২১-২৫. কাচারি বাড়ি পৌঁছে

২১.

কাচারি বাড়ি পৌঁছে চক্ষু স্থির মালুর। এলাহি কাণ্ড কাচারি বাড়ির ময়দানে। কারা যেন মাতম জুড়েছে। অদ্ভুত ওদের ভাব-ভঙ্গি। সংখ্যায় ওরা তিরিশ কী চল্লিশ হবে, কিন্তু গোটা মাঠ জুড়ে ওদের বিচিত্র তাণ্ডব। কেউ বা এলোপাতাড়ি লাফ ঝাঁপ দিয়ে চলেছে। কেউ বা বুক চাপড়ে কপাল থাপড়ে মাতম করছে। গায়ে ওদের জামা নেই কারও। পরনে শুধু কম্বল, তাও মাতমের ঘোরে কখন যে কোমর থেকে খসে পড়ছে–খেয়াল নেই ওদের। কেউবা কোনো রকমে আঙ্গুল দিয়ে কম্বলটাকে ধরে রেখেছে মাত্র।

ওরা যে যিকির করছে তাতে সন্দেহ নেই মালুর। কেননা মুখে ওদের আল্লাহর কালাম। কিন্তু এ কোন্ ধারা যিকির! এমন তো কখনো দেখেনি মালু?

ওদের চোখ বোঁজা মুখে বিচিত্র তন্ময়তা। ওরা যেন বেহুঁশ দেওয়ানা। কিন্তু হাত-পায়ের সঞ্চালন কেমন উগ্র। সে উগ্রতাকে ছাড়িয়ে হঠাৎ কী এক করুণ বিলাপের সুরে ভেঙে পড়ছে ওরা, পর মুহূর্তেই যেন লড়াইয়ের হুংকার ছেড়ে লাফিয়ে উঠছে, ধপ করে পড়ছে মাটিতে। একই সাথে হু হু বিলাপ আর হুংকার মিলিয়ে বিচিত্র এক শব্দ নির্ঘোষ বাতাস দুলিয়ে মাটি কাঁপিয়ে কোনো ভিন্ন জগতের আবহাওয়া সৃষ্টি করেছে কাচারি বাড়ির মাঠে। কেমন ভয় ভয় করে মালুর। গায়ের লোমগুলো ওর দাঁড়িয়ে যায়। পর মুহূর্তেই আবার ওদের ঢোলকের তাল দেহের শিরায় কী এক নাচন তুলে যায়, ওদের দেওয়ানা নৃত্য বুঝি দর্শকদেরও ডাক দিয়ে যায়। বড় গোছের একটা ভিড় জমেছে ওই মস্তানাদের ঘিরে।

কিছু দূরে কয়েকজন কম্বলধারী একান্ত বৈষয়িক কাজে ব্যস্ত। কেউ হ্যাজাক জ্বালাচ্ছে, কেউ শান দিচ্ছে ছুরিতে। কয়েকজন মাটি খুঁড়ে ইট বসিয়ে কাজ-চালান উনুন বানাচ্ছে। এক পাশে গোটা তিন জবাই করা খাসি-ছাগল ছটফট করছে এখনো। আরও একটা খাসি বাঁধা রয়েছে মাঠের কোণে নারকেল গাছটার সাথে। চমকে উঠল মালু, এ-যে রাবু আপার খাসিটা! রক্ত জবজব মাটিতে ছটফটিয়ে কী কাতর গোঙানি তুলছে জবাই করা খাসিগুলো, রাবুর খাসিটা সেদিকে চেয়ে রয়েছে, করুণ ভয়ার্ত ওর চোখ জোড়া। কাচারি ঘরের পেছন দিয়ে ঘুরে সেই নারকেল গাছটার কাছে পৌঁছে গেল মালু। চটপট খুলে দিল দড়িটা। পরিচিত লোক দেখে চোখ তুলে তাকাল খাসিটা। গলা দিয়ে কেমন অস্কুট একটা শব্দ করল। গভীর এক অন্তরঙ্গতায় মাথাটা বার দুই ঘষে দিল মালুর পায়ের সাথে। তার পর ছাড়া পেয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল পাশের গেণ্ডারী ক্ষেতের নিরাপত্তায়। মস্তানারা যিকিরে ব্যস্ত। এদিকে কম্বলধারীরা ব্যস্ত রান্নার আয়োজনে। কেউ লক্ষ করল না মালুকে।

মস্তানাদের কাছাকাছি সরে এল মালু। দাড়ি-গোঁফের আড়ালে মুখগুলো ওদের ঢাকা। বাবরি চুলের গোছা তেল-সাবানের অভাবে জটা পাকিয়েছে, যেন অনেক যুগের কালি-ঝুলি মাথার চাঁদি থেকে ঝুলে রয়েছে। খতিয়ে খতিয়ে দেখেও একটা চেনা লোক বের করতে পারল না মালু। অবাক হয় মালু। দিব্যি জাঁকিয়ে বসেছে লোকগুলো, যেন ওদেরই ঘর-বাড়ি। অথচ বাড়ির লোক মালু চিনতে পারছে না কাউকে।

সহসা যিকির থেমে গেল। ঢোলের আওয়াজ স্তব্ধ হল। মস্তে মাওলারা বুঝি ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। গোল হয়ে বসে পড়েছে সবাই। শুধু জনা দুই হাঁটু গেড়ে মাটিতে মুখ গুঁজে উপুড় হয়ে পড়ে রয়েছে। থর থর কাঁপছে ওদের শরীর। ওদের ক্লান্ত কণ্ঠ ভেঙে নিঃসারিত হচ্ছে ক্ষীণ আওয়াজ–আল্লাহু আল্লাহু। এখনি হয়ত যযবা উঠবে ওদের। এটা তারই পূর্ব লক্ষণ।

হঠাৎ সন্ধ্যার আনমনা বাতাসকে চমক দিয়ে ঝংকার তোলে দোতারার মিষ্টি বোল। আর যেন মন্ত্র নির্দেশে থেমে যায় সমস্ত কোলাহল। যারা খাসির ছাল ছাড়াচ্ছিল, যারা রান আর সিনার গোসতগুলো কেটে কেটে পৃথক পৃথক ভাণ্ডে রাখছিল তারাও ছুরিটাকে পাশে রেখে উৎকর্ণ হয়। যারা তামাশা দেখছিল তারাও কান খাড়া করে।

নিবিষ্ট দোতারার মারফতি সুর পাখা মেলে দেয় সন্ধ্যার মিঠেল বাতাসে। এক মনে অনেকক্ষণ ধরে তারের গায়ে আঙ্গুল চালিয়ে যায় মস্তানা শিল্পী। সুরের দমকে শিল্পী বুঝি মানুষগুলোকে টেনে নিয়ে যায় মাটির ঊর্ধ্বে কোনো দূরের দুনিয়ায়। হঠাৎ সুর পাল্টায় ও, গান ধরে। সকল মস্তানা কণ্ঠ মিলায়। গানের প্রথম কলিটা কানে যেতেই চোখ যেন খুলে গেল মালুর। মস্তানাদের পরিচয় পেয়ে খুশিই হল ও। রাবু আপার আব্বার কীর্তিই। তা না হলে সৈয়দ বাড়িতে এমন শেরেকী তাণ্ডব অনুষ্ঠানের দুঃসাহসটা কারই বা হবে! কিন্তু, কোথায় তিনি? সেই কবে একদিন কী দুদিনের জন্য তাকে দেখেছিল মালু। ছোট্টটি ছিল ও, মনেও নেই তার মুখ। তবু ওর মনে হয় সমবেত গানে যার ভূমিকাটা প্রধান, তিনিই হবেন রাবু আপার আব্বা। হ্যাঁ নাকে চোখে আর কপালে ঠিক রাবু আপার মুখের ঢক। তার পাশেই উপুড় হয়ে যে মস্তানা যিকিরের ক্ষীণ আওয়াজ তুলে চলেছে তার শরীরের কাঁপুনিটা যেন বেড়ে গেছে।

ঢোলকের মৃদু তালে একতারার ঝংকারে শির দুলিয়ে দুলিয়ে গেয়ে চলেছে মস্তানার দল!

ভাণ্ডারিতে আজবী কারবার
ওহহ কী চমৎকার।
সাজাইল মারফতের তরী
দেখবি যদি আয়
চড়বি যদি আয়-আহা মাইজ ভাণ্ডার,
ওহো কী চমৎকার।
ভাণ্ডারীতে আজবী কারবার।
ওরে হিন্দু-মুসলমান।
তোরা দেশে দশে এক প্রাণ
তোরা ভক্তি কর আওলিয়ার চরণ
ওরে চিন্তা ভবে নাই আর
ওহো কী চমৎকার,
ভাণ্ডারীতে আজবী কারবার।

কী-ই-বা গানের কথা, কী-ই-বা তার ভাব। তবু অন্তর নিঃসৃত ভক্তির রস ঢেলে ওরা সৃষ্টি করে অপূর্ব এক সুর দ্যোতনা। ওরা বুঝি জাত-শিল্পী। মজনু হৃদয়ের গভীর অনুভূতি আর ভাব-জগতের কোনো অদৃশ্য অপার্থিবকে স্পর্শ করার আকুলতা, বুঝি গানের সুরে ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্ব চরাচর কাঁদিয়ে তুলেছে এই সাঁজ রাতের মৌন প্রকৃতিটাকে। মালু দেখল মস্তানাদের চোখ ভাসিয়ে দর দর বেগে নেবে আসছে পানির ধারা।

কাচারি ঘরের দোরগোড়ায় এসে মালুর চোখটা যেন হোঁচট খেয়ে থমকে দাঁড়ায়। সেখানেই বুঝি আজকের এই মস্তানা দঙ্গলের সব চেয়ে বড় বিস্ময়। ঘন নীল পশমী গালিচা বিছিয়ে বসে রয়েছেন ফর্সা নুরানী চেহারার এক বুজুর্গ। মেহেদী রঞ্জিত দাড়ির ঢলে বুক তার ঢাকা। তেল চকচকে মসৃণ কলপ দেওয়া বাবরি। মেয়েদের মতো মাথার মাঝ বরাবর সিঁথি কাটা। দুটি পুষ্প স্তবকের মতো কোঁকড়ানো বাবরি দুভাগ হয়ে ঝুলে পড়েছে দুপাশে, কান জোড়া ঢেকে রেখেছে। অন্যদের অঙ্গাবরণের অভাবটি তিনি একলাই যেন পুষিয়ে দিয়েছেন। জামা জোব্বায় ভরা তাঁর গা। পরনে তার পাজামা। গায়ে আচকান। আচকানের উপর পাতলা চীনা সিল্কের ঢিলা চোগা। চোগার গায়ে বিচিত্র বুটি, বুকের পাড়ে, বোতামের ঘরে জরি সুতোর সূক্ষ্ম কারুকার্য। হ্যাজাকের আলো পড়ে ঝিকিমিকি ছড়ায় তাঁর জরি চুমকির রেশমি পোশাক, ঝিলিক দিয়ে যায় চেহারার নুরানী চমক। গানের সুরে তিনিও হেলছেন-দুলছেন, কখনো বা চোখ বুজছেন ধ্যানের তন্ময়তায়। এক সময় থেমে যায় দোতারার ঝংকার।

পূর্ণ বেশ বুজুর্গ একটু নড়েচড়ে আচকানের খুঁটটা টেনে চোগার ছড়ান প্রান্তটাকে আর একটু মেলে দিলেন। পর পর তিনটে হাততালি দিলেন। মেহেদীরাঙ্গা দাড়ির অরণ্যে ঘনঘন আঙ্গুল চালিয়ে একটু কেসে গলাটা পরিষ্কার করে নিলেন। তারপর আবৃত্তি আর কাওয়ালির মাঝামাঝি এক বিচিত্র ঢংয়ে গলা ছাড়লেন :

লাইলাহা ইল্ললাহ
মাফিকলমা গায়রুল্লাহ
হাসরে রাব্বি সাল্লেল্লাহ

বিস্ময়ে যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চায় মালুর চোখ জোড়া। এমন কণ্ঠ কখনো শোনেনি ও। মিহিও নয়, দরাজও নয়। মিষ্টিও বলা চলে না। অথচ কান পেতে শুনতে ইচ্ছে জাগে। কী এক মরমি আবেগে যেন জাদুময় এ কণ্ঠ।

লোকটির পোশাক-আশাক চেহারার চমক দেখে আগেই ধরে নিয়েছিল মালু এ-ই মস্তানা দলের নায়ক।

এবার বুঝি নিঃসন্দেহ হল ও। কেননা গোটা মস্তানার দল গভীর এক ভক্তির সাথে শুনে গেল তার বচন। দলপতির শেষ হবার সাথে সাথেই ওরা বাকীটা ধরে। সুর তুলে, তাল ঠুকে গেয়ে চলে। বিচিত্র এক সুরের সাথে পরিচয় হল মালুর। মাতমের উন্মত্ততা নেই। মারফতী টানের অন্তর নিঙড়ানো আবেগ নেই। কখনো উচ্চতানে, কখনো নীচু খাদে একটি শান্ত পবিত্রতা যেন ধীরে ধীরে শব্দ তরঙ্গে উৎসারিত হয়ে চলেছে।

ভালো লাগে মালুর। ওদের সাথে মালুও তাল ঠোকে।

এ পর্বও শেষ হয়ে গেল।

তারপর যে অবাক কাণ্ডটি ঘটলো তাতে মালুর গায়ের লোমগুলো সজারুর কাঁটার মতো দাঁড়িয়ে পড়ল। বুকের রক্ত হল হিম।

যে দুজন মস্তানা বেহুশের মতো এতক্ষণ উপুড় হয়ে পড়েছিল, তারই একজন এই নবকাণ্ডের নায়ক। উপুড় হয়ে পড়ে আছে তো পড়েই আছে লোকটি। ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে এসেছে মুখের বোল। মনে হয় যেন বিকারের ঘোরে কঁকাচ্ছে একজন নেতিয়ে পড়া মানুষ। হঠাৎ বুঝি দৈত্যদানোর শক্তি ভর করল ওর গায়ে। হাত-পা তেমনি গোটানো অবস্থায়ই বিকট চিৎকার করে লাফিয়ে উঠল ও। এতক্ষণে বুঝি যযবা এসেছে ওর। শক্ত মাটির আঘাতে নিশ্চয় চামড়া ফেটে একাকার হয়েছে লোকটার, চোখা চোখা ঘাসের কামড় নিশ্চয় ঘা তুলেছে ওর সর্বাঙ্গে। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই ওর। ডাঙ্গায় পড়া মাছের মতো কী এক অস্থিরতায় লাফিয়ে লাফিয়ে ও চলে যায় অনেক দূর। তারপর পুকুর পাড়ের বেত ঝোঁপে আটকা পড়ে কাঁটায় কাঁটায় ক্ষত বিক্ষত হয়। একটু পরেই হাত-পা ছেড়ে দেয়। বোধ হয় পুরোপুরি জ্ঞান হারিয়েছে লোকটি।

সাথীরা গিয়ে ধরাধরি করে নিয়ে এল ওর দিগম্বর দেহটা। একমাত্র পরিধেয় সেই কম্বলখানি রয়ে গেল বেতের ঝোঁপে।

এমনি করেই চলে ওদের মারফত লাভের সাধনা, পুলসেরাতের পুলটা পার হবার শক্তি আরাধনা। এমনিভাবে দেওয়ানা হয়ে দেশে দেশে ঘুরে বেড়ায় ওরা। পথের উপরে মাইজভাণ্ডারী কোনো শিষ্যের আতিথ্য নিয়ে যিকির করে বিশ্রামও করে।

মালুর মনে হল সুবেশ বুজুর্গ বোধ হয় মারফতের তীরটা পেয়ে গেছেন। অন্যদের এখনো সাধন-ভজনের পালা চলছে। তাই বুজুর্গ দলপতি। সেই কারণেই বুঝি তার এই আভিজাত্যিক দূরত্ব, ওই চমকদার লেবাস। রাবুর আব্বা বলে যাকে স্থির করে নিয়েছে মালু সেই দেওয়ানা দঙ্গল ছেড়ে অন্দর বাড়ির দিকে পা ফেলল। মালু তার পিছু নিল।

অন্দর বাড়িতে বেধেছে হুলুস্থুল কাণ্ড। বাক্স তোরঙ্গ আর মাল টানাটানির ঘড় ঘড় শব্দে মুখর দালান ঘর। ছুটোছুটি করছে চাকরানীর দল। আরিফা কাঁদছে।

 হুরমতি মেহেদী মাখছে রাবুর হাতে আর গজ গজ করছে : পাগলের কথা আর বলেছে কাকে? বউটাকেও খেয়েছে, এখন মেয়েটাকেও খেতে এসেছে। সৈয়দগিন্নী শুয়ে রয়েছেন নামাজের চকিতে। গোটা ব্যাপারটায় তাঁর যেন কিছুই বলার বা করার নেই।

এই রাবু, খবরদার বলছি।-ঘর থেকে এক পা নড়েছিস কী কখনো তোর মুখ দেখব না। কান্না থামিয়ে চিৎকার করে উঠে আরিফা। দরবেশ, রাবুর আব্বাকে এই নামেই ডাকে সবাই, ঘরে ঢুকতেই উঠে দাঁড়ায় রাবু।

যাও, এবার গোসল করে এসো–বলেই আবার বেরিয়ে যায় দরবেশ। রাবু আপার বিয়ে? বুঝি একটি আর্তচিৎকার বেরিয়ে এল মালুর গলা ছিঁড়ে। রাবু, একবার চোখ তুলে চাইল, যেন বলল–চুপ। ঘর ছেড়ে বারান্দায় এল রাবু। গোসলখানার দিকে মোড় নিল। দুহাত মেলে ওর পথটা আগলে দাঁড়াল আরিফা। উন্মাদ ব্যাকুলতায় চেঁচিয়ে উঠল আরিফা : তুইও কী পাগল হলি রাবু?

ওই বুড়োটাকে বিয়ে করবি তুই? চালচুলো আছে ওর? আর আমি হলফ করে বলছি ও ব্যাটার নিশ্চয় বউ রয়েছে কয়েক জোড়া। শেষে কী সতীনের পানি টানবি তুই? রাবুর কোমরটা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আরিফা।

ছাড় বড় আপা। কেমন বিরক্তিমাখা রাবুর কণ্ঠ।

কখনো না। চল, ঘরে খিল এঁটে শুয়ে পড়ি আমরা। তুই রাজি না থাকলে কখনো হতে পারে বিয়ে?

তুই তো বলছিস বড় আপা। কিন্তু আব্বা ক্ষেপলে কী কাণ্ড বাধাবে ভেবে দেখেছিস?

ক্ষিপ্ত দরবেশ যে কী অনর্থ ঘটাতে পারে সে কাহিনী শুনেছে ওরা। এত শুনেছে যে মনে হয় ওদেরই চোখের দেখা ঘটনা। সে বছর দশেক আগের কথা। রাবু-আরিফা ছোট্টটি তখন। ঘর ছাড়া হয়েও দরবেশ তখন বার দুই ঘুরে গেছে বাকুলিয়ায়।

সেই উন্মত্ত রাতে দরবেশের রাগের কী যে কারণ ঘটেছিল জানে না কেউ। শুধু কয়েকটা কথা কাটাকাটি, তারপর গোটা দুই লাথি। পরদিন একটি মরা ভাই এল রাবুর। দুদিন বাদ রাবুর আম্মাকেও গোর দেয়া হয়েছিল। যে কাহিনী স্মরণ করে আজও রাবু-আরিফা শিউরে ওঠে।

তবু বলল আরিফা : যা খুশি দরবেশ চাচা করুকগে। তুই শুধু বলবি–না। আর লম্বা হয়ে শুয়ে থাকবি চল। আরিফা ওকে টেনে নিয়ে যায় ঘরের দিকে।

আহা ছাড় বড় আপা। এক ঝটকায় ছুটে যায় রাবু।

তবে মর হতভাগী। থপথপ করে পা ফেলে চলে যায় আরিফা। তারপর কাঁদতে বসে। অনেকক্ষণ থেকেই রাবুকে বিরত করার চেষ্টা করেছে আরিফা। ব্যর্থ হয়েছে। ও আর পারে না। আগুনে ঝাঁপ দিয়ে মরবে বলে যে কৃত-সংকল্প তাকে কেমন করে ঠেকিয়ে রাখবে ও। কিন্তু রাবু কী জানে কোন্ আগুনে ঝাঁপ দিচ্ছে ও?

মাঝ রাতে কলেমা পড়ে নিকাহ্ হয়ে গেল রাবুর।

শুধু ঢিপ ঢিপ করে মালুর বুকটা। একী কাণ্ড ওর চোখের সুমুখে।

দেওয়ানা হলেও বৈষয়িক বুদ্ধিতে বুঝি কম যায় না ওরা। খবর দিয়ে কাজী আনিয়েছে। কাজীর দস্তখতে পাকাপোক্ত হয়েছে বিয়ে। কাবিন তৈরি হল। রসুলে করীমের অনুকরণে দেনমোহর ধার্য হল নামমাত্র এক টাকা পাঁচ পয়সা।

নামাযের চৌকিতে সেই যে শুয়েছিলেন, শুয়েই ছিলেন সৈয়দগিন্নী। অবাক হচ্ছিল মালু। ইচ্ছে করলে তিনি, একমাত্র তিনিই দরবেশকে ধমকে দিতে পারেন, দুঘর প্রজাকে খবর পাঠিয়ে ওই মস্তানাগুলোকে খেদিয়ে দিতে পারেন বাড়ি থেকে। অথচ তিনি নির্বাক। রাবু না হয়ে যদি হত আরিফা অমন নির্লিপ্ত থাকতে পারতেন সৈয়দগিন্নী? কথাটা হঠাৎ মনে হল মালুর আর সৈয়দগিন্নীর উপরই ওর মনের যত রাগ গিয়ে স্তুপীকৃত হল। কিন্তু কাবিনের কথা শুনেই ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলেন সৈয়দগিন্নী। যেন বলক খেয়ে উঠল তার খানদানী রক্তটা। দেওরের কাছে রীতিমতো কৈফিয়ৎ চেয়ে বসলেন : এ সব বিয়ে সাদির ব্যাপার, ফাজলামো, না ইয়ার্কি? কোন কালে কে শুনেছে সৈয়দ বাড়ির মেয়েদের কাবিন তিরিশ হাজারের নিচে? দেওর নিরুত্তর। অতএব দেওরকে ছেড়ে বুজুরগকে নিয়ে পড়লেন সৈয়দগিন্নী। বুজুরগ নির্বিকার। কাবিনের অংক নিয়ে এমন ঠেলাঠেলি, বাদানুবাদের ঝামেলা অনেকবারই হয়ত পোহাতে হয়েছে তাঁকে। মিঞা-বিবির কবুল যখন হয়েই গেছে তখন আর ভাবনা কী!

চল্লিশ হাজারের কম দেনমোহরে সৈয়দ বাড়ির মেয়ে কেউ ছুঁতে পারবে না, পষ্ট জানিয়ে দিচ্ছি আমি। বুঝি চরম কথাটা জানিয়ে দিলেন সৈয়দগিন্নী।

কিন্তু কলেমা খতম। উভয় পক্ষেরই সই পড়ে গেছে কাবিননামায়। দেওয়ানারা তাই একটুও বিচলিত হল না সৈয়দগিন্নীর চরম নোটিশে। দস্তখত করা কাবিননামাটা ভাবীর চোখের সুমুখে মেলে ধরলেন দরবেশ দেওর। একবার দস্তখত করা কাবিনের উপর চোখ বুলিয়ে সেই নামাযের চৌকিতেই আবার শয্যা নিলেন সৈয়দগিন্নী।

মুখ টিপে টিপে মিষ্টি মিষ্টি হাসত সেই মেয়েটি। চৌদ্দ বছরের রাবু। মৃতা মায়ের বিয়ের শাড়ি বেনারসি আর বিয়ের হার বিছে হারখানা পরে ও এল বাসর ঘরে। পিতার বৃদ্ধ পীরের আলিঙ্গনে ও পেল নারীত্বের প্রথম অভিজ্ঞতা। হয়ত শেষ। পুরুষ অভিজ্ঞতা হয়ত আর কখনো আসবে না ওর জীবনে। হয়ত চিরকালের জন্যই ওর অচেনা থেকে গেল পুরুষের সেরা সম্পদ যৌবন নামের সেই পরম বিস্ময়।

২২.

সবে সকাল হয়েছে।

সূর্যটা মাটি ছেড়ে মাত্র কয়েক হাত উপরে উঠে এসেছে।

আল ছেড়ে গ্রামের রাস্তায় উঠল ওরা।

ইস, ধকল কী কম গেল? হাঁটাই বা কম হল কী! আমার তো গা হাত পা টনটন করছে দিন দুই কোনো কথা নয়, স্রেফ ঘুম। কথাটা শেষ করে সেকান্দরের মুখের দিকে তাকায় জাহেদ। বলে আবার : মাস দুয়েকের ছুটি নিয়ে নাও তুমি, নইলে স্কুল কামাই করছি, ছেলেদের ক্ষতি হচ্ছে; এসব খুঁতখুঁতি যাবে না তোমার মন থেকে। ছুটি নিলে বিবেকটাও তোমার সাফ থাকবে, কাজও হবে ভালো।

আচ্ছা দেখি, সংক্ষেপে বলল সেকান্দর।

কী দেখবে, সে সম্পর্কে বুঝি নিশ্চিন্ত হবার জন্যই ওর মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল জাহেদ। তারপর পাল্টিয়ে দিল প্রসঙ্গটা। যাই বল বড় জাঁহাবাজ ওই কংগ্রেসী মৌলভীগুলো। ওদের বোঝায় কার সাধ্য। কিন্তু এখনো ওদের মিটিংয়ে লোক জমে এটা যে কেমন করে সম্ভব হয় আমি বুঝতে পারি না!

ওদের কেউ কেউ সেই খেলাফতে, তারপর সেই তিরিশের যুগে জেল ফেল খেটেছে। হয়ত তাই। তোমাদের তো সে সব বালাই নেই। কেমন বাঁকা শোনাল সেকান্দরের স্বর।

আরে রাখ। বানের তোড়ে কোথায় সব ভেসে যাবে, দেখ না?

মুশকিল হল লীগের নামটা এখনো পৌঁছায়নি অনেকের কাছেই। কিন্তু, আমি তো যতই ঘুরছি ততই উৎসাহিত হচ্ছি। আমাদের শত্রু যে এক নয়, আমাদের শত্রু যে দুই–এক ইংরেজ দোসরা হিন্দু বানিয়া মহাজন, তুমি কী মনে কর এ কথাটা বুঝতে মুসলিম সমাজের খুব দেরি লাগবে? ওই গাদ্দারগুলোকে চিনতে খুব বেশি সময় লাগবে?

তা তোমার মতো লোকেরা যখন উঠে পড়ে লেগেছে তখন বেশি দেরি হবে বলে তো মনে হচ্ছে না।

সেকান্দরের উত্তরটা একটুও ভালো লাগে না জাহেদের। এখনো কোথায় যেন ওর দ্বিধা, সংকোচ। আর ফাঁক পেলেই একটু তেড়া কথার খোঁচা মেরে জাহেদকে আঘাত দিতে বাধে না ওর। কেন? ওর গ্রাম বাকুলিয়ার আর ওর সমাজের নাড়ির স্পন্দনটা কী এখনো পড়তে পারছে না সেকান্দর মাস্টার?

কেন যে এত সন্দেহ তোমার, আমি বুঝি না। শুধাল জাহেদ।

উত্তরে শুধু বোঁচকাটা বগল বদলে নিল সেকান্দর। বলল না কিছুই।

এই সকাল বেলায় মাটির রাস্তাটা কেমন নরম আর ঠাণ্ডা। রাতের বিশ্রাম পাওয়া পথের উপর যেন লেপে রয়েছে কী এক কোমল শী। সেই কোমলতাটা পায়ে জড়িয়ে জড়িয়ে চলতে সুন্দর একটি ভালো লাগায় রোমাঞ্চিত হতে চায়। শরীরটা, মনটা। মাটির সাথে গভীর এক অন্তরঙ্গতাবোধ সুর তুলতে চায় নাড়িতে, গান হয়ে বাজতে চায় কণ্ঠে। কিন্তু মাঠটার দিকে চোখ ফিরিয়ে নিমেষের মাঝেই হয়ে যায় জাহেদের সেই ভালো লাগার অনুভূতিটা।

খাঁ খাঁ করছে মাঠ। এখানে সেখানে পোড়া সবুজের মর্মন্তুদ কান্না। এক পশলা বৃষ্টি হয়েছিল সেই ফাল্গুনের শেষাশেষি। যাদের তাড়াহুড়ো তারা তখুনি জলদি দুটো চাষ দিয়ে ধান ছিটিয়ে ছিল। কিন্তু, অন্যরা জানে প্রথম বৃষ্টিতে একটা চাষ দিয়ে মাটির বাঁধুনি দাও খুলে পরের বৃষ্টিতে পানি খেয়ে মাটি যখন ভুর ভুর করবে তখন ছিটোবে ধান, ফসল পাবে দ্বিগুণ। তাই অপেক্ষা করে আছে ওরা।

কিন্তু বৃষ্টি আর কৃপা করেনি। ঝাঁ ঝাঁ রোদে শুধু তেতে চলেছে ক্ষেতের মাটি। যারা ধান বুনেছিল তাদের ক্ষেতের দগ্ধ সবুজ আতঙ্ক জাগায় মনে। আর যারা প্রথম বর্ষাতে লাঙ্গলের ফলায় মাটিটাকে শুধু উল্টে রেখেছে তাদের বন্ধ্যা ক্ষেতগুলো তপ্ত ধুলো আর ধূসর রুক্ষতা মাখিয়ে অমঙ্গলের হাওয়া ছাড়ছে লোকালয়ের দিকে। একেবারে আ-চষা ক্ষেতগুলো ফাটল তুলেছে বিরাট, যেন বিদীর্ণ বক্ষের কোনো আকুতি মেলে চেয়ে রয়েছে নির্দয় আকাশের দিকে। কখন দয়া হবে আকাশের কখন পানি পাঠাবে, ফাটলের পিপাসা মিটবে।

সেকান্দরের চোখেও দগ্ধ সবুজের আতঙ্ক। ও বলল দেখেছ? এখনো বৃষ্টি হল না। লোকগুলো এবছরও উপোস করে মরবে।

কী যে হয়েছে জাহেদের। রোদপোড়া দীৰ্ণবুকে ক্ষেতের দিকে তাকিয়ে যে আশঙ্কা ওর মনে জেগেছে তাই তো প্রকাশ পেয়েছে সেকান্দরের কণ্ঠে অথচ খিঁচিয়ে উঠল জাহেদ : গত বছর মরেছে, তার আগের বছর, তারও আগের বছর, সব সময়ই এরা মরছে। এ বছরও মরবে, সামনের বছরও মরবে। দ্যাট ইজ হোয়াট দে ডিসার্ভ, ইট ডিসার্ভ। নির্বিবাদে মৃত্যুবরণ ছাড়া আর কোন্ কাজটা করতে পার তোমরা?

সেকান্দর বুঝল একটু আগে যে খোঁচাটা দিয়েছে সে, এ তারই পাল্টা বিস্ফোরণ। ক্ষুণ্ণ হল সেকান্দর। কিন্তু ভেতরটা ওর কী এক অপমান বোধে জ্বলে উঠল। বলল, এ মৃত্যুকে আমি রুখব। আমি মৃত্যুঞ্জয়ী হব। আমি মরণ-জয়ের ডঙ্কা বাজাব, সবাইকে শোনাব মৃত্যুহীনের ডাক।

যেন ঠোক্কর দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে জাহেদ। অবাক হয়ে চেয়ে থাকে সেকান্দরের দিকে। এমন সংকল্পের দৃঢ়তা, এমন প্রত্যয়ের ডাক কখনো শোনা যাবে তালতলি স্কুলের জুনিয়ার মাস্টার সেকান্দরের কণ্ঠে জাহেদের কাছে এ ছিল অভাবনীয়। কিন্তু যতটা খুশি হল তার চেয়ে বেশি শঙ্কিত হল জাহেদ। কেননা ও, জানে অনুভূতির এই তীব্রতা মাস্টারকে নিয়ে যেতে পারে অন্য কোথাও স্বদেশিদের খপ্পরে নতুবা শ্রেণী সংগ্রামের পথে। আর এ দুটোকেই পরিহার করে চলে জাহেদ।

মরণজয়ের ডঙ্কা বাজাও সে তো আমারও কথা কিন্তু কিসের জন্য? মুক্তির জন্য।

কার মুক্তি? শুধাল জাহেদ।

রোদে যাদের ক্ষেত পোড়ে, ক্ষিধেয় যাদের পেট জ্বলে, অকালমৃত্যু যাদের কপালের লিখন তাদের মুক্তি।

হিন্দুস্তানের সকল মুসলমানই কী তোমার এই সংজ্ঞায় পড়ে না?

না। বলেই কী এক কৌতুকে হেসে দিল সেকান্দর। হাসতে হাসতেই বলল আবার অদ্ভুত প্রশ্ন তোমার। তুমি আমাকে বোঝাতে চাও, সৈয়দপুত্র তুমি, মাতুল ফেলু মিঞা আর লেকু, ফজর আলি তোমরা সবাই এক সারিতে, এক শ্রেণীতে, বঞ্চিতের দলে, হা হা হা।

চুপ কর। চিল্লিয়ে উঠল জাহেদ।

ওর চিৎকারে চমকে দুপা পিছিয়ে গেল সেকান্দর। ভয় পেল। জাহেদের এমন ক্রুদ্ধ মূর্তি আগে কখনো দেখেনি ও।

ওরা নিঃশব্দে হাঁটছে, রাস্তার দুপাশ ধরে, পরস্পর থেকে যতটা সম্ভব দূরত্ব রেখে। ওরা এখন বন্ধু নয়, ওরা যেন দুই শত্রু শিবিরের প্রতিদ্বন্দ্বী পুরুষ, মুখোমুখি মোকাবিলার পূর্বে নীরব প্রস্তুতি চলছে ওদের। সেকান্দরের দৃষ্টিটা নিচে মাটির দিকে। জাহেদের চোখ সেকান্দরের দিকে। চোখ নয় যেন দুটো বিষ মাখা তীরের ফলা, বিঁধে ফুঁড়ে একাকার করে চলেছে সহসা বিদ্রোহী হয়ে ওঠা এককালের নিরীহ মাস্টারকে।

তুমি জান কী করে এ জমি গড়ে উঠেছিল? আবার ঝলসানো ক্ষেতের দিকে চোখ ফেরাল জাহেদ। জান? যাদের হাতের মায়া আর শ্রমের ছোঁয়া পেয়ে এ জমি শস্যময়ী হয়েছিল তারা আর এ জমির কেউ নয়?

জানি।

জান ইংরেজ আসবার আগে এ অবস্থা ছিল না?

উল্টো দিক থেকে এবারও ভেসে আসে সেই ক্ষুদ্র কিন্তু আক্রমণাত্মক জবাব, জানি।

দিনে দিনে ক্ষয় পাচ্ছে জমির উর্বরা শক্তি। অনাবৃষ্টি আর অতিবৃষ্টির খামখেয়ালী তাণ্ডবে হাহাকার জাগছে ঘরে ঘরে। জনসংখ্যা বাড়ছে, খাদ্য নেই দেশে। সর্বত্র এই অভিযোগ। কিন্তু আমি বলি এটাই তো স্বাভাবিক, এ-ই তো বিদেশি শাসন আর শোষণের পরিণতি। ইংরেজ কী তবে বেহেশত বানাবার জন্য এসেছে এদেশে। ঠুক ঠুক পেরেক ঠোকার মতো করেই যেন কথাগুলো সেকান্দরের মাথায় ঢোকাতে চাইল জাহেদ।

সে তো বুঝলাম…

বুঝেছ কচু। বুঝলেই যদি তবে কেন গোটা জাতির কথা ভাবছ না। বুঝতে পারছ না, পরপদানত কোনো মানুষের একমাত্র লক্ষ্য স্বাধীনতা আজাদী? কারণ তোমার কাছে স্বাধীনতার অর্থ শুধুমাত্র ইংরেজ বিতাড়ন।

আমার কাছে তার অর্থ আরও ব্যাপক, ইংরেজ বিতাড়ন তো বটেই সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষা জমি রুটিরুজি জীবনের নিরাপত্তা। চাপা দৃঢ়তায় উত্তর দিল সেকান্দর।

রাবিশ? চিল্লিয়ে উঠল জাহেদ আর ছিনিয়ে নিল সেকান্দরের বগলের বইগুলো। ছুঁড়ে ফেলল রাস্তায়। চেঁচিয়ে চলল এই বইগুলোই যত নষ্টের মূল। তোমায় সাবধান করে দিচ্ছি সেকান্দর, তালতলীর ওই হিন্দু মাস্টারগুলো থেকে দূরে থেকো রাজনীতিটা বুঝবার আগেই তোমার মাথায় একগাদা পোকা ঢুকিয়েছে। এরপর আস্ত মাথাটা চিবিয়ে খাবে।

সেকান্দর নীরবে বইগুলো কুড়িয়ে নেয়। নীরবেই পথ চলে।

সহসা দু হাত বাড়িয়ে সেকান্দরের পথটা আগলে দাঁড়ায় জাহেদ, হাতের মুঠোতে চেপে ধরে ওর জামার গলাটা। তারপর তীরের মতো ছুঁড়ে মারে প্রশ্নটা, বল তুমি মুসলমান কিনা?

না।

তবে তুমি কী!

মানুষ।

অপমান বোধে মুখটা লাল হয়ে আসে জাহেদের। তুমি কী বলতে চাও আমি মানুষ নই?

না। তুমি মুসলমান।

আলবৎ। আমি প্রথমে মুসলমান তারপর মানুষ।

সেজন্যই কী অমন বর্বরের মতো আচরণ করছ? গলাটা ছাড় তো এবার। যেন বিরক্ত হয়েই বলল সেকান্দর।

আমি মুসলমান। আমি মুসলমান। এ পরিচয়ে আমার গৌরব, অগৌরব তো নয়ই। বলতে বলতে মাথাশুদ্ধ সেকান্দরের গলাটাকে দোলনার মতো একবার পেছনে ঠেলল, আবার সামনে টানল, তারপর ছেড়ে দিল মুঠিটা। দুজনই ওরা পরিশ্রান্ত। রাস্তার মাঝেই ওরা বসে পড়ল। আর ফোঁস ফোঁস হাঁপিয়ে চলল।

ভুল করছ জাহেদ ভুল করছ। প্রথমে মানুষ, তারপর ধর্ম। মানুষের জন্যই তো ধর্ম। ধর্মের জন্য মানুষ নয়।

শ্রান্ত কিন্তু কী এক হিংস্র চোখে ওকে নিরীক্ষণ করল জাহেদ।

মুখ খুলল না। মুখ খুলল অনেকক্ষণ পর। তা হলে তুমি মুসলিম লীগ করছ না?

করছি। সংক্ষেপে বলে উঠে দাঁড়াল সেকান্দর।

এখুনি তো তোমাকে স্কুলে ছুটতে হবে। চল আমাদের বাড়ি।

গোছল করে কিছু খেয়ে নাও।

২৩.

রাস্তা ছেড়ে বাড়ির উঁচু মাঠে উঠে এল ওরা।

কাচারি ঘরের ময়দানে উনুনের কয়লা তখনো জ্বলছে। আধপোড়া কাঠ ধোঁয়া ছাড়ছে। একমণি দুমণি ডেগগুলো উনুনের চার পাশে, কোনোটা কাত হয়ে পড়ে রয়েছে, কোনোটা বা ঢাকনি দেয়া। রাতের ভোজের ইতস্তত ছড়ানো কলাপাতাগুলোর মতোই এদিক ওদিক বিক্ষিপ্ত মস্তানার দল। পুকুরের শান বাঁধাই চত্বরে কেউ ঘুমোচ্ছে অঘোরে, কেউ হাই তুলছে কাচারি বারান্দায়, কেউ বা সটান ঘরের লম্বা ফরাশে। কেউ চোখ বুজে হুঁকো টানছে।

ওদের চিনতে কষ্ট হল না জাহেদের। সেকান্দরের পিঠে একটা খুশির কিল বসিয়ে বলল ও : বরাত ভালো হে! বিরিয়ানী-ফিরিয়ানী বাসি হলেও কিছু জুটে যাবে মনে হচ্ছে।

কাচারি ঘর ছেড়ে দেউড়ির কাছাকাছি এসে যেন আপন মনেই আবার বলল জাহেদ : চাচার সাঙ্গোপাঙ্গোর দলটা এবার বেজায় ভারি। ব্যাপার কী? দেউড়িটা পেরিয়ে প্রশস্ত উঠোন। উঠোনের উল্টোপার লম্বালম্বি বারান্দা টানা বড় দালান। জাহেদকে দেখেই বারান্দার কোন্ ঘুপচি থেকে ছুটে আসে মালু। এসেই ঝর ঝর কেঁদে দেয়।

কী রে, কী হল? ওর হাতটা ধরে জিজ্ঞেস করে জাহেদ।

আঙ্গুলের ইশারায় বারান্দার উত্তর কোনটা দেখিয়ে দেয় মালু। সেখানে বদনার সরু নলে পানির চিকন চিকন ধারা ঢালছে বাড়ির চাকর। ওজু করছে নতুন জামাই। ভিজে হাতের তালুজোড়া কলপ দেয়া বাবরির উপর দিয়ে বুলিয়ে নিয়ে তায়ামমুমের জন্য মাথাটা উঁচু করতেই চোখাচোখি হয়ে যায় জাহেদের সাথে। কে রে? অবাক হয়ে শুধাল জাহেদ।

রাবু আপার বর। সংক্ষেপে বলে সার্টের খুঁটে চোখ মুছল মালু।

বর? রাবুর বর? কে বলেছে? বুঝি বিশ্বাস করতে চায় না জাহেদ। কান্নাটা সামলে নিয়েছে মালু। গড় গড় করে বলে গেল আজব রাতের কাহিনী।

নতুন জামাই এবার পা-টা বাড়িয়ে দিয়েছে বদনার নলের নিচে। প্রত্যেকটি নখে আলাদা আলাদা করে পানির ধারা নিচ্ছে। আঙ্গুলগুলোর ফাঁকে ফাঁকে হাতের আঙ্গুল চালিয়ে ধুয়ে নিচ্ছে। ঠোঁট তার নড়ছে মৃদু মৃদু। ওজুর দোয়া পড়ছে বুজুরগ জামাতা। সে ফাঁকেই চোখটা তার এদিক ওদিক ঘুরে জাহেদের মুখের উপর এসে ক্ষণকাল স্থির হয়ে রইল। নড়ল না, কাঁপল না। জাহেদের মনে হল ধূর্ত শৃগালের কোনো চতুর ইঙ্গিত যেন হেসে উঠল সেই চোখে। কিন্তু সে শুধু মুহূর্তের জন্য। তারপরই কী এক অবজ্ঞার উদাসীনতা ছড়িয়ে সরে গেল চোখ জোড়া।

এবার বুঝি বিশ্বাস হয় জাহেদের। আর সেই মুহূর্তে ওর শরীরের রক্ত ধারাটা যেন বলক খেয়ে টগবগিয়ে উঠল, সমস্ত রক্ত যেন উঠে এসেছে ওর মাথায়। লম্বা পায়ে উঠোন ডিঙিয়ে দাওয়ায় উঠে এল জাহেদ।

কী আম্মা! কী সব শুনছি?

আম্মার যেন বলার কিছু নেই। নীরবে তছবির ছড়া গুণে চলেছেন তিনি। কিরে আরিফা কী হয়েছে বল না।

সবে ঘুম ভেঙেছে আরিফার। চোখ কচলাচ্ছে। ভালো করে তাকাতে পারছে ও। সেই অবস্থাতেই বলল, দরবেশ চাচা.. শেষ করতে পারে না ও। কোথায় দরবেশ চাচা, খেঁকিয়ে উঠেছে জাহেদ।

যা হবার হয়ে গেছে। এখন আর চেঁচামেচি করিসনে বাপু। ছেলে চাচার সন্ধান করছে দেখে অবশেষে মুখ খুললেন সৈয়দগিন্নী।

হয়ে গেছে মানে? জাহেদের চড়া স্বরটা গুম গুম করে ঘরের দেওয়ালে। আমরা কত বললাম মেজো ভাই। কিন্তু..আরো কিছু বলতে চায় আরিফা। তার আগেই ফেটে পড়েছে জাহেদের ক্রুদ্ধ গলাটা : কী করেছিস তোরা! লোকজনের কী অভাব ছিল গ্রামে? ঠেঙিয়ে বের করে দিতে পারলি না বাড়ি থেকে?

ছিঃ বলে না ওসব কথা, নতুন জামাই শুনবে যে। প্রমাদ গোণেন সৈয়দগিন্নী। নেমে আসেন নামাজের চৌকি ছেড়ে।

কাঁথা পুড়ি নতুন জামাইর। খিঁচিয়ে উঠে জাহেদ। এদিক ওদিক কী যেন খোঁজে ও।

তা তার মেয়ে যদি সে কেটে গাঙ্গে ভাসিয়ে দেয় আমরা কেমন করে ঠেকাব? শুনলে তো আমাদের কথা? আর মেয়েটিও যেমন বাপ বলতে এক পা। বাপ বলেছে, ব্যাস, কার কথা শুনে ও … সৈয়দগিন্নীর পুরো কথাটা শোনার জন্য অপেক্ষা করে না জাহেদ। দৌড়ে বেরিয়ে আসে উঠোনে। সেকান্দরকে টানতে টানতে চলে যায় দেউড়ির দিকে।

মুনশীজী কোথায়?

জি, উনি মসজিদে। মালুর হয়েই জবাব দিল বাড়ির চাকর।

মুন্‌শীজী গোঁড়া সুন্নী। সহি হাদিসের বাইরে এক কদম চলতে নারাজ তিনি। ফুঁকফাঁক তুকতাকের ঘোর বিরোধী। চিশতিয়া নক্শবন্দিয়া মাইজভাণ্ডারি ইত্যাকার যত তরীকার তীব্র সমালোচক তিনি। তাই দরবেশ বাড়ি এলেই আপন মেজাজ এবং ঈমান দুটোরই নিরাপত্তার জন্য আত্মগোপন করেন তিনি। এবারও কম্বলধারীদের শোভাযাত্রাটা দূর থেকে দেখেই মিঞা বাড়ির মসজিদে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন মুন্‌শীজী।

বেশ তুই এক কাজ কর। লেকু, ফজর আলি, রহমত, ট্যান্ডল বাড়ি আর সারেং বাড়ির সবাইকে ডেকে নিয়ে আয়, এক দৌড়ে। চাকরটাকে হুকুম দিয়ে এদিক ওদিক তাকায় জাহেদ, কী যেন খোঁজে। দেউড়ির পেছনে নজরে পড়ে চেলা কাঠের স্তূপ। তারই পাশে মাটির ঢেলা ভাঙবার কয়েকটা মুগুর। দুটো মুগুর তুলে নিল জাহেদ। একটা সেকান্দরের হাতে দিয়ে বলল : শক্ত করে ধর। আমার দেখাদেখি ডানে বাঁয়ে ঘুরিয়ে চলবে। শুধু প্রাণে মারবে না কাউকে।

আরে, মারামারি করবে নাকি?

আহা, চল না। ওকে এক ধাক্কায় সামনের দিকে ঠেলে দেয় জাহেদ। বাবারা খোদার খাসিরা–ওই যে সড়কটা দেখছ সোজা ওই পথে গিয়ে ওঠঁ। টুটা করছ কী…। কী সেটা মুখে না বলে মগুরটা ওদের মাথার উপর দিয়ে বার কয় ঘুরিয়ে আনে জাহেদ।

হয়ত অসাবধানেই কারো কলকেতে লেগে যায় মুগুরের আগাটা। সাজান কলকেটা মেঝেতে পড়ে ভেঙে টুকরো হয়। কারো বা হুঁকোটা কাত হয়ে পড়ে যায়। গল গল করে বেরিয়ে যায় বাসি হুঁকোর পিঙ্গল পানি। ভিজে যায় ওদের ফরাশ।

এমন অতর্কিত অভদ্রতার জন্য প্রস্তুত ছিল না ওরা। ভুরি ভোজনের পর যে ঘুম, সে ঘুমের মিঠে মৌতাত এখনো লেগে রয়েছে ওদের চোখে।

শীগগীর শীগগীর জলদী ভাগো। একটু আড়মোড়া ভাঙবার সময় দিতেও নারাজ জাহেদ।

টেবিল চেয়ারগুলো এক কোণে সরিয়ে রাখা হয়েছিল। পর পর কয়েকটা চেয়ার তুলে ওদের দিকে ছুঁড়ে মারল জাহেদ।

হুড়োহুড়ি পড়ে গেল মস্তানার দলে।

এরি মাঝে কে যেন প্রতিবাদ করে ওঠে। নিমিষের মাঝেই মুগুরটা নেমে আসে ওর গর্দানে। কোঁত করে বসে পড়ে অসহায় মস্তানা।

এ্যা আপনি পয়গম্বরের উম্মত নন? এ ভাবে অপমান করছেন মেহমানদের? বারান্দা থেকে চেঁচিয়ে উঠে আর এক বেপরোয়া মস্তানা।

ও-রে আমার মেহমা-ন-রে! বে-রো-বে-রো, মুগুরটা উঁচিয়ে দৌড়ে যায় জাহেদ।

পলায়নের হিড়িক পড়ে যায়। ওরা ছুটে যায় রাস্তার দিকে। একমাত্র সম্বল কম্বলটাকে প্রাণপণে আঁকড়ে ধরে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়তে গিয়ে কেউ বা হোঁচট খেয়ে বসে পড়ছে, কেউ বা গড়িয়ে পড়ছে পাশের শুকনো নালায়। মালু, সেকান্দর, বিশ্বাস নেই ওদের, দৌড়াও ওদের পিছু পিছু। একেবারে গাঙ পার করিয়ে তবে ফিরবে। বাড়ির চাকরগুলোকেও মস্তানাদের ধাওয়া করতে বলে দিল জাহেদ। ততক্ষণে লেকুর দলটা এসে গেছে। ওদের নিয়ে অন্দর বাড়িতে ফিরে এল জাহেদ। এত যে কাণ্ড ঘটে গেল কাচারি বাড়িতে তার খবরটা বুঝি পৌঁছায়নি এখানে। অথবা পৌঁছালেও অটল বুজুরগ। বিভিন্ন শ্বশুর বাড়ির বিভিন্ন আর বিচিত্র ধরনের আপ্যায়নের সাথে নিশ্চয় পরিচয় তার দীর্ঘদিনের।

দস্তরখান পাতা হয়েছে বারান্দায়। একটা একটা করে নাশতার রেকাবিগুলো এসে জমছে সেখানে। রেশমি গালিচায় আসন নিয়ে দেয়ালের দিকে ঈষৎ হেলে রয়েছেন নতুন জামাই। চোখ বুজে মোগলাই ব্যঞ্জনের খোশবু টানছেন হয়ত। বুজুরগ মানুষ। অতএব আহারটাও তার এবাদতের অঙ্গ। হয়ত তাই এতক্ষণ ধরে ওজুর ঘটা চলছিল।

ওই যে বসে আছে বাবাজী। পাঁজা কোলা করে তুলে ফেলবি। রহমতের গাড়িতে চড়িয়ে সোজা স্টেশনে নিয়ে যাবি। টিকেট কেটে চড়িয়ে দিবি রেল গাড়িতে। গাড়িটা চোখের আড়ালে চলে গেলে তবে ফিরে আসবি। লেকুর দলকে হুকুমটা দিয়ে উঠোনেই অপেক্ষা করে জাহেদ।

যেন ছোঁ মেরে অতবড় শরীরখানা ওরা তুলে নিল কাঁধের উপর। সতর্ক হবার, একটু সজাগ হবার সামান্য সুযোগও পেলেন না বুজুরগ। কিন্তু হলে কী হবে বুড়ো, বেশ ওজনী বুড়ো। রীতিমতো শক্তি ধরে। দুই জোয়ানের অমন ভার সওয়া কাঁধেও মট করে শব্দ হল, একটুক্ষণের জন্য কুঁজো হয়ে এল ওদের পিঠ। ততক্ষণে বুঝি শ্বশুর বাড়ির এই বিচিত্র তামাশার অর্থ ধরে ফেলেছেন জামাতাজী। হাত পা ছোঁড়েন জামাতাজী। প্রায় ফসকে পড়ে যায় ওদের কাঁধ থেকে। কিন্তু পা আর গলার দিকটা ওরা শক্ত করে ধরে রেখেছে, পড়বার জো নেই। তবু গোটা শরীরটা কাঁপিয়ে দুলিয়ে গির গির আলোড়ন তুলে যান জামাতাজী। শেষে প্রচণ্ড হিংস্রতায় কামড় বসিয়ে দেয় ফজর আলির কাঁধে। সেই হিংস্র কামড়ে বুঝি এখুনি উঠে আসবে ফজর আলির কাঁধের মাংস। নিরুপায় হয়ে ডান হাতটাকে ঘুরিয়ে জামাতাজীর গালে জোর একটা ঘুষি বসিয়ে দেয় ফজর আলি।

কেয়া বাত জী, কেয়া বাত আ-জী। কেয়া কসুর কেয়া কসুর। প্রথমে লঘু স্বরে, তারপর চিৎকার করে প্রতিবাদ জানান নতুন জামাই। কিন্তু কে গ্রাহ্য করে তার প্রতিবাদ।

বারান্দা ছেড়ে উঠোনে নেমে আসে ওরা।

ছুটে আসে দরবেশ। এতক্ষণ ঘুমিয়েছিল ঘরের ভেতর। দরবেশ আগলে দাঁড়ায় ওদের পথটা–ছাড় ছাড় হারামজাদা বেতমিজ, শীগগীর ওনাকে ছেড়ে দে বলছি!

চাচা, আপনি ঘরে গিয়ে বসুন। বুঝি বজ্রের আওয়াজ জাহেদের কণ্ঠে। ভাইপোর মাথা থেকে পা পর্যন্ত রক্তিম চোখ দুটো একবার শুধু ঘুরিয়ে আনল দরবেশ। বুঝি থমকে রইলে মুহূর্ত খানিক। সঙ্গে সঙ্গেই চেঁচিয়ে উঠল কর্কশ গলায়–বেয়াদব বেতমিজ বেশরম বেলায়েক, এ বাড়ির কর্তা আমি না তুই? তারপর এগিয়ে এসে এলোপাথাড়ি ঘুষি কিল থাপ্পড় বসিয়ে দিল লেকুর পিঠে।

থর থর কাঁপছে দরবেশ। অন্ধের মতো হাত পা চালাচ্ছে চলমান লেকুর পিঠে। সে আঘাতে আর কাঁধের উপর প্রায় চারমণি ওজনের জামাতা মিঞার দাপাদাপিতে বুঝি ভেঙে যাবে লেকুর শিরদাঁড়াটা।

নিমিষের মাঝে একটা কারবালার কাণ্ড ঘটে গেল উঠোনে। দরবেশকে আড়পিছা ধরে ফেলল জাহেদ। হাঁ হাঁ করে ছুটে এলেন সৈয়দগিন্নী। রাবু এসে ওদের সুমুখে গড়িয়ে পড়ল, মাথা কুটতে লাগল উঠোনের মাটিতে : মেজো ভাই পায়ে পড়ি তোমার আব্বার দিলে কষ্ট দিও না। অনেক কষ্ট আব্বার। ছেড়ে দাও আব্বাকে, ছেড়ে দাও।

এই হুরমতি, দড়ি আন্ জলদি চিৎকার করে উঠে জাহেদ।

দেখছ দেখছ শুয়রের কাণ্ড। মুরুব্বীর গায়ে হাত দিলি তুই? জাহান্নামে যাবি, দোজখে পুড়বি তুই। জাহেদের শক্ত বাহুর বেষ্টনে ঝুটোপুটি খায় দরবেশ।

ওদিকে দরবেশের লাথির চোটে হাতের বাঁধনটা বুঝি একটু শিথিল হয়েছিল লেকুর। সে ফাঁকে জামাতাজী মুক্ত করে নিয়েছে পা জোড়া। সঙ্গে সঙ্গেই ভীষণ পদাঘাতে ছিটকে পড়েছে লেকু।

কিন্তু, জামাতাজীর মাথা আর গর্দানটা তখনো আটক ফজর আলির বাজুর বন্ধনে। পা জোড়া মাটিতে ঠেকিয়ে একবার পলট খেল জামাতাজী। সঙ্গে সঙ্গে আলগা হল ফজর আলির হাত জোড়া। মাথাটা মুক্ত করে টান হয়ে দাঁড়ায় নতুন জামাই।

ক্ষিপ্র-হস্তে দরবেশের হাত দুটো পেছনে এনে বেঁধে ফেলল জাহেদ। মাটিতে শুইয়ে হাত পিঠে জড়িয়ে দড়িটাকে তিন চারটি প্যাঁচ কষে শক্ত করে গিঁঠ বেঁধে দিল ও।

দোহাই তোমার মেজো ভাই, আব্বাকে বেঁধো না অমন করে। এত নিষ্ঠুর তুমি? ও, মেজো ভাই। রাবু এসে ধরে ফেলল হাত দুটো। ঠিক সেই মুহূর্তেই জামাতাজী কুড়িয়ে নিয়েছে জাহেদেরই ফেলে রাখা মুগুরটি। শক্ত করে বসিয়ে দিয়েছে দুর্বিনীত শ্যালকের মাথায়। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছোটে জাহেদের কপাল ফেটে। বাঁ হাত দিয়ে রক্তের ফিনকিটা চেপে ধরে জাহেদ চেঁচাতে গিয়ে ফাটা বাঁশের মতো শব্দ ওঠে ওর গলা দিয়ে। কোনো রকমে বলে, ওহ্। ছেড়ে দিলি ভণ্ডটাকে? ধর শীগগীর। নিয়ে যা স্টেশনে। জলদি কর।

বিমূঢ় স্তব্ধ হয়ে যায় লেকু। ফজর আলিও। জ্ঞানটা ওদের লোপ পেয়েছে যেন। জাহেদের রক্ত জবজব বা কপালটার দিকে একবারটি তাকিয়ে লেকু যেন ওর হারান শক্তিরই আরাধনা করল। অমন জোয়ান মরদ সে, না হয় কয়েকটা কোপই পড়েছে গায়ে, কিছু রক্ত ঝরে পড়েছে, তা বলে আজ হার মানবে সে, দার কোপে খাঁজ পড়া ওর পেশীগুলো যেন কী এমন মন্ত্রবলে ফুলে ফুলে উঠল। অস্ফুট এক চিৎকারে হিংস্র নেকড়ের মতো ও ঝাঁপিয়ে পড়ল। শূন্যে তুলে নিল অশিষ্ট জামাতাজীর শরীরখানি। ফজর আলি এসে কাঁধ দিল। ওরা ছুটে চলল।

মস্তানা বাহিনীকে গাঙ পার করিয়ে ফিরে এসেছে মালু সেকান্দর আর সারেং বাড়ির লোকেরা।

বিধ্বস্ত রণাঙ্গনটির দিকে তাকিয়ে সেকান্দরের চোখ বুঝি চড়কে ওঠে। আরিফা হুরমতি এমন কী রাবুও কান্না থামিয়ে থ মেরে রয়েছে। বুদ্ধি ভ্রষ্টের মতো কেমন শূন্য দৃষ্টি ওদের। একটি রাতের মাঝে কত কী যে ঘটে গেল! আর এত দ্রুত, কোনো লোমহর্ষক নাটকের ঘটনার মতো। এতে কারই বা হুঁশ থাকে, দিশা থাকে।

পাশে দাঁড়িয়ে কপালে করাঘাত করে চলেছেন সৈয়দগিন্নী। তাঁর চেতনাটা এখনো বুঝি লোপ পায়নি।

একটু তুলো। অনেক কষ্ট করেই যেন বলল জাহেদ। বুঝি হুঁশ এল মেয়েদের। আরিফা দৌড়ে গিয়ে তুলো আর আইডিনের শিশি নিয়ে এল। রক্তগুলো মুছে নিল সেকান্দর। মাথার চুল সরিয়ে ক্ষতের উপর আইডিন মেখে দিল। তারপর ব্যান্ডেজ বেঁধে ওকে নিয়ে এল ঘরে। বিছানায় শুইয়ে দিতে দিতে আপন মনেই বলে ও : এত অসহিষ্ণু তুমি। হুট করে কোনোদিন কোথায় কী কাণ্ড বাধিয়ে মরে থাকবে, আল্লাই জানেন। ওর আব্বার বাঁধনটি খুলে দেয় রাবু। অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে থাকে পাশে। উঠে দাঁড়িয়ে গায়ের ধূলো ঝাড়ে দরবেশ। কম্বলটা ভালো করে এঁটে নেয় কোমরে। তারপর ক্রুদ্ধ চোখের দৃষ্টি বিঁধে যেন এ ফোঁড় ওফোঁড় করে গেল লজ্জায় নুয়ে থাকা মেয়েটিকে। কহর দিল ওকে : জাহান্নামে যাবি, জাহান্নামে যাবি। দোজখের আগুনে জ্বলে পুড়ে খাক হবি, খাক হবি।

শুধু মেয়েকে অভিশাপ দিয়েই ক্ষ্যান্ত হল না দরবেশ। এ বাড়ির সকলের বিরুদ্ধেই তার নালিশ। মুনাজাতের ভঙ্গিতে আকাশের দিকে হাত তুলল দরবেশ, কাঁপা কাঁপা গলায় ফরিয়াদ পাঠাল আল্লার দরবারে, ইয়া আল্লাহ, গজব নাজেল কর, গজব নাজেল কর। গোনাহগার শয়তানগুলোকে শাস্তি দাও তুমি। লা-নত ঢাল তুমি, লা-নত ঢাল। ছারখার কর এই শয়তানের আড্ডা।

চমকে উঠেন সৈয়দ গিন্নী। দরবেশ এমন অভিশাপ দিল সৈয়দ বাড়ির উপর? তওবা, তওবা, উচ্চৈঃস্বরে তওবা পড়তে থাকেন সৈয়দগিন্নী। আব্বা, আব্বা, আমাকে ফেলে চলে যাবেন? পিছু পিছু ছুটে আসে রাবু। কাচারির পেছনে এসে লুটিয়ে পড়ে আব্বার পায়ে। জড়িয়ে ধরে তার পা জোড়া।

ঝুঁকে আসে দরবেশ। রাবুর এলো খোঁপার এক গোছা চুল মুঠোয় ধরে টেনে তোলে ওকে। উহঃ উহঃ চেঁচিয়ে ওঠে রাবু। যন্ত্রণায় নীল রাবুর মুখ। সে দিকে ভ্রুক্ষেপ নেই দরবেশের। কিন্তু যন্ত্রণাকাতর সে মুখের দিকে তাকিয়ে কেন যেন স্তব্ধ হয়ে যায়, উন্মনা হয় দরবেশ। চুলের মুঠিটা ছেড়ে দিয়ে দু হাতের কোলে রাবুর মুখটা টেন নিল দরবেশ। অশ্রুর ধারা নামছে রাবুর গাল বেয়ে। অশ্রুভরা সে মুখের দিকে নিস্পলক চেয়ে থাকে দরবেশ। কী এক কোমলতা এসে সহসা যেন মুছে নিয়েছে দরবেশ-মুখের সেই ক্রুর কঠিন রেখাগুলো। স্নেহ-মায়া আর মমতা, পার্থিব দুনিয়ার একান্ত মানবিক দুর্বলতাগুলো যেন ঘন এক ছায়া ফেলেছে দেওয়ানা চোখের কোলে।

দুটি মুহূর্ত, বুঝি দূর অতীতের কোনো স্মৃতির মাঝে থুয়ে গেছে সংসার ত্যাগী স্ত্রী-ঘাতী দেওয়ানা। কিন্তু সে শুধু মুহূর্তের জন্যই। আচমকা ওকে ছেড়ে দেয় দরবেশ। ধপ করে পড়ে যায় রাবু। জীবনে এই প্রথম পিতৃস্নেহের স্পর্শটি পেতে পেতে হারিয়ে ফেলল ও।

খবিস খবিস। নাপাক, নাপাক। চাপা গলায় ঘৃণা ছড়ায় দরবেশ। থুতু ফেলে, হাতের দশটা আঙ্গুল একই সঙ্গে বাতাসের দিকে ছুঁড়ে মারে, যেন কোনো অস্পৃশ্য ছুঁয়ে আপনাকে অপবিত্র করেছে দরবেশ। তারপর মিলিয়ে যায় কাচারির ওপারে।

২৪.

শাখায় পাতায় পল্লবিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে খবরটা। বড় বাড়ির বড় খবর। আলোচনা তার মুখরোচক।

ছিঃ ছিঃ আল্লাওয়ালা মানুষ ওরা। মেজো মিঞা পিটিয়ে পুটিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিল ওদের? সাধে কী আর শাস্ত্রে বলেছে, আলেমের ঘরে জালেমের পয়দাস! মাবিয়ার ঘরে না এজিদের জন্ম?

আহা কী বুজুরগ আদমি। হার্মাদ না হলে কেউ অমন ওলি আল্লাহ মানুষের গায়ে হাত তোলে? মেজো মিঞাটা যে নাস্তিক এতে কোনো সন্দেহ আছে? নির্ঘাত আল্লাফাল্লা মানে না ছোকরা। আহা, কী নূরানী চমক চেহারার! কত এলেমদার যে সে আদমী? দেওবন্দের কামিল মোহাদ্দেস। তাঁকে এমন অপমান? আরে অপমান কী বলছ হে! মেরে মুরে হাড্ডি মাংস একসার করে বড় গাংয়ে ভাসিয়ে দিয়েছে। হয়ত মরেই গেছে। বেপারী বাড়ির ফজু বেপারী স্বচক্ষে দেখে এসেছে। বিশ্বাস না করে উপায় আছে? রমজানের বৈঠকখানায় বসে এমনি সব কথার পিঠে কথা ভেঙে চলেছে ওরা।

মাস কয়েক আগে ছোট্ট গোছের এই বাইর ঘরটি বানিয়েছে রমজান। দেশি পালার গায়ে এখনো পচা পানির গন্ধ লেগে রয়েছে। বৈঠকটাও চালু হয়েছে হালে। রাতের বেলায় নেহাৎ মুনিবের ডাক না পড়লে মিঞা কাচারিতে আর হাজিরা দেয় না রমজান। কুপি জ্বালিয়ে খালি চৌকিটায় বসে ও। দু চারজন মাতবর, পেয়াদ কালু, ওরা আসে। পানটা তামাকটা নিজের হাতেই বাড়িয়ে দেয় রমজান। নিজের বৈঠকখানা হবে, সেখানে আড্ডা জমবে; পান তামাক চলবে, এটা অনেক দিনের শখ রমজানের। এতদিনে সে শখটা বুঝি পূরণ হল রমজানের।

মুনিব ফেলু মিঞার সাথে টেক্কা দেবার ইচ্ছে নয় তার। ফেলু মিঞার ডান হাতের যে মর্যাদা আর স্বীকৃতিটুকু একান্তই প্রাপ্য তার, শুধু সেইটুকু। এর জন্য পান তামাকের খরচাটাকে মোটেই বাড়তি খরচ মনে করে না ও। এ ছাড়া যারা খাতক তারাও এই সময়টিতেই আসে। যার যা দেবার থোবার, এই বাঁধা সময় কাচারিতে আসবে তারা। রাস্তা-ঘাটে কায়কারবারের কথা বড় না-পছন্দ আমার–নিয়মটা চালু করে দিয়েছে রমজান। তাই লোকের অভাব হয় না। রমজানের মর্যাদার আসরে।

এতক্ষণ চুপ করে ওদের কথাগুলো শুনে চলছিল রমজান। এবার গলাটা বাড়িয়ে বলল : আরে, আরো ব্যাপার, রহস্য আছে অনেক। কুঁতকুঁতে চোখ দুটো পাকিয়ে থুতনির নিচে গলগণ্ডের মতো ফোলা মাংসের দলাটা কেমন করে কাঁপিয়ে তোলে রমজান।

মাতবরও বটে।

বেফার কী? বলেই ফেল না। জিজ্ঞেস করে গ্রামের একমাত্র হাফেয, তক্ষুণি তক্ষুণি কিছু বলে না রমজান। কালো ব্যাঙের পিঠের মতো খরখরে আর মোটা ঠোঁটখানা কিম্ভুত বেঁকিয়ে কেমন এক শব্দ তোলে ও। তারপর মাথাটাকে একেবারে হাফেযের কানের কাছে নিয়ে আসে, যেন এখুনি সাংঘাতিক এক গোপন রহস্যের সন্ধান দিয়ে চমকে দেবে ওদের। আরে দরবেশের এই যে মেয়ে, এটার সাথেই তো আমাদের মেজো মিঞার, ওই যে আজকাল কী বলে–এশকে না। আশনাই, কিনা বলে, সেই কাণ্ড আর কী? অবশেষে বলেই ফেলল রমজান।

তোবা, তোবা, নাউজুবিল্লাহ, নিজের গালেই চড় মারেন খতিব সাহেব। যাচ্ছিলেন পথ দিয়ে, এক খিলি পানের আকর্ষণে উঠে এসেছিলেন। পরে কিস্সার রসটা না নিয়ে চলে যেতে পারেন নি। কিন্তু সৈয়দ গিন্নী–বাবা, মিঞার মেয়ে, গিঁঠে গিঁঠে তার বুদ্ধি। ছেলে বাইরে, ব্যাস এ সুযোগে বিদেয় করে দিল আপদটা। ছেলে যে একেবারে এশকে, মশগুল তা কী আর জানত সৈয়দগিন্নী? কথাগুলোকে কেমন চটকে চটকে বলে রমজান।

ও ও, তলে তলে এত কারবার? তাই তো বলি সৈয়দ বাড়ির বিয়ে, নিশি রাতে চুপি চুপি? দাওয়াত নেই, যেয়াফত নেই? এই তো সেদিন বছর চার হবে বড় জোর, জাহেদের ছোট ফুফুর বিয়ে হল, একশো খাসি জবাই হল, তিন গেরাম দাওয়াত খেল। দাওয়াতটা মার গেল বলে বড় আফসোস হাফেয সাহেবের।

আরে হ হ, এতক্ষণে তাহলে বুঝলে আসল ব্যাপারটা। বেচারা বুজুর্গ আমার বড় আফসোস তার জন্য। সৈয়দগিন্নী নাকি শুধু পায়ে ধরতেই বাকী রেখেছিল। শেষে এক রকম ধরে বেঁধেই গছিয়ে দিয়েছে মেয়েটাকে। কিন্তু, সৈয়দগিন্নীরও তকদীর মন্দ, চোরা বুজুরগ, তারও শনির দশা। সমবেদনায় বুঝি কাতর হয়ে আসে রমজানের গলাটা।

এ সব গল্পে সুখ পায় রমজান। বলতে বলতে দিলটা বড় ঠাণ্ডা হয়ে আসে ওর। বড় ছোট, বড় ছোট সে। অর্থে মর্যাদায় এত ছোট যে গাঁয়ের কমজাত মিসকিনগুলোও পথে যেতে সালাম দেয় না, বড়জোর এক পাশে সরে পথ করে দেয়। রেঙ্গুন ঘুরে এসে আরো তীব্র হয়েছে এই ছোট হওয়ার জ্বালাটা। আর উগ্র হয়েছে ওর মনের আকাঙ্ক্ষা। মিঞা সৈয়দদের আভিজাত্যের মিনারে একটুখানি কাদা লেপে অনেক খেদ মিটে যায় ওর। বুকের অনেক জ্বালা জুড়িয়ে যায়।

কালু এসে খবর দিল এত্তেলা দিয়েছে ফেলু মিঞা।

আসরটা ভেঙে যায়। একে একে উঠে যায় হাফেয সাহেব, খতিব সাহেব। উঠি উঠি করেও বসে থাকে সতুর বাপ।

সতুর বাপ, একটু থাক। কথা আছে। তারপর কালুকে উদ্দেশ্য করে বলল রমজান : যাতো কালু ভিতর বাড়ি, পান নিয়ে আয়। কালু চলে গেলে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে সতুর বাপ। বলে, সব এন্তেজাম তো ঠিক। টাকা লাগবে আরো কয়টা।

আরে টাকার কথা ভাব কেন, সতুর বাপ। যা লাগে নিয়ে যাও। বলেই জিব কাটল রমজান। স্বরটা বে-আন্দাজ উঁচু হয়ে গেছে। ওই যে বাঁশের বেড়া আর টিনের চাল ওদেরও তো কান আছে।

তা ব্যবস্থা সব ঠিক তো? শেষ সময় গিয়ে তোমার লোকজন সব বেঁকে বসবে না তো? এবার একেবারে ওর কানের কাছে এসে ফিসফিসিয়ে শুধাল রমজান।

আরে না, কী যে বল। বিশ্বাসী লোক, তায় আবার টাকা খেয়েছে। কিছু বলা যায় না সতুর বাপ। বার্মা মুল্লুকে এ সব খেল তো কম দেখে আসিনি, টাকা খেয়ে শালারা কাম করে উল্টো। তা ছাড়া সৈয়দদের মেজো মিঞাটা বড় বেজাহান। আর শালার লোকগুলোও যেমন ক্ষেপেছে ওর পিছে। একেবারে শেষ সময়টিতেই হয়ত বলে বসবে, মেজ মিঞার মিটিংয়ে আমরা গোলমাল করতে পারব না। তখন? তাই বলছি সতুর বাপ, তৈরি থেক সব দিক দিয়ে।

কিছু ভেব না তুমি। যাদের ঠিক করেছি ওদের মাঝে কিছু লেঠেলও আছে। লেঠেলের ভাবনা সুলতানপুরের। তুমি তোমারটা ভাব। মৃদু একটা ধমক দেয় রমজান। তারপর যেন হঠাৎ মনে পড়েছে তেমনি ভাবে বলল : মেজো মিঞার দফা তো রফা করে গেছে তার ভগ্নিপতি। তোমাদের কামটা কিছু কমিয়ে দিয়ে গেছে। কিন্তু, ওই মাস্টার হারামিটা যেন আচ্ছা শিক্ষা পায়, এটা তোমাকে বিশেষভাবে দেখতে হবে।

সে আমার খেয়াল আছে।

নাও, এটা তোমার, এটা ওদের, যাকে যেমন মোনাসিব মনে কর দিয়ে দেবে। শুধু কাম চাই, পাকা কাম, বুঝলে? তবনের গেরোর নিচে থলি, সেই থলি থেকে কিছু নোট বের করে দু ভাগে ওর হাতে তুলে দিল রমজান।

উঠে পড়ে সতুর বাপ।

এগিয়ে এসে ওর কাঁধে হাত রাখে রমজান, বলে : কিন্তু ভাই সাবধান। ফেলু মিঞার পক্ষেও আছি আমরা, বিপক্ষেও আছি। এ বড় কঠিন খেইল। জবাবে এক টুকরো রহস্যকুটিল হাসি ফেলে বেরিয়ে যায় সতুর বাপ।

পান নিয়ে এসে গেছে কালু। গোটা দুই তিন পান এক সাথে দলা পাকিয়ে মুখে পুরে নিল রমজান। সুপুরিটা হাতের চেটোয় ডলতে ডলতে শুধাল, কিরে, এই রাতের বেলায় কী আবার দরকার পড়ল তোর মুনিবের?

কী এক দলিল নাকি খুঁজে পাচ্ছে না, বলল কালু।

তুই যেমন পেয়াদা, তেমন তোর মুনিব, দলিল দলিল করেই শালা মরবে। কালু জিব কাটে। মুনিব সম্পর্কে এমন অসম্মানের কথা রমজানের মুখ থেকে ইদানীং শুনছে ও। এখনও অভ্যস্ত হতে পারছে না। সুপুরিটা মুখের ভিতর ছুঁড়ে দিয়েছে রমজান। আয়েশ করে পান চিবোচ্ছে। চলেন। তাড়া দেয় কালু।

তাড়া নেই রমজানের। বলে, এই তো চলছি, তা তুই কী করলি? মুখ নীচু করে মাথা চুলকায় কালু।

চোখ চালিয়ে এদিক ওদিক একবার দেখে নিল রমজান। আস্তে আস্তে খুলে ফেলল তবনের গিঁঠটা। বের করল সেই থলেটা। সুতো দিয়ে প্যাঁচানো থলে। প্যাঁচ খুলে বের করল একখানি পাঁচ টাকার নোট। আর দুটো রূপোর টাকা। আবার সুতো প্যাঁচিয়ে থলির মুখ বন্ধ করে তবনের নিচে লুকিয়ে রাখল থলেটা।

এটা তোর বখশিস। আর ওই দুটো টাকা তোর পোলাকে মিঠাই কিনে খাওয়াবি। টাকাগুলো ওর আড়ষ্ট হাতে গুঁজে দিল রমজান। তবু বুঝি দ্বিধাগ্রস্ত, ইতস্তত ভাব কালুর। মুনিবের নিমকহারামি করতে বাধছে ওর। তাছাড়া, অমন জলজ্যান্ত জিনিসগুলো চুরি করে আনতে যদি ধরা পড়ে যায়? হাতে নাতে না হয় ধরা না-ই পড়ল, কিন্তু যদি কোনো রকমে টের পেয়ে যায় ফেলু মিঞা? রমজানের বলার পর থেকে এই পাঁচ সাত দিন ধরে সে কথাটাই তো ভাবছে কালু।

সাবেক আমলের একটা বাংলা ঘর। এককালে হয়ত দাসী বান্দীরা থাকত। এখন কোনো কাজেই আসে না। তাই ঘরটা ভেঙে ফেলেছে ফেলু মিঞা। কিন্তু পুরোনো হলে কী হবে, কাঠগুলো তার এখনো আনকোরা মনে হয়। বিশেষ করে শাল কাঠের পালাগুলো তো একেবারে অক্ষত। সেই ঘরেরই দশটা লোহা কাঠের পালা আর এক বান টিন চেয়েছে রমজান। চুপিসারে পাচার করে দিতে হবে রমজানকে।

কাজটা তো তেমন কিছু না। তা ছাড়া রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে নষ্টই হবে অমন ভালো পালাগুলো। না কোনো কামে আসবে ফেলু মিঞার, না তার মনে থাকবে। অথচ ওই আটটি লোহা কাঠের পালায় রমজানের বড় ঘরটা সত্যি মজবুত হবে। কালুরও লাভ ছাড়া ক্ষতি নেই।

সে তো বুঝলাম কিন্তু মুনিবকে না বলে…এই উত্তরটাই দিয়েছিল কালু আর এ কয়দিন ধরে সে দ্বন্দ্বের দোলায় দুলছে ও। মুনিবকে না বলে তার জিনিসে হাত দেওয়া সে তো চুরিই হল। বেশ বেশ, আমিই না হয় তুলে আনবার ব্যবস্থা করব। তুই শুধু ফাঁস করে দিবি না ব্যাপারটা। তা হলে?

তা হলে যে কী করবে কালু, এ কয়দিন ভেবে ভেবে সেটাও ঠিক করতে পারেনি ও।

ফেলু মিঞার পেয়াদাগিরি করে কয়টি টাকাই বা পায় ও। এমনিতেই মাঝে মাঝে হাত পাততে হয় রমজানের কাছে। তবু কী চলত সংসারটা মুনিব গিন্নীর যদি একটু দয়া না থাকত। বড় ভালো ফেলু মিঞার বেগম সাহেবা। চেয়ে কোনোদিন তাঁর কাছ থেকে খালি হাতে ফিরে আসেনি কালু। না চাইতেও কতদিন চালটা, মাছটাও ন্যাকড়া বেঁধে তুলে দিয়েছেন ওর হাতে। বলেছেন, নিয়ে যাও।

সেই মুনিব গিন্নী যদি জেনে ফেলেন ব্যাপারটা, তা হলে? মুনিবের চেয়ে মুনিব গিন্নীর জন্যই বুঝি এত দ্বিধা কালুর।

শোন কালু তোকে আমি খুশি করে দেব। অকস্মাৎ বলল রমজান।

পাঁচ টাকার কাগজটা কালুর হাতের মুঠোয় কেমন কর কর আওয়াজ তুলছে। রূপোর টাকাগুলো কেমন গরম হয়ে এসেছে কালুর মুঠোর ভেতর।

আচ্ছা। সরাবার ব্যবস্থা আপনার। উঠে দাঁড়ায় কালু।

কুঁতকুঁতিয়ে হাসে রমজান। ওর খুশির হাসিটাও কেমন বীভৎস। গায়ে যেন কাঁটা ফোঁটায়।

কামিজটা কাঁধে ফেলে উঠে দাঁড়ায় রমজান। আর সেই মুহূর্তেই একটি টিকটিকি টুপ করে লাফিয়ে পড়ে ওর খালি কাঁধটায়। ত্রস্তে ওর গা বেয়ে নেমে যায়। কোত্থেকে একটা ইঁদুর এসে ধাওয়া করে টিকটিকিটাকে। হেসে দেয় কালু, বলে আপনি তোয়াঙ্গর হবেন।

তোয়াঙ্গর, মানে ধনী। টাকা পয়সা ধনদৌলতের মালিক?

কাঁধে টিকটিকি পড়লে তোয়াঙ্গর হয় না কী রে? আবারও শুধাল রমজান। হয়। ডান কাঁধে। ওই যে রামদয়ালের বাপ। সেই অল্প বয়সে যখন ইস্কুলে যেত, তখন তারও ডান কাঁধে টিকটিকি পড়েছিল। সেই থেকেই তো ইস্কুল ছেড়ে ব্যবসায় নামল দত্ত। আর এখন?

হাঁ, এখনকার কথা কে না জানে। কিন্তু সত্যি কী তাই হবে? তোয়াঙ্গর হবে রমজান? কথাটা ভাবতেও অদ্ভুত সুখ পায় রমজান। খুশির চোটে ওর বুকের ভেতরটা যেন লাফিয়ে ওঠে। এ কী কথা শোনাল কালু! এ যে ওর মনের কথা। রাত দিন খতিব সাহেবের তসবি গোনার মতো মনে মনে ও এই কথাটাই তো জপে চলেছে।

কিন্তু হঠাৎ যেন সন্দেহ জাগে রমজানের মনে, বলে, আমি তো শুনেছি টিকটিকি মাথায় পড়লে রাজা হয়, কাঁধে পড়লে কী হয় সে কথা তো শুনিনি? ওই একই কথা। কাঁধ আর মাথায় তফাত কতটুকু। বলেই ঘর ছেড়ে অন্ধকারে নেবে পড়ে কালু।

তা বটে। কাঁধ আর মাথার তফাত কতটুকু। কালুর কথাটায় সায় দিয়ে খুশি হয় রমজান।

রাতটা বড় অন্ধকার। কিন্তু পথ ঠাহর করতে একটুও যেন কষ্ট হচ্ছে না রমজানের। আজ বুঝি চোখ বুজেই বাকুলিয়ার পথ চলতে পারবে ও। চারিদিকে সবই সুসংবাদ আজ। সতুর বাপ যদি কামটা নির্বিঘ্নে সারতো সেতো মোটা দাও। তা ছাড়া এ-তো সবে শুরু। ইলেকশনের বছর এ পথ দিয়ে যে বিস্তর টাকা গড়িয়ে যাবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই ওর। আর ওর হাত দিয়েই তো সব গড়াবে, অত টাকা ধরে রাখবার ব্যবস্থারই হয় তো অভাব পড়বে শেষ পর্যন্ত।

তিন নম্বর তালুকটাও গিলছে ফেলু মিঞা। খুশিতে বাগ বাগ হয়ে কসিরের ছাড়া ভিটিটা পাঁচ বছরের জন্য মোফতে ভোগ করতে দিয়েছে রমজানকে। ইতিমধ্যেই ভিটিটাকে সমান করে ফেলেছে রমজান। কালোজিরা ধানের বীজ ফেলবে। হিসেব করে দেখেছে রমজান, হেলে ফেলেও অন্তত বিশ মণ ধান উঠবে। সরু সুগন্ধি কালোজিরা চালের দাম আছে বাজারে। কথার মানুষ রামদয়াল। ঠকায়নি রমজানকে।

আরো খুশির খবর, সৈয়দদের সম্পত্তি সবই দেখভাল করবে ফেলু মিঞা। সৈয়দ সাহেব চিঠি লিখেছেন, জরুরি কাজের জন্য ছুটি তাঁর মঞ্জুর হয়নি। তাঁর সম্পত্তির ব্যবস্থাটা ওই চিঠিতেই জানিয়ে দিয়েছেন। রমজানকে বলেছে ফেলু মিঞা, তায়তদারক তুমিই তো করবে, ওদের চাকরটাকে সঙ্গে নিয়ে ফসলি জমিগুলো বুঝে নাও। অন্য সব তো দলিলেই রয়েছে। যা ভাবা যায়নি, চিন্তা করা যায়নি, তেমনি সব সুযোগ এসে ধরা দিচ্ছে রমজানের হাতে। এ বুঝি কোনো মুরব্বীর দোয়ার বরকতে আল্লার রহম। নইলে এক সাথে এত সুযোগ?

তার উপর আজ টিকটিকি পড়ল ডান কাঁধে? না, কালুর কথাটা মিথ্যে হতে পারে না। সমস্ত আলামতই তো রমজানের পক্ষে। তোয়াঙ্গর সে হবেই। ধন দৌলত বালাখানা দাস-দাসী সবই হবে। সবই হবে। ইস, বুকটা ফুলে ওঠে খুশির চোটে, ভেতরের কইলজাটা বুঝি লাফ দিয়ে বেরিয়ে আসতে চায়।

খুঁজে না পাওয়া দলিলের বোস্তানিটা ফেলু মিঞার হাতে দিয়ে এমনি খুশির চোটে সারা গ্রামটাই যেন ঘুরে বেড়ায় রমজান। কখন ভূঁইয়া বাড়ি ছেড়ে পশ্চিমের রাস্তায় চলে এসেছে ও; টের পায়নি। অথবা ওর মনের খুশিই ওকে টেনে এনেছে পশ্চিমের রাস্তায়, ওর অজানতেই।

কিন্তু ততক্ষণে ওর মনের ফুর্তিটা কী এক উত্তেজনায় রূপান্তরিত হয়েছে। মনের ফুর্তি দেহের রাজ্যে যেন আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। দেহের রাজ্যে প্রচণ্ড এক ক্ষুধার আগুন। মোটা সোটা দেহের থল থল গোশত আর পুরু মেদের আস্তর পুড়িয়ে সে আগুনের জিহ্বা যেন রাতের আঁধারে লকলকিয়ে উঠছে। পা চলে তাড়াতাড়ি। শ্বাস পড়ে ভারি ভারি। হুরমতির বাড়ির পেছনে যে সরু পায়ে কাটা পথ, সেখানে এসে থামল রমজান। সেই ছেঁকা দেবার পর থেকে এ তল্লাট মাড়ায়নি রমজান। সাহস পায়নি। তাই গোশতের চাহিদাটা যখন অসহ্য ঠেকেছে। সব ডিভিশন শহরে গিয়ে ক্ষিধেটা মিটিয়ে এসেছে। কিন্তু আজ অন্য কোথাও যাবার কথাটা ভাবতে পারল না রমজান।

তোয়াঙ্গর হতে চলেছে সে, তোয়াঙ্গরীর আয়োজন একটার পর একটা সুসম্পন্ন হতে চলেছে। ভাগ্যের শিকা একটার পর একটা ছিঁড়ছে আর ওর করায়ত্ত হতে চলেছে।

কিন্তু, হুরমতিকে বাদ দিয়ে তোয়াঙ্গীর ছবিটা যেন অসম্পূর্ণ। হুরের মতো সুন্দরী মুখ, চিকন মুলোর মতো লাল আর তাজা সেই দেহখানি।

ঘন ঘন দুটো নিশ্বাস ছাড়ে রমজান। তবনের উপর হাত রেখে অনুভব করে থলেটা। শুকনো পাতার মতো মড়মড়িয়ে যেন কথা কয়ে গেল নোট গুলো। গোটা থলেটাই আজ তুলে দেবে হুরমতির হাতে। আর যদি নিকা বসতে রাজি হয় হুরমতি তবে তিন কানি জমি যা রমজানের সাকুল্য জমির অর্ধেক সবটাই লিখে দেবে ওর নামে।

না, না, শাদী-নিকার কথা আজ পাড়বে না রমজান। এই নিকার ব্যাপার নিয়েই তো এত গণ্ডগোল। সাফ দিলেই কথাটা পেড়েছিল রমজান। কিন্তু মুখিয়ে উঠেছিল হুরমতি, আবার বলবি তো জিব কেটে ফেলব। তবু আবার বলেছিল রমজান। তারপর দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছিল হুরমতি। মাফ চেয়েও হুরমতির মনটা গলাতে পারেনি রমজান। তবেই না অমন চটেছিল রমজান। আজ শুধু, মাফ চাইবে না, টাকার থলে দিবে না, আজ হুরমতির পায়ে ধরবে রমজান।

কিন্তু আজব মেয়ে হুরমতি। ঢাকে নক্সায় নমুনায় যেমন অবিকল মিঞা বাড়ির মেয়ে তেমনি ওর জিদটা। একেবারে খানদানী মেজাজ। কতদিন খবর দিল ফেলু মিঞা গেলই না। শেষে মিঞার মান সম্মান সব বিসর্জন দিয়ে নিজেই এসে হাজির হয়েছিল মিঞা। রা-ই করল না হুরমতি। অসুখ বিসুখ, তাও নয়। ঘন ঘন শহরে যাচ্ছে। যেদিন শহর কামাই সেদিন লেকুকে নিয়ে শুয়ে থাকছে ঘরে, এ সব খবর তো রাখত রমজান।

শাসিয়েছিল ফেলু মিঞা। সে শাসানি আর সুপুরি বাগিচায় রাতের নিমন্ত্রণ দুটোই এক সাথে বহন করে এনেছিল রমজান। শুনে বলেছিল হুরমতি, আমি তার বাঁদি? জিজ্ঞেস করে এসো তোমার মিঞাকে। আল্লা মালুম মিঞার উপর কেন যে অমন রুষ্ট হয়েছিল হুরমতি। অথচ লাভটা কী হল?

না, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বড় বেশি ইতস্তত করছে রমজান। আর যা ওর ভাবার কথা নয়, সে সব কথা ভেবে মনের ভয় আর ইতস্ততটাকেই বাড়িয়ে তুলেছে সে। ডান হাতের তালুটাকে নাকের ফুটোর নিচে ঠোঁটের উপর ঠিক ঢাকনির মতো করে ধরল রমজান। আলাজিহ্বাটায় সামান্য চাপ দিয়ে আওয়াজ তুলল : কু-উ কু–উ। এটাই সংকেত।

অধীর রমজান। নালাটা পর্যন্ত এগিয়ে আবার ফিরে আসে। আবার দু-পা এগিয়ে পিছিয়ে আসে। না, আজ যদি হুরমতি জবাব না দেয় সংকেতের জোর করেই ওর ঘরে গিয়ে উঠবে রমজান। দেখে নেবে কত জোর আছে মেয়ে মানুষের গায়। কু-উ কু-উ। আবার সংকেত পাঠাল রমজান। রাতের শিকারী পশুদের চোখের মতো জ্বলছে ওর চোখ, সে চোখ চেয়ে থাকে একটা দূরের গাছপালা ঘেরা ওই জমাট অন্ধকারটুকুর দিকে। গোটা শরীরের জ্বালাটা এবার যেন মাথায় উঠে এসেছে। মাথায় যেন পটকা ফাটছে।

সংকেতের জবাবটা কী আসবে না? উত্তেজনায় অধীর রমজান ফা-ৎ করে শব্দ হল। হ্যাঁ হ্যাঁ হুরমতির ঘরেই, কাঠি জ্বালাবার শব্দ। হ্যারিকেন ধরাল হুরমতি। ওর ঘরের বাঁশের বেড়ার খোপ দিয়ে আলোর রেখা বেরিয়ে আসছে। এবার খট খট খড়মের শব্দ হল। হ্যাঁ দরজা কী জানালার দিকে এগিয়ে আসছে হুরমতি। টুন টুন টুন। এক দুই তিন, হ্যাঁ তিন বারই টুন টুন শব্দ হল টিনের জানালায়।

সম্মতির সংকেত পেয়ে পলক ফেলল না রমজান। হুরমতির বাড়ির সীমানায় নালা। এক লাফে নালাটা ডিঙ্গিয়ে হুরমতির দাওয়ায় উঠে এল ও। দরজার উপর হাতটি রাখতেই পিছন দিকে সরে গেল কপাট। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসছে হুরমতি। কোনো রকমে কপাটটা ভেজিয়ে দিল রমজান। মুহূর্তের অবকাশ না দিয়েই লুফে নিল হুরমতির হুরের মতো শরীরখানি। লোমশ গরিলা বাহুর যাঁতায় একদলা মাংসের মতো ওকে পিষে চলে রমজান। হিংস্র পশুর আঁচড় কেটে যায় ওর মুখে গলায় বুকে। হিস হিস গরম নিশ্বাসের সাথে টেনে নেয় ওর ফুলেল তেলের গন্ধ, ওর দেহের সুবাস। কোথাও পায়নি রমজান এমন দিল মাতোয়ারা সুবাস, শহরের রণ্ডি পাড়ায় না, রঙ্গমেও না। শুনেছে মিঞা-সৈয়দদের নীলরক্তের মেয়েদেরই গায়ের গন্ধ এটা। তাই তো এত লোভ, এত আকর্ষণ রমজানের।

ওর ব্লাউজের বোতামগুলো খুলে দেয় রমজান। শাড়ির বাঁধনটা দেয় শিথিল করে। পাট আর কৃত্রিম রেশমের মিশেলী মসৃণ শাড়ি। ঈষৎ ভারি। টুক করে খসে পড়ে ওর কোমর থেকে। নগ্ন দেহটা কোলে তুলে নেয় রমজান, আস্তে করে শুইয়ে দেয় চকির বিছানায়। পা গুটিয়ে উঠে বসে হুরমতি। রমজানের হাতটা ছাড়িয়ে নেয়। হ্যারিকেনের মৃদু আলোয় আভায় হুরমতির সোনা বাটা শরীরের নিরাবরণ রেখাগুলো কী এক আগুনের শিখার মতো নেচে নেচে উঠে। আগুনের তীরের মতো এসে বিঁধে যায় রমজানের সর্বাঙ্গ।

হুরমতি হাসে। ছিনালী হাসি। ছিনালী কটাক্ষ। একী রহস্য হুরমতির! তবে কী এমনি করেই আজ ওকে বিদায় দিয়ে দেবে হুরমতি? চৌকি ছেড়ে একপা দুপা এগিয়ে আসে রমজান। ট্যাক খুলে থলেটা তুলে দেয় হুরমতির হাতে। নোটের চাপে ফোলা থলে, হুরমতির তালু গড়িয়ে পড়ে যায় মেঝেতে।

আবারও হাসে হুমতি।

অসহ্য। অসহ্য এ বিলম্ব। এতক্ষণের যে উত্তেজনা, ভেতরে ভেতরে যে অস্থির দাপাদাপি এ যেন তার চেয়েও ভয়ংকর। আপনার হিংস্র পশুত্বটাকে আর তো সামলাতে পারছে না রমজান। আবারও হাত বাড়ায় ও।

হেসে এক পাশে সরে যায় হুরমতি। হ্যারিকেনটা প্রায় নেভানোর মতো করে বুঁজিয়ে দেয়।

আধো অন্ধকারে ঠাহর করে ওকে স্পর্শ করে রমজান। আর এতক্ষণ সামলে রাখা পশুত্বটা যেন চেরাগের উপর ধরে রাখা গালার মতো গলে গলে ঝরে পড়ে।

হঠাৎ কী যেন হয়ে গেল। তীব্র তীক্ষ্ণ এক চিৎকারে বাজ খাওয়া কাকের মতো ছিটকে পড়ল রমজান। বদ্ধ দরজায় ঢুঁ খেয়ে মাথা ফাটাল। যন্ত্রণার চিৎকারে রাত্রির নীরবতা চিরে বেরিয়ে গেল রমজান আর হুরমতির খিল খিল হাসিটা যেন বিষ মাখা তীরের মতো ওর পিছু ধাওয়া করল। প্রতিশোধ নিয়েছে হুরমতি।

হাসতে হাসতে রমজানের কানটা কেটে রেখেছে ও।

শাড়ি পরে লণ্ঠনের আধবোজা আলোটা তুলে দিল হুরমতি। শিথানময় ছোপ ছোপ রক্ত। বালিশের এক কোণে বড় এক চাক রক্ত। সে রক্তের চাক থেকে মাংসের দলাটা আলাদা করে তুলে নিল হুরমতি। বালিশের তলা থেকে ন্যাকড়া বের করল। সে ন্যাকড়ায় প্যাঁচিয়ে নিল রমজানের কানটা। তার পর মেঝে থেকে কুড়িয়ে নিল রমজানের টাকার থলেটা। থলে আর ন্যাকড়ার পুঁটলিটা এক সাথে বেঁধে বেরিয়ে এল হুরমতি। লেকুর ঘরের দরজায় একটু চাপ দিতেই চৌকাঠের দিকটা ফাঁক হয়ে গেল। সে ফাঁক দিয়ে পুটলী আর থলেটা ভেতরে ছুঁড়ে দিল হুরমতি। বুঝি ভোরের উপহার রেখে গেল লেকুর জন্য।

ঘরে ফিরে হুড়কো দিল হুরমতি। হুড়কোর গায়ে লোহার শিকলিটা প্যাঁচিয়ে তালা মারল। তালাটা একবার ভালো করে টেনে দেখল। তার পর চাবিটা আঁচলে বেঁধে শুয়ে পড়ল।

২৫.

তারুণ্যের রংমোড়া সুন্দর একটি আবেগ। সেই আবেগের টানেই যেন ওর চলা। যুক্তিটা যে একেবারে অনুপস্থিত এমন নয়। কিন্তু বুদ্ধিটা আবেগে আচ্ছন্ন বলেই যুক্তির নির্দেশে পথ চলার প্রয়োজন এখনো দেখা দেয়নি ওর জীবনে।  

কিন্তু আবেগ দিয়ে বোঝা যায় না জীবনের জটিলতাকে, চেনা যায় না বিচিত্র জটবাঁধা এই পৃথিবীকে। জাহেদের কাছে এ যেন এক হঠাৎ আবিষ্কার যা ওর তারুণ্যের আবেগ দিয়ে গড়া সহজ পৃথিবীটাকে খান খান করে ভেঙে দিয়ে যায়। সে ভাঙার ফুটো দিয়ে যে পৃথিবীটা উঁকি মেরে চায় সেখানে শুধু কুসংস্কার, নীচতা, অন্ধবিশ্বাস। কদর্য তার চেহারা। সেখানে সব কিছুই যেন জটিল। মনের সহজ আবেগ দিয়ে সেখানে পথ পায় না জাহেদ। কপালে ক্ষতটা ওর সেরে উঠেছে। তবু জ্বরের ভাব আর গায়ের ব্যথাটা আবার দেখা দিয়েছে আজ। ওর হাত টিপে দিচ্ছে মালু। এভাবে আমার সর্বনাশ করলে মেজো ভাই? মাটির দিকে চোখ করে শুধায় রাবু।

চমকে তাকায় জাহেদ। রাবুর মাথায় ঘোমটা। এমন ধারা প্রশ্ন করবে রাবু কল্পনাও করতে পারেনি জাহেদ। তাছাড়া ব্যাপারটা নিয়ে রাবুরও যে একটা বক্তব্য থাকতে পারে। সেটা চিন্তার বাইরে।

বুদ্ধি হয়ে মাকে দেখলাম না, মায়ের স্নেহ কী জানব না কোনো দিন।

আব্বাকেও তুমি তাড়িয়ে দিলে। ক্ষোভের অনুযোগের স্বর রাবুর।

এমনভাবে বলছিস যেন চাচা সব সময় বাড়িতেই রয়েছে, আমি বের করে দিলাম।

এবার আব্বা থাকতেন বাড়িতে। ঠিকই থাকতেন।

খুব অসন্তুষ্ট হয়েছিস মনে হচ্ছে? খাটের মাথায় হেলান দিয়ে বসল জাহেদ।

আহা মরি। বাপ স্বামীকে মেরে মুরে বাড়ি ছাড়া করলে। আমি এখন খুশিতে নাচব, তাই না? কে বলছিল তোমায় অমন বীরত্ব ফলাতে?

কী বলছে রাবু! এত ঝাঁঝ কখন এল ওর কণ্ঠে? চোখ জোড়া কচলে নিয়ে ভালো করে ওর মুখখানা দেখবার চেষ্টা করল জাহেদ। বলল শান্ত কণ্ঠে, তোর ভবিষ্যটা কী হত ভেবে দেখেছিস?

মা নেই, বাপ থেকেও নেই। তার আবার ভবিষ্যৎ। বরাতে যা লেখা তাই হোত? তুমি কেন মাথা গলাতে এলে?

খুব কথা শিখেছিস দেখছি, ওই বুড়োটা হবে তোর বর, বরাতে সেটাই লিখে দিয়েছে, না? এ সব কথা আমার সামনে বলবি তো চড় খাবি। বুঝেছিস?

রেগে ওঠে জাহেদ। চোদ্দ বছরের মেয়ের মুখে বরাতের কথা শুনলে কার না রাগ হয়!

কাজল রেখার মতো চিকন ভ্রূ। সে ভ্রূর নিচে একজোড়া ডাগর কালো চোখ। নক্সার মতো নিখুঁত ফর্সা মুখ। পাতলা ত্বকে কিশোরী লাবণ্য আর স্বাস্থ্যের শী। যেন এই প্রথম লক্ষ করল জাহেদ।

জানিস, শহরে তোর বয়সী মেয়েরা ফ্রক পরে খেলে বেড়ায়? লেখাপড়া শিখবি নিজের বুদ্ধিতে চলবার শক্তিটা অর্জন করে নিবি। তারপর তো বিবেক যা বলে তাই করবি। তার আগে আমায় আর চটাসনে।

উত্তর দেয় না রাবু। আঁচলের খুঁটে একটি একটি করে আঙ্গুল জড়ায়। একটি একটি করে আবার খুলে ফেলে।

তুই এখন চাস কী বল্ তো? তোর মন কী কয়, ঠিক সে কথাটাই বলবি। ওকে চুপ দেখে শুধাল জাহেদ।

আব্বাকে এনে দাও। আমার স্বামীকে ফিরিয়ে আন।

অবাক মানে জাহেদ। অসুস্থতার জের টেনে এখনো দুর্বল ওর স্নায়ুগুলো। সেই স্নায়ুতে যেন আগুন ধরিয়ে যায় রাবুর কথাগুলো। চেঁচিয়ে ওঠে, যা, যা, আমার সুমুখ থেকে যা তো। শীগগির যা।

দিন দুই পর।

সকালে ঘুম ভেঙেই খিঁচিয়ে যায় জাহেদের মেজাজটা। চেঁচামেচি শুরু করে দেয় : কতবার বলেছি, সকাল সকাল দু তিন কাপ চা দিয়ে যাবে আমায়। কেউ যেন গায়েই মাখে না আমার কথা। কী মেয়েরে বাপু। কখন থেকে বলছি, যা ওর ঘুমটা ভাঙিয়ে দে। চায়ের পেয়ালার শব্দ পেলেই জেগে উঠবে ও। কী যে সারাক্ষণ ভাবে গালে হাত দিয়ে। জাহেদ শুনতে পায় রসুই ঘর থেকে ভেসে আসছে ওর আম্মার গলা।

রাবু আসে। কী এক পরমে ধীর ওর পদক্ষেপ। তেপায়ার উপর তৈরি করা চায়ের কেতলি আর পেয়ালাটা রেখে ফিরে যাবার জন্য পা বাড়ায়।

যাসনে। বস। কথা আছে। অতিরিক্ত গম্ভীর জাহেদের কণ্ঠ। মুখটা নীচু করে দাঁড়িয়ে যায় রাবু।

বসছিস না কেন? বসতে বললাম যে। ধমকে ওঠে জাহেদ।

বিড়াল ছানার মতো হাতপাগুলোকে সংকুচিত করে এতটুকু হয়ে বসে রাবু। খাটের কোণায়।

দেখ তোর লজ্জা দেখে আমারও লজ্জা পায়।

এজন্যই বসতে বলেছিলে নাকি? ছোট্ট করে শুধায় রাবু।

 থামবি? তোর এ সব বাঁকা আর সেয়ানা কথা সহ্য হয় না আমার। বরাত বুঝিস, স্বামী চিনিস। মগজটাকে তো দিব্যি পচিয়ে তুলছিস। এদিকে লেখাপড়ার বেলায় তো ঢুঁ-ঢুঁ।

বেশ, ঢুঁ ঢুঁ, তাতে কার কী?

ও বাবা, আবার গাল ফোলানো হচ্ছে! তা, এদিকে যে একেবারেই মাড়াচ্ছিস না, ব্যাপার কী?

যা যা, আমার সুমুখ থেকে যা, এ সব কথা শুনলে কার আসতে ইচ্ছে হয়?

হো হো করে হেসে দেয় জাহেদ, বলে, তোর যে দেখি রাগও আছে। ঘন ঘন চুমুক দিয়ে পেয়ালার চাটা শেষ করে জাহেদ। বলে আবার, তুই নাকি কোলকাতায় যাবি না বলেছিস?

হ্যাঁ, বলেছি তো। কেমন জেদী কণ্ঠস্বর রাবুর।

কেন যাবি না?

সব বলেছি জ্যাঠি আম্মাকে।

আমাকেও বলতে হবে।

কী আমার মোড়লরে! সবই বলতে হবে তাঁকে! বলব না।

বলবি না? কেমন আহত আর ক্ষুণ্ণ স্বর জাহেদের। কী এক ব্যথায় যেন কালো হয়ে যায় ওর সদ্য হাসি ছড়ান মুখখানা।

চকিতে একবার চেয়েই চোখ নাবিয়ে নেয় রাবু। ফস করে কথাটা বলে ফেলেছে বটে, কিন্তু জাহেদকে একটুও আঘাত দিতে চায়নি ও। তাই ব্যথাতুর মুখটার দিকে তাকিয়ে ছলছলিয়ে ওঠে রাবুর চোখ। ঘোমটাটা আর একটু টেনে দেয় রাবু আর খাটের কার্নিসে আঙ্গুলের নখ ঘষে চলে। স্থির অপলক চোখে ওর দিকে চেয়ে থাকে জাহেদ। চোদ্দ বছরের মেয়েটি–ওই একটি রাত, এই কয়টা দিন যেন কোনো যৌবন অতিক্রান্তা নারীর পরিণতি দিয়েছে, গাম্ভীর্য দিয়েছে আর দিয়েছে কী এক বিতৃষ্ণা। ঘরে বসে আনমনে বুঝি পুতুল খেলছিল মেয়েটি, বেরিয়ে এসে দেখল ওর আনন্দময় কৈশোর ওর অনাগত রোমাঞ্চ ভরা যৌবন, এতগুলো বছর কে যেন মাঝখান থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। আনন্দে নাচবার, খুশিতে হাসবার আর কোনো অধিকার নেই ওর। বৃদ্ধ স্বামীর সেবা, দেওয়ানা পিতার হাজারো অত্যাচার সয়ে সয়ে সেই পিতাকেই আবার আঁকড়ে ধরা, ওই ওর জীবন। এই ওর বরাত।

বুঝি ওর মুখটা ভালো করে দেখবার জন্যই উঠে আসে জাহেদ।

আমার সামনে ঘোমটা দিচ্ছিস, এটা সত্যি তোর বাড়াবাড়ি।

জাহেদ আর চেয়ে থাকতে পারে না নিরানন্দের বিষাদ ঘেরা ওই মুখটার দিকে। বুকের ভেতরটা ওর মোচড় দিয়ে যায় কী এক বেদনায়।

রাবু কোনো কিছু বুঝবার আগেই ওর ঘোমটার আঁচলটা সরিয়ে দিয়েছে জাহেদ আর ওকে টেনে নিয়েছে আপন বাহুর পাশে। বলে চলেছে : তুই যদি ভাবিস সবাই মিলে হাত-পা বেঁধে কুয়োর ভেতরে ফেলে দিয়েছে তোকে, বাঁচার কোনো পথ নেই তোর, তবে কিন্তু খুব ভুল করছিস। দেখ আমার দিকে দেখ।

রাবুর চোখে পানি। পানির ধারা নেবে আসছে চিবুক বেয়ে।

ওর ভিজে চিবুকটা হাতের স্পর্শে তুলে নেয় জাহেদ, দেখ, ভালো করে চেয়ে দেখ তো? বর হিসেবে কী খুব মন্দ দেখাবে আমায়? মানাবে না তোর সাথে? ওকি চোখ বুজছিস কেন?

চোখের অশ্রু আর শরমের আবিরে বুঝি অপরূপ রাবু। মুখ লুকোতে গিয়ে আরও কাছে সরে আসে রাবু।

ঝুঁকে আসে জাহেদ। নিজের মুখ দিয়ে ডলে দেয়, ঘষে দেয় রাবুর কপালটা। বলে, ওই বুড়োর ঘর করাই যদি তোর কপালের লিখন হয়ে থাকে তবে এই আমি সৈয়দ আলী জাহেদ, এই মুহূর্তে সেই লিখনটা মুছে দিলাম তোর কপাল থেকে।

ছাড়া পেয়ে ছুটে পালিয়ে যায় রাবু।

দুর্ভাবনাকে ঠাঁই দেয়ার মতো মন নয় জাহেদের। অথচ সেই রাতের অবিশ্বাস্য ঘটনাটা, সেই সকাল আর এই তিনটি চরিত্র রাবু, দরবেশ চাচা আর তাঁর কামেল ওস্তাদ, সব মিলিয়ে চিন্তা আর দুশ্চিন্তা যেন গিঁঠ বেঁধে থাকে ওর মনের ভেতর। রাবুর দুর্বোধ্য একগুঁয়েমিটা যে কোথায় নিয়ে যাবে ওতে শিউরে ওঠে ও।

এরি মাঝে সুলতানপুরে মিটিং করতে গিয়ে ঢিল খেয়ে মাথা ফাটিয়ে এসেছে সেকান্দর। শরীরটা সারেনি বলে জাহেদ যেতে পারেনি সুলতানপুর। অথচ তার অনুপস্থিতিতে মার খেয়ে এল সেকান্দর। মনটা বুঝি আরো খারাপ হয়ে যায় জাহেদের।

নিশ্চয় এই মৌলভীদের কাণ্ড। কেন যে মৌলভীগুলো অমন আদাজল খেয়ে লেগেছে লীগের বিরুদ্ধে বুঝি না আমি। সব শুনে বলল জাহেদ, আরে না, মুলভী ফুলভীর ছায়াও ছিল না ধারে কাছে। সব গিয়ে হল আমাদের স্বনামধন্য প্রেসিডেন্ট ফেলু মিঞার দক্ষিণ হস্ত, যার নাম কান কাটা রমজান, তারই কীর্তি।

তার কীর্তি? যেন আর্তনাদ করে উঠল জাহেদ।

এই তো সমাজের অবস্থা। তা বাইরের চেহারার দরকার কী, তুমি তো আজাদী আজাদী বলে চেঁচিয়ে বেড়াচ্ছ দেশময়। অথচ তোমার বাড়িতেই ঘটে কী বর্বর কাণ্ড।

থাম থাম। কানে আঙ্গুল দেয় জাহেদ। এর পরই তো সাদা চামড়াওলাদের সেই থিওরিটা আওড়াবে, এখনো স্বাধীনতার উপযুক্ত হইনি আমরা।

সাদা চামড়ার উপর যতই না গায়ের ঝাল মিটাও, কথাটা তো ঠিক। আজাদী নিয়ে আমরা করব কী বল তো? না আছে আমাদের শিক্ষা, না আছে পোক্ত নৈতিকতার ভিত্তি। নইলে ভাবতে পার অতবড় এলেমদার বাবা নিজের চোদ্দ বছরের মেয়েটিকে তুলে দিতে পারে ষাট বছরের বুড়োর হাতে?

অতএব চিরটাকাল নিজের দেশে পরবাসী হয়ে থাকি আমরা। এই তো? ব্যঙ্গ বাঁকা স্বর জাহেদের।

কদর্থ করছ কেন আমার বক্তব্যের? আমার কথা হল : সমাজটাকে মেরামত কর। শিক্ষা দাও, আলো দাও, গোঁড়ামির অচলায়তন ভেঙে উন্মুক্ত কর বুদ্ধির দ্বার, কুসংস্কারের বাঁধ ভেঙে এনে দাও মুক্তির প্লাবন। মনটা রইল তোমার শৃঙ্খলে, চাও তুমি মুক্তি। সে কী সম্ভব, না কাম্য? বেশ গুছিয়ে জোর দিয়ে দিয়ে কথাগুলো বলে গেল সেকান্দর। নিজেও অবাক হয় ও এ গাঁ ও গা ঘুরে ঘুরে বক্তৃতা আর তর্কে মেতে মুখ গেছে ওর খুলে, জিবে এসেছে ধার।

আবার ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ছ তুমি। দুশো বছর পিছিয়ে পড়া মুসলিম সমাজটার চোখ খুলে দিতে হলে যে বিরাট সংস্কার আর বিপুল কর্মোদ্যমের প্রয়োজন সে কী অস্বীকার করছি আমি? কিন্তু আমি মনে করি, অভ্রান্ত সত্য হিসেবেই মনে করি, একমাত্র রাজনৈতিক স্বাধীনতাই উন্মুক্ত করতে পারে সেই আকাঙ্ক্ষিত দ্রুত সংস্কারের পথ, রাজনৈতিক স্বাধীনতাই তৈরি করে দেবে বাঞ্ছিত পরিবর্তনের অর্থনৈতিক আর সামাজিক ভিত্তি।

সবই বুঝলাম। কিন্তু আজাদীর জন্য একটা ন্যূনতম মানসিক চারিত্রিক প্রস্তুতি থাকবে না? সে প্রস্তুতি কোথায় আমাদের? অধিকার বোধটা হল একান্ত প্রাথমিক উপলব্ধি। সে অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যে চারিত্রিক দৃঢ়তা, নিষ্ঠা, সততা আর আত্মার সম্পদ প্রয়োজন তার কী করছ? ওগুলো বাদ দিয়ে আজাদী আসতে পারে না, এলেও আজাদী ধরে রাখতে পারবে না, আত্মিক শক্তির অভাবে আজাদীটাই হবে উৎপীড়ন বিশৃঙ্খলার নামান্তর। উত্তেজিত স্বর সেকান্দরের। আজকাল তর্কের জোরে প্রায়ই উত্তেজিত হতে শুরু করেছে ও।

উদ্ভট যুক্তি তোমার। থাক গিয়ে এ তর্ক। আমি ভাবছি রমজান বলত মিনিমুখো শয়তান, কিন্তু মিনিমুখোটা যে মারমুখো হয়েছে, এখন কী বলে রমজান? হো হো করে এক সাথেই হেসে দেয় ওরা।

স্বাধীনতা একটি ব্যাপক, একটি সম্পূর্ণ চিন্তাধারা, একটি সামগ্রিক জীবনবোধ। জীবনের সব ক্ষেত্রেই এর রয়েছে একটা অর্থ, তাৎপর্য। সেটা হল জাগরণ এবং পুনর্গঠন-নৈতিক-আধ্যাত্মিক, সামাজিক-অর্থনৈতিক–সর্বক্ষেত্রে। তার মানে সংগ্রামটা হবে কঠিন, দীর্ঘস্থায়ী, প্রস্তুতি চলবে ঘরে ঘরে। এটাই তোমাকে বোঝাতে চাই। তাই এত তর্ক করি। হাসি থামিয়ে বলল সেকান্দর।

আমি বুঝি এবং আরও বুঝতে চেষ্টা করব, প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি। তর্কের ইতি টানতে চাইল জাহেদ।

কিন্তু সেকান্দর যেন জিদ ধরেছে। সে বলে চলল–আমাদের মানসিকতাটা এখনো মধ্যযুগীয় ফিউডাল, এটা উপলব্ধি করতে হবে এবং একে দূর করতেই হবে।

তা স্বীকার করি মাস্টার। কিন্তু এখন তো অন্য চিন্তায় আসতে হয়। ব্যাটারা যে মিটিংয়ে গোলমাল শুরু করল, তার কী করবে? তোমার মামুজান ফেলু মিঞা তো নোসাখা দিয়েই দিয়েছেন, লাঠ্যৌষধি অর্থাৎ ওদের লাঠির জবাবে আমাদেরও লাঠি। আর গাদ্দারগুলোকে উত্তম ঠ্যাঙ্গানি।

ঠিক দাওয়াই। সায় দিল জাহেদ।

তবু চিন্তা মুক্ত হতে পারে না জাহেদ। হৃদয়ের স্বচ্ছ আবেগ দিয়ে যা অতি সহজ এবং স্বাভাবিক ভাবতে অভ্যস্ত ও, সে সমস্তই আজ কেমন গিঁঠ পাকিয়ে উঠেছে। ঘরে এবং বাইরে। জীবনে সহজের কোনো অস্তিত্ব নেই। রূঢ় নিদারুণ এক সত্য হিসেবেই যেন কথাটা উপলব্ধি করল তরুণ জাহেদ।

ওই এক রত্তি মেয়ে রাবু, সে-ই তো কত কঠিন। জাহেদের চোখে যা অস্বাভাবিক ও মেয়েটার কাছে তা-ই যেন স্বাভাবিক। একা রাবু কেন, বাড়িতে, বাড়ির বাইরে সকলের কাছেই জাহেদের সহজ স্বাভাবিক চিন্তা আর কাজগুলো যেন অস্বাভাবিক, অসরল অর্থ ভরা। 

হোক না ভ্রান্ত তরীকার অনুসারী, তবু তো তারা আল্লার ওলি, ছিঃ ছিঃ মাইজা মিয়া কামটা বড় খারাপ করেছেন। জাহেদের সুমুখেই বলেন মুনশীজী।

তোব তোবা, এটা কী সৈয়দ বাড়ির ছেলের মতো কাম হয়েছে? কপাল থাপড়ায় মালুর মা। সৈয়দ বাড়ির নামে অমন একটা কলঙ্কের কালিমা পড়েছে। বলে বড় বিচলিত মালুর মা।

খোদার হুকুম ছাড়া গাছের পাতা নড়ে না। খোদার হুকুম হয়েছে, ওর বিয়ের ফুল ফুটেছে। নইলে অমন হুট করে সৈয়দ বাড়ির মেয়ের বিয়ে হয়েছে কখনো? কাজটা ভালো করিসনি বাবা। ভর্ৎসনার স্বর সৈয়দ গিন্নীর।

আশ্চর্য হয় জাহেদ। সত্যের পথটা কত সংস্কারে আচ্ছন্ন।

বলে না কিছু মালু আর আরিফা। ওরা সেই যে হকচকিয়ে চুপ মেরে গেছে আর মুখ খুলছে না। কেমন যেন ভোজবাজির মতো ঘটে গেলো একটার পর একটা ঘটনা, ওরা যেন নীরব দর্শকই হয়ে রইল। মনে মনে ওদের যতটুকু অভিমান, যতটুকু রাগ, সে হল রাবুর বিরুদ্ধে। যদি বেঁকে বসত রাবু। সাধ্য ছিল কার কলমা পড়ায়? তা ছাড়া এখনই বা কী কাণ্ডটা করে চলেছে রাবু। লম্বা সেজদা, ঘন্টা ধরে মোনাজাত। বুঝি কাঁদেও চুপি চুপি। মানে হয় এ সবের?

বাইরের কানাঘুষো যথাসময় এবং যথানিয়মে পল্লবিত হয়ে পৌঁছে যায় সৈয়দ বাড়ির অন্তঃপুরে। গম্ভীর হয়ে যায় সৈয়দ গিন্নী। কান জোড়া গরম গরম হয়ে উঠে রাবুর।

দেখলে তো তোমার বাহাদুরির ফলটা? তামাম দুনিয়ায় ঢি ঢি পড়ে গেছে। তোমার না হয় হায়াশরম নেই। কিন্তু আমি? গ্রামে যদি এসব রটে আমি যাব কোথায়? যেন কৈফিয়ৎ চাইছে রাবু।

কলকাতায়। সংক্ষেপে বলে মুচকি হাসে জাহেদ। ওর পরিহাস চঞ্চল চোখ দুটো ঘুরে বেড়ায় রাবুর ঘোমটা মুক্ত মুখের উপর। রাগের চোটে আজ ঘোমটা টানতে ভুলে গেছে রাবু।

ফাজলেমি রাখ তো মেজো ভাই। বংশের বদনাম হচ্ছে না? লোকের কানাঘুষো বুঝি তোমার গায়ে বিঁধে না?

আহা, ফুলচন্দন পড়ুক লোকের মুখে। আবারও হাসে জাহেদ। রাবুর মুখে রাগ দেখে হাসি সামলান সত্যি বুঝি দুঃসাধ্য।

হঠাৎ কেন যেন হাসিটা ওর উবে যায়। গম্ভীর হয়, বুঝি কঠিন হয় জাহেদ, কী এক ঝাঁঝ ফুটিয়ে বলে ও : বংশের দশ পুরুষে তোর মতো স্বার্থপর কেউ জন্মেছে?

কী কথায় কী কথা? কেমন ভয় পেয়ে যায় রাবু। এ এক মুশকিল ওর, জাহেদ যখন রেগে যায় তখন কেন যেন ওর নিজের রাগটা গলে যায়, পানি হয়ে চোখের ধারায় ছুটে আসতে চায়।

আমি তোর সর্বনাশ করেছি, কী হবে তোর, কোথায় যাবি, কী করবি? এত সব দুশ্চিন্তায় ঘুম নেই তোর। আর ওই জোব্বাধারী শয়তানটা যে ফাটিয়ে দিল আমার মাথাটা, দেখেছিস একটিবার কপালে হাত বুলিয়ে? জিজ্ঞেস করলি একটিবার, কেমন আছি? আচমকা অভিমানে ভেঙে পড়ে জাহেদ।

ও মেজোভাই। তুমি কী গো… কথাটা শেষ করতে পারে না রাবু। ওর গলাটা যেন বুজে এসেছে আর উদগত এক কান্নার দমকে দুমড়ে গেছে ওর চিকন দেহ।

খাটের আলসেয় মুখ লুকিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কেন যেন ভালো লাগছে রাবুকে। আস্তে আস্তে ওর পিঠে হাত বুলিয়ে দেয় জাহেদ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *