০১-০৫. হারামজাদী ছিনাল

সংশপ্তক – উপন্যাস – শহীদুল্লা কায়সার

০১.

হারামজাদী ছিনাল।

বজ্জাত মাগী।

খানকী বেইশ্যা।

মিঞাবাড়ির কাচারির সুমুখে লম্বালম্বি মাঠ। মাঠের পর মসজিদ। সে মসজিদের সুমুখে বসেছে বাদ জুমা মজলিস। খানিক দূরে দাঁড়ান ঘোমটা ছাড়া একটি মেয়ে। গালিগুলো ওরই উদ্দেশে।

এই কসবী হারামজাদী! ঘোমটা দে। ধমকে উঠে ফেলু মিঞা। ফেলু মিঞা শুধু মিঞার বেটা মিঞা নয়, গাঁও মজলিসের কর্তা। তার ধমকে কেঁপে ওঠে মজলিস।

আবার দেমাক দেখো না? কিরে খানকি মাগী যারবা পেটে নেবার সময় খেয়াল ছিল না? দেমাগটা তখন কোথায় ছিল? মুনিবের চেয়ে কণ্ঠস্বর আর এক ডিগ্রী চড়া করে খিঁচিয়ে ওঠে রমজান। রমজান শুধু কর্মচারী নয় সব কাজেই ফেলু মিঞার দক্ষিণহস্ত। অতএব, কর্তার রোখ বুঝে তার স্বরের ওঠানামা। তা ছাড়া কানে-কানে চালু কথা, আগাগোড়া ব্যাপারটার পেছনে কাজ করেছে রমজানের পাকা হাত।

কিন্তু মেয়েটি নির্বিকার। এত যে গালি তাতে ভাবান্তর নেই ওর মুখে। একটু হেলছেও না, কাঁপছেও না। মিঞার ধমকে মাথায় ঘোমটা তুলল না ও। একটিবার চেয়ে দেখল না হুকুমদাতা ফেলু মিঞা অথবা রমজানের দিকে। বাঁশের ছিলার মতো দেহটাকে টান করে, ঘাড়টিকে তেরছা করে অদূরের এক খণ্ড চেলা কাঠের দিকে চেয়ে সেই যে দাঁড়িয়ে আছে, আছেই। যারা থুক থুক করছে নীরব অবজ্ঞায় সেই থুতু যেন ফিরিয়ে তাদেরই গায়ে ছিটিয়ে দিচ্ছে।

বিচার শুরু হোক, কে যেন বলল। মাথা নেড়ে সায় দেয় অন্যরা, হ্যাঁ, শুরু হোক।

ফেলু মিঞা অথবা রমজানের মুখ খারাপ করার প্রয়োজন পড়ত না মেয়েটি যদি এক ডাকেই এসে পড়ত। সে আসবে না বলেছিল। বলেছিল তার অসুখ, জ্বর। আর ওই পঞ্চায়েৎ মজলিস-ফজলিস মানে না সে। কী এত-বড় দুঃসাহস ওই খানকি মেয়ের! পঞ্চায়েৎ মানে না! গর্জে উঠেছিল ফেলু মিঞা। পাঠিয়েছিল রমজানকে আর পেয়াদা কালুকে। পেয়াদা চুলের মুঠো ধরে হেঁচড়ে হেঁচড়ে টেনে এনেছে মেয়েটিকে।

হর সখছ যে মোমিন মুসলমান সে গোনাহকে ভয় করে। গোনাহ্ দুই কিসিমের–এক কবীরা গোনাহ্, দোসরা সগীরা গোনাহ্। সগীরা গোনাহর তওবা আছে, মাফ আছে। কিন্তু কবীরা গোনাহর তওবা নেই, মাফ নেই। বড় কঠোর তার শাস্তি। যেনাহ্ কবীরা গোনাহ্। পাটের গোছার মতো লম্বা দাড়ির আগায় আঙ্গুল বুলোতে বুলোতে বলে গেলেন খতিব সাহেব। তিনি হাফিজ-ই-কোরান, সহি হাদিসের মশুর ওস্তাদ। তিনি মসজিদের খতিব। জুমার নামাজ এবং খোতবা দুটোই তিনি পড়ে আসছেন গত পঁচিশ বছর। তাঁর কথা পবিত্র কোরানের বয়াতের মতোই অভ্রান্ত, অবশ্য পালনীয়। তাই তিনি যা বলেন শুধু বলেন না, এলান করেন। কী শাস্তি! কী সেই কঠিন শাস্তি। পঞ্চায়েতের শেষের দিকে বসে আছে গ্রামের ছেলেপুলেরা, মাতব্বর নয় এমন মাঝবয়সীরা। উৎকণ্ঠায় ওদের জিহ্বার তালু শুকিয়ে আসে–কী শাস্তি হবে ওই পতিতার! যেনার বিচার তারা কোনোদিন দেখেনি শোনেও নি। দুচার মৌজায় যেনার বিচার কখনো হয়েছে কিনা সে কথাও জানা নেই কারও।

শরিয়ত বলে, চুরি করলে যে হাত দিয়ে চুরি করেছে সে হাতটি কেটে দাও, খুন করলে ঠ্যাংটা ছেঁটে ফেল আর যেনা করলে বুক পর্যন্ত মাটিতে পুঁতে পাথর ছুঁড়ে মার, পাথর ঢেলাতে থাক যতক্ষণ না যেনাকার বা যেনাকারিণীর মৃত্যু হয়। এতটুকু বলে পানের পিক গেলবার জন্য থামলেন খতিব সাহেব।

ছ্যাঁৎ করে ওঠে সেই শেষ কাতারের মানুষগুলোর বুক।–বুক পর্যন্ত মাটিতে পুঁতে পাথর ঢেলিয়ে মেরে ফেল? এই মেয়েটাকে এভাবেই মারতে হবে? পানের পিকটা পেটের দিকে চালান দিয়ে বোজা চোখে ঊর্ধ্বমুখী হলেন খতিব সাহেব। গভীর চিন্তায় যেন ডুবে গেছেন তিনি। শরা-শরিয়তের জটিল ব্যাপার, না ভেবে উপায় আছে তার? সেই অবস্থাতেই চিবানো পানের দলাটা জিবের আগা দিয়ে ঠেলে ঠেলে বাঁ-গাল থেকে ডান গালে সরিয়ে আনেন। ঠোঁট জোড়া বন্ধ রেখে গরুর জাবর কাটার মতো আস্তে আস্তে চিবোতে থাকেন। 

সারা মজলিসের চোখ খতিব সাহেবের মুখের উপর। শরিয়তের এমন কঠিন বিধানটি ঘোষণা করার পরও যখন চোখ বুজে ভাবছেন তখন আরও কিছু নিশ্চয় বলার আছে খতিব সাহেবের। কী বলবেন তিনি?

অবশেষে চোখ খুললেন খতিব সাহেব। সকলের দিকে এক নজর বুলিয়ে বললেন : তবে এই আউরত পয়লা গোনাহ্ করেছে তাই আমি বলি ওকে শুধু দোররা মেরেই ছেড়ে দেওয়া হোক। পাঁচ দোররা।

আরবী ড়-আইন বর্ণটিকে যেমন একেবারে গলার গভীর খাদ থেকে টেনে উচ্চারণ করতে হয় তেমনিভাবে আলাজিহ্বারও নিচ থেকে টেনে টেনে দোররা শব্দটি বার কয়েক উচ্চারণ করেন খতিব সাহেব।

আল্লাহ্ পাক, তুমিই গোনাহ মাফ করনেওয়ালা, মোনাজাতের ভঙ্গিতে হাত জোড়া আকাশের দিকে উঁচিয়ে কথা শেষ করলেন খতিব সাহেব। তার পর কোলের উপর রাখা তসবির ছড়াটা হাতে তুলে নিলেন। তসবি গোটা গুনে গুনে আল্লাহ্ পাকের নাম স্মরণে মন দিলেন।

 দোররা? পাঁচ দোররা?

বুক অবধি মাটিতে পুঁতে ঢিলিয়ে মেরে ফেলবার অমোঘ বিধান শুনে বুক যাদের ছ্যাঁৎ করে উঠেছিল, তারা কী আশ্বস্ত হল? না। আশ্বস্ত হয় না শেষের সারির লোকগুলো, গায়ের লোমকূপ দাঁড়িয়ে যায় তেমনি একটা ভয়াকুল শিহরণ, একটা অস্পষ্ট গুঞ্জন বয়ে যায় সেখানে। মেয়েটি কেমন করে সইবে ওই ভয়ংকর শাস্তি? তাই ওদের আশঙ্কা। আবার কারও কৌতূহল। চোখগুলো খতিব সাহেবকে ফেলে এবার মেয়েটির উপর নিবদ্ধ হল।

নিঃশঙ্ক ঔদ্ধত্যে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটি যেমনটি প্রথমেই এসে দাঁড়িয়েছিল। ওসব হুমকি ধমক বুঝি বহু শোনা আছে তার, পরোয়া করে না সে। শুধু একবার ডান পা থেকে বাঁ পায়ে নিয়ে এল দেহের ভারটা। অবস্থান পরিবর্তনের আচমকা আলোড়নে ওর অন্তর্বাসহীন দুটি স্তন উত্তাল তরঙ্গের ফণার মতন মাথা তুলে কেঁপে কেঁপে আবার স্থির হয়ে যায়। ডান পায়ের উপর ভর রেখে ছেঁড়া আঁচলটাকে এবার খুব সেঁটে পিঠের এলোমেলো ছড়ানো চুলের উপর দিয়ে পেঁচিয়ে আনল মেয়েটি। তারপর গলার কাছটিতে দোপাট্টা করে বেঁধে নিল। আর সে বন্ধনে ওর ফালি-বাঁশ দেহটি নাভি অঞ্চল থেকে ঈষৎ বেঁকে এল ছিপের আগার মতো। পুষ্ট অথচ ধারালো দেহের ওই বঙ্কিম ভঙ্গিটিই যেন বিদ্রোহের প্রকাশ্য ঘোষণা। হোড়াই পরোয়া করে সে এই পঞ্চায়েতের।

মুহূর্তে চকচকিয়ে ওঠা চোখ জোড়া অন্যদিকে ফিরিয়ে নেয় ফেলু মিঞা। লালা ঝরে রমজানের জিবের ডগায়, লোভী কুকুরের মতো।

একবার আড়চোখে দেখেই মুখ ঘুরিয়ে নেয় খতিব সাহেব। তসবি গোটার উপর দ্রুততর হয় তার আঙ্গুলের সঞ্চালন। দোয়া পড়ে দূরে রাখেন পাপের শয়তানকে–তওবা আসতাগ ফিরিল্লা। তওবা তওবা।

মেয়ে মানুষ। তাকে দোররা মারাটা কী ঠিক হবে, না সম্ভব হবে? মিঞা কী বলেন? প্রশ্নের আকারে জবাবটিও উপস্থিত করে সতুর বাপ। তারপর ভার-ভারিক্কী মুখের তোয়াজটা অপ্রশস্ত হাসির আকারে মেলে ধরে মিঞা অর্থাৎ ফেলু মিঞার দিকে। তিনিই কর্তা, তিনি যা বলবেন সেটাই তো হবে শেষ বিচার, হক বিচার।

গোটা মজলিসের চোখ এবার ফেলু মিঞার দিকে। মোগলীয় হুঁকোর নল হাতে চেয়ারে বসা আতরের খোসবু ছড়ানো ওই যে মিঞার বেটাটি সে কী একটা সাব্যস্তের কথা বলতে পারে না?

ল্যায্য কথাই বলেছে সতুর বাপ। মেয়ে মানুষকে মজলিসের সামনে, বলতে গেলে গোটা গেরামের সামনে বেপর্দা করে দোররা মারা–এ বড় না-জায়েজ ব্যাপার। সতুর বাপের সমর্থনে একটা জোরালো যুক্তিই তুলে ধরলেন কারি সাহেব। তিনিও হাফিজ ই-কোরান, শরা-শরিয়ত সম্পর্কে তিনি ওয়াকিফহাল। অতএব, ফেলবার নয় তাঁর কথা।

সত্যি-ই তো। গোটা গেরাম না হোক মজলিসের এত লোকের সামনে একটি যুবতী মেয়ের নিতম্বে চাবুক মারা, এ বড় বিশ্রী কারবার। শেষের সারির লোকগুলো মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে। ওরা কী বলবে কিছু?

জরী সুতোয় পেঁচানো রাবারের নলটি আলবোলার গায়ে জড়িয়ে রেখে মুখের অবরুদ্ধ ধোঁয়া পরম আয়াশে ঢোকে ঢোকে ছেড়ে দেয় ফেলু মিঞা। চোখ উপরে তুলে অপেক্ষা করে, হাল্কা মেঘপুঞ্জের মতো ধোঁয়াটা যতক্ষণ কুণ্ডলী পাকিয়ে পাকিয়ে কাচারির উঁচু চালের সাথে লাগোয়া দমদমায় অদৃশ্য না হয়ে যায়। তারপর মিঞা তরবিয়তে একটু হেলে-দুলে বলল : সতুর বাপ মাতব্বর এবং কারি সাহেব যথার্থই বলেছেন। আমি বলি ওকে ছেঁকা দেয়া হোক। আর গ্রামে গ্রামে বাড়ি বাড়ি ঢোল পিটিয়ে দেয়া হোক ওকে কেউ জায়গা দেবে না, খাবার দেবে না; দিলে এক ঘরে হবে, মেল থেকে বরখাস্ত হবে।

তথাস্তু। মিঞার কথার উপর কী কথা আছে? সকল মাতবর এক বাক্যে সাব্যস্ত করল যেনাহ্ করার অপরাধে হুরমতিকে ছেঁকা দেয়া হবে। এবং একঘরে করা হবে।

মেয়েটি কী একবার কেঁপে উঠল? ভয় পেল?

তেমন কোনো আভাস নেই মেয়েটির চোখে অথবা মুখে। সেই যে চেলা কাঠ-টার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়েছিল, এতক্ষণে মুখটা তুলেছে ও। চোখ মেলে দেখছে দণ্ডদাতাদের। মেয়েটি গৌরবর্ণা, সুন্দরী বললে খুবই কম বলা হয় বুঝি। জ্বরের তাপে জ্বল জ্বল করছে গৌর মুখখানি। চোখ দুটি কামার চুল্লির গনগনে দুটুকরো লোহার মতো পুড়ছে আর আগুনের হলকা ছোটাচ্ছে। দেমাক নয়, এ তার প্রচণ্ড ঘৃণা। চোখের গর্ত থেকে গরম ধাতুর মতো গলে গলে পড়ছে সে ঘৃণা। বেপরোয়া সেই দৃষ্টিতেও যেন শেষবারের মতো জরিপ করে নিল কে তার শত্রু, কে তার মিত্র। তারপর আগের মতো ঘাড়টাকে শক্ত আর তেরছা করে চেয়ে রইল সেই চেলা কাঠের দিকে। কাঠের মুখটা পোড়া। কেউ হয়ত তামাক খাবার জন্য উনুন থেকে তুলে এনেছিল।

বিচারকরা কেউ তাকাতে পারে না পাপিষ্ঠার সেই জ্বলজ্বলে মুখের দিকে। অবশেষে হুকুম এল ফেলু মিঞার, কালু শুরু কর তোর কাম। ফেলু মিঞার একাধারে লেঠেল পেয়াদা আর খাস নফর কালু। হুকুম পেয়েই কালু লেগে যায় ছেঁকার এন্তজামে।

যারা মাতব্বর নয় তাদের মাঝে শেষের সারির আগের সারিতে বসেছিল সেকান্দর মাস্টার। মেয়েটি যে ব্যভিচারিণী সে সম্পর্কে তিলমাত্র সন্দেহ নেই ওর। তাই সহানুভূতিও নেই মেয়েটির প্রতি। তবু কী যেন বলার থেকে যায়, ঠোঁটের গোড়ায় এসেও কথাটা বের হতে পারে না। বলাও হয় না।

এক বাজারে দুই ভাও, এটা কোনো দেশি কথা। অল্যায্য কথা। উল্টো পক্ষের বিচারটা কী হবে না? একেবারে শেষের লাইন থেকে অর্ধেক দাঁড়িয়ে বলে লেকু। বলেই টুপ করে বসে পড়ে।

শেষের সারির লোকগুলো একটু নড়েচড়ে বসে ওরই কথায় যেন সায় দিল। এ কী বেতমিজী! মাতবরদের এক মুখের রায়কে বলে কিনা এক বাজারে দুই ভাও? লাল হয়ে ওঠে মাতবরদের মুখ, কিন্তু না শোনার ভান করে চুপ মেরে রইল ওরা।

শুধু ঘাড়টা ফিরিয়ে একবার দেখল সেকান্দর মাস্টার। ওর কথাটাই লেকু বলে ফেলেছে, অতি নিখুঁতভাবে। নিজে বললে, অত পষ্টাপষ্টি বলতে পারত না সেকান্দর মাস্টার।

আসলে কারো কাছেই অস্পষ্ট থাকার মতো নয় ব্যাপারটা। সবাই জানে মেয়েটি ছিনাল, কসবী। পাপের শাস্তি দিতেই হবে। কিন্তু যে হার্মাদ ছেলে আনল ওর পেটে সেও তো এই মজলিসে হাজির। তাকে চেনে না কে! মেয়েটির শাস্তি হলে সে লোকটিরও বিচার হওয়া দরকার বই কী? এটাই সেকান্দরের কথা।

লেকুর কথাটা আমারও। এক হাকিমের দুই বিচার, সেটা অবিচার। রমজান কিছু বলুক। যেন একটা বোমা ফাটাল সেকান্দর। আভাস নয় ইঙ্গিত নয় একেবারে স্পষ্ট কথাটা বলেই ফেলল ও?

কারো পছন্দ হল না কথাগুলো ভাঁটার মতো চোখে ক্রোধ ফাটায় রমজান। ভ্রূ জোড়া কুঁচকে নেয় সতুর বাপ। প্রচণ্ড বিরক্তির সঙ্গে চিলমচিতে পানের পিক ফেলে ফেলু মিঞা।

সেও একটা দিক বটে। মাস্টারের কথাটা গওর করতে হবে আমাদের। তবে ভাই জুম্মা শেষ হল অনেকক্ষণ। বেলা আসর হতে চলল। খাব না আমরা? সামনের মিটিং-এ বিষয়টা আসতে পারে, কী বল মাস্টার? চাতুর্যের সাথেই আলোচনার গলা কেটে দিল ফেলু মিঞা।

মাস্টার অর্থাৎ সেকান্দর আর না করে কেমন করে! বলছে ফেলু মিঞা তার উপর লেকু ছাড়া আর কেউ কী মুখ খুলবে? তেমন কোনো ভরসা দেখছে না ও। অতএব, রফার নামে ধামাচাপার প্রস্তাবটাই মেনে নেয় মাস্টার।

সম্রাট পঞ্চম জর্জের প্রতিকৃতি আঁকা তামার একটি পয়সা। কাঠ কয়লার আগুনে পুড়ে পেয়েছে নতুন এক চেহারা। না আছে সেই মুকুট, না সম্রাটের মুখ, মনে হয় জমাট আগুনের একটি গোলাকার পাত। চিমটে দিয়ে কয়লা থেকে যখন কালু তুলে আনল গনগনে পয়সাটা, গোটা মজলিসে কেঁপে কেঁপে গেল একটি ভীতির ছায়া। শুধু ভাবান্তর নেই মাতবরদের মুখে। আপনাদের বিচারের মানদণ্ডে তারা অবিচল।

ইতিমধ্যেই বসিয়ে দেয়া হয়েছিল মেয়েটিকে। দুজন জোয়ান তার হাত পাগুলো চেপে ধরেছে, যদিও নাকের আদলে ছোট্ট একটি কুঞ্চনে আর বিনা প্রতিবাদে ওদের হাতে হাত-পাগুলো সঁপে দেয়ারও মাঝে কেমন একটা অবজ্ঞা ছিটিয়ে রেখেছে মেয়েটি। যেন বলছে প্রয়োজন কী এই জবর-দস্তির।

এবার রমজান নিজেই এগিয়ে আসে। দুতালুর যাঁতায় থুঁতনিটা চেপে রেখে উঁচিয়ে ধরে ওর মুখখানি। চোখ বুঁজে নেয় মেয়েটি। মেয়েটি কী কাঁপছে? যেমন কাঁপে কোরবানীর পশুগুলো? দূর থেকে লেকু কিছুই বুঝতে পারে না। রমজানের হাতের ফাঁক দিয়ে যতটুকু নজরে পড়ে দেখে দাঁতে দাঁত চেপে কেমন ঝিম মেরে আছে ও। লাল টকটকে ওর মুখ, শরীরের সমস্ত রক্ত যেন মুখে এসে ঠাঁই করেছে। মনে হয় পাকা শসার ছিলকের মতো চিকন মুখের চামড়া ফুঁড়ে এখনি রক্তের ফিনকি ছুটবে।

চিমটের আগায় পোড়া পয়সাটা ধরে এক পা এগোয় কালু, ছ্যাঁৎ করে চেপে ধরে অনেকক্ষণ চেপে রাখে, মেয়েটির কপালের ঠিক মাঝখানে যেখান থেকে কিঞ্চিৎ ঢালু হয়ে নেমে গেছে ওর সুন্দর টিকোল নাকটি আর দুপাশে ছড়িয়ে পড়েছে দুটো কাজল রেখা ভ্রূ।

লেকু দেখল নির্দয় ব্যাধের মুঠোয় অসহায় পাখির ছানার মতো কী যন্ত্রণায় ছটফটিয়ে গেল মেয়েটি। তার পর নিথর হল। মনে হল লেকুর পায়ের তলায় মাটিটা ওর শরীরের ভর আর রাখতে পারছে না। এখুনি বুঝি মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যাবে ও। অসহ্য! অসহ্য! আল্লাতালা কী মানুষের রুহগুলো কেড়ে নিয়েছে? সেই যে সিনার নিচে থাকে মানুষের কইলজা সে কী পাথর বনে গেছে? নইলে মানুষ কেমন করে এত বেরহম হয়ে চেয়ে দেখে অমন নিষ্ঠুর নির্যাতন।

কলি। কলি। ঘোর কলি। আল্লার দুনিয়া কী আর আছে? এখন ঘরে ঘরে, মানুষের মনে মনে শয়তানের বসতি। শাস্তি যতই কঠিন হোক শয়তানের গায়ে লাগে না তার আঁচড়। সকলে মিলেই এই রায় দেয় মাতবররা এবং এ যে অভ্রান্ত সত্য তাতে লেশমাত্র সন্দেহ নেই ওদের মনে। প্রমাণ তো হাতের কাছেই। নইলে গাঁ ভর লোকের সামনে এত ঘটা করে হাতপা চেপে ধরে কপালের এক পয়সা পরিমাণ চামড়া পুড়িয়ে দেয়া হল অথচ একটু আহ শব্দ করল না মেয়েটি? তেমন যে পশু ছাগল, কোরবানির সময় কেমন করে দেখনি? ছটফটিয়ে চিল্লিয়ে ঠ্যাং ছুঁড়ে কী একাকার কাণ্ড করে, সামলানো দায়।

হ্যাঁ হ্যাঁ কলিকাল ছাড়া আর কী! সমাজ মানে না, বিচার মানে না, শাসনকে ভ্রুকুটি করে ছোটলোকের জাত। আসকারা পেয়ে ব্যাটার মাথায় চড়েছে, গায়ে ব্যাটাদের চর্বি জমেছে। যেন জনান্তিকেই কথাগুলো বলে গেল ফেলু মিঞা।

ভারত সম্রাট পঞ্চম জর্জের নাম আর প্রতিকৃতি অঙ্কিত কলঙ্ক চিহ্নটি ললাটে নিয়ে চলে যায় মেয়েটি। ঠিক দৃপ্ত ভঙ্গিমায় নয়, এতক্ষণে ওর শক্তি ফুরিয়ে এসেছে পা জোড়া ঠিকমতো ভার সামলাতে পারছে না। যন্ত্রণার কালো কুঞ্চনে বিকৃতি নেমেছে ওর মুখে আর জল জমেছে চোখে।

ব্যভিচারিণীর সমুচিত দণ্ড বিধান করতে পেরে স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ে ফেলু মিঞা। ঠোঁটের দৃঢ়তায় তার শক্তি আর মর্যাদার সদম্ভ ঘোষণা।

ইয়া পরোয়ার দেগার! গোনাহগার বান্দার সকল গোনাহ্ তু-ই মাফ করনেওয়ালা। সকলের হয়ে খোদার কাছে মাফ চেয়ে নিলেন খতিব সাহেব। তসবীর ছড়াটা পকেটে পুরে বিদায়ের জন্য মিঞার অনুমতি চাইলেন।

ক্রুর উল্লসিত দৃষ্টি রমজানের। সে দৃষ্টিটা অনেকক্ষণ ধরে পড়ে থাকে মিয়া মসজিদের উত্তর কোণের দিকে, যে দিক দিয়ে এই মাত্র চলে গেল মেয়েটি।

ব্যাটা বদমাস। হারামখোর। তুমি সাজ সাধু? এক রোখা শুয়োরের মতো গোঁৎ গোঁৎ করে তেড়ে আসে লেকু। এখনি বুঝি ঝাঁপিয়ে পড়বে রমজানের উপর।

চোখের পলকেই বেধে যেতো তুমুল কাণ্ড। ঠিক সময়টিতেই সেকান্দর লাফিয়ে পড়ল ওদের মাঝখানে।

কর কী? কর কী? বুড়ো কারি সাহেবও ধরে ফেললেন লেকুর হাতটা। দেখলেন দেখলেন হুজুর। আপনার সামনেই? ভাঁটার মতো চোখে ক্রোধ শানিয়ে গর গর করে রমজান আর নালিশ জানায় মুনিবের কাছে।

সুচতুর মিঞা সকল তূণেই অস্ত্র মজুদ রাখতে হয় তাকে। নইলে মিঞাগিরি চলে না। একটু হেসে বলল ফেলু মিঞা থাক্ আর কথা বাড়াও কেন। এদিকে এসো, চৌদ্দ নম্বর তৌজির তহসিল খাতাটা বের করে রাখ। কাজ আছে। আমি ততক্ষণে খেয়ে আসি।

০২.

ভোঁ দৌড়ে চলে আসে মালু।

জানো রাবু আপা! হুরমতি বুয়াকে ছেঁকা দিয়েছে। ইস্ কী যে তাঁতাল পয়সাটাকে লাল আগুনের মতো হয়ে গেল, দিল চেপে হুরমতি বুয়ার কপালে। ক্ষোভে কান্নায় উত্তেজনায় স্বরটা প্রায় বন্ধ হয়ে আসে মালুর। ওর বার বছরের জীবনের এ হল নিষ্ঠুরতম ঘটনা।

শুনলে তো বড় আপা! তোমার মামাটা কী রকম হার্মাদি শুরু করেছে। সাতদিনও হল না বেচারীর বাচ্চা হয়েছে। এরি মধ্যে কী টানা হ্যাঁচড়া। বড় আপা অর্থাৎ আরিফা রাবুর চেয়ে দুবছরের বড়। তাই বড়র গাম্ভীর্যটা ছেলেমী উৎসুক্যে ক্ষুণ্ণ না করে তাকাল মালুর দিকে। শুধাল হুরমতি এখন কই রে?

উত্তরটা দিতে গিয়ে এবার কেঁদেই ফেলল মালু। জড়িয়ে জড়িয়ে ভেজা গলায় বলে, জানেন বড় আপা! এই, এত বড় ঘা হয়েছে। দেখলে ডর করে। হাতের আঙ্গুলগুলো সাজিয়ে ঘায়ের আয়তনটা দেখাতে চেষ্টা করে মালু। তারপর সার্টের খুঁটে চোখগুলো রগড়ে রগড়ে মোছে, জবাব দেয় বড় আপার প্রশ্নের–হুরমতি বাড়িতে। বলেই উল্টোমুখী হয় মালু। ওকে এখুনি ছুটতে হবে রাশুদের বাড়িতে, খবরটা দিতে হবে রাশুকে। আজ সে সিন্নি খেতেও যায়নি, পঞ্চায়েতের এমন হুলস্থূল শাস্তিটাও দেখতে যায়নি। কেন, সেও এক দ্বন্দ্ব মালুর মনে।

একটু দম নিয়ে ছুট দেবে মালু। এরি মাঝে কিসে যেন কী হয়ে গেল। মুখ ঘুরিয়ে দেখবার অবকাশ পেল না। দুমদাম কিল থাপ্পড়ে পিঠটা তার জর্জরিত হল কান আর গালের উপর শক্ত শক্ত চড় পড়ল। আর সাথে সাথেই শুনল যে কণ্ঠটিকে সে পৃথিবীতে সব চেয়ে বেশি ভয় করে সেই কণ্ঠের নিত্যকার শোনা গালি হারামজাদা কামিনা, ডাকতে ডাকতে ঝাঁঝরা হয়ে গেল মাথাটা। লেখা নাই, পড়া নাই শুধু ড্যাং ড্যাং।

মালু জানে গালির মাত্রাটা যতই উচ্চগ্রামে পৌঁছাবে ততই কমতে থাকবে প্রহারের মাত্রা। তাই টানে টানে মাথাটা মার হাতে সঁপে দিয়ে সুবোধ ছেলেটির মতো অপেক্ষা করে কখন একটু ঢিল পড়বে মারের।

কানটারই ব্যথা সবচেয়ে বেশি। টন টন করছে কানের সাথে সাথে মাথাটাও। এদিক ওদিক একটু ঢিল দিয়ে একটু শক্ত করে দেখল মালু কিন্তু উপায় নেই। আজ কিছুতেই ফস্কাচ্ছে না মায়ের আঙ্গুল। যেন চিমটের মতো কামড়ে রেখেছে মালুর কানটা। কিন্তু সুযোগটা অকস্মাৎ এসে গেল। মার ডান হাতটা সবে একটু ক্লান্ত হয়ে আসছিল অতর্কিতে সেই হাতটাই খামচে দিল মালু। তখখুনি ছুট দিল দরজার দিকে। সেখানে বাঁধা পড়ল রাবুর হাতে।

খোদার কহর পড়ুক তোর উপর, জাহান্নামে যাবি তুই। জল্লাদ হবি। বাপের নাম ডুবাবি… কোত্থেকে একখানি কঞ্চি জোগাড় করে তেড়ে আসেন মা। ব্যথা পেয়েছেন তিনি। ডান হাতের নিচে প্রায় এক আঙ্গুল চামড়া খামচে দিয়েছে মালু। কয়েক ফোঁটা রক্তও জমেছে। এই কঞ্চিটা আজ তোর পিঠে আমি গুঁড়ো করব, তোর হাডডি মাংস একসার করব। মা প্রায় ধরে ফেলেন মালুর চুলের ঝুটি।

মাফ করে দেন খালা। আমিই ওকে শাসন করছি। দুহাত বাড়িয়ে মারমুখী মালুর মাকে রুখে দাঁড়ায় রাবু।

কথায় বলে, বাপ যদি হয় আলেম ছেলে হয় জালেম। এই ছেলে ঠিকই জালেম হবে। লাই দিয়ে দিয়ে ওকে নষ্ট করছে তোমরা। বিদ্যে-বুদ্ধি কিচ্ছু হবে না, এই ছেলে জালেম হবে, জল্লাদ হবে। কহর দিতে দিতে চলে যান মা।

রাবুর আঁচলের তলায় খুক করে হেসে দেয় মালু। এটা ওর বরাবরের কৌশল। রাবু আপার আঁচলে আশ্রয় নিয়ে হাডডি মাংস একসার হওয়া থেকে অনেকদিন রক্ষা পেয়েছে ও। আজও রক্ষা পেল। আঁচলের ভেতর থেকে ওর কানটি খুঁজে নিয়ে টেনে ধরে রাবু বলে সত্যি জল্লাদ হবি তুই। মাকে এমন করে খামচায়। কষ্ট পায় না মা? রাবু আপার শাসনটাও মিষ্টি, মার কর্কশ আদরের পাশাপাশি কথাটা সব সময় মনে পড়ে মালুর আজও মনে পড়ল। কানের সেই টন টনে ব্যথাটা যেন ভুলে গেল ও।

একগাল হেসে বাঁ কানটি বাড়িয়ে দেয় রাবুর দিকে বলে, দেখনা টেনে টেনে কেমন লাল করে দিয়েছে। আমার বুঝি কষ্ট লাগে না! বলতে বলতে গলাটাও কী এক অভিমানে ভারি হয়ে আসে ওর।

হেসে দেয় রাবু। আরিফাও ওর বলার ঢংয়ে না হেসে পারে না। কিন্তু পরমূহূর্তেই গম্ভীর হয়ে যায় রাবু। দৌড়ে যায় উঠোনের দিকে। ফিরে আসে এক মুঠো মাটি নিয়ে। মাটিটা মালুর হাতে দিয়ে বলে, এই মাটি ছুঁয়ে বল আর কখনো খামচাবিনা খালাকে, নইলে আমিই পিটিয়ে তোর হাডডি-মাংস একসার করবো।

না, আর কখনো খামচাবো না, মাটি ছুঁয়ে বলতে গিয়ে এবার কেন যেন কাঁদো কাঁদো হয় মালুর স্বরটা।

চুপটি করে দাঁড়িয়ে থাক এখানে, আমাদের নিয়ে যেতে হবে, বলে শোবার ঘরের দিকে চলে যায় রাবু। কিছুক্ষণ বাদ বেরিয়ে আসে তোয়ালে জড়ানো একটা পুঁটলি নিয়ে।

নে চল এবার, বলল রাবু; সামনে সামনে যাবি, লোক দেখলেই হুঁশিয়ারি করে দিবি।

হুঁশিয়ারির ব্যাপারটা শুনেই বুঝে নেয় মালু কোথায় যেতে হবে। বীর পুরুষের মতো বুকটাকে ফুলিয়ে তোলে, হাফ প্যান্টের পকেটে হাত পুরে ছটফট করে কখন রাবু পা বাড়াবে।

এ তো বাড়াবাড়ি, সত্যি বাড়াবাড়ি। মুরুব্বির মতো গম্ভীর আর কেমন ভারিক্কী মেজাজে বলে আরিফা।

জানালা দিয়ে ও এতক্ষণ দেখছিল রাবুর কাণ্ডটা। টিন খুলে বিস্কুট বের করেছে রাবু। আলমারি থেকে বের করেছে সাবুদানা, তোরং খুলে বের করেছে। তুলো আর কী একটা মলম। সব এক জায়গায় করে বেঁধেছে তোয়ালেটায়।

খারাপ মেয়ে ছিনালী করেছে, যোগ্য সাজাই পেয়েছে। তাতে তোর অত দুশ্চিন্তা কেন? জোরে জোরেই বলে আরিফা।

রাবু যেন শুনতেই পায় না ওর কথা। একটু ভ্রূক্ষেপ না করে মালুর হাতটা ধরে পা তোলে।

ওর এই গোয়ার্তুমিটাকেই দুচোখে দেখতে পারে না আরিফা, গাছে চড়তে গিয়েও এমনি করে ও। হয়ত সরু ডালে ভর্তি গাছটা, আরিফা না করল উঠিসনে, ব্যস তখুনি ওর রোখ চেপে গেল, উঠতেই হবে ওই গাছের মগডালে।

ডাকবো আম্মাকে? পেছন থেকে চেঁচিয়ে বলে আরিফা। চিত্রার্পিতার মতো দাঁড়িয়ে যায় রাবু। আতঙ্ক বিবর্ণ মুখটি এতটুকু হয়ে যায়।

হি হি করে হেসে উঠে আরিফা, তুই কী একলাই যাবি? আমি বুঝি যেতে পারি না!

আরিফার কথায় আশ্বস্ত হলেও রাগ পড়ে না রাবুর, এমন করে ভয় দেখানোর কোনো মানে হয়?

আম্মা, খালা, সবাই পাক ঘরে। সাঁ করে বেরিয়ে যায় ওরা। বাড়ির পেছনেই পুকুর। পুকুরের পর সুপুরি বাগিচা। বাগিচা পেরিয়ে গাং। গাংয়ের ওপারে মাঝিবাড়ি। তারপর গ্রামের রাস্তা। এই রাস্তার কাছে এসেই থমকে দাঁড়াতে হয় ওদের। কারা যেন আসছে রাস্তা দিয়ে। মালু রাস্তার কিনারেই দাঁড়িয়ে থাকে। রাবু আর আরিফা ঝট করে সরে যায় মাঝিবাড়ির বেতঝোপের আড়ালে।

ছয় মাস আগেও এ-রকম ছিল না অবস্থাটা। সারা গ্রাম চষে বেড়াত ওরা দুবোন। গাছে চড়ত, ফল পাড়ত সাঁতার কাটত বাইর বাড়ির বড় পুকুরটায়। সে সব বন্ধ হয়েছে। আরিফার আম্মা, রাবুর জেঠি আম্মা, তিনি একদিন ফজরের নামাজ শেষে জায়নামাজটায় বসে বসেই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন ব্যাপারটা।

শোন আরিফা। শোন রাবেয়া। তোমাদের চুল বাঁধতে হবে টেনে; খোঁপা করে। এলোচুলে শয়তান ভর করে। ঘোমটা রাখতে হবে মাথায়, বাড়ির বাইরে যাওয়া চলবে না, এমনকি বাইর বাড়ির বা কাচারী ঘরেও না। কথা বলতে হবে আস্তে আস্তে। বাড়ির পুরুষরাও যেন শুনতে না পায়। চেঁচানোটা হল অসভ্যতা, ছোটলোকরাই চেঁচায়। পরপুরুষদের সুমুখে বের হবে না। বাড়ির চাকরদের সুমুখেও না। এক এক করে নির্দেশগুলো বুঝিয়ে দিয়ে তিনি বলেছিলেন, তোমরা এখন বড় হয়েছ, বালেগা হয়েছ।

বিস্ফারিত চোখে ওরা শুনে গিয়েছিল, ভুলে যেতেও চেষ্টা করেছিল। কিন্তু পরবর্তী কয়েকটি মাসে ভালো করেই বুঝে নিয়েছে ওসব ভুলে গেলে চলে না। আমল করতে হয়। অবাধ্যতার জন্য কম মার খায়নি ওরা। মার খেয়ে খেয়ে ভয় জন্মেছে ওদের, তাই সবদিক সামলে-সুমলেই নিয়ম ভাঙে ওরা। কিন্তু একটা ব্যাপার ওরা কিছুতেই বুঝতে পারছে না কখন বড় হয়ে গেল ওরা। আর হলই যদি বা তফাৎটা কোথায়? এই তফাৎটা বুঝতে পারছে না বলেই গত ছমাস ধরে গালটা তিরস্কারটা মালুর মতোই ওদের নিত্য পাওনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

না, অপরিচিত কেউ না। সতুর বাপ পেছনে ছেলের কাঁধে সুপুরির ভার চাপিয়ে চলেছে হাটে।

ধাৎ ও তো সতুর বাপ। আমি ভাবলাম কে-না কে। বেতের কাঁটায় আটকে যাওয়া শাড়ির প্রান্তটা সন্তর্পণে আলগা করে ঝোঁপ থেকে বেরিয়ে আসে রাবু। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে বাপ-বেটার চলার দিকে। ছোপ ছোপ সবুজ আর হলুদ রং কাঁচা-পাকা সুপুরিগুলো ভারি সুন্দর। ভারের দুপাশে ঝোলান থোকগুলো দ্রুত পায়ের উঠতি-পড়তি বেগে দুলে দুলে এ ওর গায়ে ঢলে পড়ছে আর ভারটি দুপাশে বেঁকে আসছে ধনুকের মতো। তন্ময় হয়ে দেখে রাবু, এ সব দৃশ্য দেখা নাকি নিষিদ্ধ ওদের।

থোকে থোকে ক্রমাগত ধাক্কা খেয়ে গোটা দুই সুপুরি ঝরে পড়ে রাস্তায়। দুকদম এগিয়ে মালু চট করে তুলে নেয় প্যান্টের পকেটে! ইশারা দেয়, এসে পড়, রাস্তা সাফ।

তুই বুঝেছিস ঘোড়ার ডিম, ঝোঁপের আড়াল থেকেই বলে আরিফা।

কী বলছিস! সুপুরি থোকের উপর থেকে চোখ তুলে আরিফার দিকে তাকায় রাবু।

চেনা-অচেনা কারো সুমুখেই যেতে পারবিনে। সেই হল গিয়ে পর্দা।

ধ্যাৎ তা হবে কেন? সতুর বাপ, সেই ছোট্টটি থেকে দেখছে আমাদের। ওর সামনে আবার পর্দা কী রে?

তাই তো বলছি তুই বুঝিস না কিছুই। আরে বেকুফ অচেনা লোক হঠাৎ করে দেখে ফেললে বরং ক্ষতি কম, চেনা লোকে দেখলেই তো মুশকিল। ওরা বদনাম করে। এখানে-সেখানে রটিয়ে বেড়ায়।

রাবু বুঝতে পারে না ওর কথা। বুঝি ভালো করে বুঝবার জন্য ওর কাছে। এসে দাঁড়ায়, বলে, তা হলে তুই বলতে চাস ওই সতুর বাপ বুড়োর সামনে আমাদের বের হওয়া চলবে না?

আলবৎ না। সেই যে–গেল বছর আমরা কোলকাতা গেলাম কী বলেছে মেজো ভাই মনে নেই?

কী বলেছে?

আহ্, তুই কিচ্ছু মনে রাখতে পারিসনে। আম্মাকে নিয়ে আমরা সিনেমা গেলাম না? ঘোর আপত্তি ছিল না আম্মার? মেজো ভাই যখন বুঝিয়ে বলল, সিনেমায় সব বিদেশি বেগানা লোক, ওরা দেখলে পর্দা ভাঙে না। চেনা লোকের কাছেই তো পর্দার দাম। তারপর সে না রাজি হলেন আম্মা সিনেমা দেখতে?

মেজো ভাই সব সময়ই উল্টো-পাল্টা চালায়, সে আমার জানা আছে। গম্ভীর হয়ে বলল রাবু!

বুঝি আরো কিছু বলতে যায় আরিফা। কিন্তু থেমে যেতে হয়। ওদিকে অধৈর্য হয়ে মুখ খিঁচিয়ে চলেছে মালু–সাধে কী গুরুজনরা বলেন মেয়েদের নিয়ে বেরিয়ো না রাস্তায় ওরা পথের মাঝেই কোঁদল বাধায়। কবে ঠাট্টা করে কথাটা বলেছিল জাহেদ, ওদের সবার মেজো ভাই, মালু মনে রেখে দিয়েছে। আজ সুযোগ বুঝে ঝেড়ে দিল কথাটা।

ওর মুরুব্বিপনা দেখে মুখ টিপে হাসে রাবু বলে, মেজো ভাইকে তো আচ্ছা পীর ঠাউরেছিস, তোর আর ভাবনা কী?

কয়েক লাফে রাস্তাটা এক রকম টপকে চলে আসে ওরা। ভুঁইঞা বাড়ির পেছন দিক দিয়ে কারি বাড়ির পাটি পাতার জঙ্গলে ঢুকে পড়ে। এর পর একটা লম্বা ধানক্ষেত। ক্ষেতের ওপারে হুরমতির বাড়ি।

এতদূর এসে শেষে ওই ক্ষেতটাই বুঝি ওদের আটকে রাখল। ক্ষেতের এক দিকে সদর রাস্তা। অন্য দিকে মিঞাদের নারকেল-সুপারির বাগিচা। দুদিকেই লোক চলাচল।

হাফ প্যান্টের দুপকেটে দুহাত গুঁজে ক্ষেতের আলটা ধরে ছোট ছোট পায়ে এগোয় মালু। কিছুদূরে গিয়ে পকেট থেকে বাঁ হাতটা বের করে তালুটা প্রসারিত করে মালু অর্থাৎ এগিও না, রাস্তা মুক্ত নয়।

কতক্ষণ এভাবে দাঁড়িয়ে থাকা যায়! মশার কামড় খেয়ে চটে যায় আরিফা : মশা আর আস্ত রাখবে না আজ। তার উপর বাড়ি ফিরে আম্মার কিল। সবই তোর জন্য। রাবুও রেগে ছিল। এই মাত্র একটা লাল-কালো পিঁপড়ে মুখ খিঁচিয়ে কামড় বসিয়ে দিয়েছে ওর কবজির গোড়ায়, সেও জবাব দেয় তিরিক্ষি মেজাজে : আমি খুব পায়ে ধরে সেধেছিলাম কিনা? এলি কেন?

সংকেত আসে না মালুর। মাঝে মাঝে গোড়ালিটা উঁচিয়ে পায়ের আঙ্গুলে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে লম্বা হতে চেষ্টা করছে ও। যাতে দূর বাঁকটাও দেখতে পায় সহজে। কাজটায় রীতিমতো হাত পাকিয়ে ফেলেছে মালু। রাবু আর আরিফা যেদিন থেকে পর্দা নিয়েছে সেদিন থেকেই মালু ওদের আইন অমান্যের বিশ্বস্ত সহচর। এই তো সেদিন লস্কর বাড়ির বিয়েটা দেখিয়ে আনল রাবুকে। বড় শখ ছিল রাবুর কনে সাজানো দেখবে। তা দেখেছে বই কী!

আর মান্দার বাড়ির জাম খাওয়া? সে তো একবারে দিন-দুপুরের ব্যাপার।

.

মান্দার বাড়ির ভুতি জামের তুলনা হয় না, যেমন মিষ্টি রস তেমনি পুরু মাংস ভেতরে দানা এক রকম নাই বললেই চলে। রাবু আপা বলল, ওই জাম খেতে হবে এবং গাছে বসেই। মালু তো খুশিতে ডিগবাজি খায়। পাঁচবেলা নামাজের মাঝে যোহরটাই সবচেয়ে দীর্ঘ। তার উপর যোহর সেরে আম্মা ওজিফা পড়েন, সেও বেশ সময় নিয়ে। ওই সুযোগেই কেটে পড়েছিল ওরা। নামই মান্দার বাড়ি, কবেকার ছাড়াবাড়ি কে জানে! সৈয়দদেরই সম্পত্তি, এখন গাছগাছালির জঙ্গলে ভর্তি। তাও সব যে মান্দার তা নয়, আম-জাম-কাঁঠাল, সব গাছই রয়েছে কম বেশি। সে কী ফুর্তি রাবুর! ডালে ডালে ঘুরে ঘুরে বেছে বেছে সবচেয়ে সেরা জামগুলো পেড়েছে ও। ছুঁতে গেলেই রস বেরিয়ে পড়ে এমনি টসটসে জাম এক আঁচল ভর্তি করে বসেছিল চওড়া দেখে একটি ডালে, পা দিয়েছিল নিচের দিকে ঝুলিয়ে। আর সেই অবস্থাতেই টপাটপ এক আঁচল জাম শেষ করেছিল রাবু। আর মাঝে মাঝে দুএক মুঠো ফেলে দিচ্ছিল নিচের দিকে। সার্টের খুঁট পেতে ধরে নিচ্ছিল মালু। ওর তো পাহারা দেবার কঠিন দায়িত্ব, গাছে চড়লে চলবে কেন? তবু ওতেই আনন্দ ধরছিল না ওর। রাবু আপাকে খুশি করে এত আনন্দ পায় ও! কথাটা যেন আজই প্রথম মনে করল ও। আর মনে করে ওর বুকটা যেন হঠাৎ লাফিয়ে অনেক উঁচু আর চওড়া হয়ে যায়।

কিন্তু বড় আপার খেয়াল খাসলতটা দিন দিন কেমন যেন বদলে যাচ্ছে। এমনিতেই একটু ভীরু বড় আপা। তার উপর আজকাল ভারিক্কি হচ্ছে। মেজাজটা হচ্ছে পাকা গিন্নীর মতো। আর সবতাতেই পিছুটান। অথচ ইচ্ছারও কমতি নেই। আগ্রহ আছে গাছে চড়ে জাম খাবার, কিন্তু মনের ভেতর রয়েছে ভয়। সেদিন মান্দার বাড়িতক পৌঁছেও শেষ সময় আচ্ছা এক ব্যাগড়া বাধিয়ে দিল।

যোহরের সময় গাছে চড়তে নেই। শনি ধরবে বলেছিল আরিফা এবং রাবুকে বাধা দেবার জন্য রীতিমতো টানা-হ্যাঁচড়া শুরু করেছিল।

মিথ্যে কথা। কতদিন চড়লাম। ওর নিষেধটাকে একটুও গ্রাহ্য না করে রাবু শাড়ির আঁচলটা আঁট করে নিয়েছিল কোমরের চারপাশে।

এই শোন।

তাড়াতাড়ি বল। আজকাল কথা বলতে বড় বেশি সময় নিস তুই।

একটুও তর সইছিল না রাবুর।

আমি বলি মালুকে চড়িয়ে দে না গাছে। ও পেড়ে পেড়ে নিচে ফেলুক। আমরা আঁচল বিছিয়ে ধরি।

মালুকে যদি শনিতে ধরে? ওর জানটার বুঝি দাম নেই? দিন দিন কী যে হচ্ছিস তুই বড় আপা! জাম গাছের মোটা কাণ্ডটা দুহাতে জড়িয়ে ধরে তর তর করে উঠে গেছিল রাবু।

ওজিফা তেলাওয়াত শেষ করে আম্মা এসে দেখেন অঘোর ঘুমুচ্ছে রাবু আর আরিফা।

এই আরিফা, এই রাবেয়া! কী যে অলক্ষ্মী হয়েছিস তোরা। দেখ তো দালানের ছায়াটা উঠোনের শেষ মাথায়, বেলা আসর ধরে ধরে। এখনো ঘুমুচ্ছিস তোরা? ওঠ, ওঠ। তাড়া দিয়ে রান্না ঘরের দিকে চলে গেছিলেন আম্মা। আর দাওয়া থেকে দেখছিল মালু, মুখে আঁচল পুরে হাসি চাপতে গিয়ে কী বিষম খাচ্ছে রাবু।

এমনি করে নিয়ম ভাঙে ওরা। ধুলো দেয় আম্মার চোখে। মালু ওদের ডান হাত, বাঁ হাত, পথের দিশারী। আর যখন ধরা পড়ে যায়? উহ্, সে কথা মনে করতেও ছ্যাঁৎ করে ওঠে মালুর বুকটা। মনে হয় এখনো কঞ্চির বাড়িগুলো জেগে আছে ওর পিঠে।

সেদিন আম্মা গিয়েছিলেন তাঁর বাপের বাড়ি মিঞা বাড়ি। রাবুর তো মহাফুর্তি। গোটা একটা দিন কোনো পর্দা নেই, শাসন নেই! কী মজা! আম্মার ছায়াটা মিলিয়ে যেতেই তিনজনে মিলে টুক করে সটকে পড়ল। মাঝি বাড়ির লাগ সৈয়দদের একটা পুকুর। সে পুকুরটা সেঁচা হয়েছে কিছুদিন আগে। মাছটাছ মারা সে পর্বও শেষ। কিন্তু কয়েকদিন ধরেই ওরা খবর পাচ্ছে পাঁকের তলায় লুকিয়ে থাকে যে সব মাছ সিং মাগুর-বাইম-কৈ, তারা সব পাঁক খেয়ে খেয়ে এখন উপরে উঠে আসছে। পাঁকের গায়ে গায়ে শুধু মাছ আর মাছ। এমনিতেই পুকুর সেঁচার সময় যেতে পারেনি ওরা না আরিফা না রাবু। অথচ সেই থেকে ছনবন করছে ওদের মনটা।

পাঁক ঘেঁটে ঘেঁটে কাদায় সারা গা একাকার করে আশ মিটিয়ে মাছ ধরল ওরা। এ ওর গায়ে কাদা ছুঁড়ে ছুঁড়ে মারল। মাছ ভেবে সাপের গলা টিপে ধরে চমকে উঠল। সিং মাছের কাঁটা ফুটিয়ে আঙ্গুল বিষ করল। যেন কত জন্মের অন্ধ অবরোধ ভেঙে বেরিয়ে এসেছে ওরা দুজন। মুক্ত আলো-বাতাসের ছোঁয়া পেয়ে আনন্দে নেচে উঠেছে ওরা, সেই পাঁক কাদার রাজ্যে বসিয়ে দিয়েছে আনন্দের হাট। আর সেই আনন্দ মেলার কর্ণধার মালু। না : রাস্তার লোক চলাচল বন্ধ হওয়ার কোনো আলামত দেখছে না মালু। খেয়ালই ছিল না যে আজ হাটবার। খেয়াল থাকলে এমন সময় কখখনো বের হত না ও।

হঠাৎ ওর নজর পড়ে মিঞাদের নারকেল-সুপুরি বাগিচার দিকে। ক্ষেত থেকে একটা ছাগল খাসিকে কে যেন তাড়া করে নিয়ে চলেছে বাগিচার দিকে। লোকটা যেন চেনা চেনা মনে হলো। কিন্তু সেদিকে নজর দেবার ফুরসুতও নেই, প্রয়োজনও নেই মালুর। আসল বিপদের জায়গা হল রাস্তাটা। সেটা যদি একটু ফাঁকা পায় তা হলেই নিশ্চিন্ত হয়ে রাবুদের ইশারা দিতে পারে মালু।

যথেষ্ট আক্কেল হয়েছে এবার চল, বিরক্ত স্বরে বলে আরিফা। পিঁপড়ে আর মশার কামড় খেয়ে রাবুরও মেজাজটা কম খাট্টা হয়নি। তার উপর কয়েকটি শুকনো পাটিপাতার ঘষা লেগে হাতের চামড়াটা জ্বালা করছে। কিন্তু রেগেই-বা লাভ কী? কার উপরই বা রাগবে? এতদূর এসে ফিরে যাওয়ারও কোনো অর্থ হয় না। নিরুত্তর থাকে রাবু। হঠাৎ চেঁচিয়ে ওঠে–বড় আপা, বড় আপা তোর মাথার উপর সাপ। ভয়ে-আতংকে কোনদিকে ছুটবে দিশে পায় না আরিফা। কয়েকটা পাটিপাতার ডালসুদ্ধ ভেঙে নিয়ে হুড়মুড়ি খেয়ে পড়ে যায় ও।

তুই তো আচ্ছা ভীতু হয়েছিস? হি হি করে হাসে রাবু। শাড়ির প্যাঁচটা একটু আল্গা করে বুকে থুতু ছিটোতে ছিটোতে উঠে দাঁড়ায় আরিফা। কাঁপছে গা-টা। রেগে টং হয়, এমন করে ভয় দেখাস তুই?

বেশ করেছি। ফিরি ফিরি করে দিক করছিলি কেন এতক্ষণ?

দুটো মেয়ে মানুষ এক সাথে হয়েছে কী চুলোচুলি করবেই, সেয়ানা ঢংয়ে বলে মালু আর মুখ খিঁচোয়। আহ্ রাবু আপা জলদি কর না, সেই কখন থেকে হাত ইশারায় ডাকছি তোমাদের! এবার চিল্লিয়ে ওঠে মালু। মাঝারি গোছের একটা দৌড় দিয়েই ওরা পৌঁছে গেল হুরমতির বাড়ি। গেরস্ত বাড়ির মতো নয়। বেল গাছের তলায় ছোট্ট উঠোন, একটি মাত্র ঘর। কিন্তু টিনের চালা। নবজাতককে পাশ দিয়ে শুয়ে রয়েছে ও। গালের উপর হাতটি রেখে চমকে উঠল রাবু। হুরমতির গা পুড়ে যাচ্ছে।

জ্বরের ঘোরেও রাবু-আরিফাকে চিনল হুরমতি উঠে বসতে চেষ্টা করল। পারল না।

হুরমতির কপালটার দিকে তাকাতে বড় কষ্ট হয় রাবুর। এক দলা ঝলসানো মাংস ফুলে নাকের দিকে ঝুলে পড়েছে। বীভৎস কদাকার। হা আল্লা! এমন জুলুম মানুষ মানুষের উপর করে? গায়ের চামড়া পুড়িয়ে দেয়? কাঁচা হলুদের মতো রং এমন সুন্দর কপাল হুরমতির। কোন্ নিষাদের হাত উঠল সে কপালে? চির জন্মের মতো কালো কলঙ্ক এঁকে দিল? খসে পড়ুক সে হাত। বাজ পড়ুক সে হার্মাদের মাথায়। মনে মনে যেন প্রার্থনা করল রাবু।

এক পয়সার ঘায়ের উপর পুরু করে মলম মাখল রাবু। তারপর তুলো বসিয়ে বেঁধে দিল কপালটা।

ঘরে উল্টো কোণায় হাঁড়ি-পাতিল নিয়ে নাড়াচড়া করছে লেকুর বৌ আম্বরি। এগিয়ে এসে বলল, লেকু ওকে পাঠিয়ে দিয়েছে, ও থাকবে হুরমতির সাথে। ভালোই হল। আশ্বস্ত হয় রাবু। আম্বরিকে পাঠিয়ে দেয় সাগু জ্বাল দিতে। তারপর আরিফা শুদ্ধ মাটির ঘড়ায় করে পানি তুলে আনে ডোবা থেকে। প্রায় তিন ঘড়া পানি নিঃশেষ করে হুরমতির মাথায়।

নগ্ন লালসা আর কদর্য কামনার নিষ্ঠুর শিকার হুরমতি। ঈর্ষা লোভ হিংসার বিষচক্রে রূপবতী যৌবনের সর্বনাশা আগুনে বিষিয়ে দগ্ধে পুড়ে দিন কাটে হুরমতির। ছোট বেলায় মা হারিয়েছে। বাপ তার কোনো কালেই ছিল না। মমতার ছোঁয়া কদাচিৎ পেয়েছে জীবনে। তাই স্নেহের এই পরশটি ওকে অভিভূত করে। হুরমতির তপ্ত কপোল বেয়ে অশ্রুর ধারা নামে। হুরমতি। চল, আমাদের বাড়ি থাকবি যদ্দিন ভালো না হচ্ছিস।

কিছুক্ষণ রাবুর মুখের দিকে চেয়ে থাকল হুরমতি। বলল, রাবু বুজান সে হয় না।

কেন হয় না। জন্ম হল তোর আমাদের বাড়ি। বড় হলি আমাদের বাড়ি। আমাকে আপাকে কোলে করে এত বড় করলি। আর এখন আমাদের বাড়ি তোর বাড়ি না? কেন হয় না বল!

কী বলবে হুরমতি! শুধু পানি ঝরে ওর চোখ দিয়ে। বড় হলে বুঝবে বুজনি। এখন বুঝবে না। বলেই মুখটা ঘুরিয়ে নেয় হুরমতি।

সত্যি, রাবু বোঝে না হুরমতির এমন করে দূরে সরে যাওয়া আর পর হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা।

হুরমতির মায়ের জন্ম মিঞা বাড়িতে। আরিফার আম্মা যখন মিঞা বাড়ি ছেড়ে সৈয়দ বাড়ি এল বাড়ির বড় বৌ হয়ে, তখন বাদি হিসেবে সঙ্গে এসেছিল হুরমতির মা। তারও অনেক বছর পর হুরমতির জন্ম হয়েছিল এই সৈয়দ বাড়িতে। হুরমতির তখন কতই বা বয়স, পাঁচ কী ছয়, ওর মা মিঞা বাড়ি গিয়েছিল বেড়াতে সৈয়দ গিন্নীর সাথে। সেই সময় একদিনে বার তিন কম করেই শেষ নিশ্বাস ছেড়েছিল। মালুর মা খালার কাছেই এ সব কথা শুনেছে রাবু এবং আরিফা। আর ছোট বেলা থেকে চিনে এসেছে হুরমতির কোল। সেই হুরমতি যে কেমন করে আলাদা বাড়িতে একলা থাকে আর পর হয়ে যায়, এখনো বুঝে উঠতে পারে না ওরা।

হুরমতি। হুরমতি। খোদার দোহাই তোর। তুই চল আমাদের বাড়ি। ছোট্ট বুকের গভীর আকুলতায় ওর হাত দুটি ধরে বলল রাবু। এমন অবস্থায় হুরমতিকে ছেড়ে যেতে কিছুতেই মন চায় না ওর।

আচ্ছা যাব। জ্বরটা একটু কমুক। ওকে নিরাশ না করার জন্যই হয়ত বলল হুরমতি। আরো জোরে ঠেলে আসে হুরমতির চোখের ধারা। দুঃখের নয় এ কান্না। ঝলসানো কপালটার জ্বালাপোড়ার ছটফটানি কান্নাও নয়। এ যেনো ওর অন্তহীন কোনো আনন্দের নিঃস্রবণ।

০৩.

আক্রোসে ফুলতে ফুলতে বাড়ি ফিরছিল রমজান। ওই ছোট লোক লেকু সেদিনও কামলা খেটে গেছে ওর বাড়িতে। সেই লেকুর এত দুঃসাহস? বলে কিনা, এক বাজারে দুই ভাও? আবার তেড়ে আসে? আসতই আর এক পা, তা হলে বাছাধনকে মক্কা দেখিয়ে ছেড়ে দিত রমজান। আর ওই কুলাঙ্গার সেকান্দর? সে আবার ওই চাষা ছোট লোকটার কথায় সায় দিয়ে বলে–এক হাকিমের দুই বিচার কেন?

রমজানের রাগটা শেষ পর্যন্ত লেকুকে ছেড়ে সেকান্দরের উপরই গিয়ে পড়ল। সেকান্দর-রমজান চাচাত জ্যাঠাত ভাই। ওদের বাবারা ছিলেন সহোদর ভ্রাতা। একই রক্তের পয়দায়েশ ওরা। একই বাড়িতে থাকে। বাবা জ্যাঠা দুটো সমান হিস্যায় বাড়িটাকে ভাগ করে সেই যে আমের চারা দিয়ে সীমানা পুতেছিলেন সেই আমের গাছ এখনো মানুষের মাথা ছাড়ায় নি। অথচ এর মাঝেই সেকান্দর শক্রতা শুরু করল রমজানের?

কথায় বলে, জ্ঞাতি শত্ৰু বড় শত্রু। নইলে সেকান্দর যায় ওই ছোট লোকের কথায় ধুয়ো তুলতে? ছোট, অতএব ছোট ভাইয়ের মতোই ওকে স্নেহ দিয়েছে সাহায্য দিয়েছে রমজান। কত, না হয় চার বছর আগের কথা, ম্যাট্রিক পাস করে সেকান্দর গেল ফেনী কলেজে আই.এ. পড়তে। রমজানই তো এক থোকে ভর্তির টাকাগুলো তুলে দিয়েছিল ওর হাতে। সে কথাটাও কী বেমালুম ভুলে বসে আছে সেকান্দর? অকৃতজ্ঞ আর বলে কাকে।

না হয় একটু চরিত্র দোষ আছে ওর। সাধু পুরুষ বলে রমজান দাবীও করে না কোনোদিন। আর ওই হুরমতি। সব ঘাটেই যে পানি খায় যেখানে নগদ কড়ি সেখানেই যার ধর্না সে মেয়ের সাথে একটু না হয় আশনাই করল রমজান। এমন কী অপরাধের হল সেটা? যারবাটা যে রমজানেরই সেটা নিশ্চয় হলফ করে বলতে পারবে না এ গাঁয়ের কোনো মানুষ। আসল কথা যার হাতেই আছে দুটো নগদ পয়সা সে-ই হুরমতির দরজায় টোকা মেরেছে। দোষ শুধু রমজানের? আর সত্যি যদি সেকান্দরের বুকের পাঁটা থাকত তবে সে মিঞার নামটা করে দেখলেই পারত একবার? মজাটা তখুনি টের পেত বাছাধন।

দুনিয়াতে কোনো শালার উপকার করব না মনে মনে কসম খায় রমজান।

কিন্তু লেকু? ব্যাটাকে আচ্ছা রকম শিক্ষা দিতে হবে। নইলে ইজ্জত থাকবে রমজানের।

দেবে নাকি ওর ঘরটায় আগুন ধরিয়ে? শালার আবার ভারি পেয়ারের বৌ আম্বরি। এক মুহূর্ত, শুধু একটা দিয়াশলাইর কাঠি, রমজান ছারখার করে দিতে পারে শালার পেয়ারের বেহেশত!

না। ওতে তেমন কিছু ক্ষতি করা যাবে না। ছন বেচে বেটা নগদ পয়সা পেয়েছে এ বছর। চটপট বানিয়ে নেবে নতুন ঘর। তার চেয়ে…এমন একটা প্রতিশোধ নিতে হবে যাতে শালার আগামী তের গোষ্ঠী মনে রাখবে–রমজান বাপের বেটা বটে। হ্যাঁ…তাই…হাটবার। অমাবস্যার ঘুরঘুটি আঁধারে। যখন ফিরবে হাট থেকে সেই সময়, পিতলের পীত বসানো সুন্দরী কাঠের সেই লাঠিটা, তারই দুঘা বসিয়ে দেবে মাথায়। তারপর গুনে গুনে কয়েকটা বাড়ি হাঁটুতে, কনুইতে। বাছাধনকে আর হাঁটতে হবে না, কাজ করতে হবে না কোনোদিন। সারা জন্মের মতো নুলো হয়ে বাড়িতে বসে বসে খুঁতনি চিবোবে। এই হল গিয়ে বাপের বেটা রমজান। সেই বার্মা মুল্লুকে ওর কোমরে লুকানো ছুরিটা যে কী ত্রাস ছিল, ভুলে গেছে লেকু? আর হ্যাঁ, এখানেও নিজের হাতেই সারতে হবে কামটা, ভাড়াটে লোকদের বিশ্বাস নেই। থানা পুলিশের চাপে ফাঁস করে দিতে কতক্ষণ।

থানা পুলিশের কথাটা মনে আসতে একলা পথে খামোখাই চমকে উঠল রমজান। কেন যেন ভয় হল ওর উচ্চৈঃস্বরেই বুঝি চিন্তা করছিল ও আর মনের দুরভিসন্ধিটা কারা যেন জেনে ফেলল। সামনে পিছে ডানে বাঁয়ে শঙ্কিত দৃষ্টিটা ঘুরিয়ে আনে রমজান। না, মাঠে বা রাস্তায় একটি ছায়াও নেই।

অপরাহ্নের গ্রামটা রাতের মতোই নিস্তব্ধ নির্জন। হঠাৎ পাওয়া ভয়টা যেন পিছু পিছু অনুসরণ করে চলেছে রমজানকে। থানা পুলিশকে ওর বড় ভয়। এমনিতেই দুটো খুনের মামলা ঝুলে রয়েছে মাথার উপর। হোক না বিদেশে, তবু খুন তো, মনের উপর সম্ভাব্য বিচারের যে ভীতিটা চেপে রয়েছে অদৃশ্য ভূতের মতো সে ভয় থেকে তো এখনো মুক্ত হতে পারেনি রমজান।

তার চেয়ে… ছোট লোকের বউটাকে ভাগিয়ে আনলে কেমন হয়? শালার তেজ থাকবে কোথায় তখন। বউটা যদি বাধা দেয়, চেঁচামেচি করে? মুখে গামছা পুরে পাঁজা কোলে করে সোজা নিয়ে আসবে মিঞাদের সুপুরি বাগিচায়। বাগিচা তো নয়, জঙ্গল, দিন দুপুরেও ত্রিসীমানায় মানুষের সাড়া পাওয়া যায় না। ব্যবস্থাটাও সেখানে মন্দ না। পাকা ভিটির উপর ছোট্ট একটা ছনের ঘর। চৌকি বিছানা সবই চমৎকার। মিঞার যখন শখ চাপে এক আধ রাত্রি কাটায় সে বাগিচায়। সেখানেই রাতটা আর দিনটা রাখবে আম্বরিকে! মিঞা যদি খোশদিলে থাকেন তাকে দিয়েই না হয় বিসমিল্লা পড়াবে। তারপর সোয়াদ মিটিয়ে লেকুর সামনেই ফিরিয়ে দিয়ে আসবে, বলবে–নে শালা, বুঝে নে তোর বউ, জনমটা তার সার্থক করে দিলাম।

ভাবতে ভাবতে সেই সম্ভাব্য রাত আর দিনের আতপ্ত উত্তেজনা যেন এখুনি অনুভব করে রমজান, গা-টা গরম হয়ে ওঠে। আর বিশদ বিবরণগুলোও আকার দিয়ে ভেসে ওঠে চোখের সুমুখে।

কিন্তু…বড় বদসুরত আম্বরিটা। হাড় গিলগিলে চেহারা। একরত্তি চেকনাই নেই গায়ে। বুড়ির মতো বঁটে এসেছে গালের চাম। এককালে সুশ্রী আর স্বাস্থ্যবতী ছিল মেয়েটি, বার্মা যাওয়ার আগে দেখে গেছিল রমজান। কিন্তু মেয়েটার সব রসকষ চুষে নিয়েছে শালা লেকু।

আম্বরির রোগা পটকা সুরতটা মনে করতেই আস্তে আস্তে ধিমিয়ে আসে রমজানের শরীরের গরমটা। কল্পিত পরিকল্পনার জালটিও ছিঁড়ে যায়। না, ওই হাডডিসার মাগিটাকে নিয়ে শোয়া আর খরখরে একটা তক্তা বুকে জড়িয়ে শোয়া একই কথা। রমজান কামাতুর। কথাটা এক বিন্দুও মিথ্যে নয়। তাই বলে বাজারে তাজা তাজা মাছ থাকতে শুটকী মাছের দিকে নজর পড়বে ওর, এমন অপবাদ কেউ দিতে পারবে না ওকে।

হঠাৎ কী যেন চোখে পড়ল রমজানের। বিড়ালের চোখের মতো পিট পিট করে জ্বলে উঠল ওর চোখ জোড়া। লেকুর ছাগল খাসিটা মিঞাদের সেই বাগিচার পেছনে ফুটি ক্ষেতে চরে বেড়াচ্ছে। ঘাসের এক একটি কচি পাতা মুখে পুরছে আর কেমন ভীতু ভীতু চোখে এদিক ওদিক দেখছে। প্রতিশোধ নেবার এমন একটা সুযোগ অযাচিতে এসে যাবে ভাবতে পারেনি রমজান। হোক না অকিঞ্চিৎকর তবু এতেই আপাতত রমজানের গায়ের জ্বালাটা মিটবে।

পেছন থেকে গিয়ে খাসির গলায় গামছাটা আলগোছে পেঁচিয়ে দিল। তার পর কষে চেপে ধরল। একটু ভ্যাঁ করে ডাকবারও ফুরসুত পেল না পশুটা। গামছাবদ্ধ পশুটাকে বাগিচায় তুলে আনল রমজান।

ছুরি দা সবই মজুদ থাকে ফেলু মিঞার এই স্বল্প ব্যবহৃত ঘরটায়। জবাই করতে চামড়া ছিলতে গোশত কাটতে কতটুকুই বা সময় লাগল ওর। এরি মাঝে একবার চোখ তুলে দেখল সৈয়দ বাড়ির মেয়ে দুটো দৌড়ে চলেছে ক্ষেতের আল ধরে। বিস্মিত হল রমজান। আরো বিস্মিত হল যখন দেখল ওরা গিয়ে উঠল হুরমতির ঘরে।

আর্ধেকটা গোশত বেচবার জন্য হাটে পাঠিয়ে দিল রমজান। বাকী আর্ধেকটা নিয়ে এল বাড়ি। প্রতিশোধের স্পৃহাটা অল্পতেই তুষ্ট হল। বিপদ এসেছিল লেকুর জানের উপর। সামান্য মালের উপর দিয়েই সে বিপদটা কেটে গেল। খাসিটা ওর এত বড় উপকারে এসেছে বলে, লেকুর উচিত আল্লার দরবারে শোকরগুজার করা। রাত্রে হাডডি চিবুতে চিবুতে এই কথাগুলোই ভাবে রমজান।

০৪.

অনেক কিছু বলবে বলেই তো শেষের সারি থেকে উঠে দাঁড়িয়েছিল লেকু। অথচ দাঁড়িয়েই কী যেন হয়ে গেল। পা কাঁপল, জিবটাও যেন জড়িয়ে এল। কয়েকটা লবজো বলেই বসে পড়তে হল। নিজের উপরই সে রেগে গেছিল। রেগে গুম হয়ে বসেছিল। প্রতিবাদের কোনো ভাষা খুঁজে পাচ্ছিল না। ষণ্ডা কালুটা যখন চিমটেটা হাতে নিয়ে মূর্তিমান আজরাইলের মতো এসেছিল তখন ওর শরীরের শিরাগুলো যেন অকস্মাৎ পাকানো দড়ির মতো টান ধরেছিল, চামড়া ফেটে গায়ের যত রক্ত ফিনকি দিয়ে আসতে চেয়েছিল। ঠিক সেই মুহূর্তে কেমন করে যে ওর আড়ষ্ট ভাবটা কেটে গেছিল ও ঝাঁপিয়ে পড়েছিল হারামখোর রমজানের উপর; এখন ঠিক মনে করতে পারছে না। কিন্তু রাগের রেশটা এখনো ওর রগে রগে লঙ্কার গুঁড়োর মতো জ্বালা ছড়াচ্ছে।

লেকু জানে হুরমতির ব্যাপারটা কী। রমজান ওকে সাঙ্গা করতে চেয়েছিল। হুরমতি বলেছিল–আবার যদি কও তবে জিবটা কেটে রেখে দেব। তাই এই নির্যাতন। অবশ্য আরো হেতু যে নেই তা অস্বীকার করে না লেকু। তবে সে সব মিঞা আর সায়েব সুয়োদের ব্যাপার, মনে মনে ঘাঁটতেও ভয় পায় লেকু। ইদানীং সাবডিবিশন শহরটায় ঘন ঘন পাড়ি দিচ্ছিল হুরমতি, আর তাতে যে ফেলু  মিঞার চক্ষু টাটিয়েছে এটা কোনো কেয়াসের ব্যাপার নয়। এতে রমজানের হল সুবিধে, ফেলু মিঞার সমর্থনে এমন করে দাদ তুলতে পারল।

হুরমতিটা যে কী! পঁই পঁই করে সাবধানী দিয়েছিল লেকু; খবরদার ওই বদমাশটার হাতে ধরা দিবি না। বার্মা মুল্লুকে খুন করে পালিয়ে এসেছে, বেটা খুনী। হুরমতি কান দিল না ওর নিষেধে।

এখন? অমন চাঁদ মুখখানা দিলে তো জন্মের মতো বদখত করে? আর এত যে যন্ত্রণা? উ! দগদগে, সেই ঘাটা লেকু কিছুতেই তাড়াতে পারে না মনের চোখ থেকে।

আর নয়। লেকু আর কোনো সম্পর্ক রাখবে না হুরমতির সাথে। কোনো দিন না। মরুক হুরমতি। অমন পাপিষ্ঠার মরাই ভালো। নিজের বউ আছে মেয়ে আছে লেকুর। ওদের দিকে বেশি করে মন দেবে ও। আসলে হুরমতির উপর ওর রাগটা চৈত্রমাসের বৃষ্টি ফোঁটার মতো, মাটি ছুঁতে না ছুঁতেই মিলিয়ে যায়। যখন বাচ্চা হল হুরমতির কেউ এল না ওই কসবির যারবা সন্তানকে ভূমিষ্ঠ করতে। লেকুই পাঠিয়েছিল আম্বরিকে। সেই থেকে আম্বরি রাতের বেলাটা হুরমতির ঘরেই শোয় ওর রান্নাটাও সেরে দেয় নিজেদের হাঁড়িতে। উঠোনে পা রেখে লেকুর চটা মেজাজটা আরো চটে গেল–মাঝ উঠোনে ঝাঁটাটা হাঁ করে রয়েছে ওর আসার পথের দিকে।

আম্বরি আম্বরি চেঁচায় লেকু। কোনো সাড়া না পেয়ে আরো চেঁচায়। ঘরের পেছনে এসে আবার ডাকে হুরমতির ঘরটির দিকে মুখ করে। হুরমতি আর লেকুদের ঘরের মাঝখানে ব্যবধান ছোট্ট একটি ডোবা, এ ঘরের কথা ও ঘরে বসে শোনা যায়। অথচ সাড়া নেই আম্বরির। কতদিন বলেছে আম্বরিকে, ঝাঁটাটা যেখানে সেখানে ফেলে রাখবি না, আসতে যেতে চোখে পড়লে আমার মেজাজটা বিগড়ে যায়। তবু আম্বরি যেন ইচ্ছে করেই ঝাঁটাটা হয় উঠোনে নয় তো দাওয়ায় ফেলে রাখবে, লেকুর চোখে পড়বেই।

ও আম্বরি। আম্বরি। স্বরটাকে একেবারে সপ্তমে তুলে দিল লেকু। এবারের ডাকটা আম্বরির কানে যায়। জবাব না দিয়েই ত্রস্তে দৌড়ে আসে ও। হাতের নাগালে আসতে না আসতেই শক্ত হাতে ওর চুলের মুঠিটা ধরে নেয় লেকু। হিড় হিড় করে টেনে আনে উঠোনে। উপুড় হয়ে সেই হাঁ-করে থাকা ঝাঁটাটাই কুড়িয়ে নেয়। সপাং সপাং ঝাঁটার বাড়ি চালিয়ে যায় ওর পিঠে উন্মাদের মতো। খসে পড়ে আম্বরির গায়ের কাপড়। স্পষ্ট দেখা যায় কড়া পড়েছে পিঠের চামড়ায়। কত যে মারের দাগ সেখানে।

দিক বিদিক জ্ঞান নেই লেকুর। হিস-সিং হিস-সিং আর্তনাদ তুলছে ঝাঁটার বাড়ি আর নারকেল শলাগুলো দাগ কেটে বসে যাচ্ছে আম্বরির উদলা পিঠে। ওর পিঠের এক ইঞ্চি চামড়াও বোধ হয় আজ আস্ত রাখবে না। লেকু থেঁতলে দেবে সারা পিঠ। যেমন ক্ষেপেছে!

এক সময় ঝাঁটার গোছটা খুলে গিয়ে শলাগুলো এদিক ওদিক ছিটকে পড়ে। তারপর এক লাথিতে আম্বরির পলকা শরীরটাকে প্রায় তিন হাত দূরে ছিটকে ফেলে দেয় লেকু। সেখানেই একটা পাতলা কাঠির মতো অনড় পড়ে থাকে আম্বরি। হয়ত অপেক্ষা করে কখন রাগ পড়বে লেকুর।

হারামজাদী মাগি। কাঁড়ি কাঁড়ি ভাত গিলবি। কাজের বেলায় ঢুঁঢ। মিঞা বাড়ির বিবি আর কী! ঝড় বর্ষা মেহেন্নতা করে মরব আমি আর তিনি বিবি পালঙ্কে পায়ের উপর পা তুলে খাবেন। দাসী লাগবে। বান্দী লাগবে.. কেনরে হারামজাদী! ঝাঁটাটাও সরিয়ে রাখতে পারিস না? তবে আমার ভাত গিলিস কোন আক্কেলে…। বর্ষণটা একটানা চলে না। মাঝে মাঝে থামে লেকু। প্রচণ্ড হুমকি দিয়ে দৌড়ে যায় আম্বরির দিকে আবার দুপা পিছিয়ে আসে। রাগলে কখনো এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না লেকু।

হঠাৎ ওর খেয়াল হল একটুও নড়ছে না আম্বরি। মরে গেল না তো? ঝুঁকে পড়ে হাতের পিঠটা আম্বরির নাকের মুখে ধরল লেকু। না, গরম নিশ্বাস হাতের পিঠে স্পষ্ট অনুভব করছে ও! উঠে এল দাওয়ায়। গুম হয়ে বসে রইল। এটাই ওর রাগ পড়ার লক্ষণ।

আম্বরি কাঠির মতো দেহটাকে যেন বিনা চেষ্টায় তুলে নিল, সুড়সুড় করে চলে গেল হুরমতির ঘরের দিকে। হুরমতির ছেঁকা দেখে এসে লেকু যে আজ কারবালার তাণ্ডব শুরু করবে সেটা আম্বরি আগেই আঁচ করতে পেরেছিল। ঝাঁটাটা উপলক্ষ মাত্র।

তকদীরটাকেই দোষী করে আম্বরি। তকদীরটাই এমনি, নইলে সেও যাচ্ছিল মিঞা বাড়ির দিকে জুমার পর যে কাণ্ডটা ঘটবে সেটা দেখতে। কিন্তু ঘরের বাইরে পা দিয়েই মনটা খুঁত খুঁত করে। শুকনো আম পাতায় ভরে গেছে উঠোনটা। পোড়া মন ঝাঁট দিয়ে ঝাঁটাটাকে উঠোনে ফেলেই দৌড় দিয়েছিল টেন্ডল বাড়ির দিকে। টেন্ডলদের পাটি পাতার জঙ্গল থেকে ভেসে আসছে লেংড়ি মুরগিটার চিৎকার হয়ত শিয়াল তাড়া করেছে। আম্বরি পৌঁছে দেখে শিয়াল নয়, লেংড়িকে তাড়া করেছে টেন্ডল-বউ। লেংড়ি তিন গণ্ডা কাচ্চা বাচ্চা নিয়ে তার খুদ খেয়েছে এই অপরাধ। সঙ্গে সঙ্গে টেন্ডল-বউ আদ্য শ্রাদ্ধ করল লেকু এবং লেকুর বউ খানকি মাগিটার।

.

ত্রাস বিক্ষিপ্ত বাচ্চাগুলোকে এক জায়গায় করে অনেক সান্ত্বনা দিয়েও লেংড়ির চিৎকার থামাতে পারেনি আম্বরি। ভীষণ উত্তেজিত লেংড়ি চেঁচিয়েই চলেছে। অগত্যা লেংড়ি আর বাচ্চাদের ওদের পরিচিত উঠোনে পৌঁছে দিয়ে আবার দৌড় মেরেছিল আম্বরি টেন্ডল বাড়ির দিকে। টেন্ডল-বউর জন্মটা আসলে শুয়রের জন্ম আর তার মা বাপ তাকে বিষ্ঠা ছাড়া আর কিছুই নাকি খাওয়ায় নি। মুখরা টেন্ডল বউর ধারালো জিবের প্রত্যুত্তরে এই জবাবটাই আম্বরিকে নানাভাবে ফুলিয়ে বাড়িয়ে শোনাতে হয়। স্বরটাকে কখনো উচ্চতানে কখনো মধ্যতানে নানা খাদে নানা টানে এই নিত্যকার কীর্তন গাইতে গিয়ে বেলা যায় বেড়ে। উঠোনে আর ফেরা হয় না ওর। ঘরের পিছন দিক দিয়ে তাড়াতাড়ি হুরমতির ঘরেই পৌঁছুতে হয় ওকে। এর মাঝে ঝাঁটার কথাটা কেমন করে মনে থাকে! পোড়া মন পোড়া যে কপালে লেখা আছে খসমের হাতের মার পায়ের লাথি, নইলে কী আর মনে থাকত না? কপালের উপর সব ভার চাপিয়ে দিয়ে যেন একটু হাল্কা হয় আম্বরি। গায়ের ব্যথাটাও একটু কম মনে হয়।

দাওয়ায় সেই যে গুম হয়ে বসেছে লেকু। বসেই আছে। আফসোস হয় ওর। ওর জন্যই তো খেটে খেটে বউটি আজ কঙ্কালসার। আম্বরি না থাকলে ও কী পারতো ঘর বাঁধতে, আট গণ্ডা জমি কিনতে? না পারত সে সব ধরে রাখতে? এই শরীর নিয়েও কাজ কী কম করে আম্বরি? ওর জন্য কোনোদিন একটা গাছ ফেড়ে দিয়েছে লেকু? দেয়নি। আম্বরি নিজেই বন বাদাড় ঘুরে খড় শুকানো ডালপাতা হাবিজাবি জোগাড় করে সারা বছর উনুনটা জ্বালিয়ে রাখে। ভাতের সাথে কচুর লতিটা ঢেঁকি শাকটার ব্যবস্থা করে। মাছও ধরতে জানে আম্বরি। ফুরসুত পেলেই ওই ডোবাটায় নতুবা সৈয়দের মজা দীঘিতে প্যাঁক হাতড়িয়ে মাছ তুলে আনে। গুণের শেষ নেই আম্বরির।

একপাল হাঁস-মুরগি পালে আম্বরি। আণ্ডা বেচে। বাচ্চা ফোটায়। একটু বড় হলেই হাঁস-মুরগির বাচ্চাগুলো বেচে নিয়ে দুটো পয়সা ঘরে তোলে। ছাগল পালে। তালতলির রামদয়ালের হাঁপানির ব্যামো। প্রতি বছর ছাগল বিয়োলেই দুধটা রামদয়ালের জন্য বাঁধা দামটাও নগদ। 

আম্বরিকে বাদ দিলে কী থাকে লেকুর? অমন করে ওকে মারাটা সত্যি অন্যায় হয়ে গেছে। রাগটা কোথায় উবে গেছে লেকুর। ইচ্ছে করে আম্বরিকে ডেকে একটু আদর করতে। আম্বরির সন্ধানেই এদিক ওদিক তাকায় লেকু।

তিন-জনের সংসার লেকুর। সে, বৌ আর চার বছরের মেয়ে ভুনি। সম্পত্তির মধ্যে রয়েছে চৌদ্দ গণ্ডা জমি। নিজের কেনা ছয় গণ্ডা বাপের বন্ধকী দেওয়া জমি। পরে কর্জ শোধ করে সেই জমি ছাড়িয়ে নিয়েছিল লেকু। আর সেই ভিটিটা। ভিটির চার পাশে কিছু ডাঙ্গা। ডাঙ্গায় কয়েক গণ্ডা সুপুরি গাছ, গোটা চার আমগাছ একটা জাম গাছ। ডাঙ্গায় ঢালুতে পাটি পাতা। আম্বরি লক্ষ্মী। ওইটুকুন তো ডাঙ্গা। সেই ডাঙ্গা থেকেও গতরের খাটুনি দিয়ে কত কিছু আদায় করে নেয় আম্বরি। পাটি পাতা হাটে পাঠায়। আসন বানায়, পাটি বোনে, বঠনী বানায়। তালতলির হাটে এসব জিনিসের দাম আছে। আম্বরির যত্নে গাছের একটি সুপুরিও নষ্ট হয় না। নিজে পান খেতো আম্বরি। কাউয়ের কোয়ার মতো লাল টকটকে আর রসে ভরে রাখত ঠোঁট জোড়া। কিন্তু পানও ছেড়ে দিয়েছে, সুপুরি বেচার আয়টাও বাড়বে, পান কেনার ফজুল খরচাটাও কমবে। তবু আম্বরির আয় আর খেতের আয় কদ্দিন চলে : বড় জোর মাস পাঁচ। বাকী সাত মাসের খোরাকের জন্য নানা ফিকির লেকুর। কোনো বছর উত্তরে চলে যায়, বাঁশ আর ছন নিয়ে আসে। ছন আর বাঁশ বিক্রী সেরে আবার যায় সেই উত্তরের পাহাড়ে। নিয়ে আসে কুমড়ো বেগুন এমনি সব তরকারি। বিক্রী করে তালতলি আর বড় হাটে। কোনো বছর চলে যায় ধান কাটতে বাখরগঞ্জ অথবা আসামে। সে বছর পাহাড়ে যায় না। প্রথম প্রথম জোয়ানকী বয়সের দেদার খাটুনি ঢেলে খাই খরচা চালিয়েও কিছু টাকা জমাতে পেরেছিল লেকু। অবশ্য স্বীকার করবে লেকু অন্তত এই ঠাণ্ডা মেজাজের মুহূর্তে লক্ষ্মীমন্ত আম্বরির হাতে না থাকলে জমতো না সেই টাকা। ওই জমানো টাকা দিয়েই তো আট গণ্ডা জমি কিনেছে লেকু আর সুদে-আসলে বাপের ঋণটা শোধ দিয়ে বন্ধকী ছয় গণ্ডা জমি ছাড়িয়ে নিয়েছিল রামদয়ালের কাছ থেকে। তারপর ঘরটা পড়ে গেছিল সেই গেল বছরের আগের বছর যে তুফান হল সেই তুফানে। লেকু তো অন্ধকার দেখেছিল চোখে, আম্বরি ওর পায়ের রূপোর খাড়ু আর কোমরের রূপোর শিকলিটা খুলে বলেছিল, বসে বসে ঝিমোলে তো আর চলবে না। যাও এগুলো রামদয়াল খুড়োর কাছে বন্ধক দিয়ে নিয়ে আস যা পাও। তাই করেছিল লেকু। ঘর উঠেছিল। কিন্তু, আম্বরি এখনো ফিরে পায়নি ওর অলংকারগুলো। তার জন্য এতটুকু অভিযোগ নেই আম্বরির। এত মার খায়, রেগেমেগেও কোনোদিন এতটুকু একটা খোঁটা দেয় না। আম্বরি লেকুর লক্ষ্মী। আম্বরি ওর খোদার নেয়ামত। দু বাজুর বন্ধনে ডুবে যাওয়া মাথাটাকে তুলে আবার এদিক-ওদিক তাকায় লেকু। আম্বরির দেখা নেই।

আহ্ ওকে এখন একবার কাছে পেলে ওর ঝাঁঝরা পিঠটায় একটু হাত বুলিয়ে দিত লেকু। মেয়েটাও নেই। কোথায় গেল ওরা সব? হুরমতির ঘরে হয়ত। হুরমতির কথাটা মনে পড়তেই রমজানের মুখটাও ভেসে ওঠে লেকুর চোখের সুমুখে। একদলা বিষ যেন আচমকা গলা দিয়ে নেমে যায়। ওর সারা শরীরটাকে বিষময় করে তোলে। লেকুর জীবনটাকে অশান্তির আগুনে ছারখার করার জন্যই যেন রমজানের জন্ম। আম্বরিকে ঘরে এনে বছর দুই বাদেই লেকু চলে গেছিল রঙ্গম অর্থাৎ রেঙ্গুন শহরে। বুড়ো বাপ তখনো বেঁচে। নামকরা কামলা ছিল বাপজান। ঘরের বেড়া মাছের চাঁই ডুলো পলো এসব কাজে দুচার গ্রামে জুড়ি ছিল না তার। যতদিন বেঁচে ছিল বাপজান ছেলে-বউ আম্বরিকে এতটুকু কষ্ট করতে দেয়নি। আম্বরিকে সেই বাপের হাওলায় রেখে নিশ্চিন্তে আয় করতে বিদেশ পাড়ি দিয়েছিল লেকু।

রমজান ছিল রেঙ্গুন ডকের কুলি-সরদার। একটা নিয়মিত বখরা দেবে রমজানকে। সেই কড়ারে কুলির কামটা তাড়াতাড়িই পেয়ে গেল লেকু। বছর খানিক সে বন্দোবস্তের এতটুকু এদিক সেদিক করেনি লেকু। কিন্তু নটীর নগরীর রঙ্গমে যে এত ফাঁদ সে কী জানতু লেকু? মোহিনী রঙ্গম চুম্বকের মতো টেনে নিল ওকে। ফুল-বসনা রঙ্গমীর চটুল কটাক্ষ ওর মগজে ধরাল নেশা, দেহে তুলল আগুনের হিল্লোল। টাকার প্রয়োজন দেখা দিল। তাই নিয়ে রমজানের সাথে বাধল মনোমালিন্য, মতান্তর। হাতাহাতি।

গতর খাটাই আমি, তুই কেন ভাগ বসাবি? সোজা কথা লেকুর। সব কুলির সাথেই এমনি একটা ফাও রোজগারের ব্যবস্থা রমজানের। তেড়িমড়ি যে কেউ করে না তা নয়। তার দাওয়াইটাও রমজানের হাতে। বখরা নেই কামও নেই, ব্যস রাস্তা দেখ। তবু বাঁধা ব্যবস্থাটা হুট করে নাকচ করে দেয় না রমজান। নিজেও ধৈর্য ধরে দামদস্তর করে। উল্টো পক্ষকেও একটা সুযোগ দেয় নিজের স্বার্থটা তলিয়ে দেখবার।

তুই হলি গিয়ে আমার দেশি ভাই। খেসি কুটুম্বিতা না থাকুক তোর বাপ আমার বাপজানকে তো ভাই বলেই ডাকত। নে যা দিয়ে আসছিলি তার অর্ধেক দিবি টাকায় দুই আনা। রাজি তো? ধমকের পথে না গিয়ে আপসের লাইন ধরে রমজান।

এক পয়সাও না, কামাই করি আমি তুই কেন তার হিস্যা চাস? একটা মৌলিক প্রশ্ন তুলে লেকু কটমট করে তাকিয়েছিল ওর দিকে তখন আর কথা বাড়ায়নি রমজান। জবাবটা দিয়েছিল পরদিন। হাজিরা খাতায় লেকুর নামটা কাটা পড়েছিল। আফসোস করেছিল রমজান–দুনিয়াতে আপন মনে করে কোনো ব্যাটার উপকার করতে নেই।

তাই বলে রমজান কেমন করে ভাত মারবে লেকুর। অমন গোবদা গোবদা যার পায়ের গোছা, হাত আর মুখ আর বুকের পাঁটাটা যার কুলোর মতো চওড়া, খাটতে পারে সে মোষের মতো, তার আবার রঙ্গম শহরে ভাতের অভাব? আর এক সর্দার তাকে লুফে নিয়েছিল। ওতে রমজানের আক্রোশটা কেবল বেড়েই গেছিল। তলে তলে ফুলতে থাকে রমজান। ফুলতে ফুলতে একদিন ক্ষেপে গেছিল। ছোরা নিয়ে তেড়ে এসেছিল লেকুকে খুন করবে বলে।

এই ক্ষিপ্ত হওয়ার পরোক্ষ কারণ লেকু, প্রত্যক্ষ কারণ ছিল রমজানের নিজের কুলিরা। লেকুর দেখাদেখি অন্য কুলিরাও সাহস পেয়েছিল। অস্বীকার করেছিল বখরা দিতে। অবস্থা দেখে অন্য সর্দাররাও টোপ ফেলেছিল, কিছু কম দর হেঁকেছিল। সেই কম দরেই ওরা চলে আসে রমজানের দল ছেড়ে। শেষে এমন হল, রমজানের সর্দারিটাই বুঝি যায় যায়, ফাও রোজগার তো দূরের কথা।

তোকে আমি খুন করব। তোর রক্ত খেয়ে তবে আমার বিরাম।

বেশ, দেখা যাবে কে কার রক্ত খায়। লেকুও তেড়ে জবাব দিয়েছিল আর সর্বক্ষণের জন্য একটা ধারালো ছোরা গুঁজে রাখতো কোমরের ভাঁজে।

কিন্তু ওরা কেউ কারো রক্ত খেতে পারেনি। রমজানকে ফেরার হতে হয়েছিল জোড়া খুনের অভিযোগে। আর লেকুকে বাপজানের মৃত্যু-খবর পেয়ে ফিরে আসতে হয়েছিল গ্রামে।

এত বছর পেরিয়ে গেছে তবু আক্রোশে ভাটা পড়েনি রমজানের, এখনো বুঝি দাদ তুলবার ফিকির খুঁজে বেড়ায়। আর লেকু? সেও কী ক্ষমা করতে পেরেছে উৎপীড়ক রমজানকে?

ও আঘরি। আম্বরি! বাজুতে গোঁজা মাথাটা একটু তুলে কেমন মোলায়েম করে ডাকে লেকু। এটা ওর আদরের ডাক, আম্বরি জানে। আর এ ডাকে কখনো সাড়া না দিয়ে পারে না আম্বরি।

কেন আমি কম যাই কিসে? ফেলু ওস্তাগরের বেটি আমি। হামিদ বেপারীর পোলার সাথে আমার সাঙ্গাটা ভাঙলো কে? হামিদ বেপারীর পোলা, দুই দুইটা বলদ তার, একটা গাই গরু, তিন কানি জমিন, একখানা গোটা হাল! গোলা আছে হামিদ বেপারীর, সেই গোলাভর্তি ধান। আশার বাপকে পঞ্চাশ টাকা ঘুষ দিয়ে এমন সোনার সম্বন্ধ ভেঙে দিল কে? কে? কোত্থেকে হঠাৎ ছুটে এসে লেকুর সুমুখে দুহাতের দশটা আঙ্গুল নেড়ে নেড়ে চিল্লিয়ে চলে আম্বরি।

কী হল আম্বরির? লেকুর অমন আদরের ডাকে এই জবাব? কিছুক্ষণের জন্য থ মেরে যায় লেকু। কেননা আম্বরির এমন উগ্রচণ্ডী রূপ কখনো দেখেনি ও। অসহ্য হলে মনে মনে গজর গজর করেছে আম্বরি। সেও কদাচিৎ। কিন্তু এমন করে সহস্র অভিযোগে ও তো কোনোদিন ফেটে পড়েনি? তবে কী লেকুর মারের মাত্রাটা আজ বেশি হয়ে গেছে? লেকুর কোনো জবাব নেই আম্বরির অভিযোগের। একটি অভিযোগও মিথ্যে নয়। ও শুধু পরম বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে আম্বরির দিকে! এত নালিশ, এত রাগ এতদিন কোথায় লুকিয়ে রেখেছিল আম্বরি?

হাল আছে একখানা? আছে একটা গাই গরু? তবে অত রোয়াব কেন? কেন আসতে-যেতে পায়ের লাথি ঝাঁটার বাড়ি! আ-হা-রে! কী আমার বিবির সুখরে! গেলবার সেই ঈদের চাঁদে দিয়েছে একখানা শাড়ি, সে তো ছিঁড়ে তেনা-তেনা, তালি লাগাবারও জায়গা নেই। ঝাঁটার বাড়ির মতোই খেংরা আওয়াজ আম্বরির।

মারের মুখে চুপ থাকে আম্বরি, কী এক আনুগত্যে বিছিয়ে দেয় পিঠখানি, দাঁতে দাঁত চেপে গ্রহণ করে স্বামীর নিষ্ঠুর নির্যাতন। শুধু দুহাতের দুর্বল আড়াল তুলে কোনো রকমে রক্ষা করে যায় মুখ আর তল পেটটা। সেই আম্বরির আজ এ কী মূর্তি!

কেন এমন হল? বলা নেই কওয়া নেই যে চড় চড় করে চড়ে যায় লেকুর মেজাজটা! আর জানোয়ারের মতো হাত-পা চালিয়ে যায় ওই চিমসে যাওয়া দুর্বলা মেয়েটার কাড়াপড়া গায়ে? এসব কথা যে লেকু একেবারেই ভাবে না তা নয়। যখন বুকের কাছে টেনে নেয় আম্বরিকে তখন ভারি দুঃখ হয় কেমন অনুতাপও হয় লেকুর, ভালো লাগে না! সোহাগ ছেড়ে দিয়ে কেন অমন নিষ্ঠুরের মতো ঠেঙ্গায় আম্বরিকে সে কথাটাই ভাবে। আজও বাজুর কেঁচকিতে মাথা রেখে সে কথাই ভাবছে লেকু।

অথচ লেকু তো এমন ছিল না! এই বছর তিনেক আগেও আম্বরিকে ঠেঙ্গানোর কথাটা ভাবতেই পারত না ও। সেই যে তুফান এল, ঘরটা উড়ে গেল তারপর থেকেই কেমন যেন হয়ে গেছে লেকু। সেবার তো আম্বরির খাড়ু শিকলী বন্ধকীর টাকা নিয়ে কোনো রকমে চাল তুলল মাথার উপর। তারপরের বছর অর্থাৎ গেল বছরের আগের বছর এল বান। বানের পানিতে ভেসে গেল চোদ্দ গণ্ডা জমি আর বার গণ্ডা বর্গা চষা জমির ফসল। তারপর বউ-মেয়ে-ঘর সামলাতে গিয়ে এই দুটো বছর ওর ভাটিতে যাওয়া হয়নি। ফলে উপোস চলেছিল গেল বছরের প্রায় আটটি মাস। কী হবে? কী করবে? লেকু তো প্রায় অন্ধকার দেখছিল চোখে। সব বিপদের ভরসা আম্বরি, সে-ই পথ দেখাল। গলার হাঁসুলি আর এক জোড়া চুড়ি ওর হাতে দিয়ে বলল, তুফানের বছর যে কথা বলেছিল সেই একই কথা রামদয়াল জ্যাঠার কাছ থেকে যা পাও নিয়ে চলে যাও পাহাড়ে। সেদিন আম্বরি যদি ওর গায়ে দা-এর দুটো কোপ বসিয়ে দিত তা হলেই বুঝি ভালো হত। কিছুতেই নিতে চায়নি লেকু। রঙ্গম থেকে আসার সময় লেকু শখ করে কিনে এনেছিল ওই হাঁসুলি আর চুড়ি। কী খুশিই না হয়েছিল আম্বরি। সারাক্ষণ গলায় জড়িয়ে রাখত হাঁসুলিটা। সেই হাঁসুলি বিক্রি করতে হবে? এর চেয়ে দু ঘা দা-এর কোপ বসিয়ে দেয় না কেন আম্বরি?

তবু বন্ধক রেখে টাকা আনতে হয়েছিল ওকে। পাহাড়ে গিয়ে ছনও কিনে এনেছিল। কিন্তু শত্রু যে ওর পায়ে পায়ে। অর্ধেকেরও বেশি ছন গেল চুরি। আম্বরির হাঁসুলি বন্ধকের টাকাটা গেল রমজান চোরের পেটে। আবার শুরু হল উপোস।

এবার? এবার কী হবে? এবারও আম্বরিই টেনে তুলল ওকে, বলল, যাও না পাহাড়ে। ধর গিয়ে মহাজনদের। এতদিনের কারবার তোমার সাথে। এক কিস্তি কী আর বাকী দেবে না? 

ওই টুকুন তো আম্বরি কেমন করে এত বুদ্ধি খেলে তার মাথায়। তাজ্জব বনেছিল বার্মা ফেরত, বিদেশ-দেখা লেকু। আরো তাজ্জবের কথা, পুরনো মহাজন খুশি হয়েই বাকী দিয়েছে ওকে। আর এবারের বিক্রির দরটাও পেয়েছে আশাতীত ভালো। ধার শোধ করে গেল বছরের লোকসানটাও অনেকদূর পুষিয়ে নিয়েছে লেকু।

কিন্তু সেই যে ফসল গেল, অলংকার গেল, পুঁজি গেল, তার সঙ্গে সঙ্গে লেকুর মেজাজটাও গেল বিগড়ে। ফসলের বিক্ষোভ, চুরির আক্রোশ, ক্ষিধের যন্ত্রণা সবই সে মিটিয়ে চলেছে আম্বরির পিঠে নীল-কালো দাগ তুলে তুলে। দুহাতে এখনো তার দানোর বল, সব লোকসান, সব ক্ষতিই হয়ত পুষিয়ে নেবে লেকু। কিন্তু বিগড়ানো মেজাজটার কী সারাই হবে কোনোদিন? বাজুর কেঁচকিতে মাথাটা যে ডুবিয়ে রেখেছে লেকু, ডুবিয়েই রাখে। আর ভাবে শুধু ভেবে চলে। এমন করে তো কোনোদিন ভাবেনি লেকু?

গায়ের গোশত তো সবই গেছে, এখন হাডডিগুলো পঁচলেই বাঁচি। সারা দিন যত মরার খাটনি, গতরটার কী সুখ আছে এক পল? এখন আবার তাঁর বেইশ্যার সেবা, সেও আমাকেই করতে হবে। হাঁসগুলো এখনো ফিরল না, খাসিটার নেই দেখা, ছাগীটা বাঁধা রয়েছে আমতলায়, একটু দেখলে কী হয়! তা উনি তো মিঞা সেজেছেন। চাকর না থাক বান্দী তো একটা আছেই ঘরে। বান্দী বলে বান্দী, বেইশ্যার পা টিপিয়েও ছাড়ল।

হায় রে কপাল! ও এ জন্যই এত রাগ আম্বরির?

এই এই হারামজাদী! চুপ কর। হঠাৎ মাথা ঝাঁকারি দিয়ে বাঘের মতো লাফিয়ে পড়ে লেকু। মস্ত জোয়ান দেহটার ভারে শক্ত উঠোনটা যেন কাঁপে আর ঠন ঠন বেজে ওঠে।

কিন্তু একি হল লেকুর। আম্বরির পিঠের উপর তুলেও হাতটা কেমন করে সামলে নিল ও। কোনো দুঃসাহসিক প্রচেষ্টায় সংযত করে নিল ভেতরের দানবটাকে! অত বড় দেহের ফুলে ফুঁসে ওঠা শক্তি আর প্রচণ্ড ক্রোধটা নিষ্ক্রমণের পথ না পেয়ে কী বিকৃতি ফেলেছে ওর মুখে। রগ আর গলার শিরাগুলো পাকানো দড়ির মতো কেমন ফুলে কঁকিয়ে শুধু মোচড় খেয়ে চলেছে। হঠাৎ শিশুর মতো হাউ হাউ করে কেঁদে দেয় লেকু। কুঁচ কালো মুখ বেয়ে ছুটে যায় অশ্রুর ধারা। রুদ্ধ কণ্ঠে বলে লেকু, ঘরে যার ভাত নেই সে কী মানুষরে আম্বরি! সে যে অমানুষ, জানোয়ার। নইলে তোর মতো লক্ষ্মী বউকে কেউ এমন করে ঠেঙ্গায়!

ঝড়ের বেগে বেরিয়ে যায় লেকু।      

০৫.

আসসালাতো খাইরুম মিনান নওম
আসসালাতো খাইরুম মিনান্ নওম।

পূর্ব আকাশে ঈষৎ সাদা পোঁচ। একটু বাদেই সূর্য উঠবে। মোয়াজ্জিনের মিহি কণ্ঠে ভোরের আহ্বান, নিদ্রার চেয়ে উপাসনা উত্তম। ডাক দিচ্ছে মোয়াজ্জিন, ওঠ উপাসনায় শামিল হও। কুয়াশার পর্দা ছিঁড়ছে চড়ই শালিকের প্রভাত কাকলি। সারারাতের রুদ্ধ যত গান এই মুহূর্তেই যেন ওদের কণ্ঠে এসে ঝংকার তুলেছে। ওদের গান আর মোয়াজ্জিনের কণ্ঠ শীতের কুহকি সকালে যেন সুরের এক ইন্দ্রজাল। সে সুর গৃহস্থের ঘরে ঘরে আনে জাগরণের সাড়া।

এমনি করেই সকাল হয় বাকুলিয়া গ্রামে।

একশ বছর আগেও, এমনি করেই নাকি সকাল আসত এই গ্রামে। মিঞা বাড়ির মসজিদ থেকে ভেসে আসত আজানের মিষ্টি করুণ রাগিণী। আজান শুনবার আগেই, নীড়জাগা প্রথম পাখিটির আনন্দ, কূজনে, ঘুম ভাংতো কুল-বধূর, ঠেলা দিয়ে জাগিয়ে তুলত পাশের মানুষটিকে, সেই একশ বছর আগে। তার আগের ইতিহাস কিংবদন্তী।

কেউ বলে সৈয়দদেরই পূর্বপুরুষ এ অঞ্চলে এসেছিল ইসলাম প্রচারে। এখন যে মিঞা বাড়ি সে বাড়িতে ছিল এক বিত্তশালী হিন্দু পরিবার। গৌরবর্ণ দিব্যকান্তি তরুণ এক মুজতাহিদ। তার প্রচারে আকৃষ্ট হয়েছিলেন বাড়ির কর্তা। তরুণ সাধককে সাদর আমন্ত্রণে ডেকে এনেছিলেন বৈঠকখানায়। গোটা পরিবার ইসলাম কবুল করেছিলেন। তারপর কোনো এক শুভলগ্নে বাড়ির কর্তা আপন কন্যাকে সমর্পণ করেছিলেন সুদর্শন পীরের খেদমতে। যাযাবর মুজতাহিদ আটক পড়েছিল দুটি পেলব বাহুর বন্ধনে। সেই বছরই তৈরি হয়েছিল মিঞা বাড়ির ওই মসজিদ আর গ্রামের অপর প্রান্তে পত্তন হয়ে ছিল সৈয়দ বাড়ির।

অন্যরা বলে আর এক কাহিনী। একদা অঞ্চলটি ছিল বিরানা। বসতি ছিল অনেক দূরে উত্তরে। সেই উত্তরের নমো কুঁয়োররা উঁচু জাত ব্রাহ্মণদের উৎপীড়নে অস্থির হয়ে একদিন বসতি ছেড়েছিল। মুসলমান হয়ে চলে এসেছিল এই বিরানা অঞ্চলে, পত্তন করেছিল বাকুলিয়ার। এ নাকি বল্লাল সেনেরও আগের কথা।

লিখিত ইতিহাস আর কিংবদন্তী মিলে যে সত্য সে সত্য উদঘাটনের চেষ্টা কেউ করেনি। বাকুলিয়ার মানুষের সে আগ্রহ নেই। তারা শুধু জানে ওই মসজিদের দালানটি একশ বছরের পুরনো। এটা জানা সহজ কেননা মসজিদের প্রবেশ পথেই আরবী-বাংলা সনের পাশাপাশি লেখা রয়েছে ১৮৩৫ইং। অবশ্য মিঞারা বলেন, মসজিদের পত্তন আরো দুশ কি তিনশ বছর আগের, তখন ঘরটা ছিল কাঁচা। আর একটি কথা তারা জানে, সেই যে শুনেছে দাদাপিজার দিনে, বাকুলিয়ার ভাগ্য আবর্তিত হত মিঞা আর সৈয়দ বাড়িকে কেন্দ্র করে; আর সে সব কথা প্রাচীন পুঁথির মতোই বাসি হয়ে গেছে। মিঞারা আজ কোমর ভাঙা সিংহ, হয়ত গুরুত্ব আছে তাদের এই বাকুলিয়ার সমাজে কিন্তু শক্তি নেই রোয়াব নেই, শুধু আছে হৃতবিত্ত খানদানীর খেদ আর হায় আফসোস, অক্ষমের ক্রোধ। আগ্রহ না থাকলেও কিংবদন্তীর আড়ালে লুকনো কোনো সত্য যখন ঝিলিক মেরে ওঠে তখন উৎকর্ণ হয়, কৌতূহলী জটলা পাকায় বাকুলিয়ার মানুষ। ওই মসজিদেরই পয়লা কাতারের পয়লা কী দোসরা আসনটিকে কেন্দ্র করে ব্যাপারটা ঘটেছিল। সেও বছর তিরিশ আগের কথা। মরহুম বড় মিঞার তখন শেষ সময়।

দিনটা ছিল শুক্রবার, জুমার নামায শুরু হয়ে গেছে। ইমাম সাহেবের ঠিক পেছনে একজনের মতো জায়গা শূন্য। ওটা বড় মিঞার আসন। অসুস্থতার দরুন সব সময় তাঁর পক্ষে জামাতে আসা সম্ভব হয়ে ওঠে না। তবু জায়গা-টুকু খালি থাকে, তিনি যদি এসে পড়েন ওখানেই বসবেন, এটাই নিয়ম।

তিনি না এলে দু চার মিনিট অপেক্ষা করবেন ইমাম সাহেব, নিয়ত বাঁধবার আগে শেষ বারের মতো জেনে নেবেন বড় মিঞা জামাতে আসছেন না, তখন দুপাশের লোক সরে এসে ওই খালি জায়গাটুকু ভরে দেবে, শুরু হয়ে যাবে জামাত।

কিন্তু সেদিন এই নিয়মটার ব্যতিক্রম হয়ে গেল। বড়ো সৈয়দ সাহেবেরও আসতে দেরি হয়ে গেছিল। খেয়ালে হোক, বেখেয়ালে হোক এসেই টুপ করে বসে পড়লেন ওই খালি জায়গায়। ওদিকে একটু পরেই বড় মিঞা এসে মুহূর্তখানেক দাঁড়িয়ে থাকলেন, তাঁর জায়গা নেই। কিন্তু বেশিক্ষণ না, পরমুহূর্তেই কে একজন পাশে সরে গিয়ে জায়গা করে দিল, বড় মিঞা নামাযের নিয়ত বাঁধলেন। এখানেই শেষ হত ব্যাপারটা। হল না। কেননা বড় মিঞার বড় ছেলে এই অমার্জনীয় বেয়াদবীর প্রতিবাদ করে বসল সেই মুহূর্তেই। বিস্মিত অপমানিত বুড়ো সৈয়দ নীরবে সরে যান পাশে, বুঝি জায়গা করে দেন বড়ো মিঞার জন্য। কিন্তু জবাব দিলেন বুড়ো সৈয়দের সাহেবজাদা : খোদার ঘরেও কী আসন সংরক্ষণ? সে তো না-জায়েয।

হয়ত তাই। তা বলে শরাফতের খানদানের নেকবক্তের কোনো মর্যাদা থাকবে না? গরম হয়ে ওঠে বড়ো মিঞার বড় ছেলে।

সে মর্যাদা আর যেখানেই থাকুক, খোদার ঘরে নয়। জ্ঞানলব্ধ গাম্ভীর্যের সাথে কিছু উষ্ণতা ঢালে সৈয়দ-পুত্র।

বেধে গেল তুলকালাম বহস। হাদিস-ফেকাহ্-উসুল-তফছিরের জটিল তর্কের ঝড় উঠল। কিতাব এল বোখারী শরীফ মুসলেম শরীফ, তিরমিজি শরীফ আবু দাউদ আরো কতো।

সেদিনের মতো কোনো রকমে নামায সারা হল। তারপর মসজিদ ছেড়ে বাইরে এল তর্কটা। বাইরে এসেই অন্য রূপ নিল, দু বাড়ির খানদানী মর্যাদার দ্বন্দ্বে নয়া গিঁঠ লাগল।

বাকুলিয়ার মানুষ তাজ্জব হয়ে শুনল, প্রশ্ন আর হাদিস-তফসিরের নয়, আল্লাহর ঘরে সকলের সমান অধিকার নয়। প্রশ্ন বড় মুসলমান কে? সৈয়দরা অথবা মিঞারা? বাকুলিয়ার মুখ্যসুখ্যুরা দেখল কোনো লুপ্ত গহ্বর থেকে উঠে এসেছে ইতিহাসের ছেঁড়া পাতা, অবলুপ্ত ইতিহাসের বিবর্ণ অক্ষর গুলো ঝলসে উঠেছে। দলিল ছুঁড়ে দিয়ে সৈয়দরা বলল, এই দেখ তোমাদের পূর্ব পুরুষ আমাদের পূর্বপুরুষদের পায়ের ধুলো মুখের কলেমা নিয়ে মুসলমান হয়েছে।

মিঞারাই বা কম যাবে কেন? বলল, ওসব ভুয়ো, আসলে তোমরা যে ভেসে এসেছিলে, নেহাৎ আমাদের অনুগ্রহে এখানে বাস করছ। এই দেখ আমাদের পূর্বপুরুষরা ওই বসতবাটি বানিয়ে দিয়েছে তোমাদের পূর্বপুরুষদের, ওই ওই জোত, ওই ওই জমি আর তালুক খুশি হয়ে তোমাদের দান করেছে। এই বাঘে মহিষের লড়াইতে মুখ্যসুখ্যুরাও দল বেছে নিল, ফরাক হয়ে দু দল হল। কিন্তু মুখ্যসুখ্যুদের জন্য আরো যে অনেক মাদারির খেল জমা ছিল। হঠাৎ ওরা শুনল আপস হয়ে গেছে। দেখল মিঞা বাড়ির মেয়ে বধূ হয়ে চলে এল সৈয়দ বাড়ি। দুপুরুষ ধরে সেই তিন পুরুষ আগের আত্মীয়তায় যে চিড় ধরেছিল, নয়া কুটুম্বিতার বন্ধনে নিকটতর হল দুই খানদানের সেই প্রাচীন আত্মীয়তা।

মজলিসের সুমুখে আজও যখন জটলা বসে বাকুলিয়ার বুড়োরা সে বহসের গল্প শোনায় কতো রং ফলিয়ে আরবী-ফার্সী উর্দু কিতাবগুলোর বিচিত্র বর্ণনা জুড়ে।

মিঞা বাড়ির মিনার থেকে প্রভাত বন্দনার সেই মন্দ্র মধুর সুরটি ভেসে আসবার আগেই ভোর হয়ে যায় সৈয়দ বাড়িতে। শেষ রাত্রে উঠে জিকির করেন মুনশীজী। জিকির শেষে দরুদ পড়েন সারা বাড়ি ঘুরে ঘুরে।

আজও তেমনি রাত থাকতেই ভোর হয়েছে সৈয়দ বাড়িতে। জিকির শেষ করে মুনশীজী গোটা বাড়ি টহল দিয়ে চলেছেন।

বালাগাল উলা বেকামালিহী
কাসাফুদ্দোজা বেজামালিহী
হাসানাতজামী ওয়া খেসালিহী
ছল্লে আলাইহে ওয়া আ-লিহী।

দহলিজের টিনে অন্দর বাড়ির দেয়ালে দেয়ালে আঘাত খেয়ে গম গম করে মুনশীজীর গম্ভির উদাত্ত কণ্ঠ। প্রথমে দহলিজ, তারপর বাইর বাড়ি, তার পর ভিতর বাড়ি। আবার উল্টো পথে বাইর বাড়ি।

খড়মের খট খট আওয়াজ। পরিষ্কার মিষ্টি সুরের লহরী। শেষ রাত্রির নৈঃশব্দে অনির্বচনীয় এক ধ্বনির মায়াজাল বিস্তার করে চলেন মুনশীজী। সে সুরে আর যারই ঘুম ভাঙুক মালুর ঘুম ভাঙে না। চোখের পাতা গুলো যেন আরো জড়িয়ে আসে, ঘুমটা যেন আরো মিষ্টি মনে হয়। মনে হয় ঘুমের গানটি চলুক আরো কিছুক্ষণ। মালু-ওঠ, বাচ্চু মিঞা, কেনু মিঞা–ওঠেন, ভোর হল, নামাযের সময় হল। ধ্বনির লহরে অকস্মাৎ যেন ছন্দপতন। দালানের কাছটিতে এসে চেঁচিয়ে ওঠেন মুনশীজী। মালু তার আপন সন্তান, বাচ্চু, কেনু সৈয়দ বাড়ির ছেলে। তাই পদপ্রয়োগে মুনশীজীর এই পক্ষপাতিত্ব। বাচ্চু কেনুর কী মনে হয় মালু জানে না। কিন্তু মালুর কাছে ওই বিরক্তিকর। কাঁথাটাকে টেনে মুখখানা ঢেকে নেয় মালু, অস্বীকার করে ওই নিষ্ঠুর হাঁক। কান পেতে থাকে আবার কখন ভেসে আসবে ঘুমের মিষ্টি আমেজের মতো সেই মিষ্টি সুরটি। অপেক্ষা করতে করতে বুঝি ঘুমিয়ে পড়ে আবার। ঘুমের মাঝেও যেন শোনে–সামসুদ্দোজা বদ রুদ্দোজা…আর হঠাৎ ওই গানের সুরে আবৃত্তিটা থামিয়ে হাঁক দেন মুনশীজী–মালু মালু! এবার কাঁথাটাকে কানের দুপাশে একেবারে সেঁটে নেয় মালু।

বড় আপা, ও বড় আপা, দেখ সুরুজ উঠে গেল।

কাঁথাটাকে একটু ফাঁক করে দেখল মালু, ঘুম ভেঙে উঠে বসেছে রাবু, আড়-মোড়া ভাঙছে।

কী রে বড় আপা, তোর কী নামায পড়ার ইচ্ছে নেই? একটা মৃদু ঠেলা দিয়ে বলে রাবু।

ক্যাট ক্যাট করিস না তো? ঘুমুতে দে। খেঁকিয়ে উঠল আরিফা।

বেশ, ঘুমা। আমি কিন্তু রোজ রোজ জ্যাঠিআম্মার কাছে মিছে কথা বলতে পারব না তোর জন্য।

কে বলছে তোকে মিছে বলতে। বলিস নামায পড়িনি আমি, পড়বোও না। হল তো? রেগে যায় আরিফা।

বেশ, পিঠে যখন দুমদাম পড়বে আমায় দোষতে পারবিনে।

আরিফা রাগটা আর ধরে রাখতে পারে না। মাথার তলা থেকে বালিশটা তুলে ছুঁড়ে মারে রাবুর দিকে। খুব বাড় বেড়েছে তোর, ভারি নামাযি হয়েছিস।

বালিশ ছাড়াই দু হাত লম্বালম্বি বাড়িয়ে তারই ফাঁকে মাথাটা রেখে আবার ঘুমিয়ে পড়ে আরিফা।

রাবু আপাটা যে কী? এই শীতেও কেমন করে যে লেপের মায়া ছেড়ে রাত থাকতেই উঠে পড়ে। ভাবে মালু আর সজাগ থাকতে চেষ্টা করে। এক্ষুনি তো রাবুর ফরমান আসবে–ওজুর পানি এনে দে।

গানের মতো মিষ্টি আবৃত্তি থেমে গেছে। খড়মের শব্দটাও আর কানে আসছে না। বাইরের পুকুর থেকে ভেসে আসছে ওজু আর গলা ঝাড়ার শব্দ–খাঁক খাঁক, ঝপ ঝপ। আযানের শেষ কলিটাও বাতাসে ঝংকার রেখে মিলিয়ে গেল : হাইয়ালাস্-সালা হাইয়ালাল-ফালা আল্লাহ-হু-আকবর…কাল যে মস্ত বড় একটা গোনাহ করেছিস খেয়াল আছে?

রাবুর গলা। উৎকর্ণ হয় মালু। ছোট্ট বুকটা টিপ টিপ করে। গোনাহকে ওর বড় ভয়। গোনাহ্গারকে নাকি জ্বলে ও পুড়ে ছটফট করতে হয় দোজখের আগুনে। সে আগুন যে সে আগুন নয়। সে আগুন সাংঘাতিক। দুনিয়ার কেউ দেখেনি তেমন আগুন। লক্ষ বছর, কোটি বছর সে আগুনে পুড়তে হবে, যতদিন না শাস্তি মওকুফ করে দেন আল্লাহতালা। আব্বার কাছে, আম্মার কাছে এ সব কথা শুনেছে মালু। ওর ছোট্ট বুকের টিপ টিপানিটা বেড়ে যায়, কী এমন গোনার কাজ করল রাবু আপারা।

গোনাহ? গোনাহ্ কখন করলাম। গোনাহর কথা শুনে আরিফা চোখ রগড়ায়। উঠে বসে। ব্যাপারটা সত্যি বুঝে নেয়া দরকার। ওই যে পর্দা ভাঙলি কাল? আম্মা হয় না-ই জানল কিন্তু, খোদা তো দেখেছে? খোদা মাফ করবে কেন? ব্যাপারটা ভেঙে বলে রাবু।

ধ্যাৎ, কেউ তো দেখেনি আমাদের। আরিফার কণ্ঠে অবিশ্বাস।

না দেখল। আমরা তো দিনের বেলায় প্রকাশ্যেই বেরিয়েছি, নিষেধ অমান্য করে। সেটা পাপ হল না?

আরিফার ঘুমের নেশাটা এতক্ষণে ছুটে গেছে। চোখ বড় বড় করে শুধায়, কী বলতে চাস তুই?

আমি বলি, চল, নামাযটা পড়ে ফেলি। এক রাকাত নামাযে এক হাজার গোনাহ্ মাফ হয়, জানিস, তো?

গম্ভীর হয়ে ভাবতে শুরু করে আরিফা। রাবুর কথাটা একেবারে উড়িয়ে দেবার নয় বুঝি।

মেঝেতে কাঁথার নিচে এই শীতেও বুঝি ঘেমে ওঠে মালু। কেমন অস্থির লাগে ওর। বড় আপাটা যে কী! সহজ কথাটাও বুঝতে পারে না অথবা বুঝতে চায় না। সাপকে তার এত ভয় অথচ গোনাহ সম্পর্কে কেমন নির্বিকার। এক রাকাত নামাযে এক হাজার গোনাহ্ মাফ; রাবু আপার কথাটা যে একটুও বানানো নয় এটা কী বুঝতে পারছে না বড় আপা? কাঁথাটা ছুঁড়ে তড়াক করে লাফিয়ে ওঠে মালু, বলে, ওজুর পানি দেই, বড় আপা? রাবু আরিফা, দু জনেই বুঝি চমকে ওঠে। ওমা : মালু আমাদের কেমন সুবোধ ছেলে দেখ, না ডাকতেই উঠে পড়েছে আজ! কেমন সুধা ঝরা রাবু আপার কণ্ঠে।

মালুর কচি মুখটি আকর্ণ কৃতার্থতা ফুটিয়ে চেয়ে থাকে রাবুর দিকে। রাবু আপার মুখের মতোই মিষ্টি তার কথাগুলো। আব্বার কেরাত আর ওই সকাল বেলার সুর করে পড়া দরুদের মতোই মধুমাখা রাবু আপার কথা। কান পেতে শুনে যেতে ইচ্ছে করে মালুর। ধাঁ করে বেরিয়ে যায় মালু। ঝাঁ করে ফিরে আসে দু বদনা পানি হাতে।

কিছুদিন হল সাপ ঢুকেছিল রাবুদের ঘরে। নীরবে এসে নীরবেই চলে গেছিল সাপটা। ওদের দিকে ফিরেও তাকায়নি। তবু ঠক ঠক করে কেঁপেছিল আরিফা আর ভয়ের চোটে গলা ফাটিয়ে মালুকেই ডেকেছিল রাবু। সেই থেকে রাবুদের ঘরেই মালুর শোবার ব্যবস্থা। মেঝেতে চাটাই বিছিয়ে কাঁথা জড়িয়ে ঘুমোয়। সকালে নিজেই গুটিয়ে রাখে বিছানাটা। এবার দেখা যাবে কেমন বীর পুরুষ; ওর গালে ছোট্ট একটা টোকা মেরে বলেছিল রাবু।

হুঁ! সাপকে যেন ভয় করি আর কী! হাতের লাঠিতে একটা ঝাঁকুনি তুলে উত্তর দিয়েছিল মালু।

সাপ সম্পর্কে মালু অকুতোভয়। মামুলী সাপগুলোকে ও অবলীলাক্রমে লেজে ধরে নেয়, মাথার উপর দু চক্কর ঘুরিয়ে ছুঁড়ে মারে শূন্যের দিকে। শূন্যে ঘুরতে ঘুরতে ভিরমি খায় সাপের বাচ্চা, আর সে-ই ক-দ্দুর গিয়ে পড়ে যায়, অনেকক্ষণ নিথর পড়ে থাকে। গোখুরেকে নিয়ে অবশ্য একটু সাবধান হতে হয়। মাথাটা তাক করে লাঠি ছুঁড়তে হয়। ফসকে গেলে বিপদ। কিন্তু মালুর লক্ষ্য যে অব্যর্থ এ বাড়িতেই দু দুটো গোখুরো সাপ মেরে সে কৃতিত্ব অর্জন করেছে মালু। রাবুর ঘরে শোবার বন্দোবস্তটা ওর সেই সাহসিকতারই পুরস্কার। বুকের উপর হাত না রেখেও বুঝতে পারে মালু খুশির চোটে রাতারাতি ওর সিনাটা ফুলে ফেঁপে কত চওড়া হয়ে গেছে।

ওদের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ঘুমটা যেন পালিয়ে যায় মালুর। নিয়ত বেঁধে বুকের উপর হাত রাখল রাবু আর বড় আপা। রুকুতে গেল। তারপর সেজদায় পড়ল। দুবার সেজদা দিয়ে উঠে দাঁড়াল। বাতাস পেয়ে গাছের পাতাগুলো যেমন ঘন ঘন নড়ে তেমনি দ্রুত নড়ছে ওদের ঠোঁট। কোন সুরা পড়ছে বুঝবার উপায় নেই। কেন না শুধু ঠোঁট দুটোই নড়ছে কোনো শব্দ নেই। আবার সেজদায় পড়ল ওরা। তারপর সেজদা থেকে উঠে দু হাত তুলে মুনাজাত সারল। আবার দাঁড়িয়ে নিয়ত বাঁধল।

আকাশের দিকে অতক্ষণ হাত তুলে আল্লার কাছে কী চাইল রাবু আপারা। গোনাহর জন্য মাফ চাইল? সত্যি কী গোনাহ করেছে ওরা? আর তাই যদি দোজখেই যায় রাবু আপা তা হলে? ইস্! অমন টকটকে আর আরামের শরীর রাবু আপার, কেমন করে সইবে দোজখের আগুন? আল্লাহ্ শাস্তি দিও না রাবু আপাকে; মাফ করে দাও রাবু আপাকে। মনে মনে প্রার্থনা করে মালু। পানিতে ভরে যায় ওর দুটো চোখ। রাবু আর আরিফার মাঝে রাবুর প্রতিই বুঝি মালুর পক্ষপাতিত্ব। তাই প্রার্থনা থেকে আরিফার নামটা যে একেবারেই বাদ পড়ে গেল সেটা খেয়ালেই পড়ল না ওর।

কিরে ফোঁস ফোঁস করছিস কেন? কী হল? সালাম ফিরিয়ে শুধায় রাবু। তাড়াতাড়ি কাঁথা টেনে মুখ লুকোয় মালু। প্রার্থনার কান্নায় কখন ভারি হয়ে এসেছিল ওর নাকটা। দু আঙ্গুলে টিপে নাকের পানিটা বের করতে গিয়ে ধরা পড়েছে রাবুর কাছে। বড় লজ্জা।

আচ্ছা, রাবু আপা, পুরুষদের জামাতে ইমাম আছে, তোমাদের নেই কেন? তুমি বা বড় আপা ইমাম সাজতে পার না? কাঁথার তলা থেকে মুখটা বের করে হঠাৎ শুধায় মালু। প্রশ্নটা এইমাত্র জেগেছে ওর মনে। রাবু ততক্ষণে কর গুনে গুনে দরুদ পড়ছে। জবাব না দিয়ে শুধু ভ্রূ কুঁচকে তাকায় একবার।

সত্যি রাবু আপা, বল না মেয়ে ইমাম কী হয় না? কৌতূহল চেপেছে মালুর। জবাব না পেলে কৌতূহলটা মিটাবে কেমন করে? কিন্তু রাবুর দরুদটা শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারে না মালু। নামায শেষ করে মা এসে পড়েছেন ঘরে : মালু, এখনো শুয়ে?

তড়াক করে লাফিয়ে ওঠে মালু। খিড়কির পুকুরে গিয়ে দু আঙ্গুল পাঁক তুলে দাঁতগুলো সাফ করে নেয়। ভিজে হাতটা মুখের উপর বার দুই বুলিয়ে ফিরে আসে। মাথার উপর দিয়ে গলিয়ে নেয় সার্টটা। ছুট দেয় বাইর বাড়ির দিকে। মক্তবের সময় হয়ে গেছে। ছুটতে ছুটতেই মার হাত থেকে তুলে নেয় পিঠেগুলো। ভরে নেয় প্যান্টের পকেটে। চুলটা একটু আঙ্গুল চালিয়ে ঠিক করে দিতে যায় মা। দাঁড়ায় না মালু। আব্বা মুনশীজীর ছড়িটাকে ওর ভীষণ ডর। নামায নিয়ে এখনো তেমন বাড়াবাড়ি শুরু করেননি আব্বা। তাই ভোরে না উঠলেও দু একটা ধমকের উপর দিয়েই কেটে যায় তাঁর অপ্রসন্নতা। কিন্তু মক্তবে দেরি করলে রক্ষে নেই। বেহুশের মতো ছড়ি চালিয়ে যাবে, মালুর পিঠে।

সৈয়দ বাড়ির কাছারীর পাশেই মক্তব ঘর। মিঞা আর সৈয়দ বাড়ির ইজের হাফ প্যান্ট পরা ছেলে-মেয়ে ছাড়াও গ্রামের উদলা গায়ের ছেলে মেয়েরাও সূর্য উঠতে না উঠতেই মক্তবে এসে জড়ো হয়। ছোটরা আসে খালি হাতে। একটু বড়োদের হাতে থাকে আমপারা। যারা মালুর বয়সী বা আর একটু বড় ওরা আসে মাথায় টুপি, বগলে রেহাল আর কিতাব নিয়ে। আলিফ যবর আ, বে যবর বা, তে যবর তা, ঘরের চারিদিকে চাটাইয়ের উপর গোল হয়ে বসে সামনে পিছনে দুলে দুলে পড়ে যায় বাচ্চারা। একটু বড়রা মুন্‌শীজীর গলায় গলা মিলিয়ে টান ধরে–আ-উ-যু বিল্লা হে মিনাশ শায়তোয়ানির রাজিম।

সৈয়দ বাড়ির বাচ্চু কেনুদের সাথেই বসে মালু। ওরা বসে মুন্‌শীজীর ডান দিকে। অন্যরা মুনশীজীর বাঁ দিকে। দু দিকে থেকে গোল হয়ে সারিটা যেখানে এসে মিলেছে সেখানে সীমান্তের প্রহরী মুন্‌শীজীর আলমিরা। আলমিরা মুন্‌শীজীর কোরান-কিতাবগুলো ধারণ করে আর রক্ষা করে আশরাফ আতরাবের সীমানা।

কচি কচি গলার কত আওয়াজ, বিচিত্র উচ্চারণ, কল কল করে মক্তবঘর। ছোট্ট দুয়ার দিয়ে কচি কচি কণ্ঠের সেই ঐক্যতান ছড়িয়ে পড়ে শীতের কুয়াশা ঢাকা গ্রামের ঘরে ঘরে কী এক আহ্বানের মতো। সামনে পিছে ঢুলে ঢুলে আবৃত্তি করে চলেছে কিশোর-কিশোরী, উঁচুতে উঠতে ওদের কচি কণ্ঠ। সেই ধ্বনির তরঙ্গে দোল খেয়ে হয়ত অনাগত দিনের স্বপ্ন দেখছে ওদের কুটিরবাসী আব্বা আম্মারা।

মালুর চলছে কোরান শরীফের দ্বিতীয় সিপারা। রেহালের উপর কোরানটা খুলে রেখে সেও সবার সাথে দোল খায়, ঠোঁট নাড়ে। এত কণ্ঠের মাঝে ওর কণ্ঠটা যে হারিয়ে যায় সেটা জানে মালু। তাই শুধু ঠোঁট নাড়ে। একটি চোখ লক্ষ্য করে মুনশীজীকে আর একটি চোখ পড়ে থাকে উন্মুক্ত দহলিজে যেখানে চলছে ঘাস-রং ফিঙেটির উড়তি ঘুরতির বিচিত্র খেলা। আর ওর মনটা কোথায় কোথায় যেন ছুটে চলেছে। মসজিদের সুমুখে সেই পঞ্চায়েতের মেল মুখে নল পুরে ফেলু মিঞার গুড় গুড় আলবোলা টানা, হুরমতির সেই ঝলসে যাওয়া কপাল। আহ্ কী কষ্ট হুরমতির। রাবুর সেযদা, পিঠটা বেঁকিয়ে রুকু থেকে যখন সেযদায় নামে রাবু অদ্ভুত সুন্দর দেখায় ওকে…এমনি সব কথা ভাবতে ভাবতে কত জায়গায় কত কিছুর মাঝে, কত মানুষের সাথে ছুটে চলে মালুর মনটা। ডানে বাঁয়ে লেখা সেই বাঁকা অক্ষরগুলো আর চোখে পড়ে না ওর।

হঠাৎ কান খাড়া করে মালু। রাস্তার ওপারে যে ট্যাণ্ডল বাড়ি আর তার উল্টোদিকে রমজানের বাড়ি, তারই মাঝামাঝি কোনো জায়গা থেকে ভেসে আসছে আম্বরির গলা। কানের নিচে হাতের তালু রেখে ভালো করে শুনে নিল মালু। হ্যাঁ আম্বরির গলাই বটে। কেন যেন ক্রুদ্ধ হয়েছে আর কার উদ্দেশে কহর দিয়ে চলেছে অনর্গল : নিজের মেয়ের গোশত খা, পোলার গোশত খা, মেয়ের হাডডি চিবিয়ে খা, দাঁত ভাং…আমার খাসি তো নয়, খেয়েছিস নিজের মাইয়া, নিজের পোলা … হায় হায়রে আমার কী চেকনাইওয়ালা খাসিটারে। রাইন্যারা পাঁচ টেঁয়া দিতে চেয়েছিল, বেচলামনা সেই খাসিটা কোন্ হারাম-খোরের পেটে গেল-রে। তারপর শোনা যায় আম্বরির বিলম্বিত বিলাপ।

কী হল আম্বরির? উসখুস করে মালু।

মুন্‌শীজী ছড়িটা উপরের দিকে তুলে ধরেছেন। এটা পড়া বন্ধ করার ইঙ্গিত। মন্ত্রপূতের মতো স্তব্ধ হয়ে যায় সেই কচি কণ্ঠের ধ্বনি কল্লোল। ছড়ি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পড়া নিতে শুরু করেছেন মুনশীজী।

ধ্বক করে ওঠে মালুর বুকটা। কিছুই তো পড়া হয়নি। মনে মনে একটু পড়ে নিতে চেষ্টা করে মালু।

আরো স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে আম্বরির অভিশাপগুলো : যে খেয়েছে আমার খাসি মুখের জিহ্বা গায়ের গোশত তার খসে খসে পড়বে। নির্বংশ হবে সে। সাতকুলে কেউ থাকবে না। মরলে কবর দেয়ার লোক থাকবে না। মরা লাশ শিয়ালে কুত্তায় টেনে টেনে খাবে। তাই তো হঠাৎ মনে পড়ে গেল মালুর। ওই আঘরির খাসিটাকেই তো গলা বেঁধে মিঞাদের বাগিচায় টেনে উঠয়েছিল রমজান। অস্থির হয়ে ওঠে মালু, এটা জানাতেই হবে আম্বরিকে।

ভূত নেমে যায় মালুর গা থেকে। সৈয়দ গিন্নী ডেকে পাঠিয়েছেন মুনশীজীকে। অতএব পড়া দেবার সেই নিষ্ঠুর নির্যাতন থেকে রেহাই পেয়ে গেল মালু, আরো অনেকে। সমবেত গানের মতো সুর করে করে সেই ছুটির আগের দরুদটা শুরু করে দেয় ওরা!

ছল্লেল্লা হো আলা সৈয়দেনা মোহাম্মদ
ওয়া আলা আ-লেহী ওয়া আসহাবেহী ওয়াসাল্লাম।

দরুদ শেষে গল গল করে বেরিয়ে যায় ওরা। কোরানশরিফ আর রেহালটা গুটিয়ে আলমিরার লাগোয়া তাকে রেখেই ছুট দেয় মালু।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *