০৬-১০. স্ত্রীর ঘরে

স্ত্রীর ঘরে গিয়া আবদুল্লাহ্ দেখিল, সালেহা খাটের সম্মুখস্থ চৌকির উপর বসিয়া পান সাজিতেছে। ঘরে একটা বাঁদী ছিল; আবদুল্লাহকে আসিতে দেখিয়া সে বাহির হইয়া গেল।

সালেহা তাড়াতাড়ি চৌকি হইতে নামিয়া স্বামীর নিকটবর্তী হইল এবং কদমবুসি করিবার জন্য দেহ নত করিল। আবদুল্লাহ্ ইহার জন্য প্রস্তুতই ছিল, সে তৎক্ষণাৎ স্ত্রীর বাহুদ্বয় ধরিয়া তাহাকে টানিয়া তুলিল এবং কহিল, আঃ, ছিঃ তোমার ও-রোগটা এখনো গেল না দেখছি।

ইতোমধ্যে সালেহা আবদুল্লাহর বাহুবেষ্টনে আবদ্ধ হইয়া গিয়াছে। তাহার স্বামী এইরূপ অভ্যর্থনা চান বটে; কিন্তু সে কদমবুসির পরিবর্তে এরূপ বেহায়াপনার দ্বারা স্বামীর অভ্যর্থনা করা মোটেই পছন্দ করিত না। সে ভাবিত, তাহার স্বামী তাহাকে একটা বৃহৎ কর্তব্যকর্মে বাধা দিয়া কাজ ভালো করেন না।

ছাড়ুন ছাড়ুন, কেউ দেখতে পাবে বলিয়া সালেহা স্বামীর সাগ্রহ বাহুবেষ্টন হইতে আপনাকে মুক্ত করিয়া লইয়া সরিয়া দাঁড়াইল। একটু পরে আবার কহিল, আপনি বড় অন্যায় করেন।

আবদুল্লাহ্ চৌকির উপর বসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, কী অন্যায় করি?

চৌকির অপর প্রান্তে উঠিয়া বসিতে বসিতে সালেহা কহিল, এই–এই–সালাম করতে দেন না আর কি! ওতে যে আমার গোনাহ্ হয়।

যদি গোনাহ্ হয়, তবে সে আমারই হবে, কেননা, আমিই করতে দেই না।

আপনার হলে তো আমারও হল–

আবদুল্লাহ্ একটু বিদ্রুপের স্বরে কহিল, বাঃ, বেশ ফতোয়া জারি করতে শিখেছ যে দেখছি!

পানের বাটাটি স্বামীর সম্মুখে বাড়াইয়া দিয়া সালেহা কহিল, ফতোয়া আবার কোথায় হল?

বাটা হইতে দুটি পান তুলিয়া মুখে দিয়া চিবাইতে চিবাইতে আবদুল্লাহ্ কহিল, কেন, এই যে বললে, একজনের গোনাহ্ হলে দুজনের হয়! এ তো নতুন ফতোয়া নতুন মুরীদ হয়ে বুঝি এ সব শিখেছ?

সালেহা একটু বিরক্ত হইয়া কহিল, যান, ওসব কথা নিয়ে তামাশা করা ভালো না।

না, তামাশা কচ্ছিনে; কিন্তু আজকাল তোমার নামায আর ওজিফার যে রকম বান ডেকেছে, তাতে হয়তো আমি ভেসেই যাব। এই যে আমি এদ্দিন পরে এসে সন্ধে থেকে বসে আছি…

সালেহা অসহিষ্ণু হইয়া উঠিয়া কহিল, খোদার কাজ করতে আপনি মানা করেন?

আবদুল্লাহ্ কৃত্রিম ভয়ের ভাব দেখাইয়া দাঁতে জিভ কাটিয়া কহিল, তওবা তওবা, তা কেন করব? তবে কিনা সংসারের কাজও তো মানুষের আছে…।

কেন আমি নামায পড়ি বলে কি সংসারের কাজ আটকে থাকে?

নামায পড়লে আটকায় না বটে, কিন্তু অত লম্বা ওজিফা জুড়ে বসলে আটকায় বৈকি! বিশেষ করে আমাদের মতো গরিবের ঘরে, যেখানে বাঁদী গোলামের ভিড় নেই।

কথাটা সালেহার ভালো লাগিল না। সে তাহার পিতার বড়ই অনুগত ছিল, এবং শৈশব হইতে এ সকল ব্যাপারে তাহারই অনুকরণ করিয়া আসিতেছে। তাহার উপর আবার সম্প্রতি পীর সাহেবের নিকট মুরীদ হইয়া দ্বিগুণ উৎসাহে ধর্মের অনুষ্ঠানে আপনাকে নিয়োজিত করিয়াছে। তাহার বিশ্বাস জন্মিয়া গিয়াছে যে, এইরূপ কঠোর অনুষ্ঠানই পরকালে বেহেশত লাভের উপায়, ইহাই সর্বপ্রথম কর্তব্য। সংসারের কাজগুলি সব নিতান্তই বাজে কাজ, যেটুকু না করিলেই চলে না সেইটুকু করিলেই যথেষ্ট। সংসার সম্বন্ধে ইহার অধিক কোনো কর্তব্য আসিতে পারে না। তাই আজ তাহার স্বামী খোদার কাজ অপেক্ষা সংসারের কাজের গুরুত্ব অধিক বলিয়া মত প্রকাশ করিতেছেন মনে করিয়া সালেহা বিরক্ত, ক্ষুণ্ণ এবং রুষ্ট হইয়া উঠিল। সে একটু উষ্ণতার সহিত বলিয়া ফেলিল, হোক, তবু খোদার কাজ আগে, পরে আর সব।

আবদুল্লাহ্ দেখিল, এ আলোচনা ক্রমে অপ্রীতিকর হইয়া উঠিতেছে। তখন সে কথাটা চাপা দিবার জন্য কহিল, সে কথা ঠিক। তা যাক্, তুমি কেমন আছ, তাই বল।

আছি ভালোই, আম্মার তবিয়ত ভালো তো?

ভালো আর কোথায়! আব্বার এন্তেকালের পর থেকে তার শরীর ক্রমে ভেঙে পড়েছে।

সালেহা একটু চুপ করিয়া থাকিয়া জিজ্ঞাসা করিল, আমি তখন যেতে পারি নি বলে কি তিনি রাগ করেছেন?

আবদুল্লাহ কহিল, না–তিনি তোমার উপর রাগ করবেন কেন? তবে আব্বা মরবার সময় তোমাকে দেখতে পান নি বলে বড় দুঃখ করে গেছেন।

তা কী করব, আমাকে পাঠাবার তখন কোনো সুবিধে হয়ে উঠল না। পরে একটু ভাবিয়া সালেহা আবার কহিল, আপনিও তো এসে আমাকে নিয়ে যেতে পারতেন।

আমি আব্বাকে ফেলে আসি কী করে? তাকে দেখবার শুনবার তো আর লোক ছিল না।

সালেহা চুপ করিয়া রহিল। কিয়ৎক্ষণ পরে আবদুল্লাহ কহিল, আমার বোধহয় আর পড়াশুনা হবে না।

তবে কী করবেন?

ভাবছি একটা চাকরির চেষ্টা দেখব।

একজন তো চাকরি করবেন বলে আবার সঙ্গে চটাচটি করে গেছেন…

সে চাকরি করে নিজের উন্নতি করতে চায়, তাতে বাধা দেওয়া তো আমার শ্বশুরের উচিত হয় নি…

আর বাপের অমতে তাকে চটিয়ে, চাকরি করতে যাওয়া বুঝি মেজ ভাইজানের বড় উচিত হয়েছে?

এমন ভালো কাজেও যদি বাপ চটেন, তা হলে লাচার হয়ে অবাধ্য হতেই হয়…

না, তাতে কি কখনো ভালো হয়? হাজার ভালো কাজ হলেও বাপ যদি নারাজ থাকেন, তাতে বরকত হয় না।

স্ত্রীর সহিত তর্কে এইখানে আবদুল্লাহকে পরাস্ত হইতে হইল। অগত্যা সে কহিল, হ্যাঁ, সে কথা ঠিক। আবদুল কাদেরের উচিত ছিল বাপকে বুঝিয়ে বলে তাকে রাজি করে যাওয়া…

তাতেও কিছু হত না। আব্ব মেজ ভাইজানকে বলেছিলেন আবার মাদ্রাসায় পড়তে। তিনি বলেন, যারা শরীফজাদা তাদের উচিত দীন ইসলামের উপর পাকা হয়ে থাকা। ইংরেজি পড়া, কি চাকরি করতে যাওয়া ওসব দুনিয়াদারী কাজে ইমান দোরস্ত থাকে না বলে তিনি মোটেই পছন্দ করেন না।

পছন্দ করেন না, তা তো বুঝলাম। কিন্তু যারা এখন শরীফজাদা আছেন, পৈতৃক সম্পত্তি নিয়ে কোনোরকমে না হয় শরাফতি করে যাচ্ছেন। তারপর দুই এক পুরুষ বাদে সম্পত্তিটুকু যখন তিল তিল করে ভাগ হয়ে যাবে, তখন শরাফতি বজায় রাখবেন কী দিয়ে? তখন যে পেটের ভাতই জুটবে না…

কেন জুটবে না? খোদার উপর তওয়াল রাখলে নিশ্চয়ই জুটবে।

ঘরে বসে খালি খোদার উপর তওয়াল রাখলে তো আর অমনি ভাত পেটের ভিতর ঢুকবে না। তার জন্যে চেষ্টা করতে হবে ও যাতে দু পয়সা উপায় হয় তার জন্যে খাটতে হবে। যে দিন-কাল পড়েছে, তাতে ইংরেজি না শিখলে আর সেটি হবার যো নেই…।

কেন কত লোক যে ইংরেজি শেখে নি, খোদা কি তাদের ভাত-কাপড় জুটিয়ে দিচ্ছেন না?

তর্ক আবার অপ্রিয় হইয়া উঠিবার উদ্যোগ করিতেছে দেখিয়া আবদুল্লাহ্ কহিল, যা গে যাক্, ও-সব কথা তোমরা বুঝবেও না, ও-তর্কেও আর কাজ নেই…

না, আমরা বুঝিও নে, বুঝতে চাইও নে; কেবল এইটুকু জানি যে, খোদার উপর তওয়াল রাখলে আর তার কাজ রীতিমতো করে গেলে, কারুর কোনো ভাবনা থাকে না। আব্বা যে বলে থাকেন, ইংরেজি পড়লে খোদার উপর আর লোকের তেমন বিশ্বাস থাকে না, তা দেখছি ঠিক।…

শেষটা তাহার নিজের উপরই প্রযুক্ত হইল বুঝিয়া আবদুল্লাহ্ একটু বিরক্তির স্বরে কহিল, খোদার উপর অবিশ্বাস দেখলে কোন্‌খানে? সংসারে উন্নতির চেষ্টা না করে কেবল হাত-পা কোলে করে বসে থাকলেই যদি খোদার উপর বিশ্বাস আছে বলে ধরতে চাও, তবে আমি স্বীকার করি, আমার তেমন বিশ্বাস নেই।

স্বামীর মুখে এত বড় নাস্তিকতার কথা শুনিয়া সালেহা একেবারে শিহরিয়া উঠিল। সে। দাঁতে জিভ কাটিয়া কহিল, এ্যাঁ, বলেন কী! তওবা করুন, তওবা করুন, অমন কথা মুখ দিয়ে বার করবেন না! ওতে কত বড় গোনাহ্ হয়, তা কি আপনি জানেন না? ও-কথা যে শোনে সেও জাহান্নামে যায়।…

এমন সময় মসজিদে এশার নামাযের আযান আরম্ভ হওয়ায় আবদুল্লাহ্ চুপ করিয়া রহিল। আযান শেষে মুনাজাত করিয়া কহিল, জাহান্নামে যাবার ভয় থাকে তো তোমার আর ওসব শুনে কাজ নেই।

এই বলিয়া আবদুল্লাহ্ একটা বালিশ টানিয়া লইয়া শুইয়া পড়িল।

সালেহা কহিল, এখন শুলেন যে? নামায পড়তে যাবেন না?

না, আর মসজিদে যাব না, ঘরেই পড়ব এখন; একটু গড়াগড়ি দিয়ে নিই। বড় হয়রান হয়ে এসেছি।

তবে আমি যাই, নামাযটা পড়ে নিয়ে খানার যোগাড় করি গিয়ে–

তা হলে দেখছি খাওয়াদাওয়ার এখনো ঢের দেরি আছে–ততক্ষণে আমি নামায পড়ে বেশ একটা ঘুম দিয়ে নিতে পারব। তুমি এক বদনা ওযুর পানি পাঠিয়ে দিও

এই বলিয়া আবদুল্লাহ্ চৌকির উপর পড়িয়া পড়িয়া একটা বিকট হাই তুলিয়া সাড়ম্বরে আলস্য ত্যাগ করিল।

সালেহা একটা বাঁদীকে ডাকিয়া পানি দিতে বলিয়া চলিয়া গেল।

হালিমা ও সালেহার চেষ্টায় সেদিন একটু সকাল সকাল খানার বন্দোবস্ত হইল। তখন। রাত্রি দ্বিপ্রহর পার হইয়া গিয়াছে।

একটা বাঁদী আসিয়া আবদুল্লাহকে ডাকিয়া তাহার শ্বশুরের ঘরে লইয়া গেল। দস্তরখান সেইখানেই বিছানো হইয়াছিল। আবদুল্লাহ্ ঘরে প্রবেশ করিতেই শ্বশুর কহিলেন, এস বাবা, এস, ভালো আছ তো?

আবদুল্লাহ্ শ্বশুরের কদমবুসি করিয়া কহিল, জি হাঁ, ভালোই আছি। হুজুরের তবিয়ত কেমন?

শ্বশুর একটু কাতর স্বরে কহিলেন, আর বাবা তবিয়ত! এবার নিতান্তই খোদার মরজিতে আর হুজুরের (অর্থাৎ পীর সাহেবের) দোয়াতে বেঁচে উঠেছি, নইলে বাচবার আশা ছিল না। এখনো চলতে পারি নে, হাত-পা কাপে।

আবদুল্লাহ্ কহিল, তা এই দুর্বল শরীরে রাত্রে একটু সকাল সকাল খেয়ে নিলে বোধ করি ভালো হয়…

আর বাবা, ওটা অভ্যেস হয়ে গেছে–তা ছাড়া নামাযটা না পড়ে কেমন করে খাই। খেলে যে আর শুয়ে পারি নে…

এমন সময় বাঁদীরা বাড়ির ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলিকে নিদ্রা হইতে উঠাইয়া টানিতে টানিতে আনিয়া দস্তরখানে একে একে বসাইয়া দিয়া গেল। বেচারারা বসিয়া বসিয়া ঢুলিতে লাগিল। কর্তার বাঁদী-পুত্র খোদা নেওয়াজ দস্তরখানের উপর বাসন-পেয়ালা প্রভৃতি সাজাইতে সাজাইতে একটা বাঁদীকে ডাকিয়া কহিল, ওরে ফুলি, বড় মিঞা সাহেবকে ডেকে নিয়ে আয়।

আবদুল কুদ্দুস প্রথম বয়সে একটি বাঁদীকে নিকাহ্ করিয়াছিলেন, তাহারই গর্ভে খোদা নেওয়াজের জন্ম হয়। খোদা নেওয়াজই তাঁহার জ্যেষ্ঠ পুত্র; কিন্তু সে বাঁদী-গর্ভজাত বলিয়া বিবি-গর্ভজাত কনিষ্ঠ ভ্রাতাদিগকে বড় মিঞা সাহেব, মেজ মিঞা সাহেব ইত্যাদি বলিয়া ডাকিতে হয়। সংসারে যে তাহাকে ঠিক চাকরের মতো থাকিতে হয়, এরূপ বলা যায় না; কেবল মসজিদ এবং দস্তরখানে খাদেমি এবং অন্দরের ও সদরের ফুট-ফরমাইশ খাটা ভিন্ন তাহার আর বড় একটা কাজ ছিল না। অবশ্য তাহার আহারাদি যে চাকর-মহলেই হইত, তাহা বলাই বাহুল্য।

বড় মিঞা সাহেব তাহার বহির্বাটীস্থ মহল হইতে অন্দরে আনীত হইলে খান আরম্ভ হইল। কর্তা আবদুল্লাহকে লক্ষ্য করিয়া কহিতে লাগিলেন, তোমার ওয়ালেদ মরহুমের সঙ্গে আমার একবার শেষ দেখাটা হল না, সেজন্যে আমার জানে বড় সমা লেগেছে। বড় ভালো লোক ছিলেন তিনি, এমন দীনদার পরহেজগার লোক আজকালকার জমানায় বড় একটা দেখতে পাওয়া যায় না। কী করব, বাবা, সবই কিসমত? তা তোমার আম্মা ভালো আছেন তো?

জি না, তেমন ভালো আর কোথায়! আব্বার এন্তেকালের পর থেকে তারও তবিয়ত খারাব হয়ে পড়েছে।

তা তো পড়বেই বাবা, তাঁর ধড়ে কি আর জান আছে! এর চেয়ে সদমা আর দুনিয়াতে নেই। ওঁয়ার শরীরটার দিকে একটু নজর রেখো বাবা, আর এ সময় তুমি কাছে কাছেই থেকো, ওয়াকে একলা ফেলে কোথাও গিয়ে বেশি দিন থেকো না, এ-সময়ে তুমি কাছে থাকলে ওঁর মনটা একটু ভালো থাকবে।…

এইরূপ বহুবিধ উপদেশের মধ্য দিয়া খানা শেষ হইল, আবদুল্লাহ একবার মনে করিয়াছিল, তাহার পড়াশুনার কথাটা এই সময়ে পাড়িয়া দেখিবে, কিন্তু আবার ভাবিল, না, এখন ও-সব কথা পাড়িয়া কাজ নাই। কাল দিনের বেলা সুবিধামতো নিরিবিলি পাইলে তখন। বলা যাইবে। বিশেষত এতগুলি লোকের সামনে তাহার মুখ ফুটিল না; তাহার আত্মসম্মান। অন্তরের মধ্য হইতে তাহাকে বাধা দিতে লাগিল।

.

০৭.

পলাশডাঙ্গার মদন গাজীর বাড়িতে আজ মহা হুলুস্থুল পড়িয়া গিয়াছে। তাহার ভয়ানক বিপদ উপস্থিত। মহাজন দিগম্বর ঘোষ পেয়াদা এবং বহু লোকজন লইয়া আজ তাহার বসতবাড়িতে বাশগাড়ি করিতে আসিয়াছেন। পাড়ার লোকজনে তাহার বাহিরবাড়ি পরিপূর্ণ, সকলেই। বেচারার ঘোর বিপদে সহানুভূতি ও দুঃখ প্রকাশ করিতেছে। কিন্তু এ বিপদ হইতে মদন গাজী কিসে উদ্ধার পাইতে পারে তাহা কেহই স্থির করিতে পারিতেছে না।

মদনের অবস্থা বেশ ভালোই ছিল। তাহার খামার জমিগুলির মত উর্বরা জমি এ অঞ্চলে আর কাহারো ছিল না। গোলাভরা ধান, গোয়াল-ভরা গরু, ছালল এবং উঠান-ভরা মোরগ-মুরগি লইয়া সে বেশ সুখে-স্বচ্ছন্দে দিনপাত করিত। তাহার জমিতে পাটও জন্মিত এবং তাহা হইতে রাশি রাশি কাঁচা টাকা পাইয়া সে কৃষকমহলে খাতির যথেষ্ট জমাইয়া তুলিয়াছিল। কাজেই জ্যেষ্ঠপুত্র সাদেকের বিবাহের সময় পাঁচজন জ্ঞাতি-কুটুম্ব একত্র হইয়া ধরিয়া বসিল, খুব ধুমধাম করা চাই, দু-চারখানা গ্রামের লোক খাওয়াইতে হইবে, বাজি বাজনা, জারি-কবি, এসবের বন্দোবস্ত করিতে হইবে, নহিলে শুধু মদন গাজীর কেন, পলাশডাঙ্গার শেখেদের কাহারো মান থাকিবে না। শেখেরা তো আর এখন আগেকার মতো মিঞা সাহেবদের গোলামি করে না। মদন গাজীর মতো মাথা–তোলা লোকও মিঞা সাহেবদের মধ্যেই-বা কটা আছে? এবার দেখানো চাই শেখেরাও মিঞাদের মতো ধুমধাম করিতে জানে, ইত্যাদি।

প্রথমটা মদনের এসবে বড় মত ছিল না; কিন্তু পাঁচজনের উৎসাহে সেও নাচিয়া উঠিল। পুত্রের বিবাহে বিস্তর টাকা ব্যয় করিয়া ফেলিল। সুতরাং বেশ রকমের একটা দেনাও তাহাকে ঘাড় পাতিয়া লইতে হইল। আর মদনের মতো সম্পন্ন গৃহস্থকে কেই-বা না বিনা বাক্যব্যয়ে টাকা ধার দিবে। রসুলপুরের দিগম্বর ঘোষ যদিও ভারি কড়া মহাজন–তাহার সুদের হারও যেমন উঁচু আদায়ের বেলাও তেমনি কড়াক্রান্তি পর্যন্ত কোনো দিন রেয়াত করে না। তবু এক্ষেত্রে তিনি পরম আগ্রহের সহিত খামারগুলি রেহেন রাখিয়া কম সুদেই মদনকে টাকা ধার দিয়া তাহাকে মস্ত খাতির করিয়া ফেলিয়াছেন। তাই পাঁচজনে বলিল, ও দেনার জন্য কিছু ভয় নেই মদন। খোদা তোমাকে যেমন দিতে আছেন, তাতে ওই কটা টাকা পরিশোধ কত্তি আর কদ্দিন? মদন আশায় বুক বাঁধিল, পিতাপুত্রে দ্বিগুণ উৎসাহে আবার ক্ষেতের কাজে লাগিয়া গেল।

মদনের খামার জমিগুলির ওপর অনেকেরই লোভ ছিল; কিন্তু এ যাবৎকাল কেহই তাহাতে হাত দিবার সুযোগ পান নাই। এবারে যখন সে হতভাগ্য ঘোষ মহাশয়ের কবলে পতিত হইল, তখন তিনি মনে মনে বেশ একটুখানি প্রীতি অনুভব করিলেন, তাহার পর দুই তিন বৎসর ধরিয়া যখন ক্রমাগত অজন্মা হইতে লাগিল, এবং মদনের দেয় সুদ কিস্তির পর কিস্তি বাকি পড়িয়া চক্রবৃদ্ধিহারে ক্রমাগত বাড়িয়া চলিল, তখন ঘোষ মহাশয় ভাবিলেন, আর যায় কোথায়!

ফলে ঘটিল তাহাই। টাকা আর পরিশোধ হইল না। তিন বৎসরের অজন্মার পর চতুর্থ বৎসরে যখন সুপ্রচুর ফসল জন্মিবার সম্ভাবনা দেখা গেল, তখন মদনের আশা হইল যে, খোদায় করিলে এবার মহাজনের টাকা পরিশোধ করিতে পারিবে। কিন্তু ওদিকে ঘোষ। মহাশয়ের সজাগ দৃষ্টি ফসলের প্রাচুর্যের দিকে পতিত হইয়া তাহাকে একটু ব্যস্ত করিয়া তুলিল–পাছে মদন ঋণ পরিশোধ করিবার সুযোগ পাইয়া বসে, এই ভয়ে তিনি তামাদির অজুহাতে তাড়াতাড়ি নালিশ করিয়া দিলেন। মদন প্রচুর ফসলের সম্ভাবনার কথা বলিয়া সময় প্রার্থনা করিল, কিন্তু সে সময়ে তাহার হাতে নগদ টাকা ছিল না, সহসা কাহারো নিকট ধারও পাওয়া গেল না। কাজেই তদ্বিরের অভাবে বিশেষত ওপক্ষের মুক্তহস্ত তদ্বিরের মুখে সে তাহার ক্ষীণ প্রার্থনা গ্রাহ্য করাইতে পারিল না। মদনের খামার জমিগুলি নিলাম হইয়া গেল, এবং ঘোষ মহাশয় সেগুলি খরিদ করিয়া ফেলিলেন। আর একটু বিশেষ রকম তদ্বিরের ফলে সমস্ত খামার জমিগুলি নিলাম হইয়াও কতক টাকা বাকি রহিয়া গেল। মদন সেই টাকার দরুন আবার বসতবাটী রেহেন দিয়া নূতন খত লিখিয়া দিল এবং সে যাত্রা নিষ্কৃতি পাইল।

কিন্তু খামারগুলি হারাইয়া এক্ষণে তাহার পক্ষে সেই নূতন খতের টাকা পরিশোধ করা আরো অসম্ভব হইয়া পড়িল। এখন তাহার পেট চালানোই দায়; পরিবারের লোক তো কম নয়, –দুবেলা তাহাদের সকলের পেট ভরিয়া আহার জোটে না, পরিবারের পরনে কাপড় এক প্রকার নাই বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। ঘরের জিনিসপত্র একে একে সব গিয়াছে। তবু মদন জোয়ান ছেলেটিকে সঙ্গে লইয়া পাড়ায় জন-মজুরি করিয়া কোনোক্রমে পরিবারগুলিকে অনশন হইতে বাঁচাইয়া রাখিয়াছে–কিন্তু এ যাবৎ একটি পয়সা সুদ দিয়া উঠিতে পারে নাই। ক্রমে অর্ধাশনক্লেশ এবং তাহার ওপর দারুণ ভাবনায় তাহার শরীর একেবারে ভাঙিয়া পড়িয়াছে।

এদিকে কিছুদিন হইতে মদনের বসতবাটীখানির ওপর ঘোষ মহাশয়ের পুত্র শ্রীমান জনার্দন ঘোষের লোলুপ দৃষ্টি পড়িয়া আছে। বাড়িখানি বেশ উচ্চভূমির উপর নির্মিত, এবং তাহার সহিত কয়েক বিঘা বাগানের উপযুক্ত জমিও আছে। স্থানটিও বেশ নির্জন–চারিদিকে যদিও মুসলমান কৃষক বস্তি তথাপি অন্তত যখন সেখানে কোনো ভদ্রলোকের বসতি নাই, তখন স্থানটি একটি সুন্দর বাগানবাড়ির জন্য উপযুক্তরূপ নির্জন বলিয়াই মনে করা যাইতে পারে। পিতার তীক্ষ্ণ দৃষ্টির উপর ঘরে বসিয়া যদৃচ্ছা আমোদ-প্রমোদ করা চলে না; তাই একটি বাগানবাড়ি নির্মাণ করিবার জন্য এইরূপই একটি নির্জন প্রশস্ত স্থানের অভাব জনার্দন বাবু অনেক দিন হইতে বোধ করিয়া আসিতেছেন। এক্ষণে পলাশডাঙ্গা এবং রসুলপুরের মধ্যে একটা নদীর ব্যবধান থাকায়, এই গ্রামটিই বাগানবাড়ি নির্মাণের উপযুক্ত বলিয়া তিনি স্থির করিয়াছেন। মদনের বাড়িখানিও ঠিক নদীর উপরেই; সুতরাং গোপন বিহারের জন্য এরূপ নিরাপদ স্থান আর কোথায় পাওয়া যাইবে? সুতরাং মদনের নামে নালিশ করিয়া উহার। বাড়িখানির দখল লইবার জন্য তিনি কিছুকাল যাবৎ পিতাকে বারবার তাগাদা করিতেছেন। আর ঘোশ মহাশয়ই-বা কতকাল খতখানি ফেলিয়া রাখিবেন? সুতরাং আবার নালিশ হইল। ঘোষ মহাশয় দস্তুরমাফিক ডিক্রি পাইলেন।

এক্ষণে সেই ডিক্রির বাবদে ঘোষ মহাশয় বহু লোকজনসহ মদনের ভিটাবাড়িতে বাঁশগাড়ি করিতে আসিয়াছেন।

মদন আসিয়া ঘোষ মহাশয়ের পায়ের উপর আছাড় খাইয়া পড়িল এবং কহিতে লাগিল, দোহাই বাবু, আমারে এক্কেবারে পথে দাঁড়া করাবেন না বাবু, আপনার পায়ে পড়ি বাবু…

ঘোষ মহাশয় পা টানিয়া কহিলেন, তা আমি কী করব বাপু; তুই টাকাটা এদ্দিন ফেলে রাখলি, যদি কিছু কিছু করে দিয়ে আসৃতিস, তোরও গায়ে লাগত না, আমারও খত তামাদি হত না। খত ফেলে রেখে তো আর আমি টাকাটা খোওয়াতে পারিনে।

মদন কাদিতে কঁদিতে কহিল, বললে বিশ্বাস করবেন না বাবু, আমি দুবেলা দুমুঠো ভাতই জোটাতে পারিনে, পরিবারের পরনে কাপড় দিতে পারিনে, কতে আপনার টাকা দেব…

দিগম্বর ঘোষ ক্রুদ্ধ হইয়া কহিলেন, হা, ওসব মায়াকান্না রেখে দে! কেন, তোর জোয়ান ব্যাটা রয়েছে, দুই বাপ-পোয়ে তো জন খেটে পয়সা রোজগার করিস–আবার বলে কিনা (মুখ ভ্যাংচাইয়া) দুমুঠো ভাত জোটাতে পারিনে পরিবারের কাপড় দিতে পারিনে!…

মদন কহিল, হায়, হায়, বাবু দ্যাহেন তো বুড়ো হয়ে গিছি, তাতে আজ বছরখানেতে হাঁপানি ব্যারামে এক্কালে কাবু হয়ে পড়িছি–কাজ কত্তি আর পারি নে। একলা ওই ছাওয়ালডা খাটে খাটে আর কত রোজগার কত্তি পারে বাবু? খানেআলা তো এট্টা দুডো না, কেমন করে যে সবগুলোর জান্টা বেঁচে আছে, তা আল্লাই জানে…

নে নে, এখন ওসব প্যান্প্যানানি রাখ। আমার টাকা তো আদায় করতে হবে…।

একান্ত প্রাণের দায়ে মরিয়া হইয়া মদন কহিল, তবে আর কয়ডা দিন রেহাই দেন। কত্তা, আমি এবার না খায়ে, না দায়ে আপনার টাকা কিছু কিছু করে দেব…

ঘোষ মহাশয় অবজ্ঞাভরে কহিলেন, হাঃ, তুই এতদিন বড় দিতে পাল্লি, এখন আবার দিবি! শুধু কথায় কি আর চিড়ে ভিজে রে, মদন!

তবে আমার কী উপায় হবে বাবু–কনে গে দাঁড়াব সব কাচ্চা বাচ্চা নে!

তা আমি কী জানি! তোর যেখানে খুশি সেইখানে যা–এখন এ বাড়ি আমার, আমি দখল করেছি।

এই কথায় মদন আর স্থির থাকিতে পারিল না। উচ্চৈঃস্বরে কাঁদিয়া উঠিয়া কহিল, ওগো আপনারা পাঁচজন আছেন, এট্টুখানি দয়া করে ওনারে দুটো কথা কয়ে আমারে বাঁচান। গো, আমারে বাঁচান, এ বাপদাদার ভিটেটুকখানি গেলি আমি কম্নে গে দাঁড়াব–হায় রে আল্লা! আমি কম্নে গে দাঁড়াব!

বিরক্ত হইয়া জনার্দন বাবু পেয়াদাকে ডাকিয়া কহিলেন, –নেও, তোমরা বাঁশটা গেড়ে ফেল! এই ব্যাটারা, চুপ করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? বাজা, ঢোল বাজা!

দমাদম ঢোলে ঘা পড়িতে লাগিল। মদনের মনে হইল, যেন সে ঘা তাহার বুকের ভিতরই পড়িতেছে। সে আবার ডুকরিয়া কাঁদিয়া উঠিল। এদিকে ঘোষ মহাশয় তাহার লোকজন লইয়া তাহার গৃহে প্রবেশ করিতে যাইতেছেন দেখিয়া সে দরজার সম্মুখে আড় হইয়া কহিল, আমার গলায় পা দে দমড়া বার করে ফেলে দেন কত্তা। আমার জানে আর এ সয় না গো, আমার জানে আর সয় না! হায় রে আল্লাহু, আমি কাচ্চা-বাচ্চা বউ ঝি নিয়ে কমে গে দাঁড়াব–ওগো আপনারা দয়া করে আমার হয়ে বাবুকে দুটো কথা কগে! আমার ঝি-বউরে পথে বার করবেন না গো বাবু, এট্টু দয়া করেন বাবু! আমি যে তাগোরে কারো বাড়ি ধান ভানতিও যাতি দেই নি। তাগোর মান-ইজ্জত মারবেন না, হা হা হা!…

পাড়ার একজন মোড়ল এ দৃশ্য আর দেখিতে না পারিয়া দিগম্বর ঘোষের দিকে একটু অগ্রসর হইয়া কহিল, কত্তা বুড়ো মানুষ ডুকরে কাঁদতি লেগেছে, এট্টু দয়া করেন–ওগোরে পথে বের করবেন না…

জনার্দন বাবু রুখিয়া উঠিয়া কহিলেন, ও ব্যাটার কান্নাতেই আমাদের খতের টাকা পরিশোধ হবে নাকি?

মোড়ল মিনতি করিয়া কহিল, না বাবু, আমি সে কথা কই নি। এক্ষণি ওগোরে বাড়ি হতি তাড়াবেন না তাই কই। কিছুদিন সোমায় দিলি ও আপনার এট্টা মাথা গোঁজবার জাগা করে নিতে পারবে…

পাছে বাগানবাড়ির পত্তন করিতে বিলম্ব হইয়া পড়ে, এ ভয়ে জনার্দন বাবু অধীর হইয়া বলিয়া উঠিলেন, না না, ওসব হবে টবে না বাপু। আমরা আজই দখল নেব।

মোড়ল কহিল, তা নেন, কত্তা; কিন্তু ওগোরে দিন কতেক থাতি দেন…

এদিকে মদন দরজার সম্মুখে আড় হইয়া পড়িয়াই আছে। দিগম্বর ঘোষ অতিষ্ঠ হইয়া উঠিয়া কহিলেন, ওঠ, নইলে তোকে ডিঙ্গিয়ে আমরা বাড়ির ভিতর ঢুকব…

এই কথায় আরো একজন প্রতিবেশী দয়াপরবশ হইয়া কহিল, ঘোষ মশাই, দখল তো আপনার হলই, তা এখন বাড়ির মদ্দি গে ওগোরে বেইজ্জত করে আর আপনাগোর লাভ কী হবে? এট্টু থামেন, আমরা মদন গাজীর পরিবারগোরে সরায়ে নে যাই। আপনারা যদি দোরডা এট্টু ছাড়েন, তয় আমরা বাড়ি খালি করি।

পেয়াদা তখন বলিয়া উঠিল, আরে, তোমরা সেই ফাঁকে জিনিসপত্তরগুলোও সরাও আর কি?

মদন উঠিয়া বসিয়া বলিয়া উঠিল, হায় হায় প্যাদাজী, জিনিসপত্তর কি কিছু আছে! কিছু নেই রে আল্লা কিছু নেই! বউডোর এট্টা বদনা ছিল, তাও আজ কদ্দিন হল বেচে খাইচি– ছাওয়ালডার জ্বর হল, কদ্দিন কাজে যাতি পাল্লে না, কচি বউডোরে কাঁদায়ে নিজিরগোর প্যাট্টা ভল্লাম–। বলিতে বলিতে বৃদ্ধের শ্বেত শ্মশ্রুজি বাহিয়া দরবিগলিতধারে অশ্রু গড়াইয়া পড়িতে লাগিল।

এমন সময় বাড়ির ভিতর হইতে স্ত্রীলোকদিগের যুগপৎ ক্রন্দন এবং চিৎকার শোনা গেল। ব্যাপার কী জানিবার জন্য ব্যস্ত হইয়া মদন তাড়াতাড়ি উঠিয়া বাড়ির ভিতর যাইতেছিল, এমন সময় তাহার বৃদ্ধা স্ত্রী দরজার কাছে আসিয়া উচ্চৈঃস্বরে ক্রন্দন করিতে করিতে কহিল, ওগো আল্লা গো, কী হবে গো আমার সাদেক গাঙ্গে ঝাঁপ দেছে গো, –ওরে আমার সোনার যাদু রে– ভিটেমাটি সব গেলে সেই দুঙ্কে আমার যাদু পানিতে ডুব দেছে রে আল্লা! হা হা হা হা…

এদিকে স্ত্রীর মুখে এই কথা শুনিতে শুনিতে হতভাগ্য মদন দড়াম করিয়া আছাড় খাইয়া পড়িল। বাড়ির ভিতরে-বাহিরে একটা শোরগোল পড়িয়া গেল–এক দিক হইতে স্ত্রীলোকেরা অন্য দিক হইতে প্রতিবেশীরা ছুটিয়া দরজার কাছে আসিয়া দেখিল, বৃদ্ধ মদন চৌকাঠের উপর মূৰ্ছিত হইয়া পড়িয়া আছে।

.

০৮.

রসুলপুর গ্রামখানি বেশ বর্ধিষ্ণু। তথায় বহুসংখ্যক উচ্চ শ্রেণীর হিন্দু এবং মুসলমান রইস্ বাস করেন। হিন্দুগণ প্রায় সকলেই সম্পন্ন গৃহস্থ কিন্তু মুসলমান রইসগণের অবস্থা ভালো নহে। তাহাদের অনেকেরই পৈতৃক সম্পত্তি, এমনকি, কাহারো কাহারো বসতবাটীখানি পর্যন্ত রসুলপুরেরই হিন্দু মহাজনদিগের নিকট ঋণদায়ে আবদ্ধ; তথাপি তাহারা সাংসারিক উন্নতির জন্য কোনো প্রকার উদ্যোগ করিবার আবশ্যকতা বোধ করেন না। একমাত্র খোদা ভরসা করিয়াই খোশ মেজাজে বহাল তবিয়তে দিন গুজরান করিয়া থাকেন।

এতদ্ভিন্ন পলাশডাঙ্গা প্রভৃতি নিকটস্থ গ্রামগুলিতে অনেক মুসলমান কৃষক বাস করে। গ্রাম সন্নিহিত বিল এবং ক্ষেত্রগুলি প্রচুর উৎপাদনশীল হইলেও এই সকল হতভাগ্য কৃষকের অবস্থা সচ্ছল নহে। তাহারা যাহা কিছু উপার্জন করে, তাহার অধিকাংশই মহাজনেরা গ্রাস করিয়া বসে; অবশিষ্ট যাহা থাকে, তাহাতে কায়ক্লেশে বৎসরের অর্ধেককাল চালাইয়া বাকি অর্ধেকের খাওয়া-পরার জন্য ইহারা আবার মহাজনের হাতে-পায়ে ধরিতে যায়।

আবদুল্লাহর ফুফা মীর মোহূসেন আলি রসুলপুর গ্রামেরই একজন মধ্যবিত্ত রই। তিনি পৈতৃক সম্পত্তি যাহা পাইয়াছিলেন, তাহা সামান্য হইলেও পাটের করবারে এবং মহাজনিতে বেশ দু পয়সা উপার্জন করিয়া এখানে এ অঞ্চলের মধ্যে একজন ধনী লোক বলিয়া পরিচিত হইয়া উঠিয়াছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, মীর সাহেব গৃহশূন্য এবং নিঃসন্তান। লোকে বলিত স্বামী সুদ খান বলিয়া পীরের মেয়ে মনের দুঃখে সংসার ছাড়িয়া গিয়াছেন এবং সুদের গোনায় আল্লাহতালা মীর সাহেবকে সংসারের সুখ হইতে বঞ্চিত করিয়া রাখিয়াছেন।

কিন্তু মহাজনি কারবারে মীর সাহেব নিজগ্রাম অঞ্চলে বড় একটা সুবিধা করিয়া উঠিতে পারেন নাই। তাহার খাতকের প্রায় সকলেই ভিন্ন গ্রামের এবং তাহাদের অধিকাংশই ব্যবসায়ী মুসলমান। মীর সাহেবের নিকট অনেক কম সুদে টাকা পাইত বলিয়া তাহারা ফি মৌসুমে তাহার নিকট হইতে আবশ্যকমতো টাকা ধার লইত এবং মৌসুমে যথেষ্ট লাভ করিয়া মীর সাহেবের কড়া গণ্ডা বুঝাইয়া দিয়া যাইত।

মধ্যবিত্ত মুসলমান রইস্ যাহাদের একটু আধটু ভূ-সম্পত্তি আছে এবং দরিদ্র মুসলমান কৃষক, গ্রাম্য মহাজনের পক্ষে এই দুই শ্রেণীর লোকের মধ্যে টাকা খাটাইবার যেমন সুবিধা, এমন আর কোথাও নাই। রসুলপুর অঞ্চলে এই শ্রেণীর লোক যথেষ্ট থাকাতে হিন্দু মহাজনেরা বেশ ফাঁপিয়া উঠিতেছেন; কিন্তু তাহার সুদের হার অতি সামান্য হইলেও মীর সাহেব তাহাদের মধ্যে দুইটি কারণে ব্যবসায় জমাইতে পারেন নাই। প্রথমত, রইসগণের প্রায় সকলেই তাহার জ্ঞাতি-কুটুম্ব; সুতরাং তাহার পরম হিতৈষী। কাজেই হিন্দু মহাজনদিগের নিকট হইতে উচ্চ হারের সুদে ঋণ গ্রহণ করিয়া জেরবার হইতেছেন, তথাপি মীর সাহেবকে মহাজনি কারবারে প্রশ্রয় দিয়া তাহাকে জাহান্নামে পাঠাইতে তাহাদের প্রবৃত্তি হইতেছে না। দ্বিতীয়ত, পূর্বপুরুষগণের মনিব বলিয়া কৃষকমহলে রইগণের আজ পর্যন্ত যে প্রভুত্বটুকু টিকিয়া ছিল, তাহারই বলে তাহারা তাহাদিগকে বুঝাইয়া দিয়াছেন যে, মুসলমান হইয়া যে ব্যক্তি সুদ খায়, সে জাহান্নামী এবং সে জাহান্নামীর সঙ্গে মুসলমান হইয়া যে কারবার করে সেও জাহান্নামে যায়। এই জন্যেই তো সুদখোরের বাড়িতে খাওয়া অথবা তাহাকে বাড়িতে দাওৎ করিয়া খাওয়ানো মস্ত গোনার কাজ। কিন্তু হিন্দুদের যখন ধর্মে বাধে না, তখন সুদ খাইলে তাহাদের কোনো পাপ নাই, সুতরাং লাচারী হালেতে তাহাদের সঙ্গে কারবারেও কোনো দোষ হইতে পারে না।

পাঁচজন আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে একত্রে লোক দুর্দশাগ্রস্ত হইয়া পড়ে, এবং সেই অবস্থায়। কয়েক পুরুষ কাটাইয়া দেয়, তখন তাহাদের কেমন একটা দুর্দশার নেশা লাগিয়া যায়– কিছুতেই সে নেশা ছুটিতে চাহে না। ক্রমে মনে এবং দেহে একটা অবসাদ আসিয়া পড়ে, যাহার গতিকে সংসারের দুঃখ-কষ্ট তাহাদের ধাতে বেশ সহিয়া যায়। ইহা অপেক্ষা অধিক। সুখে সংসারে বাস করা সম্ভব যে হইতে পারে, এরূপ কল্পনা তাহাদের মনেও আসে না, কেননা খোদা না দিলে আসিবে কোথা হইতে? এরূপ অবস্থায় খোদার উপর একপ্রকার সম্পূর্ণ নিশ্চেষ্ট নির্ভরের মাত্রা কিছু বেশি হইয়া পড়ে, এবং ইহকালের সচ্ছলতার বিনিময়ে। পরকালে বেহেশতের মেওয়া-জাতের ওপর একচেটিয়া অধিকার পাইবার আশায় ধর্মের বাহ্যিক আচার-নিষ্ঠার বাড়াবাড়িও দেখা গিয়া থাকে।

কিন্তু অপরের সুখস্বচ্ছন্দতার প্রতি বাহ্যত ঔদাসীন্য দেখালেও যে ব্যক্তি অক্ষমতা এবং উদ্যমবিহীনতার দরুন নিজের দুর্দশা ঘুচাইতে পারে না, তাহার আচার-নিষ্ঠার অন্তরালেও অপেক্ষাকৃত অবস্থাপন্ন লোকের প্রতি একটা ঈর্ষার অস্বচ্ছন্দতা তাহার মনের কোণে সঙ্গোপনে। বিরাজ করিতে থাকিবেই, যাহাদের ওপর ব্যক্তিগত অথবা সামাজিকভাবে কোনো প্রকার শাসন-তাড়না চালাইবার সুযোগ বা সম্ভাবনা না থাকে, তাহাদের ওপর সে ঈর্ষা প্রকাশ তো পায়-ই না বরং উহা আবশ্যকমতো নীচ তোষামোদেও পরিণত হইতে পারে; কিন্তু জ্ঞাতি কুটুম্ব প্রভৃতি যাহাদের উপর একটু আধটু ক্ষমতা চলে, তাহাদের মধ্যে যখন কেহ আত্মোন্নতি করিয়া স্বসমাজে সকলের ওপর টেক্কা মারিবার যোগাড় করিয়া তোলে, তখন সেই গুপ্ত ঈর্ষা তাহার সকল প্রচেষ্টাকে নষ্ট করিয়া দিবার জন্য বিকট মূর্তিতে সকলের মনে স্বপ্রকাশ করিয়া বসে। কাজেই যাহারা দল বাধিয়া একবার মজিয়াছে, শত চেষ্টা করিলেও তাহাদের উদ্ধার পাওয়া কঠিন। কয়েকজন লোক জলে ডুবিলে পরস্পর পরস্পরকে জলের ভিতর টানিয়া রাখিতে চেষ্টা করিয়া থাকে।

রসুলপুরের রইগণও কয়েক পুরুষ ধরিয়া দল বাধিয়া ক্রমাগত মজিয়া আসিতেছেন। ইতোমধ্যে হঠাৎ মীর মোহসেন আলি নিজের চেষ্টায় যখন অবস্থা ফিরাইয়া ফেলিলেন, তখন আর কাহারো পক্ষে তাহাকে সুনজরে দেখিবার সম্ভাবনা রহিল না। তিনি সকলের অপ্রিয় হইয়া উঠিলেন–বিশেষত, তিনি যখন সুদ খাইতে আরম্ভ করিলেন তখন সকলে তাহাকে মনে মনে ঘৃণা করিতে লাগিলেন। কিন্তু প্রকাশ্যে কেহ তাহাকে অবজ্ঞা করিতে সাহস পাইতেন না, বরং মৌখিক শিষ্টাচারের একটু বাড়াবাড়িই দেখাইতেন। তাহা হইলেও, সামাজিকভাবে তাহার সহিত মেলামেশা সকলে যথাসম্ভব এড়াইয়া চলিতেন।

এদিকে মীর সাহেবের ন্যায় গৃহশূন্য নিঃসন্তানের পক্ষে তো গ্রামের ওপর অথবা বাড়ির ওপর কোনো মায়ার বন্ধন ছিল না; তাই তিনি বৎসরের অধিকাংশ সময় বিদেশে বিদেশে ঘুরিয়া বেড়াইতেন। ইহাতে তাহার পাটের কারবারেরও সুবিধা হইত এবং বিদেশে লোকের কাছে খাতিরও পাইতেন বেশ। সুতরাং স্বগ্রাম অপেক্ষা বিদেশই তাহার পক্ষে অধিক বাঞ্ছনীয় হইয়া উঠিয়াছিল। মাসেক দু মাস বিদেশে ঘুরিবার পর তিনি বাটী আসিয়া দশ-পনের দিন থাকিতেন, আবার বাহির হইয়া পড়িতেন।

এইরূপে একবার মাস দুই বিদেশ ভ্রমণের পর বাটী আসিয়া মীর সাহেব আবদুল্লাহর একখানি পত্র পাইয়া অবগত হইলেন যে, তাহার সম্বন্ধী খোন্দকার ওলিউল্লাহ্ পরলোকগমন করিয়াছেন। পত্রখানিতে প্রায় এক মাস পূর্বের তারিখ ছিল–মীর সাহেব ভাবিতে লাগিলেন, এতদিন আবদুল্লাহৃদের কোনো খবর না লওয়াটা বড়ই অন্যায় হইয়া গিয়াছে। যদিও আবদুল্লাহর পিতামাতা সুদখোর বলিয়া মীর সাহেবের ওপর নারাজ ছিলেন এবং স্ত্রীর মৃত্যুর পর হইতে মীর সাহেবের সহিত শ্বশুরালয়ের সম্বন্ধ একরূপ উঠিয়া গিয়াছিল, তথাপি তিনি আবদুল্লাহকে অতিশয়। স্নেহ করিতেন এবং কলিকাতায় গেলে একবার তাহার সহিত সাক্ষাৎ না করিয়া ফিরিতেন না। অবশ্য আবদুল্লাহর সহিত তাহার এই ঘনিষ্ঠতার বিষয় তাহার পিতামাতার নিকট হইতে গোপন রাখা হইয়াছিল; এবং যদিও এক্ষণে মীর সাহেবের গায়ে পড়িয়া খয়েরখাহী দেখাইতে যাওয়াটা আবদুল্লাহর মাতা পছন্দ নাও করিতে পারেন, তথাপি আবদুল্লাহর একটা সংবাদ না পাওয়া পর্যন্ত তিনি মন স্থির করিতে পারিতেছেন না। চিঠি তো সে বাড়ি হইতে প্রায় এক মাস পূর্বে লিখিয়াছে; কিন্তু এখন সে কোথায় আছে, তাহা কী করিয়া জানা যায়? এ অবস্থায় একবার পীরগঞ্জেও যাওয়া কর্তব্য কি না মীর সাহেব তাহাই চিন্তা করিতে লাগিলেন।

বৈঠকখানার বারান্দায় বসিয়া তিনি মনে মনে এইরূপ আলোচনা করিতেছেন, এমন সময় দেখিতে পাইলেন, একটা লোক ভিজা কাপড়ে হাঁপাইতে হাঁপাইতে তাহারই দিকে আসিতেছে। একটু কাছে আসিলেই তিনি লোকটিকে চিনিতে পারিলেন এবং তৎক্ষণাৎ কী, কী সাদেক গাজী, খবর কী? বলিতে বলিতে উঠিয়া দাঁড়াইলেন। সাদেক একেবারে ছুটিয়া আসিয়া তাহার পা দুটি জড়াইয়া ধরিল, এবং রুদ্ধ নিশ্বাসে কহিতে লাগিল, দোহাই হুজুর, আমাগোরে রক্ষে করেন…

অত্যন্ত আশ্চর্যান্বিত হইয়া মীর সাহেব তাহাকে হাত ধরিয়া উঠাইতে গেলেন, কিন্তু সে কিছুতেই তাহার পা ছাড়িয়া উঠিতে চাহিল না, কেবলই বলিতে লাগিল–আমাগোরে বাঁচান, হুজুর, আমাগোরে বাঁচান।

আরে কী হয়েছে, তাই বল না! আমার সাধ্যে যা থাকে তা করব বলছি–এখন উঠে স্থির হয়ে বসে কথাটা কী বল তো শুনি!

এই কথায় একটু আশ্বস্ত হইয়া সাদেক পা ছাড়িয়া উঠিয়া মাটির উপর বসিতে বসিতে কহিল, আর কি থির হবার যো আছে, হুজুর! দিগম্বর ঘোষ মশায় আমাগোর সব খায়ে বইছেন, এখন বাড়িখানও কোরক দে আজ আসে বাশগাড়ি করতিছেন। আমাগোর কী উপায় হবে, হুজুর! আমাগোর বাঁচান কর্তা। আপনি না হলি আর কেউ বাঁচাতি পারবে না!…

মীর সাহেব তাহাকে বাধা দিয়া কহিলেন, আরে ছি ছি! অমন কথা বলে না সাদেক, বাঁচানেওয়ালা খোদা!–আচ্ছা, কত টাকার দেনা ছিল?

সাদেক কহিল, খতে ল্যাহা ছিল দুইশো তিন কুড়ি, এখন সুদ আর খরচ-খরচা নে মহাজনের দাবি হইছে পাঁশশয় বাইশ টাকা কয় আনা যেনি!…আপনি যদি এট্টু দয়া না করেন মীর সাহেব, তবে আমরা এবার এক্কাল পথে দাঁড়াই…

মীর সাহেব কহিলেন, আচ্ছা তুমি এগোও, –আমি টাকা নিয়ে আসছি।

না, হুজুর, আমি আপনার সাথেই যাব–গাং সাঁতরে আইছি, তাড়াতাড়ি লা পালাম না, কারে কিছু কই নি, পাছে দেরি হয়ে যায়…।

আচ্ছা আচ্ছা, চল, আমি এক্ষুনি টাকা নিয়ে আসছি। বলিয়া মীর সাহেব অন্দরে চলিয়া গেলেন, এবং একটু পরেই কাপড়চোপড় পরিয়া আবশ্যকমতো টাকা লইয়া বাহিরে আসিলেন।

মীর সাহেবের বাড়ির পশ্চাতে বাগানের পরেই তাঁহাদের ঘাট; ঘাটে একখানি ডিঙ্গি নৌকা বাঁধা ছিল, উভয়ে গিয়া তাহাতে উঠিলেন। সাদেক বৈঠা লইয়া বসিলে মীর সাহেব জিজ্ঞাসা করিলেন, আচ্ছা সাদেক, তোমাদের এমন দশা হয়েছে, তা এদ্দিন আমাকে একবারও বল নি তো!

সাদেক কহিতে লাগিল, কী করব হুজুর, বাপজী আপনার কাছে আসতি সাওস করেন না। ওই বাদশা মিঞাই তো যত নষ্টের গোড়া–তানিই বাপজীরে আপনার কাছে আসতি মানা করেন। তানারা সাত-পুর্ষে মুনিব; বাপজী কন, কেমন করে তানাগোর কথা ঠেলি!…

আমি তো সেই কালেই কইছিলাম বাপজীরে যে, ও ঘোষের পোর কাছে যাবেন না– ওর যে সুদির খাই বাপই রে! তা, বাদশা মিঞা পরামিশ্যে দে বাজীরে সেই ঘোষের পোর কাছেই নে গেল–তা নলি কি আজ আমাগোর ভিটেমাটি উচ্ছন্ন যায় হুজুর!

বলিতে বলিতে ডিঙ্গি আসিয়া ওপাড়ে ভিড়িল। মীর সাহেব চট করিয়া নামিয়া মদন গাজীর বাড়ির দিকে চলিলেন। সাদেক তাড়াতাড়ি নৌকাখানি বাধিয়া রাখিয়া পশ্চাৎ পশ্চাৎ দৌড়াইয়া গেল।

.

০৯.

সেইদিন বৈকালে আসরের নামায বাদ তসবিটি হাতে ঝুলাইতে ঝুলাইতে বাদশা মিঞা প্রতিবেশী জ্ঞাতি লাল মিঞার বাড়িতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তাহার পায়ে এক জোড়া বহু পুরাতন চটি, পরিধানে মার্কিনের থান-কাটা তহবন, গায়ে ঐ কাপড়েরই লম্বা কোর্তা, মাথায় চিকনিয়া চাঁদপাল্লা টুপি তসবির দানাগুলির উপর দ্রুত সঞ্চলনশীল অঙ্গুলিগুলির সহিত ওষ্ঠদ্বয় ঘন কম্পমান।

এইমাত্র লাল মিঞা আসরের নামায পড়িয়া গিয়াছেন–বাদশা মিঞার আগমনে তিনি বাহিরে আসিয়া সালাম-সম্ভাষণ করিলেন, বাদশা মিঞাও যথারীতি প্রতিসম্ভাষণ করিয়া তাহার সহিত বৈঠকখানায় গিয়া উঠিলেন। বৈঠকখানা ঘরটি নিরতিশয় জীর্ণ এবং আসবাবপত্রও তাহার অনুরূপ। বসিবার জন্য একখানি ভগ্নপ্রায় চৌকি—সে এত পুরাতন যে, ধুলাবালি জমিয়া জমিয়া তাহার রং একেবারে কালো হইয়া গিয়াছে। চৌকির উপর একটি শতছিদ্র ময়লা শতরঞ্জি পাতা, তাহার উপর ততোধিক ময়লা দুই-একটা তাকিয়া, উহার এক পার্শ্বে সদ্যব্যবহৃত ক্ষুদ্র জায়নামাজটি কোণ উল্টাইয়া পড়িয়া আছে। মেঝের উপর একটা গুড়গুড়ি, নইচাটিতে এত ন্যাকড়া জড়ানো হইয়াছে যে, তাহার আদিম আবরণের চিহ্নমাত্রও আর দৃষ্টিগোচর হইবার উপায় নাই। গৃহের এক কোণে একটি মেটে কলসি, কোণে একটি বহু টোল-খাওয়া নল-বাঁকা কলাইবিহীন বদনা স্বকৃত কর্দমের উপর কাত হইয়া পড়িয়া আছে।

টলটলায়মান চৌকিখানির করুণ আপত্তির দিকে নজর রাখিয়া উভয়ে সাবধানে তাহাতে উঠিয়া বসিলেন। লাল মিঞা কহিলেন, তারপর, ভাই সাহেব, খবর কী?

অঙ্গুলি এবং ওষ্ঠদ্বয়ের যুগপৎ সঞ্চালন বন্ধ করিয়া বাদশা মিঞা কহিলেন, পলাশডাঙ্গার মদন গাজীর খবর শুনেন নি?

না তো। কেন, কী হয়েছে?

মারা গেছে। বলিয়া তিনি আবার পূর্ববৎ অঙ্গুলি এবং ওষ্ঠ ঘন ঘন চালাইতে লাগিলেন।

মারা গেছে! হঠাৎ মারা গেল কিসে?

ওঃ, সে অনেক কথা। ও দিগম্বর ঘোষের অনেক টাকা ধারত কিনা, তাই দিগম্বর এসেছিল বাড়ি ক্রোক কত্তে। সে কিছুতেই দখল দেবে না, তারপর যখন জোর করে ওদের বাড়ি থেকে বার করে দিতে গেল, তখন ওর ছেলেটা গিয়ে পানিতে পল, আর তাই শুনে মদন অজ্ঞান হয়ে ধড়াস করে পড়ে গেল চৌকাঠের ওপর। তারপর মাথা ফেটে রক্তারক্তি আর কি!

তাইতে ম’ল?

হ্যাঁ, সেই যে পল, আর উঠল না…

আহা! বেচারা বুড়ো বয়সে বড় কষ্ট পেয়েই গেল!

সহানুভূতিসূচক ঘাড় নাড়া দিয়া বাদশা মিঞা কহিলেন, সত্যি, বড় কষ্টটাই পেয়েছে! এদানী তার বড়ই টানাটানি পড়েছিল কিনা?

ছেলেটা যে পানিতে পল বলে তার কী হল?

তা তো আর শুনি নি। সেও গেছে বোধহয়…

আহা! একসঙ্গে বাপ-ব্যাটায় গেল! মুসিবত যখন আসে, তখন এমনি করেই আসে।

বাদশা মিঞা অনুমোদনসূচক মস্তক সঞ্চালন করিয়া কহিলেন, তার আর সন্দেহ কি? বলিয়াই আবার তসবি চালাইতে লাগিলেন।

লাল মিঞা আবার জিজ্ঞাসা করিলেন, বাড়ি ক্রোকের কী হল?

বাদশা মিঞা যেন একটু ক্ষুণ্ণ মনেই কহিলেন, আর ক্রোক কত্তে পাল্লে কই! ওদিকে মীর সাহেব যে কোন্ সন্ধানে ছিলেন তা তিনিই জানেন; ঠিক সময়মতো এসে হাজির আর কি?

তা, তিনি এসে কী কল্লেন?

টাকাটা মিটিয়ে দিলেন আর কি!

লাল মিঞা যেন আকাশ হইতে পড়িলেন। চোখ তুলিয়া কহিলেন, হ্যাঁ মীর সাহেব!

বাদশা মিঞা গম্ভীরভাবে কহিলেন, হ্যাঁ। তবে ওর ভেতর অনেক কথা আছে। আবার তাহার ওষ্ঠ ও অঙ্গুলি ক্ষিপ্রগতিতে চলিতে আরম্ভ করিল।

লাল মিঞা ঔৎসুক্যে অধীর হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, কী কথা, ভাই, কী কথা?

কিছুক্ষণ আপন মনে তসবি পড়িয়া বাদশা মিঞা কহিলেন, কথা আর কি! যেত ঘোষেদের ঘরে তার বদলে এল এখন মীরের পোর হাতে। সে ঐ ফিকিরেই দিনরাত ফেরে কিনা।

লাল মিঞা একটুখানি দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিয়া কহিলেন, তাই তো!

বাদশা মিঞার তসবি ঘন ঘন চলিতে লাগিল। একটু পরে তিনি কহিলেন, এর ভেতরে মীরের পোর আরো মতলব আছে…

সাগ্রহে লাল মিঞা জিজ্ঞাসা করিলেন, কী মতলব, ভাই সাহেব?

বাদশা মিঞা স্বর অত্যন্ত নামাইয়া ফিসফিস করিতে করিতে কহিলেন, মদনের ব্যাটার বউকে দেখেছেন?

না।

চাষা হলে কী হয়, দেখতে বেশ!

তাই–কী?

মীরের পোর নজর পড়েছে।

চোখ কপালে তুলিয়া লাল মিঞা কহিলেন, এ্যাঁ, সত্যি নাকি?

কদ্দিন দেখিছি মীরের পো ওপারে গিয়ে সময় নেই অসময় নেই, ঘুরঘুর করে একলাটি ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর দেখুন কত লোকের বাড়ি-ঘর-দোর নিলাম হয়ে যাচ্ছে, ক্রোক হচ্চে, কারুর বেলায় কিছু না, ওই মদন গাজীর জন্যেই ওর এত পুড়ে উঠল–কেন? টাকাটা অমনি দিয়ে ফেলে, একটা খতও নিলে না! হাঃ! মীর সাহেব তেমনি তোক আর কি! আর এখন তো খুব সুবিধেই হয়ে গেল! বাপ-ব্যাটা দুজনেই মরেছে। আসল কথা, আমি যা বললাম– দেখে নেবেন।

লাল মিঞা কহিলেন, মীরের পোর ওদিকেও একটু আছে, তা তো আমি জানতাম না! এই জন্যেই আর বেথা কল্লে না, কেবল পথে পথেই ঘুরে বেড়ায়।

সমর্থন পাইয়া বাদশা মিঞা সোল্লাসে কহিলেন, ঠিক বলেছেন, ভাই! ওইটাই আসল কথা। নইলে একলা মানুষ, এত টাকা রোজগারের ফন্দি কেন? তোর বাপু কে খাবে!

ওর পয়সা কি আর কারুর ভোগে লাগবে? খোদা সে পথ যে আগেই মেরে রেখেছেন! হারামের পয়সা ও হারামেই উড়িয়ে দিয়ে যাবে।

বাদশা মিঞা গম্ভীরভাবে স্বীয় মস্তকটি বারকয়েক আঁকা দিয়া অনুমোদন জ্ঞাপন। করিলেন। কিন্তু তাহার ওষ্ঠদ্বয় ও অঙ্গুলি দ্রুতবেগে তসবি পাঠ করিয়া চলিল।

এমন সময় মসজিদ হইতে মগরেবের আযান শোনা যাইতে লাগিল। উভয়েই নীরবে আযান বাদ মোনাজাত করিলেন এবং তাড়াতাড়ি বৈঠকখানা হইতে বাহির হইয়া মসজিদের দিকে প্রস্থান করিলেন।

নামায অন্তে যখন মুসল্লিগণ মসজিদ হইতে একে একে বাহির হইতে লাগিলেন, তখনো। সন্ধ্যার অন্ধকার ভালো করিয়া ঘনায় নাই। মীর মোহসেন আলিও মসজিদে আসিয়াছিলেন, কিন্তু তিনি একটু বিলম্বে আসিয়া এক প্রান্তে স্থান লইয়াছিলেন, এবং নফল নামায শেষ করিয়া মুদ্রিত নয়নে নীরবে দোয়া দরুদ পাঠ করিতেছিলেন। বাদশা মিঞা বাহিরে আসিবার সময়। অস্পষ্ট আলোকে তাহাকে দেখিতে পাইলেন এবং লাল মিঞার গা টিপিয়া ইশারা করিয়া দেখাইলেন। উভয়ে পরস্পরের দিকে চাহিয়া একটু গূঢ়ার্থসূচক হাস্য করিলেন।

আজকার মদন গাজী সংক্রান্ত ব্যাপারটি সকলের কাছে সালঙ্কারে বর্ণনা করিবার জন্য বাদশা মিঞা উৎসুক হইয়া পড়িয়াছিলেন। তাই বাহিরে আসিয়া দুই-একজনের সম্মুখে। কথাটি উত্থাপন করিবামাত্র কী হয়েছে? কী হয়েছে? বলিতে বলিতে বহু উৎকণ্ঠ শ্রোতা তাহাকে ঘিরিয়া দাঁড়াইল। বাদশা মিঞা তাহার ইতিহাস অর্ধেক চোখের ভঙ্গিতে এবং অর্ধেক নিম্ন স্বরে বলিয়া যাইতে লাগিলেন। এদিকে মীর সাহেব মসজিদ হইতে বাহির হইয়া যখন তাহাদের সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইয়া সালাম-সম্ভাষণ করিলেন, তখন সকলে প্রতিসম্ভাষণ। করিয়া, কবে আসিলেন? কেমন আছেন? ইত্যাদি কুশল প্রশ্ন করিলেন; মীর সাহেবও স্মিতমুখে সকলের কুশল জিজ্ঞাসা করিয়া গৃহাভিমুখে গমন করিলেন।

বাটী আসিয়া মীর সাহেব দেখিলেন যে, তাহার বৈঠকখানার বারান্দায় কে একটা লোক বসিয়া আছে। সিঁড়িতে উঠিতে উঠিতে তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, কে হে, অন্ধকারে বসে?

লোকটি কহিল, আমি আলতাফ।

ওঃ, তুমি এসেছ! বেশ, বেশ, বেশ। আমি আরো ভাবছিলাম, তোমাকে ডেকে পাঠাব। ঘরে এস–ওঃ, ঘর যে অন্ধকার, –এই উলফৎ উলফৎ!

উলফৎ নামক তাহার বিহার-নিবাসী ভৃত্যটি অন্য ঘরে বসিয়া বসিয়া তামাক টানিতেছিল। মনিবের ডাকে সে তাড়াতাড়ি হুঁকা রাখিয়া গালভর ধোয়া ছাড়িতে ছাড়িতে ভারী আওয়াজে উত্তর দিল, আওতা হায়, হাজুর।

মীর সাহেব একটু বিরক্ত হইয়া কহিলেন, আরে আওতা কেয়া রে। বাত্তি লাও না! শাম হো গ্যায়া আভতক বাত্তি নেহি দিয়া ঘর মে?।

উলফৎ বাহিরে আসিয়া কহিল, উ কা হায় মেজ পর! তাহার পর ঘর অন্ধকার দেখিয়া অপ্রস্তুত হইয়া বলিয়া উঠিল, আরে বুত গইল! হম্‌ তো হারকেল জ্বালকে মে হী পর ধর দিয়া রাহা।

মীর সাহেব একটু হাসিয়া কহিলেন, হ, হাঁ, বুত তো গইল, আভ ফের জ্বালা দেই তো আচ্ছা ভইল।

মনিব তাহার ভাষা লইয়া মধ্যে মধ্যে এইরূপ পরিহাস করিতেন, তাহাতে উফৎ শুধু একটু হাসিত, কখনো বেজার হইত না। সেও একটুখানি হাসিয়া কহিল, আবহী জ্বালা দেতা হাজুর।

আলো জ্বালা হইলে মীর সাহেব আলতাফকে সঙ্গে লইয়া ভিতরে গিয়া বসিলেন এবং জিজ্ঞাসা করিলেন, তোমাদের কলেজ খোলে নি?

আলতাফ কহিলেন, জি না, এই সোমবারে খুলবে। মীর সাহেব কহিলেন, তবু ভালো! আমার এবার বাড়ি ফিরতে দেরি হয়ে গেল, তাই ভাবছিলাম বুঝি এদ্দিন কলেজ খুলে গেছে। যা হোক বেশি দেরিও তো আর নেই। আজ হল গিয়ে বিষবার, মধ্যে আর তিন দিন আছে। কবে রওয়ানা হবে?

আমার তো ইচ্ছে কাল বাদজুমা রওয়ানা হই; কিন্তু বাপজানের যে মত হয় না।

কেন?

তিনি আমাকে তো আর পড়তেই দিতে চান না। বলেন, এনট্রেন্স পাস করেছিস ঐ ঢের হয়েছে, এখন একটা দারোগাগিরি-টিরির চেষ্টা দেখ।

তা তুমি কী ঠিক করেছ?

আমার তো ইচ্ছে এফ.এ টা পাস করি। এঞ্জামিনের তো আর বেশি দেরি নেই, এই কটা মাস…

মীর সাহেব বাধা দিয়া কহিলেন, এফ.এ টা যদি পাস কত্তে পার তবে কী করবে?

আলতাফ একটু আমতা আমতা করিয়া কহিল, বি. এ. পড়তে পাল্লে তো ভালোই হত, তবে…

তবে আবার কী, তুমি যদি পড়তে চাও, তবে আমি যদ্দিন বেঁচে আছি, তোমাকে যেমন খরচ দিচ্ছি, তেমনই দেব। সেজন্যে কিছু ভেবো না।

বাপজান যে বড় গোলমাল করেন। ঐ তারাপদ বাবুর ছেলে সুরেন দারোগা হয়েছে কিনা, আর উপায়ও কচ্ছে খুব, তাই দেখে তিনি আমাকেও ঐ কাজে ঢুকবার জন্যে কেবলই জেদ কচ্ছেন।

আচ্ছা বাদশা মিঞাকে আমি ভালো করে বুঝিয়ে দেবখন। খরচপত্রের জন্যে তো আর এখন আটকাচ্ছে না, কেন মিছেমিছি পড়া বন্ধ করে ভবিষ্যৎ মাটি করা! আর দারোগগিরি ফারোগিরি ও-সব কাজে যেয়ো না–ওতে গেলে মানুষ একেবারে মাটি হয়ে যায়।

জি না, আমার তো ইচ্ছে না, কেবল বাপজানই জেদ করেন কিনা, তাই বলছিলাম।

আচ্ছা আমি তাঁকে কালই বলব। আমার আবার একটু পীরগঞ্জে যাবার ইচ্ছে ছিল। মনে করেছিলাম, কালই রওয়ানা হব। থাক একটা দিন পরে গেলেও ক্ষেতি হবে না। তা। তুমি এক কাজ কর না কেন, পরশু আমার নৌকাতেই চল তোমাকে বরিহাটীতে নামিয়ে দিয়ে যাব।

আলতাফ তাতেই সম্মত হইয়া কহিল, জি আচ্ছা, পরশু আপনার সঙ্গেই যাব।

মীর সাহেব একটু চিন্তা করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, আহমদ আলি-টালি ওদের কোনো খবর পেয়েছ?

জি না, আহ্মদ আলির কোনো খবর পাই নি, তবে আবদুল বারীর পত্র পেয়েছি। সেও আজ-কাল রওয়ানা হবে।

দু মাস থেকে ওদের কারুর টাকা দেওয়া হয় নি। তা কলকেতায় গেলে পরে পাঠিয়ে দিলে চলবে না?

তা চলতে পারে। কিন্তু আমার পথ-খরচের টাকা নেই–বাপজান বললেন, তাঁর হাত বড় টানাটানি…

ওঃ, আচ্ছা আমি গোটা পাঁচেক টাকা দেব–পরশুই দেব–একসঙ্গেই তো যাওয়া হবে। আর তোমরা কলকেতায় গিয়ে এই হপ্তাখানেকের মধ্যেই টাকা পাবে। ওদেরও বলে দিও।

জি আচ্ছা। তবে এখন উঠি, রাত হল…

আচ্ছা এস।

আলতাফ কিঞ্চিৎ মাথা নোয়াইয়া আদাব করিয়া বিদায় লইল।

.

১০.

প্রাতে ঘুম ভাঙিলে আবদুল্লাহ্ দেখিল খোলা জানালার ভিতর দিয়া ঘরে রৌদ্র আসিয়া পড়িয়াছে। না জানি কত বেলা হইয়া গিয়াছে মনে করিয়া আবদুল্লাহ্ ধড়মড় করিয়া উঠিয়া বসিল; কিন্তু পার্শ্বে সালেহাকে দেখিতে না পাইয়া মনে মনে কহিল, দেখ তো, কী অন্যায়! কখন উঠে গেছে অথচ আমাকে ডেকে দিয়ে গেল না।

প্রতিদিন ভোরে ওঠা যাহাদের অভ্যাস, হঠাৎ একদিন উঠিতে বিলম্ব হইয়া গেলে সে নিজের ওপর তো চটেই পরন্তু যে লোক ইচ্ছা করিলে তাহাকে সময়মতো তুলিয়া দিতে পারিত, অথচ দেয় নাই, তাহারও উপর চটিয়া যায়। তাই, সালেহাকে বেশ একটু বকিয়া দিতে হইবে এইরূপ সঙ্কল্প করিতে করিতে আবদুল্লাহ্ পরদা সরাইয়া খাট হইতে নামিয়া আসিল। সালেহার বাঁদী বেলা রাত্রে সেই ঘরে শুইত; আবদুল্লাহ্ তাহাকে ডাকিতে গিয়া দেখিল, সেও ঘরে নাই! মনে মনে ভারি বিরক্ত হইয়া আবদুল্লাহ্ আপনাআপনি বলিয়া উঠিল, কী মুশকিল, আমি এখন বাইরে যাই কী করে!

একটু ভাবিয়া আবদুল্লাহ্ দরজার নিকট আসিল এবং কপাট দুটি সামান্য একটু ফাঁক করিয়া উঁকি মারিয়া দেখিতে চেষ্টা করিল, কেহ কোথাও আছে কি না। ভালো করিয়া দরজার বাহিরে মুখ বাড়াইতে তাহার সাহসে কুলাইল না; কী জানি যদি এমন কোনো স্ত্রী-পরিজনের। সহিত তাহার চোখাচোখি হইয়া যায়, যিনি তাহাকে দেখা দেন না, তাহা হইলে ভয়ঙ্কর লজ্জার কথা হইবে।

কিন্তু আবদুল্লাহ্ কাহারো সাড়াশব্দ পাইল না। যদিও রৌদ্রে উঠান বেশ ভরিয়া গিয়াছে, তথাপি বাড়িসুদ্ধ সকলকে নিদ্রিত বলিয়াই বোধ হইল। বেলা দেড় প্রহরের পূর্বে ইহাদের শয্যাত্যাগের নিয়ম নাই; তবে যাহারা নিতান্তই ফজরের নামায কাযা করিতে চাহেন না, তাহারা ভোরে একবার শয্যাত্যাগ করেন বটে, কিন্তু নামায পড়িয়াই আবার আর এক কিস্তি নিদ্রা দিয়া থাকেন। সুতরাং এ সময়ে একা একা সটান বাহিরে চলিয়া গেলেও কোনো অদ্রষ্টব্যা পুর-মহিলার সাক্ষাতে পড়িয়া অপ্রস্তুত হইবার সম্ভাবনা নাই। আবদুল্লাহ্ একবার ভাবিল, তাহাই করা যাউক; কিন্তু পরক্ষণেই তাহার খেয়াল হইল, একজন পথপ্রদর্শকের সাহায্য ব্যতিরেকে শ্বশুর-দুর্গের প্রাঙ্গণ অতিক্রম করা জামাতার পক্ষে গুরুতর অশিষ্টতা। কাজেই, বাহিরে যাইবার জরুরি তলব থাকিলেও তাহাকে আপাতত নিশ্চেষ্ট হইয়া শয্যাপ্রান্তে বসিয়া থাকিতে হইল।

একটু পরেই হালিমা দরজার কাছে আসিয়া মৃদুস্বরে জিজ্ঞাসা করিল, ভাইজান, উঠেচেন?

হ্যাঁ, এস হালিমা।

হালিমা ভিতরে আসিয়া কহিল, এই একটু আগেই একবার ডেকে গিইছি, তখন আপনার কোনো সাড়া পাই নি।

আজ উঠতে বড্ড বেলা হয়ে গেছে। তোমার ভাবী কোন্ সকালে উঠে গেছে, তা আমাকে তুলে দিয়ে যায় নি…

অনেক রাত্রে শুয়েছিলেন, তাই বোধহয় তিনি আপনার ঘুম ভাঙান নি…

সে গেল কোথায়?

বোধহয় আমার ঘরে গিয়ে ঘুমুচ্ছেন…

আর আমি এখানে একলা একলা বসে ফ্যা ফ্যা কচ্চি! একটু বাইরে যাব, তা একটা লোক পাচ্ছি নে যে আমাকে নিয়ে যায়…

কেন, বেলা ছুঁড়িটা কোথায় গেল?

কেমন করে বলব কোথায় গেল! ওই যে তার মাদুর পড়ে আছে, কিন্তু তার দেখা নেই!

এ বাটীর দস্তুর এই যে বিবি স্বয়ং উপস্থিত না থাকিলে কোনো বাঁদীকে স্বামীর ঘরে থাকিতে দেওয়া হয় না। এই কথা মনে করিয়া হালিমা কহিল, ওঃ, তাকে তবে ভাবী সাহেবা উঠিয়ে নিয়ে গেছেন। আচ্ছা, আমিই আপনাকে পার করে দিচ্ছি, চলুন। এখনো কেউ ওঠেন নি, খবর দেওয়ার দরকার হবে না।

এই বলিয়া হালিমা ভ্রাতাকে সঙ্গে লইয়া বাহিরে আসিল এবং এদিক-ওদিক চাহিয়া কহিল, যান। আবদুল্লাহ বাহিরে চলিয়া গেল।

বহির্বাটী তখনো নিস্তব্ধ; কেবল খোদা নেওয়াজ কুয়ার নিকটে বসিয়া কর্তার কাটি মাজিতেছিল। আবদুল্লাহ কুয়ার দিকে অগ্রসর হইয়া কহিল, আদাব, ভাই সাহেব!

আবদুল্লাহর অভিবাদনে খোদা নেওয়াজ যেন একটু ব্যস্ত হইয়া উঠিয়া কহিল, আদাব, আদাব! আসুন দুলা মিঞা। পানি তুলে দেব কি?

আবদুল্লাহ্ কহিল, না, না, ভাই সাহেব, আপনি কষ্ট করবেন না, চাকরদের কাউকে ডেকে দিন?

বাঁদী-পুত্র বলিয়া খোদা নেওয়াজকে সকলেই প্রায় বাড়ির চাকরের মতোই দেখিত; কেহ তাহাকে আপনি বলিয়া কথা কহিত না, অথবা ব্যবহারেও কোনো প্রকার সম্ভ্রমের ভাব দেখাইত না। কিন্তু তাহার সহিত আবদুল্লাহর ব্যবহার স্বতন্ত্ররূপ ছিল; বড় সম্বন্ধী বলিয়া তাহাকে যথারীতি সম্মান করিতে ক্রটি করিত না। ইহাতে খোদা নেওয়াজ যেমন একটু সঙ্কোচ বোধ করিত, তেমনই আবদুল্লাহর প্রতি শ্রদ্ধায় তাহার চিত্ত ভরিয়া উঠিত। সে তাড়াতাড়ি হুঁকাটি ধুইতে ধুইতে কহিল, না না, কষ্ট কিসের! আপনার জন্যে একটু পানি তুলে দেব, তাতে আবার কষ্ট!

এই বলিয়া খোদা নেওয়াজ কাটি রাখিয়া পানি উঠাইবার জন্য বালতির দড়ি গুছাইতে লাগিল।

আচ্ছা, আপনি পানি তুলুন, আমি বদনাটা নিয়ে আসি। এই বলিয়া আবদুল্লাহ্ বৈঠকখানার দিকে অগ্রসর হইল। খোদা নেওয়াজ উচ্চৈঃস্বরে বলিয়া উঠিল, না না, দুলা মিঞা আপনি দাঁড়ান, আমিই বদনা এনে দিচ্ছি।

চাকরদিগের ঘরে তখন দুই-এক জন উঠিয়া বসিয়া ধূমপান প্রভৃতির সাহায্যে আলস্য দূর করিতেছিল। খোদা নেওয়াজের কথা শুনিতে পাইয়া তাহারা বাহিরে আসিল, এবং একজন দৌড়িয়া গিয়া বদনা আনিয়া দিল। বদনায় পানি ভরিয়া দিয়া খোদা নেওয়াজ তাহাকে কহিল, যা তো কালু, বদনাটা পায়খানায় দিয়ে আয়।

আরে না, না; নবাবির কাজ নেই–আমিই বদনা নিয়ে যাচ্চি।–এই বলিয়া আবদুল্লাহ্ বদনা লইতে গেল, কিন্তু কালু চট করিয়া বদনাটা তুলিয়া লইয়া পায়খানার দিকে অগ্রসর হইল।

মুখ হাত ধুইয়া আবদুল্লাহ্ খোদা নেওয়াজকে জিজ্ঞাসা করিল, বড় মিঞা সাহেব এখনো ওঠেন নি?

খোদা নেওয়াজ কহিল, বোধ করি এতক্ষণ উঠেছেন; এমনি সময়ই তো ওঠেন।

তিনি থাকেন কোন ঘরে?

খোদা নেওয়াজ একটুখানি হাসিয়া কহিল, তার নতুন মহলে। সেই পাছ-দুয়ারের ঘরখানায় যেখানে মেয়েরা বসে পড়ে…।

ও! আচ্ছা তাঁর কাছে একবার যাই আর আমাদের নতুন ভাবী সাহেবার সঙ্গে আলাপ করে আসি…

যান, কিন্তু সে দেখা দিলে হয়…

কেন, কেন?

সে যে এখন বিবি হয়েছে!…

আবদুল্লাহ্ সকৌতুকে কহিল, বটে নাকি?

দেখতেই পাবেন এখন।

বাটীর পশ্চাৎ দিকের বাগানের ভিতর দিয়া আবদুল্লাহ্ বড় মিঞার মহলে আসিয়া উপস্থিত হইল। ঘরের দরজা খোলাই ছিল। আবদুল মালেক জাগিয়াছে, কিন্তু এখনো শয্যা ত্যাগ করে নাই। পেচোয়ানের অগ্রভাগ হাতে ধরিয়া, মুখনলটি ঠোঁটের উপর রাখিয়া সে আসন্ন ধূমপানের গৌরচন্দ্রিকা ভাজিতেছিল। তাঁহার সদ্য-নিকায়িতা সহধর্মিণী গোলাপী খাটের পার্শ্বে দাঁড়াইয়া কলিকায় ফুঁ দিতেছিল; বারান্দায় কাহার পদশব্দ শুনিয়া ঘাড় ফিরাইতেই আবদুল্লাহর সহিত তাহার চোখাচোখি হইয়া গেল। অমনি পুরা দেড় হাত ঘোমটা টানিয়া তাড়াতাড়ি কলিকাটি হুঁকার মাথায় দিয়া ঘরের কোণে গিয়া পিছন ফিরিয়া দাঁড়াইল।

আবদুল মালেক একটু ব্যস্ত হইয়া, কে? কে? বলিতে বলিতে বিছানায় উঠিয়া বসিল। আবদুল্লাহ্ দরজার কাছে দাঁড়াইয়া জিজ্ঞাসা করিল, আসতে পারি, ভাই সাহেব?

আরে তুমি দুলা মিঞা? তুমি আসবে, তা ধরগে’ তোমার আসতে পারিটারি আবার কেন?

কী জানি, নতুন ভাবী সাহেবা পাছে কিছু মনে করেন–বলিতে বলিতে আবদুল্লাহ্ ঘরের ভিতর উঠিয়া আসিল।

না, না, ও ধরগে’ তোমার কী মনে করবে–বরাবর তো ধরগে’ তোমার দেখা দিয়ে এসেছে…।

এদিকে দরজা খোলসা দেখিয়া গোলাপী এক দৌড়ে পলাইয়া গেল। আবদুল্লাহ কহিল, ঐ দেখুন ভাই সাহেব, যা বলেছিলাম!

আবদুল মালেক এক গাল হাসিয়া কহিল, হেঁ, হেঁ, তা এখন ধরগে’ তোমার একটু লজ্জা করবে বৈকি? তোমার বড় ভাবী যখন তোমাকে দেখা দেন না, তখন ধরগে’ তোমার…।

তা তো বটেই, তা তো বটেই! বলিতে বলিতে আবদুল্লাহ্ শয্যাপ্রান্তে বসিয়া পড়িল। আবদুল মালেক সজোরে তামাক টানিতে লাগিল।

আবদুল্লাহর ইচ্ছা হইতেছিল যে, একবার সেই চিঠিখানার কথা তুলিয়া আবদুল মালেককে একটু ভর্ৎসনা করিয়া দেয়; কিন্তু আবার ভাবিল, তাহাতে কোনো লাভ হইবে না। চিঠি খোলার যে কী দোষ, তাহা তো উহার ন্যায় কুশিক্ষিত কুসংস্কারসম্পন্ন লোককে বুঝানো যাইবেই না, বরং এই কথা লইয়া হয়তো একটা মন কষাকষির সূত্রপাত হইতে পারে। সুতরাং সে কথা মনে মনে চাপিয়া গিয়া আবদুল্লাহ্ জিজ্ঞাসা করিল, কর্তা কি আজকাল বাইরে আসেন?

আবদুল মালেক কহিল, হ্যাঁ, আজ কদিন থেকে আসছেন একবার করে।

কখন?

এই সকালেই। বাইরেই এসে নাশতা করেন। কেন, কোনো কথা আছে নাকি?

আছে কিছু কথা।

ঔৎসুক্যের ঝোঁকে বেশ একটুখানি চঞ্চলতা দেখাইয়া আবদুল মালেক জিজ্ঞাসা করিল, কী কথা, এ্যাঁ? কী কথা?

এমন কিছু না; এই কী করব না-করব তারই পরামর্শের জন্যে।

ওঃ, তারই জন্যে! বলিয়া আবদুল মালেক একটুখানি সোয়াস্তির নিশ্বাস ফেলিয়া আবার সজোরে তামাক টানিতে লাগিল। দুই-চারি টান দিয়াই সে আবার কহিল, তা তোমাদের জাত-ব্যবসায় ধর না কেন?

কথাটির ভিতরে আবদুল্লাহ্ বেশ একটুখানি শ্লেষের ইঙ্গিত অনুভব করিলেও সে মনোভাব চাপিয়া রাখিয়া কহিল, নাঃ, ওটা আমার করবার ইচ্ছে নেই।

তবে কী করবে?

এ প্রসঙ্গ লইয়া আর নাড়াচাড়া করিবার ইচ্ছা আবদুল্লাহর আদৌ ছিল না; তাই সে কহিল, দেখি আমার শ্বশুর সাহেবের কী মত হয়।

আবদুল মালেক একটা  বলিয়া পুনরায় পেচোয়ানে মনোনিবেশ করিল এবং খুব জোরের সহিত টান দিতে লাগিল। অবশেষে একটি সুদীর্ঘ সুখটান দিয়া গাল-ভরা ধোয়া ছাড়িতে ছাড়িতে কহিল, এইবারে উঠি, মুখ-হাত ধুয়ে নিই। কী জানি ধরগে’ তোমার আব্বা যদি বৈঠকখানায় এসে পড়েন, তবে এক্ষুনি নাশতার ডাক পড়বে।

নলটি বিছানার উপরে ফেলিয়া দিয়া আবদুল মালেক নামিয়া পড়িল। আবদুল্লাহ্ও তাহার সঙ্গে উঠিয়া বাহিরে আসিল এবং বৈঠকখানার দিকে চলিয়া গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *