1 of 3

১.২৩ গোদা রোটি খাও হরিকে গুণ গাও

গোদা রোটি খাও
হরিকে গুণ গাও ৷

পাখির খাঁচার সামনে প্রবীরবাবু থেবড়ে বসে পড়েছেন। আদুড় গা। কোলে একটা খরগোশ, দুটো লেংচে বেড়াচ্ছে পাশে। পাখিরা প্রভুকে দেখে আনন্দে আটখানা হয়ে খুব নাচানাচি করছে। কিছু দূরেই একটা ঘুপচি মতো জায়গায় রান্নাঘর। সেখানে স্টোভ জ্বেলে ঊষাদেবী লাল লাল করে আলু ভাজছেন। কনুই দিয়ে কপালের ওপর ঝরে পড়া চুল সরাতে সরাতে বললেন, পিন্টু, হাত মুখ ধুয়ে নাও। দাদা, তুই ওকে বাথরুমে নিয়ে যা। তুই হাত পা ধুয়েছিস!

দাঁড়া না ধুচ্ছি। তাড়া কীসের?

এই বললি নাড়িভুড়ি জ্বলে যাচ্ছে রে, ঊষী।

আজকে পাখিরা খুব লাট খাচ্ছে রে!

প্রবীরমামা, ওগুলো কী পাখি?

তুমি আমাকে মামা না বলে, দাদা বললে কেমন হয়?

দারুণ হয়।

তাই বলিস। মামা-ভাগনে সম্পর্কটা তেমন ভাল নয়। ঊষা তোর দিদি। দিদিটা কেমন বল?

একেবারে দিদির মতো।

ওঃ টেরিফিক বলেছিস। আমার যদি ওইরকম একটা দিদি থাকত রে!

দিদি নেই বলে তোর কোনও অসুবিধে হচ্ছে রে দাদা?

একটাই অসুবিধে, দিদি রে বলে ডাকতে পারছি না।

আমি দিদি হলে, তোর মতো দাদা পেতুম কোথায়!

প্রবীরদা, কী পাখি?

এ হল মনপাখি রে ভাই, ছটফটানি দেখে বুঝতে পারছিস না। সব যেন ফিল্মস্টার হবার জন্যে লাফালাফি করছে।

ঊষাদি বললেন, ওগুলো হল বদরি পাখি। দুটো থেকে অতগুলো হয়েছে। আরও হবে, তুমি নেবে?

ইচ্ছে থাকলেও নেওয়া যাবে না। বাবা রাগ করবেন।

কেন?

বনের পাখি বনে থাকবে। খাঁচায় থাকবে কেন? একবার না জিজ্ঞেস করে একটা টিয়া পাখি কিনেছিলুম। আমাকে বললেন, এখুনি উড়িয়ে দাও। আমি একটু বায়নামতো করেছিলুম, না ছাড়ব না। আমাকে একটা ঘরে ছ’ঘণ্টা বন্ধ করে রেখেছিলেন। ঘণ্টায় ঘণ্টায় দরজার বাইরে এসে দাঁড়ান। আর জিজ্ঞেস করেন, কী, কেমন লাগছে? প্রথম ঘণ্টা দুয়েক জেদের বসে বলেছিলুম, বাঃ, বেশ লাগছে! তোফা লাগছে। তা হলে সারাজীবন থেকে যাও। এই নাও খানদুয়েক বিস্কুট। কিছু পরে জানলা দিয়ে ছুঁড়ে দিলেন কাগজে মোড়া দুটো লজেন্স। হঠাৎ ছোটবাইরে পেয়ে গেল। চিৎকার করে জানান দিলুম। বললেন, ঘরের কোণে নর্দমা আছে করে ফেলল, কিংবা যেখানে দাঁড়িয়ে আছ সেইখানেই করো। বন্দি-পাখির আবার বাথরুম কীসের! খাঁচার দেড়হাত জায়গাতেই তার ওঠা-বসা, আহার-নিদ্রা, প্রকৃতির কর্ম। তোমাকে তো তোমার মাপ অনুযায়ী বেশি জায়গাই দেওয়া হয়েছে। বড়বাইরে, ছোটবাইরে সব ওইখানেই সারো। সকালে একবার পরিষ্কার করা হবে।

শেষে কী হল? তোমার মা এসে মুক্তি দিলেন!

মা কোথায়? মা তো তার অনেক আগেই স্বর্গে চলে গেছেন।

তা হলে?

তা হলে আর কী, বেলা তিনটের সময় কুঁইকুই করে জানালুম, আমি আর পারছি না। বেলা তিনটে পনেরো মিনিটের সময় মুক্ত পাখি উড়ে চলে গেল উদার আকাশে।

শাবাশ, তোর বাবা তো একটা সাংঘাতিক ক্যারেক্টার। নমস্য মানুষ! কবে যাই বল তো, একবার। প্রণাম করে আসি। উষী, যাবি তুই?

আমি গেলে রাগ করবেন। এসব মানুষ মেয়েদের দু’চক্ষে দেখতে পারেন না।

হ্যাঃ, তুই একেবারে সবজান্তা বাবা। চ না একদিন যাই।

আচ্ছা, সে দেখা যাবে। তুই বোধহয় ভুলে গেছিস দাদা, আজ সাড়ে ছ’টার সময় আশ্রমে গান আছে।

হ্যাঁ রে, তাই তো! সেধেছিস! নে নে তাড়াতাড়ি হাত চালা।

প্রবীরদা উঠতে গিয়ে আবিষ্কার করলেন, এতক্ষণ পেছন দিকে গা ঘেঁষে যে-খরগোশটি বসে ছিল, সেটি বিনা কাজে বসে ছিল না। চিবিয়ে চিবিয়ে কাপড়ের কাছাটি শেষ করে দিয়েছে।

এই দেখ ঊষী, তোর বিক্রম কী করেছে! কী বলতে ইচ্ছে করে বল! বাড়ির একটা জিনিসও আর আস্ত থাকবে না।

তোকে সকাল থেকে বলছি, ওদের ঘাস ফুরিয়েছে।

তা বলে, ও ব্যাটা আমার কাছাটা ঘাস ভেবে চিবোবে!

ওর সে বিচার থাকলে খরগোশ হবে কেন বল! রেখে দে, আমি কেটে বাদ দিয়ে সেলাই করে দেব।

হ্যাঁ, ওই তো তুই শিখেছিস। কেটে বাদ দোব। আমার সমস্ত ধুতি এইভাবে দশ থেকে আট, আট থেকে সাত, শেষে কৌপিন হয়ে যাবে।

ভালই তো, তুই না বলিস সন্ন্যাসী হয়ে যাবি! লুচিগুলো বেশ গোল করে বেলে দে তো।

ঊষাদি, আমি দোব?

প্রবীরদা বললেন, তুই পারবি না পিন্টু। বড় শক্ত কাজ। জ্যামিতির জ্ঞান থাকা চাই।

চ্যালেঞ্জ।

চ্যালেঞ্জ।

তা হলে হয়ে যাক।

বেশ মজা! যেন চড়ুইভাতি হচ্ছে, নদীর ধারের পোড়ো বাড়িতে! লুচি বেশ গোলাকারই হতে লাগল।

প্রবীরদা বললেন, শিখলি কোথা থেকে?

এই ভো আমার কাজ।

কেন, তোর বাড়িতে কেউ নেই?

আমি আর আমার পিতা, আর সাবেক কালের বিশাল এক বাড়ি!

