ছে যে মাওবাদীদের সম্বন্ধে খবর না পেলে তারা রাতে গ্রামবাসীদের ঘর জ্বালিয়ে দেবে। এই দ্বৈত হিংসার মাঝখানে পড়ে মানুষ ছটফট করছে। কোথাও একটা মুক্তির রাস্তা খুঁজছে। পাচ্ছে না।”

লোপামুদ্রা সাক্ষাৎকার নিয়ে চলে যাওয়ার পরও ক্লাবের লনে ঝিম মেরে কিছুক্ষণ বসে রইলেন উত্তরণ। একটু দূরেই অভিজাত নারী-পুরুষদের জটলা সামান্য হালকা হলেও, উৎসাহে ভরপুর। কিছুক্ষণ আগে সোমনাথ যাঁর সঙ্গে আলাপ করিয়েছিল, সিনেমার সেই পার্শ্বচরিত্রের অভিনেতার সঙ্গে সেলফি নেওয়ার ধুম চলছে তখনও। সোমনাথ বারদুয়েক উত্তরণের সামনে এসে, ইন্টারভিউ শেষ হলেই ওই হুল্লোড়ে গিয়ে যোগ দিতে বলেছে। তৃতীয়বার আসার আগেই উত্তরণ ওকে একটা মেসেজ পাঠিয়ে জানিয়ে দিলেন যে, তিনি এবার বেরিয়ে যাবেন। মেসেজটা খেয়াল করে সোমনাথ যখন দৌড়ে এল প্রায়, ততক্ষণে উত্তরণ ক্লাবের গেটের সামনে।

“এভাবে কাউকে না বলে-কয়ে পালিয়ে যাওয়ার মানেটা কী? তোর সঙ্গে ছবি তুলবে বলে…”।

“আমি এখানে যে কাজটা করতে এসেছিলাম, সেটা হয়ে গিয়েছে। আমাকে আর আটকে রাখিস না।” সোমনাথকে থামিয়ে দিয়ে উত্তরণ বললেন।

ওঁর গলার আওয়াজে এমন কিছু ছিল যার জন্য সোমনাথ আর কথা বাড়াতে পারল না। শুধু উত্তরণের হাতদুটো ধরে নীরবে কৃতজ্ঞতা জানাল আর জানানোর সময় চোখের এক ফোঁটা জল এসে পড়ল উত্তরণের হাতে।

উত্তরণ সোমনাথকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “সব ভাল হবে। ভাল থাকিস।”

কথাগুলো বলে গাড়িতে গিয়ে বসতেই উত্তরণের মাথার মধ্যে বেজে উঠল বহু দিন আগে শোনা একটা কথা, ‘যত খারাপ সময়ই আসুক, জপ কমানো চলবে না।’

সত্যসেবী আশ্রমে থাকতে যাওয়ার পরপরই বিজয়দা অর্থাৎ স্বামী অমলানন্দের মুখে উত্তরণ শুনেছিলেন কথাটা।

একদিন ভোরবেলা উঠে পড়তে বসবেন, বছর বারো-তেরোর উত্তরণ, তখনই বিজয়দা ওঁকে ডেকে বলেছিলেন যে পড়াশোনার পাশাপাশি নিত্য জপও চালিয়ে যেতে হবে। পৃথিবীর সব অমঙ্গল থেকে ওই জপই রক্ষা করাবে। জপ তার চারপাশের বাতাসকেও শুদ্ধ করে তোলে। তাই যে অহরহ জপ করে, তাকে কোনও অপবিত্রতা ছুঁতে পারে না, গ্রাস করতে পারে না কোনও ভয়। নিজেকে কখনও অরক্ষিত বোধ করে না সে।

গাড়ির মধ্যের এসি চালু হতেই মাথাটা একটু পিছনে হেলিয়ে দেওয়া উত্তরণের নিজেকে অরক্ষিত মনে হল। মনে হল, সামনের পৃথিবী যেন ছোরা কিংবা পিস্তল হাতে মারতে আসছে আর উত্তরণ যুক্তির ভাষায় কথা বলছেন; জানতে চাইছেন, কেন মারবে, কী এমন শত্রুতা! কিন্তু যে মারবে বলে অস্ত্র উঠিয়েছে, সে তো যুক্তির পরিধির বাইরে চলে গিয়েছে। এই সময়টাই তেমন। উত্তরণের আজকের জীবনটা তারই একটা বাই-প্রোডাক্ট।

এই সময়, এই জীবন থেকে একটু নিস্তার পেতে চাইছিলেন উত্তরণ। দু’টো চোখের পাতা পরস্পরের সঙ্গে লেগে গিয়ে সেই সুযোগটা করে দিল। বহু বছর আগের একটা সকালে পৌঁছে গেলেন এক অবিশ্বাস্য গতিতে, যে গতি কোনও মিসাইলেরও নেই, আছে কেবল স্মৃতির। স্মৃতি আর মন কি হাত ধরাধরি করে চলে? নইলে ওই ঝাপসা দুপুরটা এত স্পষ্ট হয়ে উঠল কার ঝাড়পোঁছে?

রাস্তা দিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে একটা দোতলা বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে অকারণে ঘেউঘেউ করা কোনও কুকুরকে মুখ ভেংচেছিল একটা বাচ্চা ছেলে। আর সেই কুকুর, এলাকার একমাত্র বুলডগ, তৎক্ষণাৎ ছাদ থেকে লাফ মেরেছিল বাচ্চাটাকে ধরবে বলে। কিন্তু লাফ দিয়ে মাটিতে পড়ার সময় পা মচকে যায় কুকুরটার। ভয়ে অবশ হয়ে যাওয়া ছেলেটা বুঝতে পারে, এবারের মতো বেঁচে গিয়েছে। প্রাণপণে দৌড় লাগায় সে। দৌড়তে-দৌড়তে ভাবতে থাকে, পা মচকে না গেলে ওই মস্ত কুকুরটা ছিঁড়ে-কামড়ে ছিন্নভিন্ন করে দিত তাকে।

কয়েকদিন পর সে প্রথমবার একটি আশ্রমে গিয়ে এক জটাধারী সাধুকে প্রণাম করে। প্রণাম করামাত্র সেই সাধু বাচ্চাটিকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে বলেন, “কুকুর কি মানুষের কথা বোঝে? ওভাবে কুকুরের সঙ্গে কথা বলতে নেই বাবা।”

বাচ্চাটা অবাক হয়ে যায়। সাধু কীভাবে জানলেন ওর কুকুরকে ভ্যাংচানোর কথা, ভেবে আকুল হয়ে যায়। কিন্তু মুখ ফুটে জিজ্ঞেস করতে পারে না কিছু। সাধু মহারাজের গা থেকে ভেসে আসা সুগন্ধে কেমন একটা ঘোরের মধ্যে পড়ে যায়।

উত্তরণের সেই প্রথম দেখা ব্রহ্মচারী ঠাকুরকে। সেদিন সত্যসেবী আশ্রম থেকে বেরিয়ে আসার সময় থেকেই জটাজুটধারী সেই সন্ন্যাসীর মূর্তি ক্রমাগত ভেসে উঠছিল চোখের সামনে। বোধ হচ্ছিল, ওই সন্ন্যাসীকে ছেড়ে আর-একটি মুহূর্ত থাকাও অসম্ভব।

খুব অল্প বয়সে বাবাকে হারান উত্তরণ। হঠাৎ স্ট্রোকে ওঁদের গোটা পরিবারকে ঘূর্ণিঝড়ের মুখে ফেলে পঞ্চভূতে মিশে যান বাবা। বাবার মৃত্যুর পর কমপ্যাশনেট গ্রাউন্ডে চাকরি পেয়েছিল মা। কিন্তু সেই চাকরির ধকল নিতে না পেরে মায়ের শরীর ভাঙতে থাকে। খুব দ্রুত এতটাই অবনতি হয় যে দুই ছেলে নিয়ে শ্বশুরের বাড়িতে এসে উঠতে হয়। সেই বাড়িটা তখন পুরোটাই উত্তরণের ছোটকাকার দখলে। কাকিমা এবং কাকু যে খুব ভালভাবে নিয়েছিল ওঁদের পাকাপাকি এই বাড়িতে চলে আসা তা নয়, কিন্তু মুখের উপর কিছু বলতে পারেনি। মা মাইনে পেয়ে প্রায় পুরোটাই তুলে দিত কাকিমার হাতে, সে কারণেও কিছুটা ঠান্ডা ছিল সম্ভবত। কিন্তু ওদের কাছে ভাল হতে গিয়ে নিজের ওষুধপত্রও ঠিকঠাক কিনত না মা। ফল যা হওয়ার তাই হল। একদিন মাথা ঘুরে পড়ে গেল রাস্তায়। ধর্মতলার মোড় থেকে ট্যাক্সি করে অচেনা লোকেরা মাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে গেল।

অ্যানুয়াল পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়ে উত্তরণ তার একটু আগেই বাড়ি ঢুকেছেন। মাকে রেজ়াল্ট দেখানোর জন্য ছটফট করছে যে ছেলে, অচৈতন্য মাকে কেউ ধরাধরি করে ঘরে নিয়ে এলে কেঁদে উঠবে না সে? কিন্তু কাঁদতে দেখে যদি ধমক দিয়ে যায় নিজের কাকিমাই? উত্তরণ সেই প্রথম কান্না গিলে নিতে শিখেছিলেন।

হাসপাতাল থেকে আধখানা হয়ে ফিরে এসেছিল মা। অফিস যাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল অনির্দিষ্টকালের জন্য। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বদলে গিয়েছিল কাকু আর কাকিমার ব্যবহার। উত্তরণ মাঝে-মাঝে মাকে বলতেন ওঁদের পুরনো ভাড়াবাড়িতে ফিরে যাওয়ার কথা। মা ভয় পেত। টাকাপয়সার নয়, টাকা তো এখানে আরও বেশি দিতে হত… দুটো বাচ্চাকে নিয়ে ল্যাজেগোবরে হওয়ার ভয়। নিজের উপর বিশ্বাসটাই চলে গিয়েছিল মায়ের। সেই ভয়টা একটু-একটু করে সঞ্চারিত হচ্ছিল উত্তরণের মধ্যেও। ওঁরও মনে হত, মা হঠাৎ করে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলে ভাইকে নিয়ে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবেন? তেমন কিছু হলে, কাকু বা কাকিমা থাকতে দেবে এখানে?

