একা একা – ১

০১.

পাশাপাশি চারজনের আর জায়গা হল না। মালপত্রেই গাড়ির বারো আনা ভরে গিয়েছিল; শরদিন্দু যেরকম লটবহর জুটিয়েছেন, মনে হচ্ছিল, আধখানা সংসারই তুলে এনেছেন। হাওড়া স্টেশনের ট্যাক্সিঅলাদের যা ধরন, তাতে এই পর্বতপ্রমাণ মালপত্র তারা কিছুতেই এক গাড়িতে নিত না। কাঠফাটা দুপুররোদে দাঁড়িয়ে ট্যাক্সি-ট্যাক্সি করতে হত। ছেলেটার কষ্ট হত খুব, চোখের যন্ত্রণায় হয়তো ছটফট করত। শরদিন্দুও রোদে-তাতে অস্থির হয়ে উঠতেন। সাতপাঁচ ভেবে নীহার বাড়ি থেকে বেরুবার সময় একটা প্রাইভেট গাড়ি ভাড়া করে নিয়ে এসেছিলেন; দেবু দত্তদের গাড়ি, কখনও-সখনও তাঁকে এরকম দু-চার ঘণ্টার জন্যে ভাড়া নিতে হয়। ড্রাইভার কেষ্ট ছেলেটিও ভাল, দরকারে সাহায্য করে সবরকম। সোয়া এগারোটার গাড়ি এল পৌনে একটায়। এতক্ষণ হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকা, গরমে পচে যাওয়া; তবু কেষ্ট একটুও বিরক্ত নয়। নীহার কুলিদের বাবা বাছা করে, কেষ্টর খবরদারিতে মালপত্র সব তুলিয়ে নিয়ে শরদিন্দুকে সামনে বসতে বললেন। সামনেও কিছু মালপত্র রাখতে হয়েছে। নীহাররা বসলেন পেছনে; নীহার, তনুশ্যাম আর রিনি।

গাড়ি ছাড়লে নীহার মাথার কাপড় নামিয়ে ঘাড়-গলার ঘাম মুছতে লাগলেন; চেহারা দিন দিন ভারী হয়ে উঠেছে, তার ওপর এই দুপুরের রোদ, গরম, প্ল্যাটফর্মে বসে অপেক্ষা, ভিড়।

নীহারের পাশে তনুশ্যাম। ছেলেটাকে জানলার পাশে বসাতে সাহস হয়নি নীহারের। গরমের হলকা যদি চোখে লাগে বেচারার খুব কষ্ট হবে। তনুর পাশে ডান দিকের দরজা ঘেঁষে বসে আছে রিনি, নীহারের মেয়ে। রিনি নিজেই হাওড়া স্টেশনে আসতে চেয়েছিল। নীহারও চেয়েছিলেন রিনি আসুক। তিনি একলা আসার চেয়ে মা-মেয়ে মিলে শরদিন্দুদের নিতে আসছেন, এটাই ভাল দেখায়।

রিনি যে শরদিন্দুদের দেখার পর থেকে আগাগোড়া হেসে মরে যাচ্ছে–এটা তেমন বোঝার উপায় নেই। হাসিটাকে সে নানাভাবে কখনও মুখ ফিরিয়ে, কখনও একেবারে উলটো দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে, কখনও বা ঠোঁট কামড়ে, মুখ আড়াল করে লুকিয়ে রাখছে। যখন আর সামলাতে পারছে না, হেসেই ফেলছে। নীহারের অবশ্য মেয়ের অত হাসি দেখার সময় কই! কুলি আর মালপত্রের দিকেই নজর তাঁর। শরদিন্দুও যেন নীহারের ব্যবস্থাপনা দেখছেন। আর তনুশ্যাম অবাক হয়ে দেখছে হাওড়া স্টেশন, লোকজন, ট্যাক্সিস্ট্যান্ড, আশপাশ।

শরদিন্দুর সাজপোশাকটাই রিনির কাছে খুব হাস্যকর লাগছিল। চার-পাঁচ, কি বড়জোর ছশো মাইল দূর থেকে আসছেন শরদিন্দুমামা; কিন্তু পোশাক দেখলে মনে হবে, খাস বিলেত থেকে এইমাত্র উড়ে এসে নেমেছেন। তাও আবার এখনকার বিলেত নয়, কেননা সেটা রিনি ছবি-টবিতে সিনেমায় দেখেছে। মামার পোশাকটা যেন ডেভিড কপারফিল্ডের লোকজনের মতন। রিনি ইংরেজি সিনেমায় সেকেলে বিলেতি পোশাক-আশাক চক্ষে দেখেছে বলে তার এই রকম মনে হচ্ছিল। এই পচা গরমেও বিচিত্র সুট, টাই, ভেস্ট এবং টুপি। মার ধমকে টুপিটা অবশ্য এখন মামার কোলে; কিছু কাঁচা, কিছু পাতলা সাদা চুল টুপির চাপে পাট হয়ে বসে আছে মাথায়।

মামার ছেলেটি যদিও পোশাকে-আশাকে মামার মতন নয়, তবু তার প্যান্টের কাটছাঁট, চেককাটা জামাটার বাহার দেখলে মনে হবে, এ একেবারেই খোট্টাই ছাঁট। নামেরই কী বাহার ছেলেটার। তনুশ্যাম! ঘনশ্যাম হতে দোষ ছিল কোথায়? রিনিদের কলেজে এক ঘনশ্যাম ছিল, ঘণ্টা বাজাত। রিনিরা তাকে বলত, ঘণ্টাশ্যাম। একে তো আর তা বলা যায় না। শরদিন্দুমামার ছেলে, মার খুব আদরের জন। অথচ মা ছেলেটাকে নাকি দেখেইনি; একবার মাত্র দেখেছিল, তখন তনুশ্যাম একেবারে বাচ্চা, হাফপ্যান্টও হয়তো ঠিক মতন পরতে পারত না। তা হলে রিনি তখন কত? মানে বয়েস কত রিনির? মা বলে, রিনি তখন কাঁথা ভেজাত। দমকা হাসি এসে গেল রিনির, সে হেসে ফেলে গলা চাপবার চেষ্টা করল, রুমালটা কোলের আশেপাশে কোথায় পড়ে গেছে, আঁচলটাই মুখে চেপে ধরল।

নীহার এবার ঘাড় ফিরিয়ে মেয়ের দিকে তাকালেন। হাসছিস?

রিনির জবাব দেবার কিছু ছিল না; সে খুব বুদ্ধি করে আঙুল দিয়ে দরজার বাইরেটা দেখাল। হাসির উপাদানটা কোথায় তা জানার উপায় থাকল না। গাড়ি চলছে। রিনি তার জানলার দিকেই আঙুল দিয়ে বাইরে কিছু দেখিয়েছে। কাজেই উপাদান যদি কিছু থেকেই থাকে সেটা পেছনে পড়ে গেছে এবং আড়ালে। নীহার কিছুই বুঝতে পারলেন না। তিনি বরং দেখলেন, গাড়িটা হাওড়া ব্রিজ দিয়ে যাচ্ছে। তনুশ্যামকে হাওড়া ব্রিজ আর গঙ্গা দেখাতে লাগলেন নীহার। তনুশ্যামও অবাক হয়ে হাওড়া ব্রিজ দেখতে লাগল।

শরদিন্দু সামনে থেকে বললেন, আমাদের সময়ে ছিল কাঠের পুল–ফ্লোটিং ব্রিজ। নতুনটা সবে তৈরি হচ্ছিল। বলে শরদিন্দুও যেন সেই পুরনো ব্রিজটার ছিটেফোঁটা অস্তিত্ব খুঁজতে লাগলেন। ধরতে পারলেন না।

নীহার বললেন, তোমাদের সময়ের কলকাতার কতটুকুই আর আছে। সে কলকাতার সঙ্গে এখানকার আর মিল খুঁজে পাবে না।

তাই শুনি, শরদিন্দু বললেন আস্তে করে, পুরনো কলকাতা মরে গেছে।

রিনির পায়ের কাছে একটা বাস্কেট, তার ওপর একটা হাত দেড়েকের সুটকেস, কোনও রকমে রিনি পায়ের আঙুলগুলো রেখে গোড়ালি তুলে বসে আছে। তার কোমরের তলার দিকের বিশ্রী চাপ পড়ছিল তনুশ্যামের ওপর। ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছিল রিনির। একদিকে ভার দিয়ে বসেও সে নিজেকে সামলাতে পারছিল না। তনুশ্যামও নড়তে পারছে না; তার ওপাশে মা, জলের ফ্রেমসমেত কুঁজোটা তনুর পায়ের তলায়, কোলের ওপর টাইমটেবল, কাগজপত্র, বই। রিনির পা যদি ভার রাখতে পারত তাকে এভাবে হেলে পড়তে হত না ছেলেটার দিকে। তবু রিনি চেষ্টা করল যাতে তার পায়ের দিকের চাপটা আলগা করা যয়। মার তনুশ্যামের তনুটি রোগা-সোগা, বড় জোর বলা যায় ছিপছিপে। গায়ের চেককাটা পুরো হাতার মোটা শার্টটার জন্যে রোগাটে ভাব অতটা বোঝা যাচ্ছে না। ছেলেটার রং শ্যামলা, প্রায় কালচে। বোধহয় সেইজন্যেই নাম হয়েছে তনুশ্যাম। মুখটি খুব মোলায়েম, মেয়েমেয়ে ঢঙের, মানে–মেয়েলি নয়, কিন্তু নরম, শান্ত ধরনের। সারা মুখে পাতলা দাড়ি, মাথার চুলগুলো রুক্ষ, লালচে, পাতলা। চোখে মোটা কাচের চশমা, সাদা কাচের চশমা নয়, রঙিন চশমা–তাতে আবার কানের দিকটাও আড়াল করা। চশমাটা এমনই যে চোখ পুরোপুরি ঢাকা তনুশ্যামের, চোখ দেখা যায় না। রিনি যতবার চোখ দেখার চেষ্টা করেছে, ঘন নীলচে কাঁচ ছাড়া আর কিছুই দেখতে পায়নি। অথচ তনু তার গগলস ধরনের চশমার ভেতর থেকে নিশ্চয় রিনিকে দেখতে পাচ্ছে। রিনির এতে কেমন এক আপত্তি হচ্ছিল, তুমি আমায় দিব্যি দেখবে আর আমি তোমায় দেখব না তা হয় না।

গাড়িটা হাওড়া ব্রিজ ছাড়িয়ে এসেছে কখন। ডান দিকে আসতে আসতে আবার যখন বাঁয়ে মোড় নিল, রিনি একেবারে আচমকা বালিশের মতন ধপ করে তনুশ্যামের কোলে ঢলে পড়ল। তার মাথাটা তনুর বুকের ওপর দিয়ে গড়িয়ে একেবারে কোলে কাগজপত্রের ওপর।

রিনি ভীষণ অপ্রস্তুত। তাড়াতাড়ি উঠতে গিয়ে শুনল তনুই হাসছে।

নীহার মেয়ের গড়িয়ে পড়া দেখে অবাক। তারপর হেসে ফেললেন, ঘুমে ঢুলছিলি নাকি?

 রাগ করে রিনি বলল, ধত, এভাবে বসা যায়?

নীহার বললেন, কেন যাবে না। আমরা বসে নেই? তুই যদি বসে বসে ঢুলিস, তবে আর বসার দোষ কী!

রিনি বলল, আমি মোটেও ঢুলিনি। মার চেয়েও তার বেশি রাগ হল, তনুর ওপর। ছেলেটা কেমন করে হাসল! অসভ্য একেবারে। রিনি যেন জেদ করেই তনুকে পাশ থেকে চেপে কোমর দিয়ে ঠেলে ঠেলে নিজের বসার জায়গা করতে লাগল। তনু আরও গুটিয়ে নিতে লাগল নিজেকে। শরদিন্দু হঠাৎ বললেন, নীহার, হাইকোর্ট।

নীহার হেসে বললেন, তুমি দেখো তোমরা তো কোনও কালে বাঙাল ছিলে শুনেছি।

তনু এদিক ওদিক তাকিয়ে হাইকোর্ট খুঁজছিল, রিনি চট করে আঙুল দিয়ে ইডেন গার্ডেনসের দিকটা দেখিয়ে দিল। বাঙালকে হাইকোর্ট দেখানো আর কী! তারপর মুখ ফিরিয়ে হাসতে লাগল।

গড়ের মাঠের কাছে এসে নীহার তনুকে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল দেখাচ্ছিলেন, রিনি দাঁতে ঠোঁট কেটে টুক করে বলল, পাশেই সবটা গড়ের মাঠ। বলে, মুখ ফিরিয়ে হাসল।

শরদিন্দু বললেন, নীহার, আমি কখনও ওই মেমোরিয়ালের ভেতরে যাইনি।

নীহার হেসে বললেন, কলকাতায় থাকতে তুমি বাপু দুটি মাত্র জিনিস দেখেছিলে, এক তোমার কলেজ আর ঠনঠনিয়ার কালীবাড়ি।

শরদিন্দু হাসির গলায় বললেন, আরে না না, আরও কত কী দেখেছি। আমি বছরে বার-দুই করে জু-য়ে বেড়াতে যেতাম।

নীহার বেশ জোরেই হেসে ফেললেন। হেসে কী মনে হল, তাড়াতাড়ি ছেলেমেয়ের দিকে তাকালেন। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, তুমি তো শিবপুরেই বেশি যেতে।

হ্যাঁ, বটানিকসে।

তা তো যাবেই; ওই গাছ-গাছড়াই তোমার জিনিস…এলে যখন আর একবার দেখে যেয়ো৷

যাব, একবার।

মামা, রিনি বলল, আমি আপনাকে এবার একদিন ভিক্টোরিয়ায় ঘুরিয়ে নিয়ে যাব।

শরদিন্দু বললেন, বেশ তো, একদিন সবাই মিলে বেড়াতে আসা যাবে।

 শুধু ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল কেন–নীহার বললেন, তোর মামাকে নিয়ে সারা কলকাতা চষে বেড়াস। কবে কলেজে পড়ার সময় কলকাতায় ছিল, সে কলকাতা আর নেই। কত দেখার জিনিস হয়েছে! বলে তনুর দিকে তাকালেন, ছেলেটাও কলকাতায় এল প্রথম, ওকে সব দেখাতে হবে।

গাড়ি পি জি হাসপাতালের কাছাকাছি আসতে তনুশ্যাম আস্তে করে নীহারকে বলল, আমি চশমাটা খুলব একটু?

নীহার মাথা নেড়ে তাড়াতাড়ি বললেন, না না, না বাবা। এই দুপুর, রোদ গনগন করছে, গরম বাতাস, দেখছ না।

শরদিন্দু ঘাড় ফিরিয়ে বললেন, চোখে জল পড়তে শুরু করবে, শ্যাম; ট্রেনেই যথেষ্ট অত্যাচার হয়ে গেছে।

তনুশ্যাম আর কোনও কথা বলল না।

রিনি মুখ ফিরিয়ে তনুশ্যামকে দেখছিল। মার কাছে সবই শুনেছে রিনি। তনু চোখের অসুখে ভুগছে অনেকদিন ধরে। বাচ্চা বয়স থেকেই। কয়েক বছর বাড়াবাড়ি যাচ্ছে। অনেক ডাক্তার দেখিয়েছে, চিকিৎসা করেছে; কিছু হয়নি। শরদিন্দুমামা ছেলেকে নিয়ে কলকাতায় এসেছেন চোখের চিকিৎসার জন্যে। রিনির বাবা নিজেই চোখের ডাক্তার ছিলেন কিন্তু তিনি তো আর নেই, রিনির বছর তেরো বয়সে তিনি চলে গেছেন। বাবা থাকলে বাবাই তনুর চোখ দেখতে পারত। বাবা না থাকলেও কলকাতায় অনেক বড় বড় ডাক্তার রয়েছেন, তাঁরা দেখবেন, বাবার বন্ধু হিসেবেও দু-একজনকে মা চেনেন, তাঁরা দেখবেন।

তনুশ্যামের জন্যে রিনির দুঃখই হল। মার কাছে যখন শরদিন্দুমামার চিঠি আসত, মা যখন এই ছেলেটির চোখের অসুখের কথা বলত-টলত, রিনি হয়তো সহানুভূতি বোধ করত কিন্তু তার তেমন কোনও কৌতূহল ছিল না। তারপর সে শুনল শরদিন্দুমামারা কলকাতায় আসছেন। ইদানীং তার খানিকটা কৌতূহল হচ্ছিল। আজ তনুশ্যামকে দেখে রিনি বুঝতে পারছে বেচারির সত্যিই বড় কষ্ট। চোখ দুটো থেকেও যেন না থাকার মতন হয়ে আছে। রিনি তনুর চোখ দুটি কেমন তা দেখার জন্যে কেমন উদগ্রীব হয়ে উঠল।

হরিশ মুখার্জি রোডে গাড়িটা ঘুরে যাবার পর রিনি বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকল। ফুটপাথ ঘেঁষে ছায়া পড়েছে খানিকটা, গাছের ছায়া। অন্যদিকে রোদ ঝলসে যাচ্ছে। একটা কৃষ্ণচূড়া গাছের তলায় কিছু খই পড়ে আছে ছিটিয়ে, কয়েকটা শুকনো ফুল। বোধহয় খানিকটা আগে হাসপাতাল থেকে কারও মৃতদেহ চলে গেছে, তারই কিছু চিহ্ন। রিনি বাইরের দিকেই তাকিয়ে থাকল।

বাড়ি এসে মালপত্র তুলতে তুলতে দুটো বেজে গেল। নীহার খুব ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। জিনিসপত্র টানাহেঁচড়া খোলাখুলি করতে দিলেন না। মাঝদুপুর পেরোতে চলল, এখন রোদে-তাতে পোড়া মানুষগুলো আগে একটু জিরিয়ে স্নান-খাওয়া করে নিক, শরীরটা জুড়োক, তারপর বাক্স-বিছানা খুললে হবে।

ব্যবস্থার কোনও ত্রুটি নীহার রাখেনি। বাড়িটা এমন কিছু ছোট নয়। বাঁ দিকটায় দুঘর ভাড়াটে; তাদের সঙ্গে এদিকটার কোথাও কোনও সম্পর্ক নেই। ওপাশটা আলাদা। এপাশে ডান দিকে নীচের তলায় একটা নার্সারি স্কুল, দোতলায় নীহাররা থাকেন, তিনতলাতেও দেড়খানা ঘর রয়েছে। নীহারদের দিকটা পড়েছে দক্ষিণে। বারান্দা ঘেঁষে পর পর ঘর, পুবের দিকে একটা বাঁক মতন আছে। শরদিন্দুর জন্যে তেতলার ঘরটাই রেখেছে নীহার। গরমের দিনে দুপুরটায় খানিক কষ্ট হলেও বিকেল পড়ে গেলে বেশ ভালই লাগবে। ঘরের লাগোয়া ছোট এক ফালি ছাদ, টবের কিছু গাছপালা, ফাঁকা, নিরিবিলি কাজ চালাবার মতন বাথরুমও আছে একটা। বাকি আধখানা ঘরে এ বাড়িটার নানান অব্যবহার্য জিনিস জমা করা ছিল। সেটা কিছু পরিষ্কার করা হয়েছে, দরকারে জিনিসপত্র রাখা যেতে পারে।

দোতলায় একটা ঘর ঠিক করা হয়েছে তনুশ্যামের জন্যে। কোনার দিকের ঘর। ঘরটা ছিল রিনির পড়াশোনার, একপাশে তার গানবাজনার কিছু সরঞ্জাম থাকত, আর যত টুকিটাকি। সেই ঘরটা পরিষ্কার করিয়ে জিনিসপত্র সরিয়ে খাট পেতে তনুর ঘর করে দেওয়া হয়েছে; পাশেই নীহারের ঘর। নীহারের ঘরের গায়ে গায়ে রিনির শোবার ঘর।

চওড়া বারান্দার সামনে উঁচু রেলিং; রেলিংয়ের মাথায় মাথায় রোদ-জল বাঁচাবার জন্যে কাঠের ফ্রেমে কাচের মোটা শার্সি বসানো, আগাগোড়া। সাদা এবং নীলচে রঙের শার্সিগুলো বাহারি। বারান্দার একদিকে বসার অন্যদিকে খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা। নীহারের হাতের গুণে সবই পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন, পরিপাটি।

স্নান খাওয়া-দাওয়া শেষ করতে করতে তিনটে বেজে গেল। তারপর নীহার বসলেন খেতে, রিনিও মার সঙ্গে বসল। শরদিন্দুকে তাঁর ঘরে পাঠানো হয়েছে বিশ্রামের জন্যে। তনুশ্যাম তার ঘরে শুয়ে আছে বোধহয়।

রিনি বলল, মা, আজ আর আমার মাধুরীদের বাড়ি যাওয়া হবে না। এরপর আর কখন বেরুব?

নীহার বললেন, আজ আর কী করে বেরুবি; বাড়িতে মানুষজন এল। বিকেলে ওদের গোছগাছ করে দিতে হবে না?

গোছগাছের আছে কী? তুমি তো সবই গুছিয়ে রেখেছিলে। ওরা যে কেন গন্ধমাদন বয়ে আনল বাপু কে জানে!

নীহার মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললেন, ওই রকম মানুষ যে!

বলে একটু থেমে আবার বললেন, কতদিন থাকবে তার তো কিছু ঠিক নেই, পনেরো দিন একমাস হতে পারে আবার বেশিও হতে পারে। তাই লটবহর বয়ে এনেছে।

রিনি এবার একটু দই মুখে দিল। স্বাদ পরখ করে সামান্য নুন মেশাল। বারান্দার শার্সিগুলো প্রায় সব বন্ধ। কাচের নীলচে রঙের জন্যে ছায়া পুরু হয়ে আছে: খোলা দু-এক পাট শার্সি দিয়ে আলো আর বাতাস আসছিল। মাথার ওপর হু হু করে পাখা ঘুরছে। বারান্দার বেসিনের দিকে পেতলের টবে একটা অর্কিড, তার প্রায় মাথার ওপর রিনির হাতের মানিপ্ল্যান্টের লতানো নকশা।

রিনি আরামের মুখে দই খেয়ে জিবের শব্দ করল বার কয়েক, তারপর বলল, এক মাসেরও বেশি! বাব্বা, ছেলেটার চোখে এত কী হয়েছে?

নীহার মেয়ের দিকে তাকালেন। ছেলেটা কীরে? তুই কি ওর নাড়ি কেটেছিস?

হেসে ফেলল রিনি। ভদ্রলোক বলব নাকি?

এর নাম নেই! অমন সুন্দর নাম-

ঘনশ্যাম।

নীহার প্রথমটায় বুঝতে না পারলেও পরে রিনির ঠাট্টাটা বুঝতে পেরে বললেন, রাখ; তোদের আজকালকার নামের যা ছিরি, নাম না খাঁড়ার ঘা, বোঝা যায় না। ও আমাদের তনুশ্যামই ভাল। আমিও তো শ্যাম বলি; তুই শ্যামদা বলবি।

রিনি হি হি করে হেসে উঠল। হাসির দমকে তার সারা গা কাঁপছিল।  তুমি মা একেবারে যাচ্ছেতাই, রিনি বলল, ওকে আমার শ্যামদা বলতে বয়ে গেছে।

নীহারেরও খাওয়া শেষ হয়ে আসছিল। মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, বলবি না?

ধ্যুত!

শ্যাম তোর চেয়ে বয়সে বড়।

কত বড়? দু-এক বছর? আবার কী?

না–নীহার বেশ হেলিয়ে মাথা নাড়লেন, কম করেও বছর তিনেকের। আমার বেশ মনে আছে, আমি যখন ওকে দেখি তখন ওর বছর পাঁচ বয়েস। তুই তখন কতটুকু। মার কাছে গেলাম তোকে নিয়ে, বাবা বলল–হ্যাঁরে নীহার, এ যে মাথায় দেড় ফুটও হয়নি। আমার বাবা তোকে বলত, ফুটকি। …

রিনি চেয়ার ঠেলে উঠি উঠি ভাব করল। আঃ মা–তোমার বাপের বাড়ির গল্প আর আমি শুনতে পারি না।

নীহার মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন কয়েক পলক, তারপর বললেন, আমার বাপের বাড়ির গল্প তোকে আমি কত শোনাই রে? খুব যে বলছিস?

রিনি হেসে বলল, রোজ শোনাও।

 রোজ?

বেশ, রোজ না হয় না হল, একদিন অন্তর।

নীহার যেন অতিরিক্ত মনঃক্ষুণ্ণ হলেন। রিনি, তুই মার সঙ্গে চালাকি করছিস?

এবার রিনি উঠে দাঁড়াল। তার খুব হাসি পাচ্ছিল। মার বাপের বাড়ির গল্প সে এত শুনেছে যে, মার বদলে সে নিজেই দাদুদের বাড়ির, পাড়ার, মানুষজনের, কে কবে জন্মেছে, কবে মরেছে, কোন আমগাছে কোন বছরে বাজ পড়েছিল সব বলে দিতে পারে। রিনি জানে, মার কাছে বাপের বাড়ি বড় বেশি নিজের জিনিস। মাকে সে মাঝে মাঝে রাগাতে চাইলেও সত্যি কি আর দুঃখ দিতে চায়! রিনি হেসে বলল, বেশ বাবা, হপ্তায় একবার, না-হয় মাসে একবার তোমার বাপের বাড়ির গল্প শুনেছি, হল তো? যাক গে, তোমার শ্যামচাঁদের বয়েস আমার চেয়ে এমন কিছু বেশি নয়। এ বড়জোর তেইশ; আমি কুড়ি। আমি ওকে দাদা-টাদা বলতে পারব না। আজকাল মেয়েরা কথায় কথায় অত দাদা বলে না। আমি ওকে শ্যামচাঁদ বলে ডাকব। বলে রিনি হাসি চেপে বেসিনে মুখ ধুতে চলে গেল।

নীহার খানিকটা চুপ করে বসে থেকে ঘাড় ফিরিয়ে মেয়ের মুখ ধোওয়া দেখলেন। তারপর বললেন, তোর খুব ইয়ার্কি হয়েছে। শ্যামকে তুই শ্যামচাঁদ বলবি কেন? চাঁদটা তুই পেলি কোথায়?

রিনি বেসিনের কল বন্ধ করল। বলল, তোমার আঁচল থেকে মাটিতে পড়ে গিয়েছিল, কুড়িয়ে নিয়েছি, বলে খিল খিল করে হেসে উঠল।

.

2 Comments
Collapse Comments

এই উপন্যাসটি সম্পূর্ণ পাওয়া যাবে না?

বাংলা লাইব্রেরি (Administrator) April 27, 2024 at 1:05 am

পুরোটা ঠিক করে দেয়া হয়েছে। ধন্যবাদ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *