২৪. সাবা মুআল্লাকার অন্যতম রচয়িতা ইমরুল কায়স ইব্‌ন হুজর আল-কনদী

সাবা মুআল্লাকার অন্যতম রচয়িতা ইমরুল কায়স ইব্‌ন হুজর আল-কনদী

জাহেলিয়াত আমলের কবিদের কাব্য সংকলন সাব’য়ে মু’আল্লাকার ইমরুল কায়সের অংশটুকু সর্বাধিক উন্নত ও প্রসিদ্ধ— যার প্রথম পংক্তি হলো –

দাঁড়াও, প্রিয়তমা ও তার বাসগৃহের বিরহে একটু কেঁদে নিই।

ইমাম আহমদ (র) হযরত আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন : ইমরুল কায়স জাহান্নামগামী কবিদের পতাকাবাহী। বিভিন্ন সূত্রে হাদীসটি বর্ণিত হলেও এটির সনদ বিশুদ্ধ।

হাফিজ ইব্‌নে আসাকির বলেছেন, ইমরুল কায়সের বংশ লতিকা হলো, ইমরুল কায়স ইব্‌ন হাজার ইব্‌ন হারিছ ইব্‌ন আমর ইব্‌ন হুজুর ইব্‌নে আমর ইব্‌ন মুআবিয়া ইব্‌ন হারিছ ইব্‌নে ইয়ারাব ইব্‌ন ছাওর ইব্‌ন মুরতা ইব্‌নে মুআবিয়া ইব্‌ন কিনৃন্দা। উপনাম আবু ইয়ামীদ, মতান্তরে আবু ওহাব ও আবুল হারিছ আল কিনদী। তিনি দামেশক এলাকায় বাস করতেন। তিনি তাঁর কবিতায় ঐ এলাকার বিভিন্ন স্থানের উল্লেখ করেছেন। তার দুটি পংক্তি নিম্নরূপঃ

— তোমরা দাঁড়াও, এসো, আমরা প্ৰিয়তমা
ও তার বাসস্থানের বিরহে একটু কেঁদে নিই,
যে বাসস্থান বালির টিলার চূড়ায় দাখূল ও হাওমাল,
তূযিহ ও মাকরাত নামক স্থানের মাঝে অবস্থিত,
উত্তর ও দক্ষিণের বায়ূ প্রবাহ সত্ত্বেও যার চিহ্ন মুছে যায়নি।

এইগুলি হূরান অঞ্চলের প্রসিদ্ধ স্থান।

হাফিজ ইব্‌নে আসাকির অন্য এক সূত্রে বর্ণনা করেন যে আকীফ ইব্‌ন মাদীকরব বলেছেন, আমরা একদিন রাসূলুল্লাহ (সাঃ)- এর নিকট বসা ছিলাম। সে সময়ে ইয়ামানের একটি প্রতিনিধি দল এসে বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! ইমরুল কায়সের কবিতার দুটি পংক্তির উসিলায় আল্লাহ আমাদের জীবন রক্ষা করেছেন। রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, তা কীভাবে? তারা বলল, আমরা আপনার সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে আসছিলাম। কিছুদূর এসে আমরা পথ হারিয়ে ফেলি, ফলে সেস্থানে আমাদের তিনদিন অবস্থান করতে হয়। অথচ, আশেপাশে কোথাও পানি পাওয়া যাচ্ছিল না। অগত্যা গাছের ছায়ায় শুয়ে মৃত্যুবরণের উদ্দেশ্যে আমরা এক একজন এক একটি খেজুর গাছ ও বাবলা গাছের নীচে চলে গেলাম। আমাদের প্রাণ যায় যায় দশা। হঠাৎ দেখতে পেলাম, একজন উষ্ট্রারোহী এগিয়ে আসছে। তাকে দেখে আমাদের একজন কবিতা আবৃত্তি করল :

প্রিয়া যখন বুঝতে পারল যে, ঘাট-ই তার লক্ষ্যস্থল, আরো বুঝল যে, তার পার্শ্বদেশ আর কাঁধের মধ্যস্থলের গৌশত হতে শুভ্রতা বিচুরিত হচ্ছে, তখন সে জারিজের নিকটস্থ সেই কূপে যেতে মনস্থ করল, যে কপি ছায়া ও কাটাদার বৃক্ষে পরিপূর্ণ।

পংক্তি দুটো শুনে আরোহী বলল, এগুলো কার কবিতা? সে তো আমাদের দুর্দশা দেখে ফেলেছে। আমরা বললাম, এগুলো ইমরুল কায়সের কবিতা! আরোহী বলল, আল্লাহর শপথ, সে একটুও মিথ্যা বলেনি। তোমাদের পার্শ্ববতী এই জায়গাটিই জারিজ। সত্যি সত্যি আমরা তাকিয়ে দেখলাম যে, আমাদের ও কৃপটির মাঝে দূরত্ব মাত্র পঞ্চাশ হাতের। ফলে আমরা হামাগুড়ি দিয়ে সেখানে গেলাম। দেখলাম, তা ইমরুল কায়সের বিবরণ অনুযায়ী হুবহু ছায়া ও কাটাদার বৃক্ষবেষ্টিত একটি কুয়া। এ কাহিনী শুনে রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন,

লোকটি দুনিয়াতে বহুল আলোচিত, পরকালে কেউ তার কথা জিজ্ঞাসাও করবে না, দুনিয়াতে সে সন্ত্ৰান্ত, পরকালে লাঞ্ছিত; তার হাতে কবিদের পতাকা থাকবে, তাদেরকে জাহান্নামের দিকে পরিচালিত করবে।

কালবী লিখেছেন, ইমরুল কায়স একবার পিতৃ হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য পতাকা উড়িয়ে বনু আসাদের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য রওয়ানা হয়। তাবালা নামক স্থানে ছিল যুল-খুলসা নামক একটি মূর্তি। আরবরা তার নিকট লটারী টানত। ইমরুল কায়স সেস্থানে পৌঁছে লটারী টানল। কিন্তু লটারীতে নেতিবাচক তীর উঠে আসে। ফলে সে আরও দুবার লটারী টানে। তাতেও ঐ একই ফল হয়। ইমরুল কায়স ক্ষিপ্ত হয়ে তীরগুলি ভেঙ্গে যুল- খুলসার মুখের উপর ছুড়ে মারে এবং বলে যে, তোর বাবা যদি খুন হতো, তবে তুই আমার কাজে বাধ সাধতে না। এই বলে সে বনু আসাদ গোত্রের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং তাদের অনেককে হত্যা করে।

ইবনুল কালবী বলেন, এরপর ইসলামের অভু্যদয় পর্যন্ত ইমরুল কায়স কখনো যুলখুলসার নিকট লটারী টানেনি।

কথিত আছে যে, ইমরুল কায়স কোনো এক যুদ্ধে রোমের বাদশা কায়সারের বিজয়ে তার ভূয়সী প্রশংসামূলক কবিতা রচনা করে। কিন্তু, কাজ্যিক্ষত পুরস্কার না পেয়ে পরে সে উল্টো তার নিন্দাসূচক কবিতা রচনা করে। কথিত আছে, রোম সম্রাট বিষ খাইয়ে তাকে হত্যা করে। আসীব নামক একটি পাহাড়ের সন্নিকটে জনৈক মহিলার কবরের পার্শ্বে তাকে সমাধিস্ত করা হয়। পরে সেখানে নিম্নের পংক্তি দুটি লিখে রাখা হয়েছে—

হে আমার প্রতিবেশিনী! নিঃসন্দেহে আমাদের সাক্ষাতস্থল নিকটেই। আসীব পর্বত যতদিন টিকে থাকবে, আমিও এখানে ততদিন অবস্থান করব। হে প্রতিবেশিনী! তুমি-আমি দুজন-ই এখানে মুসাফির। আর এক মুসাফির অপর মুসাফির-এর আত্মীয়েরই মত।

ঐতিহাসিকগণ বলেন, সাতটি মুআল্লাকাই কাবা শরীফে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। তার কারণ, আরবদের নিয়ম ছিল যে, তাদের কেউ কোন কবিতা রচনা করলে সে তা কুরায়শদের নিকট পেশ করত। কুরায়শদের অনুমোদন পেলে সম্মনার্থে তা কাবার গায়ে ঝুলিয়ে রাখা হত। এভাবে একত্রিত হতে হতে এই সাতটি মুআল্লাকা একত্রিত হয়ে যায়। তার প্রথমটি হল ইমরুল কায়স ইব্‌ন হজর-এর রচিত, যার প্রথম পংক্তিটি পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে।

দ্বিতীয় মুআল্লাকা নাবিগা যুবিয়ানীর রচিত, যার নাম ছিল যিয়াদ ইব্‌ন মুআবিয়া, মতান্তরে

মুররা ইব্‌ন আউফ ইব্‌ন সাদ ইব্‌ন যুবইয়ান ইব্‌ন বাগীয। তার প্রথম পংক্তি হলো :

উলইয়া ও সানাদে অবস্থিত হে আমার প্রিয়ার গৃহ! সে অতীত হয়ে গেছে আর তার বিরহ অনেক দীর্ঘ হয়ে গেল!

যার প্রথম পংক্তিঃ

দাররাজ ও মুতাছাল্লামের কঠিন ভূখণ্ডে অবস্থিত এই নীরব ধ্বংস স্তুপ-ই কি আমার প্রিয়তমা উন্মে আওফার স্মৃতি?

চতুর্থ মুআল্লাকার রচয়িতা হলো, তারফা ইবনুল আবদ ইব্‌ন সুফিয়ান ইব্‌ন সাদ ইব্‌ন মালিক ইব্‌ন যুবাইআ ইব্‌ন কায়স ইব্‌ন ছালাবা ইব্‌ন উকাবা ইব্‌ন সাব। ইব্‌ন আলী ইব্‌ন বকর ইব্‌ন ওয়ায়েল। যার প্রথম পংক্তিঃ

—ছাহমাদের পাথুরে অঞ্চলে আমার প্রিয়া খাওলার বাসগৃহের স্মৃতি নারীদের মহিলাদের হাতের অবশিষ্ট উলকি রেখার ন্যায় ঝলমল করছে বলে মনে হয়।

পঞ্চম মুআল্লাকার রচয়িতা আনতারা ইব্‌ন শাদাদ ইব্‌ন মুআবিয়া ইব্‌ন কুরাদ ইব্‌ন মািখযুম ইব্‌ন রবীয়া ইব্‌ন মালিক ইব্‌ন গালিব ইব্‌ন কুতায়আ ইব্‌ন আব্বাস আল-আব্বাসী। তার প্রথম পংক্তি হলো :

—আগেকার কবিরা এমন কোন অপূর্ণতা রেখে যাননি, যা পূরণ করা বাকী রয়েছে।

তোমাতে অনেক আন্দাজ অনুমানের পর তুমি তো প্রিয়ার গৃহের সন্ধান পেয়েছ।

ষষ্ঠ মুআল্লাকার রচয়িতা বনী তামীমের আলকামা ইব্‌ন আবদা ইব্‌ন নুমান ইব্‌ন কায়সী। তার প্রথম পংক্তি হলো :

–তোমাকে নিয়ে আমার সৌন্দৰ্য পিয়াসী প্ৰাণ উচ্ছসিত হলো যখন যৌবন বিগত প্ৰায় এবং বার্ধক্য এসে হানা দিলো।

সপ্তম মুআল্লাকার রচয়িতা লাবীদ ইব্‌ন মালিক ইব্‌ন জাফর ইব্‌ন কিলাব ইব্‌ন রবীয়া ইব্‌ন আমির ইব্‌ন সাসাআ ইব্‌ন মুয়াবিয়া ইব্‌ন বকর ইব্‌ন হাওয়াযিন। ইব্‌ন মনসুর ইব্‌ন ইকরিমা ইব্‌ন খাসফা ইব্‌ন কায়স ইব্‌ন আয়লান ইব্‌ন মুযার। এই সপ্তম মুআল্লাকাকে আসাময়ী প্রমুখ পণ্ডিত সাত মুআল্লাকার অন্তর্ভুক্ত বলে স্বীকার করেন না। তার প্রথম পংক্তি হলো :

মিনার যে গৃহে আমার প্রিয় কখনো অল্প সময় কখনো দীর্ঘ সময় অবস্থান করতো, তার চলে যাওয়ার ফলে সব বিরান হয়ে গেছে। মিনার গাওল ও রিজম নামক স্থানও এখন সম্পূর্ণ জনবসতি শূন্য।

আবু উবায়দা আসমায়ী ও মুবারবাদ প্রমুখ পণ্ডিতগণ অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, আরেকটি কসীদা এমনও রয়েছে, যার রচয়িতা কে তা অজ্ঞাত। তার প্রথম পংক্তিটি হলোঃ

টিলাণ্ডলোেত প্ৰশ্নকারী কোন প্রত্যুত্তর প্রায়? নাকি কথা না বলার ব্যাপারে প্রিয়ার কোন শপথ রয়েছে? এটি একটি সুদীর্ঘ অনবদ্য কবিতা। এই পংক্তিমালায় অনেক অনেক সুন্দর ব্যাখ্যা রয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *