নওবাহার
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগে চল্লিশের দশক পর্যন্ত বাঙালি মুসলমান কবি, শিল্পী, সাহিত্যিকদের আত্মপ্রকাশের দরজা ছিল সংকীর্ণ। কলকাতার হিন্দুদের পত্রপত্রিকা ও সাময়িকীতে মুসলমান লেখকদের লেখা ছাপা হতো না। মুসলমানদের দুটি প্রধান সাহিত্য পত্রিকা ছিল মোহাম্মদ আকরম খাঁর মোহাম্মদী এবং মোহাম্মদ নাসির উদ্দিনের সওগাত। আধুনিক মুসলমান লেখকদের ভরসা ছিল মোহাম্মদী ও সওগাত। পত্রিকা দুটি ছিল মানসম্মত, বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ সাময়িকীগুলোর প্রায় সমপর্যায়ের। খুব উঁচু মানের লেখা যেমন থাকত, তেমনি নতুন অনেক লেখকের কাঁচা রচনাও থাকত। প্রতিশ্রুতিশীল তরুণদের কিছুটা দুর্বল লেখাও প্রকাশ করেছে। প্রতিষ্ঠিত পত্রিকার দায়িত্ব নতুন লেখক তৈরি করা। খুব দুর্বল যারা তারা অবলীলায় ঝরে পড়ে। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, শওকত ওসমান, ফররুখ আহমদ, গোলাম কুদ্দুস, আহসান হাবীব, রশীদ করীম প্রমুখ নতুন প্রজন্মের কবি ও কথাশিল্পীর লেখা সওগাত, মোহাম্মদীই ধারণ করেছে। মোহাম্মদী ছিল প্রধানত রক্ষণশীল, অনেকটা প্রতিক্রিয়াশীলও বটে; কিন্তু সওগাত ছিল প্রগতিশীল। তিরিশ ও চল্লিশের দশকে বহু নারী কবি-সাহিত্যিক তৈরি করেছে সওগাত। নারী প্রগতির প্রশ্নে সওগাত-এর ভূমিকা ছিল অতুলনীয়। সামাজিক ও ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে ছিল সওগাত। লেখকদের মধ্যে দুটি দল দাঁড়িয়ে গিয়েছিল– সওগাত দল ও মোহাম্মদী দল। মাঝে মাঝে দুই দলের মধ্যে কলমযুদ্ধ হতো। সে বিতর্কও মূল্যহীন নয়। তাতে উভয় পক্ষের ধর্মীয় ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির সুস্পষ্ট প্রকাশ ঘটত। মোহাম্মদীতে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার প্রকাশ থাকত, সওগাত হিন্দু-মুসলমানের সমন্বয়ী সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী ছিল।
মুসলমানদের সম্পাদিত সাহিত্যপত্রিকাগুলোর মধ্যে তিরিশের দশকে হবীবুল্লাহ বাহারের বুলবুল ছিল মানসম্মত এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদী ও অসাম্প্রদায়িক। যদিও তিরিশের দশকেই হবীবুল্লাহ বাহার মুসলিম জাতীয়তাবাদী মুসলিম লীগে যোগ দেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন উদার ও অসাম্প্রদায়িক। ১৯৪৬-৪৭-এ মহাত্মা গান্ধী যখন নোয়াখালী শান্তি মিশনে আসেন, তখন তাকে তিনি সহযোগিতা করেন এবং তাতে গান্ধীজি প্রীত হন।
১৯৪১ সালে কাজী আফসারউদ্দিন আহমদ প্রকাশ করেন দ্বিমাসিক মৃত্তিকা। এই পত্রিকাটি ছিল অসাম্প্রদায়িক ও বাঙালি জাতীয়তাবাদী। হিন্দু-মুসলমান সবার লেখাই মৃত্তিকায় প্রকাশিত হতো। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহসহ অনেকেই ছিলেন মৃত্তিকার লেখক। এসব কাগজের চরিত্র ছিল লিটল ম্যাগাজিনের। প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি মোহাম্মদী বা সওগাত-এর মতো। চল্লিশের দশকে মুসলমানদের সম্পাদিত বেশ কিছু মাসিক পত্রিকা কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়। সেগুলো প্রায় সবই ছিল সাম্প্রদায়িক; হিন্দুবিরূপতা যত না ছিল তার চেয়ে বেশি ছিল ধর্মীয় গোঁড়ামির প্রচারক ও আধুনিকতা বিরোধিতা।
১৯২০-এর দশকে কবি হিসেবে বাংলায় খ্যাতিমান ছিলেন কালিদাস রায়, কুমুদরঞ্জন মল্লিক, গোলাম মোস্তফা, জসীমউদ্দীন প্রমুখ। গোলাম মোস্তফা ছিলেন বিভিন্ন জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক। অতি সরল-সোজা মানুষ। বালিগঞ্জ সরকারি হাইস্কুলে তিনি সত্যজিৎ রায়ের শিক্ষক ছিলেন। তাঁর যশোরী উচ্চারণ নিয়ে সত্যজিৎ মৃদু রসিকতা করেছেন তাঁর শৈশবস্মৃতিতে। তিনি ছিলেন অতি উদার ও ইসলামি ভাবাদর্শের কবি। পাকিস্তান আন্দোলনের এক অবিচল সমর্থক ছিলেন গোলাম মোস্তফা। নজরুল ইসলামের হিন্দু-মুসলমানের সমন্বয়ী সংস্কৃতি ও ভাবধারার তিনি ছিলেন বিরোধী, পাকিস্তানবাদী কবিতা ও গান রয়েছে তাঁর বহু। তাঁর একটি গান ছোটবেলায় আমরা স্কুলে গাইতাম :
পাকিস্তান জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ।
পুরব বাংলার শ্যামলিয়ায়,
পঞ্চনদীর তীরে অরুণিয়ায়,
ধূসর সিন্ধু মরু সাহারায়
ঝাণ্ডা জাগে যে আজাদ।
মুসলিম জাতীয়তাবাদী বা মুসলিম পুনর্জাগরণবাদী হলেও গোলাম মোস্তফা হিন্দু বিদ্বেষী ছিলেন না। ছিলেন রোমান্টিক কবি, কোনো ইনটেলেকচুয়াল বা চিন্তাবিদ ছিলেন না। তখনকার অনেকের মতোই পাকিস্তান ও ইসলাম বিষয়ে প্রচুর কবিতা রয়েছে তার। সেগুলো চল্লিশ, পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের প্রথম দিকের রচনা। ১৯৪৯-এ তিনি সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তখনই প্রকাশ করেন নওবাহার নামে একটি সচিত্র মাসিক পত্রিকা। আগস্ট ‘৪৯ সালে প্রকাশিত নওবাহার-এ সরকারি শুভেচ্ছা ছিল বলে শুনেছি। সেটা থাকা সম্ভব তা পত্রিকার ‘উদ্দেশ্য’ শীর্ষক সম্পাদকীয় থেকে ধারণা করা যায়। তাতে বলা হয়েছিল :
‘নওবাহার কোনো দলীয় প্রচারপত্র নয়। এ নিছক একখানি সাহিত্যপত্র। …বাস্তব রাজনীতির কোন আলোচনা ইহাতে থাকিবে না, তবে রাজনৈতিক চিন্তা ও দর্শন– যাহা সাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত– তাহার আলোচনায় বাধা নাই। পাকিস্তান বিরোধী কোন বিষয়বস্তুও নওবাহারে স্থান পাইবে না। …আমাদের তহজীব ও তমুদ্দনের রূপায়ণ হইবে নওবাহারের অন্যতম লক্ষ্য। নওবাহার কমিউনিজম রুখিবে। নারী-প্রগতি নওবাহারের অন্যতম সাধনা হইবে।…
‘নওবাহারকে কেন্দ্র করিয়া আমরা এমন একদিন সাহিত্যিক গঠন করিতে চাই যাহারা জাতির চিন্তায় বিপ্লব আনিবে।… এই কাৰ্য্যে আমরা আমাদের প্রিয় নবীর অনুসরণ করিতে চাই।’
পত্রিকাটি পজিটিভ ভূমিকা না নিয়ে না-বাচক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। সম্পাদক পাকিস্তানবিরোধী কোনো লেখা ছাপবেন না, সেটা স্বাভাবিক ও সংগত; কিন্তু কমিউনিজম রুখবেন এবং ইসলামি চিন্তাধারার প্রচারক হবেন। সেটা কম রাজনীতি নয়। আধুনিক চিন্তাধারার কোনো কথা নেই। পাকিস্তানের মতো একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আধুনিক চিন্তার চর্চা হওয়ারই কথা। কিন্তু শাসকেরা চাইছিলেন পাকিস্তানকে ‘ইসলামি জহুরিয়াত’ বা ইসলামি গণতন্ত্র বানাতে। সেটা কী বস্তু, তা পৃথিবীর কোনো মানুষের ধারণায় ছিল না।
নওবাহারের প্রথম সংখ্যার লেখকসূচি দেখলেই তার নীতি ও আদর্শ সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা হবে: গোলাম মোস্তফার কবিতা (নওবাহার), ফররুখ আহমদের কবিতা (জবানে আজাদী), মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলীর প্রবন্ধ (পাকিস্তানে ইসলামের নীতি), আবুল ফজলের নাটিকা (পাকিস্তান), মীজানুর রহমানের নিবন্ধ (পাকিস্তানী), বেগম সুফিয়া কামালের কবিতা (ঈদের চাঁদ), শওকত ওসমানের গল্প (আরবের বন্ধু), গোলাম মোস্তফার প্রবন্ধ (মার্কসীজম কি বাঁচিয়া আছে?) প্রভৃতি। কমিউনিজম ও সমাজতন্ত্রের ওপরই আক্রোশটা ছিল কিছুটা বেশি, কারণ মার্কসবাদ নিরীশ্বরবাদী। পাকিস্তানে ঈশ্বর থাকুন না থাকুন আল্লাহ থাকবেন না– তা সম্পাদক কল্পনাও করতে পারেননি।
লক্ষ করার বিষয় যে নওবাহারে সব রচনারই বিষয়বস্তু আরব দেশ, পাকিস্তান ও ইসলাম। নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানের নীতি-আদর্শ প্রচার দোষের ছিল না। মুসলমানপ্রধান রাষ্ট্রে ইসলাম ধর্ম এবং হিন্দুপ্রধান ভারতে হিন্দুধর্ম প্রাধান্য পাবে, তা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু সেই সঙ্গে আধুনিক শিল্প-সাহিত্য ও চিন্তাধারা যদি উপেক্ষিত হয়, তাহলে সেই রাষ্ট্র জনগণের সার্বিক কল্যাণ করতে পারে না– এই বিষয়টি সেকালের খ্যাতিমান মুসলমান কবি-লেখকেরা উপলব্ধি করার প্রয়োজন বোধ করেননি। তাঁরা ছিলেন সম্পূর্ণ বিভ্রান্ত। অথচ তাঁদেরই অনেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরে ভোল পাল্টান। ছদ্ম সেকুলার হতে গিয়ে অতিমাত্রায় ইসলামবিরূপতার প্রকাশ ঘটাতে থাকেন কারণে-অকারণে। তার ফলে এই হিন্দু মুসলমানের সমন্বিত সংস্কৃতির দেশে ইসলামি মৌলবাদকে মাথাচাড়া দেওয়ার ক্ষেত্র তৈরি করেন।
স্বাধীনতার পরে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মযহারুল ইসলাম এমন মাত্রায় বাঙালি হতে চান যে তিনি ‘আসোলামু আলাইকুম’, ‘জনাব প্রভৃতিকে সাম্প্রদায়িক বিষয় মনে করে তা বাদ দিতে চান। তাঁর প্রস্তাব হয় : ‘জনাব’ এর বদলে লিখবেন ‘সুজন’। সুজন অমুক উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রীর অফিসে কোনো চিঠি দেওয়ার পরে বিষয়টি কারও চোখে পড়ে। উচ্চপর্যায় থেকে ধমকের পরে এই অপতৎপরতা বন্ধ হয়।