রাবিয়া আসিয়া যখন হালিমার শুশ্রূষার ভার লইল, তখন সে বেচারির দুঃখ ঘুচিল। আবদুল্লাহর মাতাও রান্নাঘর হইতে নিষ্কৃতি পাইলেন–রাবিয়ার মামা সেখানে তাহার স্থান। গ্রহণ করিল।
ডাক্তারবাবু এক্ষণে প্রত্যহ আসিয়া দেখিয়া যাইতে লাগিলেন। রোগীর অবস্থা সম্বন্ধে এখনো নিশ্চয় করিয়া কিছু বলা যায় না। ফুসফুঁসের অবস্থা আর বেশি খারাপ হয় নাই; খুব সম্ভব একুশ দিনে জ্বর ছাড়িতে পারে। কিন্তু সেই দিনটাই সঙ্কটের দিন। যদি ভালোয় ভালোয় কাটিয়া যায়, তবেই রক্ষা। ক্রমে কয়েক দিনের মধ্যে ডাক্তারবাবু আরো দুইবার ইনজেকশন দিলেন।
আবদুল খালেক দুই দিন পরেই চলিয়া গেলেন বাড়িতে কেহই নাই, একজন না। থাকিলে সেখানকার কাজকর্ম নষ্ট হইয়া যাইবে। যাইবার সময় বারবার করিয়া বলিয়া গেলেন যেন প্রত্যহ পত্র লেখা হয়, এবং সময় পাইলেই সত্বর অন্তত এক দিনের জন্যও একবার আসিবেন বলিয়া প্রতিশ্রুত হইলেন।
আবদুল্লাহ্ বা আবদুল কাদের কাহাকেও আর এখন রোগিণীর শুশ্রূষা সম্বন্ধে কিছুই দেখিতে হয় না। তাহারা ঔষধাদি আনিয়া দিয়া এবং ডাক্তারবাবুর আদেশগুলি শুনাইয়া খালাস। রাবিয়া ও মালেকা পালা করিয়া রাত্রি জাগে। আবদুল্লাহ একবার রাত্রি জাগরণের। ভাগ লইতে চাহিয়াছিল; কিন্তু রাবিয়া তাহাকে আমল দেয় নাই। বলিয়াছিল, মেয়েমানুষের শুশ্রষা কি পুরুষমানুষ দিয়ে হয়?
একুশ দিনের দিন ডাক্তারবাবু বলিলেন, আজ বড় সাবধানে থাকতে হবে। ঘণ্টায় ঘণ্টায় খবর দিবেন। রাত্রে আমার এইখানেই থাকা দরকার হতে পারে।
বৈকালের দিকে একটু একটু ঘাম দিয়া জ্বর কমিতে আরম্ভ করিল। সন্ধ্যার পর দেখা গেল, জ্বর ১০০ ডিগ্রির নিচে নামিয়াছে। ডাক্তারবাবুকে খবর দেওয়া হইল। তিনি তাড়াতাড়ি আহারাদি সারিয়া ব্যাগ হাতে করিয়া আসিলেন, এবং একবার হালিমার অবস্থা নিজে দেখিতে চাহিলেন। গিয়া দেখিলেন, হাত-পা বেশ একটু ঠাণ্ডা হইয়া গিয়াছে। জ্বর আরো কমিয়াছে এবং বেশ একটু ঘামও হইতেছে। কহিলেন, একটু পরেই জ্বর একেবারে ত্যাগ হইবে; কিন্তু যদি টেম্পারেচার বেশি নামে, তবেই বিপদ। দেখা যাক, কী হয়। যদি বেশি ঘাম হয়, তবে তৎক্ষণাৎ আমাকে ডাকবেন।
সে রাত্রে আর কাহারো ঘুম হইল না। দারুণ উৎকণ্ঠায় সকলে বসিয়া ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটাইতে লাগিলেন। রাত্রি প্রায় একটার সময় হালিমার অত্যন্ত ঘাম হইতে লাগিল এবং শরীর এলাইয়া পড়িল। ডাক্তারবাবুকে ডাকা হইল। তিনি কহিলেন, যা ভেবেছিলাম কিন্তু ভয় নেই, ও ঠিক হয়ে যাবেখন। আর একটা ইনজেকশন দিতে হবে।
নূতন একটা ইনজেকশন দেওয়া হইল। কিছুক্ষণ পরে রোগীর অবস্থা একটু ফিরিল, শরীরে উত্তাপ বাড়িল, হাত-পা বেশ গরম হইয়া উঠিল, ঘাম বন্ধ হইল। সকলের মনে আশা হইল এ যাত্রা হালিমা বাঁচিয়া যাইবে।
কিন্তু শেষরাত্রের দিকে আবার ঘাম ছুটিল। ডাক্তারবাবু আবার ইনজেকশন দিলেন। ব্যাগ হইতে একটা তীব্র ঔষধ বাহির করিয়া একটু খাওয়াইয়াও দিলেন, এবং কহিলেন, ওঁকে এখন চুপ করে পড়ে থাকতে দিন, যদি একটু ঘুম হয়। আর ভয় নেই, হার্টের অবস্থা ভালো।
যাহা হউক, উদ্বেগে দুর্ভাবনায় রাত্রিটা একরকম কাটিয়া গেল। ভোরের দিকে হালিমার বেশ গাঢ় নিদ্রা হইল। ডাক্তারবাবু কহিলেন, আর কোনো ভয় নেই, এ যাত্রা উনি রক্ষা পেয়ে গেলেন। এখন ওঁর সেবা-শুশ্রূষার দিকেই একটু বেশি নজর রাখতে হবে।
পরদিন হইতে হালিমার অবস্থা ভালোই দেখা যাইতে লাগিল। কিন্তু শরীর এত দুর্বল যে কথা কহিতে কষ্ট হয়। কাশিও একটু রহিয়া গেল। ডাক্তারবাবু বলকারক ঔষধের এবং দুবেলা মুরগির সুরুয়ার ব্যবস্থা করিলেন। রাবিয়া এবং মালেকার সযত্ন ও সস্নেহ শুশ্রূষায় হালিমা দেখিতে দেখিতে সুস্থ হইয়া উঠিল। আগের দিন ডাক্তারবাবু তাহাকে অন্ন-পথ্য করিবার অনুমতি দিলেন।
আবদুল্লাহ্ কহিল, ডাক্তারবাবু, কাল আমাদের ঈদ, বড়ই আনন্দের দিন। তার উপর আমার বোনটি ঈশ্বরেচ্ছায় আর আপনার চিকিৎসার গুণে বেঁচে উঠেছে, কাজেই আমাদের পক্ষে ডবল আনন্দ। যদি আপনার কোনো আপত্তি না থাকে, তবে…
তবে কী?
আপনাকে নেমন্তন্ন কত্তে চাই?
ডাক্তারবাবু অতি আনন্দে বলিয়া উঠিলেন, বাঃ! হলে তো দেখছি তে-ডবল আনন্দ।
আবদুল্লাহ্ একটু দ্বিধার সহিত জিজ্ঞাসা করিল, খেতে আপনার আপত্তি নেই?
কিছু না! আমার ওসব প্রেজুডিস নেই, বিশেষ করে আপনাদের ঘরের পোলাও কোরমা-কো–কাবাব–এইসবের কথা মনে উঠলে সব প্রেজুডিস পগার পার হয়ে যায়!
আবদুল্লাহ্ আহ্লাদিত হইয়া কহিল, তবে কাল দুপুরবেলা আমাদের এখানে চাট্টি নুন ভাত খাবেন…
ডাক্তারবাবু যেন আকাশ হইতে পড়িলেন। নুন-ভাত? সে কী মশায়! আপনাদের বাড়িতে শেষটা নুন-ভাত খেয়েই জাতটা মারব?
আবদুল্লাহ্ হাসিয়া কহিল, তা মাল্লেনই যখন, তখন না হয় গরিবের বাড়ির নুন-ভাত খেয়েই এবার মারুন।
না, না, সেসব হবে না, মুরগি-মুসাল্লাম চাহিয়ে। একবার যা খেয়েছিলাম মশায়… বলিয়া ডাক্তারবাবু কবে কোন মুসলমান বাড়িতে কী কী খাইয়াছিলেন তাহার ইতিহাস সবিস্তারে বর্ণনা করিতে লাগিলেন। পরিশেষে রায় দিয়া ফেলিলেন, মাংসটা আপনাদের ঘরে খাসা রান্না হয়–অমন আমাদের ঘরে হয় না।
এমন সময় পাশের বাড়িতে একটা চিৎকার ছোটাছুটি গোলমাল শোনা গেল। ব্যাপার কী, জানিবার জন্য সকলে উৎকণ্ঠিত হইয়া বৈঠকখানা হইতে নামিয়া বাহিরে আসিলেন। ডাক্তারবাবুর বাসাটি হাসপাতালের হাতার এক প্রান্তে অবস্থিত। হাতার বাহিরে ছোট একটি বাগান, তাহার পর জনৈক উকিলের বাসাবাটী। সেইখানেই গোলমাল হইতেছিল। একজন চাকর হেই হেই দূর দূর রবে চিৎকার করিতে করিতে বাগানের দিকে ছুটিয়া আসিল; ইহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ একটা ঝি, এবং তাহারও পশ্চাতে ছোট ছোট কয়েকটা ছেলেমেয়ে ঢিল হাতে দৌড়াইয়া আসিতেছিল। একটা মুরগি কটুকটুকটাআশ রবে ক্রন্দন করিতে করিতে তাহাদের সম্মুখে উড়িয়া হাসপাতালের হাতার মধ্যে আসিয়া পড়িল। বাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, কী হয়েছে রে রামা?
রামা নামক চাকরটি হাঁপাইতে হাঁপাইতে কহিল, হবে আর কী বাবু, মুরগি ঢুকেছে। বাড়িতে।
তারই জন্যে এত চেঁচামেচি? আমি বলি বুঝি-বা ডাকাত পড়েছে।
ঝি কহিল, বাঃ, রান্নাঘরের দোরে গে উঠল যে! ভাত-তরকারি সব গেল! বাবুর কাছারি যাবার সময় হল, কখন আবার ব্রাধবে? না খেয়েই বাবুকে কাছারি যেতে হবে। আর তাও বলি, আপনিই-বা কেমন ধারা মানুষ বাপু, বাড়িতে মুরগি পুষছে, তা কিছু বলচ না! আমাদের বাবু কত বকাবকি করে…
আবদুল্লাহ্ তাড়াতাড়ি বাড়ির ভিতর গিয়া মামাটার ওপর তম্বি করিতে লাগিল! এত করে বলি, এ হিন্দুপাড়া, মুরগিগুলো বেঁধে রাখতে, তা কেউ সে কথা কানে করে না…
মামা কহিল, বাধাই তো ছিল ঠ্যাঙ্গে দড়ি দে। কম্নে যে খুলে পলায়ে গেছে তা ঠাওর কত্তি পারি নি।
তা নেও, এখন ওটাকে ধরে ভালো করে বেঁধে রাখ। আমাদের জন্যে ডাক্তারবাবুকে পর্যন্ত কথা শুনতে হচ্ছে। ভদ্দরলোক মনে করবে কী?
বাহিরে আসিয়া আবদুল্লাহ্ বলিল, ডাক্তারবাবু আপনাকে তো অনেক কষ্ট দিলামই, তার উপর আমাদের জন্যে আপনাকে অপদস্থ পর্যন্ত…
আরে রামঃ! এসব কথা কি গ্রাহ্য কত্তে আছে? আপনি বুঝি ভেবেছেন এ বাড়িতে মুরগির চাষ এই প্রথম? তা নয়; আমারই একপাল মুরগি ছিল। এদ্দিন ওরা কিছু বলতে সাহস করে নি–এখন আপনারা রয়েছেন কিনা, তাই একবার ঝালটা ঝেড়ে নিলে। আচ্ছা আমি এটা বুঝতে পারি নে, কাক ঢুকলে হাঁড়ি মারা যায় না, মুরগি ঢুকলে যায় কেমন করে? কাকে তো খায় না, এমন ময়লাই নেই!
আবদুল্লাহ্ কহিল, মুরগিটা যে আপনাদের সাংঘাতিক রকম অখাদ্য…
গোমাংসের চেয়েও?
তা না হতে পারে, কিন্তু অপবিত্র তো বটে।
আর কাকটা বুঝি ভারি পবিত্র হল? ওসব কোনো কথাই নয়। আমার মনে হয়, এর মূলে একটা বিদ্বেষ ভাব আছে। তা মরুক গে যাক–অপবিত্র হোক আর অখাদ্যই হোক, কাল কিন্তু ওটা চাই, নইলে সহজে জাত খোয়াচ্ছি নে…
এই বলিয়া ডাক্তারবাবু হাসিতে হাসিতে বিদায় লইলেন।
বৈকাল হইতেই রাবিয়ার পুত্র আবদুস সামাদ চাঁদ দেখিবার জন্য নদীর ধারে গিয়া দাঁড়াইল। কাছারির ফেরতা পিয়াদা-চাপরাসীরাও নদীর ধার দিয়া আকাশের দিকে চাহিতে চাহিতে চলিয়াছে। সন্ধ্যার একটু পূর্বেই ঈদের ক্ষীণ চন্দ্র-লেখা পশ্চিম আকাশের গায়ে ফুটিয়া উঠিল। দেখিতে পাইয়াই সামু আসিয়া চিৎকার করিয়া সকলকে ডাকিয়া কহিতে লাগিল, আম্মা, দাদু, চাঁদ উঠেছে, ওই দেখুন।
কই? কই? বলিতে বলিতে সকলে বাহিরে আসিয়া আকাশের দিকে চাহিয়া চাঁদ খুঁজিতে লাগিলেন! হালিমাও রাবিয়ার কাঁধে ভর করিয়া আস্তে আস্তে বাহিরে আসিয়া তাহাদের সঙ্গে যোগ দিল।
রাবিয়া প্রথমেই দেখিতে পাইল এবং ফুপু-আম্মাকে দেখাইবার জন্য বৃথা চেষ্টা করিতে লাগিল। চাঁদ এত ক্ষীণ যে কিছুতেই তাহার নজরে আসিল না। অবশেষে তিনি দুঃখিতচিত্তে কহিলেন, আর মা! সে চোখ কি আর আছে, যে দেখতে পাব? তোমরা দেখেছ, তাইতে আমার হয়েছে।
অতঃপর যে যাহার গুরুজনের কদমবুসি করিল। আবদুল্লাহ্ এবং আবদুল কাদেরও বাড়ির ভিতরে আসিয়া মুরব্বিগণের কদমবুসি করিয়া গেল। আবদুল্লাহর মাতা সকলকে দোয়া করিতে লাগিলেন, খোদা চিরদিন তোমাদের ঈদ মোবারক করুন!
হালিমা কদমবুসি করিতে আসিলে মাতা গদগদকণ্ঠে কহিলেন, থাক থাক, ব্যারাম নিয়ে আর সালাম করিস্ নে। এ ঈদে যে তুই আবার সালাম করবি, এ ভরসা ছিল না মা! শোকর তোর দরগায় খোদা! এই বলিয়া তিনি অঞ্চলে চক্ষু মুছিলেন।
সন্ধ্যার পরেই আকবর আলী সাহেব আসিয়া কহিলেন, সব্রেজিস্ট্রার সাহেব, কাল নামাযে ইমামতি করতে হবে আপনাকে।
আবদুল কাদের জিজ্ঞাসা করিল, কেন, আপনাদের মৌলবী সাহেব কোথায় গেলেন!
আকবর আলী কহিলেন, তিনি তো সেদিনকার সেই গোলমালের পর থেকে আর এ-মুখো হন নি! সৈয়দ সাহেব সেদিন বেচারাকে সকলের সামনে যে অপমানটা করলেন, অমন কোনো ভদ্রলোক করে না। বেচারার মনে বড় চোট লেগেছে!
আবদুল্লাহ্ কহিল, আহা, তা লাগবারই কথা। আমার শ্বশুরের সেটা ভারি অন্যায় হয়ে গেছে। তিনি মস্ত বড় শরীফ, এই অহঙ্কারেই তিনি একেবারে অন্ধ।
আকবর আলী কহিলেন, সে মৌলবী সাহেবকে তো আর পাওয়া যাবে না; এখন আপনাদের একজনকে ইমামতি কত্তে হচ্ছে। আপনার ওয়ালেদ সাহেবই যখন তাকে তাড়িয়েছেন, তখন আপনারই উচিত ক্ষতিপূরণ করা, সব্রেজিস্ট্রার সাহেব।
আবদুল্লাহ্ কহিল, ক্ষতিপূরণ ও-ভাবে কলে তো হবে না–সেই মৌলবী সাহেবকে ডেকে যদি আমরা সকলে তার পিছনে নামায পড়ি, তবে কিছুটা হয় বটে।
আবদুল কাদের জিজ্ঞাসা করিল, তিনি থাকেন কোথায়?
আকবর আলী কহিলেন, বেশি দূর নয়, ওপারে নিকারিপাড়ায়।
তবে তাকে খবর দিন না, কাল ঈদের নামাযে ইমামতি কত্তে।
আমি গত জুমায় তার কাছে লোক পাঠিয়েছিলাম, তা তিনি আসলেন না।
আবদুল্লাহ কহিল, তবে এক কাজ করি না কেন? আমরা নিজেরা গিয়ে তাকে অনুরোধ করে আসি…
আবদুল কাদের কহিল, দোষ কী? কয়েকজন একসঙ্গে দু-তিনটে হেরিকেন নিয়ে যাবখন।
আকবর আলী কহিলেন, নিতান্তই যদি যেতে চান তবে আমি কয়েকজন লোক পাঠিয়ে দিচ্ছি, তাদের সঙ্গে করে নিয়ে যান। কিন্তু একথা সৈয়দ সাহেব জানতে পারলে আপনাদের আর আস্ত রাখবেন না…
আবদুল্লাহ্ বাধা দিয়া কহিল, ইঃ! কী করবেন আমাদের? ওঁর ও ফাঁকা আওয়াজের আমরা আর বড় তোয়াক্কা রাখি নে।
সেই রাত্রেই আবদুল্লাহ্ এবং আবদুল কাদের ওপারে নিকারিপাড়ায় গিয়া উপস্থিত হইল। মৌলবী সাহেব যে বাড়িতে ছিলেন, তাহা খুঁজিয়া বাহির করিতে বেশি বেগ পাইতে হইল না। তাহারা ঘরে উঠিয়া সালাম-সম্ভাষণ করিতেই মৌলবী সাহেব যেন আকাশ হইতে পড়িলেন। বলিয়া উঠিলেন, এ কী আপনারা! এখানে!…
আবদুল্লাহ্ কহিলেন, জি হ্যাঁ, আমরাই, আপনারই কাছে এসেছি।
মৌলবী সাহেব কহিলেন, আপনাদের মতো লোকের আমার কাছে আসাটা একটু তাজ্জবের কথা বটে। কী মনে করে আপনাদের আসা হয়েছে?
কাল ঈদের নামায পড়াবার জন্যে আপনাকে বরিহাটী যেতে হবে।
মৌলবী সাহেব আশ্চর্য হইয়া কহিলেন, আমাকে পড়াতে হবে? আবার?
সে কথা মনে করে আর কষ্ট করবেন না, মৌলবী সাহেব। যা হবার তা হয়ে গেছে। বুড়ো মানুষ–শরাফতের গুমোর ওঁদের হাড়ে-মাংসে জড়িয়ে আছে–ওঁর কথা ছেড়ে দিন। আমরা আছি–ওঁর মেজ ছেলে এই সব্রেজিস্ট্রার সাহেবও আছেন–আমরাই আপনাকে অনুরোধ কচ্ছি, মেহেরবানি করে এসে আমাদের ইমামতি করুন।
মৌলবী সাহেব চুপ করিয়া রহিলেন। আবদুল্লাহ্ আবার জিজ্ঞাসা করিল, কী বলেন, মৌলবী সাহেব?
মৌলবী সাহেব হাত দুটি জোড় করিয়া কহিলেন, আমাকে মাফ করুন। আমরা ছোটলোক হলেও একটা মান-অপমান জ্ঞান তো আছে! ধরুন, আপনাকেই যদি কেউ কোনোখানে অপমান করে, সেখানে কি আর আপনার যেতে ইচ্ছা করে? তার উপর এরা আবার আমাকে যত্ন করে রেখেছে–এদের ফেলে তো যাওয়া যেতেই পারে না।
এ কথার আর কি জওয়াব দেওয়া যায়? অথচ এ-বেচারার উপর যে অত্যাচারটা হইয়া গিয়াছে, তাহার একটা প্রতিকার করিবার জন্য আবদুল্লাহ্ উদ্বিগ্ন হইয়া রহিয়াছে। সে ভাবিতে লাগিল।
হঠাৎ আবদুল্লাহর মাথায় একটা খেয়াল আসিল। সে বলিয়া উঠিল, তবে আমরাও আসব আপনার সঙ্গে নামায পড়তে…
মৌলবী সাহেব যেন একটু সঙ্কোচের সহিত কহিলেন, আপনারা এতদূরে আসবেন কষ্ট করে…
কষ্ট আর কী, মৌলবী সাহেব, এই রাত্রে যখন আসতে পেরেছি, তখন দিনে এর চেয়েও সহজে আসতে পারব। কী বল, আবদুল কাদের?
আবদুল কাদের কহিল, তা তো বটেই! আমরা ঠিক আসব।
মৌলবী সাহেব একটু আমতা আমতা করিয়া তা–তবে– ইত্যাদি কী যেন বলিতে যাইতেছিলেন। আবদুল্লাহ বাধা দিয়া কহিল, আপনি মনে কিছু দ্বিধা করবেন না, মৌলবী সাহেব। আমাদের কোনো কু-মতলব নেই। সরলভাবেই বলছি, আপনি একজন আলেম লোক বলে আমরা আপনাকে মনে মনে শ্রদ্ধা করি আপনার পিছনে নামায পড়া আমরা গৌরবের কথা বলেই মনে করব।
মৌলবী সাহেব যাহার বাড়িতে ছিলেন, সে লোকটা নিকারিদের মোড়ল। সেও সেখানে উপস্থিত ছিল। সে বলিল, বেশ তো, আপনারা যেতি আমাগোর সাতে নোমায পড়তি আসেন, সে তো ভালো কতা!
আবদুল্লাহ্ কহিল, কেন আসব না? আমরা সব্বাই মুসলমান, ভাই ভাই। যত বেশি ভাই মিলে একসঙ্গে নামায পড়া যায়, ততই সওয়াব বেশি হয়। ঈদের নামায যেখানে বড় জমাত হয়, সেইখানেই গিয়ে পড়া উচিত–কী বলেন, মৌলবী সাহেব?
মৌলবী সাহেব কহিলেন, সে তো ঠিক কথা!
আবদুল্লাহ্ কহিল, ওপারে জমাত ছোট হয়। কজনই-বা লোক আছে বরিহাটীতে। আমি চেষ্টা করব, যাতে ওখানকার সকলেও এপারে এসে নামায পড়েন।
এ প্রস্তাবে সকলেই খুশি হইয়া উঠিল। মোড়ল কহিল, আমাগোর হ্যাঁপারে যে জোমাত হয়, মানুষির মাথা গুনে শ্যাষ করা যায় না। এই গেরদের বিশ তিরিশ হান্ গেরামের লোক আসে আমাগোর ঈদগায়ে নোমায পড়তি। মাঠহাও পেল্লায়–বহুত লোক বসতি পারে। এত বড় ঈদগা এ-গেরুদের মদ্দি নেই!
আবদুল্লাহ্ কহিল, আপনার কাছে আরো একটা অনুরোধ আছে, মৌলবী সাহেব। নামায পড়াতে যাবার অনুরোধ তো রাখলেন না; তার বদলে আমরাই আসছি। কিন্তু এ অনুরোধটা রাখতেই হবে।
মৌলবী সাহেব কুণ্ঠিতভাবে কহিলেন, আমাকে এমন করে বলে কেন লজ্জা দিচ্ছেন আপনারা…
না, না, ওরকম কেন মনে কচ্ছেন আপনি! আমার অনুরোধ এই যে, কাল দুপুরবেলা আমাদের বাসায় আপনাকে দাওৎ কবুল কত্তে হবে।
মৌলবী সাহেব মোড়লের মুখের দিকে চাহিলেন। মোড়ল কহিল, তা ক্যামন করে হবে, মেয়া সাহেব, ঈদির দিন উনি আমাগোর বাড়ি না খালি হবে ক্যান্?
আবদুল্লাহ্ কহিল, তা উনি রাত্রে এখানে খাবেনখন। উনি তো কেবল আপনাদেরই মৌলবী সাহেব নন, আমাদেরও মৌলবী সাহেব। আমরাও ওঁকে একবেলা খাওয়াব।
মোড়ল কহিল, না, ঈদের দিন ওনারে আমরা যাতি দি ক্যাম্নয়? আপনারা ওনারে পাছে খাওয়াবিন।
আমরা যে দুই-এক দিনের মধ্যে চলে যাচ্ছি মোড়লসাহেব। কাল ছাড়া আর আমাদের দিনই নেই।
কাজেই মোড়ল সাহেবকে হাল ছাড়িতে হইল। স্থির হইল যে, কাল নামায বাদ মৌলবী সাহেব ওখানে খাইতে যাইবেন, কিন্তু রাত্রে উহাদিগকে মোড়ল বাড়ির দাওয়াদ কবুল করিতে হইবে। অবশ্য কাল দ্বিপ্রহরে মোড়ল স্বয়ং গিয়া রীতিমতো দাওয়াদ করিয়া আসিবে। আবদুল্লাহ্ রাজি হইয়া গেল।
রাত্রে বাসায় ফিরিয়া আবদুল্লাহ্ দেখিল, আবদুল খালেক আসিয়াছেন, তিনি কাজের ঝঞ্ঝাটে অনেক চেষ্টা করিয়াও এ কয়দিন আসিতে পারেন নাই বলিয়া কৈফিয়ত দিলেন। কিন্তু সে-সকল কৈফিয়তে কান দিবার মতো মনের স্থিরতা আবদুল্লাহর ছিল না। শ্বশুর কর্তৃক অপমানিত মৌলবীটিকে লইয়া কাল যে ব্যাপার ঘটাইতে হইবে, তাহারই ভাবনায় উন্মনা হইয়া ছিল। সে আবদুল খালেককে সকল কথা খুলিয়া বলিল। তিনিও অনুমোদন করিলেন দেখিয়া আবদুল্লাহ্ বড়ই খুশি হইয়া গেল।
পরদিন ভোরে উঠিয়াই আবদুল্লাহ্ আকবর আলী সাহেবের নিকটে উপস্থিত হইয়া ওপারে নামায পড়িতে যাইবার প্রস্তাব উত্থাপন করিল; কিন্তু আকবর আলী তাহাতে রাজি হইতে পারিলেন না। কহিলেন, যখন তাহারই চেষ্টায় ইহারা সকলে একটা জুমা-ঘর প্রস্তুত করিয়াছে, এবং কয় বৎসর ধরিয়া এখানে রীতিমতো নামায হইয়া আসিতেছে, তখন এ-স্থান ছাড়িয়া অন্যত্র নামায পড়িতে যাওয়া কর্তব্য হইবে না। বিশেষত একবার নামায বাদ পড়িলে ভবিষ্যতে ইহার স্থায়িত্ব সম্বন্ধে গোল ঘটিতে পারে।
অগত্যা আবদুল্লাহ্ স্থির করিল, কেবল তাহারাই কয়জন ওপারে যাইবে। আকবর আলী নিরস্ত করিতে চেষ্টা করিলেন। কিন্তু সে কহিল, যখন কথা দিয়া আসা হইয়াছে, তখন যাইতেই হইবে।
.
২৭.
বেলা দেড় প্রহর হইতে না হইতেই আবদুল্লাহরা নিকারিপাড়ার ঈদগাহে আসিয়া উপস্থিত হইল। তখন ঈদগাহ প্রায় ভরিয়া উঠিয়াছে। নিকটবর্তী বহু গ্রাম হইতে লোকে এইখানে ঈদ-বকরীদের নামায পড়িতে আসে, প্রায়-ছয় সাত শত লোকের জমাত হইয়া থাকে।
তাহারা আসিতেই সকলে ঘাড় ফিরাইয়া দেখিল, এবং তাহাদের সালাম-সম্ভাষণের যুগপৎ প্রতি-সম্ভাষণে একটা সমুচ্চ গুঞ্জন উপস্থিত হইল। সকলেই বসিয়া ছিল–কেহ-বা মাদুর, কেহ-বা ছোট জায়নামাজ বা শতরঞ্জ পাতিয়া, কেহ-বা রঙিন রুমাল ঘাসের উপর বিছাইয়া স্থান করিয়া লইয়াছিল। মৌলবী সাহেব গ্রামের কয়েকজন মাতব্বর লোকসহ। ভিড়ের মধ্যে নড়িয়াচড়িয়া, যে দুই-এক জন লোক তখনো আসিতেছিল, তাহাদিগকে বসাইবার বন্দোবস্ত করিতেছিলেন। তিনি একটু অগ্রসর হইয়া কহিলেন, তশরীফ লাইয়ে, হুজুর! আপনাদের দেরি দেখে ভাবছিলাম, বুঝি আর আসা হল না।
আবদুল্লাহ্ কহিল, না, না, মৌলবী সাহেব, না আসবার তো কোনো কারণই নেই। ওখান থেকে সবাইকে আনবার জন্যে চেষ্টা কচ্ছিলাম কিনা, তাই একটু দেরি হয়ে গেল।
আর কেউ কি আসবেন?
না; তারা বলেন, এখানকার জুমা-ঘরে বরাবর নামায হয়ে আসছে, কাজেই সেটা বন্ধ করা ভালো দেখায় না।
মৌলবী সাহেব কহিলেন, তবে আর দেরি করে কাজ কী?
জমাতের মধ্য হইতে এক ব্যক্তি বলিয়া উঠিল, নামায শুরু হয়ে যাক–রোদ তেতে উঠল!
আর এক ব্যক্তি দূর-প্রান্ত হইতে কহিল, এট্টু দেরেঙ্গ করেন আপনারা, ওই যে আরো কজন মুসল্লি আসতিছেন।
আবদুল্লাহ্ কহিল, ঈদগাহটি এঁরা বেশ সুন্দর জায়গায় করেছেন কিন্তু! চারদিকে বড় বড় গাছ, সবটা জায়গা ছায়াতে ঢেকে পড়েছে। আরামে নামায পড়া যাবেখন।
মৌলবী সাহেব কহিলেন, কিন্তু দেরি হয়ে গেলে আর আরাম থাকবে না। ইমামের মাথার উপরেই রোদ লাগবে আগে!
আবদুল্লাহ এবার হাসিয়া কহিল, সেইজন্যেই বুঝি আপনি তাড়াতাড়ি কচ্ছেন?
মৌলবী সাহেব কহিলেন, তাও বটে, আর ঈদের নামাযে বেশি দেরি করা জায়েজ নয়, সেজন্যেও বটে।
এদিকে গ্রামের মোড়ল আর একজন মুসল্লি সঙ্গে লইয়া, দুই জনে একখানা বড় রুমালের দুই প্রান্ত ধরিয়া প্রত্যেকের নিকট হইতে ফেত্রার পয়সা আদায় করিতে আরম্ভ করিল। সেই মুসল্লিটি কহিতে লাগিল, ফেত্রার পয়সা দেন, মেয়া সাহেবরা! পোনে দু সের গমের দাম চোদ্দ পয়সা। ছোট বড়, কারো মাফ নেই। ছোট, বড় আওরত, মরদ। সলকার জন্যি ফেত্রা দেওয়া ওয়াজেব! হর হর বাড়ির মালিক জনে জনে হিসেব করে দেবেন! ফেত্রা না দিলি রোজার পুরা সওয়াব মেলে না!
রুমাল ঘুরিয়া চলিল এবং সঙ্গে সঙ্গে ঝনঝন পয়সা পড়িতে লাগিল। কেহ কহিল, এই নেন আমার পাঁচ জোনের ফেতরা এক ট্যাহা ছয় পয়সা; কেহ আমি একলা মানুষ বলিয়া সাড়ে তিন আনা পয়সা ফেলিয়া দিল; কেহ-বা কহিল, আমি বড় গরিব, মেয়া সাহেব। খোদায় মাফ করবি!
ক্রমে টাকা পয়সা সিকি দুআনিতে ভরিয়া রুমালখানি দারুণ ভারী হইয়া উঠিল। তখন সেখানি বেশ করিয়া বাধিয়া মেম্বারের পার্শ্বে রাখিয়া দিয়া আর একখানি রুমাল আনা হইল। এইরূপে তিন-চারিখানি রুমাল ভরিয়া ফেত্রা আদায় করা হইয়া গেলে মৌলবী সাহেব নামাযে খাড়া হইলেন। তখন ঈদগাহের পশ্চিম প্রান্ত রৌদ্রে ভরিয়া গেলেও মেন্বর প্রান্তস্থিত ভরা রুমালগুলি তাহাকে সূর্যতাপ অনুভব করিবার অবসর দিল না।
সকলে উঠিয়া কেবলামুখী হইয়া দাঁড়াইল। মৌলবী সাহেব চিৎকার করিয়া কহিলেন কাতার ঠিক করে দাঁড়াবেন, মিয়া সাহেবরা! পায়ের দিকে চেয়ে দেখবেন।
অমনি সকলে পার্শ্ববর্তীগণের পায়ের দিকে চাহিয়া দেখিয়া নড়িয়াচড়িয়া কাতার সোজা করিয়া লইল। নামায শুরু হইল।
নিয়ত করা হইয়া গেলে মৌলবী সাহেব সমুচ্চকণ্ঠে চারবার তীর উচ্চারণ করিলেন। অতঃপর সকলে তহরিমা বাধিয়া নতমস্তকে দাঁড়াইয়া ইমামের সুরা-পাঠ শ্রবণ করিতে লাগিল। ইমাম সাহেব বড়ই সুকণ্ঠ; প্রান্তর মুখরিত করিয়া তাহার মধুর কেরাত নামাযীগণের হৃদয়ে যেন প্রতিধ্বনিত হইতে লাগিল। ক্রমে সুরা পাঠ শেষ হইলে আবার গম্ভীর রবে তীর উচ্চারিত হইল; অমনি সকলে যুগপৎ অর্ধঅবনমিত দেহে রুকু করিল–সুশিক্ষিত সেনাদল যেমন নায়কের ইঙ্গিতমাত্রে যন্ত্রচালিতের ন্যায় একযোগে আদেশ-পালনে তৎপর হয়, তেমনি তৎপরতার সহিত সকলে একযোগে রুকুতে অবনত হইল। আবার তীর উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে তেমনই সকলে একযোগে দণ্ডায়মান হইল, এবং একযোগে ভূ-তলে জানু পাতিয়া ভূ-পৃষ্ঠ-মস্তকে সেজদা করিল। আল্লাহ্ যেমন এক তেমনি নামাযরত জনসংঘেরও যেন একই প্রাণ, একই দেহ!
দুই রাকাত নামায় দেখিতে দেখিতে শেষ হইয়া গেল; ইমামের সালাম পাঠের সঙ্গে সঙ্গে সকলে দক্ষিণে ও বামে মস্তক হেলাইয়া সমগ্র মোসলেম-জগতের প্রতি মঙ্গল আশীর্বাদ বর্ষণ করিল।
তাহার পর ইমাম মোনাজাত করিলেন এবং সকলে দুই হাত তুলিয়া তাহার সহিত যোগদান করিল। মোনাজাত হইয়া গেলে তিনি দণ্ডায়মান হইয়া আরবি কেতাব হাতে লইয়া খোবা পড়িতে লাগিলেন। যদিও তাহার এক বর্ণও কাহারো বোধগম্য হইল না, তথাপি সকলে ধর্মবুদ্ধিপ্রণোদিত হইয়া গভীর মনোযোগের সহিত খোত্বা শ্রবণ করিতে লাগিল।
খোৎবার পর আবার মোনাজাত হইল। তাহার পর আলিঙ্গনের পালা। প্রত্যেকে একবার ইমামের সহিত এবং আর একবার পরস্পরের সহিত কোলাকুলি করিবার জন্য ব্যগ্রতা দেখাইতে লাগিল। যেন সকলেই ভাই ভাই, এক প্রাণ, এক আত্মা! একতার এমন নিদর্শন। শার কোথাও দেখিতে পাওয়া যায় না; কার্যক্ষেত্রে এমন নিদর্শনের এমন ব্যর্থতাও আর। সমাজে ঘটিয়াছে কি না সন্দেহ।
ঈদের নামায খতম হইল, যে যাহার ঘরে চলিল। মৌলবী সাহেবের রুমালে বাধা টাকা-পয়সার মোটগুলিও মোড়লের হাতে ঘরে চলিল! মৌলবী সাহেব তাহার ঘরে গিয়া সেখানে গনিয়া বাক্সবন্দি করিয়া আসিলেন, এবং আবদুল্লাহদের সঙ্গে নিমন্ত্রণ রক্ষা করিতে চলিলেন।
বেলা প্রায় দ্বিপ্রহরের সময় বাসায় পৌঁছিয়া যে-যাহার মুরব্বিগণের কদমবুসি করিল। মুরব্বিরাও সকলকে প্রাণ ভরিয়া দোয়া করিতে লাগিলেন।
তাহার পর আহারের পালা। ডাক্তারবাবুকে ডাকিয়া আনিবার জন্য সামুকে পাঠানো হইল। একটু পরেই ডাক্তারবাবু হসপিটাল অ্যাসিট্যান্ট বাবুকে সঙ্গে করিয়া লইয়া আসিলেন। কহিলেন, এঁকে ধরে নিয়ে এলাম। একা একাই জাতটা খুইয়ে লেজকাটা শেয়াল হব? আরো যতগুলার পারি লেজ কেটে দি!
আবদুল্লাহ সবিনয়ে কহিল, বড়ই সুখের বিষয় যে আপনি এসেছেন। আপনার প্রেজুডিস নেই তা তো জানিনে, কাজেই বলতে সাহস করি নি।
ডাক্তারবাবু কহিলেন, আরে, এর আর বলাবলি কী? যারা মুরগি-মাটনের স্বাদ একবার পেয়েছে, তাদের আর বলতে-কইতে হয় না কিছু। কী বল, ভায়া? আর এ আমার নিজের বাড়ি–আমিই তো ওঁকে নিমন্ত্রণ করে এনেছি।
বৈঠকখানা-ঘরে দস্তরখান বিছানো হইল। অন্দর হইতে খাঞ্চা ভরিয়া খানা আসিতে লাগিল এবং আবদুল খালেকের চাকর সলিম রেকাবিগুলি যথাস্থানে সাজাইয়া দিল। চিলমচি, বদনা প্রভৃতি আসিল। আবদুল্লাহ্ প্রথমেই ডাক্তারবাবুয়ের হাত ধোয়াইয়া দিল। তৎপরে মৌলবী সাহেবকে হাত ধুইবার জন্য অনুরোধ করিলে তিনি কহিলেন যে, আর আর সকলের হাত ধোয়া হইয়া গেলে তিনি ধুইবেন। কিন্তু আবদুল্লাহ্ ছাড়িল না, আপনি আগে ধোন। আপনারা আগে ধুয়ে নেন ইত্যাদি শিষ্টাচার কলহের পর মৌলবী সাহেবকেই হারিতে হইল–তিনিই সর্বাগ্রে হাত ধুইয়া লইলেন। এমনকি আবদুল্লাহ নিজেই তাহার হাতে জল ঢালিয়া দিল।
দস্তরখানে লোক বেশি নহে বলিয়া আর স্বতন্ত্র খাদেমের দরকার হইল না। আবদুল খালেক বসিয়া বসিয়াই সকলের রেকাবিতে তাম্বখশ করিয়া পোলাও পৌঁছাইয়া দিল এবং চামচে করিয়া কাবাব ও কোফতা বাটিতে লাগিল।
সুফী সাহেব আবদুল্লাহকে কহিলেন, উওহ্ নিমকদানঠো জারা বাঢ়া দিজিয়ে। আবদুল্লাহ্ তাড়াতাড়ি নিমকদান বাড়াইয়া দিল। তখন প্রত্যেকেই নিমক চাহিলেন, সুতরাং নিমকদানটা এবার সব হাত ঘুরিয়া আসিল।
সুফী সাহেব একবার সকলের মুখের দিকে চাহিতে চাহিতে জিজ্ঞাসুভাবে কহিলেন, বিসমিল্লাহ্? আবদুল্লাহ্ কহিল, জি হাঁ, বিসমিল্লাহ। খানা শুরু হইল।
সুফী সাহেব লোকটি বেশ ভোজনবিলাসী। দুই-এক লোকমা পোলাও খাইয়া তিনি বলিয়া উঠিলেন, ওঃ বড়া ওদা খানা পাক্কা! কাবাব ভি বহোৎ জায়েকাদার হুয়া!
ডাক্তারবাবু কহিলেন, বাস্তবিক, রান্নাটা খাসা হয়েছে কিন্তু। আমি অনেক জায়গায় খেয়েছি, কিন্তু এমনটি কোথাও খাই নি।
সামু খাইতে খাইতে জল চাহিল। সলিম এক গ্লাস জল ঢালিয়া তাহার হাতে দিল। কয়েক চুমুক খাইয়া সামু গেলাসটি দস্তরখানের উপর রাখিল। সুফী সাহেব চটিয়া উঠিয়া কহিলেন, বাড়া বে-তামিজ লাড়কা! দস্তরখান পর পানি কা গিলাস রাখতা হায়।
আবদুল খালেক কহিল, সামু, গেলাসটা তুলে সলিমের হাতে দাও বাবা।
খানা চলিতে লাগিল। আবদুল্লাহ কোরমার পেয়ালাটি বাম হস্তে তুলিয়া আনিয়া কাছে রাখিল এবং বাম হস্তে চামচ ধরিয়া কয়েকজনকে কোরমা তুলিয়া দিয়া, পেয়ালাটি আবদুল কাদেরের দিকে বাড়াইয়া দিয়া কহিল, দাও তো ভাই ওদিকে…ডাক্তারবাবুদের পাতে বেশি করে দিও!
দেবনাথবাবু আপত্তি করিয়া কহিলেন, ঢের রয়েছে যে, কত আর খাব! কিন্তু বলিতে বলিতেই দুই-তিন চামচ করিয়া কোরমা তাহাদের পাতে পড়িয়া গেল।
সুফী সাহেব কহিলেন, লাইয়ে তো পিয়ালা ইধার, নরম, এক বোটি চুন্ লে। আবদুল কাদের কোরমার পেয়ালা তাহার দিকে বাড়াইয়া দিল। সুফী সাহেব পেয়ালার ভিতর দক্ষিণ হস্তের অঙ্গুলি ডুবাইয়া দিয়া মাংসের টুকরা টিপিয়া টিপিয়া কয়েকখানি বাছিয়া তুলিয়া লইলেন।
আবদুল্লাহ্ তাড়াতাড়ি সলিমকে ডাকিয়া কানে কানে কহিয়া দিল, দৌড়ে আর একটা পেয়ালায় করে কোরমা নিয়ে আয় তো! আর একটা চামচও আনি।
সলিম দরজার কাছে গিয়া মামাকে ডাকিয়া কহিতেই সে আর এক পেয়ালা কোরমা চামচসহ আনিয়া দিল।–সলিম উহা লইয়া ভিতরে আসিলে আবদুল্লাহ্ তাহাকে কহিল, ওটা ডাক্তারবাবুদের সুমুখে রেখে দে।
কিছুক্ষণ পূর্বে সুফী সাহেব জল খাইয়া গেলাসটি কাছেই রাখিয়া দিয়াছিলেন। এক্ষণে আবার জলের আবশ্যক হওয়াতে তিনি গেলাসটি উঠাইয়া সলিমের হাতে দিয়া কহিলেন, পানি দেও।
গেলাসের তলায় সামান্য একটু জল ছিল, সলিম তাহাতেই আবার জল ঢালিয়া দিল। সুফী সাহেব চটিয়া উঠিয়া কহিলেন, জুঠা পানিমে পানি ডালতা হায়? ফেঁক দেও উওহ পানি।
সলিম সে জল ফেলিয়া দিয়া আবার এক গ্লাস ঢালিয়া দিল।
সামু আবদুল্লাহর পাশেই বসিয়াছিল। সে ফিসফিস করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, ফুপাজান, জুঠা পানিতে পানি ঢাললেই দোষ, আর ভরা পিয়ালায় জুঠা হাত ডুবালে দোষ হয় না?
আবদুল্লাহ্ কহিল, চুপ, ওকথা এখন থাক্।
ক্রমে আহার শেষ হইল। তাহার পর হাত ধুইবার পালা। সলিম চিলমচি, বদনা, তোয়ালে প্রভৃতি লইয়া আসিল। ডাক্তারবাবুদেরই আগে হাত ধোয়ানো হইল। তাহারা সাবান দিয়া হাত ধুইলেন। তাহার পর মৌলবী সাহেব, তিনিও সাবান লইলেন। কিন্তু বিলাতি সাবানে হারাম বস্তু থাকা সম্ভব মনে করিয়া সুফী সাহেব তাহা স্পর্শ করিলেন না; কেবল জল দিয়া হাত ধুইয়াই–খ্যাক–থু করিতে করিতে বেশ করিয়া তোয়ালে দিয়া মুছিয়া ফেলিলেন। হাতের আঙুলে যত চর্বি, ঘি প্রভৃতি জড়াইয়া ছিল, তাহাতে তোয়ালেখানি সুন্দর বাসন্তী রঙে রঞ্জিত হইয়া গেল! আবদুল্লাহ্ বাড়ির ভিতর গিয়া তাড়াতাড়ি আর একখানি পরিষ্কার তোয়ালে লইয়া আসিল।
পান আসিল এবং সঙ্গে সঙ্গে আবদুল কাদের দশ টাকার করিয়া পাঁচখানি নোট আনিয়া দেবনাথবাবুর সম্মুখে রাখিয়া দিল।
ডাক্তারবাবু একটু আশ্চর্য বোধ করিয়া কহিলেন, ও কী?
আবদুল কাদের কহিল, আপনার ভিজিট বাবদ আমরা এতদিন কিছু দিতে পারি নি, ডাক্তারবাবু। তা ছাড়া আপনি আরো যে উপকার করেছেন, তার তো কোনো তো মূল্যই হয় না। তবে মেহেরবানি করে যদি এটা অন্তত সামান্য নজর বলে কবুল করেন…
ডাক্তারবাবু কহিলেন, না, না; ওসব আবার কী! আমি তো এখানে ডাক্তার বলে আসিনে, বন্ধুভাবেই এসেছি। আর আপনারা তো ধওে গেলে হসপিটালেই আছেন–আমার বাড়িতে জায়গা ছিল, তাই ওয়ার্ডে না রেখে এইখেনেই রেখেছি…
তা হোক, হসপিটালই হোক আর যাই হোক, আমরা আপনার কাছে যে কতদূর ঋণী তা এক ঈশ্বর জানেন, আর আমরা জানি। এ সামান্য নজরটা অবশ্য সে ঋণের পরিশোধ হতেই পারে না–তবে আমার সাধ্যে যেটুকু কুলোয় তাই দিচ্ছি, ওটা আপনাকে নিতেই হবে।
ডাক্তারবাবু একটু ভাবিয়া কহিলেন, না নিলে পাছে আপনারা বেজার হন, তাই নিচ্ছি–কিন্তু আর না… বলিয়া তিনি দুখানি নোট উঠাইয়া লইলেন। কিছুতেই অধিক লইতে চাহিলেন না।
এমন সময়, ম্যা সাএব শ্যালাম, শ্যালাম বলিতে বলিতে, এবং সুদীর্ঘ হাতখানি সম্মুখের দিকে হঠাৎ বাড়াইয়া দিয়া আবার টানিয়া লইয়া কপালে ঠেকাইতে ঠেকাইতে, নিকারিপাড়ার মোড়ল আসিয়া ঘরে ঢুকিল।
.
২৮.
২৮ স্কুল খুলিবার কয়েক দিন পরে আবদুল্লাহ্ একদিন ক্লাসে পড়াইতেছে, এমন সময় হেডমাস্টার তাহাকে ডাকিয়া পাঠাইলেন। ক্লাসে কাজ করিবার সময় এমন করিয়া হঠাৎ ডাকিয়া পাঠানো স্কুলের রীতিবিরুদ্ধ–তবে কোনো বিশেষ জরুরি কারণ থাকিলে অবশ্য স্বতন্ত্র কথা। কিন্তু সে জরুরি কারণটি এক্ষেত্রে কী? কিছু একটা গুরুতর অপরাধ হইয়া গিয়াছে, না কোনো অপ্রত্যাশিত শুভ সংবাদ আসিয়াছে? এইরূপ ভাবিতে ভাবিতে স্পন্দিত হৃদয়ে আবদুল্লাহ্ হেডমাস্টারের কামরায় গিয়া প্রবেশ করিল।
তাহাকে দেখিয়াই হেডমাস্টার স্মিতমুখে, গুড় নিউজ ফর ইউ, মৌলভী, লেটু মি কগ্রাচুলেট ইউ! বলিয়া আবদুল্লাহর হাতখানি ধরিয়া প্রবলবেগে দুই-তিনটা ঝকা দিয়া দিলেন।
আবদুল্লাহর বুকের ভিতর টিপটিপ করিতে লাগিল। সে ঔৎসুক্যে অধীর হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, ব্যাপার কী, স্যার?
হেডমাস্টার কহিলেন, কবে খাওয়াচ্ছেন তা আগে বলুন, –খোশ-খবর কি অম্নি অনি বলা যায়?
বেশ তো, যদি এমনই খোশ-খবর হয় তা হলে খাওয়াব বৈকি! অবিশ্যি আমার সাধ্যে যদ্র কুলোয়।
তা আর কুলোবে না? বলেন কী! যে খবর দিচ্ছি, তার দাম নেমন্তন্ন খাওয়ার চাইতে অনেক বেশি। আচ্ছা আপনি আঁচ করুন দেখি, এমন কী খবর হতে পারে?
সংবাদটি জানিবার জন্য আবদুল্লাহর প্রাণ অস্থির হইয়া উঠিয়াছিল–অতি কষ্টে ঔৎসুক্য দমন করিয়া কহিল, বোধ করি একটা প্রমোশন পেয়ে থাকব।
হেডমাস্টার অবজ্ঞাভরে কহিলেন, না, আপনার সাধ্যই নেই সে আসল কথাটা আঁচ করা। যদি বলি আপনি হেডমাস্টার হয়েছেন, বিশ্বাস করবেন?
কোথাকার হেডমাস্টার?
রসুলপুর হাইস্কুলের।
রসুলপুরের! আমি?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, বিশ্বাস হচ্ছে না? এই দেখুন ইনস্পেক্টরের চিঠি। ও স্কুলটা যে এখন প্রভিন্সিয়ালাইজড় হয়ে গেল। আপনাকে সত্বর রিলিভ করবার জন্যেও কড়া হুকুম এসেছে!
আবদুল্লাহ্ কম্পিতহস্তে পত্রখানি লইল এবং তাড়াতাড়ি তাহার উপর দিয়া চোখ বুলাইয়া গেল। সত্যই তো তাহাকে রসুলপুরের নূতন গভর্নমেন্ট হাইস্কুলের হেডমাস্টার নিযুক্ত করা হইয়াছে।–একশত টাকা বেতন। তৎক্ষণাৎ ইনস্পেক্টর সাহেবের শেষ কথা কয়টি তাহার মনে পড়িয়া গেল, আপনার যাতে সুবিধে হয়ে যায়, তার জন্য আমি চেষ্টা করব এবং কৃতজ্ঞতায় তাহার হৃদয় ভরিয়া উঠিল। পত্রখানি হেডমাস্টারকে ফিরাইয়া দিয়া সে গদগদকণ্ঠে কহিল, স্যার, এ কেবল আপনার সুনজর ছিল বলে…
হেডমাস্টার যথেষ্ট গাম্ভীর্য অবলম্বন করিয়া কহিলেন, সাহেব সেদিন ইনস্পেকশনের সময় আমাকে বলেছিলেন, রসুলপুর স্কুল প্রভিন্সিয়ালাইজড় হবে, আর সেখানে একজন ভালো হেডমাস্টার নিযুক্ত করা হবে। আমি তক্ষনি তাকে বললাম, আমার স্টাফে একজন খুব উপযুক্ত লোক আছেন। বুঝতেই পাচ্ছেন, আপনার কথাই আমি তাকে বলেছিলাম–তা তিনি আপনার নাম নোট করে নিয়েছিলেন। আচ্ছা, আপনাকে কোনো হিন্দু দেন নি?
না, স্যার। আমি স্কুলে একজন মৌলবী দেবার কথা বলতে গিয়েছিলাম, অন্য কোনো কথা হয় নি তো।
বড়ই আশ্চর্য! সাহেবের এ্যাটিচুড দেখে কিন্তু আমার তখনই মনে হয়েছিল যে, আপনাকেই সিলেক্ট করবেন–আর করেছেন তাই। যা হোক, আমার রেকমেন্ডেশনটা যে তিনি রেখেছেন, এতে আজ আমার ভারি আনন্দ হচ্চে, মৌলবী সাহেব!
আবদুল্লাহ্ বিনয়ের সাথে কহিল, আপনার অনুগ্রহ!
তা হলে আপনি কবে যাচ্ছেন?
যখন আপনার সুবিধে হবে…
আমার সুবিধের তো কথা হচ্ছে না–মৌলবী সাহেব, আপনাকে এ্যাটওয়ান্স রিলি করবার জন্যে যে অর্ডার আছে। বিলম্ব করা তো আপনার পক্ষে উচিত হবে না।
তবে কবে আমাকে রিলিভ করবেন?
বলেন তো কালই।
আচ্ছা, স্যার।
কিন্তু আপনি যত শিগগির পারেন, ওখানে গিয়ে জয়েন করবেন। যেতেও তো দিন দুই লাগবে–কমুনিকেশন ওখানকার বড়ই বিশ্রী। আপনি আজই গিয়ে সব গুছিয়েটুছিয়ে নিন।…
আবদুল্লাহ্ একটু ভাবিয়া কহিল, তা হলে হোস্টেলের চার্জ কাকে দেব?
হেডমাস্টার যেন একটু চমকিয়া উঠিয়া কহিলেন, ওঃ হো! সে কথা তো আমি আপনাকে বলতে ভুলে গিয়েছি। এই জানুয়ারি থেকে একজন মৌলবী আসচেন যে!
আবদুল্লাহ্ একটু আশ্চর্য হইয়া কহিল, অর্ডার এসেচে নাকি?
ইনস্পেক্টর সাহেব যে একেবারে এতখানি অনুগ্রহ করিয়া ফেলিবেন, ইহা স্বপ্নেরও অতীত। যাহা হউক, নিজের পদোন্নতিতে তো আবদুল্লাহ্ সুখী হইলই, তাহার ওপর মৌলবী নিযুক্ত করা সম্বন্ধে যে তাহার অনুরোধ রক্ষা করা হইয়াছে, ইহাতেও সে যথেষ্ট আত্মপ্রসাদ লাভ করিল।
দেখিতে দেখিতে স্কুলময় এই আশ্চর্য সংবাদ রাষ্ট্র হইয়া গেল। যে যে ঘণ্টায় যাহাদের বিশ্রাম, তখন তাহারা নানাপ্রকারে ইহার সমালোচনা করিতে লাগিলেন। কোথায় কোন স্কুলে কজন বিশেষ বিশেষ যোগ্য লোক আছেন, বরিহাটীর স্টাফেও আবদুল্লাহ্ অপেক্ষা সর্বাংশে শ্রেষ্ঠ কে কে আছেন, একে একে তাঁহাদের নাম হইতে লাগিল, এবং সকলেই একবাক্যে মত প্রকাশ করিলেন যে, এ লোকটা কেবল মুসলমান বলিয়াই হঠাৎ এমন বড় চাকরিটা পাইয়া গেল। ইহাও সকলে স্থির করিয়া ফেলিলেন যে, ও স্কুলের হেডমাস্টারি করা আবদুল্লাহর কর্ম নয়; দুদিনের মধ্যেই একটা কেলেঙ্কারি কাণ্ড ঘটিয়া যাইবেই যাইবে।
আবার কেহ কেহ কহিলেন, মুসলমানের আজকাল সাতখুন মাপ। আবদুল্লাহর আমলে স্কুলটি গোল্লা-নামধেয় স্থানবিশেষের প্রতি দুর্জয় ঝোঁক দেখাইলেও তাহার কোনো ভয়ের কারণ নাই। রসুলপুরের ভূতপূর্ব হেডমাস্টার বরদাবাবু কী-ই বা অপরাধ করিয়াছিলেন– কতকগুলো দুষ্ট ছেলে একটা কাণ্ড করিল, আর তাহার জন্য কিনা বেচারা বরদাবাবুর চাকরিটাই গেল। বরদাবাবু যদি মুসলমান হইতেন, তাহা হইলে স্কুলে স্বদেশীর হাট বসাইলেও গভর্নমেন্ট তাহাকে একটা খা বাহাদুরি না দিয়া ছাড়িতেন না। আর পড়াশুনা? আপনারা পাঁচজনে দেখিয়া লইবেন, যদি সাত বৎসরেও একটি ছেলে রসুলপুর হইতে এনট্রান্স পাস না করে, তথাপি আবদুল্লাহর প্রমোশন স্থগিত থাকিবে না।
যাহা হউক, আবদুল্লাহর এই সৌভাগ্যে আকবর আলী এবং আবদুল কাদের, এই দুই জন আন্তরিক সুখী হইলেন, এবং বারবার খোদার নিকট শোকর করিতে লাগিলেন। আকবর আলী কহিলেন, দেখুন খোনকার সাহেব, আপনার মুখের উপর বলাটা যদিও ঠিক নয়, তবু বলি যে, যোগ্য লোকের উন্নতি খোদা যে কোন দিক থেকে জুটিয়ে দেন, তা বলা যায় না। বাস্তবিক এখানে যার সঙ্গে আপনার পরিচয় আছে, সকলেই আপনার প্রশংসা করে। বিশেষ আপনার খোশ-আখলাকে সকলেই মুগ্ধ। আপনি যাচ্ছেন বটে, খোদা করুন দিন দিন আপনার উন্নতি হোক–কিন্তু আমাদের আপনি কাঁদিয়ে যাচ্ছেন।
আবদুল্লাহ্ আজ্রকণ্ঠে কহিল, মুন্সী সাহেব, আপনি আমাকে বড্ড বেশি স্নেহ করেন বলেই এসব বলছেন…
আবদুল কাদের রহস্য করিয়া কহিল, নেও নেও; উনি স্নেহ করেন, আর আমি বুঝি করি নে? আমি কিন্তু ওয়াদা কচ্ছি, তুমি চলে গেলে এখানকার কেউ তোমার জন্য কাঁদবে না–আমিও না…
বলিতে গিয়া সত্য সত্যই আবদুল কাদেরের দুই চোখ ভরিয়া উঠিল। আবদুল্লাহ্ তাহাকে বক্ষের উপর টানিয়া ধরিয়া রুদ্ধকণ্ঠে কহিতে লাগিল, ভাই, প্রথম চাকরি পেয়ে অবধি আমরা দুজনে এক জায়গাতেই ছিলাম–বড়ই আনন্দে ছিলাম। এখন প্রমোশন পেলাম। বটে, কিন্তু তোমাদের ছেড়ে যেতে হবে, এই কথা মনে করে প্রাণটা অস্থির হচ্ছে। এ আড়াইটা বছর কী নির্ভাবনায়, কী আনন্দেই কেটে গেছে! বুঝি জীবনের এই কটা দিনই শ্রেষ্ঠ দিন গেল, এমন সুখের দিন আর হবে না, ভাই!
সন্ধ্যার কিছু পরে যখন আবদুল্লাহ্ বোর্ডিঙে ফিরিয়া আসিল, তখন দেখিল, স্কুলের অনেকগুলি ছাত্র সেখানে তাহার জন্য অপেক্ষা করিতেছে। তাহাকে আসিতে দেখিয়া সেকেন্ড ক্লাসের ছাত্র সতীশ অগ্রসর হইয়া নমস্কার করিল এবং কহিল, স্যার, আপনি হেডমাস্টার হয়ে চলে যাচ্ছেন, তাতে আমরা খুব খুশি হয়েছি; কিন্তু আমাদের ছেড়ে যাচ্ছেন বলে মনে বড় দুঃখ হচ্চে। তা আমরা আপনাকে একটা address দেব বলে হেডমাস্টার মহায়শকে বললাম, কিন্তু তিনি বললেন, ওটা নাকি rule-এর against-এ। এখন আপনি যদি বলেন, তবে অন্য কোনো জায়গায় মিটিং করে আপনাকে address দিই।
আবদুল্লাহ্ কহিল, না হে, যখন ওটা rule-এর against-এ তখন ওসবে কাজ নেই। তোমরা সকলে যে আজ আমার সঙ্গে এখানে দেখা কত্তে এসেছ, এতেই address-এর চাইতে আমাকে ঢের বেশি সম্মান করা হয়েছে।
অবনী নামক আর একটি ছাত্র নিরাশাব্যঞ্জক স্বরে কহিল, তবে কি স্যার, আমাদের address দেওয়া হবে না?
এই তো দিচ্ছ ভাই আমাকে address! সভা করে ধুমধাম না কলে কি আর মনের ভালবাসা জানানো হয় না? আজ সত্যিই আমি বুঝতে পাচ্ছি, তোমরা আমাকে কতখানি ভালবাস! এই বেশ; আমার সঙ্গে তোমাদের কেমন ভাব, লোকে তা নাই-বা জানল! শুধু তোমরা আর আমি জানলাম। এই বেশ।
আবদুল্লাহর কথাগুলি ছাত্রদের মর্মে গিয়া স্পর্শ করিল-–কয়েকজন আবেগভরে বলিয়া উঠিল, থাক, স্যার, address দিতে চাই নে–তবে ভগবান করুন যেন আপনি শিগগিরই আমাদের হেডমাস্টার হয়ে আসেন।
আবদুল্লাহ্ হাসিয়া কহিল, দেখ, পাগলগুলো বলে কী! কেন, আমাদের হেডমাস্টার তো চমৎকার লোক। তিনিই ইনস্পেক্টার সাহেবের কাছে আমার জন্যে সুপারিশ করে এই চাকরি করে দিয়েছেন, এমন লোককে কি অশ্রদ্ধা কত্তে হয়!
তা হোক স্যার, আপনি গেলে আপনার মতো স্যার আমরা আর পাব না।
দেখ, তোমরা আমাকে ভালবাস বলেই এমন কথা বলছ। আমার মতো শিক্ষক পাও আর না পাও–আশীর্বাদ করি যেন আমার অপেক্ষা শত সহস্রগুণ ভালো শিক্ষক তোমরা পাও।–কিন্তু তোমাদের কথাবার্তা শুনে আমি যে বুঝতে পাচ্ছি আমি তোমাদের ভালবাসা লাভ কত্তে পেরেছি, এতেই আমার মনে যে কত আনন্দ হচ্ছে, তা বলে শেষ করা যায় না। আশীর্বাদ করি, তোমরা মানুষ হও, প্রকৃত মানুষ হও–যে মানুষ হলে পরস্পর পরস্পরকে ঘৃণা কত্তে ভুলে যায়, হিন্দু মুসলমানকে, মুসলমান হিন্দুকে আপনার জন বলে মনে কত্তে পারে। এই কথাটুকু তোমরা মনে রাখবে ভাই, –অনেকবার তোমাদের বলেছি, আবার বলি, হিন্দু মুসলমান ভেদজ্ঞান মনে স্থান দিও না। আমাদের দেশের যত অকল্যাণ, যত দুঃখকষ্ট, এই ভেদজ্ঞানের দরুনই সব। এইটুকু ঘুচে গেলে আমরা মানুষ হতে পারব– দেশের মুখ উজ্জ্বল কত্তে পারব।
এইরূপ কিঞ্চিৎ উপদেশ দিয়া মিষ্ট কথায় তুষ্ট করিয়া আবদুল্লাহ্ সকলকে বিদায় দিল। যাইবার পূর্বে তাহারা জানিয়া গেল যে, আগামীকল্যই আবদুল্লাহ স্কুলের কাজ হইতে অবকাশ লইবেন এবং পরশু শুক্রবার বাদজুমা বিকালের ট্রেনে রওয়ানা হইবেন।
কিন্তু রওয়ানা হইবার সময় স্টেশনে ছাত্রদের কেহই আসিল না। আবদুল্লাহ্ মনে করিয়াছিল, তাহাকে বিদায় দিবার জন্য দুই-চারি জন ছাত্র নিশ্চয়ই স্টেশনে আসিবে, তাই প্ল্যাটফর্মের উপর দাঁড়াইয়া উৎসুক নেত্রে এদিক-ওদিক চাহিতে লাগিল। শেষ ঘণ্টা পড়িল, তবু কেহ আসিল না। আবদুল্লাহ্ তাড়াতাড়ি আকবর আলী এবং আবদুল কাদেরের সহিত কোলাকুলি করিয়া গাড়িতে চড়িয়া বসিল।
গাড়ি ছাড়িয়া দিল।
.
২৯.
রাত্রি প্রায় ৯টার সময় বিলগাঁ স্টেশনে গাড়ি থামিল। আবদুল্লাহ জিনিসপত্র লইয়া নামিয়া পড়িল। এইখান হইতে গরুর গাড়ি করিয়া তাহাকে অনেকটা পথ যাইতে হইবে। রাত্রে গাড়িতে যাওয়া যাইবে না–একটা হোটেলে থাকিতে হইবে; পরদিন প্রাতে গাড়ি ছাড়িলে সন্ধ্যার পূর্বেই রসুলপুর পৌঁছিতে পারিবে।
স্টেশনের বাহিরেই কয়েকটা হোটেল আছে। আবদুল্লাহ্ তাহারই একটাতে গিয়া উঠিল। সঙ্গে জিনিসপত্র বেশি ছিল না, একটা তোরঙ্গ, একটা বিছানার মোট আর একটা বদনা। হাত-মুখ ধুইবার জন্য জল চাহিলে হোটেলওয়ালা একটা কুয়া দেখাইয়া দিল। আবদুল্লাহ বদনাটা লইয়া কুয়ার নিকটে গেল এবং এক বালতি জল উঠাইয়া বদনা ভরিয়া জল আনিয়া বারান্দার এক প্রান্তে ওযু করিতে বসিল। হোটেলে আরো অনেক যাত্রী ছিল; আবদুল্লাহকে ওযু করিতে দেখিয়া তাহাদের মধ্য হইতে কয়েকজন উঠিয়া ওযু করিবার জন্য কুয়ার ধারে গেল। ইতোমধ্যে আবদুল্লাহ্ ওযু সারিয়া জায়নামাজ বাহির করিল এবং হোটেল ঘরটির এক কোণে গিয়া নামাযে খাড়া হইল, ক্রমে আরো দুই-চারি জন যাত্রী ওযু করিয়া আসিয়া, কেহ তাহার দক্ষিণ পার্শ্বে, কেহ পশ্চাতে, কেহ উড়ানী, কেহ স্কন্ধস্থিত রঙিন রুমাল বিছাইয়া, নামাযে যোগদান করিল।
নামায শেষ হইতে না হইতেই খানা আসিল। প্রথমে একটা শতছিন্ন লম্বা মাদুর মেঝের উপর পাতা হইল, তাহার উপর, মাদুরের অর্ধেক ঢাকিয়া একটা খেরুয়ার দস্তরখান বিছাইয়া দিল। দস্তরখানটিতে যে কয় বেলার ডাল, সুরুয়া, ঘুসা-চিংড়ির খোসা, মাছের দুই-একটা সরু কাটা ইত্যাদি শুকাইয়া লাগিয়া রহিয়াছে, তাহার ঠিকানা নাই।
নামায শেষ করিয়া উঠিয়া আবদুল্লাহ্ দেখিল, দুই-চারি জন যাত্রী খানার প্রত্যাশায় দস্তরখানে বসিয়া আছে। সেও আসিল, পার্শ্বে চিলমচি ও বদনা ছিল, হাত ধুইয়া লইল; মাদুরের কোন্খানটিতে বসিলে মাটি লাগিয়া কাপড় নষ্ট হইবে না, তাহা খুঁজিয়া পাইল না। অবশেষে মাটি-মাদুর নির্বিশেষে এক প্রান্তে তাহাকে বসিয়া পড়িতে হইল। দস্তরখানটির দুর্গন্ধে আবদুল্লাহ্ মনে মনে বিরক্ত হইল বটে, কিন্তু এরূপ দস্তরখানে বসা তাহার পক্ষে নূতন নহে–সচরাচর বন্ধুবান্ধব এবং আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে খাইতে গিয়া সে দস্তরখানের দুর্গন্ধে অভ্যস্ত হইয়া গিয়াছিল। দরিদ্র মুসলমান ভদ্রলোকেরা পৈতৃক ঠাঁট বজায় রাখিতেই চেষ্টা করিয়া থাকেন; কিন্তু মানসিক নিশ্চেষ্টতার দরুন পরিচ্ছন্নতা রক্ষা করিয়া চলিবার তৎপরতাটুকু তাহারা হারাইয়া বসিয়াছেন। এরূপ অবস্থায় বেচারা হোটেলওয়ালার আর অপরাধ কী!
ওদিকে যাহারা নামাযে শরিক হইয়াছিল, তাহাদের মধ্য হইতে একে একে সকলে আসিতে লাগিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত একটি লোক টিকিয়া গেল–এদিকে সকলের খানা শুরু হইয়া গিয়াছে, কিন্তু সে লোকটি ঘাড় গুঁজিয়া তাহার রঙিন রুমালটির উপর বসিয়াই রহিল। হোটেলওয়ালা তাড়া দিয়া কহিল, নেও নেও মেয়াসাহেব, ওঠ, উদিক দে গাড়ি আস্যে পড়ল বুঝি। ওই শোন ঘণ্টা পড়তিছে।
বাস্তবিকই স্টেশনে ঘণ্টা পড়িতেছিল; কিন্তু উহা গাড়ি আসিবার ঘণ্টা নহে, রাত্রি দশটার ঘণ্টা। কিন্তু তাহা হইলেও গাড়ির ঘণ্টা পড়িবার আর বড় বিলম্ব ছিল না। বরিহাটী যাইবার গাড়ি সাড়ে দশটায় বিলগায় আসিবে। লোকটা হোটেলওয়ালার তাড়া খাইয়া এবং সঙ্গে সঙ্গে ঘণ্টা শুনিয়া ঝটপট মোনাজাত করিয়া উঠিয়া পড়িল এবং দেও, দেও, জলদি খানা দেও বলিতে বলিতে দস্তরখানে আসিয়া বসিল।
হোটেলওয়ালা একটা বড় কাঠের খাঞ্চা ভরিয়া ভাত আনিল এবং কলাই-চটা এনামেলের রেকাবিগুলিতে দুই-তিন থাবা করিয়া ভাত দিয়া গেল। আর একটি লোক সবুজ রঙের লতাপাতা কাটা একটা বড় চিনামাটির পেয়ালা হইতে বেগুন ও ঘুসা-চিংড়ির ঘণ্টা থপথপ্ করিয়া খানিকটা খানিকটা দিয়া যাইতে লাগিল। একটা লোক বলিয়া উঠিল, কই মেয়াসাহেব, একটু নেমক দিলে না?
ওরে হাশেম, নেমক দিয়ে যা রে– বলিয়া হোটেলওয়ালা এক হাঁক দিল। হাশেম নামক ছোকরাটি দৌড়িয়া বাবুর্চিখানার দিকে গেল, কিন্তু একটু পরেই ফিরিয়া আসিয়া কহিল, নেমক তো নেই, বাপজী।
বলিস্ কী রে! নেমক নেই? দৌড়ে যা, দৌড়ে যা, বাজারতে এক পয়সার নেমক নে আয় বলিয়া হোটেলওয়ালা কাপড়ের খুঁট খুলিয়া একটা পয়সা বাহির করিয়া দিল। এ কার্যে অবশ্য তাহার আর হাত ধুইবার কোনো আবশ্যকতা দেখা গেল না।
এদিকে যাত্রীদিগের মধ্যে অনেকে বিনা লবণেই বিসমিল্লাহ্ বলিয়া খাইতে আরম্ভ করিয়া দিল; কিন্তু সেই অতি-নামাযী লোকটি এবং তাহার দেখাদেখি আরো দুই-এক জন কাঁধে রঙিন রুমালওয়ালা লবণ অভাবে বিসমিল্লাহ্ করিতে না পারিয়া হাত গুটাইয়া বসিয়া রহিল। প্রায় আট-দশ মিনিট পরে ছোকরাটি লবণ লইয়া ফিরিয়া আসিল এবং কাগজের ঠোঙা হইতে একটু একটু লবণ তুলিয়া পাতে পাতে দিয়া গেল। তখন রঙিন রুমালওয়ালা একটু নড়িয়া বসিয়া একটু কাশিয়া, তর্জনীটি একবার লবণের উপর চাপিয়া লইয়া সাড়ম্বরে বিসমিল্লাহ্ বলিয়া উহা জিহ্বাগ্রে ঠেকাইয়া, খানা আরম্ভ করিল।
বেগুনের সালুন দিয়া খাওয়া প্রায় শেষ হইল, যাত্রীরা ডাল এবং আরো চারিটি ভাত চাহিতেছে, এমন সময় স্টেশনে ঢং ঢং করিয়া ঘণ্টা বাজিয়া উঠিল। হোটেলওয়ালা কহিল, জলদি খায়্যা লেন মেয়াসাহেবেরা, গাড়ি আস্যে পড়ল।
এ্যাঁ, খাওয়াই যে হল না! কী করি? বলিতে বলিতে পাঁচ-সাত জন উঠিয়া পড়িল। তাড়াতাড়ি হাত ধুইবার জন্য বদনা লইয়া কাড়াকাড়ি পড়িয়া গেল–কেহ-বা কুয়ার দিকে ছুটিল। হোটেলওয়ালা চিৎকার করিয়া কহিল, পয়সা তিন আনার দে যাবেন মেয়া সাহেবরা। ওরে হাশেম, পয়সাডা গুনে নিস…
হাশেম পিতার আদেশ পাইয়া দরজার কাছে গিয়া দাঁড়াইল। তিন-চার জন লোক তখন হাত ধুইয়া ঘরের বাহির হইতেছিল; তাহারা ট্যাক হইতে পয়সা বাহির করিয়া গনিয়া দিয়া গেল। কিন্তু আরো কয়েকজনের নিকট হইতে পয়সা আদায় করা বাকি, তাহারা গেল। কোথায়? হোটেলওয়ালা অবশিষ্ট আহার-নিরত যাত্রীদিগকে ডাল দিতেছিল; সে কহিল, দেখ তো হাশেম, কুয়োটার কাছে, এ মেয়া-সাহেবেরা কেমন লোক? খানা খায়্যা পয়সা না দ্যেই ভাগতি চায়?
যে লোকটি হোটেলওয়ালার সহিত খাদেমি করিতেছিল, সে ইতোমধ্যে একবার বাবুর্চিখানায় যাইবার পথে কুয়ার ধারে জন তিনেক লোক ধরিয়া পয়সা আদায় করিয়া লইয়াছিল। সে ঘরে আসিয়া হোটেলওয়ালাকে কহিল, মেয়া ভাই, এই লন তিন জনের পয়সা।
হাশেম তিন জনের নিকট হইতে পয়সা আদায় করিয়াছিল। হোটেলওয়ালা গনিয়া দেখিল, সাত জন লোক উঠিয়াছে, কিন্তু পয়সা দিয়াছে ছয় জন। কোন্ লোকটা পয়সা না দিয়া পলাইল? হাশেম কহিল, যে মানুষটা শ্যাষে আইস্যা বসছিল, তারে কিন্তু আমি দেহি নাই। হোটেলওয়ালার ভাই কহিল, আমিও তো দেহি নাই! ওই মানুষটাই ভাগছে বোধ করি। মেয়া ভাই, যাই দেহি ইস্টিশনে গ্যে মানুষটারে ধরি। বলিয়াই সে চলিয়া গেল।
এদিকে সকলে খানা শেষ করিয়া উঠিয়াছে, এমন সময়ে গাড়ি আসিল। দুই-তিন মিনিটের মধ্যেই আবার গাড়ি ছাড়িয়া দিল এবং তাহার একটু পরেই হোটেলওয়ালার ভাই ফিরিয়া আসিয়া কহিল, না, তারে তো ধত্তি পাল্লাম না মেয়া ভাই–বড্ড ফাঁকি দ্যে গেল।
হোটেলওয়ালার পক্ষে এরূপ ফাঁকিতে পড়া কিছু নূতন নহে। সেও তেমনি ঘণ্টা না পড়িলে লোককে ভাত দিত না; সুতরাং অনেককেই আধপেটা খাওয়াইয়া পুরা তিনগণ্ডা পয়সা আদায় করিয়া পোষাইয়া লইত। সে কেবল কহিল, ভালো রে ভালো, এমন মুসল্লি মানুষটা। ওই যে কয়, বোলে মানুষির মাথায় কালো চুল, মানুষ চেনা ভার। তা সত্যি!
প্রাতে একখানি গাড়ি ঠিক করিয়া আবদুল্লাহ্ রওয়ানা হইল। তখন কার্তিক মাস; বর্ষাকাল শেষ হইয়া গেলেও এখনো তাহার জের মিটে নাই। রাস্তার স্থানে স্থানে অনেকটা কাদা জমিয়া আছে; কাজেই গাড়ি অত্যন্ত মন্থর গতিতে চলিতে লাগিল।
এইরূপে মাঠ পার হইয়া গ্রামের ভিতর এবং গ্রাম পার হইয়া মাঠের ভিতর দিয়া। আবদুল্লাহর গাড়িখানি চলিতে লাগিল। ক্রমে বেলা দ্বিপ্রহর হইয়া আসিল দেখিয়া আবদুল্লাহ গাড়োয়ানকে কহিল, একটা বাজার-টাজার দেখিয়া গাড়ি থামানো হউক, কিছু নাশতা করিয়া লওয়া যাইবে।
গাড়োয়ান কহিল, হুমকির এই গেরামড়ার ওই মুড়োয় বাজার আছে, কাছে এট্টা ভালো পুষ্কর্নিউ আছে, পানি-টানি খাতি পারবেন।
আবদুল্লাহ কহিল, আচ্ছা তাই চল।
যে রাস্তা দিয়া আবদুল্লাহর গাড়ি চলিতেছিল, সেটি ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তা। রাস্তাটি বেশ চওড়া ও উচ্চ; কিন্তু সম্মুখস্থ গ্রামের ভিতর দিয়া না গিয়া বাকিয়া গ্রামের বাহির দিয়া গিয়াছে। উহার দক্ষিণ পার্শ্বে গ্রাম এবং বাম পার্শ্বে বিল। গাড়োয়ান কহিল, এ সরকারি রাস্তা দিয়া আর যাওয়া যাইবে না, কারণ বিলের ভিতর খানিকটা রাস্তা নাই, জলে একদম ধুইয়া গিয়াছে। ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের কায়দাই এরূপ, এক বর্ষায় রাস্তা ভাঙে, আর এক বর্ষার প্রারম্ভে মেরামত হয়। সুতরাং গ্রামের ভিতরকার সঙ্কীর্ণ পথ দিয়াই যাইতে হইবে।
গ্রামের মধ্য দিয়াই গাড়ি চলিল। পথের উভয় পার্শ্বে ঘন বসতিঘরগুলির বারান্দা। একেবারে রাস্তারই উপর। পথ এত সঙ্কীর্ণ যে একখানি গাড়ি চলিলে আর মানুষ পর্যন্ত চলিবার স্থান থাকে না। খানিকদূর গিয়াই আবদুল্লাহ্ দেখিল, সর্বনাশ! এ রাস্তাও খানিকটা ভাঙা, মধ্যে ভয়ানক গর্ত, জল-কাদায় ভরা। ভাঙন অধিক দূর লইয়া নহে, এই হাত পাঁচ-ছয় হইবে। কিন্তু পাড় এমন খাড়া যে, গাড়ি তাহার ভিতর নামানো কঠিন না হইলেও ওঠানো একরূপ অসম্ভব। এক্ষণে উপায়?
গাড়োয়ান কহিল, হুজুর, দেখতিছেন কী? এ হা্বোড়ের মদ্দি দ্যে তো গাড়ি চলবি নে।
তবে কী করা যায়?
গাড়োয়ান একটু ভাবিয়া কহিল, দেহি যদি আর কোনো পথ পাই।
গাড়িখানি ভাঙা রাস্তার কিনারায় দাঁড় করাইয়া রাখিয়া গাড়োয়ান পাড়ার মধ্যে প্রবেশ করিল। আবদুল্লাহ্ গাড়ি হইতে নামিল। সম্মুখে রাস্তার উপরেই একখানি বাড়ি; তাহার দাওয়ায় এক ব্রাহ্মণ খালি গায়ে বসিয়া ডাবা হুঁকায় তামাক খাইতেছিলেন। আবদুল্লাহ্ একটু
অগ্রসর হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, মশায়, গাড়ি যাবার কি আর কোনো পথ আছে?
ব্রাহ্মণটি একটু ঘাড় নাড়িয়া একটি উঁহুক শব্দ করিয়া ধোঁয়া ছাড়িলেন।
আবদুল্লাহ্ কহিল, তবে কী করি, মশায়, বড়ই মুশকিল হল তো!
ব্রাহ্মণটি কোনো উত্তর করিলেন না। রৌদ্রতাপে ক্লান্ত হইয়া আবদুল্লাহর বড়ই ইচ্ছা হইতেছিল, দাওয়ার উপর উঠিয়া বসিয়া একটু বিশ্রাম করে, কিন্তু গৃহস্বামীর দুজ্ঞেয় তুষ্ণীভাব দেখিয়া আর তাহার সাহস হইল না। অগত্যা সে রাস্তার পার্শ্বেই ছাতা খুলিয়া বসিয়া ব্যগ্রচিত্তে গাড়োয়ানের প্রতীক্ষা করিতে লাগিল।
কিয়ৎক্ষণ পরে গাড়োয়ান ফিরিয়া আসিয়া কহিল, হুজুর, আছে এট্টা পথ; কিন্তু সে এক ঠাহুরির বাড়ির পর দ্যে যাতি হয়। আপনি গে তানারে এট্টু করে বুলে দ্যাহেন যদি যাতি দেন।
এই কথায় কিঞ্চিৎ ভরসা পাইয়া আবদুল্লাহ গাড়োয়ানের সঙ্গে চলিল। সরুপথ দিয়া একটু গিয়াই দূর হইতে বাড়িখানি দেখাইয়া দিয়া গাড়োয়ান কহিল, ওই বাড়ি; ওই যে বটেখানা দ্যাহা যায়। আপনি যান, আমি গাড়ির কাছে থাকলাম।
আবদুল্লাহ্ গিয়া বৈঠকখানার বারান্দার উপর উঠিল। গৃহমধ্য হইতে শব্দ আসিল, কে?
আবদুল্লাহ্ কহিল, মশায়, আমি বিদেশী, একটু মুশকিলে পড়ে আপনার কাছে… বলিতে বলিতে ঘরে উঠিবার জন্য পা বাড়াইল।
টুপি-চাপকান পরিহিত অদ্ভুত মূর্তিখানি সটান ঘরের মধ্যে উঠিতে উদ্যত হইয়াছে দেখিয়া গৃহমধ্যস্থ লোকটি সত্রাসে হাঁ হাঁ, করেন কী, করেন কী, বাইরে দাঁড়ান, বাইরে দাঁড়ান বলিতে বলিতে তক্তপোশ হইতে নামিয়া পড়িলেন। আবদুল্লাহ্ অপ্রস্তুত হইয়া তাড়াতাড়ি পা টানিয়া লইয়া বারান্দায় সরিয়া দাঁড়াইলেন।
কী চান মশায়? সেই লোকটি দরজার গবরাটের উপর দাঁড়াইয়া দুই হাতে চৌকাঠের বাজু দুটি ধরিয়া, একটু রুষ্ট স্বরে এই প্রশ্ন করিলেন।
আবদুল্লাহ্ যথাশক্তি বিনয়ের ভাব দেখাইয়া কহিল, মশায় আমি গরুর গাড়ি করে যাচ্ছিলাম, গ্রামের মধ্যে এসে দেখি রাস্তার এক জায়গায় ভাঙা, গাড়ি চলা অসম্ভব। শুনলাম। মশায়ের বাড়ির পাশ দিয়ে একটা পথ আছে, যদি দয়া করে…
লোকটি রুখিয়া উঠিয়া কহিলেন, হ্যাঃ, তোমার গাড়ি চলে না চলে তা আমার কী? আমার বাড়ির উপর দিয়ে তো আর সদর রাস্তা নয় যে, যে আসবে তাকেই পথ ছেড়ে দিতে হবে…
আবদুল্লাহ্ একটু দৃঢ়স্বরে কহিল, মশায়, বিপদে পড়ে একটা অনুরোধ কত্তে এসেছিলাম, তাতে আপনি চটছেন কেন? পথ চেয়েছি বলে তো আর কেড়ে নিতে আসি নি। সোজা বললেই হয়, না, দেব না!
ওঃ, ভারি তো লবাব দেখি! কে হে তুমি, বাড়ি বয়ে এসে লম্বা লম্বা কথা কইতে লেগেছ?
লম্বা কথা কিছু কই নি মশায়, একটু অনুগ্রহ প্রার্থনা কত্তে এসেছিলাম। থাক, আপনাকে আর কোনো অনুগ্রহ কত্তে হবে না, মেজাজও খারাপ কত্তে হবে না–আমি বিদায় হচ্চি।
লোকটা গজর গজর করিতে লাগিল। আবদুল্লাহ্ ফিরিয়া চলিল। তাহাকে বিষমুখে ফিরিতে দেখিয়া গাড়োয়ান কহিল, দেলে না বুজি? আমি জানি ও ঠাহুর ভারি ত্যান্দোড়। তবু আপনারে একবার যাতি কলাম, ভদ্দরলোক দেখলি যদি যাতি দেয়।
আবদুল্লাহ্ কহিল, এস, এক কাজ করা যাক। জিনিসপত্তর গাড়ি থেকে তুলে নিয়ে দেও গাড়ি নামিয়ে। তুমি এক চাকা ঠেল, আমি এক চাকা ঠেলি–গরুও টানুক, তা হলে গাড়ি ঠিক উঠে যাবে।
গাড়োয়ান একটু ইতস্তত করিয়া কহিল, আপনি এই হাবোড়ের মদ্দি নামবেন হুজুর?
তা কী করব! দায়ে ঠেকলে সবই কত্তে হয়। নেও আর দেরি কোরো না। এই বলিয়া আবদুল্লাহ বিছানা খুলিয়া একটা ময়লা ধুতি বাহির করিল, এবং পোশাক ছাড়িয়া মালকোচা মারিল। গাড়োয়ান তোরঙ্গ এবং বিছানা গাড়ি হইতে উঠাইয়া রাস্তার কিনারায় রাখিয়া দিয়া একটা গরুর লেজ মলিয়া এবং অপর একটার পিঠে পাঁচনবাড়ি কসিয়া র্-র্-র্ হেট্-হেট্ করিতে করিতে গাড়ি চালাইয়া দিল। ভাঙনের সেই খাড়া পাড়ের উপর দিয়া গাড়িখানা ধড়াস্ করিয়া কাদার ভিতর নামিয়া অনেকখানি বসিয়া গেল।
গরু দুটি একবার ডাইনে, একবার বায়ে আঁকিয়াৰ্বাকিয়া অগ্রসর হইবার জন্য চেষ্টা করিতে লাগিল। কিন্তু কাদা প্রায় তাহাদের বুক-সই; তাহার ভিতর হইতে পা টানিয়া উঠানো দুষ্কর হইয়া পড়িল। আবদুল্লাহ্ গাড়োয়ানের সহিত একযোগে প্রাণপণে চাকা ঠেলিতে লাগিল। কিন্তু ওপারেও তেমনি খাড়া পাড়, গাড়ি কিছুতেই উঠাইতে পারিল না। গরু দুইটা তো পূর্ব হইতেই ক্লান্ত হইয়াছিল; এক্ষণে ক্রমাগত লেজমলা এবং পাঁচনবাড়ি খাইতে খাইতে মৃতপ্রায় হইয়া সেই কাদার উপরেই শুইয়া পড়িল। গাড়োয়ান চিৎকার করিয়া উঠিল, হুমুন্দির গরু আবার বজ্যাত্তি লাগাল দ্যাহো! এবং আবার মারিবার জন্য ভীষণ আস্ফালনের সহিত পাঁচনবাড়ি উঠাইল। আবদুল্লাহ্ তাহাকে নিরস্ত করিবার জন্য তাড়াতাড়ি কহিল, আরে কর কী, মরে যাবে যে! আর পারেই-বা কত? মেরো না ওদের, এক কাজ কর। দেখ যদি দুই চার জন লোক পাওয়া যায়। পয়সা দেবখন–যা চায় তাই দেব বলে নিয়ে এসো।
গাড়োয়ান কহিল, এ হেঁইর গাঁ, এহানে কি মুনিষ্যি পাওয়া যাবি? যে গেরামডা এই পাছে থুয়ে আলাম, স্যানে পাওয়া গেলিউ যাতি পারে।
তবে তাই যাও, দেরি কোরো না।
গাড়োয়ান চলিয়া গেল। আবদুল্লাহ্ কাদা ঠেলিয়া উঠিয়া আসিল এবং ছাতাটি খুলিয়া সেই ব্রাহ্মণের দাওয়ার সম্মুখে রাস্তার উপরেই বসিয়া পড়িল।
ব্রাহ্মণটি উঠিয়া গিয়াছিলেন; কিছুক্ষণ পরে পান চিবাইতে চিবাইতে ডাবা হাতে আবার বাহিরে আসিয়া বসিলেন। আবদুল্লাহ্ ঘাড় ফিরাইয়া তাহাকে একবার দেখিয়া লইল, কিন্তু কোনো কথা কহিল না।
এদিকে দ্বিপ্রহর গড়াইয়া গিয়াছে–ক্ষুধায়, শ্রান্তিতে ও উদ্বেগে আবদুল্লাহ্ অস্থির হইয়া উঠিল। গাড়োয়ানের ফিরিতে কত দেরি হইবে, কে জানে? আবদুল্লাহ্ পথের দিকেই চাহিয়া আছে। অবশেষে প্রায় অর্ধঘণ্টা পরে দূর হইতে তিন-চারি জন লোক আসিতেছে দেখা গেল। গাড়োয়ান লোক লইয়া ফিরিতেছে মনে করিয়া আবদুল্লাহর ধড়ে যেন প্রাণ আসিল। ক্রমে তাহারা নিকটবর্তী হইলে আবদুল্লাহ্ দেখিল সে-ই বটে, তিনজন লোক সঙ্গে।
তাহারা আসিয়া কাদার ভিতর নামিয়া পড়িল। আবদুল্লাহ্ নামিবার উপক্রম করিতেছিল, কিন্তু তাহারা কহিল, আপনি আর নামবিন ক্যান হুজুর? আমরাই ঠেলে দি তুলে–আপনি বসেন। গরু দুইটি কাদার ভিতর শুইয়া শুইয়া এতক্ষণে একটু বিশ্রাম করিয়া লইয়াছে। গাড়োয়ানের পাঁচনবাড়ির দুটা খোঁচা খাইয়াই তাহারা উঠিয়া পড়িল। চার জন লোকে চাকা ঠেলিয়া অল্প সময়ের মধ্যেই গাড়ি ওপারে তুলিয়া ফেলিল। আবদুল্লাহর জিনিসপত্রগুলিও তাহারা তথায় মাথায় করিয়া পার করিয়া দিয়া আসিল।
আবদুল্লাহ্ তাহাদিগকে কহিল, তোমরা আজ আমার বড় উপকার কল্লে বাপু না হলে আমার যে আজ কী উপায় হত তার ঠিক নেই। এদের কত দেবার কথা আছে। গাড়োয়ান?
গাড়োয়ান কহিল, আমি পুস্ কছিলাম, কত লেবা; তা ওরা কলে খুশি হয়ে যা দেন, আমরা আর কী কব!
আবদুল্লাহ্ একটি টাকা বাহির করিয়া দিল। তাহারা খুশি হইয়া সালাম করিয়া চলিয়া গেল।
যাইবার পূর্বে আবদুল্লাহ্ সেই ডাবা-প্রেমিক ব্রাহ্মণটির দিকে ঘাড় ফিরাইয়া দেখিল ঠাকুরমশায় তাহাদের দিকেই তাকাইয়া আছেন এবং সুস্থচিত্তে ধূমপান করিতেছেন।
.
৩০.
মগরেবের কিঞ্চিৎ পূর্বে মীরসাহেব মসজিদে যাইবার জন্য প্রস্তুত হইয়া বাহিরে আসিয়াছেন, এমন সময় দুইটি লোক বৈঠকখানার বারান্দা হইতে নামিয়া আসিয়া একেবারে তাহার পা জড়াইয়া করুণস্বরে চিৎকার করিয়া বলিয়া উঠিল, আমাগোর সর্বনাশ হয়ে গেছে হুজুর, এ্যাঁহোন আপনি যদি বাঁচান তো বাঁচি!
হঠাৎ এইরূপ আক্রান্ত হইয়া মীরসাহেব ত্রস্তভাবে পা টানিয়া লইলেন এবং কহিলেন, আর কে? বসির মাঝি? কী, কী, হয়েছে কী?
বসির কহিল, আর কী হবে হুজুর, সর্বনাশ হয়ে গেছে, আর কী কব! লাও ডুবে গেছে, খোদা জানডা বাঁচাইছে, আর কিস্সু নেই!
এ্যাঁ! নৌকো ডুবে গেছে? কোথায়? কেমন করে ডুবল?
ম্যাগনায়। পাট বোজাই করে নে যাতিছেলম, আটশো ট্যাহার পাট হুজুর! আমার যথাসর্বিশ্যি, হুজুর! অইন্দে গোনে এট্টা বাকের মুহি মস্ত এট্টা ইষ্টিমার আস্যে পড়ল, সামাল দিতে পাল্লাম না! লার পর দে চলে গেল, সোতের মুহি সবই ভাইসে গেল!
মীরসাহেব পরম দুঃখিত চিত্তে বলিয়া উঠিলেন, ওহো!
বসির চক্ষের জলে বক্ষ ভাসাইয়া কহিতে লাগিল, হুজুর, কিস্সু বাঁচাতি পালাম না! গহিন গাঙ, তাতে আঁদার রাত, লারও ঠিকানা কত্তি পালাম না। কমে ভাইসে গেল কিছুই ঠাওর করি পালাম না! এ্যাঁহোন উপায় কী হুজুর? আমার যে আর কিসু নেই।
মীরসাহেব গভীর সহানুভূতির সহিত কহিলেন, তাই তো বসির! তোমার তো বড়ই বিপদ গেছে দেখছি। বলিয়া বৈঠকখানার তক্তপোশের উপর উঠিয়া বসিলেন। বসির এবং তাহার সঙ্গের লোকটিও বারান্দায় উঠিয়া একটু দূরে মাটির উপর বসিয়া পড়িল।
বসিরের সঙ্গের লোকটি তাহার নৌকার একজন মাল্লা। সে কিয়ৎক্ষণ গালে হাত দিয়া বসিয়া চিন্তাকুলভাবে আপন মনে কহিতে লাগিল, নাইয়ার নাও গেল, মাহাজোনের ট্যাহা। গেল, হের লাইগা কিসু না; কিন্তু–উ কাণ্ডহান অইল কী?
বসির কহিল, এ্যাঁহোন আমি লাইয়্যারেই বা কী বুজ দি, আর হুজুরির ট্যাহারই বা কী করি! আমি ধোনে-পরানে মলাম রে আল্লাহ্!
মীরসাহেব কহিলেন, আমার টাকার জন্য তুমি ভেবো না, বসির। তোমার সঙ্গে আমার অনেক দিনের কারবার! তোমাকে সৎ লোক বলেই জানি। তুমি তো আর ইচ্ছে করে আমার টাকা মার নি! খোদার মরজি সবই–তার উপর তো কারুর কোনো হাত নেই।
এমন সময় একখানি গরুর গাড়ি করুণ কাতর রবে ক্লান্ত মন্থরগতিতে আসিয়া মীরসাহেবের বাড়ির সম্মুখে দাঁড়াইল। আবদুল্লাহ্ তাড়াতাড়ি গাড়ি হইতে নামিয়া আসিল, মীর সাহেবও বৈঠকখানার বারান্দা হইতে নামিয়া আসিতে আসিতে কহিলেন, এস এস, বাবা; এত দেরি যে?
আবদুল্লাহ্ কদমবুসি করিয়া কহিল, পথে একটা মুশকিলে পড়ে গিয়েছিলাম–তা পরে বলবখন। আমার চিঠি পেয়েছিলেন?
হ্যাঁ, আজ সকালেই পেয়েছি। বড় খুশি হলাম যে তুমি আমাদের স্কুলের হেডমাস্টার হয়ে এলে তোমার পত্র পড়ে অবধি খোদার কাছে হাজার হাজার শোকর কচ্ছি।
তবিয়ত ভালো তো?
হ্যাঁ, বাবা, ভালোই আছি।
আমি মনে করেছিলাম হয়তো আপনি বাড়িতে নেই…
না থাকবারই কথা বটে–কিন্তু থেকে যেতে হয়েছে। বোধ করি তুমি আসবে বলেই খোদা আমাকে বাড়ি থেকে বেরুতে দেন নি। বলিয়া মীরসাহেব স্মিতমুখে আবদুল্লাহর স্কন্ধে হাত দিলেন।
আবদুল্লাহ্ও হাসিমুখে কহিল, তা বেশ হয়েছে, আপনি আছেন, ফুপাজান! নইলে আমার ভারি অসুবিধে হত।
মীর সাহেব কহিলেন, এস, ঘরে এস। নামাযটা পড়ে নি। ওযুর পানি চাই?
জি না, পথেই আসর পড়ে নিয়েছি। ওযু আছে।
অতঃপর মীরসাহেব গাড়োয়ানকে জিনিসপত্র তুলিয়া রাখিতে বলিয়া এবং বসিরকে বসিবার জন্য ইশারা করিয়া আবদুল্লাহকে লইয়া নামায পড়িবার জন্য বৈঠকখানায় প্রবেশ করিলেন। উলফৎ কিঞ্চিৎ পূর্বে আলো দিয়া গিয়াছিল।
নামায বাদ মীর সাহেব অন্দরে গিয়া আবদুল্লাহর জন্য কিঞ্চিৎ নাশতার বন্দোবস্ত করিতে বলিয়া আসিলেন। একটু পরেই একটা বাঁদী নাশতার খাঞ্চা চিলমচি, বদনা দস্তরখানা প্রভৃতি একে একে লইয়া আসিল। মীরসাহেব খানপোষ উঠাইয়া ফেলিলেন; খাঞ্চার উপর এক রেকাবি সমুসা, এক তশতরি কুমড়ার মোরব্বা, এক তশতরি আণ্ডার হালুয়া ছিল, তিনি সেগুলি একে একে দস্তরখানে সাজাইয়া দিলেন।
আবদুল্লাহ্ কহিল, আপনিও আসুন, ফুপাজান…
আমার তো এ সময়ে খাওয়া অভ্যাস নেই–তবে বসি তোমার সঙ্গে একটু–এই বলিয়া মীরসাহেব আবদুল্লাহর সহিত নাশতা করিতে বসিয়া গেলেন।
ফুপাজান তো একলা মানুষ; তবে এসব নাশতা কোথা হইতে আসিল? আবদুল্লাহর কৌতূহল হইল; সে জিজ্ঞাসা করিল, এগুলো কে তয়ের করেছে; ফুপাজান?
মীর সাহেব কহিলেন, কেন, ভালো হয় নি?
না, না, ভালো হবে না কেন? বেশ চমৎকার হয়েছে। তবে আপনার এখানে এসব নাশতা তয়ের করার তো কেউ নেই, তাই জিজ্ঞেস কচ্ছিলাম…
মীর সাহেব একটু হাসিয়া কহিল, ওঃ, তা বুঝি জান না? আমার এক আম্মা এসেছেন যে!
কে? ভাবী সাহেবা?
না মালেকা, আমার ছোট আম্মা।
কবে এলেন তিনি?
এই কদিন হল। মইনুদ্দীন মারা গেছে তা বোধহয় জান…
কই না! কবে?
এই পূজার ছুটির কদিন আগেই। হঠাৎ কলেরা হয়েছিল।
আবদুল্লাহ্ কেবল একবার অহো! বলিয়া অত্যন্ত বিষমুখে চুপ করিয়া বসিয়া রহিল।
মীর সাহেব বলিতে লাগিলেন, মেয়েটা বিধবা হয়ে একেবারে নিরাশ্রয় হয়ে পড়েছিল– বুবুও তো আর নেই যে তার কাছে এসে থাকবে…
কেন, ভাসুর বুঝি জায়গা দিলেন না?
দিয়েছিলেন; কিন্তু দুই জায়ে বনল না। কাজেই তিনি বাধ্য হয়ে মালেকাকে আবদুল খালেকের কাছে পাঠিয়ে দিলেন।
কেন, বনল না কেন? মালেকার তো ছেলেপিলে নেই, নির্ঝঞ্ঝাট…
সে জন্যে না; অত বড় ঘরের মেয়ে–সৈয়দজাদী, বাপ জমিদার আবার সজজ– জজিয়তিও মধ্যে মধ্যে করে থাকেন তিনি কি আর সামান্য গেরস্তের মেয়ের সঙ্গে ঘর কত্তে পারেন?
হ্যাঁ, তা ঠিক ফুপাজান! শুনেছি তিনি স্বামীকেও বড় একটা কেয়ার করেন না…
আরে কেয়ার করা তো দূরের কথা; তিনি স্বামীর কথায় নাকি বলে থাকেন, ওঃ এ্যাঁয়সা ডিবৃটি কেত্তা মেরা বাপকা জুতা সাফ কবৃনে কে লিয়ে রাখৃখা গিয়া হায়!
বটে? তবে তো মহীউদ্দিন সাহেব খুব সুখেই ঘর কচ্ছেন!
হ্যাঁ! সুখ বলে সুখ? বাড়িতে তিনি যে কী হালে থাকেন, তা শুনলে কান্না আসে। তার বাসন, পেয়ালা, গেলাস, বদনা সব আলাদা। তিনি যে গেলাসে পানি খান, বিবি সাহেব সে গেলাস ছোঁনও না…
এতদূর!
এই বোঝ! মস্ত ভয়ঙ্কর বড় ঘরের মেয়ে–স্বামী হলেই-বা কী, তার সঙ্গে তুলনায় সে তো ছোটলোক।
আবদুল্লাহ একটু ভাবিয়া কহিল, মহীউদ্দিন সাহেব তো নিতান্ত যে-সে লোক নন। বেশ খাস সম্পত্তি আছে, পুরোনো জমিদারের ঘর–তার উপর ডিপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, –এতেও যদি তিনি ছোটলোক হলেন, তবে ও বিবি সাহেবের তুল্য স্বামী পেতেন কোথায়? আর যদি এতই ছোটলোক বলে ওঁরা বিবেচনা করেন, তবে বিয়ে না দিলেই হত!
বিয়ে দিয়েছিলেন মহীউদ্দিনের বাপ অনেক চেষ্টা-চরিত্র করে–বড় ঘরে ছেলের বিয়ে দিয়ে কৃতার্থ হবেন, সেই জন্য আর কি! জজ সাহেবও দেখলেন, এমন ছেলে আর পাবেন। না, কাজেই তিনি রাজি হয়ে গিয়েছিলেন।
আবদুল্লাহ্ একটু ভাবিয়া একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়িয়া কহিল, বেচারা মহীউদ্দিন সাহেবের জন্যে বড় দুঃখ হয়।
মীর সাহেব কহিলেন, বরাতে দুঃখু থাকলে আর কে কী করবে বল! সে কথা থাক, এখন মালেকার একটা গতি করতে হয়, তাই ভাবছি।
কী কত্তে চান?
ফের বিয়ে দেব, মনে কচ্ছি।
বিয়ে দেবেন? ছেলে পাবেন কোথায়? বিধবার বিয়ের কথা শুনলে সব্বাই শিউরে উঠবে এক্কেবারে!
সত্যিই তাই। আমি আলতাফের সঙ্গে বিয়ের প্রস্তাব করিয়েছিলাম। আলতাফ রাজি আছে, কিন্তু তার বাপ শুনে একেবারে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠেছিল…
আবদুল্লাহ্ কহিল, তা তো উঠবেনই! আমাদেরও ক্রমে হিন্দুদের দশা হয়ে উঠল আর কি! ভালো মানুষের বিশেষ করে গরিব ভালো মানুষের ঘরে তো আজকাল বিধবাদের বিয়ে হয়ই না।
মীর সাহেব কহিলেন, ও তো হিন্দুদের দেখাদেখি। আর জাত্যাভিমানও আছে। বিধবাদের কথা ছেড়ে দাও, কত আইবুড়ো মেয়েরই বিয়ে হচ্ছে না। এই দেখ না, আমাদের আত্মীয়স্বজনের মধ্যেই কত মেয়ের বয়স ত্রিশ বছর পার হয়ে গেল, বিয়ে হচ্ছে না। এরা আলমগীর বাদশার অবতার হয়ে এসেছেন কিনা, শাহ্জাদা পাচ্ছেন না, কাজেই শাহজাদীদের বিয়ে হচ্ছে না।
আবদুল্লাহ্ কহিল, আমার শ্বশুর একদিন কার বিয়ের কথায় বলছিলেন, শরীফজাদীর বিয়ের জন্যে আবার এত ভাবনা কেন? না হলেই-বা কী?
চিরকাল আইবুড়ো থাকবে?
তাঁর মতে থাকলেও দোষ নেই–শরাফতির ভেলায় চড়ে ভবসিন্ধু পার হয়ে যাবে।
মীর সাহেব একটু হাসিয়া কহিলেন, খোদা করে যেন সব শরীফজাদীই ওই রকম করে ভবসিন্ধু পার হয়ে যান; তা হলে শরীফগোষ্ঠী নিপাত হবে শিগগির, মুসলমান সমাজও নিস্তার পাবে।
উভয়ে হাসিতে লাগিলেন। মীর সাহেব আবার কহিলেন, দেখ সমাজে বিয়ে-থাওয়া কয়েকটা নির্দিষ্ট ঘরের মধ্যেই আবদ্ধ–তার বাইরে কথা উঠলে মুরব্বিরা আপত্তি করে বলেন, ওদের সঙ্গে কোনো পুরুষে হসব-নসব নেই। অর্থাৎ যাদের সঙ্গে ইতিপূর্বে হসব নসব হয় নি, তারা যেন সবই অ-জাত! এই রকম করে কেবল আপনা-আপৃনির মধ্যেই শাদি-বিয়ে অনেক পুরুষ ধরে চলে আসছে। আর তার ফলে শারীরিক, মানসিক, সব রকম অধঃপাত হচ্চে। শাদি-বিয়ে যত বাইরে বাইরে হবে, বংশাবলি ততই সতেজ হবে। তাই বলে এমন কথা বলি নে যে ভদ্রঘরের ছেলে-মেয়ের সঙ্গে হেলো-চাষার ছেলে-মেয়ের বে থা হোক। দেখতে হবে মানসিক হিসাবে বিশেষ কোনো তফাত না থাকে। মনে কর, তিন চার পুরুষ আগে যারা চাষা ছিল, আজ তাদের বংশে লেখাপড়ার চর্চা হয়েছে, অবস্থা ফিরেছে, স্বভাব-চরিত্র ভালো, বড় বড় সমাজে আমাদের সঙ্গে সমানভাবে মেলামেশা কচ্চে, তাদের সঙ্গে হসব-নসবে কোনো দোষ হতে পারে না। এক কালে চাষা ছিল বলে যে রোজ কেয়ামত পর্যন্তই তাদের বংশ ঘৃণিত হয়ে থাকবে, তার কোনো মানে নেই। আর যারা নতুন উন্নতি কচ্চে, তাদের সঙ্গে রক্তের সংমিশ্রণ হলে আজ-কালকার শরীফজাদাদের নিস্তেজ রক্ত একটু সতেজ হয়ে উঠবে–আর এদের বংশানুক্রমিক উৎকর্ষেরও কিছু ফল ওরা পাবে– সুতরাং উভয় পক্ষেরই লাভ।
আবদুল্লাহ্ কহিল, কিন্তু বিলেতের মতো সভ্য দেশেও লর্ড ফ্যামিলির লোকেরা সাধারণ লোকের সঙ্গে ছেলে-মেয়ের বিয়ে দিতে চায় না।
মীর সাহেব কহিলেন, জাত্যাভিমান তাদের মধ্যেও আছে। কিন্তু তাদের আছে বলেই যে সেটা ভালো বলে মেনে নিতে হবে, তার কোনো মানে নেই। যখন দেখতেই পাচ্ছি আমাদের নিজেদের সমাজে এই রকম আপনা-আপনির ভিতর বিবাহের ফল ভালো হচ্ছে না, অনেক স্থলেই সন্তান রোগা, নিস্তেজ, বোকা এইসব হচ্চে আর যেখানেই একটু বিভিন্ন রক্তের সংমিশ্রণ হচ্ছে, প্রায়ই সেখানে দেখতে পাই সন্তান সতেজ, সবল এবং মেধাবী হয়ে ওঠে, তখন আর কোনো যুক্তিই মানতে চাই না। আবার দেখ, মুরব্বিদের। মুখে শুনেছি, সেকালে নাকি বাড়ি বাড়ি লোকজনে ভরা ছিল, তারা বলেন, দুনিয়া আখের হয়ে এসেছে, তাই এখন সব বিরান হয়ে উঠছে! লোকসংখ্যা যে মোটের উপর বাড়ছে, সেটা তারা খেয়াল করেন না; শরীফদের ঘর উজাড় হয়ে আসছে, এইটেই কেবল লক্ষ্য করেন। তা উজাড় তো হবেই! মেয়েগুলোকে কেউ কেউ আইবুড়ো করে রাখেন আর নিতান্তই বে দেন তো সে আপনা-আপনির মধ্যে, যার ফল ভালো হয় না–বিধবা হলে। আর বে দেবেন না; এত করে আশরাফ সমাজে লোক বাড়বে কী করে? এ আশরাফ সমাজের আর মঙ্গল নেই। আর দুই-এক পুরুষের মধ্যেই এঁদের দফা শেষ হবে; আর এখন যাদের দেখে এঁরা নাক সিটকাচ্ছেন, তারাই তখন মানুষ হয়ে তাদের সমাজকেই বড় করে তুলবে।
আবদুল্লাহ্ কহিল, সে কথা ঠিক, ফুপাজান। এই তো দেখতে পাই, কলকাতার মেসগুলোতে আমাদের এদিককার যত ছাত্র আছে, তার মধ্যে আশরাফ সমাজের ছেলে খুবই কম। লেখাপড়া শিখে ওরা যখন মানুষ হবে তখন এঁরা কোথায় থাকবেন?
সাএলের দলে গিয়ে ভিড় বাড়াবেন। এখনো যদি এঁরা জাত্যাভিমান ছেড়ে, অন্যান্য উন্নতিশীল সমাজের সঙ্গে হসব-নসব কত্তে আরম্ভ করেন, তা হলে এঁদের বংশের উন্নতি হতে পারে। নইলে ক্রমেই অধঃপাত! যাক সে কথা বলছিলাম মালেকার বিয়ের কথা। বাদশাহ্ মিয়া তো কিছুতেই রাজি হবেন না। ভাবছি কোনো উপায় কত্তে পারি কি না। আলতাফ ছেলেটা ভালো; বি-এ পাস করেছে, ল পড়ছে। বারে বেশ শাইন কত্তে পারবে। দেখি যদি একান্ত না হয় অন্য কোথাও চেষ্টা কত্তে হবে। তুমিও একটু সন্ধানে থেকো, বাবা।
আবদুল্লাহ্ কহিল, জি আচ্ছা, তা দেখব। তবে আশরাফ সমাজে ছেলে পাওয়া যাবে বলে বোধ হয় না…
নাই-বা হল আশরাফ সমাজে। ছেলে ভালো, সচ্চরিত্র, সুস্থ, সবল–বাস, আর কোনো সিফাৎ চাই নে। ডিপুটি তমিজউদ্দিনের কথা শুনেছ তো? তার বাপ তো সুপারি, নারকোল, তরিতরকারি মাথায় করে নিয়ে হাটে বেচতেন। ছেলে যখন বি-এ পাস কল্লে, তখনো তিনি তার নিজের ব্যবসায় ছাড়েন নি। হাইকোর্টের উকিল আবদুল জলিল ছেলেটাকে ভালো দেখে নিজের কাছে রেখে লেখাপড়া শিখিয়ে ডিপুটি ম্যাজিস্ট্রেট করে নিজের মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিলেন। তমিজউদ্দিন মারা গেছেন, তার ছেলে বদরউদ্দীন এখন ওকালতি কচ্ছেন, দিব্বি পসার। দেখ তো, একটা নিম্নস্তরের পরিবারের কেমন ধা করে উন্নতি হয়ে গেল! আর ওই ছেলে যদি ওই সহানুভূতিটুকুর অভাবে লেখাপড়া শিখতে না পেত তবে বাঙ্গালাদেশে তো আজ একটা উন্নত পরিবার কম থেকে যেত! ওসব শরাফতের মোহ ছেড়ে দেও বাবা। ছেলে ভালো পাও আমাকে এনে দেও, তা সে যেমন। ঘরেরই হোক না কেন। কেবল দেখা চাই, ছেলেটি সুস্থ, সচ্চরিত্র আর কর্মক্ষম কি না– বাস্…
আর লেখাপড়া?
হ্যাঁ, সেটা তো চাই-ই…
তবে আপনি বংশটা একেবারেই দেখবেন না? মনে করুন এমনও তো হতে পারে যে, ছেলেটি সব বিষয়ে ভালো, কিন্তু তাদের পরিবারের মধ্যে লেখাপড়ার চর্চা নেই, culture নেই, নিম্নশ্রেণীর লোকের মতনই তাদের চাল-চলন–কেবল ছেলেটি লেখাপড়া শেখবার সুযোগ পেয়ে বি-এ পাস কত্তে পেরেছে। তার সঙ্গে মেয়ে বিয়ে দিলে তো মেয়েকে নিতান্ত হীন সংস্রবে জীবন কাটাতে হবে…
মীর সাহেব কহিলেন, আমি কি আর সে কথা ভেবে দেখি নি বাবা? তেমন ঘরের কথা আমি বলছি নে। অবশ্য তাও দোষের হয় না যদি ছেলেটি পরিবার থেকে আলাদা হয়ে থাকে–যেমন ধর, তাকে যদি সারাজীবন চাকরিতে বা ব্যবসায় উপলক্ষে বিদেশে বিদেশে কাটাতে হয়। আর তা ছাড়া শিক্ষিত লোকের মধ্যে আজকাল একটা tendency দেখা যাচ্ছে। পরিবারের একান্নবর্তিতা ভেঙে স্বতন্ত্র ও স্বাধীন হয়ে থাকবার দিকে। কাজেই তেমন ক্ষেত্রে মেয়েকে কোনো অসুবিধায় পড়বার কথা নয়। যেখানে পরিবার একান্নবর্তী সেখানে অবশ্য। কেবল ছেলে দেখলে চলে না, এ কথা মানি। তবে কবরের ওপারের দিকে তাকাবার আমি কোনো দরকার দেখি না…
আবদুল্লাহ্ কৌতূহলী হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, কবরের ওপারে কী রকম?
মীর সাহেব কহিলেন, অর্থাৎ যারা আছে, তাদের দেখ, তাদের পূর্বপুরুষরা কী ছিল না ছিল দেখবার দরকার নেই…
আবদুল্লাহ্ কহিল, তা না দেখলে কি যারা আছে তাদের চরিত্র, চালচলন সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হওয়া যায়?
কেন যাবে না? তাদের একটু study করে দেখে নিলেই হল। তা ছাড়া তুমি কি মনে কর ঘরানা হলেই চরিত্র, চালচলন ভালো হবে? স্ত্রীকে ধরে মারে এমন হতভাগা শরীফজাদা কি নেই?
আবদুল্লাহ্ কহিল, তা তো বটেই।
তবে বুঝেই দেখ, যে ছেলেটিকে চাই, তাকে আর তার immediate environment, কেবল এই দেখব; তার ওদিকে দেখব না…! তুমি একটু বস বাবা–বাইরে দুটো লোক বসিয়ে রেখে এসেছি, তাদের বিদায় করে আসি… এই বলিয়া মীর সাহেব উঠিয়া বাহিরে আসিলেন, এবং কহিলেন, দেখ বসির, তোমার ও টাকা আমি মাফ করে দিলাম। যখন ডুবেছে, তখন তোমারও গেছে, আমারও গেছে। তা যাক্ তুমি কাল এসো; যদি খোদা তোমাকে দেয়, তবে ও টাকা শোধ কোরো। কিছু টাকা দেব, ফের কারবার কোরো। এখন রাত হল, বাড়িতেও মেহমান। তোমরা আজ এস গিয়ে।