২১-২৫. ১৯০৫ সালের বঙ্গবিভাগ

১৯০৫ সালের বঙ্গবিভাগের দরুন দেশের সর্বত্র যে হুলুস্থুল পড়িয়া গিয়াছিল, তাহারই ফলে রসুলপুর হাইস্কুলেও তুমুল স্বদেশী আন্দোলনের উদ্ভাবনা হয়। ছাত্রেরা বিদেশী দ্রব্যের ব্যবহার রহিত করিল, মাথায় করিয়া দেশী কাপড় ও অন্যান্য দ্রব্য ফেরি করিতে আরম্ভ করিল এবং দল বাঁধিয়া বাজারে গিয়া বিলাতি দ্রব্যের বেচাকেনা বন্ধ করিবার জন্য ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়কেই প্রণোদিত করিতে লাগিল। ইহাই লইয়া পুলিশের সহিত তাহাদের সংঘর্ষ উপস্থিত হয় এবং কয়েকজন ছাত্র ধৃত হইয়া শাস্তিও পায়। তার পর শিক্ষা বিভাগ হইতে এই ব্যাপারের তদন্ত করিবার জন্য স্বয়ং বিভাগীয় ইনস্পেক্টর রসুলপুরে আসিলেন এবং ছাত্রগণকে রাজনৈতিক আন্দোলনে যোগ দিবার জন্য প্ররোচিত করার অপরাধে হেডমাস্টার এবং তাহার কয়েকজন সহকারীকে বরখাস্ত করিলেন। সঙ্গে সঙ্গে স্কুল হইতে স্বদেশী আন্দোলনের বীজ সমূলে নষ্ট করিবার উদ্দেশ্যে উহাকে অস্থায়ীভাবে গভর্নমেন্ট স্কুলে পরিণত করিবার জন্য উপরে লিখিয়া পাঠাইলেন।

এইরূপে রসুলপুর স্কুলের গোলমাল মিটাইয়া ইনস্পেক্টর সাহেব বরিহাটী জেলা স্কুল পরিদর্শন করিতে আসিলেন। পূর্বেই সংবাদ দেওয়া ছিল; হেডমাস্টার মাস্টার-ছাত্র সকলের উপর কড়া কড়া নোটিশ জারি করিতে লাগিলেন, যেন পরিদর্শনের দিন সকলের পরিধানে পরিষ্কার কাপড় থাকে; সমস্ত শ্লেট-বহি, খাতা-পত্র প্রভৃতি আনিতে যেন কেহ না ভোলে, স্কুলঘরের ছাদ ও দেওয়ালের কোণগুলি হইতে মাকড়সার জালের রাশি বেশ করিয়া ঝাড়িয়া, দরজা জানালাগুলি ভিজা ন্যাকড়া দিয়া মুছিয়া এবং মেঝে ভালো করিয়া ধুইয়া তকতকে করিয়া রাখা হয়। কয়দিন হইতে স্কুলের চাকরবাকরগুলার খাটিতে খাটিতে প্রাণান্ত হইবার উপক্রম হইল; তথাপি তাহাদের কার্য হেডমাস্টারের মনঃপূত হইল না। দুবেলা তিনি সদলবলে আসিয়া তাহাদের উপর সচিৎকার তম্বি করিতে লাগিলেন। খাজনা অপেক্ষা বাজনাই বেশি হইতে লাগিল।

দেখিতে দেখিতে শেষের সে দিন ভয়ঙ্কর আসিয়া উপস্থিত হইল। আজ সাহেব আসিবেন; মাস্টার-ছাত্র সকলেই সকাল সকাল স্কুলে আসিয়া পড়িয়াছেন। কোনো ক্লাসে সামান্য একটু গোলমালের আভাস পাইলেই পাঁচ-সাত জন ছুটিয়া গিয়া চাপা গলায় এই, এই! চুপ চুপ! বলিয়া ধমক দিতেছেন। ছাত্রেরা কী একটা নিদারুণ বিভীষিকা আসন্ন হইতেছে মনে করিয়া, উদ্বেগে মুখ অন্ধকার করিয়া গুটিসুটি মারিয়া বসিয়া থাকিতে চেষ্টা করিতেছে।

লাইব্রেরিঘরের সম্মুখে দাঁড়াইয়া কয়েকজন মাস্টার নিম্নস্বরে আলাপ করিতেছেন– সাহেব আসিয়া কী বলিবে, কী করিবে, কাহার চাকরি থাকিবে, কাহার যাইবে–এমন সময় চাপরাসী দৌড়িয়া আসিয়া খবর দিল, –সাহেব, সাহেব! অমনি সকলে যে যার ক্লাসে গিয়া উপস্থিত হইলেন। যাহাদের ক্লাস ছিল না, তাহাদিগকে লইয়া হেডমাস্টার গেটের কাছে গিয়া দাঁড়াইলেন। অ্যাসিস্ট্যান্ট ইনস্পেক্টর, ডিপুটি-ইনস্পেক্টর, সব-ইনস্পেক্টর, ইনস্পেকটিং পণ্ডিত প্রভৃতি সামন্তবর্গ পশ্চাতে লইয়া সাহেবের শুভাগমন হইল; অমনি সকলে সপাগড়ি মস্তক আভূমি অবনত করিয়া সেলাম করিলেন। সাহেব হস্তস্থিত ক্ষুদ্র ছড়িখানির অগ্রভাগ হ্যাটের প্রান্ত পর্যন্ত উঁচু করিয়া সেলাম গ্রহণ করিলেন এবং জিজ্ঞাসা করিলেন, ওয়েল, হেডমাস্টার, হাউ আর ইউ? থ্যাংক ইউ স্যার, আই অ্যাম কোয়াইট ওয়েল বলিয়া হেডমাস্টার সাহেবের সুদীর্ঘ পদক্ষেপের পশ্চাৎ পশ্চাৎ ছুটিতে ছুটিতে তাহার কামরায় আসিয়া প্রবেশ করিলেন।

যথারীতি স্কুলের বিবরণাদি পরীক্ষা করিয়া ইনস্পেক্টর সাহেব ক্লাস পরির্দশন করিতে উঠিলেন। সামন্তবর্গকে নিম্নতর শ্রেণীগুলির পরীক্ষার ভার দিয়া সাহেব উপরকার চারিটি ক্লাস দেখিবেন বলিয়া নোটিশ দিলেন। সকলে যে যার ক্লাসে গিয়া পরীক্ষা-কার্যে ব্যাপৃত হইলেন। খোদ সাহেব প্রথম শ্রেণীতে গিয়া প্রবেশ করিলেন।

ছাত্রেরা যথাসাধ্য নীরবতার সহিত উঠিয়া দাঁড়াইল এবং শিক্ষক মহাশয় যথারীতি সেলাম করিয়া সরিয়া দাঁড়াইলেন। সাহেব কামরাটির উপর-নিচে চারিদিকে এক নজর দেখিয়া লইলেন। দেওয়ালগুলির নিচের দিকটায় স্থানে স্থানে এবং মেঝের প্রায় সর্বত্র কালির ছিটার দাগ একটু একটু দেখা যাইতেছে; ওদিকে সম্মুখের দিককার জানালার খিলানের কোণে খানিকটা ঝুল বাতাসে নড়িতেছিল। এই সকলের দিকে সাহেবদের দৃষ্টি প্রথমে পড়িয়া থাকে; তাই তিনি একটুখানি টিটকারি দিয়া কহিলেন–ওয়েল হেডমাস্টার, আপনি স্কুলঘরটি তেমন পরিষ্কার রাখিতে যত্ন করেন না বলিয়া মনে হইতেছে।

যাহার জন্য চাকরদের সঙ্গে বকাবকি করিয়া গলা ভাঙিয়া গিয়াছে, তাহারই জন্য সাহেবের কাছে অপ্রস্তুত হইতে হইল! হেডমাস্টার মহাশয়ের মনে ভয়ানক ক্রোধের উদয় হইল; তিনি সাহেবের একটু পশ্চাৎ দিকে সরিয়া আসিয়া মুখখানা ভীষণ রকম বিকৃত করিয়া, চক্ষু দিয়া অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ছুটাইয়া একবার এ-দিক ওদিক চাহিলেন। ভাগ্যে ভৃত্যদের কেহ সেখানে উপস্থিত ছিল না; থাকিলে আজ নিশ্চয়ই ভস্ম হইয়া যাইত!

প্রথম শ্রেণীর পরীক্ষা শেষ করিয়া সাহেব একে একে অপরাপর শ্রেণীর পরীক্ষা লইলেন। পরীক্ষাশেষে তিনি মত প্রকাশ করিলেন যে, ছেলেরা পড়াশুনায় মন্দ নহে, কিন্তু ছেলেদের একটা ভয়ানক বদঅভ্যাস হইয়াছে–তাহারা লিখিবার সময় কলম ঝাড়িয়া মেঝে ও দেওয়াল নষ্ট করে। ভবিষ্যতে যেন হেডমাস্টার এদিকে বিশেষ নজর রাখেন।

পরিদর্শন শেষ হইতে প্রায় চারিটা বাজিয়া গেল। সাহেব চলিয়া যাইতেছিলেন, এমন সময় একটি প্রিয়দর্শন সুবেশ ছাত্র ছুটির দরখাস্ত লইয়া তাহার সম্মুখে দাঁড়াইল। পশ্চাতে দপ্তরী দোয়াত-দান হাতে দাঁড়াইয়া ছিল; সাহেব দরখাস্তখানা হাতে লইতেই একজন শিক্ষক তাড়াতাড়ি একটা কলম তুলিয়া লইয়া দোয়াতে ডুবাইয়া একবার মেঝের উপর ঝাড়িয়া, সাহেবের দিকে বাড়াইয়া ধরিলেন। সাহেব একটু মুচকি হাসিয়া কলম লইলেন এবং দুই দিনের ছুটি মঞ্জুর করিয়া প্রস্থান করিলেন। যাইবার সময় হেডমাস্টারকে বলিয়া গেলেন, যদি কোনো শিক্ষকের বিশেষ কোনো কিছু বলিবার থাকে, তবে কল্য প্রাতে ৮টা হইতে ৯টার মধ্যে ডাকবাংলায় তাহার সঙ্গে দেখা করিতে পারেন। কে কে দেখা করিতে যাইবেন, তাহা যেন আজই সন্ধ্যার মধ্যে তাঁহাকে লিখিয়া জানানো হয়। তবে কেহ যেন অনর্থক তাহাকে বিরক্ত করিতে না যান, হেডমাস্টার সেদিকে লক্ষ্য রাখিয়া লিস্ট প্রস্তুত করিবেন!

পরদিন প্রাতে হেডমাস্টার মহাশয়ের প্রস্তুত লিস্ট অনুসারে যে তিন জন শিক্ষক সাহেবের সহিত সাক্ষাৎ করিবার অনুমতি পাইয়াছিলেন, তাঁহারা আটটার পূর্বেই আসিয়া ডাকবাংলায় উপস্থিত হইলেন। একটু পরে আবদুল্লাহও আসিয়া হাজির হইল। তাহাকে দেখিয়া একজন শিক্ষক জিজ্ঞাসা করিলেন, –আপনি যে, আপনার নাম তো হেডমাস্টার লিস্টে দেন নাই, সাহেব কি আপনার সঙ্গে দেখা করবেন? আপনি কার্ড দিবেন না, অনর্থক সাহেব বিরক্ত হবেন, আর আমাদেরও কাজ নষ্ট হবে।

আবদুল্লাহ্ কহিল, –না মশায়, ভয় নেই, আমি এখন কার্ড দিচ্ছি নে। আপনারা দেখাটেখা করে আসুন, তারপর আমি কার্ড দেব; তারপর সাহেব যা করেন!

যথাসময়ে শিক্ষকত্রয়ের একে একে ডাক হইল। দশ-পনের মিনিটের মধ্যেই তাহাদের রাজদর্শন সমাধা হইয়া গেল। সাহেব মিষ্ট কথায় তুষ্ট করিয়া তাহাদিগকে বিদায় করিলেন; তাঁহারাও হাসিমুখে ভবিষ্যৎ প্রমোশনের কথা কল্পনা করিতে করিতে যে যাহার ঘরে গেলেন। আবদুল্লাহ্ কার্ড পাঠাইয়া দিল।

একটু পরেই আবদুল্লাহর ডাক হইল। ঘরে ঢুকিবামাত্র সাহেব কহিলেন, ওয়েল মৌলবী, আপনার নাম তো হেডমাস্টার পাঠান নাই, তবে আপনি আমার সঙ্গে দেখা করিতে আসিয়াছেন কেন?

আবদুল্লাহ্ বিনীতভাবে কহিল, –স্যার, আমি নিজের কোনো কথার জন্যে আপনার সঙ্গে দেখা করতে আসি নি, এখানকার আঞ্জুমানের তরফ থেকে প্রেরিত হয়ে এসেছি…

আঞ্জুমানের কী এমন বিশেষ কথা আছে?

স্যার, স্কুলে মুসলমান ছাত্রের সংখ্যা এখন ক্রমে ক্রমে বেড়ে উঠেছে। দু বছর আগে ছিল মাত্র তেইশটি, কিন্তু বর্তমানে আটত্রিশটি হয়েছে। অথচ ফারসি পড়াবার জন্যে মৌলবী

নেই। আঞ্জুমান প্রার্থনা করেন যে, একজন মৌলবী নিযুক্ত করা হোক।

এখানকার মুসলমান ছাত্রেরা তো সব সংস্কৃত পড়ে; তবে মৌলবীর দরকার কী?

ফারসি পড়তে পায় না বলেই তারা সংস্কৃত পড়ে, স্যার। মৌলবী পেলে সকলেই ফারসি পড়বে, এবং ভবিষ্যতে ছাত্রের সংখ্যা আরো বাড়বে বলে আঞ্জুমান মনে করেন।

সাহেব একটু ভাবিয়া কহিলেন, –আচ্ছা, বেশ, আপনি আঞ্জুমানকে বলতে পারেন একটা Representation দিতে। আমি এ-সম্বন্ধে বিবেচনা করব। আর কোনো কথা আছে?

না স্যার, আমার আর কোনো কথা নাই।

আবদুল্লাহর ইংরেজি কথাবার্তায়, তাহার সসম্ভ্রম অথচ নিঃসঙ্কোচ আলাপে এবং তাহার আদব-কায়দায় সাহেব তাহার দিকে বেশ একটু আকৃষ্ট হইতেছিলেন। তিনি একটু ভাবিয়া কহিলেন, –এসিস্টান্ট ইনস্পেক্টরের মন্তব্যের মধ্যে দেখলাম আপনি দেশী খেলার বড় পক্ষপাতী। বলে তিনি রিমার্ক করেছেন–কেন, আপনি ফুটবল, ক্রিকেট, এগুলো পছন্দ করেন না?

আবদুল্লাহ্ কহিল, খুবই করি, স্যার। এগুলোতে শরীর, মন উভয়ের স্ফুর্তি জন্মে এবং ছাত্রদের পক্ষে একান্ত উপযোগী। কিন্তু আমাদের ফিল্ড ছোট, স্কুলের সকল ছাত্র একসঙ্গে খেলায় যোগ দিতে পারে না। সুতরাং অনেক ছাত্রই হয় বাড়িতে চুপ করে বসে থাকে, না হয় গল্প করে বেড়ায় আর খুব বেশি করে তো মাঠের একধারে বসে খেলা দেখে। তাই। আমি তাদের জন্যে কতকগুলো দেশী খেলা চালিয়েছি, যার জন্যে কোনো বড় মাঠ দরকার হয় না, আরো অনেকগুলো ছেলে একসঙ্গে খেলতে পারে, এমনকি, রাস্তার ধারে একটু জায়গা পেলেও খেলা চলে।

সাহেব জিজ্ঞাসা করিলেন, –কী কী খেলা আপনি চালিয়েছেন?

আবদুল্লাহ্ তখন ডাণ্ডা-গুলি, হাডু-ডুডু, কপাটি, গোল্লাছুট প্রভৃতি খেলার বিবরণ সাহেবকে বলিয়া বুঝাইয়া দিল। সাহেব শুনিয়া কহিলেন, –এ খেলাগুলো তো বেশ! কিন্তু তাই বলে ফুটবল, হকি, এগুলো একেবারে ছেড়ে দেওয়া উচিত নয়।

না স্যার, ওগুলোও ছেলেরা খুব খেলে। প্রায়ই অন্যান্য স্কুলের ছেলেদের সঙ্গে ম্যাচ হয়, তাতে আমাদেরই বেশির ভাগ জিত হয়।

সাহেব কহিলেন–খেলার দিকে আপনার এতটা ঝোঁক আছে, ভালো কথা। এসব থাকলে আর ছেলেরা বদ-খেয়ালের দিকে যাবার অবসর পায় না। আপনার চাকরি কত দিনের হল?

এই প্রায় আড়াই বৎসর হয়েছে।

কোন্ গ্রেডে আছেন?

চল্লিশ টাকার গ্রেডে।

আপনি আন্ডারগ্রাজুয়েট?

যখন চাকরিতে ঢুকি, তখন আন্ডারগ্রাজুয়েট ছিলাম; এই বৎসর বি-এ পাস করেছি। আরবিতে সেকেন্ড ক্লাস অনার পেয়েছি।

ও, বটে? বড়ই সুখের বিষয়। আশা করি, সত্বরই সার্ভিসে আপনার উন্নতি হবে।

এই বলিয়া সাহেব চুপ করিলেন। আবদুল্লাহ্ বিদায় লইবার জন্য কিঞ্চিৎ মাথা নোয়াইয়া আদাব করিতে যাইতেছিলেন, কিন্তু সাহেব আবার কহিলেন, –আমি আপনার সঙ্গে সাক্ষাতে খুশি হয়েছি, মৌলবী। আপনার যাতে একটা বিশেষ সুবিধে হয়ে যায়, তার জন্যে আমি চেষ্টা করব–তবে এখন স্পষ্ট কিছু বলতে পাচ্ছি নে।

আবদুল্লাহ্ কহিল, –আপনার মেহেরবানিই আমার পক্ষে যথেষ্ট, স্যার।

সাহেব একটু হাসিয়া কহিলেন, –অল্ রাইট, মৌলবী, গুড মর্নিং।

আবদুল্লাহ্ আবার আদাব করিয়া বিদায় হইল।

.

২২.

প্রায় চারি বৎসর পরে হালিমা শ্বশুরবাড়ি আসিয়াছে। এবার সৈয়দ সাহেব নিজে উদ্যোগ করিয়া পীরগঞ্জে গিয়া তাহাকে লইয়া আসিয়াছেন। বরিহাটী হইতে দলিল লেখাপড়া করিয়া ফিরিয়া আসিয়াই তিনি মসজিদের কাজ আরম্ভ করিয়া দিয়াছিলেন; কিন্তু ভালো লোক অভাবে কাজ বড়ই ধীরে ধীরে অগ্রসর হইতেছিল। তাই মসজিদটা শেষ করিয়া তুলিতে আট-নয় মাস লাগিয়া গেল। মসজিদ শেষ হইয়াছে; সৈয়দ সাহেব যেখানে যত আত্মীয়স্বজন আছে, কেবল এক মীর সাহেব ছাড়া সকলকেই, কোথাও আবদুল মালেককে পাঠাইয়া, কোথাও নিজে গিয়া, দাওয়াদ করিয়াছেন, রমজান মাসের ১ তারিখেই আকামত হইবে; খুব একটা ধুমধামের আয়োজন হইতেছে। সে সময়ে পূজার ছুটিও হইবে এবং আবদুল কাদেরকেও বাড়ি আনা হইবে। তখন মৌলুদ শরীফ, খাওয়াদাওয়া, ফকির খাওয়ানো, এইসব করিতে হইবে।

বেহান কিন্তু প্রথমে হালিমাকে ছাড়িতে চাহেন নাই, –আজ প্রায় চারি বৎসর সে তাহার কাছে আছে, এখন হঠাৎ চলিয়া গেলে তিনি একলা কেমন করিয়া থাকিবেন, ইত্যাদি। কিন্তু সৈয়দ সাহেব কোনো কথাই শুনিলেন না; এমনকি বেহানকে সুদ্ধ লইয়া যাইবার জন্য জেদ করিতে লাগিলেন। উভয় তরফের তর্কাতর্কির ফল এই দাঁড়াইল যে, হালিমা এক্ষণে একবালপুরে যাউক, পূজার ছুটির তো আর বেশি দেরি নাই, আবদুল্লাহ্ বাড়ি আসিলে তাহার মাতা সৈয়দ সাহেবের মসজিদ আকামতের নিমন্ত্রণ রক্ষা করিতে যাইবেন। কিন্তু ফিরিবার সময় ছেলে, বউ, মেয়ে, জামাই, সব লইয়া আসিবেন।

পূজার ছুটি আসিল; আবদুল্লাহ্ও বাড়ি আসিল। কয়েক দিন পরে আবদুল কাদের একবালপুরে আসিলে পীরগঞ্জে লোক পাঠানো হইল। আবদুল্লাহ্ মাতাকে লইয়া শ্বশুরবাড়ি আসিল।

ধুমধাম খুবই হইল। এবার আত্মীয়স্বজন কেহ কোথাও বাকি নাই। শরীফাবাদ, মজিলপুর, রসুলপুর, নূরপুর প্রভৃতি গ্রাম হইতে প্রায় সকলেই মায় সওয়ারী তশরীফ আনিয়াছেন। এমনকি, আবদুল খালেকও এবার সপরিবারে নিমন্ত্রিত হইয়াছেন।

পহেলা রমজান বাদ-মগরেব (সান্ধ্য নামাযের পর) মসজিদে মৌলুদ শরীফ শুরু হইল। ঝাড়-ফানুসে মসজিদের অন্দর ও বারান্দা আলোকময় এবং শোভাময় হইয়া উঠিয়াছে। কিন্তু লোক আর ধরিতেছে না–মসজিদ নিতান্ত ছোট নহে, ঢের লোক ধরিতে পারে; কিন্তু যিনি আসিতেছেন, তিনিই মসজিদে প্রবেশ করিয়াই দরজার কাছে বসিয়া পড়িতেছেন, কেহই মিম্বারের কাছে ঘেঁষিয়া বসিবার বেআদবিটুকু স্বীকার করিতে চাহিতেছেন না। সুতরাং আদব রক্ষা করিতে গিয়া জায়গার টানাটানি পড়িয়া গেল। অধিকাংশ লোককে বারান্দাতেই বসিতে হইল।

ক্রমেই যখন বারান্দা ভরিয়া গেল, তখনো গ্রামের নিমন্ত্রিতদের আসিতে বাকি। তাঁহারাও একে একে আসিতে আরম্ভ করিলেন। এখন বসিতে দেওয়া যায় কোথায়? আবদুল মালেক তাড়াতাড়ি আসিয়া হুকুম করিলেন, –ওরে, বাইরে একটা বড় শতরঞ্জি পেতে দে।

আবদুল্লাহ্ নিকটেই ছিল, সে জিজ্ঞাসা করিল, –বাইরে কেন?

আবদুল মালেক কহিলেন, –তবে এঁরা বসবেন কোথায়? ভিতরে তো ধরগে’ তোমার আর জায়গা নেই।

কেন থাকবে না? মসজিদের মধ্যে তো সব খালি পড়ে আছে!

তা সেখানে তো কেউ বসছে না, এখন ধরগে’ তোমার করি কী?

আচ্ছা, আমি দেখছি, দাঁড়ান–বাইরে বসানো কি ভালো দেখাবে? এই বলিয়া আবদুল্লাহ্ অতি কষ্টে বারান্দার ভিড় ঠেলিয়া মসজিদের মাঝখানের দরজাটির কাছে আসিয়া উপস্থিত হইল এবং যাহারা দরজা ঘেঁষিয়া ঠাসাঠাসি করিয়া বসিয়াছিলেন, তাহাদিগকে কহিতে লাগিল, –আপনারা একটু এগিয়ে বসুন, জনাব!

সকলেই ঘাড় ফিরাইয়া তাহার দিকে একবার চাহিল, কিন্তু কেহই নড়িয়া বসিল না।

আবদুল্লাহ্ আবার কহিল, –ঢের জায়গা রয়েছে সুমুখে, আপনারা একটু এগিয়ে না বসলে যে অনেক লোককে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়।

এই কথায় দুই-এক জন একটু নড়িয়া কেহ আধ হাত, কেহ-বা বড়জোর মুটুম হাত পরিমাণ অগ্রসর হইয়া বসিলেন। অনেক বলিয়া-কহিয়াও আবদুল্লাহ্ ইহাদিগকে আর নড়াইতে পারিল না দেখিয়া বাহিরে ফিরিয়া আসিল এবং যাহারা দাঁড়াইয়া ছিলেন, তাহাদিগকেই ভিতরে বসাইবার জন্য ডাকিয়া আনিল।

কিন্তু তাহারাও দরজা পর্যন্ত আসিয়া থমকিয়া গেলেন! কী ভয়ে যে কেহ ভিতরের খোলা ময়দানের মতো খালি জায়গায় গিয়া বসিতে চাহিতেছেন না তাহা আবদুল্লাহ্ ভাবিয়া পাইল না। অবশেষে বিরক্ত হইয়া সে বারান্দার ভিড়ের মধ্য হইতে ছোট ছোট ছেলেগুলাকে টানিয়া তুলিয়া ভিতরে ঠেলিয়া দিতে লাগিল। সে বেচারারাও ভিড়ের চাপ হইতে নিষ্কৃতি পাইয়া বাঁচিল, এদিকে বারান্দার নবাগতদিগেরও কিঞ্চিৎ স্থান হইয়া গেল।

মৌলুদ পাঠ শুরু হইয়া গেল। মৌলুদ-খান সাহেব কলিকাতার আমদানি, সঙ্গে দুই জন চেলা। তাহার গলা যেমন দরাজ, তেমনি মিষ্ট; তিনি প্রথমেই কোরান মজিদ হইতে একটি সুরা এমন মধুর কেরাতের সহিত আবৃত্তি করিয়া গেলেন যে, সকলে শুনিয়া মোহিত হইয়া গেল। তারপর উর্দু কেতাব খুলিয়া সম্মুখস্থ বালিশের উপর রাখিয়া চক্ষু বন্ধ করিলেন এবং উর্দু গদ্যে ও গজলে, কখনো-বা দুই-একটা ফারসি বয়েতে নানা সুরে কখনো-বা একা, কখনো চেলাদ্বয়ের সহিত একত্রে, রওআয়েতের পর রওআয়েত আবৃত্তি করিয়া যাইতে লাগিলেন। প্রথমেই পবিত্র মৌলুদ শরীফ শ্রবণের অশেষবিধ গুণের বর্ণনা করা হইল–কেমন করিয়া বোন্দাদবাসিনী এক ইহুদি রমণী একবার স্বপ্নে স্বয়ং হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলায়হে ওয়াসাল্লামকে প্রতিবেশী মুসলমান বণিকের গৃহে শুভাগমন করিতে দেখিয়াছিল এবং তাহাকে জিজ্ঞাসা করিয়া জানিয়াছিল যে, যে বাটীতে মৌলুদ শরীফ পাঠ করা হয় হযরত স্বয়ং এইরূপে সদা-সর্বদা সেই বাটীতে অদৃশ্যভাবে যাতায়াত করিয়া থাকেন–আবুলাহাবের বাঁদী তাহার প্রভুর নিকট হযরতের জন্ম-সংবাদ আনিয়া কিরূপ আনন্দ প্রকাশ করিয়াছিল এবং সেইদিন সোমবার ছিল বলিয়া মৃত্যুর পর কাফের থাকাবশত দোজখে গিয়াও কিরূপে প্রতি সোমবারে আজাব (নরক-যন্ত্রণা) হইতে রেহাই পাইয়া আসিতেছে–যে-ঘরে মৌলুদ শরীফ পাঠ করা হয় সেখানে কিরূপে ফেরেশতাগণের শুভাগমন হইয়া থাকে এবং তথায় কিরূপ অপূর্ব স্বর্গীয় আলোক প্রদীপ্ত হইয়া থাকে, পবিত্র হাদিস শরীফে তাহার কী কী প্রমাণ দেওয়া আছে–এসকল যথাযথরূপে বিবৃত হইল।

তাহার পর এই বিশ্বজগতের সৃষ্টির পূর্বের কথা আসিল। তখন কেবল আল্লাহতালার পবিত্র নূর এবং সেই নূর হইতে তাহারই ইচ্ছায় সৃষ্ট আমাদের নবী-করিম সাল্লাল্লাহু আলায়হেস্ সালামের পবিত্র নূর ভিন্ন আর কিছুই বিদ্যমান ছিল না। এই পবিত্র মোহাম্মদী নূর তখন এক পবিত্র স্থানে বহু আবরণের মধ্যে রক্ষিত ছিল–পরে উহা ওই সকল আবরণ হইতে বহির্গত হইয়া নিশ্বাস লইলে, সেই পবিত্র নিশ্বাস হইতে ফেরেশতাগণ, পয়গম্বরগণ এবং বিশ্বাসীগণের আত্মাসমূহ সৃষ্টি হইল। ইহার পর ওই নূর দশ ভাগে বিভক্ত হইল এবং দশম ভাগ হইতে উৎপন্ন বস্তুর দৈর্ঘ্য চারি সহস্র বৎসরের ন্যায় হইল, প্রস্থও তাহার অনুরূপ হইল। আল্লাহ্ যখন ওই বস্তুর প্রতি দৃষ্টিপাত করিলেন, তখন উহা কাপিতে কাঁপিতে অর্ধেক জল ও অর্ধেক অগ্নিতে রূপান্তরিত হইয়া গেল। ওই জল সমুদ্রে পরিণত হইল এবং সমুদ্রের তরঙ্গের ঘাত-প্রতিঘাতে বায়ুমণ্ডলের উৎপত্তি হইয়া এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের শূন্যস্থান পূর্ণ করিয়া দিল। তাহার পর সেই অগ্নির উত্তাপে সমুদ্রে ফেন ও বাষ্প এই দুইটি পদার্থ উৎপন্ন হইল; ফেন হইতে জন্মিল মৃত্তিকা এবং বাষ্প হইতে হইল আকাশ। মৃত্তিকা তখন টলমল করিতেছিল, সুতরাং তাহাকে স্থির করিবার জন্য ফেনের মধ্যে যেগুলি অত্যন্ত বৃহদাকার এবং শুভ্রবর্ণ ছিল, সেগুলিকে পর্বতরূপ পেরেকে পরিণত করিয়া মৃত্তিকায় ঠুকিয়া দেওয়া হইল। আবার পর্বতগুলির মধ্যে বিদ্যুৎ প্রবেশ করিয়া খনির সৃষ্টি করিয়া দিল।

পরে যখন আল্লাহতালা মানুষ সৃষ্টি করিলেন, তখন ওই মোহাম্মদী নূর কিরূপে হযরত আদম আলায়হেস্ সালামের পৃষ্ঠে অর্পিত হইয়াছিল, এবং অর্পণকালে তিনি পশ্চাদ্দিকে কিরূপ সুমধুর ধ্বনি শুনিয়া আশ্চর্যান্বিত হইয়া গিয়াছিলেন; কিরূপে হযরত আদমের বংশাবলির মধ্যে পর পর কাহার কাহার পৃষ্ঠে নূর প্রকাশিত হইতে হইতে অবশেষে কোরেশ বংশের বনি হাশেম শাখার আবদুল্লাহর মুখমণ্ডলে আসিয়া প্রকাশিত হইয়াছিল এবং তাহাই দেখিতে পাইয়া কিরূপে এক বুদ্ধিমতী ইহুদি সুন্দরী শেষ নবীর গর্ভধারিণী হইবার লোভে আবদুল্লাহর মনোহরণ করিয়া তাহার সহিত বিবাহিতা হইবার লোভে বৃথা চেষ্টা করিয়াছিল; যখন আমেনা খাতুনের সহিত আবদুল্লাহর বিবাহ হয়, তখন কিরূপে মক্কাবাসিনী দুই শত রূপসী যুবতী রশক ও হাসা-সে মৃত্যুমুখে পতিত হইয়াছিল; যে-রাত্রে আমেনা বিবির গর্ভসঞ্চার হয়, সে-রাত্রে কিরূপে হযরত জিব্রীল বেহেশত হইতে সবুজ রঙের পতাকা আনিয়া কাবার উপর স্থাপন করিয়াছিলেন, কিরূপে শয়তানের আকুল ক্রন্দনে আরবের উপত্যকাগুলি প্রতিধ্বনিত হইয়া উঠিয়াছিল, কিরূপে পৃথিবীর যেখানে যত দেব-দেবীর মূর্তি ছিল, সমস্তই মস্তক অবনত করিয়াছিল, কিরূপে পৃথিবীর জীবজন্তুসমূহ বাকশক্তি পাইয়া হযরতের শুভাগমন বিষয়ের আন্দোলন জুড়িয়া দিয়াছিল–এ সকল ব্যাপার পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বিবৃত হইতে লাগিল।

অবশেষে যখন আমেনা বিবির প্রসবকাল নিকটবর্তী হইল, তখন তিনি দেখিলেন যে, সূতিকাগৃহ জ্যোতির্ময়ী রমণীবৃন্দের দ্বারা আলোকিত হইয়া উঠিয়াছে। জিজ্ঞাসা করিতেই তাঁহারা কহিলেন যে, তাহারা বেহেশতের হুর, খোদাতালা কর্তৃক আমেনা বিবির সেবা শুশ্রূষার জন্য প্রেরিতা হইয়াছেন। এমন সময় একটা বিকট শব্দ হইল–আমেনা চকিতা ও ভীতা হইয়া উঠিলেন, কিন্তু তৎক্ষণাৎ এক প্রকাণ্ড শ্বেতকায় পক্ষী আসিয়া আমেনার বক্ষঃস্থলে ডানা ঘষিয়া দিল, অমনি তাহার ভয় দূর হইয়া গেল; কিন্তু ভয়ের পরিবর্তে ভয়ানক পিপাসা বোধ হইতে লাগিল। হঠাৎ কোথা হইতে এক যুবক আসিয়া পড়িলেন এবং এমন এক পেয়ালা শরবত তাহার সম্মুখে ধরিলেন, যাহা দুধ অপেক্ষাও শুভ্র এবং মধু অপেক্ষাও মিষ্ট ছিল। আমেনা তাহাই পান করিয়া সুস্থ হইলেন– যথাসময়ে হযরত ভূমিষ্ঠ হইলেন।

এইখানে মৌলুদ-খান সাহেবের ইঙ্গিতমতো মজলিসের সকলেই উঠিয়া দাঁড়াইয়া। তাহার সহিত সুর মিলাইবার বৃথা চেষ্টা করিয়া উচ্চৈঃস্বরে এয়া নবীসালাম আলায়-কা ইত্যাদি সালাম পড়িতে লাগিলেন। মৌলুদ-খান এক এক চরণ একা একা সুর করিয়া পাঠ করেন, আর চরণশেষে সকলে একযোগে এয়া নবী ইত্যাদি কোরাস ধরিয়া সুরে-বেসুরে চিৎকার করিতে থাকেন। ক্রমে সালাম পাঠ শেষ হইলে আবার সকলে বসিয়া পড়িলেন।

মৌলুদ-খান এক্ষণে কিছুক্ষণ দরুদ শরীফ পড়িলেন, এবং অনেকেই গুনগুন স্বরে তাহার সঙ্গে যোগ দিলেন। পরে হযরত রসুলে-মকবুল আহমদ মোজুতবা মোহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলায়হেস সালামের শুভ জন্মগ্রহণ মুহূর্তে পৃথিবীর কোথায় কোথায় কী কী অলৌকিক ঘটনা ঘটিয়াছিল, তাহার বর্ণনা আরম্ভ হইল। হযরত মুসা আলায়হেস্ সালাম্ তাহার শিষ্যবর্গকে (ইহুদিগণকে) বলিয়া গিয়াছিলেন যে, আকাশের বিশেষ একটি নক্ষত্র স্থানচ্যুত হইলে দুনিয়াতে কোনো নবীর আবির্ভাব হইবে। তদবধি ইহুদিগণ পুরুষপরম্পরায় সেই নক্ষত্রটি লক্ষ্য করিয়া আসিতেছিল, অদ্য সহসা উহা খসিয়া পড়িল! শাম-প্রদেশস্থ। একটি অতিথিশালার কূপ কয়েক বৎসর একেবারে শুকাইয়া গিয়াছিল, অদ্য হঠাৎ তাহা জলপূর্ণ হইয়া উঠিল! পারস্য দেশের সওয়া নামক প্রায় দশ ক্রোশব্যাপী হ্রদবিশেষ হঠাৎ শুকাইয়া গেল, এবং সাওয়া নামক মরুভূমিটি এক জলপূর্ণ বিশাল হ্রদে পরিণত হইল, পারসিক অগ্নি-উপাসকদিগের অগ্নিকুণ্ড সহস্র সহস্র বৎসর ধরিয়া অবাধে জ্বলিয়া আজ হঠাৎ নিভিয়া গেল এবং পারস্যরাজ নওশেরোআনের প্রাসাদচূড়া চূর্ণ হইয়া ভূপতিত হইল। এবং পরিশেষে কাবা মন্দিরের প্রতিমাগুলির মুখ থুবড়িয়া পড়িয়া গেল!

এইরূপ বহু অলৌকিক ঘটনার বর্ণনার পর মৌলুদ-খান সাহেব এক দীর্ঘ মোনাজাত (প্রার্থনা) করিয়া মৌলুদ শরীফ সাঙ্গ করিলেন। সমস্তই উর্দু ভাষাতে কথিত ও গীত হইল; অধিকাংশ লোকই তাহার এক বর্ণও বুঝিল না; কিন্তু তাহাতে পুণ্যসঞ্চয়ের কোনো বাধা হইল না।

যাহা হউক, মৌলুদশেষে যথারীতি মিষ্টান্ন বিতরণের পর সকলে উঠিয়া পড়িলেন। প্রতিবেশী সাধারণ লোকেরা ঘরে ফিরিয়া গেল। দুই-চারি জন আত্মীয় রাত্রের আহারের জন্য নিমন্ত্রিত হইয়াছিলেন, তাহারা রহিয়া গেলেন। সাধারণের নিমন্ত্রণ পরদিন রাত্রে।

এইরূপে বিপুল সমারোহের সহিত নূতন মসজিদের আকামত পর্ব শেষ হইল। কয়দিন ধরিয়া বাটীর প্রভু-ভৃত্য সকলেরই ক্রমাগত খাঁটিয়া প্রাণান্ত হইতে হইয়াছে। কিন্তু অন্দরমহলে যাহা কিছু খাটুনি তিনটি প্রাণীর উপর দিয়া গিয়াছে। হালিমা তো বধূ, তাহাকে খাটিতেই হইবে, কিন্তু রাবিয়া ও তাহার বোন যে খাটুনিটা খাঁটিয়াছিল, যেরূপে বাঁদীর মতো শ্রমে ও ভগ্নীর মতো যত্নে সমাগতা বিবিগণের সেবা করিতেছিল তাহাতে, সেই বিবিগণের মধ্যে যাহারা উহাদিগকে চিনিতেন না তাহারা উহাদের আভিজাত্য সম্বন্ধে সন্দিহান হইয়া এক দস্তরখানে বসিতে ইতস্তত করিতেছিলেন। এমন সময় মজিলপুরের এক বিবি, কয়েকজনকে একটু অন্তরালে লইয়া গিয়া রাবিয়াদের পরিচয় দিয়া কহিলেন, রাবিয়ার পিতামহ দ্বিতীয়বার যে বিবাহ করিয়াছিলেন, সে বিবি একটু নীচু ঘরের মেয়ে রাবিয়ার পিতা তাহারই গর্ভে জন্মিয়াছিলেন। এই কথা শুনিয়া শরীফাবাদের এক বিবি কহিলেন, হুঁ, সে আমি চালচলন দেখে আগেই ঠাউরেছিলাম! এবং সৈয়দ সাহেবের বড় বিবিকে গিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, –বেয়ান সাহেব, রাবিয়ারা কি আমাদের সঙ্গে এক দস্তরখানে বসবে?

বড় বিবি কহিলেন, না, না, ওরা কেন বসবে? ওরা খাদিমী করবেখন।

শরীফাবাদের বিবি কহিলেন—না, না, সেটা ভালো দেখাবে না। ওদের আলাদা ঘরে বসালেই হবে।

শরীফাবাদের বেয়ান আবদুল মালেকের শ্বশুর হাজী সাহেবের বিবি; এবং হাজী সাহেব হইলেন এ অঞ্চলের মধ্যে একেবারে অতি আদি শরীফ ঘর; সুতরাং তাহার কথা রাখিতেই হইল।

কিন্তু হালিমা এ কথা শুনিয়া একেবারে মর্মাহত হইল। সে তাহার শাশুড়িকে গিয়া কহিল, –তবে আমিও বসব না, আম্মা; ভাবী সাহেবাদের সঙ্গে খাবখন।

শাশুড়ি বিরক্ত হইয়া কহিলেন, –বাঃ সে কী কথা! তুমি হলে মেজবউ, বড়বউ বসবে, আর তুমি বসবে না? এরা সব কী মনে করবেন?

আর ওঁরাই বা কী মনে করবেন? আজ সারাটা দিন ওঁরা খেটে হয়রান হয়েছেন, আর তাদের না নিয়ে খাওয়া কি ভালো হবে? ওঁদের মনে যে দুঃখ দেওয়া হবে তা হলে।

শাশুড়ি কহিলেন, তা দুঃখ হলে কী করব বাপু! যে যেমন, তার তেমনভাবেই চলতে হবে তো? শরীফাবাদের বিবিদের সঙ্গে বসবার যুগ্যি ওরা নয়!

এদিকে দস্তরখান পড়িয়া গিয়াছে। বাঁদীরা শাশুড়ি-বধূকে ডাকিতে আসিয়া কহিল, বিবিরা সব বসে গেছেন!

চল বউ, আর দেরি কোরো না। বলিয়া তিনি হালিমার হাত ধরিয়া লইয়া চলিলেন। দুয়ারের কাছে আসিয়া সালেহাকে দাঁড়াইয়া থাকিতে দেখিয়া কহিলেন, রাবিয়াদের জন্যে ও-ঘরে দস্তরখান দিতে বলেছি, দিল কি না দেখে এস।

সকলে বসিয়া গিয়াছেন, বাঁদীরা সিলিপূচি (হাত ধোয়াইবার পাত্র) লইয়া একে একে হাত ধোয়াইতেছে, এমন সময় সালেহা আসিয়া মাতাকে কহিল, –তারা তো নেই! বেলার কাছে শুনলাম, এক্ষুনি তারা পাছ-দুয়ারে পালকি ডাকিয়ে চলে গিয়েছেন বলিয়া মাতার পার্শ্বে বসিয়া পড়িল।

হালিমা কাছেই ছিল, শুনিয়া তাহার মনটা বড় খারাপ হইয়া গেল। বড় বিবি মৃদুস্বরে কহিলেন, ও, গোসা করে বিবিরা চলে গিয়েছেন!

বিবিরা খাইতে বসিলেন। কেহ-বা নখে করিয়া একআধটা দানা অতি আস্তে আস্তে মুখে তুলিয়া দিতে লাগিলেন, কেহ-বা এক লোকমা মুখে দিলেন তো আর এক লোকমা কবে দিবেন তাহার ঠিকানা করা অসম্ভব হইয়া উঠিল। প্রায় এক ঘণ্টা, সকলে দস্তরখানে বসিয়া রহিলেন; কিন্তু সকলের রেকাবিতেই রাশীকৃত গোশত ও পোলাও রহিয়া গেল। শরীফ ঘরের দস্তুর অনুসারে কেহ কেহ বাটী হইতে আহার করিয়াই আসিয়াছিলেন, তাহারা কেবল সম্মান রক্ষার জন্য একবার দস্তরখানে বসিয়াছিলেন মাত্র। যাহাদিগের সত্যই পেটে ক্ষুধা ছিল, তাহারাও পার্শ্ববর্তিনীর স্থূপীকৃত রেকাবির লজ্জায় নিজের স্থূপ অধিক ক্ষয় করিতে পারিলেন না।

যাহা হউক, কোনোক্রমে আহার-পর্ব খতম হইল। বাঁদীরা সিলিচি ও বদনা লইয়া একে একে বিবিদের হাত ধোয়াইতে আরম্ভ করিল। সে হাত ধোয়ানোও এক বিষম ব্যাপার! বাঁদী বেচারিদের ঝুঁকিয়া থাকিতে থাকিতে কোমরে ব্যথা ধরিয়া যায়, তথাপি বিবি একবার এক কোষ পানি হাতে লইয়া আবার যে দ্বিতীয় কোষ এ-জীবনে লইবেন, বেচারারা এরূপ ভরসা করিতে সাহস পায় না!

হাত ধোওয়া ব্যাপার চলিতেছে, এমন সময় রাবিয়া ও মালেকাকে বারান্দার উপর উঠিতে দেখিয়া একটি অল্পবয়স্কা অদূরদর্শিনী বিবি বলিয়া উঠিলেন, –এই যে, বাঃ! এতক্ষণ কোথায় ছিলেন আপনারা? আমরা তো খেয়ে উঠলাম!

রাবিয়া বেশ একটু পরিষ্কার গলায় কহিল, –আমাকে ভাই তাড়াতাড়ি একটু বাড়িতে যেতে হল–একটা মস্ত কাজ ভুলে এসেছিলাম–না গেলে হয়তো বড় ক্ষতি হয়ে যেত…

কী এমন কাজ ছিল যে খাবার সময় তাড়াতাড়ি কাউকে না বলে চলে গেলেন?

খানকয়েক নোট বালিশের নিচে রেখেছিলাম, তখন তাড়াতাড়ি আসার সময় তা তুলে রাখতে মনে হয় নি। হঠাৎ মনে পড়ে গেল… তা থাক, আপনাদের খাওয়া হয়ে গেছে বেশ হয়েছে, আমরা তো ঘরেরই মেয়ে-বউ, আমরা খেয়ে নেবখন।

হালিমা সাড়া পাইয়া তাড়াতাড়ি কোনোমতে হাত ধুইয়া ছুটিয়া আসিল–তাহার মনে হইতেছিল, বুঝি রাবিয়ার বড়ই অভিমান ও দুঃখ হইয়াছে। কিন্তু তাহার হাসিমুখ দেখিয়া হালিমার মনের ভার অনেকটা লঘু হইয়া গেল। রাবিয়া তাহাকে দেখিয়াই বলিয়া উঠিল, বাঃ, বেশ তো! আমাদের ফেলে নিজেরা খেয়ে এলে। এখন চল, আমাদের খাওয়াবে বসে।

ইহারা চলিয়া গেলে বিবিদের মধ্যে একটা সমালোচনার গুঞ্জন উথিত হইল। কেহ কহিলেন, –যাক, বাঁচা গিয়েছে। আবার কেহ-বা কহিলেন, –হলে কী হয়? মেয়েটা খুব চালাক বটে! সবদিক বজায় রেখে গেল।

.

২৩.

মসজিদ আকামতের দিন দুই পরেই হালিমার জ্বর হইল। প্রথম দিন জ্বর তেমন বেশি হয় নাই, কিন্তু দ্বিতীয় দিনে জ্বরের বেগটা কিছু প্রবল দেখা গেল। তৃতীয় দিনও সেইভাবে কাটিল।

গ্রামে এক বৃদ্ধ কবিরাজ ছিলেন; সচরাচর তিনিই এ-বাটীর চিকিৎসা করিতেন। তাঁহাকে ডাকা হইল। রোগিণী মশারির ভিতর রহিল, তাহার পার্শ্বে একটা দোহারা রঙিন কাপড়ের পরদা লটকানো হইল। পরদার ভিতরে হালিমার মাতা, শাশুড়ি এবং আরো দুই এক জন স্ত্রী-পরিজন রহিলেন। কবিরাজ আসিয়া পরদার বাহিরে বসিলেন এবং রোগিণীর অবস্থা সম্বন্ধে নানারূপ প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন। আবদুল কাদের এক একটি প্রশ্ন শুনিয়া পরদার ভিতর যায় এবং একটু পরে আবার বাহিরে আসিয়া উত্তরটি কবিরাজ মহাশয়কে শুনায়। এইরূপে মোটামুটি অবস্থা জানিয়া তিনি একবার রোগিণীর হাত দেখিতে চাহিলেন। আবদুল কাদের ভিতরে গিয়া পরদার এক প্রান্ত সামান্য একটু উঁচু করিয়া ধরিল এবং কবিরাজ মহাশয়কে হাত বাড়াইয়া দিতে কহিল। কবিরাজ মহাশয় পরদার ভিতর হাত। বাড়াইয়া দিলেন; আবদুল কাদের তাহার হাতের আঙুল ধরিয়া হালিমার বাম হস্তের কবজির উপর ধরিয়া রহিল; কবিরাজ তিন আঙুলে নাড়ি টিপিয়া ধরিয়া যতটা সম্ভব উহার গতি অনুভব করিতে চেষ্টা করিলেন, এবং একটু পরে পরদার ভিতর হইতে হাত টানিয়া লইলেন।

নাড়ি পরীক্ষা হইয়া গেলে সকলে উৎসুক হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, কেমন দেখলেন, কবিরাজ মশায়?

কবিরাজ কহিলেন, –জ্বরটা প্রবল বটে; বাত-শ্লেষ্মর ক্ষেত্র বলে সন্দেহ হচ্ছে–তবে। ভয়ের কোনোই কারণ নেই, গোড়াতেই যখন চিকিৎসা আরম্ভ হচ্ছে, তখন ওটা কেটেই যাবে।

তাহার পর তিনি ঔষধ-পথ্যাদির ব্যবস্থা করিয়া একটি টাকা দর্শনী পাইয়া প্রস্থান করিলেন।

ঔষধ রীতিমতো চলিতে লাগিল। সঙ্গে সঙ্গে সৈয়দ সাহেবের দোয়া, তাবিজ, পানি পড়া এবং মক্কাশরীফ হইতে আনীত কোরবানি-করা উটের শুকনো গোশত ঘষা প্রভৃতিও প্রয়োগ করা হইল। কিন্তু কিছুতেই কিছু হইল না। আরো দুই দিন কাটিয়া গেল, কিন্তু রোগের কোনোই উপশম দেখা গেল না।

এদিকে আবদুল কাদেরের ছুটি ফুরাইয়াছে, আগামীকল্যই তাহাকে সদরে হাজির হইতে হইবে। স্ত্রীর এই অবস্থা; এক্ষণে কী করিবে, ভাবিয়া পাইল না। কবিরাজ বলিতেছেন, ভয় নাই; কিন্তু আবদুল্লাহর মনের সন্দেহ ঘুচিতেছে না। সে কহিল, –রোগটা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে বোধ হচ্ছে!

আবদুল কাদের কহিল, –তাই তো। এখন কী করা যায়?

আমি বলি, ডাক্তার দেখানো যাক; ও কবিরাজ-টবিরাজের কর্ম নয়।

ভালো ডাক্তার বা এখানে কই?

কেন? সদর থেকে আনা যাক।

আবদুল কাদের কহিল, –ডাক্তার দেখাতে কি অব্বিা রাজি হবেন? ডাক্তারি ওষুধের তিনি নামই শুনতে পারেন না।

তা না শুনতে পাল্লে চলবে কেন? রোগটা কঠিন তাতে সন্দেহ নেই; চল, বরং তাকে বলি গিয়ে।

কিন্তু সৈয়দ সাহেব ডাক্তারের কথা শুনিয়া প্রথমটা চটিয়াই উঠিলেন এবং কহিলেন, হ্যাঁঃ! এই রমজান শরীফে শরাবটরাব খাইয়ে এখন বউটার আখেরাতের সর্বনাশ কর আর কি! কেন, কবিরাজ মশায় তো বেশ দাওয়া দিচ্ছেন…

আবদুল্লাহ কহিল, –কিন্তু তাতে তো কোনো উপকার হচ্ছে না, জ্বর ক্রমেই বেড়ে চলেছে, তাইতে সন্দেহ হচ্ছে…

না, নাঃ! তোমরা অনর্থক সন্দেহ কচ্ছ, বাবা। আর সন্দেহ কিসের? খোদা যদি হায়াত রেখে থাকেন তো এতেই রোগ সেরে যাবে। তার উপর আমি যেসব তদ্বির কচ্ছি, এতে দেখো আল্লাহ রহম দেবে নিশ্চয়। ও-সব নাচিজ আর খাইয়ে কাজ নেই।

আবদুল্লাহ্ জেদ করিয়া কহিল, –তা হুজুর তদ্বির কচ্ছেন, ভালোই হচ্ছে। কিন্তু দোয়ার সঙ্গে দাওয়া কত্তেও তো আল্লাহতালা হুকুম করেছেন…

তা দাওয়া তো চলছেই, আবার কেন!

ও কবিরাজি দাওয়াতে বড় ফল হবে বলে বোধ হয় না; আর আজকাল ওরা সকল রোগ চিনতেই পারে না–অবিশ্যি যেটা ধত্তে পারে, ওষুধের গুণে সেটাতে উপকার দেখায় বটে…

সৈয়দ সাহেব বিরক্তির সহিত কহিলেন, –আর ডাক্তার ব্যাটারা এলেই অমনি রোগ ধরে ফেলে! তা হলে আর দুনিয়ায় কেউ মরত না।

আবদুল্লাহ কহিল, –সে কথা হচ্ছে না; ডাক্তারেরা কবিরাজদের চেয়ে অনেক বেশি। রোগী নিয়ে নাড়াচাড়া করে কিনা, তাই রোগ সম্বন্ধে এদের জ্ঞান কবিরাজদের চেয়ে বেশি। জন্মে। তা ওষুধ না হয় কবিরাজ মশায়ই দেবেন, একবার একজন ডাক্তার দেখিয়ে পরামর্শ কল্লে বোধহয় মন্দ হত না।

সৈয়দ সাহেব যেন একটু নরম হইলেন। ভাবিয়া কহিলেন, ডাক্তার দেখে আর কী-ই বা এমন বেশি বুঝবে–একটুখানি নাড়ি টিপে দেখা ছাড়া তো আর কিছু হবে না, সে তো কবিরাজও দেখছে।

আবদুল্লাহ্ কহিল, –ডাক্তারেরা নাড়ির উপর বড় বেশি নির্ভর করে না, আর আর সব লক্ষণ ধরে রোগ নির্ণয় করে।

তবে অবস্থা গিয়ে বললেই তো হয়, ডাকার দরকার কী?

কী কী অবস্থায় কোন কোন বিষয়ে সে জানতে চাইবে, তা আমরা কী করে বুঝব? ডেকে আনলে সে যা যা জিজ্ঞাসা করবে সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বলতে পারা যাবে…

কাকে ডাকবে, ঠিক করেছ?

ঠিক এখনো করি নি; আবদুল কাদের আজ শেষরাত্রেই রওয়ানা হচ্ছে, সে কাল সদর থেকে ভালো করে জেনেশুনে একজনকে নিয়ে আসবে।

কাছারি খুলবে যে কাল! কী করে আসবে ও?

ছুটি নেবে।–তা এক কাজ কল্লে হয়। নেওয়াজ ভাই সাহেবকে বরং সঙ্গে দিলে হয়। আবদুল কাদের যদি না-ই আসতে পারে, তো উনিই ডাক্তার নিয়ে আসবেনখন।

অনেক চিন্তার পর সৈয়দ সাহেব এই প্রস্তাবেই মত দিলেন; কিন্তু বারবার করিয়া সাবধান করিয়া দিলেন, যেন ডাক্তারি ঔষধ খাওয়ানো না হয়। বরং তেমন বেগতিক দেখিলে কলিকাতা হইতে হাকিম গোলাম নবী সাহেবকে আনা যাইবে।

পরদিন সদরে পৌঁছিয়াই আবদুল কাদের কোন ডাক্তারকে পাঠানো যাইবে সে সম্বন্ধে। আকবর আলী সাহেবের সঙ্গে পরামর্শ করিল। অবস্থা শুনিয়া আকবর আলী কহিলেন, — এখানকার নতুন অ্যাসিস্টান্ট সার্জন শুনিছি ডাক্তার ভালো…

কে? দেবনাথবাবু?

হ্যাঁ, হ্যাঁ, –তার বাড়ি আপনাদের ওইদিকে…

পশ্চিম পাড়ায়–ভোলানাথবাবুর ছেলে। তা উনি গেলে তো ভালোই হয়।

তা যাবেন বৈকি, বেশি দূর তো নয়…

চলুন না একবার তার কাছে…

এখনই? কাছারির সময় হয়ে এল যে!

আচ্ছা কাছারি যাবার পথে?

তাই।

বেলা প্রায় এগারটার সময় হাসপাতালে গিয়া তাহারা ডাক্তার দেবনাথ সরকারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিলেন এবং সকল কথা তাহাকে খুলিয়া কহিলেন। ডাক্তার বাবু একটু ভাবিয়া কহিলেন, আমার হাতে দুটো কেস রয়েছে, সন্ধের সময় দেখতে যাবার কথা…

আকবর আলী কহিলেন, –অমূল্যবাবুকে বলে গেলে হবে না? অমূল্য বাবুও একজন এল-এম, এফ, স্বাধীনভাবে প্র্যাকটিস করেন।

ডাক্তার একটু ভাবিয়া কহিলেন, –আচ্ছা দেখি, সাহেবকেও একবার বলতে হবে…

আবদুল কাদের কহিল, –কিন্তু আজই রওয়ানা হতে হবে–সন্ধের পরেই পৌঁছানো চাই–কাল সকালে অবস্থাটা দেখে দু প্রহরের মধ্যে ফিরতে পারবেন।

ডাক্তারবাবু কহিল–আচ্ছা আমি দেখি…

আকবর আলী কহিলেন, শুধু দেখি বললে হবে না ডাক্তারবাবু–আপনাকে যেতেই হবে।

আচ্ছা আমি একবার সাহেবের সঙ্গে আর অমূল্যবাবুর সঙ্গে দেখা করে আসি ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই আপনার আপিসে খবর পাঠাবখন…

আবদুল কাদের কহিল–নৌকা তয়ের আছে–আমি যে নৌকোয় এসেছি, আপনি সেইটেতেই যেতে পারবেন। আর দেখি যদি আমি ছুটির যোগাড় করতে পারি, তো আমিও যাবখন সঙ্গে।

ডাক্তারবাবু আশ্বাস দিয়া উঠিয়া পড়িলেন। একদিকে সৌভাগ্যক্রমে ডাক্তার সাহেব অনুমতি দিলেন এবং অমূল্যবাবুও কেস দুটি একবার দেখিয়া আসিবেন বলিয়া প্রতিশ্রুত হইলেন; কিন্তু অন্যদিকে দুর্ভাগ্যক্রমে আবদুল কাদের ছুটি পাইল না। ম্যাজিস্ট্রেট নূতন। সাহেব, লোকটা সুবিধার নহে।

যাহা হউক খোদা নেওয়াজ ডাক্তার লইয়া বেলা প্রায় দুইটার সময় রওয়ানা হইয়া গেল। খোদা নেওয়াজ মাল্লাদিগকে ডবল ভাড়া কবুল করিয়া জোরে বাহিবার জন্য উৎসাহিত করিতে লাগিল। তাহারাও প্রাণপণে বাহিয়া সন্ধ্যার পরেই একবালপুরের ঘাটে নৌকা ভিড়াইয়া দিল।

যথাসময়ে ডাক্তারবাবুকে রোগিণীর ঘরে লইয়া যাওয়া হইল। কবিরাজ মহাশয়কে যে উপায়ে হাত দেখানো হইয়াছিল, তাহাকেও সেই উপায়ে দেখানো হইল। তাহার পর তিনি থার্মোমিটার বাহির করিয়া আবদুল্লাহর হাতে দিলেন। আবদুল্লাহ্ টেম্পারেচার লইয়া আসিলে দেখা গেল, জ্বর ১০৪ ডিগ্রি উঠিয়াছে। নানারূপ জিজ্ঞাসাবাদ করিয়া ডাক্তারবাবু জানিতে পারিলেন যে, জ্বর বৈকালের দিকেই বাড়ে এবং সকালে একটু কম থাকে। নিদ্রা, কোষ্ঠ, কোষ্ঠাশ্রিত বায়ু, শরীরের কোনো স্থানে বেদনা আছে কি না, কাশি ইত্যাদি সম্বন্ধে তিনি তন্নতন্ন করিয়া জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন।

তাহার পর একটু ভাবিয়া ডাক্তারবাবু কহিলেন, চেস্ট-টা একটু এজামিন করা দরকার।

আবদুল মালেক জিজ্ঞাসা করিলেন, কী?

আবদুল্লাহ্ বুঝাইয়া দিতেই তিনি চোখমুখ উল্টাইয়া বলিয়া উঠিলেন, না, না, সে ধরগে’ তোমার কেমন করে হবে!

ডাক্তারবাবু দৃঢ়স্বরে কহিলেন, তা নইলে তো আমি কিছু বুঝতে পাচ্ছি নে। না বুঝে চিকিৎসাও তো করা যায় না।

আবদুল্লাহ্ কহিল তবে উপায়?

ডাক্তারবাবু কহিলেন, এক কাজ করুন। স্টেথসকোপটা কানে দিয়ে পরদার কাছে বসি, আপনারা কেউ ওধারটা নিয়ে যেখানে যেখানে বসাতে বলি, ঠিক সেইখানে সেইখানে চেপে ধরুন।

এখন হালিমার বুকে স্টেথসূকোপ বসাইতে যাইবে কে? সকলে এ উহার মুখের দিকে চাহিতে লাগিলেন। আবদুল মালেক আবদুল্লাহর কানে কানে জিজ্ঞাসা করিলেন, সালেহা পারবে না?

আবদুল্লাহ্ কহিল, দেখুন বলে।

আবদুল মালেক পরদার পার্শ্বে দাঁড়াইয়া সালেহাকে ইশারা করিয়া ডাকিয়া, কী করিতে হইবে, ফিসফিস করিয়া বুঝাইয়া দিলেন। ডাক্তারবাবু নলটি কানে দিয়া পরদা ঘেঁষিয়া বসিলেন, এবং প্রথমেই বুকের যেখানটায় ধুকধুক করে, সেইখানে বসাইতে বলিলেন।

কিন্তু নল কানে দিয়া মিনিট দুই বসিয়া থাকিয়াও তিনি কোনো শব্দ শুনিতে পাইলেন না; আবার কহিলেন, ভালো করে চেপে ধরুন। তবু কোনো ফল হইল না।

নাঃ, আর কাউকে বলুন বলিয়া ডাক্তারবাবু কান হইতে স্টেথকোপ নামাইয়া ফেলিলেন। ক্রমে বাড়ির স্ত্রী-পরিজন, বালক ইত্যাদি যে যেখানে ছিল, সকলকে দিয়া চেষ্টা করা হইল; কোনো ফল হইল না। যদিও-বা এক আধবার একটু শব্দ শুনিতে পাওয়া যায়, তাহাও মশারির, পরদার কাপড়ের, এবং ধবৃনেওয়ালার হাতের ঘষায় সব গুলাইয়া যায়।

নাঃ, কিছু হল না বলিয়া অবশেষে ডাক্তারবাবু উঠিয়া পড়িলেন। পরে আবদুল্লাহর দিকে চাহিয়া একটু বিরক্তির স্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন, আপনিও কি পারেন না?

আবদুল্লাহ্ মৃদুস্বরে ইংরেজিতে কহিল, যতক্ষণ এ-বাড়িতে আছি ততক্ষণ পারি না।

শ্‌শ্‌শ্‌–ননসেন্স বলিয়া ডাক্তারবাবু বাহিরে যাইবার জন্য উঠিয়া দাঁড়াইলেন।

বাহিরে আসিয়া আবদুল্লাহকে একটু আড়ালে ডাকিয়া লইয়া ডাক্তারবাবু কহিলেন, কেস সম্বন্ধে ডেফিনিট কিছু বুঝতে পারা গেল না, তবে ভাবে বোধ হচ্ছে, নিউমোনিয়া সেটু-ইন করেছে। আবদুল্লাহ্ একটু ভীত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, তবে উপায়?

উপায় সাবধানে চিকিৎসা! কিন্তু এখানে রাখলে তো চিকিৎসা চলবে না– বরিহাটীতে নিয়ে যেতে হবে।

আপনি একটু দয়া করে আসতে পারবেন না কি?

আমি আসতে পারি, কিন্তু রোজ তো পারব না! অথচ এ রোগীকে দুবেলা দেখা দরকার।

ওঃ! তবে তো বড় বিপদের কথা হল দেখি!

হ্যাঁ, তা এখানে রাখতে চাইলে বিপদের কথা বৈকি!

দেখি একবার বলে; কিন্তু এরা যেরকম গোঁড়া, তাতে যে ওকে সদরে নিয়ে যেতে দেবেন, এমন তো ভরসা হয় না।

কেন? আপনি জোর করে বলবেন; যদি বাঁচাতে চান, তবে কাল সকালেই নিয়ে যাবার বন্দোবস্ত করবেন। এর পরে কিন্তু ওঁকে রিমুভ করা আনসেফ হয়ে পড়বে।

আচ্ছা দেখি কদ্দূর কী কত্তে পারি।

তবে আমি এখন বাড়ি চলোম। কাল সকালেই একবার দেখে রওয়ানা হব। ভিজিটের টাকা লইয়া ডাক্তারবাবু চলিয়া গেলেন।

হালিমাকে সদরে লইয়া যাইবার প্রস্তাবে বৃদ্ধ সৈয়দ সাহেব তো একেবারে আকাশ হইতে পড়িলেন। বসিয়া ছিলেন–একেবারে আধ হাত উঁচু হইয়া চক্ষু কপালে তুলিয়া উঠিলেন সে কী! মান-সম্ভ্রম তোমরা আর কিছু রাখলে না দেখছি!

আবদুল্লাহ্ বেশ একটুখানি প্রতিবাদের সুরে কহিল, মান-সম্ভ্রমের কথা পরে, জান। বাঁচান আগে। ডাক্তারবাবু যেমন বললেন, তাতে এখানে রেখে চিকিৎসা চলতে পারে না, অথচ রোগ কঠিন।

সৈয়দ সাহেব বিরক্ত হইয়া কহিলেন, নাঃ, এখানে তো আর কারো কোনোদিন চিকিৎসা হয় নি, তোমরা খোদার উপর ভরসা করতে শেখ নিওটা ইংরেজি পড়ারই দোষ। খোদা যদি হায়াত রেখে থাকেন, তবে যেখানেই থাকুক না কেন, চিকিৎসা হবেই। তগদির কখনো রদ হবার নয়।

তাই বলে কি তদ্বির কত্তে খোদা মানা করেছেন?

না, তা মানা করবেন কেন? বেশ তো, তদবির কর। কবিরাজ মশায় দেখছেন, না হয় কলকাতা থেকে হাকিম সাহেবকেও আনাও। তিনি আমাদের হযরতের ঘরেও দাওয়া করে থাকেন–আর আমাদের পীর ভাই–খুব যত্ন করে দাওয়া করবেন।

আবদুল্লাহ্ কহিল, আজকালকার হাকিমদের চিকিৎসার উপর আমার বিশ্বাস নেই। ওদের সেই চৌদ্দ পুরুষের তৈরি কতকগুলো নোকা আছে, সেইগুলো আন্দাজে চালায়, যেটা খাটে সেটাতে রোগ সারে, আর যেটা না খাটে, তাতে কিছুই হয় না। হালিমার যে অবস্থা, তাতে হাকিমের হাতে দিতে আমার ভরসা হয় না। ডাক্তারি চিকিৎসাই করাতে চাই।

তা ডাক্তারি করাতে হয়, এইখানেই করাও–ও সদরে যাওয়া হবে না। আর সেখানে। নিয়ে গেলেই বা রাখবে কোথায়? বাড়ি দেবে কে তোমাকে?

কেন আকবর আলী সাহেবদের ওখানে…

কীহ্! আকবর মুন্সীর বাড়ি? তারা কোনকালের কুটুম আমাদের যে বউমাকে সেখানে পাঠাব? দু পাতা ইংরেজি পড়ে জ্ঞান-বুদ্ধি সব ধুয়ে খেয়েছ? কী বলে তুমি ওদের বাড়ি নিয়ে যেতে চাইলে! ওরা কে, তা জান? ওদের সঙ্গে যে তোমরা বসা-ওঠা কর, সেই ঢের, তার উপর আবার অন্দর নিয়ে সেখানে যাওয়া! এ কি একটা কথা হল?

বৃদ্ধের ভাবগতিক দেখিয়া আবদুল্লাহ্ প্রমাদ গনিল। সত্যই তো সেখানে আর বাড়ি পাওয়া যাইবে না। এক আকবর আলীর আশ্রয় গ্রহণ ভিন্ন কোনো উপায় নাই; কিন্তু সৈয়দ সাহেব তাহার আভিজাত্যের গর্বে হালিমাকে সেখানে লইয়া যাইতে দিবেন না। আবদুল্লাহ্ দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিয়া উঠিয়া গেল।

অনেক ভাবিয়া চিন্তিয়া কোনো উপায় স্থির করিতে না পারিয়া অবশেষে আবদুল্লাহ্ সেই রাত্রেই পশ্চিম পাড়ায় সরকার মহাশয়ের বাড়ির দিকে চলিল। সেখানে উপস্থিত হইয়া ডাক্তারবাবুর সহিত দেখা করিতে চাহিল। দেবনাথ তখন আহারে বসিয়াছিলেন। সংবাদ পাইয়া তাড়াতাড়ি আহার সারিয়া বাহিরে আসিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, খবর কী? এত রাত্রে যে!

আবদুল্লাহ্ দুঃখিত চিত্তে কহিল, খবর বড় ভালো নয় ডাক্তারবাবু। হালিমাকে তো বরিহাটীতে নিয়ে যেতে পাচ্ছি নে।

কেন, কর্তার বুঝি অমত?

অমত বলে অমত! শুনে একেবারে চটেই উঠেছেন। সেখানে এক আমাদের মুন্সী সাহেবের বাড়ি ছাড়া আর উঠবার জায়গা নেই, কিন্তু সেখানে তিনি কিছুতেই নিয়ে যেতে দেবেন না।

কেন?

তারা নাকি ছোটলোক!

ওঃ! তবে একটা বাড়ি ভাড়া নেবেনখন।

বাড়ি কোথায় পাব? মুসলমানকে কেউ বাড়ি দেয় না।

বাঃ! কেন দেবে না? চেষ্টা কল্লে নিশ্চয়ই পাবেন। ভাড়া পাবে–বাড়ি দেবে না কেন?

চেষ্টা এর আগে ঢের করে দেখা গেছে। কোনোমতেই পাওয়া গেল না। আবদুল কাদের তো আজ ক বছর মুন্সী সাহেবদের বাড়িতেই কাটিয়ে দিলে।

দেবনাথ একটু চিন্তা করিয়া কহিলেন, আচ্ছা, আমার কোয়ার্টার ছেড়ে দিই যদি তা হলে আসতে পারবেন?

আবদুল্লাহ্ একটু আশ্চর্যান্বিত হইয়া কহিল, আপনার কোয়ার্টার ছেড়ে দেবেন? আর আপনি?

আমার ফ্যামিলি তো এখন ওখানে নাই; স্বচ্ছন্দে ছেড়ে দিতে পারব। আমি হয়। বাইরের কামরাটায় থাকবখন, না হয় হসপিটাল এসিস্টেন্টের ওখানে…

সত্যিই বলছেন ডাক্তারবাবু?

বাঃ! সত্যি বলছি নে তো কি আর মিথ্যে বলছি? আমার ওসব প্রেজুডিস নেই।

আবদুল্লাহ্ আবেগভরে দেবনাথের হাত ধরিয়া কহিল, ডাক্তারবাবু, কী বলে আপনাকে ধন্যবাদ দেব তা আমি ভেবে পাচ্ছি নে। বাস্তবিক আমি…

থাক, থাক। আপনি এখন যান; গিয়ে সব বন্দোবস্ত ঠিক করে ফেলুন; কাল সকালেই রওয়ানা হতে হবে। দেরি হয়ে গেলে রোগীর অবস্থা সঙ্কট হয়ে দাঁড়াবে।

.

৪.

ডাক্তারবাবুর কোয়ার্টারটি পাওয়া গিয়াছে শুনিয়াও সৈয়দ সাহেব প্রথমটা রাজি হন নাই। কিন্তু আবদুল্লাহ্ একেবারে নাছোড়বান্দা হইয়া জেদ করিয়া হালিমাকে পরদিন বেলা দেড় প্রহরের মধ্যেই নৌকায় তুলিয়া ফেলিল। কেবল সে হালিমাকে লইয়াই ছাড়িল, এমন নহে। প্রবল বাধা ও গুরুতর আপত্তি খণ্ডন করিয়া সে সালেহাকেও লইয়া চলিল। নহিলে রোগীর শুশ্রূষা করিবে কে? আবদুল্লাহর মাতাও সঙ্গে গেলেন।

মাঝিরা নৌকা খুব টানিয়া বাহিয়া লইয়া চলিল! আসরের পূর্বেই তাহারা বরিহাটীর ঘাটে পৌঁছিলেন। নদীর তীরেই ডাক্তারবাবুর কোয়ার্টার। হালিমাকে সাবধানে পালকিতে করিয়া বাসায় উঠানো হইল। ডাক্তারবাবু বলিয়া পাঠাইলেন রোগীকে এখন একটু বিশ্রাম করিতে দেওয়া হউক; যদি একটু নিদ্রা হয় ভালোই, যদি না হয়, সন্ধ্যার পরই তিনি একবার ভালো করিয়া পরীক্ষা করিবেন।

আবদুল কাদেরের নিকট সংবাদ দেওয়া হইল; সে তৎক্ষণাৎ ছুটিয়া আসিল; এবং আবদুল্লাহ্ কেমন করিয়া এমন অসাধ্য সাধন করিল তাহা ভাবিয়া আশ্চর্য হইয়া গেল। সে হাসপাতালে গিয়া ডাক্তারবাবুকেও অশেষ কৃতজ্ঞতা জানাইয়া আসিল।

ডাক্তারবাবুর ঝি দ্বিপ্রহরে বাড়ি চলিয়া গিয়াছিল; সন্ধ্যার পূর্বেই সে আসিল। পরিবার নাই; ডাক্তারবাবু ছোট ডাক্তারবাবুর বাড়িতে খান। কাজেই ঝট-পাট দেওয়া ছাড়া তাহার আজকাল বড় একটা কাজ নাই। সে ধীরেসুস্থে বাড়ির ভিতর প্রবেশ করিয়া লোকজন দেখিয়া মনে করিল, বুঝি গিন্নি মা-রা আসিয়াছেন। তাই সে একগাল হাসিয়া ঘরে উঠিয়া গেল; কিন্তু ঘরের ভিতর সব অপরিচিত মুখ দেখিয়া অবাক হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, আপনারা কারা গো?

আবদুল্লাহ্ জিজ্ঞাসা করিল, কেন?

না, তাই জিজ্ঞেস কচ্ছি, আপনাদের নতুন দেখনু কিনা…

এমন সময় হালিমা ক্ষীণস্বরে কহিল, ভাইজান, একটু পানি!

ঝি দুয়ারের বাহিরে কপাট ধরিয়া দাঁড়াইয়াছিল। হালিমার কথা শুনিয়া সে তাড়াতাড়ি। কপাট ছাড়িয়া দিয়া পায়ের আঙুলের উপর ভর করিয়া বলিয়া উঠিল, –মা গো! এরা যে মোচম্মান! ডাক্তারবাবু কেমন নোক গো! মোচম্মান ঘরে এনেচে! আমি এই চনু, আর এস্বনি, এদের বাড়ি আর কাজ করবনি! মা গো! কী হবে গো–এই সন্ধেবেলা নাইতে হবে গিয়ে…।

এরূপ বকিতে বকিতে এবং ডিঙ্গী মারিয়া পা ফেলিতে ফেলিতে সে উঠান পার হইয়া চলিয়া গেল।

ঠিক সন্ধ্যার সময় বাবু আসিলেন।

আবদুল্লাহ্ তাড়াতাড়ি ইফতার করিয়া বাহিরে গেল এবং আবদুল কাদের খাটের উপর একটা মশারি লটকাইয়া তাহার উপর দুই পার্শ্বে দুইটি মোটা চাদর ফেলিয়া পরদা করিয়া দিল। একখানি চেয়ার আনিয়া বিছানার পার্শ্বে রাখিল। আবদুল্লাহ্ ডাক্তারবাবুকে লইয়া ভিতরে আসিল।

আবার পরদার হাঙ্গামা দেখিয়া ডাক্তারবাবু কহিলেন, এর ভেতর থেকে তো স্টেথসকোপ ইউস্ করা যাবে না!

আবদুল কাদের উৎকণ্ঠিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, কেন?

ডাক্তারবাবু একটু হাসিয়া কহিলেন, হার্ট আর লাংস-এর শব্দ অত্যন্ত মৃদু, খুব সাবধানে শুনতে হয়। এত কাপড়ের ভেতর থেকে স্টেথসকোপের নল চালিয়ে দিলে কেবল কাপড়ের ঘষার শব্দই শুনতে পাওয়া যাবে–লাংসের অবস্থা কিছুই বোঝা যাবে না। বাড়িতেও তো ওই রকম করা হয়েছিল, জিজ্ঞেস করুন আপনাদের দুলামিয়াকে।

আবদুল কাদের চিন্তিত হইয়া কহিল, তবে উপায়!

ডাক্তারবাবু কহিলেন, ওসব মশারি-টশারি তুলে ফেলুন, রোগীকে ভালো করে দেখতে দিন। না দেখে কি আন্দাজে চিকিৎসা চলে? আপনারা এজুকেটেড হয়েও যে এসব ওল্ড ফগিইজম ছাড়তে পারেন না, এ বড় আশ্চর্য!

আবদুল্লাহ্ কহিল, কি জানেন, ডাক্তারবাবু–পরদার মারামারিটা আমাদের ভেতর এত বেশি যে, এর একটু এদিক ওদিক হলেই মনে হয় বুঝি এক্ষণি আকাশ ভেঙ্গে মাথায় বাজ পড়বে! কিন্তু দরকারমতো পরদার একটু-আধটু ব্যতিক্রম কল্লে যে সত্যি সত্যিই বাজ পড়ে, সংসার যেমন চলছে তেমনিই চলতে থাকে, এটুকু পরীক্ষা করে দেখবার সাহস কারুর নেই!

ডাক্তারবাবু কহিলেন, তবে কি আমাকে আন্দাজেই চিকিৎসা কত্তে হবে?

আবদুল্লাহ্ কহিল, না, তা কল্লে চলবে কেন? এক কাজ করা যাক; রোগীর গায়ে আগাগোড়া একটা মোটা চাদর দিয়ে দিই, আপনি কাপড়ের উপর উপর থেকে স্টেথকোপ লাগিয়ে দেখুন। আবদুল কাদের কী বল?

আবদুল কাদের আমতা আমতা করিতে লাগিল। আবদুল্লাহ আবার দৃঢ়স্বরে কহিল, নেও, ওসব গোঁড়ামি রেখে দাও। ডাক্তারবাবু, আপনি মেহেরবানি করে একটু বাইরে দাঁড়ান, আমি সব বন্দোবস্ত করে দিচ্ছি।

ডাক্তারবাবু বাহিরে চলিয়া গেলেন। আবদুল্লাহর মাতা অনেক আপত্তি করিলেন। আবদুল কাদেরও লোকে শুনলে কী বলবে, আব্বা ভয়ানক চটে যাবেন, ইত্যাদি অনেক ওজর করিতে লাগিল, কিন্তু আবদুল্লাহ্ কাহারো কথায় কান দিল না। অবশেষে হালিমাও ক্ষীণ স্বরে আপত্তি জানাইল, কহিল, ভাইজান, কাজটা কি ভালো হবে? সকলেই নারাজ…

আবদুল্লাহ্ কহিল, নে, নে, তুই থাম; আমি যা কচ্ছি তা তোর ভালোর জন্যেই কচ্ছি…।

উনি যে অমত কচ্ছেন ভাইজান!

হ্যাঁঃ, ওর আবার মতামত! ওকে আমি ঠিক করে নেব, তুই ভাবিস নে। থাক পড়ে এই চাদর মুড়ি দিয়ে, নড়ি চড়ি নে। আম্মা, আপনি ও-ঘরে যান। আবদুল কাদের, ডাক ডাক্তারবাবুকে।

আবদুল্লাহ্ এরূপ দৃঢ়তার সহিত কথা বলিয়া এবং কাজ করিয়া গেল যে, কেউ আর বাধা দিবার সুযোগ পাইলেন না। কর বাবা যা ভালো বোঝ! এখন বিপদের সময়–খোদা। মা কবৃনেওয়ালা।

ডাক্তারবাবু আসিয়া যথারীতি পরীক্ষাদি করিয়া কহিলেন, একবার চোখ-মুখের ভাবটা দেখতে পাল্লে ভালো হত।

আবদুল্লাহ্ কহিল, আর কাজ নেই ডাক্তারবাবু; আজ এই পর্যন্ত থাক। এরপর যদি দরকার হয়, না হয় দেখবেন। লাংসের অবস্থা কেমন দেখলেন?

চলুন, বলছি বলিয়া ডাক্তারবাবু বাহিরে আসিলেন। আবদুল কাদের ও আবদুল্লাহ্ পশ্চাৎ পশ্চাৎ আসিল। ডাক্তারবাবু কহিলেন, নিউমোনিয়া!

আবদুল্লাহ্ শঙ্কিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, একধারে, না দুইধারেই?

ডান দিকটায় তো খুব স্পষ্ট, বাঁ-দিকটাতেও একটু কনজেশ্চান্ বোধ হচ্ছে।

তা হলে তো ভয়ের কথা!

হ্যাঁ একটু ভয়ের কথা বৈকি! তবে শুশ্রূষা ভালো রকম চাই। ওষুধ তো চলবেই; সঙ্গে সঙ্গে বুকে পিঠে অনবরত পুলটিস দিতে হবে। ঠিক যেমন যেমন বলে দেব, তার যেন একটুও ব্যতিক্রম না হয়। নার্সিঙের উপরেই সমস্ত নির্ভর কচ্ছে। আর একটা কথা ইনজেকশন ট্রিটমেন্ট কত্তে পাল্লে ভালো হয়—

আবদুল কাদের জিজ্ঞাসা করিল, সে কী রকম?

এক রকম সিরাম বেরিয়েছে, সেটা চামড়া ফুঁড়ে পিচকারি করে দিতে হয়। রোগের প্রথম অবস্থায় দিতে পাল্লে খুবই ফল পাওয়া যায়। এখনো সময় আছে, –কিন্তু সিরাম। কলকেতা থেকে আনাতে হবে। চিঠি লিখে সুবিধে হবে না; কি তার করেও সুবিধে হবে না–কার দোকানে পাওয়া যায় না-যায়, অনর্থক দেরি হয়ে যেতে পারে। কাউকে যেতে হবে–আজ রাত্রের গাড়িতেই…

আবদুল্লাহ কহিল, তা বেশ, আমিই না হয় যাচ্ছি–এখনো ট্রেনের সময় আছে।

তাই যান। আমি লিখে দিচ্ছি–স্মিথ কি বাথগেট কি আর কোনো সাহেব-বাড়ি থেকে নেবেন–ফ্রেশ পাওয়া যাবে। আর নিতান্তই ওদের ওইখানে না পান, তো অগত্যা বটকৃষ্ণ পালের ওখানে দেখবেন। কালকের গাড়িতেই ফেরা চাই কিন্তু পরশু সকালেই ইনজেকশন দিতে হবে।

ডাক্তারবাবু প্রেসক্রিপশন লিখিয়া এবং শুশ্রষার বিষয়ে ভালো রূপ উপদেশাদি দিয়া সব-অ্যাসিস্ট্যান্ট সার্জনের বাসায় চলিয়া গেলেন। আবদুল কাদের কহিল, দেখ ভাই, তুমি থাক, আমিই কলকেতায় যাই…।

আবদুল্লাহ্ একটু আশ্চর্য হইয়া কহিল, কেন?

তুমি না থাকলে আমার দ্বারা ওসব হাঙ্গামা হয়ে উঠবে না ভাই–বড় ভয় হয়, কী কত্তে কী করে বসব–আমি ওসব বড় একটা বুঝি-সুঝি নে…।

আবদুল্লাহ্ একটু ভাবিয়া কহিল, তুমি যাবে কী করে? ছুটি যদি না পাও?

কাল যে রবিবার!

ওহ হো? তাও তো বটে। আচ্ছা, তুমিই যাও, আমি থাকছি।

পরদিন প্রাতে কলিকাতায় পৌঁছিয়া আবদুল কাদের বরাবর তাহার পিতার পীর সাহেবের বাড়িতে গিয়া উঠিল, এবং সাক্ষাতে যথারীতি তাঁহার কদমবুসি করিয়া হালিমার অবস্থা এবং তাহার আগমনের কারণ সমস্ত আরও করিল। শুনিয়া তিনি কহিলেন, –আচ্ছা, বাবা, দাওয়া করো আওর দোআ-ভি করো! মায় সুফী কো তোহারে সাথ ভেজ দেতা, যো যো তদ্বির মায় বাতা দেউঙ্গা উওহ্ ঠিক ঠিক করে গা—এন্‌শা আল্লাহ্ আওর কোই খাওফ নেহি রহে গা।

পীর সাহেব যাহাকে সুফী বলিয়া নির্দেশ করিলেন তিনি তাহার একজন প্রধান মুরীদ। তাহার প্রকৃত নাম সফিউল্লাহ্; কিন্তু ধার্মিক লোক বলিয়া সকলে তাহাকে সুফী সাহেব বলিয়া ডাকিত। পোশাক তিনি ঠিক সুফী ধরনেরই পরিতেন; কখনো রঙিন লুঙ্গি, কখনো ঢিলা পায়জামা, তাহার উপর আগুলফ লম্বিত ঢিলা কোর্তা, এবং সর্বোপরি ঘন-ঘুণ্টি দেওয়া দ্বিতীয়ার চাঁদের মতো গোল পকেটওয়ালা বেগুনি মখমলের সদৃরিয়া আঁটা, মাথায় কলপ দেওয়া রেশমি সুতার কাজ-করা সাদা টুপি, পায়ে দিল্লিওয়ালা নাগরা–দেখিলে লোকে তাহাকে পরম সুফী বলিয়া ভক্তি না করিয়া থাকিতে পারিত না। লেখাপড়া বড় কিছু শেখেন নাই; তবে মছলেকায় কোরান মজিদের পারা দশেক মুখস্থ করিয়া নিম-হাফেজ হইয়াছিলেন। দেশে তাহার বড় কিছু নাই–এইখানেই পড়িয়া থাকেন আর হযরতের হুকুম তামিল করেন। কলিকাতাতেই জনৈক পীর-ভাইয়ের এক বিধবা আত্মীয়াকে পীর সাহেবের হুকুমেই বিবাহ করিয়াছেন। সংসারের কোনো চিন্তা-ভাবনা নাই, নিশ্চিন্ত মনে এবাদত বন্দেগি করেন আর পীর সাহেবের মজলিসে বসিয়া অবসর কাল কাটাইয়া দেন।

আবদুল কাদের ঔষধ ক্রয় করিতে যাইবার জন্য বাহির হইবে মনে করিতেছে এমন সময় তাহার খালাতো ভাই মজিলপুরের ফজলুর রহমান আসিয়া উপস্থিত হইল। সে আবদুল কাদেরকে দেখিয়া কহিল, বাঃ, ভাই সাহেব যে! কখন এলেন? বলিয়া কদমবুসি করিল।

আবদুল কাদের কহিল, এই সকালে। তুমি এখানে কদ্দিন?

বলছি, থামুন বলিয়া ফজলুর রহমান আবদুল কাদেরকে পার্শ্ববর্তী কামরায় লইয়া গেল। সেখানে তক্তপোশের উপর বসিয়া ফজলু কহিতে লাগিল, আমি এবার ডেপুটিশিপের জন্য ক্যান্ডিডেট হয়েছি। বি-এটা পাস করতে পাল্লে কোনো কথাই ছিল না–তবে হযরত আশা দিচ্ছেন, বলছেন, চেষ্টা কর, খোদার মরজিতে হয়ে যাবে। তা উনি যখন এতটা বলছেন তখন আমার তো খুবই ভরসা হয়–কী বলেন ভাই সাহেব?

আবদুল কাদের কহিল, সে তো বটেই–ওঁর দোয়ার বরকতে কী না হতে পারে!

হ্যাঁ–ভাই, একবার চেষ্টা করে দেখছি–অনেক সাহেব-সুবার সঙ্গে দেখাও করেছি। সেদিন আমাদের কমিশনার ল্যাংলি সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম, তিনি খুব খাতির-টাতির করলেন–উঠে দাঁড়িয়ে শেকহ্যান্ড করে বসলেন–উঠে দাঁড়িয়ে, বুঝলেন ভাই সাহেব?

তা হলে বোধহয় তোমার চান্স আছে। ম্যাজিস্ট্রেট নমিনেশন দিয়েছে?

কমিশনার সাহেব বললেন, আমার কেসে সেসব লাগবে টাগবে না–একেবারে গভর্নমেন্ট থেকে হয়ে যাবে বোধহয়। তিনি আমাকে চিফ সেক্রেটারির সঙ্গে দেখা করতে বললেন…

করেছ দেখা?

না–করব এই দুই-এক দিনের মধ্যে। কমিশনার সাহেবের সঙ্গে দেখা করে এই পরশু কলকেতায় এসেছি। হযরত যেদিন যেতে বলবেন সেইদিন যাব। উনি যখন দোয়া কচ্ছেন, তখন হয়ে যাবে নিশ্চয়–কী বলেন ভাই সাহেব?

খুব সম্ভব হয়ে যাবে…

সম্ভব কেন! হবেই নিশ্চয়–আমার খুব বিশ্বাস।

বেশ তো, হয় যদি, সে খুব সুখের বিষয় হবে।

ফজলুর রহমান জিজ্ঞাসা করিল, তা আপনি এখন কী মনে করে?

তোমার ভাবীর বড্ড অসুখ…

কী–কী অসুখ?

নিউমোনিয়া…

বাপ্ রে! নিউমোনিয়া! কে দেখছে?

ডাক্তার দেবনাথ সরকার–বরিহাটীর অ্যাসিস্ট্যান্ট সার্জন। বেশ ভালো ডাক্তার আমাদের ওদিকেই বাড়ি–তিনি এই ওষুধ লিখে দিয়েছেন, আজই কিনে নিয়ে রাত্রের গাড়িতে ফিরতে হবে। আবদুল কাদের প্রেসক্রিপশন বাহির করিয়া দেখাইল।

ওঃ–নিউমোনিটিক সিরাম। হ্যাঁ, আজকাল সিরাম ট্রিটমেন্টই হচ্ছে। তা কোত্থেকে নেবেন?

কোনো সাহেব-বাড়ি থেকে নিতে হবে।

চলুন তবে বাথগেটের ওখান থেকে কিনে দেবখন।

তা হলে তো ভালোই হয়, আমি ওসব সাহেব-টাহেবদের দোকানে কখনো যাই। নি, –তুমি সঙ্গে গেলে ভালোই হয়।

আচ্ছা যাবখন খেয়েদেয়ে দুপুরবেলা।

দ্বিপ্রহরের আহারাদির পর দুই জনে ট্রামে চড়িয়া বাথগেটের দোকানে গেল। সেখান হইতে ঔষধ কিনিয়া চাঁদনী হইতে আরো কিছু জিনিসপত্র সগ্রহ করিয়া বাসায় ফিরিবার জন্য তাহারা ট্রামে চড়িল। ট্রাম চলিতে লাগিল; কিন্তু কন্ডাক্টর টিকিট নিতে আসিল না। ক্রমে যখন ট্রাম তাহাদের নামিবার স্থানের নিকটবর্তী হইয়া আসিল, তখন সে আসিল। আবদুল কাদের পয়সা বাহির করিতেছিল, কিন্তু ফজলুর রহমান তাড়াতাড়ি দুয়ানি বাহির করিয়া কহিল, –থাক থাক, আমিই দিচ্ছি– বলিয়া দুয়ানিটা কন্ডাকটরের হাতে দিয়া একটু ইশারা করিল। কন্ডাক্টর চলিয়া গেল।

আবদুল কাদের কহিল, ও কী! টিকিট না দিয়েই চলে গেল যে?

যাকটিকিট নিতে গেলে আরো চারটে পয়সা দিতে হত–ছ পয়সা করে কিনা। ও দু আনা ওরই লাভ–আমাদেরও কম লাগল।

সেটা কি ভালো হল? ঠকানো হল যে!

ওঃ! আপনি পাড়াগায় থাকেন কিনা! এমন ঠকানো তো সব্বাই ঠকাচ্ছে… বলিতে। বলিতে উভয়ে ট্রাম হইতে নামিয়া বাসার দিকে চলিল।

সন্ধ্যার পর খানা খাইবার সময় পীর সাহেব সুফী সাহেবকে হালিমার রোগের জন্য যে যে তদ্বির করিতে হইবে তাহা বুঝাইয়া দিলেন। রাত্রি নয়টার সময় আবদুল কাদের তাহাকে লইয়া একখানি গাড়ি করিয়া স্টেশনের দিকে রওয়ানা হইল। ফজলুর রহমানও তাহাদিগকে গাড়িতে তুলিয়া দিবার জন্য সঙ্গে আসিল। গাড়ির ছাদে একটা বড় গোছের ট্রাংক, প্রকাণ্ড একটা বিছানার মোট, এবং কতকগুলি পোটলা-পুঁটলি দেখিয়া কুলিরা আসিয়া ঘিরিয়া দাঁড়াইল। সকলে গাড়ি হইতে নামিলে একটা কুলি আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, কৌ কিলাস কে টিকিট মুন্সীজী?

ফজলুর রহমান কহিল, ইন্টার।

কুলি জিজ্ঞাসা করিল, টিকিট হায়, না করূনা হোগা? করুনা হোয় তো জলদি কিজিয়ে, পয়লা ঘণ্টা হো গিয়া।

আচ্ছা, আচ্ছা, হাম জানতা হায়। বলিয়া ফজলুর রহমান গাড়োয়ানকে জিনিসপত্র নামাইতে কহিল। কুলি নিম্নস্বরে কহিল, কেয়া বখশিশ মিলেগা কহিয়ে, বিনা ওজনকে চড়া দেগা।

আবদুল কাদের কহিল, আরে নেই, নেই, হামলোগ ওজন করা লেগা।

ফজলুর রহমান কহিল, আপনি আসুন না ভাই সাহেব, আমি দিচ্ছি সব ঠিক করে। এই কুলি, কেন্যা লেগা বোলো।

কুলি কহিল, –একঠো রুপিয়া মিল যায়, নবাব সাব!

আরে নেই নেই, আট আনা দেগা, চড়া দেও।

নেই সাব–-আপ লোক আমীর আমী, একঠো রুপিয়া দে দিজিয়েগা।

তব্‌ নেহি হোগা, যাও…।

কুলি যাইতে যাইতে কহিল, যাইয়ে ওজন করাইয়ে, দো তিন রুপিয়া লাগ্‌ জায়েগা।

আবদুল কাদের কহিল, তা লাগে লাগুক, ওসব ঠকামি দিয়ে কাজ নেই।

ফজলুর রহমান একটু অগ্রসর হইয়া কহিল, –এই কুলি, আরে চল কুছ কম লেও…

বারে আনা দিজিয়েগা?

আচ্ছা চল।

নেই, ঠিক ঠিক কহ্ দিজিয়ে–বারে আনা পয়সা লেঙ্গে, ইস্ সে কমতি নেহি হোগা!

আচ্ছা আচ্ছা, দেঙ্গে চল! জারা ঠারো, হাম্‌ টিকিট লে আতে হেঁ।

আবদুল কাদেরের রিটার্ন টিকিট ছিল, কেবল সুফী সাহেবেরই জন্য টিকিট কিনিতে হইবে। ফজলুর রহমান ভিড়ের মধ্যে ঢুকিয়া পড়িল। তাহার পর প্রায় পনের মিনিট হইয়া গেল, তবু সে ফিরিতেছে না দেখিয়া আবদুল কাদের উদ্বিগ্ন হইয়া তাহাকে খুঁজিতে গেল! কিন্তু টিকিটঘরে তাহাকে কোথাও দেখিতে পাইল না। এদিক-ওদিক খুঁজিয়া না পাইয়া ব্যস্ত হইয়া ফিরিয়া আসিতেছে, এমন সময় ফজলুর রহমান অন্য একদিক হইতে আসিয়া পড়িল। আবদুল কাদের কহিল, এত দেরি হল? আমি আরো তোমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম।

ব্যস্ত হচ্ছেন কেন? গাড়ির এখনো ঢের সময় আছে। চলুন।

সুফী সাহেব খাক-থু করিয়া থুতু ফেলিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, টিকিট হো গিয়া, ফজলু মিয়া?

হ্যাঁ, চলিয়ে, দেতে হেঁ বলিয়া ফজলু সকলকে লইয়া গাড়িতে গিয়া উঠিল। গেটের ভিতর দিয়া আসিবার সময় আবদুল কাদের জিজ্ঞাসা করিল, কুলিরা কোথায় গেল? ফজলর রহমান হাত চাপিয়া ধরিয়া কহিল, চুপ, আসুন, তারা আচে।

ইন্টার ক্লাস কামরার ধারে তাঁহারা দাঁড়াইয়া আছেন, এমন সময় কুলিরা অন্যপথে প্ল্যাটফর্মে ঢুকিয়া তাহাদের সম্মুখে আসিল। জিনিসপত্র তুলিয়া কুলি বিদায় করিয়া ফজলু নিম্নস্বরে কহিল, দেখুন, একটা লোকের কাছে একখানা রিটার্ন হাফ পাওয়া গেল। আজ শেষ তারিখ। তার যাওয়া হল না। আট গণ্ডা পয়সায় দিয়ে ফেলে। বেচারার সবটাই মারা যাচ্ছিল, আমাদেরও প্রায় ডেট্টাকা বেঁচে গেল।

সুফী সাহেব একবার খাক–থু করিয়া একগাল হাসিয়া কহিলেন, ও ফজলু মিয়া, আপ তো বড়া চালাক হায়। আপনে আজ বহুত পয়সা বাঁচা দিয়া।

ঘণ্টা পড়িল। তাড়াতাড়ি দুই জনে গাড়িতে চড়িয়া বসিলেন। ফজলুর রহমান বিদায় লইয়া গেল। গাড়ি ছাড়িয়া দিল।

.

২৫.

বরিহাটীতে ফিরিয়া আসিয়া আবদুল কাদের দেখিল তাহার পিতা আসিয়াছেন। দেখিয়াই তো তাহার চক্ষুস্থির! এক্ষণে হালিমার চিকিৎসার কী উপায় হইবে, তাহাই ভাবিতে গিয়া পিতার কদমবুসি করিতে সে যেটুকু বিলম্ব করিয়া ফেলিল, তাহা নিতান্তই দর্শনটুকু হইয়া উঠিল।

পিতা যথাসম্ভব ক্রোধ চাপিয়া কহিলেন, তোমরা বাকি কিছু রাখলে না, দেখছি!

আবদুল কাদের জিজ্ঞাসা করিল, কেন, আব্বা?

ডাক্তারকে নাকি দেখানো হয়েছে?

হ্যাঁ, তা চাদর মুড়ি দিয়ে তো ছিল!

থাকলই-বা! কোন্ শরীফের ঘরের বউ-ঝিকে এমন করে ডাক্তারকে দিয়ে পরীক্ষে করাতে দেখেছ? আর কি মুখ দেখাবার যো রইল? আবার শুনছি গা ছুঁড়ে দাওয়াই দেওয়া হবে–ওই ডাক্তারের সামনে বউ-মা গা আলগা করে দেবেন?

হাতের উপরটা একটুখানি আগা করে…

তা হলে বে-আবরু হল না? তোমরা কি জ্ঞান-বুদ্ধি একেবারে ধুয়ে খেয়েছ? আমি যদ্দিন আছি, বাবা, তদ্দিন এসব বে-চাল দেখতে পারব না। যা হবার তা হয়ে গেছে– ওসব ডাক্তারি-ফাক্তারির কাজ নেই, বাড়ি নিয়ে চল, আমি হাকিম সাহেবকে আনাচ্ছি– হযরতের কাছ থেকেও দোয়া-তাবিজ আনিয়ে দিচ্ছি, খোদা চাহে তো তাতেই আরাম হয়ে যাবে।

তার কাছে গিয়াছিলাম…

গিয়েছিলে? তবু ভালো! তা তিনি কী বললেন?

সুফী সাহেবকে পাঠিয়ে দিয়েছেন…

সুফী সাহেবকে?–কই, কোথায় তিনি?

বাইরের ঘরে আছেন।

সৈয়দ সাহেব তাড়াতাড়ি সুফী সাহেবের সঙ্গে দেখা করিতে চলিলেন।

আবদুল্লাহ কহিল, এখন উপায়?

তাই তো, কী করি!

চল ডাক্তারবাবুর কাছে যাওয়া যাক, দেখি তিনি কী বলেন।

ব্যাপার শুনিয়া ডাক্তারবাবু কহিলেন, কেসের এখনো প্রথম অবস্থা, কোনো খারাপ টার্ন নেয় নি। তবে ভবিষ্যতের জন্যে সাবধান হওয়া দরকার। কেবল ওষুধেও ফল যে না হয়। এমন কথা নয়–ওষুধ আর শুশ্রূষা। কিন্তু ইনজেকশন কয়েকটা দিতে পাল্লে অনেকটা নিশ্চিন্ত হওয়া যেত।

তাহার পর একটু ভাবিয়া তিনি আবার কহিলেন, এক কাজ কল্লে হয়। আপনারা কেউ দিতে সাহস করবেন?

আবদুল্লাহ্ কহিল, কী, ইনজেকশন?

আবদুল কাদের তাড়াতাড়ি কহিলেন, না, না, তার কাজ নেই…

ডাক্তারবাবু কহিলেন, কেন, ভয় কী? ইনজেকশন দেওয়া অতি সহজ। আমি দেখিয়ে দিচ্ছি।

আবদুল্লাহ কহিল, আমাদের হাতে আবার কোনো বেকায়দা না হয়ে পড়ে…

না, না, কিছু হবে না। আপনি বরং আমার হাতেই দিয়ে একবার প্র্যাকটিস করে নেন!

এই বলিয়া ডাক্তারবাবু যন্ত্রপাতি বাহির করিলেন এবং সেগুলি যথারীতি পরিষ্কার করিয়া আবদুল্লাহকে কহিলেন, আসুন, আপনার হাতে একবার ছুঁড়ে দেখিয়ে দি।

আবদুল্লাহর বাহুমূলে হাইপোডার্মিক সিরিঞ্জের সুচটি ফুটাইয়া দিয়া ডাক্তারবাবু প্রক্রিয়াগুলি বেশ করিয়া বুঝাইয়া দিলেন। তাহার পর সেটি বাহির করিয়া আবার পরিষ্কার করিলেন, এবং নিজের বাহুমূল বাহির করিয়া দিয়া কহিলেন, –এখন দিন দেখি আমাকে একটা ইনজেকশন।

আবদুল্লাহ্ নির্দেশমতো সাবধানে ডাক্তারবাবুর বাহুমূলে রীতিমতো টিংচার-আইওডিন মালিশ করিয়া সুচটি প্রবেশ করাইয়া দিল। তাহার পর যেই নলদণ্ডটি টিপিতে যাইবে, অমনি ডাক্তারবাবু বাধা দিয়া কহিলেন, থাক থাক, ওটা আর এখন টিপে অনর্থক খানিকটা বাতাস ঢুকিয়ে দেবেন না।

আবদুল্লাহ নিরস্ত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, ঠিক হয়েছে তো?

ডাক্তারবাবু হাসিয়া কহিলেন, হ্যাঁ, ঠিক হয়েছে, ওতেই চলবে। তবে আমার হাতে হলে ব্যথাটা কম লাগত।

যাহা হউক, ডাক্তারবাবুর প্রদর্শিত প্রণালীতে যথারীতি সতর্কতা অবলম্বন করিয়া আবদুল্লাহ্ হালিমার বাহুমূলে ইনজেকশন করিয়া দিল।

ঔষধাদি রীতিমতো চলিতে লাগিল। এদিকে সৈয়দ সাহেব এবং সুফী সাহেব উভয়ে পীরসাহেবের আদেশমতো তদবির করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। হালিমার গলায় এবং বাহুতে তাবিজ বাধিয়া দেওয়া হইল, এবং দুই বেলা পীর সাহেবের দোয়া লেখা কাগজ ধুইয়া ধুইয়া খাওয়ানো হইতে লাগিল।

কিন্তু রোগীর শুশ্রূষা যেরূপ হওয়া উচিত সেরূপ হওয়া অসম্ভব হইয়া পড়িল। আবদুল্লাহর মাতা একে রুগ্ণা, বৃদ্ধা; এই রমজানের সময় তিনি আর কতই-বা খাটিতে পারেন! রান্নার কাজ প্রায় সব তাহাকেই করিতে হয়, নইলে রোগীর পথ্য পর্যন্ত প্রস্তুত হয় না। পুলটিস দেওয়া যেরূপ বৃহৎ ব্যাপার তাহাতেই দুই জন লোককে ক্রমাগত নিযুক্ত থাকিতে হয়; কিন্তু লোকাভাবে তাহা রীতিমতো দেওয়া ঘটে না; আবদুল্লাহ একটু বাহিরে গেলে ঔষধ খাওয়াইবারও সময় বহিয়া যায়। আবদুল কাদেরের কাজ অনেক, বেলা দশটা। হইতে প্রায় সন্ধ্যা পর্যন্ত তাহাকে আপিসে থাকিতে হয়। সালেহার তো জায়নামাজ আর তসবি আছেই; তাহার ওপর সন্ধ্যার পর তারাবির নামাযে খাড়া হইলে আর তাহাকে পাওয়া। যায় না; সুতরাং পরিচর্যা চলিতে পারে না। বাঁদীগুলা তো কেবল চিৎকার করা ছাড়া অন্য কোনো কাজ জানেই না!

ভাবিয়া চিন্তিয়া আবদুল্লাহ আবদুল খালেকের নিকট পত্র লিখিল।

এদিকে রোগীর অবস্থার আর বিশেষ কোনো পরিবর্তন দেখা যাইতেছে না– কোনোদিন জ্বরের বৃদ্ধি, কোনোদিন কাশির বৃদ্ধি–কিন্তু ডাক্তারবাবু বলিতেছেন, ভয়ের এখনো কোনো কারণ নাই। তবু আর একবার ফুসফুঁসের অবস্থাটা দেখিতে পারিলে ডাক্তারবাবু নিশ্চিন্ত হইতে পারিতেন; কিন্তু তাহার উপায় নাই। তিনি কদিন আর এ বাড়িতে আসেনই নাই; আবদুল্লাহ্ গিয়া অবস্থা জানাইতেছে এবং তিনি শুনিয়া ও টেম্পারেচার-চার্ট দেখিয়া ব্যবস্থা দিতেছেন।

সেদিন শুক্রবার। সুফী সাহেব জুমার নামায পড়িবার জন্য মসজিদে যাইতে চাহিলেন। মসজিদ বলিয়া একটা কিছু বরিহাটীর সদরে নাই। তবে মুসলমান পাড়ায় নিষ্ঠাবান পিয়াদা চাপরাসীরা আকবর আলী সাহেবের নেতৃত্বে চাদা তুলিয়া একটা টিনের জুমা-ঘর প্রস্তুত করিয়া লইয়া আজ কয়েক বৎসর হইতে তাহাতেই জুমা ও ঈদের নামায পড়িয়া। আসিতেছে। সৈয়দ সাহেব পিয়াদা-চাপরাসীদের সঙ্গে নামায পড়িতে যাইবার জন্য মোটেই উৎসুক ছিলেন না; কিন্তু সুফী সাহেবের প্রস্তাবে অমত করিতেও পারিলেন না। সুতরাং তাহাকে বিরস মনেই যাইতে হইল।

জুমা-ঘরে পৌঁছিয়া তাঁহারা দেখিলেন, প্রায় পঁচিশ-ত্রিশ জন লোক জমিয়াছে। কেহ কালাল-জুমা পড়িতেছে, কেহ-বা পড়া শেষ করিয়া বসিয়া আছে। সৈয়দ সাহেবকে অনেকেই চিনিত, তাহাকে দেখিয়া তাহারা তটস্থ হইয়া তাড়াতাড়ি সরিয়া গিয়া সম্মুখের কাতারে তাঁহাদিগের জন্য স্থান করিয়া দিল। তাহারা অগ্রসর হইয়া কালাল-জুমা পড়িতে আরম্ভ করিলেন। আর আর সকলে পশ্চাতে বসিল, প্রথম কাতারে কেহই বসিতে সাহস করিল না।

কিছুক্ষণ পরে আকবর আলী সাহেবের সহিত একজন পাগড়িওয়ালা মৌলবী এবং আরো কয়েকজন মুসল্লি মসজিদে প্রবেশ করিতে করিতে উপস্থিত সকলকে মৃদুস্বরে সালাম সম্ভাষণ করিল। অনেকেই ঘাড় ফিরাইয়া তাহাদিগকে দেখিল এবং যথারীতি প্রতি-সম্ভাষণ করিল। সৈয়দ সাহেবের কাবলাল-জুমা তখনো শেষ হয় নাই।

পাগড়িওয়ালা মৌলবী সাহেব অগ্রসর হইয়া সৈয়দ সাহেবের পার্শ্ব দিয়া, সম্মুখস্থ পেশ নামাজের উপর গিয়া কালাল-জুমা পড়িতে লাগিলেন। আকবর আলী সঙ্গী কয়জনকে লইয়া সৈয়দ সাহেবের সহিত প্রথম কাতারে স্থান লইলেন। সৈয়দ সাহেব নামায শেষ করিয়া একমনে মাথা নিচু করিয়া বসিয়া নীরবে দোয়া-দরুদ পড়িয়া যাইতে লাগিলেন।

সানি আযান হইয়া গেল। এক্ষণে জুমার নামায শুরু হইবে। পাগড়িওয়ালা মৌলবী সাহেব খোবা পাঠ করিবার জন্য কেতাব হাতে লইয়া, মুসল্লিগণের দিকে ফিরিয়া দাঁড়াইলেন। সৈয়দ সাহেব তাহাকে এক নজর দেখিয়া লইবার জন্য মাথা উঁচু করিলেন।

সেই পাগড়িওয়ালা মৌলবী সাহেবকে দেখিবামাত্র সৈয়দ সাহেবের চেহারা ভয়ঙ্কর রকম বদলাইয়া গেল! ঘৃণায় ও রাগে কাপিয়া কাপিয়া কেয়া হায়, এত্তা বাৎ! বলিতে বলিতে বৃদ্ধ উঠিয়া দাঁড়াইলেন।

না জানি কী ঘটিয়াছে মনে করিয়া অনেকেই সেইসঙ্গে উঠিয়া দাঁড়াইল। আকবর আলী সাহেব ব্যস্ত সমস্ত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, কী, কী সৈয়দ সাহেব, কী হয়েছে?

সৈয়দ সাহেব ক্রোধে উন্মত্তের ন্যায় হইয়া চিৎকার করিয়া বলিয়া উঠিলেন, এত বড় আস্পর্ধা ওর! ব্যাটা জোলা, পাগড়ি বেঁধে এমামতি কত্তে এসেছে?

আকবর আলী দৃঢ়স্বরে কহিলেন, কেন, তাতে কী দোষ হয়েছে? উনি তো দস্তুরমতো পাস-করা মৌলবী, ওঁর মতো আলেম এদেশে কয়টা আছে, সৈয়দ সাহেব?

এঃ! আলেম হয়েছে! ব্যাটা জোলার ব্যাটা জোলা, আজ আলেম হয়েছে, ওর চৌদ্দ পুরুষ আমাদের জুতো বয়ে এসেছে, আর আজ কিনা ও আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে এমামতি করবে, আর আমরা ওই ব্যাটার পেছনে দাঁড়িয়ে নামায পড়ব?

পাগড়িওয়ালা মৌলবী সাহেব ধীরভাবে কহিলেন, এটা আপনার বাড়ি নয়, সৈয়দ সাহেব, এটা মসজিদ, সে-কথা আপনি ভুলে যাচ্ছেন।

সৈয়দ সাহেব রুখিয়া উঠিয়া কহিলেন, চুপ রহ্, হারামজাদা! আভি তুঝকো জুতা মাকে নেকাল দেঙ্গে।

মুসল্লিগণের মধ্য হইতে এক ব্যক্তি বলিয়া উঠিলেন, উনি কোহাকার লাট সাহেব গো? আমাগোর মৌলবী সাহেবের গালমন্দ দিতি লাগলেন যে বড়! এ আমারগোর জুমা ঘর, দে তো দেহি কেমন করে ওনারে বার করে দিতি পারেন উনি!

আর একজন কহিল, ওনারেই দেও বার করে–ওসব সয়েদ ফয়েদের ধার আমরা ধারি নে–

আকবর আলী তাহাদিগকে নিরস্ত করিয়া কহিলেন, সৈয়দ সাহেব, এটা আপনার অন্যায়। কেতাবমতো ধত্তে গেলে মুসলমানের সমাজেই উঁচু-নীচু বিচার নেই; তাতে আবার এটা খোদার ঘর–

সৈয়দ সাহেব বাধা দিয়া কহিলেন, তাই বলে জোলা তাঁতি নিকেরি যে-সে জাতের পেছনে দাঁড়িয়ে নামায পড়তে হবে? ভালো চাও তো ওকে এক্ষুনি বের করে দাও, ওর পেছনে আমরা নামায পড়ব না।

সমবেত লোকের মধ্য হইতে একটা প্রতিবাদের কলরব উঠিল। একজন চিৎকার করিয়া বলিয়া উঠিল, উনি না পড়েন উনিই বেরিয়ে যান না কেন? আমরা মৌলবী সাহেবকে দিয়ে নামায পড়াবই।

চলে আইয়ে সুফী সাহেব। শালা জোহা-লোক জাহা মৌলভী বন্‌কে ইমাম হোতা হায়, ওহ ভালে আদ্মী কা রান্না দোরস্ত নেহী। এই বলিয়া সৈয়দ সাহেব সুফী সাহেবকে টানিয়া বাহিরে লইয়া আসিলেন। সুফী সাহেব বাহিরে আসিয়া একবার খাক–থু করিলেন এবং সৈয়দ সাহেবের পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিয়া গেলেন। অতঃপর নির্বিবাদে জুমার নামায শুরু হইয়া গেল।

গরম মেজাজে বাসায় আসিয়া সৈয়দ সাহেব যাহা দেখিলেন, তাহাতে তাহার মেজাজে একেবারে আগুন লাগিয়া গেল। তিনিও ঘরে ঢুকিতেছেন, ডাক্তারবাবুও স্টেথসকোপ গুটাইয়া পকেটে ভরিতে ভরিতে বাহির হইতেছেন। পশ্চাতে আবদুল্লাহ্ এবং বারান্দায় খোদা নেওয়াজ।

সৈয়দ সাহেব থমকিয়া দাঁড়াইয়া চক্ষু লাল করিয়া একবার প্রত্যেকের মুখের দিকে চাহিয়া দেখিলেন। ডাক্তারবাবু বরাবর বাহির হইয়া চলিয়া গেলেন।

তোমাদের নিতান্তই কপাল পুড়েছে, আমি দেখছি। যা খুশি তাই কর তোমরা কিন্তু আমি এখানে আর এক দণ্ডও নয়। খোদা নেওয়াজ, যাও, নৌকা ঠিক কর গিয়ে। সওয়ারী যাবার নৌকা চাই।

খোদা নেওয়াজ ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করিল, সওয়ারী কেন, হুজুর?

সৈয়দ সাহেব চটিয়া উঠিয়া কহিলেন, যা বলি তাই কর, কৈফিয়ত তলব কোরো না।

খোদা নেওয়াজ চলিয়া গেল। সৈয়দ সাহেব গুম হইয়া বসিয়া রহিলেন। কিছুক্ষণ পরে আবদুল্লাহ্ জিজ্ঞাসা করিল, এদের সকলকে কি নিয়ে যাবেন?

সৈয়দ সাহেব কহিলেন, না। কেবল সালেহাকে নিয়ে যাব। তোমাদের এসব বে-পরদা কারবারের মধ্যে ওকে আমি রাখতে চাই নে। বউমাকে নিয়ে তোমরা যা খুশি তাই কর। ছেলেই যখন অধঃপাতে গেছে তখন বউ নিয়ে কি আমি ধুয়ে খাব?

আবদুল্লাহ্ বলিতে যাইতেছিল যে তাহার স্ত্রীকে সে যাইতে দিবে না। কিন্তু আবার ভাবিল, তাহাকে রাখিয়াও যে বড় কাজের সুবিধা হইবে, এমন নয়; বরং তাহাকে ধরিয়া রাখিতে গেলেই শ্বশুরের সঙ্গে একটা মনোবিবাদের সৃষ্টি হইয়া যাইবে, এবং স্ত্রীরও মনে কষ্ট দেওয়া হইবে। সুতরাং সে স্থির করিল, বাধা দিয়া কাজ নাই।

এক্ষণে আবদুল কাদেরকে সংবাদ দেওয়া উচিত বিবেচনা করিয়া আবদুল্লাহ্ তাড়াতাড়ি আপিসের দিকে চলিল। পথেই আবদুল কাদেরের সহিত তাহার দেখা হইল। খোদা নেওয়াজ তাহাকে আগে খবর দিয়া পরে নৌকা ঠিক করিতে গিয়াছিল।

আবদুল কাদের ব্যস্ত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, আব্বা নাকি সকলকে নিয়ে যেতে চাচ্ছেন?

কেবল সালেহাকে।

তাকে তুমি নিয়ে যেতে দেবে?

তা যাক না সে; সে তো কোনো কাজেই লাগছে না। আর ছোট তরফের ভাইজানকেও চিঠি লিখেছি; তিনিও হয়তো এসে পড়বেন–নেওয়াজ ভাইকেও বলে দেবখন তাকে শিগগির পাঠিয়ে দিতে। তোমার আর এখন বাসায় গিয়ে কাজ নেই–অনর্থক একটা বকাবকি মন-কষাকষি হবে। উনি যে যাচ্ছেন, এটা খোদার তরফ থেকেই হচ্ছে; থাকলে কেবল হাঙ্গামা কত্তেন বৈ তো নয়।

আবদুল্লাহর পরামর্শমতো আবদুল কাদের আবার আপিসে চলিয়া গেল। খোদা নেওয়াজ নৌকা ঠিক করিয়া আসিল। বৈকালেই সৈয়দ সাহেব সালেহাকে লইয়া রওয়ানা হইলেন। যাইবার সময় আবদুল্লাহর মাতা আপত্তি করিয়াছিলেন, কিন্তু আবদুল্লাহ্ তাঁহাকে বুঝাইয়া নিরস্ত করিয়াছিল। সুফী সাহেব রহিয়া গেলেন।

ঠিক সন্ধ্যার সময় আবদুল খালেক আসিয়া পৌঁছিলেন। সঙ্গে স্ত্রী রাবিয়া, পুত্র এবং মালেকা, একজন মামা এবং একজন চাকর।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *