১১-১৫. বৈঠকখানার এক প্রান্তে

বৈঠকখানার এক প্রান্তে তখন এ বাটীর পারিবারিক মক্তব বসিয়া গিয়াছে। একখানি বড় অনতিউচ্চ চৌকির উপর ফরুশ পাতা; তাহারই উপর বসিয়া পূর্বাঞ্চল-নিবাসী বৃদ্ধ মৌলবী সাহেব আরবি, ফারসি এবং উর্দু সবকের রাশিতে ছোট ছোট ছেলেদের মাথা ভরাট করিয়া দিতেছেন। বাটীর ছোট ও মাঝারি পাঁচ-ছয়টি, প্রতিবেশীদিগের মাঝারি ও বড় আট দশটি ছেলে সুরে-বেসুরে সবক ইয়াদ করিতে লাগিয়া গিয়াছে। বাড়ির ছেলেগুলি মৌলবী সাহেবের সহিত একাসনে বসিয়াছে, কিন্তু অপর সকলকে ফশের সম্মুখে মেঝের উপর মাদুর পাতিয়া বসিতে হইয়াছে।

মৌলবী সাহেব প্রত্যহ এখানে বসিয়া এই ক্ষুদ্র মক্তবটি চালাইয়া থাকেন। এতদ্ভিন্ন। তাহাকে বৈকালে আরো একটি ক্ষুদ্র বালিকা-মক্তব চালাইতে হয়। যে ঘরটিতে আবদুল মালেক আজকাল অধিষ্ঠিত হইয়া আছেন, সেটি একটু নিরালা জায়গায় বলিয়া বাড়ির খুব ছোট ছোট মেয়েরা সেইখানে বসিয়া মৌলবী সাহেবের নিকট সবক গ্রহণ করে। এইজন্য বহির্বাটীর অপর কোনো পুরুষের সেখানে গতিবিধি একেবারে নিষিদ্ধ। মৌলবী সাহেব একে বৃদ্ধ, তাহাতে বহুকাল যাবৎ বাটীর লোকের মধ্যেই গণ্য হইয়া উঠিয়াছেন বলিয়া আট বৎসরের অধিক বয়স্কা বালিকাদিগকে সবক দিবার অধিকারটুকু প্রাপ্ত হইয়াছেন। পরম দীনদার লোক বলিয়া সকলেই এমনকি খোদ্ সৈয়দ সাহেব পর্যন্ত তাহার খাতির করেন।

আবদুল্লাহ্ বৈঠকখানায় প্রবেশ করিয়া আসোলামু আলায়কুম বলিয়া মৌলবী সাহেবকে সম্ভাষণ করিল। মৌলবী সাহেব তাড়াতাড়ি উঠিয়া ওয়ালায়কুম সালাম বলিয়া প্রতিসম্ভাষণ করিলেন, সঙ্গে সঙ্গে বালকেরাও দাঁড়াইয়া উঠিয়া সমস্বরে ওস্তাদজীর অনুকরণে অভ্যাগতের সংবর্ধনা করিল। অতঃপর মৌলবী সাহেব আবদুল্লাহর সহিত মোসাফা করিতে করিতে জিজ্ঞাসা করিলেন।

কবে আসলেন দুলহা মিঞা? তবিয়ত বালো তো?

এই কাল সন্ধ্যাবেলায় এসেছি। ভালোই আছি। আপনি কেমন আছেন মৌলবী সাহেব?

বালোই! হলাম আপনার ওয়ালেদ সাহেব এন্তেকাল ফর্মাইছেন?

জি হাঁ।

আচানক? খি বেমারী আসর খছিল তানিরে?

এই জ্বর আর কি?

মৌলবী সাহেব তাঁহার সুদীর্ঘ শ্বেত শ্মশ্রুরাশির মধ্যে অঙ্গুলি চালনা করিতে করিতে গভীর দুঃখ ও সহানুভূতির সুরে কহিলেন, আহা, বরো নেক বান্দা আছিলেন তিনি। আমারে বরো বালা জানাতেন। এ বারি আইলেই আমার লগে এক বেলা বইস্যা আলাপ না কইর‍্যা যাইতেন না!

এদিকে বালকগুলি দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া হাঁ করিয়া ইহাদের আলাপ শুনিতেছিল। হঠাৎ সেদিকে মৌলবী সাহেবের মনোযোগ আকৃষ্ট হওয়ায় তিনি ধমক দিয়া কহিলেন, বহ, বহ্, তরা সবক পর। বইঅ্যান, দুলহা মিঞা, খারাইয়া রইল্যান?

আবদুল্লাহ্ ফরশের উপর উঠিয়া বসিল, মৌলবী সাহেবও তাহার পার্শ্বে বসিলেন। ওদিকে বালকের দল আরবি, ফারসি এবং উর্দুর যুগপৎ আবৃত্তির অদ্ভুত সম্মিলিত কলরবে বৈঠকখানাটি মুখরিত করিয়া তুলিল।

আবদুল্লাহ্ কিছুক্ষণ মনোযোগের সহিত উহাদের পাঠ শ্রবণ করিল। পরে কে কী কেতাব পড়ে, কোন ছেলেটি কেমন, ইত্যাদি বিষয় মৌলবী সাহেবকে জিজ্ঞাসা করিতে লাগিল। বাড়ির ছেলেগুলি বয়সে ছোট হইলেও, অপর ছেলেদের অপেক্ষা অনেক বেশি পড়িয়া ফেলিয়াছে দেখিয়া আবদুল্লাহ্ জিজ্ঞাসা করিল, ও বেচারারা এত পিছনে পড়ে আছে। কেন, মৌলবী সাহেব?

মৌলবী সাহেব নিতান্ত অবজ্ঞাভরে কহিলেন, অঃ, অরা? অরা আর খি খম্‌ ফারে? অরূগো কি জেহেন আছে দুলহা মিঞা সাব! বচ্ছর বচ্ছর খায়দা বোগদাদী আর আম্‌ফারা লইয়া গঁাগোর গ্যাগোর খরুতে আছে। সবক এয়াদই খতাম্ ফারে না…।

আচ্ছা দেখি বলিয়া আবদুল্লাহ উহাদের নিকটে গিয়া দুই একটি বালককে পরীক্ষা করিতে আরম্ভ করিল। দেখিল উহারা যে সবকটুকু পাইয়াছে, সেটুকু মন্দ শিখে নাই। নানারূপ জিজ্ঞাসাবাদ করিয়া আবদুল্লাহ্ বুঝিতে পারিল যে, ইহারা বহুদিন অন্তর নূতন সবক পাইয়া থাকে; তাও যেটুকু পায়, সে অতি সামান্য। এই হতভাগ্য বালকগুলি ওস্তাদজীর চেষ্টাকৃত অবহেলায় মারা যাইতেছে দেখিয়া আবদুল্লাহ্ উঠিয়া আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, ওদের বুঝি রীতিমতো সবক দেন না, মৌলবী সাহেব?

মৌলবী সাহেব চট করিয়া বলিয়া উঠিলেন, দিমু না কিয়েল্লাই? ইয়াদ খরতাম্ ফারে না তো!

আবদুল্লাহ্ প্রতিবাদ করিল, কেন পারবে না, মৌলবী সাহেব, আমি তো যে কয়টাকে দেখলাম, তারা তো কয়েকটা সুরা বেশ শিখেছে!

বৃদ্ধ একটু চঞ্চল হইয়া কহিলেন, হে, যে ইয়াদ খরতাম্ ফারে, হে ফারে! আর হগ্‌গোলে ফারে চীখার ফারবার। আয় তো দেহি কলিমুদ্দীন তর সবক লইয়া।

কলিমুদ্দীন নামক একটি দশ কি এগার বৎসরের বালক আম্পারা ও পান্দেনামা হাতে লইয়া মাদুরাসন হইতে উঠিয়া আসিল। মৌলবী সাহেব তাহাকে আদেশ করিলেন, ক তো দেহি, খয় সুরা ইয়াদ খছস?

বালকটি গড়গড় করিয়া অনেকগুলি সুরা মুখস্থ বলিয়া গেল। পরে আবদুল্লাহর নির্দেশক্রমে পান্দেনামা হইতেও কয়েকটি বয়েত আবৃত্তি করিল। ছেলেটি মেধাবী বলিয়া মৌলবী সাহেব যে তাহাকে ঠেকাইয়া রাখিতে পারেন নাই, তাহা বেশ বুঝা গেল।

আবদুল্লাহ জিজ্ঞাসা করিল, এরা এসবের মানেটানে কিছু বোঝে?

মৌলবী সাহেব দারুণ তাচ্ছিল্যের সহিত কহিলেন, হঃ, মানি বুজবো! হেজেমতনই খরুতে মুণ্ডু গুইর্যা যায়, তা আবার মানি বুজবো! খি বা খন্ দুলহা মিঞা! ইয়ার মইদ্দে আরো খতা আছে দুলহা মিঞা, বোজলেন? খতা আছে! বলিয়া মৌলবী সাহেব গূঢ়ার্থসূচক ভঙ্গিসহকারে মস্তক সঞ্চালন করিলেন।

আবদুল্লাহ্ কৌতূহলী হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, কী কথা, মৌলবী সাহেব?

কলিমুদ্দীন তাহাদের সম্মুখে এতক্ষণ দাঁড়াইয়া ছিল। মৌলবী সাহেব তাহাকে এক ধমক দিয়া কহিলেন, যা-যাঃ–সবক ইয়া কর্‌ গিয়া।…

তাড়া খাইয়া বেচারা গিয়া স্বস্থানে বসিয়া আবার অপরাপর বালকগণের কলরবে যোগদান করিল।

মৌলবী সাহেব আবদুল্লাহর আরো কাছে ঘেঁষিয়া আসিয়া ফিসফিস করিয়া কহিতে লাগিল, খতাড়া খি, বোজুলেননি, দুলহা মিঞা? অরা অইলো গিয়া আাফগোর ফোলাফান, অরা এইসব মিয়াগোরের হমান হমান চলতাম্ ফারে? অবৃগো জিয়াদা সবক দেওয়া মানা আছে, বোজুলেননি?

কার মানা?

খোদ্ সাবের! তিনি আইস্যা দহলিজে বইস্যা বইস্যা হুনেন, খারে খি সবক দি না দি।

এতক্ষণে আবদুল্লাহ্ এই পাঠদান-কৃপণতার মর্ম হৃদয়ঙ্গম করিতে সমর্থ হইল। পাছে প্রতিবেশী সাধারণ লোকের ছেলেরা নিজের ছেলেদের অপেক্ষা বেশি বিদ্যা উপার্জন করিয়া বসে, সেই ভয়ে তাহার শ্বশুর এইরূপ বিধান করিয়াছেন। সে আবার জিজ্ঞাসা করিল, তা ওদের পড়তে আসতে দেন কেন? একেবারেই যদি ওদের না পড়ানো হয়, সেই ভালো নয় কি?

এই কথায় মৌলবী সাহেবের হৃদয়ে করুণা উথলিয়া উঠিল। তিনি কহিলেন, অহহঃ, হেডা কাম বালা অয় না, দুলহা মিঞা! গরিব তাবেলম হিক্রবার চায়, এক্কেকালে নৈরাশ করলে খোদার কাছে কী জবাব দিমু? গোম্রারে এলেম দেওনে বহুত সওয়াব আছে কেতাবে ল্যাহে।

মৌলবী সাহেবের কেতাবের জ্ঞানের বহর এবং তাহার প্রয়োগের প্রণালী দেখিয়া আবদুল্লাহ্ মনে মনে যথেষ্ট কৌতুক অনুভব করিতেছিল, এমন সময় কর্তা সৈয়দ আবদুল কুদ্দস সাহেব ধীরে ধীরে লাঠি ভর করিয়া বৈঠকখানায় প্রবেশ করিলেন।

.

১২.

সৈয়দ সাহেবকে আসিতে দেখিয়া সকলে উঠিয়া দাঁড়াইল। আবদুল্লাহ্ একটুখানি মাথা নোয়াইয়া আদাব করিল, কিন্তু মৌলবী সাহেব পরম সম্ভ্রমে আভূমি অবনত হইয়া তাহাকে আদাব করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, হুজুরের তবিয়ত বালা তো?

সৈয়দ সাহেব উভয়ের আদাব গ্রহণ করিয়া, বৈঠকখানার অপর প্রান্তস্থ প্রশস্ত ফশের উপর উঠিয়া বসিতে বসিতে একটু ক্ষীণস্বরে কহিলেন, হ্যাঁ, একরকম ভালোই, তবে কমজোরীটা যাচ্ছে না…

মৌলবী সাহেব সহানুভূতির ভঙ্গিতে ঘাড় নাড়িয়া কহিলেন, –অহঃ, হুজুর যে বেমারী কাটাইয়া উঠছেন, তাই খোদার কাছে শোকর করন লাগে। খুজুরী অইবই! তা অডা যাইব গিয়া খাইতে লইতে।

সৈয়দ সাহেব জামাতার দিকে চাহিয়া কহিলেন, –এস বাবা, বস।

আবদুল্লাহ্ বড় ফশের উপর উঠিয়া বসিল। মৌলবী সাহেব তাহার ছাত্রদিগের নিকট ফিরিয়া গেলেন, এবং ছাত্রেরা দ্বিগুণ উৎসাহের সহিত দুলিয়া দুলিয়া সবক ইয়াদ করিতে লাগিল।

শ্বশুরকে একাকী পাইয়া আবদুল্লাহ্ তাহার পড়াশুনার কথা বলিবার জন্য উৎসুক হইয়া উঠিল। কী বলিয়া কথাটি তুলিবে, মনে মনে তাহারই আলোচনা করিতেছিল, এমন সময় তাহার শ্বশুর জিজ্ঞাসা করিলেন, –তা, এখন কী করবেটরবে কিছু ঠিক করেছ, বাবা?

শ্বশুর আপনা হইতেই কথাটি পাড়িবার পথ করিয়া দিলেন দেখিয়া সোৎসাহে আবদুল্লাহ্ কহিলেন, জি, এখনো কিছু ঠিক করতে পারি নি; তবে পরীক্ষেটার আর ক মাস মাত্র আছে, এ কটা মাস পড়তে পাল্লে বোধহয় পাস করতে পারতাম…

তা বেশ তো! পড় না হয়…

কিন্তু খরচ চালাব কেমন করে তাই ভাবছি। হুজুর যদি মেহেরবানি করে একটু সাহায্য করেন…

বাধা দিয়া শ্বশুর বলিয়া উঠিলেন, –হেঃ হেঃ আমি! আমি কী সাহায্য করব?

এই কটা মাসের খরচের অভাবে আমার পড়াটা বন্ধ হয়। সামান্যই খরচ, হুজুর যদি চালিয়ে দিতেন, তো আমার বড্ড উপকার হত…।

আমি কোথা থেকে দেব? আমার এখন এমন টানাটানি যে তা বলবার নয়। মসজিদটার জন্য ক বছর ধরে মাথা খুঁড়ে খুঁড়ে যদি-বা শুরু করে দিয়েছিলাম, তা এখনো শেষ করতে পারলাম না। এবারে ব্যারামে পড়ে ভেবেছিলাম, বুঝি খোদা আমার কেসমতে ওটা লেখেন নি! তাড়াতাড়ি আকামত করে নামায শুরু করিয়ে দিলাম; কিন্তু কাজটা শেষ করতে এখনো ঢের টাকা লাগবে। কোথা থেকে কী করব ভেবে ভেবে বেচায়েন হয়ে পড়িছি। এখন এক খোদাই ভরসা বাবা, তিনি যদি জুটিয়ে দেন, তবে মসজিদ শেষ করে যেতে পারব। কিন্তু এখন আমার এমন সাধ্যি নেই যে, তোমাকে সাহায্য করি।

আবদুল্লাহ অত্যন্ত দুঃখের সহিত কহিল, তা হলে আর আমার পড়াশুনা হয় না, দেখছি!

শ্বশুর একটু সান্ত্বনার ও সহানুভূতির সুরে কহিলেন, তা আর কী করবে বাবা, খোদা যার কেসমতে যা মাপান, তার বেশি কি সে পায়? সকল অবস্থাতেই শোকর গোজারী করতে হয়, বাবা! সবই খোদাতালার মরজি! আর তা ছাড়া এতে তো তোমার ভালোই হবে, আমি দেখছি; তোমাকে ইংরেজি পড়তে দিয়ে তোমার বাপ বড়ই ভুল করেছিলেন, এখন বুঝে দেখ বাবা, খোদাতালার ইচ্ছে নয় যে তুমি ওই বেদীনী লোভে পড়ে দীনদারী ভুলে যাও। তাই তোমার ও-পথ বন্ধ করেছেন তিনি। তোমরা যে পীরের গোষ্ঠী, তোমাদের ও-সব চালচলন সইবে কেন, বাবা? ও-সব দুনিয়াদারি খেয়াল ছেড়ে-ছুঁড়ে দিয়ে দীনদারীর দিকে মন দাও, দেখবে খোদা সব দিক থেকে তোমারে ভালো করবেন ।

আবদুল্লাহ্ তাহার শ্বশুরের এই দীর্ঘ বক্তৃতায় অসহিষ্ণু হইয়া উঠিয়াছিল। সে একটু বাধা দিয়া বলিয়া উঠিল, কিন্তু সংসার চালাবার জন্যে তো পয়সা রোজগার করতে হবে…

শ্বশুর বলিলেন, –কেন, তোমার বাপ-দাদারা সংসার চালিয়ে যান নি? তারা যেমন দীনদারী বজায় রেখেও সুখে-স্বচ্ছন্দে সংসার করে গেছেন, তোমরা এলে-বিয়ে পাস করেও তেমন পারবে না। আর লোকের কাছে কত মান সম্ভ্রম…

তারা যে কাজ করে গেছেন, আমার ও কাজে মন যায় না!

শ্বশুর একটু বিরক্তির স্বরে কহিলেন, –ওই তো তোমাদের দোষ। সাধে কি আমি ইংরেজি পড়তে মানা করি? ইংরেজি পড়লে লোকের আর দীনদারীর দিকে কিছুতেই মন যায় না–কেবল খেয়াল দৌড়ায় দুনিয়াদারির দিকে খালি পয়সা, পয়সা। আর তাও বলি, তোমার বাপ খোন্দকারী করেও তো খাসা পয়সা রোজগার করে গেছেন, তোমার পেছনেও কম টাকাটা ওড়ান নি! একটা ভালো কাজে টাকাগুলো খরচ করতেন, তাও না হয় বুঝতাম, নিজের আব্বতের কাজ করে গেলেন। নাহক টাকাটা উড়িয়ে দিলেন, না নিজের কোনো কাজে লাগল, না তোমাদের কোনো উপকার হল! আজ সে টাকাটা যদি রেখেও যেতেন তা হলে তোমাদের আর ভাবনা কী ছিল?

আবদুল্লাহ্ কহিল, –আমাকে লেখাপড়া শেখাবার জন্যে আব্বা যে টাকাটা খরচ করেছেন, অবিশ্যি তাতে তার নিজের আব্বতের কোনো উপকার হয়েছে কি না তা বলতে পারি নে, কিন্তু আমার যে তিনি উপকার করে গেছেন, তাতে কোনো সন্দেহ নাই। যদি পড়া শেষ করতে পারতাম, তা হলে তো কথাই ছিল না; সেইজন্যেই আপনার কাছে কিছু সাহায্য চাইতে এসেছিলাম। তা যাক, এখনো খোদার ফজলে চাকরি করে যা রোজগার করতে পারব, তাতে সংসারের টানাটানিটাও তো অন্তত ঘুচবে। আব্ব তো চিরকাল টানাটানির মধ্যেই কাটিয়ে গেছেন…।

শ্বশুর বাধা দিয়া কহিলেন, –সে তারই দোষ; দু ঘর মুরীদান যাতে বাড়ে, সেদিকে তো তার কোনোই চেষ্টা ছিল না! তুমি বাপু যদি একটু চেষ্টা কর, তবে তোমার দাদা পর-দাদার নামের বরকতে এখনো হাজার ঘর মুরীদান যোগাড় করে নিতে পার। তা হলে আর তোমার ভাবনা কী? নবাবি হালে দিন গুজরান করতে পারবে-ও শত চাকরিতেও তেমনটি হবে না, আমি বলে রাখলাম বাপু!

ইহার উপর আবদুল্লাহর আর কোনো কথা বলিতে ইচ্ছা হইল না; সে চুপ করিয়া ঘাড় নিচু করিয়া বসিয়া রহিল। তাহাকে নীরব দেখিয়া শ্বশুর আবার কহিলেন, –কী বল?

জি না, ও-কাজ আমার দ্বারা হবে না।

সৈয়দ সাহেব একটু রুষ্ট হইয়া কহিলেন, –তোমরা যেসব ইংরেজি কেতাব পড়েছ, তাতে তো আর মুরব্বিদের কথা মানতে শেখায় না। যা খুশি তোমরা কর গিয়ে বাবা, আমরা আর কদিন! ছেলে তো একটা গেছে বিগড়ে, তাকেই যখন পথে আনতে পারলাম না, তখন তুমি তো জামাই, তোমাকে আর কী বলব বাবা!

আবদুল্লাহ্ আর কোনো কথাই কহিল না। এদিকে খোদা নেওয়াজ নাশতা লইয়া আসিল। আবদুল মালেকের ডাক পড়িল। তিনি আসিলে মৌলবী সাহেব তাহার ফরশী ছাত্রগণকে সঙ্গে লইয়া দস্তরখানে বসিয়া গেলেন। অপর ছাত্রেরা মাদুরের উপর বসিয়া গুনগুন করিয়া সবক ইয়াদ করিতে লাগিল বটে; কিন্তু বেচারাদের এক চোখ কেতাবের দিকে থাকিলেও আর এক চোখ অদূরবর্তী দস্তরখানটির দিকে ক্ষণে ক্ষণে নিবদ্ধ হইতে লাগিল।

.

১৩.

নাশতা শেষ হইতে হইতেই একজন চাকর আসিয়া সংবাদ দিল যে, পশ্চিমপাড়ার ভোলানাথ সরকার মহাশয় আরো একজন লোক সঙ্গে করিয়া সৈয়দ সাহেবের সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিয়াছেন। সৈয়দ সাহেব ব্যস্তসমস্ত হইয়া কহিলেন–নিয়ে আয়, নিয়ে আয় ওঁদের!

ভোলানাথ এবং তাহার অনুচরবর্গ বৈঠকখানায় প্রবেশ করিতেই সৈয়দ সাহেব তাহাদের অভ্যর্থনার জন্য অসতে আজ্ঞা হোক, আসতে আজ্ঞা হোক, বলিতে বলিতে সসম্ভ্রমে গাত্রোত্থান করিতে যাইতেছিলেন, কিন্তু ভোলানাথ সরকার কহিলেন, –থাক্ থাক, উঠবেন না, আপনি কাহিল মানুষ–আমরা এই বসছি– বলিয়া তাহার ফরশের এক প্রান্তে উঠিয়া বসিলেন। সৈয়দ সাহেব তাঁহাদের নিকটে সরিয়া বসিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, –তারপর, সরকার মশায়, খবর ভালো তো?

সরকার মহাশয় পরম বিনয়ের সহিত কহিলেন, –হ্যাঁ, আপনার দোয়াতে খবর ভালো। আপনার শরীর-গতিক আজকাল কেমন?

সৈয়দ সাহেব একটু কাতরোক্তির সহিত কহিলেন, আর মশায় এ বয়সে আবার শরীর-গতিক! বেঁচে আছি, সেই ঢের। জ্বরটায় বড় কাহিল করে ফেলেছে…

সরকার মহাশয় কহিলেন, –তাই তো! আপনার চেহারা বড্ড রোগা হয়ে গেছে–তা আপনার বয়েসই বা এমন কী হয়েছে, দু-চার দিনেই সেরে উঠবেন এখন।

সৈয়দ সাহেব বলিলেন, –হ্যাঁ, বয়সে তো আপনি আমার কিছু বড় হবেন; কিন্তু আপনার শরীরটা বেশ আছে–আমি একেবারে ভেঙে পড়েছি…।

ভোলানাথ একটু হাসিয়া কহিলেন, –আমাদের কথা আর কী বলছেন, সৈয়দ সাহেব–খাটুনির শরীর, একটু মজবুত না হলে চলে না যে! আপনাদের সুখের শরীর কিনা, অল্পেই কাহিল হয়ে পড়েন। মনে করবেন ওটা কিছু না, তা হলে দুদিনেই তাজা হয়ে উঠবেন। সরকার মহাশয়ের সঙ্গে একটি যুবকও আসিয়াছিলেন। তাঁহাকে লক্ষ্য করিয়া আবদুল কুদ্দুস জিজ্ঞাসা করিলেন, –এটি কে, সরকার মশায়?

এটি আমার কনিষ্ঠ পুত্র হরনাথ! এম-এ পাস দিয়েছে, এখন আইন পড়ছে, –হরে, সৈয়দ সাহেবকে সেলাম কর বাবা, এরা হচ্ছেন আমাদের মনিব!

হরনাথ মাথা নোয়াইয়া সালাম করিলে সৈয়দ সাহেব কহিলেন–বেঁচে থাক, বাবা! তারপর ভোলানাথের দিকে চাহিয়া পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলেন, –আপনার বড় ছেলেরা সব কোথায়?

তারা সব নিজের নিজের চাকরিস্থানে–বড়টি রাজশাহীতে–মেজটি বাঁকুড়ায়, আর সেজটি আছে কটকে।

বড়টি ডিপুটি হয়েছে, না?

আজ্ঞে না, সে মুনসেফ, মেজটি ডিপুটি হয়েছে আর সেজটি ডাক্তার।

বেশ বেশ, বড় সুখের কথা! আপনাদের উন্নতি দেখলে চোখ জুড়ায়, সরকার মশায়।

এ-সব আপনাদেরই দোয়াতে!

তা ছোটটিকে কি চাকরিতে দেবেন ঠিক করেছেন?

না, ওঁকে চাকরিতে দেব না–আর ওরও ইচ্ছে নয় যে চাকরি করে। আইন পাস করে ওকালতি করবে।

সৈয়দ সাহেব কহিলেন–তা বেশ, বেশ! ওকালতি করবেন উনি সে তো খুব ভালো কথা!–যত সব বাজে লোকের কাছে যেতে হয় মালি-মোকদ্দমা নিয়ে, একজন ঘরের ছেলে উকিল হলে তো আমাদেরও সুবিধে–কী বলেন সরকার মশায়!

সরকার মহাশয় সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়িয়া কহিলেন, –তা তো বটেই, তা তো বটেই–হারু তো আপনাদের ঘরের ছেলের মতোই–ওর বাপ-দাদা তো আপনাদের খেয়েই মানুষ!

সৈয়দ সাহেব হে হে হে করিয়া একটু হাস্য করিলেন। এমন সময় অন্দর হইতে এক তশতরি ছেঁচা পান এবং এক বাটা খিলি আসিল। সৈয়দ সাহেবের কয়েকটি দাঁত পড়িয়া গিয়াছে এবং অবশিষ্টের অনেকগুলিই নোটিশ দিয়াছে; তাই তিনি খিলিগুলি অভ্যাগতগণের দিকে বাড়াইয়া দিয়া চামচে করিয়া হেঁচা পান তুলিয়া তুলিয়া খাইতে লাগিলেন এবং তামাকের হুকুম করিলেন।

ভোলানাথ পান চিবাইতে চিবাইতে কহিলেন, আজ আপনার কাছে একটা দরবার নিয়ে এসেছিলাম, তা যদি মেহেরবানি করে শোনেন তো…

সৈয়দ সাহেব ব্যস্ত হইয়া বলিয়া উঠিলেন, –সে কী! সে কী! আমার কাছে আবার দরবার কী রকম!

দরবার বৈকি! একটা লোক–আমারই একজন আত্মীয়–মারা যায়, এখন আপনার দয়ার উপরই তার জীবন-মরণ!

কথাটা কী সরকার মশায়, খুলেই বলুন না। আমার যা সাধ্য থাকে, তা আমি করব।

ভোলানাথের নায়েব রতিকান্ত বলিয়া উঠিল, –সাধ্যের কথা কী বলছেন হুজুর! আপনার একটা মুখের কথার উপরেই সব নির্ভর করছে।

ভোলানাথ কহিতে লাগিলেন–বলছিলাম ঐ মহেশ বোসের কথা…

আবদুল কুদ্দুস জিজ্ঞাসা করিলেন, –কোন মহেশ বোস?

আপনারই তহসিলদার সে…

ওঃ, তারই কথা বলছেন? কেন কী হয়েছে?

ভোলানাথ দেখিলেন সৈয়দ সাহেব তাহার বিষয়-আশয় সম্বন্ধে বড় একটা খবর রাখেন না। আগেও এ-কথা তিনি জানিতেন, তবে এখন তাহার চাক্ষুষ প্রমাণ পাইয়া ভাবিলেন, তাহার কাজ হাসিল করিতে বড় বেগ পাইতে হইবে না। তিনি কহিলেন, –কথাটা এত সামান্য যে হয়তো সেটা আপনার নজরেই পড়ে নি, –কিন্তু সামান্য হলেও বেচারা গরিবের পক্ষে একেবারে মারা যাওয়ার কথা…

সৈয়দ সাহেবের ঔৎসুক্য চরম মাত্রায় চড়িয়া উঠিল! তিনি একটু অসহিষ্ণু হইয়া কহিলেন, আসল কথাটা কী, তাই বলুন না, সরকার মশায়!

হ্যাঁ হ্যাঁ, তাই বলছি। কথাটা কী, –বেচারার তহবিল থেকে কিছু টাকা খোয়া গেছে…।

খোয়া গেছে? কত টাকা?

বেশি নয়, এই শ’আষ্টেক আন্দাজ হবে…

কেমন করে খোয়া গেল?

তা সে নিজেই বুঝতে পাচ্ছে না, সৈয়দ সাহেব! গেল চোত মাসে হিসেব মিলাবার সময় ওটা ধরা পড়ল–একটা মাস সে অনেক করে উল্টেপাল্টে দেখলে, কিছুতেই টাকাটার মিল হল না;–এখন বেচারা একেবারে পাগলের মতো হয়ে গেছে…

সৈয়দ সাহেব বলিয়া উঠিলেন, –ওরে কে আছিস্, মহেশকে ডাক্ তো।

ভোলানাথ কহিতে লাগিলেন–আপনি দয়া না কলে বেচারার আর কোনোই উপায় নাই। অনেকগুলো পুষ্যি, না খেয়েই মারা যাবে!

আচ্ছা, দেখি!

রতিকান্ত কহিতে লাগিল, –হুজুর একটি মুখের কথা বললেই বেচারা মাফ পেয়ে যায়–ও কটা টাকা তো হুজুরদের নখের ময়লা বৈ তো নয়!

সৈয়দ সাহেব কহিলেন, –আচ্ছা দেখি।

মহেশ গলার চাদরখানি দুইটি হাতে জোড় করিয়া ঘরের ভিতর আসিল এবং আভূমি নত হইয়া সকলকে সালাম করিল। তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ ওসমান আলী নামক সৈয়দ সাহেবের অপর একজন গোমস্তা খাতাপত্র লইয়া প্রবেশ করিল।

সৈয়দ সাহেব ওসমানকে আসিতে দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, –তুমি কী চাও?

ওসমান কহিল, –হুজুর, আমিই মহেশের তহসিলের গরমিলটা ধরেছিলাম কিনা তাই…

সৈয়দ সাহেব ক্রোধভরে কহিলেন, –তোমাকে কে আসতে বল্লে! যাও…

ওসমান বেচারা বে-ওকুফ হইয়া খাতাপত্র রাখিয়া চলিয়া গেল। অতঃপর সৈয়দ সাহেব মহেশকে কহিলেন, –কই দেখি, কোথায় গরমিল হচ্চে?

মহেশ কম্পিতহস্তে হিসাবের খাতা খুলিয়া দেখাইতে লাগিল এবং ক্রন্দনের সুরে কহিতে লাগিল, –হুজুর, কেমন করে এ টাকাটা যে কোথায় গেল তা আমি কিছুই ভেবে ঠিক করতে পাচ্ছি নে–এখন আপনি মাফ না কল্লে একেবারেই মারা পড়ি–বলিয়া সৈয়দ সাহেবের পা ধরিতে গেল।

আরে কর কী, কর কী বলিয়া সৈয়দ সাহেব পা টানিয়া লইলেন এবং কহিলেন, আচ্ছা যাও, ও টাকা আমি তোমাকে মাফ করে দিচ্ছি–আয়েন্দা একটু সাবধানে কাজকর্ম কোরো।

ভোলানাথ কহিলেন, –সে কি আর বলতে! এবার ওর যা শিক্ষা হল–কেবল আপনার দয়াতে পরিত্রাণ পেলে। এতে ওর যথেষ্ট চৈতন্য হবে।

সৈয়দ সাহেব হিসাবের খাতায় মাফ করা গেল লিখিয়া ফারসিতে এক খোঁচায় নিজের নাম দস্তখত করিয়া খাতাটা ছুড়িয়া দিলেন। মহেশ এক সুদীর্ঘ সালাম বাজাইয়া খাতাপত্র লইয়া চলিয়া গেল।

রতিকান্ত কহিতে লাগিল, –হুজুররা বাদশার জাত কিনা, নইলে এমন উঁচু নজর কি যারতার হয়? এঁদের পূর্বপুরুষদের কথা শুনিছি, তাদের কাছে কেউ কোনোদিন আশা করে নিরাশ হয় নি। এই যে একবালপুরে যত তালুকদার টালুকদার আছে, সমস্তই তো এই বংশেরই দান পেয়ে আজ দুমুঠো খাচ্ছে!

ভোলানাথ কহিলেন, –তাতে আর সন্দেহ কী! এ অঞ্চলে এঁরাই তো বুনিয়াদী জমিদার, আর সকলে এঁদেরই খেয়ে মানুষ। যেমন ঘর তেমনি ব্যাভার। ভগবান যারে দ্যান, তার নজরটাও তেমনি উঁচু করে দ্যান কিনা।

এমন সময় এক চাকর আবদুল মালেকের একটি শিশুপুত্র কোলে লইয়া কলিকায় ফুঁ দিতে দিতে বৈঠকখানায় প্রবেশ করিল এবং শিশুটিকে ফর্‌শের উপর নামাইয়া দিয়া কলিকাটি পেচোয়ানের মাথায় বসাইয়া দিল।

সৈয়দ সাহেব কহিলেন, –ওরে, আর একটা কল্কে নিয়ে আয় না। আর বাবুদের হুঁকোটা আলি নে…।

ভোলানাথ কহিলেন, –থাক্, বেলা হয়ে উঠল, আমরা এখন উঠি…

সৈয়দ সাহেব বাধা দিয়া কহিলেন, –না, না, একটু বসুন–ওরে, আর কল্কেয় কাজ নেই; এতেই হবে, কেবল কোটা নিয়ে আয়।

চাকর একটা শুকনা নারিকেলি হুঁকা আনিয়া ভোলানাথের হাতে দিল। সৈয়দ সাহেব স্বহস্তে পেচোয়ানের মাথা হইতে কলিকাটি তুলিয়া তাহাকে দিতে গেলেন।

ভোলানাথ না, না, না, থাক, থাক্ আমি নিচ্ছি বলিয়া একটু অগ্রসর হইয়া কলিকাটি লইলেন এবং ধূমপান করিবার জন্য বাহিরে যাইবার উদ্দেশ্যে ফরশ হইতে নামিয়া পড়িলেন।

সৈয়দ সাহেব কহিলেন, –ওকি, উঠলেন যে! এইখানেই বসে তামাকটা খান না, সরকার মশায়!

সরকার মহাশয় কহিলেন, –না, না, তাও কি হয়! আপনারা হচ্চেন গিয়ে আমাদের মনিব! বলিয়া তিনি বারান্দায় গিয়া শুষ্ক হুঁকায় টান দিতে লাগিলেন।

এদিকে আবদুল মালেকের শিশুপুত্রটি আসিয়া তাহার দাদাজানের ক্রোড় অধিকার করিয়া বসিয়াছে। দাদাজান পান খাইতেছেন দেখিয়া সে আমালে দাদাজান বলিয়া পক্ষী-শাবকের ন্যায় হাঁ করিয়া তাহার মুখের কাছে মুখ লইয়া গেল। পান তখন প্রায় ফুরাইয়াছে–কাজেই দাদাজান আর কী করিবেন, নড়া-নড়া দাঁতগুলির ফাঁকে যাহা কিছু লাগিয়া ছিল, তাহাই জিভ দিয়া টানিয়া টানিয়া খানিকটা লাল থুতুর সহিত মিশাইয়া তাহার মুখে ঢালিয়া দিলেন। ইহা দেখিয়া হরনাথ মুখোনি অত্যন্ত বিকৃত করিয়া ঘাড় ফিরাইয়া রহিল।

তামাক খাওয়া হইলে ভোলানাথ বৈঠকখানায় পুনঃপ্রবেশ করিলেন, এবং কলিকাটি যথাস্থানে প্রত্যর্পণ করিয়া বিদায় লইলেন।

.

১৪.

বৈকালে একটু বেড়াইতে যাইবে মনে করিয়া আবদুল্লাহ্ আবদুল মালেকের সন্ধানে তাহার মহলে গিয়া উপস্থিত হইল। কিন্তু দেখিল সে নাক ডাকাইয়া ঘুমাইতেছে এবং গৃহের অপর পার্শ্বে বৃদ্ধ মৌলবী সাহেব তাহার দুই তিনটি ছাত্রী লইয়া নিম্নস্বরে সবক দিতেছেন। আবদুল্লাহ্ তাহাকে জিজ্ঞাসা করিল, ইনি ওঠেন কখন?

মৌলবী সাহেব কহিলেন, –অঃ, আসরের আগে উঠতাই না–গুমানের বাতে বড় মিঞা সাব এক্কালে সত্ লইছেন বলিয়া তিনি মৃদু হাস্য করিলেন।

অগত্যা আবদুল্লাহ একেলাই বেড়াইতে বাহির হইল। সৈয়দ সাহেবদের বিস্তীর্ণ বাগানটির পশ্চাতেই আবদুল খালেকদের বৃহৎ পুষ্করিণী; তাহার ওপারে তাহাদের পুরাতন মসজিদটি মেরামতের দরুন তক্ত করিতেছে দেখিয়া আবদুল্লাহ্ ভাবিল, যাই, একবার। দেখিয়া আসি।

বাগানের পথটি ধরিয়া, পুষ্করিণীর তীর দিয়া আবদুল্লাহ্ মসজিদের ঘাটে গিয়া উপস্থিত হইল। সিঁড়ির উপর আবদুল খালেকের দশমবর্ষীয় পুত্র আবদুস সামাদ একাগ্রচিত্তে বসিয়া মাছ ধরিতেছিল, কেহ যে আসিয়া তাহার পিছনে দাঁড়াইয়া আছে তাহা সে টের পায় নাই। আবদুল্লাহ্ কহিল, –কিরে, সামু, কটা মাছ পেলি!

হঠাৎ ডাকে সামু ওরফে আবদুস সামাদ চমকিয়া ফিরিয়া চাহিল এবং বাঃ! চাচাজান। কখন এলেন? বলিয়া ছিপ ফেলিয়া উঠিয়া আসিয়া আবদুল্লাহর কদমবুসি (পদচুম্বন) করিল।

এই কাল এসেছি। তোরা ভালো আছিস্ তো?

জি হ্যাঁ–অ্যাঁ! ভালো আছি। বলিয়া সামু ঘাড়টা অনেকখানি কাত করিয়া দিল! আবদুল্লাহ্ তাহার মাথায় হাত রাখিয়া কহিল, –ক্রমেই যে লম্বা হয়ে চলেছি, সামু! গায়ে তো গোশত্ নেই। কেবল রোদে রোদে খেলে বেড়াস্ বুঝি আর মাছ ধরিস্–কেমন, না?

সামু মুখ নিচু করিয়া ঘাড় নাড়িয়া কহিল, –না, –আঃ—

কী মাছ পেয়েছিস দেখি?

বেশি পাই নি, দু-তিনটে বাটা আর একটা ফলুই…

ওঃ, তবে তো বড় পেয়েছিস দেখছি!

পাছে আবদুল্লাহ তাহার ক্ষমতা সম্বন্ধে ভুল ধারণা করিয়া বসেন, এই ভয়ে সামু তাড়াতাড়ি দুই হাতে এক বৃহৎ মৎস্যের আকার দেখাইয়া চোখ পাকাইয়া গম্ভীর আওয়াজে বলিয়া উঠিল, –আর একটা মস্ত মোটা মাছ, বোধ হয় রুই কি কাতলা হবে–আর একটু হলেই তুলেছিলাম আর কি!

তুলতে পাল্লিনে কেন?

সামু ক্ষুণ্ণস্বরে কহিল, –যে জোর কল্লে, কেটে গেল!

আবদুল্লাহ্ কহিল, –ভাগ্যি কেটে গেল, নইলে হয়তো তোকেসুদ্ধ টেনে পানির ভেতর নিয়ে যেত।

সামু আপনাকে যথেষ্ট অপমানিত জ্ঞান করিয়া কহিল, –ইস্, টেনে নিয়ে গেল আর কি! আমি কত বড় মাছ ধরি, ছিপে!

ওঃ, তাই নাকি? তবে তো খুব বাহাদুর হয়ে উঠেছি। স্কুলেটুলে যাস, না খালি মাছ মারিস?

সামু খুব সপ্রতিভভাবে কহিল–বা স্কুলে যাইনে বুঝি? এখন যে বন্ধ।

কোন্ ক্লাসে পড়িস?

গম্ভীরভাবে সামু কহিল,  সিকসথ ক্লাস, দি পশ্চিমপাড়া শিবনাথ ইনস্টিটিউশন!

এই সাড়ম্বর নামোল্লেখ শুনিয়া আবদুল্লাহ্ মনে মনে একটু হাসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, তোদের স্কুল খুলবে কবে?

ওঃ, সে ঢের দেরি। সামনের সোমবারের পরের সোমবার।

এ ছুটির মধ্যে পড়াশুনা কিছু করিছিস?

বাঃ, করি নি বুঝি? রোজ সক্কালে উঠে পড়া করি। আজ দাদাজান আমার একজামিন নিলেন।

দাদাজান? কোন দাদাজান?

রসুলপুরের দাদাজান! আবার কে?

ও তিনি এসেছেন?

হ্যাঁ, আজ সক্কালে, আমি যখন পড়া কচ্ছিলাম, সেই তখন।

বাড়িতে আছেন?

নাঃ–আব্বার সঙ্গে তিনি ক্ষেতে গেছেন।

কোথায় ক্ষেত?

উ-ই যে ওদিকে–বলিয়া সামু আঙুল দিয়া বাড়ির পশ্চাৎদিক দেখাইয়া দিল। আবদুল্লাহ্ সেই দিকে প্রস্থান করিল এবং সামু পুনরায় তাহার বড়শিটোপে মন দিল।

ক্ষেতের কাছে গিয়া আবদুল্লাহ্ দেখিতে পাইল, জন দুই কৃষাণ জমি পাইট করিতেছে এবং তাহার এক পার্শ্বে দাঁড়াইয়া মীর সাহেব ও আবদুল খালেক তাহাদের কাজ দেখিতেছেন। দূর হইতে আবদুল্লাহকে দেখিতে পাইয়া তাহারা উভয়ে উচ্চৈঃস্বরে বলিয়া উঠিলেন, বাঃ আবদুল্লাহ্ যে!

মীর সাহেব কহিলেন, আমি তোমাদের ওখানেই চলেছি। তা এখানে কবে এলে?

আবদুল্লাহ্ উভয়ের কদমবুসি করিয়া কহিল, কাল সন্ধেবেলা এসেছি।

ভালো তো সব?

হ্যাঁ, এক রকম ভালোই–আপনি পীরগঞ্জে যাবেন বলছিলেন…

হ্যাঁ, বাবা, তোমার চিঠি পেলাম তরশু দিন বাড়ি এসে–প্রায় মাসেক কাল আগের চিঠি, মনে করলাম একবার খবরটা নিয়ে আসি। তা ভালোই হল, তোমার সঙ্গে এইখানেই দেখা হয়ে গেল। এখন খবর কী, বল।

আবদুল্লাহ্ কহিল খবর আর কী, পড়াশুনোর আর কোনো সুবিধে করে উঠতে পাচ্ছিনে, ফুফাজান।

কেন, খরচপত্রের অভাবে?

জি হ্যাঁ।

তোমার শ্বশুরকে বলে দেখেছ?

তাই বলতেই তো আম্মা আমাকে ঠেলেঠুলে পাঠিয়ে দিলেন; কিন্তু যা ভেবেছিলাম তাই– তিনি কোনো সাহায্য কত্তে পারবেন না।

মীর সাহেব জিজ্ঞাসা করিলেন, কেন পারবেন না, তা কিছু বললেন কি?

বললেন যে মসজিদটায় তার অনেক খরচ পড়ে যাচ্ছে, এ সময় হাত বড় টানাটানি কিন্তু এ-দিকে আর এক ব্যাপার দেখলাম।

কী?

শুনবেন? তবে আসুন এই গাছতলায় বসি–বসে বসে সব বলছি, সে বড় মজার কথা।

তিন জনে আমগাছের ছায়ায় ঘাসের উপর বসিয়া পড়িলেন। আবদুল্লাহ্ কহিল– পশ্চিমপাড়ার ভোলানাথবাবু এসেছিলেন একটা সুপারিশ কত্তে।

আবদুল খালেক কহিল, ওঃ বুঝেছি! মহেশ বোসের জন্যে তো?

হ্যাঁ তারই জন্যে–আপনি তা হলে জানেন সব?

কতক কতক জানি–ওসমানের মুখে শুনেছি। দেখুন মামুজান, আমার খালুজানের কাণ্ড, কোনো দিনও হিসেবপত্র দেখেন না, গোমস্তারা যা খুশি তাই করে। মহেশ বোস যে কতকাল থেকে টাকা লুটছে, তার ঠিক নেই। এবার ওসমান ধরেছে, গেল বছরের হিসেবে আট শ টাকারও ওপর তসরুফ হয়ে গেছে। এইবার মহেশটা জব্দ হবে।

মীর সাহেব কহিলেন, সে তার কাজ গুছিয়ে নিয়েছে, এখন তাকে আর কী জব্দ করবেন? না হয় টাকাটা ঘর থেকে আবার বার করে দেবে, এই তো? তা সে কত টাকাই তো নিচ্ছে, না হয় এ টাকাটা ফসকেই গেল।

আবদুল্লাহ কহিল, না, না, ফুফাজান, তাও ফসকায় নি। সে ব্যাটা গিয়ে ধরছে ভোলানাথবাবুকে, তিনি এসে একটু আমড়াগাছি কত্তেই আর কি! কর্তা অমনি খসখস করে লিখে দিলেন– মাফ!

আবদুল খালেক অতিশয় আশ্চর্যান্বিত হইয়া কহিল, –মাফ করে দিলেন, –সব?

আবদুল্লাহ্ কহিল, সব।

এই কথায় আবদুল খালেক ক্রোধ ও ঘৃণায় উত্তেজিত হইয়া উঠিল। যদিও তাহারা সৈয়দ আবদুল কুদ্দুসদিগের শরিক, তথাপি অবস্থা অত্যন্ত খারাপ হইয়া পড়ায় তাহাকে অনন্যোপায় হইয়া সৈয়দ সাহেবের সেরেস্তায় কয়েক বৎসর গোমস্তাগিরি করিতে হইয়াছিল। ঘটনাক্রমে এক সময়ে তাহার তহবিল হইতে আশিটি টাকা চুরি যায়; সৈয়দ সাহেব ওই টাকা উহার বেতন হইতে কাটিয়া লইবার আদেশ দেন। সেই কথা মনে করিয়া আবদুল খালেক চিৎকার করিয়া বলিয়া উঠিল, দেখুন তো মামুজান, এঁদের কী অবিচার! আমার বেলায় সিকি পয়সা ছাড়লেন না, আর এ ব্যাটাকে একেবারে আট আট শ টাকা মাফ। করে দিলেন।

মীর সাহেব কহিলেন, আস্তে কথা, আস্তে! এইটুকুতেই কি অতটা চটলে চলে! এই রকমই তো আমাদের সমাজে ঘটে আসছে, নইলে কি আর আমাদের এমন দুর্দশা হয়? তোমাকে মাফ কল্লে তো লোকের কাছে ওঁর মান বাড়ত না, শুধু শুধু টাকাগুলোই বরবাদ যেত। আর এক্ষেত্রে দেখ দেখি, বাবা, হিন্দু সমাজে ওঁর কেমন নাম চেতে গেল!

আবদুল্লাহ্ কহিল, সে কথা ঠিক, ফুফাজান। সেইখানেই বসে বসেই নবাব বংশটংশ বলে ওঁকে খুব তারিফ করে গেল। যে ভোলানাথ বাবু ইচ্ছে কল্লে ওঁকে এক হাটে সাত বার বেচাকেনা কত্তে পারে, সে-ই বলতে লাগল, আমরা তো আপনাদেরই খেয়ে মানুষ! আর। উনি তাই সব শুনে এক্কেবারে গলে গেলেন!

মীর সাহেব কহিলেন, সে তো ঠিকই বলেছে! ওঁদের খেয়েই তো মানুষ ওরা।

কী রকম? ওরা যে মস্ত টাকাওয়ালা লোক!

মস্ত টাকাওয়ালা আজকাল হয়েছে; আগে ছিল না; সেসব কথা বোঝাতে গেলে অনেক কিছু বলতে হয়। আবদুল খালেক–-বোধ হয় জান কিছু কিছু…

আবদুল খালেক কহিল, শুনেছি কিছু কিছু, কিন্তু সব কথা ভালো করে জানি নে।

আবদুল্লাহ্ সাগ্রহে কহিল, বলুন না, ফুফাজান, শুনি।

মীর সাহেব আবদুল্লাহকে লক্ষ্য করিয়া কহিতে লাগিলেন, ভোলানাথের বাপ শিবনাথ তোমার পর-দাদাশ্বশুরের নায়েব ছিল। তিনি যখন মারা যান, তখন তোমার দাদাশ্বশুর সৈয়দ আবদুস সাত্তার ছিলেন ছেলেমানুষ, এই ষোল-আঠার বছর বয়েস হবে, আর আবদুল খালেকের দাদা মাহতাবউদ্দীন তো নিতান্ত শিশু-তারও বাপ কিছু আগেই মারা। গিয়েছিলেন। এরা দুই জন মামাতো-ফুফাতো ভাই ছিলেন, তা বোধহয় জান। এখন। শিবনাথ দেখলে যে দুই শরিকের দুই কর্তাই নাবালক; কাজেই সে পাকেচক্রে একটাকে দিয়ে আর একটার ঘাড় ভাঙতে আরম্ভ কল্লে। এর ভেতরে আরো একটু কথা ছিল। সেটুকু খুলে বলতে হয়।

এঁদের সকলের পূর্বপুরুষ ছিলেন সৈয়দ আবদুল হাদি। তার বিস্তর লাখেরাজ সম্পত্তি ছিল–আজ তার দাম লাখো টাকার উপর। তা ছাড়া ছোট বড় অনেক তালুকটালুকও ছিল। যাক সে কথা–সৈয়দ আবদুল হাদির কেবল দুই মেয়ে ছিল, ছেলে ছিল না। তাদের বিয়ে দিয়ে তিনি দুটো ঘরজামাই পুষলেন। এই দুই পক্ষই হল গিয়ে দুই শরিক… বড়টির অংশে হলেন গিয়ে তোমার শ্বশুর, আর ছোটটির হল আবদুল খালেক।

আবদুল্লাহ্ জিজ্ঞাসা করিল, তবে এক শরিক সৈয়দ হলেন আর এক শরিক হলেন না কেন?

মীর সাহেব হাসিয়া কহিলেন, ঠিক ধরেছ বাবা! মা সৈয়দের মেয়ে হলে ছেলে সৈয়দ সচরাচর হয় না বটে, কিন্তু কেউ কেউ সেক্ষেত্রে সৈয়দ কওলান, কেউ কেউ কওলান না। আবদুল খালেকদের পূর্বপুরুষেরা বোধহয় একটু sensible ছিলেন, তাই তারা সৈয়দ কওলাতেন না।

যা হোক, এখন সৈয়দ আবদুল হাদি তার বিষয়-সম্পত্তি সমস্ত সমান দুই ভাগ করে দুই মেয়েকে বুঝিয়ে দিয়ে গেলেন। তিনি গত হলে মেয়েরা ভিন্ন হলেন–অবিশ্যি বাপের সেই রকমই হুকুম ছিল, –তা সত্ত্বেও দু বোনের মধ্যে ভারি ভাব ছিল। বড়টি পৈতৃক বসতবাটী, পুকুর, বাগান, মসজিদ, সমস্ত ছোট বোনকে দিয়ে নিজে একটু সরে গিয়ে নতুন বাড়ি করে রইলেন।

এদিকে ছোট বোনের একটিমাত্র ছেলে, তার বিয়ে হল খালাতো বোনের সঙ্গে। খালার ছেলে মাত্র একটি, তোমার পর-দাদাশ্বশুর তিনি। শিবনাথ ছিল তাঁরই নায়েব। দুই শরিকেরই নায়েব বলতে হবে, শুধু তার কেন–কেননা ও-শরিকের বিষয় দেখাশুনার ভার ছিল তোমার পর-দাদাশ্বশুরের ওপর। তিনি খুব কাজের লোক ছিলেন–তার আমলে শিবনাথ কোনো দিকে হাত চালাতে পারে নি। যা হোক, তিনি আর তার ভগ্নীপতি প্রায় এক সময়েই মারা গেলেন–রইলেন ও-ঘরে তোমার দাদাশ্বশুর, আর এ-ঘরে আবদুল খালেকের দাদা–দুই মামাতো-ফুফাতো ভাই।

আগেই বলেছি আবদুল খালেকের দাদা তখন নিতান্ত শিশু। তার বিষয় আশয় দেখাশুনার ভার তোমার দাদাশ্বশুরকেই নিতে হল। তিনিও একরকম ছেলেমানুষ, কাজেই শিবনাথের উপর ষোল আনা নির্ভর। আর তিনি বাপের আমলের নায়েব বলে শিবনাথকে মানতেনও খুব–আর ওদিকে বুদ্ধিসুদ্ধিও খোদার ফজলে ছিল একটু মোটা, তাই সে যা বলত তাই শুনতেন, যা বোঝাত তাই বুঝতেন। এখন এঁদের সম্পত্তি খানিকটা এর ফুফুর সঙ্গে ও-ঘরে গিয়ে পড়াতে ওরা সম্পর্কে ছোট শরিক হয়েও কাজে বড় শরিক হয়ে দাঁড়িয়েছে, এইটেই শিবনাথ বেশ ভালো করে আবদুস সাত্তারকে বুঝিয়ে দিলে। আর ওদের একটু খাটো করবার উপায়ও বাতলে দিলে, মাহতাবউদ্দীনের বড় দুই বোন আছে, তার অন্তত একটাকে বিয়ে করা আর যদ্দিন মাহতাব ছোট আছে, তদ্দিনের মধ্যে ওদের দু-চারটে মহালের খাজনা সেস্-টেস সব বাকি ফেলে ফেলে সেগুলো নিলেম করিয়ে বেনামীতে খরিদ করা। তোমাকে বলে রাখি আবদুল্লাহ্, হয়তো তুমি জানও, মাহতাবউদ্দীনের আর এক বোনকে তোমার দাদা নজিবউল্লাহ বিয়ে করেছিলেন।

আবদুল্লাহ্ কহিল, জি–হাঁ, তা জানি।

মীর সাহেব কহিতে লাগিলেন, কিন্তু তিনি একদম ফাঁকিতে পড়েছিলেন, বিষয়ের ভাগ এক কানাকড়িও পান নি। যা হোক, সৈয়দ আবদুস্ সাত্তার শিবনাথের পরামর্শমতোই কাজ করতে লাগলেন–আর কাজ তো আসলে শিবনাথই করত, তিনি খালি হাঁ করে বসেই থাকতেন। শেষটাতে বেচারা মাহতাবউদ্দীনের অনেকগুলো লাখেরাজ সম্পত্তি শিবনাথ কতক নিজের নামে, কতক তার স্ত্রীর নামে খরিদ করে ফেল্লে। আবদুস সাত্তার তার কিছুই জানতে পারলেন না।

শেষটা মাহতাবউদ্দীন যখন বড় হয়ে দেখলেন যে, তিনি প্রায় পথে দাঁড়িয়েছেন, তখন মামাতো ভাইয়ের নামে নালিশ কল্লেন। তখন শিবনাথও নেই, কিছুদিন আগেই মারা গেছে। মোকদ্দমা প্রায় তিন-চার বচ্ছর ধরে চলল, কিন্তু কোনো পক্ষেই কিছু প্রমাণ হল না, মাহতাবউদ্দীন হেরে গেলেন। লাভের মধ্যে তার যেটুকু সম্পত্তি অবশিষ্ট ছিল, তারও কতকটা মোকদ্দমার খরচ যোগাতে বিকিয়ে গেল।

এখন এই মোকদ্দমার সময় আর একটা মজার কথা প্রকাশ হয়ে পড়ল। শিবনাথ যে কেবল এ-শরিকেরই সর্বনাশ করে গিয়েছে, তা নয়, ওঁর নিজের মাথায়ও বেশ করে হাত বুলিয়ে গিয়েছে! কিন্তু যা হোক সব নিতে পারে নি। বেচারা হঠাৎ মারা গেল কিনা, আর কিছুদিন বেঁচে গেলে ও-শরিককেও হাতে মালা নিতে হত।

আবদুল খালেক কহিল, তারও বড় বেশি বাকি নেই, মামুজান। আমি তো এদ্দিন কাজ করে এলাম, সব জানি। তার ওপর আবার এই মসজিদ দেবার ঝেকে দেখুন না কী দাঁড়ায়।

আবদুল্লাহ্ কহিল, তা যাক্, এখন দেখছি ভোলানাথ বাবুরা এদের সম্পত্তি নিয়েই বড় মানুষ হয়েছেন…

মীর সাহেব কহিলেন, আর এঁরা হাঁ করে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছেন–তা একরকম ভালোই হয়েছে বলতে হবে।

কেন?

ও সম্পত্তিগুলো এদের হাতে থাকলে নাস্তাখাস্তা হয়ে যেত এদ্দিনে–দেখ না, যা আছে তারই দশা কী! আর দেখ তো ওদের দিকে চেয়ে, যেমন আয়ও ঢের বাড়িয়েছে, তেমনি সম্পত্তিও দিন দিন বাড়াচ্ছে–ছেলেগুলো সব মানুষ করেছে, বড় বড় চাকরি কচ্ছে।

আবদুল্লাহ্ কহিল, সুদের জোরেই তো ওরা বাড়ে, আমাদের যে সেটা হবার যো নেই।

মানি, সুদের জোরে বাড়ে কিন্তু ছেলেপিলে মানুষ হয়, সেও কি সুদের জোরে? এদিকে মহালের বন্দোবস্ত ভালো করেও তো আয় বাড়ানো যায়–তাই-বা কই? এঁরা কি কিছু দেখেন শোনেন? নায়েব-গোমস্তার হাতে খান, তারা যা হাতে তুলে দেয়, তাতেই খোশ!–এমন জুত পেয়ে যে ব্যাটা নায়েব কি গোমস্তা শিবনাথের মতো দু হাতে না লোটে, সে নেহাত গাধা।

এমন সময় সামু, আব্বা, দাদাজানকে আর চাচাজানকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ির মধ্যে আসুন বলিতে বলিতে দৌড়িয়া আসিল। মীর সাহেব জিজ্ঞাসা করিলেন, কেন ভাইজান, আম্মা কি নাশতা করাবেন আমাদের!

সামু কহিল, হ্যাঁ–হ্যাঁ। শিগগির আসুন বলিয়া সে দাদাজানের হাত ধরিয়া টানিয়া উঠাইল। অতঃপর সকলে বৈঠকখানার দিকে চলিলেন।

.

১৫.

এদিকে আসরের ওক্ত হইয়া গিয়াছে দেখিয়া মীর সাহেব বৈঠকখানায় প্রবেশ করিতে করিতে সামুকে ডাকিয়া কহিলেন, আম্মাকে বল গে, ভাইজান, আমরা নামায পড়ে যাচ্ছি।

জি আচ্ছা বলিয়া সামু দৌড়িয়া মাকে বলিতে গেল।

নামায বাদ তিন জনে অন্দরে আসিলেন। শয়নঘরের বারান্দায় ছোট একটি তক্তপোশের উপর ফর পাতা হইয়াছিল।

মীর সাহেব গিয়া তাহার উপর বসিলেন এবং আবদুল খালেক আবদুল্লাহকে ঘরের ভিতর লইয়া গেল।

আবদুল খালেকের পত্নী রাবিয়া মেঝের উপর বসিয়া পান সাজিতেছিল। আবদুল্লাহকে দেখিয়া আঁচলটা মাথার উপর তুলিয়া দিয়া হাসি-হাসি মুখে রাবিয়া কহিল, বাঃ, আজ কী ভাগ্যি! কবে এলেন, খোকার সাহেব?

আবদুল্লাহ্ রাবিয়ার কদমবুসি করিয়া কহিল, কাল সন্ধেবেলায় এসেছি। আপনি ভালো আছেন তো, ভাবী সাহেবা?

হ্যাঁ ভাই, আপনাদের দোয়াতে ভালোই আছি…

আবদুল খালেক ঠাট্টা করিয়া কহিল, আঃ, ওর দোওয়াতে আবার ভালো থাকবে! ও খখানকার হলে কী হয়, খোনকারী তো আর ও করে না যে, ওর দোয়াতে কোনো ফল হবে।

রাবিয়া কহিল, তা নাই-বা কল্লেন খোনকারী, ভালবেসে মন থেকে দোওয়া কল্লে সবারই দোয়াতে ফল হয়। বলুন না খোনকার সাহেব!

আবদুল খালেক আবদুল্লাহকে লইয়া খাটের সম্মুখস্থ তক্তপোশের উপর বসিলে রাবিয়া জিজ্ঞাসা করিল, বাড়ির সব ভালো তো ভাই? ফুফু-আম্মা কেমন আছেন?

তাঁর শরীরটা ভালো নেই…

তা তো না থাকবারই কথা; তা হালিমাকে আর বউকে এবার নিয়ে যান, ওরা কাছে গেলে ওঁর মনটা একটু ভালো থাকবে।

আবদুল্লাহ্ কহিল, তাই মনে কচ্ছি। কিন্তু আপনাদের বউকে হয়তো ওঁরা এখন পাঠাতে চাইবেন না।

কেন?

তাকে নিয়ে যেতে চাইলে আমার শ্বশুর তো বরাবরই একটা ওজর করেন–আর। আবার ব্যারামের সময়েই পাঠাইলেন না…

রাবিয়া একটু বিরক্তির স্বরে কহিল, বাঃ, তাই বলে বউকে আপনারা নিয়ে যাবেন না, বাপের বাড়িতেই চিরকাল রেখে দেবেন?

তাই রেখে দিতে হবে, দেখতে পাচ্ছি। আর তাকে নিয়ে যাওয়াও তো কম হাঙ্গামের কথা নয়, সঙ্গে বাঁদী তো নিদেনপক্ষে জন তিনেক যাবে–তা ছাড়া তার তো নড়ে বসতেই ছ মাস–হ্যাঁতে করে সংসারের কুটো গাছটিও নাড়ে না। এখন তাকে নিয়ে গেলে কেবল আম্মারই খাটুনি বাড়ানো হবে। তা ছাড়া আমাদের যে অবস্থা এখন, তাতে এতগুলো বাঁদী। পোষা-ও পেরে ওঠা যাবে না! তার চেয়ে এখন ওর এইখেনেই থাকা ভালো।

রাবিয়া একটা দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিয়া কহিল, ও মেয়ে যে কখনো সংসার করতে। পারবে, তা বোধ হয় না! আপনার কপালে অনেক দুঃখ আছে দেখতে পাচ্ছি, খোনকার সাহেব!

আবদুল্লাহ্ কহিল, তা আর কী করব, ভাবী সাহেবা!

আবদুল খালেক কহিল, এখন আর কিছু করে কাজ নেই, চল নাশতাটা করা যাক। এই বলিয়া সে আবদুল্লাহকে বারান্দায় লইয়া গিয়া ফশের উপর ছোট্ট একটি দস্তরখান পাতিয়া দিল। রাবিয়া রেকাবিগুলি আনিয়া তাহার উপর সাজাইতে লাগিল।

নাশতার আয়োজন দেখিয়া আবদুল্লাহ্ কহিল, এ কী করেছেন ভাবী সাহেবা!

মীর সাহেব কহিলেন, ও তোমার ভাবী সাহেবার দোষ নয়, বাবা। আমারই অত্যাচার। তাহার পর একটু ভারী গলায় কহিতে লাগিলেন, আমার এই আম্মাটি ছাড়া আমাকে আদর করে খাওয়াবার আর কেউ নেই! তাই যখন এখানে আসি, ফরমাশের চোটে আমার আম্মাকে হয়রান করে দিই। খেতে পারি আর না-পারি, আমাকে পাঁচ রকম তয়ের করে খাওয়ানোর জন্যে উনি হাসিমুখে যে খাটুনিটা খাটেন, তাই দেখেই আমার প্রাণটা ভরে। যায়। আমার আম্মার আদরে সংসারের যত অনাদর-অবহেলা সব আমি ভুলে যাই। তাই ছুটে ছুটে আমার আম্মার কাছে আসি।

মীর সাহেবের কথায় সকলেরই চোখ ছলছল করিয়া উঠিল। রাবিয়া তাড়াতাড়ি জল আনিবার ছলে সরিয়া পড়িয়াছিল।

এই মেয়েটিকে মীর সাহেব ছেলেবেলা হইতেই অত্যন্ত স্নেহ করিতেন। ইহার মাতা তাহার দূরসম্পর্কের চাচাতো বোন, কিন্তু সম্পর্ক দূর হইলেও তিনি ইহাদিগকে আপনার জন বলিয়াই মনে করিতেন। তাই রাবিয়ার বিবাহের অল্প কাল পরেই যখন তাহার পিতার মৃত্যু হয় এবং তাহার মাতা শিশু-কন্যা মালেকাকে লইয়া অকূল সাগরে ভাসিলেন, তখন মীর সাহেবই তাহাদের একমাত্র আশ্রয়স্থল ছিলেন। মীর সাহেবেরই চেষ্টায় অসহায় বিধবার এবং কন্যা দুইটির সম্পত্তিটুকু অপরাপর অংশীদারগণের কবল হইতে রক্ষা পাইয়াছিল। সম্প্রতি তিনি মালেকারও বেশ ভালো বিবাহ দিয়া দিয়াছেন–জামাতা মঈনুদ্দীন একজন সব্‌ডিপুটি, তাহার ভ্রাতা মহিউদ্দীন ডিপুটি, পৈতৃক সম্পত্তিও ইহাদের মন্দ নহে। নূরপুর গ্রামের মধ্যে এই বংশই শ্রেষ্ঠ বংশ–পুরাতন জমিদার ঘর হইলেও নিতান্ত ভগ্নদশা নহে।

মীর সাহেবের এই সকল অযাচিত অনুগ্রহে রাবিয়া এবং তাহার মাতা ও ভগ্নী তাহার নিকট সর্বদা আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য উৎসুক। উপকার করিয়া মীর সাহেব যদি কাহারো নিকট আন্তরিক শ্রদ্ধা ও ভালবাসা পাইয়া থাকেন তবে সে এইখানেই।

নাশতার পর মীর সাহেব উঠিয়া বাহিরে গেলে আবদুল্লাহ্ জিজ্ঞাসা করিল, তারপর ভাইজান, আপনার কাজকর্ম চলছে কেমন?

আবদুল খালেক কহিল, তা খোদার ফজলে মন্দ চলছে না। মামুজানের মেহেরবানিতে আমার দুখখু ঘুচেছে! আজ প্রায় তিন বছর আম্মার এন্তেকাল হয়েছে, এরই মধ্যে মামুজানের পরামর্শমতো চলে আমার অবস্থা ফিরে গিয়েছে। আহা, এদ্দিন যদি মামুজানকে পেতাম, তবে কি আর শরিকের ঘরে গোলামি করতে যেতে হত? তা আম্মা ওঁর ওপরে এমন নারাজ ছিলেন যে, বাড়িতে পর্যন্ত আসতে দিতেন না।

কেন, সুদ খান বলেই তো!

তা ছাড়া আর কী? কিন্তু এমন লোক আর দেখি নি! সকলেই চায় গরিব আত্মীয়স্বজনের ঘাড় ভেঙে নিজের নিজের পেট ভরতে–কিন্তু ইনি গায়ে পড়ে এসে উপকার করেন। খালুজান যখন আমার মাইনে বন্ধ করে দিলেন, তখন উনিই তো এসে আমার সব দেনা। পরিশোধ করে আমাকে চাকরি থেকে ছাড়িয়ে আনলেন, তারপর এইসব ক্ষেত-খামার, জমি-জারাত সব গুছিয়ে নিতেও তো আমাকে উনি কম টাকা দেন নি…।

আবদুল্লাহ্ কহিল, ওঁর যে সুদের টাকা, ওইখানটাতেই তো একটু গোল রয়েছে।

আবদুল খালেক কহিল, তা থাকলই-বা গোল, তাতে কিছু আসে যায় না। আর সুদ নিয়ে ওঁর যে গোনাহ্ হচ্ছে তার ঢের বেশি সওয়াব হচ্ছে পরের উপকার করে। এতেই আল্লাহতালা আখেরাতে ওঁর সব গোনাহ মাফ করে দেবেন বলে আমার বিশ্বাস।

এই কথাটি লইয়া আবদুল্লাহ্ কিয়ৎক্ষণ চিন্তা করিতে লাগিল, কিন্তু কোনো সন্তোষজনক। মীমাংসায় উপনীত হইতে পারিল না। একটু পরে আবদুল খালেক আবার কহিতে লাগিল, দেখ ভাই, উনি যে শুধু টাকা দিয়েই লোকের উপকার করেন, তা নয়; সৎপরামর্শ দিয়ে বরং তার চেয়ে ঢের বেশি উপকার করেন। আজকাল যে আমি এই ক্ষেত-খামার-গরু ছাগল-হাঁস-মুরগি–এই-সব নিয়ে আছি, আগে কখনো স্বপ্নেও আমার খেয়ালে আসে নি যে, এ-সব করে মানুষ সুখে-স্বচ্ছন্দে থাকতে পারে। এই পানের বরজ একটা জিনিস, যাতে বেশ দু পয়সা আয় হয়, এ তো বারুইদেরই একচেটে; কোনো শরীফজাদাকে বলে দেখো পানের বরজ করতে, অমনি সে আড়াই হাত জিভ বার করে বলবে, সর্বনাশ, ওতে জাত থাকে! ক্ষেতি-টেতির বেলাতেও সেই রকম; তাতে যে একটু নড়েচড়ে বেড়াতে হয়, সেই জন্যেই শরীফজাদাদের ওসব দিকে মন যায় না। ঘরে ঠ্যাঙের উপর ঠ্যাং দিয়ে দুমুঠো মোটা ভাত জুটলেই তারা বিেশ থাকেন। নিতান্ত দায়ে ঠেকলে পরের গোলামি করে জুতো-লাথি খাবেন তাও স্বীকার, তবু ও-সব ছোটলোকের কাজে হাত দিয়ে জাত খোয়াতে চান না। এই আমার কী দশা ছিল, দেখ না; বিষয় যা পেয়েছিলাম, তাতে তো আর সংসার চলে না। কী করি, গেলাম ওঁদের গোলামি করতে–জমি-জারাত যা ছিল, সেগুলো যে খাঁটিয়ে খাব, সে চিন্তাই মনে এল না! তারপর মামুজান এসে যখন পথে তুলে দিলেন তখন চোখ ফুটল।

আবদুল্লাহ্ তন্ময় হইয়া কথাগুলি শুনিতেছিল। শুনিতে শুনিতে প্রতি মুহূর্তে তাহার মনের ভিতর নানাপ্রকার চিন্তা বিদ্যতের ন্যায় খেলিয়া যাইতেছিল। আর পড়া কি চাকরি-বাকরির দিকে না গিয়া ভাইজানেরই পথ অবলম্বন করিবে–কিন্তু তাহার উপযুক্ত জমি তেমন নাই, নগদ টাকাও নাই, কেমন করিয়া আরম্ভ করিবে? ফুফাজানের সাহায্য চাহিবে? আম্মা তাতে নারাজ হইবেন। তবে কিছুদিন চাকরি করিয়া টাকা জমাইয়া ওই সব কাজ শুরু করিয়া দিবে। সে হঠাৎ জিজ্ঞাসা করিয়া বসিল, আচ্ছা, ভাইজান, আজকাল আপনি কী কী কাজ নিয়ে আছেন? আর কোন্ কোন্‌টায় বেশ লাভ হচ্ছে?

আবদুল খালেক কহিতে লাগিল, আমি হাত দিয়েছি তো ঢের কাজে–তা কোনোটাতেই লাভ মন্দ হচ্ছে না। আমার জমি বেশি নেই, ধান যা পাই, তাতে একরকম করে বছরটা কেটে যায়। তা ছাড়া আমার ক্ষেতগুলোতে হলুদ, –এটাতে খুবই লাভ আদা, মরিচ, সর্ষে, কয়েক রকম কলাই, তারপর পিঁয়াজ, রসুন, তরিতরকারি–এসব যথেষ্ট হয়, খেয়েদেয়েও ঢের বিক্রি করতে পারি। গোটা চারেক বরজ করিছি, তাতেও বেশ আয় হচ্ছে। সুপুরি নারিকেলের গাছ আমার বেশি নেই, আরো কিছু জমি নিয়ে বেশি করে লাগাব মনে কচ্ছি। যে জমিতে এগুলো দেব, সেখানে কলার বাগান করা যাবে, যদ্দিন ফসল না পাওয়া যায়, তদ্দিন কলা থেকেও কিছু কিছু আয় হবে। তারপর দেখ, মাছ তো আমাকে। আর এখন কিনতেই হচ্ছে না, কাজেই বাজার খরচ বলে একটা খরচ আমার একরকম করতেই হয় না বললে চলে। ছাগল, মুরগি, হাঁস এ-সব দেদার খেয়েও এ-বছর বেচেছি প্রায় শ দেড়েক টাকার, ক্রমে আরো বেশি হবে। একটু ভেবে দেখলে এই রকম আরো ঢের উপায় বার করা যায়, যাতে কারুর গোলামি না করে সুখে-স্বচ্ছন্দে দিন কাটানো যেতে পারে।

এই সকল বিবরণ শুনিয়া আবদুল্লাহর মনে বড়ই আনন্দ হইল। সে কহিল, আচ্ছা, ভাইজান, চোখের উপর উপায় করবার এমন এমন সুন্দর পন্থা থাকতে কেউ যায় গোলামি করতে আর কেউ-বা হাত-পা কোলে করে ঘরে বসে আকাশ পানে চেয়ে হা-হুঁতাশ করে। কী আশ্চর্য!

আবদুল খালেক কহিল, আমার নিজের জীবনে যা ঘটেছে, তাতে বুঝতে পাচ্ছি যে, আমাদের শরাফতের অভিমান, দারুণ আলস্য, আর উপযুক্ত উপদেষ্টার অভাব, এই তিনটে কারণে আমরা সংসারের সুপথ খুঁজে পাই নে। কোনো রকমে পেটটা চলে গেলেই আল্লাহ্ আল্লাহ করে জীবনটাকে কাটিয়ে দিই। আর নেহাত পেট যদি না চলে, তো ঝুলি কাঁধে নিয়ে সায়েলী কত্তে বেরুই।

এইরূপ কথাবার্তা কহিতে কহিতে মগরেবের সময় হইয়া আসিল দেখিয়া আবদুল্লাহ্ কহিল, তবে এখন উঠি, ভাইজান!

আবদুল খালেক স্ত্রীকে ডাকিয়া কহিল, ওগো, শুনছ, আবদুল্লাহ্ রোখসৎ হচ্ছে– একবার এদিকে এস।

রাবিয়া রান্নাঘরে ছিল, তাড়াতাড়ি হাতের কাজ ফেলিয়া বাহিরে আসিয়া কহিল, এখনই রোখৃসৎ হচ্চেন কী, খখানকার সাহেব! আজ রাত্রে আমাদের বাড়িতে খেতে হবে যে।

আবদুল খালেক কহিল, না গো না, তার আর কাজ নেই। এখানে যে ও বেড়াতে এসেছে, তাতেই ওর শ্বশুরবাড়িতে কত কথা হবে এখন।

আবদুল্লাহ্ সোৎসুকে জিজ্ঞাসা করিল, কেন–কেন?

আবদুল খালেক কহিল, আমাদের সঙ্গে যে ওঁদের আজকাল মনান্তর চলছে।

মনান্তর হল কিসে?

ওই যে কটা তালুক খালুজান বিক্রি কল্লেন, সে কটা মামুজান আমারই নামে বেনামী করে খরিদ করেছেন কিনা, তাই।

হ্যাঁ তা তো শুনেছি। কিন্তু তাতে আপনার সঙ্গে মনান্তর হল কেন?

খালুজানের ইচ্ছে ছিল, কোনো আত্মীয়স্বজন কথাটা না জানতে পারে। বরিহাটীর দীনেশবাবু ওঁয়াদের উকিল কিনা, তাকে দিয়ে গোপনে বিক্রি করবার বন্দোবস্ত করেছিলেন। কিন্তু এদিকে দীনেশবাবুর সঙ্গে মামুজানের খুব ভাব; তাই যখন মামুজান জানতে পেরে নিজেই নিতে চাইলেন, তখন দীনেশবাবু আর আপত্তি কল্লেন না। খালুজান কিন্তু মনে

করলেন যে, আমিই পাকেচক্রে মামুজানকে সন্ধান দিয়ে খরিদ করিয়েছি।

আবদুল্লাহ জিজ্ঞাসা করিল, আচ্ছা, উনি যখন বেচলেনই তখন আপনিই না হয় কিনলেন, তাতে আপনার অপরাধ!

আবদুল খালেক কহিল, ওই তো কথা ঘোরে রে ভাই! অপরাধ যে আমার কী, সেটা আর বুঝলে না? ছিলাম ওঁদের গোলাম হয়ে আর আজ কিনা দু পয়সা উপায় কচ্ছি, তার ওপর আবার ওঁদের তালুক কিনে ফেললাম, এতে আমার স্পর্ধা কি কম হল?

আবদুল্লাহ্ ব্যঙ্গ করিয়া কহিল, তা তো বটেই!

সেইজন্যেই তো বলছিলাম, তুমি আমাদের সঙ্গে মেলামেশা খাওয়াদাওয়া কল্লে তোমার শ্বশুরবাড়িতে কথা উঠবে।

তা উঠলই বা! ওঁরা চটলেন তো ভারি বয়েই গেল! এমনিই বড় ভালবাসেন কিনা…

আরে না, না। তুমি তো আজ বাদে কাল চলে যাবে, তারপর এর ঝক্কি সইতে হবে আমাদেরই।

রাবিয়া এবং আবদুল্লাহ্ উভয়েই প্রায় সমবয়সী। আবদুল খালেকের বিবাহ হওয়া অবধি তাহাদের অনেকবার দেখা-সাক্ষাৎ হইয়াছে এবং স্বাভাবিক স্নেহশীলতাগুণে রাবিয়া আবদুল্লাহকে অত্যন্ত আপনার করিয়া লইয়াছে। আবদুল্লাহও তাহাকে আপন ভগ্নীর ন্যায় ভক্তি করে এবং ভালবাসে; বিশেষত রাবিয়ার নিপুণ হস্তের রন্ধন এবং পরিবেশন-কালে ততোধিক নিপুণ আদর-কুশলতা এমনি লুব্ধ করিয়া রাখিয়াছে যে, ভ্রাতার প্রত্যাখ্যানে সে আজ বড়ই মনঃক্ষুণ্ণ হইয়া গেল। অগত্যা সে কহিল, তবে থাক এ যাত্রা ভাবী সাহেবা! আমি কিন্তু কাল ভোরেই রওয়ানা হব।

রাবিয়া কহিল, সে কী, ভাই!–বাড়ি এসে কি এক দিন থেকেই চলে যেতে আছে?

না ভাবী সাহেবা, এবার আর থাকতে পারছি নে। আম্মা ও-দিকে পথ চেয়ে আছেন, পড়াশুনার তো কোনো বন্দোবস্ত এখনো হয়ে উঠল না, অন্তত কাজ-কর্মের চেষ্টা তো দেখতে হবে। মনটা বড় অস্থির হয়ে আছে। খোদা যদি দিন দেন, তবে কত আসব যাব, আপনাকে বিরক্ত করব। এখন তবে আসি।

এই বলিয়া আবদুল্লাহ্ রাবিয়ার কদমবুসি করিয়া বিদায় লইল।

বাহিরে আসিয়া মীর সাহেবের নিকট বিদায় লইবার সময় তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, তবে এখন তোমার পড়াশুনার কী করবে আবদুল্লাহ?

কিছু তো ঠিক করে উঠতে পাচ্ছি নে কী করব। ভাবছি মাস্টারি করে প্রাইভেট পড়ব।

সে কি সুবিধে হবে? তা হলে ল-টা আর পড়া হবে না…

তা জিজ্ঞাসা করবে ছিল

বছর দুই তিন মাস্টারি করে কিছু টাকা জমিয়ে শেষে ল পড়তে পারি।

ও, সে অনেক দূরের কথা। তার কাজ নেই, আমিই তোমার পড়ার খরচ দেব, তুমি কলেজে পড় গিয়ে!

আবদুল্লাহ্ তাহার প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতাপূর্ণ দৃষ্টি স্থাপিত করিয়া কহিল, তা হলে তো বড়ই ভালো হয়, ফুফাজান। কিন্তু আম্মাকে একবার জিজ্ঞাসা করে দেখতে হবে।

তা জিজ্ঞাসা করবে বৈকি!

আবদুল্লাহ্ একটু ভাবিয়া কহিল, কিন্তু তিনি যদি আপনার টাকা নিতে না দেন?

মীর সাহেব একটু চিন্তিত হইয়া কহিলেন, তাও তো বটে! আমার টাকা নিতে আপত্তি করা তাঁর পক্ষে আশ্চর্য নয়। না হয় তুমি তাকে বোলো যে এ টাকা কর্জ নিচ্ছ, পরে যখন রোজগার করবে, তখন শোধ দেবে।

কিন্তু আবদুল্লাহর মনে খটকা রহিয়া গেল। তাহার মাতা যে সুদখোরের টাকা কর্জ লইতেও রাজি হইবেন, এরূপ সম্ভবে না। একটু ভাবিয়া অবশেষে সে কহিল, –আচ্ছা তাই বলে দেখব। নিতান্তই যদি আম্মা রাজি না হন, তখন মাস্টারি করতে হবে, আর কোনো উপায় দেখছি নে!

আবদুল খালেক কহিল, আরে তুমি আগে থেকেই এত ভাবছ কেন? বলে দেখ গে তো! রাজি হবেন এখন। মামুজান তো কর্জ দিচ্ছেন, তাতে আর দোষ কী!

মীর সাহেব কহিলেন, না, ভাববার কথা বৈকি! এঁরা সব পাক্কা দীনদার মানুষ, আমার সঙ্গে এদের ব্যবহার কেমন, তা জান তো!

আবদুল্লাহ্ কহিল, সেই জন্যেই তো আমি ভাবছি। তবু একবার বলে দেখি। তারপর আপনাকে জানাব।

এই বলিয়া আবদুল্লাহ্ বিদায় গ্রহণ করিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *