১১. পালরাষ্ট্রের সামাজিক আদর্শ

পালরাষ্ট্রের সামাজিক আদর্শ

পাল-চন্দ্র-কম্বোজ যুগের সমসাময়িক অবস্থাটা দেখা যাইতে পারে। এ-তথ্য সুবিদিত যে পাল রাজার বৌদ্ধ ছিলেন—পরম সুগত। বৌদ্ধধর্মের তাহার পরম পৃষ্ঠপোষক, ওদন্তপুরী, সোমপুর এবং বিক্রমশীল মহাবিহারের তাঁহারা প্রতিষ্ঠাতা, নালন্দা মহাবিহারের তাঁহারা ধারক ও পোষক; বজ্রাসনের বিপুল করুণা পরিচালিত দলবল পাল রাষ্ট্রের রক্ষক। বাংলাদেশে যত বৌদ্ধ মূর্তি ও মন্দির আবিষ্কৃত হইয়াছে তাহা প্রায় সমস্তই এই যুগের; যত অসংখ্য বিহারের উল্লেখ পাইতেছি নানা জায়গায় জগদ্দল বিক্রমপু্রী-ফুল্লহরি-পট্টিকেরক-দেবীকোটপণ্ডিত-ত্ৰৈকূটক-পণ্ডিতসন্নগর—এই সমস্ত বিহারও এই যুগের; দেশ-বিদেশ-প্রখ্যাত যে বৌদ্ধ পণ্ডিতাচার্যদের উল্লেখ পাইতেছি তাঁহারাও এই যুগের। চন্দ্রবংশও বৌদ্ধ; জিন (বুদ্ধ), ধর্ম ও সংঘের স্বস্তি উচ্চারণ করিয়া চন্দ্রবংশীয় লিপিগুলির সূচনা; ইহাদের রাজ্য হরিকেল তো বৌদ্ধতান্ত্রিক পীঠগুলির অন্যতম পীঠ। ভিন্ন-প্রদেশাগত কম্বোজ রাজবংশ ও বৌদ্ধ, পরমসুগত।

অথচ ইঁহাদের প্রত্যেকেরই সমাজাদর্শ একান্তই ব্রাহ্মণ্য সংস্কারানুসারী, ব্রাহ্মণ্যাদর্শানুযায়ী। এই যুগের লিপিগুলি ত প্রায় সবই ভূমিদান সম্পর্কিত; এবং প্রায় সর্বত্রই ভূমিদান লাভ করিতেছেন ব্রাহ্মণেরা, এবং সর্বাগ্রে ব্রাহ্মণদের সম্মাননা না করিয়া কোন দানকার্যই সম্পন্ন হইতেছে না। তাঁহাদের সম্মান ও প্রতিপত্তি রাষ্ট্রের ও সমাজের সর্বত্র। “হরিচরিত” নামক গ্রন্থের লেখক চতুর্ভূজ বলিতেছেন, তাঁহার পূর্বপুরুষের বরেন্দ্রভূমির করঞ্জগ্রাম ধৰ্মপালের নিকট হইতে দানস্বরূপ লাভ করিয়া ছিলেন। এই গ্রামের ব্রাহ্মণেরা বেদবিদ্যাবিদ এবং স্মৃতিশাস্ত্রজ্ঞ ছিলে।(১) এই ধর্মপাল প্রসিদ্ধ পাল-নরপতি হওয়াই সম্ভব, যদিও কেহ কেহ মনে করেন ইনি রাজেন্দ্রচোল-পরাজিত ধৰ্মপাল। বৌদ্ধ নরপতি শূরপাল (প্রথম বিগ্রহপাল) মন্ত্রী কেদারমিশ্রের যজ্ঞস্থলে স্বয়ং উপস্থিত থাকিয়া অনেকবার শ্রদ্ধাসলিলাপ্লুতহৃদয়ে নতশিরে পবিত্র শান্তিবারি গ্রহণ করিয়াছিলেন। বাদল প্রস্তরলিপিতে শাণ্ডিল্যগোত্রীয় এক ব্রাহ্মণ মন্ত্ৰীর শৈব প্রশস্তি উৎকীর্ণ আছে; এই বংশের তিনপুরুষ বংশপরম্পরায় পালবাষ্ট্রের মন্ত্রীত্ব করিয়াছিলেন। দর্ভপাণিপুত্র মন্ত্রী কেদারমিশ্র সঙ্গন্ধে এই লিপিতে আরও বলা তইয়াছে, “তাহার [হোমকুণ্ডোত্থিত] অবক্ৰভাবে বিরাজিত সুপুষ্ট হোমাগ্নিশিখাকে চুম্বন করিয়া দিকচক্রবাল যেন সন্নিহিত হইয়া পড়িত।” তাহা ছাড়া তিনি চতুৰ্বিদ্যা-পয়োনিপি পান করিয়াছিলেন (অর্থাৎ চারি বেদবিদ ছিলেন)। কেদারমিশ্রের পুত্র মন্ত্রী গুরবমিশ্রের “বাগ্‌বৈভবের কথা, আগমে ব্যুৎপত্তির কথা, নীতিতে পরম নিষ্ঠার কথা… জ্যোতিষে অধিকারের কথা এবং বেদার্থচিন্তাপরায়ণ অসীম তেজসম্পন্ন তদীয় বংশের কথা ধর্মাবতার ব্যক্ত করিয়া গিয়াছেন।” পরমসুগত প্রথম মহীপাল বিষুবসংক্রান্তির শুভতিথিতে গঙ্গাস্নান করিয়া এক ভট্ট ব্রাহ্মণকে ভূমিদান করিয়াছিলেন। তৃতীয় বিগ্ৰহপালও আমগাছি লিপিদ্বারা এক ব্রাহ্মণকে ভূমিদান করিয়াছিলেন।

মদনপালেব মহনলি লিপিতে বলা হইয়াছে, শ্রীবটেশ্বর স্বামীশর্মা বেদব্যাসপ্রোক্ত মহাভারত পাঠ করায় মদনপালের পট্টমহাদেবী চিত্রমতিকা ভগবান বৃদ্ধভট্টারককে উদ্দেশ্য করিয়া অনুশাসন দ্বারা বটেশ্বরকে নিষ্কর গ্রাম দান করিয়াছেন। বৈদ্যদেবের কমৌলি লিপিতে দেখিতেছি, বরেন্দ্রীর অন্তর্গত ভাবগ্রামে ভরত নামক ব্রাহ্মণ প্রাদুর্ভূত হইয়াছিলেন; “তাহার যুধিষ্ঠির নামক বিপ্র (কুল) তিলক পণ্ডিতাগ্রগণ্য পুত্র জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। তিনি শাস্ত্রজ্ঞানপরিশুদ্ধবুদ্ধি এবং শ্রেত্রিয়ত্বের সমুজ্জ্বল যশোনিধি ছিলেন।” যুধিষ্ঠিরের পুত্র ছিলেন দ্বিজাধীশ-পূজ্য শ্রীধর। তীর্থভ্রমণে, বেদাধ্যয়নে, দানাধ্যাপনায়, যজ্ঞানুষ্ঠানে, ব্রতাচরণে, সবশ্রোত্রীয়শ্রেষ্ট শ্রীধর প্রাতঃ, নক্ত, অযাচিত এবং উপরসন (নামক বিবিধ কৃচ্ছ্রসাধন) করিয়া মহাদেবকে প্রসন্ন করিয়াছিলেন, এবং কর্মকাণ্ড জ্ঞানকাণ্ডবিং পণ্ডিতগণের অগ্রগণ্য, সর্বাকার-তপোনিধি এবং শ্রৌতস্মার্তশাস্ত্রের গুপ্তার্থবিৎ বাগীশ বলিয়া খ্যাতিলাভ করিধাছিলেন। পবিত্র ব্রাহ্মণবংশোদ্ভব কুমারপাল-মন্ত্রী বৈদ্যদেব বৈশাখে বিষুবসংক্রান্তি একাদশী তিথিতে ধর্মাধিকার পদাভিষিক্ত শ্ৰী গোনন্দন পণ্ডিতের অনুরোধে এই ব্রাহ্মণ শ্রীধরকে শাসনদ্বারা ভূমিদান করিয়াছিলেন। কিন্তু আর দৃষ্টান্ত উল্লেখের প্রয়োজন নাই; লিপিগুলিতে ব্রাহ্মণ্য দেবদেবী এবং মন্দির ইত্যাদির যে সব উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায় তাহারও আর বিবরণ দিতেছি না। বস্তুত, পালযুগেব লিপিমালা পাঠ করিলেই এ-তথ্য সুস্পষ্ট হঠয়া উঠে যে এইসব লিপির রচনা আগাগোড়া ব্রাহ্মণ্য পুরাণ, রামায়ণ মহাভারতের গল্প, ভাবকল্পনা, এবং উপমালঙ্কার দ্বারা আচ্ছন্ন—ইহাদের ভাবাকাশ একান্তই ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও সংস্কারের আকাশ। তাহা ছাড়া বৌদ্ধ পালরাষ্ট্র যে ব্রাহ্মণ্য সমাজ ও বর্ণব্যবস্থা পুরোপুরি স্বীকার করিত তাহার অন্ততঃ দুটি উল্লেখ পাল-লিপিতেই আছে। দেবপালদেবের মুঙ্গের লিপিতে ধর্মপাল সম্বন্ধে বলা হইয়াছে, ধর্মপাল “শাস্ত্রার্থের অতুবর্তী শাসনকৌশলে (শাস্ত্রশাসন হইতে) বিচলিত (ব্রাহ্মণ্যদি) বর্ণসমূহকে স্ব স্ব শাস্ত্রনিদিষ্ট ধর্মে প্রতিস্থাপিত করিয়াছিলেন”। এই শাস্ত্র যে ব্রাহ্মণ্যশাস্ত্র এই সম্বন্ধে তো কোন সন্দেহই থাকিতে পারে না। স্ব স্ব ধর্মে প্রতিস্থাপিত কবিবার অর্থও নিশ্চয়ই ব্রাহ্মণ্য বর্ণবিন্যাসে প্রত্যেক বর্ণের যথানিদিষ্ট স্থানে ও সীমায় বিন্যস্ত করা। মাৎস্যন্যায়ের পরে নূতন করিয়া শাস্ত্রশাসনানুযায়ী বিভিন্ন বর্ণগুলিকে সুবিন্যস্ত কবার প্রয়োজন বোধ হয় সমাজে দেখা দিয়াছিল ৷ আমগাছি লিপিতেও দেখিতেছি তৃতীয় বিগ্রহপালকে “চাতুবর্ণ্য-সমাশ্রয়” বর্ণাশ্রমের আশ্রয়স্থল বলিয়া বর্ণনা করা হইয়াছে।

——————————————————–
(১) Sastri, H. P.–Cat of Mss. Nepal. 1, 134 p; হরপ্রসাদ সংবৰ্দ্ধন লেখমালা, ২য় খণ্ড, ২০৮ পৃ; যতীন্দ্র মোহন রায়—ঢাকার ইতিহাস, ২য় খণ্ড, ১০৭ পৃ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *