1 of 3

১.০৬ বিবাদে বিষাদে প্রমাদে প্রবাসে

বিবাদে বিষাদে প্রমাদে প্রবাসে

আপনার প্রথম চিঠি আমি পেয়েছি। কিন্তু আপনার দ্বিতীয় চিঠি, যে-চিঠিতে আপনি দিন, তারিখ লিখে জানিয়েছেন বলছেন, সে চিঠি আমি পাইনি। দেখুন পোস্ট করেছেন কি না!

কী বলছেন আপনি হরিদা? আমি নিজে হাতে লাল ডাকবাক্সের ঠোঁটে টুক করে গলিয়ে দিলুম, কোর্টে যাবার পথে। আমার স্মৃতিশক্তি অত্যন্ত প্রখর। আইনের ব্যাবসা করি। মক্কেল চরিয়ে খাই।

আপনি তো গোড়াতেই গলদ করে বসে আছেন বিনয়দা। যেসব ডাকবাক্স পথের ধারে ষাঁড়ের মতো বসে আছে, তাদের স্বভাব আপনার জানা নেই। কিছু গলায় রাখে, কিছু পেটে। চিঠি ফেলতে হলে কঁধ পর্যন্ত হাত ঢুকিয়ে দিয়ে ফেলতে হবে। সে চিঠি এখনও আপনার আটকে আছে। লেটারবক্স ডাইজেস্ট করতে পারেনি।

হতে পারে। পৃথিবীকে আমি আর বিশ্বাস করি না। এর অনেক মুখ। জাস্ট লাইক এ কারবাঙ্কল। তবে ডাকবাক্সে আমি আর জীবনে হাত ঢোকাব না। সে চিঠি যাক আর না-যাক।

অদ্ভুত প্রতিজ্ঞা। কারণটা কী?

সে এক কেলেঙ্কারি ব্যাপার। ডাকবিভাগের ইতিহাসে লেখা থাকবে।

কনক চায়ের কাপ হাতে ঘরে ঢুকছিল। তার গলা দিয়ে কুঁক করে একটা শব্দ বেরোল। যেন পাতিহাঁস একবার ডেকেই পেছন উলটে জলে গলা ডোবাল। সঙ্গে সঙ্গে সামলে নিতে পেরেছে। এই যা রক্ষে। দুই অভিভাবকই ভুরু কুঁচকে তাকিয়েছেন। দু’জনেই মনে হয় সমান ধাতের মানুষ। একই ধাতুতে তৈরি। টাকার এ পিঠ আর ও পিঠ। কনক আমার পিতাঠাকুরের সামনে খুব কায়দা করে চায়ের কাপ রেখে বললে, আপনার চা মেসোমশাই। দুধ কম, চিনিও কম।

দ্যাটস ফাইন। তুমি কী করে জানলে, আমি দুটোই কম পছন্দ করি?

আমি যে জেনে নিয়েছি আগেই।

তোমার সব দিকে এত নজর?

সবে আধঘণ্টাও পেরিয়েছে কি না সন্দেহ। পিতা অফিস থেকে ফিরেছেন। এর মধ্যেই কনকের নজরে অভিভূত। মেয়েদের এই একটা সুবিধে। সহজেই মন জয় করে নিতে পারে। পিতা এমনভাবে তাকিয়ে আছেন যেন সন্ধিপুজোর মুহূর্তে ধূপধুনোর ধোঁয়ার পাতলা আবরণের আড়ালে দেবী দুর্গাকে দেখছেন ভক্তের চাহনিতে। স্তোত্রটি পড়ে ফেললেই হয়, নমস্তে সিদ্ধসেনানী, আর্যে। মন্দরবাসিনী, কুমারী, কালী, কপালী, খগখেটকধারিণী।’ উপায় থাকলে লিঙ্গ পরিবর্তন করে পৃথিবীটাকে বাকি জীবনের জন্যে একবার দেখে নিতুম। ন্যাজে খেলানো কাকে বলে! মুকুর প্রশংসা তো আগেই এক পক্কড় হয়ে গেছে। গার্গী মৈত্রেয়ীর সমপর্যায়ে উঠে পড়ার টেবিলে গ্যাট হয়ে বসে, গনর গনর করে কী একটা মুখস্থ করছে। এলো চুল ছড়িয়ে আছে পিঠের ওপর। সুখেন হলে নেচে নেচে গাইত, এলো চুলে গৌরী আমার শাঁখা সিঁদুর পরেছে।

বাবা, তোমার গরম জল কি এখন আনব?

গরম জল? আচ্ছা নিয়ে আয়।

আমার পিতার হঠাৎ খেয়াল হল কনকের পিতার এই অসময়ে গরম জল আবার কী হবে? প্রশ্ন করলেন, গরম জল কী হবে? চান করবেন?

না না। গরম জল খাব।

কেন চা?

চা আমার চলে না। যৌবনে বিশ কাপ, পঁচিশ কাপ ডেলি খেয়েছি। লিভার পাকতেড়ে মেরে গেছে। রোজ সন্ধের দিকে অম্বল। ডা. রায়ের প্রেসক্রিপশন– গরম জল।

চায়ে লিভার খারাপ করে এ থিয়োরি আপনি কোথায় পেলেন?

প্র্যাকটিক্যাল করে সিদ্ধান্তে এসেছি।

আপনার লিভার তো মশাই ডাক্তারের বাবার ক্ষমতা নেই খুঁজে বের করে। সাত-আট লেয়ার চর্বির তলায় যেভাবে চাপা পড়ে আছে! ওটাকে ওভাবে বাড়তে দিলেন কেন? উত্তরপ্রদেশ বড় করুন। কাজে লাগবে। মগজটাই তো সব। অবশ্য ভারতবর্ষের জিওগ্রাফিতে মধ্যপ্রদেশই বড়।

এ কি আর ইচ্ছে করে করেছি দাদা! মেড বাই অম্বল। আপনি কিন্তু চেহারাটাকে বেশ ফিট রেখেছেন!

রাখার কৌশল আছে। জানতে হয়। সবকিছুই সাধনার ব্যাপার। আছেন তো এক মাস। আপনাকে একটা চেহারা দেখাব।

ওসব ব্যায়ামবীরদের কথা আমাকে বলবেন না। এনাফ অফ দেম। ফ্যাশানেবল স্ত্রী আর মাসলম্যান, দে আর গুড ফর নাথিং।

আরে না মশাই, ওসব দেহধর ফেহধরদের আমিও জানি। তেল মেখে আলোর সামনে দাঁড়িয়ে পেশি নাচানো ছাড়া তারা আর কিছু জানে না। আপনাকে একটা সিস্টেম দেখাব। আমাদের ন্যাশন্যাল ফুটের মতো ঝনঝনে।

ন্যাশন্যাল ফুট কী জিনিস? কাঁঠাল? যা আমরা এতকাল ধরে পরস্পর পরস্পরের মাথায় ভেঙে আসছি। যা চিরকাল গাছেই থেকে গেল আর আমরা গোঁফে তেল দিয়ে দিয়ে তেল ফুরিয়ে। ফেললুম।

মন্দ বলেননি। কাঁঠালের জাতীয় ফল হবার সব গুণই আছে। তবে আমি জাতীয় ফল করে রেখেছি আমড়াকে। আদর্শ বাঙালি চরিত্র। আঁটি চর্মসার। দাঁতে ঠেকান, বাপ বলে লাফিয়ে উঠতে হবে। ওই যে বসে আছে। তাকিয়ে দেখুন। নিশ্চিন্ত আরামে। হাত পা এলিয়ে। চোখের দৃষ্টি দেখুন। উদাস, নিরালম্ব। যেন এন্ড অফ দি ওয়ার্লডে পৌঁছে গেছে। গান ধরলেই হয়, হরি দিন তো গেল সন্ধ্যা হল। ওই হল দিশি আমড়া।

ওর সিস্টেম কি খুব ভাল?

কনক কাঁচের গেলাসে গরম জল এনে সামনের টেবিলে রেখে চলে যেতে যেতে আমার দিকে তাকাল। এক ফুটের গরম জল দেখলেই বোঝা যায়। বুজকুড়ি ভাসছে। অনেকটা মায়ার গালের যুবতী ব্রণের মতো। মেয়েদের গালে ব্রণ এলেই বুঝতে হবে আম গাছে মুকুল এসেছে। মউ মউ সুবাস। ভ্রমরের ভ্যানর ভ্যানর। তোমার মুখে জুতো। কেন? কে তুমি? আমি তোমার সাত্ত্বিক মন। এত তুলোধানা হয়েও তোর শিক্ষা হয় না রে! মন ছুটছে মায়াপুর।

কাআ তরুবর পঞ্চবি ডাল
চঞ্চল চীত্র পইঠো কাল ॥

তোর দেহ থেকে পাঁচটা ডাল পাঁচ পাশে হাত বাড়িয়ে উদম নৃত্য করছে, মনের অঙ্গনে ঢুকে বসে আছে মহাকাল। মন তুই কৃষ্ণ কথা বল, কৃষ্ণ কথা বল।

ওর সিস্টেম? পিতা চায়ে চুমুক দিয়ে এমন একটা মুখ করলেন যেন পৃথিবীর বাইরে অন্ধকার মহাশূন্যে ভেলায় চেপে বেড়াতে বেরিয়েছেন। দু’হাতে কাপডিশ। কাপ ডিশ থেকে ইঞ্চিখানেক ওপরে ঝুলছে। আবার বললেন, অনেকটা ঘুমঘোরে, ওর সিস্টেম? আহারে অনাহার, শ্রমে বিশ্রাম, চিন্তায় নিশ্চিন্তা, দর্শনে অদর্শন, ভাবে বিভাব, উনি এক শাপভ্রষ্ট মহাপুরুষ। দয়া করে পাটকাঠি সদৃশ এক দেহাধারে ধরা পড়েছেন। একদিন মট করে ভাঙবেন আর উড়ে চলে যাবেন। আমি যার কথা বলছি তিনি এ পাড়ায় থাকেন, নাম মেনিবাবু। জীবনে একবারও অসুস্থ হননি। শরীর কঞ্চির মতো। মন ধারালো তলোয়ারের মতো। বায়ুর বেগে চলেন। তড়িৎ বেগে কথা বলেন। খাদ্য? চা আর জর্দাপান। কী আপনি লিভার লিভার করছেন? জেনে রাখুন শরীরের নাম মহাশয়, যা সহাবে তাই সয়।

মেসোমশাই গরম জল খেতে লাগলেন। পিতা উঠে পড়লেন চেয়ার ঠেলে। বসবার সময় কোথায়? কথায় কথায় বলেন, আই হ্যাভ নো টাইম টু স্ট্যান্ড অ্যান্ড স্টেয়ার। রান্নামহল থেকে হাঁক এল, চলে এসো। অন্যদিন হলে এই ডাকে আমার ময়দা মাখা শুরু হবার কথা। দু’কৌটো ময়দা, মাঝে গাব্ব তৈরি করে দু’চামচে ভাদুয়া, একটু নুন। নাও ঠেসে যাও। ঠাসতে ঠাসতে হাতের কবজি, কাধ টনটন করতে থাকবে। ততক্ষণ চালিয়ে যেতে হবে যতক্ষণ না হুকুম হয়, স্টপ।

ভেতরের দরজার পাশে কনক চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল। ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, এখন কী হবে?

একের পর এক নাটকের অঙ্ক হয়ে চলেছে সেই উত্তীর্ণ সন্ধ্যা থেকে। পরদা পড়ছে আর উঠছে। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে ছড়ানো-ছেটানো জিনিস দেখে বললেন, একী, এয়াররেড হয়ে গেছে নাকি? কনক, মুকু আর মেসোমশাইকে সামনে দেখে বললেন, আপনারা আবার কে? চেনাচিনি হয়ে যাবার পর হাওয়া মোটামুটি ধীরেই বইছিল। আবার ঝড় বইতে শুরু করেছে।

সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই বেশ উঁচু গলায় জিজ্ঞেস করলেন, দুপুরে অতিথিদের কী ব্যবস্থা করেছিলে? কিছু জুটেছিল?

আজ্ঞে হ্যাঁ। সবই তো ছিল। ওঁরাই সব তৈরিটৈরি করে নিলেন।

তা হলে রাতের ব্যবস্থা করা যাক। ওঁরা কী আহারাদি করবেন জানতে পারলে ভাল হত।

অন্ধকার থেকে কনক সাহস করে এগিয়ে এল। পিতা যেন আশার আলো দেখতে পেলেন, এই যে কাঞ্চন, তোমরা রাতে কী খাবে?

উত্তর দেবার আগে কনক নামটা সংশোধন করাবার জন্যে বললে, আজ্ঞে আমি কনক।

ও হ্যাঁ, তুমি কনক। কনক কাঞ্চন।

আমার মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল, কাঞ্চন সাধারণত ছেলেদেরই নাম হয়।

দ্যাট আই নো। কনক মানে কী?

সোনা।

কাঞ্চন মানে কী?

সোনা।

তা হলে? আমার ভুলটা দেখলে কোথায়? আমি ওকে স্বর্ণ বলে ডাকতে পারি, সোনা বলে ডাকতে পারি। একই মানে। রোজ সকালে কয়েক পাতা করে অমরকোষটা মুখস্থ করো। তাতে তোমার ওই বোকা-বোকা ভাবটা কিঞ্চিৎ কেটে যাবে।

উঃ, কী থেকে কী হয়ে গেল! দু’জনেই অপ্রস্তুত। গাধার মতো দাঁড়িয়ে ঘা চাটছি। কনকের কিন্তু সাহস কম নয়। পরিস্থিতি একটু থিতোতেই প্রশ্ন করল, আপনারা রাতে কী খান জানতে পারলেই ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে সব তৈরি হয়ে যাবে। আমরা যে কদিন আছি, আপনাকে আর রান্নাবান্না নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না।

খুব ভাল কথা। আমি কিন্তু তা হতে দেব না। আমার অভ্যাস নষ্ট হয়ে যাবে। তোমরা চলে যাবার পর বিপদে পড়ে যাব।

আপনি কী বলছেন মেসোমশাই। জ্ঞানী মানুষের কখনও অভ্যাসের দাস হওয়া উচিত নয়।

উঃ, শাবাশ। ভয়ে চোখ আর দম দুটোই বন্ধ। বোমের পলতেয় আগুন পড়েছে। দেখতে পাচ্ছি ফিচির ফিচির ফুলকি ছাড়তে ছাড়তে এগোচ্ছে। ফাটল বলে। মৃদু হাসির শব্দে চোখ খুলে গেল। বোমা ফাটল না। কনকের মেসোমশাই হাসছেন। মেয়েদের কী মহিমা রে! আগুনে আগুন নেই। তাপে তাপ নেই। জলে জল নেই। আমার মায়া! বিকেলে যখন চটকাঁচটকি করছিল, শরীরে উত্তাপ দেখে মনে হয়েছিল, ম্যালেরিয়া। তুমি কাপছ। তোমার জ্বর। কুইনিন খাও।

আজ্ঞে না গর্দভ। মেয়েদের আর বেড়ালের তাপ একটু বেশিই হয়। বুড়ি হয়ে বৃন্দাবনে গেলে তবেই এ জ্বর ছাড়বে।

আবার সেই মায়া? মায়ায় মজেছে মন। ভালই গাও, মজল আমার মনভ্রমরা শ্যামাপদ নীল কমলে। শ্যামামাকে আর কষ্ট দিয়ো না। মন টোল খেয়েছে, টাল খেয়েছে। শ্যামা কেটে মায়া। বসাও।

পিতা বললেন, হেরে গেলুম তোমার কাছে।

এ যেন নিমাইয়ের কাছে রঘুনাথ শিরোমণির হার। হারতেই হবে। অতবড় একটা কাবুলিকে ছোট্ট মেয়ে মিনি নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরিয়েছিল। মুঠো মুঠো কিসমিস, আখরোট, মনাক্কা, খুবানি। ঝুলি থেকে বেরোচ্ছে তত বেরোচ্ছেই। কনক হাসতে হাসতে বললে, এতে হারজিতের কিছু নেই। মেসোমশাই, মেয়েদের কাজ মেয়েরাই করবে।

তা ঠিক, তা ঠিক। পিতা মাথা নাড়লেন।

কনক কথাটা এমন করুণ করুণ মুখে বললে, যেন কুকুরের কাজ কুকুর করেছে কামড় দিয়েছে। পায়ে। পৃথিবীর সমস্ত সম্পর্কেই যদি এই কুকুর আর প্রভুর ভাবটা ঢুকিয়ে দেওয়া যায় তা হলে আর কোনও সমস্যা থাকে না। ন্যাজ নেড়ে নেড়ে ঘুরে যাও।

রাতে তা হলে লুচিই হোক।

তাই হোক, মেসোমশাই। এক হাতে কাঁচের গেলাস, আর এক হাতে তাসের মতো ধরা দুটো বড় নোট।

আপনার তো আবার অম্বল হয়েছে? আই ডোন্ট কেয়ার। সোডিবাইকার্ব ইজ দেয়ার।

তা হলে লুচি হোক, রাতটা নিরামিষেই চলুক, চিনে ঘাস দিয়ে দুধের পায়েস, একটু গোলাপের আতর। মারভ্যালাস!

গেলাসটা মেয়ের হাতে ধরিয়ে দিয়ে, মেসোমশাই দু’বার গলা ঝেড়ে বললেন, হরিদা, সবার আগে একটা কাজ সেরে নেওয়া যাক, এই দুটো আপাতত আপনার কাছে রাখুন।

মেসোমশাই হাসি-হাসি মুখে গুটিগুটি এগোচ্ছেন। পিতার মুখ ক্রমশই কঠিন থেকে কঠিনতর হচ্ছে। এইবার বোমা ফাটবে।

হোয়াট!

বাতাসের ধাক্কায় মেসোমশাই দুলে উঠলেন। এত জোরে হোয়াট বেরোবে কে আর ভেবেছিল?

আপনি আমাকে টাকা দেখাতে এসেছেন? এত অহংকার! অহংকারং বিমূঢ়াত্মা।

ছি ছি, এ আপনি কী বলছেন হরিদা! এতে আপনি অহংকারের কী দেখলেন?

সেই বোধটুকু থাকলে আপনি ওভাবে টাকার পেখম মেলে বাইজি বাড়ির বাবুর মতো এগিয়ে আসতেন না। আপনি আমার অভিমানে ধাক্কা মেরেছেন। ভাবতেই পারলেন না যে আপনি আমার আত্মীয়। আপনি ক্ষুদ্র, আপনি বীভৎস। আপনার সভ্যতার ঝুলি থেকে হুলো বেরিয়ে পড়েছে।

পিতা ধাপে ধাপে চড়ছেন, মেসোমশাইয়ের কপালের কোচ একটি একটি করে বাড়ছে। প্রতিবাদের জন্যে ঠোঁট নড়ছে, শব্দ বেরোবার ফাঁক মিলছে না। সিনেমা হলের দরজা দিয়ে যখন গলগল করে তোক বেরোতে থাকে তখন ঢোকার লোকেরা একপাশে দাঁড়িয়ে থাকে গা বাঁচিয়ে। যত জোরে হোয়াট দিয়ে শুরু করেছিলেন ততোধিক জোরে একটি হাঁচি দিয়ে মেসোমশাই-নিধন পর্ব শেষ হল।

মেসোমশাই বললেন, আমাকে আপনি ক্ষমা করুন। আমি টাকা দেখাবার জন্যে টাকা দেখাইনি। এই বাজারে তিনজন এক মাস এবেলা ওবেলা খাবে তার একটা খরচ আছে তো! আমি সেই ভেবেই শেয়ার করতে চেয়েছিলুম। আপনি আমার পয়েন্টটা না বুঝেই বেশ কিছু কটু কথা হুড়হুড় করে বলে গেলেন, আপনার যেমন সেন্টিমেন্টে লাগল, আমার তেমনি লাগল প্রেস্টিজে। এ এক ধরনের অপমান।

দুই যোদ্ধার মাঝে কনক এসে দাঁড়াল। এ মেয়ে অ্যানি বেসান্ত কি হেলেন কেলারের দ্বিতীয় সংস্করণ। লেডি উইথ দি ল্যাম্প। কনক বললে, ভুল বোঝাবুঝি হয়ে গেছে। মেসোমশাই, আপনি শান্ত হন। বাবা, আপনি একটু কাঁচা কাজ করে ফেলেছেন।

সমর্থন পেয়ে পিতা আবার লাফিয়ে উঠলেন, তুমি বুদ্ধিমতী মেয়ে। তুমি জিনিসটার কুৎসিত দিকটা ঠিক ধরতে পেরেছ। এটা তো হোটেল নয়, সরাইখানা নয়, পাঞ্জাবির পকেট থেকে কড়কড়ে নোট বের করে নাকের ডগায় ছুঁড়ে দেবেন, এই নিন। এক মাস কেন? আপনারা এখানে এক বছর থাকুন অতিথি হয়ে। আমার কে আছে বিনয়দা। রাজ্যপাট ভেঙে গেছে, সভাসদরা বিদায় নিয়েছে। আপনারা এসেছেন এই তো আমার সৌভাগ্য। বহুদিন পরে গাছের ডালে পাখি এসে বসেছে। কতকগুলো নোংরা কাগজ নেড়ে সুর কেটে দেবেন না। আমার অনুরোধ।

গলা যেন একটু ধরাধরা। এই যে সব থাকা আর না-থাকা, আমি আছি, তোমরা নেই, এইসব বিচ্ছেদের ব্যাপারট্যাপার সংসারী মানুষকে বড় বিচলিত করে। একটু বেদান্তের দিকে সরতে পারলেই বগল বাজিয়ে ঘোরা যায়, ‘এই সংসার ধোঁকার টাটি, খাই দাই আর মজা লুটি।’ জগৎ সব ভুল, স্বপ্নবৎ। আমিতেই মেরেছে। আমির বোধেই, তোমার বোধ। নীচে আগুন জ্বলছে, হাঁড়িতে ডাল, ভাত, আলু, পটল সব টগবগ করছে। লাফাচ্ছে, আর বলছে, ‘আমি আছি’, আমি ধিন ধিনা লাফাচ্ছি। শরীর সেই হাঁড়ি, মনবুদ্ধি জল, ইন্দ্রিয়ের বিষয়গুলি ডাল, ভাত, আলু, পটল, স্ত্রী, পুত্র, পরিবার। অহং যেন তাদের অভিমান, আমি ফুটছি, ফাটছি। সচ্চিদানন্দ, তুমিই সেই অগ্নি। আহা, জগৎজোড়া কাবাবের কারখানা। থুড়ে থুড়ে কিমা। প্রশ্ন, কিমাং কিম করোতি। আসল জ্ঞান কি ব্যাকরণে আছে? আসল জ্ঞান কি গণিতে আছে? পাঁজিতে অনেক জলের কথা লেখা আছে। নিংড়োলে এক ফোঁটাও বেরোবে না। আসল জ্ঞান ফুটে ওঠে। প্রথমে একটু জ্বরজ্বর, কোমর ব্যথা, তারপর কপালে একটি গুটি, গলায় দুটি, পিঠে তিনটি! ব্যাপার কী? পক্স। ফক্সের সংসারে পক্সের মতো এইভাবেই গুটিকয়েক মানুষের মনে ব্ৰহ্মজ্ঞানের গুটি বেরোয়। বাকি সব অহংয়ের কচকচি। বয়েসফয়েস কিছুই নয়। ধ্রুব, প্রহ্লাদ, সব কঁচা বয়সেই যোগী।

পিতার শেষ কথায় পরিস্থিতি শীতল হয়ে এল। মৃত্যু, বিচ্ছেদ, শূন্যতা প্রৌঢ় মানুষদের সহজেই কাবু করে ফেলে। যুবকদের সমস্যা অনেক কম। এই যেমন আমি। কনকরা চলে যাবার পর দিন তিনেক মন হুহু করবে বাউল আর ভাটিয়ালি গানের মতো। বাথরুমে জল পড়ার ঝরঝর শব্দের সঙ্গে, মন মাঝি তোর বইঠা নে রে, আমি আর বাইতে পারলাম না মিলিয়ে, ছলছলে চোখে নাঙ্গা হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা। তাতে কনকেরও কিছু এসে যাবে না, আমারও কাঁচকলা। দশ বছর পরে দেখা যাবে কনক মা হয়ে মেয়ে কোলে কোনও এক্স ওয়াই জেডের ঘরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। খুব। দুঃখ হবে মায়ার কিছু হলো না, মায়ার কথা যখন-তখন ভাবা উচিত নয়। মায়া আমার মাঝরাতের মালকোষ, ভোররাতের যোগিয়া।

মেসোমশাই এগিয়ে এসে পিতার হাত ধরে বললেন, ফরগিভ অ্যান্ড ফরগেট। যা হয়ে গেল, তা হচ্ছে প্রিন্সিপিল-এর লড়াই।

হাত-ধরা অবস্থাতেই পিতা বললেন, আজ্ঞে না, একে বলে অহংয়ের ঠোকাঠুকি। কেউ কারুর কাছে ছোট হব না। অহংয়ের বাষ্পে দৃষ্টি আচ্ছন্ন, বিচারবুদ্ধি ঘোলাটে। মোটরবাইক কীভাবে স্টার্ট নেয় দেখেছেন?

দেখলেও খেয়াল করিনি।

পিতা হাত মুক্ত করে নিলেন। দু’হাতে মোটরসাইকেলের হাতল। সামনে শরীর একটু ঝুঁকে আছে। বাঁ পা স্টার্টারে। ফার্স্ট ফিক, সেকেন্ড, থার্ড কিক। ভটভট, ভটভট। একেই বলে অহংয়ের। লাথি।

মেসোমশাই, কনক দু’জনেই হেসে উঠলেন। যাক বাবা, আবহাওয়া ময়ান দেওয়া ময়দার মতো মোলায়েম হয়ে গেল। দুই ব্যাঘ্র চলে গেলেন বারমহলে। ছায়াছায়া বারান্দায় কনককে কী সুন্দর দেখাচ্ছে। বুলবুল গান গায় নার্গিস বনে। বিচিলি রঙের শাড়ি। সাদা ব্লাউজ। ধারালো চেহারা। চকচকে কালো চুল। চোখে আলো পড়লে নীল সাগরে ভেসে থাকা কালো মণি ঝলসে ঝলসে উঠছে।

কনক দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললে, তোমার একজন বোন থাকলে বেশ হত।

তুমি তো আছ।

আমি আর কদিন বলো?

তা ঠিক। যদিন আছ তদিনই বাড়ি জমজমাট। তারপর সংসার চলবে শেষবেলার জলের চাকার। মতো। চাষার ক্লান্ত হাতে চাকা জলে নামছে, ঘুরে ঘুরে, ধীরে ধীরে উঠছে। সরষে-খেতে জল পড়ছে ছিড়িক ছিড়িক করে।

থাক আর কাব্য করতে হবে না। এখন লুচি, ছোলার ডাল, আলুর দম। ঘড়ির কাটা কোথায় গেছে দেখেছ!

ডাক উঠল, পিন্টু, পিন্টু। এক মিনিট দেরি করার উপায় নেই। আজ্ঞে বলে ক্যানেডিয়ান ইঞ্জিনের মতো দৌড়োতে হবে। দুই পিতাই আবার চেয়ারস্থ। বেশ ভাব হয়ে গেছে দু’জনের। প্রসঙ্গটা কী জানি না। মেসোমশাই খুব কাকুতিমিনতি করছেন, ওসব হাঙ্গামার দরকার নেই হরিদা। খাদ্যতালিকা যা তৈরি করেছেন যথেষ্ট।

এ ব্যাপারে আপনার কথা বলার কোনও অধিকার নেই বিনয়দা। আপনি আমার সম্মানিত অতিথি। আমাদের বংশের একটা ধারা আছে। . বংশই নেই তো বংশের ধারা! শেষ বাতিটি কে জ্বালাবে! আমি তো আজ আছি কাল নেই। গুরু পেলেই বৃন্দাবন। তখন তো অনেক কথাই ফিরিয়ে নিতে হবে, যেমন দুষ্ট গোরুর চেয়ে শূন্য গোয়ালই ভাল। পিতা বললেন, একটা কাজ করতে পারবে?

আজ্ঞে হ্যাঁ, কেন পারব না!

পরেশের দোকানে গরম রসগোল্লা কটার সময়ে নামে?

রাত বারোটা নাগাদ।

তুমি ঘোড়ার ডিম জানো।

আমি সেইরকমই শুনেছি।

কার কাছে?

কে যেন বলছিল। ওই পেটের গোলমাল হয়েছিল। রাত বারোটায় গিয়ে পরপর তিন দিন ছ’টা করে রসগোল্লা খেয়ে সেরে উঠেছে।

সে তোমার কোনও গেঁজেল বন্ধু। আমি জানতুম, তোমার দ্বারা চুলের কেয়ারি ছাড়া অন্য আর কিছু হবার উপায় নেই। আমিই যাচ্ছি। কতক্ষণ লাগবে? যেতে তিন মিনিট, আসতে তিন মিনিট।

আমি তো যাব না বলিনি!

তবে যাও। বলে এসো রাত দশটার সময় এক সের গরম রসগোল্লা চাই। সবচেয়ে বড় সাইজের যেটা সেইটা।

মেসোমশাই আর একবার মৃদু গলায় বললেন, কেন হাঙ্গামা করছেন হরিদা?

এটা আমাদের ব্যাপার বিনয়দা। যাও, তুমি আবার তানানানা করছ কেন?

গরম হাওয়া পেলে বেলুন ফুস করে ঠেলে আকাশে ওঠে। রাস্তায় পা রেখে মনে হল আমারও সেই অবস্থা। বাড়ির দিকে তাকিয়ে ফিরে ফিরে দেখছি। খোলা জানলায় আলো ফটফট করছে। মানুষের ছায়া নড়ছে দেয়ালে। বাইরে থেকে দেখলে মনেই হবে না, গরাদহীন উন্মাদ আশ্রম! পাশ দিয়ে যেতে যেতে কে যেন বললেন, কী দেখছ হে ঘুরে ঘুরে? আমাদের পাড়ার বিধুজ্যাঠা। পাটের দালাল। বেশ ভোগীর চেহারা। বগলে একটা ব্যাগ। চোখে সোনালি চশমা।

বাড়ি দেখছি জ্যাঠামশাই।

তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে বিশ্বরূপ শেষরাতে গৃহত্যাগ করছেন, জানলায় দাঁড়িয়ে আছে বিষ্ণুপ্রিয়া। হরি ফিরেছে?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

একবার মনে করিয়ে দিয়ে তো! আমি যা বলেছিলুম সেটার কী হল? রবিবার আমি অবশ্য একবার দেখা করার চেষ্টা করব।

পরেশদা ছানায় আঁক দিচ্ছেন। পরনে সেই গামছা, গোলগলা আধময়লা গেঞ্জি। রসে-ডোবা চমচমের মতো চেহারা। নীচের দিকটা তাকিয়ার মতো, ওপরদিকটা মাথার বালিশের মতো। তার ওপর একটা তিন নম্বর ফুটবল। দুটো বারকোশের মাঝখানে কাপড় জড়ানো ছানার নাদা। ছাদে উঠে পরেশদার লেফটরাইট চলছে। এক একবার চাপ পড়ছে আর সাদা সাদা জল বেরিয়ে আসছে। পরেশদা দিন দিন কী হচ্ছে! সত্যিই এর নাম ‘টনিক ময়রা। মিষ্টির দোকানে কাজ করতে পারলে, মাসখানেকের মধ্যেই মুটিয়ে যেতুম। নধরকান্তি একটি বটব্যাল।

পরেশদা, গরম রসগোল্লা কখন নামবে?

ছানার ওপর নাচতে নাচতে বললেন, ওই তো রস জ্বাল হচ্ছে। এইবার পড়বে।

দশটা নাগাদ?

এসো, দেখা যাবে।

এক সের বুক করে গেলুম। সবচেয়ে বড়টা।

বুক পেট জানি না। নামলেই নিয়ে যেয়ো।

রাত ক্রমশই রসগোল্লার মতো রসস্থ হয়ে উঠছে। সাত নম্বর বাড়িতে গানের আসর বসেছে। তবলায় চটি পড়ছে। পানবিড়ির দোকানে রেডিয়ো বাজছে। ফটফট করে আলো। বোকাদা ডিম ভেঙে সকালকে সুপ্রভাত করেছিলেন। এখনও ভেঙে চলেছেন। বিদায়রজনী হবে রাত বারোটায়। ইংরেজি মতে তখন নতুন দিন শুরু হয়ে গেছে। জবাদের বাড়ির সেই সদাহাস্যমুখ বাবুটি হাতে একগাদা প্যাকেট ঝুলিয়ে নেচে নেচে চলেছেন, রাত হল, রাত হল, দ্বার খোলো প্রমদা।

গরম রসগোল্লা রেডি হচ্ছে। রাত দশটা নাগাদ পাওয়া যেতে পারে।

দেখেছ, তোমার ইনফর্মেশন কত ভুল! এই ভুল ইনফর্মেশনের জন্যে অতবড় হিটলারের পতন হল। ইংরেজের রাজত্বে সূর্য ডুবে গেল। সত্য শ্রবণে নেই সত্য দর্শনে।

হুড়মাড় দুদ্দাড় করে কনক উত্তরমহল থেকে দক্ষিণমহলে ছিটকে এল। হাতে একটা খুন্তি। সমস্বরে প্রশ্ন, কী হল, কী হল?

কোনওরকমে দম ফেলে কনক বললে, আরশোলা, অসংখ্য আরশোলা। ঝাকে ঝাকে উড়ে আসছে।

পিতা মেসোমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললেন, নাপচিয়াল ফাঁইট, বুঝলেন বিনয়দা! এখন দরকার ঝাটা ট্রিটমেন্ট। এ রোগের দাওয়াই হল ঝাটা পেটা। চলো পিন্টু।

কনকের চেয়ে আমার কিছু বেশি সাহস নেই। মাতুলক্রমঃ। সেই ঘটনাটি মনে পড়লে এখনও, আমার হাসি গুমরে গুমরে ওঠে। কলকাতার এক প্রেক্ষাগৃহে বসেছে উচ্চাঙ্গ সংগীতের আসর। সময় সকাল। মাতুল ধরেছেন গুর্জরী টোড়ি। আলাপ জমে উঠেছে। দুটো তানপুরা দু’পাশ থেকে মিঞাও মিঞাও করছে। তবলচির হাত উসখুস করছে তবলায়। গানের মুখ এলেই তেরে কেটে করে লাফিয়ে পড়বেন। ডান পাশ থেকে বাঁ পাশে ফিরর করে কী একটা উড়ে গেল। সুর বোধহয় পক্ষ বিস্তার করেছে। সুর নয় আরশোলা। পেছনের সাদা পরদায় বসে তাল খুঁজছে। কে জানত, মাতুলের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় কাজ করছে। আরশোলা যাঁহাতক উড়েছে দ্বিতীয় চক্করে, তবলা, তবলচি, মাইক্রোফোন, হারমোনিয়ম, গাইয়ে সব একসঙ্গে তালগোল পাকিয়ে স্টেজ থেকে সামনের সারির দর্শকদের ঘাড়ে। গানের মুখ সবে ধরেছিলেন অব মেরে নইয়া। নইয়া পাড়ে ভেড়ার আগেই ডুবে গেল। হইহই ব্যাপার। বেনারসের ওস্তাদ চিৎকার করছেন, কেয়া হুয়া ওস্তাদজি? ওস্তাদজি, তবলচি তখন হামা দিচ্ছেন সামনের প্যাসেজে।

রান্নাঘরের আকাশে লাল বিমানবহর। সপাসপ ঝাটা চলছে। ডাইনে বাঁয়ে। মাঝেমধ্যে দু’-এক ঘা পরস্পরের পিঠেও পড়ছে। পিতা বলছেন, নেভার মাইন্ড, নেভার মাইন্ড। এক একবার চাপস মারছেন। কখনও বলছেন অস্ট্রেলিয়া থেকে কিছু বড় সাইজের টিকটিকি ইমপোর্ট করতে হবে। কখনও বলছেন, ছাতাওয়ালা গলির পিংলিংকে খবর দেবেন। এ জিনিস মেরে শেষ করা যাবে না, খেয়ে শেষ করতে হবে।

প্রেমোন্মাদ শেষ আরশোলাটিকে ঝাটায় চেপে ধরে পিতা হাঁকলেন, কনক, অল কোয়ায়েট অন দি ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *