জীবনানন্দ ও শামসুদ্দীন আবুল কালাম
এক
মুদ্রণ ও প্রকাশনাশিল্প উনিশ শতকের প্রথমার্ধেই বিকশিত হয় কলকাতায়। তার সিকি শতাব্দী পরে উনিশ শতকের ষাটের দশকে ঢাকায় খুব ছোট আকারে মুদ্রণ ও প্রকাশনাশিল্প যাত্রা শুরু করে। ঢাকায় মুদ্রণ ও প্রকাশনাশিল্পের পথিকৃৎদের মধ্যে ছিলেন কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার এবং কবি ও গদ্যলেখক হরিশ্চন্দ্র মিত্র। তাঁদের প্রতিষ্ঠিত বাঙ্গালা যন্ত্র নামক ছাপাখানা থেকে বহু ছোট-বড় বই প্রকাশিত হয় ১৮৬০ থেকে ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে। ওই সময়সীমায় আরও অনেক ছাপাখানা প্রতিষ্ঠিত হয় ঢাকায়। কুড়ি শতকের শুরুতে ঢাকায় স্থাপিত হয় মনোমেশিন– সেকালের সবচেয়ে আধুনিক মুদ্রণযন্ত্র। একটি-একটি করে সিসার তৈরি হরফ সাজিয়ে কম্পোজ করার পরিবর্তে স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রে টাইপ করলেই হয়ে যেত মেশিনেই কম্পোজ। তারপর তা সংশোধন করে প্রয়োজনমতো মেকআপ দিয়ে হতো বই ছাপা। ঢাকায় প্রথম যে ছাপাখানায় মনোমেশিন স্থাপিত হয়, তার নাম আলেকজান্ডার স্টিম মেশিন প্রেস। সেটি ছিল নবাবপুরে। ওই প্রেস থেকে ঢাকায় উন্নতমানের বই প্রকাশিত হয়েছে। উনিশ শতকের শেষ দশকেই গড়ে ওঠে বাংলাবাজারে বইপাড়া, যেমন কলকাতায় কলেজ স্ট্রিট ও কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটের (বর্তমানে বিধান সরণি) বইয়ের জগৎ।
আমাদের কয়েকজন আত্মীয়ের ঢাকায় ছাপাখানা ও প্রকাশনার ব্যবসা ছিল পাটুয়াটুলী, ইসলামপুর, তাঁতীবাজার, বাংলাবাজার, প্যারীদাস রোড, প্রসন্ন পোদ্দার লেন, পাতলা খান লেন প্রভৃতি এলাকায়। পঞ্চাশের দশকের শুরুর দিকে, ভাষা আন্দোলনের অল্পকাল পরে, পাটুয়াটুলী দ্য বেঙ্গল প্রিন্টিং ওয়ার্কস নামক এক বড় ছাপাখানায় প্রায়ই যেতাম আব্বার সঙ্গে। একদিন সেখানে দেখি, কয়েকজন ভদ্রলোক গল্পগুজব করছেন। ওই প্রেসে মুদ্রিত হয়েছে একটি বই। এর মধ্যে এক ঘি বিক্রেতা সেখানে গিয়ে হাঁক দেন। প্রেস মালিক তাকে ডাকেন এবং একটি পাত্রে সম্ভবত পাঁচ সের (কেজি) ঘি দিতে বলেন। মুদ্রক ও প্রকাশক ছিলেন একই ব্যক্তি। প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের নাম ছিল প্যারাডাইস লাইব্রেরি, যা ছিল বাংলাবাজারে। প্রকাশক যাকে ওই পাঁচ কেজি ঘি উপহার দিলেন, তাঁর নাম সরদার জয়েনউদ্দিন। উপলক্ষ নয়ান ঢুলী নামক একটি গল্পগ্রন্থের প্রকাশ। নয়ান ঢুলীর লেখক জয়েনউদ্দিন।
আজকাল স্রেফ আবর্জনা ধরনের বইয়েরও প্রকাশনা উৎসব হয়। খ্যাতিমান লেখকেরা ঘটা করে টিভি চ্যানেলের ক্যামেরার সামনে মোড়ক উন্মোচন করেন। রঙিন কাগজের প্যাকেট খুলে বুকের কাছে বইটি ধরে ছবি তোলেন। তারপর একটি পঙক্তি না পড়েও হড়হড় করে বইটির লেখক ও বইটির প্রশংসা করেন। এ কাজটি আমাকেও মাঝে মাঝেই করতে হয়। বলতে হয় : এ বই আমাদের সাহিত্যে এক গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। মনে মনে বলা হয় : এই ঘোড়ার ডিম প্রকাশ কাগজ ও কালির স্রেফ অপচয়।
নয়ান ঢুলীর একটি কপি উপহার পেলেন আমার আব্বা। বইটি নাড়াচড়া করে দেখে আমার অভূতপূর্ব অনুভূতি হলো। সেই প্রথম আমি একটি সৃষ্টিশীল সাহিত্যকর্মের ঘ্রাণ উপভোগ করি। সেই থেকেই নতুন বাঁধাই করা বইয়ের ঘ্রাণ নিতে আমার ভালো লাগে। কেমন এক মদির গন্ধ।
ওই প্যারাডাইস লাইব্রেরি থেকেই প্রকাশিত হয় শামসুদ্দীন আবুল কালামের গল্পগ্রন্থ পথ জানা নাই। তার আগেই প্রকাশিত হয়েছিল তার আরেকটি গল্পের বই শাহের বানু। পথ জানা নাই-এর কাগজ, বাঁধাই ও প্রচ্ছদপট ছিল নয়ান ঢুলীর চেয়ে উন্নত। পঞ্চাশের দশকের শুরুর দিকে আমার অল্প বয়সেই আমি পথ জানা নাই এবং নয়ান ঢুলী পড়ি।
শামসুদ্দীন আবুল কালাম প্রথম লিখতেন আবুল কালাম শামসুদ্দীন নামে। আজাদ সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীনের সঙ্গে নাম মিলে যাওয়ায় বন্ধুবান্ধবের পরামর্শে তিনি নাম পরিবর্তন করেন। শামসুদ্দীনকে আমি তখনো কাছ থেকে দেখিনি। পাটুয়াটুলীতে তিনি তাঁর প্রকাশকের অফিসে যেতেন এবং কখনো যেতেন। বাংলাবাজার প্যারাডাইস লাইব্রেরিতে, যে লাইব্রেরির ম্যানেজার ছিলেন আমাদের পরিবারের একজন। আমার সেই ভাইয়ের কাছেই তাঁর কথা শুনতাম। তাঁকে আমি কাছে দেখি কয়েক বছর পরে আজিমপুর কলোনিতে।
শামসুদ্দীনকে কাছ থেকে না দেখার আরেক কারণ, তিনি আইয়ুব খান ক্ষমতা দখলের কিছুদিন পরেই কোনো এক বৃত্তি নিয়ে অথবা চাকরি নিয়ে ইতালির রোমে যান। পরে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (ফাও) এবং বিশ্বখাদ্য কার্যক্রমে ভালো পদে নিযুক্ত ছিলেন। বিদেশে চাকরি অনেকেই করেছেন, কিন্তু তাঁরা মাঝে মাঝে ছুটিছাটায় দেশে আসতেন। শামসুদ্দীনের দেশে না আসার একটি কারণও ছিল। তাঁর স্ত্রী তাকে ছেড়ে অভিনেতা ও অসামান্য আবৃত্তিকার গোলাম মোস্তফাকে বিয়ে করেন। তখন মহিলা একটি কন্যাসন্তানের মা। দাম্পত্য জীবনের এই ট্র্যাজেডিতে শামসুদ্দীন প্রচণ্ড আঘাত পান। তাঁর বেদনার কথা তার বন্ধুবান্ধবেরা জানতেন।
শামসুদ্দীন আবুল কালামের প্রথম জীবন থেকে শেষ পর্যন্ত যিনি ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন তাঁর নাম আবদুল মতিন। তিনি আমারও অগ্রজপ্রতিম ছিলেন এবং আমাকে খুবই ভালোবাসতেন। আবদুল মতিন ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আবদুল। মতিন চৌধুরীর শ্যালক। ঢাকা কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র অবস্থায় আবদুল মতিন বামপন্থী রাজনীতি এবং প্রগতি লেখক ও শিল্পসংঘের একজন সক্রিয় কর্মী। ছিলেন। তিনি ছিলেন ফজলুল হক হলের ছাত্র। ছোটগল্প, কবিতা লিখতেন এবং ঢাকা-কলকাতার ভালো ভালো পত্রিকায় তাঁর লেখা ছাপা হয়েছে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তিনি সাংবাদিকতা শুরু করেন। পাকিস্তান অবজারভারে কাজ করেছেন। ১৯৬০ সালে তিনি লন্ডনে যান এবং সেখানেই স্থায়ীভাবে থাকার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি ষাটের দশকে লন্ডনে পাকিস্তান অবজারভার-এর বিশেষ প্রতিনিধি ছিলেন।
অত্যন্ত বন্ধুবৎসল ও সজ্জন ছিলেন আবদুল মতিন। তিনি সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ ও শামসুদ্দীন আবুল কালামের সঙ্গে অব্যাহত যোগাযোগ রেখেছেন। ১৯৭১-এর ১০ অক্টোবর প্যারিসে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ মারা গেলে আবদুল মতিনই প্রথম তাঁর মৃত্যুসংবাদ ঢাকা ও কলকাতায় প্রকাশের ব্যবস্থা করেন। তিনি লন্ডন থেকে প্যারিসে গিয়ে আনমারি ওয়ালীউল্লাহর সঙ্গে দেখা করেন। তখন মুক্তিযুদ্ধ চূড়ান্ত পর্যায়ে। কলকাতায় শওকত ওসমানের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। শওকত ওসমান তাঁর বন্ধু ওয়ালীউল্লাহর আকস্মিক মৃত্যুসংবাদ শুনে প্রায় পাগলের মতো হয়ে যান। ১৬ ডিসেম্বরের পর কলকাতা থেকে ঢাকায় ফিরে তিনি আমাকে আবদুল মতিনের সঙ্গে যোগাযোগ করে ওয়ালীউল্লাহ সম্পর্কে লেখার তাগিদ দেন।
আবদুল মতিন মাঝে মাঝে রোমে গিয়ে শামসুদ্দীনের সঙ্গে এবং প্যারিসে গিয়ে ওয়ালীউল্লাহর সঙ্গে দেখা করেছেন। শেষ জীবনে শামসুদ্দীনের সঙ্গে তাঁরই সবচেয়ে বেশি যোগাযোগ ছিল। রোমে শামসুদ্দীন প্রায় নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করেছেন। লেখালেখিতেই বেশি সময় ব্যয় করতেন। ওয়ালীউল্লাহর মতো তাঁরও গল্প-উপন্যাসের বিষয়বস্তু ছিল বাংলার গ্রামের মানুষ, যে মানুষদের থেকে তিনি বহুদিন ছিলেন দূরে।
দু-এক বছর পর পর আবদুল মতিন ঢাকায় আসতেন। লন্ডনেও তার সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। ঢাকায় আসতেন একুশের বইমেলার সময়। অনেকগুলো বইও তিনি লিখেছেন। ঢাকায় এলে তার সঙ্গে দীর্ঘ সময় কাটাতাম। আমার বাড়িতে হোক বা অন্য কোথাও হোক। রেস্তোরাঁয় তিনি আমাকে খাওয়াতেন। তাঁর কাছে শুনতাম শামসুদ্দীনের রোমের দিনযাপনের কথা। নিতান্ত নিঃসঙ্গ। এক অ্যাপার্টমেন্টে একা থাকতেন। নিজেই রান্নাবান্না করে খেতেন। তাঁর শেষটি ছিল খুবই করুণ। একা ঘরে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন। ডাক্তারকে জরুরি ফোনে জানানোর সময় পাননি। মৃত্যুর কয়েক সপ্তাহ পরে সরকারি লোকজন ঘর থেকে তাঁর লাশ উদ্ধার করে। কারও থেকে শুনে আমি তাঁর মৃত্যুসংবাদ প্রচার করি।
কাশবনে কন্যা এবং কাঞ্চনমালা উপন্যাস দুটির জন্যই শামসুদ্দীনের খ্যাতি। একসময় লালসালু, সূর্যদীঘল বাড়ি এবং কাশবনের কন্যার নাম একসঙ্গে উচ্চারিত হতো। পূর্ব বাংলার গ্রামের দরিদ্র মুসলমানদের জীবনালেখ্য।
নদীমাতৃক পূর্ব বাংলার গ্রামীণ মানুষের জীবনসংগ্রামের কথা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝির পরে আর যে দুটি উপন্যাসে চিত্রিত হয়েছে তার মধ্যে অমরেন্দ্র ঘোষের চর কাসেম এবং অদ্বৈত মল্লবর্মণের তিতাস একটি নদীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আমার অল্প বয়সে আমি চর কাসেম পড়েছি। অমরেন্দ্র ঘোষও ছিলেন নদীবহুল বরিশালের অধিবাসী। চল্লিশের দশকে বা পঞ্চাশে তিনি বাংলাদেশে খ্যাতিমান ছিলেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই তিনি কলকাতায় চলে যান। সেখানে গিয়ে সাহিত্যচর্চা অব্যাহত রেখেছিলেন। তিনি হিন্দু-মুসলমানের সম্প্রীতি ও মিলনে বিশ্বাস করতেন। কলকাতার মূলধারার হিন্দু কথাশিল্পীরা তাঁকে পছন্দ করতেন না। শুনেছি, তিনি কলকাতায় ছিলেন প্রায় পরবাসী।
অমরেন্দ্র ঘোষের পূর্ব বাংলা থেকে চলে যাওয়ায় পূর্ব বাংলার কথাসাহিত্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তার আরেকটি উপন্যাসও প্রশংসিত হয়েছিল : পদ্মদীঘির বেদেনী। পঞ্চাশের শুরুতে কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয় তাঁর উপন্যাস দক্ষিণের বিল (দুই খণ্ড)। সাম্প্রদায়িকতা একটি বহুমাত্রিক বিষয়। তা যে শুধু অন্য ধর্মের মানুষের মধ্যেই বিদ্বেষ ও দূরত্ব সৃষ্টি করে তা-ই নয়, স্বধর্মাবলম্বীর মধ্যেও বিভেদ তৈরি করতে পারে। অমরেন্দ্র ঘোষ ছিলেন একজন সত্যিকারের অসাম্প্রদায়িক বাঙালি –অনেকের মতো ছদ্মবেশী অসাম্প্রদায়িক নন। আমাদের এখানে অদ্বৈত মল্লবর্মণকে নিয়ে যথেষ্ট লেখালেখি হয়েছে, কিন্তু অমরেন্দ্র ঘোষ হারিয়ে গেছেন। আশির দশকে আমি মুক্তধারার স্বত্বাধিকারী চিত্তরঞ্জন সাহাকে অনুরোধ করেছিলাম অমরেন্দ্র ঘোষের চর কাসেম পুনর্মুদ্রণের জন্য। তিনি আমাকে বলেছিলেন একটি দীর্ঘ ভূমিকা লিখে দিতে, কিন্তু নানা কারণে আর হয়ে ওঠেনি। চর কাসেম-এর কলকাতায় সংস্করণ হয়েছিল কিন্তু সমাদৃত হয়নি।
শিল্পকর্ম হিসেবে দুর্বল এবং ভাষা সুপাঠ্য না হলেও কাজী আফসারউদ্দিন। আহমদের চর ভাঙা চর উপন্যাসেও ঢাকা অঞ্চলের নদীতীরের মানুষের জীবনের কথা আছে। বই হিসেবে প্রকাশের আগেই মোহাম্মদীতে চর ভাঙা চর ধারাবাহিক বের হয়েছে। তখনই পড়তাম। তিনি ছিলেন মানিকগঞ্জে আমাদের এলাকার মানুষ। ঢাকায় থাকতেন পুরানা পল্টন নিজের বাড়িতে। আমরা নতুন লেখকেরা তাঁর বাড়িতে যেতাম। তাঁর স্ত্রী বেগম জেবু আহমদ শিশুদের জন্য লিখে নাম করেছিলেন। জেবু আহমদ ছিলেন বিখ্যাত ইংরেজি দৈনিক ডন-এর সম্পাদক এবং পরে পাকিস্তানের বাণিজ্যমন্ত্রী আলতাফ হোসেনের বোন।
জীবনানন্দ দাশ, অমরেন্দ্র ঘোষ, শামসুদ্দীন আবুল কালাম বরিশালের অধিবাসী। জীবনানন্দের সঙ্গে শামসুদ্দীনের ব্যক্তিগত পর্যায়ে খুবই ঘনিষ্ঠতা ছিল। অমিশুক নির্জন স্বভাবের মানুষ হিসেবে সবাই জীবনানন্দকে জানে। শামসুদ্দীন ছাত্রজীবন থেকেই তাঁকে খুব কাছে থেকে দেখেছেন। জীবনানন্দ দ্বারা ছাত্রজীবনে তিনি প্রভাবিত হয়ে কিছুদিন পদ্যচর্চাও করেছেন।
১৯৫৪-র অক্টোবরে দুর্ঘটনায় যখন জীবনানন্দ মারা যান, তখন শামসুদ্দীন ঢাকায়। শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমানসহ ঢাকার তরুণ কবি সাহিত্যিকেরা একটি শোকসভার আয়োজন করেন। সেখানে মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন শামসুদ্দীন। তাতে তিনি বলেছিলেন :
‘বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত কবিতা পত্রিকায় প্রথম জীবনানন্দের কবিতা পড়েছিলাম। তারপর কলকাতায় কবিতার পুরোনো সংখ্যাগুলো কেনার জন্য একদিন ‘কবিতা ভবনে’ যাই। তখন বুদ্ধদেব বাবুই প্রথম তার আশ্চর্য কবিত্বশক্তির কথা বারবার উল্লেখ করেছিলেন। স্কুলে পড়ি তখন, ম্যাট্রিক দেব। সেই কালে আমরা দুই বন্ধু তাঁর অনুসরণে কবিতা লেখার প্রয়াস করেছিলাম।’
জীবনানন্দের স্মৃতিচারণা করে শামসুদ্দীন সেদিন আরও বলেছিলেন :
‘তারপর তাঁকে প্রথম দেখি যখন আমরা আই. এ ক্লাসের ছাত্র। বরিশাল ব্রজমোহন কলেজে ইংরেজির অধ্যাপক ছিলেন তিনি। শ্যাম রঙের স্বাস্থ্যবান মানুষ। চল্লিশোত্তর বয়স তখন। পরনে ধুতি-পাঞ্জাবি, পাম্প-সু। কাঁধে পাট করে রাখা একখানা চাদর, হাতে একটি কি দুটি বই। মুখ তাঁর সর্বদা ভারি, গম্ভীর, চোখে আশ্চর্য সারল্য এবং তীক্ষ্ণতা। লম্বা লম্বা পা ফেলে চলতেন। আমি আর আমার আর এক বন্ধু নির্মল চট্টোপাধ্যায় তাঁকে অবাক হয়ে দেখতাম। কখনো ক্লাসের অবকাশে মাঠের ধারে শুয়ে শুয়ে পড়তাম তার কবিতা। তখনও পর্যন্ত তাঁর শেষতম কাব্যগ্রন্থ ধূসর পাণ্ডুলিপি। কিছুদিন পরে “কবিতা ভবন” থেকে “এক পয়সায় একটি” কবিতা সিরিজে প্রকাশিত হলো তাঁর বনলতা সেন। আমাদের মধ্যে সেদিন রীতিমতো সাড়া পড়ে গিয়েছিল। নতুন বয়সের অনভিজ্ঞ মনের কাছে ধূসর পাণ্ডুলিপি যে সাড়া জাগাতে পারেনি, বনলতা সেন দ্বারা তা সম্ভব হয়েছিল। “বনলতা সেন” কবিতাটি আমরা যত্রতত্র মুখে মুখে আবৃত্তি করে বেড়াতাম। কলেজের এক অনুষ্ঠানেও আবৃত্তি করলাম একদিন।
একসময় জীবনানন্দের সঙ্গে শামসুদ্দীনের ব্যক্তিগত পর্যায়ে সম্পর্ক সৃষ্টি হয়।
দুই
জীবনানন্দ দাশকে তাঁর প্রথম জীবনে খুব কাছে থেকে দেখেছেন এমন মানুষের সংখ্যা দুই বাংলাতেই কম। তাঁর জীবনের একটি বড় সময় কেটেছে তার জন্মস্থান বরিশালে। ব্রজমোহন কলেজে তিনি শিক্ষকতা করেছেন। কলকাতার খ্যাতিমানদের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল না বললেই চলে। তিরিশ ও চল্লিশের দশকে তার ছাত্ররা বরিশালে তাঁকে কাছে থেকে দেখেছেন বটে, তবে ঘনিষ্ঠভাবে মেশার সুযোগ পাননি। সে জন্য দায়ী তাঁর লাজুক স্বভাব। লোকজনের সঙ্গে মেলামেশায় তাঁর আগ্রহের অভাব। অথচ তিনি কোনো অহংকারী মানুষ ছিলেন না। শামসুদ্দীন আবুল কালাম ছিলেন তাঁর সাক্ষাৎ ছাত্র। জীবনানন্দকে তিনি গভীর শ্রদ্ধা করতেন। তিনি তাঁর সেই স্মৃতিচারণামূলক লেখায় বলেছিলেন :
‘একদিন বাড়িতে গেলাম তার। কলেজে তাঁর প্রখর গাম্ভীর্যের জন্য কাছে এগোতো না কেউ। সবারই ধারণা ছিল তিনি ভীষণ রাশভারী প্রকৃতির লোক। আমরাও অবকাশ পেতাম না কথা বলার। তাঁর বাড়ি একটা মেয়েস্কুলের কম্পাউন্ডের মধ্যে। খুব সম্ভবত সে ইস্কুলটা তাঁর পিতারই প্রতিষ্ঠিত ছিল। বাংলো ধরনের বাড়ির উপরে শণের চাল। বেড়া আধেক ইট আর আধেক বাঁশের। কিন্তু ভিতরে সাহিত্য পাঠকের কাছে আশ্চর্য এক জগৎ। বই, বই আর বই। বাংলার, বাংলার বাইরের, অসংখ্য পত্রিকা। সবই সযত্নে গুছিয়ে রাখা দেখে মনে হয় বার বার পড়া। একধারে একটা ছোটো টেবিল। হয়তো তাঁর লেখার। অন্দরে ছিলেন তাঁর স্ত্রী এবং বালিকা কন্যা মঞ্জু দাশ। তাঁরাও কবিরই মতো স্বল্পভাষী– নির্জনতাপ্রিয়। সেইকালে, মঞ্জু দাশের বোধ হয় বয়স দশ কি বারো, বঙ্গশী পত্রিকায় একটি কবিতা প্রকাশিত হয়েছিলো।’
জীবনানন্দের কাছে গিয়ে শামসুদ্দীন ও তাঁর বন্ধুদের তাঁর সম্পর্কে ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়। তিনি চুপচাপ থাকতে পছন্দ করলেও কথা বলার মানুষ পেলে গল্পসল্প করতেন। তাঁর মধ্যে শিশুসুলভ সারল্য ছিল। শামসুদ্দীনের ভাষায় :
‘সেদিন তার বাড়িতে না গেলে “জীবনানন্দবাবু অসামাজিক মানুষ” এই ধারণা করেই চিরদিন দূরে দূরে থেকে যেতাম। সে ধারণা অচিরেই ভেঙে গেলো। অমন রাশভারী চেহারার ভিতরে একটি সহজ সরল শিশুর মন খুঁজে পেয়ে আমরা চমৎকৃত হয়ে গেলাম।’
তিরিশের দশকে ছাত্রজীবন থেকেই শামসুদ্দীন কবিতা-গল্প-প্রবন্ধ– ‘কতকী’ লিখতেন। তাঁর চলাফেরা ছিল বাম প্রগতিশীল কবি-সাহিত্যিকদের সঙ্গে। সমাজের নিচতলার মানুষের প্রতি ছিল তাঁর সহানুভূতি। জীবনানন্দের দ্বারা প্রথম দিকে অনেকটা প্রভাবিত ছিলেন। তিনি জানান :
‘এই সময় কলেজে একদিন তার সঙ্গে কথা বলছি, এমন সময় প্রগতিশীল [এক] ছাত্র-কবি হঠাৎ কথার মাঝখানেই তাঁকে প্রশ্ন করলে : “আপনি জনগণের জন্য লেখেন না কেন?” তার সাহস দেখে আমরা স্তম্ভিত হয়ে গেলাম।
‘জীবনানন্দ বাবু এমন প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। কয়েকবার তার এবং আমার মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি আস্তে প্রশ্ন করলেন : “তুমি এই প্রগতিশীল সাহিত্য-আন্দোলনের মধ্যে আছো বুঝি?”
‘সে বললে : “হ্যাঁ। অবশ্যই। আমরা এই সমাজ-ব্যবস্থাকে বদলাতে চাই; কায়েম করতে চাই শোষণহীন সমাজ-ব্যবস্থা। যেখানে কবি ও সাহিত্যিকেরাও আমাদের সঙ্গে আসবেন তাদের বুর্জোয়া, পেটি-বুর্জোয়া শ্রেণি ত্যাগ করে– মার্কসবাদ যে নতুন পথ দেখিয়েছে–।”
‘কথার মাঝখানেই জীবনানন্দ বাবু হঠাৎ প্রশ্ন করলেন : “তুমি কার্ল মার্কস পড়েছো? ডস ক্যাপিটাল?”
‘ছাত্র “কবি”টি থতমত খেয়ে বললে : না।
‘জীবনানন্দ বাবু একটু কাল তার দিকে তাকিয়ে থেকে হাসি গোপনের বহু চেষ্টা করেও অকস্মাৎ উচ্চহাস্যে ফেটে পড়লেন। হঠাৎ সে হাসি। এমন আচম্বিতে [সে হাসি] বেরিয়ে আসা যে, অবাক হয়ে দেখতে হয় তাঁকে। সঙ্গে হাসা যায় না।
‘ছাত্রটি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে পালিয়ে বাঁচলো।’
নজরুল ইসলামের অট্টহাসি নিয়ে অজস্র লেখালেখি হয়েছে। মাইলখানেক দূর থেকে তা শোনা যেত। তাঁর হাসির কারণে পাড়া-প্রতিবেশীর ঘুম হারাম হয়েছে। অনেকে অভিযোগ করেছেন, কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। নজরুলের হাসি ছিল প্রাণমাতানো এবং তাঁর শ্রোতাদের মতে উপভোগ্য। তাঁর সমসাময়িক আরও দুই কবিও ছিলেন অট্টহাসিতে অভ্যস্ত। তাঁরা হলেন জীবনানন্দ দাশ ও বুদ্ধদেব বসু। বসু ছিলেন ছোটোখাটো হালকা পাতলা মানুষ, নজরুলের মতো সিংহের শক্তি তাঁর ছিল না, কিন্তু তাঁর হাসিও আধা কিলোমিটার দূর থেকে শোনা যেত। রিপন কলেজ বা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি আছেন কি না, তা তাঁর সহকর্মী ও ছাত্ররা জানতে পারতেন তার হাসির শব্দ থেকে। এ কথা জানান খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ ভবতোষ দত্ত।
জীবনানন্দের হাসির বৈশিষ্ট্য ছিল অন্য রকম। হঠাৎ হেসে উঠতেন খুব জোরে। কী কারণে হাসছেন, তা স্পষ্ট ছিল না। শামসুর রাহমান যখন তাঁর বাসায় তার সঙ্গে দেখা করতে যান কলকাতায় তখনো তিনি জীবনানন্দের হাসি শুনে বিস্মিত হয়েছিলেন। সে গল্প শামসুর রাহমান বহুবার আমাদের বলেছেন। হঠাৎ কী কারণে হেসে উঠলেন, তা বোঝার আগেই হাসি মিলিয়ে গেল। শামসুর রাহমানের ভাষায়, দুনিয়ার কোনো কিছুর সঙ্গেই সে হাসির কোনো সম্পর্ক নাই। এবং সে হাসির স্থায়িত্বও খুব কম।
জীবনানন্দের হাসি উপভোগের অভিজ্ঞতা শামসুদ্দীনেরও ছিল। তাঁর ভাষায় :
‘জীবনানন্দ বাবুর এই হাসিটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আবেগকে চেপে রাখতে অভ্যস্ত ছিলেন তিনি। ভালো লাগার আবেগকেও। অসংযত জীবনযাপন তো দূরের কথা– রচনাও ছিল সংযমী। হাসির আবেগকেও লুকিয়ে রাখতে চাইতেন তিনি। অনেক সময় দেখা গেছে, যে-হাসির প্রসঙ্গ উত্তীর্ণ হয়ে গেছে অনেকক্ষণ, সেইকালে অকস্মাৎ বাঁধভাঙার মতো করে বেরিয়ে পড়েছে তার হাসি। তবু এমন হাসতে তাকে তার বন্ধুবান্ধব ছাড়া কেউ কখনো দেখেনি।
প্রতিবেশী হিসেবে জীবনানন্দকে খুব কাছ থেকে দেখে তাঁর প্রকৃত স্বরূপটি ধরতে পেরেছিলেন শামসুদ্দীন। তিনি বলেছেন,
‘বন্ধু-সংখ্যা তাঁর প্রচুর নয়। অচিন্ত্য বাবু, প্রেমেন বাবু তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বুদ্ধদেব বাবুও শ্রদ্ধা করতেন তাঁকে খুব।’ শামসুদ্দীন আরও জানান, যারা তাঁর সঙ্গে অন্তরঙ্গভাবে মিশেছেন তাঁরা তাঁর সত্যিকারের মনটিকে চিনেছেন। নয়তো বাইরে তিনি নির্জনতাপ্রয়াসী, আত্মকেন্দ্রিক, অর্থাৎ ভদ্রতাহীন ভাষায় “অসামাজিক” বলেই পরিচিত ছিলেন। বরিশালের মতো মফস্বল শহরে থেকেও তাঁর মনকে আমি কোনোদিন হাঁপিয়ে উঠতে দেখিনি। নিজের বাড়ি, তাঁর সামনের মাঠ এবং ইংরেজি সাহিত্যের অসংখ্য কাব্য ও কবিতার বই-ই ছিল তাঁর সবচেয়ে বড় সুহৃদ।’
সমবয়সী হলেও বিপুল খ্যাতিমান নজরুলকে জীবনানন্দ সমীহ করতেন। বাংলা কবিতায় তাঁর অতুলনীয় অবদান এবং জাতীয় জীবনে তার ভূমিকার প্রশংসা করতেন। তাঁদের মধ্যে ব্যক্তিগত পর্যায়ে মেলামেশার সুযোগ ঘটেনি। প্রথম দিকে জীবনানন্দ নজরুলের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। শোকসভায় শামসুদ্দীন বলেছিলেন :
‘কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ ছিল ঝরা পালক। সুন্দর সাবলীল ছন্দোবদ্ধ কবিতা। নজরুল ও সত্যেন দত্তের কথা মনে পড়িয়ে দেয় সে-সব কবিতা।’
স্মৃতি রোমন্থন করে শামসুদ্দীন তাঁর প্রবন্ধটিতে লিখেছিলেন : “বরিশাল থেকে। তিনি চলে গেলেন কলকাতায় দেশভাগের পরেই। বরিশালে আমরা তার অত্যন্ত কাছাকাছি এসেছিলাম। তিনি আমার বরিশালের বাসায় এসেছেন অনেকদিন। আমাদের ছোটো টিনের ঘরের দোতলায় তাঁকে সাহিত্যের আড্ডায়ও পেয়েছি। একদিন সেই আড্ডায় অচিন্ত্য কুমারকে দেখে তিনি অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে উঠেছিলেন বলে মনে পড়ছে। মনে তাঁর কোনো ঘোরপ্যাঁচ বা সঙ্কীর্ণতা ছিল না– সহজ সরল, সাদাসিধে এবং নিরহঙ্কার ছিলেন তিনি। আরও ছিলেন বিনয়ী।
চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকটি ছিল রাজনৈতিকভাবে অস্থির। জীবিকা উপার্জনে হিমশিম খেয়েছেন জীবনানন্দ। বরিশাল থেকে গিয়ে কলকাতায় থাকতেন ১৮৩ ল্যান্সডাউন রোডে। দৈনিক স্বরাজ পত্রিকার রবিবারের সাময়িকীর সম্পাদনা করতেন কিছুদিন। তখনো শামসুদ্দীন তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছেন। জীবনানন্দ একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগও নিয়েছিলেন, সে তথ্য দিয়েছেন তিনি:
‘স্বরাজ বন্ধ হয়ে যাবার পরে একটা মাসিক পত্রিকা প্রকাশের সঙ্কল্প করেছিলেন তিনি, আমি ও নির্মল চট্টোপাধ্যায় মিলে। কিন্তু বিজ্ঞাপন সংগ্রহে তিনজনই অপটু ছিলাম বলে শেষ পর্যন্ত সাহসে কুলালো না।’
শামসুদ্দীনের সহপাঠী বন্ধু ছিলেন নির্মল চট্টোপাধ্যায়, লেখালেখি করতেন, তবে বেশি দূর যেতে পারেননি কলকাতায় গিয়ে। কলকাতায় গিয়ে বড়িষা ও খড়গপুর কলেজে বছর দুই অল্প বেতনে জীবনানন্দ অধ্যাপনা করেন। কলকাতা থেকে শামসুদ্দীন চলে আসেন ঢাকায়। তাঁর জীবনের অন্যতম ব্রত ছিল হিন্দু মুসলমানের মিলন। কিন্তু দুই সম্প্রদায়ের নেতাদের নীতি ছিল বিপরীত। কলকাতায় একসঙ্গে হেঁটেছেন, গল্প করেছেন। তিনি লিখেছেন : ‘দেশভাগের অব্যবহিত পরেই কলকাতার অর্থনৈতিক জীবনে যে আলোড়ন এসে পড়েছিল, তাতে করে বেশি দিন আর সম্পর্ক রাখা চললো না। ঢাকায় আসার পর আর তার সঙ্গে দেখা হয়নি। গত বছর (১৯৫৩) কালকাতায় বন্ধু নির্মল চট্টোপাধ্যায়ের কাছে শুনেছিলাম তিনি কোথায় হাওড়া গার্লস কলেজ] অধ্যাপনার কাজ নিয়েছেন। প্রশ্ন করে জেনেছিলাম, আমার খোঁজখবরও তিনি নিতেন নির্মলের কাছ থেকে।’
শোকসভায় শামসুদ্দীন বলেছিলেন : ‘তাঁর খ্যাতি সাহিত্যমহলের চৌকাঠ পেরিয়ে সাধারণ্যে পৌঁছায়নি। কারণ তিনি ছিলেন স্বল্পবাক, চলতেন ভিড় এড়িয়ে, লিখতেন না ঘন ঘন, সভায় হতেন না সভাপতি, না করতেন বক্তৃতা। সবচেয়ে বড় কথা, না ছিলেন তথাকথিতভাবে “ফ্যাসিবাদবিরোধী” বা “প্রগতিশীল”। …কিন্তু তার জন্য, তাঁকে আমি জানতাম বলেই বলতে পারি খেদ করতে দেখিনি কোনোদিন। বরঞ্চ যাদের কাছে তিনি শ্রদ্ধা পেয়েছিলেন, তাঁরা মুষ্টিমেয় হলেও, তাদের নিয়েই তিনি খুশি থেকেছেন। তিনি নিজেই বলতেন : খ্রিষ্টান পাদরীরা যেমন জনতার হাজার হাজার বর্গমাইলের দিকে তাকিয়ে বাইবেল বিতরণ করেন, শ্ৰেষ্ঠকাব্য সে রকমভাবে বিতরিত হবার জিনিস নয়।
‘কথাটি অবশ্য তাঁর নিজের কবিতা সম্বন্ধে তিনি বলেননি।’
জীবনানন্দ দাশ ‘বামপন্থী’ বা প্রগতিবাদী কবি ছিলেন না বটে কিন্তু যাঁরা নিজেদের ওই পন্থী বলে ঘোষণা করতেন বা দাবি করতেন তাঁরা কার্ল মার্কসের ক্যাপিটাল না পড়লেও তিনি পড়ছিলেন বলে শামসুদ্দীন জানতেন।
পঞ্চাশের দশকে শামসুদ্দীন আবুল কালাম পূর্ব পাকিস্তান সরকারের ডিপিআর বা জনসংযোগ বিভাগের সহকারী পরিচালক ছিলেন। থাকতেন আজিমপুর কলোনির ফ্ল্যাটে। আমরা থাকতাম কলোনির পাশেই শেখ সাহেব বাজারে। তিনি সুদর্শন ছিলেন। মুখে চমৎকার দাড়ি ছিল। ফ্যাশনের দাড়ি, ধর্মীয় দাড়িনয়। সাহিত্যচর্চাছাড়া চলচ্চিত্রে তার আগ্রহ ছিল। ইতালি গিয়েও তিনি চলচ্চিত্র নিয়ে গবেষণা করেছেন। তাঁর একটি প্রজেক্টরও ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গঠনে কাজ করেছেন। লন্ডনে আবু সাঈদ চৌধুরী এবং প্যারিসে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। শামসুদ্দীন ছিলেন বাঙালি জাতীয়তাবাদী। কলকাতা থাকা অবস্থাতেই শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তাঁর জানাশোনা ছিল। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর সে সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হয়। তাঁর যে সিনেমার ব্যাপারে উৎসাহ রয়েছে, তা শেখ মুজিব জানতেন। স্বাধীনতার পর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বঙ্গবন্ধু যখন লন্ডন যান, তখন শামসুদ্দীন রোম থেকে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করেন। তাঁকে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আপনি দেশে চলে আসেন। আপনাকে চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশনের পরিচালক নিয়োগ দেব।’
প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধে শামসুদ্দীন ঢাকায় এসেছিলেন। প্রায় এক মাস ছিলেন। লেখকসমাজ থেকে কোনো অভ্যর্থনা পাননি। লেখক-শিল্পীদের মধ্যে প্রভাবশালী যারা তারা যার যার মতো সরকারের আনুকূল্য পেতে ব্যস্ত ছিলেন। বেইলি রোডের গণভবনে এবং ধানমন্ডি বঙ্গবন্ধু ভবনে কয়েক দিন শামসুদ্দীন গিয়েছিলেন, কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাকে কেউ দেখা করার ব্যবস্থা করে দেননি। ঢাকায় কয়েক দিন ঘোরাফেরা করে হতাশ হয়ে রোমে ফিরে যান। সেখানে গিয়ে বাংলাতেই উপন্যাস লিখেছেন কিন্তু দেশের সঙ্গে স্থায়ী দূরত্ব রচিত হয়েছিল শামসুদ্দীন আবুল কালামের।