১. এক খণ্ড বৃহৎ মেঘ

পূর্ণ অপূর্ণ – উপন্যাস – বিমল কর

০১.

মাথার ওপর কৃষ্ণকায় এক খণ্ড বৃহৎ মেঘ, দুপাশে নিবিড় অরণ্য আর অন্ধকার ফণা-তোলা সাপের মতন এতক্ষণ যেন অবনীকে তাড়া করে নিয়ে যাচ্ছিল। অনেকক্ষণ ধরে সে এই অসহায় ও উদ্বেগজনক অবস্থা থেকে পালিয়ে আসার চেষ্টা করছিল; পারছিল না। উভয় পাশের স্থির নিস্তব্ধ বৃক্ষলতাপূর্ণ পার্বত্য উচ্চভূমি, ঘন অন্ধকার, মসিময় মেঘখণ্ড তাকে ঘিরে ফেলেছে। অবনীর মনে হচ্ছিল, এই পথ বুঝি আর সে অতিক্রম করতে পারবে না, কোথাও থেমে যেতে বাধ্য হবে।

হঠাৎ, অধাবৃত্তাকার একটি বিপজ্জনক বাঁক পেরিয়ে কাঠের সাঁকোর মুখে গাড়ি আসতেই মনে হল, কী যেন তার চারপাশ থেকে সরে যাচ্ছে। আরও কিছুটা পথ এগিয়ে সেই আকাঙিক্ষত দীর্ঘ ঢাল পাওয়া গেল। মাখারিয়ার পাহাড়ি জঙ্গল তবে শেষ হয়েছে। এখন পথ ক্রমশই নীচে নেমে যাবে। অবনী অনুভব করতে পারল, তার মাথার ওপর সেই কুণ্ডলীকৃত মেঘটিও আর নেই। সন্ধ্যার অন্ধকার এখন দুঃসহ নয়; বাতাস আরও কিছুটা প্রবল হয়েছে। এতক্ষণ যে অরণ্য তাকে ক্রমাগত দুপাশ থেকে গ্রাস করার, এবং কৃষ্ণকায় মেঘখণ্ড তাকে আত্মসাৎ করার চেষ্টা করছিল তারা পিছনে সরে যাচ্ছে; বনভূমি আর তত নিবিড় নয়, ক্রমশই পাতলা হয়ে আসছে। ভীত এবং বিপন্ন অবনী এতক্ষণে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল।

বিকেলে, অবনী যখন শহরের হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আসে তখন, দমকা বৃষ্টি এসেছিল। বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটায়, এলোমেলো ঝাঁপটায় তার গাড়ি ভিজে গিয়েছিল, অবনীও পুরোপুরি শুকনো থাকতে পারেনি। তার জিপগাড়ির ক্যানভাসগুলো অকেজো হয়ে গেছে, বাতাসে ফটফট করে ওড়ে। গাড়ির পিছন দিকটা ভিজে গেল বিকেলের বৃষ্টিতেই। সেই দমকা বৃষ্টির মধ্যেই মাইলটাক পথ পেরিয়ে আসতে আসতে বিকেল পড়ে এল, বৃষ্টি ধরে গেল। আকাশ পরিষ্কার হল না। কোথাও একটু কালো, কোথাও ধূসর, কোথাও বা ঈষৎ রক্তাক্ত মেঘ ছিল। অবনী এসব খেয়াল করে দেখেনি, তবু যেন চোখে পড়েছিল। আকাশ ও মেঘের সঙ্গে তার চোখের সংযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল, সে উদাসীন হয়ে ছিল, তবু মনে মনে ক্রমশই কোনও এক বিষণ্ণতায় ভারাক্রান্ত হয়ে উঠেছিল। হীরালালের কথা তার মনে স্থায়ী কোনও ছায়ার মতন পড়ে ছিল। বেচারি হীরালাল! এখনও তাকে হাসপাতালের বিছানায় দেখা যাবে, দুপাশে পরদা ফেলে দেওয়া হয়েছে, অক্সিজেন চলছে, হয়তো সন্ধ্যায় বা রাত্রে কিংবা কাল সকালে শেষবারের মতন একটু অক্সিজেন নিয়ে সে চলে যাবে, তার শয্যা শূন্য হবে। কোথায় যাবে হীরালাল? আকাশে? আকাশে নয়। দ্বিপদ জীব, মেঘ নয়, বাতাস নয়, ধূলিকণাও নয় যে ওই আকাশে তার ঠাঁই হবে। তবু অবনী উদাস চোখে শেষ বর্ষার অপরাহ্নের বিক্ষিপ্ত মেঘমালা দেখেছিল।

ওই সময়, আসার পথে শহরের শেষ প্রান্তে সেন্ট জোসেফ স্কুলের সামনে তার গাড়ি কেমন মন্থর হয়ে গিয়েছিল। হয়তো অবনী সামান্য সময় দাঁড়িয়ে পড়েছিল। স্কুল কম্পাউন্ডের একটা পাশ অসাড়, ক্লাসরুমের দরজা জানলা বন্ধ; অন্য পাশে মস্ত মাঠ আর পুকুর, পুকুরের গা ঘেঁষে হোস্টেল। ঘণ্টা পড়ছিল হোস্টেলে, কয়েকটা বাচ্চা ছেলে পুকুর থেকে উঠে সপসপে ভিজে গায়ে ছুটছিল; খেলার মাঠ ছেড়ে সবুজ ভিজে ঘাসের ওপর দিয়ে জলকাদা-মাখা কটা ছেলেও হোস্টেলে ফিরে যাচ্ছিল। অবনী ওদের দেখতে দেখতে হীরালালের কথা ভাবছিল। হীরালাল ছেলেবেলায় ওই স্কুলে পড়েছে। একবার এই পথ দিয়ে যাওয়ার সময় হীরালাল তার পাশে বসে স্কুলের ঘরবাড়ি মাঠ পুকুর দেখাতে দেখাতে অবনীকে তার ছেলেবেলার গল্প শুনিয়েছিল। পুকুরে সাঁতারকাটা শিখতে গিয়ে হীরালাল একবার ডুবতে ডুবতে কী করে বেঁচে গিয়েছিল সে-গল্প শুনিয়ে হীরালাল বলেছিল: মাগর দো সাল বাদ হাম জুনিয়ার গ্রুপমে সুইমিং চামপিয়ান হুয়া থা৷ সিনিয়ার গ্রুপেও হীরালাল মেডেল পেয়েছিল সাঁতারের।

স্কুলের পুকুরটিতে বাদলা-অন্ধকারের ছায়া পড়ে গিয়েছিল, অবনী দূর থেকে জল দেখতে পাচ্ছিল না, তবু তার মনে হল, সেন্ট জোসেফ স্কুলের পুকুরটিকে কোনও রকমে হীরালালের কথা যদি জানানো যেত অবনী জানাত।

স্কুল ছাড়িয়ে আসতেই অবনী কেমন এক আক্রোশ অনুভব করল। হয়তো অনেকক্ষণ থেকে ক্রমশই কোনও ক্ষোভ তার মনে জমছিল, মেঘলা জমে আসার মতন কোনও গুমট এবং ভার। জীবন এই রকমই, তার থাকা না থাকার কোনও নিয়ম নেই; স্থিরতাও নেই। অকারণে অপ্রয়োজনে থাকে, আবার অকারণেই চলে যায়। মানুষ তাকে রাখব বললেই রাখতে পারে না। হীরালাল শক্ত সমর্থ যুবক, বছর পঁয়ত্রিশ বয়স হয়েছিল মাত্র, উদ্যোগী, পরিশ্রমী, প্রসন্ন-স্বভাব, কাজকর্ম চমৎকার বুঝত, ঠাকুর দেবতায় ভক্তি ছিল, মদগাঁজা খেত না, কুসংসর্গে পড়েনি, ঘুষ নিতে তার বিবেকে বাধত। এইসব সাধারণ সৎ গুণ রক্ষা করে হয়তো সে ভাবত জীবনের খাতায় কিছু জমাচ্ছে। অথচ, সেই জীবনের হিসেবের পাতাটা কত অনায়াসে এবং সহজে কে যেন ধুত বলে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে বাতাসে উড়িয়ে দিল। হীরালাল মিশ্র, পাঁচ ফুট আট ইঞ্চির কাঠামো, দেড় মণের ওপর ওজন, সাঁতারু শক্ত হাত এবং স্থির উদ্দেশ্যে নিয়েও অন্য একটি পুকুরের সামান্য পথ এগিয়েই থেমে গেল। কেন?

কখন যেন বিকেল পড়ে গিয়ে আলো মুছে আঁধার জমছিল। গাড়ি অনেক দুর এসে পড়েছিল। তাকে পাশ কাটিয়ে, তার সামনে দিয়ে আরও কত গাড়ি চলে গেল। অবনী লক্ষ করল, অন্যমনস্কতার মধ্যেই সে কখন নিজের অজ্ঞাতেই গাড়ির হেডলাইট জ্বালিয়ে দিয়েছে। ঠাণ্ডা বাদলা বাতাস আসছে হুহু করে, গাড়ির পিছন দিকের ক্যানভাস বাতাসের দমকায় উড়ে উড়ে আছড়ে পড়ছে, কেমন এক শব্দ হচ্ছে যেন কেউ অবনীর পিছু পিছু বুক চাপড়াতে চাপড়াতে চলেছে। অসহ্য মনে হওয়ায় গাড়ি থামাল অবনী। শহরের দিকের বাসটা তার পাশ কাটিয়ে উলটো দিকে চলে গেলে ঘড়ি দেখল, প্রায় সাড়ে ছয়। এখনও অনেকটা পথ, মাইল পনেরোরও বেশি। গাড়ির ইঞ্জিনে কোথাও একটা বেয়াড়া শব্দ হচ্ছে। নামল অবনী, ইঞ্জিন দেখল। ঠিক বোঝা গেল না। একটা টর্চ আনা উচিত ছিল, সাধারণত সঙ্গে থাকে। আজ তাড়াতাড়ি হাসপাতালে যাবার সময় টর্চের কথা খেয়াল হয়নি। গাড়িতে ফিরে এসে উঠে বসার আগে পিছনের ক্যানভাস বাঁধার চেষ্টা করল, উঠে এসে সিগারেট ধরাল অবনী। কেমন একটা অবসাদ এসেছে, ছোটাছুটি করার জন্যে হতে পারে, মনের ভারের জন্যেও হতে পারে। প্রায় আধখানা সিগারেট চুপচাপ বসে বসেই শেষ করে গাড়িতে আবার স্টার্ট দিল, দিয়ে ডান দিকের পথ ধরল। মাইলটাক এগিয়েই মাখারিয়ার জঙ্গল শুরু হবে। পথটা সাবধানে পেরিয়ে যাওয়াই রীতি। জঙ্গলের দিকে বৃষ্টি হয়েছে কিনা বোঝা গেল না। বাসটার গায়ে জল ছিল, ঠিক কোথায় বৃষ্টি পেয়েছে কে জানে, জঙ্গলে বৃষ্টি থাকলে খুব সাবধানে এই পথটা পেরোতে হবে।

সাবধান হওয়া না হওয়ায় খুব কি একটা যায় আসে? হীরালাল কখনওই বেপরোয়া ছিল না। প্রতিটি কাজ সে ভেবেচিন্তে সাতপাঁচ ভেবে করত। ঠাণ্ডা মাথার লোক যেমন হয়। এই এলাকায় সে আজ চার বছর ওভারহেড ইলেকট্রিক লাইন লাগাবার তদারকি করছিল। জরিপনকশা, পথঘাট বন পাহাড় তার সব জানা, কাগজ পেনসিল দিলে চোখ বুজে ছক করে কোথায় কী আছে বলে দিতে পারত। অথচ সেই হীরালাল সামান্য একটা ট্রাক নিজের হাতে পথের পাশে সরিয়ে রাখতে গিয়ে কেমন করে যেন কালভার্টের পাশে গাড়িটাকে গড়িয়ে দিল, ঢালু পথে গাড়িটা মালপত্র সমেত উলটে গেল, হীরালাল জখম হল। প্রথমে মনে হয়েছিল, তার আঘাত গুরুতর নয়, শরীরের বাইরে তেমন একটা ভাঙাচোরা রক্তারক্তির চিহ্ন ছিল না। ছোকরা অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। হাসপাতালে নিয়ে যাবার পর জানা গেল, মাথায় জোর চোট লেগেছে, রক্তক্ষরণ হচ্ছে ভেতরে। আজ নিয়ে দুদিন ওই রকম, অজ্ঞান অবস্থা। আশা ভরসা আর নেই। বিন্দুমাত্রও নয়।

কেমন এমন হয়? কেন?

.

অবনী হঠাৎ অনুভব করল সে মাখারিয়ার জঙ্গলে ঢুকে পড়েছে, সন্ধ্যা হয়ে গেছে, এবং তার মাথার ওপর এক খণ্ড কালো ভয়ংকর মেঘ। থমথমে সেই মেঘের পুঞ্জ ক্রমশই ধোঁয়ার মতন কুণ্ডলী পাকিয়ে আকাশ ঢেকে ফেলতে চাইছে। জঙ্গলের মাথার ওপর দিয়ে যেন সাঁতার কেটে চলেছে মেঘটা। ক্রোধ, তিক্ততা, আক্রোশ সমস্তই যেন আচমকা অবনীকে কেমন বেপরোয়া করে তুলল। পাথরের মতন শক্ত হয়ে সে বুঝি কারও বিরুদ্ধে দাঁড়াতে চায়, অন্ধ হিংস্র দৃঢ় হয়ে। গিয়ার বদলে নিল। অ্যাকসিলারেটারে চাপ বাড়াতে লাগল, স্টিয়ারিং ধরল শক্ত মুঠোয়। তারপর মনে মনে অদৃশ্য কোনও শত্রুকে যেন ঘৃণার সঙ্গে কিছু বলল।

শাণিত তরোয়ালের মতন আলোর দীর্ঘ ফলা অরণ্য ও অন্ধকারকে চিরে পথ দেখিয়ে দিচ্ছিল, অবনী সাবধানে গাছের সারি বাঁচিয়ে, মাঝ বরাবর পথ ধরে, উঁচুনিচু লক্ষ রেখে, এবং প্রতিটি বিশ্রী বিপজ্জনক বাঁক অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে পেরিয়ে যাচ্ছিল। হঠকারিতা করে সে কখনও পথের পাশে সরছিল না। উভয় পাশেই বৃক্ষলতাকীর্ণ গভীর খাদ অন্ধকারে ফাঁদ পেতে রেখেছে, অসতর্ক হলে অবনী সেই ফাঁদে ধরা পড়বে। সম্ভবত বিকেলের দিকে বৃষ্টি হয়ে গেছে জঙ্গলে, কালো পিচের রাস্তা এখনও ভিজে, গাড়ির আলোয় দীর্ঘ কোনও সরীসৃপের পিচ্ছিল শরীরের মতন কুৎসিৎ দেখাচ্ছিল। রাস্তার দু পাশে দীর্ঘকায় প্রাচীন বৃক্ষ। অবনী জানে, অসাবধান হলে এই পথে গাড়ির চাকা পিছলে যেতে পারে, পিছলে গিয়ে সরাসরি গাছের সঙ্গে প্রচণ্ড ধাক্কা খেতে পারে। তার সে রকম কোনও স্পৃহা নেই। লক্ষ স্থির তীক্ষ্ণ রেখে, শরীরে অঙ্গগুলি অস্বাভাবিক কঠিন করে, দক্ষতার সঙ্গে সে পথ অতিক্রম করছিল।

যেতে যেতে কখন যেন অবনী অনুভব করল, তার চতুর্দিকের স্তব্ধতা ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ ছাড়া কোথাও কোনও রকম শব্দ নেই, সেই একঘেয়ে যান্ত্রিক শব্দও দীর্ঘ সময় কানের কাছে বাজতে বাজতে কখন যেন সয়ে গেছে, স্বতন্ত্রভাবে আর শোনা যায় না। এই নিরালোক অসাড় জগতের নৈঃশব্দ এক অবর্ণনীয় প্রাণহীনতা সৃষ্টি করেছে। অবনী হঠাৎ কেমন আতঙ্ক অনুভব করল।

তারপর সহসা তার দৃঢ়তা ভাঙল, যে অবজ্ঞা আক্রোশে সে অজ্ঞাত এক শত্রুর সঙ্গে যুঝতে নেমেছিল মনে হল–সেই অবজ্ঞা এখন তাকে উপহাস করছে। কপালে ঘাম ফুটল, মেরুদণ্ড সামান্য নুয়ে পড়ল। দ্বিধা ও সন্দেহবশে তার মনে হল, গাড়ির আলো ক্রমশই নিষ্প্রভ হয়ে আসছে, এবং সে যেন কোনও গুহার মাঝ বরাবর এসে আটকে পড়েছে। যে কোনও মুহূর্তেই আলোটুকু ফুরিয়ে যেতে পারে, যে কোনও মুহূর্তে সর্বগ্রাসী এই অন্ধকার ও অখণ্ড স্তব্ধতা তাকে আক্রমণ করবে। অবনী ভীত হয়ে অকারণে গাড়ির হর্নে হাত দিল। তীব্র তীক্ষ্ণ এক শব্দ সদ্য ভূমিষ্ঠের মতন যেন এই উদ্বেগের মধ্যে চিৎকার করে উঠল। …অবনী অনেকক্ষণ আর হর্ন বন্ধ করল না বন্ধ করতে তার সাহস হল না, নিতান্ত অন্তরঙ্গ সঙ্গীর মতন তাকে অনুভব করতে করতে এক সময় অর্ধবৃত্তাকার একটি বাঁক পেরিয়ে কাঠের সাঁকোর মুখে এসে হঠাৎ অনুভব করল কী যেন তার চারপাশ থেকে সরে যাচ্ছে। আরও সামান্য এগিয়ে সে বুঝতে পারল মাখারিয়ার জঙ্গল এবং সেই কৃষ্ণকায় মেঘের সীমানা সে অতিক্রম করে চলে এসেছে।

স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল অবনী। কপাল গাল-গলার ঘাম মুছল। ধীরে সুস্থে সিগারেট ধরাল।

.

এখন আর সে কোনও দুশ্চিন্তা অনুভব করছে না। মাইল সাতেক পথ এখনও তাকে যেতে হবে, এবং রাস্তা অধিকাংশ সময় এই রকম নির্জন ও লোকালয়হীন। তবু অবনী বিন্দুমাত্র উদ্বেগ বোধ করল না। কেননা এর পর রাস্তা ভাল, পাহাড় জঙ্গল নেই, ঝোপঝাড় মাঠঘাট, কোথাও বা বালিয়াড়ির মতন স্তূপ। বড় বড় পাথরের চাঁই ইতস্তত দেখা যাবে। এখানটায়, অবনীর খেয়াল হল, সরকারি নতুন রিজার্ভ ফরেস্ট তৈরি হচ্ছে, গাছপালা লাগিয়েছে বিস্তর, কাঁটাতার দিয়ে ঘিরে রেখেছে। কাছেই নদী।

দূরে আড়াল থেকে যেন হামাগুড়ি দিয়ে একটি আলোর রেখা লাফিয়ে উঠে এল। আলোটা উঁচুনিচু হয়ে নাচতে নাচতে সামনে এগিয়ে আসছিল, তারপর জোরালো হল। অবনী মাঝরাস্তা থেকে ধীরে ধীরে সরে যেতে লাগল। গাড়ি আসছে। দেখতে দেখতে কাছাকাছি এসে গেল। কখনও অবনী,কখনও আগতগাড়ির চালক জোরালো আলো নিবিয়ে এবং জ্বেলে পরস্পরকে যেন দেখে নিল, তারপর আলোর রশ্মি হ্রাস করে পরস্পরকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। পলকের মধ্যেই অবনী বুঝতে পারল, চলে যাওয়া গাড়িটা বড় এবং ভারী, কয়েকজন লোক রয়েছে ভেতরে।

ওরা শহরে যাচ্ছে। পৌঁছতে রাত হয়ে যাবে। হঠাৎ অবনী কেমন নির্বোধের মতন কুণ্ঠিত হাসি হাসল। যারা গেল তাদের মাখারিয়ার পাহাড় জঙ্গল ভেদ করেই যেতে হবে, হামেশাই ওই পথে গাড়ি যায়, তবু আজ অবনী কেন যে অত ভীত ও ত্রস্ত হয়ে উঠল।

আসলে আজ তার কিছু যেন হয়েছিল। কী হয়েছিল? মন খারাপ? হীরালালের মৃত্যুর চিন্তা তাকে ভাবপ্রবণ করে তুলেছিল? সে আহত হয়েছে? বিরক্ত ও বীতশ্রদ্ধ? মৃত্যুর চিন্তা কি গোপনে তাকে ভীত ও উদভ্রান্ত করে তুলেছিল?

.

যে কোনও কারণেই হোক অবনী তখন অতিরিক্ত চঞ্চল ও বিভ্রান্ত হয়েছিল। তার সমস্ত হৃদয় ভারাক্রান্ত ও বিষণ্ণ ছিল। সে ছেলেমানুষের মতন ক্ষুব্ধ হয়ে মৃত্যুর প্রতি আক্রোশ অনুভব করেছিল, এবং উন্মাদের তুল্য মৃত্যুকে তার বিপক্ষ খাড়া করে তার সঙ্গে লড়বার চেষ্টা করছিল। এইসব মিলেমিশে তার স্বাভাবিক বোধ অস্বাভাবিক এত ভীতির সম্মুখীন হয়েছিল। নিজের একাকিত্ব, অসহায়তা, আঘাত, ক্রোধ, বিভ্রান্তি মাখারিয়ার নির্জন নিস্তব্ধ আরণ্যক পরিবেশে ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে অত্যন্ত প্রখর হয়ে উঠেছিল।

অবনী ভাবল, শ্মশান দর্শনে যেমন সাময়িক বৈরাগ্য, শ্রাবণের মেঘ দর্শনে মন যেমন ক্ষণিক উদাস হয়–এও সেই রকম। স্বাভাবিক, অথচ অর্থহীন। হীরালালের অপ্রত্যাশিত মৃত্যুর জন্যে বেদনা অনুভব করলেও, অবনী এখন আর সেই উৎপীড়ন বোধ করছিল না। সংসারে এরকম হয়, শত সহস্র হচ্ছে। কেন হচ্ছে, এ প্রশ্ন অবান্তর? জীবনের অনেক প্রশ্নেরই উত্তর থাকে না। সান্ত্বনার জন্যে স্বীকার করে নাও, হীরালালের মৃত্যু দুর্দৈব, দুর্ভাগ্য।

ছেলেমানুষের মতন অবনী শক্ত একটা ঢোঁক গিলল। বাঁ হাতে পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখ মুছল।

.

ছড়ানো ছিটোনো পেঁজা পাতলা তুলোর মতন কয়েকটি মেঘ আকাশে, ধীরে ধীরে কোমল জ্যোৎস্না ফুটে উঠল। শিশিরের মতন এই আলো ভিজে এবং মিহি রঙের। অন্ধকারে প্রান্তরগুলি ক্রমশ কেমন পুঞ্জ পুঞ্জ ছায়ার মতো স্পষ্ট হল। দুর্বল রেখায় আঁকা ছবির মতো কাছের দু-একটি অসাড় গ্রামও দেখা যাচ্ছিল। কোথাও জোনাকির মতন আলোর বিন্দু জ্বলছে।

অবনী অনুভব করল, তার মনে এখন আর উদ্বেগের বিন্দুমাত্র অবশিষ্ট নেই। যেন সে কোনও দুরূহ অঙ্কের হিসেব শেষ পর্যন্ত মিলিয়ে নিয়েছে, নিয়ে স্বস্তি অনুভব করছে। একটি বিষণ্ণতা অবশ্য থেকে যাচ্ছে। থাকুক। থাকতে থাকতে কোনওদিন এও চলে যাবে।

মিহি ও আর্দ্র জ্যোৎস্নার মধ্যে শিথিল ভঙ্গিতে গাড়ি চালাতে চালাতে অবনী আরও কিছুটা পথ এগিয়ে এল। সামনে এক জনবসতি, আলো জ্বলছে মিট মিট করে, চালা বাড়ি, শিবমন্দিরও চোখে পড়ছে। আর মাত্র মাইল দুই পথ।

মোড়ের কাছাকাছি আসতে অবনীর চোখে পড়ল লাল রঙের একটি বাস রাস্তার পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। এক দল তোক নীচে রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কাছাকাছি একটা দোকান, লণ্ঠন জ্বলছে। কে যেন গলা ছেড়ে কাউকে ডাকছিল।

প্রায় কাছাকাছি আসতে অবনীর চোখে পড়ল, ধুতি-জামা পরা এক ভদ্রলোক রাস্তার প্রায় মাঝামাঝি এসে দাঁড়িয়ে, সামান্য ঝুঁকে তার গাড়ির দিকে তাকিয়ে আছে। অবনী হর্ন দিল। লোকটা আহাম্মকের মতন পথ জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে কেন?

পাশ কাটিয়ে চলে যেতে যেতে অবনী দাঁড়াল। লোকটি হাত তুলেছে, দাঁড়াতে বলছে।

গাড়ির পাশে আসতেই অবনী চিনতে পারল মানুষটিকে। সুরেশ্বর। কাছে এসে মুখ বাড়াতে অবনীকেও চিনল সুরেশ্বর। আরে, আপনি?

কী ব্যাপার? অবনী বলল।

 আর কী, বাস খারাপ হয়ে গেছে।

 অবনী বুঝতে পারল। এরকম দৃশ্য দেখার অভ্যাস তার আছে।

 আমি একটু বিপন্ন হয়ে পড়েছি-সুরেশ্বর বিব্রঙ্কণ্ঠে বলল, বাস কখন ঠিক হবে বুঝতে পারছি; চেষ্টা করছে ওরা, তবু…।

কোথায় গিয়েছিলেন?

স্টেশনে। সন্ধের গাড়িতে এক মহিলা এসেছেন। তাঁকে আনতে গিয়েছিলাম।

অবনী সুরেশ্বরের মুখ লক্ষ করার চেষ্টা করল। অবনীকে দেখতে পেয়ে ভদ্রলোকের যেন কিঞ্চিৎ আশার সঞ্চার হয়েছে। অবনী বলল, কোথায় যাবেন? আপনার আশ্রমে? আশ্রম শব্দটা উপেক্ষা ও কৌতুকের স্বরে বলবার চেষ্টা করল অবনী।

সুরেশ্বর বলল, বেশি দূর নয়, কাছেই; মাইল খানেকের সামান্য বেশি। একা হলে আমি হেঁটে চলে যেতাম। মেয়েটির জন্যে বিপদে পড়েছি, সঙ্গে কিছু মালপত্রও রয়েছে।

অবনী বিশেষ প্রসন্ন হল না। সুরেশ্বরকে তার আশ্রমে পৌঁছে দেওয়া অবনীর দায়িত্ব নয়। তা ছাড়া এতটা পথ–শহরে যাওয়া এবং ফিরে আসায় সে ক্লান্তি অনুভব করছে। তবু, বিপন্ন এক মহিলার কথা ভেবে অবনী সুরেশ্বরের অনুরোধ এড়িয়ে যাওয়ার কৈফিয়ত খুঁজে পেল না। তার বিরক্তিও প্রকাশ করল না, নিস্পৃহ গলায় শুধু বলল, আসুন তা হলে..একটু তাড়াতাড়ি।

সুরেশ্বর আর দাঁড়াল না, বাসের দিকে চলে গেল।

অবনী চুপচাপ বসে সিগারেট ধরাল। ধরিয়ে পাশ ফিরে বাসের দিকে তাকিয়ে থাকল! জ্যোৎস্না অনাবিল নয়, তবু দেখা যায় সব। বাসের ড্রাইভার ইঞ্জিনের ঢাকা খুলে যন্ত্রপাতি দেখছে, হাতে লণ্ঠন নিয়ে তার পাশে অন্য একজন দাঁড়িয়ে। বাস থেকে নেমে পড়ে একদল দেহাতি এদিকে ওদিকে দাঁড়িয়ে গল্পগুজব করছে, বিড়ি ফুকছে, দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে কেউ কেউ পানটান খাচ্ছে। বাস খারাপ হয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়ায় এদের তেমন কোনও ব্যাকুলতা আছে বলে এখন অন্তত মনে হচ্ছে না।

অবনীর চোখে পড়ল, বাসের পিছন দিকে একটি মেয়ে এসে দাঁড়াল। হয়তো এতক্ষণ বাসের মধ্যেই বসে ছিল, সুরেশ্বরের কথামতন নীচে নেমে এসেছে। সামান্য দূর থেকে স্পষ্ট করে মেয়েটিকে দেখা গেল না। অনুমান করা গেল।

কৌতূহল অনুভব করল অবনী। বৃদ্ধা অথবা বয়স্কা বলে মনে হচ্ছে না। সুরেশ্বর বলেছিল মহিলা: অবনীর ধারণা হয়েছিল, বৃদ্ধা বা বয়স্কা। পরে সুরেশ্বর বলেছে মেয়েটি; অবনী তখন তেমন খেয়াল না করলেও ঠিক এই ধরনের কোনও মেয়ের কথা ভাবেনি। সুরেশ্বরের কোনও আত্মীয়া নাকি? এই বনজঙ্গলের মধ্যে তার আশ্রমে একটি মেয়েকেই বা সে টেনে আনবে কেন?

মেয়েটি তফাতে দাঁড়িয়ে অবনী গাড়ির দিকে তাকিয়েছিল, তারপর বাসের দরজার কাছে সরে গেল আবার। বোধ হয় সুরেশ্বরকে জিনিসপত্র নামাতে সাহায্য করতে গেল।

সুরেশ্বরই প্রথমে একটা সুটকেস এনে গাড়ির পিছন দিকে রাখল। বলল, বাক্স বেডিং আর কাঠের পেটি আছে একটা, কিছু খুচরো-খাচরা জিনিসও।

দুটি দেহাতি ধরাধরি করে বাক্স বেডিং এনে ফেলল গাড়ির মধ্যে। সম্ভবত এরা সুরেশ্বরকে চেনে। কথাবার্তা থেকে সেই রকম মনে হল। জিপের পিছনের কাটা-দরজাটা খোলা অসুবিধেজনক বলে কোনও রকমে চাপিয়ে দিল।

শেষে পেটিবাক্স, আর পিছু পিছু সুরেশ্বর ও সেই মেয়েটি। দুজনের হাতেই খুচরো জিনিসপত্র: ছাতা, মেয়েলি কাঁধব্যাগ, টর্চ, জলের ফ্লাস্ক।

অবনী বলল, এদিক থেকে উঠুন। …গাড়ির পেছন দিকটা ভিজে থাকতে পারে, দেখে নিয়ে বসবেন। বলে সে সামনে দিয়ে ওঠার ব্যবস্থা করে দিল।

সুরেশ্বর বলল, হেম, তুমি ওঠো। সাবধানে। এই নাও, চর্ট জ্বেলে একবার দেখে নিয়ো।

হেম মাথা নিচু, পিঠ কুঁজো করে টর্চ জ্বেলে গাড়িতে উঠছিল। অবনী তাকে অনেকটা স্পষ্ট করে দেখতে পেল। হেম যখন আসছিল, কাছে এসে গাড়ির সামনে কয়েক মুহূর্তের জন্যে দাঁড়িয়েছিল, অবনী সঠিকভাবে কিছু অনুমান করতে পারেনি। হেম যুবতী, দীর্ঘাঙ্গী, তার সাজসজ্জা শহুরে এইমাত্র বুঝতে পেরেছিল। এখন, হেম যখন টর্চ জ্বেলে, অবনীর গায়ের পাশে পিঠমাথা নুইয়ে গাড়ির পেছনের দিকটা দেখছে কোথায় বসবে ভেবে নিচ্ছে–তখন অবনী চকিতের জন্যে যেটুকু দেখল, তাতে বিস্মিত হল। কী যেন অবনীকে আকর্ষণ করল, এক ঝলক ফুলের তীব্র গন্ধ সহসা অ-স্থানে অন্যমনস্ক পথচারীকে যেমন আকর্ষণ করে অনেকটা সেই রকম।

হেম পিছনে গিয়ে বসল।

অবনী সুরেশ্বরকে ডাকল, আপনি সামনে আসুন। দোমড়ানো সিটটা সোজা করে দিল। সুরেশ্বর উঠে এল।

গাড়িতে স্টার্ট দিতে দিতে অবনী বলল, আমি আপনার রাস্তা চিনি না, চিনিয়ে দেবেন।

সুরেশ্বর বলল, সামনে এগিয়ে ডান দিকের রাস্তা।

বাসটা খারাপ হয়েছিল ঠিক তেমাথা একটা মোড়ে। হয়তো আরও সামান্য আগেই ওটা বিগড়েছিল, সকলে মিলে ঠেলেঠুলে একেবারে মোড়ে এনে রেখেছে। অবনী এ বিষয়ে তেমন কোনও আগ্রহ বোধ করল না, গাড়ি ঘোরাল।

সুরেশ্বর কুণ্ঠার সঙ্গে বলল, আপনাকে কষ্ট দিচ্ছি। …বাসটা স্টেশন ছাড়ার পর থেকেই গোলমাল করছিল।

এটাই তো শেষ বাস?

 হ্যাঁ। আমাদের দিকে যাবার শেষ বাস…আপনি কি টাউনে গিয়েছিলেন?

অবনী হ্যাঁ বলল। সুরেশ্বরদের রাস্তা পাকা নয়, চওড়াও নয়। পাথুরে পথ। অবনী শুনেছে, এই রাস্তা খুবই কম, মাইল দেড়েক বড় জোর। সারা দিনে দুতিনটে মাত্র বাস স্টেশন, টাউন এবং ফুলগিরের দিকে যাবার পথে এই পথটুকু পাক দিয়ে আবার ফিরে যায়। অর্থাৎ যে বাস যায় তাকে আবার সামান্য পরেই এই পথ ধরে ফিরতে হয়।

গাড়ি বেশ লাফাচ্ছিল। পিছনের সিটে ঝাঁকুনি খেয়ে হেম কেমন একটু শব্দ করে উঠল। সুরেশ্বর ঘাড় ফিরিয়ে অন্ধকারে হেমকে লক্ষ করে বলল, কিছু একটা ধরে থেকো। ওষুধের বাক্সটা আলাদা আছে তো?

ওপরে রেখেছে, হেম বলল। হেমের গলার স্বর পরিণত, ভরা-ভরা।

সুরেশ্বরের যেন হঠাৎ খেয়াল হল কিছু। সরল, সরস গলায় অবনীকে বলল, নতুন মানুষটির সঙ্গে আপনার পরিচয় করিয়ে দিই। ওর নাম হৈমন্তী, আমরা বলি হেম। হৈমও বলে কেউ কেউ। চোখের ডাক্তারি পাশ করেছে। এখানে নিয়ে এলাম। বলে সুরেশ্বর ঘাড় ফিরিয়ে হৈমন্তীকে উদ্দেশ করে বলল, হেম, ইনি আমাদের বন্ধুবিশেষ, অবনীবাবু–অবনীনাথ মিত্র। এখানেই থাকেন। ওঁর কনস্ট্রাকশান দেখা শোনার কাজ, ইঞ্জিনিয়ার মানুষ।

পরিচয় হল; সদ্য পরিচিতরা কেউ কারুর মুখ দেখতে পেল না। স্বভাবতই সৌজন্যসুলভ বাক্যালাপও নয়। হৈমন্তী শুধু গলা পরিষ্কারের শব্দ করল সামান্য। অবনী বুঝতে পারল না, সুরেশ্বর তাকে বন্ধু হিসেবে পরিচিত করাল কেন! সে সুরেশ্বরের বন্ধু নয়, পরিচিত মাত্র; এবং এই পরিচয়ও এমন নয়, যাতে সুরেশ্বর তাকে পছন্দ করতে পারে। সুরেশ্বর কি উপকার পাচ্ছে বলে অবনীকে আপ্যায়ন করার চেষ্টা করছে? নাকি এটা নিছক ভদ্রতা! অবনী কিছু বুঝতে পারল না। সুরেশ্বরের অনেক কিছুই বোঝা যায় না। যেমন এখন পর্যন্ত বোঝা গেল না, হৈমন্তী সুরেশ্বরের আত্মীয় কি না! মেয়েটি যে তার পূর্ব-পরিচিত, এবং সুরেশ্বরের স্বার্থেই এখানে এসেছে, তা বোঝা যায়। কিন্তু স্বেচ্ছায় এসেছে, না সুরেশ্বর তাকে আনিয়েছে? কী সম্পর্ক উভয়ের মধ্যে?

বর্ষায় এদিকের রাস্তাটা নষ্ট হয়ে গেছে একেবারে। ভারী বাস চলে চলে কাঁচা রাস্তার দুপাশের অবস্থা নালার মতন হয়েছে, মাঝে মাঝে গর্ত, জল জমে আছে। লাফিয়ে লাফিয়ে টাল খেয়ে জিপটা যাচ্ছিল। যেতে যেতে একবার কাত হয়ে উলটে যাবার মতন হল। হৈমন্তী টাল সামলাতে না পেরে আঁতকে ওঠার মতন শব্দ করল, সঙ্গে সঙ্গে তার হাত অন্ধকারে অবনীর পিঠের পিছনে এসে কিছু আঁকড়ে ধরল। কাঁধের কাছে অবনী হৈমন্তীর হাত অনুভব করতে পারল। হৈমন্তী তার সিটের ওপরটা ধরে আছে।

সুরেশ্বর বলল, এদিকে দুপুরে বেশ বৃষ্টি হয়েছে। …ওদিকে কেমন দেখলেন?

বিকেলে বৃষ্টি হয়েছে, আবার হচ্ছে হয়তো।

এরকম বৃষ্টিবাদলা মাথায় করে টাউন ছুটলেন? কাজ হচ্ছে নাকি?

অবনী সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল না; পরে বলল, আমাদের হীরালালকে চিনতেন?

সুরেশ্বর একমুহূর্ত ভাবল, হীরালাল! …ও, হ্যাঁ–চিনতাম।

ছেলেটি মারা যাবে।

 সুরেশ্বর মুখ ফিরিয়ে অবনীর দিকে তাকিয়ে থাকল।

অবনী খানিকটা সময় যেন জোর করে হীরালালের কথা ভুলে যাবার চেষ্টা করেছিল: সেই জোর কোনও সিদ্ধান্ত অথবা সাহসবলে নয়; যেহেতু চিন্তাটা তাকে পীড়ন ও অসুখী করছিল, ভীত ও উদভ্রান্ত করছিল–সেহেতু অবনী সাময়িক কিছু সাধারণ সান্ত্বনা আশ্রয় করে দূরে সরে আসার চেষ্টা করেছে। এখন পুনরায় সে বেদনা ও কাতরতা অনুভব করল।

কী হয়েছিল? হঠাৎ? সুরেশ্বর শান্তস্বরে শুধোল।

অ্যাকসিডেন্ট অবনী বলল। খুব সংক্ষেপে হীরালালের দুর্ঘটনার বিবরণ দিল, শেষে বলল, কী বলবেন একে? ভাগ্য? ঈশ্বরের বিধান?

অবনীর কণ্ঠস্বরে অদ্ভুত এক তিক্ততা ছিল। এই তিক্ততা তার পূর্বেকার ভাবপ্রবণতা নয়, ভীতিও নয়। কিন্তু এই তিক্ততার মধ্যে যেন সুরেশ্বরের মতন মানুষের প্রতি কোনও উপহাস ও বিতৃষ্ণাও আছে।

সুরেশ্বর নীরব। অবনীর দিকে না তাকিয়ে সে বাইরে তাকিয়ে আছে। নির্জন নিস্তব্ধ মাঠ, ছোট ছোট ঝোপ, একটি-দুটি পলাশ কি তেঁতুল গাছ, জল জমেছে কোথাও, ঝিল্লিস্বর, ভেকরব, জলবিন্দু মেশানো দুর্বল জ্যোৎস্না। তাকিয়ে থাকতে থাকতে সুরেশ্বর মৃদু গলায় বলল, আপনাকে একটা কথা বলি, সাধক-মানুষেই বলেছেন। বলেছেন: যাকে আমরা হারাই, সে আমাদের অন্দরমহলে কোথাও শুয়ে ঘুমিয়ে আছে–এরকম ভেবে নেওয়াই ভাল। তাকে ডাকাডাকি করে জাগাবার চেষ্টা অনর্থক। কান্নাকাটি আমরা করি, কিন্তু তাতে সে জাগে না। চেঁচামেচি করলে কিছু পাওয়া যায় না, শুধু প্রমাণ হয়, প্রকৃতির অলঙ্ঘ্য নিয়মের কথা আমরা কিছু জানি না, জেনেও বুঝি না।

অবনী বিন্দুমাত্র আকর্ষণ বোধ করল না কথাটায়। মামুলি কথা। সান্ত্বনা পাবার চেষ্টা। কিন্তু সুরেশ্বরের বলার ভঙ্গি ও কণ্ঠস্বর থেকে সে অনুভব করল, লোকটা বিচলিত হয়ে থাকলেও নিজেকে বেশ সংযত রেখেছে। সুরেশ্বরকে ঠিক এই মুহূর্তে অবনীর ঘৃণা হচ্ছিল। এরা শুধু ঘায়ের ওপর ব্যান্ডেজ বেঁধে ঘা আড়াল করে রাখে, রোগীকে দেখতে দিতে চায় না। অবনী বিরক্ত হয়ে উপহাসের গলায় বলল,–হ্যাঁ–সবই প্রকৃতির অলঙ্ঘ্য নিয়ম৷ বলে হঠাৎ গাড়িটাকে জমা জলের বিশ্রী ডোবা থেকে বাঁচাতে ডান দিকে কাটিয়ে নিল। হেলে পড়তে পড়তে গাড়িটা মাঠে উঠে গেল। হৈমন্তী দুলে উঠে অবনীর কাঁধের কাছটা ধরে ফেলেছে। মাঠ থেকে আবার পথে নেমে অবনী বলল, গাড়িটা ডোবায় পড়লে আমরা উলটে যেতে পারতাম। হয়তো হীরালালের মতন আমাদের কেউ জখম হত, হাসপাতালে মরত। প্রকৃতির সেই অলঙ্ঘ্য নিয়মটা আপনি কীভাবে নিতেন?

সুরেশ্বরের কপালে সামান্য লেগেছিল। হাত বুলিয়ে নিল। বলল, জানি না। এখন তা বলতে পারব না। শান্ত সরল গলায় সে বলল, যেন অবনীর সঙ্গে এই বিষয় নিয়ে তর্ক করার ইচ্ছে তার নেই। শেষে কী ভেবে, অনেকটা যেন স্বগতোক্তির মতন, অনেকটা যেন কবিতা আবৃত্তি করার মতন বলল, আকাশ ও পৃথিবী মানুষের শবাধার। সূর্য, চন্দ্র তার শবশয্যার সাজ, নক্ষত্রগুলি আমার গায়ে ছড়িয়ে দেওয়া ফুল। সমস্ত জীব আমার শবযাত্রার সঙ্গী। মৃত্যুর কাছে সকলেই আমাকে বহন করে নিয়ে যাচ্ছে।

অবনী কেমন অন্যমনস্ক হল। শুনতে ভাল লাগল বলে, না-কি রুক্ষ ও নির্মম কিছু হঠাৎ আজ অন্য কোনও রূপে দেখা দিল বলে। কাব্য নাকি? অবনী শুধোল।

না কাব্য নয়, তবে কাব্যও হতে পারত। আপনি ভাববেন না কথাটা আমার। প্রাচীন এক চীনা দার্শনিক এই রকম বলেছিলেন। সুরেশ্বর আস্তে আস্তে জবাব দিল। অল্প থেমে আবার বলল, সংসারের সমস্ত জিনিস নিয়েই বাহুল্য করা যায়। জন্ম নিয়ে মৃত্যু নিয়ে, ভালবাসা নিয়ে, শঠতা নিয়ে সমস্ত নিয়েই। বাহুল্য যদি করতেই হয় তবে নিকৃষ্ট বাহুল্য করা কেন? নাটকটা খারাপ লিখে লাভ কী!

অবনী কোনও জবাব দিতে পারল না। হয়তো সে তখনও সবটা ভাল বুঝতে পারেনি।

ততক্ষণে সুরেশ্বরের আশ্রমে চলে এসেছে ওরা। সুরেশ্বর আশ্রমের আলো দেখিয়ে বলল, ওটাই আমার আস্তানা। আপনি তো আগে কখনও আসেননি। আজও বড় অসময়ে আপনাকে টেনে আনলাম।

অবনী হেসে বলল, কী নাম আপনার আশ্রমের? …অন্ধজনে দেহ আলো?

গাড়িটা আশ্রমের মধ্যে ঘুরিয়ে ব্রেক করার পর অবনী আবার কাঁধের ওপর হৈমন্তীর হাতের স্পর্শ পেল। যেন অন্ধকারে হৈমন্তী তার কাঁধে ভর না দিয়ে উঠতে পারছে না।

.

০২.

সকালে ঘুম ভাঙার আগে অবনী হীরালালকে স্বপ্ন দেখছিল। ঘুম ভেঙে গেলে সে কয়েক মুহূর্ত হীরালালকে খুঁজল, যেন ভিড়ের মধ্যে হীরালাল কোথাও অদৃশ্য হয়েছে এখুনি ফিরে আসবে। হীরালাল এল না; অপেক্ষা অন্তে হতাশ হয়ে ফেরার মতন আস্তে আস্তে চোখ খুলল অবনী। সকাল হয়েছে, সে বিছানায়, মশারির আড়াল থেকেও বোঝা যায় বাইরে মেঘলা হয়ে আছে, ঘরের মধ্যে আলোর মালিন্য, মাথার ওপর পাখা ঘুরছে শব্দ করে।

বিছানা ছেড়ে উঠতে অবনীর আগ্রহ হল না। শুয়ে শুয়েই হাই তুলল। কেমন অবসাদে ভরে আছে সব। মাঝে মাঝে এক ধরনের অদ্ভুত অবসাদ বোধ করে অবনী। এই অবসন্নতা মদ্যপানজনিত নয়, ক্লান্তিবশতও নয়। কী যেন তার শরীর ও মনকে এমন এক অবস্থার মধ্যে টেনে আনে যখন প্রতিটি বিষয়ে সে অনাসক্তি বোধ করে। তার ইন্দ্রিয়গুলি কোনও কিছুতেই উৎসাহ অনুভব করে না। এই অবস্থায় অবনী নির্বিশেষে এমন এক অবহেলা, বিরক্তি আর উপেক্ষার মধ্যে ডুবে থাকে যে তাকে জড়বৎ মনে হয়।

আজ অবনী অন্য এক ধরনের গভীর অবসাদ বোধ করছিল। অবহেলা, উপেক্ষা বা বিরক্তির সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক নেই। বরং উদাসীনতার সঙ্গে রয়েছে। যেন গতকাল কোনও শব বহন করে সৎকার শেষে সে অতীব ক্লান্ত হয়েছিল, এবং দুঃখভারের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছিল, আজ এখন ঘুম ভেঙে জেগে উঠে কেমন এক শূন্যতা অনুভব করছে।

আরও কিছুক্ষণ অবনী চুপচাপ শুয়ে থাকল। হীরালালের কথা ভাবল। হীরালালের কথা ভাবতে গিয়ে কাল সন্ধ্যা ও রাত্রের কথাও তার মনে পড়ল। নিসর্গ চিত্রের বিবিধ দৃশ্যগুলির মতন তার চোখে মাখারিয়ার জঙ্গল, অস্ফুট জ্যোৎস্না, সুরেশ্বর, হৈমন্তী ঝাপসা হয়ে আসছিল। শেষে অবনী দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুখের সামনে মশারি সরিয়ে উঠে পড়ল।

বাইরে মেঘলা খুব গাঢ় নয়, জলের মতন হালকা রঙের। জানলার কাচের শার্সিগুলো পুরোপুরি খোলা নয়, শার্সিতে জলবিন্দু, বাইরে বৃষ্টির আঁশ ঝরছে, দূরে স্টেশনে ইঞ্জিনের হুইসল বাজল, বাদলার কাক ডাকছে কোথাও, বাইরে চাকর বাকরের গলা শোনা গেল।

অবনী খাটের তলা থেকে চটিটা খুঁজে পায়ে গলিয়ে নিল। বাথরুমে যাবার আগে ঘরের দরজা খুলে চাকরকে হাঁক দিয়ে চা আনতে বলল।

সামান্য পরেই ফিরল অবনী। ততক্ষণে মহিন্দর মশারি তুলে বিছানা পরিষ্কার করে দিয়েছে, ঘরের জানলার শার্সিগুলো একে একে খুলে দিচ্ছিল। অবনী অন্যমনস্কভাবেই দেখল, বাতাসে ময়দার গুঁড়োর মতন বৃষ্টির কণাগুলি এলোমেলো হয়ে উড়ছে।

চা নিয়ে এল নন্দ। জানলার কাছাকাছি টিপয়ে চা নামিয়ে রাখল, রেখে চলে যাচ্ছিল, অবনী পাখাটা বন্ধ করে দিয়ে যেতে বলল।

অন্যদিন এতক্ষণে সকালের নিত্যকর্মের অনেক কিছুই সারা হয়ে যায়, অবনী এ-সময় অফিস যাবার জন্যেও মোটামুটি তৈরি হতে পারে। আজ কোনও কিছুতেই আগ্রহ হচ্ছিল না। পট থেকে চা ঢেলে নিল অবনী, যৎসামান্য চিনি মেশাল। বাইরে সেই একই ধরনের বৃষ্টি।

এ বছরে এদিকে বৃষ্টি বেশিই হচ্ছে। গত বছর এতটা হয়নি। তবু এখন বর্ষার শেষ; মাঝ বর্ষায় অবনী রীতিমতো বিরক্ত হয়ে উঠেছিল। গত তিন মাস কাজকর্ম প্রায় কিছুই হয়নি। হবার উপায় ছিল না। প্রায় প্রত্যহ মুষলধারায় বৃষ্টি। শুরু হলে থামতে চায় না; একঘেয়ে ক্লান্তিকর কী বিশ্রী বৃষ্টি! মাঠ-ঘাট জলে জলময়, নদী-নালায় বান ডাকত, জঙ্গলে কাজ করা অসম্ভব ছিল। তার ওপর কুলিমজুরের অভাব; রাস্তা বন্ধ, মালপত্রও পাঠানো যেত না। লোকালয় ছেড়ে কোনও জঙ্গলে তাঁর পড়েছে। কুলিমজুরের, হঠাৎ দেখো ঝড়ে-জলে তাঁবু উড়ে গেল, চাল-ডাল ভেসে গেল জলে, মালপত্র তছনছ হল। ব্যাস, কাজ বন্ধ করে বসে থাক। অসুখ-বিসুখ, সাপ-বিছে, ভালুক-টালুক তো আছেই। এত রকম বাধাবিঘ্নের জন্যে এ সময় কাজ চলে মন্থর গতিতে। এবার আরও মন্থর। এই এলাকাটা পাহাড়ে জঙ্গলে নদীনালায় ভরা, এর মধ্য দিয়ে পথ পরিষ্কার করে খুঁটি পুঁতে পুঁতে ওভারহেড ইলেকট্রিক লাইন টেনে নিয়ে যাওয়া সময় সাপেক্ষ।

মাত্র দুবছর হল অবনী এখানে এসেছে। প্রথমে সমস্ত ব্যাপারটাই তার কাছে অদ্ভুত মনে হয়েছিল। সাবেকি কিছু কোদাল গাঁইতি শাবল কুড়ুল দড়িদড়া আর দেহাতি কিছু কুলিমজুর-জোয়ান গোছের দুচারজন পাঞ্জাবি, খাকি হাফপ্যান্ট পরা এক সুপারভাইজারবাবু। সবাই মিলে যা করছে তাকে। অসাধ্যসাধন বললেও অন্যায় হয় না। হীরালালের কাঁধে রাজ্যের বোঝা। তবু আশ্চর্য, ওই সাবেকি সম্পদ নিয়েও দেখতে দেখতে কাজ অনেকটা এগিয়ে গেল।

অবনী নিজে ঠিক এ কাজের মানুষ নয়। তার আগের অভিজ্ঞতার বেশিটাই ছিল কাগজপত্রে। বিদেশি এক ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্মের যন্ত্রপাতি বসানোর কাজে ডিজাইন করত। সাত ঘাটে জল খেত না। ওই কাজে বছর আষ্টেক কাটিয়ে হঠাৎ সব ছেড়েছুঁড়ে চলে এল এখানে। আসার পেছনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কারণ ছিল অনেক। মোটামুটি কারণটা এই যে, তার আর ভাল লাগত না, নিজের বৃত্তি বা পেশায় সে বিরক্ত হয়ে উঠেছিল, ওপরঅলাদের সঙ্গে কথা কাটাকাটি, সহকর্মীদের সঙ্গে মনোমালিন্য দিনে দিনে বাড়ছিল। অসন্তোষ আর তিক্ততা, গ্লানি আর ক্ষোভ বাড়তে বাড়তে ক্রমেই একটা অসহ্য অবস্থা হল।

বাড়িতেও মানসিক তৃপ্তি বা আরাম বলে কিছু ছিল না। ললিতার সঙ্গে তার সম্পর্ক চরমে উঠেছিল। বাহ্যত তারা স্বামী-স্ত্রী হলেও ভেতরে পরস্পরের সঙ্গে তাদের সম্বন্ধ হয়েছিল বিরক্তির এবং ক্লান্তির। ঘৃণার। দাম্পত্য সম্পর্ককে মনে হত পায়ের কাছে ছড়ানো কাচের ভাঙা বাসনের মতন, টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে ছড়িয়ে পড়ে আছে, ধারালো কানা চকচক করছে, পা রাখলেই ক্ষত-বিক্ষত না হয়ে উপায় নেই। এই তিক্ততা সন্তানের মধ্যেও সংক্রামিত হয়ে উঠছিল। অবনীর পক্ষে সেটা কাম্য ছিল না। ললিতা আইন-আদালতের শরণাপন্ন হবার পক্ষপাতী, অবনীও অনিচ্ছুক নয়। সৌভাগ্যক্রমে একটা ভদ্রলোকের চুক্তি-মতন বোঝাপড়া হয়ে যাওয়ায় আপাতত তারা বিচ্ছিন্ন হতে পারল। স্ত্রীকে মুক্তি দিয়ে অবনী দূরে সরে এল। ললিতা মেয়েকে রেখে দিল। ভরণপোষণের টাকাটা সে কোনওভাবেই হাতছাড়া করতে চায় না।

চায়ের পেয়ালা শেষ হয়েছিল। অবনী সিগারেট ধরাল। তারপর আরও এক পেয়ালা চা ঢেলে নিল।

এখানের চাকরিটা পেতে তার সময় লাগেনি। যেহেতু সে বাইরে পালাতে চায়, কিছু একটা হলেই হবে–এই মনে অবনী চাকরি খুঁজছিল, কিছু খুঁটিয়ে না দেখেই এখানে দরখাস্ত করেছিল। কয়েক দিনের মধ্যেই জবাব এল। অবনী দ্বিধা করল না। চলে এল। চাকরিটা আধা-সরকারি বললেও বলা যায়। দায়দায়িত্ব তেমন কিছু নেই। হাতে কলমে কাজও নয়। শুধুমাত্র তদারকির আর চিঠিপত্র লেখালেখির। নির্ঝঞ্ঝাট কাজ। ওপরঅলা বলতে মাথার ওপর যিনি আছেন তাঁর অফিস অন্যত্র, বছরে দু-চারবার মুখোমুখি দেখা হয়। একেবারে অপদার্থ, তবে মানুষটি ভাল। অবনীর এই কাজে একটা মাত্র অসুবিধে এই যে, প্রায়ই তাকে কাজকর্ম দেখতে যত্রতত্র যেতে হয়। কিছুটা ছোটাছুটি রয়েছে। তা থাক। সুবিধের তুলনায় অসুবিধে প্রায় কিছুই নয়। থাকার বাড়ি পেয়েছে, অ্যালাউন্স আছে। মাইনে অবশ্য খুব কিছু না। অবনীর তাতে ক্ষোভ নেই।

দ্বিতীয় কাপ চা শেষ করে অবনী উঠল। ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি থেমে গেছে। মেঘলা কখনও খুব ফিকে, কখনও আবার গাঢ় হয়ে আসছে। বাতাস রয়েছে বেশ, মনে হচ্ছে, বেলায় কিংবা দুপুর নাগাদ মেঘলা। কেটে যাবে।

সামান্য বেলায় অবনী যখন অফিস যাবার জন্যে তৈরি হয়ে বাড়ির বারান্দায় বেরিয়ে এল তখন তাকে খানিকটা ঝরঝরে দেখাচ্ছিল। সদ্য দাড়ি কামানো মুখ, মাথার চুল সামান্য ভিজে, গায়ে হালকা রঙের বুশ কোট, পাটভাঙা ট্রাউজার পরনে, হাতে ওয়াটারপ্রুফ। বৃষ্টি পড়ছিল না, পথ ভিজে, গাছের পাতায় জল জমে আছে; বাগানের মধ্যে দিয়ে যাবার সময় অবনী দেখল, কদমতলায় দাঁড়িয়ে মহিন্দর ডিম কিনছে। কাঠের ফটক খুলে অবনী রাস্তায় উঠল।

অবনীকে দেখলে তার বয়স সঠিক অনুমান করা মুশকিল। মনে হয় বছর পঁয়তাল্লিশ। কিন্তু তার বয়স চল্লিশের কিছু বেশি। মাথায় বেশ দীর্ঘ, অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলি লম্বা ছাঁদের, মুখ লম্বা এবং শক্ত, কপাল উঁচু, নাক দীর্ঘ, চোখ গভীর করে বসানো। গলাও সামান্য লম্বা। বয়সের মেদবাহুল্য নেই শরীরে, যেটুকু আছে তা না থাকলেও তাকে বেমানান দেখাত না। মনে হয়, অবনী বরাবরই ছিপছিপে গড়নের ছিল, শক্ত ছিল। পিঠের কাছটায় ঈষৎ নুয়ে থাকে, কাঁধ তেমন ভরাট নয় বলেই হয়তো অমন দেখায়। অবনীর মাথার চুল পাতলা, কোঁকড়ানো, ধূসর রঙের। গায়ের রং ময়লা।

প্রথম দর্শনে অবনীকে রূঢ় ও গম্ভীর প্রকৃতির বলে মনে হয়। সম্ভবত তার চোখের দৃষ্টির জন্যে। তার চোখে অস্বাভাবিক কিছু আছে, বোঝা যায় না, তবু মনে হয়, অবহেলা এবং উপেক্ষার চোখে সব কিছু দেখাই যেন তার অভ্যেস। নম্রতা বা সৌজন্য, কৌতূহল বা উৎসাহ সহসা তার দৃষ্টিতে দেখা যায় না। অথচ অবনীর সঙ্গে মেলামেশা করতে পারলে বোঝা যায়, তার হালকা কালো রঙের চোখের মণি এবং ঈষৎ হলুদ রঙের চোখের জমিতে জমিতে কেমন এক মমতা মাখানো আছে। এমনকী কোনও কোনও সময় এই চোখ এবং তার উজ্জ্বল দৃষ্টি অবনীর সুতীব্র কোনও আবেগকেও প্রকাশ করে। সে যে কখনও কখনও অসহায় বালকের মতন বিক্ষুব্ধ, কাতর হতে পারে–আবার মন হালকা থাকলে গলা ছেড়ে হাসতে পারে, অনর্গল কথা বলে, তাস খেলতে পারে–এ অনেকের জানা নেই। যাদের আছে তারা মনে করে অবনী মজাদার মানুষ, চমৎকার লোক। যারা জানে না তারা অবনীকে ভদ্রজন বলে মনে করে না, ভাবে লোকটা অহংকারী, অসভ্য, ইতর শ্রেণীর। এই দুবছরে এখানে সুনাম দুর্নাম দুইই কিছু হয়েছে তার। সুনাম করেছে তারা যারা কমবেশি অবনীর অন্তরঙ্গ হতে পেরেছে, দুর্নাম করেছে তারা যারা ওর ঘনিষ্ঠ হতে পারেনি। সুনাম অথবা দুর্নামের প্রতি এখন পর্যন্ত তেমন কোনও মোহ জন্মায়নি অবনীর।

.

অফিসের কাছাকাছি পৌঁছে বিজলীবাবুর সঙ্গে দেখা অবনীর। সাইকেলে চেপে বিজলীবাবু কোথাও যাচ্ছিলেন, নেমে পড়লেন। এখানকার বাস-সার্ভিসের ম্যানেজার। প্রায় প্রৌঢ়, তবু শখ শৌখিনতা ছাড়েননি। কাঁচাপাকা চুলে অ্যালবার্ট টেরি কাটেন, চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা; মালকোঁচা মারা ধুতির সঙ্গে সাদা শার্ট, শার্টের দুদিকে বুক পকেট। বেঁটেখাটো গোলগাল মানুষ, ধবধব করছে গায়ের রং। গোটা তিনেক আংটি আঙুলে। পান খান প্রচুর। গৃহে যুগল স্ত্রী, বাইরেও নারীসঙ্গ করে থাকেন বলে লোকের বিশ্বাস। বিজলীবাবুর ধারণা, পুরুষমানুষকে স্বাস্থ্য টিকিয়ে রাখতে হয়, তার জন্য শুধু কর্মঠ হলেই যথেষ্ট নয়, পানভোজন ও আনুষঙ্গিকের প্রয়োজন আছে। যেটুকু পাও হাত বাড়িয়ে, ভোগ করে নাও-রেখ না লেশ, নইলে পরে হায় তুমিও করবে কখন ধুলোয় প্রবেশ। ভদ্রলোক ওমর খৈয়মের বাংলা অনুবাদ প্রাণভরে মুখস্থ করেছেন, সুযোগ মতন তার থেকে দুচার লাইন আওড়ে জীবন সম্পর্কে তাঁর ধারণাটা অকপটে বুঝিয়ে দেন। অবনীর সঙ্গে বিজলীবাবুর এক ধরনের বন্ধুত্ব আছে। বিজলীবাবু তাঁর বাসের ড্রাইভারকে দিয়ে মাঝে মাঝেই কখনও শহর কখনও অন্য কোনও বড় জায়গা থেকে অবনীর মদ্যাদি আনিয়ে দেন, অবনীর নিমন্ত্রণ রক্ষা করেন, পালটা আপ্যায়নেও ইতস্তত করেন না।

বিজলীবাবু সাইকেল থেকে নেমে বললেন, মিত্তিরসাহেবকে দেখলাম কাল রাত নটা নাগাদ ফিরছেন…কোথায় যাওয়া হয়েছিল? টাউনে?

হাসপাতালে।

ও! হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ; সেই ছোকরা…। কেমন আছে?

 ভাল না, খুবই খারাপ।

 আশা নেই?

কোথায় আর!

 বিজলীবাবু দুপলক অবনীর দিকে তাকিয়ে থাকলেন। কোনও কিছু মনোযোগের সঙ্গে লক্ষ করার সময় তাঁর নাক সামান্য কুঁচকে ওঠে, মনে হয় তিনি শুধু চোখ দিয়ে দেখছেন না–গন্ধটাও শুঁকে নিচ্ছেন। ইতর প্রাণীদের মতন বিজলীবাবু ঘ্রাণক্ষমতায় যেন অনেক কিছু বোঝান। সাইকেলের হ্যান্ডেলে ঝোলানো ছাতার বাঁটে হাত বুলিয়ে নিলেন অকারণে। তারপর কপাল দেখাবার ভঙ্গি করে বললেন, নিয়তি। …বলেছে না, নিয়তি কেন বাধ্যতে…। ওখানে মিত্তিরসাহেব, মানুষ ঠুটো, জারিজুরি চলে না।

অবনী কোনও কথা বলল না। অন্য দিকে তাকিয়ে থাকল।

এই দুনিয়ার এটাই খেলা– বিজলীবাবু এবার হাসবার চেষ্টা করলেন, মাথার ওপর এক শালা পেয়াদা বসে আছে, ঠিক সময় শমন ধরিয়ে দিয়ে কাছারিতে টেনে নিয়ে যাবে। তাই তো বলি, যে কদিন আছ বাপু, খেয়েদেয়ে ফুর্তি-আরাম করে কাটিয়ে দাও। চার্বাক ঋষিটিষি বলেছেন, যাবৎ জীবেৎ সুখ জীবেৎ… খাঁটি কথা।

অবনীর হঠাৎ এ সময় সুরেশ্বরের কথা মনে পড়ল। কী যেন বলেছিল কাল সুরেশ্বর…? পৃথিবী এবং আকাশ আমার শবাধার…চন্দ্র সূর্য তারা…

বিজলীবাবু ততক্ষণে পকেট থেকে সিগারেট বের করে এগিয়ে দিয়েছেন। আসুন–একটা কড়া খান।

অবনী অন্যমনস্কভাবেই সিগারেট নিল। বিজলীবাবু তাঁর সিগারেট কে-এ মিক্সচারঅলা সিগারেট পাকিয়ে রাখেন, বন্ধুবান্ধবকে দিতে হয় বলে পাকানোর সময় উচ্ছিষ্ট করেন না।

দুজনেই সিগারেট ধরাল। অবনী বলল, আপনার বাস যে মশাই প্রায়ই দেখি রাস্তায় খারাপ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কাল ফেরবার পথে এক ঝামেলা। সুরেশ্বর একটি মেয়েকে নিয়ে যাচ্ছিল, পথে আটকা পড়েছে। তাদের আবার পৌঁছে দিলাম।

আজ সকালে শুনলাম। বাসের আর কী দোষ বলুন, ভাগে মা-মালিক থেকে শুরু করে ক্লিনারসব বেটাই কিছু কিছু করে ভাগ মারছে, আমিও মারিভাগে মা গঙ্গা পাবে কোথায়! এই লং ট্রিপ, প্রপার মেনটেনান্স করতে হলে খরচটা কেমন লাগে ভাবুন। জোড়াতালি মেরে চালানো। ওই রকমই হবে। আমার আর কী! …তা কাল আমাদের মহারাজজিকে আপনি পার করলেন! বিজলীবাবুর চোখে কেমন কৌতূহল ও হাসি ফুটল।

অবনী বলল, জায়গাটার কী নাম যেন?

 গুরুডিয়া।

রাত্তিরে ঠিক বুঝলাম না, তবে অনেকগুলো ঘরটর করেছে দেখালাম।

দিব্যি করেছে। আপনার বুঝি ওদিকে আগে যাওয়া হয়নি। দিন-দিন যাবেন একদিন, দেখবেন। সুরেশ-মহারাজ, বুঝলেন মিত্তিরসাহেব, বেশ কাজের লোক। তিন-চার বছর লেগে পড়ে এখন মোটামুটি দাঁড় করিয়ে ফেলেছেন।

ভদ্রলোককে আপনি সুরেশ-মহারাজ, মহারাজজি–এসব বলেন কেন? অবনী একটু হেসে বলল। বলার মধ্যে তেমন কোনও কৌতূহল ছিল না, থাকার কথা নয়; বিজলীবাবু বরাবরই ওই ভাবে কথা বলেন, এবং আগেও দু-চার বার অবনী তাঁকে পরিহাস করে জিজ্ঞেস করেছে কথাটা।

আগে যেমন, এবারও বিজলীবাবু হেসে হেসে জবাব দিলেন, বলব না! গেরুয়া না পরলেও সুরেশ-মহারাজ যে সন্নেসী মানুষ। ভেক যোগী নয়, কর্মযোগী… গীতাটি পড়েছেন নাকি আপনি মিত্তিরসাহেব? আমি পড়িনি, বাড়িতে একটা আছে, হিন্দুর ছেলে, মরার সময় মাথার পাশে রাখতে হবে তো! বিজলীবাবু আপন রসিকতায় মজে গিয়ে হাসলেন। হাসি থামলে হঠাৎ বললেন, সুরেশ-মহারাজ কাল এসেছিলেন, আমার বাস-অফিসে পা দিয়েছিলেন দুদণ্ড। বললেন, কাকে যেন নামাতে এসেছেন। দেখলাম তো, বেশ ডাগর একটি মেয়ে নিয়ে বাসে চাপলেন, মালপত্র সমেত। …তা শুনলেন কিছু? মেয়েটি কে?

চোখের ডাক্তার।

মেয়েরাও চোখের ডাক্তার হয়?

 হবে না কেন?

তা ঠিক। পুরুষের চোখ মেয়েরা ভালই বোঝে…মেয়েদের চোখও মেয়েরা আন্দাজ করে ভাল। বাড়িতে তো দেখছি… তা যিনি এলেন তিনি কি সধবা না কুমারী?

জানি না।

সুরেশ-মহারাজের কেউ হয় না কি?

চেনাশোনা।

 নিজের কেউ নয়?

বুঝলাম না।

 চুপচাপ। দুজনেই বোধ হয় মনে মনে মেয়েটিকে দেখছিল। অবনী হঠাৎ যাবার তাড়া অনুভব করল। বলল, চলি…।

বিজলীবাবুও যাবার জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। দেখেছেন কাণ্ড, আপনাকে লেট করিয়ে দিলাম। আচ্ছা, মিত্তিরসাহেব, চলি। আমি একবার গোপীমোহনের কাছে যাব। …বিকেলে দেখা-সাক্ষাৎ হবে।

বিজলীবাবুর সাইকেল সামনে থেকে সরে যেতেই অবনী অফিসের দিকে পা বাড়াল।

অল্প এগিয়েই অবনীর অফিস। দেখলে অফিস বলে মনে হয় না, কোনও বন্ধ-হয়ে-যাওয়া ছোটখাটো কারখানা যেমন দেখায় অনেকটা তেমনি চেহারা। কাঁটাগাছের কিছু কিছু বেড়া, তার গা-ঘেঁষে জালি-তার দিয়ে অনেকটা জায়গা জুড়ে ফেন্সিং; প্রায় মাঝ-মধ্যে ইটরঙের ঘন লাল এক ছোটখাটো বাড়ি, মাথায় টালির ছাউনি। ফাঁকা জায়গাটায় নানান জিনিস ছড়িয়ে আছে–লোহার খুঁটি, শালের খুঁটি, হরেক রকম তার, কে-এর চাকা, ভাঙা বাক্স, চিনেমাটির ইনসুলেটার, দু-একটা ভাঙাচোরা ট্রাক, মায় একটা ক্রেনও। আর কত বিচিত্র বস্তু। ওরই মধ্যে কোথাও কয়েকটা করবী গাছ, কলাফুলের ঝোপ। মস্ত একটা হরীতকী গাছ একপাশে তার গায়েই ইঁদারা। বাড়িটা যে ভাড়া নেওয়া বুঝতে কষ্ট হয় না।

অবনী কোনওদিকে না তাকিয়ে সোজা অফিসে চলে গেল। এখন এখানে কুলিমজুর বা ভিড় থাকার কারণ নেই। অফিসের চাকরবাকর, কেরানি আছে কয়েকজন। মোটামুটি জায়গাটা শান্ত। বর্ষার জলে কাদা হয়েছে যেমন, ঘাসও হয়েছে প্রচুর। সবই ভিজে ভিজে দেখাচ্ছিল।

নিজের ঘরে গিয়ে অবনী চেয়ারে বসল। বেয়ারা টেবিল চেয়ার মুছে পরিষ্কার করে রেখেছে, জানলাও খোলা। সামনের দেওয়ালেই নানান রকম ব্লু-প্রিন্ট ঝোলানো, একটা ক্যালেন্ডারও ঝুলছে, বড় বড় তারিখ।

অবনী চেয়ারে বসে হাত বাড়িয়ে ঘন্টি টিপল। বেয়ারা এল। সকালে আসা ডাকের চিঠিগুলো কেরানিকে দিয়ে দিতে বলল। চিঠিপত্র তার দেখতে ইচ্ছে করছে না।

উন্মনা হয়ে বসে থাকল অবনী। জানলা দিয়ে কখনও আকাশ দেখল, কখনও জামগাছ। মুখ ফেরালেই দেওয়ালে টাঙানো নকশাগুলো চোখে পড়ছিল। বিজলীবাবুর সঙ্গে দেখা হবার পর কেন যেন তার সুরেশ্বরদের কথাই মনে পড়ছে। হয়তো হৈমন্তীর জন্যে। বিজলীবাবুর মতন তারও অসীম কৌতূহল মেয়েটি সম্পর্কে। ও কে, কেন এখানে এল? সুরেশ্বরের সঙ্গে কী সম্পর্ক হৈমন্তীর?

সুরেশ্বরের আশ্রম থেকে আসার সময় সুরেশ্বর বলেছিল, আজ সকালে তার শহরে দরকার আছে, বৃষ্টি বাদলা না হলে যাবে, শহরে গেলে হীরালালের খোঁজ নেবে। সুরেশ্বর কি শহরে গিয়েছে? না কি, কাল অবনী পথের বিপন্ন মানুষকে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছে বলে ওটা সুরেশ্বরের ভদ্রতা, স্তোক দিয়েছে।

মানুষটাকে আর যাই হোক, ঠিক বাজে, ধাপ্পা-মারা তোক বলে অবনী মনে করতে পারে না। আজকের দিনে কী করে একজন প্রাপ্তবয়স্ক, শিক্ষিত, জ্ঞানবুদ্ধিসম্পন্ন পুরুষমানুষ আশ্রম খুলে বসতে পারে অবনীর তা মাথায় না ঢুকলেও লোকটাকে এসব ব্যাপারে একেবারে অবিশ্বাস করা যায় না। হয়তো সুরেশ্বর সত্যিই শহরে গেছে।

কাল ওই অবস্থার মধ্যেও অবনী কিন্তু বেশ অবাক হয়েছে। কোথাকার কোন গুরুডিয়া–যেখানে যাওয়া-আসার ভাল পথ নেই, চারদিক জঙ্গল আর পাহাড়ি গাঁ গ্রাম সেখানে সুরেশ্বর আজ তিন-চার বছর ধরে আস্তে আস্তে সত্যিই একটা অন্ধ আশ্রম করে ফেলল। সুরেশ্বরদের নামিয়ে দিয়ে ফেরার সময় কতটুকু আর ঠাওর করা যায়–তবু ওরই মধ্যে ম্লান জ্যোৎস্নায় যেটুকু দেখেছে অবনী তাতে অবাক হয়েছে। মানুষটা কাজের, অন্তত একথা বলা যাবে না, সুরেশ্বর ধুনি জ্বেলে সেখানে বাবাজি হয়ে বসে আছে।

এই সুরেশ্বর, বছরখানেক আগে একবার অবনীর কাছে কিছু সাহায্যের জন্যে অনুরোধ জানিয়েছিল। অবনী যতটুকু পারে, যা পারে। অবনী সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছিল, বলেছিল–ক্ষমা করবেন; ওসব আমি দিই না। …হয়তো এভাবে প্রত্যাখ্যান না করেও অবনী কিছু দিতে পারত, যেমন অন্যান্য জায়গায় দিয়ে থাকে, ভদ্রতা করে বা দয়া করে। সুরেশ্বরের বেলায় অবনী ইচ্ছে করেই মুখের ওপর না বলেছিল। কারণ এই ধরনের মানুষকে সে আঘাত করতে চায়।

সুরেশ্বর কী ধরনের মানুষ?

আশ্রম-ফাশ্রমে আমার কোনও ইন্টারেস্ট নেই, আমি ও-সব বিশ্বাস করি না। অন্ধদের জন্যে কিছু করতে হলে দরকার হাসপাতালের। দরকার ডাক্তার। আপনি কি ডাক্তার? হাসপাতাল খুলবেন জঙ্গলে?

আমার তো কোনও সম্বল নেই। চেষ্টা করছি। আস্তে আস্তে যতটা পারি।

 সম্বল যখন নেই তখন করছেন কেন?

আপনাদের সাহায্য পাব এই আশায়।

 তা হলে করুন। আমি কিন্তু আপনাকে নিরাশ করলুম।

 তাতে কী!

আশ্চর্য, লোকটা অপমানিত হওয়া সত্ত্বেও রাগল না, কটু কথা বলল না, আগের মতনই সরল হাসিমুখ করে থাকল, অবনীর দেওয়া চা খেল, অন্য পাঁচটা গল্প করল। তারপর নমস্কার জানিয়ে চলে গেল। অথচ, অবনী প্রায় নিঃসন্দেহ এই অপমান সুরেশ্বরকে ভেতরে বিচলিত করেছিল। ওপরে সে তা প্রকাশ করেনি।

এর পরও কয়েকবার দেখা হয়েছে দুজনের, হঠাৎই। সুরেশ্বর প্রসন্ন মুখে কথা বলেছে, গল্প করেছে, তার আশ্রমে যাবার নিমন্ত্রণ জানিয়েছে। অবনীই কেমন যেন সঙ্কুচিত হয়েছে সামান্য, কিন্তু শেষ পর্যন্ত গায়ে মাখেনি।

আসলে সুরেশ্বরদের মতন মানুষের ওপর অবনীর পরম বিতৃষ্ণা ছিল। ব্যক্তিগতভাবে সুরেশ্বর যাই হোক, ওরা একটা গোষ্ঠী, সামাজিক দিক থেকে পরিকল্পিত সম্প্রদায়, সুরশ্বরকে তা থেকে আলাদা করা যায় না। জীবনের যাবতীয় রুক্ষ যন্ত্রণা থেকে এরা ভীরুর মতন পাশ কাটিয়ে পালিয়ে গেছে। ধর্মের নামে, সেবার নামে, মুক্তির নামে। এমন নয় পালিয়ে গিয়ে এরা পরিচ্ছন্ন হয়েছে। সংসারের সমস্ত রকমের স্বার্থ, ইতরতা, আকাঙ্ক্ষা, মোহকে পালন ও লালন করছে। তবে এই ভেক কেন? এই মিথ্যা কেন?

সাধারণ মানুষের মতন ওদের অন্নের জন্যে পরিশ্রম নেই, প্রাত্যহিক গ্লানি নেই; দায় নেই কোথাও, দায়িত্ব নেই: পিতামাতা স্ত্রী-পুত্র পরিজনের জন্যে চিন্তা নেই, উদ্বেগ নেই; যে-সব রূঢ় সমস্যা সাধারণ মানুষকে নোখ দিয়ে নিয়ত আঁচড়ায়, গলা টিপে ধরে, আয়ু নিঃশেষ করে নেয় তোমরা সেখান থেকে পালিয়ে গেছ। অথচ ওই বেচারিদের শ্রদ্ধার চাঁদায় তোমরা দিব্যি বেঁচে আছ, আশ্রম গড়ছ, মঠ বানাচ্ছ, মন্দির তুলছ–আর ভক্ত-শিষ্য পরিবৃত হয়ে ধর্মজ্ঞান বিতরণ করছ। অকর্মণ্য, আত্মপরায়ণ, ধাপ্পাবাজ সব।

অবনী প্রায় নিঃসন্দেহ ছিল, সুরেশ্বর কিছুই করবে না, করতে পারবে না। বড় জোর একটা আখড়া তৈরি করবে নিজের, কাউকে ধরে-পাকড়ে একটা মন্দিরও তুলবে হয়তো, তারপর শাঁখ ঘণ্টা কাঁসর বাজিয়ে, ভক্তসমাগম ঘটিয়ে ছোটখাটো মহাপুরুষ হয়ে অধিষ্ঠান করবে।

অথচ লোকটা ভদ্র, শিক্ষিত, বুদ্ধিমান। অবনী বুঝতেপারে না, কী করে তার প্রায় সমবয়সী একজন, আজকের দিনে এমন করে নিজেকে প্রবঞ্চনা করতে পারে এই জঙ্গল কি তার অন্ধ-আশ্রম খোলার জায়গা? যদি তোমার মহৎ উদ্দেশ্যই থেকে থাকে–কেন তুমি নিজে ভাল চোখের ডাক্তার হলে না? কেন শহরে-গঞ্জে লোকালয়ে চেম্বার খুলে বসলে না? কেন কোনও হাসপাতালের সঙ্গে থাকলে না?

তুমি ধর্মপ্রাণ, ঈশ্বর বিশ্বাসী। অবনীর তাতে কোনও আগ্রহ নেই। উৎসাহও নেই। বরং উপেক্ষা আছে। মানুষের যার যা পছন্দ তা বিশ্বাস করতে পারে, ভূত-প্রেত, পরজন্ম দীন-দয়াল অবতার কারুর কিছু বলার নেই। অবনী এসব গ্রাহ্য করে না। সে অন্য কিছু বিশ্বাস করে, বিজলীবাবুর আবার অন্য ধারণা।

কিন্তু, অবনী বুঝতে পারল না, সুরেশ্বর কী করে বাস্তবিকই গুরুডিয়ার জঙ্গলে অন্ধ আশ্রম গড়ে তুলতে পারল। কিছুনা হোক–হঠাৎ দেখলে অবাক হবার মতন খানিকটা নিশ্চয় করেছে। কেমন করে করল?

কেমন করেই বা হৈমন্তীর মতন একটি মেয়েকে সুরেশ্বর এখানে টেনে আনল? হৈমন্তীই বা কেন এল? সুরেশ্বর কি তাকে ভুলিয়ে এনেছে? ভাসিয়ে এনেছে? যেমন করে নিজে ভেসে এসেছে–তেমন করেই কী ভাসিয়ে এনেছে হৈমন্তীকে? নাকি সুরেশ্বরকে ভালবেসে এসেছে ও? ভা…ল…বা…সা…?

কী যে সম্পর্ক দুজনের কিছুই বোঝা যায় না। সুরেশ্বরকে রহস্যময় পুরুষ বলেই মনে হচ্ছিল অবনীর। তার আশ্রমে যুবতী সমাগমের পরিণতি কী হবে তাও বোঝা যাচ্ছিল না।

.

আরও খানিকটা বেলায় পোস্টঅফিসের ফোন মারফত অবনীর কাছে খবর এল, হীরালাল কাল রাত্রে মারা গেছে।

সুরেশ্বর শহর থেকে ফোন করেছিল।

.

০৩.

এক সময়ে জায়গাটার কোনও নামই ছিল না, গুরুডিয়া ছিল আরও একটু তফাতে। সুরেশ্বরের অন্ধ আশ্রম গড়ে ওঠার সময় গুরুডিয়া যেন পা বাড়িয়ে এইটুকুও চলে এল। তখন গুরুডিয়া বললে বোঝাত গ্রাম, এখন বোঝয় অন্ধ আশ্রম। তখন ঠিক এই অঞ্চলটায় কোনও লোকবসতি ছিল না, জঙ্গল আর মাঠ ছিল পড়ে; সারা শীত শালের জঙ্গলে কাঠ কাটতে আসত কাঠুরিয়া, কাঠ কাটার শব্দ আর বয়েল গাড়ির আসা-যাওয়াতে সকাল দুপুর সাড়া দিত। যুদ্ধের শেষাশেষি এদিককার বনজঙ্গল কিছু পরিষ্কার হয়, কাঁচা রাস্তাও খানিকটা হয়েছিল। সঠিক বিবরণ কেউ জানে না, তবে ব্যারাক হয়েছিল কিছু, কাঁটাতারের বেড়াও পড়েছিল। কেউ বলত গুর্খা সেপাইদের চাঁদমারি হয়েছিল, কেউ বলত কয়েদি মাঠ। সম্ভবত যুদ্ধের শেষাশেষি কিছু হবার উপক্রম হয়েছিল এখানে, যুদ্ধ থেমে যাওয়ায় সব বন্ধ হয়ে গেল। যেটুকু হয়েছিল ফেলে দিয়ে চলে গেল ওরা। তারপর দীর্ঘদিন ব্যারাকের কাঁচা বাড়িগুলো পড়েই থেকেছে, দেহাতিরা ক্রমে ক্রমে ইট কাঠ খসিয়ে নিয়ে গেছে কিছু, বাকিটা ঝড়ে জলে রোদে বৃষ্টিতে মাটিতে মিশেছে।

দেখেশুনে সুরেশ্বর এই জায়গাটাই পছন্দ করেছিল। কারণ তার সামর্থ্য ছিল পরিমিত। নিজের কিছু সঙ্গতি আর অন্যের অনুগ্রহের ওপর যেখানে নির্ভর সেখানে এর বেশি কিছু প্রত্যাশা করা যায় না। নামমাত্র মূল্যে অনেকটা জমি পেল এখানে সুরেশ্বর, কাঁচা রাস্তা পেল, মোেটামুটি আশপাশ পরিষ্কার আর সামান্য দূরে একটা গ্রাম পেল। ভাঙাচোরা ব্যারাকের কিছু অবশেষ, তাও বা মন্দ কী!

ভেবে দেখতে গেলে সুরেশ্বর জায়গাটা মোটামুটি ভালই পছন্দ করেছিল। এখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশ চমৎকার। ছোটনাগপুরের পার্বত্য এলাকার প্রকৃতি যেমনটি হতে পারে। অজস্র বনসম্পদ। শাল পলাশ মহুয়ার যেন শেষ নেই, অজস্র হরীতকী আর অর্জুন গাছ ঘোড়া নিম আর গরগল। উঁচুনিচু প্রান্তর; কোথাও সেই অনুর্বর ভূমি ঢেউয়ের ফণার মতন মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে, কোথাও আনত নম্র হয়ে গেছে। মাটি শক্ত, কাঁকর আর নুড়িভরা, বাতাসে আর্দ্রতা নেই, শুকনো, বনগন্ধে পূর্ণ। গুরুডিয়ার কাঁচা রাস্তাটুকু ধরে কিছুটা এগিয়ে গেলেই সরকারি পাকা রাস্তা। এই রাস্তা ধরে তিনদিকে চলে যাওয়া যায়, দক্ষিণ আর মধ্য বিহারের অনেকখানি এই রাস্তার জালে জড়ানো। গুরুডিয়া থেকে রেল স্টেশনও এমন কিছু দুরে নয়, ব্যাপারীরা আসা-যাওয়া করে সবসময়।

সুরেশ্বর যা চেয়েছিল, নিরিবিলি শান্ত পরিবেশ, আশেপাশে দেহাত, নাগালের মধ্যে পথঘাট, যোগাযোগের সুবিধে–এখানে মোটামুটি তা সবই পেয়েছিল।

আশ্রম তৈরি করার আগে সুরেশ্বর কোথায় ছিল সে কথা এখানের কেউ জানে না। ঘোরাঘুরি সে অনেক করেছে তা অবশ্য বোঝা যেত। আজ প্রায় চার বছর সুরেশ্বর এখানে। প্রথমে থাকত শহরের দিকে, তারপর এল স্টেশনের কাছে। শহরে তার নানা রকমের যোগাযোগ ছিল। ক্রিশ্চান মিশনারিদের সঙ্গে, সেবাসঙ্ঘের কর্মীদের মধ্যেও তার মেলামেশা ছিল।

স্টেশনের দিকে যখন চলে এল সুরেশ্বর তখন থেকেই সে যেন কিছু খুঁজছিল। প্রথম প্রথম বোঝ যেত না সুরেশ্বর কী খুঁজছে। মনে হত, অধিকাংশ বাঙালিই এদিকে এলে যেমন করে–ঘরবাড়ি জমি বাগানসুরেশ্বরও তাই করবে, বরাবরের মতন থেকে যাবে। ক্রমে ক্রমে বোঝা গেল, সুরেশ্বর জমি জায়গা খুঁজছে অন্য উদ্দেশ্যে। অন্ধ আতুর জনের জন্যে কিছু করবে। কী করবে? হাসপাতাল না আশ্রম?

মনে মনে যা ভাবত সুরেশ্বর অন্যের কাছে তা প্রকাশ করত না। সামান্য যা করত তা থেকে স্পষ্ট কিছু বোঝা যেত না। অন্ধদের জন্যে তার এত বিচলিত হবার কারণ কী, সে যে কী করতে চাইছে তা কখনও বিস্তারিত করে বলেনি। প্রথমটা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার; দ্বিতীয়টা সম্পর্কে তার ধারণা, যা সে করেনি, যা শুধুমাত্র তার ইচ্ছা তা বিস্তারিত করে বললে নিজের কল্পনাশক্তির পরিচয় দেওয়া হয়, তার বেশি আর কিছু নয়। সুরেশ্বর অলস স্বপ্ন দেখতে এবং তার বিবরণ শুনিয়ে কাউকে চমৎকৃত করতে পছন্দ করত না।

প্রথমাবধিই তার সংশয় ছিল। নানা রকমের দ্বিধাও ছিল। অনেক দিন পর্যন্ত অনিশ্চিত বোধ করেছে। নিজের কর্মের সাফল্য সম্পর্কে এই সংশয়বোধ তাকে চিন্তিত করলেও হতাশ করতে পারত না।

নিজের সঙ্গতি ও সামর্থ্য মতন সুরেশ্বর তার অন্ধ আশ্রমের ভিত পাতল। অন্ধ আশ্রম নামটা সে দেয়নি; এটা লোকমুখে রচিত হয়েছে। দেহাতের মানুষ এখনও বলে, দাবাইখানা।

গুরুডিয়ায় এসে প্রথমে নিজের মাথা গোঁজার মতন এক চালা করে নিয়েছিল সুরেশ্বর, আর ছোট মতন এক কুঁড়েঘর করেছিল পাশেই, সেটাই ছিল চোখের হাসপাতাল। শহর থেকে সপ্তাহে একদিন বাসে চেপে আসতেন এক মাদ্রাজি ক্রিশ্চান, প্রায় বৃদ্ধ মামেনসাহেব। মিশনারি হাসপাতালে চোখের ডাক্তারি করেছেন দীর্ঘকাল। এখন অবসর নিয়েছেন। তবু যথাসাধ্য সাহায্য করেন আতুর অনাথকে। হাটের দিন দেহাত থেকে আসা-যাওয়ার পথে গ্রাম্য মানুষগুলি সুরেশ্বরের চোখের হাসপাতালে চোখ দেখিয়ে নিয়ে যেত। সুরেশ্বরকে সাইকেল চেপে দেহাতের গ্রামে গ্রামে এক সময় ঘুরে বেড়িয়ে তার চোখের হাসপাতালের কথা বলতে হয়েছে। এ অঞ্চলে চোখের ব্যাধি কম নয়। বাচ্চাকাচ্চা থেকে শুরু করে জোয়ান মজুররাও নানা রকম চক্ষুরোগে ভোগে।

আশ্রমের গোড়াপত্তন হয়েছিল এইভাবে, অতি দীন চেহারা নিয়ে। ক্রমে ক্রমে সে চেহারা বদলে আসছে। এখনও এমন কিছু হয়নি যা দেখে বিমূঢ় বা হতবুদ্ধি হতে হয়; নিতান্ত সাধারণ সাদামাটা একটা আকার নিতে পেরেছে। তবু, এখানে বনে জঙ্গলে দেহাতে–যেখানে কোনও কিছুই ঘটে না, প্রাকৃতিক নিয়মে শুধু গাছপালা বাড়ে আর জৈবিক নিয়মে মানুষের জন্মমৃত্যু ঘটে–সেখানে সাধারণ যা ঘটল, যতটুকু ঘটল তাতেই অনেকে বিস্মিত হয়, হয়তো মুগ্ধও হয়। সুরেশ্বরের অন্ধ আশ্রম অনেকটা সেই রকম বিস্ময়কর ঘটনা।

অন্ধ আশ্রমের সব কথা হৈমন্তীর জানা ছিল না, কিছু কিছু শুনেছিল, চিঠিপত্রেও জেনেছিল। গুরুডিয়ায় এসে দেখছিল সব।

কেমন দেখছ? সুরেশ্বর পরের দিনই জিজ্ঞেস করেছিল হৈমন্তীকে।

বেশ সুন্দর। হৈমন্তী তখনও তেমন করে কিছু দেখেনি।

জায়গাটা সুন্দরই। …আমাদের ব্যবস্থা কেমন দেখছ?

 আমি আর কতটুকু বুঝি। ভালই লাগছে।

তোমার হাসপাতাল?

 সবই তো আছে। অসুবিধে খুব একটা হবে না।

 প্রথম যখন হয়েছিল, তখন একটা কুঁড়েঘর আর টিনের চেয়ার। হাটবারের দিন মামেনসাহেব আসতেন। একটা সুটকেস হাতে, যন্ত্রপাতি বয়ে আনতেন।

এখন অনেক হয়েছে।

সাহেব নিজেই অর্ধেক জিনিস দিয়েছেন, বাকি কিনতে হয়েছে। …গত বছরে সাহেব মারা গেছেন। এখন যিনি আসেন, তাঁর নানা অসুবিধে। সাহেব বেঁচে থাকতে তাঁর পছন্দমতনই হাসপাতালটা করিয়েছিলেন।

কাজের মানুষ।

নিষ্ঠাবান ব্যক্তি। দয়া ধর্ম প্রেম–তিনগুণে তিনি যথার্থ ক্রিশ্চান ছিলেন: সুরেশ্বর সশ্রদ্ধায় বলল। তারপর আবার বলল, কুড়ি বছর শুধু এদিকের, সমস্ত মিশন হাসপাতালে দীনদরিদ্রের চোখ দেখে বেড়িয়েছেন। বলতেন: যিশু অন্ধকে দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন, আমরা পাপীজন–মানুষকে দৃষ্টিহীন করি।

হৈমন্তী নীরব থাকল।

সুরেশ্বর পরে জিজ্ঞেস করেছিল, কেমন লাগছে তোমার?

ভাল।

 থাকতে পারবে?

 হৈমন্তী চোখ তুলে তাকাল, দেখল সুরেশ্বরকে, অল্প করে মাথা নোয়াল পারব।

তারপর থেকে আজ কদিন হৈমন্তী নতুন আবহাওয়া এবং পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেবার চেষ্টা করছে।

.

দু চোখ ভরে ঘুম জড়িয়ে আসছিল। বাসের ঘন ঘন হর্নে চোখের পাতা খুলল হৈমন্তী, আবার সঙ্গে সঙ্গে চোখ বুজল। তার ঘোরে কয়েক দণ্ড কাটল, তারপর আধবোজা চোখে জানলার দিকে তাকাল, খানিকটা দূরে জামতলায় বাস এসে থেমেছে, লোজন তুলে নিচ্ছে, এখুনি আবার হর্ন দিয়ে চলে যাবে। বিছানায় শুয়ে হৈমন্তী কিছুই দেখতে পাচ্ছিল না, কিন্তু সবই বুঝতে পারছিল। আজ আট-দশ দিনে মোটামুটি এখানকার সবই তার জানা হয়ে গেছে। এই বাসটা দুপুরের, এখন প্রায় তিনটে বাজে, কিংবা বেজে গিয়েছে।

শেষ কয়েকবার হর্ন দিয়ে বাসটা চলে গেল। হৈমন্তী আলস্যভরে হাই তুলল, চোখের দৃষ্টি এখনও পরিষ্কার নয়, তন্দ্রাজড়িত সামান্য ছলছলে ভাব রয়েছে।

এইভাবে আরও সামান্য সময় শুয়ে থেকে চোখ মুছে হৈমন্তী বিছানায় উঠে বসল। বড় করে হাই তুলল। দুপুরে সে ঘুমোতে চায় না, তবু এখানে–এত নিরিবিলি এবং নির্জনতার মধ্যে শুয়ে থাকতে থাকতে, কাগজপত্র বই পড়তে পড়তে কখন যেন দু চোখ জড়িয়ে আসে। ঘুমিয়ে পড়লে রাত্রে আর ঘুম আসতে চায় না। এখানে রাত্রে জেগে থাকা কেমন যেন! হৈমন্তীর ভয় করে। মনে হয়, বিশ্বসংসারে কেউ কোথাও নেই, জনপ্রাণী না, শুধু সে একা; চারপাশের অবর্ণনীয় স্তব্ধতা তার চেতনাকে এত নগণ্য, হেয় ও তাৎপর্যহীন করে তোলে যে হৈমন্তী কেমন এক আতঙ্ক অনুভব করে মৃতপ্রায় হয়ে থাকে।

এ-রকম দু দিন হয়েছিল। তারপর থেকে হৈমন্তী দুপুরে ঘুমোতে চায় না। এমনকী একটু বেশিক্ষণ তন্দ্রার ঘোরে শুয়ে থাকলেও বিকেল থেকে সে কেমন অস্বস্তি বোধ করে, রাত্রের কথা ভেবে তার উদ্বেগ হয়। হয়তো এসব কিছুই না, আর কদিন পরে সবই অভ্যাস হয়ে যাবে। একেবারে নতুন জায়গা, পুরনো অভ্যস্ত জীবনের সঙ্গে কোথাও কোনও মিল নেই, সাদৃশ্য নেই, এমন করে আগে সে আর কখনও থাকেনি–তাই নতুন নতুন এ রকম লাগে। পরে আর লাগবে না।

হৈমন্তী বিছানা থেকে নামল। জানলায় দাঁড়ালে দুরে জামতলা দেখা যায়। জামতলা এখন নির্জন, কেউ নেই। দুপুরে ওখানে একে একে লোক জমে, পাঁচ সাত দশ–কিছু ঠিক নেই। গাঁ-গ্রাম থেকে লোক আসে; এখানে যারা চোখ দেখাতে আসে তারাও বাস-আসার সময় সময় জামতলায় ফিরে গিয়ে গাড়ির অপেক্ষা করে। বাসটা চলে গেলে সব ফাঁকা–জামতলা নির্জন।

আবার বাস আসবে একবার; সন্ধে নাগাদ। আসবে আর যাবে। ওই বাসেই হৈমন্তীরা এসেছিল। অবশ্য শেষ পর্যন্ত আর আসা হয়ে ওঠেনি, বাস খারাপ হয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে গিয়েছিল, সেই ভদ্রলোক, অবনীবাবু, জিপে করে তাদের পৌঁছে দেন। ভদ্রলোকের কথাবার্তা কেমন যেন!

পাশের দিকের জানলা থেকে সরে হৈমন্তী বিছানার পায়ের দিকের জানলার কাছে এসে দাঁড়াল। জানলার আধখানা ঢেকে, নীচের দিকে, নতুন পরদা দিয়েছে; কচিকলাপাতা রঙের পরদা। হাতের কাছে কিছু ছিল না, আধ-পুরনো শাড়ি থেকে পরদা করা। বোঝা যায় না অবশ্য। এখানে কোথাও পরদা নেই, সব ফাঁকা, খোলামেলা। হাসপাতালের ঘরেই যা পরদা দেখা যায়। হৈমন্তী কেমন অস্বস্তি বোধ করছিল, কাছাকাছি কেউ কোথাও থাক না থাক–তবু ওইটুকু আড়াল না থাকলে তার স্বস্তি হচ্ছিল না।

জানলার কাছে দাঁড়িয়ে অলস চোখে হৈমন্তী সামনে তাকিয়ে থাকল। বর্ষার জলে মাঠের ঘাস বড় বড়, সবুজ হয়ে আছে। মোলায়েম জাজিমের মতন আশে-পাশে বিছানো। বিকেলের পরিষ্কার রোদে খুব ফিকে হলদের মতন একটা রং ধরেছে মাঠে। এখানে ওখানে গাছপালা, মস্ত একটা শিরীষ, হাসপাতাল-ঘরের কাছে একজোড়া অর্জুন গাছ। এখান থেকে হাসপাতাল-ঘরের অর্ধেকটা দেখা যায়, বাকিটা গাছের আড়ালে।

অন্যমনস্কভাবে হৈমন্তী আঙুল দিয়ে চুল ছাড়িয়ে পিঠময় ছড়াতে লাগল। চুল প্রায় শুকিয়ে এসেছে। শব্দ করে আবার একটু হাই তুলল। হাসপাতাল-ঘরের সামনে দিয়ে পাতলা মতন ছায়া ভেসে গেল, টুকরো মেঘ ভেসে যাচ্ছে, নিচু দিয়ে। বর্ষা বোধহয় ফুরিয়ে এল।

চোখ মুখ ধোবার জন্যে হৈমন্তী ঘর ছেড়ে বাইরে এল। তার ঘরের গায়ে গায়ে কাঁচা বারান্দা, পাশেই হলঘর। ওর ঘরের গা লাগিয়ে মালিনীর ঘর, মালিনীর ঘরের দরজা জানলা হাট করে খোলা, মালিনী পশ্চিমের মাঠে শুকনো কাপড় জামা তুলছে, তুলে বুকের কাছে জড়ো করছে।

কলঘর থেকে ফিরে হৈমন্তী ভিজে চোখ মুখে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকল। এখান থেকে গোটা এলাকাটাই মোটামুটি দেখা যায়। জায়গা বড় কম নয়–হৈমন্তী জমির হিসেব বোঝে না, সুরেশ্বরের কাছে শুনেছে, প্রায় বিঘে পাঁচেক। সমস্ত জমি এখনও বেড়া দেওয়া হয়নি, কিছু হয়েছে, কিছুটা ফেলে রাখা হয়েছে ভবিষ্যতের জন্যে। শাল কাঠের খুঁটি আর তার দিয়ে বেড়া, কোথাও কোথাও বুনো কাঁটালতা ঘন হয়ে উঠেছে বেড়ার গায়ে। পুব পশ্চিম দক্ষিণ তিন দিকে ঘর উঠেছে। একে ঠিক পাকা বাড়ি বলা যায় না, আবার কাঁচা বাড়িও নয়। ইটের গাঁথুনি করা দেওয়াল, মাটির বাড়ি মাত্র একটি, মাথায় টালি বা খাপরা। হাসপাতাল বাড়িটার মাথায় শুধু অ্যাসবেস্টাস। সব সুষ্ঠু ছোট বড় খান পাঁচেক দালান, লম্বা লম্বা। জামরুল বা কাঁঠাল কাঠের দরজা জানলা।

পুবের দিকে সুরেশ্বরের ঘর। মাটির বাড়ি, মাথায় খাপরা, সামনে লতাগাছের জাফরি। এক সময়, সুরেশ্বর যখন প্রথম এখানে এসে আশ্রয়ের জন্যে ঘর বাঁধে তখন কাঠকুটো কঞ্চি দিয়ে বেড়া দিয়েছিল সামনে, লতাপাতা লাগিয়েছিল। দিনে দিনে লতাপাতা বেড়ে সামনেটা জাফরির মতন আড়াল পড়েছে, বেড়া ভেঙে গেছে কবে। ওখানে কিছু ফুলের গাছ-জবা, করবী, বেল, দোপাটি। জুই গাছের ডালপালা বাড়ির মাথায় গিয়ে উঠেছে। সুরেশ্বরের বাড়ির একপাশে সিমেন্ট বাঁধানো ছোট একটু বেদি।

মফস্বলের স্কুল বাড়ির মতন লম্বা লম্বা কয়েকটা দালান বেশ খানিকটা তফাত তফাত পুব পশ্চিম দক্ষিণে ছড়ানো। সামান্য উঁচু করে ভিত, ইটের গাঁথনি, মাথায় খাপরা কিংবা টালি, বড় বড় জানলা আর দরজা। কোথাও কোনও রকম বাহুল্য নেই, নিতান্ত যেটুকু প্রয়োজন তার অতিরিক্ত কিছু না। দালানগুলোর সামনে কোথাও করবী ঝোপ, কোথাও কলাফুলের গাছ, টিপফুল, কাঠচাঁপা গাছ, রঙ্গন ফুল। আর অজস্র সবুজ ঘাস।

পশ্চিমের দালানটায় যারা থাকে তারা কজনই পুরোপুরি অন্ধ। কাছাকাছি একটা ঘরে ওরা হাতের কাজ করে। পেছন দিকে বাগান। পুব-দক্ষিণ ঘেঁষে যে দালানটা সেটা তেমন বড় নয়, ছোটই; ওখানে পাঁচ-সাতজন রোগী আছে, বাচ্চাকাচ্চাই বেশি। তারই পাশে মেয়ে রোগী জন দুই তিন।

দক্ষিণের ঘোট দালানটায় হৈমন্তী আর মালিনী থাকে। দেহাতি কটা চাকরবাকর থাকে অল্প তফাতে।

জল বলতে দুটো ইঁদারা। খুব কাছেই নদীর একটি শীর্ণ স্রোতোধারা আছে অনেকেই সেখানে যায়; এখন বর্ষার শেষে জলভরা সেই শীর্ণ ধারাটিকে ছোটখাটো নদী বলেই মনে হয়।

এখানে এসে হৈমন্তীর ভালই লাগছিল। সকালটা কাজেকর্মে কেটে যায়, দুপুর থেকে নিরিবিলি, আলস্য আর বিশ্রামে কাটে, বিকেলটাও মন্দ না কখনও ঘুরে বেড়ায়, কখনও সুরেশ্বরের সঙ্গে কথাবার্তা বলে, গল্প করে; কখনও তার সঙ্গী হয় মালিনী। সন্ধে হয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে সারাদিনের ভাললাগাটুকু ফিকে হয়ে আসতে থাকে। তখন আর মন বসাতে পারে না এখানে। বড় নির্জন, ফাঁকা, শূন্য মনে হয় সব। রাত যত বাড়ে ততই কেমন অস্বস্তি বোধ করে, উদ্বেগ জমতে থাকে, শেষে ভয় ভয় করে।

সবই অভ্যেস। আর কটা দিন কেটে যাক, তখন হৈমন্তী এই নির্জনতা, নিস্তব্ধতা, হ্যারিকেনের মিটমিটে আলো, বাইরের নিবিড় অন্ধকারে অস্বস্তি অনুভব করবে না, ভয় পাবে না।

হৈমন্তী মাঠে নেমে এল। নরম ঘাসে তার পায়ের চটি ডুবে আছে। বড় বড় ঘাসের ডগা গোড়ালি পর্যন্ত; হাঁটার সময় মনে হয় যেন অল্প জলে পা দিয়ে হাঁটছে, এত নরম আর কোমল।

সামান্য এগিয়ে হৈমন্তী দাঁড়াল। মালিনী আসছে।

মালিনী তাড়াতাড়ি হাঁটে, দেখলে মনে হয় ছুটে ছুটে হাঁটছে। হাঁটার সময় ওর সমস্ত শরীর দোলে। অল্প দুর থেকে মালিনীকে বৈশ দেখাচ্ছিল। রং কালো হলেও মালিনীর গড়নটি নরম, মাথায় মাঝারি, চোখমুখ টলটলে। মালিনী হাসতে হাসতে আসছিল। তার সাদা ধবধবে দাঁত, মাথা ভর্তি এলো চুল, পরনের সাদা শাড়ি রোদের আভায় যেন আরও দেখার মতো হয়ে উঠেছিল। বুকের কাছে কাপড় জামা জড়ো করে এমনভাবে ছুটে ছুটে আসছে যে মনে হচ্ছে যেন কিছু চুরি করে পালাচ্ছে। হৈমন্তীর হাসি পেল।

কাছে এসে মালিনী বলল, যাবেন?

 হৈমন্তী চোখে চোখে চেয়ে থাকল। কোথায়?

আমাদের বাড়ি।

মালিনীর বাড়ি রেলস্টেশনের কাছে। বাড়িতে মা আছে, ছোট ভাই আছে, বোন আছে।

তুমি বাড়ি যাচ্ছ?

মালিনী মাথা নাড়ল, মুখভরা হাসি। কপালে গালে ঘাম ফুটে আছে।

যাবে কী করে?

বাস।

বাস তো চলে গেছে। হৈমন্তী অবাক হয়ে বলল।

যে বাস গেল সেটা কি স্টেশনের? দূর…ওটা শহরে যাবার। এত করে শিখিয়েও মালিনী যেন এই নতুন মানুষটিকে কিছু মনে রাখতে পারল না। কাঁচা রাস্তাটুকু হেঁটে গেলে মোড়ের মাথা থেকে স্টেশন যাবার বাস যে এখন পাওয়া যাবে–হেমদিদি তাও ভুলে গেছে। কখন কী বাস পাওয়া যায় তার একটু দ্রুত বিবরণ আবার মনে করিয়ে দিয়ে মালিনী বলল, তিনটের বাস শহরে যায়, চারটের বাস যায় স্টেশন, লাটঠার মোড়ে গিয়ে বাস ধরতে হবে। যাবেন?

হৈমন্তী হ্যাঁ-না কিছু বলল না। সুরেশ্বরকে বলতে হবে, মাইল খানেকের ওপর হাঁটা, অত সময় কই! তারপর ফেরার বাস। ফিরবে কখন?

তুমি ফিরবেনা আজ? হৈমন্তী শুধোল। মালিনী না থাকলে তাকে একলা থাকতে হবে। এক ঘরে না থাকলেও তারা পাশাপাশি থাকে, রাত্রে এ একটা বড় স্বস্তি হৈমন্তীর। মালিনী না ফিরলে হৈমন্তী থাকবে কী করে?

ফিরব।

 হৈমন্তীর দুর্ভাবনা গেল। বলল, আজ আর সময় কই! পরে একদিন যাব।

 মালিনী বলল, আজই চলুন। চারটেয় বাস আসে না, বলে চার, আসতে আসতে সাড়ে চার। ঢের সময় আছে।

হৈমন্তীর ইচ্ছে হচ্ছিল যায়, অথচ ছুটোছুটি করে যেতে হবে বলে যেন ভরসা পাচ্ছিল না। তার কিছু কেনাকাটা করার দরকারও ছিল। মাথার তেলের শিশিটা হাত ফসকে পড়ে ভেঙেছে, যেটুকু তেল বেঁচে ছিল তাতে এ কদিন কোনও রকমে হয়েছে। গায়ে মাখার সাবান ফুরিয়ে এল। দরজার পরদার জন্যে খানিকটা কাপড় কিনতে হবে। এই ধরনের সব টুকটাক। সুরেশ্বরকে বললে আনিয়ে দেবে, কিন্তু হৈমন্তী বলতে চায় না। সঙ্কোচ অনুভব করে। মালিনী তাকে চা তৈরি করে খাওয়ায়, সেই চা হৈমন্তীর ভাল লাগে না। খানিকটা ভাল চা আনতে হবে। কিছু বিস্কুট।

সুরেশ্বরকে হৈমন্তীর সুখ-সুবিধের কথা বলা যায় না। বললে হয়তো সব হবে, কিন্তু কী ভাববে সুরেশ্বর! তার জন্যে বাড়তি খরচে সুরেশ্বর আপত্তি করবে না, তবে মনে মনে হাসবে। তেল, সাবান, চায়ের মতন তুচ্ছ কটা জিনিসের জন্যে এত খুঁতখুঁতুনি!

হৈমন্তী মালিনীর দিকে তাকাল। মালিনীকে দিয়েও এসব আনানো যায়। কিন্তু মালিনীর কি অত সময় হবে? সে কি পছন্দমতন সব আনতে পারবে?

মালিনীর তাড়া ছিল। চঞ্চল হয়ে উঠে মালিনী বলল, আপনার যে কত ভাবনা! চলুন। দেরি হয়ে যাচ্ছে।

যাবার মন হৈমন্তীর ছিল। আসবার দিন স্টেশনের কিছুই প্রায় সে ভাল করে দেখেনি; বাসে এসে বসেছিল, সটান চলে এসেছে; ওরই মধ্যে দেখেছে, দোকান-পশার আছে স্টেশনে, লোকজন, আলো মোটামুটি যা হৈমন্তীর দেখা অভ্যেস, যার মধ্যে সে এতকাল থেকেছে। এখানে এসে পর্যন্ত সে এসব আর দেখেনি! দেহাতি রোগীদের মুখ ছাড়া আর-একটা নতুন মুখ নয়।

মালিনী হাঁটতে শুরু করেছিল, হৈমন্তীও পাশে পাশে চলতে লাগল। বলল, আজ আর যাব না। কাল পরশু যাব। আমার কিছু কেনাকাটা করতে হবে।

মালিনী হেসে বলল, একলা?

তুমিও যাবে।

 না ।

 কেন?

রোজ রোজ বাড়ি গেলে দাদা রাগ করবে। মালিনী সুরেশ্বরকে দাদা বলে।

হৈমন্তী মালিনীকে দেখল। মালিনীর মুখে কোনও রকম ক্ষোভ নেই।

আজ দাদা টাকা দিয়েছে। মাকে দিয়ে আসব। …আমার ভাইটা, বলেছি না আপনাকে, বিজলি-অফিসে চাকরি করে, ছোট চাকরি, টাকা না পেলে মার কষ্ট হয়।

মালিনী এখানে টাকা পায় হৈমন্তী জানত না। মাইনে হিসেবে পায়, না সাহায্য? হৈমন্তী কৌতূহল বোধ করলেও কিছু জিজ্ঞেস করল না।

ঘরের কাছে এসে মালিনী বলল, এর পর যখন টাকা পাব, আপনাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাব। আমায় একটা শাড়ি কিনে দেবেন। মিলের শাড়ি না, ভাল শাড়ি।

হৈমন্তী কথা বলল না, মাথা হেলিয়ে সায় দিল।

মালিনীর কথায় কোনও কোনও সময় সে অন্যমনস্ক হয়ে যায়। মালিনী ছেলেমানুষ নয়, বোধবুদ্ধিহীনও নয়, কিন্তু খুব সরল আর সাধাসিধে। বছর বাইশ বয়স হয়েছে, লিখতে পড়তেও একেবারে না জানে এমন নয়, তবু কখনও কখনও অবোধের মতন কথা বলে।

শাড়ি কেনার কথাটা এমন কিছু নয়, কিন্তু ওর কথার সুরে ছেলেমানুষের মতন কোথায় যেন একটু ক্ষোভ ছিল। এর আগে একদিন মালিনী বলেছিল: আপনি কত লোককে চিঠি লেখেন হেমদি, আমায় একটা খাম দেবেন–আমার একজনকে চিঠি লিখব।

হৈমন্তী নিজের ঘরে এল। মালিনীকে দেখলে কিছু বোঝা যায় না, কিন্তু তার সঙ্গে মিশলে বোঝা যায়, এখানে সে পুরোপুরি মনোসুখে নেই, কোথায় যেন তার একটা অভাব রয়েছে। এই অভাব, ওপর ওপর থেকে দেখলে মনে হবে, তুচ্ছ কটা বাস্তব জিনিস, যা সহজলভ্য, অথচ সে পায় না তার জন্যে; ভেতরে চোখ ফেললে মনে হবে মালিনীর অভাব অন্য কোথাও। সুরেশ্বরের অন্ধ আশ্রমে সে কত, রকমের কাজ করছে, এই কাজে তার মুখ ভার হয় না, বরং বেশির ভাগ সময়েই হাসি হাসি ভাব, অথচ সন্দেহ হয়, মনে মনে মালিনী কোনও দুঃখ নিয়ে আছে। কী দুঃখ?

আর-একদিন মালিনী জিজ্ঞেস করেছিল: আপনি এখানে কেন এলেন হেমদি?

হৈমন্তী এ-ধরনের প্রশ্নে অস্বস্তি বোধ করেছিল, সরাসরি কোনও জবাব দেয়নি, দায়সারা একটা জবাব দিয়েছিল। কিন্তু সে অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল।

মালিনী ঘরে এল। তাড়াতাড়ি করে কাপড় বদলে নিয়েছে, চুল বেঁধেছে এলো করে, হাতে চায়ের কাপ। বলল, আমি চলি হেমদি, সন্ধের বাসে ফিরব। …আপনার জন্যে ছাঁচি পান নিয়ে আসব, আমাদের ওখানে একজন যা পান করে দেখবেন… মালিনী চলে গেল।

সামান্য পরেই হৈমন্তী জানলা দিয়ে দেখল, মালিনী যেন ছুটতে ছুটতে যাচ্ছে, পরনে মিলের সাদা শাড়ি, গায়ে সাদা জামা, পায়ে পুরনো চটি, একহাতে একটা ছাতা। খোঁপার গোড়ায় লাল ফিতে বাঁধা।

দেখতে দেখতে মালিনী অনেকটা চলে গেল। হৈমন্তীর মন কেমন ভার হয়ে এল হঠাৎ।

 বিকেল পড়ে গিয়েছিল। হৈমন্তী অন্য দিনের মতন আশ্রমের বাইরে এসে জামতলার পাশ দিয়ে কাঁচা রাস্তা ধরে বেড়াচ্ছিল। আকাশ পরিষ্কার, হালকা পাতলা পেঁজা তুলোর মতন ভেঁড়া এক-আধ টুকরো মেঘ ভেসে যাচ্ছে, রোদ ফুরিয়ে গেছে, দূরে টিলার গায়ে গায়ে শেষ একটু আলো, ঠাণ্ডা বাতাস বইছিল, পুবের বাতাস, পাখির ঝাঁক গাছ ডিঙিয়ে চলে যাচ্ছে।

কাঁচা রাস্তা ধরে খানিকটা পথ হেঁটে আসার পর হৈমন্তী একটু দাঁড়াল। সাইকেলে করে কে যেন আসছে। দূর থেকে চেনা গেল না। কাছাকাছি এলে হৈমন্তী চিনতে পারল, শিবনন্দনজি। শিবনন্দনজি সুরেশ্বরের পরিচিত, আশ্রমে অন্ধদের হাতের কাজকর্ম শিখিয়েছেন–বেতের কাজ, গামছা বোনা, বাঁশের টুকটাক জিনিস, খেলনা এই সব। জিনিসগুলো বেচা কেনার ব্যবস্থা তিনিই করেন। যেতে যেতে শিবনন্দনজি সাইকেল থেকে না নেমেই সম্ভাষণ জানিয়ে বললেন, এদিকে কোথায় যাচ্ছে হৈমন্তী, সন্ধে যে হয়ে এল।

কথাটা শুনলেও অন্যমনস্কভাবে হাঁটছিল। আরও খানিকটা পথ এগিয়ে এসে হৈমন্তী হঠাৎ দাঁড়াল। আলো এত ম্লান হয়ে এসেছে যে দূরের জিনিস আর দেখা যায় না, ঝাপসা অন্ধকারে সব একাকার হয়ে আছে। সন্ধ্যার কালিমা অগোচরে শূন্যের রং ধূসর ও আঁধার করে তুলছে।

হৈমন্তী আকাশের দিকে তাকাল, পরে চোখ নামিয়ে সামনের দিকে। দূরের আর কিছুই তার দৃষ্টিগোচর হল না।

আর সহসা, মালিনীর সেই প্রশ্ন, এখন এই নির্জনে, নিঃসঙ্গ অবস্থায় তার মনে পড়ল: আপনি এখানে কেন এসেছেন, হেমদি?

হৈমন্তী কিছুক্ষণ নিঃসাড় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। সে কেন এসেছে? কেন?

যেমন দুরের কিছু আর দেখা যাচ্ছিল না, হৈমন্তীও যেন সেই রকম কিছু দেখবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়ে কিছু ভাবতে পারছিল না। সে কেন এসেছে? কার কাছে? কোন প্রত্যাশায়?

ভীত মানুষের মতন হৈমন্তী হঠাৎ ফিরতে লাগল, তাড়াতাড়ি।

.

০৪.

সুরেশ্বর বাগানের কয়েকটা গাছপালা পরিষ্কার করে মাটিমাখা হাতে দাঁড়িয়েছিল, হৈমন্তী এল।

এসো– সুরেশ্বর সহজ সরল অভ্যর্থনা করল।

বাগানই দেখছিল সুরেশ্বর, দেখতে দেখতে আঙুল দিয়ে একটা জায়গা দেখাল, ভাবছি ওখানটায় মাটি একটু খুঁড়িয়ে নিয়ে কিছু মরশুমি ফুলের বীজ ছড়িয়ে দেব। সামনে শীত আসছে–খুব ফুল ফুটবে।

হৈমন্তী বাগানের দিকে তাকাল। এ কোনও সাজানো বাগান নয়, এখানে ওখানে গাছপালা বেড়েছে। সুরেশ্বর যে বাগান নিয়ে মাথা ঘামায় তেমন, তা বোঝা যায় না। হৈমন্তী চোখ তুলে সুরেশ্বরকে কপলক দেখল, অন্য দিকে দৃষ্টি ফেরাল: মরশুমি ফুলের বীজ ছড়ানোর কথাটা হৈমন্তীর কানে ছেলেমানুষের মতন শুনিয়েছিল।

কথা বলতে হয় বলেই যেন হৈমন্তী বলল, শীতের এখন অনেক দেরি।

সুরেশ্বর আস্তে মাথা নাড়ল, হাসি মুখে বলল, না হেম, এ তোমাদের কলকাতা নয়। এখানে দেখতে দেখতে শীত এসে যাবে। পুজোর পরপরই।

হৈমন্তী কিছু বলল না।

সুরেশ্বর দুহাত রগড়ে রগড়ে শুকনো মাটি হাত ঝেড়ে ফেলে দিতে দিতে বলল, এখানে বর্ষাটা যেমন খারাপ লাগে, শীতটা আবার তেমনি সুন্দর…। আছো তো, দেখতেই পাবে। …চলো, বারান্দায় গিয়ে বসি।

কয়েক পা এগিয়ে সিঁড়ি, ছোট ছোট পাঁচ ছ ধাপ। সিঁড়ি উঠে সুরেশ্বর বলল, বসো, হাতটা ধুয়ে আসি।

হৈমন্তী বসল না, দাঁড়িয়ে থাকল।

বর্ষ যে ফুরিয়ে গেছে বেশ বোঝা যায়। আজ চার পাঁচদিন বৃষ্টি নেই। শরতের বৃষ্টির মতন এল-গেল এক আধ পশলা যা হয়েছে তা কিছুই না। আকাশের রং বদলে গেছে; ধোয়ামোছা হালকা নীল। রোদ খুব পরিষ্কার আর ঝকঝকে। বিকেলও যেন দেখতে দেখতে ফুরিয়ে যাচ্ছে।

হৈমন্তী চোখ তুলল। আকাশের তলায় যেটুকু ধূসর আলো তা ক্রমশই কালোয় মিশিয়ে যাচ্ছিল, মিশে চোখের পাতার মতন আকাশের পট ঢেকে দিচ্ছিল। তারা ফুটছে। স্নিগ্ধ এলোমেলো বাতাস পাচ্ছিল হৈমন্তী।

সুরেশ্বর এল। তুমি না আজ স্টেশনের দিকে বেড়াতে যাবে বলেছিলে। গেলে না?

আজ হল না। কাল পরশু যাব।

সুরেশ্বর বেতের চেয়ারটা হৈমন্তীর দিকে এগিয়ে দিল, বসো৷ নিজে ক্যাম্বিসের চেয়ার টেনে নিল। বসল।

হৈমন্তী বসতে বসতে বলল, আজ মার আর-একটা চিঠি পেয়েছি।

কী লিখেছেন?

ওই কেমন আছি, কেমন লাগছে।

মাসিমার ধারণা আমরা বনেজঙ্গলে আছি, বাঘভালুকের মধ্যে, সুরেশ্বর সহাস্যে বলল। আমায় কতবার করে যে সাবধান করে দিয়েছেন।

আবার চিঠি দিয়েছে মা? হৈমন্তী সুরেশ্বরের চোখের দিকে তাকাল। মা যে কখন কী লিখে ফেলবে কে জানে!

 না না; আগের চিঠির কথাই বলছি।

হৈমন্তী চোখ ফিরিয়ে নিল। মার খুব আপত্তি ছিল হৈমন্তী এখানে আসে। মা এ-সব গোড়াগুড়ি থেকেই চায়নি। ডাক্তারি পড়ার সময়ে নয়, তারপর এই চোখ নিয়ে আবার সময় নষ্ট, এখানে আসা। কোনওটাতেই মার ইচ্ছে ছিল না। কী হবে? এই যে পড়ছ আর পড়ছ, কী হবে তোমার?

মার অনিচ্ছাসত্ত্বেও সব হয়ে আসছিল হৈমন্তীর; এখানে আসার বেলাতেও মার অমতে এসেছে।

 সুরেশ্বর আগের প্রসঙ্গেই বলল, আমাদের অনেক অহেতুক ভয় থাকে।

হৈমন্তী কিছু বলল না। মনে মনে ভাবল: যে বলছে হয়তো তারও আছে।

সুরেশ্বরের ঘরের মধ্যে নড়াচড়ার, এটা ওটা সরিয়ে রাখার এবং পায়ের শব্দ শুনতে পাওয়া যাচ্ছিল। ঘরের কাজ করছিল ভরতু।

সুরেশ্বর বলল, তুমি আমার মাকে দেখনি, হেম। আমার মার বরাবর ভয় ছিল আমি নির্ঘাত একদিন তেতলার ছাত থেকে পড়ে যাব। মার হুকুমে তেতলার ছাতের দরজায় তালা দেওয়া থাকত।

সুরেশ্বরের মাকে হৈমন্তী দেখেনি। দেখার কথাও নয়। গল্প শুনেছে নানারকম। বরাবরই নাকি একটু পাগলাটে ভাব ছিল; পরে বেশ পাগল হয়ে যান।

হৈমন্তী বলল, সব ভয়েরই একটা কারণ থাকে।

সুরেশ্বর হৈমন্তীকে লক্ষ করল। বলল, থাকে। ভয়ের ধারণা থেকে ভয় হয়। বনে জঙ্গলে বাঘ থাকে এই ধারণা থেকেই মানুষের জঙ্গলে ভয়। কিন্তু সব সময় তো তা সত্যি নয়। আমি এখানে যতদিন আছিবাঘভালুক কিছুই দেখিনি। শেয়াল-টেয়াল অবশ্য দেখেছি। সুরেশ্বর শেষ কথায় হাসল।

ভরতু লণ্ঠন এনে দিল। বাইরে সব সময়ে দু-একটি চেয়ার, ছোট চৌকি মতন টুল পড়ে থাকে। টুল টেনে লণ্ঠন রেখে আবার চলে গেল ভরতু।

সুরেশ্বর নরম গলায় বলল, ছেলেবেলায় ছাতে উঠতে আমার খুব ভাল লাগত। দেশের বাড়ি– ছাতটা ছিল মস্ত, ঘুলঘুলি দেওয়া, আলসে উঁচু। আলসেটা আমার প্রায় মাথায় মাথায়। একদিকে ছিল নদীর চরা, সামনে আমবাগান আর দূরে রথতলার মাঠ। ছাতে উঠলে মনে হত, কে যেন আমায় এতক্ষণ আটকে রেখেছিল, আমি ছাড়া পেয়ে গেছি। পায়ে ভর দিয়ে নদী আর রথতলার মাঠ দেখতাম, পা ব্যথা করলে বসে বসে ঘুলঘুলি দিয়ে তাকিয়ে থাকতাম। একদিন আমি আলসেতে অল্প একটু উঠে বুক ঝুঁকিয়ে কিছু দেখছিলাম, কে যেন দেখে ফেলেছিল। সেই যে ধরা পড়ে গেলাম, মা আর ছাতে উঠতে দিত না একলা।

ভয়ে। হৈমন্তী বলল; এমনভাবে বলল যাতে মনে হল সুরেশ্বরের মার ভয় অকারণ ছিল না।

ছাতে আমি ছুটোছুটি করতাম না, আলসের ওপর ওঠাও আমার সাধ্য ছিল না। তবু মার কী ভয়! সুরেশ্বর একটু হাসল। দু মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, আমার এক মাসি ছিল–বিনুমাসি, মার দেখাশোনা করত, বিনুমাসি আমায় কপালকুণ্ডলার গল্প বলেছিল; আমার কেমন একটা ভয় ছিল, ওই নদীর চরা দিয়ে কাঁপালিকটা রোজ আসা-যাওয়া করে। একবার এক সাধুবাবাকে নদীতে দেখে ভয়টা আরও বেড়ে গিয়েছিল।

সুরেশ্বরের ছেলেবেলার কথা হৈমন্তী যেটুকু শুনেছে তাতে মানুষটির ওপর তার কেমন সহানুভূতি ছিল; ওর মা ছিলেন অসুস্থ, মাথা পাগল; বাবা ছিলেন যেমন রাশভারী তেমনি দুর্জন। অর্থ ছিল, অত্যাচারও ছিল। স্ত্রীর সঙ্গে বড় একটা সম্পর্ক রাখেননি। সুরেশ্বরের মা বেঁচে থাকার সময়েই তিনি অন্য এক স্ত্রীলোককে স্ত্রী হিসেবে রেখেছিলেন। এই উপপত্নীটি থাকতেন কলকাতায়। কাজেকর্মে সুরেশ্বরের বাবাকে প্রায়ই কলকাতায় এসে থাকতে হত। বাসা ছিল, ব্যবস্থাও ছিল। মহিলার একটি পুত্রসন্তান হয়। সুরেশ্বরের বাবার মৃত্যুর পর সম্পত্তি দাবি করে মামলার ভয় দেখিয়েছিল ওরা। সুরেশ্বর মামলা চালায়নি, দাবি মিটিয়ে দিয়েছিল।

হৈমন্তী এ সমস্তই মার কাছে শুনেছে। মার ধারণা, সুরেশ্বর আগাগোড়া বোকামি করেছে। সম্পত্তির অংশ দেবার কোনও দরকার তার ছিল না। আইন সুরেশ্বরের পক্ষে ছিল।

হৈমন্তী অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল, সতর্ক হল।

সুরেশ্বর কথা বলল। আমার মার আর-একটা অদ্ভুত ভয় কী ছিল জানো? মা কোথাও দড়ি টাঙানো দেখতে পারত না। দড়ি দেখলেই মার কী যেন হত, চেঁচামেচি হইচই করে সে এক কাণ্ড করত। মা ভাবত, হাতের সামনে দড়ি থাকলেই মা বুঝি কিছু করে বসবে। …অথচ মা সুরেশ্বর বলতে গিয়েও থেমে গেল। তারপর কথা ঘুরিয়ে নিয়ে বলল, তুমি মাসিমাকে লিখে দিয়ো এখানে সত্যিই বাঘভালুকের ভয় নেই।

কথার পিঠে কথা বলতে হৈমন্তীর ভাল লাগে না। এখানে শেয়াল আছে না বুনো কুকুর আছে তা নিয়ে মাথা ঘামানোর ইচ্ছেও এখন তার নেই। চিঠিতে মা একটা কথা লিখেছে–সেটা কি জানিয়ে দেবে? জানানো নয়; মা যা জানতে চেয়েছে ঘুরিয়ে হৈমন্তীও যেন তা জেনে নিতে চায়। অথচ সুরেশ্বরের কাছে কথাটা বলা যায় না।

সুরেশ্বর হৈমন্তীর দিকে তাকিয়েছিল। কী যেন দেখছিল। লণ্ঠনের আলো এখনও তেমন করে ফুটে ওঠেনি, অন্ধকার কিছুটা হালকা।

তোমার মুখের সঙ্গে মাসিমার মুখের খুব মিল আছে। সুরেশ্বর বলল।

কথাটা সুরেশ্বর কেন বলল হৈমন্তী বুঝতে পারল না। মার সঙ্গে তার মুখের মিল যেটুকু আছে সেটুকু আদলে, আর কোথাও নয়।

মার সঙ্গে আমার অমিলও অনেক– হৈমন্তী হঠাৎ বলল, বলে হাসবার চেষ্টা করল।

সুরেশ্বর অস্বীকার করল না, ঘাড় হেলিয়ে জবাব দিল, তা তো থাকবেই। সুরেশ্বরও হাসল।

হৈমন্তী হাত বাড়িয়ে লণ্ঠনটা সরিয়ে রাখল সামান্য। কেরাসিন তেলের গন্ধ এখনও তার নাকে লাগে। বলল, এখানে কোনওদিন আলো হবে না, না?

কীসের আলো? সুরেশ্বর অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল, কথাটা খেয়াল করেনি।

 ইলেকট্রিক।

 তোমার খুব অসুবিধে হচ্ছে।

আমার সুবিধের জন্যেই কি লাইট হবে। …এমনি জিজ্ঞেস করছি। এখানে ইলেকট্রিক হবার আশা নেই, না?

এখন নয়। দু-চার বছরের মধ্যেও হবে না। তারপর যদি হয়।

হৈমন্তী অতটা দুরের কথা ভাবতে পারল না। সমস্ত জিনিসই কি পাঁচ সাত দশ বছরের পরের চেহারা নিয়ে ভাবা যায়। এভাবে সে অনেক ভেবেছে, আর নয়।

সুরেশ্বর বলল, পাঁচ জায়গা থেকে কুড়িয়ে আমায় দিন চালাতে হয়, আলো করার পয়সা কোথায়, হেম।

হৈমন্তীর ইচ্ছে হল বলে, কেউ তোমায় কুড়োতে বলেনি, তুমি নিজেই হাত পেতে কুড়োতে এসেছ।

অভাব জিনিসটা– সুরেশ্বর একটু হেসে বলল, ভয়ের মতন; যত ভাববে তত বাড়বে।

এধরনের অর্থহীন কথা হৈমন্তীর পছন্দ হল না। ঠাট্টার গলায় বলল, তবে আর কী, মানুষকে কিছুই বোধ করতে হবে না, খিদে পেলেও নয়, অন্ধকারে থাকলেও নয়, কিছুতেই নয়।

আমি অমন বাড়াবাড়ির কথা বলিনি। যা পেলে মোটামুটি আমার প্রয়োজন মেটে তার বেশি চাইলেই মুশকিল হয়।

মোটামুটিই বা কজনের মেটে! …তা ছাড়া সব অভাবই তো খাওয়া পরার নয়– হৈমন্তী বলল। মনে পড়ল: মালিনীর যে অভাব সে-অভাব কীসের কে বলতে পারে। আমি কোন অভাব বোধ করি তুমি কী করে বুঝবে?

 সুরেশ্বর মাথা নাড়ল আস্তে করে। কী ভাবছিল কে জানে। সামান্য সময় চুপচাপ, তারপর বলল, সংসারটা সুখের নয় হেম; জগৎটাও নিখুঁত নয়। অ-সুখের সংসারেই আমাদের জন্ম, খুঁতখুঁতুনি থাকবেই। …আমার মনে হয়, আমরা অনেক জিনিস ঢাক পিটিয়ে চাই, যেন সেগুলো ফেরার হয়েছে, কোতোয়ালিতে ধরে এনে দিতে হবে।

হৈমন্তী কিছু বুঝল না; বলল, সংসারে সবাই সুখ চায়।

তা তো চাইবেই।

তবে?

সুখের কোনও চেহারা নেই। যে যেমন করে তাকে গড়ে নেয়।

তাই বা পায় কোথায়?

না পেলে উপায় নেই।

হৈমন্তী চকিতের জন্যে সুরেশ্বরের দিকে তাকাল। এই নিস্পৃহতা সুরেশ্বরের চরিত্রে কিছুটা নতুন। আগেও ছিল, তবে এভাবে নয়। অথচ সংসারের সমস্ত ব্যাপারে সুরেশ্বরের এই নিস্পৃহতা তো এখনও নেই। শুধু…।

সুরেশ্বর নিজের থেকেই বলল, তুমি এখানে এসেছ, আমার পক্ষে সেটা মস্ত লাভ। আমি একটু স্বার্থপরের মতন কথা বলছি। যদি এখানে থাকতে তোমার ভাল না লাগে, আমি তোমায় জোর করে আটকে রাখব না! তোমায় যদি আমরা না পাই উপায় কী বলল। আমাদের হাতে সব কিছু তো থাকে না—হাতের বাইরেও থাকে।

 হৈমন্তী কোনও কথা বলল না। কোথায় যেন সে অনুভব করল, সুরেশ্বরের কাছে আজ তার মূল্য আশ্রমের ডাক্তার হিসেবে। এর বেশি–এর বাইরে সুরেশ্বর কিছু ভাবে না নাকি?

কোনও কোনও মানুষ আছে যারা অনেকটা আয়নার মতন, তাদের নিজের কিছু দেখা যায় না। সুরেশ্বরকে অনেক সময় হৈমন্তীর ওই রকম মনে হয়। মানুষটির সামনে দাঁড়ালে নিজেকে শুধু প্রতিফলিত দেখা যায়। কখনও কখনও হেমন্তী অধৈর্য হয়ে ওই আয়নাতে বোকার মতন আলো ফেলে ভেতরটা দেখতে গিয়ে দেখেছে নিক্ষিপ্ত আলোর ঝলকটাই ফিরে আসছে। সুরেশ্বর কি এখন এইরকম এক সুদৃশ্য আয়না হয়ে থাকবে।

হৈমন্তী বিরক্তি বোধ করল। সুরেশ্বর তার কাছে যদি একেবারেই অপরিচিত হত তবে অন্য কথা। তুমি অচেনানও, অজানাও নয়–মনে মনে হৈমন্তী বলল: এক সময় আমি তোমার অনেকটা দেখেছি। তখন তুমি আরশি ছিলে না।

হৈমন্তী বলল, কী জানি, আমার এত ভাল লাগে না।

কী? সুরেশ্বর মুখ ফিরিয়ে তাকাল।

হৈমন্তী সরাসরি কোনও জবাব দিল না, বলল, সব মানুষই নিজের কথা ভাবে।

পরের কথাও ভাবে। সুরেশ্বর শান্ত, কেমন এক হাসির গলায় জবাব দিল।

 নিজের ভাবনা বাদ দিয়ে নয়।

সুরেশ্বর আর কোনও জবাব দিল না। পরে এক সময়ে বলল, তা ঠিক।

হৈমন্তীর ইচ্ছে হল না অকারণ কথা বাড়ায়। আরও অল্পক্ষণ বসে থাকল চুপচাপ। তারপর বলল, আমি উঠি।

উঠবে কেন, আর খানিকটা বসো।

 মার চিঠিটা লিখে রাখি গিয়ে, সকালে সময় পাব না।

কাল হাটবার, তোমার খাটুনি বাড়বে।

ওদের কথাবার্তা আমি বুঝতে পারি না কী যে বলে।

 যুগলবাবুকে বলল, বুঝিয়ে দেবে।

উনিই দেন।

যুগলবাবু কম্পাউন্ডার গোছের মানুষ। হাসপাতালের কাজকর্ম প্রায় সবই দেখাশোনা করেন। এখানে থাকেন না। সাইকেলে যাওয়া-আসা করেন।

হৈমন্তী উঠে দাঁড়াল। সুরেশ্বরও উঠল। হৈমন্তী আপত্তি করতে যাচ্ছিল। সুরেশ্বর অল্প একটু পথ তাকে এগিয়ে দেবে, দিয়ে ফিরবে, কিংবা পায়চারি করে বেড়াবে মাঠে। এরকম সৌজন্য অকারণ।

নীচে নামল হৈমন্তী, সুরেশ্বরও নেমে এল পেছনে।

হাঁটতে হাঁটতে সুরেশ্বর বলল, কাল সকালে আমি টাউনে যাব। সরকারি একটা গ্রান্ট পাওয়া যাবে শুনছি। দেখি…।

অভ্যাস মতন অল্প একটু পথ এগিয়ে দিয়ে সুরেশ্বর দাঁড়াল, হৈমন্তী আর দাঁড়াল না, এগিয়ে গেল। পিছন দিকে তাকাবার ইচ্ছেও তার ছিল না, ইচ্ছাকৃতভাবে দ্রুত হাঁটার চেষ্টা করল। ব্যর্থতার অনুশোচনা অথবা গ্লানির মতন তার মনে বিরক্তি জমছিল।

এইরকমই হচ্ছে প্রায়। এখানে আসা পর্যন্ত হৈমন্তী মাঝে মাঝে অত্যন্ত হতাশ ও বিমর্ষ হয়ে পড়ছে। এখন তার বিন্দুমাত্র ভাল লাগছিল নাঃ সুখ না, তৃপ্তি না, স্বস্তিও নয়। নিজের ওপরেই সে অসন্তুষ্ট, বিরক্ত হয়ে উঠছিল।

কোনও কিছু লক্ষ না করে ঝোঁকের মাথায় খানিকটা পথ হেঁটে এসে হৈমন্তী দাঁড়াল। সামনে হাসপাতাল-ঘর চোখ তুলে দেখল, দেখে বিতৃষ্ণা অনুভব করল। নিজের সঙ্গে এই হাসপাতালের কোনও রকম সম্পর্ক আছে বলেও তার মনে হল না।

কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে হৈমন্তী অন্য দিকে মুখ ফেরাল, তারপর ফিরতে লাগল। মা জানতে চেয়েছে, তারপর হৈমন্তী কী করবে? স্পষ্ট করে মা ঠিক সে কথাটা বলেনি, তবে মার কথার ওই রকমই মানে দাঁড়ায়, তুমি বরাবরই তোমার মতে কাজ করলে, আমার কোনও কথাই শুনলে না। এখনও যদি তুমি তোমার ভালমন্দ না বোঝ আর কবে বুঝবে। তোমার বেশ বয়েস হয়েছে, এভাবে ভেসে বেড়ানো আমার আর পছন্দ নয়।

মার চিঠির আরও কোনও কোনও কথা মনে পড়ায় হৈমন্তী অতি তিক্ত অসন্তোষ অনুভব করল। সুরেশ্বর শিশু নয়, অজ্ঞান নয়। হৈমন্তী কেন এখানে এসেছে সুরেশ্বর যে বোঝে না তাও নয়। এই আশ্রম বল, আদর্শ বল, এর ভালমন্দ কিছু থাক তা সুরেশ্বরের। অন্ধ-আতুরের সেবার জন্যে হৈমন্তী এখানে আসেনি। ডাক্তারিটা তার পেশা, জীবন-নয়। এই পেশার জন্যে হৈমন্তীর মাথা ব্যথা ছিল না, এখনও নেই। যদি সে পেশার জন্যে কাতর হত, তবে এখানে এই জঙ্গলে আসত না, কলকাতায় থাকত; তাতে রোজগার হলে হত, না হলেও সে মরে যেত না।

সুরেশ্বর সমস্তই বোঝে। বোঝে বলেই নিজের প্রয়োজন মেটাতে হৈমন্তীকে এখানে এনেছে। অথচ কত নিস্পৃহ হয়ে বলতে পারল, হৈমন্তীর যদি এখানে ভাল না লাগে–সে চলে যায়, সুরেশ্বর তাকে আটকাবে না।

মানুষ কত বদলে যায়। আজকের সুরেশ্বরকে দেখলে হৈমন্তীর অতিপরিচিত সেই সুরেশ্বরকে আর চেনাই যায় না।

হৈমন্তী চোখ তুলল; বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। মালিনী বারান্দায় বসে আপনমনে গান গাইছে, সন্ধেবেলায় মাঝে মাঝে সে এইভাবে গান গায়। মালিনীর গলা মেঠো, কিন্তু মিষ্টি। গানের সুরটা শুধু হৈমন্তীর কানে গেল, কী গাইছে বুঝল না, শোনার আগ্রহও অনুভব করল না। মুখ তুলে আকাশের দিকে তাকাল হৈমন্তী, তারায় তারায় ভরা, চোখের মণির মতো কালো যেন আকাশটা।

ঠাণ্ডা বাতাসে সামান্য সময় দাঁড়িয়ে থাকল হৈমন্তী। মালিনী গান থামাল, কী যেন বলল, হৈমন্তী অন্যমনস্কতাহেতু শুনতে পেল না। অন্ধকারে কোথাও কিছু উড়ে গেল, কোনও পাখি, সে বারান্দায় উঠে এল।

মালিনী অল্প তফাত থেকে বলল, বৃষ্টি বাদলার দিনে অন্ধকারে মাঠে অত ঘুরবেন না, হেমদি।

 হৈমন্তী কোনও জবাব দিল না।

ঘরের দরজায় শিকল তোলা ছিল, খুলে ভেতরে এল হৈমন্তী। লণ্ঠন জ্বলছে মিট মিট; সবই অস্পষ্ট। জানলার কাছে এসে দাঁড়াল, তারপর বিছানায় গিয়ে বসল; শেষে গা এলিয়ে বিছানার পাশে পা রেখে শুয়ে পড়ল।

সুরেশ্বর এ-রকম ছিল না। বড় বেশি রকম পরিবর্তন হয়েছে। স্বাভাবিক পরিবর্তন নয়, অস্বাভাবিক। হৈমন্তী এতটা কল্পনা করেনি, চিন্তাও করেনি। আজ সুরেশ্বরকে দেখলে বা তার কাছাকাছি বসলে হৈমন্তীরই সন্দেহ হয়, ওই মানুষটি এক সময় দিবারাত্র হেম হেম করেছে কি না! তখন মনে হত, হেম ছাড়া সুরেশ্বর কিছু ভাবতে পারে না।

হৈমন্তীর বুকের তলায় সব যেন আস্তে আস্তে অসাড় হয়ে আসছিল, এবং অদ্ভুত এক শূন্যতা সৃষ্টি হচ্ছিল। এই শূন্যতা এত বেশি রকম নিজস্ব যে একমাত্র অস্পষ্টভাবে অনুভব করা যায় মাত্র, বলা যায় না, চিন্তা করা যায় না।

কিশোরী বয়স থেকে হৈমন্তী সুরেশ্বরকে দেখছে। তখন সুরেশ্বরর বয়স কম ছিল, সমস্ত চেহারার মধ্যে অত্যন্ত স্বচ্ছ নির্মল এক সৌন্দর্য যেন মাখানো থাকত, দেখতে ভাল লাগত, মন প্রসন্ন হত। চরিত্রে কোথাও এমন এক মিষ্টতা ছিল সুরেশ্বরের যা সকলকেই আকর্ষণ করত আনন্দ দিত। মামা ঠাট্টা করে বলতেন, ছোকরা সুর অসুর নয়–একেবারে সুরাসুর।

সুরেশ্বর পুরোপুরি সুপুরুষ ছিল না। তবে সুদর্শন ছিল। ওর মা অসামান্য সুন্দরী ছিলেন। মার সেই রূপ সুরেশ্বর পায়নি, মুখের সৌন্দর্যমাত্র পেয়েছিল। যেন ওর মা ইচ্ছাকৃতভাবে সন্তানকে নিজের সবটা দিতে চাননি, দিলে সুরেশ্বরের অমঙ্গল হত। বাবার মতনই ময়লা রং পেয়েছিল ও; বাবার মতনই মাথায় কিছুটা খাটো ছিল, দোহারা গড়ন। নিতান্ত পুরুষ বলে সুরেশ্বরের মুখে সৌন্দর্য ছিল, লাবণ্য ছিল না। লাবণ্য থাকলে তাকে মেয়ে বলেও মনে হতে পারত। জোড়া ভুরু, টলটলে দুটি চোখ, মণি ঈষৎ নীলচে, কোমল, নিবিড় দৃষ্টি, নিখুঁত দুটি ঠোঁট। সুরেশ্বরের তখন যৌবন। সুরেশ্বর সামনে এলে হৈমন্তীর মনে হত, খোলা জানলা দিয়ে যেন আলো বাতাসভরা এক সকাল এসেছে।

সেই সুরেশ্বর দেখতে দেখতে বয়সের বাহ্য চাঞ্চল্য কাটিয়ে উঠল। হৈমন্তীও কিশোরী বয়স উত্তীর্ণ হয়েছে। সুরেশ্বরের সঙ্গে তাদের পারিবারিক সম্পর্ক যা সেটা নিকট আত্মীয়তার নয়; হৈমন্তীর মা দূর সম্পর্কে সুরেশ্বরের মার বোন হতেন। যোগাযোগও বড় একটা ছিল না শেষের দিকে। থাকার কথাও নয়। হৈমন্তীরা কলকাতায়, সুরেশ্বরের মা দেশের বাড়িতে।

তা ছাড়া উনি ততদিনে মারাও গেছেন। মার কাছে শুনেছে হৈমন্তী, মৃত্যুটা নাকি স্বাভাবিক ছিল না। সুরেশ্বরের যখন বছর ত্রিশ বয়েস ওর বাবাও মারা গেলেন। হৈমন্তীদের কলকাতার বাড়িতে সুরেশ্বরের আসা-যাওয়া তখন থেকেই বাড়ে, তার আগে কলেজে পড়ার সময় কয়েক বছর নিয়মিত আসা-যাওয়া করলেও মধ্যে কয়েক বছর সুরেশ্বর তেমন আসেনি, তখন সে কলকাতায় থাকত না। বলতে গেলে হৈমন্তী প্রথম কৈশোরে কিছু দিন সুরেশ্বরকে বাড়িতে আসতে যেতে দেখেছিল, তারপর দেখল বছর পাঁচ পরে, যখন সে কৈশোর উত্তীর্ণ হয়ে যৌবনে পা দিয়ে দাঁড়িয়েছে। আগের দেখাটা তেমন যদি নাও হয়, তবে বিরতির পর নতুন করে সুরেশ্বরকে দেখাটা হঠাৎ যেন কিছু আবিষ্কারের মতন। তখন যে কী হয়েছিল আজ আর তা মনে করতে পারে না হৈমন্তী, শুধু মনে পড়ে নিজের শরীরের ছায়া যেমন সর্বক্ষণের সঙ্গী, সুরেশ্বরের চিন্তাটাও তেমনই তার চেতনা-অর্ধচেতনার মধ্যে সর্বদা বিরাজ করত।

তারপর যা ঘটল সেটা যেন বজ্রপাত। কোথাও কোনও মেঘ না, আভাস নয়, জ্বর গায়ে ব্যথা যন্ত্রণা নিয়ে শুয়ে হৈমন্তী হঠাৎ একদিন মাঝরাতে ঘুম ভেঙে বসে কাশতে কাশতে রক্তবমির মতন রক্ত ফেলল। তারপর অল্প অল্প। ডাক্তার মুখ ভার করল। মামা বেচারি ভয়ে ভাবনায় নীল। মা সারাক্ষণ বিছানার পাশে বসে। সুরেশ্বর ছিল, ছোটাছুটি শুরু করল।

তিন চারটি সপ্তাহ সবাই উদ্বেগের মধ্যে বসে থাকল। কী হয়েছে সঠিক করে বলার সাহস যেন কারও নেই। শেষে বোঝা গেল ব্যাধিটা রাজব্যাধি। বড় ভাইচা বাগানে চাকরি করত, বিয়ে করেছিল চার-আনি মেমসাহেব। মনি-অর্ডারে শদুই টাকা পাঠিয়ে কর্তব্য শেষ করল। অন্য ভাই ছোট, স্কুলে পড়ে। মামার উপার্জনেই সংসার চলত। বিয়ে-থা করেননি মামা। কিন্তু তাঁর উপার্জন এত নয় যে, ডাক্তারদের পরামর্শ মতন রাজচিকিৎসা হতে পারে।

এ-সময় যা করার সুরেশ্বরই করেছিল। বল, ভরসা, আশা বলতে সে ছিল বারো আনা। প্রথমে বাড়িতে সাময়িক চিকিৎসা, বাইরের হাসপাতালে দেড় বছর, আবার বাড়ি, শেষে কিছুদিন ঘাটশিলায় থেকে তবে হৈমন্তী মুক্তি পেল।

এই ব্যাধি হৈমন্তীকে দুটো জিনিস দিয়েছিল: সুরেশ্বরের প্রতি অসীম কৃতজ্ঞতা ও প্রেম, আর সে অনুভব করেছিল সংসারের আর পাঁচটা সাধারণ মেয়ের মতন কর্মক্ষম না হতে পারলে তার হীনতাবোধ সে অতিক্রম করতে পারবে না।

সুরেশ্বর বলল, ডাক্তারি পড়তে। এক সময়ে হৈমন্তীর ওটা সাধ ছিল। পড়ার কথা উঠলে মা আপত্তি করল। মামাও সন্দেহও করল শরীরে কুলোবে কি না। যে ডাক্তার হৈমন্তীকে সাময়িক চিকিৎসা করেছিলেন তিনি বললেন, চমৎকার পারবে। না পারলে আত্মবিশ্বাস হারাবে, পারলে তুমি জিতে গেলে। তা ছাড়া তোমার শরীর তো চমৎকার হয়েছে।

হৈমন্তী জীবন ফিরে পেয়ে তাকে পুনৰ্ষত করতে চায়নি; আবার এখন ঠিক ডাক্তারি পড়তেও নয়, অন্য কিছু হলে ভাল হত। সুরেশ্বরের আগ্রহে সে ডাক্তারি কলেজে ভরতি হল। যেন সুরেশ্বরের মনোবাসনা বা শখ পূর্ণ করাতেই সে বাধিত হবে।

অসুস্থতার দু-আড়াই বছর হৈমন্তী যে সুরেশ্বরকে দেখেছে সে সুরেশ্বর হৈমন্তীর নিকটাত্মীয়েরও অধিক। সুরেশ্বরের জীবন যেন তার মরা বাঁচার ওপর নির্ভর করেছে। হেম বেঁচে থেকে সুরেশ্বরকে বাঁচিয়ে রেখেছে, সুরেশ্বরও হেমের আয়ু-দীপ হয়ে থেকেছে।

হেম, তুমি সবসময় বাঁচার ব্যাকুলতা নিয়ে বাঁচবে, ব্যাকুলতা ছাড়া বাঁচা যায় না। ..হেম মনে কখনও সন্দেহ এনো না সন্দেহ করে বাঁচা যায় না। সুরেশ্বর এই সব বলত, চিঠিতে লিখত। ছুটে ছুটে দেখতে যেত হাসপাতালে অশেষ কষ্ট করে, বলত: দুর…একটা রাত জাগা কি কষ্ট নাকি! তোমাকে দেখতে আসছি ঘুমটুম চোখের দশ হাত দূরে থাকে। বা, অনেক ইম্প্রভ করেছ। মার্ভেলাস!

ঘাটশিলায় বাড়ি নিয়ে থাকার সময় মা ছিল, আর সুরেশ্বর। শীতের সকালে গরম কাপড়ে সতর্কে ও সাবধানে হৈমন্তীকে ঢেকে নিয়ে সুরেশ্বর বেড়াতে যেত। দুপুরে গ্রামোফোন বাজিয়ে শোনাত, গল্পের বই পড়ত, বিকেলে আবার বেড়াতে নিয়ে যেত, সন্ধেবেলায় কত রকম গল্প। এই সাহচর্য এবং সঙ্গ এত অন্তরঙ্গ ও উষ্ণ ছিল যে, হৈমন্তীর মনে হত তার বসনে, অঙ্গে, হৃদয়ে এবং ত্বকেও যেন সুরেশ্বরের সর্বক্ষণ স্পর্শ আছে।

হৈমন্তী যখন আর অসুস্থ নয়, রাহুমুক্ত, জীবনের স্বাদ উপভোগ করে প্রতিনিয়ত সুখী, নির্ভার, নিশ্চিন্ত, ডাক্তারি কলেজে পড়তে ঢুকেছে তখনও সুরেশ্বরকে দেখে বোঝা যেত না তার দিক থেকে হৈমন্তীর প্রতি কোনও উপেক্ষা আছে।

ডাক্তারি পড়ছে যখন হৈমন্তী-মাঝামাঝি–তখন সুরেশ্বর কলকাতা ছাড়ল। বলল, একটু বেড়িয়ে আসি। মাস দুই পরে ফিরল, তারপর আবার বাইরে গেল, বলল: একটা কিছু করব ভাবছি, দেখি। কলকাতা আর ভাল লাগছে না। তখন থেকেই সুরেশ্বর কেমন যেন। আসে, আবার চলে যায়। চাকরি বাকরিতে ওর কোনওকালেই গা ছিল না। কখনও এটা করত, কখনও সেটা।

এই যে সুরেশ্বর কলকাতা ছেড়ে উধাও হত, দুচার ছ মাস আর আসত না, কিন্তু যোগাযোগ নষ্ট করত না। চিঠিপত্র লিখত। হৈমন্তী এটা পছন্দ করত না। সুরেশ্বরের অদর্শন প্রথম প্রথম তাকে ব্যথিত ও চিন্তিত করত। পরে সহ্য হয়ে গেল। পড়া প্রায় শেষ হয়ে এসেছিল, ছেড়ে দিতেও ইচ্ছে হত না, অথচ যার জন্যে এত আগ্রহ করে পড়া সে কাছে না থাকায় মন বিমর্ষ থাকত।

ডাক্তারি পাশ করার পর সুরেশ্বর আবার তাকে চোখের ডাক্তারি পড়ে নিতে লিখল। নিজেও এসেছিল একবার। হৈমন্তীর আর ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু সুরেশ্বরের অনুরোধ ও ইচ্ছা সেনা রেখেও পারল না। ততদিন সুরেশ্বর গুরুডিয়ায় এসে বসেছে। হৈমন্তীকে তার প্রয়োজন ছিল।

হৈমন্তী ভেবেছিল, সে সুরেশ্বরের সমস্ত ইচ্ছা পূর্ণ করেছে, সুরেশ্বরও তার ইচ্ছা পূর্ণ করবে। কেন যে, আজকাল তার দ্বিধা এসেছিল, মনে হত সেই সুরেশ্বর–যে তাকে মৃত্যু থেকে জীবনে ফিরিয়ে এনেছে বিস্বাদ, বিবর্ণ, মুখে-মাছি বসা এক জগৎ থেকে–সে যেন আড়ালে কোথাও সরে যাচ্ছে। হৈমন্তীর এটা সহ্য হত না। মা বুঝতে পেরেছিল, সুরেশ্বরকে আর অকারণ কাছে টানার চেষ্টা। হৈমন্তী বোঝেনি, বুঝতে রাজি হয়নি। একরকম বেপরোয়া হয়ে, এবং কিছুটা আশা নিয়েই হৈমন্তী এসেছিল এখানে এসে দেখেছে, সুরেশ্বর অন্য মানুষ।

নিজের জীবনের জন্যে হৈমন্তী সুরেশ্বরের কাছে এত বেশি রকম কৃতজ্ঞ যে, কখনও ওই মানুষটিকে সে বেদনা দিতে চায়নি। এখনও চায় না। সুরেশ্বরকে আঘাত করলে বা তাকে পরিত্যাগ করলে সুরেশ্বর সহ্য করে নেবে, কিন্তু হৈমন্তীর মর্যাদা থাকবে না। সুরেশ্বর তাকে সমস্ত দিক থেকে ছোট, হীন করতে পারে না। যদি এমন হয়, সুরেশ্বর তার প্রতি করুণা করে এসেছে, যদি এমনও হয় যে সুরেশ্বর যে সাহায্য হৈমন্তীকে করেছিল আজ তার প্রতিদান চাইছে মনে মনে–তবু হৈমন্তী সুরেশ্বরকে এই মর্যাদার প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে যেতে দেবে না। তুমি মহানুভব, উদার; আমি স্বার্থপর, ঋণী, প্রবঞ্চক–এই অহঙ্কার যেন তোমার না থাকে।

হৈমন্তী শুয়ে শুয়ে অনুভব করল দমকা প্রবল বাতাসে তার জানলার পরদা ফুলে উঠেছে, শব্দ হচ্ছে, যেন হঠাৎ পরদাটা ছিঁড়ে গিয়ে অবরুদ্ধ বাতাস ঘরে ঢুকে সব তছনছ করে দেবে।

.

০৫.

পথের মধ্যে দাঁড়িয়ে না থেকে হৈমন্তী একা একাই ধীরে ধীরে হেঁটে যাচ্ছিল। তার হাতে সামান্য কটা জিনিসপত্র, বাকি সবই মালিনীর কাছে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে অল্প একটু এসেই মালিনীর কী যেন হল, অপ্রতিভ মুখে বলল: আমায় একবার বাড়ি যেতে হবে হেমদি; আপনি বেড়াতে বেড়াতে এগোন, আমি আসছি।

আশপাশ দেখতে দেখতে হৈমন্তী এগোচ্ছিল। বেশ লাগছে চোখে। পাথর বাঁধানো রাস্তা, দু ধারে অনেকটা তফাতে তফাতে কাঠের খুটির মাথায় ইলেকট্রিক তার টেনেছে, গাছগাছালিও কম নয়, পথের দু দিকেই ছাড়া ছাড়া বাড়ি, খোলামেলা, বাগান-টাগান আছে, খুব শৌখিন বাড়িগুলো একেবারে ফাঁকাফটক বন্ধ; নানারকম নাম। ছোটখাটো বাড়িগুলোতে মানুষজন আছে।

পাড়াটা খুবই ভাল, মালিনীদের বাড়ি অবশ্য খানিকটা পিছিয়ে, সদর রাস্তা থেকে চার পাঁচটা বাড়ি ভেতরে। এক সময় মালিনীর বাবা যখন বাড়ি করেছিলেন তখন নাকি এখানে লোক আসত না, তারপর হুড়মুড় করে কত পয়সাঅলা লোক এসে গেল, বাড়ি করল, ফেলে রাখল, ছুটিছাটায় আসা-যাওয়া করতে লাগল। কে জানত বলুন হেমদি, শেয়াল রাজার এত বড় লেজ গজাবে। …তবু রক্ষে বাবা এই মাথাগোঁজার জায়গাটুকু করেছিল, নয়তো আমরা রাস্তায় দাঁড়াতাম। কথাটা ঠিকই বলেছে মালিনী; হোক না কেন দু খুপরির ঘর, শ্যাওলা ধরা চেহারা, চিটদেওয়াল টালিছাওয়া বাড়ি–তবু তো বেচারিদের মাথা গোঁজার আশ্রয়। এই আশ্রয় ওদের কাছে কতটা তা ওরাই বোঝে।

রাস্তাটা ভাল, কিন্তু ধুলো ওড়ে বড়। এলোমেলো, ঘোট ঘোট ঘূর্ণি বাতাসে মাঝে মাঝে ধুলো উড়ছিল। হৈমন্তী নাকেমুখে রুমাল চাপা দিল না। কেন যেন ধুলোর গন্ধটা তার ভালই লাগছিল। শৌখিন বাড়িগুলোর ফটকে মাধবীলতা, জুই, আরও কত লতাপাতা। এক বাড়ির গেটের দুপাশে ইউক্যালিপটাস গাছ। লিকলিকে চেহারা, সোজা উঠে গেছে। হৈমন্তী গাছ দুটোর গা মাথা দেখতে গিয়ে আকাশ দেখল। চমৎকার এক টুকরো লাল মেঘ, হাঁসের মতন গড়ন। যেন পাখা গুটিয়ে ভাসতে ভাসতে চলেছে।

আরও কয়েক পা এগিয়ে এসে হৈমন্তীর হঠাৎ নজরে পড়ল, তার খুব কাছাকাছি, মুখোমুখি এক ভদ্রলোক, তার দিকে তাকিয়েই এগিয়ে আসছেন।

চেনা, নাকি চেনা নয়, কোথায় যেন দেখেছি, চোখ এবং স্মৃতি অকস্মাৎ ঘোলাটে হয়ে আবার পরিষ্কার হয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে হৈমন্তী থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। উলটো দিকের ভদ্রলোকও মুখের সামনে।

ঈষৎ বিমূঢ়তা এবং অস্বস্তি যেন উভয়পক্ষই অনুভব করল।

 আপনি! অবনী বিস্মিত হয়ে বলল।

হৈমন্তীর তখনও পুরোপুরি বিমূঢ়তা কাটেনি। ইতস্তত ভাব করল। এই তো 

এদিকে কোথায়? অবনী স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল।

একজনের সঙ্গে এসেছিলাম– হৈমন্তী ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনের দিকে দূরের পানে ইঙ্গিত করল; তারপর হাসবার মতন মুখ করে বলল, একটু কাজে সে বাড়ি গিয়েছে, আসবে এখুনি। …আপনি এখানে?

অবনী হাত বাড়িয়ে রাস্তার পাশে একটা বাড়ি দেখাল, বলল, আমার বাড়ি। অফিস থেকে ফিরছি।

হৈমন্তী মুখ ফিরিয়ে বাড়িটা দেখল। একেবারে তার ডান পাশে। বাগান খানিকটা, তারপরই বাড়ি, বারান্দা দেখা যাচ্ছে।

হৈমন্তী কী বলবে ঠিক করতে না পেরে সাধারণ আলাপ করার গলায় বলল, এদিকে বেশ ভাল ভাল বাড়ি দেখছি।

তা দেখবেন। কিছু পয়সাঅলা লোক আছে, বাড়ি করে রেখেছে, এখানে থাকে না, ছুটিতে আসে। …তবে, এদিকের অ্যারিসট্রোকেট পাড়া ওপাশে, কলকাতা-পাটনার ধনী ব্যক্তিদের ব্যাপার… অবনী হাসির মুখ করল। কী ভেবে লঘু সুরে অবনী আবার বলল, আমি কিন্তু বাড়ির মালিক নই, ভাড়াটে।

হৈমন্তী কিছু বলল না, হাসল।

অবনী সামান্য অপেক্ষা করে আবার বলল, কেমন লাগছে নতুন জায়গা?

তাকাল হৈমন্তী, অবনী নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে আছে, দৃষ্টিটা কৌতূহলের না কৌতুকের ঠিক বোঝা যায় না। মন্দ না।

বাইরে থেকে এসে প্রথম প্রথম ভালই লাগে—

 হ্যাঁ, খুব ফাঁকা। জঙ্গলই প্রায়।

আপনাদের আশ্রম তা হলে ভালই চলছে! অবনী ঠাট্টা করছে কি না বোঝা গেল না।

 চলছে হৈমন্তী সসঙ্কোচে হাসল সামান্য; আপনি তো কই আর এলেন না?

অবনী কিছু বলতে যাচ্ছিল, সংযত হল; বলল, যাব একদিন। সুরেশ্বরবাবুর নেমন্তন্ন আছে।

 হৈমন্তী পিছন দিকে তাকাল। মালিনীর এখও দেখা নেই। কী যে করছে কে জানে।

অবনী লক্ষ করল: হৈমন্তী সামান্য অধৈর্য হয়ে উঠেছে। বলল, আমার বাড়িতে বসবেন খানিক? 

না না, থাক; অন্য একদিন বসব। …বেড়াতে আমার ভালই লাগছে।

এভাবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা যায় কতক্ষণ। অবনী বলল, চলুন তা হলে আপনাকে খানিকটা এগিয়ে দিই।

থাক না…আপনি অফিস থেকে ফিরছেন আবার এখন কষ্ট করে. হৈমন্তী আপত্তি জানাবার চেষ্টা করল।

কী আর কষ্ট, চলুন, আস্তে আস্তে হাঁটি–ততক্ষণে আপনার সঙ্গী এসে পড়বে। হাঁটতে হাঁটতে আবার বলল, কে এসেছে সঙ্গে–?

একটি মেয়ে, ওখানেই থাকে, বাড়ি এখানে।

অবনী তেমন কোনও মেয়েকে খেয়াল করতে পারল না। সুরেশ্বরের কি একটা নারী-আশ্রমও আছে নাকি? অবনী মনে মনে কৌতুক বোধ করল।

হৈমন্তী হঠাৎ শুধোল, আপনি এখানে অনেক দিন থেকেই আছেন?

 না; দু বছর।

 তবে তো অল্প দিনই। …কেমন লাগে আপনার?

খারাপ কী!

হৈমন্তী মুখ ফিরিয়ে অবনীকে লক্ষ করবার চেষ্টা করল। শেষে বলল, এদিকটা মন্দ নয়; লোকজন, হাটবাজার, আলো বেশ শহর-শহর ভাব। আমাদের ওদিকটায় একেবারে চুপচাপ। কলকাতা থেকে এসে মনে হয়, জলে পড়ে গিয়েছি! হৈমন্তীর হাসল।

অবনী হৈমন্তীকে দেখতে চাইল। এই আলোয় তেমন করে হৈমন্তীর চোখ দেখা যায় না। অবনী বলল, কোথায় থাকতেন কলকাতায়?

ভবানীপুর। …আপনিও কি কলকাতায়…

 বাদুড়বাগানে। অবনী হাসল হঠাৎ, তারপর বলল, প্রায় বাদুড়ের মতনই।

হৈমন্তী কিছু বুঝল না, কিন্তু অবনীর হাসিটা কানে লাগল। কিছু না বুঝেও কেমন হাসির মুখ করল হৈমন্তী।

চুপচাপ আরও কয়েক পা এগিয়ে এসে অবনী বলল, আপনার ডাক্তারি কেমন চলছে?

এবারে হৈমন্তী হেসে ফেলল। অবনী এমন ভাবে কথাটা বলেছে যেন মনে হয় হৈমন্তী সদ্য একটা ডিসপেনসারি খুলে বসেছে। হৈমন্তী বলল, এখনও হাতযশ হয়নি।

অবনী বোধ হয় বুঝতে পারল, বুঝতে পেরে হালকা গলায় হাসল।

হৈমন্তী বেশ সপ্রতিভ হয়ে উঠেছিল। বলল, ডাক্তার উকিলদের কেমন পশার তা নাকি রুগি আর মক্কেলদের জিজ্ঞেস করতে হয়। আমার তো পশার নেই।

ছুটতে ছুটতে মালিনী এসে পড়েছে ততক্ষণে। এসে অবনীকে দেখে বোকা হয়ে গেছে যেন।

 হৈমন্তী বলল, এতো দেরি তোমার!

মালিনী আড়ষ্ট, কোনও কথা বলল না। অবনী মালিনীকে দেখল। দেখা মুখ।

 বাস পাব তো? হৈমন্তী শুধোল।

মাথা হেলিয়ে মালিনী জানাল, হ্যাঁ–পাওয়া যাবে।

অবনী ঘড়ি দেখল হাতের, এখনও মিনিট পনেরো আছে। তাড়াতাড়ি যান–পেয়ে যাবেন। আচ্ছা–

হৈমন্তী চঞ্চল হয়ে উঠল। অবনীর দিকে চকিতে তাকাল, আসবেন একদিন।

 অবনী মাথা হেলিয়ে হাসল। যাব।

এগিয়ে এসে মালিনী সবিস্ময়ে শুধোল, ওঁকে আপনি চেনেন, হেমদি?

 হৈমন্তী মালিনীর মুখ লক্ষ করল। হ্যাঁ, ওঁর গাড়িতেই আমরা সেদিন গিয়েছিলাম। কেন?

মালিনী জানে হেমদিরা প্রথম যেদিন আশ্রমে আসেন গাড়ি করেই এসেছিলেন। বাস খারাপ হয়ে যাবার গল্পও সে শুনেছে। কিন্তু জানত না অবনীর গাড়িতেই হেমদিরা এসেছিলেন। সে কাছে ছিল না, অবনীকেও দেখেনি।

মালিনী বলল, আমার ভাই ওঁর অফিসে চাকরি করে।

ও! হৈমন্তী বুঝতে পারল।

 খানিকটা এগিয়ে এসে মালিনী বলব কি বলবনা করে আবার বলল, লোক কিন্তু ভাল না।

 হৈমন্তী মুখ ফেরাল।

খুব মদটদ খায়.. মালিনী বলল।

মালিনীর মুখ দেখছিল হৈমন্তী, যেন তার চোখ বলছিল: কী করে জানলে তুমি?

 মালিনী গলা একটু নামিয়ে বলল আবার, বাড়িতে একলা থাকে।

মালিনীর গলার স্বরে এমন এক ইঙ্গিত ছিল যা কানে খারাপ লাগে। হৈমন্তী হঠাৎ কেমন বিরক্তি বোধ করল মালিনীর ওপর, অসন্তুষ্ট হল।

ভর্ৎসনার মতন করে হৈমন্তী বলল, পরচর্চা করতে হবে না এখন, চলো।

মালিনী চুপ করে গেল।

.

সন্ধের পর বিজলীবাবু এলেন। এই সময়টা তাঁর পক্ষে সাইকেল নিয়ে ঘুরে বেড়াবার উপযুক্ত সময় নয়। যেদিনই আসেন হেঁটে আসেন, হেঁটেই ফেরেন।

হাতে কাগজে মোড়া একটা প্যাকেট, দেখলে মনে হয় কোনও জিনিস কিনে ফিরছেন। বাগানটুকু পেরিয়ে বারান্দায় ওঠার আগে বিজলীবাবু সিঁড়ির পাশের বেলঝাড় থেকে কয়েকটা বেলফুল তুলে নিলেন, তুলে ফুলের গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে বারান্দায় এসে ডাকলেন–মিত্তিরসাহেব।

অবনী বেরিয়ে এল। আরে, এই যে আসুন–!

বিজলীবাবু ডান হাতের মুঠো থেকে বেলফুল দেখালেন। আপনার বাগানের বেলিফুলের খাসা গন্ধ তো, মিত্তিরসাহেব। মাটিতে কিছু দেন নাকি? বিজলীবাবু ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি হাসলেন। যাবার সময় আরও কটা নিয়ে যাব। আমার দ্বিতীয়টির আবার লুকিয়েচুরিয়েও দু-চারটে বেল মাথায় গোঁজার শখ এখনও আছে।

অবনী হেসে ফেলল। যাবেন; পুরো বেলগাছটাই উপড়ে নিয়ে যেতে পারেন। বিজলীবাবু মজার মুখ করে মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, আমার বাড়ির মাটিটা তেমন সরেস নয় বুঝলেন মিত্তিরসাহেব, রসের মাটি থেকে দু-চারটে ফুলই ভাল।

হাসতে লাগল অবনী। বিজলীবাবুও হাসলেন।

অবনী বলল, চলুন, বসা যাক।

মধ্যের ঘর দিয়ে পাশের এক ঘরে এল অবনী। ছোট, চৌকো ঘর; দুদিকে জানলা। বাতি জ্বলছিল। বসার জন্যে নিচু, গোটা তিনেক চেয়ার, এক পাশে কালো রঙের এক আর্মচেয়ার, একটা গোল সেন্টার টেবিল। একদিকে কাঠের ছোট একটি দেরাজ, বেতের বুককেসে কিছু এলোমেলো বই, দেওয়ালে একটি ক্যালেন্ডার।

ঘরে আসবাবপত্র যা আছে তা সামান্য হলেও এই ঘরের পক্ষে যথেষ্ট। অবনীর এটা ঠিক বসার ঘর নয়, অবসর সময় কাটানোর নিভৃত ঘর। পানাদি এই ঘরে বসেই করে থাকে অবনী।

বিজলীবাবু বসলেন। হাতের প্যাকেটের কাগজ খুললেন, একটা ভোয়ালে; তোয়ালে জড়ানো নতুন বোতলটি তিনি অবনীর দিকে বাড়িয়ে দিলেন। গয়া থেকে আনিয়েছি। …এ-সব জিনিস, বুঝলেন মিত্তিরমশাই, কখনও-সখনও এদিকে দু-একটা পাওয়া যায়। একেবারে গলা কেটে দাম নেয় বেটারা।

অবনী দেখল। হুইস্কি: ডিমপল স্কচ। বলল, ভাল জিনিস।

 কুলীন।

বসুন, সোড়া আছে বোধ হয় দেখছি– অবনী চলে গেল।

 বিজলীবাবু সিগারেট ধরিয়ে এপাশ-ওপাশ তাকালেন। একটা বই পড়ে ছিল, উঠিয়ে নিয়ে দেখলেন, রেখে দিলেন। ইলাস্ট্রেটেড উইকলির পাতা ওলটাতে লাগলেন বিজ্ঞাপনের মেয়েদের ছবি দেখলেন খুঁটিয়ে। চশমা খুলে মুছে নিলেন।

খেতে খেতে বিজলীবাবু বললেন, আরে, আপনাকে তো আসল খবরটা দিতেই ভুলে গিয়েছি, মিত্তিরসাহেব। …আজ কার দর্শন পেলাম বলুন তো?

কার–? অবনী সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাল।

সেই চোখের ডাক্তারনির…। এদিকে এসেছিল। ফিরছে। বাসে চাপল।

 আমার সঙ্গে দেখা হয়েছে। অবনী বলল।

তাই নাকি? কোথায় দেখলেন? বিজলীবাবু উৎসাহ অনুভব করলেন।

রাস্তায়। বাড়ির কাছেই। …অফিস থেকে ফিরছিলাম, দেখা হল। …এদিকের একটি মেয়ের সঙ্গে এসেছিল।

মালিনী। …আরে, ওই তো প্রণবকুটিরের পাশ দিয়ে যে গলিমতন রাস্তাটা নেমে গেছে তার মধ্যে থাকে; শশধর বাঁড়ুজ্যের মেয়ে। বাপ মরে গেছে কবে। ওর ভাইটা তো আপনার অফিসে কাজ করে।

কে?

কেষ্ট। ভাল নামটা যেন কী..অনাদি-টনাদি হবে।

অবনী চিনতে পারল।

 বিজলীবাবু বললেন, মেয়েটা সুরেশমহারাজের আশ্রমে থাকে আজকাল। বলে একটু থেমে অবনীর দিকে তাকিয়ে আবার বললেন, আপনাকে একবার বলেছিলুম মিত্তিরসাহেব, একটি মেয়ে দিচ্ছি রাখুন রান্নাবান্না করবে, ঘরদোর দেখবে…তা আপনি রাজি হলেন না। রাখলে আরামই পেতেন। ওই মেয়েটির কথা ভেবেই বলেছিলাম।

অবনী বিজলীবাবুর চোখ এবং মুখ দেখল।

বিজলীবাবু অপ্রতিভ হলেন না, বললেন, ওই সব মেয়ে, দেখতে দেখতে বর্ষার কলাগাছ হয়ে উঠেছে। বিজলীবাবুর চোখের তারা চিকচিক করে উঠল। ফেমিনাইন জেন্ডারের ওপর তেমন ভক্তি নেই কেন, মিত্তিরসাহেব?

অবনী কৌতুক অনুভব করল। বিজলীবাবু বরাবরই শব্দটা ওইভাবে বলেন। মাঝে মাঝে কথাটা জিজ্ঞেসও করেন। অবনীর ব্যাপারে তাঁর কোথাও যেন এক ধরনের কৌতূহল ও অবিশ্বাস রয়েছে। বিজলীবাবুর কাছে অবনী নিজের পারিবারিক পরিচয়টা এমনভাবে দিয়েছিল যাতে বিজলীবাবু কোনও কিছুই ঠিক মতন বুঝতে পারতেন না।

অবনী পাত্রটুকু শেষ করল। চাপা হাসি মুখে বলল, আপনার কী মনে হয়?

পাঁচ রকম সন্দেহ হয়

যেমন! অবনী সিগারেট ধরাল।

 বিজলীবাবু মাথা নিচু করে অভ্যস্ত হাতে উভয়ের পাত্রে হুইস্কি ঢাললেন মাপমতন। সোড়া মেশাতে মেশাতে বললেন, কোথাও কোনও ব্রেকডাউন আছে নাকি?

অবনী হাসল। জোরে নয়।

অসুখ-বিসুখও তো আপনার থাকার কথা নয়। বিজলীবাবু এক টুকরো ওমলেট, কয়েকটা আদার কুচি মুখে দিলেন, দিয়ে চিবোতে লাগলেন। বিজলীবাবুর ধারণা, ডিমে উত্তেজনা বৃদ্ধি হয়।

অবনী অনেকটা ধোঁয়া গলায় টেনে নিল।

বিজলীবাবু বললেন, অনেকে শুদ্ধাচারী থাকতে ভালবাসে, সাধুসম্নেসী মানুষ-টানুষের কথা বলছি। তারা, মিত্তিরসাহেব, ব্রেহ্মচারী, বেটাদের সব তাতেই পাপ পাপ ভাব। …আরে–মুখ্য পাপ কীসের? পাপটা তুই দেখলি কোথায়? নপুংসক হয়ে জন্মেছি নাকি জগতে। বলবে, লালসা…। আলবাৎ লালসা. দেহের লালসা সখি পাপ বলে গণ্য করে যারা–একথা কি ভুলে যায় তারা সেলালসা সৃজিয়াছে নিজে ভগবান…।

বিজলীবাবু ওমর খৈয়ম আওড়াতে শুরু করেছেন। লালসা পাপ কি না বলা যায় না। তবে, অবনী ভাবল, লালসাও শেষ পর্যন্ত থাকে কোথায়? ভাবতে গিয়ে পানীয়ে তেমন জুত করে চুমুক দিতে না পেরে কেমন অস্বস্তি অনুভব করল।

মানুষের ইন্দ্রিয়গুলো কি বাক্সে তুলে রাখবার জিনিস, মিত্তিরসাহেব? বিজলীবাবুবড় করে একটা চুমুক দিলেন, দিয়ে সিগারেট ধরালেন, দেশলাই কাঠি কানে দিয়ে সুড়সুড়ি দিতে দিতে বললেন, মুখ, শালারা সব মুখ। আমি বোকা নয়, গাধার বাচ্চা নই। মুখ্যরাই এ জগতের মর্ম বোঝে না। আমার স্ট্রেট কথা, যে কদিন বেঁচেবর্তে থাকব, আমি শালা রাজার মতন থাকব। চোখ বুজলে কে কার আমাদের আসা-যাওয়া কে বা খোঁজ নেবে? সিন্ধুজলে বিন্দুসহ মিশে যাব সবে।

বিজলীবাবুর মুখের ভাবটা আস্তে আস্তে বদলে আসছে: ফরসা মুখের চামড়ায় সামান্য লালচে ভাব, কপালে কয়েক বিন্দু ঘাম, চোখ ঈষৎ অলস। চশমাটা তিনি খুলে ফেলেছেন।

অবনী হেসে বলল, ড্রিংক, ফর ওয়ানস ডেড, ইউ শ্যাল নেভার রিটারন…

উ… হ্যাঁ হ্যাঁ…নেভার রিটারন। মাথা ঝাঁকালেন বিজলীবাবু, ছেলেবেলায় পদ্য পড়েননি– সময় চলিয়া যায় নদীর স্রোতের প্রায়–যে জন না বোঝে তারে ধিক শত ধিক। আপনার সময় চলে যাচ্ছে…গ্রোয়িং ওলড়…; শেষ কালে আফশোস হবে মিত্তিরসাহেব।

আপনার কোনও আফশোস নেই?

 এমনিতে নেই, বিজলীবাবু হাত তুলে নাড়লেন। একটা প্রাইভেট আফশোস অবশ্য আছে: আমার ডান বাঁ দু দিকেই শূন্য কুম্ভ। বুড়ো আঙুল দিয়ে বিজলীবাবু তাঁর ডান বাঁ দেখালেন।

অবনী ঠিক বুঝতে পারল না, তাকিয়ে থাকল। জিবের স্বাদের জন্যে কয়েকটা ভাজা আলু মুখে দিল।

বিজলীবাবু হাত বাড়িয়ে দেশলাই তুলে নিলেন, চোখের পাতা আধবোজা করে হাসলেন, বউয়ের কথা বলছি। আমার দুটো বউই বাঁজা। পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যা। …আমার ভার্যাতে কিছছু হল না।

অবনী বিজলীবাবুকে দেখছিল: বোঝা যায় না তেমন তবু সন্দেহ হয় বিজলীবাবুর মনে গভীর একটি ক্ষোভ আছে। সহসা অবনীর চোখের সামনে কুমকুমের মুখ ভেসে উঠল, একমাথা চুল, রিবন বাঁধা, সামনের দাঁতটা পড়ে গেছে। মেয়েটা এখন আরও বড় হয়েছে, দাঁত উঠে গেছে এতদিনে।

বিজলীবাবু শুধোলেন, ভগবান-টগবানে বিশ্বাস আছে, মিত্তিরসাহেব?

অবনী যেন কুমকুমকে টুপ করে ডুবে যেতে দেখল। বিজলীবাবু সিগারেট ধরালেন আবার।

 দু-একটা জায়গায়– বিজলীবাবু বললেন, যা মারার–ওই ভগবান শালাই মারে।

অবনী একটু হাসার মুখ করল, করে তার গ্লাসের বাকি পানীয়টুকু শেষ করল।

 সামান্য সময় চুপচাপ। বাইরের জানলা দিয়ে বাতাস আসছে, মাথার ওপর পাখা চলছে, তবু গরম লাগছিল। বিজলীবাবু মুখ মুছলেন। চশমাটা পরলেন আবার। অবনীর চোখের তলা যেন ঈষৎ স্ফুরিত হয়েছে, সাদা জমিটা সামান্য লালচে। স্বেদ জমেছে মুখে।

অবনী উঠে গিয়ে পাখাটা বাড়িয়ে দিল। দিয়ে ভেতরে চলে গেল। সামান্য পরে ফিরল আবার। বিজলীবাবু চোখ বন্ধ করে কোনও পুরনো বাংলা গানের সুর আলাপ করার চেষ্টা করছিলেন গুনগুন করে। ফিরে এসে অবনী আবার দুজনের গ্লাস তৈরি করল।

বিজলীবাবু বললেন, কথায় কথায় আসলটাই ভুলে যাচ্ছি, মিত্তিরসাহেব। …ওই যে মেয়েটি চোখের ডাক্তার–ওঁর ব্যাপারটা কী?

কীসের ব্যাপার?

 এখানে এসে জুটল যে। সুরেশ-মহারাজের আত্মীয় নাকি?

জিজ্ঞেস করিনি।

 কী নাম?

 হৈমন্তী।

উপাধিটা কী?

 জানি না। …জিজ্ঞেস করিনি!

 কোথ থেকে আসা?

কলকাতা।

বিজলীবাবু কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ থেকে শেষে বললেন, একটু বয়েস হয়ে গেছে, তা হোক, চেহারাটা আছে। …বিয়েটিয়ে করেছে বলে তো মনে হল না।

অবনী মাথা নাড়ল, জানি না। বোধহয় না। …বিয়ে করলেও আজকাল অনেকে মাথায় সিঁদুর দেয় না। ব্রাহ্ম হতে পারে, ক্রিশ্চান হতে পারে। এরাও অনেকে সিঁদুর পরে না। অবনী পরিহাস করে বলল।

সুরেশ-মহারাজ পাকা হিন্দু। বিজলীবাবু যেন মনে মনে হিসেব করলেন, না, মহারাজজির স্ত্রী হলে সিঁদুরটা থাকত।

অবনী সিগারেট ধরাল। গা এলিয়ে বসে উলটো দিকের জানলার দিকে তাকিয়ে থাকল, বাইরে পেয়ারা ডাল নড়ছে অন্ধকারে, বারান্দার আলোর মৃদু আভায় ডালের কয়েকটি পাতা শাড়ির আঁচলের মতন মনে হচ্ছে।

বিজলীবাবু বললেন, শুনেছি আজকাল আশ্রমটাশ্রম করতে হলে একজন করে মা লাগে। সুরেশ-মহারাজ কি মা আমদানি করলেন…?

অবনী কোনও জবাব দিল না।

 উত্তরের অপেক্ষা করে শেষে বিজলীবাবু আবার বললেন, না–মিত্তিরসাহেব, আমাদের মহারাজজি আবার ও-সব সাধনাফাধনাও করে না। মা আমদানিই বা করবেন কেন!

অবনী এবার কথা বলল, সেবা-টেবা করতে এসেছে হয়তো। আপনার সুরেশ-মহারাজের ভক্ত।

ভক্তরাই সব লণ্ডভণ্ড করে দেয়। এ তো তারও বেশি–ভক্তি…। আপনার মতন মানুষ আর কটা পাবেন, ফেমিনাইন জেন্ডার বাদ দিয়ে চলে।

অবনী হেসে ফেলল। আপনার সুরেশ-মহারাজ কি মেয়েতে ভুলবে?

ভোলা উচিত নয়। …তবে দেবী কেমন তার ওপরেই দেবতার সেলফ কনট্রোল। এ তো আমার কথা নয়, শাস্ত্ৰতেই দেখুন–অমন বোমতোলা খেপা শিব–সেও উমাকে দেখে মজে গেল। দেবীতেই সৃষ্টি-দেবীতেই প্রলয়। কিছু বলা যায় না, এই দেবীটি সুরেশ-মহারাজের চোখ ফুটিয়ে দিতে পারে আবার বন্ধ করে দিতেও পারে।

অবনী চেয়ারের কাঁধে মাথা হেলিয়ে চোখের পাতা বন্ধ করল। মাথা ভারী হয়ে আসছে। বিজলীবাবুর কথায় হাসবার চেষ্টা করল, তেমন হাসতে পারল না।

রাত হয়েছে। বিজলীবাবু এইমাত্র চলে গেলেন। যাবার সময় তাঁর বেলফুলের কথা মনে থাকল না, অবনীরও নয়। ফটক পর্যন্ত বিজলীবাবুকে এগিয়ে দিয়ে অবনী ফিরল।

আজ একটু বেশি রকম খাওয়া হয়ে গিয়েছে, চোখে পরিষ্কার কিছুই দেখতে পাচ্ছিল না অবনী, ঝাপসা গাছপালা, বারান্দার একটু আলো, অভ্যস্ত পথে এলোমেলো হেঁটে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। ঠাণ্ডা বাতাসে দাঁড়াল সামান্য, পায়ে জোর পাচ্ছে না, হাত যেন কাঁপছে। সিগারেটের টুকরোটা অনাবশ্যক জোরে ছুঁড়ে ফেলে দিল। স্টেশনের দিক থেকে ভারী একটা শব্দ ভেসে আসছে মালগাড়ি চলে যাচ্ছে নিজের নিশ্বাস-প্রশ্বাস হঠাৎ কেমন কষ্টকর লাগল। মাথা তুলে আকাশ দেখার, অথবা ঊর্ধ্বমুখে নির্মল বাতাস টানার বাসনা হল, মাথা তুলতে গিয়ে অসম্ভব ভারী এবং বেসামাল লাগায় অবনী মাথা তুলল না। চোখের পাতা জুড়ে আসছিল।

সিঁড়ির কাছাকাছি আসতে সহসা তার মনে হল কে যেন ডাকল। দাঁড়াল অবনী। আস্তে আস্তে পিছন ফিরল। পরিষ্কার কিছু দেখা যাচ্ছে না, অল্প একটু আলো সামনে, তারপর অন্ধকার। কিছু সময় দাঁড়িয়ে থাকল অবনী, অপেক্ষা করল। না, কেউ নয়।

সিঁড়ি দিয়ে বারান্দায় উঠে হঠাৎ তার মনে হল, গলার স্বরটা তার চেনা। কার যেন, কার? ললিতার। অবনী সঙ্গে সঙ্গে আবার ঘুরে দাঁড়াল। যথাসম্ভব উজ্জ্বল চোখে তাকাল। না, কেউ না।

অবনী এবার হাসল। জোরে নয়, মৃদু শব্দ করে, যেন নিজেকে শোনাল। অদ্ভুত এক চিন্তা এল মাথায়: কখনও কখনও নাকি দূরে কোনও আত্মীয়-টাত্মীয় মরে গেলে হঠাৎ তার ডাক শোনা যায়। প্রিমোনিশান? টেলিপ্যাথি? ললিতা কি মারা গেল নাকি হঠাৎ? …ননসেন্স! হুইস্কিটা ভালই। মনিঅর্ডারে ললিতা এখনও তার আত্মীয়।

ঘরে ঢোকার সময় অবনী যেন সহসা তার পাশে বিজলীবাবুকে অনুভব করতে পারছে সামান্য মুখ ফেরাল। বিজলীবাবু তার মুখের পাশে মুখ লাগিয়ে যেন চলেছেন। সারা মুখে একটা হাসি।

হাসিটা ভাল লাগল না অবনীর। বিজলীবাবুর মুখ হাসিতে ফুলে উঠছে ক্রমশ, বেলুনের মন বাড়ছে, শেষ পর্যন্ত ফেটে যাবে।

বিরক্ত হয়ে অবনী মুখ ফিরিয়ে নিল।

কানের পাশে বিজলীবাবু যেন ফিসফিস করে বললেন, ও কে?

কে আবার, ললিতা। অবনী কোনওদিকে তাকাল না।

 বিজলীবাবুর মুখ যেন ফেটে যাবার অবস্থা: ফেমিনাইন জেন্ডারের মজা কী জানেন, ওটা কী বোঝ যায় না, কখন কাকে দেখছেন কী ভাবছেন…

অবনী ঘরে চলে এল। বিজলীবাবুর হাসি পিচকিরির রঙের মতন যেন তার চেতনার কোথাও ছিটিয়ে পড়েছে।

বিছানায় এসে বসল অবনী। বসল এবং বিজলীবাবুকেই যেন মনে মনে বলল:

ললিতাকে আপনি দেখেননি বিজলীবাবু, শরীরে আঙুল ছোঁয়ালে এক সময় আমার সমস্ত কিছু জ্বলে যেত। পাকা বড় আঙুরের মতন শরীর, নোখের দাগ লাগলে যেন ফেটে রস গড়িয়ে পড়বে। ললিতার জন্যে আমি পাগল হয়েছিলাম। ওকে বিয়ে করার পর, আগেও তিন-চারটে বছর, ললিতাকে আমি রাক্ষসের মতন ভোগ করেছি। …তখন, আমার ধারণা, আমি তাকে ভালবাসতাম। …অথচ, পরে আমার ওর প্রতি আকাঙ্ক্ষা চলে গেল, আস্তে আস্তে; ভালবাসাও থাকল না। তৃষ্ণার্তের পিপাসা মিটে গেলে যেমন হয়। তখন আর ললিতাকে ভাল লাগত না, অকারণ, অপ্রয়োজনীয় মনে হত। আমাকেও ললিতার প্রয়োজন ছিল না। ভোগস্পৃহা মরে গেলে ভোগ্যবস্তু ভোগ করা যায় না, উপভোগও নয়। আমার ভোগস্পৃহা মরে গিয়েছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *