২৮. মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা

মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা

পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস ১৪ আগস্ট, জাতীয় দিবস ২৩ মার্চ, একুশে ফেব্রুয়ারি, জিন্নাহর জন্ম-মৃত্যুদিন প্রভৃতি উপলক্ষে বিভিন্ন সংগঠন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করত। আজিমপুর কলোনির সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন, স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন, আজিমপুর লেডিস ক্লাব, কিংবা বাংলা একাডেমি বা পাকিস্তান কাউন্সিলের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিতা আবৃত্তিও হতো। তাতে একজন স্বনামধন্য কবির উপস্থিতি ছিল অবধারিত। হালকা মোটাসোটা, বেঁটে খাটো ওই মহিলা কবির নাম মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা। তাঁর কাঁধে থাকত ঝোলানো একটি কাপড়ের ব্যাগ। তাতে দু-চারখানা বই বা খাতা। তার মুখে স্মিত হাসি। কথাবার্তায় গভীর মমতা। তিনি ছিলেন মৃদু হাস্যরসিক। এক মমতাময়ী মাতৃমূর্তি। প্রবীণদের তিনি ছিলেন আপা এবং আমাদের বয়েসী তরুণদের তিনি ছিলেন সবারই খালাম্মা। ষাটের দশক পর্যন্ত তিনি ছিলেন বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান ও খ্যাতিমান মহিলা কবি। স্বাধীনতার পরে তিনি আড়ালে চলে যান। সমাদর ছিল না বলে জীবনের শেষ আট-দশ বছর তিনি সভা-সমাবেশে আসতেন না। ১৯৭৭ সালে তিনি নীরবে নিভৃতে ৭১ বছর বয়সে পরলোকগমন করেন।

১৯৩০-এর দশকের শুরুতে কবি হিসেবে মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকার আত্মপ্রকাশ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পসারিনী প্রকাশিত হয় ১৯৩২-এ। এই বই সম্পর্কে সওগাত সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিনের মন্তব্য : বাংলা ভাষায় মুসলিম (মহিলা) কবির ইহাই প্রথম প্রকাশিত আধুনিক কবিতার বই। এতে তিনি প্রকৃতি, প্রেম ও বিরহ নিয়ে কতকগুলো কবিতা লিখেছেন।’

প্রাতিষ্ঠানিক উচ্চশিক্ষার সুযোগ পাননি সিদ্দিকা। বাড়িতেই উচ্চশিক্ষিত বাবার কাছে এবং গৃহশিক্ষকের কাছে পাঠ নিয়েছেন। আর পাঠ নিয়েছেন তিনি প্রকৃতি থেকে। মাহমুদা খাতুন তার আত্মকথায় লিখেছেন :

‘আমি যখন মিশন স্কুলে ক্লাস টুতে পড়ি, সেই সময় কবিতা লিখতে শুরু করি। বারো কি তেরো বছর বয়সে আমার প্রথম কবিতা পত্রিকায় ছাপা হয়।

‘ছোটবেলা থেকে আমি মুক্ত প্রকৃতির মধ্যে ঘুরে বেড়াতাম। মায়ের মৃত্যুর পর কোনো শাসন ছিল না বলেই আমার এক কৃষাণী বন্ধুর সঙ্গে ঘুরতাম বনে জঙ্গলে, পুকুর ধারে, বাড়ির পেছনে ছিল বিরাট আমবাগান। সেখানকার পাখির ডাক, বুনোফুল আমাকে মুগ্ধ করত। দুই-এক লাইন করে কবিতা লিখতাম। সেই সময় আমার গৃহশিক্ষক ছিলেন বিখ্যাত আনোয়ারা গ্রন্থের লেখক মজিবর রহমান। তিনি আমার কবিতা লেখায় উৎসাহ দিতেন।

‘আমার মায়ের অনেক বই ছিল। আমি চুপি চুপি সেইসব বই পড়তাম। তা থেকেই আমি জীবন ও প্রেম সম্পর্কে সচেতন হই। বাবার একজন হিন্দু কেরানি আমাকে খোকাখুকু ও শিশুসাথীর গ্রাহক করে দেন। আমার কবিতা লেখার পেছনে বাবার প্রেরণা ছিল।

‘বাবার বদলির চাকরির জন্য কোনো এক জায়গায় বেশিদিন থাকতে পারতাম না। তাই বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন স্কুলে পড়াশোনা করেছি। রাজশাহী এসে মিশন স্কুলে ভর্তি হলাম, তখন মেমসাহেবের সংস্পর্শে এসে আমার মনে অনেক আধুনিক চিন্তাধারার সৃষ্টি হয়। বাড়িতে তখন ভীষণ কড়া পর্দা। আমার বড় বোনকে স্কুল থেকে নাম কাটিয়ে পর্দায় আব্রু করা হয়েছে। আমার বেলা সেটা সম্ভব হতে দেইনি।

‘শুরুতে আমি কেবল কবিতাই লিখতাম না, শান্তি, দীপক ও সবুজ বাংলা প্রভৃতি পত্রিকায় আমার বেশ কয়েকটি ছোটগল্প প্রকাশিত হয়েছে।

‘দেশ বিভাগের পূর্বে কলকাতা থেকে প্রকাশিত মানসী ও মর্মবাণী, উদয়ন, বসুমতি, প্রদীপ, কিষাণ, অগ্রগতি, সওগাত, মোহাম্মদী, বুলবুল, আজকাল, দীপালি, জয়ন্তী, বঙ্গলক্ষ্মী, উত্তরায়ণ, গুলিস্তান, যুগান্তর, মোয়াজ্জিন, আনন্দবাজার [পত্রিকা], বেগম, নবশক্তি, নবযুগ, স্বাধীনতা, নায়ক, সত্যযুগ, পুষ্পপত্র ইত্যাদি পত্রিকায় আমার লেখা বের হয়েছে।’

মাহমুদা খাতুন ছিলেন অতি শান্তশিষ্ট প্রকৃতির মানুষ। কিন্তু ভেতরে তিনি ছিলেন দ্রোহী। সমাজে প্রচলিত নারীর অবরোধ প্রথা তিনি মেনে নেননি। অল্প বয়সেই বেরিয়ে আসেন তিনি সেই কারাগার থেকে। সাহস করে যোগাযোগ স্থাপন করেন রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ইসলামের সঙ্গে। দুই শ্রেষ্ঠ কবির আশীর্বাদ ও অনুপ্রেরণা তিনি পান। পরিচয়-এ প্রকাশের অনুরোধ জানিয়ে সিদ্দিকা রবীন্দ্রনাথকে একটি কবিতা পাঠিয়েছিলেন, প্রাপ্তি স্বীকার করে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে লেখেন :

কল্যাণীয়াসু,

আমার শরীর অত্যন্ত ক্লান্ত এবং দুর্বল। যথাসাধ্য সকল কাজ থেকে নিষ্কৃতি নেওয়ার চেষ্টা করছি।

তোমার কবিতাটি পরিচয়-এর সম্পাদকের কাছে পাঠাই, আশা করি তারা ছাপাবেন, কিন্তু সম্পাদকীয় বিচারবুদ্ধির ওপর আমার কোনো হাত নেই এ কথা নিশ্চিত জেনো। দেখেছি তারা অনেক সময় অনেকের ভালো লেখাকেও বর্জন করে।থাকেন; তার পরিচয় পেয়েছি।

ইতি ৩ আশ্বিন, ১৩৪২ শুভার্থী
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

তিনি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে গিয়ে দেখাও করেন। সে কথা তিনি তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন :

‘… বিশ্বকবির পায়ে হাত দিয়ে সেলাম করলাম। আমি সেলাম করে উঠলে দুহাত ঊর্ধ্বে তুলে চোখ বন্ধ করে বহুক্ষণ ধরে কি প্রার্থনা সারলেন। আমি অবাক হয়ে দেখছি তাঁর সর্বদেহ থেকে আলোক বিকিরণ হতে লাগলো। তার পরে তিনি পাশে বসিয়ে গল্প করতে আরম্ভ করলেন, “তোমরা যে পর্দা থেকে বাইরে এসেছ এই আমি আশ্চর্য হয়েছি। দ্যাখো সূর্যের কিরণ না পেলে যেমন গাছপালা বড় হয় না, ফল-ফুল ভালো দেয় না, মানুষও তেমনি বাইরের আলো-বাতাস ছাড়া পূর্ণ হতে পারে না। পদ্ম পঙ্ক থেকে ঊর্ধ্বে উঠেই সূর্যের কিরণ লাভ করে, না হলে সে লাভ করতে পারত না। আর এখানেই তার সার্থকতা।”

নাসিরউদ্দিন লিখেছেন, ‘বাল্যকালে কবির বিবাহ হয় কিন্তু তার বিবাহিত জীবন খুব স্বল্পকাল স্থায়ী। তিনি স্বামীগৃহে যাননি, বিবাহিত জীবন উপভোগ করেননি। সকলে তাঁকে চিরকুমারী বলেই জানে। মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা তাঁর পিতার সঙ্গে ভারতের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করেছেন।’

সিদ্দিকা ছিলেন সমাজসচেতন রোমান্টিক কবি। ১৯৩০ সালে সওগাত-এ প্রকাশিত একটি কবিতায় তিনি বলেন :

বসন্ত উৎসব আজ হয়ে গেছে শেষ
পড়ে আছে বাসি ফুল-মালা,
রিক্ত ভূষা উদাসিনী ধরণীর বুকে
জাগে শুধু বুক ভরা জ্বালা।

[বসন্ত বিদায়]

১৯৬০-এ প্রকাশিত হয় তাঁর দ্বিতীয় কবিতার বই মন ও মৃত্তিকা। ওই কাব্য সম্পর্কে কলকাতার দেশ লিখেছিল :

‘কবিতাগুলির শীতল স্বভাব, ছন্দের কোমল মাধুর্য মনকে পরিষ্কৃত করে, বক্তব্যে কোথাও অস্পষ্টতা নেই। স্বচ্ছ, সুন্দর একটি ভাবাবেশ প্রতিটি কবিতায় পরিব্যাপ্ত।’

সংগ্রামী মানুষের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ পেয়েছে সিদ্দিকার কোনো কোনো কবিতায় :

রাজপথ বেয়ে চলে উদ্দাম মিছিল
হৃদয়ে হৃদয়ে তার পদধ্বনি বাজে।
বাঁচার মতো বেঁচে ওঠো,
মানুষের অধিকার মানুষের দাবি
সবচেয়ে বড়।

বাংলাদেশে অনেক সামান্য মানুষের, যাদের তেমন কোনো ঐতিহাসিক ভূমিকা নেই, জন্ম-মৃত্যুবার্ষিকী ঘটা করে পালিত হয়। মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকার যদি থাকত সুযোগ্য ও বিত্তবান ছেলেমেয়ে, তাহলে তিনি বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যেতেন না। তাঁর তৃতীয় কবিতার বই অরণ্যের সুর প্রকাশিত হয় ১৯৬৩-তে। শুধু কাব্যচর্চা নয়, সমাজ থেকে কুসংস্কার দূর করতেও তিনি সমাজসেবামূলক কাজ করতেন। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে তিনি ছিলেন ঢাকার শ্রদ্ধেয়া মহিলাদের একজন।

প্রাতিষ্ঠানিক উচ্চশিক্ষাপ্রাপ্ত মুসলমান নারী কবি-সাহিত্যিক পঞ্চাশের দশক পর্যন্ত বাংলাদেশে ছিলেন অল্প কয়েকজন। তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন খোদেজা খাতুন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলায় মাস্টার্স, খোদেজা খাতুনের জন্ম ১৯১৭ র ১৫ আগস্ট, মৃত্যু ৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৯০। কর্মজীবনের শুরু বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক হিসেবে, শেষ জীবনে ছিলেন রাজশাহী সরকারি মহিলা কলেজ এবং ইডেন গার্লস কলেজের অধ্যক্ষা। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে তিনি বিভিন্ন সাহিত্য সংস্কৃতি সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়েছেন, প্রথম জীবনে কবিতার চর্চাও করেছেন, তবে তিনি ছিলেন মূলত গদ্যলেখক, ১৯৭৭ থেকে ৮৫ পর্যন্ত তিনি ছিলেন বাংলাদেশ লেখিকা সংঘের সভানেত্রী।

খোদেজা খাতুনের এক ভাই কে এম শমসের আলী কবি হিসেবে খ্যাতিমান ছিলেন। তিনিও ছিলেন উচ্চশিক্ষিত। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন, তাঁরও রয়েছে অনেকগুলো কবিতার বই : আলিঙ্গন (১৯৩৩), সাক্ষর (১৯৪৯), সুরের মায়া (১৯৪৭), রসনার কবি (১৯৬১) প্রভৃতি।

খোদেজা খাতুনের গদ্য কবিত্বময়। স্বাধীনতার আগে আমরা তাঁকে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পেয়েছি। স্নিগ্ধ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ছিলেন তিনি। তিরিশের দশকে ইডেন কলেজের ৩৬ জন ছাত্রীর মধ্যে মুসলমান মেয়ে ছিলেন চারজন। তাঁদের একজন। তিনি, আর একজন দর্শনের অধ্যাপিকা আখতার ইমাম।

তাঁর কবিতার বই বেদনার এই বালুচরে (১৯৬৩), গল্পগ্রন্থ সাগরিকা (১৯৫৯), রূপকথার রাজ্যে (১৯৬৩), শেষ প্রহরের আলো (১৯৬৯) প্রভৃতি এবং প্রবন্ধগ্রন্থ সাহিত্য ভাবনা প্রভৃতি। তাঁর একটি রম্যরচনা গ্রন্থের নাম অরণ্য মঞ্জুরী (১৯৭১)।

তিনি তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দশ নম্বর বাংলোর আবাসিক ছাত্রী ছিলেন। তাঁর ভাষায় :

‘১৯৩৫ থেকে ১৯৩৯ সন পর্যন্ত আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রজীবন যাপন করেছি। ১৯৩৫ থেকে ১৯৩৮ পর্যন্ত কাটিয়েছি ওই বাংলোতে। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী সংখ্যা, বিশেষ করে আবাসিক ছাত্রী সংখ্যা এতই নগণ্য ছিল যে, কেবলই ছাত্রীদের জন্য কোন আবাসিক হল ছিল না। তখন ছাত্রদের জন্য মাত্র তিনটি হল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। হল তিনটির নাম ছিল ঢাকা হল, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ও জগন্নাথ হল। ছাত্রীরা নিজেদের সুবিধামতো যে কোন হল-এ সংযুক্ত হতে পারত। আবাসিক ছাত্রীদের বেলায়ও তাই, তবে তারা অবস্থান করত ওই দশ নম্বর বাংলোতে, যার নাম ছিল ইউনির্ভাসিটি উইমেন্স রেসিডেন্স। তখন আবাসিক ছাত্রী সংখ্যা ছিল আট জন; পরে হয়েছিল বারো জন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের চারটি ক্লাসে সর্বমোট পঞ্চাশ জনেরও কম ছাত্রী পড়ত।

‘দশ নম্বর বাংলো অর্থাৎ ঢাকা ইউনির্ভাসিটি উইমেন্স রেসিডেন্স ছিল তৎকালীন একমাত্র বিখ্যাত ছাত্রীনিবাস, যাকে অনেকেই বলত সাইনোসিওর অব অল আইজ। ওই বাড়ি সম্বন্ধে এই মন্তব্যটি অন্তত তখনকার দিনে খুব চালু ছিল। মনোরম ভঙ্গিতে তৈরি ছিল সেই বিল্ডিং। ভারি চমৎকার ছিল তার পরিবেশ। ব্রিটিশ আমলে সাহেবদের থাকবার জন্য তৈরি হয়েছিল এই সুদৃশ্য বাংলো। অট্টালিকার ভেতরে দু’পাশে দুটো ফায়ার প্লেস এবং তার উপর দিয়ে ছাদের উপর পর্যন্ত দুটো চিমনি ছিল বিলাতি প্যাটার্নে। বাংলোতে সম্মুখভাবে লম্বা বারান্দার দু’পাশে বৃত্তাকার বরান্দা ঘিরে সবুজলতার নীল ফুল ফুটে থাকত, ফুলসমেত হালতার টব ঝুলানো ছিল। বিরাট এলাকাজুড়ে ছিল দশ নম্বর বাংলোর চৌহদ্দি প্রাচীর। প্রাচীরের পাশে সমান্তরালভাবে ছিল দীর্ঘকায় বিলাতি পাম-ট্রি; সকালের রোদ তার মাথায় চিকন মসৃণ পাতায় পাতায় পড়ে ঝিকমিক করত। সামনের কাঁটাতারের বেড়া ঘিরে ছিল ঝুমকোলতা আর মেহেদির বেড়া। কাঁটাতারের বেড়ার দু’প্রান্তে দুটি বড় গেট। বাড়িটির একপাশে ছিল অশোক, বকুল, শিরীষ, চেরি আর কৃষ্ণচূড়ার বড় বড় গাছ, ফুল ফোঁটার সময় এলে তাদের দিক থেকে চোখ ফেরানো যেত না। অন্য পাশে ছিল কাঠবাদাম, কুল, তেঁতুল আর জারুল গাছ। পেছনে কিচেন হাউস আর সারভেন্টস কোয়াটারস ছিল। সামনে বিরাট লন। অর্ধচন্দ্রাকার পিচঢাকা রাস্তা। বাংলোর সম্মুখভাগ দিয়ে ইন ও আউট দু’ধারের দু’গেটে শেষ হয়েছে। এই রাস্তার দুপাশ দিয়ে অজস্র ফুলের সমারোহ নিয়ে ফুলগাছিগুলো সবাইকে যেন স্বাগত জানাত ফোঁটা ফুলের হাসিমুখ বাড়িয়ে। মালী নমি সমস্ত দিন ফুলগাছগুলোর যত্ন নিত। শীতের বিকালের মরসুমি ফুলের এবং অন্যান্য ফুলের সুরভিত স্মৃতি এখনও সুদূর থেকে অনেক স্মৃতির সঙ্গে বিজড়িত হয়ে ভেসে এসে মনকে আকুল করে। রঙবেরঙের ডালিয়া, এস্টার, পপি, হলিহকস, ক্রিসেনথিমাম, টিউলিপ, কর্নফ্লাওয়ার, সূর্যমুখী, অপরাজিতা, রজনীগন্ধা, গন্ধরাজ দেশি-বিদেশি আরও কত কী ফুল; সেসব ফুলে ঘেরা সেই কমনীয় দিনগুলো দশ নম্বর বাংলোসমেত কোথায় গেল? জীবনের তারুণ্যের দিন, বসন্তের দিন, সৌন্দর্যের দিন, আনন্দের দিনগুলো যে এভাবেই কেটেছে। এই শহরের আকাশে বাতাসে সেদিন রঙধনুর রঙ ছড়ানো ছিল। শত শত সূর্য উদয়ের পথে ছড়িয়ে ছিল আশার আলোর ফুলঝুরি। তাই এক সূক্ষ বেদনাবোধের আবেগে বলতে ইচ্ছে হয়, “দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইল না, রইল না, সেই যে আমার নানারঙের দিনগুলি!”…

‘বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গেই ছিল দশ নম্বর বাংলো। প্রায় সময়ই ক্লাসের ঘণ্টা শুনে তবে আমরা ক্লাসে ছুটতাম বাংলো থেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটের বাড়িতে সে সময় ছিলেন মরহুম মনীষী ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। প্রতি ঈদপর্বে ড. শহীদুল্লাহ, ড. হাসান, ড. মোয়াজ্জেম হোসেন এবং আরও অনেক শ্রদ্ধেয় প্রফেসর আবাসিক ছাত্রীদের সাদর আমন্ত্রণ জানাতেন। সেই সব স্নেহসিঞ্চিত মুহূর্তগুলো জীবনের অক্ষয় সম্পদ।

[স্মৃতিময় এসএম হল, সলিমুল্লাহ হল, প্রাক্তন ছাত্র সমিতি পুনর্মিলনী, ২০০৩ স্মরণিকা]।

ষাটের দশকে শিক্ষকতায় আসেন অনেক নারী। স্কুলগুলোতে তো ছিলই, বিভিন্ন সরকারি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়েও আধ্যাপিকা ছিলেন কেউ কেউ। তাঁরা ছিলেন প্রগতিবাদী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের অধ্যাপিকা আখতার ইমাম ছিলেন সবার শ্রদ্ধার মানুষ। ইংরেজি, বাংলায় দর্শন বিষয়ে প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখতেন। তাঁর প্রকাশিত বইও রয়েছে দর্শন বিষয়ে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *