০৬-১০. গ্রামের কিষাণ কিষাণী

০৬.

গ্রামের কিষাণ কিষাণী। শিক্ষার আলোকে দৃষ্টি ওদের প্রখর হয়নি, জ্ঞানের চর্চায় বুদ্ধি ওদের শাণিত হয়নি। সে অভাবটি পূরণ করার জন্যই হয়ত ওদের রয়েছে সরল বুদ্ধির একটি সহজাত অনুভব ক্ষমতা, যা দিয়ে ওরা আঁচ করে সম্ভাব্য বিপদ, আবহাওয়ার গতি। কুকুরের যেমন ঘ্রাণশক্তি, মাটি শুঁকে শুঁকে খুঁজে নেয় অনেক দূরের শিকার, বিড়ালের যেমন দৃষ্টি, অন্ধকারেও জ্বল জ্বল করে, তেমনি কৃষকদের এই সহজাত অনুভব ক্ষমতা। হাওয়ার গতিতে ওরা বুঝে নেয় আসন্ন দুর্যোগের সংকেত, আকাশের চেহারায় ওরা খুঁজে পায় খরার চিহ্ন চারা গাছটির রং দেখে ওরা করে ফসলের ভবিষ্যদ্বাণী। সব ক্ষেত্রেই ওদের এই বিচার শক্তি হয়ত অভ্রান্ত নয়। কিন্তু অনেক পুরুষে সজ্ঞাত অভিজ্ঞতাটা দিয়েই ওরা বুঝেছে ওদের এই সহজ সরল প্রবৃত্তির ইঙ্গিত মোটামুটি সঠিক পথেই চালিয়ে নেয় ওদের।

মারতে গিয়েও আম্বরিকে মারতে না পেরে সেই যে বেরিয়ে এসেছিল লেকু কিছুক্ষণ বসেছিল রাস্তার ধারে। খুঁটি বাঁধা ছাগিটা ঘরে ফেরার জন্য যখন অস্থির চেঁচামেচি শুরু করে তখন বুঝি হুঁশ হয় লেকুর। বাচ্চাসুদ্ধ ছাগিটাকে বাড়ি নিয়ে আসে ও।

ঢেলা ঢেলা মাটি দিয়ে তৈরি খোয়াড়ের দরজাটা বন্ধ ছিল, হাঁস-মুরগিগুলো ঢুকতে পারছিল না। প্যাঁক প্যাঁক কঁক কঁক চিৎকারে বাড়ি মাথায় তুলেছিল ওরা। ওদের খোয়াড়ে বন্ধ করতে গিয়েই লেকুর মনে পড়েছিল খাসিটার কথা। বাড়ির আশেপাশে, সৈয়দদের মান্দার বাড়ি। ট্যাণ্ডল বাড়ি, মাঝি-বাড়ি কোথাও খাসিটার খোঁজ না পেয়ে রমজানের উপরই সন্দেহ হয়েছিল লেকুর। তারপর গাঙ্গের কিনারটা ঘুরে এসেও যখন সন্ধান পাওয়া গেল না তখন দৃঢ় হয়েছিল লেকুর সন্দেহটা।

রমজান, নিশ্চয় রমজান ডাকাতের কাণ্ড। ওর ঘরদোরটা ভালো করে দেখে এসো তুমি। খবরটা শুনে আম্বরিও চেঁচিয়ে উঠেছিল।

সারা রাত ঘুমুতে পারেনি আম্বরি। রাতভর শুধু এপাশ ওপাশ করেছে আর খাসিটার শোকে লম্বা লম্বা নিশ্বাস ছেড়েছে। আর গোটা পয়লা প্রহর ধরে শুধু অভিসম্পাত ছুঁড়ে গেছে কোনো হারামখোর চোর বাটপাড়ের উদ্দেশে। সকালে উঠেই রমজানদের বাড়ির সীমানাটায় দাঁড়িয়ে সেই অভিশাপগুলোকে আরও চোখো আরও স্পষ্ট করে শুনিয়ে চলেছিল।

রাতের বেলায় এবং সকালেও অনেকক্ষণ শুনি না শুনি করে চুপ মেরে ছিল রমজানের স্ত্রী তাজুর মা। কিন্তু বেলা বাড়তে সেও জিবে ধার দেয়। খানকির বেডি খানকি, ফকীরার মাগি! তোর মেয়ের মাথা খা তুই। তুই শুয়ার খা। তুই হারাম খা। তারপর দীর্ঘ বর্ণনা দিয়ে চলে তাজুর মা–সাত কানি তাদের জমি, মিঞা বাড়ির নায়েরি, পুকুরে অঢেল মাছ, কিসের অভাব তাদের? তারা কেন যাবে ভিখারীর স্ত্রী ভিখারিনীর খাসি চুরি করতে? অমন কত খাসি তাদের ডাঙ্গায় ডাঙ্গায় ঘুরে বেড়ায়!

স্ত্রীদের এই মুখের লড়াইয়ে দুদিকের পুরুষরাই চুপ। বিগতযৌবনা মেয়েটির মাধুর্যহীন অনাকর্ষণীয় কণ্ঠস্বরের চিৎকারে কী এক পৈশাচিক পুলক পায় রমজান। গোটা শরীর দুলিয়ে হাসে ও।

মনে মনে প্রতিকারহীন অন্যায়ের প্রতিশোধ খোঁজে লেকু। নির্বিষ সাপের আস্ফালনের মতো মনে মনে ফোঁসে গর্জে তড়পায়।

লেকুর কানের উপর মুখটা নিয়ে ফিস ফিস করে সেই গত কালকের কিসসাটাই বুঝি বলল মালু। তারপর প্যান্টের পকেট থেকে সকালের নাশতার পিঠেগুলো বের করে। একটি ভুনির হাতে গুঁজে দেয়। আর একটি মুখে পুরে দৌড় দেয়। ওর মেলা দৌড়াদৌড়ি আজ, তালতলিতে নাকি কবির লড়াই হবে, রাধাকৃষ্ণের পালা হবে, যাত্রা হবে। যাত্রায় নাকি পুরুষ মানুষ মেয়ে সাজে। এ এক তাজ্জব ব্যাপার। নিজ চোখে না দেখে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারবে না মালু। পথে রাসুকে দেখে যেতে হবে, কী মজা হয় ও যদি সঙ্গে যায়!

ওদের বাড়ির পেছনটায় সেই ডোবার মতো ছোট্ট পুকুরটার ঘাটে বসে আছে রাসু। হাত দিয়ে মাঝে মাঝে পানিটা নাড়ছে আর কী যেন দেখছে। একটা মোটাসোটা ঢিল কুড়িয়ে ছুঁড়ে মারল মালু। রাসুর সামনে গিয়েই ঢুপ করে পড়ল ঢিলটা। কয়েক ছিটা পানি উড়ে পড়ল রাসুর গায়ে। চমকে উঠে ঝুঁকে আর আশপাশে থুথু ছিটায় রাসু। এদিকে ওদিকে তাকায় ভীতু ভীতু চোখে। কোথাও কিছু নেই, তবে কী ভূতের ঢিল? ভূত নাকি এমনি করে ঢিল ছোঁড়ে। রাসু তাড়াতাড়ি শাড়ির আঁচলটা টেনে দেয় মাথার উপর। যেন বাতাস থেকে টুপ করে রাসুর পাশটিতেই ঝরে পড়ে মালু। বলে এত ভীতু তুই?

এবারও কেমন যেন গায়ে কাঁটা দেয় রাসুর। জিন-পরীর সাথে খাতির আছে নাকি মালুর? মুখটা উল্টাদিকে ঘুরিয়ে নেয় রাসু। হড় হড় করে বলে গেল মালু। একটু বাড়িয়ে বলল, এলাহি কাণ্ড হতে চলেছে তালতলি মহা ধুমধাম, রাসু কী দেখতে যাবে না? না। এমন ভাবে বলল রাসু, সত্যি সত্যি ঘাবড়ে যায় মালু।

কেন রে? রাসুর মুখটা ভালো করে দেখবার জন্য একটু ঝুঁকে আসে মালু কিন্তু ওর মুখটা দেখা যায় না। চোখে পড়ে ডোবার কালচে পানিতে প্রতিবিম্ব পড়ছে ওদের দুজনের, সেখানে রাসুর মুখটা কেমন ভার ভার। বেজার হয়েছিস? শুধাল মালু।

ইস বয়ে গেছে আমার ওনার উপর বেজার হতে। ফোঁস করে বলল রাসু, আর মুখটা সোজা ঘুরিয়ে আনল মালুর দিকে।

কেমন হকচকিয়ে যায় মালু। তাজ্জব হয়ে তাকায় রাসুর মুখের দিকে। স্বরটাই শুধু বাঁকা হয়নি রাসুর মুখের আদলটাও কেমন বদলে গেছে ওর। কখন? এতদিন তো চোখে পড়েনি মালুর?

একটুকরো ভাঙা পিঠে এখনো বুঝি পড়ে রয়েছে পকেটে। সেটা বের করে রাসুর হাতে গুঁজে দেয় মালু, নে খা। খালি খালি বেজার হয়েছিস তুই।

এতক্ষণে বুঝি হাসি আসে রাসুর মুখে। সে টুকরো পিঠেটাকেই ভেঙে দুটুকরো করে ও। একটা টুকরো গালে পুরে বাকীটা দেয় মালুকে।

একা একা বসেছিলি কেন? শুধায় মালু।

মাছ ধরব।

তবে নামছিস না কেন? চুলের গোছার ভেতর দিয়ে আচমকা হাতটা চালিয়ে দেয় মালু। ঘাড়টা ধরে ঠেলে দেয় সামনের দিকে। পড়তে পড়তে সামলে নেয় রাসু। একটা পা ওর পানিতে পড়ে যায়। আঁতকে পা-টা তুলে নেয় রাসু। চেঁচিয়ে ওঠে, জোঁক জোঁক!

প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মালুও পা-টা নামিয়ে দেয় পানিতে। ঝুঁকে পড়ে অনেকক্ষণ ধরে জোঁকের সন্ধান খোঁজে। কোথায় জোঁক। জোঁক নেই।

ঘাটটার শেষ ধাপ একটি নারকেল গাছের গুঁড়ি, তিরতিরে পানি তার গায়ে। সেদিকে আঙ্গুলে উঁচিয়ে বলল রাসু ওই যে ওখানে। খুঁটাটাকে জোরে জোরে নাড়া দিল মালু। নারকেল গুঁড়িটা একটু হেলে কেঁপে গেল। পা-টাকে সজোরে পানির উপর আছড়িয়ে আনল মালু। আবর্ত উঠল পানির গায়ে। ছলাৎ ছলাৎ লাফিয়ে উঠল পানি। এমন ঘুটুনী পেয়ে জোঁক বসে থাকতে পারে না, থাকলে নিশ্চয় বেরিয়ে আসত। পানিটা আবার স্থির হয়। জোঁকের নাম নিশানা নেই।

আয় নাম, জোঁক নেই, ডাক দেয় মালু।

সভয়ে এক ধাপ পিছিয়ে যায় রাসু বলে : নেই মানে, নিজ চোখে দেখলাম যে? ভাইজানের স্কুলের সময় হয়ে এল মাছ না নিলে তাঁর খাওয়া হবে কেমন করে? কিন্তু ওই জোঁকের জন্যই তো পানিতে নামতে পারছি না। সেই কখন থেকে বসে আছি।

পা-টাকে জোরে জোরে সামনে পেছনে চালিয়ে মালু আবার ঘুঁটিয়ে দেয় পানি। ঘোলা হয়ে যায় পানিটা। তন্ন তন্ন করে দেখে মালু।

না জোঁক নেই। আয় নেমে আয়। রাসুর কব্জিটা মুঠোয় পুরে একটা জোর টান দিল মালু।

ঘাটের উঁচু খুঁটিটা আঁকড়ে থাকে রাসু, ও কিছুতেই নামবে না পানিতে। ওর ডর দেখে সত্যি রাগ হয় মালুর। ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দেয় ওর গালে, এতই যদি জোঁকের ভয় তবে মাছ ধরতে আসিস কেন?

অতর্কিত চড় খেয়ে মুহূর্তের জন্য সরে যায় রাসু। চোখ ঠেলে বেরিয়ে পড়ে কান্না। দুহাতে চোখ কচলায় রাসু।

বুঝি হকচকিয়ে যায় মালু, হঠাৎ করে কেঁদে দেবে রাসু। ভাবতে পারেনি ও। তাড়াতাড়ি রাসুর হাত দুটো টেনে নামায়, ধরে রাখে নিজের হাতে। শুধায়, খুব লেগেছে নাকি রে?

ওর নরম গলাটা বুঝি আরো অসহ্য মনে হয় রাসুর। ফোঁস করে ওঠে ও আর মালুর হাতে আটকে থাকা ওর দুখানি হাতের মুঠো সজোরে ঠেলে দেয় সামনের দিকে। টাল সামলাতে না পেরে ঝুপ করে পানিতে পড়ে যায় মালু।

পাঁকের উপর সন্তর্পণে পা-টা টেনে চলে মালু। পুকুরটার কিনার ঘেঁষে দাম গজিয়েছে। দামের নিচে নিশ্চয়ই মাছ আছে। কিনার ধরে আস্তে আস্তে এগোয় মালু। হঠাৎ পায়ের নিচে সির সির করে ওঠে। পা-টাকে নরম কাদার ভেতর সোজা গেড়ে দেয় মালু। পালাবার ফুরসত পায় না মাছটা। তুলে দেখে মাঝারি গোছের একটা টাঁকি। ছুঁড়ে দেয় পারের দিকে।

কী যে লাফাতে পারে টাকিগুলো। শুকনো মাটি যে ফোঁসকা ফেলে ওদের গায়ে, গাটা মাটিতে লাগতে না লাগতেই তিড়িং তিড়িং লাফিয়ে চলবে। রীতিমতো বেগ পেতে হয় রাসুর মাছটাকে জুত করে ধরে ডুলোয় পুরতে।

দামের নিচে হাত চালিয়েই বুঝতে পারে মালু অনেকগুলো খোড়ল সেখানে। পায়ের আগা দিয়ে প্রথম খোড়লের মুখটা একটু আলগাভাবে পরীক্ষা করে দেখল ও। ছোট্ট, সরু আর তেরছা খোড়লের মুখটা, হয় সাপের, নতুবা সিঙ্গী মাগুরের। আস্তে করে নিঃশব্দে বসে পড়ে মালু শুধু নাকটাকে ভাসিয়ে রাখে পানির উপর। না, সাপও নয়, সিঙ্গী-মাগুরও নয়, একজোড়া কই মাছ। স্পর্শ পেয়েই কানের আর পিঠের কাঁটাগুলো খাড়া করে দৌড় মেরেছে মাছ-গুলো। আর সেই কাঁটার উপরই চেপে বসে যায় মালুর হাতের তালু। বিষিয়ে ওঠে হাত, তবু মুঠিটা ছাড়ে না মালু, তুলে আনে পানির উপর ছুঁড়ে দেয় রাসুর দিকে।

ভারি পোক্ত কই। পিঠ যেমন তেলতেলে কালো তেমনি সোনালী লাল পেট। খুশি হয়ে ওঠে রাসু, চেঁচিয়ে বলে এগুলো আমি কুটতে দিয়ে আসি। এই যাচ্ছি আর আসছি।

ডুলাটা লয়ে রাসু দৌড়ে চলে যায় বাড়ির দিকে।

বাকী খোড়লগুলো পরিত্যক্ত, মাছ নেই সেখানে। এবার মালু মাঝ পুকুরের কাঁটা ঝোঁপটার দিকে এগিয়ে যায়। বড় মাছ যত সবই ওই ঝোঁপের তলায় কিন্তু সেখানে পানি বড্ড বেশি। ঠাঁই পাবে না মালু। আর ডুব দিয়ে বড় মাছ কী ধরতে পারবে ও, ওই তালতলির জেলেপাড়ার ছেলেদের মতো?

কিন্তু অতদূর যেতে হয় না ওকে। পায়ের নিচে আর একটা বড় গোছের টাকি সির সির করে বেরিয়ে যায়, ওর জোড়াটা নিশ্চয় আছে ধারে-কাছে। খুঁজতে থাকে মালু। হঠাৎ একটা চিংড়ি ঠাস করে ওর পায়ে বাড়ি মেরেই এক লাফে সটকে পড়ে।

দাঁড়িয়ে যায় মালু। একটু যাতে শব্দ না হয়, আলোড়ন না জাগে পানিতে তেমনি সতর্কতায় ধীরে ধীরে পা-টা ঘুরিয়ে আনে কাদার উপর দিয়ে। আর দুহাত পানির উপর রেখে এক-পায়ে শক্ত হয়ে থাকে ওর শরীরটা। এমনি করে কাদার উপর পা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বুঝি অনেকক্ষণ চলে যায়। উঠেই আসছিল মালু হঠাৎ পায়ের নিচে একটু খরখরে শক্ত মতো কী যেন বাধল। হুঁ বুঝতে পেরেছে মালু। টুপ করে ডুব দেয় ও। দুহাতে চেপে ধরে শক্ত বস্তুটাকে। তারপর দমটা ছেড়ে দেয়, আপনি আপনিই ভেসে ওঠে ওর শরীরটা। ইতিমধ্যে শক্ত বস্তুটা বের করে দিয়েছে ওর সাঁড়াসির মতো লম্বা ঠ্যাং যে ঠ্যাংয়ের তীক্ষ্ণ নখ অংকুশের মতো বিঁধে গেছে মালুর হাতের চামড়ায়। উহ্ কী অসহ্য কামড়! গায়ের গোশত বুঝি তুলে নিয়ে গেল। তারপর হঠাৎ কামড়টা ছেড়ে দিয়ে মাছটা লেজ আর মাথা এক করে ঝপাং ঝপাং ঝাপটা মারতে থাকে। পানি কেটে সেই লেজের ঝাপটা কোনো কাঁটা পরা হাতের চড়ের মতো ঠাস ঠাস করে এসে বাজছে মালুর হাতের পিঠে। বুঝি একেবারে ঝাঁঝরা করে দিল ওর হাতের চাম। পানির উপর তুলে মালু তো অবাক, ইয়া বড় চিংড়ি। এত বড় চিংড়ি অনেকদিন দেখেনি ও। পানির ভেতর সব মাছেরই জোর থাকে, তাই বলে এত বড় মাছ কল্পনাও করতে পারেনি ও। ও মা, কত বড়, কত বড় চিংড়ি, খুশিতে পায়ের উপর যেন নেচে ওঠে রাসু। ছুঁড়বি না, ছুঁড়বি না–উঠে আয়, রাসু চেঁচায়।

দু-হাতে ঠ্যাং সুদ্ধ চিংড়িটা যেতে ধরে উঠে আসে মালু। ঠিকই বলেছে রাসু অত বড় চিংড়িটাকে ছুঁড়ে পাড় অবধি হয়ত পাঠাতে পারত না মালু। ডুলার মাঝে ধরে না চিংড়িটা। তিন গিঁটের প্রায় দেড় হাত লম্বা ঠ্যাং সে ঠ্যাংয়ের মুখে শলার মতো তীক্ষ্ণ লম্বা নখ, সাহস পায় না রাসু ওটাকে হাতে ধরতে। শক্ত মতো একটা মাটির ঢেলা কুড়িয়ে নেয় মালু, ঢেলার বাড়ি মেরে মাছটার নখের আগাগুলো ভোতা করে দেয়, বলে, যা, নিয়ে যা।

দৌড়ে চলে যায় রাসু।

ও-রকম সুন্দর আর দুর্লভ চিংড়িটা ধরতে পেরেও কেন যেন খুশির খোঁজ পায় না মালু। কেমন যেন হয়ে গেছে রাসুটা। মক্তবে যায় না, সেও বুঝি মাসের উপর হয়ে গেল। এদিকে আবার শাড়ি ধরেছে। কী বিশ্রী দেখায় ওকে শাড়িতে। না পারে সামলাতে, না পারে গুছিয়ে পরতে। তার উপর যেতে চায় না তালতলিতে। এই তো সেদিন ভট্টচায্যি বাবুদের বাড়িতে কী একটা পূজো ছিলো। ওরা দুজনই গিয়েছিল। পেট পুরে পেসাদ খেয়েছিল। আর আজ বলে কিনা যাবে না? কী হল রাসুর? ভেবে কোনো কিনারা পায় না মালু।

একটা কলা গাছের আড়ালে মালু। এদিক-ওদিক তাকিয়ে চট করে খুলে ফেলে ভেজা হাফ প্যান্টটা। ভালো করে চিপে নিংড়িয়ে পানিটা ঝরিয়ে দেয়, আবার পরে নেয় প্যান্টটা। গেঞ্জিটা চিপে বিছিয়ে রাখে পিঠের উপর। তার পর আগের জায়গাটিতে এসে বসে পড়ে। ভেজা প্যান্টের কুঞ্চনগুলো টেনে টেনে ঠিক করে আর ভাবে এত মোটা কাপড় প্যান্টের, তালতলি যেতে যেতে শুকালে হয়। কাঁধের উপর স্পর্শ পেয়ে ঘাড় ফেরায় মালু। দুষ্টু হাসি রাসুর মুখে।

তুই রেগেছিস? শুধাল রাসু।

যাহ্ মুখটা ঈষৎ বেঁকিয়ে বুঝি আগের ভাবনাটায় মন দেয় মালু। হাসিটাও কেমন বদলে গেছে রাসুর। এইমাত্র যে হাসল, সে কী রাসু?

মক্তবে যাস না কেন? ওর দিকে না তাকিয়েই শুধাল মালু।

বুঝি গম্ভীর হয়ে যায় রাসু। কী যেন ভাবে। আপনিই যেন নত হয়ে আসে ওর মুখখানি, কেমন ধীর টানে বলল, বড় হয়েছি না?

সহসা সব কিছু স্পষ্ট হয়ে গেল মালুর কাছে। রাবুদের মতো রাসুরও পর্দার সময় হয়েছে। তাই মক্তবে যায় না। শাড়ি ধরেছে। তালতলি যাবে না। অকস্মাৎ মনে হয় মালুর, অনেক দূরে সরে গেছে রাসু, পর হয়ে গেছে রাসু। আজ তবু চেনা যায় ওকে, আসছে কাল হয়ত চেনাই যাবে না। কিন্তু মালু? সেও তো বড় হচ্ছে। কই ওর তো এমনি করে বদলে যাওয়ার কথাটা মনে হয় না? মালু তাকায় রাসুর দিকে, সত্যি বড় হয়ে গেছে রাসু, শাড়ি পরে অনেক বড় দেখাচ্ছে ওকে।

তা হলে তো বিয়ে হবে এবার! ফস করে মালুর মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায় কথাটা।

রাঙা হয়ে ওঠে রাসুর মুখ। চুপ করে মালুর পিঠে একটা কিল মেরে উঠে যায়, দৌড় দেয় বাড়ির দিকে। দৌড়াতে দৌড়াতে একটু থামে, পেছন ফিরে বলে : কাল আসিস, ওই কুল গাছটার তলায়। চুপি চুপি আসবি, কেউ যেন না দেখে।

রাসুর সাথে দেখা করতে হবে গোপনে? সব যেন গুলিয়ে যায় মালুর। গেঞ্জিটা কাঁধে চড়িয়ে উঠে পড়ে মালু। মিঞাদের মসজিদের সুমুখ দিয়ে দক্ষিণ ক্ষেতে পড়ে। দখিন ক্ষেতের দিকে তাকিয়ে ওর মনে হল কেমন ঝাপসা সব কিছু, ও যেন স্পষ্ট দেখছে না কিছুই। কখন পানিতে ভরে গেছে ওর চোখ জোড়া।

কান্নাটা মালুর কাছে অতি সহজ আর মামুলি। মায়ের মার খেয়ে অহোরাত্র গলা ফাটিয়ে কাঁদতে হয় ওকে। কিন্তু আজকের কান্নাটা যেন কেমন, নিজেই বুঝতে পারে না মালু। আরও অদ্ভুত, আজকের কান্নায় দুঃখ নেই। কী যেন কথা, ও বলতে পারে না, বুঝতেও পারে না স্পষ্ট করে, সে সব কথাই যেন চোখের পানি হয়ে ঝরে পড়ছে। আর কেমন আরাম পাচ্ছে মালু।

০৭.

বাকুলিয়া আর তালতলি। পাশাপাশি দুটো গ্রাম।

দু গ্রামকে ফারাক করে রেখেছে বিস্তীর্ণ এক শস্যক্ষেত। পাশ তার পোয়া মাইল। লম্বায় মাইলেরও উপর। বাকুলিয়ার দক্ষিণে, তাই ক্ষেতটার নাম দখিন ক্ষেত। আর তালতলির মানুষরা বলে উত্তুরের ক্ষেত।

বাকুলিয়ার প্রবেশ পথে সৈয়দ বাড়ির সদর ফটক আর বেরুবার পথে মিঞা বাড়ির মসজিদ। দুটো খানদানী বাড়ি। দুই প্রহরীর মতো গোটা গ্রামটিকে যেন হাতের বেষ্টনে ধরে রেখেছে। মিঞা বাড়ির মসজিদের লাগ বড় পুকুরটার সীমানা থেকে শুরু হয়েছে দখিনের ক্ষেত। ক্ষেতের ওপারে তালতলির দত্তদীঘির দীর্ঘ তাল বীথি, তালতলির প্রবেশ তোরণ।

সোনার চেয়েও দামী পূর্ব বঙ্গের মাটি। কাঁড়ি কাঁড়ি সোনা ফলে এ মাটিতে। পুস্তক-কিতাবের লেখা নয়, দখিন ক্ষেতে যারা লাঙ্গল চালায় তারাই জানে কত উর্বর সোনা-ফলা এ মাটি। বছরে ধানী ফসল উঠে দুটো, চৈতী ফসল উঠে এন্তার। কখনো খালি পড়ে থাকে না এ জমি। কখনো ধান, কখনো সরিষা, মুগ, কলাই, খেসারি, গুচ্ছ গুচ্ছ হলুদ আর সবুজ বুকে নিয়ে সন্তানবতী নারীর পুষ্ট বক্ষের মতো ভরে থাকে দখিনের ক্ষেত।

দখিন ক্ষেতের বুক চিরে চলে গেছে বড় খাল, তালতলিকে বেড় দিয়ে বারগনিয়া চাটখিলের দিক। তার পর সুলতানপুর, উদরাজপুর গ্রামগুলোকে চক্রাচারে ঘুরে গিয়ে পড়েছে মেঘনায়। এই বড় খালটায় এসে মিশেছে তালতলি বাকুলিয়ার গাঙ, ছোট ছোট খাল আর অজস্র নালা।

বিরাট বটের অসংখ্য শিকড় যেমন এঁকেবেঁকে মাটির ভেতর ছড়িয়ে যায়, মাটির সাথে অচ্ছেদ্য বন্ধনে ধরে রাখে বিশাল মহীরুহকে, রস সিঞ্চন করে প্রতিনিয়ত, তেমনি ওই গাঙ আর ছোট ছোট খালগুলো তালতলি বাকুলিয়াকে ধরে রেখেছে অসংখ্য বাহুর আলিঙ্গনে। রস ভরে যায় তালতলি বাকুলিয়ার মাটি, বৃষ্টি বন্যার পানি আর আবর্জনা বয়ে নিয়ে অটুট রাখে দু গ্রামের স্বাস্থ্যশ্রী। আর বর্ষার মরসুমে, শীতের শুরুতে মাছ দেয় অঢেল। পুকুর পাড়ের গাব গাছটির নিচে দাঁড়িয়ে। নির্নিমেষ চেয়ে থাকে ফেলু মিঞা। দৃষ্টি তার প্রসারিত দক্ষিণের ক্ষেতে। পুকুরটির পূর্ব পাড় থেকে একটা সরু রাস্তা এঁকেবেঁকে গিয়ে উঠেছে তালতলির তালবীথি ছায়া পথে। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ফেলু মিঞা ধীরে ধীরে নেমে আসে রাস্তাটায়। হাত জোড়া পেছনে কোমরের উপর কেঁচির মতো আড়াআড়ি রেখে আনত মুখে হেঁটে চলে।

কিছুদূর এগিয়ে ফেলু মিঞা উদাস চোখে তাকায় সামনের দিকে, যেখানে একটি রূপোর সুতোর মতো চিকচিক করছে বড় খাল। ওই খালের এপার-ওপার একদা সবটাই ছিল মিঞাদের সম্পত্তি। তালতলি, চাটখিল, সুলতানপুর এসব গ্রাম ছিল মিঞাদেরই জমিদারীর অংশ। কিন্তু কর্ণওয়ালিসের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সময় কেমন করে যে জমিদারীটা বেহাত হয়ে যায়, সে ইতিবৃত্ত এখনো উদ্ধার করতে পারেনি ফেলু মিঞা। শুধু শুনেছিল প্রাচীন সম্পত্তি পুনর্বার বন্দোবস্ত নেবার মতো নগদ টাকা নাকি ছিল না তাদের দুর্ভাগা পূর্বপুরুষদের হাতে। ছিল না তেজারতী কারবারে নগদ অর্থের অধিকারী কোনো হিন্দু বেনিয়ার সাথে প্রতিযোগিতার রৌপ্যশক্তি। তাই ত্রিপুরার মহারাজার অধীন কয়েকটা পত্তনী আর বন্দোবস্ত নিয়েই তুষ্ট থাকতে হয়েছিল সেই অভাগা পূর্ব পুরুষদের। পরে সেই পত্তনী বন্দোবস্তগুলোও একের পর এক হাতছাড়া হয়েছে। 

খালের ধারটিতে পৌঁছে ফেলু মিঞা একবার পেছন ফিরে তাকায়, তাদের পুকুরের সেই গাব গাছটিকে ছোট একটা ঝোঁপের মতো দেখায় এখান থেকে। এই তো সেদিনও আব্বাজান বড়ো মিঞার আমলে খালের এপারে ভূঁইগুলো ছিল তাদেরই তালুকভুক্ত, কিছু ছিল খাস দখলি। একনাগাড়ে দশ বছর ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্টগিরি করে গেছেন আব্বাজান বড়ো মিঞা। কী তার প্রতাপ! কত তাঁর রব-রোয়াব! জমিদার না হয়েও ক্ষমতা রাখতেন জমিদারের মতো। আর আজ? দখিন ক্ষেতের ষোল আনার দুই আনাও মিঞাদের হাতে আছে কিনা সঠিক করে বলতে পারে না ফেলু মিঞা। তালুক পত্তনী, ওসব দিয়ে কী হব? ছেলেরা বিদ্বান হোক, মানুষ হোক বলতেন বড় মিঞা। আর একটার পর একটা তালুক বেচে গিয়েছেন ছেলেদের শহুরে জীবনধারার অন্তহীন চাহিদা মেটাতে।

সাঁকোর উপর পা রেখে আর একবার পেছনের দিকে তাকায় ফেলু মিঞা। আলঘেরা ক্ষেতের পর ক্ষেত। এসব খালের এপার-ওপার সবটাই, সবটাই কত পুরুষের সম্পত্তি মিঞাদের! ওই তো ডান দিকে তিন নম্বর তালুকের সীমানা, যে তালুকটা আব্বাজান বড় মিঞা বেচে গিয়েছিলেন রামদয়ালকে। বাঁয়ে সাত নম্বর। ওটা তামাদী হয়েছিল। রামদয়ালই নীলাম ডেকেছিল। আর সুমুখেরটা মৌজা সুলতানপুরের চৌদ্দ নম্বর তৌজি, ধড়িবাজ রামদয়াল লাহা স্টেটের নায়েবকে ঘুষ দিয়ে আট হাজার টাকার সম্পত্তিটা স্রেফ দু হাজারেই গাপ করেছে। সাদাসিধে আর সাফ দিলের মানুষ আব্বাজান বড় মিঞা, টেরই পেলেন না কেমন করে রাতারাতি বেহাত হয়ে গেল সম্পত্তিটা। সব, গোটা দখিন ক্ষেতটাই এখন ওই মালাউনের বাচ্চা রাম-দয়ালের পেটে। অনুপস্থিত সেই রামদয়ালের উদ্দেশেই যেন একবার কটমটিয়ে তাকাল ফেলু মিঞা। সঙ্গে সঙ্গেই রাগটা ঘুরে গিয়ে পড়ল শহরবাসীর নাফরমান ভাইগুলোর উপর।

তিন তিনটি ভালো তালুক বেচা পয়সায় মানুষ হল, অথচ একটি পয়সা যদি দেয় দেশের বাড়িতে। যদি একটু সাহায্য করত ওরা, বেশি না তিরিশটি করে তিন ভাই মিলে যদি নব্বইটি টাকা পাঠাত দেশে, তা হলে… তা হলে দেখিয়ে দিত সে যে মিঞার বেটা ফেলু মিঞা। বুদ্ধি আর টাকার খেলে ঘোল খাইয়ে ছাড়ত ওই রামদয়ালকে। অন্তত তিন নম্বর আর সাত নম্বর তালুকটা যে উদ্ধার করতে পারত রামদয়ালের খপ্পর থেকে এতে এতটুকু সন্দেহ নেই ফেলু মিঞার।

এসে পড়েছে তালতলি। দত্তদীঘির পাড়ের মানুষগুলোকে চেনা যাচ্ছে। তালদীঘির ওপার থেকে উঁকি দিচ্ছে রামদয়ালের দোতলা দালান। ওই দালানটার উপর নজর পড়তেই যেন বিছুটির বিষে সারা গাটা জ্বলে গেল ফেলু মিঞার। আর ওর গলা দিয়ে বেরিয়ে আসে অভিসম্পাত, ধিক্কার-অপদার্থ পূর্বপুরুষদের প্রতি। যদি থাকত তাঁদের এতটুকু দূরদৃষ্টি, এই হাল হত মিঞা বাড়ির? মরহুম আব্বাজান বড় মিঞা, (আত্মার তাঁর মাগফেরাত হোক, ) তাঁকেও ক্ষমা করতে পারে না ফেলু মিঞা। সব গিয়ে-টিয়ে সায়-সম্মানে বাঁচার মতো যাও ছিল সে সবও বেচে বিলিয়ে একেবারে ফতুর করে গেছেন মিঞা বাড়িটাকে। আঃ আব্বাজান।

সেই আট বছর বয়সে দেখা ছবিটা এখনো ভেসে ওঠে ফেলু মিঞার চোখের সুমুখে। শুভ্র শ্মশ্রু কেশ সৌম্য-দর্শন সুপুরুষ সে বছরই কনিষ্ঠ সন্তান ফেলু মিঞার মাথায় আশীর্বাদের হাতটা রেখে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন বাকুলিয়ার বড় মিঞা। শেষ বয়সে কী যে ভীমরতি ধরেছিল আব্বাজানের, ওই শালা মালাউনের পাল্লায় পড়ে গেলেন খেলাফতে স্বদেশিতে, জেল খাটলেন দুই দুইবার। জেলেই তো ভাঙলো শরীরটা। আর ওই সুদখোর রামদয়ালটা সেই ফাঁকেই তো বেহাত করে নিল মোটা মোটা সম্পত্তিগুলো। আর বড় মিঞার সেই অপরিণামদর্শিতার ফলটা ভুগতে হচ্ছে আজ ফেলু মিঞাকে, মিঞার মতো বাঁচার সামর্থ্য নেই তার।

কী বোকামিই না করে গেছেন আব্বাজান! সাহেব বানিয়ে গেছেন ছেলে গুলোকে। সাহেব না হাতী, ইংরেজের নফরদারী। একজন করেন ডেপুটিগিরি, একজন কলেজের মাস্টার, সেজো জন বিলেতী কোম্পানীর ক্যাশিয়ার। ফুস, মুনিবের পা-ই যদি চাটবি, ইংরেজের নফরদারীই যদি করবি তবে কেন মিঞার ঘরে জন্মেছিস?

আর গোলামী করে করে কেমন ছোট হয়ে গেছে ওদের নজরটা। বছর পাঁচ আগের কথা। ফেলু মিঞা গেছিল বড় ভাই ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের কোলকাতার বাড়িতে। অনেক কাকুতি-মিনতি করে, অনেক ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে চেয়েছিল, বেশি না, মোটে হাজার দুই টাকা। শুনে তো আঁতকেই উঠেছিল বড় ভাই। বলেছিল, কোথায় পাব অত টাকা? কী করবি, তুই টাকা দিয়ে?

আগরতলার মহারাজা কিছু জমিদারী স্বত্বের বন্দোবস্ত দিচ্ছে। তা লাগবে তো অনেক টাকা। কিন্তু তার আগেই যে কিছু টাকা ঢালতে হবে মহারাজার কাচারিতে। নায়ের মশায়ের সাথে সে সব বন্দোবস্ত না করেই কী শহর অবধি ছুটে এসেছে ফেলু মিঞা? সব বন্দোবস্ত পাকা। শুধু হাজার আটেক টাকা কাচারীর ডালিডুলি নজরানায় খরচা হবে। স্বত্বটা লেখা হয়ে যাবে ফেলু মিঞার নামে, অথবা ওদের চার ভাইয়ের নামে। ব্যস। বাকী টাকা সে পঞ্চাশ হাজারই হোক আর লাখই হোক সে জন্য পরোয়া করে না ফেলু মিঞা। একবার জমিদারী স্বত্বটা পেয়ে গেলেই কিস্তি কিস্তি টাকা দেবে, কিছু এধার-ওধার করবে। কত খুঁটির খেল, কত ফাঁকফুকর এ সব কাজে সে কী আর জানেন না ফেলু মিঞা?

তা আট হাজার টাকার সবটাই তো আর ভাইদের কাছে চাইছে না ফেলু মিঞা! বড় মিঞা দুহাজার মেজো মিঞা এক সেজো মিঞা এক–মোট চার হাজার। বাকী চার হাজার ফেলু মিঞাই চালিয়ে নেবে। একি খুব বেশি চাওয়া হচ্ছে, মিঞা বাড়ির ইজ্জত হুরমতের নিশান বরদার বড় মিঞার বংশধরদের কাছে?

সব শুনে অট্টহাসিতে ভেঙে পড়েছিল মিঞা বাড়ির বড় মিঞা হালে ইংরেজ কাচারীর হাকিম। হাসি থামিয়ে বলেছিল : ওসব ফাজলামো রেখে জমিজমা কিছু বিক্রি করে চলে আয় কোলকাতায়। একটা দোকান করে দেব তোকে। সেই দোকান নাড়াচাড়া করতে করতে চাই কী একদিন মস্ত বড় ব্যবসায়ী বনে যাবি।

শুনে লজ্জায় অধোবদন হয়েছিল ফেলু মিঞা, এই কী মিঞা বাড়ির জ্যেষ্ঠ সন্তানের কথা? শেষ পর্যন্ত মিঞা বাড়ির ছেলে দোকানদার হবে? ছিঃ ছিঃ। কোত্থেকে একটা রাগের হলকা এসে যেন ঝলসে দিয়েছিল ফেলু মিঞার গোটা শরীরটা। মুখ তুলে বড় ভাইয়ের চোখে চোখ রেখে বিনীত কিন্তু দৃঢ় কণ্ঠে বলেছিল ফেলু মিঞা : ভাই সাহেব। বেয়াদবী মাফ করবেন। আপনার কথা শুনে মিঞা বংশের স্বর্গীয় আত্মারা পর্যন্ত দুঃখ-বেদনায়-লজ্জায় মুখ ঢাকছে। থাক, আমি আর কথা বাড়াব না। নফরদারীর মর্যাদা নিয়ে শহরে সুখে-স্বচ্ছন্দেই বসবাস করুন আপনারা, বাড়ির লুপ্ত গৌরব এই ফেলু মিঞা একাই পুনরুদ্ধার করবে। যদি বেঁচে থাকেন ইনশাল্লাহ দেখবেন।

কথাগুলো মনে পড়ায় অদ্ভুত একটা রোমাঞ্চের কম্পন অনুভব করল ফেলু মিঞা। মনে হয় মাথার চুলগুলো তার দাঁড়িয়ে পড়েছে আর এক ঝলক গরম রক্ত পা থেকে মাথা পর্যন্ত তীব্র বেগে দৌড়ে গেল।

স্কুলের নয়টা ধাপ পেরিয়ে দশমটাতে পৌঁছাতে পারেনি ফেলু মিঞা।

তবু সেদিন কেমন করে ওই কথাগুলো গুছিয়ে-গাছিয়ে বলেছিল ভাবতে গেলে আজও তাজ্জব বনে যায় ফেলু মিঞা। অবশ্য বড় ভাই ঠাট্টা করে সেদিনও বলেছিল আজও বলেন, আমাদের ফেলু চটে গেলে কেমন চোস্থ বাংলা বলে দেখেছিস? এর সাথেই ফোড়ন কেটেছিলেন মেজো মিঞা, হুঁ ঠিক যেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। নো, নো, বিদ্যাসাগরের আলহজ্ব এডিশন, ক্যাশিয়ার ভাই গলা বাড়িয়ে যোগ করেছিলেন। তারপর ফেলু মিঞার বুকের তাজা ঘায়ে বস্তা বস্তা লবণ ছিটিয়ে তিন ভাই হো হো করে হেসেছিল। পাঁচ বছর আগে কত বড় মুখ করে কথাগুলো বলে এসেছিল ও। এই পাঁচ বছরে সেই হৃতগৌরব পুনরুদ্ধারের সংকল্প কতদূর এগিয়েছে ফেলু মিঞা? শাঁ করে কোত্থেকে যেন তীরের মতো ছুটে আসে প্রশ্নটা, এফোঁড় ওফোঁড় করে যেন দু ভাগে কেটে দিয়ে যায় ফেলু মিঞার বুকের ভেতরটা। হ্যাঁ হ্যাঁ। আশানুরূপ না হলেও কিছুদূর, অনেকদূর, এগিয়েছে বই কী ফেলু মিঞা। আজকের এই দিনটি সেই অগ্রগতিরই এক ফলক-চিহ্ন হয়ে থাকবে। তাই তো মনে করছে, আশা করছে ফেলু মিঞা। বাকী খোদার মর্জি। মনে মনে সেই সর্বশক্তিমানের উদ্দেশে মাথা নত করল ফেলু মিঞা আর দত্তদীঘির উঁচু পাড়ে পা রাখবার আগে যেন পিছুটান খেয়েই মুখটা আবার ঘুরিয়ে নিল দখিন ক্ষেতের দিকে। দখিনের ক্ষেত, এখন সেটা উত্তরের ক্ষেত কাঁচা-পাকা শস্যে অথবা উদলা বুকে সবুজ-হলুদ আর মাটি রংয়ে চিহ্নিত দেহটি এলিয়ে দিয়ে রোদ পোহাচ্ছে। কী এক নিগূঢ় হাতছানি সেখানে, যেন ডাকছে ফেলু মিঞাকে, বলছে তার জাদুভরা কণ্ঠে-আমার এ সম্ভার, সবই তোমার, সবই তোমার। কেন যেন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলু মিঞার বুক চিরে কেঁপে কেঁপে বেরিয়ে আসে। দত্তদের বৈঠকখানার দিকে দ্রুত পা চালায় ফেলু মিঞা।

আরে আসেন আসেন। মিঞার বেটার পায়ের ধূলো আমার বাড়ি? কী সৌভাগ্য! দু কদম এগিয়ে এসে অভ্যর্থনা করে রামদয়াল।

প্রতি আদাব দিয়ে চেয়ারে গিয়ে বসে ফেলু মিঞা। কিন্তু ভেতরটা তার জ্বলতেই থাকে, মিঞারা কোনোদিন ভুলেও পা ফেলেনি দত্তবাড়ি আর আজ ফেলু মিঞা যেচে এসেছে। ফেলু মিঞা সেই খোঁটাটাই খুঁজে পেল রাম দয়ালের অভ্যর্থনায়।

রমজান আগেই এসেছিল ফেলু মিঞার আগমন বার্তা নিয়ে। তাই ডাবের পানি, চা-বিস্কুট প্রস্তুত রেখে অপেক্ষা করছিল রামদয়াল। ডাবের পানিটা নিঃশেষ করে আলবোলার নলটা টেনে নেয় ফেলু মিঞা। এ তার নিজস্ব আলবোলা। একমাত্র আত্মীয় বাড়ি ছাড়া যখন যেখানে যায় হুঁকোটাও সঙ্গে যায় ফেলু মিঞার। কখনো বা তার আগেই এসে পড়ে হুঁকোটা। এটা মিঞা আভিজাত্যের প্রাচীন রেওয়াজ।

মুসলমান ডাবায় নিজের জন্য তামাক সাজাতে সাজাতে কথাটা পাড়ে রমজান–দয়াল মশায় তালুক তো আপনার অনেক, একখানা আমাদের দিন। ভনিতা ব্যাখ্যা পূর্বাহ্নেই সারা। ভাবার যা সে আগেই ভেবে নিয়েছে রামদয়াল, বলল : সাত নম্বর তো? দশ হাজার।

আলবোলার নলটা বুঝি মুখ থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসে ফেলু মিঞার। নিজের কানটাকেও যেন বিশ্বাস হয় না তার। তিন হাজার টাকায় যে তালুক নিলাম ধরেছে রামদয়াল, পনেরো বছর ভোগ করেও তার দাম হাঁকছে দশ হাজার?

বহুত বেশি চাচ্ছেন, কিছু কমিয়ে দিন, ডাবটা মুখের কাছে এনে বলল রমজান।

একটু যেন ভাবল রামদয়াল। বুঝি ভেবে-চিন্তেই বলল : ফেলু মিঞার সামনেই বললেন আপনি। না করতে পারি? আচ্ছা নয় হাজারই দিন।

আকাশ-পাতাল ভাবনা সুঁই চালায় ফেলু মিঞার মগজে। ধান বেচে চাকলা রোশনাবানের যে তিনটি তালুক এখনো হাত ছাড়া হয়নি সেখানকার প্রজাদের এক রকম জোর-জুলুম করে বাকী বকেয়া আদায় করে হাজার সাতেক টাকা জোগাড় করেছে ফেলু মিঞা। অভ্যস্ত আরামগুলোকে হারাম করে, রুহটাকে নিষ্ঠুরভাবে বঞ্চিত করেই টাকাটা জমিয়েছে ফেলু মিঞা। এর বেশি এক আধলাও আর সংগ্রহ করা সম্ভব নয়। রামদয়ালের সাথে দরদস্তুর করতে ফেলু মিঞার মর্যাদায় বাধল, সংক্ষেপে বলল, ভেবে দেখি। উঠি উঠি করেও এক কথায় দু কথায় আলাপ জমে যায়। তালুক পত্তনিতে কী আর সে সুখ আছে? বাড়ি বাড়ি ট্যা ট্যা করুন, তাগিদ দিতে দিতে মাথাটা ঝালাপালা করুন, পায়ে ফোস্কা ফেলুন, তবু কী পাবেন খাজনা? ওই যে আপনাদের গ্রামের রসুন আলির পোলা ফরজ আলি, কত করে বললাম, দে বাবা, চার বছরের বাকী অন্তত দু বছরেরটা উসুল দিয়ে রাখ, তা কী বলে শুনবেন? বলে, ঘ্যানর ঘ্যানর করবেন না দয়াল মশায়। হাকিম আছে, আদালত আছে, নালিশ করুন গিয়ে। থেমে একটা বিড়ি ধরায় রামদয়াল। বলল আবার–থুক মারেন তালুকের কপালে। তালুক না গলায় ফাঁস।

সেই দিন কী আর আছে দয়াল মশায়? হুঁ জমিদারী তালুকদারী, সে এক সময় মিঞারা চালিয়েছে বটে দেখেছি। পেয়াদা পাঠিয়েছে, বেঁধে এনেছে। চোখ একবার তুলেছে, কী চাবকিয়ে শেষ করেছে। ছোট লোকের জাত, পিঠ যে তাদের হামেশাই সুড়সুড় করে চাবুকের জন্য। সে তো আপনারা বুঝবেনও না, শাসনটাও ছেড়ে দিয়েছেন আজকাল। রামদয়ালের কথাটাকে আর একটু টেনে বলল রমজান।

ফেলু মিঞা সাহেব, তার চেয়ে এক কাজ করুন আপনি। কিছু জমি কিনে নিন, ট্রাক্টর এনে ভালো করে চাষ করুন। ধান পাট গেণ্ডারী সব ফসলেরই দর আছে আজকাল। আর যা অবস্থা তাতে তো মনে হচ্ছে যুদ্ধ একটা লাগবেই। তা হলে তো কথাই নেই, ধান চাল মানেই কাঁচা সোনা, টাকা রাখবার জায়গা পাবেন না তখন। পরামর্শ দেয় রামদয়াল। হিসেবী লোক রামদয়াল। তালুক জোত আর কম নয়। কিন্তু মহাজনী তেজারতিটাই আসল পেশা, পূর্বপুরুষদের পেশাও বটে। তা ছাড়া দত্তের বাজারে অর্ধেক শরীক, দোকান, মহকুমা শহরে ধান-চাল-মশলার পাইকারী কারবার। ওতেই টাকা ঢালে রামদয়াল। ওতেই মুনাফা অঢেল নগদানগদি। ইতিমধ্যে সম্ভাব্য যুদ্ধের হিসাবটাও করে ফেলেছে রামদয়াল।

মুখটা লাল হয়ে ওঠে ফেলু মিঞার। রামদয়াল ওকে চাষ করতে বলছে? বেটা সুদখোর মালাউন মিঞার ছেলেকে চাষা বানাতে চায়? হারামখোরিতে পয়সা বানিয়ে এত স্পর্ধা হয়েছে ব্যাটার?

আর একটু তামাক টানতে ইচ্ছে করে ফেলু মিঞার। সামনের দরজা দিয়ে একটা ছেলেকে যেতে দেখে বলে, এই-এই ছেলেটা। নাম কী না ওর! দে তো একটু তামাক সাজিয়ে।

আনমনে চলছিল মালু। হাত দুটো গোঁজা হাফ প্যান্টের পকেটে। রমজানের উপর মনটা তার কোনোদিনই প্রসন্ন নয়। হুরমতিকে ছেঁকা দেয়ার পর থেকে ফেলু মিঞার উপর মালু বিরক্ত। আড়চোখে একবার দেখল মালু। বুঝল তাকেই তামাক সাজতে ডেকেছে ফেলু মিঞা। মিনিট খানিক বুঝি নীরবে তাকিয়ে রইল। তার পর বলল–আমি কী চাকর নাকি?

শুনলেন তো, শুনলেন তো বান্দির পুতের কথা? তিন লাফে বেরিয়ে আসে রমজান।

থতমত খেয়ে যায় মালু। হাত দুটো এখনো প্যান্টের পকেটে আটক। পকেট ভর্তি মিত্তির বাড়ির আমলকি। কতটা হবে তাই পকেটে হাত রেখে গোপনে গুনে গুনে দেখছিল ও। রমজান প্রায় এসে পড়েছে, এখুনি বুঝি ধরে ফেলবে ওকে। মালু দেখল দৌড়ে পালাবার উপায় নেই। কোনো দিকে দেখবারও অবসর নেই। তর তর করে উঠে গেল ও সুমুখের সুপুরি গাছটায়।

বেআদব পোলা, আছাড় মেরে তোর নাড়িভুড়ি বের করব একদিন। নিচে থেকে দাঁত-মুখ খিঁচোয় রমজান। আর খামোখাই তড়পায়, হাত-পা ছোঁড়ে। চিকন আর পিছল সুপুরি গাছটা প্রাণপণে আঁকড়ে থাকে মালু। বুক ঘেঁষে ঘেঁষে উপরে ওঠে। বুকটা বুঝি ছড়ে যায়, একটু জ্বালাও টের পাচ্ছে মালু। কিন্তু সেদিকে লক্ষ করলে চলবে না। একটু বেখেয়াল হয়েছে কী ধড়াম করে পড়বে ওই ইট আর ঝামার টুকরো ছড়ানো মাটিতে; নতুবা গাছে; দেহটার উপর দিয়ে ছচ্ছড় করে গিয়ে পড়বে একেবারে রমজানের মুঠোয়, এখনো তো দাঁড়িয়ে আছে রমজান সাক্ষাৎ আজরাইলের মতো।

মালুর ছোট্ট শরীরের দৃঢ় আকর্ষণে আর বাতাসে দোল খায় চিকন সুপুরি গাছটা। মালু চেয়ে দেখল আগার দিকটা বড় আম গাছটার ডাল থেকে মোটে দু হাত দূরে। কিন্তু এত সরু সুপুরি গাছের আগাটা মালুর ভার সইতে পারবে তো? আস্তে আস্তে সেই সরু আগাটায় উঠে এল মালু। গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে টাল খেল মালু, আর সুপুরি গাছের সরু আগাটা বেঁকে এল আম গাছটার দিকে। থপ করে ধরে ফেলল মালু আম গাছের ডালটা, শরীরটাকে একেবারে হাল্কা করে উল্টো লাফে চড়ে বসল ডালের ওপর। আম ডালে বসে হাঁপাতে থাকে মালু। গা টা ওর কাঁপছে।

আর একটু হলেই হাতটা তার ফসকে গেছিল আর কী। আর ফসকালে…? একবার নিচের দিকে তাকিয়ে দেখল মালু।

দাঁত মুখের খিচুনিটা বন্ধ করে উপরের দিকে চেয়ে আছে রমজান। চোখ তার ছানাবড়া। ছেলেটার দুঃসাহসিকতায় তারও বুকটা বুঝি ঢিপ ঢিপ করছে।

হারামজাদা বান্দির পুত। গালিটা ছুঁড়ে ব্যর্থ ক্রোধের জ্বালাটা লাঘব করে রমজান। পা বাড়ায় রামদয়ালের বৈঠকখানার দিকে। ঠিক আন্দাজ করে পর পর দুমুখ থুতু নিচের দিকে ফেলে দেয় মালু। দুমুখ থুতুই, থক করে রমজানের ঘাড় খোলা কামিজ আর চুলের মধ্যবর্তী জায়গাটুকুতে পড়ে লেপে যায়।

ছি ছি ছি তড়িতাহতের মতো বৈঠকখানার দিকে দৌড়ে যায় রমজান। রামদয়াল হাসে।

ফেলু মিঞা সিগারেট ধরায়।

০৮.

শা-লা-কর্ন ওয়ালিস…নাফরমান ইংরেজের বাচ্চা…ব্যাটা মালাউন, বলে কিনা চাষ করুন? উত্তরের ক্ষেতে পা রেখে দাঁত দাঁতে চেপে অনেকটা স্বগতোক্তিতে বলে ফেলু মিঞা।

কর্নওয়ালিসের নামটা মুনিবের কাছেই দুচারবার শুনেছে রমজান। অন্য কোথাও কখনো শোনেনি। তবে নামটা যে কোনো ইংরেজের সেটা মুনিবের কথা থেকেই আন্দাজ করে নিয়েছে ও। কিন্তু সেই কর্নওয়ালিসের সাথে মুনিবের যে ঠিক কোথায় এবং কী ধরনের সংঘর্ষ সেটা আজও অজ্ঞেয় রমজানের কাছে। মালাউন বলতে কাকে বোঝায় ফেলু মিঞা, সেটা রমজান জানে। তাই মুনিবের শেষের কথাটই আমল করে রমজান। গলাটাকে বেশ উঁচিয়ে বলে : হারামখোরী করে তিন পুরুষ ধরে খালি টাকাই জমিয়েছে। টাকার গরমে কী আর মানুষকে মানুষ কয়? কী রকম চশমখোর! আরে নিলাম ধরলি তিন হাজার, এখন কোন শরমের মাথা খেয়ে দশ হাজার চেয়ে বসলি? মুনিবের চিন্তাগুলোরই প্রতিধ্বনি করে রমজান। পুরুষ পরম্পরায় মিঞাদের সাথে দীর্ঘ দিনের সম্পর্কের ভেতর দিয়ে এ বিদ্যাটি বুঝি পুরোপুরিই রপ্ত রমজানের।

এই বাংলা দেশটা, তামাম হিন্দুস্তানটা কাদের ছিল জান? স্বরটা হঠাৎ তীক্ষ্ণ করে আর মুখটা রমজানের দিকে ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করে ফেলু মিঞা। প্রশ্নটা শুধু আকস্মিক নয়, কিছুটা দুর্বোধ্যও। তা ছাড়া এ ধরনের ব্যাপার একটুও খেলে না রমজানের মাথায়। তবু ভড়কে না গিয়ে স্বাভাবিক বুদ্ধিটা খাটিয়ে বলল, তা আর জানি না?

সেই যে আকবর বাদশা, তামাম হিন্দুস্তানের বাদশা ছিলেন। আর ওই যে নবাব আলিবর্দী তিনি ছিলেন সুবে বাংলার হর্তা-কর্তা মালিক। তাঁদেরই বংশধর আমরা। এই দেশ তো আমাদের। নিজের প্রশ্নের নিজেই জবাব দিয়ে চলে ফেলু মিঞা। কিন্তু ওই শুয়োরখোর ইংরেজ? কেড়ে নিল আমাদের বাদশাহী তখত। বাদশার জাত, আমরা এখন ভিখিরীর জাত। পোয়াবারো, ওই মালাউনদের, জমিজিরাত সবই লুটপুটে খাচ্ছে ওই ব্যাটারা।

তা ঠিকই বলেছেন স্যার, সায় দেয় রমজান। স্যার শব্দটা বার্মা মুল্লুক থেকে শিখে এসেছে ও। আর লক্ষ করেছে ওই সম্ভাষণটি শুনলে কেমন খুশি হয় মুনিব ফেলু মিঞা। তাই সুযোগ পেলেই ওটা ব্যবহার করে রমজান।

কিন্তু বাদশার জাত বাদশারই জাত। টাকা হলেই কী আর খানদান পাওয়া যায়? কী বল রমজান?

ছোট্ট একটা জি বলে চুপ মেরে থাকে রমজান। এসব ভাবালুতার আগা মাথা খুঁজে পায় না ও। মুনিবের দু কদম পিছে পিছে চলেছে ও। আর ভাবছে ওই সাত নম্বর তালুকটারই কথা। তালুকটা বেচেই দিতে চায় রামদয়াল। ওতে নাকি লোকসান যাচ্ছে। তাই রমজানের বরাবর ফেলু মিঞার প্রস্তাবটা আসতেই লুফে নিয়েছিল রামদয়াল। দামটা ইচ্ছে করেই একটু বেশি হেঁকেছিল, কারণ জাতমহাজন রামদয়াল জানে মিঞার যখন রোখ চেপেছে তখন তালুক সে কিনবেই। দশ হাজার হেঁকেছে অন্তত আট হাজার বের করবেই সেই সাথে রমজানকেও টিপে দিয়েছে রামদয়াল, যদি আট হাজার খসাতে পারে তবে পাঁচ শো রমজানের। পান চিনি খাবে রমজান। যদি এর বেশি হয় তবে বেশিটুকুর বকরাও আধাআধি। দুটো কদম তাড়াতাড়ি ফেলে মুনিবের পাশাপাশি এসে দাঁড়ায় রমজান। কিন্তু, মুখের দিকে তাকিয়ে ভড়কে যায়, ঠোঁটের কাছে ঠেলে কথাটা উল্টো দিকেই ফিরে যায়।

কী ভাবছে ফেলু মিঞা অমন রক্ত-টকটক মুখে?

তালুকটা আসলে বেচবার ইচ্ছে নেই রামদয়ালের। তাই অমন অসম্ভব দাম হেঁকেছে। মাঝখানে ফেলু মিঞাকে নিজের কাচারিতে বসিয়ে শুধু একটু মজা দেখে নিল। এ সম্পর্কে একটুও সন্দেহ নেই ফেলু মিঞার মনে।

আহ্ বুকের সেই আগুনটা আবার দাউ করে জ্বলে উঠছে। অপমানে ক্ষোভে রাগে ফেটে যেতে চায় গোশতের শরীরটা। সে জন্যই বুঝি স্কুলের স্বল্প শেখা ইতিহাসের জ্ঞান থেকে বার বার ভেসে ওঠে দুটো নাম–আকবর বাদশা আর নবাব আলিবর্দী। এই নাম দুটোর সাথেই জড়িত যত গৌরব। তারপর সিরাজুদ্দৌলা, বাংলা তথা ভারতের স্বাধীনতা হরণ। এই কলঙ্কের সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত মিঞা আভিজাত্যের বিলুপ্ত অধ্যায়। তার ওপর শালা কর্নওয়ালিস, শেষের শূলটা তো ওই শুয়োরখোরটাই মেরে গেছে। তাই তো আজ বাইন্যারামদয়ালের কাচারিতে যেচে আসতে হয় ফেলু মিঞাকে। ফিরে যেতে হয় ব্যর্থ মনোরথে। জ্বালা। জ্বালা। এ এক অসম্ভব জ্বালা। ভেতরের শিরাগুলো কেমন টাটিয়ে ওঠে আর ফেলু মিঞার মনে হয় শরীরের সমস্ত চামড়া যেন ঝলসে গেল। এমনিই হয়, মিঞাদের অতীত বর্তমান আর ভবিষ্যৎটা যখন চিন্তা করে ফেলু মিঞা তখন এমনি এক জ্বালায় দাউ দাউ করে বুকটা, কোত্থেকে কোন হারানো দিগন্তের বহ্নি শিখারা এসে ছেঁকে ধরে ওকে। সেই শিখার মাথায় চড়ে, লুণ্ঠিত মর্যাদা, লুপ্ত অতীত, অতৃপ্ত আকাক্ষা আর এখনো অপূর্ণ সেই সংকল্পটি ধেই ধেই করে কী এক আগুনের নাচন জুড়ে দেয় ফেলু মিঞাকে ঘিরে। কখন যে এমন অবস্থা হবে আগে ভাগে একটুও টের পায় না ফেলু মিঞা।

হয়ত বা রাত্রে ঘুমুতে গেছে অথবা দিবানিদ্রার উদ্দেশে হাতপাগুলো একটু ছড়িয়ে দিয়েছে অমনি ওৎপাতা জন্তুর মতো চিন্তাগুলো একটার পর একটা লাফিয়ে পড়ে ঘিরে ধরে ফেলু মিঞাকে। অন্য সময় কোন্ কানি-ঘুপচিতে যেন লুকিয়ে থাকে এসব চিন্তা। মাঝে মাঝে শুধু থাবাটা বাড়িয়ে দেয় একটুখানি, আর কাজ করতে করতে অন্যমনস্ক হয়ে যায় ফেলু মিঞা। কিন্তু অবসর সময়টাতে ওদের দৌরাত্মের আর সীমা থাকে না। নিদারুণ তীক্ষ্ণতা অসহ্য বিষ ওই জম্ভর মতো থাবা-মেলা চিন্তাগুলোর। দাদুর নাকি একটা হাতি ছিল, ঘোড়া ছিল চারটে। হাতিটা মরে যায়। দাদুর জীবিত কালে হাতি আর কেনা হয়নি। কতদিন ভেবেছে ফেলু মিঞা–হাতি হল আভিজাত্যের বিশিষ্ট অঙ্গ, হাতি একটা কিনতেই হবে। কোনোদিন কী কিনতে পারবে ফেলু মিঞা? আল্লা কী সে তৌফিক দিবেন তাকে।

সেই দাদুর আমলের ষোল বেহারার পালকিটা, খুঁটো আর দরজা ভেঙে কবে পড়ে আছে দেউড়ি ঘরে। না আছে সেই বেহারা, না চড়বার লোক। ফেলু মিঞার আছে সেই আব্বাজান বড় মিঞার আমলের একটি মাত্র ঘোড়া। বুড়ো হাড়জিরজিরে ঘোড়াটা। চড়বে কী, ওটাকে দেখলেই যে মায়া হয়! পাছে লোকে দেখে হাসাহাসি করে তাই চাকরটাকে কড়া নির্দেশ দিয়ে রেখেছে ফেলু মিঞা–দিনের বেলায় আস্তাবল থেকে কখনো বের করবি না ঘোড়াটাকে। নেহাৎ মরহুম আব্বাজানের ঘোড়া নইলে কবে এক গুলি খরচ করে ওটাকে চোখের সুমুখ থেকে সরিয়ে দিত ফেলু মিঞা। কবে, কবে একটা তেজী বলিষ্ঠ-স্বাস্থ্য সুন্দর চকচকে ঘোড়া কিনতে পারবে ফেলু মিঞা? কত দিনের সাধ তার!

এ গাঁ সে গাঁ, দুচারজন থুথ থুরে বুড়ো, তাদের মুখে শুনেছে ফেলু মিঞা, একটা পুইন্যাহত বটে মিঞা বাড়ি। সে কী পুইন্যা রীতিমতো ভোজ-জিয়াফত। লেগে থাকত দুটো দিন। পিঁপড়ের সারির মতো দূরদূরান্ত থেকে প্রজারা আসত। কত নজরানা, কত উপঢৌকন। রূপার টাকা, কাগজের টাকা আলাদা আলাদা জমা। জমে জমে স্তূপ হয়ে রীতিমতো পাহাড়ের মতো উঁচিয়ে উঠত। শুধু কী টাকা। চাল ডাল ফল গরু ভেড়া ছাগল, মনে হত চার পাঁচটা হাট উঠে এসেছে মিঞা বাড়ির কাচারি মাঠে। যারা সম্ভ্রান্ত প্রজা ওরা আসত ঘোড়া অথবা পাল্কিতে চড়ে। নজরানা দিত গিনি সোনা অথবা সেই বাদশাহী আমলের আশরফি। সে এক দিন ছিল বটে। আর আজ? আজও বছর বছর পুইন্যা হয়, কিন্তু, সে শুধু নিয়ম রক্ষার খাতিরে। জমক নেই, লয়-লস্কর নেই, প্রজা নেই; পুইন্যা কেমন করে জমবে! অথচ ওই রামদয়ালের কাচারিটা পুইন্যার সময় কেমন গম গম করে, কত ধুমধাম কত হৈ হৈ।

এ সব ভাবতে ভাবতে ফেলু মিঞা দেখে মনের পর্দায় মিঞা-আভিজাত্যের যে নিখুঁত ছবিটি এঁকে রেখেছে, সেই ছবিটি কখন জীবন্ত অবয়ব নিয়েছে, একটা ছবি নয়, অসংখ্য ছবি–তারা জীবন্ত হয়ে ওর চোখের সুমুখে চলে বেড়াচ্ছে। নহবতখানায় সানাইয়ালা বাঁশিওয়ালা ঘুঙ্গুর ওয়ালা। কী এক ললিত রাগিণীর মুর্ছনায় ধিমি ধিমি সুরের জাল বিস্তার করে চলেছে ওরা। হাতিশালায় হাতি। ঘোড়াশালায় ঘোড়া। মেজবান খানায় মেহমানের ভিড়। লোক-লস্করে গম গম করছে মিঞা বাড়ি। কত কণ্ঠ কত হাসি। হাসি হাসি মুখ প্রজাদের, মিঞার অনুগ্রহ পেয়ে হাত তুলে দোয়া করছে। আল্লার দরবারে দীর্ঘায়ু কামনা করছে ফেলু মিঞার। আহা সে দিন কখনো আসবে না? এই তো ছবি মিঞা বাড়ির। এ ছবিটা সেই কবে থেকে মনে মনে নাড়া-চাড়া করছে ফেলু মিঞা। কত রং লেগেছে কত বিচিত্র বর্ণে মুড়ে নিয়েছে নিত্যকার আঁকা সেই ছবিকে।

এমনি ভাবতে ভাবতে আনন্দ উত্তেজনায় স্নায়ুগুলো তার চিন চিন করে বেজেছে। কান পেতে শুনেছে ফেলু মিঞা ধমনীর উষ্ণ রাজ্যে সে এক স্পন্দন, সে এক রুদ্ৰ নাচন। চোখ তার জ্বলে উঠেছে, শরীরটা উঠেছে তেঁতে। অস্থির হয়েছে ফেলু মিঞা। ঘুমের আয়োজন হয়েছে লণ্ডভণ্ড। আর হঠাৎ, হঠাৎ তার মনে হয়েছে কোত্থেকে ছুটে আসছে সেই সব বহ্নিশিখা যা ওকে ঝলসে পুড়িয়ে একাকার করে দিয়ে যায়। স্বপ্ন, অতীত, বর্তমান, অপূর্ণ সাধ আর সংকল্পের শিখারা… ধেই ধেই নাচন দাউ দাউ অগ্নিতাণ্ডব আপন জগতের বন্দী ফেলু মিঞা।

সাঁকোটায় উঠতে গিয়ে ফেলু মিঞা কী হোঁচট খেল? দু হাতের বেড় দিয়ে তাড়াতাড়ি ধরে নেয় রমজান। সাঁকোটা পেরিয়ে জলদি জলদি পা ফেলে ওরা। বেলাটা হেলে পড়েছে।

সাঁকোটার মেরামত দরকার, অনেকক্ষণ পর মুখ খুলল ফেলু মিঞা।

একটা কথা। যা এতক্ষণ বলার জন্য সাহসটা সংগ্রহ করতে পারছে না, রমজান সেই বরাভয়টা চেয়ে বসল মুনিবের কাছে। বল। বল।

বলছিলাম কী : মান বেশি, না টাকা বেশি।

মর্মে গিয়ে বিঁধল কথাটা। এতক্ষণ ধরে এ কথাটাই তো ভাবছে ফেলু মিঞা, মান বড়, না টাকা বড়। মনে মনে একটু হিসেব করে দেখে ফেলু মিঞা। স্ত্রী হালিমার বিছে হারটা আর এক জোড়া বাজুবন্দ, এতে হাজার খানিক টাকা হয়ে যাবে। কিন্তু, বাকী আরেক হাজার?

আমার তো মনে হয় ব্যাটা আট হাজার তক নামবে, বুঝি মুনিবের চিন্তাটা অনুসরণ করেই বলে রমজান।

কী? চকচকিয়ে ওঠে ফেলু মিঞার চোখ মুখ! তবে তুমি যাও। কালকের মধ্যেই পাকা দলিল করে ফেল। আমি রাজি। ভবিষ্যতের রঙিন কল্পনাটা কী এক অপরূপের মূর্তি ধরে আর একবার নেচে যায় ফেলু মিঞার চোখের উপর দিয়ে। সারা দিনে এই প্রথম একটু হাসল ফেলু মিঞা।

কিন্তু রমজানের ঝুলিতে আরো অনেক বুদ্ধি। অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত সে বুদ্ধির জাল। বলল রমজান : লেকু, বসির, ট্যান্ডল, সেকান্দর মাস্টার, তাজু, ব্যাপারী, হামিদ শেখ, কারিবাড়ি, খতিব বাড়ি, আরো অনেক–কেউ চার বছর, কেউ তার চেয়েও বেশি খাজনা বাকী ফেলেছে। ওদের ক্রোক দিন উঠে যাক, গাছ গাছড়া ভিঁটিভুঁটি সমান করে ফেলি অন্তত দশ কানি জমি তো হবেই। ধান তোলা যাবে দু খন্দ, রবি ফসলও নেহাৎ কম হবে না।

কী বলতে চাও তুমি! রমজান বুঝি সেই চাষের কথাটাই তুলছে আবার। তীক্ষ্ণ আর কর্কশ হল ফেলু মিঞা।

একটুও না দমে বলে চলে রমজান : কানি প্রতি যদি দুই খন্দে পঞ্চাশ মণ ধানও ধরি তা হলে বছরে হল গিয়ে পাঁচ শো মণ। মণকরা দু টাকা করে ছেড়ে দিন ধানগুলো। কত হল? পুরো এক হাজার টাকা। কম কথা? বছরে যদি হাজার টাকা জমে তা হলে, সাত নম্বর তো থোড়ি বাত, ওই তিন নম্বর, চৌদ্দ নম্বর আর মিত্তিরদের জোতগুলো কিনতে কয় বছর লাগে বলুন তো? আপনার জন্য জমি, অন্য সব তহসিলের আয়ের কথাটা বাদ দিয়েই বলছি।

অজস্র শিখায় জ্বলছে যে দাবাগ্নি, সেটা বুঝি আর একটু উসকে দিল রমজান। সহসা উত্তর জোগায় না ফেলু মিঞার মুখে।

এ তো গেল এই বছরের হিসেব। যুদ্ধ কী লাগবে না ভাবছেন? নির্ঘাত লাগবে। তা হলে? তা হলে দুটাকার ধান হবে তিরিশ টাকা। তখন ওই দশকানি জমির পাঁচশো মণ ধান দিয়ে হেলে-ফেলেও পনেরোটি হাজার টাকা ছেঁকে তুলবেন আপনি। এর একটি কথাও যদি মিথ্যে হয় তবে বলছি স্যার, আপনার এই না-কাবেল গোলাম রমজানের কানটা কেটে রেখে দেবেন আপনি। আপনাদের দোয়ায় বিদেশ ঘুরে কিছু তো শিখেছি স্যার।

চেয়ে থাকে ফেলু মিঞা রমজানের খোঁচা-খোঁচা-দাড়ি মুখটার দিকে। এত বুদ্ধি রাখে রমজান? কড়া গণ্ডা হিসেব, নিখুঁত পরিকল্পনা। তার চেয়েও আশ্চর্য, রামদয়ালের কথাগুলোই রমজানের মুখ দিয়ে কেমন আকর্ষণীয় আর লোভনীয় হয়ে ঘিরে ধরে ফেলু মিঞাকে।

তবু খোঁচা লাগে, নীতিবোধে নয়, সম্মানকামী আভিজাত্যবোধে। প্রজা মানে সভ্ৰম। আসতে যেতে সালামটা, কারণে অকারণে একটু হাঁকডাক। এসব বাদ দিয়ে, প্রজাকে নাকচ করে বড় মানষীর কথা, অভিজাত্যের কথা কী ভাবা যায়? দ্রোণে দ্রোণে জমির মালিক হাজার জন মজুর খাটিয়ে চাষ, সে বলদ দিয়েই হোক আর কলের লাঙ্গলেই হোক, টাকা লাখই আসুক আর কোটিই আসুক হাতে, তবু তো চাষ করা? লোকে চাষা-ই বলবে; বলবে না মিঞার বেটা মিঞা। টাকার পাহাড়ের উপর বসে থাক, হাজার জনমজুরের উপর সর্দারী কর, সে এক জিনিস। আর মিঞাগিরি? সে এক গৌরব। সে এক বড়মানষি। আর কে না জানে খুদে মিঞা, জমিদার তালুকদার, ওদের যা কিছু রব-রোয়াব, প্রতিপত্তি সে তো ওই দশ বিশ ঘর প্রজারই দৌলতে! কিন্তু… সরকারি খতিয়ানের আঁকাবাঁকা দাগগুলো ভেসে ওঠে ফেলু মিঞার চোখের সমুখে। কত বিচিত্র নাম লেখা সেখানে, চাকলা রওশনাবাদ, পরগনা সুলতানপুর আমিরাবাদ, কোথায় কত ডিসিমলের মাপ, কত ঘর প্রজা, সবই যে মুখস্থ ফেলু মিঞার। আর ওই তিন নম্বর, সাত নম্বর, চৌদ্দ তালুকগুলো, সে যে মিঞা আভিজাত্যে দুষ্ট কাঁটা, খচ খচ করে অনবরত বিঁধে চলেছে ফেলু মিঞাকে। না, যেমন করেই হোক ফিরিয়ে আনতে হবে ও সব তালুক। আর? আর আগরতলার মহারাজার কাছ থেকে একটা স্বত্ব। সেই যে একটা ব্যবস্থা প্রায় পাকা করে এনেছিল, নাফরমান নালায়েক ভাইগুলোর মদদ না পাওয়ায় সে তো ভণ্ডুল হয়ে গেছে। কিন্তু যদি টাকা আসে হাতে তবে ম্যানেজারকে ভজিয়ে ভুজিয়ে আর একটা ব্যবস্থা ফেলু মিঞা করে ফেলতে পারবে বইকি।

প্রয়োজন টাকার। টাকা ছাড়া মিঞাগিরি চলে না, চলবে না। দাঁড়িয়ে পড়ল ফেলু মিঞা। এগিয়ে এসে রমজানকে পাশে দাঁড়াবার সময় দিল। বলল, ওদের সবাইকে খবর দাও আসতে। একটু থামল ফেলু মিঞা। বলল আবার, হ্যাঁ, আর জানিয়ে দাও খাজনা তাদের দিতেই হবে, নইলে ক্রোক।

কী এক লোভ-চিকচিকে হাসির ঝিলিক তুলেগেল খোঁচা-খোঁচা-দাড়ি মুখটায়। মনে মনে হিসেব কষে ফেলল রমজান সাত নম্বরের জন্য পাঁচশ, তিন আর চৌদ্দ নম্বরের জন্য এক হাজার করে দুহাজার, একুনে আড়াই হাজার। ইস্ রঙ্গমের সেই সর্দারী যাবার পর থেকে এত টাকা, একসাথে দেখেনি রমজান।

ওরা পৌঁছে যায় বাকুলিয়া। পুকুর পাড়ে উঠে সেই গাব গাছটার তলায় দাঁড়িয়ে পেছনে তাকায় ফেলু মিঞা। দখিনের ক্ষেতে শীত দুপুরের রোদ মাকড়শার মতো আপন মনে বুনে চলেছে সূক্ষ্ম কোনো জরির জাল। ফেলু মিঞার চোখের ক্ষেতে ফুটে উঠেছে স্বপ্নের কোনো কারু চিত্র।

০৯.

কেমন করে যে দিনটা গড়িয়ে গেল টেরই পেল না মালু। তালতলি এলে সময়টা বড় তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যায়। বাকুলিয়ার মতো সংকীর্ণ আর আঁকাবাঁকা নয় তালতলির রাস্তাগুলো, সোজা আর প্রশস্ত। দুপাশে আমলকি, জাম, কামরাঙ্গা জামরুল কত ফলের আর ফুলের গাছ। মাঝে মাঝে কেয়ার জঙ্গল। অজস্র কাঁঠালিচাপার গাছ, সারা গ্রামটিতে ভুর ভুর গন্ধ ছড়ায়। অদ্ভুত মিষ্টি কাঁঠালিচাপার গন্ধটি, ওই দত্তদের মেয়ে রামদয়ালের ভাইঝি রানুদি, তার চুলেও এমনি একটা সুবাস। এই কাঁঠালিচাঁপা বেটেই বুঝি তেল বানায় রানু আর সেই তেল চুলে মাখে, কত দিন জিজ্ঞেস করবে ভেবেছে মালু কিন্তু জিজ্ঞেস করা হয়নি।

বড় বড় দালান তালতলিতে। বাকুলিয়ায় তো দালানই মোটে দুটো–সৈয়দ দের আর মিঞাদের। কিন্তু তালতলির দালানের তুলনায় এগুলো যেন কবুতরের খোপ। দালানগুলোর চেয়েও তালতলির ইয়া বড় বড় টিনের চৌচালাগুলো যেন আরো ভালো লাগে মালুর। ভালো লাগে তকতকে ঝকঝকে মাটির ভিটি। বাকুলিয়াটা বড় নোংরা, তালতলিতে এলেই একথাটা মনে পড়ে ওর। তাই তালতলির রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে, ফল কুড়োতে ফুল কুড়োতে কেমন করে যেন সময়টা কেটে যায়। বাকুলিয়ায় ফেরার কথাটা মনেই থাকে না।

এসবেরও উপর তালতলির রানুদি আর ওই স্কুল। মালুর মনে তারা এঁকে রেখেছে ভয় বিস্ময় আর আনন্দ মেশানো এক আশ্চর্য ছবি। কী এক দুর্নিবার আকর্ষণ ওকে টেনে নিয়ে যায় রানুদির কাছে, ওই স্কুল ঘরের দিকে।

লম্বা স্কুল ঘরটির কাছাকাছি এসে কিন্তু বুকটা মালুর ঢিপ ঢিপ করে। কী এক সম্ভ্রম এবং ভয় ওকে আর কাছে যেতে দেয় না। রজনী ময়রার টুলের উপর বসে বসে দেখে মালু ঢং ঢং ঘন্টা পড়ছে, ছেলেরা হুড় হুড় করে বেরিয়ে আসছে। আবার ঘণ্টা পড়ছে ছেলেরা হৈ হৈ করে ক্লাসে যাচ্ছে। তারপর কত ধরনের কত স্বরে পড়ার শব্দ আসে ভেসে। মালু ভাবে ওখানে যারা পড়ে কত না ভাগ্যবান তারা। কতদিন ইচ্ছে হয়েছে মালুর ভিতরে গিয়ে দেখুক কেমন করে ছেলেরা বসে, কথা বলে অথবা পড়া করে। অমন যে মালু সাপকে যার ভয় নেই, এখানে এলে কেমন যেন কেঁচো বনে যায় ও। সাহস পায় না ভিতরে যাবার। আব্বার মক্তবটার কথাও মনে পড়ে যায়। ওই মক্তবটা সম্পর্কে যেমন ভীষণ বিতৃষ্ণা মালুর তেমনি গভীর শ্রদ্ধা আর বিস্ময়ভরা কৌতূহলের আকর্ষণ তালতলির স্কুল সম্পর্কে।

রানুদি গো। তুমি বুঝি ওই চাঁপা ফুল বেটে চুলে মাখ। আজ এরকম চোখ বুজেই জিজ্ঞেস করে ফেলল মালু। কিন্তু অমন যে ভালো দিদি রানুদি সেও কেমন অদ্ভুত আচরণ করে বসে। মালুর হাতটা ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে যায়। তারপর হাত ছেড়ে কানটা বার দুই টেনে মুচড়ে দেয়, বলে, দুষ্ট ছেলে, পালিয়ে এসেছিস বুঝি?

দেখ না কাণ্ড রানুদির। কী জিজ্ঞেস করল মালু আর কী তার জবাব। আর মালুর কানটা যেন এজমালি সম্পত্তি, জাতিধর্ম বয়স নির্বিশেষে সকলের যেন অবাধ অধিকার সেখানে। প্রতিবাদে মালু গাল ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে চুপচাপ।

ওহ্ হো জনাবের আবার অভিমান আছে দেখছি। সেই উঠোনভর লোকের সামনেই ঝুঁকে পড়ে ওর কপালে চুমু খায় রানু। কী যে আক্কেল রানুদির। লজ্জা হয় মালুর। বাকুলিয়ায় অমন করে কেউ চুমু খায় না ওকে, আম্মাও না, রাবুও না।

নে খা। শানকি ভর্তি খই আর সন্দেশ এনে দেয় রানু। মুহূর্তে লজ্জাটা ভেঙে যায়, রাগটা পড়ে যায় মালুর। বলল, রানুদি তুমি কী চাঁপা ফুল–আহ্ ভীষণ ফাজিল হয়েছিস মালু। ধমক দিয়ে ওকে থামিয়ে দেয় রানু। তারপর শুধায় সেই পুরনো কথা–আচ্ছা রাবু, আরিফা কেমন আছে রে? বোরখা পরে ওরা সারাদিন ঘরেই বসে থাকে বুঝি? পুকুরে স্নান করতে যায় না?

উদ্ভট প্রশ্ন রানুর। কতদিন বলেছে মালু, রাবু আপারা বোরখা এখনো ছোঁয়নি। বিশ্বাসই করে না রানু। তাই উত্তর না দিয়ে নির্বিকার মালু খই চিবিয়ে যায়।

রাবু নাকি নোলক পরেছে আর এক্কেবারে চোখ ঢেকে ঘোমটা দিচ্ছে? এবারও চুপ চাপ খই চিবিয়ে চলে মালু।

আচ্ছা মালু। কে বেশি সুন্দর রে, আমি না তোর রাবু আপা?

খই চিবানোটা বন্ধ হয়ে যায় মালুর, এ প্রশ্নটা আগে কখনো ওঠেনি, ভেবেও দেখেনি মালু। আর যদি ভেবেও থাকতো, মালু কী বলতে পারবে : রানু দি তুমিই সুন্দর? তা পারবে না। কেননা, রানুদির চুলে যেমন চাপার গন্ধ তেমনি রাবু আপার গায়ে অদ্ভুত এক মিষ্টি সুবাস, যার নাম জানে না মালু। রাবু আপার কথায় মধু, রাবু আপার তিরস্কার মিষ্টি, রাবু আপার স্পর্শ মিষ্টি, রাবু আপা কাঁচা হলুদের মতো টকটকে সুন্দর। কিন্তু রানুদি যে আরো সুন্দর। গান করে রানুদি, রাবু আপা গান করে না। রানুদি ফুল দিয়ে খোঁপা বাধে, ফুলের চুরি পরে হাতে। রাবু আপার টেবিলে সাজান থাকে না ফুল। আর কী সুন্দর রানুদির আদরটা।

তুমিও সুন্দর, রাবু আপাও সুন্দর, শানকিটা মাটিতে রেখে বলল মালু।

ওরে বাবা, এযে একেবারে সেয়ানা ছেলের সেয়ানা উত্তর। খুব চালাক হচ্ছিস বুঝি আজকাল? মালুর চিবুকটা ধরে টিপে দেয় রানু।

খাওয়া শেষ হয়েছে মালুর। আস্তিনের খুঁটে মুখটা মুছে বলল, বই দাও, বই চেয়েছে রাবু আপা।

কী বই? শুধাল রানু।

তা তো বলেনি?

বোকারাম কোথাকার, এর পর থেকে বইয়ের নাম নিয়ে আসবি। নইলে পাবি না। বুঝলি? বলতে বলতে আর এক ঘরে চলে গেল রানু। কয়েকটা বই এনে মালুর হাতে দিয়ে বলল আবার হ্যাঁরে, রাবু কী আমার চেয়েও লম্বা হয়ে গেছে?

জবাব না দিয়ে বইগুলো বগলে নিয়ে পা বাড়ায় মালু। যখনি দেখা হবে এই বাঁধা ধরা প্রশ্নগুলো জিজ্ঞেস করবে রানু। শুনে শুনে মালুর বিরক্তি ধরে গেছে।

মালু একদিন বলেছিল লম্বা, আর একদিন বুঝি বলেছিল খাট। বলে, কী বিপদেই না পড়েছিল। আজ আবার কোন্ কথা বলে নাজেহাল হবে রানুর হাতে? কেন, রানুদি একবার গিয়ে নিজের চোখে দেখে আসতে পারে না?

কিরে, কথার উত্তর না দিয়ে চলে যাচ্ছিস যে বড়? মালুর পথটা আগলে দাঁড়ায় রানু।

গিয়ে দেখে আসলেই তো পার। নইলে বল, আমি নিয়ে আসব রাবু আপাকে?

আসবে রাবু? আনতে পারবি?

বা-রে। পারবো না কেন? কত জায়গায় নিয়ে যাই রাবু আপাকে?

কিন্তু, ওর আম্মা? আম্মা কী আসতে দেবে?

এ প্রশ্নের যে কী জবাব সেটা রানুকে ভাবতে দিয়ে বেরিয়ে আসে মালু। এত চিঠি লেখালেখি, এত ভাব ওদের দুজনের। অথচ ওদের দেখা হয় না, ওরা দেখা করতে পারে না। রানু কোনোদিন যায়নি বাকুলিয়ায়। রাবু সেই কবে একবার এসেছিল তালতলিতে থিয়েটার দেখতে। মনে আছে মালুর রাবু আর আরিফা তখনো ফ্রক পরত। মেজ ভাই ওদের দু জনকে দু পাশে রেখে হাত ধরে হাঁটছিল।

মালু ছিল পেছনে। ওই একবারই তো দেখা রাবুর সাথে রানুর। তাতেই কত ভাব। কিন্তু, ওরা দেখা করে না কেন? রানু কেন যায় না বাকুলিয়ায়? অথবা রাবু কেন আসে না রানুদের বাড়ি। প্রশ্নটা শুধু আজ নয়, অনেক-দিনই জেগেছে মালুর মনে।

কিন্তু এ কী বিপত্তি। কবিয়াল আর যাত্রার দলটার ধারে কাছেও কী ঘেঁষতে পারবে না মালু? সেই কখন থেকে চেষ্টা করছে ও। কিন্তু একটা বদখত ভুড়িওয়ালা লোক বার বার ওর সব ফিকির বানচাল করে দিচ্ছে। একবার তো তাঁবুর ভেতর প্রায় ঢুকেই পড়েছিল মালু, এমন সময় আস্ত একটা চেলা কাঠ এসে পড়ল ঠিক কোমর ঘেঁষে। আর একটু হলে মালুর মাজাটা হয়ত আস্ত থাকত না এতক্ষণে। আর কী শ্যেন দৃষ্টি লোকটার। বার তিন চেষ্টা করেও সে দৃষ্টিটাকে ফাঁকি দিতে পারল না মালু। যেই একটু কাছে গেছে অমনি তেড়ে এসেছে লোকটা। হয়ত যাত্রা পার্টির দারোয়ান, নইলে অমন করে তেড়ে আসবে কেন?

তৃতীয় চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে মিত্তির বাড়ির আমলকি গাছটায় উঠে কিছু আমলকী পেড়ে নিয়েছিল মালু। সে আমলকী চিবুতে চিবুতে আর পকেটেরগুলো গুনতে গুনতে বাজারের শেষ প্রান্তে ওই তাঁবুগুলোর দিকেই যাচ্ছিল মালু। এমন সময় ফেলু মিঞার দৃষ্টি পড়ে, কী কাণ্ডটাই না ঘটে গেল। ইস্ কেমন ছড়ে গেছে বুকটা। এত থুতু লেপে দিয়েছে তবু এখনো জ্বালা করছে। সার্টের বোতামগুলো খুলে বুকটা আর একবার দেখে নিল মালু, অনেকটি জায়গা লাল হয়ে আছে এখনো।

তারপর রানুদের ওখানে গিয়ে আরো দেরি হয়ে গেল মালুর। না গিয়েই বা উপায় ছিল কী? পেট তো রীতিমতো কুলহুয়াল্লা পড়ছিল সেই কখন থেকে। ভারি ভালো লাগছে মালুর। খই আর সন্দেশ ভরা পেটে এক গ্লাস পানি পড়ে বেশ টিমটিমে হয়েছে পেটটা।

রজনী কাকা, তোমার চৌকির নিচে বইগুলো রেখে যাচ্ছি: কাউকে ধরতে দিও না কিন্তু। বইগুলো রেখে ছুট দেয় মালু।

আঃ বাঁচা গেল। সেই ভুঁড়িওয়ালা লোকটা নেই। স্যাঁৎ করে মালু ঢুকে পড়ল তাঁবুর ভেতর। কিন্তু নিদারুণ ভাবে হতাশ হল মালু। ওর এত সুন্দর কল্পনাটা মুহূর্তে কে যেন খান খান করে ভেঙে দিল। সেই ভট্টাচায্যি বাবুদের ছেলে বাদল বলছিল রূপোর জাজিম, সোনার পোশাক, হীরের তাজ, ঝিলিক দেওয়া রামের তরবারি, আরো কত কিছু আছে ওখানে। কিন্তু কোথায় সে সব? মালু শুধু দেখল কতগুলো নোংরা দড়ির খাটিয়া তারই উপর কতগুলো লোক বিশ্রী ঢঙে বসে কী সব আলাপ করছে। শুনে মালুর কানটা গরম হয়ে উঠল। তাড়াতাড়ি পাশের তাঁবুটায় চলে এল ও। এদিক ওদিক চোখ ফেলতেই দেখল মালু পরমাশ্চর্য এক পুরুষ মূর্তি ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে এল ওর দিকে। হাত রাখল ওর কাঁধে বলল, কোথা হতে আগমন তব, বৎস?

চোখ বড় বড় করে মালু দেখল ইয়া জোয়ান এক পুরুষ কী পুষ্টু আর শক্ত তার বাহু। সে বাহুর ভারে মালু বুঝি বসে পড়বে মাটিতে। বৎসে, কী নাম তব কোথা তব নিবাস? জবাব না পেয়ে আবার শুধাল লোকটা। আশ্চর্য ঝংকার লোকটার কণ্ঠে। কথায় তার তরবারির ঝিলিক। এমন অলংকৃত কথা কখনো শোনেনি মালু। মুগ্ধ বিস্ময়ে চেয়ে থাকে ও। কে হে বালক তুমি? চেন না মোরে? মোর নাম সুগ্রীব, রামের মিতা। মালুর পলকহীন চোখের জিজ্ঞাসাটা আন্দাজ করেই যেন বলল লোকটা।

সুগ্রীব? মালু কখনো শোনেনি এ নাম। তাই খানিকক্ষণ ওর মুখটাকে যেন চেনবার চেষ্টা করল মালু। বলল ও, তুমি রাম নও?

মুহূর্তে সুগ্রীবের চোখ কী এক হিংস্রতায় উগ্র হয়ে ওঠে। বলল সুগ্রীব-রাম? সে আবার বীর নাকি। সে তো আস্ত এক গবেট। সাধ্য কী রামের বিনা সুগ্রীব যুদ্ধ জিতে? আমিই সেই সুগ্রীব। ডান হাতের তর্জনীটা তুলে বুক ঠোকে সুগ্রীব, মাসল ফোলায়। সে বীরত্ব ব্যঞ্জনায় তাক লেগে যায় মালুর। সত্যি, মহাবীর সুগ্রীব।

হঠাৎ মানুষের মতো গলাটা দরাজ করে হাসে সুগ্রীব, বলে–চল, দেখাই তোমারে রামের কারখানা। সঙ্গের আর একটা তাঁবুতে মালুকে নিয়ে আসে সুগ্রীব। কাগজের মুকুট, টিনের তলোয়ার আর কিছু জরি আঁকা পোশাক এদিকে ওদিকে ছড়ানো। কিন্তু ওসবে মালুর কৌতূহল উবে গেছে, সুগ্রীবই ওকে মুগ্ধ করেছে। কিছুক্ষণ ইতস্তত করে সুগ্রীবের সেই দোসরা প্রশ্নটার জবাব দেয় মালু–আমার নাম মালু, আবদুল মালেক, গ্রাম বাকুলিয়া।

এ্যাঁ, তুমি মুসলমান? নেড়ে? হঠাৎ যেন সাপের উপর পা পড়ে আঁতকে উঠে সুগ্রীব। পিছিয়ে আনে দুপা।

শুকিয়ে এতটুকু হয়ে আসে মালুর মুখখানি। কেমন ছোট মনে হয় নিজেকে। এই পরমাশ্চর্য পুরুষটির সামনে সে বুঝি মহা অন্যায় করে ফেলেছে।

সৌভাগ্য মালুর, সুগ্রীবের আতঙ্কটা স্থায়ী হয় না বেশিক্ষণ। সামলে নিয়ে বলে সুগ্রীব তা মুসলমান হলে কী হবে, চেহারা তোমার সুন্দর; খাসা মানাবে সখির পার্টে।

আপনার বাড়ি কোথায়? সুগ্রীবের পুরো পরিচয়টা জানবার আশায় শুধাল মালু।

আমার বাড়ি বিন্ধ্য পর্বতের ওপারে, কিষ্কিন্ধ্যার রাজপরিবারে আমার জন্ম। কথাগুলো বলতে বলতে বাইসেপটা ফুলিয়ে তোলে সুগ্রীব। তারপর চওড়া বুকটাকে নিশ্বাসের টানে বেশ এক প্রস্থ ফুলিয়ে বলে–রাম? রামটা তো আস্ত ছাগল। শুধু তীর ছুঁড়ে কী লড়াই জেতা যায়? বিজয়ের জন্য চাই বুদ্ধি, কৌশল। সে বুদ্ধি সে কৌশল এই সুগ্রীবের? আমি না থাকলে হেরে ভূত হতনা রাম। আশ্চর্য! আশ্চর্য বীরত্ব ভঙিমা সুগ্রীবের।

আচ্ছা ভাই, রিহার্সালের ডাক পড়েছে। তোমাকে কিন্তু পার্ট নিতে হবে। মালুর চিবুকে একটি টোকা মেরে বীরের দৃপ্ত পদক্ষেপে চলে যায় সুগ্রীব অন্য তাঁবুতে।

বাকুলিয়ার সৈয়দ বাড়িতে পালিত ছোট্ট সেই কিশোর। আচমকা বিচিত্র বিস্ময় আর পুলক ভরা এক দুনিয়া উন্মোচিত হয়ে গেল, ওর বার বছর বয়সের অনিরুদ্ধ কৌতূহলের সুমুখে।

১০.

অকালে কোত্থেকে খাজনা দেব? কেমন অসহায় ভাবে বলল কসির। খাজনা দেব না, ভিটিও ছাড়ব না, দেখি কী করতে পারে। মিয়ার পুতি। যেন কসিরের অসহায়তারই প্রতিবাদে বলল লেকু। চমকে উঠে সেকান্দর মাস্টার। বলে কী লেকু? ওরা খুঁজছে একটা ভদ্রস্থ রফা। কিন্তু লেকুর মতো গোয়ার্তুমি দেখালে তো যে কোনো রফারই দফারফা।

ওই শুয়রের জাত রমজান, সব তারই শয়তানী, সে ব্যাটাই বুদ্ধি দিয়েছে মিঞাকে। আমাদের গেরাম ছাড়া করবে এই তার মতলব। ফুলে ফুলে উঠে লেকুর ঘাড়ের পেশীগুলো।

ওরা কেউ ভাবেনি অমন আচমকা একটা নোটিশ দিয়ে বসবে ফেলু মিঞা। মাঘ ফাল্গুনে কৃষকদের ঘরের কাজের সময়। এই দুটো মাসে সেরে ফেলতে হয় সারা বছরের বকেয়া কাজ। এ সময় আবহাওয়াটা থাকে ওদের অনুকূল, বৃষ্টি নেই, প্যাঁক নেই, শীতের নির্মল রোদ-ঝকঝক আবহাওয়া, কাজ করে শ্রান্ত হয় না ওরা। ফসল তোলা শেষ করেই হাজার গণ্ডা টুকিটাকি কাজে মন দেয়: মন্থর অবসরে হাত-পা ছড়িয়ে ছন বাছে, ছোট বড় নানা আকারের গুচ্ছ বেঁধে বেঁধে তুলে দেয় চালের উপর, দেখতে দেখতে, ঘরের উপর ওঠে নতুন ছাউনি। ভাঙা বেড়াগুলো মেরামত করতে হয়, পাল্টাতে হয় বর্ষার উইয়ে খাওয়ার পালা। ডোবাটার প্যাঁক তুলে আর একটু গভীর করে রাখতে হয় যাতে বর্ষার পানির সাথে মাছ পড়ে আবার পালিয়ে না যায়। এ সব কাজে টাকা লাগে। এমন সময় বকেয়া খাজনার নোটিশটা বাজের মতো পড়েছে ওদের মাথায়।

যাদের জমি আছে তাদের কথা আলাদা, তারা ধান বেচবে, পাট বেচবে, নগদ পয়সা তুলবে ঘরে।

কিন্তু বাকুলিয়া, শুধু বাকুলিয়া কেন, এ তল্লাটে কয়জন চাষীর হাতে জমি আছে? বাকুলিয়ার আশি ঘর প্রজার মাঝে পঞ্চাশ ঘরই সৈয়দ অথবা মিঞাদের প্রজা। বাকি তিরিশ ঘরের খাজনা পাওয়ার মালিক রামদয়াল। বাকুলিয়ার উত্তরে পশ্চিমে যে জমি, সে আর কতটুকু। তাও প্রায় আধা-আধি ভাগ সৈয়দ আর মিঞাদের ভেতর। দখিনের ক্ষেত, বিশ পঁচিশ মৌজায় সেটাই তো সবচেয়ে বড় ক্ষেত, সে ক্ষেতের যদি দুআনা থাকে মিঞাদের তবে বার আনাই তালতলির দত্ত মিত্তিরদের। বাদবাকি দু আনার হাজার মালিক, হাতের তালুর মতো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খণ্ডে ভাগ করা। কৃষকরা নিজের মেহনতেই চাষ করে সে জমি। মিঞারা অথবা তালতলির বাবুরা মাঠে নামে না। ওদের সব জমিই বর্গা খাটে। ওই দুই আনার যে হাজার মালিক তারাই অথবা যাদের নেই এক রত্তি জমি তারা, অর্ধেক বিনিময়ে চাষ করে দেয় সে জমি। একমাত্র রামদয়ালই আট জোড়া লাঙল আর দশ জন গাবুর খাটিয়ে নিজেই চাষ করায় তার জমির কিছু অংশ।

সারা বাংলাদেশেই জমির অভাব। জমির অনুপাতে মানুষ নাকি অনেক বেশি। মানুষ তো কাজ চায়, খেটে খেতে চায়। এক টুকরো ক্ষেতের পিছে কী অমানুষিক পরিশ্রম ঢেলে দেয় ওরা। তবু বছরে দুটো মাসের অন্ন জোটে কী? জমি যে নেই কাজই বা কোথায়। তথ্য নিয়ে যারা ঘাঁটাঘাটি করেন সে সব পণ্ডিতরা বলেন–এক দিকে গারো পাহাড় অন্য দিকে ত্রিপুরা পর্বতের বেষ্টনী, আর ওই আরাকান পর্বতমালার সানুদেশ থেকে নাবতে নাবতে একেবারে মেঘনা আর বঙ্গোপসাগরের মোহনা অবধি–এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলটা পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতি অঞ্চল। পৃথিবীর আর কোথাও এত ছোট এলাকায় এত বেশি মানুষ বাস করে না। কথাটা যে কত নিমর্মভাবে সত্য বাকুলিয়ার লাঙল-ঠেলা চাষীর মতো করে অন্যরা কী বুঝবে? ওদের ছেলেরাই যে অল্প বয়সে মায়ের আঁচলের মায়া কাটিয়ে ঘর ছাড়ে। অন্নের সন্ধানে ঘুরে বেড়ায় দেশান্তরে। এক রত্তি যে ছেলে, লুঙ্গিটা পড়ে যেতে চায় কোমর ছেড়ে, সেও বিদেশে ছোটে কামাই করবে বলে। দুমুঠো ভাত দিতে অক্ষম মা-বাবা ধরে রাখতে পারে না কচি ছেলেগুলোকে। যারা থেকে যায় গ্রামে তারাও বছরের অর্ধেকটা সময় কাটায় পাহাড়ে, আসামে অথবা ভাটি অঞ্চলে, শ্রমের বিনিময়ে টাকা অথবা শস্য নিয়ে ঘরে ফেরে।

বাকুলিয়ার সারেং বাড়ি, সব কয়টা জোয়ান জাহাজে জাহাজে ঘোরে এক সমুদ্র থেকে আর এক সমুদ্রে। গোটা ট্যান্ডল বাড়িটাই তো রেঙ্গুনে, এক বৌগুলো আর ট্যাণ্ডলবুড়ো বাদে। কসির, ফজর আলী, ওদেরও ভাইরা কাকারা হয় রেঙ্গুনে, নয়তো কোলকাতায়, বিদেশ না করলে যে ওদের ভাত জোটে না।

মরসুমের শুরুতেই লেকু পাহাড় থেকে ছন এনেছিল। ইচ্ছে ছিল আর একটা খেপ দেবে। কিন্তু চার বছরের খাজনা যদি দিতে হয় তাহলে ও ছন আনবে কেমন করে? আবার পয়সার মুখ দেখবে সেই বর্ষার শেষাশেষি পূবের দেশে গিয়ে। তাই বুঝি এমন উত্তেজিত হয়েছে ও। কিন্তু মাস্টার সাহেবের কাছে এসেছে ওরা পরামর্শের জন্য, সেখানে অমন গোঁয়ারের মতো চটে যাওয়াটা তার মোটেই সমীচীন হয়নি। বুঝতে পেরে বুঝি লজ্জিত হয় লেকু, বলে, সবাই মিলে যা সাব্যস্ত হবে তাই তো করতে হবে।

হ্যাঁ, হ্যাঁ তাই। তবে অসুবিধাটা যা সে তো বলবেই, সেকান্দর আশ্বস্ত করে।

গালে হাত দিয়ে ভাবে ওরা।

হাতে নেই টাকা, ঘরের হাঁড়িতে টান, তখন গালে হাত দিয়ে ভাবা ছাড়া উপায় কী? কিন্তু ভাবলেই কী উপায় আসে? ওরা তাকিয়ে থাকে মাস্টারের মুখের দিকে। মাস্টার কী বলে?

দুসনের খাজনাটা দিতেই হবে। দিয়ে একটা সন মওকুফ চাইতে হবে। আর বাকী, সে আগামী সন, কী কও? ভেবে চিন্তে বুঝি এই একটা উপায় ঠাওরায় সেকান্দর। সেই ভালো, দুটো সনের টাকার ব্যবস্থা কোনো রকমে করা হোক। বাকী বছরের বকেয়া বাখরগঞ্জ বা আসাম থেকে ফিরে এসে। সেকান্দরের প্রস্তাবটায় সায় দিয়ে বলল ফজর আলী। মিঞাদের প্রজা না হলেও সে এসেছে দোস্ত লেকুর দাওয়াতে। লেকুর বিপদে আপদে ও মদদ দেয়। লেকুও দোস্তের নামে এক পা।

প্রস্তাবটিতে যুক্তি আছে, সবাই মনে মনে নেড়ে চেড়ে দেখছে বুঝি বা। কী কও তোমরা, জিজ্ঞেস করে সেকান্দর।

এই সনে এক পয়সাও দিতে পারবো না আমি। যদি পারি আগামী সনে সব জমাই এক সাথে উসুল করে দেব।

লেকুর কথায় সবার মুখেই যেন অসন্তোষ। কিন্তু ওরা বুঝছে না কেন লেকুর সমস্যাটা? দুসনের খাজনা দিতে হাতের টাকাটা যদি খরচ হয়ে গেল, তবে যে পাহাড়ে যাওয়াটা ওকে বাদ দিতে হবে। আর পাহাড় থেকে ছন আর বাঁশ এনে দুটো নগদ পয়সা যদি শীত থাকতে থাকতেই হাতে না তুলতে পারে তবে যে ওর কোনো কামই হবে না। রাতে শিয়াল ঢোকে ঘরে, এমনি হয়েছে বেড়াগুলোর অবস্থা। নতুন বেড়া দিতে হবে না? ঘরের সুমুখের চালটায় গেল বছর নতুন ছন দিয়েছে। পেছনের চালটা যদি এবার ছেয়ে না দেওয়া যায় তবে বর্ষায় আর রক্ষে আছে?

সবই তো বুঝলাম কিন্তু মিঞা যদি না শোনে? জিজ্ঞেস করে সেকান্দর। শুনবে না কেন? আমরা তো আর ফাঁকি দিচ্ছি না। সামনের সনে যেমন করে হোক দেব, মুখের করার আমাদের। তর্ক করে লেকু।

এক সনেরও আদায় দিবি না, আর মিঞাকে বললেই মিঞা তোদের আর্জি রাখবেন? বলল কসির।

বুঝিয়ে সুঝিয়ে একটা ব্যবস্থা করতে গেলেও অন্তত একটা বছরের খাজনা হাতে নিয়ে যেতে হবে। কসিরের কথাটাকেই অন্য ভাবে ঘুরিয়ে বলল ফজর আলি, লেকুর দোস্ত।

বেশ, তোমাদের ট্যাঁক ভর্তি, তোমরা দাও গে। আমার ট্যাঁক খালি, আমি দিতে পারব না। এবার সত্যি চটে যায় লেকু। ঘাড়ের শিরা ফুলে উঠেছে, স্বরটা চড়েছে। একমাত্র লেকুই বেঠিক, আর ওরা সবাই ঠিক, কী যে কথা বলার ঢং ওদের!

না দিলে চলবে কেন, ক্রোক করবে যে। শান্ত স্বরে আশু বিপদটার কথা ওকে স্মরণ করিয়ে দেয় সেকান্দর।

করুক। রামদয়ালের অনেক খালি ভিটে পড়ে রয়েছে, তারই একটাতে গিয়ে উঠে পড়ব। মিঞার প্রজা অথবা রামদয়ালের প্রজা, কথা তো একই। চাষাভুষোর আর কী ভবিষ্যৎ! যেন আগে থেকেই সব ঠিক করা, এমনি ভাবেই বলে গেল লেকু।

বাপদাদার ভিটে। একেবারে ছেড়ে দিবি? লেকুর দিকে তাকিয়ে কেমন করে যেন বলে ফজর আলি।

মুহূর্তের মধ্যে স্তব্ধ হয়ে যায় লেকু। অমন যে চটাং চটাং কথা ছুঁড়ছিল সে সব কথা কে যেন নিমেষের মাঝেই কেড়ে নিল ওর মুখ থেকে।

বাপদাদার কথা এলেই কেমন যেন হয়ে যায় এ গাঁয়ের লাঙল-ঠেলা মানুষগুলো। বাপদাদারা ধর্মকর্ম করতো তাই ওরাও ধর্ম কর্ম করে, মসজিদে যায়, শিন্নি দেয়। মিঞা সৈয়দদের সেলাম দিয়ে এসেছে বাপদাদা, ওরাও দেয়। বাপদাদা লাঙল ঠেলতে শিখিয়েছে, পূর্বের পথ দেখিয়েছে, পাহাড়ের পথ চিনিয়েছে, বিদেশের ঠিকানা দিয়ে গেছে। তাই ওরা লাঙল ঠেলে পূর্বে যায়, বিদেশকে ভয় করে না। পদে পদে ওদের অতীতের বন্ধন। প্রশ্নাতীত ওদের আনুগত্য বাপদাদার নামে চলতি অনুশাসনের প্রতি। বুঝি সব দেশের সব যুগের কৃষকরাই এমনি, অতীত ওদের বড় প্রিয়। নিত্য কর্মে নিত্য ভাবনায় তাদের অতীতের টান, স্মৃতির সঞ্চালন। ভিটিটা সে অতীতেরই মূর্ত প্রতীক, মৃত বাপদাদার জীবন্ত নিশানি।

সেই ভিটি ছেড়ে যাবে লেকু? সেই আব্বাজানের ভিটি? আজও যার হাতের কাজের সুনাম ছড়িয়ে রয়েছে গ্রামে গ্রামে? রাগের মাথায় ক্রোকের কথাটা একদম খেয়াল ছিল না ওর। কেমন আনমনা হয়ে গেল লেকু। চেয়ে রইল মাস্টারের দাওয়ার দিকে। কখন দুফোঁটা পানি এসে জমেছে ওর চোখের কোণে। ঝরে পড়ার আগে টলটলিয়ে উঠল ফোঁটা দুটো। ওরা দেখল। ওরা মুখ নাবিয়ে নীরব হল।

শেষ পর্যন্ত যেখান থেকে শুরু করেছিল সেখানেই ফিরে এল ওরা। ওরা আর কী বলবে? কতই বা বুঝ ওদের! মিঞার সাথে বোঝাপড়া, আপস-রফা, যাই করতে হয় মাস্টার করুক, তার কথাই সকলের কথা। ওরা চলে যায়।

সরল গাঁয়ের মানুষ। শিক্ষা থেকে বঞ্চিত বলেই বুঝি শিক্ষা আর শিক্ষিতের প্রতি অমন ভক্তি ওদের। যারা এলেম হাসিল করেছে তারা হল খোদার খাস বান্দা, রসুলের পেয়ারা। ইহলোক পরলোক তাদের করায়ত্ত। বাপদাদার মুখ থেকে আরো হাজারটি উপদেশের মাঝে, এই উপদেশটাও শুনেছে ওরা। সে ভক্তিটাই ওরা দেয় সেকান্দর মাস্টারকে। আর সংকুচিত হয় মাস্টার। অমন বিশ্বাস, শ্রদ্ধাভক্তির বিনিময়ে ওরা যা চায় সেটা দেবার সামর্থ্য বা যোগ্যতা কোথায় মাস্টারের? ভাবতে ভাবতে যেন আরো সংকুচিত হয়ে আসে সেকান্দর মাস্টার।

বাকুলিয়ায় শিক্ষা বলতে যা বোঝায় সে তো মিঞা আর সৈয়দদেরই এক চেটিয়া। বাকুলিয়ার প্রজাকুল ওদের এই এলেমকে সম্মান দেয়, যখন যায় তালতলির হাটে বুক ঠুকে তর্ক করে, আমাদের বাকুলিয়ার মিঞাদের মতো অতোটা পাস কাদের আছে? তালতলির ঘরে ঘরে বি.এ, এম. এ. পাস, তাই তালতলির মানুষ হয়ত মুখ লুকিয়ে হাসে। সে হাসিতে বাকুলিয়ার কৃষক একটুও ক্ষুণ্ণ হয় না, বলে, ওটা হিংসে।

কিন্তু সেকান্দর মাস্টারকে নিয়ে ওদের গৌরবটা অন্য ধরনের। সে যেন ওদের আপন জন ঘরের ছেলে। সন্তানের গৌরবে গর্বিত পিতার মতো সেকান্দর মাস্টারের কথা বলতে বলতে বাকুলিয়ার কৃষকদের বুকটাও ফুলে ওঠে। ও যে কৃষকের সন্তান। আর মিঞা এবং সৈয়দ বাড়ির বাইরে একমাত্র সেকান্দরই তো দু দুটো পাস দিয়েছে, বি.এ. পর্যন্ত পড়েছে। ম্যাট্রিক পর্যন্ত পড়েছে এমন একটা ছেলেও তো নেই বাকুলিয়ার কৃষকদের। তাই মাস্টার ওদের গৌরব। ওদের অকুণ্ঠ বিশ্বাস স্নেহপ্রীতি আর বোধহয় অনেক আশা ভরসা ওকে ঘিরে।

তুমি আমাদের লায়েক ছেলে। তোমার কাছে না এসে যাব কার কাছে? তুমিই তো করবে সব। ওরা বলে আর সেকান্দর যেন মিইয়ে যায় মাটির সাথে। ওদের জন্য কী করতে পারে সেকান্দর? ওর সেই সামর্থ্য বা সচ্ছলতা কোনোটাই যে নেই? একটু যে চিন্তা করবে ওদের নিয়ে সে ফুরসতই বা কই? সে তো নিজের সমস্যায় আকণ্ঠ নিমগ্ন।

স্কুলেই কেটে যায় দিনটা। সেখান থেকে মাসে মাসে যে কুড়িটা টাকা মাইনে পায় ছাঁকা আয় বলতে একমাত্র ওটাকেই ধরা যায়। জমি আছে দুকানি। তার জন্য একখানা হালও রাখতে হয়েছে। জমির ফসল আর স্কুলের মাইনেয় মোটামুটি চলে যায় সংসারটা। ভাই সুলতান, বোন রাসু আর মাকে নিয়ে ওর যে সংসার তার চাহিদাও হয়ত বেশি নয়, ডাল ভাত আর সাফ কাপড়।

কিন্তু শুধু চলে যাওয়াতেই যে সন্তুষ্ট নয় সেকান্দর। আব্বাজানের আকস্মিক মৃত্যুর পর অল্প বয়সেই সংসারের হাল ধরতে হয়েছে ওকে। সেই অবস্থাতেই আইএ-টা পাস করেছে। ভর্তি হয়েছিল বি. এ-তে কিন্তু ওই সংসারের তের ঝঞ্ঝাটে পড়াটা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি ওর পক্ষে। অথচ কত স্বপ্নই না ছিল ওর। সেই অতৃপ্ত আকাক্ষাটা পুরনো ক্ষতের মতো আজও জেগে ওঠে, মনে আর শরীরে যন্ত্রণা ছড়ায়। তাই নিজেকে একটা গোপন শপথে আবদ্ধ করেছে। সেকান্দর-–ছোট ভাই সুলতানকে যেমন করে হোক বি. এ-টা পাস করাবে এবং ভালো ভাবেই পাস করাবে। ক্লাস এইটে পড়ছে সুলতান। ওর কলেজের খরচের জন্য এখন থেকেই একটা দুটো করে টাকা জমিয়ে চলেছে সেকান্দর। জমাতে গিয়ে পরিশ্রমটা ওর একটু বেড়েছে বই কী! চাকরটাকে বিদেয় দিয়েছে। শুধু খন্দের কয় মাস একটা গাবুর রাখে। সেই গাবুরের সাথে সেকান্দর নিজেও ফুরসুত মতো হাল ধরে। ডাল খেসারি, এ সব ফসলের জন্য ও নিজেই চাষ দেয়, বীজ বোনে। দিনের কাজগুলো সেরে বিকেল বেলায় যেতে হয় সৈয়দ বাড়ি রাবু আর আরিফাকে পড়াতে। মাস মাস সৈয়দ বাড়ির ওই দশটি টাকা বড় লোভনীয়। সব দিক সামাল দিয়ে চলার জন্য ওই টাকাটা একটা নিশ্চিন্ত অবলম্বন। বিকেলটা সৈয়দ বাড়িতে কাটে বলে সুলতানকে নিয়ে রাত্রে আর বসা হয়ে উঠে না। সকালেই ওকে নিয়ে কিছুক্ষণ বসতে হয়।

দিন আর রাতের এমনি একটানা খাটুনির পর লেকু কসিরের কথা, বাকুলিয়ার কথা চিন্তা করা, এ কেমন করে সম্ভব হবে: কখনো সম্ভবও হয়নি। কিন্তু আজ লেকু ওরা সমস্ত দায়িত্বটাই ওর উপর ছেড়ে দিয়ে গেল কেন? একি ওদের বিশ্বাস অথবা ওকে একটু বাজিয়ে দেখবার ছল! সেই কখন চলে গেছে ওরা, তবু উঠোনে ওই বৈঠকের জায়গাটিতেই বসে বসে ভাবছে সেকান্দর।

কী বলবে ও ফেলু মিঞাকে? সেই হুরমতির বিচারের দিন সেকান্দরের কথায় ফেলু মিঞা রীতিমতো নাখোশ হয়েছে সে তো স্পষ্ট। এর পর ফেলু মিঞা কী শুনবে ওর কোনো আর্জি? তা ছাড়া ওঁর নিজেরই যে খাজনা বাকী তিন সনের। নিজেরটা পরিষ্কার না করে অন্যের জন্য কেমন করে সুপারিশ করবে ও? মনে মনে একটু হিসেব কষে নিলে সেকান্দর। সামনে ঈদের জন্য কয়েকটা টাকা তুলে রেখেছে ও। সেই টাকার সাথে চলতি মাসের মাইনেটা যোগ করলে বকেয়া খাজনা শোধ হয়ে যাবে। ঈদের ভাবনা ঈদের সময়টাতেই ভাবা যাবে।

তাই ঠিক করল সেকান্দর। নিজের জমাটা পরিষ্কার থাকলে অন্যদের জন্য আবেদন করতে বাধবে না ওর।

অন্ধকারটা ঘন হয়ে রাতের খবরটা জানিয়ে গেল। আস্তে আস্তে উঠে সৈয়দ বাড়ির দিকে পা বাড়াল সেকান্দর।

সেকান্দরদের উঠোন থেকে বাইরে যাবার পথটা রমজানের গোয়াল ঘর ঘেঁষে। লেকু কসিরকে আসতে দেখেই চুপি চুপি গোয়াল ঘরে গিয়ে আড়ি পেতেছিল রমজান। শুনছিল ওদের আলোচনা। শুনতে শুনতে শরীরের রক্ত ওর মাথায় চড়েছিল আর কী এক তাণ্ডব শুরু হয়ে গেছিল ওর মাথার খুলিতে।

কমজাত ছোট লোকের দল জোট বাঁধতে শুরু করেছে। আবার গুরু ঠাউরেছে মাস্টারকে! কেন রমজানকে চোখে পড়ে না, না চোখে লাগে না তোদের? রমজানের কাছে এলে সে কী কোনো একটা পথ বাতলে দিতে পারত না? কে না জানে রমজান ফেলু মিঞার ডান হাত বাঁ হাত–ব্যাটা লেকু, গায়ে চর্বি বড় বেশি হয়ে গেছে ওর। বলে কিনা, শুয়রের জাত রমজান? যদি হতি মরদের বাচ্চা তবে রমজানের মুখের উপরই কথাটা বলতি! বলে দেখতি কত তোর মাজার জোর। মনে মনে গজরায় রমজান আর বড় ঘরে গিয়ে মাচাং থেকে এক ঝটকায় কামিজটা হাতে নেয়। তারপর কামিজটা কাঁধের উপর ফেলে বেরিয়ে পড়ে।

কমজাত কী আর সাধে বলে! বোঝে না নিজের স্বার্থটাও। রমজান তো শুধু মিঞার নায়েব নয়! আরো কিছু। চাষী আর মিঞার মাঝে রমজান হল গিয়ে এক সেতু। কত জনের কত দরবার নিয়ে ও যায় মিঞার কাছে। মিঞা শুধু চোখ তুলে একবার তাকায় ওর দিকে, যেন শুধায়, তুমি বলছ? তারপর যা চায় রমজান তা-ই মঞ্জুর করে দিয়ে অল্প হেসে কাজে মন দেয় ফেলু মিঞা।

চাষী আর মিঞার মাঝামাঝি এই যে একটা মর্যাদা রমজানের, এতো নিছক একটি মর্যাদাই মাত্র। আর কী? না এতে দুটো পয়সা আমদানি হয় রমজানের না কোনো বিশেষ সুবিধে। এমন ব্যবস্থায় ফেলু মিঞা তো খুশি হয়েই সায় দিয়েছে। কিন্তু কমজাতের বাচ্চাগুলো রমজানের নাম শুনলেই যেন ফোঁসকা পড়ে ওই ব্যাটাদের গায়ে। উপরে ফেলু মিঞা নিচে ওরা, মাঝখানের স্তরে রমজানকে বিশেষ মর্যাদা দিতে যেন আঁতে ঘা লাগে ছোটলোকগুলোর। অথচ সে কী কম করেছে, না কম করে তার চাষী ভাইদের জন্য। এই তো গেল বার জমি বর্গা দিল মিঞারা। দুকানি জমি কসিরকে পাইয়ে দিয়েছে রমজান। সৈয়দরা তো বছর বছরই জমি লাগিত দেয়। রমজানের সুপারিশেই ফজর আলির জন্য সে জমির এককানি প্রতি বছরকার বরাদ্দ। সে সব জমিতে কী ধান হয়নি? রমজান কী গেছে সে ধানে ভাগ বসাতে? আর সেই অযাচিত উপকারের প্রতিদান–শুয়রের জাত রমজান?

কয়েকটা দিন আগে সেই যে কসম খেয়েছিল রমজান, সে কথাটা মনে পড়ল ওর। এ দুনিয়াতে কোনো শালার উপকার করতে নেই। কোনো শালার উপকার করবে না রমজান, কমজাতের তো নয়-ই। অকৃতজ্ঞ ছোটলোকের দল, বোঝে কী ওরা উপকারের। ওরা বোঝে রক্ত চক্ষুর শাসন, ওরা বোঝে ডাণ্ডা, গুঁতো, উঠতে বসতে পায়ের লাথি।

আবার ওরই বিরুদ্ধে জোট বাঁধা হচ্ছে মাস্টারকে নিয়ে? বেশ, বেশ, কত ধানে কত চাল সে আমারও জানা আছে। বিড় বিড় করে যেন নিজেকেই শোনাল রমজান।

যা ঘটেছে এবং যা ঘটেনি সব মিলিয়ে রং চড়াল রমজান। তিলকে করল তাল। সুবিস্তৃত এক ষড়যন্ত্রের গোপন জাল উদ্ঘাটিত হল ফেলু মিঞার চোখের সুমুখে। গুম হয়ে সবই শুনল ফেলু মিঞা। খাজনা নেবার মালিক ফেলু মিঞাই। মাফ করনেওয়ালাও ফেলু মিঞাই। তার কাছে না এসে প্রজারা গেল মাস্টারের কাছে?

সহসা রামদয়ালের পরিবর্তে সেকান্দরকেই আপনার প্রতিদ্বন্দ্বী বলে মনে হল ফেলু মিঞার। আপনার অশিক্ষার পাশাপাশি সেকান্দরের দুটো পাস কেন যেন বড় হয়ে দেখা দিল আজ।

ছোটলোকের বাড় দিন দিন বেড়ে চলেছে স্যার। সময় থাকতেই ওদের থুতনিগুলো ভেঙে দিতে হবে। নইলে বোল ছাড়লে কী যে বলে বসবে আর কী যে করে বসবে তার কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। আর ওই যে সেকান্দর–মিনিমুখো, চুপচাপ থাকে ও, আসলে কিন্তু শয়তানের আলি খুঁটা। দুটো পাস করেছে বলে মনে করে নবাব সলিমুল্লা হয়েছেন তিনি! ছোটলোকগুলোকে ওইতো ক্ষেপিয়ে তুলছে। একটু থামল রমজান, বুঝি দেখে নিল মুনিবের মুখের প্রতিক্রিয়াটা। বলল আস্তে আস্তে : মিঞার পুত আপনি। আপনার জ্ঞানগম্যি আর বুদ্ধির কাছে আমি আদনা কোন্ ছার তবু আপনার দোয়ার বরকতে দেশ-বিদেশ যা ঘুরেছি স্যার তাতে যেমন মুনিব বাছতে ভুল করিনি তেমনি কমজাত কমদিলের লোকগুলোকেও চিনেছি রোঁয়ায় রোঁয়ায়। আমি বলছি স্যার এখুনি যদি ওই মাস্টারকে সজুত না করা যায় তবে বড় দুর্ভোগ এই গ্রামের। দুটো পাসের দেমাকেই হয়ত কোনোদিন বলে বসবে–গ্রামের বিচার আমিই করব। কিচ্ছু বিশ্বাস নেই, কিচ্ছু বিশ্বাস নেই।

ফেলু মিঞার মুখটাই আবার পড়তে চেষ্টা করল রমজান। অস্বাভাবিক গম্ভীর মুখ। রমজান কী বেশি বলে ফেলেছে? অথবা কম বলেছে। ভাবতে ভাবতেই আবার মুখ খুলল রমজান : আমি ও শুনিয়ে এসেছি স্যার, বললাম–এই গ্রামে মিঞার পুত ফেলু মিঞা থাকতে তুই আবার কে রে? ব্যাটা গোলামের বাচ্চা! তুই কেন আসিস রাজাপ্রজার ব্যাপারে নাক গলাতে?

এরপর বলার মতো কিছু খুঁজে পায় না রমজান। শ্রোতা পক্ষ নীরব, কেমন যেন নিরুৎসাহিত। অনেকক্ষণ চুপ থেকে বলল ফেলু মিঞা, কাচারিতে আসতে খবর দাও ওদের।

.

বাবা, আমার জমিগুলো একটু ভালো লোক দেখে লাগত করে দাও। তুমি ছাড়া আর কাউকে দিয়ে হবে না এ কাজ। কথাটা শেষ করে রাবু, আরিফা এবং মাস্টার সাহেবের মাঝখানের খালি চেয়ারটিতে বসলেন সৈয়দগিন্নি।

ব্যাপারটার আগামাথা বুঝতে না পেরে, সৈয়দগিন্নীর দিকে একবার তাকিয়ে চুপ থাকে সেকান্দর।

সৈয়দ সাহেব লিখেছেন, ঈদের ছুটিতে আসছেন তিনি। সবাইকে নিয়ে যাবেন কোলকাতায়। গিন্নি যেন প্রস্তুত হয়ে থাকেন। তাই জমিজমার বিলি ব্যবস্থাগুলো স্বহস্তেই করে যেতে চায় সৈয়দগিন্নি। কিন্তু আমাকে…

সেকান্দরের কথাটা শেষ হবার আগেই বলে উঠেন সৈয়দগিন্নি, হ্যাঁ বাবা, তুমি ছাড়া এই কষ্টটা আমার জন্য আর কে করবে বল? ফেলুকে যে আমার বিশ্বাস হয় না, নইলে ওর জিম্মাতেই সব ছেড়ে দিয়ে যেতাম। সহসা কোনো উত্তর জোগায় না সেকান্দরের মুখে। সৈয়দ গিন্নীর গ্রাম ত্যাগের অর্থ ওর দশটি টাকার নিয়মিত আয় বন্ধ হওয়া।

ব্যাপারটা আচমকা কিছু নয়। সেই দু বছর আগে বুড়ো সৈয়দ গত হবার পর থেকেই সৈয়দ গিন্নী যাই যাই করছেন। বাড়ির বড় বৌর বিদেশ বাসের প্রধান অন্তরায় ছিলেন বুড়ো সৈয়দ। সে বাধা অপসারিত হবার পরও বোধ হয় সব দিকে সামাল দিতে দিতে দুটো বছর লেগে গেছে ওদের। এবার যে সৈয়দ বাড়িতে সত্যি সত্যি তালা পড়বে তাতে কোনো সন্দেহ নেই সেকান্দরের।

পুকুরগুলো বড় দূরে দূরে। তোমার পক্ষে নজর রাখা সম্ভব হবে না। ওগুলো ইজেরা দিয়ে দিও। আর খেয়াল রেখ, ফসলে কিন্তু ভারি ঠকায় ভাগচাষীগুলো। পনেরা মণ ফসল হলে বলবে দশ মণ। তোমাকে পাঁচমণ দিয়েই বুঝ দেবে। মিথ্যে আর ফাঁকির রাজা ওই চাষাগুলো, সে তো জানই…।

উঠি স্যার? সৈয়দগিন্নীর কথার মাঝেই বলে উঠল মালু। অনেকক্ষণ ধরেই উঠবার জন্য উসখুস করছে ও।

যা যা, আজ ছুটি। রাবেয়া আরিফা তোমরাও যাও। এশার নামাজটা পড়ে নাও। আমি এসে ভাত দেব। সৈয়দগিন্নীই ছুটি দিলেন ওদের।

মুন্‌শীজীরা থাকবেন। মক্তবটা দেখবেন মুন্‌শীজী। ওর মাইনেটা খাজনা আদায়ের টাকা থেকে দিয়ে দিও। আর বছরের খোরাকিটা খন্দ শেষে এক-সাথেই আলাদা করে দিয়ে দিও ওঁদের। এত কাজ হয়ত একলা সামলাতে পারবে না তুমি। একটা গাবুর রেখ, মাইনেটা আমার খরচা থেকেই যাবে। এতটুকু বলে থামলেন সৈয়দগিন্নী। বুঝি ভাবলেন। ভেবে চিন্তে বললেন, তোমার বাড়ির পেছনে আমাদের তিন কানি জমি আছে না? সেই জমির ফসলটা তোমার খরচা বাবদ নিয়ে নিও তুমি।

যেন সব ব্যবস্থাই পাকাপাকি হয়ে গেছে এমন ভাবে বলে গেলেন সৈয়দগিন্নী।

.

সেকান্দরের মনে হল আপন ভাইয়ের প্রতি অবিশ্বাসের চেয়েও সৈয়দগিন্নীর অনুগ্রহ বিতরণের ইচ্ছেটাই যেন প্রবল। সেকান্দরের বাঁধা আয়টা বন্ধ হয়ে যাবে। হয়ত সেটাই পুষিয়ে দিতে চান সৈয়দগিন্নী তে-গুনা কিংবা চৌ-গুনা আয়ের ব্যবস্থা করে। কিন্তু সৈয়দগিন্নীর অনুগ্রহ ফেলু মিঞার সাথে যে চির শত্রুতার সূত্রপাত করে যাবে তার কী হবে? তাছাড়া আদায় তহশিল বিলি বণ্টনের অত ঝঞ্ঝাট কী সামলাতে পারবে সেকান্দর? অথচ লোভনীয় আয়ের কেমন একটা অপ্রত্যাশিত সুযোগ। দু বছরেই হয়ত নিজের কোনো-রকমে-চলে-যাওয়া সংসারের অবস্থাটা পাল্টিয়ে ফেলতে পারে সেকান্দর।

সেকান্দরের দ্বিধাটা এতই স্পষ্ট যে এবার আর চোখ বুজে থাকা সমীচীন মনে করলেন না সৈয়দগিন্নী। সোজা জিজ্ঞেস করলেন, বাবা! এত সংকোচ কেন তোমার? তুমি তো আর পর নও আমাদের।

সৈয়দগিন্নীর এই অযাচিত আত্মীয়তায় বুঝি আরও সংকুচিত হয়ে আসে সেকান্দর। কিন্তু সৈয়দগিন্নীর তিরস্কারের চোখ দুটো এখনও ধরা ওর মুখের উপর। ও বলতে পারে না কিছু।

রাবু আরিফা যখন পর্দা নিল তখনই তো কথাটা উঠেছিল। সবাই বলল এখন তো ওরা আর বেগানা পুরুষের সামনে যেতে পারবে না, মাস্টারকে বিদেয় দাও। আমি বললাম, তা কেন হবে? সেকান্দর তো আমার জাহেদেরই মতো, ঘরের ছেলে। বলতে বলতে অপত্য স্নেহে সত্যি বুঝি নরম হয়ে আসে সৈয়দগিন্নীর চোখ জোড়া।

ভেবে দেখি বলে বেরিয়ে এল সেকান্দর।

ফুটফুটে জ্যোৎস্না, কুয়াশার সাথে মিশে গাঢ় ধারায় ঝরে পড়ছে। শীত মাটির খটখটে রাস্তা। জ্যোৎস্না রাতের সৌন্দর্যটা কী এক সোহাগী আলস্যে শয্যা নিয়েছে ওই লক্ষ পায়ে মন্থন-করা পথের বুকে। আর সেকান্দরের পায়ে পায়ে বুলিয়ে দিচ্ছে স্নেহসিক্ত স্পর্শ। আশ্চর্য হয় সেকান্দর, আজকের এই জ্যোৎস্নাসিক্ত মাটির আর্দ্র স্পর্শটি ওর মাঝে সঞ্চারিত হবে বলেই যেন দিন কয় আগে ওর কেম্বিসের জুতোর তলাটা ফেটে গেছিল। নিজের মনেই হাসল ও। দারিদ্র্যকে সহনশীল এমন কী মহান করে তুলবার কত যুক্তিই না রয়েছে পৃথিবীতে। আপন অক্ষমতা আর ব্যর্থতাকে ঢাকবার জন্য দরিদ্ৰকুলই কত সান্ত্বনা আর দর্শনের প্রলেপ আবিষ্কার করে নিয়েছে। সেকান্দরের মনে পড়ল ওই তালতলি স্কুলেই ছোট বেলায় শোনা সতীশ স্যারের নীতি কথা : যারা দরিদ্র, নিরন্ন তাদের ভেতর থেকেই তো জন্মেছে যত মহাপুরুষ–ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, আব্রাহাম লিংকন, আরও অনেক নাম বলতেন সতীশ স্যার। সে সব নাম যথা সময়ে অর্থাৎ কলেজ ছেড়েই ভুলে গেছে সেকান্দর। বক্তৃতার শেষে বলতেন সতীশ স্যার–দারিদ্রকে হেলা কর না।

কলেজে এসে সেকান্দর নজরুলের দারিদ্র-বন্দনা পড়েছিল আর সতীশ স্যারের নীতি কথাটা নিজের জীবনে প্রয়োগ করার ব্রতও নিয়েছিল। বিশ্বাস করিয়েছিল নিজেকে প্রতিভা আছে তার, দারিদ্র্যের সাথে সংগ্রাম করেই সে প্রতিভার বিকাশ ঘটবে। কিন্তু অভিভাবকহীন দরিদ্র সংসারের অভাব নামক নিষ্ঠুর দৈত্যটি গুঁড়িয়ে দিয়েছে ওর শৈশব আর কৈশোরের সেই বিশ্বাস। বি.এ. পাস করার স্বপ্নটা চিরতরে বিসর্জন দিয়ে যেদিন মা আর ভাইবোনের মুখে অন্ন তুলে দেবার দায়িত্ব নিয়ে ও ফিরে এসেছিল বাকুলিয়ায় সেদিনই সে বিশ্বাসের মিনারটা ভেঙে চুরমার হয়েছিল। সেই ভগ্ন বিশ্বাসের জঞ্জালের উপরই জন্ম নিয়েছিল আর একটি বিশ্বাস–বিপুল ঐশ্বর্যের লালনার অভাবে এ দেশ রবীন্দ্র প্রতিভা নামক কোনো বস্তুর সাক্ষাৎ পেত না কোনোদিন। সেদিন থেকে নিজের উপর কোনো মোহ ছিল না সেকান্দরের।

.

বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের নামটাই যে কেন মনে পড়েছিল বলতে পারে না সেকান্দর। আজ একটু অবাকই হল ও।

অবশ্য এইটুকু লেখাপড়া নিয়েই বিদেশ গিয়ে নিজের ভাগ্যটা একবার পরখ করে দেখতে পারত সেকান্দর। কিন্তু ওর মনটা গ্রাম ছাড়তে সায় দেয়নি। কী যেন আছে বাকুলিয়া গ্রামে আর তালতলির স্কুলে যা ওকে বন্দী করে রেখেছে এই কয়েক মাইল পরিধির জগতে।

কিন্তু আজ তো অতি সহজেই ও ফিরিয়ে ফেলতে পারে নিজের অবস্থাটা। টেনেটুনে কড়া ক্লান্তির হিসেব করে করে দিন গুজরানের যে অভিশাপ তা থেকে মুক্তি পেতে পারে অতি সহজে। ছোট ভাই সুলতানের উচ্চ শিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের ব্যবস্থাটা করে ফেলতে এতটুকু বেগ পেতে হবে না ওর। একটা সহজ সচ্ছলতায় সুন্দর আর শ্রীময় করে তুলতে পারে সংসারের চেহারাটা। আর, যে চিন্তাটাকে মনের ধারে কাছেও ঘেঁষতে দেয় না ও, মা ঘেনর ঘেনর করে শুধুই ধমক খায় ওর, সেই একটি লাজুক লাজুক লক্ষ্মীমতী বৌর কথাটাও ভাবতে পারবে বই কী সেকান্দর। জমাতে হবে দুটো পয়সা, একটি বাড়তি মুখ মানে সেই আশায় জলাঞ্জলি। তাই তো ওই চিন্তাটাকে কখনো মনের কিনারে ঠাঁই দেয়নি সেকান্দর।

সমস্ত দুর্ভাবনা আর দুশ্চিন্তার হাত থেকে মুক্ত হবার এমন অভাবনীয় সুযোগ পেয়েও সেটা গ্রহণ করতে এত দ্বিধা কেন ওর? ফেলু মিঞার রোষবহ্নির ভয়? অপরের অনুগ্রহ করে আপনাকে ছোট করতে চায় না সেকান্দর? অথবা অন্য কিছু! নিজের মাঝেই কোনো স্পষ্ট উত্তর খুঁজে পায় না সেকান্দর।

শীত রাতের কুয়াশামাখা জ্যোৎস্নাটা কেমন যেন থকথকে। মুখে আর হাতে পায়ে মেখে দেয় কী এক ভালোলাগার পরশ। ক্ষণিকের জন্য এই ভালোলাগাটা অন্য সব দুর্ভাবনাকে বুঝি দূর করে দেয় সেকান্দরের মন থেকে কিন্তু রোমাঞ্চ নেই এই ভালোলাগায়। নেই কোনো শিহরণ। এ যেন সদর রাস্তার লম্বা বাঁকটি এড়িয়ে কোনাকুনি মেঠো পথ ভেঙে সময় এবং শ্রম বাঁচিয়ে ওই তালতলির স্কুলে পৌঁছানোর আনন্দ। আনন্দটা ফাঁকির, প্রাপ্তির নয়। কতই বা রাত হয়েছে। সন্ধ্যে সন্ধ্যে গিয়েছিল সৈয়দ বাড়ি। বড় জোর ঘণ্টাখানিক ছিল সেখানে। এরি মাঝে গ্রামটা নিঝঝুম, যেন মুখ থুবড়ে পড়ে রয়েছে রাতের বুকে। হঠাৎ ওর মনে হল দুটো ছায়ামূর্তি চলছে ওর পিছু পিছু, যেন ওকেই অনুসরণ করছে। ফিরে দাঁড়াল সেকান্দর। কুয়াশাটা বোধ হয় বেড়েছে তাই, চাঁদের আলোটা সাদা পর্দার মতো আড়াল করে রেখেছে ওদের। আগন্তুকদের ছায়াগুলো একটু এগিয়ে আসতেই সামনের ছায়াটি চিনতে কষ্ট হল না সেকান্দরের। ওটা মালু। কিন্তু, আপাদমস্তক চাদরে মোড়া পেছনের ছায়াটি কার? আরো এগিয়ে আসতে বুঝি চিনে ফেলল সেকান্দর।

হুরমতি? আর একটু হলে বুঝি চেঁচিয়েই উঠছিল সেকান্দর। এরি মাঝে কী সেরে উঠল হুরমতি? সেরে উঠে আবার রাস্তায় বেরিয়েছে? আরো আশ্চর্য, সামনে আসতেই হুরমতি মাথার চাদরটা ফেলে দিয়ে যেন সেই ছেঁকা খাওয়া কপালটা ওকে দেখাবার জন্য দাঁড়িয়ে পড়ল।

মালু নাকি রে? যাস্ কই? জিজ্ঞেস করল সেকান্দর।

তালতলি। কবির গানে। ভয়ে ভয়েই বলল মালু। পড়ার বইগুলো দেরাজে রেখেই তো ছুট দিয়েছে ও। হুরমতি তৈরি হতে দেরি করেছিল, তাই তো এভাবে মাস্টার সাহেবের মুখোমুখি পড়তে হল।

হঠাৎ মনে পড়ল সেকান্দরের এ কয়দিন পড়াশোনায় নিয়মিত ফাঁকি দিয়ে আসছে মালু। ও নিজেও বুঝি একটু ঢিল দিয়েছে এ কয়টা দিন। বলল সেকান্দর–যা। পড়াশোনায় বড্ড ফাঁকি দিচ্ছিস কিন্তু।

চাঁদের আলো হুরমতির কপালের কলঙ্কটা ঢেকে রেখেছে। তবু কেন যেন ওর দিকে তাকাতে পারল না সেকান্দর। মেয়েটির স্বভাবের প্রতি এক আধলাও শ্রদ্ধা নেই সেকান্দরের। কিন্তু ওর সাহসের কাছে মাথা নত না করে পারে না সেকান্দর। সেই ছেঁকা দেবার দিনও দেখেছে, আজও দেখল। গোটা গ্রাম মিলে কলঙ্কের দুরপনেয় স্বাক্ষর এঁকে দিয়েছে ওর ললাটে, একঘরে করেছে। তবু এই গ্রামের পথ দিয়েই ও হেঁটে চলেছে অকুতোভয়ে। ওর অপসৃয়মাণ ছায়াটির দিকে তাকিয়ে নিজকে আজ কেমন অপরাধী মনে হল সেকান্দরের। লঘু পাপে গুরু দণ্ডের মতো অন্যায়টিকে ওরা কেউ রুখতে পারল না, না সেকান্দর, না লেকু কসির মিলে গ্রামের যে মানুষ, তারা।

.

ফেলু মিঞার কাচারির দিকে তাড়াতাড়ি পা বাড়াল সেকান্দর।

সেলামের পর্ব সেরেই কথাটা পাড়ল সেকান্দর। ধৈর্য ধরে শুনল ফেলু মিঞা। শোনার পর বলল, তোমার যদি অসুবিধে হয় যা পার দিয়ে দাও আপাতত, বাকীটা দিও যখন খুশি।

রমজানের বর্ণনায় সেকান্দরের উপর বিরক্ত ও উত্তেজিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ ছিল ফেলু মিঞার। একটু যে উত্তেজিত হয়নি, তাও নয়। কিন্তু ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে নিজের রাগটার রাশ টেনেছে ফেলু মিঞা। হাজার হোক এই গ্রামের অপর দশটা পরিবারের মতো সেকান্দরের বাপ-দাদারাও মিঞাদের খেয়ে, মিঞাদের ক্ষেতে মেহন্নত করেই বেঁচেছে, মানুষ হয়েছে। সেই মিঞাদের বংশধর হয়ে ফেলু মিঞা বদদেমাগী হবে কেমন করে। লেকু ফেকুদের ব্যাপার নিয়ে তুমি কেন মাথা ঘামাতে যাও? ওটার জন্য আমার নায়েব আছে, আমি আছি। ক্ষতি করব না কোনো প্রজার–এটা তো মান? হিতাকাক্ষীর সদুপদেশের মতো ধীর কণ্ঠে বলে ফেলু মিঞা।

দু বছর পরপর দুর্যোগ গেল, ওরা কোত্থেকে খাজনা দেবে? ওদেরও কিছু মাফ করে দিন, নতুবা যা নেবার সে নেবেন আগামী সনে। অনুরোধের স্বর ফোটাল সেকান্দর।

সহসা ভ্রূজোড়া কুঁচকে চোখ দুটোকে ছোট্ট এতটুকু করে আনল ফেলু মিঞা। ছুরির মতো তীক্ষ্ণ আর ধারালো স্বরে বলল, রাজস্টেট কী খাজনাটা মাফ দেয় আমাকে?

এর পর সেকান্দরের বলার কিছু থাকে না, আস্তে উঠে পড়ে ও। বাড়ি ফিরতে ফিরতে ভাবে সেকান্দর। বিছানায় শুয়ে শুয়েও শেষ হয় না ভাবনাটা। কাল সকালেই তো আসবে ওরা। কী বলবে সেকান্দর? দিও না খাজনা, ক্রোক আসুক! ক্রোকই বা লাগবে কেন? রমজান কালুর দল লাগিয়ে ফেলু মিঞা যদি ভেঙেই দেয় ওদের ঘরগুলো, লাঙ্গল চালিয়ে সমান করে দেয় ভিটি-ভুটি, কী করবে ওরা? কী করতে পারে? বাধা দিতে গেলে, বড় জোর দু একটা খুন জখম হবে। আর খুন হলেই বা কী! এই পড়তি অবস্থায়ও দুচারটা খুন হজম করে নেবার শক্তি এবং বুদ্ধি দুই-ই আছে মিঞাদের।

কী যে করবে ওরা সেটা যেন স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছে সেকান্দর। ওরা যাবে রামদয়ালের কাছে। টাকা নেবে, মিটিয়ে দেবে মিঞার পাওনা। বাকুলিয়ার আরো কিছু জমি যাবে রামদয়ালের পেটে আর ওই লোকগুলো সম্বৎসর উপবাসের চিত্রটা কল্পনা করে এখুনি আধমরা হবে। যদি তাকত পায় শরীরে তা হলে চলে যাবে পূবে অথবা উত্তরের পাহাড়ে। যখন ফিরে আসবে সেই তখন দুটো ভাত পেটে পড়বে বৌ বাচ্চাদের। কিন্তু জমি? যে গেল সে তো আর উদ্ধার করতে পারবে না ওরা। এমনই হয় এমনই হচ্ছে, সেই ছোটবেলা থেকেই তো দেখে আসছে সেকান্দর। রেহানী জমি কখনো ফিরে আসে না কৃষকের হাতে।

এ ছাড়া অন্য উপায় আছে কী? মাঝ রাতেও চিন্তার হাত থেকে রেহাই পায় সেকান্দর। কী হল সেকান্দরের? এ সব চিন্তা তো কোনোদিন গিঁঠ পাকায়নি ওর মাথায়? পাঁচজনে মিলে বিশ্বাস করে ওকে একটা দায়িত্ব দিয়েছে, তাই বলে এমন অস্থির হতে হবে কেন ওকে? ফেলু মিঞার দয়া হয়নি অতএব যার যা করার কর গিয়ে। সেকান্দর মাস্টারের কিছুই করার নেই। সব চিন্তা দূরে সরিয়ে ঘুমের আরাধনায় মন দিল সেকান্দর।

ঘুম বুঝি হল না। দুটো পাশ ফিরতেই সকাল হয়ে গেল। কী সব অশ্রাব্য গালিগালাজ কানে এসে ওর চোখের পাতাগুলো আত্মা করে দিল। চোখ মুখে এক কোশ পানি ছিটিয়ে মুখটা মুছতে মুছতে বেরিয়ে এল সেকান্দর।

হারামজাদা বেজন্মা, কুত্তার বাচ্চা। গর্দান তোর মটকিয়ে ভাঙব, রক্ত তোর চুষে চুষে খাব। বেজন্মা কুত্তার বাচ্চা…

কার বিরুদ্ধে আস্ফালন করে চলেছে রমজান, আর গিরোয় গিরোয় টিনের পাত দিয়ে বাঁধা বাঁশের লাঠিটা অনবরত শূন্যে ঘুরিয়ে চলেছে। লাঠি ঘুরোতে ঘুরোতেই, ডাঙ্গা পেরিয়ে দৌড়ে যাচ্ছে রমজান, যেখান থেকে লেকুদের বাড়ির কলা গাছের ঝাড়টা চোখে পড়ে সেই উঁচুমতো ফাঁকা জায়গাটিতে।

রমজানের এমন হিংস্র ক্রুদ্ধ মূর্তি ক্কচিৎ দেখেছে সেকান্দর। সদ্য ঘুম ভাঙা চোখে ও ঠাহর পায়নি, উঠোনের মাঝখানে বাঁধা রমজানের গাই-গরুটি। গাইটির গা-ময় ছোপ ছোপ রক্ত। মাঝে মাঝে গাইটির দিকে তাকিয়ে রমজান যেন হিংস্রতর হয়ে উঠছে। আক্রোশে ফুলে উঠছে ওর শরীর। বাতাস চিরে চিরে হুংকার ছাড়ছে। সেই হুংকারের সাথে গালভর্তি পানের পিক ছিটকে পড়ছে ওরই গায়ে, আশপাশে। ভারি পায়ের গোড়ালিগুলো ঠনঠনে উঠোনের মাটিতে যেন ঠং ঠং করে বাজছে, যেন কাঁপছে উঠোনটা। কে না চেনে রমজানের এই হিংস্র বীভৎস চেহারা বাকুলিয়ায়, গোটা মৌজায় এ চেহারা মূর্তিমান ত্রাস। প্রমাদ গোণে সেকান্দর, একটা খুনখারাবি কাণ্ড বাধিয়ে তুলবে রমজান।

ঘটনাটা ঘটেছিল সেই সোবেসাদেকের সময়। আম্বরি উনুনের ছাই ফেলতে গিয়েছিল বাড়ির পেছনে। ছাই গাদাটা একেবারে বাড়ির শেষ সীমায়। তারপর একটা গড়। গড়ের ওপারে ওদের এক ফালি ক্ষেত। কার্তিকের শেষাশেষি ওই ক্ষেতটায় লেকু ছিটিয়ে দিয়েছিল খেসারি, ওরা বলে বাউলা। ছাই ফেলতে এসে ক্ষেতটার উপর একবার চোখ বুলোন আম্বরির রোজকার অভ্যাস।

ও দেখত, শীষ গজাল বাউলার। শীষ থেকে বেরিয়ে এল কচি কচি পাতা। শীষটা বাড়তে বাড়তে লতিয়ে গেল। সেই লতা থেকে লকলকিয়ে উঠল চিকন চিকন সবুজ শাখা। সবটা মিলে পুষ্ট হল, থলথলিয়ে উঠল সবুজ লতানো দেহগুলো। ফুল হল, ফুলের বুক চিরে বেরিয়ে এল ছড়া।

ছাইয়ের ডালাটা কোমর থেকে নাবাতে ভুলে গিয়ে তন্ময় হয়ে চেয়ে থাকত আম্বরি। লতানো দেহগুলো ছড়ার ভারে নুয়ে পড়েছে। পাতারাও ঢাকা পড়েছে ছড়ার আড়ালে, এত ঘন হয়েছে বাউলার ছড়া। গড়টা পেরিয়ে একবার আলের উপর গিয়ে দাঁড়াত আম্বরি; মাটি দেখা যায় না, গোটা জমিনটা যেন এক হাত পুরু সবুজ কাঁথায় ঢাকা পড়েছে।

ধীরে ধীরে ফিকে হতে থাকে বাউলা পাতার রং, ছড়াগুলোও হলদেটে হয়ে ওঠে। ওরা ঠিক করেছিল, আর কয়টা দিন গেলেই, তুলে আনবে বাউলাগুলো। ইতিমধ্যে কাঁচা বাউলাও দুচারিদিন খোলায় ভেজে খেয়েছে ওরা। লেকুর বেজায় আপত্তি, বলেছিল–কাঁচাই শেষ করবি নাকি!

আজ ক্ষেতটার দিকে ভালো করে তাকাবার আগেই গাদায় ছাই ফেলল আম্বরি। কোদাল নিয়ে এসেছিল ও, ছাইয়ের গাদাটা ঢিপির মতো উঁচিয়ে উঠেছে। কোদাল চালিয়ে ওটাকে সমান করে দিল ও। কিন্তু, গড়ের পারে উঠে ক্ষেতের দিকে তাকিয়েই বুকটা ওর ধড়ফড়িয়ে উঠল, এ কী দেখছে ও। দুটো গরু অসম্ভব দ্রুততায় সংহার করে চলেছে বাউলা ক্ষেতটা। অদূরে উত্তর কোণে যেখানে রমজানের বাড়ির একটা সীমানা এসে মিশেছে ক্ষেতের সাথে সেখানে দাঁড়িয়ে রমজান। ডালা কোদাল ফেলেই পড়ি মরি ছুটে আসে আম্বরি ওর মানুষটিকে জাগিয়ে তোলে। লেকু এসে দেখে প্রায় সিকি ক্ষেত নিঃশেষ। ক্ষেতটার মাঝে খেজুর কাঁটা বিছিয়ে রেখেছিল লেকু আর তিন দিক থেকেই চোখা চোখা কাঁটাওয়ালা খেজুর ডালের থের তৈরি করে দিয়েছিল। গরু ছাগলের সম্ভাব্য আক্রমণের বিরুদ্ধেই এ সব সতর্কতা। দু হাতে দুটো খেজুর ডাল উপড়ে নিয়ে লেকু তাড়া করল গরু দুটোকে। একটি ছুটে কোনো রকমে পালিয়ে গেল। কিন্তু গাইটা পালাবার পথ পেল না। উন্মাদের মতো লেকু পিটিয়ে গেল গাইটাকে। লম্বা লম্বা কাঁটাগুলো গভীর ক্ষত করে বসে গেল গাইটার গায়ে, ভেঙে ভেঙে লেগে রইল গোশতের ভেতর। কসির যাচ্ছিল তালতলি কামলার কাজে। সে-ও একটা কাঁটা ডাল তুলে নিয়ে লেগে গেল পিটুনী যজ্ঞে। কাঁটায় কাঁটায় বুঝি জর্জর হল গাইটার শরীর। রক্ত ঝরল ফোঁটা ফোঁটা। থক থক রক্ত জমল চামড়ার উপর। অবশেষে প্রাণভীতু পশুটাও শেষ শক্তি টেনে উৰ্দ্ধশ্বাসে দৌড় দিল। লেকু কসিরের রাগটাও বোধ হয় পড়ে এসেছে ততক্ষণে।

রমজান ভাবেনি এতদূর গড়াবে ব্যাপারটা, এমন মারাত্মকভাবে জখমি হবে গাইটা। পয়লা বিয়ানের গাই। রোজ দেড় সের করে দুধ দিচ্ছিল। ও জখমি সেরে উঠবে গাইটা, ভরসা কম। গাইটার শোকেই অমন ক্ষিপ্ত হয়েছে রমজান।

গাইটার গায়ে হাত রেখে চমকে উঠল সেকান্দর। কাঁটায় কাঁটায় একসার গোটা শরীর। ফোঁটা ফোঁটা রক্ত ঝরছে, নিচের মাটিটা রক্তে ভিজে লাল হয়ে গেছে। ইস্ নির্বোধ পশুটাকে এমন ভাবে জখম করল লেকু? রমজানের প্রতি নয়, অবুঝ পশুটার প্রতি সহানুভূতিতে সেকান্দরের মনটা বিরূপ হল লেকুর উপর।

হি হি হি হি, তীক্ষ্ণ হাসিতে রমজানের হু হুংকার চিৎকারটাও বুঝি তলিয়ে গেল।

রমজানের উঠোনের দক্ষিণ পাড়ে ডাঙ্গা। ডাঙ্গা ঘেঁষে পায়ে চলা পথ। সেখানে দাঁড়িয়ে হাসছে হুরমতি। কপালের পোড়াটি ওর বীভৎস এক হাঁ মেলে চেয়ে রয়েছে। এখনো পুরোপুরি শুকোয়নি ঘা-টা। রাতজাগা ফ্যাকাশে মুখটা যেন হঠাৎ আলো লেগে কেমন ঝলকে উঠেছে। তালতলির কবির গান শুনে এই মাত্র বুঝি ফিরছে হুরমতি।

কেম-ন? হার্মাদির ফলটা কী খুব তিতো লাগছে এখন? হি হি হি। আবার হাসে হুরমতি। সেকান্দরের চোখে চোখ পড়ে গিয়ে যেন আরো বেশি করে হাসে ও। আর ওর হাঁ মেলা ঘা-টাও কী এক ক্রুর বীভৎসতা নিয়ে যোগ দেয় সে হাসিতে।

চিৎকার থামিয়ে কুঁতকুঁতে চোখ দুটোকে সরু করে হুরমতিকে একবার দেখে নিল রমজান। হাতের লাঠিটা ছুঁড়ে মারল হুরমতির দিকে। কিন্তু লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে লাঠিটা ঝুলে রইল কলা গাছের মাথায়।

বাহরে আমার মরদ। মেয়েমানুষের উপর বাহাদুরি কেন? যাওনা লেকুর কাছে? যেন জিঘাংসার একখানি ছুরি ঝিলিক দিয়ে গেল হুরমতির ঠোঁটের আগায়। রমজান কুঁদে উঠবার আগেই মিলিয়ে গেল হুরমতি। হারামজাদি কুচকি, নিষ্ফল আক্রোশে গর গর করে রমজান।

উন্মত্ত রমজান কী যে করে বসবে কে জানে? আশঙ্কায় বুক কাঁপে সেকান্দরের। লেকুদের বাড়ির খেজুর পাতার আব্রুটার বাইরে দাঁড়িয়ে ও ডাক দেয়–লেকু বাড়ি আছ?

দাওয়ায় বসে কোঁচের শলায় ধার তুলছিল লেকু। সেকান্দরের ডাক শুনে কোঁচটা এক পাশে সরিয়ে চলে যায় ঘরে। আম্বরির নক্সা আঁকা বঠনীটা বাইরে এনে বিছিয়ে দেয় দাওয়ায়। আম্বরি ঘোমটা তুলেছে কিনা একবার আড়চোখে দেখে ডাক দেয়–আসেন, মাস্টার সাব!

বঠনীতে পা তুলে বসে সেকান্দর। তারিফ করে বনীর নক্সার, বলে আম্বরি করেছে, না?

ছোট্ট একটা হুঁ বলে লেকুও তাকায় রুইতনের ঘরের মতো নক্সাগুলোর দিকে নক্সাটা যে সুন্দর, এ কথাটা কোনোদিন মনে হয়নি ওর।

আম্বরি আমাদের খুব কামের বৌ, না রে লেকু? লেকুর জমাট গাম্ভীর্যটাকে একটু তরল করার উদ্দেশেই বুঝি বলল সেকান্দর।

নিরুত্তর লেকু তাকায় আম্বরির দিকে। বুঝি লজ্জা পেয়ে ঘোমটাটাকে আরো কয়েক ইঞ্চি মুখের উপর নাবিয়ে নিয়েছে আম্বরি। প্রথমে ফেলু মিঞার সাথে গত রাত্রির আলাপের কথাটাই পাড়ে সেকান্দর। মেহেরবানী হয়নি তার, এখন ওরা করবে কী? লেকুর উত্তরের জন্য অপেক্ষা করে সেকান্দর।

লেকুদের ঘরের সামনে উঠোনটুকু মাত্র কয়েকহাত। তারই মাঝে উত্তরের কোণটা খেজুর পাতার বেড়া দিয়ে চলে এসেছে আম্বরি। ঘরের দিকটায় বেড়া নেই, ওটা খোলা। উপরেও কোনো আচ্ছাদন নেই। শীতকালে উন্মুক্ত আকাশের তলায় এমনি ভাবেই রান্নার ব্যবস্থা করে এদিকের কৃষকরা। বৃষ্টি-বাদলার ভয় নেই দিব্যি খটখটে আবহাওয়া। এই আবহাওয়ায় খোলামেলা জায়গায় চুলো বসিয়ে রান্না করাটা চমৎকার একটি আনন্দ। খড়কুটো, শুকনো ডালপালার আগুন জ্বলে লকলকিয়ে। রান্নাও হয়, আগুন পোহানোর কাজও চলে।

শুকনো সব আম জামের পাতা, পটপটির মতো শব্দ তুলে ফাটছে, জ্বলছে। খোলায় চাল ভাজছে আম্বরি। ঠুটঠার লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়ছে চালগুলো। চালগুলোর সেই কাতর ছটফটানীর সাথে তাল রেখেই আম্বরির হাতের কলা ডগাটি দ্রুত সঞ্চালিত হচ্ছে। তারপর আঙ্গুলের আগায় করে দুটো চাল তুলে আম্বরি পট করে ছুঁড়ে দেয় মুখের ভেতর। মুড় মুড় করে গুঁড়িয়ে গেল চালগুলো ওর দাঁতের নিচে। বুঝল আম্বরি ঠিক মতোই হয়েছে করই ভাজাটা। খোলাটা উপুড় করে নামিয়ে নিল করই। তারপর এক চিমটে লবণ মিশিয়ে দু মুঠ বাউলা ছেড়ে দিল খোলার উপর।

আজ তো আমার ওখানে যাওয়ার কথা ছিল তোমাদের, যাবে না? লেকুকে নিরুত্তর দেখে শুধাল সেকান্দর।

নাঃ যা করার আপনারাই ঠিক করেন, এতক্ষণে মুখ খুলল লেকু। কিন্তু গলাটা ওর মুখটার মতোই কেমন ভার ভার।

লেকুর নিরুৎসাহ দেখে যে কথাটা প্রথমেই বলবে ভেবেছিল সেটাই বলল সেকান্দর : অবোধ পশুটা, ওটা তো বেকসুর। কেন অমন অমানুষের মতো মারলে ওটাকে?

লেকু তাকায় মাস্টারের দিকে, দপ করে জ্বলতে গিয়েই নিভে যায়।

শুধু বলে, মাস্টার সাব, আপনি আপনিও?… শেষ করতে পারে না লেকু।

কণ্ঠনালির কোনো গ্রন্থিতে যেন আটকে গেছে কথাগুলো। অপ্রকাশিত ব্যথার মোচড়ে নীল শিরা জাগা বিকৃত মুখখানি অন্যদিকে ফিরিয়ে নেয় লেকু। কী এক কষাঘাতে যেন জর্জর হল সেকান্দর। লেকুর অসমাপ্ত বাক্যের না-বলা কথাগুলো সাজিয়ে গেল মনে মনে : তুমি তো রমজানের জ্ঞাতি ভাই, জমি আছে, মাস্টারী আছে তোমার। পেট ভরে মাছ ভাত খাও দু বেলা। তুমি তো বলবেই ও কথা। রমজান তোমার কাছে মানুষ, তার গরুটাও বোধ হয় মানুষ তোমার চোখে। কিন্তু লেকু, সে অমানুষ, অমানুষ … সেকান্দরের মনে হল প্রচণ্ড ঘৃণা মিশিয়ে এ কথাগুলোই বলতে চেয়েছিল লেকু।

আম্বরি ওদের সামনে দু খোরা বাউলা মেশানো করই ভাজা রেখে যায়। একটা খোরা টেনে নেয় সেকান্দর। কিন্তু খোরাটার উপর চোখ রেখেই জ্বলে উঠল লেকু। এতক্ষণের সংযমের বাঁধটা বুঝি ভেঙে পড়েছে ওর। কী রে আম্বরি: বাউলা কোথায় পেলি? চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল ও।

কেন ক্ষেত থেকে আনলাম তো?

কার হুকুমে, কার হুকুমে ক্ষেতের বাউলা ধরলি তুই? একশো বার যে না করেছি?

ইস, গরু-ছাগলে খেতে পারে আর মানুষে খেলে দোষ? হঠাৎ কেমন ঠেস দিয়ে বলল আম্বরি।

ওরা যেন ভুলেই গেল ভিন্ বাড়ির লোক সেকান্দর মাস্টার উপস্থিত ওদের মাঝে।

মানুষ? কে? তুই? আমি? পশুর চেয়েও অধম। অমানুষ অমানুষ। বলতে বলতে খোরাটা হাতে তুলে নিল লেকু। ছুঁড়ে মারল আম্বরির মাথাটা লক্ষ্য করে। খা তোর বাউলা তুই খা।

মাটির খোরা, আম্বরির কপালে লেগে দুটুকরো হয়ে ভেঙে পড়ল। আর আম্বরির চোখের কোণ থেকে কান পর্যন্ত চামড়াটা দু ফাঁক করে রেখে গেল। অল্পের জন্য বেঁচে গেছে চোখটা। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটছে আম্বরির গাল বেয়ে। হতভম্ব আম্বরি! যন্ত্রণাটা ব্যক্ত করার ভাষাটাও হারিয়ে ফেলেছে বুঝি।

অমানুষের জাত, বাউলা খাবার শখ? অকারণেই সেই পাশে ফেলে রাখা কোঁচটা হাতে তুলে নিল লেকু। আর বাকী রাগটুকু সেই কোঁচটার উপরই ঝেড়ে ফেলল। সজোরে উঠোনের দিকে সোজা করে ছুঁড়ে দিল কোঁচটা। ঘচাং ঘিং একটা আওয়াজ তুলে মাটির গায়ে গেঁথে রইল কোঁচের তীক্ষ্ণ শলাগুলো। অপরাধীর মতো মাটির দিকে চেয়ে রইল সেকান্দর। না পারল লেকুর দিকে চাইতে, না পারল আম্বরিকে একটা সহানুভূতির কথা শোনাতে। ত্রস্তপদে যেন পালিয়ে এল সেকান্দর। কী জন্য এসেছিল সে, আর কী হয়ে গেল। কিছুদূর এসে পেছনে তাকিয়ে দেখল খেজুর পাতার দরজাটা আলগা করে বেরিয়ে এল লেকু; হন হন করে চলে গেল তালতলির রাস্তাটার দিকে।

অপরাধ গ্লানিমার বোঝা ঠেলে অবশেষে একটা স্বস্তির নিশ্বাস উঠে এল সেকান্দরের বুকের ভেতর থেকে। যাক, কপালের খুন ঝরিয়ে পিঠটা আজ বাঁচাতে পেরেছে আম্বরি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *