বর্ণ ও কোম
উল্লিখিত তালিকাগুলিতে এবং সমসাময়িক লিপি ও স্মৃতিগ্রন্থে কতকগুলি আদিবাসি আরণ্য ও পার্বত্য কোমের এবং বিদেশি বা ভিন-প্রদেশি কোমের নাম পাওয়া যাইতেছে; যথা ভিল্ল, মেদ, আভীর, কোল, পৌণ্ডক (পোদ), পুলিন্দ, পুক্কশ, খস, খর, কম্বোজ, যবন, সুহ্ম, শবর, অন্ধ ইত্যাদি। ব্ৰহ্মবৈবর্তপুরাণে ভিল্লদের সৎশুদ্র পর্যায়ে কী করিয়া গণ্য করা হইয়াছিল বলা কঠিন; ভবদেব ইঁহাদের মেদদের সঙ্গে বিন্যস্ত করিয়াছেন অন্ত্যজ পর্যায়ে। পৌণ্ড্রকরা অসৎশূদ্র পর্যায়ে পরিগণিত হইয়াছিলেন; বাকী সমস্ত কোমই হয় অন্ত্যজ, না হয় ম্লেচ্ছ পর্যায়ে। কোলেরা পুরাণোক্ত কোল্ল সন্দেহ নাই। পুরাণোক্ত কোল্ল-ভিল্লের দর্শন তাহা হইলে এখানেও পাওয়া যাইতেছে। পুলিন্দরাও প্রাচীন কোম এবং ইঁহাদের উল্লেখ বল্লালসেনের নৈহাটি লিপিতেও পাওয়া যাইতেছে। খসদের উল্লেখ পালদের লিপিতেই পাওয়া যাইতেছে, গৌড়-মালব কুলিক-হূণ- কর্ণাট-লাট প্রভৃতি বেতনভুক্ সৈন্যদের সঙ্গে। খর, পুক্কশ, ইঁহারাও পুরাণোক্ত আদিবাসি কোম। আভীররা বিদেশাগত প্রাচীন কোম এবং ভারতেতিহাসে সুবিদিত। বৃহদ্ধৰ্মপুরাণ মতে উঁহারা মধ্যম সংকর পর্যায়ভুক্ত। আর কোনও বিদেশি কোমের পক্ষে কিন্তু এতটা সৌভাগ্য ঘটে নাই। কম্বোজরা উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের সুপরিচিত কোম হইতে পারে অথবা আসাম-ব্ৰহ্ম সীমান্তের বা ভোট অঞ্চলের পার্বত্য কোমও হইতে পারে; শেষোক্ত কোম হওয়াই অধিকতর সম্ভব। এক কম্বোজ রাজবংশ বাঙলাদেশে কিছুকাল রাজত্বও করিয়াছিলেন। আমার ধারণা, যাঁহাদের কোচ বলি, তাহারা এই কম্বোজদেরই বংশধর। যবনরা বর্তমান আলোচনার ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে মুসলমান। অন্ধ্রদের কথা তো পালপর্বে নিম্নতম স্তরের জাতগুলির আলোচনা প্রসঙ্গেই বলা হইয়াছে। সুহ্মরা বাঙলার প্রাচীনতম আদিবাসী কোমগুলির অন্যতম। শবরীরাও তাঁহাই। ইঁহাদের কথাও পালপর্বে বলা হইয়াছে; বল্লালসেনের নৈহাটি লিপিতে পুলিন্দদের সঙ্গে ইহাদেরও উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায়। শবর-নারীদের মতন পুলিন্দ নারীরাও গুঞ্জাবীচির মালা পরিতে খুব ভালোবাসিতেন; নৈহাটি লিপিতে এ-কথার ইঙ্গিত আছে। যাহা হউক, উপরোক্ত বিশেষণ হইতে বুঝা যাইতেছে, হিন্দু বর্ণ-সমাজে ধীরে ধীরে যে স্বাঙ্গীকরণ ক্রিয়া চলিতেছিল। তাহার ফলে কোনও কোনও আদি বাঙালী কোম এবং বিদেশী কোম বৰ্ণাশ্রমের অন্তর্ভুক্ত হইতেছিল, যেমন পৌণ্ডক এবং আভীররা এবং ব্ৰহ্মবৈবর্তপুরাণের সাক্ষ্য সত্য হইলে, ভিল্লারাও; কোনও কোনও আদিবাসী কোম বৰ্ণাশ্রমের বাহিরে অন্ত্যজ পর্যায়ে স্থান পাইয়াছিল, যেমন মেদ, ভিল্ল, কোল প্রভৃতি; আবার কেহ কেহ, একেবারে ম্লেচ্ছ পর্যায়ে পুক্কশ, খস, খর, কম্বোজ, যবনদের সঙ্গে, যেমন সুহ্ম, শবর, পুলিন্দ প্রভৃতি। অনুমান করা কঠিন নয়, ব্যাধ, হড্ডি (হাড়ি), ডোম, জোলা, বাগতীত (বাগদী ?), চণ্ডাল, মল্ল, ডোলাবাহী (দুলিয়া, দুলে), ঘট্টজীবী (পাটনী?), বরুড় (বাউরী) প্রভৃতিরাও আদিবাসি কোম। হিন্দু সমাজের সামাজিক স্বাঙ্গীকরণ ক্রিয়ার যুক্তিপদ্ধতিতে ইহারাও ক্রমশ সমাজের নিম্নতম স্তরে স্থান পাইয়াছিল। পাল আমলের লিপিগুলিতে “মেদান্ধ্রচণ্ডালপর্যন্তান” পদাংশ হইতে মনে হয় এই স্বাঙ্গীকরণ পালযুগেই সুপরিণতি লাভ করিয়া গিয়াছিল। সেন-আমলে সামাজিক নিম্নতম স্তর তো রাষ্ট্রের দৃষ্টির অন্তর্ভুক্তই ছিল না, অন্তত রাজকীয় দলিলপত্রে ইহাদের কোনও উল্লেখ নাই।