1 of 3

১.২৪ তুমি নাহি দিলে দেখা

তুমি নাহি দিলে দেখা কে তোমারে দেখিতে পায়

চারপাশ কেমন যেন ঝিমঝিম করছে। পুঁতির জালির মধ্যে দিয়ে তাকালে যেমন দেখায় সেইরকম দেখাচ্ছে। কিংবা তারের জালির ওপর বৃষ্টি পড়লে যেমন হয়। এপাশে আমি ওপাশে দৃশ্য। সুর ফোঁটাফেঁটা হয়ে জমে গেছে। ঝিলঝিল করে ঝুলছে, দুলছে বাতাসে।

গান থেমে গেছে। আর একটি গানের সুর খেলছে হারমোনিয়ামে।

স্থির সাধিকা ধীরে ধীরে একটা আঙুল তুললেন। নিমীলিত দৃষ্টি। সুর সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেল। তিনি খুব মৃদু অথচ ইস্পাতকঠিন কণ্ঠে বললেন, একেবারে শেষের সারিতে বসে যিনি পাপ চিন্তা করছেন, তিনি অবিলম্বে স্থান ত্যাগ করুন।

আমি ছাড়া আর কেউ ফিরে তাকালেন না। আমার এখনও শিক্ষা সম্পূর্ণ হয়নি। অহেতুক কৌতূহল মনের মাঝে বসে আছে ফুলঝাড়ু হাতে নিয়ে। থেকে থেকেই খোঁচা মারে, দেখ কী হচ্ছে, আশেপাশে তুচ্ছ তুচ্ছ কী হচ্ছে গোল্লা গোল্লা চোখ বের করে তাকিয়ে দেখ। পড়েছিলুম, বৌদ্ধভিক্ষুরা পায়ের বুড়ো আঙুলের দিকে দৃষ্টি রেখে পথ হাঁটেন। দিনকতক সেই চেষ্টা করতে গিয়ে একদিন কেলেমতো ভুসকো একটা ষাঁড়ের পিঠে উঠে পড়েছিলুম। ষাঁড়টা পথের পাশে শুয়ে ছিল। বুদ্ধদেবের কৃপায় রক্ষে পেয়ে গিয়েছিলুম। সাধনার যুগ কীভাবে হারিয়ে যাচ্ছে!

শেষ সারি থেকে ধুতি পাঞ্জাবি পরা এক ভদ্রলোক মাথা নিচু করে উঠে গেলেন। আশ্চর্য, এই আদেশ অমান্য করার ক্ষমতা তার হল না। সাধিকাই বা কীভাবে তার মনের কথা পড়ে ফেললেন। সাধনজগতের রহস্য সাধক ছাড়া বুঝবে কে!

পদ্মফুলে এতক্ষণ কোনও সুবাস ছিল না। সাধারণত থাকেও না। হঠাৎ প্রচণ্ড সুবাস ছড়াতে লাগল। সাধিকা আপনমনে মৃদু হাসলেন।

ঊষাদি হারমোনিয়ামে সুর তুলতেই, তিনি আবার আঙুল তুললেন। সুর বন্ধ হল। তিনি মৃদু সুরে বললেন, ওই ছেলেটিকে একটা গান গাইতে বলল।

আমি গান গাইব! গলা ভয়ে শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসছে।

তিনি বললেন, কোনও ভয় নেই। হারমোনিয়াম টেনে নাও।

আমি বেশ বুঝতে পারছি, মনের ওপর আমার আর কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। মন্ত্রে না হোক অন্য কিছুতে বশীভূত। মাতামহের কাছে শেখা সেই গানটি চোখ কান বুজিয়ে ধরে ফেললুম,

বিফল জনম, বিফল জীবন
জীবনের জীবনে না হেরে।
আমি খুঁজি সব ঠাঁই
কোথা তারে পাই,
কে হরে নিল মম মনচোরে ॥

একেবারে পুরো টপ্পা, ভৈরবীতে বসানো। কে বলেছে ভৈরবী সকাল ছাড়া গাওয়া যায় না। রাতেও তো দেখছি বেশ জমে। চোখ বুজিয়েই গাইছি। চাইলেই লজ্জা এসে যাবে। হারমোনিয়ামে হাত ফসকাবে আর বেসুরে গলা খেলবে। একবার ন্যাজেগোবরে হলে, সেন্যাজ আর নাড়ানো যাবে না। মাঝে মাঝে চোখ পিটপিট করে শ্রোতাদের মুখ দেখে নিচ্ছি। না, কারুর মুখে ব্যঙ্গের রেখা পড়েনি। জয় ঠাকুর, উতরে দাও। বিশ্বাসে কী না হয়। মিলায় বস্তু, তর্কে বহু দূর।

গান শেষ করে ভয়ে ভয়ে চোখ মেলে তাকালুম। সাধিকা স্থির, অচঞ্চল। ধ্যানস্থ। সারাঘর নিস্তব্ধ। হঠাৎ তিনি তাকালেন। এমন চোখ আমি কখনও দেখিনি। এই দৃষ্টিতে হিংস্র বাঘকেও বশীভূত করে ফেলা যায়। এক লক্ষ মানুষকে স্থির করে রাখা যায়। আমি যদি অমন দৃষ্টি পেতুম!

সাধিকা আমার দিকে তাকিয়ে ইশারায় কাছে ডাকলেন।

দূরত্ব বেশি না, কার্পেটের ওপর দিয়ে হামা টেনে বেড়ালের মতো সামনে গিয়ে থাবা গেড়ে বসলুম। গোলাপের গন্ধ বেরোচ্ছে। যে-আঙুল তুলে তিনি নির্দেশ দেন, সেই আঙুলটি দুই ভুরুর মাঝে কপালে রেখে বললেন, এইখানে, এইখানে, এইখানে।

আমার মনে হল, একটা বরফের ছুরি আমার কপাল ভেদ করে চলে গেল। একটা শীতল অনুভূতিতে মস্তিষ্ক ধীরে ধীরে আচ্ছন্ন হয়ে আসছে। স্থান, কাল, পাত্র সব হারিয়ে যাচ্ছে। চোখ বুজে আছি তবুস্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, এতক্ষণ যা দেখছিলুম তা নয়, অন্য কিছু, অন্য এক জগৎ। জ্যোৎস্নার মতো নীল আলো, গাছের পাতা যেন রুপোর তবক। অগাধ জলাশয় যেন তরল কাঁচ।

তিনি ধীরে ধীরে বলতে লাগলেন, মা বল, মা বল, মা বল।

আমি মা বলছি, আর যতবার বলছি, চোখের সামনে একটি করে সোনার কদম ফুল ফুটে উঠছে।

জোরে নিশ্বাস নে, খুব জোরে। মনে কর, প্রাণবায়ু মেরুদণ্ড দিয়ে পিঠ বেয়ে ধীরে ধীরে উঠছে। মাথার দিকে। সেখানে একটি সোনার কমল ফুটে আছে। নিশ্বাস জোরে ফেল। মনে কর একঝলক কালো বাতাস বেরিয়ে যাচ্ছে।

মা বল, মা বল, মা বল।

সাধিকা নিজেই গাইতে লাগলেন। তেমন সুর, তেমন উচ্চারণ সহসা শোনা যায় না।

অধরং মধুরং বদনং মধুরং নয়নং মধুরং হসিতং মধুরম্‌।
হৃদয়ং মধুরং গমনং মধুরং মধুরাধিপতেরখিলং মধুরম্‌ ॥

প্রবীরদার হাতে কাঠ খত্তাল, ভক্তদের হাতে খঞ্জনি। প্রত্যেক চরণের শেষ লাইনটি সকলে সমস্বরে গেয়ে গেয়ে উঠছেন: চলিতং মধুরং ভ্ৰমিতং মধুরং মধুরাধিপতেরখিলং মধুর।

সুরে আর ছন্দে আমাদের শরীর দুলে দুলে উঠছে। কেউ কেউ হাঁটু গেড়ে বসছেন।

গীতং মধুরং পীতং মধুরং ভুক্তং মধুরং সুপ্তং মধুর

ক্রমে সকলে পঁড়িয়ে উঠলেন, দক্ষিণে বামে দুলতে দুলতে গাইতে লাগলেন, সলিলং মধুরং কমলং মধুরং মধুরাধিপতেরখিলং মধুর ॥

এক একটি চরণ ঘুরে ঘুরে আসছে, করণং মধুরং তরণং মধুরং হরণং মধুরং রমণং মধুর।

আমি কিন্তু থেবড়েই বসে আছি। ভক্তেরা যখন গাইছেন, সাধিকা তখন কানের কাছে মুখ এনে বলছেন, মা বল, মা বল। আমার ভুরুর মাঝখানে বৃত্তাকারে আলোর ঢেউ খেলছে। ঘোট, ক্রমশ বড় হতে হতে অসীমে মিলিয়ে যাচ্ছে। এক একটি বৃত্তের এক এক রং। রামধনুর মতো পরপর সাজানো।

ঢং ঢং করে আটটা বাজল। চিত্রপটের দুপাশে মোমবাতির মতো আলো দুটি ছাড়া ঘরের সব আলো একে একে নিবে গেল। সংগীত থেমে গেল। চারপাশে অখণ্ড নীরবতা। অগাধ জলে ডুবে বসে থাকার মতো অনুভূতি।

ঊষাদি ধীরে ধীরে আমার পাশে এসে হাঁটু গেড়ে বসলেন, চলো, এবার বাড়ি চলো।

সাধিকা বললেন, দাঁড়া। বুকের কাছে জামার বোতাম খোল।

নেশাচ্ছন্নের মতো বোতাম খুলোম। তিনি কড়ে আঙুল দিয়ে একটি ব এঁকে, তিনবার ফুঁ দিলেন।

যা, তোর হবে। ঊষা!

মা!

তুমি আজ এত চঞ্চল কেন?

কই না তো!

আমি যে দেখতে পাচ্ছি। যাও তোমরা প্রসাদ নাও।

প্রণাম করে উঠে দাঁড়াতেই তিনি বললেন, তোর সঙ্গে আমার আবার দেখা হবে ছ’বছর পরে, তার আগে নয়। একটা বীজ ফেলে রাখলুম, অঙ্কুর থেকে গাছ, গাছ থেকে মহীরুহ। তোর জীবনটা আমি নষ্ট করে দিলুম।

নষ্ট করে দিলেন?

হ্যাঁ বাবা। সংসারটংসার তোর দ্বারা হবে না। চেষ্টাও করিস না। বড় চাকরি, গোলদারি ব্যাবসা, ধন, ঐশ্বর্য, যশ, খ্যাতি, প্রতিপত্তি সবই পড়ে থাকবে তোর এলাকার বাইরে। তবে আনন্দে থাকবি, বড় আনন্দে। ভরপুর আনন্দ। কেন এমন করলুম?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

যে-মাটিতে যা হবে তাই তো করতে হবে। এখানে এলি কেন?

তা তো জানি না মা!

আসতে হবে বলে।

তা হলে ছ’বছর পরে কেন দেখা হবে? কেন তার আগে হবে না?

একটু ঘুরেফিরে আয়, জগৎটাকে একটু দেখেশুনে বাজিয়ে নে। ডাব বুনো না হলে তার আঁশ ছাড়ানো যায় না। দেয়ালে মাথা না ঠুকলে মাথা শক্ত হয় না, খালি পায়ে না হাঁটলে পায়ের। তলা শক্ত হয় না। আঙুলে কড়া না পড়লে সেতার বাজানো যায় না। আয়, আয়, জয়ী হয়ে ফিরে আয়।

আমি কি যুদ্ধে চলেছি মা?

তুই সাঁতরে একটা নদী পার হবি। জলে হাঙর আর কামট। ওপার থেকে এপারে আয় অক্ষত শরীরে। ছ’বছর সময়।

তখন আপনি থাকবেন?

তিনি জানেন।

তিনি কে?

যিনি নিজে ধরা না দিলে ধরা যায় না, যিনি নিজে দেখা না দিলে দেখা যায় না। তাই যোগী ধ্যান ধরে হয়ে গিরি গুহাবাসী। নিবিড় আঁধারে মা তোর চমকে অরূপরাশি। যে জানে সে জানে, যে। দেখে সে দেখে।

রিকশা করে আবার আমরা ফিরে এলুম প্রবীরদার বাড়িতে। এইবার বেশ ভয়ভয় করছে। রাত ক্রমশই বেড়ে চলেছে। আজ বরাতে নির্ঘাত তিরস্কার।

প্রবীরদা, আর রাত করিয়ে দেবেন না।

ঊষাদি বললেন, আবার আসবি তো?

খুব ইচ্ছে করবে।

তা হলে আসবি। তোকে আমি গান শেখাব।

প্রবীরদা বললেন, আমরা একটা গানের দল করব।

ঊষাদি বললেন, পঁড়া, তোকে এক শিশি আমের মোরব্বা দিই। দুপুরে খাবি।

ট্রাম চলেছে ঠ্যাং ঠ্যাং করে, ঘণ্টা বাজিয়ে। আমি জানলার ধারে, প্রবীরদা আমার পাশে। কলকাতার রাতের নেশা বেশ জমে উঠেছে। একটি মেয়ে বসে আছে, খোঁপায় গোড়ের মালা। বেলফুলের সুবাসে ট্রামের মন কেমন করছে।

সামনের সিটে দু’হাঁটুর ঠেকনা দিয়ে, শরীরটাকে পেছনে ঠেলে প্রবীরদা বেশ আরামে বসে ছিলেন। ট্রাম একবার থেমে যেই চলতে শুরু করেছে, হাঁটু খুলে প্রবীরদার পা দুটো ধপাস করে নীচে পড়ে গেল। চটিটা ড্যাংগুলির মতো ছিটকে লাফিয়ে উঠে ডিগবাজি খেয়ে উপুড় হয়ে গেল।

প্রবীরদা সামনে টাল খেয়ে ঝুঁকে পড়লেন। সামনের আসনে কপাল ঠুকে গেল। কপালে হাত বোলাতে বোলাতে বললেন, বাপস, পৃথিবীর কোনও কিছুই কি সহজ নয়?

সামনের আসনের ভদ্রলোক ঘাড় ঘুরিয়ে বললেন, কী করছেন মশাই, কুস্তি নাকি?

ফুলেল মহিলা কুঁক কুঁক করে হেসে উঠলেন।

প্রবীরদা ফিসফিস করে বললেন, কান মলে দিতে ইচ্ছে করছে।

কার? ওই মহিলার?

না রে বাবা, আমার নিজের। নিজের দোষেই বেইজ্জত। কপালটা দেখ তো?

একটু লাল হয়েছে। এ কপাল ঘেঁতো হবার জন্যেই জন্মেছে। যাক, তোর শরীর কেমন লাগছে? ঘোর কেটেছে? তা কেটেছে, তবে অদ্ভুত একটা ব্যাপার হচ্ছে। বড়কে ঘোট দেখছি, ছোটকে বড়। সে আবার কী? চোখ খারাপ হয়ে গেল নাকি?

না, চোখের ব্যাপার নয়। এ হল ভেতরের ব্যাপার। যেমন ধরুন, একেবারে সামনের আসনে ওই যে ভদ্রলোক বসে আছেন, বিশাল চেহারা, আসলে উনি খুব ক্ষুদ্র। জোরে একটা ধমক দিলে ঘাবড়ে যাবেন।

পরীক্ষা করে আসব?

যাঃ, লোকে আপনাকে পাগল ভাববে। আবার ওই যে মেয়েটি, কুক কুঁক করল, ও একেবারে শিশু।

তোর এরকম কেন হচ্ছে বল তো?

তা জানি না। আরও একটা ব্যাপার হচ্ছে।

সেটা আবার কী?

সকলের ভেতর দেখতে পাচ্ছি।

মানে সকলকে উলঙ্গ দেখছিস?

না গো, মন দেখতে পাচ্ছি। যেমন আমাদের সামনের আসনের ভদ্রলোক একটা অন্যায় কাজে চলেছেন।

কী হবে?

কিছুই হবে না। কাজটা করে আসবেন।

আমার মন দেখতে পাচ্ছিস?

হ্যাঁ, আপনি ওই মেয়েটির কথা ভাবছেন।

ওঃ ঠিক বলেছিস। তোর সামনে দাঁড়াতে ভয় করছে রে।

আর ওই মেয়েটিও আপনার কথা ভাবছে।

মরেছে, চল, তা হলে নেমে পড়ি।

দরকার নেই। হরেকরকম মনের মানুষ চারপাশে ঘুরছে, ঘুরবে।

হ্যাঁরে আমার ভেতর পাপ আছে?

না, হুজুগ আছে।

যাক বাবা খুব বাঁচান বাঁচিয়েছিস। তোর এই শক্তিটা কবে কাটবে?

ওই মা জানেন।

আমাদের পাড়ায় যখন ঢুকলুম, তখন ন’টা বেজে গেছে। চারপাশ কেমন যেন থমথমে। কিছু একটা হয়েছে। দোকানে দোকানে জটলা। দীনুর নামটা কানে আসছে। দীনু আবার কিছু করল নাকি?

পিতৃদেব গম্ভীর মুখে বারান্দায় বসে আছেন। পাশে একটি চেয়ারে প্রফুল্লকাকা। সিঁড়ির মুখে। পঁড়িয়ে প্রবীরদা ফিসফিস করে বলছেন, তুমি আগে।

আমি বলছি, আপনি আগে।

আর ঠিক সেই মুহূর্তে কাকিমা ডালে লঙ্কা ফোড়ন দিলেন, হ্যাঁ করে। সমস্ত ঝাঁঝ আমাদের নাকে। কোরাসে দুটি সশব্দ হচি। প্রফুল্লকাকা লাফিয়ে উঠলেন, কে, কে? কে ওখানে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *