ব্রাহ্মণেতর বর্ণবিভাগ
বৃহদ্ধর্মপুরাণে(১) দেখা যাইতেছে, ব্রাহ্মণ ছাড়া বাংলাদেশে আর যত বর্ণ আছে, সমস্তই সঙ্কর; চতুবর্ণের যথেচ্ছ পারস্পরিক যৌনমিলনে উৎপন্ন মিশ্রবর্ণ, এবং তাহার, সকলই শূদ্রবর্ণের অন্তর্গত। ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য বর্ণদ্বয়ের উল্লেখই এই গ্রন্থে নাই। ব্রাহ্মণেরা এই সমস্ত শূদ্র সঙ্কর উপবর্ণগুলিকে তিনশ্রেণীতে বিভক্ত করিয়া প্রত্যেকটি উপরর্ণের স্থান ও বৃত্তি নির্দিষ্ট করিয়া দিয়াছিলেন। এই বর্ণ ও বৃত্তিসমূহের বিবরণ দিতে দিয়া বৃহদ্বর্মপুরাণ বেণ রাজা সম্বন্ধে যে-গল্পের অবতারণা করিয়াছেন কিংবা উত্তম, মধ্যম ও সংকর এই তিন পর্যায়-বিভাগের যে-ব্যাখ্যা দিয়াছেন তাহার উল্লেখ বা আলোচনা অবান্তর। কারণ, স্মৃতিগ্রন্থের বর্ণ-উপবর্ণ ব্যাখ্যার সঙ্গে বাস্তব ইতিহাসের যোগ আবিষ্কার কথা বড় কঠিন। যাহা হউক, এই গ্রন্থ তিন পর্যায়ে ৩৬ টি উপবর্ণ বা জাতের কথা বলিতেছে, যদিও তালিকাভুক্ত করিতেছে ৪১টি জাত। বাঙলাদেশের জাত সংখ্যা বলতে আজও আমরা বলি ছত্রিশ জাত। ৩৬টিই বোধ হয় ছিল আদি সংখ্যা, পরে আরও ৫টি উপবর্ণ এই তালিকায় ঢুকিয়া পড়িয়া থাকিবে। উত্তম-সংকর পর্যায়ে ২০টি উপবর্ণ :
উত্তম-সংকর
১. করণ – ইঁহারা লেখক ও পুস্তককর্মদক্ষ এবং সৎশুদ্র বলিয়া পরিগণিত।
২. অম্বষ্ঠ – ইঁহাদের বৃত্তি চিকিৎসা ও আয়ুর্বেদচর্চা, সেইজন্যে ইঁহারা বৈদ্য বলিয়া পরিচিত। ঔষধ প্রস্তুত করিতে হয় বলিয়া ইঁহাদের বৃত্তি বৈশ্যের, কিন্তু ধর্মকর্মানুষ্ঠানের ব্যাপারে ইহারা শুদ্র বলিয়াই গণিত।
৩. উগ্র – ইঁহাদের বৃত্তি ক্ষত্রিয়ের, যুদ্ধবিদ্যাই ধর্ম।
৪. মাগধ – হিংসামূলক যুদ্ধব্যবসায়ে অনিচ্ছুক হওয়ায় ইহাদের বৃত্তি নির্দিষ্ট হইয়াছিল সূত বা চারণের এবং সংবাদবাহীর।
৫. তন্ত্রবায় (তাঁতী)।
৬. গান্ধিক বনিক (গন্ধদ্রব্য বিক্রয় যে-বণিকের বৃত্তি; বর্তমানে গন্ধবনিক)।
৭. নাপিত।
৮. গোপ (লেখক)।
৯. কর্মকার (কামার)।
১০. তৈলিক বা তৌলিক – (গুবাক-ব্যবসায়ী)।
১১. কুম্ভকার (কুমোর)।
১২. কাংসকার (কাঁসারী)।
১৩. শাঙ্খিক বা শঙ্খকার (শাঁখারী)।
১৪. দাস – কৃষিকার্য ইঁহাদের বৃত্তি, অর্থাৎ চাষী।
১৫. বারজীবী (বারুই) – পানের বরজ ও পান উৎপাদন করা উঁহাদের বৃত্তি।
১৬. মোদক (ময়রা)।
১৭. মালাকার।
১৮. সূত – (বৃত্তি উল্লিখিত নাই, কিন্তু অনুমান হয় এরা চারণ-গায়ক)।
১৯. রাজপুত্র – (বৃত্তি অনুল্লিখিত; রাজপুত?)
২০. তাম্বলী (তামলী) – পানবিক্রেতা।
মধ্যম-সংকর
মধ্যম-সংকর পর্যায়ে ১২টি উপবর্ণ :
২১. তক্ষণ – খোদাইকর।
২২. রজক – (ধোপা)।
২৩. স্বর্ণকার – (সোনার অলংকার ইত্যাদি প্রস্তুতকারক)।
২৪. সুবর্ণবনিক – সোনা ব্যবসায়ী।
২৫. আভীর (আহীর) – (গোয়ালা, গোরক্ষক)।
২৬. তৈলকার – (তেলী)।
২৭. ধীবর – (মৎস্যব্যবসায়ী)।
২৮. শৌণ্ডিক – (শুঁড়ি)।
২৯. নট – যাহারা নাচ, খেলা ও বাজি দেখায়।
৩০. শাবাক, শাবক, শারক, শাবার (?) – (ইঁহারা কি বৌদ্ধ শ্রাবকদের বংশধর?)।
৩১. শেখর (?)
৩২. জালিক (জেলে, জালিয়া)।
অধম-সংকর বা অন্ত্যজ
অধম সংকর বা অন্ত্যজ পর্যায়ে ৯টি উপবর্ণ; ইঁহারা সকলেই বর্ণাশ্রম-বহির্ভূত। অর্থাৎ, ইঁহারা অস্পৃশ্য এবং ব্রাহ্মণ্য বর্ণাশ্রম-ব্যবস্থার মধ্যে ইঁহাদের কাহারও কোনও স্থান নাই।
৩৩. মলেগ্রহী (বঙ্গবাসী, সং: মলেগৃহি)।
৩৪. কুড়ব (?)।
৩৫. চণ্ডাল (চাঁড়াল)।
৩৬. বরুড় (বাউড়ী?)
৩৭. তক্ষ (তক্ষণকার?)।
৩৮. চর্মকার (চামার)।
৩৯. ঘট্টজীবী (পাঠান্তর ঘণ্টজীবী– খেয়াঘাটের রক্ষক, খেয়াপারাপারের মাঝি? বর্তমান, পাটনী?)।
৪০. ডোলাবাহী – ডুলি-বেহারা, বর্তমানে দুলিয়া বা দুলে (?)।
৪১. মল্ল (বর্তমানে মালো ?)।
ম্লেচ্ছ
এই ৪১টি জাত ছাড়া ম্লেচ্ছ পর্যায়ে আরও কয়েকটি দেশি ও ভিন্প্রদেশি আদিবাসি কোমের নাম পাওয়া যায়; স্থানীয় বর্ণ-ব্যবস্থার ইঁহাদেরও কোনও স্থান ছিল না, যথা, পুক্কশ, পুলিন্দ, খস, থর, কম্বোজ, যবন, সুহ্ম, শবর ইত্যাদি।
ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণেও অনুরূপ বর্ণ-বিন্যাসের খবর পাওয়া যাইতেছে।(২) ‘সৎ’ ও ‘অসৎ’ (উচ্চ ও নিম্ন) এই দুই পর্যায়ে শূদ্রবর্ণের বিভাগের আভাস বৃহদ্বর্মপুরাণেই পাওয়া গিয়াছে; করণদের বলা হইয়াছে ‘সৎশূদ্র’। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে সমস্ত সংকর বা মিশ্র উপবর্ণগুলিকে সৎ ও অসৎ শূদ্র এই দুই পর্যায়ে ভাগ করা হইয়াছে। সৎশূদ্র পর্যায়ে যাঁহাদের গণ্য করা হইয়াছে তাঁহাদের নিম্নলিখিতভাবে তালিকাগত করা যাইতে পারে। এই ক্ষেত্রেও সর্বত্র পৃথক সূচীনির্দেশ দেওয়া হইতেছে না। এই অধ্যায়ে আহৃত অধিকাংশ সংবাদ এই গ্রন্থের প্রথম অর্থাৎ ব্রহ্মখণ্ডের দশম পরিচ্ছেদে পাওয়া যাইবে; ১৬-২১ এবং ৯০-১৩৯ শ্লোক বিশেষভাবে দ্রষ্টব্য। ২/৪টি তথ্য অন্যত্র বিক্ষিপ্তও যে নাই তাহা নয়। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের মিশ্রবর্ণেরও সম্পূর্ণ তালিকা এক্ষেত্রে উদ্ধার করা হয় নাই, করিয়া লাভো নাই; কারণ, এই পুরাণেই বলিতেছে, মিশ্রবর্ণ অসংখ্য, কে তাহার সমস্ত নাম উল্লেখ ও গণনা করিতে পারে (১।১০।১২২)? সৎশূদ্রদের তালিকাও যে সম্পূর্ণ নয়, তাহার আভাসও এই গ্রন্থেই আছে (১।১০।১৮)।
লক্ষণীয় যে, এই পুরাণ বৈদ্য ও অম্বষ্ঠদের পৃথক উপবর্ণ বলিয়া উল্লেখ করিতেছে, এবং উভয় উপবর্ণের যে উৎপত্তি-কাহিনী দিতেছে, তাহাও পৃথক।
সৎশুদ্র
১. করণ
২. অম্বষ্ঠ (দ্বিজ পিতা ও বৈশ্য মাতার সন্তান)
৩. বৈদ্য (জনৈক ব্রাহ্মণীর গর্ভে অশ্বিনীকুমারের ঔরসে জাত সন্তান; বৃত্তি চিকিৎসা)(৩)
৪. গোপ
৫. নাপিত
৬. ভিল্ল (ইঁহারা আদিবাসী কোম; কি করিয়া সৎশদ্র পর্যায়ে পরিগণিত হইলেন, বলা কঠিন)
৭. মোদক
৮. কুবর (?)
৯. তাম্বুলী (তাম্লী)
১০. স্বর্ণকার ও অন্যান্য বনিক (ইঁহারা পরে ব্রাহ্মণের অভিশাপে, ‘পতিত’ হইয়া ‘অসৎশূদ্র’ পর্যায়ে নামিয়া গিয়াছিলেন; স্বর্ণকারদের অপরাধ ছিল সোনাচুরি)
১১. মালাকার
১২. কর্মকার
১৩. শঙ্খকার
১৪. কুবিন্দক (তন্তুবায়)
১৫. কুম্ভকার
১৬. কাংসকার
১৭. সূত্রধার
১৮. চিত্রকার (পটুয়া)
১৯. স্বর্ণকার
সূত্রধর ও চিত্রকর কর্তব্যপালনে অবহেলা করায় অপরাধে ব্রাহ্মণের অভিশাপে ‘পতিত’ হইয়া অসৎশুদ্র পর্যায়ে গণ্য হইয়াছিলেন। স্বর্ণকারও ‘পতিত’ হইয়াছিলেন, এ কথা আগেই বলা হইয়াছে।
পতিত বা অসৎশূদ্র পর্যায়ে যাঁহাদের গণনা করা হইত তাঁহাদের তালিকাগত করিলে এইরূপ দাঁড়ায়:
অসৎশূদ্র
স্বর্ণকার। [সুবর্ণ] বনিক। সূত্রধার (বৃহদ্বর্মপুরাণের তক্ষণ)। চিত্রকার।
২০. অট্টালিকাকার
২১. কোটক (ঘরবাড়ি তৈরীর মিস্ত্রী)
২২. তীবর
২৩. তৈলকার
২৪. লেট
২৫. মল্ল
২৬. চর্মকার
২৭. শুঁড়ি
২৮. পৌণ্ড্রক (পোদ?)
২৯. মাংসচ্ছেদ (কসাই)
৩০. রাজপুত্র (পরবর্তী কালের রাউত?)
৩১. কৈবর্ত (কলিযুগের ধীবর)
৩২. রজক
৩৩. কৌয়ালী
৩৪. গঙ্গাপুত্র (লেট-তীবরের বর্ণ-সংকর সন্তান)
৩৫. যুঙ্গি (যুগী?)
৩৬. আগরী (বৃহদ্বর্ম্পুরাণের উগ্র ? বর্তমানে আগুরী)
অসৎশদ্রেরও নিম্ন পর্যায়ে, অর্থাৎ অন্তজ-অস্পৃশ্য পর্যায়ে যাঁহাদের গণনা করা হয় তাঁহাদের তালিকাগত করিলে এইরূপ দাঁড়ায়:
ব্যাধ, ভড় (?), কাপালী, কোল (আদিবাসী কোম), কোঞ্চ (কোচ, আদিবাসী কোম), হড্ডি (হাড়ি), ডোম, জোলা, বাগতীত (বাগদী), শরাক, ব্যালগ্রাহী (ব্রহ্মদ্বর্ম্পুরাণের মলেগ্রাহী?), চণ্ডাল ইত্যাদি।
এই দুইটি বর্ণবিভাগের তালিকা তুলনা করিলে দেখা যায় প্রথমোল্লিখিত গ্রন্থের সংকর পর্যায় এবং দ্বিতীয় গ্রন্থের সৎশূদ্র পর্যায় এক এবং অভিন্ন; শুধু মগধ, গন্ধবণিক, তৌলিক বা তৈলিক, দাস, বারজীবি, এবং সূত দ্বিতীয় গ্রন্থের তালিকা হইতে বাদ পড়িয়াছে; পরিবর্তে পাইতেছি ভিল্ল ও কুবর এই দুইটি উপবর্ণের উল্লেখ, এবং বৈদ্যদের উল্লেখ। তাহা ছাড়া, প্রথম গ্রন্থের উত্তম সংকর বর্ণের রাজপুত্র দ্বিতীয় গ্রন্থের অসৎশূদ্র পর্যায় এক এবং অভিন্ন; শুধু ব্রহ্মদ্বর্মপুরাণের আভীর, নট, শাবাক (শ্রাবক?), শেখর ও জানিল দ্বিতীয় গ্রন্থের তালিকা হইতে বাদ পড়িয়াছে; পরিবর্তে পাইতেছি অট্টালিকাকার, কোটক, লেট মল্ল, চর্মকার, পৌণ্ড্রক, মাংশচ্ছেদ, কৈবর্ত, গঙ্গাপুত্র, যুঙ্গি, আগরী এবং কৌয়ালী। ইঁহাদের মধ্যে মল্ল ও চর্মকার বৃহদ্বর্মপুরাণের অধর সংকর বা অন্ত্যজ পর্যায়ের। বৃহদ্বর্মপুরাণে ধীবর ও জালিক, মৎস্য-ব্যবসাগত এই দুইটি উপবর্ণের খবর পাইতেছি; ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে পাইতেছি কেবল কৈবর্তদের। কৈবর্তদের উদ্ভব সম্বন্ধে ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে একটি ব্যাখ্যা দেওয়া হইয়াছে: কৈবর্ত ক্ষত্রিয় পিতা ও বৈশ্য মাতার সন্তান; কিন্তু কলিযুগে তীবরদের সঙ্গে যোগাযোগের ফলে ইঁহারা ধীবর নামে পরিচিত হন এবং ধীবর বৃত্তি গ্রহণ করেন। ভবদেব ভট্টের মতে কৈবর্তরা অন্ত্যজ পর্যায়ের। ভবদেবের অন্ত্যজ পর্যায়ের তালিকা উপরোক্ত দুই পুরাণের তালিকার সঙ্গে তুলনা করা যাইতে পারে: রজক, চর্মকার,নট, বরুড়, কৈবর্ত, মেদ এবং ভিল্ল। ভবদেবের মতে চণ্ডাল ও অন্ত্যজ সমার্থক। চণ্ডাল, পুক্কশ, কাপালিক, নট, নর্তক, তক্ষণ (বৃহদ্বর্মপুরাণোক্ত মধ্যম সংকর পর্যায়ের তক্ষ?), চর্মকার, সুবর্ণকার, শৌণ্ডিক, রজক এবং কৈবর্ত প্রভৃতি নিম্নতম উপবর্ণের এবং পতিত ব্রাহ্মণদের স্পৃষ্ট খাদ্য ব্রাহ্মণদের অভক্ষ্য বলিয়া ভবদেব ভট্ট বিধান দিয়াছেন, এবং খাইলে প্রায়শ্চিত্ত করিতে হয়, তাহাও বলিয়াছেন।
দেখা যাইতেছে, কোনও কোনও ক্ষেত্রে উল্লিখিত তিনটি সাক্ষ্যে অল্পবিস্তর বিভিন্নতা থাকিলেও বর্ণ-উপবর্ণের স্তর-উপস্তর বিভাগ সম্বন্ধে ইঁহাদের তিনজনেরই সাক্ষ্য মোটামুটি একই প্রকার। এই চিত্রই সেন-বর্মণদের আমলের বাঙলাদেশের বর্ণ-বিন্যাসের মোটামুটি চিত্র।
করণ-কায়স্থ
প্রথমেই দেখিতেছি করণ ও অম্বষ্ঠদের স্থান। করণরা কিন্তু কায়স্থ বলিয়া অভিহিত হইতেছেন না; এবং ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে বৈদ্যদের স্পষ্টতই অম্বষ্ঠ হইতে পৃথক বলিয়া গণ্য করা হইয়াছে। করণদের সম্বন্ধে পাল-পর্বেই আলোচনা করা হইয়াছে, এবং করণ ও কায়স্থরা যে বর্ণহিসাবে এক এবং অভিন্ন তাহাও ইঙ্গিত করা হইয়াছে। এই অভিন্নতা পাল পর্বেই স্বীকৃত হইয়া গিয়াছিল; বৃহদর্মপুরাণে বা ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে কেন যে সে ইঙ্গিত নাই তাহা বলা কঠিন। হইতে পারে, ব্রাহ্মণ্য সংস্কারের তখনও তাহা সম্পূর্ণ স্বীকৃত হইয়া উঠে নাই।
অম্বষ্ঠ বৈদ্য
বৃহদ্বর্মপুরাণে বর্ণহিসাবে বৈদ্যদেরও উল্লেখ নাই, ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে আছে; কিন্তু সেখানেও বৈদ্য ও অম্বষ্ঠ দুই পৃথক উপবর্ণ এবং উভয়ের উদ্ভব-ব্যাখ্যাও বিভিন্ন। এই গ্রন্থের মতে দ্বিজ পিতা ও বৈশ্য মাতার সঙ্গমে অম্বষ্ঠদের উদ্ভব; কিন্তু বৈদ্যদের উদ্ভব সূর্যতনয় অশ্বিনীকুমার এবং জনৈকা ব্রাহ্মণীর আকস্মিক সঙ্গমে। বৈদ্য ও অম্বষ্ঠরা যে এক এবং অভিন্ন এই দাবি সপ্তদশ শতকে ভরতমল্লিকের আগে কেহ কহিতেছেন না; ইনিই সর্বপ্রথম নিজে বৈদ্য এবং অম্বষ্ঠ বলিয়া আত্মপরিচয় দিতেছেন। তবে ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের উল্লেখ হইতে বুঝা যায়, দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতকে বৈদ্যরা উপবর্ণ হিসাবে বিদ্যমান, এবং বৃহদ্বর্মপুরাণ ও সদ্যোক্ত পুরাণটির সাক্ষ্য একত্র করিলে ইহাও বুঝা যায় যে, অম্বষ্ঠ ও বৈদ্য উভয়েই সাধারণত একই বৃত্তি অনুসারী ছিলেন। বোধ হয়, এক এবং অভিন্ন এই চিকিৎসাবৃত্তিই পরবর্তীকালে এই দুই উপবর্ণকে এক এবং অভিন্ন উপবর্ণে বিবর্তিত করিয়াছিল, যেমন করিয়াছিল করণ ও কায়স্থদের।
কৈবর্ত-মাহিষ্য
পাল-পর্বে কৈবর্ত-মাহিষ্য প্রসঙ্গে বলিয়াছি, তখন পর্যন্ত কৈবর্তদের সঙ্গে মাহিষ্যদের যোগাযোগের কোনও সাক্ষ্য উপস্থিত নাই এবং মাহিষ্য বলিয়া কৈবর্তদের পরিচয়ের কোনও দাবিও নাই স্বীকৃতিও নাই। সেন-বর্মণ-দেব পর্বেও তেমন দাবী কেহ উপস্থিত করিতেছেন না; এই যুগের কোনও পুরাণ বা স্মৃতিগ্রন্থেও তেমন উল্লেখ নাই। বস্তুত, মাহিষ্য নামে কোন উপবর্ণের নামই নাই। কৈবর্তদের উদ্ভবের ব্যাখ্যা দিতে গিয়া ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের সংকলয়িতা বলিতেছেন, ক্ষত্রিয় পিতা ও বৈশ্যমাতার সঙ্গমে কৈবর্তদের উদ্ভব। লক্ষণীয় এই যে, গৌতম ও যাজ্ঞবল্ক্য তাঁহাদের প্রাচীন স্মৃতিগ্রন্থে মাহিষ্যদের উদ্ভব সম্বন্ধে এই ব্যাখ্যাই দিতেছেন; ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের লেখক কৈবর্ত সম্বন্ধে এই ব্যাখ্যা কোথায় পাইলেন, বলা কঠিন; কোনও প্রাচীনতম গ্রন্থ কৈবর্ত সম্বন্ধে এই ব্যাখায় নাই, সমসাময়িক বৃহদ্বর্মপুরাণ বা কোনও স্মৃতিগ্রন্থেও নাই। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের ব্যাখ্যা যদি বা পাইতেছি মাহিষ্য-ব্যাখ্যা অনুযায়ী, কিন্তু কলিযুগে ইঁহাদের বৃত্তি নির্দেশ দেখিতেছি ধীবরের, মাহিষ্যের নয়। সুতরাং মনে হয়, ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের ব্যাখ্যার মধ্যেই কোনও গোলমাল রহিয়া গিয়াছে। দ্বাদশ শতকে ভবদেব ভট্ট কৈবর্তদের স্থান নির্দেশ করিতেছেন অন্ত্যজ পর্যায়ে। বৃহদ্বর্মপুরাণ ধীবর ও মৎস্যব্যবসায়ী অন্য একটি জাতের অর্থাৎ জালিকদের স্থান নির্দেশ করিতেছেন মধ্যম সংকর পর্যায়ে, ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ ধীবর ও কৈবর্তদের স্থান নির্দেশ করিতেছেন অসৎশূদ্র পর্যায়ে; এবং ইঁহাদের প্রত্যেকেরই ইঙ্গিত এই যে, ইঁহারা মৎস্যজীবী, কৃষিজীবী নন। তবে, স্পষ্টই বুঝা যাইতেছে, ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ সংকলয়িতা ইঁহাদের উদ্ভব-ব্যাখ্যা দিতেছেন, এই জাতীয় ব্যাখ্যার উপর নির্ভর করিয়াই পরবর্তীকালে কৈবর্ত ও মাহিষ্যদের এক ও অভিন্ন বলিয়া দাবী সমাজে প্রচলিত ও স্বীকৃত হয়। যাহাই হউক, বর্তমানকালে পূর্ববঙ্গের হালিক দাস এবং পরাশর দাস এবং হুগলী-বাঁকুড়া-মেদিনীপুরের চাষী কৈবর্তরা নিজেদের মাহিষ্য বলিয়া পরিচয় দিয়া থাকেন। আবার পূর্ববঙ্গে (ত্রিপুরা, শ্রীহট্ট, মৈমনসিংহ, ঢাকা অঞ্চলে) মৎস্যজীবী ধীবর ও জালিকরা কৈবর্ত বলিয়া পরিচিত। বুঝা যাইতেছে, কালক্রমে কৈবর্তদের মধ্যে দুইটি বিভাগ রচিত হয়, একটি প্রাচীন কালের ন্যায় মৎস্যজীবীই থাকিয়া যায় (যেমন পূর্ববঙ্গে আজও), আর একটি কৃষি (হালিক) বৃত্তি গ্রহণ করিয়া মাহিষ্যদের সঙ্গে এক এবং অভিন্ন বলিয়া পরিগণিত হয়। বল্লালচরিতে যে বলা হইয়াছে, রাজা বল্লালসেন কৈবর্ত (এবং মালাকার, কুম্ভবকার ও কর্মকার)-দিগকে সমাজে উন্নীত করিয়াছিলেন, তাহার সঙ্গে কৈবর্তদের এক শ্রেণীর বৃত্তি পরিবর্তনের (চাষি-হালিক হওয়ার) এবং মাহিষ্যদের সঙ্গে অভিন্নতা দাবীর যোগ থাকা অসম্ভব নয়।
———————
(১) Bib, Ind, edn. এই গ্রন্থ দুইখণ্ডে বিভক্ত। এই অধ্যায়ে আহৃত সংবাদ গ্রন্থের ইতস্তত বিক্ষিপ্ত, সর্বত্র সূচী-নিৰ্দেশ করিয়া লাভ নাই, সেইজন্য পাদটীকা সর্বত্র দেওয়া হয় নাই। অনুসন্ধিৎসু পাঠকের পক্ষে গ্রন্থখানির আনুপূর্বিক পাঠ প্রয়োজন। বর্ণবিন্যাস সংক্রান্ত অধিকাংশ তথ্য দ্বিতীয় অর্থাৎ উত্তরখণ্ডের ১৩শ ও ১৪শ অধ্যায়ে পাওয়া যাইবে। এই সঙ্গে শ্ৰীযুক্ত রমেশচন্দ্র মজুমদার মহাশয়ের সুলিখিত আলোচনা দ্রষ্টব্য: ভারতবর্ষ মাসিক পত্রিকা, ১৩৩৬-৩৭, ২য় খণ্ড, ৬৭৩পৃপৃ. ১৩৩৭-৩৮, ১ম খণ্ড, ৯৪ পৃপৃ। বঙ্গবাসী প্রেস সম্পাদিত ও প্রকাশিত এই পুরাণের একটি সংস্করণ আছে, তবে Bib, Ind. সং অধিকতর প্রামাণিক।
(২) জীবানন্দ বিন্যাসাগর কৃত সংস্করণ। এই ক্ষেত্রেও সবত্র পৃথক সূচিনির্দেশ দেওয়া হইতেছেনা। এই অধ্যায়ে আহৃত অধিকাংশ সংবাদ এই গ্রন্থের প্রথম অর্থাৎ ব্ৰহ্মখণ্ডের দশম পরিচ্ছেদে পাওয়া যাইবে; ১৬-২১ এবং ৯০–১৩৭ শ্লোক বিশেষভাবে দ্রষ্টব্য। ২/৪টি তথ্য অন্যত্র বিক্ষিপ্তও যে নাই তাহা নয়। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের মিশ্রবর্ণেরও সম্পূর্ণ তালিকা এক্ষেত্রে উদ্ধার করা হয় নাই, করিয়া লাভও নাই; কারণ, এই পুরাণই বলিতেছে, ‘মিশ্রবর্ণ অসংখ্য, কে তাহার সমস্ত নাম উল্লেখ ও গণনা করিতে পারে’ (১।১০।১২২)? সৎশূদ্রদের তালিকাও যে সম্পূর্ণ নয় তাহার আভাসও এই গ্রন্থেই আছে (১।১০১৮)।
(৩) লক্ষ্যণীয় যে এই পুরাণ বৈদ্য ও অম্বষ্ঠদের পৃথক উপবর্ণ বলিয়া উল্লেখ করিতেছে; এবং উভয় উপবর্ণের যে উৎপত্তি-কাহিনী দিতেছে, তাহাও পৃথক।