বলিস কী? তুই তো মহাভাগ্যবান রে! যার কেহ নাই, তুমি আছ তার। আর সংসার ফংসারে ঢুকে ন্যাজেগোবরে হয়ো না। সন্ন্যাসী হয়ে বেরিয়ে পড়ো। শালা, সংসারের নিকুচি করেছে।

সন্ন্যাসী হবার আগে তোরা দু’জনে হালুহকর হয়ে যা। দু’পয়সা রোজগার হবে, হরিদ্বার যাবার গাড়িভাড়াটা উঠে যাবে।

সন্ন্যাসীর আবার গাড়িভাড়া কী রে! সবই তো ফ্রি।

লুচি, লাল লাল আলুভাজা, চা। পেটটা ঠান্ডা হল। প্রবীরদা বললেন, তুমিও চলো আমাদের সঙ্গে। খুব ভাল লাগবে। দেখবে উষী কেমন গান গায়!

ফিরতে দেরি হলে বাবা বকবেন।

আঃ এক ছেলে হওয়ার এই বিপদ। আমি তোমাকে আটটার মধ্যে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসব। যদি বকেন, আমাকে বকবেন।

যেতে তো খুব ইচ্ছে করছে, কিন্তু ভয় লাগছে।

আরে দুর, লজ্জা, ঘৃণা, ভয় তিন থাকতে নয়। আজ একজন সাধিকা দেখবে। তোমার মাথায় একবার শুধু হাত রাখবেন, সারাশরীর জুড়িয়ে যাবে। কী সংসারে পড়ে আছ? গোদা রোটি খাও, হরি কা গুণ গাও। দুটো কাঠ খত্তাল হাতে তুলে নিয়ে প্রবীরদা বাজাতে লাগলেন, আর সারা ঘরময় নেচে নেচে গাইতে লাগলেন, গোদা রোটি খাও, হরিকে গুণ গাও। আমাকে বললেন ধর, ধর। নেচে নেচে গা। দেখবি তোর ভেতর থেকে কী যেন একটা বেরিয়ে আসছে।

আমি যে নাচতে পারি না প্রবীরদা। লজ্জা করে।

আরে ধ্যার ব্যাটা, ছাগলেও নাচতে পারে। তুই মানুষ হয়ে নাচতে পারবি না?

ঊষাদি এসে পড়ায় বেঁচে গেলুম। ঘরের বাইরে আমরা দু’জনেই নির্বাসিত। ঊষাদি একটু সাজগোজ করবেন।

দাদা, ধেই ধেই করে না নেচে, জামাকাপড় পরে নে। দুটো রিকশা ডাক।

ঘরের দরজা ভেজিয়ে দিলেন। প্রবীরদার দু’জোড়া খরগোশ। সবক’টাকে কান ধরে ধরে বাক্সে পুরে দিলেন। চারজন চারটে ফুটো দিয়ে মুখ বের করে সংসারের বিচিত্র হালচাল দেখছে। প্রবীরদা গায়ে সেই সকালের জামাটা চাপিয়ে, চুলে দু’বার আঙুল চালিয়ে বললেন, পিন্টু, তুই বোস, আমি মোড়ের মাথা থেকে দুটো রিকশা ধরে আনি।

রান্নাঘরের সামনে ছোট্ট একফালি ছাদ। ছাদে একটি নিখুঁত তুলসীমঞ্চ। নিকোনো তকতকে। এঁরা মনে হয় বৈষ্ণব। আমরা শাক্ত। চারপাশেই খাড়া খাড়া প্রাচীন বাড়ি। ভাঙাভাঙা বারান্দা। হেলে-পড়া জানলা। একেবারে লাগোয়া একটি বাড়ি বেশ নতুন। হালে রং পড়েছে। ভেতরে। কোথাও রেডিয়ো বাজছে। ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য গাইছেন, বাঁকা ভুরু মাঝে আঁকা টিপখানি। জানলায়। জানলায় পরদা ঝুলছে।

হঠাৎ পায়ের কাছে ছোট্ট একটা ইটের টুকরো পড়ল। চারপাশে তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেলুম না। আবার একটা ইটের টুকরো এসে কপালে লাগল। বেশ চমকে দেবার মতো লাগা। এবার ওপর দিকে তাকালুম। তিনতলার ছাদের আলসেতে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বয়েস মনে হল যোলো-সতেরো হবে। একমাথা চুল হাওয়ায় উড়ছে। তাকাতেই মেয়েটি হেসে বললে, প্রিয়তমা।

সামান্য একটা শব্দ মানুষকে কীরকম গতিবেগ দিতে পারে। দৌড়ে একেবারে ভেতরে চলে। এলুম। আর ঠিক তখনই ঊষাদি ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন।

কী হয়েছে পিন্টু! তোমার কপালটা কাটল কী করে!

তিনতলার ছাদে মেয়েটি হা হা করে হাসছে প্রেতিনীর মতো।

সেই হাসি শুনে ঊষাদি বললেন, তুমি বুঝি ওই ছোট ছাদটায় গিয়েছিলে?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

মেয়েটি পাগলি। কখনও ভাল থাকে, কখনও উন্মাদ হয়ে যায়। এখন উন্মাদ অবস্থা। এসো দেখি। ইট মেরেছে?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

তোমাকে আমার বারণ করে দেওয়া উচিত ছিল। দোষটা আমারই। এসো ওষুধ লাগিয়ে দিই। অত বড়লোক, মেয়েটাকে কেন যে উন্মাদ আশ্রমে পাঠাচ্ছে না!

সামান্য একটু কেটে গেছে, ও আর ওষুধ লাগাতে হবে না।

দেখো পিন্টু, আমার অবাধ্য হবে না। অবাধ্য ছেলেদের আমি পছন্দ করি না।

ঊষাদির দৃপ্ত শাসনের ভঙ্গিতে বেশ ভয় পেয়ে গেলুম। ছিপছিপে বেতের মতো লম্বা চেহারা। গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ। ধারালো মুখ, চোখ, নাক। জোড়া ভুরু। সাদা শাড়ি, সাদা ব্লাউজ। হাতদুটো কী লম্বা, যেন শালুক ফুলের উঁটা। হাত তুলে খপ করে যখন আমার একটা হাত ধরলেন, মনে হল সাপে ছোবল মারতে আসছে।

এদিকে আয়, আমার হাত ছাড়িয়ে যাবার ক্ষমতা কারুর নেই। বৃথা চেষ্টা করিসনি।

সত্যিই তাই। মেয়েদের আঙুলে এত জোর হয় আমার জানা ছিল না। যেন লোহার বেড়িতে হাত বাঁধা পড়েছে। আমি অবাক হয়ে ঊষাদির মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। জ্বলজ্বলে দুটো চোখ। ধনুকের মতো বাঁকা ভুরু। কপালে ছোট্ট একটা সাদা টিপ। শুদ্ধ আত্মার জ্যোতির মতো দুই ভুরুর মাঝখানে ভাসছে। চূর্ণ চুল কপালের প্রান্তরেখায় সামান্য অবাধ্য। পৃথিবী এত সুন্দর? ঈশ্বর তোমার আয়োজন এত পূর্ণ? আবেগে আমার চোখে জল এসে গেল। একইনারীর কত বিচিত্র, বিভিন্ন রূপ। ওদিকে একজন নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ঢিল ছুঁড়ে কপাল ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছে। এদিকে একজন পৃথিবীকে হাতের মুঠোয় চেপে ধরে শাসন করছে।

বকেছি বলে তুই কঁদছিস! পাগল ছেলে। ঠিক ধরেছি, তুই এখনও শিশু। চিরকালই তুই শিশু থেকে যাবি। তোকে না চালালে চলতে পারবি না।

ঊষাদি আমার মুখটা বুকে চেপে ধরলেন। আবেগ এমন একটা জিনিস, যখন হঠাৎ আসে তখন মত্ত হাতির মতো ভেতরটা একেবারে তছনছ করে দিয়ে যায়। রোখা যায় না। আমার ভেতরটা ফুলে ফুলে উঠতে লাগল। নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করতে লাগলুম, তোর হলটা কী! কেন এমন করছিস! মানুষ কেন যে কী করে মানুষ যদি জানত। বুকের ওপর ঊষাদি মুখটা চেপে ধরে আছেন। আমার মনে হচ্ছে।

সে বহুদিন আগের এক অভিজ্ঞতা। সাত দিন নাগাড়ে বৃষ্টি হবার পর খুব রোদ উঠেছে। খাল বিল সব ভেসে মাঠ ময়দান একাকার। আমাদের বাড়ির পাশের ঘাসে-ঢাকা একটা মাঠ ভেসে গেছে। চারপাশে পায়ের পাতা ডোবা জল। মাগুর আর শিঙি ভেসে ভেসে চলেছে। সেই জলে পা ডুবিয়ে খপাত খপাত করে চলেছি। জলের ওপরটা গরম, নরম ঘাসে পা পড়লেই ঠান্ডা জল কী এক নাতিশীতোষ্ণ স্নেহে পা জড়িয়ে ধরছে।

এখন এই অবস্থায় আমার মনে হচ্ছে আমি সেই নরম সিক্ত ঘাসে মুখ থুবড়ে পড়ে আছি। ঊষাদির ভরাট বুক থেকে একটা শীতল স্পর্শ উঠে আসছে, একটা পূর্ণতার অনুভূতি। সমস্ত শরীর শিথিল হয়ে আসছে। এই মহিলার নিশ্চয়ই কোনও ঐশী শক্তি আছে।

ঊষাদি আমার মুখটা উঁচু করে তুলে ধরে ঠোঁটে একটা চুমু খেয়ে বললেন, তোর মুখটা কী মিষ্টি রে! এই বয়সের ছেলেদের মুখ কেমন যেন চোয়াড়ে হয়।

কপালের কাটা জায়গাটা মুছিয়ে দিয়ে এক ফোঁটা আইডিন লাগিয়ে দিলেন। হাতে একটা চিরুনি দিয়ে বললেন, নে, চুলটা আঁচড়ে নে।

হঠাৎ আমার মুখ ফসকে বেরিয়ে এল একটা প্রশ্ন, আপনি কে?

আমি? আমি ঊষা। পৃথিবীর প্রথম আলো।

হেঁট হয়ে ঝপ করে একটা প্রণাম করে নিলুম।

করিস কী, করিস কী?

আর করিস কী! আমার মন বলছে, তুই এঁকে ধরে থাক। কী পেতে কী পেয়ে যাস, তার ঠিক নেই। পরশপাথর ছুঁইয়ে নে সোনা হয়ে যাবি।

প্রবীরদা নীচে থেকে হাঁক মারলেন, ওরে নেমে আয়।

রিকশা চলেছে ঠুনঠুন করে। একটায় আমি আর ঊষাদি। আর একটায় প্রবীরদা আর হারমোনিয়ম। আজ কী বাতাস ছেড়েছে! সন্ধের কলকাতা যেন পাগল হয়ে গেছে। চারপাশ ভিজেভিজে। কোথা থেকে নীলচে আলো নেমে এসেছে। দোকানের হলদে বাতি সব সবুজ বর্ণ। লোকজন, পথঘাট সব যেন স্বপ্নের ভেতর দিয়ে চলেছে।

ঊষাদির মুখ অসম্ভব গম্ভীর। একটাও কথা বলছেন না। একবার শুধু জিজ্ঞেস করেছিলেন, গান জানিস?

আমরা কোথায় যে চলেছি, কিছুই জানি না। শুধু চলেছি। ছায়াছায়া পৃথিবীর পথ দিয়ে তরতর করে বয়ে চলেছি। সামনে একটা বলিষ্ঠ পিঠ, ডাইনে বাঁয়ে ছন্দে দুলছে। দুটো পা একই লয়ে নেচে চলেছে। মাঝে মাঝে ঠুং ঠুং শব্দে বাতাস যেন ঝিমিয়ে পড়ছে।

গোটা তিনেক বাঁক নিয়ে রিকশা একটা পরিচ্ছন্ন রাস্তায় ঢুকে পড়ল। দু’পাশের বাড়িতে বেশ একটা শ্ৰী আছে। নিয়মমতো রং পড়ে। তেমন ভাঙাচোরা নয়। একটা গেরুয়া রঙের বাড়ির সামনে আমরা নেমে পড়লুম। বিশাল গেট। গেটের মাথায় কেয়ারি করা বাগান বিলাস উত্তেজনায় লাল হয়ে আছে। ভেতরে সবুজ ঘাসে ঢাকা বাগান। বাড়িটা ভেতর দিকে লম্বা হয়ে পড়ে আছে। কোনও আড়ম্বর নেই। পরিচ্ছন্নতায় মন ভরে যায়।

ভেতরের হলঘরে বেশ বড় রকমের আয়োজন। একেবারে শেষ মাথায় মার্বেল পাথরে বাঁধানো একটি বেদি। তার ওপর বিশাল একটা চিত্রপট। কোনও সাধিকার। আসন করে বসে আছেন। একটি পায়ের ওপর আড়াআড়ি করে রাখা আর একটি পা। একেই বলে সিদ্ধাসন। বজ্রের মতো চেহারা। মাথায় নটরাজের মতো চুল একপাশে চুড়ো করে বাঁধা। গেরুয়া রঙের শাড়ি। বসে আছেন বাঘছালে। চারপাশে মোমবাতির মতো উঁচু উঁচু চারটে বিজলি বাতি জ্বলছে। বড় বড় পদ্মফুল পায়ের কাছে ছড়ানো। ধূপের ধোঁয়া উঠছে পাকিয়ে পাকিয়ে।

ঘরে আলোর ব্যবস্থা এমনভাবে করা, যেন সবে ভোর হল। বড় বড় কার্পেট টানটান করে পাতা। এরই মধ্যে বেশ ভাল জমায়েত হয়েছে। বৃদ্ধ আর বৃদ্ধার সংখ্যাই বেশি। তরুণ, তরুণী এমনকী বালক বালিকাও রয়েছে। কেউ এতটুকু শব্দ করছেন না, একেবারে ধ্যানস্থ। কে যেন বলছেন চুপ, সব নীরব হয়ে গেছেন। সমুদ্রে ঢেউ উঠেছিল, জাদুদণ্ড ঘুরিয়ে সেই মুহূর্তে স্থির করে দেওয়া হয়েছে।

কে সেই জাদুকর!

সেই চিত্রপটের একপাশে বসে আছেন এক সন্ন্যাসিনী৷ এঁকেই বলা যায় যৌবনে যোগিনী। সিল্কের গেরুয়া। রুক্ষ্ম, এলোচুল। কপালে এত বড় একটা লাল টিপ, ঘষা লেগে ছড়িয়ে পড়েছে। নিমীলিত চোখ। কোথায় কোন জগতে আছে? দেহ যেখানে রয়েছে, মন সেখানে নেই। দেখলেই বোঝা যায়।

ঊষাদি ফিসফিস করে বললেন, পা টিপে টিপে এক পাশ দিয়ে সামনে এগিয়ে চলল। পায়ের গাঁট ভাঙার শব্দ যেন না হয়।

প্রবীরদার হাতে ধরা হারমোনিয়মের আংটায় খটাস করে বিশ্রী শব্দ হল। নিস্তব্ধতায় যেন চিল পড়ল।

ঊষাদি হাঁটু মুড়ে প্রণাম করলেন।

তিনি নিমীলিত দৃষ্টি মেলে দেখলেন। খুব রোদের দিনে জানলার পাখি একটু ফাঁক করলে যেমন একঝলক রোদ আসে, চোখের ফাঁক দিয়ে সেইরকম একঝলক তেজ বেরিয়ে এল। সাধন-ভজন করলে মানুষের কী যে একটা অদ্ভুত পরিবর্তন হয়!

প্রবীরদার প্রণাম শেষ হতেই আমি নিচু হলুম। আমার মনে হল অনন্তের সামনে মাথা নিচু করছি। নাকে দেবালয়ের গন্ধ। গায়ে কেমন যেন কাঁটা দিচ্ছে। শক্তিশালী চুম্বকের সামনে লোহার টুকরো পড়লে যেমন কাঁপতে থাকে, আমার শরীর সেইরকম কাঁপতে থাকল। মনে হল, আমি যেন বরফের মতো গলতে শুরু করেছি। তিনি একটি আঙুল তুললেন। আমার সমস্ত শরীর সঙ্গে সঙ্গে স্থির হয়ে গেল। কেন জানি না, তার ঠোঁটের কোণে বিদ্যুৎচমকের মতো একঝিলিক হাসিও খেলে গেল।

পিঠে আঙুলের স্পর্শ পড়ল। ঊষাদি ইশারায় বলছেন, উঠে এসো।

যেকার্পেটটিতে এতক্ষণ কেউ বসেননি, আমরা সেই আসনে সাবধানে বসে পড়লুম। ডান পাশে চিত্রপট। কোনাকুনি বসে আছেন ধ্যানস্থ সাধিকা। সামনে ভক্তমণ্ডলী। করুণাধারার মতো আলো নেমে আসছে। বাইরে উতলা বাতাসে, জানলায় জানলায় ফুলন্ত যুঁই কেঁপে কেঁপে গন্ধ ছড়াচ্ছে। ধূপের ধোয়া মৃতের আত্মার মতো ঘুরে ঘুরে ওপরে উঠছে।

সাধিকা একটি হাত তুলে ইশারায় জানালেন, শুরু করো। এ বেশ ভাল ব্যবস্থা! অনর্থক কোনও বাগাড়ম্বর নেই। ঈশ্বর এই, ঈশ্বর ওই। ধর্ম, ধর্ম। নীরব ধ্যানে তোমরা যে পারো তাকে খুঁজে নাও।

হারমোনিয়মে সুর খেলতে লাগল। তবলা নেই। তাই তেওঁটে তালের টক্করে সুর হোঁচট খাচ্ছে। না। ঊষাদি ধরলেন,

ন তাতো, ন মাতা ন বন্ধুর্ণ নপ্তা,
ন পুত্রো ন পুত্রী ন ভূতত্যা ন ভর্তা।
ন জায়া ন বিদ্যা ন বৃত্তিৰ্মমৈব,
গতিস্তং গতিস্তং ত্বমেকা ভবানী ॥

শ্রোতারা শেষ লাইনটি কণ্ঠে তুলে নিলেন, গতিস্তং গতিস্তং ত্বমেকা ভবানী।

আশ্চর্য এই স্তোত্রটি আমি পুরো জানি, হে ভবানী! আমার পিতা নেই, মাতা নেই, বন্ধু, পৌত্র, পুত্র, কন্যা, ভৃত্য, ভর্তা, জায়া কেউ নেই, আমার বিদ্যা নেই, জীবিকা নেই, তুমি গতি, তুমিই আমার একমাত্র গতি।

ঊষাদির গলা এত সুন্দর! এত সুন্দর! এত স্পষ্ট উচ্চারণ। আমি নেহাতই একটা মেড়া। কিছুই নেই আমার। বিদ্যা নেই, বুদ্ধি নেই, স্বাস্থ্য নেই, পুরুষকার নেই। কে কোথায় কতদূর এগিয়ে বসে আছে, কিছুই জানি না।

ঊষাদি এবার গাইলেন:

ওহে রাজ রাজেশ্বর দেখা দাও,
করুণা-ভিখারি আমি করুণা কটাক্ষে চাও।।
চরণে উৎসর্গ দান করিতেছি এই প্রাণ,
সংসার-অনলকুণ্ডে ঝলসি গিয়াছে তাও।।

বেহাগে এমন একটা গান ধরেছেন, কারুর আর নড়বার চড়বার উপায় নেই। বাইরেটা যত অন্ধকার হচ্ছে ভেতরটা তত উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। চিত্রপটে দেবী হাসছেন। চোখের ভুল কি না জানি না, সাধিকাকে দেখাচ্ছে, আগুনের পুতুল যেন!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *