উপাদান-বিচার
আর্যীকরণের তথা বাংলার বর্ণবিন্যাসের প্রথম পর্বের ইতিহাস নানা সাহিত্যগত উপাদানের ভিতর হইতে খুঁজিয়া বাহির করিতে হয়। সে-উপাদান রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ, মনু-বৌধায়ন প্রভৃতি স্মৃতি ও সূত্রকারদের গ্রন্থে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত। বৌদ্ধ ও জৈন প্রাচীন গ্রন্থাদিতে ও এ-সঙ্গন্ধে কিছু কিছু তথ্য নিহিত আছে। উত্তরবঙ্গে এবং বাংলাদেশের অন্যত্র গুপ্তাধিপত্য প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে আর্যীকরণ তথা বাংলার বর্ণবিন্যাসের দ্বিতীয় পর্বের সূত্রপাত। এই সময় হইতে আবম্ভ করিয়া একেবারে ত্রয়োদশ শতকের শেষ পর্যন্ত বর্ণবিন্যাস-ইতিহাসেব প্রচু্র উপাদান বাংলার অসংখ্য লিপিমালায় বিদ্যমান। বস্তৃত, সন-তারিখযুক্ত এই লিপিগুলির মত বিশ্বাসযোগ্য নির্ভরযোগ্য যথার্থ বাস্তব উপাদান আর কিছু হইতেই পারে না; এইগুলির উপর নির্ভর করিয়াই বাংলার বর্ণবিন্যাসের ইতিহাস রচনা করা যাইতে পারে, এবং তারা করাই সর্বাপেক্ষ নিরাপদ। বতর্মান নিবন্ধে আমি তাহাই করিতে চেষ্টা করিব। সঙ্গে সঙ্গে সমসাময়িক দু-একটি কাব্যগ্রন্থের, যেমন রামচরিতের সাহায্যও লওয়া যাইতে পারে। ইহাদের ঐতিহাসিকতা অবশ্যস্বীকার্য।
তবে, সেন-বর্মণ আমলে বাংলাদেশে প্রচুর স্মৃতি ও ব্যবহার গ্রন্থ রচিত হইয়াছিল। সেগুলি কখন কোন রাজার আমলে ও পোষকতায় কে রচনা করিযাছিলেন তাহা সুনির্ধারিত ও সুবিদিত। সমস্ত স্মৃতি ও ব্যবহার গ্রন্থ কালের হাত এড়াইয়া আমাদের কালে আসিয়া পৌঁছায় নাই; অনেক গ্রন্থ লুপ্ত হইয়া অথবা হারাইয়া গিয়াছে। কিছু কিছু যাহা পাওয়া গিয়াছে তাহার মধ্যে ভবদেব ভট্টের ও জীমূতবাহনের কয়েকটি গ্রন্থই প্রধান। এই সব স্মৃতি ও ব্যবহার গ্রন্থের সাক্ষ্য প্রামাণিক বলিয়া স্বীকার করিতে কোনও বাধা নাই; এবং লিপিমালায় যে-সব তথ্য পাওয়া যায়, সে-সব তথ্য এই স্মৃতি ও ব্যবহার গ্রন্থের সাহায্যে ব্যাখ্যা করিলে অনৈতিহাসিক বা অযৌক্তিক কিছু করা হইবে না।
স্মৃতি ও ব্যবহার গ্রন্থ ছাড়া অন্তত দুইটি অর্বাচীন পুরাণ-গ্রন্থ বৃহদ্ধর্মপুরাণ ও ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, গোপালভট্ট-আনন্দভট্টকৃত বল্লালচরিত, এবং বাংলার কুলজী গ্রন্থমালায় হিন্দুযুগের শেষ অধ্যায়ের বর্ণবিন্যাসের ছবি কিছু পা ওয়া যায়। কিন্তু ইহাদের একটিকেও সমসামযিক সাক্ষ্য বলিয়া স্বীকার করা যায় না। সেইজন্য ইতিহাসের উপাদান হিসাবে ইহার কতখানি নির্ভরযোগ্য সে-বিচার আগেই একটু সংক্ষিপ্ত ভাবে করিয়া লওয়া প্রযোজন।
বৃহদ্ধর্মপুরাণ, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ
বৃহদ্ধর্ম ও ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের (১) ঐতিহাসিক নির্ভরযোগ্যতা সম্বন্ধে কিছু কিছু বিচারালোচনা হইয়াছে।(২) প্রথমোক্ত পুরাণটিতে পদ্মা ও বাংলাদেশের যমুনা নদীর উল্লেখ, গঙ্গার তীর্থমহিমার সবিশেষ উল্লেখ, ব্রাহ্মণের মাছমাংস খাওয়ার বিধান (যাহা ভারতবর্ষের আর কোথাও বিশেষ নাই) ব্রাহ্মণেতব সমস্ত শূদ্রবর্ণের ছত্রিশটি উপ ও সংকর বর্ণে বিভাগ (বাংলার থাকথিত ‘ছত্রিশ জাত’ যাহা ভারতবর্ষে আর কোথাও দেখা যায় না) ইত্যাদি দেখিয়া মনে হয় এই পুরাণটির লেখক বাঙালী না হইলেও বাংলাদেশের সঙ্গে তাহার সবিশেষ পরিচয় ছিল। ক্ষত্রিম এবং বৈশ্য বর্ণের পৃথক অনুল্লেখ, ‘সৎ’ ও ‘অসৎ’ পর্যায়ে শূদ্রদের দুই ভাগ, ব্রাহ্মণদের পরেই অম্বষ্ঠ (বৈদ্য) এবং করণ (কায়স্থ)দের স্থান নির্ণয়, শংখকার (শাঁখারী), মোদক (ময়রা), তন্তুবায়, দাস (চাষী), কর্মকার, সুবর্ণবণিক ইত্যাদি উপ ও সংকর বর্ণের উল্লেখ প্রভৃতি ও এই অনুমানের সমর্থক। বাংলাদেশের বাহিরে অন্যত্র কোথাও এই ধরনের বর্ণব্যবস্থা এবং এই সব সংকর বর্ণ দেখা যায় না। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ সম্বন্ধে ও প্রায় একই কথা বলা চলে; বস্তুত, বৃহদ্ধর্মপুবাণ ও ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের বর্ণব্যবস্থার চিত্র প্রায় এক এবং অভিন্ন, এবং তাহা যে বাংলাদেশ সম্বন্ধেই বিশেষভাবে প্রযোজ্য ইহা ও অস্বীকার করা যায় না। এই দুই গ্রন্থের রচনাকাল নির্ণয় করা কঠিন; তবে এই কাল দ্বাদশ শতকের আগে নয় এবং চতুর্দশ শতকের পরে নয় বলিয়া অনুমিত হইয়াছে।(৩) এই অনুমান সত্য বলিয়াই মনে হয়। যদি তাহা হয় তাহা হইলে বলা যায়, এই দুই পুরাণে বাংলার হিন্দুযুগের শেষ অধ্যায়ের বর্ণবিন্যাসের ছবির একটা মোটামুটি কাঠামো পাওয়া যাইতেছে।
বল্লালচরিত
বল্লালচরিত নামে দুইখানি গ্রন্থ প্রচলিত। একখানির গ্রন্থকার আনন্দভট্ট; নবদ্বীপের রাজা বুদ্ধিমন্ত খাঁর আদেশে তাঁহার গ্রন্থপনি রচিত হয়। রচনাকাল ১৫১০ খ্ৰীষ্টাব্দ।(৪) আনন্দভট্টের পিতা দাক্ষিণাত্যগত ব্রাহ্মণ, নাম অনন্তভট্ট। আর একখানি গ্রন্থ পূর্বখণ্ড, উত্তরখণ্ড ও পবিশিষ্ট এই তিন খণ্ডে বিভক্ত। প্রথম এবং দ্বিতীয় খণ্ডের রচল্লিতার নাম গোপালভট্ট, গোপাভট্ট নাকি বল্লালসেনের অন্যতম শিক্ষক ছিলেন, এবং বল্লালের আদেশানুসারে ১৩০০ শকে নাকি গ্রন্থখানি রচিত হয়। তৃতীয় খণ্ড রাজার ক্ৰোধোৎপাদনের ভয়ে গোপালভট্ট নিজে লিখিয়া যাইতে পারেন নাই; দুই শত বৎসর পর ১৫০০ শকে আনন্দভট্ট তাহা রচনা করেন।(৫) দ্বিতীয় গ্রন্থটিতে নানা কুলজীবিবরণ, বিভিন্ন বর্ণের উৎপত্তিকথা ইত্যাদি আছেই, তাহা ছাড়া প্রথম গ্রন্থে বল্লাল কর্তৃক বণিকদের উপর অত্যাচার, সুবর্ণবণিকদের সমাজে ‘পতিত’ করা এবং কৈবর্ত প্রভৃতি বর্ণের লোকদের উন্নীত করা প্রভৃতি যে-সব কাহিনী বর্ণিত আছে তাহারও পুনঃবিবৃতি আছে। দ্বিতীয় গ্রন্থে বল্লালের যে তারিখ দেওয়া হইয়াছে তাত বল্লালের যথার্থ কাল নয়; কাজেই গোপালভট্ট বল্লালের সমসাময়িক ছিলেন একথাও সত্য নহে। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় এই গ্রন্থটিকে বলিয়াছিলেন ‘জাল’; আর শাস্ত্রী মহাশয় সম্পাদিত প্রথম গ্রন্থটিকে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় বলিয়াছিলেন ‘জাল’।(৬)
বল্লালচরিতের কাহিনীটি সংক্ষিপ্তাকালে উল্লেখযোগ্য।
“সেনরাজ্যে বল্লভানন্দ নামে একজন মস্তবড় ধনী বণিক ছিলেন। উদন্তপুরীর রাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিবার জন্য বল্লালসেন বল্লভানন্দের নিকট হইতে একবার এক কোটি নিষ্ক ধার করেন। বারবার যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর বল্লাল আর একবার শেষ চেষ্টা কবিবার জন্য প্রস্তুত হন, এবং বল্লভানন্দের নিকট হইতে আরও দেড় কোটি সুবর্ণ (মুদ্রা) ধার চাহিয়া পাঠান। বল্লভানন্দ সুবর্ণ পাঠাইতে রাজী হন, কিন্তু তৎপরিবর্তে হরিকেলির রাজস্ব দাবি করেন। বল্লাল ইহাতে ক্রদ্ধ হইয়া অনেক বণিকের ধনরত্ব কাড়িয়া লন এবং নানাভাবে তাহদের উপর অত্যাচার করেন। ইহার পর আবার সৎশূদ্রদের সঙ্গে এক পংক্তিতে বসিযা আহার করিতে তাঁহাদের আপত্তি আছে বলিয়া বণিকেরা রাজপ্রাসাদে এক আহারের আমন্ত্রণ অস্বীকার করে। এই প্রসঙ্গেই বল্লাল শুনিতে পান যে বণিকদের নেতা বল্লভানন্দ পালরাষ্ট্রের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করিতেছেন, এবং মগধের রাজা তাহার জামাতা। বল্লাল অতিমাত্রায় ক্রুদ্ধ হইয়া সুবর্ণবণিকদের শূদ্রের স্তরে নামাইয়া দিলেন, তাহাদের পূজা অনুষ্ঠানে পৌরোহিত্য করিলে, তাহাদের কাছ হইতে দান গ্রহণ করিলে কিংবা তাহাদের শিক্ষাদান করিলে ব্রাহ্মণেরাও ‘পতিত’ হইবেন, সঙ্গে সঙ্গে এই বিধানও দিয়া দিলেন। বণিকের তখন প্রতিশোধ লইবার জন্য দ্বিগুণ ত্রিগুণ মূল্য দিয়া সমস্ত দাসভৃত্যদের হাত করিয়া ফেলিল। উচ্চবর্ণের লোকের বিপদে পড়িয়া গেলেন। বল্লাল তখন বাধ্য হইয়া কৈবর্তদিগকে জলচল সমাজে উন্নীত করিয়া দিলেন, তাহাদের নেতা মহেশকে মহামাগুলিক পদে উন্নীত করিলেন। মালাকার, কুম্ভকার এবং কর্মকার, ইহারাও সৎশূদ্র পর্যায়ে উন্নীত হইল। সূবর্ণবণিকদের পৈতা পরা নিষিদ্ধ হইয়া গেল; অনেক বণিক দেশ ছাডিয়া অন্যত্র পলাইয়া গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে বল্লাল উচ্চতর বর্ণের মধ্যে সামাজিক বিশৃংখল দেখিয়া অনেক ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়কে শুদ্ধিযজ্ঞের বিধান দিলেন। ব্যবসায়ী নিম্নশ্রেণীর ব্রাহ্মণদের ব্রাহ্মণত্ব একেবারে ঘুচিয়া গেল, তাহারা ব্রাহ্মণ-সমাজ হইতে ‘পতিত’ হইলেন।“
কাহিনীটির ঐতিহাসিক যাথার্থ্য স্বীকাব করা কঠিন; কিন্তু ইহাকে একেবারে অলীক কল্পনাগত উপন্যাস বলিয়া উড়াইয়া দেওয়া আরও কঠিন। গ্রন্থদুটিকেও ‘জাল’ বলিয়া মনে করিবার যথেষ্ট কারণ বিদ্যমান নাই। সেনবংশ ‘ব্রহ্মক্ষত্ৰ’ বংশ; বল্লাল সেন কলিঙ্গরাজ চোড়গঙ্গের বন্ধু ছিলেন (সমসাময়িক তাহারা ছিলেনই); বল্লালের সমযে কীকটমগধ পালবংশের করায়ত্ত ছিল এবং তাহার আমলেই পালবংশের অবসান হইয়াছিল; বল্লাল মিথিলায় সমরাভিযান প্রেরণ করিয়াছিলেন— বল্লালচরিতের এই সব তথ্য অন্যান্য স্বতন্ত্র সুবিদিত নির্ভরযোগ্য সাক্ষ্যপ্রমাণ দ্বারা সমর্থিত। এই সব হেতু দেখাইয়া কোনও কোনও ঐতিহাসিক যথার্থই বলিয়াছেন, বল্লালচরিত ‘জাল’ গ্রন্থ নয়, এবং ইহার কাহিনী একেবারে ঔপন্যাসিকও নয়। তাহাদের মতে ষোড়শ-সপ্তদশ শতকে প্রচলিত লোক-কাহিনীর উপর নির্ভর করিয়া বল্লালচরিত এবং এই জাতীয় অন্যান্য গ্রন্থ রচিত হইয়াছিল; কেহ কেহ ইহাও মনে করেন যে “The Vallala charità contains the distorted echo of an internal disruption caused by the partisans of the Pāla dynasty which proved an important factor in the collapse of the Sena rule in Bengal.” এই মত সর্বথা নির্ভরযোগ্য।(৭) তবে, এই কাহিনীকে যতটা বিকৃত প্রতিধ্বনি বলিয়া মনে করা হয় আমি ততটা বিকৃত বলিয়া মনে করি না। আমরা জানি কৈবর্তরা পালরাষ্ট্রের প্রতি খুব প্রসন্ন ছিলেন না, একবার তাঁহারা বিদ্রোহী হইয়া এক পালরাজাকে হত্যা করিয়া বরেন্দ্রী বহুদিন তাঁহাদের করায়ত্তে রাখিয়াছিলেন। কাজেই সেই কৈবর্তদের প্রসন্ন করা এবং তাঁহাদের হাতে রাখিতে চেষ্টা করা বল্লালের পক্ষে অস্বাভাবিক কিছু ছিল না, বিশেষত মগধের পালদের সঙ্গে শত্রুতা যখন তাঁহাদের ছিলই। দ্বিতীয়ত, অন্যান্য সাক্ষ্যপ্রমাণ হইতে সেন-রাষ্ট্রেব সামাজিক আদশের, স্মৃতি ও পুরাণ গ্রন্থাদিতে সমসাময়িক সমাজ-বিন্যাসের যে পরিচয় আমরা পাই তাহাতে স্পষ্টই মনে হয় সমাজে বণিকদের স্থান খুব শ্লাঘ্য ছিল না। বৃহদ্ধর্মপুরাণে তাঁতী, গন্ধবণিক, কর্মকার, তৌলিক, (সুপারি ব্যবসায়ী), কুমার, শাঁখারী, কাঁসারী, বারজীবী (বারুই), মোদক, মালাকার সকলকে উত্তম সংকর পর্যায়ে গণ্য করা হইয়াছে, অথচ স্বর্ণকার-সুবর্ণবণিকেরা ধীবর-রজকের সঙ্গে জল-অচল মধ্যম সংকর পর্যায়ে। ইহার তো কোনও যুক্তিসংগত কারণ খুঁজিয়া পাওয়া যায় না। বল্লালচরিতে এ সম্বন্ধে যে ব্যাখ্যা পাওয়া যাইতেছে তাহাতে একটা যুক্তি আছে; রাষ্ট্ৰীয় ও সামাজিক কারণে এইরূপ হওয়া খুব বিচিত্র নয়। ইহাকে একেবারে উড়াইয়া দেওয়া যায় কি? সেন-বর্মণ আমলে এইরূপ পর্যায় নির্ণয় যে হইয়াছে স্মৃতিগ্রন্থগুলিই তাহার সাক্ষ্য। লোকস্মৃতি এক্ষেত্রে একেবারে মিথ্যাচরণ করিয়াছে, এমন মনে হইতেছে না। বল্লালচরিত-কাহিনী একেবারে অক্ষরে অক্ষরে সত্য না হইলেও ইহার মূলে যে একটি ঐতিহাসিক সত্য নিহিত আছে, এ সম্বন্ধে সন্দেহ করিবার কারণ দেখিতেছি না।
কুলজীগ্রন্থমালা
বল্লালচরিতের ঐতিহাসিক ভিত্তি কিছুটা স্বীকার করা গেলেও কুলজী গ্রন্থের ঐতিহাসিকত্ব স্বীকার করা অত্যন্ত কঠিন। বাংলাদেশে কুলজী গ্রন্থমালা সুপরিচিত, সুআলোচিত। ব্রাহ্মণ-কুলজীগ্রন্থমালায় ধ্রুবানন্দ মিশ্রের মহাবংশাবলী বা মিশ্র গ্রন্থ, নুলো পঞ্চাননের গোষ্ঠকথা, বাচস্পতি মিশ্রের কুলরাম, ধনঞ্জয়ের কুলপ্রদীপ, মেলপনায় গণনা, বারেন্দ্র কুলপঞ্জিকা, কুলার্ণব, হরিমিশ্রের কারিক, এডু মিশ্রের কাবিকা, মহেশের নির্দোষ কুলপঞ্জিকা এবং সর্বানন্দ মিশ্রের কুলতত্বার্ণব প্রভৃতি গ্রন্থ সমধিক প্রসিদ্ধ। ধ্রুবানন্দের মহাবংশাবলী পঞ্চদশ শতকের রচনা বলিয়া অনুমিত; মুলে পঞ্চানন এবং বাচস্পতি মিশ্রের গ্রন্থের কাল ষোড়শ-সপ্তদশ শতক হইতে পারে। বাকি কুলজীগ্রন্থ সমস্তই অর্বাচীন। বস্তুত, কোন কুলজী গ্রন্থেরই রচনাকাল পঞ্চদশ শতকের আগে নয়; অধিকাংশ কুলজীগ্রন্থ এখনও পাণ্ডুলিপি আকারেই পড়িয়া আছে, এবং নানা উদ্দেশ্যে নানা জনে ইহাদের পাঠ অদলবদলও করিয়াছেন, এমন প্রমাণও পাওয়া গিযাছে। বৈদ্য-কুলজী গ্রন্থের মধ্যে রামকান্তের কবিকণ্ঠহার এবং ভরত মল্লিকের চন্দ্র প্রভা সমধিক খ্যাত; ইহাদের রচনাকাল যথাক্রমে ১৬৫৩ ও ১৬৭৩ খ্ৰীষ্টাব্দ। কাযস্থ এবং অন্যান্য বর্ণেরও কুলজী ইতিহাস পাওয়া যায়, কিন্তু সেগুলি কিছুতেই সপ্তদশঅষ্টাদশ শতকের আগেকার রচনা বলিয়া মনে করা যায় না। উনবিংশ শতকের শেষপাদ হইতে আরম্ভ করিয়া একান্ত আধুনিক কাল পর্যন্ত বাংলা দেশের অনেক পণ্ডিত এই সব পাণ্ডুলিপি ও মুদ্রিত কুলজীগ্রন্থ অবলম্বন করিয়া বাংলার সামাজিক ইতিহাস রচনার প্রয়াস করিয়াছেন, এবং এখনও অনেক কৌলীন্য মযাঁদাগর্বিত ব্রাহ্মণ-বৈদ্য-কায়স্থ বংশ এই সব কুলজীগ্রন্থের সাক্ষ্যের উপরই নিজেদের বংশমযাঁদ প্রতিষ্ঠা করিয়া থাকেন। বস্তুত, বাংলার কৌলীন্যপ্রথা একমাত্র এই কুলশাস্ত্র বা কুলজী গ্রন্থমালার সাক্ষ্যের উপরই প্রতিষ্ঠিত।
একান্ত সাম্প্রতিক কালে উচ্চশ্রেণীর সামাজিক মযাঁদা যে ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত তাহাকে আঘাত করা অত্যন্ত কঠিন। নানা কারণেই ঐতিহাসিকের এই সব কুলজীগ্রন্থমালার সাক্ষ্য বৈজ্ঞানিক যুক্তিপদ্ধতিতে আলোচনার বিষয়ীভূত করেন নাই, যদিও অনেকে তাঁহাদের সন্দেহ ব্যক্ত করিতে দ্বিধা করেন নাই। ইহাদের ঐতিহাসিক মূল্য প্রথম বিচার করেন স্বৰ্গত রমাপ্রসাদ চন্দ মহাশয়।(৮) খুব সাম্প্রতিক কালে শ্রীযুক্ত রমেশচন্দ্র মজুমদার মহাশয় এই সব কুলজীগ্রন্থের বিস্তৃত ঐতিহাসিক বিচার করিয়াছেন; তাহার সুদীর্ঘ বিচারালোচনার যুক্তিবত্তা অবশ্যস্বীকার্য।(৯) কাজেই এখানে একই আলোচনা পুনরুত্থাপন করিয়া লাভ নাই। আমি শুধু মোটামুটি নির্ধারণগুলি সংক্ষেপে উল্লেখ করিতেছি মাত্র।
প্রথমত, ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকে যখন কুলশাস্ত্রগুলি প্রথম রচিত হইতে আরম্ভ করে তখন মুসলমান-পূর্ব যুগের বাংলার সামাজিক বা রাষ্ট্ৰীয় ইতিহাস সম্বন্ধে বাঙালীর জ্ঞান ও ধারণা খুব অস্পষ্ট ছিল৷(১০) কোন ও কোন ও পারিবারিক ইতিহাসের অস্তিত্ব হয়ত ছিল, কিন্তু আজ সেগুলির সত্যাসত্য নির্ধারণ প্রায় অসম্ভব। এই সব বংশাবলী এবং প্রচলিত অস্পষ্ট রাষ্ট্ৰীয় ও সামাজিক জনশ্রুতির উপর নির্ভর করিয়া, অর্ধসত্য অর্ধকল্পনার নানা কাহিনীতে সমৃদ্ধ করিয়া এই কুলশাস্ত্রগুলি রচনা করা হইয়াছিল। পরবর্তী কালে এই সব গ্রন্থোক্ত কাহিনী ও বিবরণ বংশমযাঁদাবোধসম্পন্ন ব্যক্তিদের হাতে পড়িয়া নানা উদ্দেশ্যে নানাভাবে পাঠ-বিকৃতি লাভ করে এবং নূতন নূতন ব্যাখ্যা ও কাহিনীদ্বারা সমৃদ্ধতর হয়। কাজেই ঐতিহাসিক সাক্ষ্য হিসাবে ইহাদের উপর নির্ভর করা কঠিন। পঞ্চদশ-ষোড়শ শতকে, প্রায় দুই শত আড়াই শত বৎসর মুসলমানাধিপত্যের পর বর্ণহিন্দুসমাজ নিজের ঘর নূতন করিয়া গুছাইতে আরম্ভ করে, রঘুনন্দন তখনই নূতন স্মৃতিগ্রস্থাদি রচনা করিয়া নূতন সমাজনির্দেশ দান করেন; চারদিকে নূতন আত্মসচেতনার আভাস স্বম্পষ্ট হইয়া উঠে। কুলশাস্ত্রগুলির রচনা ও তখনই আরম্ভ হয়, এবং প্রচলিত ধর্ম ও সমাজব্যবস্থাকে প্রাচীনতর কালের স্মৃতিশাসনের সঙ্গে যুক্ত করিয়া তাহার একটা সুসঙ্গত ব্যাখ্যা দিবার চেষ্টা ও পণ্ডিতদের মধ্যে উদগ্র হইয়া দেখা দেয়। সেন-বর্মণ আমলই স্মৃতিরচনা ও স্মৃতিশাসনের প্রথম সুবর্ণযুগ; কাজেই কুলশাস্ত্রকারেরা সেই যুগের সঙ্গে নিজেদের ব্যবস্থা-ইতিহাস যুক্ত করিবেন তাহা ও কিছু আশ্চর্য নয়!
দ্বিতীয়ত, কুলশাস্ত্রকাহিনীর কেন্দ্রে বসিয়া আছেন রাজা আদিশূর। আদিশূর কর্তৃক কোলাঞ্চ-কনৌজ (অন্যমতে, কাশী) হইতে পঞ্চ ব্রাহ্মণ আনয়নের সঙ্গেই ব্রাহ্মণ-বৈদ্য-কায়স্থ ও অন্যান্য কয়েকটি বর্ণ-উপরর্ণের কুলজী কাহিনী এবং কৌলীন্য প্রথার ইতিহাস জড়িত। কৌলীন্যপ্রথার বিবর্তনের সঙ্গে বল্লাল ও লক্ষ্মণসেনের নামও জড়িত হইয়া আছে, এবং রাঢ়ীয় ব্রাহ্মণ কুলজীর সঙ্গে আদিশূরের পৌত্র ক্ষিতিশূরের এবং ক্ষিতিশূরের পুত্র ধরাশূরের; বৈদিক-ব্রাহ্মণ কুলকাহিনীর সঙ্গে বৰ্মণরাজ ও শ্যামবৰ্মণ এবং হরিবর্মণের নামও জড়িত। একাদশ শতকে দক্ষিণবাঢ়ে এক শূববংশ রাজত্ব করিতেন, এবং রণশূর নামে অন্তত একজন রাজার নাম আমরা জানি। আদিশূর, ক্ষিতিশূর এবং ধরাশূরের নাম আজও ইতিহাসে অজ্ঞাত। সেন ও বর্মণ রাজবংশদ্বয়ত খুবই পরিচিত। কিন্তু আদিশূরই বাংলায় প্রথম ব্রাহ্মণ আনিলেন, তাঁহার আগে ব্রাহ্মণ ছিল না, বেদের চর্চা ছিল না, কুলজী গ্রন্থগুলির এই তথ্য একান্তই অনৈতিহাসিক, অথচ ইহারই উপর সমস্ত কুলজী কাহিনীর নির্ভর। পঞ্চম শতক হইতে আরম্ভ করিয়া বাংলা দেশে ব্রাহ্মণের কিছু অভাব ছিল না, বেদ-বেদাঙ্গচর্চাও যথেষ্টই ছিল; অষ্টম শতকের আগেই বাংলার সর্বত্র অসংখ্য বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণের বসবাস হইয়াছিল আর অষ্টম হইতে আরম্ভ করিয়া দ্বাদশ শতক পর্যন্ত ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল হইতে অসংখ্য ব্রাহ্মণ যেমন বাংলায় আসিয়া বসবাস আরম্ভ করিয়াছিলেন, তেমনই বাংলার ব্রাহ্মণ-কায়স্থেরা বাংলার বাহিরে গিয়া ও বিচিত্র সম্মাননা লাভ করিয়াছিলেন। বঙ্গজ ব্রাহ্মণদের কোনও কাহিনী কুলশাস্ত্রগুলিতে নাই, অথচ (পূর্ব) বঙ্গেও অনেক ব্রাহ্মণ গিয়া বসবাস করিয়াছিলেন, এ-সম্বন্ধে লিপি প্রমাণ বিদ্যমান। রাঢ়ীয়, বারেন্দ্র এবং সম্ভবত বৈদিক ও গ্রহবিপ্র ব্রাহ্মণদের অস্তিত্বের খবর অন্যতর স্বতন্ত্র সাক্ষ্যপ্রমাণ হইতেও পাওয়া যায়। রাঢ়ীয় ও বারেন্দ্র একান্তই ভৌগোলিক সংজ্ঞা; বৈদিক ব্রাহ্মণদের অস্তিত্ব সম্বন্ধে আদিশূর-পূর্ব লিপিপ্রমাণ বিদ্যমান; আর গ্রহবিপ্রেরা তো বাহির হইতে আগত শাকদ্বীপী ব্রাহ্মণ বলিয়াই মনে হয়। ইহাদের সম্পর্কে কুলজীর ব্যাখ্যা অপ্রাসঙ্গিক এবং অনৈতিহাসিক। বৈদ্য ও কায়স্থদের ভৌগোলিক বিভাগ সম্বন্ধেও একই কথা বলা চলে। কৌলীন্য প্রথার সঙ্গে বল্লাল ও লক্ষ্মণসেনের নাম অবিচ্ছেদ্য ভাবে জড়িত, অথচ এই দুই রাজার আমলে যে-সব স্মৃতি ও ব্যবহার গ্রন্থ রচিত হইয়াছিল, ইহাদের নিজেদের যে-সব লিপি আছে তাহার একটিতেও এই প্রথা সম্বন্ধে একটি ইঙ্গিতমাত্রও নাই, উল্লেখ ত দুরের কথা; তাহা ছাড়া, এই যুগের ভবদেব ভট্ট, হলায়ুধ, অনিরুদ্ধ প্রভৃতি প্রসিদ্ধ ব্রাহ্মণ পণ্ডিত এবং অসংখ্য অপ্রসিদ্ধ ব্রাহ্মণের যে-সব উল্লেখ সমসাময়িক গ্রন্থাদি ও লিপিমালায় পাওয়া যায় তাঁহাদের একজনকেও ভুলেও কুলীন কেহ বলেন নাই। বল্লাল ও লক্ষ্মণের নাম কৌলীন্যপ্রথা উদ্ভবের সঙ্গে জড়িত থাকিলে তাহার নিজের কেহ তাহার উল্লেখ করিলেন না, সমসাময়িক গ্রন্থ ও লিপিমালায় তাহার উল্লেখ পাওয়া গেল না, ইহা খুবই আশ্চর্য বলিতে হইবে। আদিশূরকাহিনী এবং কৌলীন্যপ্রথার সঙ্গে ব্রাহ্মণদের গাঞী বিভাগও অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। গাঞীর উদ্ভব গ্রাম হইতে; যে গ্রামে যে-ব্রাহ্মণ বসতি স্থাপন করিতেন তিনি সেই গ্রামের নামানুযায়ী গাঞী পরিচয় গ্রহণ করিতেন। বন্দ্য, ভট্ট, চট্ট প্রভৃতি গ্রামের নামের সঙ্গে উপাধ্যায় বা আচার্য জড়িত হইয়া বন্দ্যোপাধ্যায়, ভট্টাচার্য, চট্টোপাধ্যায় প্রভৃতি পদবীর সৃষ্টি। বস্তুতঃ বন্দ্য, ভট্ট, চট্ট ব্রাহ্মণদের এই সব গ্রামনামায় পরিচয় অষ্টম শতক-পূর্ব লিপিগুলিতেই দেখা যাইতেছে। কাজেই এই সব গাঞী পর্যায়-পরিচয় স্বাভাবিক ভৌগোলিক কারণেই উদ্ভূত হইয়াছিল এবং তাহার সূচনা ষষ্ঠ-সপ্তম শতকেই দেখা গিয়াছিল—আদিশূরকাহিনী বা কৌলীন্য প্রথার সঙ্গে উহাকে যুক্ত করিবার কোনও সঙ্গত কারণ নাই। বৈদ্য এবং কোনও কোনও ব্ৰাহ্মণ কুলজীতে আদিশূর এবং বল্লালসেনকে বলা হইয়াছে বৈদ্য। এ-তথ্য একান্তই অনৈতিহাসিক। সেনের নিঃসন্দেহে ব্ৰহ্মক্ষত্রিয়; ইঁহারা এবং সম্ভবত শূরেরাও অবাঙালী। কাজেই বাঙালী বৈদ্য সংকরবর্ণের সঙ্গে ইহাদের যুক্ত করিবার কোনই কারণ নাই।
কুলজী গ্রন্থগুলিতে নানা প্রকার গালগল্প ও বিচিত্র অসংগতি ত আছেই। সাম্প্রতিক পণ্ডিতেরা তাহা সমস্তই অঙ্গুলি নির্দেশে দেখাইয়া দিয়াছেন। আমি শুধু কয়েকটি ঐতিহাসিক যুক্তি সংক্ষিপ্তভাবে উল্লেখ করিলাম। এইসব কারণে কুলশাস্ত্রের সাক্ষ্য ঐতিহাসিক আলোচনায় নির্ভরযোগ্য বলিয়া মনে হয় না। তবে ইহাদের ভিতর দিয়া লোকস্মৃতির একটি ঐতিহাসিক ইঙ্গিত প্রত্যক্ষ করা যায়, এবং সে-ইঙ্গিত অস্বীকার করা কঠিন। পঞ্চদশ-ষোড়শ-সপ্তদশ শতকে যে বর্ণ, উপবর্ণ সমাজ-ব্যবস্থা, যে-স্মৃতিশাসন বাংলাদেশে প্রচলিত ছিল তাহার একটা প্রাচীনতর ইতিহাস ছিল, এবং লোকস্মৃতি সেই ইতিহাসকে যুক্ত করিয়াছিল শূর, সেন ও বর্মণ রাজবংশগুলির সঙ্গে—পাল, চন্দ্র বা অন্য কোনও রাজবংশের সঙ্গে নয়, ইহা লক্ষণীয়। আমরা নি:সংশয়ে জানি সেন ও বর্মণ বংশদ্বয় অবাঙালী; শূরবংশও সম্ভবত অবাঙালী; ইহাও আমরা জানি সেন এবং বর্মণ রাষ্ট্র ও রাজবংশ দুটির ছত্রছায়ায়ই এবং তাঁহাদের আমলেই বাংলাদেশে ব্রাহ্মণ্য স্মৃতি ও ব্যবহাব-শাসন, পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্য ধর্মানুশাসন সমস্ত পরিবেশ ও বাতাবরণ, সমস্ত খুঁটিনাটি সংস্কার লইয়া সর্বব্যাপী প্রসার ও প্রতিষ্ঠা লাভ করে। কুলজীগ্রন্থগুলির ইঙ্গিতও তাহাই। এই হিসাবে লোকস্মৃতি মিথ্যাচরণ করিয়াছে বলিয়া মনে হইতেছে না। দ্বিতীয়ত, কোনও কোনও বংশের প্রাচীনতর ইতিহাস পঞ্চদশ-ষোড়শ শতকে বিদ্যমান ছিল বলিয়া মনে হয়, এবং কুলজী গ্রন্থাদিতে তাহা ব্যবহৃতও হইয়াছে। এই রকম কয়েকটি বংশের সাক্ষ্য স্বাধীন স্বতন্ত্র প্রমাণদ্বারা সমর্থনও করা যায়।(১১) কুলজীগ্রন্থে রাঢ়ীয়, বারেন্দ্র, বৈদিক ও গ্রহবিপ্র, ব্রাহ্মণদের এই চারি পর্যায়ের বিভাগ ও স্বাধীন স্বতন্ত্র প্রমাণদ্বার সমর্থিত। কুলশাস্ত্রগ্রন্থমালায় ব্রাহ্মণদের বিভিন্ন শাখার বিচিত্র গাঞীর বিভাগের অন্তত কযেকটি গাঞীর নাম লিপিমালায় এবং সমসাময়িক স্মৃতিসাহিত্য গ্রন্থে পাওয়া যায়।(১২) এইসব কারণে মনে হয়, কুলজীগ্রন্থমালার পশ্চাতে একটা অস্পষ্ট লোকস্থতি বিদ্যমান ছিল, এবং এই লোকস্মৃতি একেবারে পুরোপুরি মিথ্যাচার নয়। তবে, কুলশাস্ত্রগুলির ঐতিহাসিক ইঙ্গিতটুকু মাত্রষ্ঠ গ্রাহ, তাহাদের বিচিত্র খুঁটিনাটি তথ্য ও বিবরণগুলি নয়।
চর্যাগীতি
এই সব ব্রাহ্মণ্য গ্রন্থাদি ছাড়া আর একটি উপাদানের উল্লেখ করিতে হয়; এই উপাদান সহজিয়াতন্ত্রের বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের একটি গ্রন্থ, চযাঁচর্যবিনিশ্চয় বা চযাঁগীতি। এই গ্রন্থ বিভিন্ন বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্য কর্তৃক গুহা তান্ত্রিক সাধনা সম্বন্ধীয় সন্ধাভাষায় রচিত কয়েকটি (৫০টি) পদের সমষ্টি। পদ গুলি প্রাচীনতম বাংলা ভাষার নিদর্শন; ইহাদের তিব্বতী ভাষারূপও কিছুদিন হইল পাওয়া গিয়াছে। যাহাই হউক, ইহাদের রচনার কাল দশম হইতে দ্বাদশ শতকের মধ্যে বলিয়া বহুদিন পণ্ডিতসমাজে স্বীকৃত হইয়াছে। এই পদ গুলির যত গুহ্য অর্থই থাকুক, কিছু কিছু সমাজসংবাদও ইহাদের মধ্যে ধরা পড়িয়াছে, এবং বিশেষভাবে ডোম, চণ্ডাল প্রভৃতি তথাকথিত অন্ত্যজ পর্যায়ের বর্ণসংবাদ। সমসাময়িক সাক্ষ্য হিসাবে ইহাদের মূল্য অস্বীকার করা যায় না।(১৩)
—————————-
(১) বৃহদ্ধর্মপুরাণ, Bib. Ind. edn; বঙ্গবাসী মুদ্রাযন্ত্র প্রকাশিত একটি সংস্করণও বিদ্যমান। উত্তরখণ্ডের ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ অধ্যায়ে এবং অন্ত খণ্ডের ইতস্তত বর্ণসংবাদ বিক্ষিপ্ত। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ, জীবানন্দ বিন্যাসাগর সং। প্রথমভাগে ব্রহ্মখণ্ডের দশম অধ্যায়ের ১৬-২১ এবং ৯০-১৩৭ শ্লোকে বর্ণবিন্যাস-সংবাদ নিবদ্ধ।
(২) ভারতবর্ষ মাসিকপত্র, ১৩৩৬-৩৭, ২য় খণ্ড, ৬৭৩ পৃ., ১৩৩৭ ৩৮, ১ম খণ্ড, ৯৪ পৃ.। History of Bengal, I., D. U. : pp. 5’7-574, Paul, P. C., Early History of Bengal Vol. II, 59-61.
(৩) ২নং পাদটীকা দ্রষ্টব্য।(৪) Vallala-Charita, ed. Haraprasad Sastri, Asiatic Society of Bengal. 1904.
(৫) Vallala-Charita, ed. by Harischandra Kaviratna, 1889.
(৬) Intro. to the English trans. of the Vallalacharita by Haraprasad Sastri, pp. v.-vi.; Ep. Ind. XV, p. 281; যতীন্দ্রমোহন রায়, ঢাকা।
(৭) H B (D.V.), I, pp. 239-4 I
(৮) Chanda, R. P., Indo-Aryan Races, Chap. V.
(৯) ভারতবর্ষ মাসিক পত্রিকা, ১৩৪৬, কাতিক—ফাল্গুন, “বঙ্গীয় কুলশাস্ত্রের 3\fa <ifa 35 5[a] “; HB (D U.), pp. 623-34
(১০) Majumdar, R. C., “An Indigenous History of Bongal,” ln Proc, of the Ind, Hist. Records Commission, XVI, 59 ff.
(১১) History of Bengal, (D. U.), pp. 630 31, footnotes.
(১২) lbid., pp. 635-37 and footnotes
১৩ বৌদ্ধ গান ও দোহা, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী সং, বঙ্গীয় সাহিত পরিষৎ, Md. Sahidullah Buddhist Mystic Songs; Bagchi, P. C., Materials for a Critical Edition of the Caryapadas; চযাঁপদ, মণীন্দ্রমোহন বসু সং, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়।