ব্রহ্মচারী ঠাকুরের কাছে প্রথমবার যাওয়ার দিন থেকেই সেই ভয়টা কমতে শুরু করল। উত্তরণের মনে হতে লাগল, কেউ একজন আছেন যিনি সর্বাবস্থায় রক্ষা করবেন। সত্যসেবী আশ্রমে যার হাত ধরে যাওয়া, সেই সুধীরমামা মায়ের দূর সম্পর্কের ভাই। মামা-ই একদিন বলেছিল যে একজন সিদ্ধপুরুষের কাছে নিয়ে যাবে, যাঁর দেওয়া আশীর্বাদি ফুলে সব অসুখ ভাল হয়ে যায়। কথাটা শোনা ইস্তক মা উত্তরণকে বারবার করে বলত ওই আশ্রমে যাওয়ার কথা। আসলে মায়ের তখন খড়কুটো সামনে পেলে তাকেও আকড়ে ভেসে ওঠার বাসনা…

উত্তরণ গিয়েছিলেন মায়ের ইচ্ছামতো সত্যসেবী আশ্রমে, সুধীরমামার হাত ধরে। ওঁরা তখন থাকতেন দমদম দু’নম্বর এয়ারপোর্টের কাছে উত্তরণের ঠাকুরদা বাড়ি করেছিলেন ওখানেই। আর বাবার চাকরির সূত্রে উত্তরণ জন্মের পর থেকেই ছিলেন হাওড়া ময়দানের কাছাকাছি। সেখানে জমিও কেনা ছিল ওঁদের। কিন্তু দমদমে চলে আসতেই কাকু এবং কাকিমা মিলে মাকে বোঝাতে থাকে যে ওই জমিটা রেখে দিলে হয়তো একদিন জবরদখল হয়ে যাবে, তার চেয়ে ভাল খদ্দের যখন আছে তখন ওটা বেচে দেওয়াই শ্রেয়। প্রথম-প্রথম রাজি না থাকলেও ওদের লাগাতার চাপের সামনে বেশিদিন প্রতিরোধ খাড়া করতে পারেনি মা। কিন্তু জমিটা বিক্রি হয়ে যাওয়ার অল্পদিন পরেই জানতে পেরেছিল যে বাজারদরের চেয়ে অনেক কমে জমিটা নিজের শালার কাছেই বিক্রি করিয়েছে কাকু।

“তুমি ওদের ডেকে জিজ্ঞেস করো, কেন এরকম করল ওরা?” উত্তরণ মাকে বলেছিলেন।

বড় ছেলেকে জড়িয়ে কাঁদতে থাকা মা জবাব দিয়েছিল, “জিজ্ঞেস করেছিলাম। কিন্তু তোর কাকিমা বলল যে, বিক্রি করে টাকা যখন পেয়ে গিয়েছি তখন ওই জমির সঙ্গে আমাদের কোনও সম্পর্ক নেই। আর সম্পর্ক যখন নেই, তখন কে কিনেছে না কিনেছে, তাই নিয়ে প্রশ্ন করার অধিকারও নেই… আত্মীয়রা এভাবে ঠকায় আত্মীয়দের?” মা জিজ্ঞেস করেছিল কান্না থামিয়ে।

উত্তরণ কোনও জবাব খুঁজে পাননি কথাটার। মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল তাই।

মনখারাপ নিয়েই ওই বাড়িতে থাকাটা একটা অভ্যাসের মতো হয়ে গিয়েছিল। ব্রহ্মচারী ঠাকুরের কাছে যাওয়ার আগের দিন তা আরও বেড়ে গিয়েছিল কারণ বিনা দোষে কাকিমার কাছে গালে চড় খেতে হয়েছিল।

চড় খাওয়ার কারণটা ছিল অদ্ভুত। ভোট আসছে বলে কোনও এক প্রার্থী স্কুল থেকে ঘরে ফেরা বাচ্চাদের দশ টাকা করে দিচ্ছিলেন, সঙ্গে একমুঠো করে লজেন্স। দেওয়ার সময় একগাল হেসে বলছিলেন, “বাবা-মাকে বলবে ভোটটা আমাকেই দিতে, কেমন?” ভদ্রলোকের দু’জন স্যাঙাত হাতে একটা লিফলেট ধরিয়ে দিচ্ছিল সেই মুহূর্তেই। তাতে তাঁরই হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে থাকা ছবি ছাপা। কাকুর ছেলে সন্দীপন টাকা আর লজেন্স দু’টোই নিলেও, উত্তরণ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। ওঁর কীরকম ভাল লাগেনি ব্যাপারটা। সন্দীপন নিজেকে উত্তরণের ভাই বলে পরিচয় দিয়ে উত্তরণের ভাগের লজেন্স আর টাকা চাইতে গিয়েছিল। কিন্তু দাবড়ানি খেয়ে ফিরে আসে। সেই রাগেই সে মায়ের কাছে নালিশ করে এবং কোনও কিছু তলিয়ে না দেখেই কাকিমা ঠাস করে চড়িয়ে দেয় উত্তরণকে।

“ছোট ভাই নিতে পারে আর তুমি পারো না? কোথাকার সাধুপুরুষ তুমি? ঢাকাটা পেলে তোমার মায়ের আপেল আর বেদানার খরচটা তো অন্তত উঠত।” কাকিমা চিৎকার করে বলেছিল।

মায়ের জন্য কবে আপেল কিংবা বেদানা আনা হয়েছিল মনে করতে পারেননি উত্তরণ। তাও ঘাড় গোঁজ করে চুপচাপ দাঁড়িয়েছিলেন। নিজের মনে বিড়বিড় করেছিলেন, এমনি এমনি টাকা নেব কেন, অচেনা-অজানা লোকের থেকে?

উত্তর না পেয়ে মাথা আরও গরম হয়ে গিয়েছিল কাকিমার। উত্তরণকে আর-একটা চড় মেরে রান্নাঘরে ঢুকে গিয়েছিল।

উত্তরণ মাকে বলেননি পর্যন্ত ঘটনাটা। কিন্তু রাত্রে মা যখন কাছে টেনে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, “আমি মরে গেলে রাস্তায়-রাস্তায় ভিক্ষে করিস ভাইকে নিয়ে, তবু এখানে থাকিস না,” তখন চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা গরম জল গড়িয়ে পড়েছিল। তবে তৎক্ষণাৎ মনে হয়েছিল, কান্না থামিয়ে শক্ত হওয়া দরকার, কারণ ওঁর অসুস্থ মা প্রতিজ্ঞা করছে এই ঘটনার প্রতিশোধ নিয়ে তবে মরার।

সত্যসেবী আশ্রমের ভজন কুটিরে যখন সুধীরমামার হাত ধরে উত্তরণ প্রবেশ করলেন, তখন ব্রহ্মচারী ঠাকুর কৃষ্ণের প্রতিজ্ঞাভঙ্গের গল্প বলছিলেন।

“কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে তিনি কোনওরকম অস্ত্র ধারণ করবেন না, এমনটাই প্রতিজ্ঞা করেছিলেন কৃষ্ণ। এই প্রতিজ্ঞা রক্ষা করার জন্য অর্জুনের রথের সারথি হলেন তিনি। কিন্তু যুদ্ধ চলাকালীন ভীষ্মও প্রতিজ্ঞা করলেন যে কৃষ্ণকে তিনি অস্ত্র ধারণ করাবেনই। একদিন ভীষ্মের একের পর এক তিরে অর্জুন বিপর্যস্ত হয়ে পড়লেন। ভীষ্মের অভিজ্ঞতার সঙ্গে পাল্লা দিতে না পেরে তাঁর ধনুক গেল ভেঙে। তিরবিদ্ধ, রক্তাক্ত অর্জুন শেষমেশ কৃষ্ণের হাত ধরে বললেন যে কৃষ্ণ আর তাঁর রথের সারথি না থেকে নেমে যেন সামনে এসে দাঁড়ান। তিনি কৃষ্ণের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রাণত্যাগ করতে চান। অর্জুনের এই অবস্থা দেখে কৃষ্ণ নিজের প্রতিজ্ঞা বিসর্জন দিয়ে অর্জুনের রথের একটা চাকা খুলে হাতে নিয়ে ভীষ্মকে বধ করার জন্য অগ্রসর হলেন। সেই ভয়ংকর রূপ দেখে ভীষ্ম মুহূর্তে অস্ত্র ত্যাগ করে বলে উঠলেন যে কৃষ্ণ স্বয়ং প্রতিজ্ঞা করেছিলেন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে তিনি অস্ত্র ধারণ করবেন না। অথচ অর্জুনকে বিপর্যস্ত দেখে আত্মহারা হয়ে সেই তিনিই নিজের প্রতিজ্ঞা ভাঙলেন। আর সারা পৃথিবী তা প্রত্যক্ষ করল। কৃষ্ণকে দিয়ে এইটুকু করানোই যে তাঁর অভীষ্ট ছিল, ভীষ্ম সে কথাও বলতে ভুললেন না।”

শুনতে-শুনতে কোন ভাবসাগরে তলিয়ে গিয়েছিলেন উত্তরণ। ব্রহ্মচারী ঠাকুর থামতেই মনে হল, ঈশ্বর যদি প্রতিজ্ঞা ভাঙতে পারেন, মানুষ কেন পারবে না? আজ বাড়ি ফিরে মাকে বলতে হবে প্রতিশোধ নেওয়ার প্রতিজ্ঞা ভেঙে ফেলতে। মা সুস্থ হয়ে উঠুক, সেটাই প্রতিশোধ, সেটাই প্রাপ্তি।

প্রাপ্তির তখনও বাকি ছিল উত্তরণের। ঠাকুরের ভজন-কুটির থেকে বেরোনোর ঠিক আগে যে ঘটনাটা ঘটল, সেটা বোধহয় উত্তরণকে শান্তি আর সাহস দিতেই ঘটালেন ব্রহ্মচারী ঠাকুর।

একটি লোক এসে ঠাকুরকে প্রণাম করে কোনও কথা না বলে, একশো টাকার একটা নোট এগিয়ে দিল।

ব্রহ্মচারী ঠাকুর লোকটির চোখের দিকে স্থির তাকিয়ে বললেন, “টাকা থাকলেই দেওয়া যায়, না টাকা দিলেই নেওয়া যায়?”

কথাটা শুনে লোকটা একটু ঘাবড়েই গেল সম্ভবত, কিন্তু তারপর সে কী করল তা আর উত্তরণ খেয়াল করেননি, কারণ ততক্ষণে আনন্দের একটা উদ্দাম স্রোত আছড়ে পড়েছে ওঁর মনে। যায় না। টাকা থাকলেই দেওয়া যায় না আর দিলেই নেওয়াও যায় না।

রাতে ঘরে ফিরে মাকে কথাটা বললেন উত্তরণ। ভাবলেন মা বুঝি ওঁর মতোই উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠবেন। কিন্তু নির্জীব মা একটা ম্লান হাসি হেসে জিজ্ঞেস করলেন, “আমার অসুখ সেরে যাবে সেরকম কোনও দৈব ওষুধ দিলেন?”

উত্তরণ একটু দমে গিয়েও মুহূর্তের মধ্যে সামলে নিলেন নিজেকে, “দিয়েছেন তো। রাতে শোওয়ার সময় প্রতিদিন তিনবার ব্রহ্মচারী ঠাকুরের নাম বালিশে লিখবে। লিখলেই দেখবে শরীর ভাল লাগছে। লিখতে-লিখতে সেরে যাবে তুমি।”

সম্পূর্ণ বানিয়ে কথাটা বলেননি উত্তরণ। আশ্রম থেকে বেরোনোর সময় ঠাকুরের একজন শিষ্য আর-একজনকে এই কথাটাই বলছিলেন। উত্তরণের মাথায় গেঁথে গিয়েছিল। মা যখন নিরাশায় তলিয়ে যেতে-যেতে একটা কোনও ভরসা পেতে মুখ তুলে তাকিয়েছিল, তখন ওই কথাটাই মাথায় ঝিলিক দিয়েছিল উত্তরণের। শুধু মাকে বলাই নয়, নিজেও সেই রাত থেকেই বালিশে ব্রহ্মচারী ঠাকুরের নাম লিখতে শুরু করেন উত্তরণ। যখন মা, “আমি মন থেকে বলছি আমার এই ছেলেটাকে আপনিই নিন” বলে উত্তরণকে ব্রহ্মচারী ঠাকুরের কাছে সমর্পণ করে আসে আর রাতে আশ্রমের একটি ঘরে শুতে গিয়ে উত্তরণ জানতে পারেন যে বালিশ মাথায় দিয়ে শোওয়ার বিলাসিতা আশ্রমিকদের জন্য নয়, তখন কোনও শারীরিক কষ্টের কথা মনেও আসেনি। শুধু মনে হয়েছিল, ঘুমোনোর আগে ঠাকুরের নাম কোথায় লিখবেন?

ব্রহ্মচারী ঠাকুর উত্তরণকে চাওয়ামাত্র মা রাজি হয়ে গিয়েছিল। মা বোধহয় তেমন কিছুই শুনতে চাইছিল। আসলে শরীর সামান্য সারলেও মায়ের নিজের উপর ভরসা তখনও ফিরে আসেনি। তাই নিজের থেকে আলাদা করে বাঁচাতে চাইছিল সন্তানদের। ভাই এতই ছোট যে ওর ক্ষেত্রে সে সুযোগ আসেনি তখনও। উত্তরণকে ব্রহ্মচারী ঠাকুর চেয়ে নিতে মা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছিল।

উত্তরণের নিজেরও কি খুব খারাপ লেগেছিল? কাকিমার চড়-থাপ্পড়, কাকুর অবহেলা, মায়ের অসুস্থতা -এই সমস্ত কিছুর চাপ ওঁকে কুঁকড়ে রাখত দিনরাত। উলটোদিকে প্রথম দেখার মুহূর্ত থেকেই ব্রহ্মচারী ঠাকুরের দুর্নিবার টান ওঁর অনেক বন্ধন আলগা করে দিয়েছিল। কলকাতার উত্তর শহরতলি ছেড়ে দক্ষিণ কলকাতার প্রান্তে, গড়িয়া থেকে অনেকটা ভিতরে, সত্যসেবী আশ্রম ওঁর নতুন ঠিকানা হয়ে উঠল, অচিরেই। কেবল মাঝে-মাঝে ভাইয়ের কথা মনে করে একটু আনচানানি হত। মা কি পারছে, ওই বাচ্চাটাকে ঠিকমতো সামলাতে? সে দুশ্চিন্তা অবশ্য স্থায়ী হত না বেশিক্ষণ। ব্রহ্মচারী ঠাকুরের কাছে যেমন সহজে নিজেকে সমর্পণ করেছিলেন, নিজের সব ভয়-ভাবনাকেও তাঁর চরণে তুলে দিতে খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি। কেবল ঠাকুর-নির্ভর হয়ে থাকার এক নতুন আনন্দ তখন গ্রাস করেছে উত্তরণকে।

ছুটন্ত গাড়ির মধ্যে বসে উত্তরণের ক্রমাগত মনে হতে লাগল, সময়ই সবচেয়ে বড় প্রতারক। সে শুধু নিজে পালটায়, মানুষের ভিতরটাকে পরিবর্তিত করে না। নইলে আজ এত বছর পরও কেন একইরকম জাগরূক সেই যন্ত্রণা! নচিকেতার বাবা নিজের ছেলেকে যমকে দান করেছিলেন। নচিকেতা সেই দানের মর্যাদা রক্ষা করেছিলেন। কিন্তু উত্তরণ তো পারলেন না, কেবল ঠাকুরের হয়ে থেকে জীবনভর শুধু ঠাকুরের কাজই করতে। অথচ সেরকমটাই হওয়ার কথা ছিল না কি? কেন বিচ্যুত হতে হল? কেবল নিয়তিই কি দায়ী তার জন্য, নাকি উত্তরণের নিজের মধ্যেও সেই পুণ্যস্রোতে ভেসে থাকার দম ছিল না?

আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতিমান অধ্যাপক হিসেবে আজ যত লোকই চিনুক, যতই দেশ-বিদেশ করে বেড়ান, গুরুর কাজে নিজের জীবন অতিবাহিত করার যে স্বপ্ন উত্তরণ দেখেছিলেন, তা ভেঙে যাওয়ার বেদনা কার সঙ্গে ভাগ করে নেবেন তিনি? পৃথিবীর মানুষজন দিনরাত্রি শুধু আরও বেশি কিছু পাওয়ার আশায় ছুটছে। তাদের কে বোঝাবে যে বৈরাগ্যের জন্যও কারওর মনে তীব্র আকুতির জন্ম সম্ভব? প্রচুর ব্যাঙ্ক-ব্যালেন্স, বিলাসবহুল বাড়ি বা গাড়ি, সবকিছুই সেই মানুষটার কাছে অভিশাপ বলে মনে হতে পারে, তার মন দিনরাত্রি হাহাকার করতে পারে একখণ্ড গেরুয়া কাপড়ের জন্য, যার দাম খুবই সামান্য, কিন্তু দাম দিলেই যাকে কেনা যায় না, অর্জন করতে হয়।

সেই অর্জন না করতে পারার যন্ত্রণা, উত্তরণকে যেন দশ দিক থেকে আক্রমণ করল। মনে হতে লাগল, জীবনের সব কৃত্রিম সাফল্য, যার জন্য কলকাতায় আসামাত্রই উত্তরণকে এই মেকি অনুষ্ঠানের সভাপতি করে আনা হয়েছে, একটা শিকারি পাখির মতো আকাশে উড়িয়ে দিয়েছে ওঁকে। মুখে শিকার নিয়ে সেই পাখিটা অনেক উঁচুতে উড়ছে। কিন্তু যত উঁচুতেই যাক না কেন, সে কিছুতেই নিস্তার পাচ্ছে না তার বুকে বিঁধে থাকা বুলেটটার হাত থেকে রক্তক্ষরণ চলছেই।

একবার আশ্রমে যাওয়ার কথা ভাবলেন উত্তরণ। কিন্তু কীভাবে যাবেন, পেটে মদ, মুখে গন্ধ নিয়ে? প্রবল আত্মধিক্কারে নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করল উত্তরণের। যেমন প্রায়শই হয়। আর তখনই সিগন্যালে আটকে যাওয়া গাড়ির বন্ধু জানলার এপাশ থেকে রঘুকে দেখলেন।

এসির ভিতরেও ঘামতে থাকা উত্তরণ গাড়ির কাচ নামিয়ে ভাল করে তাকালেন পথের ধারে মাছ নিয়ে বসে থাকা লোকটার সামনে দাঁড়ানো মানুষটার দিকে। হ্যাঁ, রঘুই তো। ওরকম টিয়াপাখির মতো নাক, আশ্রমে আর-একটাও ছিল না। উত্তরণ যখন আশ্রমে আসেন, তার কয়েকদিন আগেই এসেছিল রঘু। ওদের বাড়ি ছিল রানাঘাটে। রঘুর বাবা ট্রেনে-ট্রেনে লজেন্স ফিরি করতেন। শীতের এক ভোরে কুয়াশার মধ্যে লাইন পার হতে গিয়ে ট্রেনে কাটা পড়েন। একসময় সব শুনে থাকলেও, কার হাত ধরে রঘুর আশ্রমে আসা, তা এখন আর মনে পড়ল না উত্তরণের। বরং রঘুর সূত্রে মনে পড়ে গেল নিজের ছেলেবেলার হাজারও কথা।

মা পয়সার অভাবে পৈতে দিতে পারেনি বড় ছেলের। উত্তরণ আশ্রমে আসার পর আর-একজন দরিদ্র ব্রাহ্মণ সন্তানের সঙ্গে ওঁর পৈতে হয়। পৈতের পর গঙ্গায় দণ্ডি ভাসাতে গিয়ে উত্তরণের মনে হয়েছিল দু’টো স্রোত দু’দিক থেকে টানছে ওঁকে। একদিকে বিপুল, বিস্তৃত গঙ্গা, অন্যদিকে জ্যোতির্ময় সন্ন্যাসী ব্রহ্মচারী ঠাকুর। দু’টো টানের মধ্যে ঠাকুরের টানই যেন জোরালো। দণ্ডি ভাসিয়ে আশ্রমে ফেরার পর, আশ্রমের সবকিছু যাঁর নখদর্পণে থাকত, সেই বিজয়দা উত্তরণকে নিজের ঘরে নিয়ে গিয়েছিলেন। আর রঘুকে বলেছিলেন আশ্রমের রান্নাঘর থেকে দই-চিঁড়ে মেখে নিয়ে আসতে।

উত্তরণ একটু উশখুশ করছিলেন কারণ ছোট থেকে তিনি শুনেছেন এবং দেখেছেন যে দণ্ডি ভাসিয়ে ফিরে আসার দিনটা অব্রাহ্মণের হাতে খায় না সদ্য ব্রাহ্মণরা। কিন্তু রঘুরা তো…

বিজয়দা ওঁর মনের কথা পড়তে পেরেই যেন বললেন, “তোমার অস্বস্তির কোনও কারণ নেই। আশ্রমে আমরা কেউ বামুন-কায়েত-বদ্যি-মাহিষ্য-শূদ্র নই। আমাদের একটাই পরিচয়, আমরা ব্রহ্মচারী ঠাকুরের সন্তান। আমি যে তোমার সামনে বসে আছি, আমিও তো ব্রাহ্মণ ছিলাম না পূর্বাশ্রমে, তাই বলে কি আমি ঠাকুরের কিছু কম সেবাইত?”

উত্তরণ লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললেন।

বিজয়দা বললেন, “হ্যাঁ, এবার তোমার মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, সবাই যখন একই, তখন তোমায় কেন পৈতে দিলেন ঠাকুর? উত্তরটা হল, আমরা আমাদের পরম্পরা বিসর্জন দেব না, আবার একই সঙ্গে প্রচলিত নিয়মগুলোর সংস্কার করতেও পিছপা হব না। মানে…”

“কাঁটাটুকু ফেলে দিয়ে মাছটা খাব, তাই তো?” চুপচাপ ঘরে ঢুকে আসা রঘু বলে উঠল।

“তোকে বলেছি না, আশ্রমের সীমানার মধ্যে মাছ-মাংসের কথা তুলবি না?” বিজয়দা রেগে যাওয়ার ভান করে হাত উঁচু করে থাপ্পড় দেখালেন রঘুকে।

আশ্রমে থাকতে গেলে যে সমস্ত কথা তুলতে নেই, তার অনেক কিছুই অবশ্য রঘু মাঝে-মাঝেই তুলত। উত্তরণ বাধা দিতে গেলে বলত, মনের মধ্যে যখন কথাগুলো আসে তখনই তো ঠাকুর জানতে পেরে যান, তবে আর মুখে না বলার ফায়দা কোথায়? বরং মন আর মুখ এক হলেই ঠাকুরের কৃপা পাওয়া যায়।

রঘুর কথার উত্তরে খুব বেশি কিছু বলতে পারতেন না উত্তরণ। আবার কথাগুলো মেনেও নিতেন না।

একদিন একটা পিকচার পোস্টকার্ড দেখিয়ে রঘু বলেছিল, “এই হিরোইনটাকে চিনিস? একদম ডায়মন্ড হারবারের ডাব। যত শাঁস, তত জল।”

কথাটার মাথামুণ্ডু বুঝতে পারেননি, কিন্তু রঘুর জোরাজুরিতে উত্তরণ কার্ডটা হাতে নিয়ে দেখেছিলেন, নীল শাড়ি-পরা একটা মেয়ের ছবি। ছবিটা রঘুর হাতে ফিরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, “মেয়েটা মুখটা ওরকম করে আছে কেন?”

“চুমু খাওয়ার আগে মুখটাকে ওরকম করতে হয়। মেয়েরা করে, ছেলেরাও। চুমু খেয়েছিস কোনওদিন কাউকে?”

উত্তরণ ছিটকে চলে এসেছিলেন রঘুর সামনে থেকে। একদম ভাল লাগেনি কথাগুলো। মনে হয়েছিল সাদা দুধের গামলায় কে যেন কালো কালি ঢেলে দিচ্ছে।

“এই কথাটা আবার স্বামীজিদের বলতে যাস না যেন!” রঘু পিছন থেকে চেঁচিয়েছিল।

উত্তরণ ছুটে চলে আসার সময় ধাক্কা খেয়েছিলেন অনিলদার সঙ্গে। অনিলদার সন্ন্যাস নাম ছিল বিরজানন্দ। কিন্তু আশ্রমের এ মাথা থেকে ও মাথা সবাই ‘অনিলদা’ বলেই ডাকত তাঁকে। আশ্রমের প্রকাশনা বিভাগ এবং মাসিক পত্রিকার দায়িত্বে ছিলেন অনিলদা। তা ছাড়া আরও হাজারটা কাজ নিজেই ঘাড়ে টেনে নিতেন। কিন্তু মেজাজ হারাতেন না কখনও।

ধাক্কা খেয়ে পড়ে যাচ্ছিলেন উত্তরণ, অনিলদাই ধরে নেন ওঁকে। উত্তরণ নিচু হয়ে যখন প্রণাম করছেন, তখন বললেন, “তাড়াহুড়ো করে কোথায় যাচ্ছিলে?”

উত্তরণ জবাব দিতে না পেরে চুপ করে ছিলেন।

অনিলদা বললেন, “আমাদের যেখানে পৌঁছনোর, আমরা তো সেখানে পৌঁছেই গিয়েছি। সারা জীবন উদভ্রান্তের মতো ঘুরেও লোকে যার নাগাল পায় না, তুমি তো ঠাকুরের সেই শ্রীচরণে একদম ছোটবেলাতেই ঠাঁই পেয়েছ। কত ভাগ্যবান বলো তো তুমি! আর তাড়াহুড়ো কীসের?

উত্তরণের নিজেরও তাই মনে হত। তিনি ভাগ্যবান। না হলে সন্ন্যাসীদের এত ভালবাসা এবং স্বয়ং ঠাকুরের এমন অহৈতুকী করুণা কীভাবে লাভ করলেন? পৈতের পরপরই ঠাকুর দীক্ষা দিয়েছিলেন ওঁকে। তার কয়েকদিনের মধ্যেই আশ্রমের রাধাগোবিন্দ মন্দিরে পুজোর কাজে স্বামী অভয়ানন্দকে সাহায্য করার দায়িত্ব পান উত্তরণ।

তখন সময়টা যেন এক অনন্ত ভাবের আবেশে কেটে যেত। ভোরে উঠেই স্নান সেরে মন্দিরে গিয়ে ঠাকুরের বেদি সাজাতেন উত্তরণ। অভয়ানন্দ যেভাবে দেখিয়ে দিয়েছিলেন, সেভাবেই ফুলে-ফুলে বৃন্দাবন করে তুলতেন সবটা। তারপর ধ্যানে বসতেন। ধ্যান যখন শেষ হত, ততক্ষণে ঠাকুরের নিত্যপুজো শুরু হয়ে যেত। উত্তরণ নিবিষ্ট হয়ে দেখতেন অভয়ানন্দ কীভাবে ঠাকুরের পুজো করছেন। প্রতিটা মন্ত্র, প্রত্যেকটি আঙ্গিক মনে-মনে একেবারে মুখস্থ করে নিতেন। তারপর পুজো শেষ হয়ে গেলে, ঠাকুরের প্রসাদ নিয়ে ফিরে আসতেন নিজের ঘরে। ঠাকুরের দৃঢ় নির্দেশ ছিল উত্তরণকে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে হবে একদম আগের মতো, তাই নতুন যে স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন, তার দিকে সাড়ে দশটা বাজলেই রওনা দিতেন।

স্কুল থেকে ফিরে সামান্য বিশ্রাম নিয়ে বৈকালিকী প্রার্থনায় যোগ দিতেন। ‘ভবসাগর তারণ কারণ হে/ রবিনন্দন বন্ধন খণ্ডন হে/ শরণাগত কিঙ্কর ভীত মনে/ গুরুদেব দয়া করো দীনজনে…’ গাইতে-গাইতে চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে নামত এক-একদিন। আবার মনে হত, ভয় কীসের? ভয় কাকে? গুরুদেব তো পৃথিবীর সবটুকু স্নেহ আর ভালবাসা মিশিয়ে আশ্রয় দিয়েছেন।

সান্ধ্য প্রার্থনার পর ঘরে ফিরে গিয়ে পড়তে বসতেন উত্তরণ। ঠাকুর বলেই দিয়েছিলেন, পড়াশোনা করতে-করতে উঠে এসে উত্তরণের আরতিতে যোগ দেওয়ার দরকার নেই। তবু সন্ধ্যারতি শুরু হওয়ার ঘণ্টাটা বাজলেই, ভিতরটা কেমন ছটফট করে উঠত। মনে হত সবাই যখন গাইবে, ‘সচ্চিদানন্দ বিগ্রহ, গুরু কৃপাহি কেবলম’, তখন একমাত্র তিনিই বাদ থাকবেন, তা কী করে হয়?

দুর্দান্ত খোল বাজাত রঘু আর হারমোনিয়ামে সুর ধরতেন রঞ্জিতদা। ওই খোল আর হারমোনিয়ামের যুগলবন্দি উত্তরণকে টেনে আনত মন্দিরের চাতালে। সবার সঙ্গে তিনিও গেয়ে উঠতেন, “গুরু বলো রে/হরি বলো রে…”

আরতির শেযে শান্তিজল নিয়ে খেতে যেতেন। সন্ন্যাসীরা সাধারণত রান্নাঘরে বসেই প্রসাদ পেতেন। আশ্রমের অন্যান্য আবাসিক এবং গৃহী ভক্তদের জন্য নির্দিষ্ট ছিল ব্রহ্মানন্দ ভবন। রঘু পরিবেশন করত সেখানে আর উত্তরণের থালায়, ডাব্লু হাতায় করে, অনেকটা ডাল ঢেলে দিয়ে মজা দেখত সময়-সময়।

একদিন পরীক্ষার আগে পড়ায় এতই নিমগ্ন ছিলেন উত্তরণ যে আরতিতেও উঠে যাননি, তারপর প্রসাদ নিতেও না। আশ্রমিকদের দরজায় ছিটকিনি লাগানোর নিয়ম ছিল না, কিন্তু পড়তে-পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন বলেই উত্তরণ খেয়াল করেননি কখন গুরুদেব এসে দাঁড়িয়েছেন ঘরের ভিতর। যখন উত্তরণের ঘুম ভাঙল, গুরুদেবের হাত তাঁর শিষ্যের মাথায়।

“তুমি না খেলে পরে আমি কীভাবে খাই বলো তো?” ব্রহ্মচারী ঠাকুর জানতে চাইলেন।

উত্তরণ কিছুক্ষণ থমকে থেকে কেঁদে ফেললেন। তাঁর মনে হল, মায়ের পর আর কেউ কোনওদিন তিনি অভুক্ত থাকলে জেগে থাকেননি। ঠাকুর শুধু বাবা নন, তিনি মা-ও।

বাবা একদিনের ভিতর চলে যাওয়ার পর মা ছিল ভরসা। এবার তিন দিনের জ্বরে মা মারা যেতে যখন অশৌচ পালন করতে দমদমের বাড়িতে গেলেন উত্তরণ, ঠাকুরের নির্দেশে প্রায় প্রতিদিন আশ্রমের কেউ না কেউ যেত ওঁর সঙ্গে দেখা করতে। কিন্তু যে ছেলেটা চব্বিশ ঘণ্টাই উত্তরণের সঙ্গে থেকে ওঁদের দুই ভাইয়ের হবিষ্যি বানিয়ে দেওয়া থেকে রাতের মশারি টাঙানো অবধি সবটাই করত, সে আর কেউ নয়, রঘু।

উত্তরণ নতুন করে চিনেছিলেন রঘুকে তখন। অনেকটা ভালবাসা আর সাহস নিয়ে ছেলেটা উত্তরণের পাশে দাঁড়িয়েছিল। ভাইয়ের কী হবে ভেবে উত্তরণ ভেঙে পড়তেন মাঝে-মাঝে। তাই দেখে রঘু বলত, “ব্রহ্মচারী ঠাকুর যদি তোর ভার নিয়ে থাকেন, তা হলে তোর ভাইকে নিশ্চয়ই ফেলে দেবেন না। তুই ঠাকুরের আশ্রয়ে আছিস, তোর এত চিন্তা কীসের?”

চিন্তা থেকে মনখারাপ, সেখান থেকে শরীর খারাপ। এমনটাই ছিল রঘুর থিয়োরি। সেই মনখারাপ কাটাতেই মায়ের শ্রাদ্ধশান্তি করে আশ্রমে ফিরে আসা উত্তরণকে একদিন জোর করেই একটা হিন্দি সিনেমা দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল রঘু। সেটাই ছিল উত্তরণের জীবনে প্রথম হিন্দি সিনেমা দেখা। খুব ছোটবেলায় মা কিংবা বাবার কোলে চেপে যে দু-তিনটে সিনেমা দেখতে গিয়েছিলেন, সেগুলো সবই বাংলা কিংবা ইংরেজি ছিল।

“হিন্দি সিনেমাই আসল সিনেমা। না দেখলে লাইফ বৃথা।” হলে ঢোকার সময় বলছিল রঘু।

সিনেমাটা দেখতে দেখতে উত্তরণের মনে হচ্ছিল জীবন এমনিও বৃথা। নইলে আশ্রমিক হয়েও তিনি কীভাবে ঠাকুরের কাছে গোপন করে এমন একটা গর্হিত কাজ করতে চলে এসেছেন।

ইন্টারভ্যালের সময় উত্তরণ রঘুর কাছে বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার অনুমতি চাইলেন।

রঘু হেসে উঠল, “আভি তো পিকচার শুরু হোগা দোস্ত। বোস চুপ করে।”

উত্তরণের কান্না পেয়ে গেল সেই হাসির আওয়াজে। ইচ্ছে হল ছুটে বেরিয়ে যান হল ছেড়ে। কিন্তু যে রঘু মায়ের মৃত্যুর পর অতখানি করেছে, তার মনে আঘাত দিতেও মন চাইছিল না।

উত্তরণ তাই চুপচাপ সিনেমাটা দেখলেন রঘুর পাশে বসে। শেষের দিকে ছবি না দেখে কাঁদলেন। ঠাকুরের অবাধ্য হয়েছেন, এই বোধ কুরে-কুরে খেতে থাকল ভিতরটা।

“তুই কিন্তু আশ্রমের কাউকে বলবি না যে আমরা সিনেমা দেখতে এসেছিলাম। আমি বলব যে তোকে নিয়ে কালেকশনে এসেছিলাম।” ফেরার পথে রঘু বলল।

“কালেকশনে?” উত্তরণ যেন ইলেকট্রিক শক খেলেন।

“হ্যাঁ তা-ই। তাতে অসুবিধে কী?” রঘু রাস্তার ধারের একটা দোকান থেকে সিগারেট কিনে ঝুলতে থাকা জ্বলন্ত নারকেল দড়ি দিয়ে ধরাল।

ঠাকুর তাঁর শিষ্য-ভক্তদের সবাইকে বাড়িতে মঙ্গলঘট রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন এবং প্রত্যহ সেই মাটির ঘটে স্নানের পর, খাওয়ার আগে, একমুঠো করে চাল রাখতে বলেছিলেন। সেই চাল মাসের নির্দিষ্ট এক বা দু’দিন আশ্রমিকরা সংগ্রহ করতেন শিষ্য-ভক্তদের বাড়ি থেকে। সেই সংগৃহীত চাল দিয়ে সারা মাস আশ্রমবাসী এবং আশ্রমে প্রসাদ পেতে আসা মানুষদের অন্নসংস্থানই শুধু হত না, দরিদ্র শিষ্য-ভক্তদের মধ্যে বিতরণও করা হত সেই চাল।

“ঠাকুর শুধু আশ্রমবাসীর পেট ভরানোর জন্য মঙ্গলঘট প্রতিষ্ঠা করাননি, মঙ্গলঘটের চাল বিলি না করলে তাহেরপুর, কুপার্স ক্যাম্প, অশোকনগর, চাকদা, কাঁচরাপাড়া, দত্তপুকুর, বারাসত, বিরাটির অনেক উদ্বাস্তু পরিবার না খেয়ে মরত।” বিজয়দা বলেছিলেন উত্তরণকে।

এত পবিত্র একটা ব্যাপার নিয়ে মিথ্যে বলবে রঘু? উত্তরণ শিউরে উঠলেন।

“বন্ধুর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করিস না।” আশ্রমে ঢোকার মুখে রঘু আবার বলল।

না, বিশ্বাসঘাতকতা উত্তরণ করেননি, গুরুদেব কিংবা কোনও সন্ন্যাসীর কাছে গিয়েই বলেননি সেদিন তিন ঘণ্টা মঙ্গলঘটের চাল কালেকশনের নাম করে কোথায় ছিলেন। কিন্তু সেই না-বলার অভিঘাত, সহস্র সাপের দংশন হয়ে দিনরাত্রি কামড় দিত ওঁকে। যখন সকালে ঠাকুরের পুজোয় সাহায্য করতেন কিংবা সন্ধ্যারতির সময় করতাল বাজাতেন অথবা রাত্রে প্রসাদ নিতে যেতেন, উত্তরণের মনে হত যে ওঁর মতো পাপিষ্ঠের কোনও অধিকার নেই আশ্রমে থাকার। যখন গুরুদেবের মুখোমুখি হতেন, তখনই সবচেয়ে বেশি করে মনে হত কথাটা।

“গুপ্ত পাপ প্রকাশ্য পাপের চাইতে অনেক বেশি ভয়ঙ্কর। জন্মের পর জন্ম এর ফল ভোগ করতে হয়।” ব্রহ্মচারী ঠাকুর একদিন বলছিলেন ভজন-কুটিরে বসে।

উপস্থিত সব শিষ্যই কথাটা শুনলেন, কিন্তু সারা গায়ে বিছুটি ঘষা খাওয়ার জ্বালা শুরু হল শুধু উত্তরণের।

সেদিনই দুপুরে বিজয়দা উত্তরণকে ডেকে আশ্রমের লাইব্রেরিতে একটি বই দিয়ে আসতে বলেন। তখনও বিমলেশদা লাইব্রেরি খোলেননি বলে, উত্তরণ নিজের বিছানার পাশে রেখে দেন বইটাকে। তারপর একেবারে ভুলে যান।

কয়েকদিন পর স্কুলের জন্য বেরোনোর সময় ঠাকুরের সামনে পড়ে যান উত্তরণ। ব্রহ্মচারী ঠাকুর উত্তরণের মাথায় হাত রেখে বলেন, “জায়গার জিনিস জায়গায় রাখতে হয়, ভুলে গেলে চলে না।”

উত্তরণ একছুটে নিজের ঘরে গিয়ে বইটা নিয়ে, দিয়ে আসেন লাইব্রেরিতে। কিন্তু সেদিন রাতে পড়াশোনায় মন দিতে পারেন না। কেবলই মনে হতে থাকে, ঠাকুরের কথার নিহিত অর্থ অনেক বড়। ঠাকুরের দয়ায় আশ্রমে জায়গা পেলেও, উত্তরণের জায়গা আশ্রম নয়। গুরুদেবের কাছে সত্য গোপন করা কোনও ভণ্ড, প্রতারকের জায়গা সত্যসেবী আশ্রম হতে পারে না।

যন্ত্রণা এত প্রবল হয়ে ওঠে যে উত্তরণ ছুটে যান ঠাকুরের শয়নকক্ষের দিকে। বাইরে দাঁড়িয়ে হাপুস কাঁদতে থাকেন। কাঁদতে কাঁদতে একসময় বসে পড়েন দেওয়াল ঘেঁষে। ঘড়িতে ঢং-ঢং করে বারোটা বাজতেই খুলে যায় ঘরের দরজা। ব্রহ্মচারী ঠাকুর এসে সামনে দাঁড়ান। স্বপ্ন দেখছেন ভেবে চুপ করে থাকেন উত্তরণ।

“মন যদি অনুতাপে দগ্ধ হয়, তা হলেই পাপের প্রায়শ্চিত্ত হয়ে যায়… আর তুমি তো নিজের ইচ্ছায় যাওনি।” ব্রহ্মচারী ঠাকুর বললেন।

ঠাকুর সব জানেন! উত্তরণ অবাক চোখে তাকালেন।

“রঘু আমার কাছে এসে সব বলেছে। আর তোমার যে মত ছিল না, সে কথাও বারবার করে জানিয়েছে।”

ব্রহ্মচারী ঠাকুরের কথায় রঘুকেও নতুন করে চিনলেন উত্তরণ। উত্তরণকে বারণ করে, ও নিজেই ঠাকুরের কাছে এসে সব অপরাধ স্বীকার করে গিয়েছে? অদ্ভুত ছেলে তো!

সেই অদ্ভুত ছেলেটাই এখন লোক হয়ে গিয়েও অদ্ভুত কাণ্ডই করছে। বারবার মাছ বিক্রেতার সামনে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে, আবার পিছিয়ে আসছে। উত্তরণ গাড়ি থেকে নেমে কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে রঘুর কাঁধে হাত রাখলেন। রঘু চমকে পিছন ফিরে প্রায় আধমিনিট ধরে দেখল উত্তরণকে। তারপর, “বুবাই!” বলে জড়িয়ে ধরল।

কতদিন পরে ডাকনাম ধরে কেউ ভাকল। উত্তরণের মনে হল, ওঁর অতীত যেন পায়ে হেঁটে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। রঘুর গায়ের গন্ধের ভিতর দিয়ে কুড়ি বছর আগের পৃথিবী প্রত্যক্ষ হয়ে উঠল। একসঙ্গে ইস্কুলে যাওয়া থেকে বৃষ্টিভেজা পর্যন্ত।

“বিজয়দার মৃত্যুর দিনই লাস্ট দেখেছিলাম তোকে। তার কয়েকদিন পরেই তো তুই…” রঘু হাত দিয়ে প্লেন উড়ে যাওয়ার ভঙ্গিমা করল।

“কার থেকে খবর পেয়েছিলি?”

“আশ্রমে গিয়েছিলাম, তখনই শুনেছিলাম। শুনেই খুব মনখারাপ হয়ে গিয়েছিল। আফটার অল, তোকে মহারাজের সিটে দেখব, তুই ঠাকুরের প্রতিনিধি হয়ে দীক্ষা দিবি…”

“এসব আর বলিস না রঘু। এই কথাগুলো আমার শোনার অধিকার নেই।” উত্তরণ থামিয়ে দিলেন রঘুকে।

“নেই কেন? তুই বিদেশে প্রফেসর হয়েছিস, খুনখারাপি তো করিসনি যে ঠাকুরের কাজ আর করতে পারবি না। ঠাকুর চাইলে আবারও আশ্রমে ফিরবি না, কে বলতে পারে?” |

উত্তরণ কেঁপে উঠলেন রঘুর কথায়, “কী বলছিস তুই?”

“ঠিকই বলছি। আমি তো কয়লাখনির লেবার হয়ে ধানবাদে চলে গিয়েছিলাম। তারপর একটা ফাউন্ড্রিতে চাকরি নিয়ে মধ্যপ্রদেশের রিমোট এরিয়ায়। সেখান থেকে অসমের চা-বাগানে। আমি কোনওদিন ভেবেছিলাম, আশ্রমের হাফ কিলোমিটারের মধ্যে জমি কিনে বাড়ি করতে পারব? আমার ওয়াইফ তত বেহালায় ওর মাসির দেখে দেওয়া ফ্ল্যাট কেনার জন্য খেপে উঠেছিল। কিন্তু আমার মাথায় সারাক্ষণ ঘুরঘুর করত, ‘গুরুর কাছে বাসে হয় কাশীবাসের ফল’। তবে সত্যি বলছি, নিজের থেকে কিছু করতে পারতাম না… গুরুদেবই হাতে করে আমার বাড়িটা বানিয়ে দিলেন। দু’কাঠা জমির ওপর, কিন্তু ভিতরে ঢুকলে মনে হবে অনেকটা জায়গা। চল না আজ আমার বাড়িতে গিয়ে থাকবি? সারা রাত জেগে গল্প করব।”

“আজ না রে, পরে একদিন। কিন্তু তুই এখানে কী করছিলি?”

“আমার শ্বশুরবাড়ি এখান থেকে পাঁচ মিনিট। মেয়ের পরীক্ষা চলছে বলে, বউ ক’দিন এখানেই আছে। তোর সঙ্গে সেই বিজয়া চলে যাওয়ার দিন আলাপ করিয়ে দিয়েছিলাম, ভুলে গেছিস?”

উত্তরণ কথা ঘোরাতে চেয়ে বললেন, “বউ-মেয়ে বাড়িতে নেই তো মাছওয়ালার সামনে কেন?”

“নিজেকে খেতে হবে না?” রঘু হেসে উঠল।

“কিনছিলি তো না! খালি এগোচ্ছিলি আর পিছোচ্ছিলি।” উত্তরণ বললেন।

“তোর মতো ডলারে যদি কামাতাম, তা হলে কি আর পিছছাতাম রে ভাই? আমাদের যে মাস গেলে ব্যাঙের আধুলি সম্বল। তাই দিয়েই সারাটা মাস…”

কথাটা শুনে লজ্জা পেয়ে গেলেন উত্তরণ। পুরোটা না জেনে ধারণা করে ফেলার লজ্জা।

“তোকে কিন্তু একদিন আসতেই হবে, আমার বাড়িতে। আমরা একসঙ্গে আশ্রমে যাব, কেমন?”

উত্তরণ আবারও চমকে উঠলেন। ঠাকুরের ইচ্ছা ছাড়া ঠাকুরকে কেউ প্রণামও করতে পারে না, বিজয়দা ওঁকে একবার বলেছিলেন। ঠাকুর কি তবে চাইছেন যে উত্তরণ আবার ভজন-কুটিরে ঢুকে প্রণাম করুন তাঁকে?

গাড়িতে ওঠার পরও ভাবনাটা গেল না মাথা থেকে। রঘু কি নিজেই কথাটা বলল? এমনি-এমনি? নাকি ও উপলক্ষ মাত্র? ওকে দিয়ে ব্রহ্মচারী ঠাকুরই কথাটা বলালেন?

“এখন কোনদিকে যাব স্যার?” ড্রাইভার জিজ্ঞেস করল।

‘যেদিকে দুচোখ যায়’ বলতে গিয়ে উত্তরণ থমকে গেলেন। বললেন, “হোটেলের দিকে চলো।”

রাস্তার লাল আলো সবুজ হয়ে গিয়েছে ততক্ষণে।

হোটেলে ফিরে ফের একবার গরম জলে অনেকক্ষণ ধরে স্নান করলেন উত্তরণ। সমস্ত গ্লানি ধুয়ে যাক, শাওয়ারের নীচে দাঁড়িয়ে এমনটাই ভাবছিলেন তিনি। স্নান সেরে বেরিয়ে মনে হল, এই যে দশ বছরের মেয়েটাকে কলকাতায় এনে, ক্ৰেশে রেখেছেন, হোটেলে নিজের কাছে রাখেননি, এটা কি অন্যায় নয়? কিন্তু নিজের কাছে রাখলে তো ঠিকমতো দেখভাল করতে পারতেন না। তার চেয়ে ও যেখানে আছে সেখানে অনেক যত্নে আছে। আচ্ছা, বড় হয়ে ওঁর মেয়েও যদি বাবার সম্বন্ধে কাউকে ফোন করে অভিযোগ করে? কথাটা মনে হওয়ামাত্রই যন্ত্রণা আর স্বস্তি একসঙ্গে দীর্ঘশ্বাস হয়ে বেরিয়ে এল। না, ওঁর মেয়ে আর যা-ই করুক, ফোনে কাউকে অভিযোগ জানাবে না।

রঘু, উত্তরণের বিরুদ্ধে ওঁর কাছেই অভিযোগ জানাচ্ছিল। কেন উত্তরণ আশ্রমে থাকলেন না, কেন বিদেশে চলে গেলেন, আমেরিকার বিলাসে-ব্যসনে কেন ডুবিয়ে দিলেন নিজেকে?… উত্তরণ ঘরের টিভিটা মিউট করে চালিয়ে ভাবছিলেন, তবে কি আরামের জীবন খুঁজতেই আমেরিকা গিয়েছিলেন?

ঠাকুর কিংবা বিজয়দার সঙ্গে কোনও ভক্ত-শিষ্যের বাড়ি গেলে তাঁরা যখন ফল-মিষ্টি ইত্যাদি দিয়ে আপ্যায়ন করতেন, উত্তরণ প্রায় পুরোটাই আশ্রমে নিয়ে এসে রান্নাঘরের ভাণ্ডারী গোপালদার হাতে জমা করে দিতেন, সবার মধ্যে ভাগ করে দেওয়ার জন্য। একবার ঠাকুরের সম্পন্ন শিষ্য রমণী সাহা উত্তরণের হাতে পাঁচশো টাকা দিয়ে বলেছিলেন, “পুজোর সময় যা ইচ্ছা হয় কিনো।” উত্তরণ টাকাটা নিয়ে গিয়ে জমা করে দিয়েছিলেন আশ্রমের ক্যাশিয়ার মাধবদার হাতে। পরে বিষয়টা জানতে পেরে বিজয়দা ডেকে বলেছিলেন যে উত্তরণ চাইলে টাকাটা নিজের কাছেও রাখতে পারতেন। উত্তরণ মাথা নেড়েছিলেন। মনে হয়েছিল, আলাদা করে কারওর কাছ থেকে কিছু নেওয়ার দরকারটা কোথায়, যখন ঠাকুর কোনও অভাবই রাখেননি?

উচ্চ মাধ্যমিকে দুর্দান্ত রেজ়াল্টের পর যখন কলেজে ভর্তির সময় এল, তখন ঠাকুর একবারও কলকাতার সেরা কলেজ থেকে ফর্ম তুলতে বা সেখানে ভর্তি হতে বারণ করলেন না। আশ্রমের কোনও এক সন্ন্যাসীই কো-এডুকেশন-এর ব্যাপারটা তুলেছিলেন। ঠাকুর তাঁকে চুপ করিয়ে দিয়ে বলেছিলেন যে, দিন আর রাত্রি যেমন পৃথিবীতে চিরন্তন, তেমনই নারী আর পুরুষও। উত্তরণ কলেজে পড়াশোনা করতে যাচ্ছেন, পাশের বেঞ্চে ছেলে না মেয়ে তাই নিয়ে মাথা ঘামানোর কোনও দরকার নেই।

“পাশের বেঞ্চে যতক্ষণ, ততক্ষণ মাথা না ঘামালেও চলবে। কিন্তু যদি কোনও মেয়ে এসে একদম পাশেই বসে পড়ে?” কলেজে ক্লাস শুরু হওয়ার আগের দিন রাতে উত্তরণের ঘরে এসে জিজ্ঞেস করলেন বিজয়দা।

উত্তরণ কোনও কথা না বলে তাকালেন বিজয়দার দিকে।

বিজয়দা নস্যি নিতেন মাঝে-সাঝে। সামান্য নস্যি নিয়ে বললেন, “চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে দুটো সময় খুব গুরুত্বপূর্ণ, জানো তো। ব্রাহ্মমুহূর্ত এবং গোধূলি। প্রথমটায় রাত্রির ভিতর থেকে দিন জন্ম নিতে শুরু করে। আর দ্বিতীয়টায় দিন গিয়ে মিশে যায় রাত্রির মধ্যে। তাই ব্রাহ্মমুহূর্তে সাধক নিজের সঙ্গে ঈশ্বরের সংযোগ চেয়ে সাধনায় বসেন। আর দ্বিতীয়টায় জগতের মঙ্গলকামনায় প্রার্থনা করেন! উষালগ্ন সাধকের, গোধূলিলগ্ন সংসারীর।”

“বুঝতে পারছি বিজয়দা।”

“কিন্তু কেন তোমাকে কথাগুলো বলছি তা এখনও বোঝোনি। যখন কলেজে যাবে, ক্লাস করবে, কলেজ থেকে ফিরবে, তখন তোমার ভিতর সবসময় সেই ব্রাহ্মমুহূর্তকে জাগ্রত রেখো। রাত্রির ভিতর থেকে জন্ম নিয়েও দিন যেমন নিজেকে আলাদা করে রাত্রির থেকে, মায়ের পেট থেকে জন্ম নেওয়া সাধকও তেমন নারীর থেকে দূরত্ব রচনা করেন। না পারলেই সংসার গ্রাস করে নেবে তাঁকে। গোধূলি, রাত্রির দিকে ধাবিত হবে।”

“আশীর্বাদ করুন, যেন পারি।”

“তোমাকে পারতেই হবে বুবাই। তোমার উপর যে এই আশ্রমের অনেক কিছু নির্ভর করছে।” বিজয়দা উত্তরণের মাথায় জপ করে দিয়ে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে।

সেই রাতটা কিছুতেই ঘুমোতে পারলেন না উত্তরণ। পায়চারি করতে থাকলেন ঘরের মধ্যে। মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে লাগল একটাই কথা। অন্য যারা কলেজে আসছে তারা একটি বাড়ি থেকে আসছে, কিন্তু উত্তরণ কলেজে যাচ্ছেন সত্যসেবী আশ্রম থেকে। অন্যরা স্রেফ স্টুডেন্ট, উত্তরণ প্রতিনিধি। ওঁর প্রতিটি আচরণের নিরিখে কেবল ওঁর নয়, সত্যসেবী আশ্রমের মূল্যায়ন হবে।

ঠাকুরকে প্রণাম করে কলেজের দিকে রওনা হবেন বলে উত্তরণ ভজন-কুটিরে এসেছেন, ঠাকুরের কাছে বসে থাকা এক রিটায়ার্ড বিচারক জানতে চাইলেন, উত্তরণের অনার্স কী বিষয়ে।

“দর্শন।” উত্তরণ বললেন।

“তোমার গুরু-দর্শন তো হয়েছে। তা হলে আর দর্শন নিয়ে চিন্তা কী?” ঠাকুর হেসে উঠলেন।

সমস্ত ভার নেমে গেল উত্তরণের। মনে হল, গুরুদেবের আশীর্বাদ প্রতিটি ক্ষণে, প্রতিটি মুহূর্তে ওঁকে রক্ষা করবে।

গুরুদেব রক্ষা করবেন মানে যে ঝড়-ঝাপটার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে, তা তো নয়। কলেজে যাওয়ার প্রথম দিন থেকেই প্রচুর টিটকিরির মুখে পড়তে হল উত্তরণকে। কলেজে ঢুকতে আওয়াজ, বেরোনোর সময় আওয়াজ, ক্লাসে কিছু বলার জন্য উঠে দাঁড়ালে প্যাঁক। প্রথম-প্রথম উত্তরণের খারাপ লাগত, কিন্তু অনিলদাকে গিয়ে ব্যাপারটা বলায় অনিলদা একটা টোটকা বলেছিলেন। তাতে অনেকটা কাজ হয়েছিল। টোটকাটা আর কিছুই নয়, যে যাই বলুক, তার দিকে তাকিয়ে হাসা। স্রেফ হাসা। যাকে খ্যাপানো হচ্ছে, সে যদি হাসে তা হলে যে খ্যাপাচ্ছে তার বিড়ম্বনার অন্ত থাকে না।

তবে শুধু হাসিই নয়, একটা সময়ের পর উত্তরণের মেধা এবং ব্যক্তিত্বও গোটা কলেজকে ওঁকে অন্য চোখে দেখতে বাধ্য করল। পার্ট ওয়ানে ফার্স্ট হওয়ার পর ব্যাপারটা অনেকেরই মাথার মধ্যে গেঁথে গেল যে ধুতি-ফতুয়া পরা এই ছেলেটা গড়পড়তা পাঁচজনের থেকে বিদ্যায়, বৈদগ্ধে অনেকটা এগিয়ে।

তবে তার মধ্যে কি ঘটনা ঘটেনি? উত্তরণের গায়ে একবার দোলের আগের দিন মদ ছিটিয়ে দিয়েছিল কিছু ছাত্র নামধারী লুম্পেন। তখন ওঁরই এক সহপাঠী দীপ্ত খেপে উঠে ছুটে গিয়েছিল ছেলেগুলোর দিকে।

ওই ছেলেগুলোর একটার চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকাতে-ঝাঁকাতে দীপ্ত জিজ্ঞেস করেছিল, “পারবি? পড়াশোনা, চরিত্র, কোনও কিছুতে ওই ছেলেটার সমকক্ষ হতে পারবি?”

উত্তরণকে কলেজে দাঁড় করিয়েই, কে জানে কোত্থেকে, দীপ্ত নতুন একটা পাঞ্জাবি কিনে এনেছিল আর খানিকটা বাধ্য করেছিল উত্তরণকে সেটা পরতে। তারপর নিজের গাড়িতে করে ওঁকে পৌঁছে দিয়েছিল গড়িয়া অবধি। কোনও বারণ শোনেনি।

সেদিনের পর থেকে প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী বাড়ির ছেলে দীপ্ত অনেকটা কাছে চলে এসেছিল উত্তরণের। সবকিছু থেকে দূরে-দূরে থাকার অভ্যাস সত্ত্বেও উত্তরণ ওকে সরিয়ে দিতে পারেননি নিজের বৃত্ত থেকে।

“কিন্তু তুমি আমাকে গাড়ি করে পৌঁছে দেওয়ার ধকলটা নিতে চাও কেন প্রায়-দিনই?” উত্তরণ জিজ্ঞেস করেছিলেন ওকে।

“পৌঁছে কোথায় দিই? খানিকটা এগিয়ে দিই মাত্র।”

“কলেজ স্ট্রিট থেকে যাদবপুর খানিকটা? এতে সময় নষ্ট হয় না তোমার?”

“সারা দিন যাদের সঙ্গে মিশি… সেসবের পর কিছুটা সময় তোর সান্নিধ্য পেলে, আমার পুণ্য হয়। আর তার চাইতেও বড় কথা, ফিলোসফি পড়তে এসেছি, একটু সাধুসঙ্গ না করলে চলবে কী করে?” উত্তরণ ‘তুমি’ বললেও, দীপ্ত ‘তুই’ বলেই সম্বোধন করত।

“দার্শনিক হতে গেলেই যে সাধু হতে হবে তার কিন্তু কোনও মানে নেই। সেদিন ক্লাসে কেপিসি যাঁকে আধুনিক দর্শনের জনক বলে বলছিলেন, সেই দেকার্ত কিন্তু সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে যুদ্ধ করতে চলে গিয়েছিলেন।”

“আমিও তো যুদ্ধই করছি ভাই, তোর জন্য।”

“মানে?” একটু অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালেন উত্তরণ।

“আরে কলেজে যে দক্ষিণপন্থী অংশটা আছে তারা ভোটে দাঁড় করাতে চাইছে তোকে।

“ভোটে? আমাকে?”

“এত অবাক হওয়ার কী আছে?”

“না, এতদিন টিটকিরি দিত তো সবাই…”

“এখনও হয়তো অল্প কয়েকজন দেয়। কিন্তু যে ছেলেটা কোনওরকম টোন-টিটকিরিকে পরোয়া না করে টানা দু’বছর ধুতি-পাঞ্জাবি পরে কলেজ করছে, ফার্স্ট হচ্ছে ইউনিভার্সিটির পরীক্ষায়, সে এখন বেশির ভাগ ছেলেমেয়ের কাছেই ইয়ার্কির পাত্র নয়, উলটে একটা আইকন। সেই আইকনকে ভোটে দাঁড় করিয়ে ছাত্রনেতারা বৈতরণী পার হতে চাইবে না?”

উত্তরণ এতই অবাক হয়ে গেলেন কথাটা শুনে যে তৎক্ষণাৎ কোনও জবাব মুখে এল না। স্তব্ধ হয়ে শুধু ভাবতে থাকলেন, এ কেবলই গুরুকৃপা।

“কী ভাবছিস?” দীপ্ত জিজ্ঞেস করল।

“ভাবছি আমার গুরুদেবের কথা। যিনি ঝঞ্ঝাকেও বসন্তের বাতাস করে দিতে পারেন।”

“ওরা প্রোপোজ়াল দিলে তুই কি দাঁড়াবি?” দীপ্ত জিজ্ঞেস করল।

“কখনওই না। আমি এ জীবনে আমার ঠাকুরের কাজ ব্যতিরেকে অন্য কোনও কাজের সঙ্গে জড়াব না।”

“ব্বাবা! কী কনফিডেন্স! কিন্তু লাইফ কী জিনিস জাননা তো না! কবে কখন কার সঙ্গে জড়িয়ে যাবে, টেরটিও পাবে না।”

উত্তরণ বলবেন ভাবলেন, ‘কনফিডেন্স নয় সংকল্প’। কিন্তু সে কথা না বলে বললেন, “ঠাকুর জড়াতে দেবেন না।”

“ওকে মহারাজ। জড়াবেন না। কিন্তু আমি আপনার হয়ে একটা জায়গায় কথা দিয়ে ফেলেছি, সেখানে উপস্থিত হয়ে আমাকে উদ্ধার করতেই হবে।” সিগন্যাল লাল হতেই স্টিয়ারিং থেকে হাতটা সরিয়ে উত্তরণের হাতটা ধরল দীপ্ত।

সেমিনারটার শীর্ষক ছিল, ‘কমিউনিজ়ম ভারতীয় ভাবধারা নয়’। প্রস্তাবের বিপক্ষে বলতে গিয়ে উত্তরণ প্রায় বোমা ফাটালেন। উপস্থিত শ্রোতৃমণ্ডলীর কাছে জানতে চাইলেন, যিনি কী আনা হয়েছে না দেখে যা আনা হয়েছে, তা-ই পাঁচ ছেলেকে সমান ভাগে ভাগ করে নিতে বলতে পারেন, সেই কুন্তীকে কমিউনিস্ট বলা যাবে না কেন? কেন কমিউনিস্ট বলা যাবে না, চণ্ডালকেও দ্বিজশ্রেষ্ঠ হিসেবে স্বীকার করে নিতে কুণ্ঠিত না হওয়া মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যকে? যিনি একশো বছরেরও আগে সমাজের সমস্ত পতিতাদের জন্যও বেলুড় মঠের দরজা খুলে দিতে বলেছিলেন, সেই স্বামী বিবেকানন্দ সাম্যবাদী নন? আরও আগে যদি চলে যাওয়া যায়, তা হলে ঋগ্বেদের সেই কবি, যিনি রচনা করেছিলেন, ‘সংগচ্ছধ্বং সংবদধ্বং সংবোমনাং সিজানতাম’, অর্থাৎ, ‘এসো আমরা এক কথা বলি, এক সঙ্গে চলি, এক হোক আমাদের মন’, তাঁকে কী বলব আমরা?

হাততালিতে হল ফেটে পড়ছিল, তখনই কোথাও থেকে একটা বেড়ালের ডাক শোনা গেল। তারপর একজন উঠে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করল, “আপনি কি মার্ক্স এবং এঙ্গেলসকে নস্যাৎ করে দিতে চাইছেন?”

উত্তরণ খুব শান্ত গলায় বললেন, “সনাতনী ভাবধারা কাউকেই নস্যাৎ করার পক্ষপাতী নয়। কারণ এর মূল কথাটিই হচ্ছে, ‘যত মত, তত পথ’। একটিই মাত্র মত এবং পথের তত্ত্বে ভারতের আত্মাকে ছোঁওয়া যাবে না।”

এবারের হাততালি আরও স্বতঃস্ফূর্তভাবে ছড়িয়ে পড়ল গোটা হলে। আর এবার কোনওদিক থেকে বেড়াল-কুকুরের ডাক ভেসে এল না।

কলেজ থেকে বেরোনোর সময় একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। একটি মেয়ে এগিয়ে এসে প্রণাম করল উত্তরণকে। উত্তরণ বাধা দেওয়ার চেষ্টায় বলে উঠলেন, “কী করছেন?”

মেয়েটি ওঁর দিকে চোখ তুলে বলল, “প্রণাম। মনে-মনে তো রোজই করি। আজ যখন পা ছুঁয়ে করার সুযোগ পেয়েছি, তখন ছাড়ি কেন?”

এবার মেয়েটিকে চিনতে পারলেন উত্তরণ। কয়েকমাস আগে যখন অন্য একটি মেয়ে এগ বা মাটন রোলের ভুক্তাবশিষ্ট ছুড়ে মেরেছিল উত্তরণের দিকে, তখন এই মেয়েটিই ছুটে গিয়ে তাকে এক থাপ্পড় মেরেছিল। উত্তরণ কোনওরকম প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত না করে কলেজ থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন সেদিন। আজ জিজ্ঞেস করলেন, “কোন ইয়ার?”

“ফার্স্ট ইয়ার। ফিলোসফি। আমার নাম অনসূয়া।”

“আচ্ছা।” উত্তরণ পা চালালেন।

অনসূয়া বলে উঠল, “একটা রিকোয়েস্ট ছিল। আমায় পড়াবেন?”

আবার চমকে উঠলেও উত্তরণ তা প্রকাশ করলেন না। নিচু গলায় বললেন, “আমি নিজেই এখনও শিখছি।”

কথাগুলো বলে উত্তরণ বেরিয়ে এলেন, কিন্তু সেদিন সন্ধ্যায় যখন জপে বসেছেন তখন ওঁকে বিস্মিত করে, অনসূয়ার মুখ ভেসে উঠল দুই ভুরুর মাঝখানে।

উত্তরণ চমকে উঠে, চোখ খুলে আবার বন্ধ করলেন। কিন্তু সেই একই মুখ ভেসে উঠল। কেমন একটা ভয় পেয়ে গেলেন উত্তরণ। এরকম তো আগে কখনও হয়নি।

দীক্ষা পাওয়ার পরপর বিজয়দা ওঁকে একদম কাছে বসিয়ে বোঝাতেন চারপাশের বেশির ভাগ মানুষ কীরকম গুহ্য-লিঙ্গ-নাভিতে আটকে আছে। তারা আহার এবং মৈথুনে লিপ্ত হয়ে তার বাইরের কিছু অনুভব করতে পর্যন্ত পারে না। এর পরের ধাপ হচ্ছে, যারা হৃদয় অবধি পৌঁছেছে এবং তার পর যারা কণ্ঠ পর্যন্ত। তারও পরে তারা, যারা দুই ভুরুর মাঝবরাবর, আজ্ঞাচক্র পর্যন্ত আসতে পেরেছে। একদম শীর্ষ সাধকরা পারেন কুণ্ডলিনীকে সহস্রারে জাগ্রত করতে। কিন্তু উত্তরণের কপালের মাঝখানে যে জায়গাটায় স্বয়ং ব্রহ্মচারী ঠাকুরের পায়ের স্পর্শ লেগেছে, ধ্যানের সময় সেখানে একটি মেয়ের ছবি ভেসে উঠল কেন?

নিদারুণ মনোবেদনায় আসন ছেড়ে উঠে বেশ অনেকক্ষণ পায়চারি করলেন উত্তরণ। তারপর ঠাকুরের কাছে গেলেন, নিজের অপরাধ বা ব্যর্থতা স্বীকার করতে। তখনই ঠাকুরের শয়নকক্ষের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অনিলদা জানালেন যে শরীর ভাল নয় বলে ঠাকুরকে তাড়াতাড়ি শুইয়ে দেওয়া হয়েছে।

উত্তরণের মনটা ছটফট করতে লাগল। রাতের আরতিতে যোগ দিলেও মন দিতে পারলেন না। ফিরে এসে পড়ার বই খুলেও খুব কিছু সুবিধা হল না। শুধু ভাবতে থাকলেন, কী অপরাধ হল, কেন ঠাকুরের দর্শন পেলেন না?

কেন ওই মেয়েটার মুখ, যা বিকেলেই ভুলে যাওয়ার কথা, রাতেও এতটা স্পষ্ট?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *