২৮. আবদুল মুত্তালিবের পুত্ৰ যবেহ করার মানত

আবদুল মুত্তালিবের পুত্ৰ যবেহ করার মানত

ইবন ইসহাক বলেন, যমযম খনন করার সময় কুরাইশের সঙ্গে আবদুল মুত্তালিবের যে বিবাদ হয়েছিল, তার প্রেক্ষিতে তিনি মানত করেছিলেন যে যদি তার দশটি সন্তান জন্ম নেয় এবং বয়ঃপ্রাপ্ত হয়ে তাকে শক্ৰদের থেকে রক্ষা করার উপযুক্ত হয়, তাহলে তাদের একজনকে কা’বার নিকটে আল্লাহর উদ্দেশ্যে জবাই করবেন। যখন তাঁর সন্তান সংখ্যা দশে উপনীত হয় এবং তিনি উপলব্ধি করলেন যে, তারা তাকে রক্ষা করতে সমর্থ, তখন তাদের সকলকে একত্রিত করে তিনি তার মানতের কথা অবহিত করলেন এবং তা বাস্তবায়নের জন্য তাদের প্রতি আহবান জানালেন। তারা হলেন হারিছ, যুবায়র, হাজাল, যেরার, মুকাওয়িম, আবু লাহাব, আব্বাস, হামযা, আবু তালিব ও আবদুল্লাহ। পিতার আহবানে সাড়া দিয়ে পুত্ররা বললেন, আমরা কিভাবে আপনার এই মানত পূরণ করতে পারি? আবদুল মুত্তালিব বললেন, তীরে নিজের নাম লিখে আমার কাছে নিয়ে এসো। পুত্ররা তা করলেন। আবদুল মুত্তালিব তাদেরকে কা’বার অভ্যন্তরে হোবল দেবতার মূর্তির নিকট নিয়ে যান।

উল্লেখ্য যে, কা’বার জন্য নিবেদিত উপঢৌকনাদি কা’বা স্থিত একটি গহবরে রাখা হত । আর হোবলের নিকট সাতটি লটারীর তীর ছিল। বিশেষ কোন সমস্যা দেখা দিলে মুশরিকরা তার নিকট গিয়ে লটারী ফেলে মীমাংসায় আসত। বিশেষ প্রক্রিয়ায় এই তীর থেকে যে নিদের্শনা পাওয়া যেত, তাই তারা সর্বান্তকরণে মেনে নিত।

আবদুল মুত্তালিব পুত্রদের নিয়ে হোবলের কাছে গেলেন এবং যথারীতি লটারী তীর তুললেন। নাম আসল আবদুল্লাহর। আবদুল্লাহ ছিলেন পুত্রদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ এবং তাঁর সর্বাধিক প্রিয়। আবদুল মুত্তালিব পুত্র আবদুল্লাহর হাত ধরলেন এবং ছুরি নিয়ে তাকে জবাই করার জন্য আসাফ ও নায়েলা প্রতিমা দুইটির দিকে অগ্রসর হলেন। তা দেখতে পেয়ে কুরাইশ তাদের মজলিস থেকে দৌড়ে এসে বলল, আবদুল মুত্তালিব! আপনার উদ্দেশ্য কী? আবদুল মুত্তালিব বললেন, আমি একে জবাই করব। কুরাইশ এবং আবদুল মুত্তালিবের পুত্ররা বললেন, আল্লাহর কসম! কোন নিশ্চিত বিকল্প না হওয়া পর্যন্ত আপনি একে জবাই করতে পারবেন না। যদি তা’ করেন, তাহলে পুত্ৰ বলি দেওয়ার ধারা চালু হয়ে যাবে। তাহলে মানুষের নিরাপত্তা কেমন করে রক্ষিত হবে ?

ইউনুস ইবন বুকায়র ইবন ইসহাক থেকে বর্ণনা করেন যে, জবাই করার জন্য যখন আবদুল মুত্তালিব আবদুল্লাহকে পায়ের নীচে চেপে ধরেন, তখন আব্বাস আবদুল্লাহকে পিতার পদতল থেকে টেনে সরিয়ে নেন। এর কারণে আবদুল মুত্তালিব আব্বাসের মুখমণ্ডলে এমন প্রচণ্ড আঘাত করেন যে, মৃত্যু পর্যন্ত সে আঘাতের দাগ থেকে যায়।

অতঃপর কুরাইশরা আবদুল মুত্তালিবকে পরামর্শ দিল যে, হিজাযে একজন গণক ঠাকুরণী আছে। তার অনুগত জিন আছে। তার কাছে গিয়ে আপনি এ বিষয়ে আলাপ করুন। তারপর সে আপনাকে যা আদেশ করে, আপনি তা-ই করুন, তাতে আমরা আপনাকে বাধা দিব না। যদি সে আবদুল্লাহকে জবাই করতে বলে, আপনি তা-ই করতে পারবেন। আর যদি আবদুল্লাহকে নিষ্কৃতি দিয়ে আপনাকে অন্য কোন পরামর্শ দেয়, তবে তা-ও আপনি মেনে নেবেন ।

সে মতে আবদুল মুত্তালিব দল-বলসহ মদীনা অভিমুখে রওয়ানা হলেন । মদীনা শহরে এসে তিনি গণকের সাক্ষাৎ পেলেন। তার নাম ছিল সাজাহ। আবদুল মুত্তালিব তার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করলেন এবং নিজের সমস্যার কথা জানালেন। বিস্তারিত শুনে গণক ঠাকুরানী বলল, আজ। আপনারা ফিরে যান, আমার অনুগত জিন যখন আসবে; তখন তার কাছ থেকে আমি এ সমস্যার সমাধান জেনে রাখব। আবদুল মুত্তালিব সঙ্গীদের নিয়ে ফিরে গেলেন। গণক ঠাকুরণীর নিকট থেকে বের হয়ে এসে আবদুল মুত্তালিব আল্লাহর নিকট দোয়া করতে লাগলেন। পরদিন যথাসময়ে তারা গণক ঠাকুরণীর নিকট গিয়ে উপস্থিত হন। গণক ঠাকুরণী বলল, আপনাদের সমস্যার সমাধান আমি পেয়ে গেছি। আচ্ছা, আপনাদের সমাজে মুক্তিপণের পরিমাণ কত? তারা বলল, দশটি উট। গণক ঠাকুরণী বলল, আপনারা দেশে ফিরে যান। গিয়ে দশটি উট নিন। এই দশটি উট ও ছেলেটির মধ্যে লটারী করুন। লটারীতে যদি ছেলেটির নাম আসে, তাহলে আরও দশটি উটি নিয়ে আবারো লটারী করুন। আর যদি উটের নাম আসে, তাহলে পুত্রের স্থলে উটগুলো জবাই করুন। এতেই তোমাদের প্রভু সন্তুষ্ট হয়েছেন বলে ধরে নেয়া যাবে। ছেলেটির জীবনও তাতে বেঁচে যাবে।

আবদুল মুত্তালিব সঙ্গীদের নিয়ে মক্কায় ফিরে আসলেন। সকলের সম্মতিক্রমে লটারী শুরু হলো। আবদুল মুত্তালিব আল্লাহর নিকট দোয়া করতে লাগলেন। দশটি উট এবং আবদুল্লাহকে উপস্থিত করা হল । লটারী টানা হলো। নাম আসল আবদুল্লাহর। এবার আরো দশটি উট বাড়িয়ে লটারী দেওয়া হলো। এভাবে দশটি করে উট বাড়িয়ে লটারী টানা হলো । কিন্তু প্রতিবারই আবদুল্লাহর নাম উঠতে লাগল। অবশেষে একশত উটি আর আবদুল্লাহর মধ্যে লটারী দেওয়া হলে উটের নাম উঠলো। আবদুল মুত্তালিব তখন হােবলের নিকট দাঁড়িয়ে আল্লাহর কাছে দেয়া করছিলেন। কুরাইশের লোকেরা তাঁকে বলল, সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে। আল্লাহ। আপনার প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন। কিন্তু আবদুল মুত্তালিব বললেন, না, এতে হবে না। আরো তিনবার লটারী না করে আমি নিশ্চিত হতে পারছি না। অগত্যা লোকেরা আরো তিনবার লটারী দিল। প্রতিবারই উটের নাম আসল। এবার উটগুলো জবাই করা হলো আর আবদুল্লাহ বেঁচে গেলেন ।

এক বর্ণনায় আছে যে, উটের সংখ্যা একশ’তে পৌছার পরও আবদুল্লাহর নাম আসে। তখন আরো একশত বাড়িয়ে লটারী দেওয়া হয়। এবারও আবদুল্লাহর নাম আসলে উট আরো একশত বাড়ানো হয়। এভাবে তিনশত উটি আর আবদুল্লাহর মাঝে লটারী দেওয়ার পর উটের নাম আসে। তখন গিয়ে আবদুল মুত্তালিব উটগুলো জবাই করেন। তবে প্রথম বর্ণনাটিই বিশুদ্ধতর । আল্লাহই ভাল জানেন ।

এক বর্ণনায় আছে যে, জনৈক মহিলা ইবন আব্বাস (রা)-এর নিকট এসে জিজ্ঞাসা করে যে, সে মানত করেছিল কাবার নিকটে তার একটি সন্তান বলি দেবে। এখন তার করণীয় কী? জবাবে ইবন আব্বাস (রা) তাকে একশত উট জবাই করার আদেশ দেন এবং মহিলাকে আবদুল মুত্তালিবের ঘটনাটি শুনিয়ে দেন। আবার মহিলা আবদুল্লাহ্ ইবন উমর (রা)-কে সমস্যাটির কথা জানালে তিনি কোন সিদ্ধান্ত দানে বিরত থাকেন। মারওয়ান ইবন হাকাম তখন মদীনার গভর্নর। তিনি সংবাদ শুনে বললেন দু’জনের একজনেৰ সিদ্ধান্তও সঠিক হয়নি। অতঃপর তিনি মহিলাকে পুত্ৰ জবাই করতে নিষেধ করে দিয়ে তার সাধ্যমত সৎকাজ করতে আদেশ দেন। উট জবাই করার আদেশ তিনি দিলেন না। পরে এরূপ সমস্যায় মানুষ মারওয়ানের ফয়সালা অনুযায়ীই আমল করতে শুরু করে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *