1 of 3

১.২৯ আমি দেহ বেচে ভবের হাটে

আমি দেহ বেচে ভবের হাটে দুর্গানাম কিনে এনেছি

বলাইবাবু খুব পোষ মেনে গেছে। পিতা তার পিঠ পালিশ করে দিয়েছেন। এমন পরিচ্ছন্ন কচ্ছপ জীবজগতে আর দুটি নেই। সারা বাড়িতে ইচ্ছেমতো পায়চারি করে বেড়ায়। খাদ্য পুঁইশাক, কুটনোর খোসা, আলু, কলা। চুকচুক করে দুধ খেতে শিখেছে। আগের মতো আর কথায় কথায় খোলে ঢুকে পড়ে না। গলা বের করে পৃথিবী দেখে। তবলার শব্দে চঞ্চল হয়।

রান্নাঘরের সামনে বারান্দায় বলাই ঘুরছে। পিতা ডাকছেন, বলাই আয়, একটু চা খেয়ে যা। নীচে প্রফুল্লকাকা কাপড় থোবার তালে তালে গাইছেন, লোহারই বাঁধনে বেঁধেছে সংসার, দাসখত লিখে নিয়েছে হায়।

সামনের রাস্তায় গাড়ি থামার শব্দ হল। মনে হয় মাতুল এলেন। এতদিনে সিনেমা নিশ্চয় অনেকটা এগিয়ে গেছে। গম্ভীর গলায় ডাক শোনা গেল, হরিদা আছেন, হরিদা।

দীর্ঘকাল পরে মেসোমশাই এলেন। নিশ্চয় মেয়ের বিয়ের নিমন্ত্রণ করতে এলেন! এমাসে কি বিয়ের দিন আছে! যে জানে সে জানে। আসুন আসুন, বলে পিতা সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন। বলাইবাবু প্লেট থেকে চেটে চেটে চা খাচ্ছে।

মেসোমশাইকে বেশ চিন্তিত মনে হচ্ছে। ভেবেছিলুম পেছন পেছন প্রতাপ রায় উঠে আসবেন না, মেসোমশাই একা। গাড়িটা অবশ্য প্রতাপ রায়ের। ড্রাইভার চালিয়ে এনেছে। বসার ঘরের চেয়ারে বসে মেসোমশাই চারপাশ একবার ভাল করে দেখে নিয়ে, কেউ কিছু প্রশ্ন করার আগেই বললেন, বড় দুঃসংবাদ।

পিতা উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন, কেন, কী হয়েছে? মেয়েরা ভাল আছে তো!

মেয়েদের মধ্যে ছোট মেয়ে ভালই আছে, পরীক্ষাও ভাল দিয়েছে, তবে বড় মেয়েটা নেই।

নেই মানে? পিতা প্রায় চিৎকার করে উঠলেন। আমার বুকের মধ্যে কেমন করছে। গলা শুকিয়ে কাঠ। কনক মারা গেছে! সে কী করে হয়?

হরিদা, কনক নিরুদ্দেশ, কনককে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না! তা কী করে হয়! ছেলেরা হিরো হবার জন্যে বাপের পকেট কেটে বোম্বে পালায়। মেয়ে পালায়, আমি বিশ্বাস করি না। কনক সেরকম মেয়েই নয়। আপনারা ভাল করে খুঁজে দেখেছেন?

কোথাও বাকি নেই। নো স্টোন লেফট আনটার্নড। সব জায়গা দেখেছি। হাসপাতালে, মর্গে, শ্মশানে। থানায় ডায়েরি করা হয়েছে। কোনও খবর নেই। কনক এখানে আসেনি তো!

এখানে? এখানে এলে তো আপনাকে আগেই বলতুম।

সেইটাই তো উচিত। তবে মানুষ তো অনেক সময় অনেক কিছু চেপে যায়!

বাঃ বাঃ, বেশ বললেন যা হোক। চেপে রাখার পেছনে একটা উদ্দেশ্য থাকবে নিশ্চয়ই। এখানে আমার উদ্দেশ্যটা কী!

আপনাদের দিকে কনকের একটা টান দিনদিন বাড়ছিল। তার ওপর আমি প্রায় জোর করেই তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে প্রতাপের সঙ্গে ম্যারেজ ফাঁইন্যালাইজ করে ফেলেছি। এই অবস্থায় সে কোথায় যেতে পারে! লজিক বলে, এখানেই আসা উচিত।

আপনার লজিকের নিকুচি করেছে! এমন ফাদার আমি জীবনে দেখিনি। পুরো ঘটনাটা বলুন।

আপনার ছেলে এখানে আছে তো?

দরজা দিয়ে উঁকি মেরে একটু আগে কে দেখে গেল?

হ্যাঁ, মনে হল তাই; কিন্তু সাহস করে ঘরে আসছে না কেন? ও মহলে কেউ নেই তো!

পুলিশের কাছ থেকে একটা সার্চ ওয়ারেন্ট বের করে তা হলে বাড়ি সার্চ করান।

না, সেটা তো হয়ে গেল শেষ কথা, তার আগে দেখতে হবে, একটা অ্যামিকেবল সেটলমেন্টে আসা যায় কি না!

না আসা যায় না, আপনার মতো একটা ক্রুকেড লোকের সঙ্গে কোনও সেটলমেন্ট চলে না।

হ্যাঁ, তা তো বলবেন। মেয়ের বাপ হলে বুঝতেন কী জ্বালা!

মেসোমশাই হাক পাড়লেন, কনক, কনক, আমি এসেছি, কাল থেকে প্রতাপ তোর জন্যে না খেয়ে আছে মা।

আপনার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। যান সারাবাড়ি তন্নতন্ন করে দেখে আসুন।

মেসোমশাই লাফিয়ে উঠে দরজা দিয়ে বেরোতে গিয়ে আতঙ্কে চিৎকার করে উঠলেন, ওটা কী?

সামনেই আমি দাঁড়িয়ে ছিলুম। মেয়ে হারিয়ে গেল তবু জীবনের ভয় গেল না। অতবড় একটা মানুষ, সামান্য একটা কচ্ছপ দেখে আঁতকে উঠলেন। বললুম, চলে আসুন, ভয় নেই, ওটা একটা কচ্ছপ!

কচ্ছপ! ছি ছি, অযাত্রা। তোমরা কচ্ছপ খাও নাকি!

ওটা খাবার নয়, আমরা পুষেছি।

কচ্ছপ আবার কেউ পোষে নাকি? যাক তোমাদের ব্যাপার, আমার নাক গলিয়ে দরকার কী! তা তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি, কনক কি সত্যিই এই বাড়িতে নেই!

আপনি নিজে দেখুন না। সব ঘুরে দেখে আসুন।

মেসোমশাই আবার লাফিয়ে উঠলেন, ওই তো কনকের গলা। নীচে লুকিয়ে আছে।

সিঁড়ির দিকে দৌড়ালেন। কাকিমার গলা। নিজের মেয়ের গলা চেনেন না! বাধা না পেলে এখুনি হুড়মুড় করে নীচে ছুটতেন। ও কনকের গলা নয়। বারান্দা দিয়ে নীচের দিকে তাকিয়ে দেখুন।

ও বাবা, ইনি আবার কে?

বাবার বন্ধুর স্ত্রী।

হরিদার স্বভাবই হল যত উড়ো ঝামেলায় জড়িয়ে পড়া। তা পড়ুন। আমার তাতে কী! কনক নীচে নেই তো!

আপনি অনর্থক সময় নষ্ট করছেন। কনক এখানে আসেনি।

চুপ করো পেঁপো ছেলে, আমার মেয়ের মাথাটি তুমিই খেয়েছ। প্রেম কাকে বলে সে জানত! প্রেম আবার কী? প্রেম! রাধাকেষ্ট পালা।

ঘর থেকে পিতা সাবধান করলেন, তুমি চলে এসো। দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মানুষ। কোনও উত্তর দিয়ো না। চলে এসো।

মেসোমশাই হতাশ হয়ে বেশ কিছুক্ষণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইলেন আকাশের দিকে তাকিয়ে। তারপর ধীর পায়ে ঘরে এসে ঢুকলেন। চোখে জল। পিতা বললেন, শান্ত হয়ে বসুন, বিনয়দা। বিপদের সময় উতলা হতে নেই।

মেসোমশাই রুদ্ধ কান্নায় ফুলেফুলে উঠতে লাগলেন, হরিদা, আমি কোন মুখে বাড়ি ফিরব? বাড়ি গিয়ে আমি কী বলব? এই এত বড় শহর, কোথায় আমি খুঁজব!

আপনি কোনও চিঠি পেয়েছেন?

কী চিঠি? কনকের সুসাইড নোট!

না, র‍্যানসাম চেয়ে কোনও চিঠি। যেমন বিলেতে হয়। প্রথমে কিডন্যাপ করে নিয়ে যায়, তারপর বিরাট টাকা চেয়ে চিঠি ছাড়ে না দিলে খুন করে।

না, কোনওরকম চিঠিই আমি পাইনি।

ঘটনাটা খুলে বলুন তো আপনি।

কাল সকালে প্রতাপের বউদির সঙ্গে…

প্রতাপের তো কেউ নেই শুনেছিলাম।

না না, সবাই আছে, মিল নেই, আলাদা আলাদা থাকে। মামলা-মকর্দমা চলছে।

বেশ বলুন তারপর। বউদির সঙ্গে?

বউদির সঙ্গে দক্ষিণেশ্বর যাবে বলে বেরোল। বেলা একটার সময় বউদি ফিরে এলেন। এসে জিজ্ঞেস করলেন, কনক ফিরেছে। আমরা অবাক। কনক একা ফিরবে কী করে! সে তো গেল আপনার সঙ্গে। খোঁজ খোঁজ, তোলপাড়, এখনও তার সন্ধান নেই।

জল-পুলিশে খবর নিয়েছেন?

জল-পুলিশে কেন?

দক্ষিণেশ্বরের গঙ্গাটা মশাই তেমন সুবিধের নয়। এ সময়টা আবার বান আসার কাল। হয়তো জলে নেমেছিল, টেনে নিয়ে চলে গেছে।

সঙ্গে যিনি ছিলেন, তিনি বলছেন, গঙ্গার ঘাটে সে নামেনি। পঞ্চবটীর কাছে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়।

সেই মহিলার কথা কতটা বিশ্বাসযোগ্য! আপনি খুব ভুল করেছেন। শুনেছেন নিশ্চয়, লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু।

কার লোভ, কীসের লোভ!

বড়লোক জামাইয়ের লোভ। অগাধ বিষয়সম্পত্তি। মামলার জট ছাড়াতে পারলেই, অভিভাবক হয়ে নিজে লাঠি ঘোরাবেন। এখন ম্যাও সামলান। ওরা কায়দা করে আপনার মেয়েকে মেরেও ফেলতে পারে।

মারবে কেন? মেরে ফেলে কার কী লাভ হবে!

খুব হবে। প্রতাপের উত্তরাধিকারী আসার পথ বন্ধ হবে। আপনি আইন বোঝেন, এই সামান্য জিনিস বোঝেন না? জমিদারি মানেই খুন, জখম, রাহাজানি, হত্যা, ব্লাডবাথ। অর্থকণিকা আর রক্তকণিকা এক জিনিস। আমাদের এখানে এক জমিদারকে বিষ খাইয়ে মেরেই দিলে। কে মারলে, জানেন? ভাগনে। সমস্ত সম্পত্তি পড়ে রইল কোর্ট অফ ওয়ার্ডে। নাবালক ছেলে কবে সাবালক হবে, তারপর সব ছাড়ান পাবে! এর মধ্যে তাকে যদি সরিয়ে ফেলতে পারে তো হয়ে গেল! বেশ ছিলেন এখানে, লোভে লোভে পা দিলেন গিয়ে জতুগৃহে।

হরিদা, আমি তো এত সব ভাবিনি। আমি এখন নিমজ্জমান ব্যক্তি। আমাকে তিরস্কার না করে উদ্ধার করুন।

পিতা আপনমনে বলতে লাগলেন, কোথায় যেতে পারে? আচ্ছা, প্রতাপকে কি ওর পছন্দ হয়নি?

মেয়েদের আবার পছন্দ-অপছন্দ কী! আমরা যা পছন্দ করে দোব সেইটাই তো হবে তাদের পছন্দ।

তা বললে চলে! যুগ পালটাচ্ছে। মেয়েকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন। তার একটা পছন্দ অপছন্দ থাকবে না! প্রতাপকে স্বামী হিসেবে আমার খুব একটা রিলায়েবল মনে হয়নি।

ছেলেটার সব ভাল, তবে একটু খেয়ালি। জীবনটাকে হিসেব করে খরচ করতে শেখেনি। আর অসম্ভব স্ফুর্তিবাজ। অত ফুর্তি আবার ভাল নয়।

মানুষকে একটা দুঃখকষ্টের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়, বিনয়দা। তা না হলে চরিত্র তৈরি হয় না। আপনারা ভাবেন টাকায় সুখ। একেবারে ভুল ধারণা। জীবনকে যত সিম্পল করবেন তত সুখ বাড়বে। সব ছাড়োয়ে, সব পাওয়ে। স্বভাব একবার এলে গেলে বড় বিপদ। তাকে খাড়া করা খুব শক্ত!

গানের সুরে কথা চাপা পড়ে গেল। অভয় পদে প্রাণ সঁপেছি। আমি আর কি যমের ভয় রেখেছি। এ আমার মাতামহের গলা। দুলে দুলে সিঁড়ি বেয়ে উঠছেন। কালী নাম কল্পতরু হৃদয়ে রোপণ করেছি। আমি দেহ বেচে ভবের হাটে দুর্গানাম কিনে এনেছি।

গানের শেষ চরণটি নিচু হয়ে ঘরে ছাড়লেন, যেন কোল থেকে বেড়াল নামালেন। আজ একেবারে রাজবেশ। ফরসা ধবধবে ধুতি। কোয়ার্টার হাতা সাদা পাঞ্জাবি। পায়ে বার্নিশ করা জুতো।

এলুম গো। কে কেমন আছ তোমরা! কেন বসে বিরস বদনে? কী হল কী তোমাদের?

পিতা বললেন, আপনার পানিশমেন্ট হওয়া উচিত। হঠাৎ কোথায় যে উধাও হয়ে যান।

উঃ, সে তোমাকে কী বলব হরিশঙ্কর। জীবনে একটা অভিজ্ঞতা হল। সাধনার জোরে মানুষ যে কোথায় যেতে পারে! এক মহাপুরুষ দেখে এলুম হরিশঙ্কর।

চেয়ারে বসতে বসতে মাতামহ বলছেন, আর চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। হঠাৎ মেসোমশাইয়ের দিকে চোখ পড়ল। এতক্ষণ নিজের খেয়ালে ছিলেন।

কী খবর? আপনি আবার বৃন্দাবন থেকে মথুরায় ফিরে এলেন?

আমার বড় বিপদ।

চাবি হারিয়ে ফেলেছেন?

হারিয়েছি, তবে চাবি নয়, মেয়ে। আমার বড়মেয়েকে খুঁজে পাচ্ছি না।

কোথায় রেখেছিলেন?

কোথায় আবার রাখব। ঘরে রেখেছিলুম।

ওইজন্যেই হারিয়েছে। রিং-এ না রাখলেই হারাবে।

পিতা বললেন, আপনি কোন জগতে আছেন! উনি চাবি হারাননি! মেয়ে হারিয়েছেন। বড়মেয়ে কনককে কাল থেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

আঃ। বলো কী! কী সর্বনাশ! কনক সেই মেয়েটি! যার সঙ্গে মনে মনে আমার নাতির বিয়ের ঠিক করেছিলুম! চলো তা হলে।

কোথায় যাবেন?

খুঁজতে বেরোই। আমার মনে হয় সে জিটি রোড ধরে হাঁটছে। এতক্ষণে তারকেশ্বরে পৌঁছে। গেছে।

মেসোমশাই উদগ্রীব হয়ে বললেন, কী করে বুঝলেন? আপনার সঙ্গে দেখা হয়েছিল!

না, দেখা হয়নি। আমি নখদর্পণে যেন দেখতে পেলুম।

নখদর্পণ কী জিনিস!

সে আছে। অবিশ্বাসীদের জন্যে নয়। একটু অলৌকিক ধরনের ব্যাপার।

ওসবে আমার খুব বিশ্বাস। পারেন তো বলুন না আমার মেয়েটাকে কোথায় পেতে পারি?

আমার ক্ষমতায় হবে না, তবে আপনাকে একজায়গায় নিয়ে যেতে পারি। ঘুরঘুরে বাবার কাছে।

তিনি বলে দিতে পারবেন?

খুব পারবেন। তার অসাধারণ ক্ষমতা। মৃত্যুর পর কে কোন লোকে আছে একেবারে সঠিক বলে দেন।

কনকের মৃত্যু হয়েছে!

না না, মৃত্যুর কথা আমি ভাবছি না। মৃত্যু হবে কেন? আমি বলছি পরলোকের কথা যিনি বলতে পারেন, এ লোক তো তার কাছে ছেলেখেলা।

ঘুরঘুরে বাবা দমদম বিমানবন্দরের কাছে কোনও এক গ্রামে থাকেন। মেসোমশাই গাড়ি এনেছেন। যেতে আধঘণ্টাও লাগবে না। পিতার তেমন মত ছিল না, তবু আমরা বেরিয়ে পড়লুম। যেতে যেতে মেসোমশাই শুধু একটি কথাই বললেন, কনককে যদি খুঁজে না পাই, তা হলে আমি। আত্মহত্যা করব। মাতামহ বললেন, আত্মহত্যার কোনও প্রয়োজন হবে না। বেনারসে আমার স্ত্রী একবার হারিয়ে গিয়েছিলেন। আমি কিছু করিনি। চুপচাপ বসে রইলুম আর বগলা স্তোত্র আওড়াতে লাগলুম। সন্ধের দিকে সুড়সুড় করে সৌদামিনী এসে হাজির। তখন আমি শ্রীরামচন্দ্রের মতো বললুম, এবার তোমাকে অগ্নিপরীক্ষা দিতে হবে। তিনি বললেন, ঝাটার বাড়ি দোব। যাঁড়ের তাড়া খেয়ে শিবঠাকুর আমার বউ ফেলে পালালেন। তা দেখুন, সেই স্ত্রীর কল্যাণে স্বামী জগদানন্দের সঙ্গে পরিচয় হয়ে গেল। জ্বলন্ত মহাপুরুষ। চোখ দিয়ে যেন আগুনের হলকা বেরোচ্ছে। দু’জনেরই দীক্ষা হয়ে গেল। বীজমন্ত্র যেন ভঁসা ভোমরার মতো ভোঁ ভোঁ করছে। তবে একটা কথা, স্ত্রী ফিরে আসবেই। সে যে জন্মজন্মের বন্ধন। এই সামনের বার আবার আমার সৌদামিনীর সঙ্গে বিয়ে হবে। আপনার স্ত্রী হারিয়ে গেলে ভাবনার কিছু ছিল না। মেয়ে তো? কেউ যদি পেয়ে থাকে সে কি আর ফেরত দেবে! অমন সুন্দরী মেয়ে। একটা টাকা ফেরত দেয় না যে দেশের মানুষ, সে দেশের মানুষের ওপর আমার তেমন বিশ্বাস নেই। যাক যা করেন কালী সেই সে জানে।

বিমানবন্দরের রানওয়ের পাশ দিয়ে গাড়ি চলেছে। রোদে দাঁড়িয়ে থাকা একটা প্লেন চকচক করছে। মাতামহ নানা কথা বলছেন, আমার মনটা কিন্তু তেমন সুবিধের নেই। মনে হচ্ছে আমিই হারিয়ে গেছি। এই বিশাল শহরে কনক সত্যিই হারিয়ে গেল। কার খপ্পরে গিয়ে পড়ল কে জানে। কনক তো কচি মেয়ে নয় যে গোলাপ ফুল শুকিয়ে অজ্ঞান করে দেবে, কি লজেন্সের লোভ দেখিয়ে থলেতে ভরে ফেলবে! এই হোঁতকা বাপটার জন্যে মেয়েটার জীবনটাই নষ্ট হয়ে গেল। যে ধরেছে সে নিশ্চয়ই আরবদের দেশে চালান করে দেবে।

মাতামহ বললেন, এই যে আমরা এসে গেছি। ঘুরঘুরে বাবার আশ্রম দেখা যাচ্ছে।

মেসোমশাই জিজ্ঞেস করলেন, ঘুরঘুরে বাবা নাম হল কেন? খুব ঘুরে ঘুরে বেড়ান?

গেলেই বুঝবেন, কেন ওঁর নাম ঘুরঘুরে বাবা।

ছিটে বেড়া দেওয়া বিশাল একটা জায়গা। মাঠে এক কণাও ঘাস নেই। পরিষ্কার তকতকে। কী করে এমন হল! মাথায় টাক পড়ে, মাঠে কেমন করে পড়ে কে জানে? চারপাশ সাদা খনখনে। দমকা হাওয়ায় মাঝে মাঝে ধুলো উড়ছে। একপাশে একটা ছোট মাপের মন্দির। তার মাথায় লাল পতাকা উড়ছে। ভেতর দিকে আটচালা ধরনের কয়েকটা বাড়ি। উঁচু উঁচু দাওয়া। দেখলেই মনে হয় ভেতরটা বেশ শীতল হবে। লাল রঙের পাঞ্জাবি, ধুতি, কৌপিন ঝুলছে। দাওয়ার এক পাশে বিশাল একটা ত্রিশূল পোঁতা। ফলায় ঝুলছে জবার মালা। দিনের উত্তাপ শুকিয়ে এসেছে। তলায় একটি নির্বাপিত হোমকুণ্ড। কিছু কাঠে তখনও আগুনের স্পর্শ লেগে আছে। ফুরফুরে ধোয়া পাকিয়ে পাকিয়ে বাতাসের গায়ে অদৃশ্য কোনও লোকের লিপি লিখে চলেছে।

ঘরের ভেতর থেকে বিরাট এক হুংকার ভেসে এল, মা, মা, একবার তেড়েফুঁড়ে ওঠ মা।

মাতামহ ততোধিক জোরে হাঁক পাড়লেন, বাবা, বাবা, আমি আ গিয়া।

খটাস খটাস করে খড়মের আওয়াজ ক্রমশই এগিয়ে আসছে। উঃ ঘুরঘুরে বাবার কী সাংঘাতিক চেহারা! দারা সিং, কিংকং, রানধোয়া, সব একসঙ্গে এক ছাঁচে ফেলে ভগবান বাবাকে তৈরি করেছেন। এরকম বিশাল ভুড়ি খুব কমই দেখেছি। ভয় হতে লাগল, এখুনি না ফটাস করে ফেটে যায়। বেলকুঁড়ির মতো নাইকুণ্ডল, ভোমরার মতো সেঁটে আছে, ভোঁ করে উড়ে এসে কামড়ে না দেয়। নিম্নাঙ্গে একটুকরো লাল কাপড় কোনওরকমে জড়ানো। টেনিস বলের মতো লাল দুটো চোখ। কপালে গোল এতবড় একটা লাল টিপ। মাথায় জটা। মহাপুরুষ সামনে এসে দাঁড়ালেন। প্রায় ফুট ছয়েক লম্বা। যখন দূরে ছিলেন মুখ দেখতে পাচ্ছিলুম, যখন কাছে এলেন, তখন জালার মতো ভুড়ি আর থামের মতো দুটো পা ছাড়া আর কিছুই দেখার উপায় নেই। তিনি ঈশ্বরের মতো বিশাল, আমি কীটের মতো ক্ষুদ্র।

মাতামহ দমাস করে পায়ের ওপর পড়লেন।

বাবা বললেন, রান্ধুসি তোর মঙ্গল করুক।

আমরাও পালা করে প্রণাম সারলুম। মহাপুরুষ কর্কশ গলায় ডাকলেন, পঞ্চা, পঞ্চা।

গুড়গুড় করে বামনাকৃতির একটি মানুষ, যাই বাবা, বলে ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন। সার্কাসের ক্লাউনের মতো ভাবভঙ্গি।

মহাপুরুষ হুকুম করলেন, মাদুর বিছাও। ছিলিম লে আও।

যো হুকুম, বলে চ্যালা নাচতে নাচতে চলে গেলেন। দাওয়ায় মাদুর পড়ল। আমরা একে একে বসে পড়লুম। মহাপুরুষ বসলেন পদ্মাসনে। যোগের শরীর। পায়ের ওই বিচিত্র মুদ্রায় আসতে এতটুকু কষ্ট হল না। ভুড়িটি সামনে লটকে পড়ল। ত্রৈলঙ্গস্বামী কীভাবে উলঙ্গ থাকতেন আজ বুঝতে পারলুম। ছোট একটি কলকে এসে গেল। দমভোর টানে ব্লপ করে আগুন জ্বলে উঠল। এর নাম গাঁজা। ব্যারিস্টার মেসোমশাইয়ের চোখমুখের অবস্থা তেমন ভাল নয়। মহাপুরুষকে পছন্দ হয়নি।

কলকেটি চ্যালার হাতে দিয়ে বাবা বললেন, শিক্ষিত লোকেদের বড় অবিশ্বাস, আর অবিশ্বাসী লোক দেখলে আমার খুব দুষ্টুমি করতে ইচ্ছে করে। তোমরা মজা দেখবে? তা হলে দেখো।

মহাপুরুষ মৃদু হাসলেন আর সঙ্গে সঙ্গে মেসোমশাই আর্তনাদ করে উঠলেন, এ কী হল, আমি কিছুই যে দেখতে পাচ্ছি না। আমি অন্ধ হয়ে গেছি।

মহাপুরুষ বললেন, হবেই তো, হবেই তো। তুমি যে বাবা অহংকারে অন্ধ। পূর্বজন্মে তুমি ছিলে একজন রূপবান অভিনেতা, আগামী জন্মে তুমি হবে একজন শবর। এ জন্মে তুমি সব হারাবে। নদীর তীরে একলা বাস করবে। বেঁচে থাকবে এক নীচ জাতীয় মহিলার অন্নে। মৃত্যু হবে অমাবস্যায়, শেষরাতে, শ্বাসকষ্টে। মৃতদেহ সৎকার করবে নীচ জাতির লোকেরা।

মেসোমশাই, বাবা, বলে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়লেন।

বাবা একটি তালি বাজালেন। স্পষ্ট দেখলুম হাত দিয়ে ধোঁয়া বেরোল। মেসোমশাই উল্লাসে চিৎকার করলেন, দেখতে পাচ্ছি, দেখতে পাচ্ছি। আপনি আমাকে ক্ষমা করুন।

আমি ক্ষমা করার কে রে ব্যাটা! নিজের কাছে ক্ষমা চা। নিজের আত্মপুরুষের কাছে। প্রতিদিন তুই যাকে খাটো করছিস। তোর দীনতা দেখে প্রতিদিন যে অশ্রু বিসর্জন করছে।

বাবা, আমি আমার বড়মেয়েকে কাল থেকে খুঁজে পাচ্ছি না। আপনি দয়া করে তাকে পাইয়ে দিন। বলে দিন সে কোথায় আছে

মহাপুরুষ আবার হাঁক পাড়লেন, পঞ্চা পঞ্চা। কৌটো লে আও।

সেই ক্ষুদ্র চ্যালা নাচতে নাচতে একটি রুপোর কৌটো নিয়ে এলেন। নদীর জলে চাঁদের আলোর মতো চকচক করছে।

কৌটোটাকে মাদুরের পাশে মেঝেতে রেখে গেলেন। মনে হয় কোনও মশলাটশলা আছে। মহাপুরুষের জীবনে ভোগ আর ত্যাগ দুটোই হাতধরা।

তোমার মেয়ে পালিয়েছে। পালিয়ে বেঁচেছে। তবু একবার দেখি, কোথায় সে আছে? পঞ্চা!

হাঁক শুনে সেই পঞ্চ মহারাজ আবার নেচে নেচে এলেন। বাবার এবারের হুকুম, স্লেট পেনসিল আর এক সানকি জল। স্লেট-পেনসিলটা মেসোমশাইয়ের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, তিনটে সংখ্যা লেখো।

মেসোমশাই লিখলেন, দুই সাত দুই। মহাপুরুষ সংখ্যা তিনটির দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, তোমার মেয়ের নাম ক দিয়ে, বোধহয় কনক। চন্দ্রের জাতক, সুন্দরী, কেশ ঈষৎ কুঞ্চিত, নাতিদীর্ঘাঙ্গী, মৃদুস্বভাব, ভাবপ্রবণ, কল্পনাবিলাসী। পিতা এবং মাতার চরিত্রের সম্পূর্ণ বিপরীত।

মহাপুরুষ হোমকুণ্ড থেকে আঙুলের ডগায় ছাই নিয়ে মেঝেতে একটা চক্র আঁকলেন। চক্রের মাঝখানে একটা ব লিখলেন। ঊর্ধ্বনেত্র হয়ে তিনটি বীজমন্ত্র ছুড়লেন, শব্দে বাতাস কেঁপে উঠল পাতলা ধাতব চাঁদরের মতো। সেই কম্পন যেন আর থামতেই চায় না। সানকির জলে তরঙ্গ খেলছে। এক ধরনের চিনচিন শব্দ হচ্ছে।

কী যে হচ্ছে ঈশ্বরই জানেন। পৃথিবীর প্রগতি অনেকটা লম্বা বেলুনের চেহারা নিয়েছে। এক প্রান্ত যেমন ছিল তেমনই আছে, অন্য প্রান্তে ঠেলে এগিয়ে চলেছে। মহাপুরুষ রুপোর কৌটাটি হাতে তুলে নিয়ে ঢাকা খুলে সেই বৃত্তের কেন্দ্রবিন্দুতে উপুড় করে দিলেন, যেন পাশার দান ফেললেন। চোখ বুজিয়ে কিছুক্ষণ স্থির হয়ে বসে থেকে ঝপ করে কৌটোটা তুলে নিলেন। অদ্ভুত চেহারার একটা পোকা, কেন্দ্রে স্থির থেকে হঠাৎ সড়সড় করে দক্ষিণে চলতে শুরু করল।

দক্ষিণ দিকেই আমরা বসেছিলুম। মেসোমশাই ঘুরঘুরে ঘুরঘুরে বলে এক ডিগবাজি খেয়ে দাওয়া থেকে নীচে পড়ে গেলেন। মাতামহ পড়লেন না, তবে ভয়ে সিঁটিয়ে রইলেন। ঠোঁট বিড়বিড় করছে। মন্ত্র জপছেন। আর আমি, দ্বিতীয় কোনও কথা নয়। ঘুরঘুরে শুনেছি সাংঘাতিক প্রাণী। তিরবেগে দৌড়ে একেবারে চৌহদ্দির বাইরে।

বাবার চ্যালা পঞ্চা মেসোমশাইকে ঠেলেঠুলে আবার দাওয়ায় তুলে দিল। মাতামহর গলার স্বর ফিরে এসেছে। আমাকে ডাকছেন, চলে আয়। তার মানে ঘুরঘুরে আবার কৌটোয় ঢুকে পড়েছে।

কী কায়দায় ঢোকালেন, কে জানে! মহাপুরুষরা সব পারেন।

মেসোমশাইয়ের মাথার পেছন দিকে এক তাপ্পি ধুলো। মহাপুরুষ বললেন, তোমাদের এত ভয়! বেঁচে আছ কী করে! মনটাকে বড় চঞ্চল করে দিলে। পঞ্চা, ছিলিম আন।

এক টানে কলকের মাথা ব্লপ করে জ্বলে উঠল। চোখে এসে গেল তুরীয় দৃষ্টি।

মেসোমশাই একটু সামলেছেন। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কী বুঝলেন বাবা?

বাবা হুম করে একটি হুংকার ছেড়ে বললেন, মেয়ে তোমার দক্ষিণ দিকে গেছে।

দক্ষিণ মানে দক্ষিণ কলকাতা?

না রে বোকা, দক্ষিণ ভারতের দিকে গেছে।

সেকী, সেখানে কে আছে!

বাবা খুব চটে গিয়ে বললেন, কে আছে, তার আমি কী জানি, সে জানবে তুমি। আচ্ছা দাঁড়াও জলদর্পণে একবার দেখি।

বাবা একটি দেশলাই কাঠি জ্বেলে সেই জল-টলটলে সানকির ওপর ধরলেন। আগুনের শিখায় জলের রং সোনার বর্ণ হল। কী আশ্চর্য! রং ক্রমেই ফিকে থেকে গাঢ় হচ্ছে। জল যেন টলটলে কাঁচা সোনা। বাবা তাকিয়ে আছেন স্থির দৃষ্টিতে। উত্তেজনায় আমাদের শ্বাসপ্রশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে।

বাবা হঠাৎ নড়ে উঠলেন, নাঃ এখনও সে কোথাও পৌঁছোয়নি। মনে হয় ট্রেনেই আছে।

মেসোমশাই বললেন, ট্রেনের ভেতরেই একবার দেখুন না।

তা তো হবে না রে। ট্রেন যে গতিশীল। সে স্থিত না হলে আমার দর্পণে তো আসবে না।

আমি তা হলে এখন কী করব বাবা?

কী আর করবে, অপেক্ষা করো। ধৈর্য ধরো। সংসারে এমন ঘটনা কত হচ্ছে!

বাবা, ওর সঙ্গে আর কেউ আছে কি!

অবশ্যই আছে।

কে সে? সে কে?

অত সহজে বলতে পারব না। অমাবস্যার দিন আসনে বসব। সেই দিন তোমার জন্যে আমি সারাভারত চষে আসব। প্রতিপদে বলতে পারব, মেয়ে তোমার কোথায় আছে, কেমন আছে!

মেসোমশাই একটি দশ টাকার নোট বাবার সামনে মাটিতে রাখলেন। প্রণাম করার জন্য সবে। মাথাটি নিচু করতে যাবেন, বাবা অমনি থামের মতো পা বের করে নোটে মারলেন লাথি। রাগে লাল চোখ ঘোর রক্তবর্ণ, তুই আমাকে টাকা দিতে এসেছিস! দশ টাকায় আমার সাধনা কিনতে এসেছিস? এটা কি মুদির দোকান? বেরিয়ে যা, বেরিয়ে যা এখান থেকে।

মাতামহ বাবার পা জড়িয়ে ধরে বলতে লাগলেন, শান্ত হন বাবা! শান্ত হন। না জেনে অন্যায় করে ফেলেছে। অবোধ সন্তানকে ক্ষমা করে দিন। শিব, শিব। শিব, শিব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *